৬. দীপন চোখ বন্ধ করে আছে

৬.

দীপন চোখ বন্ধ করে আছে, ঘুমোচ্ছে না—বুঝতে পেরে কল্যাণী জিজ্ঞেস করে—ওদের সঙ্গে খেললে বুঝি? কি খেললে?

দীপন ভাঙা কণ্ঠে বলে—আমি খেলিনি। ওরা পিঁপড়ে পিঁপড়ে খেলছিল।

—পিঁপড়ে পিঁপড়ে আবার কী খেলা, এই নাম শুনিনি তো!

—দেওয়ালে যখন লাইন ধরে পিঁপড়ে যায়, ওরা বেছে বেছে লাল পিঁপড়ে মারে, কালো পিঁপড়ে মারে না। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কালোগুলো মারছ না কেন? ওরা বলল কালো পিঁপড়ে তো মুসলমান, তাই। তবে লালগুলো কী, ওরা বলল হিন্দু।

কল্যাণীর বুক কেঁপে ওঠে। দীপনের মুখে কী শুনছে সে! শরিফার ছেলেমেয়েরা হিন্দু পিঁপড়ে মারে? দীপন পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। কল্যাণীর সারারাত ঘুম আসে না। ঘরটিতে কোনও ভেন্টিলেটর নেই, গা তার ভিজে যায় ঘামে। খাটের নিচে পিঁয়াজ রাখা, হঠাৎ হঠাৎ ইদুর দৌড়য়। সপসপ করে সাপের মত কিছু নড়ে। কল্যাণীর ঘুম আসতে চায় না। সে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে।

ভোরবেলা দরজা খুলে সে বেরোয়। অত ভোরেই বারান্দায় বসে শরিফার বাচ্চারা আরবি পড়ছে, টুপি পাঞ্জাবি পরা এক লোক সুর করে বলছে—‘আলহামদুলিললাহ হি রাব্বিল আল আমিন আর রাহমানির রাহিম।’ বাচ্চারাও সঙ্গে সঙ্গে একই সুর ধরছে। কল্যাণী বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়ায়। ভোরের ঝিরঝির হাওয়া তাকে অল্প অল্প ছুঁয়ে যায়। সে দাঁড়াবার পরই থেমে যায় ওদের পড়া। কল্যাণী শোনে হুজুর ফিসফিস করে বলছে—হিন্দু নাকি?

বাচ্চাদের একজন গলা চেপে বলে—হ। ইন্ডিয়া থেইকা আইছে।

ফিসফিস বাড়ে। রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা কল্যাণী বুঝে ফেলে, সে না সরলে ওদের পড়া আর এগোবে না। ফিরে আসবার সময় সে লক্ষ করে প্রতিটি চোখ তার আপাদমস্তক দেখছে।

গত রাতেও এ ধরনের গুঞ্জন সে শুনেছে শরিফা আর তার স্বামীর মধ্যে। স্বামীটি বলছে—তুমি তো কুনোসময় কও নাই ছোটকালে তুমার একটা হিন্দু বান্ধবী ছিল!

—কই নাই মনে ছিল না।

—কয়দিন থাকবে মনে অয়?

—জানি না।

—বাড়িঘর নাই, আত্মীয়স্বজন নাই, তাইলে আইছে কেন সে?

—এইটাই তো বুঝলাম না।

বাড়িঘর নেই, আত্মীয়স্বজন নেই, কী দেখতে তবে এসেছে কল্যাণী—এই প্রশ্ন অনেকের চোখে। কল্যাণী আসলে বোঝাতে পারছে না কেন তবু এসেছে সে। এসে কী লাভ হয়েছে তার।

রাতে খেতে বসে কল্যাণী বলেছিল—শরিফা, বিরুই চালের ভাত খাইতে বড় ইচ্ছা করতাছে, সাথে চেপা শুটকির ভর্তা। কই মাছের ঝোল করা যায় না? জ্যোষ্ঠি মাসের শেষ, ইলিশ উঠে নাই? ওই দেশে যে কী রান্না করে, মুখে দিতে পারি না, সুক্ত ছ্যাকা পঞ্চব্যাঞ্জন থোকা যত্তসব। মনে আছে আমরা বড়শি দিয়া মাছ ধরতাম? লাটি মাছের ভর্তা যে কী ভাল বানাইত খালাম্মা। কুমড়া পাতা দিয়া নুনা ইলিশ!

আতাহার তাকিয়ে ছিল কল্যাণীর দিকে। কল্যাণীকে দেখতে শরিফার চেয়ে অনেক কম বয়স লাগে। ছিপছিপে শরীর। মেদ নেই। আতাহারের চোখের তীর কল্যাণীর বুক, পেট, তলপেট, কোমর, নিতম্ব ছুঁয়ে যায়—ভেতরে শিউরে ওঠে সে। এরকম ছুঁচোলো দৃষ্টি সে তিলজলায় সৌমিত্রর চোখে দেখেছিল। সকালেই সে বেরোবার জন্য তৈরি হয়। দীপনকে কাপড়চোপড় পরিয়ে শরিফাকে ‘একটু কালিবাড়ির দিকে যাই’ বলে সে বেরিয়ে যায়। সকালেও শরিফার নির্লিপ্ত সেই মুখ। এককাপ চা খেতে ইচ্ছে হয়েছিল খুব। চায়ের তৃষ্ণাটি সে সঙ্গে নিয়ে বেরোয়। হাঁটতে থাকে, হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার ধারের গাছে দেখে কদমফুল ফুটেছে। এ কি আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের কদম ফুল! ঝেঁপে বৃষ্টি আসত যদি আজ। কল্যাণীর বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ইচ্ছে করছে, বৃষ্টি এলে আগে উঠোন জুড়ে দৌড়ে বেড়াত সে। পুকুরঘাটে বসে জলের ওপর জল পতনের শব্দ শুনত। সরলাবালা বলতেন—উইঠা আয় জলদি। জ্বর উঠব।

কল্যাণীর একবার জ্বর হয়েছিল। সাতদিন কলেজে যায়নি। কী যে ছটফট লাগছিল। বাদলের কথা জ্বরের ঘোরে বারবার বলেছে। কত কেউ কপালে জলপট্টি দিয়েছে, কত কেউ হাতের পিঠে কপাল ছুঁয়ে দেখেছে। যার স্পর্শের জন্য তার প্রাণ শুকিয়ে থাকত, সে বাদল। বাদল তো আর বাড়ি এসে তার জ্বর দেখতে পারে না। সরলাবালা নুন মাখা আদা দিতেন খেতে, কল্যাণী খেত আর উদাস তাকিয়ে থাকত জাম পাতার ফাঁকে টুকরো টুকরো আকাশের দিকে। তার মনে হত বাদল যদি ওই আকাশে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ তার জানালায় একবার তাকায়, দেখবে শুকনো মুখে কল্যাণী শুয়ে আছে। তার শিয়রে আঙুর আর কমলালেবু পড়ে আছে না খাওয়া, তার খেতে ইচ্ছে করে না। তার জ্বর-শরীরে চলে যেতে ইচ্ছে করে দূরের কোনও গ্রামে, সেই গ্রামের কোনও ঝোপঝাড়ে জোনাক জ্বলা রাতে তার গান গাইতে ইচ্ছে করে—‘আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী।’ বাদল খুব কাছে বসে শুনবে আর বিহ্বল চোখে তাকে দেখবে। মনে হত তার যদি পাখা থাকত, পাখা মেলে সবটা আকাশ সে উড়ে বেড়াতে পারত। উড়তে উড়তে বাদল আর সে সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে চলে যেত অন্য এক অচেনা দেশে। কল্যাণী আকাশের দিকে তাকায়, এই আকাশ যেন তার বেশি চেনা। এই আকাশের সঙ্গে মনে মনে তার কত কথা হত। তার নাগালের মধ্যে এখন সবটুকু প্রিয় আকাশ। স্বপ্নের পুরোটা শহর তার হাতে। এখন তো শাসন করবার কেউ নেই। সরলাবালা নেই, হরিনারায়ণও নেই, কে কল্যাণীকে টেনে তুলে দেবে ট্রেনে! ময়মনসিংহ জংশন থেকে ঢাকার ফুলবাড়িয়া স্টেশন, ফুলবাড়িয়া থেকে নারায়ণগঞ্জ, শীতলক্ষার ঘাট থেকে স্টিমারে খুলনা, খুলনা থেকে ব্রডগেজের লাইন ধরে বেনাপোল, থমথমে সীমান্ত হেঁটে পার হয়ে বনগাঁ থেকে শিয়ালদার উদ্দেশ্যে আবার ট্রেন। এখনও মনে হলে কল্যাণীর গা কেঁপে ওঠে। রাস্তায় এত লোক হাঁটে, বাদল হাঁটে না! এই যারা মর্নিং ওয়াক সেরে, কেউ বাজার সেরে ফিরছে—এদের মধ্যে বাদলের থাকা অসম্ভব কিছু নয়। বাদলও তো সংসার করছে নিশ্চয়ই, তারও ঘর ভরে ছেলেমেয়ে হয়েছে। সেই যে সে বলেছিল তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। বাদল কি কল্যাণীকে ছাড়া বেঁচে নেই! আসলে ওরকম বলে সবাই, মনে হয় কিছু তার চাই-ই চাই, তা না হলে বোধ হয় সে বাঁচবে না, বেঁচে মানুষ যায়ই শেষ পর্যন্ত। কারও জন্য কারও জীবন বসে থাকে না, জীবন এত ছোট যে কাকে ছাড়া বাঁচব, কাকে ছাড়া বাঁচব না এসব হিসেব কষতে কষতেই জীবন ফুরিয়ে যায়। জীবনে যাকে সবচেয়ে প্রয়োজন আজ, তাকেই হয়ত কাল অচ্ছুৎ মনে হয়। কড়া রোদ পড়েছে। কল্যাণী একটি রিক্সা ডাকে। রিক্সাকে বলে যেদিকে খুশি যাও। মাঝে মাঝে শরিফাকে নিয়ে কল্যাণী এরকম বেরিয়ে পড়ত, রিক্সায় উঠে বলত যেদিকে খুশি যাও। যেদিকে খুশি সেদিকে চলে যাবার ইচ্ছে তার অনেকদিনের। কিন্তু যেদিকেই যেত ফিরে সে আসতই। যাবার আনন্দ তার যেমন ছিল ফেরার তাড়াও তার ছিল। একবার বাদলের সঙ্গে রিক্সা চড়েছিল কল্যাণী, যেতে যেতে অনেক দূর চলে গিয়েছিল। ভয়ে বুক কাঁপছিল তার, কে না কে দেখে ফেলে, শহর ভর্তি হরিনারায়ণের চেনা লোক, খবর পৌঁছে গেলে সর্বনাশ। শহর পার হয়ে খাগডহরের কাছে গিয়ে মুখ থেকে হাত সরিয়েছিল সে। বাদল বারবারই বলছিল—‘তুমি একটা ভীতুর ডিম। তোমারে দিয়া কিচ্ছু হবে না। দেখুক না সবাই, দেখুক। কী হবে! বলুক তোমার বাবার কাছে, বলুক। কী হবে!’ কল্যাণীকে দিয়ে হয়নি কিছুই। তার ফেরা হয়নি বাদলের উদ্যাম ভালবাসার কাছে, বাদলের ঘোর কালো শরীরের কাছে। ফেরা হয়নি ছুঁই ছুঁই করেও ছোঁয়া হয়নি এমন স্বপ্নের কাছে। রিক্সা করে ওরা মুক্তাগাছা গিয়েছিল, জমিদারবাড়ি, কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ, মন্দির ঘুরে এসে যখন পুকুরঘাটে থামল, বাদল বলল—‘এই পুকুরে সূর্যকান্ত মহারাজা যখন গোসল করতেন, পুকুরের চার কিনারে মোমবাতি হাতে মহারাজার উপপত্নীরা দাঁড়াত, তারা শ্বাস বন্ধ করে রাখত যদি শ্বাস লেগে মোমবাতি নিবে যায়, যার মোমবাতি নিবত না তার সাথে মহারাজা সেই রাতে থাকতেন।’ শুনে কল্যাণী বলেছিল—‘আমি হলে ফুঁ দিয়ে নিজেই বাতি নিবিয়ে দিতাম।’ গোপালের দোকানে বসে মণ্ডা খেয়েছিল দুজন। আহা কী স্বাদ সেই মণ্ডায়! কলকাতার রসগোল্লা নিয়ে লোকের আহা আহা ভাব দেখলে রাগ ধরে কল্যাণীর। মুক্তাগাছার মণ্ডা একবার যদি সে খাওয়াতে পারত ওখানে! শান্তি সুনীতিরা কলকাতার সন্দেশ নিয়ে হইহুল্লোড় করলে একবার সে ঠোঁট উল্টে বলেছিল—‘আমাদের মণ্ডা কত মজা!’ শুনে ওরা হো হো করে হেসে ওঠে। বলে—‘মজা কী গো। খাবার জিনিস আবার মজার হয় নাকি? মজার হয় গল্প, মজার হয় লোক।’ কল্যাণী বড় লজ্জা পেয়েছিল। মণ্ডা ছেড়ে ওর ‘মজা’ শব্দ নিয়ে ওরা মজা করেছিল। মুক্তাগাছা থেকে ফিরবার পথে ঘনশ্যামপুরের কাছে বাদল তার হাত ছুঁয়ে বলেছিল—‘আমরা এখানে শনের একটি ঘর করে থাকব।’ কল্যাণী আঁতকে উঠেছিল—‘এই ধানক্ষেতের মধ্যে?’ শনের ঘর নিয়ে তার কোনও আবেগ ছিল না, কিন্তু বাদল তার স্বপ্ন দিয়ে এমন নিবিড় করে বেঁধেছিল কল্যাণীকে যে দিগন্ত ছোঁয়া সবুজ ধানক্ষেতের ওপর টকটকে লাল শাড়ি পরে কল্যাণী মনে মনে সারাদিন দৌড়ে বেড়াত। নতুন বাজার, পণ্ডিতবাড়ি, টাউন হল, সার্কিট হাউসের পাশ ঘুরে এসে কলেজ রোডে ওঠে রিক্সা। গাছে বরই পাকলে ডাল ধরে ঝাঁকুনি দিলে যেমন টপটপ করে পড়ে, তেমনি তার স্মৃতির বৃক্ষ ধরে কেউ বোধহয় ঝাঁকালো হঠাৎ। তার মনে পড়তে থাকে এই পথ ধরে সে কলেজে যেত। আনন্দমোহন কলেজ। লাল ইটের বিল্ডিংটি বাঁদিকে পড়তেই সে রিক্সা থেকে নেমে পড়ে—মাঠের কড়ইগাছটি আছে এখনও। ছেলেমেয়েরা বসে আছে, হাঁটছে। সোনার খনি খুঁজে পাবার আনন্দ হয় কল্যাণীর। সে এলোমেলো হাঁটতে থাকে মাঠে, কলেজের করিডোরে, পুকুরঘাটে, দূরের শিমুলগাছটি খোঁজে, পায় না। বাদলকে খোঁজে, কারও কারও মুখ অনেকটা বাদল-বাদল লাগে। করিডোরে দাঁড়িয়ে বাদল তার হাতের পিঠে একবার চুমু খেয়েছিল, কী যে শিরশির লেগেছিল সেদিন। দু দিন সে বাঁ হাতখানায় জল ছোঁয়ায়নি। যদি মুছে যায়! কল্যাণী লক্ষ করে তার পিছন পিছন একদল ছেলে আসছে, তাদের কেউ শিস দিচ্ছে, কেউ গান গাইছে—‘দেখা হ্যায় পহলি বার সাজন কি আখো মে পেয়ার।’ কল্যাণী পিছন ফিরে ওদের একজনকে জিজ্ঞেস করে—তোমরা কোন ইয়ারের ছাত্র?

—ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ার।

—জানো আমি এই কলেজে পড়েছি। অনেক আগে। তোমাদের জন্মেরও আগে। এখনও কি নিচের তলায় বাংলা ক্লাস হয়?

ছেলেরা এ ওর মুখের দিকে তাকায়। যেন খুব হাসির কথা শুনছে ওরা। আঠারো-উনিশ হবে ওদের বয়স। ওদের একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করে—এই বাংলা ক্লাস কোথায় হয় রে?

যাকে জিজ্ঞেস করে, সে হেসে বলে—স্যারের বাংলোয়।

—ঠিক কইরা বল। দুষ্টামি রাখ।

—বললাম ত।

পিছন থেকে একজন বলে—দোতলায়।

কল্যাণী হেসে জিজ্ঞেস করে—তোমরা বুঝি ক্লাস ফাঁকি দাও?

শুনে হাসির রোল ওঠে। কল্যাণীর বুক চিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরোয়। পিছনের একটি ছেলে চিৎকার করে ওঠে—‘ল যাই গা’ বলে, সঙ্গে সঙ্গে বাকি ছেলেরা শব্দ করে হেসে ওঠে। কল্যাণী ঠিক বুঝে পায় না কাকে নিয়ে হল্লা করছে ওরা? পাশ কেটে একদল মেয়ে চলে গেল, ওদের উদ্দেশ্যেই কি? তার আরও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল—কেমেস্ট্রির ল্যাবরেটরি কি আগের জায়গায় আছে? তোমরা এখন ফিজিক্স কার বই পড়? জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল—পুকুরপাড়ে যে একটি শিমুলগাছ ছিল, ওটি নেই কেন? শিমুল কি ফুটত না? তার বলতে ইচ্ছে করছিল—জানো তো, আমাদের সময় মেয়েরা স্যারের পিছন পিছন ক্লাসরুমে যেত। ক্লাস শেষ হলে আমরা বসে থাকতাম কমনরুমে। ঘোরাফেরা করতে হত লুকিয়ে। আর এখন মেয়েরা দিব্যি এদিক ওদিক হেঁটে বেড়াচ্ছে, ভাল লাগছে দেখতে। আচ্ছা, পুকুরে কি সাঁতার খেলা হয় না আগের মত? আমরা কিন্তু ছাত্র ইউনিয়ন করেছি। দল বেঁধে গণসঙ্গীত গেয়েছি। উই শ্যাল ওভারকাম…তোমরা গাও না আমরা করব জয়…তারপর ধর কারার ওই লৌহকপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট?

এসব আর বলা হয় না কল্যাণীর। ঠোঁটের কাছে কথাগুলো নিয়ে এসেও আবার গিলে ফেলে। কলেজ গেটের দিকে বড় উদাস হেঁটে যায় সে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি গেলে যেমন লাগে, তেমন লাগে তার। কী যেন খুব নেই নেই লাগে।

‘লাগবে চুড়ি ফিতা’ কাচের বাক্সে চুড়ি ফিতে ক্লিপ সাজিয়ে ফেরিঅলা যেত আগে, জিভে নিলে মিলিয়ে যায় গোল গোল গোলাপি হাওয়াই মিঠাই যেত, বাইরে ‘হাওয়াই মিঠাই’ ডাক শুনলে কল্যাণী দৌড়ে বেরোত ঘর থেকে। রাস্তায় হাওয়াই মিঠাই, চুড়ি ফিতে কোনও ফেরিঅলা চোখে পড়ে না। শপিং সেন্টার বেড়েছে। শাড়ি কাপড় কসমেটিকস কনফেকশনারি বেড়েছে। অনেক বদলে গেছে নদী ঘেঁষা স্নিগ্ধ শহরটি। পণ্ডিতবাড়ি, কোর্ট-কাছারি, সাহেব কোয়ার্টারে ঘুরতে ঘুরতে জজকুঠিতে চোখ পড়ে কল্যাণীর। এই কুঠিতে ছোটবেলায় কত সে এসেছে, অনিল মুখুজ্জে সেই কতকাল আগে এই কুঠির সামনে দাঁড়িয়ে একদিন বলেছিলেন—‘এখানে একজন জজসাহেব ছিলেন, তিনি এই কুঠির দোতলায় বসে তাঁর মানস সরোবর দেখতেন। বল তো মানস সরোবরটা কী?’ কল্যাণী বলেছিল—‘থুক্ক’। অনিল মুখুজ্জে বলেছিলেন—‘ব্রহ্মপুত্র। একদিন সেই জজের দেড় বছরের মেয়ে একটি জবাকুসুম তেলের শিশি ভেঙে ফেলেছিল, দেখে জজসাহেব ছড়া লিখলেন—‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ কর, তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ কর, তার বেলা?’ বল তো এই জজসাহেবের নাম কী?’ কল্যাণী আবার ‘থুক্ক’ বলেছিল। অনিল মুখুজ্জে বলেছিলেন—‘অন্নদাশংকর রায়। কত আড্ডা দিয়েছি দুজনে দোতলার বারান্দায় বসে। মানুষ বড় ভাল ছিলেন।’ কল্যাণী দীপনকে জজকুঠির দোতলা দেখিয়ে বলে—‘ওখানে বসে একজন খুব বড় রাইটার একটি ছড়া লিখেছিলেন, স্কুলের প্রাইজ গিভিং সেরিমনিতে পড়বার জন্য একটি ছড়া শিখিয়েছিলাম তোমাকে, বল তো ছড়াটি’; দীপন থুক্কু বলে না, চোখ বুজে বলে যায়—‘…তোমরা যে সব ধাড়ি খোকা ভারত ভেঙে ভাগ কর, তার বেলা?’ ভারত ভেঙে ভাগ করলে দীপনের কিছু এসে যায় না বলে ছড়াটি বলতে পেরে সে হেসে ওঠে। এদিকে বুক ভেঙে যায় কল্যাণীর। এই হৃদয়-ছোঁওয়া আপন শহরটি কেমন পর পর লাগছে। আজ কার জন্য এ শহর তার নিজের হয়েও নিজের নয়? কার দোষে সে আজ পথে পথে পরশপাথরের মত কিছু খুঁজছে? জন্মের পর নাড়ি ফেলা হয় মাটিতে, সেই নাড়ি খুঁজছে সে? নাকি গন্ধ খুঁজছে, মায়ের বুকের গন্ধ? শশাবার ঘরের জানালার পাশে যে কামিনীগাছ ছিল, সেই কামিনীর গন্ধ খুঁজছে সে? কি খুঁজছে কল্যাণী বুঝে পায় না। কাছারি রোড, পণ্ডিতবাড়ি, নতুনবাজার, স্বদেশি বাজার, মেছুয়াবাজার, স্টেশন রোড, আমলাপাড়া, আমপট্টি, মহারাজা রোড, পাটগুদাম ঘুরতে ঘুরতে রিক্সাঅলা মোটা গলায় বলে—‘কুন জাগায় নামবাইন ঠিক কইরা কইন। চরকির মত ঘুর পারলে চলব নি?’ ছোট্ট ম্যাচবাক্সের মত শহর, দুবার ঘুরে এলেই শহরটি শেষ হয়ে যায়। অথচ ছোটবেলায় এই শহর ফুরোতে চাইত না। হাঁটতে হাঁটতে হাঁটুতে ব্যথা ধরত, দীর্ঘ পথ তবু না দেখা থেকেই যেত। শ্মশানঘাটে এসে কল্যাণী রিক্সা ছেড়ে দেয়। সামনে শম্ভুগঞ্জের ব্রিজ, কল্যাণী বলে—‘দীপন, ওই যে দেখ রেল ব্রিজ, গভীর রাতে ওই সেতুর ওপর দিয়ে ঝমঝম করে ট্রেন যেত। মা বলতেন—বড়লাট যায় গৌরীপুরের জমিদারবাড়ি দেখতে। শুনে শুনে পরিমল বলত—দিদি দিদি বললাট দায় গৈলিপুলে…।’

দীপন শুকনো মুখে হাসে।

এই শ্মশানেই ওঁদের পোড়ানো হয়েছে। হরিনারায়ণ আর সরলাবালার হতভাগ্য সন্তান কল্যাণী, তিরিশ বছর পর সে এসেছে চিতার আগুন দেখতে, পোড়াকাঠ দেখতে। চারদিক শুনশান। জনমনুষ্যি নেই। দু-একটি কুকুর কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। হু হু হাওয়া আসছে বিরান ব্ৰহ্মপুত্র থেকে।

‘দীপন, তোমার দাদু দিদিমাকে এই শ্মশানে দাহ করা হয়েছে’—কল্যাণী তার ছেলেকে কাছে টেনে ঘাস উঠে যাওয়া এবড়ো-খেবড়ো মাটি আর ধুলোর জমিন দেখিয়ে বলে। দাদু দিদিমা দীপনের কাছে কেবল গল্পই। রূপকথার ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর মত। ওর চোখে কোনও হাহাকার নেই বরং ও সামান্য কেঁপে উঠে বলে—ওমা এটি শ্মশান!

শ্মশানে আসতে ভীষণ ভয় পেত কল্যাণী, পরিমল একবার বাজি ধরেছিল—শ্মশানে যাইতে পারবি একলা একলা?

—তুই পারবি? কল্যাণী পাল্টা প্রশ্ন করেছিল।

পরিমল তখন তেরোয় পড়েছে। সে বলেছিল—পারবাম।

রাত যখন নটা, কল্যাণী বলল—‘এইবার যা। শ্মশান ছুঁইয়া আয়। পারলে হাড়গোড় কিছু আনিস।’

পরিমল দম নিয়ে দৌড়ল বটে, কিন্তু ওর জন্য দুশ্চিন্তায় কল্যাণীর তখন ঘাম ছোটে। সে ওই রাতে কাউকে কিছু না বলে, একাই বেরিয়ে গিয়েছিল পরিমলকে ডাকতে, একাই সে অন্ধকারে দৌড়েছিল শ্মশানের দিকে। নিঝুম শ্মশানে দাঁড়িয়ে ‘পরিমল পরিমল’ বলে ডেকেছিল, ঘোর অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল তার শরীর। তার মনে হচ্ছিল শ্মশানের ভূত বুঝি পরিমলকে টেনে নিয়ে জলে ডুবিয়ে দিয়েছে। চোখের জল মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরেছে কল্যাণী, ফিরে দেখে সরলাবালার কোলে বসে পরিমল গুড়ের সন্দেশ খাচ্ছে, সে নাকি চুপিচুপি ছাদে শুয়েছিল, বাড়ি থেকে মোটে বেরই হয়নি।

সেই রাতের মত কল্যাণী ঊর্ধ্বশ্বাস ছোটে কালিবাড়িতে, তার বাড়ির দিকে। যেন বাড়ি গেলেই এখন পাওয়া যাবে সরলাবালাকে, তাঁর কোলে বসা পরিমলকে। যেন বাড়ি গেলেই দেখবে ছাদে দাঁড়িয়ে জ্যোতিপ্রকাশ নক্ষত্র গুনছে। নিচতলার বৈঠকঘরে রেক্সিনে বাঁধা বই-এ মুখ গুঁজে বসে আছেন হরিনারায়ণ। কল্যাণী দ্রুত হাঁটে। সন্ধে নামলে যে মেয়ে বাড়ির বাঁশঝাড়ের কাছেই যেত না, ঘুরঘুট্টি শেয়াল-ডাকা রাতে সে মেয়ে ভূত-প্রেতের ভয় ভুলে দৌড়েছিল কার জন্য? কার জন্যই বা এখন দৌড়চ্ছে সে? দৌড়লেই কী সব ঠিক ঠিক পাওয়া যায়? কামিনী ফুলের ঝাঁকড়া গাছ, রান্নাঘরের পেছনে কাগজি নেবু? দল বেঁধে গোল্লাছুট? মায়ের ওম ওম বুকের ঘ্রাণ?

হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় জোড়া সিংহের ওপর। তাদের বাড়ির উত্তরে ছিল অনিল মুখুজ্জের বাড়ি। সেই বাড়ির গেটে ছিল জোড়া সিংহের মূর্তি। সেই বাড়িই, সেই সিংহঅলা বাড়িই এটি। বাড়িটি আগের মতই আছে। দু পাশে দুটো গোল ঘর, অনিল মুখুজ্জে বলতেন—‘আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা এইসব ঘরে বসে বাঈজিদের নাচ দেখতেন, বাঈজি আসত কলকাতা থেকে।’ বাড়িটির সদর দরজা হাঁ করে খোলা, কল্যাণী গেট পেরিয়ে খোলা দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে। যেন এ বাড়িতেও সে তার অনিলকাকাকে পাবে। একগাদা বই-এর ভেতর ডুবে থাকবে ধুতি ফতুয়া পরা আলাভোলা মানুষটি। বাড়িতে গাদা গাদা বই ছিল। বিছানায়, টেবিলে, চেয়ারে, মেঝেয়, শীতলপাটিতে বই গড়াত। এত বই দেখে কল্যাণী বলত—‘এত যে বই পড়েন, আপনার মাথা ধরে না?’ অনিল মুখুজ্জে বলতেন—‘বই না পড়লেই বরং মাথা ধরে।’ তিনি তাকে মাঝে মধ্যেই সাহেব কোয়ার্টারের দিকে বিকেলে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। জজসাহেবের কুঠির দক্ষিণে নলিনী সরকারের বাড়ি, বাড়ির কাছে কৃষ্ণচূড়া, তার তলায় বসে পুরো ঠাকুরমার ঝুলি শুনিয়েছিলেন অনিকাকা। দীপন জয়িষাকে গল্প শোনাতে গিয়ে কল্যাণীকে আর দক্ষিণারঞ্জন পড়তে হয়নি। কল্যাণী যে ঘরে এসে দাঁড়ায় ঘরটি ভরে বড় বড় সোফা, বড় খাট, আলনা, টেলিভিশন, ভি সি আর, ফুলদানিতে থোকা থোকা প্লাস্টিকের ফুল। সে যখন ঘুরে ঘুরে বই খুঁজছিল, তার বিস্মিত চোখের সামনে দাঁড়ায় এসে একুশ-বাইশ বছর বয়সের একটি মেয়ে।

কল্যাণী জিজ্ঞেস করে—এটি অনিল মুখুজ্জের বাড়ি না?

মেয়েটি বলে—না তো!

—ওঁরা কোথায়?

—শুনেছি যাঁর বাড়ি তিনি মারা যাবার পর তাঁর ছেলেরা বাড়ি বিক্রি করে ইন্ডিয়া চলে গেছে। আপনি?

—আমি কলকাতা থেকে এসেছি, সামনে বাড়িঘর দেখছেন, সবই আমাদের জায়গা ছিল, দু বিঘা জমির ওপর ছিল আমাদের বাড়ি।

মেয়েটি কৌতূহলী চোখে প্রশ্ন করে নিজেদের বাড়িঘর দেখতে এসেছেন বুঝি?

কল্যাণী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে—হ্যাঁ।

—বসেন বসেন। মেয়েটি কল্যাণীকে চেয়ার এগিয়ে দেয়। দীপনের চিবুক নেড়ে বলে—আপনার ছেলে, তাই না? কি নাম তোমার বাবু?

—ওর নাম দীপন।

—বাহ খুব সুন্দর নাম তো। কোন ক্লাসে পড় তুমি?

—সিক্সে পড়ে।

—কোথায় উঠেছেন আপনারা? মেয়েটি আবার প্রশ্ন করে।

—ছোটবেলার এক বন্ধু আছে আমার, ওর বাড়িতে। আমাদের বাড়ির একেবারে লাগোয়া বাড়িটি ছিল ওদের।

—তা হলে তো কাছেই, তাই না?

—ও এখন নওমহল থাকে।

—আপনার একা একা ঘুরে বেড়াতে অসুবিধা হচ্ছে না?

—তা হবে কেন? শহরের সবই তো চিনি আমি।

—ও তাই তো। তবে ময়মনসিংহ তো একেবারে ডেভেলপ করেনি। আপনি যদি ঢাকা আর চট্টগ্রাম দেখেন, ভাল লাগবে।

—আমি কি আর ডেভেলপমেন্ট দেখতে এসেছি? আমি আগের সেই…

—চা-টা কিছু খাবেন কি? ছেলেটার মুখ শুকিয়ে আছে।

—আমপট্টির সুধীর ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে লুচি হালুয়া খেয়েছি। দই আর মালাইকারির স্বাদ আগের মতই আছে।

—স্বাদ কেমন ছিল আপনার মনে আছে? মেয়েটির চোখে সরল কৌতুক।

কল্যাণী মলিন হাসে। মেয়েটি ভেতর-ঘর থেকে দুটো বাটি করে পায়েস আনে, সঙ্গে দু গ্লাস ডাবের জল। দুজনের হাতে পায়েসের বাটি তুলে দিয়ে মেয়েটি বলে—আমার নাম নীপা। বি. এ. পড়ি। মুমিনুন্নিসায়। সামনে পরীক্ষা আমার। এখানে কি কি দেখলেন? ঘুরে ঘুরে দেখেছেন তো! এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটি গেছেন? মেয়েদের ক্যাডেট কলেজ দেখেন নাই? দেখার অবশ্য বেশি কিছু নাই ময়মনসিংহে। নতুন ব্রিজ হয়েছে, ওটা দেখতে পারেন।

কল্যাণী ডাবের জলে চুমুক দিয়ে বড় তৃপ্তি পায়। যেদিন গাছ কাটানো হত, কচি ডাবে ভরে যেত বাড়ি। বারান্দায় স্তুপ করে রাখা হত ডাব। কল্যাণীর পছন্দ ছিল ডাবের শাঁস, সে লুকিয়ে জল ফেলে চামচে তুলে শাঁস খেত। বাড়ি বাড়ি বিলিয়েও নারকেল ফুরোত না, খাটের তল বোঝাই হয়ে থাকত নারকেলে। ঝুনা নারকেল কুরিয়ে পুজো-পার্বণে চমৎকার নাড়ু বানাতেন সরলাবালা।

—থাকছেন তো কয়েকদিন? নীপা জিজ্ঞেস করে।

কল্যাণী হঠাৎ বুঝে পায় না এর উত্তর সে কী দেবে। সে ক্লান্ত চোখে তাকিয়েছিল খোলা দরজার ওই পাশে যেটুকু ঘাস, ঘাস উঠে যাওয়া মাটির যেটুকু পথ দেখা যায়, সেদিকে।

আশঙ্কায় আর আশায় কণ্ঠ তার কাঁপে—কিছুই তো নেই আর। একটি গাছ আছে শুধু। আচ্ছা, ওরা যদি গাছটা কেটে ফেলে? তোমরা বলে কয়ে রাখতে পার না? বলবে পুরনো গাছ, না হয় থাকুক। তা ছাড়া জাম তো ধরছে। এই গাছের জাম আগে কত লোকে খেত। পাড়ার বাচ্চারা কুড়িয়ে নিয়ে যেত। আমরা টিনের থালায় নুন লঙ্কা মেশানো জাম নিয়ে আরেকটি থালা দিয়ে ঢেকে জোরে ঝাঁকুনি দিতাম, জামগুলো ভর্তা হয়ে যেত।

এ তো এখন আর আপনাদের নয়? নীপা হেসে বলে—কেটে ফেললেই বা কী।

—তবু আমাদের তো ছিল। কাটলে কষ্ট হবে না?

—আপনি কি অনেকদিন থেকে কলকাতায়?

—হ্যাঁ তিরিশ বছর।

—তিরিশ বছর পরও গাছের কথা মনে রেখেছেন? নীপা খিলখিল হেসে ওঠে।

কল্যাণী ম্লান হাসে। উঠে বারান্দায় যায়, দেওয়ালে হাত বুলোয়, বলে—‘অনিলকাকার এ বাড়িতে আমরা কত এসেছি। ওঁর কথা বড় মনে পড়ছে। বড় ভাল লোক ছিলেন।’ বলতে বলতে কল্যাণীর চোখ ভিজে যায় চোখের জলে।

সে তার বাড়ির দিকে হাঁটে, কালো গেটটি নেই, গেটের ওপর মাধবীলতা ফুটে থাকত, কার নিষ্ঠুর আঙুল সব টেনে ছিঁড়েছে! বাড়িটির একটুকরো চুন সুরকিও যদি পাওয়া যেত—মেঝেয় সোনামুখি সুঁই পড়লে লোকে যেমন করে খোঁজে, কল্যাণীও গভীর মন দিয়ে কিছু ছিটেফোঁটা খোঁজে ধান দুব্বার ভেতরে। দেখে সেগুন কাঠের বড় পালঙ্ক, সিন্দুক, টেবিল, চেয়ার, মেহগিনি কাঠের আলমারি, ঝাড়বাতি—এ সবের কোনও চিহ্ন কোথাও পাওয়া যায় কি না। দোতলার জানলার পাশে কল্যাণীর শোবার ঘর ছিল, ওই ঘরে সারাদিনই ব্রহ্মপুত্রের উতল হাওয়া বইত। দোতলার ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওই পার দেখা যায় না অমন কুলকুল জলের দিকে বিভোর তাকিয়ে থাকত, নৌকো করে ওই পার থেকে সকালে ভাগীরথীর মা আসত দুধ নিয়ে, কলাপাতায় ঢাকা দুধ। রাতে দুধ ভাত খেতে দিয়ে সরলাবালা ছড়া কাটতেন—‘নদীর পাড়ে যাইও না ভাই ফটিং টিং এর ভয়, তিন মানুষের মাথা কাটা পায়ে কথা কয়।’ রাতে ফটিং টিং-এর ভয়ে ঘুম ভেঙে যেত। পরদিন আলো ফুটলে আর কোনও ভয় থাকত না। বিকেল হলে মাঠে হুল্লোড় করে খেলতে নামা, নয়ত নদীর পাড়ে দৌড়ানো! একবার কল্যাণী অনিলকাকার কাছে জিজ্ঞেস করেছিল—‘ফটিং টিং দেখতে কেমন?’ তিনি তখন দু হাত মেঝেয় রেখে পা ওপর দিক তুলে মাথাকে বুকের কাছে ডুবিয়ে এনে এমন এক অদ্ভুতুড়ে আকৃতি বানালেন যে কল্যাণী সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ভাবলে এখনও তার গা ছমছম করে।

এই এক চিলতে মাঠের মধ্যে, যদিও সেই বাড়ির কোনও চিহ্ন নেই, কল্যাণী পায়ের জুতো খুলে হাঁটে। মাঠ জুড়ে একটি বারো-তেরো বছর বয়সের মেয়ে বেণী দুলিয়ে দৌড়চ্ছে, মেয়েটিকে সে ছুঁতে চায়, ছুঁতে পারে না। সে যেন নিজেই নিজের নাগাল পায় না। আগে মাঠে দাঁড়ালে ব্রহ্মপুত্রের হাওয়া এসে গা কাঁপিয়ে যেত, এখন স্পর্শও করে না। হাওয়া কোত্থেকে আসবে, সরু একটি সুতোর মত নদী, কল্যাণীর বিশ্বাস হয় না ওই নালাটিই তার প্রিয় ব্রহ্মপুত্র! তার মনে হয় সবাই মিথ্যে বলছে, ব্রহ্মপুত্র এত দরিদ্র হতে পারে না। আস্ত একটি নদী লোকে হেঁটে পার হচ্ছে। নদীর ওপর ধানক্ষেত, সবজিক্ষেত—ও কি নদী নাকি অন্য কিছু?

চৌচালা একটি টিনের ঘর ছিল বাড়ির পিছন দিকে, টিনের চালে বৃষ্টি পড়লে কী চমৎকার শব্দ হত, কলকাতার কংক্রিট আর টালির ছাদে কী আর সেই রিমঝিম শব্দ মেলে! পুকুরের পাশ দিয়ে সরু একটি পথ ছিল, ওই পথে রুখসানাদের বাড়ি যাওয়া যেত। একদিন ভরদুপুরে চারদিক অন্ধকার হয়ে এসেছিল, আকাশে কালো মেঘ, গুড়ুম গুড়ুম শব্দ, ঠাণ্ডা হাওয়া তীরের মত শরীরে বিঁধছিল—তখন রুখসানা ওই পথ ধরে পা টিপে টিপে এসে বলল—‘আম পড়তাছে, চল যাই।’ ওদের বাড়িতে ছ’টা কাঁচামিঠে আমের গাছ ছিল। রুখসানার সঙ্গে কাঠগোলাপ গাছের তল দিয়ে কল্যাণী যখন দৌড়ে যাচ্ছিল, পিছন থেকে সরলাবালা ডাকছিলেন—‘গাছের ডাইল ভাইঙ্গা মাথায় পড়ব, যাইস না কল্যাণী।’ গাছগুলো এত ভীষণ দুলছিল ঝড়ো হাওয়ায়, দরজা জানালা বন্ধ করে ঘরে বসে থিরথির কাঁপছিল সবাই, আর সে দৌড়ে চলে গিয়েছিল রুখসানাদের উঠোনে। শিল পড়ে শাদা হয়ে ছিল ওদের উঠোন, আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল আর তার আলোয় দু হাতে আম কুড়িয়েছিল দুজন। এখনও তো ঝড় হয়, এখনও কী আগের মত বালিকারা ফ্রক ভরে ঝড়ে পড়া আম কুড়োয়? রুখসানাদের গাছে বড় বড় পেয়ারা হত, পেয়ারাগাছে চড়ে ওরা পা দুলিয়ে দুলিয়ে গল্প করত আর পেয়ারা খেত। ওর ছোট দুভাই নিচে দাঁড়িয়ে থাকত, ওদেরও ছুঁড়ে ছুঁড়ে পেয়ারা দিত ওরা। রুখসানার আম্মার অবশ রোগ ছিল, সারাদিন শুয়ে থাকত। বাড়ির লোকেরা বলত—‘জিনের বাতাস লাগছে।’ কল্যাণী আর রুখসানাকে গাছে উঠতে দেখে আম্মা চিকনগলায় চেঁচাত—‘মেয়েমানুষ গাছে উঠলে গাছ কিন্তু মইরা যায়।’ রুখসানা ঠোঁট উল্টে বলত—‘ছাই মরে।’ কল্যাণীর চোখের সামনে সেই দস্যি রুখসানার বিয়ে হয়ে গেল, ও তখন বিদ্যাময়ী স্কুলে এইটে পড়ে, ওকে ইস্কুল ছাড়িয়ে বাড়িতে বসিয়ে রাখা হল, তারপর একদিন চেনা নেই—শোনা নেই এক বুড়ো মত লোকের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিল। বিয়ের দিন ও একফোঁটা কাঁদেনি। কল্যাণীর কানে কানে বলেছিল—‘দেখিস কালই আমি পালাইয়া চইলা আসব।’ কল্যাণী অপেক্ষা করেছিল, রুখসানা আসেনি। বছর দুই পর শাড়িপরা মহিলা হয়ে ঘোমটা মাথায় কোলে একটি বাচ্চা নিয়ে যখন সামনে দাঁড়িয়েছিল, কল্যাণী প্রথম চিনতে পারেনি যে এ রুখসানা। নিজেকে অনেকটা রুখসানার মত মনে হয় তার—পালিয়ে চলে আসবে তো সেও বলে গিয়েছিল, আসেনি। রুখসানার মত সেও বছর গেলে বয়স গেলে ফিরেছে। রুখসানাকে যেমন চেনা যায়নি, কল্যাণীকেও বোধ হয় চেনা যাচ্ছে না।

হঠাৎ কল্যাণী নিজেই জানে না তার ভেতরে শৈশব কৈশোর এত তীব্র জেগে ওঠে যে সে মাটিতে নুয়ে পড়ে। এটি তার নিজের মাটি, এই মাটিতে তার দীর্ঘ দীর্ঘ দিনের পায়ের ছাপ লাগা, মাঠের এই দক্ষিণ দিকটিতে জামগাছটির দু হাত দূরে কল্যাণী মাটি থেকে সেই ঘ্রাণ পাচ্ছে। সে মাটির ঘ্রাণ শুঁকতে যেয়ে নত হতে হতে মাটিতে উবু হয়ে মাটিকেই দু হাতে আঁকড়ে ধরে। কালো কালো জাম থেতলে পড়ে আছে ঘাসের ওপর। পাড়ার লোকেরা এই গাছের জাম কত কুড়িয়ে নিয়েছে, নিমগাছের ডাল ভেঙে নিয়ে যেত, কল্যাণীরাও আনত, শরিফাদের গাছ থেকে পুজোর জন্য বেল পাতা আনত। দু-একজন অলস হাঁটছিল হয়ত, কল্যাণীর নত শরীরের কাছে এসে দাঁড়ায়—সন্দিগ্ধ, উৎসুক দৃষ্টি ওদের। কেউ হাসে, কেউ এর ওর কাছে জানতে চায় ঘটনাটি কী! কল্যাণী কি এখানে এখন উদ্ভট কোনও বস্তু! হরিনারায়ণ রায়ের মেয়ে সে। লোকে বলত রায়বাবু আছে বলে শহরে বিচার আছে। রায়বাবুকে মনে রাখবার জন্য এই শহরে এখন কেউ বসে নেই। কল্যাণীকেও কেউ চেনে না এখন।

ওইখানে কে? কে ওইখানে? বলে দোতলার জানালা থেকে কর্কশ কণ্ঠে একটি লোক চেঁচিয়ে ওঠে। লোকটি খালি গায়ে লুঙ্গি পরে নিচে নেমে প্রশ্ন করে—কি চাই? তখন নিজেদের জামগাছটিকে আঁকড়ে ধরে যেটি তার ঠাকুরদা পুঁতেছিল এই মাটিতে, ডুকরে কেঁদে ওঠে কল্যাণী। ভিড় যত বাড়ে, বুক ভেঙে কান্না নামে তার। সে নিজেও ঠিক বুঝতে পারে না সে কেন কাঁদছে। তার কেবল মনে হচ্ছিল এই মাটির সে মানুষ। সরলাবালা নামে কোনও মা তার ছিল না, এই মাটি কুঁড়ে সে আটচল্লিশ বছর আগে জন্মেছে। সে নেই বলে এখন আগের মত বৃক্ষ নেই, বৃক্ষেরা আগের মত সবুজ নেই, সে নেই বলে ব্রহ্মপুত্রেও জল নেই। দাঁড়ানো লোকগুলো নিজেদের মধ্যে বলতে থাকে—মেয়েলোকটা কে, কান্দে কেন?

কেউ বলে—আরেকদিনও আইছিল, হিন্দু।

শুনে একজন বলে—হিন্দু বেটি এইখানে আইসা কান্দে কেন?

একজন মিনমিন করে বলে—ইন্ডিয়া থেইকা আইছে, বাড়িঘর নাকি এইখানে ছিল।

—এইখানে ছিল? এইখানে বাড়ি আবার কবে ছিল? ব্রিটিশ আমলে?

—কি জানি কে জানে?

—নাকি পাগল?

—তাই বা কে জানে?

—এইখানে আগে হিন্দু বাড়ি ছিল বুঝি?

—তাই তো কয়।

—থাকলে ছিল। কত কারও তো ছিল। এই জন্য কানতে হয় নাকি? ইন্ডিয়া থেইকা মুসলমানরা আসে নাই সব ছাইড়া ছুইড়া? কই তারা অইগুলা এখন দখল করতে যায় নাকি?

—কাদেররা জমিদারি ছাইড়া চইলা আসল না? গাঙ্গিনার পাড়ে সোনার দোকান দিছে ‘ক্যালকাটা মুসলিম জুয়েলার্স।

—আসলে বোধ হয় মায়ায় কান্দে। বয়স হইয়া গেছে। বাপ-মা’র কথা মনে পড়ে। চেক লুঙ্গি পরা একটি যুবক গাছে হেলান দিয়ে বলে।

একটি ভারী কণ্ঠ আর সব সংলাপ হটিয়ে দিয়ে বলে—যতসব ফাইজলামি, থাকতে চায় ইন্ডিয়ায় আবার দেশের ভাগটাও লইতে চায়।।

বুড়োমত একজন কাছে এসে বলে—কী নাম তোমার মা? বাবার কী নাম? কত দূর থেকে আসছ মা, কারও বাসায় বস, খাওয়াদাওয়া কর। এইসব কী শুরু হইছে এইখানে, মানুষ তো না এরা, সব অমানুষ হইয়া গেছে। সব অমানুষ। বাড়িঘর না থাক মা, দুইটা ভালমানুষ তো এখনও আছে দেশে। নাইলে দেশ কি কইরা টিইকা আছে কও। উঠ উঠ। কাইন্দো না মা। কানবা কেন? কান্দনের কি হইল। যারা তোমারে এইসব বলতাছে তারা কি আর বুইঝা বলতাছে? জিভের ডগায় যা আসে বইলা ফেলে। দোষ নিও না মা।

আর তখন ভিড় ভেঙে দীপন এসে দাঁড়ায় গাছের গোড়ায় গড়িয়ে কাঁদা কল্যাণীর সামনে। চোখে বিস্ময় তার, সে বুঝে পাচ্ছে না কেন একটি গাছকে ধরে তার মা কাঁদছে, আর ভিড় করে লোকে তা দেখছে। দীপন তাকে হাত ধরে টানে—মা চল।

ইন্দ্রনাথ রায়ের পুত্র সতীনাথ রায়, তাঁর পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ রায়, তাঁর পুত্র হরিনারায়ণ রায়, আর হরিনারায়ণের জীবন থেকে ছিন্ন হয়ে যাওয়া কল্যাণী আজ তার জন্মের মাটি শুকঁতে এসেছে। সে এই মাটি ফুঁড়ে জন্ম নিয়েছে। কোনও নারীর গর্ভে তার জন্ম হয়নি। সে এই বৃক্ষের মত একা। নিঃসঙ্গ। আর কেউ তাকে না চিনুক, বৃক্ষ নিশ্চয় চিনতে পেরেছে, বৃক্ষ তো আর মানুষের মত নিষ্ঠুর নয়। কল্যাণী তার কান্না থামাতে পারে না, সে দীপনের হাত ধরে একঝাঁক তীক্ষ্ণ চোখের সামনে চোখের জল চোখে নিয়েই রাস্তায় নামে।

দ্রুত হাঁটতে থাকে কল্যাণী। হাতে তার শক্ত করে ধরে রাখা দীপনের হাত। কতদূর হেঁটেছে সে নিজেও খেয়াল করেনি, হঠাৎ পেছন থেকে ‘দিদি দিদি’ ডাক শুনে সে থমকে দাঁড়ায়। তাকে কী ডাকছে কেউ! কে ডাকবে, এই শহরে কেউ তো নেই তাকে দিদি বলে ডাকবার। আবার হাঁটতে থাকে, আবার সেই ডাক, দিদি। পরিমলের মত লাগে, কিন্তু ও এখানে কোত্থেকে আসবে! ও তো সেই নাকতলায়, আসবার আগে সেধেছিল কল্যাণী—‘চল যাই।’ পরিমল বলেছে—‘তুমি যাও, আমার আবার বোম্বে দৌড়তে হবে।’ তবে কে ডাকে, নাকি হ্যালুসিনেশন? অডিটরি হ্যালুসিনেশন? তবু পিছন ফিরে দেখে কল্যাণী, একটি ছেলে দৌড়ে আসছে, তার দিকেই আসছে। পরিমল নয়, চেনা কেউই নয়। কে তবে? ও বাড়ির মাঠ থেকে ভিড় করা লোকদের কেউ? ভয় ভয় লাগে তার, দ্রুত পা চালায়, দীপনকে টানতে টানতে বলে—‘হাঁটো দীপন।’ দীপন না হেঁটে দাঁড়িয়ে যায়, বলে—‘তোমাকে ডাকছে মা।’

—আরে না। আমাকে এখানে কে ডাকবে?

—দাঁড়াও। তোমাকেই ডাকছে।

এর মধ্যে ছেলেটি দৌড়ে সামনে এসে থামে। কল্যাণীকে দিদি বলে ডাকে যদি এই ছেলে, একে তো চেনে না সে, ছেলেটি একটু হাঁপাচ্ছিল, বলল—আপনি কি কল্যাণীদি?

কল্যাণী হতবাক। কে তাকে চিনেছে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে! সে প্রথম বলতে চায় না সে কল্যাণী। দ্বিধা, আশঙ্কা তার জিভ ভার করে রাখে। ছেলেটির দু চোখ থেকে থোকা থোকা কামিনীর স্নিগ্ধতা ফুটে ওঠে, দেখে কল্যাণী বলে—হ্যাঁ।

—আমার নাম স্বপন।

—স্বপন? কোন স্বপন?

—রুখসানার ভাই। আপনাদের বাড়ির পেছনেই ছিল তো আমাদের বাড়ি। মনে নাই?

—হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন!

—আমি ভিড় দেখে জিগাস করলাম কি হইছে এইখানে ভিড় কেন? লোকগুলা বলল এই জায়গায় বাড়ি ছিল তাদের, ইন্ডিয়া থেকে আসছে, মেয়েলোক। তখনই দেখি আপনি চইলা যাইতাছেন। আমি তো জানিই কাদের বাড়ি ছিল এইটা। তাই আপনারে ডাকলাম।

—তোমরা কি ওই বাড়িতেই আছ?

—হ্যাঁ আগের বাসাতেই। আসেন, আসেন, আমাদের বাসায় আসেন।

—তোমার বড় ভাই সেলিম কোথায়?

—মনে আছে ওর নাম? স্বপন শিশুর মত হাসে।

কল্যাণীও হাসে। স্বপনের কথা তার মনেও পড়েনি। সেই ছোট্ট একরত্তি ছেলেটি, পেয়ারাতলায় দাঁড়িয়ে থাকত, দিদিরা কখন ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেবে আশায়। কত বড় হয়ে গেছে এখন ও! কল্যাণীরও মাথা ছাড়িয়ে গেছে। স্বপনের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আবার তার ভাবতে ভাল লাগে এই যে শহর, এটি তার; এই যে সামনেই বাড়িঘর—এটি তারই, তারই পূর্বপুরুষের ভিটে এই। তারই পড়শি তিরিশ বছর না দেখেও দিদি বলে ডেকেছে তাকে। আর কী চাওয়ার আছে তার! পুকুরের ধার দিয়ে চলে যাওয়া যেত রুখসানাদের বাড়ি। আর এখন ঘুরে ছোট একটি গলির ভিতর ঢুকে এ বাড়ি ও বাড়ির গা ঘেঁষে তাকে সেই বাড়িতে পৌঁছতে হল। বাড়ির কিছুই সে চিনতে পারে না। উঠোনে পেয়ারাগাছ নেই, আমগাছগুলো নেই, সেই টিনের বাড়িটি উধাও আর নতুন একটি তিনতলা বাড়ি উঠেছে, স্বপন বলে—উপরে আসেন, উপরে আমরা থাকি, নিচের তলা ভাড়া দেওয়া।

দোতলায় উঠেই সে হইচই শুরু করে। —কই লিপি কোথায়, দেখ কে আসছে। কল্যাণীকে দেখতে লিপি আর ফুটফুটে একটি ছ’ বছরের বাচচা ছুটে আসে।

—বসেন দিদি, ওরা সবাই আপনার গল্প শুনেছে।

—আমার গল্প?

—হ্যাঁ আপনি আর রুখসানা আপা সে যে কী গেছো ছিলেন, সেইসব। মনে আছে আমাদের টিনের চালে আমলকি পড়ার শব্দ হইত আর আপনি বলতেন, আপনার একটা পালা ভূত আছে, সেই ভূত বলছে বাচ্চারা যেন ঘুমাইয়া যায়, না ঘুমাইলে সে বাচ্চাদের ঝোলায় ভইরা খোক্কশের দেশে নিয়া যাবে। বাচ্চারা ঘুমাইয়া যাইত, আমি চোখ বন্ধ কইরা শুনতাম আপনি আর রুখসানা আপা হাসতেছেন। দিন পাল্টে গেছে দিদি, ভূতের গল্পে আজকালের বাচ্চারা আর ভয় পায় না।

—রুখসানা কোথায় থাকে?

—নরসিংদি।

—ওর যেন কোথায় বিয়ে হয়েছিল, জামালপুর…না কোথায় যেন?

—হ্যাঁ, জামালপুরের মধ্যেই। শেরপুরে। সেই বিয়া তো ভাইঙা গেল। জামাই তালাক দিল। পরে আবার বিয়া হইল নরসিংদি। এই জামাইও সুবিধার না দিদি, মারধর করে।

—বল কী, রুখসানাকে মারে, ও চলে আসে না কেন?

—কোথায় চলে আসবে, এতগুলো বাচ্চা নিয়া? বাবা মা নাই। উঠলে ভাইয়ের সংসারে উঠতে হয়। আমার আপত্তি নাই দিদি, আমি ঠিকই তার দায়িত্ব নিব, অন্য ভাইরা হয়ত নিবে না। কিন্তু ও বোধ হয় কারও সংসারে বোঝা হইতে চায় না।

কল্যাণীর মনে পড়ে রুখসানার সেই ছুটে বেড়ানো স্বভাব। এর গাছের বরই পাড়ো, ওই বাড়িতে খেলতে যাব। কল্যাণীর খেলা করবার পুতুল ছিল। রুখসানা বলত, ‘এইসব ফালা ত, চল দাড়িয়াবান্ধা খেলি।’ রুখসানা মাঠ পছন্দ করত, বড় মাঠ, হাত পা ছুঁড়ে খেলতে চাইত। পুকুরে নামলে এক ডুবে ওই পাড়ে চলে যেত। কল্যাণীরা ঘাটে বসে হাততালি দিত। মেয়েটি এখন মার খায়, বাড়ি থেকে বেরোতে দেয় না তাকে। কী করে মেনে নিচ্ছে সে এই সব? কল্যাণী বোঝে রুখসানা পড়াশুনা করেনি বেশি, চাকরিবাকরি করে যে নিজের মত থাকবে তাও সম্ভব নয়। কার জীবন যে শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামে, আগে থেকে কিছুই ধারণা করা যায় না। কল্যাণীরও হয়ত পড়াশুনা হত না। ননীগোপাল যদি জানতেন হরিনারায়ণ কলকাতায় আর আসবেন না তবে হয়ত কলেজে পড়বার খরচও কল্যাণীকে দেওয়া হত না।

লিপি মেয়েটি ঝকঝকে সুন্দরী। সে বলল—দিদি কী খাবেন বলেন।

—না খাবো না কিছু। ক্ষিধে নেই।

—ক্ষিধা থাকব না কেন? বেলা কম হইল?

—বেলার জন্য নয়। খেতে আসলে ইচ্ছে করছে না। কলকাতায় দুপুরের খাবার খেতে বিকেল হয়। ও আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে।

—এইটা একটা কথা হইল খাবেন না! আমাদের বাসায় আইসা কেউ না খাইয়া যায় না। কলিকাতায় কি করেন, সেইটা কলিকাতার ব্যাপার। আমরা ময়মনসিংহের মানুষ। এইখানে আমাদের নিয়ম মাইনা চলতে হইব।

—তুমিই বুঝি ময়মনসিংহের মানুষ? আমি নই?

—ও তাই তো। আপনিও তো। লিপি সশব্দে হেসে ওঠে।

কল্যাণী ঘরদোর দেখে, বারান্দায় দাঁড়ালে জানালার ফাঁক গলে ফাঁকে ফাঁকে চোখ চলে যায় নিজেদের ভিটের দিকে। হরিনারায়ণের ভিটে জুড়ে দালান উঠেছে, সেইসব দালানের হলুদ পিঠ দেখে কল্যাণী। দেখে আর ভীষণ পিপাসায় তার হৃদয় শুকিয়ে যায়।

স্বপন আর লিপির ছোট সংসারে সে আসবে এরকম কোনও স্বপ্ন তার ছিল না। অথচ রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে এসেছে তাকে স্বপন। তাকে যার মনে রাখবার কথা নয়, সে-ই তাকে মনে রেখেছে, বউ ছেলেমেয়ের কাছে গল্পও করেছে। এমন অপ্রত্যাশিত পাওয়া কল্যাণীকে ভাবায় খুব, ভাবায় যে কলকাতায় কি এরকম ঘটনা ঘটে কখনও যে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে বাড়িতে বসায়, খেতে বলে, কণ্ঠ উপচে আবেগ ঝরে কারও? এ দেশ ছাড়া আর কোথায় তা সম্ভব!

—দিদি, এ আমার ছেলে। প্রি-ক্যাডেটে পড়ে।

—প্রি-ক্যাডেট কোথায় বল তো। এই নামে কোনও স্কুলের নাম তো শুনিনি!

—কয়েক বছর হয় হইল। কাছেই, কালিবাড়িতে।

—আমাদের সময় এ পাড়ায় শুধু কুমার উপেন্দ্রকিশোর বিদ্যাপীঠ ছিল।

—হলুদ দালান তো? আছে এখনও। তবে অনেক কিন্ডারগার্টেন হইছে।

—আমার খুব রাধাসুন্দরী স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে। মৃত্যুঞ্জয় স্কুলেও। রাস্তার দু পাশে দুটো স্কুল। একবার বৃক্ষ রোপণ উৎসবে স্কুলের মাঠে আমি জবা ফুলের চারা লাগিয়েছিলাম। গাছটা কি আর নেই স্বপন?

—জবাগাছ বুঝি এতদিন থাকে? শাল সেগুন লাগালে থাকত।

—মাঠের দক্ষিণ দিকে ছিল গাছটি। গাছটিতে আমি থাকতেই ফুল ফুটেছিল।

স্বপন হাসে। এই হাসিতে কল্যাণী বুঝতে পারে না কল্যাণী যে গাছটি লাগিয়েছিল সেই আনন্দ নাকি গাছে যে ফুল ফুটেছিল সেই আনন্দ কাজ করে। নাকি এ স্বপনের স্রেফ তার কথায় সঙ্গ দেওয়া!

—রুখসানার ছেলেমেয়েরাও অনেক বড় হয়েছে বুঝি?

—কি বলেন, আপা তো নানী হইয়া গেছে।

—বল কি? সেই ছোট রুখসানা, ও নানী হয়েছে? কল্যাণী অবাক হয়।

—নানী কি মা? দীপন জিজ্ঞেস করে। সে সোফায় শুয়ে কথা শুনছিল।

—নানী বোঝ না? নানী হচ্ছে দিদিমা। তোমার দিদিমাকে তুমি তো দেখইনি।

—ও বুঝেছি, দিদির বাচ্চা হলে ও তোমাকে দিদিমা ডাকবে। তাই না মা?

—হ্যাঁ বাবা। কল্যাণী দীপনের চিবুক নেড়ে দেয়।

স্বপনের ছেলেটিকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে কল্যাণী। বলে—কি নাম তোমার সোনা?

—সৌখিন।

—তুমি বুঝি খুব সৌখিন ছেলে?

—হ্যাঁ আব্দুর মত সৌখিন।

—তুমি আমার নাম জানো?

—হ্যাঁ। ঘাড় কাত করে সৌখিন।

—তোমার নাম কল্যাণী রায়। তোমার বাবার নাম হরিনারায়ণ রায়। তোমার ভাইয়ের নাম জ্যোতিপ্রকাশ রায়।

সৌখিনকে বুকের আরও কাছে টানে কল্যাণী।—বাহ এত নাম তোমার মনে আছে? এই স্বপন, তোমার ছেলে তো খুব ব্রিলিয়ান্ট।

—হ্যাঁ দিদি। কিন্তু হইলে কি হইব। পরিবেশ বড় খারাপ। ছেলেটারে বাইরে খেলতে দিতে পারি না। দৌড়ঝাপ দিয়া না খেললে বাচ্চাদের মন ছোট হইয়া যায়।

কল্যাণীর মন খারাপ হয়ে যায়। বলে—পরিবেশ খারাপ এ কথা বলছ কেন? এখানকার পরিবেশ বুঝি কখনও খারাপ ছিল?

—না দিদি, ভাল মানুষের সংখ্যা খুব কম আজকাল। হাতে গোনা কয়জন মাত্র ভাল, যাদের সঙ্গে ওঠা-বসা করা যায়।

—কি জানি আমার এরকম মনে হয় না। আচ্ছা তোমার বা তোমাদের কি এরকম কখনও মনে হয় স্বপন, যে, আমরা আলাদা কেন?

—আলাদা মানে?

—মানে ধর আমরা একরকম কথা বলছি, বাংলায়, তো আমরা দুই দেশে থাকি কেন, দুই দেশ বানিয়েছি কেন?

—দুই দেশ কি আর আমরা বানাইছি?

—যারাই বানাক, বানিয়েছে তাদের স্বার্থের জন্য। কিন্তু আমাদের স্বার্থ কি ছিল বল তো? আমরা ভাই-বোনেরা নিজেদের বাড়ি ফেলে কোথায় কোন দূরে কার বাড়িতে পড়ে রইলাম, আমাদের কি কষ্ট কম হয়েছে?

—তা তো ঠিকই।

—তারপর ধর, এই যে তোমরা, তুমি সেলিম রুখসানা, এদের সঙ্গে আমার মন চাইছে কথা বলতে অথচ কথা বলতে পারছি না। আমার খুব ইচ্ছে করে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বসে থাকতে, পারি না। তুমি বুঝবে না স্বপন আমার যে কি রকম ইচ্ছে করে। কিন্তু আমি পারি না কেন, বল?

উত্তেজনায় কল্যাণী উঠে দাঁড়ায়, হাঁটে। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে হলুদ দালানের পৃষ্ঠদেশ দেখে।

—আচ্ছা বল তো তোমার কি মনে হয় না আমরা আবার এক হয়ে যাব?

—এক হওয়া মানে?

—মানে কোনও পাসপোর্ট ভিসা থাকবে না, কাঁটাতার থাকবে না।।

—ও দুই দেশ এক হওয়ার কথা বলতাছেন? সেইটা কি আর এখন সম্ভব?

—কেন সম্ভব নয়? জার্মানিতে হল না?

—জার্মানি আর বাংলাদেশ এক হইল? ধর্ম এইখানে প্রধান বাধা দিদি।

—ধর্ম আর ক’দিন? ধর্ম কি আর সারাজীবন বয়ে বেড়াব আমরা? এক ভাষা আর এক সংস্কৃতি নিশ্চয়ই ধর্মের বাধা দূর করতে পারবে। কি বল?

স্বপন হাসে। তার হাসিতে না বোধক কিছু ফুটে ওঠে কি না, নাকি তার হাসির আড়ালে কল্যাণীর কথায় সায় দেবার কিছু আছে কল্যাণী ঠিক বুঝতে পারে না। কল্যাণীর এও মনে হয় স্বপন দেশভাগের পরের প্রজন্ম। তার এই কষ্ট বয়ে বেড়াবার কিছু নেই হয়ত। সে হয়ত জানে একটি মানুষকে দু টুকরো করে ফেললে মানুষটি প্রাণে বাঁচে, কিন্তু সত্যিকার যে বাঁচে না তা জানে না। কী করে জানবে, স্বপনের তো আর হারাতে হয়নি কিছুই। সে তার বাবা মা আত্মীয়স্বজন সবাইকেই কাছে পেয়েছে, পাচ্ছে। কিন্তু কল্যাণীর ছিটকে গেল সবই। সুখের লাগি এ ঘর বাঁধিনু, অনলে পুড়িয়া গেলর মত। ভেতরে তার লালন করা স্বপ্ন স্বপনের বাড়ির ভালবাসা পেয়ে বানের জলের মত ফুলে ওঠে। জানালার কাছে দাঁড়ালে ছবির মত ভেসে ওঠে নিকোনো উঠোন, টিনের চৌচালা, পুকুর, পুকুরের পাড়ে কাঠগোলাপ। পরিমল একবার পুকুরে প্রায় ডুবতে বসেছিল, সাঁতার জানে না, শখ করে নেমেছে, জল-টল খেয়ে সে এক বিচ্ছিরি অবস্থা, সরলাবালা চিৎকার করছিল, ‘গেল রে আমার ছেলে মরল রে।’ কল্যাণী জানালায় দাঁড়িয়ে ঠিক সরলাবালার কান্না যেন শুনতে পায়, কে কাঁদে সরলাবালার মত সুর করে? কারও ছেলে কি পুকুরে ডুবছে?

স্বপন তাকে ফেরায়, বলে—কী দেখেন এত? গবরমেন্ট তো সব নিয়াই নিছে। আমার কিন্তু এখনও মনে আছে আপনাদের বাড়িটা, চোখে ভাসে। দোতলা দালান ছিল, অনেক গাছ ছিল। আমরা বলতাম বড়লোকের বাড়ি। আমরা তো বড় হইয়াও আপনাদের বাড়ির মাঠে ক্রিকেট খেলছি।

—তখন বাবা বেঁচে ছিলেন?

—না। তখন বাড়িটা খালি পইড়া থাকত। মাঠের ঘাসগুলা বড় বড় হইয়া যাইত। নদীর ওই পার থেইকা বিহারী গোয়ালারা আইসা ঘাস কাইটা নিত।

—আমাদের সময় ভাগীরথীর মা দুধ দিত। আচ্ছা ওরা এখনও আছে কি না জানো? ভাগীরথী, ভাগীরথীর বোন পার্বতী?

—না দিদি। ওদের খবর জানি না।

দীপনের হাত ধরে সৌখিন তার পড়বার ঘরে যায়। দেখে মন ভরে যায়। কল্যাণীর। এদিকে স্বপনও শিশুর মত হেসে আনন্দমোহনে পড়েছে সে, তারপর ব্যবসা করছে, ব্যবসায় ভালই লাভ হয়, প্রায়ই তার ইন্ডিয়া যেতে হয়—এসব বলে।

আনন্দমোহনের নাম শুনে চমকায় কল্যাণী। চমকায় আবার চোখে তার থিকথিক সুখও। —আনন্দমোহনে পড়েছ? আনন্দমোহনে আমার সঙ্গে পড়ত বাদল। পরে কোথায় কী পড়েছে জানি না। বাদলকে চিনতে তুমি?

—এক বাদলকে চিনতাম, আনন্দমোহনের ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, একটা পা নাই, কামালপুরের অপারেশনে গ্রেনেডে উইড়া গেছে তার বাম পা।

কল্যাণীর হিম হয়ে আসে শরীর। তার জিজ্ঞেস করতে ভয় হয় বাদল দেখতে কেমন?

স্বপন নিজেই বলে-কালো গায়ের রঙ, চেহারাটা ভাল।

—তোমার সঙ্গে দেখা হয় প্রায়ই?

—মুক্তিযোদ্ধা সংসদে আসে মাঝে মধ্যে। ওইখানেই আমার সঙ্গে পরিচয়। একদিন দেখি বারান্দায় শুকনা মুখে বইসা আছে। বলল কিছু টাকাপয়সার জন্য আসছে, খুব নাকি অভাব।

—পেয়েছিল?

—কি?

—টাকা পয়সা?

—জানি না।

—মুক্তিযোদ্ধারা এই দেশে অভাবে থাকে স্বপন? কল্যাণীর গলার স্বর অন্যরকম শোনায়, ভয়ার্ত, করুণ। স্বপনের চোয়ালের পেশি শক্ত হয়, বলে—এই দেশে সবচেয়ে সুখে আছে রাজাকাররা। মুক্তিযোদ্ধারা না খাইয়া থাকে, মরে। আর যে মুক্তিযোদ্ধারা ভাল পজিশনে আছে, তারা রাজাকারদের সাথে আপস কইরা বাঁইচা থাকে। ফান্ডামেন্টালিস্টরা মাথা চাড়া দিয়া উঠতাছে। অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এরা গর্তের ভিতরে লুকাইয়া ছিল। ধীরে ধীরে নানান সরকারের আশকারা পাইয়া এরা গর্ত থেইকা বার তো হইছেই, পার্লামেন্টেও বসছে। এদের সঙ্গে হাত মিলাইয়া বি এন পি ভোটে জিতল। শেখ মুজিব রাজাকারদের ক্ষমা করছিল, আর জিয়া তাদের গদিতে বসাইয়া গেল। মন্ত্রী বানাইল। এখনকার সরকার আর জামাতিতে ফারাক নাই কোনও দিদি।

বাদলই কি মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, তার বাদল? যুদ্ধে পা হারিয়ে বসে আছে, আর সে কিছুই জানেনি, মগ্ন ছিল অনির্বাণের মোহে? নিজের প্রতিই ঘৃণায় রি রি করে ওঠে শরীর-মন। হঠাৎ তার কার যেন লেখা একটি কবিতা মনে পড়ে:

‘কোথাও হেলেনি কিছু কোথাও খায়নি কোনো টাল এই বাংলায়—এই প্রচণ্ড

পশ্চিম বাংলায়

সেই আত্মঘাতী যদুবংশ মেতে আছে অদ্ভুত নেশায়, পায় পায় হিংস্র হানাহানি

সেই ভীরু পলায়ন, সেই কাপুরুষ আত্মসমর্পণ, সেই সন্দেহ এবং কুটিল বাসনা

যখন ওই ওপার বাংলায় অর্থাৎ বাংলাদেশে তাজা রক্তের স্রোতে পথ ঘাট নদী

হচ্ছে রোজ

শ্মশান চিতার মত পুড়ে যাচ্ছে মাইল মাইল গ্রাম অন্তঃপুর ঢলে পড়ছে ভয়ানক

কামড়ের বিষে

যখন ওই বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ করিম মকবুল কামানের গোলার মুখে ঝাঁপ দিচ্ছে

দুর্জয় সাহসে।

কোথাও হেলেনি কিছু কোথাও খায়নি কোনো টাল এই টাল মাটাল পশ্চিম

বাংলায়।’

লিপি টেবিলে খাবার দিয়ে ডাকে। দোকান থেকে বিরিয়ানি আনিয়েছে। দীপন অল্প সময়ের মধ্যে ভাব জমিয়ে ফেলে স্বপনের ছেলে সৌখিনের সঙ্গে। ওদের ডেকে এনে চেয়ারে বসিয়ে দেয় লিপি। কল্যাণীর খাওয়ার মন নেই। গ্লাসে জল ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞেস করে—সেই বাদল থাকে কোথায়?

—জানি না। শুনছি কোন এক গ্রামে, তারাকান্দা নয়ত ধোবাউড়া-টোবাউড়া হবে।

—ওর বাড়ি তো ছিল নালিতাবাড়িতে।

—নালিতাবাড়ি? তা অবশ্য জানি না।

—যাওয়া যায় না স্বপন একবার?

—কোথায়?

—বাদল যেখানে থাকে, নালিতাবাড়ি হোক, ধোবাউড়া হোক, যেখানেই হোক।

—কি যে কন দিদি। আপনি আসছেন মাত্র কয়দিনের জন্য। ওইসব ব্যাকওয়ার্ড জায়গায় যাইবেন কি কইরা? রাস্তা ভাল না।।

—রাস্তা ভাল না? তো বাদল যায় কি করে?

—সে মুড়ির টিন বাসে চইড়া যায়। আপনি কি তা পারবেন? হাঁটতেও হয় বোধ হয় অনেক।

—বাদল যখন যেতে পারে। আমরাও পারব নিশ্চয়ই।

কল্যাণীর উৎসাহকে হেসে উড়িয়ে দেয় স্বপন। বলে—বাদল পারলে আপনি পারবেন, এইটা কোনও যুক্তি হইল?

অনেকক্ষণ স্থবির বসে থেকে কল্যাণী জিজ্ঞেস করে—ও কি বিয়ে-টিয়ে করেছে? বাচ্চা-কাচ্চা?

—তা তো জানি না দিদি। বিয়ে কী কইরা করবে! পঙ্গু লোকের ঘরে থাকবে কে।

—বাদল পঙ্গু, এ কথা আমার বিশ্বাস হতে চাইছে না।

—যুদ্ধে কি আর একজন-দুইজন পঙ্গু হইছে। হাজার হাজার।

—আচ্ছা স্বপন, ওর কী মাথায় ঘন কোঁকড়া চুল ছিল? কল্যাণীর দুই চোখে দুই আহত পায়রা ডানা ঝাপটায়।

—অত মনে নাই।

—চোখ বড় বড়? নাক খাড়া?

—বোধ হয়।

—ঘাড়ে একটা জরুল দেখেছ?

—ঘাড়ের জরুল? কি জানি…অত খেয়াল করি নাই।

বাদলের ঘাড়ে একটি জরুল ছিল। কল্যাণী সেটি ছুঁলেই বাদল বলত ঘাড়ে জরুল থাকলে শত্রুর হাতে গুলি খেয়ে মরতে হয়। শুনে তার মন খারাপ করত। বলত—না তুমি কখনও মরবে না। আমি তোমাকে মরতে দেবই না। কল্যাণী কী জোর দিয়ে কথা বলত! তার কণ্ঠের সেই জোর কবে কখন মরে গেছে, কবে কখন নিভে গেছে তার স্বপ্নের আকাশে একশ নক্ষত্র, তার মনেও নেই।

লিপি বারবারই বলে কিছুই তো খাচ্ছেন না দিদি। আরও একটুকরো মাংস নেন। আগে জানলে মাছ-টাছ রাঁধা যাইত। এতদিন পর আসলেন দেশে…

কল্যাণীর চোখ ভিজে ওঠে। স্বপন দেখে বলে—কী দিদি, চোখে কিছু পড়ল নাকি!

—না। না। ঝাল একটা লঙ্কা পড়েছে তো মুখে, তাই।

একাত্তরে যুদ্ধে যায়নি স্বপন, বয়স অল্প ছিল তাই। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির সঙ্গে সে কিশোর বয়স থেকেই জড়িয়ে আছে। স্বপনের সারামুখে বেদনার মলিন ছায়া। বলে—দিদি, চারদিক দেইখা খুব মন খারাপ হইয়া যায়। বিদেশি সাহায্যের ওপর চলতাছে দেশ, বছর বছর বন্যা হয়, ঘূর্ণিঝড় হয়, আর বাংলাদেশ মহা আনন্দে এর ওর দ্বারে ভিক্ষা করতে বার হয়। এর মধ্যেই স্মাগলাররা টাকার পাহাড় গড়তাছে আর গরিবের সংখ্যাও সেই সাথে বাড়তাছে। ইললিটারেড আনকালচার্ড লোকের হাতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা এখন। তারা এই দেশে ইসলামি সংস্কৃতি গড়তে চায়, বুঝলেন দিদি। মানুষের পেটে ভাত নাই, বিদ্যা নাই, শিক্ষা নাই, অথচ মার্বেল পাথরের তারা খচিত মসজিদ ওঠে দুই ঘর পরে পরে। দেশটা এখন মিনি পাকিস্তান হইয়া গেছে। বড় দুঃখ লাগে।

কল্যাণী বলবার জন্য কোনও কথা খুঁজে পায় না। নিজের জীবনে কত ভাঙচুর হল, স্বপ্নের চারাগাছ দুমড়ে মুচড়ে গেল, তবু মনে হয় কোথাও তার হেলেনি কিছু কোথাও খায়নি কোনো টাল, নিভাঁজ নিপাট পরিপাটি জীবনযাপন তার। বাদলের ঠিকানাটি কী পাওয়া যাবে! ইচ্ছে করলে পাওয়া যেতেও পারে, কোন অজ্ঞাতবাসে অভিমানে অবহেলায় বাদল তার ব্যর্থ অথর্ব জীবন পার করছে, একবার তার দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কী মুখে দাঁড়াবে কল্যাণী তার সামনে! কল্যাণীর তো সব হয়েছে জীবনে। স্বামী, সংসার, সন্তান, টাকাপয়সা, সুখ…সুখও বোধ হয় হয়েছে। হতেও তো পারে এই বাদল সেই বাদল নয়, আনন্দমোহনে পড়ত বাদল নাম কী আর একজনেরই!

স্বপন রিক্সা করে দিতে নিচে নেমে আসে। লিপি আর সৌখিন হাত নাড়ে দোতলা থেকে। কল্যাণী আকুল তাকিয়ে থাকে ওদের আন্দোলিত হাতের দিকে। মনে মনে কল্যাণী বলে—‘এত ভাল পড়শি কারও ভাগ্যে জোটে! আমার জন্মের মাটির কাছে রইলে তোমরা, দেখে রেখো।’ হঠাৎ কল্যাণীরই মনে হয় কী তারা দেখে রাখবে? কী আর আছে দেখে রাখবার। মাটি? মাটিই তো। ওইখানে অবহেলায় পড়ে রইল দু বিঘা মাটি, গাছটিও বড় একা, মাঝে মধ্যে ওই গাছটির পাশে গিয়ে বসো। ওদের তো আর রইল না কেউ। কল্যাণীও হাত নাড়ে। বিষাদে বেদনায় তার আঙুল কাঁপে। যদি বারবার তার গল্প করতে ইচ্ছে হয় স্বপন লিপির সঙ্গে? বারবার যদি তার আসতে ইচ্ছে করে এই প্রিয় আঙিনায়? তা কি সম্ভব নয়? কেন সম্ভব নয়? রিক্সার জন্য বড় রাস্তা অবধি যেতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে কল্যাণী জিজ্ঞেস করে—এদিকে প্যাঁড়ার দোকান ছিল না?

স্বপন বলে—দিদি, খাঁটি দুধের প্যাঁড়া কী আর হয়? ওসব কবেই উইঠা গেছে।

রাস্তায় আধময়লা জামা পরা কিছু বাচ্চাছেলে খেলা করছিল, তারা খেলা থামিয়ে তাকিয়ে থাকে কল্যাণীদের দিকে। কী করুণ ওদের মুখ, চোখ বসে গেছে কোটরে, চোয়াল ভাঙা, পাঁজরের হাঁড় গোনা যায়, ম্যালনিউট্রিশানে ভুগছে সবকটি শিশু…ওদের দেখে বড় মায়া হয় কল্যাণীর।

হঠাৎ ওরা হেসে ওঠে, সবকটি মলিন শিশু হাসিতে ঝলকায়, আর চেঁচিয়ে বলে—‘হিন্দু হিন্দু তুলসীপাতা, হিন্দুরা খায় গরুর মাথা।’

কল্যাণীর গা কেঁপে ওঠে। স্বপনের দিকে আড়চোখে তাকায় সে, নিজের জন্য নয়, তার লজ্জা হয় স্বপনের লজ্জার কথা ভেবে। স্বপন নিশ্চয়ই কুঁকড়ে যাচ্ছে শঙ্কায় সঙ্কোচে। অনেকটা পথ নিঃশব্দে হাঁটে তারা, পিছনে তখনও ‘হিন্দুরা খায় গরুর মাথা’র হৈ হৈ রব, অবোধ জিভের উচ্চারণ।

একসময় দূর থেকে টিম টিম করে একটি রিক্সা আসে। যেন পিছনের চিৎকার কিছুই কল্যাণীর কানে যায়নি, সে স্বপনের হাতদুটো ধরে বলে—আমাদের আর দেখা হবে কি না জানি না, তবু তুমি আমাদের বাড়ির কাছে রইলে, আমার খুব ভরসা হচ্ছে গো।

রিক্সায় উঠে কল্যাণী আবার ডাকে—স্বপন।

স্বপন উৎসুক তাকায়, পেয়ারা পাবার জন্য যেমন তাকাত। কল্যাণী বলে—যদি ওই বাদল নামের মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কখনও দেখা হয়, তোমার এই দুঃখী দিদির কথা মনে করে তার জন্য কিছু কোরো। তোমার ঠিকানায় আমি যদি কিছু টাকা মাসে মাসে পাঠাই, তুমি কি পৌঁছে দিতে পারবে?

স্বপন আশ্চর্য হয়। বলে—আপনি যার কথা ভাবছেন সে যদি না হয় ওই লোক!

—না হোক। কল্যাণীর কণ্ঠ বুজে আসে।

রিক্সা চলতে শুরু করে। পিছনে পড়ে থাকে হঠাৎ দেখা পড়শি স্বপন, স্বপনের পিছনে নতুন বালক পড়শির দল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *