৬৪. এক হাঁটু জল ঠেলে ঠেলে

এক হাঁটু জল ঠেলে ঠেলে বাড়িতে ফিরতে লাগল ভরত। ইরফান তার সঙ্গে আসতে চেয়েছিল, ভরত রাজি হয়নি। ইরফান এমন প্রস্তাবও দিয়েছিল যে, ভরতের আর রাত্রে ফেরার দরকার কী, সে তো মানিকতলার বাড়িতে থেকে গেলেই পারে। ইরফান খুবই বিভ্রান্ত অবস্থার মধ্যে আছে, সে একা থাকতে চাইছিল না। কিন্তু নিজের বাড়ির বালিশটির ওপর ভরতের খুব মায়া, সেখানে মাথা না দিলে তার ঘুম আসে না। কেউ যখন বলে, ভরত, তোর জন্যে তো বাড়িতে কেউ অপেক্ষা করে নেই, তখন তার উত্তরে ভরতের বলতে ইচ্ছে করে, কেন, আমার বালিশটা যে অপেক্ষা করে আছে!

অন্ধকারেও ভরতের কোনও অসুবিধে হয় না। রাস্তা তার চেনা। হেদোর পাশ দিয়ে চলে যাবে। এই সময়টায় মাতালের খুব উপদ্রব হয়। মানিকতলা বাজারের কাছে মাতাল থাকে অনেক, এক একটি মাতালের আবার বিচিত্র সব বাতিক। কেউ কেউ পয়সা কেড়ে নেয়, কেউ কেউ পয়সা দিতে চায়। একদিন এই রাস্তায় একটি মাতাল ভরতকে জোর করে মদ্যপান করাতে চেয়েছিল নিজের পয়সায়, ভরত রাজি হয়নি বলে সে দমাদ্দম ঘুঁসি মারতে মারতে বলেছিল, কেন শালা খাবি না, আমি মাতাল হব, আর তুই শালা কেন সাধুপুরুষ হয়ে থাকবি!

বৃষ্টির পর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে বাতাস। এখনও তারা ফোটেনি। অবশ্য, আকাশ যেন একটা পাতলা চাদরে ঢাকা। কোনও বাড়িতেই আলো নেই, নগরীর অস্তিত্বই যেন মুছে গেছে। ভরত গুনগুন করে গান গাইতে লাগল। তার গানের গলা নেই, কিন্তু একলা গাইতে ক্ষতি কী! একলা থাকলে আর একজনের কথাও খুব মনে পড়ে। সে যেন এখন ভরতের পাশে পাশে হাঁটছে। ভরতের চিঠির এখনও উত্তর আসেনি, এদিকে বাণীবিনোদ গেছে চন্দননগরে।

বাড়ি ফিরে হারিকেনটা জ্বালল ভরত। আজ আর রান্নাবান্নার পাট নেই। তবু এখনও শুয়ে পড়তেও ইচ্ছে করছে না। ইরফানের সঙ্গে নিরিবিলিতে সে আজ যে-সব কথা আলোচনা করেছে, সেসব কথা সে আগে কোনও দিন মুখ ফুটে বলেনি। এরকম চিন্তার কোনও ভাষাই ছিল না তার। আজ যেন হঠাৎ বেরিয়ে এল।

রাস্তায় ভরতের বাড়ির সামনেই শোনা গেল দু’জন মাতালের জড়ানো গলার হল্লা। ভরত বারান্দা দিয়ে একটু উকি মেরে দেখল, দু’জনেরই বেশ ষণ্ডমার্কা চেহারা, স্খলিত পায়ে হাঁটছে। ভরত আর একটু দেরি করলেই ওদের পাল্লায় পড়ে যেত। রাত্তিরবেলা মাতালরা যখন নিরীহ মানুষদের ধরে টানাটানি করে, তখন সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসে না। কোতোয়ালির পাহারাওয়ালারা পথে পথে টহল দেয় বটে, মাতাল দেখলে তারা বেদম পেটায়, কিন্তু তারা এরকম গলিতে ঢোকে না।

ছাদের কার্নিস দিয়ে একটা বেড়াল ম্যাও ম্যাও করে ঘুরছে। পাশের বাড়ির মাচার ওপর পায়রারা ঝটপটিয়ে উঠছে সেই ডাক শুনে। বেড়ালটা প্রায়ই বাঁশ বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করে, কিন্তু কোনও লাভ নেই, পায়রাগুলো হুস করে উড়ে যায়। রাত্রির আকাশে ঘুরপাক খায় তারা। বেড়ালটা ব্যৰ্থ আক্ৰোশে গজরাতে থাকে, যেন সে বলতে চায়, কেন তার ডানা নেই? বেড়ালটার এই ধরনের দৃষ্টতা পছন্দই করে ভরত, কারণ তাতে পায়রাগুলো ওড়ার দৃশ্য সে উপভোগ করতে পারে। রাক্তিরবেলা তারা ডাকে না, শুধু নিঃশব্দে উড়তে থাকে। আজকের রাত অন্ধকার, কিন্তু জ্যোৎস্না রাতে এক গুচ্ছ পায়রা যখন ঘুরে ঘুরে ওড়ে, তখন যেন এক অলৌকিক মায়ার সৃষ্টি হয়।

বিছানা একেবারেই টানছে না ভরতকে। একটুক্ষণ সে চুপ করে বসে চুরুট টানল, তারপর তার ইচ্ছে হল চা বানিয়ে খেতে। এর আগেও কয়েকবার মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে সে চা বানিয়ে খেয়েছে, অপূর্ব স্বাদ পাওয়া যায় তখন।

উনুন ধরাবার আগেই ভরত একটা বেশ বড় ধরনের ঘোড়ার গাড়ির শব্দ পেল রাস্তায় এবং গাড়িটা যেন এ বাড়ির দরজার সামনেই থামল। তারপরই একজন কেউ গর্জন করার মতন ডাকল, ভরত! ভরত! দরজা খোল!

সেই ডাক শুনে ভরত কেঁপে উঠল। এত রাতে তাকে কে ডাকতে আসবে? এ কণ্ঠস্বর তো দ্বারিকার নয়! বারান্দা দিয়ে ঝুঁকে সে জিজ্ঞেস করল, কে?

ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে একজন দীর্ঘকায় মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, ওপর থেকে চেনা যাচ্ছে না । সেই ব্যক্তি ওপরের দিকে মুখ তুলে বলল, দরজা খুলে দে!

ভরত এবার ছুটে নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে। একতলার কোলাপসিবল গেটের চাবিটা পাশের দেওয়ালেই ঝোলে। গেট খুলে বাইরে এসে দেখল, পুরোদস্তুর সাহেবি পোশাক পরা শশিভূষণ, হাতে একটা ছড়ি, অসহিষ্ণু এক সৈনিকের মতন ছটফট করছেন। ভরতের মুখের দিকে তিনি চেয়ে রইলেন কয়েক পলক, তারপর গাড়ির দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, নেমে এসো!

বুকের কাছে হাত দুটি জড়ো করে গাড়ি থেকে নামল এক রমণী, রাস্তায় আলো নেই, সে রমণীও মুখ নিচু করে আছে, তবু শুধু শরীরের রেখা দেখেই ভূমিসূতাকে চিনতে তার এক মুহূর্তও দেরি হল না।

তলোয়ারের ভঙ্গিতে হাতের ছড়িটা তুলে শশিভূষণ বললেন, ওপরে চল!

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে দু’বার হেঁ।চট খেলেন শশিভূষণ, বিরক্তিতে গজগজ করতে লাগলেন এবং ওপরে এসে যদিও দেখলেন যে একটা হারিকেন জ্বলছে, তবু বললেন, আলো জ্বালাসনি কেন?

ওই হারিকেন ছাড়া ভরতের ঘরে আর কোনও বাতি নেই। সে শিখাটা উস্কে দিল অনেকখানি, তারপর হারিকেনটা উঁচু করে তুলে ধরল। প্রথমেই তার নজরে পড়ল, ভূমিসূতার কপালে একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা, তার এক পাশ এখনও রক্তে ভেজা।

সাঙ্ঘাতিক কিছু একটা ঘটেছে, এই আশঙ্কায় ভরতের মুখ দিয়ে একটা শব্দও বেরুল না।

শশিভূষণ মেঝেতে পাতা মাদুরের একটা ধার ছড়ির ডগা দিয়ে সরিয়ে দিলেন, সেটা যেন অতি নোংরা পদার্থ এই ভাবে জুতোপরা পা দিয়ে ঠেলে দিলেন আরও খানিকটা। তারপর শান্ত গম্ভীর গলায় বললেন, রেখে গেলাম তোর কাছে। এখন তোরা যা খুশি কর। আমি আর কোনওদিন দেখতে আসব না। আমার সঙ্গে তোদের আর কোনও সম্পর্ক থাকবে না। তোরা যদি সুখে থাকতে পারিস হ্যাঁ, আমি খুশিই হব। আগে আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করতাম না, এখন দেখছি নিয়তি যাকে যেদিকে টানে, তা আর এড়াবার উপায় নেই-

হঠাৎ কথা থামিয়ে দিয়ে শশিভূষণ বললেন, চলি-

তিনি পিছন ফিরতেই ভরত ব্যাকুল ভাবে বলল, স্যার-

সঙ্গে সঙ্গে শশিভূষণ ফেটে পড়লেন। নিজেকে তিনি প্রাণপণে সংযত করার চেষ্টা করছিলেন, এবার বাঁধ ভেঙে গেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে তিনি প্রচণ্ড জোরে বললেন, চুপ! অকৃতজ্ঞ! তোর একটা কথাও শুনতে চাই না। আমাকে কিছু না জানিয়ে… গোপনে গোপনে চিঠি লেখা! তুই পড়াশুনো করে বড় হবি বলেছিলি, সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলুম, তুই আসলে আমার চোখে ধুলো দিয়েছিস… জন্মের দোষ… সততা বলে কিছু নেই। আমি এই মেয়েটিকে সিংহের মুখ থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম, মহারাজ ওকে খেয়ে ফেলতেন. .. আমি ওর জন্য চাকরি ছাড়তে রাজি ছিলাম, ওকে সব কিছু দিতে চেয়েছি… স্বাধীনতা, নিজস্ব বাড়ি, সংসার, গঙ্গার ধারে সুন্দর একটা বাড়ি দেখে রেখেছিলাম, সেখানে ও সম্মানের জীবন পেত… রক্ষিতা নয়… অন্য কারুর আপত্তি আমি গ্রাহ্য করতুম না, মন ঠিক করে ফেলেছিলুম আমি আবার সংসারী হব. . . অকৃতজ্ঞ, এত অকৃতজ্ঞ তুই, তলে তলে ষড়যন্ত্র করেছিস

ভরত বলল, স্যার, আমি…

ভূমিসূতা মুখ ভুলে আস্তে আস্তে বলল, ওঁর দোষ নেই, সব দায় আমার…

শশিভূষণ বললেন, তোমার কোনও কথা আর আমি শুনতে চাই না-

তিনি এমন ভাবে মুখটা বাঁকিয়ে রইলেন, যেন তিনি ভূমিসূতাকে দেখতেও চান না। তাঁর সমস্ত মুখে যন্ত্রণার রেখা। তিনি ভরতকে বললেন, তোর চালচুলো নেই, তুই ওকে খাওয়াতে পারৰি? মহারাজ ওর খোঁজ করবেনই, তোর কথা যদি জানতে পারেন, সারাজীবন তোকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে। অনেক ঝুঁকি নিয়ে তোকে কলকাতায় এনেছিলুম, আশা করেছিলুম নিজের পায়ে দাঁড়াবি, মানুষের মতন মানুষ হবি, সব আমার ভুল, রক্তের দোষ যাবে কোথায়… যাক, তোদের নিয়তি তোরা বুঝবি, আমি তো দেখতে আসব না, এই শেষ!

ভরত বলল, স্যার, আপনি বসুন, দয়া করে বসুন।

শশিভূষণ কয়েক পলক স্থির চোখে চেয়ে রইলেন ভরতের দিকে। তারপর দু’দিকে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, না, বসব না, তোর এখানে নিশ্বাস নিতেও আমার কষ্ট হচ্ছে। আর কোনওদিন… না না, আমি আর তোদের মুখ দেখতে চাই না, সব শেষ, তোরা বাঁচিস বা মরিস, তাতে আমার কিছু আসে যায় না!

ভরত এবার শশিভূষণের পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, স্যার, আপনাকে একটু বসতেই হবে, আমি কিছুই জানি না।

দ্রুত সরে গিয়ে শশিভূষণ রুদ্র কণ্ঠে বললেন, আমাকে ছুঁৰি না! হারামজাদা! আমার সঙ্গে ভণ্ডামি, মাথা গুঁড়ো করে দেব!

ভরতকে সত্যি সত্যি মারার জন্য তিনি ছড়িটা একবার তুললেন। তাঁর সারা শরীর কাঁপছে।

তারপর আস্তে আস্তে ছড়িটা নামিয়ে নিয়ে ক্লান্ত ভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আস্তে আস্তে বললেন, নাঃ, আর কী হবে, আমি এবার যাই!… ওর যে মাথা ফেটে গেছে, আমি কিন্তু ওকে মারিনি… ও বারান্দা দিয়ে লাফিয়ে পালাতে গিয়েছিল… আমি কি ওকে জোর করে বন্দী করে রেখেছিলুম? শশিভূষণ সিংহ জীবনে কারুর ওপর জোর করেনি, আমি শুধু চেয়েছিলুম. . . থাক, আর থাক, সব কথা শেষ হয়ে গেছে…

শশিভূষণ ঝট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, সিঁড়িতে ধুপধাপ শব্দ শোনা গেল। তারপর জুড়িগাড়ির ঝমঝম শব্দ একটু একটু করে মিলিয়ে গেল দূরে।

ভরত কান পেতে শুনতে লাগল সেই শব্দ। যেন সেই শব্দের সঙ্গে তার হৃৎস্পন্দনের যোগ আছে।

দুটো ঘরের মাঝখানের একটা মোড়ার ওপর বসেছে ভূমিসূতা। থুনিতে দুই হাতে তালু, সোজা চেয়ে আছে ভরতের দিকে, এ ঘরের একটিমাত্র চেয়ারে না বলে, পেছনটা ধরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল ভরত। এটা যেন তার বাড়ি নয়, অচেনা কোনও গৃহে হঠাৎ ঢুকে পড়েছে, কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছে না।

দু’জনে তাকিয়ে রইল শুধু। ওরা সামনাসামনি কথা বলার সুযোগ পেয়েছে খুব কমই, মনে মনেই দু’জনে দু’জনের কাছাকাছি এসেছে।

এক একটা মিনিট কাটছে, না এক একটা যুগ!

একটা ফর ফর শব্দ শুনতে পেল ভরত। বেড়ালটা সক্ষম হয়েছে পায়রাগুলোকে উড়িয়ে দিতে। অন্য দিন ভরত বারান্দায় দৌড়ে দেখতে যায়। এখন যাওয়া চলে না। ভূমিসূতাকে অন্য কিছু বলার আগে প্রথমেই বলা যায় না, চলো, আমরা রাত্রির আকাশে পায়রার ওড়াওড়ি দেখি।

সে চেয়ে রইল ভূমিসূতার দিকে। দু’জনের চোখে চোখ, কিন্তু ভরত ভূমিসূতার চোখের ভাষা পড়তে পারছে না, তার এখনও বুক কাঁপছে। শশিভূষণের গাড়িটার চলে যাবার শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে এখনও।

একটা কিছু বলা উচিৎ, তাই ভরত অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলল, তুমি চা খাবে?

একটু আগে সে নিজে চা বানাবে ভেবেছিল, তাই এ কথাটা তার মনে এল।

ভূমিসূতা খুব মৃদু গলায় বলল, না।

ভরতের মতন সকলেরই যে মাঝরাত্তিরে চা খেতে ভালো লাগবে তার কোনও মানে নেই। ভরত সেটা বুঝে মাথা নাড়ল। তারপরই তার মনে পড়ল, আর একটা কথা অনায়াসেই জিজ্ঞেস করা যেতে পারে।

সে বলল, তোমার মাথায় চোট… খুব বেশি লেগেছে?

ভূমিসূতা এবারও বলল, না।

তারপর সে উঠে দাঁড়াল। হারিকেনটা তুলে নিয়ে ভেতরের ঘরটা দেখল। রান্নাঘরের কাছে এসে উকি মারল, সেখান থেকে কল-পায়খানা ঘরে, কিন্তু ব্যবহার করার জন্য নয়, ভরতের ক্ষুদ্র বাসাবাড়িটা সে দেখে নিচ্ছে। ফিরে এসে হাট করে খোলা দরজার পাল্লা দুটো ভেজিয়ে দিতে দিতে বলল, মহারাজ আমাকে তাঁর সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।

ভরত বলল, ত্রিপুরায়?

ভূমিসূতা বলল, হ্যাঁ, আমি যেতে চাইনি। ওখানে সবাই বলল, ত্রিপুরায় একবার গেলে আমার আর ফেরার আশা ছিল না।

ভরত বলল, রাজবাড়িতে একবার ঢুকলে কোনও মেয়ে আর বেরুতে পারে না।

ভরত কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছিল না বুঝেই ভূমিসূতা তাকে কথা বলানোর দায়িত্ব নিয়েছে। ভরতের সারা শরীর এখনও আড়ষ্ট, ভূমিসূতা অনেক স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আঁচল দিয়ে সে মুখ মুছল। তারপর বলল, রাজবাড়িতে থাকতাম কিনা জানি না। মহারাজ আমাকে রোজ গান শোনাবার জন্য নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।

ভরত বলল, গান? মেয়েরা সবাই রাজবাড়ির মধ্যেই থাকে। তুমি যেতে চাওনি, মহারাজ তা শুনে রাগ করেননি? আমার মাস্টারমশাই কী বলেছিলেন?

হারিকেনের শিখাটা দপদপ করছে, হাঁটু গেড়ে বসে সেটা বসিয়ে দিতে দিতে ভূমিসূতা বলল, উনি আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। আমাকে উনি বিয়ে করে অন্য জায়গায় নিয়ে গেলে মহারাজ আর রাগ করবেন না বলেছিলেন। আমি সে কথা শোনার সময় কান বন্ধ করে ছিলাম। খুব মন দিয়ে অন্য কথা ভাবতে থাকলে আমি সামনে কেউ কথা বললেও শুনতে পাই না।

ভরত এবার চেয়ারটায় বসে দুহাতে মুখ চাপা দিল।

আবার বৃষ্টি নেমেছে। ঝড়ো হাওয়াও বইতে শুরু করেছে নতুন করে। বারান্দার দরজা দিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগছে ভরতের গায়ে, ভরত তা টের পেল না।

ভূমিসূতা বলল, সব ভিজে যাবে। দরজা বন্ধ করে দেব? মুখ থেকে হাত, ভরত এক সদ্য সর্বস্বান্ত মানুষের মতন গলায় বলল, ভূমি-

ভূমিসূতা ঘুরে দাঁড়াল।

ভরত বলল, কী হয়ে গেল বল তো?

ভূমিসূতা বলল, আমি আপনার চিঠির উত্তর লিখে রেখেছিলাম। কী করে পাঠাব… পুরুতমশাইয়ের কাছে যেতে পারিনি। তাই আজ ঠিক করেছিলাম, যেভাবেই হোক, আমি নিজেই চলে আসব। আমার ওখানে আর থাকতে একটুও ইচ্ছে করছিল না।

ভরত বলল, তুমি… আমি মাসের পর মাস ভেবেছি তোমাকে ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার করে আনব, আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, কিন্তু হঠাৎ এ কী হয়ে গেল? আমার মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে, আমি কিছু ভাবতে পারছি না।

ভূমিসূতা নিজের মাথার ব্যান্ডেজটা খুলে ফেলতে লাগল।

ভরত প্রবলভাবে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, না, না, এ হয় না, হয় না! ভূমি, মাস্টার মশাইয়ের কাছে আমি কতখানি ঋণী, তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। উনি দয়া না করলে আমি বেঁচে থাকতাম না। আমার ওপর এমন রেগে গেছেন দেখে কত কষ্ট হচ্ছিল, আমি কি সত্যি অকৃতজ্ঞ? আমি ওঁকে মনে মনে পুজো করি। মাস্টারমশাই তোমাকে পছন্দ করেছেন, বিয়ে করতেও চেয়েছিলেন, তারপর আমি, না না, হয় না, কিছুতেই হয় না। তুমি কেন এখানে এলে?

ভূমিসূতা বলল, আপনি যদি চিঠি না লিখতেন,… তাহলেও আমি ওঁকে বিয়ে করতাম না। আমি কারুর দয়া চাই না। আমি…

ভরত বলল, দয়া নয়, ভূমি, তুমি মাস্টারমশাইয়ের কথা শুনে বুঝতে পারলে না? উনি তোমাকে ভালোবেসেছেন। ওঁর মুখে আমি কখনও কোনও স্ত্রীলোক সম্পর্কে কথা শুনিনি, উনি বিয়ে করবেন না ঠিক করেছিলেন-

ভূমিসূতা বলল, আমি দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছি। জানতাম, আপনার কাছ থেকে ডাক আসবেই…

ভরত বলল, আজ তুমি এলে, আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন হতে পারত, কিন্তু মাস্টারমশাই তোমাকে চেয়েছেন, উনি খুব আঘাত পেয়েছেন, তারপরেও আমি কী করে…

দু’জনে চুপ করে রইল একটুক্ষণ। যাদের আলিঙ্গনাবদ্ধ হবার কথা ছিল, তারা এক পাও কাছে এগোয়নি। দু’জনের চোখ মাটির দিকে।

একটু পরে ভরত অসহায় ভাবে বলল, এখন আমি কী করি?

ভরত বলল, তোমার কপালে লেগেছে, আমার কাছে কোনও ওষুধ নেই।

ভূমিসূতা বলল, লাগবে না।

সব দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে ভরত চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজার কাছে তার চটি জোড়া পায়ে গলিয়ে নিল, দৃঢ় গলায় বলল, আমাদের এভাবে থাকা চলে না। তুমি কি পাগল, মাস্টারমশাই তোমাকে বিয়ে করতে চাইলেন, তবু তুমি তাঁর মনে দুঃখ দিয়ে চলে এলে! মাস্টারমশাইয়ের অভিশাপ নিয়ে আমি সারা জীবন তোমার সঙ্গে… তা কখনও হয়? আমার চালচুলো নেই, পৃথিবীতে কেউ নেই, উনি আমার মাসোহারা বন্ধ করে দিলে আমাকে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজতে হবে… উনি তোমাকে কত আদর যত্নে রাখবেন, তুমি সুখী হয়েছ দেখলেই আমার আনন্দ হবে। আমি কালই তোমাকে মাস্টারমশাইয়ের কাছে ফেরত দিয়ে আসব।

ভূমিসূতা আর কোনও কথা না বলে দেয়ালের এক কোণে জড়সড় হয়ে দাঁড়াল।

ভরত বলল, ও ঘরে বিছানা পাতা আছে। তুমি শুয়ে থাকো। আমি আমার এক বন্ধুর বাড়িতে চলে যাচ্ছি। আমরা দু’জনে এখানে রাত কাটাইনি, একথা বললে মাস্টারমশাই নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবেন। উনি কত বড় একজন মানুষ, আমার ওপর রাগ করে থাকতে পারবেন না।

দরজার কাছেই দেয়ালের এক আংটায় ঝোলানো জামাটা পরতে পরতে ভরত আবার বলল, কুঁজোয় জল তোলা আছে, তেষ্টা পেলে খেও। আমি কাল সকাল-সকাল চলে আসব। তার আগে যদি ইচ্ছে হয়, চা বানিয়ে নিতে পারো। উনুন ধরাবার জন্য ঘুঁটে আছে, দেশলাই রাখা আছে তাকে। দুধ অবশ্য পাবে না, দুধ নিয়ে আসব আমি। ছাদে ঘটার ঘটর শব্দ হতে পারে, তাতে ভয় পেও না, বড় বড় ইঁদুর দৌড়োয়…

দরজা খুলে বেরুতে গিয়েও আবার ফিরে এল ভরত। ভূমিসূতা একই রকম ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি মাটির দিকে।

একটুক্ষণ চুপ করে রইল ভরত। তার বুকের ভেতরটা যে কঠিনভাবে মুচড়ে মুচড়ে রক্তপাত হচ্ছে, তা কেউ বুঝবে না। তার দু’চোখের নীচে ঝাপটা মারছে সমুদ্রের ঢেউ। সে কাতর গলায় ফিসফিসিয়ে বলল, আমাকে ভুল বুঝে না, ভূমি। আমি অতি নগণ্য মানুষ। আমি তোমায় কিছুই দিতে পারব না, মাস্টারমশাই তোমাকে সম্মানের আসনে বসাবেন, তুমি এতদিন যত কষ্ট সয়েছ, সব দূর হয়ে যাবে।

রাস্তায় বেরিয়ে ছুটতে লাগল ভরত। বৃষ্টি পড়ছে জোরে জোরে, কিন্তু এ পথে জল জমেনি। এখন আর মানুষ তো দূরের কথা একটা কুকুর পর্যন্ত নেই। ভরত পাগলের মতন ছুটছে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সে আপন মনে কী যে বলছে তা কেউ শুনবে না।

হেদো পেরুবার পর হাঁটু পর্যন্ত জল, তা লক্ষই করল না ভরত, সে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটতে লাগল। মানিকতলার বাড়িটিতে এক বিন্দু আলো নেই। দরজা খটখটিয়ে সে ডাকতে লাগল, ইরফান, ইরফান।

দ্বারিকা ফেরেনি, বাড়িতে ইরফান একা। বেশ কিছুক্ষণ পর গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠে সে একটা মোমবাতি হাতে নিয়ে এসে দরজা খুলল। জল কাদায় মাখামাখি হয়ে ভরতের চেহারা ভূতের মতন, তার যেন খুব শীত লেগেছে, সে ঠকঠকিয়ে কাঁপছে।

ইরফান দারুণ অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার, কী হয়েছে, ভরত?

ভরত তার একটা হাত জড়িয়ে ধরে বলল, ইরফান তোর এখানে আমাকে একটু থাকতে দিবি?

ইরফান বলল, তখন তোকে কত বললাম রাতটা থেকে যেতে, তুই বৃষ্টি মাথায় করে চলে গেলি… ভূতের ভয় পেয়েছিস নাকি। ভগবানের বিশ্বাস করিস না, ভূতের বিশ্বাস করিস!

ভরত প্ৰাণপণে কান্না চাপার চেষ্টা করছে, অন্য কারুর সামনে সে কখনও কাঁদে না।

ইরফান আবার জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে বল তো? কোনও খারাপ খবর পেয়েছিস? নিকটজন কেউ মারা গেছে? ভরত কোনও উত্তর দিতে পারছে না।

ইরফান সদর বন্ধ করে দিয়ে বলল, ইস, একেবারে পাঁঠা ভেজা ভিজেছিস। সান্নিপাতিক হয়ে যাবে যে! ধূতি আর পিরান এক্ষুনি ছেড়ে ফেল। আমার একটা লুঙ্গি পরে নে—

গামছা এনে ইরফান নিজেই বন্ধুর মাথা মুছে দিল। জামাটা খুলে দিতে দিতে বলল, আসলে দুঃস্বপ্ন দেখেছিস, তাই না? তাতে ভয় পেয়েছিস। আমারও এরকম হয় মাঝে মাঝে।

ভরত এবার সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে বলল, আমার একটু চা খেতে ইচ্ছে করছে।

ইরফান বলল, এত রাতে চা! অবশ্য একটা গরম কিছু খেলে বুকে ঠাণ্ডা বসবে না। দ্বারিকার ঘরে ব্র্যান্ডি থাকতে পারে, গরম জল মিশিয়ে তাই খাবি?

ভরত বলল, না। চা নেই?

উনুন জ্বলিয়ে চা বানানো হল। ইরফান নিজে অবশ্য খেল না। বেশি চা খেলে তার ঘুম আসে না। অনেকখানি চা খেয়ে কাঁপুনি কমল ভরতের। ইরফানের কাছ থেকে একটা চুরুট নিয়ে টানতে লাগল সে।

ইরফান বলল, অনেক ঘরই তো খালি পড়ে আছে। তুই যেখানে ইচ্ছে শুয়ে পড়তে পারিস। দ্বারিকার বিছানায় তুই শুলেও সে আপত্তি করবে না। তবে তুই আজ ভয় পেয়েছিস তো, আজ আর একা থাকা ঠিক নয়। আমার ঘরে দুটো তক্তাপোশ আছে, সেখানেই শুবি আয়-

ভরত বলল, তুই ঘুমো, আমি একটু পরে যাচ্ছি। ইরফান, সন্ধেবেলা আমরা কত রকম যুক্তির কথা বলছিলাম। কিন্তু মানুষের জীবন কি যুক্তি মেনে চলে?

ইরফান বলল, ওসব কথা কাল সকালে হবে। আমার চোখ টেনে আসছে।

ভরত শুতে গেল না। বসে রইল বারান্দার মেঝেতে। ঘুমের কোনও প্রশ্নই নেই, চোখের পলকই যেন পড়ছে না। আজ সন্ধেবেলাতেই সে হালকা মেজাজে ছিল, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সব ওলোটপলেট হয়ে গেল! ভূমিসূতার কথা সে মুখ ফুটে বন্ধুদের কাছেও কখনও বলেনি। কিন্তু কত স্বপ্ন ছিল ভূমিসূতাকে ঘিরে। একদিন ভূমিসূতা চলে আসবে তার কাছে, সে তখন সরকারি খাতায় নাম লিখিয়ে বিয়ে করবে ভূমিসূতাকে। সেই সময় অবশ্য বন্ধু-বান্ধবদের সাহায্য নিতে হতোই। দ্বারিকা আর যদুপতি তাকে নিশ্চয়ই সাহায্য করত। তারপর তার ওই হরি ঘোষ ছোট বাড়িতেই বসে পড়াত। লেখাপড়ায় খুব আগ্ৰহ ভূমিসূতার, তাকে সে ইংরেজি পড়তেও শিখিয়ে দিত। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আর কোথাও যেত না ভরত, সোজা ছুটে আসত বাড়িতে।

ভূমিসূতা সেই এল, কিন্তু এই কি আসা!

এখন এই মুহূর্তে, ভূমিসূতা রয়েছে তারই ঘরে, তারই বিছানায় শুয়ে আছে। কিন্তু সেখানে ভরতের থাকার কোনও অধিকার নেই। কাল সকালে তাকে যে শুধু ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হবে তাই-ই নয়, মন থেকেও মুছে ফেলতে হবে। তার স্বপ্নে আর ভূমিসূতার স্থান নেই।

নিজের ঘরখানির কথা ভাবতে গেলেই তার চোখে ভেসে উঠছে শশিভূষণের ক্রুদ্ধ বেদনার্ত মুখ। মায়ের কথা মনে নেই ভরতের, রক্তের সম্পর্কে যিনি পিতা, তিনি ভরতকে সঁপে দিয়েছিলেন ঘাতকদের হাতে। একমাত্র শশিভূষণই ভরতের মতন এক অকিঞ্চিৎকর মানুষকে মূল্য দিয়েছিলেন। শশিভূষণ দয়া না করলে সে এক গঞ্জের কাঙালি হয়ে থাকত। শশিভূষণ তার কাছে বাবা-মায়ের চেয়েও বেশি। সেই শশিভূষণের মনে আঘাতের কারণ হয়েছে সে। শশিভূষণ ভেবেছেন, ভরত তলে তলে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে ভূমিসূতাকে পেতে চেয়েছে? ছিছিছিছি। শশিভূষণ যে ভূমিসূতার প্রতি আকৃষ্ট হবেন, এ কথা ঘুণাক্ষরেও তার মনে আসেনি কখনও। নারী জাতির প্রতি ফিরে তাকাতেন না শশিভূষণ, ত্রিপুরায় তাঁর কত প্রলোভন ছিল, ইচ্ছে করলেই তিনি নিজের বাসস্থানে একাধিক সোমথ দাসী রাখতে পারতেন, তাতে কেউ কিছু মনে করে না। ভবানীপুরের বাড়িতেও ভূমিসূতার সঙ্গে শশিভূষণকে কখনও একটি কথাও বলতে দেখেনি ভরত।

যদি নিজের প্রাণ দিয়েও প্রমাণ করতে হয় যে ভরত অকৃতজ্ঞ নয়, তাতেও সে রাজি আছে।

যারা অনিদ্রা রোগী, যারা সাধক-যোগী, তাদেরও এক সময় ঘুম আসে, কিন্তু ভরতের চোখে ঘুম নেই। বিছানায় আরাম করে শুতেও তার ইচ্ছে করছে না, সে মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে আছে। নিশ্ছিদ্ৰ অন্ধকারের মধ্যে সে দেখতে পাচ্ছে তার অকিঞ্চিৎকর জীবনের সমগ্ৰ ছবি। তার আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই। সে শুধু এইটুকু ঠিক করে ফেলেছে, সে আর কলকাতা শহরে থাকবে না। একদিন সে মহারাজের দৃষ্টিপথ থেকে এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেছিল, এখন থেকে সে আর শশিভূষণ-ভূমিসূতার দৃষ্টিপথেও থাকবে না। এঁদের দু’জনের জীবনে কোনও অস্তিত্ব থাকবে না ভরতের।

রাস্তার ওপারে তাঁতিদের বস্তিতে ডেকে উঠল মোরগ। এখনও আকাশে আলো ফোটেনি, পুব দিগন্তে শুধু সামান্য লালচে আভা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যেই ভোর হয়ে গেল? ভরত তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। আর দেরি করা ঠিক হবে না। পাশের বাড়ির পুরুতে বাণীবিনোদ এক একদিন এমন ভোরেই চা খাওয়ার জন্য ছাদ ডিঙিয়ে চলে আসে।

নিজের জামা ও ধুতি শুধু ভিজে নয়, একেবারে নোংরা। হয়তো কাল আসার পথে দু-একবার আছড়ে খেয়েছে, খেয়ালও নেই। এগুলো পরে যাওয়া যায় না। ভোর হতে না হতেই শহরের অনেক জেগে ওঠে। ভরত দ্বারিকার ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকল। একটা আলনায় পরিপাটি করে সাজানো আছে বেশ কয়েকটা ধুতি, বেনিয়ান ও কুর্তা। দ্বারিকার কাছ থেকে এক প্রস্থ পোশাক ধার করতে কোনও বাধা নেই।

পোশাক বদলাবার পর রান্নাঘরে এসে একটা ধারালো মাংস কাটা ছুরিও নিয়ে নিল ভরত। সেটা কোমরে গুঁজে রাখল, একটা অস্ত্র রাখা দরকার। শশিভূষণ যদি কোনওক্রমে তাকে অবিশ্বাস করেন, তাহলে তাঁর সামনেই নিজের গলায় ছুরি বসিয়ে দেবে ভরত।

এরই মধ্যে রাস্তা দিয়ে দল বেঁধে বেঁধে চলেছে গঙ্গাস্নানার্থীরা। কিছু কিছু ফেরিওয়ালা বেরিয়ে পড়েছে সওদা নিয়ে। বাড়ির কাছেই একটা মিষ্টির দোকানে মস্ত বড় একটা কড়াইতে দুধ জ্বাল দেওয়া হয়। ভরত এক পোয়া দুধ নিয়ে নিল একটা ভাঁড়ে। তার কাছে পয়সা নেই, কিন্তু এ দোকানে সে ধার রাখতে পারে। জিলিপি ভাজার মাদকতাময় গন্ধ নাকে আসছে। ভূমিসূতা কি জিলিপি খেতে ভালোবাসে! ভূমিসূতা তার বাড়িতে এল, কিছু না খেয়ে চলে যাবে? দু’আনার জিলিপিও নিল ভরত। একটা বড় শালপাতার ঠোঙায় সব কিছু নিয়ে এক হাতে ধরে সে অন্য হাত চাপা দিয়ে সাবধানে হেঁটে চলল। চিলে ছোঁ মারার ভয় আছে।

নীচের গেট খোলা, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে এসে ভরত দেখল বাইরের দরজাও খেলা। তার শয্যা শূন্য। সে দুবার ডাকিল, ভূমি, ভূমি!

এরপর শালপাতার ঠোঙাটা নামিয়ে রেখে ভরত দৌড়োদৌড়ি করে রান্নাঘর, স্নানের ঘর, বারান্দা, ছাদ, ন্যাড়া ছাদ সব খুঁজে দেখল বটে, কিন্তু আগেই সে বুঝে গেছে, ভূমিসূতা নেই। কোনও কোনও শূন্যতায় পা দিলেই টের পাওয়া যায় যে তা একেবারেই শূন্য। কোনও ঘরেই ভূমিসূতার উত্তাপ নেই। ভরতের বিছানাটি নিভাঁজ, সেখানে কেউ শোয়নি। ভূমিসূতাকে ভরত শেষ দেখেছিল দেওয়ালে এক কোণে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে, সেখান থেকেই বোধহয় ভূমিসূতা চলে গেছে।

কোথায় চলে গেল! সে নিজেই ফিরে গেল শশিভূষণের কাছে? ভরতের প্রত্যাখ্যানে সে অপমানিত বোধ করেছে, ভূমিসূতা তেজস্বিনী মেয়ে, সে রকম অপমান বোধ তার হবেই। ভরত তার চোখে একটা অপদাৰ্থ, কাপুরুষ, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী, হ্যাঁ ভরত এর সবটাই মেনে নিতে রাজি আছে। ভূমিসূতার চোখে এখন সে একটা ঘৃণ্য জীব হওয়াই ভালো। ভরতের পক্ষেও ভূমিসূতাকে স্বপ্ন থেকে মুছে ফেলা সহজ হবে।

সেই জন্যই ভূমিসূতা আর ভরতের সাহায্য চায়নি, নিজেই সে চলে গেল আগে থেকে। কিন্তু সে কি পথ চিনে যেতে পারবে? রাজবাড়ি থেকে সে তো আগে বেরোয়নি, কালও এসেছে অনেক রাত্রে। ভূমিসূতা সঙ্গে কিছু এনেছিল কি না ভরত লক্ষ করেনি, ঘরের মধ্যে শুধু পড়ে আছে তার কপালের ব্যান্ডেজ বাঁধা ন্যাকড়ার। তাতে লেগে আছে রক্ত। ভরতের কাছে আসবার জন্য ভূমিসূতা বারান্দা থেকে লাফ দিয়েছিল, সেই ভূমিসূতাকে গ্রহণ করার অধিকার নেই ভরতের।

ভূমিসূতা ঠিক মতন পৌঁছেছে কিনা তা একবার খোঁজ নিয়ে দেখতেই হবে। একটু আগে যদি বেরিয়ে থাকে তাহলে এখনও রাস্তায় তাকে পাওয়া যেতে পারে। শশিভূষণের কাছে ঠিক মতন ভূমিসূতাকে সমৰ্পণ করায় দায়িত্ব ভরতের।

সে আবার ছুটে বেরিয়ে এল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিম ডাল দিয়ে দাঁতন করছে বাণীবিনোদ। সে ভরতকে দেখে এক গাল হাসল। কিন্তু এখন কথা বলার সময় নেই।

এত সকালে গাড়ি ঘোড়া পাওয়া যায় না। ভাড়ার গাড়িগুলো বেরোয় একটু দেরিতে। সার্কুলার রোড দিয়ে ঘোড়ায় টানা ট্রামগাড়িও চলে না। অগত্যা দৌড়োতেই হল ভরতকে। পথের দু’দিকে অনবরত মাথা ঘোরাতে ঘোরাতে সে মনে মনে বলতে লাগল, ভূমি, তুমি সুখী হবে। মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে একবার বিয়ে হয়ে গেলে, তোমার নিজস্ব সংসার হলে তুমি বুঝতে পারবে, এইটাই ঠিক। ভরত কেউ না, সে তোমাকে কিছুই দিতে পারত না। ক্রীতদাসী ছিলে, তুমি হবে এক সম্ভ্রান্ত বংশের ঘরণী।

রাজবাড়ির সামনে এসে ভরত থমকে দাঁড়াল। এই প্রাসাদ তার কাছে সিংহের গুহা। মহারাজ হয়তো এখনও জাগেননি, কিন্তু ত্রিপুরার অন্য কোনও কর্মচারি তাকে দেখতে পেলেই মহারাজের কাছে খবর চলে যাবে। মৃত ভরত হয়ে উঠবে জীবন্ত, নতুন করে তার মাথার ওপর ঝুলবো দণ্ডাজ্ঞা।

এখন এসব চিন্তা করার সময় নেই। গেটের দারোয়ান একজন ফেরিওয়ালাকে ঢুকতে দিচ্ছে, সেই ফাঁক দিয়ে ভরতও ছুটে গেল। বাণীবিনোদের কাছে শুনে শুনে এ বাড়ির অনেক তার জানা। দোতলায় সে চলে এল শশিভূষণের মহলে।

শশিভূষণ জেগে উঠেছেন, একটা আরাম কেদারায় তিনি বসে আছেন জানলার দিকে চেয়ে। ভরত সোজা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর পায়ের ওপর। পাগলের মতন শশিভূষণের ফর্সা পায়ে মুখ ঘষতে ঘষতে সে বলতে লাগল, স্যার, আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমি তাকে চাইনি, ফিরিয়ে দিয়েছি, সে-ও আপনাকেই চায়, আমি কেউ না, আমি কেউ না, সে আপনাকে…

শশিভূষণ কঠোর ভাবে বললেন, ফের নষ্টামি করতে এসেছিস, বলেছি না, আমি তোদের দুজনেরই আর মুখ দেখতে চাই না!

ভরত বলল, আমি তাকে ছুঁইনি, আমি কাল রাত্তিরে বাড়িতে থাকিনি। আপনি যদি বিশ্বাস না করেন, আমি মরে যাব। এক্ষুনি মরে যাব। আমি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি।

শশিভূষণ বললেন, কোথায় ফিরিয়ে দিয়েছিস?

ভরত বলল, এখানে। সে এখানে আসেনি?

শশিভূষণ বললেন, এখানে সে আসবে কেন? আমি তো তাকে আর চাই না। না, না, চাই না!

ভরত মুখ তুলে উদভান্তের মতন বলল, এখানে সে আসেনি? আমার বাড়িতে সে নেই। রাস্তাতেও দেখিনি। সে কোথায়, সে, কোথায়?

আগের রাতে শশিভূষণ ভরতকে আঘাত করতে গিয়েও সামলে নিয়েছিলেন, আজ আর পারলেন না। ভরতের চুলের মুঠি ধরে রক্তচক্ষে বললেন, আমি তাকে নিয়ে নতুন করে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলাম, তুই তার মন বিষিয়ে দিয়েছিস, তুই নিজে তাকে লোভ করেছিলি। বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা! রাখতে পারলি না। তাকে হারালি, হারামজাদা, তুই দূর হয়ে যা চোখের সামনে থেকে!

তিনি সবেগে ভরতকে ঠেলে ফেলে দিলেন মাটিতে।

শশিভূষণ ভবানীপুরের বাড়িতে লোক পাঠিয়ে খবর আনালেন, ভূমিসূতা সেখানেও যায়নি। এই রাজবাড়িতে তার জিনিসপত্র পড়ে আছে, এখানেও সে ফিরে এল না। সে কোথাও নেই।

ভরত নিজের বাড়ি ফিরল না। শহরের সমস্ত পথ চষে বেড়াল সারা সকাল-দুপুর। গঙ্গার ধারের সবকটি ঘাট খুঁজে দেখল। ভূমিসূতা অদৃশ্য হয়ে গেছে। বিকেলবেলায় অভুক্ত, শ্ৰান্ত শরীরে ভরত শুয়ে পড়ল গঙ্গার তীরে এক গাছতলায়। একটু পরে তার ঘুম এসে গেল। গত রাত্রে সে এক পলকের জন্য চক্ষু বোজেনি, আজ সে এখানেই ঘুমোবে সারা রাত। আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে, বৃষ্টি নামবে খানিক বাদেই। তা নামুক, যে আকাশে ঈশ্বর থাকেন, সেদিকে ভরত আজ চোখ তুলে চায়নি একবারও। ভরত ঘুমিয়েই রইল। গঙ্গাবক্ষে ভোঁ বাজিয়ে যাতায়াত করছে কত কলের জাহাজ, দেশ বিদেশ থেকে কত যাত্রী এসে নামছে। এই রাজধানী শহর সদাব্যস্ত, রাজা কিংবা নফর, হঠাৎ ধনী কিংবা কাঙালি সবাই ছোটাছুটি করছে নানান উদ্দেশ্য নিয়ে। নদীর ধারের রাস্তা দিয়েও অনেকে মেটেবুরুজ বা খিদিরপুর যায়। গাড়ি-ঘোড়ার শব্দেও ঘুম ভাঙাল না ভরতের। সন্ধের একটু আগে ইডেন বাগানে গোরাদের ব্যান্ড বেজে উঠল, তা শুনবার জন্যও ভিড় করে দাঁড়াল অনেকে। বাজনাদারদের মুখগুলি গৰ্বমণ্ডিত। যেন তারা স্বর্গ থেকে নেমে এসে এই কালোকোলো ভারতীয়দের অভিনব বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি শোনাচ্ছে।

উত্তম সাজে সজ্জিত হয়ে বেশ কিছু সাহেব মেম ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ান যুবক যুবতী সান্ধ্য ভ্রমণে এল স্ট্যান্ডে, কত বিচিত্র তাদের পোশাক। তারা কলহাস্যে মুখরিত করে দিল বাতাস। ঘাটে ধপধপে সাদা রং করা অনেকগুলি মাঝারি মাপের বজরা নোঙর করা আছে। এগুলি কিছু কিছু ইংরেজ রাজপুরুষের নিজস্ব। এক এক করে সেই সব বজরা ভাসল।

পথচারীরা কেউ কেউ এক পলক এই শায়িত মানুষটির দৃষ্টিপাত করেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। পোশাক ও মুখশ্ৰী ভদ্রোচিত, তবু সে এমন অসময়ে কেন গাছতলায় শুয়ে আছে, তা নিয়ে কৌতূহল দেখায় না কেউ। শহরের মানুষ বড়ই নির্দয়।

সারাদিন এক দানাও খাদ্য মুখে তোলেনি, তবু এ কী কঠিন ঘুম ভরতের। যেন মরণ ঘুম। তার ব্যর্থতা, তার অপরাধবোধ ও গ্লানি ঘুমের মধ্যে গেছে, স্বপ্নে সে আর ভূমিসূতাকে তল্লাশ করছে না। এক পাশ ফিরে সে শুয়ে আছে, তার মুখে ক্লিষ্ট রেখা নেই, প্রগাঢ় শান্তির মতন ঘুম।

তারপর এক সময় ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *