৬. আলফ্রেডের জন্য দুঃসংবাদ

আলফ্রেডের সঙ্গে কথা ছিলো সকাল নটার ভেতর গাড়ি নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসবে। ভিকি একটা ট্যাক্সি নিয়ে শীলা আর জেনকে তুলে আনবে। আলফ্রেডদের বাড়ি ওয়েলস-এর সাউথ গ্ল্যামের্গোনের পেনার্থে। যেতে হবে রাজধানী কার্ডিফ হয়ে। লন্ডন থেকে কার্ডিফ যেতে গাড়িতে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগে। কার্ডিফ থেকে পেনার্থের দূরত্ব বারো মাইল। ঘড়ি ধরে ঠিক কাঁটায় কাঁটায় নটায় এসে পৌঁছলো আলফ্রেড। তখনও শীলারা এসে পৌঁছায়নি।

দিব্যেন্দু মার সঙ্গে বেরিয়েছে। মাকে বুশ হাউসে নামিয়ে দিয়ে ওর এক বন্ধুর বাড়িতে যাবে কী এক কাজে। যাওয়ার সময় দুঃখ প্রকাশ করেছে থাকতে পারছে না বলে। পরশু রাতের পর দিব্যেন্দু আবার আগের মতো চমৎকার ব্যবহার করছে। ঠিক আগের মতোও নয় তার চেয়ে বরং বেশিই করছে। আমার সঙ্গে সকালে যেমন পরামর্শ করলো, পুরোনো এ বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে আরও ভালো বাড়িতে উঠবে কিনা এ নিয়ে। এ বাড়িতে আমার জন্ম না হলেও চৌদ্দ বছর ধরে থাকার কারণে এটার ওপর এক ধরনের মায়া পড়ে গেছে। দিব্যেন্দুকে সেটা বলাতে ও আর কথা বাড়ায়নি।

আলফ্রেড রাস্তার ওপর গাড়ি থামিয়ে ভেতরে এলো। আমি বাইরের দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম ওদের অপেক্ষায়। আলফ্রেডকে বললাম, ওরা তো এখনও এলো না। টেলিফোন করে দেখবো?

এত ব্যস্ত হওয়ার কী আছে! হেসে বললো আলফ্রেড–ওরা না আসা পর্যন্ত তোমার সঙ্গে একটু এক্সকুসিভ কথা বলবো, যদি বুড়োটাকে অসহ্য মনে না করো।

আলফ্রেড তুমি আমার বন্ধু। গম্ভীর হয়ে বললাম, একথা বলে তুমি আমার বন্ধুত্বকে অপমান করছো। তুমি কী করে ভাবতে পারলে তোমাকে অসহ্য মনে করবো?

আমার কথায় অপ্রস্তুত হয়ে আলফ্রেড বললো, আমি দুঃখিত। তুমি যদি আহত বোধ করো– আমার কথা প্রত্যাহার করছি!

ধন্যবাদ, আশা করি ভবিষ্যতে এরকম কথা তুমি বলবে না।

আলফ্রেড আর আমি ড্রইংরুমে সোফায় বসেছিলাম। আমার কথা শুনে ও বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ আমাকে দেখলো। আমি বিব্রত বোধ করলাম–। এভাবে কী দেখছো আলফ্রেড?

তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো নিক?

কেন বাসবো না! তোমার মতো চমৎকার বন্ধু কজনের ভাগ্যে জুটে।

আলফ্রেডের চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। আপন মনে বললো, আমি ভাবতেই পারি না, যাকে তার নিজের ছেলেরা পরিত্যাগ করেছে সে কী করে অচেনা কারও এত ভালোবাসা পায়।

আমরা কি এখনও অচেনা আলফ্রেড? তুমি আমাদের পরিবারের হারিয়ে যাওয়া আনন্দ ফিরিয়ে দিয়েছো। তোমাকে আমি এমন অনেক কথা বলেছি যা শীলা পর্যন্ত জানে না।

আলফ্রেড সামান্য হেসে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। নিক তুমি এমনভাবে কথা বলো, মনে হয় আমার কাছাকাছি বয়সের কারও সঙ্গে কথা বলছি। তুমি এত জানো, এত বোঝ!

আমি বিব্রত হয়ে শুধু বললাম, ধন্যবাদ আলফ্রেড, আমাকে ভালোবাস বলেই তুমি এতটা গুরুত্ব দিচ্ছো।

ভালো নিশ্চয়ই বাসি। আপনমনে আলফ্রেড বললো, কাল রাতে মনে হয়েছে আমার অপদার্থ দুই ছেলের চেয়েও তুমি আমার বেশি আপন। তোমাকে নিয়ে অনেক কথা ভেবেছি। আমার এক বন্ধুর সঙ্গে রাতে কথাও বলেছি। আমি ঠিক করেছি।

আলফ্রেডের কথা শেষ না হতেই ডোরবেল বাজলো। ও কী ঠিক করেছে জানা হলো না। উঠে গিয়ে দরজা খুলোম। শীলা, জেন আর ভিকি একসঙ্গে কথা বলতে বলতে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো। দেরির জন্য ওরা প্রত্যেকে একে অপরকে অভিযুক্ত করছিলো। আলফ্রেডের কাছে ওরা তিনজনই ক্ষমা চাইলো।

আলফ্রেড ব্যস্ত হয়ে বললো, আরে না না। এত বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। আমরা তত বেড়াতেই যাচ্ছি, নিশ্চয় কোনো আন্তর্জাতিক শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেয়ার জন্য যাচ্ছি না।

তুমি কী ভালো! বলে শীলা আর জেন আলফ্রেডকে জড়িয়ে ধরে ওর দুগালে চুমু খেলো।! ভিকি বললো, আমরা তো ভয়েই বাঁচি না, এক ঘন্টা দেরি না জানি কী বকুনি আছে কপালে।

আলফ্রেড হেসে বললো, আমরা কি এখন যাত্রা শুরু করতে পারি?

ভিকি ষড়যন্ত্রের গলায় বললো, যাওয়ার আগে একটু গলা ভিজিয়ে নিলে হতো না! আমাকে হিন্দিতে বললো, দোস্ত তোর বাবা কাল কী দারুণ মার্টিনি খাওয়ালো! ছিটেফোঁটা আছে নাকি রে! আমিও হিন্দিতে বললাম, কোত্থেকে থাকবে! কাল রাতে অর্ধেক বোতল তুইই তো সাবাড় করলি। ভুলে গেছিস নাকি!

আলফ্রেড রেগে যাওয়ার ভান করলো–এসব কী! আমরা কেউ এখানে ইডিশ ভাষা জানি না। তোমরা দুজন অচেনা ভাষার ষড়যন্ত্র করবে এটা হতে পারে না!

আমি বললাম, ইড্ডিশ নয়, হিন্দি। তোমাকে বলিনি ভিকিরা ইন্ডিয়ান! আমরা কোনো ষড়যন্ত্র করিনি!

একগাল হেসে আলফ্রেড বললো, ঠাট্টা করছিলাম। তুমি কি ভুলে গেছো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পাঁচ বছর আমি ইন্ডিয়াতে ছিলাম?

আমি বললাম, ভিকির গলা শুকিয়ে গেছে। ঘরে অরেঞ্জ জুস আছে, ব্লুবেরি জুসও আছে। কে কোনটা নেবে বলো। আলফ্রেড ছাড়া সবাই একসঙ্গে বললো, ব্লুবেরি। অরেঞ্জ জুসের চেয়ে ব্লুবেরি জুসের দাম বেশি, খেতেও মজা। আলফ্রেড বললো, আমাকে তুমি যা দেবে তাই খাবো।

