৫. পথের দুপাশে

          পথের দুপাশে, নীল-লাল-হলুদ ঝিলমিলে আলোয়, নিচে তলায়, সরকার অনুমোদিত গাঁজার দোকান, একা-একা যৌনকর্মের টুকিটাকি সাজ-সরঞ্জামের দোকান, অহরহ-চালু যৌনকর্ম দেখার দোকান, সবুজ বা ফিকে-সবুজ আবসাঁথ যা র‌্যাঁবো-বদল্যারের প্রিয় ছিল তা পান করার দোকান, যৌনকর্মের ফিল্ম-ডিভিডি-সিডির দোকান, কিনে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য ফোলানো যায় এরকম রবারের যুবতী বা রবারের যুবকের দোকান । ওপরতলায় বিশাল জানালায়, ফিকে লাল আলোয়,  প্রৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ থেকে আনা, প্রায়-নগ্ন যুবতীরা, বসে আছে খদ্দের আকৃষ্ট করার জন্য । রেস্তরাঁর মেনুর মতন, যেমন যৌনকর্ম, তার তেমন দাম বাঁধা, সময়ও নির্দিষ্ট । ওরা যখন মহিলা গাইডের পেছন-পেছন যাচ্ছিল, আরেকটু হলেই এক যুবক গাইডের গায়ের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ত । গাইড সেই যুবকটির হাত ধরে গ্র্যানাইট-বেছানো পথে বসানো একটা ভাস্কর্য দেখালেন, যেটিতে যুবক হোঁচট খেয়েছিল ।

           ব্রোঞ্জের তৈরি ভাস্কর্য, মাই টিপতে উদ্যত পুরুষের হাত । হাজার হাজার আদেখলা পুরুষ তার ওপর দিয়ে হেঁটে, তাকে ঝকঝকে করে তুলেছে ।

          আরেকবার পর্যটনে গিয়েছিল থাইল্যাণ্ডে । সেখানের হট জোন নামের এলাকায়, সারি-সারি কাচের শোকেসে দাঁড়িয়ে আছে, নগ্নবুক, সরু জাঙিয়া পরা তরুণী-কিশোরীর দল, আলু-পটল বাছাই করার মতন তাদের মধ্যে যাকে চাই বেছে নাও । অ্যামস্টারডমের মতন অমন দোকানপত্তর নেই, আছে রেস্তরাঁ আর বার । রেস্তরাঁয় পাওয়া যায় সব রকমের মাংস, কুমির, তিমি, অক্টোপাস, সাপ, হাঙর, কাঙ্গারু, আরও অজানা জীবজন্তুর ।

        ঝণ্টুদা সেদিন বলেছিল, ওঃ, জানিস তাহলে , আমি ভেবেছিলুম এখনও ন্যালাক্যাবলা বোকা হাঁদা গঙ্গারাম থেকে গেছিস ।

        অঞ্জলি রাহুলকে সেই স্কুলের দিন থেকে বোকা, ক্যাবলা, আনস্মার্ট বলে এসেছে বটে ।    

         ফোনে কোনো সাড়া না পেয়ে অঞ্জলির যাদবপুরের ঠিকানায় গিয়েছিল রাহুল । অমন কোনো বাড়িই পেল না খুঁজে, ওই নামের রাস্তা নেই, বাস ডিপোর আশে-পাশের গলিতে বর্ণনা দেয়া সত্ত্বেও, হদিশ দিতে পারল না কেউ, অঞ্জলির মতো কোনো যুবতীর ।”সরু কোমরের যুবতী এ-পাড়ায় নেই, আপনি যে বলছেন, কোমর সরু আর বুক-পাছার মাপ ভারি, অমন মেয়ে এদিকে পাবেন না”, বলে, স্মিত হাসি বিলিয়েছিল একজন টাকমাথা পথচারী ।

         আলিপুরের সেই ফ্ল্যাটেও গিয়েছিল রাহুল । পেটের ওপর গেঞ্জি ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলেন এক মারোয়াড়ি, আর কয়েকটা গোলগাল কিশোর-কিশোরী ; জানালেন যে যারা ভাড়া নিয়েছিল তারা উঠে গেছে, কোথায় গেছে তা জানেন না। রাহুল স্তম্ভিত । ঘটনাটা সত্যিই ঘটেছিল তো, নাকি হ্যাশিশের নেশা দিয়ে গড়ে তুলেছিল অঞ্জলিকে ! কী করেই বা সম্ভব । অঞ্জলির উপহার দেয়া চামড়ার পার্সটা তো ওর হিপ পকেটে রাখা ।

         অঞ্জলির আরেকবার অন্তর্ধানের সংবাদে রাহুলের যা ঘটল, তা হয়ত চিত্তবিক্ষোভ ।

         যেখানেই পোস্টেড থাকুক না কেন, বছরে এক দিন, ১৬ই মার্চ দুপুর দেড়টার সময় গড়িয়াহাটের মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে থেকেছে রাহুল সিংহ, বিয়ে করার আগে পর্যন্ত , যদি, যদি, যদি, যদি, যদি, যদি, অঞ্জলির দেখা মেলে ।

          মেলেনি ।

          গড়িয়াহাট মোড়ের চেহারা পালটে গেছে, ফ্লাইওভার হয়েছে, ফুটপাতে আর হাঁটা যায় না, রাসবেহারির দোকানগুলো চলে গেছে অবাঙালিদের কবজায়, অঞ্জলির দেখা মেলেনি ।

        অথচ যে মেয়েটি  রাহুলকে চেয়েছিল, দিল্লি অফিসে ওর অধস্তন অফিসার সুরেখা রেড্ডি, মমমমমমম, রাহুলের বয়স তখন কত, যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, রাহুলের চেয়ে উনিশ বছরের ছোটো, রাহুলকে পাবার জন্য উন্মাদ, তাকে তো রাহুল প্রশ্রয় দেয়নি, তাহলে কেন  ও নিজে চেয়েছে অঞ্জলি দাশ ওকে প্রশ্রয় দিক । সুরেখা রেড্ডি প্রতিদিন বাংলা তাঁতের শাড়ি পরে আসত অফিসে, একদিন শাঁখা-রুলি পরেও এসেছিল, সহকর্মীদের টিটকিরি সইত, তা যে রাহুলকে ইমপ্রেস করার জন্য, পরে জেনেছিল ও । ঢ্যাঙা, ময়লা, দীর্ঘ চুল, চুলে সুগন্ধী ফুল, ইংরেজি স্কুলের দ্রুত কথা বলার অভ্যাসে রপ্ত ।

         একদিন, ট্যুরে আজমের যাবার জন্য আইটিবিপি বাস স্ট্যান্ডে  টিকিট কাটবে বলে নির্দিষ্ট খিড়কির কাছে পৌঁছে দ্যাখে সুরেখা রেড্ডি দাঁড়িয়ে । ডেনিমের ট্রাউজারে, পিঠে রাকস্যাক, সিনথেটিক জ্যাকেট । রাহুলের কবজি ধরে,

পরিষ্কার বাংলায় বলল, স্যার, আমি দুটো টিকিট কেটে রেখেছি, সামনের সিট, চলুন, ওই যে আমাদের বাস ।

         রাহুল হতবাক । কোনো তরুণী ওর হাত ধরলে যে আচমকা ক্রোধে আক্রান্ত হতে পারে, তা নিজের মধ্যে আবিষ্কার করল । রাগে ওর কানের দু’পাশ দপদপ করতে লাগল ।

         –তুমি বাংলা জানো ? বলল রাহুল । ভাবল, এরকম কেন হয়, এই অন্তরঙ্গ অর্জন যা চাই না, বিষাদের আত্মময়তা, অতীতের অপসৃয়মান শঙ্খধ্বনির আহ্বান, যা শুনতে চাই না, গন্তব্যহীনতার ছকে রাখা পথ, যে রাস্তায়

হাঁটার মতন ফুরসত অবশিষ্ট নেই, হিসেবনিকেশহীনতা, যা অপরিচিত হয়ে গেছে, স্পন্দিত দ্যুতির সর্বস্বতা-বিস্তারী টান, যার চুম্বকত্ব ও ফেলে দিয়েছে, সময়কে অসময়ে রূপান্তরণ, যে ক্ষমতা কবেই বিসর্জিত ।

         হঠাৎ, কোথা থেকে এই যুবতী, এবং কেনই বা ! উল্লসিত দেহ-জাগরণের এ কোন নিমন্ত্রণ ! ও তো চুলে কলপও লাগায় না, পোশাক সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ নেই, পারফিউম-পাউডার লাগায় না— অভীপ্সাহীন দিনানুদৈনিকের অনতিক্রম্য প্রকৃতিজগতে চলে গেছে বহুকাল, লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছে প্রায় দেড় দশক । সর্বোপরি, প্রায় প্রায় প্রায় ভুলে গেছে অঞ্জলিকে দাশ নামের মেয়েটিকে । এখন অঞ্জলি ওর সামনে এসে দাঁড়ালেও পরস্পরকে চিনতে পারবে না । অভিকর্ষহীন হয়ে গেছে, বুঝতে পারবে দুজনে দুজনকে দেখে ।

        এই মেয়েটি, সুরেখা রেড্ডি, ওর, রাহুলের, কেবিনে এসে কোনে রাখা চেয়ারে বসে থাকত কখনও-কখনও । ইয়েস মিস, জিগ্যেস করলে বলত, নাথিং ইমপরট্যান্ট স্যার, আই শ্যাল কাম আফটারওয়র্ডস । রাহুল সেসময়ে বুঝতে পারেনি যে ওর কেবিনে অফিসারদের অবিরাম আসা-যাওয়ার সুযোগ নিয়ে মেয়েটি ওর দিকে তাকিয়ে বসে থাকে । কেবিনের দরোজা খোলা রেখে তাহলে উচিত কাজই করত রাহুল । নয়ত বন্ধ কেবিনে হাত চেপে ধরে কী করে ফেলত কে জানে ।

        রাহুল, বিপদ থেকে কী করে বেরোবে, তা সমান্তরাল চিন্তায় বিশ্লেষণ করে, নির্ণয় নেবার সময়টুকু হাতে পাবার জন্য, একই প্রসঙ্গ আবার তুলল, ইংরেজিতে জিগ্যেস করল, তুমি বাংলা শিখলে কোথায় ?

         আমার মা বাঙালি স্যার । চলুন না , যাবার পথে গল্প করব ।

          রাহুল বেকায়দায় । আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, নিশ্চিত হবার জন্য, পরিচিত কেউ নেই তো । বলল, ইংরেজিতেই, আমি তো ট্যুরে যাচ্ছি, তুমি কী করবে সঙ্গে গিয়ে ? অফিস তো কোনো অ্যাসিসট্যান্ট দেয়নি, আমি সহায়ক নিয়ে কাজ করতে পারি না ।

         মেয়েটি চাপা গলায়, রাহুল টের পেল যে কন্ঠস্বর আবেগে ক্রুদ্ধ, বলল, আই লাভ ইউ, ইয়েস, আমি আপনাকে ভালোবাসি। ইফ ইউ ফিল লাইক, ইউ মে কল ইট লাস্ট ; আমি আপনাকে চাই ।

         হাত ছাড়ো, ট্যুরে যাচ্ছি না । ‘কেউ দেখে ফেলতে পারে’, কথাগুলো বলা উচিত হবে না মনে করে চেপে গেল । বলল, ইংরেজিতেই, বাংলায় কথা বলছ, এখানে বাংলাদেশিরাও রয়েছেন, আজমের শরিফে তীর্থ করতে  যাবার জন্য ।

         নারীসঙ্গ থেকে যতটা সম্ভব নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসে সফল হবার অলস গোমানুষ আনন্দে ছিল এতকাল । কোথা থেকে এই মেয়েটা উদয় হয়ে ওর শান্ত একাকীত্বকে নড়বড়ে করে দিতে চাইছে । ট্যুরে-ট্যুরে ভারতবর্ষের প্রেমে এমনই মশগুল যে অন্য কোনো কিছু আর ওকে আকৃষ্ট করে না । বাউলদের বোধহয় এরকমই হয়, পথে-পথে ঘোরাঘুরি করে, নানা ধরণের মানুষদের সঙ্গে মিশতে-মিশতে — একাকীত্বের পরিসরে আত্মলীন ।

         ট্যুরে না যেতে চান যাবেন না, ছুটি নিন, আমি বললাম না আপনাকে, যে আমি আপনাকে ভালোবাসি । আমি আপনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেবো । আপনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমার সঙ্গে থাকবেন, যদি বলেন তাহলে এখনই আমরা কোথাও চলে যেতে পারি । উধাও হয়ে যাবো । আমি আপনাকে চাই ।

        কী করবে বুঝে উঠতে পারল না রাহুল , এ কি পাগল, কোনো রোগ নেই তো এর, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে, হয়তো কাউকে কিছু না বলে । প্রেমে পড়ার রসদ রাহুলের মনে হল, সবই ও খরচ করে ফেলেছে । এই যুবতীর, যার স্মাগলিং বা অঞ্জলি-জাতীয় কোনো গোপনতার সঙ্গে সংস্রব নেই বলে মনে হচ্ছে, তার প্রস্তাব  আরও কুড়ি বছর আগে পেলে হয়তো ও পিছলে যেতে পারত । এখন তো মগজ একেবারে ফাঁকা — উত্তেজনার গ্রন্হিগুলো অকেজো । স্কুলের শিক্ষকরা ওকে বলতেন অ্যাম্বিশানহীন ; ও এখনও তা-ই রয়ে গেছে, উচ্চাকাঙ্খাহীন । নারীর কোনো জায়গা ওর জীবনে আর নেই। ইজিচেয়ারে ঠ্যাং তুলে, চোখ বুজে, ও এখন বাড়ির বাগানে একা বসে থাকতে ভালোবাসে, প্রজাপতিদের ডানাগুঞ্জন শুনতে পায়, ভেঙেপড়া সোভিয়েত দেশ  থেকে ভরতপুরের দিকে উড়ন্ত সারসদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালোবাসে, ও চায় যে কেউ যেন ডিস্টার্ব না করে ।

        সুরেখা বলল, আমি আজমের গেছি স্যার, আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না, অনেক ভালো-ভালো লজ আছে,

আমরা আজমের শরিফে গিয়ে চাদরও চড়াতে পারব । চলুন, চলুন, কন্ডাক্টার যাত্রীদের ডাক দিচ্ছে, ওই যে, হর্ন বাজাচ্ছে।

         রাহুলের কানে পৃথিবীর কোনো শব্দ প্রবেশ করছিল না । রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমম, বোধহয় কত হবে, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । কি করে এই পাগল অফিসারকে কাটাবে দ্রুত ভাবার চেষ্টা করছিল । ব্রিফকেস বাঁ হাতের ওপর রেখে ডালা খুলে বলল, ইংরেজিতেই, আরে, আমি তো রিপোর্টের ফরম্যাট আনতে ভুলে গেছি ।

তুমি যাবে বলে মনস্হ করেছিলে তো একটা ডুপলিকেট ফরম্যাট রেখে নিতে পারতে । যাকগে, আজকে ট্যুরটা ড্রপ করে দিই, আবার অ্যাপ্রুভাল নিয়ে পরে যাবো । রিপোর্টের কোনো ফরম্যাট হয় না, সুরেখা ধরতে পারল না, ওর স্তরে এই সমস্ত গুরুগম্ভীর ব্যাপার পৌঁছোয় না ।

        –টিকিট তো কাটাই আছে স্যার, চলুন না জাস্ট বেড়িয়ে আসি, দুজনে এক সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাবো ।

        –একে তো ট্যুরে যাচ্ছি না, তার ওপর যদি ছুটি নিয়ে বেড়াতে যাই, জানতে পারলে ডায়রেকটার পারফাংকটারি ডিউটির অভিযোগে চার্জশিট করে দেবেন ; তুমি তো বেঁচে যাবে, আমি দায়িত্বজ্ঞানহীনতার দায়ে পড়ব । আর, সুস্পষ্ট বলল রাহুল, স্ক্যান্ডাল ক্রিয়েট হবে, হাত ছেড়ে দাও, কী করছ কি । জানো না কি আমার ছেলে আর মেয়ে স্কুলে পড়ে ?

        –জানি, আমি আপনার স্ত্রীকেও একদিন বলেছি যে আমি আপনাকে পছন্দ করি ।

        কী বিপদ । এই মেয়েটা ওর জীবনপ্রবাহে বাঁধ তোলার চেষ্টা করেছে তলে-তলে, আর ও কিচ্ছু টের পায়নি । প্রত্যেকদিন নজর রেখেছে হয়তো, চেয়ে-চেয়ে দেখেছে ও কী করছে, কবে কোথায় ট্যুরে যাচ্ছে, একা যাচ্ছে না কারোকে সঙ্গে নিয়ে ।

       –তুমি বাড়ি যাও । আমি জোর করে হাত ছাড়িয়ে সিন ক্রিয়েট করতে চাই না । আমার স্ত্রীকে বিপন্ন করার চেষ্টা করে ভালো করোনি ।

         –তাতে কি স্যার ? আমি পুরো রেসপনসিবিলিটি নেবো । আমার বাবার জমিজমা আছে প্রচুর, আমিও চাকরি করছি । কোনো প্রবলেম হবে না ।

         ‘হাত ছাড়ো’, কন্ঠস্বরে অধস্তনকে বকুনি-মেশানো চাউনি মেলে বলল রাহুল ।

         সুরেখা হাত ছেড়ে দিয়েছিল । ওর হাত থেকে টিকিট দুটো নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিল রাহুল, আর সোজা গিয়ে একটা অটোয় বসে বাড়ি চলে গিয়েছিল ।

         সুরেখা পরের দিন অফিসে আসেনি; দুপুর নাগাদ ওর বাড়ি থেকে সংবাদ এলো যে টয়লেটের অ্যাসিড খেয়ে আত্মহত্যা করেছে সুরেখা রেড্ডি ।

         কোনো সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে কি, জানতে চেয়েছিল আতঙ্কিত রাহুল ।

         না, পাওয়া যায়নি । ওর মা-বাবাও জানেন না কেন অমন কাজ করতে গেল ।

         ভাগ্যিস সুরেখার হাত থেকে বাসের টিকিট দুটো নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল । পুলিশ নির্ঘাত সুরেখার আজমেরের সঙ্গে রাহুলের আজমেরের মিল খুঁজে পেত ।

         বেশ কয়েকদিন পরে সুরেখার লেখা দীর্ঘ প্রেমপত্র, যা ও সম্ভবত কয়েকমাস ধরে লিখেছে, ডাকে পেয়েছিল রাহুল। বাংলা অক্ষর, কিন্তু তেলুগু টানে পাকানো হাতের লেখা । চিঠি আর রাখে না রাহুল, সমস্ত চিঠিই পড়ার পর ছিঁড়ে ফেলে দ্যায় ও । সুরেখার চিঠি সংস্কৃত অভিধানের ভেতরে লুকিয়ে রেখে দিয়েছিল, বহুকাল, ভুগেছে দুশ্চিন্তায়, আমিই কি দায়ি, আমিই কি দায়ি, আমিই কি সুরেখার মৃত্যুর জন্য দায়ি ? এই অপরাধবোধ থেকে মুক্তির উপায় কি হতে পারে ভেবেছে, ভেবেছে, তারপর একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখেছে সুরেখাকে কল্পনা করে, সেই উপন্যাসে নিজেকে পিঁপড়ে আর কুকুর দিয়ে খাইয়েছে রাহুল, আর, আর হ্যাঁ, অদ্ভুত, ওর মনের ভেতরে যে পিঁপড়ে আর কুকুররা ওকে খেয়ে ফেলছিল এতকাল, তা থেকে মুক্তি পেয়েছে । অনেকদিন ধরে ও পিঁপড়ে আর পিট বুল কুকুরের সামনে নিজেকে মনে-মনে ছেড়ে দিয়েছিল ; শেষ পর্যন্ত লিখে ফেলল, কাউকে কিছু জানতে না দিয়ে ।

         ডিটেকটিভ উপন্যাসটা প্রকাশিত হবার পর সুরেখার চিঠি, শেষবার পড়ে, যা রাহুলের প্রায় মুখস্হ হয়ে গিয়েছিল, ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল জুহুর সমুদ্রে । কত তফাত সুরেখার প্রাণবন্ত চিঠির সঙ্গে অঞ্জলির মেকি চিঠির ।

        সুরেখার আত্মহত্যার পরই রাহুলের মাও মারা গেলেন । ভেঙে-পড়া কাকে বলে তার আগে ও জানত না । অঞ্জলি স্মাগলারকে বিয়ে করেছে জেনেও ভেঙে পড়েনি । রাস্তা দিয়ে হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি বেঁধে যখন নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখনও ও ভেঙে পড়েনি।  মামলায় বন্ধুরা বিশ্বাসঘাতকতা করলেও ভেঙে পড়েনি । মায়ের মৃত্যুতে ভেঙে

পড়ল । কেঁদে নেবার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল রাস্তার একপাশে ।

         মায়ের মৃত্যু আর সুরেখার আত্মহত্যার পর থেকেই আবার লেখেলিখি ফিরে এলো রাহুলের কলমে, ভাঙা-ভাঙা ছন্দে, কোনো নারীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেবার রচনা, নিজেকে স্বাধীনতা দেবার রচনা, ট্যুরে পাওয়া দুর্বিষহ ঘটনা থেকে চাগিয়ে ওঠা রচনা । বাংলা ভাষায় কেমনতর অপেরা লেখালিখি সেসময়ে হচ্ছে তার কোনো হদিশ ওর ছিল না, কেননা পত্রপত্রিকা পড়া ছেড়ে দিয়েছিল বহুকাল ।

         ঢাকার এক সম্পাদক, মাহমুদ রহমান, কোথা থেকে ওর ঠিকানা যোগাড় করে অবিরাম অনুরোধ করছিলেন লেখা পাঠাবার জন্য । কয়েকমাসে কয়েকটা অপেরাপ্রতিম লেখা লিখে রাহুল পাঠিয়ে দিয়েছিল , আর ভুলে গিয়েছিল । অনুমান করতে পারেনি যে সেগুলো ঢাকায় প্রকাশিত হবার পর সেখানকার অন্যান্য লিটল ম্যগাজিন সম্পাদকরা ওকে অবিরাম  চিঠি লিখতে থাকবেন লেখা পাঠাবার অনুরোধ জানিয়ে ; স্মৃতিকথা লেখার অনুরোধ জানাবেন এক বৃদ্ধ সম্পাদক ।

          উৎসাহিত রাহুল নেমে পড়ল নিজের একাকীত্বের কুয়োর ভেতরে, টের পেল যে ওর লেখার ধারা পালটে গেছে, তাতে আন্দোলনের তাপস্নিগ্ধ আত্মস্বীকৃতির রেশ আর নেই । তার বদলে উঠে এসেছে ট্যুরে পাওয়া, অন্যের জীবনের বা শহর-গ্রামের কারোর অঘটন-দুর্ঘটনার বিপর্যয় ।

        আবার লিখতে আরম্ভ করে, রাহুল তখন জয়পুরে, ওর অজান্তে, হিন্দি ভাষার পত্রপত্রিকায় ওর ফোটো আর আন্দোলনের সংবাদ পুনঃপ্রকাশিত হতে থাকায় , ও তখন বিভাগীয় প্রধান, আকর্ষণ গড়ে ফেলেছিল অপরূপা হিন্দি-ভাষী এক তরুণী কর্মীর দৃষ্টিতে ।  ওর লেখালিখি বারবার গোলমাল সৃষ্টি করেছে, ওর জীবনে তো বটেই, অন্যের জীবনেও । সেই তরুণীর নাম সঙ্গীতা মনসুখানি ।

         অফিস টাইম শেষ হবার পরও ঘণ্টা দেড়েক বসেছিল রাহুল ; বেসমেন্ট থেকে গাড়ি বের করতে ওর অধস্তন কর্মচারী, যার গাড়িতে ও বাসায় ফেরে, হায়দার হুসেইনের সময় লাগবে, অবসর নেবার বয়সে পৌঁছে গেছে লোকটা । স্লোপে রিভার্স করে সহজে গাড়ি তুলতে পারে না ওপরে । কেবিনে বসে গাড়িটার বেগড়বাঁই শুনতে পায় । হায়দার হুসেইনের হর্ণ না বাজা পর্যন্ত আরও কয়েকটা ফাইল ক্লিয়ার করে নিতে পারে, অনায়াসে । হঠাৎ ফুঁপিয়ে কান্নার মেয়েলি আওয়াজ । উইনডো এসিটা শব্দ করে বলে, বন্ধ করে উৎকর্ণ হল রাহুল । হ্যাঁ, ঠিক তাই, চাপা কান্না ।

        কেবিন থেকে হলঘরে বেরিয়ে রাহুল দেখল সব আলো জ্বলছে, ফ্যানগুলো চলছে, সানমাইকার অত্যুজ্বল কিউবিকলগুলো ফাঁকা । বিভাগীয় প্রধান হবার দরুন প্রতিদিন ও মাথা ঘুরিয়ে একবার চারিদিকে না তাকিয়ে পারে না,  অভ্যাসমতো চাউনি যেতেই, দেখল সঙ্গীতা মনসুখানি, বিষন্ন সুন্দরী, ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে । চোখ তুলে রাহুলের দিকে তাকাতেই ছাঁৎ-করার বোধে আক্রান্ত হল ও । বিভাগের প্রধান হিসাবে দূরত্ব বজায় রাখতে হয় বলে কখনও কথা বলেনি।  সুমিতাদির পর, এত সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ ওর হয়নি আজও । কান্নাটা বেশ সিরিয়াস । কী করবে ও । মোবাইলে হায়দার হুসেইনকে দ্রুত ওপরে আসতে বলল ; মেয়েটির ডেস্কের উল্টো দিকে দাঁড়াল গিয়ে, আর কাঁপা কন্ঠস্বরে জিগ্যেস করল, ‘কী হল মিস মনসুখানি, কাঁদছেন কেন ? বাড়ি যাননি কেন ? কী হয়েছে কী ? কমপ্লেন করলেই তো পারতেন । সামথিং পার্সোনাল ? অসুবিধা না থাকলে আমায় বলুন । দেখি কী করতে পারি ।

        মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে, সুমিতাদির পর আরেকবার, অপরূপ শব্দটার মানে স্পষ্ট হয়েছিল রাহুলের । কী ফর্সা । টকটকে লিপ্সটিক । গভীর চোখ। ছোট্টো কপাল । কোঁকড়া চুলে মেক্সিকান বিনুনি । ম্যানিকিওর করা নখে টকটকে নেলপালিশ । কানে পান্নার দুল । গলায় সোনার হারে বড়ো মাপের পান্নার লকেট । ছোট্টো হাতঘড়ি । বাঁ হাতের সব আঙুলেই আজকালকার আংটি, বুড়ো আঙুলেও । ঝিরিঝিরি বিদেশি পারফিউম । তার মানে মাইনের অনেকটা সাজগোজে যায় । গলা-খোলা সবুজ ডিজাইনার পোশাকটারই যথেষ্ট দাম হবে ।

         হায়দার হুসেইন হন্তদন্ত এসে হাঁপাতে-হাঁপাতে মেয়েটিকে জিগ্যেস করল, ‘আয়া কোথায় ? আয়া আসেনি এখনও?’

         হায়দারকে দেখে আত্মস্হ মেয়েটি বলল, আয়া তিনটের সময় এক্ষুনি আসছি বলে এখনও আসেনি, মাকে ফোন করেছিলাম, বাড়িতেও যায়নি । কথা শেষে আলতো ফুঁপিয়ে ওঠে তরুণী ।

        কেঁদো না, কেঁদো না, আমি তোমার হুইলচেয়ার আনছি । বলে, রাহুলের হাত ধরে লিফটের দরোজার কাছে টেনে নিয়ে গিয়ে হায়দার হুসেইন বলেছিল, সঙ্গীতা মনসুখানি  কোমরের তলা থেকে বিকলাঙ্গ , পা দুটো নেই বললেই চলে, চাকরি পেয়েছে প্রতিবন্ধি কোটায়, প্রাইভেটে পড়ে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর, একাডেমিক রেকর্ড ভালো, চব্বিশ ঘণ্টার আয়া আছে, সে-ই ওকে অফিসে আনে আর নিয়ে যায়, অফিসে বাড়িতে বাথরুম করায়, বাবা নেই, মা স্কুল টিচার

ছিলেন, ওর হুইলচেয়ার বা প্রতিবন্ধি পুশকার্টটা বেসমেন্টে রেখে যায় আয়া, হয়তো কোথাও গিয়ে আটকে পড়েছে, এরকম ব্যাপার তো ঘটেনি কখনও আগে, এমনিতে তো ও সকলের আগে সাড়ে চারটের সময়েই চলে যায়, আমি ওর পুশকার্টটা আনছি ।

      বোকা-বোকা, অসহায়, কর্তত্বের অনুপযুক্ত মনে হয়েছিল নিজেকে, রাহুল সিংহের, হায়দার হুসেইনকে নিয়ে লিফট নিচে নেমে যাবার পর । অধস্তন স্টাফদের ব্যক্তিগত সমস্যাকে আমল দেয়নি । দৃশ্যমান অর্ধেকটুকু দেখে, মেয়েটি সম্পর্কে রঙিন ছবি এঁকে ফেলেছিল মগজে, অথচ জীবনের নিষ্পত্তি হচ্ছে বাকি অর্ধেকটা দিয়ে, যা টেবিলের আড়ালে

থেকে গেছে ।

         অর্ধেক সুমিতাদি ! বাকি অর্ধেক খেয়ে ফেলেছে বিপ্লবের স্বপ্ন !

         বিকলাঙ্গের ঠেলাগাড়ি, বিশেষভাবে তৈরি, পেরাম্বুলেটারের আকারে, নিয়ে ঘর্মাক্ত হায়দার পৌঁছোলে, দুজনে মুখ চাওয়া-চায়ি করে যে অনুচ্চারিত কথাগুলো বলল, মেয়েটিকে তুলে ওর গাড়িতে বসাতে হবে, তা তো ভাবিনি, কে তুলবে, কী ভাবে ?

         হায়দার বলেছিল, স্যার, আমি গতবছর বাইপাস করিয়েছি, তাছাড়া এখনও হিন্দু-মুসলমান রাজনৈতিক গোলমালের রেশ মেটেনি, কী থেকে যে কী ঘটে যায় আজকাল তার ঠিক নেই, তখন মেয়েটি বলেছিল, স্যার, আমি আরেকটু অপেক্ষা করছি, আয়া এসে যাবে নিশ্চয়ই ।

          রাহুল ভাবল কী ভাবে তুলবে, যেভাবেই তুলুক না কেন, জড়িয়ে তুলে ধরা ছাড়া উপায় নেই । এত সুন্দরী তরুণীকে জীবনে কখনও জড়িয়ে ধরার অভিজ্ঞতা ওর হয়নি, সুযোগ হয়নি কখনও । যাকে ও চেয়েছিল, যে ওকে না-পেয়ে  আত্মহত্যা করেছে, তহমিনা আপা, কাউকেই সুন্দরী বলা যায় না, গালে টোল পড়লেও, সুমিতাদি ছাড়া । সুমিতাদি স্কুলে রাহুলের চেয়ে তিন ক্লাস উঁচুতে পড়তেন, কতদিন ওনার বৈঠকখানা ঘরে গিয়ে কোমর জড়িয়ে ওপরে তোলার ইচ্ছে হয়েছে, তুলে, চেঁচাতে ইচ্ছে করেছে, কমরেড সুমিতা জিন্দাবাদ ।

         সুমিতাদিকে কল্পনা করে, সঙ্গীতাকে জড়িয়ে ধরার তীব্র ইচ্ছা হল, আর রাহুল একটু ঝুঁকতেই, দু’হাত ওপরে তুলল যুবতী, যেভাবে কোলে ওঠার জন্য শিশুরা তোলে, হয়ত ছোটোবেলা থেকে যান্ত্রিক অভ্যাস ।

         বুকে জড়িয়ে রাহুল তুলে নিয়েছিল সঙ্গীতা মনসুখানিকে,  আর যা ও ভাবতেও পারেনি ঘটতে পারে, মেয়েটি ওর গলা জাপটে দুদিক থেকে আঁকড়ে কাঁধে মাথা রেখে প্রায় গালের কাছে নিজের ঠোঁট চেপে রাখল, ভিজে-ভিজে শ্বাসের গরম ভাপ, মনে হল রাহুলের । স্পর্শের নেকট্যে সম্পূর্ণ সঙ্গীতাকে অনুভব করতে পারছিল রাহুল, সে বিকলাঙ্গ হলেও, কোমরের তলায় শীর্ণ উরু আর বিকৃত পা হলেও । একজন সুন্দরী, সুসজ্জিতা, সুগন্ধমাখা যুবতীর তাজাগরম দেহ, নিম্নাঙ্গ তার সম্পূর্ণ না থাকলেও, জড়িয়ে ধরার রসায়ন শুরু হয়ে গিয়েছিল রাহুলের আগাপাশতলা । ওর পুশকার্টে নামিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে দেবার সময় বুকে হাত ঠেকল । বুকে হাত ঠেকতেই মনে পড়ল, অঞ্জলি বলেছিল, পুরুষগুলো লেচার হয় ।

        সুমিতাদির কোমর জড়িয়ে ওপরে তুললে কী বলতেন উনি ?

        কত আর ব্যা-ব্যা-ব্যা-ব্যা করবি !

        রাহুল বলত, কী করি, রামছাগলরা এরকমই হয়, ব্যা-ব্যা-ব্যা-ব্যা…

         বেসমেন্টে গিয়ে হায়দার হুসাইনের গাড়িতে তোলার সময়ে আরেকবার জড়িয়ে ধরার সুযোগ পেল রাহুল, কিন্তু এবার সঙ্গীতা মনসুখানি নিজেই ওর কোমর আঁকড়ে ধরল, যাতে ও তুলে নিয়ে গাড়ির ব্যাক সিটে বসিয়ে দিতে পারে । আলিঙ্গনের মধ্যেই খুলে দিল মেয়েটির সিট বেল্ট, বুকে কয়েকবার হাত লাগা ছাড়া উপায় ছিল না ; হৃৎস্পন্দনের পারস্পরিক আলতো দামামার আদান-প্রদানের মাধ্যমে দুদিক থেকে পাছার তলায় হাত দিয়ে  এক লপ্তে তুলে নিয়েছিল মেয়েটিকে, আর টের পেয়েছিল খাপে-খাপে বসে গেল নিজেদের চনমনে প্রত্যঙ্গ । রাহুলের মনে হয়েছিল, মিস মনসুখানি যেন বিকল অংশটা ঠেসে ধরেছে ওর সচল অংশে । সম্ভবত ও-ই এই মেয়েটির প্রথম পুরুষ, পুরো অবয়ব কেঁপে-কেঁপে উঠেছিল মেয়েটির । সঙ্গীতার বাড়িতে পৌঁছেও একই কাজ আরেকবার ধাপে-ধাপে করতে হল রাহুলকে । মেয়েটি ওর হাত ধরে বার-বার থ্যাংকস জানিয়েছিল । পরে, রাহুলের মনে হয়েছে, আয়ার না আসা কী ইচ্ছাকৃত, কেননা থ্যাংকস জানাবার পরও সঙ্গীতা ওর হাত ছাড়তে চায়নি কেন ।

        রাহুলের রগ দপদপ করে বলছিল, লেচার লেচার লেচার লেচার….

         কেন, সুমিতাদি ?

         ঘটনাটা স্মৃতিতে যখনই ভেসে উঠেছে, রাহুলের ভেতরের কুকুর ওকে ঘেউ-ঘেউ করে মনে করিয়ে দিয়েছে যে ওই একটি ঘণ্টায় সে একজনকে আকর্ষণের তীব্র মাতলামিতে টেনে নিয়েছিল, যে ধরণের আকর্ষণ তহমিনা আপা,  অঞ্জলি, এমিলিয়া বনিয়া, মীরা, সুরেখার কাছ থেকে পায়নি । একজন মেয়ের ভালোবাসা আরেকজনের থেকে একেবারে পৃথক হয়, তার কারণ ব্যক্তি হিসাবে একটি মেয়ে আরেকটি মেয়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ।

        মীরা ব্যানার্জি । সুরেখার মতনই আরেক নারী যে প্রথম পরিচয়ের দিনই রাহুলকে স্তম্ভিত করে, জানিয়েছিল, ওর ইউটেরাস নেই । রাহুলের বয়স তখন কত হবে, মমমমমমম, বোধহয় কত , সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়  । প্রথম পরিচয়ের দিনই একজন যুবতী কেন এরকম একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার তাকে জানাল, তা ওর দুশ্চিন্তা হয়ে

উঠেছিল। তার পর মীরা একদিন বলল, সুরেখার ঢঙেই, আপনার স্ত্রীকে আমি বলেছি, আপনাকে আমি পছন্দ করি । যে ইঁটগুলো দিয়ে রাহুল নামের বাড়িটা গড়া, সেটাকে ভাঙার প্রয়াস কেন করেছে সুরেখা আর মীরা, তার কুলকিনারা সেদিন পায়নি রাহুল । ওকে দেখতে তো স্মার্ট নয়, শরীর থেকে যৌনগ্রন্হির গন্ধও ওড়ায় না, সাদামাটা আটপৌরে চেহারা, মহিলাদের সঙ্গে কথা বলতে কুন্ঠিত বোধ করে, রেকলুজ, কম কথা বলে, তবু কেন ও কাউকে-কাউকে আকর্ষণ করে ফ্যালে ।

        একদিন, অফিসে নিজের কেবিনে কাজে মশগুল ছিল, তবু প্রচণ্ড একটা আওয়াজ শুনতে পেয়ে, রাহুল অনুমান করল, অ্যানি বেসান্ত রোডে গাড়িতে-গাড়িতে ধাক্কা লাগল ;বৈভবশালীদের শহর, অঢেল টাকা, ডজনখানেক গাড়ি, ধাক্কা লাগলেও গায়ে মাখে না । একটা গাড়ি আচমকা থামলে, তার পেছনের সব গাড়িগুলো একটার পর একটার পেছনে ধাক্কা মারতে থাকে । আরেকবার অমন আওয়াজ হতেই, রাহুল দেখল যে মীরা ব্যানার্জি ওর হাত ধরে টান দিয়ে বলছে, চলুন, চলুন, বেরোন, শিগগির বেরোন, ভূমিকম্প হচ্ছে ।

          মীরা ওকে টেনে কেবিনের বাইরে নিয়ে যেতে, রাহুল দেখল, সত্যিই, অফিসার আর কর্মীরা সবাই দৌড়োচ্ছে হলের বাইরে , সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে ওপরতলার কর্মিরা । মীরা ওর হাত ধরে টানতে-টানতে বাইরে ভিড়ের মধ্যে এনে দাঁড় করিয়ে দেবার পর, সমবেত সবাই দেখল, ভূমিকম্প নয়, ওদের অফিস বিল্ডিংটাই, ওপরতলা থেকে একেরপর এক ফ্লোর নিয়ে শব্দ করে, সিমেন্টের ধুলো উড়িয়ে, পড়ছে । রাহুলের চোখের সামনে, কয়েক মিনিটের ভেতর, পড়ে গেল বিশাল দশতলা বাড়িটা ।

         মীরাকে ধন্যবাদ জানাতে, ও বললে, বলেছিলাম তো আপনাকে যে আমার ইউটেরাস জন্ম থেকে নেই । যাকে পছন্দ হয়, তাকে ইন্সটিংক্টিভলি পছন্দ হয় ; ওই পছন্দের পরিবর্তে তাকে কিছু উপহার দিই । আমি এভাবেই, আজ পর্যন্ত, আপনাকে নিয়ে, সাতজনকে বাঁচিয়েছি । আজকে আপনাকে আরও বেশি করে বাঁচবার জন্য সময় উপহার দিলাম।  মনে রাখবেন ।

         ব্যাস, স্মৃতিতে তুলে রেখেছে রাহুল । অজস্র স্মৃতি-ছবির একটা । ওর বিভাগের কেবল একজন মারা গিয়েছিল, বিল্ডিংটা চাপা পড়ে । যে মারা গিয়েছিল, তার অভ্যাস ছিল জুতো খুলে খালি পায়ে বসে কাজ করা । হল ছেড়ে পালাবার চেঁচামেচি শুনে জুতো পরবার জন্য টেবিলের তলায় মাথা ঝুঁকিয়েছিল, তাতে যেটুকু দেরি হয়েছে, বাইরে বেরোবার সময় পায়নি । রাহুলকে অমন সময়টুকু পাইয়ে দিয়েছিল মীরা ।

         ওপরতলা থেকে চোদ্দজন সময়মতো নামতে পারেনি । তাদের থ্যাঁতলানো দেহ সিমেন্টের চাঁই সরিয়ে কয়েকদিন পর পাওয়া গিয়েছিল ।        

         যে মেয়েটিকে রাহুল বিয়ে করল, সুমনা  সেন, তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল এক তামিলভাষী তরুণী । রাহুলের বয়স তখন কত, বোধহয় আঠাশ, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় ।  সেবারও ট্রেনিং নিতে গিয়েছিল চেন্নাইয়ে।

         এত রকমের ট্রেনিং ওকে দিয়েছে ওর গ্রামীন উন্নয়ন অফিস যে চাকুরির এক চতুর্থাংশ সময় ওর কেটে গেছে ট্রেনিং নিতেই। কী ট্রেনিং যে নেয়নি ! বিদ্যুৎ প্রসারণ, তাঁতের কাজ, চাষের কাজ, খাল তৈরি, জমিতে নিয়ে যাবার পিভিসি পাইপ, ঘাসের রকমফের, হরটিকালচার, প্ল্যান্টেশান, ছোটোএলাচ, ঋণখেলাপির কার্যকারণ, সহযোগীতা, আরটেজিয়ান কুপ, শ্যালো বনাম ডিপ, মৎস্যচাষ, দুধ-কোঅপারেটিভ, গোপালন, মাংসের প্রক্রিয়াকরণ, নদীর বাঁধ, কোল্ড স্টোরেজ, আলু চাষ, চাষের যন্ত্রের ব্যবহার, ক্ষুদ্র সেচ, গ্রামের বউদের জন্য কমপিউটার, একই ট্রেনিঙের রিফ্রেশার কোর্স ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি । এরকমই একটা ট্রেনিং নিতে গিয়ে সুমনার সঙ্গে ওর আলাপ । বাংলা তাঁতের শাড়ির সঙ্গে হাই হিলে পেখমতোলা সুমনাকে, পরিচয়ের পরমুহূর্তেই সরাসরি বলেছিল, ‘আপনাকে বিয়ে করতে হলে

আপনাদের বাড়িতে কার সঙ্গে কথা বলতে হবে ?’

       –বড় মামার সঙ্গে, আমার বাবা-মা ছোটোবেলায় মারা যান, আমি মামার বাড়িতে মানুষ ।

       চেন্নাইয়ের মাউন্ট রোডে ওদের বাংলোবাড়িতে গিয়ে রাহুল দ্যাখে, ড্রইংরুমে সাজানো নানা মাপের কাপ আর শিল্ড, দুটো কুকুর, বারান্দায় বেতের চেয়ার, টুপি টাঙাবার আর ওভারকোট ঝোলাবার আয়নালাগানো র‌্যাক ; একটা আলমারিতে গোটা দশেক রাইফেল আর বন্দুক । লাল ড্রাগেট বেছানো ঘরে অজস্র ইংরেজি পেপারব্যাক, এত পুরানো যে পাতা ওলাটানো গেল না সহজে, দেয়াল-ঘেঁষা তাকগুলোয়, বোঝা যায় যে কুড়ি-পঁচিশ বছরের ওপর কেউ হাত দেয়নি ওগুলোয়, পৃষ্ঠাগুলো কালচে । রাহুলের প্রথম প্রতিক্রিয়া, যাকে বলা যায় স্টান্ড । কোথায় চেন্নাইয়ের এই অভিজাত পরিবার আর কোথায় ওর নিম্নবিত্ত দিন-আনি-দিন-খাই পরিবার ।

        সুমনার বড়মামা চন্দ্রনাথ গুপ্ত, রাহুল জেনে নিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ধাপে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত, বাড়ি ছিলেন না । মেজমামা, সূর্যনাথ গুপ্ত, স্যুটপরা, ঢুকলেন ড্রইংরুমে, নিজেই আগাগোড়া কথা বলে গেলেন, ওনাদের বিখ্যাত হিন্দি-ইংরেজি-তামিলে চোবানো বাংলায় । ওনার ঠাকুর্দা রহড়ার, যেখানে উনি, যাননি কখনও, রাহুলও যায়নি । বাবা ছিলেন ইন্সিওরেন্স কোম্পানির মালিক । ইন্সিওরেন্স ন্যাশানালাইজেশান হবার পর ওনাদের আর্থিক অবস্হা পড়ন্ত ।

পড়ন্ত শুনে আস্বস্ত হয়েছিল রাহুল । সে-কারণেই সুমনাকে চাকুরি করতে পাঠানো হয়েছে । এ-কথা শুনে আবার দমে গিয়েছিল রাহুল । সুমনার নিজের বোন সুচরিতা আর মামাতো বোন বসুধা ক্যাথলিক স্কুলে পড়ায়, বাড়িতে টিউশানির কোচিং ক্লাস নেয় ওরা । 

          কাচের আলমারি থেকে দু’তিনটে বন্দুক আর রাইফেল বের করে তাদের ক্যারদানি দেখালেন মেজমামা । সুমনা ওর মামাতো বোনেদের বলে থাকবে যে রাহুল বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে : পরিচয়মাত্রই প্রস্তাব, এরকম পাত্র ওরা দেখেনি আগে, রাহুলও দেখেনি । এক-একজন করে এসে দেখে যাচ্ছিল ওকে । রাহুলের মনে হল, প্রত্যেকেই, বিয়ে করার উপযুক্ত । সবাইকে একসঙ্গে বিয়ে করে নিয়ে গেলে মন্দ হয় না, এক-এক ঋতুতে এক-একজন ।

        রাহুলকে কথা বলার, প্রস্তাবটা পাড়ার সুযোগ না দিয়ে, মেজমামা এমন অবিরাম কথা বলতে থাকলেন যে রাহুলের সন্দেহ হল, সম্ভবত ইনি চাকুরে ভাগ্নিকে হাতছাড়া করতে রাজি নন । মেজমামা বললেন, ওনারা তিন ভাই দু’বোন । ছোটো বোন পনেরো বছর বয়সে মারা গেছে । সুমনার মা মারা গিয়েছিলেন সুচরিতা যখন এক মাসের । ওনাদের দুটো গাড়ি ছিল, শেভ্রলে, দুটোই জেড-ব্ল্যাক । এখন আছে ফাঁকা গ্যারাজ, যেটা সার্ভেন্ট কোয়ার্টার হিসেবে কাজে লাগে । ছোটোভাই থাকে ভুসাওয়ালে । ওনার বাবার আরও দু’জন ভাই, দু’জনেই বিয়ে করেননি, একজন জীবিত । বাবা গ্রীষ্মকালে লণ্ডনে গিয়ে থাকতেন । আলমারিতে লণ্ডনের কাটলারি, নীল ফিনফিনে ।

         বিলেতফেরত হবার ছাপ ওদের টয়লেটে দেখেছিল রাহুল, টয়লেটে পায়খানার জন্য চেয়ার রাখা, যে  চেয়ারের বসার জায়গায় গোল করে কেটে এনামেলের ডেকচি বসানো, ওই ডেকচিতে হাগতে-মুততে হবে, কাজ হয়ে গেলে কবজা-লাগানো কাঠের পিঠটা ফেলে ঢাকা দিতে হবে, পরিষ্কার করার জন্য দুপুরে আর রাতে মেথর আসে । কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে হাগতে বসে টুং-টাং শব্দ উঠবে থাতব ডেকচি থেকে ।

            বিয়ের প্রস্তাব দিতে গিয়ে, দু’বার শরবত খেয়ে,  রাহুলের পক্ষে পেচ্ছাপ চেপে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না বলে বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছিল, নয়তো অন্যের বাড়ি গিয়ে টয়লেটে, যাকে সবাই এখন ওয়াশরুম বলে, যাওয়া এড়িয়ে যায় রাহুল । এখন, ওর বয়স সত্তর, তাই কারোর বাড়ি একেবারেই যেতে চায় না, প্রস্টেটের দরুন টয়লেটে বার কয়েক ঢোকবার আশঙ্কায় ; গেলেও, সেদিন জল আর তরল খাওয়া নিয়ন্ত্রণে রাখে ।

        মেজমামার বক্তৃতার জন্য সেদিন রাহুলের প্রস্তাব জানাবার সুযোগ হয়নি । পরের দিন যেতেই বহু প্লেট এসে গেল রাহুলের সামনের সেন্টার টেবিলে, নানা রকম খাবার সাজানো, যাকে বলে থরে-থরে । পেটুক রাহুলের কাছে আটপৌরে বাঙালি রান্নার বাইরে অন্যধরণের রান্না বেশ গুরুত্বপূর্ণ । ও জানতে চাইলে, ওকে যখন জানানো হল যে যাবতীয় রান্না সুমনা করেছে, বিশেষভাবে রাহুলের জন্য, তখন ওর পেটের আনন্দ মুখময় ছড়িয়ে পড়েছিল ।

          সুমনার বড়-মাইমা ড্রইংরুমে ঢুকে রাহুলের ইন্টারভিউ নিতে বসলেন । রাহুলের বহু গুরুত্বপূর্ণ ইনটারভিউ, যেগুলো ছাপা হয়নি, অথচ যেগুলো প্রকাশিত হওয়া সবচেয়ে জরুরি ছিল, এই ইনটারভিউ তার অন্যতম । রক্তিম চাটুজ্জে ওনার প্রেমিকার বাবার নেয়া এই ধরণের ইনটারভিউতে ফেল করে রাহুল-বিরোধী, অনিকেত-বিরোধী হয়ে গিয়েছিলেন । ইনটারভিউতে  রাহুল সফল হলেও, ও শুনতে পেল ভেতরে গিয়ে বড়মাইমা সুমনাকে বলছেন, তোর চেয়ে বয়সে ছোটো মনে হচ্ছে, যা, রাহুলের মনে হল, সম্ভবত পারিবারিক রাজনীতির মারপ্যাঁচ ।

      একটু পরে সুমনার বড়মামা ফিরলে, গ্রুপ ডিসকাশান হল, যার আলোচ্য বিষয় ছিল রাহুলের জন্মসন, অনিকেতের জন্মসন, রাহুলের বাবার জন্মসন, বাবা-মা স্কুলের মুখ দ্যাখেননি বলে ওর আর অনিকেতের জন্মসন স্কুলে ভর্তির দিন পাঁজি দেখে শুভ দিন খুঁজে রাখা হয়েছিল শুনে অবাক হলেন না, কেবল ঘাড় নাড়লেন, যার মানে হয়তো ‘কোথ্থেকে এই ছোটোলোকটাকে ধরে আনল সুমনা’, কিংবা ‘ও আচ্ছা, চলবে, এরকম পরিবার ইউপি সাইডে আছে বটে।’

          চাকুরির বয়স, কত মাইনে ইত্যাদি জানতে চেয়ে উপরি নেই শুনে উপস্হিত সবাইকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল, কিন্তু ট্যুরের টিএ-ডিএ থেকে টাকা বাঁচে শুনে আস্বস্ত হলেন, যে টাকা রাহুল এতকাল উড়িয়ে আনন্দ পেতো । প্রাথমিকভাবে রাহুল সেলেকটেড হল, কিন্তু, হ্যাঁ, ওনাদের একটা কিন্তু আছে, আর তা হল, আগামি মাসের চার তারিখে মেজমামার বড় মেয়ের বিয়ে, পাত্র কাস্টমসে কাজ করে, অনেক উপরি, ক্যাশ এবং কাইন্ড দুইই।         

         রাহুল বিয়ে করছে জানিয়ে কানপুরে বাবাকে, আর অনিকেতকে ওর অফিসের ঠিকানায় সিংভূমে টেলিগ্রাম করে দিয়েছিল, সুমনার মামাদের অনুমতি পাবার আগেই । তার কারণ রাহুলের প্রচারিত চরিত্রদূষণের কারণে রাহুলের মা, যাকে বলে প্রকাশ্যে, ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, যে,  রাহুল যে-কোনো যুবতীকে সিঁদুর পরিয়ে বাড়িতে আনলে তাকে

তৎক্ষণাত বাড়ির ছোটো বউএর স্বীকৃতি দেয়া হবে, জাত-ধর্মের ক্রাইটেরিয়া প্রযোজ্য হবে না, যেহেতু ওগুলো রাহুল আগেই খুইয়ে বসে আছে ।

          মামা-মামিদের ইতস্তত উসখুসভাব দেখে রাহুল আবার দুটো টেলিগ্রাম করে দিয়েছিল, বাবাকে আর অনিকেতকে,  ‘ম্যারেজ ক্যানসেল্ড’ । রাহুল আঁচ করল যে সংসারে সুমনার আর্থিক অবদান এতই জরুরি যে ওকে এখনই ছাড়া যাবে না । সুমনার দাদামশায় যা রোজগার করতেন তার পুরোটাই ইংরেজিয়ানায় খরচ করে দিতেন, ফলে সঞ্চয় নামের কোনো পুঁজি নেই । সেই লোকদেখানো আভিজাত্য টিকিয়ে রাখতে গিয়ে তথৈবচ হালচাল । অফুরন্ত রোজগার করতেন বলে বেঁচে থাকতে ছেলেদের চাকরি করতে দেননি, ভাড়া নেয়া বাংলোয় বসবাস করে নিজের বাড়ি কেনার কথা চিন্তা করেননি । তিনি মারা যাবার পর, ছোটো ছেলে, যার তখনও চাকরিতে ঢোকার বয়স ছিল, সুমনাদের চেন্নাই এসট্যাবলিশমেন্ট থেকে কেটে পড়ে, রেলের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন, রেলের জনৈক কেউকেটা কর্তার চিঠির জোরে, যিনি, সেই কেউকেটা কর্তার শর্ত ছিল যে তাঁর একাধিক মেয়ের একটিকে, যাকে পছন্দ, বিয়ে করতে হবে ।

         গল্প-উপন্যাসের মামা-মামির সংসারে যেমন হয়, ততটা না হলেও, সুমনা আর ওর বোনকে মামাতো বোনেদের চেয়ে বেশি শ্রম দিতে হতো, বিশেষ করে প্রতিদিন সবায়ের জন্য রুটি বেলা আর সাঁকায় ।

         –কতগুলো রুটি ? জানতে চেয়েছিল রাহুল ।

        –ছেচল্লিশটা !

        –আমাদের কানপুরের বাড়িতে কাজের মাসি আছে, যে রুটি বেলে-সেঁকে দিয়ে যায় ।

        –গিয়ে ছাড়িয়ে দেব ।

        –এখনও তো মামারা ফাইনাল করে উঠতে পারছেন না ।

        –করবেন ।

        ক্যানসেল টেলিগ্রামের পরের দিন সুমনা রাহুলের ট্রেনিং সেন্টারে এসে হাজির, বড় মাইমা ডেকে পাঠিয়েছেন । গেল রাহুল । ওনারা রাতভর শলা-পরামর্শ করে নির্ণয় নিয়েছিলেন যে চাকুরি করে না এমন এক মামাতো বোন, যাকে রাহুলের পছন্দ, বিয়ের প্রস্তাব দেবেন । কিন্তু সুমনার ছোটোবোন সুচরিতার প্রস্তাবে ওনারা বিপদে পড়লেন । সুচরিতা জানালো যে রাহুলকে দেখে ওর ভালো লেগেছে, তাই ও-ই রাহুলকে বিয়ে করবে, কারোর কোনো চিন্তার প্রয়োজন নেই । শুনে, বেশ লেগেছিল রাহুলের, ও-ই যেন স্বয়ম্বর সভায় বসে আছে,  আর রাজকুমারীরা প্রতিযোগীতায় নেমেছেন।

            পরিবারে একাধিক বিয়ের বয়সী মেয়ে থাকায় দুই মামার মতবিরোধের মাঝে পড়ে গিয়ে সুমনাকে ওনারা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন, নয়তো পরে ওর জন্য পাত্র তো ওনাদেরই খুঁজতে হবে, টাকাকড়ি খরচ করতে হবে, আর তখন যদি না পাওয়া যায় ! মেজমামা রাহুলকে হুকুম করলেন, ওনাদের টেলিফোন থেকে কানপুরে বাবাকে টেলিফোন করতে , ওনারা কথা বলতে চান । রাহুলদের কানপুরের বাড়িতে টেলিফোন ছিল না । বাবাকে আর অনিকেতকে ওনাদের টেলিফোন থেকে ফোনোগ্রাম করে দিল ।

         ফোনোগ্রাম করার পর, কার্ড ছাপাবার জন্য, মেজমামা তথ্য নিলেন ইংরেজিতে, কেননা বাংলা ভাষায় ওনার

অনুপ্রবেশ ঘটেনি । মেজমামাকে তথ্য দিচ্ছিল রাহুল, দেখল সুমনা আর ওর ছোটো বোন ইংরেজিতে তর্কাতর্কি চেঁচামেচি করতে-করতে বাংলোর ঘেট খুলে দৌড়োলো, বাইরে মাউন্ট রোডে, তখন সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকার । রাহুলের দিকে তাকিয়ে সুমনা বলল, ‘ও-ই আপনাকে বিয়ে করতে চাইছে, অ্যাডামান্ট’ । ওদের পিছনে ছুটে দুজনকে দুহাতে ধরে, ঝাঁকিয়ে রাহুল বললে, ‘কি করছেন কী, আমি যে-কোনো কাউকে বিয়ে করার জন্য কানপুর থেকে চেন্নাই আসিনি, চলুন, ফেরত চলুন’। দুজনের কবজি ধরে, প্রায় ফিলমি ঢঙে শিভালরি দেখিয়ে, ফেরত আনতে মেজমামা ওদের বাড়ির ভেতরে যাবার নির্দেশ দিয়ে কার্ডের খসড়া রচনায় মন দিলেন ।

         কার্ডের খসড়ায়, সুমনার বাবা সুরঞ্জন সেনের নামের আগায় এমন কোনো ইঙ্গিত পেল না রাহুল যা থেকে টের পাওয়া যায় যে উনি জীবিত না মৃত । ফলে প্রশ্নটা তুলতে, সুমনার বড় মামা বললেন, ‘ইট ইজ এ লঅঅঅঅং স্টোরি’ । কিন্তু স্টোরিটা যে কী তা বলতে চাইলেন না । পরে, রাহুল তখন কানপুরে, পাঁচ-ছয় বছর বয়সের স্মৃতি রিকালেক্ট করে সুমনা বলেছিল, বাবা এসেছিল আমাদের নিতে, সঙ্গে ঘোমটায় মুখ-ঢাকা কমবয়সী সৎ-মা, কোলে বছরখানেকের বাচ্চা। দেখলেই বেশ বোঝা যায়  বাবার আর্থিক অবস্হা খুবই খারাপ । বড়দাদু বকুনি দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন ।

          তারপর ওর বাবা ওর অফিসে কয়েকবার গিয়ে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন, সম্পর্ক নবীকরণের উদ্দেশ্যে ।

মামারা আর দাদুরা বাবা সম্পর্কে এমন আতঙ্ক ওর মনে গেঁথে দিয়েছিলেন শৈশব থেকে যে ও দ্রুত এড়িয়ে গিয়ে বাবার সামনে থেকে পালিয়েছিল ।

         বড়দাদু নামক বৃক্ষটিকে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য ছোটোদাদু আর মেজদাদুর সংসার পাতা হয়নি । পারিবারিক গল্পগাছা অনুযায়ী, বার্ধক্যে মারা যাবার সময় দুজনেই ভার্জিন ছিলেন । যৌবনের কী অপচয়, মনে হয়েছে রাহুলের । সুরঞ্জন সেন ছিলেন অনুশীলন বা যুগান্তর সমিতির সদস্য, জেনেছিল রাহুল, সুমনার দিদির কাছ থেকে । কলকাতায় বিএ পড়ার সময় পুলিশ সুরঞ্জনদের ডেরায় হানা দিলে তিনি বেনারস পালান । সেখানে শচীন্দ্রনাথ সান্যালের শিষ্যদের আস্তানায় লুকিয়ে থাকার পর পালিয়ে যান লাহোর । আমিরচাঁদ, বালমুকুন্দ, অবোধবিহারী প্রমুখের গড়া বৈপ্লবিক পরিকাঠামোয় ঢুকে পড়েন । ভালো ইংরেজি বলতে পারতেন বলে ইংরেজদের মন্টেগোমারি ক্লাবে নাম ভাঁড়িয়ে স্যুট-টাই পরে ম্যানেজারের চাকরিতে যোগ দেন । মন্টেগোমারি ক্লাবের জনৈক সদস্য, ইন্সিওরেন্স কোম্পানির মালিক, চেন্নাইয়ের এক বিলাতপ্রেমী বাঙালির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, যিনি তাঁর বড়ো মেয়ের সঙ্গে সুরঞ্জনের বিয়ের প্রস্তাব দ্যান ।

         সমাজে ঢুকে এভাবে লুকিয়ে থাকার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি সুরঞ্জন সেন । বিয়ের পর তাঁর প্রকৃত কাজকারবার ফাঁস হয়ে যায় তাঁর শ্বশুরের কাছে, এবং ব্রিটিশ-শাসকের স্নেহধন্য শ্বশুরমশায় দুই নাতনি আর মেয়েকে নিয়ে  ফিরে যান চেন্নাই । সুমনার সন্দেহ যে বড়দাদু পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন বাবাকে । সুমনার অন্তসত্ত্বা মা হয়ত স্বামী আর বাবার মূল্যবোধের সংঘর্ষের উদ্বেগজনিত সংক্রামে মারা গিয়েছিলেন তৃতীয় মেয়ের জন্মের সময়ে । একদিকে বিলেত ফেরত নব্যপ্রবাসীর অতিসাহেবিয়ানা, আরেকদিকে বিপ্লবীর স্বপ্নালু বাঙালিয়ানার ঘাত-প্রতিঘাত । সুরঞ্জন সেনের দ্বিতীয় স্ত্রী আর ছেলের কী হল, জানার ইচ্ছা হয় সুমনার । কানাঘুষা শুনেছে যে সুরঞ্জন সেন  ভবঘুরে হয়ে গেছেন ।

         সুমনার ছোটোমামার ছেলের বিয়েতে বরযাত্রী হয়ে ভুসাওয়াল থেকে ট্রেনে মুম্বাই যাচ্ছিল ওরা সবাই, একটা তৃতীয় শ্রেনির সাধারণ কামরা সম্পূর্ণ দখল করে । দাদারে সকাল সাতটায় ট্রেন পৌঁছাবে, কন্যাপক্ষের লোকেরা– সবাই মারাঠি, কেননা ছেলেটি বিয়ে করছে প্রদেশের রাজস্ব সচিবের মেয়েকে– নিতে আসবে, মহিলারা তাই সাজগোজ করে নিচ্ছিলেন । হঠাৎ টয়লেটের কাছ থেকে সুমনার ‘বাবা-বাবা’ চিৎকারে রাহুল আর ছোটোমামা দৌড়ল কী হয়েছে দেখতে।  দেখল, প্রায় ভিকিরির জামাকাপড়ে, এক দীর্ঘদেহী বৃদ্ধ, কদমছাঁট চুল । সুমনা বলল, আমার ডাকে চাদরে মুখ লুকিয়ে নিয়েছে । ছোটোমামা মুখ থেকে চাদর সরাবার চেষ্টা করে ‘জামাইবাবু-জামাইবাবু’ বলে বারকয়েক ডাকলেন, আর সাড়া না পেয়ে নিশ্চিত হবার জন্য নিজের দাদা-বৌদিকে ডাকতে গেলেন । ওনার পেছন-পেছন রাহুল আর সুমনাও গেল বড়মামা মেজমামা আর মাইমাদের ডেকে আনতে কামরার কিউবিকলগুলো থেকে ।

         রাহুল হতভম্ব, বাকরহিত।

         সবাই দল বেঁধে ফিরল টয়লেটের কাছে । কুড়িজনের ঠেলাঠেলি । রাহুলরা ফিরে দ্যাখে সুরঞ্জন সেন নেই । দাদার স্টেশান এসে পড়ায়, উত্তেজনায় খেয়াল করেনি কেউই, ট্রেনের গতি স্তিমিত হয়ে এসেছিল, আর সেই সুযোগে নেমে পড়েছেন রাহুলের শ্বশুরমশায় । প্ল্যাটফর্মে ছুটোছুটি করে, স্টেশানের বাইরে খোঁজাখুঁজি করেও, তাঁর দেখা মিলল না। আর কখনও তিনি এলেন না রাহুলের সামনে । নিজের শ্বশুরের সঙ্গে পরিচয় হল না রাহুলের । শাশুড়ির ব্যবহারিক

স্নেহ থেকেও বঞ্চিত থেকে গেল । রাহুলের বয়স তখন কত হবে, মমমমমমম, বোধহয়, মমমমমম, কতইবা, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় ।

         পরে, কলকাতায় থাকার সময়ে, জামাইষষ্ঠীর বাজার করতে-আসা প্রতিটি প্রৌঢ়াকেই রাহুলের মনে হত ওর শাশুড়ি ।

         –এত ভারি দু-দুটো থলে বইবেন কী করে ? আমাকে দিন আপনাকে রিকশয় তুলে দিচ্ছি ।

         –হ্যাঁ বাবা, বয়স হয়ে আসছে তো, আর বইতে পারিনে, মেয়ে-জামাই-নাতি কাল সকাল-সকাল আসবে বলেছে; তাই বাজারটা আজকেই করে রাখলাম, মাছের অর্ডার দিয়ে দিয়েছি, কালকে ভোরবেলা এসে কাটিয়ে নিয়ে যাবো ।

        –আমার গাড়ি আছে, বলেন তো আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেবো ; গাড়িতে আমার স্ত্রী বসে আছে । আসলে আমার তো শাশুড়ি ছিলেন না ।

        –তাহলে তুমি আর তোমার বউও চলে এসো কালকে, ভালোই হবে ।

        –না মাসিমা, আরও কয়েকজন শাশুড়ির নেমন্তন্ন গত কয়েকবছর যাবত তোলা আছে । আপনারটাও তোলা থাক । সেনচুরির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি । জীবনে কত-কিছু যে তুলে-তুলে রাখছে !

        –আজকাল আর তোমাদের মতন মানুষ বড় একটা হয় না । রিকশয় উঠে বললেন রাহুলের, হয়তো, নব্বুইতম শাশুড়ি ।

          রাহুল নিজেকে বলল, আমি তো ভাবছিলুম আমি মানবেতর মানুষ, কত যে অমন ‘তুলে রাখা’ তুলে রেখেছি ।

         সুরঞ্জন সেনের অন্তরজগতে যি বিপ্লবী বাসা বেঁধেছিল, তা রাহুলের মতনই, রাহুলের মনে হয়েছে, মানবেতর কোনো প্রাণী ।          

        ওর, রাহুলের ভেতরে, মানুষ আছে না জানোয়ার, তা নিয়ে নিজেকে ঝালাতে গিয়ে ওর সন্দেহ কাটেনি । একবার ট্যুরে গিয়ে, রাহুলের চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে, অবিরাম ট্যুরের চাকরিতে, মরা বাঘিনীকে যখন চিৎ করে শোয়ানো হয়েছিল, তার রক্তাক্ত যোনির দিকে তাকিয়ে নিজেকে বাঘ মনে হয়েছিল ওর, এমনই ছিল তার অপ্রতিরোধ্য ইরটিক আকর্ষণ । উত্তর প্রদেশের, তখনও উত্তরাখণ্ড রাজ্য হয়নি,  নেপালের ঘন-সবুজ সীমান্তে দু’সপ্তাহ যাবত জঙ্গলঘেঁষা গ্রামগুলোয় ক্ষেত্রসমীক্ষা করে বেড়াচ্ছিল রাহুল আর ওর সহায়ক ভেটেরিনারি ডাক্তার উমাপ্রসাদ রাও । পিলিভিত জেলার উত্তরাঞ্চলের টনকপুর পর্যন্ত নেপাল সীমান্ত কভার করে, নানপারাতে বেস ক্যাম্প বানিয়ে নেপালগঞ্জ রোড, ভনঘা, ধর্মনপুর, কুমভের, হাটারিয়ান ঘাট, সিঙ্গাহি, নিঘাসন অঞ্চলের পাহাড়তলির গ্রামগুলো ঘুরে তারপর মৈলানিকে কেন্দ্র করে সোনারিপু, ধনগড়হি, কৈলাটি, চন্দনচৌকি পর্যন্ত গ্রামগুলোয় সেরে ফেলেছিল ক্ষেত্রসমীক্ষা ।

         রাহুলের ক্ষেত্রসমীক্ষার বিষয় ছিল বিশুদ্ধ ভারতীয় গরু নামে আর কোনো প্রাণী এদেশে টিকে আছে, নাকি স্বদেশি-বিদেশী সংমিশ্রণে এদেশি গরু আর একটিও নেই । ক্যালেণ্ডারে শ্রীকৃষ্ণের সাথে যে গরুগুলোর দেখা মেলে, সেগুলো নিউ জার্সি বা হলস্টিন ফ্রিজিয়ান । রবি বর্মা শ্রীকৃষ্ণের পেছনে যদি কয়েকটা গোরু এঁকে যেতেন তাহলে সমস্যা হয়ত কম হতো ।

          বাজারের বিশ্বায়নের বহু আগে থাকতে, গৃহপালিত জন্তুজানোয়ার আর হাঁস-মুর্গির সংকরায়ন হয়ে চলেছে । হিমালয়ের সমতলের জঙ্গলে রাহুল খুঁজে পেয়েছিল স্বদেশি গোরু, গাধার মাপের ছোটো-ছোটো গোরু, সামনে ছুঁচালো শিং, জঙ্গলে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য ।  দুধ তেমন দেয় না বলে কেউ পোষে না, এত ছোটো যে চাষের কাজেও লাগে না । কখনও কখনও অবশ্য মারোয়াড়িদের ছেড়ে-দেয়া অন্য জাতের বা বিদেশি-সংকর ষাঁড় হেলতে-দুলতে পৌঁছে যায় জংলি গোরুর পালে, আর তাদের ধর্ষণের পর , বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে মারা পড়ে কিছু-কিছু গোরু ।

         গোরু খাবার লোভে একটা বাঘিনি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে নেমে এসেছিল কোথাও, তারপর জলভরা খালে পড়ে উঠতে পারেনি, খালের দু-ধার সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো । পিছলে-পিছলে বার-বার পড়ে গেছে জলে । সুন্দরবনের বাঘেদের মতন জলে অনেকক্ষণ সাঁতরাতে পারেনি । জল খেয়ে-খেয়ে, মরে  ভেসে উঠেছিল । গ্রামবাসীরা বাঘিনীর লাশ জল থেকে তুলে বিডিওকে খবর দিতে, বিডিও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জানায় । বিডিওর মাধ্যমে তিনি রাহুলকে অনুরোধ করেন যাতে রাহুলের সহায়ক ভেটেরিনারি ডাক্তার পোস্ট মর্টেম করে একটা রিপোর্ট লিখে জেলাসদরে পাঠায়, কেননা জেলা সদর থেকে জানোয়ারের, তাও বাঘের,  পোস্টমর্টেম করায় দক্ষ ভেটেরিনারি সার্জেনকে পাঠাতে কয়েকদিন লেগে যাবে ।

           পোস্টমর্টেমের জন্য গ্রামবাসীরা বাঘিনীটাকে চিৎ করে শুইয়ে রাখতে, বাঘিনীর রক্তাক্ত যোনির দিকে নজর

পড়েছিল রাহুলের । বাঘিনীর লাশ তখনও শক্ত হয়নি । তার মানে বেশিক্ষণ হল মারা যায়নি । নিজের ভেতরের

বাঘটাকে, যে বাঘিনীর যোনিতে আকৃষ্ট হয়ে ওর দেহকে একটু-একটু করে জাগিয়ে তুলছিল, আবিষ্কার করে রাহুল অবাক হল না । বুঝতে পারল ও, রাহুল, যে,  ডারউইনের সব কয়টা জীব-ধাপের প্রাণী রয়ে গেছে ওর ভেতরে, যারা, অঞ্জলির বিশ্লেষণে, লেচার ।

         শার্ট-প্যান্ট খুলে, উদোম উলঙ্গ হয়ে, বাঘিনীর ফর্সা গোলাপি বুকের ওপর শুয়ে  বোঁটাগুলোয় মুখ ঘষার ইচ্ছে করছিল । ভেটেরিনারি অফিসারকে প্রস্তাবটা দিতে সে বলল, কোনো প্রবলেম নেই স্যার, এরা চিৎ করে ধরে থাকুক, আপনা থেকেই বডি শক্ত হয়ে যাবে ; ভেটেরিনারি সায়েন্সে পড়ানো হয় যে মানুষদের মধ্যে এরকম কারনাল ডিজায়ার জেগে ওঠা স্বাভাবিক; তবে সেসব পশুরা তো গৃহপালিত, বাঘিনীর প্রতি আকর্ষণের কথা পড়িনি । তবে, ম্যাকলের লেখা ইনডিয়ান পিনাল কোড অনুযায়ী, নন-হিউমানদের সাথে ইনটারকোর্স করা ক্রিমিনাল অ্যাক্ট । আপনি তো শুধু শুতে চাইছেন , ক্রিমিনাল অ্যাক্ট আর সম্ভব হবে না স্যার, কেননা বডি শক্ত হয়ে গেছে ।

       –হ্যাঁ, বাঘিনীর বুকে শুয়ে ওর ভালোবাসা চাই ।

        পোস্টমর্টেম হবার পর সরকার কেবল চামড়াটা নেবে, মাংস-হাড়টাড় ফেলে দেবে জানতে পেরে পাহাড়ি গ্রামগুলো থেকে বহু পুরুষ-মহিলা-বাচ্চা বাঘিনীকে ঘিরে জড়ো হয়েছিল, তাদের হাতে নানা মাপের, আকারের, পাত্র  ; আকাশেও জড়ো হয়েছিল উড়ন্ত শকুন আর চিল ।

          গ্রামের পাহাড়ি লোকেরা বাঘের মাংস খায়, হাড় শুকিয়ে গুঁড়িয়ে রেখে দ্যায়, ওষুধ হিসাবে । পাহাড় ডিঙিয়ে

চিনেতেও পাচার হয়ে যায় । রাহুলের নির্দেশে, বাঘিনীর পিছনের দুটি পায়ে আর সামনের দুটি পায়ে সমান্তরাল করে বাঁশ বাঁধা হল, যাতে বাঘিনী ওভাবেই চিৎ শুয়ে থাকে, আর কোথাও রাতভরের জন্য বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় ।  বাঘিনীকে, গ্রামবাসীদের কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে গিয়ে, রাখা হল জনৈক পাঞ্জাবি সরদারের ফাঁকা গ্যারাজে । দেশভাগের পর প্রচুর জাঠ পাঞ্জাবির বসত গড়ে উঠেছে হিমালয়ের সমতলভূমিতে । সবাইকে জানিয়ে দেয়া হল যে কাল সকালে পোস্টমর্টেম হবে ।

        সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলে, ভেটেরিনারি অফিসার পারফিউম ছিটিয়ে বাঘিনীর দেহের গন্ধকে কিছুটা দমন করে রাহুলকে বললে, স্যার আপনি যান, আমি বাইরে পাহারা দিচ্ছি । ও, রাহুল, অনেকটা রাম টেনে নিজেকে মাতাল করে নিয়েছিল ।

        রাহুল জামাকাপড় খুলে শুয়ে পড়ল বাঘিনীর ঠান্ডা বুকের ওপরে । অন্ধকারে বাঘিনীর স্তনের বোঁটায় মুখ ঘষতে-ঘষতে, ওর, আশ্চর্য,  কান্না পেতে লাগল, সুরেখা রেড্ডির জন্য । মদের নেশায়, সুরেখা রেড্ডির বুকে মুখ রেখে, প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল । সহায়ক অফিসার টর্চ জ্বেলে গ্যারাজে ঢুকে টেনে তুলল ওকে, আর, হাত ধরে টানবার সময়ে রাহুলের মনে হল ও এমিলিয়া বনিয়ার স্লিপিং ব্যাগ থেকে অনীক খাস্তগীরের টানে উঠে পড়েছে ।

         ডাক্তার রাও রাহুলকে র‌্যাপার মুড়ি দিয়ে বলল, স্যার, পোস্টমর্টেমের সময় আপনি থাকবেন না, বুকের মাঝখান থেকে চেরা সহ্য হবে না আপনার, তাছাড়া গ্রামবাসীরা মাংসের জন্য কাড়াকাড়ি করবে ।

      ওফ, আত্মহত্যা করেছিল বলে সুরেখারও বুক চিরে পোস্টমর্টেম হয়েছিল নিশ্চয়ই ।

      একজন যুবতীর বুকের মাঝখান থেকে চিরে সেলাই করে দেয়া ! বাঘিনীকে অন্তত সেলাই করা হবে না ।

       রাতেই ও, রাহুল,  জিপে চেপে ফিরে গেল ক্যাম্প-স্টেশানে । মাংস খাবার জন্য কাড়াকাড়ি হবে শুনে অসুস্হ বোধ করছিল।           

         সুরেখাও প্রত্যাখ্যাত হয়ে অসুস্হ বোধ করেছিল কি ? গুমরে কেঁদেছিল হয়তো । কে জানে ।

         সুরেখার চিঠির ভাঁজে আরেকটা চিঠি ছিল, বহুদিন, বাসি-পোস্টকার্ড, সময় তাকে হলুদ করে দিয়েছিল । প্রদীপন  চাটুজ্জের চিঠি । রাহুলের কেস হাইকোর্টে শেষ হবার পর লিখেছিলেন : “প্রিয় রাহুল, হাইকোর্টের রায় পড়ে তোমাকে মনে মনে তৎক্ষণাৎ কনগ্র্যাচুলেট করেছি । একটা মামলা হওয়া দরকার ছিল, কাউকে না কাউকে এরকম মামলার আসামী হতেই হত । সীমাবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এর ফলাফল আধুনিক সত্য-সাহিত্যের পক্ষে যথেষ্ট ভালো হবে, মনে হয় । কৃতিত্ব সবটাই তোমার একার, তবু, লেখক নামের যোগ্য সকলেই একে পুরস্কার বলে মনে করবে ও ভাগ করে নিতে চাইবে । ব্যক্তিগতভাবে আমি পুরস্কৃত হওয়ার আনন্দ পেয়েছি । প্রীতিসহ, প্রদীপন চট্টোপাধ্যায় ।” ওই একই দিনে এই চিঠিটাও ছিঁড়ে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল রাহুল ।

         বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজ থেকে ওই একটি চিঠিই ও, রাহুল, পেয়েছিল, মামলা জিতে যাবার পর ; তার কারণ

প্রদীপন ছাড়া বাকি ৯৯৯ জন চাননি যে ও মামলা জিতে যাক । অসীম, যিনি রাহুলের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তাঁর  কাছ থেকেও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি, যদিও দাদা অনিকেতের সঙ্গে উনি তখনও চিঠির মাধ্যমে পত্রঅপেরা চালিয়ে যাচ্ছিলেন । প্রদীপন রাহুলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ; তার কারণ অসীম বিদেশ থেকে ওনাকে তাতাচ্ছিলেন, রাহুলের বিরুদ্ধে ; ওনাকে, রক্তিমকে, চঞ্চলকুমার বসুকে, যাঁরা ওনার বঁড়শির কেঁচো খেতে গিয়ে, এমন আটকে পড়েছিলেন, যে ,রাহুলের বিরুদ্ধে যাওয়াটাই আখেরের পক্ষে সুবিধাজনক মনে করেছিলেন ওনারা । অসীম তা-ই চাইছিলেন । ওনারা রাহুলের বিরুদ্ধে পুলিশের সাক্ষী হয়ে যেতেই অসীম তুরুপের তাসটি খেললেন রাহুলের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে, আর অপেরার ইতিহাসে চিরকালের জন্য বিশ্বাসঘাতক হিসাবে বদনাম করে দিলেন নিজের বন্ধুদেরই ।   

       কলেজ স্ট্রিট  কফিহাউসে, সেদিন সন্ধ্যায়, যখন প্রদীপন, রক্তিম, চঞ্চলকুমার বসু ঘিরে ধরেন অসীমকে, তখন অসীম একখানা ডিগবাজিপত্র লেখেন অনিকেতকে, অদ্ভুত ডিগবাজি, যা সচরাচর সিরিয়াস লেখকেরা খেতে চাইবে না । 

         প্রদীপন আর রক্তিমের আস্হা ফিরে পাবার জন্য ততটা নয়, যতটা ছিল,  যে সংবাদপত্রে অসীম গাঙ্গুলি যোগ দিয়েছিলেন, তার মালিকদের প্রীত করার জন্য, নিজের রামায়ণ নট্ট কোম্পানির সুভেনিরে সম্পাদকীয় লিখলেন রাহু-কেতুদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে । তখনও রাহুলের মকদ্দমা শেষ হয়নি, সাব জুডিস ছিল, আদালতের দৃষ্টি আকর্ষন করে কনটেম্পট অব কোর্টের মামলা ঠুকে দিতে পারত । প্রদীপন পরামর্শ দিয়েছিলেন, দাও না ঠুকে, দেখোই না খেলাটা কেমন জমে যায় ।  দেয়নি রাহুল , কেননা অসীম তার আগে ওর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ।

         রাহুল আবার লেখালিখিতে ফিরে আসার আনন্দে,  অনিকেত বললে, তোর বিরুদ্ধে লেখা অসীমের পত্র-অপেরার চিঠিটা এবার প্রকাশ করার সময় হয়েছে, ও বেঁচে থাকতেই বেরিয়ে যাওয়া উচিত, যদিও ওর তাতে একটা মুথাঘাসও ছিঁড়বে না, তবু, লিটল অপেরাদের জগতে এটা গিয়ে পড়ুক ।

       ঘাস আর আছে কি ? মহীরুহের তলায় তো ঘাস গজায় না । বলেছিল রাহুল ।

        সাক্ষ্য দেবার চার দিনের মাথায় অসীম অনিকেতকে লিখেছিলেন, আরও অনেক কথার পর, “সাক্ষীর কাঠগড়ায়  রাহুলের রচনা আমাকে পুরো পড়তে দেয়া হয় । পড়ে আমার গা রি রি করে । এমন বাজে লেখা যে আমাকে পড়তে বাধ্য করা হল, সে জন্য আমি ক্ষুব্ধ বোধ করি— আমার সময় কম, ছাপা-লেখালিখি কম পড়ি, আমার রুচির সঙ্গে মেলে না — এমন লেখা পড়ে আমি মাথাকে বিরক্ত করতে চাই না । রাহুলের তিনপাতা রচনায় একটা লাইনেও অপেরার চিহ্ণ নেই । রাহুল যদি আমার ছোটো ভাই হতো, আমি ওকে অপেরা লিখতে বারণ করতাম অথবা গোড়ার অ-আ-ক-খ থেকে শুরু করতে বলতাম । যাই হোক, তবু আমি বেশ স্পষ্ট গলাতেই দুবার বলেছি ওর ঐ অপেরা আমার ভালো লেগেছে । এর কারণ, আমার কোনো মহত্ব নয়– আমার সাধারণ, স্বাভাবিক, সীমাবদ্ধ জীবন । যে-কারণে আমি আনন্দবাজারে সমালোচনায় কোনো বাজে বইকে ভালো লিখি— সেই কারণেই রাহুলের লেখাকে ভালো বলেছি ।”

       অসীম গাঙ্গুলির চিঠিটা পড়ে, রাহুল বলল, তাহলে একটা জুতোর বাক্স দিয়ে আসি রিভিউ করার জন্য, বাচ্চাদের চটির বাক্স তো মোটা বইয়ের মতন দেখায় ।

       কলকাতায় ফেরার পর একদিন, সুকৃতি রেস্তরাঁয় মুর্গির কাটলেট খেতে-খেতে প্রদীপন চাটুজ্জে বললে, রাহুল যে তৈরি হয়েই যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেছিল তা বোধহয় অসীম অনুমান করতে পারেনি । তুমি যে আবার ফিরে আসবে, ফিরে এসে এত রকমের কথা বলবে, প্রশ্ন তুলবে, দার্শনিকদের দাড়ি চটকাবে, কেউই আঁচ করতে পারেনি । অনিকেত ওটা সময়মতন ছেড়েছে । হাঃ হাঃ, বাজে বইকে ভালো বলে-বলেই তো কত রাঘব বোয়ালকে জালে তুলল ; বাজে বই কেন, ওর চারপাশে যে মালগুলো পাক খাচ্ছে তা কে-ই বা না জানে । ভোঁদাদের সন্ধ্যায় একবার ঘুরে এসো । এক-একখানা ওই তোমরা যাকে বলো ইয়ে, মানে, বাল, বাঙালি লেখকের অ্যাবরিভিয়েশান ।       

        প্যারানয়েড ছিলেন রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারীমশায় । বিদেশে গিয়েও অপপ্রচার করতে ছাড়েন নি, বলেছিল রাহুল । ওনার পর ওই একই অপেরা-শিক্ষার স্কুলের খরচে হরিপদ রায় গিয়েছিল, সে লোক তো নিউ ইয়র্কে সেইন্ট মার্কস চার্চে নিজের লেখার অনুবাদ পড়তে গিয়ে ঘোষণা করেছিল যে সেও সর্বভূক আন্দোলনের সদস্য ; এদিকে কলকাতায় রাহু-কেতুদের বাঁশ দেবার জন্য লাগাতার দৌড়ঝাঁপ চালিয়েছে ।

        প্রদীপনের উক্তি : যাক, জীবনে একটা প্যারানয়া তো আছে ; সেটার কনট্রিবিউটার হিসাবে তোমার প্রাউড হওয়া উচিত । কজন মানুষই বা পারে আরেকজনের জীবনে একখানা পার্মানেন্ট ঘা তৈরি করে দিতে, সিক্রেট উন্ড ! সে-ক্ষত চাপা দেবার জন্য পাতার পর পাতা, হাজার-হাজার পাতা, সারা জীবন লিখে যেতে হয়েছে, যাতে ধারে না কাটুক,  ভারে তো কাটবে। অসীমের সমস্যা কী জানো ? এম এতে ফলাফল খুব বাজে হয়েছিল ; বাংলায় এম এ, সে

কিনা একেবারে তালিকার শেষে !

         প্রাউড ? প্রাইড ? ব্যাপারটা আদপে কী ? জিগ্যেস করার পর, রাহুলের মনে পড়ল, থানার লক আপে সকালে ওর হাগা পেয়ে গিয়েছিল । একটা কনস্টেবল ওর কোমরে দড়ি বেঁধে বলল যাও, ওদিকে গোসল করে এসো ; দড়িটা আনেক লম্বা, আমি এখানে বসেই পাহারা দিচ্ছি দড়ি ধরে, তুমি সেরে এসো।

         কোমরে দড়ি বাঁধা অবস্হায় হাগতে গিয়েছিল রাহুল । অত্যন্ত নোংরা পায়খানা, দরোজার বালাই নেই, কবেকার বড়ি-বড়ি বড়া-বড়া গু শুকিয়ে আছে, অনেক কয়েদি পায়খানায় না হেগে তার আসেপাশে বাইরেই ঘাসের ওপর হেগে রেখেছে । রাহুলও ফাঁকা দেখে, কাঁধের ওপর ট্রাউজার ফেলে,  ঘাসের ওপর সেরে নিয়েছিল, ছোঁচাবার মগ-টগ ছিল না, যে কল থেকে অবিরাম জল পড়ে চলেছে সেখানে পেছন ফিরে ছুঁচিয়ে নিয়েছিল ।

        যখন ফিরল, কনস্টেবলটা বলল, আরে বেবকুফ, ভাগনা চাহিয়ে থা ; তুমকো হমনে ইসিলিয়ে অকেলে ভেজা কি উধর সে ভাগ যাও । তুমহারা কেস সমঝা হ্যায় হমনে । ভাগ যাতে তো ইয়ে কলকত্তাওয়ালে পুলিস ফির আতে কেয়া তুমহারা ঝাঁট উখাড়নেকে লিয়ে ? বেবকুফ কহিঁকা । ফালতু কেস ঠোক দিহিস হ্যায় । লিখালিখি করকে সরকারকা দুশমন কোই নহিঁ বনতা হ্যায় । সরকার কওন হ্যায় ? হম । তব ? হমারে খিলাফ যেতনা চাহিয়ে লিখতে রহো, কেয়া ফরক পড়তা হ্যায় ! সরকারকা ঝাঁট উখাড়নেকে লিয়ে চাহিয়ে বব্বর শের মারনেওয়ালে পহলওয়ানোঁ কা বন্দুকধারি ঝুণ্ড ।

         একজন খইনিখোর সেপাইয়ের অব্যর্থ ভবিষ্যবার্তা । পাঁচ-ছয় বছর পরেই দেখা দিল শহর-দাপানো নকশাল কিশোর আর যুবকেরা । তারপর, অবিরাম, নানা প্রদেশের জঙ্গলে দেখা দিতে লাগল বন্দুকধারী বিপ্লবীর দল ।

       পালাবার জন্য তো আর লেখালিখির যুদ্ধক্ষেত্রে নামেনি রাহুল ।

        সকাল দশটা নাগাদ সবাইকে হাতকড়া পরিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে, একসঙ্গে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল কানপুরের

ফৌজদারি আদালতে । কি ভিড়, কি ভিড়, নানা থানা থেকে আসা কোমরে দড়ি আসামিতে আদালত চত্ত্বর গিজগিজ । রাহুলের বাবা আর দিনুদা ওকে দেখতে পেয়ে বলে গেলেন, চিন্তার কিছু নেই, বসন্তবাবুকে কোর্টে দেখলে হাইকোর্টের জজরাও ভয় পায়, আর এ তো মামুলি ম্যাজিস্ট্রেট , জামিন হয়ে যাবে, তারপর তোকে কলকাতায় উকিল ঠিক করে ব্যাংকশাল কোর্টে সারেণ্ডার করতে হবে । কলকাতার পুলিশগুলো তোকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যাবার তালে আছে, যাতে কলকাতা যাবার পথে ট্রেনের কামরায়  তোকে দুচারঘা দিতে পারে, সেরকম হুকুমই ওদের দেয়া হয়েছে, ইন্সপেক্টর খান বলছিল ।

         একটার সময় রাহুলের নম্বর এলো । পায়ে ব্যথা ধরে গিয়েছিল বলে অন্য আসামিদের সঙ্গে ও-ও মাটিতে বসে পড়েছিল । রাতে থানায় বাড়ি থেকে টিফিনকৌটোয় রুটি তরকারি দিয়ে গিয়েছিল বাবার কর্মচারী রাম খেলাওন । তারপর সকাল থেকে খাওয়া হয়নি, খিদে পেয়ে গিয়েছিল, ক্লান্তও বোধ করছিল, ঘুম হয়নি, লকআপে একটু গড়িয়েছিল বটে কিন্তু গড়িয়ে-আসা পেচ্ছাপ গায়ে লাগতে উঠে পড়েছিল । গা থেকে ঘাম আর পেচ্ছাপের গন্ধ বেরোচ্ছে । এজলাসে ওকে যেতে হল না । আসামীদের কোনো ভূমিকা থাকে না ফৌজদারি মামলায়, হেনস্হা আর জেল-জরিমানা ছাড়া । বাকি কাজগুলো করে উকিল মোক্তার পেশকার সাক্ষী ম্যাজিস্ট্রেটরা । আসামি কেবল নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবার শোপিস। 

            অসীম গাঙ্গুলির বাড়ি থেকে অঞ্জলির সঙ্গে দেখা করতে যাবে রাহুল । ওর আন্দোলনের ফালি-কাগজটার পেছনে অঞ্জলির যাদবপুরের ঠিকানা লেখা । যে যুবকের সঙ্গে অঞ্জলি থাকে সে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে ভারতে আর ভারত থেকে পূর্ব-পাকিস্তানে নানা জিনিসের স্মাগলিং করে । চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সোনা আনে সিলেটে, সে সোনা চলে আসে কলকাতায়, শিলচর বা আগরতলা হয়ে ।

          সুমিতাদিকে কি সাম্যবাদের স্মাগলার বলবে রাহুল ?

          পরে যখন দেখা হয়েছে, সুমিতাদির মুখের দিকে তাকালেই মনে হয়েছে, ডাক্তার বোধহয় ওনাকে বলে দিয়েছে যে ওনার কখনও বাচ্চা হবে না। ডাক্তারের ওই অমোঘ ঘোষণা কী ভাবে গ্রহণ করে একজন নারী ? কোনো পুরুষের পক্ষে সে অভিজ্ঞতার গভীরে প্রবেশ করা অসম্ভব । একজন নারীর মনে সারা জীবন বাজতে থাকে ওই ঘোষণা । হবে না, হবে না, হবে না । হবে না, হবে না, হবে না । সকালে উঠে, রান্নাঘরে, কাজে যাবার সময় পথে, অফিসে বা স্কুলে পড়াতে গিয়ে কাজের সময়, ফেরার পথে, বিকালে, সন্ধ্যায়, ব্রাহ্মমন্দিরে প্রার্থনার সময়ে, রাতে শোবার সময়, ঘুমের ভেতর স্বপ্নে ।

       অঞ্জলি তাই রাহুলকে ধরেছিল, বীজ স্মাগলিং করে গর্ভে লুকিয়ে নেবার জন্য । কাউকে না কাউকে ও পাকড়াও করবেই ।

        সুমিতাদির সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল, সান্মানিক স্নাতক হবার পর, রাহুলের কাকিমা যে স্কুলে পড়াতেন সেখানেই শিক্ষকতা করতেন সুমিতাদি, গালের টোল অটুট । নিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ি, বেবি অস্টিনে পাশে বসিয়ে । তারপর সযত্নে রাখা ভাঁজকরা একটা চিরকুট বের করে রাহুলকে বলেছিলেন, তোর লেখা, যখন স্কুলে পড়তিস, লাইব্রেরিতে আমার টেবিলের পেপারওয়েটের তলায় গুঁজে, হঠাৎ এসে হঠাৎ চলে গিয়েছিলি, রেখে দিয়েছি, কেন বলতো। তুই আমার নির্ভেজাল রসিক নাগর । তখন তো তোর প্রেমপত্র লেখার বয়স হয়নি ; শরীরে টেসটোসটেরন না জন্মালে যতই চিঠি লেখো না কেন, তাকে প্রেমপত্র বলা যায় না । সুমিতাদির কথা শুনে, ওনার  প্রৌঢ় গালের টোলে ঠোঁট ঠেকাবার ইচ্ছে সংবরণ করেছিল রাহুল । চিরকুটে লেখা ছিল, ‘ভালোবাসি আপনাকে।’ সুমিতাদি চিরকুটটা মুড়ে বইয়ের ভেতরে ঢুকিয়ে আলমারিতে রাখতে-রাখতে জানতে চেয়েছিলেন, ‘কাদের অপেরা পড়ছিস আজকাল ? কেতু নাকি কলকাতা থেকে দু-আলমারি বই দিয়ে গেছে তোকে ।

       –আপনি পড়বেন ? আমার পড়া হয়ে গেছে ; আমি বোধহয় ওই ধরণের রচনার জগতে বিচরণ করতে চাই না। বইগুলো এবার বিলি করে দিতে হবে । দেখি আর অস্বস্তি হয় । আপনি বললেন না একটু আগে, টেসটোসটেরন । ওই জিনিসটা বিশেষ নেই ।

        –না রে , অপেরা পড়ার মতো সময় আর নেই, স্কুলের পর তো টিউশানিতে কেটে যায় সেই রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত । তুইও নাকি লেখালিখি করছিস লুকিয়ে-লুকিয়ে । তা ইংরেজিতে লিখিসনি বাবা, তোর ওই  ক্যাথলিক স্কুলের পিছুটান এবার ছাড় । রবীন্দ্রসঙ্গীত থাকতে তোর কেন যে জন নিউটন নামের সেই নোংরা ক্রীতদাসটার গান পছন্দ তা জানি না ।

         আয়ারল্যান্ডের নানদের চোখ ভেসে ওঠে রাহুলের স্মৃতিতে ; গির্জার প্রায়ান্ধকারে রাহুল আর ওর সহপাঠীরা, ওর বয়স তখন কত, মমমমমমমম, তিন কি চার, হাতজোড় করে গাইবার চেষ্টা করছে ইংরেজি ভাষায় গান, যে ভাষা তখনও পর্যন্ত ও বিশেষ জানে না, আর যে গান ওর মগজে থেকে যাবে মস্তিষ্করোগের মতন :

অ্যামেজিং গ্রেস ! হাউ সুইট দি সাউন্ড
দ্যাট সেভড এ রেচ লাইক মি
আই ওয়ান্স ওয়াজ লস্ট, বাট নাউ অ্যাম ফাউন্ড
ওয়াজ ব্লাইন্ড বাট নাউ আই সি

শাউট, শাউট, ফর গ্লোরি
শাউট, শাউট অ্যালাউড ফর গ্লোরি ;
ব্রাদার, সিসটার, অ্যান্ড মোরনার
অল শাউট গ্লোরি হ্যালেলুয়া..

          রাহুল কেবল হ্যালেলুয়া শব্দটা সবায়ের সঙ্গে চেঁচাত । তারপর সিসটারদের সঙ্গে গাইতে-গাইতে মুখস্হ হল যখন, তখন সেই স্কুল ছেড়ে ব্রাহ্ম স্কুলে চলে যেতে হল, বাড়ির অভিভাবকদের মতে ওর, রাহুলের, স্বভাবচরিত্র কেরেস্তানদের মতন হয়ে যাচ্ছিল বলে ।

         পরে, রাহুল জেনেছে যে গানটা জন নিউটন নামে একজন খালাসির লেখা, যে কৈশোরে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল, প্রেমিকা পলির সঙ্গে বিচ্ছেদের কারণে ; তারপর জাহাজের ক্যাপ্টেন সম্পর্কে নোংরা-নোংরা গান লিখে গাইবার অপরাধে ক্রিতদাসরূপে চালান হয়ে গিয়েছিল সিয়েরা লিওনের খেত-খামারে চাষবাসের কাজে । সেখানে তাকে দিন-রাত খাটতে হতো । বেশ কয়েক বছর পর, যৌবন শেষ হতে চলেছে, তার বাবা খবর পেয়ে, তাকে কিনে বাড়ি ফিরিয়ে আনেন । অ্যামেজিং গ্রেস গানটা বাড়ি ফিরে লেখা, ক্রমশ মুখে-মুখে লোকগীতি হয়ে ওঠে, আর উপনিবেশের নেটিভদের জন্য সেখানকার গির্জায়, খ্রিস্টানদের স্কুলে, প্রার্থনাসঙ্গীতের মতন হয়ে ওঠে ।

        –হ্যালেলুয়াআআআআ..

        –আঃ অমন বিটকেলভাবে চেঁচাসনি, কী যা হালুয়া-হালুয়া মাথামুন্ডু মানে, তাই জানি না । ওসব ছাড় দিকিনি ।   

         –কি করে ছাড়ি ! টেসটোসটেরন তো আইরিশ নানরা দিয়ে গেছেন ।

         –ছিঃ, কী যে বলিস, ওনারা তোর প্রথম শিক্ষক ছিলেন । শ্রদ্ধা করবি তো ।

         –শ্রদ্ধায় কি টেসটোসটেরন থাকতে নেই ! আপনি তো আমার উন্মাদ ক্রাশ, যখন টেসটোসটেরন তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে । আইরিশ নানরা ছিলেন প্রথম ক্রাশ । আপনাকে স্কুলে দেখার আগে কুলসুম আপা নামে এক কিশোরীর হাতে পড়েছিলুম, জানেন ।

        –না না, ওসব আমায় বলিসনি, আঁৎকে উঠেছিলেন সুমিতাদি, অনুমান করে ফেলেছিলেন বোধহয় কী ঘটে থাকবে।

        –আপনি যে বইগুলো দিয়েছিলেন, আর দাদা মামার বাড়ি থেকে যে দাড়িওয়ালা বইগুলো এনেছিল, সেগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছে যে রাজনীতির  তত্ত্ব যতই আকর্ষক হোক না কেন, সবকিছু নির্ভর করে লোকগুলোর ওপর, বুঝলেন, যে লোকগুলো ওই তত্ত্বকে ভালো বাসতে-বাসতে কোনো এক ফাঁকে নিজেকে ভালো বাসতে আরম্ভ করে । ব্যাস , তত্ত্ব একেবারে গুবলেট । ভালোবাসা, অন্যকে বাসলেও, আসলে নিজেকেই ভালোবাসবার মাধ্যম, নয়তো মানুষ কেনই বা বারবার প্রেমে পড়বে ? একজন প্রেমিক বা প্রেমিকাকে ছেড়ে আরেকজনের দিকে এগিয়ে যাবে ?

       –ঠিক ধরেছিস । বই লিখে ফ্যাল না ।

       –লিখতে আরম্ভ করেছি । খসড়াটা দাদা দিয়েছে বিমানবিহারী মজুমদারের ছেলেকে ,প্রতিক্রিয়া জানাবার জন্য ।

       –যা লিখছিস, যা ভাবছিস তাই লেখ । অন্য কারোর মতামতের ওপর নির্ভর করিসনি ।

       খসড়াটা দাদা আর বুজলুদা অনুমোদন করে দিলে, রাহুল ওটা দিয়েছিল রক্তিমকে, কলকাতায় কোনো ছাপাখানায় ছাপিয়ে প্রুফ পাঠাতে ।

       রক্তিমকে টাকা দিয়েছিল ছাপাবার জন্য ।

      তুমি আর লোক পেলে না ? ঘটনাটা শুনে বলেছিলেন প্রদীপন চাটুজ্জে, ও টাকা চলে গেছে শুঁড়ির বাড়ি ।

       সুমিতাদি চা তৈরি করার জন্য রান্নাঘরে গেলে, রাহুল চিরকুটটা বই থেকে বের করে ‘ভালোবাসি আপনাকে’ লেখার তলায় লিখে দিয়েছিল, ‘ইতি ভ্লাদিমির ইলিচ’ । তারপর বইটা যেখানে ছিল, গুঁজে দিয়েছিল সেখানে ।

      দেয়ালে টাঙানো, ফ্রেম-বাঁধানো, ওনার ক্রচেটের কাজে ধুলো জমে ছিল । কালো আর লাল সুতোয় একটা কাজ আজও মনে আছে রাহুলের । ‘’এনিওয়ান হু নোজ এনিথিং অফ হিসট্রি নোজ দ্যাট গ্রেট সোশাল চেনজেস আর ইমপসিবল উইদাউট ফিমেল আপহিভল । সোশাল প্রগ্রেস ক্যান বি মেজার্ড এগজ্যাক্টলি বাই দি সোশাল পোজিশান অফ দি ফেয়ার সেক্স, দি আগলি ওয়ানস ইনক্লুডেড।’’ দি আগলি ওয়ানস ইনক্লুডেড, এইটুকু ছিল লাল রঙে, বাকিটা কালো সুতোয় ।

        –ওইটুকু লাল সুতোয় কেন ?

        –ওটা আমার জন্য । আমি তো আগলি, নয়তো আমার প্রেমিক ছেড়ে চলে যাবে কেন, বল । বিপ্লবী মাত্রেই আগলি, সে নারী হোক বা পুরুষ ।      

        প্রেমিক ? আমি জানতুম সে সুমিতাদির বর !  সে তো ছাড়েনি ; সুমিতাদিই তাকে বের করে দিয়েছেন বাড়ি আর জীবন থেকে, কানপুরের ব্রাহ্মমহলে সেরকমই গুজব ।

        সুমিতাদির ডিভোর্সের গুজবও শুনেছিল রাহুল, কিন্তু বর যে কে, তার নাম কী, কেমন দেখতে, কিছুই জানতে পারেনি কখনও । কথা বাড়ালে অন্যের জটিলতায় অযথা জড়িয়ে পড়তে পারে আশঙ্কায়, আচ্ছা চলি বলে কেটে পড়েছিল রাহুল ।

          রাহুলের এখন মনে হয়, সুমিতাদি বোধহয় অনুমান করে ফেলেছিলেন যে শেষ পর্যন্ত কী হবে সোভিয়েত রাষ্ট্রের ; দলের হয়ে  মসকো ইউক্রেন লেনিনগ্রাড কোথায়-কোথায় বেড়িয়ে এসেছিলেন । সম্ভবত নিজের বৈবাহিক জীবন আর দলীয় সোভিয়েত বৈবাহিক জীবনের রমরমার দিনে। আর কোনোদিন বাচ্চা হবে না, হয়ত এই ভাবনার সঙ্গে গর্বাচভ-ইয়েল্তসিনের কাজ-কারবারকে মিশিয়ে এক ভিন্ন জগতে চলে গিয়েছিলেন সুমিতাদি । নিজেই যে-বিপ্লবীকে যেচে বিয়ে করেছিলেন বলে গুজব, তাকে যে জীবন থেকে লাথিয়ে বের করে দিয়েছিলেন, তাও গুজব, যেন সেই অপদার্থ সোভিয়েত নেতাদের লাথাচ্ছেন, যাদের গুমখুন আর অত্যাচারের জন্য বিপ্লবের স্বপ্ন ঘুচে গিয়েছিল ওনার ।

          সুমিতাদি কিন্তু পশ্চিমবাংলার বামপন্হীদের ব্যাপারেও ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন,  “এরা আরও নৃশংস, দেখে নিস তুই, কালে-কালে নরক গুলজার করে ফেলবে, নেমে যাবে আত্মধ্বংসের গলিঘুঁজিতে ।’’

         ওনার গালের টোলের লালচে রঙ যে কমে যাচ্ছে তা উনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টের পেতেন । গালের টোলে দেখতে পেতেন মানব সমাজের ভবিষ্যৎ । পচে যাচ্ছে, পচে যাচ্ছে, পচে যাচ্ছে ।

        –দাদা যে সমস্ত পত্রিকা এনেছিলেন, তাতে একটা নাম পেয়েছি, বেশ আকর্ষক, হরিচরণ খাঁড়া ।

       –স্কুলে তো একটা মেয়ে ছিল, জানিস না, সারদা খাঁড়া, তোর চেয়ে দু’বছর জুনিয়ার ? ম্যাথসে হানড্রেড পার্সেন্ট মার্কস পেতো ।  খাঁড়া পদবি হয়, হবে না কেন !

        –না, ওনার ঠিকানাও দেয়া আছে পত্রিকাটায় । আপনি কখনও বুদ্ধদেব বসুর পত্রিকায় এই ধরণের পদবি দেখেছেন ? হরিচরণবাবুকে বলেছি আমাদের বাড়িতে আসতে, উনি সালকিয়াতে থাকেন । ওই সময়ে দাদা রক্তিমকেও সঙ্গে আনবেন । আমরা যে আন্দোলন আরম্ভ করতে চলেছি তার জন্য প্ল্যানিং করতে চাই ।

        –তোর কাকিমা বলছিলেন বটে; রক্তিম ছেলেটাকে ওনার ভাল্লাগেনি, বদগন্ধে নাকি ভুরভুর করে ।

        –হরিচরণবাবু আর রক্তিম চাটুজ্জে এলে নিয়ে আসব আপনার বাড়ি ।

        –না না । আমার বাড়িতে আর বিপ্লবীদের পায়ের ধুলো চাই না । তুই ওড়াগে যা বিপ্লবের ধুলোর ঝড় । গালের টোলে আলোর সমুদ্রের ঢেউ তুলে বলেছিলেন সুমিতাদি ।

        সুমিতাদির কোমর জড়িয়ে ওপরে তুলে, কমরেড সুমিতাদি জিন্দাবাদ, স্লোগান দেবার, পুরো ইচ্ছেটা, আবার চেপে গেল রাহুল ।

         আশ্চর্য যে মোহন পালের বোনের গালেও, দুই গালে, টোল পড়ত । নিজেই নিজের সাইক্লোনের ঘুর্ণিপাকে জড়িয়ে চলে গেছে আত্মহত্যার পথ ধরে ।

         অসীম গাঙ্গুলিও চুপচাপ সাইক্লোনের পাক বাঁধছিলেন সেদিন , তা এখন, এই এতকাল পরে জানতে পারছে রাহুল সিংহ।

         কানপুরের ছাপাখানার বাংলা হরফ কেবল বিয়ে-পৈতে-শ্রাদ্ধর ম্যাটারে সীমিত, সে খবর রাখে না অনেকেই। অসীম গাঙ্গুলির কথা শুনে একটা আইডিয়া এলো রাহুলের । ঠিক, বিয়ের কার্ড । বিয়ের কার্ডকেও কাজে লাগাতে হবে ।

         প্রাপক কার্ড পেয়ে ভাববে বিয়ের নেমন্তন্ন । খুলে দেখবে ক্ষমতার তীব্র আকস্মিকতার মেজাজে ভেতর থেকে

বেরোল শ্বদাঁতের ঝিলিক নিয়ে সাহিত্যের দানবের ঔজ্জ্বল্যের ভ্রুকুটি । যারা বসন্ত ঋতুকে পছন্দ করে না,  তাদের একাধটা কালো-গ্রীষ্মের ঘেয়ো স্মৃতি থাকা উচিত । যাদের মাথা ঘাড়ের ওপর নেই তারা জানে না যে তারা টপলেস ।

         হরিচরণ খাঁড়া ওরফে দুর্গা বর্মণকে আইডিয়াটা দিতে ও বলেছিল, ‘সব শালারা মুখোশ  পরে বসে আছে । একএক জন ভাম, বুঝলে, বর্ষার বাচাল বাঞ্চোত ।’

         হরিচরণ খাঁড়া ওরফে দুর্গা বর্মণের কথা শুনে রাহুলের আরেকটা আইডিয়া এল । ঠিক । মুখোশ । জানোয়ার দানব রাক্ষস জোকার ইত্যাদির কাগজের মুখোশ, যার ওপর ছাপানো থাকবে, ‘দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন ।’  পেয়ে কী ভাববেন প্রফুল্লচন্দ্র সেন ?

         ইইইইইনটেএএএলেকচুলরা ! চুলগুলোই দেশটাকে ডোবালো, বলবেন মন্ত্রীসভার সদস্যদের ।

         প্রদীপন চাটুজ্যে একদিন সাহিত্যিক অমল ধরের বাড়ি গিয়েছিল, জানোতো ? ওই যে হে অমল ধর, বিগব্যানার সাপ্তাহিকের জন্য ছোটোগল্প ছাঁটেন। ওনার বাড়িতে সামনের ঘর থেকে আরম্ভ করে মায় সিঁড়িতেও চারিদিকে নিজের ফোটো টাঙিয়ে রেখেছেন, কয়েকটা বেশ পেল্লাই মাপের ।

        প্রদীপনকে বলেছেন ,আপনাদের আন্দোলন আত্মপ্রচারমুখী হয়ে উঠেছে । কথাটা বলে, হাওয়া থেকে একটা অদৃশ্য চুল উপড়ে ফুঁ দিয়ে নাকি উড়িয়েছিলেন ।

         বিষের নিঃশব্দ বিকীরণ । লোকে বুঝুক যে তথ্যের মধ্যে বসবাস করে অম্বলের চোঁয়াঢেঁকুর মাখানো সংলাপে ভেজা  সময়কে ইতিহাস বলে চালানো যায় না ।

         বাগড়ি মার্কেটে চলো, ওখানে হোলসেল দরে মুখোশ পাওয়া যায় । জব প্রেসও আছে কাছাকাছি ।

         আরে, ও তো এখন অসীম গাঙ্গুলির ঘরে, খেয়াল হল রাহুলের ।

         ওনার পরের কথায় অবস্হান স্পষ্ট হল রাহুলের, ‘নেতার নাম যদি একান্তই দেবার ছিল, নিজের নাম দিলে না কেন ! তুমিই যখন সব করছ তখন নেতা হিসেবে নিজের নাম দিলে না কেন ? আর হরিচরণ খাঁড়া ওরফে দুর্গা বর্মণ নামের সম্পাদকের ভূমিকাই বা তাহলে কী ?‘

         যাক , বাঁধাধরা ধারণায় জবর চোট দেয়া গেছে তাহলে ।  রাহুল চুপ করে রইল ; শোনা যাক ওনার মনের

ভেতরের লুকোনো ইউরেকা চিৎকারগুলো, যা গমগম করতে চাইছে ক্ষোভ আর ক্রোধের ভুলভুলাইয়ায় ।

         –এখন বোধহয় এসেছ তোমাদের সঙ্গে যোগদানের প্রস্তাব নিয়ে ! একটা কথা তুমি ভুলে গিয়েছিলে রাহুল  ; আমিই তরুণ কবিদের নেতা । তুমি কেন আমার সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন মনে করোনি ? কারা বাধা দিয়েছিল তোমায় ? তুমি কি বুঝতে পারোনি যে আমাকে বাদ দিয়ে আমার বিরুদ্ধে একটা কিছু করার চেষ্টা হচ্ছে? রামায়ণ নট্ট কোম্পানিকে এলেবেলে করে দেবার চেষ্টা হচ্ছে ? অথচ আমিই তোমাকে সাহিত্যে এনেছিলুম ।

         আমিই তোমাকে সাহিত্যে এনেছিলুম ।

         আমিই তোমাকে এনেছিলুম ।

         আমিই তোমাকে….

         আমিই….

         আমি….

         আমি, আই অ্যাম দি এমপেরর ।

         তার পরের কথায় রাহুলের মাথার ওপর বোমা ফাটিয়ে দিলেন অসীম গাঙ্গুলি, ‘আমি কি রক্তিমের থুতু চাটব ?’

         অসীম গাঙ্গুলি এভাবে ক্ষেপে গেলেন কেন, তাও আচমকা, এতক্ষণে ঠাহর করতে পারল   রাহুল , যার ডাক নাম রাহু, আর যার দাদার ডাক নাম কেতু । ওর , রাহুলের বা রাহুর, মনে হল, নেতিপ্রধান আলো আর ইতিপ্রধান অন্ধকারের পাঁচিল তুলে দূরত্বের ইঙ্গিত দিতে চাইছেন উনি, মানে অসীম ঘাঙ্গুলি, রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারীমশায় । ও যতটা পরিচিত ততটাই আগন্তুক হয়ে উঠছিল ওনার দোতলার ঘরে বসে । হয়ত, হয়ত কেন, বোধহয়, বা বোধহয়ও নয়, ওনার হৈতুকবাদী উষ্মা কাটিয়ে ভেসে আসছিল নিয়মনিষ্ঠ রক্ষণশিলতার  সীসকবর্ণ অদৃশ্য গোমরের মেঘ।

         এই বাড়িটায় ঢোকার মুখে গেট থেকে অনেকটা জায়গা ফাঁকা । পাঁচিলের ধারে-ধারে রক্তকরবী । দীর্ঘ পলাশ গাছ, রক্তকরবীদের জেঠামশায়, ছেয়ে আছে লালচে গোলাপিতে । কিন্তু সে যাই হোক, তার ডালে বসে কয়েকটা কাক, কে জানে কোন ভাষায়,  ঝগড়া করছিল, হয়ত দুর্গন্ধের নান্দনিকতা নিয়ে ।

         অসীম গাঙ্গুলির কথাটা , যা শুনে  রাহুলের মনে হচ্ছিল ,স্মৃতির আগের শৈশবে পাওয়া কোনো তথ্য মেলে ধরতে চাইছেন উনি, তা মিথ্যা নয় । রাহুলের  দাদা অনিকেতের সহপাঠী ছিলেন অসীম । সেই সূত্রে রাহুলদের শ্যাওড়াফুলি বাড়ির খণ্ডহরের আলকাৎরা মাখা কেঠো চিলেকোঠায় নিকোটিনের কুণ্ডলী-পাকানো  নিঃশব্দ বিকিরণের আওতায় আড্ডাধারী দাদার বন্ধুদের মাঝে বসে, ছায়া গড়তে পারে না এমন দুর্বল রোদের মতন কন্ঠে ওনার গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেছিল রাহুল :-

অনেক দিনের আমার যে গান আমার কাছে ফিরে আসে
তারে আমি শুধাই, তুমি ঘুরে বেড়াও কোন বাতাসে ।।
যেফুল গেছে সকল ফেলে গন্ধ তাহার কোথায় পেলে,
যার আসা আজ শূন্য হল কী সুর জাগাও তাহার আশে ।।
সকল গৃহ হারাল যার তোমার তানে তারি বাসা,
যার বিরহের নাই অবসান তার মিলনের আনে ভাষা ।
শুকালো যেই নয়নবারি তোমার সুরে কাঁদন তারি,
ভোলা দিনের বাহন তুমি স্বপন ভাসাও দূর আকাশে ।।

          এই গানের দরুন আবহাওয়া কিছুটা বুড়োটে হয়ে উঠেছিল বলে অশোক মিত্র  গমগমে গলায় গেয়ে উঠেছিলেন:-

নাই ভয় নাই ভয় নাই রে ।
থাক পড়ে থাক ভয় বাইরে ।।
জাগো মৃত্যুঞ্জয় চিত্তে, থৈ থৈ নর্তননৃত্যে ।
ওরে মন বন্ধনছিন্ন
দাও তালি তাই তাই তাইরে ।।

         রূপক মজুমদার ওই গানটাই আরও উঁচু গলায় গাইতে, দাদা অনিকেত রূপকদাকে বলেছিলেন, ‘চুপ চুপ, ঠাকুমার কানে গেলে চেঁচাবেন, জানিস না রবীন্দ্রনাথ আমাদের বাড়িতে নিষিদ্ধ, বেম্মো বলে ; অন্য গান ধর’ ।

         রূপকদা, যিনি হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের মাপজোকের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, গেয়ে উঠেছিলেন :

হম দর্দকে মারোঁ কা, ইতনাহি ফসানা হ্যায়
পিনেকো শরাবে ঘম, দিল ঘম কা নিশানা হ্যায়
তকদির কে হাথোঁ মেঁ মরনে কি তমন্না হ্যায়
হম দর্দকে মারোঁ কা ইতনাহি ফসানা হ্যায়…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *