তখন পাঁচটা বেজে গেছে। সূর্য হেলে পড়েছে টালিগঞ্জের তেমাথার বৃহৎ বটগাছটার আড়ালে। খানিকটা নিস্তেজ হলদে রোদ ছিটকে এসে পড়েছে স্টুডিওর সিমেন্ট বাঁধানো চত্বরটার উপর। তারই শেষপ্রান্তে কোরিন্থিয়ান থিয়েটারের একটা জমকালো সিন টাঙিয়ে, মেঝেয় বহুমূল্য কার্পেট বিছিয়ে, আশেপাশে কয়েকটা টেবিল সাজিয়ে একটা কক্ষের দৃশ্য করা হয়েছে আর সেই কক্ষের ঠিক মাঝখানে কার্পেটের উপর বিচিত্র পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে নর্তকী বীণা।
এত ভিড় ম্যাডান স্টুডিওয় এর আগে কখনো দেখিনি। অতি কষ্টে দুহাতে ভিড় ঠেলে আমি আর মনমোহন একটু একটু করে সামনে এগোতে লাগলাম। আশেপাশের মৃদু গুঞ্জনের কয়েকটা টুকরো কানে এল। কী আইডিয়া দেখেছিস! এই জন্যেই জাল সাহেবকে ম্যাডান কোম্পানি মাসে হাজার টাকা মাইনে দেয়। মেয়েটা কী সুন্দর দেখতে ওকে হিরোইন করলেই ঠিক হতো–ইত্যাদি ইত্যাদি। দ্বিগুণ উৎসাহে সামনে এগিয়ে চললাম। বেশ খানিকটা কাছে এসে বীণাকে দেখলাম। হ্যাঁ, সত্যিই দেখবার মতো। লম্বা ছিপছিপে চেহারা, রং বেশ ফরসা, আর তারই সঙ্গে মিল রেখে নাক চোখ মুখ নিখুঁত সুন্দর। বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে দেখতে ইচ্ছে করে।
ফিসফিস করে কানের কাছে মুখ এনে মনমোহন বলল, এটা কোন দেশী পোশাক ভাই?
এতক্ষণে মেয়েটির পোশাকের দিকে নজর পড়ল। সত্যিই অবাক হবার কথা। বাঙালি মেয়েদের ধরনে একখানা দামী গাঢ় নীল রঙের বেনারসী পরা। সোনালী জরির কাজ করা মোগল আমলের দুতিনটে লাউড রঙের বিচিত্র ব্লাউজ, জাহাঙ্গীর বাদশার আমলের ভারী ভারী জড়োয়া গয়নায় বাহু-গলা-কান ভর্তি। মাথায় আধুনিক ফাপাননা খোঁপায় লাল নীল সাদা ফুল গোঁজা। পাতলা ফিনফিনে গোলাপী ওড়নাটা মাথা থেকে বুকের দুপাশে ঝোলানো, পায়ে মেমসাহেবদের হাই-হিল জুতো। এ যেন বিস্মৃতির অতলে ফেলে আসা দুতিনটে যুগকে নাকে দড়ি দিয়ে টেনে এনে বর্তমানের সঙ্গে মিল খাওয়ানোর চেষ্টা।
হঠাৎ হাসিতে ফেটে পড়ল মনমোহন। আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে পান-দোক্তা খাওয়া মুখখানা কাঁধের উপর ঘষতে ঘষতে অতি কষ্টে বলল-জাল সাহেবের দিকে চেয়ে দ্যাখ!
দেখলাম স্ট্যান্ডটাকে যথাসম্ভব ছোট করে তার উপর ক্যামেরা বসিয়ে বাঁ চোখটা ভিউফাইন্ডারের উপর চেপে হাত দিয়ে ডান চোখটা টিপে ধরে উটের মতো এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে নিশ্চল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছেন জাল সাহেব। ঘামে ভিজে ব্ল ব্ল্যাক পার্শি-কোটটার বুক, পেট, পিঠ ও হাত দুটো আবলুস কাঠের মতো আরও কালো দেখাচ্ছে। অবশিষ্ট কয়েকটি অংশ ঘামের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে অতি কষ্টে নিজের বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে লজ্জায় নীল হয়ে ফ্যালফ্যাল করে সবার দিকে চেয়ে আছে। টুপি মাথায় থাকলে ক্যামেরার মধ্য দিয়ে দেখার অসুবিধা হয়, তাই সেটা খুলে ক্যামেরার হ্যাঁন্ডেলটার উপর ঝুলিয়ে রেখে দেওয়া হয়েছে। হাসি আসাই স্বাভাবিক। হঠাৎ ক্যামেরা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন জাল সাহেব। বদরাগের ডিনামাইট দিয়ে ঠাসা গোমড়ামুখো লোকটা হঠাৎ যেন কোন যাদুমন্ত্রে আগাগোড়া বদলে গেছে। হাসি খুশিতে মাংসবহুল গোল মুখখানা আরও গোল হয়ে উঠেছে। দেখলাম, ঘামে স্যাঁতসেঁতে মুখখানা ও টাকবহুল মসৃণ মাথাটা জামার হাতা দিয়ে বেশ যত্ন করে মুছে নিলেন জাল সাহেব। তারপর হেলেদুলে গজেন্দ্রগমনে বীণার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। একটু পরে হঠাৎ দেখি, হাত দিয়ে বীণার ডান বুকের ওড়না সরিয়ে দিলেন, তারপর একগাল হেসে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কী যেন বললেন। লজ্জায় লাল হয়ে মুখ নীচু করে রইল মেয়েটা। বুঝলাম, এবার বক্স অফিসের দিকে নজর দিয়েছেন জাল সাহেব।
চুপিচুপি মনমোহনকে বললাম, এই না হলে বড় ডিরেক্টর! দেখেছিস সব দিকে কী রকম কড়া নজর!
উত্তরে কী একটা বলতে যাচ্ছিল মনমোহন, বলা হল না। বিজয়গর্বে ফিরে এসে ক্যামেরার কাছে দাঁড়ালেন জাল সাহেব। জগন্নাথ, অসিত ও একটি অবাঙালি সহকারী কাছে এসে বলল, একটা কথা স্যার, অনেকক্ষণ ধরে–
কথা শেষ করতে পারল না ওরা, হঠাৎ ডিনামাইটে আগুন লেগে গেল। অধৈর্য হয়ে চিৎকার করে উঠলেন জাল সাহেব, গেট আউট, অল অফ ইউ। বাত নেহি মাংতা, কাম মাংতা। সমঝা? ইউ ফুলস।
রাগে ক্যামেরার হাতল থেকে টুপিটা উঠিয়ে নিয়ে চেপে মাথায় বসিয়ে দিলেন জাল সাহেব। তারপর ক্যামেরার লেন্স-এর মধ্যে চোখ দিয়ে দেখতে লাগলেন। নিস্তব্ধ জনতা ভয়ে বিস্ময়ে একটা কিছু অঘটন ঘটবার প্রত্যাশায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, ঘটলও তাই।
ক্যামেরায় চোখ রেখে ডান হাতখানা নীচু থেকে উপরে তোলার সঙ্গে সঙ্গে। বললেন জাল সাহেব, শাড়ি উঠাও, বীণা শাড়ি উঠাও।
ভয়ে বিস্ফারিত চোখে বীণা চেয়ে রইল জাল সাহেবের দিকে। অপেক্ষমাণ জনতার ভেতর থেকেও খুশির কি বিস্ময়ের জানি না, একটা অস্ফুট গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল।
ক্রুদ্ধ চোখে চারদিক দেখে নিয়ে হাত ইশারায় সহকারীদের কাছে ডাকলেন জাল সাহেব। তারপর গলাটা একটু খাটো করে বীণাকে দেখিয়ে বললেন, উসকো উধার লে যাও, আওর আচ্ছা করকে সমঝা দো, হোয়াট আই ওয়ান্ট।
কক্ষের শেষ প্রান্তে খালি একটা সোফায় বীণাকে নিয়ে বসাল জগন্নাথ। তারপর হাত-মুখ নেড়ে দুতিন জনে কী বোঝাতে লাগল, আর মাটির দিকে চেয়ে বীণা খালি মাথা নেড়ে চলল।
মনমোহনকে বললাম, চল বাড়ি যাই, এদিকে সন্ধ্যেরও তো আর দেরি নেই।
আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে মনমোহন বলল, পাগল হয়েছিস, এর শেষ না দেখে যাবি কোথায়? আর রোদ্র না থাকলেও জাল সাহেবেরক্যামেরায় ছবি ওঠে। ওর লেন্স খুব পাওয়ারফুল।
ভাবলাম, হবেও বা।
ইতিমধ্যে হতাশ করুণ মুখে বীণা এসে দাঁড়িয়েছে স্বস্থানে। দ্বিগুণ উৎসাহে জাল সাহেব ক্যামেরা নিয়ে ফোকাস করতে শুরু করে দিলেন। এবার ক্যামেরাটা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বীণার পায়ের উপর। ঐভাবে ক্যামেরা ফিট করে আবার এগিয়ে বীণার ডান দিকের বুকের ওড়না সরিয়ে দিলেন জাল সাহেব। মনমোহন ফিসফিস করে আমার কানের কাছে বলল, ফটো যখন তুলছে পায়ের, তখন বারবার ওর বুকের ওড়না সরাচ্ছে কেন ভাই?
বেশ একটু বিরক্ত হয়েই চাপাগলায় বললাম, ওরে মুখ, ঐ ক্যামেরা যখন পায়ের দিক থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে মুখ তুলে বীণার সারা দেহের উপর চোখ বোলাবে, তখন বুঝতে পারবি।
বুঝতে পেরেই বোধহয় চুপ করে গেল মনমোহন। কিছু দূরে দাঁড়িয়ে জগন্নাথ ও অসিত বিবর্ণ মুখে পরস্পরকে জাল সাহেবের দিকে ইশারা করে কী যেন বলতে বলছে, কিন্তু দেখলাম শেষ পর্যন্ত কেউই সাহস করে এগোতে পারল না। শুটিং শুরু হল। ঐ হুমড়ি খেয়ে পড়া ক্যামেরায় চোখ ঢুকিয়ে একটা কালো কাপড়ে মাথা ঢেকে ডান হাত দিয়ে ক্যামেরা ঘোরাতে শুরু করলেন জাল সাহেব। একটু পরেই জাল সাহেবের গলা শুনতে পেলাম, শাড়ি উঠাও বীণা, শাড়ি উঠাও।
সবিস্ময়ে দেখলাম ভীত চকিত চোখদুটো দিয়ে চারদিক দেখে নিয়ে লজ্জানত মুখে আস্তে আস্তে ডান পায়ের দিকের শাড়িটা গুটিয়ে উপরে ওঠাতে শুরু করল বীণা। কৌতূহলী জনতা লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে যেন ভেঙে পড়ল পায়ের উপর। বেশ একটু শঙ্কিত হয়ে মনে মনে ভাবলাম, বক্স অফিস থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে এবার কি জাল সাহেব কর্পোরেশনের কোনো বিশেষ ডিপার্টমেন্টের দিকে নজর দিতে চলেছেন?
সন্দেহভঞ্জন হতে দেরি হল না। বীণা হাঁটু পর্যন্ত শাড়িটা তুলেছে, আর হাঁটুর আঙুলছয়েক নীচে নকল সোনার চওড়া একটা ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা রয়েছে একটা গোল রিস্টওয়াচ। হঠাৎ মনে হল যেন ঘড়িটা আমাদের দিকে চেয়ে দাঁত বের করে নির্লজ্জের মতো হাসছে। ভাবলাম আর কিছুদিন যদি সুস্থ দেহে বেঁচে থাকেন আর এইরকম তিন-চারখানা নাচের ছবি তোলেন জাল সাহেব, তাহলে নারীদেহ রিস্টওয়াচের পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? কল্পনা করেই আতঙ্কে চোখ বুজে ফেললাম।
জাল সাহেবের গলা শুনতে পেলাম, নাচো বীণা, হ, অ্যায়সে শাড়ি পাকড়কে নাচো ভাই!
গালচের উপর শাড়িখানা হাঁটু পর্যন্ত তুলে নাচতে শুরু করেছেবীণা। একটু পরেই দেখি ক্যামেরার হাতল বন্ধ হয়ে গেছে, কালো কাপড় দিয়ে মাথা থেকে গলা পর্যন্ত ঢেকে ত্রিভঙ্গ মূর্তিতে বেঁকে ক্যামেরার লেন্সে চোখ লাগিয়ে, কালো পার্শি কোটে ঢাকা প্রকাণ্ড ব্যাকগ্রাউন্ডটা হেলিয়েদুলিয়ে নেচে চলেছেন জাল সাহেব। হঠাৎ ছেলেবেলায় পড়া আবোল তাবোল-এর একটি বিখ্যাত কবিতার প্রথম লাইনটা মনে পড়ে গেল, যদি কুমড়োপটাশ নাচে। নাচতে নাচতে মুখে তারিফ করতে লাগলেন জাল সাহেব, বহুত আচ্ছা মেরে জান, ভেরি গুড! হঠাৎ বোধহয় মনে পড়ে গেল যে ক্যামেরা চলছে না। নাচ থামিয়ে উৎসাহভরে ক্যামেরা ঘোরাতে শুরু করলেন আবার। এইভাবে আরো দশ মিনিট ধরে চলল ঐ অদ্ভুত নাচ। তারপর নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেদিনকার মতো শুটিং শেষ করতে হল। বাহ্য জগতে ফিরে এসে দেখি বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে।
সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে ঘর্মাক্ত অবশ দেহে একটা সোফার উপর এলিয়ে পড়ে সদ্য ডাঙায় তোলা একটা বৃহৎ কাতলা মাছের মতো হাঁপাতে লাগলেন জাল সাহেব।
সামনে চেয়ে দেখি এরই মধ্যে কাপড় বদলাতে বীণা চলে গিয়েছে মেক-আপ রুমে। আশাহত দর্শকের দল ক্ষুণ্ণ মনে একে একে সরে পড়তে শুরু করেছে। অনুসন্ধানী চোখ দিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও মনমোহনকে কোথাও দেখতে পেলাম না। অবাধ্য হাসি সামলাতে অথবা পান-দোক্তা খেতে সে এরই মধ্যে কখন নিঃশব্দে চম্পট দিয়েছে। আমি কিন্তু তখনও হাসিনি। কী জন্য জানি না চুপ করে এক পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু বাদে খানিকটা সুস্থ হয়ে সোফার উপর উঠে বসলেন জাল সাহেব। তারপর হাত ইশারায় সহকারীদের কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, বোলো, ক্যা বোলনে চাহতা থা?
জগন্নাথ মুখখানা কাচুমাচু করে বলল, এখন আর বলে কী হবে স্যার!
বিস্ফারিত চোখে হুংকার ছাড়লেন জাল সাহেব, হোয়াট!
সাহস করে এগিয়ে এসে অসিত বলল, সকাল থেকে যতবার কথাটা আপনাকে বলতে এসেছি, দূর দূর করে আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছেন।
অধৈর্য হয়ে চিৎকার করে উঠলেন জাল সাহেব, মগর মামলা ক্যা হ্যায়?
জগন্নাথ কুঁইকুঁই করে বলল, আজ সারাদিন খালি ক্যামেরায় ছবি তুলেছেন, ওতে ফিল্ম পরানোই হয়নি।
কোনো জবাব না দিয়ে আবার সোফায় শুয়ে পড়লেন জাল সাহেব। আর আমি? কোনোরকমে দম বন্ধ করে এক রকম ছুটেই স্টুডিওর গেট পার হয়ে দুহাত দিয়ে পেটটাকে চেপে ধরে হাসতে হাসতে বসে পড়লাম রাস্তার উপর।
.
স্টুডিও থেকে বাড়ি এসে যতক্ষণ জেগেছিলাম সবাইকে জাল সাহেবের ঐ বিচিত্র নাচ দেখালাম। মা পর্যন্ত হেসে খুন। রাত্রে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম রায়বাহাদুরের কলেজে পড়া মেয়ে গোপাকে। হাতে ফুলের মালা নিয়ে ছাদের আলসের উপর ঝুঁকে পড়ে প্রতীক্ষা-ব্যাকুল চোখ দুটো দিয়ে যেন কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে গোপা।ওর দৃষ্টিপথে পড়ার অনেক রকম চেষ্টাই করলাম, কিন্তু সব বৃথা। আমি যখন রিনিদের ছাদে পায়চারি করি ও তখন নীচু হয়ে খোঁজে নীচের রাস্তায় অথবা রিনিদের দোতলার জানলায়। আবার আমি যখন নীচে দোতলার জানলার ধারে দাঁড়াই, ও তখন চোখ তুলে খোঁজে রিনিদের ফাঁকা ছাদটায়!
ঘুম ভাঙল, না বাঁচলাম! জেগে দেখি, বেশ বেলা হয়ে গেছে। রবিবার, কারও কাজের তাড়া নেই, আরও কিছু সময় চোখ বুজে শুয়ে থাকলাম। উঠে মুখ-হাত ধুয়ে জগুবাজার থেকে একজোড়া জুতো কিনে আনলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে সেদিন একটু বেলাই হল। তারপর প্রসাধন-পর্ব শেষ করে যখন খিদিরপুরে রিনিদের বাড়ি রওনা হলাম তখন প্রায় বেলা একটা। হেমচন্দ্র স্ট্রীট থেকে বেরিয়ে ছোট্ট একটা গলি সোজা উত্তরমুখো গিয়ে যে বাড়িটার সামনে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে সেইটাই হল রিনিদের বাড়ি। কড়া নাড়তে না নাড়তেই রিনি এসে দরজা খুলে দিল।
বললাম, কী করে বুঝলি, আমি? আমি না হয়ে ইয়া দাড়িওয়ালা কাবুলিওয়ালাও তো হতে পারত!
–বা রে, তা হবে কেন! উপরের বারান্দা থেকে দেখলাম যে তুমি বড় রাস্তা ছেড়ে গলিতে ঢুকছে। তাছাড়া আমি জানতাম তুমি আসবেই। বলেই এমন একটা দুষ্টুমিভরা হাসি হাসল রিনি যে দেখলে সর্বাঙ্গ জ্বলে যায়।
বাইরের দরজায় খিল লাগাতে লাগাতে বললাম, আজকাল বড্ড বেড়ে উঠেছিস, দাঁড়া কাকাকে বলে মজা দেখাচ্ছি।
–বেশ, বেশ। দাও বলে তোমার কাকাকে। অভিমানভরে দুমদুম করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল রিনি।
মনে মনে ভাবলাম, রিনির রাগ জল করার ওষুধ তো আমার হাতেই রয়েছে–পার্ল হোয়াইটের দি আয়রন ক্ল।
সদর দরজা খুললেই পড়ে দরদালান। উত্তরমুখো দুখানা ঘর। একখানায় রান্না হয়, অন্যটি কাকিমার ভাড়ার। পশ্চিমদিকে একটা দরজা, সেটা খুললেই দেখা যায় লম্বা একখানা ঘর। সেইটা বাইরের ঘর। কাকার আফিসের লোকজন অথবা বন্ধুবান্ধব কেউ ছুটির দিনে এলে সেইটাতে বসে। পুবদিক দিয়ে উপরে ওঠবার সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। উপরেও ঠিক নীচের মতো চওড়া বারান্দা বা দরদালান, আর তিনখানা ঘর, ঠিক একতলার মাপে। বারান্দায় একখানা চওড়া তক্তপোশ পাতা, মাদুর বা শতরঞ্চি কিছু নেই। রিনি তারই একপাশে গুম হয়ে বসে একখানা খাতায় হিজিবিজি কাটছে।
বললাম, কাকা কোথায় রে রিনি?
কোনো জবাব না দিয়ে মুখ গুঁজে বসে রইল রিনি। বুঝলাম অভিমান হয়েছে। আস্তে আস্তে ওর পাশে বসে আদর করে কাছে টেনে এনে বললাম, দূর বোকা মেয়ে, দাদার কথায় রাগ করতে আছে? কাকা কোথায়?
রাগ জল হয়ে গেল রিনির। চুপিচুপি পশ্চিমের বন্ধ দরজাটা দেখিয়ে বলল–বাবা মা ঘুমোচ্ছে। ছুটির দিন হলেই বাবা দুপুরে লম্বা ঘুম দেয়।
পিছন ফিরে দেখলাম, রিনির ছোট ভাই আর বোনটা একরাশ খাতাবই-এর মাঝখানে দিব্যি হাঁ করে ঘুমোচ্ছ। আর কথা খুঁজে পাই না, চুপচাপ বসে রইলাম। বলি বলি করেও গোপার কথাটা রিনিকে কিছুতেই জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না, কেমন লজ্জা করতে লাগল। আর হতভাগা মেয়েটাও সেদিক দিয়ে একদম মাড়াল না। কী করি, অগত্যা ওদেরই একখানা পাঠ্যপুস্তক টেনে নিয়ে অন্যমনস্কভাবে পাতা ওল্টাতে লাগলাম। খুট করে জানলা খোলার আওয়াজ হতেই বিদ্যুতের মতো ছুটে গেল রিনি দক্ষিণদিকের জানলার কাছে, তারপর ফিরে এসে কোন কথা না বলেই আমার হাত ধরে টানতে শুরু করে দিল। কী একটা আপত্তি করতে যাচ্ছিলাম, মুখে একটা আঙ্গুল দিয়ে আমায় কথা না কইতে ইশারা করল রিনি। তারপর হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে ছাদের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ছাদে উঠে দক্ষিণদিকের আলসের কাছে এসে হাত ছেড়ে দিল রিনি। রিনিদের বাড়ি থেকে মাত্র হাততিনেক ব্যবধান, তার পরেই দক্ষিণের সমস্ত আলো-হাওয়া গ্রাস করে বিরাটকায় দৈত্যের মতো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে রায়বাহাদুরের প্রাসাদোপম প্রকাণ্ড অট্টালিকা। রিনিদের ছাদ থেকে মুখোমুখি পড়ে একটা দোতলার জানলা, তারই একটা লোহার গরাদ ধরে এলোচুলে রূপকথার বন্দিনী রাজকন্যার মতো দাঁড়িয়ে আছে গোপা। পরিচয় করিয়ে দেবার দরকার হলো না, আমার কল্পনায় আঁকা গোপার সঙ্গে হুবহু না হলেও অনেকখানি মিল আছে। গোপাই আগে হাসিমুখে নমস্কার জানাল, হাত তুলে প্রতি-নমস্কার করে স্থান-কাল পাত্র ভুলে অপলক চোখে চেয়ে রইলাম।
রিনি বলল, ছোড়দা।
গোপা বলল, জানি।
সমুদ্রের রহস্যভরা দুটি কালো হরিণচোখ আর আজানুলম্বিত কোকড়া মেঘবরণ চুলের পাহাড়, মাত্র এই দুটিতে যে নারীসৌন্দর্য কত গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে, গোপাকে চোখে দেখার আগে তা উপলব্ধি করা যায় না। শান্ত অসীম কাব্যসমুদ্রে কোন সে কালো মেয়ের কালো হরিণচোখ দুটি কী করে তুফান তুলেছিল, আজ তা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম। আরও বুঝতে পারলাম, ধপধপে ফরসা রঙের সঙ্গে ঐ চোখ আর চুল ঠিক খাপ খায় না। গোপার রং খুব কালো না হলেও বেশ চাপা, নাক চোখ দেহের গড়ন এককথায় নিখুঁত। গোপা যেন চুম্বকের মতো শুধু আকর্ষণ করে, ইচ্ছে করলেও ফেরা যায় না। নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়ে নির্লজ্জের মতো শুধু চেয়েই আছি, স্বপ্ন ভাঙল রিনির কথায়।
–বারে, তোমরা তো বেশ লোক গোপাদি। এদিকে তো আলাপ করবার জন্য পাগল। যেই আলাপ করিয়ে দিলাম, ব্যস, আর কথা নেই, একদম চুপচাপ। যাই বাবা, সামনে এগজামিন, পড়াশুনা করিগে যাই। এখুনি বাবা উঠে যদি দেখেন আমি পড়ছি না, বকুনি লাগাবেন।
গোপা হেসে জবাব দিল, তুমি আরো কিছুক্ষণ নির্ভয়ে এখানে থাকতে পারো রিনি। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোমার বাবা-মার রুদ্ধ দুয়ার এখনও খোলেনি।
সাহস সঞ্চয় করে বলে ফেললাম, এতদিন একটা ভুল ধারণা বুকের মধ্যে যত্ন করে পুষে রেখেছিলাম। আজ আপনাকে দেখে সেটা শুধরে নিলাম।
হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল গোপা। ভীত শঙ্কিত চোখে শুধু বলল, কীসের ধারণা?
আমি আজ মরিয়া। বললাম, এতদিন জানতাম সুন্দরী আখ্যা পেতে হলে রং ফরসা হওয়াটা এসেনশিয়াল। আজ বুঝলাম, মস্ত ভুল ধারণা।
খুশি হলো কিনা বুঝলাম না, কিন্তু লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিয়ে নীচের গলিপথের দিকে চেয়ে রইল গোপা।
রিনি বলল, গোপাদি কী বলে জান হোড়দা? বলে, তোমার ছোড়দা সীতা দেবী, ললিতা দেবী আরও কত সব সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে অভিনয় করেন। আমার মতো একটা কালো কুৎসিত মেয়ের সঙ্গে হয়তো ঘেন্নায় কথাই কইবেন না।
বেশ একটু উত্তেজিত হয়েই রিনিকে বললাম, ঐ কালো কুৎসিত মেয়ের কাছে দাঁড়াবার যোগ্যতাও ওদের–
কথাটা শেষ হল না। এরই মধ্যে কখন নিঃশব্দে জানলা বন্ধ করে সরে পড়েছে গোপা। সমস্ত উৎসাহ উত্তেজনা নিমেষে নিভে জল হয়ে গেল।
কাছে ঘেঁষে এসে চুপিচুপি বলল রিনি, গোপাদি ওভাবে চুপিচুপি জানলা বন্ধ করে সরে পড়ল কেন, কিছু বুঝতে পারলে ছোড়দা?
ঐ বিরাট বন্দীশালার বন্ধ জানলাটার দিকে চেয়ে শুধু ঘাড় নাড়লাম।
রিনি বলল, মাকে গোপাদি বাঘের মতো ভয় করে। তাছাড়া, তিনি ভয়ানক সেকেলে। সিনেমা-থিয়েটার দেখা একদম পছন্দ করেন না। তার উপর যদি দেখেন তোমার সঙ্গে আলাপ করছে গোপাদি। মায়ের সাড়া পেয়েই গোপাদি পালিয়েছে। এস ছোড়দা, নীচে যাই। এক্ষুণি বাবা-মা উঠে আসবেন।
নীচে নেমে এলাম। রিনির ছোট ভাই ও বোনটা তখনও অকাতরে ঘুমোচ্ছ। একখানা ইংরেজি পাঠ্যপুস্তক আমার হাতে গুঁজে দিয়ে খাতা-পেন্সিল নিয়ে রিনি বলল, আমায় একটা ডিকটেশন দাও না ছোড়দা। •
তারপর গলাটা নামিয়ে আস্তে আস্তে বলল–আজ আর গল্প শোনা হল না। বাবা-মা ঘরে কথা কইছেন, এক্ষুণি দরজা খুলবেন।
ডিকটেশনের মাঝখানেই কাকিমা দরজা খুলে বাইরে এলেন। আমাকে দেখেই হেসে বললেন, তবুও ভাল, গরিব কাকা-কাকিমার কথা মনে পড়েছে ছেলের।
বললাম, ওসব পোশকি ফরম্যালিটি শিকেয় তুলে রেখে দিয়ে শিগগির শিগগির এক থালা গরম লুচি, হালুয়া আর এককাপ চা খাওয়াও কাকিমা। ক্ষিধেয় একদম কথা বলতে পারছি না।
হেসে ঝি মোক্ষদার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে নীচে নেমে গেলেন কাকিমা। ইতিমধ্যে কখন কাকা এসে পাশে বসেছেন জানতে পারিনি। রিনির ডিকটেশন শেষ করে সেই বইটারই পাতা ওল্টাতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
হঠাৎ কোনো রকম ভূমিকা না করেই কাকা বললেন, এই যে সিনেমায় নামছিস, এর জন্যে মাসে মাসে কত দেবে ওরা তোকে?
কাকার ঈর্ষার আগুনটা হাওয়া দিয়ে আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম–এখন দেড়শ টাকা করে দিচ্ছে, কালপরিণয় ছবি রিলিজ হলে পাঁচশ করে দেবে।
বিস্ময়ে চোখ দুটো কপালে তুলে কাকা বললেন-পাঁচ-শ!
সহজভাবেই বললাম, হ্যাঁ, এ আর বেশি কী! সিনেমা দিন দিন যে রকম জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তাতে বছরখানেক বাদে হাজারখানেক টাকা মাসে অনায়াসে রোজগার করা যাবে।
বাকশক্তি রহিত হয়ে গোপাদের প্রকাণ্ড বাড়িটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বসে রইলেন কাকা।
টাটকা গাওয়া ঘিয়ে লুচি ভাজার ক্ষিধে-বাড়ানো গন্ধ নীচ থেকে ভেসে এল। রিনির ছোট ভাইবোন দুটো আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। ঐভাবে গোপাদের বাড়ির দিকে উদ্দেশ্যহীন ভাবে চেয়েই কাকা বললেন, তুই বলিস কী? বি-এ, এম-এ পাশ করে একশ টাকা রোজগার করতে পারলে লোকে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। আর শুধু রং মেখে মাগিদের সঙ্গে নেচে-গেয়ে তোরা অত টাকা রোজগার করবি?
বেশ বুঝতে পারলাম, কিছুদিনের জন্যে কাকার আহার-নিদ্রার রীতিমত ব্যাঘাত সৃষ্টি করে গেলাম।
নীচ থেকে রিনির ডাক পড়ল। বাপের সামনে থেকে উঠতে পেরে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল রিনি। চেয়ে দেখি, ছোট ভাইবোন দুটিও এই অছিলায় ঘুমজড়ানো কুকুতে চোখে সভয়ে বাপের দিকে চাইতে চাইতে রিনির পিছু নিয়েছে। অন্য সময় হলে এ-দৃশ্য দেখে হেসে ফেলতাম, কিন্তু কাকার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে সে ইচ্ছা দমন করলাম। কাটা ঘায়ে নুনের প্রলেপ দেবার এমন সুযোগটা ছাড়তে ইচ্ছা হল না। মুখখানা যথাসম্ভব কাঁচুমাচু করে হতাশার ভঙ্গিতে বললাম, টাকাটাই শুধু দেখলেন কাকা! সামাজিক বয়কট, তাচ্ছিল্য, শিক্ষিত ভদ্রসমাজের ঘেন্না এইরকম কতগুলো ঝক্কি মাথায় নিয়ে ঐ টাকাটা রোজগার হবে সেটা একবার ভেবে দেখলেন না?
অধৈর্য হয়ে একরকম চেঁচিয়েই উঠলেন কাকা, বাজে, মিথ্যে কথা। আমিও প্রথমে তাই মনে করেছিলাম। এখন দেখছি, ভুল করেছিলাম। এই তো আমার সামনের বাড়ির রায়বাহাদুর, সেদিন আফিস থেকে ফেরার সময় গেটের সামনে দেখা। প্রথমেই বলে বসলেন–ধীরাজ ভট্টাচার্য আপনার ভাইপো? চমৎকার চেহারা ছেলেটির, আর অভিনয়ও বেশ ভালই করেছে। বেশ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম–আপনি সিনেমা-থিয়েটারের একজন ভক্ত তাতো জানা ছিল না!
একগাল হেসে জবাব দিলেন রায়বাহাদুর –ভক্ত-উক্ত নই মশাই, গিরিবালা ছবিটা প্রথমত রবি ঠাকুরের গল্প। তার উপর আমার মেয়ে গোপা তিন চারবার দেখেছে। সেই-ই একদিন জোর করে দেখিয়ে আনল। তা মন্দ লাগেনি মশাই।
চুপ করে বসে রইলাম। কাকাই একটু পরে আবার শুরু করলেন, তাছাড়া, আমাদের অফিসের বড়বাবু থেকে শুরু করে প্রায় সবাই দেখে এসেছে। তাই ভাবছি, শিক্ষাদীক্ষার কোনো দামই রইল না। দেশটা দিন দিন রসাতলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষিত ভদ্রসমাজের হঠাৎ অধঃপতনে কাকার আক্ষেপোক্তি আরও হয়তো শুনতে হতো, বাঁচিয়ে দিল রিনি। সিঁড়ির মাঝ বরাবর উঠে ডাকল, এস ছোড়দা, খাবার দেওয়া হয়েছে।
কাকার সামনে থেকে উঠে আসবার একটা সুযোগ পেয়ে বেঁচে গেলাম।
.
বাড়ি ফিরেই শুনলাম দুতিনবার স্টুডিও থেকে লোক এসেছিল ডাকতে, দেখা না পেয়ে বলে গেছে, যখনই বাড়ি ফিরি অতি অবশ্য যেন একবার স্টুডিওতে গিয়ে পরিচালক জ্যোতিষ বাঁড়ুজ্যের সঙ্গে দেখা করি। রবিবার হঠাৎ এরকম জোর তলব। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে টালিগঞ্জের ট্রামে উঠে বসলাম। গেট পেরিয়েই দেখি অগতির গতি আমগাছতলায় কয়েকখানা ভাঙা চেয়ার ও টুল পেতে জটলা করছেন পরিচালক জ্যোতিষবাবু, মনমোহন, একাধারে গাঙ্গুলীমশায়ের সহকারী ও এডিটর জ্যোতিষ মুখুজ্যে এবং আরও দু তিনজন গোল টুপি পরা অবাঙালি। আমায় দেখতে পেয়েই হৈহৈ করে উঠল মুখার্জি ও মনমোহন।
মুখুজ্যে বলল, এই যে ডুমুরের ফুল! এক দণ্ড বাড়িতে থাকে না, যাও কোথায়?
আমি কিছু বলবার আগেই মুখে রুমাল চাপা দিয়ে খুকখুক করে খানিকটা হেসে নিল মনমোহন। তারপর বলল, বুঝলে মুখুজ্যে, এখন থেকেই ওকে বাড়িতে পাওয়া যাচ্ছে না, এরপর কালপরিণয় রিলিজ হলে কলকাতাতেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। আবার সারা দেহ কাঁপিয়ে হাসতে লাগল মনমোহন। কিছুই বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
জ্যোতিষবাবু বললেন, ওহে বড় অ্যাক্টর! না হয় কালপরিণয়ে ভাল অভিনয়ই করেছ। কিন্তু এ গরিবকে ভুলে যেও না। আমিই সতীলক্ষ্মী ছবিতে তোমাকে প্রথম চান্স দিয়েছিলাম।
বললাম, দয়া করে হেঁয়ালি ছেড়ে আসল কথাটা বলবেন কি?
মুখুজ্যে বলল, আসল কথাটা হলে জ্যোতিষবাবু বঙ্কিমচন্দ্রের মৃণালিনী ছবি তুলবেন ঠিক করেছেন। তাতে তোমায় নায়কের পার্ট, মানে হেমচন্দ্রের ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে।
বললাম, এরই জন্যে এত জোর তলব? দয়া করে হুকুম করলেই তো হতো।
জ্যোতিবাবু বললেন, এই মাসেই বইটা আরম্ভ করতে চাই। কাজেই এখন থেকে তোড়জোড় না করলে শুরু করতে পারব না। এ তো আর সোশ্যাল বই নয়, রীতিমতো ঐতিহাসিক উপন্যাস। পোশাক আশাক, গয়নাকাপড়, সিনসিনারি সব সময়গাপযোগী হওয়া চাই। সেইজন্যে তোমার পোশাকের মাপ নেবার বিশেষ দরকার। মেকআপ রুমে কোরিন্থিয়ান থিয়েটারের দর্জি মকবুল ফিতে-পেন্সিল নিয়ে বসে আছে, দয়া করে মাপটা দিয়ে এসো।
নানা রকমের জামা সালোয়ার পাগড়ি প্রভৃতির মাপ দিয়ে যখন আমতলায় ফিরলাম তখন মনমোহন ও মুখুজ্যে সরে পড়েছে। একাই একখানা চেয়ারে বসে সিগারেট খাচ্ছিলেন জ্যোতিষবাবু। আমায় দেখেই উঠে পড়ে বললেন, আর বসা নয়, চল বাড়ি যাই। রাত প্রায় নটা বাজে।
পথে যেতে যেতে জ্যোতিষবাবু বললেন, তুমি তো এক্ষুণি ভবানীপুরে নেমে যাবে। আমায় যেতে হবে সেই হাওড়ায়, গোলাবাড়ি থানার কাছে।
বললাম, আপনি বসে না থেকে চলে গেলেই তো পারতেন।
–বাপ রে, হিরোকে একা রেখে চলে যাই আর কাল এসে শুনব আমার চাকরিটি খতম।
হেসে ফেললাম। বললাম, আমাকে নিয়ে আপনারা এত বাড়াবাড়ি করছেন কেন বলুন তো?
ট্রাম স্টপেজের কিছু দূরে হঠাৎ থেমে চারদিক দেখে নিয়ে প্রায় আমার কানে কানে বললেন জ্যোতিষবাবু, বাড়াবাড়ি একটুও নয় ভাই। তোমাকে হেমচন্দ্রের পার্ট দিতে চাই শুনে গাঙ্গুলীমশাই প্রবল আপত্তি তুলে বললেন, না না, সে হবে না। কালপরিণয়ের পরই আমি দেবীচৌধুরাণী ধরব। ওকে ছাড়তে পারি না। শেষকালে ম্যাডানের মেজ ছেলে ফ্রামজীকে ধরে তবে পারমিশন পেলাম। সবে ঢুকেছ। এখানকার ক্লিকের ব্যাপার তো কিছু জান না। ধরো তুমি অনেক খুঁজেপেতে একটা ভালো হিরোইন যোগাড় করলে। অমনি আমি পিছনে লেগে গেলাম কী করে সেটিকে হাত করে তোমার নাগালের বাইরে নিয়ে আসব। শুধু কি তাই? তুমি একখানা ভাল ছবি তুললে হিংসেয় আমি জ্বলে-পুড়ে মরব, সবার কাছে তার নিন্দে করে বেড়াতেও ছাড়ব না।
অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, বলেন কী মশাই! একই কোম্পানিতে একসঙ্গে মিলেমিশে সবাই কাজ করছে, তার মধ্যেও এত নোংরামি?
