জগদীশের শ্যামলা রঙের দোহারা চেহারা। সাতাশ বছর বয়েস, মাথার চুল কোঁকড়ানো, বড় গোঁফ রেখেছে। আপাতদৃষ্টিতে তাকে শান্ত স্বভাবের মনে হলেও ছেলেবেলায় সে বেশ ডানপিটে ছিল। পাঁচ বছর বয়েসেই ঘোড়া চালানো শিখেছে। একা একা ছুটে গেছে বনে-জঙ্গলে। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ার সময় মারামারিতেও বেশ নাম ছিল তার।
প্রায় বছর খানেক ধরে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াচ্ছে সে, তার সহকর্মী ইংরেজ অধ্যাপকরা যেন তাকে একঘরে করে রেখেছে। দু একজন ছাড়া অন্যরা তার সঙ্গে ভালো করে কথাই বলতে চায় না। অধ্যাপকদের জন্য নির্দিষ্ট বিশ্রামকক্ষে জগদীশ প্রবেশ করলেই অন্যরা চুপ করে যায়। জগদীশ অবাক হয়ে ভাবে, যারা বিজ্ঞানের শিক্ষক, তাদের মধ্যেও এত কুসংস্কার থাকে কী করে? গায়ের চামড়ার রঙের তফাতের জন্য মানুষে মানুষে যে প্রকৃত কোনও প্রভেদ থাকে না, তা কি এরা বিজ্ঞান পড়েও বোঝে না? ইংল্যান্ডের রাস্তায় ঘাটে জগদীশকে কয়েকবার ব্ল্যাকি ব্ল্যাকি বলে কিছু সাধারণ লোক টিটকিরি দিয়েছে বটে, কিন্তু শিক্ষিত মহলে বর্ণবৈষম্যের জন্য ব্যবহারের কোনও বিকৃতি দেখেনি সে।
প্রেসিডেন্সির ছাত্ররা অবশ্য জগদীশকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। জগদীশ কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সময় ক্লাসে যায়, প্রত্যেকটি ছাত্রের নাম জানে, সরাসরি তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে পড়ায়।
প্রেসিডেন্সির ছাত্রদের বশ করা সহজ কর্ম নয়। অনেক অধ্যাপকেরই ক্লাসে ঢোকার আগে বুক কাঁপে। অধ্যাপকদের কোনও দুর্বলতা দেখলেই হই হই করে ছাত্ররা, এক একজন অধ্যাপকের পড়ানোর ভুলও ধরে দেয় কোনও কোনও ছাত্র। কিছুদিন আগে একজন অধ্যাপক ছাত্রদের বিদ্রূপে অতিষ্ঠ হয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
জগদীশ জানে, সে যখন ক্লাসে পড়ায় তখন প্রিন্সিপাল টন সাহেব আড়াল থেকে তাকে লক্ষ করেন। জগদীশের কোনও একটা দুর্বলতা খুঁজছেন তিনি, যাতে সেই ছুতোয় তাকে বরখাস্ত করা যায়। সেইজন্যই তো তাকে অস্থায়ী ভাবে নিয়োগ করা হয়েছে।
জগদীশ ভাবে, সে পড়ানোতে ফাঁকি দিতে যাবে কেন? সে তো বিদেশে চাকরি করতে যায়নি, এটা তার নিজের দেশ, এখানকার ছাত্রদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তোলাই তো তার উদ্দেশ্য।
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পাস করার পর জগদীশ প্রথমে ঠিক করেছিল তার অন্যান্য কয়েকজন সহপাঠীর মতন সেও বিলেতে গিয়ে আই সি এস হয়ে আসবে। তাতে তার বাবার আপত্তি ছিল খুব। ভগবানচন্দ্র নিজে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে জেলায় জেলায় ঘুরে এদেশের আপামর জনসাধারণের দুরবস্থা প্রত্যক্ষ করেছেন। একসময় যাকে বলা হত সোনার বাংলা, সেই বাংলার কোথাও এখন সামান্য সোনালি রঙও অবশিষ্ট নেই। পরাধীন দেশ অনবরত ঝাঁঝরা হয়ে যায়। ইংরেজরা এ দেশটাকে শাসনের নামে শোষণ করে চলেছে, সরকারি কর্মচারিরা সেই শোষণের যন্ত্র। ভগবানচন্দ্র প্রথম জীবনে ছিলেন এক স্কুলের হেডমাস্টার, পরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি নিয়েছিলেন ক্ষমতা ও উচ্চ বেতনের আকর্ষণে, এখন সেজন্য অনুতাপ করেন। তিনি। জগদীশকে বলেছিলেন, আমার ছেলে ম্যাজিস্ট্রেট হোক, তা আমি চাই না। এমন কিছু করো, যাতে দেশের মানুষের সেবা হয়।
জগদীশ সে কারণেই বিলেতে গিয়ে ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছিল। ডাক্তার হয়ে ফিরতে পারলে জীবিকার সংস্থান হয়ে যেত, দেশের কিছুটা সেবাও হত। কিন্তু কালাজ্বরের ধকলে আর ডাক্তার হওয়া হল না। যে নিজেই সৰ্বক্ষণ অসুস্থ, সে আবার চিকিৎসক হবে কী করে! অধ্যাপকরাই তাকে পড়তে দিলেন না। কেমব্রিজে গিয়ে শরীর যদি সুস্থ না হত, তা হলে কিছু পাস না করেই ফিরে আসতে বাধ্য হত জগদীশ।
নিজের দেশের ছাত্রদের বিজ্ঞানমুখী করে তোলাটাও কি দেশসেবা নয়। এই যুগটাই বিজ্ঞানের, ভারতীয়রা সে বিষয়ে সজাগ না হলে পড়ে থাকবে অন্ধকারে।
বিজ্ঞান পাঠ যাতে ছাত্রদের কাছে নীরস মনে না হয়, সেই জন্য জগদীশ নিজের হাতে ছোট ছোট মডেল বানায়। পড়াবার সময় কিছু কিছু তত্ত্ব হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখায়।
কলকাতায় জগদীশের নিজস্ব কোনও আস্তানা নেই। কলেজ থেকে বেতন নেয় না বলে কোনও উপার্জনও নেই। সে এখন থাকে এক পরিচিত ব্যক্তির কাছে। কিন্তু শিগগিরিই তো তাকে আলাদা বাসা ভাড়া নিতে হবে, তখন চলবে কী করে? বিলেতে তার স্কলারশিপের টাকা কিছুটা জমিয়ে নিয়ে এসেছে, কিন্তু তাতেই বা চলবে কতদিন।
জগদীশের এক দিদি স্বর্ণপ্ৰভা বারবার অনুরোধ করেছিলেন তাঁর বাড়িতে থাকবার জন্য। ওঁদের বিশাল বাড়ি, অনেক টাকা। জামাইবাবু আনন্দমোহন বসু দেশবরেণ্য মানুষ। তাঁর বাড়িতে সৰ্বক্ষণ বহু মানুষের যাতায়াত। ওখানে থাকা যায় না। বিশেষত জগদীশের এখনও নিজস্ব কোনও উপার্জন নেই বলেই অন্যের আশ্রিত হয়ে পড়ে থাকতে তার আত্মাভিমানে আঘাত লাগবে।
দিদির বাড়িতে একদিন সে জামাইবাবুর বিশেষ বন্ধু দুৰ্গামোহন দাসের কন্যাকে দেখেছিল। আনন্দমোহন সর্ব বিষয়ে সংস্কারমুক্ত, তাঁর বাড়ির প্রার্থনাসভায় নারী ও পুরুষেরা পাশাপাশি বসে। অন্য সময়েও একসঙ্গে গল্পগুজবে কোনও বাধা নেই। সেখানে দুর্গামোহনের মেয়ে অবলার সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল, বেশ সপ্রতিভ মেয়েটি, ডাক্তারি পড়ে। একা একা এক বঙ্গীয় যুবতী সুদূর মাদ্রাজ শহরে থেকে ডাক্তারি পড়ে শুনে বেশ বিস্মিত হয়েছিল জগদীশ। এরকম আগে কখনও সে শোনেনি। বিলেতে চার বছর ছিল, তার মধ্যেই এতখানি পরিবর্তন এসে গেছে দেশে? জগদীশ অবলাকে নিজের স্বল্পকালীন ডাক্তারি পড়ার অভিজ্ঞতা শুনিয়েছিল।
সেই আলাপের কিছুদিন পরেই জগদীশ একদিন বাবার কাছে শুনল যে দুর্গামোহন তার সঙ্গে অবলার বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছেন। শুনেই জগদীশের সর্বাঙ্গে রোমাঞ্চ হয়েছিল। নিজেই সে এর কারণটা বুঝতে পারেনি। এদেশে বাবা-মায়েরা অনেক দেখেশুনে পাত্রী নির্বাচন করেন, তারপর বিবাহ ঘটে। ছেলে বা মেয়েরা কেউ নিজে থেকে বিয়ে করে না। তাদের বিবাহ ঘটে। বিলেত থেকে ফেরার পরই মা তার বিয়ের জন্য পেড়াপিড়ি করছেন, সুতরাং জগদীশ ধরেই নিয়েছিল, যেকোনও একটি পাত্রীর সঙ্গে তার একদিন বিয়ে হবে। তা হলে অবলার নাম শুনেই তার রোমাঞ্চ হল কেন? বারবার চোখের সামনে ভাসছে সেই মুখ। কেন এমন হয়? হঠাৎ মনে পড়ল এক নবীন কবির কবিতা :
তুমি কোন কাননের ফুল
তুমি কোন গগনের তারা!
তোমায় কোথায় দেখেছি
যেন কোন স্বপনের পারা?
এই কবিতা মাত্র একবার পড়েছিল। জগদীশ, তবু মুখস্থ হয়ে গেল কী রে?
জগদীশ অবশ্য বলেছে, মাস ছয়েকের আগে সে বিয়ে করতে পারবে না। তাকে একটু গুছিয়ে নিতে হবে। তার বাবারও খুব টাকার টানাটানি চলছে, পিতৃঋণ তারই শোধ দেওয়া উচিত, একটা কিছু উপার্জনের ব্যবস্থা করা খুব দরকার। ইংরেজ অধ্যাপকদের সমান বেতন না দিলে সে এক পয়সাও নেবে না প্রতিজ্ঞা করেছে, এই ব্যাপারটা লর্ড রিপনকে চিঠি লিখে জানাতে হবে।
জগদীশ নিজেই বিয়েটা পিছিয়ে দিয়েছে, অথচ এই প্রতীক্ষা তার কাছেই অসহ্য বোধ হচ্ছে কেন? বিজ্ঞানের বই ছেড়ে সে মাঝে মাঝে কাব্যগ্রন্থের পাতা ওলটায়। মনে পড়ে যায়, ছেলেবেলায় শোনা বোষ্টমির গান :
পিরিতি বলিয়া একটি কমল
রসের সায়র মাঝে
প্ৰেম-পরিমল লুবধ ভ্ৰমর
ধায়ল আপন কাজে।
ভ্রমর জানয়ে কমল-মাধুরী
তেঞি সে তাহারি বশ
রসিক জানিয়ে রসের চাতুরি
আনে কহে অপযশ।
জগদীশ বিলেতে দেখেছে, বিয়ের আগে যুবক-যুবতীদের মধ্যে কোর্টশিপ হয়। এ দেশের ব্ৰাহ্ম সমাজ কিছু কিছু প্রাচীন প্ৰথা ভাঙলেও এ সবের এখনও চল হয়নি। দিদির বাড়িতে অবলা হরদম আসে, সেখানে গেলে অবলার সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে বলে জগদীশ দিদির বাড়িতে যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে। ইচ্ছে করলেই অবলার সঙ্গে দেখা করা যায়, দুটো কথা বলা যায়, তবু সে যায় না। তা হলে মনে মনে তাকে এতবার দেখে কেন? মনে মনে অনেক কথা হয় কেন? এই কি সেই বোষ্টমির গানের ‘পিরিতি বলিয়া কমল’? ইস, অন্য কেউ জানতে পারলে কী ভাববে!
কলেজে জগদীশের একটা নিজস্ব ছোট ঘর আছে। ক্লাসের সময় ছাড়া সে এখানে একা বসে থাকে। পিছনের জানলা দিয়ে একটা বড় চাপা গাছ ও কিছু ঝোপঝাড় দেখা যায়। ছেলেবেলা থেকেই গাছপালা তাকে টানে। এখনও ফাঁক পেলেই কলকাতা ছেড়ে কোনও গ্রামে চলে যায়, নদীর ধারে গাছতলায় বসে থাকে। জগদীশ কবি নয়, কবিতা লেখার সে চেষ্টাও করে না। তবে, বিজ্ঞানের নানা কচকচির মধ্যেও মাঝে মাঝে বাংলা পড়তে সে ভালোবাসে। বাল্যকালে মুসলমান চাপরাশির ছেলের সঙ্গে, তাঁতি-কুমোরদের ছেলেদের সঙ্গে সে বাংলা পাঠশালায় পড়েছে। তার বাবা ডেপুটি হয়েও ছেলেকে ইংরেজি ইস্কুলে দেননি, তিনি চেয়েছিলেন ইংরেজি শেখার আগে জগদীশ বাংলা ভাষাটা ভাল করে শিখুক। তাই বাংলার সঙ্গে তার নাড়ির যোগ রয়ে গেছে। এখনও, ফিজিক্সের অধ্যাপক হয়েও সে কোনও গ্রামের নদীর ধারে গাছতলায় অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। নদীও তাকে টানে খুব। বসে থাকতে থাকতে তার মনে কোনও কবিতার লাইন আসে না, কিন্তু মধ্যে কেমন যেন উতলা উতলা ভাব হয়।
ইদানীং জগদীশের ঝোঁক হয়েছে ফটোগ্রাফির দিকে। গাছপালার ছবিই সে বেশি তোলে।
মহেন্দ্রলাল যখন জগদীশের কক্ষে প্রবেশ করলেন, তখন জগদীশ টেবিলের ওপর তার ক্যামেরাটা খুলে ফেলেছে। ঠিকমতন ফোকাসিং হচ্ছিল না বলে সে ক্যামেরাটার সব কিছু খুলে ফেলে সারাচ্ছে নিজেই।
মহেন্দ্রলালের দিকে সে চোখ তুলে তাকাল কিন্তু চিনতে পারল না।
কোনওরকম ভূমিকা না করে। মহেন্দ্রলাল জিজ্ঞেস করলেন, তুমিই তো ভগবানের ব্যাটা জগদীশ তুমি বন্দুক চালাতে জান? জগদীশ অবাক হয়ে চেয়ে রইল।
মহেন্দ্রলাল বললেন, ও হ্যাঁ, তুমি তো বাঘ শিকারে গিয়েছিলে, তা হলে বন্দুক চালানোও শিখেছিলে। এখনও অভ্যেস আছে? আমার সঙ্গে ডুয়েল লড়বে? আলিপুরের ফাঁকা মাঠে এক সকালে, কবে তোমার সময় হবে বল?
জগদীশ বলল, আজ্ঞে, আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না।
মহেন্দ্রলাল বললেন, দুর্গার মেয়ে অবলাকে আমি বিয়ে করব ঠিক করে রেখেছিলাম। সে ডাক্তারিটি পাশ করলেই বিয়ের সানাই বাজাব। ও মা, এর মধ্যে কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে তুমি নাকি বিয়ে করতে চাইছ? আমার সঙ্গে ডুয়েল লড়ে না জিতলে তো তুমি বিয়ে করতে পারবে না। ব্রাদার। ধরো হাতিয়ার!
নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হেসে উঠলেন মহেন্দ্রলাল। কাছে এসে জগদীশের কাঁধ চাপড়ে বললেন, মঙ্করা করছিলাম। তুমি দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। অবলা হবে তোমার যোগ্য সহধর্মিণী। আমাকে চেনো না বোধ হয়, অধমের নাম মহেন্দ্রলাল সরকার, ডাক্তারি করি। অবলা আমার কন্যাসমা, তাই তোমাকে একবার দেখতে এলাম!
জগদীশ এবার শশব্যস্ত হয়ে বলল, আপনাকে কে না চেনে? আপনি স্বনামধন্য। যখন ছাত্র ছিলাম, আপনার ইনস্টিটিউট ফর দা কালটিভেশন অব সায়েন্সে আমি অনেকবার বক্তৃতা শুনতে গেছি।
জগদীশ নিচু হয়ে মহেন্দ্রলালের পা ছুঁয়ে প্ৰণাম করল।
মহেন্দ্রলাল বললেন, ছাত্র অবস্থায় তুমি বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলো। এখন তুমি অধ্যাপক, এখন তুমি মাঝে মাঝে ওখানে বক্তৃতা দেবে। তার জন্য আমি কিছু ফি দেব। বিনা পয়সায় ওসব হয় না। না, না, তোমাকে নিতেই হবে, ঘাড় নাড়লে চলবে না।
তারপর টেবিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ যে দেখছি। একটা ক্যামেরার হাড়গোড় সব আলাদা হয়ে গেছে। তুমি এটা আবার জোড়া লাগাতে পারবে?
জগদীশ বলল, সেটা এমন কিছু শক্ত নয়।
মহেন্দ্রলাল বললেন, আমায় একটু শিখিয়ে দাও তো। আমি ক্যামেরার ব্যাপারটা ঠিক বুঝি না।
তারপর মহেন্দ্রলাল জগদীশের সঙ্গে ক্যামেরার খুঁটিনাটি আলোচনায় এমন মগ্ন হয়ে গেলেন যে অবলার প্রসঙ্গ আর তাঁর মনে এল না। জগদীশের সঙ্গে তাঁর বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
এর দুদিন পর মহেন্দ্রলালকে যেতে হল কাসিয়াবাগানে জানকীনাথ ঘোষালের বাড়িতে। জানকীনাথের কিছুদিন ধরে ঘুষঘুষে জ্বর চলছে।
বসবার ঘরে জানকীনাথের মেয়ে সরলা পিয়ানো বাজিয়ে একটা গান গাইছে। বন্দে মাতরম, সুজরাং সুফলাং শস্য শ্যামলাং…। বঙ্কিমবাবুর লেখা এই পদ্যটির প্রথম দু স্তবকের সুর দিয়েছে সরলার ছোট মামা রবি। তারপর ছোটমামা সরলাকে বলেছে বাকি অংশটায় তুই সুর বসিয়ে দে না।
সরলা সেই চেষ্টাই করছে বসে বসে। এক একটা পঙক্তি গাইছে বারে বারে। মহেন্দ্রলাল একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গানটা শুনলেন। তাঁর নিজের কণ্ঠে সুর নেই, কিন্তু গানের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা আছে।
সরলা একবার থামতেই তিনি বললেন, বাঃ, গানের কথাগুলি তো বেশ, তুই রচনা করেছিস নাকি রে?
সরল জিভ কেটে বলল, ওমা, কী যে বলেন। এ গান লিখব। আমি! আপনি কিছু জানেন না। এ তো বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা!
মহেন্দ্রলাল বললেন, বঙ্কিমবাবু গান লেখেন, নিজে সুর দিতে পারেন না বুঝি?
সরলা বলল, উনি তো গান হিসেবে লেখেননি। পদ্য লিখেছিলেন, রবিমামা এটা সুর দিয়ে গায়। রবিমামা অনেকের গানে সুর দেয়।
মহেন্দ্রলালের হঠাৎ অন্য কথা মনে পড়ল। অবলা গেছে, সবলা তো আছে। বিয়ের সঙ্গে সঙ্গেই অবলাকে আর কিছুতেই মাদ্রাজে পাঠানো যাবে না। দুটি বছর অন্তত নব বিবাহিত দম্পতি পরস্পর মগ্ন হয়ে থাকবেই। সেটাই স্বাস্থ্যকর। সরলাও মেধাবিনী ছাত্রী।
তিনি চুপি চুপি ষড়যন্ত্রের সুরে বললেন, হ্যাঁ রে, সরলা, তুই পাস করার পর কী করবি? ডাক্তারি পড়বি?
সরলা ভুরু কুঁচকে বলল, ডাক্তারি, কেন?
মহেন্দ্রলাল বললেন, কেন কী রে? সাহেবদের দেশে কত মেয়ে এখন ডাক্তার হচ্ছে। এটা মেয়েদের পক্ষে একটা নোবল প্রফেশন!
সরলা বলল, আগে তো বি এ পাস করি। তারপর ভেবে দেখা যাবে!
সরলা সবেমাত্র এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে, তার বি এ পাশ করার দেরি আছে। মহেন্দ্রলাল ঠিক করলেন, লেগে থাকতে হবে, মাঝে মাঝেই ফুসমন্তর দিতে হবে এই মেয়েটার কানে।
এই সময় জানকীনাথ এলেন এই ঘরে। গায়ে জুর আছে, চক্ষু দুটি ছলছলে, কিন্তু তিনি বিছানায় শুয়ে থাকতে পারেন না।
মহেন্দ্রলাল বললেন, তুমি তত দিব্যি আছ দেখছি। তবে আবার আমায় ডাক পাঠালে কেন?
জানকীনাথ বললেন, না হে, মহেন্দ্ৰ, জ্বরটা কিছুতেই ছাড়ছে না। তোমার ওষুধ দিয়ে ভাল করে দাও, আমার এখন অনেক কাজ।
মহেন্দ্রলাল বললেন, জ্বর গায়ে অমন চক্কর মেরে ঘুরে বেড়ালে কোনও ওষুধের বাপের সাধ্য নেই রোগ সারায়। অমন, অনাচার করলে আমায় ডাকবে না।
জানকীনাথ বললেন, এসেই বকাবকি করছ কেন? ভেতরে এসো, ভাল করে নাড়ি দেখে দাও।
সরলা আবার পিয়ানো টুং টং শুরু করতেই মহেন্দ্রলাল জিজ্ঞেস করলেন, জানকী, তোমার মেয়ের বিয়ে দিচ্ছ কবে? ওর দিদির তো এই বয়সেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।
জানকীনাথ বললেন, আর বলো না, সম্বন্ধ তো কতই আসছে, কিন্তু এ মেয়ে ধনুৰ্ভঙ্গ পণ করেছে, বিয়ে করবে না। সারা জীবনই নাকি বিয়ে না করে দেশের কাজে লেগে থাকবে। ওর মায়েরও দেখছি তাতে আপত্তি নেই।
মহেন্দ্রলাল সপ্রশংস দৃষ্টিতে সরলার দিকে ফিরে তাকালেন। রূপ আছে, বাপের অগাধ টাকা আছে। তবু মেয়ে বিয়ে করতে চায় না, এমন কথা কে কবে শুনেছে? তা হলে আশা আছে। যে মেয়ে ডাক্তার হবে, তার বিয়ে না করাই ভাল।
নিজে থেকে জেদ ধরেছে বিয়ে করবে না, এ মেয়ে তো একটি দুর্লভ রত্ন!
কিন্তু মহেন্দ্রলালের সবচেয়ে বেশি আশা ভরসা যার ওপর, সেই কাদম্বিনী তো বিয়ে করে ফেলেছে। তাও এক বিচিত্র বিবাহ। অসাধারণ সুন্দরী এই কাদম্বিনী, বছর চারেক আগে সে চন্দ্রমুখী বসু নামে আর একটি মেয়ের সঙ্গে বি এ পাশ করে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র ভারতের ললনাদের গৌরবের কারণ হয়েছে। সেই কাদম্বিনী বিয়ে করেছে এক দোজবরে পাত্ৰকে, যার সঙ্গে কাদম্বিনীর বয়েসের তফাত প্ৰায় সতেরো বছর। দ্বারিকানাথ গাঙ্গুলি ছিল কাদম্বিনীর ইস্কুলের মাস্টার। এ বিয়ের সময় ঘোর প্রতিবাদ উঠেছিল, দ্বারিকানাথ সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অক্লান্ত কৰ্মী, তৰু ব্ৰাহ্মরাও অনেকে এ বিয়ে সমর্থন করেনি। কাদম্বিনীর উপযুক্ত পাত্র তো সে নয় বটেই, বয়েসের ব্যবধান ছাড়াও দ্বারিকার লম্বা ধ্যাড়েঙ্গা চেহারার কোনও ছিরি ছাঁদ নেই, সবচেয়ে বড় কথা মাস্টারের সঙ্গে ছাত্রীর বিবাহ কুদৃষ্টান্ত স্থাপন করে। যারা নারী শিক্ষার বিরোধী, তারা এই উপলক্ষে আবার ছোটাবে নিন্দের ফোয়ারা। পুরুষ শিক্ষকদের কাছে অনেকেই মেয়েদের পড়াতে চাইবে না।
সেই সময় দুর্গামোহন, মহেন্দ্রলালের মতন কয়েকজন গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন দ্বারিকা গাঙ্গুলির পাশে। তাদের প্রধান বিবেচ্য ছিল, পাত্রীর সম্মতি আছে কি না। কাদম্বিনী দ্বারিকাকে বিয়ে করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, যত বাধাই আসুক সে মানবে না। মহেন্দ্রলালরা বুঝেছিলেন, এ শুধু সাময়িক মোহ বা তথাকথিত প্রেম নয়। কাদম্বিনী স্বামী হিসেবে পেতে চাইছে একটি আদর্শকে। দ্বারিকা গাঙ্গুলি এ দেশের নারী জাতির উন্নতির জন্য প্রাণপাতও করতে পারে। ‘অবলা বান্ধব’ পত্রিকা সে চালিয়েছে নিজের খরচে, যে-কোনও মেয়ে লেখাপড়া শিখতে চাইলে দ্বারিকা তাকে সব রকম সাহায্য দিতে প্রস্তুত। কাদম্বিনীরও উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে, সে ডাক্তার হতে চায় কিশোরী বয়স থেকে। তার বাড়ি থেকে এ ইচ্ছের প্রতি প্রশ্রয় ছিল না, অভিভাবকরা তাড়াহুড়ো করে তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিল। কাদম্বিনী বুঝেছিল, কোনও ধনীর ঘরে বিয়ে হলে তাকে অন্তঃপুরে আবদ্ধ করে রাখা হবেই। বাড়ির বউকে কলেজে পড়তে পাঠানো সকলেরই কল্পনার অতীত। আর কারোকেই বিশ্বাস করা যাক বা না যাক, দ্বারিকানাথ গাঙ্গুলিকে বিশ্বাস করা যায়। সে তার স্ত্রীর পড়াশুনোর ইচ্ছেতে কিছুতেই বাধা দেবে না।
আমন্ত্রণ করলেও অনেকে আসবে না জেনে বিয়েটা হয়েছিল খুব সংক্ষিপ্তভাবে, রেজিস্ট্রি করে। এই স্বামী-স্ত্রী যুগলের সংসারে কোনও অশান্তি নেই।
মহেন্দ্রলাল মাঝে মাঝে ওদের দেখতে যান। সময় নেই, অসময় নেই, তার জন্য অবারিত দ্বার। হয়তো কোনও দুপুরবেলা রুগী দেখে ফেরার পথে মহেন্দ্রলাল চলে এলেন এ বাড়িতে। এখানে এলেই দ্বারিকার লেখা একটা গান তাঁর মনে পড়ে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তিনি বেসুরো গলায় চেঁচিয়ে গান ;
না জাগিলে সব ভারত ললনা।
এ ভারত আর জাগে না জাগে না…
দ্বারিকার প্রথম পক্ষের মৃত স্ত্রীর দুটি সন্তান। বড় মেয়ে বিধুমুখী কাদম্বিনীর চেয়ে সামান্য ছোট। ছেলে সতীশ অস্বাভাবিক, জড় ধরনের। এর মধ্যে কাদম্বিনীরও একটি পুত্র জন্মেছে। সংসারটি যেন হট্টমেলা। বাড়িতে দাস-দাসী রাখার ক্ষমতা নেই দ্বারিকার। মেয়ে বিধুমুখীর সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী নামে একটি ভাল ছেলের বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে গেছে, কিন্তু টাকা-পয়সা কী করে জোগাড় হবে। সেই চিন্তায় দ্বারিকা ব্যাকুল।
মহেন্দ্রলাল এসে দেখেন, কাদম্বিনীর শিশু সন্তানটি বিধুমুখীর কোলে শুয়ে ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদছে, সতীশ হামাগুড়ি দিচ্ছে ঘরময়, এটা সেটা ছুঁড়ে ছুঁড়ে ভাঙছে। রান্নাঘরে উনুনে ভাত চাপিয়ে, তরকারি কুটতে বসেছে দ্বারিকা, তার খালি গা, পিঠ ভিজে গেছে ঘামে। কাদম্বিনীকে সে কিছুতেই রান্নাঘরে ঢুকতে দেয় না। কেউ কেউ তাকে প্রকাশ্যেই মাগ ভেড়ুয়া বলে গালাগালি দেয়, দ্বারিকা তা শুনে হাসে। স্বীকার করে নিয়ে বলে, সত্যিই তো আমি তাই। মেয়েরা চিরকাল অন্ধকারে হেঁশেল ঠেলেছে, এখন দু’একজন পুরুষ অন্তত মেয়েদের ধার শোধ করুক!
এই সব বিশৃঙ্খলার মধ্যেও ঘরের এক কোণে একটা ছোট টেবিলের সামনে বসে আছে কাদম্বিনী। এমন গম্ভীর মনোনিবেশের সঙ্গে সে বই পড়ছে যে ছেলের কান্না বা অন্য কোনও শব্দই যেন তার কানে যাচ্ছে না। তার হাত দুটি চলছে অবশ্য, সেই হাতে সে ছেলে-মেয়েদের জন্য লেস বুনছে।
মহেন্দ্রলাল এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন সেই ধ্যানী যুবতীর দিকে। তাঁর চোখে জল এসে গেল। তপস্যা আর কাকে বলে। এত প্রতিকূল মধ্যেও কাদম্বিনী পাঠ চালিয়ে যাচ্ছে, সে ডাক্তার হবেই!
মহেন্দ্রলাল কাছে এসে কাদম্বিনীর মাথায় হাত রেখে ধরা গলায় বললেন, পারবি তো মা? শেষ পর্যন্ত পারবি? দেখিস, যেন কিছুতেই হেরে যাস না!