যাত্রীবাহী একখানা বড় বাস রিজার্ভ করে বেলা দুটো নাগাদ কলকাতা থেকে সদলবলে বেরিয়ে পড়তাম। মেয়ে-পুরুষ সবাই হৈহন্না করতে করতে বেলা চারটে পাঁচটার মধ্যে গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যেতাম। একটু বিশ্রাম করে, চা-খাবার খেয়ে মেক-আপ শুরু করা হত। সাতটা সাড়ে সাতটায় প্লে আরম্ভ আর শেষ রাত্রি দুটো তিনটেয়।
মেক-আপ তুলে লুচি মাংস অথবা লুচি আলুর দম মিষ্টি খেয়ে আবার যখন বাসে উঠতাম তখন হয়তো রাত চারটে সাড়ে চারটে। বাড়ি পৌঁছতে বেশ বেলা হয়ে যেত। দুপুরে খেয়েদেয়ে কষে এক ঘুম দিয়ে বিকেলে আবার হাজির হতাম রিহার্সালে। শ্যামবাজার চৌমাথার মোড় থেকে একটুখানি পুবদিকে গেলেই আর, জি. কর রোড। ডান হাতের ফুটপাথের অসংখ্য দোকানের মাঝখানে সরু একফালি পথ, দুপা এগোলেই পড়ে ৬নং বাড়িটা। সামনের সিঁড়ি বেয়ে বরাবর তিনতলায় উঠে গেলে দেখা যায় একটা দরজার মাথায় কাঠের সাইনবোর্ডে লেখা দীপালি নাট্যসংঘ। উপরে দক্ষিণদিকের বড় হলটা রিহার্সাল রুম, বাকি দুটো ঘরে একটায় অগণিত অসহিষ্ণু দর্শকের সমবেত চিৎকার আর করতালি। মুহূর্তের জন্য সেইদিকে চেয়ে নিয়ে অভিনেতা বললেন, এতগুলো লোকের আনন্দ উল্লাসের মাথায় আমার ব্যক্তিগত দুঃখের লাঠি মেরে আমি যদি এখুনি তোমার সঙ্গে হাসপাতালে যাই, খোকা বেঁচে উঠবে?
অদ্ভুত প্রশ্ন। সংবাদদাতা অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন।
–ভরসা করে বলতে পারলে না, কেননা তুমিও জান, হাসপাতালে নিয়ে যাবার সময় পথেই হয়তো সে মারা গেছে। খোকাকে বাঁচাতে পারব না, কিন্তু এদের আরও কয়েক ঘন্টা আনন্দ দিতে পারব। দুদিক না হারিয়ে একদিক রাখি। বলেই উত্তরের জন্য না দাঁড়িয়ে ঢুকে পড়লেন স্টেজে।
কয়েক মিনিট পরেই শুনতে পেলাম, দর্শকের মুহূর্মুহূ আনন্দ উল্লাস ও করতালি। সারা বাড়ি থেকে থেকে কেঁপে উঠতে লাগল।
নির্দিষ্ট সময়ে অভিনয় শেষ হল। মেক-আপ রুমে এসে রং তুলে কাপড়চোপড় ছেড়ে ফেললেন অভিনেতা। ব্যস, মোহময়ী পাদপ্রদীপের নাগপাশ ছিন্ন হল। কোথায় গেল সেই দৃঢ় মনোবল আর কোথায় পড়ে রইল সেই অকাট্য যুক্তি। সাধারণ বাপের মত ছেলের নাম ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে চললেন তিনি হাসপাতালে মৃত ছেলের পাশে। অভিনেতা আর কেউ নন, স্বর্গীয় কার্তিকচন্দ্র দে, হাস্যর্ণব। শুধু আমাদের দেশেই নয়, খুঁজলে এ রকম নজির সব সভ্য দেশেই দুচারটে পাওয়া যায়।
.
শ্রীরামপুর রেলস্টেশনের দক্ষিণ দিকে লাইনের গা ঘেঁষে যে প্রমোদাগারটি বর্তমানে শ্রীরামপুর টকিজ সাইনবোর্ড গলায় ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেদিন আমাদের সম্প্রদায়ের অভিনয় হচ্ছিল সেখানে। সরলা ও বসন্তলীলা। সন্ধ্যে ছটা থেকে শুরু হয়ে পুরো পাঁচ ঘন্টায় শেষ হল সরলা। বিশ্রাম ও রাত্রের ভোজন-পর্ব শেষ করে বারোটা থেকে বসন্তলীলা আরম্ভ হবে। বসন্তলীলা মূলত নৃত্যগীতবহুল নাটিকা। এর তিনটি প্রধান ভূমিকা–শ্রীকৃষ্ণ, রাধিকা ও বসন্তদূত। বারোটার অনেক আগেই বসন্তদূত ও শ্রীরাধা যথাক্রমে শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র দে ও মিস লাইট সেজে বসে আছেন, শ্রীকৃষ্ণের কোনো পাত্তাই নেই। শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় নামবেন তখনকার জনপ্রিয় গায়ক অভিনেতা শ্রীধীরেন দাস। সরলা নাটকে ধীরেনবাবুর কোনো ভূমিকা ছিল না। তাই কথা ছিল সন্ধ্যে থেকে অন্য এনগেজমেন্ট সেরে শেষ গাড়িতে রাত্রি এগারোটায় শ্রীরামপুরে পৌঁছবেন। ঠিক এগারোটায় সমস্ত বাড়িটা ভূমিকম্পের মতো কাঁপিয়ে হাওড়া থেকে শেষ গাড়ি এল, কিছুক্ষণ থেমে আবার সগর্জনে আমাদের নাড়া দিয়ে গন্তব্যপথে চলে গেল। কিন্তু কৃষ্ণরূপী ধীরেন দাসের দেখা নেই। কর্তৃপক্ষমহল, বিশেষ করে নরেশদা ও কেষ্টদা, বেশ নারভাস হয়ে পড়লেন। শুধু অভিনয় হলে যাকে হোক নামিয়ে দিয়ে কাজ চালান যেত, কিন্তু বসন্তলীলা গানের জন্য বিখ্যাত। কৃষ্ণেরই অন্তত ছয়-সাতখানি গান। এখন উপায়? পরিপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে দর্শক বারোটার পর থেকেই গুঞ্জন শুরু করে দিয়েছে। তার উপর যদি জানতে পারে কেষ্ট নেই, ভাবতেও ভয় করে।
সরলায় দু-তিন সিনের পুলিশ দারোগার পার্ট আমার ছিল। বসন্তলীলায় আমার ছুটি। মেক-আপ তুলে নিজের কাপড়জামা পরে দিব্যি পান খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, একজন এসে বলল, তোমায় কেষ্টদা ও নরেশদা ডাকছেন। নরেশদা ও কেষ্টদা আলাদা একটা ছোট ঘরে মেক-আপ করতেন। বেশ একটু অবাক হয়েই তাদের ঘরে ঢুকে পড়ে দেখি নিঃশব্দে দুজনে পাশাপাশি দুখানা চেয়ারে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন।
সাড়া পেয়েই কেষ্টদা বললেন, ধীরাজ, এদিকে শোন।
কাছেই একখানা বেঞ্চি ছিল–টেনে নিয়ে বসলাম। দুজনেই চুপচাপ। নরেশদাও কিছু বলেন না, কেষ্টদাও না। আমি বললাম, কী ব্যাপার কেষ্টদা, আমায় ডেকেছেন?
ফোঁস করে এক দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কেষ্টদা বললেন, ধীরাজ, বসন্তলীলা বইটা কতবার দেখেছিস?
তা চার-পাঁচ নাইট হবে।
–কেষ্টর প্রথম গানখানামম যৌবন নিকুঞ্জে গাহে পাখি, তোর মুখস্থ আছে?
–আছে।
–ব্যস আর কিছু চাই না। চটপট কেষ্ট সেজে নে।
আঁতকে উঠে দাঁড়ালাম। হাত ধরে জোর করে বসিয়ে কেষ্টদা বললেন, অন্য গানগুলো ছোট, প্রম্পট করলে গাইতে পারবি।
চোখ কপালে তুলে বললাম, তুমি কি পাগল হয়েছ কেষ্টদা?
–এখনও হইনি, আর পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যে প্লে আরম্ভ না হলে সবাইকে হতে হবে। শুধু তাতেই শেষ হবে না, মারধোর পর্যন্ত খেতে হবে।
–কিন্তু আমার গানের দৌড় তো তুমি জান কেষ্টদা, নিজেদের মধ্যে হারমোনিয়াম বাজিয়ে কোনরকমে গাইতে পারি, তাই বলে স্টেজে? বিশেষ করে ধীরেন দাসের নামকরা গান?
-আমি কথা দিচ্ছি তোকে, বদনাম হবে না। আর এছাড়া পথও নেই ভাই। আমাকে আর কোনও কথা বলবার অবসর না দিয়েই হাঁক দিলেন কেষ্টদা–মণিমোহন! মণিমোহন ড্রেসার কাছেই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে সে ও আর একজন আমাকে একরকম টানতে টানতে নিয়ে চলল মেক-আপ রুমের দিকে। স্টেজের কাছেই মেক-আপ রুম, যেতে যেতেই শুনলাম, কেষ্টদা নরেশদাকে বলছেন, নরেশদা, আপনি স্টেজের উপর গিয়ে ধীরাজের নামটা এনাউন্স করে দিন, আর সেই সঙ্গে ধীরেনের অ্যাকসিডেন্টালি না এসে পড়ার কথাটা জানিয়ে দিন।
সমস্ত ব্যাপারটা নিমেষে ঘটে গেল। স্বপ্নবিষ্টের মতো মেক-আপ রুম থেকে শুনতে পেলাম এক বাড়ি অধৈর্য দর্শকের সমবেত গণ্ডগোল।
হঠাৎ গণ্ডগোল বেড়ে গেল, সঙ্গে হাততালি। অনুমানে বুঝলাম নরেশদা যবনিকার কালো পর্দা ঠেলে স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন বলবার চেষ্টা করছেন। একটু পরে গোলমাল একটু কমে গেলে নরেশদার গলা শুনতে পেলাম।
-সমবেত ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, আজ আমি আপনাদের কাছে একটা দুঃসংবাদ জানাতে
ব্যস্ আর এগোতে পারলেন না নরেশদা। দর্শকের মধ্যে থেকেই শুরু হল
-জানি মশাই কী বলবেন।
-বলবেন তো কৃষ্ণচন্দ্র দে-র গলা খারাপ, বসন্তদূত করতে পারবেন না?
-ওসব বাজে কথা শুনব না।
-টাকা ফেরত দিন।
-দু ঘন্টা বসিয়ে রেখে এখন দুঃসংবাদ জানাতে লজ্জা করে না?
দুতিনখানা চেয়ার ভাঙার আওয়াজ শুনতে পেলাম যেন। নরেশদা প্রাণপণে কথা বলার চেষ্টা করছেন, হট্টগোলে সব চাপা পড়ে যাচ্ছে।
মেক-আপ শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি কেষ্টর পোশাক পরে একপা দু পা করে এসে দাঁড়ালাম উইংসের পাশে। স্পষ্ট দেখতে পেলাম, নরেশদা কখনও দুহাত উপরে তুলে চুপ করতে বলছেন, কখনও হাতজোড় করে মিনতি করছেন। কে কার কথা শোনে! ঠিক এমনি সময়ে হুইসিল দিয়ে সারা বাড়িটা কাঁপিয়ে একখানা কলকাতাগামী ট্রেন এসে প্ল্যাটফরমে দাঁড়াল। বোধহয় মালগাড়ি। চিৎকার-শ্রান্ত দর্শক একটুখানি চুপ করল। এই সুযোগ।
নরেশদা বললেন, আপনারা গোলমাল না করে দয়া করে আমার কথা শুনুন। কলকাতা থেকে শেষ ট্রেনে ধীরেন দাসের আসবার কথা ছিল। কী কারণে জানি না, তিনি ট্রেন ফেল করেছেন, এখনও পৌঁছননি। সেইজন্যই আমাদের অভিনয় আরম্ভ করতে দেরি হচ্ছিল। যাই হোক, আপনারা নিরাশ হবেন না। সম্প্রতি আপনাদের এই চিত্ৰগৃহে কালপরিণয় দেখান হয়েছে। তার প্রিয়দর্শন নায়ক ধীরাজ ভট্টাচার্য আমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত শিল্পী। তিনি শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন।
কে একজন বলে উঠল, গান বাদ দিয়ে?
নরেশদা–না, গান একটিও বাদ দেওয়া হবে না। আপনারা হয়তো জানেন, ধীরাজবাবু গান গাইতে পারেন।
দুটো দল হয়ে গেল। একদল, যারা সিনেমা-ভক্ত, আমি গান গাই শুনে একটা নতুন কিছুর আশায় রাজি হল। আর একদল, যারা গানের ভক্ত, তারা ধীরেন দাসের পরিবর্তে আমাকে খুশি মনে নিতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত সবাই নিমরাজি হয়ে গেল। আর তাছাড়া উপায়ই বা কী ছিল!
নরেশদা আশ্বাস দিয়ে বললেন, আপনারা এতক্ষণ অপেক্ষা করে আছেন, আর পাঁচ মিনিট ধৈর্য ধরুন। আমরা অভিনয় আরম্ভ করে দিচ্ছি।
চেয়ে দেখি পাশে কেষ্টদা এসে দাঁড়িয়েছেন। বললাম, কেষ্টদা আমি পারব। যদি নারভাস হয়ে যাই বা গান যদি একটু বেসুরো হয়ে যায়, আমায় ওরা আস্ত রাখবে না।
পিঠ চাপড়ে অভয় দিয়ে কেষ্টদা বললেন, কোনো ভয় নেই তোর। প্রথম গান–মম যৌবন নিকুঞ্জে তোকে গাইতে হবে না।
বাকরোধ হয়ে গেল। আমার অবস্থা বুঝতে পেরেই কেষ্টদা বললেন, কী করতে হবে মন দিয়ে শোন। অডিয়েন্স ক্ষেপে আছে। প্রথমে তোর গান দিয়েই অভিনয় শুরু। এ অবস্থায় একটু ত্রুটি হলেই আর প্লে জমানো যাবে না।
বললাম, তাহলে?
–তাহলে যা তোকে করতে হবে বলছি শোন। কুঞ্জবনে রাত্রি শেষ হয়ে আসছে, তোর কোলে মাথা রেখে শ্রীরাধিকা অকাতরে ঘুমোচ্ছেন।
ক্রমে পুবদিকে আলোর আভাস দেখা দিল, পাখিরা ঘুম ভেঙে কলরব করে উঠল। তুই আস্তে আস্তে রাধিকার মুখে এসে পড়া চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে দিতে ঝুঁকে মুখের কাছে মুখ নিয়ে গান ধরবি-মম যৌবন নিকুঞ্জে।
অসহিষ্ণু হয়ে বললাম, এই যে বললেন, গাইতে হবে না!
কেষ্টদা বললেন, পিছনে সিনের আড়ালে তোর হাতখানেক তফাতে হারমোনিয়াম নিয়ে থাকব আমি। আমিই গাইব গানটি, গলাটা একটু অন্যরকম করে। তুই শুধু ঠোঁট
নেড়ে যাবি। সেই জন্যই জিজ্ঞাসা করছিলাম, গানটা মুখস্থ আছে কিনা।
খুব ভরসা পেলাম না। বললাম, কিন্তু কেষ্টদা, আপনি তো প্লেন গানটা গাইবেন। গিটকিরি, তান বা আড়িতে ধরলে আমি থাকব কোথায়?
–ওরে মুখ! ঐ রকম একটা অঘটন ঘটবার আগেই মুখ নিচু করে রাধিকাকে আদর করতে শুরু করে দিবি, লিপ মুভমেন্ট ধরতে পারবে না।
ঐকতান থেমে গেছে। তাড়াতাড়ি দুরুদুরু বক্ষে স্টেজে গিয়ে বসলাম। মিস লাইট এসে কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লেন, যবনিকা উঠে গেল। সারা স্টেজ অন্ধকার, শুধু একটা ফোকাস আমাদের উপর। নেপথ্যে বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছে। আমার ঠিক পিছনে সিনের আড়াল থেকে কেষ্টদার চাপা গলায় আওয়াজ পেলাম, ধীরে!
বললাম, উঁ!
–কোনও ভয় নেই, সব ঠিক আছে।
একটু পরে অন্ধকার কেটে গেল, পুবের আকাশ ফরসা হয়ে এল। স্টেজে পাখিরা ডাকতে শুরু করল। আমার বুকের স্পন্দন বেড়ে গেল।
নিস্তব্ধ অডিটরিয়ামে পিন পড়লে শোনা যায়।
আবার কেষ্টদার চাপা গলা, মুখ নিচু কর, গান ধরছি।
মুখ নিচু করে রাধিকার চুলগুলো যত্ন করে সরিয়ে দিতে লাগলাম। গান শুরু হল।
–মম যৌবন নিকুঞ্জে গাহে পাখি–
সখি জাগো, সখি জাগো, জাগো
ও—ও–ও মম।
যৌবন নিকুঞ্জে গাহে পাখি।
অপূর্ব কণ্ঠ কেষ্টদার, কী কারণে জানি না সেদিন একটু অন্যরকম করে গাইলেন বলেই বোধ হয় আরও ভাল লাগল। সারা প্রেক্ষাগৃহ সুরের মূর্ঘনায় থমথম করতে লাগল। গানের মধ্যে যেখানে কোনও সুর-তানের প্যাঁচ নেই, মুখ তুলে সামনে চেয়ে ঠোঁট নাড়ি, যেখানে বিপদের সম্ভাবনা, মুখ নিচু করে রাধিকাকে আদর করি। গানের শেষে আস্তে আস্তে চোখ মেলে চাইলেন শ্রীরাধা। সমস্ত দর্শক আনন্দে করতালি দিয়ে চিৎকার করে উঠল–এনকোর, এনকোর প্লিজ!
মহাবিপদে পড়ে গেলাম। পেছন থেকে কেষ্টদা বললেন, ধর, জাগো নবীন গৌরবে, নব মুকুল সৌরভে।
রাধিকা আবার চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়লেন, নবীন গৌরব থেকে শুরু করে পুরো গানটা আবার গেয়ে গেলাম। আবার করতালি, আবার এনকোর।
কেষ্টদা বললেন, আর না, উঠে অ্যাক্টিং শুরু করে দে।
তাই হল। এর পরের গানগুলো সোজা। বেশির ভাগ রাধার সঙ্গে ডুয়েট। নিজেই গেয়ে গেলাম। কেন জানি না, আমার নারভাসনেস একেবারে কেটে গেল, গানগুলো ভাল উতরে গেল।
অনেকেই বলল, অনেকদিন বসন্তলীলা এত ভাল অভিনয় হয়নি। একটু আত্মপ্রশংসা করে নিচ্ছি। সকলেই একবাক্যে বলে গেল, চেহারায় ও গানে এত ভাল শ্রীকৃষ্ণ এর আগে বসন্তলীলায় হয়নি।
হাসি এল। ভাবলাম এ যেন ঠিক নেপোয় মারে দই-এর মত। গাইলেন কেষ্টদা, এনকোর হাততালি আর প্রশংসা পেলাম আমি।
দিনচারেক বাদে স্টুডিওয় গিয়ে শুনি, গাঙ্গুলীমশাই আমায় খুঁজছিলেন। মনে মনে বেশ একটু বিস্মিত হয়েই দেখা করলাম গাঙ্গুলীমশাইয়ের সঙ্গে।
বললেন, ধীরাজ, ভাল ভাল স্টেজের নাটক থেকে এক একটা পুরো সিন ঢকিতে নেওয়া হবে। চন্দ্রগুপ্ত আর আবুহোসেন নাটক দুখানায় তোমাকে দেওয়া হয়েছে যথাক্রমে নন্দ ও নবাবের ভূমিকা। বেশ ভাল করে মুখস্থ করে নাও। একটি শটে একটি পুরো সিন নেওয়া হবে, যেন আটকে না যায়। কাল টেক করা হবে, আজ বই নিয়ে সিনটা জেনে বাড়ি গিয়ে ভাল করে মুখস্থ করে নাওগে।
যাক, ফেল তাহলে করিনি! থার্ড ডিভিশনে হলেও পাস করেছি নিশ্চয়।
চন্দ্রগুপ্ত নাটকে নন্দের রাজসভা। মন্ত্রী কাত্যায়ন ডেকে নিয়ে এসেছে চাণক্যকে পৌরোহিত্য করতে। নন্দের আদেশে বাঁচাল অপমান করে তাড়িয়ে দিচ্ছে চাণক্যকে–সেই সিনটা নেওয়া হল। নন্দ আমি, চাণক্য দানীবাবু, কাত্যায়ন নরেশদা। পুরো হাজার ফিটের একটি রীলে দৃশ্যটি নেওয়া হল একটি শটে। প্রায় দশ মিনিটের শট, নির্বিঘ্নে শেষ হল।
আবুহোসেনে আবুর ভূমিকা দেওয়া হয়েছিল হাঁদুবাবুকে। বারকয়েক দুজনে রিহার্সাল দিয়ে নেওয়া হল দৃশ্যটি। সেটিও প্রকাণ্ড সিন। এর পরে দেখলাম, দুর্গাদাস রঘুবীর সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শুনলাম, রঘুবীর নাটকে রঘুবীর আর অনন্তরাও এর একটি নাটকীয় দৃশ্য নেওয়া হবে। অনন্তরাও করলেন নরেশদা। শটটা দেখলাম। সত্যিই অপূর্ব কণ্ঠ দুর্গাদাসের, হিংসা হয়। রোজই এই রকম দুটো-তিনটি দৃশ্য নেওয়া হতে লাগল। শুনলাম এগুলো ক্রাউন সিনেমায় দেখানো হবে। ক্রাউন সিনেমায় টকি মেশিন বসানো শুরু হয়ে গেছে।
দুনম্বর ফ্লোরও কমপ্লিট হয়ে এল। শুনতে পেলাম ওখানে পূর্ণাঙ্গ সবাক ছবি জামাইষষ্ঠী তোলা হবে। রচনা, পরিচালনা ও মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করবেন–কর্নওয়ালিশ থিয়েটারের ম্যানেজার অমর চৌধুরী মশাই।
দীপালি নাট্য সংঘে আর রোজ যাওয়া হয়ে ওঠে না। বাইরে অভিনয় করতে যাওয়া বন্ধ। নরেশদা বললেন, আমাদের নিজস্ব বাড়ি রঙমহল প্রায় শেষ হয়ে এল। সামনের মাস থেকে ওখানেই নিয়মিত অভিনয় আরম্ভ হবে।
দেখতে দেখতে আট-দশ দিন কেটে গেল। রোজ একবার করে স্টুডিওতে যাই। সেদিনও গিয়ে উদ্দেশ্যহীনের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি, এমন সময় নরেশদার সঙ্গে দেখা। বেশ উত্তেজিত মনে হল নরেশদাকে। একটা দৈনিক বাংলা কাগজ হাতে নিয়ে একবার। যতীন দাসের সঙ্গে কথা বলছেন, একবার জাহাঙ্গীর সাহেবের ঘরে ঢুকে আবার তখনি বেরিয়ে আসছেন।
আমায় দেখতে পেয়েই বললেন, এই যে ধীরাজ, তোমাকেই খুঁজছিলাম, একটা জবর সুখবর আছে।
কৌতূহলী হয়ে বললাম, কী খবর নরেশদা?
বেশ উত্তেজিত হয়েই বললেন নরেশদ, সিরাজগঞ্জে ফ্লাভ। অর্ধেক গ্রাম জলে ডুবে গেছে। স্টেশন থেকে আধ মাইল জলের নিচে।
মর্মাহত হয়ে বললাম, এটা সুখবর হল নরেশদা?
একটু লজ্জিত হয়ে নরেশদা বললেন, না, না, সেভাবে কথাটা নিও না। আমি বলছিলাম আমার নৌকাডুবির আসল সিনটা–মানে বিয়ে করে নৌকাতে আসবার সময় রমেশের ও কনের নৌকা ডুবে যাওয়া এবং কনে বদলের সিনগুলো নেওয়ার পক্ষে এখন সিরাজগঞ্জ হল আইডিয়াল প্লেস। তোমার চুলও তো বেশ বড় হয়ে গেছে। তৈরী হয়ে নাও। কাল বাদে পরশু রওনা হতে হবে।
কথায় বলে, কারও সর্বনাশ কারও পৌষ মাস। বন্যার তাণ্ডবলীলায় সিরাজগঞ্জে হাহাকার, নৌকাডুবির রোমাঞ্চকর স্বাভাবিক দৃশ্য তোলার আশায় আমাদের মত্ত উল্লাস। ১৯৩১ সালে সিরাজগঞ্জের ভয়াবহ বন্যার বর্ণনা তখনকার সংবাদপত্রে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু চোখে দেখার পর বুঝলাম-সংবাদপত্রের রিপোটাররা শুধু দূর থেকেই ওপরের ছবিটা তুলে ধরেছেন পাঠকের চোখের সামনে-ভেতরকার আসল রূপটাই বাদ পড়ে গেছে।
রাত্রের ট্রেনে রওনা হয়ে ভোরে পৌঁছে গেলাম সিরাজগঞ্জে। স্টেশনে নয়। স্টেশন বলে কিছু নেই তখন। যেখানে ট্রেন থামল সেখান থেকে প্রায় আধ মাইল যমুনাগর্ভে। আমাদের ইউনিটে ছিলাম আমি, নরেশদা, যতীন দাস, গিরিজা গাঙ্গুলী, বি. এস. রাজহন্স, শ্রীমতী সুনীলা দেবী, ক্যামেরা অ্যাসিস্টেন্ট হামিদ ও জনচারেক কুলি।
সারা রাত ট্রেনে নরেশদা ও যতীন দাসের উৎসাহ উদ্দীপনা ও কাজের ফিরিস্তি শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে সকালে সিরাজগঞ্জে নেমেই কী কী শট নেওয়া হবে, দুপুরে খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রাম করে আবার বেরিয়ে পড়ে বেলা চারটের মধ্যে যে সব শট নেওয়া হবে তার লিস্ট, আবার তারপর দিন ভোর থেকে শুরু করে সারাদিন, এইভাবে কাজ করতে পারলে তিন দিনে কেল্লা ফতে করে কলকাতায় ফেরা। যাবে।
কোথায় গেল সেই সব উৎসাহ উদ্দীপনা, কোথায় পড়ে রইল সেই কর্মব্যস্ত দৈনন্দিন কার্যতালিকায় ট্রেন থেকে নেমে একটু উত্তর দিকে এগিয়ে দেখি নরেশদা ও যতীন কূলহারা সর্বগ্রাসী যমুনার দুরন্ত স্রোতের দিকে নিরাশ চোখ মেলে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। কথা কইতে গিয়ে থেমে গেলাম মাত্র হাতদশেক দুরে স্রোতে ভেসে চলেছে দুটো মানুষ, পচে ফুলে ওঠা, তারই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চলেছে যেন পাল্লা দিয়ে একটা মরা গরু ও বাছুর, গলার দড়িটা বাছুরের গলার কাছে বাঁধা। চার দিকে নিস্তব্ধ নিশ্চপ–একটু একাগ্রভাবে কান পেতে শুনলে মনে হবে একটা ভয়াবহ চাপা আর্তনাদ হাওয়ায় ভেসে এসে ঢেউগুলোর ওপর আছড়ে পড়ে নিমেষে ভেঙে চুরমার করে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
অবাক হয়ে পলকহীন চোখে শুধু চেয়েই আছি। প্রতি মুহূর্তে না জানি কোন নতুন বিস্ময় মাথায় করে নিয়ে আসে ঐ সর্বনাশা নদীর মাতাল ঢেউ! গিরিজা গাঙ্গুলীর ডাক চমক ভাঙল সবার। পিছনে ফিরে দেখি দুতিনজন অজানা ভদ্রলোক গিরিজার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। গিরিজা চিৎকার করে বলল–
নরেশদা এদিকে একবার আসুন!
সবাই এগিয়ে গেলাম। গিরিজাই আলাপ করিয়ে দিল–ইনি হচ্ছেন এখানকার নামকরা উকিল শ্ৰীকৃতান্তকুমার বসু আর এদের একজন মুহুরী, অপরজন প্রতিবেশী দোকানদার।
যথারীতি নমস্কার বিনিময়ের পর ম্লান হেসে নরেশদা বললেন, এলেন কীসে? কিছু দূরে একটা গাছের গুঁড়িতে বাঁধা ডোঙাটিকে দেখিয়ে কৃতান্তবাবু বললেন, হাঁটা পথ বলতে কিছুই নেই, সব জলপথ, কাজেই ভোঙা বা নৌকা ছাড়া পা বাড়াবার উপায় নেই।
আমাদের পৌঁছে দিয়ে পিছু হটে ট্রেন অনেক আগেই চলে গেছে। স্টেশনমাস্টার এবং দুএকটি কর্মচারীর অনুগ্রহে কিছু দূরে সাইডিঙে দাঁড়ানো দুখানা সেকেন্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টে মালপত্র তুলে আপাতত আমাদের থাকবার জায়গা ঠিক হয়েছে। এক পা দু-পা করে সবাই গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।
নরেশদা বললেন, আপনার বাড়ি কোথায় কৃতান্তবাবু?
রসিক লোক কৃতান্তবাবু, এতবড় বিপর্যয়েও রসবোধ হারাননি, হেসে বললেন–
জলে এবার ঘর বেঁধেছি,
ডাঙায় বড় কিচিমিচি।
সবাই গলা জাহির করে
চেঁচায় খালি মিছিমিছি।
হাসলাম না, সবাই চুপ করে রইলাম। নিজেই খানিকটা হেসে নিয়ে শুরু করলেন কৃতান্তবাবু, আমার বাড়িটার চারপাশে অন্তত দুশখানা ঘর ছিল। বেশির ভাগ কাঁচা বাড়ি। মাটির দেওয়াল, ওপরে খড়, টালি বা টিন দিয়ে ছাওয়া। দুচারখানা পাকা ইটের বাড়ি যা ছিল তাও জরাজীর্ণ। কিছু নেই মশাই সব সাফ। নিশ্চিহ্ন। শুধু চারধারে থৈথৈ করছে জল, তার মাঝে ভূশণ্ডি কাকের মতো নির্বিকারে দাঁড়িয়ে আছে আমার ছোট্ট একতলা বাড়িখানা। দু-একদিনের মধ্যে যদি জল সরে না যায়, আমাকেই সরে আসতে হবে স্ত্রী পুত্র পরিবার নিয়ে।
কৃতান্তবাবুকে ভাল করে দেখলাম। বয়স ত্রিশ পয়ত্রিশের মধ্যে, মিশমিশে কালো রং, শৌখিন হাঁটা গোঁফ ও চুল, দোহারা গড়ন, চোখে চশমা। বেশ একটা বুদ্ধিমত্তার ছাপ চোখেমুখে মাখানো। আমাদের সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে নরেশদা বললেন, আমরা যে নৌকাডুবি তুলতে এসেছি, এ খবরটা পেলেন কী করে?
–এ খবর কি চাপা থাকে মশাই। তাছাড়া ট্রেনে আপনারা কজন ছাড়া আরও লোক ছিল, একথাটা ভুলে যাচ্ছেন কেন? ওকালতি করা ছাড়াও আমার আরও কয়েকটি বদ অভ্যাস আছে–থিয়েটার-যাত্রার নাম শুনলেই যে অবস্থায় থাকি না কেন, নেচে উঠি। সকালে খবরটা শোনা মাত্র চা পর্যন্ত না খেয়ে ডোঙা নিয়ে ছুটে এলাম।
চায়ের নামে নরেশদার চমক ভাঙল, বললেন, ওহে গিরিজা, হামিদকে অনেকক্ষণ আগে চায়ের জন্যে পাঠিয়েছি, একটু খবর নাও তো।
গিরিজা চলে যাচ্ছিল, ডাকলেন নরেশদা, আর দ্যাখো, ঐ সঙ্গে খান বাবো টোস্ট আর বিস্কুট নিয়ে আসবে।
হোহোহা করে হেসে উঠলেন কৃতান্তবাবু। তারপর নরেশদার দিকে চেয়ে বললেন, মোটে চাচী রাধে না, তার তপ্ত আর পান্তা! চা পান কি না দেখুন–কেননা দুধ নেই চিনি নেই, আছে শুধু মরচে পড়া প্যাকেটে চা আর গুড়, তাতে যদি চায়ের তেষ্টা মেটে চেষ্টা করে দেখুন। টোস্ট বিস্কুটের কথা ভুলে যান–সাত আট দিনের শুকনো বাসি পাউরুটিতে যদি আপত্তি না থাকে নিয়ে আসতে বলুন।
থ হয়ে গেলাম। কৃতান্তবাবু বললেন, তার চেয়ে হাত মুখ ধুয়ে চলুন গরিবের বাড়িতে, দেখি কত দূর কী করতে পারি।
তা ছাড়া আর উপায়ই বা কী! তাড়াতাড়ি ট্রেনের বাথরুমে ঢুকে কোনও রকমে মুখ-হাত ধুয়ে কাপড় বদলে রেডি হয়ে গেলাম। দুখানা কামরা। একটা দেওয়া হয়েছে নায়িকা সুনীলাকে–অন্যটায় আমরা সবাই। এরই মধ্যে মুখ-হাত ধুয়ে মায় প্রসাধন শেষ করে কখন যে সুনীলা দেবী এসে গেছেন আমাদের কামরায় জানতেও পারিনি। নরেশদা আলাপ করিয়ে দিলেন কৃতান্তবাবু ও আরও কয়েকজনের সঙ্গে। ইতিমধ্যে স্থানীয় ব্যায়াম ক্লাবের কয়েকটি ছেলেও এসে গিয়েছিল। আলাপ হল। তাদের কাছেই শুনলাম, কৃতান্তবাবু স্থানীয় ক্লাবের ড্রামাটিক সেক্রেটারি ও নিজে একজন ভাল অভিনেতা। আধঘন্টার মধ্যে সবাই রেডি হয়ে গেলাম। রেল লাইনের পাশেই পুবদিকের বাগানে দুতিনখানা ডোঙা বাঁধা। একখানায় উঠলেন কৃতান্তবাবু, নরেশদা ও সুনীলা, অন্য দুখানায় আমরা সবাই ভাগাভাগি করে উঠলাম ব্যায়াম ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে। কুলিরা গাড়িতে মাল পাহারা দেবার জন্য রইল। নরেশদা ওদের সবাইকে আট আনা করে দিয়ে দিলেন চা ও খাবারের জন্যে।
লম্বা তালগাছের ডোঙা–কোনো মতে উবু হয়ে বসে দুহাতে দুধার শক্ত করে ধরে রইলাম। সামনে সরু মাথাটার কাছে অনায়াসে দাঁড়িয়ে লম্বা বাঁশ দিয়ে লগি ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে নিয়ে চলল ব্যায়াম ক্লাবের সেক্রেটারি সমীর। আমাদের ডোঙায় ছিলাম আমি, রাজহল ও হামিদ, আর একটি স্থানীয় বারো চৌদ্দ বছরের ছেলে। ছেলেটি ভোঙার ঠিক মাঝখানে একখানা নারকেল মালা হাতে নিয়ে বসে ছিল–মাঝে মাঝে জল বেশি হলে হেঁচ ফেলাই ওর কাজ। রাজহল এর আগে দুএকখানা বাংলা ছবিতে কাজ করেছে, তাছাড়া ও নিজে পাঞ্জাবী হলেও বাঙালিদের সঙ্গে মেশবার আগ্রহটা প্রবল। ভাল বলতে না পারলেও বাংলা বুঝতে পারত। বয়স কুড়ি-বাইশের বেশি নয় কিন্তু বিরাট দেই, দেখাত ঠিক ত্রিশ-বত্রিশ বছরের জোয়ানের মতো।
বললাম, কী হংসরাজ! কেমন লাগছে?
জবাব না পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, ঠিক আমার পেছনে জেবড়ে বসে পড়েছে রাজহল, হাত দুটো দিয়ে শক্ত করে ধরেছে ডোঙার দুটো ধার, ভয়ে বিস্ফারিত চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
অসমসাহসী বেপরোয়া পাঞ্জাবী ছেলে রাজহল এবং বোধহয় সেই জন্যেই গাঙ্গুলীমশাই ফ্ৰামজীকে বলে ওর মাস মাইনে করে দিয়েছেন ম্যাডানে-আড়াই শটাকা। সিরাজগঞ্জে ওর কোনো কাজ না থাকলেও বিদেশে আপদেবিপদে কাজে লাগতে পারে ভেবেই নরেশদা ওকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন।
হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কী টারজান দি ফিয়ারলেস? অত ঘাবড়ে গেছ কেন?
শুকনো গলায় অতি কষ্টে রাজহন্স বলল, ধীরাজ, এখানে জোল কোতো, আমি সাঁতার জানি না।
শুনতে পেয়ে সশব্দে হেসে উঠে সমীর জবাব দিল, ভয় নেই সাহেব, ডুবে মরবে না। বলেই ডোঙাটা থামিয়ে দিয়ে, লম্বা বাঁশের লগিটা দুতিনবার জলের মধ্যে ঠুকে তুলে দেখাল, জল খুব বেশি যদি হয় তো বুক পর্যন্ত।
ভয় তবু গেল না রাজহন্সের। চেষ্টা করে কাষ্ঠহাসি হেসে বলল, এবার কলকাতায় গিয়ে আগে সাঁতারটা শিখে লিব।
সামনে চেয়ে দেখি, নরেশদা ও যতীনদের ডোঙা এরই মধ্যে নদীর ধার ঘেঁষে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। জোরে লগি মারবার সময় পেশীবহুল হাত দুটো ফুলে দ্বিগুণ হয়ে উঠছে সমীরের, প্রশংসাভরা দৃষ্টিতে সেই দিকে চেয়ে আছি। সমীর বলল, জানেন ধীরাজবাবু, যেখান দিয়ে আমরা যাচ্ছি, এটা দিনদশেক আগেও ছিল সিরাজগঞ্জের প্রসিদ্ধ হাট, অসংখ্য ছোট বড় চালা ও টিনের ঘর ছিল এখানে। নদীপথে, ট্রেনে হাটবারে বহু লোক দূরদূরান্ত থেকে বেচাকেনা করতে আসত এখানে। এই যে মাঝে মাঝে বড় বড় বটগাছ, আমগাছ দেখছেন–এগুলো গরমের দিনে অগণিত লোককে ছায়ার আড়ালে ঘিরে রাখত। আজ গাছগুলো শুধু সাক্ষীগোপালের মতো দাঁড়িয়ে আছে, আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
আশেপাশে যতদুর দৃষ্টি যায় চেয়ে দেখি, নোংরা আবর্জনা ভর্তি ঘোলা জলে মাঝে মাঝে এক একটা বড় গাছকে ঘিরে জঙ্গলের মত জমে উঠেছে ঘরের চালা, দরমা, বাতা। দুএকটা গাছ এরই মধ্যে হেলে কাত হয়ে পড়েছে জলে। বাগানের সীমানা ছাড়িয়ে উত্তরদিকে চাইলে নজরে পড়ে শুধু জল আর জল।
সমীর বলল, হাট থেকে আধমাইলেরও বেশি দূরে ছিল যমুনা, এখন একাকার।
রাজহন্স বলল, নরেশদা যতীন এরা সোব পৌঁছে গেছে বোধহয়?
সামনে একনজর চেয়ে সমীর বলল, না, ঐ তো দূরে ওঁদের ডোঙা দেখা যাচ্ছে। যমুনার কাছ দিয়ে উজানে লগি মেরে অত সহজে এগিয়ে যাওয়া যায় না মশাই। আমি বাগানের সীমানা ছেড়ে একটু উত্তর দিক দিয়ে গেলে ওঁদের আগেই পৌঁছে যেতাম, কিন্তু ধীরাজবাবু, আপনাকে কয়েকটি দৃশ্য দেখিয়ে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। থাকেন কলকাতায়–সকালে খবরের কাগজে হেডলাইন পড়ে দুচার বার আহা বলে স্টুডিওতে গিয়ে রাজা সেজে সব ভুলে যান, তাই ভাবলাম—
বাধা দিয়ে বললাম, এর চেয়েও ভয়ানক কিছু আছে নাকি সমীরবাবু–
শুধু অনুকম্পাভরা দৃষ্টি দিয়ে মিনিটখানেক চেয়ে থেকে কোনো কথা না বলে সমীর ডোঙা ঘুরিয়ে দিল দক্ষিণমুখো। দুতিন মিনিট নিঃশব্দে চলার পর, একটা উৎকট গন্ধ নাকে এল–বমি হবার উপক্রম। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বসলাম, যতই সামনে এগিয়ে যাই গন্ধের তীব্রতা বেড়ে উঠতে থাকে। চুপ করে থাকতে পারলাম না, বললাম, কীসের গন্ধ সমীরবাবু?
নির্লিপ্তভাবে জবাব দিল সমীর, পচা মানুষের, নয়তো গরু, মোষ, ভেড়ার। স্রোতে ভেসে এসে আটকে গেছে কোনও গাছে অথবা জঙ্গলের ঝোপেঝাড়ে। প্রথম প্রথম আমাদেরও গন্ধ লাগতনাকে কাপড় বেঁধে বেরোতাম, এখন আর দরকার হয় না, গন্ধও টের পাইনা।
আর খানিকটা সামনে এগিয়ে যেতেই গন্ধটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। একটু একটু করে দক্ষিণমুখো এগোচ্ছি, জলের গভীরতা অপেক্ষাকৃত কম হলেও গাছগুলো ঘন ঘনবেশ একটু আঁকাবাঁকা ধরনে ভোঙা বাইতে লাগল সমীর। ছোট ছেলের কান্না শুনতে পেলাম–খুব কাছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়েও আশেপাশে কিছু দেখতে পেলাম না, বেশ একটু বিস্মিত হয়েই সমীরকে জিজ্ঞাসা করলাম, মনে হচ্ছে চারধারে মাইলখানেকের মধ্যে মানুষের বসতি নেই, অথচ ছোট ছেলের কান্না শুনতে পাচ্ছি।
ম্লান হেসে সমীর বলল, আর একটু ধৈর্য ধরুন, চোখে দেখতেও পাবেন। আর একটু এগিয়ে গিয়েই একটা ছোট গাছের কাছে ডাল ধরে ডোঙা থামিয়ে দিল সমীর। সামনে হাত দশ-বারো দূরে একটা বড় আমগাছের ওপরের ডালের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, দেখুন!
দুখানা মোটা ডাল যেন সামনে হাত বাড়িয়ে আছে–সেই প্রসারিত হাতের ওপর চওড়া তক্তা আর দরজার কবাট বিছিয়ে ছেঁড়া কাঁথা কম্বল, পোটলা-পুটলি, ভাঙা টিনের বাক্স এক পাশে গাদা করে অন্য ধারে ভিড় করে দল পাকিয়ে একসঙ্গে বসে আছে এক পাল ছোট ছেলেমেয়ে–আর ওদের পাশেই শতছিন্ন ময়লা কাপড়ে সর্বাঙ্গ জড়িয়ে নির্লিপ্তভাবে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে বোধহয় ওদের মা। ঘোমটার ভেতর দিয়ে চোখ দুটো স্পষ্ট দেখতে পেলাম, কোনো ভাষা নেই তার, লজ্জা সঙ্কোচ ভয় বিস্ময়–কোনো অনুভূতির স্পর্শ নেই সে চোখে। এ যেন জ্যান্ত মানুষের চোখে মরা মানুষের চাহনি।
সমীর বলল, এখান থেকে শুরু। আরও এগোলে দেখতে পাবেন–গাছগুলো সব ভর্তি। বন্যার রাত থেকে চার-পাঁচদিন ধরে দিন-রাত আমরা আঠারোজন ব্যায়াম সমিতির সভ্য অতি কষ্টে এদের বাঁচাতে পেরেছি। গরু ছাগল সব ভেসে গেছে। গোয়ালে ছিল যেগুলো, মরে পচে ওপরে ভেসে উঠেছে।
গাছের ওপর থেকে আবার কান্নার আওয়াজ পেলাম, বড্ড খিদে পেয়েছে মা। অতর্কিত আমাদের আবির্ভাবে এতক্ষণ বোধহয় খিদের কথা ভুলে গিয়েছিল সবাই একসঙ্গে শুরু করল এবার, চাট্টি ভাত খেতে দে মাকতদিন খাইনি।
কৌতূহলী হয়ে তাকালাম ওদের মায়ের দিকে। ঘোমটার ভেতরে সেই ভাবলেশশূন্য মুখ, নিষ্প্রভ চোখে সেই মরা চাহনি। দূরে দুরন্ত যমুনার দিকে অপলক চেয়ে জড় পাথরের মতো বসে আছি।
সমীর বলল, এই পরিবারটির একটি ছোট্ট ইতিহাস আছে। অবস্থা বেশ সচ্ছল, তিন পোতায় তিন খানা ঘর, গোয়ালে গরু, উঠোনে ধানের গোলা। তাছাড়া বাজারে একটা মনিহারীর দোকান–সব মিলিয়ে বাড়ির কর্তা সনাতন কুণ্ডুর দিন বেশ ভালই যাচ্ছিল। এল সর্বগ্রাসী বন্যা, নদীর কাছে বাড়ি। আগে নিল সেটা, বন্যার জল ছুটে চলল স্টেশন হয়ে বাজারের দিকে সঙ্গে ছুটল সনাতন। আমরা রিলিফ পার্টির ছেলেরা অনেক কষ্টে প্রাণ কটা বাঁচালাম ওর পরিবারের, ধরে রাখতে পারলাম না শুধু সনাতনকে। বলে, সারা জীবনের সঞ্চয় টাকাকড়ি সব পোঁতা রয়েছে দোকানে লোহার সিন্দুকে, শুধু প্রাণটা বাঁচিয়ে হবে কী? পরদিন অনেক খুঁজে পাওয়া গেল সনাতনের মৃতদেহটা বাজার থেকে অনেকটা দূরে। জলের নিচে পড়ে যাওয়া একটা গাছের দুটো ডালের ভেতরে। দুহাতে বুকে চেপে রয়েছে তখনও একটা পুঁটলি, টাকাতে রেজকিতে মিলিয়ে শ আড়াই হবে।
গাছের ডালে কান্নার আওয়াজ বেড়ে উঠেছে। মিনিটখানেক চুপ করে থেকে সমীর বলল, টাকাটা জমা রেখেছি আমাদের ফান্ডো জল সরে গেলে ওদের যা হোক একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে। হঠাৎ সমস্ত বাগান সচকিত করে কাছ থেকে ভেসে এল একটা হুইসলের তীব্র আওয়াজ। মুহূর্তে সোজা হয়ে দাঁড়াল সমীর। তারপর নিমেষে পকেট থেকে আর একটা হুইসল বার করে দুবার বাজাল। ওপরের কান্না থেমে গেছে। নিস্তব্ধ বাগানে একসঙ্গে অনেকগুলো দাঁড়ের ছপছপ আওয়াজ শুনতে পেলাম। একটু পরেই দেখতে পেলাম, ঐ ঘিঞ্জি গাছগুলোর মধ্যে দিয়ে অনায়াসে এঁকেবেঁকে একখানা নৌকা তীব্র বেগে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। আমার দিকে ফিরে সমীর বলল, আমাদের রিলিফ পার্টি এসে গেছে ধীরাজবাবু।
ছোট্ট নৌকায় ছটি ছেলে। বয়েস ষোল থেকে বাইশের মধ্যে। স্বাস্থ্যবান সুন্দর চেহারা, দেখলে ব্যায়াম ক্লাবের সভ্য বলে চিনতে কষ্ট হয় না। নৌকার উপরের পাটাতনে দুবস্তা মোটা ধানের চিড়ে, আর দুটো কলসিতে খেজুর গুড়। নৌকার খোলের ভিতর থেকে ওরা উপরে উঠিয়ে রাখল দুটো মাটির কলসি–শুনলাম ওতে পানীয় জল। কান্না থামিয়ে লোলুপ ক্ষুধার্ত চোখগুলো ঐ ছোট্ট নৌকাটার উপর নিবদ্ধ রেখে উপর থেকে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়তে চাইছে ছেলেমেয়েগুলো।
সমীর জিজ্ঞাসা করল, এত দেরি হল কেন পন্টু?
একটা দড়ির সিঁড়ি দুহাতে পাক খুলতে খুলতে পন্টু বলল, সকালে গিয়ে দেখি জহির সর্দারের বৌ আর কোলের ছেলেটা মরে গেছে। ওদের নিয়ে যমুনায় ভাসিয়ে দিয়ে আসতে–
বাধা দিয়ে সমীর বলল, তিন নম্বর তাঁবুর খবর কী?
-আর সব ভাল, শুধু ত্রৈলোক্য হালদারের মেজ ছেলেটার রক্ত দাস্ত হচ্ছে।
-তার উপরে চিড়ে গুড় দিয়ে এলে তো?
-না সমীরদা, দুপুরে বার্লি রান্না করে দিয়ে আসব।
ইতিমধ্যে সার্কাসের খেলা শুরু হয়ে গেছে। একটি ছেলে পিঠে একরাশ শালপাতা গামছা দিয়ে বেঁধে দড়ির সিঁড়ির একপ্রান্ত দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে তরতর করে বাদুরের মত গাছটায় উঠে গেছে। উপরে চেয়ে দেখি, ছেলেমেয়েগুলো এর মধ্যেই পোঁটলা থেকে কলাই-এর ঘটি গ্লাস বার করে প্রস্তুত হয়ে বসেছে। ওদের মা আর নির্লিপ্ত বসে নেই, চোখের ভাষাও বদলেছে। দড়ির সিঁড়ির একপ্রান্ত ডালে বাঁধা হতে না হতেই আর একটি ছেলে একটি চিড়ের পোঁটলা পিঠে বুলিয়ে হাতে করে দড়ি বাঁধা একটা গুড়ের কলসি নিয়ে এক হাতে সিঁড়ি বেয়ে অনায়াসে উপরে উঠে গেল। দুটি ছেলে নৌকার উপর সিঁড়ির গোড়াটা বেশ শক্ত করে ধরে রইল। শালপাতায় দুমুঠো করে চিড়ে আর খানিকটা করে গুড়, এই হল সারা দিন-রাতের আহার। একটু পরে গাছের উপর থেকে একটা দড়ি নামিয়ে দিল পন্টু। নিচ থেকে জল ভরে একটা বড় পেতলের ঘটি ঐ দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হল। উপরে টেনে তুলে কলাই-এর গ্লাস ও বাটিতে ঢেলে দেওয়া হল। পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যে ভোজনের পর্ব শেষ। ছেলেরা নেমে এল নৌকোয়।
কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল রাজহন্স–ধীরাজ, আমায় ভাই ডাঙায় নামিয়ে দাও। মাথা ঘুরছে, গা বমি বমি করছে।
কথাটা সমীরকে বলতেই সে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল রাজহন্সের দিকে। তারপর বলল, সেই ভাল। আপনি গাড়িতে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। গা বমি-বমি করা খুব খারাপ লক্ষণ।
দুতিনজন ছেলের হাত ধরে একরকম লাফিয়ে উঠল রাজহন্স ডোঙা থেকে নৌকোয়। তিন-মণি একটা বোঝা থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে জলের উপর প্রায় পাঁচ আঙুল জেগে উঠল ভোঙা। সমীর বলল, খুব লোক নিয়ে এসেছেন সাহায্য করতে।
রাজহন্সকে নামাতে স্টেশনের দিকে নৌকা চালিয়ে চলে গেল ছেলের দল। সমীর বলল, আরও কিছু দেখতে চান?
বললাম, প্রথম দিনের পক্ষে এই যথেষ্ট নয় কি?
কৃতান্তবাবুর বাড়ির দিকে জোরে ডোঙা চালিয়ে দিল সমীর। যেতে যেতে বলল, গাছ ছাড়াও শুকনো জমির উপর তাঁবু খাঁটিয়ে রাখা হয়েছে অনেকগুলো পরিবার। তাছাড়া কলাগাছের ভেলার উপর খড় বিছিয়ে উপরে একটা আচ্ছাদন দিয়েও অনেকে বাঁচবার চেষ্টা করছে। চাল নেই বা যা আছে জলে ভিজে তা অখাদ্য হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে দুর গ্রাম থেকে চিড়ে গুড় এনে এদের খাওয়ানো হচ্ছে, তাও আর কতদিন সম্ভব হবে ভগবান জানেন।
সব দেখে শুনে মনে হচ্ছিল, ছবি না তুলে আজ রাত্রে ট্রেনেই কলকাতা ফিরে গেলেই বোধহয় সব দিক দিয়ে ভাল হত। হাটের সীমানার বাইরে স্রোতের টান খুব বেশি। সাবধানে লগি মারতে লাগল সমীর। কারও মুখে কথা নেই–শুধু দূর থেকে ভেসে আসছে যমুনার অস্ফুট গর্জন, ঢেউ-এর মাথায় কড়া রোদের আলো পড়ে আয়নার মত জ্বলে জ্বলে উঠছে। চাইলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মাথা ঝিমঝিম করে। চোখ বুজে বসে থাকি। এইভাবে প্রায় মিনিট পনের কাটবার পর পৌঁছে গেলাম কৃতান্তবাবুর উঠোনে।
আমাদের অনেক আগেই পৌঁছে গেছেন আর সবাই। কৃতান্তবাবু বুকের উপর এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন। ডোঙা থেকে পা বাড়িয়ে একরকম লাফিয়ে উঠলাম রকের উপর। দেখলাম, চায়ের প্রাথমিক পর্ব শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। কাপগুলো ইতস্তত ছড়ান রয়েছে।
কৃতান্তবাবু বললেন, সমীরের পাল্লায় পড়েছিলেন তো? জানি আপনার আসতে দেরি হবেই, সব দেখেছেন তো?
সমীর হেসে জবাব দিল, সব আর দেখলেন কই। প্রথম দৃশ্য দেখেই পালের গোদা পাঞ্জাবীর মাথা ঘোরা, গা-বমি-বমি।
রাজহন্সের ব্যাপারটা আমিই সবাইকে বললাম। নরেশদা সব শুনে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর বললেন, অথচ ওর কাছেই বেশি সাহায্য পাব ভেবে ফ্রামজীকে অনেক বলে-কয়ে পারমিশন করিয়ে এনেছি।
চা আর হালুয়া এসে গেল। খেতে খেতে নরেশদা বললেন, বুঝলে ধীরাজ, কৃতান্তবাবুকে না পেলে কী যে করতাম, ভাবতেও ভয় হয়। হয়তো আমাদের সবাইকে কৃতান্তেই পেয়ে বসত। তাই ওঁকে একটা পার্টও দিয়েছি। উনি হলেন কন্যা কর্তা। এইখান থেকেই বর, বরযাত্রী, কনে সব দুখানা নৌকায় রওনা হবে। নৌকা ডোবানোর সিনটা আমরা অন্য কোথাও একটা ফাঁকা জায়গা দেখে তুলব।
ঘরের ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখি সুনীলা দেবী ইতিমধ্যে বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেলেছেন। চায়ের কাপটা হাতে করে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। চেয়ে দেখি নরেশদাও এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন। সমুদ্রের মাঝখানে ছোট্ট একটা দ্বীপের মত বাড়িটা। যেদিকে তাকাই শুধু জল।
নরেশদা বললেন, কী ওয়ান্ডারফুল সিন বলতো? এই পরিবেশে বিয়ের পর তোমাদের নৌকা করে যাত্রা, মাঝনদীতে কনের নৌকাডুবি। খবর শুনে তোমার নদীতে লাফিয়ে পড়া। সিনগুলো যতীন যদি ঠিকমত নিতে পারে–ব্যস! বাংলা ছবির রাজ্যে একটা ভূমিকম্প হয়ে যাবে।
সত্যি কথা বলতে কি, যে উৎসাহ নিয়ে কলকাতা থেকে এসেছিলাম, সমীরের সঙ্গে সকালে এক ঘন্টা ঘুরে তা নিভে ছাই হয়ে গিয়েছিল। যেদিকে তাকাই চোখের সামনে ফুটে ওঠে সনাতন কুণ্ডুর বিধবা বৌ-এর হিমশীতল সেই চাহনি। চেষ্টা করেও ভুলতে পারছিলাম না। উত্তরদিকে যমুনার বেগবান স্রোতের দিকে চেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। নরেশদা বলে চলেছেন, সত্যি সত্যি নৌকা ডোবাব, কাজেই নৌকা একখানা চাই, কৃতান্তবাবু সে ব্যবস্থা করেও দিয়েছেন। পুরোনো ফাটাফুটো একখানা নৌকা একেবারে কিনে নিতে হবে, নইলে ডোবাবার জন্যে কেউ নৌকা দিতে চায় না।
দক্ষিণে উঠোনের দিকে চেয়ে দেখি, নৌকো আর ডোঙায় চারপাশ ভর্তি হয়ে গেছে। স্কুল-কলেজের ছেলেই বেশি। আমরা বায়োস্কোপের ছবি তুলতে এসেছি শুনে সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছে। বেলাও অনেক হয়েছে, প্রায় বারোটা বাজে।
কৃতান্তবাবু বললেন, চলুন আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসি। আজ বিশ্রাম করুন, কাল সকাল থেকে যা হয় করা যাবে।
সুনীলা দেবীকে ডেকে নিয়ে আমি, নরেশদা ও যতীন সমীরদের রিলিফ পার্টির নৌকোয় উঠলাম, আর সবাই চলল ডোঙায়। সুনীলা দেবীর বয়স খুব বেশি হয়তো আঠারো। খুব সুন্দরী না হলেও ও-বয়সে দেখলে ভাল লাগবারই কথা। নৌকায় ওঠার পর ছেলেদের মধ্যে একটা মৃদু গুঞ্জনের ঢেউ বয়ে গেল। বেশ কিছুদূর এসে পিছন ফিরে দেখি, পরম উৎসাহে ডাঙায় করে ওরাও সঙ্গে সঙ্গে আসছে।
স্টেশনে পৌঁছতেই আসছি বলে উধাও হয়ে গেলেন কৃতান্তবাবু। মিনিট পনেরো বাদে দুজন স্টীমার কোম্পানির লোক নিয়ে ফিরে এলেন। আমাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে এবং কী জন্যে এখানে এসেছি সংক্ষেপে বলে নরেশদাকে বললেন, কুলিদের বলুন, মালপত্র গাড়ি থেকে বার করে গাধাবোটে তুলতে।
হকচকিয়ে গেলাম। গাড়ি থেকে গাধাবোটে! ব্যাপার কী? কৃতান্তবাবু হেসে বললেন, ভয় নেই। ওখানে আরামে থাকবেন। গাড়ি টেম্পোরারি, রিলিফের জন্যে যেকোনো মুহূর্তে ট্রেনের সঙ্গে জুড়ে দিতে পারে। তখন গাছে বাস করা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না।
বোধহয় ঘুমিয়ে ছিল ট্রেনের কামরায়, গাছের প্রসঙ্গ শুনে চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলে বাইরে এল রাজহ। চারদিকে অত লোকজন দেখে বেশ একটু ভড়কে গিয়ে আমায় চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করল, ব্যাপার কী? গাছের কথা কী হচ্ছিল?
একটু মজা করবার লোভ সামলাতে পারলাম না। বললাম, এখুনি এ গাড়ি আমাদের ছেড়ে দিতে হবে, এখানে বাস করবার মতো শুকনো ডাঙা যখন নেই, তখন গাছের ডালে তক্তা বিছিয়ে থাকা ছাড়া উপায় কী? সেই ব্যবস্থাই হচ্ছে।
ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল রাজহন্সের। বেশ নারভাস হয়ে বলল, আমি তো গাছে উঠতে পারি না!
রাগে ফেটে পড়লেন নরেশদা। সামনে এগিয়ে এসে বললেন, কী পার তুমি, সেই কথাটা একবার বলবে দয়া করে? গাছে উঠতে পার না, সাঁতার জান না, নৌকোয় বা ডোঙায় উঠলে তোমার মাথা ঘোরে, নদীতে মরা গরু-বাছুর দেখলে তোমার গা বমি-বমি করে। তোমায় নিয়ে এই জলের দেশে কী করব আমি বলতে পার?
আশেপাশে একটা হাসির ঢেউ বয়ে গেল। দেখলাম লজ্জায় ও অপমানে কান দুটো লাল হয়ে গেছে রাজহন্সের। কোনও উত্তর না দিয়ে আস্তে আস্তে উত্তর দিকে নদীর ধারে গিয়ে চুপ করে দাঁড়াল। জলের ধার থেকে বেশ খানিকটা দূরে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে বিরাটকায় গাধাবোট, যমুনার উন্মাদ ঢেউও ওর কাছে এসে ভেঙে চুরমার হয়ে ফিরে যাচ্ছে।
কৃতান্তবাবু বললেন, আপনাদের বরাত ভাল, তাই বোর্টটা পেয়ে গেলেন। এমনিতে পাওয়া খুব শক্ত। মাটি কাটা, মাল বওয়া, একটা না একটা কাজে লেগে আছেই, শুধু বন্যার জন্যে সেসব বন্ধ।
সমীরদের নৌকায় করে কুলিরা মালপত্র গাধাবোটে তুলে দিল। এইবারে আমরা সবাই একটা দড়ির সিঁড়ি দিয়ে এক-এক করে উঠে গেলাম। রাজহল তখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখে ডাকলাম ওকে। নরেশদাকে চটানোর ভয়েই হোক, অথবা আড়াইশো টাকা মাইনের চাকুরি হারাবার ভয়েই হোক-দ্বিরুক্তি না করে সুড়সুড় করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল রাজহল।
নৌকো থেকে কৃতান্তবাবু ও ছেলের দল বিদায় নমস্কার জানিয়ে চলে গেল। প্রকাণ্ড ডেক, চারদিক খোলা। মাথার উপর পুরু তেরপলের ছাউনি। ডেকের শেষের দিকে কাঠের ছোট একটা কেবিন, তার পাশে বাথরুম ও পায়খানা। ছোট কেবিনটা সুনীলা দেবীকে দিয়ে আমরা সবাই খোলা ডেকের উপর বেডিংসুটকেস রেখে তখনকার মতো আরামে নিশ্বাস ফেলে বাঁচলাম। একটা দুর্ভাবনা গেল। এইবার আহারাদির ব্যবস্থা হলে একটু ঘুমিয়ে বাঁচি। আগের দিন ট্রেনে চোখের পাতা বুজতে পারিনি। নরেশদাকে বললাম, খিদে পেয়েছে নরেশদা।
গিরিজা ও যতীনকে দশ টাকার একখানা নোট দিয়ে বললেন নরেশদা, যাও, কাছে কোথাও হোটেল নিশ্চয় আছে। কুলিদের বাদে আমাদের ছসাতজনের জন্য রাইসকারি বা মাছের ঝোল যা পাও পাঠিয়ে দিতে বলে এস।
এক ঘন্টার উপর হয়ে গেল যতীন বা গিরিজার দেখা নেই। যতীনের অ্যাসিস্টেন্ট হামিদ ডেকের একপাশে কম্বল বিছিয়ে শুয়েছিল, তাকে আবার পাঠানো হল খবর নিতে। আর মিনিট পনেরো বাদে ওরা ফিরে এল, সঙ্গে চার-পাঁচ খানা বাসি পাউরুটি আর খানিকটা ভেলি গুড় নিয়ে।
কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই যতীন বলল, ভাত এ তল্লাটে নেই। শুধু ডাল বা ভাত পিছু দেড়টাকা দিতে চাইলাম, পেলাম না।
বেলা আড়াইটে বাজে, অগত্যা চামড়ার মতো সেই শুকনো রুটি দিয়ে খাবার চেষ্টা করলাম। অসম্ভব! আমি, নরেশদা, সুনীলা দেবী খাওয়ার অভিনয় করলাম শুধু। রাজহন্স, যতীন, হামিদ ও গিরিজা মিনিটদশেকের মধ্যে রুটি-গুড়ের সদ্ব্যবহার করে বোটের বাথরুমে ট্যাঙ্ক-এ রাখা পানীয় জল এক ঘটি ঢকঢক করে খেয়ে দিব্যি বেডিং পেতে ডেকের ওপর খোলা হাওয়ায় নাক ডাকাতে শুরু করল।
আমার আর নরেশদার কথা ছেড়েই দিলাম। দুঃখ হচ্ছিল বেচারি সুনীলা দেবীর জন্যে, ছেলেমানুষ, তায় ভীষণ মুখচোরা লাজুক প্রকৃতির। নরেশদা বললেন, এখানে এরকম অবস্থায় পড়তে হবে জানলে ওকে আনতামই না। সব দায়িত্ব যখন নিয়ে এসেছি, তখন একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।
কেবিনে ঢুকে নরেশদা বললেন, সুনীলা, খাওয়া তো কিছুই হল না। আমার কাছে ভাল বিস্কুট আছে, তাই খানকতক খেয়ে একগ্লাস জল খেয়ে শুয়ে পড়ো।
সুনীলা ঘুমোয়নি। উঠে বসে হেসে বলল, আপনারা আমার জন্যে কেন মিছিমিছি এত ব্যস্ত হচ্ছেন। কৃতান্তবাবুর স্ত্রী আমাকে যা খাইয়ে দিয়েছেন, রাত্রেও কিছু না খেলে চলে যাবে।
বেলা চারটে নাগাদ যতীনকে ডেকে তুললেন নরেশদা। পর দিনের শুটিং-এর প্রোগ্রাম ঠিক করতে হবে। যতীন উঠে এসে বলল, আসল কথাটা বলতে ভুলে গেছি নরেশদা, রাত্রে গোয়ালন্দের স্টীমার দশটার মধ্যে এসে যাবে। সেখানে রাইস কারি পাওয়া যাবে, আর ওদের কাছ থেকে টাটকা রুটি, মাখন কিনে রেখে দিলে পরদিন সকালে খাওয়া হয়ে যাবে।
খুব ভাল খবর। রাত্রে রাইস-ফারির আশায় নতুন উদ্যমে পরদিনের শুটিং-এর আলোচনা শুরু হয়ে গেল।
বেলা পাঁচটার সময় কৃতান্তবাবু এসে পড়লেন। প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, দুপুরে কী খেলেন?
হেসে জবাব দিলেন নরেশদা, হরিমটর!
–তাহলে দেখছি আমার স্ত্রী ঠিকই বলেছিলেন।
জিজ্ঞাসা করলাম, কী?
–আপনারা চলে আসতেই আমাকে বললেন, এত বেলায় ওঁদের ছেড়ে দিলে, দুপুরে হয়তো খাওয়াই জুটবে না। আমি উল্টে তর্ক করলাম–পয়সায় বাঘের দুধ মেলে—তো–!
বাধা দিয়ে নরেশদা বললেন, বাঘের দুধ হয়তো মেলে, কিন্তু চারগুণ পয়সা দিয়েও চারটি ডাল-ভাত মিলল না।
তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে বোটের দক্ষিণ ধারে দাঁড়িয়ে কৃতান্তবাবু ডাকলেন, পাঁচু।
দড়ির সিঁড়ি বেয়ে বছর-বাবোর একটি ছেলে উপরে উঠে এল। হাতে একটা তোয়ালে জড়ানো পোঁটলা। কোনও কথা না বলে পোঁটলা খুলে ফেললেন কৃতান্তবাবু। দেখা গেল একটা কলাই-এর বাটিতে রয়েছে কতকগুলো পরোটা ও আলুর চচ্চড়ি। সুনীলাকে দুখানা পরোটা ও আলুর চচ্চড়ি দিয়ে আমরা সবাই শকুনের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়লাম বাটিটার উপর। মিনিটপাঁচেক কথা-বার্তা নেই, শুধু মুখের একটা অব্যক্ত একঘেয়ে আওয়াজ-ব্যস, বাটি পরিষ্কার। দেখলাম আমাকে ও নরেশদাকে পাঁচ লেংথ দূরে ফেলে নেক-টু-নেক বাজি জিতল রাজহন্স, যতীন ও গিরিজা। যাই হোক, দুতিন গ্লাস জল খেয়ে বাঁচলাম যেন।
কৃতান্তবাবু বললেন, আপনার নৌকা ঠিক হয়ে গেছে, দাম পড়বে দেড়শো টাকা। অন্য সময় হলে দশ-পনেরো টাকায় ভাড়া পেতেন। ডুবোনোর পর ওরা অনায়াসে আবার তুলে নিতে পারবে। কিন্তু এখন কাছে পিঠে ডুবলেও চোরাটানে নৌকা বিশ-ত্রিশ হাত দূরে চলে যাবে। বর আর বরযাত্রীরা যে নৌকোয় যাবে, সেটা ভাড়া পাওয়া যাবে, সমস্ত দিন আপনার হুকুম মতো চলবে ভাড়া দশ টাকা। . সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। কৃতান্তবাবু বললেন, এইবার হ্যারিকেন বা আলোর ব্যবস্থা যদি থাকে করুন, আপনার টাকার হিসেবটা দিয়ে যাই।
নরেশদা বললেন, সেসব কিছুই তো আনিনি। ওসব যে দরকার হতে পারে, খেয়ালই করিনি।
নরেশদার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কৃতান্তবাবু পাঁচুকে বাজারে পাঠিয়ে দিলেন। বলে দিলেন, একেবারে তেল, সলতে পরিয়ে দুটো হ্যারিকেন জ্বালিয়ে নিয়ে আসতে।
আজেবাজে গল্পে সময় কাটতে লাগল। ততক্ষণ সন্ধ্যার আঁধার নেমে এসেছে যমুনার বুকে। ঘুটঘুঁটে আঁধারে প্রেতের মতো বসে আছি আমরা কজন, গাধাবোটের ডেকে পুরু তেরপলের নিচে, আলো আর আসে না।
কৃতান্তবাবু বললেন, বন্যার পর এ অঞ্চলে চুরির উপদ্রব খুব বেড়ে গেছে। রাত্রে একটু সজাগ থাকবেন দু একজন, নইলে নিঃশব্দে বোটের পাশ দিয়ে উঠে দু একটা সুটকেস নিয়ে সরে পড়লে জানতেও পারবেন না। একটা আলো অন্তত ডেকের উপর সারারাত জ্বালিয়ে রাখতে ভুলবেন না।
হ্যারিকেন লণ্ঠন এসে গেল। একটা সুনীলা দেবীর কেবিনে দিয়ে অন্যটা দড়ি দিয়ে তেরপলের বাঁশের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম সবাই। কৃতান্তবাবু বললেন, যে কয়দিন এখানে থাকবেন, একখানা ঘোট নৌকো দিনরাত ভাড়া করে রেখে দেবেন গাধাববাটের পাশে। বোট থেকে এক-পা বাড়াতে হলেই নৌকোর দরকার। আমি এনেছি একখানা। যদি রাখেন, তাহলে আজ রাত থেকেই ও এখানে থাকবে-চব্বিশ ঘন্টার ভাড়া দশ টাকা।
নরেশদা সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। কৃতান্তবাবু বোটের ধারে গিয়ে হাঁক দিলেন, ফুলমি! লুঙ্গিপরা বছরত্রিশের একটি দাড়িওয়ালা মুসলমান উপরে উঠে সেলাম করে দাঁড়াল।
মোটামুটি ব্যবস্থা করে কৃতান্তবাবু যখন বাড়ি যাবার জন্য বিদায় নিলেন, তখন রাত দশটা বেজে গেছে। বেডিং খুলে শুয়ে পড়লাম। অন্য সময় হলে খোলা হাওয়ায় তখনই ঘুমিয়ে পড়তাম। কিন্তু ঘুম এল না, এল রাজ্যের খিদে। খিদে জিনিসটার একটা মজা লক্ষ্য করলাম। যদি বোঝা যায়, খাদ্যের প্রচুর ব্যবস্থা রয়েছে, হাজার খিদে পেলেও সহ্য করে খানিকটা সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু যেখানে খাদ্যের কোনো ব্যবস্থা নেই এবং চেষ্টা করেও কিছু মেলে না সেখানে ক্ষুধার তাড়না অসহ্য। ঘুমোবার বৃথা চেষ্টা না করে উঠে ডেকের উত্তর দিকে যমুনার দিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইলাম।
কৃষ্ণপক্ষের কালো ঘুটঘুঁটে আকাশ, নদীর বুকে তারই ছায়া। চেষ্টা করেও আর কিছু দেখাই যায় না, শুধু ডেকের হ্যারিকেনের ছোট একটা আলোর ফালি কিছু দূরে স্রোতের ওপর অপরাধীর মতো থরথর করে কাঁপছে। দূরে কালো আকাশের বুক চিরে বিদ্যুৎ চমকায়–কালোর রাজ্যে ঐটুকু আলোর ঝিলিক আরো ভয়ানক দেখায়। বাতাসের একটানা সোঁ সোঁ আওয়াজ, নদীর গর্জন তালগোল পাকিয়ে এক অব্যক্ত রূপ নিয়ে কানে ভেসে আসছে। মনে হল, প্রলয়ের সূচনা নয়, প্রলয় শুরু হয়ে গেছে। কতক্ষণ এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে বসেছিলাম মনে নেই। কানে এল গুরুগম্ভীর আওয়াজ, বোঁ-ও-ও-ও, সঙ্গে দিশেহারার মতো একটা পাওয়ারফুল সার্চলাইট একবার ডাইনে, একবার বাঁয়ে, একবার আকাশের দিকে চোখ মেলে কাকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে।
গোয়ালন্দের স্টীমার এতক্ষণে আসবার সংকেত জানিয়ে দিলে। রাজহন্স, যতীন ও গিরিজা স্টীমারের বাঁশির আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে রেডি। প্যান্ট পরাই ছিল, জুতোটা পরে নিয়ে বেডিং-এর পাশ থেকে কোটটা গায়ে চাপিয়ে দিল। তখনও বহুদূরে স্টীমার দুরন্ত স্রোতের বিপরীতে একটু একটু করে এগোচ্ছে। হাতঘড়ি দেখে নরেশদা জানালেন এগারোটা বেজে গেছে। প্রচণ্ড হাওয়া তার সঙ্গে স্টীমারের আওয়াজ ও বাঁশি। দুহাত দুরে থেকেও কথা শোনা যায় না।
আমায় ইশারায় কাছে ডেকে নরেশদা বলল, রাজহন্সের উৎসাহটা যেন সব চেয়ে বেশি। তুমি যতীনকে বল কিছু টাকা নিয়ে যেতে।
কাছে গিয়ে টাকার কথা বলতেই যতীন বলল, টাকা আমার কাছে আছে, পরে দিলেই চলবে।
গাধাবোটের পাশে বাঁশ, তক্তা ও উপড়ে-পড়া মোট মোটা আস্ত গাছ দিয়ে টেম্পরারি ঘাট তৈরি হয়েছে স্টীমারের জন্যে। মিনিটপনেরো বাদে চারপাশের জল তোলপাড় করে নোঙর ফেলল স্টীমার। তারপর চওড়া তক্তা পেতে দিল ঘাটের উপর। অসংখ্য ভিড়। বোঁচকা-কুঁচকি নিয়ে নামতে শুরু করল প্যাসেঞ্জারের দল। পিছন ফিরে দেখি এরই মধ্যে রাজহন্স, যতীন ও গিরিজা–ফুলমিঞার নৌকা করে নাচতে নাচতে চলেছে স্টীমার ঘাটের দিকে। সুনীলা দেবীর কেবিনের সামনে দাঁড়ালে স্টীমার ঘাট স্পষ্ট দেখা যায়, আস্তে আস্তে সেইখানে গিয়ে দাঁড়ালাম।
কাঁধে হাত পড়তেই চমকে দেখি পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন নরেশদা। খুবই গম্ভীর। কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই ইশারা করে ডেকের উপর পুবদিকের শেষ প্রান্তে নিয়ে গিয়ে বললেন, রাজহন্সের কাণ্ড শুনেছ?
অবাক হয়ে বললাম, না তো, আবার কী করল?
কৃতান্তবাবু চলে যাবার পর আমি তো শোয়ামাত্রই ঘুমে অচেতন। তুমিও ঘুমিয়েছিলে বোধহয়?
বললাম, না, খুব খিদে পেলে আমার ঘুম আসে না। তাই উঠে গিয়ে অন্ধকারে ডেকের ওপর বসেছিলাম।
কী যেন ভাবলেন নরেশদা, তারপর বললেন, ওর সাহস ও স্পর্ধা দেখে অবাক হয়ে গেছি।
ব্যাপার গুরুতর। বললাম, কী করেছে নরেশদা?
–সবাই যখন ঘুমুচ্ছেসেই সময় ব্যাটা রাজহল সুনীলার কেবিনে ঢুকে পড়েছিল।
আঁতকে উঠে বললাম, বলেন কী?
রক্ষে মেয়েটা ঘুমোয়নি, তখনই উঠে জিজ্ঞাসা করে, আপনি আমার কেবিনে কেন?
অপ্রস্তুত হয়ে ব্যাটা আমতা আমতা করে বলে, বাথরুমে যেতে গিয়ে ভুল করে ঢুকে পড়েছি। পাশাপাশি কি না!
কথা শেষ করে নির্লজ্জের মতো হাসতে থাকে রাজহল।
যাবার নামও করে না দেখে সুনীলা বলে, আপনি আমার কেবিন থেকে দয়া করে বেরিয়ে যান।
রাজহল বলে, অত ব্যস্ত কেন? সবাই তো ঘুমুচ্ছে। কেউ কিছু জানতে পারবে না। হ্যাঁ, তার আগে তোমায় একটা কথা বলতে চাই।
রাগে কাঁপতে কাঁপতে সুনীলা বলে, কী কথা?
উত্তরে রাজহন্স বলে, কলকাতায় গিয়ে তোমায় আমি বিয়ে করব। দেশে, মানে পাঞ্জাবে, আমার জমিদারি আছে, তাছাড়া ম্যাডানে মোটা টাকা মাইনে পাই। নরেশবাবুর নৌকাডুবি ছবিটা শেষ হয়ে গেলেই আমি হিন্দি ছবির ডাইরেকশান দেব। তাতে তোমায় আমি হিরোইন করব।
কাঁপতে কাঁপতে উঠে সুনীলা বলে, আপনি এই মুহূর্তে যদি বেরিয়ে না যান, তাহলে আমি বাইরে গিয়ে সবাইকে ডেকে তুলব। তখন অগত্যা ব্যাটা ভয়ে ভয়ে এসে আবার শুয়ে পড়ে।
কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না। একটু পরে বললাম, আপনি তো ওর কেবিনের পাশেই শুয়েছিলেন, তাছাড়া ঘরে একটা হ্যারিকেনও জ্বলছিল। এতখানি সাহস–
বাধা দিয়ে নরেশদা বললেন, আমি যদি একটু আগেও জানতে পারতাম বা ঘুমটা ভেঙে যেত। আর একটা কী মুশকিল হয়েছে জান? কেবিনের দরজা নেই। তাহলে ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলে সব গোল মিটে যেত। তাছাড়া এই ঝড়ো হাওয়ায় জেগে থাকলেও কিছু শুনতে পেতাম না।
বললাম, এ সব কথা আপনাকে বলল কে?
–ওরা স্টীমারে চলে যাবার পরই সুনীলা কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে আমায় সমস্ত বলল। কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে মেয়েটা। বলছে, কাল সকালেই আমায় কলকাতায় পাঠিয়ে দিন। তা না হয় দিলাম। কিন্তু বিদেশে এরকম একটা কেলেঙ্কারি প্রকাশ হয়ে পড়লে আমাদের মুখ দেখানো দুষ্কর হয়ে পড়বে। তরপর কলকাতায় গিয়ে সাহেবদেরই বা বলব কী?
বললাম, তার চেয়ে এক কাজ করুন নরেশদা। যত অশান্তির মূল ঐ রাজহন্সকে সকালের গাড়িতে কলকাতায় পাঠিয়ে দিন। ওকে বলুন–এখানে তোমার দরকার হবে না, তাছাড়া ফ্রামজীকে আমি বলে এসেছি দুদিন বাদেই তোমায় ছেড়ে দেব। সুনীলা দেবীকে আমরা পাঁচজনে বুঝিয়েসুঝিয়ে শান্ত করব।
অকূলে কুল পেলেন নরেশদা। বললেন, ঠিক বলেছ। তাই করব। তবে এখন এ সব কথা কাউকে কিছু বলবার দরকার নেই। আমরা যেন কিছুই জানি না।
নিঃশব্দে দুজনে নরেশদার বেডিং-এর উপর এসে বসলাম। সুনীলা দেবী তখনও কাঁদছেন। বললাম, মানুষের চামড়ায় ঢাকা কতকগুলো জানোয়ার আমাদের মধ্যে সব সময় ঘুরে বেড়ায়। এমনিতে তাদের চেনা যায় না–যায়, যখন কথা বলে বা জানোয়ারোচিত কিছু করে বসে। তাদের উপর রাগ অভিমান করা ভুল সুনীলা দেবী। বরং বাঘ বা সাপের মতো ওদের সান্নিধ্য এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। আপনি নিশ্চিন্ত মনে কেবিনে গিয়ে শুয়ে পড়ুন, ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর যে হবে না সে বিষয়ে আপনাকে কথা দিলাম।
নরেশদা বললেন, এখুনি ওকে অপমান করে তাড়িয়ে দিতে পারি কিন্তু তাতে কেলেঙ্কারিটা ছড়িয়ে পড়বে আর আমাদের ইউনিটের বদনাম হবে। তুমি এ নিয়ে আর কারো কাছে উচ্চবাচ্য করো না।
বুদ্ধিমতী মেয়ে সুনীলা আর কোনো কথা না বলে নিজেকে সংযত করে আস্তে আস্তে কেবিনে গিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। হাতঘড়ি দেখেই নরেশদা নীরবতা ভাঙলেন, ব্যাপার কী ধীরাজ? এক ঘন্টা হতে চলল এখনো ওদের দেখা নেই!
সত্যি, ভাবনার কথা। উঠে দেখতে যাব, দেখি দড়ির সিঁড়ি বেয়ে তিন মূর্তি উপরে উঠছে। গিরিজা উপরে উঠে জুতো-জামা খুলে শুয়ে পড়ল। রাজহন্স ও যতীন আমাদের কাছে দাঁড়াল। পকেট থেকে কাগজ মোড়া তিনখানা গ্রেট ইস্টার্নের রুটি ও দুটিন মাখন বের করে নরেশদার বেডিং-এর উপর রেখে যতীন বলল, অনেক কষ্টে এই যোগাড় হল। আগে থেকে অর্ডার না দিলে রাইস-কারি পাওয়া যায় না। কাল রাত থেকে ঠিক পাবেন, আমি অর্ডার দিয়ে পাঁচ টাকা অ্যাডভান্স করে এসেছি।
একটু রেগেই জিজ্ঞাসা করলেন নরেশদা, তা এই রুটি-মাখন আনতে এক ঘন্টা লাগল?
যতীন বলল, সে কথা জিজ্ঞাসা করুন আপনার সুপারভাইজারকে।
-আমার সুপারভাইজার? অবাক হয়ে বললেন নরেশদা। যতীন বলল, হ্যাঁ, জাহাজে সবার কাছে রাজহল পরিচয় দিয়েছে ওই বলে। আরো বলেছে সাহেবরাই নাকি জোর করে পাঠিয়েছে ওকে। এসব ডিফিকাল্ট সিন একা নরেশবাবু পেরে উঠবেন না, তাই নিজের ক্ষতি করেও আসতে হয়েছে ওকে।
হারিকেনের আবছা আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম রাগে ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপছে নরেশদার। অন্ধকারে একখানা হাত বাড়িয়ে নরেশদার হাঁটুতে একটা চাপ দিলাম। নিমেষে নিজেকে সংযত করে নরেশদা বললেন, এই এক রাশ মিথ্যে কথা বলে কিছু লাভ করতে পেরেছে রাজহন্স?
-সিওর। বলে সামনে এগিয়ে এসে রাজহল বেশ গর্বের সঙ্গেই বলল, তিন প্লেট রাইসকারি। কথাটা শেষ করেই প্রকাণ্ডভুড়িটায় হাত বুলোত বুলোতে হো-হো করে হাসতে লাগল রাজহল।
ঘেন্নায় সারা দেহমন রি রি করে উঠল। আমাদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। একটি মাত্র মেয়ে সারাদিন না খেয়ে রয়েছে–তার কথা একবার চিন্তামাত্র না করে, নিজের লোভী উদর পূর্ণ করে যে লোক গর্ব করে বলে, এ ভাবে নির্লজ্জের মতো হাসতে পারে, সে যে মানুষ নয় তাতে সন্দেহ নেই। জানোয়ার হলেও কোন্ শ্রেণীর, সেটাও রীতিমত গবেষণার বিষয়।
যতীন বলল, আর বাহাদুরি করো না, তুমি তো রীতিমত চালাকি করে মিথ্যে কথা বলে খেয়েছ। জানেন নরেশদা, ওরা যখন বলে দিল আগে থেকে অর্ডার না দিলে রাইস-কারি পাওয়া যাবে না, রাজহন্স তখন সটান ঢুকে পড়ল বাবুর্চিখানায়। তারপর হেড বাবুর্চিকে নিজের কলকাতার ঠিকানা দিয়ে এবং তার ছেলেকে বায়োস্কোপে চাকরি দেবার লোভ দেখিয়ে ওদের খাবারগুলো সাবাড় করে দিয়ে এল।
কিছুমাত্র অপ্রস্তুত না হয়ে তেমনি হাসতে হাসতে জবাব দিলে রাজহল, কী জানেন নরেশদা, খিদে পেলে আমার বাপ-মার কথাও মনে থাকে না।
পাঞ্জাবী রসিকতা বাংলা শাড়ি পরে শুধু শাড়িটারই অপমান করে গেল।
কষ্টে নিজেকে সংযত করে রেখে নরেশদা বললেন, যাও শুয়ে পড়ো, কাল সকালে অনেক কাজ।
সবাই শুয়ে পড়লে বেডিংটা কেবিনের দরজার সামনে টেনে এনে নরেশদা বললেন, রুটি-মাখন খাবে নাকি?
হেসে জবাব দিলাম, বৈষ্ণব সঙ্গীতের একটি গানের কলি হঠাৎ মনে পড়ে গেল নরেশদা–
হরিনাম সুধা, আমার ক্ষুধা তৃষ্ণা সব হরেছে।
আজ সন্ধ্যে থেকে যা সব কাণ্ড ঘটছে–দেখেশুনে ও দুটোর অস্তিত্ব পর্যন্ত অনুভব করছি না। রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল। দুজনে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম। ঘুম এল না, সে চেষ্টাও করিনি। এলোমেলো চিন্তার জট পাকাতে পাকাতে ভোরের দিকে একটু তার মতো এসেছিল। কানের কাছে বেজে উঠল স্টীমারের বাঁশি। লাফিয়ে উঠে দেখি সবাই উঠে পড়েছে। নরেশদা ডেকের উপর পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বললেন, ইচ্ছে করেই তোমায় ডাকিনি, আমি উঠেছি অনেক আগে, হামিদকে কেটলি দিয়ে পাঠিয়েছি স্টীমারের চায়ের জন্যে।
বাথরুমে ঢুকে তাড়াতাড়ি করে মুখ হাত ধুয়ে এলাম। সুনীলা দেবীর কেবিনে ব্রেকফ্রাস্টের, আয়োজন। দেখি এরই মধ্যে রুটি কেটে তাতে মাখন লাগানো হয়ে গেছে। অসম্ভব খিদে পেয়েছিল, চায়ের অপেক্ষায় থাকতে পারলাম না। দুতিনখানা রুটি শেষ করে ফেললাম। চা এসে গেল, নরেশদা সবাইকে ডাকলেন। সবাই এল, রাজহলকে দেখতে পেলাম না। নরেশদার দিকে চাইতেই বেশ সহজভাবে বললেন নরেশদা, রাজহন্সকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিলাম ধীরাজ। এখানে ওর না থাকলেও চলবে। কিন্তু কলকাতায় ওকে না হলে ফ্রামজীর চলবে না। সাহেব আমায় বলেও দিয়েছিল দুএক দিনের বেশি না রাখতে।
একটা নোংরা জটিল ব্যাপারের সহজ মীমাংসায় মনটা অনেকখানি হাল্কা হয়ে গেল।
একটু পরেই স্টীমার ছেড়ে দিল। যতীন বলল, এইবার ট্রেন ছাড়বে, যাই একবার বড়সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আসি।
যতীন, গিরিজা, হমিদ চলে যাবার পর জিজ্ঞাসা করলাম, কী করে ম্যানেজ করলেন?
সকালে সবার ঘুম ভাঙবার আগেই ওকে ডেকে নিয়ে ডেকের ধারে গেলাম। তারপর বললাম, ভেবেছিলাম দিন দুয়ের মধ্যেই সিনগুলো তুলে নিতে পারব, কিন্তু এখন দেখছি দেরি হবে। সাহেবকে সেই ভেবেই কথা দিয়ে এসেছিলাম, আর তাছাড়া এখানে কৃতান্তবাবুদের এতখানি আন্তরিক সহযোগিতা পাব ভাবিনি। কাজেই আর দেরি না করে সকালের ট্রেনেই তুমি চলে যাও।
বললাম, কী বলল রাজহল?
-বলবার কোনও ফাঁকই তো রাখিনি। তবুও দুচারবার ক্ষীণ প্রতিবাদ করবার চেষ্টা করেছিল। কোন ফল হবে না বুঝতে পেরেই বোধহয় আমার কাছ থেকে ট্রেনভাড়া নিয়ে আস্তে আস্তে বোট থেকে নেমে গেল।
ইস দিয়ে ট্রেনও ছেড়ে দিল। একটু পরেই যতীনদের দল এসে গেল। আমরাও রেডি হয়ে ফুলমিঞার নৌকো নিয়ে কৃতান্তবাবুর বাড়ির দিকে রওনা হয়ে পড়লাম। স্টীমারে রইল হামিদ আর কুলি চারজন। যতীন হামিদকে বলে গেল, যদি বুঝি আজই সিন নেওয়া হবে তাহলে নৌকো পাঠিয়ে দেব। তুমি ক্যামেরা ও দুজন কুলি নিয়ে চলে আসবে।
কৃতান্তবাবুর বাড়ি গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। ডোঙা-নৌকো ও কলাগাছের ভেলা বাড়ির চারপাশে বাঁধা। সবাই শুটিং দেখতে এসেছে, ছেলের সংখ্যাই বেশি। আর একবার চা খাওয়ার পর কৃতান্তবাবু নরেশদাকে বাইরে নিয়ে এসে নৌকো দেখালেন দেড়শো টাকায় যেটা কেনা স্থির হয়েছে। বেশ বড় নৌকো, অনেক পুরোনো বলে তক্তাগুলো মাঝে মাঝে ক্ষয়ে গেছে। সামান্য চেষ্টায় তলায় দু-তিনটে ফুটো করে অনায়াসে ডোবানো যায়।
নরেশদা বললেন, ঠিক আছে। উপরে শুধু একটা ছই তৈরি করে নিতে হবে। দরমা চট খড় যা হোক দিয়ে একটা আচ্ছাদন বিশেষ দরকার। কনে আর পাঁচ সাতজন বরযাত্রী বসতে পারে, এমনিভাবে ওটা তৈরি করতে হবে! আর যেটায় বর যাবে, সেটাও ঠিক ঐ একই ধরনের হবে।
কৃতান্তবাবুর হাতে নরেশদা দেড়শো টাকা গুনে দিলেন।
ব্যায়াম-ক্লাবের সেক্রেটারি সমীর ইশারায় আমায় একপাশে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ধীরাজবাবু! যা শুনছি একি সত্যি?
বললাম, কী শুনেছেন?
-এই যে সত্যি-সত্যি নৌকো ভোবানো আর তার সঙ্গে সুনীলা দেবীও জলে ডুবে যাবেন।
বললাম, রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবি বইটা নিশ্চয় পড়েছেন, তাতে তো তাই লেখা আছে।
–কিন্তু এই নদী সম্বন্ধে কোনও আইডিয়া নেই আপনাদের। তাই ওরকম মারাত্মক সিন তুলতে সাহস করছেন। তাছাড়া, সুনীলা দেবী সাঁতার জানেন না।
অবাক হয়ে বললাম, সে খবর এর মধ্যে আপনি জানলেন কী করে?
-একটু কৌশল করে জানতে হয়েছে। কাল থেকে এ ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের ক্লাবে আলোচনা চলছিল। আজ সকালে বোন জয়াকে বলেছিলাম যে সুনীলা দেবী সাঁতার জানেন কি না, খবরটা জেনে আমায় বলতে। এইমাত্র জয়া জানিয়ে গেল।
পিছন ফিরে ঘরের মধ্যে চাইতেই দেখি সুনীলা দেবীকে ঘিরে মেয়েদের রীতিমত ভিড় জমে গেছে।
সমীর বলল, আর সাঁতার জানলেও এখানকার নদীতে সাঁতার কাটার নাম করতে সাঁতারুরাও ভয় পায়। আপনার পরিচালক মশায়কে জানিয়ে দিন-ওসব সিন এখানে নেওয়া চলবে না।
বললাম, কিন্তু নগদ দেড়শো টাকা দিয়ে নৌকা পর্যন্ত কেনা হয়ে গেছে। অম্লানবদনে বলল সমীর, মাঝিকে ডেকে আনছি। টাকা ফেরত নিন।
জটিল ব্যাপার, আমার দ্বারা মীমাংসা হওয়া অসম্ভব। নরেশদাকে গিয়ে সমীরের কথাগুলো বললাম। এগিয়ে এসে সমীরকে বললেন নরেশদা, সে কি মশাই। কলকাতা থেকে এত কষ্ট করে আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্যই হল ওই সিনটা নেওয়া। এখন আপনারা যদি বলেন
বাধা দিয়ে সমীর বলল, আমাদের মতামত নিয়ে যদি আসতেন তাহলে আসতে বারণই করতাম।
–এখন উপায়? ও মশাই কৃতান্তবাবু? বলেই ঝুপ করে হতাশভাবে বসে পড়লেন নরেশদা পাশের চেয়ারটায়। কৃতান্তবাবু মাঝিদের সঙ্গে দর কষাকষি করছিলেন। কাছে এসে বললেন, ব্যাপার কী নরেশবাবু?
–আর ব্যাপার! ছেলের দল বায়না ধরেছে, সুনীলা দেবীকে জলে ডোবানো চলবে না।