ঢালতে গিয়ে দেখি ব্লুবেরি জুস তিন গ্লাসের বেশি হচ্ছে না। ওদের ব্লুবেরি দিয়ে আমি আর আলফ্রেড অরেঞ্জ নিলাম। আলফ্রেড একগাল হেসে বললো, আমার আর নিকের ভাগ্য এক সুতোয় বাঁধা।

জেন আদুরে গলায় বললো, আগে বললে না কেন, তা হলে আমিও অরেঞ্জ জুস নিতাম।

আলফ্রেড রহস্য ভরা গলায় বললো, তুমি যদি আমার সঙ্গে তোমার ভাগ্য জুড়তে চাও তা হলে সুতোটা একটু বাড়াতে পারি।

কীভাবে?

আমার গ্লাস থেকে খানিকটা তোমার গ্লাসে ঢেলে দিতে পারি।

আমি হেসে বললাম, ওটা মোটেই উপাদেয় হবে না।

শীলা দার্শনিকের মতো বললো, ভাগ্য কখনও এভাবে বদলানো যায় না। ওটা আগে থেকে ঠিক থাকে।

ভিকি আঁতকে ওঠার ভান করলো, ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন! শীলা, এখন থেকেই আমাদের জ্ঞান দেয়া শুরু করলে?

শীলা সুযোগ পেলেই গুরুগম্ভীর সব কথা বলবে, আর ভিকিও ওকে এ নিয়ে খোঁচাবে। আলফ্রেড বললো, জ্ঞানলাভের জন্য কত মানুষ সারাজীবন সাধনা করে শেষ হয়ে যায়। আর তুমি অযাচিতভাবে পেয়েও নিচ্ছো না?

ভিকির মতো দুর্ভাগা মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। শীলা হেসে আলফ্রেডের সঙ্গে গলা মেলালো।

গলা ভেজানোর পর্ব শেষ করে আমরা সবাই আলফ্রেডের মস্ত বড় ফোর্ড গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। গাড়িটা পুরোনো মডেলের, তবে ভেতরটা খুব আরামের। বোঝাই যায় আলফ্রেড ওর গাড়ির যত্ন নেয়। ও নিজে বসেছিলো ড্রাইভিং সিটে, পাশে আমি। ভিকি, শীলা জেন পেছনে। আমাদের সবার ব্যাগগুলো ওপরের লাগেজ ক্যারিয়ারে।

রোববার লন্ডনে গাড়ির ভিড় কম থাকে বলে শহর থেকে বেরোতে বেশি সময় লাগলো না। হাইওয়েতে ওঠার পর আলফ্রেড গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলো। শীলা বললো, তুমি কি সব সময় এতটা পথ গাড়িতে যাওয়া আসা করো আলফ্রেড?

না শীলা, গত এক বছর আমি ট্রেনেই যাওয়া আসা করেছি। গাড়ি চালাতে চালাতে আলফ্রেড বললো, এবার আমার অক্সফোর্ডে কিছু কাজ ছিলো, তাই গাড়ি নিয়ে এসেছিলাম।

আমরা কেউ এর আগে ওয়েলস যাইনি। ভিকি জানতে চাইলো–অক্সফোর্ড কি আমাদের পথে পড়বে?

হ্যাঁ বাছা। অক্সফোর্ড, গ্লচেস্টার, নিউপোর্ট হয়ে কার্ডিফ যেতে হয় যদি একটানা গাড়িতে যেতে চাও। সময় বাঁচানোর জন্য অনেকে অবশ্য ব্রিস্টল হয়ে যায়, তবে মাঝখানে ব্রিস্টল চ্যানেল পেরোতে হয় ফেরিতে। সময় কম লাগলেও ঝামেলা বেশি, ভিড়ও বেশি। আমার তো অতো তাড়া নেই। তাই গাড়িতে এলে এ পথটাই ব্যবহার করি।

ভিকি গলা বাড়িয়ে বললো, আলফ্রেড, তুমি হিন্দি জানো?

আলফ্রেড হেসে বললো, কেন, নিকের সঙ্গে আমাকে নিয়ে হিন্দিতে মজা করতে অসুবিধে হচ্ছে!

আহ্ আলফ্রেড, আমার কথার জবাব দাও।

বলতে পারি না। কিছু শব্দ বুঝি।

ঠিক আছে, তোমাকে আমি হিন্দি শেখাবো। নিজের লোকদের সঙ্গে হিন্দিতে কথা না বললে আমি ঠিক জমাতে পারি না।

শীলা বললো, জেনকে শেখাতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়ে এখন বুঝি আলফ্রেডকে ধরতে চাইছো?

আলফ্রেড বললো, কেন, জেন কি ছাত্রী হিসেবে ভালো নয়?

জেন হৈচৈ করে উঠলো–কী বলছো তুমি! আমি গত পরীক্ষায় ছটা এ পেয়েছি।

ভিকি তবে হাল ছেড়ে দিলো কেন?

জেন হেসে বললো, যখন জানলাম ভিকি একটা জার্মান আর একটা টার্কিস মেয়েকে হিন্দি শেখানো শুরু করেছে তখনই বলেছি আমার দ্বারা হিন্দি শেখা হবে না।

আলফ্রেড মুখ টিপে হেসে বললো, তুমি কি কখনও ভিকিকে বলেছিলে তোমাকে ছাড়া আর কোনো মেয়েকে ও হিন্দি শেখাতে পারবে না?

বলতে হবে কেন? জেন রেগে যাওয়ার ভান করলোও কি সেটা বুঝতে পারে না?

শীলা হেসে বললো, সাধেই কি আমি বলি, ভিকির মতো দুর্ভাগা মানুষ পৃথিবীতে যে খুব কম আছে!

ভিকি কোণঠাসা হয়ে বললো, লন্ডনে ফিরে এসে আমি মেয়েদের জন্য হিন্দি শেখার ক্লাস খুলবো।

জেন ফোড়ন কাটলো–ওখানে কেবল মার্থাদের মতো ধুমসি মেয়েরাই ভর্তি হবে।

শীলা, ভিকি, জেনের কথা শুনতে শুনতে আলফ্রেড মিটিমিটি হাসছিলো। ওরা নিজেদের ভেতর খুনসুটি শুরু করেছে। আমি মৃদু গলায় বললাম, তুমি বিরক্ত হচ্ছে না তো আলফ্রেড?

আলফ্রেড ফিসফিস করে বললো, আমার জন্য তুমি স্বর্গের আনন্দ বয়ে এনেছে।

আমি কোনো কথা বললাম না। ভাবলাম, কত অল্পে মানুষ সন্তুষ্ট হয়। আলফ্রেডের জন্য আমার বুকের ভেতর একটা নরম কোণ তৈরি হয়ে গেলো। মনে মনে বললাম, তোমার কাছে আমার অনেক ঋণ।

ঠিক একটার সময় লিডনি নামের ছোট নিরিবিলি এক লোকালয়ে গাড়ি থামালো আলফ্রেড। একপাশে নদী, আরেক পাশে গভীর বন। হাইওয়ের পাশে এই লোকালয়টি মনে হয় গড়ে উঠেছে দূরের যাত্রীদের বিশ্রামের জন্য। আলফ্রেড গাড়ি থামিয়েছিলো একটা রেস্তোরাঁর সামনে। পাশেই পেট্রল পাম্প, অল্প দূরে ছোট্ট একটা গির্জা, গোটা চারেক মুদির দোকান, আর কিছু ঘরবাড়ি। বেশির ভাগ বাড়িই কাঠের। এমনকি লিডনি রেস্টুরেন্টও। কাঠের সুইংডোর ঠেলে আমরা ভেতরে ঢুকলাম। রেস্তোরাঁর মেঝেও কাঠের। ভেতরের কোণে দুই বুড়োবুড়ি ছোট্ট টেবিলের ধারে বসে আছে মুখোমুখি। কাউন্টারে মোটাসোটা এক লোক বসে ঝিমোচ্ছিলো। আমাদের পায়ের আওয়াজ শুনে বেরিয়ে এলো। বিগলিত গলায় আলফ্রেডকে বললো, আমি ম্যানেজার। আপনারা লাঞ্চ করবেন তো? এখানটায় বসুন।

আমরা একটা বড় গোলটেবিলের চারপাশে বসলাম। ম্যানেজার বললো, আপনাদের কী দেবো বলুন।

আলফ্রেড বললো, আগে গলা ভেজাবার জন্য কিছু দাও। কী আছে তোমাদের?

একগাল হেসে ম্যানেজার বললো, সব পাবেন। পনেরো বছরের পুরোনো স্কচ হুইস্কি যদি চান তাও পাবেন। বিয়ার নিতে পারেন কিংবা যদি বলেন কোনো ককটেল–

ততক্ষণে শীলা আর জেন হেসে গড়িয়ে পড়েছে। স্কচ হুইস্কি দিয়ে ওদের গলা ভেজাতে হবে–এর চেয়ে হাসির কথা আর কী হতে পারে! ওদের হাসি দেখে আলফ্রেড ব্যস্ত হয়ে ম্যানেজারকে থামালো–ওসব চলবে না। এদের বাপ মা জানতে পারলে আমাকে আস্ত রাখবে না। তুমি বরং লেমোনেড দাও।

ভিকি আদুরে গলায় বললো, একটু মার্টিনি হলে মন্দ হতো না।

আলফ্রেড মুখ টিপে হাসলো, ঠিক আছে, লেমোনেডের সঙ্গে মার্টিনি মিশিয়ে দাও।

মার্টিনিতে সামান্য অ্যালকোহল থাকলেও এটাকে কেউ হার্ড ড্রিংকস বলে না। পার্টিতে আমাদের মার্টিনি খেতে কেউ কখনও আপত্তি করেনি। ম্যানেজার পাঁচটা গ্লাসে টলটলে লাল মার্টিনি এনে টেবিলে রাখলো–এবার বলুন খাবার কী দেবো?

কী আছে তোমাদের? জানতে চাইলো আলফ্রেড।

খিদে বেশি পেলে ল্যাম্ব স্টেক নিতে পারেন। আলু মটরশুঁটি ভাজি আছে। চিকেন। স্টু আছে।

আলফ্রেড আমাদের জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কী নেবে বলো!

শীলা বললো, ল্যাম্ব স্টেক।

ভিকি, জেন আর আমিও স্টেক চাইলাম। আলফ্রেড নিলো চিকেন স্টু। বললো, বয়স হয়েছে। ল্যাম্ব স্টেক-এ প্রচুর চর্বি থাকে, আমার জন্য চিকেন ভালো। আলফ্রেড স্টেকের সঙ্গে আলু মটরশুটি ভাজাও দিতে বললো। ম্যানেজার বললো, দশ মিনিটের ভেতর সার্ভ করছি।

চারদিকে কোনো শব্দ নেই। বাইরে শীতের বিষণ্ণ দুপুর। বনের ভেতর ন্যাড়া গাছগুলো বসন্তের অপেক্ষায় ধুকছে। ভেতরে কোণের টেবিলে দুই খুনখুনে বুড়োবুড়ি নিচু গলায় নিজেদের ভেতর কথা বলছে। শীলা বললো, ভারি সুন্দর জায়গা।

ভিকি বললো, ওয়েস্টার্ন ছবিতে এরকম কাঠের কেবিনে বসে সবাই মগভর্তি বিয়ার খায়।

জেন ওকে ফোড়ন কাটলো–ওই শুরু হলো।

ভিকি গম্ভীর হয়ে বললো,  ড্রিংসের মজা মেয়েরা কি বুঝবে!

শীলা মৃদু হেসে বললো, তোমার এখনও মজা বোঝার বয়স হয়নি ভিকি!

আমি খেতে চাইনি। শুধু একটা বর্ণনা দিচ্ছিলাম।

জেন বললো, যার মনে যা সে তাই তো বলবে শীলা! ওয়েস্টান ছবিতে শুধু কি বিয়ার খায়! এরকম কেবিনে বসে কড়া কফিও খায়।

আলফ্রেড হাসিমুখে ওদের কথা শুনছিলো। বললো, তোমাদের সঙ্গে কিছুদিন কাটালে আমার বয়স অর্ধেক হয়ে যাবে।

ম্যানেজার টেবিলে খাবার দিয়ে গেলো। তখনই চুলো থেকে নামিয়ে এনেছে। স্লাইস করা পাউরুটি, মাখন, স্টেক আর আলু মটর ভাজি দিয়ে লাঞ্চ সারতে দারুণ লাগলো। খাওয়ার পর শীলা বললো, আলফ্রেড, তুমি যদি কিছু মনে না করো একটা কথা বলতে চাই।

একটা কেন, হাজারটা কথা বলো। ব্যস্ত গলায় বললো আলফ্রেড।

আমরা তো এখনও তোমার বাড়িতে যাইনি। লাঞ্চের বিলটা আমরা নিজেরা দিতে চাই।

আহত গলায় আলফ্রেড বললো, আমাকে এভাবে অপমান কোরো না শীলা। যখন থেকে আমার সঙ্গে বেরিয়েছে তখন থেকে তোমরা আমার অতিথি। ওয়েলস-এর লোকেরা এ ধরনের কথা বা আচরণকে অপমান মনে করে।

দুঃখিত আলফ্রেড। শীলা বিব্রত গলায় বললো, আমি মোটেই তোমাকে অপমান করতে চাইনি। তখন থেকে তোমাকে ট্যাক্স করছি দেখে খারাপ লাগছিলো।

আমাকে বন্ধু ভাবলে খারাপ লাগতো না। ট্যাক্সের কথা কী বলছো? আমার যা সঞ্চয় তোমরা খেয়ে কোনো দিন শেষ করতে পারবে না। আলফ্রেডের চেহারা থমথম করছিলো।

পরিবেশটা হালকা করার জন্য হাতজোড় করে ভিকি বললো, এ যাত্রা মাপ করে দাও আলফ্রেড, এমন অন্যায় কথা জীবনেও আমাদের মুখ দিয়ে বেরোবে না।

মনে থাকে যেন! আলফ্রেডের মুখে হাসি ফুটলো।

লিডনি থেকে লাঞ্চ সেরে গাড়িতে উঠতে উঠতে তিনটা বেজে গেলো। শীতের দুপুরগুলো অদ্ভুত এক আলস্যে ভরা থাকে। আমরা সব কিছুই করছিলাম ঢিলেঢালাভাবে। লাঞ্চ সেরে কফি খেতে আধঘন্টা লাগিয়ে দিলাম।

ওয়েলস-এর রাজধানী কার্ডিফে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য পশ্চিমের পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে গেছে। গাড়ির কাঁচ বন্ধ থাকাতে বাইরে কী রকম কনকনে ঠান্ডা বাতাস টের পাচ্ছিলাম না।

সন্ধ্যার পর যখন পেনার্থ-এ আলফ্রেডের বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেকে নামলাম–পাহাড়ি নেকড়ের মতো ঠান্ডা বাতাস ঝাঁপিয়ে পড়লো আমাদের ওপর। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম আলফ্রেড একচুলও বাড়িয়ে বলেনি।

সূর্য ডুবে গেলেও আকাশে তখন গোধূলির লাল রঙ ছড়িয়ে ছিলো। বিশাল জায়গা জুড়ে বার্চ আর লাইম গাছের বন। বনের মাঝখানে খোলা জায়গায় আলফ্রেডের ছবির মতো কাঠের দোতলা বাড়ি। পশ্চিমে বার্চ লেক, আরও পশ্চিমে গিয়ে মিশেছে কালো পাহাড়ের গায়ে। পথে যে কয়টা বাড়ি চোখে পড়েছে সবই বিরাট জায়গার ওপর। আলফ্রেডকে বললাম, তুমি বলেছিলে সুন্দর । এতটা সুন্দর বাড়ি আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।

জেন উচ্ছ্বসিত গলায় বললো, এত সুন্দর বাড়ি আর পরিবেশ ফেলে তুমি নোরা লন্ডনে কেন পড়ে থাকো আমার মাথায় ঢুকছে না।

আলফ্রেড হাসিমুখে বললো, ঢোকার যথেষ্ট সময় আছে। এখন বাড়ির ভেতরে চলো। বাইরে বেশিক্ষণ থাকলে শীতে জমে যাবে।

সবাই দৌড়ে বাড়ির বারান্দায় গিয়ে উঠলাম। আলফ্রেড তালা খুললো। ঘরে ঢুকে অনেকগুলো সুইচ টিপলো। সারা বাড়ি আলোয় ভেসে গেলো।

আমরা আলফ্রেডের বিরাট ড্রইংরুমে এসে বসলাম। আসবাবপত্র পুরোনো হলেও আভিজাত্যের ছাপ রয়েছে সবখানে। দেয়ালে দুটো বড় অয়েলপেইন্টিং, একপাশে রিডিং কর্নার। সেখানে অনেকগুলো ফ্রেমে বাঁধানো পারিবারিক ছবি ঝোলানো রয়েছে। আলফ্রেড বললো, আমার একটা কেয়ার টেকার আছে হার্ভে নাম। ওকে ফোন করে দিই। রাতে হয়তো আসতে পারবে না, কাল সকালে আসবে। ভিকি আর নিক কি দয়া করে গাড়ির ওপর থেকে ব্যাগগুলো নামিয়ে আনবে? আজ রাতের জন্য কিচেনের দায়িত্ব শীলা আর জেনের।

শীলাদের অবশ্য কিচেনে তেমন কিছু করার ছিলো না। আলফ্রেড আসার পথে কার্ডিফের এক ডিপার্টমেন্ট শপ থেকে প্রচুর খাবার কিনেছে। বেশ কিছু কুড ফুডও ছিলো যা একটু গরম করে নিলেই হলো।

আলফ্রেড টেলিফোন করতে দোতলায় গেলো। আমরা আমাদের লাগেজগুলো এনে ড্রইংরুমে রাখলাম। শীলা খাবারের প্যাকেটগুলো রান্নাঘরে নিয়ে গেলো। বললো, এই শীতে কফি খেতে মন্দ লাগবে না।

কিছুক্ষণ পর দোতলা থেকে চিন্তিত মুখে নেমে এলো আলফ্রেড। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, সব কিছু ঠিক আছে তো আলফ্রেড?

শীলা জেন দুটো ট্রেতে করে কফি আর কিছু ক্র্যাকার্স নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরোলো। আলফ্রেড ওদের দিকে একবার তাকালো। তারপর বিব্রত গলায় বললো, বুঝতে পারছি না কিছু। কার্ডিগান থেকে আমার বড় বোন জরুরী টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে। খবর পাওয়া মাত্র যেন ওর সঙ্গে দেখা করি। হার্ভে বললো, কয়েকবার নাকি টেলিফোনও করেছে। বলেছে ওর নাকি খুব বিপদ!

আমি বুঝলাম নেমন্তন্ন করে এনে আলফ্রেড আমাদের একা ফেলে যেতে চাইছে। । অথচ ওর চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে যাওয়াটা খুব জরুরী। বললাম, আলফ্রেড তুমি কাল সকালেই রওনা হয়ে যাও। বোনের বিপদের সময় তোমার পাশে থাকা উচিত।

আলফ্রেড বললো, তাই বলে তোমাদের একা ফেলে যাবো?

আমরা যথেষ্ট বড় হয়েছি। আমি বললাম, আমাদের জন্য তুমি বিন্দুমাত্র ভেবো না।