৭. অতৃপ্ত আত্মা না ভিন গ্রহের আগন্তুক

বাইরে থেকে আনা তৈরি খাবার দিয়ে ডিনার সারতে সারতে নটা বেজে গেলো। খাওয়ার পর আমরা সবাই ড্রইংরুমে বসেছিলাম। বাইরে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের একেবারে কাছে নেমে এসেছে। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ থাকলেও ভেতরে একটা ঠান্ডা ভাব রয়েছে। ফায়ার প্লেসের আগুন এত বড় ঘর গরম হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো না। আলফ্রেড একটা রকিং চেয়ার নিয়ে ফায়ার প্লেসের একেবারে কাছে বসেছিলো। ওর বোনের কথা বলছিলো আমাদের।

শার্লি আমার তিন বছরের বড়, গত নবেম্বরে পঁচাত্তরে পা দিয়েছে। আলফ্রেড পাইপের ধোয়া ছেড়ে বললো, নবেম্বরের তিরিশ তারিখে ওর জন্মদিনে টেলিফোনে ওকে উইশ করেছিলাম। তখন ও বলেছিলো–আজকাল ওর কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। রাতে কারা নাকি বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। চোখে দেখা যায় না তবে টের পাওয়া যায়। শার্লি ছোটবেলা থেকেই একটু ভয়কাতুরে। ওকে বলেছিলাম, ভয়ের গল্প পড়া আর ভয়ের ছবি দেখা বন্ধ করতে । ও বললো, চিরকাল ভয়ের গল্প পড়ে কাটালাম–কিছু হলো না, এখন কেন হবে! ওকে বললাম, তোমার বয়স হয়েছে রাতে নিশ্চয় ভালো ঘুম হয় না। ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করো। তারপর ওর সঙ্গে আর কথা হয়নি। আমি অবশ্য গত তিন সপ্তাহ ধরে লন্ডনে। এর মধ্যে বেচারা দুবার ফোন করেছিলো।

এখানে আসার পর আলফ্রেড ওর বোনকে ফোন করার চেষ্টা করেছিলো। লাইন না পেয়ে এক্সচেঞ্জে ফোন করেছে। ওখানকার টেলিফোন এক্সচেঞ্জ বলেছে, লাইন নাকি খারাপ।

শীলা বললো, তোমার বোন একা থাকে কেন? তোমরা দুজন একসঙ্গে থাকলেই তো পারো।

ও বরাবরই স্বাধীনচেতা। আলফ্রেড বললো, পাঁচ বছর হলো ওর স্বামী মারা গেছে। একটামাত্র মেয়ে, কানাডায় থাকে, চার পাঁচ বছরে একবার আসে। তারও ওখানে বড় সংসার। নিয়মিত মার খবর নিতে পারে না। আমি বহুবার বলেছি এখানে এসে থাকতে। শার্লি রাজি হয়নি।

খাওয়ার সময় আলফ্রেডের সঙ্গে আমাদের কথা পাকা হয়ে গেছে। ও কাল সকালে কার্ডিগান যাচ্ছে। এখান থেকে মাত্র দুঘন্টার ড্রাইভ। ওর বোনের খবর নিয়ে দিনে দিনে ফিরে আসবে। নয়তো একরাত ওখানে থাকবে। আমাদের দেখাশোনা করবে। হার্ভে। ইচ্ছে করলে আমরা বার্চ লেকে মাছ ধরতে পারি। কিংবা নৌকা নিয়ে ঘুরতেও পারি। আলফ্রেডের নিজের নৌকা রয়েছে।

সাড়ে নটার দিকে হার্ভে এলো। বয়স পঞ্চাশের ওপর হলেও বেশ শক্ত সমর্থ পরিশ্রমী শরীর। চেহারাটা একটু রুক্ষ প্রতিকৃতির । আলফ্রেড আমাদের সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দিলো। ও শুধু–হ্যালো এভরিবডি বললো।

আলফ্রেড ওকে বললো, শার্লির কী হয়েছে কিছু আর্চ করতে পেরেছো?

না স্যার! কথা শুনে মনে হয়েছে ভীষণ ভয় পেয়েছেন। আমি বলেছিলাম কী দরকার আমাকে জানাতে। তিনি বার বার বললেন, তোমাকে দিয়ে হবে না। আলফ্রেডকে দরকার। আমি তারপরও বলেছিলাম, যদি তেমন কোনো বিপদ হয় পুলিশকে বলুন। তিনি আরও বেশি ঘাবড়ে গেছেন। বললে, এটা পুলিশের কাজ নয়, আমার দরকার ওঝা।

আলফ্রেডও বিরক্ত হয়ে বললেন, সারাক্ষণ ওর মাথায় কেবল ওসবই ঘোরে! হার্ভে, তুমি আমাদের তরুণ অতিথিদের জন্য নিচের তলায় গেস্টরুম দুটো রেডি করে দাও।

হার্ভে আমাদের ব্যাগ নিয়ে চলে গেলো। ড্রইংরুমের পাশেই গেস্টরুম। দশ মিনিট পর হার্ভে এসে বললো, রুম রেডি। একটা ছেলেদের জন্য, একটা মেয়েদের জন্য।

ঠিক তখনই ওপরে টেলিফোনের রিং হলো। হার্ভে টেলিফোন ধরতে গেলো। আলফ্রেড একটু অবাক হয়ে বললো, এখানে আবার কে ফোন করতে এলো?

একটু পরেই হার্ভে ওপর থেকে ডাকলো–মিস্টার আলফ্রেড স্যার, আপনার বোন ফোন করেছেন। দয়া করে জলদি আসুন।

আলফ্রেড শোনামাত্র দৌড়ে গেলো। অন্য সময় হলে বাহাত্তর বছরের একজন বুড়োকে এভাবে দৌড়াতে দেখলে ভিকি আর জেন হেসে খুন হতো অথচ আজ ওর বোনের বিপদের কথা ভেবে ওরা সবাই গম্ভীর হয়ে বসে ছিলো। মনে হচ্ছিলো কার্ডিগানের অচেনা বুড়ি বুঝি ওদের খুব কাছের একজন। আমি একবার ভেবেছিলাম আলফ্রেডকে বলবো–তোমার বোনের বিপদ আর আমরা এখানে ফুর্তি করবো এটা হয় না। চলো আমরাও তোমার সঙ্গে যাই। পরে মনে হলো এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। আলফ্রেডের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব থাকলেও ওর বোন আমাদের সহজভাবে নাও নিতে পারে।

একটু পরে আলফ্রেড ওপর থেকে আমাদের ডাকলো–নিক, তোমার বন্ধুদের নিয়ে ওপরে আসবে?

আসছি, বলে আমরা চারজন আলফ্রেডের চেয়েও বেশি দ্রুত দোতলায় ছুটে গেলাম।

সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার পর এক চিলতে বারান্দা সামনে পড়লো। টেলিফোনটা বারান্দার এক কোণে রাখা। আলফ্রেড ফোনে বলছিলো। –হ্যাঁ শার্লি ওরা এসে গেছে। আমি কথা বলছি, তুমি লাইনে থাকো। এই বলে রিসিভারটা মুখ থেকে সরিয়ে ও আমাদের বললো, একটু আগে শার্লির টেলিফোন ঠিক হয়েছে। সত্যিই খুব ভয় পেয়েছে। তোমাদের কথা শুনে ও বলছে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে যেতে । নাকি ওর বাড়ি ভরা লোক থাকলে ওরা কিছু করতে সাহস পাবে না।

আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম–ওরা কারা?

সেটাই তো শার্লি ফোনে বলছে না। বার বার বলছে পারলে চলে এস। ওকে কী বলবো?

শীলা শান্ত গলায় বললো, বলো কাল সকালে তোমার সঙ্গে আমরাও কার্ডিগান যাবো।

ধন্যবাদ শীলা। শীলার কথা শুনে স্বস্তি বোধ করলো আলফ্রেড-তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ, বলে ও রিসিভার মুখের কাছে নিয়ে বললো, ঠিক আছে শার্লি, ওরাও আমার সঙ্গে আসবে। তুমি ঘুমের ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়ো। তোমার কাজের মেয়েটাকে বলো, দরজা জানালা সব ভেতর থেকে বন্ধ করতে।

ওপাশ থেকে শার্লি বোধহয় আমাদের ধন্যবাদ জানিয়েছে। আলফ্রেড বললো, তোমার ধন্যবাদ ওদের পৌঁছে দেবো। তুমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ো।

টেলিফোন রেখে আলফ্রেড আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসলো, শার্লি তোমাদের ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। একটু থেমে বললো, তোমরা তা হলে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো। কাল খুব সকালে রওনা দিতে চাই।

আলফ্রেডকে শুভরাত্রি জানিয়ে আমরা নিচে আমাদের ঘরে এলাম। শীলা আর জেনকে নিয়ে আমাদের ঘরে বসলাম। প্রত্যেক ঘরে পাশাপাশি দুটো বিছানা ওয়ার্ডরোব ড্রেসিং টেবিল পরিপাটি করে সাজানো। দুটো ঘরের সঙ্গেই অ্যাটাচড বাথরুম রয়েছে। হার্ভে আমাদের শুভরাত্রি বলে বাইরের ঘরে শুতে গেছে।

জেন বললো, আলফ্রেডের বোনের যদিও বিপদ, আমার কাছে পুরো ব্যাপাটা খুব উত্তেজনাকর মনে হচ্ছে।

শীলা বললো, এতে উত্তেজিত হওয়ার কী আছে?

বারে, শোননি শার্লি কী বলেছে। ওর ওঝা দরকার। চোখে দেখা যায় না অথচ উপস্থিতি টের পাওয়া যায়–এটাকে তোমরা রোমাঞ্চকর বলবে না?

ভিকি বললো, শার্লির বাড়িতে খারাপ কোনো ভূতের পাল্লায় একবার পড়ে দেখো, রোমাঞ্চ কীভাবে উধাও হয় টেরও পাবে না।

জেন বললো, কদিন আগে একটা সাইফি ছবিতে দেখেছি, এরকম এক নিঃসঙ্গ বুড়ির বাড়িতে আউটার স্পেস থেকে এক ধরনের বুদ্ধিমান প্রাণী এসেছিলো।

আমার মতো শীলা জেন আর ভিকিও সায়েন্স ফিকশন আর হরর পছন্দ করে। এ নিয়ে খানিকক্ষণ আলোচনা হলো, ভূত না ভিন গ্রহের আগন্তুক। শীলা বললো, ওসব কিছুই নয়। নিশ্চয় কোনো খারাপ লোক ভয় দেখাচ্ছে।

শীলার কথা জেনের পছন্দ হলো না। হাই তুলে বললো, আমার ঘুম পাচ্ছে।

আমরা তা হলে শুতে যাই নিক। এই বলে শীলা জেনকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

ভিকি বললো, তোর ঘুম পাচ্ছে না ইয়ার?

বিছানায় শুলে অবশ্য ঘুম আসবে। তুই কী করবি?

আমি এখন একটা লম্বা ঘুম দেবো।

ঠিক আছে, শুয়ে পড়। লাইট নিভিয়ে দিচ্ছি। সুইচ টিপে টেবিল লাইটটা নিভিয়ে দিলাম। সারা ঘর অন্ধকারে ডুবে গেলো। আমি বিছানায় শুয়ে মা আর দিব্যেন্দুর কথা ভাবলাম। আলফ্রেড ঠিকই বলেছে। আমার একটা আলাদা জগৎ তৈরি হচ্ছে যেখানে ওদের প্রয়োজন নেই। ওরা কি ভাবতে পারবে ওয়েলস-এর গ্রামে কীভাবে রাত কাটাচ্ছি, কিংবা আগামীকাল আমাদের কীভাবে কাটবে? প্রত্যেক মানুষেরই একটা আলাদা জগৎ থাকে।

ভোরবেলা হার্ভের ডাকে ঘুম ভাঙলো। তখনও বাইরে ভালোমতো আলো ফোটেনি। চারদিক ঘন কুয়াশা ঢাকা। একহাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। হার্ভে বললো, তৈরি হয়ে নাও, আমার ব্রেকফাস্ট রেডি।

আলফ্রেড উঠেছে?

ডাইনিং টেবিলে অপেক্ষা করছেন তোমাদের জন্য।

আমরা এক্ষুণি আসছি, বলে ভিকিকে ঘুম থেকে তুলে আমি বাথরুমে ঢুকলাম।

পনেরো মিনিট পরে আমি আর ভিকি মুখ হাত ধুয়ে ডাইনিং রুমে এসে দেখি শীলা আর জেনও এসে গেছে। ওরা একেবারে পোশাক পরে তৈরি হয়েই এসেছে। ভিকির চোখে তখনও ঘুম লেগে আছে। জেন বললো, ছেলেদের নিয়ে এই এক জ্বালা। কোনো কাজই সময়মতো করতে পারে না।

আলফ্রেড বললো, আমি কি ছেলেদের দলে নই?

জেন বললো, বোনের বাড়িতে যাওয়ার তাড়া না থাকলে তুমিও ঘুম থেকে উঠতে নটা বাজাতে।

আমি এক সময় সামরিক বাহিনীতে ছিলাম জেন ডার্লিং। ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে দেরি হতে পারে, আমার কখনও দেরি হয় না।

বেশি ভোরে আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করে না। এক টুকরো রুটি, আধসেদ্ধ ডিম আর চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম। ভিকি ঘুমের ঘোরে চায়ে চিনির বদলে লবণ ঢেলে সবার হাসির কারণ হলো। বেচারা একটু বেশি ঘুমকাতুরে।

আলফ্রেডের বাড়ি থেকে আমরা ঠিক আটটায় বেরোলাম। তখনও যথেষ্ট কুয়াশা ছিলো। আলফ্রেড হেডলাইট জ্বালিয়ে কম স্পীডে গাড়ি চালাচ্ছিলো, ঘন ঘন হর্ণ দিচ্ছিলো। দুর্ঘটনা কখন ঘটে কিছুই বলা যায় না।

দশটায় যখন আমরা উঁচু পাহাড়ি জনপদ কার্ডিগানে আলফ্রেডের বোনের বাড়িতে পৌঁছলাম তখন কুয়াশা কেটে রোদ উঠলেও ওতে এতটুকু তেজ ছিলো না। তবে বেশ বাতাস ছিলো। কার্ডিগান জায়গাটা একেবারে সমুদ্রের ধারে। ছোট বড় নানা আকারের পাহাড়ের ওপরে ঘরবাড়ি ছড়িয়ে রয়েছে। সমুদ্রের ধারে জেটিতে কতগুলো নৌকা বাঁধা। দূরে জেলেদের লম্বা জাল শুকোতে দেয়া হয়েছে। সমুদ্র থেকে উঠে আসা ঠান্ডা বাতাস আমাদের শরীরের যতটুকু জায়গা খোলা পেলো সেখানেই হুল ফোঁটালো।

শার্লির বাড়িটা কাঠের। আলফ্রেডের বাড়ির মতো বড় না হলেও ওপরে নিচে সব মিলিয়ে ছয় সাতটা ঘর। পেইন্ট করেছে বেশি দিন হয়নি। দূর থেকে পাহাড়ের ওপর ধূসর আকাশের পটভূমিতে ধবধবে সাদা বাড়িটাকে মনে হচ্ছিলো একটা বড় সৃগাল বসে আছে।

বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই আলুথালু পোশাকে ছুটে এলো শার্লি। মনে হয় আলফ্রেডের চেয়ে কম করে হলেও দশ বারো বছরের বড় হবে। আলফ্রেড গাড়ি থেকে নামতেই ওকে জড়িয়ে ধরে ফোৎ ফোৎ করে কাঁদলো–আমি তো ভেবেছিলাম মরণের আগে তোর আর দেখা পাবো না। কী ভয়ঙ্কর বিপদ যাচ্ছে আমার ওপর–কথা শেষ করার আগেই আমাদের ওপর শার্লির চোখ পড়লো–এরা বুঝি তোর সেই গেস্ট। আলফ্রেডকে ছেড়ে শার্লি আমাদের কাছে এসে সবার কপালে চুমু খেলো ভারি খুশি হয়েছি তোমরা এ বুড়ির অনুরোধে সাড়া দিয়েছো দেখে। কাল রাতে আলফ্রেডের সঙ্গে কথা বলার পরও ভেবেছি–বললাম তো তোমাদের আসতে, সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকবে তো?

শীলা বললো, ওরা কি কাল রাতেও এসেছিলো?

শার্লি এক ধাপ গলা নামিয়ে বললো, আস্তে বলো, দেয়ালেরও কান আছে। কাল রাতেও এসেছিলো ওরা।

আলফ্রেড এগিয়ে এসে একটু বিরক্ত হয়ে বললো, তখন থেকে তুমি হেঁয়ালি করছো শার্লি। ওরা কারা তা বলবে তো?

সব বলবো! শুকনো গলায় শার্লি বললো, তার আগে ঘরে চলো। কখন কার। নজরে পড়ি কিছুই ঠিক নেই।

যে যার ব্যাগ নিয়ে আমরা শার্লির পেছন পেছন ওর ড্রইংরুমে গিয়ে বসলাম। ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে। পাশে একটা ইজিচেয়ারের মতো, একখানা টকটকে লাল কম্বল পড়ে আছে ওটার ওপর। ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম বাড়ির বাইরের দিকটা সাদা হলেও ভেতরে সবখানে উজ্জ্বল রঙের ছড়াছড়ি। সোফায় রং সোনালি হলুদ, কার্পেটের রঙ লাল, জানালার পর্দায় লাল নীল আর হলুদের ছোপ দেয়া। এমনকি শার্লির পরনের গাউনটা ছিলো উজ্জল সব রঙের ছাপওয়ালা।

আমি তোমাদের জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করে রেখেছি। শার্লি বললো, চলো টেবিলে গিয়ে সবাই বসবে।

আলফ্রেড বললো, আমরা খেয়েই বেরিয়েছি।

তাতে কী! এখানকার পাহাড়ি বাতাসে কদিন ঘুরলে টের পাবে! এখানে ঘণ্টায় ঘন্টায় মানুষের খিদে লাগে।

সকালে আমার আর ভিকির খাওয়া ঠিকমতো হয়নি। আমরা কথা না বাড়িয়ে খেতে বসে গেলাম। জেন বললো, ছেলেদের খাওয়া দেখলে আমার বিশেষ একটা প্রাণীর কথা মনে হয়।

কী প্রাণী? জানতে চাইলে ভিকি।

শীলা বললো, আহ জেনি। ওরা খেতে বসেছে, এখন আজেবাজে কথা বোলো না।

আমি বললাম, তোমরা কিছু খেলে পারতে!

জেন বললো, আমরা হিসেব করে খাই।

ভিকি বললো, দেখলাম তো সকালে হাঁসের মতো প্লেটের পর প্লেট ওড়ালে। পেটে জায়গা থাকতে হবে তো!

জেন হেসে বললো, শুয়োরের চেয়ে হাঁস অনেক ভালো।

শুয়োর কে?

যারা ঘোৎ ঘোঁৎ করে। সারাক্ষণ ওই প্রাণীটার মতো খেতে আর দাপাদাপি করতে ভালোবাসে।

আলফ্রেড মৃদু হেসে ওর বোনকে বললো, সব সময় দেখবে ওরা চড়ুই পাখির মতো কিচিরমিচির করছে।

শার্লি বললো, আমার ভারি আনন্দ লাগছে আলফ্রেড। কতদিন পর ছোট ছেলেমেয়েদের গলার শব্দ শুনলাম।

খাওয়ার পর ভেবেছিলাম বাইরে বেরিয়ে চারপাশটা একটু ঘুরে দেখবো। শার্লি হয়তো আমাদের সামনে আলফ্রেডকে ওর বাড়ির সমস্যার কথা বলতে সংকোচ বোধ করছে। মেয়েদের অনেক ব্যক্তিগত সমস্যা যা সবাইকে বলা যায় না। আলফ্রেডকে বললামও–আমরা কি কিছুক্ষণের জন্য ঘুরে আসতে পারি?

আলফ্রেড কিছু বলার আগে শার্লি ব্যস্ত গলায় বললো, তোমরা আবহাওয়ার বুলেটিন শোননি? আজ যে কোনো সময়ে বৃষ্টি নামতে পারে। এই ঠান্ডায় বৃষ্টিতে ভিজলে নির্ঘাত নিউমোনিয়া হবে।

বাইরে তাকিয়ে দেখলাম শার্লি বা আবহাওয়ার বুলেটিন মিথ্যে বলেনি। কিছুক্ষণ আগেও বাইরে রোদ ছিলো, আকাশে তেমন মেঘ ছিলো না। অথচ এরই মধ্যে সারা আকাশ মেঘে ছেয়ে গেছে। এলোমেলো ঠান্ডা বাতাস বইছে। আলফ্রেড বললো, তোমরা এখন কোথাও যেয়ো না নিক! আকাশের অবস্থা ভালো নয়। ঝড় আসবে। এই বলে নিজের বোনের দিকে তাকালো–শোনো শার্লি, ছেলেমেয়েগুলোকে লন্ডন থেকে এনেছিলাম কদিন সবাই মিলে ফুর্তি করবো বলে। লেকে মাছ ধরবো, নৌকায় ঘুরে বেড়াবো আর বনের ভেতর ফাঁদ পেতে খরগোশ শিকার করবো। তুমি সব ভেস্তে দিয়েছো তোমার বিপদের কথা বলে। তোমাকে আমি বলছি, এক্ষুণি যদি সব কথা খুলে না বলে এই ঝড়ের ভেতরই আমি ওদের নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবো।

এটা বুঝি বাড়ি না আলফ্রেড? শার্লি থমথমে গলায় বললো, বড় বোন হিসেবে তোর ওপর কি আমার কোনো দাবি নেই? আমি কি তোকে বলেছি আমার এখানে কারও ফুর্তি করা নিষেধ? সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি সব সময় তুই আমাকে শাসন করিস।–আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতেন।

এইটুকু বলে শার্লি টিস্যু পেপার দিয়ে নাক ঝাড়লো। ওর চোখ দুটো ছলছল করছিলো, বুঝি এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে।

তোমার পচাত্তর বছর বয়স হয়েছে শার্লি। এখনও তোমার ছিচকাঁদুনে স্বভাবটা গেলো না। নাও খুব হয়েছে। এবার লক্ষী মেয়ের মতো বলে ফেলো তো তোমার বিপদটা কী?

আরেকবার ভালো করে নাক ঝেড়ে শার্লি বললো, তুই তো নাস্তিক হয়ে গেছিস, দিনক্ষণ কিছু মানিস না। এসব কথা যখন তখন বলা যায় না। সূর্যকে সাক্ষী রেখে অন্ধকার জগতের বাসিন্দাদের নিয়ে আলোচনা করা ঠিক নয়। ভেবেছিলাম রাতে বলবো। দেখছি ঈশ্বরের অভিপ্রায় অন্যরকম। তিনি চান এখনই তোমাদের বলি। সে জন্য এই ভরদুপুরে সূর্যকে তিনি মেঘের সমুদ্রে ডুবিয়ে রেখেছেন। শোন তা হলে, তোমরাও শোনো সবাই।

আমরা সবাই কান খাড়া করলাম। শার্লি বললো, আরও কাছে এসে বসো। আমার বলতেও ভয় হচ্ছে।

আমরা কোনো কথা না বলে ওর হুকুম তামিল করলাম। শীলা আর জেন ওর দুপাশে কার্পেটের ওপর বসলো। শার্লি ওর আরাম চেয়ারে আধশোয়া হয়ে বললো, ঘটনাটা প্রথম ঘটেছে আমার গত জন্মদিনের তিনদিন আগে। রাতে আমি দোতলার বেডরুমে শুয়ে আছি। তখন রাত দুটো বাজে। নিচের তলায় শুনি কারও পায়ের শব্দ। একজন নয়, মনে হলো দুতিনজন। ফিসফিস করে কথা বলার শব্দ শুনলাম। নিচে আমার কাজের মেয়ে মেরি থাকতো। মেয়েটার স্বভাব চরিত্র ভালো ছিলো না।

আলফ্রেড বললো, ছিলো না বলছো কেন, মেরি এখন তোমার কাছে থাকে না? ·

হায় ঈশ্বর! তবে আর বলছি কী! কাষ্ঠ হেসে শার্লি বললো, মেরি তো কবেই ভেগেছে। তারপর আরও ডজনখানেক এসেছে আবার চলেও গেছে। কাল চাকরি দিলাম মেক্সিকান মেয়ে কারমেলাকে। আমার বাড়ির দুর্নামের কথা শুনেছে কারও কাছে। বলেছে রাতে থাকতে পারবে না। রোজ সন্ধ্যা ছটায় চলে যাবে আবার সকালে আটটায় আসবে। মাইনে সপ্তায় একশ পাউন্ড। আমি তাতেও রাজি ছিলাম। এই তো আজ এখন পর্যন্ত এলো না। আবার আমাকে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হবে।

ঠিক মাছে দিও। এখন বলল ওরা পালাচ্ছে কী জন্য?

পালাবার মতো ঘটনা ঘটছে বলেই পালাচ্ছে। ওরা আমাকে একা পেতে চায়। আমাকে দিয়ে ওদের কোনো কাজ করিয়ে নিতে চায়। জানে এ তল্লাটে আমার মতো পবিত্র আত্মা কারও নয়। সেটা দখল করতে চায় ওরা।

হাজার বার ওরা ওরা বোলো না তো? আলফ্রেড বিরক্ত হয়ে বললো, ওরা কে সেটাই তো শুনতে চাইছি!

এখনও বুঝতে পারিসনি ওরা কারা?

না পারিনি। তুমি নিশ্চয়ই বলতে চাইছো ওরা ভূত!

না, ঠিক ভূত নয়। শুকনো গলায় শার্লি বললো, ওরা হচ্ছে অতৃপ্ত প্রেতাত্মা। শার্লির কথা শুনে জেন একটু নড়েচড়ে বসলো। ফায়ার প্লেসের আগুনের আঁচ কমে গিয়েছিলো। পাশে রাখা টুকরো করা শুকনো কাঠ ওতে গুঁজে দিলো শীলা। আলফ্রেড গম্ভীর হয়ে বললো, কেন তোমার মনে হলো ওরা অতৃপ্ত আত্মা?

রাতে যতবার শব্দ শুনে নিচে এসেছি, কাউকে কোথাও দেখেনি। কাজের মেয়েরাও আমার মতো ওদের চলাফেরার শব্দ শুনেছে কিন্তু কিছু দেখেনি। আমাদের প্রতিবেশী ব্রাউনদের বাড়ির কয়েকজন দেখেছে আমার বাড়িতে অনেক রাতে অন্ধকারে আলোর টুকরো ঘুরে বেড়ায়। গির্জার ফাদার ফার্নান্দোও দেখেছেন। তাঁকে এনে একদিন জপতপ করালাম। তাতেও কিছু হলো না। ফাদার ফার্নান্দো বললেন খুব শক্তিশালী আত্মা এবং দুষ্ট প্রকৃতিরও বটে।

অন্যসব বাড়িতে না গিয়ে তোমার বাড়িতে কেন ওরা আসে? জানতে চাইলে আলফ্রেড।

জেন বললো, তুমি শিওর হচ্ছে কী করে ওরা খারাপ আত্মা?

ভালো আত্মা মানুষকে কখনও ভয় দেখায় না।

আত্মা ছাড়া কি অন্য কিছু হতে পারে না?

অন্য কী হতে পারে?

ধরো আউটার স্পেস থেকে মানুষের চেয়ে শক্তিশালী অন্য কোনো প্রাণী আসতে পারে। ইটিতে যেমন দেখিয়েছে? হুঁ, ভাববার কথা বটে। এই বলে শার্লি চিন্তামগ্ন হলো। বললো, ভিন্ন গ্রহ থেকে অদৃশ্য প্রাণী আসুক আর না-ই আসুক এটুকু বলতে পারি–তারা এ পৃথিবীর রক্তমাংসে গড়া মানুষ নয়।