৬. লাল স্ট্যান্ডবাই হিসেবে

মনে হলো আবারো ‘লাল’ স্ট্যান্ডবাই হিসেবে স্কোয়াড্রনের কাজে নেমেছে ডেভিড। বড় গাছের শেডের নিচে নাভাজো পার্ক করা। রেডিও সেটও রাখা হয়েছে সুইচ অন অবস্থায়। সামের ট্রান্সমিটারের সিগন্যাল আসছে ভাসা ভাসা। পুলের উপরে পাহাড়ের মাথায় ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করছে সে।

বেশ গরম পড়েছে। পূর্ব দিক থেকে ঝড়ের আভাসও পাওয়া যাচ্ছে।

এয়ারক্রাফটের উইংয়ে ছায়ায় বসে আছে ডেভিড, ডেবরা আর কনরাড বার্গ। ককপিটে গরমের জন্যে বসাই যাচ্ছে না। হালকা চালে খোশগল্পে মেতে থাকলেও সবার কান খাড়া হয়ে আছে স্যামের কাছ থেকে সংকেতের আশায়।

 ‘লোকটা আজ আসবে না। দুপুর হবার খানিক আগে জানাল ডেবরা। আসবে, নির্ঘাৎ আসবে। কনরাড শুধরে দিল ডেবরাকে। এই বাফেলোগুলোর লোভ সামলানো সোজা কথা নয়। হয়তো আজ না—-কিন্তু আগামীকাল বা তার পরে সে আসবেই।

 উঠে দাঁড়াল ডেভিড। কেবিনের খোলা দরজা দিয়ে উঠে পড়ল। ককপিটের দিকে এগিয়ে গেল।

 ‘স্যাম?’ মাইক্রোফোনে ডেকে পাঠাল সে। আমার কথা শুনতে পাচ্ছো? অনেকক্ষণ বিরতি। বোঝা গেল রেডিও ব্যবহার করতে হিমশিম খাচ্ছে স্যাম। এরপর আস্তে হলেও পরিষ্কার ভাবে শোনা গেল ওর গলা ‘আমি শুনতে পাচ্ছি নখোসি।’

‘কিছু দেখতে পেয়েছো?

কিছু না।

 নজর রাখো তাহলে।

ইয়েবো, নখোসি।’

এয়ারস্ট্রিপে ঠাণ্ডা পিকনিক লাঞ্চ নিয়ে এলো জেন। টেনশন থাকা সত্ত্বেও পেট পুরে খেলো সকলে। এরপর হাত দিতে যাবে মিল্ক টার্টের প্লেটে, হঠাৎ করেই জীবন্ত হয়ে উঠল রেডিও। পরিষ্কার কণ্ঠে ঘোষণা করল স্যাম :

‘এসে গেছে!

‘রেড স্টান্ডবাই গো! যাও!”

 চিৎকার করে উঠল ডেভিড। সবাই হুড়মুড় করে ঢুকলো কেবিনের দরজা দিয়ে। জেনের মিল্ক টার্টের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে যাচ্ছিল ডেবরা। তাড়াতাড়ি তার হাত ধরে সিটে নিয়ে বসিয়ে দিল ডেভিড।

ব্রাইট ল্যান্স এয়ারবর্ন হয়ে উঠে পড়ছে। উত্তেজনায় হেসে উঠল ডেভিড। এরপর স্মৃতি এসে যেন ছুরি বসিয়ে দিল মুখে। মনে পড়ল ছয়ের কাটার ঘরে ঝুলে আছে জো। জোর করে মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। শূন্য চোখে তাকাল হেডিংয়ের দিকে। অলটিচ্যুডের জন্যে সময় নষ্ট না করে গাছের উপরে ডান দিকে রইল সমান্তরালভাবে।

তাদের পেছনে সিটে কুঁজো হয়ে বসে আছে কনরাড বার্গ। সবসময়ের চেয়েও বেশি লাল হয়ে আছে তার চেহারা। মনে হচ্ছে বেশি পেকে যাওয়া একটা টমেটোর মতো যে কোন মুহূর্তে বিস্ফোরিত হয়ে যাবে। ল্যান্ড রোভারের চাবি কোথায়? উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল সে। ইগনিশনে আর ট্যাঙ্কিও ভর্তি হয়ে আছে।

‘আরো জোরে চালাতে পারো না? গর্জন করে উঠল কনরাড।

‘ওয়াকি টকি এনেছেন? মনে করিয়ে দিল ডেভিড।

‘এই যে! বিশাল হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে কনরাড। আরেক হাতে জোড়া ব্যারেলের ৪৫০ ম্যাগনাম দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার ভাবে।

উঁচু গাছগুলোর মাথায় উঠে পড়ল ডেভিড। সীমান্ত বেড়ার উপর পৌঁছে গেল। সামনে পড়ে আছে জাবুলানির পাহাড়।

প্রস্তুত হোন, কনরাড়কে জানাল ডেভিড। নাভাজো নিয়ে উড়ে গেল এয়ারস্ট্রিপে; ট্যাক্সিইং করে এগিয়ে গেল পার্ক করে রাখা ল্যান্ড রোভারের দিকে।

ডেভিড ব্রেক কষে থামার সাথে সাথে লাফ দিয়ে নেমে গেল কনরাড। কেবিনের দরজা খুলেই দৌড় দিল ল্যান্ড রোভারের দিকে। সাথে সাথে থ্রটল খুলে দিল ডেভিড। এয়ারক্রাফটকে ঘুরিয়ে নিল। নাভাজো আবারো শক্তি ফিরে পাবার আগেই টেক-অফ করল।

উপরে উঠে পড়তেই দেখতে পেল এয়ারস্ট্রিপ ধরে ধুলার মেঘ উড়িয়ে গর্জনে ছুটে চলেছে ল্যান্ড রোভার।

‘ডু ইউ রিড মি, কনি?”

‘লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। স্পিকারে গমগম করে উঠল কনরাডের কণ্ঠস্বর। ডেভিড মোড় নিয়ে পাহাড়ের পেছনে গাছের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাওয়া পাবলিক রোডের দিকে ঘুরে গেল।

অনুসরণ করে চলল সে। প্রায় পাঁচশ ফুট উপরে আছে। ভোলা পার্ক ল্যান্ডের চারপাশে খুঁজতে লাগল।

মাটি থেকে সবুজ ফোর্ড ট্রাককে দেখা না গেলেও আকাশ থেকে পরিষ্কার ভাবে চোখে পড়ল। আক্কারস ভাবতেই পারল না কী ঘটতে চলেছে।

কনি, পেয়েছি ট্রাককে লুজান স্ট্রিম থেকে তীরের দিকে আধা মাইলের মাঝে। ভাল হবে তুমি যদি ব্রিজের দিকে এগিয়ে যাও। এরপর শুকনো নদীর মাঝে নেমে গিয়ে চেষ্টা করা ট্রাক আসার আগেই ধরতে।

“ঠিক আছে, ডেভিড।’

মুভ ইট, ম্যান।

হুম। গাছের উপর দিয়ে ও ল্যান্ড রোভারের ধুলা দেখতে পেল ডেভিড। কনরাড নির্ঘাৎ প্যাডেলে পা চেপে রেখেছে শক্ত করে।

‘আমি চেষ্টা করব লোকটাকে হাতেনাতে ধরে তোমার হাতে তুলে দিতে।

‘তুমি পারবে।’

পাহাড়ের দিকে লম্বা টান নিল ডেভিড। চারপাশ দেখতে লাগল নিচে চকচক করছে পুল। হালকাভাবে প্রটল খুলে দিল ডেভিড। অনেক উপর থেকে দেখা গেল ছোট্ট একটা বিন্দু পাগলের মতো নাচানাচি করছে।

‘স্যাম।’ দেখতে পেল ডেভিড। যুদ্ধের নাচ নাচছে। কোর্স বদলে স্যামের একেবারে কাছ দিয়ে উড়ে গেল ডেভিড। উইন্ডমিলের মতো ঘোরা বন্ধ করে হাত বাড়িয়ে পশ্চিম দিকে দেখাল স্যাম। হাত নেড়ে স্বীকৃতি জানাল ডেভিড। এরপর পশ্চিমে নেমে গেল খানিকটা।

সামনের ছড়িয়ে আছে সমভূমি, ঠিন যেন চিতা বাঘের পিঠ। ঘন ঝোঁপঝাড় আর সোনালি ঘাস। আরো এক মিনিট উড়ে গিয়ে কালো একটা জমায়েত দেখতে পেল। তার সামনে দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। বাকি বাফেলোগুলো একত্রিত হয়েছে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছে।

বাফেলো। ডেবরাকে জানাল ডেভিড। দৌড়াচ্ছে। কিছু একটা সচকিত করে তুলেছে তাদেরকে। ডেভিডের পাশে চুপচাপ বসে আছে সে। কোলের উপর হাত রেখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।

আহ! চিৎকার করে উঠল ডেভিড। পেয়েছি তাকে-হাতে রক্ত!

সামনের খালি জায়গাগুলোর একটার ঠিক মাঝখানে পোকার মতো দেখাচ্ছে মৃত বাফেলোর দেহটাকে। পেট অনাকৃত, পা ঝুলে আছে একপাশে।

 চারজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে এর চারপাশে। নির্ঘাৎ কসাইয়ের কাজ শুরু হবে এখন। তিনজন আফ্রিকান, একজনের হাতে ছুরি।

চতুর্থজন হলে আক্কারস। এত লম্বা-চওড়া দেহ ভুল হবার কোন কারণ নেই। পরনে কালো ফেদোরা, টুপি আছে মাথায়। যে কাজে লেগেছে তার তুলনায় পোশাকটা  বড় বেশি আনুষ্ঠানিক মনে হল। কিন্তু শার্টের উপর ব্রেস আছে আড়াআড়ি ভাবে।

ডান হাতে ধরে আছে একটা রাইফেল। এয়ারক্রাফটের শব্দ পেয়ে তাকাতে লাগল চারপাশে। এরপর আকাশের দিকে তাকিয়েই জমে গেল যেন।

 ‘শুয়োর কোথাকার। ওহ, কী যে করতে ইচ্ছে করছে আমার!’ ফিসফিস করে উঠল ডেভিড। রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করল সে।

 ‘হোল্ড অন! সাবধান করল ডেবরাকে। ঠিক খাড়াভাবে নেমে যেতে লাগল মানুষটার উপর। মৃত বাফেলোর চারপাশে জড়ো হওয়া দলটা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। এয়ারক্রাফট নেমে যেতে লাগল তাদের উপর। কিন্তু ডেভিড নির্বাচন করল টুপিওয়ালাকে। পোপেলারের পাখা স্পর্শ করল ঘাসের মাথা। দৌড়ে গেল আক্কারসের দিকে।

মনে হলো আক্কারসের উপর দিয়ে প্লেন চালিয়ে দেবে সে। অসম্ভব রেগে উঠল নিজের অবোধ প্রাণীদের উপর এহেন নির্যাতন দেখে। চাইল প্রপেলারের ব্লেড দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে দুষ্ট লোকটাকে।

কাঁধের উপর দিয়ে পেছনে তাকাল আক্কারস। ভয়ে সাদা হয়ে গেল তার মুখ। গভীর আর গর্তে বসানো চোখগুলোতে ভয়ার্ত ছায়া দেখতে পেল- খুনীর মতো এগিয়ে আসছে ব্লেডগুলো। আর হয়তো ফুটখানেক দূরে। ঘাসের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল লোকটা।

এক ইঞ্চি উপর দিয়ে উড়ে গেল নাভাজো। আবার ঘুরিয়ে এদিকে আসতে লাগল ডেভিড। এবার পাখার মাথা দিয়ে ঘাসের ডগা কাটতে কাটতে এগোতে লাগল। আসার সময় দেখতে পেল উড়ে যাবার মতো দৌড় লাগাল আক্কারস। আর গাছের কিণার থেকে পঞ্চাশ কদম দূরে আছে।

 সমান্তরাল ভাবে উঠে গেল ডেভিড। রাগে এখনো কাপঁছে সে। কিন্তু বুঝতে পারল গাছগুলোর কাছে পৌঁছানোর আগে তাকে ধরতে পারবে না সে।

বড়সড় একটা গাছের মোটা গুঁড়ির কাছে পৌঁছে কাঁধে রাইফেল তুলে নিল আক্কারস। এগিয়ে আসা এয়ারক্রাফটের দিকে তাক করল, যদি হাত কাঁপছে, কিন্ত রেঞ্জ কম আছে।

‘নিচে’, চিৎকার করে উঠল ডেভিড। উইন্ডশিল্ডের নিচে নামিয়ে দিল ডেবরার মাথা। থ্রটল খুলে খাড়াভাবে উঠে গেল উপর দিকে।

ইঞ্জিনের গর্জন ছাপিয়েও ডেভিডের কানে এলো এয়ারক্রাফটের ফিউজিলাজে আঘাত করা বুলেটের শব্দ।

‘কী হচ্ছে ডেভিড?’ আর্তনাদ করে উঠল ডেবরা। ও আমাদের দিকে গুলি ছুঁড়ছে। কিন্তু আমরা তাকে দৌড়াতে বাধ্য করেছি। নিশ্চয় ট্রাকের কাছে যাবে এখন। এতক্ষণে সেখানে পৌঁছে গেছে কনরাড।

গাছের ফাঁকে ফাঁকে কাভার নিয়ে দৌড়াতে লাগল আক্কারস। উপরে কর দিচ্ছে ডেভিড। বুঝতে পারল পালানোর জন্যেই দৌড়াচ্ছে প্রাণপণে আক্কারস।

 ‘ডেভিড, শুনতে পাচ্ছো আমার কথা?’ ককপিটের মাঝে গমগম করে উঠল কনরাডের স্বর।

কী হয়েছে, কনি?

‘আমরা সমস্যায় পড়েছি। ল্যান্ড রোভার পাথরের গায়ে ধাক্কা লেগেছে। পুরো জায়গা ভরে যাচ্ছে তেলে। পাম্প ফুটো হয়ে গেছে।

‘কীভাবে হলো এমনটা? জানতে চাইল ডেভিড।

‘আমি একটা শর্ট-কাট রাস্তা দিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কনরাডের কাতরতা বুঝতে পারল ডেভিড। লজুন স্ট্রিম থেকে কতদূর আপনি?

‘প্রায় তিন মাইল।

‘ঈশ্বর, পার হয়ে যাবে শয়তানটা এতক্ষণে। জানিয়ে দিল ডেভিড। ট্রাক থেকে দুই মাইল দূরে আছে। আর এমন ভাবে দৌড়াচ্ছে যেন পিছনে ট্যাক্স কালেকটর ছুটে আসছে।

 ‘তুমি এখনো জানো না বৃদ্ধ কনি কী করতে পারে। আমি ওখানে অপেক্ষা করব ওর জন্যে। তুমি শুধু দেখো৷ প্রমিজ করল কনরাড।

গুড লাক, ডেভিড জানাতেই যোগায়োগ কেটে গেল।

নিচে পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে গেছে আক্কারস। গাছের নিচে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার টুপি। নিজের স্টারবোর্ড উইং তার দিকে তাক করে রাখল ডেভিড। ধীরে ধীরে তার উপরে চক্কর কাটছে নাভাজো।

আক্কারসকে ছাপিয়ে আরেকটা মূর্তি নজরে এলো এবার। এক মুহূর্তের জন্যে ভাবল বোধ হয় কোন জম্ভ। এরপরই রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে রইল। বুঝতে পারল ওর ভুল হয়েছে।

কী হয়েছে? ডেভিডের চিন্তা বুঝতে পেরে জানতে চাইল ডেবরা।

 ‘স্যাম। ওই গাধা কোথাকার। কনি বারবার বলেছে ওর জায়গা থেকে না নড়তে। ওর কাছে কোন অস্ত্র নেই—কিন্তু নিচে নেমে আসছে আক্কারস’কে ধরতে।

ওকে থামতে পারো না তুমি?’ উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল ডেবরা। উত্তর দেবার সময়ও নেই ডেভিডের।

 প্রতি উত্তরের আগে চারবার কল করল কনরাডকে। দৌড়ানোর কারণে মোটা হয়ে আসছে তার স্বর।

‘স্যাম আক্কারসের সামনে পড়তে যাচ্ছে। বোধ হয় মোকাবেলা করতে চায়।’

 ‘ওহ ঈশ্বর। গুঙ্গিয়ে উঠল কনরাড।

‘আমি পেলে ওকে মেরে ফেলবো।

‘দাঁড়ান, জানাল ডেভিড। আমি কাছে যাচ্ছি কী ঘটে দেখার জন্যে।

পরিষ্কারভাবে সব কিছু ঘটতে দেখল ডেভিড। মাত্র তিনশ ফুট উপরে সে। আক্কারস বুঝতে পারলো কেউ একজন দৌড়ে আসছে। পুরো থেমে রাইফেল তুলে নিল। হয়তো সর্তকবাণী দিয়েছেও; কিন্তু দৌড়ানো বন্ধ করল না স্যাম। পাথুরে জমি পেরিয়ে দৌড়ে এসে ধরতে চাইল মানুষটাকে। যে কিনা তার ছেলেমেয়েকে পুড়িয়ে মেরেছে।

 কাঁধে রাইফেল তুলে নিল আক্কারস। ইচ্ছে করে তাক করল। রাইফেল নেচে উঠল। ভারী নরম নাকওয়ালা বুলেট আঘাত করল স্যামের গোড়ালিতে।

ছোট্ট বাদামী রঙের দেহটা গড়িয়ে পড়তে লাগল ঢালু বেয়ে।

ডেভিড দেখতে পেল রাইফেল রিলোড করল আক্কারস। নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিল কার্টিজ শেল। এরপর চোখ তুলে তাকাল তাকে ঘিরে চক্কর দিতে থাকা এয়ারক্রাফটের দিকে। হয়তো ডেভিডের ভুল হয়েছে কিন্তু মনে হলো হাসছে আক্কারস। ভয়ঙ্কর দেখতে কুৎসিত দাঁতগুলো ঝিক দিয়ে উঠল। এরপর লাফিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল ট্রাকের দিকে।

‘কনি’ কর্কশ ভাবে নিজের হ্যান্ডসেটে বলে উঠল ডেভিড, স্যামকে খুন করেছে ব্যাঞ্চোতটা।

.

এবড়ো-খেবড়ো বালিময় ভূমির উপর দিয়ে বহু কষ্টে দৌড়ে এলো কনরাড বার্গ। টুপি হারিয়ে গেছে। বিশাল লাল মুখ থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ছে ঘাম। চোখ জ্বালা করছে, ধূসর চুলগুলো লেপ্টে আছে কপালের সাথে। পিছনে লাফাচ্ছে ওয়াকি টকির সেট। কোমরে তালে তালে দুলছে রাইফেলের বাট।

পুরো মনোযোগ দিয়ে দৌড়াচ্ছে সে। চেষ্টা করল হৃৎপিণ্ডের লাফানি ভুলে যেতে, নিঃশ্বাসের কষ্ট উপেক্ষা করতে। কাটা গাছ লেগে কেটে গেল হাতের উপরের অংশ। চামড়া দিয়ে গড়াতে লাগলো চিকন রক্তের ধারা। কিন্তু দৌড়ানো থামালো না সে।

আকাশের দিকে লাল মুখ তুলে তাকাল। দেখতে পেল ডেভিডের এয়ারক্রটাকে। তার সামনে চক্কর দিচ্ছে। খানিকটা বাম পাশে। এর মানে হলো আক্কারস সেদিকে আছে। এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে পালাবার আগে তাকে ধরতে পারবে কনরাড।

 পিঠের রেডিও সেট বাজতে লাগল। কিন্তু কল ধরল না সে। এখন থামতে পারবে না সে। দৌড়ানো থামানো মানে হলো নিঃশেষ হয়ে পড়ে যাবে সে। বিশালদেহী মানুষ সে, বাতাস বেশ গরম, তিন মাইল দৌড়ে এসেছ সে, আরেকটু এগিয়ে যাওয়া মনে হচ্ছে কিছুতেই সম্ভব না। শেষ শক্তি দিয়ে দৌড়াচ্ছে সে।

হঠাৎ করেই পায়ের তলার মাটি মনে হলো সরে গেল। সামনে ঝুঁকে অর্ধেক পড়িয়ে অর্ধেক গড়িয়ে লুজানে স্ট্রিমের খাড়াই বেয়ে নেমে যেতে লাগল। সাদা নদীর বুকে এসে থামলো। পরিষ্কার একেবারে চিনির মতো। মাংসের মাঝে খোঁচা মারছে পিঠের রেডিও, বহুকষ্টে বের করল।

তখনো নদীর বুকে শুয়ে কুকুরের মতো হাঁপাতে লাগল সে। ঘামে ভেজা চোখে মনে হলো কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। অনেক কসরত করে ট্রান্সমিট বাটনে চাপ দিল।

‘ডেভিড’ ব্যাঙের মতো স্বর বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। আমি স্ট্রিমের কাছে শুয়ে আছি–দেখতে পাচ্ছো আমাকে?

পুরোপুরি মাথার উপর চলে এলো এয়ারক্রাফট। তৎক্ষণাৎ শোনা গেল ডেভিডের কণ্ঠস্বর।

‘আমি দেখতে পাচ্ছি, কনি। ট্রাক থেকে একশ গজ নিচে আছেন। আপনি। আক্কারস এসে পড়েছে কনি। যে কোন মুহূর্তে চলে আসবে।

 হাঁপাতে হাঁপাতে মনে হলো নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। কনরাড বার্গ হাঁটু গেড়ে উঠে বসল আর ঠিক সেই মুহূর্তে ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পেল। ভারী রেডিও খুলে ফেলে একপাশে ফেলে রাখল। এরপর রাইফেলও ফেলে দিল কাঁধ থেকে। ব্রিচ খুলে লোড চেক করল। নিজেকে তুলে দাঁড় করালো।

 নিজের শরীরের এই দুর্বলতায় অবাক হয়ে গেছে সে নিজেও। আস্তে আস্তে এগোতে লাগল মাঝখানে।

শুকনো নদীবক্ষ বন্যার পানির জন্যে আট ফুট গম্ভীর হয়ে আছে। এখানে পনের মিটার চওড়া ও। মেঝে ঢেকে আছে নরম সাদা বালিতে। চারপাশে ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট পাথর। বেসবলের চেয়ে বড় নয়। এটি জাবুলানিতে পৌঁছানোর জন্যে চমৎকার একটি অবৈধ রাস্তা। নরম মাটিতে এখনো দেখা যাচ্ছে আক্কারসের ট্রাকের চাকার দাগ।

স্ট্রিমের একটা বাকের মুখে ট্রাকের এগিয়ে আসার শব্দ শুনতে পেল কনরাড।

নদীবক্ষের মাঝখানে চারকোনা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কনরাড। কোমরের কাছে আড়াআড়ি ভাবে ধরে রেখেছে রাইফেল। চেষ্টা করছে নিজের নিঃশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণে আনতে। এগিয়ে আসা ট্রাক পাগলের মতো বাঁকের কাছের স্কিড করল। এরপর দ্রুত নেমে আসতে লাগল তার দিকে। রিয়ার হুইল থেকে বালির ফোয়ারা ছিটকে আসছে।

স্টিয়ারিং হুইলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে জন আক্কারস। আইব্রোর উপর নেমে এসেছে টুপি। ঘামে চকচকে সাদা হয়ে আছে চেহারা। দেখতে পেল রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে কনরাড।

‘থামো!’ রাইফেল নাড়িয়ে চিৎকার করে উঠল কনরাড। থামো নয়তো আমি গুলি করব

 এলোমেলো ভাবে দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে ট্রাক। হাসতে শুরু করল আক্কারস। হাসির দমকে তার কাঁধ কাঁপছে দেখতে পেল কনরাড। বের হয়ে গেছে বিভৎস দাঁতের সারি। ট্রাকের গতি একটুও কমলো না।

রাইফেল তুলে নিয়ে জোড়া ব্যারেল দিয়ে তাকাল কনরাড। এই রেঞ্জে একটা করে বুলেট জোহান আক্কারসের গভীরে বসানো ব্যাপারই নয়। কিন্তু মানুষটার মনে হলো এ ব্যাপারে কোন চিন্তাই নেই। মাড়ির সাথে আলগা ভাবে ঝুলন্ত দাঁত নিয়ে হেসে চলেছে সে। পঞ্চাশ ফুট দূর আছে ট্রাক। উঠে আসছে কনরাডের গায়ের উপর।

মাথা খারাপ না হলে ইচ্ছে করে একটা মানুষ আরেটা মানুষের উপর গুলি চালাতে পারে না। এটা হতে হবে সৈন্যের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া অথবা আইন পালনকারী অফিসারের কাজ। অথবা কোন শিকারির হাত নতুবা বদ্ধ উন্মাদ কোন অপরাধী।

 এদের একজনও নয় কনরাড বার্গ। বেশির ভাগ বিশালদেহী মানুষের মতো সেও একজন নম্র-ভদ্র মানুষ। তার সমস্ত চিন্তা-ভাবনা ঘিরে আছে জীবনকে নিয়ে–ট্রিগারে চাপ দিতে পারল না সে।

ট্রাক পনের ফুট দূরে থাকতে ছিটকে একপাশে লাফ দিল কনরাড। জোহান আক্কারস ইচ্ছে করে তার দিকে চালিয়ে দিল ট্রাক।

ট্রাকের পাশের অংশ দিয়ে ধাক্কা মারলো কনরাডের কোমরে। স্ট্রিমের মাটির দিকের তীরের কাছে ছিটকে পড়ল সে। আরো একটু নিচে গিয়ে আলগা পাথরসহ আরো একবার হড়কে গেল ট্রাকের চাকা। হুইল নিয়ে যুদ্ধ শুরু করল আক্কারস। অ্যাক্সেলেটরে পা চেপে ধরে উঠে আসল নদীর বুকে। তীরে নরম বালির উপর পড়ে রইল কনরাড।

ট্রাকের ধাক্কা খাবার সাথে সাথে কনরাড বুঝতে পারল কোমরের কাছের হাড় ভেঙ্গে গেল গ্লাসের মতো। পাজরের খাঁচার সাথে ধাতুর ঘর্ষণে ফুসফুস থেকে বের হয়ে গেল সবটুকু বাতাস।

 একপাশে কাত হয়ে বালির উপর শুয়ে রইল সে। ধীরে ধীরে মুখ থেকে বের হয়ে এলো রক্তের ধারা। তিক্ত লবণাক্ত স্বাদ। বুঝতে পারল ভাঙা পাজর বর্শার মতো আঘাত করেছে ফুসফুস। শরীরের অনেক গভীর থেকে বের হয়ে আসছে রক্ত।

মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পেল দশ কদম দূরে পড়ে আছে রেডিও সেট। নিজেকে টেনে হেঁচড়ে এগোতে লাগল এর দিকে। ভেঙ্গে গুঁড়ো হয়ে যাওয়া পা ঝুলছে পেছনে।

 ‘ডেভিড, মাইক্রোফোনে ফিসফিস করে উঠল কনরাড। আমি থামাতে পারি নি। চলে গেছে। সাদা বালির উপর থু দিয়ে ফেলল মুখ ভর্তি রক্ত।

লুজানের পাকা ব্রিজের নিচ থেকে নদীবক্ষ পেরিয়ে উঠে এলো ট্রাক, দেখতে পেল ডেভিড। ড্রেন পার হয়ে কাঁপতে কাঁপতে উঠে এলো রাস্তায়। দ্রুত গতি বাড়ালো, পশ্চিমে ধেয়ে চলল ব্যান্ডেলিয়ার পাহাড় আর মহাসড়কের দিকে। সবুজ চেসিসের পেছন থেকে ধুলার মেঘ উড়তে লাগল। পরিষ্কার চিহ্ন রেখে গেল ডেভিডের জন্যে।

সুজান পার হবার পর রাস্তা তীক্ষ্মভাবে মোড় নিয়ে পাথুরে জায়গা পার হলো। তারপর ধনুকের মতো হয়ে এগোলো আরো দুই-মাইল।

নিজের ল্যান্ডিং গিয়ার নামিয়ে থ্রটল পেছনে টানলো ডেভিড। নাভাজো নেমে এলো মাটির উপর। ধুলি মাখা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল যেন এটা একটি ল্যান্ডিং স্ট্রিপ।

 ঠিক সামনেই ট্রাকের ধুলা দেখা যাচ্ছে। সোজাসুজি এগিয়ে চলেছে পরম্পর। কিন্তু ডেভিড চাইছে গাছের উঁচু দেয়ালের মাঝে সরু লেনের মধ্যে নামিয়ে আনতে প্লেনকে। আস্তে আস্তে কথা বলল ডেবরার সাথে। নিশ্চয়তা নিয়ে ব্যাখা করল ও কী করতে চলেছে।

সরু রাস্তায় আস্তে করে মাটি স্পর্শ করল নাভাজো। এরপর আবারো থ্রটল খুলে দিল। রাস্তার মাঝ বরাবর এগিয়ে গেল। নাভাজোকে আবার উঠিয়ে নেয়ার মতো প্রয়োজনীয় গতি আছে। যদি আক্কারস আত্মসমর্পণ না করে সংঘর্ষ বাধাতে চায়।

তাদের সামনে রাস্তার আরেকটা বাঁক। এর দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতেই হঠাৎ করে ধেয়ে আসতে লাগল ট্রাক। খুব বেশি হলে একশ গজ দূরত্ব।

দুইটি বাহনই একে অপরের দিকে মুখোমুখি এগিয়ে যাচ্ছে। যৌথভাবে গতি হবে ঘণ্টায় দুইশ মাইল। আর এই ধরনের দৃশ্য তো জোহান আক্কারসের কল্পনারও বাইরে।

রাস্তার ঠিক মাঝখানে এয়ারক্রাফট। প্রোপেলারের ঘূর্ণনশীল অবস্থা দেখে ভিরমি খাবার জোগাড় হলো তার।

হুইল শক্ত করে টেনে ধরল সে। শুকনো মাটিতে স্কিড করে উঠল ট্রাক। অল্পের জন্যে মিস করল নাভাজোর পোর্ট-উইংয়ের মাথা।

সামনের চাকাগুলো ঘুরে পড়ে গেল ড্রেনে। জানালা থেকে গ্লাস ভেঙ্গে দরজা গেল খুলে। একপাশে কাত হয়ে পড়ে গেল ট্রাক।

থ্রটল বন্ধ করলো ডেভিড। হুইল ব্রেকের উপর চেপে ধরল পা। এখানে অপেক্ষা করো।’ চিৎকার করে ডেবরাকে জানিয়েই রাস্তায় লাফিয়ে নামালো ডেভিড। ক্ষত-বিক্ষত টিস্যু জমে মুখোশের মতো সেটে আছে তার মুখে। কিন্তু চোখ জোড়া জ্বলছে ধকধক করে, এক দৌড় লাগল সবুজ ট্রাকের দিকে।

ডেভিডকে দৌড়ে আসতে দেখল আকারস। চেষ্টা করল উঠে দাঁড়াতে। দেখতে পেল ক্যাবের মাঝে পড়ে আছে তার রাইফেল। বহুকষ্টে উঠে খোলা দরজা দিয়ে চাইল সেটা নিতে। কপালে গভীর ভাবে কেটে গিয়ে রক্ত পড়তে লাগল চোখের মাঝে। মনে হলো অন্ধ হয়ে গেছে সে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে পিটপিট করে তাকাল চারপাশে।

কাছে চলে এসেছে ডেভিড। সেচ নালা পার হয়ে তার দিকে দৌড়ে আসছে। বিধ্বস্ত সবুজ গাড়ির উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল আক্কারস। বেল্টে থাকা হান্টিং নাইফ নিতে উদ্যত হলো। শেফিল্ড স্টিল দিয়ে বানানো আট ইঞ্চি ফলা, হ্যান্ডেলও আছে আর রেজারের মতোই ধার।

ছুরি নিয়ে যুদ্ধ করে যারা তাদের মতোই বাগিয়ে ধরল ছুরিটা। তারপর হাতের তালু দিয়ে মুছলে চোখ।

আস্তে আগে বেড়ে ডেভিডের মুখোমুখি হলো। বিশাল হাতের মুঠির মাঝে লুকিয়ে ফেলল ছুরি।

তার একটু দূরে থাকতেই থেমে গেল ডেভিড। চোখ আটকে গেল ছুরিতে। আবারো হাসতে শুরু করল আক্কারস। এমন গুড়গুড় শব্দ হতে লাগল বোঝাই গেল যে, নিষ্ঠুরতার চরম সীমা অতিক্রম করেছে সে বহু আগেই।

কোবরার মতো মোহনীয় ভঙ্গিতে ফলা এদিক-ওদিক করতে লাগল আক্কারস। সূর্যের আলো পড়ে চকচকে করে উঠল স্ট্রিলের ফলা। তাকিয়ে থেকে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে প্যারাট্রুপারের সমস্ত ট্রেনিং স্মরণ করে নিল। ডেভিড।

দ্রুত আগে বেড়ে পোচ দেয়ার ভঙ্গি করল আক্কারস। ডেভিড সরে যেতেই আরো উঁচু শব্দে হেসে উঠল।

আবার চক্রকারে ঘুরতে শুরু করল দুজনে। মুখ অল্প খোলা রেখে অদ্ভুত ভাবে কিড়মিড় শব্দ করছে আক্কাস। তাকিয়ে আছে গভীরে বসা চোখ জোড়া দিয়ে। ধীরে ধীরে আবারো তার সামনে গেল ডেভিড। আক্কাস খেদিয়ে তাকে নিয়ে গেল ট্রাকের দিকে। এক কোণায় আটকে ফেলতে চাইল ডেভিডকে।

এরপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আহত চিতাবাঘের মতো। এতটা গতি আর শক্তি সত্যিই অবিশ্বাস্য। হিসহিস শব্দে ডেভিডের পেটের কাছে থেকে ঘুরে এলো ছুরির ফলা।

কব্জি দিয়ে ছুরিটা ধরে ফেলল ডেভিড। বাধ্য করল ছুরি ধরা হাত নিচে নামাতে। বুকে বুক ঠেকে গেছে, দুর্গন্ধ আসছে আক্কারসের নোংরা দাঁত থেকে।

নিঃশব্দে যুদ্ধ করছে দু’জনে। একে অন্যের শক্তি আর সামর্থ্যের পরীক্ষা নিচ্ছে যেন।

ডেভিড অনুভব করে তার হাতের মাঝে ধরা ছুরি হাত মোচড় খাচ্ছে। মানুষটার হাত বাহু যেন স্ট্রিল দিয়ে তৈরি। আর বেশি সময় আক্কাসকে ধরে রাখতে পারবে না বুঝলো সে। সেকেন্ডের মাঝেই মুক্ত হয়ে যাবে হাত আর পেটের মাঝে ঢুকে যাবে।

এবার লোকটার পা আটকে একপাশে কাত করে ফেলতে চেষ্টা করল ডেভিড। ফলে খানিকটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ল আক্কারস। আরেক হাত দিয়ে ধরে ফেলল ছুরির হাত। কিন্তু দুই হাত দিয়েও ধরে রাখতে পারছে না সে।

দুজনেই হাপাচ্ছে, পড়ে না যাওয়া পর্যন্ত আটকে রইল ট্রাকের গায়ে। উত্তপ্ত ধাতব শরীর থেকে আসছে তেলের গন্ধ।

ছুরির উপরই নিজের মনোযোগ আটকে রাখল ডেভিড। কিন্তু বুঝতে পারল আরেকটা হাত দিয়ে ওর গলা ধরতে চাইছে আক্কারস। মাথা দিয়ে কাঁধের উপর বাড়ি মারলো তাকে ডেভিড। চিবুক দিয়ে বুকে খোঁচা মারলো। কিন্তু হুড়কোর মতো আটকে যাওয়া আঙুল কিছুতেই খোলা যাচ্ছে না ছুরি থেকে। মনে হলো গলার মাংসে বিধে গেল আক্কারসের হাতের আঙুল। চেষ্টা করল তার জীবন টেনে বেরে করে আনতে।

মরিয়া হয়ে ছুরি ধরা হাতে হেঁচকা টান মারলো ডেভিড। বুঝতে পারল কাজ হয়েছে। কেননা আক্কারস এখন মনোযোগ দিয়েছে ওর গলা চেপে ধরার কাজে।

ডেভিডের কাঁধের পাশেই খোলা উইন্ডস্ক্রীন দেখা যাচ্ছে। কাঁচ ভেঙ্গে গেছে আগেই। কিন্তু ধাতব খাঁচার মতো চারপাশ রয়ে গেছে। দেখতে লাগছে ভয়ঙ্কর করাতের মতো।

গলার মাঝে আঙুলের চাপ বাড়ছে অনুভব করল ডেভিড। চেষ্টা করছে। ব্রেইনে যাওয়া ধমনীকে ভেঙ্গে ফেলতে। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো তার। মনে হলো ডগ ফাইটে এইট জির সাথে লড়ছে সে।

শেষ চেষ্টা স্বরূপ ভাঙা কাঁচের গায়ে ধাক্কা দিলো ডেভিড ছুরি ধরা হাতকে। নিচে নামিয়ে টেনে নিল কাঁচের ভাঙা কিনারের দিকে।

চিৎকার করে ডেভিডের গলা ছেড়ে দিল আক্কারস। আগে-পিছে করে হাত চেপে ধরল ডেভিড ভাঙা কাঁচের উপর। ছেঁড়া গোলাপ পাপড়ির মতো ক্ষত তৈরি হতে লাগল মাংস কেটে। আঙুল থেকে খসে পড়ল ছুরি। মেয়েদের মতো নাকিকান্না জুড়ে দিল আক্কারস।

ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিল ডেভিড। হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়েও কান্না করে যেতে লাগল আক্কারস। নিজের গলায় হাত বুলিয়ে নিল ডেভিড। নিঃশ্বাস নিয়ে অনুভব করল ব্রেইনে পৌঁছালো তাজা রক্ত।

ঈশ্বর জেসাস, আমি মারা যাচ্ছি, রক্ত পড়েই মারা যাবো আমি। ওহ, সুইট জেসাস, আমাকে সাহায্য করো!’ চিৎকার করে উঠল আক্কারস। পেটের কাছে ধরে রাখল আহত হাত। সাহায্য করো, ওহ ঈশ্বর, আমাকে মরতে দিও না। আমাকে বাঁচাও জেসাস, আমাকে বাঁচাও।

বন্যার মতো রক্ত বইছে হাত থেকে। ভিজে গেল ট্রাউজারের সামনের অংশ। চিৎকারের সাথে মুখ থেকে খসে পড়ল নকল দাঁত। চকচকে মুখের মাঝে দেখাচ্ছে কালো গন্ধের মতো। তুমি আমাকে মেরে ফেলেছে। আমি রক্ত পড়ে মারা যাচ্ছি!’ ডেভিডের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল সে। ‘আমাকে বাঁচাও আমাকে মরতে দিও না।’

ট্রাক থেকে উঠে দাঁড়ালো ডেভিড। দুই কদম দৌড়ে গেল আক্কারসের কাছে। এরপর ডান পা ঘুরিয়ে সারা শরীরের শক্তি দিয়ে লাথি মারলো আক্কারসের চিবুকের নিচে। মাথা ঝুলে গেল পিছন দিকে লোকটার।

পিছনের দিকে পড়ে গিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে রইল আক্কারস। উঠে দাঁড়িয়ে শ্বাস টানলো ডেভিড।

.

রায় ঘোষণার জন্যে সুপ্রিম কোর্টের মি: জ্যাস্টিস বার্নাড প্রাক্তন চারটা ব্যাপার মাথায় রাখালো–এর মাঝে দু’টি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায়, একটি দুঃসাহসিক প্রচেষ্টায় প্রাণহরণ ও চতুর্থটি ইচ্ছেকৃত ভাবে শারীরিক ক্ষতি।

জোহান আক্কাসকে বন্যাপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা হলো। এই কারণে জরিমানার ব্যবস্থা না রেখেই তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হলো। কেননা এ কাজে মোটর ভেহিকেল আর গোলা-বারুদও ব্যবহার করেছে সে।

ইচ্ছেকৃতভাবে আক্রমণের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করে তিন বছরের আরো সশ্রম কারাদণ্ডের শাস্তি পেল সে।

শারীরিক ক্ষতি করার অপরাধে অভিযুক্ত জোহান আক্কাসকে পাঁচ বছরের কারাবাসের শাস্তি দেয়া হলো।

সবশেষে খুনের দায়ে অপরাধী জোহান আক্কারসকে জাস্টিস বার্নাড খোলা কোর্টরুমে সবার সামনে শাস্তি প্রদান করলেন:

‘এই অপরাধে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা উচিত হলেও একটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়েছে যে হতভাগ্য লোকটা ফাঁদে আটকা পড়া পশুর ন্যায় আচরণ করে ছিল।

এক্ষেত্রে দণ্ড হলো আঠারো বছরের কারাবাস আর সব শাস্তিই একের পর এক ভোগ করতে হবে তাকে।

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে প্লাস্টার করা পা আর এক হাতে ওল্ড বাক জিনের গ্লাস নিয়ে কনরাড বার্গ জানাল, যাই হোক আগামী আটাশ বছর এই বাঞ্চোতকে নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না আমাদের। আমি ক্ষমা চাইছি মিসেস মরগ্যান। উনত্রিশ বছর, প্রিয়তম আমার, দৃঢ় কণ্ঠে তাকে শুধরে দিল জেন কনরাড বার্গ।

.

জুলাই মাসে আ প্লেস অব আওয়ার ওন-এর আমেরিকা সংস্করণ প্রকাশিত হলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় অন্যান্য অনেক ভালো বইয়ের মতোই হারিয়েও গেল। কেউ কোন উচ্চবাচ্য করল না। একটুও সাড়া পেল না ডেবরা।

ববি ডুগান, আমেরিকাতে ডেবরার লিটারির এজেন্ট জানাল সে কতটা দুঃখিত, কতটা হতাশ। আশা করেছিল অন্তত সমালোচকরা কিছু লিখবে।

 ব্যক্তিগত ভাবে অপমানিত বোধ করল ডেভিড। সপ্তাহখানেক ধরে নিজের ঘরে রেগেমেগে ঘুরে বেড়ালো সে। এক পর্যায়ে তো মনে হলো যে আমেরিকাতে গিয়ে হয়তো দেশটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে–একক ভাবে ভিয়েতনাম হয়ে উঠবে সে।

 ‘এগুলো গাধার দল ছাড়া আর কিছু নয়। প্রতিবাদ করে উঠল সে। এরকম সুন্দর বই আর কখনো লেখা হয়নি।’ ‘ওহ ডেভিড!’ নরম স্বরে বোঝাতে লাগল ডেবরা।

“হুম, এটাই সত্যি! আমার ইচ্ছে করছে সেখানে গিয়ে বই দিয়ে তাদের নাক ঘষে দিতে।

 ডেবরা কল্পনাতে দেখতে পেল যে নিউইয়র্কের সব প্রকাশকের দরজা হাট করে খুলে গেল। আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দিল সকলে। উঁচু দালানের জানালা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত হলো বা ডেভিডের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে পালালো মেয়েদের টয়লেটে।

 ‘ডেভিড মাই ডার্লিং, তুমি আমার কাছে অনেক সুন্দর। খুশিতে খিকখিক করে হেসে উঠল ডেবরা। কিন্তু সে ও আঘাত পেয়েছে। সত্যি অনেক আঘাত পেয়েছে। ভেতরে মনে হলো দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ইচ্ছে করছে কিছু একটা গরম গরম লিখতে।

নিজেরে ডেস্কে ঠোঁটের কাছে মাইক্রোফোন নিয়ে বসল ডেবরা। শব্দগুলো জুড়িয়ে গেল না। চিন্তাগুলো একে অন্যের সাথে হারিয়ে গেল না। আগে যেখানে মনে হতো সব কিছুই চোখের সামনে ঘটতে দেখছে সে। দেখছে তার চরিত্রগুলো হাসছে, কাঁদছে, গান গাইছে। এখন সেখানে সেখানে শুধু কালো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে তার চোখে। বর্ণহীন আকারহীন।

মাঝে মাঝে ঘণ্টার পর পর ঘণ্টা এমনিই ডেস্কে বসে কাটিয়ে দেয় ডেবরা। চুপচাপ বসে শুনতে থাকে জানালার নিচে পাখির ডাক।

ওর হতাশা বুঝতে পারল ডেভিড। চেষ্টা করল ডেবরাকে সাহায্য করতে। ডেস্কে বসে কিছু না করার চেয়ে ডেভিড চাইল ডেবরা উঠে যাক সেখান থেকে। ডেবরাকে নিয়ে নতুন বেড়ার ধারে বেড়াতে যেতে চাইল সে। অথবা বলল পুলে বড় নীল মোজাম্বিক মাছ ধরতে যেতে।

 এতদিনে বাসা আর এর আশে-পাশের পুরো পরিবেশ মুখস্ত হয়ে গেছে ডেবরার। ডেভিড চাইল ডেবরার পৃথিবী যেন আরো বড় হয়। প্রতিদিন একসাথে হেঁটে পুল পর্যন্ত বেড়াতে যায় তারা। ফলে এ রাস্তাটুকুও চিনে নিতে শুরু করল ডেবরা। ডেভিডের তৈরি করে দেয়া ওয়াকিং ষ্টিক নিয়ে হেঁটে হেঁটে সব চিনে নিতে লাগল ডেবরা। এ কাজে নিজের কর্তব্য ঠিক করে নিল জুলু। ডেভিডের পরিকল্পনা মতো জুলুর গলায় বেঁধে দেয়া হলো রুপালি ঘণ্টা। ফলে ডেবরা সেই শব্দ শুনে সহজেই অনুসরণ করে চলল। কয়েকদিনের মাঝেই ডেভিডকে ছাড়াই বের হওয়া শুরু করল ডেবরা। জুলুকেও তেমন বলতো না কোথা ও যেতে চায়। এভাবে নিজের পরীক্ষা নিজেই নিতে লাগল ডেবরা।

ডেভিড এ সময় ব্যস্ত রইল কনরাডের গেমফেন্স ঠিক করার কাজে। এখনো পা নিয়ে কষ্ট পাচ্ছে বেচারা। এছাড়া জাবুলানির অন্য তিন পাশেও বেড়া দেবার কাজ করতে হচ্ছে তাকে। এর সাথে আবার আফ্রিকার রেঞ্জার বাহিনীও চাপ দিচ্ছে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজে সাহায্য করার জন্য। তাদের জন্যে বিশেষ ভাবে ইউনিফর্মের নকশা করেছে ডেভিড। এছাড়াও এস্টেটে ঢোকার সবগুলো প্রবেশপথে অডিট পোস্ট বানিয়েছে রেঞ্জারদের জন্যে। এসব কাজে কনরাড বার্গের সাথে পরামর্শ করে নেবার জন্য নিয়মিত নেলস্প্রুটে যায় ডেভিড। তার পরামর্শ মতো এস্টেটে ওয়াটার সার্ভে করা শুরু করল ডেভিড। পুল থেকে দুরে থাকা অন্যান্য নদী বা খাল দিয়ে ভ্রমণ করে এলো ডেভিড। পরীক্ষা করে দেখল বাঁধ নির্মাণের বাস্তবতা। সক্রিয় কাজে ব্যস্ত থাকায় পরিশ্রমী কৃশকার আর রোদে পোড়া ত্বকের অধিকারী হয়ে উঠল ডেভিড। তারপরেও বেশির ভাগ ঘণ্টা কাটতো ডেবরার সাহচর্যে।

৩৫-এমএম রঙিন ছবি যেগুলো জোহান আক্কাস আক্রমণ করার আগেই তুলেছিল ডেভিড, সেই বাফেলো দলের ছবিগুলো এলো প্রিন্ট হয়ে। কিন্তু দেখা গেল যে একটাও মনমতো হলো না। বিশাল বাফেলোর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে দিগন্তের কাছে দাঁড়িয়ে আছে আর গায়ে থাকা অক্স-পেকারগুলোকে মনে হচ্ছে ছোট ছোট পোকা। হতাশায় মুষড়ে পড়ল ডেভিড। আবার নেলস্প্রুটে গিয়ে কিনে আনল ৬০০ এমএম টেলিস্কোপিক লেন্স।

যখন ডেবরা কাজ করতে বসে ডেস্কে, তার পাশে ক্যামেরা সেট করে দেয় ডেভিড। খোলা জানালা দিয়ে পাখির ছবি ভোলা হয়ে যায়। ফলাফল হলো মিশ্র। ছত্রিশটি ছবির মাঝে দেখা গেল পঁয়ত্রিশটি ফেলে দিতে হয়। কিন্তু একটা ছবি হয় অসাধারণ। ঠিক উড়ে যাবার ভঙ্গিতে ধরা পড়ল ধূসর পাখির ছবি। পাখা ছড়িয়ে উজ্জ্বল চোখে সূর্যের আলোয় চকচক করা পাখা নিয়ে উড়ে যাচ্ছে পাখিটা।

এ কাজে মনপ্রাণ ঢেলে দিল ডেভিড। আরো লেন্স, ক্যামেরা, ট্রাই-পড কিনে নিয়ে এলো। এরপর অভিযোগ করে উঠল ডেবরা। এই শখ পুরোপুরি দৃষ্টি শক্তির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এক্ষেত্রে সে অক্ষম।

ডেভিড চেষ্টা করল ডেবরাকে উৎসাহী করে তুলতে। লোক পাঠিয়ে জুন স্টানার্ডের বার্ড সং কিনে নিয়ে এলো। শুনে চমকিত হলো ডেবরা। মনোযোগ দিয়ে শুনল সে। পুরো মুখ ভেসে গেল আনন্দের বন্যায় যখন পরিচিত একটা আওয়াজ শুনতে পেল সে।

তখন থেকে শুরু করল নিজের মতো করে পাখির গান রেকর্ড করা। এর সাথে যুক্ত হলো জুলুর ঘণ্টার শব্দ, ডেভিডের ল্যান্ড রোভারের গুঞ্জন, রান্না ঘরের আঙিনাতে ভৃত্যদের চেঁচামেচি, আর খুব সূক্ষ্মভাবে চকচকে স্টালিংয়ের কিচিরমিচির।

‘একটুও ভালো হচ্ছে না।’ তিক্ততায় ভরে গেল ডেবরার মন। আমি বুঝতে পারছি না জুন কীভাবে এত পরিষ্কার ভাবে রেকর্ড করতে পেরেছে।’

কয়েকটা বইপত্র পড়ে ডেবরার জন্যে প্যারাবোলিক রিফেক্টর তৈরি করল ডেভিড। দেখতে ততটা সুন্দর না হলেও কাজ করল জিনিসটা। শব্দের উৎস রেকর্ড করে সাউন্ড ওয়েভকে মাইক্রোফোনে পাঠাল।

ডেবরার স্টাডি থেকে জানালার মাধ্যমে পুরো ব্যাপারটা আরো অভিযান সুলভ হয়ে উঠল। পুলের পাশে যেখানে পাখিরা পানি খেতে আসে, আরামদায়ক আর স্থায়ী হাইড আউট বানালো ডেভিড। রেঞ্জারদের এনে দেয়া তথ্যানুযায়ী বিভিন্ন প্রজাতির পাখির বাসার কাছে ও গাছের ডালে বানানো হল এমন সব হাইড আউট। এসব জায়গায় একত্রে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে লাগল ডেভিড আর ডেবরা। একসাথে বসে ছবি তোলা, রেকর্ড করা হয়ে উঠল নেশার মতো। এসব সময়ে এমনকি জুলুও শিখে গেল কীভাবে ঘণ্টার শব্দ না করে চুপচাপ করে শান্ত হয়ে শুয়ে থাকতে হয়।

ধীরে ধীরে পেশাদারদের মতো দক্ষ লাইব্রেরি তৈরি হলো, যেখানে জমা হতে লাগল ছবি আর রেকর্ডি। অবশেষে সাহস করে এসব ছবি থেকে ডজনখানেক শ্ৰেষ্ঠ ছবি বাছাই করে পাঠিয়ে দিল আফ্রিকান ওয়াইল্ড লাইফ ম্যাগাজিনের কাছে। দুই সপ্তাহ পরে একশ ডলারের চেকসহ স্বীকৃতিপত্র এলো তার কাছে। এই অর্থ দেখা গেল যন্ত্রপাতির পেছনে ব্যয় হওয়া অর্থের বিশ ভাগের এক ভাগ মাত্র। তারপরেও খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল ডেভিড। একই অবস্থা ডেবরার। ডিনারে দুই বোতল ভেভ ক্লিকোট পান করল দু’জনে। আর উত্তেজনা ও শ্যাম্পেনের বদৌলতে ঐ রাতে ভালোবাসা-বাসি পেল নতুন মাত্রা।

ওয়াইল্ড লাইফ’তে ডেবরার লেখাসহ ডেভিডের ছবি প্রকাশিত হবার পর অভাবনীয় সাড়া পেল দু’জনে। সারা পৃথিবীতে এ কাজে আগ্রহী এমন সব লোকজন চিঠি লেখা শুরু করল তাদেরকে। প্রকাশক নিজে অনুরোধ করল যেন জাবুলানির উপর ছবিসহ আর্টিকেল আর এ জায়গা নিয়ে মরগ্যানদের পরিকল্পনা লিখে পাঠানো হয়।

ডেভিডের ছবিতে মডেল হিসেবে কাজ করল ডেবরা। এছাড়া অনেক যত্ন করে বর্ণনা লেখা শুরু করল ডেবরা বিভিন্ন সমালোচনা আর নতুন ধারণা দিয়ে তাকে সাহায্য করল ডেভিড।

ডেবরার নতুন বইয়ের কাজ পড়ে রইল অনাদরে। কিন্তু নিজের দুঃখ ভুলে গিয়ে একসাথে কাজ করার আনন্দে মেতে উঠল সে।

অন্যান্য সংরক্ষণবাদীদের সাথে পত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ হতে থাকায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন নতুন বুদ্ধি পেতে লাগল তারা। আর মাঝে মাঝেই কনরাড বার্গ আর জেন বার্গের সাহচর্য পাওয়ায় মানব সংসর্গ থেকেও বঞ্চিত হলো না। এখনো পর্যন্ত বাইরের মানুষের সাথে মেশার ব্যাপারে যথেষ্ট সংবেদশীল তারা। এভাবে ব্যাপারটা এড়িয়ে চলাও সম্ভব হলো।

ওয়াইল্ড লাইফ আর্টিকেল প্রায় শেষ হয়ে গেল। পোস্ট করার জন্যেও প্রস্তুত। এমন সময়ে নিউইয়র্কের ববি ডুগানের কাছ থেকে পত্র এলো ডেবরার কাছে। কসমোপলিটন ম্যাগাজিনের প্রকাশক আ প্লেস অব আওয়ার ওন-এর কপি পড়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে নিজের ম্যাগাজিনে ধারাবাহিকভাবে বইটি প্রকাশ করার জন্যে। এছাড়া সম্ভব হলে ডেবরার জীবনীও ছাপতে চায়। ববি চাইল ডেবরা যেন নিজের কিছু ছবি আর চার হাজার শব্দের মধ্যে আত্মজীবনী লিখে পাঠায়।

ছবি তৈরিই আছে। ওয়াইল্ড লাইফে যাবার জন্যে প্রস্তুত। তিন ঘন্টার মাঝে ঝড়ের বেগে চার হাজার শব্দ লিখে শেষ করল ডেবরা। সাহায্য করল ডেভিড।

একই সাথে টেপ, ছবি আর আর্টিকেল চলে গেল নিউইয়র্কে আর ওয়াইল্ড লাইফের জন্যে প্রায় মাসখানেক কেটে যাবার পরে কোথাও থেকে কোন খবর এলো না। এরপর এমন একটা ঘটনা ঘটল যে এ ব্যাপারে ভুলেই গেল তারা।

প্রধান পুলের কাছে লুকানোর জন্যে তৈরি কুঁড়েঘরে বসে আছে তারা। চুপচাপ বসে সন্ধ্যা হওয়া দেখছে। জানালার কাছে ট্রাইপ ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছে ডেভিড। ছাদের উপর লাগানো আছে ডেবরার রিফ্লেক্টর। রং লাগিয়ে ছদ্মবেশের মাধ্যমে লুকিয়ে রাখা হয়েছে আর অপারেট করার জন্যে হ্যান্ডেল ডেবরার মাথার উপর।

ঠাণ্ডা, শান্ত আর কালো হয়ে আছে পানি। দূরের একটা তীরে মাথা তুলল একটা মাছ। পানির ধারে নেচে বেড়াচ্ছে কয়টা ঘুঘু। পানিতে চুমুক দিয়ে আকাশের দিকে ঠোঁট তুলে গলা দিয়ে নামিয়ে নেয় পানি।

হঠাৎ করে ডেবরার হাতে চাপ দিয়ে সাবধান করল ডেভিড। ডেবরা বুঝতে পারল যে ডেভিড অস্বাভাবিক কিছু একটা দেখতে পেয়েছে। তাই তাড়াতাড়ি ডেভিডের কাছে ঘেসে বসল ডেবরা, যেন ফিসফিসে বর্ণনা শুনতে পায়। ডান হাতে রেকর্ডার অন করল সে। এরপর রিফ্লেক্টরে হাত দিল।

আস্তে আস্তে পানি খেতে এগিয়ে আসছে লাজুক প্রকৃতির দুর্ভল নায়লা অ্যান্টিলোপ। কান দুটোর সাবধানী ভঙ্গিতে খাড়া হয়ে আছে। নাক টেনে বাতাসে গন্ধ শুকলো বিপদের আশঙ্কায়। হালকা আলোতে লণ্ঠনের মতো জ্বলছে বড়ঘন চোখজোড়া।

শিংবিহীন নয়জন স্ত্রী, গায়ের রং চেস্টনাটের মতো, সাদা ডোরাকাটা দাগ, সন্দেহ বাতিকগ্রস্তের মতো পা ফেলছে। অনুসরণ করছে শক্তিশালী পুরুষ দু’টির। এ দুটোকে দেখতে একদম আলাদা। কোন সাদৃশ্যই নেই। বেগুনি আর কালো রঙের মিশেল। কানের পাশ থেকে কেশর পর্যন্ত এবড়ো খেবড়ো। মোটা শিং, মাথা ক্রিম রঙা আর চোখ জোড়ার মাঝখানে উজ্জ্বল দাগ।

একবার মাত্র এক পা করে আগে বাড়ছে। এরপর থেমে চারপাশ দেখে নিচ্ছে। বিপদের চিহ্নের জন্যে সাবধান ভাবে আস্তে আস্তে নেমে এলো তীরে।

 ডেভিডদের থেকে এত কাছ দিয়ে গেল যে ভয় পেলও। মনে হলো শাটার টেপার ক্লিক শব্দ শুনতে পেলেও হয়তো ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে।

বরফের মতো জমে গিয়ে বসে রইল সে আর ডেবরা। হরিণের দল গেল পানির কাছে। খুশিতে হেসে ফেলল ডেবরা। কেননা ওর রেকর্ডিংয়ে পুরুষ হরিণের পানি খাবার আগের শব্দটা স্পষ্ট ধরা পড়েছে। একই সাথে পানির কলকল আওয়াজ রেকর্ড হয়ে গেছে।

সবাই যখন একসাথে পানি খেতে নামল অনেক যত্ন করে ফোকাস করল ডেভিড। কিন্তু শাটারের ক্লিক শব্দ হতেই ওর পাশে থাকা পুরুষ হরিণটা ভয় পেয়ে এক দৌড় লাগল। সাথে সাথে পুরো দলটা ঘন গাছপালার মাঝে দিয়ে এমন ভাবে হাওয়া হয়ে গেল যেন ভূতে তাড়া করেছে।

‘আমি পেরেছি। আমি পেরেছি।’ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল ডেবরা। ওয়াও! এত কাছে এসেছিল যে মনে হচ্ছিল আমার কানের পর্দা ফেটে যাবে।

পুরো জাবুলানিতে ছড়িয়ে পড়ল এ উত্তেজনা। এর আগে এস্টেটে নালনা অ্যান্টিলোপ আর আসেনি। এমনকি ডেভিডের বাবার সময়েও নয়। তাই এ দলটা যাতে থেকে যাওয়ার উৎসাহ পায়, সে রকম বন্দোবস্ত করা হলো। পুলের কাছাকাছি সব রেঞ্জার আর ভৃত্যদের চলাচল নিষিদ্ধ করা হলো। যেন এখানে নিজের বসতি গড়ে তোলার আগেই ভয় পেয়ে চলে না যায় তারা।

 কনরাড বার্গও পৌঁছে গেল খবর পেয়ে। এখনো হাঁটার সময় ওয়াকিং স্টিক ব্যবহার করে আর বেশ খানিকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। বাকি জীবন এভাবেই কাটাতে হবে বেচারাকে। ডেভিড আর ডেবরার সাথে হাইড আউটে বসে আরেকদিন দেখল অ্যান্টিলোপের দলটাকে। এরপর তাদের সাথেই ঘরে ফিরে ফায়ারপ্লেসের পাশে বসে বীফ স্টেক আর ওল্ড বাক জিন খেতে খেতে নিজের মন্তব্য জানাল।

এরা পার্ক থেকে আসেনি। আমার যতদূর মনে হচ্ছে। আমি যদি আগে কখনো এই পুরুষ অ্যান্টিলোপকে দেখতাম আমি ঠিক চিনতে পারতাম– সম্ভবত আশেপাশের এস্টেট থেকে এসেছে। তুমি তো এখনো দক্ষিণ দিকে বেড়া দাওনি, তাই না?

না, এখনো না।’

“ঠিক আছে। এদিক থেকেই তারা এসেছে। মনে হয় টুরিস্টদের সামনে দর্শন দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এখানে এসেছে শান্তির খোঁজে। চুমুক দিল জিনের গ্লাসে। তুমি এখানে ভাল জিনিসই জড়ো করেছো ডেভিআর কয়েক বছরের মাঝে এ জায়গা সত্যি দেখার মতো কিছু একটা হয়ে উঠবে। দর্শনার্থীদের জন্যে তোমার কোন প্ল্যান আছে–এই জায়গা থেকে তুমি অনেক কিছুই পাবে। যেমনটা আছে মালা-মালাতে। ইকোনমি প্রাইস দিয়ে পাঁচ তারকা সাফারি’ কনি, আমি বেশ স্বার্থপর, কেননা এ জায়গা আমি অন্য কারো সাথে সহভাগিতা করতে চাই না।’

সময় আর মনোযোগ অন্য কাজে লেগে যাওয়ায় আ প্লেস অব আওয়ার ওনের আমেরিকান ব্যর্থতার অংশটুকু ভুলে যাবার সুযোগ পেল ডেবরা। এক সকালে আবারো বসল নিজের ডেস্কে। কাজ শুরু করল দ্বিতীয় উপন্যাস নিয়ে। সেই সন্ধ্যাতেই ডেভিডকে বলল:

 ‘একটা সমস্যা হয়েছিল যে আমি কোন নাম খুঁজে পাচ্ছিলাম না। যেন এটা একটা শিশু-নাম না দেয়া পর্যন্ত ব্যক্তি হিসেবে বোঝা যাবে না।’

‘এখন নাম পেয়েছ? জানতে চাইল ডেভিড।

 ‘হ্যাঁ।

বলবে আমাকে?

একটা দোনমোন করল ডেবরা। প্রথম বার কাউকে বলতে গিয়ে একটু লজ্জাও পেল। আমি ভাবছি “আ ব্রাইট অ্যান্ড হলি থিং” নামে ডাকবো। কিছুক্ষণ ভাবল ডেভিড। আস্তে করে নিজের মনে আউড়াল নামটা।

‘পছন্দ হয়েছে?’ উদ্বিগ্ন স্বরে জানাতে চাইল ডেবরা।

 ‘অসাধারণ। আমার পছন্দ হয়েছে। সত্যি।

আরো একবার ডেবরার সাথে উপন্যাসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ডেভিড। মনে হল দিনগুলি এত ছোট কেন। আরো একটু ভালোবাসা-বাসি, হাসাহাসি কাজকর্ম করতে মন চাইল দু’জনেরই।

সামনের বাগানে বারবিকিউ করতে বসেছে ডেভিড আর ডেবরা। এমন সময় ফোন বেজে উঠল।

‘মিস মোরদেসাই? অবাক হয়ে গেল ডেভিড। এ নামটা তো ততটা পরিচিত নয় এখানে।

 ‘হ্যাঁ। মিস ডেবরা মোরদেসাইয়ের সাথে ব্যক্তিগত ভাবে আলাপ করতে চান নিউইয়র্ক থেকে আগত একজন।’ অধৈর্য স্বরে বলে উঠল অপারেটর। তখনি ডেভিড বুঝতে পারল ব্যাপারটা। ও আসছে। ডেবরার নাম ধরে ডাকলো। ববি ভুগান ফোন করেছে। প্রথম বারের মতো লোকটার গলার স্বর শুনতে পেয়েছে ডেবরা।

 ‘ওয়ান্ডার গার্ল। ফোনের মাঝে চিৎকার করে উঠল ববি ডুগান। বসো যেন পড়ে না যাও। বিগ ড্যাডি এখন তোমাকে এমন সংবাদ জানাবে যে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। দুই সপ্তাহ আগে তোমার উপর আর্টিকেল প্রকাশ করেছে কসমোপলিটন। পুরো পৃষ্টজুড়ে তোমার ফটোগ্রাফ দিয়েছে ডার্লিং–গড়, তোমাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছে যে–’

নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসল ডেবরা। হাত ইশারা করে ডেভিডকে কাছে ডেকে বলল কান পেতে শুনতে।

 ‘শনিবারের সবকিছুকে হারিয়ে দিয়েছ তুমি। আর সোমবার সকালে বইয়ের দোকানগুলোতে দাঙ্গা লেগে গেছে। সবাই দরজা ভেঙ্গে ফেলতে চাইছিল। তুমি কল্পনা করতে পারছে ডার্লিং? মাত্র পাঁচ দিনে সতেরো হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। তুমি একলাফে নিউইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার লিস্টের পাঁচ নম্বরে উঠে গেছ। এমন একটা অবস্থা যেন সবাই পাগলের মতো খুঁজছে তোমাকে। ডার্লিং আমরা এই বইয়ের হাফ মিলিয়ন কপি বিক্রি করতে যাচ্ছি। সব বড় বড় সংবাদপত্র আর ম্যাগাজিন রিভিউ কপি চাইছে–তিন মাস আগে যে কপিগুলো পাঠিয়েছিলাম যেগুলো তারা হারিয়ে ফেলেছে। প্রতি দুই দিনে পঞ্চাশ হাজার করে কপি ছাপতে হচ্ছে। আর আমার কথা শুনে রাখো, ওরা যেন পাগল হয়ে গেছে–এটা শুধুমাত্র শুরু–পরের সপ্তাহে দেখবে ওয়েস্ট কোস্টে আগুন লেগে গেছে, সারা দেশ জুড়ে কপির জন্যে হাহাকার পড়ে যাবে। আরো অনেক কথা বলেই চলল ববি ভুগান। চিৎকার করে বলতে লাগল নিজের আশা আর পরিকল্পনার কথা। আর দুর্বলভাবে হেসে ডেবরা শুধু বলতে লাগল না। আমি এটা বিশ্বাস করি না। আর এটা সত্যি নয়।’

 এই রাতে তিন বোতল ভেভ ক্লিকট খেয়ে ফেলল তারা। আর মধ্যরাতের খানিক আগে ডেভিড মরগ্যানের সন্তান গর্ভে ধারণ করল ডেবরা।

.

মিস মোরদেসাই ভাষার দক্ষ ব্যবহারের পাশাপাশি সাহিত্যের ছোঁয়া দিয়ে এই বইয়ের মাধ্যমে বেস্টসেলারের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছেন।’ মন্তব্য করল নিউইয়র্ক টাইমস।

 ‘কে বলেছে যে সাহিত্যকে নিষ্প্রাণ হতে হবে? জিজ্ঞেস করল টাইম ম্যাগাজিন। পরিষ্কার সাদা ধোয়ার মতো জ্বলে উঠেছে ডেবরা মোরদেসাইয়ের প্রতিভা।

‘মিস মোরদেসাই তোমার গলা টিপে ধরবে, দেয়ালের সাথে পিষে ফেলবে, মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলবে আর পশ্চাৎদেশে লাথি কষাবে। সে তোমাকে এত দুর্বল বানিয়ে ফেলবে যে তোমার মনে হবে তুমি গাড়ি দুর্ঘটনায় ছাতু হয়ে গেছ। যোগ করল ফ্রি প্রেস।

গর্বিত ভঙ্গিতে অটোগ্রাফসহ আ প্লেস অব আওয়ার ওন-এর একটি কপি কনরাড বার্গকে দিল ডেভিড। অবশেষে মিসেস মরগ্যান বলা ছেড়ে দিল কনরাড। তার বদলে ডেবরাকে নাম ধরে ডাকা শুরু করল। বই দেখে এতটাই আশ্চর্য হয়ে গেল যে তৎক্ষণাৎ বলে বসল।

‘এসব জিনিস আপনি কীভাবে ভেবেছেন, মিসেস মরগ্যান?’

 ‘ডেবরা’, তাকে শুধরে দিল ডেবরা।

‘সে ওগুলো চিন্তা করেনি। সাহায্য করল জেন বার্গ। এটা ওর কাছে আপনাতেই এসেছে–এর নাম inspiration. ববি ডুগান সত্যি কথাই বলেছে আর পঞ্চাশ হাজার কপি প্রকাশ করতে হল।

.

ঘটনা এমন হয়ে দাঁড়াল যে মনে হল ভাগ্যদেবী ডেভিড আর ডেবরার উপর নিজের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য উঠেপড়ে লাগল উপহার দিয়ে দু’জনকে ভরে দেবার জন্য।

নিজের জলপাই কাঠের টেবিলের কাছে বসে আছে ডেবরা। সন্তানের কল্যাণে দিনকে দিন ফুলে ঢোল হয়ে উঠেছে, আরো একবার শব্দের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল তার মনের মাঝে। যেন মুক্তোর ছড়ার ঝরনার পানি। যাই হোক এর পরেও ডেভিডকে পাখি নিয়ে করা তার বইয়ের কাজে সাহায্য করে চলল ডেবরা। এছাড়া প্রতিদিন জাবুলানির বিভিন্ন অংশে ডেভিডের সঙ্গী হওয়া তো ছিলই। এর সাথে আরো যুক্ত হলো শূন্য নার্সারিতে ফার্নিচার বসানো আর ভরে তোলার পরিকল্পনা।

গোপনে কনরাড বার্গ এসে ডেবরার সাহায্য নিতে লাগল যেন ডেভিড বোর্ড অব দ্য ন্যাশনাল পার্ক কমিটিতে মনোনয়ন পায়। সবিস্তারে আলোচনা করল দু’জনে। বোর্ডে একটা আসন মানে মানুষটা বেশ সম্মানীত হবে আর ডেভিডের চাইতেও বয়সে বড় আর প্রভাবশালী হবে। কিন্তু কনরাড এ ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী যে ডেভিডের সম্পদ আর নামের শেষে মরগ্যান পদবী, জাবুলানির মালিকানা, সংরক্ষণের প্রতি তার আগ্রহ আর এ সমস্ত কাজে যোগদানের জন্যে অফুরন্ত সময় দেখে নিশ্চয়ই বোর্ড সদস্যদের মন গলবে।

‘হা। সিদ্ধান্ত নিল ডেবরা। এটা ওর জন্যে ভালই হবে। আরো একটু বাইরে যাওয়া, বাইরের মানুষের সাথে মেশা, এখানে একা থাকলেই বরঞ্চ বিপদে পড়ব আমরা।’

করতে চাইবে সে?

‘চিন্তা করবেন না। এ ভার আমার উপর ছেড়ে দিন।

ডেবরার সিদ্ধান্তই সঠিক হয়েছে। বোর্ডের সাথে প্রথমবার সাক্ষাতের জড়তা কাটিয়ে ওঠার পর অন্যান্য সদস্যরাও যখন অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগল এরকম অদ্ভুত বিভৎস চেহারা দেখতে আর বুঝতে পারল যে ডেভিড কতটা আন্তরিক আর উদ্যমী মানুষ, নিজের উপর আস্থা ফিরে পেল ডেভিড। এরপর প্রায়ই প্রিটোরিয়াতে বোর্ডের সাথে দেখা করতে লাগল সে। ওর সাথে উড়ে বেড়াত ডেবরা। আর বোর্ড মিটিংয়ের সময় জেন বার্গের সাথে ঘুরে ঘুরে সন্তান আর গৃহস্থালির আরাম আয়েশের সব কেনাকাটা সারতো। সাধারণত এসব জিনিস পাওয়া যেত না নেলটে।

কিন্তু নভেম্বর নাগাদ খারাপ লাগা শুরু করল ডেবরার। আর বেশ বড়সড় ভারী হয়ে গেল শরীর। বুঝতে পারলো নাভাজোর ককপিটে বসে লম্বা ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে এমন সময়ে যখন-তখন বৃষ্টি হতে পারে বাতাসে ভরে উঠল মেঘের গুরুগুরু ডাক আর কালো মেঘে বেশির ভাগ সময় আচ্ছন্ন থাকে আকাশ। আর এরই মাঝে নিজের বইয়ের শেষ অংশ নিয়েও ব্যস্ত হয়ে গেল ডেবরা। আমি এখানে ভালোই থাকবো। ডেভিডকে আশ্বস্ত করল যে ‘আমার কাছে একটা টেলিফোন আছে, ছয়জন গেম রেঞ্জার, চারজন ভৃত্য আর ভয়ঙ্কর একটা হাউন্ডও আছে পাহারা দেবার জন্যে।

কিছুই মানতে চাইলো না ডেভিড। মিটিংয়ে যাবার আগে ঝগড়া করল পুরো পাঁচ দিন। অবশেষে রাজি হল।

‘আমি ভোর হবার আগেই বের হয়ে যাবো। নয়টার মাঝে মিটিংয়ে পৌঁছে যাবো। তিনটার ভেতরে আমাদের অধিবেশন শেষ হয়ে যাবে আর আমার এখানে ফিরে আসতে আসতে খুব বেশি হলে সাড়ে ছয়টা বাজবে।’ বিড়বিড় করল ডেভিড। আর যদি দেখি যে বাজেট তৈরি হয়নি, ফিনালশিয়াল অ্যাফেয়ারস ভোট দিয়েছে, তাহলে আমি অসুস্থ বলে চলে আসব।

‘এটা বেশি জরুরি, ডার্লিং। তুমি যাও।

 ‘তুমি ঠিক বলছো তো?’

‘আমি তো এমনকি বুঝতেও পারব না যে তুমি এখানে নেই।

‘এটা নিয়ে খুশি হয়ো না।’ ডেবরাকে জানালো ডেভিড। এমনো তো হতে পারে যে তোমাকে শাস্তি দেবার জন্যে থেকেও গেলাম।

সকালবেলা ওয়াইন রঙের বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। মাঝে মাঝে মনে হলো আকাশ ঢেকে গেল ধোয়ায়, কখনো মনে হল পাকা ফলের মতো টসটসে হল রং। ছোট্ট এয়ারক্রাফটটা এই জমকালো আবহাওয়ার হাতে পড়ে নাজেহাল হতে লাগল।

খোলা আকাশে একাই উড়ে বেড়াতে লাগল ডেভিড। আর নিজের মাঝে এই সান্ত্বনা ছিল যে আকাশে কখনো কিছু হয়নি তার। মাঝে মাঝেই কোর্স বদল করে পর্বত প্রমাণ সব মেঘমালা পার হল সে। এগুলোর মাঝে লুকিয়ে আছে মৃত্যু আর ধ্বংস। ঘূর্ণিবাতাস মেশিন থেকে পাখা খুলে নিয়ে যাবে। টুকরো টুকরো করে ভাসিয়ে দিবে উপরে। এত উপরে অক্সিজেন ছাড়া একটা মানুষকে টিকে থাকার কোন আশাই থাকবে না।

গ্রান্ড সেন্ট্রালে ল্যান্ড করল সে। ভাড়া করা গাড়ি এখানে অপেক্ষা করছিল তার জন্য। সকালের সংবাদপত্র পড়তে পড়তে প্রিটোরিয়া পৌঁছালো ডেভিড। শুধুমাত্র তখন অস্বস্তি হতে লাগল যখন আবহাওয়ার পাতায় দেখতে পেল মোজাম্বিক চ্যানেল থেকে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে আসছে একটি ঝড়।

কনফারেন্সরুমে ঢোকার আগে রিসিপসনিস্টকে বলল জাবুলানিতে ফোন লাগাতে।

‘দুই ঘণ্টা দেরি হবে, মি: মরগ্যান।

ঠিক আছে লাইন পাওয়া গেলেই জানাবে আমাকে।

লাঞ্চের সময় আবারো মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল।

আমার ফোনের কী হল?

 ‘আমি দুঃখিত মি: মরগ্যান। আমি আপনাকে জানাতেই যাচ্ছিলাম, লাইন নষ্ট হয়ে গেছে। নিচু জায়গাতে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে।

অস্পষ্ট অস্বস্তি বয়ে নিয়ে এলো মৃদু চিন্তা।

 ‘আবহাওয়া অফিসে ফোন করা যাবে?

আবহাওয়ার অবস্থা একেবারে বেহাল দশা বলা যায়। বাবারটন থেকে মপুভা মিলিয়া এবং লরেঙ্কো মারকুইস থেকে মাকাদোৰ্ডপ পর্যন্ত চলছে অবিরাম বৃষ্টিপাত। মাত্র বিশ হাজার ফুট উপরেই মেঘ। মনে হচ্ছে এখনি ভেঙ্গে পড়বে মাটিতে। নাভাজোতে কোন অক্সিজেন আর ইলেকট্রনিক নেভিগেশনাল যন্ত্রপাতি নেই।

‘কতক্ষণ পর্যন্ত আবহাওয়া অফিসে অফিসারের কাছে জানতে চাইল ডেভিড।

কতক্ষণ লাগবে পরিষ্কার হতে?

 ‘বলা কঠিন স্যার। দুই থেকে তিন দিন।

‘ধুত্তোরি! তিক্তভাবে চিৎকার করে উঠল ডেভিড। দৌড় দিল গভর্নমেন্ট বিল্ডিংয়ের নিচতলায় থাকা ক্যান্টিনে। কোণায় একটা টেবিলে অন্য আরো দু’জন বোর্ড মেম্বারের সাথে বসে আছে কনরাড বার্গ। কিন্তু ডেভিডকে দেখার সাথে সাথেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে যত দ্রুত সম্ভব চলে এলো কাছে।

 ‘ডেভিড’, হাত ধরল কনরাড। গোলাকার লাল মুখটা বেশ সিরিয়াস দেখাচ্ছে। আমি এই মাত্র শুনলাম–গত রাতে জেল থেকে পালিয়েছে জোহান আক্কারস। একজন গার্ডকে খুন করে হাওয়া হয়ে গেছে। সতেরো ঘণ্টা হয়ে গেছে কোন পাত্তা নেই।

 হাঁ করে তাকিয়ে রইল ডেভিড। এতটাই ধাক্কা খেয়েছে যে মুখে কথা ঝরছে না।

 ‘ডেবরা কী একা?’ জানতে চাইল কনরাড়। মাথা নাড়াল ডেভিড। ক্ষত বিক্ষত টিস্যু ঢাকা মুখটা শক্ত হয়ে আছে। কিন্তু চোখগুলোতে বাসা বেঁধেছে

তুমি এখনি চলে যাও।

আবহাওয়া–সব এয়ারক্রাফট কে নামিয়ে আনা হয়েছে।’

 ‘আমার ট্রাক নিয়ে যাও!’ তাড়াতাড়ি বলে উঠল কনরাড।

এর চেয়েও দ্রুতগতির কিছু প্রয়োজন আমার।

“তুমি কি চাও আমিও আসি তোমার সাথে?

না, জানাল ডেভিড। আপনি আজ সন্ধ্যায় এখানে না থাকলে তারা নতুন বেড়ার জন্যে বরাদ্দ দেবে না। আমি একাই চলে যাবো।

.

ডেস্কে বসে কাজ করছে ডেবরা, এমন সময় বাতাসের শব্দ শুনতে পেল। টেপ রেকর্ডার বন্ধ করে বারান্দায় গেল। কাছে কাছে রইল কুকুরটা।

দাঁড়িয়ে গর্জন শুনল খানিকক্ষণ। বুঝতে পারল না কিসের আওয়াজ। কেমন যেন একটা শব্দ, মনে হল পাথুরে সমুদ্রতীরে আছড়ে পড়ছে ঢেউ।

কুকুরটা সরে এলো ডেবরার পায়ের কাছে। উবু হয়ে পাশে বসে কুকুরের গলায় হাত বুলাতে লাগল ডেবরা। শুনতে লাগল বাতাসের গর্জন। বুঝতে পারল ক্রমশ বাড়ছে। মারুল্লা বনে গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ার শব্দ পাওয়া গেল।

নাক দিয়ে শব্দ শুরু করল জুলু। নিজের আরো কাছে টেনে নিল ডেবরা।

‘কিছু হবে না। এইতো এইতো’, ফিসফিস করল ডেবরা। সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাতাস। গাছের মাথা ভেঙ্গে পড়ার পটপট শব্দ পাওয়া গেল।

বারান্দায় পোকা-মাকড়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য যে জাল লাগানো হয়েছিল তার উপর পড়ল এসে গাছের ভাঙা অংশ। মনে হলো নৌকার বড় পাল ছিঁড়ে পড়েছে। কামানের গোলার মতো ছিটকে গেল দরজা জানালার হুড়কো।

লাফ দিয়ে পিছন ফিরে নিজের কাজের রুমে ফিরে এল ডেবরা। জানালার পাল্লা বাড়ি খেতে লাগল এপাশ-ওপাশ ধুলা। ময়লা সব ঢুকে যেতে লাগল-এর মাঝ দিয়ে কাধ ঠেকিয়ে আটকে ফেলল ডেবরা জানালা। এরপর একই ভাবে দৌড়ে গিয়ে আটকালো আরো একটি জানালা। এর মাঝে দৌড়ে এলো ভৃত্য।

ম্যাডাম বৃষ্টি আসবে এখন। অনেক বৃষ্টি।

 যাও, তোমার পরিবারের কাছে যাও।’ ভৃত্যকে জানাল ডেবরা।

 ‘ডিনার ম্যাডাম?’

 ‘চিন্তা করো না। আমি তৈরি করে নেব।’

 কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে ভূত্যের দল দৌড় লাগাল তাদের ঘরের দিকে।

পনের মিনিট ধরে স্থায়ী হল এই দমকা বাতাস। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল ডেবরা। বুঝতে পারল তার শরীর কাঁপছে। উত্তেজিত হয়ে হাসতে শুরু করল ডেবরা। ঝড়ের তাণ্ডব উপলব্ধি করে।

এরপর হঠাৎ করেই থেমে গেল বাতাস। যেভাবে হঠাৎ এসেছিল সেভাবে হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেল চারপাশ। শুনতে পেল পুলের উপর দিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে গেল বাতাসের গর্জন।

 নিঃশব্দতার মাঝে মনে হল পুরো পৃথিবী অপেক্ষা করে আছে যে কিছু একটা ঘটবে। ঠাণ্ডা লাগল ডেবরার, তাপমাত্রা হঠাৎ করে কমে গেল। মনে হল হঠাৎ করে বরফের বাক্স খুলে গেছে। কাঁপতে লাগল ডেবরা। কিন্তু দেখতে পেল না যে বিশাল বড় একটা কালো মেঘ অন্ধকার ছড়িয়ে দিল জাবুলানির উপর। কিন্তু তারপর কীভাবে যেন খানিকটা অনুভব করলো যে কী ঘটতে চলেছে।

প্রথম বিদ্যুৎ চমকের সাথে সাথে এত শব্দ হল যে ডেবরা নিজেও বুঝতে পারল না যে ও কাঁদতে শুরু করেছে। এত জোরে বাজ পড়ল যে মনে হল সারা আকাশ ভেঙ্গে চুড়ে পড়বে। পৃথিবীর ভূমিতল পর্যন্ত কেঁপে উঠল।

ঘুরে দাঁড়িয়ে আরো ভেতরের দিকে সরে যেতে চাইল ডেবরা। নিজের বেডরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। কিন্তু বৃষ্টি আসার পর মনে হল দেয়ালের বাধাও মানতে চাইছে না পানির স্রোত। ড্রামের মতো শব্দ হতে লাগল চারপাশে। মনে হলো কানে তালা লেগে যাবে। জানালার কাঁচ ভেঙ্গে কাঠামো শব্দ করে বাড়ি ভেসে গেল পানিতে।

এত বৃষ্টির পরেও বজ্রপাতের কড়কড় শব্দে নার্ভাস বোধ করতে লাগল ডেবরা। প্রতিবার ভয়ে কেঁপে উঠতে লাগল ডেবরা। আর মনে হল সরাসরি ওর উপরই পড়তে লাগল বজ্রপাত।

নিজের বিছানার উপর গুটিসুটি মেরে বসে রইল সে। কাছে জড়িয়ে ধরল জুলুকে। মনে হলো ভূত্যদেরকে চলে যেতে বলাটা ঠিক হয়নি। মনে হল বোমার মতো বজ্রপাতের আঘাতে কিছু একটা হয়ে যাবে ওর।

অবশেষে আর ধরে রাখতে পারল না নিজেকে। লিভিংরুমের দিকে পা বাড়ালো। অবস্থা এমন হলো যে, মনে হলো নিজের রুমের পথঘাট ভুলে গেছে সে, তারপরও টেলিফোন হাতে পেয়ে কানের কাছে তুলল।

সাথে সাথে বুঝতে পারল ফোন ডেড হয়ে আছে। কোন শব্দ নেই। তারপরেও পাগলের মতো ডায়াল করতে লাগল। কিন্তু শেষমেশ বাধ্য হলো ছেড়ে দিতে। তারের সাথে ঝুলতে লাগল রিসিভার।

নিজের কাজের রুমে ফিরে আসতে আসতে ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগল ডেবরা। নিজের পেটে হাত বুলিয়ে অনুভব করল সন্তানের উপস্থিতি। বিছানার উপর ধপ করে বসে দুই হাতে কান ঢাকালো। বন্ধ করো চিৎকার করে উঠল ডেবরা। বন্ধ করো। ওহ, প্লিজ গড়, বন্ধ কর।

.

নতুন তৈরি করা ন্যাশনাল হাইওয়ে যেটা কয়লার খনির শহর উইটবাঙ্ক পর্যন্ত গেছে, বেশ চওড়া আর মসৃণ। ছয় লেন ধরে গাড়ি-ঘোড়া চলছে। প্রথম লেনে ভাড়া করা পন্টিয়াক চালাতে লাগল ডেভিড। পা শক্ত করে চেপে বসে রইল। ঘন্টায় একশ ত্রিশ মাইল বেগে চলতে লাগল গাড়ি। রাস্তার উপর এতটাই স্বচ্ছন্দে চলতে লাগল গাড়ি যে মনে হলো ড্রাইভ না করলেও চলবে। মনের মাঝে সব ভয়ের কাহিনী ভাসতে লাগল। মনে পড়ে গেল কোর্ট রুমে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কেমন শীতল চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল জোহান আক্কারস। গভীরে কোটরে বসা কাদার মতো চোখ, মুখ খোলা মানে হল এখনি থুথু মেরে বসবে। ওয়ার্ডার এসে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে জেলেখানায় নিয়ে যাবার সময় পিছন ফিরে চিৎকার করেছিল আক্কারস, ‘আমি তোকে দেখে নিব। এর জন্যে যদি উনত্রিশ বছরও লেগে যায় আমি অপেক্ষা করব।’ এরপর জেলে কক্ষে ঢুকিয়ে দেয়া হল আক্কাসকে।

উইটবাঙ্কের পর রাস্তা হয়ে গেল সরু। গাড়িতে গাড়িতে ভিড় জমে গেছে। আর প্রতিটি মোড় হয়ে উঠল বিপজ্জনক। ডেভিড মনোযোগ দিল রাস্তার উপর। জোর করে মন থেকে তাড়িয়ে দিল জনের ভুতকে।

লিনডেনবার্গে টার্ন নেয়ার পর চারপাশে গাড়ির সংখ্যা কমে গেল। মাঝে মাঝে একটা দুটো ট্রাক। আবারো গতির ঝড় তুলে এগোতে লাগল গাড়ি। এরপর হঠাৎ করে রাস্তা আবার মোড় নিয়ে নিচু ভূমিতে চলা শুরু করল।

ইরাসমাস টানেল থেকে বের হবার পর বৃষ্টির দেখা পেল ডেভিড। বাতাসে ভরে আছে কালো মেঘ। রাস্তা ভেসে যাচ্ছে পানিতে। ফলে গতি কমাতে বাধ্য হলো পিচ্ছিল রাস্তায় ডেভিড। উইন্ডশীল্ড পর্যন্ত পানির ধারা মুছে শেষ করতে পারছে না।

নিজের গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে নিল ডেভিড। এর ভেতরেও যত জোরে সম্ভব ছুটতে লাগল। নিজের সীটের উপর বসে গলা বাড়িয়ে সামনে তাকিয়ে রইল বৃষ্টি ভেদ করে দেখতে পাবার আশায়।

বৃষ্টির কারণে সন্ধ্যা এলো তাড়াতাড়ি। ভেজা রাস্তায় নিজের হেডলাইটের প্রতিবিম্ব মনে হল চোখ ধাধিয়ে দেবে। আর বৃষ্টির ফোঁটা মনে হল পাথরের মতো সশব্দে আড়ছে পড়তে লাগল। বাধ্য হলো গতি আরো খানিকটা কমাতে। সামনের রাস্তা চলে গেছে ব্যান্ডেলিয়ার হিলের দিকে।

 অন্ধকারের কারণে আরেকটুকু হলেই মিস করে যেত মোড়। গাড়ি ঘুরিয়ে আবারো ফিরে এলো সে।

 কাদামাটিতে পুরো রাস্তা ভরে গেছে। আবারো গতি কমাতে বাধ্য হলো সে। একবার তো ভুল করে চাকা হড়কে পাশের নালার মাঝেই পড়ে যাচ্ছিল আরেকটুকু হলে। এরপর চাকার নিচে আলগা পাথর বসিয়ে ইঞ্জিন চালিয়ে কোনমতে পার হলো এ রাস্তা।

লুজান স্টিমের ব্রিজের উপর যখন পৌঁছালো তখন ছয় ঘণ্টা হয়ে গেছে যে সে একনাগাড়ে বসে আছে পন্টিয়াকের হুইলের উপর। ঘড়িতে তখন আটটা বেজে আরো কয়েক মিনিট।

ব্রিজে পৌঁছাতে পৌঁছাতে হঠাৎ করেই আবার থেমে গেল বৃষ্টি। আবহাওয়া মনে হলো খেলা করতে লাগল তাকে নিয়ে। মাথার উপরেই দেখা গেল তারাদের মিটমিটে রহস্যময় আলো। চারপাশে অলস ভাবে ভাসছে কয়েক টুকরো মেঘ।

অন্ধকার চিরে দিল ডেভিডের হেডলাইট। দূরে একশ গজ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার ভাবে। পনের ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে ব্রিজ। পানির স্রোত এত বেশি যে নিচের পাথরগুলো দেখা যাচ্ছে চকচক করছে। এর সাথে সাথে ভাসছে উপড়ে যাওয়া গাছের গুঁড়ি।

 এখনকার অবস্থা দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে এখানেই নদীবক্ষে বালির উপর দিয়ে সবুজ ফোর্ড নিয়ে জোহান আক্কারস তাড়া করেছিল কনরাড বার্গকে।

পন্টিয়াক থেকে নেমে পানির কিনারে গিয়ে দাঁড়াল ডেভিড। দাঁড়াতেই বুঝলে পারল যে পানি আরো বাড়বে।

চোখ তুলে তাকাল আকাশের দিকে। হিসাব কষে দেখল।

সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল তৎক্ষণাৎ। দৌড়ে গেল পন্টিয়াকের দিকে। রিভার্স করে যতদূর যাওয়া যায় গেল। হেডলাইট এখনো নদীর কিনারে আলো ফেলছে। এরপর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে শার্ট খুলে ফেলল। ট্রাউজার থেকে বেল্ট খুলে নিয়ে কোমরে পেঁচালো। জুতা জোড়া বেল্টের সাথে বেঁধে নিল।

খালি পায়ে দৌড়ে গেল পানির কিনারে। বুঝতে পারল নদীতীরে পা পিছলে যাচ্ছে। আরো কয়েক কদম এগিয়ে হাঁটু পানিতে যেতেই স্রোত ভাসিয়ে নিল তাকে। সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে ঠিক দিকে ধরে রাখল ডেভিড।

এভাবেই খানিক দাঁড়িয়ে রইল সে। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল একটা গাছের গুঁড়ি আসছে ভেসে ভেসে। শাখা-প্রশাখা এমন ভাবে ছড়িয়ে আছে যে শিকড় দেখে মনে হচ্ছে গাছের হাত-পা। এখনি পার হয়ে যাবে তার কাছে দিয়ে।

 সময় হিসেবে করে ঝাঁপ দিল ডেভিড। অর্ধডজন শক্তিশালী স্টোক তাকে পৌঁছে দিল গুঁড়িটার কাছে। সাঁতার কেটে ধরে ফেলল একটা শিকড়। তৎক্ষণাৎ হেডলাইটের আলো থেকে ভয়ঙ্কর স্রোতশীল নদীর বুকে পড়ল সে। গাছের গুঁড়ি আঁকড়ে একবার ডুবে, একবার ভেসে কাশতে কাশতে এগিয়ে চলতে লাগল ডেভিড, একের সময় মনে হলো দম বন্ধ হয়ে যাবে।

হঠাৎ করেই কিছু একটা খোঁচা মারলো তাকে। কোমরের বেল্টের সাথে পেঁচানো শার্ট ছিঁড়ে চামড়াও কেটে গেল। আবারো পানিতে ডুবে গেল সে। তারপরেও ছাড়লো না গাছের গুঁড়ি।

চারপাশে অন্ধকারের মাঝে শুধু পানির বয়ে চলার শব্দই পাওয়া যাচ্ছে। এর শক্তির কাছে নিঃশেষ হয়ে যেতে লাগল ডেভিড। হাত-পা ছুঁড়ে জ্বালা করতে লাগল পাথরের টুকরা গাছের ভাঙা অংশের আঘাতে।

হঠাৎ করেই মনে হলো কোন কিছুর গায়ে আটকে গেছে গাছের গুঁড়ি। কেমন করে আবারো ছাড়া পেয়ে আবারো স্রোতে ভেসে যেতে লাগল।

কাদা জল চোখে গিয়ে মনে হলো অন্ধ হয় গেছে সে। জানে যে এভাবে বেশিক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব নয়। ইতিমধ্যেই বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। বুঝতে পারল মাথা কাজ করছে না। শরীর চলতে চাইছে না। মনে হলো কোন দৌড় প্রতিযোগিতায় দশম রাউন্ড শেষ করেছে সে।

বহুকষ্টে কাছাকাছি তীরের কাছে গিয়ে ঝাঁপ দিল ডেভিড। হাত থেকে সরে গেল গাছের গুঁড়ি। টান দিয়ে ধরল একটা কাটা গাছ। সর্বশক্তি দিয়ে টেনে ধরে উঠে এলো পাড়ে। হাতের তালু ছিঁড়ে গেল ছাঁটার খোঁচায়। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল ডেভিড। তারপরেও ছাড়ল না। আস্তে আস্তে পানি থেকে উঠল হামাগুড়ি দিয়ে। কাশতে কাশতে ফুসফুস থেকে উগড়ে দিল পানি। নদীর তীরে কাদার উপর মুখ দিয়ে পড়ে গেল। বমির তোড়ে ভিজে গেল নাক মুখ।

অনেকক্ষণ পর্যন্ত নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইল সে। কাশি থামলে পর ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে লাগল স্বাভাবিক ভাবে। স্রোতের টানে জুতো খুলে গেছে বেল্ট থেকে। হারিয়ে গেছে নদীতে। বহুকষ্টে পা টেনে টেনে অন্ধকারে উঠে হাঁটতে লাগল ডেভিড। একটু পরেই দৌড়াতে শুরু করল। মুখের সামনে হাত এনে তালু থেকে দাঁত দিয়ে টেনে টেনে বের করে ফেলতে লাগল কাটার ভাঙা অংশ।

মাথার উপরে এখনো আলো ছড়াচ্ছে তারার দল। এই আলোতে রাস্তা দেখে এগোতে লাগল ডেভিড। প্রতি কদমের সাথে আরো জোরে দৌড়াতে লাগল। চারপাশ একেবারে চুপচাপ। মাঝে মাঝে নীরবতা ভঙ্গ করছে গাছের পাতা থেকে ঝড়ে পড়া পানির ফোঁটা বা বহুদূর থেকে ভেসে আসা বিদ্যুৎ চমকের শব্দ।

বাসা থেকে দুই-মাইল দূরে রাস্তার পাশে কিছু একটা গাঢ় ছায়া দেখল ডেভিড। এর কাছ থেকে কয়েক কদম দূরে থাকতেই বুঝতে পারল যে, এটা একটা গাড়ি বহু পুরাতন শেভি। এখানে এমনিই পড়ে আছে গাড়িটা, নিশ্চয় কোন একটা মাটি-কাদার গর্তে ছিল। বৃষ্টি এসে গর্তের মুখ ধুয়ে দেয়ায় এখন দেখা যাচ্ছে।

দরজা খোলা। ভেতরের আর পার্কিং লাইট জ্বালালে ডেভিড। সিটের উপর পড়ে আছে শুকনো রক্ত। গাঢ় রং। পিছনের সিটে কাপড়ের বান্ডেল। তাড়াতাড়ি খুলে ফেলল সে। তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারল জেলেখানার কয়েদীর পোশাক এটা। বোকার মতো খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল সে। এরপর যেন মাথার উপর বাজ পড়ল।

চুরি করা হয়েছে গাড়িটা। রক্ত সম্ভবত দুর্ভাগা মালিকের শরীরের। কয়েদীর পোশাক বদল করা হয়েছে এখানে। সম্ভবত শেভির মালিকের পোশাকের সাথে।

জোহান আক্কারস এখন জাবুলানীতে, এ ব্যাপারে আর কোন সন্দেহই রইল না। যখন এসেছে তখন নিশ্চয়ই লুজান স্ট্রিমের ব্রিজ ঠিক ছিল। না হয় এ গাড়িটা এখানে থাকতো না–তার মানে তিন থেকে চার ঘণ্টা পার হয়ে গেছে এর মাঝে।

গাড়ির পিছনে কয়েদীর পোশাক ছুঁড়ে ফেলে দৌড় লাগাল ডেভিড।

.

জোহান আক্কারস শেভি নিয়ে পৌঁছে গেল লুজান স্ট্রিমের কাছে। পানি তখনো ততটা বাড়েনি। গাড়ির গায়ে লেগে আছে কাদা-পানি। স্টিয়ারিং ঘুরতে চাইছে না। দরজার নিচ দিয়ে আক্কারসের পায়ে লাগছে পানি। কিন্তু তারপরে নিরাপদে পৌঁছালো সে অপর তীরে। নরম মাটিতে ঘুরতে লাগল চাকা। স্কিড করতে লাগল শেভি। জাবুলানি যত কাছে এগিয়ে আসছে ততই মনে হলো অধৈর্য হয়ে উঠল সে। জেলে যাবার আগে আক্কারস ছিল ধীরস্থির স্বভাবের মানুষ। নিজের ইন্দ্রিয়ের উপর পূর্ণ দখল তার।

কিন্তু গত দুই বছরে জেলখানার পরিশ্রম আর প্রতিশোধের আগুন এখন সহ্যের শেষ সীমায় নিয়ে এসেছে তাকে।

বেঁচে থাকার একমাত্র কারণই হচ্ছে প্রতিশোধ নেয়া। প্রতিদিন না হলেও শত বার ব্যাপরটা আগা-গোড়া প্রতিটি অংশ রিহার্সাল করেছে সে। এমনভাবে পরিকল্পনা করেছে যেন জেল ভেঙ্গে তিনদিনের জন্যে মুক্তিলাভই যথেষ্ট হয়। এর মাঝেই যা করার করে ফেলবে সে। তারপর যা হয় হোক।

নিজের চোয়ালে নিজেই ব্যথা সৃষ্টি করেছে সে। দূষিত সুইয়ের খোঁচা দিয়ে পচন ধরিয়েছে। তারপর তার পরিকল্পনা মতো তাকে দাঁতের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গার্ডকে কাবু করতে কোন বেগ পেতে হয়নি। আর গলায় স্কালপেল ধরতেই ডেন্টিস্টও সাহায্য করতে দ্বিধা করেনি।

জেলখানা থেকে বের হবার সাথে সাথেই স্কালপেলটা ব্যবহার করেছে আক্কারস। অবাক হয়ে গেছে দেখে যে একটা মানুষের গলার শিরা দিয়ে কতটা রক্ত চলাচল করে। ময়লা ফেলার একটা জায়গাতে নিজের গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলের উপর ফেলে এসেছে ডেন্টিস্টের মৃতদেহ। নিজের কয়েদীর পোশাকের উপর চাপিয়েছে সাদা গাউন। এরপর অপেক্ষা করছে ট্রাফিকের লাইটের জন্য।

 লাল আলো দেখে থেমে গিয়েছিল চকচকে নতুন শেভি গাড়িটা। আক্কারস প্যাসেঞ্জার ডোর খুলেই গিয়ে বসল ড্রাইভারের গা ঘেঁষে।

 লোকটা উচ্চতাতে আক্কারসের চেয়ে খাটো, মাংসল, সুখী-সুখী চেহারা, মসৃণ ত্বক, স্টিয়ারিং হুইল রাখা ছোট ছোট হাতে তেমন পশম নেই। আক্কারসের আদেশ হাসিমুখে মেনে নিয়ে গাড়ি চালাতে লাগল।

তুলতুলে সাদা শরীরের কাছে গড়িয়ে গেল আক্কারস। একটু পরেই তেমন ব্যবহার করা হয় না এমন একটা রাস্তায় ফেলে দিল মৃতদেহ। এরপর মাত্র চল্লিশ মিনিটের মাথায় শহরের বাইরের প্রথম রোড ব্লকে চলে এলো।

পাশের রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে পূর্ব দিকে এগিয়ে এলো। চোয়ালে ইনফেকশনের ব্যথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ডেন্টিস্ট অবশ্য অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছিল। কিন্তু কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। গিয়ার লিভারের উপর তেমন কাজ করতে পারছে না অর্থব একটা হাত। ছিঁড়ে যাওয়া পেশী আর নার্ভগুলো আর জোড়া লাগেনি। মৃতের মতো হয়ে গেল হাতটা, নির্জীব।

প্রাকৃতিক ভাবেই একজন শিকারি সে। তার উপর রেডিওতে প্রচারিত হওয়া আবহাওয়ার সংবাদ শুনে মনে হচ্ছে ভাগ্য তার সহায় আছে। এখন জাবুলানিতে পৌঁছে আর তর সইছে না তাই।

চল্লিশ মাইল গতিতে কাদার গর্তে পড়ে গেল শেভি। পড়ে ঘুরতে লাগল চাকা। পেছন দিক কাদার গভীরে দেবে গেল।

সেখানেই গাড়িটাকে রেখে দিল আক্কারস। বৃষ্টি মাথায় হাঁটা শুরু করল যত দ্রুত সম্ভব। একবার মনে হল ঠাণ্ডায় দাঁতে দাঁত বাড়ি খেল। তারপর আবারো নিঃশব্দে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোতে লাগল।

জাবুলানিতে বাসার পেছনের কোপজেতে সে পৌঁছালো ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। এরপর দুই ঘণ্টা চুপচাপ বসে বৃষ্টি দেখল, অপেক্ষা করল রাত নামার জন্য। রাত নামার পর অবশ্য একটু চিন্তায় পড়ে গেল কোথাও আলো জ্বলছে না, এতক্ষণে আলো জ্বেলে দেবার কথা।

কোপজে ছেড়ে সাবধানে পাহাড়ের নিচে এগোতে লাগল। আস্তে করে পার হয়ে গেল ভৃত্যদের কোয়ার্টার, গাছের ফাঁক দিয়ে পৌঁছে গেল ল্যান্ডিং স্ট্রিপে।

হ্যাঙ্গারের পাশের দেয়াল অনুসরণ করে দরজার কাছে পৌঁছাল।

উন্মাদের মতো হাত বাড়িয়ে খুঁজতে লাগল এয়ারক্রাফটকে, যেটা সেখানে থাকার কথা। যখন বুঝতে পারল যে এটা নেই, হতাশায় মুষড়ে পড়ল সে।

তারা চলে গেছে। এত কষ্ট, এত পরিকল্পনা, এত প্রচেষ্টা সব মাঠে মারা গেল।

জন্তুর মতো গর্জন করে সুস্থ হাতের মুঠি পাকিয়ে দেয়ালে মারলো আক্কারস। হতাশার চোটে ব্যথাও খারাপ লাগল না। এতটাই ঘৃণা তার আর এতটাই রেগে উঠল সে জ্বরতপ্ত রোগীর মতো কাঁপতে লাগল শরীর। চিৎকার করে উঠল, যেন বোধবুদ্ধিহীন জড় কোন জন্তু চিৎকার করছে।

হঠাৎ করেই থেমে গেল বৃষ্টি। হ্যাঙ্গারের লোহার ছাদের উপর ড্রামের বাজনার মতো বৃষ্টি শব্দ থেমে গেল। অবাক হয়ে গেল আক্কারস। খোলা জায়গায় গিয়ে বাইরে তাকাল। উপরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারকারাজি শব্দ বলতে কেবল পানি বয়ে চলার কুলকুল ধ্বনি আর পাতা থেকে টুপটাপ করে ঝরে পড়ার শব্দ।

আলোর আভা দেখা গেল। গাছ-পালার ফাঁকে বাসার সাদা দেয়াল উজ্জ্বলতা ছড়াতে লাগল। আক্কারস বুঝতে পারল যে এখনো কিছু করতে পারবে সে। নিজের হতাশা মেটানোর জন্য কিছু না কিছু তো করবেই সে। ফার্নিচার আছে, ভেঙ্গে ফেলবে। ঘরের চাল জ্বালিয়ে দেবে-ভেতর থেকে আগুন লাগিয়ে দিলে এই আবহাওয়াতেও দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠতে কোন সমস্যাই হবে না।

অন্ধকারের মাঝে গাছের মধ্য দিয়ে পথ করে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো আক্কারস।

.

নীরবতার মাঝে ঘুম ভাঙ্গলো ডেবরার। ঝড়ের মাঝামাঝি সময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। হয়তো ভয়ের হাত থেকে পালাবার জন্য ক্লান্ত দেহ আপনাতেই ঘুমিয়ে গেছে।

হাত বাড়ালো জুলর দিকে কিন্তু নেই কুকুরটা। ডেবরার পাশে বিছানার যে অংশে কুকুরটা ছিল সেখানটা এখনো গরম হয়ে আছে।

মনোযোগ দিয়ে শুনল ডেবরা। পানির মৃদু শব্দ আর অনেক দূরে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।

বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। এ সময়ে পরার জন্য টিলা ধরনের ফোলানো পোশাকের মাঝে কাঁপছে শরীর। বুড়ো আঙুল ঠেকালো মেঝেতে। পাথরের মেঝেতে হালকা ব্যালে পাম্প সু পেয়ে পা গলিয়ে দিল।

 ড্রেসিংরুমের দিকে যেতে লাগল সোয়েটারের জন্য। এরপর ঠিক করল নিজের জন্য গরম এক কাপ স্যুপ তৈরি করে নেবে।

ঘেউ ঘেউ করে উঠল জুলু। সামনের বাগানে আছে কুকুরটা বোঝা গেল। নিশ্চিত বারান্দার দেয়ালের মাঝে তার জন্য তৈরি করা বিশেষ দরজা দিয়ে বের হয়ে গেছে কুকুরটা।

বিভিন্ন রকম ভাবে ঘেউ ঘেউ করে কুকুরটা। প্রতিটার নির্দিষ্ট অর্থ আছে যা ডেবরা ঠিকই বুঝতে পারে।

নিজের মতো করে উফ শব্দ যেটা শুনে মনে হয় ওয়াচম্যানের-জুন মাসের রাতে দশটা বেজেছে–সবকিছু ঠিক আছে।

 অথবা লম্বা একটা একটানা শব্দ। যেটার মানে আজ রাতে পূর্ণিমা আর আমার রক্তে থাকা নেকড়ের রক্ত আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না।

একটা তীক্ষ্ণ, অর্থবহ ঘেউ ঘেউয়ের মানে হচ্ছে, পাম্প হাউজের কাছে কিছু একটা ঘুরছে। হতে পারে এটা একটা সিংহ।

আর এছাড়া আছে জরুরি কোরাস, ভয়াবহ বিপদ আসছে। সাবধান! সাবধান!

এখন এভাবেই চিৎকার করছে কুকুরটা। এর সাথে সাথে চোয়াল বন্ধ করে গরগর করছে। তার মানে কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে।

বারান্দায় এলো ডেবরা। অনুভব করল পায়ের জুতা ভিজে গেছে পানিতে। সামনের বাগানে কিছু একটা দেখছে জুলু। গর্জন শুনতে পাচ্ছে। ডেবরা। কিছু একটা নিয়ে যুদ্ধ করছে জুলু।

 চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সে। কী করবে বুঝতে পারছে না। জানে যে ইচ্ছে করলেই যেতে পারবে না জুলুর কাছে। অচেনা শত্রুর সামনে অন্ধ ডেবরা ভয়ঙ্কর অসহায়। দ্বিধার মাঝেই শুনতে পেল ভারী কিছু একটা দিয়ে বাড়ি মারার শব্দ। হাড়ের উপর পড়ে ভাঙার শব্দও পেল সে। থপ করে পড়ে গেল একটা শরীর। হঠাৎ করেই থেমে গেল জুলুর শব্দ। আবার নেমে এলো নীরবতা। কিছু একটা হয়েছে কুকুরটার। এবার সে সত্যিকারের একা হয়ে গেল।

না, পুরোপুরি নীরব নয়। নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে–জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে কেউ।

পিছু হটে বারান্দার দেয়ালের গায়ে সেঁটে গেল ডেবরা। চুপচাপ শুনছে। আর অপেক্ষা করছে।

শুনতে পেল পায়ের শব্দ। বাগানের মাঝে দিয়ে কেউ একজন এগিয়ে আসছে সদর দরজার দিকে। বৃষ্টির কাদায় মাঝে মাঝে পিছলে যাচ্ছে শব্দ।

চিৎকার করে আগন্তুকের পরিচয় জানতে চাইতে ইচ্ছে করল তার। কিন্তু মনে হলো গলার কাছে জমে গেছে কিছু একটা। মনে হলো দৌড় লাগাবে। কিন্তু সামনের সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেয়ে নিজের পা দুটো মনে হল জমে গেছে।

 বারান্দার জালের নেটের দিকে হাত বাড়ালো কেউ একজন। হ্যাঁন্ডেলে হাত রেখে আস্তে করে মোচড় দিল।

অবশেষে স্বর খুঁজে পেল ডেবরা ‘কে?’ ভয়ার্ত স্বরে কেঁদে উঠল সে। রাতের নীরবতায় কানে বাজালো ঝনঝন করে।

সাথে সাথে থেমে গেল হাতল ঘুরানোর শব্দ। থেমে গেল লোকটা। ডেবরা স্পষ্ট কল্পনা করতে পারল যে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে অন্ধকার বারান্দায় তাকে দেখতে চেষ্টা করছে লোকটা। তৎক্ষণাৎ গাঢ় রঙের পোশাক পরায় নিজেকে ধন্যবাদ দিল সে।

 চুপচাপ নড়াচড়া না করে কান পেতে শুনতে লাগল ডেবরা। শুনতে পেল বাতাস এসে নড়ে উঠল গাছের মাথা, টুপটুপ করে অনেকগুলো ফোঁটা একসাথে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। বাঁধের কাছে ডেকে উঠল একটা শিকারি পেঁচা। পাহাড়ের কাছে কড়াৎ কড়াৎ করে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল, পয়েনসেটিয়া ঝোঁপ থেকে কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল একটা নিশাচর পাখি।

আরো অনেকক্ষণ চুপচাপ রইল চারপাশ। বুঝতে পারল বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারবে না সে। অনুভব করল ঠোঁট কাঁপছে। ঠাণ্ডা আতঙ্ক, সন্তানের ভার সব মিলিয়ে চাপ পড়েছে ব্লাডারের উপর। ইচ্ছে করল দৌড়ে পালায়—কিন্তু কোথায় যাবে।

এরপরই নীরবতা ভেঙ্গে গেল। অন্ধকার খিকখিক করে হেসে উঠল কেউ। এত কাছে আর এত উন্মাদের মতো শোনাল হাসিটা–আতঙ্কে মনে হলো হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে তার। পা দুর্বল হয়ে গেল, কাঁপতে শুরু করল ডেবরা। ব্লাডারের উপর চাপ আর নিতে পারছে না সে–কেননা এই হাসি পরিষ্কার ভাবে চিনতে পারছে সে। মনের গহীনে থেকে যাওয়া ভয়ঙ্কর স্মৃতি স্মরণে এলো।

দরজার হাতল ঘোরাতে লাগল হাতটা। বাঁকাতে লাগল জোরে জোরে। এরপর কাধ দিয়ে বাড়ি মারলো কাঠামোর গায়ে। এটা পাতলা একটা দরজা, ভার সহ্য করার মতো তৈরি হয়নি। ডেবরা জানে যে কোন মুহূর্তে ভেঙ্গে পড়বে এটা।

আবার চিৎকার করে উঠল ডেবরা, আতঙ্কে ভয়াবহ শব্দ বের হলো গলা চিরে। আর মনে হল এতেই কাজ হল। সব ধরনের জড়তা কেটে গেল। পা আবার নড়ে উঠল, ব্রেইন কাজ করা শুরু করল।

তাড়াতাড়ি উঠে নিজের ওয়ার্করুমে দৌড় দিল সে। দরজা বন্ধ করে তাড়াতাড়ি লক্ করে দিল।

এরপর বিছনার কাছে গিয়ে গুটিশুটি মেরে বসে চিন্তা করতে লাগল কী করা যায়। জানে যে ঘরে ঢোকার সাথে সাথে আলো জ্বেলে দিবে আক্কারস। বৈদ্যুতিক জেনারেটর অটোম্যাটিক্যালি জ্বলে উঠলেই পুরোপুরি আক্কারসের হাতে পড়ে যাবে সে। অন্ধকার ডেবরার একমাত্র ভরসা এখন। এতে তার সুবিধা হবে, কেননা অন্ধকারেই অভ্যস্ত সে।

আবারো নিশাচর পাখি আর পেচার ডাক শুনতে পেল। বুঝতে পারল রাত নেমেছে বাইরে। আর সম্ভবত মেঘ এখনো ঢেকে রেখেছে চাঁদ আর তারাদের। বাইরের জঙ্গলেও এখন অন্ধকার। এখন যা করতে হবে তা হলো বাইরে গিয়ে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে পৌঁছানো।

তাড়াতাড়ি আবার উঠে রুমের মাঝখানের দরজা দিয়ে আরো ভেতরের রুমে চলে গেল সে। যেতে যেতে ভাবতে লাগল অস্ত্র হিসেবে কী ব্যবহার করা যায়। ডেভিডের অফিসের স্টিলের কেবিনেটে গোলাবারুদ রাখা আছে। রান্নাঘরের দিকে দৌড় দিল ডেবরা। দরজার কাছে জায়গা মতেই রাখা আছে তার ওয়াকিং স্টিক। হাতে নিয়ে দরজা খুলে ফেলল।

ঠিক তখনি শুনতে পেল সামনের দরজা ভেঙ্গে গেল। তালার উপর ভারী পায়ে লাথি মেরে লিভিং রুমে ঢুকে গেল আক্কারস। পেছনে রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে দিল ডেবরা। তাকাল উঠানের দিকে। চেষ্টা করল নিজেকে শান্ত করতে। ভয় পেলে চলবে না। পথ হারানো যাবে না। প্রতিটি পা গুনেগুনে ফেলতে লাগলা। কোপজেতে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে যাবার রাস্তা খুঁজে পেতে হবে তাকে।

ওর প্রথম ল্যান্ডমার্ক হলো বেড়ার গায়ের দরজাটা যেটা বাড়ির চারপাশে ঘিরে আছে। এর কাছে পৌঁছানোর আগেই শুনতে পেল ইলেকট্রিসিটি জেনারেটর গ্যারাজের পেছনে স্বশব্দে চলা শুরু করল। আক্কারস লাইটের সুইচ খুঁজে পেয়েছে।

পথ থেকে সরে গেল ডেবরা। দৌড়াতে লাগল কাটাতারের বেড়ার দিকে। উন্মাদের মতো চেষ্টা করল দরজাটা খুঁজে পেতে। মাথার উপরে শুনতে পেল বাতির চড়চড় শব্দ। তার মানে এখনি আলোর বন্যায় ভেসে যাবে পুরো বাগান।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই রান্নাঘরের দরজার পাশে থাকা বাতির সুইচের গায়ে চোখ পড়েছে আক্কারসের। মনে হল আলোর নিচে তাকে নিশ্চয় দেখে ফেলেছে লোকটা।

শুনতে পেল তার পেছনে চিৎকার করছে আক্কারস। বুঝতে পারল তাকে দেখতে পেয়েছে। সেই মুহূর্তে গেইট পেয়ে গেল ডেবরা। স্বস্তির শ্বাস ফেলে গেইট খুলেই দৌড়াতে লাগল।

 তাকে আলো থেকে সরে যেতে হবে। অন্ধকারে হারিয়ে যেতে হবে। আলোই এখন বিপদ ডেকে আনবে, অন্ধকার তাকে রক্ষা করবে।

রাস্তাটা হচ্ছে আঁকাবাকা, পুলের বাম পাশ দিয়ে ডানদিকে ভৃত্যদের কোয়ার্টার ডানহাতি রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে লাগল ডেবরা। পেছনে খুলে গেল গেইট। তার পেছনেই আসছে আক্কারস।

দৌড়াতে গিয়েও গননা করতে ভোলেনি ডেবরা। পাঁচশো কদম সামনে গেলেই নতুন মোড়। কিন্তু পড়ে গেল বেচারা।

হাঁটুতে বেঁধে গড়িয়ে গেল। হারিয়ে গেল ওয়াকিং স্টিক। এটা খুঁজতে গিয়ে সময় নষ্ট করার মানে হয় না। আবারো দৌড়াতে শুরু করল।

আরো পঞ্চাশ কদম গিয়েই বুঝতে পারল যে সে ভুল পথে এসেছে। এই পথ পাম্পহাউজের দিকে গেছে-এই রাস্তা সে ততটা ভালো চেনে না। এই পথে তেমন আসে না সে।

একটা মোড় নিতে ভুলে যাওয়ায় এবড়ো-খেবড়ো মাটিতে চলে গেল সে। পায়ে ঘাস জড়িয়ে এক পাশে কাত হয়ে পড়ে গেল। পুরোপুরি দিশেহারা অবস্থা তার। জানে যে পথ ভুলে বসে আছে। কিন্তু এটুকু সান্ত্বনা যে আলোর কাছ থেকে সরে এসেছে। ভাগ্যক্রমে চারপাশে একেবারে অন্ধকার–কিন্তু এত দ্রুত হার্টবিট হচ্ছে যে বুঝতে পারল ভয়ে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যাবার জোগাড়।

নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে করতে কান পেতে রইল কিছু শোনার আশায়।

এরপরই শুনতে পেল আসছে আক্কারস। ভারী পায়ের শব্দ স্পষ্ট শোনা গেল, ভেজা মাটিতেও কান এড়ালো না। মনে হলো সরাসরি ডেবরার কাছেই আসছে সে। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখে নিজেকে শান্ত করতে চাইল ডেবরা।

একেবারে শেষ মুহূর্তে ডেবরার কাছ দিয়ে চলে গেল পদশব্দ। মনে হল অসুস্থ হয়ে যাবে সে। কিন্তু আবার ফিলে এলো পদশব্দ। এতটা কাছে যে আক্কারসের হাঁপানির শব্দও পাচ্ছে সে।

 ডেবরার জন্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল আকারস। একেবারে কাছাকাছি। দাঁড়িয়ে আছে দু’জনে। কিন্তু অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছে না। আর মনে হলো সময়গুলো হয়ে গেল ভীষণ দীর্ঘ। মিনিট যেতে লাগল ঘণ্টার মতো করে। অবশেষে কথা বলল আক্কারস।

 ‘আহ্! এই তো পেয়েছি তোমাকে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। খিকখিক করে হাসতে লাগল আক্কারস।

হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনি বেড়ে গেল ডেবরার। যতটা কাছে ভেবেছিল তার চেয়ে কাছে দাঁড়িয়ে আছে আক্কারস। আরেকটু হলেই আবারো দৌড় লাগাতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু মনের গভীরে কেউ একজন আশ্বস্ত করল যেন।

‘এই তো দেখতে পাচ্ছি তুমি লুকিয়ে আছে। আবার বলে উঠল আক্কারস। আমার কাছে বড়সড় একটা ছুরি আছে। এখনি ধরে জবাই করে ফেলবো দাঁড়াও।

কুলকুল করে কাঁপতে লাগল ডেবরা। আতঙ্কিত হয়ে শুনতে লাগল আক্কারস কথা। এরপর হঠাৎ করেই বুঝতে পারল যে ও এখনো নিরাপদ। আক্কারস তাকে এখনো দেখেনি। রাতের অন্ধকারে ঢেকে আছে ডেবরা। ঘন গাছপালার আবরণ থাকাতেও তাকে দেখতে পাচ্ছে না আক্কারস। লোকটা তাকে ভয় দেখাতে চাইছে শুধুমাত্র। চাইছে আবারো দৌড়াতে শুরু করলেই ধরে ফেলবে ডেবরাকে। তাই মনোযোগ দিয়ে একেবারে স্থির পাথরের মতো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ডেবরা।

আবারো চুপ করে রইল আক্কারস। শিকারির মতো ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। আবারো কাটতে লাগল মিনিটের পর মিনিট।

ব্লাডারের চাপে মনে হল কেউ গরম লোহা চেপে ধরেছে। চিৎকার করে কেঁদে উঠতে মন চাইল ডেবরার। এর সাথে আরেক যন্ত্রণা, চটচটে আঠালো কিছু একটা হাতের উপর দিয়ে উঠে আসছে। চামড়ার উপর হাজারো পায়ের সিড়সিড়ানি অনুভূতিতে মনে হলো আতঙ্কে মরেই যাবে সে। কিন্তু তারপরেও এতটুকু নড়লো না।

জিনিসটা মাকড়সা বা বিছা যাই হোক না কেন, গলার কাছে উঠে এলো। বুঝতে পারল যে কোন মুহূর্তে সব ভুলে গিয়ে চিৎকার করে উঠবে সে।

হঠাৎ আবারো চিৎকার করে উঠল আক্কারস- “ঠিক আছে। আমি গিয়ে একটা ফ্লাশ লাইট নিয়ে আসছি। দেখবো কত দূরে যেতে পারো। শীঘ্রিই ফিরে আসব আমি। ভেব না বৃদ্ধ আক্কারসকে কাবু করতে পারবে তুমি। তুমি শিখতে পারবে না এরকম হাজারো কৌশল জানা আছে আমার।’

শব্দ করে সরে গেল আক্কারস। ডেবরা চাইল তৎক্ষণাৎ গাল থেকে পোকাটাকে ফেলে দৌড় লাগাতে। কিন্তু আবারো কেউ একজন মনের গহীনে ফিসফিস করে বলে উঠল, সবকিছু ঠিক আছে, তুমি শান্ত হও। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করল ডেবরা। এরপর দশ। পোকাটা পৌঁছে গেল তার চুলে।

আবারো অন্ধকারে ঠিক তার পাশেই চিৎকার করে উঠল আক্কারস। ঠিক আছে?’ বেশি চালাক হয়েছিস তাই না শয়তানী দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা। এবার সত্যি চলে গেল আক্কারস।

চুল থেকে ঝেড়ে পোকাটাকে ফেলে দিল ডেবরা। ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। এরপর আস্তে আস্তে হাঁটা ধরল আরো বনের ভেতরে। আঙুলগুলো শক্ত হয়ে গেছে ঠাণ্ডায় আর জোর করে কাপড় ধরে রাখায়। হাত ছেড়ে তলপেটের ভারমুক্ত হল ডেবরা।

 আবারো উঠে দাঁড়াল। অনুভব করল পেটের মাঝে নড়ে উঠল তার সন্তান। এর সাথে জেগে উঠল মাসুলভ সব বোধগুলো। নিরাপদ স্থানে সরে যাবার তাগিদ অনুভব করল ডেবরা। নিজের সন্তানকে অবশ্যই নিরাপত্তা দিতে হবে। কিছু হতে দেবে না সে। চিন্তা করল পুলের পাশে গিয়ে লুকিয়ে থাকবে।

 কিন্তু কীভাবে যাবে? পুরোপুরি পথ হারিয়ে ফেলেছে সে। এরপর মনে পড়ল ডেভিড বলেছিল বাতাসের কথা। পশ্চিম দিক থেকে বয় বৃষ্টির বাতাস। এখন খানিক হালকা হয়েছে বাতাসের গতি। অপেক্ষা করল গালের উপর আবার কখন স্পর্শ পাওয়া যায়। তাহলে পথ পেয়ে যাবে সে। তাই হলো, দিকনিদের্শনা পেল সে। ঘুরে দাঁড়িয়ে দুই হাত পাশে ছড়িয়ে দিল। আবারো হাঁটা শুরু করল। শুধুমাত্র পুলের কাছে পৌঁছাতে পারলেই লুকানো তীরে যেতে পারবে।

কিন্তু সাইক্লোনের বাতাস ঝড়ের মতো করে দিক পরিবর্তন করতে লাগল অথচ বিশ্বস্ততার সাথে এর পিছুপিছু যেতে লাগল ডেবরা। ফলে জঙ্গলের মধ্যে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগল শুধু।

জাবুলানির আলোকিত রাস্তা ধরে ঘরের মধ্যে ঝড়ের বেগে ঢুকলো আক্কারস। খোলা ড্রয়ার ধরে টান দিল, লাখি মারতে লাগল আটকানোগুলোতে।

ডেভিডের অফিসে বন্দুকের কেবিনেট খুঁজে পেল। চাবির জন্য হাতড়াতে লাগল ভোয়গুলো। কিছুই না পেয়ে হতাশায় দাঁত কিড়মিড় করতে লাগল।

এ রুম থেকে গেল বিল্ট ইন কার্বাড ইউনিটে। ডজনখানেক প্যাকেট করা শটগান শেল আর ইলেকট্রিক লণ্ঠন আছে একটা। তাড়াতাড়ি লণ্ঠন তুলে সুইচ জ্বালালো। সাদা আলো বের হল–খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল আক্কারস।

আবারো দৌড়ে গেল রান্নাঘরে। কাটলারি ড্রয়ার খুলে লম্বা বাঁকানো ছুরি নিল একটা, স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে তৈরি। তারপর তাড়াহুড়া করে উঠান পার হয়ে গেইটের দিকে ছুটল।

লণ্ঠনের আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল ভেজা মাটিতে ডেবরার পায়ের ছাপ। পাশাপাশি নিজের পায়ের ছাপও দেখতে পেল আক্কারস। অনুসরণ করে গেল সে। যেখানে বসে মূত্রত্যাগ করেছে খুঁজে পেল সে জায়গাও।

‘চালাকের হাড়ি কোথাকার। বিড়বিড় করে উঠল আক্কারস। বনের গভীরেও অনুসরণ করে চলল ডেবরাকে। পরিষ্কার ছাপ আর চিহ্ন রেখে গেছে ডেবরা। বৃষ্টিস্নাত ঘাসের বুকে। গাছের গায়ে থেকে পানি মুছে গেছে ডেবরার হাতের চাপে। শিকারির চোখে এ পরিষ্কার চিহ্ন ভুল হবার কথা নয়।

প্রতি মিনিট অন্তর অন্তর থেমে দাঁড়িয়ে লণ্ঠন বাড়িয়ে নিজের সামনের অংশও দেখে নিচ্ছে আক্কারস। শিকারি সুলভ উত্তেজনা জেগে উঠল। আদিম এই বোধটুকুই এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে তাকে। প্রথমবার ব্যর্থ হওয়ায় এবার আরো বেশি উত্তেজনা বোধ করছে সে।

সাবধানে এগোতে লাগল সে। বিশাল একটা চক্রাকারে ঘুরতে লাগল ডেবরার উদ্দেশ্যহীন পায়ের ছাপ।

আবারো থেমে গেল আক্কারস! খাদের মাথাগুলো পরীক্ষা করে দেখল লণ্ঠন বাড়িয়ে। দেখতে পেল আলোর শেষ মাথায় গোলগোল কিছু একটা ছুটে গেল।

আলো ধরে রাখল এটার উপর। দেখতে পেল পাণ্ডুর আতঙ্কিত এক মুখ আস্তে আস্তে দ্বিধাভরা পায়ে সামনে এগোচ্ছে। মনে হল ঘুমের ঘোরে হাঁটছে। ডেবরা। হাত দুটো সামনে বাড়ানো।

সরাসরি আক্কারসের দিকে এগিয়ে আসছে মেয়েটা। আলোর মাঝে ধরা পড়ে গেছে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। একবার থেমে নিজের পেটে হাত বুলিয়ে ভয়ের চোটে ফোঁপাতে লাগল।

পায়ের ট্রাউজার ভিজে গেছে বৃষ্টির পানিতে। জুতা এরই মাঝে ছিঁড়ে একাকার। যতই কাছে এলো আক্কাস দেখল হাত আর ঠোঁট নীল হয়ে গেছে ঠাণ্ডায়।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে ডেবরাকে দেখতে লাগল আক্কারস। মনে হল মুরগি দেখে সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে আছে একটা কোবরা।

কাধ জুড়ে নেমে গেছে ভেজা দড়ির মতো কালো চুল, মুখেও লেপ্টে আছে কিছু। পাতলা ব্লাউজটাও গাছের গায়ে থেকে পানি পড়ে ভিজে গেছে। পুরো কাপড় লেপ্টে আছে পর্বতপ্রমাণ পেটের উপর।

মেয়েটাকে আরো কাছে আসতে দিল আক্কারস। উত্তেজনায় মনে হল ফেটে পড়বে এত সহজে তাক হাতে পাওয়ায়। অবশেষে প্রতিশোধ নিতে পারবে সে। প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতে চায় সে।

মাত্র পাঁচ কদম দূরে থাকতেই ডেবরার ঠিক মুখের উপর আলো ফেলল আক্কারস। খিকখিক করে হাসতে লাগল।

চিৎকার করে উঠল ডেবরা। পুরো মুখ বিকৃত হয়ে উঠল। বন্য পশুর মতো ঘুরে দাঁড়িয়েই অন্ধের মতো দৌড় লাগাল, বিশ কদম সামনে গিয়ে পা বেঁধে পড়ে গেল মারুলা গাছের শিকড়ের সাথে।

 পড়ে গিয়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। হাত বুলাতে লাগল গালের ক্ষতে।

হাচোড়-পাচোড় করে আবারো উঠে দাঁড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। শুনতে চাইল পরবর্তী শব্দ।

নিঃশব্দে ডেবরার চারপাশে ঘুরে ঘুরে কাছে এগিয়ে গেল আক্কারস। তারপর ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আবারো খিকখিক করতে লাগল।

আবারো চিৎকার করে উঠে দৌড়াতে লাগল ডেবরা। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে গেল পিপড়ার গর্তে পা দিয়ে। সশব্দে মাটির উপর আছাড় খেল। শুয়ে ফোঁপাতে লাগল বেচারা।

অলসভাবে হেলেদুলে তার কাছে এগিয়ে গেল আক্কারস গত দুই বছরের মাঝে এই প্রথমবার বেশ আনন্দ হচ্ছে তার। বিড়ালে মতো পুরো ব্যাপারটাকে এত তাড়াতাড়ি শেষ করতে চায় না সে। বহুক্ষণ ধরে খেলাতে চায়।

 ডেবরার গায়ের উপর গিয়ে উচ্চারণ করল কুৎসিত সব শব্দ। তৎক্ষণাৎ আবার উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়াতে শুরু করল ডেবরা। পেছন থেকে ছুটতে লাগল আক্কারসও। মনে পড়ে গেল তার শিকার করা হাজারো জন্তুর কথা।

.

রাস্তার ভেজার নরম মাটির উপর দিয়ে খালি পায়ে দৌড়াতে লাগল ডেভিড। নিজের ব্যথা প্রায় ভুলেই গেল। এমনকি হৃৎপিণ্ডের নিস্তেজ ভাব বা ফুসফুসের জ্বলুনিও টের পেল না।

পাহাড়ের গায়ে ঘুরে গেল পথ। ঘরের কাছে এসে থেমে দাঁড়াল। হাপাতে হাপাতে তাকিয়ে রইল বাড়ি উজ্জ্বল করে জুলতে থাকা আলোর দিকে। জাবুলানির বাগান ভেসে যাচ্ছে আলোর বন্যায়। এ সময় ফ্লাডলাইট জ্বলার কোন কারণ নেই। নতুন করে সর্তক ঘণ্টা বেজে উঠল মনের মাঝে। পাহাড়ের গা বেয়ে লাফিয়ে নামাতে লাগল।

শূন্য, তছনছ হওয়া ঘরের মাঝে ডেবরার নাম ধরে ডাকতে লাগল ডেভিড। কিন্তু নিজের শব্দের প্রতিধ্বনি শুনল কেবল।

 সামনের বারান্দায় পৌঁছে কিছু একটা দেখতে পেল। অন্ধকারে নড়ছে কিছু একটা।

 ‘জুলু! সামনে দৌড়ে গেল ডেভিড, ‘হিয়ার বয়! হিয়ারডেবরা কোথায়?

সিঁড়ি দিয়ে ঘসটে ঘসটে উঠে এল জুলু। বোঝা গেল অনেক আঘাত পেয়েছে কুকুরটা। মাথার একপাশে ভারী কিছুর বাড়ি খাওয়ায় চোয়াল ভেঙ্গে গেছে। অথবা জায়গা থেকে সরে গেছে। তাই হাস্যকরভাবে ঝুলছে এটা। নিস্তেজ হয়ে আছে জুলু।

হাঁটু গেড়ে বসল ডেভিড। ডেবরা কোথায় জুলু, কোথায়?

কুকুরটা মনে হল চেষ্টা করছে নিজেকে প্রকাশ করতে। কোথায় সে বয়? ও ঘরে নেই। কোথায় তাহলে? ফাইন্ড হার বয়! ফাইন্ড হার। আকুতি জানাল ডেভিড।

উঠানে কুকুরটাকে ফেলে এল ডেভিড। কিন্তু তার পিছুপিছু ঘুরতে লাগল জুলু। পিছনের দরজায় ভেজা মাটির গন্ধ পেল কুকুরটা। ফ্লাডলাইটের আলোয় পায়ের চিহ্ন দেখতে পেল ডেভিড। ডেবরার আর তার পিছনে বড় বড় পুরুষালী পা।

উঠানে গেল জুলু। নিজের অফিসে গেল ডেভিড। লণ্ঠন নেই। কিন্তু পিছনে পাঁচ ব্যাটারীর ফ্লাশ লাইট আছে। পকেটে ভরে নিল ডেভিড। হাত ভর্তি করে নিল শটগান শেল। এরপর তাড়াতাড়ি করে গান কেবিনেটে গিয়ে খুলে ফেলল তালা। পার্ডে শট গান হাতে নিয়েই দৌড়াতে দৌড়াতে লোড করতে লাগল।

 গেইটের বাইরের রাস্তা ধরে হেঁচড়ে হেঁচড়ে এগিয়ে যাচ্ছে জুলু। কুকুরটার পেছনে ছুটল ডেভিড।

.

জোহান আক্কারস আর মানুষ রইল না। পশু হয়ে উঠল। শিকারের দৌড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে শিকারির সুলভ মনোভাব চাঙ্গা হয়ে উঠল। পেছনে দৌড়ে গিয়ে খুন করো। ক্ষত-বিক্ষত আহত শিকার নিয়ে খেলতে লাগল সে, যতক্ষণ পর্যন্ত ইচ্ছে তাড়া করে বেড়াবে মেয়েটাকে তারপর নিজের খুশিমতো খুন করবে।

অবশেষে এলো এই মাহেন্দ্রক্ষণ শিকারের সমস্ত নিয়ম মেনে খেলছে সে প্রতিটি খেলার নির্দিষ্ট সময় আছে। বিদায় ঘণ্টা বাজার–আক্কারস বুঝতে পারল শেষ করার সময় এসেছে।

 ছুটন্ত দেহের পিছনে চলে এলো সে। হাত বাড়িয়ে মুঠি দিয়ে কব্জিতে পেঁচিয়ে মাথা পেছনে টেনে ধরল। পাণ্ডুর গলা উন্মুক্ত হয়ে গেল ছুরি বসানোর জন্য।

কিন্তু সমান শক্তি আর হিংস্রতা নিয়ে আক্কারসের দিকে ফিরে তাকাল ডেবরা। এতটা আশা করেনি আক্কারস। ভেজা শক্ত শরীর নিয়ে তার উপর আক্রমণ করল ডেবরা। বাঁচার জন্য মরীয়া এখন সে।

প্রস্তুত ছিল না আক্কারস। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। ডেবরাকে বুকের উপর নিয়ে পিছনে আছাড় খেল। ছুরি ফেলে দিল হাত থেকে। চোখ বাঁচাতে লণ্ঠন তুলে ধরল মুখের উপর। তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে খোঁচা দিতে চাইছে ডেবরা। নাক আর গালে ঢুকে গেল নখ। বিড়ালের মতো আঁচড় কাটতে লাগল ডেবরা। এই মুহূর্তে ওকেও দেখতে পশুর মতোই মনে হচ্ছে।

হাত থেকে চুলের মুঠি ছেড়ে দিল আক্কারস। ডান হাতে চেপে ধরলো ডেবরাকে আঘাত করল। কাঠের কুঠারের মতো ভীষণ ভারী আর শক্ত সে আঘাত। এর একটি আঘাতেই নিস্তেজ হয়ে গেছে ল্যাব্রাডর জুলু। চোয়াল ভেঙ্গে গেছে কুকুরটার। ডেবরার মাথার উপর মারলো আক্কারস। এমন শব্দ হল মনে হল গাছের গুঁড়ির গায়ে কোদালের কোপ পড়ল। সব শক্তি শেষ হয়ে গেল মেয়েটার। হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়ল। সুস্থ হাতে ডেবরাকে ধরে রেখে অন্য হাতে একের পর এক তাকে মারতে লাগল আক্কারস। নির্দয় সেই মারের চোটে কালো রক্ত ছিটকে বের হল নাক থেকে। খুলির উপর উপযুপরী আঘাত করতে লাগল আক্কারস। ডেবরা একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ার পরেও থামলো না সে। নিজের স্বাদ মিটিয়ে মারার পর উঠে দাঁড়াল। পড়ে রইল ডেবরা। হেঁটে গিয়ে লণ্ঠন হাতে তুলে নিল আক্কারস। চকচক করে উঠল ছুরির ফল। প্রাচীন একটি পদ্ধতি আছে যার মাধ্যমে এ শিকারযজ্ঞ শেষ করতে চায় আক্কারস।

জোহান আক্কারস হাতে তুলে নিল লণ্ঠন। এরপর এমন ভাবে রাখল যেন আলো পড়ে ডেবরার উপর। হাতে তুলে নিল ছুরি।

ডেবরার কাছে এগিয়ে গিয়ে পা দিয়ে গড়িয়ে দিল নিস্তেজ শরীরটাকে। ঘুরে গেল ডেবরা। মুখের উপর লেপ্টে গেল ভেজা চুলের রাশি।

 হাঁটু গেটে তার পাশে বসল আক্কারস। ব্লাউজের সামনে ঢুকিয়ে দিল বজ্র কটিন হাত। একটানে খুলে ফেলল। লণ্ঠনের আলো ভেসে উঠল স্ফীত উদর সাদা পেটের মাঝে শিশু পুরোপুরি ভাবে প্রস্তুত পৃথিবীত আসার জন্য। কালো বিন্দুর মতো দেখা গেল নাভি।

খিকখিক করে হেসে হাত দিয়ে চেহারা থেকে মুছে ফেলল ঘাম আর বৃষ্টির ফোঁটা। এর ছুরি ধরা হাতে তৈরি হল। ঘুরিয়ে নিল ফলা। ইনটেস্টিন না কেটে পাঁজর পর্যন্ত নামিয়ে আনা ছুরির মাথা। একজন সার্জনের মতো দক্ষ হয়ে উঠেছে এ কাজে সে। এর আগে না হলেও দশ হাজার বার করেছে একই কাজ।

 আলোর কিনারে ছায়া পড়ায় চোখ তুলে তাকাল আক্কারস। দেখতে পেল নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে কালো একটা কুকুর। লণ্ঠনের আলোয় ধকধক করে জ্বলছে চোখ।

তাড়তাড়ি হাত দিয়ে গলায় হাত দিতেই লোমশ শরীর ঝাঁপ দিয়ে পড়ল তার উপর। একসাথে গড়াগড়ি খেতে লাগল জুলু আর আকারস। আহত চোয়ালে সুবিধা করতে পারছে না জুলু।

আবারো হাতের মুঠোয় ছুরির দিক পরিবর্তন করল। আক্কারস জুলুর পাজরে খোঁচা দিল। প্রথম বারেই পেয়ে গেল হৃৎপিণ্ড। একবার নড়ে উঠেই নিস্তেজ হয়ে গেল জুলু। ধাক্কা দিয়ে একপাশে ফেলে দিল জুলুকে আক্কারস। ছুরি বের করে হামাগুড়ি দিয়ে এগোল ডেবরার কাছে।

জুলু এসে পড়ায় আক্কারস মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। এই ফাঁকে পৌঁছে গেছে ডেভিড।

 আক্কারসের দিকে দৌড় দিল সে। লণ্ঠনের আলোয় কাদার মতো রঙের চোখ জোড়া নিয়ে তাকাল আক্কারস। হাতে জুলুর রক্ত লেগে থাকা লম্বা ফলার ছুরি নিয়ে গর্জন করে উঠল। পায়ের উপর উঠে দাঁড়াতে লাগল। ঠিক পুরুষ বেবুনের মতো করে মাথা ঝাঁকাতে লাগল হিংস্র ভাবে।

ঠিক আক্কারসের মুখের উপর জোড়া ব্যারেলের শটগান ধরে ট্রিগার টেপে দিল ডেভিড। সলিড ভাবে উড়ে গিয়ে আঘাত করল শেল। কোন দিক না ছড়িয়ে সোজা ছিটকে বের হল থকথকে হলুদ পদার্থ। আক্কারসর পুরো মাথা পেছন দিকে হেলে গেল। পা জোড়া দিয়ে এলোমেলো ভাবে লাথি মারতে মারতে মাটিতে শুয়ে পড়ল আক্কারস। একপাশে শটগান ছুঁড়ে ফেলেই ডেবরার দিকে দৌড় দিল ডেভিড।

ডেবরার উপর উপুর হয়ে ফিসফিস করে উঠল, ‘মাই ডার্লিং, ওই মাই ডার্লিং, প্লিজ ক্ষমা করো। তোমাকে একা রেখে যাওয়া উচিৎ হয়নি আমার। আস্তে করে সাবধানে তুলে নিয়ে বুকের কাছে ধরল স্ত্রীকে। এরপর নিয়ে গেল ঘরে।

ভোরের দিকে জন্মগ্রহণ করল ডেবরার সন্তান। সময়ের আগেই এসেছে ছোট্ট কন্যাশিশু। দক্ষ চিকিৎসকের সহায়তা পেলে হয়তো বাঁচতে শিশুটি। কিন্তু এ ব্যাপারে পুরোপুরি অনভিজ্ঞ ডেভিড। উন্মত্ত নদী সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে তাদেরকে আর টেলিফোন তখনো মৃত। ডেবরারও জ্ঞান ফিরেনি।

 সবকিছু শেষ হয়ে যাবার পর ছোট্ট নীল শরীরটাকে পরিষ্কার শিটে জড়িয়ে তার জন্যে তৈরি দোলনায় শুইয়ে দেয়া হল। তাকে যাদের দরকার তাদের জন্য কিছু করতে না পেরে-বিবশ বোধ করতে লাগল ডেভিড।

সেই দিন দুপুর তিনটায় নিজের বিশাল ট্রাকের চাকার উপরেও পানি এমন অবস্থায় চলে এল জোর করে গাড়ি চালিয়ে। তিন ঘণ্টা পরে নেলট হাসপাতালের প্রাইভেট ওয়ার্ডে ভর্তি করা হল ডেবরাকে। দুই দিন পর জ্ঞান ফিরল তার। কিন্তু মুখটা ভয়ানকভাবে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পাণ্ডুর বর্ণ ধারণ করেছে।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *