২. ফর্মুলা ওয়ান রেসিং ড্রাইভার

ভবিষ্যতে ফর্মুলা ওয়ান রেসিং ড্রাইভার হতে চায় এমনতরদের জন্য রোমের পথে অস্টিয়াতে পরিত্যক্ত একটা কংক্রিট সার্কিটে গড়ে উঠেছে স্কুল। তিন সপ্তাহের কোর্সের খরচ ৫০০ ইউ এস ডলার

ভিয়া ভেনেতোতে উঠল ডেভিড আর প্রতিদিন গেল ট্রাকে। যদিও ও পুরো কোর্সটাই শেষ করল তারপরেও প্রথম সপ্তাহের শেষেই জেনে গিয়েছিল এটা ওর গন্তব্য নয়। অবারিত আকাশে ছুটে বেড়ানোর পর ট্র্যাক মনে হলো সংকীর্ণ। এমনকি একটা জেটের ইঞ্জিনের কাছের টাইরেল ফোর্ডের গড়গড় করা শক্তি কিছুই নয়। যদিও ক্লাশের অন্যদের তুলনায় ওর মনোসংযোগ কমই ছিল, কিন্তু গতি আর সামঞ্জস্য সম্পর্কে জন্মগত প্রতিভার জোরে সবার উপরেই থাকল ওর ফলাফল। একটা কোম্পানির কাছ থেকে ড্রাইভিং করার প্রস্তাবও পেয়ে গেল। বেতন তত একটা ভালো না হলেও সিজনের জন্য প্রায় কন্ট্রাক্ট সাইন করেই ফেলেছিল সে। একেবারে শেষপর্যায়ে মন পরিবর্তন করে আবারো শুরু হয় চলা।

এথেন্সে এক সপ্তাহ কাটায় পিরাউস আর গ্লাইফাড়ার ইয়ট বেসিনের কাছে ঘোরাঘুরি করে। একটা মোটর ইয়ট কিনে দ্বীপ সমূহে চার্টার করে ঘুরে বেড়ালে কেমন হবে ব্যাপারটা, এ সম্পর্কে ও খোঁজখবর নিল। সূর্য, সমুদ্র আর সুন্দরী মেয়েদের মিলনমেলা দেখে মনে হলে ভাল হবে ব্যাপারটা। ইয়টগুলোও বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিল তুষারের মতো পেইন্ট-ওয়ার্ক আর বার্নিশ করা কাঠের কাজের জন্য। কিন্তু সপ্তাহখানেকের মাঝে বুঝে গেল যে চার্টার করে সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানো মানে একদল বিরক্তিকর রোদে পোড়া সী-সিক টুরিস্টদের বোর্ডিং হাউজ বয়ে বেড়ানো।

 সপ্তম দিনে এথেন্স বন্দরে নোঙ্গর ফেলল আমেরিকান ষষ্ঠ বহর। বিচের দিকে মুখ করে থাকা একটা ক্যাফের টেবিলে বসেছিল ডেভিড। সূর্যের নিচে বসে ওজো পান করতে করতে বাইনোকুলার চোখে দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারকে। বিশাল সমতল উপরতলায় পাখা ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি ক্রুসেডারস আর ফ্যান্টমস্। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো কেমন একটা তৃষ্ণা জেগে উঠল। অনেক দিনের পিপাসার্ত যেন সে। আত্মার গহীন থেকে উঠে এলো দীর্ঘশ্বাস। মনে হলো সারা পৃথিবী খুঁজে নিজের জন্য কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। বাইনোকুলার রেখে দিল একপাশে। তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। অনেক উঁচুতে একটা মেঘখণ্ড। নীলের গায়ে উজ্জল রুপালি।

দুধের মতো ওজোর গ্লাস তুলে নিল ডেভিড। সূর্যের তাপে গরম হয়ে আছে পানীয়টুকু। গলায় ঢেলে দিল মিষ্টি তরল।

পূর্ব অথবা পশ্চিম, ঘরই হলো আসল।

উঁচুস্বরে বলে উঠল ডেভিড। মনশ্চক্ষে দেখতে পেল গ্লাস আর স্টিল দিয়ে ঘেরা উঁচু অফিসে বসে আছে পল মরগ্যান। ধৈর্য নিয়ে বসে আছে যেন একটা জেলে। সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে আছে তার জাল। ঠিক এই সময়ে এথেন্সে ছড়িয়ে থাকা জালটা গুটাতে শুরু করে দিল। পল মরগ্যানের চোখে মুখে ফুটে ওঠা তৃপ্তির ছাপটাও যেন স্পষ্ট দেখতে পেল ডেভিড। টেনে নিচ্ছে ডেভিডকে। ধুত্তোরি, আমি তো এখনো রিজার্ভ অফিসার হিসেবে ফ্লাই করতে পারি, মনে মনে ভাবল সে। আর সবসময়ের জন্য লিয়ার তো আছেই যদি বার্নির থেকে নেয়া যায়, তবেই।

গ্লাস রেখে দ্রুত উঠে দাঁড়াল ডেভিড। আত্মরক্ষার ক্ষীণ আশা জেগে উঠেছে মনের মাঝে। ক্যাব থামিয়ে ছুটে চলল সিনডাগমা স্কোয়ারে গ্রান্ডে ব্রেটাগনেতে নিজের রুমে।

অথচ সব সংকল্প উবে যেতে খুব বেশি একটা সময়ও লাগেনি। কেননা রাতের ডিনারে ডেভিডের সঙ্গী হয় জন ডিনোপোলাস, মরগ্যান গ্রুপের গ্রীস এজেন্ট। কৃশকায় রোদে পোড়া বলিরেখাহীন অভিজাত চেহারার জনের চুলে সাদার ছোঁয়া আর বেশভূষাতেও আড়ম্বরহীন।

ডেভিডের সাথে এক টেবিলে বসার জন্য জন নির্বাচন করল বেশ কয়েকটি ইটালিয় স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্সের নারী-তারকাকে। উদ্ধত যৌবন তরুণী নারীর চোখ দুটি ঘন কালো আর উজ্জ্বল। জন ডেভিডকে আফ্রিকা থেকে আগত একজন হীরক কোটিপতি হিসেবে প্রমাণ দেয়ার পর থেকে কালো চোখ দুটোতে রীতিমত আন্দোলন আর ব্যাকুলতা শুরু হয়ে গেল।

ডায়মন্ড যদিও সবচেয়ে সুন্দর, তথাপি মরগ্যান গ্রুপে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়।

কোমল সন্ধ্যায় ডায়োনি সিয়াসের ছাদে বসল তারা। লাইকা বেটাস-এর পাথর কেটে ধাপে ধাপে তৈরি করা হয়েছে রেস্টুরেন্টটি; সেন্ট পল গির্জার নিচে।

 এঁকেবেঁকে পথ বেয়ে পাইন বনের মাঝখান দিয়ে শান্ত রাতের বাতাসে হাতে মোমবাতি নিয়ে মিষ্টি গান গেয়ে এগিয়ে চলেছে ইস্টার শোভাযাত্রাকারীদের দল। এর অনেক উপরে পাহাড়ের মাথায় অ্যাক্রোপলিসের সোজা কলামগুলো ভেসে যাচ্ছে আলোর বন্যায়। প্রাচীন আইভরির মতই মাখন রঙা হয়ে আছে এগুলো। এর নিচে মধ্যরাতের পানিতে আলোর মালা গলায় দিয়ে ভাসছে আমেরিকান রনপোত।

‘গ্রিসের বিজয়গাথা ছিল। বিড়বিড় করে উঠল ইটালিয় তারকা। মনে হল যেন প্রাচীন আমলের কোনো তাপসীর গলা। ভারী রত্ন পরা একটা হাত রাখল ডেভিডের উরুতে। আরেকটা হাত দিয়ে লাল সামোস ওয়াইন তুলে ধরল ডেভিডের উদ্দেশে আর এমন ভাবে তাকাল যে ঘন চোখের পাতার নিচের ভাষা বুঝতে সমস্যা হলো না ডেভিডের।

 মহিলার ধৈৰ্যশক্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল ডেভিড। ক্রিম দেয়া লেমন সসে ডুবিয়ে রাখা আঙুর পাতায় মোড়ানো মাংস দিয়ে মেইন কোর্স খাবার পরই কেবলমাত্র ইটালিয় তারকা পরামর্শ দিল যে ডেভিড হয়তো তার পরবর্তী ছবিতে অর্থলগ্নী করতে রাজি হয়ে যাবে। চলুন এমন কোন জায়গা খুঁজে বের করি যেখানে বসে এ ব্যাপারে কথা বলতে পারব আমরা। বিড়বিড় করে উঠল নারী তারকা আর তার স্যুইট ছাড়া ভালো জায়গা আর কোনটা হতে পারে?

জুন ডিনোপোলাস হাত নেড়ে বিদায় জানাল তাদেরকে। জনের মুখে হাসি আর বিরক্তিকর একটা ভঙ্গি থেকে পুরো ব্যাপারটার অসাড়তা টের পেল ডেভিড।

নারী তারকার সুইট বেশ চিত্তাকর্ষক। মোটা সাদা কার্পেট আর বড়সড় চামড়ার কালোসোফা। নিজের জন্য ড্রিংক নিল ডেভিড। এই ফাঁকে বেশ পরিবর্তন করতে গেল নারী তারকা। ড্রিংক মুখে নিয়েই ডেভিড বুঝতে পারল যে এটা তার পছন্দ নয়। বার কাউন্টার ছেড়ে চলে আসল সে।

বেডরুম থেকে বের হয়ে এলো নারী তারকা। পরনে সাদা সাটিনের বেডরোব। হাতা কাটা রোবের স্বচ্ছ কাপড় ভেদ করে গোলাপী উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে দেহত্বক। চুল খোলা, আবেদনময়ী ভঙ্গিতে কুঁকড়ে আছে কাঁধের চারপাশে হঠাৎ করেই পুরো ব্যাপারটাতে অসুস্থ বোধ করল ডেভিড।

 ‘আমি দুঃখিত। জানাল ডেভিড। জন মজা করছিল–আমি কোন মিলিয়নিয়ার নই আর ছেলেদের ক্ষেত্রেই আগ্রহী বোধ করি শুধু।

দরজা বন্ধ করে বের হয়ে এলো ডেভিড। সাথে সাথে শুনতে পেল দরজার গায়ে গ্লাস ভাঙার শব্দ।

 নিজের হোটেলের রুমে ফিরে কফির অর্ডার দিল ডেভিড। কী মনে হতেই আবারো টেলিফোন তুলে নিয়ে কেপ টাউনে কল করল। অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে লাইন পেয়ে গেল সে। ঘুম জড়ানো মেয়েলি কণ্ঠ শোনা গেল অপর পাশ থেকে।

‘মিটজি? হেসে ফেলল ডেভিড। কেমন আছে মেয়েটা

? ‘তুমি কোথায় ওয়ারিওর? বাসায়?

 ‘আমি এথেন্সে, ডল।

 ‘এথেন্স–গড! যুদ্ধের খবর কী?

টানা হেচড়া করে এগোচ্ছে।

ইয়াহ! আমারই তাই মনে হয়। কাশি দিল মিটজি। গ্রিক গার্লস আর আগের মতো নেই–ডিয়ার।

কেমন আছো মিটজি?’

 ‘আই অ্যাম ইন লাভ, ডেভি। মানে সত্যিকারের প্রেম। অনেক দূর এগিয়ে গেছি। আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি। অদ্ভুত না ব্যাপারটা?’

হঠাৎ করেই রেগে গেল ডেভিড। মিটজির গলার কণ্ঠে মনে হলো হিংসাও এলো ওর মাঝে।

‘দ্যাটস গ্রেট, ডল। আমি কি চিনি ওকে?

 ‘সিসিল ললি। তুমি চেনো। ড্যাডির অ্যাকাউন্ট্যান্টদের একজন।

 বিশালদেহী, বিবর্ণ চেহারা, চশমা পরা আর সিরিয়াস টাইপের একটা মানুষের কথা মনে পড়ে গেল ডেভিডের।

কনগ্রাচুলেশনস,’ বলল ডেভিড। নিজেকে খুব একা মনে হলো। বাড়ি থেকে এত দূরে, তাকে ছাড়াও জীবন সেখানে ঠিকই এগিয়ে চলেছে।

 ‘তুমি ওর, সাথে কথা বলতে চাও?’ জানতে চাইল মিটজি। আমি তাকে জাগিয়ে দিচ্ছি।’ বিড়বিড় শব্দে কিছু শোনা গেল অপরপাশে। তারপরই লাইনে এলো সিসিল।

 ‘নাইস ওয়ার্ক, সত্যি কথাই বলল ডেভিড। তার তুলনায় মিটজির শেয়ার নিঃসন্দেহে বেশি মরগ্যান গ্রুপে। নিজেকে তেলের কূপে ফেলে দিয়েছে সিসিল।

‘ধন্যবান, ডেভি। পাঁচ হাজার মাইল পার হয়েও টেলিফোনের তার বেয়ে ঠিকই ভেসে এলো সিসিলের কণ্ঠের অস্বস্তি।

 ‘শোন, লাভার যদি মেয়েটাকে তুমি একটুও আঘাত দাও, আমি নিজে তোমার কলজে ছিঁড়ে গলা দিয়ে ঢুকিয়ে দেবো, বুঝলে?

‘ঠিক আছে। নিজের কণ্ঠের সতর্কতা ভাব লুকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলো সিসিল। আমি মিটজিকে ফোন দিচ্ছি।

রাখার আগে আরো বকবক করল মিটজি। পঞ্চাশ ডলার খরচ করিয়ে তবেই ছাড়লো সে। মাথার পেছনে হাত দিয়ে শুয়ে রইল ডেভিড। ভাবতে লাগল নরম মনের গাড়ল বোনটা আর নতুন পাওয়া খুশির কথা। এরপর হঠাৎ করেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল ডেভিড। স্পেন ছাড়ার পর থেকেই অবচেতন ভাবে কাজটা করতে চাইছে সে। আবারো ফোন তুলে নিয়ে পোর্টারের ডেস্কে ফোন করল।

 ‘এত সকালে তোমাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। কিন্তু যত শীঘ্ন সম্ভব ইস্রায়েলের ফ্লাইট ধরতে চাই আমি। অ্যারেঞ্জ করতে পারবে প্লিজ?

.

মরুভূমি থেকে আসা মোলায়েম সোনালি কুয়াশায় ঢেকে আছে আকাশ। এর মাঝ দিয়েই উড়ে চলল বিশাল টি.ডব্লিউ.এ. ৭৪৭। টাচ্ ডাউনের ঝাঁকুনি খাবার আগে ঘন সবুজ সিটরাস বাগানের একঝলক দেখতে পেল ডেভিড। পৃথিবীর অন্য সব বিমানবন্দরের সাথে কোন পার্থক্য নেই লডের। কিন্তু এর দরজার বাইরের এমন জায়গা আর কখনো দেখেনি সে। বিশাল এক ভিড়ের সাথে যুদ্ধ করে বড়সড় কালো কন্যুনাল ট্রাক্সির মাঝে একটা সিট পেল ডেভিড। ট্রাক্সির গায়ে প্লাস্টার লাগান আর বিভিন্ন অলংকারও ঝুলছে। এমনকি ভদ্র-সভ্য ইটালিয়দের মাঝেও দেখা গেল উজ্জ্বলতা।

ট্যাক্সিতে উঠে বসার পর মনে হল পরিবারের সবাই মিলে মিশে ঘুরতে বের হয়েছে আর ডেভিডও এই পরিবারেরই সদস্য। তার একপাশে বসে আছে বুকে সেনাবাহিনীর চিহ্ন সম্বলিত প্যারাট্রুপার, গলা থেকে ঝুলছে উজি সাব-মেশিনগান; সিগারেট সাধলো লোকটা ডেভিডকে। অন্যপাশে বসেছে খাকি ইউনিফর্ম পরিহিত এক বালিকা। হরিণ চক্ষু ইস্রায়েলী বালিকার চোখ দুটো হয়ে উঠল আরো ঘন কালো আর সুন্দর, যখন ডেভিডের দিকে ঘুরে তাকাল। প্রায়ই স্যান্ডউইচ আর ভাজা মটরশুটির বল সাধলো ডেভিডকে। পিঠাও নিতে বলল সাথে। আবার নিজের ইংরেজিও ঝালাই করে নিতে লাগল ডেভিডের উপর। সামনের আসনে বসা সবাই ঘুরে তাকাল এই আলোচনায় অংশ নিতে। এদের মাঝে ড্রাইভারও অন্তর্ভূক্ত হলো। যদিও সে তার গতি এতটুকু কম হতে দিল না আর কথার ফাঁকে ফাঁকে যতিচিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করল বিকট শব্দের হর্ন আর পথচারী ও অন্য ড্রাইভারদের উপর গালি-গালাজ।

উপকূলীয় নিচু ভূমিতে কুয়াশার মতই ভারী হয়ে আছে কমলার সুগন্ধ। এরপর থেকে ইস্রায়েলের পরিচিতি হিসেবে এই গান্ধটাই পাবে ডেভিড।

 জুদাইয়ান পাহাড়ে উঠে এলো ট্যাক্সি। নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসল ডেভিডকে। পাইনের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাইওয়ে, শো শো বাতাস, চারপাশে উজ্জ্বল-ধূসর গড়ানে ভূমি পার হওয়া যেখানে সূর্যের আলোয় সাদা পাথর চকচক করে হাড়ের মতো রুপালি জলপাই গাছগুলো শাখা মেলে রেখেছে ছাদের উপর–যা স্বাক্ষী হয়ে আছে ছয় হাজার বছর ধরে মানুষের ধৈর্যশীল পরিশ্রমের। ডেভিডের মনে হচ্ছে সবকিছুই তার অনেক পরিচিত। যদিও দক্ষিণের অন্তরীপের যেসব পাহাড়ের চেয়ে একেবারে ভিন্ন, যাদেরকে সে ঘর বলে জানে। অনেক ধরনের ফুল দেখা গেল, ঠিক ভাবে নাম বলতে পারবে না সে। ক্রিমসন ফুটে ওঠে রক্তের মতো লাল হয়ে। হঠাৎ করেই ঝাঁকি খাওয়ায় মনে হলো শরীরে ব্যথা পেল সে। এমন সময় চোখ পড়ল গাছের ফাঁকে থাকা চকোলেট রঙের ঝটপটানি আর সাদা পাখা। চিনতে পারল আফ্রিকান হুপির নড়াচড়া–এমন একটা পাখি যার অর্থ ঘরে পৌঁছে গেছে সে।

 ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা বোধ করল সে। নাম-ঠিকানাবিহীন এ উদ্বেগ বেড়েই চলল, যত সে পৌঁছে যাচ্ছে সেই নারীর কাছে যাকে দেখতে সে এসেছে–আর এমন কিছু যার ব্যাপারে সে এখনো সন্দিহান।

অবশেষে নিজের শিকড় খুঁজে পেয়েছে সে, এমন বোধ হল তার। কাছাকাছি বসে থাকা তরুণীর জন্য সমবেদনা জাগল।

‘দেখো, চিৎকার করে উঠল মেয়েটা। ডেভিডের হাত ধরে দেখাতে লাগল রাস্তার পাশে পড়ে থাকা যুদ্ধের আবর্জনার দিকে, পোড়া ট্রাক আর সশস্ত্র বাহন, জেরুজালেমের পথে মারা যাওয়া মানুষের স্মরণার্থে সাজিয়ে রাখা। হয়েছে এগুলো। এখানে যুদ্ধ হয়েছিল।’

সিটের উপর ঘুরে বসে মেয়েটার চোখ-মুখ পরীক্ষা করতে লাগল ডেভিড। দেখতে পেল একই শক্তি আর নিশ্চিন্তের ভাব; ডেবরার যে গুণের প্রশংসা করে সে। এরা এমন মানুষ যারা পুরো দিনটাই উপভোগ করে আর এর কাছাকাছিটুকুই পরের দিন বলে বিবেচনা করে।

“আর যুদ্ধ হবে এখানে? জানতে চাইল ডেভিড।

‘হ্যাঁ। কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই উত্তর দিল মেয়েটা।

 “কেন?”

‘কারণ–যদি এটা ভালো হয়–তুমি অবশ্যই এর জন্য লড়বে। এরপরে মেয়েটা হাত দুটো ছড়িয়ে এমন ভঙ্গি করল যেন ঢেকে ফেলবে পুরো ভূমি, আর এর মানুষকে।

আর এটা আমাদের অনেক ভালো এটা।

‘রাইট অন, ডল। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসল ডেভিড আর মেয়েটা।

 তো, জেরুজালেমে পৌঁছে গেছে তারা। কাস্টার্ড হলুদ রঙের পাথর দিয়ে বানানো লম্বা সব অ্যাপার্টমেন্ট, পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ স্তম্ভের মতো বিশাল দেয়াল ঘেরা দুর্গ প্রাচীরের মাঝে, এটিই হচ্ছে জেরুজালেমের হৃদয়।

ফ্লাইটে থাকা অবস্থাতেই ডেভিডের জন্য ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে রুম বুক করে দিয়েছে টি.ডব্লিউ.এ.। রুমের জানালা দিয়ে পুরাতন শহরে গেৎশিমানি বাগানের দিকে তাকাল ডেভিড। দেখা যাচ্ছে ছোট গম্বুজ, সুক্ষাগ্র চূড়া আর সোনালি আভা মণ্ডিত পাথরের গম্বুজ। জুদাইজম আর খ্রিস্টিয়ানিটির কেন্দ্রস্থল মুসলিমদের পবিত্র স্থান, দু’হাজার বছরব্যাপী যুদ্ধের ক্ষেত্র, প্রাচীন ভূমি সব মিলিয়ে কেমন অদ্ভুত বোধ জাগলো ডেভিডের মনে। জীবনে প্রথমবারের মতো নিজের মাঝে এমন একটা অংশ উন্মোচিত হলো যা ইহুদি, মনে হল এ শহরে আসাটা কোন মতেই ভুল হয়নি।

 ‘সম্ভবত, চিৎকার করে বলে উঠল সে, এখানে আছে সবকিছু যা আমি খুজঁছি।’

সন্ধ্যার খানিকটা আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার পার্কিংয়ের জায়গায় ট্যাক্সি ক্যাব ছেড়ে নামলো ডেভিড। মেইন গেইটের কাছে সারা শরীর সার্চ করে দেখল গার্ড। এখানে এভাবে সার্চ করাটা রুটিনের মতো, তাই কয়েক দিনের মাঝেই ব্যাপারটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ল ডেভিড। কিন্তু ভেতরে ঢুকে খালি ক্যাম্পাস দেখে অবাক হয়ে গেল সে। কোথাও কেউ নেই। তারপর মনে পড়ল যে আজ শুক্রবার-সাব্বাতের জন্য কিছুই আজ ধীর গতিতে চলবে।

প্রধান প্লাজার চারপাশে ফুটে আছে লাল-পাপড়ির গাছ। অনিন্দ্যসুন্দর পুলের চারপাশেও তাই। অ্যাডমিন ব্লকে ঢুকে ডেবরার কথা জানতে চাইল ডেভিড। আরেকটু হলে পোর্টার প্রায় চলেই যাচ্ছিল ডেস্ক থেকে।

মিস মোরদেসাই– নিজের লিস্ট চেক করে দেখল পোর্টার। হ্যাঁ ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে, লটারম্যান বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায়।’ কাঁচের দরজা দিয়ে দিক নির্দেশ করে দেখাল লোকটা। আপনার ডানদিকের তৃতীয় বিল্ডিংটা। সোজা ভেতরে চলে যান।

 শিক্ষার্থীদের টিউটোরিয়ালে ব্যস্ত, ডেবরা। অপেক্ষার সময়টুকু ছাদে সূর্যের উষ্ণতায় চেয়ারে বসে কাটিয়ে দিল ডেভিড। হঠাৎ করেই অনিশ্চয়তার শীতল স্রোত বয়ে গেল যেন মেরুদণ্ড বয়ে। এথেন্স ছাড়ার পর এই প্রথম মনে। হলো যে, ডেবরা মোরদেসাইয়ের কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পাবার কোন কারণ কী আছে তার? এমনকি মেয়েটার প্রতি নিজের আচরণ ব্যাখা করতেও হিমশিম খেয়ে গেল সে। আত্মসমালোচনা এমন একটা ব্যাপার যেটা ডেভিড খুব বেশিবার চেষ্টা করেনি আগে। এছাড়া তার যে ভাগ্য আর চেহারা তাতে খুব বেশি প্রয়োজনও পড়েনি ব্যাপারটার। তাই বসে থাকতে থাকতে মনে হলো পছন্দ না হলেও কথাটা হয়তো সত্যি। ডেবরা তাকে বখে যাওয়া হিসেবে উল্লেখ করেছে। তা হয়তো মিথ্যে নয়। চিন্তায় ছেদ ঘটিয়ে ছাদের দিকে এগিয়ে আসল শিক্ষার্থীদের জুতার শব্দ। এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে উঠে এলো উপরে। বুকের মাঝে ধরা বই আর বেশির ভাগ মেয়েরাই পথ চলতে গিয়ে দ্রুত নজর বুলিয়ে নিল ডেভিডের উপর।

আরো খানিক বিরতির পর এগিয়ে এলো ডেবরা। বগলের নিচে বই, এক কাঁধে ব্যাগ ঝুলছে। কাঁধের উপর জড়ো করে বাঁধা চুল, মুখে কোন মেক-আপ নেই, কিন্তু স্কার্টে গ্রীষ্মের উজ্জ্বল কমলা রঙ। উন্মুক্ত পায়ের পদযুগল চামড়ার স্যান্ডেলে মোড়ানো। দু’জন শিক্ষার্থীদের সাথে গভীর আলোচনায় মগ্ন ডেবরা প্রথমটাতে খেয়ালই করেনি ডেভিডকে। উঠে দাঁড়াল ডেভিড। তারপরই তার বিখ্যাত নীরবতা নিয়ে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইল ডেবরা। এর আগে ও জারাগোজার ক্যান্টিনে যার সাথে পরিচয় হয়েছিল ডেভিডের।

হঠাৎ করে মনে হলো হাত-পা ভারী হয়ে গেল, ডেভিড নিজেও অবাক হয়ে গেল নিজের আচমকা ভারী হওয়া বোধ নিয়ে। হেসে কাঁধ ঝাঁকাল সে।

 ‘হ্যালো, ডেবস।’ নিজের কানেই অদ্ভুত ঠেকল ডেভিডের গলা। নড়ে উঠল ডেবরা, চাইল দ্রুত হাত দিয়ে অন্তত চুলটা ঠিক করে নিতে। কিন্তু হাতে বই থাকায় পারল না সে।

‘ডেভিড’ এগিয়ে আসতে গিয়েও অস্বস্তি নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীর দিকে তাকাল ডেবরা। বুঝতে পেরে চলে গেল তারা। ডেবরা তাকাল ডেভিডের দিকে।

‘ডেভিড’–আবারো একই কথা বলল ডেবরা, এরপর হঠাৎ করেই অভিব্যক্তি বদলে গেল। ওহ গড! আমি একটু লিপস্টিকও লাগাইনি।’

হেসে ফেলল ডেভিড। মনে হলো কাঁধ থেকে বিশাল একটা বোঝা নেমে গেল যেন। এগিয়ে গেল সে। হাত বাড়িয়ে দিল আলিঙ্গন করতে। ডেবরাও এগিয়ে এলো কিন্তু হাতের বই আর ব্যাগ নিয়ে কী করবে বুঝতে পারল না। নিচে পড়ে গেল সব। আহত হয়ে সেগুলো কুড়িয়ে নিতে গেল। অবশেষে আলিঙ্গন করল দু’জন-দু’জনকে।

‘ডেভিড। শক্ত করে ডেভিডের গলা জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করল ডেবরা। ‘তুমি একটা যাচ্ছেতাই এত সময় লাগল কেন? আমি তোমার চিন্তা প্রায় ছেড়েই দিয়ে ছিলাম।’

 ডেবরার একটা মোটর স্কুটার আছে, সেটা নিয়ে জেরুজালেমের রাস্তায় এমনভাবে ছুটে বেড়ায় সে যে তার পথে পড়া ট্যাক্সি ড্রাইভাররাও ভিরমি খেয়ে যায়- স্টিলের মতো শক্ত নার্ভ আর বিপদে ভয় না পাবার ব্যাপারে যাদের সুখ্যাতি প্রবাদতুল্য।

পিছনের সিটে বসে ডেবরার কোমর ধরে রাখল ডেভিড। এত ভিড়ের মাঝেও ঠিকই পথ করে নিয়ে এগিয়ে চলল ডেবরার স্কুটার। লেপ্টে বসে রইল ডেভিড। এমনকি বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির ভিড়কেও হাসিমুখে উড়িয়ে দিল স্কুটার।

‘আমার অনেক আনন্দ হচ্ছে।’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল ডেবরা।

‘খুব ভালো! এই মুহূর্ত উপভোগের জন্য চলল বেঁচে থাকি।’

 ‘জো তোমাকে দেখলে অবাক হয়ে যাবে।

‘যদি কখনো পৌঁছাই তবেই না।

 ‘তোমার নার্ভ নষ্ট হয়ে গেছে নাকি?

মাত্র এই মিনিটখানেকের মাঝে হারিয়ে ফেলেছি এটা।

ইন কারেম উপত্যকার আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল ডেবরা। মনে হলো যেন ও একটা মিরেজ প্লেন চালাচ্ছে আর ওর পেছনে বসে আছে ভ্রমণ পিপাসু একটা মানুষ। এমনভাবে ডেভিডকে চারপাশের বর্ণনা দেয়া শুরু করল ডেবরা।

‘এটা মেরির কূয়ার আশ্রম। এখানেই তিনি জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট মায়ের সাথে দেখা করেছিলেন। খ্রিস্টান রীতি অনুযায়ী–এ ব্যাপারে তো তুমি বিশেষজ্ঞ।’

 ‘ইতিহাস বাদ দাও।’ আর্তনাদ করে উঠল ডেভিড। সামনের বাকের মুখে একটা বাস।

 জলপাই গাছগুলোর মাঝে গ্রামটাকে দেখে মনে হলো এখানে সময় বোধহয় থমকে গেছে। গড়ানে ভূমির মাঝে গির্জা, আশ্রম, উঁচু দেয়াল ঘেরা বাগান, ছবির মতো সুন্দর মরূদ্যান আর অন্যদিকে আকাশের ওপারে দেখা যাচ্ছে আধুনিক জেরুজালেমের সু-উচ্চ সব বহুতল ভবনের বিশৃঙ্খলা।

প্রধান রাস্তা ছেড়ে সরু একটা গলির মুখে ঢুকে গেল ডেবরা। দু’পাশে বয়সের কোন গাছপাথর না থাকা পাথরের দেয়াল। লোহার দরজার সামনে ব্রেক কষলে স্কুটার।

‘হোম।’ জানিয়ে দিল ডেবরা। একটু দূরে গেইট হাউজের মাঝে স্কুটার লক্ করে দেয়ালের কোনায় থাকা ছোট দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো তারা।

বিশাল একটা বাগানে পৌঁছ গেল দু’জনে। চারপাশে চুনকামের ফলে সাদা যেখানে উঁচু প্লাস্টারের দেয়াল। মোটা মোটা কাওলা জলপাই গাছ দাঁড়িয়ে আছে বাগানের মাঝে। দেয়াল বেয়ে উঠে গেছে আঙুরলতা। থোকা থোকা আঙুর ও দেখা গেল ঝুলছে।

‘বিগ একজন আগ্রহী কিন্তু পাগল তরুণ প্রত্নতত্ত্ববিদ। জলপাই গাছগুলোর ভেতর ভেতরে থাকা রোমান আর গ্রিক মূর্তিগুলো দেখিয়ে বলল ডেবরা। দেয়ালের চারপাশেরও মাটির পাত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রাচীন আমলের মোজাইক টাইলস্ বিছানো রাস্তা চলে গেছে ঘরের দিকে। এটা আইন বিরুদ্ধ কিন্তু তারপরেও সে তার পুরো অবসর সময়টুকু পুরাতন জায়গা খুঁড়ে কাটায়।

রান্নাঘরে বিশাল খোলা চুল্লি, যেখানে আধুনিক ইলেকট্রিক স্টোভ মনে হলো বেমানান। কিন্তু তামার পাত্রগুলো যে নিয়মিত ঘষে মেজে পরিষ্কার রাখা হয়, তা স্পষ্টই বোঝা গেল। টাইলস করা মেঝেও বেশ পরিষ্কার আর সুগন্ধও ছড়াচ্ছে।

চুপচাপ স্বভাবের ডেবরার মা লম্বা আর কৃশকায়। দেখে মনে হলো ডেবরার বড় বোন। পারিবারিক আবহ বেশ আনন্দময়, সকলকে অভিবাদন জানাল ডেবরা। মনে মনে ব্যাপারটা ভেবে ডেভিড খুশিই হলো যে এই বয়সে ডেবরাকে এমনই দেখাবে। সকলের সাথে ডেভিডের পরিচয় করিয়ে দিয়ে ডেবরা ঘোষণা করল যে আজ রাতে ডেভিড তাদের সাথে ডিনার করবে। এক মুহূর্ত আগ পর্যন্তও এটা জানতো না ডেভিড।

 ‘প্লিজ।’ তাড়াতাড়ি বলে উঠল ডেভিড। আমি অনধিকার প্রবেশ করতে চাই না। সে জানে যে ইহুদী বাড়িতে শুক্রবারের রাত বিশেষ একটা সময়।

‘তুমি অনাধিকার প্রবশে করছে না। আমরা সম্মানিত বোধ করব যদি তুমি থাকো। ডেভিডের দাবি উড়িয়ে দিল ডেবরা। জোর স্কোয়াড্রনের বেশিরভাগ ছেলের এটাই ঘর। আমাদের ভালোই লাগে ব্যাপারটা।

ডেভিডকে একটা গোল্ডস্টার বিয়ার এনে দিল ডেবরা। এরপর ছাদে গিয়ে বসল দু’জনে। এমন সময় এলো ডেবরার বাবা। ছোট্ট গেইট দিয়ে ঢুকে পাথরে চৌকাঠের নিচে এসে দাঁড়াল ঋজু দেহ। বাগানে ঢুকে ইউনিফর্মের টুপি খুলে হাতে নিয়ে নিল ডেবরার বাবা।

গলার কাছে ভোলা সাধারণ ছটের ইউনিফর্ম পরে আছে ডেবরার বাবা। বুকপকেটের কাপড়ের গায়ে লাগানো সেনাবাহিনীর র্যাংকের চিহ্ন আর পদক সমূহ। কাঁধ সামান্য গোলে ধাচের, হতে পারে চওড়া দেহ সরু ফাইটার এয়ারক্রাফটের মাঝে থাকতে থাকতে এমন হয়ে গেছে। মাথা বাদামি। আর সন্তদের মতো হালকা চুল। কিন্তু গোঁফ বেশ বাঁকানো, যার ফাঁক দিয়ে চকচক করছে স্বর্ণের দাঁত। লম্বা, বাঁকানো নাক, প্রাচীন আমলের যোদ্ধাদের মতো। চোখজোড়া কালো আর ঠিক ডেবরার মতো সোনালি আভা ছড়াচ্ছে। পুরো অভিব্যক্তিটাই এমন যে সাথে সাথে শ্রদ্ধা ভাব এলো ডেভিডের মনে। স্বাভাবিকভাবেই তাই উঠে দাঁড়িয়ে জেনারেলের সাথে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল ডেভিড, সম্বোধন করল স্যার বলে।

খুব দ্রুত ডেভিডের উপর চোখ বুলিয়ে নিল বিগ। নিজের মন্তব্য অবশ্য প্রকাশ করল না। হাবে-ভাবে তাই আনন্দ বা হতাশা কিছুই ফুটে উঠল না।

পরবর্তীতে ডেভিড জানতে পারে যে ডেবরার বাবাকে তারা ‘দ্য ব্রিগ’ নামে ডাকে। যেটা ‘দ্য ব্রিগান্ড’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ। ১৯৪৮ সালের আগে প্যালেস্টাইনে হাগানাহর জন্য যুদ্ধজাহাজ আর অস্ত্র ছিনতাইয়ের জন্য ব্রিটিশরা এই উপাধি দেয় ডেবরার বাবাকে। সবাই এমন কী ছেলেমেয়েরাও তাকে এই নামেই ডাকে। শুধুমাত্র তার স্ত্রী ডাকে নিজস্ব নাম–জোশুয়া।

‘ডেভিড আজ রাতে আমাদের সাথে সাব্বাথ ভোজনে অংশ নেবে। ব্যাখা করল ডেবরা।

‘ইউ আর ওয়েলকাম।’ ডেভিডকে স্বাগত জানিয়ে স্ত্রী আর কন্যার দিকে হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে আলিঙ্গন করল ব্রিগ। গত সাবাথের পর থেকে কারো সাথে দেখা হয়নি তার। সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এয়ার বেস কন্ট্রোলের দায়িত্ব পালন করেছে ব্রিগ এসময়।

একটু পরে ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় এসে পৌঁছালো জো। গ্রীষ্মকালীন খোলা গলার খাকি ড্রেস। ডেভিডকে দেখতে পেয়েই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল জো। ভালুকের মতো বিশাল বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ধরল ডেভিডকে। কাঁধের উপর দিয়ে ডেবরাকে বলল আমি ঠিক বলেছিলাম, তাই না?

‘জো বলেছিল যে তুমি আসবে।’ ব্যাখা করল ডেবরা।

‘মনে হচ্ছে একমাত্র আমিই ব্যাপারটা জানতাম না। অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দিল ডেভিড।

 ডিনারের টেবিলে জড়ো হলো সব মিলিয়ে পনেরো জন। পলিশ করা বিশাল টেবিল আর রুপার থালা-বাসনের উপর প্রতিফলিত হচ্ছে মোমবাতির আলো। সংক্ষিপ্ত করে প্রার্থনা সারলো ব্রিগ। টাক মাথার উপর খানিকটা হাস্যকর লাগল সাটিনের গোল্ড অ্যামব্রয়ডারি করা ইয়ামুলকা, নিজের হাতে ওয়াইন ঢেলে বিড়বিড় করে স্বাগত জানাল উপস্থিত সব অতিথিকে। জো’র সাথে হান্নাহও এসেছে। সুন্দর দেখাচ্ছে ওর তামাটে চুল। ডেভিডকে দেখেও কিছু বলল না সে। ব্রিগের নিজের পরিবার ছাড়াও আরো উপস্থিত হয়েছে ওর দু’ভাই, তাদের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনী। সবাই বেশ উঁচুস্বরে কথা বলছে আর ভাষা দ্রুত হিব্রু আর ইংরেজিতে অদল-বদল হচ্ছে। খাবারের স্বাদ বেশ মসলাদার কিন্তু মুখরোচক! যদিও ডেভিডের কাছে ওয়াইনের স্বাদ একটু বেশি মিষ্টি মনে হল। ডেবরার পাশে চুপচাপ বসে তৃপ্তি নিয়ে উপভোগ করতে লাগল এহেন হাসি-খুশি পরিবেশে নিজের উপস্থিতি। হঠাৎ করেই চমকে গেল, যখন দেখল যে, ডেবরার কাজিন ঝুঁকে এলো তার সাথে কথা বলতে।

‘তোমার জন্য ব্যাপারটা নিশ্চয় বেশ দ্বিধার মতো–ইস্রায়েলের মতো দেশে তোমার প্রথম দিন আর হিব্রুও বুঝতে পারো না, তুমি তো ইহুদি নও।

যদিও কথাগুলোতে খারাপ কিছু ছিল না, কিন্তু মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গেল সব কোলাহল। চোখ তুলে তাকাল বিগ, তার ঘরে বেড়াতে আসা অতিথির মর্যাদাহানিকর কিছু করতে চায় না সে।

ডেভিড বুঝতে পারল যে ডেবরা মনোযোগ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই তার মনে চিন্তা এলো যে কেমন করে তিন ধরনের প্রতিবাদ কোন ইস্যুকে সঠিক রূপ দেবে–নতুন টেস্টামেন্ট, মোহামেডান আইন আর সম্ভবত মোশির বিধানও। ডেভিড বুঝতে পারল সে এই ঘর থেকে বিতাড়িত হতে চায় না। এই মানুষগুলোর কাছ থেকে আলাদা হতে চায় না। আবারো একা হয়ে যেতে চায় না। বেশ ভালো লাগছে এখানে।

কাজিনের দিকে তাকিয়ে হাসল ডেভিড। মাথা নেড়ে বলল, এটা অদ্ভুত, সত্যি–কিন্তু তুমি যতটা ভাবছো ততটা খারাপও না। আমি হিব্রু বুঝতে পারি যদিও তেমন ভালো বলতে পারি না। আর শোন আমি কিন্তু ইহুদিও।

পাশে বসা ডেবরার চেহারায় খুশির মোলায়েম আলো ফুটে উঠতে দেখল ডেভিড। জো’র সাথে দৃষ্টি বিনিময় ও করল দ্রুত।

‘ইহুদি? জানতে চাইল ব্রিগ। তোমাকে তেমন দেখায় না। ব্যাখ্যা করল ডেভিড। মাথা নাড়ল ব্রিগ।

‘শুধু তাই না, ডেভিড বিমানও চালায়। ডেবরা বলে উঠতেই জীবন্ত প্রাণীর মতো নড়ে উঠল ব্রিগের গোঁফ জোড়া। ন্যাপকিন দিয়ে গোঁফ ঠিক করে সর্তকতার সাথে ডেভিডের দিকে তাকিয়ে রইল ব্রিগ।

‘কতটা অভিজ্ঞ? বিস্তারিত জানতে চাইল ব্রিগ।

‘বারোশ ঘণ্টা স্যার। জেট’এ প্রায় হাজার।

 ‘জেট?

‘মিরেজ।

‘মিরেজ! গোপনে ঝিক করে উঠল বিগের স্বর্ণের দাঁত।

‘কোন স্কোয়াড্রন?

 ‘কোবরা।

‘রাসটাস নড’সের শিক্ষার্থী? হাঁ করে ডেভিডের দিকে তাকিয়ে রইল ব্রিগ। পাল্টা প্রশ্ন করল ডেভিড।

‘আপনি রাসটাসকে চেনেন? অবাক হয়ে গেল সে।

‘আমরা একসাথে প্রথম স্পিট ফায়ার্সে উড়েছিলাম চেকোশ্লোভাকিয়াতে– ৪৮এর দিকে। আমার ওকে ডাকতাম বুচ বেন ইয়ক।

জেন্টিলি’দের পুত্র। কেমন আছে সে?

 সবসময় যেমন ছিলেন তেমনই চঞ্চল। কৌশলে উত্তর দিল ডেভিড।

‘ওয়েল, যদি রাসটাস তোমাকে উড়তে শেখায় তাহলে তুমি মোটামুটি ভালো। সিদ্ধান্তে পৌঁছালো ব্রিগ।

সাধারণ একটা নিয়ম হলো যে ইস্রায়েলি এয়ারফোর্স কখনো বিদেশী পাইলট ব্যবহার করবে না। প্রথম শ্রেণীর ফাইটার পাইলট হিসেবে ইহুদিই বেশি মার্ক পায়। ডেভিডের ভেতরে একই গুণ দেখতে পেল ব্রিগ, যা খুঁজে পেয়েছে পল মরগ্যান। মোমবাতির আলোয় আবারো তরুণটিকে খেয়াল করে দেখল ব্রিগ। চোখ এড়ালো স্থির আর পরিষ্কার ডেভিডের দৃষ্টি যা খুঁজে বেড়াচ্ছে দূরের দিগন্ত। এটা একটা গান ফাইটারের চোখ আর ব্রিগের সব পাইলটরাই গান ফাইটার।

এ জাতীয় একটা পাইলটকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করতে বহু বছর আর প্রায় মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়। সময় এবং অর্থ নির্ভর করতে তার দেশের উপর–নিয়মও তাই বদলানো যায়।

ওয়াইন বোতল তুলে নিয়ে সাবধানে ডেভিডের গ্লাস পূর্ণ করে দিল ব্রিগ। ‘আমি রাসটাস নড়কে ফোন করব।’ নীরবে সিদ্ধান্ত নিল ব্রিগ। এই তরুণ সম্পর্কে আরো জানতে হবে।’

ব্রিগ যখন ডেভিডকে ইস্রায়েলে আসার কারণ, কারণ না থাকা আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করল, তাকিয়ে রইল ডেবরা।

ব্রিগের মনে কী চিন্তা চলছে তা পরিষ্কার বুঝতে পারল ডেবরা। এই সন্দেহই করেছিল সে। ডেভিডকে ডিনারের দাওয়াত দেয়া, ব্রিগের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া সবকিছু নিয়ে হিসাব কষা শুরু হয়ে গেল।

মনোযোগ ফিরিয়ে নিল ডেভিডের দিকে। পাকস্থলীতে কেমন অদ্ভুত উত্তেজনা এলো। ডেভিডের দিকে তাকালেই মনে হয় দেহত্বকে বৈদ্যুতিক শকের মতো কিছু একটা হচ্ছে।

 ‘হুম, বড়সড় স্ট্যালিয়ন একটা।’ আনন্দিত মনে ভাবতে লাগল ডেবরা। এবার আর এত সহজে পালাতে পারবে না। এবার আমি বুদ্ধি করেছি ধরে রাখার জন্য আর ব্রিগকেও লাগিয়ে দিয়েছি।’

গ্লাস তুলে ডেভিডের দিকে তাকিয়ে চশমার উপর দিয়ে মিষ্টি করে হাসল ডেবরা।

তুমি যার পেছনে ছুটছে তা অবশ্যই পাবে; কিন্তু কাঠ-কয়লা পুড়িয়ে তবেই। মনে মনে হুমকি দিল ডেবরা; কিন্তু সবার সামনে উঁচুস্বরে বলে উঠল

‘লিচেইম! জীবনের জন্য!’ একই কথা উচ্চারণ করল ডেভিডও।

‘এবার এত সহজে হাল ছাড়ছি না আমি।’ প্রতিজ্ঞা করল ডেভিড মনে মনে। তাকিয়ে দেখল ডেবরার চোখে সোনালি আলোর ফোঁটা। আমি তোমাকে পাবই, যত সময় লাগুক, যাই করতে হোক।’

.

ভোরবেলা বিছানার পাশে রাখা টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো ডেভিডের। চনমনে স্বরে কথা বলে উঠল ব্রিগ। মনে হলো ইতিমধ্যে দিনের কাজ সাড়া হয়ে গেছে তার।

‘আজকের জন্য যদি তোমার জরুরি কোন পরিকল্পনা না থাকে আমি তোমাকে কিছু দেখাতে চাই। জানিয়ে দিল ব্রিগ।

‘অবশ্যই স্যার।’ ভারসাম্য বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে ডেভিড।

পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাঝে তোমাকে হোটেল থেকে তুলে নেবো আমি। এই সময়ের মাঝে নাস্তা করে ফেলল। লবিতে অপেক্ষা করো আমার জন্য।

ছোট, অনাড়ম্বর আর সাধারণ একটা গাড়ি ড্রাইভ করে এলো ব্রিগ। দ্রুত আর স্বচ্ছন্দ্য গতিতে চলতে লাগল গাড়ি। ব্রিগের সময়ানুবর্তিতা আর কর্মতৎপরতা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল ডেভিড। কম করে হলে ডেবরার বাবার বয়স পঞ্চাশের ঘরে। এই বয়সে নিজের কথা ভেবে ভয়ঙ্কর লাগল তার।

প্রধান হাইওয়ে ধরে দক্ষিণে তেল আবিবের দিকে এগিয়ে চলল গাড়ি। দীর্ঘ নীরবতা ভাঙ্গলো ব্রিগ।

‘গত রাতে তোমার পুরাতন সি.ওর সাথে কথা বলেছি আমি। তুমি কোথায় তা জানতে পেরে অবাক হয়ে গেছে সে। আমাকে জানিয়েছে যে নেমে আসার আগে তোমাকে স্টাফ র‍্যাঙ্কে পদোন্নতির প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল।

‘এটা ছিল ঘুষ’ ডেভিড তাড়াতাড়ি বলে উঠল। মাথা নেড়ে আবারো কথা শুরু করল ব্রিগ। চুপচাপ তার কথা শুনতে লাগল ডেভিড। খুশি মনে দেখতে লাগল পাহাড় থেকে নেমে যেতে যেতে কেমন করে পরিবর্তীত হয়ে যাচ্ছে চারপাশের দৃশ্যবলী। নিচু সমভূমি দিয়ে দক্ষিণে বারসেবা আর মরুভূমির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি।

 ‘আমি তোমাকে একটা এয়ারফোর্স বেসে নিয়ে যাচ্ছি। আর এ সাথে যুক্ত করতে চাই যে, এই কারণে সব ধরনের সিকিউরিটি রেগুলেশন্ ভাঙ্গতে হচ্ছে আমায়। রাসটাস আমাকে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে তুমি উড়তে জানো। আমি দেখতে চাই ও সত্যি কথা বলছে কিনা।

দ্রুত একবার ব্রিগের উপর চোখ বুলিয়ে নিল ডেভিড।

 ‘আমরা প্লেন চালাতে যাচ্ছি?

ব্রিগ ইতিবাচক মাথা নাড়াতেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল ডেভিড। উত্তেজনা বোধ করতে লাগল মনে মনে।

 ‘আমাদের এখানে যুদ্ধ হচ্ছে। তাই কমব্যাট প্লেন চালাবে তুমি আর সেই সাথে বইয়ের সব নিয়ম-কানুন ভেঙ্গেচুরে ফেলবে। কিন্তু বইয়ের কথা মতো সব সময় তো চলাও যায় না।

এরপর আস্তে আস্তে ইস্রায়েল সম্পর্কে, এর যুদ্ধ আর সফলতার সুযোগ সম্পর্কে নিজের মতামত ব্যাখ্যা করল ব্রিগ। ডেভিডের কানে বাজতে লাগল কয়েকটা অদ্ভুত বাক্য।

–আমরা একটা জাতি গঠন করছি আর ফাউন্ডেশনে যে রক্ত মিশিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি আমরা, তা একে আরো মজবুত করবে’

–আমরা একে শুধুমাত্র দুনিয়াজুড়ে মার খাওয়া ইহুদিদের আশ্রয়স্থল বানাতে চাই না। আমরা শক্তিশালী উজ্জ্বল ইহুদিদেরও চাই’।

আমরা আছি তিন মিলিয়ন আর শত্রুর সংখ্যা দেড়শ মিলিয়ন। যাদের লক্ষ্যই হলো আমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া

 যদি তারা একটা যুদ্ধে হেরে যায় তাহলে হয়তো মরুভূমির কয়েক মাইল হারাবে মাত্র আর যদি আমরা হেরে যাই তাহলে হয়তো অস্তিত্বই মুছে যাবে

‘–তাদেরকে আরো একবার হারাতে হবে আমাদের। অন্যকিছু গ্রহণ করবে না তারা। তারা বিশ্বাস করে যে ১৯৪৮ সালে তাদের অস্ত্রে সমস্যা ছিল। সুয়েজের পর লাইন ঠিক হয়ে যাওয়াতে কিছুই হারাতে হয়নি তাদের। ৬৭’তে তারা ভেবেছে তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। আরো একবার তাদেরকে হারাবো আমরা আর আমাদেরকে একা ছেড়ে যাবে তারা—-

মনে হলো কোন মিত্র বা বন্ধুর সাথে কথা বলছে এমনভাবে মনের কথা ডেভিডকে খুলে বলল ব্রিগ। তার প্রতি বিশ্বাস দেখে খুশি হয়ে গেল ডেভিড আর আবারো প্লেন চালাবার সম্ভাবনায় তো রীতিমত রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠল তার।

রাস্তার পাশে ঘন করে লাগিয়ে রাখা ইউক্যালিপটাসের ফলে দৃষ্টিগোচর হলো না কিছুই। তারের বেড়ার গায়ে লাগানো গেইটের কাছে এসে গাড়ি থামালো ব্রিগ। উভয় ভাষায় লেখা সাইনবোর্ড দেখা গেল ঝুলছে : ‘চেইম ওয়েইসম্যান কৃষি পরীক্ষণ কেন্দ্র।

 গেইটের ভেতরে ঢুকে আবার সাইড রোডে নেমে গেল গাড়ি, দ্বিতীয় আরেকটা বেড়া আর গার্ড পোস্ট দেখা গেল গাছ-পালার মাঝে।

গেইটে থাকা গার্ড দ্রুত ব্রিগের কাগজপত্র চেক করে দেখল। ভালোভাবেই ওকে চেনে তারা। আবারো চলতে শুরু করল গাড়ি বেরিয়ে এলো পরিষ্কার ভাবে ব্লক করা বিভিন্ন শস্যক্ষেতের মাঝে। ওটস, বার্লি, গম, ভুট্টা চিনতে পারল ডেভিড-বসন্তের উষ্ণ তাপে চমৎকার দেখাচ্ছে সবকিছু। প্রতিটি ক্ষেতের মাঝে চওড়া রাস্তা। এই দুই মাইল লম্বা মসৃণ রাস্তার মাঝে কিছু একটা আছে যা ঠিক স্বাভাবিক নয়। সঠিক কোনা করে কাটা হয়েছে। প্রতিটি রাস্তা, যদিও ডেভিডের কাছে তেমন অপরিচিত নয় পথটুকু। বুঝতে পেরে মাথা নাড়ল ব্রিগ। হ্যাঁ’ ব্যাখা দিল ব্রিগ, ‘রানওয়ে ৬৭’তে যে কৌশল ব্যবহার করেছি তা নয় কিন্তু।

ব্যাপারটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগল ডেভিড। গাড়ি দ্রুত এগিয়ে গেল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কংক্রিটের কাঠামোর দিকে। ক্ষেতে বেগুনি রঙের ট্রাক্টরগুলো কাজে ব্যস্ত, উপরের বাতাসে অস্ট্রিসের পাখার মতো স্প্রে ছিটাচ্ছে সেচের যন্ত্র।

কংক্রিটের তৈরি শস্যাগারের কাছে পৌঁছালো গাড়ি। চওড়া দরজা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ঢুকে গেল ব্রিগ। অবাক হয়ে ডেভিড দেখতে লাগল সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা বাস আর আটোমোবাইলের দিকে। না হলেও শত শত মানুষের যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে এখানে। অথচ মাত্র কয়েকজন ট্র্যাক্টর ড্রাইভার ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়েনি বাইরে।

আবারো গার্ড এগিয়ে এলো, প্যারাট্রুপার ইউনিফর্ম পরা শস্যাগারের গোলাকার কাঠামোর কাছে ডেভিডকে নিয়ে গেল ব্রিগ। হঠাৎ করেই পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেল ডেভিডের কাছে। বুঝতে পারল শস্যাগার আসলে একটা জমি। সলিড কংক্রিট দিয়ে বানানো বিশাল বোমাপ্রুফ কাঠামো। আধুনিক ফাইটার বেসের সমস্ত অস্ত্র আর রাডার যন্ত্রপাতির সব বন্দোবস্ত আছে এখানে। চারটি সম্পূর্ণ মিরেজ ফাইটারদের স্কোয়াড্রন আছে এঁটে যাবে এই যৌথ কন্ট্রোল টাওয়ারে। এলিভেটর করে ব্রিগের সাথে মাটির নিচে নেমে যেতে যেতে সব জানা হয়ে গেল ডেভিডের।

এলিভেটর থেকে বের হয়ে রিসেপশন এরিয়ায় বেরিয়ে এলো তারা। আবার পরীক্ষা করা হলো ব্রিগের কাগজপত্র। একজন প্যারাট্রুপার মেজরকে ডেকে ডেভিডকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হলো। খুশি মনেই দায়িত্ব পালন করল মেজর। এরপর পথ দেখিয়ে কার্পেটে মোড়া এয়ারকন্ডিশন্ড আন্ডার গ্রাউন্ড টানেলে পাইলটদের ড্রেসিংরুমে ডেভিডকে নিয়ে এলো ব্রিগ। দাগবিহীন টাইলস করা মেঝে টয়লেট, শাওয়ার, লকার সবকিছু মিলিয়ে মনে হলো কাউন্টি ক্লাবের চেঞ্জিংরুম।

ডেভিডের সাইজ অনুমান করে তার জন্য কাপড় আনার আদেশ দিল ব্রিগ। আনার পর দেখা গেল অনুমান একেবারেই নির্ভুল হয়েছে। কর্পোরাল ডেভিডকে পরিয়ে দিল ওভার অল, বুটস, জি-স্যুট গ্লাভস, হেলমেট।

নিজের লকার থেকে কাপড় বের করে পরে নিল ব্রিগ। এরপর দুজনেই প্রস্তুতি রুমে গেল। জি-স্যুটের খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে গেল চলাফেরা, বগলের নিচে হেলমেট।

 দু’জনে ঢুকতেই দাবা খেলা আর ম্যাগাজিন থেকে চোখ তুলে তাকাল কর্তব্যরত পাইলট। জেনারেলকে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়াল কিন্তু পুরো পরিবেশটাই বেশ সহজ আর অনানুষ্ঠানিক। ছোট্ট একটা জোক্স বলল ব্রিগ। হেসে ফেলল সবাই। এরপর ডেভিডকে ব্রিফিং রুমে নিয়ে এলো ব্রিগ।

দ্রুত কিন্তু কোন কিছুই চোখ এড়ায়নি এমনভাবে উড়তে যাওয়া পুরো পেট্রোলকে ব্রিফ করল ব্রিগ। ডেভিডকে চেক করে দিল রেডিও চালনা, এয়ারক্রাফটের পরিচিতি, অন্যান্য জরুরি বিষয়।

‘সব ঠিক আছে? অবশেষে জানতে চাইল সে। ডেভিড মাথা নাড়াতেই আবারো বলে চলল ‘মনে রাখবে তোমাকে যা বলেছি। আমরা যুদ্ধ করছি। যখনি এমন কিছু খুঁজে পাবে যেটা আমাদের নয়, সজোরে আঘাত করবে, ঠিক আছে?

‘ইয়েস স্যার।

‘গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সবকিছু সুন্দর চুপচাপ ছিল। কিন্তু মাত্র গতকাল ইন যাদবের কাছে নিচে খানিকটা সমস্যা হয়েছে। আমাদের একটা বর্ডার পেট্রোলের সাথে অসদাচারণ করেছে তারা। তাই পরিবেশ খানিকটা থমথমে হয়ে আছে এই মুহূর্তে। নিজের হেলমেট আর মানচিত্রের কে তুলে নিয়ে ডেভিডের দিকে ফিরল ব্রিগ। কাছে এসে তাকিয়ে রইল ভয়ঙ্কর বাদামী সোনালি চোখজোড়া দিয়ে।

‘আজই দফারফা হয়ে যাবে সব। চল্লিশ হাজারে গেলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে তোমার কাছে। রোজ হানিক্রা থেকে সুয়েজ, মাউন্ট হারমন থেকে এইলাতের প্রতি ইঞ্চি দেখতে পাবে তুমি। দেখবে এটি কতটা ছোট আর চারপাশের শত্রুর কাছে কতটা অসহায়। তুমি বলেছিলে এমন কিছু খুঁজছে যেটার জন্য জান বাজি রাখা যায়। তাই তিন মাইল মানুষের ভাগ্য পাহারা দেয়ার কাজ কী এর উপযুক্ত কিনা এই সিদ্ধান্ত নেবার ভার তোমার উপরেই ছেড়ে দিচ্ছি আমি।’

লম্বা আন্ডার গ্রাউন্ড প্যাসেজে ছোট ইলেকট্রিক পার্সোনেল ক্যারিয়ারে করে নিচে নেমে এলো তারা। প্রবেশ কংক্রিটের বাঙ্কারে লাফ দিয়ে নামল গাড়ি থেকে।

এক সারিতে দাঁড়িয়ে আছে ছয়টি মিরেজ। মসৃণ চকচকে শরীর, সুচের মতো নাক। অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়ে ওঠা পশুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। মনে রাখতে কোন সমস্যাই হবে না এমন আউটলাইনে তৈরি। কিন্তু মরুভূমির মতো বাদামী আর মেটে সবুজের ক্যামোফ্লেজের ফলে চট করে অন্য কেউ বুঝতেও পারবে না। লেজের কাছে ডেভিডের স্মারক চিহ্ন নীল তারা।

দুইটা মেশিনের জন্য সাইন করল ব্রিগ। ডেভিডের নাম্বারের কাছে এসে হেসে ফেলল, লিখলো বুচ বেন ইয়ক।’

 ‘যেমন ভালো নাম তেমনি ভালো তার অধীনে উড়তে পারাটা। রায় দিয়ে দিল ব্রিগ।

ছোট ককপিটে ঢুকে বসল ডেভিড। মনে হলো যেন নিজের ঘরে ফিরে এসেছে। এখানকার সবকিছুই ওর পরিচিত। একগাদা সুইচ ইনস্ট্রমেন্টস্ আর কন্ট্রোলের উপর উড়ে বেড়াতে লাগল আঙুল। চেক করে নিল ফ্লাইটের আগের সবকিছু।

বাঙ্কারের সংকীর্ণ জায়গায় কামান দাগার মতো গুরুগম্ভীর শব্দ করতে লাগল জেট। কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়। এখনো সবাই টিকে আছে পুরো বেস্ কাঠামোর মাঝে স্টিলের গায়ে ছিদ্র থাকার ফলে।

ব্রিগ তাকালো ডেভিডের দিকে। জমকালো পেইন্টিং করা হেলমেট পরে আছে মাথায়। হাই-সাইন দেখাল ডেভিডকে। একই ভাবে উত্তর দিল ডেভিড। বন্ধ করে দিল ক্যানোপি। সামনে দ্রুত উপর দিকে ভাঁজ হয়ে উঠে গেল স্টিলের ব্লাস্ট ডোর। উপরে আলো জ্বলে উঠল লাল থেকে সবুজ।

টেক-অফের জায়গায় ট্যাক্সিং করার কোন জায়গা নেই, অপ্রয়োজনীয় এতটুকুও জায়গা নেই। সরাসরি একের পর এক বাঙ্কার থেকে সূর্যের আলোয় বেরিয়ে এলো তারা। সামনে বাদামী দীর্ঘ রানওয়ে। ডেভিড থ্রটলে চাপ দিল, আফটার বার্নারস জ্বালিয়ে দিল। নিজের সিটের কুশন ভেদ করে অনুভব করল শক্তিশালী জেটের স্পন্দন। সবুজ শস্যের ক্ষেতের মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলল তারা। উড়ে গেল আকাশে। আরো একবার বিমোহিত হয়ে পড়ল ডেভিড।

চল্লিশ হাজার ফিটের সামান্যে নিচে স্থির হলো সকলে। কোন ফ্লাইট প্যাটার্নও নেই তাদের। ব্রিগের লেজের কাছে নিজের মেশিনকে স্থির করল ডেভিড। থ্রটল টেনে সহজ হলো, ফ্লাইটের পরিচিত কাজ করতে পেয়ে বেজায় খুশি হাত দুটো, হেলমেট পরিহিত মাথাটা ক্লান্তিহীনভাবে ঘুরছে এদিক সেদিক রুটিন মোতাবেক সার্চের জন্য। আকাশের প্রতিটি ইঞ্চিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে চোখ।

অসম্ভব শুদ্ধ বাতাসে চারপাশ এতটাই স্বচ্ছ যে দূরের পবর্তমালা ও দেখা যাচ্ছে একেবারে পরিষ্কারভাবে, আরো দূরের নীলের ছায়া। উত্তরে সূর্যের আলোয় গলিত রূপার মতো ঝকঝক করছে ভূমধ্যসাগরের পানি। অন্যদিকে গালিলি সাগর নরম ঠাণ্ডা সবুজ আর আরো দূরে দক্ষিণে দেখা যাচ্ছে ঘন ডেড সী, নিষিদ্ধ মরুভূমি।

কামেলের উপর দিয়ে উত্তরে উড়ে গেল তারা। নিচে আরো পড়ল হাইফার সাদা বিল্ডিংগুলো, কমলা সোনালি বিচ্ যার গায়ে আছড়ে পড়ছে ক্রিম রঙা লেসের মতো মসৃণ, ছোট ছোট ঢেউ। এরপর একসাথে ঘুরে গিয়ে আস্তে আস্তে নেমে এলো প্যাট্রলিংয়ের জন্য বিশ হাজার ফিট নিচুতে। মাউন্ট হারমানের চূড়া পার হলো সকলে। তুষারের শেষ কণা চিকচিক করছে এখনো।

নরম স্বপ্নময় সবুজ রঙের প্রকৃতি মনে হলো কেউ এঁকে রেখেছে রঙিন পেন্সিল দিয়ে। আনন্দিত হয়ে উঠল ডেভিড। কেননা আফ্রিকার একঘেয়ে বাদামী রং দেখতেই অভ্যস্ত সে। পাহাড়ের মাথায় ঝুলে আছে গ্রামগুলো। ঘন কৃষি জমি আর ঢালের উপর সাদা দেয়ালগুলো উজ্জ্বলভাবে চোখে পড়ছে।

আবারো দক্ষিণ দিকে ঘুরে গেল তারা। জর্দান উপত্যকা বেয়ে নামতে শুরু করল। গালিলি সাগরের স্বচ্ছ সবুজ জলের চারপাশে দেখা গেল খেজুর গাছের সারি আর পরিষ্কারভাবে চাষ করা কিবুতজিমের ক্ষেত। পাহাড়ের চারপাশে ওয়াদিকে মনে হলো কোন ভয়ঙ্কর শিকারি পশুর থাবা। | বাম পাশে উঠে গেছে ইডম পর্বত। এই রুক্ষ্ম প্রকৃতির নিচে জেরিকো শহরকে মনে হচ্ছে বনের মাঝে সবুজ মরূদ্যান। সামনে পড়ে আছে ডেডসির চকচকে পরিবেশ। নিচে নেমে গেল ব্রিগ। লবণাক্ত পানির উপর নিচু শব্দে উড়ে চলল জেট।

ডেভিডের কানে ভেসে এলো ব্রিগের কণ্ঠস্বর–এত নিচু দিয়ে আর কখনোই উড়ে যাওনি তুমি–বারোশ ফিট নিচেই সমুদ্র।

সমুদ্রের দক্ষিণ অংশে খনির কাজ চলায় আবারো উপরে উঠে এলো তারা। মুখোমুখি হলো দুর্ধর্ষ মরুভূমির।

 ‘হ্যালো, ক্যাকটাস ওয়ান, মরুর ফুল বলছি।’ আবারো ভঙ্গ হলো রেডিওর নীরবতা। কিন্তু এবার কমান্ড নেটের কল সাইন চিনতে পারল ডেভিড। সরাসরি এয়ারফোর্স কমান্ডের অপারেশনস সেন্টার থেকে কল করা হয়েছে তাদেরকে। এত গোপন একটি আন্ডার গ্রাউন্ড বাঙ্কারে এর অবস্থান যা ডেভিড কখনোই জানতে পারেনি। রাডারের মাধ্যমে তাদের অবস্থান সঠিকভাবেই জেনে যাচ্ছে কমান্ড সেন্টার।

হ্যালো, মরুর ফুল। উত্তর দিল ব্রিগ। তৎক্ষণাৎ এমনভাবে আলোচনা শুরু হলো যেন বহুদিন পর দেখা হয়েছে দুই বন্ধুর। যদিও এই অনানুষ্ঠানিক আলোচনা মোটেও তা নয়।

‘ব্রিগ, মোটি বলছি, এই মাত্রই তোমার অঞ্চলে গ্রাউন্ড সাপোর্টের অনুরোধ পেয়েছি আমরা। দ্রুত কো-অডিনেশন বলে গেল লোকটা।

‘সীমান্ত পুলিশের মোটর প্যাট্রলে অচেনা এয়ারক্রাফট নাক গলিয়েছে। একটু দেখে আসবে না?’

“ঠিক আছে, মোটি। ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সিতে ফিলে এলো ব্রিগ।

ক্যাকটাস টু, আমি দিক বদল করছি। সাথে থাকো। ডেভিডকে জানানো শেষ করেই নতুন দিকে ঘুরে গেল প্লেনের নাক।

রাডার স্ক্যানের চেষ্টা করার কোন মানে হয় না। চিৎকার করে বলে উঠল ব্রিগ। নিচেই কোথাও আছে এটা। ঐ পর্বতগুলো থেকে বের হতে দেয়া যাবে না শুকরটাকে। শুধু চোখ দুটো খোলা রাখো।

 ‘ঠিক আছে। ডেভিড ইতিমধ্যেই বুঝে গেছে যা ববাঝাতে চেয়েছে ব্রিগ। সবার পছন্দের এই হিব্রু শব্দটা এমন একটা দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে যেখানকার খুব কম জিনিসই ‘ঠিক আছে।’

সবার আগে দেখতে পেল ডেভিড। উজ্জ্বল নীল দিগন্তে বাতাস না থাকলেও দেখা গেল ধোয়ার চিকন কালো একটি রেখা। মনে হলো পেন্সিল দিয়ে লাইন টানা হয়েছে।

গ্রাউন্ড স্মোক। হেলমেট মাইক্রোফোনে কথা বলল ডেভিড। নিচে ঘড়ির এগারো কাটার ঘরে।

 নিঃশব্দে সামনে তাকিয়ে আঁতিপাতি করে খোঁজা শুরু করে দিল ব্রিগ। অবশেষে দৃষ্টিসীমার একেবারে শেষ মাথায় দেখতে পেল এটিকে। মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলো যে ছেলেটার অন্তত একটা দিক পুরোপুরি নির্ভুল, রাসটাস ঠিক কথাই বলেছে-শকুনের মতো চোখ।

‘আক্রমণের গতিতে যাচ্ছি আমি।’ ব্রিগের কথা শুনতে পেয়ে আফটারবার্নারস জ্বালিয়ে নিল ডেভিড। সিটের পেছন দিকে যেন তাণ্ডব নৃত্য শুরু হয়ে গেল। সনিক ব্যারিয়ারের মাঝ দিয়ে শু্যটিং শুরু করল মিরেজ।

 ধোঁয়ার রেখার পাশে বাদামী মাটির গায়ে চকচক করে উঠল কিছু একটা। চোখ সরু করে তাকাল ডেভিড। দৃষ্টি নিবদ্ধ করল ছোট্ট আকৃতিটার উপর। পাখির মতো দ্রুত চলতে থাকা আকৃতিটা মরুভূমির সাথে স্বাচ্ছন্দ্যে মিলে গেছে। একটা ছায়া ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না।

‘ঘুরে যাচ্ছে দুবৃর্তটা। দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠল ডেভিড।

আমি পেয়েছি তাকে। জানিয়ে দিল বিগ। কমান্ড নেটের সুইচ অন করল।

‘হ্যালো, মরুর ফুল। আমি ওর পিছু নিয়েছি। আঘাত করার অনুমতি দাও প্লিজ।’ এই সিদ্ধান্ত একমাত্র কমান্ড লেভেল থেকেই আসতে হবে। সাদামাটা উত্তরটা শোনা গেল পরিষ্কার ভাবে।

‘ব্রিগ, মাটি বলছি। আঘাত করো!’

কথা বলতে বলতেই দ্রুত নিচে নেমে এলো তারা। ফলে ছোট্ট নাটিকাটা মনে হলো চোখের পলকে ঘটে গেল।

সীমান্তের ধূলি মাখা রাস্তায় থেমে গেছে বর্ডার পুলিশের তিনটি টহলদার গাড়ি। রাস্তার সাথে প্রায় একই রঙের আঁকা গাড়িগুলোতে। বিশাল মরুভূমিতে গাড়িগুলো দেখাচ্ছে বাচ্চাদের খেলনার মতো।

পথের অর্ধেকটাই পুড়ে গেছে। তেলতেলে কালো ধোঁয়া উঠে আসছে বাতাসে। রাস্তায় পড়ে আছে একটা মানব শরীর। কোন কারণ ছাড়াই মৃত্যু এসে নিয়ে গেছে তাকে। এই দৃশ্য দেখে তিক্ততার ভাব এলো ডেভিডের মনে। যেমনটা শেষবার অনুভব করেছিল মাদ্রিদের ষাড়ের লড়াইয়ের জায়গায়।

রাস্তার পাশে কাত হয়ে পড়ে আছে আরেকটা গাড়ি। আরোহীদেরকে পাথর আর ধুলার মাঝে কাতরাতে দেখতে পেল ডেভিড। তাদের কেউ কেউ আবার ছোট অস্ত্র দিয়ে আততায়ীর উপরে পরবর্তী আঘাতের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এই ধাচের প্লেন আগে কখনো দেখেনি ডেভিড। কিন্তু আগে অনেকবার ছবিতে দেখায় সাথে সাথে চিনতে পারল। সিরিয়ান এয়াফোর্সের রাশান মিগ ১৭, লম্বা লেজ ভুল হবার কোন কারণ নেই। মরুভূমির বাদামী রঙের সাথে মিলিয়ে ছদ্মবেশের মাঝে উজ্জ্বল হয়ে আছে লাল, সাদা আর কালো রং। ফিউজিলাজে সবুজ রং আর পাখা মোটা ও বেটে।

দ্রুত নিচের দিকে নামতে লাগল মিগ। এগিয়ে যাচ্ছে পার্ক করে রাখা গাড়িগুলোর দিকে। পাথরের কাছে পড়ে থাকা অসহায় মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে পাইলট। তাই উপর থেকে নেমে আসা বিপদ সম্পর্কে একটুও আঁচ করতে পারল না সে।

সিরিয়ান প্লেনের লেজের উপর নেমে এলো ব্রিগ। ক্লাসিক স্টাইলে আঘাত করল পেছন থেকে আর উপর থেকে। মাঝামাঝি অবস্থান নিল ডেভিড। ব্রিগকে কাভার দেয়ার পাশাপাশি প্রথম আঘাত ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় আঘাত করার দায়িত্ব তার।

আবারো আক্রমণ করল সিরিয়ান পাইলট। নিচে থাকা মানুষ আর ট্রাকগুলোর উপর গর্জে উঠল কামান। ড্রাগনের বিষাক্ত নিঃশ্বাসের মতো ধোঁয়া আর আগুনের শিখা নিয়ে বিস্ফোরিত হলো আরেকটা ট্রাক।

‘বেজন্মা, কুত্তা, ব্রিগের পেছনে থেকে ফিসফিস করে উঠল ডেভিড। তাকিয়ে দেখল নিজের লোকদের উপর নেমে এলো নরক। এই প্রথমবারের মতো তাদেরকে আপন মনে হলো তার। ঠাণ্ডা রাগের স্রোত নেমে গেল শরীর বেয়ে, মনে হলো সে একজন মেষপালক আর তার মেষের পালের উপর আঘাত এসেছে।

কোথা থেকে একটা কবিতার লাইন চলে এলো মাথার মাঝে “আসিয়ীররা এমন ভাবে নেমে এলো যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছে নেকড়ের পাল।” স্বেচ্ছায় নিজের কামানকে লক করল ডেভিড। জয়স্টিকের ট্রিগার টেনে দিল সামনে। নরম সবুজ আলো জ্বলে উঠল কামানের পাশে, হয়ে উঠল জীবন্ত। চোখ পিটপিট করল ডেভিড।

খুব কাছে থেকে আক্রমণের প্রস্তুতি নিল ব্রিগ। কিন্তু ঠিক যে মুহূর্তে মনে হল সে আঘাত করবে ডেভিড পেল সিরিয়ান প্লেনটার পাখা উল্টে গেল। নিজের কাজের ভয়ঙ্কর পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চিত ডেভিড তৎক্ষণাৎ যা গুরুতুপূর্ণ সেটাই করবে বলে ঠিক করল। নিজের গতি কমিয়ে নিল রাতারাতি। ফলে এক দিকের পাখা কাত হয়ে মাটির দিকে ঝুঁকে গেল একশ ফিট নিচে।

 ব্রিগের গোলা লক্ষ্যচ্যুত হলো। ঠিক সে সময় নিচে নেমে গেল সিরিয়ান প্লেন। মনে হলো কোন এক মুষ্টিযোদ্ধা প্রতিপক্ষের ভয়ঙ্কর পাঞ্চ এড়িয়ে নেমে গেছে। ধুলা রঙের এয়ারক্রাফটের অনেক উপরে বিস্ফোরণ দেখতে পেল ডেভিড। এরপরেও মিস্ করল ব্রিগের প্রতিটি শেল। ভেতরে ভেতরে ক্ষেপে উঠল ব্রিগ।

ঠিক তখনই মিগ প্লেনের কাঠামো দেখে পুরোপুরি অবচেতনে ঠিক কাজটাই করল ডেভিড। নিজের পাওয়ার বন্ধ করে দিয়ে মিরেজের গতি বন্ধ করে দিল।

মিগ চেষ্টা করল দ্রুত ফিরে যেতে যেখান থেকে এসেছে সেখানে। হঠাৎ করেই ঘূর্ণায়মান দুটি এয়ারক্রাফটের সামনে পথ রোধ করে দাঁড়াল খাড়া পাহাড়ের চূড়া।

পাহাড়ের উপরে ওঠার কোন চেষ্টাই করল না মিগ। এর বদলে পাহাড়ের মাঝে সরু একটা গলি ঠিক করে ঢুকে গেল। পালিয়ে যাবার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে মিগ।

কিন্তু এই ধরনের কাজের জন্য উপযুক্ত নয় মিরেজ। ডেভিড অনুভব করলো তার উচিত আফটারবার্নারস জ্বালিয়ে পাহাড় শ্রেণীর উপর উঠে যাওয়া–কিন্তু এর মানে হবে মিগটাকে পালিয়ে যেতেই দেয়া আর এটা চিন্তা করেই রেগে গেলে সে।

পাথরের গলির ভেতর সিরিয়ানটার পিছু নিল ডেভিড। দুই পাশের পাথরে ঘষা খাচ্ছে মিরেজের পাখার মাথা। তাড়াতাড়ি পাখা নামিয়ে অনুসরণ করে চলল ডেভিড। সতর্কবার্তা হিসেবে লাল আলো জ্বলে উঠল মিরেজের মাঝে।

অথচ সামনে ঠিকই পথ করে নিয়ে এগিয়ে পেছনে তাকাল পাইলট। দেখতে পেল অনুসরণ করে আসছে মিরেজ। ধীরে ধীরে প্রায় সিরিয়ানের ঘাড়ের উপর চলে এসেছে। আবারো কন্ট্রোলের উপর মনোযোগ দিল পাইলট। নিচে নামিয়ে আনল নিজের মেশিনকে পাথরের দেয়ালে প্রায় ঘষটে ঘষটে চলেছে পাখা।

পাহাড়ের ভিতর বাতাস ক্রমেই গরম আর দূষিত হয়ে উঠছে। এদিকে মিরেজও অস্থির হয়ে উঠেছে মুক্ত হবার জন্য। অন্যদিকে এখনো ডেভিডের গান সাইটের কেন্দ্রবিন্দুতে এদিক-ওদিক দুলছে সিরিয়ান মিগ।

আবারো মোড় এলো উপত্যকার মাঝে। হয়ে গেল আরো সরু। হঠাৎ করেই দেখা গেল সামনে পাথরের কঠিন কিন্তু মসৃণ দেয়ালে পথ হয়ে গেছে বন্ধু।

 ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে সিরিয়ান প্লেন। চেষ্টা করল উপর দিকে উঠে যাবার। কিন্তু দু’পাশে আর সামনে সব দিকেই পথ আটকে ফেলেছে পাথরের দেয়াল।

 থ্রটল টেনে আফটারবার্নারস জ্বালিয়ে দিল ডেভিড। গর্জে উঠল শক্তিশালী ইঞ্জিন; সামনে ঠেলে দিল ডেভিডকে। সিরিয়ান মিগের স্টার্নের দিকে এগিয়ে গেল মিরেজ।

মনে হলো অনন্তকাল ধরে চলতে লাগল এই মাইক্রো সেকেন্ড। অলস ভঙ্গিতে মিরেজের গান সাইটে উঠে এলো সিরিয়ান মিগ। কেন্দ্র দখল করে এমনভাবে মূর্ত হয়ে উঠল, মনে হলো মিরেজের নাকটা হয়তো মিগের লেজের মাঝে ঢুকে যাবে।

 কামানের ট্রিগার চাপ দিল ডেভিড। কেঁপে উঠল মিরেজ। ফায়ারের সাথে সাথে ধোয়া আর শেল ছুটলো সামনের দিকে।

রূপালি ধোয়ার ভস্মীভূত হয়ে গেল সিরিয়ান মিগ। উজ্জ্বল সাদা আলো জ্বলে উঠল আকাশপানে। ফিউজিলাজ দিয়ে পরিষ্কার দেখা গেল পুড়ছে পাইলটের শরীর। এক মুহূর্তের জন্য স্পষ্ট করে সব দেখা দিল ডেভিডের স্ক্রিনে। হাত আর পাগুলো দুই পশে ছড়িয়ে দিল পাইলট। মনে হলো ক্রুশে দেয়া হচ্ছে তাকে। মাথায় হেলমেট আর পরনের কাপড় বেলুনের মতো উড়ছে বাতাস পেয়ে। এরপরই অদৃশ্য হয়ে গেল সব। কেননা দ্রুত উপত্যকা থেকে উপরে উঠে খোলা আকাশে বের হয়ে এলো মিরেজ।

নিজেদের গাড়ির মাঝে মাঝে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে সৈন্যরা। নিজেদের ক্ষত বেঁধে নিচ্ছে, মৃতদেহ ঢেকে দিচ্ছে। কিন্তু রাস্তার খুব নিচু দিয়ে ডেভিডকে উড়ে আসতে দেখে চোখ তুলে তাকাল সকলে। এত কাছ দিয়ে উড়ে গেল ডেভিড যে পরিষ্কার দেখতে পেল সবার চেহারা। রোদে পোড়া বাদামী ত্বক, কারো আছে দাড়ি, কারো মোচ, শক্তিশালী তরুণ চেহারা, হাত নেড়ে ডেভিডকে ধন্যবাদ জানিয়ে উল্লাসে চিৎকার করে উঠল সকলে।

এরা সবাই আমার আপনার লোক; ভাবল ডেভিড। ঝড়ের গতিতে এখনো রক্তে মিশে যাচ্ছে অ্যাড্রেনালিন। কেমন অদ্ভুত বোধ হলো নিজেকে তার। নিচে মানুষের দিকে তাকিয়ে হাসল সে ও। গ্লাভস পরা এক হাত তুলে স্যালুট জানাল তাদের উদ্দেশে। এরপর উঠে গেল উপরে ব্রিগ চক্রাকারে ঘুরে অপেক্ষা করছে ওর জন্য।

সূর্যের উজ্জ্বল আলোর তুলনায় স্নান দেখাল বাঙ্কারের কৃত্রিম আলো। একজন ইঞ্জিনিয়ার এগিয়ে এসে ককপিট থেকে নামতে সাহায্য করল ডেভিডকে। অন্যরা এসে মিরেজের রিফুয়েল আর বি-আর্মের কাজ শুরু করল। এই ছোট্ট এয়ারফোর্সের এটাই বড় গুণ, যুদ্ধের জন্য প্লেনকে প্রস্তুত করতে খানিকটা সময় লেগে যায়। কিন্তু এই মিরেজ ভগ্নাংশের মাঝে প্রস্তুত হয়ে যায়। তাই প্রয়োজনের সময় শক্রর বহু আগেই যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে যায় মিরেজ।

ককপিটের আড়ষ্টতা থেকে মুক্তি পেয়ে ডেভিড এগিয়ে গেল ব্রিগের দিকে। ফ্লাইট কন্ট্রোলারের নিচে হেলমেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ব্রিগ। হাতের গ্লাভস খুলতে খুলতে তাকিয়ে দেখল এগিয়ে আসছে ডেভিড। হাসল দ্বিগ। ঝিকঝিক করে উঠল স্বর্ণের দাঁত।

আস্তে করে চাপড় দিল ডেভিডের কাঁধে। কেন! ইয়েস!’ বলে উঠল জেনারেল জোশুয়া মোরদেসাই। তুমি পারবে।’

.

সন্ধ্যায় ডেবরার সাথে ডিনারে দেখা করতে দেরি করে ফেললো ডেভিড। যদিও আগেই বাবার কাছে কারণটা শুনতে পেয়েছে ডেবরা।

 ডেভিডের টাওয়ারের পেছনে সিলেক্টে গেল তারা পুরোনো শহরের জাফো গেটের ভেতরে। এর আটপৌরে অন্দর সজ্জা, দেয়ালের উপর দড়ির সজ্জা কিছুই একটু পরে পরিবেশিত হওয়া সুস্বাদু খাবারের আভাস দিতে পারল না

ডেভিডকে। একটুও তেমন দেরী না করে খাবার দিয়ে গেল আরবীয় পরিবেশক—মৌশাখা চিকেন, কুসকুসের উপর ছড়ানো বাদাম আর মসলা।

প্রায় নিঃশব্দে খেতে লাগল দুজনে। ডেভিডের মড বুঝতে পেরে শ্রদ্ধা জাগলো ডেবরার মনে। যুদ্ধ পরবর্তী আবেশে মগ্ন হয়ে আছে ডেভিড। উদ্বেগ আর উত্তেজনায় বয়ে গেছে অ্যাড্রেনালিন। কিন্তু পেটে ভালো খাবার পড়ায় আর ভারী কামেল ওয়াইন সাহায্য করল রিল্যাক্স হতে। এরপর এলাচি দানার ঘ্রাণওয়ালা কালো, টার্কিশ কফি শেষ করার পরেই কেবল ডেবরা ফুরসত পেল কথা বলার।

‘আজ কী হয়েছে, ডেভিড?

উত্তর দেবার আগে এক চুমুক কফি খেল ডেভিড।

‘আমি একজন মানুষকে মেরে ফেলেছি। নিজের কাপ নামিয়ে রেখে মনোযোগ দিয়ে ডেভিডের চেহারা দেখতে লাগল ডেবরা। এরপর পুরো ঘটনা তাকে খুলে বলল ডেভিড। পিছু ধাওয়া করা, মেরে ফেলা; এরপর শেষ করল অনুতাপের স্বরে। ঐ সময়ে আমি কেবল তৃপ্তিই বোধ করেছি। কিছু একটা পেয়েছি মনে হয়েছিল। আমি জানি সে সময় যা করেছি সেটাই ছিল সঠিক।

‘আর এখন? আরেকটু জানতে চাইল ডেবরা।

এখন আমার খারাপ লাগছে।’ কাঁধ ঝাঁকালো ডেভিড। খারাপ লাগছে। এটা ভেবে যে কাজটা করতে হয়েছে আমাকে।

 ‘আমার বাবা, সব সময়ে যাকে সৈন্য হিসেবেই দেখেছি, বলে যে যারা সত্যিকারের যুদ্ধ করে তারাই শুধু জানে যে যুদ্ধকে ঘৃণা করা বলতে কী বোঝায়।

 মাথা নাড়াল ডেভিড, হ্যাঁ। এখন আমিও বুঝতে পারছি এটা। আমি উড়তে পছন্দ করি। কিন্তু ঘৃণা করি ধ্বংস করতে।’

আবারো চুপচাপ হয়ে গেল দু’জনে। দু’জনেই মনে মনে ভাবছে যুদ্ধ নিয়ে নিজস্ব ভাবনা। দু’জনেই শব্দ খুঁজে বেড়াচ্ছে একে প্রকাশ করার।

 ‘আর তারপরেও এটা জরুরি। নীরবতা ভাঙ্গলো ডেবরা। আমাদেরকে যুদ্ধ করতেই হবে আর কোন পথ নেই।’

‘আর কোন উপায় নেই–পেছনে সমুদ্র আর গলার মাঝে আরবীয়।

‘তুমি একজন ইস্রায়েলির মতোই কথা বলছো। নরম স্বরে জানাল ডেবরা।

‘আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ–অথবা এমনো বলা যায় যে তোমার বাবাও এতে ভূমিকা রেখেছে। তিন সপ্তাহ সময় দিয়েছে আমার হিব্রু ঝালাই করে নেয়ার আর অভিবাসনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার।

আর তারপর? ডেভিডের দিকে ঝুঁকে এলো ডেবরা।

 ‘এয়ারফোর্সে একটা কমিশন। শুধুমাত্র এই কারণেই রয়ে যাচ্ছি আমি। আমি ঠিক সেই র্যাংক চাই যা হয়তো স্বদেশে ফিরে গেলে পেতাম। মনে হয়েছিল সে সেকেন্ডহ্যাণ্ড কাপড় বিক্রেতার মতো আচরণ করছিল। কিন্তু আমিও তাকে বশ করে ফেলেছি। তাই অবশেষে মেনে নিয়েছে। অ্যাক্টিং মেজর। এক বছর পরে র্যাংকের নিশ্চয়তা।

‘এটা তো বেশ ভালো খবর, ডেভি। সার্ভিসে একেবারে তরুণ মেজরদের একজন হবে তুমি।

হ্যাঁ, একমত হলো ডেভিড।

‘আর পরে ট্যাক্স দেয়ার পরে আমার বেতন হবে স্বদেশে একটা বাস ড্রাইভারের চেয়ে সামান্য কম।’

 কিছু মনে করোনা। প্রথমবারের মতো হাসল ডেবরা। হিব্রু শিখতে আমি সাহায্য করব তোমাকে।

 ‘এই ব্যাপারে তোমার সাথে কথা বলতে যাচ্ছিলাম আমি। ডেবরার হাসির উত্তর দিল ডেভিড।

 ‘চলো এখান থেকে বেরিয়ে যাই। আজ রাতে কেমন যেন লাগছে হাঁটতে চাই আমি।’

খ্রিস্টান কোয়ার্টারের ভেতরে হেঁটে বেড়ালো তারা। রাস্তার দু’পাশের দোকানগুলোও খোলা। পূর্ণ হয়ে আছে কাপড়, চামড়া আর গয়নার সম্ভারে। একই সাথে সরু গলিটাতে পাওয়া গেল বিভিন্ন মসলা, খাবার, নর্দমা আর মানবতার অপচয়ের গন্ধ, প্রায় মাথার উপরেই খিলানগুলো।

ডেবরা, ভিয়া ডলোরোজাতে একটা অ্যান্টিক শপে নিয়ে গেল ডেভিডকে। খুশিতে গদগদ দোকানি এগিয়ে এলো সামনে।

 ‘আহ মিস মোরদেসাই–আর তোমার বাবা কেমন আছে?’ এরপরই দ্রুত বেগে পিছনের দরজায় অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটা তাদের জন্য কফি আনার উদ্দেশ্যে।

‘অর্ধেকটাই সৎ, এমন লোকদের একজন এই দোকানি আর ব্রিগকে যমের মতো ভয় পায়।

 ডেভিডের জন্য সরু চেইনের মাঝে অ্যান্টিক সোনার তারা পছন্দ করল ডেবরা। এর আগে যদিও এভাবে কোন গয়না পরেনি ডেভিড, তারপরেও মাথা নামিয়ে দিল ডেবরার সামনে। চেইন পরিয়ে দিল ডেবরা। বুকের ঘন কালো কেশের মাঝে ফুটে রইল সোনালি তারা।

 ‘এইটাই একমাত্র পেলে তুমি-সাধারণত মেডেল দিই না আমরা।’ হাসতে হাসতে বলে উঠল ডেবরা।

কিন্তু যাইহোক, ইস্রায়েলে স্বাগতম।

‘এটা অনেক সুন্দর। আবেগ আপ্লুত হয়েও অস্বস্তি বোধ করল ডেভিড। ‘ধন্যবাদ।’ তাড়াতাড়ি শার্টের বোতাম লাগিয়ে নিল। এরপর ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল ডেবরার দিকে। বুঝতে পেরে সরে গেল ডেবরা। সাবধান করে দিল ডেভিডকে।

‘এখানে নয়। দোকানি মুসলিম। ভালোভাবে নেবে না ব্যাপারটা।

‘ঠিক আছে।’ বলে উঠল ডেভিড। চলো এমন কোথাও যাই যেখানে আমাদের জন্য কারো মর্যাদাবোধ আহত হবে না।

বিশাল দেয়ালের লায়ন গেইট দিয়ে বের হয়ে এলো তারা। মুসলিম কবরস্থানে জলপাই গাছগুলোর ভিড়ে খুঁজে পেল একটা পাথরের বেঞ্চ। আকাশে আধখানা চাঁদ, চারপাশে রহস্যময় রূপালি আলো, উষ্ণ রাত অপেক্ষা করছে কিছু একটার জন্য ঠিক যেন নব পরিণীতা বধূ।

 ইন্টারকন্টিনেন্টালে থাকতে পারো না। ডেবরার কথা শুনে দু’জনেই মাথা তুলে উপত্যকার উপরে থাকা হোটেলটার খিলান আর আলো-ছায়ার দিকে তাকিয়ে রইল।

‘কেন নয়?

‘ওয়েল, প্রথমত এটা বেশ ব্যয়বহুল। তুমি যে বেতন পাবে কখনোই টিকতে পারবে না।’

‘তুমি ভাবছো আমি বেতনের টাকায় চলতে পারব না? ডেভিডের অভিযোগ পাশ কাটিয়ে ডেবরা বলে উঠল।

‘আর সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো তুমি কোন মতেই আর ট্যুরিস্ট নও। তাই তুমি সেভাবে থাকতে পারো না।

তাহলে তোমার পরামর্শ কী?

 ‘আমরা তোমাকে একটা অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজে দিতে পারি।’

‘তাহলে ঘরের কাজ, রান্না, কাপড় ধোয়া এগুলো কে করবে?’ প্রায় চিৎকার করে অভিযোগ জানাল ডেভিড। এইসব কাজে আমার তেমন কোন অভিজ্ঞতা নেই।

 ‘আমি করব।’ জানিয়ে দিন, ডেবরা। এক মুহূর্তের জন্য জমে গেল। ডেভিড। এরপর আস্তে করে ঘুরে তাকাল ডেবরার দিকে।

কী বলছো তুমি?

 ‘আমি বলেছি আমি করব। স্থিরপ্রতিজ্ঞা সহযোগে উত্তর দিল ডেবরা। এরপর হঠাৎ করে শান্ত হয়ে গেল কণ্ঠস্বর। যদি তুমি চাও আমি করি।’ বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো ডেভিড।

‘দেখো ডেবস, তুমি কী লিভিং টুগেদারের কথা বলছো? মানে আমি বলতে চাইছি ফুল-টাইমের জন্য ঘরবাড়ি খেলা খেলা?

“ঠিক এই জিনিসটাই বলতে চাইছি আমি।’

‘কিন্তু’ আর কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না ডেভিড। পরিকল্পনাটা চমৎকার, শ্বাসরুদ্ধকর আর আরো অনেক কিছুর সম্ভাবনাও থকে যায়। এর আগে বিপরীত সেক্সের সাথে অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রচুর। কিন্তু কোনটাই তেমন গভীর ছিল না। তাই মনে হলো অজানা কোন দেশের সীমান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে।

“ওয়েল?’ অবশেষে জানতে চাইল ডেবরা।

তুমি বিয়ে করতে চাও?’ শব্দগুলো কেমন ভেঙ্গে ভেঙ্গে বের হলো ওর গলা দিয়ে। কেশে গলা পরিষ্কার করল ডেভিড।

‘ডার্লিং, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই যে, বিয়ের বাজারে তুমি সেরা কিনা। সকালের মতই সুন্দর তুমি আর মজা করে বলতে চাইল–তুমি স্বার্থপর নাবালক আর বখে যাওয়া।

‘ধন্যবাদ, তোমার অনেক দয়া।

‘ওয়েল, আমার ভেতর ঢং করে কথা বলার কোন প্রবণতা নেই। তখনো হয়তো থাকবে না যখন সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে তোমার মিসট্রেস হয়ে যাবো।

 ‘ওয়াও!’ আনন্দিত হয়ে উঠল ডেভিড। সমস্ত আড়ষ্টতা উধাও হয়ে গেল কণ্ঠ থেকে। এভাবে সরাসরি যখন কথা বললো আমার মাথায় প্রায় বিস্ফোরণের মতো ঘটে।

 ‘আমারও’, স্বীকার করল ডেবরা। কিন্তু শর্ত একটাই–আমাদের নিজেস্ব বিশেষ জায়গা না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব আমরা। তোমার হয়তো মনে আছে জনসমক্ষে বীচে বা পাথুরে দ্বীপে তেমন সহজ নই আমি।

‘আমি কখনোই ভুলবো না।’ একমত হলো ডেভিড। এর মানে কী তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও না?

 ‘আমি এটা বলিনি। বিড়বিড় করে উঠল ডেবরা। কিন্তু দু’জনেই যখন প্রস্তুত হবো এই সিদ্ধান্ত তখনকার জন্যই মুলতবী থাক।

 ‘রাইট অন ডল। সারা মুখে প্রায় বোকার মতো হাসি নিয়ে উত্তর দিল ডেভিড।

 ‘আর এখন, মেজর মরগ্যান, তুমি চাইলে আমাকে কিস করতে পারো। কিন্তু শর্তের কথা মনে রেখে আমাকে সাহায্য করবে।’ জানিয়ে দিল ডেবরা।

অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ করে একটা চিন্তা এসে আতঙ্কিত করে তুলল ডেভিডকে।

মাই গড! প্রায় চিৎকার করে উঠল সে। ব্রিগ কী বলবে?

 ‘সে নিশ্চয় আমাদের সাথে থাকতে আসবে না। হেসে ফেলল দু’জনেই।

না সিরিয়াসলি, কী বলবে তোমার মা-বাবা কে? জানতে চাইলে ডেভিড।

‘আমি খুব সুন্দরভাবে মিথ্যা কথা বলব; তারাও এমন অভিনয় করবে যে আমার কথা বিশ্বাস করেছে। এ ব্যাপারে আমাকেই মাথা খাটাতে দাও।

“ঠিক আছে। তৎক্ষণাৎ একমত হলো ডেভিড।

 ‘এই তো তুমি শিখে যাচ্ছে সব।’ হাততালি দিয়ে উঠল ডেবরা।

‘আই লাভ ইউ। হিব্রুতে জানাল ডেভিড।

 ‘লক্ষ্মী ছেলে। বিড়বিড় করে উঠল ডেবরা।

কিছুদিনের মাঝেই ডেভিড আবিষ্কার করল যে জেরুজালেমে অ্যাপার্টমেন্ট খোঁজা আর হলি গ্রেইল খোঁজার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। যদিও অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে সুউচ্চ সব দালান। তারপরেও চাহিদারর তুলনায় তা কিছুই না।

 ডেবরার এক ছাত্রের বাবা এস্টেট এজেন্ট। হৃদয় দিয়ে গৃহহীনদের আর্তি অনুভব করে ভদ্রলোক। নতুন ব্লকের জন্য অপেক্ষমান তালিকা কেবল বড় হতে থাকে। কিন্তু কোন কারণে পুরাতন একটি দালানের একটা অ্যাপার্টমেন্ট খালি হয়ে যাওয়ায় সব প্রভাব খাঁটিয়ে ডেবরাকে সাহায্য করে সে।

হঠাৎ করেই যখন আসার কথা নয় এমন সময়ে ডেবরার মেসেজ পায় ডেভিড। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্যাক্সি সহযোগে তাড়াতাড়ি শহরের উদ্দেশে রওনা হয় দু’জনে। ড্রাইভারকে তাড়া লাগিয়ে দেখে আসতে চায় নতুন পাওয়া সুযোগ।

জায়গাটা দেখার সাথে সাথে ডেভিডের মনে পড়ে গেল লরেন্স অব অ্যারাবিয়ার মুভি সেটের কথা। সামনের দিকে তাল গাছের সারি, প্রতিটি ব্যালকনিতে আর জানালাতে ঝুলছে রঙিন কাপড়-চোপড়, ভেসে আসছে আরবীয় উটের বাজারের গন্ধ আর শব্দ আর উঠানের একপাশে নার্সারি স্কুলের খেলার জায়গা।

অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে দুইটা রুম আর লাগোয়া একটা বাথরুমও আছে। ওয়ালপেপারের গোলাপগুলো ইতিমধ্যে ঝাপসা হয়ে গেছে। শুধুমাত্র যেসব জায়গায় অন্য কোন আসবাব ঝোলানো ছিল সেখানে এখনো অক্ষত আছে ওয়ালপেপারের সত্যিকারের নকশা আর রং।

বাথরুমের দরজা খুলে উঁকি দিল ডেভিড। ভেতরে না ঢুকেও নজর বুলিয়ে দেখে নিল এবড়ো-থেবড়ো মেঝে, সস্তা দামের বাথটাব। এরপর দরজাকে আরো একটু ধাক্কা দিতেই দেখতে পেল টয়লেট বোলের বেহাল দশা। এমন ভাবে হাঁ করে আছে যেন কোন মাতাল পরীর শূন্য মুখ।

‘তুমি আর জো নিশ্চয়ই এতে কাজ চালাতে পারবে। অনিশ্চয়তার সুরে বলে উঠল ডেবরা। এটা এত একটা খারাপও নয়।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে এমনভাবে বাথরুমের দরজা আটকে দিল ডেভিড, যেন কোন কফিনের ঢাকনা।

তুমি নিশ্চয়ই মজা করছে–তাই না।’ ডেভিড বলতেই দেখা গেল ডেবরার মুখে নিশ্চিন্তের হাসি।

“ওহ, ডেভিড। আমরা আর কোন জায়গা পাবো না।’

“আর আমি বেশিদিন অপেক্ষা করতে পারব না।

 ‘আমিও না।’ স্বীকার করল ডেবরা।

 “ঠিক আছে। দুই হাত ঘসলো ডেভিড। সময় হয়েছে প্রথম দল পাঠানোর।

জেরুজালেমে মরগ্যান গ্রুপের পরিচয় নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান ডেভিড। কিন্তু ডিরেক্টরীতে মরগ্যান ইনড্রাষ্ট্রিয়াল ফিন্যান্স নামে খুঁজে পেল অবশেষে। ম্যানেজিং ডিরেক্টর, অ্যারন কোহেন। প্রধান পোস্ট অফিসের পেছনে লিউমি ব্যাংক বিল্ডিংয়ে অফিস। গত দশ দিন ধরে জেরুজালেমে বাস করছে মরগ্যান পরিবারের সদস্য, জানতে পেরে হতভম্ব হয়ে যায় অ্যারন। যদিও দ্রুতই আবার সামলে নেয় নিজেকে।

কী চায় ডেভিড জানিয়ে দিতেই মাত্র বিশ ঘন্টার মাঝে সাইন করিয়ে টাকা পরিশোধের ঝামেলাও মিটিয়ে দেয় অ্যারন। পল মরগ্যান অনেক ভেবে-চিন্তেই নিজের এক্সিকিউটিভদের নিয়োগ দেয় তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হলো অ্যারন কোহেন। আর এই কাজের জন্য ডেভিডের যা পরিশোধ করতে হলে তা হলো পরদিন সকালবেলা পল মরগ্যানের ডেস্কে পৌঁছে গেল তার সাম্প্রতিক অবস্থান, আর্থিক লেনদেন আর ভবিষ্যত পরিকল্পনা–কিন্তু এতটুকু দিতে কার্পণ্য করল না ডেভিড।

হিন্নম গভীর খাদের উপরে, মাউন্ট জিয়নের দিকে মুখ করে থাকা মন্টেফিওরে কোয়ার্টারকে সম্পূর্ণ নতুন করে গড়ে তুলেছে কয়েকজন ব্যবসায়ী। প্রায় পুরোটাই তৈরি অনিন্দ্যসুন্দর সোনালি জেরুজালেম পাথর দিয়ে। আর এর নকশা করা হয়েছে প্রাচীনতার ছাপ দিয়ে। যার কোন বয়স নেই। কিন্তু যাইহোক অভ্যন্তরের নকশায় আছে অত্যাধুনিক লম্বা-শীতল রুম, মোজাইক টাইলসের বাথরুম আর সিলিংয়ের খিলান দেখে মনে হবে ক্রুসেডীয় আমলের গির্জা। কোয়ার্টারের বেশিরভাগ বাড়িগুলোর নিজস্ব ছাদ আর সীমান্ত দেয়াল আছে।

মালিক স্ট্রিটের দিকে মুখ করে থাকা বাড়িগুলোর একটি ডেভিডের জন্য নির্বাচন করল অ্যারন কোহেন। দামটাও বেশ ভারিক্কি চালের। হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পেয়ে এটাই ছিল ডেবরার প্রথম প্রশ্ন। ছাদে একটা মাত্র জলপাই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে যেন পাথর হয়ে গেল সে। ছাদের পাথরগুলোকে কেটে এমন পালিশ করা হয়েছে যে দেখতে মনে হচ্ছে পুরোনো আইভরি খোদাই করা সদর দরজার উপর হালকা ভাবে হাত বুলাতে লাগল ডেবরা। স্তম্ভিত ডেবরার কণ্ঠস্বর হয়ে গেল ফ্যাসফ্যাসে আর শোনার অযোগ্য।

‘ডেভিড! ডেভিড! এর দাম কত?

‘এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা?

‘এটা অনেক সুন্দর। অনেক বেশি, ডেভিড। আমরা এতটা খরচ করতে পারব না।

ইতিমধ্যে এর দাম পরিশোধ করা হয়ে গেছে।

হয়ে গেছে? হাঁ করে তাকিয়ে রইল ডেবরা। কত ডেভিড?

যদি আমি এক মিলিয়ন বা আধা মিলিয়ন ইস্রায়েলী পাউন্ডস, কী যায় আসে তাতে? এটা শুধুমাত্র অর্থ।

দুই কানে হাত চাপা দিল ডেবরা। না!’ চিৎকার করে উঠল। আমাকে বলো না। আমার খুব খারাপ লাগবে। আমি এখানে থাকতে পারব না।

‘ওহ, কী! তুমি ইতিমধ্যে সম্মতি দিয়েছে এখানে থাকার।’

 ‘চেষ্টা করে দেখো।’ জোর দিয়ে বলে উঠল ডেবরা। চেষ্টা করে দেখো।’

মাঝখানের রুমে দাঁড়িয়ে কথা বলছে তারা। সামনে খোলা ছাদ। যদিও ভয়ঙ্কর গরমের কথা মাথায় রেখে এখানে বাতাস চলাচলের যথেষ্ট ব্যবস্থা রাখা হয়েছে আর রংও হালকা; তারপরও নতুন রং আর কাঠের বার্নিশের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

ফার্নিচার সম্পর্কে কী করতে চাও?’ জানতে চাইল ডেভিড।

ফার্নিচার? একই প্রশ্ন করল ডেবরা। আমি, এতটা এগিয়ে ভাবিনি এখনো।

আমার যেটা মনে হয় আমাদের একটা বড়সড় বিছানা প্রয়োজন।

গম্বুজের মত ছাদ বা পাথরের মেঝের উপর কোন আধুনিক ফার্নিচার ভালো লাগবে না। তাই অ্যান্টিক শপ আর বাজার ঘুরে ঘুরে ফার্নিচার কেনা শুরু করল দুজনে।

প্রধান সমস্যার সমাধান করে দিল ডেবরা। একটা অপরিত্যক্ত মালের গুদামে পেয়ে গেল বিশাল একটা খাট; যদিও ধুলা ময়লা পরিষ্কার করে নিতে হলো। চকচক না করা পর্যন্ত পালিশ করা হলো এটিকে। নতুন কেনা হলো ভেতরের দিকে স্প্রিং দেয়া ম্যাট্রিস। আর খাটটাকে ঢেকে দেয়ার জন্য ডেবরার ড্রয়াল থেকে বের করা হলো ক্রিম রঙা লেসের চাদর।

পুরোন শহরের আরবীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনে নিল উল দিয়ে বোনা রাগ। পাথরের মেঝের উপর মোটা করে বিছিয়ে দিল। সাথে থাকল বসার জন্য চামড়ার কুশন আর খাবার-দাবারে জন্য ইবোনি আর মাদার অব পার্ল দিয়ে তৈরি, জলপাই কাঠের নিচু টেবিল। অন্যান্য আসবাব কেনা হবে যখন বিক্রির জন্য নোটিশ লাগানো কিছু পাবে অথবা এতেও কাজ না হলে ডেবরার পরিচিত আরবীয় কেবিনেট মেকার তো আছেই। খাট আর টেবিল দু’টোরই ওজন অসম্ভব ভারী। তাই শক্তিশালী কাউকে দরকার এ দু’টো বহন করার জন্য। এক্ষেত্রে একমাত্র উপায় জোকে ডাকা। তাই করল তারা। জোর ছোট্ট জাপানি গাড়িতে করে এসে পৌঁছালো জো আর হান্নাহ। মরগ্যান প্রাসাদ দেখে তো দুজনের ভিরমি খাবার জোগাড়। যাই হোক একটু ধাতস্থ হতেই আগ্রহ নিয়ে কাজ শুরু করল তারা। আর সবকিছুর তত্ত্ববধানের দায়িত্বে রইল ডেভিড। কাজ করতে শুরু করল জো, অন্যদিকে ডেবরার সাথে আধুনিক আমেরিকান রান্নাঘরে হারিয়ে গেল হান্নাহ। ওয়াশিং মেশিন, ড্রয়ার, ডিশ ওয়াশার আর অন্যান্য যন্ত্রপাতি দেখে একই সাথে শ্রদ্ধা আর হিংসা ফুটে বের হলো হান্নাহর গলা চিরে। প্রথম খাবার রান্না করায় ডেবরাকে সাহায্য করল সে।

এককেস গোল্ডস্টার বিয়ার নিয়ে এলো ডেভিড। নিজ নিজ কাজ শেষ করে জলপাই কাঠের টেবিলের চারপাশে জড়ো হলো সবাই ঘর গরম করতে আর ছাদ ভিজাতে।

ডেভিড ভেবেছিল জো হয়তো খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে থাকবে। যেহেতু এটা তার দুগ্ধপোষ্য বোনের রূপকথার বাসা। কিন্তু সবসময়কার মতো প্রাণবন্ত রইল জো। বিয়ার আর সবার সঙ্গে এতটাই মশগুল হয়ে পড়ল যে অবশেষে বাধ সাধলো হান্নাহ।

‘দেরি হয়ে গেছে। দৃঢ়গলায় ঘোষণা করল সে।

 ‘দেরি? অবাক হয়ে জানতে চাইল জো। মাত্র নয়টা বাজে।

 ‘আজকের রাতের মতো একটা রাতে এইটাই অনেক দেরি।

মানে?’ মানে হলো কিছুই বুঝতে পারছে না জো।

 ‘যোসেফ মোরদেসাই, অসাধারণ কূটনীতিবিদ। ভারী গলায় জ্বিপের স্বরে বলে উঠল হান্নাহ। হঠাৎ করে বদলে গেল জোর অভিব্যক্তি। অপরাধীর ভঙ্গিতে তাকাতে লাগল ডেভিড আর ডেবরার দিকে। একচুমুকে শেষ করে ফেলল নিজের বিয়ার। আর এক হাত দিয়ে দাঁড় করিয়ে নিল হান্নাহকে।

 ‘চলো। আমরা এখানে বসে আছি কেন?’ বোধোদয় হলো জো’র।

ছাদের আলো জ্বালিয়ে রাখলো ডেভিড। খোলা জানালা দিয়ে সেই আলোর রেশ আসছে ঘরে। রুম জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল নরম আলো। পাথরের দেয়াল আর দূরত্ব থাকায় শহরের কোলাহলও শোনা যাচ্ছে না তেমন। আর এই মৃদু শব্দ তাদের একাকিত্বকে ভেঙ্গে দেয়ার বদলে বাড়িয়েই তুলল কেবল।

হালকা আলো ছড়াচ্ছে ক্রিম রঙা বেডকাভার। আইভরি লেসের কাজ থেকে ভেসে আসছে ল্যাভেন্ডার আর মথ বলসের গন্ধ।

বিছানায় শুয়ে ডেবরার পোশাক খোলার দৃশ্য দেখতে লাগল ডেভিড। নিজের উপরে ডেভিডের দৃষ্টি আর পূর্বে কখনো এমন না করায় লজ্জিত হয়ে উঠল ডেবরা।

কৃশকায় শরীরে লম্বা কোমর আর শিশুর মতো লাবণ্য মাথা পদযুগল; তারপরেও এতটুকু হারায়নি নারীসুলভ কমনীয়তা।

বিছানার কিনারে এসে বসল ডেবরা। ওর দেহত্বকের চকচকে মসৃণ ভাব দেখে আবারো চমৎকৃত হলে ডেভিড। কোন কোন জায়গায় সূর্যের তাপে পোড়া তুক ক্রিম থেকে হয়ে গেছে মধু-রঙা। আস্তে আস্তে ডেভিডের দিকে ঝুঁকে এসে গালে হাত রাখল ডেবরা।

তুমি অনেক সুন্দর। ফিসফিস করে উঠল ডেবরা। দেখল এর পুরোটাই সত্যি। লম্বা, ঋজু দেহে পেশীবহুল কাঁধ, কোমর আর সরু পেট। নিখুঁত মুখমণ্ডল। এতটাই অপার্থিব সৌন্দর্য যে মনে হলো এটাই ওর খুঁত। মনে কোন দেবদূত অথবা পুরাণ থেকে উঠে আসা দেবতার পাশে শুয়ে আছে ডেবরা।

 পা ভাঁজ করে বিছানায় উঠে এলো সে। চাদরের নিচে একে অন্যকে স্পর্শ না করেও কাছকাছি শুয়ে দু’জনে তাকিয়ে রইল দু’জনের দিকে।

 তৃপ্তি আর খুশির শ্বাস বের হয়ে এলো ডেবরার গলা চিরে। মনে হলো বহুদূর একাকী ভ্রমণ করে এসে গন্তব্যে পৌঁছেছে কোন পরিব্রাজক।

‘আই লাভ ইউ, প্রথমবারের মতো উচ্চারণ করল ডেবরা।

.

পুরো একটা সন্ধ্যা ব্যয় করে ডেভিডকে বোঝাতে লাগল ডেবরা–যে এয়ার বেস আর মালিক স্ট্রিটের ঘরে পৌঁছানোর জন্য উচ্চ শক্তি সম্পন্ন স্পোর্টস কারের কোন প্রয়োজন নেই। এতদিনে ডেভিডের পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে বুঝে গেছে সে ভালোভাবেই। ডেভিডকে বোঝাতে লাগল যে এত জাকজমক আর ব্যয়বহুলতা ভালো দেখায় না। একমত হলো ডেভিড। জানে যে অ্যারন কোহেন আর ওর সঙ্গোপাঙ্গোরা নজরদারী করছে।

জোর মতোই জাপানিজ কার নিতে বলল ডেবরা। ডেভিড জানাল যে এ। ব্যাপারে অবশ্যই মনোযোগ দিয়ে ভাববে সে।

অ্যারন কোহেনের লোক তেল আবিবে অবস্থানরত জার্মান চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ারসের কাছে একটা মার্সিডিজ বেঞ্জ ৩৫০ এস এল দেখে এলো। এই ভদ্রলোক আবার বার্লিনে ফিরে যাচ্ছে কিছুদিনের মধ্যে। তাই আলোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ক্যাশ পেলে অটো ছেড়ে দিতে রাজি আছে। একটা মাত্র ফোনকলের মাধ্যমে জুরিখের সুইস ক্রেডিটের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা হয়ে গেল।

 গাড়ির রং সোনালি ব্রোঞ্জ। ঘড়িতে দেখা গেল বিশ হাজার কিলোমিটারের খানিকটা নিচে কাটা। আর মালিক যে যথেষ্ট যত্নের সাথে এর দেখভাল করেছে তা বুঝতে কোন কষ্ট হলো না।

 বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিজের মোটর স্কুটারে ফিরে মালিক স্ট্রিটের শেষ মাথায় এই মহার্ঘ্য মেশিন বাধা দেখতে পেল ডেবরা। একটা মোটাসোটা শিকল গ্রামে সকল ধরনের মোটর চালিত বাহনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে।

একবার তাকিয়ে দেখল ডেবরা। আর সাথে সাথেই বুঝে গেল যে এটা কার হতে পারে। অসম্ভব রেগেমেগে ছাদে উঠে এলো সে। কিন্তু হাবে ভাবে চাইল আরো বেশি রাগ দেখাতে।

‘ডেভিড মরগ্যান, তোমাকে নিয়ে আসলে কিছুই করার উপায় নেই।

‘তুমি সত্যিই দ্রুত বুঝতে পারো সব।’ ঘঁদের উপর সূর্য স্নান করছে। ডেভিড।

কত টাকা দিয়েছে এর জন্যে?”

অন্য কোন প্রশ্ন করো, ডল। বেশ একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা।

 ‘তুমি সত্যি একটা’-থেমে গিয়ে উন্মত্তের মতো উপযুক্ত শব্দ খুঁজতে লাগল ডেবরা। অবশেষে খুঁজে পেয়ে তৃপ্তির স্বরে উগরে দিল গলা দিয়ে ‘অধোপতনে যাচ্ছো!

 ‘এই শব্দের সঠিক অর্থই জানো না তুমি।’ কুশন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্র ভাবে ডেবরাকে উত্তর দিল ডেভিড। অলস ভাবে ঘুরে দাঁড়াল ডেবরার দিকে। যদিও মাত্র তিনদিন ধরে একে অন্যের এতটা সান্নিধ্যে এসেছে তারা, তারপরেও ডেভিডের চোখের ভাষা বুঝতে পারল ডেবরা।

‘তোমাকে অর্থটা বুঝিয়ে দেবো আমি।’ বলে উঠল ডেভিড। হাতে কলমে অধপতনে যাবার এমন উদাহরণ দিয়ে দেবো অনেক দিন মনে রাখবে।’

ডেভিড এগোনো শুরু করতেই জলপাই গাছের পিছনে চলে গেল ডেবরা। সারা ছাদে ছড়িয়ে পড়ল বইখাতা।

‘ছাড়ো আমাকে হাত সরাও জানোয়ার কোথাকার।

ডানদিকে লাফ দিল ডেভিড সহজেই তুলে নিল ডেবরাকে। ডেভিড মরগ্যান আমি সর্তক করে দিচ্ছি তোমাকে, এই মুহূর্তে আমাকে নিচে নামাও নয়তো চিৎকার করব আমি।’

‘চলো শোনা যাক! করো চিৎকার। তাই করল ডেবরা, কিন্তু প্রতিবেশীদের কোন নিদ্রাই ভঙ্গ হলো না তাতে।

অন্যদিকে ৩৫০ দেখে যারপরনাই খুশি হলো জো। চারজনে মিলে ট্রায়াল দিতে চলে গেছে। ডেড সীর তীরে অবস্থিত জুদায়ার বন্য অঞ্চলের আঁকাবাঁকা রাস্তায়। গাড়ির সহ্য ক্ষমতা আর ড্রাইভার হিসেবে ডেভিডের দক্ষতার পরীক্ষা হয়ে গেল। প্রতিটি বাকের মুখে উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল সকলে। এমনকি নিজের প্রাথমিক বিরোধিতা মনোভাব কাটিয়ে ডেবরা স্বীকার করতে বাধ্য হলো যে গাড়িটা সত্যিই সুন্দর–তারপরেও অধোপতনোম্মুখ।

ইন জেদির মরূদ্যানের ঠাণ্ডা সুবজ পানিতে সাঁতার কাটলো সবাই। এরপর সমুদ্রের ঘন লবণাক্ত পানিতে চলে গেল। সবাই মিলে এর আগে বানালো পাথরের গভীর পুল।

নিজের ক্যামেরা নিয়ে এসেছিল হান্নাহ। পুলের পাথরের পাশে বসা ডেভিড আর ডেবরার ছবি তুলে নিল তাতে।

গোসলের উপযোগী পোশাক পরে আছে সবাই। ডেভিডের দিকে তাকিয়ে হাসছে ডেবরা। বিকিনি ফুটে বেরিয়ে পড়েছে সুন্দর তনু। ডেভিডও হাসল, কপালের উপর এসে পড়েছে চুল। মরুভূমির আলোয় বিশুদ্ধভাবে ফুটে উঠেছে তার পুরুষালী সৌন্দর্য।

 দু’জনকেই এই ছবির একটা করে প্রিন্ট দিয়ে দিল হান্নাহ। পরবর্তীতে এই ছবির চকচকে কাগজটুকু রইল কেবল সেসব দিনের হাসি-আনন্দের সাক্ষী হয়ে। মনে হলো জীবনের গাছ থেকে ছিঁড়ে নেয়া হলো একটা ফুল শুকিয়ে হয়ে পড়ল কদর্য, চলে গেল বর্ণ আর গন্ধ।

কিন্তু এই উজ্জ্বল দিনে তাদের খুশির উপর কোন ছায়া ফেলতে পারল না ভবিষ্যত। জেরুজালেম ফেরার পথে ড্রাইভ করল জো। পথিমধ্যে ট্যাংক কোর’ এর একদল ছেলে বাড়ি ফেরার সময় কিছু না পেয়ে ডেভিডের গাড়ির উদ্দেশে হাত তুলে নাচানাচি শুরু করাতে ডেবরার পীড়াপিড়িতে গাড়ি থামালো জো। যদিও ডেভিড প্রচণ্ড আপত্তি করেছে, দেখা গেল চেপেচুপে ছোট্ট ক্যাবে ঠিকই জায়গা করে নিল তিনজনে। নিজেকে অপরাধী মনে হওয়ায় পেছনের সিটে ডেবরার কাঁধে হাত রেখে বসে রইল ডেবরা। সবাই মিলে গাইতে লাগল এ বছর ইস্রায়েলের তরুণদের কাছে জনপ্রিয় গান ‘লেট দেয়ার বি পিস।

শেষের দিনগুলোতে যখন এয়ারফোর্সে ঢোকার জন্য অপেক্ষা করছে। ডেভিড, এ সময় সময় কাটানোর জন্য ঘরের ছোটখাটো কাজ করতে লাগল সে। যেমন নিজের ইউনিফর্ম ঠিকঠাক করা। ডেবরার পরামর্শ, যা হলো রেগুলেশন যদি তার বাবার জন্য ঠিক হয় তাহলে ডেভিডের জন্যও তা ঠিক হবে। কিন্তু সবকিছুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল ডেভিড। অ্যারন কোহেন নিজের টেইলরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল ডেভিডকে। ডেভিডের স্টাইল সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ জাগতে শুরু করল অ্যারনের মনে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাটলেথিক ক্লাবে ডেভিডের সদস্যপদের ব্যবস্থা করে দিল ডেবরা। প্রতিদিন প্রথম শ্রেণীর আধুনিক জিমে যাওয়া শুরু করল ডেভিড। আর শেষ করল নিজের গঠনকে ধরে রাখার জন্য অলিম্পিকের সাইজের চওড়া বিশটি সুইমিং পুলে সাঁতার কাটা।

যাইহোক, অন্য সময় সে ব্যস্ত রইল ছাদের সূর্যস্নান অথবা ইলেকট্রিক প্লাগ বা ঘরের এ জাতীয় অন্যান্য টুকটাক কাজে, যা চাপিয়ে দিতে লাগল ডেবরা।

ঘরের মাঝে ঘুরে বেড়ানোর সময় হয়তো হাতের কাছে পেলো ডেবরার ব্যবহৃত কোন জিনিস–একটা বই বা পিন, তৎক্ষণাৎ সেটা হাতে তুলে নিয়ে আদর করে দেয় ডেভিড। একবার তো এমন হলো যে ডেবরার বোব এলোমেলো ভাবে পড়ে রইল খাটের কিনারে। বিশেষ এই গন্ধ ডেভিডকে এতটাই বিবশ করে ফেলল যে অপেক্ষা করতে লাগল কখন আসবে ডেবরা।

যাইহোক, অন্য কিছু নয়, বইয়ের মাঝে এমন কিছু আবিষ্কার করল ডেবরা সম্পর্কে যা বুঝতে হয়তো লেগে যেত বছরের পর বছর। ফার্নিচার বিহীন দ্বিতীয় বেডরুমের ক্রেট ভর্তি বই রেখে দিয়েছে ডেবরা। কাবার্ড আর শেষ্য পাবার আগে এটা তাদের অস্থায়ী স্টোররুম। এক বিকেলে ক্রেট হাতড়াতে লাগল ডেভিড। মিশ্র সাহিত্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ গিবন আর ভিদাল শেক্সপিয়ার আর মেইলার, সলজোনিৎসিন আর মেরী স্টুয়ার্ট, আরো আছে অন্যান্য অদ্ভুত লেখকরা। আছে গল্প, জীবনী ইতিহাস, কবিতা, হিব্রু, ইংরেজি নরম বাধাই আর চামড়ায় মোড়ানো সংখ্যা। আর আছে পাতলা সবুজ মোড়কে বাধাই ভলিউম যেটা প্রায় ফেলেই দিচ্ছিল সে এমন সময় লেখকের নাম দেখে হাতে তুলে নিল। ডি মোরদেসাই। আবিষ্কারের নেশায় পাতা উল্টালো ডেভিড।

“দিস ইয়ার, ইন জেরুজালেম, কবিতার সংকলন, লেখক ডেবরা মোরদেসাই।

হাতে করে বইটা নিয়ে বেডরুমে এলো ডেভিড। ভুলে গেল লেস কাভারের উপর শোয়ার সময় জুতা খুলে রাখতে–এ ব্যাপারে বেশ কড়া ডেবরা প্রথম পৃষ্ঠা উল্টালো ডেভিড।

পাঁচটা কবিতা। প্রথমটি টাইটেলে থাকা নাম। বাস্তব হয়ে উঠল দুই হাজার বছরের প্রতিজ্ঞা করা নেক্সট ইয়ার ইন জেরুজালেম। নিজের দেশের প্রতি দেশত্ববোধ ফুটে উঠেছে এতে। এমনকি ডেভিড যে কিনা ম্যাকলিন আর রবিনস পড়ে অভ্যস্ত, সেও স্বীকার করতে বাধ্য হলো যে অত্যন্ত উন্নতমানের লেখা হয়েছে এটি। প্রতিটি লাইনে ফুটে উঠল চমকে যাবার মতো সৌন্দর্য, শব্দের অসাধারণ ব্যবহার। ভালো বেশ ভালো হয়েছে আর নিজের ভিতর কেমন অদ্ভুত গর্ব বোধ করতে লাগল ডেভিড। ডেবরার হৃদয় আর চেতনার এতটা গভীরতা সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না তার।

শেষ কবিতায় এসে দেখল এটা বাকিগুলোর মাঝে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত আর ভালোবাসা নিয়ে লেখা–অথবা এমন কাউকে নিয়ে লেখা যাকে অনেক ভালোবাসা দিয়ে ঘিরে রাখা হলেও চলে গেছে সে। আর হঠাৎ করেই ডেভিড বুঝলে পারল যে ভালো আর জাদুকরী বলতে কী বোঝায়, এদুটোর পার্থক্য কী।

ডেবরার লেখার শব্দমালা পড়ে কেঁপে উঠল ডেভিড। খেয়াল করে দেখল যে এমন অদ্ভুত একটা সৌন্দর্য যে গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল আর অবশেষে এই বিষাদে ভেসে গেল সেও। মনে হলো দম বন্ধ হয়ে যাবে। সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে যেন ডেভিড। এমন দুঃখের মাঝে পড়ে চোখ বেয়ে নামতে লাগল অশ্রুকণা। আর দ্রুত চোখ মুছতে হলো বারবার, কেননা কবিতার শেষটুকু একেবারে হৃদয় বিদীর্ণ করে দিল তার।

বুকের উপর নামিয়ে রাখল বই, মনে পড়ে গেল জো’র কাছে শোনা সৈন্যের কথা, যে মারা গেছে মরু। হঠাৎ করে একটা আওয়াজ পেয়ে উঠে বসে তাড়াতাড়ি চাইল বইটাকে লুকিয়ে ফেলতে। এমন একটা ব্যক্তিগত জিনিস এটা, এই কবিতা, নিজেকে চোর বলে মনে হলো তার।

বেডরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ডেভিডের দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল ডেভিডকে।

বিছানায় উঠে বসে হাতে বই তুলে নিল ডেভিড। এটা বেশ সুন্দর। অবশেষে কোনক্রমে বলে উঠল ডেভিড। কণ্ঠস্বরে কান্নার রেশ।

তুমি পছন্দ করেছে শুনে আমার ভালো লাগছে।’ বলল বটে ডেবরা কিন্তু ডেভিড বুঝলে পারল যে সে লজ্জিত হয়েছে।

‘আমাকে আগে দেখাওনি কেন?

 ‘ভয় পেয়েছি যে হয়তো তুমি পছন্দ করবে না।’

 ‘ওকে অনেক ভালোবাসতে, তাই না? নরম স্বরে জানতে চাইল ডেভিড।

হ্যাঁ। তাই করতাম। বলে উঠল ডেবরা। কিন্তু এখন আমি তোমাকে ভালোবাসি।

***

অবশেষে নির্ধারিত হলো ডেভিডের পোস্ট। পরিষ্কার বোঝা গেল যে এর সব ক্ষেত্রেই ব্রিগের হাত রয়েছে। যদি জো স্বীকার করল যে সে তার সব পারিবারিক ক্ষমতা ব্যবহার করে এই আদেশকে প্রভাবিক করেছে।

ডেভিডকে আদেশ দেয়া হলো যেন মিরেজ স্কোয়াড্রন ‘ল্যান্স’তে রিপোর্ট করে। এটি একটি ইন্টারসেক্টর আউটফিট বেস আর অবস্থান একই গোপন এয়াফিল্ডে যেখান থেকে সে প্রথমবার উড়ে গিয়েছিল। একই স্কোয়াড্রনে আছে জো মোরদেসাই। মালিক স্ট্রিটে ডেভিডকে সংবাদটা দিতে এসে নিজের মনোভাব না লুকালেও জো আশা করল যে শীঘ্রই তারা একসঙ্গে উড়তে পারবে রেগুলার দল হিসেবে। সন্ধ্যায় বসে পুরো স্কোয়াড্রনের সবার সম্পর্কে ডেভিডকে জানিয়ে দিল জো। ‘লে ডফিন’ কমান্ডিং অফিসার থেকে শুরু করে সবচেয়ে নিচু পদমর্যাদার মেকানিক পর্যন্ত। সামনের সপ্তাহগুলোতে ডেভিড টের পাবে যে জোর পরামর্শ আর সাহায্য কতটা অমূল্য ওর জন্য।

পরের দিন টেইলর নিয়ে এলো ডেভিডের ইউনিফর্ম। ডেবরাকে সারপ্রাইজ দিতে ইউনিফর্ম পরে নিল ডেভিড। রান্নাঘরের দরজা দিয়ে ঘুরে ঢুকলো ডেবরা। হাত ভর্তি বই আর বাজার সদাই। শরীরের নিচের অংশ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো। পেছনে খোলা চুল, মোটা চশমা মাথার উপরে তুলে রাখা।

সিঙ্কের উপর ঢেলে দিল হাতের বোঝা। এরপর কোমরে হাত রেখে ধুরে ঘুরে চারপাশ থেকে দেখল ডেভিডকে।

 ‘আমি চাই তুমি এই পোশাক পরে কাল বিকালে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিতে আসবে। প্লিজ। অবশেষে বলে উঠল ডেবরা।

 ‘কেন?’

‘কেননা কয়েকটা ডাইনী ঘুরে বেড়ায় লটারম্যান বিল্ডিংয়ে। তাদের কেউ কেউ আমার ছাত্রী, কেউ কেউ সহকর্মী। আমি চাই ওরা তোমাকে ভালোভাবে দেখুক আর তাদের ছোট্ট হৃদয়টা খেয়ে ফেলুক।

হেসে ফেলল ডেভিড। তো আমাকে নিয়ে কোন লজ্জা নেই তোমার?

মরগ্যান, একজনের পক্ষে তুমি একটু বেশিই সুন্দর। তোমার উচিৎ ছিল যমজ নিয়ে জন্ম নেয়া।

একসাথে আজই তাদের শেষ দিন। তাই ডেবরার কথামতো ইউনিফর্ম পরে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে তাকে নিতে এলো ডেভিড। আর অবাক হয়ে দেখল যে কেমন করে এই পোশাক রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী সকলের মনোযোগ কেড়ে নিলমেয়েরা তার দিকে তাকিয়ে হাসল, বৃদ্ধরা বলে উঠল শালোম, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে থাকা প্রহরীও হাসি মুখে হাত নেড়ে কৌতুক বলল ডেভিডকে।

তাদের সবার কাছে ডেভিড হলো রক্ষাকারী দেবদূত।

তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে তাকে কিস করল ডেবরা। এরপর হাঁটতে লাগল পাশে পাশে গর্বের সাথে আর অধিকার বলে জড়িয়ে রাখল ডেভিডের কনুই। গোলাকার কাঁচের বেলজিয়াম বিল্ডিংয়ে তাড়াতাড়ি ডিনার করতে নিয়ে গেল ডেভিডকে।

খেতে খেতে একটা মাত্র সাধারণ প্রশ্নে ডেভিড জেনে গেল নিজের খ্যাতি বজায় রাখার জন্য কোন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে ডেবরা।

 ‘আমি সম্ভবত প্রথম কয়েক সপ্তাহ বেস থেকে বের হতে পারব না। কিন্তু মালিক স্ট্রিটে লিখবো তোমাকে।

‘না। তাড়াতাড়ি বলে উঠল ডেবরা। আমি ওখানে থাকবে না। বিশাল বিছানাটাতে তুমি ছাড়া বেশি একাকী লাগবে।’

তাহলে কোথায়? তোমার বাবা-মায়ের কাছে?

‘এটা হবে আরো খারাপ। যতবার তুমি শহরে আসবে আমাকে বাসা ছাড়তে হবে! না, তারা ভাবছে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে হোস্টেলে আছি। আমি তাদের জানিয়েছি যে আমি ডিপার্টমেন্টের কাছাকাছি থাকতে চাই’

‘এখানে তোমার একটা রুম আছে? ডেবরার দিকে তাকিয়ে রইল ডেভিড।

 ‘অবশ্যই ডেভিড। আমাকে একটু আলাদা হতে হবে। আমি আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা চাকুরিদাতাকে তো বলতে পারি না যে আমাকে মেজর ডেভিড মরগ্যানের ঠিকানায় চিঠি লেখো। হতে পারে এটা বিংশ শতাব্দী আর আধুনিক ইস্রায়েল, কিন্তু তারপরেও এখনো আমি একজন ইহুদি, মমতা আর তার ঐতিহ্যে মোড়ানো।’

প্রথম বারের মতো ডেভিড আনন্দিত হয়ে উঠল যে তার কাছে এসেছে ডেবরা। ডেবরার তুলনায় সে নিজে ব্যাপারটাকে বেশ হালকা ভাবে নিয়েছিল।

আমি তোমাকে মিস করব।’ জানিয়ে দিল ডেভিড।

আর আমি তোমাকে’, উত্তর দিল ডেবরা।

‘চলো বাসায় যাই।

‘হ্যাঁ, একমত হলো ডেবরা। ছুরি কাঁটাচামচ রেখে দিল একপাশে। আমি যেকোন সময় খেতে পারব।’

যাইহোক বেলজিয়াম হাউজ থেকে বের হবার সাথে সাথে চিৎকার করে উঠল ডেবরা- ‘ধুত্তোরি, আমাকে এই বইগুলো আজকেই ফেরৎ দিতে হবে। আমরা লাইব্রেরি হয়ে যাই? আমি দুঃখিত ডেভি। এক মিনিটের বেশি লাগবে না।’

 তো, তারা আবারো উঠে এলো প্রধান ছাদে। পার হয়ে গেল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন রেস্টুরেন্টের আলো। দু’জন একসাথে এগিয়ে চলল চৌকোনা লাইব্রেরি টাওয়ারের দিকে। দ্রুত নেমে আসা অন্ধকারের জন্য ইতিমধ্যে আলো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে লাইব্রেরির জানালাগুলোতে। লাইব্রেরির সিঁড়ি দিয়ে উঠে কাঁচের দরজার কাছে থেমে যেতে হলো তাদেরকে। একদল ছেলেমেয়ে বের হয়ে আসল ভেতর থেকে। একপাশে সরে তাদেরকে জায়গা দিল। ডেভিড ও ডেবরা।

 যে পথ দিয়ে তারা এসেছে সেদিকে তাকিয়েছিল দু’জনে। প্লাজা, ছাদ, লাল-কলির গাছগুলো দেখা যাচ্ছে রেস্টুরেন্টের দিকে।

হঠাৎ করে সন্ধ্যার অন্ধকার চিরে দিল প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণের সাদা আলো রেস্টুরেন্টের কাঁচের জানালা ভেঙ্গে কাঁচ উড়তে লাগল বৃষ্টির মতো। মনে হলো যেন পাথর চূড়ায় ঝড় শুরু হয়েছে। ফোয়ারার মতো চারপাশে ছুটছে ভয়ঙ্কর কাঁচের কণা। সেই মুহূর্তে জানালার নিচে দিয়ে চলা দুটা মেয়েকে ভয়ঙ্কর ভাবে আঘাত করল এই ফোয়ারা।

বিস্ফোরণের আলোর সাথে সাথে সারা ছাদ লণ্ডভন্ড হয়ে গেল। বিস্ফোরণের ধাক্কা লাল-কলির গাছে হয়ে ডেভিড আর ডেবরার দিকেও ধেয়ে এলো। লাইব্রেরি বারান্দার পিলারের সাথে ধাক্কা খেলো দু’জনে। বাতাসের ধাক্কায় মনে হলো কানের পর্দা ফেটে যাবে ফুসফুস থেকে সব বাতাস গেল বের হয়ে।

নিজের কাছে ডেবরাকে টেনে নিল ডেভিড। বিস্ফোরণের পরেও ধরে রাখল। চারপাশ হঠাৎ করে মনে হলো ঢেকে গেল নৈশব্দের অন্ধকারে। খানিকটা ধাতস্থ হয়েই তাকিয়ে দেখল যে রেস্টুরেন্টের ভাঙা জানালা দিয়ে বের হচ্ছে ফসফরাসের সাদা ধোয়ার মেঘ; গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে চললো ছাদের দিকে।

এরপরই বিভিন্ন শব্দ শুনতে পেল দু’জনে। কাঁচ ভাঙার মচমচ শব্দ, প্লাস্টার আর ফার্নিচার ভাঙার শব্দ। চিৎকার ভেসে এলো নারীকণ্ঠ থেকে আর এতেই ভঙ্গ হলো আতঙ্কের নীরবতা।

চারপাশ জুড়ে শোনা গেল চিৎকার আর দৌড়াদৌড়ির শব্দ। ডেভিড আর ডেবরার পাশ দিয়ে দৌড়ে যাবার সময় একটা ছাত্র হিস্টিরিয়ার মতো চেঁচাতে লাগল, ‘বোমা! ক্যাফেতে বোমা মেরেছে ওরা।

ভাঙা কাঁচের টুকরার বৃষ্টির কবলে পড়া একটা মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ছোটাছুটি শুরু করে দিল আর নাকি সুরে কান্নাও করছে। মনে হলো বোধবুদ্ধি সব হারিয়ে গেছে মেয়েটার। প্লাস্টারের ধুলাতে পুরো সাদা হয়ে যাওয়া মেয়েটার স্কার্ট বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে গাঢ় রঙের রক্ত।

ডেভিডের হাতের মাঝে কাঁপতে শুরু করল ডেবরা। শুয়োরের দল ফিসফিস করে উঠল সে। ওহ শুয়োরের দল খুনের নেশায় মেতেছে।’

ধোয়ার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো আরো মানব শরীর। বিস্ফোরণের জন্য শরীরের কাপড় ছিঁড়ে গেছে। ছেঁড়া কাপড় এমনভাবে ঝুলে আছে যে দেখতে হাস্যকর কাকতাড়ুয়ার মতো মনে হচ্ছে। ছাদে উঠে আস্তে করে বসে পড়ল। চোখের উপর থেকে সরিয়ে নিল চশমা। কাকতালীয়ভাবে চশমা ঠিকঠাক জায়গা মতো রয়ে গেছে এখনো। চেষ্টা করল শার্টের টুকরা দিয়ে কাঁচ দুটো পরিষ্কার করে নিতে। চিবুক থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত।

‘চলো।’ তাড়া দিল ডেভিড।

‘আমাদের সাহায্য করা দরকার। দুজনে মিলে একসাথে নামতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে।

ছাদের একটা অংশ প্রায় ধসে পড়েছে বিস্ফোরণে আটকে ফেলে ছারখার করে দিয়েছে তেইশ জন ছাত্র-ছাত্রীকে, যারা সান্ধ্য খাবার আর আড্ডার আশায় এসেছিল এখানে।

সবাই ছুটে গেল বড় নিচু হলটাতে। রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল মেঝে। তাদের কেউ হামাগুড়ি দিচ্ছে, কেউ কাঁদছে। ভাঙা প্লেট-বাটি, ছড়িয়ে থাকা খাবার, এলোমেলো ফার্নিচারের মাঝে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরছে কেউ কেউ। কেউ কেউ এমন বিকৃত হয়ে পড়ে আছে যেন মৃত্যুর নিষ্ঠুর কৌতুকে নিঃশব্দে হাসছে।

পরবর্তীতে সবাই জানতে পারে যে আল ফাতাহ’র দু’জন তরুণী নারী সদস্য ভুয়া কাগজপত্র নিয়ে ভর্তি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর প্রতিদিন একটু একটু করে বিস্ফোরক এনে জড়ো করেছে ক্যাম্পাসে। অবশেষে এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে সবটুকু বিস্ফোরক জড়ো করে। একটা টেবিলের নিচে পড়ে আছে। টাইমিং ডিভাইস বাধা স্যুটকেস আর সন্ত্রাসী দু’জন হেঁটে হাওয়া হয়ে গেছে। এক সপ্তাহ পরে দামাস্কাস টেলিভিশনে নিজেদের সফলতায় গর্ব করতেও দেখা গেল তাদেরকে।

কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে এই বিস্ফোরণের কারণ বা কোন ব্যাখা জানা নেই কারোরই। এতটাই অপ্রত্যাশিত আর এতটাই করুণ যে অবাক হয়ে গেল সকলে। দিশেহারা হয়েও যারা সুস্থ আছে স্থবিরতা কাটিয়ে উঠে চেষ্টা করল আহতদের সেবা করতে, মৃতদেহ সরিয়ে নিতে।

 লাল-কলির গাছের নিচের লনে সবাইকে শুইয়ে দেয়া হলো। তাড়াতাড়ি কাছের হোস্টেলের চাদর এনে ঢেকে দেয়া হলো সবাইকে। সবুজ ঘাসের উপর সাদা কাপড়ের লম্বা সারি এমন এক স্মৃতি হয়ে রইল ডেভিডের মাঝে যা মনে হয় না কখনো ভুলবে।

সাইরেন বাজিয়ে ছাদের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে এসে গেল অ্যাম্বুলেন্স। বিস্ফোরণস্থল কর্ডন করে দিল পুলিশ। ডেভিড আর ডেবরা আস্তে আস্তে হেঁটে এগিয়ে গেল পার্কিং লটে থাকা মার্সিডিজের দিকে। দু’জনেরই গায়ে মাখামাখি হয়ে আছে রক্ত আর ধুলা; বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে যন্ত্রণাকাতর শব্দ শুনে আর মৃত্যুদৃশ্য দেখে। চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে গেল মালিক স্ট্রিটে। গোসল করে ধুয়ে ফেলল ময়লা আর মৃত্যুর গন্ধ। রক্ত ধোয়ার জন্য ঠাণ্ডা পানিতে ডেভিডের ইউনিফর্ম ভিজিয়ে দিল ডেবরা। এরপর কফি বানিয়ে আনল। বিশাল বিছানায় পাশপাশি বসে কফি পান করল দুজনে।

 ‘ভালো আর শক্তিশালী ছিল এমন অনেক কিছু মারা গেছে এখানে, আজ রাতে।’ বলে উঠল ডেবরা।

 ‘মৃত্যু ততটা খারাপ নয়। এটি একটি প্রাকৃতিক ব্যাপার আর সবকিছুর যৌক্তিক উপসংহার। কিন্তু আমাকে ভাবাচ্ছে ভাঙাচোরা দেহ নিয়ে যারা বেঁচে গেল তারা। মৃত্যুর প্রতি তা ও শ্রদ্ধা হয় কিন্তু পঙ্গুত বড় কষ্ট।

 চোখে ভয় নিয়ে তাকাল ডেবরা, ‘এটা বেশ নিষ্ঠুর ডেভিড।

‘আফ্রিকাতে একই সাথে সুন্দর আর ভয়ঙ্কর একটা প্রাণী আছে নাম কৃষ্ণবর্ণ অ্যান্টিলোপ। দলবদ্ধ হয়ে প্রায় একশ একসাথে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু তাদের কেউ যদি আক্রান্ত হয় কোন শিকারির হাতে বা সিংহের হাতে, দলপ্রধান সে সদ্যসকে দল থেকে বের করে দেয়। আমার মনে আছে আমার বাবা আমাকে বলেছিল যে, যদি তুমি বিজয়ী হতে চাও তাহলে তোমার পরাজিত সঙ্গীদের এড়িয়ে যেতে হবে। কেননা হতাশা সংক্রামক।

‘ঈশ্বর, ডেভিড, এটা তো জীবনকে দেখার বেশ শক্ত একটা পথ।’

সম্ভবত’, একমত হলো ডেভিড। কিন্তু দেখো জীবন সত্যিই কষ্টের।’

প্রথমবারের মতো তাদের ভালোবাসায় যোগ হলো নিরাশা। কেননা বিচ্ছেদের ঘণ্টা বাজছে। সারা জীবন এটি তাড়িয়ে বেড়াবে তাদের।

সকালবেলা নিজের স্কোয়াড্রনে যোগ দিতে গেল ডেভিড। মালিক স্ট্রিটের ঘরে তালা লাগাল ডেবরা।

.

সতেরোদিন ধরে প্রতিদিন দু’বার ওড়াউড়ি করল ডেভিড। আবার কখনো তিনবার। সন্ধ্যাবেলা যদি রাতের জন্য কোন ফ্লাইং না থাকতো, তাহলে লেকচার শোনা আর ট্রেনিং ফিলস দেখতে হতো। আর এরপর তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুম।

কর্নেল লে, ডফিন, একদিন একসাথে প্লেন চালালো ডেভিডের সঙ্গে। দ্রুত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর শান্ত স্বভাবের মানুষটা ছোটখাটো। দ্রুত নিজের সিন্ধান্ত নিয়ে নিল কর্নেল।

প্রথম দিনের পরে জো আর ডেভিড একসাথে প্লেন চালালো। ডেভিড জোর লকার থেকে নিজের জিনিস আন্ডারগ্রাউন্ড কোয়ার্টারের স্ট্যান্ডবাই ক্রুদের লকারে নিয়ে গেল।

এই সতেরো দিনের শেষদিনগুলোতে লৌহকঠিন বন্ধুত্ব নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছে গেল। ডেভিডের উজ্জ্বলতা আর আঘাতের প্রচণ্ডতা দক্ষভাবে ভারসাম্য তৈরি করলো জো’র পাথরের মতো কঠিন নির্ভরতার সাথে।

ডেভিড সবসময় একটা স্টার হিসেবেই থাকে; অন্যদিকে জোর জন্মই হয়েছে সংগত প্রদানের জন্য। সোজা সাপ্টা মানুষ, যার উপর চোখ বন্ধ করে নির্ভর করা যায়। এমন একজন উইংম্যান যার নিজের কোন উচ্চাকাংখা নেই। যার প্রতিভা হলো আঘাত করার জন্য নাম্বার ওয়ানকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়া।

দ্রুত অলঙ্ঘনীয় একটা দল গড়ে তুলল দুজনে মিলে। এতটাই সুদক্ষ হলো যে বাতাসের মাঝে যোগাযোগের ক্ষেত্র প্রায় একস্ট্রা সেনসরী। যেন পাখির দুটি পালক বা মাছের আঁশ।

পেছনে জো বসে থাকা ডেভিডের জন্য মিলিয়ন ডলারস ইনস্যুরেন্সের মতো। ডেভিড জানে যতক্ষণ জো আছে ওর পেছনে কোন ভয় নেই। তাই সে মনোযোগ দেয় তার বিশেষ ক্ষমতাধর দৃষ্টিশক্তি আর তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতার উপর। ডেভিড একজন গান ফাইটার। আর এই সার্ভিসে গান ফাইটারদেরই জয় জয়কার।

আই.এ.এফ. সর্বপ্রথম এয়ার-টু এয়ার মিসাইলের খামতি নিয়ে আলোচনা। শুরু করে। আর তাই ফিরে যায় ক্লাসিক টাইপের আকাশযুদ্ধে। কখনো কখনো মিসাইল নির্বোধের মতো আচরণ করতে পারে। এমনও হতে পারে কম্পিউটার এক ধরনের প্যাটার্ন সেট করল আর বাস্তবে ঘটল উল্টো। এয়ার টু- এয়ার কমব্যাটে তিনশ মিসাইল নিক্ষেপ করা হলে মাত্র একটা হয়তো টার্গেটে লাগবে।

যাই হোক, যদি এমন হয় যে ঘড়ির ষষ্ঠ কাঁটার মতো অবস্থানে গান ফাইটার এগিয়ে আসছে তোমার দিকে, যার আঙুল জোড়া ৩৩-এমএম কামানের ট্রিগারের উপর, মাত্র এক মিনিটে যে কিনা বারো হাজার শেল ঢেলে দিতে পারবে তোমার উপর, তাহলে তোমার সুযোগ আরো হালকা হয়ে যাবে তিনশ থেকে একের তুলনায়।

এছাড়াও জোর আরো একটা বিশেষ গুণ আছে। মিরেজের সামনের দিকের স্ক্যানিং রাডার বেশ জটিল আর নাজুক ধাচের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস দিয়ে তৈরি। পুরো মেকানিজম চালাতে হয় বাম হাত দিয়ে। আর বাম হাতের আঙুলগুলো এত দ্রুত জায়গা বদল করে যেন পিয়ানো বাজাচ্ছে কোন পিয়ানিস্ট। কিন্তু এর চেয়েও জরুরি হচ্ছে এ যন্ত্রকে ‘অনুভব করা। এর কাছ থেকে সর্বোচ্চ কাজ আদায়ের জন্য ভালোবাসার স্পর্শ। এই অনুভব আছে। জোর কাছে। ডেভিডের নেই।

দিনে-রাতে ট্রেনিং ইন্টারস্পেশন চালানো শুরু করলো তারা। এতে থাকল অনেক উঁচু দিয়ে উড়ে যাবার পাশাপাশি নিচু লেভেলের টার্গেট প্র্যাকটিস করা। এ ছাড়াও নিচু লেভেলের ট্রেনিং স্ট্রাইকও চালালো তারা। অন্যান্য সময় ভূমধ্যসাগরের উপর একে অন্যকে এনগেজ করে প্লেন টু প্লেন ডগ ফাইটও প্র্যাকটিস হলো।

 এত সব কিছুর পরেও মরুর ফুল কৌশলে তাদেরকে সত্যিকার বা সম্ভাবনাময় যুদ্ধাবস্থা থেকে সরিয়ে রাখল। সবাই মিলে খেয়াল করছিল ডেভিডকে।

পিরিয়ডের শেষে মেজর জেনারেল মোরদেসাইয়ের ডেস্কে পাঠানো হলো ডেভিডের সার্ভিস রিপোর্ট। প্রতিজন অফিসার সম্পর্কে দেখভাল করা ব্রিগের বিশেষ দায়িত্ব। আর যেহেতু প্রতিটি অফিসারের রিপোর্ট নিয়মিত চেক করতে হয় ব্রিগকে। এবার বিশেষ ভাবে তাকে বলা হলো ডেভিডের রিপোর্ট চেক করে দেখতে।

রিপোর্টের স্বাস্থ্য এখনো বেশ পাতলা। দ্রুত প্রাথমিক ভাবে দেয়া সুপারিশ আর ডেভিডের বর্তমান কমিশনের ডকুমেন্ট দেখে নিল ব্রিগ। এরপর পড়ে ফেলল পরবর্তী রিপোর্ট আর রেজাল্ট। গানারি রিপোর্ট দেখে হেসে ফেলল। তৃপ্তি নিয়ে ভাবল যে তাদেরকে ভিড়ের মাঝে থেকে তুলে আনতে এখনো দক্ষ সে। অবশেষে পড়ল লে, ডফিনের ব্যক্তিগত প্রশংসাবাক্য: ‘পাইলট হিসেবে মরগ্যানের দক্ষতা অসাধারণ। সুপারিশ জানানো যাচ্ছে যে বর্তমান ব্যাঙ্কে বহাল থাকুক আর সামনে তাকে পুরোপুরি অপারেশন কাজে লাগানো হোক।

নিজের বিশেষ লাল কলম তুলে নিল ব্রিগ। রিপোর্টের নিচে লিখে ফেলল। আমিও এতে একমত আছি।’

এভাবেই শুরু পাইলট মরগ্যানের যাত্রা। এখন তাকে পুরুষ, মরগ্যান হিসেবেও বিবেচনা করা হবে। নিজের অভিব্যক্তি অনাবৃত হয়ে গেল ওর কাছে। আর তাই কাকতালীয়ভাবে হঠাৎ করে ডেবরার ঘর ছাড়ার ইচ্ছে আর ডেভিডের জেরুজালেমে পৌঁছানো, সব ঘটে গেল এক সঙ্গে।

পুরো দুই দিন আর কয়েকটা ফোন কলের পরে ডেভিড জানতে পারল যে ডেবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলকে কেবলমাত্র ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করতো। বাস্তবে তার সত্যিকারের বাসায় সবকিছু ছিল দুর্দান্ত।

প্রথম দিকটায় অনুমতি দেয়নি ব্রিগ। তারপরেও সে জানে যে এক্ষেত্রে বলার কিছু নেই তার। ব্রিগ ভালো করেই জানে যে তার মেয়ের ইচ্ছাশক্তি আর পছন্দ অপছন্দ কতটা কঠিন। তাদের মাঝে মতবিরোধ প্রায় বৈপ্লবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝে মাঝে এমনকি পরিবারের ভিত নাড়িয়ে দেয়া এসব বাদানুবাদ অবশ্য সন্তুষ্টিজনক ফলাফলই বয়ে এনেছে।

 যদিও নিজের বেশির ভাগ সময় তরুণদের সাথেই ব্যয় করে, তারপরেও নতুন মূল্যবোধগুলো মাঝে মঝে মেনে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। স্বীকার করে নিতে তো আরো কষ্ট হয়।

‘ওয়েল, মেয়েটার অন্তত এতটুকু জ্ঞান আছে যেন কোন বিদ্রূপ বা হাসাহাসি না হয়। তাদেরকে যেন লজ্জায় না পড়তে হয়। এতটুকু সন্তুষ্টি দিয়েছে মাকে। রিপোর্ট বন্ধ করে দিল ব্রিগ।

.

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *