৪. দুর্লভ বন্ধু আলফ্রেড

ঘড়িতে তখন ঠিক সাড়ে বারোটা। সূর্য যদিও মাথার কাছে এসে পড়েছে রোদে এতটুকু তেজ নেই। মাঝে মাঝে কনকনে বাতাসে গাছের শুকনো ঝরা পাতা এলোমেলো উড়ছিলো। গাছের পাতার সামান্য খসখস শব্দ ছাড়া কোথাও এতটুকু শব্দ নেই। আমার চারপাশে থ্রি নান তামাকের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে। আলফ্রেড এক মনে পাইপ টানছিলো। ওর সঙ্গে মাত্র দুঘন্টা আগে পরিচয়। কোনো ইংরেজ যদি কাউকে দুঘন্টার পরিচয়ে তাকে তার গ্রামের বাড়িতে যেতে বলে এর চেয়ে আশ্চার্যের আর কিছু হতে পারে না। আলফ্রেড ইংরেজ নয়। তবু এত অল্প পরিচয়ে আমাকে ওর বাড়িতে যেতে বলছে দেখে খুবই অবাক হলাম। ওকে বললাম, আলফ্রেড, আমি তোমার বাড়িতে যাবো কি না সেটা এখনই বলতে পারছি না। তুমি আমাকে এত অল্প পরিচয়ে তোমার বাড়িতে যেতে বলছে–এতে আমি বেশ অবাক হয়েছি।

পাইপ টানা বন্ধ করে আলফ্রেড আমার মুখের দিকে তাকালো। ওর চোখে কৌতুকের ঝিলিক, যেন আমি খুব মজার কথা বলেছি। বললো, আমার বয়স কত বলো তো?

ষাটের মতো হতে পারে।

আমার বয়স বাহাত্তর।

তোমাকে দেখে মনে হয় না এত বয়স হয়েছে।

প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ।

তুমি আমার কথার জবাব দাওনি।

দেখ নিক, এ বয়সে আমি মানুষ কম দেখিনি। তোমাকে বলেছি বোধহয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমার পোস্টিং ছিলো ইন্ডিয়াতে। পাঁচ বছর ছিলাম সেখানে। ইন্ডিয়ানদের আমি ভালোমতো চিনি। তা ছাড়া কোনো মানুষকে চিনতে আমার বেশি সময় লাগে না। লোকটা ভালো না মন্দ, ওর মনটা কেমন–এসব আমি এক ঘন্টার আলাপেই বুঝতে পারি।

আমার সম্পকে তোমার ধারণা কী?

তোমাকে আমি বলেছি, তুমি খুব ভালো ছেলে। তোমার বাবা, মা সবাই ভালো। তোমাকে যা বলিনি সেটা হচ্ছে তোমার মনের অবস্থা । যে কোনো কারণেই হোক আজ তোমার মন ভালো নেই। তুমি নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ ভাবছে।

কী করে বুঝলে?

আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, আমার পাঠ্য বিষয়ের তালিকায় মনোবিজ্ঞান ছিলো। বিষয়টা এমনিতেও আমার প্রিয়। এ নিয়ে যথেষ্ট পড়েছি, মানুষের চরিত্র বোঝারও চেষ্টা করেছি। এত বছরের অভিজ্ঞতা একেবারে মিথ্যা হতে পারে না।

আমি তোমাকে এমন কোনো কথা বলিনি যাতে মনে হতে পারে আমার মন ভালো নেই।

বলোনি। কিন্তু আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি। এমন চমৎকার দিনে তোমার বয়সী ছেলেরা বন্ধুদের সঙ্গে হৈ-হুল্লোড় করে কাটায়। তোমার মতো কেউ একা এভাবে অজানা গন্তব্যে পাড়ি জমায় না। আমার সঙ্গে কটনউড আসতে রাজি হলে, কারণ তোমার সহৃদয় কারও সান্নিধ্য প্রয়োজন ছিলো। তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় লক্ষ্য করেছি তুমি বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলে। একবার দারুণ মজার একটা হাসির ঘটনা তোমাকে বললাম, সত্যিই দারুণ না! তুমিও বললে সত্যিই দারুণ। যদি জিজ্ঞেস করি কী ছিলো দারুণতুমি বলতে পারবে না। তুমি অন্য কিছু ভাবছিলে। তোমার মনটা বিক্ষিপ্ত ছিলো।

আলফ্রেডের কথায় আমি বিব্রত বোধ করলাম। ও এমনভাবে কথা বলছিলো যেন। আমার মনের সব খবর ওর জানা হয়ে গেছে। বিব্রত গলায় বললাম, আলফ্রেড, তোমার কথার সময় আসলেই আমি অমনোযোগী ছিলাম। তুমি শুরু করেছিলে ওয়েলস-এর গল্প দিয়ে। আমি তখন ভাবছিলাম আমার মার কথা। কাল রাতে মাকে আমি বিমর্ষ দেখেছি। আমার সৎ বাবা দিব্যেন্দুরও মন ভালো ছিলো না। কেন যেন মনে হচ্ছে আমি বোধহয় ওদের মন খারাপের কারণ। বুঝতে পারছি না কী করবো। আমার অমনোযোগকে উপেক্ষা ভেবো না। তোমার সঙ্গে থাকতে আমার ভালো লাগছে।

আমার কথা শুনে আলফ্রেড কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বললো না। চুপচাপ তাকিয়ে থাকলে আমার মুখের দিকে। তারপর নরম গলায় বললো, বয়সে আমি তোমার চেয়ে অনেক বড়। কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছো এমনভাবে যেন আমি তোমার সমবয়সী কেউ। এতে বোঝা যায় তোমার মনটা কত নিষ্পাপ। নিক, তুমি কি আমাকে বলবে কাল রাতে কী হয়েছিলো?

কথাগুলো আলফ্রেড এমনভাবে বললো, যেন ও আমার অনেক দিনের পুরোনো খুব কাছের একজন বন্ধু। মনে হলো অন্য কারও সঙ্গে না হলেও ওর সঙ্গে আমার কষ্টের বোঝা ভাগ করে নেয়া যায়। যদিও আলফ্রেডের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বোঝা এমনিতে কিছুটা হালকা হয়ে এসেছিলো, ভাবলাম যদি এভাবে বোঝাটা নামিয়ে ফেলতে পারি ক্ষতি কী! ওকে বললাম কাল কী হয়েছিলো। শুধু কালকের কথা নয়, দিব্যেন্দুর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব, মার সঙ্গে ওর বিয়ে, ইন্ডিয়া যাওয়া, ওদের পরিবারের রক্ষণশীলতা সবই ওকে বললাম।

আমার কথা শোনার পর আলফ্রেড কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। আপন মনে পাইপ টানছিলো। আমি তাকিয়েছিলাম দুর্গের দিকে। শীতের ঝিমধরা দুপুরে জীর্ণ দুৰ্গটাকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিলো একসময় কত দাপট ছিলো এই দুর্গের। কত মানুষ এটাকে দেখে ভয়ে সিটিয়ে যেতো। এখন কেউ জানেও না এটার কথা। অযত্নে অবহেলায় এভাবে ধীরে ধীরে একদিন মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। সে মাটিতে ঘাস গজাবে, বসন্তে ঘাসফুল ফুটবে। ছোট ছোট বাচ্চারা প্রজাপতির পেছনে ছুটোছুটি করবে। যখন একা থাকি এরকম ভাবতে আমার ভালো লাগে। মা একদিন বলেছিলেন, তুই জেগে জেগে স্বপ্ন দেখিস।

আলফ্রেড আস্তে আস্তে বললো, নিক, তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই, যদি কিছু মনে না করো। আর আমাকে যদি বন্ধু ভাবতে পারো তবেই প্রশ্নের জবাব দিও।

দিব্যেন্দু আমার চেয়ে বাইশ বছরের বড় হয়ে যদি বন্ধু হতে পারে তুমি কেন পারবে না! তোমার প্রশ্ন বলো–

আমাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার জন্য তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ নিক।

তোমার প্রশ্নটা কী?

দিব্যেন্দুর মা যা চেয়েছে, দিব্যেন্দু যদি ছোট্ট একটা বাচ্চার বাবা হতে চায় তুমি কি আপত্তি করবে?

একথা কেন বলছো?

আমার ধারণা তোমার মা তা চায় না। তোমার কথা ভেবেই হয়তো। তোমার মার হয়তো মনে হয়েছে তাতে তুমি নিজেকে উপেক্ষিত ভাবতে পারো। তুমি নিজে কী বলো?

আলফ্রেডের কথার জবাব কীভাবে দেবো কিছুক্ষণ ভাবতে হলো। তারপর বললাম, মা যদি সত্যিই ওরকম ভেবে থাকে তার নিশ্চয় কারণ আছে আলফ্রেড।

আমি জানি। তবু আমাদের সব সময় সব পরিস্থিতির ভেতর মানিয়ে চলা শিখতে হয়। এই যে আমার ছেলেরা আমার জন্মদিনে আর ক্রিসমাসে শুধু দুটো কার্ড পাঠিয়ে আমার প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করে–এটা তো আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু তোমার মা তোমাকে কাছে পেতে চায়। দিব্যেন্দুও নিশ্চয় চায় তুমি ছোট ভাইবোনকে ভালোবাসবে। যদি তুমি এটা সহজভাবে নিতে পারো তোমার মা আর দিব্যেন্দুর ভেতর আর কোনো বিরোধ থাকবে না। আমার ধারণা তুমি আগের চেয়ে বেশি ওদের ভালোবাসা পাবে।

আমার ভয় হচ্ছে ওরা আমাকে বোর্ডিং-এ পাঠিয়ে দেবে।

তুমি অনেক বিষয় তোমার বয়সী ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি বোঝ। এটা কেন বুঝতে পারছে না দিব্যেন্দুর সঙ্গে তোমার মায়ের বিয়েটা যেমন তোমার ইচ্ছায় হয়েছে, তোমার ইচ্ছাতেই তোমাদের বাড়িতে নতুন অতিথি আসবে। এজন্য তোমার বাবা মা দুজনই তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।

কথাটা ভেবে দেখলাম, আলফ্রেড মিথ্যে বলেনি। আমি না চাইলে মার সঙ্গে দিব্যেন্দুর বিয়ে হতো না কিন্তু ওদের একটা দুঃখের কারণ হতাম আমি, যা ওরা কখনও আমাকে জানতে দিতো না। কখনও যদি আমি না চাই দিব্যেন্দু বাবা হবে না, ওর মার ইচ্ছা পূরণ হবে না, এর দায় শেষ পর্যন্ত আমাকেই নিতে হবে ।

আলফ্রেডও আবার বললো, তুমি বড় হচ্ছো নিক। এখন তুমি আরও বেশি করে নিজের জগতে জড়িয়ে যাবে। দশ বছর পর বাবা মার চেয়ে অনেক বেশি আপন মনে হবে তোমার নিজের জগৎকে। তখন ওদের কী হবে সেটাও একবার ভাবো।

তুমি ঠিকই বলেছো আলফ্রেড। আমি ততক্ষণে মনস্থির করে ফেলেছি। বললাম, আমি খুব স্বার্থপরের মতো নিজের কথাই শুধু ভাবছিলাম। আজই মাকে বলবো–আমি ভাই পেতে চাই।

নরম হেসে আলফ্রেড বললো, তুমি মোটেই স্বার্থপর নও নিক। স্বার্থপর হলে বন্ধুদের ফেলে এমন চমৎকার দিনে আমার মতো বিটকেল বুড়োকে সঙ্গ দিতে না।

আলফ্রেডের কথার ধরনে আমি হেসে ফেললাম–কী যা তা বলছো আলফ্রেড! তুমি শুধু বন্ধু নও, তার চেয়েও বেশি কিছু। জানো, কাল সারা রাত আমি ঘুমোতে পারিনি। অনেক রাত পর্যন্ত কেঁদেছিলাম। নিজেকে খুব হতভাগ্য ভাবছিলাম। মনে হচ্ছিলো আমার আনন্দের দিন চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে।

আমার কাঁধে হাত রেখে আলফ্রেড বললো, তোমার মতো চমৎকার ছেলে নিজেকে কেন হতভাগ্য ভাববে? আশা করি এরপর থেকে এরকম কোনো সমস্যা হলে এ বুড়োকে স্মরণ করবে। আমি চাই চিরকাল তুমি আনন্দের জগতে বাস করবে।

ভবিষ্যতে নিশ্চয় তোমাকে স্মরণ করবো। পরিবেশটা হালকা করার জন্য বললাম, আপাতত অন্য একটি কারণে তোমাকে স্মরণ করতে ইচ্ছে করছে।

কী কারণে? একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলো আলফ্রেড।

আমি ক্ষুধার্ত। নেকড়ে বাঘের মতো ক্ষুধার্ত।

ঘড়ি দেখে আঁতকে উঠলো আলফ্রেড–হায় ঈশ্বর, দেড়টা বেজে গেছে! আমি দুঃখিত নিক, একটায় খাবো বলেছিলাম। এই বলে ব্যাগ থেকে ও স্যান্ডউইচ আর দুটো কোকের ক্যান বের করলো। স্টেশনের রেস্তোরাঁ থেকে চা খেয়ে আসার সময় এগুলো সে কিনেছিলো।

স্যান্ডউইচ খেতে খেতে বললাম, একেবারে টাটকা জিনিস। লন্ডনে এত টাটকা স্যান্ডউইচ পাওয়া যাবে না।

গ্রামের সব কিছুই টাটকা। বুক ভরে এখানকার বাতাসে নিঃশ্বাস নাও। লন্ডনে এ বাতাস কোথায় পাবো?

ওয়েলস-এর বাতাস নিশ্চয় এর চেয়েও ভালো?

আহ্ ওয়েলস! ওখানকার কোনো কিছুর সঙ্গে এখানকার তুলনা হয় না। বলতে গিয়ে গভীর তৃপ্তিতে আলফ্রেডের চোখ বুজে এলো। তারপর হঠাৎ মনে পড়াতে বললো, ভালো কথা, তুমি কি আমার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছো?

হেসে বললাম, নিশ্চয় যাবো আলফ্রেড। কবে যেতে চাও বলো?

অবশ্য তোমার স্কুল খোলার আগে। যখন খুশি যেতে পারো।

সঙ্গে যদি আমার দু তিনজন বন্ধু যেতে চায়অসুবিধে হবে?

আলফ্রেডের মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। শুকনো গলায় বললো, তোমার বন্ধুরা কি আমার মতো একজন বুড়োর সঙ্গ পছন্দ করবে?

নিশ্চয় করবে। আমাকে তোমার পছন্দ হলে ওদেরও হবে।

ওরা কি ইংরেজ?

আলফ্রেডের ভয়ের কথা জানতে পেরে হেসে ফেললাম–একজনও ইংরেজ নয়।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললোআলফ্রেড–তা হলে অবশ্যই ওদের স্বাগত জানাবো। ওর মুখে আবার হাসি ফিরে এলো অসভ্য ইংরেজ জাতটাকে দুচোখে দেখতে পারি না আমি।

আজকাল ইংরেজদের ভেতর এশিয়ানদের প্রতি ঘৃণা অনেক বেড়েছে। ওদের সম্পর্কে আমার ধারণাও খুব ভালো নয়। তবে আলফ্রেডের মতো এতটা বিদ্বেষ আমার ভেতর নেই। বললাম, তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবো কীভাবে?

আলফ্রেড একটা কাগজে ওর লন্ডনের ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বর লিখে দিলো। বললো, এটা হচ্ছে সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন অফিসারের একটা ক্লাব। লন্ডনে এলে আমি ক্লাবের গেস্ট হাউসে উঠি। তোমার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলো। যদি চাও আমরা কালই যেতে পারি।

ততক্ষণে আমাদের দুপুরের লাঞ্চ হয়ে গেছে। আলফ্রেডকে বললাম, বলেছিলে কাছে নাকি নদী আছে, নৌকায় ঘোরা যায়! এদিকে তো কোনো নদী দেখছি না।

মুখ কাঁচুমাচু করে আলফ্রেড বললো, তোমাকে লোভ দেখাবার জন্য বলেছিলাম নদী কাছে। আসলে এখান থেকে দেড় মাইল পশ্চিমে নদী। যদি হাঁটতে আপত্তি না থাকে যেতে পারি।

আজ তা হলে থাক। হেসে বললাম, তবে যে বললে ওয়েলস-এ নাকি বার্চলেকের ধারে তোমার বাড়ি! সেখানে গিয়ে আবার হ্রদ দেখার জন্য কয়েক মাইল হাঁটতে হবে না তো?

মোটেই না। ব্যস্ত গলায় প্রতিবাদ জানালো আলফ্রেড–হ্রদের পানিতে আমাদের বাড়ির ছায়া পড়ে। সত্যি বলছি নিক!

মুখ টিপে হেসে বললাম, দেখা যাবে।

দেখে নিও। হাসিমুখে বললো আলফ্রেড।

সূর্য বেশ কিছুক্ষণ আগে পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। ঠান্ডা বাতাস ধীরে ধীরে বাড়ছিলো। দুর্গের বা পাশে বন, ডানদিকটা অনেকখানি খাড়া নেমে গেছে খোলা মাঠে। সামনের চত্বরে একসময়ে পাথর বিছানো ছিলো। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে বুনন ঘাস আর আগাছা গজিয়ে সব ঢাকা পড়েছে। আলফ্রেডকে বললাম তুমি কখনও এ দুর্গের ভেতরে গিয়েছো?

 না যাইনি। একা সাহসে কুলোয়নি। তুমি যদি সঙ্গী হও একদিন যেতে পারি। অবশ্য আমার মতো যদি ভীতু না হও।

এখন যাবে? আমি সাহস দেখাবার জন্য উদগ্রীব হলাম।

আজ বাদ দাও। তোমার সঙ্গে বসে গল্প করতে বেশি ভালো লাগছে।

আমার পুরোনো প্রাসাদ, দুর্গ এসব দেখতে ভালো লাগে।

আমাদের পাশের গ্রামে একটা অনেক দিনের পুরোনো প্রাসাদ আছে, লোকে ওটাকে হন্টেড প্যালেস বলে। দিনের বেলায়ও ওর ধারেকাছে কেউ যায় না।

আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম, সত্যিই বলছো আলফ্রেড! তা হলে তো দারুণ মজা হবে।

আলফ্রেড মৃদু হাসলো। কোনো কথা বললো না। বিকেল চারটা পর্যন্ত আলফ্রেডের সঙ্গে কটনউডে কাটালাম। তারপর লন্ডনের ট্রেন ধরে যখন ভিক্টোরিয়া স্টেশনে নামলাম তখন চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। আলফ্রেড বললো, তুমি বাড়ি যাবে কিভাবে?

টিউবে চলে যাবো। তুমি আমার জন্য ভেবো না।

আমি তোমাকে তোমাদের স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দেবো।

কোনো দরকার হবে না আলফ্রেড। রাত নটা দশটায় বাড়ি ফেরার অভ্যাস আছে আমার।

আলফ্রেড করুণ গলায় বললো, তোমর জন্য নয়, আমার নিজের গরজেই যেতে চাইছি। আমি আরও কিছু সময় তোমার সঙ্গে কাটাতে চাই।

ওর জন্য মায়া হলো। মাত্র পাঁচটা বাজে। মা আর দিব্যেন্দু ফিরবে সাতটা আটটার দিকে। নিরীহ গলায় বললাম, ঠিক আছে আলফ্রেড, আমার সঙ্গে যেতে পারো এক শর্তে

অবাক হয়ে ও জানতে চাইলো–কী শর্তে?

যদি আমাকে এক কাপ কফি খাওয়াও।

স্টেশন ভর্তি লোকের সামনে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আলফ্রেড বললো, শুধু কফি কেন, তুমি যদি আমার সঙ্গে ডিনার করতে চাও তা হলে আরও বেশি খুশি হবো।

ডিনার পাওনা থাক। আজকের মতো কফি হলেই চলবে। এই বলে আমরা দুজন হাত ধরাধরি করে বাইরে এসে একটা কফিশপে ঢুকলাম।

কফির সঙ্গে আলফ্রেড জোর করে পেস্ট্রি খাওয়ালো। তারপর আমাকে নিয়ে গেলো পাশের ডিপার্টমেন্ট শপে। তিনতলায় উঠে গেমস সেকশনে গিয়ে কম্পিউটার গেমস-এর ক্যাটালগ নিয়ে এক পাশের সোফায় বসে বললো, এখান থেকে দশটা চমৎকার গেম বেছে দাও দেখি, যা তোমার নেই।

তুমি কি কম্পিউটার গেম পছন্দ করো!

না, একজনকে দেবো।

কী রকম দামের ভেতর চাও? গেম বাছতে বাছতে জানতে চাইলাম আমি।

দাম নিয়ে ভেবো না। খুব উত্তেজনা আর বুদ্ধির খেলা হতে হবে।

ক্যাটালগে শয়ে শয়ে গেমের তালিকা। নামের পাশে বিবরণ আর দাম লেখা আছে। গেম যত জটিল দাম তত বেশি। আলফ্রেডের বাজেট জানি না। মাঝামাঝি দামের দশটা গেম বাছলাম। ক্যাটালগ পড়ে মনে হলো আমার যেগুলো আছে তার চেয়ে অনেক ভালো। হবে না কেন, প্রতিমাসে নতুন নতুন গেম বেরোচ্ছে, অথচ গত ছমাস আমি কোনো গেম কিনিনি।

ছোট একটা গিফট প্যাকেটে দশটা ফ্লপি ডিস্ক নিয়ে আলফ্রেড ওর ব্যাগে ঢোকালো। আমার সঙ্গে টিউবে সাউথ গেট স্টেশন পর্যন্ত এলো। মোটামুটি ফাঁকাই ছিলো স্টেশন। ও যাবে উল্টো দিকে। আমি বললাম, এবার তোমাকে আমি ট্রেনে তুলে দেবো।

আলফ্রেড আপত্তি করলো না। ওপরে সংকেত দেখা গেলো দু মিনিট পর ওর ট্রেন আসছে। আলফ্রেড বললো, তুমি কিন্তু কাল সকালেই ফোন করছো?

মাথা নেড়ে সায় জানালাম। ওর ট্রেন এসে গেলো। ব্যাগ থেকে ফ্লপি ডিস্কের প্যাকেটটা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে ও বললো, এটা তোমার।

আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। এত দামী উপহার আলফ্রেড আমার জন্য কিনেছে ভাবতেও পারিনি!

তোমার চেয়ে আপন এ মুহূর্তে আমার আর কেউ নেই। এই বলে আলফ্রেড ট্রেনে উঠে পড়লো।

আমি একটা ধন্যবাদও জানাতে পারলাম না। জানালার ফ্রেমে ওর হাসিমাখা মুখখানা ভেসে উঠলো। হুশ করে বেরিয়ে গেলো ট্রেনটা।