১. প্লেনের সিঁড়ি বেয়ে

১.

প্লেনের সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে চারদিক তাকায় কল্যাণী। পেছন থেকে দীপন বলে—‘কই তুমি না নেমেই জল খাবে?’

হ্যাঁ, কল্যাণী জল খাবে, জল না খেলে তার হৃদয় জুড়োবে না। দেশের জলের যে স্বাদ, সে স্বাদ কি আর অন্য জলে মেলে? তিরিশ বছর কলকাতায় অমন স্বাদের জল সে একঢোকও পান করেনি।

আঠারো বছর বয়স ছিল কল্যাণীর। আনন্দমোহনে পড়ত। এই কলেজে তার বাবা পড়েছে, দাদা পড়েছে, কলেজটির আলাদা একটি দাপট ছিল বটে। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, জামালপুর, গৌরীপুর থেকে ছেলেরা পড়তে আসত, টিনের ফুলতোলা পেটরা নিয়ে গ্রাম থেকে আসা ছেলেগুলো যখন শহরের রাস্তায় হাঁটত, সাইকেল রিক্সার টুংটুং শব্দ ঠিক বুঝে উঠতে পারত না, এলোপাতাড়ি ছুটত—আর তাল সামলাতে না পেরে আরোহীসহ সাইকেলও হুমড়ি খেয়ে পড়ত ওদের গায়ের ওপর, দেখে কল্যাণীর দাদা জ্যোতিপ্রকাশ ওদের নাম দিয়েছিল ‘বলদ’। ওরা প্রথম দিকে চুলে সর্ষের তেল মেখে ক্লাসে আসত, সার্টের পকেটে ভাঁজ করা ‘ভুলো না আমায়’ লেখা রুমাল রাখত, আর ফাঁক পেলেই সেই রুমাল দিয়ে পাউডার মাখা ঘাড়ের ঘাম মুছত, পেছনের বেঞ্চে বসে হাঁ করে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকত, স্যারদের কথা অর্ধেক বুঝত, অর্ধেক বুঝত না, মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে গলা কাঁপত, অফ পিরিয়ডে ছাত্ররা যখন করিডরে বা মাঠে বসে আড্ডা পেটাত, ওরা ছোটবেলার ‘আমাকে খেলায় নেবে?’ মুখ করে দূরে দাঁড়িয়ে থাকত। আর এই বলদগুলোই পরীক্ষায় গিয়ে শহুরে স্মার্ট ছাত্রদের কাত করে দিত। ততদিনে ওরা চুলে টেরি কেটে কলেজে আসে, সার্টের দুটো-তিনটে বোতাম অবসর মত খোলে, ইংরেজিতে কিছু বাক্যও আওড়ায়, মেয়েদের সঙ্গে ‘আই লভ য়্যু’ চিরকুটের চালান এমনকি থামে হেলান দিয়ে কথাও বলতে শেখে। জ্যোতিপ্রকাশ কথায় কথায় দিনে দুবেলা ওদের ল্যাং মারত, পরে ফেরে পড়ে ওদের কাছেই পড়া বুঝতে যেত, যে দাবা খেলায় ওর অনেকদিনের হাতযশ, ওতেও সে নীতিশ নামের এক তারাকান্দার পাঁঠার সঙ্গে হেরে যায়। এইসব কারণে জ্যোতিপ্রকাশের এত রাগ হত যে ওদের বিরুদ্ধে সে লোকাল ছাত্রদের এক হবার পরামর্শ দেয়, কেউ অভিযোগ জানতে চাইলে বলে কলেজের মাঠ নোংরা করে ফেলে, দেওয়ালে পানের পিক ছোঁড়ে, পুকুরের জল ঘোলা করে। আন্দোলন শেষ অবধি জমত না। কারণ ততদিনে ওই বলদগুলো কেবল পড়ালেখায় নয়, গানবাজনা খেলাধুলাতেও বেশ নাম করে ফেলেছে। জ্যোতিপ্রকাশের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও শেষে গিয়ে ওদের পেছনে ঘুরঘুর করত। আনন্দমোহনে যখন প্রথম ক্লাস করতে যায় কল্যাণী, জ্যোতিপ্রকাশ বলেছিল—‘দেখিস ওদের ফাস্ট-সেকেন্ড হইতে দিস না যেন। খাইটা পড়ালেখা করবি। ওরা কোন ক্ষেতের ভেতর কুপি জ্বাইলা নামতা পড়ত, আর এইখানে আইসা দিব্যি আমাদেরই টেক্কা দিয়া যায়।’ পরিমল তখন জেলা স্কুলের ছাত্র, কল্যাণীর কানে কানে বলেছিল—‘জুতসই গেঁয়ো দেইখা তুই একটা প্রেম করিস তো এইবার, দেখি দাদার কী অবস্থা দাঁড়ায়।’ কল্যানী হেসে বলেছিল—‘পাগল হইছস?’ সেই কল্যাণীই, কী অবাক কাণ্ড, কলেজ ভরা মাখন মাখন ছেলে থাকতে জুটল গিয়ে ঘোরকালো বাদলের সঙ্গে। নালিতাবাড়ির ছেলে, গা থেকে তখনও ধানসেদ্ধর গন্ধ যায়নি—সার্টের বুকপকেটে ফাউন্টেন পেন থাকে, গোল ফ্রেমের চশমা পরে, চুল বেয়ে তেল নামে ঘাড়ে সেই বাদলই কল্যাণীর ফিজিক্স বই ধার নিয়ে তিনদিন পর ফেরত দিয়েছিল। বইয়ের ভেতর একটি চিঠি ছিল, লেখা—‘কল্যাণী প্রিয়বরেষু, তুমি আকাশের চাঁদ সে আমি জানি, আমি কিন্তু বামন নই। ইতি বাদল।’ কল্যাণীর রাতে রাতে ঘুম হত না, দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে আকাশ দেখত, ইজিচেয়ারে শুয়ে সারারাত পূর্ণিমার চাঁদ দেখত। জ্যোতিপ্রকাশ তখন কী জানত কার কথা ভেবে ভেবে কল্যাণী ইনসোমনিয়ায় ভোগে! কলেজে ঢুকেই মনে মনে আগে সে বাদলকে খুঁজত, একদিন না দেখলে অস্থির অস্থির লাগত। কল্যাণী নিজেই অবাক হত কই আর কারও জন্য তো তার এমন হয় না। বাদলকে একবার দেখবার জন্য, একবার তার সঙ্গে কথা বলবার জন্য বুকের মধ্যে যেন কেমন করে। সেই গোবেচারা তেল চিটচিটে ছেলে বাদল একদিন ভরদুপুরবেলা কেমেস্ট্রি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কল্যাণীকে কলেজ ক্যাম্পাসের উত্তরে শিমুলগাছের তলে দেখা করতে বলে, কী নাকি জরুরি কথা আছে—কল্যাণী সেই মত যায়, বাদল মাথার নিচে বই-খাতা রেখে সটান শুয়ে ছিল ঘাসের ওপর, কল্যাণীকে দেখে গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে বসে, বাদলকে দেখতে তখন আর অত গেঁয়োও লাগেনি, বরং ওর খাড়া নাক, বড় বড় চোখ, একমাথা ঘন কালো চুলের দিকে বারবারই চোখ পড়ে কল্যাণীর। কেউ দেখে ফেললে যে কী সর্বনাশ হবে এই কথা কল্যাণীকে প্রায় ঢোক গিলে গিলে বলতে হয়। অথচ বাদল নির্বিকার, মুখ চোখে আতঙ্কের লেশ নেই, ঠোঁট উল্টে বলে—ছোঃ আমি কেয়ার করি না।’ জরুরি কথাটি কী জানতে চাইলে সে কোনও রাখঢাক না করেই বলে বসে—‘তোমাকে আমি ভালবাসি।’ শুনে কল্যাণীর বুকের মধ্যে জল ছলকে ওঠে। সে দাঁত দিয়ে নখ কাটে, খাতা খুলে অযথাই আঁকিবুকি করে, ঘাস ছেঁড়ে—‘ভালবাসা’ শব্দটি মানুষকে কী এমনই এলোমলো করে দেয় কল্যাণী বুঝে পায় না। ক্লাসে তার মন বসে না, বাড়ির ছাদে উদাস হেঁটে বেড়ায়, লুকিয়ে লুকিয়ে চিঠি লেখে, দেখে বাড়ির সবচেয়ে যে বেখেয়াল ছেলে সেই জ্যোতিপ্রকাশও একদিন বলে— ‘তোর হয়েছে কী বল তো, প্রেমে-ট্রেমে পড়িসনি তো?’ কলেজ পালিয়ে তারা তখন লেডিস পার্কে দেখা করে, নৌকো করে ওইপার চলে যায়, নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায় এমন ঘন হয়ে বসে বাদল তার হাত ছোঁয়, বলে—‘তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না কল্যাণী।’ সেই বুক ধুকপুক করা তুমুল সময়ে কল্যাণীর বাবা কোর্টের দাপুটে ম্যাজিস্ট্রেট হরিনারায়ণ রায় একদিন বাড়িতে ঘোষণা করলেন—‘বাঁধাছাঁদা কর, ইন্ডিয়া যাইতে হইব।’ কল্যাণী ফুঁসে উঠেছিল—‘কিসের ইন্ডিয়া? ইন্ডিয়া আমি যাইতাম না।’

এখনও কান পাতলে সদরঘাট থেকে ভেসে আসা স্টিমারের ভোঁও শব্দটি শোনে সে, শব্দটি কি বাতাসে ভাসে নাকি তার বুকের মধ্যে বাজে ওই তীব্র হাহাকার—ছ’ বছর বয়সে কল্যাণী বাবার হাত ধরে স্টিমারঘাটে গিয়েছিল পিসিদের বিদায় দিতে, পিসিরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল, পিসিদের চেনা, বাবার চেনা আরও অনেক দেশ ছেড়ে যাবার লোক ছিল স্টিমারে, ঘাট ছেড়ে যাবার জন্য যখন ভোঁ বাজল, আকাশ-ফাটা চিৎকার ভেসে এল স্টিমার থেকে, স্টিমারের তীব্র ভোঁ শব্দ ম্লান হয়ে গেল সেই করুণ কাতর আর্তনাদের কাছে। ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিল পিসি, পিসেমশাই, পিসতুতো দাদা, দুই দিদি। স্টিমার নড়ে উঠতেই, কল্যাণী স্পষ্ট দেখল, ওরা লুটিয়ে পড়ে ডুকরে কাঁদছে। বাবার কাছে সে জিজ্ঞেস করেছিল—‘ওরা কাঁদে কেন বাবা?’ হরিনারায়ণ সার্টের হাতায় চোখ মুছে বলেছিলেন—‘তুই বুঝবি না।’ কলকাতায় নামকরা স্কুল কলেজ আছে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আছে, গড়ের মাঠ, ইডেন গার্ডেন, সাহেবদের বানানো বড় বড় বাড়িঘর, হাওড়া ব্রিজ আছে—তবু যাবার সময় মানুষ কাঁদে কেন এ কথা সে জ্যোতিদাকেও জিজ্ঞেস করেছিল, জ্যোতিদা বলেছিল—‘নিজে যখন যাইবি বুঝবি, যে না যায় সে কখনও বুঝব না যারা যায় তারা কান্দে কেন।’ কল্যাণী যাবার দিন সকালে পালিয়েছিল, শরিফাদের বাড়ির চিলেকোঠায় গুটিসুটি বসেছিল যেন কেউ না দেখে, যেন খুব শিগরি বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, যেন তাকে ইন্ডিয়া পাঠাবার ষড়যন্ত্রটি বাতিল হয়ে যায়। কল্যাণী ধরা পড়েছিল হরিনারায়ণের হাতেই, তাকে হিড়হিড় করে টেনে নামিয়েছিলেন তিনি। কল্যাণী একবার তার ঘরের দরজা, একবার বারান্দার থাম, একবার সরলাবালার হাত, একবার তুলসীতলা আঁকড়ে ধরে হু হু করে কাঁদছিল, ঘাট ছেড়ে যাওয়া স্টিমারে অমন মর্মন্তুদ আর্তনাদ কেন ওঠে, কল্যাণী সেদিন বুঝেছিল।

জ্যোতিদা, পরিমল, নীলোৎপল কাকা আর তাঁর মেয়ে বাণীর সঙ্গে কল্যাণীকে ট্রেনে উঠতে হয়েছে, হরিনারায়ণ ময়মনসিংহ জং-এর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে তাঁর পুত্র কন্যা ভাই ভাইঝির উদ্দেশ্যে যখন হাত নাড়ছিলেন তিনি কি জানতেন এদের সঙ্গে এই তাঁর শেষ দেখা! কল্যাণীও কি ভেবেছিল বাদলকে যে সে যে করেই হোক শিগরি ফিরে আসবে কথা দিয়েছে এই কথা সে আর রাখতে পারবে না! শরিফা, শাহানা, মুন্নিকেও কল্যাণী বলেছিল—‘দেখিস পালাইয়া হইলেও চইলা আসব।’ পালাবার সুযোগ কি এই তিরিশ বছরে কল্যাণী পায়নি! নাকি ওদের সে ফাঁকি দিয়েছে, কল্যাণীর মাঝে মধ্যে মনে হয় ফাঁকি আসলে সে নিজেকেই দিয়েছে।

তিলজলায় গাদাগাদি করা কয়েকটি ঘরে উঠেছিল কল্যাণীরা। প্রথম প্রথম তার বড় দমবন্ধ লাগত। মনে হত যেন গাছের পাতা নড়ছে না, হাওয়া বইছে না, কানের কাছে যানবাহন আর মানুষের বিচ্ছিরি চিৎকার, মানুষগুলোর কথা বোঝা যায় না, হাঁটাচলাও কেমন অদ্ভুত, সারাক্ষণ যেন কোথায় দৌড়চ্ছে, বড়মামার মেয়েরা তাকে খুব একটা কাছে ডাকত না, মামি একটি স্কুলে পড়াতেন, সকালে বাড়ি থেকে বেরোবার আগে কল্যাণীকে বলে যেতেন—‘ঘরদোর দেখ কেমন নোংরা হয়ে আছে, ঘরেই তো আছ, একটু ঝাঁট দিয়ে দিও। আর ভাল কথা, কলঘরে আমার একটা শাড়ি রাখা আছে, স্কুলের দেরি হয়ে গেল বলে ধুতে পারলাম না। তুমি স্নানের আগে কেচে দিও।’ কালিবাড়ির বাড়িতে কল্যাণীর যখন তেরো-চৌদ্দ বছর বয়স, সরলাবালা মাঝে মধ্যে মেয়েকে রান্নাঘরে ডাকতেন, বলতেন—‘মেয়ে হইয়া জন্মাইছিস, কাজকাম কিছু না শিখলে চলে?’ শাকসবজি কাটাবাছার কাজ দিতেন কল্যাণীকে, হরিনারায়ণ দেখে একদিন বলেছিলেন—‘মেয়ে আমার লেখাপড়া করবে, তারে দাসী বাঁদি হওয়ার ট্রেনিং দিও না।’ যে মেয়ে নিজের কাপড়ই কখনও কাচেনি, সে কলকাতায় গিয়ে প্রথমে মামির ধীরে ধীরে মামাতো বোনদের কাপড়ও কাচল। রান্নাঘরেও তাকে ঢুকতে হয়েছে, নুন মশলার আন্দাজ ভুল হলে মামি বলেছেন—‘বাঙাল মেয়ে হয়েও রান্না শেখোনি!’ মামাতো বোনরা রান্না খেয়ে ‘ওয়াক’ করেছে, মামি তখন কল্যাণীর পিঠ চাপড়ে বলেছেন—‘ও কিছু না। ক’দিন শিখলেই ঠিক হয়ে যাবে।’ কল্যাণী দেশে চিঠি লিখল—‘বাবা, আমাকে নিয়ে যাও, এখানে আমার কষ্ট হচ্ছে খুব।’ হরিনারায়ণ উত্তরে লিখলেন—‘বায়নাপত্র হইয়া গিয়াছে। বাড়ি বিক্রির আর দেরি নাই। তোমার বড়মামাকে বলিও বাসন্তী দেবী কলেজের চেয়ে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ ভাল হইবে, উহাতে যেন তোমার ভর্তির ব্যবস্থা করেন। জ্যোতির হাতে ননীগোপালকে দিবার জন্য টাকা দিয়াছি। তিনি যেন তোমার এবং পরিমলের খরচ নিয়া চিন্তিত না হন। শরীরের প্রতি নজর রাখিও। আমরা শীঘ্রই আসিতেছি। ইতি তোমার বাবা।’

জ্যোতিপ্রকাশের একটি চাকরি হবার কথা ছিল, এই দিচ্ছি এই হচ্ছে বলে ননীগোপাল তাকে অনেকদিন ঘুরিয়ে শেষে বলে দিলেন, ‘বুঝলে হে জ্যোতিবাবু, হরিদা তো ভাবছেন কলকাতায় বোধহয় এখনও দু টাকা মন চাল, আনায় দু সের ঘি পাওয়া যায়। দিন বদলেছে, চারদিকে যে কী কমপিটিশন তা তো টের পাচ্ছই। আজকাল ঘুষ ছাড়া কোথাও কথা বলার যো আছে? হরিদা আর চিঠিপত্তরও লিখছেন না। দেখ কী করবে, তোমার পিসে তত বেশ দাঁড়িয়ে গেছেন, তাঁর কাছেই বা যাও না কেন। কল্যাণীরও একটা বিয়ে-টিয়ে হওয়া দরকার।’ জ্যোতিপ্রকাশ এরপর পিসের কাছেও গেল না, বাড়িও ফিরল না। হঠাৎ হঠাৎ কল্যাণীর কাছে টাকা চাইতে আসত, ‘দিবিরে দুটো টাকা দিবি?’ কল্যাণী না পারত দিতে, না পারত অমন আমুদে মানুষটির মলিন মুখের দিকে তাকাতে। পরিমলও আগের মত আর দিদির নেওটা নয়, ওর বরং শান্তি সুনীতির সঙ্গে ভাব হয়েছে বেশি। কলেজেও কল্যাণী একা বোধ করত, আনন্দমোহনের গেঁয়ো ছাত্রদের মত। পেছনের বেঞ্চে বসে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত কলকাতার স্মার্ট স্মার্ট মেয়েদের দিকে, জ্যোতিদা যেমন তারাকান্দা মুক্তাগাছা থেকে আসা ছেলেদের ‘বলদ’ বলে খেপাত, ব্রেবোর্নের মেয়েরাও কল্যাণীকে ঠাট্টা করে ‘বাঙাল’ বলত। কল্যাণীর বড় একা লাগত। বাড়িতে শান্তি সুনীতিরা যখন গলা ছেড়ে গান গাইত, তাকে রান্নাঘরে একা বসে আলুর দম নয়ত হিং দেওয়া ডাল রাঁধতে হত, বাড়িসুদ্ধ সিনেমায় চলে গেলে একা কল্যাণীকে বাড়ি পাহারা দিতে হত। তার নিঃসঙ্গতা কেউ ছুঁয়েও দেখত না। রোববার সারাদিন ঘরের ঝুল ঝাড়া, লেপ তোষক রোদে দেওয়া, মশারি-চাদর কাচা, ঠাকুরঘর ধোয়ামোছা আর রাঁধাবাড়ার কাজ করতে করতে অথবা সপ্তাহের বাকি ছটা দিন কলেজ ছুটির পর দুপুরের রোদে পিচ গলে যাওয়া সড়কে ট্রামের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে যখন খুব জলতেষ্টা পেত, দেশের কথা খুব মনে পড়ত কল্যাণীর। দেশের জলের স্বাদ কলকাতার কোনও জলে সে পায়নি।

1 Comment
Collapse Comments

Darun

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *