৩. অনির্বাণ মেদিনীপুরের লোক

৩.

অনির্বাণ মেদিনীপুরের লোক, কড়া হিসেবি। টাকা হাতে এলে কল্যাণী দু হাতে খরচা করে ফেলে বলে কল্যাণীর সঙ্গে বড় বাধে ওর। দীপনকে একটির জায়গায় দুটো জামা বা জুতো কিনে দিলেই ও বলে—কী দরকার ছিল। খামোকা পয়সা খরচা।

—না হয় কিছু পয়সা খরচা করলামই। তোমাদের ঘটিদের কিপ্টেমি নিয়ে আমি আর পারছি না গো!

কল্যাণী রাগ করে।

—বাঙালরা বুঝি খুব উদার?

—হ্যাঁ উদারই তো। বাড়িতে ভাল কিছু রান্না হলে পাড়া-পড়শিকে না খাইয়ে মুখে খাবার উঠত না। কারও গাছের ফল কেউ কাউকে না দিয়ে খাইনি। পুকুরের মাছ তুলে কখনও একা খেয়েছি এরকম মনে পড়ে না। কত মাছ উঠত; বড় বড় শোল টেংরা পুঁটি শিং কৈ, আহা চেপা শুটকির ভর্তা কতদিন খাইনি। শরিফা ফ্রক বানালে একরকম দুটো বানাত, একটি আমার একটি ওর। ঝাড়গ্রামের মানুষ তোমরা, এসবের বুঝবে কী, কেবল শিখেছ অন্যকে ঠকিয়ে কী করে নিজের পেট ভরা যায়। শরিফার বড় ভাই বিয়ে করতে গিয়েছিল হাতির পিঠে চড়ে, লাখ টাকার সাজবহর নিয়ে, বিয়েতে দু হাজার লোকের নেমন্তন্ন ছিল। দুদিন ধরে আমরা বিয়েবাড়িই সাজিয়েছিলাম। আর তুমি যে বিয়ে করলে, সাকুল্যে খরচা হল ষাট কী পঁয়ষট্টি টাকা।

অনির্বাণ হেসে জিজ্ঞেস করে—আর কী কী করতে তোমরা?

—ঝড়ের রাতে দল বেঁধে শিল কুড়োতাম। বৃষ্টি ভিজে জ্বর এলে পড়শিরা কমলালেবু আর আঙুর নিয়ে জ্বর দেখতে আসত, ডাক্তার ডেকে আনত, শিয়রে বসে কপালে জলপট্টি দিত, তোমাদের দেশে এমন পড়শি পেয়েছ?

কল্যাণীর চোখে আনন্দ চিকচিক করে।

—পড়শিদের কারও সঙ্গে প্রেম-ট্রেম হয়নি?

—এ কথা কেন জিজ্ঞেস করছ?

—এত টান কি আর ব্রহ্মপুত্রের জন্যই নাকি আর কোনও মনুষ্যপুত্র-টুত্র…

—তুমি ক্রিটিসাইজ করছ?

—না তা কেন।

—তোমাকে আসলে বোঝানোর উপায় নেই অনির্বাণ, মানুষ তো এখানে এসে অনেকই দেখা হল, কই আমার দেশের মত সরল সোজা ভালমানুষ তো দেখি না।

—এত যখন ভাল, তবে আর এলে কেন দেশ ছেড়ে?

—সে কি আর শখে এসেছি?

অনিবার্ণ তাকে মাঝে মধ্যেই খোঁচায়। বলে—তোমাদের গাছের পেয়ারা তো লোকেরা চুরি করে খেয়ে ফেলত।

—-সে তো লক্ষ্মীপুজোয়!

—পরিমল তো বলে কারা নাকি ঢিলও ছুঁড়ত তোমাদের বাড়ি!

—বাজে কথা। ঢিল ছুঁড়বে কেন।

কল্যাণী কপাল কুঁচকে উত্তর দেয়।

—পাড়ার লোকেরাই নাকি?

অনির্বাণ আবার প্রশ্ন করে।

—পরিমল ডাহা মিথ্যে বলে। পাড়া-পড়শি ঢিল ছুঁড়বে? পারলে জীবন দেবে।

—চৌষট্টির দাঙ্গায় কিছু হয়নি তোমাদের?

—ও তো বাঙালি বিহারিদের দাঙ্গা। বাঙালি বাঙালিতে হয়নি কিছু। মফস্বলে কোথাও বোধহয় কিছু হয়েছিল, আমরা টের পাইনি।

—তুমি তখন কলকাতায় না?

—কলকাতায়, তাতে কি? বাবা মা ছিলেন তো, যখনের খবর তখনই পেয়েছি।

তিরিশ বছর কল্যাণী তার বুকের মধ্যে গাছপালা-ঘেরা ছায়া সুনিবিড় একটি দোতলাবাড়ির সামনে অপর পাড় দেখা যায় না এমন বিশাল স্রোতময় ব্ৰহ্মপুত্রকে লালন করেছে। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বালুর ঘর বানানো, জলে দাপাদাপি খেলা, পাড় ঘেঁষে দিগন্তের দিকে ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়, হু হু হাওয়ায় চুল উড়িয়ে নেওয়া আর সন্ধের মুখে হাঁটু অব্দি ধুলো মেখে বাড়ি ফেরা তার এখনও মনে হয় এই সেদিনের ঘটনা। এখনও তাকে নিবিড় স্পর্শ করে কোঁচড় ভরে শিউলি কুড়োনো ভোর, ধোঁয়া ওঠা ভাপাপিঠে, দল বেঁধে রাধাসুন্দরী স্কুলের দিকে হেঁটে যাওয়া, দু পয়সায় মালাই আইসক্রিম কেনা, ঘুঙুর পরে ঝুমঝুম হেঁটে যাওয়া চানাচুরঅলাকে পটিয়ে বাকিতে এক ঠোঙা চানাচুর খাওয়া, কাঠের বাক্সে চোখ লাগিয়ে বায়স্কোপ দেখা, শীতের রাতে মাঠে ইট বিছিয়ে বসে পাবলিসিটির বোবা ছবি দেখা।

দীপনের স্কুল সামারের ছুটি। সে মায়ের সঙ্গে দেশ দেখতে যাবে গোঁ ধরেছে। কল্যাণী ভেবেছিল অনিবার্ণও আসবে। অথচ অনির্বাণ কোনও উৎসাহ দেখায়নি, এত গল্প শুনেছে, কল্যাণী খানিকটা অন্যমন হলেই বলেছে ‘বাড়ির কথা ভাবছ বুঝি, মাইরি বড় দেখতে ইচ্ছে করে তোমাদের সেই অট্টালিকা, বাগানবাড়ি’—-একটু বাড়িয়েই হয়ত বলেছে তবু তো বলেছে—ইচ্ছে করলে আসতে পারত, শরিফাদের বাড়িতে থাকা, অনিলকাকা, সৌমেন, মুন্নি, সেলিম, রুখসানাদের সঙ্গে দেখা হওয়া, তা ছাড়া কল্যাণীদের বাড়িঘর কোথায় ছিল, কেমন ছিল তার শৈশব কৈশোর—তার খেলার মাঠ, নদী—অনির্বাণের তো ফি বছর পুরী যাওয়া চাই, একবার যাত্রাটির মোড় একটু ঘুরিয়ে দিলে এমন কী হয়! মাত্র আধ ঘণ্টার উড়ান দূরত্ব! হাওড়া যেতেও তো এর চেয়ে সময় বেশি লাগে। কল্যাণী যখন স্কুলে বেতন পেতে শুরু করে, নিজের উপার্জনের ওপর কিছু হলেও দাবি করা যায় বলে তার মনে হয়, তখন থেকেই তার থেকে থেকেই বলা ‘চল যাই একদিন চল না যাই।’ সে তো আজকের কথা নয়, জয়িষার জন্মেরও আগে থেকে। আর সেই জয়িষার এখন আঠারো বছর বয়স। অনির্বাণ প্রথম দিকে বলত—‘সংসার ফেলে কী করে যাবে বল, কে সামলাবে এসব।’ পরে বলত—‘বাচ্চাটা আরও বড় হোক তারপর যেও।’ বাচ্চা বড় হলে বলেছে—‘পাসপোর্ট টিকিটের ঝামেলা—খামোকা এত পয়সা খরচ করবে কেন, কী আর দেখার আছে ওখানে বল, কেউ নেই কিছু নেই পথঘাট চিনবে না, যাওয়ার চিন্তা বাদ দাও বরং।’ অনির্বাণ কী বুঝবে সেখানে কি আছে কি নেই। সে এও বলত ‘ঘুরতে চাও তো দার্জিলিং ঘুরে এস, ভাল লাগবে।’ কল্যাণী হাসত শুনে। শেষ দিকে অনির্বাণ বলেছে—‘ওখানে যাওয়াটা তোমার ঠিক হবে না, পলিটিক্যাল সিচ্যুয়েশন ভাল না।’ কল্যাণী বুঝেছিল অনির্বাণ তাকে কোনওদিনই বলবে না, চল যাই, বা যাও ঘুরে এস। শেষে যখন কল্যাণী সিদ্ধান্ত নিয়েই নিল সে যাবেই, অনির্বাণ প্রথম হ্যাঁ না কিছু বলেনি, পরে বলেছে—‘ছুটি পেলে আমি ঠিকই যেতাম তোমার সঙ্গে, অফিসে যে কী রাজ্যির ঝামেলা, তুমি বরং দীপনকে নিয়েই যাও। জয়িষার এম. এ. ফাইনাল সামনে, আমি গেলে ওর একা লাগবে।’ ইচ্ছে করলে অনির্বাণ সঙ্গে আসতে পারত। ময়মনসিংহ নিয়ে তার কোনও আবেগ কাজ করে না বলেই হয়ত আসেনি। অনির্বাণ কিন্তু কল্যাণীকে ঝাড়গ্রামে নিয়ে যায়, ঘুরে ঘুরে দেখায় এই আমার শোবার ঘর, এই মাঠে খেলেছি, আর ওই যে লাল ইটের দালান ওটি আমার ইস্কুল ছিল। এই যে দেখছ আমবাগান, এখানে বসে আমরা গান গাইতাম। কল্যাণী মগ্ধ চোখে অনির্বাণের শৈশব কৈশোর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে।

টালিগঞ্জ ছেড়ে এখন বিধান সরণী স্কুলে পড়ায় কল্যাণী। সল্টলেকে স্থায়ী হবার পর এই স্কুলে এসেছে, আগের চেয়ে বেতন এখানে ভাল। সংসারে খরচা করেও কিছু সে জমাতে পারে। ছ’ মাস জমিয়ে দুটো পাসপোর্ট, দুটো টিকিট আর একশ ডলার অবধি পেরেছে, অনির্বাণের কাছে সে একটি টাকাও চায়নি। চাইলে হয়ত না করত না। কল্যাণী ভেবেছিল যাবার আগে অনির্বাণ নিজেই আগ বাড়িয়ে কিছু দেবে। ওর থেকে হাজার দুই পেলে জয়িষাকেও সঙ্গে আনা যেত। কল্যাণী পনেরো দিনের ছুটি নিয়েছে, অনির্বাণ শুনে চোখ কপালে তুলে বলেছে—‘তোমার কী মাথা খারাপ, এত দিন তুমি বিদেশে থাকবে?’ অনির্বাণের ভুল শুধরে বলেছে সে—বিদেশে নয়, আমার দেশে থাকব।

—একাই যাবে নাকি?

—দীপনকে নেব।

—দীপনের প্রি-টেস্ট না কি ছিল যেন সামনে?

—সে দেরি আছে। আরও আড়াই মাস বাকি।

—বাংলাদেশ যাবে, আজকাল ও দেশে কেউ যায়? তা ছাড়া আমি বুঝি না কে আছে ওখানে তোমার যে যেতে চাইছ।

—সে তুমি বুঝবে না অনির্বাণ।

—তোমার কথা তো কেবল তুমিই বোঝ। আমাকে কি আর বুঝতে দেবে? নিজে যা ভাল মনে কর, কর। আমার কী!

—তোমার কিছু না? এতকাল তো সব ব্যাপারে তোমার কিছু ছিল, যখন আমার বাড়ি যাবার সময় হল তখন বলছ তোমার কিছুই না?

—তোমার বাড়ি আবার কি? কে ওখানে তোমার জন্য বাড়ি সাজিয়ে রেখেছে শুনি?

—আবারও বলছি অনির্বাণ, তুমি এসব বুঝবে না। এ তোমার ঝাড়গ্রাম নয় যে তুমি নেই তো সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

—ঠিক আছে যাও। শখ মেটাও গিয়ে।

—তাই মেটাব। কেন ভাব যে আমার কোনও শখ-টখ নেই? কেন ভাব আমার কোনও বাড়িঘর নেই। ভিটেমাটি নেই। তুমি যেমন তোমার মাকে দেখতে মাস মাস ঝাড়গ্রাম যাও, আমারও তো কোথাও যেতে ইচ্ছে করে। আমারও তো কাউকে দেখতে ইচ্ছে করে।

—তোমার মা তো আর নেই, তিনি থাকলেও কথা ছিল।

—মা মারা গেছেন। তাই বলে কি মা’র রেখে যাওয়া জিনিসপত্তর কিছু নেই? শরিফারা নিশ্চয়ই প্রিজার্ভ করেছে কিছু। তা ছাড়া অনিলকাকা, তিনি কি আর বাড়িটা আগলে রাখছেন না!

কল্যাণী বুঝে পায় না অনিবার্ণ এত নাক সিটকায় কেন? সে কি ঈর্ষা করে? হতে পারে। ঈর্ষা ছাড়া এ আর কী? তিরিশ বছর কল্যাণী তার বুকের স্বপ্ন বুকেই রেখেছে। বিয়ে হল, মেয়ে হল, সেই মেয়ে স্কটিশচার্চ থেকে মাস্টার্স করছে, সংসারের ঝামেলা কল্যাণীর অনেকটাই দূর হয়েছে, তারপরও তার সময় হয় না কোথাও যাবার, সংসার তাকে এমনই আটকেছে। আসলে অনির্বাণের গোয়ার্তুমি তাকে এতদিন সংসার এবং সীমান্ত কোনওটাই পার হতে দেয়নি। চুল আঁচড়াতে গিয়ে আজকাল পাকা চুল চোখে পড়ে কল্যাণীর, বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে, তবে কি সময় ফুরিয়ে আসছে! তবে কি একটু একটু করে শ্মশানের দিকে এগোতে হবে তার? শ্মশান শব্দটি শুনলে তার গা হাত পা কেঁপে ওঠে। কোন শ্মশানে সে যাবে, কেওড়াতলা? নিমতলা? নাকি ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে শম্ভুগঞ্জ ব্রিজের তলে যে শ্মশান, ওতে? যেখানে ঠাকুরদা ঠাকুরমা জ্যাঠামশাই বাবা কাকা মা’র চিতা জ্বলেছে! হঠাৎ হঠাৎ সে বলেও অনির্বাণকে যে আমি মরলে আমাকে ওখানেই রেখে এসো।

অনিবার্ণ বলে—ওখানে মানে?

—ওখানে মানে যেখানে জন্ম। জন্ম মৃত্যু এক মাটিতে হওয়াই ভাল।

—মরলে তুমি তো আর মানুষ থাকবে না। মস্ত বড় এক বোঝা হবে। তুমি ভাবলে কি করে যে সেই বোঝা কাঁধে করে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়া যাবে!

—আরেক দেশ আরেক দেশ করো না তো অনির্বাণ। রাগ ধরে।

—তবে কি এক দেশ বলব?

—সেদিন তো আগরতলা থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত হেঁটে এলে। মাটির কোনও রং দেখেছ আলাদা? ঘাসের রং? ভাষা পেয়েছে আলাদা? পোশাক-আশাক? নিজেই বললে এপারের গাছ থেকে ফুল ঝরছে ওপারে, ওপারের পাখি আসছে এপারে। দুপারের গরু ছাগল দুপারেই যাচ্ছে আসছে। কেবল যে মানুষের বেলায় আপত্তি উঠছে সে তো জেনে বুঝেই এলে। তারপরও ফাঁক পেলেই আলাদা আলাদা বল কেন?

—তুমি কি ইতিহাস অস্বীকার চাও? অনির্বাণ চোখের চশমাটি খুলে টেবিলে রাখে। আজকাল উত্তেজিত হয়ে গেলে সে চোখের চশমা আর চোখে রাখে না।

একশ ডলার ভাঙিয়ে টাকা করে নেয় কল্যাণী। ট্যাক্সি-স্কুটারের লোকেরা ঘিরে ধরে তাকে। ময়মনসিংহে কী করে যেতে হবে জিজ্ঞেস করলে ওরা একযোগে বলে—‘মহাখালির বাসস্ট্যান্ড থেইকা বাসে উঠবেন, ব্যস সোজা ময়মনসিংহ, কোনও থামাথামি নাই।’ ময়মনসিংহের কথা ভাবতে বড় নির্ভার লাগে তার। সে একটি স্কুটার নিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে যায়। এখানকার কারুকে আগে থেকে সে জানায়নি কিছু, আসবার কথা জানিয়ে একটি পোস্টকার্ডও ছাড়েনি। কল্যাণী আসছে জানলে ওরা নিশ্চয়ই এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে আসত। তার চেয়ে এই ভাল হঠাৎ চমকে দেওয়া। এতদিন পর কল্যাণীকে দেখে নিশ্চয়ই সারা পাড়ায় হইচই পড়ে যাবে, মাত্র ক’দিনের জন্য আসা, তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি না হয়েই যায় না। একবার সে চট্টগ্রামে মাসির বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল, কথা ছিল এক মাস থাকবে কিন্তু তের দিনের মাথায় তাকে ফিরে আসতে হয়েছিল কারণ ময়মনসিংহ থেকে খবর এল শরিফার নাওয়া খাওয়া বন্ধ—তার নাকি কিছুই ভাল লাগে না। ফিরে এসে তের দিনের অদর্শন-শোক ঘোচাতে দু মাস মত সময় লেগেছিল। চট্টগ্রামে কী কী দেখল—পতেঙ্গা বিচ, ফয়েজ লেক, পোর্ট, পাহাড়—সব গল্প করতে হল—জামগাছে হেলান দিয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে আকাশের মেঘ দেখতে দেখতে তারা কত কথা বলত তবু কথা ফুরোত না। দীর্ঘ তিরিশ বছরের গল্প তবে ক’দিনে শেষ করবে সে?

কল্যাণীকে যেদিন চলে আসতে হয় দেশ ছেড়ে, শরিফা ধুলোয় গড়িয়ে কাঁদছিল, তাকে ছুঁয়ে সে বলেছিল একদিন যে করেই হোক ফিরে আসবে। আজ এতদিন পর শরিফা তাকে দেখে কী বাকরুদ্ধ হবে না? জীবন ফুরিয়ে এ তার কেমন ফিরে আসা—ভাবতে ভাবতে কল্যাণীর চোখ ভেসে যায় চোখের জলে। স্কুটারে বসে দীপনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে কল্যাণী বলে—‘এই দেশটা আমার, জানিস তো দীপন?’ দীপন মাথা নাড়ে অর্থাৎ সে জানে। কল্যাণীর গা কাঁপছে। গলাও শুকিয়ে এসেছে। তার আসলে জল খাওয়া চাই। দেশের জল। দীপনের চোখ-মুখ খুশিতে নাচে, বলে—দেখেছ মা, গাড়ির নম্বর প্লেটগুলোও বাংলায় লেখা। আর সাইনবোর্ডগুলোও বাংলায়।

—হ্যাঁ তাই তো থাকবে, এখানে সবাই বাংলায় কথা বলে। সবাই বাঙালি।

—সবাই বাঙালি? আমাদের ওখানে তো সবাই বাঙালি না!

—তোমাকে বলিনি এ দেশের মানুষ ভাষা আন্দোলন করেছে বাহান্নোয়? একাত্তরে যুদ্ধ করেছে? ওরা সবাই যেন বাংলায় কথা বলতে পারে—তাই তো করেছে যুদ্ধ। বলতে বলতে এই দেশের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধায় তার মাথা নুয়ে আসে।

—তা হলে আমরা যুদ্ধ করি না কেন? দীপন জিজ্ঞেস করে।

—কি করে করবে, ওটা তো অনেক বড় দেশ! অনেক ভাষা, অনেক মানুষ!

দীপন চারপাশে মুগ্ধ চোখে তাকায়, বলে—নতুন দেশে এসেছি মনেই হয় না, তাই না মা?

দীপনের বিস্ময় এবং আনন্দ দেখে কল্যাণী তাকে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে। এ যেন তার অবোধ শিশুকাল, তার দুরন্ত কৈশোর, তার শরিফা, তার বাদলকে জড়িয়ে ধরা। ফুটবে বলে একটি কলি ছিল বুকে সেটি দীর্ঘদিন জল হাওয়া না পেয়ে বুকেই মরে ছিল, আজ সেই মরা ফুল কার জাদুস্পর্শে শত পাপড়ি মেলে ফোটে! কল্যাণীর হৃদয়ে একটি উচ্ছল ঝর্ণা বইছে। কী সুন্দর প্রশস্ত পরিচ্ছন্ন পথ, দুপাশে কৃষ্ণচূড়া আর দেবদারুর সারি। এই দেশ নতুন দেশ হবে কেন! হরিনারায়ণ বলতেন বয়সকালে হাতে পয়সা এলেই গিলে করা পাঞ্জাবি আর ফিনফিনে ধুতি কিনতে তিনি কলকাতা চলে যেতেন। কারও তো দিনের বাজার-সওদাটাও কলকাতার না হলে চলত না। কাঁচাগোল্লার লোভে মালদহের লোক চলে আসত নাটোরে। দেশ তো একটিই ছিল, কল্যাণীর জন্মও একটি অখণ্ড দেশে। ভাগ কর, সীমান্তে চৌকি বসাও—এসব ঘটেছে কল্যাণী যখন খুব ছোট, তখন। বুদ্ধি হবার পর সে দেখেছে হরিনারায়ণ বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে গড়গড়ায় টান দিতেন, আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন—সরলা, বড় সব্বনাশ হইয়া গেল, বড় সব্বনাশ। ভারত ব্রিটিশ তাড়াইল ঠিকই, নিজেরে টুকরা কইরা তাড়াইল।

কল্যাণী দেশভাগের সবটুকু যন্ত্রণা নিজে ভোগ করেছে। সে বোঝে হরিনারায়ণ কেন দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। এই দেশ থেকে উর্দুঅলা মুসলমানদের তাড়ানো হল, নিজের দেশ থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে তবে কেন চলে যেতে হয়েছিল হিন্দুদের? মুসলমানের হোমল্যান্ড না হয়ে দেশ তো শেষ পর্যন্ত বাঙালিরই থেকে গেছে। দেশটি তিরিশ লাখ বাঙালির রক্ত দিয়ে গড়া। কল্যাণী এই ভেবে গর্ব অনুভব করে, ভারত যারা ভেঙেছিল, যারা এই দেশকে মুসলমানের হোমল্যান্ড করেছিল, যাদের কূটবুদ্ধি এই দেশের মানুষকে দেশছাড়া করেছে, তাদের গালে কড়া একটি থাপ্পড় মেরেছে একাত্তরের পাকিস্তানি খেদানো যুদ্ধ, প্রমাণ করেছে এই দেশ বাঙালির, মুসলমানের নয়; ভাষা এখানে বড়, ধর্ম নয়।

দীপন আনন্দে হাততালি দেয়, বলে—কী সুন্দর তোমার দেশ মা। এত সুন্দর দেশে আমরা সবাই কেন থাকি না?

কল্যাণীরও এই এক প্রশ্ন এত সুন্দর দেশে সবাই মিলে থাকি না কেন? এই দেশ ছেড়ে তাকে কেন চলে যেতে হল? সে কি এই দেশে বাস করবার যোগ্য ছিল না? কী তার অপরাধ ছিল যে তাকে জন্মের মাটি ছেড়ে পালাতে হয়, সে কি খুনের আসামি ছিল? সে কী এমন অপরাধ করেছিল যে তাকে এত বড় শাস্তি পেতে হয়েছে! কই শরিফাকে তো কোথাও পালাতে হয়নি, সে তার স্মৃতি আর স্বপ্নের গভীর নিকটে বাস করছে। তাকে তো রাতভর কাঁদতে হয়নি ব্রহ্মপুত্রের জল ছোবার তৃষ্ণায়, তাকে তো খেলার মাঠ—-মার্বেল লাটিম পুতুল—কাঠগোলাপের কোনও গাছ হারাতে হয়নি। তাকে তো হারাতে হয়নি একটি তিরতির জলের পুকুর, যে পুকুরের জলে চোখ রাখলে দেখা যায় সারাদুপুর সাঁতার কাটা শিশুকাল, কৈশোর। তাকে তো হারাতে হয়নি কামিনীফুলের সেই গাছ, সেই জাম, পেয়ারা, আম, কাঁঠাল আর নারকেল সুপুরির বন! তাকে তো হারাতে হয়নি ট্রেনের পুঁ-ঝিকঝিক শব্দ! হারাতে হয়নি আচার চুরি করে গুমটিঘরে বসে থাকা দুরন্ত সেই দিন! সেই গুমটিঘর, সেই ট্রেন, সেই মাঠ, সেই পুকুর, গাছ, ব্রহ্মপুত্রে কি তার অধিকার কিছু কম ছিল? তবে?

