শশিভূষণের এখন প্রায় উন্মাদের মতন দশা। সৰ্বক্ষণ একটাই চিন্তা, ভূমিসূতা, ভূমিসূতা! সকালবেলা ঘুম ভেঙেই মনে হয়, কই, আজ কোন ভূমিসূতা তাঁর ঘরের জানলা খুলে দিচ্ছে না। কোথায় ভূমিসূতা?
এখন শশিভূষণের একটাই স্বপ্ন, তিনি চাকরি ছেড়ে দেবেন, কলকাতাতেও আর থাকবেন না, দাদাদের কাছে নিজের সম্পত্তির ভাগ বেচে দিয়ে ফরাসডাঙায় একটা বাড়ি কিনবেন। গঙ্গার ধারে একটি সুন্দর বাড়ি, সঙ্গে থাকবে বাগান, সেই বাড়িতে শুরু হবে নতুন সংসার। সেখানে ভূমিসূতাকে চাই।
কিন্তু মেয়েটি কি পাথর? সে কিছুতেই সাড়া দিতে চায় না, শত প্রশ্নেরও উত্তর দেয় না।
তিনি তাকে দাসিত্ব থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন। কোনও অসম্মানজনক প্রস্তাব দেননি, বিয়ে করার সঙ্কল্প জানিয়েছেন, একটি মেয়ে এর চেয়ে আর বেশি কী আশা করতে পারে? শশিভূষণ ওর জাতি-গোত্ৰ-পিতৃপরিচয় নিয়েও মাথা ঘামাননি, এতখানি উদারতারও কি মূল্য বোঝে না ভূমিসূতা? অথচ সে বুদ্ধিহীনা নয়!
দুটি মাত্র পথ খোলা আছে। মহারাজের ইচ্ছা অনুসারে ভূমিসূতাকে ত্রিপুরা গিয়ে রাজপ্রাসাদে বন্দিনী হতে হবে, অথবা শশিভূষণের সঙ্গে চলে যেতে হবে কলকাতা ছেড়ে। যদি মহারাজের শয্যাসঙ্গিনী হবার লোভ থাকত তার, তা হলেও না হয় তার এই অসাড়তার অর্থ বোঝা যেত। কিন্তু ত্রিপুরায় যাবার প্রসঙ্গ উঠলেই ভূমিসূতা প্রবলভাবে মাথা নাড়ে। অথচ শশিভূষণের প্রস্তাবে সে চুপ করে থাকে। একেবারে নিথর, মুখে যেন কুলুপ আঁটা।
এদিকে সময় যে পার হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। ত্রিপুরায় ফিরে যাবার প্রস্তুতি প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে এসেছে। বাঁধা-ছাঁদা হচ্ছে টলবহর। মহারাজ ভূমিসূতার কথা প্রায়ই উল্লেখ করেন। রানী মনোমোহিনীর কাছ থেকে নিশ্চয়ই শুনেছেন যে ভূমিসূতা আর অসুস্থ নয়। কিন্তু এখনই তার গান শোনার জন্য পীড়াপীড়ি করেননি। তিনি ব্যস্ত রয়েছে, প্রত্যেক দিনই দেখা করতে আসছে বহু মানুষ। দু-একটি থিয়েটার দেখে যাওয়ার জন্য মহারাজ যাত্রার দিন আবার পিছিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাও বা আর কদিন! শশিভূষণ এখনও পর্যন্ত মহারাজের সামনে ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করেননি যে ভূমিসূতা তাঁর সঙ্গে যেতে রাজি নয়। শশিভূষণ মহারাজের মেজাজ জানেন, এমনিতে দরাজ হৃদয়ের মানুষ, তবে কেউ তাঁর ইচ্ছার বিরোধিতা করলে সহ্য করতে পারেন না। তুলকালাম বাধাবেন। অথচ এ কথাও ঠিক, শশিভূষণ যদি মুখ ফুটে বলতে পারেন, মহারাজ, আমি ওই কন্যাটিকে বিবাহ করতে চাই, তৎক্ষণাৎ মহারাজ জল হয়ে যাবেন। বিবাহপ্রথাকে তিনি সম্মান করেন, অন্যের স্ত্রী কেড়ে নেবার অভ্যেস তাঁর নেই।
শশিভূষণ যে সব দিক দিয়ে ভূমিসূতাকে উদ্ধার করতে চাইছেন, তা কেন ও বুঝতে পারছে না?
আজ বেশ আগে ঘুম ভেঙেছে শশিভূষণের। এখনও চা আসার সময় হয়নি। শশিভূষণের তর সাইল না। তিনি সিঁড়ির কাছে গিয়ে ডাকলেন, ভূমি, ভূমি!
ভূমিসূতা সিঁড়ির নীচে এসে দাঁড়াল।
ভূমিসূতাকে কখনও অসংবৃতা বা দেখা যায় না। সে দিনে দু-তিনবার স্নান করে। তার পরনের শাড়ি দু-তিন জায়গায় সেলাই করা হলেও মলিন নয়, শাড়ি পরারও একটা বিশেষ ঢঙ আছে। চুল থাকে বিন্যস্ত, পায়ে আলতা, কপালে একটা চন্দনের ফোঁটা।
আজই প্রথম মনে হল, সে স্নান করেনি এখনও, চুলে চিরুনি পড়েনি একটুও, শাড়ির আঁচল কাঁধে জড়ানো, সে মুখ তুলে ওপরের দিকে চাইল।
শশিভূষণ কয়েক পলক তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ওই মুখখানি দেখলেই তাঁর বুকের মধ্যে তোলপাড় হয়। কেন আগে ভালো করে দেখেননি, কেন প্রথম থেকেই মিষ্ট বাক্য বলেননি, আফসোস হয় সেজন্য।
তিনি শুধু বললেন, চা নিয়ে এসো। কথা আছে।
খানিক বাদে ট্রে-তে সাজিয়ে চুনের জল, চা ও বিস্কুট নিয়ে এল অন্য একজন দাসী। মাঝবয়সী এক দাসী, এর নাম সুশীলা। দাঁতে মিশি দেয়, তাই মুখখানা সব সময় ঝোল মাখা মতন হয়ে থাকে, মোটাসোটা গড়ন, চুলে নিশ্চয়ই উকুন আছে, যখন-তখন ঘ্যাস ঘ্যাস করে মাথা চুলকোয়।
তাকে দেখেই শশিভূষণের মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল। এ কী ব্যাপার, এ রকম তো কোনওদিন হয়নি। ভূমিসূতা তাঁর পরিচারিকা, রাজবাড়ির কোনও কাজ সে করে না। শুধু শশিভূষণের সেবা-যত্নের জন্যই তাকে রাখা হয়েছে। আজ ভূমিসূতার কী হল?
শশিভূষণের একবার ইচ্ছে হল, এক টান মেনে তিনি ট্রে-টা ফেলে দেবেন মেঝেতে। ভূমিসূতাকে তিনি নিজে বললেন, কথা আছে, তবু সে এল না?
দাস-দাসীদের সামনে অসংযত ব্যবহার শোভা পায় না। শশিভূষণ অতি কষ্টে মেজাজ দমন করে বললেন, ভূমি কোথায়?
সুশীলা বলল, সে তো এই মাত্তর নাইতে গেল।
ভূমিসূতা সাত চড়ে রা কাড়ে না, কিন্তু অন্য সব দাস-দাসীরাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত বেশি কথা বলে। সুশীলা আরও বলল, তার কী জানি হয়েছে বাবু। কাল সারা রাত ঘুমোয়নি, ফ্যাঁচোর ফ্যাঁচোর করে কেন্দেছে। আমি ভাবলুম বুঝি পেটে যাতনা হচ্ছে। তা কোনও কথাই বলে না।
শশিভূষণ গুম হয়ে রইলেন। ভূমিসূতা অসুস্থ ও তা যদি না হয়, তা হলে ভূমিসূতার কান্নার আর কী কারণ থাকতে পারে? কি তার প্রতি কোনও অন্যায় ব্যবহার করেছেন। বিবাহ! একজন নারীর কাছে এর চেয়ে ন্যায্য প্রস্তাব আর কী হতে পারে। দাসী থেকে গৃহিণী হবে ভূমিসূতা, তার সন্তানেরা সিংহ বংশের পদবী পাবে।
শশিভূষণ একবার জানলার কাছে দাঁড়ালেন, একবার নেমে গেলেন বাগানে। তাঁর শরীরের মধ্যে এক দারুণ অস্থিরতা। এই সকালে ভৃত্যমহলে গিয়ে ভূমিসূতার খোঁজখবর নেওয়া কি ভালো দেখাবে? বেলা বাড়লে ভূমিসূতা সত্যি অসুস্থ কিনা ঠিক জানা যাবে। অসুস্থ হলে সে স্নান করবে। কেন?
যেদিন থেকে শশিভূষণ ভূমিসূতাকে আর দাসী মনে করেন না, সেদিন থেকে তিনি নীচের মহলে যেতে সঙ্কোচ বোধ করেন। অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘর। ছেড়া ঝুলি-বুলি মাদুর-কাঁথার বিছানা, ওই পরিবেশে তিনি ভূমিসূতাকে দেখতে চান না আর। ফরাসডাঙার বাড়িতে তিনি ভূমিসূতার জন্য মেহগনি কাঠের পালঙ্ক আনবেন।
শশিভূষণ বড় আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। হাত বুলোতে লাগলেন নিজের চিবুকে ও বক্ষে। বহুদিন এ শরীরে কোনও নরম হাতের স্পর্শ লাগেনি। লোকে তাঁকে সুপুরুষই বলে। তাঁদের বংশের সব পুরুষরাই দীর্ঘকায়, গৌরবর্ণ। শশিভূষণ এক সময় ঘোড়ায় চেপে বন্দুক হাতে শিকার করতেন, তাঁর স্বাস্থ্য মজবুত। ভূমিসূতার পক্ষে তাঁকে অপছন্দ করার কোনও কারণ থাকতে পারে কি? তার চেয়ে অনেক বেশি বয়েসের লোকেরা দ্বিতীয় বিবাহ করে।
শশিভূষণ আশা করেছিলেন, ভূমিসূতা নিশ্চিত তাঁর জলখাবার দিতে আসবে। কিন্তু তার আগেই মহারাজের কাছ থেকে তার ডাক এল।
এর মধ্যেই মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য সেজেগুজে তৈরি হয়ে বসে তৃতীয় পেয়ালা চা খাচ্ছেন। মুখ দেখেই বোঝা যায়, মন বেশ প্রফুল্ল। আজ তিনি হ্যামিল্টনের দোকানে বন্দুক দেখতে যাবেন। ব্রিটিশ ভারতের প্রজাদের অন্ত্র রাখার অধিকার নেই। শশিভূষণের নিজের বন্দুক বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ত্রিপুরায় রাজপরিবার, এমনকি সাধারণ মানুষদের সম্পর্কেও এ নিষেধ খাটে না। মহারাজ দুখানা বন্দুক কিনবেন।
মহারাজ বললেন, বসো হে মাস্টার। আমার সঙ্গে চা খাও। কলকাতার চা অতি সরেশ। জলের গুণেই হয় বোধ হয়। আমাদের ত্রিপুরায় এমন কলের জলের ব্যবস্থা করা যায় না।
শশিভূষণ বললেন, অবশ্যই করা যায়। দু-একটি সাহেবকে নিয়ে গিয়ে আগে সমীক্ষা করাতে হবে।
মহারাজ বললেন, সংবাদপত্রে দেখলাম, এ শহরের আরও অনেক অঞ্চলে নল টানা হচ্ছে। দু-একটি ইংরেজ কারিগরকে কি ত্রিপুরায় যেতে বললে যাবে?
শশিভূষণ বললেন, পয়সা পেলে ইংরেজরা যে কোনও জায়গায় যেতে রাজি হয়। মহারাজ বললেন, হুঁ, পয়সা! প্রশ্ন হচ্ছে, কত পয়সা? ঘোষমশাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করে দেখতে হবে। তোমাদের এই বাঙালিবাবুটির বড় কৃপণ স্বভাব। আমার খরচের জন্যও বেশি পয়সা দিতে চায় না। আমারই রাজকোষের পয়সা, তবু আমাকে দেয় না!
নিজের রসিকতায় মহারাজ নিজেই হা-হা করে হেসে উঠলেন।
তারপর বললেন, চল মাস্টার, আগে বন্দুকের দোকানে যাই। তারপর নগর দর্শন করব সারা দিন। আগরতলায় নতুন রাজধানী গড়ার ইচ্ছে আছে আমার। এখানকার রাস্তা-ঘাটের নকশা জোগাড় করে নিও তো!
শশিভূষণ ভাবলেন, এই মুহূর্তে তিনি যদি বলেন যে তিনি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন, তা হলে মহারাজের মুখের অবস্থা কী রকম হবে?
মহারাজ অবশ্য আগাগোড়াই তাঁর সঙ্গে সহৃদয় ব্যবহার করে এসেছে। খুব বেশি আনুষ্ঠানিকতা পছন্দ করেন না তিনি। প্রত্যেকবার সাড়ম্বরে তাঁর জয় ঘোষণা করে প্রণাম জানাতে গেলে তিনি হাত তুলে বাধা দিয়ে বলেন, আরে থাক, থাক, অতি দরকার নেই!
শশিভূষণ একেবারে বিনা কারণে পদত্যাগ করতে চাইলে তিনি হতভম্ব হয়ে যাবেন নিশ্চয়ই। তবু বলতেই হবে, দুএক দিনের মধ্যেই!
বন্দুকের দোকান, হোয়াইট ওয়ে লেড ল, হগ সাহেবের বাজার ঘুরে ক্লান্ত হয়ে মহারাজ উইলসন হোটেলে খেতে এলেন। সেখানে গুরু ভোজন হয়ে গেল। এখন তিনি গঙ্গার ধারে কিছুক্ষণ বায়ুসেবন করতে চান। জুড়িগাড়ি এসে থামল আরমানি ঘাটে। ছড়ি হাতে নিয়ে পায়চারি করতে লাগলেন মহারাজ। এখন গঙ্গার বুকে অনেক কলের জাহাজ দেখা যায়। সাধারণ জল ফুটিয়ে বাষ্প, সেই বাষ্পের কী তেজ, বড় বড় জাহাজ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বাষ্পই যেন এ যুগে সেই আলাদিনের কলসির দৈত্য।
মেঘলা দিন, গঙ্গার ধারে অনেকেই বেড়াতে এসেছে। অনেক উচ্চপদস্থ ইংরেজের নিজস্ব বজরা বাধা আছে বিভিন্ন ঘাটে। কোনও কোনও চলন্ত বজরার ছাদে তরুণী মেমসাহেবরা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তাদের রঙিন ছাতা। এমন লোকচক্ষুর সামনে ভারতীয় মেয়েরা দাঁড়াতে পারে না। শশিভূষণ যা দেখছেন, তাতেই তাঁর মনে পড়ছে ভূমিসূতার কথা। চন্দনগরে তাঁর বাড়ির সামনেও বজরা বাঁধা থাকবে। বিকেলবেলা তিনি ভূমিসূতাকে নিয়ে ভেসে পড়বেন।
এক সময় মহারাজ বললেন, আঃ, কী অপূর্ব নদী। পতিত-উদ্ধারিণী জাহ্নবী! দেখ মাস্টার, কত নদীই তো দেখলাম, কিন্তু গঙ্গার মতন এমন স্নিগ্ধ বাতাস আর কোনও নদী দিতে পারে না। আচ্ছা, এই গঙ্গার একটা ধারা আমাদের ত্রিপুরায় টেনে নিয়ে যাওয়া যায় না?
এরকম কথা শুনে শশিভূষণ হাস্য সংবরণ করতে পারলেন না। তিনি বললেন, মহারাজ, আমার মনে হয়, তার চেয়ে ত্রিপুরার একটি পাহাড় এই সমতলে টেনে আনা অনেক সোজা!
মহারাজও হেসে বললেন, বাংলায় অনেক পাহাড় আছে, ওদিক চট্টগ্রাম এদিকে দাৰ্জিলিং, তোমাদের পাহাড় দরকার কী? কিন্তু গঙ্গার মতন একটি নদী আমাদের বড় প্রয়োজন! যা কিছু সুন্দর, যা কিছু পবিত্র তা সব দিয়ে আমার ত্রিপুরাকে সাজাতে ইচ্ছে করে!
আর একটুখানি যাবার পর মহারাজ হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেন, আমার সাধ হয় কী জান, মৃত্যুর পরেও যেন এই গঙ্গা তীরেই থাকি। মাস্টার, আমি মরলে এই গঙ্গার ধারে আমাকে দাহ করো।
এরকম কথার উত্তরে যা বলতে হয়, শশিভূষণ সেটা জোর দিয়ে বললেন, মহারাজ, মৃত্যুর কথা এখনই মনে আনছেন কেন? আপনি যুবকের মতন স্বাস্থ্যবান!
মহারাজ বললেন, এখনও ভোগ-বিলাস অনেক বাকি আছে, অনেক কিছুই আঁকড়ে ধরতে চাই, নিজের অধিকার এক বিন্দু ছাড়তে চাই না, এ সবই ঠিক, তবু মাঝে মাঝে মৃত্যুর ছায়া দেখতে পাব না, এমন নির্বোধ আমি নই। কার কখন সময় ফুরিয়ে যায়, কে বলতে পারে?
এবার শশিভূষণ মনে মনে বললেন, আপনার যবেই মৃত্যু হোক, আমি তখন ধারে-কাছে থাকব না। আপনার সঙ্গে আমার সব শেষ হতে চলেছে। আমি ভূমিসূতাকে নিয়ে অন্য জায়গায় ঘর বাঁধব।
ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে গেল। একটু পরে রানী মনোমোহিনীকে নিয়ে মহারাজ গিরিশ ঘোষের ‘প্রভাস যজ্ঞ’ নাটক দেখতে যাবেন, শশিভূষণ তাতে সঙ্গী হবেন না। নিজের ঘরে এসেই শশিভূষণ ভূমিসূতার নাম ধরে ডাকতে লাগলেন।
এবারে ভূমিসূতা নিজেই রেকাবিতে জলখাবার নিয়ে এল। একটা ধপধপে সাদা শাড়ি পরা, চুল খোলা। শশিভূষণ লক্ষ করলেন, আজ সে পায়ে আলতা দেয়নি, কপালে চন্দনের ফোটা নেই, চক্ষু দুটি থমথমে। হঠাৎ দেখলে তাকে বিধবাবালা বলে মনে হয়।
শশিভূষণ গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি নাকি কাল সারা রাত কেঁদেছ? কী হয়েছে তোমার? কোনও অসুখ?
ভূমিসূতা আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে নত বলল, কিছু হয়নি!
শশিভূষণ আবার জিজ্ঞেস করলেন, তবে কেঁদেছ কেন? কেউ তোমাকে কোনও কটু কথা বলেছে?
ভূমি বলল, না। আমি আপনার জন্য জল নিয়ে আসি?
শশিভূষণ বললেন, কিচ্ছু আনতে হবে না। তুমি বসো। তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। আজ সব কথা শেষ করে দিতে হবে। বসো।
ভূমি অনেকখানি দূরত্বে মেঝের ওপর বসে পড়ল। শশিভূষণ প্রায় ধমকের সুরে বললেন, ওখানে নয়, ওই চেয়ারে বসো। এসো, উঠে এসো!
ভূমিসূতা উঠল বটে, কিন্তু চেয়ারে বসল না, দাঁড়াল চেয়ারটির পিছনে। শশিভূষণ বললেন, তোমাকে আমি সমমর্যাদা দিতে চাই, তুমি কেন তা নেবে না? কেন তা বুঝতে চাও না? চুপ করে থাকলে চলবে না, আজ তোমায় উত্তর দিতেই হবে।
ভূমিসূতা বলল, আমি এর যোগ্য নই।
শশিভূষণ বললেন, কে বলেছে, তুমি এর যোগ্য নাও! তুমি অসাধারণ। একটা কথা সত্যি করে বল তো? আমাকে কি তোমার মন্দ লোক মনে হয়! তুমি কি ভাব, আমার কিছু কু অভিসন্ধি আছে? বলো, বলো!
ভূমি বলল, না। আপনি মহৎ।
শশিভূষণ একজন আহত মানুষের আর্তনাদের সুরে বললেন, তবে? তবে কেন তুমি আমার ডাকে সাড়া দিচ্ছ না? তুমি বুঝতে পার না, আমি তোমাকে চাই। কতখানি চাই! আর কোনও নারীকে আমি এমন ভাবে চাইনি। এই দাসিত্ব তোমাকে মানায় না, ভূমি। তুমি আমার জীবনসঙ্গিনী হবে। তুমি তা চাও না? কেন?
ভূমিসূতা চুপ করে রইল। শশিভূষণ আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। আবেগের বশে ছুটে এসে ভূমিসূতার একটা হাত ধরলেন।
বিদ্যুৎপৃষ্টের মতন কেঁপে উঠে ভূমিসূতা হাত ছাড়িয়ে নিল। পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়াল দেয়াল সেঁটে। অসহায় কান্না জড়ানো গলায় বলতে লাগল, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন!
শশিভূষণ গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন ওর মুখের দিকে। তারপর বললেন, ক্ষমা? কিসের জন্য ক্ষমা? তুমি কোনও দোষ করোনি! আমি তোমাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিলুম, তুমি সারা রাত কাঁদলে। আমি তো এর কোনও অর্থই বুঝতে পারছি না। তুমিও কি বুঝতে পার না যে এ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই? তুমি যদি ত্রিপুরায় যেতে না চাও, তাহলে আমি তোমাকে কোথায় লুকিয়ে রাখৰ মহারাজের কাছে আমি মিথ্যে কথা বলতে পারব না। ভূমিসূতা চুপ করে রইল।
শশিভূষণ বললেন, তোমার কি ইচ্ছে করে না, ভূমি নিজস্ব একটা বাড়ি পেতে? নিজের সংসার, স্বামী, আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি।
ভূমিসূতা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
শশিভূষণ অস্থিরভাবে বললেন, এখন কান্নার সময় নয়। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তালতলায় একটা ভাড়া বাড়ি দেখে রেখেছি। সেখানে গিয়ে কয়েক দিনের মধ্যে বিবাহটা সেরে নিতে হবে। তারপর আমরা চলে যাব চন্দননগর, আমি বলছি, সে জায়গাটা তোমার খুব পছন্দ হবে, দেখো!
ভূমিসূতা কান্নার মধ্যে আত্মগোপন করে রইল, আর উত্তর দেয় না। শশিভূষণ একই কথা বলে যেতে লাগলেন বারবার।
এক সময় দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন সুশীলা নামী দাসীটি।
শশিভূষণ তার দিকে ফিরে ক্রুদ্ধভাবে বললেন, কী চাই?
সুশীলা বলল, একটা চিঠি। পুরুতমশাই বললেন, তোমাদের এখানে ভূমিসূতো নামে কে আছে, তাকে এই চিঠিখানা দিও। আজই। আমি সেই তখন থেকে খুঁজে মরছি।
শশিভূষণ ভ্ৰকুঞ্চিত করে বললেন, চিঠি? ওকে কে চিঠি লিখবে? পুরুতমশাই-ই বা ওকে চিঠি দেবেন কেন?
সুশীলা বলল, আমিও তো তাই ভাবছি। আমরা দাসী মাগী, মুখ্যু, নেকাপড়া জানি না, আমাদের কে পত্তির দেবে? তারপর মালুম হল, বোধ হয় ভূমির হাত দিয়ে আনপার কাছেই এটা পাঠাতে চায়। তাই নিয়ে এলুম।
সুশীলার হাতে একখানা সাদা লেফাফা। শশিভূষণ হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে বললেন, ঠিক আছে, তুমি যাও।
লেফাফার ওপর কোনও নাম লেখা নেই। মুখটা গঁদ দিয়ে সাঁটা। সেটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে শশিভূষণ বললেন, এই পুরুতটা মহা পেটুক। প্রায়ই এটা-সেটা ছুতো করে টাকা চায়। আবার বোধ হয় কিছু চাইছে।
চিঠির সম্বোধন ও লেখকের নাম আগে দেখলেন তিনি। যেন বজ্ৰপাত হল। শশিভূষণের চিন্তা একমুখী ছিল, কিন্তু বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছেন সেই তো যথেষ্ট, ভূমিসূতার আপত্তির কোনও কারণ তিনি খুঁজে পাননি। অন্য কোনও দিকের কথা তার মাথাতেই আসেনি একবারও।
তিনি হতবুদ্ধির মতন ধাপ করে পালঙ্কে বসে পড়ে, অস্ফুট স্বরে বললেন, ভরত!
হে ভূমিসূতা ;
তোমাকে আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তোমার সহিত সংযোগ রক্ষা করিব। তোমাকে অপমানের জীবন হইতে মুক্তির ব্যবস্থা অবশ্যই করিব। কিন্তু এতদিন তাহা পারি নাই। তুমি নিশ্চয় স্থির করিয়াছ যে আমি কাপুরুষের ন্যায় পলায়ন করিয়াছি, তোমাকে বিস্মৃত হইয়াছি। ইহা তুমি অবশ্যই মনে করিতে পারো, দোষ আমারই। তবে সত্য এই যে, আমি তোমাকে একদিনের জন্যও বিস্মৃত হই নাই। সৰ্বক্ষণ তোমার কথা মনে পড়ে। রাত্রে আমার ঘুম আসে না। আমার ঘরের শূন্য দেওয়ালে আমি তোমার মুখচ্ছবি দেখিতে পাই।
ভবানীপুরের বাড়ি হইতে অকস্মাৎ বিতাড়িত হওয়ার সময় আমি তোমার সহিত কথা বলার সুযোগ পাই নাই। পূজনীয় মাস্টারমহাশয়কে আমি সঙ্কোচবশে জানাইতে পারি নাই কিছু। কিন্তু তুমি এখন যে রাজবাড়িতে আছ, তাহা আমি বিলক্ষণ জানি। কিন্তু কোনও বিশেষ কারণবশত ওই বাড়ির ত্রিসীমানায় আমার যাইবার উপায় নাই। কারণটি তোমাকে এখন বলিতে পারিব না, কিন্তু তুমি বিশ্বাস করিও, তোমার প্রতীক্ষাতেই আমার প্রতিটি দিন কাটে। খবর পাইয়াছি, মহারাজ শীঘ্রই ত্রিপুরায় ফিরিবেন। তুমি কোনওক্রমেই ত্রিপুরায় যাইতে সম্মত হইয়ে না। তা হইলে তোমার সহিত আমার চিরবিচ্ছেদ ঘটবে, আমি কোনওক্রমেই তাহা সহিতে পারিব না। মহারাজ চলিয়া গেলে আমি তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিব। পুরোহিত মহাশয় আমার বিশেষ বন্ধু, তাহার মারফত পত্র পাঠাইলাম। তুমি তাঁহার হস্তে উত্তর দিতে পারো। অবশ্য দিও। তোমার কুশল সংবাদ দিও।
ইতি
নিত্য প্রীত্যর্থী
ভরতকুমার
চিঠিখানা পাঠ শেষ করার পর দীতে দাঁত চেপে শশিভূষণ আবার শুধু বললেন, ভরত!
তাঁর সমস্ত শরীরে আগুনের মত ছড়িয়ে পড়েছে ক্ৰোধ। তাঁর এমন প্রিয় একটা স্বপ্ন তছনছ করে দিতে চায় ভরত? কে ভরত? সেই গঞ্জের নদীর ঘাটে, ভিখারিদের সারিতে বসে ছিল ন্যাড়া মাথা একটা ক্যাংলা ছেলে, প্রায় উন্মাদ। শশিভূষণ যদি সেখান থেকে তাকে তুলে নিয়ে না। আসতেন, তা হলে কোথায় থাকত ভরত? কলকাতায় কে তাকে আশ্রয় দিত! এখনও শশিভূষণের দেওয়া মাসোহারায় সে টিকে আছে। সামান্য একটা পরগাছা হয়ে সে ভূমিসূতার মতন একটি রমণীরত্নকে পেতে চায়। বান্দরের গলায় মুক্তোর মালা!
জ্বলন্ত চোখে চেয়ে শশিভূষণ বললেন, ভরত! এর জন্য তুমি আমার কথায় রাজি হওনি? এর জন্য তুমি কেঁদে ভাসাচ্ছিলে?
ভূমিসূতা উত্তর না দিয়ে লুব্ধ শশিভূষণের হাতের চিঠিখানির দিকে চেয়ে রইল।
নারীর প্রতি আকর্ষণ এমনই তীব্র যে ভরতের প্রতি শশিভূষণের সব স্নেহ-মমতা যেন মুছে গেছে। তিনি মহারাজ বীরচন্দ্রকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবেছিলেন, মহারাজের লালসার গ্রাস থেকে ভূমিসুতাকে ছিনিয়ে নেবার জন্য সবরকমভাবে প্ৰস্তুত ছিলেন। হঠাৎ ভরতের মতন একটা নগণ্য প্রাণীর মাঝখানে এসে পড়াটা তিনি মাছি তাড়ানোর মতন উড়িয়ে দিতে চান। ভরত তাঁর কথায় ওঠে বসে। ভরতকে তিনি পুনর্জীবন দিয়েছেন, তাকে এক ধমক দিলে সে আর জীবনে ভূমিসূতার দিকে ফিরে চাইবে না। তাঁর চন্দননগরের বাড়ির স্বপ্ন কিছুতেই নষ্ট হতে পারে না। ভূমিসূতাকে তাঁর চাই।
তিনি বললেন, তুমি কি পাগল হয়েছ, ভূমি? ভরতের ওপর তুমি নির্ভর করেছিলে? ওর কী ক্ষমতা আছে? নিজেরই চাল-চুলোর ঠিক নেই, ও তোমাকে কোথায় আশ্রয় দেবে? আমি সাহায্য না করলে ও কালই আবার পথের ভিখিরি হয়ে যাবে!
চিঠিখানা এখনও পড়েনি ভূমিসূতা, কিন্তু ভরত তাকে চিঠি লিখেছে, এটা জানার পরই তার মুখ-চোখ অনেক বদলে গেছে। অসহায়, কান্না কান্না ভাবটা আর নেই। এখন সে স্পষ্ট চোখে শশিভূষণের দিকে তাকিয়ে আছে। এখন তার নীরবতার মধ্যেও রয়েছে দৃঢ় প্রতিবাদ।
শশিভূষণ বললেন, ভরত কোনও দিন আমার অবাধ্য হবে না। আমি আদেশ করলে সে তোমার পা ধোওয়ার জল ঢেলে দেবে। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে তোমাকে প্ৰণাম করবে!
চিঠিখানা দুমড়ে মুচড়ে মাটিতে ছুঁড়ে দিয়ে তিনি আবার বললেন, ভরত কেউ না। ওসব ভুলে যাও! তুমি আর আমি যে নতুন জীবন শুরু করব, সেখানে ভরতের কোনও স্থান নেই।
ভূমিসূতা প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে তুলে নিল চিঠিখানা। দুহাতের মুঠিতে ধরে নিজের বুকে ঠেকিয়ে রাখল।