৬. যমুনা পুলিনে শুটিং আরম্ভ

যমুনা পুলিনে শুটিং আরম্ভ হয়ে গেছে। সেদিন সকাল থেকে গাছপালায় ঘেরা আয়ান ঘোষের বাড়ির পাশের রাস্তায় আমার গান টেক হচ্ছিল। বর্তমানে প্লেব্যাকের দৌলতে গান টেক করা জলের মতো সোজা। অপরের গাওয়া গান অ্যামপ্লিফায়ারে বাজিয়ে তার সঙ্গে বারকতক রিহার্সাল দিয়ে সুর-তাল-লয়ে ঠোঁট নেড়ে যাও-ব্যস, তুমি গাইয়ে হয়ে গেলে। কিন্তু তখন সবে টকির শুরু, প্লে-ব্যাকের নাম শোনা দুরে থাক, কল্পনাও কেউ করতে পারত না। কাজেই সে এক দক্ষযজ্ঞের ব্যাপার। গানটাকে চার ভাগে ভাগ করে নিয়ে, গাইতে শুরু করেসমের মুখে ছেড়ে দিলাম। বাজতে লাগল শুধু নেপথ্য সংগীত। ক্যামেরা বন্ধ করে দেওয়া হল। ছোট ট্রাকের ওপর ক্যামেরা, গাইতে গাইতে আমি এগিয়ে চলিক্যামেরা চলে পিছিয়ে-মুখের সামনে মাইক্রোফোন, স্ট্যান্ডে ঝোলানো–সেটাও প্যান করে চলে সঙ্গে-সঙ্গে। আমার চলার সঙ্গে ক্যামেরা ও মাইক সমতা ও দুরত্ব ঠিক রেখে চলবে। এর একটু ব্যতিক্রম হলেই কাট, মানে। আবার গোড়া থেকে শুরু। গানের সঙ্গে যেসব যন্ত্রপাতি বাজবে তারা আর একটি মাইক্রোফোনের সামনে ক্যামেরার চোখের আড়ালে বসে আছে। চার-পাঁচটা শটে এইভাবে গান শেষ করতে সারা দিনটাই কেটে গেল, বেলা চারটের পর রোদের জোর কমে আসে–শুটিং বাধ্য হয়েই বন্ধ করতে হয়। বলতে ভুলে গেছি, বাংলা যমুনা পুলিনের একটা শট নেবার পরই ঠিক ঐ একই পদ্ধতিতে হিন্দী রাধাকৃষ্ণ নেওয়া হতে লাগল। ফলে বাংলা-হিন্দী দুটো গানই নেওয়া হয়ে গেল।

দু সপ্তাহ কেটে গেল, মায়ের জ্বর ছাড়ল না। বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। ডাক্তার সেন দু-এক দিন অন্তরই এসে দেখে যান। শুধু বলেন, শুশ্রূষা ও পথ্যের দিকে ভাল করে নজর রাখুন। হার্ট খুব দুর্বল–কোনও কারণে ওঁকে উত্তেজিত হতে দেবেন না।

তাই হল। সারাদিন ছোটবোনটা মাকে আগলে বসে থাকে।সন্ধ্যের পর শুটিং থেকে এসে ওকে খানিকটা বিশ্রাম দিই। এইভাবে আরও কয়েকদিন কাটল। রোগে ভুগে ভুগে মায়ের মেজাজ হয়ে উঠল রুক্ষ, খিটখিটে। পান থেকে চুন খসলেই চেঁচিয়ে অনর্থ বাধিয়ে দেন। অনেক করে বুঝিয়ে মিষ্টি কথায় শান্ত করি।

সেদিন নিয়মিত শুটিং-এ গিয়ে শুনি, সাউন্ড মেশিনের কী একটা কল বিগড়ে গেছে। আজ শুটিং বন্ধ। সকাল সকাল বাড়ি চলে এলাম। অনেকদিন সিনেমা দেখিনি, ভাবলাম আজ ম্যাটিনি শোতে যা হোক একটা ছবি দেখে আসব। ফরসা কাপড় পরে বেরুতে যাচ্ছি, মায়ের ঘর থেকে চিৎকার শোনা গেল, ওকে আজ বেরুতে মানা করে দে খুকি (আমার ছোটবোনকে মা খুকি বলেই ডাকতেন)। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। একটু পরেই ঘর থেকে বোনটা বেরিয়ে এসে অপেক্ষাকৃত একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বলল, আজ তুমি বেরিও না ছোড়দা!

অবাক হয়ে বললাম, কেন রে?

একটু ইতস্তত করে বোন বলল, গোপালপুর থেকে আজ তোমায় পাকা-দেখা দেখতে আসবে। মেঘশূন্য আকাশ থেকে হঠাৎ বাজ পড়ে। ধারে-কাছে যারা থাকে আঁতকে কেঁপে ওঠে, কারও-কারও কানে তালা লেগে যায়। কিন্তু যে হতভাগ্যের মাথায় পড়ে তার অবস্থা কী হয় সম্যক জানা না থাকলেও, আজ ছোটবোনের ছোট্ট একটা কথায় খানিকটা উপলব্ধি করলাম। বাকশক্তিহীন হয়ে দরজার কপাট ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। বোনটা গড়গড় করে একগাদা কথা বলে যেতে লাগল। কতক শুনলাম না, শুধু মোটামুটি বুঝলাম–আমি শুটিং-এ বেরিয়ে গেলে মায়ের বন্ধু, পাড়ার কয়েকটি বিধবা পরোপকারী মহিলা এসে অনতিবিলম্বে আমার বিবাহ দেওয়ার জন্য মাকে ক্রমাগত তাগিদ দিতে থাকেন। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবার দুর্নীতি ও ম্লেচ্ছাচারের আবর্তে তলিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এটাও অকাট্য যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিতে কসুর করতেন না। ফলে মা দিশেহারা হয়ে আমার এক দূরসম্পর্কের কাকাকে ডেকে আনিয়ে তাঁরই সাহায্যে বিয়ের সব ঠিকঠাক করে ফেলেছেন। আজ গোপালপুর থেকে চিঠি এসেছে, বিকেল চারটের সময় পাকা দেখতে আসবে।

বিয়ে! বিয়ে জিনিসটাকে কোনদিনই সাধারণ ডাল-ভাতের মতো সহজ ভাবতে পারিনি। ছেলেবেলা থেকেই বিয়ে জিনিসটাকে ভাবতাম কল্পনার সুখস্বপ্ন, বিলাস। দামী সিল্কের সুট পরে একবার মেক-আপ রুম, একবার সেট, একবার সাউন্ড ট্র্যাক–নিশ্বাস ফেলবার সময় নেই, আজ যেন ওরই রাজ্যাভিষেক।

কৌতূহলী দর্শকের ভূমিকা নিয়ে একপাশে দাঁড়ালাম। শুটিং আরম্ভ হল বেলা তিনটেয়। বিচারের দৃশ্য নেওয়া হল। আবু হোসেন বাদশার অদ্ভুত বিচার। খুনে আসামীকে দিচ্ছে বেকসুর খালাস, আবার সামান্য চুরির অপরাধে দিচ্ছে প্রাণদণ্ড। দু তিনটে শট নিতে-নিতেই রোদের আলো ফুরিয়ে গেল। বন্ধ-ঘরের দরজা খুলে আনা হল অসংখ্য ইলেকট্রিক আলো। শুনলাম, ঐ আলো ফিট করে শুটিং শুরু হতে রাত আটটা বাজবে। অতক্ষণ অপেক্ষা করে শুটিং দেখার ধৈর্য বা কৌতূহল ছিল না। আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে রওনা হলাম। প্রায় পোয়াটাক পথ চলে এসেছি, হঠাৎ মোটরের দুটো পাওয়ারফুল হেডলাইট মুখে পড়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিল। সভয়ে সরে গিয়ে একটা গাছের ঝোঁপের ভিতর দাঁড়ালাম। সামনে এসে গাড়ি থেমে গেল। ভিতর থেকে মুখ বাড়ালেন মালিক মতিলাল চামরিয়া। নমস্কার করতেই প্রশ্ন, কাহা যাতা হ্যায় ধীরাজ?

বললাম, বাড়ি।

–কেঁও, শুটিং হুয়া নেহি?

-না, রাজহন্সের কিং ফর এ ডের শুটিং হচ্ছে। তাছাড়া সেট তৈরি হয়নি বলে যমুনা পুলিনে শুটিং বন্ধ।

-উঠো গাড়িমে।

বেশ একটু অবাক হয়ে দরজা খুলে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি থামল এসে দরবার সিনের কাছে। একখানা চেয়ারে অবসন্নভাবে বসে যতীন টোস্ট আর ডিম-সিদ্ধ খাচ্ছিল। গাড়ি থেকে নেমেই মতিলালবাবু যতীনকে জিজ্ঞাসা করলেন, আজ ধীরাজ কা কুছ কাম হুয়া যতীন?

জবাব না দিয়ে খেতে লাগল যতীন। সুর একটু নরম করে মতিবাবু বললেন, আরে, একঠো ক্লোজ-আপ তো লে লেও।

খিঁচিয়ে উঠল যতীন, দেখুন, যা বোঝেন না, সে সম্বন্ধে কথা কইতে আসবেন না। ধীরাজের ক্লোজ-আপ নিতে গেলে রাজহন্সের এইসব পাগলামি বন্ধ করে দিতে হয়। কোনটা করব বলুন?

জুয়োখেলায় সর্বস্ব হেরে গেলে মানুষের মুখচোখের অবস্থা যা হয়, ঠিক সেই রকম চোখে প্রায় মিনিটখানেক আমার দিকে চেয়ে থেকে মতিবাবু বললেন, তব তুম ঘর চলা যাও ধীরাজ।

বাড়ি এসে শুনলাম, মায়ের জ্বর ছেড়ে গেছে, যাকে রেমিশন বলা হয় তাই। ডাক্তারবাবু বলেছেন, দুএকদিন বাদেই অ-পথ্য দেবেন। বুকের ওপর থেকে একটা গুরুভার নেমে গেল।

পরদিন স্টুডিও গিয়ে শুনলাম, আগের দিন রাত বারোটা পর্যন্ত শুটিং করেও সব সিন শেষ করতে পারা যায়নি। আজও যমুনা পুলিনে বন্ধ, হবে রাজহন্সের এক দিনকা বাদশা। মেক-আপ রুমে ঢুকে হেড মেক-আপ ম্যান হরিবাবুর সঙ্গে আড্ডা জমিয়ে বসলাম। হরি বলল, কাল সকাল-সকাল না পালিয়ে একটু থেকে গেলে অনেক হাসির খোরাক পেতে ভটচায়।

বললাম, কী রকম?

হরি, রাজহন্স বলে একভাবে শট নিতে, যতীন বলে অন্য রকম, শেষপর্যন্ত একটা আপস রফা করে শুটিং আরম্ভ হল। প্রায় দুশো মবসামনে দরবারে বসে আছেন পাত্র-মিত্র-সভাসদ নিয়ে বাদশা। বাদশার অদ্ভুত বিচারে বিদ্রোহী হয়ে গোলমাল করতে করতে এগিয়ে যাবে ঐ দুশো এক্সট্রা। বড় একটা উঁচু জায়গার ওপর ক্যামেরা ফিট করে যতীন ছবি তুলতে শুরু করল। বাদশার বিচার শেষ হয়ে গেল, জনতা কিন্তু এগোলোনা। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। সামনে থেকে হাত-মুখ নেড়ে অনেক রকমে ওদের এগিয়ে যেতে বললে রাজহন্স–কিন্তু সব বৃথা। শেষকালে অধৈর্য হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজহল ঐ জনতার মাঝে। তারপর কিল-চড়-ঘুষি মেরে ঠেলে দিতে লাগল দরবারের দিকে, অনেক কষ্টে শটটা শেষ হল। ঘর্মাক্ত কলেবরে রাজহন্স এসে জিজ্ঞাসা করল, শটটা কেমন হল যতীন? একমুখ বিরক্তি নিয়ে ক্যামেরার পাশে একটা ছোট্ট টুলে বসেছিল যতীন, বলল, শটে যা যা করবে, আগে থেকে আমায় একটু বলে রেখ রাজহন্স, নইলে ভারি অসুবিধায় পড়তে হয়।

বিস্মিত হয়ে রাজহন্স বলল, কেন, মনিটারে যা হয়েছে তাইতো টেক করলাম।

যতীন বলল, মোটেই না, তুমি যে জনতার মাঝখানে লাফিয়ে পড়ে কিল ঘুষি মারতে-মারতে ওদের সামনে ঠেলে দেবে, এটা মনিটারে করোনি।

বোয়াল মাছের মতো হাঁ করে বলল রাজহল, ওটাও ক্যামেরায় উঠেছে নাকি?

যতীন বললে, নিশ্চয়! উঁচু তড়পার ওপর মুখ নিচু করে আছে ক্যামেরা, যা কিছু হবে সবই উঠবে।

হতাশভাবে রাজহন্স বলল, তখনই সিনটা কাট করে দিলে না কেন?

যতীন, মাইরি আর কী। তুমি পরিচালক–তুমি কাট না বললে আমি ক্যামেরা থামাই কী করে? শেষে তুমি এসে বলবে–ওটা আমার একটা নতুন স্টান্ট। এমনিতেই তো দেখছি মিনিটে মিনিটে তোমার মাথায় নতুন পাঁচগজিয়ে উঠছে। আর তাছাড়া ক্যামেরা সম্বন্ধে এটুকু জ্ঞান তোমার নেই, অথচএত বড় একটা ছবি পরিচালনা করছ এটা আমি ভাবি কী করে?

রাজহন্সের বিয়োগান্ত কাহিনী শেষ করে খানিক হেসে নিয়ে হরি বলল, সকাল থেকে দাড়ি গোঁফ আর নুর তৈরী করেইর আর আমার হাত ব্যথা হয়ে গেছে। আজ যদি জনতার দিন শেষ না হয়, তাহলে চুলের অভাবে শুটিং বন্ধ হবে। আব্দুল বারির দোকানে দেশি-বিলাতী ক্রেপ সব সাবাড়।

কাজ বেশি ছিল না, সন্ধ্যে ছটার মধ্যেই প্যাক-আপ হয়ে গেল। মেক-আপ ড্রেসিং রুমে তিলধারণের স্থান নেই। গিসগিস করছে এক্সট্রার দল। কেউ পোশাক ছাড়ছে, কেউ মেক-আপ তুলছে। হঠাৎ হরির চিৎকার শুনলাম, মোন্না, যাকে পাকা দাড়ি গোঁফ দিয়ে মোল্লা সাজিয়েছি সে কোথায়?

কে একজন বলল, পোশাক ছেড়ে সে তো অনেকক্ষণ বাড়ি চলে গেছে।

হরি, দাড়ি? দাড়ি কোথায় রেখে গেছে? খেমকাবাবুর হুকুম দাড়ি-গোঁফ খুলে রেখে যেতে। বিলাতি ক্রেপের দাম অনেক, ঐ দাড়ি গোঁফ দিয়ে অন্য মেক-আপ হবে।

বললাম, হঠাৎ এ রকম হুকুমের মানে?

হরি, কাল রাতে অর্ধেকের বেশি লোক দাড়ি নিয়েই বাড়ি চলে গেছে।

এক একজন এক্সট্রা ঘরে ঢোকে, হরি আর তার দুজন অ্যাসিস্ট্যান্ট বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে মুখ থেকে দাড়ি-গোঁফ ছিঁড়ে নিয়ে পাশের টেবিলে স্তূপাকার করে রাখে। হাসব না কাদব বুঝতে না পেরে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

সাউন্ড ফ্লোরের সামনে চওড়া লাল সুরকির পথ, দুপাশে ফুলের বাগান। কিছুটা এগিয়ে দেখি মেক-আপ ম্যান সেখ ইদু ম্লানমুখে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে।

জিজ্ঞাসা করলুম, কী ইদু, দাঁড়িয়ে যে?

ইদু বলল, রোজার মাস এটা, সারাদিন উপোস, আজ সকাল-সকাল শুটিং শেষ হয়ে গেছে যখন, বাবুকে বলে বাড়ি যাব।

বললাম, খোকাবাবু এদিকে আসছেন নাকি?

হাত দিয়ে গাড়িবারান্দার নিচেটা দেখিয়ে ইদু বলল, ঐ যে, ওখানে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে কথা কইছেন।

বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম। ইচ্ছেটা, খেমকাবাবুকে বলে আমিও বাড়ি চলে যাব। নইলে হয়তো আবার কালকের ব্যাপারটার পুনরাবৃত্তি হবে–মতিবাবুর সঙ্গে দেখা হলে। একটু পরেই জোরে পা চালিয়ে খেমকাবাবু দেখি মেক-আপ রুমের দিকে চলেছেন। কাছে আসতেই নমস্কার করে বললাম, বাড়ি যাচ্ছি। কোনও জবাব না দিয়ে চলে গেলেন খেমকাবাবু।ইঁদুর কাছে যেতেই দেখলাম, ইদু নমস্কার করে কী বলতেই বেশ একটু রেগেই কী একটা বলে এগিয়ে চললেন খেমকাবাবু। পরক্ষণেই দেখি লুঙ্গি পরে একরকম ছুটতে ছুটতেই চলেছে ইদু খেমকাবাবুর পিছনে পিছনে। কেমন কৌতূহল হল, এগিয়ে গেলাম। একটু দুরে থেকে শুনলাম খেমকাবাবু শুধু বলে চলেছেন, কোনও কথা শুনতে চাইনে–ওগুলো খুলে রেখে যেও। আর বেচারী ইদু দুহাতে দাড়ি ধরে কাঁদকদ স্বরে বলতে বলতে ছুটেছে, এটা আমার নিজের স্যার। এতক্ষণে ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম। আর এগোতে পারলাম না, হাসতে হাসতে পথের উপর বসে পড়লাম।

যমুনা পুলিনে রিলিজ ডেট আর আমার বিয়ের তারিখ, সমান তালে পা ফেলে এগিয়ে আসতে লাগল। দুটোর জন্যেই বেশ নারভাস হয়ে পড়লাম। এই সময় ভারতলক্ষ্মী পিজ্জার্স থেকে বাবুলাল চৌখানি ডেকে পাঠালেন ওঁদের প্রথম সবাক ছবি চাঁদ-সদাগরে লখিন্দরের ভূমিকা করবার জন্য। পরিচালনা করবেন নির্বাক যুগের জাঁদরেল পরিচালক প্রফুল্ল রায়। লোভও হচ্ছিল, অথচ ইস্ট ইন্ডিয়ার কনট্রাক্ট তখনও শেষ হয়নি। কী করি, মহা সমস্যায় পড়ে গেলাম। অনেক ভেবে একদিন খোকাবাবুর সঙ্গে দেখা করলাম। সব শুনে খেমকাবাবু বললেন, যমুনা পুলিনে শেষ হয়ে গেছে হিন্দী রাধাকৃষ্ণ আরম্ভ হতে দেরি আছে, এ অবস্থায় চুপচাপ বসে থেকে তুমি যদি ওঁদের ছবিতে কাজ কর, আমার আপত্তি নেই। আমার রাধাকৃষ্ণ ছবি আরম্ভ হলে তুমি এসে কাজ করবে, ওটা ওদের জানিয়ে তবে কনট্রাক্ট সই করবে।

পরদিন ভারতলক্ষ্মী স্টুডিওতে গিয়ে বাবুলাল চৌখানির সঙ্গে দেখা করলাম, প্রফুল্ল রায় পাশেই চেয়ারে বসেছিলেন। বিরাট লম্বা-চওড়া চেহারা, কথা কইতে ভয় হয়। নির্বাক যুগের হিমাংশু রায়ের ইউনিটে বিলেত-জার্মানি নানা দেশ ঘুরে ইন্টারন্যাশনাল খ্যাতি অর্জন করেছেন। ওঁর ছবিতে কাজ করব–কী ভাগ্য আমার। আলাপ হতেই নমস্কার করলাম। আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বাবুলালজীকে বললেন, একে ডেকেছেন কেন? কী পার্ট করবে আমার ছবিতে?

একগাল হেসে বাবুলাল বললেন, কেনো–আমার নায়ক লখিন্দর? ইস্ট ইন্ডিয়ার যমুনা পুলিনেতে কেষ্ট করেছে ধীরাজ!

তাচ্ছিল্যভরে হোহোহা করে হেসে উঠলেন প্রফুন্নবাবু; তারপর বললেন, তা লখিন্দর চলবে, ওটাও তো একরকম কেষ্টামার্কা পার্ট। আজকাল কী হয়েছে জানেন বাবুলালজী, রাঙা মূলোর মতো মেয়েলি চেহারা নিয়ে এই সব ছেলেগুলো সিনেমায় নায়ক হবার স্বপ্ন দেখে। ওরে বাপু, হিরো হওয়া অত সহজ নয়। পুরো ছফুট সাড়ে ছফুট লম্বা হওয়া চাই, ইয়া জোয়ানের মতো বুকের ছাতি।

বলতে বলতে বিশাল বুকখানা ফুলিয়ে প্রায় ডবল করে উঠে দাঁড়ালেন প্রফুল্লবাবু। সভয়ে এক পা পিছিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। প্রফুল্পবাবু বললেন, এদেশে সেরকম চেহারা নজরেই পড়ে না। দুএকটা যা আছে, তা দিয়ে কোনো রকমে কাজ চালিয়ে নিতে হয়। এ রকম করে কি ছবি হয়?

মনে মনে ভাবলাম, প্রফুলবাবুকে ভগবান জার্মানি অথবা রাশিয়ার জন্যে তৈরি করে অন্যমনস্ক হয়ে ভারতে পাঠিয়েছেন। কন্ট্রাক্ট সই করে এলাম, কিন্তু যতখানি উৎসাহ নিয়ে গিয়েছিলাম, ঠিক ততখানি নিরুৎসাহ হয়ে ফিরে এলাম।

কয়েকদিন বাদেই বিয়ের দিন। স্টুডিও থেকে ছুটি নিয়ে বন্ধুবান্ধব নিয়ে রওনা হলাম। দিনক্ষণ কিছু মনে নেই, শুধু মনে আছে সেই দিনই যমুনা পুলিনে রূপবাণীতে রিলিজ। সামনে দিয়েই যাবার রাস্তা। ভীষণ ভিড়-গাড়ি থামাতে হল। আমায় চিনতে পেরে গাড়ির চারপাশে ছেলের দল ভিড় জমিয়ে বলতে শুরু করল, হকি, হামার কুনো দুঃখ নাই।

হেসে মনে মনে ভাবলাম, এতদিনে মুখুজ্যের কপালের ঘাম বুকে ফেলা সার্থক।

ছমাস পরের কথা। চাঁদ সদাগর ও হিন্দী রাধাকৃষ্ণ ইতিমধ্যে শেষ করে দিয়েছি। উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। জ্যোতিষবাবু ইন্দ্রপুরী ছেড়ে রাধা ফিল্ম-এ যোগদান করেছেন। একদিন দেখা হতেই বললেন, কাল একবার স্টুডিওতে দেখা কোরো, কথা আছে। করলাম। জ্যোতিষবাবু বললেন, বিরাট ছবি ধরেছি ধীরাজ, দক্ষযজ্ঞ। এতে নায়ক শিবের ভূমিকা তোমায় দেব ভাবছি। বললাম, কেষ্টবিষ্ট তো আমার একচেটে। ভোলানাথকেই বা ভুলে থাকব কেন?

রাধাকিষণ ও মতিলাল চামারিয়ার মাস্টারমশাই হরিপদ ব্যানার্জী স্টুডিওর সর্বময় কর্তা। তার সঙ্গে কথাবার্তা ও টার্মস ঠিক হয়ে গেল। দক্ষযজ্ঞ ছবিতে চারশো টাকার বিনিময়ে হিমালয়ের গুহা ছেড়ে আমি মর্ত্যে অগণিত নরনারীকে দর্শন দিয়ে তাদের মুক্তির পথ প্রশস্ত করে দেব এই মর্মে চুক্তিপত্রে সই করে এলাম। বাড়ি এসে কনট্র্যাক্টের কপিটা ভাল করে পড়ে দেখি দক্ষযজ্ঞ ছবির নিচে খুব ছোট্ট হরফে লেখা আর একটা ছবির নাম রাজনটী বসন্তসেনা, পরিচালনা করবেন চারু রায়। ছুটে গেলাম স্টুডিওয়। হরিপদবাবু কদাচিৎ হাসেন, আমার কথা শুনে একগাল হেসে বললেন, তোমার ভালর জন্যই করেছি ধীরাজ। এখন যত বেশি ছবিতে কাজ করতে পারবে, ততই তোমার পক্ষে ভাল। দুখানা ছবিই প্রায় একসঙ্গে তোলা হবে, কাজেই সেদিক দিয়েও তোমার লাভ।

লাভবান হয়ে চুপচাপ বাড়ি ফিরে এলাম। দক্ষযজ্ঞের ভূমিকালিপিও বেশ লোভনীয়। দক্ষ অহীন্দ্র চৌধুরী; শিব–আমি; নারদ-মৃণাল ঘোষ এবং সতীর ভূমিকায় নামবেন শ্রীমতী চন্দ্রাবতী। এখানে উল্লেখযোগ্য, দক্ষযজ্ঞই চন্দ্রাবতীর প্রথম সবাক ছবি। এর আগে দু-একখানা নির্বাক ছবিতে চিত্রাবতরণ করেন, সেগুলো উল্লেখযোগ্য নয়। চন্দ্রাবতীর রিহার্সাল দরকার, রোজ দুপুরে রাধা ফিল্ম-এ রিহার্সাল দিয়ে যাই। একদিন জ্যোতিষবাবু বললেন, ধীরাজ, নাচতে জান?

অবাক হয়ে বললাম, না, নাচিনি কখনও। কেন বলুন তো?

চিন্তিতভাবে জ্যোতিষবাবু বললেন, পতিনিন্দা শুনে দক্ষের যজ্ঞসভায় সতীর দেহত্যাগের পর সবাই বলছেন তোমার একখানা তাওব নাচ দিতে। যেখানে ভূত প্রেত নিয়ে যজ্ঞসভা লণ্ডভণ্ড করছ তুমি।

মহা ভাবনায় পড়ে গেলাম। নাচের মাস্টার তারক বাগচী জ্যোতিষবাবুর টেবিল চাপড়ে বলে উঠলেন, কোনও ভাবনা নেই বাঁড়ুজ্যেমশাই, নাচ আমি শিখিয়ে দেব। তবে আমাকে মাস-দুই রিহার্সাল দেবার সময় দিতে হবে।

তাই হল। রোজ গিয়ে ডায়লগের রিহার্সাল দিয়ে মিউজিক রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে তাণ্ডব নাচ শিখতে শুরু করি। দুদিন নেচেই সর্বাঙ্গ ব্যথা হয়ে গেল। আর একটা বিপদ হল এই যে, নাচের পর প্রচণ্ড খিদে পায়। ভয়ে-ভয়ে জ্যোতিষবাবুকে বললাম, দেখুন কিছু খাবারের ব্যবস্থা না করলে আর দুচারদিন বাদে আমি নেচেই মারা যাব। ফল, সন্দেশ, দই-এর ব্যবস্থা হল।

মহা-আড়ম্বরে শুটিং শুরু হয়ে গেল। অনেকরকম ক্যামেরার কসরত আছে বলে পুণার বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান জি. টি গুণেকেনিয়ে আসা হয়েছে দক্ষযজ্ঞ ছবির জন্যে। সেট-সেটিং সাজপোশাক কোনও দিক দিয়েই খামতি নেই। খানিকটা সান্ত্বনা পেলাম।

দক্ষের অন্তঃপুরের সেট শেষ হবার পরই হিমালয়ের গুহার সেট পড়ল। সকাল থেকে সর্বাঙ্গে চুনকাম করার মতো মেক-আপ করে দুটো বড় বড় ড্যাবডেবে চোখের ওপর কপালে আর একটা চোখ এঁকে, এক টুকরো বাঘছালে সিকি অঙ্গ কোনও মতে আচ্ছাদন করে সেটে এলাম। চন্দ্রাবতীর মেক-আপ তখনও শেষ হয়নি। অসংখ্য লোক সেটে। শুটিং দেখতে এসেছে। সেটের এক পাশে দেখি সাপখেলার ঝাপি নিয়ে এক সাপুড়ে বসে আছে। ব্যাপার কী? একে-ওকে জিজ্ঞাসা করে জবাব পাই না। জ্যোতিষবাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম। সেটের মধ্যে নিরিবিলি একটা জায়গায় আমায় নিয়ে গিয়ে বললেন, সবাই বলছে শিবের গলায় গোখরো সাপ ঝোলানো না থাকলে শিবই নয়, তাই—

বাধা দিয়ে বললাম, বলেন কী মশাই, জ্যান্ত গোখরো সাপ গলায় দিয়ে অভিনয় করতে হবে?

ভরসা দিয়ে জ্যোতিষবাবু বললেন, আহা তুমি ঘাবড়াচ্ছ কেন, সাপুড়ে সাপের বিষদাঁত ভেঙে দেবে।

কিছুমাত্র ভরসা না পেয়ে বললাম, ভেঙে দিলেও অনেক সময় খানিকটা বিষ থেকে যায়, যদি–

হরিপদবাবু এসে পড়লেন। বললেন, তুমি ঘাবড়াচ্ছ কেন বাপু, জ্যান্ত সাপ গলায় নিয়ে শিবের পার্ট করলে নামটা কী রকম হবে, সেটাও একবার ভেবে দ্যাখো।

জ্যোতিষবাবু সায় দিয়ে বললেন, তা ছাড়া তোমার যদি কিছু হয় ব্যাটা সাপুড়েকে আস্ত রাখব ভেবেছ?

দশচক্রে ভগবান ভূতের মতন। আর কোনো যুক্তি বা প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পেলাম না। বেশ খানিকটা নিরুৎসাহ হয়ে বেদীর উপর বসে পড়লাম। বেদীর উপর বাঘছাল পাতা, পাশে ত্রিশূল। আলো-অন্ধকারের একটা ভয়াবহ নির্জনতা যেন চারদিক থেকে ঘিরে রয়েছে গুহাটাকে। প্রথমে কয়েকটি শট নেওয়া হল ধ্যানমগ্ন মহাদেবের। শটের ঠিক আগে ঝাপি খুলে গলায় ঝুলিয়ে দ্যায় গোখরো সাপ। সঙ্গে সঙ্গে বুকের স্পন্দন বেড়ে যায়। চোখ বুজে ভয়ে কাঠ হয়ে থাকি। ইলেকট্রিক আলল পড়লে সাপ মাথা গুঁজে বুকের উপর লেপটে থাকে ভয়ে। লকলকে জিভটা দিয়ে গলা বুক চাটতে থাকে। কোনরকমে আমার একার শটগুলো শেষ হল। মেক-আপ শেষ করে এলোচুল পিঠের ওপর ফেলে, চওড়া লালপাড় গরদের শাড়ি পরে, গলায় হাতে ফুলের গহনা পরে চন্দ্রাবতী সেটে এলেন। গুহার অন্ধকার কেটে গেল।

দুতিনবার মনিটার হল। সিনটা হল–ফুলের সাজি হাতে হাসিমুখে সতী এসে ধ্যানমগ্ন শিবের বেদীর নিচে হাঁটু গেড়ে বসে সাজি থেকে দুহাত ভরে ফুল নিয়ে শিবের উদ্দেশে প্রেমাল্লুত কণ্ঠে বললেন, নাথ! ধুতুরা-বেলপাতা তোমায় এইসবে মানায় না। আজ আমি ফুলে-ফুলে তোমার সর্বাঙ্গ আচ্ছন্ন করে দেব। মহাদেব হাসিমুখে চোখ মেলে চাইবেন। গোল বাধল সাপ নিয়ে। শটের আগে আমার গলায় জ্যান্ত গোখরো সাপ দেখে সতী-শিরোমণি পতির ত্রিসীমানায় আসতে রাজি হলেন না। সাপ নিয়ে তিন-চারটে শট করে সাহস আমার খানিকটা এসে গিয়েছিল, অভয় দিয়ে বললাম, এই দেখুন না, সাপ আমার বুকে নির্জীব হয়ে পড়ে আছে। আপনার কোনো ভয় নেই। বলতে বলতেই দেখি সাপটা সড়সড় করে আমার বুকের ওপর থেকে নেমে চৌকির ওপর দিয়ে নিচে নামছে। মরিয়া হয়ে হাত দিয়ে ধরে গলায় পেঁচিয়ে দিলাম। অনেক বলে কয়ে রাজি করানো গেল চন্দ্রাবতাঁকে, কিন্তু বেদীর গা ঘেঁষে বসতে কিছুতেই রাজি করান গেল না। শুটিং শুরু হল। আলো দিইে নেতিয়ে বুকের ওপর লেপটে রইল সাপটা। ফুল হাতে সতী কিছুদূরে বসে সংলাপ শুরু করলেন। নির্বিষ নেতিয়ে পড়া সাপটা আস্তে আস্তে ফণা তুলে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল চন্দ্রাবতীর দিকে। তারপর একটু একটু করে ঝুঁকতে লাগল ফুলসুদ্ধ প্রসারিত হাতের দিকে। সুন্দরী স্ত্রীলোক সম্বন্ধে দুর্বলতা শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে এতদিন জানতাম। আজ নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম। দেখি চার মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে, সেখানে এসে জড়ো হয়েছে রাজ্যের ভয়। দু-একটি সংলাপ ঐ অবস্থায় বলেই-বাবা রে মা রে! করে পিছনে পড়ে প্রায় অজ্ঞান। বেশ কিছু সময় কেটে গেল। তারপর ক্লোজ শটে সিনটা কেটে-কেটে কোন মতে কাজ শেষ হল।

সারা দেহে সাপের একটা বিটকেল গন্ধ লেগে আছে। নিজেরই ঘেন্নায় বমি আসছে। পূর্বের ব্যবস্থা মতো গরম জল আর কার্বলিক সাবান দিয়ে বেশ করে স্নান করে বাড়ি এলাম।

ইতিমধ্যে চাঁদ সদাগর ক্রাউনে রিলিজ হল। হিট ছবি। নাম করলেন পরিচালক প্রফুল্ল রায়, অকুণ্ঠ প্রশংসা পেলেন নাম-ভূমিকাভিনেতা অহীন্দ্র চৌধুরী, প্রচুর পয়সা পেলেন প্রযোজক বাবুলাল চৌখানি, শুধু রাজ্যের অপযশ ও নিন্দার মালা পরে দর্শক ও সমালোচকদের বিদ্রুপের খোরাক হয়ে দাঁড়ালাম হতভাগ্য আমি। কেষ্টামার্কা পার্ট হলেও খানিকটা বাঁচতাম, এ তার চেয়েও মেয়েলি ভূমিকা; ছবিটার গোড়ার দিকে মা-বাপের নয়নের মণি আদুরে দুলাল লখিন্দর অস্ত্রশিক্ষকের কাছে তলোয়ার খেলা শেখে, আর ওরই মধ্যে পুত্রগতপ্রাণা মা সনকা এসে পরিশ্রান্ত ছেলেকে ফল-দুধ খাইয়ে যান। কিছুদিন বাদেই লখিন্দরের বিয়ে হল-বাসরঘরে সাপের কামড়ে বেচারি অকালে মৃত্যু বরণ করে। এরপর সারা ছবিটায় সতী-শিরোমণি বেহুলার সতীত্ব প্রচারে উপলক্ষ্য হয়ে মড়া হয়ে ভেলায় শুয়ে থাকা ছাড়া বেচারির আর কিছু উপায় নেই। ছবি দেখে লজ্জায়-ঘেন্নায় আমারই নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল, দর্শক ও সমালোচকের দোষ কী?

কয়েকমাস আগে যমুনা পুলিনে রিলিজ হয়ে ক্ষেত্র তৈরী হয়েছিল। এইবার তাতে বিষবৃক্ষের অঙ্কুর গজিয়ে উঠল।

রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার উপায় নেই। অরসিক দুষ্টু ছেলের দল পিছু লাগে। কেউ বলে, বাবা লখিন, বড্ড পরিশ্রম করেছ। যাও দুধ খেয়ে এস।

আর কেউ, তোমার ছকি কেমন আছে কলির কেষ্ট?

এতেও শেষ হয় না। ঘরে-বাইরে অশান্তি। বাড়ি এসে দেখি স্ত্রীর মুখ ভার। চার পাঁচদিন কথা বন্ধ! রোজ রাত্রে কতকরে বোঝাই, দ্যাখো আমি তো তোমায় প্রতারণা করে বিয়ে করিনি। তোমার অভিভাবক, দাদা নিজে দেখে-শুনে, আমি বায়োেস্কাপ থিয়েটারে কাজ করি জেনেই তো বিয়ে দিয়েছেন। তা হলে আমার দোষটা কোথায়?

অভিমান বা রাগ তবু যায় না। অনেক কষ্টে আবিষ্কার করি, আমি কেষ্ট সেজে একপাল মেয়ের সঙ্গে ঢলাঢলি করি তার খুব খারাপ লাগে। তার ধারণা ঐ ধরনের ভূমিকা অভিনয় করা যেন সম্পূর্ণ নির্ভর করে আমার ইচ্ছার উপর। হায় ভাগ্য!

ইতিমধ্যে অনেকগুলো সামাজিক ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছি। আমার ভাগ্যে সবগুলো যেন এক সুরে বাঁধা। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে অভাবের সঙ্গে লড়াই করে আর ফোঁসফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাগ্যদেবতাকে অভিসম্পাত দ্যায়। ড্যাবডেবে করুণ চোখে চেয়ে দর্শকের করুণার চেয়ে বিরক্তি উৎপাদনই বেশি করে মেরুদণ্ডহীন বোকা ভালমানুষ নায়ক।

ভাবলাম দেখা যাক দক্ষযজ্ঞ ছবিতে জ্যান্ত সাপ গলায় ঝুলিয়ে ভূতপ্রেতের সঙ্গে তাণ্ডব নেচে যদি মোড় ঘোরাতে পারি, ভোলানাথকে ভোলাবার চেষ্টায় সর্বশক্তি নিয়োগ করলাম।

একদিন স্টুডিওতে গিয়ে শুনলাম দক্ষযজ্ঞ ছবির বহির্দশ্য তুলতে আমাকে দার্জিলিং যেতে হবে। আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম যেন। একে কলকাতা নানা কারণে অসহ্য, তার উপর ছেলেবেলা থেকে আমার কল্পনার স্বর্গরাজ্য ধবল তুষারমৌলি হিমালয় দেখার অদম্য বাসনা। এত শিগগির সে সুযোগ আসবে কল্পনাও করিনি। নির্দিষ্ট দিনে বেডিং-সুটকেস নিয়ে দার্জিলিং মেলে রওনা হয়ে পড়লাম। জ্যোতিষবাবু কী কারণে যেতে পারলেন না, সঙ্গে গেলেন শ্রীহীন কৃষ্ণের লেখক পরিচালক তড়িৎকুমার বোস, এম. এ.। চমৎকার আমুদে লোক তড়িৎদা, পথের কষ্ট জানতেই পারলাম না।

দার্জিলিং পৌঁছে স্লো ভিউ হোটেলে সদলবলে উঠলাম। দু-তিন দিন আকাশ মেঘলা, মাঝে মাঝে বৃষ্টি শুটিং হল না। সকালে চা-জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়ি, আবার দুপুরে এসে খেয়ে একটু বিশ্রাম করে আবার প্রকৃতির খামখেয়ালির রাজ্যে ঘুরে বেড়াই। ছোট শহর দার্জিলিং, দুএকদিন ঘুরলেই দর্শনীয় সব কিছু দেখা হয়ে যায়। তবু যেন আশা মেটে না।

চতুর্থ দিনে রাত্রি চারটের সময় সোরগোল করে তড়িৎদা সবাইকে তুলে দিলেন, বললেন, আজ ভোর থেকে রেডি হয়ে বসে থাকব। রোদ উঠলেই শুটিং। এভাবে চুপচাপ বসে থাকলে কোম্পানি ভাববে কী?

তাই হল, শীতে কাঁপতে কাঁপতে সারা গায়ে চুনকাম করে জটাজুটো পরে সদলবলে ম্যালে গিয়ে উঠলাম। ওখানে সবচেয়ে উচুঁ টিলাটার উপর বাঘছাল বিছিয়ে হিমালয়কে পিছনে করে ধ্যানে বসলাম। কোথায় রোদ! কুয়াশা কাটতেই বেলা নটা বাজল। তারপর যদিও বা একঝলক রোদ দেখা গেল, ক্যামেরাম্যান গুণে ক্যামেরা আর রিফ্লেক্টার ঠিক করতে না করতেই তা চলে গেল, এল বৃষ্টি। কোম্পানির ছাতা মাথায় দিয়ে বসে ভিজলাম খানিকক্ষণ। এইভাবে বেলা বারোটা একটা পর্যন্ত বসে হোটেলে চলে এলাম। এইভাবে তিন-চার দিন কাটল। এতদিনে সূর্যদেব করুণা করলেন। সকাল থেকেই পরিষ্কার রোদ বেশ কিছুক্ষণ পাওয়া গেল। নানা এ্যাঙ্গেলে ঘুরিয়েফিরিয়ে কতকগুলো শট নেওয়া হল। হিমালয়ের সামনে বসে ধ্যানমগ্ন মহাদেব। ধ্যান ভেঙে সামনে চেয়ে দেখি বেদীটার সামনে ক্যামেরার পাশে ভিড় জমে গেছে। সর্বজাতের সমন্বয়। একটি ইউরোপীয়ান মহিলা ক্যামেরা হাতে এগিয়ে এসে আমার ছবি তুললেন। মনে হল ভারতবর্ষের চিড়িয়াখানা থেকে অদ্ভুত জীবের নমুনা দেশের লোককে দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেবার উদ্দেশ্যেই ছবিটা নিলেন। ছবি তোলা হয়ে গেলে মহিলাটি আমার একেবারে কাছে এসে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন–হুঁ আর ইউ?

বেশ একটু দোটানায় পড়ে গেলাম। ভাবলাম, আমার সত্যিকার নাম জানতে চাইছে, না যা সেজে আছি তার নাম। যা থাকে কপালে, বললাম, শিব।

শিব কে?

একজন দেব।

দেবতা? এখানে বসে কী করছ?

ধ্যান করছি, পিছনের ঐ পাহাড়টা আমার রাজ্য। বলে, হাত দিয়ে সগর্বে হিমালয় দেখিয়ে দিলাম। বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে মহিলাটি একবার হিমালয় একবার আমার দিকে দেখতে লাগলেন, তারপর সংশয়াকুল কণ্ঠে বললেন, ঐটেই যদি তোমার রাজত্ব হয় তাহলে ওখানে না গিয়ে এখানে বসে আছ কেন?

মহা সমস্যায় পড়লাম। বোঝাই কী করে যে ওখানে মানুষ উঠতে পারে না, তাই ওর যতটা কাছে সম্ভব–। আমায় চুপ করে থাকতে দেখে নিজেই সোৎসাহে বলে উঠলেন, আই সি! অন্য দেবতা এসে তোমার রাজ্য অধিকার করে নিয়েছে। তাই ধ্যান করে দেবতাদের তুষ্ট করে ওখানে ফিরে যাবার চেষ্টায় আছ।

মনে-মনে ভাবলাম, ধ্যান করে তুষ্ট করতে হবে না, আর দিনকতক খালি গায়ে এখানে বসে থাকলেই ওখানে যাবার পথ সুগম হয়ে যাবে।

তড়িৎদা কাছে এসে গল্পটা বুঝিয়ে দিলেন মেমসাহেবকে, মাঝেমাঝে কী সব নোট করে নিয়ে আমাদের কাছে অযথা বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চেয়ে হৃষ্টমনে চলে গেলেন তিনি।

ফিরে এলাম কলকাতায়। দার্জিলিং-এর শটগুলোয় ছবির উন্নতি হোক বা না হোক আমাদের স্বাস্থ্যের খানিকটা উন্নতি হল। ইতিমধ্যে চারু রায় রাজনটী বসন্তসেনা আরম্ভ করে দিয়েছেন। পূর্ণ উদ্যমে কাজে লেগে গেলাম। ও হরি, আমার ভাগ্যে সেই ড্যাবডেবে চোখ নিয়ে শুধু নর্তকী বসন্তসেনার সঙ্গে প্রেম করা–। খুব নিরুৎসাহ হয়ে পড়লাম। ঠিক এই সময় পুরোনো মনিব জাহাঙ্গীর সাহেব ম্যাডানের সব স্বত্ব হারিয়ে খিদিরপুরে ময়ূরভঞ্জ রোডে একটা প্রকাণ্ড বাগানবাড়ি ভাড়া নিয়ে কেশরী ফিল্মস নাম দিয়ে নিজস্ব একটি প্রতিষ্ঠান খুলে আমায় ডেকে পাঠালেন। পরদিনই গিয়ে দেখা করলাম। দেখলাম, ম্যাডানের অনেকগুলো পুরোনো মুখ সাহেবের চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সাহেব বললেন, ধীরাজ। দশ জায়গায় ঘুরে না বেড়িয়ে আমার এখানে স্থায়ীভাবে যোগ দাও, সতীশ দাসগুপ্তকে নিয়ে বাসবদত্তা তুলব ঠিক করেছি। তুমি নায়ক উপগুপ্ত, বাসবদত্তাকাননবালা। কাননের তখন চারদিকে বেশ নাম ও চাহিদা, তার বিপরীতে নায়ক, রাজি হয়ে গেলাম। মাইনে ঠিক হল মাসে একশো পঁচাত্তর টাকা।

দিনপনেরো বাদেই শুটিং আরম্ভ হল। চমৎকার গল্পটি। যাক এবার বদনাম খানিকটা ঘোচাতে পারব। তখনও কোনও ফ্লোর তৈরি হয়নি। সিমেন্টের একটি উঁচু বেদীর উপর সিন খাঁটিয়ে রোদের আলোয় ছবি তোলা হতে লাগল। ক্যামেরার কাজে ধীরেন দে নির্বাক যুগে বেশ নাম করেছিলেন, তাঁকেই নেওয়া হয়েছে। সাউণ্ডে ম্যাডানের ভূতপূর্ব সেটিং মাস্টার দীনশা ইরাণীর ছেলে বর্তমানে নাম করা রেকর্ডার জে. ডি. ইরাণী। বেশ উৎসাহ নিয়ে রোজ শুটিং করে যেতে লাগলাম। মাঝে ব্যবসা সংক্রান্ত, না পারিবারিক ব্যাপারে সাহেব স্টুডিওয় আসা বন্ধ করে দিলেন। আড়াই মাস শুটিং বন্ধ। বাইরে থেকে দু-একটা অফার এলেও নিতে পারলাম না, এক বছরের জন্য চুক্তি। কী করি, প্রায় তিন মাসের মাইনে বাকি পড়ে গেল। হঠাৎ একদিন সাহেব স্টুডিওয় এলেন। দেখা করে সব বললাম। সাহেব বললেন, ধীরাজ। তুমি আমার নিজের লোক, তাই তোমায় বলছি। খুব অর্থসংকটে পড়ে গেছি। দাজিলিং-এর বিলাতি মদের দোকানটা আমার ভাগে পড়েছিল, ভাল আয় হত তা থেকে। বহুদিনের পুরোনো ম্যানেজার প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা ভেঙে আত্মগোপন করেছে। তাই পাগলের মতো ছুটেছিলাম দার্জিলিং-এ। গিয়ে লস্ দিয়ে দোকান বিক্রি করেও সব দেনা শোধ করতে পারিনি। এখন ভরসা এই ছবিটা। কোনও রকমে ছবিটার শুটিং শেষ করে দাও। এটা আমি আউটরাইট বিক্রি করে দেব এক লাখ পঁচিশ হাজারে। তার আগে কাউকে এক পয়সাও দিতে পারব না।

সবাইকে বলা হল, কেউ শুনল, কেউ শুনল না। যারা শুনল না, সাহেব তাদের বাকি মাইনে চুকিয়ে দিলেন। আমাকে ডেকে গোপনে বললেন, এ ছবির পর ওদের তাড়িয়ে দেব। শুধু থাকবে তোমরা কজন আমার বিপদের বন্ধু।

বুক ভরে গেল। এতদিন যাদের নিমক খেয়েছি তাদের দুর্দিনে যে কিছু কাজে লাগতে পারলাম এতেই ধন্য হয়ে গেলাম। সংসারে অভাব অনটন দেখা দিল, দিক। কদিন বই তো নয়। এতদিন যখন দুঃখ-কষ্টে কেটেছে তখন আর একটা মাস কোনরকমে কাটিয়ে দিতে পারব। সবাই মিলে পূর্ণোদ্যমে কাজ করতে লাগলাম। ছবিটার দশআনা আগেই হয়ে গিয়েছিল, এক মাসের মধ্যেই কাজ শেষ হল। বুক ফুলিয়ে সাহেবের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। পিঠ চাপড়ে সাহেব বললেন, ভেরি গুড! এর পুরস্কার তোমরা পাবে।

বললাম, সাহেব এইবার আমাদের মাইনের একটা ব্যবস্থা করুন। সাহেব বললেন, ছবিটা রাশ প্রিন্ট হতে দিনচারেক লাগবে। তারপর যারা কিনবে তাদের দেখাব। এই ধর দিনসাতেকের মধ্যেই সব ব্যবস্থা করে ফেলব। তোমরা সামনের সোমবার আমার সঙ্গে দেখা কর।

খুশি মনে বাড়ি চলে গেলাম। সোমবার বেলা বারোটার সময় আমি, ইরাণী, ধীরেন এবং লেবরেটরির সাত-আটজন সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। হাসিমুখে সাহেব বললেন,সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আজ রাত্রে বিক্রি কবলায় সই হয়ে টাকা পাব। তোমরা কাল দশটায় এসে টাকা নিয়ে যেও।

পরদিন দশটায় দিয়ে দেখি গেটে মস্ত বড় তালা। আশেপাশের লোকের মুখে শুনলাম, সাহেব রাতারাতি সব বিক্রি করে কলকাতার বাইরে চলে গেছেন।

.

কেশরী ফিল্মস-এর ধাক্কা সামলাতে বেশ কিছুদিন লাগল। প্রায় পাঁচ-ছয় মাস বেকার বসে রইলাম। শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমি রাধা ফিল্মস্ থেকে ডাক এল। ছবি হবে কৃষ্ণ সুদামা। সুদামা–অহীন্দ্র চৌধুরী, রুক্মিণী–কানন, আর কিছু না বললেও সবাই বুঝতে পারবে শ্রীকৃষ্ণ কে। শুটিং চলতে লাগল–আর কিছু না হোক, বেকার চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে অনেক ভাল। দক্ষযজ্ঞ রিলিজ হল ক্রাউন সিনেমায়। সারা কলকাতা সরগরম হয়ে উঠল। কোন পৌরাণিক ছবিই এর আগে এত সাড়া জাগাতে এবং একাদিক্রমে একই সিনেমায় ত্রিশ সপ্তাহের গৌরব অর্জন করতে পারেনি। ভাবলাম, ভোলানাথ হয়তো বা তুষ্ট হয়েছেন। কথায় আছে, তুমি যাও বঙ্গে, কপাল যায় সঙ্গে। আমারও হল ঠিক তাই। সমালোচকের দল সব কিছুর প্রশংসা করে আমার সম্বন্ধে লিখল, শিবের ভূমিকায় ধীরাজ ভট্টাচার্যের অভিনয় আমাদের একদম ভাল লাগেনি, ঐ একঘেয়ে ড্যাবডেবে চোখের চাহনি আর মেয়েলি ঢং-এ সংলাপ অসহ্য। তবে আমরা তার তাণ্ডব নাচটির প্রশংসা করব, আর করব তার গলায় ঝোলানো রবারের সাপটির। ওটি যিনি তৈরি করেছেন তাকে আমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

রবারের সাপ? প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে জলজ্যান্ত গোখরো সাপ গলায় ঝুলিয়ে লাভ হল এই? নায়ক জীবনটার ওপরই ধিক্কার এসে গেল।

একদিন কৃষ্ণ সুদামা মুক্তি পেল, পৌরাণিক ছবির জন্য ইতিপূর্বেই রাধা ফিল্মস বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন–কৃষ্ণ সুদামা সে খ্যাতি আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিল। গোল বাধল আমাকে নিয়ে, পোস্টারে আমার আর কাননের মুখ বেশ বড় করে ছাপা হল–সিনেমা হাউসের সামনে দর্শকের মধ্যে রীতিমত বাজি ধরা শুরু হয়ে গেল। কোনটা আমার মুখ আর কোনটা কাননের। দুজনেরই বড় বড় চোখ, উন্নত নাক, তার উপর পৌরাণিক পোশাক আর গয়না মুকুটে একটু দূর থেকে মনে হবে যমজ বোন। ব্যস আর চাই কী? সমালোচকদের বেশ খানিকটা মুখরোচক খোরাক জুটে গেল। এতেও নিস্তার নেই, পাড়ার কয়েকটি ধর্মপ্রাণ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ছবি দেখে এসে প্রকাশ্যে আমাকে আশীর্বাদ করে করে বলে গেলেন, এই রকম ছবিতে নেবো তুমি–আহা কেষ্টঠাকুর তো কেষ্টঠাকুর।

সুকুমার দাশগুপ্ত কমলা টকিজের হয়ে ডাঃ নরেশ সেনগুপ্তের বিখ্যাত উপন্যাস রাজগীর চিত্ররূপ দেবেন, নায়কের ভূমিকায় আমাকে নির্বাচন করে ডেকে পাঠালেন। প্রথমটা বিশ্বাস করতেই পারিনি ওরকম একটি জটিল মনস্তত্তমূলক ভূমিকায় কী করে আমায় মনোনীত করলেন। সত্যিকার রক্তমাংসের জলজ্যান্ত নায়ক-স্ত্রী থাকতেও অপর মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে। মোট কথা, যে ধরনের ভূমিকা আমি বরাবর করে এসেছি তা থেকে বেশ কিছু ব্যতিক্রম। মন-প্রাণ দিয়ে অভিনয় করলাম, ভালও বলল সবাই, সমালোচকের ছুরি কলম হয়ে লিখল আজ পর্যন্ত যা করেছেন তার মধ্যে রাজগী বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

কিন্তু কী ফল লভিনু হায়, শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি বেজে উঠল–আবার ছুটলাম বৃন্দাবনে। এবার রাধা ফিস্ তুলবেন নর-নারায়ণ।

হাতি-মার্কা ছবি তখন বাজার একচেটে করে ফেলেছে। যে ছবি বেরোয় নিউ থিয়েটার্স থেকে, দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়ে। চণ্ডীদাস, পুরাণ ভকত, ভাগ্যচক্র, মুক্তি–একটার পর একটা হিট ছবি বেরুতে লাগল ঐ একমাত্র বাঙালি প্রতিষ্ঠান থেকে। ভাবলাম, একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি, যদি ওখানে ছবিতে চান্স পাই, আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে।

গেলাম একদিন সকাল নটার সময় নিউ সিনেমায়, হেড অফিসে। দুরুদুরু বক্ষে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে দেখি মিঃ সরকারের দরজার সামনে টুল পেতে পুরু খাকির ওপর লাল এন. টি. ছাপা কোট গায়ে বুক ফুলিয়ে বসে আছে বেয়ারা। সাহেবের সঙ্গে দেখা করব বলতেই পকেট থেকে একটা ছোট কাগজের স্লিপ ও পেন্সিল এগিয়ে দিল আমার দিকে। লিখে দিলাম। একটু পরেই ভিতরে ডাক পড়ল। ঘরে ঢুকতেই খালি একটা চেয়ার দেখিয়ে মিঃ সরকার বললেন, বসুন।

দেখলাম ৫৫৫ সিগারেটের টিন থেকে একটার পর একটা শুধু খেয়েই চলেছেন। একটা শেষ হয়ে যাবার আগেই আর একটা ধরিয়ে নেন। চুপচাপ বসে চারদিক দেখছি। মিঃ সরকার বললেন, বলুন।

কী বলি! হাউহাউ করে একসঙ্গে বলে গেলাম আমার পাথরচাপা বরাতের ফাপা একরাশ কথা। সব শেষে বললাম, আপনি আমার শেষ ভরসা, আপনার এখানে একটা চান্স পেলে আমার সব দুর্নাম ধুয়েমুছে নিঃশেষ হয়ে যাবে, এ লাইনে আমি হয়তো আরও কিছুদিন টিকতে পারব।

প্রথম আলাপ। দেখলাম খুব কম কথা কন ভদ্রলোক। সব শুনে চুপ করে কী যেন একটু ভেবে নিলেন, তারপর টেবিলের ওপর প্যাডে পেন্সিল দিয়ে কী একটা লিখে আমায় বললেন, আপনি নেক্সট উইকে, মানে সামনের সোমবার, আমার সঙ্গে দেখা করবেন। নমস্কার করে চলে এলাম।

সপ্তাহকে মাস হতে দেখেছেন কেউ? আমার ভাগ্যে এক সপ্তাহ এক মাস দীর্ঘ হয়ে আমার ধৈর্যের সঙ্গে ছিনিমিনি খেলতে শুরু করে দিল, সোমবার আর আসে না। নির্দিষ্ট দিনে একটু আগেই নিউ সিনেমায় গিয়ে হাজির হলাম, বেয়ারা বলল, সাহেব এখনও আসেননি। মিঃ সরকার একটু দেরি করেই আফিসে এলেন। স্লিপ পাঠালাম। ডাক আর আসে না। আধঘন্টা পরে স্লিপটা হাতে করে বেয়ারা এসে বলল, সাহেব এতেই লিখে দিয়েছেন।

রুদ্ধনিশ্বাসে স্লিপটার উল্টো পিঠে পেন্সিলে লেখা ইংরেজি লাইন দুটো বার চারেক পড়ে ফেললাম। সেই মামুলি ঘুরিয়ে নাক দেখানোর কথা, দুঃখিত, বর্তমানে লোকের দরকার নেই, পরে প্রয়োজন হলে আপনাকে ডেকে পাঠাব।

ব্যস। আর কোন ক্ষোভ নেই আমার। এইবার নিশ্চিন্তমনে একঘেয়েমির স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে পারব। রেলিং ধরে তিনতলার খাড়া সিঁড়িগুলো দিয়ে কোন রকমে নেমে বাড়ি চলে এলাম।

দিনচারেক বাদে একদিন মনমোহনের সঙ্গে দেখা, ধর্মতলার মোড়ে। দেখতে পেয়েই কাছে এসে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলল মাঠের দিকে, মনুমেন্টের কাছাকাছি এসে হাত ছেড়ে দিয়ে হাসতে শুরু করল মনমোহন। একটু পরে বলল, হ্যাঁ রে, তুই নিউ থিয়েটার্সে ঢোকবার চেষ্টা করেছিলি? ওরা তোকে কোনো দিনই নেবে না।

রীতিমত অবাক হয়ে গেলাম। আমার দৃঢ় ধারণা ছিল মিঃ সরকারের সঙ্গে আমার দেখা হওয়া এবং তার ফলাফল আমি আর মিঃ সরকার ছাড়া আর কেউ জানে না। কথা কইব কী, হাঁ করে চেয়ে রইলাম মনমোহনের দিকে। আমার অবস্থা দেখে বেশ খানিকটা হেসে নিয়ে মনমোহন বলল, ভাবছিস আমি জানলাম কী করে? তুই বোধ হয় জানিসনে, আমি এখন নিউ থিয়েটার্সের ক্যামেরাম্যান। কয়েকদিন আগে স্টুডিওর গোলঘরের আদালতে সন্ধ্যেবেলায় তোর মামলা তুলেছিলেন মিঃ সরকার। পাবলিক প্রসিকিউটর অমর মল্লিক লাফিয়ে উঠে প্রতিবাদ করে বললেন, এ হতেই পারে না, ও একটা আর্টিস্টই নয়, ওকে নিউ থিয়েটার্সে নিলে আমাদের প্রেস্টিজের হানি হবে।

ব্যস, কেস ডিসমিস হয়ে গেল। অবাক হয়ে ভাবছিলাম, সদালাপী, হাস্যময় নাদুসনুদুস মল্লিকমশায়ের কথা। সামান্য মৌখিক আলাপ ছিল, দেখা হলেই অতি পরিচিতের মতো গায়ে পড়ে আলাপ-আপ্যায়ন করেন, অজ্ঞাতে কবে কী ক্ষতি তার করেছি। অনেক ভেবেও কিছু আবিষ্কার করতে পারলাম না।

বললাম, যাকগে, তোর কথা বল। নিউ থিয়েটার্স লাগছে কেমন?

–চমৎকার, দশটায় যাই, বেলা দুটো পর্যন্ত লাইট ফিট করি–তারপর লাঞ্চের ছুটি। খেয়ে-দেয়ে তিনটে নাগাদ ফ্লোরে আসি। চারটের সময় একটা শট নেওয়া হয়, আবার ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল চেঞ্জ করে লাইট করা শুরু হয়। পাঁচটা, সাড়ে পাঁচটায় আরেকটা শট নেওয়া হয়। তারপরই সবাই উৎকর্ণ হয়ে থাকি মোটরের হর্নের অপেক্ষায়, সন্ধ্যে ছটা-সাড়ে ছটায় শ্যামের বাঁশি বেজে ওঠে, সব ফেলে ছুটে যাই গোলঘরে। সাহেব ঘন্টাখানেক থাকেন, দৌড় ঐ গোলঘর পর্যন্ত। ঐখানে বসে স্তাবকদের মুখে স্টুডিওর খুঁটিনাটি সব খবর নিয়ে চলে যান বাড়ি। আমাদেরও ছুটি।

পরিচালক মধু বসু সদলবলে সবাক চিত্রজগতে অবতীর্ণ হয়ে অল্পদিনের মধ্যেই বেশ খানিকটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। অভিজাত বংশের নরনারীদের নিয়ে আলিবাবা এঁদের প্রথম ছবি। এবার তিনি ভারতলক্ষ্মীর হয়ে মন্মথ রায়ের গল্প অভিনয়-এর চিত্ররূপ দেবেন। নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য আমাকে ডেকে পাঠালেন। বার বার আশাহত হয়ে হয়ে কিছুতেই আর চট করে আশান্বিত হই না।

ভারতলক্ষ্মী স্টুডিওতে গিয়ে কথাবার্তা ঠিক করে চুক্তিপত্রে সই করে এলাম। রিহার্সাল দিতে হবে। মিঃ বোস তখন এম্পায়ার থিয়েটারের (অধুনা রক্সি সিনেমা) উপরতলায় সমস্ত ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। সেইখানেই রোজ দুপুরে রিহার্সাল দিতে যাই। প্রধান ভূমিকায় ছিলাম আমরা তিনজন–আমি, অহীনদা ও মিসেস সাধনা বোস। প্রথম দিন কাহিনীকার মন্মথ রায় গল্পটি শোনালেন, চমৎকার লাগল। নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখা কাহিনী, নায়ক হীরক রায় খামখেয়ালি বড়ঘরের ছেলে, কাগজে সুন্দরী মেয়ের ছবি দেখে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রেখে বিয়ে করল মধ্যবিত্ত ঘরের মা-হারা বিদুষী মেয়ে মনীষাকে। গোল বাধল তারপর। হীরক রায় রতনগড়ের রাজকন্যার সঙ্গে প্রেম করে বাইরে রাত কাটায়, ঘরে মনীষা প্রহর গুনে বসে থাকে স্বামীর অপেক্ষায়। ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলে কাহিনী। অবশেষে মনীষা জানতে পারলে তাকে বাজি রেখে বিয়ের কথা। লজ্জায় অপমানে স্বামীর গৃহ ত্যাগ করে যায় মনীষা স্টেজে, অভিনয়ের মধ্যে নিজের সব দুঃখ ডুবিয়ে দিতে। শেষকালে এক নাটকীয় পরিবেশের মধ্যে রতনগড়ের রাজকন্যার সঙ্গে স্বামীর মিলন ঘটিয়ে দিয়ে চরম আত্মত্যাগ করে মনীষা ফিরে যায় অন্ধ বাপের কাছে। গল্পের শেষ এইখানেই।

অনেকদিন বাদে আবার আশান্বিত হলাম। নায়ক হীরক রায় দোষত্রুটিতে ভরা সাধারণ রক্তমাংসের মানুষ। পরোপকারী, চরিত্রবান, পত্নীগতপ্রাণ ভালমানুষ নয়, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলাম। একটা অভিজ্ঞতা লাভ করলাম। পরিচালক নিজে যদি অভিনয় করেন অথবা তার স্ত্রী যদি নায়িকা হন, তাহলে সবসময় বেচারি নায়কের উপর সুবিচার রক্ষা করতে পারেন না বা করেন না। যাকগে, তবুও নায়ক হীরক রায় গতানুগতিক নায়কদের চলার পথের বাইরে দিয়ে হাঁটে, সেইটেই কি আমার মতো পথশ্রান্ত নায়কের পক্ষে কম লাভ? পরিচালক মধু বোসকে ধন্যবাদ দিলাম।

সকলের ঐকান্তিক সহযোগিতায় অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রায় আট মাসে শুটিং শেষ হল। মাসখানেক বাদে রূপবাণী চিত্রগৃহে সাড়ম্বরে মুক্তি পেল অভিনয়। বাইরে তোলা প্রথম একখানি ছবি হাতিমার্কা ছবির পাশে সগর্বে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল। দর্শক-সমালোচকের প্রশংসাগুঞ্জনে কলকাতার আকাশবাতাস মুখরিত হয়ে উঠল। আমার অভিনয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েও কেউ উঠল না, শতমুখে নিন্দাও করল না কেউ, শুধু লিখল ভাল পরিচালক ও ভাল ভূমিকা পেলে ভবিষ্যতে সুঅভিনয় করলে আমরা অবাক হব না। যথেষ্ট। ভাবলাম যাক এতদিন বাদে ভাটার টান বন্ধ হয়ে জল স্থির হয়েছে। এবার একদিন জোয়ার এলেও আসতে পারে।

সাহিত্যিক শৈলজানন্দ সাহিত্যের সভামঞ্চ থেকে নিচে ফিল্ম দুনিয়ায় দৃষ্টিপাত করলেন, আর দৃষ্টি ফেরাতে পারলেন না, সিঁড়ি বেয়ে সটান নেমে এসে ঢুকে পড়লেন গেট পেরিয়ে একেবারে স্টুডিওর মাঝখানে। নিজের নন্দিনীর চিত্ররূপ দেবার সব ব্যবস্থা শেষ করে ফেললেন। কলেজজীবনে সাহিত্যক্ষেত্রে প্রথম অস্থির পদক্ষেপের সঙ্গেসঙ্গেই শৈলজানন্দের সঙ্গে আলাপ, উনিও নতুন ব্রতী, সবে কয়লাকুঠির গল্প লিখেছেন। সেই থেকে বন্ধুত্ব।

দেখা হতেই বললেন, ছবি করছি শুনেছ বোধহয়? আমার প্রথম ছবিতে তোমাকে রোম্যান্টিক নায়কের ভূমিকায় নামাব ঠিক করেছি।

বললাম, আবার রোম্যান্টিক নায়ক? তার চেয়ে যদি কোনও ভিলেনের রোল থাকে তাই দিন না? হহহহ করে বীরভূমী হাসিতে ঘরসুদ্ধ সবাইকে সচকিত করে শৈলজাবাবু বললেন–তোমরা সবাই শোন, রোম্যান্টিক নায়কের ভূমিকার বদলে ধীরাজ চাইছে ভিলেনের রোল। এক রোম্যান্টিক নায়ক ছাড়া আর কোনও ভূমিকায় যে তোমায় মানায় না, এই সোজা কথাটা এতদিনে কেউ তোমায় বুঝিয়ে দেননি ধীরাজ?

জবাব দিলাম না, চুপ করে রইলাম। একবার ভাবছিলাম বলি, সেই নির্বাক যুগ থেকে এই একটা কথা হাড়ে-হাড়ে বুঝেছি বলেই আজ একটু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়েই আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাইছিলাম।

শৈলজানন্দ বললেন, বেশ তোমাকে আমি ভিলেনই দেব।

অবাক হয়ে চাইলাম।

শৈলজানন্দ সোৎসাহে বলে চললেন, শুধু দেখিয়ে দাও তোমার মতো একটি ছেলে-নাক-চোখ-মুখ তোমার মতো নিখুঁত সুন্দর–আমি তোমাকে দেব ভিলেন রোল।

বিতৃষ্ণা ধরে গিয়েছিল নিজের ওপর। ওই নাক-চোখ-মুখ, যার প্রশংসায় আজ পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছেন শৈলজানন্দ–সেগুলো যে আমার কত বড় শত্রু, তা আজ আমার চেয়ে আর কেউ জানে না। চুপ করে রইলাম।

শৈলজানন্দ বললেন, পারলে না তো? আমি জানি বাংলাদেশে তুমি ছাড়া আর। একটিও রোম্যান্টিক নায়ক নেই। নাও কনট্র্যাক্ট সই করো, সোমবার থেকে শুটিং।

.

ঘুরেফিরে আবার সেই ম্যাডানে। এখন আর ম্যাডান নেই, ইন্দ্রপুরী স্টুডিও। রায়বাহাদুর সুখলাল কারনানি স্টুডিওর ভাড়া দেওয়া ছাড়াও নিজে প্রডাকসনে নেমেছেন। জ্যোতিষবাবু বহুদিনের পুরোনো লোক, তাকে দিয়েই শকুন্তলার বাংলা চিত্ররূপ দেবার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। পুরোনো জিনিসের ওপর রায়বাহাদুরের একটা ঝোঁক দেখলাম। পুরোনো গল্প, পুরোনো পরিচালক, পুরোনো নায়ক। ডাক পড়ল আমার। জ্যোতিষবাবুর সঙ্গে দেখা করলাম। বললেন, পারিশ্রমিক ঠিক করবেন রায়বাহাদুর স্বয়ং, তুমি নিজে গিয়ে ঠিক করে এস।

বিকেল পাঁচটা বেজে গেল। ইন্দ্রপুরী স্টুডিওর দু নম্বর ফ্লোরের সামনে চওড়া কংক্রিটের রাস্তা, তারই এক পাশে প্রকাণ্ড একটা গোল টেবিল পাতা, চারধারে পাঁচসাতখানা চেয়ার। মাঝের বড় চেয়ারটায় বসে আছেন বিরাট বপু বুলডগের মতো ভয়াল গম্ভীর মুখ নিয়ে ধনকুবের রায়বাহাদুর সুখলাল কারনানি। অসম্ভব রাশভারি দুর্মুখ লোক, কাছে যেতে ভয় হয়। দেখলাম চেয়ারে বসবার সাহস কারো নেই। সবাই বেশ কিছুটা দূরে হাত-জোড় করার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে চারধারে। নামডাকই শোনা ছিল, এতটা নিকট সান্নিধ্যে আসবার সৌভাগ্য কোন দিন হয়নি। একটু থমকে দাঁড়িয়ে ভাবলাম, হাত-জোড় করার দলে ভিড়ে যাব, না সামনে চেয়ারে গিয়ে বসব-যা থাকে কপালে, সামনে গিয়ে নমস্কার করে একখানা চেয়ারে বসে পড়লাম। একনজর চেয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলেন রায়বাহাদুর। ড্রাইভার সতীশের বিচার হচ্ছিল, হঠাৎ আমি এসে পড়াতে একটুখানি মুলতুবি ছিল, আবার শুরু হল।

রায়বাহাদুর, তুমি ব্যাটা পাক্কা চোর আছ।

সতীশ, না হুজুর।

আলবাত, বাঘের মতো গর্জন করে উঠলেন রায়বাহাদুর। গেল মাসের পেট্রলের হিসাবে দেখা গেল, দো গ্যালন কমতি। দো গ্যালন তেলের দাম তোমার মাইনেসে কাটা হোবে।

ম্যাডানের আমল থেকে পুরোনোলোক সতীশ, একপাল বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ঘর করে, মনে মনে দুঃখিত হলাম।

সামনে রাখা ছোট্ট একটা কাগজের স্লিপে একবার চোখ বুলিয়ে হাঁক দিলেন রায়বাহাদুর, উছবা ব্যাটা চোরের সর্দার, উহ্বা কাহা? বুলাও উসকো।

বুলাতে হল না, সামনে অপেক্ষমাণ জনতার মাঝে গরুড়পক্ষীর মতো হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে ইন্দ্রপুরীর হেড মালি বা গাছপালা সাপ্লায়ার উছবা। টকি আসবার পর থেকে উদ্বার রোজগার হানড্রেড পারসেন্ট বেড়ে গেছে। নির্বাক যুগে রাস্তা বা বন-জঙ্গলের সিন তুলতে হলে সত্যিকার রাস্তায় বা বনে-জঙ্গলে গিয়ে তোলা হোত। কিন্তু সবাক ছবিতে সব সময় তা সম্ভব হয় না, কাজেই স্টুডিওতে গাছপালা বসিয়ে দূরে আকাশের সিন টাঙিয়ে সে কাজ সেরে নেওয়া হয়, আর সেই গাছপালার জন্য আপনাকে উছুবার দ্বারস্থ হতে হবেই। ঘন্টাখানেকের মধ্যে তিন চারটে সেটিং কুলিকে নিয়ে উছুবা বড় বড় আম জাম কাঁঠাল গাছের ডাল কেটে এনে স্টুডিওর ভেতর জঙ্গল তৈরি করে দিল, মহানন্দে শুটিং শেষ হল। একমুখ। পানদোক্তা নিয়ে হাসিমুখে উছবা এসে নমস্কার করে আপনার হাতে গাছপালার বিল দিল। দেখেই চক্ষু চড়কগাছ। একদিনের শুটিং-এর গাছপালার বিল করেছে উবা ষাট টাকা। অনেক বকাবকি রাগারাগি করে সেইটে কেটে চল্লিশ টাকায় রফা হল। মহা দুঃখিত হয়ে টাকা নিয়ে গজগজ করতে করতে চলে গেল উছবা। আসলে কিন্তু ঐ চল্লিশ টাকাই উছুবার লাভ। গাছ কাটা আর বয়ে আনার জন্য তিন চারটে কুলিকে খুব বেশি হলে এক টাকা দিয়ে বাকি টাকাটা উছবা বাক্সে তুলে রাখল। দশ-বারো বছর বয়সের সময় উছবা উড়িষ্যা থেকে ম্যাডানে আসে, সেই থেকে আছে। পরশ্রীকাতর দুষ্টু লোকে কানাঘুষা করে বলে, এরই মধ্যে নাকি উছুবা দেশে দুখানি বাড়ি ও প্রচুর ধানের জমি করেছে।

সামনে রাখা কয়েকটি কাগজের ফর্দের ওপর চোখ বুলিয়ে গর্জন করে উঠলেন রায়বাহাদুর, ব্যাটা চোরের সর্দার, তিন দিনের গাছপালার বিল একশ সাত টাকা? তুই ব্যাটাই ফতুর করবি আমাকে।

পানদোক্তা ঠাসা গোমড়া মুখখানা মুহূর্তে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল উছুবার। পচা চিংড়ি মাছের খোলসের মতো লাল দাঁত দুপাটি বার করে এক গাল হেসে বলল, যেদিন তা পারিব, সেদিন উছবা মালির কাজ ছাড়ি দিবে। স্টুডিও খুলিকিরি গ্যাট হয়ে চেয়ারে বসিকিরি বিল সই করিব।

রায়বাহাদুরকে অনুকরণের ভঙ্গিতে গালদুটো ফুলিয়ে গম্ভীর ভাবে শূন্যে অদৃশ্য কাগজে সই করে দেখিয়ে দিল উছবা।

ঈষৎ শঙ্কিতভাবে রায়বাহাদুরের দিকে চাইলাম। ঝুলে পড়া পুরু চামড়ার আবরণ ভেদ করে, খুশি বা রাগের কোনও আভাসই দেখতে পেলাম না। শুধু দেখলাম, বিলটা কাছে টেনে এনে খসখস করে কী লিখে সই করে দিলেন। কৌতূহলে সামনে একটু ঝুঁকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম–একশ সাত টাকার বিলটার মাত্র সাত টাকা কেটে পুরো একশ টাকা মঞ্জুর করে সই করে দিয়েছেন রায়বাহাদুর।

এই অদ্ভুত লোকটার ততোধিক অদ্ভুত কার্যকলাপের কথা ভেবে বেশ একটু অবাক হতে যাচ্ছি, পিছনে কংক্রিটের রাস্তায় জুতোর আওয়াজ পেলাম-খট খট খট। মুখ ফিরিয়ে দেখি পাতলা সিল্কের প্যান্টের সঙ্গে সিল্কের হাফশার্ট পরে বেশ দ্রুতপদে এগিয়ে আসছেন পরিচালক-অভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়া। সোজা এসে একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে হাতের ফাইলটা টেবিলের ওপর রেখে সশব্দে বসে পড়লেন বড়ুয়াসাহেব। রায়বাহাদুরের ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটের টিনটা সামনেই ছিল, তা থেকে একটা সিগারেট বার করে পরমানন্দে টানতে লাগলেন। পরিচয়ের সৌভাগ্য তখনও হয়নি, নীরব দর্শকের মতো শুধু চেয়েই রইলাম। চেয়ারটায় বেশ একটু নড়েচড়ে বসে রায়বাহাদুর বললেন, আপনার কি খোবর বড়ুয়াসাব?

সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বড়ুয়াসাহেব বললেন, আপনার এখানে ছবি করা আমার পোষাবে না রায়বাহাদুর!

শঙ্কিতভাবে রায়বাহাদুর বললেন, কেননা? কেন বলুন তো?

কালকে আমার চাঁদের কলঙ্কর শুটিং ছিল–মেয়ে-পুরুষ নিয়ে প্রায় দেড়শ একসট্রার দরকার। শুটিং করতে এসে দেখি মাত্র শ-খানেক লোক, তার মধ্যে মেয়েগুলোকে ধরে নিয়ে এসেছে টালিগঞ্জের বস্তি থেকে, চেহারা দেখলে চোখ বুজে আসে। আর ডায়লগ? সাতদিন ধরে চেষ্টা করলেও ওদের মুখ দিয়ে একটা কথা কওয়ানো যাবে না। একসট্রা সাপ্লায়ার হানিফকে জিজ্ঞাসা করতেই বলল, কী করব স্যার। রায়বাহাদুর প্রতি মেয়ে-পিছু তিন টাকা আর ব্যাটাছেলে এক টাকার বেশি পাস করতে চান না। তিন টাকায় তো আর কুমোরটুলি থেকে মেয়ে গড়িয়ে আনতে পারিনে। কী করব, বাধ্য হয়ে শুটিং প্যাক-আপ করে দিলাম।

ঝুঠা! একদম ঝুঠা বাত। সিংহের মতো গর্জন করে চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন রায়বাহাদুর। বুলাও নিমকহারাম হানিফকো!

কোথায় হানিফ? সে একটু আগে বেগতিক বুঝে য পলায়তি নীতি অনুসরণ করে সরে পড়েছে। রায়বাহাদুর হানিফের উদ্দেশে বেশ চোখা চোখা কতকগুলো গালাগালি বর্ষণ করে অপেক্ষাকৃত শান্ত কণ্ঠে বললেন, কী জানেন বড়ুয়াসাব, সব শালা চোর। ওরা যদি আমার সামনে এসে বলে যে ভাল মেয়ের দরকার বেশি টাকা না দিলে পাওয়া যাবে না, আমি কি দিতাম না? ভয়ে কেউ সামনে এসে কোনও কথা বলবে না। তাছাড়া আমি জানি। মেয়েদের ঐ তিনটাকার মধ্যে একটাকা দস্তুরি লিবে ঐ ব্যাটা হানিফ।

স্টুডিও ম্যানেজার বিজয় মুখুজ্যেকে ডেকে আর এক দফা বকাবকি করে পরের দিন বড়ুয়াসাহেবের শুটিং-এর সব বন্দোবস্ত পাকা করে রায়বাহাদুর বললেন, এই

যে আপনি সোজা আমার কাছে এসে সব বললেন এতে আমি খুশিও হল, আর চটপট সব ব্যবস্থা হয়েও গেল। ভয়ে কেউ আমার কাছেই আসবে না–কেন রে বাবা! আমি কি বাঘ আছি না ভাল্লুক আছি যে কাছে এলেই চট করে গিলে খেয়ে লিব। আমি সব বুঝি বড়ুয়াসাব, বুঝলেন? যারা কাছে না এসে দূর থেকে শুধু হুজুর হুজুর করে আর দোসরা আদমি দিয়ে কাজ বাগিয়ে নিতে চায়,সে শালারা চোর আছে। যারা অভাব-অসুবিধা হলে সোজা কাছে এসে সব খুলে বলে, তারা সাচ্চা আদমি আছে, মনে কোনো ঘোর-প্যাঁচ নাই।

কাজ শেষ করে খুশি মনে আর একটা সিগারেট ধরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে গটগট করে চলে গেলেন বড়ুয়াসাহেব।

এতক্ষণে সত্যিকার নজর পড়ল আমার দিকে। প্রকাণ্ড চেয়ারটায় হেলান দিয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে সিগারেট ধরাতে ধরাতে রায়বাহাদুর বললেন, আপনি? আপনি কী জন্য আমার কাছে এসেছেন?

সংক্ষেপে নাম-পরিচয় এবং আসার উদ্দেশ্য বললাম।

অন্য দিকে চেয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রায়বাহাদুর বললেন, নাম শুনেছি, আপনি তো ম্যাডানের আমলের বহুত পুরোনো আর্টিস্ট আছেন। বলুন, আমার

শকুন্তলা ছবিতে কত লিবেন?

একটু চুপ করে থেকে বললাম, দেখুন রায়বাহাদুর, অভাব আমার অফুরন্ত, চাইবার অধিকার আমাকে দিলে, অসম্ভব চেয়ে ফেলব। তার চেয়ে আপনি কত দেবেন বলুন। পোষায়, সোজা হা বলে রাজি হয়ে যাব। না পোয় তাও আপনাকে জানিয়ে দেব।

একটা বাজে কাগজের ওপর লাল পেন্সিল দিয়ে হিজিবিজি দাগ কাটতে কাটতে বললেন–ই, আপনার বুদ্ধি আছে।

ফিল্ম-লাইনে আসা অবধি আমার বুদ্ধির তারিফ এই প্রথম শুনলাম।

-দেখুন ধীরাজবাবু, আমি সিধা কথার মানুষ। তিন মাসের কনট্রাক্ট করব আপনার সঙ্গে, ছশো টাকা দিব।

-আমার পোষাবে না রায়বাহাদুর।

-কেন? ম্যাডানে তো আপনি অনেক কম মাইনেতে কাজ করেছেন?

-সত্যি কথা। কিন্তু সেটা ছিল নির্বাক যুগ, সবে ঢুকেছি লাইনে, আর তখন জিনিসপত্তর ছিল সস্তা। এখন চাল ব্ল্যাকে সত্তর-আশি টাকা দিয়ে কিনতে হয়–যার সংসারে দশ-বারোটি পোষ্য তার অবস্থাটা একবার ভাবুন তো, ঐ টাকাতে দুবেলা ডাল-ভাত জোটানোই কষ্টকর।

পেন্সিল থামিয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন রায়বাহাদুর। বললাম, বাড়িতে আধপেটা ডালভাত খেয়ে স্টুডিওয় এসে রাজা দুষ্মন্ত সেজে সোনার সিংহাসনে বসার মতো বিড়ম্বনা জীবনে আর কী থাকতে পারে বলুন তো!

মনে হল বৃহৎ উঁড়িটার সঙ্গে ঝুলেপড়া মুখের পুরু চামড়াগুলো বারকয়েক কেঁপে উঠেই তখুনি থেমে গেল। নিস্তরঙ্গ কালো দিঘির বুকে ছুঁড়ে ফেলা ছোট্ট একটা ঢিলের প্রতিক্রিয়ার মতো ক্ষীণ, ক্ষণস্থায়ী। টেবিলের ওপর আস্তে আস্তে পেন্সিলটা ঠুকতে ঠুকতে রায়বাহাদুর বললেন, কত টাকা পেলে রাজার মতো খেয়ে দেয়ে আপনি সিংহাসনে বসতে পারেন?

ঠাট্টা করছেন নাকি? যা থাকে কপালে, বললাম, বারোশো টাকা। কোনও কথা না বলে ফাইল থেকে একটু সাদা কাগজ টেনে নিয়ে লাল পেন্সিলে দিয়ে কী একটা লিখে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে রায়বাহাদুর বললেন, এ কাগজটা নিয়ে আফিসে ক্যাশিয়ারের কাছে চলে যান। সেখানে কনট্র্যাক্ট সই করে তিনশো টাকা অ্যাডভান্স নিয়ে বাড়ি গিয়ে রাজার মতো নাক ডেকে ঘুম দিন।

বা-র-শো টাকা। জীবনে এই প্রথম তিন মাসের পারিশ্রমিক একখানা ছবিতে বারশো টাকার কনট্রাক্ট। কাগজখানা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বসে ভাবছিলাম।

রায়বাহাদুর বললেন, ভাবছেন ছশো থেকে এককথায় বলে রাজি হলাম কেন? আপনি সোজা সত্যি কথা বললেন বলে। কোনো মুরুব্বি সঙ্গে এনে কায়দা করে টাকা বাড়ানোর চেষ্টা করলে, ছশোর একপয়সা বেশি দিতাম না।

ছোট্ট চিরকুটখানা হাতে নিয়ে স্বপ্নবিষ্টের মত আস্তে আস্তে আফিসের দিকে পা বাড়ালাম। এতখানি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম যে আসবার সময় রায়বাহাদুরকে নমস্কার করতেও ভুলে গেলাম।

দু-নম্বর ফ্লোর থেকে অফিসঘর বেশ খানিকটা দূর। কংক্রিটের পথ ধরে এগিয়ে চলেছি, হঠাৎ পিঠে কার হাত পড়তেই চমকে চেয়ে দেখি জ্যোতিষবাবু। চকিতে চারদিকে চেয়ে নিয়ে চুপিচুপি বললেন, কীহে, সুবিধে করতে পারলে কিছু?

কথা না বলে চিরকুটখানা চোখের সামনে মেলে ধরলাম। টাকার অঙ্ক দেখে বোয়াল মাছের মতো হাঁ করে জ্যোতিষবাবু বললেন, বা-র-শো টাকা! বল কী? আজই ঘন্টাদুয়েক আগে রায়বাহাদুর আমাকে বললেন, দুষ্মন্তের পার্টের জন্যে ছশশা টাকা এস্টিমেট। তার বেশি একপয়সাও দেবেন না। তুমি বুড়োকে যাদু করেছ নাকি?

হেসে বললাম, যাদু নয় ভেল্কিও নয়–আসল কথা কী জানেন, আপনারা বুড়োকে চিনতে পারেননি। স্পষ্ট, সোজা কথা ভালবাসে, আপনারা কাছে যেতেই সাহস পান না। তাই ওর ধারণা–|

বাধা দিয়ে জ্যোতিষবাবু বললেন, থাক থাক, তোমায় আর ব্যাখ্যা করে বলতে হবে না, কাছে গিয়ে যা-তা গালাগাল খাওয়ার চেয়ে দূরে থাকাই নিরাপদ।

যেখানে বাঘের ভয়–জ্যোতিষবাবুর ডাক পড়ল রায়বাহাদুরের কাছে। ভয় বিবর্ণ মুখে আস্তে আস্তে চলে গেলেন জ্যোতিষবাবু। একবার ভাবলাম, শুনে যাই ব্যাপার কী, আবার ভাবলাম, না কাজ নেই। পা চালিয়ে অফিসঘরের দিকে চলে গেলাম।

কত বিরুদ্ধ সমালোচনাই না শুনেছিলাম, এই অপ্রিয়দর্শন রাশভারি স্পষ্টভাষী রায়বাহাদুর সম্বন্ধে। হাড়কেপ্পন, দুর্মুখ। কুকুর-বেড়ালের চেয়েও খারাপ ব্যবহার করে বেতনভুক কর্মচারীদের ওপর, আরও কত কী। কিন্তু শকুন্তলার শুটিং উপলক্ষ্য করে মানুষটির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসে বুঝলাম, ঐ বিশেষণগুলো শুধু নির্জলা মিথ্যেই নয়, অপরাধী, ভীরু কর্মচারীদের মনগড়া সাফাই।

নিয়মিত দুবেলা স্টুডিওয় আসা রায়বাহাদুরের একটা নেশার মধ্যে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ভোর ছটায় এবং বিকেল পাঁচটায় স্টুডিওয় আসা চাই। ঝড়জল, শারীরিক অসুস্থতা, কিছুতেই এর ব্যতিক্রম দেখা যেত না। গাড়ি থেকে নেমেই মোটা লাঠিটা হাতে নিয়ে কংক্রিটের রাস্তা ধরে ঠকঠক করে সারা স্টুডিওটা ঘুরে দেখে এসে। দুনম্বর সাউন্ড স্টুডিওর সামনে ফুলবাগানে প্রকাণ্ড চেয়ারটায় বসে অভাব-অভিযোগ শুনতেন। দুবেলা ঐ একই প্রোগ্রাম। কোথায় গাছের একটা শুকনো পাতা পড়ে আছে, কোথায় কিছু ময়লা জমে রয়েছে, কিছুই ওঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এড়াত না। মালি থেকে শুরু করে সবাই দুটি বেলা রায়বাহাদুরের ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকত! ইন্দ্রপুরী তো ইন্দ্রপুরী, ঝকঝকে-তকতকে, পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন। সর্বত্র একটা লক্ষ্মীশ্রী বিরাজ করত।

জাপানি বোমার ভয়ে জনশূন্য কলকাতা। যারা কোনও মতে টিকে আছে, দুবেলা পেটভরে খাবার জোগানো কষ্টকর। চাল বাজার থেকে অদৃশ্য হয়ে চোরাকারবারিদের গুদামে আত্মগোপন করে সোনার দামে বিক্রী হচ্ছে। যাদের পয়সা আছে তাদের কথা ছেড়ে দিলাম। মুশকিল হল মধ্যবিত্ত-গৃহস্থ আর মজুর-গরিবদের নিয়ে। অনেকগুলো স্টুডিও কর্মীর অভাবে বন্ধ, শুধু ইন্দ্রপুরীতে এর ব্যতিক্রম দেখা গেল। ব্যাপার কী? অথচ অন্যান্য স্টুডিওর তুলনায় এখানে মাইনে কম। উত্তর পেতেও দেরি হল না। সেদিন শুটিং-এর পর গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি–দেখি স্টুডিওর গেটের কাছে বেশ ভিড়! কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, বাইরের লোক কেউ নয়, সব স্টুডিওর কর্মী–সেটিং মিস্ত্রী, কুলি, ঝাড়ুদার, মেথর, ড্রাইভার প্রভৃতি দাঁড়িয়ে জটলা করছে। একটু পরেই দেখি পাতালপুরীর অদৃশ্য চোরাকুঠুরি থেকে বেরিয়ে আসছে বস্তা বস্তা চাল-ডাল-আটা-ময়দা আর টিন ভর্তি ঘি। তারপর মাইনের হিসাবে সেগুলো বণ্টন শুরু হয়ে গেল কর্মীদের মধ্যে। শুনলাম যেদিন থেকে চোরাবাজারের সূত্রপাত হয়েছে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বাজার থেকে অদৃশ্য হয়েছে সেই দিন থেকে প্রতি সপ্তাহে ন্যায্য দামে এইগুলো দেওয়া শুরু হয়েছে রায়বাহাদুরের হুকুমে। একে সামান্য মাইনে, তাতে চারগুণ দামে ঐগুলো কিনে খেতে হলে ওদের কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে–তাই এ ব্যবস্থা।

পাতালপুরীর চোরাকুঠুরী সম্বন্ধে কিছু খুলে বলা দরকার। ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে গেট দিয়ে ঢুকেই ডান দিকে দেখা যাবে একতলা ঘর–প্রথমটা খাবার ঘর, পরেরটা অফিস, তার পরেরগুলো ভাড়াটে পার্টির আফিস, যারা স্টুডিও ভাড়া নিয়ে বাইরে থেকে এসেছে তাদের অফিস হিসাবে অমনি ঘর দেওয়া হয়েছে। এইরকম পাশাপাশি অনেকগুলো ঘরের পর বাড়িটা শেষ হয়েছে। শেষ ঘরটা কাউকে ভাড়া দেওয়া হয়না, সবসময় বন্ধ থাকে। ঐ ঘরটা খুললে দেখা যাবে নিচের দিকে কতকগুলো সিঁড়ি নেমে গেছে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেই আবার দেখা যাবে সারবন্দী ঘর। এইগুলোই পাতালপুরীর চোরাকুঠুরী। বাইরে থেকে দেখলে একতলা বাড়ি বলে মনে হলেও আসলে বাড়িটা দোতলা। শুনেছি নিছক খেয়ালের বশেই রায়বাহাদুর বাড়িটা তৈরী করিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ওর প্রয়োজন অসম্ভব বেড়ে গিয়েছিল। বর্তমানে ওখানে raw ফিল্মস্ আর নেগেটিভ স্টক করে রাখা হয়।

মেয়েদের রায়বাহাদুর অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। এই একটি ব্যাপারে কোনও তারতম্য ছিল না। বড় অভিনেত্রী থেকে ছোট একস্ট্রা মেয়েদের পর্যন্ত দেবী বলে ডাকতেন। ইন্দ্রপুরীর ফুলবাগান প্রসিদ্ধ। বড়, বড় টকটকে লাল গোলাপ ফুটে আছে কিন্তু কারও হাত দেবার হুকুম ছিল না। মেয়েদের বেলায় কিন্তু নিয়মের বা ঢিলে হয়ে যেত। যে কোন মেয়ে যদি সামনে গিয়ে বলতেন–ঐ ফুলটা আমার চাই, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মালিকে ডাকিয়ে ফুল তুলে নিজের হাতে খোঁপায় গুঁজে দিতেন।

একটা মজার ঘটনা বলি। জ্যোতিষবাবুর কাছে শোনা, কী একটা বাংলা ছবির শুটিং-এ সেদিন ইন্দ্রপুরী সরগরম। বিরাট সেট, সাতদিন সময় লেগেছে তৈরি করতে। অহীন্দ্র চৌধুরী, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, কার্তিক দে প্রভৃতি বড় বড় শিল্পীদের শুটিং হচ্ছে, সঙ্গে প্রায় একশ একসট্রা। সেদিন একটু সকাল-সকাল এসে পড়েছেন রায়বাহাদুর, জ্যোতিষবাবু অনেক করে বলে শুটিং দেখাতে নিয়ে চলেছেন রায়বাহাদুরকে। এমনিতে শুটিং-ফ্লোরে বড় একটা দেখা যেত না রায়বাহাদুরকে সবাই বেশ অবাক হয়ে দূর থেকে পিছনে পিছনে চলেছে। দুনম্বর ফ্লোরটা জুড়ে রাজসভার সেট, ফ্লোরে ঢোকবার আগে থেমে গিয়ে রায়বাহাদুর জিজ্ঞাসা করলেন, আজ কার শুটিং হচ্ছে? অর্থাৎ নামকরা শিল্পীদের মধ্যে কে কে আছেন।

জ্যোতিষবাবু মহা উৎসাহে বলে গেলেন আর্টিস্টের নাম। সব শুনে রায়বাহাদুর বললেন–আজ দেবীলোগ কে কে আছেন?

জ্যোতিষবাবু বেশ ভড়কে গিয়ে বললেন, আজ্ঞে রাজসভার শুটিং, এখানে দেবীরা কেউ নেই।

–দেবীলোগ নেহি হ্যায় তো খালি ষাঁড়কা শুটিং ক্যা দেখেঙ্গে? বলেই এ্যাবাউট টান করে ফিরে গিয়ে ফুলবাগানে নিজের চেয়ারটায় বসে পড়লেন রায়বাহাদুর।

মেয়েদের ব্যাপারে একেবারে মুক্তহস্ত ছিলেন রায়বাহাদুর। কোনও মহিলা-শিল্পী কিছু চেয়ে পায়নি, এ রকম বদনাম অতি বড় শত্রুরাও দিতে পারবে না।

আর একদিনের ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন শকুন্তলার শুটিং হচ্ছিল। বিরাট রাজসভা, পাত্র-মিত্র-পরিষদ নিয়ে সিংহাসনে বসে আছি দুষ্মন্ত সেজে, সামনে তাপস-বালকের মাঝে শকুন্তলা আত্মপরিচয় দিচ্ছেন। স্মৃতিভ্রষ্ট রাজা চিনতে পারছে না। এই সিনটা নেবার তোড়জোড় চলছিল। একবার, দুবার মনিটার হয়ে গেল, এইবার টেক। মেক-আপ ম্যানকে ডেকে সবাই নিজে-নিজে মেক-আপ ঠিক করে নিচ্ছি, একজন চিৎকার করে ছুটে এসে বলল, শুটিং বন্ধ করে দাও, রায়বাহাদুরের হুকুম।

বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো নিমেষে সমস্ত ফ্লোরটা স্তব্ধ হয়ে গেল। এ লোজন, এত অর্থব্যয় করে আজকের শুটিং বন্ধ করা মানে অনেক টাকা লোকসান।

দেখি জ্যোতিষবাবু রীতিমত ভয় পেয়ে আস্তে আস্তে ফ্লোর ছেড়ে বাইরে চলেছেন, সিংহাসন ত্যাগ করে সঙ্গ নিলাম। বাইরে এসে দেখি এক নম্বর ফ্লোরের উত্তর প্রান্তে কাঁচের পার্টিশন দেওয়া রায়বাহাদুরের অফিসের সামনে সমস্ত স্টুডিও ভেঙে লোক জড়ো হয়েছে। এমনিতে রায়বাহাদুর বাইরে বসেই কাজকর্ম করতেন, বিশেষ প্রয়োজন না হলে পার্টিশন দেওয়া অফিসঘরে ঢুকতেন না। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলাম। দূর থেকে দেখি অফিসঘরে রায়বাহাদুরকে ঘিরে বসে রয়েছেন কজ্জন বাঈ, আখতারি বেগম, পেসেন্স কুপার আর মিস্ বোজ। খোশমেজাজে রায়বাহাদুর কী একটা বলছেন আর ওরা হেসে এ-ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ছে। ব্যাপার কী? কেউ বলতে পারে না, সবাই আমার মতো অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্ধকারে আলো দেখতে পেলাম। কাঁচের দরজা খুলে ক্যাশিয়ারবাবু হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলেন, সবাই ঘিরে ধরল তাকে। একটু পরে আসল ব্যাপারটা জানতে পারলাম। ঝরিয়া, ধানবাদ প্রভৃতি অঞ্চলে অনেকগুলো কয়লার খনি আছে রায়বাহাদুরের। এরই মধ্যে একটা খনি থেকে কিছু আগে টেলিগ্রাম এসেছে কয়লা খুঁড়তে খুঁড়তে সোনা বেরিয়েছে, কয়লার খনি রায়বাহাদুরের ভাগ্যে সোনার খনি হয়ে উঠেছে। আরও শুনলাম, স্টুডিওর সবাইকে চার মাসের মাইনে বোনাস দেওয়ার হুকুম হয়েছে। শুটিং হঠাৎ বন্ধ হবার কারণ এতক্ষণে বুঝতে পারলাম।

পরের ঘটনা আরও বিস্ময়কর। টেলিগ্রাম যখন আসে, তখন কজ্জন বাঈ প্রভৃতি চারজন নায়িকা রায়বাহাদুরের ঘরে বসেছিল। খবর শুনে ওরা সবাই এক-একখানা নতুন মোটরগাড়ির বায়না ধরে। তখনি রাজি হয়ে টেলিফোনে চারখানা নতুন গাড়ির অডার দিয়ে বসে আছেন রায়বাহাদুর। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই গাড়িগুলো স্টুডিওয় এসে যাবে। অবাঙালি নায়িকাদের এত উচ্ছ্বাসের কারণও এতক্ষণে বুঝতে পারলাম।

দানবীর ওই অসাধারণ মানুষটির কথা একমুখে বলে শেষ করা যায় না। আমার দীর্ঘ নায়ক জীবনে রুস্তমজীর মতো ঐ অদ্ভুত মানুষটিও চিরদিন স্মৃতির ভাণ্ডারে উজ্জ্বল হয়ে আছেন ও থাকবেন। চেষ্টা করেও কোন দিন ভুলতে পারব না।

স্টুডিও ইন্দ্রপুরী আজও আছে, শুটিং হয় রোজ। অগণিত লোকজনের কলহাস্য, গানে আজও ওর আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। সবই আছে, নেই শুধু লক্ষ্মীশ্রী, নেই সে ছিমছাম পারিপাট্য। মাত্র একটি মানুষের অভাবে সব থেকেও যেন কিছু নেই।

আজও শুটিং শেষে জনকোলাহল শান্ত হয়ে যখন স্তব্ধতা নেমে আসে ইন্দ্রপুরীর বুকে–আস্তে আস্তে পাঁচ নম্বর ফ্লোরের দক্ষিণদিকের কংক্রিট রাস্তার সামনে গিয়ে পুবমুখো হয়ে দাঁড়ালে স্পষ্ট চোখের সামনে ভেসে ওঠে, মোটা লাঠি ঠকঠক করে বিরাটকায় রায়বাহাদুর গজেন্দ্রগমনে চলেছেন একা ঐ রাস্তা বেয়ে। মাঝেমধ্যে থমকে দাঁড়িয়ে শুকনো পাতা বা একটু আবর্জনা দেখে লাঠি ঠুকে চিৎকার করে বলছেন, কোথায় সেই চোরের সর্দার উছুবা মালি, মেথর নাথুরাম? সব শালা নেমকহারাম, বসে-বসে মাইনে খাবে আর কাজে ফাঁকি দেবে, সব শালাকে আজ ঝেটিয়ে বিদেয় করে দেব।

আজও উছবা মালি, নাথুরাম মেথর ইন্দ্রপুরীতে রয়েছে, নেই শুধু ঝেটিয়ে বিদায় করবার লোকটি। সবাইকে বহাল রেখে সে নিজেই আগে বিদায় নিয়ে চলে গেছে। অজান্তে চোখের ভারী পাতা দুটো বুজে আসে, চেষ্টা করেও চেয়ে থাকতে পারি না।

.

আমার জীবন নদীতে জোয়ার নেই, শুধু ভাঁটা। অনাদি-অনন্তকাল ধরে একঘেয়ে মিনমিনে জলস্রোত বয়ে চলবে লক্ষ্যহীন, উদ্দ্যেশ্যহীন পথভোলা পথিকের মতো। বাঁকের মুখে ক্ষণিক থমকে দাঁড়াবে, আবার চলতে শুরু করবে গতানুগতিক রাস্তা ধরে। এ নদী শুকিয়ে চড়া পড়ে গেলেও জোয়ার কোনদিন আসবে না, এই বোধ হয় নিয়তির বিধান।

দীর্ঘ নায়ক জীবনে কত ছবিতেই না অভিনয় করলাম। অধিকাংশ মনে রাখবার মতো না হলেও তার মধ্যে কয়েকটি সত্যিই উল্লেখযোগ্য অভিনয় করেছিলাম। যথা–রাজগী, অভিনয়, অভয়ের বিয়ে, রাজকুমারের নির্বাসন প্রভৃতি, কিন্তু তাতে হল কী? শুধু বাঁকের মুখে ক্ষণিক থমকে দাঁড়িয়ে জোয়ারের স্বপ্ন দেখা, তারপর আবার যে তিমির সেই তিমিরে। চেনা-অচেনা অসংখ্য পরিচালককে করজোড়ে অনুরোধ করেছি, দয়া করে আমাকে অন্য ধরনের একটা ভূমিকা দিয়ে দেখুন। আমি আপনাদের নিরাশ করব না। আমার অভিনয় ক্ষমতার ওপর আস্থা করে কেউই লক্ষ্মণের গণ্ডি ডিঙোতে সাহস পেলেন না। রাঙামূলো ভালমানুষ নায়ক দ্বিতীয় আর কেউ তখন নেই, অথচ ঐ রকম একটা মাকাল ফল নইলে বাংলা ছবি চলে না–তাই আমাকে নেওয়া।

নিউ থিয়েটার্সের হয়ে বাংলা চণ্ডীদাস ও হিন্দি পুরাণ ভকত ছবি তুলে সারা ভারতব্যাপী খ্যাতিলাভ করেছেন পরিচালক দেবকী কুমার বসু। ইস্ট ইন্ডিয়ার হয়ে এবার তিনি তুলবেন বাংলায় ও হিন্দীতে নিজস্ব কাহিনী সোনার সংসার। হিন্দীর জন্য শিল্পী বোম্বাই থেকে আগেই ঠিক করে এসেছেন, বাংলায় বাংলাদেশের ছোট-বড় সব শিল্পীকেই নিয়েছেন। শুধু বাকি আছে সুদর্শন তরুণ নায়কের ভূমিকাটি। কেন বলতে পারি না, দেবকীবাবু আমাকে একটু স্নেহের চোখে দেখতেন। নিউ থিয়েটার্সে চণ্ডীদাসের ভূমিকা আমায় দেবেন বলে ভয়েস, ক্যামেরা সব টেস্ট সন্তোষজনক হওয়া সত্ত্বেও আভ্যন্তরীণ কয়েকটি গূঢ় কারণে তখন আমায় নিরাশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এবার নির্বিবাদে আমাকে নায়কের ভূমিকায় নির্বাচন করলেন। ধন্য হয়ে গেলাম–আশা-মরীচিৎকার ছলনায় নতুন করে চলার পথের কল্পনায় মেতে উঠলাম। দীর্ঘ বাঁকের মুখে ভাটার টান অনেকক্ষণ ধরে বন্ধ হয়ে আছে, দূরে জোয়ার আসার অস্ফুট কলধ্বনিও শুনতে পেলাম যেন।

ইতিমধ্যে আরও অনেকগুলো ছবি মুক্তি পেয়েছে, ইচ্ছে করেই সেগুলোর উল্লেখ করলাম না। কাগজের সমালোচনা আর পড়বার দরকার হয় না, না পড়েই বুঝতে পারি কী লিখছে ওরা আমার সম্বন্ধে। আমার বন্ধুভাগ্য হিংসা করবার মতো। কোথায় কোন্ পত্রিকায় গালাগাল দিয়ে লিখেছে আমার নামে, লাল পেন্সিল দিয়ে লাইনগুলো আন্ডারলাইন করে বাড়ি এসে আমার সামনে সেটি মেলে ধরে বন্ধুবর বললেন, দ্যাখ ব্যাটাদের কাণ্ড, কেন আমরাও তো ছবি দেখেছি, অত খারাপ তো হয়নি। কিন্তু দৈবাৎ যদি কোনও ছবিতে সামান্য প্রশংসা করে লিখেছে, সেটা আমার বন্ধুর হয় পড়ে না, নয়তো ইচ্ছে করেই অবজ্ঞার ভান করে। যাক সে কথা।

সমস্ত স্টুডিওর উত্তরদিকের মাঠটা জুড়ে বস্তির সিন তৈরি শুরু হয়েছে। শুনলাম সত্যি-সত্যি একটা বস্তি তৈরি হবে, সময় লাগবে পনেরো কুড়ি দিন।

এরমধ্যে একদিন সবাইকে ডেকে দেবকীবাবু গল্পটি শুনিয়ে দিলেন। চমৎকার গল্প, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত নাটকীয় সংঘাতে পরিপূর্ণ কাহিনী, অন্তত বাংলাদেশের সর্বস্তরের দর্শকের মন-প্রাণ হরণ করবার সম্ভব-অসম্ভব এত প্যাঁচের ছড়াছড়ি এর আগে আর কোন ছবিতে দেখা যায়নি। একটু নিরুৎসাহ হলাম, আমার ভূমিকাটি লখিন্দরের এক ধাপ উঁচু সংস্করণ। অনাথ ছেলে, ছেলেবেলা থেকে অপরের দয়ায় নির্ভর করে লেখাপড়া শিখে যৌবনে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ে বস্তিতে। বস্তি তো নয়, মানুষের চিড়িয়াখানা–সেইখানে কয়েকটি উন্মাদ যুবকের আড্ডায় এসে আস্তানা গাড়ল অনাথ রঘুনাথ। ঐ বস্তিরই অপর একটি ঘরে থাকে একটি অসহায় মেয়ে। রঘুনাথ ভালবাসল তাকে। তারপর হৈ-হুঁলোড়ের মধ্যে ওদের প্রেম আরও ঘনীভূত হয়ে উঠল, শেষকালে এক নাটকীয় মুহূর্তে রঘুনাথ ফিরে গেল বাবা-মার কাছে, সবাই মিলে বরণ করে নিয়ে এল বস্তির মেয়েটিকে রঘুনাথের বধূরূপে। ছবির শেষ এইখানেই।

পরিচালক দেবকী বসুর সঙ্গে কাজ করে একটা জিনিস বিশেষভাবে লক্ষ্য করলাম। যে কোনও অভিনেত্রীর পক্ষে দেবকীবাবুর ছবিতে নায়িকা হওয়া ভাগ্যের কথা। ঐ একটিমাত্র চরিত্রকে কেন্দ্র করে মন-প্রাণ ঢেলে তিনি গল্পের জাল বুনে চলেন। ফলে অন্যান্য চরিত্র নায়িকার পাশে বেশ কিছুটা নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। তা হোক–তাতে ছবির আকর্ষণ কমে না, বাড়ে। দেবকী বসু পরিচালিত অধিকাংশ ছবিতে এটি বিশেষ লক্ষণীয়।

মেট্রো সিনেমায় এমিল জেনিংস-এর প্রথম ইংরেজি সবাক ছবি রু এঞ্জেল মুক্তি পেল। নির্বাক যুগে এই অসাধারণ শক্তিধর অভিনেতার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে বিস্মিত হয়েছিলাম, তার প্রথম কথা-কওয়া ছবি দেখবার লোভ সামলাতে পারলাম না। অপূর্ব ছবি, অভিভূত হয়ে গেলাম। ছবি শেষ হয়ে গেলেও চুপ করে চেয়ারে বসে আছি। অসংখ্য ভিড়, ভাবলাম ভিড় কমে গেলে একটু পরে নিচে নামব। কানে তখনও বাজছিল মারলিন ডিয়েট্রিচের সেই বিখ্যাত গান–ফলিং ইন লাভ এগেন। আর চোখে ভাসছিল ভীত অবহেলিত এমিলের পথ দিয়ে ছুটে পালানো–। তন্ময় হয়ে বসেছিলাম। একটু পরে চারদিকে চেয়ে দেখি উপরে আর কেউ নেই, সবাই নেমে চলে গেছে। আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছি, কানে এল, ছোড়দা!

আজও মনে আছে চমকে রেলিংটা ধরে পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। চাইতে সাহস হচ্ছিল না। বছর তেইশ-চব্বিশের একটি লাবণ্যময়ী সুন্দরী মেয়ে নিচের লবিতে আস্তে আস্তে সিঁড়ির কাছে এগিয়ে এসে বললে, ছোড়দা, আমি রিনি! নাম না বললে, সত্যিই চেনা একটু কষ্টকর হত আমার পক্ষে। কয়েক বছরে কী বিস্ময়কর পরিবর্তন হয়েছে রিনির! অবাক হয়ে চেয়ে আছি, রিনি বলল, আমার ওপর রাগ করেছ ছোড়দা?

তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে রিনির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বছরপাঁচেকের একটি ফুটফুটে ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে রিনি, হেসে ছেলেটিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করলাম–ছেলের সঙ্গে তো আলাপ হল, ছেলের বাপ কই?

কিছুদূরে একটা সোফায় বছর সাতাশ-আঠাশের মিশমিশে কালো একটি যুবক গম্ভীর মুখে আমাদের দিকে চেয়ে বসে আছে দেখলাম। রিনি কাছে গিয়ে কী একটা বলতেই গম্ভীর মুখে উঠে এসে হাত তুলে নমস্কার করল। সাত-আট বছর আগে রিনির বিয়ের খবরটা শুনেছিলাম, কাকা সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবার ভয়ে নেমন্তন্ন করেননি। বললাম, অনেকদিন তোদের কোনও খবর রাখি না রিনি, যাক আজ তোদের দেখে খুব খুশি হলাম।

রিনির শ্বশুরের অবস্থা ভাল, কলকাতায় নিজস্ব বাড়ি-গাড়ি আছে। স্ট্র্যান্ড রোডে মস্ত বড় লোহা-লক্কড়ের দোকান। ছেলেটি লেখাপড়া বেশিদূর না করলেও বেশ পাকা ঝানু ব্যবসাদার, পৈত্রিক দোকান সে-ই দেখাশুনা করে। আমাদের এই ঘরোয়া আলোচনার মধ্যেই রিনির স্বামী গম্ভীর মুখে দূরে সরে গিয়ে লবিতে ঝোলানো একটা ছবির দিকে চেয়ে পিছন ফিরে দাঁড়াল। সত্যি কথা বলতে কি, রিনির স্বামীকে প্রথম থেকেই আমার ভাল লাগেনি। জিজ্ঞাসা করলাম, হারে পাল হোয়াইট, সত্যি বলতে, এ বিয়েতে তুই সুখী হয়েছিস?

ঠোঁটদুটো যেন একটু কেঁপে উঠল রিনির, তাড়াতাড়ি আমার ওপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ছেলেটার চুলের মধ্যে আঙুল দিয়ে আদর করার আড়ালে নিজেকে সামলে নিয়ে জোর করে হাসি এনে বলল, ওরা স্বভাব নৈকষ্যকুলীন, ঠিক বাবা যেমনটি চেয়েছিলেন। আর বলতে পারল না রিনি, চোখ ছলছলিয়ে এল।

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। রিনি বলল, ফাঁকি দিয়ে বিয়ে করলে ছোড়দা, আমাদের খাওয়া পাওনা আছে।

আমাদের অর্থে কার কথা বলতে চাইছে রিনি বুঝতে পেরে বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। একটু পরে রিনি আবার বলল, গোপাদির কাছে আমি বাজি হেরে গেছি ছোড়দা!

সব বুঝেও অজ্ঞতার ভান করে বললাম, কিসের বাজি?

আবার চোখ দুটো ম্লান হয়ে গেল রিনির, অন্য দিকে চেয়ে বলল…তোমার বিয়ের বাজি। আমি বলেছিলাম, আমার ছোড়দা কোনওদিনই বিয়ে করবে না। গোপাদি হেসে বলেছিল, পুরুষ মানুষকে তোমার এখন চিনতে দেরি আছে রিনি, অল্পদিন হলেও যেটুকু চিনেছি তাতে আমি বলছি চিরকুমার তোমার ছোড়দা থাকবে না। এই নিয়ে বাজি।

একটা কিছু বলার দরকার, তোমার গোপাদি ঠিকই বলেছেন তিনি। ব্যথাভরা চোখ দুটো দিয়ে আমার অন্তস্তল পর্যন্ত দেখে নিতে চায় রিনি। ওর দিকে চাইতেও ভয় হচ্ছিল। লবির পশ্চিমদিকের দেওয়ালে ক্লার্ক গেবেলের প্রকাণ্ড ছবিটার দিকে চেয়ে রইলাম। ক্লার্ক গেবেলের মুখে দুষ্টুমি হাসি। চোখ ফিরিয়ে উত্তর-পশ্চিম কোণে চাইলাম, রহস্যময়ী গ্রেটার ছবি, রাজ্যের বিরহ ব্যথা বুকে চেপে মুখে মানুষকে ধোকা-দেওয়া হাসি। রিনি বলল, গোপাদির মা-বাবার মৃত্যুর খবর তুমি জানতে ছোড়দা?

ঐদিকে চেয়েই বললাম, বাবার মৃত্যুর খবর কাগজে দেখেছিলাম…মায়ের খবর পাইনি।

–মাত্র একবছরের মধ্যেই গোপাদি মা-বাবা দুজনকেই হারায়, এম. এ. পরীক্ষার তখন মাত্র দুমাস বাকি। কত করে বললাম, কিছুতেই পরীক্ষা দিল না গোপাদি। তারপর ছমাসের মধ্যেই জমি-জমা বিক্রি করে, বাড়িটা ভাড়া দিয়ে ট্রাস্টি-অ্যাটর্নির সঙ্গে সব ব্যবস্থা করে বিলেত চলে যায়। সেও আজ ছ-সাত বছরের কথা।

মেট্রোর আগামী আকর্ষণ বাইবেলের ঘটনা নিয়ে কী একটা বিরাট জমকালো প্রডাকসনের রঙিন ব্যানার প্রবেশপথের মাথার ওপর ঝোলানো। কী নাম ছবিটার, কে অভিনয় করেছে, কার প্রডাকসন কিছুই মনে নেই, প্রাণহীন চোখে সেই দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। দুপা এগিয়ে কাছে এসে রিনি বলল, প্রতি মাসে যেখানেই থাকুক না কেন, একখানা করে চিঠি পোপাদি আমাকে লেখে। প্রত্যেক চিঠিতে তোমার কথা থাকে। ছোট্ট একটা লাইন, তোমার ছোড়র খবর কী রিনি! বহুদিন তোমার খবর রাখি না। আন্দাজে লিখে দিই, ছোড়দা ভালই আছে, বাংলাদেশের একচ্ছত্র নায়ক।

ছেলের হাত ধরে রিনির স্বামী গম্ভীর অপ্রসন্নমুখে কাছে এসে দাঁড়ায়। একনজর চেয়ে বেশ বুঝতে পারি, আমার মতো বিখ্যাত লোকের সঙ্গে স্ত্রীর এতখানি ঘনিষ্ঠতা ভদ্রলোক মোটই ভাল চোখে দেখছেন না। আস্তে আস্তে রিনি বলে, গোপাদির প্যারিসের ঠিকানাটা নেবে ছোড়দা? ভ্যানিটি ব্যাগটা খুলে কী যেন খুঁজে বার করবার চেষ্টা করে রিনি।

অম্লানবদনে বললাম, না!

অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে রিনি বলল, না?

–হ্যাঁ। ঠিকানা নিলেও আমি হারিয়ে ফেলব রিনি। তার চেয়ে তোর কাছেই থাক। বিস্ফারিত চোখে রাজ্যের হতাশা ও ব্যথা নিয়ে তাকিয়ে রইল রিনি, কোনও দিকে না চেয়ে প্রকাণ্ড দরজাটা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম।

ভিতরে ঠাণ্ডা, বাইরে গরম। সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখতে-দেখতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাবার মতো। বাইরের লবিতে অসম্ভব ভিড়। কোন রকমে ঠেলেঠুলে রাস্তা ক্রস করে ধর্মতলা ট্রাম টার্মিনাসের কাছে এসে দাঁড়ালাম। ট্রামেও ভিড়, দু-তিনখানা ট্রাম ছেড়ে দিয়ে মাঠে মনুমেন্টের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। আজ আর ভিড় সহ্য করতে পারছিলাম না, একটু নির্জনতা, মানুষের নিষ্ঠুর দৃষ্টিসীমার বাইরে তা সে যেখানেই হোক, একটুখানি একা থাকতে চাই। ঘুরেফিরে বারে বারে রিনির কথাটাই মনটাকে তোলপাড় করে তুলছিল। সেই সদাহাস্যময়ী চঞ্চলা রিনির এ কী মূর্তি দেখে এলাম। হাসতে ভুলে গেছে রিনি। শুধু কৌলীন্যপ্রথা বজায় রাখতে জেনেশুনে একটা লৌহদানবের সঙ্গে ফুলের মতো রিনিকে লোহার শৃঙ্খলে বেঁধে দিয়েছেন কাকা! রামগরুড়ের ছানার মতো কোনদিন ভুলেও না-হাসবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে যারা পৃথিবীতে এসেছে শুধু পয়সা রোজগারের জন্য, তাদের সংসারে রিনির মতো মেয়ে সারা জীবন কাটাবে কী সম্বল করে? মনে পড়ল ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধে গাড়ির মধ্যে গোপার মায়ের কথা, গরীব হলেও ক্ষতি ছিল না, শুধু তুমি যদি নৈকষ্যকুলীন হতে, আর বায়োস্কোপে অভিনয় না করতে। সারা দেহ-মন বিদ্রোহী হয়ে উঠল। মনে হল চিৎকার করে বলি, এই ভণ্ড ব্রাহ্মণসমাজে জাতের নামে বজ্জাতি আর কতদিন চলবে? ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দিয়ে দুনিয়ার দরবারে এদের সত্যিকার আসন নির্দেশ করতে আর কতদিন লাগবে ভগবান?

অন্ধকার নির্জন গড়ের মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটেই চলেছি। খুব কাছে কে একজন বলে উঠল, আরে কে যায়! ধীরাজ না?

অনিচ্ছার সঙ্গে দাঁড়ালাম। উঠে এসে একেবারে মুখের কাছে মুখ নিয়ে মনমোহন বলল, অন্ধকার মাঠের মধ্যে একা চলেছিস কোথায়?

বললাম, চুলোয়! তুই বা এখানে বসে করছিস কী?

একটা কাগজের ঠোঙা আমার হাতে তুলে ধরে মনমোহন বলল, চিনেবাদাম খাচ্ছি, খাবি?

সামনে কিছু দূরে আর একজন কে বসে রয়েছে দেখলাম। চিনেবাদামের ঠোঙাটা হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললাম, তোর সঙ্গে আর কেউ আছে নাকি?

দাঁত দিয়ে কড়মড় করে একটা বাদামের খোলা ভাঙতে ভাঙতে মনমোহন বলল, ও আমার বন্ধু দ্বারিক, তিনটের শোতে মেট্রোয় বু এঞ্জেল দেখতে গিয়েছিলাম।

বললাম, আমিও তো গিয়েছিলাম, কিন্তু তোদর তো দেখতে পাইনি।

-বাহ্যজ্ঞান থাকলে তো দেখতে পাবি! ওরকম একটা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে প্রেমালাপ করতে গেলে আমাদের মতো লোককে চোখে না দেখাই স্বাভাবিক।

কাধ ধরে একটা ঝকানি দিয়ে বললাম, কোনও মেয়ের সম্বন্ধে সঠিক কিছু না জেনে এ ধরনের রিমার্ক ভবিষ্যতে আর কখনও করিসনে মনু। মেয়েটি আমার বোন, রিনি। রিনি ও গোপার কথা কিছু কিছু বলেছিলাম মনমোহনকে। লজ্জায় এতটুকু হয়ে মাপ চাইল মনমোহন। প্রসঙ্গ চাপা দেওয়ার জন্য হেসে বললাম, চল, তোর বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিবি, চল।

দ্বারিক পাল অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। ফিল্মে ক্যামেরার কাজ শিখতে চায়, তাই মনমোহনকে মুরুব্বি পাকড়ে সিনেমা, রেস্তোরাঁ প্রভৃতি বেপরোয়া খরচ করে চলেছে। চিনেবাদামের ঠোঙা শেষ করে পকেট থেকে ডালমুটের একটা ঠোঙা বার করে খেতে খেতে অভিজ্ঞ শিক্ষকের মতো স্টুডিও সম্বন্ধে সারগর্ভ উপদেশ দিতে শুরু করে মনমোহন। তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে ভবিষ্যতে ক্যামেরাম্যান হওয়ার স্বপ্ন দেখে ধনী পিতার একমাত্র ছেলে দ্বারিক পাল।

ভাল লাগে না, মন চাইছে একান্ত নির্জনতা। এরই মধ্যে একাকে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, চলি।

অবাক হয়ে মনমোহন বলে, এরই মধ্যে? আজ তোর হয়েছে কী?

বললাম, দেহ-মন দুটোই আজ একসঙ্গে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, ফলং আজ রাতে নিদ্রা নাস্তি।

হাসতে গিয়ে ডালমুটের বিষম খেয়ে খানিক কেশে নিল মনমোহন। তারপর বলল, জানি, কিন্তু সেদিক দিয়েই আজ আমি যাব না। ভাল কথা, তোর গিন্নি কোথায়?

বললাম, পিত্রালয়ে। কেন, গিন্নির পিত্রালয়ে থাকার সঙ্গে আমার নিদ্রাহীনতার কোনও ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র আবিষ্কার করেছিস নাকি?

হঠাৎ গম্ভীর হয়ে মনমোহন বলল, তোর জন্যে সত্যিই দুঃখ হয় ধীরাজ। ভাগ্যদেবতার ত্যাজ্যপুত্র হয়ে তোর সারা যৌবনটাই প্রায় দুঃখ আর নৈরাশ্যের মধ্যে দিয়ে কাটল।

হেসে ফেললাম, মনমোহনের মতো ছেলে যখন স্বভাবসিদ্ধ হাসি চেপে গম্ভীর হয়ে পাকা দার্শনিকের মতো চোখা চোখা ধর্মের বুলি আওড়ায় তখন কী জানি কেন আমার গসি পায়।

ক্ষুণ্ণ হল মনমোহন, বেশ একটু বিরক্ত হয়েই বলল, আজকের খেয়ালি দেখেছিস? মাথা নাড়লাম। তখনকার দিনে বহুলপ্রচারিত সিনেমা সাপ্তাহিক খেয়ালি। মনে ভাবলাম, নতুন আর কী লিখবে, হয়ত আমার কোনো ছবিকে উপলক্ষ্য করে গালাগালি দিয়েছে। মনমোহন বলল, দেখলে হাসি আসত না। আমার কথা শুনে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতিস।

ভয়ে ভয়ে বললাম, কোন্ ছবিটা নিয়ে আমায় গালাগালি দিয়েছে রে?

–ছবি নয়, এবার ব্যক্তিগত আক্রমণ। তোমাকে খোলা চিঠি দিয়েছে। বলতে বলতে পকেট থেকে ভাজ করা একখানা খেয়ালি বার করে সামনে মেলে ধরল মনমোহন। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাই না। মনমোহন বলল, পকেটে করে বাড়ি যাও, রাত্রে পড়ে দেখ। তবে হ্যাঁ, এও বলি, এ ধরনের নোংরা মনোবৃত্তি নিয়ে যারা পত্রিকায় সমালোচকের আসন কলঙ্কিত করে, তাদের প্রকাশ্যে চাবকানো উচিত। নয়তো আদালতের সাহায্য নিয়ে মানহানির মামলা করে শিক্ষা দেওয়া দরকার।

রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠেছে মনমোহন, বুঝলাম ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দেবার মতো নয়। আবার ভাঁজ করে খেয়ালিটা পকেটে পুরে দ্বারিক পাল ও মনমোহনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ট্রামরাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। ট্রাম স্টপেজে যখন এসে পৌঁছলাম, হোয়ায়িটওয়ে লেডলর বড় গোল ঘড়িটায় তখন প্রায় রাত্রি সাড়ে নটা বাজে।

.

শেষ এখানে হয় না; অনাদ্যনন্তকাল ধরে চলবে আমার যোগসূত্রবিহীন নায়কজীবনের একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যানানি,তাই ইচ্ছে করেই ছেদ টেনে দিয়েছি। কত আশা, কত আকাঙ্ক্ষা নিয়েই না নায়ক হবার স্বপ্নে দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়েছিলাম, কিন্তু কী পেলাম? না পেলাম পয়সা, না হল খ্যাতি যশ। শুধু সামাজিক অবজ্ঞা ও অপযশের মালা গলায় বুলিয়ে একঘেয়েমির স্রোতে ভেসে চলেছি। নিজের কাছেই যখন এই ব্যর্থ জীবনটার কোনও মূল্যই রইল না, তখন অপরের কাছে কী-ই বা আশা করতে পারি?

 মনমোহনের কাছ থেকে ভাঁজ করা খেয়ালিটা পকেটে করে বাড়ি এসে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলাম। স্ত্রী দীর্ঘদিন বাদে পিত্রালয়ে গেছেন। সেদিক দিয়ে খুব রক্ষে, নইলে এত বড় একটা পাথর বুকে চেপে মুখে হাসির অভিনয় করা অসম্ভব হত।

সম্পাদকীয় মন্তব্যের পরেই খুব বড় বড় হরফে লিখেছে, ভোলা চিঠি-ধীরাজ ভট্টাচার্যকে। চিঠিটার সঠিক ভাষা মনে না থাকলেও মূল বক্তব্যটা আজও স্পষ্ট মনে আছে, ওহে অপদার্থ মাকাল ফল! আর কতদিন তুমি ফিল্মলাইনে থেকে আমাদের ধৈর্যের ওপর কশাঘাত করবে?তুমি বিদায় নাও। তোমার ঐ ড্যাবডেবে চোখের চাহনি আর যে আমরা সহ্য করতে পারছি না। অভিনয় করবার ক্ষমতা না দিয়ে ভগবান তোমায় রাঙা-মুলোর মতো শুধু খানিকটা বাহ্যিক চাকচিক্য দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তাই মাঝেমাঝে তোমার জন্য আমাদের দুঃখ হয়। অবশ্য এটুকু ভেবে

তুমি কিঞ্চিৎ সান্ত্বনা পেতে পার যে, তোমার দীর্ঘ নায়কজীবনে একশ্রেণীর দর্শকের চিত্ত জয় তুমি করেছ, তারা হল কতকগুলো অপরিণামদর্শী স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়ে আর মফস্বলের ধর্মান্ধ একশ্রেণীর দর্শক। এদের কাছে তোমার কেষ্টবিষ্টুমহাদেব তুলনাবিহীন। আমরা শুধু অবাক হয়ে ভাবি বাংলাছবির প্রযোজক-পরিচালকদের কাণ্ডজ্ঞানহীনতার কথা; কী দেখে তারা পয়সা দিয়ে একটার পর একটা ছবিতে তোমাকে নায়কের ভূমিকায় মনোনীত করেন, ভেবে কূল-কিনারা পাই না। তাদের কাছে আমাদের বিনীত অনুরোেধ আর যেন তোমাকে নেওয়া না হয়। অবশ্য কিছু একটা করলে তোমারই বা উপায় কী হবে? তাই তোমাকে একটা সদুপদেশ দিচ্ছি–এখন তুমি যাত্রাদলে যোগদান কর, উদাসিনী রাজকন্যার ভূমিকায় তোমাকে চমৎকার মানাবে। তুমিও নাম, যশ, পয়সা পাবে, আমরাও স্বস্তির হাঁফ ছেড়ে বাঁচব, ইত্যাদি ইত্যাদি।
তোমার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী
আনিয়াৎ খাঁ

একবারই যথেষ্ট, চিঠিখানি দুবার পড়বার প্রবৃত্তি বা ক্ষমতা ছিল না। টকটকে লাল লোহার শিকের ছেকার মতো প্রতিটা লাইন আমার সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে দিল। ঘরে আলো জ্বলছিল–নিজের দিকে চাইতেও লজ্জা করছিল, তাড়াতাড়ি আলোটা নিবিয়ে দিয়ে অন্ধকারে চুপ করে বসে রইলাম।

নায়ক জীবনের শুরু থেকে একের পর এক ঘটনাগুলো চোখের ওপর ভেসে উঠতে লাগল। স্পষ্ট মনে আছে, নির্বাক যুগ থেকে রোনাল্ড কোলম্যান, এমিল জেনিংস, পল মুনি, চালর্স বয়ার প্রভৃতি ক্ষণজন্মা অভিনেতার অভিনয় দেখে মনের নিভৃত কোণে কত আশাই না বাসা বেঁধেছিল! বড় হয়ে একদিন আমিও ওদের মতো অভিনয়-দক্ষতায় সারা বাংলাদেশকে সবার ঈর্ষার কেন্দ্র করে তুলব। পিছিয়ে-পড়া অপাংক্তেয় শিশু-শিল্পকে আমিই একদিন বসাব মর্যাদার স্বর্ণ সিংহাসনে। অসার দম্ভ দেখে ভাগ্যদেবতা অন্তরীক্ষে বসে বাঁকা হাসি হেসেছিলেন সেদিন–শুনেও বুঝতে পারিনি, আজ না শুনেও দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।

দুঃখ, কষ্ট, অভাব-অনটন কোনও দিনই আমার অদম্য মনোবলকে দমাতে পারেনি। আজ মনে হল সহ্যের শেষ সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছি।

মানুষের কল্পিত দেবদেবীর মূর্তির সামনে কেঁদে মাথা খুঁড়ে দুঃখভার লাঘব করার চেষ্টা কোনও দিন করিনি। সে অন্ধবিশ্বাস ও ভক্তি আমার কোনও দিনই ছিল না আজও নেই। মাটির পৃথিবীতে প্রত্যক্ষ দেবতা জ্ঞানে মনে মনে পূজা করতাম আমার বাবা-মাকে। বাবার প্রতিটি কথা অভ্রান্ত সত্য বলে মানতাম। চরম দুঃখে মনে শান্তি ও বল পেতাম বাবার কথা স্মরণ করে। আজও দিগভ্রান্ত পথিকের মতো রাত্রির ঘন আবরণ ভেদ করে অতীতের অতলে ডুব দিয়ে কী যেন খুঁজতে লাগলাম। সবই অস্পষ্ট ঝাপসা, দু-একবার বাবাকে দেখলাম যেন, বিদ্যুৎ ঝিলিকের মতো ক্ষণিক সে দেখা। মনে হল, মুখে সে শান্ত সৌম্য হাসি নেই, চোখে নেই অনুকম্পার দৃষ্টি, শুধু অনুযোগ ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে একবার চেয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলেন বাবা; কাতর স্বরে ডাকলাম–বাবা! ফিরে চাইলেন না, তেমনি মুখ ফিরিয়ে বললেন-জীবনসংগ্রামে পরাজিত হয়ে, প্রতিপদে নতি স্বীকার করে, মনগড়া যুক্তি দিয়ে মনকে চোখ-ঠেরে আজ ভাগ্যদেবতার দুয়ারে মাথা খুঁড়তে তোমার লজ্জা করে না? সব চেয়ে বড় পরাজয়গুলো পিতৃমাতৃভূমির দোহাই-এর আড়ালে চাপা দিয়ে যে ক্ষণিক আত্মপ্রসাদ তুমি পাবার চেষ্টা করেছ, আজ বুঝতে পারছ সেগুলো কত বড় মিথ্যে? আসলে সব কিছুর মূলে রয়েছে তোমার ভীরু মন; এইরকম মন নিয়ে সংসার-অরণ্যে পা বাড়ালে যা অবশ্যম্ভাবী পরিণাম, তাই হয়েছে সহানুভূতি বা অনুকম্পার প্রশ্ন ওঠে না।

সর্বগ্রাসী অন্ধকার এগিয়ে আসছে, বাবাকে আর দেখতে পারছি না–চিৎকার করে ডাকতে গেলাম, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। অন্ধকারের বুক চিরে চোখের সামনে ফুটে উঠল জনবহুল প্যারিসের রাস্তা, বায়োস্কোখে দেখা প্যারিস। রংবেরং-এর পোশাক পরা নানা জাতের নরনারীর মিছিল।ওরই মধ্যে চোখে পড়ল শাড়ি পরা কাঁধে ক্যাম্বিসের মতো ঝোলানো ব্যাগ–তাতে ছোট-বড় কতকগুলো তুলি–ডানহাতে ছবি আঁকবার একটা ফোল্ড করা ক্যানভাস–অজ্ঞাতে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, গোপা। চলতে চলতে থমকে দাঁড়াল মেয়েটি। তারপর আস্তে আস্তে আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল। গোপর মুখে বিদ্রোহের হাসি, চোখে অবজ্ঞা-মাখানো দৃষ্টি। বেশিক্ষণ সে দৃষ্টি সহ্য করতে পারি না–মুখ নিচু করে দাঁড়ালাম। গোপা বলল, মানুষের তৈরী, বোকাকে ধোঁকা-দেওয়া কয়েকটা ভুয়ো সামাজিক গণ্ডি ডিঙোবার সাহস নেই, তুমি চাও সংসার-সংগ্রামে জয়ী হয়ে দশজনের একজন হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে? জীবনের জুয়াখেলায় বুদ্ধির দোষে সর্বস্ব খুইয়ে আজ ভিখারির মতো পিছু ডাকতে লজ্জা করে না তোমার? মুখ ফিরিয়ে চলতে শুরু করল গোপা। মনে হল ছুটে গিয়ে বলি, ফাঁসির আসামীকেও সপক্ষে কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হয়, তোমরা কি তাও দেবে না আমায়? ছুটতে গেলাম, পা-দুটো শিকল দিয়ে বাঁধা, কথা বলতে চাই, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না।

আবার অন্ধকারে প্যারিসের রাস্তা হারিয়ে গেল। সমগ্র দৃষ্টিসীমা জুড়ে স্বর্গ-মর্তের ব্যবধান ঘুচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড এক সিঁড়ি। মাটি থেকে সোজা উঠে গেছে আকাশে। আদি আছে, অন্ত নেই। অগুনতি তার ধাপ, মাটিতে শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে আছি আমি। উপরে উঠবার চেষ্টা করি-পারি না, পা দুটো অসাড় অবশ। হঠাৎ একাধিক নারীকণ্ঠের কলগুঞ্জনে চমকে ফিরে তাকালাম। দেখলাম ললিতা, সীতা, সবিতা থেকে আরম্ভ করে সব ছবির নায়িকারা এগিয়ে আসছে। লজ্জায় সংকোচে এতটুকু হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। ফিরেও চাইল না কেউ আমার দিকে পাশ কাটিয়ে হাসিমুখে জয়যাত্রার কোরাস গাইতে গাইতে সবাই একসঙ্গে ওপরে উঠতে লাগল–ঐ অন্তহীন সিঁড়ির–একটার পর একটা ধাপ অনায়াসে অতিক্রম করে। সমস্ত দেহমন ব্যথায় টনটন করে ওঠে–চাইতে কষ্ট হয়, তবু চেয়ে থাকি আজ সব ইন্দ্রিয়গুলো একসঙ্গে জোট পাকিয়ে আমার আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে।

দেখলাম একখণ্ড কালো মেঘ চোখের নিমেষে কোথা থেকে এসে বিশ্বচরাচর অন্ধকারে ঢেকে ফেলল। ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ওপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনের জমাট অন্ধকারের দিকে চেয়েই বিস্ময়ে ভয়ে আঁতকে উঠলাম। ঘর বাড়ি গাছপালা সব ভেঙেচুরে একাকার করে সামনে এগিয়ে আসছে সর্বগ্রাসী জলপ্লাবন। ছুটে পালাবার চেষ্টা করলাম, পারলাম না, আর পালাবই বা কোথায়? আমার ওপর দিয়ে চলে গেল উন্মত্ত জলরাশি, কিন্তু আশ্চর্য! আমায় তো সঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে গেল না! অকর্মণ্য, অসহায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। দেখতে দেখতে জল হাঁটু ছাড়িয়ে কোমর ডুবিয়ে বুক পর্যন্ত উঠে এল। সভয়ে দেখলাম চারপাশ দিয়ে ভেসে চলেছে সংখ্যাহীন মানুষের সারি, গরু, গাছ, বাড়িস্থাবর-জঙ্গমে কোনও ভেদাভেদ নেই-সব একাকার। ওদের সঙ্গে ভেসে গেলে বেঁচে যেতাম। কিন্তু তা যে হবার নয়, এই একভাবে দাঁড়িয়ে তিলেতিলে মৃত্যুর সবগুলো বিভীষিকা দেখতে দেখতে মরা, এই আমার নিয়তি। গলা পর্যন্ত ডুবে গেছে জলে, আর কতক্ষণই বা; মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে জীবনের হাতছানির মতো দূরে অস্পষ্ট ছায়ার মতো দেখলাম, কে যেন তীরবেগে নৌকা বেয়ে আমায় উদ্ধার করতে ছুটে আসছে। কাছে প্রায় হাত-দশেক দূরে দাঁড়িয়ে গেল নৌকা। সবিস্ময়ে দেখলাম বৈঠা হাতে বসে আছে জয়া। কঠিন চোখে আমার দিকে একবার চেয়েই ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল জয়া। পর মুহূর্তে দ্বিগুণ জোরে বৈঠা বেয়ে স্রোতের অনুকূলে নৌকা ভাসিয়ে চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল। ও যেন যাবার আগে নীরব ভর্ৎসনায় বলে গেল, একবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে তোমার মতো অপদার্থকে বাঁচিয়েছিলাম, ভুল করেছিলাম, আবার সেই ভুল করব ভেবেছ?

আমিও ভুল করেছিলাম, জয়াকে নৌকো করে এগিয়ে আসতে দেখে ক্ষণিকের জন্যও বাঁচবার স্বপ্ন দেখেছিলাম। কী সম্বল করে মানুষ বেঁচে থাকে? সুখ-শান্তি-যশ মান-খ্যাতি-প্রতিপত্তি-আর্থিক সচ্ছলতা এই সব নিয়েই তো সত্যিকারের জীবন। সব পুঁজি যার শূন্য হয়ে জমার ঘরে স্থায়ী আসন পেতে বসেছে, তার বেঁচে থাকার সার্থকতা কোথায়? বাবাকে মনে পড়ল। মনে-মনে বললাম, এই চরম মুহূর্তে ধীরভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নেবার মনোবলটুকু যেন আমি না হারিয়ে ফেলি–শুধু এই আশীর্বাদ করুন বাবা!

একটু একটু করে অতল গভীরে তলিয়ে যেতে লাগলাম–গাঢ় অন্ধকারের বুকের ওপর দিয়ে, অনন্তপথের যাত্রীর মতো। তারপর আর কিছু মনে নেই।

.

রাত কটা বাজল জানি না, ঘুমিয়ে পড়লাম না জেগে রইলাম কিছু মনে নেই। শুধু আজও স্পষ্ট মনে আছে, এক ঝলক আলোর হল্কা নিয়ে কে যেন দরজা খুলে আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকল। চোখ ধাঁধানো আলোর কুণ্ডলীর মাঝে দেখলাম, বাবা! চাইতে পারি না, চোখ ঝলসে যায়, চোখ বুজে শুয়ে রইলাম। অনুভব করলাম শিয়রে মাথার কাছে এসে বসলেন বাবা।

ঠিক সেদিনের মতো, যেদিন এলফিনস্টোন পিকচার প্যালেস থেকে ষাট টাকা মাইনের খবর শুনে বাড়ি এসে লজ্জায়-ঘেন্নায় কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছিলাম।

শান্তিজলের মতো হাতখানি আমার মাথায়-পিঠে বুলোতে বুলোতে বাবা বললেন, ধীউ বাবা! অধৈর্য হয়ো না। তোমার দুঃখ-নিশার অবসান হবে।

দেহের সমস্ত শক্তি জড়ো করে কণ্ঠে নিয়ে এসে ধড়মড় করে উঠে বসে উন্মাদের মতো চিৎকার করে উঠলাম, কবে, বাবা কবে?

বাইরে থেকে কে যেন দরজায় জোরে ধাক্কা দিচ্ছে। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে শুনলাম মা দরজা ঠেলতে ঠেলতে উৎকণ্ঠিত ব্যাকুল স্বরে বলছেন, কী হল রে? এত ভোরে চিৎকার করে কার সঙ্গে কথা কইছিস?

কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে শান্তকণ্ঠে জবাব দিলাম, কিছু না মা, স্বপ্ন দেখছিলাম।

কয়েকদিন পরে হঠাৎ দুপুরে সাহিত্যিক-বন্ধু প্রেমেন্দ্র মিত্র বাড়িতে এসে হাজির। ব্যাপার কী? এতকাল প্রেমেন্দ্র শুধু গল্প, গান, সংলাপ আর চিত্রনাট্য লেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন, সম্প্রতি এস. ডি. প্রডার্সনের প্রথম সবাক চিত্র সমাধান-এর গল্প, চিত্রনাট্য ছাড়াও পরিচালনার গুরুদায়িত্ব ওঁর কাঁধে চাপানো হয়েছে এবং সেই গুরুভার স্বেচ্ছায় আরও গুরু করে তুলতে চলেছেন তিনি চরম দুঃসাহসের পরিচয় দিয়ে–বিলেত-ফেরত, স্মার্ট, সুশ্রী একটি ভিলেনের ভূমিকায় আমায় মনোনীত করে। কথা কইতে পারলাম না–ঊর্ধ্বে আকাশের দিকে চাইলাম–নির্মল, মেঘশূন্য নভস্তল। কানে ভেসে এল উচ্ছৃঙ্খল জলরাশির কলকল ধ্বনি, দূরে দৃষ্টি প্রসারিত করে পরিষ্কার দেখতে পেলাম–সাপের মতো ফণা বিস্তার করে আসছে বহুআকাঙ্ক্ষিত জোয়ার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *