রাহুকেতু – একটি উপন্যাস – মলয় রায়চৌধুরী
কলকাতার উত্তর-শহরতলিতে, রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারী অসীম গাঙ্গুলি মশায়ের ওঝাপুর বাড়ির নড়বড়ে কাঠের গেটের ভেতরে ঢুকে, সে-ই শেষবার, রাহুলের, তখন কত বয়স হবে, মমমমমমমমম, থাকগে, যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, মনে পড়ে গেল, কানপুরের অশোক নগর থানায় হাজতবাসের কথা । উত্তরবঙ্গের কোনো জোতদারের বাগানমহল ভেঙে তৈরি হয়েছিল অসীমবাবুর ওঝাপুরের সেই ভাড়া-করা ছয়-ফ্ল্যাটের কোঠাবাড়ি ।
হাজতের অন্ধকারে, রাতের মশাগুঞ্জনের বহুভাষি ঝাঁকের খেয়ালি ঘুর্ণির ভেতর দিয়ে মেঝেয় ছিটকে পড়ল, রাহুলের হাঁটুতে ধাক্কা খেয়ে, একজন মানুষ, যে, গন্ধ থেকে যেটুকু আঁচ করা গেল, কানপুরি-ঠররার নেশায় বস্তাপ্রতিম কেউ হাড়গিলে । ঘরের মধ্যে আগে থাকতে কতজন যে রয়েছে তা জানতে পারছে না রাহুল ; কেবল বুঝতে পারছে যে বেশ কয়েকজন মানুষ, যারা পুলিশ আইনপ্রণেতা আর যে বা যারা তাদের আইনের প্যাঁচে পাকিয়ে হাজতে ঢুকিয়ে দিয়েছে, তাদের সবাইকে হিন্দির বহুপ্রচলিত খিস্তিগুলো বিড়বিড়িয়ে চলেছে, একনাগাড়ে, সেই যখন থেকে রাহুলকে পোরা হয়েছে এই অচেনা দুর্গন্ধের ছোট্টো স্যাঁতসেতে লক-আপে ।
রাহুলকে, ওর বয়স তখন কত হবে, মমমমমমম, থাকগে, যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, অমনভাবে ছুঁড়ে ফেলা হয়নি ; পিঠে ঠেলা মেরে ঢোকানো হয়েছিল অন্ধকারে, আহ্লাদী মশাদের ঘুর্নিগুঞ্জনে, হাত থেকে হাতকড়া আর কোমরের দড়ি খুলে । কানপুর শহরের জুহি পরমপুরওয়া বস্তি, যেখানের নিচুজাতের কালচে-তাগড়াই হিন্দু কাঙালি আর হতদরিদ্র ডিগডিগে শিয়া মুসলমানদের অবাঙালি পাড়ায় ওর শৈশব কেটেছে, সেখানকার প্রতিদিনের কথোপকথনে ব্যবহৃত এই সমস্ত খিস্তির সঙ্গে রাহুল অতিপরিচিত , তাই ওর মধ্যবিত্ত সংবেদন, এখন অশোক নগরে চলে গেলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর হলেও, নাড়া খেল না।
পাশের জনানা হাজত থেকে নারীকন্ঠে শোনা গেল, “দারোগাজি, অব তো বত্তি জলাইয়ে, অন্ধেরে মেঁ মরদ ইয়া মেহরারু কওন ঘুসে যা রহা হ্যায় পতা নহিঁ ।”
কিছুক্ষণ পর, দুর্গন্ধকে আরও অসহ্য করে, আলো জ্বলল ।
টিমটিমে পঁচিশ ওয়াটের হলুদ-টুনির বিজলিবাতিতে চোখ সয়ে গেলে , ইংরেজ আমলের হলদেটে ঘরের, খুপরি-জানলার মরচেপড়া শিক ধরে, রাহুল দাঁড়িয়ে ছিল, দশ বাই দশ হবে চুনকামহীন ছ্যাদলাপড়া ঘরটা, ঔপনিবেশিক লোহার জংধরা বরগা, দেখল, হেটো-ধুতি আর ময়লা গেঞ্জি-পরা দুজন তামাটে মজবুত প্রৌঢ় উবু হয়ে বসে দেয়ালে ঠেসান-দেয়া একজন পাজামা-কুর্তায় চওড়াকাঁধ তাগড়া যুবকের পা টিপছে, দু’জন খালিগা চাক-কাটা লুঙ্গিতে রোগাটে প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে ফিসফিসোচ্ছে, কোনের দিকে একটা কোঁচাকাছা-ধুতি-হাফশার্ট যুবক বসে আছে বেঢপ ঢঙে, কেননা তার হাত থেকে হাতকড়া খুলে দেয়া হয়নি , রোগা শিড়িঙ্গে মাতালটা মেঝেয় আর ও, সব মিলিয়ে আটজন।
এক কোনে, যেখানে ঝাঁঝালো চটচটে-হলদে পেচ্ছাপ জমে আছে, সেখানে, যেহেতু লক-আপে পেচ্ছাপ করার কোনো ব্যবস্হা নেই, যার পা টেপা হচ্ছিল, তার নির্দেশে, মাতালটাকে টেনে বাঁধের কাজে লাগানো হল, যাতে পেচ্ছাপের স্রোত ঘরের ভেতর এসে অন্যান্যদের না ভেজায় ।
“ই বেওড়াকো ঠিক সময় পর ভেজিস ভগওয়ান”, বলল দাঁড়িয়ে থাকা ঢ্যাঙা কালো লোকটা ।
লোকগুলোর কথাবার্তা থেকে, পরের দিন ফৌজদারি আদালত-চত্তরের কাঁকরে বসে জিরোবার সময়, রাহুল জানতে পারবে, কাকে কোন আরোপে পোরা হয়েছে গারদে । যে পা টেপাচ্ছিল সে আর তার দুজন স্যাঙাত কাল বিকেল থেকে রয়েছে, ডাকাতি করতে গিয়ে পাবলিকের হাতে ধরা পড়ে পিটুনি খেয়েচে ; পুলিশ ওদের নেতার ঠ্যাঙে বাড়ি মেরে-মেরেও, ডাকাতির মালপত্তর কোথায় লুকিয়ে রাখে, তা তখনও পর্যন্ত জানতে পারেনি বলে, কোর্টে তোলেনি ; ওরা মুখ খোলেনি, যাতে সময় থাকতে বাদবাকি স্যাঙাতেরা সেগুলো অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলতে পারে । দাঁড়িয়ে যারা ফিসফিস করছিল, যে দু’জন, তাদের একজন বলল তাকে চুরি করার আরোপে বাড়ি থেকে তুলে আনা হয়েছে, যদিও সে বহুদিন চুরি করতে বেরোয়নি, অন্য ছোঁড়াটা আরেকজন চোর, যেদিন চুরি করে তার পরের দিন উনোনে আগুন জ্বলে, চুরি না করে উপায় নেই ; জামিন পায় ভালো, আবার চুরি করতে যাবে, না পেলে ওর বউ গঙ্গার ধারে অন্ধকারে খদ্দের ফাঁসিয়ে, একটাকা-দুটাকা যা পায়, দু’চার খেপ সাঁঝনি করে আসবে । যার হাতকড়া রাতের বেলাও খোলা হয়নি, সে, হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া বালিশ-পেট সেপাইয়ের তথ্য অনুযায়ী, তার কাকাকে খুন করার পর পরিবারের
লোকেদের জাপট ছাড়াতে পারেনি । অন্যজন পকেটমার, সাপ্তাহিক কোটায় তাকে তুলে আনা হয়েছে । চশমা-চোখ
রাহুলের পোশাক আর গাম্ভীর্যের কারণে ওরা কেউ ওর কাছে ঘেঁষেনি । খৈনি ঠুকে সঙ্গের সেপাই অন্যদের জানিয়েছে যে সে, রাহুল, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো খতরনাক কেতাব লিখেছে ।
টিমটিমে ঝিমন্ত আলো আরেকবার নিভে গেলে, বা নিভিয়ে দেয়া হলে, খিস্তির ঝাড় পুলিশের তরফ থেকে এলো, হুমকিসহ, কথা বলা বন্ধ না করলে পিটিয়ে বেহোশ করে দেয়া হতে পারে । তবু, তাগড়া ডাকাতটা মা-বোনের গালমন্দে ফিসফিসিয়ে জানালো যে পাশের জনানা লকআপে বেশ্যাদের রাতের বেলায় ধরে এনে সিপাহিগুলো ধর্ষণ করছে, পারাপারি করে, কতবার আলো নিভলো তা গুনে বলা যায় যে কটা সিপাহি কবার কিরিয়াকরম করে বেরোল যা থেকে আন্দাজ করা যায় যে থানায় কতজন সেপাই আছে ।
রাহুল, ক্লান্ত, চুপচাপ, পানের পিক শুকনো গয়ের বমি-মাখা দেয়ালে ঠেসান দিয়ে, জানলার তলায়, এককোনে বসে পড়েছিল, অন্ধকারে মশাদের সঙ্গে ছারপোকারাও নতুন কুটুম পেয়ে তাদের উপস্হিতির মুফত-চুলকানি জানাতে শুরু করেছে, টের পেল । মাতালকে টেনে বাঁধের কাজে লাগালেও পেচ্ছাপের কিলবিলে স্রোত উঁকি মারতে-মারতে ওর দিকেও পৌঁছে গেছে । লকআপে ঢুকলে মানুষের বেশি পেচ্ছাপ পায় ।
দুপুরে, অফিস-প্রধানের তিন তলার সিনথেটিক কার্পেটপাতা ঘরে ডেকে-পাঠিয়ে রাহুলকে বলা হয়েছিল, এই দুজন কলকাতা থেকে এসেছেন, আপনার সঙ্গে কোনো ব্যাপারে কথা বলতে চান ; নিচে যান, যা আলোচনা করার অফিসের বাইরে গিয়ে করুন। অফিস-প্রধানের নির্দেশে অবাক রাহুল দুই আগন্তুকের সঙ্গে পথে গিয়ে নামার পর তারা দুদিক থেকে ওর জামা খামচে ধরে বলে ওঠে, পালাবার চেষ্টা করবেন না, আমরা বলপ্রয়োগ করতে বাধ্য হবো, আপনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে, আমরা লালবাজার পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ থেকে এসেছি ।
রাহুল বিমূঢ় হতবাক থ । বলল, ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না, অপরাধটা কী ? অনুমান করল যে এরা অফিস-প্রধানকে বিস্তারিত জানিয়ে থাকবে, তাই, রাহুল যাতে অফিস কর্মীদের সামনে অপদস্হ না হয়, আর ওর গ্রেপ্তারিতে অফিস যাতে জড়িয়ে না পড়ে, সেকারণে উনি অফিসের বাইরে গিয়ে কথাবার্তা চালাতে বললেন ।
–আপনার বাড়ি নিয়ে চলুন, সেখানেই জানতে পারবেন ।
একটা রিকশ ডেকে ওকে মাঝখানে বসিয়ে দুজনে দুদিক থেকে রাহুলের বাহু আঁকড়ে ধরে রইল । রিকশঅলা বলল, হুজুর তিনজন বসলে পুলিশ ধরবে আমায়, এখনও তেমন রোজগার হয়নি যে ছাড়াবার হাতখরচ দেবো । মোটা গোছের লোকটা রিকশঅলার মাথায় কশে চাঁটি মেরে বলল, আমরাই পুলিশ, তোকে বলা হচ্ছে, তুই চল, অশোক নগর । তাই না, মিস্টার রাহুল সিংহ ?
এরা ওর বাড়ির হদিশও জানে দেখছি, নিজেকে নিঃশব্দে বলল রাহুল ।
বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখল একটা পুলিশ জিপ দাঁড়িয়ে, স্হানীয় পুলিশের লাঠি আর বন্দুকধারীরা আগে থাকতেই ঘিরে রেখেছে পুরো বাড়ি । হ্যাঁ, পুরো বাড়ি, চারিদিক থেকে । এক সঙ্গে এত পুলিশকর্মীকে এ-পাড়ায় আগে দেখা যায়নি বলে অনুসন্ধিৎসু জনতার গুজগুজানি ভিড় । স্হানীয় পুলিশের টাকমাথা ইন্সপেক্টর আর কলকাতার দুই পুলিশ অফিসার রাহুলকে নিয়ে ঢুকল বাড়ির ভেতরে ।
রাহুলের বাবা দরোজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, বললেন, তোর কিছু লেখালিখির জন্যে এরা কলকাতা থেকে তোকে গ্রেপ্তার করতে এসেছে , আমি দিনুকে খবর পাঠিয়েছি, বসন্তবাবুকে জানাতে । তোর দুজন বন্ধু পরশু দিন অ্যারেস্ট হয়েছে, তাদের কাছ থেকে তোর অফিসের আর বাড়ির ঠিকানা যোগাড় করে এসেছে কলকাতার পুলিশ । দিনু বা দীননাথ রাহুলের জাঠতুতো দিদির স্বামী । বসন্তবাবু বা বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় দিনুর আত্মীয়, শহরের সবচেয়ে নামজাদা আর দামি অ্যাডভোকেট ।
ভাড়ার জন্য রিকশঅলাটা ঘ্যানর-ঘ্যানর করছিল দেখে রাহুলের বাবা ভাড়াটা মিটিয়ে দিলেন ।
রাহুলের বাবার কাচের আলমারিতে পেপারওয়েট মেরে কলকাতার রোগাটে পুলিশ অফিসার বলল, আমাদের কাছে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে, খানাতল্লাসি করা হবে । আলমারিগুলো খুলে দিন ।
–আমার আলমারির কাচ ভাঙছেন কেন, আশ্চর্য ? ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ তো ওর পড়ার ঘরে গিয়ে তল্লাসি চালান । বললেন, রাহুলের বাবা, বেশ উত্তেজিত, কাঁপছিলেন । প্রত্যুত্তরে সে বলল, পুরো বাড়ি তল্লাসি করা হবে, ষড়যন্ত্রের অভিযোগও আছে, একশো কুড়ি বি, জানেন তো, একশো কুড়ি বি আই পি সি ? রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ? ইতিহাস পড়া আছে নিশ্চয়ই ? রাজনারায়ণ বসু, অরবিন্দ ঘোষ, বলবন্ত ফাড়কে, দামোদর চাপেকর, ওনাদের ধরার
জন্য এই আইন পাশ হয়েছিল । আপনার তো গর্ব হওয়া উচিত । আপনার ছেলেকেও ধরা হচ্ছে সেই অভিযোগে । আমি কলকাতা পুলিশের এস আই মুখার্জি আর উনি এস আই বারোড়ি ; লোকাল থানার এই অফিসারকে চিনে রাখুন,
মাঝে-মাঝে রোঁদে বেরিয়ে আপনার বাড়িতে ঢুঁ মারতে পারেন, ইনি ইন্সপেক্টর আবদুল হালিম খান ।
ঘোড়েল সাবইন্সপেক্টর, পুলিশ ট্রেনিঙে শেখা বুলি আউড়ে গেল ।
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে তিন অফিসার বিভিন্ন ঘরে চলে গেল । রাহুল শুনতে পেল ওর মায়ের প্রায়-কেঁদেফেলা কন্ঠস্বর, আপনারা যে কাজ করতে এসেছেন তা করুন, আমার বিয়ের তোরঙ্গ ভাঙছেন কেন ? বললে তো আমিই খুলে দিতুম । তোরঙ্গ হাঁটকাচ্ছেন কেন ? ওটা আমার বিয়ের বেনারসি, ছিঁড়ে যাবে, ছিঁড়ে যাবে, অনেক পুরোনো, ওভাবে হাতড়াবেন না, ওটা আমার শ্বশুরমশায়ের বিদেশে-পাওয়া ফোটোগ্রাফির পদক ।
তার মানে এদের উদ্দেশ্য কেবল ওকে গ্রেপ্তার আর ওর লেখা সংক্রান্ত নয়, স্পষ্ট হল রাহুলের কাছে । ওর বাবা-মাকে, অপমান করার মাধ্যমে, আঘাত দিয়ে, ওকে ঘিরে ফেলার, অবদমনের, দুমড়ে-ফেলার প্রয়াস । কোন লেখা, কোন বই, কিছুই ওকে বলা হল না, অথচ ব্রিটিশ আমলের লাল-পাগড়ির ঢঙে ভাঙচুর লণ্ডভণ্ড করতে নেমেছে । কী ধরণের ষড়যন্ত্র, কাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র, আঁচ করতে পারছিল না । মুখার্জি নামের সাব ইন্সপেক্টার ওর পড়ার ঘরে ঢুকে আলমারি থেকে বইপত্র ছুঁড়ে-ছুঁড়ে মেঝেয় ফেলতে থাকলে রাহল বলল, ‘’এগজ্যাক্টলি কি খুঁজছেন জানালে ভালো হয়, আপনি রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শেকসপিয়ার সবাইকেই হেনস্হা করছেন ওভাবে মাটিতে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ।’’
–হ্যা হ্যা, ওনাদের হাড়-পাঁজর ভেঙে গেল বোধহয়, হ্যা হ্যা । বলল সাব ইন্সপেক্টর ।
লোকটা বদল্যার, র্যাঁবো, টলস্টয়, কাফকা, ডস্টয়েভস্কিতে হাত দিল না, এমনকি ফ্যানি হিল, হ্যাভলক এলিস আর হেনরি মিলারেও, সম্ভবত সেগুলো পেপারব্যাক বলে ,বা নাম শোনেনি বলে ।
–আপনার কাছ থেকে আমরা জ্ঞান নিতে আসিনি, কোন বই কার লেখা তা জানা আছে । আপনার লেখার খাতা, ডায়রি, বন্ধুদের চিঠিপত্র, কোথায় রেখেছেন, সব বের করুন । রাহুল ওর পড়ার টেবিলের পাশের আলমারি খুলে দিয়ে জানাল, এখানেই সবকিছু পাবেন ।
খান সাহেব, একঠো কনোসটেবোলকো ওপর মেঁ বোলাইয়ে, বলল মুখার্জি । জনৈক কন্সটেবল এলে তার হাতে তুলে দিতে থাকল, সম্ভবত যা যা চাই ।
রাহুলের বাবা-মা’র ঘর লণ্ডভণ্ড করার পর সাব ইন্সপেক্টর বারোড়ি রাহুলের পড়ার ঘরে ঢুকে বলে উঠল, এই টাইপরাইটারটা তো টানা মাল মনে হচ্ছে, এটাও নিয়ে নে, কন্সপিরেসির চিঠিচাপাটি এতেই লেখা হয় নিশ্চই । রাহুল বলল না যে টাইপরাইটারটা একজন বিদেশি পত্রিকা-সম্পাদকের পাঠানো ।
টাইপরাইটারসহ রাহুলের টেবিলে রাখা পাণ্ডুলিপি, দুটো ডায়েরি, ওর আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত লিফলেটগুলো, অসীম গাঙ্গুলি, প্রদীপন চাটুজ্জে, রক্তিম চাটুজ্জে, হরিচরণ খাঁড়া, সুকোমল রুদ্র আর অন্য বন্ধুদের লেখা চিঠিপত্রের দুটো ফাইল, একটা ভারতীয়দের চিঠি আর অন্যটায় বিদেশি লেখকদের, দাদা অনিকেতের সদ্য প্রকাশিত বইয়ের সব কয়টি কপি, বিদেশি সাহিত্য পত্রিকা আর যা যা ওদের মনে হল মামলা সাজাতে কাজে দেবে, বা রাহুলের লেখালিখির প্রবাহকে নষ্ট করতে পারবে, বা ওর মগজকে ফাঁকা করে তুলতে পারবে,সবই জড়ো করে তালিকা তৈরি করতে বসল মুখার্জি । চিঠিপত্রের ফাইলের ভেতরে একটা খামে জনৈকা ফরাসি মহিলার ফোটো আছে যা অসীম গাঙ্গুলি বিদেশ থাকার সময়ে চিঠির সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন । বিদেশিনীর ফোটো দেখে এরা নোংরা রঙ্গ-তামাশা করতে পারে ভেবে রাহুল চেপে গেল।
বার্ধক্যে পৌঁছে রাহুলের আপশোষ হয় যে ফোটোগুলো নিতে বারণ করা উচিত ছিল । করেনি, কেননা এক সপ্তাহ আগে সিংহবাহিনী নামে কেউ একজন আমহার্স্ট স্ট্রিট পোস্ট অফিস থেকে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিল, ‘’বি কেয়ারফুল। রামায়ণ নট্ট কোম্পানি’জ অধিকারী হ্যাজ কাম ব্যাক ।’’ কে যে টেলিগ্রামটা পাঠিয়েছিল, তা বহুকাল জানতে পারেনি রাহুল ; জানতে পারল যখন তখন ওর বয়স , মমমমমমমমমম, থাকগে, যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, আর ওর প্রথম উপন্যাসের প্রুফ দেখতে বসে বলে উঠেছিলেন গেঞ্জি-লুঙ্গিতে মল্লিকমশায়, ‘’আপনাকে তো আমি সতর্কতার টেলিগ্রাম করেছিলাম, যা ষড়যন্ত্রের আবহাওয়া কলকাতায় সেসময়ে তৈরি হয়েছিল, নানা কথা কানে আসছিল।’’
–ওঃ, আপনি করেছিলেন ? সিংহবাহিনী শব্দটার জন্য ঠাহর করতে পারিনি ।
–কেন ? কেতু তো কলেজে পড়ার সময় থেকে প্রতিবছর সিংহবাহিনীর পুজোয় আমার বাড়ি এসেছে ।
–আসলে জানা ছিল না ; তাছাড়া তখন তো আপনার সঙ্গে পরিচয় ছিল না ।
–ওহে, আমাকে এ-পাড়ায় এক ডাকে লোকে চেনে ; এক ডাকে মানে এক ডাকে, বুঝেছ ।
–কেয়ারফুল হয়েই বা কী করতুম বলুন । বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে তো আর যেতে পারতুম না । এক পুলিশ
কনস্টেবল অবশ্য লকআপ থেকেই পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দিয়েছিল । পালাইনি বলে আমায় বলেছিল বেবকুফ ।
–ওতো বিখ্যাত হে । তিনটে শব্দকে আলাদা আলাদা করে যদি পড়তে তাহলে বুঝতে পারতে । রামায়ণ, নট্ট আর কোম্পানি ।
–ভালো আইডিয়া দিলেন । কখনও যদি এই-সমস্ত ঘটনা নিয়ে লিখি তাহলে আপনার এই ফ্রেজটা প্রয়োগ করব।
মল্লিকমশায় মারা গেছেন । আজকে লিখতে বসে ওনার পাঠানো টেলিগ্রামটার কথা মনে পড়ল রাহুলের ।
আবদুল খান আর বারোড়ি তিনতলার ঘরে সংগ্রহযোগ্য এগজিবিট খুঁজতে যাবার নাম করে আরও কিছু জিনিসপত্র ভাঙচুর-লণ্ডভণ্ড করে এলো । ওই ঘরটায় বাবার সংগ্রহের উনিশ শতকের শেষে ঠাকুর্দার তোলা ফোটোর বহু নেগেটিভ প্লেট সযত্নে রাখার ব্যবস্হা। একটা তাকের সব প্লেটগুলো যে ভেঙে ফেলা হল, তা ভাঙা-কাঁচের ছেতরাবার আওয়াজ থেকে আঁচ করল রাহুল, যা, পরে, বাড়ি ফিরে সত্য বলে জানতে পেরেছিল । ওর লেখালিখির সঙ্গে যে এভাবে বহুমূল্য সংগ্রহ নষ্ট হয়ে যেতে পারে সে ধারণা ছিল না , আর, পরে, যখনই ও প্রাচীন ফোটোর কোনো প্রদর্শনীতে গেছে, বা সে-বিষয়ে কোনো বইয়ের পাতা উলটেছে, অপরাধবোধে ভুগেছে । বাবা মারা যাবার পর, তখন রাহুলের বয়স কত,মমমমমমমম,বাহান্ন, হতে পারে, যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, ওর থিতিয়ে-যাওয়া সেই অপরাধবোধ ফিরে এসে কাঁদিয়ে দিয়েছিল ওকে ।
বাবা মারা গিয়েছিলেন কানপুরে, আর রাহুল তখন ভূবনেশ্বরে ট্যুরে । দাদা অনিকেতের টেলিফোন পেয়েও তৎক্ষণাত ও কানপুর যায়নি ; কয়েকদিন পরে গিয়েছিল, স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে মুম্বাই থেকে তুলে নিয়ে ।
রাত নটা নাগাদ বাজেয়াপ্ত বইপত্র জিপগাড়িতে তুলে চলে গেল পুলিশের অফিসাররা । রাস্তা থেকে দু’জন লোককে, তারা কর্পোরেশনের ঝাড়ুদার, ডেকে এনেছিল, বাজেয়াপ্ত জিনিসের তালিকায় সই করার জন্য ।
রাহুলকে হাতে হাতকড়া পরালো একজন কনস্টেবল, কোমরে দড়ি বেঁধে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল । পাড়ার সকলে ওকে ছোটোবেলা থেকে চেনে । সরকারকে উৎখাত করার কী এমন বই লিখেছে, বই লিখলে সরকার উৎখাত হয় কিনা, একাধজন কাছে এসে জানতে চাইলেও, জবাব দেবার মতন মনস্হিতি ছিল না রাহুলের । নটা বেজে যাবার দরুণ দোকানপাট বন্ধ হয়ে রাস্তাঘাট প্রায় অন্ধকার ; তার মাঝখান দিয়ে বকলস-পরা কুকুরের মতন চলল ও, রশির এক প্রান্ত জনৈক ক্লান্ত-বিরক্ত কনস্টেবলের হাতে ।
একটা সাদা-কালো নেড়িকুকুর, পুলিশ দেখে, কিংবা ওকে ওভাবে দেখে, চেঁচিয়ে অন্য কুকুরদেরও খবর পাঠালো। ওভাবে একজন দর্শনীয় অপরাধী-মানুষ হিসাবে, হাঁটতে-হাঁটতে, দড়ির টানে হাঁটতে-হাঁটতে, রাহুল ক্রমশ টের পাচ্ছিল, যে, সমাজের ভেতরে থেকেও, কী ভাবে সে আলাদা হয়ে চলেছে, হেঁটে-হেঁটে বিচ্ছিন্ন হয়ে চলেছে, স্বয়ংসম্পূর্ণ একক হয়ে চলেছে, সবায়ের থেকে ক্রমশ পৃথক হয়ে চলেছে । ফুলশার্ট ট্রাউজার চশমা পরা একজন যুবককে, হাতকড়া পরিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাবার ঘটনা, এই রাস্তায়, আগে কখনও ঘটেনি মনে হয় ; রাস্তার দু’পাশের জনতা, যারা নিজেদের দোকানপাতি গোটাতে ব্যস্ত, ওর দিকে তাকিয়ে ।
আলাদা হবার অভিজ্ঞতায় যে লুকোনো হর্ষ, গোপন আহ্লাদ, চাপা গর্ববোধ, আর অতিক্রমণের নিরাময় থাকতে পারে, তা ওর ভাবনায় স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, কোমরে দড়ি আর হাতে হাতকড়া পরা অবস্হায় । অথচ আলাদা তো হতে চায়নি ও, রাহুল ।
জীবনে এই অভিজ্ঞতা অত্যন্ত জরুরি ছিল । এই ঘটনার পর আর কোনো আক্রমণ, সমালোচনা, টিটকিরি, খোঁচা দিয়ে বলা কথা ওর অপ্রিয় লাগেনি, লাগে না, অপমানজনক মনে হয়নি, হয় না । অপ্রিয়, এই শব্দটাই অকর্মণ্য হয়ে গেছে রাহুলের ক্ষেত্রে, এক্কেবারে ফালতু ।
হাজত থেকে কানপুরের ফৌজদারি আদালতে যাবার দিন ভোরবেলা, থানায় এসেছিলেন সুমিতাদি, সুমিতা চক্রবর্তী, গায়ে কাশ্মিরি শাল চাপা দিয়ে, বেশ উদ্বিগ্ন, বলেছিলেন, আজকের ডেইলি পায়োনিয়ারের প্রথম পাতায় তোর গ্রেপ্তারির সংবাদ পড়ে নিজেকে সামলাতে পারলাম না, নাউ ইউ হ্যাভ ডান ইট, রাহুল, ইউ হ্যাভ ডান ইট,বৈঠকখানা থেকে পথে নামার ছাড়পত্র পেয়ে গেলি, কনগ্র্যাচুলেশান্স । অন্য কয়েদিদের অবাক করে, গরাদের ভেতর হাত বাড়িয়ে রাহুলের চুলে বিলি কেটে দিয়ে, বেবি অস্টিন চালিয়ে চলে গিয়েছিলেন ।
ওঝাপুরের পথে, রাহুলের বয়স তখন কত, বোধহয় সত্তর, মমমমমমমম, থাকগে, সে যা-ই হোক, কী-ই
বা এসে যায়, ফ্ল্যাট অনুসন্ধানকালে, একজন বিদেশিনীকে দেখে, পুলিশের বাজেয়াপ্ত-করা ফোটোগুলোর স্মৃতি উসকে ওঠায়, কয়েক দশক আগের ওই ঘটনাগুলো আচমকা মনে পড়ে গেল ।
‘আরে, আমি তো এ- জায়গায় এসেছি আগে, অনেক বছর আগে, বেশ কয়েকবার এসেছিলুম’, রাহুল সিংহ, যার গায়ের চামড়া হয়ে গেছে মরচেপড়া লোহা, বলল তিরিশোর্ধ ছেলে পার্থপ্রতিমকে । রাহুল আর ওর স্ত্রী সুমনা
দুজনেই সত্তর পেরিয়েছে, তাই পার্থপ্রতিম , নিজের বাসার কাছাকাছি সাংসারিক আসবাব সমেত একটা ফ্ল্যাট দেখাতে নিয়ে এসেছিল । যে ফ্ল্যাটের ভাড়া সে-সময়ে ছিল একশ টাকা, তা এখন কুড়ি হাজার ; যে ফ্ল্যাটের দাম ছিল এক লাখ টাকা, তা এখন এক কোটি । যে পথে ছিল সবুজ গাছগাছালি, সে পথ নিজেই নিজেকে খুঁজতে বেরিয়ে
চুন-বালি-ইঁট-সিমেন্টে-দেয়াল শ্লোগানে নিরুদ্দেশ । ধানখেত ছিল, ছিল ধানখেতের সবুজ বাতাস, ছিল চাষি ; ছিল পুকুর, পুকুরে হাঁস, হাঁসের ডাক, মাছের আচমকা ঘাই ; সেসব কোথ্থাও নেই ।
একই বাড়িতে একই পাড়ায় একই শহরে বেশিদিন থাকতে পারে না রাহুল , পারেনি, ফলে, এতদিন ছিল পশ্চিমবাংলার বাইরে একের পর এক প্রবাসে । ওর মনে হয়, একই মানুষের দ্বারা পরিবৃত থাকবার ফলে জীবন ও জীবনবীক্ষা মামুলি ও ক্ষুদ্র হয়ে পড়ে । নতুন কিছু ঘটার সম্ভাবনা সীমিত হয়ে যায় । যদিও রাহুল রেকলুজ প্রকৃতির, একা থাকতে পছন্দ করে, কম কথা বলে, কিন্তু ওর চারিদিকের মানুষদের কথাবার্তা ও জীবনযাত্রায় আগ্রহের কারণে, একই বাড়ি-পাড়া-শহরের ঘানিতে পাক খেয়ে, একই মানুষের মুখ অবিরাম দেখে-দেখে ও তাদের কথাবার্তা শুনে, কিছুদিনের মধ্যেই দমবন্ধ, ক্লান্ত ও হতাশ বোধ করে । হ্যাঁ, ঠিকই, অন্যের জীবনের রুটিনবদ্ধ-ঘটনাহীনতা, ওর জীবনকেও ঘটনাহীন করে তুলতে পারে এমন আশঙ্কায় পীড়িত হয় । যে-শহরেই থেকেছে, একা-একা রাস্তায়-রাস্তায় হেঁটেছে, চাকরি করার সময়ে ছুটির দিনে, অবসর নিয়ে প্রতিদিন ।
প্রতিটি ঘরের নিজস্ব উদাসীনতার যন্ত্রণাক্লিষ্ট বা আনন্দঘন সুবাস হয়, প্রতিটি বাড়ির নিজস্ব নয়নসুখ আলোবিচ্ছুরণ আর ঘনান্ধকারের রহস্য , প্রতিটি পাড়ার নিজস্ব বুলির গুঞ্জনমালা বাতাসকে ভারাক্রান্ত বা হালকা স্পর্শে ভাসায়, প্রতিটি শহরের নিজস্ব কথাপ্রণালীর কাহিনিময় শব্দতরঙ্গ চতুর্দিক মথিত করে । সে-কারণে চিরকাল নতুন সুবাস, আলো, গুঞ্জন ও শব্দতরঙ্গের অনুসন্ধানে ক্ষণিক-তীর্থের উদ্দেশ্য-সন্ধানী যাযাবরের মতন একা চরে বেড়াবার প্রয়াস করে গেছে রাহুল । তা করতে গিয়ে, ওর দেহের এমনই ক্ষতি হয়েছে যে সত্তরে পৌঁছে, এক-একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের হাতে এক-একটা অঙ্গ আর প্রত্যঙ্গ সোপর্দ করে দিতে হয়েছে ।
জীবনের বাঁকবদলগুলো অন্যের হাতে ছেড়ে দেয়নি। ওকে নিয়ে, সময়ের রঙের সঙ্গে তাল দিয়ে, এক জিভ থেকে আরেক জিভে, তা থেকে আরও-আরও জিভে, বহু গল্পের লাফালাফি হয়েছে, হয়ে চলেছে আজও, জানে ও । গল্প যারা তৈরি করেছিল, তারা প্রায় কেউই আর নেই ; নানা রকম রোগ তাদের দখল করে শ্মশানে বা কবরে তুলে নিয়ে গেছে । ও-ভাবে উঠে যাওয়ায়, অনেকের ক্ষেত্রে, রাহুলের মনে হয়েছে, গুড রিডেন্স অব ব্যাড রাবিশ, যা ও বলেওছে কাউকে-কাউকে, যারা কখনও-সখনও রাবিশের স্তুপ থেকে মুণ্ডু বের করে ওর দিকে পিটপিটিয়ে তাকিয়ে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছে ।
গোরখপুরে ট্যুরে গিয়ে, সেখানের কৃষি আধিকারিক হরিশচন্দ্র শর্মা, ওকে নিয়ে গিয়েছিল গোরখনাথ মন্দিরে, রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমম, বোধহয় চুয়াল্লিশ, থাকগে, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, এক সাধু হঠাৎ দৌড়ে এসে জটাপড়া দাড়ি ওর মুখে ঘষে দুর্গন্ধিত হাঁ-মুখ খুলে নোংরা দাঁতের হাসি ছড়িয়ে বলেছিল, ‘’দীকছা অওর আশির্বাদ দে রহা হুঁ তুমহে, জয় ভোলেনাথ, কোই ভি আদমি, যো তুমহারে সাথ দুশমনি করেগা, ও্য়হ তুমসে পহলে মর যায়গা ।’’ তখন রাহুলের ফালতু, বিরক্তিকর, লেগেছিল নোংরা-গেরুয়াল্যাঙোট সাধুর ছাইমাখানো বুকনিটা, কেননা ওর পৈতের সময় পুরুতমশায় তেরো বছর বয়সেই ওকে দীক্ষা দিয়েছিলেন, কানে-কানে গায়ত্রীমন্ত্র, যা এখন মোবাইলের কলার টিউন বা অ্যালার্মে বাজে । অনেক সময়ে নামজানা কেউ মারা গেলেই রাহুলের ঘুমন্ত আতঙ্ক চাগিয়ে ওঠে, আর মনে হয়, আরে, কি ভয়াবহ, এ লোকটা তো সত্যিই শঠতা করেছিল, পেছনে লেগেছিল ।
কাচের বাসন ভাঙার আওয়াজে বাবার দুশ্চিন্তিত মুখ ভেসে ওঠে । কোনো ফ্যক্ট্রিতে লোহা বা টিন পেটার ঠুংঠাং ধ্বনি উঠলে মায়ের বিয়ের তোরঙ্গের কথা মনে পড়ে ।
একদিন দুপুরে, তরুণ নট তীর্থংকর গুহরায় রাহুলকে ফোনে জানালো যে সুপ্রসিদ্ধ মাতাল এবং স্বল্প-পরিচিত নট প্রভাস চোঙদার মারা গেছে, ঠিক সেই সময়ে, প্রভাসেরই অপেরার একটা রচনাংশ, রাহুলকে উদ্দেশ্য করে লেখা,
পড়ছিল, এমনি-এমনি, ডাকে বহুদিন আগে পাঠিয়েছিল প্রভাসেরই বধিবিহার-নিবাসী জ্ঞাতি, “এই তো উনি
সকালবেলায় দাড়ি মুখ পয়পরিষ্কার করলেন — বেরোনোর আগে –, বৌয়ের হাত থেকে মায় চুন অবধি — কিন্তু আর ফিরে এলেন না — হয় এরকম — তাছাড়া আমাদের বাবারা আমাদের জন্য কোনো উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারেননি — রাখবার কথাও ছিল না অবশ্য–” । টেলিফোনটা রিসিভারে রেখে স্তম্ভিত রাহুল, নাকে এসে লাগল গোরখপুরের সাধুর জটার দুর্গন্ধ । কী করে প্রভাস নিজের মৃত্যুর কথা গোরখপুরের সাধুর কাছ থেকে আগাম জেনে ফেলেছিল ! প্রভাস যখন
লিখেছিল, তখন রাহুলের বয়স, মমমমমমমম, বোধহয় পঁয়ত্রিশ, থাকগে, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, অথচ এতকাল পড়েনি । পড়তে বসল কিনা প্রভাস চোঙদারের মৃত্যুর দিন, যেদিন থেকে ও আর ফিরবে না !
তিরিশ বছর পরে, কলকাতায় ফিরে, প্রভাস চোঙদারের মফসসলের বাড়িতে গিয়েছিল অনিকেত আর রাহুল, ওকে আগাম না জানিয়ে । লোকাল ট্রেন থেকে নেমে, রিকশ ধরবে বলে দাঁড়িয়েছিল, দেখল দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসক দলের
মিছিলে লাল ঝাণ্ডা নাড়িয়ে স্লোগান দিতে-দিতে চলেছে প্রৌঢ় প্রভাস । একদা-প্রতিষ্ঠানবিরোধী আজ কোন লোভে বা ভয়ে শাসকের দলে ভিড়ে গিয়ে তাদেরই ধ্বজা ওড়াচ্ছে ? ওরা অবাক । মিছিলে ঢুকে ওকে ডাক দিতেই, বোঝা গেল, রাহুলের চোখের আয়নায় নিজেকে দেখতে পেয়ে, আঁৎকে উঠল প্রভাস । আরেকজনের হাতে ঝাণ্ডা-পরানো ডান্ডা ধরিয়ে, ওর বাসায় নিয়ে গেল । বাসায় গিয়ে, প্রবেশ করেই, রাহুল দেখতে পেল, দেয়ালে ঝোলানো শাসক দলের মুখ্যমন্ত্রীর ফোটো, এক কোনে ডাঁই করে রাখা লাঠি আর দলের ঝাণ্ডার গোছা, থাকের পর থাক দলীয় সংবাদপত্র । দেখে থ হয়ে গেল ওরা, রাহুল আর রাহুলের দাদা অনিকেত ।
প্রভাস জানাল, উপায় নেই, ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা ভুলে যাও, মফসসলে থাকলে বুঝতে ।
–তাহলে মাঝে-মধ্যে আন্দোলনের নাম করে পত্রিকা প্রকাশ করছ কেন ?
–আন্দোলনকে এইভাবেই জিইয়ে রেখেছি ।
–শাসকের সঙ্গে যোগ দিয়ে ?
–শাসক বলছ কেন ? দ্রোহের মাধ্যমে সমাজকাঠামোয় উলটপালট করছি আমরা, সমাজকে দিচ্ছি বৈপ্লবিক অভিমুখ, গ্রামে গিয়ে দেখে এসো, ঔপনিবেশিক সামন্তকাঠামো আর খুঁজে পাবে না ।
রাহুল বলল, আমি তো পশ্চিমবাংলার গ্রামে-গ্রামে ঘুরে বেড়াবার চাকরিটাই করছি ; তোমরা হেঁসেল থেকে শোবার ঘর, খেত-খামার থেকে দপতর, এমন নজরদারি-জাল বিছিয়ে দিয়েছ, আর মগজ-দখলের নৃত্য চালিয়েছ, যে লোকে কথা বলতে ভয় পায় । দাড়ি-গোঁফ আছে আর হিন্দি-উর্দু জানি বলে অবাঙালির ভেক ধরে তাদের সঙ্গে কথা বলি আর প্রকৃত তথ্য আদায় করি । নতুন সামন্তকাঠামো গড়ে তুলেছ তোমরা প্রতিটি গ্রামে ।
প্রভাসের শরীরের ভাষা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে ওর কাছে প্রতিষ্ঠান শব্দটার মানে পালটে গেছে । ওর ভেতরে যে লড়াই চলছে, তা, ও, প্রভাস, লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে গেল ; প্রতিষ্ঠানের কাছে হেরে যেতে বাধ্য হয়েছে, মফসসলি সন্ত্রাসের চাপে পড়ে । রাহুলকে বলল, তোমার পশ্চিমবঙ্গ-বিশ্লেষণ পড়েছি, সব লেখাই পড়ি, সব নট্ট কোম্পানিতেই তো আজকাল দেখছি তোমার পায়ের ছাপ ।
–তোমার অপেরার অভিনয়ও তো দেখি, আমার আর রাহুল সম্পর্কে তরুণ নটদের যে গালগল্প শুনিয়েছ, তাও জানি, তাদের কেউ-কেউ বলে ফেলেছে । এমনকি নিজের স্ত্রীকেও একজন আন্দোলনকারী ঘোষণা করেছ । কামেশ্বর চোঙদারও তা-ই করেছে । ভালোই, কাউকে বাদ দেবার প্রকল্প তো আমাদের ছিল না, তাই স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সকলকেই অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা যেতে পারে । অনিকেত বলল ।
রাহুল বলল, আমার ছেলে আর মেয়েকে নির্দেশ দেয়া আছে যে তারা যেন কখনও কারোর বিরুদ্ধে আমার লেখালিখি নিয়ে নাক না গলায়, কেননা আমার লেখালিখি উত্তরাধিকারহীন ।
অনিকেত বলল, যাক, তোমার সঙ্গে আবার দেখা হল, তোমার বীশ্ববীক্ষার তারল্যের সঙ্গে পরিচয় হল ; কিন্তু মুচলেকা দিয়েছিলে, সে কথাটা অস্বীকার করো কেন ? প্রদীপন, রক্তিম, চঞ্চল, ওরাও তো পুলিশের সাক্ষী হয়েছিল, কিন্তু কেউই তোমার আর কামেশ্বরের মতন লুকোছাপা করেনি, গল্প বানিয়ে পরের প্রজন্মকে ভুল বোঝায়নি । ওরা কেউই অস্বীকার করে না ।
–হেঁঃ হেঁঃ ।
–আন্দোলনের ইতিহাসকে বিকৃত করার কি সত্যিই দরকার ছিল ? বলল রাহুল ।
প্রভাস চোঙদার কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ গম্ভীর করে, আরোপটা স্বীকার করে নিল । বেশ কিছুক্ষণ পরে বলল,
“অসীম গাঙ্গুলি প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে যেভাবে বাইরে থেকে ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন সেভাবে মহাভারত নট্ট
কোম্পানির বঙ্কু বোস ভিতর থেকে ভেঙে দিতে চেয়েছেন, কামেশ্বরের কাঁধে বন্দুক রেখে।”
রাহুল বলল, হ্যাঁ, জানি, কলকাতায় এসে তিন-চার বছর কাটিয়ে, অমন ধারণা আমারও হয়েছে ; রামায়ণ নট্ট কোম্পানি যেমন আন্দোলনকে বাইরে থেকে ভেঙে দিতে চাইছিল, তেমনই, মহাভারত নট্ট কোম্পানি ভেতর থেকে ভেঙে দেবার চেষ্টা করে গেছে, মূলত কামেশ্বর চোঙদারের মাধ্যমে । কিন্তু জেলি ফিশদের তো ভাঙা যায় না ।
শাসক-দলের সঙ্গে বেঁধে-বেঁধেই থাকো, বঙ্গকেজিবির ছত্রছায়ায়, বলে, ওর বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছিল অনিকেত।
তারপর তীর্থঙ্কর গুহরায়ের টেলিফোনে প্রভাসের মৃত্যু সংবাদ ; মৃত্যু দিয়ে প্রভাস প্রমাণ করে গেল যে মফসসলি সন্ত্রাসের চাপ আর ও নিতে পারছিল না, পাড়াতুতো নেতাদের এড়াবার জন্য সবসময় মাতাল থাকতে হচ্ছিল । মারা গেল রক্তচাপজনিত হার্ট অ্যাটাকে ।
ওইভাবেই, হঠাৎই, কোনো ভুলে-যাওয়া ঘটনা মনে পড়ে যায় রাহুলের , হয়তো সংবাদপত্রের পাতায় দাঙ্গার খবর পড়ে। রাহুলের বয়স তখন, মমমমমমমমম, বোধহয় বত্রিশ, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়। ফয়জাবাদের এক সংস্হার পরিচালন পরিষদের সদস্য হিসাবে প্রায়ই যেতে হত ওই ঘুমন্ত গঞ্জ শহরে, গ্রামীণ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসাবে । একদিন সংস্হার অধ্যক্ষ বললেন, চলুন আপনাকে অযোধ্যা দেখিয়ে আনি, রাম কোথায় জন্মেছিলেন দেখে যান। অবাক হল রাহুল । বাল্মিকীর মস্তিষ্কপ্রসূত অযোধ্যানগরী আর রাম, ওই মহাকাব্যের বাইরে, প্রচ্ছদ ফুটো করে, বাস্তব জগতে কী করে এলেন ! সত্যই আছে নাকি অযোধ্যানগরী ? অ্যামব্যাসাডরে চেপে গোলাপিফুল পোস্তখেত আর সবুজ ধানখেতের হাওয়া মেখে পৌঁছোল নোংরা ঘিঞ্জি এক জায়গায় ।
অধ্যক্ষ এক ফুলঅলাকে জিগ্যেস করতে, সে বললে, ও রামকোট খুঁজছেন ? ওই বাঁদিকের খোঁড়া রাস্তাটা দিয়ে যান।
এটা অযোধ্যা ? না এলেই তো ভালো হত । কল্পনার অযোধ্যার সঙ্গে তো কোনো মিল নেই, এতই নোংরা, এঁদো, পুজোর দোকানপাটে দমবন্ধ পথগুলোয় গাড়ি ঢোকা মুশকিল । অতএব নেমে হাঁটতে হল , বাঁদরের উৎপাত সামলে । শুকনো খাদের ধারে, আগাছায় ঘেরা, বৃষ্টি আর রোদে কালো , ফাঁকা চুনসুরকি-খসা ইঁটবেরোনো মসজিদকে দেখিয়ে অধ্যক্ষ বললেন, এই যে এইটিই রামের জন্মস্হান । প্রধান গম্বুজ আর তার দু’ধারে ছোটো গম্বুজ , দশরথের প্রাসাদ ।
সুর্যবংশের মহারাজা দশরথের প্রাসাদ !
এটা ? জনশূন্য, লোকজন নেই, একেবারে ফাঁকা, কেবল একজন পাহারাদার দড়ির চারপাই পেতে ঘুমোচ্ছিল প্রবেশপথের সামনে । সে বলল, স্যার আপনারা জুতো খুলে যান । রাহুলের অবিশ্বাস আরও দৃঢ় হল ; দশরথ রাজার বাড়িতে জুতো খুলে যেতে হয়, এরকম কথা বাল্মিকী লিখেছেন বলে তো মনে পড়ল না । সে রাজত্বের সিংহাসনে নির্বাসিত-বনবাসী রাজপুত্রের জুতো রাখা হতো । তখনকার দিনে হয়ত ঘাসের দড়ি দিয়ে বোনা জুতো হতো ; যদিও বাঙালি কবি বলেছেন খড়ম । খড়ম পরে সারা রাজ্যে চলাফেরা অসম্ভব ছিল নিশ্চই ।
ভেতরে, হলঘরসদৃশ এলাকায় ঢুকে আরও অবাক । লম্বাটে ঘরে বেঞ্চ ধরণের একটা বেদির ওপর গোটাকতক মূর্তি রাখা । বাঁদিকের একটা থাম কেবল কালো গ্র্যানিট পাথরের, যার গায়ের ভাস্কর্য দশরথের প্রাসাদের নয় বলেই তো মনে হল । এটা আঁতুড় ঘর? দেয়ালের চুনসুরকি খসে-খসে পড়েছে, দশরথের দাসদাসীরা প্রতিদিন পরিষ্কার করে বলে মনে হল না ।
অধ্যক্ষকে বলল, আপনি আমার কল্পনার মহাকাব্যকে নষ্ট করে দিলেন । তখনও পর্যন্ত, টিভি-জগতের রঙিন রাজা-রাজড়ারাদের জন্ম হয়নি, যারা পরে রোম বা গ্রিসের সৈন্যদের পোশাক পরে দেখা দেবে বিভিন্ন সোপ-অপেরায় । মন-খারাপ করে ফিরে এসেছিল রাহুল ।
বহুকাল পর, রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমমম, বাহান্ন বোধহয়, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, মুম্বাইতে পোস্টেড, শীতকালের কয়েকদিন লাগাতার সংবাদ বেরোচ্ছিল দশরথের সেই প্রাসাদ ধ্বংসের তোড়জোড় চলছে, শেষে টিভিতে দেখল, অজস্র লোকের গেরু্য়া কিলবিল উঠে পড়েছে গম্বুজের ওপর, ভাঙতে আরম্ভ করেছে, ধুলো উড়ছে । মন আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিল । আজ আর দশরথের রাজপ্রাসাদকে কল্পনায় আনতে পারে না রাহুল, চোখ বুজলেই দেখতে পায় একজন পাহারাদার, জনশূন্য মসজিদে কয়েকটা মূর্তি, আর অজস্র লোক তাকে ভাঙবার জন্য ওপরে উঠে নাচছে । কল্পনা জবরদখলের নৃত্য।
তার কয়েকদিন পরে, নিজের ফিয়াট গাড়ি ড্রাইভ করে অফিস যাচ্ছিল রাহুল, দেখল, মাহিমের কাছে, রাজপথের
ওপর, মারামারি চলছে, জনগণের এই ধরণের মারামারি এর আগে কখনও দেখেনি ও, রাহুল । কারোর কারোর হাতে লাঠি, তরোয়াল, ছোরা এমনকি. মনে হয়েছিল, জনাকয় লোকের হাতে বন্দুক । তরোয়ালের কোপে, ওর আতঙ্কিত চোখের সামনে, স্বামী বিবেকানন্দ রোডে পড়ে গিয়েছিল দুজন লোক । প্রাচীনকালে যে যুদ্ধ খোলা মাঠে হতো, সৈন্য-সামন্তরা করত, তা করছে খ্যাংরাটে গরিব মানুষের দল । করছে একদল অন্যদলের কল্পনাজগতকে দখল করার
জন্য । মাহিম-ব্যান্ড্রার মোড়ে গাড়ি ঘুরিয়ে ওয়েস্টার্ন এক্সপ্রেস হাইওয়ে দিয়ে সান্টাক্রুজ কোয়ার্টারে ফিরে এসেছিল । পরের দিনের সংবাদপত্রের খবরে জানতে পারল যে অনেক গাড়ি পুড়েছে, কতজন মারা গেছে তা জানা যায়নি ।
টিভি দেখতে-দেখতে ওর মনে পড়ে যাচ্ছিল অনেককাল আগে দমদমের পথে রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারী-মশায়ের ঢিল ছুঁড়ে-ছুঁড়ে বায়বীয় অপেরার যুদ্ধক্ষেত্রে লাশ ফেলার প্রয়াস। সেও ছিল কল্পনা দখলের খেলা । দাদা অনিকেত দেখা করতে গেলে আরও বড়ো একখানা পাথর ছুঁড়েছিলেন নর্দমায়, যার পাঁক চলকে নোংরা করে দিয়েছিল দাদার ট্রাউজার ।
রাহুল, কোন মহাগ্রাসে আক্রান্ত হয়ে, জঙ্গম-সক্রিয় প্রেমের স্বনির্মিত কলুষে, যে দিকে ইচ্ছা সূর্যোদয় ঘটাবার ইন্দ্রিয়মন্হন চালিয়েছিল, অক্ষরের যুদ্ধক্ষেত্রে একক লড়াইয়ের সেইসব দিনগুলোয়, মাঝে-মধ্যে ভেবে ফ্যালে,
তাড়ণাতাপের বিচলনে চক্রব্যুহে প্রবেশ-ক্ষমতার দুঃসাহস তো সকলের থাকে না, ওর কেন হল, কী করেই বা হল, বর্ণোচ্ছল স্মৃতিতরঙ্গের ঈশ্বরহীন অভিনিবেশের জাদুময়তা, মরুভূমির চিরকালীন উজ্জ্বলতায় অভ্রান্তির নিমগ্ন অভিসার, উপাসনা-বর্জিত, একক উজ্জীবন !
ছেলেকে বলছিল রাহুল, অসীম গাঙ্গুলি নামে একজন নট থাকতেন ওঝাপুরের এই পাড়ায় ; তাঁর দোতলার ফ্ল্যাটে যেত ও, নিয়মিত না হলেও বার পাঁচ-ছয় গিয়েছিল । তার আগে ওনার নিমপুকুর স্ট্রিটের বাড়িতেও গিয়েছিল । শেষবার কথা কাটাকাটির পর আর মাত্র এক বারই । সামনে আধমরা ঘাসের উবড়ো-খাবড়া মেঠো শহুরেপনা নিয়ে দোতলা বাড়ি , চূনকামের অবহেলায় আর বৃষ্টির দাপটৈ ছাইরঙা , যার ওপর তলায়, ছটা ফ্ল্যাটের একটিতে ভাড়া থাকতেন উনি । ছড়ানো-ছেটানো জায়গা নিয়ে বাগান ; ফুল-ফলের গাছ, তারপর গেট দিয়ে ঢুকে, ওপরে উঠে গোলবারান্দা । দক্ষিণ দিকে সবুজ , এখনকার নাগরিকের চোখে প্রান্তর বলা চলে, শাকসব্জির চাষে ব্যস্ত ক্ষেতমজুর । আর বিশাল জলাশয় । এখন সে জায়গায় বহুতল আবাসন, চেনা কঠিন , যেমন আর চেনা যেত না ওনাকে, সর্ষের তেল বা কোষ্ঠকাঠিন্যের ওষুধের বিজ্ঞাপনে বা পেজ থ্রির খোকা-খুকুদের রঙিন গ্যানজামের চাককাটা বুশশার্টের লোলচর্ম ফোটোয় ।
টিভিতে অসীম গাঙ্গুলির বিশাল শবযাত্রা দেখেছিল রাহুল সিংহ ; ছুটকো-ছাটকা নট্ট কোম্পানির অভিনেতাদের হইচইময় শোকযাত্রা। রাহুলের বয়স তখন কত হবে, মমমমমমম, বোধহয় বাহাত্তর, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়। টিভিতে ওনাকে নিয়ে যে প্রোগ্রাম হয়েছিল, বিজ্ঞাপনের কাঁটাতার ডিঙিয়ে তা থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, যে , যৌবনের গোলালু স্বাস্হ্য শুষে উপঢৌকন দিয়েছেন জনপ্রিয়তার নেশাকে । রবীন্দ্রনাথও অনেক বয়স পর্যন্ত, প্রস্টেটের শারীরিক কষ্ট নিয়ে বেঁচেছিলেন, কিন্তু অসীম গাঙ্গুলির মতো অমন শুকিয়ে আমসি হয়ে যাননি তো ! যশ আর জনপ্রিয়তা তাহলে ভিন্ন । কুড়ি-তিরিশের কোঠায় রবীন্দ্রনাথের যে গোঁফ ছিল তাতে উনি তা দিতেন, ফোটো দেখে অনুমান করা যায়, আদর-খাওয়া গোঁফের প্রান্ত । অসীম গাঙ্গুলি কখনও গোঁফ রাখেননি, যতদূর মনে পড়ে, সেই যখন উনি কলেজে পড়তেন, ধুতির ওপর বাড়িতে-কাচা হাফ-হাতা শার্ট , তখনও ।
স্কুল-কলেজের সিলেবাসে ঢোকার আনন্দে কী দেহের স্নেহপদার্থকে অসীম গাঙ্গুলি গলিয়ে ফেলেছিলেন ? কিংবা হাপিত্যেশ করে বসে-থাকা প্রকাশকদের অগ্রিমের কড়ার রাখতে । অথবা তরুণ স্তাবকদের টাঙানো প্রশংসার মশারিতে ঢাকা গদিতে শোবার নেশায় । হবেও বা । ডটপেনের রিফিলে ভরা নীল কল্পনাপ্রবণ স্নেহপদার্থ !
শেষ বারের পর রাহুল ওনাকে, মানে অসীম গাঙ্গুলিকে, অ-দেখন বা নির্দেখা করে দিয়েছিল, কারণ উনি তখন বিখ্যাত, কোষ্ঠকাঠিন্য আর সর্ষের তেলের বিজ্ঞাপনের পোস্টারে, অপ্রতিরোধনীয়তার দুরমুশে বয়সের বানভাসি-খাওয়া ওনার ফুলকোফোলা মুখ ঝুলত লাইটপোস্টগুলোয়, টিভির পর্দায়, দুর্গা-প্রতিমাকে পুরস্কার দানকারী গ্লসি পত্রিকার পাতায়-পাতায় , ক্ষমতার মায়াময় চোখধাঁধানো নিখুঁত মানুষের অতিকথার হাসি, ঠোঁটের ইন্দ্রজালে মিশিয়ে হয়ে উঠেছেন মধ্যবিত্ত বাঙালির গন্ধমাদনের উদ্ভিদ, নটবণিক ।
রাহুলের দাদা অনিকেত সিংহের বাড়িতে, যখন যে শহরে পোস্টিং হয়েছে দাদা অনিকেতের, অসীম গাঙ্গুলি
গেছেন সেখানে বেড়াতে , ওনার নট্ট কোম্পানির বন্ধুদের দলবল নিয়ে । বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে । শিশুপুত্রকে নিয়ে ।
প্রিয় বন্ধু ছেলেকে নিয়ে আসছেন শুনে দুধেল গোরু কিনেছিল অনিকেত ; কলকাতায় তো আর খাঁটি দুধ খাওয়া হয় না, যদিও পাড়ায়-পাড়ায় দলীয় বলদের খাটাল । বিখ্যাত হবার পর, কোষ্ঠকাঠিন্য, সর্ষের তেল, দোল-দুর্গোৎসব, সভা-সন্মেলন, বিদেশ ভ্রমণ থেকে ফুরসত পেতেন না বলে অধিকারীমশায় যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন ; সাহিত্যসভায় প্রধান অতিথির আসনে বসে, প্রথমে প্রৌঢ়, পরে বৃদ্ধ, অনিকেতকে চিনতে পারতেন না । অনিকেতও ওনাকে অচেনা
করে দিয়েছিল । অসীম গাঙ্গুলি মারা যেতে, লিটল অপেরাদের নতুনগোঁফ অধিকারীদের বায়নার দরুন অচেনা থেকে চেনায় ফিরতে হয়েছে অনিকেতকে ; পুরোনো কাগজপত্র ঘেঁটে অসীমের কয়েক দিস্তা চিঠি, যেগুলোর কপিরাইট উইপোকারা দাবি করেনি, তাদের বিলিয়ে দিয়েছেন অনিকেত ।
অসীম গাঙ্গুলি মারা যাবার পর ওনার মানসীর ভাসিয়ে দেয়া নিঃশ্বাসগুলো মনে পড়ল রাহুলের—
‘’যেহেতু প্রতিশ্রুতি দিয়েছ, তাই অপেরা লিখতে তোমায় হবেই ?”
“পুজোয় তোমার অপেরা নাহলে কি-ই বা হত বলো তো ?”
“শরীর যদি বিদ্রোহ করে, তবুও কেন ! কেন তোমায় অপেরা লিখতে হবে ?”
“অপেরা যদি খুব খারাপ হয় তারচেয়ে না লেখাই কি ভালো ছিল না ?”
সে-সব বাতাস গায়ে এসে লাগায়, রাহুলের মনে হল, রবীন্দ্রনাথকে অমন করে বলার স্মৃতি-বিদেশিনী ওনার বোধজগতে ছিল না বলেই কি লেখালিখি বাদ দিয়ে ছবি আঁকতে আরম্ভ করলেন ? তোরা যে যা বলিস ভাই, লিখব না লিখব না ।
তা নয় । অসীম গাঙ্গুলীর জীবনে কোনো ব্যর্থতার বিষাদ ছিল না, লাৎ মেরে চলে যাবার সময়ে প্রেমিকার দেয়া পরাজয়ের ক্ষয়রোগ ছিল না, নিকটতমের উধাও হবার মানসিক অশান্তি ছিল না , অন্তরজগতে কখনও হাহাকার বাসা বাঁধেনি ।
আর ? আর হাতে হাতকড়া, কোমরে দড়ি-বাঁধা অবস্হায় ডাকাত-খুনি-চোর-পকেটমারদের সঙ্গে রাজপথ দিয়ে জনগণের চোখের সামনে হাঁটার অভিজ্ঞতা ছিল না ।
ওনার, মানে অধিকারীমশায়ের, বা আর কারোর, চিঠিফিটি রাখেনি রাহুল সিংহ । যেগুলো পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেনি, সেগুলো কুটিকুটি করে উড়িয়ে দিয়েছে । রাহুলের মা বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, সব্বাইকে ছিঁড়ে গুয়ের ডাবায় ফেলে দে, এখনও মেথরানিটার আসার সময় আছে ।’ রাহুলদের কানপুরের বাড়িতে, তখন খাটা পায়খানা ছিল । অবশ্য গুয়ের ডাবায় ফেলেনি ; তিন তলার ছাদে দাঁড়িয়ে ছিঁড়ে-ছিঁড়ে উড়িয়ে দিয়েছিল সাওনকে মহিনার ভিজে হাওয়ার উদ্দেশে ; রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমমম, থাকগে, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় ।
গুয়ের ডাবা ছেঁড়া চিঠির টুকরো-টাকরায় কবিত্বময় হয়ে উঠতে পারে, হয়ত এই আশঙ্কায়, রাহুলের অনুমান, পরের বছর থেকে, সরকারি হুকুমনামায়, খাটা পায়খানা বন্ধ হয়ে গেল ।
–কেতুর ঘাড়ে বসে দুবচ্ছর খেয়েচে-দেয়েচে ওই রক্তিমটা, কেতুকে যে তোশক দিয়েছিলুম তাতে কতগুলো সিগারেটের ছ্যাঁদা করেচে দেখেচি, মদের গেলাস ফেলে দাগ ধরিয়েছে, লজ্জা নেই, কেতুর বন্ধুদের রেঁধে-বেড়ে খাইয়েচি, ওদের বাসন মেজেচি, আর তার বদলে কিনা এই ? অকিতোগ্গো, অকিতোগ্গো । বলেছিলেন মা ।
–কেতুর রোলেক্স হাতঘড়িটা, যেটা ওর জ্যাঠা দিয়েছিল, সেটাও তো ওদের কেউ হাতিয়েছিল, তারপর থেকে কেতুটা হাতঘড়ি পরাই ছেড়ে দিলে । বলেছিলেন বাবা ।
স্মৃতি যদিও তার পর অজস্র ছবি গড়েছে আর মুছেচে, দুটো হুল ফুটিয়ে-ফুটিয়ে সময়কে বিষাক্ত করে দিয়েছে নানারকমের ঘড়ি, তবু মনে পড়ে যাচ্ছিল রাহুলের, সেই সব গোলমেলে আচরণের ইতিহাসে ছয়লাপ মানুষদের মুখমন্ডল । মাতাল জোচ্চোরদের তাপদগ্ধ বালখিল্যে থমথমে কুতূহলী কফিহাউসের, আর চপল শুঁড়িখানার মর্মভেদী ঝিলমিলে একাকীত্বের জবজবে টয়লেট । বাসে-ট্রামে স্যাঁতসেতে ঘেমো ভিড়ের ভেপো যাত্রীদের গা-ঘেঁষাঘেষি অভিজ্ঞতা। জীবন্ত রক্তমাংসে পুনরুথ্থান ঘটছিল মৃতদের । বদল ঘটেছে কি ? আসলে পরিবর্তন হল কল্পনা, ম্যাজিক, ইন্দ্রজাল ; কেননা বদল তো শাশ্বত, চিরন্তন, চিরস্হায়ী ।
আর রাহু-কেতু ? যারা কল্পনামন্হনে উঠে এসেছিল ? তারা পৃথকভাবে একক অনুপম অদ্বিতীয় সর্বগ্রাসী সর্বভূক সর্বাশী সর্বত্র-বিদ্যমান স্হিতধী বন্ধনহীন সীমাহীন অতিবাস্তবতার ভূমন্ডলের যাযাবর , আর তাই, উত্তরাধিকারহীন ।
আগের আর পরের মাঝে স্হিতিস্হাপকতাই বোধহয় ঐতিহ্য । কিন্তু যদি আগের আর পরের স্হিতিতে যারা
আছে তারা না মানে তাহলে আর কীই বা করা ।
তারপর, সেই যে ,তারপর ,অসীম গাঙ্গুলির ওঝাপুরের বাসায় ইলিশের বদলে আমেরিকান কই ।
–আমি, আমিই তোমাকে অপেরা-জগতে এনেছি ; তা তুমি ভুলে গেলে কী করে ? আমিই সর্বপ্রথম তোমার লেখা অপেরা নিয়মিত প্রকাশ করার ব্যবস্হা করে দিয়েছিলুম । তোমার দাদা করেনি । তোমার রক্তিমদাও কিছু করেননি ।
শাসাঘাতে ওপরনিচ ঘটিয়ে কথাগুলো বললেন অসীম , অসীম গাঙ্গুলি, রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারীমশায় । মরুভূমির হুহু হাওয়ায় বালিয়াড়ির ঢেউরা পালটিয়ে পালটিয়ে পালটিয়ে আদল বদল করে গেল অবিরাম । বালির ওপর দিয়ে হালকা পায়ে দৌড়ে উধাও হল হলদে অক্ষরের মাকড়সারা ।
ভাসিয়ে-দেয়া নিঃশ্বাস ভেঙে-ভেঙে তার ভেতরে পুরে দেওয়া এই বার্তাটা পেল রাহুল সিংহ, যার ডাক নাম রাহু : “অনুগত রেনিগেড কোথাকার ! ক’দিন আগের গুণমুগ্ধ আজ আততায়ীর রূপ ধরে উপস্হিত হয়েছে।”
রাহুল সিংহ , যার ডাক নাম রাহু , আর যার দাদার নাম কেতু, ওনার কথাগুলো শোনার চেয়ে ওনার মুখমন্ডল কেন গোলাকৃতি, আর গোলাকৃতি বলেই উনি অমন ব্যতিক্রম কিনা, তাই ভাবছিল । গালে দু’দিনের দাড়ির তলায় ভাতের নরম চর্বি ।
রাহুলের দাদা অনিকেত আর অসীম গাঙ্গুলির বন্ধু নৃপতি চাটুজ্যে ওরফে প্রদীপন বলেছিলেন, ‘লক্ষ্য করে
দেখো, ওর মুখমন্ডল পুরুষের মতো নয়, বিরল, বিরঅঅঅঅঅঅল ।’ সিঁড়ির ধাপে এক পা আর আরেক পা মাটিতে রেখে, ঠোঁটের কোনে চারমিনার । ‘আর রক্তিমের মুখটা আয়তাকার, বুঝলে, দাড়ির আড়ালে চাপা দিয়ে গোলাকৃতি দেখানোর চেষ্টা করে, টলস্টয়ের পারভারটেড সংস্করণ ; সেক্সলেস হলে যা হয় আরকি । এসব আবার কোথাও লিখে দিও না ; তোমাকে কোনো কথা বলাও বেশ রিসকি ।’
–না, ওনার সেফটি রেজার কেনার পয়সা নেই বলে দাড়ি রাখতে হয়েছে ।
–আর মাল খেতে বুঝি পয়সা লাগে না ?
–সে তো এর-তার ঘাড়ে ।
–ঘ এর জায়গায় যে গ-এ চন্দ্রবিন্দু হবে, এটুকু জ্ঞান নেই ? বাংলা ভাষায় অপেরা করছ, এটুকু জানো না ?
রাহুল যাতে কোথাও লেখে, তা-ই যে নৃপতি চাটুজ্যে ওরফে প্রদীপন চাইছেন, পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসির মাধ্যমে ওনার বক্তব্যের স্বীকৃতি দিল হরিচরণ খাঁড়া ।
লেখালিখির জন্য হরিচরণ খাঁড়া এফিডেভিট করে দুর্গা বর্মন নাম নিয়েছে । খাঁড়া পদবি তখনও, রাহুলের বয়স যখন, মমমমমমম, বোধহয় একুশ, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, লেখালিখিতে অচল ছিল, আর এখনও তাই, রাহুলের বয়স যখন, মমমমমমম, বোধহয় তিয়াত্তর । সমাজের সেবক হতে হলে খাঁড়া পদবি সচল, অথচ লেখালিখির ময়দানে নামতে চাইলে খাঁড়া অচল।
হরিচরণ খাঁড়াকে দুর্গা বর্মণ বলে না ডাকলে বুড়ো বয়সেও রাগ হয় হরিচরণের । খাঁড়া বিসর্জন দিতে গিয়ে, মায়ের দেয়া আদরের নাম, হরিচরণকেও বিসর্জন দিয়েছে । সারা জীবনে কেউই হরিচরণকে সিরিয়াসলি নেয়নি, তার কারণ নাম-বদল নয় ; তার কারণ হরিচরণ বুঝতে পারে না যে ওর দুলকি-কাঁধ খোকা-ঢেউ আচরণই ওকে খেলো করে তোলে ।
প্রদীপন চট্টো ওরফে নৃ্পতি চাটুজ্যে, হাসার সময়েও, যে মুখোশটা পরে থাকেন, সেটা দৌর্মনস্যের উইপোকারা কুরে-কুরে খেয়ে চলেছে । ওনার চোখ কুঁচকে তাকানোর নানারকম মানে হয় । যারা ডেসিফার করতে পারে তাদের অন্যতম রাহুল সিংহ ।
—ফিজিওনমি পড়ছেন নাকি প্রদীপনদা ?
–লেখক হতে চাইছ , মুখের আকৃতি বিচার করবে না ? আমার মুখ তোমার মুখ আমরা পিকাসোর কিউবিস্ট ক্যানভাস থেকে নেমেছি । আর অসীইইইইম ? তো, ওর মুখ দেখো ভালো করে , হেলেনিক, আগামেমননের তাপ্পিমারা কেঠো ঘোড়া থেকে যেন সদ্য নেমেছে, হাতে বর্শা, পিঠে ঢাল, ঢুকতে চলল বিগহাউসের দুর্গে । পেছন-পেছন, বুকে চামড়ার বডিস বাঁধা, যুবতী সৈন্যের দল । গ্রিসে কি ইটালিয়ান মার্বেল যেতো, হোমারের সময়ে ? অসীমের পাশে দাঁড়িয়ে খেয়াল করেছ কি, মার্বেলের ঠাণ্ডা গন্ধ ঘিরে থাকে ওকে । মেয়েদের, জানো তো, ঠাণ্ডা মার্বেলের ওপর শুতে ভাল্লাগে ?
–কীইইই যে বলেন, শীতকালের গ্রিসে মার্বেলের ঠাণ্ডা মেঝেয় হেলেন অব ট্রয়কে হোমার নিশ্চই শুতে বলতেন
না, বলল রাহুল । ইউলিসিসের গল্পতেও নেই ঠান্ডা মার্বেলের মেঝেয় শোবার ঘটনা ।
–রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারীমশায় নিজেও জানেন সেকথা । বিরল, একসেপশানাল, প্রগলভ, প্রলিফিক ।
সেদিন, ওনার ওঝাপুরের বাড়িতে, অসীম গাঙ্গুলির মুখের দিকে নজর ঘুরিয়ে নৃপতি চাটুজ্যে ওরফে প্রদীপন চট্টোর বিশ্লেষণ যাচাই করছিল রাহুল ।
হরিচরণ খাঁড়া ওরফে দুর্গা বর্মণ, যে , মরা চিঠির ডাক বিভাগে কাজ করে, জীবিত লেখক আর জীবিত প্রাপকের মাঝে মরা চিঠি পড়ে-পড়ে, তাদের জ্যান্ত করে তোলে দপতরের অন্ধকারে, লোডশেডিঙে বসে মুচকি হাসির স্টক তৈরি করে রাখে, আজকে সকালে একটা ব্যানাল-হাসি স্টেটমেন্ট দিয়েছিল । কাঁধ নাচিয়ে, ও বলেছিল, ‘ ভবিষ্যত কাউকে কবি হবার অভিশাপ দেয়, আর কাউকে আবার কবি হবার আশীর্বাদ দেয় । প্রদীপন চাটুজ্জেকে অভিশাপ দিয়েছে আর অসীম গাঙ্গুলিকে দিয়েছে আশীর্বাদ; অপেরা না লিখে ছোটোগল্পই লিখুন প্রদীপন ।’
নৃপতি চাটুজ্যে ওরফে প্রদীপন সাইকেলে শিবপুরের দিকে পাইডেল মারতেই ভবদেব মিত্র বলেছিল, ‘লক্ষ করেছ ? প্রদীপন চাটুজ্জে সক্রিয় হলে ঘাড়ের ওপর ওনার মাথাটা শকুনের মতন কেমন আগে-আগে যায়? জীবনের যাবতীয় নোংরামির ভেতরে মুকুটসুদ্দু মাথা ঢুকিয়ে পচাগলা মালগুলো তুলে আনেন কলমের ডগায় !’
‘তাই ওনার গদ্যের বিস্তার উড়ন্ত শকুনের বিশাল ডানার মতন ; অনেক ওপরে উঠে যাচ্ছেন , কেউ আর সহজে ধরতে পারবে না ওনাকে ; বিনা অনুমতিতে ইনসমনিয়া রুগির স্বপ্নেও দিব্বি ঢুকে পড়েন’, বলেছিল সুকোমল রূদ্র ।
তাই অসীম গাঙ্গুলির হিংসে । প্রদীপনের গদ্যকে হিংসে, রক্তিমের পদ্যকে হিংসে । হিংসায় পাহাড়প্রমাণ অপেরা লেখার টেবিল।
নৃপতি চাটুজ্জেকে, ওনার পৌরসভার ঝিমন্ত দপতরে, লোকে নৃপতি নামে চেনে ; প্রদীপন নামে খোঁজ করতে গেলে সহকর্মী, যদি নাদুসপেট কেউ উপস্হিত থাকে, যা কদাচিৎই, তিনি ভাতঘুম থেকে জেগে উঠে, বলেন, ‘ওঃ, নৃপতিকে খুঁজছেন ? ওই যে চেয়ারে ঝোলা ঝুলছে, ঘণ্টাতিনেক অপেক্ষা করুন, দুপুরের পর একবার পদার্পন করবেন, ঝোলা তুলতে ।’ লিখিয়ে বন্ধুরা কেউই নৃ্পতি নামে ডাকে না । তারাই আবার হরিচরণ খাঁড়াকে দুর্গা বর্মণ নামে ডাকতে চায় না, হরিচরণ খাঁড়া নামে ডেকে মর্ষকামী হর্ষ পায় । আসলে প্রদীপন নামে উল্লেখ না করলে উনি ওনার কোনো লেখায় জীবনভরের মতো ঐতিহাসিক বাঁশ দিয়ে রাখবেন, বা, হতে পারে, সম্পূর্ণ বাঁশঝাড় ।
অসীম-প্রদীপনের আরেক বন্ধু আছেন, যিনি ঝোলা টাঙিয়ে অফিস থেকে উধাও হয়ে যেতেন, হরিপদ রায় ; ওনাকে দেখলেই যে লোকের হাসি পায়, তা উনি জানতেন বলে, হাসির অপেরা দিয়ে শুরু করেছিলেন । পরে, একদিন, চেয়ারে বসে হাই তুলতে-তুলতে, চোয়াল আটকে যেতে, দেখতে পান আলমারির ওপর, লাল শালুতে, আর কয়েক দশকের ধুলোয় মোড়া, একটা বস্তা সেই কবে থেকে পড়ে আছে, যখন উনি লোয়ার ডিভিশান কেরানি হয়ে মহাকরণের অ্যানেক্সিতে টেবিলের তলায় ঠ্যাং দোলাতে ঢুকেছিলেন ।
ছুটির পর অফিস ফাঁকা হয়ে যেতে, বস্তাটা নামিয়ে দেখেন, আরেসসসসশালা, অতি-পুরানো ক্ষেত্রসমীক্ষার প্রতিবেদন । জমা দেবার পর, সরকার, যেমন হয় আরকি, ভুলে গেছে যে ক্ষেত্রসমীক্ষা করানো হয়েছিল, তার প্রতিবেদন জমা পড়েছে । হরিপদ রায় বাড়ি নিয়ে গিয়ে প্রতিবেদনের তথ্য আমকাঠের টেবিলের ওপর উপুড় করে, লুঙ্গি দিয়ে ধুলো ঝেড়ে, উপজাতিদের সম্পর্কে একখানা সিরিয়াস বই লিখে, হাসির অপেরা-লেখক পদবি থেকে হাঁফ ছেড়ে মুক্তি পেলেন, আর প্রকাশকের কাছ থেকে লাখখানেক টাকা । ওই গ্রন্হের জোরে উনি প্রথমে ডাবলু বি সি এস হলেন, ঠ্যাং দোলানো কিছুটা থামল, তারপর প্রোমোটি আই এ এস হয়ে ঠ্যাং দোলানো থেমে গেল এক লপ্তে । যখন হাসির অপেরা লিখতেন, তখন উনি ছিলেন প্রফুল্ল সেনের সেবক । প্রোমোটি আই এ এস হয়ে রূপ পালটে হয়ে গেলেন বামপন্হীদের দরবারি ; কেরানি-বিপ্লবে বড় একটা অংশ নিতেন না । হরিপদ রায়কে ওনার ঠ্যাংদুলুনি কেরানি অবতারে রাহুল দেখেছিল বটে, ওপরে ওঠার গল্পটা প্রদীপন চট্টোর কাছ থেকে পাওয়া।
রাহুল অনেকবার চটিয়েছে প্রদীপনকে ।
প্রদীপনের দপতরে গিয়ে, ওনার সহকর্মীদের সামনেই রাহুল জানতে চেয়েছে, সহকর্মীরাও একই নরকের নিবাসী যখন, ‘ আজকাল ঘুষের রেট কীরকম যাচ্ছে ?’ পৌরসভায় ওনার বিভাগে ওপর থেকে নিচে পর্যন্ত সবাই ঘুষখোর, পিওনরাও । উনি নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে অপেরা লেখেন কিন্তু চারিপাশে ঘুষের মোচ্ছব নিয়ে লিখতে চান না । দাদা অনিকেতকে প্রশ্ন করতে অনিকেত বলেছিল, ‘ ছদ্মনামে লিখলেও সরকারি দপতরের নিয়ম ভাঙার দায়ে বিপদে
পড়বে। অবসর নিয়েও লিখবে না, দেখিস, পেনশন আটকে যাবার ভয়ে । ওনার প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা হল
বেডরুমসেন্ট্রিক, বিছানাই এসট্যাবলিশমেন্ট, আর ভাষাকে স্যাবোটাঝ করার কাজটা ক্লাসি নয়, মিডলক্লাসি।’
আরেকবার, তখনও গ্রামের শেয়ালরা রাজনৈতিক দলের কর্মীতে রূপান্তরিত হয়নি, হুক্কাহুয়াও পালটায়নি স্লোগানে, হ্যারিসন রোডের মোড়ে, এখন যার নাম মহাত্মা গান্ধি রোড, কয়েকজন হিজড়ে রাহুলদের ঘিরে হাততালি বাজিয়ে পয়সা চাইতে, ওই চিৎপুর ক্রসিংটায়, ওনার বিব্রত গ্রিক বায়ুদেবতা ঈওলাসের ঢঙে বিড়ম্বিত মুখের পানে
তাকিয়ে রাহুল বলে ফেলেছিল, ‘আপনার হেটেরোসেক্সুয়াল ছলাকলার দাম চাইতে এসেছে ।’ উনি ট্রামে চাপতেই, রঙীন নাইলন শাড়ি মোড়া হিজড়েগুলোও ওনার পেছন-পেছন লাফিয়ে উঠে গিয়েছিল ।
ট্রামের হাতল ধরে দরোজা দিয়ে মাথা বের করে, ঘুষিকে সমান্তরাল করে, রাহুলের উদ্দেশে কয়েকবার নাড়িয়ে, অদৃশ্য কাপড়ে সাবান ঘষে বাতাসকে পরিচ্ছন্ন করার প্রয়াস করছিলেন প্রদীপন ।
রাহুলের পিঠে আলতো করে ছুরি চালিয়েছিলেন প্রদীপন, লালবাজারে বসে, ওনার বিখ্যাত গদ্যকলমে, একখানা অস্বীকৃতির ঘোষণা , আর পরে, আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে । তার আগে কখনও, মনে হয়নি রাহুলের যে প্রদীপন মনে-মনে এতটা ভিতু ; সবকিছুকেই ভয় পান । রাস্তায় টায়ার ফাটলেও অচেনা আশঙ্কায় ওনার মুখ পীড়িত হয়ে উঠত। এখন ওনার মুখটা মনে করলেই পীড়া শব্দটা বেজে ওঠে, কর্কটক্রান্তির পীড়া । অসীম গাঙ্গুলির ভয়ে, চিঠির ঠোকরানি খেয়ে-খেয়ে, উনি রাহুলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন কাঠগড়ায় । পরে যদিও লিখেছিলেন যে বউয়ের ভয়ে অমন অস্বীকৃতি দিতে হয়েছিল, যদিও বউ তখনও বউ হয়নি, হবো-হবো ।
হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে ধোঁয়া খেতে-খেতে ভবদেব মিত্র আর ওর বন্ধুনি রোশনিকে রাহুল বলেছিল,
‘একজনের স্মৃতি আরেকজনের মুখমন্ডলকে ততদিন দূষিত করে রাখে যতদিন না নতুন কোনো স্মৃতি এসে তোমার চেতনাকে বিষাক্ত করছে ।’ ব্রিজের তলা দিয়ে তখন বিকেলের ক্লান্ত ঢেউ । যে যার গোপন স্ক্যানডাল নিজের-নিজের সামুরাই ব্রহ্মচর্যে চাপা দিয়ে বাড়িমুখো বাসি-বিকেলের নিত্যযাত্রী ।
হরিচরণ খাঁড়া ওরফে দুর্গা বর্মণ রোজই একটা মরা চিঠি বাড়ি নিয়ে গিয়ে মাকে পড়ে শোনায় । মাকে চিঠি লেখার কেউ নেই অথচ বয়সকালে চিঠি পেতে ইচ্ছে করে তো । বাড়ি মানে বস্তির একটা চালাঘর , শ্যাওলা-সবুজ বারোয়ারি খাটা পায়খানা । রাহুল মাঝে-মাঝে রাত কাটায় ওর ওই ঘরে, কেননা কলকাতায় রাহুলের মাথা গোঁজার জায়গা নেই । চারিদিকে বইপত্র ছত্রখান, উনিশ শতকের গন্ধের, আলোর, ঝিমঝিমে হাওয়া । জানালায় কাঠের গরাদ, ক্ষয়াটে । বারোয়ারি পায়খানা, ওই একটাই, ভোর থেকেই রিজার্ভেসানের লাইন । ফলে, রাহুল ওর আস্তানায় রাত কাটাতে চায় না।
অসীম গাঙ্গুলির বাড়িতে কথা-কাটাকাটির সেই সূত্রপাত ।
–ক্রিয়েটিভ লেখালিখি ? জানি না, আপনি যাকে অপেরা বলে মনে করেন, আমিও ঠিক তাই করতে চাইছি কিনা। না, রাহুল যার ডাক নাম রাহু , আর যার দাদার নাম কেতু, সেকথা বলা প্রয়োজন মনে করল না অসীম গাঙ্গুলিকে, ওনার ওঝাপুরের ফ্ল্যাটের ঘরে দাঁড়িয়ে । দুজনে যে ক্রমশ মেরুপৃথক ভাবনাজগতের বাসিন্দা হয়ে চলেছে, তা দুজনেই খেপে-খেপে জেনে ফেলেছে ; প্রথম পরিচয়ের সময় থেকেই । উনি চাইছেন ওনার নামের প্রতিধ্বনি ওনাকে ঘিরে থাকুক ক্ষমতাবান অশরীরির মতন, যাতে উনি কথার হইচই গায়ে মেখে নিজের ইচ্ছেমতন আত্ম-অভিকর্ষ নিয়ে খেলতে পারেন, তরুণ-তরুণীরা সেই অভিকর্ষের টানে পাক খেয়ে চলুক । বন্ধুদের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, এসো, দেখাও, কার অভিকর্ষে কত জোর আছে , কার পালে কত ঝড় , কার পেছনে কতগুলো হ্যামেলিনের নংটি আর ধেড়ে ইঁদুর, কার হেফাজতে কত তোষাখানা !
প্রথম পরিচয় । রাহুল , যার ডাক নাম রাহু , আর যার দাদার নাম কেতু, তখন হাফপ্যান্ট পরত, বয়স, মমমমমমম, বোধহয় চোদ্দ, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । অসীম গাঙ্গুলি পরতেন ধুতির ওপর শহুরে ধোপার আদর-খাওয়া হাফশার্ট ।
আজকে, ওঝাপুরের দোতলায়, উনি ময়লা পায়জামার ওপর জলকাচা ফিকে নীল বুশশার্ট পরে আছেন। ওই পোশাকেই বাজার থেকে ফিরেছেন ।
আসার সময়ে রাহুল , রাহুল সিংহ, ডাক নাম রাহু , মনের ভেতরে বিড়বিড় করে এসেছিল যে অসীম গাঙ্গুলির সঙ্গে কোনো তর্ক করবে না, কথার ওপর কথা বলবে না, তবু সম্পূর্ণ অপ্রসঙ্গিক একটা কথা বলে ফেলল, পিরামিডের তলায় লুকোনো শবের সোনার মোড়ক খুলে হিরেবসানো তরোয়াল বের করার মতন করে, ‘আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্হ
তো আমার দাদা নিজের গ্যাঁটের কড়ি দিয়ে ছেপেছিলেন।’
নীরবতার অন্ধকার গোলকধাঁধায় ফেলে আসা একটা বাক্য কুড়িয়ে নিজেকে অবাক করে তুলল রাহুল । শ্বাসাঘাত হল, এঃ, হেএএএ ।
–মূল প্রসঙ্গে এসো , বললেন অসীম গাঙ্গুলি, কোনো চিঠিতেও তো তুমি জানাওনি যে তুমি কী করতে চলেছ ? কৃতজ্ঞতাবোধ নেই তোমার । অথচ আমিই তোমাকে অপেরা-জগতে এনেছিলুম । তুমি নিজের কী ক্ষতি করেছ তা আজ
বুঝতে পারবে না , তবে একদিন নিশ্চয় বুঝতে পারবে, তখন আমি অপেরাসম্রাট হয়ে রাজত্ব করব । তোমাকে আমি প্রায় দশ বছর চিনি-জানি । আমি তোমায় একজন রেকলুজ তরুণ বলেই তো জানতুম, ইউ ওয়্যার আ লোনার । নিজেকে ঘিরে সবাইকে জড়ো করলে কী ভাবে ! অমন অরগানাইজিং দক্ষতা আছে বলে তো জানতুম না ।
প্রবাসে, কানপুরে, যেদেশে রাহুল সিংহ , যার ডাক নাম রাহু , সে সময়ে থাকত, সেখানকার মণ্ডিরোডের চালগমের আড়তদারদের দেয়ালে সিঁদুর দিয়ে লেখা থাকত “শুভ লাভ।” হিসেবের লাল-মলাট হলুদ-কাগজের খেরোখাতায়, খাড়া লম্বা লাইনের একদিকে লাভের অঙ্ক, আরেকদিকে ক্ষতির । তার মানে, অসীম গাঙ্গুলির ওষধি-তর্কে, শুভ ক্ষতির দিকে পড়েছিল রাহুল , যার ডাক নাম রাহু, আর যার দাদার নাম কেতু ।
অশুভ লাভের চেয়ে শুভ ক্ষতি বরং শ্রেয়, নিজেকে নিঃশব্দে বলল রাহুল ।
ইংরেজরা কেন কলকাতা ছেড়ে দিল্লিতে পাট তুলে নিয়ে গিয়েছিল, আসার সময়ে সেকথা ভাবতে-ভাবতে রাহুল, যার ডাক নাম রাহু, আর যার দাদার নাম কেতু, টের পেয়েছিল যে ইতিহাসের ওই বাঁকবদলের কিছুই ওর মনে নেই । ইংরেজরা বোধ হয় বাঙালিদের বলতে চাইছিল, :”দাঁড়া, দেখাচ্চি মজা।” কিন্তু দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে রাজধানি তুলে
নিয়ে যাওয়া, অমন কাজ প্রতিভাবান শাসকই করতে পারেন ।
চামড়ার টাকাও টাকা । শাসক চাইলে চামড়ার টাকাকেও স্বর্ণমুদ্রার সমান মূল্য দিতে বাধ্য হয় শাসিত জনগণ ।
নিমপুকুর ছেড়ে অসীম গাঙ্গুলি অভিকর্ষের নাড়ি তুলে নিয়ে এসেছেন কলকাতার বাইরে, ওঝাপুরে ! চলে গেছেন, র্যাদার। রাহুল যেমন এক শহর থেকে অন্য শহরে নিজের চাকরি তুলে-তুলে নিয়ে গেছে সারা জীবন, তারপর চাকরিকে তুলে নিয়ে গেছে গ্রামে-শহরে-গঞ্জে-নদীতে, এমনকী গভীর জঙ্গলেও । জঙ্গলে বসে উপজাতি পরিবারের বউয়ের দেয়া বেগুনপোড়া খেয়েছে শালপাতায়, পোড়ানো কাঁঠালবিচি বা কাঁচকলা-পোড়া খেয়েছে , চাল-গম তাদের অনধিগম্য বলে।
তাই, মনে হয়েছে ওর, কোনো জীবনকাহিনীই ব্যক্তিগত নয়; একজনের জীবনের জিজ্ঞাসাচিহ্ণগুলো , সব চিহ্ণই, আরেকজনের জীবনে বেমালুম পাওয়া যায় । উত্তরগুলোর সদিচ্ছা চালিয়ে নিয়ে যায় ব্যক্তিগত থেকে কৌমের দিকে । সম্ভবত । তার কারণ কারোর-কারোর কাছে আলো মানেই অতীত ,আর ভবিষ্যৎ মানেই আতঙ্ক ।
একটু আগে ফালিকাগজটা অসীম গাঙ্গুলির বাঁহাতে শিহরন তুলেছিল । শিহরণের রিনরিন বাজনা শুনতে পেয়েছিল রাহুল ।
থেকে-থেকে কাঁপুনিটা ছড়িয়ে পড়েছে সারা ঘরে, উড়ছে ঘরময়, জাগরণকে স্বপ্নের নামে চালাবার মতন করে । ঠোঁট নিঙড়ে একফোঁটা শ্লেষ । অসীম গাঙ্গুলির শ্লেষে, হাসিও বেফাঁস । বললেন, “বাংলা অপেরাকে ওমুখো হতে দেব না।”
রাহুল, যার ডাক নাম রাহু , আর যার দাদার নাম কেতু, মহাশূন্য থেকে পৃথিবীতে নেমে আসা ভিনগ্রহী প্রানী, মগজের ভেতরে মা-বাবার তৈরি-করা রণক্ষেত্র বয়ে বেড়াবার, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া রণক্ষেত্র, দায়-দায়িত্ব থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে এনেছে স্কুলের গন্ডী পেরোবার আগেই । বঙ্গজীবনের সময়কে একটা মাত্র লাইন বরাবর চলার ধারণায় বসবাস করার এলেম পায়নি, যদিও প্রাইমারি স্তরে ক্যাথলিক স্কুলে পড়েছিল ।
ওমুখো ? লিনিয়ার ! তিরিশ চল্লিশ পঞ্চাশ বছর পর যারা লেখালিখি করবে, তারা বাংলা অপেরাকে, দশ দিকে হাজার মুখে চালিয়ে দেবে, তা বোধহয় উনি অনুমান করতে পারছেন না । এক কালে নিজে কেঠো ট্রোজান ঘোড়া থেকে নেমেছিলেন, আর কতগুলো ট্রোজান ঘোড়া ওনার সিংদরোজার দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে তা উনি অনুমান করতে পারছেন না ।
অসীম গাঙ্গুলির কাছে রাহুলের প্রথম অপেরার পাণ্ডলিপি জমা আছে মাস তিনেক । ওনার ‘রামায়ণ নট্ট কোম্পানি’ থেকে প্রকাশ করবেন । অথচ বলছেন লিনিয়ার থাকতে হবে। রামায়ণের বদলে মহাভারতের কথা মাথায় রাখলে হয়ত খেয়াল রাখতেন যে মানবজীবনের ন্যারেটিভগুলো একই রেখায় চলে না ।
পঞ্চাশ বছর পর যারা লেখালিখি করবে, তারা বলবে, ‘আমার অপেরার রাজপাট আমার নিজের, আমি কী করি
না করি তাতে কার বাপের কি ; তুমি পড়তে না চাও পোড়ো না, আরেকজন তো পড়বে । তোমার বেছানো লাইন ধরে চলুক তোমার পরাগিত সন্ততি, তোমার আই ভি এফ করা কচি-নটের দল ।’
তা ঠিক ; প্রচুর পরাগিত সন্তান-সন্ততি হাওয়ায় উড়িয়ে গেছেন উনি ।
আর বাংলা অপেরা ? যারা বাঙালি থেকে পাকিস্তানি হয়ে আবার বাংলাদেশি হয়ে বাংলা ভাষায় রাজত্ব করতে
আসবে, তারা খেপে খেপে নিজেদের উথালপাথাল দিয়ে কোন মুখে যে যাবে তা কে-ই বা জানত? বাংলা অপেরার ভাষাকেই কলকাতিয়া নাম দিয়ে ঘাড় থেকে নামিয়ে দিতে চাইবে, নিজেদের পৃথক প্রমাণ করতে চাইবে, তা-ই বা কে জানত !
রাহুল সিংহ , যার ডাক নাম রাহু, তার দাদা অনিকেত সিংহের কলেজ-জীবনের বন্ধু ছিলেন অসীম গাঙ্গুলি । তখন রাহুলের বয়স, মমমমমমমম, বোধহয়, থাকগে , ওনার সঙ্গে পরিচয় হয়নি, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । কলেজের দেয়াল পত্রিকায় অসীমের অপেরা পড়ে মনে ধরেছিল বলে দাদা অনিকেত যেচে আলাপ করেছিলেন নিজের পত্রিকায় ওনার অপেরা চাইবার জন্য । দাদা তখন হুগলির অশোক মৈত্রর সঙ্গে ‘লেখা’ নামে একটা লিটল অপেরার যোগাড়যন্তর করতেন । থাকতেন শ্যাওড়াফুলিতে দেশের বাড়ির দু’আড়াইশ বছরের পুরোনো খণ্ডহরের চিলেকোঠার সোঁদা ঘরে । কাঠের ঘর, আলকাৎরা লেপা, যাতে উইপোকারা না সংসার পাতে । রাতে লন্ঠনের প্রভা । দেয়ালে সেকালের বিশাল খাঁড়া, চোখ আঁকা , কোনের দিকে দশ ফিট উঁচু বর্শার গোছা, লোহার ভারি-ভারি ঢাল, শাদা চুলের চামর, যেগুলোয় একশ বছরেও হয়ত হাত দেয়নি কেউ । শীতের দুপুরে আসেপাশের ছাদে যুবতীরা তাদের দীর্ঘ চুল
পিঠের ওপর ফেলে জবাকুসুম তেলের সুগন্ধ পাঠায় অনিকেতের উদ্দেশে।
অসীম গাঙ্গুলি নিমপুকুর ছেড়ে চলে গিয়েছেন বেশ উত্তরে, শহরতলিতে । দোতলা বাড়িটা খুঁজতে কিছুটা হয়রান তো হয়েছে রাহুল । এর আগেও এসেছে কিন্তু মনে রাখতে পারে না ও । রাস্তাটা নিজের সময়মতন যেদিকে যখন ইচ্ছে বাঁক খেয়ে কাদায় কাঁকরে বালিতে খানাখোঁদলে অবয়বহীনতার আগাম খবরের ধাঁচে পৌঁছে দিয়েছে রাহুলকে, যার ডাক নাম রাহু, আর যার দাদার নাম কেতু । কলকাতার কেন্দ্র ছেড়ে এত দূরে কেন ? বাড়িভাড়া কম বলে , নাঃ, তা নয়, নিজের সঙ্গে অভিকর্ষ তুলে নিয়ে যাবার ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য। পরাগিত সন্ততিদের টেনে আনার গৌরব ।
কলকাতা শহরের কেন্দ্র বলে কিছু আছে কি ? কেন্দ্র ! না, এই শহরের কোনো কেন্দ্রস্হল নেই । ডালহাউসি স্কোয়ারকে বলা যাবে না কেন্দ্র — ওই জায়গাটা তো সন্ধ্যা হলেই ফাঁকা। দিনের বেলায় একের পর এক দেশভাগোত্তর উৎখাতদের রাগি মিছিল আছড়ে পড়ে, অথচ বিকেল হতেই, সারা দিনের গ্রীষ্মকে হাওয়ায় জড়িয়ে ভোঁ-ভাঁ । স্লোগানের শুকনো জিভগুলো ভেসে বেড়ায় ফাঁকা এলাকাটায় । খুঁজে মরে বিধান রায়কে । ওনারও তো অভিকর্ষে তোবড়ানো মানব-শরীর । চলে গেছেন । মিছিল সামলাতে হিমসিম প্রফুল্ল চন্দ্র সেন ।
রাগি জিভের ভুত-ভুতনিরা গ্রীষ্মের লুবাতাস হয়ে টিকে যাবে সরকারি পাড়াটায়, আর, পরে, পরে-পরে, ভলকে-ভলকে মুঠো-ওড়ানো রাগি, গরিব, দুস্হ, উৎখাত, মুখশুকনো শিড়িঙে মানুষের আদলে দেখা দেবে, যেদিন যখন ইচ্ছে । উনিশ শতকের হাওয়া মুছে ফেলে দেশোদ্ধারের নামে তিরিশ বছরের ঐতিহাসিক বিপ্লব করবে হয়ত ভেতো কেরানিদের টেকো বা তেল-চুকচুকে আধঘুমন্ত দল ।
কিছুকাল আগে এই পাড়াতেই ধোপদোরস্ত মানুষদের ভিড় ‘ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায়’ চেঁচাতে-চেঁচাতে যেত ; তারাই, পরে গিয়ে, —তখন তো প্রফুল্ল সেন প্রফুল্ল মনে সিংহাসন থেকে উধাও— বসল ডালহাউসির মসনদে, আর যতটা পারে প্রমাণ করার চেষ্টা করল যে স্বাধীনতার ফলটা পেড়ে খেতে হলে তাকে মিথ্যা বলে ঘোষণা দিতে হবে । ঝুঠা আজাদির নামে কত ট্রাম-বাস তারা পুড়িয়েছিল । পরে, বিধান রায়ের সময়েও কত ট্রাম বাস পুড়ল । তারপর থেকে পুড়েই চলেছে ট্রাম-বাস । সরকার ট্রাম তুলে দিতে পারছে না ; ট্রাম না থাকলে ছাইয়ের ভাইরা কীই বা পোড়াবে? বাসগুলো তো প্রায় সবই বেসরকারি । ক্রমশ সবই ঝুঠা হয়ে গেল, সবই, সবই, সবই, সবই ।
ধর্মোন্মাদদের তাড়ানো উৎখাত মানুষের পোড়ানো বাসের কঙ্কাল পথের একপাশে । রাহুল স্পষ্ট দেখল ধোঁয়ার আদল নিয়ে নানা আকার-প্রকারের ভুত আর ভুতনিরা উড়ে বেড়াচ্ছে । এই ভুতগুলোই হয়ত তিরিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পর বাংলার উড়ন্ত জাজিমে বসে রাজত্ব করবে । ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ভুত-ভুতনি নয়, রঙীন । তাদের কন্ঠস্বরও শুনতে পাচ্ছিল, রক্ত খাঁবো, পোড়া মাংস খাঁবো, হাড়গোড় চেঁবাবোঁ, জ্যান্ত পুঁতে দেবোঁ মাটির তলায় । আকাশ জুড়ে উড়ছে মেঘলা-স্লোগানে ভেজা কাক, চিল, শকুনের গোলাপি উল্লাস। গুন্ডা-বদমায়েশ অধ্যুষিত সবুজ গ্রামাঞ্চলেও
উল্লসিত জিভগুলো পৌঁছে যাবে একদিন ।
সেন্ট্রাল ক্যালকাটা নামে জায়গাটাকেও বলা চলে না কেন্দ্র ; ওটা যেন ভাইভূক অক্টোপাসের মতন বাছবিচারহীন বিস্তারে আক্রান্ত, আত্মরক্ষার জন্য থুতুর রঙিন ধোঁয়ার আড়ালে ঢেকে রাখে নিজেকে । সামলে না হাঁটলে গায়ে একশ বছরের পুরোনো চুনবালির গয়ের খসে পড়ে । আসলে রাবণের মাথাগুলোর কথাই লোকে জানে ; শিরদাঁড়ার ওপর ওই ভারসাম্যহীন মাথাগুলোর চাপের কথা কাউকে বলতে শোনা যায় না । এক দিকে চারটে মাথা, মাঝখানে
একটা, আরেকদিকে পাঁচটা ; ভারসাম্য বজায় রাখা চাড্ডিখানি কথা নয় । আর দশটা মাথার সবকটা মগজ কি একই ভাবনা ভাবে ? হাজারমাথা শহরের খামখেয়ালি দেহরাজ্যে মূল মগজ বোধহয় মরিচিকা সেজে বসে আছে , আর মরিচিকা তো হল প্রতিশোধ । সবাই সেখানে আগন্তুক, বহিরাগত, অসংশ্লিষ্ট, সেখানে অলিগলির ফ্যাকাশে বা তরতাজা বাড়িগুলো নিজের-নিজের গোপনীয়তা খরচ করে টিকে আছে । বউবাজারও ।
একসঙ্গে কুড়িটা চোখ মেলে সীতার দিকে তাকিয়ে রাবণ !
চোখের প্রতিভা । প্রতিভা কি কেবল মাথার ? করতলের, বুকের, কাঁধের, উরুর, পায়ের পাতার, নাকের, কানের প্রতিভা কি নেই ?
বউবাজার ! সত্যিই বউয়েরা বাজার বসায় ; রাহুলের অভিজ্ঞতা আছে । কলকাতায় নয়, অন্য শহরের অভিজ্ঞতা । যে-হাত প্রেমের উচ্ছন্নে টেনে তোলে।
বন্ধুদের ডাকে রাহুল গিয়েছিল কাঠমাণ্ডুতে, যৌবনে । ওর বয়স তখন কত, মমমমমমম, হবে কিছু, কী-ই বা এসে যায় । স্পষ্ট মনে পড়ে যেতে লাগল ওর, রাহুলের ।
মাটিতে শাল বা শিশুকাঠের গুঁড়ি পুঁতে তাকে পাকিয়ে-পাকিয়ে চারতলা পর্যন্ত উঠে গেছে বাঁশের রেলিং আর
কঞ্চির ধাপ-দেওয়া সরু সিঁড়ি, এতই সরু যে, একজন যদি নামতে থাকে তাহলে তাকে জায়গা দেবার জন্য রেলিং-এ হেলে দাঁড়াতে হবে । তা সত্ত্বেও ছোঁয়া বাঁচানো ছিল কঠিন । স্হান সংকুলানের জন্য দুই পাক ওঠার পর একতলা, তারপর দুই পাক উঠে দুতলা, এইভাবে পাক খেয়ে চারতলা পর্যন্ত টালির চালে তৈরি কাঠের প্রাসাদ ; ওই প্রাসাদে অমন সিঁড়ি ছিল কুড়িটা । প্রতিটা সিঁড়ি কেবল সরু নয়, তা বেশ প্যাঁচালো । প্রতিটি তলায় সিঁড়ির মুখে বাঁ দিকে একটা ঘর আর ডান দিকে খোলা বারান্দা । বারান্দা থেকে ভেতরের উঠোন দেখতে পাওয়া যেত । ঘরের মেঝেও কাঠের । ঘরগুলোর দুটি জানালাই পেল্লাই মাপের, দরোজার সমান বলা যায়, জানালার শিকগুলোও কাঠের । ঘরগুলো বারো বাই আট হবে ।