-হ্যাঁ নোংরামি। রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠলেন জ্যোতিষবাবু। আর এরকম নোংরামি এক সিনেমা লাইনে ছাড়া আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। এর জন্যে দায়ী কারা জানো? কোম্পানি নয়, দায়ী আমরা। অর্থাৎ মুষ্টিমেয় কজন বাঙালি যারা এই কোম্পানিতে কাজ করছি। শুনবে তবে বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলেন জ্যোতিষবাবু। গলা নামিয়ে চুপিচুপি বললেন, স্টুডিওর দুতিনজন চেনা লোক আসছে। ট্রামও রেডি, চল উঠে পড়া যাক।
ট্রামে আর কোনও কথা হয়নি। জ্যোতিষবাবু সস্তা সিরিজের বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলীর ভিতর থেকে মৃণালিনী উপন্যাসখানির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। ট্রাম রসা থিয়েটারের (অধুনা পূর্ণ) সামনে দাঁড়াতেই নেমে পড়লাম।
রাত্রে খাওয়ার সময় বাবাকে খিদিরপুরে কাকার সঙ্গে আমার ভবিষ্যৎ মাইনে নিয়ে যা যা কথাবার্তা হয়েছে খুলে বললাম। সব শুনে বাবা বললেন, এমনিতেই ও একটু ঈর্ষাকাতর। অত করে বাড়িয়ে না বললেও পারতে।
স্টুডিওর কথা উঠতে বললাম, কালপরিণয় ছবি রিলিজ হলে মনে হয় ভাল মাইনেতে ম্যাডানের পারমানেন্ট হয়ে যেতে পারব।
বাবা বললেন, দ্যাখো, তাহলে তো সব দিক রক্ষে হয়, নইলে পেটও ভরল না, জাতও গেল।
রাত্রে অনেকক্ষণ অবধি ঘুমোত পারলাম না। জেগে ছটফট করে কাটালাম। সব ছাপিয়ে গোপার বিচিত্র ব্যবহার মনের দুয়ারে বার বার এসে ঘা দিতে লাগল। সারাদিনের কথাবার্তাগুলো নিয়ে তোলপাড় করে ফেললাম কিন্তু এমন কোনো কথা খুঁজে পেলাম না যার অছিলায় গোপা ওভাবে জানলা বন্ধ করে দিয়ে চলে যেতে পারে। আকাশ-পাতাল ভেবেও কোনও কূল-কিনারা না পেয়ে শেষকালে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন বেশ একটু বেলাতেই ঘুম ভাঙল। শুটিং নেই, অন্য কোনো জরুরি কাজের তাড়াও নেই। রবিবারেরও অনেক দেরি, আজ সবে সোমবার। সময় আর কাটতে চায় না। কী করি। দুপুরে খেয়েদেয়ে কষে এক ঘুম দিলাম। বেলা তিনটেয় উঠে দেখি তখনও রোদ পড়েনি। জুতো জামা পরে স্টুডিওর হেড অফিস ৫নং ধর্মতলা মুখো রওনা হলাম।
ধর্মতলা স্ট্রীটের উপর এখন যেখানে নিউ সিনেমা, ঠিক তার উল্টোদিকে যে লম্বা প্রকান্ড বাড়িটা, সেইটার নীচের তলায় জে. এফ ম্যাডান কোম্পানির প্রসিদ্ধ বিলিতি মদের দোকান। তারই শেষ প্রান্তে খানিকটা জায়গা কাঁচের পার্টিশন করা। সেইটা হল আফিস বা হেড কোয়ার্টার্স, ম্যাডানের জামাই রুস্তমজী সাহেব সেইখানে বসে কোম্পানির হরেকরকম ব্যবসার হিসাবপত্র রাখেন ও তদারকি করেন। সিনেমা ডিপার্টমেন্টটাও তারই মধ্যে নগণ্য একটি। মদের দোকানের পাশ দিয়ে উপরে ওঠবার সিঁড়ি, তারপরই উত্তরমুখো প্রকাণ্ড লম্বা বারান্দা। ঐ বারান্দায় উঠলেই দেখা যায় দক্ষিণমুখো খোপ খোপ ছোট অনেকগুলো ঘর। কোনোটায় বসেন গাঙ্গুলীমশাই, কোনোটায় জ্যোতিষবাবু বা জাল সাহেব। তারপর দুতিনটে ঘর, কঁচিঘর বা এডিটিং রুম। বারান্দায় পায়চারি করতে করতে ওরই মধ্যে একটি ঘরে দেখলাম গাঙ্গুলীমশাই ও মুখুজ্যে। একরাশ ফিল্মের মধ্যে ডুবে বসে একটা লেন্স দিয়ে সেগুলো পরীক্ষা করছেন ও পাশের একখানা খাতায় পেন্সিল দিয়ে কী সব নোট করছেন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, তখনও স্টুডিওতে এডিটিং রুম বলে কিছু ছিল না। ছবি তোলা হয়ে গেলে সেগুলো ডেভেলাপ করে সেই সব নেগেটিভ ফি নিয়ে আসা হতো ৫নং ধর্মতলায়। তারপর সেগুলো কাট-ছাঁট করে এডিট করা হতো।
সিগারেট খাওয়ার অছিলায় বাইরে বেরিয়ে এল মুখার্জি। বললাম, ছবি বেরোতে আর কতদিন দেরি মুখুজ্যে?
নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মুখার্জি বলল, রোসো, আসল সিনটাইতো বাকি।
অবাক হয়ে বললাম, আসল সিন কোনটা?
নিঃশব্দে সিগারেটে দু তিনটে টান দিয়ে বেশ রসিয়ে বলল মুখার্জি, কোর্ট সিন, মোক্ষপা হত্যার দায়ে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছ তুমি। হয় ফাঁসি নয় দ্বীপান্তর।
বেশ একটু নার্ভাস হয়ে বললাম, কিন্তু মোদাকে রিভলভার দিয়ে গুলি করে মারল তো নরেশদা!
আমার কথার জবাব না দিয়ে উল্টে প্রশ্ন করতে শুরু করল মুখার্জি-মোক্ষদার ঘর থেকে বেরিয়ে আসবার সময় হঠাৎ গুলির আওয়াজ শুনে একরকম ছুটেই তার ঘরে তুমি ঢুকেছিলে কিনা?
বললাম, হ্যাঁ।
–তারপর যখন দেখলে মেঝেতে পড়ে আছে মোদা, রক্তে ভাসাভাসি, তখন তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসেছিলে কিনা?
–হ্যাঁ।
–ঐ ভাবে বসবার পর যখন দেখলে মোক্ষদার ডান হাতে রয়েছে একটা রিভলভার তখন সেটা নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলে কিনা?
চুপ করে রইলাম। মুখার্জি বলে চলল–ঐ ভাবে রিভলভার হাতে হাঁদারামের মতো যখন বসেছিলে তুমি মৃতা মোদার পাশে, তখন দুতিনজন লোক নিয়ে মোক্ষদার স্বামী নরেশদা মানে সারদা ঘরে ঢুকেছিল কিনা? এর পরও যদি বলতে চাও তুমি নির্দোষ, তাহলে আদালতে হাকিমকে বলে, আমাদের বলে কোনও ফল হবে না। কেস জেতার পর বিজ্ঞ উকিলের মতো হাসতে লাগল মুখার্জি।
সিনটার একটু আভাস এইখানে দিয়ে রাখি। কালপরিণয় ছবিতে সারদা হলো আমার দুর সম্পর্কের জ্ঞাতি ভাই। তার স্ত্রী মোক্ষদা মনেপ্রাণে ভালবাসে আমাকে। নানা ছল-ছুতোয় ডেকে পাঠায়। কখনও কালীবাড়িতে, কখনও বা গঙ্গার ধারে। কিন্তু কোনও সুবিধে হয় না। আমি খাঁটি বাংলা ছবির নায়ক, পত্নীগত প্রাণ। অন্য স্ত্রীলোকের দিকে তাকাই সাধ্য কী আমার! মরিয়া হয়ে উঠল মোদা। একদিন অসুখের অজুহাতে ডেকে পাঠাল ওদের বাড়িতে। তখন মোক্ষদার স্বামী বাড়ি নেই। বারে বসে মদ খাচ্ছে। সারদা হলো ছবির ভিলেন। কাজেই সব রকম পাপ কাজ তাকে করতেই হবে। এদিকে ঘরের মধ্যে মোদার প্রেম নিবেদন পুরোদমে চলছে। মোক্ষদা মরিয়া হয়ে আলিঙ্গন করতে ছুটে আসে। আমি ঘৃণাভরে কঠিন হাতে ওর হাত দুখানা সরিয়ে ঠেলে ফেলে দিই। সেই সঙ্গে আউড়ে যাই চোখা চোখা ধর্মের বুলিযথা, তোমার মতো কুলটার নরকেও স্থান পাওয়া কষ্টকর, আর এক মিনিটও এই পাপপুরীতে থাকলে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাব, ইত্যাদি। এইসব ভাল ভাল কথাগুলো বলে আমি চাই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে, মোক্ষদা যেতে দেয় না, পথ আগলে দাঁড়ায়। আমাদের এই সব প্রেমালাপের মাঝখানে টলতে টলতে সারদা বাড়ি আসে এবং লুকিয়ে কথাগুলো শোনে এবং আমি মোদাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে একরকম ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরই গুলি করে মোদাকে। এবং চক্ষের নিমেষে মৃত স্ত্রীর হাতে রিভলভার গুঁজে দিয়ে অন্য দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে তোক ডেকে আনে।
গিরিবালা রিলিজের পর ভিলেন-এর ভূমিকায় নরেশদার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তাই এ ছবিতেও শয়তান সারদার ভূমিকাটি ওঁকেই দেওয়া হয়। মোদার চরিত্রটিও বেশ কঠিন, তাই বেছে বেছে পোড় খাওয়া পেশেন্স কুপারকে ঐ ভূমিকা দেওয়া হয়।
চারদিক চেয়ে আমার আরও কাছে এসে বলল মুখার্জি, কাউকে বোলো না যেন, সিনটা রিয়্যালিস্টিক করবার জন্য আমরা সত্যিকারের আদালতে শুটিং করবার ব্যবস্থা করছি। সেইজন্যই তো একটু দেরি হচ্ছে হে। •
বিস্মিত ও পুলকিত হয়ে বললাম, বল কী মুখুজ্যে, রিয়্যাল কোর্ট সিন!
–শুধু কি তাই? আরও একটা কথা। না, থাক ভাই। তুমি আবার পাঁচজনকে বলে দেবে আর গাঙ্গুলীমশাই আমার উপর চটে যাবেন।
মুখুজ্যের হাত দুটো চেপে ধরে বললাম, দিব্যি গালছি, কাউকে বলব না। বল না ভাই, কী কথা?
কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে মুখার্জি বলল, অধ্যাপক চ্যাটার্জিকে দিয়ে কালপরিণয়-এর টাইটেল লেখাবার ব্যবস্থা হচ্ছে। একটু সবুর করো, দ্যাখো না কী করি।
কঁচিঘর থেকে মুখুজ্যের ডাক পড়ল। তাড়াতাড়ি আধখাওয়া সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে চলে গেল মুখার্জি।
কালপরিণয় ছবিটা দেরি করে রিলিজ হওয়ার দুঃখটা অনেকখানি কমে গেল মুখুজ্যের কথায়। বারান্দার উপর দিয়ে পশ্চিমমুখো হাঁটতে শুরু করলাম। দুতিনটে বন্ধ ঘর পেরিয়ে একটা ঘরের কাছে এসে দেখি, ঘর ভর্তি মেয়ে আর তার মাঝখানে সাদা কোটপ্যান্ট পরে এক গাল হাসি নিয়ে বসে আছেন পরিচালক জ্যোতিষবাবু। উঁকি দিয়ে চলে যাব কিনা ভাবছি, কানে এল, আরে এসো ধীরাজ, তোমার জনেই এত আয়োজন আর তুমি কিনা উঁকি দিয়ে সরে পড়তে চাইছ।
এর পরে চলে আসা সম্ভব নয়, আর ইচ্ছাও ছিল না। ঘরে ঢুকে পড়লাম। গাঙ্গুলীমশাই হচ্ছেন রাশভারি লোক, কম কথা বলেন। জ্যোতিষবাবু ঠিক তার উটো। মনে যা আসে মুখে তা বলতে আটকায় না। এর জনন্য এক এক সময় বিষম। অপ্রস্তুত হতে হয়েছে। কিন্তু মনটা সাদা, সেখানে ঘোর-প্যাঁচ কিছু নেই।
জড়সড় হয়ে জ্যোতিষবাবুর পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লাম। কোনওরকম দ্বিধা করে হাত দিয়ে মেয়েগুলোকে দেখিয়ে বললেন জ্যোতিষবাবু, ভাল করে দ্যাখো, এর মধ্যে কোনটি তোমার পছন্দ।
নির্লজ্জ প্রশ্ন–ভারি লজ্জা পেলাম। দেখলাম, জ্যোতিষবাবুর সামনে পান দোক্তা খাওয়া দাঁতগুলো বের করে বেহায়ার মতো হেসে এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ছে মেয়েগুলো। বুঝলাম, খাস পাড়া থেকে আমদানি।
বেশ বিরক্ত হয়েই বললাম, কী যা তা বলছেন!
হঠাৎ গম্ভীর হয়ে আমার দিকে কিছু সময় চেয়ে থেকে বললেন জ্যোতিষবাবু, নায়ক, অথচ সামান্য কথার আঘাতেই মুষড়ে পড়ো? এর পরে দেখবে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে সমস্ত উপলব্ধি হারিয়ে পাথর হয়ে গিয়েছ। প্রথম প্রথম ওরকম হয়।
মেয়েদের দিকে ভাল করে চেয়ে দেখলাম। নায়িকা হবার যোগ্যতা ওদের মধ্যে কারও নেই। বয়স খুব বেশি না হলেও ও পাড়ার একটা বিশেষ ছাপ এরই মধ্যে ওদের অনেকের মুখে স্থায়ী আসন পেতে নিয়েছে।
মনের ভাব বুঝতে পেরেই বোধহয় জ্যোতিষবাবু বললেন, রোজ এরকম ঝুড়ি ঝুড়ি আনাচ্ছি, কিন্তু মৃণালিনীকে খুঁজে পাচ্ছি না।
জরুরি কাজের অছিলায় জ্যোতিষবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরিয়েই দেখি গাল ভর্তি পান-দোক্তা নিয়ে দরজার পাশে উৎকর্ণ হয়ে আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে আছে মনমোহন। আমাকে দেখেই হাসতে গিয়ে বিষম খেতে খেতে অতিকষ্টে সামলে নিয়ে হাত ইশারায় একটু দূরে ডেকে বলল, মেলোমশায়ের কাণ্ডটা দেখেছিস।
বললাম, হ্যাঁ, কিন্তু ব্যাপারটা কী বলতো?
তাচ্ছিল্য ভরে মনমোহন বলল, কে জানে, রোজ গাদাগাদা মেয়ে আসছে, আর বেলা দশটা থেকে ছটা পর্যন্ত বাছাই চলছে।
জিজ্ঞাসা করলাম, কী পার্ট ওদের দেবে বলতো?
–ঝি-এর, নয়তো এক্সট্রার। হয়তো কোনো পার্টই দেবে না। এত করে মেসোমশাইকে বললাম যে, আমার একটি জানালোনা ভাল মেয়ে আছে, তাকে একবার দেখুন। তা দেখা দূরের কথা, উল্টে আমায় কতকগুলো গালাগালি দিয়ে বলে দিল, মেয়েদের সিলেকশনের সময় আমি যেন সেখানে না থাকি।
মনমোহনের ব্যথা কোথায় বুঝলাম। হেসে শুধু বললাম, দাউ টু মনমোহন?
একটু থতমত খেয়ে আবোল তাবোল যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চাইল মনমোহন যে, এটা নিছক পরোপকার ছাড়া আর কিছুই নয়। জানা-শোনা মেয়ে, চেহারা ভাল, অবস্থা খারাপ। যদি তার কিছু উপকার করতে পারে এই আর কী। আরও অনেক কিছু হয়তো বলত মনমোহন, বাধা দিয়ে বললাম, এক কাজ কর তুমি। ভরসা করে আমার সঙ্গে মেয়েটির আলাপ করিয়ে দাও। আমি যদি জ্যোতিষবাবুকে অনুরোধ করি, আশা করি ঠেলতে পারবেন না।
হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল মনমোন আমার মুখের দিকে। তারপর দুর্বার হাসিতে ওর সারা দেহ কেঁপে উঠল। আমার দিকে ঐ ভাবে এগিয়ে আসছে দেখে তাড়াতাড়ি দুপা পিছু হটে ঘুষি বাগিয়ে বললাম, খবরদার! আর না এগিয়ে বসে পড়ল মনমোহন। হাসির রেশ কিছুটা কমলে রুমাল দিয়ে চোখ-মুখ মুছে বলল, দরকার নেই ওর ফিলিমে নেমে।
মনমোহনের হাসিতে এবার আমিও যোগ দিলাম।
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার আগে তাকাই ক্যালেন্ডারের পাতার দিকে। বড় বড় কালো অঙ্কের সংখ্যাগুলো নির্দয়ভাবে মনে করিয়ে দেয় রবিবারের এখনও অনেক দেরি, আজ সবে বুধবার। হতাশায় চোখের পাতা দুটো আপনিই বুজে আসে, চুপ করে শুয়ে থাকি। কখনও ভাবি, উইক-ডেজের মধ্যে একবার খিদিরপুরে সারপ্রাইজ ভিজিট দিয়ে এলে কেমন হয়? তখনই মনে পড়ে দুপুরে রিনি থাকবে স্কুলে আর কাকা আফিসে। বাড়ি থাকবেন শুধু কাকিমা আর মোদা। সুতরাং না যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
দুপুরে খেয়ে-দেয়ে ভাবলাম যাই একবার হেড অফিসে, সময়টা তবু কাটবে। বোধহয় একটু সকাল সকালই এসে পড়েছিলাম। জ্যোতিষবাবুর ঘর খালি, তখনও এসে পৌঁছননি। একখানা চেয়ার টেনে বসে ড্রয়ার থেকে মৃণালিনী বইখানা বার করে লাল নীল পেন্সিলে দাগানো পাতাগুলোর উপর চোখ বুলোত লাগলাম।
কানে এল গুরুগম্ভীর আওয়াজ, কুড ইউ প্লীজ টেল মি হেয়ার ক্যান আই মীট ডাইরেক্টর ব্যানার্জি?
প্রশ্নকারিণী বছর চল্লিশের একটি প্রৌঢ়া অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলা, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসু চোখে আমার দিকে চেয়ে আছেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, দিস ইজ হিজ চেম্বার। হি ইজ একসপেকটেড এনি মোমেন্ট। প্লীজ টেক ইয়োর সীট।
বসলেন না। ঐভাবে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে ডাকলেন, লোলা।
বছর আঠারো-উনিশের একটি গোলগাল মেয়ে মহিলাটির পাশে এসে দাঁড়াল। এ রকম গোল স্বাস্থ্যবতী মেয়ে আমি এই প্রথম দেখলাম। মুখ থেকে শুরু করে দেখলাম, লোলার সর্বাঙ্গ নিটোল গোল। ইচ্ছে করেই টাইট ফিটিং পাতলা গাউনটা পরেছে কিনা জানি না, মনে হচ্ছিল একটু জোরে হাসলে বা চলে কিংবা কোনও রকমে লোলাকে একটু ইমোশনাল করে দিলেই গাউনটা ফেটে চৌচির হয়ে কাপড়ের টুকরোগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে।
লোলাকে সঙ্গে নিয়ে মহিলাটি ঘরে ঢুকে একখানা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। লোলা বসল না, একখানা চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে ঘরময় চোখ বুলিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, মামি, লুক!
ওর বিস্ফারিত চোখ অনুসরণ করে দেখলাম, একখানা ছবিওয়ালা বাংলা ক্যালেন্ডার। যমুনার তীরে কদম গাছে নীল রঙের কেষ্ট পা ছড়িয়ে বসে বাঁশি বাজাচ্ছেন, আশেপাশে ডালে ঝোলানো রয়েছে অনেকগুলো রং-বেরঙের শাড়ি ও ডুরে কাপড়। নীচে যমুনায় হাঁটু-জলে দাঁড়িয়ে গোপিনীর দল এক হাতে কোনও রকমে লজ্জা রক্ষা করে অন্য হাতে কৃষ্ণের কাছে কাপড় চাইছে।
এর আগে অনেকবার ছবিটা দেখেছি কিন্তু আজ যেন ওর অন্য একটা রূপ চোখের সামনে বেশি করে ফুটে উঠল।
লোলার মা কষে এক ধমক দিয়ে উঠলেন–ডোন্ট বি সিলি লোলা, সিট ডাউন!
একটু অপ্রস্তুত হয়েই যেন চেয়ারটায় বসে পড়ল লোলা, তারপর এই প্রথম আমার দিকে চেয়ে দেখল। ড্যাবড্যাবে সরল চাউনি। বুঝলাম, মায়ের কড়া শাসনে এখনও ও-চোখে অন্য পুরুষের ছায়া পড়বার সুযোগ পায়নি।
হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন জ্যোতিষবাবু। সোলার টুপিটা মাথা থেকে খুলে একরকম ছুঁড়ে ফেললেন টেবিলের উপর, তারপর হাতের লাল ফিতে বাঁধা ফাইলটা খুলতে খুলতে বললেন-হাওড়া পুলের উপর গাড়ি জ্যাম। বল কেন আর দুর্ভোগের কথা।
লোলার মাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, হিয়ার ইজ ডাইরেক্টর ব্যানার্জি।
লোলার মার গোমড়া মুখ হাসিতে ভরে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আই অ্যাম মিসেস সিমসন, দিস ইজ মাই ডটার লোলা।
করমর্দনের পালা শেষ করে লোলার দিকে হাঁ করে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন জ্যোতিষবাবু।
মিসেস সিমসন বললেন, হামিদের কাছে শুনলাম, আপনি আগামী নতুন ছবির জন্যে হিরোইন খুঁজছেন, তাই আমার মেয়েকে নিয়ে এসেছি।
হামিদ কোরিন্থিয়ান থিয়েটারের একজন দালাল। মেয়ে সংগ্রহ করাই ওর কাজ।
জ্যোতিষবাবু বললেন, ওর কোনও ফটো আছে কি?
বলা বাহুল্য, কথাবার্তাগুলো ইংরেজিতেই হচ্ছিল। ফটোর কথায় মিসেস সিমসন দ্বিধাভরে মাথা নাড়লেন দেখে, লোলা উৎসাহভরে বলে উঠল, মামি, আমার সেই বেদিং কস্টিউম পরে তোলা ছবিটা–
শুধু একটা চাউনি। কথার চাইতে যে কত বেশি কাজ হয় ওতে, মিসেস সিমানের ছোট একটা চাউনিতে নিমেষে সংকুচিত হয়ে লোলাকে মুখ নিচু করে বসতে দেখে সেদিন হাড়ে-হাড়ে উপলব্ধি করলাম।
মিসেস সিমসন বললেন, না, কোনও ছবি ওর তোলা নেই। যদি বলেন তো একটা তুলে আপনাকে দেখাতে পারি।
জ্যোতিষবাবু বললেন, বেশ কথা, ছবিটা তুলে পরের সপ্তাহে আমাকে দেখাবেন।
বিদায় নমস্কার করে মা-মেয়েতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এতক্ষণে বসে সিগারেট ধরালেন জ্যোতিষবাবু। বললাম, নেবেন না মেয়েটাকে জানি। মিছিমিছি ছবি তুলিয়ে আনতে বললেন কেন?
আমার দিকে চেয়ে নিঃশব্দে সিগারেটে দুতিনটে টান দিলেন জ্যোতিষবাবু, তারপর বললেন, মিছিমিছি নয়, ওর একটা হিল্লে আমি করে দেব।
কিছু না বুঝতে পেরে চুপ করে চেয়ে রইলাম।
জ্যোতিষবাবু বললেন, ঐ হিউম্যান-রোলারকে আমি ইউটিলাইজ করতে পারব না এটা ঠিক। যে পারবে, তার হাতেই তুলে দেব।
হেঁয়ালির কথা। বললাম, কে?
–জাল সাহেব।
কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই দুজনে হো হো করে হেসে উঠলাম। হাসির বেগ একটু কমে এলে জ্যোতিষবাবু বললেন, সাধারণ ফটোটায় যদি দেখি কাজ হল না, তখন ঐ বেদিং কস্টিউম পরা ছবিটা জাল সাহেবকে দেখাতে বলব। ব্যস, নির্ঘাৎ।
আবার হাসতে যাব, একজন বেয়ারা ঘরে ঢুকে সেলাম করে একটা সাদা কাগজের চিরকুট জ্যোতিষবাবুর হাতে দিল। একবার চোখ বুলিয়েই জ্যোতিষবাবু বললেন, যা ভেবেছি তাই একে আসতে দেরি, তার উপর হিরোইন এখনও ঠিক হয়নি। আজ রুস্তমজী সাহেবের কাছে নির্ঘাৎ বকুনি। বেয়ারাটার দিকে চেয়ে বললেন, যাও, গিয়ে বল, আমি যাচ্ছি। আবার সেলাম করে বেয়ারাটা চলে গেল।
ফাইলটা ফিতে দিয়েবেঁধে নিয়ে যাবার সময় জ্যোতিষবাবু বললেন, বসো ধীরাজ, আমি আধঘন্টার মধ্যে আসছি।
হাসি-গল্পে তৰু সময়টা কাটছিল। এখন করি কী? মনের অগোচরে পাপ নেই, সামনে বারান্দাটার উপর একটা সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে গোপিনীদের বস্ত্রহরণের ছবিটা আবার নতুন চোখে দেখতে লাগলাম। কতক্ষণ ঐভাবে ছিলাম মনে নেই। হঠাৎ কী একটা আওয়াজে চমকে ফিরে দেখি, পান-দোক্তাভরা মুখে ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে হাসছে মনমোহন। লজ্জা পাইনি বললে মিথ্যা বলা হবে। ওটা চাপা দেওয়ার জন্যে হেসে বললাম, আজকাল কাজকর্ম ছেড়ে এ-ঘর ও-ঘরে আড়ি পেতে বেড়াস কেন বলতো?
ইচ্ছে থাকলেও কথা কইবার উপায় ছিল না মনমোহনের। খপ করে আমার একখানা হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলল বারান্দার পশ্চিম কোণে। রেলিং-এর কাছে এসে হাত ছেড়ে দিয়ে কাছের একটা নর্দমায় গাল ভর্তি পিক ফেলে চোখ ইশারায় সামনের একখানা ঘর দেখিয়ে চুপি চুপি বলল, দেখ!
দেখলাম।
সামনে দক্ষিণ দিকে ছোট একটা ঘরে একটা চেয়ারে ন্যাশনাল ড্রেসে, মানে কালো পার্শি কোট ও লম্বা টুপি মাথায়, বসে আছেন ম্যাডানের শ্রেষ্ঠ ক্যামেরাম্যান পরিচালক জাল সাহেব। সামনে একটা ছোট টেবিল, তার পাশে আর একখানা চেয়ারে বসে আছেন দেখেই বাকশক্তি রহিত হয়ে গেল আমার। বসা অবস্থাতেই, অনুমান করা মোটেই শক্ত নয়, লম্বা ছফুটের বেশী। মাথায় পাতলা রঙিন ওড়না, চোখে সুরমা, ঠোঁটে রং। পরনে সালোয়ার, আর তার উপর হাঁটু পর্যন্ত ঝোলানো জরিদার ঘাঘা বা ঐ জাতীয় ঢিলে জামা পরে বসে আছে এক বিরাট–।
কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে মনমোহন বলল, পাঠানী, লাহোর থেকে আমদানি করেছে জাল সাহেব।
হাঁ করে চেয়ে আছি। হাসিখুশিতে জাল সাহেবের মুখখানা সিঁদুরের মতো টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। ভাঙা-ভাঙা উর্দুতে কী একটা বলতেই দেখলাম, পাঠানী কপট ক্রোধে খুঁষি বাগিয়ে হাত তুলেছে জাল সাহেবকে মারতে। হাতের কব্জি দেখেই আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। মনে হল, যে কোনো ব্যায়ামবিদের ঈর্ষার বস্তু। হঠাৎ উদ্যত ঘুষি-বাগানো হাতখানা নামিয়ে একটা আঙুল দিয়ে জাল সাহেবের বুকে একটা খোঁচা দিয়ে হাসিতে চৌচির হয়ে ফেটে পড়ল পাঠানী। জাল সাহেবের তো কথাই নেই। ভয় হচ্ছিল, হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়ে না যায়।
অবাক হয়ে বললাম, করছে কী ওরা?
মনমোহন বলল, রিহার্সাল দিচ্ছে।
কী রিহার্সাল দিচ্ছে জিজ্ঞাসা করা বৃথা। জাল সাহেবের সব কাজেই একটা অরিজিন্যাল টাচ থাকবেই। তবুও সংশয়ভরে জিজ্ঞাসা করলাম, বাংলাদেশের হিরোইনরা কী দোষ করল যে লাহোর থেকে–
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মনমোহন বলল, শুধু বাংলা? বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা জাল সাহেবকে হিরোইন না দিতে পেরে লজ্জায় মুখ নিচু করে আছে। শেষকালে কোরিন্থিয়ান থিয়েটারের একজন মুসলমান অভিনেতা দোস্ত মুহম্মদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে জাল সাহেব নিজে লাহোর গিয়ে দিনপনেরো থেকে ঐ মৈনাক পর্বত ঘাড়ে করে কলকাতায় নিয়ে এসেছেন।
কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কী এমন ছবি, যাতে ঐ হস্তিনীকে হিরোইন না করলে চলত না! নাম কী ছবিটার?
উত্তরে এমন একটা খটমট উর্দু নাম করল মনমোহন যা উচ্চারণ করতে দাঁত ভেঙে যায়, চেষ্টা করেও নামটা মনে রাখতে পারিনি। বললাম–ওর নাম কী?
মনমোহন বলল, গুলজার বেগম। দেখছিস না, এসেই নরক গুলজার করে বসেছে! হঠাৎ দৃষ্টি নামিয়ে চোখ দুটো বিস্ফারিত করে মনমোহন বলল, দ্যাখ দ্যাখ টেবিলটার নীচে চেয়ে দ্যাখ।
দেখলাম গুলজার বেগমের বেডরুম মিনার পরা পা দুটো নিয়ে জাল সাহেব ফুটবল খেলছে আর হাসিতে ফেটে পড়ছে।
অজ্ঞাতে একটা মারাত্মক অপরাধ করে ফেললাম, সশব্দে হেসে উঠলাম। পরমুহর্তে দেখি হাসি থামিয়ে দু-জোড়া ক্রোধরক্তিম চোখ আমাদের দিকে চেয়ে আছে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, তারপর জাল সাহেব চেয়ার থেকে উঠে সবলে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
বেশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে দুজনে পরস্পরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। একটু বিরক্ত হয়েই মনমোহন বলল, দিলি তে হেসে সব মাটি করে? নাঃ, তোকে ডেকে আনাটাই ভুল হয়েছে।
হেসে জবাব দিলাম, আরও কিছু দেখবার আশা করছিলি নাকি?
কোনও জবাব না দিয়ে আস্তে আস্তে জাল-গুলজারের সীমানা ছাড়িয়ে পূর্বদিকের রেলিং ধরে রাস্তার দিকে চেয়ে দাঁড়াল মনমোহন। অপরাধীর মতো আমিও পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটু চুপ করে থেকে বললাম, আচ্ছা, তোর কাজ হল কাঁচি দিয়ে ফিল্ম কেটে আঠা দিয়ে সেগুলো জুড়ে দেওয়া। সে সব ছেড়ে সবসময় এর ওর তার পেছনে ঘুরে ঘুরে অকারণে তাদের হাঁড়ির খবর সংগ্রহ করে বেড়াস কেন বলতে পারিস?
বর্ষার আকাশ মনমোহন–এই রোদ্দুর, এই বৃষ্টি। মেঘ কেটে গেল, খুঁতখুঁত করে খানিকটা হেসে নিল। তারপর বলল, এমনি। বন্ধ ঘরে বসে একরাশ ফিল্ম কাটা আর জোড়া আমার ভালই লাগে না। শুধু মেসোমশায়ের ভয়ে মাঝে মাঝে গিয়ে বসি।
জিজ্ঞাসা করলাম, জাল সাহেবের এই নতুন ছবিটার গল্প জানিস?
সবজান্তা মনমোহন তখনি উৎসাহভরে মাথা নেড়ে বলতে শুরু করল, অদ্ভুত গল্প। শুনবি? সাধারণ গল্পে কী হয়, হিবোরই সব বীরত্বের কাজ করে। যুদ্ধ জেতে, দুশমনকে শায়েস্তা করে, এই তো? জাল সাহেবের এ গল্পে ঠিক তার উল্টো। হিরোইনই সব। নায়ক বুদ্ধর মতো মার খেয়ে বাড়ি আসে আর তখন নায়িকা একখানা তলোয়ার নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে অগুনতি শত্রুদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধ করে একাই চার-পাঁচশ লোককে কচুকাটা করে বুক ফুলিয়ে ফিরে আসে। বুঝলি কিছু?
বোকার মতো মাথা নাড়লাম। হেসে ফেলল মনমোহন। তারপর বলল, আরে মুখ, এটা বুঝলি না? ঝাসীর রাণী নাটক থেকে এ আইডিয়াটা জাল সাহেবের মাথায় ঢুকেছে। সাহেবদের বুঝিয়েছে, এ ছবি শিওর হিট।
জিজ্ঞাসা করলাম, ছবিটা কি ঐতিহাসিক?
একটু ভেবে নিয়ে জবাব দিল মনমোহন, না, সামাজিক। হিরো-হিরোইন খুব গরিব, গাঁয়ের শেষ প্রান্তে পাহাড়ের পায়ের কাছে কুঁড়েঘরে বাস করে। সীমান্তের একদল ডাকাত মাঝে মাঝে গ্রামে এসে হানা দেয়, গাঁয়ের লোকজনদের মেরে তছনছ করে। সেই সময় আমাদের এই গুলজার বেগম তলোয়ার হাতে তাদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বে, এবার বুঝলি হাঁদারাম?
জাল সাহেবের বন্ধ দরজাটার দিকে চেয়ে চুপ করে রইলাম।
মনমোহন বলল, সেদিন কোরিন্থিয়ান থিয়েটারের অডিটরিয়ামে বসে গল্পটা পড়া হচ্ছিল। পিছনে অন্ধকারে একখানা চেয়ারে বসে যা শুনেছিলাম, তাই তোকে বললাম।
আমি আবার প্রশ্ন করলাম, হতভাগ্য নায়ক কাকে দেওয়া হল? এর জন্য আবার না জাল সাহেবকে কাবুল কান্দাহার পাড়ি দিতে হয়।
মনমোহন বলল, দূর, তা কেন? কোরিন্থিয়ান থিয়েটারের তালগাছের মতো লম্বা বিশ্রী চেহারার দোস্ত মুহম্মদ, সেই হিরো। আরে সেই বেটাই তো ভুজুং দিয়ে গুলজার বেগমকে আনতে জাল সাহেবকে লাহোর পাঠাল। ও বেশ জানে গুলজার বেগম ছাড়া ওর ভাগ্যে নায়কের পার্ট পাওয়া অসম্ভব। আর তা ছাড়া অন্য কোনও গোপন ব্যাপারও হয়তো আছে, এখনও জানতে পারিনি।
–কত মাইনে ঠিক হল?
–মাসে পাঁচশ টাকা।
অবাক হয়ে যাচ্ছি, হাত তুলে বাধা দিয়ে মনমোহন বলল, শুধু এই? তবে শোন। দিন চারেক আগে দুপুরের দিকে এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে পান খাচ্ছি। একখানা মাল বোঝাই লরি এসে দাঁড়াল। গোটা তিন-চার বদনা, ঘটি, গোটা তিনেক গড়গড়া, গোটা সাতেক বড় বড় বেডিং, ছোট বড় কাপড়ের পোঁটলা গোটা আষ্টেক, তা ছাড়া অনেকগুলো ছোট বড় অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচি হাঁড়ি, দুটো ঝুড়িতে চিনে মাটির প্লেট, চায়ের কাপ–আর কত নাম করব! লরিটার পিছনে তিনখানা ট্যাক্সি, তাতে লোক ঠাসা। প্রথমে ভাবলাম বোধহয় কোরিন্থিয়ান থিয়েটার পার্টি বায়নায় বিদেশ যাচ্ছে। হঠাৎ দেখি, একটা ট্যাক্সির দরজা খুলে নামল জাল সাহেব। আগে শুনেছিলাম হিরোইন আনতে জাল সাহেব লাহোর গিয়েছেন। সমস্ত ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। একরকম ছুটেই নীচে নেমে গেলাম।
ফুটপাথের উপর থেকে একবার উঁকি দিয়েই চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। দেখলাম, তিনখানা ট্যাক্সিতে গুড়ের কলসির মতো ঠাসা গুলজারের সংসার। ওখানে দাঁড়িয়ে কানাঘুষো শুনে শুনে দেখলাম, ওর নানী, ফুফু, ভাবী, গোটা তিনেক ভাই, তাদের আস্ত-বাচ্ছা সব মিলিয়ে সতেরো-আঠারো জন। জাল সাহেব লরির কাছে এসে মাল নামাতে কুম করলেন–এমন সময় দেখি, মদের দোকানটার বাইরে এসে দাঁড়ালেন রুস্তমজী সাহেব। জাল সাহেব তাড়াতাড়ি কাছে এসে ওদের দেখিয়ে কী যেন বললেন। কোনও জবাব না দিয়ে রুস্তমজী সাহেব ঢুকে পড়লেন কাঁচের পার্টিশন দেওয়া ঘরে। হাত মুখ নেড়ে কী সব বলতে বলতে জাল সাহেবও সঙ্গে গেলেন। একটু পরে দেখি, গম্ভীর হয়ে বেরিয়ে এলেন জাল সাহেব। তারপর গাড়িগুলোকে হাত দিয়ে এগিয়ে যেতে বলে গুলজার বিবির ট্যাক্সিতে উঠে বসলেন।
হঠাৎ থেমে গিয়ে পকেট থেকে দলাপাকানো একটা কাগজ বার করল মনমোহন। তারপর সেটা খুলে একটা পান বার করে মুখে পুরে দিল। অসহিষ্ণু হয়ে বললাম, কোথায় নিয়ে গেল ওদের?
হেসে নিয়ে অন্য পকেট থেকে একটা দোক্তার কৌটো বের করে খানিকটা মুখে দিয়ে বলল মনমোহন, রাস্তার দুধারে টু-লেট দেখতে দেখতে মৌলালিতে মনের মতো বাড়ি পাওয়া গেল। সেইখানেই ঐ রাবণের গুষ্ঠি নিয়ে তুলল। বাড়িভাড়া, খাওয়াখরচ, গুলজারের জন্য একখানা গাড়ি ইত্যাদি সব খরচ কোম্পানির। তা ছাড়া মাসে পাঁচশ টাকা মাইনে। বাংলা ছবির হিরো হয়ে কী ঘোড়ার ডিম হবে বলতে পারিস? .
বললাম, এ সব দেখে শুনে কী মনে হচ্ছে জানিস?
জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল মনমোহন।
ম্লান হেসে বললাম, না থাক, বলব না।
.
ভীষণ যুদ্ধ হচ্ছে কুরুক্ষেত্রে।সপ্তরথী মিলে ঘিরে ফেলেছে কিশোর অভিমন্যুকে, আজ আর অর্জুন-তনয়ের নিস্তার নেই। এমন সময় দেখা গেল পাশ দিয়ে চলেছে একখানা খিদিরপুরের ট্রাম। অস্পষ্ট নয়, পরিষ্কার পড়লাম–ট্রামের পাশে বড় বড় করে লেখা রয়েছে খিদিরপুর, প্রথম শ্রেণী, ভাড়া দুপয়সা। সেকেন্ড ক্লাসের গায়েও লেখা দ্বিতীয় শ্রেণী, ভাড়া পাঁচ পয়সা।
ম্যাডান কোম্পানির তোল মহাভারত ছবিটা টিকিট কেটে দেখেছিলাম বছরখানেক আগে এপ্রেস থিয়েটারে। আর সব ভুলে গেলেও অভিমন্যু-বধ দৃশ্যটা স্পষ্ট মনে আছে। তখনকার দিনে পায়োনিয়ার বলতে একমাত্র ম্যাডান কোম্পানিকে ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করাও যেত না। একমাত্র ওঁরাই যা খুশি ছবি তুলে মানুষকে আনন্দ দেবার অছিলায় প্রচুর পয়সা রোজগার করতেন। ব্যতিক্রম দেখা গেল নরেশচন্দ্র মিত্র ও শিশিরকুমার ভাদুড়ীর যৌথ প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা তাজমহল ফিল্ম কোম্পানির তোল দুখানি ছবিতে মানভঞ্জন ও আঁধারে আলো। তারপর। জ্যোতিষবাবুর ম্যাডান কোম্পানির হয়ে তোলা সতীলক্ষ্মী ছবি তখনকার দিনে কর্নওয়ালিস (অধুনা শ্ৰী) থিয়েটারে একাদিক্রমে চৌদ্দ সপ্তাহ চলেছিল। ভাল রকম সাড়া জাগিয়ে এল পি. এন. গাঙ্গুলীর পরিচালনায় ভোলা বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণকান্তের উইল। এই একখানা ছবিতে কাজ করেই দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও সীতা দেবী অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
তখনকার দিনে প্রযোজক হওয়াটা মোটই ব্যয়সাধ্য বা কষ্টকর ছিল না। মাত্র দশ-বারো হাজার টাকা হলেই যে কেউ একখানি ছবি তুলে প্রযোজক হয়ে বসতে পারত। স্টুডিও ভাড়া করার প্রয়োজন কিছু নেই বা সেট-সেটিং-এর বালাই নেই। সামাজিক ছবি হলে পোশাকআশাকের খরচাও নেই। শুধু র-ফিল্ম আর একটা ক্যামেরা ভাড়া করা। ক্যামেরাম্যানের মাইনে আর প্রধান ভূমিকায় যারা নামবে তাদের কিছু টাকা এবং কলকাতার বাইরে গেলে বাড়িভাড়া, থাকা-খাওয়ার খরচা। ব্যস, ছবি হয়ে গেল।
শ্রীধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (ডি.জি.) এই সময়ে দমদমে খানিকটা জমি লিজ নিয়ে ব্রিটিশ ডোমিনিয়ান ফিল্মস নামে এক লিমিটেড কোম্পানি খাড়া করে ছবি তুলতে শুরু করেন। অধুনা বিখ্যাত পরিচালক দেবকী বসু ও প্রমথেশ বড়ুয়া এইখানেই অভিনেতা ও পরিচালক হয়ে যোগদান করেন। বাংলা ছবির বাজার বেশ সরগরম হয়ে উঠল। কলকাতার চারধারে সব নতুন নতুন কোম্পানি গজিয়ে উঠতে লাগল, বেশির ভাগই দু-একখানা ছবি তুলে পটল তুলল। যারা টিকে গেল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইন্ডিয়ান সিনেমা আর্টস। ঘনশ্যামদাস চওখানি নামে একজন ধনী মাড়োয়ারী কালিপ্রসাদ ঘোষকে পরিচালক নিযুক্ত করে কয়েকটি ছবি তোলেন। তার মধ্যে শঙ্করাচার্য, অপহৃত, কণ্ঠহার, নিষিদ্ধ ফল প্রভৃতি তখনকার দিনে জনসমাদর লাভ করেছিল। আর্য ফিল্মস নাম দিয়ে সুবিখ্যাত ইম্প্রেসারিও হরেন ঘোষ এই সময় দুর্গাদাসকে নিয়ে একখানা ছবি তোলেন। ছবিটির নাম বুকের বোঝা। বিখ্যাত পরিচালক নীতিন বসুর এইটাই প্রথম ছবি।
বর্তমান রিগ্যাল সিনেমার ঠিক সামনের রাস্তার উপর একখানা বড় ঘর ভাড়া নিয়ে টেবিল চেয়ার সোফা সাজিয়ে, নিজের ব্যক্তিগত ব্যবসা উপলক্ষে বসতেন হরেন ঘোষ। ব্যবসা কতদুর কী হত বোঝা না গেলেও ঐ ঘরে প্রায় সব সময়ই অধুনাবিখ্যাত ফিল্মের চাঁইদের আড্ডা দিতে দেখা যেত। মধ্য কলকাতার আড্ডা হিসাবে তখন ঐ ঘরটি সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে। ওখানে নিয়মিত যাঁদের দেখা যেত, বীরেন্দ্রনাথ সরকার, ছোটাই মিত্তির, অমর মল্লিক, চারু রায়, প্রফুল্ল রায়, অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, হেম চন্দ্র, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, দীনেশরঞ্জন দাশ, পি. এন. রায় প্রভৃতি তাঁদের অন্যতম। বলা বাহুল্য হবে না, পরবর্তীকালে বিখ্যাত নিউ থিয়েটার্সের পরিকল্পনা ঐ আড্ডাঘরেই জন্মলাভ করে। ইতিমধ্যে চারু রায় ও প্রফুল্ল রায় যথাক্রমে চোরকাটা ও চাষার মেয়ে নামে দুখানি ছবি ওখান থেকেই শেষ করেন।
নির্বাক বাংলা ছবির বাজারে বেশ খানিকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দিল। উত্তর ও মধ্য কলকাতা ছাড়াও আশেপাশে নিত্য নতুন মাশরুম কোম্পানি গজিয়ে উঠতে লাগল। পিছনে পড়ে রইল শুধু দক্ষিণ কলকাতা। তা কি হয়? পূর্ণ থিয়েটারের মালিক মনোময় বন্দ্যোপাধ্যায় (বর্তমান স্বত্বাধিকারী তুলসী বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা) বেশ তৎপর হয়ে উঠলেন। গ্রাফিক আর্টস নামে একটি নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে চারু রায় ও প্রফুল্ল রায়ের পরিচালনায় তিনখানি ছবি পর পর তোলেন–বঙ্গবালা, বিগ্রহ, অভিষেক। তখনকার বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান দেবী ঘোষ স্থায়ীভাবে এই কোম্পানিতে যোগদান করেন। আর একটি বিশেষ কথা এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার। বিখ্যাত অভিনেত্রী উমা দেবী এই প্রতিষ্ঠানেই প্রথম আত্মপ্রকাশ করে প্রচুর জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি লাভ করেন ও পরে নিউ থিয়েটার্সে স্থায়ীভাবে যোগদান করেন।
নির্বাক কৃষ্ণকান্তের উইল-এর মুক্তির পর দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রচুর খ্যাতি লাভ করেন। এরকম অসম্ভব জনপ্রিয়তা কুচিৎ দেখা যায়। টাকাকড়ির ব্যাপারে এই সময় মতান্তর হওয়ায় দুর্গাদাস ম্যাডানের চাকরি ছেড়ে হরেন ঘোষের সঙ্গে যোগদান করেন। বাইরে তখন দুর্গাদাসের একাধিপত্য। তবু ওরই মধ্যে দু একটি নতুন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নায়কের অফার পেলাম। মহা সমস্যায় পড়ে গেলাম। এদিকে আশা আছে ম্যাডানে গাঙ্গুলীমশাই একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা করে দেবেন, আবার ওদিকেও প্রলোভন রয়েছে ভাল টাকার, মানে ম্যাডানে গিরিবালায় ও কালপরিণয়ে যা পেয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি টাকা। কী করি? অগত্যা বাবাকে গিয়ে সব বললাম। বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বাবা বললেন, আমার মনে হয় তোমার ওসব অফার না নেওয়াই ভাল। হাজার হোক ম্যাডান একটা বনেদী প্রতিষ্ঠান। ওরা বরাবর ছবি তুলে যাবে। তাছাড়া গাঙ্গুলীমশাই যখন বলেছেন তখন একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই।
তাই হল। সব ছেড়ে ম্যাডানের মাটি আঁকড়ে পড়ে রইলাম।
আর একটা পরিবর্তন এই সময়ে লক্ষ্য করলাম। আগে, মানে বছরখানেক আগে, যাঁরা বায়োস্কোপে অভিনয় করি বললে নাক সিটকে সরে যেতেন, এখন তারা দেখা হলে বায়োস্কোপের খুটিনাটি খবর জানবার জন্য ছুতোয়নাতায় আলাপ জমাবার চেষ্টা করেন। সামাজিক জীবনে বয়কটের গণ্ডিটা যেন ঢিলে হয়ে উঠল। একটা ঘটনার কথা বলি।
আমাদের বাড়ির ঠিক সামনে অমরেশবাবু বলে এক ভদ্রলোক ভাড়া থাকতেন। উপর-নীচে চারখানা ঘর। বাইরের দরজা খুলে বেরোলেই নজর পড়ে উপরের দুটো জানলার দিকে। দেখতাম পনেরো থেকে বাইশ বছরের চারটি বয়স্কা মেয়ে একটু সাড়া পেলেই এসে দাঁড়ায় ওই জানলা দুটোয়। যে দিন দরজা খুলে বেরিয়ে ওদের দেখতে পেতাম না, সেদিন দুষ্টুমি করে মাকে অথবা ছোট ভাইবোনদের উদ্দেশ্য করে গলা ছেড়ে বলতাম, দরজাটা বন্ধ করে দাও, আমি স্টুডিওতে যাচ্ছি। ব্যস, আর দেখতে হতো না। হয়তো খেতে বসেছিল, সেই অবস্থায় এটো হাতে চার বোনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। কিছুদিন বাদে ওদের দাঁড়ানোটা, আর আমার কোথাও বেরোবার আগে চেয়ে দেখাটা, একটা নেশার মতো হয়ে উঠল। মেয়েরা দেখতে যে খুব অপরূপ সুন্দরী তা নয়, তবুও সব মিলিয়ে ওবয়সে মন্দ লাগত না। আশেপাশের বাড়ির অনেকেই জেনে গেল ব্যাপারটা। সবাই যেন মজা দেখে আর কৌতূহল চেপে অপেক্ষা করে থাকে একটা অঘটনের আশায়।
অমরেশবাবু পোস্ট আফিসের কেরানী। দশটা-পাঁচটার ডিউটি। তাছাড়া সকাল বিকেল দুটো টিউশনি করেন। সংসারে নিজে, স্ত্রী, আর শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আটটি মেয়ে। চারটি বিয়ের যোগ্যা আর চারটি ঘোট, বাড়িতে বাপের কাছেই পড়াশুনা করে। বড় মেয়ে চারটির বিয়ের কথা নিয়েও কানাঘুষো শুনলাম। কেউ বলে অমরেশবাবু হাড়-কেপ্পন, পয়সা খরচের ভয়ে বিয়ে দিচ্ছেন না। একথাও সবাই জানে যে ভদ্রলোক পোস্ট আফিসে টাকা জমিয়েছেন যথেষ্ট, তবুও টাকার নেশা প্রবল। স্ত্রী-পুত্র পরিবারকে বঞ্চিত করে শুধু টাকা জমিয়েই চলেছেন। কেউ বলে ওসব নয়, লোকটা ভয়ানক ধড়িবাজ, কারো সঙ্গে একটা লটঘট পাকিয়ে ফাঁকতালে বিয়েটা দেবার মতলব। হাতে বেশ পয়সা আছে অথচ খরচ করবে না। বাড়িতে অতগুলো লোক, কিন্তু একটা ঠিকে ঝি পর্যন্ত রাখে না লোকটা পয়সা খরচের ভয়ে। সব কাজ মুখ বুজে করেন অমরেশবাবুর স্ত্রী। আমাদের পাড়ার আশেপাশে অনেকেই আমায় অ্যাভয়েড করে চলতেন। হয়তো ভাবতেন, বেশি আলাপ রাখলে একদিন যে লটঘটের অপেক্ষায় অমরেশবাবু বসে আছেন, অপ্রত্যাশিত ভাবে সেইটা আগে তাদেরই সংসারে ঘটে যাবে, নয়তো অন্য কী ভাবতেন তারাই জানেন।
সেদিন স্টুডিও বন্ধ। পাঁচটার পর সিনেমায় যাব বলে সেজেগুজে বেরোচ্ছি অভ্যাসমতো উপরে চেয়ে দেখি চারজোড়া হাসিমাখা চোখ সজাগ প্রহরীর মতো ঠিক ডিউটি দিচ্ছে। আমার ছোট ভাইবোন দুটি স্কুলের পর পার্কে গেছে খেলতে, বাবাও স্কুল থেকে এসে টিউশনিতে বেরিয়ে গেছেন। ঝি-চাকরের বালাই নেই। বাড়িতে আছেন শুধু মা। দরজা বন্ধ করে দেবার জন্য অগত্যা বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁকেই ডাকলাম, তিনি দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলেন। যাবার জন্য পা বাড়াতেই দেখি উপরের জানলায় মেয়েরা নেই। কোন যাদুমন্ত্রে নিমেষে তারা অদৃশ্য হয়ে গেছে। সেখানে দুটো কঠিন হাত দিয়ে লোহার রড দুটো ধরে ক্রুদ্ধ চোখে দাঁড়িয়ে আছেন অমরেশবাবু। মনে হল শাপভ্রষ্ট দুর্বাসা চোখ দিয়ে ভস্ম করার ক্ষমতা অরিয়ে নির্বিষ টোড়া সাপের মতো রুদ্ধ আক্রোশে লোহার রডে মাথা খুঁড়ে মরছে। মনে মনে হেসে আস্তে আস্তে চলে গেলাম।
পরদিন সকালে উঠেই চোখে পড়ল জানলা দুটো পুরু কালো পর্দায় আগাগোড়া ঢাকা। সে আবরণ ভেদ করে ভেতর থেকে হয়তো বাইরের সব কিছু দেখা যায়, কিন্তু বাইরে থেকে দেখা অসম্ভব। সাময়িক একটু দমে গেলেও কিছুদিন বাদে পর্দা প্রথায় অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। বেরিয়েই অভ্যাসমতো পর্দার দিকে তাকাই। দেখতে না পেলেও বেশ অনুভব করি চারজোড়া চোখের উপস্থিতি। আর একটা নতুন জিনিস লক্ষ্য করলাম। আগে সকালে বা বিকেলে অমরেশবাবুকে বাড়িতে দেখতে পাওয়া যেত না। ইদানীং দেখলাম আফিসের সময়টা ছাড়া সব সময়ে তিনি বাড়িতে। কখনো উপরে ঘুরছেন আর বেশীর ভাগ সময় নীচে বাইরের ঘরের দরজা খুলে বসে আছেন। অবাক হয়ে ভাবলাম, ব্যাপার কী? আমার জন্যে ভদ্রলোক টিউশনি ছেড়ে বাড়ি বসে মেয়েদের পাহারা দিতে শুরু করলেন নাকি? একদিন রাত্রে খাওয়ার সময় মার কাছে শুনলাম অমরেশবাবু প্রায়ই উপরের ঘরে দাঁড়িয়ে আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন, আগে যদি জানতাম থিয়েটার-বায়োস্কোপের লোক এ পাড়ায় থাকে, তাহলে কখনো এ বাড়ি ভাড়া নিতাম না। বাড়ি দেখছি, পেলেই উঠে যাব। বাবা নির্বিকার। কথার সূত্র ধরে খানিকক্ষণ হা-হুঁতাশ করে গেলেন। রাগে ভেতরটা আমার রি-রি করে জ্বলতে লাগল। রাত্রে ভাল করে ঘুমোত পারলাম না। মনে মনে কাতরভাবে বললাম-এর শোধ নেবার একটা সুযোগ তুমি আমায় করে দাও ভগবান। কথাটা বোধহয় ভগবান শুনেছিলেন।
আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গলি বেয়ে বড় রাস্তায় পড়তে হলে অমরেশবাবুর : বাইরের ঘরের দরজার সামনে দিয়ে যেতে হয়।
কয়েকদিন পরে যাবার সময় কানে এল, শুনুন।
থমকে দাঁড়িয়ে চেয়ে দেখি বাইরের ঘরের দরজার কাছে চশমাটা নাকের ডগায় নামিয়ে হাতে দৈনিক খবরের কাগজটা দলা পাকিয়ে ধরে এক অপরূপ ভঙ্গিতে আমার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন অমরেশবাবু। বেশ একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, আমায় কিছু বলছেন?
তেমনিভাবেই অমরেশবাবু বললেন, খুব ব্যস্ত না থাকেন তো দয়া করে একটু বসুন। কয়েকটা কথা জানতে চাই।
একবার ভাবলাম বলি যে, দাঁড়াবার সময় নেই। কিন্তু কৌতূহল প্রবল হয়ে উঠল। কোনও জবাব না দিয়ে ঘরের মধ্যে একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। সামনে চুপচাপ বসে খবরের কাগজ নিয়ে উসখুস করতে লাগলেন অমরেশবাবু।
বললাম, কী জানতে চান বলুন? বেশীক্ষণ বসতে পারবো না, কাজ আছে।
একটু ইতস্তত করে অমরেশবাবু বললেন, আমাদের অফিসের কয়েকটি সহকর্মীর কাছে শুনেছিলাম যে শিশির ভাদুড়ী নাকি প্রফেসারি ছেড়ে দিয়ে যোগ দিয়েছে আপনাদের থিয়েটার-বায়োস্কোপের দলে? নরেশ মিত্তিরও তো শুনতে পাই বি. এল. পাশ, প্র্যাকটিস ছেড়ে বায়োস্কোপ করে বেড়াচ্ছেন।
সংযত কণ্ঠে বললাম, ঠিকই শুনেছেন, এইটা শোনবার জন্যেই কি ডেকেছেন?
–হ্যাঁ, কীসের লোভে বলতে পারেন সুনাম, ইজ্জত, প্রতিপত্তি ছেড়ে মনুষ্যজীবনের অমূল্য সম্পদ চরিত্রটি খোয়াতে ওঁরা এই বিপথে পা বাড়িয়েছেন?
সহজভাবেই বললাম, টাকা।
অবাক হয়ে অমরেশবাবু বললেন, টাকা! টাকাটাই কি জীবনের সব চাইতে বড় হল?
বললাম, নিশ্চয়ই, টাকা থাকলে আপনার ঐ অমূল্য সম্পদগুলো আপনিই এসে হাজির হয়। কষ্ট করে খুঁজে বেড়াতে হয় না। এতখানি বয়স হল এটাও আপনাকে বলে দিতে হবে?
ঘরের মধ্যে জানলার খড়খড়িটা যেন একটু ফাঁক হল। নারীকণ্ঠের একটু অস্ফুট চাপা গুঞ্জনও যেন কানে এল, কটমট করে জানলার দিকে একবার দেখে নিয়ে একটু উত্তেজিত ভাবেই অমরেশবাবু বললেন, আপনিও তো শুনলাম ছবছরের পুলিশের চাকরি ছেড়ে
বাধা দিয়ে বললাম, ছেড়ে নয়, ছাড়িয়ে দিয়েছে।
–সে কী, কেন! অবাক হয়ে বললেন অমরেশবাবু।
হেসে জবাব দিলাম, অমূল্য সম্পদটির জন্য। মগের মুলুকে খোদ গভর্নমেন্টের চাকরি করতে গিয়েও ওটা অক্ষত রাখতে পারলাম না। একটা গোলমেলে ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে কেলেঙ্কারির ভয়ে পালিয়ে এলাম। উপরওয়ালা জানতে পেরে দূর করে তাড়িয়ে দিল। এখন বেশ আছি মশাই।
দেখলাম ভদ্রলোক বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছেন, এরকম একটা উত্তর উনি আশাই করতে পারেননি। আমি তখন মরিয়া, মাথায় খুন চেপে গেছে। বললাম, এসব খবর রাখেন আর এটা রাখেন না যে, যাঁদের অনুকরণ করে আমরা বেঁচে আছি, বিশেষ করে ঐ বায়োস্কোপ-থিয়েটারে, তাঁদের দেশে নামকরা অভিনেতা অভিনেত্রীদের স্যার প্রভৃতি সম্মানজনক উপাধিতে ভূষিত করা হয়? এমন কি রাজা-রাণীও তাঁদের নেমন্তন্ন করে এক টেবিলে বসে খানা খেতে ইতস্তত করেন না?
একটু আগে অবাক হয়ে যে হাঁ করেছিলেন, দেখলাম সেটি বন্ধ করতে ভুলে গিয়ে অমরেশবাবু ঠায়, তেমনি আমার দিকে চেয়ে বসে আছেন। হাসি পাচ্ছিল, অতি কষ্টে চেপে বললাম, আজ দুজন শিক্ষিত গুণীলোক বায়োস্কাপ করতে নেমেছে শুনেই নাক সিঁটকোচ্ছেন। কিন্তু যেদিন ঐ দুয়ের সংখ্যা দুশোয় দাঁড়াবে সেদিন এতখানি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাদের সম্বন্ধে কথা কইতে আপনার রুচিতে বাধবে।
উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অমরেশবাবু বললেন, কখনোই না। বায়োস্কোপ থিয়েটারের লোক কোনোদিনই কারও সম্মান পাবে না। আর ঐ সব চরিত্রহীনদের জীবনের মূল্যই বা কী?
রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে উঠে অমরেশবাবুর মুখের দিকে চেয়ে বললাম, একটু আছে। বায়োস্কোপ-থিয়েটারের লোক হলেই চরিত্রহীন হবে কি হবে না এ নিয়ে আপনার মতো লোকের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। আর সে প্রবৃত্তিও আমার নেই। শুধু একটা কথা বলে যাচ্ছি, পৃথিবীতে মানুষের খোলস নিয়ে জন্মে শেয়াল কুকুরের মতো কত অগুনতি জানোয়ার খেয়েদেয়ে বংশবৃদ্ধি করে সবার অগোচরে রোজ টুপটাপ করে মরে যাচ্ছে তাতে হচ্ছে কী? ঐ অসংখ্য চরিত্রবান জীবগুলোকে মনেই বা রাখছে কে? আপনার কথাই ধরুন। ভগবান না করুন, কাল যদি হঠাৎ হার্টফেল করে আপনি মারা যান, দোর বন্ধ করে কাঁদবে আপনার একপাল মেয়ে আর স্ত্রী। ব্যস, চুকে গেল। আর এদিকে দেখুন, কাল যদি শিশির ভাদুড়ী কিংবা নরেশ মিত্তির এমনকি কাল কা যোগী আমিই হঠাৎ মরে যাই, খবরের কাগজগুলোয় খুব ছোট্ট করে হলেও খবরটা বেরোবে, আর খুব কম করে দুশ লোক শ্মশানে গিয়ে এইসব চরিত্রহীনদের উদ্দেশে সমবেদনার একফেঁটা চোখের জল, নয়তো একটা মৌখিক আহা অন্তত বলে আসবে। এইটাই কি কম লাভ?
দেখলাম রাগে সর্বাঙ্গ কাঁপছে অমরেশবাবুর। চেষ্টা করেও কথা কইতে পারছেন না। শুনেছিলাম পূর্ববঙ্গে বাড়ি, বহুদিন এদেশে আছেন বলে কথাবার্তায় কিছুই ধরা যায় না। শুধু উত্তেজিত হয়ে উঠলে বা রাগলে দুএকটা দেশের কথা বেরিয়ে পড়ে। প্রাণপণে নিজেকে সংযত করবার চেষ্টা করেও পারলেন না, রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, বোঝলাম, আপনি অখন যাইতে পারেন!
বিজয়ী সেনাপতির মতো হেসে নমস্কার করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। অনেকদিন বাদে মনটা হাল্কা হয়ে গেল। আনন্দাতিশয্যে নগদ তিন আনা খরচা করে চড়কডাঙার মোড়ে লক্ষ্মীর চায়ের দোকানে ঢুকে এক আনার একটা বড় মটন চপ, আর দু আনার একটা ডিমের ডেভিল খেয়ে ফেললাম।
দিনতিনেক বাদে একদিন সকালে উঠে অবাক হয়ে দেখলাম অমরেশবাবুর জানলা-দরজা সব বন্ধ। ব্যাপার কী? বাড়িওয়ালার কাছে শুনলাম আট মাসের বাড়িভাড়া মেরে দিয়ে ভদ্রলোক রাতারাতি অমূল্য সম্পদ বাঁচাতে অজ্ঞাতবাসে চলে গেছেন।
খুব খুশি হতে পারলাম না, হাজার হোক এতদিনের অভ্যাসটা—।
.
শনিবার সকাল সকাল খেয়ে কাপড়চোপড় পরে তৈরি হয়ে রইলাম। আজ কালপরিণয় ছবির কোর্ট সিনটা নেওয়া হবে। এইটাই শেষ শুটিং। বেশ একটু বেলায় গাড়ি নিয়ে এল মুখার্জি, এসেই হতাশ ভাবে বলল, নাঃ, হল না।
–কী হলো না?
–আলিপুর কোর্ট থেকে আসছি। অনেক চেষ্টা করে দেখলাম কোর্টের ভিতর রিফ্লেকটার ও তিন চারখানা বড় আয়না দিয়েও আলো ঢোকানো যাবে না।
বললাম, তা হলে উপায়?
বিজ্ঞের হাসি হেসে মুখার্জি বলল, উপায় একটা করেছি বৈকি! আমার আগেই সন্দেহ ছিল, সেইজন্য খরবুজ মিস্ত্রিকে সঙ্গে করে তিন-চারদিন আগে আলিপুর আদালত ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছি। সে তৈরি করেছে কাঠের ফ্রেম, আর তার উপর কাপড় এঁটে রং লাগিয়েছেন দীনশা ইরাণী। কাল সারাদিন ধরে সিনটা ফিট করেছি। চল দেখবে। সিনটা দেখলেই মনে হবে আলিপুরের ম্যাজিস্ট্রেটের বিচারকক্ষটিকে যেন আলাদিনের মতো স্রেফ তুলে এনে বসিয়ে দিয়েছে ম্যাডানের সিমেন্ট করা ফ্লোরটার উপর।
দীনশা ইরাণী, বর্তমানে ইন্দ্রপুরী স্টুডিওর নাম করা রেকর্ডার জে, ডি, ইরাণীর পিতা। তখনকার দিনে উনি ছিলেন ম্যাডানের একসকুসিভ আর্ট ডাইরেক্টর ও পেন্টার। কোরিন্থিয়ান থিয়েটারের ও স্টুডিওর যাবতীয় সিনসিনারি ওঁরই নিজস্ব তত্ত্বাবধানে তৈরি হতো।
স্টুডিওতে পৌঁছে তাড়াতাড়ি মেক-আপ রুমের দিকে চলে গেলাম। টালিগঞ্জ ট্রামডিপোর পিছনে রেলিং-এর গা ঘেঁষে যে ছোট্ট লাল রঙের ঘরখানা দেখা যায় সেইটাই ছিল তখন সবেধন নীলমণি মেক-আপ রুম। বর্তমানে ওটাকে ইলেকট্রিক জেনারেটিং রুম করে ব্যবহার করা হয়।
মেক-আপ রুমে তিল ধারণের স্থান নেই। সাদা প্যান্ট আর কালো কোট গিসগিস করছে। মুখার্জি এসে বলল, কোনো রং নয়, শুধু পাউডার আর কালো পেন্সিল দিয়ে চোখ-ভুরু এঁকে ছেড়ে দাও।
এখানে বলা দরকার মাস দুই থেকে মেক-আপের জিনিসপত্তরও বদলে গেছে। সবেদা পিউড়ির পরিবর্তে চালু হয়েছে জার্মানীর লিচনার কোম্পানির স্টিক পেন্ট, গায়ের রং অনুসারে শেড নম্বর দেওয়া। কাজল দিয়ে চোখ-ভুরু আর আঁকতে হয় না। এসেছে কালো পেন্সিল। আলতার স্থান অধিকার করেছে লিপস্টিক। প্রথম প্রথম ভয়ানক অসুবিধা হতো, পরে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।
আমার ওসব বালাই ছিল না। তিন-চারদিন না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ভুসো কালি মাখিয়ে ঘন করে নিলাম যাতে আগের সিনের সঙ্গে কন্টিনিউইটি ব্যাহত না হয়। তেল-না-মাখা রুক্ষ চুলগুলো ফাঁপিয়ে আরও উস্কোখুস্কো করে নিলাম। তারপর রাজবেশ, সেই ছেঁড়া তালি দেওয়া কোটটি আর শতচ্ছিন্ন ময়লা কাপড়।
পোশাক পরে ভুসো কালি আঙুলে করে চোখের নীচটায় লাগাতে যাচ্ছি, কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে মুখার্জি বলল, এদের মধ্যে বেশির ভাগই সত্যিকারের উকিল। আলিপুর বটতলা থেকে ধরে এনেছি।
চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, কত দিতে হবে?
এক পয়সাও না। ছবিতে নামছে এই ঢের। আবার পয়সা! উকিলদের আর একবার তাড়া দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মুখার্জি।
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই শুটিং শুরু হল, প্রথমে নেওয়া হল একটা লঙ শট কোর্টের অ্যাটমসফিয়ারের জন্যে। তারপর সব ক্লোজ শটে নেওয়া হল–আমার, নরেশদার ও হাকিমের সিনগুলো। পাঁচটার মধ্যেই শুটিং শেষ হয়ে গেল।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে ক্যালেন্ডারের দিকে চেয়ে মনে করতে হল না যে আজ আমার বহু আকাঙিক্ষত রবিবার। দাড়ি কামিয়ে, মাথায় বেশ করে তেল মেখে, সাবান দিয়ে স্নান করে খেয়েদেয়ে বারোটার আগেই রওনা হয়ে পড়লাম খিদিরপুরে। রিনিদের বাইরের দরজায় কড়া নাড়তে না নাড়তেই দরজা খুলে গেল। সামনে বিষাক্ত সাপ দেখলে যে অবস্থা হয়, ঠিক তেমনি ভাবেই এক পা পিছু হটে অবাক বিস্ময়ে হাঁ করে চেয়ে রইলাম।
দরজা খুলে সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে রিনি নয়, রায়বাহাদুরের মেয়ে গোপা।
আমার অবস্থা দেখে গোপা হেসে বলল, দয়া করে ভেতরে আসুন। আমাদের রানাঘর থেকে ওখানটা পরিষ্কার দেখা যায়।
লজ্জা পেয়ে ভিতরে এসে দরজাটা বন্ধ করতেই হাততালি দিয়ে হাসতে হাসতে ভাঁড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এল রিনি। গোপাকে জড়িয়ে ধরে বলল-কেমন, বলিনি গোপাদি, আজ হোড়দাকে বোকা বানিয়ে দেব?
বাকশক্তি ফিরে এল। কপট রাগের ভান করে বললাম, চলো উপরে, কাকাতক বলে আজ মজা দেখাচ্ছি তোমার।
কিছুমাত্র না দমে আবার হাসতে লাগল রিনি।
গোপা বলল, ছোট ভাইবোনদের নিয়ে রিনির মা-বাবা সকালে অফিসের এক বন্ধুর বাড়িতে নেময়ে গেছেন। ফিরতে সেই সন্ধ্যে। বাড়িতে আছে শুধু রিনি আর মোদা।
রিনি বলল, মোক্ষদা আবার কানে কম শোনে।
তিনজনেই হেসে উঠলাম। রিনি বলল, বারে, এইখানে দাঁড়িয়েই কথাবার্তা কইবে নাকি? উপরে চল।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললাম, তোকে একা রেখে কাকা-কাকিমা গেল যে বড়?
রিনি বলল, এমনিই কি গিয়েছে, আমার যে জ্বর। তাছাড়া সামনে এগজামিন, পড়াশুনার ক্ষতি হবে যে!
বললাম, পড়াশুনা যা করছিলি তাতে নিজের চোখেই দেখলাম। আর জ্বর–
উপরে উঠে দেখি তক্তপোশের উপর একটা মাদুর পাতা, একটা মাথার বালিশ ও চাদর রয়েছে একপাশে। বুঝলাম সত্যিই রিনি অসুস্থ। গোপা তাড়াতাড়ি ওদের বাড়ির দিককার জানলাটা বন্ধ করে দিল। তারপর মাদুরটার একপাশে বসে বলল, বসুন।
সকালে আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম জানিনা। দূর থেকে শুধু দেখা নয়, একেবারে পাশে বসে কথা কওয়া। দুরুদুরু বক্ষে একপাশে অপরাধীর মতো বসে পড়লাম। এরই মধ্যে দেখি রিনি চাদরটা গায়ে জড়িয়ে বালিশটা মাথায় দিয়ে শুয়ে একদৃষ্টে আমাদের দিকে চেয়ে হাসছে।
গোপা বলল, আপনি আমায় এ বাড়িতে দেখে খুব অবাক হয়ে গেছেন, না? মাসিমা, মানে রিনির মা, যাবার সময় আমায় ডেকে বললেন, মেয়েটা একলা রইল, যদি পারো দুপুরে এসে ওর ইংরেজি পড়াটা একটু দেখিয়ে দিও।
বালিশ থেকে মাথা তুলে ফোঁস করে উঠল রিনি, ওঃ, সেই জন্যেই বুঝি তুমি সুড়সুড় করে চলে এসেছ গোপাদি? জান ছোঁড়া, তুমি আসবার আগে অন্তত চার-পাঁচবার জিজ্ঞাসা করেছে গোপাদি, তোমার ছোড়দা আসবেন তো রিনি?
–আঃ রিনি। বাধা দিল গোপা। লজ্জা পেয়ে আবার শুয়ে পড়ল রিনি। মুখ নীচু করে মাদুরটার একটা ধার নখ দিয়ে খুটতে খুটতে গোপা বলল, হ্যাঁ সত্যি, আপনি না এলে আজ ভারি দুঃখ পেতাম। আমার সেদিনকার ব্যবহারে আপনি আমায় অভদ্র ইতর এই রকম অনেক কিছু ভেবে নিয়েছেন হয়তো, আর ভাবাটাই স্বাভাবিক। তাই সব কথা আপনাকে জানিয়ে ক্ষমা চাইব বলে রিনিকে আপনি আসবেন কিনা জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
বললাম, আপনি কেন এর জন্যে নিজেকে অপরাধী মনে করে মিথ্যে দুঃখ পাচ্ছেন? রিনি আমাকে বলেছে কেন ওভাবে হঠাৎ আপনি জানলা বন্ধ করে চলে গিয়েছিলেন।
গোপা বলল, রিনি আন্দাজ করেছিল মাত্র, সব কথা না শুনলে আপনি বুঝতে পারবেন না।
মনে মনে অবাক হয়ে ভাবছিলাম, আমার মতো একজন সমাজের তুচ্ছ অবজ্ঞাত নায়কের ভ্রান্ত ধারণা নিরসনের জন্য গোপার মতো মেয়ের এত মাথাব্যথা কেন? সম্ভব-অসম্ভব অনেক রকম যুক্তি দিয়েও কোনো কূল-কিনারা পেলাম না। হাল ছেড়ে দিয়ে ভাবলাম, দুয়ে নারীচরিত্র দেবা ন জানন্তি, আমি তো কোন ছার!
গোপা বলে চলল, আমাকে দেখে ভাবছেন কলেজে-পড়া মেয়ে, গায়ে পড়ে সিনেমার নায়কের সঙ্গে আলাপ করে, নিশ্চয়ই বাড়ির অভিভাবকরা খুব লিবারেল। ভুল, মস্ত ভুল ধারণা। আমার মা উগ্র সেকেলেপন্থী। তার মতে চলতে হলে আরো দুতিনটে যুগ পিছু হটে যেতে হয়। তিনি চান মেয়েরা বেশি লেখাপড়া শিখবে না। থেমে থমকে বড় জোর সুর করে রামায়ণ-মহাভারতটা পড়বে আর গোয়ালা ও ধোপার হিসেবটা রাখবে। পুরুষের সান্নিধ্য একদম পরিহার করে চলবে। বয়স দশ এগারো হলেই অভিভাবকরা বিয়ে দিয়ে গৌরীদানের অক্ষয় পুণ্য সঞ্চয় করবেন। সেই থেকে দেড় হাত ঘোমটা টেনে শ্বশুরবাড়ি আসবে। শ্বশুর-শাশুড়িস্বামীর সেবা থেকে শুরু করে মায় রান্না পর্যন্ত সংসারের যাবতীয় কাজ নিজের হাতে তুলে নেবে। ছেলেপিলে হলে তাদের মানুষ করবে এবং বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেলে প্রাণপণে চেষ্টা করে আগে মরে ইহলোকে সতীত্বের ডঙ্কা বাজিয়ে পরলোকে স্বর্গের সিঁড়ির ধাপগুলো আঁচল দিয়ে মুছে পরিষ্কার করে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করবে।
রিনি হেসে উঠল। ওর দিকে একবার দেখে নিয়ে শান্তকণ্ঠে আবার শুরু করল গোপা, আমার বাবা কিন্তু ঠিক উল্টো। তিনি চান মেয়েরা শিক্ষায় দীক্ষায় পুরুষের সঙ্গে সমান তালে পা ফেলে চলবে, সাংসারিক জ্ঞান-বুদ্ধি হবার পর নিজে দেখে পছন্দমতো বিয়ে করবে। সংসারে অনটন বুঝলে স্বামীর সঙ্গে চাকরির সন্ধানে বেরোতেও দ্বিধা করবে না।
একটু থেমে আমার মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল গোপা। আমার জিজ্ঞাসু চোখের ভাষা বুঝতে পেরেই বোধহয় বলতে শুরু করল, আমি যথাসম্ভব আমার বাবার মতবাদকে অনুসরণ করবার চেষ্টা করি, মায়ের ভয়ে সব সময় পেরে উঠিনা। তাইতো সেদিন মায়ের সাড়া পেয়ে হঠাৎ জানলা বন্ধ করে সরে গিয়েছিলাম। কাজটা খুব অশোভন ও অন্যায় হয়েছিল স্বীকার করছি, কিন্তু সাংসারিক অশান্তি ও কেলেঙ্কারি এড়াবার ছাড়া আর পথও বা কী ছিল বলুন তো?
এস্রাজে পাকা দরদী হাতের দরবারী কানাড়ার আলাপ শুনছিলাম এতক্ষণ। থেমে যেতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে ভাবছিলাম শ্রোতার আসনে বসে অনায়াসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারি শুধু কাছে বসে গোপা যদি কথা বলে যায়। অপূর্ব সুরেলা কণ্ঠ গোপার। চেয়ে দেখি এরই মধ্যে কখন রিনি উঠে গেছে। নির্জন বারান্দায় পাশাপাশি বসে আছি শুধু আমি আর গোপা। চুপ করে থাকি, কিছু বলবার চেষ্টা করি, কথা খুঁজে পাই না।
হঠাৎ রিনির কথায় চমক ভাঙে, নীচ থেকে উঠে সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে টোল-খাওয়া গালে দুষ্টুমির হাসি মাখিয়ে রিনি বলল, তোমাদের দুজনকে ওভাবে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখে আমার কী মনে হচ্ছে জান?
শঙ্কিত চোখে দুজনে তাকাই রিনির দিকে, না জানি দুষ্ট মেয়েটা কী কথা বলে ফেলে।
আমাদের অবস্থা দেখে খিলখিল করে হেসে রিনি বলে, না বাবা, বলব না। জানি ছোড়দা খুশিই হবে কিন্তু গোপাদি যদি রাগ করে?
বেশ রেগেই বললাম, শুধু গোপাদি নয়, আমিও ভীষণ রাগ করব রিনি। এরকম ফাজলামি যদি কর, আর কখনও তোমাদের বাড়ি আসব না।
তুই থেকে তুমি সম্বোধনে রিনির মুখের হাসি নিমেষে মিলিয়ে গেল। ও বেশ বুঝতে পারল আমি সত্যিই রাগ করেছি।
মুখখানা কাঁচুমাচু করে কাছে এসে বলল, আমায় মাফ কর ছোড়দা।
আদর করে কাছে টেনে নিয়ে গোপা বলল, ওরে দুষ্টু মেয়ে, মনে হওয়া সব কথাগুলো যদি সবাই ভাষায় রূপ দিয়ে প্রকাশ্যে ছেড়ে দিত, পৃথিবীতে তাহলে এতদিনে বিপ্লব শুরু হয়ে মানুষের অস্তিত্ব পর্যন্ত লোপ পেয়ে যেত।
প্রসঙ্গটা চাপা দেবার জন্যে বললাম, আপনি নিশ্চিন্ত মনে এখানে বসে গল্প করছেন, ওদিকে আপনার মা যদি বাড়িতে দেখতে না পেয়ে ইচ্ছে করেই শেষ করলাম না কথাটা।
একটু গম্ভীর হয়ে গোপা বলল, আজ অমাবস্যা, সেদিক থেকে কোনো ভয় নেই।
কিছু বুঝতে না পেরে চেয়ে রইলাম। রিনিও দেখি বেশ একটু অবাক হয়ে চেয়ে আছে। গোপা বলল, অমাবস্যা ও পূর্ণিমা এই দুটো দিন আমরা মায়ের প্রভাবমুক্ত। কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম।
কপট গাম্ভীর্যের আবরণ খসে গেল, হেসে ফেলল গোপা। বলল, বুঝতে পারলেন না? আমার মা খুব মোটাসোটা মানুষ। কাজেই সায়েটিকা বাতের হাত থেকে নিস্তার পাননি। অমাবস্যা আর পূর্ণিমায় বাতের ব্যথা খুব বেড়ে যায়, মা একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। আর ঐ সময়ে পেয়ারের ঝি হরিমতি ছাড়া আর কারও মায়ের ঘরে প্রবেশ নিষেধ।
তিনজনে একসঙ্গে হেসে উঠলাম। হঠাৎ জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে হাসি থেমে গেল রিনির। ভয়ে পাংশু মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সর্বনাশ! গোপাদি, মা-বাবা!
উঠে উঁকি দিয়ে দেখি, রিনির মা-বাবা ছোট ভাইবোনকে নিয়ে বড় রাস্তা ছেড়ে গলির পথ ধরছেন। এতক্ষণ সময়ের হিসেব ছিল না। সন্ধ্যে হয় হয়। এ অবস্থায় রিনির মা-বাবা আমাদের তিনজনকে একসঙ্গে দেখলে যা ভাববেন, কল্পনা করেও আঁতকে উঠলাম।
–কী হবে গোপাদি?
–তোমাদের ঝি মোক্ষদা কোথায়?
–এই তো একটু আগে তাকে বার করে বাইরের দরজা দিয়ে এলাম। আজ বাড়িতে রান্নার হাঙ্গামা নেই বলে মা ওকে এ-বেলা ছুটি দিয়ে গেছেন।
অদ্ভুত বুদ্ধিমতী মেয়ে গোপা। এক মিনিট চিন্তা করে বলল, নিচে চল শিগগির, আমি ভাড়ার ঘরে লুকিয়ে থাকব, তোমার মা-বাবাকে দরজা খুলে দাও। ওঁরা উপরে এলে আমি বেরিয়ে যাব, তারপর দরজা বন্ধ করে তুমি উপরে উঠে আসবে।
কথা শেষ হবার আগেই বাইরের দরজার কড়া নড়ে উঠল। রিনি ও গোপা তাড়াতাড়ি নীচে নেমে গেল। চুপ করে তক্তপোশের একপাশে বসে রইলাম। কাকা আগে এলেন, আমায় দেখে একটু অবাক হয়েই যেন বললেন, এই যে, তুমি কতক্ষণ?
যা কপালে থাকে, বলে ফেললাম, এই ঘন্টাখানেক আগে। বাড়িতে কেউ নেই, তাই রিনি বলল, মা বাবা না আসা পর্যন্ত যেতে পারবে না।
পেছন থেকে কাকিমা বললেন, তা বেশ করেছিস। ঐ একফোঁটা মেয়েকে একলা বাড়িতে রেখে গেছি। আমি অনেকক্ষণ থেকে ছটফট করছি আসবার জন্যে, তো ওঁর আর গল্পই শেষ হয় না।
দরকারি অদরকারি দুচারটে সাংসারিক কথাবার্তার পর বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম যখন, রায়বাহাদুরের পেটা ঘড়িতে তখন ঢং-ঢং করে সাতটা বাজছে।
ট্রামে সারাটা পথ শুধু গোপার কথাই ভাবতে ভাবতে এলাম। বাড়ি আসতেই বাবা বললেন, এলফিনস্টোন পিকচার প্যালেস (বর্তমান মিনার্ভা সিনেমা) থেকে গাঙ্গুলীমশাই ডেকে পাঠিয়েছেন। বলেছেন যতই রাত হোক তার সঙ্গে দেখা করা দরকার।
ভাবলাম ব্যাপারটা কী? কালপরিণয় শুটিং তো শেষ–তবে কী?
বাবা বললেন, বোধহয় ভাল খবর হবে, তোমার জন্যে হয়তো একটা মাস মাইনে ঠিক করেছেন।
বাবার অনুমানই ঠিক বলে মনে হল। বহুবার একটা বাঁধা মাইনে করে দেবার জন্যে গাঙ্গুলীমশাইকে জ্বালাতন করেছি। তাছাড়া গিরিবালা ও কালপরিণয় ছবি দুটোতে কাজ ভালই করেছি, সুতরাং একটা ভাল মাইনে আশা করা খুব অন্যায় নয়। কাপড়চোপড় না ছেড়েই বাবা-মার পায়ের ধুলো নিয়ে ধর্মতলার ট্রামে উঠে কলাম।
এলফিনস্টোন পিকচার প্যালেসের লবিতে ঢুকেই বাঁ হাতে পড়ে একটা বুকিং কাউন্টার। তার মধ্যে দিয়ে গিয়ে একটা বড় ঘর। সেইটাই গাঙ্গুলীমশাইয়ের অফিস। সিনেমার ম্যানেজারি, স্টুডিওর শুটিং-এর যাবতীয় প্রাথমিক কাজকর্ম এখানে বসেই করেন তিনি।
ঢুকেই দেখি ঘরভর্তি লোক। নমস্কার করে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু বাদে গাঙ্গুলীমশাই বললেন, একটু ঘুরে এস ধীরাজ, বড় ব্যস্ত।
বেরিয়ে লবিতে এসে দাঁড়ালাম। আগামী ছবিগুলোর ফটো দেওয়ালে চারদিকে বোর্ডে টাঙানো, ঘুরে ঘুরে সেগুলো দেখতে লাগলাম। একটা বোর্ডের কাছে এসে দেখি নির্বাক বিখ্যাত ছবি শো-বোট এর কতকগুলো পুরোনো ফটো, উপরে বড় বড় ছাপার অক্ষরে লেখা রয়েছে–সাউন্ড সিনক্রোনাইজড, চল্লিশ পারসেন্ট টকি। টকি জিনিসটাই তখনও ভাল করে বুঝিনি। শুধু লোকপরম্পরায় ও দুএকটা ইংরেজি সিনেমায় দেখতাম,আমেরিকা ছবিকে কথা কওয়াবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। তারিখটা দেখলাম সামনের শনিবার। হঠাৎ দেখি ব্যস্তসমস্তভাবে মুখার্জি বেরিয়ে আসছে গাঙ্গুলীমশাইয়ের ঘর থেকে। অকূলে কূল পেলাম যেন। ডাকতেই কাছে এসে দাঁড়াল মুখার্জি। বললাম, সাউন্ড সিনক্রোনাইজড, চল্লিশ পারসেন্ট টকি, এগুলোর মানে কী মুখুজ্যে?
কোনও জবাব না দিয়ে অনুকম্পাভরা দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইল মুখার্জি। তারপর হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, না, তুমি একেবারে হোপললস। চল্লিশ পারসেন্ট টকি মানে ছবিটা পুরোপুরি সবাক নয়, এটাও বুঝতে পারলে না?
বললাম, তা বুঝেছি, নির্বাক শো-বোট আমি দেখেছি, বোর্ডের স্টীল ছবিগুলো দেখেও মনে হচ্ছে এটা সেই পুরোনো ছবিটা। তাহলে ও কথাগুলোর মানে কী?
মুখুজ্যে বলল, নির্বাক ছবিটায় পল রোবসনের গান শুনতে পেয়েছিলে কি?
বললাম, না।
মুখুজ্যে বলল, এটায় পাবে।
চল্লিশ পারসেন্ট টকি কথাটার মানে বুঝলাম এতক্ষণে। বললাম, আর ঐ যে লেখা আছে সাউন্ড সিনক্রোনাইজড, ওটার মানে?
সামনে লক্ষ্যহীন দৃষ্টিতে চেয়ে কী যেন ভাবল মুখার্জি, তারপর মৃদু হেসে বলল, ওসব সায়েন্সের গোলমেলে ব্যাপার, তুমি বুঝবে না। বলেই যাবার জন্যে পা বাড়াল মুখার্জি। একরকম ছুটে গিয়েই ধরলাম ওকে। বললাম, ঐ দুটো কথার মধ্যে বিজ্ঞানের কী বাঘ-ভালুক লুকিয়ে থাকতে পারে বুঝতে পারছি না, বল না ভাই মুখুজ্যে?
দাঁড়িয়ে আশেপাশে চারদিকে দেখে নিয়ে চুপিচুপি বলল মুখার্জি, সত্যি কথাটা বলতে কী, ঐ সাউন্ড সিনক্রোনাইজড কথাটার মানে আমি নিজেই ভাল বুঝতে পারিনি। বলেই কপোরেশন বিল্ডিং-এর উত্তর দিকের রাস্তা ধরে হনহন করে হাঁটতে শুরু করল মুখার্জি।
খুব ছোটবেলায় ঠাকুরদার কাছে শোনা একটা গল্প মনের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠল।
অনেক-অনেকদিন আগে,বোধহয় ইংরেজ আমলেরও আগে,বাংলাদেশের একটি ছোট গ্রামে গল্পটির জন্ম হয়। গাঁয়ের অধিকাংশ লোকই অশিক্ষিত; দুএকজন একটু আধটু লিখতে পড়তে পারে। বিদেশে যাওয়া দুরের কথা, বেশির ভাগ লোকই গাঁয়ের বাইরে পা বাড়ায়নি। কিন্তু তাতে তাদের কোনোদিন কোনো অসুবিধেয় পড়তে হয়নি। চুরি-ডাকাতি থেকে শুরু করে সামাজিক জীবনের যত দুরূহ সমস্যাই হোক না কেন, এককথায় জলের মতো মীমাংসা করে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারতেন গ্রামের মাত্র একটি লোক। তিনি গাঁয়ের মোড়ল শ্রীবিষ্ণুপরমেশ্বর গড়গড়ি। বয়স একশো দশ পার হয়ে গেলেও মোড়ল অথর্ব বা অকর্মণ্য হয়ে পড়েননি। প্রায়ই দেখা যেত ষোল বেহারার পাল্কি চড়ে মোড়ল চলেছেন কোনো না কোনো ব্যাপারের মীমাংসা করতে। মোট কথা মোড়ল যা করবে তাই। তার উপর কথা কইবার সাহস বা ক্ষমতা কারও ছিল না।
গাঁয়ের শেষ প্রান্তে পথের ধারে এক বিরাট গর্ত। বোধহয় পুকুর কাটবার মতলবে শুরু হয়ে কী কারণে বন্ধ হয়ে যায়। দৈবাৎ একটা দলছাড়া হাতি কী করে যেন ঐ গর্তে পড়ে যায়। নিশুতি রাতে একটা বিকট আর্তনাদ শুনে কৌতূহলী গাঁয়ের লোক সব জড়ো হয় গর্তের চারপাশে। গর্তের মধ্যে অদ্ভুত একটা প্রকাণ্ড জানোয়ার দেখে ওরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। চোখে দেখা দূরে থাক, এরকম একটা বিরাট জীবের অস্তিত্বও এতদিন ওদের কল্পনাতীত ছিল। সবাই মিলে ঐখানে বসেই গবেষণা শুরু করে। অনেক যুক্তি-তর্ক দিয়েও যখন কোনও মীমাংসায় পৌঁছনো গেল না, তখন ওদের মধ্যে একজন বলল, আমরা তো আচ্ছা মুখ্য, আমাদের সবজান্তা মোড়ল বেঁচে থাকতে এই রকম একটা জটিল ব্যাপারে মাথা ঘামিয়ে অনর্থক সময় নষ্ট করছি!
অকুলে কুল পাওয়া গেল। সবাই একসঙ্গে বলে উঠল–ডাক মোড়লকে!
তখনই লোক ছুটল মোড়লের বাড়ি। একঘন্টার মধ্যে পাল্কি চড়ে মোড়ল এসে হাজির। পাল্কি থেকে নেমে বেশ কিছুক্ষণ হাতিটার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল মোড়ল। চারপাশে অগণিত জনতা রুদ্ধনিশ্বাসে চুপ করে আছে। হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল মোড়ল, সে কান্না আর থামে না। জনতা প্রথমটা মোড়লকে ওভাবে কাঁদতে দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল, পরে একটু একটু করে সংক্রামক রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ল সে কান্না। পরে যারা এল, কিছু না বুঝে তারাও তার সঙ্গে কাঁদতে শুরু করল। প্রায় আধঘন্টা পরে রীতিমতো পরিশ্রান্ত হয়ে কান্না থামিয়ে আবার হাতিটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল মোড়ল। নিস্তব্ধ জনতা মোড়লের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
কান্নার মতোই হঠাৎ এবার হাসতে শুরু করল মোড়ল। প্রথমটা আস্তে, তারপর একটু একটু করে বাড়তে লাগল হাসি। কিছু না বুঝে জনতাও হাসতে শুরু করল। ভাবল মোড়ল যখন হাসছে, তখন হাসবার ব্যাপার একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। সারা গাঁয়ে প্রতিধ্বনি তুলে হাসির ঝড় বয়েই চলল।
হাসতে হাসতে বসেই পড়েছিল মোড়ল। খানিক বাদে হাসি থামিয়ে কাউকে কিছু না বলে পাল্কিতে উঠে বেহারাদের যাবার ইশারা করতেই জনতার মধ্যে অস্ফুট চাপা গুঞ্জনের ঢেউ বয়ে গেল। কেউ সাহস করে কিছু বলতে পারে না, এদিকে মোড়লও চলে যায়। অগত্যা সাহস করে একজন এগিয়ে আসে পাল্কির কাছে। মোড়ল বলে, কী চাও?
লোকটা ভয়ে ভয়ে বলে, কিছু তো বলে গেলে না মোড়ল?
বলবার কিছু নেই বলে বলিনি। বেশ রেগেই বলে মোড়ল।
লোকটা বলে, কিন্তু তুমি ওভাবে কদলেই বা কেন, আর শেষকালে হেসে কিছু না বলেই বা যাচ্ছ কেন, এটা বলে যাও!
মোড়ল বলল, কাঁদলাম এই জন্যে যে, আমি মরে গেলে তোদের মতো হাঁদা গঙ্গারামদের উপায় কী হবে!
লোকটি খুশি হয়ে বলল, বেশ, কিন্তু শেষকালে হাসলে কেন মোড়ল?
মোড়লের রেখাবহুল কুঞ্চিত মুখখানায় একটু হাসির আভাস দেখা গেল। হাসলাম কেন শুনবি?
বলে হাতিটার দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে মোড়ল বলল, ও ঘোড়ার ডিম আমিও চিনতে পারলাম না।
নিঃশব্দে নিজের মনে দাঁড়িয়ে হাসছিলাম। দেখলাম পার্টিশনের দরজা ঠেলে গাঙ্গুলীমশাই বাইরে বেরিয়ে আসছেন। হাসি থামিয়ে এক-পা দু-পা করে ওঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
.
লবির পশ্চিমদিকে দোতলায় উঠবার সিঁড়ি। নিঃশব্দে দুজনে উপরে উঠে বারান্দায় দুখানা চেয়ারে বসলাম। চারপাশে কেউ কোথাও নেই। পকেট থেকে সিগারেটের কেসটা বার করে তা থেকে একটা সিগারেট নিয়ে কেসটার উপর ঠুকতে ঠুকতে গাঙ্গুলীমশাই বললেন, তোমার কথা ফ্রামজী সাহেবকে বললাম ধীরাজ। সাহেব সামনের সপ্তাহেই আমেরিকা চলে যাচ্ছে। ভাবলাম, যাবার আগে তোমার একটা কিছু করে নেওয়া দরকার–
কথাটা শেষ করলেন না গাঙ্গুলীমশাই। সিগারেটটা ধরিয়ে দুতিনটে টান দিয়ে আবার শুরু করলেন, সাহেব পারমানেন্ট লোক নিতেই রাজি হয় না। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তোমার অভিনয়ের সুখ্যাতি করতে খানিকটা নিমরাজি হয়েছে। কিন্তু মাইনে খুব কম দিতে চাইছে। এখন তুমি যা ভাল মনে হয় কর।
আশা-নিরাশার দোলনায় দুলতে দুলতে সাহস করে জিজ্ঞাসা করলাম, কত?
সামনের ছোট গোল টেবিলটার উপর অ্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে গাঙ্গুলীমশাই বললেন, যাট টাকা মাসে।
মনে হল কে যেন আমাকে দোতলার বারান্দা থেকে সবলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে নীচের কংক্রিটের রাস্তাটার উপর। আপনা থেকেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ষাট টাকা মাসে?
গাঙ্গুলীমশাই বললেন, হ্যাঁ, অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু সাহেব ওর বেশী কিছুতেই রাজী হল না। হঠাৎ হাতঘড়িটা দেখে উঠে দাঁড়ালেন গাঙ্গুলীমশাই। তারপর যেন নিজের মনেই বললেন, এ, দশটা বেজে গেছে, বড় ছেলেটার জ্বর দেখে এসেছি। আচ্ছা আমি চললাম।
কাঠের সিঁড়িগুলোয় বিরাট পায়ের প্রতিধ্বনি তুলে নীচে নেমে গেলেন গাঙ্গুলীমশাই। ইচ্ছে থাকলেও উঠবার ক্ষমতা ছিল না। চুপ করে বসে রেসের আপসেট ঘোড়ার মতো ভাগ্যের এই ডিগবাজির কথাই ভাবতে লাগলাম। হপ্তাখানেক আগে কার্তিক রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এরা নিজেরাই ফ্রামজীর সঙ্গে দেখা করেন। সঙ্গে সঙ্গেই দেড়শ টাকা মাইনেতে ম্যাডানের পারমানেন্ট স্টাফে ভর্তি হয়ে যান। রোজ একবার করে এসে কোরিন্থিয়ান থিয়েটারের অডিটরিয়মে বসে দু চারটে খোস গল্প করে চাকরি বজায় রেখে বাড়ি চলে যান।
গাঙ্গুলীমশাইকে চাকরির তাগাদা দিতে প্রায় রোজই একবার করে হেড অফিসে যেতে হতো। এখানেই ভানুদার সঙ্গে আলাপ। চমৎকার মানুষ। শিক্ষিত, অমায়িক, সদালাপী। একবার আলাপ হলে চেষ্টা করেও সহজে ভোলা যায় না।
আজও স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের কথাগুলো। আমায় দেখেই ভানুদা ডেকে কাছে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী ভায়া, পাকাপাকি ব্যবস্থা কিছু হল?।
ম্লান হেসে জবাব দিলাম, না, গাঙ্গুলীমশাই বললেন এখনও ফ্রামজীর সঙ্গে কথা কইবার সুযোগ পাননি, সাহেব খুব ব্যস্ত।
স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে বললেন ভানুদা, আমরা ভাই চুনোখুঁটি, সুপারিশ পাব কোথায়? নিজেরাই সাহস করে সাহেবের সঙ্গে দেখা করে বললাম–ছবিতে নামতে চাই। ফ্রামজী কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করলেন, সত্যি-মিথ্যে মিশিয়ে চটপট বলে গেলাম। ব্যস, চাকরি হয়ে গেল। মাসে দেড়শ টাকা মাইনে, দু-একটা ছবিতে কাজ দেখে পরে বাড়িয়ে দেবেন। কিন্তু তোমার কথা আলাদা। দু-দুখানা বাঘা ছবির নায়ক, তার উপর মুরুব্বি ধরেই বড় রুই গাঙ্গুলীমশাইকে। ব্যস্ত হয়ো না ভাই, ধৈর্য ধরে একটু সবুর করো, মেওয়া ফলবেই।
এত দুঃখেও হাসি এল। ভাবলাম ভানুদার সঙ্গে দেখা হলে বলব, মেওয়া ফলেছে ভানুদা। তবে দেরি একটু বেশি হয়েছে বলে খাওয়ার অযোগ্য, ভেতরটা পচা।
মনে পড়ল খিদিরপুরে কাকার সঙ্গে এই মাইনের কথা নিয়ে আলোচনার সময় আমার দম্ভভরা: উক্তিগুলো। সব ছাপিয়ে বাবার কথাগুলো বারবার কানে ভেসে আসছিল। গাঙ্গুলীমশাই যখন কথা দিয়েছেন, একটা ভাল ব্যবস্থা হবেই।
দরোয়ান সামনে এসে দাঁড়াল। ফিরে চাইতেই সেলাম করে বলল, হুজুর, সাড়ে এগারা বাজ গিয়া, আভি ফটক বন্ধ হোগা।
উঠে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। জনবিরল পথ। হাঁটতে হাঁটতে ট্রামের রাস্তায় এসে দেখি লোক ভর্তি একখানি ট্রাম সবে ছাড়ছে, বোধহয় শেষ ট্রাম। একটু চেষ্টা করলে হয়তো ওটাতে যেতে পারতাম, প্রবৃত্তি হল না। চুপ করে একটা টেলিগ্রাফের পোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। সামনে নিঝুম অন্ধকার গড়ের মাঠ। দুরে তারার মালার মতো অস্পষ্ট ল্যাম্পপোস্টের মাথার আলোগুলো, উদ্দেশ্যহীনভাবে সেইদিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। রাজ্যের চিন্তা বিদ্রুপের রূপ ধরে ঘিরে ফেলল।
স্টুডিওর সহকর্মীদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ–বড় মুরুব্বি ধরে, দুখানা ছবিতে হিরো সেজে, তোর মাইনে হল ষাট টাকা?
কাকার অযাচিত তিরস্কার–তখন আমার কথা শুনলে না রাঙদা, এখন তোগো, অমন গভর্নমেন্টের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে তুমি ওকে বায়োস্কোপ করতে অনুমতি দিলে কীসের আশায় শুনি?
মায়ের অনুযোগভরা আক্ষেপ–ইচ্ছে করে ছেলেটার পরকালটা ঝরঝরে করে দিলে তুমি, তুমি কী?
নীরবে সব অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে চুপ করে বসে আছেন মৌন সন্ন্যাসী আমার বাবা। বাবার মুখের দিকে চেষ্টা করেও চাইতে পারলাম না, চোখ বুজে ফেললাম। অনেকক্ষণ একভাবে অন্ধকারের দিকে চেয়েছিলাম বলে, নয়তো মাঠের ঠাণ্ডা হাওয়া লেগে চোখ দুটো ভারী হয়ে গিয়েছিল, দুফোঁটা জল গড়িয়ে গালের পাশ দিয়ে পড়ে গেল। সমস্ত দেহের ভার ঐ পোস্টটার উপর দিয়ে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলাম। অন্ধকার মাঠের ভিতর দিয়ে গোপা যেন এসে সামনে দাঁড়াল। কিছু বলবার আগেই গোপা বলল–সেদিন একটা দরকারি কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, তাই বলতে এসেছি।
সাহস হল না জিজ্ঞাসা করি কী কথা।
গোপা বলল–আমাদের ড্রাইভার বটুক দাস কী করে জেনেছে আপনার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে, আমাকে খুব ধরেছে আপনাকে বলে সিনেমায় ঢুকিয়ে দেবার জন্যে। সত্তর টাকা মাইনে পায়, তাতে নাকি কুলোয় না। ওর ধারণা বায়োস্কোপ করলে অনেক টাকা রোজগার করতে পারবে।
এই চরম অপমানটুকুর জন্যই যেন প্রতীক্ষা করছিলাম। ম্লান হেসে চারদিকে তাকালাম, পাশ দিয়ে লুঙ্গি পরা একটি মুসলমান টলতে টলতে গজল গেয়ে চলেছে
প্রীত রাখো না রাখো, উঁহারি মরজি,
বদনামি তো হো গয়ি উমর ভরকি।
ওপারের ফুটপাথ থেকে আওয়াজ এল–এই, ইধার আও।
গান থেমে গেল। লুঙ্গি পরা লোকটি থমকে দাঁড়িয়ে কী যেন দেখল, তারপর হাত দুটো উপরে তুলে বুড়ো আঙুল দুটো প্রশ্নকর্তার উদ্দেশে নাড়তে নাড়তে বলল কুছ নেহি জমাদারসাব। কথাটা শেষ করে আর দাঁড়াল না লোকটা। সহজ মানুষের মতো দ্রুত পা চালিয়ে সামনের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। দু-এক পা এগিয়ে সামনের রাস্তার দিকে এসে দাঁড়ালাম। ওপারে ফুটপাথের একটা অন্ধকার লাইটপোস্টের নিচ থেকে একটি লালপাগড়ি দুহাতে খৈনি ডলতে ডলতে সোজা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। লালপাগড়ি কাছে এলে দেখলাম বয়স চল্লিশের উপর। মোটা গোঁফ দুটো হাত দিয়ে নাকের দুপাশে উঠিয়ে দেওয়া। কাছে এসে আমায় আপাদমস্তক সন্দেহভরা দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে প্রশ্ন করল, যাওগে কিধার?
বললাম, ভবানীপুর।
প্রশ্ন, আপকে সাথ অওর কোই হ্যায়?
বললাম, না।
বিশ্বাস করল না লালপাগড়ি। সামনের অন্ধকার ভেদ করে ঝুঁকে আশেপাশে বেশ ভাল করে দেখে নিয়ে আবার প্রশ্ন, যাওগে ক্যায়সে?
বললাম, ট্রামে।
বিস্ময়ে চোখ দুটো বড় করে আমার মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ে কোনও বিশেষ গন্ধ আবিষ্কারের চেষ্টা করল লালপাগড়ি। কিছু না পেয়ে বেশ খানিকটা নিরাশ হয়ে সোজা দাঁড়িয়ে আরও রুক্ষস্বরে প্রশ্ন করল–রাত এক বাজ গিয়া, টেরাম-উরাম সব বনধ হো গিয়া, খেয়াল নেহি?
চেষ্টা করেও জবাব দেবার কোনও কথাই যখন খুঁজে পাচ্ছি না, ত্রাণকর্তারূপে দেখা দিল একখানা বাতি-নেভানো খালি গরুর গাড়ি। গাড়োয়ান একটা ময়লা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে, গলায় ঘন্টা-বাঁধা ঘরমুখো গরু দুটো সারাদিনের গাধার খাটুনির পর টুংটাং শব্দ করে রাস্তার মাঝখান দিয়ে বেশ জোরেই হেঁটে চলেছে। গাড়ির নীচে দড়ি বাঁধা ছোট্ট চৌকো লণ্ঠনের বাতিটা দুলুনির চোটে অথবা হাওয়া লেগে নিভে গেছে। নিশ্চিত শিকারের সম্ভাবনায় লালপাগড়ি হুঙ্কার ছাড়ল, এই ভঁইসা, গাড়ি রোখখো!
রোখা দূরে থাক, গরু দুটো আচম্বিতে হেঁড়ে গলার আওয়াজ পেয়ে আরও জোরে পা চালিয়ে দিল দক্ষিণমুখো। ছুটে গিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে অনেক কসরত করে গাড়ি থামালো লালপাগড়ি। ভাবলাম এই সুযোগ। আর এখানে থাকা কোনো দিক দিয়ে নিরাপদ হবে না। গাছের ছায়ায় ঢাকা আলো-অন্ধকার ফুটপাথ ধরে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। বাড়ি পৌঁছলাম যখন, পাশের একটা বাড়ির দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে দুটো বাজছে। সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে লাগলাম, এত রাতে কড়া নেড়ে সবাইকে জাগাবো? দরজা একটু ঠেলতেই খুলে গেল। দেখলাম বাবা উঠোনে পায়চারি করছেন। শুধু একটু থমকে দাঁড়ালাম। কোনো প্রশ্ন করলেন না বাবা। আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে কোনো রকমে জুতো খুলে কাপড়জামা না ছেড়েই অন্ধকারে বিছানাটার উপর শুয়ে পড়লাম।
জেগেই ছিলাম, সময়ের হিসাব ছিল না। খানিকক্ষণ বাদে বাবা অন্ধকারে আস্তে আস্তে এসে আমার বিছানার পাশে বসলেন, তারপর একখানা হাত আমার মাথায় পিঠে বুলাতে বুলোতে শান্ত কণ্ঠে বললেন, ধীউ বাবা! সুখ-দুঃখ এ দুটো যদি ভগবানের দান বলে স্বীকার করো, তাহলে সুখের বেলায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে দুহাত বাড়িয়ে ছুটে যাও, আর দুঃখ দেখে ভীরুর মতো কেঁদে-কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে যাও কেন? ওতে দুঃখ আর অশান্তিটাই বাড়ে, আর কোনো লাভ হয় না।
নিঃশব্দে কাঁদছিলাম, মাথার বালিশের খানিকটা জায়গা ভিজে গিয়েছিল। একটু চুপ থেকে বাবা বললেন, তোমার আসতে দেরি দেখেই আমি খানিকটা অনুমান করে নিয়েছিলাম। কিন্তু তাতে হয়েছে কী? সমস্ত ব্যাপারটা আমায় খুলে বলতো।
ধরা গলায় বললাম, মোটে ষাট টাকা মাইনে, আমি কল্পনাও করতে পারিনি বাবা।
বোধহয় বাবাও কল্পনা করতে পারেননি, অন্ধকারে বাবার চাপা দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজও যেন শুনতে পেলাম। একটু পরে বললেন, তা, এর জন্যে তুমি এত কাতর হয়ে পড়েছ কেন? অবিশ্যি তোমার একটা ভাল মাইনে, মানে দুশ-আড়াইশ টাকা হলে আমি একটু বিশ্রাম পেতাম। ভোরে উঠে এক কাপ চা খেয়ে ছুটতে হয় টিউশনি করতে, বেলা দশটার মধ্যে দুটো টিউশনি সেরে বাড়ি ফিরে নাকে-মুখে কোনো রকমে দুটো ভাত গুঁজে দৌড়ই স্কুলে, চারটের পর বাড়ি এসে এক কাপ চা খেয়ে আবার ছুটি টিউশনি করতে। ফিরতে এক-একদিন রাত দশটা বেজে যায়। তাই ভাবছিলাম এই গাধার খাটুনি থেকে এবার হয়তো খানিকটা রেহাই পাব। কিন্তু মানুষ যা ভাবে সব সময় তা যে হয় না, এটা জেনেও কুহকিনী আশার ছলনায় পড়ে যে ভুলটা করেছিলাম, এ তারই শাস্তি।
একটু চুপ করে থেকে আবার শুরু করলেন, একটা কথা তুমি কোনো দিনই ভুলে যেও না ধীউ বাবা, সংসারে দুঃখ-দারিদ্রের ভিতর থেকে যারা বড় হয়, তারাই সত্যিকারের মানুষ হয়। জীবনটাকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারে শুধু তারাই। নইলে রুপোর চামচ মুখে করে জন্মে যে সব আলালের ঘরের দুলালরা ঐশ্বর্যের গদির উপর বসে ধরাকে সরা জ্ঞান করে, কতটুকু মূল্য তাদের জীবনের? যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যে সৈনিক বিজয়ী হয়ে ফিরে আসে, জয়ের আনন্দ পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারে শুধু সে-ই। নইলে দাঁড়ানো মাত্রই যদি অপরপক্ষ নতি স্বীকার করে অথবা শান্তির প্রস্তাব করে বসে, সে যুদ্ধ জয়ের কোনো গৌরব বা আনন্দ নেই। আজ আমি তোমায় এই আশীর্বাদ করছি, জীবনযুদ্ধে দুঃখ-দারিদ্রের কাছে নতি স্বীকার না করে তুমি বড় হও, সত্যিকারের মানুষ হও। তখন পিছন ফিরে তাকালে দেখতে পাবে পায়ে মাড়িয়ে আসা কাঁটাগুলো ফুল হয়ে হাসছে।
বাবার কথায় মনে অনেকখানি শান্তি পেলাম, বিছানায় উঠে বসে শান্ত কণ্ঠে বললাম–স্টুডিওর সবাই জেনে যাবে আমার মাইনের কথাটা। ওদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ সহ্য করে–
কথাটা শেষ করতে দিলেন না বাবা। বললেন, তাও আমি ভেবে দেখেছি ধী বাবা। তুমি হাসিমুখে ঠাট্টা-বিদ্রূপ মাথা পেতে নিয়ে হেসেই জবাব দিও, কী জানিস, টাকা রোজগারটাকেই মুখ্য উদ্দেশ্য করে এ লাইনে আসিনি, এসেছি শিল্পের সাধনা করে বড় শিল্পী হতে। নইলে ছবছরের পুলিসের চাকরি ছেড়ে এ পথে আসতাম না। আর তা ছাড়া আমার রোজগারে সংসার চলে না, চলে বাবার রোজগারে। বাবা এখনো বেঁচে। দেখো আর কোনো দিন তারা তোমার মাইনের কথা তুলে ঠাট্টা করবে না। রাত শেষ হতে চলল। এবার তুমি শুয়ে পড়।
যাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়ে হেসে বললেন বাবা, আর কালপরিণয়ের পারিশ্রমিক দেড় বছরে দেড়শ টাকার চেয়ে এটা অনেক ভাল–নয় কি?
ঘর থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্তে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বাবা চলে গেলেন। বন্ধ ঘরে জমাট অন্ধকারে বাবার কথাগুলো বেরোবার পথ না পেয়ে দৈববাণীর মতো আমার চারপাশে গুঞ্জন করে ফিরতে লাগল। যুক্তকরে বাবার উদ্দেশে প্রণাম করে শুয়ে পড়লাম।
কেউ না ডাকতেই ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের চারদিকে চেয়ে দেখি দরজা-জানলার ফাঁক দিয়ে সামান্য আলোর আভাস এসে পড়েছে ঘরের মধ্যে। বাড়ির ভিতর সব চুপচাপ, কারও সাড়াশব্দ নেই। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলতেই দমকা হাওয়ার মত এক ঝলক কড়া রোদ আমার সর্বাঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বুঝলাম বেলা অন্তত দশটা। আস্তে আস্তে বাড়ির ভিতর ঢুকলাম। দেখি উঠোনে একটা বেশ বড় রুই মাছ কুটছেন মা। আর সামনে রকের উপর বই খুলে পড়বার অছিলায় পা ঝুলিয়ে বসে আড়চোখে তাই দেখছে আমার ছোটভাই রাজকুমার আর বোনটা। আমার সাড়া পেয়েই একনজর দেখে নিয়ে মা বললেন, যা চট করে স্নান করে নে। কাল রাতে তো কিছু খাসনি। আমি এখুনি মাছের ঝোলটা চড়িয়ে দিচ্ছি।
অবাক হবার কিছু নেই, আজ সব কিছুতেই বাবার প্রচ্ছন্ন প্রভাব স্পষ্টই অনুভব করলাম। প্রাত্যহিক বাজার করার ভার ছিল আমার উপর, আজ বাবাই সেটা করে এনেছেন। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল, তাড়াতাড়ি স্নান করতে চলে গেলাম।
দুপরে খেয়েদেয়ে কষে এক ঘুম দিলাম। ঘুম ভাঙল বাইরে কড়া নাড়ার আওয়াজে। উঠে দোর খুলে দেখি মনমোহন। বেশ একটু অবাক হয়ে বললাম, তুই?
গম্ভীর ভাবে মনমোহন বলল, কথা আছে, একটু বাইরে আয় না।
বললাম–দাঁড়া, জামাটা পরে আসি।
ঘরে এসে আলনার উপর থেকে একটা ছিটের শার্ট গায়ে দিয়ে চটিটা পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কাছেই হরিশ পার্ক। দুজনে নিঃশব্দে পথটুকু হেঁটে ছোট পার্কের মধ্যে একটা খালি বেঞ্চের উপর বসলাম। দুজনেই চুপচাপ। হাসি আসছিল মনমোহনের অবস্থা দেখে। স্বভাবসিদ্ধ হাসি অতি কষ্টে দমিয়ে রেখে আমায় সমবেদনা জানাতে এসেছে, বেচারা!
বললাম, কীরে, কী কথা বলবি বল?
মনমোহন বলল, আমি অবাক হয়ে গেছি ভাই। গাঙ্গুলীমশাই যে এরকম একটা ব্যাপার করতে পারেন কল্পনাও করতে পারিনি। মেসোমশাই বললেন, এ আমার জানাই ছিল, যেদিন সাহেবের পারমিশন নিয়ে ওকে হেমচন্দ্রের পার্ট দিয়েছি, সেইদিন থেকেই উনি চটেছেন।
হেসে বললাম, চটাচটির কথা নয় মনু, আমি অদৃষ্টবাদী, ভাগ্য ছাড়া পথ নেই।
চুপ করে কী যেন ভাবল মনমোহন, তারপর বলল, মেসোমশাই বলছিলেন—
বললাম, কী?
তিন চারদিন বাদেই ফ্রামজী আমেরিকা যাচ্ছে। ও চলে গেলেই তোমাকে নিয়ে রুস্তমজী সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন। ওঁর খুব বিশ্বাস রুস্তমজী কখনোই এতবড় একটা অন্যায় হতে দেবেন না।
বললাম, কিন্তু তোমার মেসোমশাই ভুলে যাচ্ছেন যে, গাঙ্গুলীমশাই ওদের ডান হাত। তিনি যে ব্যবস্থা একবার করে দিয়েছেন তার রদবদল ফ্রামজী কিছুতেই করবেন না। কিংবা ধরে নিলাম কিছু করলেন, তখন গাঙ্গুলীমশাই-এর মানটা কোথায় থাকবে সেটা ভেবে দেখেছ কি?
অকাট্য যুক্তি। চুপ করে রইল মনমোহন। বেশ খানিকক্ষণ বাদে হতাশ হয়ে বলল, নাঃ, তাহলে আর কোন উপায় নেই। ও মাইনেতে তুমি কেন, কোনও ভাল আর্টিস্টই কাজ করবে না। অথচ তিন-চারদিনের মধ্যেই মেসোমশাই শুটিং শুরু করতে চান। এই অল্প সময়ের মধ্যে নতুন হিরো কাকেই বা নেবেন।
হেসে একখানা হাত দিয়ে ওর কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, জ্যোতিষবাবুকে বোলো নতুন হিরো খুঁজতে হবে না, আর রুস্তমজী সাহেবের কাছে মাইনে বাড়ানোর সুপারিশও করতে হবে না। গিরিবালা ও কালপরিণয়ের বিখ্যাত নায়ক আমিই মৃণালিনীতে হেমচন্দ্রের ভূমিকায় অভিনয় করব।
অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চাইল মনমোহন।
বললাম, সত্যি, ঠাট্টার কথা নয়। শুটিং-এর দিন গাড়িটা পাঠাতে বোলো হাজার হোক অতবড় কোম্পানির হিরো, মাইনে যাই হোক, ট্রামে-বাসে তো আর যেতে পারিনা!
অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল মনমোহন।