ডেভিডের বিপরীত প্রান্তে তাকিয়ে রইল জো। আরও তিন চারজন পাইলট নিজেদের চেয়ার টেনে এনে টেবিলের পাশে বসে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। ডেভিড আর জোর মাঝে দাবা খেলা প্রায় পৌরাণিক কাহিনীর সমতুল্য। হয়ে গেছে অন্যদের কাছে। সবাই তাই বেশ আগ্রহ নিয়েই তাকিয়ে আছে।
প্রায় আধডজন চাল দিয়ে জোর রুককে আটকে ফেলেছে ডেভিড। আর দু’বার চাল দিলেই ভেঙে যাবে রাজার প্রতিরক্ষাব্যুহ। তৃতীয় চালে নির্ঘাৎ পরাজয়। হাসতে লাগল ডেভিড। সিদ্ধান্ত নিয়ে নাইটকে বের করে আনল জো।
মাত্র এইটুকুতেই তুমি বাঁচতে পারবে না ডিয়ার। নাইটের দিকে প্রায় তাকালই না ডেভিড। রুককে আবারো আঘাত করল সাদা বিশপ দিয়ে।
কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। দেখতে পেল নাটকীয় ভাবে জোর মুখ থেকে উধাও হয়ে গেল দুঃশ্চিতার রেখা। হোসেফ মোরদেসাই এতক্ষণ কৌশল করেছে প্রতিপক্ষকে ফাঁদে ফেলার জন্য। তাড়াতাড়ি সতর্ক চোখে নাইটের দিকে তাকাল ডেভিড। বুঝতে পারল জোর দুর্গ পুরোপুরি অক্ষত। ওহ’ দেখেছো কতবড় চালাক। গুঙ্গিয়ে উটলো ডেভিড।
‘চেক!’ হাসিমুখে ঘোষণা করল জো। সৈন্যদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে পড়ল ডেভিডের রানী।
‘চেক!’ বোর্ড থেকে সাদা রানী তুলে নিল জো। সাথে সাথে নড়বড়ে রাজা আর সামনের খোলা পথ বেছে নিল পালাবার জন্যে।
‘অ্যান্ড মেট। পেছন দিক থেকে আক্রমণে ছুটলো তার রানী। হাততালি দিয়ে হেসে উঠল উপস্থিত দর্শকেরা। ডেভিডের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো জো।
‘আবার?’ জিজ্ঞেস করতেই মাথা নাড়ল ডেভিড।
অন্যদের কাউকে ডেকে নাও। আমি এক ঘণ্টার জন্য বাইরে যাচ্ছি। নিজের আসন খালি করে উঠে দাঁড়াল ডেভিড। বোর্ড আবার নতুন করে সাজালো জো। হেঁটে কফি মেশিনের কাছে গেল ডেভিড। জি স্যুট পরণে থাকায় আড়ষ্ট হলো চলা-ফেরা। কালো ঘন তরলে চার চামচ চিনি নিয়ে কু রুমের কোণার দিকে শান্ত একটা অংশ গিয়ে বসল।
একই টেবিলে বসে আছে কোঁকড়ানো চুলের পাতলা শরীরের একজন কিবুজনিক ছেলে। ডেভিডের সাথে ইতিমধ্যেই খানিকটা সখ্যতা গড়ে উঠেছে ছেলেটার। মোটাসোটা একটা উপন্যাস পড়ছে বসে বসে।
‘শালোম, রবার্ট কেমন আছো?
বই থেকে চোখ না তুলেই হাঁ সূচক মাথা নাড়ল রবার্ট। মিষ্টি গরম কফিতে চুমুক দিল ডেভিড। তার পাশে নিজের আসনে বসে অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসল রবার্ট। আস্তে করে কাশলো। নিজের ভাবনায় ডুবে গেল ডেভিড। এত মাসের মাঝে প্রথমবারের মতো মনে পড়লো নিজের বাড়ির কথা। ভাবতে লাগল মিউজি আর বানি ভেন্টারের কথা। মনে পড়ল এই সিজনে ফলস বেতে ইয়ালো টেইল চলছে কিনা। কে জানে কেমন আছে হিল্ডারবার্গে প্রোটিয়ারা।
নিজের চেয়ারে বসে আবারো উসখুস করে উঠল রবার্ট। গলা পরিষ্কার করল কেঁশে নিয়ে। তার দিকে তাকাল ডেভিড। বুঝতে পারল বেশ আবেগ আপুত হয়ে পড়েছে ছেলেটা। ঠোঁট দুটো কাঁপছে, চোখ দুটোও বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।
কী পড়ছো তুমি? অবাক হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে ‘টাইটেলে চোখ বোলালো ডেভিড। বইয়ের গায়ে লাগানো ধুলার জ্যাকেটের ছবিটা তৎক্ষণাৎ চিনতে পারল। খুব মনেযোগ দিয়ে দেখা একটি মরুভূমির ল্যান্ডস্কেপ। ভয়ঙ্কর সব রঙ আর বিশাল ভূমি। দুটি শরীর নারী আর পুরুষ, মরুভূমির মাঝ দিয়ে হেঁটে চলেছে হাতে হাত রেখে; পুরো আবহটাই বেশ রহস্যময়। ঝিম ধরা। ডেভিড বুঝতে পারলো কেবল একজনই এটা আঁকতে পারে ইলা কাঁদেশ।
বইটা নিচু করল বরার্ট। অদ্ভুত!’ আবেগে থরথর করছে ওর গলা। আমি তোমাকে বলছি ডেভি। একটা অসাধারণ। এত সুন্দর বই খুব কমই লেখা হয়েছে।
কেমন করে কী যেন টের পেল ডেভিড। পুরোপুরি নিশ্চয়তার ভার নিয়ে রবার্টের হাত থেকে নিল বই। চোখ রাখল টাইটেলে, ‘আ প্লেস অব আওয়ার ওন।’
তখনো কথা বলে চলেছে রবার্ট। আমার বোন আমাকে বলেছে এটা পড়তে। প্রকাশকের হয়ে কাজ করে সে। এটা পড়ে পুরো রাত কেঁদেছে। আমার বোন। একদম নতুন বই। মাত্র গত সপ্তাহেই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু নির্ঘাৎ এদেশে লেখা সবচেয়ে অসাধারণ বইগুলোর মাঝে একটি হতে যাচ্ছে এটি।’
মনে হলো কিছু শুনতেই পেল না ডেভিড। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। টাইটেলের নিচে ছোট করে লেখা লেখকের নামের দিকে।
‘ডেবরা মোরদেসাই।
আলতো করে বইয়ের মোড়কের গায়ে অক্ষরের উপর হাত বুলালো ডেভিড।
‘আমি এটা পড়তে চাই।’ বলে উঠল আস্তে করে।
‘আমার শেষ হলেই তোমাকে দেবো আমি। প্রতিজ্ঞা করল রবার্ট।
“আমি এখনি পড়তে চাই!
“উঁহু হবে না। প্রায় আতঙ্কিত হয়ে ডেভিডের কাছ থেকে বইটা কেড়ে নিল রবার্ট।
‘তোমার সময়ের জন্য অপেক্ষা করো কমরেড। জানিয়ে দিল সে।
চোখ তুলে তাকাল ডেভিড। রুমের ওপাশ থেকে তাকিয়ে আছে জো। অভিযোগের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল ডেভিড। তাড়াতাড়ি দাবা বোর্ডের দিকে চোখ নামিয়ে নিল জো। ডেভিড বুঝতে পারল বইয়ের কথা জানে জো। উঠে দাঁড়াল ওর কাছে যাবে বলে। গিয়ে কারণ জানতে চাইবে ওকে না জানাবার কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বাঙ্কারে বেজে উঠল সাইরেন।
ল্যান্স স্কোয়াড্রনের ‘রেড স্ট্যান্ডবাই-এর সবাই। রেডিনেস বোর্ডে বিভিন্ন পদবীর পাশে লাল আলো জ্বলে উঠল।
ব্রাইট ল্যান্স।
‘রেড ল্যান্স।
ফায়ার ল্যান্স।’
নিজের ফ্লাইং হেলমেট ছো করে তুলে জি স্যুট পরিহিত ছুটতে থাকা শরীরগুলোর সাথে ছুটলো ডেভিড। কু-রুমের দরজার বাইরে কংক্রিটের টানেলে থাকা ইলেকট্রিক পার্সোনেল ক্যারিয়ারের উদ্দেশে ছুটছে সবাই। ঠেলেঠুলে তুলে জোর পাশে গিয়ে দাঁড়াল ডেভিড।
‘আমাকে বলনি কেন?’ জানতে চাইল জোর কাছে।
‘আমি বলতেই যাচ্ছিলাম, সত্যি।
হ্যাঁ। বুঝতে পেরেছি আমি।’ বিদ্রুপের স্বরে উত্তর দিল ডেভিড। ‘পড়েছো তুমি?
মাথা নাড়ল জো। আবারও জানতে চাইল ডেভিড, কী সম্পর্কে?
‘আমি তোমাকে বলব না। তুমি নিজেই পড়ো।
‘এটা নিয়ে ভেব না।’ বিড়বিড় করে উত্তর দিল ডেভিড। আমি পড়বো।’
হ্যাঙ্গারে পৌঁছে লাফ দিয়ে নিচে নেমেই ছুটলো মিরেজের দিকে।
বিশ মিনিটের মাঝে আকাশে উঠে পড়ল সবাই। তড়িঘড়ি আদেশ পাঠাল মরুর ফুল, যেন ভূমধ্যসাগরে ইন্টারস্পেশনে অংশ নেয় তারা। একটা এল আল ক্যারাভেল থেকে মে ডে কল এসেছে। তার পিছু নিয়েছে। মিশরীয় মিগ ২১ জে।
মিরেজ বহর আসতে দেখে পিছু হটে উপকূলের দিকে চলে গেল মিশরীয় মিগ। এয়ারলাইনারকে নিরাপত্তার চাদরে ঘিরে ফেলল মিরেজ বহর। বেসে ফিরে আসার আগে পাহারা দিয়ে লডে পৌঁছে দিয়ে এলো।
জি স্যুট আর ওভারঅল পরা অবস্থাতেই লে ডফিনের অফিসের সামনে থামলো ডেভিড। জোগাড় করে নিল চব্বিশ ঘণ্টার পাশ।
বন্ধ হবার মাত্র দশ মিনিট আগে পৌঁছালো জাফো রোডের একটা বুক স্টোরে।
দোকানের মাঝখানের টেবিলে পিরামিড আকৃতিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে আ প্লেস অব আওয়ার ওয়ন।
‘অসাধারণ একটা বই। প্যাকেটে ভরতে গিয়ে জানাল সেলসগার্ল।
.
গোল্ডস্টার খুলে জুতা ছুঁড়ে ফেলে বিছানার লেইস কাভারের উপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল ডেভিড।
শুরু করল পড়া। শুধুমাত্র একবার বিরতি দিয়ে মাথার উপরের বাতি জ্বালিয়ে আরেকটা বিয়ার নিয়ে এলো। বইটা বেশ মোটাসোটা। ধীরে ধীরে পড়তে লাগল ডেভিড- প্রতিটি শব্দ আলাদা করে, মাঝে মাঝে একই অংশ দু’বার পড়ল।
এটা তাদের দুজনের কাহিনী। ডেবরা আর তার। শুরু হয়েছে। কোস্টাব্রাভার দ্বীপ থেকে। চমৎকার ভাবে উঠে এসেছে এ ভূমি আর মানুষের কথা। দ্বিতীয় সারির অনেক চরিত্রকে চিনতে পারল ডেভিড। জোরে জোরে প্রাণ খুলে হাসল মজার আর আনন্দের অংশগুলোতে। সব শেষে দুঃখের ভারে মনে হলো গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে এলো। গল্পের মেয়েটা মারা যাচ্ছে হাদ্দাসা হাসপাতালে। সন্ত্রাসীদের বোমার আঘাতে নষ্ট হয়ে গেছে তার অর্ধেক চেহারা। মেয়েটা চায় না ছেলেটা তার কাছে আসুক। শুধু চায় জীবিত অবস্থায় সে যেমন ছিল তেমন স্মৃতিই থাকুক ছেলেটার মনের মাঝে।
ভোর হয়ে এসেছে। কোথা দিয়ে রাত কেটে গেল টেরই পেল না ডেভিড। উঠে দাঁড়াল বিছানা থেকে। ঘুম হয়নি তাই মাথা পুরোপুরি হালকা। বিস্মিত হয়ে ভাবল ডেবরা কত সুন্দরভাবে তুলে এনেছে সবকিছু। ডেভিডের ভেতরটা কত গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে সে। এত সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছে অনুভূতিগুলো যে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
গোসল করে, শেভ সেরে আটপৌরে পোশাক পরে নিল ডেভিড। এরপর আবার এলো বিছানার উপর বইটার কাছে। মোড়ক পরীক্ষা করে নিশ্চিত হবার জন্য পাতা উল্টালো। যা ভেবেছিল তাই। প্রচ্ছদ ডিজাইনে ইলা কাঁদেশ।’
এত সকালবেলা রাস্তা পুরো খালি। খুব দ্রুত গাড়ি চালাতে লাগল ডেভিড। সূর্য মাত্র উঠি উঠি করছে। জেরিখো গিয়ে উত্তর দিকে ঘুরে সীমান্তের রাস্তায় চলতে লাগল গাড়ি। মনে পড়লো আগেরবার তার পাশে বসে ছিল ডেবরা।
মার্সিডিজের গায়ে বাতাসের ঝাপটা যেন বলতে লাগল তাড়াতাড়ি করো, তাড়াতাড়ি করো।’ টায়ারের ঘর্ষণ নিয়ে এলো লেকের উপর।
প্রাচীন ক্রুসেডার দেয়ালের পাশে গাড়ি পার্ক করল ডেডিভ। লেকের তীরে বাগানের মধ্য দিয়ে হাঁটা শুরু করল।
চওড়া বারান্দায় নিজের ইজেলের সামনে বসে আছে ইলা। মাথায় পরে আছে প্রায় একটা ওয়াগন হুইলের মতো বড় স্ট্র হ্যাট। প্লাস্টিকের চেরী আর অস্ট্রিচের পাখা গোজা তাতে। এত বড় ওভারঅল পরে আছে যে দেখাচ্ছে সার্কাসের তাঁবুর মতো। আর সবকিছুর উপরে পড়ে আছে শুকনো ছোপ ছোপ রঙ।
শান্তভাবে ব্রাশ থামিয়ে চোখ তুলে তাকাল ইলা।
‘জয় হো হো তরুণ দেবতা। অভিবাদন জানাল ইলা। ভালই হলো দেখা হয়ে, কিন্তু আমার ছোট্ট অঙ্গিনায় পদধূলির কারণটা বলবে?
‘থামো ইলা, তুমি ভালই জানো আমি কেন এসেছি।’
‘ভালোই বলেছো। বুঝতে পারল কথা এড়িয়ে যাচ্ছে ইলা। উজ্জ্বল চোখে পরিষ্কার ফুটে উঠল দুষ্টুমি। এত সুন্দর ঠোঁট জোড়াতে কঠোর কথা মানায় না। বীয়ার খাবে, ডেভি?
না আমি বীয়ার চাই না। আমি জানতে চাই ও কোথায়?
‘কার কথা বলছি আমরা?
‘কাম অন, আমি বইটা পড়েছি। কাভার দেখেছি। ধুত্তোরি তুমি জানো আমি কার কথা বলছি।
একটুক্ষণ চুপচাপ থেকে ডেভিডের দিকে তাকাল ইলা। আস্তে করে জানাল,
‘হ্যাঁ। আমি জানি। একমত হলো ইলা।
‘আমাকে বলো কোথায় আছে ও?
‘এটা আমি করতে পারব না ডেভি। তুমি আর আমি দু’জনেই প্রমিজ করেছি। হ্যাঁ আমি তোমারটা জানি।
ইলা দেখল কেমন স্থবির হয়ে পড়ল ডেভিড। উদ্ধত স্বভাবের সুন্দর তরুণ দেহ কেমন শীতল হয়ে ঝুলে পড়ল। সূর্যের আলোয় অনিশ্চিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল ডেভিড।
‘বিয়ারের চিন্তাটা কেমন মনে হয়, ডেভি? ফুল থেকে নিজের পাহাড় প্রমাণ শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়াল ইলা। ছাদের দিকে গেল। ফিরে এসে লম্বা একটা গ্লাস ধরিয়ে দিল ডেভিডের হাতে। ছাদের শেষপ্রান্তে তেমন বাতাস নেই এরকম একটা জায়গায় একসাথে বসল দু’জনে। শীতের নরম রোদ এসে পড়ল গায়ে।
‘এক সপ্তাহ ধরে তোমার অপেক্ষা করছি আমি। বইটা প্রকাশিত হবার পর থেকে। আমি জানি দৌড়ে চলে আসবে তুমি-অসাধারণ হয়েছে। এমনকি আমি নিজেও অনেকদিন কেঁদেছি নষ্ট হয়ে যাওয়া কলের মতো। লজ্জিত স্বরে জানাল ইলা। তুমি নিশ্চয় ভাবতেও পারছে না যে এমনটা হতে পারে তাই না?
‘এটা আমাদের বই–ডেবরা আর আমার।’ জানাল ডেভিড। ও আমাদের কথা লিখেছে।
‘হ্যাঁ, একমত হলো ইলা। কিন্তু এতে সিদ্ধান্ত বদলায়নি। যে সিদ্ধান্তটা আমার মনে হয় ঠিক আছে।
‘আমার নিজের কথাই বর্ণনা করেছে সে, ইলা। যা কিছু আমি অনুভব করতাম এবং এখনো করি কিন্তু যা কখনো ভাষায় বলতে পারতাম না।’
‘এটা বেশ সুন্দর আর সত্যি। কিন্তু কেন বুঝতে পারছে না যে এতে ওর সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়েছে।
কিন্তু আমি ওকে ভালোবাসি। ইলা আর ও আমাকে। চিৎকার করে উঠল ডেভিড।
‘ও চায় এনভাবেই সব ঘটুক। ও চায় না সব শেষ হয়ে যাক। ও চায় না সব নষ্ট হয়ে যাক।আবারো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ডেভিড। কিন্তু শক্ত হাতে তাকে থামিয়ে দিল ইলা। ও জানে আর কখনোই তোমার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারবে না। নিজের দিকে তাকাও ডেভিড, তুমি এখনো তরুণ আর প্রাণশক্তিতে ভরপুর ও তোমাকে পিছনে ধরে রাখবে আর কোন এক সময় বিরক্ত হয়ে উঠবে তুমি।
আবারো বাধা দিতে চাইল ডেভিড। কিন্তু বিশাল মুঠি দিয়ে হাত চেপে ধরল ইলা। তুমি শিকলে বাঁধা পড়ে যাবে, কখনো ছেড়ে যেতে পারবে না ওকে। ও অসহায়। তোমার সারা জীবনের বোজা হয়ে যাবে ও–চিন্তা করো ডেভিড।’
‘আমি ওকে চাই।’ জেদী স্বরে বিড়বিড় করে উঠল ডেভিড। ওর সাথে দেখা হবার আগে কিছুই ছিল না আমার জীবনে আর এখনো নেই।
‘আস্তে আস্তে বদলে যাবে সব। হতে পারে ও তোমাকে কিছু শিখিয়েছে। তরতাজা অনুভূতি তরুণ বয়সের মতোই হারিয়ে যায়। ও চায় তুমি খুশি হও, ডেভিড। ও তোমাকে এতটাই ভালোবাসে যে মুক্তিই তোমাকে উপহার দিয়েছে। ও তোমাকে এতটাই ভালোবাসে যে তোমার খাতিরে এটুকুও ছেড়ে দিতে রাজি সে।’
‘ওহ গড।’ গুঙ্গিয়ে উঠল ডেভিড। যদি একবার তাকে দেখতে পেতাম। ছুঁতে পেতাম কয়েক মিনিট কথা বলতে পারতাম।
বিশাল ধড় নাড়াতে লাগল ইলা। ঝনঝন করে উঠল সব গহনা।
‘ও এতে একমত হবে না কিছুতেই।
‘কেন ইলা আমাকে বল কেন?’ আবারো গলা চড়ালো ডেভিড।
‘ও ততটা শক্ত নয়। জানে যে তুমি কাছে গেলে ও ভেঙ্গে পড়বে আর দু’জনের জন্য আরো বড় কোন বিপর্যয় ডেকে আনবে।’
এরপর পাশাপাশি চুপচাপ বসে রইল দু’জনে। তাকিয়ে রইল লেকের দিকে। গোলান হাইটসের উপর দিয়ে উঠে গেছে মেঘের সারি, শীতের রোদ পড়ে আরো সাদা হয়ে ভাসছে। নীল আর ধূসরের ছায়া মেখে উড়ে আসছে লেকের উপরে। ছাদের ওপাশ থেকে একঝলক ঠাণ্ডা বাতাসে খানিকটা কেঁপে উঠল ডেভিড।
নিজের অবশিষ্ট বীয়ার শেষ করল সে। আস্তে আস্তে আঙুল দিয়ে হাতের মাঝে ঘুরাতে লাগল গ্লাস।
‘আমি যদি কোন মেসেজ দেই, ওকে পৌঁছে দেবে প্লিজ?
‘আমার মনে হয় না’
‘প্লিজ ইলা, শুধু এই মেসেজটা।
মাথা নাড়ল ইলা।
‘ওকে বলো ও বইতে যতটা লিখেছে ঠিক ততটাই ভালোবাসি আমি ওকে। ওকে বলো যে এর উপরে ওঠাটাই যথেষ্ট হয়েছে। ওকে বলল যে আমি অন্তত একবারের জন্য চেষ্টা করার সুযোগ চাই।
চুপচাপ ডেভিডের কথা শুনল ইলা। মনে হলো শব্দের সন্ধানে বাতাসে হাত বাড়ালো ডেভিড, যা বললে রাজি হবে ডেবরা।
‘ওকে বলে’ থেমে গিয়ে মাথা নাড়ল। না এতটুকুই হবে। শুধু বলল যে আমি ওকে ভালোবাসি আর ওর সাথেই থাকতে চাই।’
ঠিক আছে ডেভিড আমি বলব ওকে।
আর আমাকে জানাবে ওর উত্তর?
‘কোথায় পাবো তোমাকে?’ ক্রু রেডি রুমের নাম্বার ইলাকে দিল ডেভিড।
‘আমাকে তাড়াতাড়ি ফোন করবে ইলা। অপেক্ষায় রেখো না।
আগামীকাল। প্রতিজ্ঞা করল ইলা।
সকালবেলা।
দশটা বাজার আগে। দশটা বাজার আগেই জানিয়ো।’
উঠে দাঁড়াল ডেভিড। তারপর হঠাৎ করেই সামনে ঝুঁকে কোঁচকানো চামড়ায় গালে চুমু খেলো।
‘ধন্যবাদ।’ জানিয়ে দিল ডেভিড।
‘তুমি ততটা খারাপ পুরাতন কোন ব্যাগ নও।’
‘ধূর হও আমার সামনে থেকে। চারপাশ থেকে ওডেসি ধেয়ে আসছে তোমার দিকে। আস্তে করে নাক টানলো ইলা। আমার মনে হচ্ছে আমি কান্না করে দেবো। আমি একা রেখে এ মুহূর্ত টুকু উপভোগ করতে চাই।’
খেজুর আর তাল গাছের নিচে লন পার হয়ে ডেভিডকে চলে যেতে দেখল ইলা। দেয়ালের গেইটের কাছে গিয়ে থেমে ফিরে তাকাল ডেভিড। এক সেকেন্ডের জন্য একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থেকে বের হয়ে গেল ডেভিড।
সে শুনতে পেল মার্সিডিজের ইঞ্জিন গর্জে উঠে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল দূরে। এরপর হাইওয়েতে উঠতেই চলে গেল। দক্ষিণে ছুটে চলল তীরের মতো। ভারী মন নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ছাদ থেকে নামল ইলা। জেটির দিকে চলে যাবার জন্য নিচে নামল।
ঘাটে নোঙ্গর বাঁধা অবস্থায় দুলছে স্পিডবোট। এটাতে চড়ে ওপাশের সবচেয়ে বড় আর দূরের বোটহাউজে গিয়ে খোলা দরজায় দাঁড়াল ইলা।
ভেতরটা নতুন করে রঙ করে পুরো সাদা বানিয়ে ফেলা হয়েছে। আসবাবপত্রগুলোর সাধারণ আর সংখ্যায় কম। পাথরের মেঝেতে ঠাণ্ডা ভাব কাটানোর জন্য পাতা হয়েছে মাদুর। পুরোপুরি উল দিয়ে বোনা, মোটা আর ঘন। ফায়ারপ্লেসের পাশে পর্দা ঘেরা অংশে রাখা হয়েছে বিশাল বিছানা।
বিপরীত পাশের দেয়ালে একটা গ্যাস স্টোভ রাখা। ডাবল কুকিং রিং লাগানো। আমার বেশ কয়েকটা রান্নার পাত্র ঝোলানো আছে দেখা যাচ্ছে। ভেতরের দিকে একটি দরজা দিয়ে বাথরুমে যেতে হয়। মাত্র কয়েকদিন আগেই এগুলো বানিয়েছে ইলা।
মালিক স্ট্রিটের বাসা থেকে আনা একমাত্র আসবাব ইলা কাদেশের আঁকা ছবিটা সাদা দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দরজার দিকে মুখ করে। মনে হলো এতেই আলোকিত হয়ে উঠেছে সারা রুম। এর নিচে ওয়ার্কিং টেবিলে বসে আছে একটা মেয়ে। টেপ রেকর্ডার থেকে নিজের গলায় হিব্রুতে কিছু একটা শুনছে তন্ময় হয়ে। শূন্য অভিব্যক্তি নিয়ে পুরো মনোযোগ দিয়ে সামনের সাদা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে।
মাথা নাড়ল। যা শুনল, হাসল। বন্ধ করে দিল রেকর্ডার। সুইভেল চেয়ার ঘুরিয়ে দ্বিতীয় রেকর্ডারের দিকে ফিরল। চাপ দিল ট্রান্সমিট বোতামে। মুখের কাছে ধরল মাইক্রোফোন। অনুবাদ করা শুরু করল হিব্রু থেকে ইংরেজিতে।
দরজার কাছে এসে দাঁড়াল ইলা। দেখতে লাগল মেয়েটার কাজকর্ম। একজন আমেকিান প্রকাশক ইংরেজি স্বত্ব কিনে নিয়েছে। বইটার জন্য ডেবরাকে অগ্রিম ত্রিশ হাজার আমেরিকান ডলার দিয়েছে। আর বাড়তি পাঁচ হাজার ডলার অনুবাদের জন্য। কাজটা প্রায় শেষ করে এনেছে সে।
যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে ডেবরার মাথায় ক্ষতচিহ্ন দেখতে পাচ্ছে ইলা। মুখের তামাটে চামড়ার তুলনায় জায়গাটা সাদা গোলাপি হয়ে আছে। মনে হলো ছোট কোন শিশু এঁকে রেখেছে উড়ন্ত সি-গালের ছবি। ভি আকারের দাগটা তুষার কণার চেয়ে তেমন বড় নয়। মনে হলো এতে মেয়েটার সৌন্দর্য আরো বেড়ে গেছে। প্রায় একটা বিউটি স্পটের মতো।
এটা ঢাকার কোন চেষ্টাই করেনি সে। কালো চুলগুলো ঘাড়ের পেছনে টানটান করে বাঁধা। চামড়ার ফিরে দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। কোন মেকআপ নেয়নি মেয়েটা তারপরেও মুখের চামড়া দেখাচ্ছে পরিষ্কার, উজ্জ্বল, টানটান আর মসৃণ।
ফিশারম্যানদের বিশাল জার্সি আর উলের স্ন্যাক্স থাকা সত্ত্বেও দেহ দেখাচ্ছে দৃঢ় আর কৃশকায়। প্রতিদিন নিয়ম করে সাঁতার কাটে মেয়েটা। এমনকি উত্তরে ঠাণ্ডা বাতাসও তাকে থামাতে পারে না।
দরজা পার হয়ে নিঃশব্দে ডেস্কের কাছাকাছি গেল ইলা। তাকিয়ে থাকল ডেবরার চোখে। যা সে প্রায়ই করে। কোন একদিন এই ছবিটা আঁকবে সে। বাইরে থেকে আঘাতের কোন চিহ্নই নেই। কিছুতেই বোঝা যায় না যে মেয়েটা দেখতে পায় না। উপরন্তু অনিন্দ্যসুন্দর চোখ দুটো দেখে মনে হয় যে সবকিছু গভীর পর্যন্ত দেখতে পায় ওদুটো। এতটাই স্বচ্ছ চোখ দুটো যে রহস্যময় মনে হয় এই প্রশান্ত ভাব। এই গভীরতা আর সবকিছু বুঝে নেবার ভাবটাকে মেন অদ্ভুত মনে হয় ইলার কাছে।
মাইক্রোফোনের সুইচ অফ করল ডেবরা। রেকর্ডিং বন্ধ করে মাথা না ঘুরিয়েই বলে উঠল,
‘ইলা, এসেছো তুমি?
‘কেমন করে এটা করো তুমি? বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল ইলা।
‘তুমি হাঁটার সময় বাতাসে তার শব্দ পাই আমি আর তারপর তোমার গন্ধ।
‘ঝড় তোলার মতো যথেষ্ট বড়সড় আমি। কিন্তু আমার গায়ের গন্ধ কী এতটাই বাজে?’ কিড়মিড় শব্দে অভিযোগ জানাল ইলা।
‘তোমার গা থেকে তারপিন, রসুন আর বীয়ারের গন্ধ আসে। নাক টেনে হাসল ডেবরা।
‘আমি ছবি আঁকছিলাম। রোস্টের জন্য রসুন কেটেছি আর একজন বন্ধুর সাথে বীয়ারও পান করেছি। একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল ইলা। বইয়ের কাজ কতদূর হয়েছে?
‘প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আগামীকাল টাইপিস্টের কাছে যেতে পারবে। কফি খাবে?’ উঠে দাঁড়িয়ে গ্যাস ষ্টোভের কাছে গেল ডেবরা। ইলা জানে সাহায্য করতে চাইলে কী ঘটবে। প্রতিবার আগুন আর গরম পানির কাছে ডেবরাকে যেতে দেখলে দাঁত ঠকঠক করতে থাকে ইলা। মেয়েটা ভয়াবহ রকমের স্বাধীনচেতা। অন্য কারো সাহায্য আর সহানুভূতি চায় না কিছুতেই।
ঠিকঠিক ভাবে সাজানো আছে রুমটা। প্রতিটি জিনিস জায়গামত রাখা আছে যেন ডেবরা হাত দেয়ার সাথে সাথে জিনিসটি পেয়ে যায়। নিজের এই ছোট্ট দুনিয়ায় নিঃসংকোচে চলাফেরা করে ডেবরা। স্বচ্ছন্দে নিজের কাজ করে, নিজের খাবার নিজেই তৈরি করে, মাথা উঁচু করে নিজের মতো বাঁচতে শিখে গেছে মেয়েটা।
সপ্তাহে একবার, জেরুজালেমে প্রকাশকের অফিস থেকে ড্রাইভার এসে ডেবরার লেখা আর টেপ নিয়ে যায়।
এছাড়াও সপ্তাহে একবার ইলার সাথে স্পিডবোটে করে লেকের ওপারে টিবেরিসে যায় ডেবরা। একসাথে কেনাকাটা সারে দু’জনে আর প্রতিদিন পাথরের জেটিতে একঘণ্টা সাঁতার কাটে। প্রায়ই একজন পুরোন জেলে যার সাথে ইতিমধ্যেই বেশ সখ্যতা জমে গেছে ডেবরার, এসে ওকে নিয়ে যায়। তারপর দুজনে মিলে মাছ ধরে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যায় ডেবরাকে।
জেটির পাশে থাকা লনে, ক্রুসেডের প্রাসাদে আছে ইলার বন্ধুত্ব আর বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা আর এখানে নিজের ছোট্ট কুটিরে আছে নৈঃশব্দ আর নিরাপত্তা, দীর্ঘকালব্যাপী করার জন্য কাজ। রাতে সঙ্গ দেয় একাকিত্ব আর নিঃশব্দ কান্না। একমাত্র বালিশটা ভিজে নকশা হয়ে যায়, যার কারণ একমাত্র জানে ডেবরা।
ইলার চেয়ারের পাশে এক মগ কফি রেখে দিল ডেবরা। নিজের কফি নিয়ে বসলো বেঞ্চে।
এখন বল’, বলে উঠল ডেবরা।
‘নিজের চেয়ারে এরকম আড়ষ্ট হয়ে বসে আছো কেন? চেয়ারের হাতলে আঙুল কৈছো। ইলার দিকে তাকিয়ে হাসল ডেবরা। বুঝতে পারল অবাক হয়েছে ইলা।
‘আমাকে কিছু একটা বলতে চাও তুমি। তাই না?
‘হ্যাঁ।’ একটু চুপ করে থেকে উত্তর দিল ইলা। হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছো। ডিয়ার’ লম্বা শ্বাস নিয়ে আবার বলে উঠল। ও এসেছিল ডেবরা। আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। যেমনটা ভেবেছিলাম আমরাও।
টেবিলের উপর মগ নামিয়ে রাখল ডেবরা। একটুও হাত কাঁপল না, মুখে কোন ভাব ফুটলো না।
‘আমি ওকে বলিনি তুমি কোথায় আছো।
‘ও কেমন আছে ইলা? কেমন দেখাচ্ছিল ওকে?’
‘শুকিয়ে গেছে, খানিকটা। আমার মনে হয়েছে আর শেষবার যেমন দেখেছিলাম তার তুলনায় বিবর্ণ দেখাচ্ছিল। কিন্তু এটাও মানিয়ে গেছে তাকে। ও এখনো আমার দেখা সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ।
‘ওর চুল’, জানতে চাইল ডেবরা।
‘হ্যাঁ, আমার তাই মনে হয়েছে। নরম, ঘন আর গাঢ় রঙের। কানের পাশে বেশি। পিছনে কোকড়া।
মাথা নেড়ে হাসল ডেবরা। ভাল লাগল শুনে যে ও চুল কাটেনি। দু’জনেই আবার চুপচাপ হয়ে গেল। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলে উঠল ডেবরা, কী বলেছে ও? কী চায়?
‘তোমাকে একটা মেসেজ দিয়েছে।
‘কী?
পুরোপুরি ডেভিডের ভাষায় হুবহু বলে গেল ইলা। শেষ করার পর নিজের ডেস্কের সামনের দেয়ালের দিকে ঘুরে তাকাল ডেবরা।
‘প্লিজ এখন যাও, ইলা। আমি একটু একা থাকতে চাই।’
ও আমাকে বলেছে তোমার উত্তর জানাতে। আমি ওর কাছে প্রমিজ করেছি যে আগামীকাল সকালে ওকে ফোন করব।’
‘আমি পরে যাবো তোমার কাছে কিন্তু এখন আমাকে একটু একা থাকতে দাও প্লিজ। ইলা দেখল উজ্জ্বল অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ল ডেবরার বাদামী গালের উপর।
চলমান পাহাড়ের মতো উঠে দাঁড়াল ইলা। চলে গেল দরজার কাছে। পেছনে শুনতে পেল কান্নার শব্দ, কিন্তু তাকাল না সে। পাথরের জেটি পার হয়ে ছাদে উঠে গেল। নিজের ক্যানভাসের সামনে বসে হাতে তুলে নিল ব্রাশ। শুরু করল ছবি আঁকা। বড় বড় আঁচড়ে ফুটে উঠল রাগ আর নিষ্ঠুরতা।
নিজের প্রেশার স্যুটের ভেতর ঘেমে নেয়ে উঠল ডেভিড। উদ্বিগ্ন মুখে অপেক্ষা করছে টেলিফোনের পাশে। কু-রুমের দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির প্রতিটি কাটা অনুসরণ করছে চোখ দিয়ে।
দশটার দিকে সে আর জো চলে যাবে রেড স্ট্যান্ডবাই হিসেবে হাই অলটিচড়ে হাতে মাত্র সাত মিনিট সময় আছে আর। এখনো ফোন করেনি ইলা।
হতাশায় ছেয়ে গেল ডেভিডের মন। বুকের মাঝে জমে উঠল রাগ আর ক্ষোভ। ইলা প্রতিজ্ঞা করেছিল দশটার আগেই ফোন করবে।
কাম অন, ডেভি। দরজার কাছ থেকে ডেকে উঠল জো। ভারী মন নিয়ে উঠে দাঁড়াল ডেভিড। জোর পিছন পিছন চলল ইলেকট্রিক ক্যারিয়ারের দিকে। জোর পাশের আসনে উঠে বসতেই শুনতে পেল কু-রুমের ফোন বেজে উঠল।
‘দাঁড়াও।’ ড্রাইভারকে থামিয়ে দিল ডেভিড। দেখতে পেল রবার্ট ফোন তুলে কথা বলছে আর কাঁচের প্যানেলের মাঝ দিয়ে হাত নেড়ে ওকে ডাকছে।
‘তোমার ফোন ডেভি। দৌড়ে কু-রুমে গেল ডেভিড।
‘আমি দুঃখিত, ডেভিড। বহুদূর থেকে যেন ভেসে এলো ইলার কণ্ঠস্বর।
‘আমি অনেকক্ষণ থেকে চেষ্টা করছি। কিন্তু এখানকার এক্সচেঞ্জ
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। ইলাকে থামিয়ে দিল ডেভিড। এখনো রেগে আছে সে।
কথা বলেছিলে ওর সাথে?
‘হ্যাঁ ডেভিড। বলেছি। তোমার মেসেজ দিয়েছি ওকে।
কী উত্তর দিয়েছে ও?’ তাড়াতাড়ি জানতে চাইলো ডেভিড।
‘কোন উত্তরই দেয়নি।
‘এসব কী ইলা! নিশ্চয় বলেছে কিছু একটা।
‘ও বলেছে’ দ্বিধায় ভুগছে ইলা,
–আর এগুলোই ওর শব্দ–”মৃত কেউ জীবিতের সাথে কথা বলতে পারে না। ডেভিডের জন্য আমি এক বছর আগেই মৃত্যুবরণ করেছি।”
দুই হাত দিয়ে রিসিভার আঁকড়ে ধরল ডেভিড। তারপরও কাঁপতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে আবারো কথা বলে উঠল ইলা।
‘তুমি এখনো লাইনে আছো?
হাঁ, ফিসফিস করে উত্তর দিল ডেভিড।’ ‘আমি আছি এখানে।
আবারো চুপ করে গেল দুজনে। অবশেষে কথা বলল ডেভিড।
‘তো তাহলে এটাই।
হ্যাঁ। আমার বলতে ভয় লাগছে যে এটুকুই সব, ডেভি।
দরজার ওপাশ থেকে কাঁচের ভিতর দিয়ে মাথায় টোকা দিল জো।
‘অ্যাই ডেভি। শেষ করো এবার। সময় হয়ে গেছে চলো।’
‘আমাকে যেতে হবে, ইলা। ধন্যবাদ, যা করেছে সব কিছুর জন্য।’
‘গুড বাই, ডেভিড। ফোন রেখে দেবার পরেও ইলার কণ্ঠের সহানুভূতির ভাষা কানে বাজতে লাগল ডেভিডের। মিরেজের বাঙ্কারে জোর পাশের সিটে বসে মনে পড়ল আগুনে ঘি পড়ল। ধা ধা করে মাথায় চড়ে গেল রাগ।
জীবনে প্রথমবারের মতো মিরেজের ককপিটে বসেও শান্তি পেল না সে। ফাঁদে আটকা পড়া জন্তুর মতো হাসফাস করতে লাগল। রাগের চোটে ঘামতে লাগল দরদর করে। আর প্রতিটি পনের মিনিটের প্রস্তুতিপর্ব মনে পড়ল ঘণ্টার চেয়েও দীর্ঘ।
নিচে গ্রাউন্ড ক্রুরা খেলা করছিল। ডেভিড দেখতে পেল তারা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসছে, মজা করছে। তদের খুশি দেখে রাগে মনে হলো অন্ধ হয়ে যাবে ডেভিড।
‘মাথা মোটা গর্দভের দল! মাইক্রোফোনে চিৎকার করে উঠল ডেভিড। মাথার উপরে থাকা লাউড স্পিকারে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল শব্দগুলো। ল্যান্স স্কোয়াড্রনের চীফ ইঞ্জিনিয়ার তাড়াহুড়ো করে ককপিটে তার পাশে উঠে তাকিয়ে রইল। আমার স্ক্রিনে ধুলা পড়েছে। হাত দিয়ে ইশারা করল ডেভিড। ‘তুমি কেমন করে ভাবলে যে তোমার ব্রেকফাস্টের নোংরা লেগে আছে এমন একটা স্ক্রিন নিয়ে আমি মিগ চালাব।’
ডেভিডের এহেন আচরণের কারণ ছোট্ট একটু কার্বন কণা যেটা ক্যানোপির চকচকে ভাবকে খানিকটা ধোঁয়াশা করেছে। চীফ ইঞ্জিনিয়ার তাবি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পরিষ্কার করল সবকিছু।
কিন্তু ডেভিড়ের মতো টপ বয়ের পক্ষে ব্যাপারটা বেশ অশোভন হয়ে গেল। হাঁ হয়ে গেল সবাই। যাই হোক, রেড স্ট্যান্ডবাইয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে জানে সবাই। তাই এর পাইলটদের নার্ভ সম্পর্কেও সচেতন সবাই।
“ঠিক আছে।’ ডেভিড বুঝতে পারল খানিকটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সে। নিচে নেমে যাবার আগে হাসল তাবি।
ঠিক সেই মুহূর্তে ইয়ারফোনে ক্লিক শব্দের সাথে সাথে শোনা গেল ব্রিগের কণ্ঠ। “রেড” স্ট্যান্ডবাই, যাও! গো!
পুরোপুরি মনোযোগ ঢেলে দিয়ে উত্তর দিল ডেভিড, হ্যালো, মরুর ফুল, ব্রাইট ল্যান্স, এয়ারবরণ অ্যান্ড ক্লাইম্বিং।
‘হ্যালো, ডেভিড। ব্রিগ বলছি। আমাদের আকাশসীমায় অনধিকার প্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে কেউ। মনে হচ্ছে আরেকটা সিরিয়ান। ছাব্বিশ হাজারে আমাদের সীমান্তের কাছাকাছি আসছে আর প্রায় তিন মিনিট লাগবে। আমরা গিডন প্ল্যানে অ্যাটাক করব। তোমার নতুন হেডিং ৪২° আর আমি চাই তুমি ডেকের ডান পাশে থাকবে।’
মাথা নেড়ে তৎক্ষণাৎ ঘুরে মিরেজের নাক নিচে নামিয়ে দিল ডেভিড। গিডন প্ল্যান মানে হলো অনেক নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া। ফলে শত্রুর রাডার খানিকটা অস্পষ্ট কাজ করবে পৃথিবীর উপরিভাগের নোংরা’র জন্য। ফলে একেবারে টার্গেটের নিচে স্টর্ম ক্লাইম্ব করার আগপর্যন্ত তাদের অস্তিত্ব বোঝা যাবে না।
প্রায় মাটির কাছাকাছি নেমে এলো ডেভিড। পাহাড়ের উপর দিয়ে ওঠানামা করতে করতে এগোচ্ছে। এতটাই নিচু দিয়ে যে স্পষ্ট দেখা গেল কালো পারসীয় জাতের ভেড়া। ভয় পেয়ে পূর্ব দিকে জর্দানের দিকে দৌড় লাগাল ভেড়াগুলো।
‘হ্যালো ব্রাইট ল্যান্স, মরুর ফুল বলছি-আমরা তোমাকে ট্র্যাক করছি না। ভালোই হলো। মনে মনে ভাবল ডেভিড। তার মানে, শত্রুও তার দেখা পাচ্ছে না। টার্গেট খানিকটা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। কো-অর্ডিনেট জানিয়ে দিল ব্রিগ–’নিজের কনট্যাক্ট স্ক্যান করো।’
প্রায় সাথে সাথে কথা বলে উঠল জো। লিডার, আমি টু বলছি। দেখতে পেয়েছি।’
নিজের রাডার স্ক্রিনে চোখ নামালো ডেভিড। জোর কথা মতো রেঞ্জ আর বিয়ারিং মিলিয়ে দেখল। এতটা নিচু দিয়ে উড়ে যাবার সময় এরকম মনোসংযোগে ব্যাঘাত হয়ে উঠতে পারে অত্যন্ত বিপজ্জনক। যাই হোক স্পষ্ট দেখতে পেল ডেভিড নিজেও।
আরো কয়েক সেকেন্ড উড়ে গেল তারা। এরপরই নিজের লুমিনাস চশমা তুলে নিল ডেভিড।
‘পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। রেঞ্জ ৯৬ নটিক্যাল মাইল। সমান তালে এগিয়ে আসছে। উচ্চতা ২৫৫০০ ফুট।
নিজের অতি পরিচিত রাগের দেখা পেল ডেভিড। মনে হলো পেটের ভেতর নড়াচড়া শুরু করল কুণ্ডুলি পাকিয়ে ঘুমিয়ে থাকা সাপ।
‘টু, টার্গেট ল করেছি। ইন্টারসেপ শন স্পিডে ছুটে যাচ্ছি।’
সুপারসনিক গতিতে ছুটে চলল মিরেজ। সামনে অনিন্দ্যসুন্দর পর্বতমালার সারি রূপালি আর ধূসর বর্ণ নিয়ে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে চাইলে যে কোন কিছু কল্পনা করে নেয়া যায় সুউচ্চ কোন টাওয়ার, গর্বিত কোন মানব শরীরের উদ্ধত ভঙ্গি, দাবার বোর্ডের ঘোড়া সওয়ার, একপাল নেকড়ে, এরকম আরো বহু কিছু–তাদের মাঝে গভীর খাদগুলোতে ব্রিজ তৈরি করেছে রঙিন রংধনু। শত শত আছে এমন। হরেক রকমের রং, যেন পিছু ধাওয়া করল মিরেজের। এর অনেক উপরে অসহ্য রকমের নীল হয়ে আছে আকাশ। দ্রুত ধাবমান যুদ্ধপ্লেনের উপর চমকাচ্ছে সূর্যের আলো। এখানে টার্গেটের দেখা পাওয়া গেল না। তার মানে উপরে পর্বতের মেঘের ভাঁজে লুকিয়ে আছে। আবারো রাডার স্ক্রিনে তাকাল ডেভিড। স্ক্যান থেকে রাডার বের করে টার্গেটের উপর লক করল। আর যত এগিয়ে আসছে অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হচ্ছে সে।
তাদের সমান্তরালে উড়ছে টার্গেট প্লেন। স্টারবোর্ড সাইড থেকে বিশ মাইল সামনে। তাদের অনেক উপরে তাদের গতির অর্ধেকের খানিকটা বেশি, গতি নিয়ে উড়ে যাচ্ছে। টার্গেটের পেছন দিকে সূর্য। আক্রমণের হিসেব কষতে লাগল ডেভিড।
‘স্টারবোর্ডের দিকে ঘুরে যাচ্ছি।’ জোকে সতর্ক করে দিল ডেভিড। পাশাপাশি চলে এলো দু’জনে। রেঞ্জ আর বিয়ারিং বলে চলল জো। বোঝ গেল এটা হেলেদুলে পেট্রোলে বের হয়েছে। খোশমেজাজে টহলদারি করছে। ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে পেটের নিচে শিকারির অস্তিত্ব সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই তার।
টু, দিস ইজ লিডার। সার্কিটে অস্ত্র ভরে নাও।
রাডার স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়েই উইপন কনসেলের মাস্টার সুইচে চাপ দিল ডেভিড। চালু করল এয়ার টু-এয়ার সাইড উইন্ডার মিসাইল, প্রতিটি পাখার নিচে ঝুলে আছে এগুলো। আর সাথে সাথে ইয়ারফোন শুনতে পেল নরম স্বরে হিসহিস শব্দ শুরু হলো। এর মানে মিসাইলগুলো এখন সুবোধ বালক হয়ে আছে কোন রকম ইনফ্রারেড জাতীয় রশ্মির দেখা পায়নি এখনো। পাবার সাথে সাথে শব্দ বেড়ে যাবে, গরগর করতে করতে ঘুরতে শুরু করবে। শিকারি কুকুরের মতো লম্ফঝম্ফ শুরু করে দেবে। ভলিউম কমিয়ে দিল ডেভিড, যেন তার নিজের কান ঝালাপালা হবার হাত থেকে বেঁচে যায়।
এরপর কামানের সুইচ সিলেক্ট করল ডেভিড। ঠিক তার সিটের নিচে রাখা জোড়া ৩০ এমএম অস্ত্রকে নিজ নিজ পড়ে প্রস্তুত করে রাখল। জয়স্টিকের মাথায় রাখা ট্রিগার আগে বাড়লো। আঙুল দিয়ে স্পর্শ করল ডেভিড।
‘টু, দিস ইজ লিডার। আমি সামনে বাড়ছি। এটা জোর জন্য সতর্কতা। এর মানে হলো জো যেন তার পুরো মনোসংযোগ রাডার স্ক্রিনে ঢেলে দেয় আর ডেভিডকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করে।
টার্গেট এখন দশটার ঘরে। রেঞ্জ ২-৭ নটিক্যাল মাইল।
সতর্কতার সাথে তল্লাশি শুরু করল ডেভিড। চারপাশে খোঁজা শেষ করে পৃথিবী পৃষ্ঠের কোন উঁচু মাথা অথবা মেঝের ভেতরেও নাক ঢুকিয়ে দিল। যেন শিকারি নিজেই না আবার শিকার বনে যায়।
এরপরই দেখতে পেল তাদের। হঠাৎ করেই অনেক উপরে মেঝের মাঝ থেকে বের হয়ে এলো পাঁচটি প্লেন। আর সাথে সাথে নিজ পরিপাটি চাদরের মতো সমান্তরাল হয়ে গেল। তখনি আবার রেঞ্জ জানিয়ে দিল জো।
১-৩ নটিক্যাল মাইল।’ কিন্তু টার্গেটের অডিটলাইন এতটাই তরতাজা যে কোন সন্দেহই রইল না যে দলটা মিগ ২১ জে।
‘টার্গেট দেখতে পেয়েছি আমি।’ জোকে জানিয়ে দিল ডেভিড। পাঁচটা মিগ ২১ জে। সাদামাটা কণ্ঠে ঘোষণা করল ডেভিড। কিন্তু এটা মিথ্যে হলো। অন্তত এবার তার বোবা রাগ ভাষা খুঁজে পেল। আকার আর রং বদলে হয়ে গেল কালো থেকে উজ্জ্বল আর ছুরির মতো তীক্ষ্ণ।
‘টার্গেট এখনো আক্রমণাত্মক। জো নিশ্চিত করল যে ওগুলো এখনো ইস্রায়েলি ভূমিতে আছে। কিন্তু ডেভিডের মতো নিরুত্তাপ শোনাল না ওর গলা। ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে ডেভিড বুঝে গেল জোর মনের মাঝেও ঝড় বইছে।
আরো পনের সেকেন্ড পরে শত্রুর পশ্চাদদেশে ঘুরে যাবে তারা। অবস্থানটুকু চিহ্নিত করে ডেভিড তাকিয় দেখল যে সামনে ভালো জায়গা রয়েছে এর জন্য।
শান্তভাবে এগিয়ে চলেছে শত্রু প্লেনবহর। লেজের নিজে বিপদ সম্পর্কে পুরোপুরি অন্ধকারে আছে এখনো। সামনের স্ক্যানিং রাডারে কোন অস্তিত্বই নেই। ডেভিড বা জোর সূর্যের দিকে এগিয়ে চলেছে দলটা। ওখানে পৌঁছে ডেভিডও আক্রমণে নামবে। খাড়া উঠে গিয়ে শক্রর বহরের গায়ে আঘাত করবে। সামনের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল যে এক্ষেত্রে ভাগ্যও তাকে সহায়তার জন্যে এগিয়ে এসেছে। বিশাল উঁচু একটা মেঘ এমনভাবে এগিয়ে আসছে যে তার আড়ালে ঢাকা পড়ে ভালোভাবেই লাফ দিতে পারবে ডেভিড। নিজেকে কাভার করে এগোবে সে, ঠিক যেমনভাবে আফ্রিকার বোয়া শিকারিরা বন্য ষাড় নিয়ে লড়াই করে।
‘টার্গেট ফোর্স বদল করছে স্টার বোর্ডের দিকে। সাবধান করে দিল জো। সামনের দিকে ঘুরে যাচ্ছে মিগের বহর। সিরিয়ান সীমান্তে ধার ঘেঁষে চলতে শুরু করল। নিজেদের কাজ শেষ করেছে। অবিশ্বাসীদের মুখে ইসলামের রঙের ছিটে মেরেছে। এখন ফিরে যাচ্ছে নিরাপত্তা বলয়ে।
নিজের ভেতর ঠাণ্ডা রাগের ছোঁয়া পেল ডেভিড। মনোযোগ হয়ে উঠল আরো তীক্ষ্ণ। লাফ দেবার আগে আরো কয়েক সেকেন্ড সময় নিল। তারপর এসে পড়ল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। গলার স্বর একটুও কাঁপল না। ডেকে উঠল জো। কে ‘টু লিডার বলছি, ক্লাইম্ব দিতে যাচ্ছি।’
‘টু কনফর্মিং।
কন্ট্রোলে হালকা হয়ে বসল ডেভিড। আর এত দ্রুত প্লেন লাফ দিল যে মনে হলো পেট থেকে পশ্চাৎদেশ আলাদা হয়ে যাবে। প্রায় তৎক্ষণাৎ রাডার ইমেজ দেখতে পেল মরুর ফুল। যেহেতু ডেভিড প্লেন নিয়ে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উপরে উঠে গেল।
হ্যালো, ব্রাইট ল্যান্স। আমরা তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। বন্ধু বা শত্রুকে দেখাও।
ডেভিড আর জো দু’জনেরই বসে স্টার্ম-ক্লাইম্বের চাপ সহ্য করছে। কিন্তু নির্দেশ পেয়ে নিজেদের আইএফএফ সিস্টেম চালু করতেও ভুলল না। আইডেন্টিফিকেশন ফ্রেন্ড অর ফো এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে তাদের চারপাশের রাডার ইমেজ যে কোন গড়ন আলাদা আলাদা ভাবে ফুটে উঠবে।
“ঠিক আছে–তোমাদের আই এফ এফ পেয়েছি।’ জানাল ব্রিগ। মেঘের মাঝে ঢুকে সামনে এগোতে লাগল ডেভিড আর জো। এতটাই কাছে দেখাতে লাগল রাডার ইমেজ যে শক্র বহরের প্রতিটি প্লেন স্পষ্ট দেখতে লাগল ডেভিড।
‘টার্গেড গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। স্টারবোর্ডের দিকে টার্ন নিচ্ছে। তাড়াতাড়ি সতর্ক করে দিল জো।
ডেভিড নিশ্চিতভাবে জানে যে শত্রু বহর তাদের অস্তিত্ব টের পায়নি। কাকতালীয় ভাবেই মোড় নিয়েছে। স্কিনে তাকিয়ে দেখতে পেল প্রয়োজনমতো উচ্চতা পেয়ে গেছে সে। শত্রু বহরের থেকে দুই মাইল উপরে আছে সে। পেছনে সূর্য। এটাই মোক্ষম সময়।
ফাইনাল অ্যাটাক প্যার্টানের জন্য ঘুরে যাচ্ছি। জোকে জানাল ডেভিড। এগোতে লাগল দুজনে।
সামনে নির্ভার মনে উড়ে যাচ্ছে টার্গেট। সাইড উইডার মিসাইল শত্রুর উপস্থিতি স্বরূপ হালকা ইনফ্রারেড টের পেয়েছে। ডেভিডের ইয়ারফোনে মৃদু গর্জন শুরু করল তারা।
এখনো চারপাশে ঘন ধূসর মেঘ; এরপর হঠাৎ করেই খোলা পরিষ্কার আকাশে বের হয়ে এলো দু’জনে। তাদের ঠিক নিচেই সূর্যের আলোয় চকচক করছে রূপালি মিগ বহর। সুন্দর খেলনার মতো দেখতে প্লেনগুলোর গায়ে লাল, সাদা আর সবুজ রঙের নকশা। জ্যামিতিক নকশা কাটা পাখা।
ধীরেসুস্থে ভি-ফর্মেশনে উড়ছে প্লেনগুলো। সেকেন্ডের মাঝে তাদেরকে দেখে নিল ডেভিড। চারজন উইংম্যানই সিরিয়ান { বোঝা গেল যে তেমন কোন কন্ট্রোলের ধার ধারছে না। ওড়ার ভঙ্গিতেও কোন দেখনসই, আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি নেই। খুব সহজেই কাবু করা যাবে এগুলোকে।
যাই হোক, লিডারের প্লেনের ফিউজিলাজে তিনটা লাল রিং দেখে বোঝা গেল যে এটা রাশান ইনস্ট্রাকটর। শিরার বয়ে চলেছে বাজপাখির রক্ত। শক্ত আর ধূর্ত আর কালো মাম্বার মতই রাগ।
‘পোর্ট টার্গেট দুটো এনগেজ করছি। জোকে নির্দেশ দিল ডেভিড। হেডফোনে মিসাইলের গর্জন বেড়ে গেল। নিজে শক্রর অস্তিত্ব টের পেয়ে খুনের নেশায় পাগল হয়ে উঠেছে ওগুলো।
কমান্ড নেটের সুইচ অন্ করল ডেভিড। হ্যালো মরুর ফুল, টার্গেটের উপর আঘাত করার নির্দেশ চাইছে ব্রাইট ল্যান্স।
প্রায় সাথে সাথে উত্তর এলো। ডেভিড ব্রিগ বলছি– দ্রুত কথা বলছে ব্রিগ,_আক্রমণ করবে না। আমি আবারো বলছি, টার্গেট ছেড়ে দাও তারা আমাদের জন্য হুমকি নয়। আক্রমণ স্থল ত্যাগ করো।’
হতভম্ব হয়ে গেল ডেভিড। নিচে মেঘের উপত্যকার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল পেছনে পড়ে আছে জর্দানের বাদামী ভূমি। ভূমির উপর দিয়ে মাত্র একটা লাইন পার হওয়ায় বদলে গেছে তাদের ভূমিকা। কিন্তু টার্গেট এখনো হাতের কাছে। সহজেই আঘাত করা যাবে।
‘আমরা তাদেরকে আঘাত করব। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল ডেভিড। কমান্ড নেট বন্ধ করে জোর সাথে কথা বলল।
‘টু’ লিডার আক্রমণ করছি।
‘নেগেটিভ। আমি আবারো বলছি নেগেটিভ!’ তাড়াতাড়ি বলে উঠল জো। টার্গেট বিধ্বংসী নয়।’
‘হান্নাহর কথা স্মরণ করো।’ মাস্কের ভেতরে চিৎকার করে উঠল ডেভিড। ‘আমাকে নিশ্চিত করো। ট্রিগারের উপর চেপে ধরল আঙুল। স্পর্শ করল বাম পাশের রাডার।
জো মনে হলো দম বন্ধ করে বসে রইল খানিকক্ষণ। তরপরই কঠিন স্বরে ঘোষণা করল,
টু কনফর্মিং।’
‘তাদেরকে মেরে ফেলো জো। দাঁত কিড়মিড় করে ট্রিগারের স্প্রিং আলগা করে টেনশনমুক্ত হলো। মৃদু হিসহিস শব্দ শোনা গেল। কেঁপে উঠে পিছনে বের হয়েই ছোটা শুরু করল টার্গেটের দিকে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই সচেতন হলো মিগ বহর।
চিৎকার করে সাবধান করল তাদের লিডার। পুরো কাঠামো পাঁচ ভাগে ভাগ হয়ে গেল। মনে হলো যে বারাকুড়াকে দেখতে পেয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল রূপালি সার্ডিনের দল।
সবচেয়ে কিনারে থাকা সিরিয়ানটা একটু ধীর গতিতে মোড় ঘুরলো। তখনি লেজে বাড়ি খেল সাইডইডার মিসাইল একসাথে দুটিই যাত্রা করল দূর আকাশে স্বর্গপানে।
শক ওয়েভের ধাক্কায় কেঁপে উঠল ডেভিডের মেশিন। কিন্তু শব্দ থেমে গেল দ্রুত; কেননা চোখের পলকে ভগ্নাংশে ভেঙ্গে গিয়ে মেঘের আঁধারে হারিয়ে গেল মিগ। একটা পাখা অনেক উপরে উঠে ছাইয়ের মতো ঝরে পড়তে লাগল নিচে। অল্পের জন্য বেঁচে গেল ডেভিডের মাথা।
দ্বিতীয় মিসাইল নিজের প্রতিপক্ষ হিসেবে বেছে নিল লাল রিং আঁকা প্লেনটাকে। কিন্তু দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাল রাশান লিডার। শক্তভাবে মোড় ঘোরায় অল্পের জন্য হাত ফসকে গেল মিসাইলের। মিগকে আর অনুসরণ করতে পারলো না। ডেভিড নিজের মিরেজ নিয়ে ছুটলো রাশানের পিছনে। দেখতে পেল বহুদূরে মেঘের ভিড়ে সবুজ ধোঁয়া ছড়িয়ে বিস্ফোরিত হয়ে গেল মিসাইল।
ডান দিকে কাত হয়ে মোড় নিল রাশান। পিছু নিল ডেভিড। শত্রুর মেশিনের সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে। পাইলটের বেগুনি রঙের হেলমেট, আইডেনটিফিকেশন মার্ক হিসেবে থাকা আরবী হরফ–এমনকি মিগের চকচকে ধাতব গায়ের প্রতিটি ধূলিকণা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে।
নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জয় স্টিককে পেছন দিকে টেনে ধরল ডেভিড।
এদিকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি টেনে ধরতে চাইছে ডেভিডকে। ফলে মনে হলো মাথা থেকে সব রক্ত বের হয়ে যাবে, চোখের সামনেটা হয়ে গেল ঝাপসা। শত্রুর পাইলটের হেলমেটের রং হয়ে গেল তামাটে বাদামী। ডেভিডের মনে হলো নিজের আসনে বসেই ভেঙেচুড়ে চুড়মার হয়ে যাবে সে।
কোমর আর পায়ের কাছে জি-স্যুট এঁটে বসে আছে। মনে হলো চেপে ধরে আছে কোন নিষ্ঠুর অজগর; চেষ্টা করছে কপালের খুলি চিড়ে ফেলে রক্ত শুষে নিতে।
ডেভিড চাইল শরীরের পেশীগুলোকে পাড়াতে। উপরের দিকে সামান্য কাত করল মিরেজ। চেষ্টা করল নিজের উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে আরো একবার শত্রুর উপর আঘাত হানতে।
চোখের দৃষ্টি আবারো ঝাপসা হয়ে এলো। নিজের সিটে পিন দিয়ে কেউ যেন আটকে দিল তাকে। মুখ হাঁ হয়ে গেল আপনাতেই। চোখের মণি মনে হলো ঠিকরে বের হয়ে আসবে। কন্ট্রোল কলামের উপর ডান হাত রাখতেই হিমশিম খেতে লাগল সে।
চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল স্টল ইন্ডিকেটরের কাঁটা নড়ছে। লাল বিন্দু জানিয়ে দিল যে এতটা সুপারসনিক গতি বিপদ বয়ে আনতে পারে তার জন্য।
ফুসফুস ভর্তি করে নিজের সমস্ত শক্তি এক করে চিৎকার করে উঠল ডেভিড। ধূসর কুয়াশায় শুনতে পেল নিজের প্রতিধ্বনি। এই চেষ্টার ফলে মনে হলো ব্রেইনে রক্ত ফিরে এলো খানিকটা। চোখের দৃষ্টিও একটু স্বাভাবিক হলো। স্পষ্ট দেখতে পেল যে মিগ আবার চলে এসেছে তার নিচে।
ঘুরে গিয়ে রাশানের কামানের মুখ থেকে পালানো ছাড়া আর কোন পথ রইল না ডেভিডের। গড়িয়ে গিয়ে বের হয়ে আনল মিরেজকে। আফটারবার্নারস এখনো জ্বলছে। অসম্ভব রকমের ফুয়েল খরচ করছে।
একজন ব্যালে নর্তকীর মতোই ভারসাম্য বজায় রেখে ডেভিডের পিছু নিল রাশান মিগ। রিয়ার ভিউ মিরর দিয়ে ডেভিড দেখতে পেল তাকে আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছে রাশান। আবারো গড়িয়ে উপরে উঠে ডান দিকে সরে গেল ডেভিড।
গড়িয়ে ঘুরে যাওয়া, জীবনের জন্য মোড় নেয়া। রাশানটাকে ভালই বুঝে নিল ডেভিড। প্রতিপক্ষ হিসেবে দুর্ধর্ষ রাশান দ্রুত আর নিখুঁতভাবে অনুসরণ করছে ডেভিডের প্রতিটি বাঁক আর মোড়ঘোরা। প্রতিবারই আঘাত করার চেষ্টা করছে।
কন্ট্রোল নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে ডেভিডের কাঁধ আর হাত ব্যথা হয়ে গেল। মাধ্যাকর্ষণের চাপ, ব্রেইনে রক্তের অভাব, নিজের ভেতর অ্যাড্রেনালিনের প্রবাহ সব কিছু মিলিয়ে অসুস্থ বোধ করতে লাগল ডেভিড। নিজের ভেতরের ঠাণ্ডা রাগটা মনে হলো জমাট বাঁধা হতাশায় রূপ নিল। কেননা প্রতিবারই ওর কোন চেষ্টা ব্যর্থ হতে লাগল রাশানের কাছে। প্রতিবারই ওর প্রায় কাঁধ অথবা পেট ছুঁয়ে বের হয়ে যেতে লাগল মিগ। সমস্ত দক্ষতা, পাইলট হিসেবে সহজাত বোধ, সবকিছু মনে হলো নষ্ট হয়ে যেতে লাগল। বোঝা গেল শক্রর যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আরো বেশি।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় একবার যখন তারা প্রায় পাখায় পাখায় লেগে আছে মাঝখানের ফাঁকটুকু দিয়ে মানুষটার চেহারা স্পষ্ট দেখতে পেল ডেভিড। অক্সিজেন মাস্কের উপর দিয়ে কপাল আর চোখ। হাড়ের মতো ধূসর আর বিবর্ণ চামড়া। চোখগুলো খুলির একেবারে গর্তের মাঝে বসানো। আবারো মোড় নিল ডেভিড। ঘুরতে লাগল আর চিৎকার করতে লাগল। মাধ্যাকর্ষণের চাপ, ভয় সবকিছু চাইল চিৎকার করে তাড়িয়ে দিতে।
মাত্র অর্ধেক ঘোরা শেষ করে তারপরেই আবার কোন চিন্তা না করে উল্টো দিকে ঘুরে গেল। প্রতিবাদ জানাতে চাইল মিরেজ। গতি গেল কমে। রাশানটা দেখতে পেয়েই চলে এলো ডেভিডের স্টারবোর্ড কোয়ার্টারের দিকে। জয়স্টিক পুরো সামনের দিকে ঠেলে দিল ডেভিড। মাধ্যাকর্ষণের চাপে মাথা থেকে যে রক্ত সরে গিয়েছিল এখন সেটা শরীরের উপর দিকে বইতে লাগল। চোখের সামনে নাচতে লাগল বিভিন্ন রং। প্রেশারের ফলে নাকের নিচে একটি শিরা দপদপ করতে লাগল। তারপরই তার অক্সিজেন মাস্ক ভরে গেল রক্তে।
রাশানটা এখনো তার পেছনে লেগে আছে।
মুখ ভর্তি রক্ত নিয়েই চিৎকার করে উঠল ডেভিড। আবারো সর্বশক্তি দিয়ে টেনে ধরল জয়স্টিক। আবারো মনে হলো রক্ত সরে গেল মাথা থেকে। সেকেন্ডের মাঝে লাল থেকে সব কালো রং ভাসতে লাগল চোখের সামনে। রাশান মিগ এখন ওর উপরে। উপরের দিকে গুতো দিল ডেভিড। শত ভাগের এক ভাগ সেকেন্ড সময় দেরি করাতেই নিজের কামান থেকে গুলি ছুড়লো ডেভিড। খোলা আকাশে মনে হলো বাগানের হোস পাইপ থেকে পানির মতো গুলিবৃষ্টি শুরু হলো। পাইলটের কেবিনে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠতে দেখল ডেভিড। ঘুরে উল্টো দিকে চলতে লাগল ডেভিড। রাশান ককপিট থেকে উড়তে দেখা গেল সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডুলি।
আমি পেরেছি; উচ্ছস্বিত হয়ে ভাবতে লাগল ডেভিড। ভয় চলে গিয়ে আবারো ফিরে এলো রাগ। ভয়ঙ্কর রাগ। আবারো মিরেজ নিয়ে উপরে উঠে গেল ডেভিড। কামানের গান সাইটের মাঝখানেই দেখা গেল রাশান মিগ।
এক সেকেন্ডের জন্য গুলি ছুড়লো ডেভিড। শেল গিয়ে আঘাত করল মিগ এর রূপালি ফিউজিলাডে।
একটু মোড় ঘুরেই সোজা ছুটলো রাশান মিগ। সম্ভবত কন্ট্রোলে বসে আছে মৃত পাইলট।
আবারো এক সেকেন্ডের জন্যে গুলি ছুড়লো ডেভিড। ভেঙ্গে চুরে পড়তে লাগল মিগ। ডেভিডের দিকে উড়ে আসতে লাগল অচেতন কিছু আবর্জনার অংশ। কিন্তু মেশিনের সাথে রয়ে গেল রাশান। আবারো দুই সেকেন্ডের জন্য গুলি ছুড়লো ডেভিড। এবার নিচের দিকে নেমে গেল মিগের নাক। রূপালি বর্শার মতো নেমে যেতে লাগল নিচে। ডেভিড তাকিয়ে দেখতে লাগল অন্তত মার্ক ২ এর বেশি গতি নিয়ে ছুটতে লাগল রাশান মিগ। এরপরই ধুলা আর ধোঁয়া ছুটিয়ে বোমার মতো আঁছড়ে পড়ল সিরিয়ার সমভূমিতে।
আফটারবার্নার বন্ধ করে ফুয়েল গজের দিকে তাকাল ডেভিড। শূন্য হবার কাটার খানিকটা উপরে হালকা রেখা দেখা গেল। বিপদ টের পেল ডেভিড। শত্রুভূমির উপর মাত্র পাঁচ হাজার ফুট উঁচুতে আছে সে।
মূল্যবান ফুয়েলটুকু নষ্ট করে পশ্চিমে ছুটলো ডেভিড। ইন্টারসেপশন স্পিড় নিয়ে উড়তে লাগল। চেষ্টা করছে দ্রুত সরে যেতে আর উপরে স্বর্গের দিকে তাকিয়ে চাইল খুঁজে দেখতে জো বা অন্য কোন মিগের দেখা পাওয়া যায় কিনা। যদিও সে ধারণা করল যে এতক্ষণে নিশ্চয়ই আল্লাহর সাথে মোলাকাত হয়ে গেছে সিরিয়ানগুলোর। অথবা মায়ের সাথে ফিরে গেছে।
ব্রাইট ল্যান্স, টু, দিস ইজ লিডার। শুনতে পাচ্ছো?
‘লিডার, দিস ইজ টু’, প্রায় সাথে সাথে উত্তর দিল জো।
‘আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। ঈশ্বরের দোহাই ওখান থেকে সরে এসো।’
‘আমার অবস্থান কী?
‘আমরা সিরিয়ার ভেতর পঞ্চাশ মাইল পর্যন্ত চলে এসেছি। বেসের জন্য ফোর্স ২৫০°।
‘তোমার কী অবস্থা?
‘আমি একটাকে খতম করেছি। আরেকটার পিছনে আছি। এরপর ব্যস্ত হয়ে গেছি তোমার উপর চোখ রাখতে।
চোখ পিটপিট করল ডেভিড। অবাক হয়ে খেয়াল করল যে কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে হেলমেটে পড়ছে। আর পুরো মাস্ক চটচটে হয়ে গেছে নাকের ক্ষত থেকে পড়া রক্তে। হাত আর কাঁধ এখনো ব্যথা হয়ে আছে। মাতালের মতো হালকা লাগছে মাথা। কন্ট্রোলের উপর থাকা হাত দুটো কাঁপতে লাগল। দুর্বল বোধ হলো।
‘আমি দুটো মেরেছি–একটা ডেবরার জন্য আর আরেকটা হান্নাহর জন্য।’
‘চুপ করো, ডেভি।’ চিন্তিত স্বরে জানাল জো। এখান থেকে কীভাবে বের হবে সে চিন্তা করো। তুমি এখনো ফ্ল্যাক আর গ্রাউন্ড মিসাইলের রেঞ্জে আছে। লেজ জ্বালিয়ে নাও আর চলল।
‘নেগেটিভ।’ উত্তর দিল ডেভিড। আমার ফুয়েল শেষ হয়ে এসেছে। কোথায় তুমি?
ছয়টার কাঁটার ঘরে, ২৫০০০ ফুট উঁচুতে। উত্তর দিতে দিতে নিজের সিটে বসে সামনে ঝুঁকে অনেক নিচে ডেভিডের দিকে তাকাল জো। ধীরে ধীরে উঠে আসছে এটি অনেক ধীরে আর অনেক নিচুতে।।
ডেভিডের জন্য ভয় পেল জো। নিজের মাস্কের ভেতরে হাসফাস করতে লাগল। দ্রুত চারপাশে চোখ বুলাতে লাগল বিপদের আশংকায়। দুই মিনিটের মাঝে নিরাপদ স্থানে চলে যাবে তারা। কিন্তু এই দুই মিনিট মনে হলো হয়ে গেল শত বছরের মতো দীর্ঘ।
প্রথম মিসাইলটা অল্পের জন্য মিস্ করল ডেভিডকে। গ্রাউন্ড ক্রুরা নির্ঘাৎ ভুল করে ডেভিডকে সুযোগ দিয়েছে লঞ্চ প্যাড দিয়ে উড়ে যাবার।
‘মিসাইল, বামে চলে যাও। মাস্কের ভেতর গর্জন করে উঠল জো। যাও। গো! গো!’ দেখতে পেল তৎক্ষণাৎ ঘুরে গেল ডেভিড।
‘এটা তোমাকে হারিয়ে ফেলেছে!’ পাগলের মতো শূন্যপানে মিসাইলটাকে এগোতে দেখে মন্তব্য করল জো।
শিকারের খোঁজে একটুখানি এদিক-ওদিক হেলেদুলে অবশেষে বিস্ফোরিত হয়ে গেল মিসাইলটা।
‘চলতে থাকো, ডেভি। উৎসাহ দিল জো। কিন্তু খেয়াল রেখো, আরো আসছে।’
দু’জনেই দেখতে পেল মাটি ছাড়ল দ্বিতীয় মিসাইলটা। আরো দেখা গেল একগাদা জড়ো হয়ে আছে ভূমির উপর। পাথরের খাঁজ থেকে ডেভিডের ছোট্ট মেশিন লক্ষ্য করে উড়ে আসতে লাগল সার্পেন্ট।
‘লেজে আলো জ্বালিয়ে এটার জন্য অপেক্ষা করো!’ বলে উঠল জো। তাকিয়ে দেখতে লাগল পূর্ণ গতিতে ডেভিডের মিরেজের দিকে ধেয়ে আসছে মিসাইল।
‘ডানে ব্রেক চাপো। যাও! যাও! গো! জোর গর্জন শুনেই মোড় নিল ডেভিড। আবারো অল্পের জন্যে মিস করল মিসাইল। কিন্তু এবার আর লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো না। ঘুরে আবার ডেভিডের পিছু নিল।
‘ও এখনো তোমার পেছনে লেগে আছে। চিৎকার করে উঠল জো। সূর্যের দিকে উঠে যাও ডেভি। চেষ্টা করো। মিরেজ সাথে সাথে নাক উঁচু করে কালো মেঘের উপর জ্বলতে থাকা নক্ষত্রপানে ছুটে চলল। সার্পেন্ট সাথে সাথে উপরে উঠে অন্ধের মতো অনুসরণ করে চলল।
‘ও এখনো পিছু ছাড়েনি ডেভি। যাও! যাও! গো।’
হঠাৎ করেই ধুপ করে নিচের দিকে পড়তে শুরু করল মিরেজ। সার্পেন্ট ও সামনে সূর্য থেকে আসা ইনফ্রারেডের দিকে ধেয়ে চলল। আবারো বেঁচে গেল ডেভিড।
‘তুমি এটাকে হারিয়ে দিয়েছে। বাইরে যাও, ডেভি! বাইরে যাও। আকুতি জানাতে লাগল জো। কিন্তু অসহায় হয়ে পড়েছে মিরেজ। প্রাণভয়ে সূর্যের দিকে উঠে যাওয়ায় সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে অলস ভাবে পড়ে যাচ্ছে। এখন নিচের দিকে। এদিকে জো দেখতে পেল তৃতীয় মিসাইলটাকে। ধোঁয়ার পাখা ছড়িয়ে এগিয়ে আসছে ডেভিডের মিরেজের দিকে।
জো নিজেও ঠিকভাবে জানে না যে সে কী করতে চলেছে। শুধুমাত্র পুরো শক্তি নিয়ে নিচের দিকে ডাইভ দিল প্লেন নিয়ে। শব্দের চেয়েও দ্বিগুণ গতি নিয়ে ডেভিডের লেজের সমান্তরাল চলে এলো জো। চাইল আড়াআড়ি ভাবে থেকে সার্পেটের নাক ভোঁতা করে দিতে।
নিজের ছোট্ট গোলাকার রাডার চোখ দিয়ে জোকে দেখতে পেল সার্পেন্ট। টের পেল এর থেকে বের হওয়া তাপ ডেভিডের চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় মনে হলো এটি। বিকল্প টার্গেট ধরে নিয়ে ডেভিডের পিছু নেয়া বাদ দিয়ে জোর দিকে ঘুরে গেল মিসাইল।
জোর এয়ারক্রাফটের পাখা সরে যেতে দেখল ডেভিড। একটু পরেই দেখল সার্পেন্টও তার পিছু নিল। এক সেকেন্ড লাগল বুঝতে যে ইচ্ছে করেই মিসাইলের গতি ঘুরিয়ে নিয়েছে জো, কেননা ডেভিডের বাঁচার কোন সম্ভাবনাই থাকতো না নইলে।
আতঙ্কিত হয়ে ডেভিড দেখল নিজের গতি বাড়িয়ে সূর্যের দিকে ছুটলো জো। মসৃণভাবে তার পিছু নিল মিসাইলটাও। নিজের আয়নায় পিছনের মিসাইলটাকে দেখল জো। কিন্তু মনে হলো ছলনার আশ্রয় নিয়েও লাভ হয়নি। ডেভিডের মতো অসহায় বোধ করল জো নিজেও। মিসাইল খুঁজে পেয়েছে তাকে আর ধোয়ার পুচ্ছ ছড়িয়ে এগিয়ে আসছে। জো আর তার মিরেজ একসাথে চলে গেল না ফেরার দেশে।
একা উড়ে চলল ডেভিড। ভয়, দুঃখ আর আতঙ্কে গলা শুকিয়ে কাঠ। জোরে চিৎকার করে উঠল ডেভিড। জো, না জো। ওই ঈশ্বর না! তুমি এটা করতে পারো না।
সামনে মেঘের ফাঁকে দেখা গেল জর্দানের ভূমি।
‘ঘরে ফেরার কথা ছিল তোমার জো। তোমার। গলার মাঝে দলা পাকিয়ে উঠল কান্না।
কিন্তু বেঁচে থাকার আদিম বোধের কল্যাণে তাকিয়ে দেখতে পেল শেষ মিসাইলের আগমন। অনেক দূরে ছোট্ট কালো একটা বিন্দু। ঘন ধোয়ার লেজ। কিন্তু রাক্ষসের মতো তাকিয়ে দেখছে ডেভিডকে ছোট্ট চোখ দিয়ে।
দেখা মাত্র ডেভিড বুঝতে পারল যে এর হাতেই লেখা রয়েছে তার নিয়তি। এতক্ষণ পর্যন্ত এত কিছু ঘটার পরে স্নায়ু অবশ হয়ে আসতে চাইল। তার পরে শেষ চেষ্টা করল সে।
চোখ ভেঙ্গে আসতে চাইছে। পুরো মাস্ক ভিজে গেছে ঘামের ফোঁটায়। বাম হাতে থ্রটল খুলে দিল পুরোপুরি। ডান হাতে চেপে ধরল কন্ট্রোল কলাম। হতাশা নিয়ে ভাবতে লাগল নিজের কথা।
মিসাইল প্রায় তার ঘাড়ের উপরে পৌঁছে গেছে। সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠল সে। চাইল মিরেজকে ঘুরাতে কিন্তু সেকেন্ডের জন্য ভুল হয়ে গেল। মোড় নেয়ার সময় তার পাশ দিয়ে গেল মিসাইল। নিজের ফিউজিং ডিভাইসের ফটো ইলেকট্রিক চোখ দিয়ে দেখে ফেলল মিরেজের ছায়া। বিস্ফোরিত হলো মিসাইল।
বিস্ফোরণের ঠিক মাঝখানে পড়ল ককপিট ক্যানোপি। শক ওয়েঙের ধাক্কায় কাঁপতে লাগল প্লেন। ওড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল মিরেজ।
ক্যানোপির চারপাশে পড়তে লাগল উড়ন্ত স্টিলের অংশ। ডেভিডের সিটে। ধাক্কা দিল একটা অংশ। বাম হাতে কনুইয়ের উপর আঘাত করল এটি। নিখুঁতভাবে কেটে গেল হাড়। ভারসাম্যহীনভাবে ঝুলতে লাগল হাতটা।
ভাঙা ক্যানোপিটার মাঝে ঢুকে গেল হিম শীতল বাতাস। আত্মহত্যা করার ভঙ্গিতে গোত্তা খেতে খেতে নামতে লাগল প্লেন পূর্ণ গতিতে। সিট বেল্ট থেকে ছিটকে পড়ল ডেভিড। পাঁজর ভেঙ্গে গেল। কাঁধের চামড়া ছিঁড়ে গেল।
চেষ্টা করল সিটের উপর ধরে রাখতে নিজেকে। ইজেক্টর মেকানিজমের হ্যান্ডেল ধরে রইল সুস্থ হাতে। ভাবল সিটের নিচে চার্জ বিস্ফোরিত হয়ে মিরেজ থেকে মুক্তি মিলবে তার। কিন্তু কিছুই ঘটল না।
তাড়াতাড়ি হ্যান্ডেল ছেড়ে সামনে ঝুঁকে সেকেন্ডারি ফায়ারিং মেকানিজম ধরতে চাইল তার সিটের নিচে দুপায়ের ফাঁকে। কিন্তু হতাশ হয়ে দেখল কোন কাজই করছে না এটি। সিট কাজ করছে না। বিস্ফোরণের ফলে এর গুরুতৃপূর্ণ কোন অংশের ক্ষতি হয়েছে। এক হাতে এভাবেই মিরেজ চালাতে হবে তাকে। আর খুব বেশি উচ্চতাও বাকি নেই। জয়স্টিকের উপর ডান হাতের মুঠি রাখল। আর পাগলের মতো হচড়পাঁচড় করে চেষ্টা করল কন্ট্রোলের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে। সহজাত অভ্যাসবশে এখনো উড়ে চলেছে সে। নইলে চোখের সামনে ঝুলছে আকাশ আর পৃথিবী একসাথে।
বুঝতে পারল দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। যতবার চোখ দিচ্ছে বাইরে দেখতে পাচ্ছে মাটি আরো কাছে চলে এসেছে।
মাটির খুব কাছাকাছি এসে মনে হলো মিরেজ তার কথা শুনল। জয়স্ট্রিক আর রাডার একসাথে হয়ে উত্তর দিল। আস্তে করে সোজা হলো মিরেজ। ছুটতে লাগল সামনের দিকে। মিসাইলের আঘাতে অসুস্থ হয়ে গেছে বেচারা মিরেজ। ডেভিড অনুভব করল ইঞ্জিনের যন্ত্রণাকাতর ঘড়ঘড়ানি শব্দ। বুঝতে পারল কমপ্রেসর গেছে। হয়তো আর মিনিটখানেক বা সেকেন্ডের মাঝেই টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। উপরে চেষ্টা করেও লাভ নেই আর।
তাড়াতাড়ি নিজের চারপাশে তাকাল ডেভিড। এমনভাবে দুলতে থাকতে আকাশের কোথায় গিয়ে পড়বে ভয় পেল সে। মাটির থেকে মাত্র দুইশ থেকে তিনশ ফুট উপরে আছে। নিজের পতনের দিক সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই তার। কিন্তু নিজের উপলার কম্পাস চেক করে খানিকটা বিস্মিতই হলো; ঘরের দিকেই উড়ে যাচ্ছে।
ইঞ্জিনের কাপন গেল বেড়ে। ধাতুর ঘর্ষণও শুনতে পাচ্ছে সে। মনে হয় না ঘর পর্যন্ত টিকতে পারবে। আর ক্যানোপিকে ঠিকঠাক করার মতো যথেষ্ট উচ্চতাও নেই। তাই স্ট্র্যাপ খুলে ককপিট থেকে বের হবার সম্ভাবনাও নেই। মাত্র একটা কোর্স বাকি আছে। মিরেজকে তাই চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে ভেতরের দিকে।
সিদ্ধান্ত নেয়ার সাথে সাথে সুস্থ হাত লেগে গেল কাজে। হাঁটুর মাঝে ধরল জয়স্ট্রিক। ল্যান্ডিং গিয়ার নামিয়ে দিল।
সামনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল পাথুরে ভূমি আর তারপর সবুজ ক্ষেত। সেখানেই শুয়ে আছে তার সমাপ্তি কিন্তু তার আরেকটু পরেই দেখা যাচ্ছে খোলা মাঠ, ফসলি জমি, ফলের বাগান, দালানের সারি–তার মানে, খুশি হয়ে উঠল ডেভিডের মন, ইস্রায়েলের সীমান্তে পৌঁছে গেছে সে।
ভাঙা পাথরের কিনারা দিয়ে উড়ে গেল ডেভিড। গ্রানাটের হাঁ করা মুখের উপর থেকে অল্পের জন্যে বেঁচে গেল। সামনে পড়ে আছে ক্ষেত। স্পষ্ট দেখা গেল ফল বাগানে কাজ করছে মহিলারা। থেমে তাকিয়ে রইল তার দিকে। এত কাছ থেকে দেখল ডেভিড যে পরিষ্কার পড়তে পারল তাদের মুখের বিস্মিত ভাব।
নীল ট্রাক্টরের উপর বসে আছে একজন পুরুষ। সিট থেকে লাফ দিয়ে মাটির উপর পড়ে গেল লোকটা। মাথার সামান্য ফুটখানেক উপর দিয়ে উড়ে গেল ডেভিড।
ফুয়েল ট্যাঙ্কের চাবি বন্ধ, সমস্ত সুইচ বন্ধ, মাস্টার সুইচ বন্ধ–ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করতে চলেছে ডেভিড।
সামনে দিগন্ত বিস্তৃত মসৃণ বাদামী ক্ষেত। ভাগ্যই বলতে হবে শেষ হয়ে এসেছে তার যাত্রা।
গতি কমে আসছে মিরেজের। নাক নিচু হয়ে এসেছে নিচের দিকে। এয়ারস্পিডের কাঁটা উলটো দিকে ঘুরছে। ঘণ্টায় ২০০ মাইল, ১৯০, ১৮০, ১৫০-এর ঘরে এসে কাঁপতে লাগল।
হঠাৎ করেই সামনের ভূমিতে দেখা গেল কংক্রিটের সেচের যন্ত্রাংশ। বিশ ফুট চওড়া, দশ ফুট গভীর–একটা সেঞ্চুরিয়ান ট্যাংক ধ্বংস করার জন্যে যথেষ্ট।
খোলা মুখ এড়িয়ে যাবার কোন পদ্ধতিই জানা নেই তার। নিচে নামল মিরেজ। এতটাই সাবধানে যে, মনে মনে ভাবল বার্নি নিজেও গর্ববোধ করবে আমাকে এভাবে দেখলে।’ ভূমি কর্কশ হলেও ঠিকঠাকভাবে এগোতে লাগল মিরেজ। ককপিটে বসে ভয়ঙ্করভাবে কাঁপছে ডেভিড। তারপরেও এখনো তিন চাকার উপর দাঁড়িয়ে আছে প্লেন। সেচের নালার দিকে এগোবার সময় দেখা গেল ছোটার গতি ঘণ্টায় ৯০ মাইল। নালার মাঝে লেগে ভেঙ্গে গেল প্লেনের অংশ। নাক ডুবিয়ে দিল মিরেজ। ফিউজিলাজ সরসর করে এগিয়ে গেল মাঠের উপর। ভেতরে ডেভিড এখনো স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা অবস্থায় বসে আছে। পাখা ভেঙ্গে নরম মাটির উপর খানিকটা ঘষটে গিয়ে অবশেষে স্থির হলো মিরেজ।
ডেভিডের বাম পাশ পুরো অবশ হয়ে আছে। হাত বা পায়ে কোন বোধ নেই। কঠিনভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছে স্ট্র্যাপ। হঠাৎ নেমে আসা নীরবতার স্থানুর মতো বসে রইল সে।
বেশ কিছু সেকেন্ড পার হলো এভাবে। নড়াচড়া বা চিন্তা করার শক্তিটুকুও মনে হলো নেই আর। এরপরই গন্ধ পেল নাকে। ট্যাংক আর লাইনের জেট ফুয়েলের গন্ধ। আগুনে পুড়ে যাবার ভয় জেঁকে ধরল তাকে।
ডান হাত দিয়ে চেপে ধরল ক্যানোপি রিলিজ লিভার। টানাটানি করে চেষ্টা করল খুলে ফেলতে। কিন্তু মূল্যবান দশটি সেকেন্ড নষ্ট হলো কেবল। পুরো জমে গেছে লিভার। এরপর লিভারের নিচে থাকা স্টিলের ক্যানোপি ব্রেকারে চোখ পড়ল। এই যন্ত্রটি এ জাতীয় কোন বিপজ্জনক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছিল। টেনে ধরল ডেভিড। কাজ হলো না। মাথার উপরের গম্বুজ আঘাত করল। টের পেল জেট ফুয়েলের গন্ধে ভারী হয়ে উঠছে ককপিটের বাতাস।
বাম হাতে কোন কাজই করতে পারছে না সে। এদিকে স্ট্রাপ গুলোও শক্ত করে আটকে রেখেছে সিটের সাথে।
আবারো শুরু করল চেষ্টা। মাথার উপরের কাঁচের ঢাকনিতে হাত সমান ফুটো করতে পারল অবশেষে। চাইল আরেকটু বড় করা যায় কিনা। এমন সময় চিড় ধরা ফিউজিলাজের কোন অংশ থেকে ফিনকি দিয়ে আকাশে উঠে পড়ল ফুয়েল। ঝরে পড়তে লাগল বৃষ্টির মতো। ক্যানোপির উপরে বাগানের ফোয়ারার মতো ভারী হয়ে পড়তে লাগল। ডেভিডের তৈরি করা ফুটো প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম। ফুয়েল গড়িয়ে পড়তে লাগল চোখে মুখে, গাল বেয়ে। কাঁধ থেকে গড়িয়ে প্রেশার স্যুটের ভেতরেও পড়ল ফুয়েল। প্রার্থনা করতে লাগল ডেভিড। জীবনে প্রথমবারের মতো শব্দগুলো অর্থবহ হয়ে উঠল তার কাছে। বুঝতে পারল ভয় কমে আসছে প্রার্থনার শক্তিতে।
‘শোন ও ইস্রায়েল, প্রভু আমাদের ঈশ্বর, প্রভু একমাত্র।
জোরে জোরে চিৎকার করে প্রার্থনা শুরু করল ডেভিড। আস্তে আস্তে ভেঙ্গে পড়া কাঁচের ঢাকনিতে আঘাত করতে করতে মনে হলো মৃত্যু চুঁইয়ে পড়ছে চোখ মুখ বেয়ে। হাত দিয়ে কাঁচের ফাটলকে চেষ্টা করল আরো বড় করতে। হাত কেটে রক্ত পড়তে লাগল।
‘পূজিত হোক তার নাম, যার রাজতু চিরকালের
বেশ বড় হলো মুখটা। সিট থেকে উঠতে চাইল। দেখা গেল অক্সিজেন আর রেডিও লাইন জড়িয়ে গেছে হেলমেটের সাথে। অথর্ব বাম হাত দিয়ে কিছু করতেও পারছে না সে। তাকিয়ে দেখল স্যুটের হাতা ছিঁড়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বাঁকা হয়ে ঝুলছে বিবশ পেশী। অথচ কোন রকম ব্যথাও বোধ করল না সে।
‘তোমার প্রভু। তোমার ঈশ্বরকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসো=
ফিসফিস করল ডেভিড, ডান দিয়ে চেষ্টা করে চিবুকের স্ট্র্যাপ খুলে হেলমেট খুলে ফেলল মাটিতে। চুল বেয়ে কানের পেছন দিয়ে ঘাড়ে পড়ছে ফুয়েল। মনে পড়লো নরকের আগুনের কথা।
ব্যথায় জর্জরিত হয়ে ক্যানোপির ভাঙা অংশ দিয়ে বের হয়ে আসল ডেভিড। আর এখন এমনকি প্রার্থনার শক্তিও পারল না বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা ভয় তাড়াতে।
ঈশ্বরের রোষানলে পড়বে তুমি
পিচ্ছিল ধাতুর গা বেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে লাগল পাখার দিকে। পড়ে গেল মাটিতে। মাটিতে মুখ দিয়ে শুয়ে রইল বহুক্ষণ। আতঙ্ক আর পরিশ্রমে নিঃশেষ হয়ে গেছে।
‘ঈশ্বরের আদেশ স্মরণ করো।’
‘ধূলিমাখা মাটির উপর মুখ দিয়ে শুয়ে থাকার সময় শুনতে পেল মানুষের কণ্ঠস্বর। অতি কষ্টে মাথা তুলে দেখতে পেল খোলা মাঠ দিয়ে দৌড়ে আসছে নারীদের দল। শব্দগুলো বুঝতে পারল হিব্রু। জেনে গেল ঘরে পৌঁছে গেছে সে।
মিরেজের ভাঙা শরীরের গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে চাইল ডেভিড। ভাঙা হাত ঝুলছে পাশে। চেষ্টা করল চিৎকার করে তাদেকে থামাতে।
পিছনে যাও! সাবধান! কিন্তু গলা দিয়ে ফ্যাসফাসে আওয়াজ ছাড়া আর কোন স্বর ফুটলো না। সবাই দৌড়ে আসতে লাগল তার দিকে। শুকনো বাদামী মাটির উপর রং-বেরঙের উড়ন্ত অ্যাপ্রন আর পোশাক দেখে মনে হলো আলোর ফুলকি নাচছে।
ঘষটে ঘষটে এয়ারক্রাফটের সামনে থেকে সরেমহিলাদের কাছে যাবার চেষ্টা করতে লাগল ডেভিড।
‘পিছনে যাও!’ ব্যাঙের মতো আওয়াজ বের হয়ে এলো গলা চিরে। জি স্যুট মনে হলো হাত-পা টেনে ধরেছে আর চুলে আর মুখের নিচে হিম শীতল ফুয়েল।
জেট কমপ্রেসরের সাদা-গরম শেলের কারণে উত্তপ্ত হয়ে উঠল মিরেজের হাল।
ভয়ঙ্কর গর্জন করে ঘন লাল রঙের ধোঁয়া ছড়িয়ে বিস্ফোরিত হলো মিরেজ। বাতাস বাইরের দিকে ধেয়ে নিয়ে গেল ধোয়া। জ্বলন্ত আগুনের মাঝে এগোতে চেষ্টা করল ডেভিড।
নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইল সে যদি এমনটা না করতো তাহলে ফুসফুস ফুটো করে দিত ধোঁয়া। চোখ বন্ধ করে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াতে লাগল ডেভিড। শরীরে ফায়ারপ্রুপ প্রেশার স্যুট পরা। বুট আর গ্লাভও আছে–কিন্তু মাথা উন্মুক্ত আর ফুয়েলে ভিজে আছে।
দৌড়ানোর সময় মাথা জ্বলতে লাগল মশালের মতো। কুঁচকে গেল সব চুল। গন্ধের সাথে সাথে ধোয়া ছড়িয়ে মাথার চামড়া, মুখ আর ঘাড় হয়ে পড়লো উন্মুক্ত। আগুনের শিখায় পুড়ে গেল কান আর নাকের বেশির ভাগ অংশ। চামড়ায় পড়ল অসংখ্য ফোঁসকা। তারপরই দেখা গেল ফোঁসকা গলে তাজা মাংস। পুড়ে গেল ঠোঁট, দাঁত বের হয়ে গেল। চোয়ালের হাড় দেখা গেল। চোখের পাতা পুড়ে গেল। গাল থেকে মাংস পুড়ে খসে পড়তে লাগল।
জ্বলন্ত বাতাস আর ধোঁয়ার মাঝে পড়ে গেল ডেভিড। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো যে এতটা ব্যথাও সহ্য করা যায়। চিন্তা-চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে এলো। কিন্তু জানে যে চিৎকার করা চলবে না। চোখ বন্ধ করে রইল শক্তভাবে। কানের উপর মনে হলো ড্রাম বাজাতে লাগল বাতাস। চামড়া পুড়ে নরকের কথা মনে এলো তার। কিন্তু জানে যে এই ভয়ঙ্কর আগুন শরীর ছুঁতে দেয়া যাবে না। তাই চিৎকার না করেই এগিয়ে চলল সে।
ফল বাগান থেকে দৌড়ে আসা নারীরা এসে পড়ে। ওরা দেখল সামনে ধোয়ার দেয়াল, এয়ারক্রাফটের শরীর পুড়ে যাচ্ছে আর এই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে দৌড়ে আসতে চাইছে পাইলট!
তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে উত্তাপ আর ঘন ধোয়ার দেয়াল। বাধ্য হলো তারা পিছু হটতে। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল লেলিহান শিখা।
হঠাৎ করেই বাতাসের একটা ঝাপটা এসে ধোয়ার তেলতেলে পর্দাটা দিল সরিয়ে। এর ভেতর থেকে বের হয়ে এলো পুড়ে যাওয়া ধোঁয়াওয়ালা মাথা নিয়ে ডেভিড!
অন্ধের মতো বের হয়ে এলো ধোঁয়ার দেয়াল ভেদ করে। একটা হাত ঝুলছে নরম মাটির উপর। পা ঘষে প্রায় হামাগুড়ির মতো ভঙ্গি করে এগিয়ে আসছে মানব দেহ। ভয় পেয়ে জমে গেল নারীর দল।
এরপরই সাহস সঞ্চয় করে বাদামী দেহত্বকের মাথা ভর্তি চুল নিয়ে চিৎকার করে সামনে এগিয়ে ডেভিডের কাছে এলো একটি মেয়ে।
দৌড়াতে গিয়েই নিজের মোটা উলের স্কার্ট খুলে ফেলল। শক্তিশালী বাদামী পা হয়ে পড়লো উলঙ্গ। ডেভিডের কাছে পৌঁছে মাথায় পেঁচিয়ে দিল স্কার্ট। মাংস কামড়ে থাকা শিখাগুলো নিভে গেল। অন্য নারীরাও এগিয়ে এসে নিজেদের কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে ফেলল ডেভিডকে। মাটিতে শুয়ে পড়ল ডেভিড।
এতক্ষণে চিৎকার শুরু করল সে। ঠোঁটবিহীন মুখে দেখা যাচ্ছে সব দাঁত। এই শব্দ কখনোই ভুলতে পারবে না উপস্থিত নারীর দল। চিৎকার করতে গিয়ে খুলে গেল চোখ। চোখের পাপড়ি, আই ব্রো আর পাতার বেশিরভাগ অংশই পুড়ে গেছে। ভেজা পুড়ে যাওয়া মাংসের মাঝে ঘন নীল হয়ে আছে চোখ জোড়া। চিৎকার করতে গিয়ে নাকের ফুটো থেকে রক্ত ঝরতে লাগল। যদিও নাক বলতে আর কিছুই নেই প্রায়। সারা শরীর কাঁপিয়ে ব্যথার পর ব্যথার ঢেউ আঘাত করতে লাগল তাকে।
নারীরা চেপে ধরে চেষ্টা করল তাকে শান্ত করতে। নখ দিয়ে মুখ আঁচড়াতে চাইল ডেভিড। সবাই মিলে থামাতে চেষ্টা করল।
কিব্বুইজ ডাক্তার এসে প্রেশার স্যুটের হাতা কেটে ফেলল। তখনো এক নাগাড়ে চিৎকার করে চলেছে ডেভিড। লাফাতে থাকা পেশীর উপর মরফিন ইনজেকশনের সুই ঢুকিয়ে দিল ডাক্তার।
.
প্লট থেকে রাডারের সর্বশেষ উজ্জ্বল ছবিটাকেও হারিয়ে যেতে দেখল ব্রিগ। শুনতে পেল তরুণ রাডার অফিসার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করল, কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। কমান্ড বাঙ্কারে নেমে এলো ভয়ঙ্কর এক নীরবতা।
সবাই মিলে দেখতে লাগল তাকে। প্লটের উপরে কুঁজো হয়ে দাঁড়াল ব্রিগ। পাশে ঝুলে আছে বিশাল হাত। শক্ত মুখে কোন আবেগ ফুটে উঠল না। কিন্তু চোখ দুটো জ্বলছে ধকধক করে।
মনে হলো মাথার উপরে এখনো ভাসছে দুই পাইলটের কথোপকথনের শব্দ, প্রচণ্ড যুদ্ধের মাঝে একে অন্যকে ডেকে চলেছে তারা।
কান্না আর ভয় মেশানো ডেভিডের গলা শুনতে পেয়েছে সবাই।
‘জো! না জো! ওহ্ ঈশ্বর না! সবাই জানে এর মানে কী। দু’জনকেই হারিয়েছে তারা। আর স্থানুবৎ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ব্রিগ ভাবছে কী থেকে কী হয়ে গেল।
যেই মুহূর্তে নিজের যোদ্ধাদের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সেই মুহূর্ত থেকে বুঝতে পেরেছে যে ঝড় ঘনিয়ে আসছে–আর এখন পুত্রহারা হয়ে গেছে। ইচ্ছে করল চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। অভিযোগ জানায় সবকিছুর বিরুদ্ধে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য শক্ত করে চোখ বন্ধ করে রইল। খোলর পর দেখা গেল নিজের উপর আবারও নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে সে।
‘সাধারণ সতর্ক সংকেত।’ বলে উঠল ব্রিগ। “রেড” স্কেয়াড্রনের সব স্ট্যান্ডবাই জানে আন্তর্জাতিক সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে তারা। তারা যেখানে পড়েছে সে অংশের আকাশ কাভার করা হোক। হতে পারে পড়ে গেছে তারা। দুটি ফ্যান্টম ফ্লাইট নিয়ে ঢেকে ফেলো তাদেরকে। আমি চাই এই মুহূর্তে হেলিকপ্টার পাঠিয়ে দেয়া হোক। সাথে প্যারাট্রুপার গার্ড আর মেডিকেল টিম
সাধারণ সংকেত জারি করায় তৎপর হয়ে উঠল কমান্ড বাঙ্কার।
‘প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলব আমি। অনেক রকমের ব্যাখ্যা দিতে হবে তাকে। মূল্যবান কয়েকটা সেকেন্ড ব্যয় করল ডেভিড মরগ্যানের উপর গালিবর্ষণ করে।
***
ডেভিডের ক্ষত আর পুড়ে যাওয়া মাথার দিকে তাকিয়ে এয়ারফোর্সের ডাক্তার বলে উঠল, ‘একে বাঁচাতে পারলে নিজেদেরকে ভাগ্যবানই বলতে হবে।’
হালকা করে ভ্যাসলিনের ব্যান্ডেজ করে দিল ডাক্তার ডেভিডের মাথায়। বাগানে অপেক্ষারত বেল ২০৫ হেলিকপ্টারের স্ট্রেচারের উপর তাড়াতাড়ি উঠানো হলো কম্বল মোড়া শরীর।
হাদ্দামা হাসপাতালের নিচে হেলিপ্যাডে নামল হেলিকপ্টার। একটা মেডিকেল দল প্রস্তুত হয়েই আছে। হাসপাতালের তৃতীয় তলার বিশেষ বার্ণ ইউনিটে ঢুকলো ডেভিড। সেচ নালায় মিরেজ ভেঙ্গে পড়ার এক ঘণ্টা তিপ্পান্ন মিনিট পর। শান্ত, গোছানো একটি পৃথিবী যেখানে সবাই মাক্স পরে আছে। গায়ে লম্বা সবুজ বোব। বাইরের পৃথিবীর দেখা পাওয়া যাবে একমাত্র কাঁচের জানালা দিয়ে। এমনকি নিঃশ্বাস নেবার বাতাসটুকুও পরিষ্কার করা হয়েছে।
হালকা মরফিনের কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে আছে ডেভিডের চেতনা। তার উপর ঝুঁকে কাজ করতে থাকা মুখোশ পরিহিত মুখগুলোর গলার শব্দ তাই কিছুই বুঝতে পারল না সে।
‘পুরো অঞ্চলের উপর তিন ডিগ্রি
‘এটা স্থির না হওয়া পর্যন্ত পরিষ্কার করার বা ছোঁয়ার কোন চেষ্টাই করা যাবে না সিস্টার। আমি ইপিগার্ড স্প্রে করে দিচ্ছি। এছাড়া চার ঘন্টা পর পর ইন্ট্রী মাসকুলার টেটরাসাইক্লিন দেবব আমরা–যাতে ইনফেশন না হয়।’
‘দুই সপ্তাহ কাটলে তবেই আমরা ছুঁতে পারব।’
‘ঠিক আছে ডাক্তার।
‘ওহ, আরেকটা কথা সিস্টার। প্রতি ছয় ঘণ্টায় ১৫ মিলিগ্রাম মরফিন। একে নিয়ে অনেক ব্যথা সহ্য করতে হবে।’
এই ব্যথার বোধ মনে হলো কখনো শেষ-ই হবে না। সীমাহীন সমুদ্রে ব্যথার ঢেউ একটু পরপর ধাক্কা মারছে ডেভিডের হৃদয়ের বালুতটে। অনেক সময় এমন মনে হয় যে ব্যথার চোটে বুদ্ধি-বিবেচনা সব লোপ পেয়ে যায়। মাঝে মাঝে আবার এমন সময় আসে যখন কিছুটা কম থাকে ব্যথার বোধ। মনে হয় যেন ভাসতে ভাসতে মরফিনের কুয়াশার চাদরে হারিয়ে যায় সে। এরপরই আবার মনে হয় কুয়াশার চাদর ভেদ করে মাথার উপর চলে পড়ে সূর্যের তেজ। চিৎকার করে ওঠে ডেভিড। মাথা মনে হয় ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
এরপরই হঠাৎ করে মাংসের মাঝে ঢুকে যায় সুইয়ের মাখা। কুয়াশা এসে ঘুমের দেশে নিয়ে যায় তাকে।
‘এর দিকে তাকাতে পারি না আমি। কালচার নিয়েছি আমরা সিস্টার?”
হ্যাঁ ডাক্তার।
‘কেমন মনে হচ্ছে?
আমার ভয় হচ্ছে জীবাণু বেড়ে যাচ্ছে।
‘হ্যাঁ আমারো তাই মনে হয়। আমার মনে হয় ক্লোক্সাসিলিনে ফেরা উচিৎ-দেখা যাক ভাল কোন ফলাফল পাওয়া যায় কিনা।
ব্যথার মাঝেই নতুন এক ধরনের গন্ধ পেল ডেভিড। অনেক আগে মারা যাওয়া কোন কিছুর গন্ধ, নোংরা কম্বলে পোকার গন্ধ, বমি আর বিষ্টার গন্ধ। আর ভেজা আবর্জনার গন্ধ। অবশেষে পেল নিজের মাংস পচার গন্ধ। ব্যাকটেরিয়া এসে আক্রমণ করেছে উক্ত টিস্যুকে।
ঔষধ দিয়ে ব্যাকটেরিয়ার সাথে যুদ্ধে নামল ডাক্তারের দল। ইনফেকশনের ফলে জ্বর আসায় কমে গেল ব্যথা। পোড়ার অংশে দগদগে ঘাকে কোন তরলই শুকাতে পারছে না।
জ্বরের সাথে এলো দুঃস্বপ্ন। কল্পনার রাজ্যে বহু দূরে ভেসে যেতে লাগল ডেভিড।
‘জো’ আক্ষেপে চিৎকার করে উঠে ডেভিড। সূর্যের দিকে এগিয়ে যাও, জো। বাম দিকে ব্রেক কষে যাও! যাও!’ এরপরই কেঁদে ওঠে, ভাঙা গলায় বলে ওঠে, “ওহ, জো! ওহ, ঈশ্বর? না! জো।
রাতে ডিউটিরত সিস্টার সহ্য করতে পারে না। এগিয়ে আসে সিরিঞ্জ নিয়ে। চিৎকার পরিণত হয় বিড়বিড়ানিতে, এরপর আস্তে আস্তে গুঙ্গিয়ে উঠে ওষুধের ঝাঁঝে ঘুমিয়ে পড়ে ডেভিড।
‘এখন ড্রেসিং শুরু করব আমরা সিস্টার।
প্রতি আটচল্লিশ ঘণ্টায় ড্রেসিং করার সময় পুরো মাথায় জেনারেল অ্যানেসথেশিয়া দেয়া হতো। কাঁচা মাংস, বাচ্চাদের ড্রইংয়ের মতো টাক মাখা। চুল নেই, কান নেই, নিষ্ঠুর সব আঁক টানা।
‘ক্লোক্সাসিলিন মনে হয় কাজ করছে। আগের তুলনায় বেশ ভালো দেখাচ্ছে। তাই না সিস্টার?
চোখের পাতার নগ্ন চামড়া নতুন করে ভরতে শুরু করেছে। গোলাপি গোলাপের মতো পাঁপড়ি বের হয়েছে। চোখের কোটরে হলুদ মলম লাগিয়ে আরাম দেয়ার ব্যবস্থা করেছে ডাক্তারেরা। মাথার ইনফেকশন যাতে চোখে না ছড়িয়ে পড়ে সেটাও একটা কারণ। মলমের কারণে দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে গেছে।
‘আমার মনে হয় এখন আমরা পেটের ব্যাপারে কিছু একটা করতে পারি। বিকেলে থিয়েটার তৈরি করে রাখবেন প্লিজ, সিস্টার?
এখন ছুরি চালানোর সময় হয়েছে। ডেভিড শিখতে চলেছে যে ভয়ঙ্কর পাপের মাঝে ছুরি আর ব্যথা একত্রে বাস করে। পেট থেকে বড়সড় এক টুকরো চামড়া তুলে নিল ডাক্তারেরা। মোটাসোটা সসেজের মতো করে রোল করে নিল। এরপর ভালো হাত বেঁধে ফেলল। এরপর সসেজের এক অংশ হাতের এক অংশে লাগিয়ে রক্ত চলাচলের ব্যবস্থা করল। এরপর থিয়েটার থেকে নিয়ে আসা হলো তাকে।
যাক বাবা, দুটো চোখই বাঁচাতে পেরেছি আমরা।’ গর্বিত স্বরে ঘোষণা করল একটি কণ্ঠ।
প্রথম বারের মতো চোখ মেলে তাদেরকে দেখতে পেল ডেভিড। তার চারপাশে এসে জড়ো হয়েছে সবাই। সবার মাথা, নাক আর মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক। কিন্তু মলমের কারণে এখনো ঝাপসা হয়ে আছে দৃষ্টি।
‘এখন চোখের পাতার ব্যবস্থা করতে হবে।’
আবারো সক্রিয় হলো ছুরি। চোখের পাতা কেটে-ছেটে, সেলাই করে, ছুরি আর ব্যথা কাজ করে চলল একত্রে। চামড়ার একেবারে গভীর থেকে বোধ করল যন্ত্রণাবোধ।
‘খুব সুন্দর হয়েছে, সত্যিই ইনফেকশনকে খুব সুন্দর ভাবে ঢেকে দিয়েছি। আমরা। এখন আমরা শুরু করতে পারব।’
মাথার উপরে এখন একটা চকচকে ভেজা ভাব তৈরি হয়েছে। নতুন টিস্যু গজানোতে রং হয়েছে উজ্জ্বল লাল, ককটেল চেরীর মতো। কানের জায়গায় কুঁচকানো চামড়া। দাঁতের সারি উজ্জ্বল সাদা। শুধুমাত্র ঠোঁট দুটো নেই। চোয়ালের জায়গায় সাদা হাড়ের ব্লেড। নাকের জায়গায় শট গানের মতো নাকের ফুটো। শুধুমাত্র চোখ দুটো এখনো আগের মতো উজ্জ্বল–ঘন নীল আর সাদা। লাল চোখের পাতার উপর পরিষ্কার কালো সেলাই।
‘ঘাড়ের পেছনে কাজ শুরু করব আমরা। এই কারণে সন্ধ্যায় থিয়েটার তৈরি রাখবেন সিস্টার।
ছুরির মাঝেও কত রকম বৈচিত্র্য আছে। থাই থেকে সমান করে চামড়া কেটে নেয়া হলো। এরপর এগুলো বিছিয়ে দেয়া হলো উন্মুক্ত মাংসের উপর। এরপর ভালোভাবে মাংসের উপর। এরপর ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা হলো ব্যথাতুর ডেভিডের প্রতিটি পদক্ষেপ।
‘এটা দেখে ভালো মনে হচ্ছে না। আমার মনে হয় আমাদের আবার চেষ্টা করতে হবে।’
থাই-তে নতুন করে চামড়া গজানো শুরু হতেই গোড়ালি থেকে নতুন করে চামড়া কেটে নেয়া হলো। প্রতিটি জায়গা হয়ে উঠল নতুন করে ব্যথার উৎস।
চমৎকার! একেবারে খাপে খাপে মিশে গেছে এবারে।
ধীরে ধীরে ঘাড়ের উপর, মাথার উপর চামড়া বসে গেল।
এবার আমরা হাত খুলবো।’
সন্ধ্যার থিয়েটারে, স্যার?
‘হা, প্লিজ তৈরি রাখবেন সিস্টার।
ডেভিড পরবর্তীতে জানতে পারে যে প্রতি বৃহস্পতিবার বার্ন ইউনিটের অপারেশন থিয়েটারে কাজ অপারেশন করা হয়। তাই প্রতি বৃহস্পতিবারে আতঙ্ক নিয়ে দেখে যে বিছানার চারপাশে জড়ো হয় ডাক্তার দল। এমন ভাবে পুনরায় চামড়া প্রতিস্থাপন নিয়ে কথা বলতে থাকে যে শিউরে ওঠে ডেভিড।
পেট থেকে মোটা সসেজটাকে মুক্ত করল তারা। হাত থেকে সরানোর পর দেখা গেল সাদা লেসের মতো নিজের জীবন শুরু করেছে যেন রক্ত পেয়ে।
হাত তুলে বুকের সাথে বেঁধে দেয়া হলো। আরো একটু চামড়া কেটে চোয়াল আর নাকে লাগানো হলো।
‘খুব সুন্দর হয়েছে কাজটা। আজ সন্ধ্যায় একে ঘষামাজা করা হবে। থিয়েটার লিস্টে সবার আগে যাবে তার নাম। এদিকে খেয়াল রাখবেন সিস্টার।
পেট থেকে কাটা মাংস নিয়ে নাক, সরু ঠোঁট আর চোয়ালের হাড়ের জন্য নতুন কাভার তৈরি করা হলো।
‘ফোলা ভাবটা মিশে গেছে। আজ সন্ধ্যায় চোয়ালের হাড় সমান করা হবে।’
বুক খুলে ফেলে চতুর্থ পাঁজরে ভেঙে নেয়া হলো। এখান থেকে হাড় নিয়ে চোয়ালের হাড় ঠিক করা হলো। এরপর পেটের মাংস দিয়ে ঠিকঠাক ভাবে ঢেকে দেয়া হলো।
বৃহস্পতিবার কাটে ছুরি আর অ্যাশেথেটিক গন্ধে। আর বাকি দিনগুলোতে আচ্ছন্ন করে কাটা আর জোড়া লাগানো মাংসের ব্যথা।
নতুন নাক সুন্দর করে জোড়া লেগে গেল নাশাররে সাথে। চোখের পাতাও ঠিক হয়ে গেল। শেষ কাজ করা হলো কানের পেছনে। চোয়ালের কাছে জিগ-জাগ করে কেটে ফেলে অপরিষ্কার টিস্যু ফেলে দেয়া হলো। পুরোন পেশীর সাথে সংযুক্ত হয়ে গেল নতুন ঠোঁট। আস্তে আস্তে তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলল ডেভিড। ফলে পুনরায় আগের মতো কথা বলায় অভ্যস্ত হয়ে উঠল সে।
উক্ত মাংসের শেষ অংশটুকু জোড়াতালি দিয়ে ঢেকে দিল ডাক্তারেরা। হাই ইনফেকশন রিস্ক কেটে গিয়ে একটু একটু চলাফেরার স্বাধীনতা দেয়া হলো তাকে। আবারো সাধারণ মানুষের চেহারা দেখতে পেল সে। এ পর্যন্ত তো শুধু সার্জিক্যাল মাস্ক পরিহিত চোখ দেখতে পেত। মুখগুলো বেশ বন্ধুবৎসল আর হাসি খুশি। মৃত্যুর মুখ থেকে তাকে ফিরিয়ে আনতে পেরে বেশ খুশি সবাই। গর্বিত হয়ে উচ্চারণ করল ওর মাথা বাঁচানোর আনন্দ ধ্বনি।
‘তোমার কাছে দশনার্থীরা আসতে পারবে এখন। আর আমি আসা করি তুমিও উপভোগ করবে ব্যাপারটা।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তার জানাল ডেভিডকে। এই তরুণ সার্জনকে শত ভিড়ের মাঝেও আলাদা করে চোখে পড়তে বাধ্য। সুইস ক্লিনিকের মোটা বেতনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এই বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান হয়েছে ভদ্রলোক।
‘আমার মনে হয় না যে আমাকে কেউ দেখতে আসবে।’ বার্ন ইউনিটে থাকাকালীন এই নয় মাসে বাইরের পৃথিবীর সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে ডেভিডের।
‘ওহ হ্যাঁ অবশ্যই আসবে’; বলে উঠল সার্জন। অনেকেই নিয়মিত তোমার শারীরিক অবস্থার উন্নতি সম্পর্কে খোঁজ খবর করেছে আমাদের কাছে। তাই না সিস্টার?
‘ঠিক তাই, ডাক্তার।
তাদেরকে জানিয়ে দিন যে তারা চাইলে এখন ওর সাথে দেখা করতে পারবে।’
বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আর তার দলবদল বিদায় নিল।
‘ডাক্তার পেছন দিকে ডাক দিল ডেভিড। আমি আয়না দেখতে চাই।’
সবাই চুপ হয়ে গেল। বোঝা গেল অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। গত কয়েক মাসে ওর এই অনুরোধ অনেকবার ফিরিয়ে দিয়েছে তারা। ধুত্তোরি।’ রেগে উঠল ডেভিড। এভাবে চিরকাল আমাকে মানা করে যেতে পারেন না আপনারা।’
অন্যদেরকে হাত ইশারা করে চলে যাবার নির্দেশ দিয়ে ডেভিডের বিছানার ধারে এলো ডাক্তার।
‘ঠিক আছে, ডেভিড। নম্রভাবে একমত হলো ডাক্তার। আমরা তোমাকে একটা আয়না খুঁজে এনে দেবো। যদিও আমরা এটা তেমন ব্যবহার করি না এখানে।’ বহু মাসের মাঝে এই প্রথমবার একে অন্যকে বোঝার সুযোগ পেল তারা। ডাক্তারের সহানুভূতি টের পেল ডেভিড। একটা মানুষ প্রতিনিয়ত ব্যথা সহ্য করেও ঠিকই একদিন কাটিয়ে উঠতে পারে তা।
‘তোমাকে মনে রাখতে হবে যে এখন তোমাকে যা দেখাচ্ছে সব সময় তেমন দেখাবে না। আমি যা করতে পেরেছি তা হলো খোলা মাংস ঢেকে আবারো কাজ করার উপযোগী করে তুলতে চেয়েছি। তুমি আবারো একজন মানুষ হিসেবে ফুটে উঠেছে তোমার শরীরের কোন অংশ হারানোর বেদনা পাওনি তুমি–তবে আমি এই অভিনয়ও করব না যে তোমাকে অসাধারণ দেখাচ্ছে। যাই হোক, আরো অনেক কিছু করার আছে আমার। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় তোমার কান ঠিক করার জন্যে উপাদান জোগাড় করে রেখেছি আমি।’ ডেভিডের হাত থেকে ঝুলতে থাকা মাংস পিণ্ড দেখাল ডাক্তার। ‘এখনো চাইলে চোখ নাক আর মুখের উপর অনেক কাজ করা যাবে।’ ওয়ার্ডের মাঝে আস্তে আস্তে হেঁটে বাইরের সূর্যালোকের দিকে একমুহূর্ত তাকিয়ে আবারো ডেভিডের কাছে ফিরে এলো ডাক্তার।
‘কিন্তু তোমাকে সত্যি কথাটাই বলতে চাই আমি। আমার কাজের ক্ষেত্রেও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। চোখ আর মুখের চারপাশের অনেক নাজুক পেশী নষ্ট হয়ে গেছে। আমি তাদেরকে পুনরায় গঠন করতে পারবো না। তোমার চোখের পাপড়ি ব্রো আর খুলির হেয়ার ফলিকেলগুলোও পুড়ে গেছে। তুমি একটা উইগ ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু
নিজের বেডসাইড লকারের দিকে ফিরে ড্রয়ার থেকে ওয়ালেট বের করল ডেভিড। ভেতর থেকে বের করল একটা ছবি। অনেক আগে এ ছবিটা তুলেছিল হান্নাহ। ইন জেদির রক পুল ও পাশাপাশি বসে আছে ডেভিড আর ডেবরা। হাসছে একে অপরের দিকে তাকিয়ে। সার্জনের হাতে ছবিটা দিল ডেভিড।
তুমি এরকম দেখতে ছিলে ডেভিড? আমি কখনো জানতামই না।’ চোখের মাঝে দ্রুত ভেসে উঠল অনুতাপের ছায়া।
‘আবারো আমাকে এরকম করে তুলতে পারবেন আপনি?
বহুক্ষণ ধরে ছবিটা দেখল ডাক্তার। তরুণ দেবতার মতো চেহারায় পরিষ্কার সব রেখা আর মাথায় চুলের মেঘ।
না। জানিয়ে দিল ডাক্তার।
‘এমনকী কাছাকাছিও যেতে পারব না আমি।
‘আমি এটাই জানতে চেয়েছি। ডাক্তারের কাছ থেকে ছবিটা নিয়ে নিল। ডেভিড। আপনি বলেছেন আমি কর্মক্ষম এখনো। তাই না? ঠিক আছে। একটুকুই থাক।
তুমি আর কোন কসমেটিক সার্জারি চাও না? আমরা এখনো অনেক কিছু।’
‘ডাক্তার আমি নয় মাস ধরে ছুরির নিচে বেঁচে আছি। মুখে এখনো শুধু অ্যান্টিবারোটিক আর অ্যানেশথেশিয়ার স্বাদ। এখন আমি ব্যথা থেকে মুক্তি চাই। একটু শান্তি আর নাকে বিশুদ্ধ বাতাসের গন্ধ।
“ঠিক আছে।’ তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেল ডাক্তার। এটা এমন কোন গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় নয় যে এখনি করতে হবে। ভবিষ্যতে যে কোন সময় আসতে পারো তুমি।’ ওয়ার্ডের দরজার কাছে চলে গেল ডাক্তার। চলো। আয়না খুঁজে বের করা যাক।
প্যাসেজের শেষে ডাবল দরজার পেছনে নার্সরুমে পাওয়া গেল একটি। রুমটা একেবারে খালি। ওয়াশ বেসিনের উপর দেয়ালের সাথে লাগানো আছে আয়নাটা।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল সার্জন। সিগারেট জ্বালিয়ে দেখতে পেল হেঁটে আয়নার সামনে গেল ডেভিড। নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল হঠাৎ করে।
পায়জামার উপর নীল রঙের হাসপাতালের ড্রেসিং গাউন পরে আছে ডেভিড। লম্বা-চওড়া শরীর, সরু কোমর আর পুরুষালি শরীর।
যাই হোক, এর উপরে মাথা দেখে মনে হলো দুঃস্বপ্ন দেখছে ডেভিড। আপনাতেই হাঁ হয়ে গেল মুখ। শক্ত, ঠোঁট বিহীন মুখ, মনে হলো কোবরা।
আতঙ্কে জমে গেলেও আয়নার আরো কাছে এগিয়ে গেল ডেভিড। চুলের গোছা না থাকায় অদ্ভুত দেখাচ্ছে ক্ষতবিক্ষত খুলি। কখনো আগে ভাবেনি যে চুল না থাকলে এমন দেখাবে মাথা।
মুখের চামড়া আর মাংসে হাজারো কাটাকুটির মতো চিহ্ন। গালের উপর চামড়া টানটান হয়ে আছে। অনেকটা এশিয়াটিক ভাব এসেছে চেহারায়। কিন্তু চোখগুলো দেখাচ্ছে গোলগাল, নাজুক চোখের পাতা আর ভয়াবহ ফোলা ফোলা মাংসপিণ্ড।
নাকের কোন গড়ন বোঝা যাচ্ছে না। মাথার পাশে কানের জায়গায় হাস্যকর কিছু একটা ঝুলে আছে। পুরোটাই নগ্ন আর সেদ্ধ কিছু একটা দেখাচ্ছে।
হাসতে গেলে ভয়ঙ্কর ভাবে মোচড় খায় চামড়া। তারপর আবার শক্ত হয়ে যায়।
‘আমি হাসতে পারছি না।’ বলে উঠল ডেভিড।
না।’ একমত হলো সার্জন। তোমার অভিব্যক্তির উপর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না তোমার।
ব্যাপারটা চিন্তা করতে গেলে সত্যিই ভয়াবহ। এটা কোন মোচড় খাওয়া বা নির্যাতিত মাংসপিণ্ড নয়। দেখা যাচ্ছে যেসব সেলাইয়ের দাগ সেসবও মুখ্য নয় পুরোটা মনে হচ্ছে একটা অভিব্যক্তিহীন মুখোশ জমে যাওয়া মুখখানা দেখে মনে হলো বহু আগেই মারা গেছে সে, মানবিক কোন অনুভূতি বা উষ্ণতা ফুটে উঠল না চেহারায়।
‘ইয়াহ! কিন্তু অন্যদেরকে দেখা উচিৎ আপনার!’ নরম স্বরে জানাল ডেভিড।
‘আগামীকাল তোমার কানের পেছনে থাকা বাকি সেলাইগুলোও কেটে দেব আমরা। হাত থেকে বাকি মাংসপিণ্ডও সরিয়ে ফেলবো। এরপর ছেড়ে দেয়া হবে তোমাকে। প্রস্তুত হলেই আমাদের কাছে ফিরে এসো।
টাক মাথার উপর আলতো করে হাত বুলালে ডেভিড।
‘এখন থেকে আর চুল কাটা লাগবে না। রেজার ব্লেড ব্যবহার করতে হবে না। ডেভিডের কথা শেষ হতেই তাড়াতাড়ি উল্টো দিকে ঘুরে তাকাল সার্জন। চলে গেল প্যাসেজ ধরে। ডেভিডকে রেখে গেল নিজের নতুন চেহারার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে।
ডেভিডের জন্য খুঁজে পেতে যে পোশাক আনা হলো তা হলো বেশ সস্তা আর ঢিলেঢালা। স্লাকস, খোলা গলার শার্ট, হালকা জ্যাকেট আর স্যান্ডেল। মাথা ঢাকার জন্যে কিছু একটা চাইল ডেভিড। খুলির এই নতুন গড়ন অন্তত যেন ঢেকে রাখা যায়। একজন নার্স কাপড়ের টুপি এনে দিল তাকে। এরপর জানাল হাসপাতাল সুপারিনটেন্ডেন্টের অ্যাপার্টমেন্টে একজন অপেক্ষা করছে ডেভিডের সাথে দেখা করার জন্য।
মিলিটারি প্রভোস্ট মার্শাল অফিস থেকে এসেছে একজন মেজর। হালকা পাতলা গড়ন, ধূসর চুল, ঠাণ্ডা ধূসর চোখ আর শক্ত কঠিন মুখাবয়ব। হ্যান্ড শেকের কোন প্রস্তাব না করেই নিজের পরিচয় দিল মেজর। এরপর সামনে রাখা ডেস্কে একটা ফাইল খুললো।
‘আমাকে অফিস থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন ইস্রায়েলী এয়ারফোর্সের তোমার কমিশনে পদত্যাগপত্র নিয়ে যাই। শুরু করল মেজর। হা করে তাকিয়ে রইল ডেভিড। গভীর যন্ত্রণাদায়ক জ্বরতপ্ত রাতগুলোতে মনে হলো আরেকবার ওড়ার সুযোগ পেলে হাতে স্বর্গ পাবে সে।
বুঝতে পারলাম না আমি। তোতলাতে লাগল ডেভিড। সিগারেটের জন্য হাত বাড়ালো। প্রথম দিয়াশলাই ভেঙে গেলে দ্বিতীয়টি দিয়ে তাড়াতাড়ি আগুন জ্বেলে নিল। আপনি আমার পদত্যাগপত্র চাইছেন কিন্তু যদি আমি দিতে অস্বীকৃতি জানাই?
‘তাহলে কোর্ট মার্শাল ডাক ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই আমাদের হাতে। অভিযোগ হবে শত্রু সম্মুখে উপরওয়ালার আইনাদেশ অমান্য করেছো তুমি।
‘তাই। ভারী মনে মাথা নাড়ল ডেভিড। সিগারেটে টান দিল। চোখে ঢুকে গেল ধোয়া।
মনে হচ্ছে আমার কোন অপশন নেই।
‘আমি প্রয়োজনীয় কাগজ তৈরি করে এনেছি। এখানে আর এখানে স্বাক্ষর দাও, সাক্ষী হিসেবে আমি স্বাক্ষর করব।
কাগজগুলোর উপর নিচু হয়ে স্বাক্ষর দিল ডেভিড। নীরব রুমে কলমের ঘসঘস শব্দই শোনাল জোরালো হয়ে।
‘ধন্যবাদ।’ কাগজগুলো তুলে নিজের ব্রিফকেসে গুছিয়ে রাখল মেজর। ডেভিডের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে দরজার দিকে হাঁটা ধরল।
‘তো এখন আমি অচ্ছুত। আস্তে করে বলে উঠল ডেভিড। থেমে গেল মেজর। এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল দুজন দুজনের দিকে। এরপরই বদলে গেল মেজরের অভিব্যক্তি। ধূসর চোখ দুটো হয়ে উঠল হিংস্র।
‘তোমার কারণে দুটো যুদ্ধ প্লেন এমনভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে যে কিছুই করার নেই। অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়েছে আমাদের। তোমার কারণে মৃত্যু হয়েছে ভ্রাতৃসম অফিসারের। তোমার কারণে একটা যুদ্ধ প্রায় শুরু হবার উপক্রম, যাতে মূল্য দিতে হবে আরো হাজারো তরুণের জীবন হয়তো আমাদের অস্তিত্বই নড়ে উঠবে। আমাদের আন্তর্জাতিক বন্ধুদেরকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে তুমি। শক্তি দিয়েছো শত্রুর হাতে।’ থেমে গিয়ে লম্বা করে শ্বাস নিল মেজর। ‘আমার অফিস থেকে সুপারিশ করা হয়েছিল যেন তোমাকে ট্রায়ালে ফেলা হয় আর বিচার বিভাগ মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে যেন। কিন্তু শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ আর মেজর জেনারেল মোরদেসাই তোমাকে বাঁচিয়েছে এর হাত থেকে। আমার মনে হয় ভাগ্যকে দোষ না দিয়ে নিজেকে তোমার ভাগ্যবানই ভাবা উচিত।’
ঘুরে হাঁটা ধরল মেজর। পাথরের মেঝেতে জুতার শব্দ শোনা গেল পরিষ্কার।
হাসপাতালের সরু লবিটাতে দাঁড়িয়ে হঠাৎ করেই ডেভিডের ইচ্ছে হলো কাঁচের সুইং ডোর ঠেলে চলে যায় বাইরে, বসন্তের নরম রোদের তাপ পোহাতে। আগে একবার শুনেছিল যে বহুদিন ধরে কয়েদ থাকা কয়েদীর যখন মুক্তির সময় হয়ে আসে তখন নাকি এমন লাগে।
দরজার কাছে পৌঁছে পাশ ফিরে দেখল হাসপাতালের ছোট্ট প্রার্থনার জায়গা। নীরব চৌকোনো হলের এক কোণায় গিয়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো ডেভিড। অনেক উঁচু পর্যন্ত উঠে গেছে কাঁচের জানালা। রঙিন কাঁচের ভেতরে দিয়ে এসে পড়েছে সূর্যের আলো হলের মেঝেয়। একটুখানি শান্তি আর জায়গাটার সৌন্দর্য ভরে তুললো তাকে। সাহস করে উঠে দাঁড়াল ডেভিড। হেঁটে বের হয়ে চলে এলো রাস্তায়। জেরুজালেমগামী একটা বাসে উঠে বসে। পড়ল।
বাসের মাঝবরাবর জানালার পাশে একটা সিটে বসে পড়ল ডেভিড। আস্তে আস্তে চলতে লাগল বাস। পাহাড়ের উপর উঠে ছুটে চলল শহর। অভিমুখে।
একটু পরেই খেয়াল হলো যে তাকে কেউ দেখছে তাকিয়ে তাকিয়ে। মাথা তুলতেই দেখতে পেল তার সামনের সিটেই দুই বাচ্চা নিয়ে বসে আছে এক তরুণী মা। মলিন কাপড় পরিহিত তরুণীকে দেখে বোঝা গেল তার জীবনের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বহু ঝড় বয়সের আগেই তাকে বুড়ো বানিয়ে দিয়েছে। কোলের কাছে ধরা ছোট্ট শিশুকে দুধ খাওয়াচ্ছে প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে। দ্বিতীয় বাচ্চাটার চেহারা একেবারে স্বর্গদূতদের মতো। বয়স হবে চার কী পাঁচ। বড় বড় কালো চোখ আর মাথাভর্তি ঘন কোঁকড়া চুল। সামনের সিটে বসলেও পেছন ফিরে ডেভিডের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। বুড়ো আঙুল পুরে দিয়েছে মুখের ভেতর। মনোযোগ দিয়ে ডেভিডের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। পর্যবেক্ষণ করছে শিশুসুলভ কৌতূহল নিয়ে। হঠাৎ করেই মেয়েটার প্রতি কেমন মায়া জেগে উঠল তার মনে। মানুষের সংস্পর্শে আসার তাগিদ অনুভ করল। এত মাস ধরে এর অভাব বোধ করেছে সে।
ঝুকে সামনের দিকে গেল ডেভিড। হাসার চেষ্টা করে এক হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করল মেয়েটাকে।
মুখ থেকে হাত বের করে তাড়াতাড়ি সরে গেল মেয়েটা। মায়ের দিকে ফিরে হাত ধরে মুখ লুকালো মায়ের ব্লাউজের ভেতর।
পরের স্টপেজে বাস থেমে নেমে গেল ডেভিড। রাস্তা ছেড়ে পাথুরে পাহাড়ের পথ বেয়ে ওঠা শুরু করল।
দিনটা বেশ উষ্ণ আর কেমন ঝিম ধরা ভাব চারপাশে। পীচ্ ফলের বাগান থেকে মৌমাছির গুঞ্জন আর ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। ছাদে উঠে গেল ডেভিড। কিনারের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বুঝতে পারল কাঁপছে; অস্থির লাগছে তার। মাসের পর মাস হাসপাতালে কাটানোতে বহুদূর পর্যন্ত হাঁটার অভ্যেস নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু শুধু এটাই যে কারণ নয় তাও বেশ বুঝতে পারল। বাচ্চা মেয়েটার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটুকু তাকে বেশ নাড়া দিয়েছে।
মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো ডেভিড। একেবারে পরিষ্কার উজ্জ্বল নীল রঙে ছেয়ে আছে চারপাশ। উত্তরের দিকে অনেক উঁচুতে খানিকটা মেঘ। মনে হলো ওখানে যেতে পারলেই শান্তি খুঁজে পেত সে।
মালিক স্ট্রিটের উপর একটা ট্যাক্সি নামিয়ে দিয়ে গেল ডেভিডকে। সদর দরজা খোলা। তালায় চাৰি ঢোকানোর আগেই ধাক্কা দিতেই খুলে গেল।
বিস্মিত আর সতর্ক হয়েই লিভিং রুমে পা দিল সে। ঠিক তেমনটিই আছে যেমনটা সে বহু মাস আগে রেখে গিয়েছিল। কিন্তু কেউ এসে নিয়মিত ঝাড় দিয়েছে, পরিষ্কার করেছে। জলপাই কাঠের টেবিলের উপরে রাখা ফুলদানিতে তাজা ফুল-হলুদ আর বেগুনি রঙের ডালিয়া ফুলের বড়সড় একটা তোড়া।
খাবারের গন্ধ পেল ডেভিড। গরম গরম আর মসলাদার। হাসপাতালের দিনগুলোর তুলনায় একেবারে ভিন্ন আবহ এখানে।
“হ্যালো।’ ডেকে উঠল ডেভিড। কে এখানে?
‘ওয়েলকাম হোম! বন্ধ বাথরুমের দরজার ভেতর থেকে পরিচিত কণ্ঠে কথা বলে উঠল কেউ। আমি ভাবিনি তুমি এত তাড়াতাড়ি আসবে–আমার স্কার্ট উপরে আর প্যান্ট নিচে।
এরপর বজ্রগর্জনে বাথরুমের ফ্লাস টানা হলো আর দরজা গেল খুলে। জমকালো ভাবে বের হয়ে এলো ইলা কাঁদেশ। তার বিশাল কাফতানগুলোর একটা পরনে, প্রাথমিক রংগুলোর মিশেল দেখা গেল তাতে। মাথার টুপিতে আপেল সবুজ রঙ, পাশের আবার একটা মুরগির পাখা গোঁজা। মনে হলো যেন অস্ট্রেলিয়ান বুশ হ্যাট। সাথে আরো আছে বিশাল জেড পাথরের ব্রোচ আর উটপাখির পালকগুচ্ছ।
স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে নড়ে উঠল বিশাল হাত দুটো। মুখে ভেসে উঠল সন্দেহের হাসি। ডেভিডের দিকে এগিয়ে এলো ইলা। সন্দেহ চলে গিয়ে উজ্জ্বল ছোট ছোট চোখে দানা বাঁধলো ভয়। চলার গতি হয়ে গেল শ্লথ।
‘ডেভিড?’ অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বলে উঠল ইলা। এটা তুমি, ডেভিড?
‘হ্যালো ইলা।’
“ওহ, ঈশ্বর। ওহ, ঈশ্বর। ওরা কী করেছে তোমার সাথে, হে তরুণ দেবতা
‘শোন ত্যাঁদড়ের ছানা কর্কশ স্বরে বলে উঠল ডেভিড, যদি এরকম বিড়বিড় করা শুরু করো তাহলে সিঁড়ি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেবো।
নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করল ইলা। চোখে আসা পানি চেষ্টা করল আবারো ফেরৎ পাঠাতে। কিন্তু ঠোঁট কেঁপে উঠল, গলা ভারী হয়ে এলো। নাক টেনে এগিয়ে এসে বিশাল হাতে বুকে চেপে ধরল ডেভিডকে।
‘রেফ্রিজারেটরে এক কেস ঠাণ্ডা বীয়ার রেখে দিয়েছি আর আমাদের জন্য কারী রান্না করেছি। আমার রান্না পছন্দ হবে তোমার। এই কাজটা আমি সত্যিই ভাল পারি।’
চেটেপুটে সব সাবাড় করে দিল ডেভিড। ঠাণ্ডা বীয়ার দিয়ে এমন ভাবে খেলো যেন কতদিনের অনাহারী সে। শুনতে লাগল সাথে ইলার বকবকানি। মরণার মতো ছিটকে বের হতে লাগল শব্দের বহর। ইলা চেষ্টা করল এর মাধ্যমে নিজের অস্বস্তিকে ঢেকে রাখতে।
‘তারা আমাকে তোমার সাথে দেখা করতে দেয়নি। কিন্তু আমি প্রতি সপ্তাহে ফোন করে খবর নিয়েছি। সিস্টার আর আমার মাঝে বেশ বন্ধুত্বও হয়ে গেছে। সে আমাকে জানিয়েছে যে তুমি আজ আসবে। তাই আমি চেষ্টা করেছি তোমার জন্য তৈরি থাকার
এমন ভাবে কথা বলছে ইলা যেন সরাসরি ডেভিডের দিকে তাকাতে না হয়। তারপরেও চোখে চোখ পড়লেই দেখা গেল ছায়া। যদিও সেটা লুকাতে সদা সচেষ্ট ইলা। অবশেষে খাওয়া শেষ করল ডেভিড। জানতে চাইল ইলা; ‘এখন তুমি কী করবে ডেভিড?’
‘আমার যেটা ইচ্ছে তা হলো ফিরে গিয়ে আকাশে উড়ে যাওয়া। এটা করতেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি আমি–কিন্তু তারা আমাকে বাধ্য করেছে। কমিশন থেকে পদত্যাগ করতে। আমি আইন অমান্য করেছি। জো আর আমি ওদের অনুসরণ করে সীমান্ত পর্যন্ত গিয়েছিলাম তাই তারা আমাকে আর চায় না।’
‘যুদ্ধ প্রায় শুরু হয়েই যাচ্ছিল ডেভিড। তুমি আর জো সত্যিই পাগলামী করেছে।
মাথা নাড়ল ডেভিড। আমি সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। আমি সেদিনের পর থেকে সোজা ভাবে আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না– ডেবরা_
তাড়াতাড়ি থামিয়ে দিল ইলা। হ্যাঁ, আমি জানি। আর একটা বীয়ার নেবে?
বাধা দেবার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল ডেভিড। ও কেমন আছে, ইলা?’ পুরো সময় ধরে এই প্রশ্নটাই করতে চাইছে সে।
‘ও ভালো আছে। ডেভি। নতুন বই শুরু করেছে আর মনে হয় প্রথমটার চেয়েও ভালো হবে। আমার মনে হয় ও খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন লেখক হয়ে উঠবে।
‘ওর চোখ? কোন উন্নতি হয়েছে?
মাথা ঝাঁকালো ইলা। ও এটা মেনে নিয়েছে। এখন মনে হয় না এতে কিছু আর যায় আসে। যেভাবে তুমিও যা হয়েছে তাকে মেনে নেবে’।
কিছুই শুনছিল না ডেভিড। ইলা এই সময়টুকুতে, যতদিন আমি হাসপাতালে ছিলাম শুধু এটুকুই আশা করেছি যে–আমি জানি যে এটা অনর্থক কিন্তু তারপরেও আশা করেছি ও আমার সাথে কথা বলবে। একটা কার্ড, একটা শব্দ–’
‘ও জানেই না ডেভি।
জানে না?’ তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল ডেভিড। টেবিলের ওপাশ থেকে বঁকে ইলার হাতের কব্জি চেপে ধরল, এর মানে কী?
‘জো মারা যাবার পর ডেবরার বাবা অনেক রেগে গেছে। সে বিশ্বাস করে যে এর জন্য তুমিই দায়ী।
মাথা নাড়ল ডেভিড। মুখের শূন্য মুখোশেও ফুটে উঠল অপরাধবোধ।
‘ডেবরার বাবা ওকে জানিয়েছে যে তুমি ইস্রায়েল ছেড়ে চলে গেছে। আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করেছি যে এ ব্যাপারে নীরব থাকবো। ডেবরা এটাই বিশ্বাস করে এখন।
ইলার কব্জি ছেড়ে দিল ডেভিড। নিজের বীয়ারের গ্লাস তুলে নিয়ে চুমুক দিল।
‘তুমি এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি ডেভিড? এখন কী করবে তুমি?
‘আমি জানি না ইলা। আমাকে ভাবতে হবে মনে হয়।
পাহাড়ের দিক থেকে বয়ে আসছে গরম বাতাসের হল্কা। লেকের দিকটা প্রায় কালোই দেখাচ্ছে। নোঙ্গরে বাঁধা অবস্থায় দুলছে ফিশিং বোটগুলো। ঝুলিয়ে রাখা জালের সারি উড়ছে নববধূর ওড়নার মতো।
ডেবরার চুলে এসে লাগল বাতাসের ঝাপটা। খুলে গিয়ে মনে হলো মেঘ জমেছে। শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে গায়ের সিঙ্কের পোশাক।
ক্রুসেডার দুর্গের ছাদের উপর দাঁড়িয়ে নিজের লাঠির মাথার উপর হালকা ভাবে রাখল দুই হাত। তাকিয়ে রইল পানির দিকে। যেন সত্যিই দেখতে পাচ্ছে সে।
পাশে বসে আছে ইলা। মিস্ত্রিদের ফেলে যাওয়া একটা ব্লকের উপর বসে আছে ইলা। কথা বলার সময় এক হাত দিয়ে ধরে রাখল মাথার টুপি। ডেবরার মুখের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে ওর মনোভাব বুঝতে চাইল ইলা।
‘একটা সময় মনে হয়েছিল এরকম করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমিও রাজি হয়েছিলাম সত্যিটা তোমার কাছে থেকে লুকিয়ে রাখার পক্ষে। কারণ আমি চাইনি যে তুমি নিজেকে কষ্ট দাও–
তীক্ষ্ণস্বরে বলে উঠল ডেবরা আর কখনো এরকম করবে না।
মাথা নেড়ে একমত হয়ে বলে চলল ইলা, আমার জানার কোন উপায় ছিল না যে ও কতটা আঘাত পেয়েছে। কেউ আমাকে ওর সাথে দেখা করতে দেয়নি।
রাগতভাবে মাথা নাড়ল ডেবরা। কিন্তু চুপ করে রইল। ইলা আবারো অবাক হলো দেখে যে দৃষ্টিহীন চোখেও এতটা অভিব্যক্তি ফুটে উঠতে পারে। ইলার দিকে মাথা নাড়তেই মধুরঙা চোখের বিদ্যুৎ স্পষ্ট বোঝা গেল।
‘এ সময় তোমাকে আঘাত করা উচিত ছিল। তাই না ডিয়ার? তুমি এত সুন্দর ভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছো–বই নিয়ে কাজ করছে। আমার মনে হয়েছে তোমাকে বলে কোন লাভই হবে না। আমি তাই তোমার বাবার সাথে সাহায্য করার প্রতি মনস্থির করেছি। দেখো কেমন করে সব হয়ে গেল।
‘তাহলে এখন কেন বলছো আমাকে’, জানতে চাইল ডেবরা। তাহলে এখন কেন তোমার মত পরিবর্তন করেছ? কী হয়েছে ডেভিডের?
‘গতকাল দুপুরবেলা হাদ্দাসা হাসপাতালে থেকে রিলিজ দেয়া হয়েছে ওকে।
হাসপাতাল? হতভম্ভ হয়ে গেল ডেবরা। তুমি নিশ্চয়ই বলতে চাইছে না যে ও এতদিন হাসপাতালে ছিল? নয় মাস–এটা অসম্ভব!
‘এটাই সত্যি।
‘তার মানে ও অনেক আঘাত পেয়েছে। ডেবরার রাগ পরিণত হয়ে গেল উদ্বিগ্নতায়। “ও কেমন আছে ইলা? কী হয়েছে? এখন সুস্থ হয়েছে?
এক মুহূর্ত চুপ করে রইল ইলা। ডেবরা এগিয়ে এলো তার কাছে। কী জানতে চাইল সে।
‘ডেভিডের প্লেন পুড়ে গেছে। আর মাথায় খুব বাজে ভাবে পোড়র আঘাত পেয়েছে সে। এখন পুরোপুরি সুস্থ। পোড়া ক্ষত শুকিয়ে গেছে কিন্তু
দ্বিধা করতে লাগল ইলা। ডেবরা ওর হাত চেপে ধরল। বলো ইলা! কিন্তু?’
‘ডেভিড আর আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মানুষটি রইল না।’
‘আমি বুঝতে পারছি না।’
‘ও আর আগের মতো দ্রুত আর প্রাণশক্তিতে ভরপুর নেই–যে কোন নারী ওকে এখন দেখতে পেলে ভালোবাসা তো দূরের কথা কাছেই যেতে চাইবে না।’
মনোযোগ দিয়ে শুনছিল ডেবরা। এখন মুখের ভাব হয়ে গেল নরম।
‘ও এখন নিজের ব্যাপারে সচেতন। লুকিয়ে যাবার মতো কোন জায়গা খুঁজছে, আমার মনে হয়। ও উড়ে যাবার কথা বলছে যেন এভাবেই পালাতে চায়। ও জানে ও এখন একা, মুখোশের কারণে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন’
কুয়াশা দেখা গেল ডেবরার চোখে। গমগমে কণ্ঠস্বর খানিকটা শান্ত করে বলে চললো ইলা।
‘কিন্তু একজন আছে যে কখনো এই মুখোশ দেখতে পাবে না।’ মেয়েটাকে নিজের দিকে টেনে নিল ইলা। একজন কেউ ওকে আগের মতোই মনে রেখেছে। ইলার হাতে ডেবরার চাপ বাড়লো। হাসতে শুরু করল সে এটা এমন একটা অভিব্যক্তি যা একেবারে তার ভিতর থেকে উঠে আসে।
‘ওর এখন তোমাকে দরকার ডেবরা।’ নরম স্বরে জানাল ইলা। এই একমাত্র জিনিস আছে ওর জন্য। তোমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে তুমি?
‘ওকে আমার কাছে নিয়ে এসো ইলা। কেঁপে গেল ডেবরার গলার স্বর। ‘যত তাড়াতাড়ি পারো ওকে আমার কাছে নিয়ে এসো।’
.