কল্যাণীর ইচ্ছে করে স্কুটার থামিয়ে মাটিতে নামতে। মাটি তুলে সারা গায়ে মাখতে। এই মাটির প্রতি ভালবাসা তাকে আর কোনও মাটিকে নিজের ভাবতে দেয়নি। এক মাটিতে মন পড়ে থাকলে আরেক মাটিতে বুঝি মন বসে! এক মন মানুষ ক’জনকে দেবে! দেশের হাওয়া কল্যাণীর চোখ মুখ ধুয়ে দেয়। ‘আহ’ বলে একরকম সুখের ধ্বনি করে সে। তার এই সুখধ্বনি দীপনকেও স্পর্শ করে, সে তার মায়ের গা ঘেঁষে বলে—চল একটা সারপ্রাইজ দিই বাবাকে, আমরা আর ফিরব না জানিয়ে।

কল্যাণী হেসে বলে—ওর কাছে এটা কোনও সারপ্রাইজ নয়, বরং ফিরে গেলেই ও অবাক হবে।

দীপন হাসে। কত আর বয়স ওর। তবু ও বুঝতে পারে এই দেশ নতুন কোনও দেশ নয়। অথচ অনির্বাণের এই বোধটুকুও জন্মায়নি। ওর জন্য একরকম করুণাই হয় কল্যাণীর। মানুষটা কি পাথর দিয়ে গড়া? হবে হয়ত। কলকাতার প্রায় মানুষকে তার পাথর পাথর লাগে। মায়া নেই, কিছু নেই। যে যার স্বার্থের ঘোলা জলে সারাদিন নাক ডুবিয়ে পড়ে থাকে। দেখতে দেখতে ঘেন্না ধরে গেছে কল্যাণীর। আসলেই তার আর ফিরতে ইচ্ছে করে না স্বার্থপর মানুষের ভিড়ে, তার আর হাঁটতে ইচ্ছে করে না ঘিঞ্জি কলকাতার রাস্তায়। সেদিন পাশের বাড়ির বৌদি, দিনরাত গায়ে পড়ে ভালবাসতে আসেন, আর কল্যাণী ট্যাক্সি মেটাতে গিয়ে খুচরো ছিল না বলে পাঁচটি টাকা চাইল, তাতেই এমন ভাব করলেন তিনি যেন কল্যাণীকে চেনেন না, যেন কোথাকার কোন হাভাতে ভিক্ষুক এসেছে দয়া চাইতে। বললেন—টাকা? টাকা তো নেই।

বাসস্ট্যান্ডে ঢাকা টু ময়মনসিংহ লেখা মিনিবাস দাঁড়িয়ে ছিল, কল্যাণী একটিতে ওঠে। বাসে যাত্রী বসা পনেরো-ষোলো জন। ওরা নিজেদের মধ্যে যে ভাষায় কথা বলে, কল্যাণী জানে এটি ময়মনসিংহের ভাষা। তার স্কুলের হেডক্লার্কের বাড়ি ময়মনসিংহে ছিল জানবার পর সে ফাঁক পেলেই তাঁর অফিস-ঘরে যায়, বলে—‘আপনার কাছে এলে দেশের গন্ধ পাই, দেশের ভাষায় চলুন দুজন কথা বলি।’ হেডক্লার্ক সম্ভবত বুঝে পান না শেকড় উপড়ে চলে এলেও কী আর থাকে পেছনে যে বারবার ঘাড় ঘুরে তাকাতে হয়। লোকটি একবার টাকাপয়সার ঝামেলায় পড়েছিলেন, কল্যাণী নিজের কাজ ফেলে তাঁর ঝামেলাটি মেটাবার জন্য লেগে থাকে; বোর্ড বসে, কল্যাণী সেই বোর্ডে হেডক্লার্কের পক্ষে জোর চ্যালেঞ্জ করে। অনিবার্ণকে জানালে বলেছে—‘অনর্থক তুমি এই ঝামেলায় জড়ালে, লোকটি ঠিকই টাকাপয়সা এদিক-ওদিক করেছে, আর তুমি কি না দিব্যি একটি ডিসঅনেস্টকে সাপোর্ট করে বসলে!’ কল্যাণী বলেছে—‘ডিসঅনেস্ট হবে কেন, ময়মনসিংহের লোক…।’

যাত্রীদের ‘আইবাম যাইবাম খাইবাম, আইছুইন গেছুইন’-এর মিঠে সুর তাকে টেনে নিয়ে যায় মেছুয়াবাজারের গলিতে, বিদ্যাময়ীর মাঠে, পুরোহিতপাড়ার পুকুরঘাটে। কল্যাণী মনে মনে দৌড়ে ফেরে কাচিঝুলি থেকে কেওয়টখালি, স্টেশন রোড থেকে পুলিশ লাইন, আকুয়ার তিনকোণা পুকুর থেকে স্বদেশিবাজার। পেছনে তার ফ্রক উড়তে থাকে, উড়তে থাকে ফিতে বাঁধা দুই বেণী।

বাসের লোকগুলো তার নিজের দেশের লোক। তার জন্মের শহরে ওদের বাস। ওদের সবার প্রতি কল্যাণী অদ্ভুত এক টান অনুভব করে, দু-একজনকে জিজ্ঞেসও করে—আপনারা হরিনারায়ণ রায়কে চেনেন, কালিবাড়ির হরিনারায়ণ, সেই যে বড় একটি মাঠ, গাছপালা-ঘেরা দোতলা বাড়ি, দোতলায় ওঠার লোহার সিঁড়ি। এখন কারা থাকে বাড়িটিতে?

ওরা মাথা নাড়ে। জানে না।

দীপনকে কিছু কলা বিস্কুট কিনে দেয় কল্যাণী। ও খুব মন দিয়ে যাত্রীদের কথা শোনে আর ফিসফিস করে কল্যাণীর কান তার মুখের কাছে নামিয়ে জিজ্ঞেস করে—ওরা এভাবে কথা বলে কেন?

—এটা হচ্ছে ময়মনসিংহের ভাষা। আমাদের অরিজিনাল ভাষা।

—বুঝেছি এটা হল বাঙাল ভাষা।

—কে বলল তোমাকে?

—তীর্থ আছে না আমার বন্ধু? ওর ঠাকুরমা এরকম কথা বলে। তীর্থ আর ওর বোন নম্রতা বলে, কী যে বাঙাল ভাষায় কথা বলে ঠাকুরমা আমরা কিছু বুঝি না।

—বাঙাল আবার কী? এ হচ্ছে বাংলা ভাষা। কিছু কিছু আঞ্চলিকতা তো থাকেই। কলকাতার সঙ্গে চব্বিশ পরগনার, চব্বিশ পরগনার সঙ্গে মুর্শিদাবাদের দেখবে খুব সামান্য হলেও পার্থক্য আছে। তারপর ধর ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ, যারা ইংলিশ বলে সবাই কি একরকম বলে? কিছুটা এদিক-ওদিক নেই? আমেরিকান আর ব্রিটিশদের ইংলিশে তো বেশ পার্থক্য আছে, তাই বলে কি ইংলিশ ভাষা না বলে কোনওটিকে আংলাশ বলা হয়?

আংলাশ শব্দ শুনে দীপন হেসে ওঠে। কলার খোসা জানালার ওপারে শূন্যে ছুঁড়ে দিতে দিতে সে বলে—আংলাশ।

—এই ভাষা তোমার না বোঝার কী আছে? ঘরে তো আমিও মাঝে মধ্যে বলি। তুমি কি একেবারেই বুঝতে পারছ না দীপন? কল্যাণী নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

—কিছু কিছু পারছি। সবটা নয়।

কল্যাণী সামান্য আহত হয়। সন্তান যদি তার মায়ের দেশের ভাষা না বোঝে, দুর্ভাগ্য তবে কার? সন্তানের না ভাষার? কল্যাণীর কপালে সিঁদুরের টিপ, সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে শাঁখা, পরনে নীল সুতিশাড়ি, বাসের অনেকে ফিরে ফিরে দেখে তাকে। এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক সামনের সিট থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করেন—যাইবেন কই?

কল্যাণী হেসে বলে—ময়মনসিংহ।

—ঢাকায় থাকেন?

—না। কলকাতায়। আমাদের বাড়ি ময়মনসিংহে। কালিবাড়ি। হরিনারায়ণ রায়ের বাড়ি চেনেন? ব্রহ্মপুত্রের পাড়েই।

লোকটি মাথা নাড়লেন। তিনি চেনেন না।

এক সময় শহরের সবাই এক নামে চিনত হরিনারায়ণকে। আজ এতগুলো মানুষের মধ্যে একজনও তাঁকে চেনে না এ কেমন আশ্চর্য কথা। কল্যাণীর মন খারাপ হতে চায় কিন্তু নিজেকে এই বলে সে প্রবোধ দেয় বোধহয় এরা ঠিক ময়মনসিংহের লোক নয়, কিছু দূরের।

—‘আপনার নাম কি দাদা?’ কল্যাণী সামনের সিটে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে।

—‘আবদুল জব্বার।’ লোকটি ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দেন। কল্যাণীর কলকল করে কথা বলতে ইচ্ছে করে। লোকটি মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ায় তাকে চুপ হয়ে যেতে হয়। কল্যাণীর পিছনের সিট থেকে এক যুবক প্রশ্ন করে—কোন হরিনারায়ণ? কাপড়ের ব্যবসা আছে?

—‘না। না। আমার বাবা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন।’ কল্যাণী পেছনে তাকিয়ে বলে।

—ও। স্টেশন রোডের গৌরহরি বস্ত্রালয়ের মালিকের নামও হরিনারায়ণ।

—হরিনারায়ণ কি? রায়?

—তা জানি না।

—আমার বাবাকে সবাই চেনে শহরের।

—উনি কি জজকোর্টেই আছেন?

—‘বাবা তো নেই। বাবা নেই আজ ক’বছর হল…আঙুলের কড়ায় গুনে কল্যাণী বলে—‘আজ সাতাশ বছর।’

—সাতাশ বছর আগে মারা গেছেন? বলেন কি?

—হ্যাঁ সাতাশ বছর আগে।

কল্যাণী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সাতাশ বছর যেন চোখের নিমেষে কেটে গেল। হরিনারায়ণের কোলে বসে লেবেনচুষ খেতে খেতে মনে হয় এই সেদিনের ঘটনা। সরলাবালা বলতেন—‘এত আদর কইরা ওরে মাথায় উঠাইও না তো।’

—‘ক্ষতি কী। মেয়েরে আমি মাথায় তুলতেই তো চাই।’ হরিনারায়ণ হেসে বলতেন।

কোথায় আর মাথায় তোলা হল তাকে! তিলজলার জলে ফেলে ওঁরা ভাবলেন মেয়ে বুঝি সাঁতার জানে। মেয়ে পুকুরের জলে সাঁতরাতে জানে, তাই বলে জীবনের কাদাঘাঁটা জলে সে হাত পা ছুঁড়তে জানে এ কথা ওঁরা ভাবলেনই বা কেন? কল্যাণী স্থবির বসে ছিল। হাত পা বেঁধে চোরাবালিতে ফেললে যেমন অবস্থা হয় কল্যাণীর তেমন হয়েছে।

বাস চলতে শুরু করে। কল্যাণী জানালার পাশে বসে চোখের নাগালে যা আসে, চোখ মেলে দেখে। টঙ্গী, জয়দেবপুর, রাজেন্দ্রপুর পার হয়ে বাস চলতে থাকে নিবিড় ঘন শালবনের আলো-আঁধার পথ বেয়ে। দীপন দেখে আর বলে—‘দিদিটা এলে খুব ভাল হত, তাই না মা?’ কল্যাণী মাথা নাড়ে। ভাল তো হতই, মায়ের দেশ দেখবে, নিজের মায়ের দেশ—এর চেয়ে আনন্দ আর কী আছে। কল্যাণী অনুভব করে সে এখন আর দীপন জয়িষার মা নয়, অনির্বাণের বউ নয়, স্রেফ কল্যাণী রায়, হরিনারায়ণ রায়ের কন্যা। সে যে বাইশ বছর ধরে সংসার সমাজে কল্যাণী দাশ হিসেবে পরিচিত এটি সে শ্রীপুর, ভালুকা, কাজির শিমলা, ভরাডোবার স্নিগ্ধ হাওয়ায় প্রায় ভুলতে বসে। ছোটবেলায় কল্যাণী মাঝে মধ্যে হরিনারায়ণের সঙ্গে ঢাকা শহরে যেত, ময়মনসিংহ জংশন থেকে ছেড়ে সুতিয়াখালি, গফরগাঁও, কাওরাইদ, ভাওয়াল, জয়দেবপুর, ধীরাশ্রমে জিরোতে জিরোতে ট্রেন থামত ফুলবাড়িয়া স্টেশনে। কল্যাণীরা উঠত দুলেন্দ্রর বাড়িতে, গোপীবাগে। দুলেন্দ্র হরিনারায়ণের পিসতুতো দাদার ছেলে। সেই বাড়ির ছেলেমেয়েরা কল্যাণীকে দেখলেই অদ্ভুত ভাষায় কথা বলত। চিচচিলচিওচিকেচিভচিয়চিদেচিখাচিই—এইসব বলে ওরা খিল খিল হেসে উঠত। কল্যাণী বুঝত না কিন্তু অপমানে লাল হয়ে উঠত। তাকে নিয়েই যে ওরা কথা বলছে এবং কথাগুলো যে তার মোটেই পক্ষে যাচ্ছে না এ কথা সে বুঝতে পারত, ভাষাটা শিখবার জন্য সে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কেউ তাকে শেখাচ্ছিল না, গোপনে একে ওকে ধরেও কিছুতেই কাজ হল না যখন—বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে মশারির নিচের অল্প আলোয় কাগজ কলম নিয়ে সে অদ্ভুত ভাষাটি লিখত আর পরীক্ষা করত কী আছে এতে। একদিন ঠিকই খুলে যায় রহস্য। ওরা কল্যাণীর সামনেই বলল— চিওচিরচিজুচিতাচিপুচিকুচিরেচিফেচিলেচিদাচিও। এরপরই দেখল তার জুতোজোড়া নিয়ে একজন ভোঁ দৌড়। জুতোর পেছনে না দৌড়ে সে লম্বা শব্দটি মুখস্থ করে খাতায় লিখে রাখল, পরে এই শব্দের মধ্য থেকে জুতো শব্দটি উদ্ধার করে পুরো শব্দের জট খুলে ফেলল। অত রাতে রহস্যটি আবিষ্কার করবার আনন্দে কল্যাণী ওদের গভীর ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল—চিতোচিমরিচিখুচিবচিখাচিরাচিপ। এরপর থেকে ওদের তেমন আমল দেয় না সে। ভাবটা এমন যে আমার পেছনে লেগে পারবে না, খামোকা লেগ না।

আবদুল জব্বার আর পিছন ফিরছেন না। কল্যাণী খুব আগ্রহ বোধ করে লোকটির প্রতি। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহে। কল্যাণীর বাড়িও। কলকাতা থেকে তিরিশ বছর পর সে দেশে ফিরছে। কেন ফিরতে তার তিরিশ বছর লাগল, কল্যাণী কি ইচ্ছে করলে সব ফেলে ভেঙে বাঁধা ডিঙিয়ে চলে আসতে পারত না? ইচ্ছে করলে আরও আগেই তো সে আসতে পারত। অনির্বাণের অনুমতির অপেক্ষাই বা করতে হল কেন? এত বছর সে কেন আসেনি জন্মের মাটি, নদী, মাঠ, ভরা ফসলের ক্ষেত আর শ্যামল সবুজ বৃক্ষ আর ঘরের পিছনে ঝোপে- জঙ্গলে বড় অবহেলায় বেড়ে ওঠা কলাবতি ফুলের কাছে! পাষণ্ড না হলে কেউ ভুলে থাকে কাঁঠাল-পাকা দুপুরে বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে পাজামার চোরকাঁটা তোলা! গেছে যে দিন সে দিন কী একেবারেই গেছে! কল্যাণীর বড় ইচ্ছে করে কেউ একটি ফুঁ দিয়ে দিক, আর মুহূর্তে সে তার মুঠোর মধ্যে শৈশব কৈশোর—যেন হাত ভরে উপচে পড়ে—ফিরে পাক। ফিরে পাক সেই দিনগুলি, বাঁশি বাজানোর দিনগুলি, ভাটিয়ালির দিনগুলি, বাউলের দিনগুলি, কুলভাঙা গাঙের বাঁকে তাল সুপারির ফাঁকে ফাঁকে…

রাস্তার দুপাশে শাল সেগুনের বন পার হয়, ভাওয়ালের গড় পার হয়, দীর্ঘ অনাবাদি লালমাটির জমি ভাওয়াল পার হলে মাইল মাইল কাঁঠালের বন, এক-একটি গাছে দশ বারোটি কাঁঠাল ঝুলে আছে, আমগাছে আমও, কলকাতার রাস্তার ধারে গাছে আম কাঁঠাল ঝুলে থাকবে-কল্পনাই করা যায় না। কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে সরলাবালা কী চমৎকার এচোড় রান্না করতেন, এখনও তার স্বাদ লেগে আছে জিভে। চারদিক ঘন সবুজে ছেয়ে আছে। ত্রিশাল বাজারে বাস থামে কিছুক্ষণ, দীপন জানালায় মাথা গলিয়ে ধান চাল, শাকসবজি, আলু পটল, আর রকমারি মাছের হাট দেখে। কল্যাণী বলে—এরা গরীব কিন্তু মানুষ বড় ভাল, যদি কারও বাড়িতে যাও, সবাই তোমাকে বসতে দেবে, খেতে দেবে, ক’দিন থাকতেও বলবে।

—তাই নাকি? দীপন বড় বড় চোখ করে তাকায়।

—হ্যাঁ রে।

—কেন এরা আমাদের খেতে দেবে, থাকতে দেবে?

—এরা খুব সরল মানুষ তো, তাই।

—বোকাও বুঝি?

—তুমি কি অনেস্টকে ফুল বল?

—ও নো ডিয়ার। দীপন হেসে মাথা গুঁজে দেয় কল্যাণীর কোলে।

দরিরামপুর এলে কল্যাণী জানালায় আঙুল বাড়িয়ে দেখায়—দেখ দেখ দীপন, কাজী নজরুল ইসলাম এখানে ছিলেন। এখানের এক স্কুলে পড়তেন।

কিন্ডারগার্টেনে পড়া ছেলে কাজীকে চিনতে দেরি করলে কল্যাণীর তর সয় না। বলে—‘পড়নি বাবুদের তাল পুকুরে হাবুদের ডালকুকুরে…’ দীপন হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে মায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলে—‘সে কী বাস করলে তাড়া বলি থাম একটু দাঁড়া পুকুরের ওই কাছে না লিচুর এক গাছ আছে না…’

কল্যাণীর ঘোর কেটে যায় বাসের গায়ে কন্ডাক্টরের থাপ্পড় মারবার শব্দে। ছোকরাটি তারস্বরে চেঁচাতে থাকে—‘এই চরপাড়া চরপাড়া।’ চরপাড়ায় জঙ্গল ছিল একসময়। রাতে শেয়াল ডাকত। আর এখন পাড়া জুড়ে উঁচু উঁচু বাড়ি, ওষুধপথ্যের দোকান, পলিটেকনিক্যাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিশাল ক্যাম্পাস। রাস্তায় বাস, রিক্সা আর মানুষের ভিড়। তখন হাসপাতাল একটিই ছিল—সূর্যকান্ত হাসপাতাল। ব্রাহ্মপল্লীতে ছিল লিটন মেডিকেল স্কুল। কল্যাণীর এক খুড়তুতো দাদা পড়ত ওই স্কুলে। দাদার হাত ধরে সে কয়েকদিন ওই হলুদ দালানের স্কুলে গিয়েছিল, দাদার বন্ধুরা তাকে আইসক্রিম খাওয়াত আর বলত—‘মানুষের কঙ্কাল দেখবা? মরা মানুষ কাটি, দেখবা?’ কল্যাণী মাথা নেড়ে বলত না সে দেখবে না। তার চেয়ে বরং ঘাটে বসে ওদের সাঁতার কাটা দেখতে ভাল লাগত ওর। সুড়সুড় করে বাস থেকে চরপাড়া মোড়ে প্রায় অর্ধেক যাত্রী নেমে গেল, আবদুল জব্বারও নেমে গেলেন, একবার পিছনে তাকালেন না। দুজন মহিলা ছিল বাসে, একজনের কালো বোরখায় গা ঢাকা, আরেকজন পরনে লাল সিল্কের শাড়ি। ওদের দিকে তাকিয়ে কল্যাণী হাসে। জিজ্ঞেস করে—আপনাদের বাড়ি কি এখানেই?

লাল সিল্কের মহিলা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় অন্যদিকে। কল্যাণী কন্ডাক্টরকে বলে—আমি কালিবাড়ি নাবব।

—কালিবাড়ি বাস যায় না। কন্ডাক্টর ধাতব কণ্ঠে উত্তর দেয়।

—তবে নাবব কোথায়?

—প্রেস ক্লাবের সামনে। কন্ডাক্টর টাকা গুনতে গুনতে বলে।

শহরটিকে বড় অচেনা লাগে, প্রেস ক্লাবের দিকে যেতে দুটো সিনেমা হল পড়ে—অজন্তা আর ছায়াবাণী। ছায়াবাণীই কি অমরাবতী নাট্যমন্দির? কল্যাণীরা অলকা হলে ছবি দেখত। তখন ওই একটি হলই ছিল শহরে। হিন্দি, উর্দু, বাংলা সব ছবিই চলত। একসময় কলকাতা-বোম্বের ছবি আসা বন্ধ হয়ে গেল, বড়রা দাওয়ায় বসে দিলীপকুমার আর মধুবালার শোকে দীর্ঘশ্বাস ফেলত। কল্যাণীর মনে আছে ছবি উঠে যাওয়ার আগে আগে লোকে লাইন দিয়ে শাপমোচন, সবার ওপরে, অগ্নিপরীক্ষা দেখত। শরিফার এক খালা ‘সবার ওপরে’ ছবিটি কল্যাণীকে দুবার দেখিয়েছিলেন, কল্যাণী হলে বসে দুবারই রুমাল ভিজিয়েছিল কেঁদে। ‘ফিরিয়ে দাও আমার সেই বারোটি বছর’ শুনে সেদিনের অবুঝ কল্যাণীর চোখে যে জল ঝরেছিল, সেই জলই আবার তার চোখে নতুন করে ঝরে, ছবি বিশ্বাসের জন্য নয়, নিজের জন্য—নিজের হারিয়ে যাওয়া তিরিশ বছর ফিরে পাবার জন্য মনে মনে সে দু হাত বাড়ায়—শূন্যতাকে ছুঁয়ে ফিরে আসে তার তৃষ্ণার্ত আঙুল। ‘প্রেস ক্লাব প্রেস ক্লাব’ বলে চেঁচাতেই মহিলা দুজন উঠে দাঁড়ায়, কল্যাণীও দাঁড়ায়। কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞেস করে—কালিবাড়ি কোন দিকে? ছেলেটি থুতনি উঁচু করে দেখিয়ে দেয় ওই সোজা। নেমে দাঁড়াতেই বাস দ্রুত বাঁয়ে ঘুরে যায়। সামনেই লাল ইটের উঁচু জলের ট্যাঙ্ক, ট্যাঙ্কটি চেনে কল্যাণী, ছোটবেলায় সে জ্যোতিপ্রকাশের কাছে নাকি সুরে আবদার করত তাকে যেন একদিন সে ট্যাঙ্কটির মাথায় ওঠায়, ওই উঁচুতে দাঁড়িয়ে সে পুরো শহর দেখবে। ট্যাঙ্কটি দেখে সেই অপূর্ণ ইচ্ছেটি এই চুল-পাকা বয়সেও, এই ঘোর অবেলায় তার ভেতরে নিঃশব্দে জেগে ওঠে। এর পাশেই ছিল অলকা হল, তার পাশে বিদ্যাময়ী স্কুল। শহরটি বদলে গেছে, ছায়া সুনিবিড় নিঝুম নির্জন নিখুঁত নেই আর। মানুষের ভিড় চেঁচামেচি, রিক্সার জ্যাম। কল্যাণী একটি রিক্সা ডাকে। তার ক্ষিধেও পেয়েছে খুব, ঘড়িতে দুটো বাজে, আধ ঘণ্টা এগিয়ে নিলে আড়াইটা। দীপন বিস্মিত চোখে তার মায়ের শহরটি দেখে, ক্ষিধের কথা ভুলে যায়।

রিক্সা কালিবাড়ির দিকে যেতে থাকে। রিক্সাঅলার পরনে লুঙ্গি গেঞ্জি, ঠোঁটের ফাঁকে আধ-খাওয়া বিড়ি, জিজ্ঞেস করে—‘কালিবাড়ির কুন জায়গায় নামবেন?’ আগে তো হরিনারায়ণ রায়ের বাড়ি বললে রিক্সাঅলারা চিনত, এখন কী আর চিনবে? কল্যাণী বিপিন পার্কের নাম বলে। রিক্সাঅলা ভিড়ের মধ্যে কেড়ি কেটে কেটে ছোটে। দীপন মন দিয়ে রাস্তার সাইনবোর্ড পড়তে পড়তে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে—মা, তোমার ব্রহ্মপুত্র কতদূর?

—এই তো সামনে।

—তোমার ব্রহ্মপুত্রে তুমি অনেকদিন পর সাঁতার দেবে, তাই না মা? তোমার ব্রহ্মপুত্রে স্টিমার চলে না? আচ্ছা মা, ওই পার কি এমনি চোখে দেখা যায়? আমি যে দূরবীনটা আনিনি, কি করে দেখব? ওই পারে তুমি না বলেছ কাশবন আছে! অপু-দুর্গা রেল দেখতে যেরকম কাশবনে দৌড়েছিল, সেরকম কাশবন?

—হ্যাঁরে।

—এখনও তোমার সাঁতার মনে আছে মা?

—দূর বোকা, ছোটবেলায় যা শেখা যায়, তা কি কেউ ভোলে?

—তবে যে দিদির ট্রান্সলেশন করে দিতে পারোনি একবার, দিদি বলল।

—ও তো কলকাতার কঠিন কঠিন সব ট্রান্সলেশন। আর এ তো সাঁতার, আমি তো সারাদিন পুকুরে সাঁতরাতাম, গল্প করিনি তোমার সঙ্গে?

—সারাদিন সাঁতরাতে? আমিও তোমাদের পুকুরে সাঁতার দেব।

—নিশ্চয়ই।

—আমি যে সাঁতার জানি না মা!

—তোমাকে শিখিয়ে দেব। আমাকেও জ্যোতিদা সাঁতার শিখিয়েছিল, কলাগাছ ধরে সাঁতার।

—মা তুমি কাঁপছ কেন?

—কই, না তো!

—এই যে কাঁপছ। এই যে আমার হাত ধরে আছ, তোমার হাত কাঁপছে।

—আমার খুব আনন্দ হচ্ছে দীপন। এই যে দেখছ রাস্তা, জানো এই পথ দিয়ে আমি স্কুলে যেতাম।

দীপন রাস্তার সাইনবোর্ড পড়তে পড়তে বলে—এই জায়গার নাম দুর্গাবাড়ি, এখানে দুর্গাপূজা হয়, তাই না?

—হ্যাঁ।

ব্রহ্মপুত্রের জন্য কল্যাণীর মন বড় আকুল হয়। আহা, নদী এত টানে কেন মানুষকে! তিরিশ বছর পর সে শৈশবের প্রিয় নদীকে দেখবে, তার শরীর থিরথির করে ভালবাসায় কাঁপে, দু চোখ জলে ভরে ওঠে। অষ্টমী স্নানের দিন সাঁতরে সাঁতরে সে প্রায় মাঝনদীতে চলে যেত। বর্ষায় দুকূল ভাসা নদী বারবারই মন উপচে ওঠে তার, কলকাতায় যাকে পেয়েছে তাকেই সে ব্রহ্মপুত্রের গল্প শুনিয়েছে, জয়িষা আর দীপনকে বলেছে–গঙ্গার চেয়েও বড় একটি নদী আছে জানো তো? ব্রহ্মপুত্র নাম।

অনির্বাণ কখনও শুনে বলত—নদীর রচনা শেখাবে, সেটা শেখাও। বরং ওদের কাজে দেবে।

তিরিশ বছর নদী বলতে তার কাছে এই ব্ৰহ্মপুত্ৰই। জল বলতে ময়মনসিংহের টিউবওয়েলের জল। কলকাতার জলে স্নান করলে এখনও কেমন গা আঁষটে লাগে। চুলে জট বেঁধে যায়। অনির্বাণ তাকে বিয়ের পর পর গঙ্গার ধারে নিয়ে যেত। কল্যাণী বলত—আমাদের ব্রহ্মপুত্রের প্রাণ আছে গো।

অনির্বাণ কপাল কুঁচকে বলত—আর গঙ্গায় বুঝি নেই?

কল্যাণী উদাসীন চোখে এদিক-ওদিক তাকাত, আর নাকে আঁচল চেপে বলত—চল চল, গাঁজার ধোঁয়ায় এখানে দাঁড়ানো যাচ্ছে না।

—তুমি না বললে একটু নদীর ধারে দাঁড়াবে?

—সে কি আর এই নদী?

কল্যাণী ব্ৰহ্মপুত্রের কথা ভাবত। তার বুক থেকে উঠে আসা উতল হাওয়া গভীর একাকী রাতে স্বপ্নের ভেতর তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে। ভরা নদীর ওপর গুন টানা নৌকো যায়, দূর থেকে ভেসে আসে ভাটিয়ালির সুর—‘নাইয়ারে নাওয়ের বাদাম তুইলা কোন দেশে যাও চইলা।’ গঙ্গার যান্ত্রিক জীবন আর ঘোলা জলের সামনে দাঁড়িয়ে কল্যাণী কখনও একফোঁটা স্বস্তি পায়নি। সে কখনও কাউকে বোঝাতে পারেনি হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্রের স্বচ্ছ শুদ্ধ গভীর জলের স্নিগ্ধতা। অনির্বাণ বলত—‘তুমি এত বেশি নস্টালজিয়ায় ভোগো কল্যাণী!’ কল্যাণী দীর্ঘশ্বাস ফেলত।

—দীপন, তোর ক্ষিধে পায়নি?

দীপন মাথা নাড়ে। তার ক্ষিধে পেয়েছে।

কল্যাণী বলে—‘এই তো এসে গেছি বাবা। দেখিস ওরা তোকে কত কী খেতে দেবে, তোকে কোলে কোলে রাখবে, কত কিছু কিনে দেবে দেখিস।’ কল্যাণীর ছেলে দীপন, ওরা তো করবেই—কল্যাণীর ছেলের জন্য করবে না তো কার জন্য করবে! এই তো সেই স্বদেশি বাজার, ছোটবাজার, বড়বাজার। বড়বাজারে যে একটি মন্দির ছিল, সেটি কোথায়—হুডখোলা রিক্সায় বসে আশেপাশে খোঁজে কল্যাণী। বড় একটি ঝকমকে মিনার চোখে পড়ে। কল্যাণী জিজ্ঞেস করে—ওটি কি মন্দির নাকি?

রিক্সাঅলা ধমকে ওঠে—মন্দির মানে? ওইটা বড় মসজিদ।

—এখানে যে একটি মন্দির ছিল, ওটি কোথায়?

—মন্দির? মন্দিরের খোঁজ দিতে রিক্সাঅলার উৎসাহ নেই তেমন। এটি নিয়ে কল্যাণীরও যে খুব আগ্রহ তাও নয়। তবে পুরনো একটি জিনিস, বড়বাজার পেরোলেই তো চোখের সামনে ঢ্যাঙাদার মত দাঁড়িয়ে থাকত! ঢ্যাঙাদা—সেও এক মজার জিনিস। কল্যাণী যখন ফোর-ফাইভে পড়ে, নেত্রকোণা থেকে লিকলিকে এক ছোকরা এসেছিল, ষোল বছর বয়সে ছ’ ফুট লম্বা, কল্যাণীদের লতায়-পাতায় আত্মীয় হয়, কাচারিঘরে রাতদিন শুয়ে থাকত, বিকেলে কাঁথা গায়ে দিয়ে জামগাছের নিচে এসে বসত, দাঁতে দাঁতে শব্দ হত এমন কাঁপত সে, কল্যাণীরা খেলতে খেলতে দেখত সে খুক খুক কাশছেও। অনেকদিন কল্যাণী কাছে এসে বসেছে, জিজ্ঞেস করেছে—তুমি কোন ক্লাসে পড় ঢ্যাঙা।

ঢ্যাঙা মুখ গম্ভীর করে বলেছে—টু-তে!

টু-তে পড়ে এত বড় ছেলে হেসে গড়াত কল্যাণী! সে বুঝে পেত না। এত বড় একটি ছেলে কী করে অত নিচের ক্লাসে পড়ে।

সে-ও সরল স্বরে বলত—ও, তুমি বুঝি খুব ফেল কর?

ঢ্যাঙা বলত—না। আমি অঙ্কতে একশয় একশ পাই!

ছেলেটিকে বাড়িসুদ্ধ লোক ঢ্যাঙা বলে ডাকত, সেও দিব্যি ঢ্যাঙা ডাক শুনে এগিয়ে যেত। বলত—‘কি কন?’ বড়দের মত কল্যাণীও ঢ্যাঙাকে ঢ্যাঙা বলত। শুনে সরলাবালা চোখ রাঙাতেন। বলতেন—ঢ্যাঙা কি রে? ঢ্যাঙা কি? নাম নাই ওর? ও তর ছোট না বড়? দাদা কইয়া ডাকবি।

কল্যাণী এরপর থেকে ‘দাদা’ কইয়া ডাকল বটে তবে ‘জয়ন্ত’ আর ডাকল না। ডাকল, ঢ্যাঙাদা। কল্যাণীর সন্দেহ ঘুচত না। একদিন সরলাবালাকে জিজ্ঞেস করল—ঢ্যাঙাদা অঙ্কে নাকি একশয় একশ পায় মা?

—পায় বোধহয়।

—তাইলে ওরে আমি বাঁশের অঙ্কটা করতে দিলে ও কি মিলাইতে পারব?

—পারতেও পারে।

—কচ্ছপের অঙ্কটা মনে হয় পারব না।

—তা জানি না।

—ও এত বড়, টু-তে পড়ে কেন?

—ঢ্যাঙার বড় অসুখ হইছে। হাসপাতালে ভর্তি হইব। ও যে টু-তে পড়ে এইটাই তো বেশি।

কল্যাণী নিজেই পরে শুনেছে রাতে রাতে ঢ্যাঙাদা কাশে, জ্যোতিদা বলেছিল, কাশির সঙ্গে ঢ্যাঙার গলা থেকে রক্তও বেরোয়। একদিন বাড়ির বড়মানুষেরা ঢ্যাঙাদাকে হাসপাতালে রেখে এল। ঢ্যাঙাদ আর ফেরেনি।

ঢ্যাঙাদা জামগাছের তলে দাঁড়িয়ে থাকলে প্রায় আকাশে তাকাবার মত করে তার মুখের দিকে তাকাতে হত। কালিবাড়ির মন্দিরের দিকেও একইরকম তাকাত কল্যাণী। হুড খোলা রিক্সায় বসে কল্যাণী এদিক ওদিক দেখে, ঢ্যাঙাদার মত দেখতে কিছু খোঁজে। অসুখে ভোগা টু-তে পড়া ছেলে ঢ্যাঙাদার জন্য বড়বাজারের রাস্তায় শৈশব কৈশোর যৌবন পার হওয়া কল্যাণীর হঠাৎ মায়াই হয়। বড়বাজার পেরিয়ে কালিবাড়ির রাস্তায় উঠতে গিয়ে মন্দিরটি চোখে পড়ে তার। শ্যাওলা ধরা, ভাঙা, শরীর ফুঁড়ে বটগাছ বেরিয়েছে। রিক্সাঅলা হঠাৎ ব্রেক কষে, বলে—‘এই যে আইসা গেছে আপনের বিপিন পার্ক।’ রিক্সা থেকে নেমে সে পার্কে হাঁটে। আহা, এই পার্কে কত কত বিকেল সে কাটাত, বাড়িতে ‘এমপ্রেস’ খেলতে গিয়ে হঠাৎ সে লুকোতে লুকোতে বাড়ি ছেড়ে চলে আসত। পার্কের ঘাসে শুয়ে কখনও কখনও ঘুমিয়ে পড়ত। জলের যে মিষ্টি একটি ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হত, তাতে কী ঘুম না এসে পারে! কিন্তু সেই অবাধ সবুজ আর স্নিগ্ধ নির্জনতা কোথায়? তিন-চারটে গরু শুয়ে আছে, ভাসমান মানুষের বস্তি ছড়ানো, হাড় বেরনো শিশুরা ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে আছে। পরনে কাপড় নেই, কোমরের নিচে কালো সুতোয় ঝুনঝুনি বাঁধা। কলকাতার ফুটপাতে কল্যাণী এমন উদ্বাস্তুর ঢল দেখেছে। তবে কি তার দেশও সংক্রামিত হচ্ছে? সব ভুলে সে তার ব্রহ্মপুত্রের কাছে যেতে চায়, হৃদয়ের একূল ওকূল ভেসে যাওয়া ব্রহ্মপুত্রকে আজ সে দু চোখ ভরে দেখবে। এই ব্রহ্মপুত্রে দিন নেই রাত নেই জলকন্যার মত ডুবেছে ভেসেছে সে। কোথায় ব্রহ্মপুত্র, সে অবাক তাকিয়ে থাকে শীর্ণ একটি জলধারার দিকে। ধূ ধূ চর, মানুষ হেঁটে যাচ্ছে এপার থেকে ওপার। ব্রহ্মপুত্র তো এখানেই ছিল, বিপিন পার্কের সামনে, কল্যাণী নিশ্চয়ই ভুল করছে না, তার ভুলই বা হবে কেন —তিরিশ বছর সে এই নদী, নদী পাড়ের মাঠ, জলঘাসই তো বুকের মধ্যে লালন করেছে, তবে? তবে তার শৈশব কৈশোরের উতল ব্ৰহ্মপুত্ৰই কী এই শীর্ণ জলধারা? এই ঘোলা স্থির নিথর ক্লান্ত জল ব্রহ্মপুত্রের—এও কী তার ভাবতে হবে! নাকি সে ভুল দেখছে, ভুল হবার কথা তো নয়। স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকা কল্যাণীকে দীপন গা ঠেলে জিজ্ঞেস করে—ওখানে জল কেন মা? নালা বুঝি?

লজ্জায়, বেদনায় কল্যাণীর কণ্ঠ বুজে আসে, বলে—‘বোধ হয়।’ বলে দীপনের হাত ধরে সে উল্টো দিকে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে সে দুপাশে তাকায়, গুদারাঘাট, ডাকবাংলো, এস কে হাসপাতাল সব আগের মত আছে, কোতয়ালি থানাটিও মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে আছে, কল্যাণীর এক জ্যাঠামশাই ছিলেন এখানকার বড় দারোগা, কল্যাণীর যখন পাঁচ-ছ’ বছর বয়স সেই জ্যাঠা তাকে হাজত দেখাতে নিতেন, লোহার গরাদের আড়ালে উড়োখুড়ো কিছু মানুষ দেখিয়ে বলেছিলেন—‘এরা হচ্ছে চোর’, সে অবাক হয়ে বলেছিল—‘চোর কই, এরা তো মানুষ!’ জ্যাঠামশাই ঠা ঠা করে হেসেছিলেন। থানার সামনে খানিক দাঁড়ায় কল্যাণী, কান পাতলে এখনও যেন সেই হাসির শব্দ কানে আসে। চেনা দালানকোঠার ফাঁকে ফাঁকে নতুন বাড়িঘর উঠেছে। কুমার উপেন্দ্রকিশোরের একতলা বাড়িটি আগের মতই আছে। দূরে দেখা যায় শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ। বড় একা, শান্ত, রোদে পুড়ে যাওয়া রেলব্রিজটির জন্য তার বড় মায়া হয়। কল্যাণীর মনে ছবির মত আঁকা এ শহর। চোখ বুজলেই জগৎ ছাপিয়ে মনে ভাসে একটি ছোট্ট শান্ত শহর, শহরের প্রায় সবাই সবার চেনা, কেউ কাউকে ডিঙিয়ে ছুটছে না, রাস্তাঘাটে মাঠে বাজারে সবাই সবার কুশল জিজ্ঞাসা করছে। এ একটা সারপ্রাইজও বটে, তার হঠাৎ এসে যাওয়া। উত্তেজনায় কল্যাণী ভেতরে ভেতরে কাঁপে। তার স্মৃতি ও স্বপ্ন খুঁজতে সে দৌড়ে যায়, দু হাত বাড়ায়, হাতড়ায়। মাটি ফুঁড়ে থোকা থোকা হাহাকার উঠে আসে, তন্নতন্ন করে খুঁজেও তার বাড়িটি সে পায় না। তবে কী ব্রহ্মপুত্রের মত এটিও উধাও হয়ে গেছে? কোথায় হরিনারায়ণ রায়ের বাড়ি? কালো গেট, গেটের দুপাশে মাধবীলতা, বাড়ির প্রাচীর ঘেঁষে আম জাম সুপুরি নারকেলের সারি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *