কোনো মানুষকে দেখলেই বা তার সঙ্গে পরিচিত হলেই তার জীবনের গল্প জানার আগ্রহের অভ্যাস না থাকায়, চিলেকোঠায় বেশিক্ষণ বসেনি রাহুল , গানও পুরোটা শোনেনি । তাছাড়া দাদা অনিকেত আর দাদার বন্ধু রূপক মজুমদারও ইশারার মাধ্যমে জানিয়েছিলেন যে এটা বড়োদের জমায়েত, তুই এখন যা । রূপকদাকে একবার ওর পিসতুতো দাদার সঙ্গে হিন্দি ফিলমের নায়িকা রেহানা, সুরাইয়াকে নিয়ে তর্ক করতে শুনেছিল রাহুল । বিষয় ছিল যৌনতা।
পিসতুতো দাদা ঝণ্টু, ভালো নাম দুর্জয় চক্রবর্তী , কান নাড়তে পারেন ইচ্ছামতো, হাসির নিঃশ্বাস নাক দিয়ে বের করার অভ্যাস, কলকাতার আদি বনেদি পরিবারের কিনা , তাই কথা বলার সময়ে বহু অক্ষর উহ্য থেকে যায়, ওনার দাবি ছিল যে সুরাইয়ার যৌনতা রেহানার চেয়ে বেশি ।
রূপক মজুমদার দাবি করছিলেন রেহানার বেশি ; সানডে কে সানডে আনা মেরি জান শুনেছেন ?
পরনোগ্রাফিক ফিনকির লালচে চোখ কুঁচকিয়ে ঝণ্টুদা, দিশি মদ খেয়ে-খেয়ে যাঁর দাঁতে কালচে ছোপ পড়ে গেছে, চটে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ রেহানা তো বিশ্বাসঘাতক , পাবলিকের ভালোবাসা পেয়েও পাকিস্তানে পালিয়েছে।’
–পাকিস্তানে চলে গেলেই কি তার যৌনতা নষ্ট হয়ে যায় ?
–আপনি রেহানার ওখানে হাত দিয়ে দেখেছেন নাকি ?
–হাত দিয়ে যদি দেখেন তাহলে একজন রূপসীর থেকে আরেকজনের পার্থক্য অনুভব করতে পারবেন না ।
–অনুভব আবার কী ?
–রক্তমাংসকে অনুভব করতে হয় । আপনি যখন চুমু খান তখন তার অনুভূতিকে স্পর্শ করেন , তার স্বাদ গ্রহণ করেন ।
–আরে মশায় আমাকে শেখাবেন না । আমি স্কুলের সময় থেকে সোনাগাছি যাচ্ছি ।
–তাহলে তো একেবারেই বুঝতে পারবেন না । প্রেম করেছেন কখনও ?
–প্রেম তো অযথা সময় নষ্ট । মজনু যদি লায়লাকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করত, তাহলে তার পরে আরও তিনটে মেয়েকে বিয়ে করত, বুঝলেন, প্রেমের শুধু গপ্পো হয় । মার্ক করেছেন কি যে যারা প্রেম করে তারা লম্পট ? আপনার লেখক বন্ধুদেরই দেখুন না ; উইকেন্ডে সোনাগাছি-হাড়কাটা-খিদিরপুর করে বেড়ায় । আমিই সেসব ঘোঁতঘাতের হদিশ দিয়েছি। ওরা কেউই জানত না কোথায় ইমাম বক্স লেন আর কোথায় অবিনাশ কবিরাজ লেন ।
–আপনার সঙ্গে বিতর্কে গিয়ে আমারও সময় নষ্ট, আপনি বরং হাত দিয়েই অন্যের আকর্ষণের মনোহারিত্বে বসবাস করুন । তবে আপনার আঙুলে স্পর্শের আকুলতা নেই বলেই মনে হয় । লজ্জাবোধের রক্ত আপনার দু’গালে হৃদয় থেকে উঠে আসে না । আপনার মতো লোকদের চাউনির চাহিদা মেটাতে গিয়েই অধিকাংশ যুবতীকে ক্লান্ত দেখায় ।
রাহুলের মনে হল, প্রেমিকও হতে হবে, অপ্রেমিকও হতে হবে, নয়তো নিজের মধ্যে ঝড়ের হ্যাঙ্গামের মজা কোনো দিনই টের পাবে না । দুটোর একটা অধরা থেকে যাবে ; ঝড় চলে যাবে পাশ কাটিয়ে ।
রূপকদা সারাটা জীবন ওই ঝড়ের চোখের ভেতরে পাক খেয়ে কাটিয়েছেন ।
রূপকদার কতরকমের যে রূপ ! দাদা অনিকেত যখন ধানবাদে চাকরি করত, রাহুল একবার গিয়ে দেখেছিল যে রুপকদা বাসন মাজছেন । সেই রূপকদা পরে বাউলদের সঙ্গে নিয়ে এদেশ-সেদেশ করে বেড়ালেন, কত রেহানার সঙ্গ পেলেন, ওখানে-সেখানে হাত দিলেন, তারপর ফিরে এলেন রূপসী বাংলার হাতছানিতে ; ওখানে হাত দিয়ে দেখতে ।
দেশের বাড়ির খণ্ডহরে গেলে, রাহুলের প্রধান আকর্ষণ ছিল ঠাকুমা সবাকসুন্দরী দেবীর সঙ্গে সময় কাটানো, ওনার মুখে ওনার ছোটোবেলার গল্প শোনা, ওনার বিয়ের পর জড়ো করা পারিবারিক কেচ্ছা । রাহুলের মনে হতো ঠাকুমা সবাকসুন্দরী দেবী কন্ঠ দিয়ে চিন্তা করেন । সারাদিন খালি গায়ে থাকেন, বুকের ওপর শুকিয়ে যাওয়া মাই ঝুলিয়ে, কোমরে গামছা বেঁধে, আর নিজের সঙ্গে অনর্গল নিজে কথা বলেন, অনর্গল । রাহুল ওনাকে খন্ডহরে চিরকাল এই পোশাকেই দেখেছে, শীতেও । কোন বয়সে পৌঁছে নারী অমন যৌনতার বোধ হারিয়ে ফেলে, ভেবেছে রাহুল । মেয়েরা তো নিজেদের দেহ নিয়ে কত সচেতন । ঠাকুমার অনেককিছু সহ্য হয় না।
গরম আমি সহ্য করতে পারি না ।
গান-বাজনা আমি সহ্য করতে পারি না ।
খবরের কাগজ আমি সহ্য করতে পারি না ।
বউ-ঝিদের হাসাহাসি আমি একেবারে সহ্য করতে পারি না ।
বিউলির ডালের গন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না ।
বাজি ফাটানো আমি সহ্য করতে পারি না ।
দোল-খেলা আমি সহ্য করতে পারি না ।
রাহুলের জন্মের আগেই ঠাকুরদা মারা গিয়েছিলেন ; দাদা অনিকেতের স্মৃতিও আবছা । দাদুর যাকিছু ভালো লাগত তা আর ঠাকুমার সহ্য হয় না । অনিকেতের সংগ্রহের সাহিত্যের বইগুলোকে উনি মনে করতেন সময় নষ্ট । অনিকেত স্নাতকের পরীক্ষা দিয়ে সবকটা বই কয়েকটা বস্তায় বেঁধে দেশের বাড়ি থেকে কানপুরের বাড়িতে এনে রাহুলের সোপর্দ করে দিয়েছিল । বেশির ভাব নটের নামই অচেনা । কোথায় বিক্রি হয় এসব বই !
রাহুল সিংহের সমবয়সী সাহিত্যিকরা কেউ গান গায় না ; গানে তেমন আগ্রহ নেই কারোর । নবদেব দাশগুপ্ত বাংলা-হিন্দি সিনেমার এঁটুলি , প্রথম পরিচয়ের দিনই হিন্দি ফিল্ম এর গান গেয়ে শুনিয়েছিল অথচ বামপন্হীরা গদিতে বসতেই , গান গাইতে হলে কমিউনিস্ট ইনটারন্যাশানাল, ব্যাস । সিনেমার গান গাইতে লজ্জা করে অথচ অ্যান্টিএসট্যাবলিশমেন্ট ।
রাহুলের স্কুল-কলেজের বন্ধুরা, যে তিনজন জিগরি-দোস্ত ছিল, তারা তো অবশ্যই, গলা ছেড়ে রাস্তাঘাটেও গান গাইত । নবীন গুপ্ত তো শচীনদেব বর্মনের ভক্ত । ক্লাস টেনে পড়ার সময়ে বিঠুর দুর্গের ধারে গঙ্গা নদীর পাড়ে তালগাছের তলায় বসে সদ্য-নামানো দুপুরের গ্যাঁজানো তাড়ি টেনে চেঁচিয়ে অতুলপ্রসাদ গাইত । তাড়ির মাটির হাঁড়িতে পৈতের আংটি-পরা আঙুলে তবলা বাজাত অর্ণব উপাধ্যায় । তাড়ি টেনে বাঙালিয়ানার ইনফিডেল ভান্ডাফোড় :-
জল বলে চল, মোর সাথে চল
তোর আঁখিজল, হবে না বিফল, কখনো হবে না বিফল ।
চেয়ে দেখ মোর নীল জলে শত চাঁদ করে টলমল
জল বলে চল মোর সাথে চল ।
বধূরে আন ত্বরা করি, বধূরে আন ত্বরা করি,
কূলে এসে মধু হেসে ভরবে গাগরি
ভরবে প্রেমের হৃদকলসি, করবে ছলছল ।
জল বলে চল, মোর সাথে চল ।
মোরা বাহিরে চঞ্চল, মোরা অন্তরে অতল,
সে অতলে সদা জ্বলে রতন উজ্বল ।
এই বুকে, ফোটে সুখে,হাসিমুখে শতদল
নহে তীরে, এই নীরে, গভীরে শীতল ।
জল বলে চল, মোর সাথে চল ।
–তাড়ি টানলে অতুলপ্রসাদ গাইতে ইচ্ছে করে কেন রে ?
–মগজে ঢুকে কেউ কাঁদতে থাকে, ‘শূন্য এ-বুকে পাখি মোর…’
–গীতবিতান হাত থেকে পড়ে গেলে তাড়ির হাঁড়ি ভাঙার আওয়াজ হয়, মার্ক করেছিস ?
কলেজে ঢুকে, ফার্স্ট ইয়ারে, গঙ্গার ঘাটে, বিঠুর দুর্গের ভাঙা পাথরের পাঁজার ওপর বসে, গাঁজা টেনে, রাহুল, নবীন, অর্ণব আর বরুণ ধর চারজনে মিলে জসিমউদ্দিন-শচীনদেব বর্মণ :-
নিশিতে যাইও ফুলবনে
–রে ভোমরা
নিশিতে যাইও ফুলবনে ।।
জ্বালায়ে চান্দের বাতি
আমি জেগে রব সারা রাতি গোওওওওওও ;
আমি কব কথা শিশিরের সনে
–রে ভোমরা ।
নিশিতে যাইও ফুলবনে ।।
তুমি নীরব চরণে যাইও
–রে ভোমরা ।
নিশিতে যাইও ফুলবনেএএএএএএ…
ওদের আচরণে একজন অধ্যাপক আরেকজনকে বললেন, স্পষ্ট শুনতে পেল রাহুল, ‘ফার্স্ট ইয়ার মেঁ হি নশে মেঁ ধুত হ্যায় পাগল সব । ‘
আশ্চর্য, নিজে নিজের মালিক হবে, তাতেও ব্যাগড়া ।
গাঁজা টেনে বাড়ি ফিরে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল বরুণ । ওর মা ওকে রাহুলদের সঙ্গে মিশতে বারণ করতেন । যত্তোসব দলিদ্দর বাড়ির ছেলে । চোপোর দিন গাঁজা ভাঙ খেয়ে স্বাস্হ্যের দফারফা । তাড়ি খেতে নিষেধ করতেন না ।
তাড়ি খেলে মোটা হয় মনে করে ওনারা ভাবতেন বরুণের চেহারার খোলতাই হচ্ছে। কয়েকদিন জ্বরে ভোগার পর সারছিল না বলে কলকাতায় নিয়ে গেলেন ওর বাবা । তখন ধরা পড়ে গেল ওর লিউকেমিয়া রোগ ।
কানপুর শহরে সে-সময়ে, কেমোথেরাপির, বোন ম্যারো ট্র্যান্সপ্ল্যান্টৈর, কোনো চিকিৎসা ব্যবস্হা ছিল না । চিকিৎসার জন্য বারবার কলকাতা যেতে হতো । একবার কলকাতা থেকে ফিরে, টাকমাথা তখন বরুণের, বললে, কেমোথেরাপিও এক টাইপের অপেরা রে, তুই কলমে লিখিস, নবীন গায়, অর্ণব আবৃত্তি করে, এই যা । জাস্ট সহ্য করার ক্ষমতা চাই, কলকাতায় না গেলে তোদের রোগ সারা কঠিন ।
বরুণের সঙ্গে কতবার বাড়ি থেকে পালিয়েছে রাহুল , বাড়িতে বাবা-মাকে না বলে, এক কাপড়ে, একটা গামছা নিয়ে বরুণের সঙ্গে উধাও হয়ে গেছে । বাড়ি ফেরার পর বাবা-মা কখনও কোনো জবাবদিহি চাননি, বা কোথায় গিয়েছিল তা জানতে চাননি । বরুণের আত্মীয়ের ট্রাকে চেপে নানা শহরে চলে যেত । পথের ধারে ঢাবায় ড্রাইভারদের সঙ্গে চারপাইয়ে বসে তড়কা-রুটি আর ঠররা বা আধপোড়া মুর্গীর সঙ্গে রাম । ধানকাটা খোড়ো-খেতে, সন্ধ্যাবেলায়, সেই যে-মাঠে অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধ লড়েছিল, তেরপল পেতে গন্ধকগন্ধা শাড়িখোলা যুবতী, যার বয়স, অন্ধকারের আদরা দেখে আঁচ করল, ওদের চেয়ে বেশি ; তার মুখ থেকেও দিশি মদের ভুরভুর। কেননা ,ড্রাইভার জ্ঞান দিয়েছিল, মদ না খেলে যুবতীদের মুখের দুর্গন্ধে খদ্দের পালিয়ে যায় । রোজই তো আর গাবভেরেন্ডার দাঁতন করা হয়ে ওঠে না ।
ড্রাইভার বলেছিল, যাও, মালিক, সঙ্গত করে এসো, ওই খড়ের আঁটির ঢিপির ওদিকে । রাহুল আর বরুণ গিয়ে দেখে, পাতা তেরপলের ওপর একজন বউ । ওদের দেখতে পেয়ে বউটা শাড়ি খুলে ফেলল । ওরা দুজনে একসঙ্গে বলে উঠল, ব্যাস ব্যাস । বউটা তখন, সময়ের রঙে রাঙানো ওই অন্ধকারে, যেন ছায়ার মাংস দিয়ে গড়া ডানা নাচিয়ে, আকাশ থেকে নেমে আসা নক্ষত্রগুলোকে, যেগুলো জোনাকির আদলে ওকে ঘিরে উড়ছিল, তাদের শুনিয়ে গাইতে লাগল, ‘জাদুগরো সাঁইয়া ছোড়ু মোরু বাঁইয়া হো গোয়ি আধিরাতো, আবো ঘরো জানো দো ।’ ওইটুকুই বেশ বারকয়েক গাইবার পর, বরুণ মেয়েটাকে বললে, ‘হো হো আবো ঘরো যাও, আর পাকা ধানের গন্ধের স্ট্রিপটিজ দেখাতে হবে না ।’ রাহুলকে বলেছিল, ড্রাইভারগুলো অন্ধকারে কেন জানিস ফাকাফাকি করে ? নিজেই তার উত্তর দিয়েছিল, ‘তাহলে মন দিয়ে রাতভর গাড়ি চালাতে পারে ।’
বরুণ টর্চ জ্বালাতেই চেঁচিয়ে বসে পড়েছিল বউটা ।
সম্রাট অশোক এই মাঠে যুদ্ধ করেছিল ; সৈন্যরা কি তখনকার দিনে ফাকাফাকি করত ! পরের দিন আবার লড়তে হবে বলে রাতভর ঝাঁপিয়ে পড়ে এর-তার সঙ্গে ? রাহুলরা সেইসব সৈন্যদের রক্ত-সম্পর্কের যোদ্ধাভুত হয়ে সেই মাঠে নেমেছে । সিংহ খেতাব তো গৌড়ের রাজার দেয়া ; কোনো যুদ্ধ লড়ে জেতার ঘুষ , সেটাই বয়ে বেড়াচ্ছে রাহুল ।
বরুণের মামা ট্রাক ড্রাইভারদের যে বাড়তি টাকা দেন তাতে, বরুণ বললে, ফাক করার খরচও অন্তর্ভুক্ত । বরুণ অন্ধকারে পার্স বের করে দুটো টাকা বউটাকে দিতে চাইলে ; নিল না ।
ফিরে দড়ির খাটে গিয়ে বসতে, ড্রাইভারকে সেকথা জানাতে , পাগড়ি খুলে কাঁধে চুল-নামানো পাঞ্জাবি ট্রাকচালক বললে, আরে মালিক ,আমি টাকা ওর মরদকে দিয়ে দিয়েছি, ওই যে, ওর মরদ, বাসনগুলো তুলে নিয়ে মাজতে বসেছে । সকলে ওর মরদকেই টাকা দিয়ে দ্যায় । মরদকে দেখে রাহুলের মনে হয়েছিল তেমন গরিব তো নয়, যে এভাবে বাড়তি আয় করতে হবে । বাড়তি আয় ব্যাপারটা বোধহয় একরকমের সুযোগ ; লোকটা তার , যাকে বলে সদ্ব্যবহার, তা-ই করে নিচ্ছে । ও ওর বউকে ভালোবাসে নিশ্চয়ই , তার ব্যাখ্যা যেমনই হোক না কেন । তার মানে ভালোবাসা হল অবস্হানবিশেষ, নর-নারীর নির্দিষ্ট হাল !
–তাহলে তেরপলটা তুলে আনো, যা কাজ করার তা তো হয়ে গেছে ?
–তেরপলটাও ওদেরই মালিক ।
চিকিৎসার জন্য বরুণ এতবার কলকাতা যেত যে কবে ফিরল কবে গেল তার খবর পেত না ওরা। মন খারাপের ভয়ে আর ওদের পাল্লায় পড়ে বরুণ রোগটা ধরিয়েছে শুনে-শুনে ওর বাড়ি মুখো হয়নি । ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল বলা যায় ।
মারা যাবার বেশ কিছুকাল পরে রাহুল ওর মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিল। সংবাদটা যেদিন পেল, সেদিন বাড়ি ফিরে অন্ধকার ঘরে চুপচাপ বসেছিল । অন্য দিন অফিস থেকে ফিরে ওর চার বছরের মেয়ের সঙ্গে খেলা করত । লক্ষ্য করল ওর মেয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে, পেছনে দুটি হাত । রাহুলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, তুমি দাদু-ঠাকুমাকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালাতে ।
চারজনের মধ্যে বরুণই প্রথম খসে গিয়েছিল । নবীন ছেড়ে দিলে গান গাওয়া ; অর্ণব ছেড়ে দিলে আবৃত্তি । রাহুলের ক্ষেত্রে ফল হল বিপরীত । লেখালিখি আর একাকীত্ব ওকে পেয়ে বসল। ক্রমশ, যাকে বলে রেকলুজ, তাই হয়ে গেল রাহুল । আলফা সিংহের মতন রেকলুজ । তিনজনেই বরুণের মৃত্যুর দায়টা স্বীকার করে নিয়েছিল , রাহুল বেশি করে, আর সেই অকারণ অপরাধবোধ ওকে ছেড়ে যায়নি আজও, সত্তর পেরিয়ে যাবার পরও ।
কানপুরে বরুণের স্মৃতি থেকে বেরোনো অসম্ভব হয়ে উঠছিল বলে নোট পোড়াবার চাকরি ছেড়ে গ্রামীণ উন্নয়নের চাকরি পেয়ে রাহুল অন্য শহরে চলে গেল, কলকাতায় গেলে সেখানেও বরুণের অনুপস্হিত উপস্হিতি এড়ানো যাবে না, তাই কলকাতায় গেল না । বরুণের স্মৃতি থেকে বেরোবার জন্য একের পর এক শহর বদলেছে, একই শহরে বারবার বাড়ি পালটিয়েছে । বরুণ যায়নি স্মৃতি থেকে ।
কলকাতায় বারকয়েক গিয়ে, পিসেমশায়ের বাসায় থাকার সময়ে, দাদার প্রায় সব বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গিয়েছিল রাহুলের । রূপক মজুমদার আর দাদার সঙ্গে গিয়েছিল নাটকের মহড়ায় ।
তার বেশ কিছুকাল পর দাদার সঙ্গে রাহুলদের কানপুরের আধখ্যাঁচড়া চূনকামহীন বাড়িতে , তখনও পুরো তৈরি হয়নি, শীতকালে এসেছিলেন অসীম গাঙ্গুলি । দাদা আর অসীম গাঙ্গুলি দুজনেই তখন ধুতি আর হাফশার্ট পরতেন । গন্ধ থেকে টের পেয়েছিল রাহুল , স্হানীয় দিশি মদ ঠররা খেয়েছিলেন নিশ্চয়ই, দোতলার আলসের নর্দমার কাছে বসে অসীম গাঙ্গুলি বমি করতে লাগলেন রাত এগারোটা নাগাদ, ওয়াক-ওয়াক-ওয়াক-ওয়াক অপেরা । রাহু-কেতু, বা রাহুল-অনিকেতের মা তখন রান্নাঘর পরিষ্কার করছিলেন । ওনার উষ্মা মনে আছে রাহুলের, ‘এই রাহু-কেতুর বন্ধুরা মদ খেয়ে সামলাতে পারে না যখন তখন যতটা পারে ততটা খেলেই তো হয় ‘। তারপর উনি রাহুলকে ডেকে দুটো লেবু নেঙড়ানো জল পাঠিয়েছিলেন, অসীমদার জন্য ।
গামছা এগিয়ে দিলে, মুখ পুঁছে লেবুজল চোঁচোঁ খেয়ে, অসীম গাঙ্গুলি বলেছিলেন, অনেকটা স্বগতসংলাপের ভঙ্গীতে, যেন হাতির দাঁতের তৈরি ব্যাবেল-মিনারের চূড়া থেকে, ‘ও তুমিই রাহুল, রাহু ? তুমি তো সূর্যকে কালো রঙে রাঙিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখো । কাল সকালে কথা হবে’ । স্বগতসংলাপের অতিরেকে ছিল স্বর্গোদ্যানের আপেলে কামড় দেবার অভিজ্ঞতা।
সকালবেলা, দাদা আর ওনার বন্ধুকে চা বিস্কুট দিতে গেলে, অসীম গাঙ্গুলি বলেছিলেন, ‘বাড়ি থেকে হাত খরচ পাও?’‘
–না, পাই না, তার জন্য দুজন ছাত্রীকে পড়াই ।
–বাংলায় গল্প কবিতা প্রবন্ধ লেখো না কেন ?
রাহুলের দাদা অনিকেত বলেছিলেন, ও গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ লিখছে আজকাল, ফাইলটা দিয়েছি বিমানবিহারী মজুমদারের ছেলেকে, আমার সঙ্গে স্কুলে পড়ত ; ক্রিয়েটিভ লেখাও কয়েকটা লিখেছে ওর ডায়েরিতে ।
— ভালো তো । যা লিখছ সবই আমায় পাঠাতে পারো ; আমি প্রকাশের ব্যবস্হা করে দেব । তার জন্য হাত খরচের টাকা পেয়ে যাবে । টিউশানি করে অযথা সময় নষ্ট করতে হবে না । নিজের নামে যদি লিখতে অস্বস্তি হয় তাহলে ছদ্মনামে লিখতে পারো । ছাত্রীদের কেউ প্রেমিকা নয় তো ?
–টাকা !
— যে কোনো বিষয়ে লিখতে পারো । পাণ্ডুলিপি কী ভাবে তৈরি করতে হয় জানোতো ? পরীক্ষার খাতার মতো ।
অনুপ্রবেশ্য আভার একাকীত্বের জেলগারদে তখন নিজেকে ঘিরে রাখত রাহুল ; অহংকারের তরল আলকাৎরার বিছানায় শুয়ে আমুদে গড়াগড়ি খেত । টাকায় কি অপেরা থাকে ? স্বর্ণমুদ্রার স্বকীয়মূল্য হিসাবে ভাবা যায় কি ক্রিয়েটিভ লেখাকে ? তা তো অবৈধ গুপ্তপ্রণয়ের মতন, বা নিজের সঙ্গে নিজে গুপ্তচক্রান্তের মতন, ইনট্র্যানসিজেন্ট । পশু-পাখিদের অপেরা নেই কেননা তারা চমকে উঠতে পারে, কিন্তু তাদের বিস্মিত হবার চেতনা নেই, চমৎকারে মোহিত হয় না । অপেরাকাররা তাই অবজ্ঞাপূর্ণ অনিশ্চয়তার পীড়ায় ভুগতে পছন্দ করে, প্রশংসনীয় দুঃসাহসের সপ্রতিভ প্রদর্শনী জাহির করে বেড়ায় ।
স্নাতকোত্তরের ফল বেরোতেই অধ্যাপকের চাকরি পেয়েছিল, দুদুটো, একটা ত্রিপুরায় আর একটা আসামে । গেলনা । নিজে রান্না করে, বা হোটেলে খেতে হবে, ঠররা খাবার ভুরভুরে অসুবিধা, পাতা ফোঁকার পথে নকল গাম্ভীর্যের অসুবিধে, এইসব ভেবে, গেল না । কানপুর শহরেই চাকরি পেয়ে গেল । বাবা বললেন আমাকে টাকা দিতে হবে না, নিজের জামা-জুতো বইপত্তর এবার নিজের খরচে চালাও । মা বললেন, মুরগির মাংস কিনে আনিস, আমি রেঁধে দেব, তোর তো খেতে ইচ্ছে করে জানি । তবে সিগারেট বেশি খাসনি । জানি, সুমিতার আড্ডায় গিয়ে বিড়ি-সিগারেট খাস ।
রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমমম, বোধহয় কত, থাকগে,সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় !
রাহুল লেখালিখির টেবল কিনল, বইপত্রের আলমারি তৈরি করাল, ট্রানজিসটার কিনল, রাজপথের ওপরে বইয়ের বড়ো দোকানটায় অর্ডার দিয়ে রাখত বইয়ের, ইংরেজি বইয়ের । বাংলা বই অনিকেত নিয়ে আসত কলকাতা থেকে ।
বইয়ের পোকা রাহুল একা ছিল না । আলমারিতে অনাকাঙ্খিত কীটরাও বই ফুটো করার শ্রমদান করত । কোনো-কোনো উদগ্রীব পোকা একটা বইতে ঢুকে একের পর এক বইয়ের ভেতর দিয়ে টানেল তৈরি করে জ্ঞান-কোষাগারের খোঁজে বেরিয়ে, মনে করিয়ে দিত যে বইগুলো রাহুল কেনই বা কিনেছিল, স্রেফ সাজিয়ে রাখার জন্য ? হ্যাঁ, কতো বই স্রেফ সাজাবার জন্যই হয়, বাড়ির লোকেরা পড়ে না, যে কিনেছে সেও পড়া হয়ে যাবার পরও কেন যে বইটাকে আলমারিতে গুছিয়ে বা গুঁজে রাখে, তার উত্তর সে নিজেই হয়ত বলতে পারবে না ।
দাদা অনিকেত যে বইগুলো কলকাতা থেকে পাত্তাড়ি গুটিয়ে চলে আসার সময়ে এনেছিল, সেগুলো, ওই যখন এনেছিল, তখনই পড়ে ফেলেছিল রাহুল; তবু পড়ে আছে বইগুলো, পড়ে-পড়ে বলদের মতো তাকিয়ে থাকে, কখন তাদের ল্যাজে মোচড় দিয়ে কাজে লাগানো হবে। কোনো খেতমজুর-পাঠক পেলে রাহুল তার মুখে হাসি ফোটাতে দিয়ে দিত । সেই ফাঁকে উই আর সিলভার মথরা বইগুলোর ভেতরে হরপ্পা-মহেঞ্জোদরো বানাতে থাকে । অবশ্য কিছু বই পোকাদের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল, সেই যখন রাহুল কলকাতায় মামলা লড়তে ব্যস্ত, তখন বেশ কয়েকজন বইচোর, কী মাসিমা, কেমন আছেন, রাহুলের মামলা এখনও চলছে নাকি, হ্যাঁ কাগজে দেখেছি, বুলির ঘুমের ওষুধ ছড়িয়ে, ভারতে দুষ্প্রাপ্য বই ঝোলায় পুরে, মাসিমার পায়ে গদগদ প্রণাম জানিয়ে, কেটে পড়ত।
অসীম গাঙ্গুলিকে বাদ দেবার কথা, আন্দোলন শুরু করার সময়ে, কই, ভাবেনি তো রাহুল । আন্দোলনে নেয়া বা বাদ দেয়া ইত্যাদি গালভারী প্যাঁচপয়জারগুলো আসেনি মগজে । আর বাদই বা দেয়া হবে কেন ! বাদ দেবার ক্ষমতা মানুষ কোথা থেকে পায় ? একে বাদ দাও, তাকে বাদ দাও, অসহিষ্ণুতার চূড়ান্ত ! মনুস্মৃতি পড়ে তো আর রাহুলরা জাত্যাভিমানের পিরামিড গড়েনি ; ইংরেজদের দেখাদেখি কালা আদমিদের বাদ দেবার আধুনিকতাবাদী থিম সংও
বাঁধেনি । বাদ দেয়া হচ্ছে না, হবে না, ঘোষণা করার জন্যই তো হরিচরণ খাঁড়াকে দায় নিতে অনুরোধ করা হয়েছে । দাদার বন্ধু, রক্তিম চাটুজ্জে তখন বলেছিলেন, অসীমকেও আমি আনব, রোসো ; আওয়াজটা আগে তুলে দেওয়া যাক ।
ডাক নাম যেহেতু রাহু, সেকারণে দেবতাদের মোহিনী ষড়যন্ত্রের আঁচ পায়নি । বুঝতে পারেনি যে অসীমকে না জানিয়ে আওয়াজ তুলতে চাইছেন রক্তিম । পরে প্রদীপন চাটুজ্জে, যাঁর আসল নাম নৃপতি, তিনিও, মানে প্রদীপনও, পরামর্শ দিয়েছিলেন যে সবাইকে অমন জানিয়ে কী করবে ! দেখোই না কী ঘটে । তুমি তো আর ফুটবল টিম তৈরি করছ না যে ক্যাপ্টেন দরকার। সময় তোমাকে দিয়ে যা করিয়ে নিচ্ছে তা সময়ের ব্যাপার, বুঝলে, তোমার এতে কোনো অবদান নেই ; তুমি জাস্ট ওয়ার ক্রাই বজায় রাখো । গিভ এ ড্যাম টু ওয়ান অ্যান্ড অল ।
ফলে, রাহুলের কন্ঠ থেকে : হ্যালেলুয়াআআআআ….
ফুটবল টিম ! প্রকারান্তরে উনিও, মানে প্রদীপন চাটুজ্জেও, বলেছিলেন, ফুটবল টিমের মতো কাউকে ক্যাপ্টেন রাখার প্রয়োজন নেই । রক্তিমের নামে নেতা যোগ করায় উনিও অখুশি । উনিও বাদ দিতে চাইলেন অসীম গাঙ্গুলিকে ।
এতক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন অসীম গাঙ্গুলি । খাটে বসলেন ।
–তুমি উপলক্ষ্য মাত্র । তোমার কি মনে হয় না যে তুমি দায়িত্ববোধহীন কাজ করছ ?
–পুরো ব্যাপারটা আমার পরিকল্পিত, বলল রাহুল, যার ডাক নাম রাহু । বিছানা থেকে লিফলেটটা , যার পিঠে জরুরি ঠিকানা লিখে রেখেছিল, তুলে ,ভাঁজ করে ,পকেটে রেখে যোগ করল, এটা আমারই লেখা, আর আপনি বলছেন যে আমি উপলক্ষ্য , আসল লক্ষ্য আপনি ! রাহুল, যার ডাক নাম রাহু , মগজের রসায়ন চেপে রাখার চেষ্টা করেও পারল না । বলল, আসলে দায়িত্ববোধহীনতাই তো গতি , নিজস্ব দায়িত্বহীনতার আক্রমণাত্মক বোধ, আমার কাছে ক্রিয়েটিভিটি অন্তত তা-ই, আমি আমিই ।’
রাহুলের বর্ণময় কন্ঠস্বর ঘেউ-ঘেউ স্তরে চলে গিয়ে থাকবে । মাসিমা, মানে অসীম গাঙ্গুলির মা, ঘরে ঢুকে বললেন, এত চেঁচামেচি শুনছি তখন থেকে ; ছেলেটা কখন থেকে এসে বসে আছে তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য , ওর তো খিদে পেয়ে গিয়েছে ।
রাহুল , যার ডাক নাম রাহু , উঠে প্রণাম করল অসীম গাঙ্গুলির মাকে । যখন এসেছিল, তখনও করেছিল। অসীম বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন ।
ওনার দিকে তাকিয়ে, অসীম গাঙ্গুলিকে রাহুল বলল, ‘’তোলা থাক।’’ বলার পর, রাহুলের মনে হল যে অসীম গাঙ্গুলির বাড়ি আসা জরুরি ছিল । লেখালিখি ব্যাপারটাই তো অ্যান্টিএসট্যাবলিশমেন্ট কাজ, একধরণের দ্রোহ, সীমালঙ্ঘন– বাস্তবতার, ভাষার, অভিধার, বাক্যের, ব্যকরণের, শব্দার্থের, ব্যানালিটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ।
মাসিমা বললেন, কী হয়েছে বাবা, প্রণামও তুলে রাখছ ? অসীমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, যা স্নান করে আয় ।
আজ আর স্নান করব না ; এঘরেই দিয়ে দাও, বললেন অসীম ।
রাহুল সিংহ , যার ডাক নাম রাহু , টের পেল যে তাকে তাড়াতাড়ি বিদেয় করে দিতে চাইছেন অসীম গাঙ্গুলি।
প্রণাম মুলতুবি রাখার জন্য ততটা নয় , যতটা ওর বুকপকেটে রাখা হ্যণ্ডবিলটার জন্য । নিয়মিত জায়গার বদলে ওনার শোবার বা লেখালিখির ঘরেই পাত পাড়তে বললেন ।
–হ্যণ্ডবিল ? একটা এক ফালি কাগজ ছাপিয়ে সৃজনশীলতা ? ভালো প্রেসও পাওনি দেখছি, হরফগুলো সবই ভাঙা-ভাঙা । সৃজনশীলতা হবে রবীন্দ্রনাথের মতন পুরুষ্টু বই লিখে, বা যেমন বঙ্কিমের উপন্যাস । আঁদ্রে ব্রেতঁ, ত্রিস্তান জারা, এজরা পাউন্ড কেউ কি হ্যাণ্ডবিল ছাপিয়ে আন্দোলন করেছেন ? পরাবাস্তববাদী ম্যানিফেস্টোতে কি আঁদ্রেঁ ব্রেতঁ লিখেছিলেন যে তিনি লিডার, নেতা ? তিনি ক্রিয়েটর যখন তিনিই তো নেতা ! তিনি ক্রিয়েটর হয়েও তা তোমাদের মতো প্রচার করে বেড়াননি ।
–সব ঝড়ই মাঠে নামার আগে একটা পাতাকে ছুঁয়ে আগমন-বার্তা পাঠায়, বলল রাহুল ।
অসীমদার বোন ঘরে ঢুকলেন । স্পষ্ট যে রাহুল নামের জীবটিকে ভালো করে দেখে নিতে চান । ‘দাদা, আমি একটু বেরোচ্ছি’ বলে বেরিয়ে গেলেন ।
ফিরতে বেলা করিসনি , বললেন অসীম গাঙ্গুলি । বোনের মুখের দিকে তাকায়নি রাহুল । হাতের দিকে তাকিয়ে হালকা রোম দেখতে পেল । রাহুলের বড়দির হাতে-পায়ে অমন রোম ।
বোন আবার ঢুকলেন, হাতে দুটো আসন নিয়ে । মেঝেতে পাশাপাশি আসন দুটো পেতে, কাঁসার গেলাসে জল রেখে চলে গেলেন । আবার ঢুকে ভাতের থালা রেখে চলে গেলেন ।
পাশাপাশি খেতে বসেছিল ওরা । রাহুল,ইচ্ছাকৃতভাবে, গণ্ডুষের আচরণ করল । ওর পদবি যে আসলে জাস্ট খেতাব, তা জানেন অসীম । দেখে উনি বললেন, বামুনগিরি চালিয়ে যাচ্ছ দেখছি । হেসে উঠলেন, যাকে বলা যায় , মনের সুখে । শ্লেষ প্রয়োগ করলেন, গণ্ডুষের মন্ত্র জানো তো, না হাত ঘোরানোই সার ?
রাহুল বলল, জানি, মুখস্হ, তারপর গম্ভির ভাবে মন্ত্রোচ্চারণের ঢঙে বলল, ‘জিংগল বেল জিংগল বেল জিংগল অল দ্য ওয়ে… ।’
পাশের ঘর থেকে চাপা খিলখিলের রেশ ভেসে এল ।
অসীম কি বুঝতে পারলেন যে রাহুল তাঁকে শ্রদ্ধার আসন থেকে নামিয়ে দিতে পারে । উনি জানেন যে যাদের ঈশ্বর নেই উনি তাদের পয়গম্বর ।
–সুররিয়্যালিস্ট শব্দের জনক হলেন গিয়ম অ্যাপলিনার । উনি আন্দোলনে ছিলেন না । ওনাকে ক্রিয়েটর হিসাবে বা লিডার হিসাবে প্রচার করা হয়নি পরাবাস্তব ম্যানিফেস্টোতে । তোমার সঙ্গে যারা গেছে তারা লোভি । কেউ তো তোমার সমবয়সী নয় , ভেবে দ্যাখো । তুমি কি ভাবছ তোমার দাদার জন্য রক্তিম আর প্রদীপন তোমার সঙ্গে যোগ দিল ? আমাকে না জানিয়ে ? ভাতের ওপর মুগের ডালের বাটি উপুড় করে মাখতে-মাখতে বললেন অসীম গাঙ্গুলি ।
রাহুল তেলাপিয়ার পিঠ থেকে পুরো মাংস খুবলে নিয়ে বলল, গিলতে গিলতে, আপনি আমাকে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছেন না, ফেকলু মনে করছেন । যেটুকু তোলপাড় ঘটিয়েছি, তা থেকেই তো আমার ভূমিকা স্পষ্ট । আমি আপনাকে জানাবার জন্যই এসেছিলুম । আপনার বন্ধুরা যাঁরা আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের আহ্বান করে আনিনি আমি । রক্তিম চট্টোপাধ্যায়ের মনে ধরেছিল আমার বক্তব্য । তাঁরা কেউই এই সমস্ত প্রশ্ন তোলেননি । রক্তিম আমায় বলেননি যে উনি নেতা হতে চান । প্রদীপন, মৃণ্ময় মজুমদার, চঞ্চলকুমার বসু, যাঁরা আপনার বন্ধু, তাঁরা নিজেরাই যোগ দিয়েছেন।
–হুঃ, মৃণ্ময়, ওকে যে রক্তিম নিয়ে গেছে, তুমি উদ্যোক্তা হয়ে নিজেই জানো না । লেখালিখির বাইরে , লেখকদের কার্যকলাপ নিয়ে মৃণ্ময়ের কোনো উৎসাহ নেই , ও হয়ত বুঝতেও পারেনি যে রক্তিম ওকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে’ , বললেন উনি ।
চুপ করেই ছিল রাহুল । কে কাকে এনেছেন আর আনছেন এগুলোর কোনো গুরুত্ব নেই আর, আন্দোলন নিজস্ব গতি ধরে নেবার পর । হরিচরণ খাঁড়া ওরফে দুর্গা বর্মণকে বেশ কয়েকজন অচেনা তরুণ অনুরোধ করেছে তাদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য । এমনকী শান্তিনিকেতনের পাঠভবন থেকে অমলেন্দু আতর্থী নামে একজন ছাত্র ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। হরিচরণ খাঁড়া ওরফে দুর্গা বর্মণের মতে, ক্রিয়েটিভ লেখকরা কমবেশি হিংসুটে হয়, আর বাজে ব্যাপার হল, প্রক্রিয়াটা আত্মবর্ণনার রূপক ।
–আমার রামায়ণ নট্ট কোম্পানি তো ছিলই । তুমি আলাদা করে আন্দোলন আরম্ভ করে ভালো করোনি । ভালো যে করোনি তা তুমি কিছুদিনেই জানতে পারবে । যারা লোভি তারা কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই তোমার ওই সোকলড
আন্দোলনে গেছে । আলুভাজা খেতে-খেতে বললেন অসীম গাঙ্গুলি ।
ইলিশ পাওয়া যায়নি নাকি অসীম গাঙ্গুলির এখন টানাটানি চলছে, তেলাপিয়া শেষ করে খেয়াল হল রাহুলের, যার ডাক নাম রাহু । অতুল্য ঘোষের সংবাদপত্রের চাকরি অতুল্য ঘোষের সঙ্গেই উধাও । আসানসোলে গিয়ে ভোটের মাঠে বীজ ছড়াচ্ছেন অতুল্য ঘোষ ; কম বয়সে উনি স্বামী বিবেকানন্দের ভাইয়ের প্রভাবে সাম্যবাদী ছিলেন । অসীম গাঙ্গুলি এখন কংগ্রেসি ; বয়স বাড়লে হয়ত সাম্যবাদী হবেন । সাম্যবাদীদের ঘোর সমালোচনা করেন । বয়স হলে হয়ত গুণগান করবেন । তারা মসনদে বসার সুযোগ পেলে হয়ত নিজেকে, আর সেই সঙ্গে রামায়ণ নট্ট কোম্পানিকে আমূল বদলে ফেলবেন । হয়ত রামায়ণ-মহাভারত ভাই-ভাই হবে ।
খাওয়া শেষ হলে অসীম গাঙ্গুলি বললেন, ভোজনান্তেও তো বোধহয় গণ্ডুষের প্রক্রিয়া কমপ্লিট করতে হয়। রাহুল ওনার মুখের পানে তাকিয়ে, উঠে পড়ে বলল, ‘’তোলা থাক ।’’
চাকরি-বাকরি যদি না-ই থাকে, তাহলে বন্ধুদের সঙ্গে হইহই করে খালাসিটোলা, অলিমপিয়া, এটসেটরা যান কার টাকায় ? টিমটিমে নিয়ন পাড়ার আলোয় রইরই করেন কার খরচে ? বোধহয় শিল্প সমালোচক সাবর্ণীচরণ মুকুজ্জের টাকায় বা হিসাবরক্ষক বন্ধু বসন্ত বাঁড়ুজ্জের টাকায় । যদিও বাংলা চকচকে ফিল্ম পত্রিকাগুলোতেও লিখে চলেছেন, শচীন ভৌমিকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে । ওই করে শচীন ভৌমিক বম্বে পাড়ি দিয়েছেন । অসীম গাঙ্গুলিও হয়তো কোথাও পাড়ি মারবার তালে আছেন । একটা বড় খবরের কাগজে চাকরির জন্য ওনার নাম সুপারিশ করে মালিককে
চিঠি দিয়েছেন আগের কাগজের মালিক । অসীম গাঙ্গুলির এই এলেমের সঙ্গে কেউ টেক্কা দিতে পারবে না । তাঁর পাবলিক রিলেশানের কাজ খুব উন্নত । নেটওয়রকিং, নেটওয়র্কিং, নেটওয়র্কিং। যোগাযোগ যোগাযোগ যোগাযোগ যোগাযোগ, আর সংলাপ রোমন্হনের ক্ষমতা । কলকাতার কেউকেটাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন রূপক মজুমদার ; রূপকদার সঙ্গে সবায়ের বাসায় গিয়ে পরিচয় করে নিয়েছেন অসীম।
রূপক সবাইকে খেই ধরিয়ে দিয়ে নিজে উধাও ।
উধাও হবার আগে, বড়োবাজারে মারোয়াড়ির গদিতে, মামলার সময়ে, যেখানে কোনো-কোনো দিন রাতে রাহুল আশ্রয় নিতো, আর সান্ধ্য জমায়েতে দেয়ালে ঠেসান দিয়ে মাদকে বুঁদ থাকত, সেখানে হঠাৎ উপস্হিত হয়ে, কোনো কথা না বলে, পকেট থেকে বের করলেন একজোড়া মধ্যপ্রদেশী পাঁচমারি ঘুঙুর, নিজের পায়ে বাঁধলেন, আর নাচতে-নাচতে গাইতে লাগলেন :
চোখ মেরো না বেদানা চুল বেঁধো না
তোমার ঐ হলুদ জানালায়
তুমি ঝুলিয়ে রেখো না বেদানা
ঝুলিয়ে রেখো না
নীল কাঁচুলি ঝুলিয়ে রেখো না
আমো যখন আসব ঘরে
তুমি নাইতে যেও না বেদানা নাইতে যেও না…
উপস্হিত সবাইকে এমন মাতিয়ে দিলেন যে সকলেই উঠে নাচতে লাগলেন, যেন নাচিয়েদের ঘুর্ণাবর্ত শুরু হল, পাকের পর পাক পাকের পর পাক কোমর থেকে কাঁটাতারের ঘের নামিয়ে দিতে লাগল রাহুল ।
বহুকাল আর বহুবিবাহের পর রূপকদার সঙ্গে বইমেলায় দেখা হয়েছিল রাহুলের । রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমম, যা-ই হোক না, কী-ই বা এসে যায় !
রাহুলকেও ইতিহাসের দর্শন পড়ার খেই ধরিয়েছিলেন দীপক ; সেই তখন, যখন দাদা অনিকেত ধানবাদে পোস্টেড । বাসন মাজার সঙ্গে ইতিহাসের দর্শনকে দিব্বি মিলিয়ে দিয়েছিলেন রূপকদা ।
রাহুলের দাদা অনিকেতের বিয়ের সময়ে দাদার বন্ধুরা সবাই বরযাত্রী ছিলেন । সিংভূমের পাহাড়ি জেলাসদরে । কেবল রক্তিম চাটুজ্জে আসেননি, কেননা ওই বাড়িতে রক্তিম চাটুজ্জের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল । একটি যুবতীর প্রেমে প্রায় উন্মাদ রক্তিম কী করে সম্পর্ক নাকচ করে চলে গেলেন ! জাস্ট হাওয়া ।যুবতীর বাবা অনুমোদন করেনি বলে মেয়েটকে স্মৃতির কারাগারে ফেলে রেখে পালালেন। যে তরুণীর জন্য টানা দুবছর পড়ে রইলেন , শরৎ চাটুজ্জের দেবদাসের মতন অষ্টপ্রহর মহুয়ায় মাতাল, তার কী হবে চিন্তা করলেন না । তাকে নিয়ে লেখা রচনাগুলোকে তার চেয়ে বেশি ভালোবেসেছেন । প্রেমিকরা তাঁদের প্রেমের কবিতায় যে ভালোবাসার কথা বলেন, তা কোন ভালোবাসা !
দাদা অনিকেতের বিয়েতে রূপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় ছাড়া সবাই এসেছিলেন সিল্কের ধুতি পাঞ্জাবি পরে । অসীম গাঙ্গুলি তো বটেই ,এমনকি রূপকও । অনুপস্হিতির মাধ্যমে উপস্হিত ছিলেন রক্তিম, গালের ভাঁজে গোপন ট্র্যাজেডির ব্যক্তিগত ইতিহাস দাড়ির তলায় লুকিয়ে , কোথাও, কোনো মাতাল-জমায়েতে। পরে একজনকে ছুঁয়ে আরেকজনকে স্পর্শের স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখবেন হয়ত ।
এসব ব্যাপারে রাহুলের যা হয় তাকে বলা চলে প্রতিক্ষিপ্ত হওয়া । এনসিসিতে থ্রি-নট-থ্রির গুলি চালানো শেখার সময়ে বন্দুকের বাঁটের ধাক্কায় যেমনটা হতো । নড়ে উঠত বহু দূরের টার্গেট ।
অসীম গাঙ্গুলির ঘরে, আঁচিয়ে এসে, রাহুল ভাবল বলবে, কিন্তু বলল না, যে, আপনার বন্ধুরা খোঁয়াড়বদ্ধ হবার দরুণ বেড়া ভেঙে ভিনমুখো হয়েছেন । কয়েক বছর পরে প্রদীপন একটা পোস্টকার্ডে লিখেছিলেন রাহুলকে,’অসীম আমার ধোপা-নাপিত বন্ধ করে দিয়েছে হে, তুমি তাড়াতাড়ি এর বিহিত করো ।’
ফালিকাগজ তো রয়েছেই, এক ফর্মার করে দেয়া যেতে পারে । হ্যালেলুয়াআআআ….
রাহুল বলল, তেলাপিয়া মাছটা ভালো খেতে ; বাজার দখল করে নেবে মনে হয় । ইলিশ ক্রমশ লোপাট হয়ে যাবে। এই মাছের কথা জানি ; পুকুরে ছাড়লে অন্য মাছের চারা খেয়ে সাবাড় করে দ্যায়, আর নিজেদের বংশ বাড়াতে থাকে । তারপর তেলাপিয়াদের একচ্ছত্র ।
–তোমার মতলব জানি । তোমাকে কেই বা কলকাতায় চেনে ! একটা বই বেরোবার পরও অনিকেতকেই লোকে
তেমন চেনে না । ওদের ব্যবহার করে তুমি নিজের ফিল্ড গড়ে নিয়েছ ।
রাহুল অপেক্ষা করছিল অসীম গাঙ্গুলির পরের সংলাপের জন্য ।
–এখন আর ওদের প্রয়োজন নেই তোমার । তুমি জানো যে তরুণ কবিদের নেতা আমি, অসীম গঙ্গোপাধ্যায়, রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারী । তাই আমাকেও ব্যাবহার করে নিতে চাও । তার আর প্রয়োজন নেই । এবার নিজে করে দেখাও । আমিও দেখব, হ্যাণ্ডবিলে কেমন করে নট্ট কোম্পানি চালাও ।
–দেখাদেখির কিছু নেই । আমার কাজ কেবল বাক্য-খরচে আর শব্দ সাজানোয় সীমিত থাকবে না । বাঙালি সমাজকে নাড়িয়ে দেবার, ডিরোজিওর মতন পরিকল্পনা আছে আমার । ডিরোজিওর সামনে এসট্যাবলিশমেন্ট ছিল প্রাগাধুনিক বঙ্গসমাজ । আমার সামনে এসট্যাবলিশমেন্ট এই সময়, উত্তরঔপনিবেশিক সমাজ । ডিরোজিও ছিলেন সোফিসটিকেটেড। আর আমার মিলিউ বা হরিচরণ খাঁড়ার মিলিউ তো আপনি জানেনই, ছোটোলোকেদের । আমি আপনাকে আন্দোলনে যোগ দেবার আহ্বান নিয়ে আসিনি । যদি তা করবার থাকত তাহলে আপনার বন্ধু অনিকেতই করতেন । আমি ভেবেছিলুম আপনি আনন্দিত হবেন ।
–তোমার ওই হিলহিলে হ্যাণ্ডবিল বিলি করে ! দেখব । হ্যাণ্ডবিলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ! প্রতিষ্ঠানকে ভাঙতে হলে তার ভেতরে ঢুকে ভাঙতে হয় । বুলেটিন ছাপিয়ে হয় না ।
রাহুলের মনে হল দাদা অনিকেত অসীম গাঙ্গুলি সম্পর্কে যা বলতেন তা সঠিক । অসীম গাঙ্গুলি প্রতিষ্ঠান বলতে বোঝেন কোনো ইন্সটিটিউশান, বিশেষ সংবাদপত্র দপতর, কিংবা ঝন্টুদা যাকে বলেন কলকাতার বড়-বাঙালিরা । প্রতিষ্ঠান যে ক্ষমতা আস্ফালনের বিমূর্ত অবয়ব, তা কি উনি টের পান না ? সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলেই হয়ত কাগজঅলাদের মনে করেছেন প্রতিষ্ঠান । বাঙালি সংস্কৃতির সামগ্রিক ছবি হয় ওনার সামনে ভেসে উঠছেনা বা উনি নিজের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছেন । পাঁচের দশক থেকে কলকাতার রাজপথে উদ্বাস্তুদের লড়াই ওনার চোখে পড়ছে না । তারা কার বিরুদ্ধে লড়ছে ? অনেকের বিরুদ্ধে । ক্ষমতা-প্রতাপের ছড়ানো-ছেটানো আস্ফালনঘাঁটিগুলোর বিরুদ্ধে। ইংরেজরা চলে যাবার সময়ে যে খোস-পাঁচড়া চামড়ার ওপর, আর ক্ষয়রোগ শরীরের ভেতর, দিয়ে গেছে, তা থেকে কত রকমের কায়েমিস্বার্থের প্রতাপী আস্ফালন জন্মেছে, তা উনি দেখতে পাচ্ছেন না, বা দেখতে চাইছেন না ।
–শুধু বুলেটিন লিখে নয় । আরও অনেক পরিকল্পনা আছে । মর্ত্যে বিশৃঙ্খলাও তো দরকার । আধুনিকতার প্রকল্প আর ঘাঁটিগুলো আক্রান্ত হবে, একের পর এক, লক্ষ রাখবেন । আপনার পছন্দ হবে না । বাঙালি মধ্যবিত্তের আত্মাভিমানের দানবটাকে আমরা খুঁচিয়ে বের করে আনব । তারপর যা হবার তা হবে ।
কথাগুলো বলার সময়ে রাহুল নিজেকে শুধিয়ে নিঃশব্দে বলতে শুনল, যে সমস্ত লেখকরা ‘এ আজাদি ঝুটা হ্যায়’ বা এই স্বাধীনতা মিথ্যা আওয়াজ তুলে একসময় ট্রামে বোমা মেরে বাসে পেটরল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল, অজস্র বাঙালিকে আহত-নিহত করেছিল, তারা এখন অসীম গাঙ্গুলির শ্রদ্ধার আরামকুর্সিতে বসে দোল খাচ্ছেন ; তাদের ওই অপরাধ উনি বেমালুম ভুলে গেছেন ; আমি তো তাদের মতন তথাকথিত বিপ্লব করতে যাচ্ছি না ।
–ও, তুমি বিশৃঙ্খলার দেবদূত । অ্যানজেল অব কেয়স ! দেখব দেখব । চালিয়ে যাও যতদিন পারো । জুতোর ফোস্কাও বেশ কিছুদিন একাগ্র আর একগুঁয়ে থাকে । তবে যিশুখ্রিস্ট হবার চেষ্টা কোরো না ।
–আসার সময় আপনার গলির মোড়ে দেখলুম একটা ঘোড়ার খুরে লোহার নাল বসানো হচ্ছে । ঘোড়াটার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল হাসছে ।
অসীম গাঙ্গুলি বললেন, হুঁ । তারপর, জল খাওয়া শেষ করে বললেন, চ্যালেঞ্জ কোরো না । জানো তো আমি লাঠিচালানো শিখেছিলুম । জলে ডোবার সম্ভাবনা তোমার ; তুমি তো আমার মতো সাঁতার জানো না, এপার-ওপার করতে পারবে না, পাড়েই ডুবে মরবে ।
–জানি । প্রদীপন চাটুজ্জেকে আর রক্তিম চাটুজ্জেকে আপনি বলেছেন, আন্দোলন ছেড়ে বেরিয়ে যেতে ।
প্রদীপন কেন যোগ দিয়েছেন জানেন ? উনি আমায় বলেছেন যে ‘এটা মিস করেছিলুম হে, এই রিলেন্টলেস বমবারডিং অব দি হেডকোয়ার্টার, প্রতি সপ্তাহে একটা করে গ্রেনেড’ । উনি একে বলেছেন, ‘গৌরবের এথিকাল ঝিলমিল।’ বলেছেন, যত পারো আনন্দের হেঁচকি তুলে নাও এই সুযোগে ।
প্রদীপন আরেকটা কথা বলেছিলেন, যা রাহুল বলল না অসীম গাঙ্গুলিকে, ‘’এর পর লক্ষ্মণের ট্যালকাম-পাউডার লাইনটা কারা টানছে সেদিকে খেয়াল রেখো।’’ অসীমদার কথা মাথায় রেখেই বলেছেন, সন্দেহ নেই ।
–দ্যাখো কে কতদিন টেকে । এসট্যাবলিশমেন্টের সঙ্গে লড়ে জেতা যায় না । এসট্যাবলিশমেন্টে প্রবেশ করে
অন্তর্ঘাত ঘটাতে হয় । ‘মোজেকের ওপর পা আর হাওয়ায় চোলাই-করা মেঘেতে মাথা গলিয়ে বললেন অসীম গাঙ্গুলি , যেন পিঠে করে নদী বয়ে বেড়াচ্ছেন ।
–স্ট্রেঞ্জ । রাহুলের ব্যারিটোন গলার স্বরে ধ্বনিত হয়েছিল ওর হতভম্ব হওয়া । আর মগজের ভেতর ফিসফিস হয়েছিল , মার্ক অ্যান্টনির সংলাপ । তার মানে, হুশিয়ারি দিয়ে রাখলেন অসীম গাঙ্গুলি ।
পরজন্ম দেখতে-পাবার ক্ষমতাসম্পন্ন কন্ঠে অসীম বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক শুনেছ ।’ উনি যেন নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেন ।
–আপনি হাওয়াইজাহাজের পাইলট হয়েই থাকুন ; আমি প্যারাশুট পিঠে প্যারাট্রুপারের ভূমিকায় থাকতে চাই । আপনার চোখে প্যারাট্রুপারের দেখা ব্রহ্মাণ্ডটা বিমূর্ত । বোধহয় সেকারণেই আপনি বিষ্ণু দেকে নাকচ করেছেন ।
–না, আমি বিষ্ণু দেকে বিমূর্ত বলে নাকচ করিনি ; উনি আমার কবিতা থেকে অংশবিশেষ বাদ দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন ।
–তার মানে ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে একজন কবি আরেকজনকে নাকচ করতে পারেন ! একে-তাকে বাদ দেয়া, এর-তার লেখা থেকে অংশ ছাঁটাই, এগুলো তো ইংরেজদের শিখিয়ে যাওয়া ঔপনিবেশিক রোগ ।
–পারবে না কেন ? আমার যাকে পছন্দ নয় তাকে আমি নাকচ করে দিই । কথাটা মনে রেখো ।
জিতে যাওয়া হেরে যাওয়া , সৃজনশীলতা তাহলে রণক্ষেত্র ; ক্ষমতার মাদকতন্দ্রা দেয় । দেয় নিশ্চয়ই । একে সাব-এডিটারের চাকরি থেকে বের করে দাও । ওকে এই পুরস্কার, তাকে সেই পুরস্কার দিয়ে পোড়া বাসের ভুত-ভুতনিতে পালটে দাও । দরবার বসাও । যত ক্ষমতা তত সন্দেহ তত স্তাবক তত পীড়া ।
গেট খুলে বেরিয়ে বাঁদিকে এগোবার পর রাহুল দেখল আস্তাকুঁড়ে পড়ে আছে কারোর উদযাপিত জন্মদিনের গোলাপতোড়া । ও এখন যাবে যাদবপুর, বান্ধবীর বাসায় ।
খুরে নতুন নাল-বসানো কালো চকচকে ঘোড়াটা উঠে দাঁড়িয়েছে ।
তা ছিল প্রথমবারের কথা কাটাকাটি ।
শেষবার, অসীম গাঙ্গুলির ওঝাপুরের বাড়ির গেটের ভেতরে ঢুকে, রাহুলের মনে পড়ে গেল প্রথমবারের কথাকাটাকাটি ।
ওকে ঢুকতে দেখে, অসীম গাঙ্গুলি, যে ভাবে দৌড়ে নিচে চলে এলেন, বোঝা গেল, রাহুলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন । বিদেশ থেকে ফিরে ধুতি বাতিল করে দিয়েছেন । চেককাটা শার্ট আর ট্রাউজার, চুলে শ্যাম্পু । শ্লেষাত্মক চাউনি মেলে, বললেন, তাহলে, যাকে নেতার আসনে বসিয়েছিলে, সে-ই পিঠে ছুরি মারল তোমার ? মনে করে দ্যাখো, আমি সতর্ক করেছিলুম তোমায়, আন্দোলনের নেতৃত্ব সকলের দ্বারা হয় না, নেতা সাজিয়ে কাউকে বসিয়ে দিলেই সে নেতা হয়ে যাবে, অমন চিন্তাকরাটাই তো ভুল, বলেছিলুম তোমায় সেবার ।
রাহুল নিজেকে নিঃশব্দে বলতে শুনল, এশিয়া সোসাইটির বনি ক্রাউন তো আন্দোলনের নেতা হিসাবে রক্তিম চাটুজ্জের জন্যে স্কলারশিপের সুপারিশ করেছিলেন, তা ওলোট-পালট কী ভাবেই বা হয়ে গিয়েছিল !
–আমার কেসের ব্যাপারে সব খবর রেখেছেন । থ্যাংকস । হ্যাঁ, লিডার-ক্রিয়েটার চিহ্ণিত করে প্রথম ইশতাহারেই নামের দরকার ছিল না , ওটা আমারই ব্লান্ডার । আর, রাহুল একটু থেমে, বলবে কি না ভেবে নিয়ে বলে ফেলল, রক্তিম চট্টোপাধ্যায় মনে করেন যে তাঁর প্রেমিকাকে বিয়ে করার পথে আমি এবং দাদা অনিকেত বাগড়া দিয়েছি । আসল ব্যাপার আপনিও জানেন । রক্তিম চাটুজ্জে এত মদ খেয়ে প্রতিদিন ওনাদের বাড়ি যেতেন যে ওদের বৈঠকখানা থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত চলে যেত মহুয়ার গন্ধ ; উনি পুরো দু’আড়াই বছর দাদার বাসায় কাটালেন, বেকার, কী করে একজন বাবা তার মেয়ের বিয়ে দেবার কথা ভাববে অমন পাত্রের সঙ্গে ?
–ওর প্রেমিকা তোমাদের কানপুরের বাড়িতে রয়েছে, শুনেছি ।
–রয়েছে নয়, উনি স্নাতকোত্তর পড়তে গেছেন ; আমি আর অনিকেত দুজনেই বাইরে, আমাদের বাড়িতে ওনার পড়াশুনার সুবিধা হবে বলে আছেন । কলকাতায় এই ধরণের গুজব ছড়ানোর দরুণই রক্তিম চাটুজ্জে আরো অফেনডেড হয়েছেন ।
–তোমাকে তাহলে মারতে গিয়েছিল কেন , কফিহাউসের সামনে, দলবল নিয়ে ?
–আমাকে নয়, সুকোমল রুদ্রকে ; আপনার পরিচিত এক সংবাদপত্র মালিককে জানাবার জন্য, যে উনি তাদের জন্য কতটা নামতে পারেন। চাকরি তো অলরেডি পেয়ে গেছেন বলে শুনেছি । মারকুটে সেই লেখকদলের সদস্য কারা
ছিল সে-খবরও হয়ত আপনি পেয়ে গিয়ে থাকবেন ।
–তোমার আন্দোলনের লোকেরা শেষ পর্যন্ত তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে, রাজসাক্ষী হয়েছে, তোমার তো অপমানিত বোধ করা উচিত । মনে হচ্ছে না, তুমি ডিফিটেড ?
— না, তা হবে কেন, আমি তো কোনো রাজ্য জয় করতে বেরোইনি । তবে, আমি এক্সপেক্ট করিনি যে প্রদীপন, রক্তিম আর চঞ্চলকুমার বসু আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী হবেন, সরকার পক্ষের সাক্ষী ।
–চোঙদার ভাইরা তো তোমার বিরুদ্ধে, তোমার আন্দোলনের বিরুদ্ধে, মুচলেকা সই করে দিয়েছে ; আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করেছে, লিখেছে নাকি যে ওরা তোমার আন্দোলনের মটোতে বিশ্বাস করে না । তোমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছে ।
–বারবার তোমার তোমার বলছেন কেন ? এই আন্দোলন তো কারোর ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা প্রায়ভেট প্রপার্টি নয়। আমরা কি ওই গাছের তলায় গিয়ে আলোচনা করতে পারি ? অনেকটা হেঁটে এসেছি । হাঁটতে-হাঁটতে রাহুল বলল, চোঙদার ভাইদের সমস্যা হল আত্মবিশ্বাসের অভাব, মূলত চাকরি চলে যাবার ভয় ।
অসীম গাঙ্গুলি এগোলেন গেটের বাইরে অর্জুন গাছের ছায়ার তলায়, উত্তেজনা বা ক্রোধ চাপা দিতে রাস্তা থেকে কয়েকটা পাথরটুকরো তুলে দূরের কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে ছুঁড়তে থাকলেন । রাহুলকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন না । ভালোই হল, ভাবল রাহুল, অসীম গাঙ্গুলির মা শুনতে পেতেন ওদের তর্কাতর্কি । রাহুল যে গ্রেপতার হয়েছে, মামলা চলছে ওর বিরুদ্ধে, বন্ধুরা ওর বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়েছে, হয়ত ওনার কানে গিয়ে থাকবে, এবং উনি অসীম-বিরোধী অবস্হান নিয়ে ফেলতে পারেন অনুমান করে অসীম গঙ্গোপাধ্যায় রাহুলকে নিয়ে গেছেন বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে ।
–আপনি বিদেশ থেকে ফিরতেই আমাদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হল, আন্দোলন তো চলছে সেই একষট্টি থেকে, অনেকেরই কিছু কর্মকাণ্ড পছন্দ হয়নি । তখন কিন্তু পুলিশ অ্যাকশানের গুজব রটেনি । আপনি ফিরতেই এ-সব হল । এ-ও শোনা যাচ্ছে যে লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেণ্টের ডেপুটি কমিশনার আপনার রামায়ণ নট্ট কোম্পানির একজন নটের নিকটাত্মীয় ।
–কী বলতে চাইছ কি, স্পষ্ট করে বলো । তুমি বলতে চাইছ আমি ফোন তুলে প্রফুল্ল সেনকে এবং পুলিশ কমিশনার পি. সি. সেনকে বললুম যে এদের এগেইনস্টে কড়া অ্যাকশান নাও, আর তারা আমার কথা শুনে হুকুম দিলে যে যাও, রাহুলকে দড়ি বেঁধে রাস্তায়-রাস্তায় ঘোরাও ; শিশুসুলভ ভাবনা । এখনও একটা ভালো চাকরি জোটাতে পারলুম না, আর তুমি এসেছো দোষারোপ করতে ।
–দোষারোপ করতে আসিনি । আপনার জোর গলায় বলা সত্ত্বেও আমার সন্দেহ থেকে যাচ্ছে যে আমার আর দাদার বিরুদ্ধে মামলায় আপনার হাত আছে ।
–কী করে এসব কথা বলতে পারছ ? রামায়ণ নট্ট কোম্পানি থেকে তোমার অপেরার বই প্রকাশ করেছি ।
–আপনি করেছেন ?
–আমার অনুমোদন আর নির্দেশেই প্রকাশিত হয়েছে ।
–খরচ তো আমাকে করতে হয়েছে । আপনার নট্ট কোম্পানির ছোকরারা এখানের প্রেসগুলোতে গিয়ে হুমকি দিয়ে বইটা ছাপতে দেয়নি। বসন্তবাবুও সাহায্য করেননি ছাপার ব্যাপারে । আমি বইটা বহরমপুর থেকে ছাপিয়ে এনেছি ।
–তোমার বই, তোমাকেই তো আগ্রহ দেখাতে হবে । কে-ই বা চেনে তোমাকে যে এগিয়ে এসে তোমার বই নিজের
আগ্রহে প্রকাশ করবে ?
–সে যাক, আমি এসেছি জানতে যে আপনি আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে রাজি কিনা । মায়াময় দত্ত আপনাকে অনুরোধ করে থাকবেন, উনি আর বরুণ সান্যাল স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছেন, যুধাজিৎ দত্তও দিচ্ছেন ।
–কে যুধাজিৎ ?
–তিরিশের একজন কবির ছেলে, লুম্বিনি পার্কে সাইকোলজিস্ট । মনোবৈজ্ঞানিক হিসাবে বিশেষজ্ঞের মতামত দেবেন ।
–আমি দেবো না বলিনি তো । আমাকে ভেবে দেখতে হবে । তোমার সম্পর্কে আমার যতই স্নেহ থাক, তুমি আমাকে না জানিয়ে হঠাৎ করে আন্দোলন আরম্ভ করতে গেলে কেন, তার কোনো কুলকিনারা পাইনি এখনও । রামায়ণ নট্ট কোম্পানি তো ছিলই । তোমার অপেরাগ্রন্হও আমার কোম্পানি থেকে বেরোচ্ছিল, আমার সুভেনিরে তোমার বইয়ের বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলুম । আমার চিন্তা করার সময় দরকার ।
–জানি । প্রদীপন চাটুজ্জে আপনার চিঠিটা, যেটা আমার বিরুদ্ধে লিখেছিলেন বিদেশ থেকে, সেটার একটা অংশ পড়ে শুনিয়েছিলেন । আপনি বিদেশে যাবার আগেই প্রদীপন আমায় বলেছিলেন যে আপনি ওনার ধোপা-নাপিত বন্ধ করে দিয়েছেন । চঞ্চল বসুরও ধোপা-নাপিত বন্ধ করে দিয়ে থাকবেন, যে-জন্য উনি ইংল্যন্ডে বসবাস করতে চলে যাচ্ছেন । চঞ্চল বসু আর রক্তিমকেও অমন চিঠি লিখেছিলেন । বসন্তবাবু আর হরিপদ রায়কেও লিখে থাকবেন ; কখনও হয়তো জানা যাবে, ওনাদের কাগজপত্র প্রকাশিত হলে । মূল সুর ছিল যে আপনি আমাদের আন্দোলন ভেঙে দেবেন ।
–বাজে বকছ । আমি ভেঙে দেব বলিনি । বলেছিলুম, ভেঙে দেবার ক্ষমতা রাখি ।
–আপনি প্রদীপন চাটুজ্জেকে লিখেছিলেন, মনে করে দেখুন, যে আমরা আন্দোলন করছি রামায়ণ নট্ট কোম্পানি অর্থাৎ অসীমের প্রতিপক্ষ হিসেবে । লিখেছিলেন যে আপনি প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশ্যে আমাদের আন্দোলনের বিরোধিতা করেননি ; এর অর্থ কী ? গোপনে আপনি অনেক কিছু করতে পারেন, আপনার চেনাজানা প্রচুর, অতুল্য ঘোষের মাধ্যমে আপনি প্রফুল্ল সেনের কাছে আপনার ভাবনা সহজেই পৌঁছে দিতে পারেন । আমি বা অনিকেত পরি না । আমাদের মামলা চলছে, আর কলকাতায় আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, আমরা চাকরি থেকে সাসপেণ্ডেড । দেখছেন তো, আপনি কতোবার আমাদের বাড়িতে, দাদার বাড়িতে গিয়ে থেকেছেন, কিন্তু দাদা আপনার কাছে এখনও একবারও আসেননি ।
–তোমাদের আন্দোলন আমি একেবারে পছন্দ করি না । বিদেশ থেকে ফিরে এসে শুনলুম তোমার আন্দোলনের কে একজন অমলেন্দু আতর্থী, শান্তিনিকেতনের পাঠভবনের ছাত্র, রাসটিকেট হয়েছে । সে একটি ছাত্রী সম্পর্কে তার পত্রিকায় অকথা-কুকথা লিখেছিল ।
–হরিচরণ খাঁড়াকে অমলেন্দু আতর্থী জানিয়েছে যে আমাদের আন্দোলনে যোগ দেবার অপরাধে তাকে পাঠভবন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে ।
–তবে ? ভেবে দ্যাখো ! পাঠভবনের মতন শিক্ষণসংস্হাও তোমাদের অপাংক্তেয় মনে করছে । সুতরাং আমার পক্ষে অপছন্দ করার যথেষ্ট কারণ আছে । আমার সোজা কথা, তোমাদের আন্দোলনকে পছন্দ করি না ।
–করেন না তার কারণ আপনি একে মনে করেছেন এই আন্দোলন রামায়ণ নট্ট কোম্পানি-বিরোধী বা অসীম-বিরোধী । আপনি সবাইকে যে চিঠিগুলো লিখেছেন, সেগুলো তো আমার বিরুদ্ধে । আমি তো আপনার বিরুদ্ধে এক লাইনও কোথাও লিখিনি, কাউকে লিখিনি , মানে, এখনও লিখিনি ।
–বিষ্ণু দে সম্পর্কে আমার বক্তব্য ছাপিয়েছ । ওটা আমার ব্যক্তিগত মতামত ।
প্রতিটি কথার পর একটা করে ঢিল ছুঁড়ছিলেন অসীম গাঙ্গুলি । হাত ব্যথা হয়ে গিয়ে থাকবে বলে থামলেন, আসে-পাশে যত ঢিল ছিল, রাহুল এক পলক চেয়ে দেখল, খরচ করে ফেলেছেন উনি । প্রচুর কৃষ্ণচূড়া ফুল ঝরাতে পেরেছেন ; অদৃশ্য শত্রুদের রক্তাক্ত করতে পেরেছেন ।
–তাতে কী এসে যায় ? বিষ্ণু দেকে বলেছেন অশিক্ষিত ; খোলাখুলি বললেই তো পারতেন । আপনি প্রদীপনকে লিখেছিলেন, “রাহুলকে এত পছন্দ করছেন কেন ; ওর মধ্যে সত্যিকারের কোনো লেখকের ব্যাপার আছে আপনি নিশ্চই মনে-মনে বিশ্বাস করেন না”, এটসেটরা । আপনি তাহলে আমার অপেরাগ্রন্হ রামায়ণ নট্ট কোম্পানি থেকে বের করতে রাজি হলেন কেন, আমাকে লিখতে উৎসাহিত করতেন কেন, প্রথমবার যখন আপনি আমাদের বাড়ি এসেছিলেন তখন কেন বলেছিলেন আপনাকে লেখা পাঠাতে ; আপনি ছাপাবার আর টাকা রোজগারের ব্যবস্হা করে দেবেন ? আসলে আমি আপনার দরবারে যোগ দিতে চাইনি , সেকারণেই আপনার রাগ । যাকগে, তাহলে ধরে নিচ্ছি যে আপনি সাক্ষ্য দেবেন না । যদি সাক্ষ্য দেন তাহলে এ-কথা মনে রাখতে হবে যে আদালতের কাঠগড়াটা সমালোচনার জায়গা নয়,
আমার লেখাটার বিরুদ্ধে যদি কোর্টে মতামত দেন, তাহলে সাক্ষ্য দেবার প্রয়োজন নেই ।
–দেবো না, বলিনি তো । তুমি আমাকে আক্রমণ করছ, সেই সঙ্গে সাক্ষ্যও দিতে বলছ ।
–তার কারণ আপনার সম্পর্কে আমার সেই আগেকার দৃষ্টিভঙ্গী বেশ ঘা খেয়েছে । পছন্দ করেন না বলছেন যখন, তার মানে তো কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করবেন হয়ত । আপনি ফিরে এসে চারিদিক থেকে আমার সঙ্গে শত্রুতা করছেন , অন্য সবাইকে আমার বিরুদ্ধতা করতে বলছেন, আমার এরকম একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে আরম্ভ করেছে । আপনি প্যারানয়ায় ভুগছেন ।
–তোমাদের আন্দোলনকে যেমন পছন্দ করি না, তেমন বিষ্ণু দের কবিতা পছন্দ করি না । অনেকের লেখাই আমি পছন্দ করি না, আমার ভালো লাগে না । জেমস জয়েস, এজরা পাউন্ড পড়ে আমার ভালো লাগেনি, আমার রুচির সঙ্গে
মেলে না । যাদের ভালো লাগে তাদের আমি তাদের পছন্দ করি । তুমি যদি একে সাবজেকটিভ বলে উড়িয়ে দিতে চাও, সেটা তোমার সমস্যা । যাদের পছন্দ করি তাদের বাজে বইকেও ভালো বলি, আনন্দবাজারে-দেশে দেখে থাকবে ।
–আমাদের আন্দোলনকে অপছন্দের কারণটা কী ?
–কারণটা তুমি জানো । অনিকেতকেও বলেছি । প্রদীপনকে, রক্তিমকে, চঞ্চলকে, বসন্তবাবুকে আমি সেসব কথা বিদেশ থেকে লিখেছিলুম, ওরা তোমায় বলেছে হয়ত । আমার বক্তব্য সোজামাটা, যে-যে বন্ধু হতে চাও, কাছে এসো, সঙ্গে থাকো, আমিও সঙ্গে থাকব, সাহায্য করব ; যে-যে বন্ধু হতে চাও না, কাছে আসতে চাও না, আলাদা হয়ে যেতে চাও,দূর হয়ে যাও চোখের সামনে থেকে ।
–তার মানে সাক্ষ্য দিচ্ছেন না
–দেবো না বলিনি তো । অনিকেতকে বোলো দেখা করতে ।
–আপনি বিদেশে গিয়ে ভারত-ফেরত একজন বিটনিক কবিকে বলে এসেছেন যে আমি নাকি রক্তিমকে দিয়ে ওনার কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করতে প্ররোচনা দিয়ে রক্তিমের বহুমূল্য সময় নষ্ট করে চলেছি । ইংরেজিতে রক্তিম চট্টোপাধ্যায়ের যতগুলো অনুবাদ এখন পর্যন্ত বুলেটিনে প্রকাশিত হয়েছে, সবই আমি করেছিলুম ।
–ও, জানতুম না । কই, রক্তিম বলেনি তো ।
রাহুল সিংহ আর অসীম গাঙ্গুলি দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ সংলাপহীন ।
–চলো, খেয়ে যেও । রাহুলের দিকে মুখ করে বললেন অসীম ।
রাহুল বলল, তোলা থাক । একটা ফাঁকা বাস যাচ্ছিল, যেখানেই যাক, আস্তানা তো নেই কোথাও, হাত দেখিয়ে উঠে পড়ল ।
একেবারে ফাঁকা প্রাইভেট বাস ; কেবলমাত্র একজন মহিলা বসেছিলেন লেডিজ সিটে, যাঁকে দেখে, রাহুল প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, আরে, সুমিতাদি, তুমি, এখানে, কলকাতায় !
মহিলা বললেন, তোর খোঁজেই তো সেই সকাল থেকে বেরিয়েছি ; শুনলাম রাহুকেতু নামে কি একটা বই ছাপিয়েছিস, আর তাতে পাঠকদের কাছে আসল কথাটাই চেপে গেছিস ।
–কী কথা ?
–যে তুই-ই ছিলিস আমার একমাত্র তুই…