যা গেছে তা যাক
সুলেখা কড়া চোখে তাকান গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ের দিকে, ‘একবার তো বললাম, যাবি না। কানে কথা যাচ্ছে না বুঝি? যা, পড়তে বোস।’
মায়ের বকুনিতে চোদ্দো বছরের কিশোরীর চোখ ছলছল। ফের মরিয়া আর্জি জানায়, ‘কেন যাব না? স্কুলের সবাই দেখে ফেলেছে সিনেমাটা। সবাই বলছে, দারুণ হয়েছে। আজ সন্ধের শো-তে অরুণিমা-দেবস্মিতারা যাচ্ছে। ওদের সঙ্গে যেতে না দাও, তুমি বা বাবা নিয়ে চলো।’
সুলেখা ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, ‘ওরা যাচ্ছে যাক। হলে গিয়ে ওসব বড়দের হিন্দি বই দেখার বয়স তোর হয়নি। তুই যাবি না, ব্যস।’
—কে বলল বড়দের ছবি? ‘কয়ামত সে কয়ামত তক’ মোটেই বড়দের ছবি নয়। তা হলে তো ‘এ’ মার্কা থাকত, অরুণিমারাও যেতে পারত না। রোম্যান্টিক ছবি। ব্যারাকপুরে ‘জয়ন্তী’-তে চলছে। চলো না নিয়ে।
সুলেখার মাথায় আগুন চড়ে যায়। বাবা-দাদু-ঠাকুমার আদরে মেয়েটা যেন বাঁদর হয়ে উঠছে দিন-কে-দিন। ক্লাস এইটের মেয়ে হিন্দি বই দেখতে যাবে হলে! তা-ও আবার রোম্যান্সের বই! শখ কত! তা ছাড়া মুখে-মুখে এত চোপা করার মতো সাহসই বা হয় কী করে?
মেয়ে এখনও জেদ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে সুলেখা ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দেন গালে, ‘সিনেমা দেখা নিয়ে আর একটা কথাও যেন মুখ থেকে না বেরয়। দশ মিনিটের মধ্যে পড়তে বসবি।’ কথাগুলো বলেই দোতলা থেকে নেমে আসার সিঁড়িতে পা রাখেন সুলেখা। রান্নাবান্নার অনেক কাজ পড়ে আছে। দ্রুত পা চালিয়ে চলে আসেন নীচে। সময় হয় না আর পিছনে ফিরে তাকানোর। তাকালে দেখতে পেতেন, কিশোরী কন্যা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকে একচুলও নড়েনি। ঠায় দাঁড়িয়ে দেখছে মায়ের নীচে নেমে যাওয়া। পাতা প্রায় পড়ছেই না চোখের। অদ্ভুত সে দৃষ্টি! ক্ষোভ-রাগ-অভিমানের সঙ্গে যাতে দ্বেষেরও তীব্র মিশেল!
.
— হল তো! হল তো! কতবার বলেছিলাম, পাপ বিদেয় করো, বিদেয় করো! কানে কথাই তুললে না! তুললে আজ এভাবে মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হত না। গলায় দড়ি দিয়ে মরতে ইচ্ছে করছে আমার!
থামানো যাচ্ছিল না সুলেখাকে। স্ত্রী-র মুখরা স্বভাবের সঙ্গে সুভাষ পরিচিত বিয়ের অল্পদিন পর থেকেই। কিন্তু আজ যেন সুলেখার মেজাজ আরও বেশি বাঁধনহীন। রণচণ্ডী মূর্তি একেবারে। অন্যদিন হলে সুভাষ ঠান্ডা মাথায় শান্ত করার চেষ্টা করতেন সুলেখাকে। আজ সেটা করে লাভ নেই। যা ঘটেছে, শুনে তাঁর নিজেরই মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। ভুল তো কিছু বলছে না সুলেখা। সত্যিই তো আগে একাধিকবার বলেছে ওই মাস্টারকে ছাড়িয়ে দিতে। তেমন একটা পাত্তা দেননি সুভাষ। কিন্তু আজ যা ঘটল, তারপর তো পাড়ায় থাকাই দায় হয়ে যায়। লোকে বাড়ি বয়ে এসে এভাবে অপমান করে যাবে!
আর অপমান বলে অপমান! সন্ধেবেলা কাজ সেরে বাড়ি ফিরে স্ত্রীর মুখে সুভাষ শুনলেন, বিকেলের দিকে অলকা এসেছিলেন। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দশ মিনিট ধরে পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে শুনিয়ে তুমুল গালিগালাজ করে গেছেন, ‘এমন মেয়ে আমার থাকলে গলায় পা দিয়ে মেরে ফেলতাম! ছি ছি! লজ্জা করে না! বলিহারি যাই এমন বাপ-মায়ের! বাপের বয়সি মাস্টারের পিছনে মেয়েকে লেলিয়ে দিয়ে মজা দেখছে…।’
সুলেখা প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন, ‘এসব আপনি কী যা-তা বলছেন!’ উত্তরে গলার মাত্রা আরও চড়িয়েছিলেন রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য অলকা, ‘ঠিকই বলছি। একদম ন্যাকা সাজবেন না! ধিঙ্গি মেয়েকে সামলে রাখতে পারেন না তো জন্ম দিয়েছিলেন কেন? আর লাইনেই যদি নামাতে হয়, ভদ্রপাড়ায় কেন? সোনাগাছিতে পাঠান!’
প্রতিটা শব্দ যেন কানে আগুনের হলকা পৌঁছে দিচ্ছিল সুলেখার। মেয়ে স্কুল থেকে ফিরে নিজের ঘরে ঘুমচ্ছিল। টেনে তুলেছিলেন চুলের মুঠি ধরে, কিল-চড়-থাপ্পড় খরচ করেছিলেন এলোপাথাড়ি, ‘ঠিকই তো বলে গেল, তোর মতো মেয়েকে পেটে ধরাটাও পাপ। থাকার থেকে না থাকা ভাল। পড়াশুনো করে দিগ্গজ হওয়া বার করছি তোর।’
মা যতক্ষণ মারছিল, আত্মপক্ষ সমর্থনে একটি শব্দও খরচ করেনি মেয়ে। মারের পর্ব শেষ হওয়ার পর শুধু স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল সুলেখার দিকে। অদ্ভুত সে দৃষ্টি! যা থেকে অভিমান তো নয়ই, ক্ষোভ-রাগ-দ্বেষও নয়, ঠিকরে পড়ছিল স্রেফ প্রতিহিংসা।
নেমন্তন্ন-বাড়ি থেকে ফিরতে একটু বেশিই রাত হয়ে গিয়েছিল রথীনবাবুর। সেই বরানগরের বিয়েবাড়ি থেকে এই নোয়াপাড়া, দূরত্ব তো নেহাত কম নয়। রাতে খাওয়ার পর ছাদে একটু পায়চারি করা মধ্যপঞ্চাশের রথীনের বরাবরের অভ্যেস। রাত প্রায় পৌনে বারোটা নাগাদ ছাদে উঠে সবে একটা সিগারেট ধরিয়েছেন, আওয়াজটা তখনই কানে এসেছিল। গোঁ-গোঁ করে একটা শব্দ আসছে না পালবাড়ির দিক থেকে? কে গোঙাচ্ছে এত রাতে? বিপদ-টিপদ হল নাকি কিছু? ছাদের উপর থেকে স্পষ্ট কিছু দেখাও যাচ্ছে না। রথীন তড়িঘড়ি নেমে এসেছিলেন নীচে। বেরিয়ে পড়েছিলেন টর্চ নিয়ে। মিনিটদুয়েকের মধ্যেই আবিষ্কৃত হয়েছিল ওই গোঁ-গোঁ আওয়াজের উৎস।
পালবাড়ির সদর দরজার সামনেই পড়ে আছে মেয়েটা। দড়ি দিয়ে হাত-পা বাঁধা পিছমোড়া করে। মুখও বাঁধা কাপড় দিয়ে। ওই অবস্থাতেই আওয়াজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রাণপণ। কাছে গিয়েই চমকে উঠলেন রথীন। আরে, এ তো পালবাড়িরই মেয়ে! এখানে এভাবে পড়ে? তাড়াতাড়ি হাত-পা আর মুখের বাঁধনটা খুলে ফেললেন রথীন। মেয়েটা হাঁফাচ্ছে। কাঁপছে সারা শরীর। ‘কী রে, কী হয়েছে?’-র জবাবে কেঁদে ফেলল ঝরঝরিয়ে। কোনওরকমে নিজেদের বাড়ির দিকে আঙুল দেখাতে পারল শুধু।
দোতলা বাড়িটার কোথাও কোনও আলো জ্বলছে না। একতলার সদর দরজাটা হাট করে খোলা। বড়সড় অঘটন ঘটে গেল নাকি কোনও? একটু নার্ভাস লাগছিল রথীনের। ভিতরে ঢুকতে গিয়েও থমকে গেলেন। ঢোকার আগে আশেপাশের দু’-তিনটে বাড়ির লোককে ডেকে তুললেন। রথীন সহ পাড়ার অন্তত জনাছয়েক একসঙ্গে ঢুকলেন ভিতরে। এবং ঢুকেই বুঝলেন, অবিলম্বে নোয়াপাড়া থানায় খবর দেওয়া দরকার।
একতলায় দুটো শোবার ঘর। একফালি ড্রয়িংরুম। রান্নাঘর, বাথরুম। একতলার ভিতর থেকেই দোতলায় উঠে যাওয়ার সিঁড়ি। দুটো বেডরুম দোতলাতেও। দুটো ঘরের সঙ্গেই অ্যাটাচড বাথরুম। আর ছোট বসার ঘর একটা।
একতলার ঘরের মেঝেতে দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার নিস্পন্দ দেহ পড়ে আছে। দেবেন্দ্রমোহন পাল এবং তাঁর স্ত্রী লতিকা। এপাড়ার একেবারে আদি বাসিন্দা বলা যেতে পারে এঁদের। একতলাতেই রান্নাঘরের বাইরে পড়ে আছেন সুলেখা। দেবেন্দ্র-লতিকার পুত্রবধূ। দোতলার একটা বেডরুমের বিছানায় নিথর পড়ে আছেন দেবেন্দ্রমোহনের একমাত্র ছেলে, বছর পঁয়তাল্লিশের সুভাষ।
চারজনের দেহেই তামার তার জড়ানো। যে তারের অন্য প্রান্ত গুঁজে দেওয়া রয়েছে কাছাকাছির ইলেকট্রিক প্লাগ-পয়েন্টে। শরীরের কিছু কিছু অংশ পুড়ে গেছে সবারই। চারজনের কারও দেহেই যে প্রাণের বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট নেই আর, সেটা বুঝতে ডাক্তার না হলেও চলে।
দুটো তলাই লন্ডভন্ড। বাড়ির যা কিছু আলমারি-দেরাজ, মূলত দোতলাতেই। সব খোলা। ভিতরের কাপড়চোপড়-জিনিসপত্র সব যে হাঁটকানো হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে, স্পষ্ট। বাড়িময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এদিক-সেদিক পড়ে আছে এটা-ওটা-সেটা।
নোয়াপাড়া থানার জিপ যখন এসে থামল বাড়ির সামনে, ততক্ষণে পাড়ার সবাই জেগে গিয়েছেন। ভিড় জমে গেছে বাড়ির সামনে। পাড়ার মহিলারা ধাতস্থ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন সুভাষ-সুলেখার একমাত্র মেয়েকে। হাত-পা-মুখের বাঁধন রথীন খুলে দেওয়ার পর থেকেই যে কেঁদে চলেছে লাগাতার। কেঁপে কেঁপে উঠছে মাঝেমাঝে। বারবার মুখে-চোখে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দেওয়া সত্ত্বেও এখনও কথা বলার মতো অবস্থাতেই পৌঁছয়নি মেয়েটি। যাকে ডাকনামেই পাড়ার সবাই চেনে। বুড়ি। ভাল নাম সুদীপা। সুদীপা পাল।
.
কোন মামলার কথা লিখছি, সেটা পাঠক অবধারিত আন্দাজ করতে পারছেন আগের অনুচ্ছেদগুলো পড়ে। সেই সাড়া-জাগানো মামলা, যার অভিঘাত শুধু রাজ্যের মানুষকেই স্তব্ধ করে দেয়নি, আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল দেশজুড়েই। সেই ঘটনার কথা, প্রায় তিরিশ বছর পেরিয়ে গেলেও যা নিমেষে আমবাঙালির স্মৃতিতে ফিরে আসে ফ্ল্যাশব্যাকে, ‘নোয়াপাড়া’ আর ‘সুদীপা পাল’, এই শব্দ তিনটে একসঙ্গে উচ্চারণ করলেই।
কিছু মামলা থাকে, যা নিয়ে লোকের আগ্রহের পারদ কখনই নিম্নগামী হয় না। সে যতই পেরিয়ে যাক বছরের পর বছর, দশকের পর দশক। সুরূপা গুহ হত্যামামলা যেমন। সাতের দশকের শেষদিকের যে কেস নিয়ে এখনও অশেষ ঔৎসুক্য মানুষের মনে। তেমনই, কৌতূহলের শেষ নেই গড়িয়াহাটে দেবযানী বণিকের হত্যাকাণ্ড বা অক্সিটাউনের বহুচর্চিত খুনের মামলা নিয়ে। অথবা স্টোনম্যান বা খাদিম কর্তা অপহরণ বিষয়ে। এমন আছে আরও বেশ কিছু, যে সব ঘটনার নেপথ্যকথায় আমার-আপনার মতো সাধারণের আগ্রহ চিরকালীন। যে মামলার কথা লিখছি, তা-ও এই গোত্রেরই। কী হয়েছিল, কে করেছিল, কেন করেছিল, সেই মূল ব্যাপারটা সবারই মনে আছে মোটামুটি। তবু ঘটনাটাই এমন, আরও বিশদে জানতে চাওয়ার চাহিদাটা বেঁচে থাকেই।
এ মামলা নয়ের দশকের একেবারে শুরুর দিকের। সেসময় এই মামলার গতিপ্রকৃতি নিয়ে খবরের কাগজগুলো দিনের পর দিন নিউজ়প্রিন্ট খরচ করেছে অকৃপণ। এই কেস নিয়ে মনোবিদরাও গবেষণা করেছেন বিস্তর। তবু তিক্ত সত্যিটা হল, সে সংবাদপত্রের রিপোর্টই হোক বা বিশেষজ্ঞদের গবেষণা, উভয় ক্ষেত্রেই তথ্যের শুদ্ধতার সঙ্গে অনায়াসে মিশে গেছে কল্পনার ভেজাল, জল্পনার খাদ।
আরও স্বীকার্য, কেস ডায়েরিতে ধরা থাকা বিভিন্ন নথি-বয়ানের নীরস খতিয়ানে বা চার্জশিটে নথিবদ্ধ সাক্ষ্যপ্রমাণের বিবরণীতে, কিংবা আদালতের যুক্তি-তথ্য সমৃদ্ধ রায়েও বেরিয়ে আসে না এই ধরনের মামলার নেপথ্যের সব কিছু। বেরিয়ে আসে না পরদার পিছনে থাকা টুকরো টুকরো খণ্ডচিত্র। যা জানা যায় তদন্তের সঙ্গে জড়িত সর্বস্তরের অফিসার-কর্মীদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণের আলাপচারিতায়। খোলস ছাড়ে বহু অজ্ঞাত-অশ্রুত তথ্য, প্রকাশ্যে আসে ঘটনার ‘কী-কেন-কখন-কীভাবে’-র আদ্যোপান্ত।
জানা ঘটনার অজানা কাহিনি, তাই থাকল লিপিবদ্ধ।
.
২৬, ব্রজনাথ পাল স্ট্রিটের উপর দোতলা বাড়িটা নোয়াপাড়ায় বেশি পরিচিত ‘পালবাড়ি’ হিসেবে। ইছাপুরের গোয়ালাপাড়ায় এই বাড়িটা তৈরি করেছিলেন দেবেন্দ্রমোহন পাল। শুরুতে অবশ্য একতলা ছিল। দোতলাটা হয়েছে এই বছর পাঁচেক হল, ছেলে সুভাষের উদ্যমে। সুভাষ পেশায় স্কুলশিক্ষক ছিলেন। পাশাপাশি হাত লাগাতেন দেবেন্দ্রমোহনের খড়ের ব্যবসাতেও। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষমতা কমল দেবেন্দ্রের। শুরু হল অসুখ-বিসুখের উপদ্রব। স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে পাকাপাকিভাবে ব্যবসার হাল ধরলেন সুভাষ। শুধু হাল ধরলেন বললে কম বলা হয়, উদয়াস্ত পরিশ্রমে কয়েক বছরের মধ্যেই ব্যবসাকে বাড়িয়ে তুললেন দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে। পালবাড়িতে লক্ষ্মীর বসতি স্থায়িত্ব পেল। ‘মধ্যবিত্ত’ থেকে পরিবারের উত্তরণ ঘটল ‘উচ্চবিত্তে’।
পাঁচজনের সংসার। দেবেন্দ্রমোহন-লতিকা, সুভাষ-সুলেখা আর তাঁদের কিশোরী কন্যা সুদীপা, পালবাড়ির একমাত্র মেয়ে। বাড়ির আদরের ‘বুড়ি’। দাদু-ঠাকুমা তো নাতনিকে চোখে হারান। সুদীপা যা যা খেতে ভালবাসে, ঠাকুমা পরম যত্নে বানিয়ে দেন নাতনির আবদারে। ‘বুড়ি’-অন্ত প্রাণ দাদুও। মুখের কথা খসতে না খসতেই সুদীপার জন্য হাজির করেন হরেক উপহার।
মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন সুভাষের। নিজের ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি সংসারের জাঁতাকলে। সেই স্বপ্নের পুনর্জন্ম হয়েছে সুদীপাকে ঘিরে। মেয়েটা পড়াশুনোয় ভাল। ক্লাসে প্রথম তিন-চার জনের মধ্যে থাকে ছোটবেলা থেকেই। এখন ক্লাস এইট। আর দু’বছর পরে, মানে ১৯৯০-এ মাধ্যমিক। সুভাষের স্থির বিশ্বাস, মেয়ে ভাল রেজাল্ট করবে। হায়ার সেকেন্ডারিতে সায়েন্স নিয়ে পড়ে তারপর জয়েন্ট এন্ট্রান্সে বসবে মেয়ে, ভাবাই আছে সুভাষের। ভাবতে কী যে ভাল লাগে সুভাষের, আজকের এই একরত্তি মেয়েটা সাত-আট বছর পর কোনও বড় কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার! ভেবেই রেখেছেন, বাড়ির সদর দরজায় তখন বেশ বাহারি একটা নেমপ্লেট লাগাবেন। ‘সুদীপা পাল, বিটেক’।
স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে এতটুকু খামতি রাখেননি সুভাষ। ইছাপুরেরই বাপুজি কলোনিতে রণধীর বসুর বাড়ি। নবাবগঞ্জ হাইস্কুলে অঙ্কের শিক্ষক। বাড়িতে প্রাইভেট টিউশনি করেন। পঞ্চান্ন বছরের রণধীর পাড়ায় পরিচিত ‘গদু মাস্টার’ নামে। লোকে বলে, গদু মাস্টারের কাছে নাড়া বাঁধলে অঙ্কে লেটার নিশ্চিত। এই গদু মাস্টারের কোচিং ক্লাসে মেয়েকে ভরতি করে দিয়েছিলেন সুভাষ। সপ্তাহে তিনদিন পড়তে যেত সুদীপা।
একদিন কোচিং থেকে মেয়েকে আনতে গিয়ে সুভাষ দেখলেন, যে ব্যাচে সুদীপা পড়ে, তার ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে কয়েকজন। একচিলতে ঘরে গাদাগাদি করে বসতে হচ্ছে। সুভাষ সেদিনই রণধীরকে বললেন, ‘মাস্টারমশাই, এতজনের সঙ্গে এক ব্যাচে পড়লে পার্সোনাল অ্যাটেনশনটা সেভাবে পাচ্ছে না মেয়েটা। আমি চাইছি, আপনি বাড়িতে এসে পড়ান। যে সময়টা আপনি আমার বাড়িতে খরচ করবেন, তাতে হয়তো আপনার আরেকটা ব্যাচ পড়ানো হয়ে যেত। কিন্তু ওই টাকাটা পুষিয়ে দেব আমি। টাকা নিয়ে ভাববেন না।’
রণধীর রাজি হয়ে গেলেন। প্রাইভেট টিউটর হিসেবে তাঁর সুনাম আছে ঠিকই। তবে তাঁর দুই কামরার বাড়ির যে ঘরটায় ছাত্র পড়ান, তাতে খুব ঠাসাঠাসি করে বসলেও ছ’-সাতজনের জায়গা হয়। ব্যাচ বড় করার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। তা ছাড়া একটু বিত্তশালী ঘরের অভিভাবকদের একটা অনীহা থাকেই ওই ঘিঞ্জি ঘরে ছেলেমেয়েদের পাঠাতে।
কোচিংয়ের জন্য একটা বড় ঘর ভাড়া নিতে পারলে হত। কিন্তু সে আর্থিক সংগতি আর কোথায়? স্কুলে পড়িয়ে মাস গেলে মাইনে হাতে আসে হাজার দেড়েক। টিউশনি থেকে যা পান, সেটা মাসমাইনের সঙ্গে যোগ করলেও সংসার চালাতে হিমশিমই খেতে হয় রণধীরকে। মেয়ের বয়স এখন আট। তার স্কুলের খরচ আছে। তার উপর স্ত্রী অলকা মাঝেমাঝেই রোগে ভোগেন। চিকিৎসার খরচ আছে। মাসের শেষ সপ্তাহে পৌঁছে হাতে প্রায় কিছুই থাকে না। সুদীপার বাবা যে টাকাটা দেবেন বলছেন বাড়ি গিয়ে পড়ালে, সেটা নেহাত কম নয়।
সপ্তাহে চারদিন, সোম-বুধ-শুক্র-শনি, সন্ধে সাতটা থেকে সাড়ে ন’টা, বাড়িতে এসে সুদীপাকে পড়াতে শুরু করলেন রণধীর। এই ব্যবস্থায় সুলেখাও খুশি হলেন। চোদ্দো-পনেরো বছরের মেয়েকে নিয়ে মায়েরা একটু বেশিই সাবধানি থাকেন। কিন্তু সুলেখা ছিলেন আরও মাত্রাধিক সতর্ক। এবং ঘোর রক্ষণশীলও। মেয়ে আর দশজনের সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে অঙ্ক শিখবে মাস্টারের বাড়ি গিয়ে, এতে শুরু থেকেই সায় ছিল না সুলেখার। মাঝেমাঝেই তাগাদা দিতেন সুভাষকে, ‘বলে দেখো না, যদি বাড়িতে এসে পড়াতে রাজি হন।’
শুধু অঙ্ক শেখাই নয়, সুলেখা চাইতেন, শুধু স্কুলে যাওয়া-আসাটা বাদ দিয়ে সুদীপার বাকি সবকিছুও আবদ্ধ থাকুক বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই। বাড়ির সামনের মাঠে বিকেলে পাড়ার ছেলেমেয়েরা খেলাধুলো করত। সুদীপাকে যেতে দিতেন না সুলেখা, ‘কত রকমের লোক আসে ওখানে, তোর যাওয়ার দরকার নেই। বাড়িতে খেলনা আছে তো অনেক। বারান্দায় বসে খেল।’
বাড়িতে একা একা খেলে কি আর সেই আনন্দ পাওয়া যায়, যা পার্কে বা মাঠে সকলের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করে মেলে? সুদীপার খুব ইচ্ছে করত মাঠের দোলনাটায় দুলতে, স্লিপে চড়তে। কিন্তু মা অনুমতি দিলে তো! অনুমতি ছিল না পাড়ার সমবয়সি কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার। অনুমতি ছিল না বন্ধুদের জন্মদিনে যাওয়ারও। কার জন্মদিন? কোথায় যেতে হবে? আর কে কে থাকবে? শুধু মেয়েরাই থাকবে তো, না কি কোনও ছেলেও থাকবে? ওই বাড়িতে কতজন পুরুষ? বন্ধুর বাবা কী করেন? হাজাররকম ফিরিস্তি দিতে হত সুদীপাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নাকচ হয়ে যেত আর্জি। যদি বা কখনও সুলেখা অনুমতি দিতেন, সেটা হত বহুবিধ শর্তসাপেক্ষে, ‘ঠিক সোয়া ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসতে হবে’, ‘অপরিচিত লোকের সঙ্গে কথা বলবে না’… এমন আরও অনেক। শুনতে শুনতে বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছেটাই মরে যেত সুদীপার। যেত না কোথাও, থেকে যেত বাড়িতেই। অভিমান আর মনখারাপ নিয়ে।
ধৈর্যের বাঁধ অবশ্য ভেঙে যেত কখনও কখনও। যেমন হয়েছিল ‘কয়ামত সে কয়ামত তক’ দেখতে যাওয়া নিয়ে। স্কুলে রোজ বন্ধুদের মুখে শুনছে, কী দারুণ হয়েছে সিনেমাটা। নতুন হিরো আমির খান বলতে তো বন্ধুরা পাগল। ভীষণ কিউট আর হ্যান্ডসাম নাকি। গানগুলোও সুপারহিট, টিভিতে ‘চিত্রহার’-এ শুনেওছে সুদীপা। মায়ের কাছে সিনেমাটা দেখতে যাওয়ার আবদার করা মাত্র মুখঝামটা শুনতে হল, ‘ক্লাস এইটের মেয়ে হিন্দি বই দেখতে যাবে হলে! তা-ও আবার রোম্যান্সের বই! শখ কত!’ জেদ করে দাঁড়িয়েছিল বলে থাপ্পড়ও পড়ল গালে, ‘সিনেমা দেখা নিয়ে আর একটা কথাও যেন মুখ থেকে না বেরয়। দশ মিনিটের মধ্যে পড়তে বসবি।’
সেদিন সন্ধেবেলা মাস্টারমশাই এসে লক্ষ করলেন, সহজ অঙ্কতেও আটকে যাচ্ছে সুদীপা। একবার নয়, বারবার। রণধীর জিজ্ঞেস না করে পারলেন না, ‘আজ কী হয়েছে তোমার? এত কেয়ারলেস মিসটেক তো তোমার হয় না।’ সুদীপা মাথা নিচু করে বসে আছে দেখে আলতো করে ছাত্রীর পিঠে হাত রাখলেন রণধীর, ‘কী হয়েছে তোমার?’ সুদীপা মুখ তুলে তাকাল। চোখে জল ভরে এসেছে। রণধীর অবাক হয়ে বললেন, ‘এ কী! কাঁদছ কেন?’ সুদীপা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলতে থাকে সিনেমা দেখতে যাওয়া নিয়ে অশান্তির বৃত্তান্ত।
রণধীর শুনলেন। বললেন, ‘মায়ের নিশ্চয়ই আজ কোনও কারণে মেজাজ খারাপ ছিল, তাই তোমাকে মেরেছেন। এটা নিয়ে মন খারাপ করে থেকো না। মা তো তোমার ভালই চান…।’
বাক্য শেষ করতে পারলেন না রণধীর, খানিক চমকেই গেলেন সুদীপার প্রতিক্রিয়ায়, ‘না স্যার, মা আমার ভাল চায় না। কথায় কথায় গায়ে হাত তোলে। বাবা-দাদু-ঠাকুমা ছাড়া কেউ ভাল চায় না আমার। মা আমাকে কোথাও যেতে দেয় না। কারও সঙ্গে মিশতে দেয় না। কারও সঙ্গে কথা বলতে দেয় না। আপনিই বলুন স্যার, আমাকে সিনেমাটা দেখতে দিলে মায়ের কী ক্ষতি হত?’
—তুমি বাবাকেও তো বলতে পারো। হয়তো বাবা বুঝিয়ে বলতে পারবেন তোমার মা-কে।
সুদীপা চুপ। রণধীর বুঝতে পারলেন নীরবতার কারণ। এবাড়িতে নিয়মিত যাতায়াতের সুবাদে বুঝে গেছেন, মেয়েকে প্রাণাধিক ভালবাসেন ব্যবসার কাজে সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত ব্যস্ত থাকা সুভাষ, কিন্তু সুদীপার রোজকার জীবন কীভাবে চলবে, সে ব্যাপারে শেষ কথা বলার অধিকার এবাড়িতে সুলেখারই। দাদু-ঠাকুমাও জানেন সেটা। অনন্ত স্নেহ-ভালবাসা দেন ওঁরা, কিন্তু নাতনির দৈনন্দিন জীবনধারার ব্যাপারে নাক গলান না কখনও। কখনও পেরোন না সুলেখার নির্ধারণ করে দেওয়া অদৃশ্য লক্ষ্মণরেখা।
মাস্টারমশাই সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন ছাত্রীকে, ‘তুমি দুঃখ কোরো না, রেজাল্ট ভাল করলে আমি একদিন তোমাকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাব, কেমন?’
সুদীপা মুখ তুলে তাকায়। জোর করে হাসার চেষ্টা করে। পড়ানো শেষ করে রণধীর উঠে পড়েন। বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, হলুদ টপ আর কালো স্কার্টে আজ কী দারুণ লাগছিল সুদীপাকে। এই বয়সে সব মেয়েকেই দেখতে ভাল লাগে। আর সুদীপা তো এমনিতেই দেখতে ভারী সুন্দর। যত বয়স বাড়ছে, রূপ যেন আরও ঝলসে উঠছে। দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। আজকাল কখনও কখনও সুভাষবাবুকে বলতে ইচ্ছে করে রণধীরের, ‘আমি সপ্তাহে চারদিন নয়, রোজই আসব আপনাদের আপত্তি না থাকলে। তার জন্য বাড়তি টাকা লাগবে না।’ বলা হয়ে ওঠে না চক্ষুলজ্জায়। কী না কী ভেবে বসবেন ওঁরা! অবশ্য ভাবলে ভুল কিছু কি আর ভাববেন? নিজের কাছে কীভাবে লুকোবেন নিজেকে? সত্যিই তো সুদীপাকে রোজ দেখতে ইচ্ছে করে তাঁর। রোজ। মেয়েটার সঙ্গে সময় কাটাতে ইচ্ছে করে প্রতিদিন।
মাস দুয়েক পরের ঘটনা। পড়াতে এসে ফের রণধীর দেখলেন, সুদীপার মুখ ভার। বড্ড অন্যমনস্ক। কারণটা আজ আর খুঁচিয়ে জানতে হল না। সুদীপা নিজেই বলল, বাঁ হাতে খুব ব্যথা। মা আজ দুপুরে স্কেল দিয়ে মেরে কনুই ফুলিয়ে দিয়েছে। কেন? স্কুল থেকে ফেরার সময় বাড়িতে ঢোকার মুখে দেখা হয়ে গিয়েছিল অজন্তার সঙ্গে। পাড়াতেই থাকে কয়েকটা বাড়ি পরে। অজন্তার দাদা মানসও ছিল সঙ্গে। খুব বেশি হলে মিনিটদুয়েক ‘কী রে, কী খবর?’ গোছের কথাবার্তা বলেছে সুদীপা। তা-ও অজন্তার সঙ্গে। মানসদা দাঁড়িয়েই ছিল চুপচাপ। মা দেখেছে বারান্দা থেকে।
বাড়ি ঢুকতেই কৈফিয়ত তলব, ‘কেন কথা বলছিলি ওই ছেলেটার সঙ্গে?’ সুদীপা প্রতিবাদ করেছিল, ‘কথা তো অজন্তার সঙ্গে বলেছি!’ মা পালটা বলেছিল, ‘না, তুই ওর দাদার সঙ্গেই কথা বলছিলি, আমি নিজের চোখে দেখেছি।’ সুদীপারও রাগ হয়ে গিয়েছিল মায়ের অকারণ দোষারোপে, ‘তুমি ভুল দেখেছ। আর যদি মানসদার সঙ্গে একটা-দুটো কথা বলেই থাকি, কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে?’ শুনে সুলেখা খেপে গিয়েছিলেন। চুলের মুঠি ধরে মেয়েকে মার, স্কেলপেটা।
‘কোথায় লেগেছে দেখি?’ সুদীপার হাতটা টেনে নিয়েছিলেন মাস্টারমশাই। ফুলে থাকা কনুইয়ে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। সহানুভূতির স্পর্শে কান্না উথলে এসেছিল সুদীপার। রণধীর বলেছিলেন, ‘ইশ! এভাবে কেউ মারে!’ চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে হাত রেখেছিলেন ছাত্রীর পিঠে। যাবতীয় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে কাছে টেনে নিয়েছিলেন সুদীপাকে। স্যারের আঙুল ঘুরে বেড়াচ্ছিল ছাত্রীর কাঁধে-ঘাড়ে-পিঠে-গলায়। কী ভাল যে লাগছিল সুদীপার! মনে হচ্ছিল, স্যার যেন না থামেন। রণধীর আলতো করে সুদীপার মুখটা তুলে কপালে চুমু খেয়েছিলেন, বুকে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে নিয়ে। ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়েছিলেন। সুদীপা কাঁপছিল। ভাললাগার কাঁপুনি। পুরুষস্পর্শে সব উজাড় করে সাড়া দিচ্ছিল কিশোরী শরীর।
সেদিন পালবাড়ি থেকে বেরনোর আগে রণধীর কানে কানে বলেছিলেন সুদীপার, ‘কোনও চিন্তা নেই তোমার। আমি তো আছি। আমাকে একটু ভাবতে দাও। তোমার মা বেশি বাড়াবাড়ি করলে তার ব্যবস্থা আমাদেরই করতে হবে।’
মেয়েকে শাসন করতে গিয়ে কেন মাঝেমাঝেই বাড়াবাড়ি করে ফেলতেন সুলেখা? কেন মেয়ের প্রতি আচরণে প্রায়শই ‘শাসন’ রূপ নিত ‘অত্যাচারের’? বাবা-দাদু-ঠাকুমার অফুরান স্নেহের প্রশ্রয়ে মেয়ে বিগড়ে যাবে, এমন আশঙ্কায় ভুগতেন বলেই কি জারি করেছিলেন এত নিয়মনিষেধ? নাকি অন্য কোনও অভাববোধ ছিল? যে না-পাওয়ার ক্ষোভ গভীর শিকড় গেড়েছিল অবচেতনে, এবং যার বহিঃপ্রকাশ প্রায়ই ঘটে যেত মেয়ের প্রতি ব্যবহারে? সুদীপার জন্মের পর বেশ কিছুদিন জটিল রোগে ভুগেছিলেন সুলেখা। সেরে ওঠার পর ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছিলেন, কখনওই আর দ্বিতীয় সন্তানের মা হতে পারবেন না সুলেখা। গর্ভধারণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে পাকাপাকি। সুলেখার তীব্র ইচ্ছে ছিল, মেয়ের পর ছেলে হোক একটা। সেই পুত্রাকাঙ্ক্ষায় দাঁড়ি পড়েছিল সুদীপার জন্মের পর। কে জানে, অবচেতনে হয়তো মেয়ের ঘাড়েই চাপাতেন ইচ্ছাপূরণ না হওয়ার দায়।
একমাত্র সন্তানের যত্ন নিতেন না সুলেখা, এমন অপবাদ তা বলে কেউ দিতে পারবে না। কেউ বলতে পারবে না, মা হিসেবে মেয়ের প্রতি কর্তব্যে কোনওরকম ফাঁক রেখেছিলেন সজ্ঞানে। সুলেখার সমস্যা আসলে ছিল ওই ‘কর্তব্যবোধ’ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ধ্যানধারণায়।
একটা বয়সের পর যে সন্তানের জীবনের প্রতিটি ওঠাপড়া নিয়ন্ত্রণে রাখা আর সেভাবে সম্ভব নয়, এবং জোর করে সেটা করতে গেলে যে সন্তানের মনে মা-বাবার প্রতি একটা অনিবার্য বৈরিতা তৈরি হয় ক্রমশ, সেটা সুলেখা বুঝতেন না। বুঝতেন না, অভিভাবকদের এই মাত্রাধিক নিয়ন্ত্রণকে সন্তানদের কাছে দাসত্ব বলে বোধ হয় বয়ঃসন্ধির বছরগুলোয়। বুঝতে চাইতেন না, দাসত্বের শৃঙ্খল যত বেশি নিশ্ছিদ্র হয়, তার থেকে মুক্তি পাওয়ার তাগিদও হয় ততটাই উদগ্র। মনও ততটাই বিদ্রোহী হয়ে উঠতে থাকে। মনস্তত্ত্বের ভাষায় authoritarian parenting-এর শিকার এই ছেলেমেয়েরা তখন চায় মানসিকভাবে অন্য কারও উপর নির্ভর করতে। কেউ যদি একটু সময় খরচ করে ওদের সুখ-দুঃখের কথা শোনে এ সময়, যদি পিঠে স্নেহের হাত রেখে দুটো সমবেদনার কথা বলে, তাকেই তখন নিজের শ্রেষ্ঠতম শুভানুধ্যায়ী মনে হয়।
নিজের পরিবারের বাইরে কাউকে অবলম্বন করে এই বাঁচতে চাওয়া কারও কারও ক্ষেত্রে পরিণত হয় ‘অবসেশনে’। সান্ত্বনা দেওয়ার মানুষটা, সমবেদনা পাওয়ার জায়গাটা তখন হয়ে ওঠে যে-কোনও মূল্যে পরম কাঙ্ক্ষিত। হয়ে ওঠে নিজের একমাত্র পরিত্রাণের জায়গা।
রণধীর ছিলেন সুদীপার সেই পরিত্রাণ। এক পক্ককেশ পঞ্চান্ন বছরের কুদর্শন পুরুষের প্রেমে সুদীপার মতো সুন্দরী উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরী যেভাবে ভেসে গেছিল অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই, তার নেপথ্যে ছিল ওই পরিত্রাণেরই রসায়ন।
মায়ের প্রতি সুদীপার পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে প্রথমে ক্রোধ এবং ক্রমে ঘৃণায় পরিণত করতে অনুঘটকের ভূমিকা নিয়েছিলেন রণধীর। জানতেন, এই বয়সের উন্মত্ত রাগ ভুলিয়ে দিতে পারে অনেক কিছু। ভুলিয়ে দিতে পারে পরিবারের অন্যদের থেকে পাওয়া নিঃশর্ত স্নেহ-ভালবাসা, পরিবার থেকে পাওয়া অটুট নিরাপত্তা। রণধীর বুঝতেন, কৌশলী পরিচর্যা পেলে অন্ধ ক্রোধ একসময় বদলে যায়ই প্রতিহিংসায়। লোপ পায় বোধবুদ্ধি। নিরুদ্দেশ যাত্রায় যায় বিচার-বিবেচনা। ঠিক যেমনটা হয়েছিল সুদীপার।
প্রথম চুম্বনের সেই রাতে ঘুমতে পারল না সুদীপা। কানে নাগাড়ে বেজেই চলেছিল স্যারের কথাগুলো, ‘আমি তো আছি।’ কী ভালবেসে বললেন কথাটা! এমনভাবে তো কেউ কখনও বলেনি। এমনভাবে তো তার কথা ভাবেনি কেউ কখনও। মা যে এত কথায়-কথায় বকে-মারে, কই, বাবা-দাদু-ঠাকুমাও তো কখনও আটকাতে আসে না, বারণ করে না মা-কে। পরে এসে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে যায় ঠিকই। কিন্তু বলে না তো কখনও, ‘কাঁদিস না বুড়ি, আমরা তো আছি।’ স্যার যেভাবে বললেন আজ, কত আদর করে!
আচ্ছা, সে কি স্যারের প্রেমে পড়তে চলেছে? স্যার তার থেকে প্রায় চল্লিশ বছরের বড়। মুখভরতি শ্বেতির দাগ। চুল পেকে গেছে অর্ধেক। রোগাটে সাদামাটা চেহারা। শেষ পর্যন্ত এমন একজনের প্রেমে পড়ল সে? না কি প্রেম এমনই হয়? চেহারা তুচ্ছ হয়ে যায়, বয়সের ব্যবধান তুচ্ছ হয়ে যায়, যখন সত্যিকারের ভালবাসা আসে ঢেউয়ের মতো?
সুদীপা ভেবেছিল, প্রেম। রণধীর বুঝেছিলেন, প্রেম নয়, মোহ। ‘Teenage infatuation’। শৃঙ্খলিত আবহে বড় হওয়া এক কিশোরীর অবদমিত চাওয়া-পাওয়ার প্রকাশ। এই মোহকে ব্যবহার করেছিলেন রণধীর, নিজের অর্থকষ্ট লাঘবের সিঁড়ি হিসেবে।
দ্বিধার বাঁধ একবার ভেঙে গেলে যা হয়, যত দিন যাচ্ছিল, গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল শিক্ষক-ছাত্রীর অসমবয়সি সম্পর্ক। পড়াশুনার ফাঁকে রোজই হত টুকটাক শরীরী আদর। সুদীপার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে তখন ‘স্যার’, যাঁকে আপনি বলে সম্বোধন সবার সামনে, একান্তে স্রেফ ‘তুমি’।
’৯০-এর মাধ্যমিকের তখন মাত্র তিন মাস বাকি। রণধীর পড়াতে এসে সুদীপাকে একদিন বললেন, ‘মনে হয়, তোমাকে আর পড়াতে আসতে পারব না।’ সুদীপার মাথায় বিশ্বচরাচর ভেঙে পড়ল, ‘কেন স্যার?’ রণধীরকে বিষণ্ণ দেখাল, ‘আমি তো পড়াতেই চাই তোমাকে। তোমার বাবা মাইনেপত্র ভালই দেন, কিন্তু তবু আর পোষাচ্ছে না। অনেকটা সময় চলে যাচ্ছে এখানে। নতুন ব্যাচের ছাত্র পেয়েছি পাঁচজন। মাসে দুশো করে দেবে বলছে। মাস গেলে এক হাজার। ওটা পেলে আমার উপকার হবে। সংসারের যা টানাটানি, পেরে উঠছি না। তুমি কিছু মনে কোরো না।’
শরীরে-মনে ততদিনে সম্পূর্ণতই রণধীরের উপর নির্ভরশীল হয়ে-পড়া সুদীপা হাত চেপে ধরল স্যারের, ‘না, তুমি যাবে না। আমাকে কয়েকটা দিন সময় দাও, আমি দেখছি। টাকার জোগাড় হয়ে গেলে তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?’ রণধীর নিরুত্তর থাকলেন।
টাকার জোগাড় হল। পরের দিনই সুদীপা রণধীরের হাতে তুলে দিল একটা সোনার আংটি, ‘তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না।’ বাড়ির সমস্ত আলমারি-সিন্দুকের চাবি ঘরের দেরাজেই পড়ে থাকে। ঠাকুমার ঘরের সিন্দুক থেকে একটা সোনার আংটি সরিয়ে ফেলা আর কী এমন কঠিন কাজ? আংটিটা হাতে নিয়ে সুদীপাকে একটা গভীর চুমু খেলেন রণধীর। স্যারের বিপদে পাশে দাঁড়াতে পারার আনন্দে ছাত্রী তখন আত্মহারা। রণধীর বুঝে গেলেন, সুদীপা ‘সোনার হাঁস’। যাকে একবারে মেরে ফেললে চলবে না।
অর্থকষ্টের অজুহাতে দেড়-দুই মাস অন্তর টিউশনটা ছেড়ে দেওয়ার কথা তুলতে শুরু করলেন রণধীর। যা শুনলেই অস্থির হয়ে পড়ত স্যারের হাতের পুতুলে পরিণত হওয়া সুদীপা। কখনও মায়ের সোনার চেন, কখনও ঠাকুমার রুপোর বালা, কখনও বাবার আলমারিতে পড়ে থাকা ‘ইন্দিরা বিকাশ পত্র’… সুদীপা জোগান দিয়ে যেত নিয়মিত। একবার একসঙ্গে প্রায় আট-দশ হাজার টাকার মতো দরকার পড়ল রণধীরের। লাইফ ইনশিয়োরেন্সের প্রিমিয়াম দিতে হবে। বাবার কাছে আবদার জুড়ল সুদীপা, ‘স্যার লজ্জায় বলতে পারছেন না। ওঁর খুব দরকার টাকার। আমাকে বলেছেন, তোমার বাবাকে বোলো, মাইনে থেকে যেন মাসে মাসে কিছু কিছু করে কেটে নেন।’ মেয়ের আর্জি ফেলতে পারলেন না সুভাষ।
মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরল। ‘স্টার’ পেল সুদীপা, অঙ্ক সহ তিনটে সাবজেক্টে লেটার। পালবাড়িতে সেদিন খুশির হইহই। সুভাষ বেশ কয়েক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। মা-ঠাকুমাও সারা সন্ধে ধরে রান্না করলেন সুদীপার পছন্দের খাবার। দাদু ভাবতে বসলেন, ঠিক কোন উপহারটা কিনে আনা যায় নাতনির জন্য।
সন্ধেবেলা রণধীর এলেন। সুদীপা বলল, ‘যা নম্বর পেয়েছি, সবটাই স্যারের জন্য।’ বলে নিজের হাতে মিষ্টি মুখে পুরে দিল রণধীরের। ছাত্রীর মাথায় হাত ছোঁয়ালেন রণধীর। শুধু ছোঁয়ালেন নয়, হাত বুলোলেন প্রায় মিনিটখানেক ধরে। মধ্যপঞ্চাশের শিক্ষক মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করছেন কিশোরী ছাত্রীকে। নেহাতই স্বাভাবিক দৃশ্য। কিন্তু স্বাভাবিক লাগল না সুলেখার। মিষ্টি তো প্লেটে দেওয়াই আছে। নিজে হাতে করে খাইয়ে দেওয়ার কী আছে? যত সব আদিখ্যেতা! মাস্টারেরও বলিহারি, আশীর্বাদ করার নামে অতক্ষণ মাথায় হাত বুলোনোরই বা কী আছে! আর মেয়েও কেমন বলল, যা নম্বর পেয়েছে, সবই নাকি এই গদু মাস্টারের জন্য! ওঁর কাছে পড়িস তো শুধু অঙ্ক! বাকি সাবজেক্টগুলোর নম্বরও কি এই মাস্টারের জন্য নাকি? বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে! গদু মাস্টার পড়াতে এলেই মেয়ে আজকাল যেন খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে, নজর এড়ায়নি সুলেখার। কথাটা বলা দরকার সুভাষকে।
সুভাষ পাত্তাই দিলেন না সুলেখাকে, ‘ধুর, কী যে বলো! ভদ্রলোকের লেট ম্যারেজ। সাত-আট বছরের মেয়ে আছে একটা। আমাদের বুড়ি ওঁর মেয়ের মতো। তা ছাড়া এত ভাল রেজাল্ট করেছে ওঁর কাছে পড়ে। সামনে ইলেভেন-টুয়েলভ। তারপর জয়েন্ট এন্ট্রান্স। ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট এই দুটো বছর। এসময় দুম করে ছাড়িয়ে দেব অঙ্কের মাস্টার? হয় কখনও? তুমি এসব উলটোপালটা ভেবো না তো!’ সুভাষ জানতেন না, ‘এসব উলটোপালটা’ তাঁকেও ভাবতে হবে কিছুদিনের মধ্যেই।
‘ব্যারাকপুর হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল ফর গার্লস’-এ সায়েন্স নিয়ে ভরতি হল সুদীপা। শিক্ষক-ছাত্রীর এমনিতে দেখা হত শুধু পড়ানোর সময়টায়। সে আর কতটুকু? দেড় থেকে দু’ঘণ্টা। কখনও কখনও আড়াই। তার মধ্যে সকলের নজর এড়িয়ে একটুকু ছোঁয়া লাগা, একটুকু কথা শোনা। একান্ত সান্নিধ্যের সিকিভাগও পূরণ হয় না বাড়িতে। রণধীর-সুদীপা দেখা করতে শুরু করলেন ব্যারাকপুরের চিড়িয়া মোড়ে বা রেল স্টেশনে। স্কুল কামাই করতে শুরু করল সুদীপা। রণধীরও সপ্তাহে অন্তত দু’দিন যেতেন না নবাবগঞ্জের স্কুলে। দু’জনে ট্রেনে করে চলে যেতেন কলকাতায়। ভিক্টোরিয়া, চিড়িয়াখানা, ইডেন গার্ডেন্স…। সিনেমা হলের অন্ধকারে একে অন্যের আরও কাছাকাছি আসা।
মেলামেশা যে হারে বাড়ছিল, পরিচিত কারও না কারও নজরে আজ নয় কাল পড়তই। পড়লও। এক প্রতিবেশিনী সুলেখাকে বলে গেলেন, ‘জানো, গদু মাস্টারের সঙ্গে তোমার মেয়েকে কাল দেখলাম চিড়িয়া মোড়ে। রোল খাচ্ছিল দু’জনে।’
সুলেখা চেপে ধরলেন মেয়েকে। সুদীপা বলল, ‘স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখা হয়ে গিয়েছিল স্যারের সঙ্গে। স্যারই রোল খাওয়ালেন।’ দু’-চারটে চড়-থাপ্পড় পড়ল নিয়মমাফিক। কিন্তু সুদীপা নিজের বক্তব্য থেকে নড়ল না একচুলও। সুভাষও সব শুনলেন। খটকা একটা লাগল না, এমন নয়। কিন্তু পাশাপাশি এ-ও ভাবলেন, হতেও তো পারে মেয়ে সত্যিই বলছে। সুলেখাকে বোঝালেন, ‘দেখা হয়েছে, রোল খাইয়েছেন। টিচার স্টুডেন্টকে খাওয়াতেই তো পারে। খারাপটাই ভেবে নিচ্ছ কেন?’ সুলেখা জোর করলেন, ‘ছাড়িয়ে দাও এই মাস্টারকে।’
সুভাষ মানলেন না। ছাড়িয়ে দেওয়াই যায় রণধীরকে । অন্য টিচার পাওয়া যাবে না, এমনও নয়। কিন্তু মেয়েটা হয়তো দুঃখ পেয়ে পড়াই বন্ধ করে দেবে। ভাববে, বাবাও মায়ের কথায় সন্দেহ করে টিউটর ছাড়িয়ে দিল। তা ছাড়া যে দশ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন রণধীর, সেটা শোধ করছেন টিউশনের টাকা থেকে প্রতি মাসে কিছুটা করে কাটিয়ে। এখন অগস্ট, পুরোটা শোধ হতে হতে বছর ঘুরে যাবে। ততদিন অন্তত অপেক্ষা করা যাক চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে। আর সুলেখা চিরদিনই মেয়ের ব্যাপারে অতিরিক্ত ‘পজ়েসিভ’। তিলকে তাল করছে হয়তো অকারণে, যেমন প্রায়ই করে থাকে।
অকারণে যে নয়, শীঘ্রই বোঝা গেল অবশ্য। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সেটা। রণধীর এসেছেন। দোতলার ঘরে পড়াচ্ছেন সুদীপাকে রোজকার মতো। সুলেখা গিয়ে অন্যদিনের মতো চা-বিস্কুটও দিয়ে এসেছেন। রান্নার কাজ সারছেন একতলায়। হঠাৎ খেয়াল হল, পরের দিন নেমন্তন্ন আছে একটা। সন্ধেবেলা সবাই মিলে কল্যাণী যাওয়ার আছে। কাল পড়াতে আসার দরকার নেই, এটা বলে দেওয়া দরকার গদু মাস্টারকে।
ফের উপরে উঠলেন সুলেখা। এবং উঠে দোতলার বসার ঘরে ঢুকে যা দেখলেন, দাঁড়িয়ে পড়লেন স্ট্যাচুবৎ। রণধীর সোফায় শুয়ে পড়েছেন। মাথাটা সুদীপার কোলে। সুদীপা তার স্যারের মাথায় ‘অম্রুতাঞ্জন’ মালিশ করে দিচ্ছে। মুখটা ঝুঁকে পড়েছে রণধীরের মুখের কাছে। দু’জনের ঠোঁটের মধ্যে স্রেফ হাইফেনের ব্যবধান।
মা-কে দেখে যেন ইলেকট্রিক শক খেল সুদীপা। ছিটকে সরে গেল দ্রুত। রণধীর আপ্রাণ চেষ্টা করলেন স্বাভাবিক থাকার, ‘আসলে হয়েছে কী বউদি, মাথাটা খুব ধরেছিল হঠাৎ। শিরাগুলো যেন ছিঁড়ে যাচ্ছিল। তাই সুদীপাকে বললাম…।’
সুলেখা নিজেকে প্রাণপণ সামলালেন, ‘শরীর খারাপ লাগছে যখন, বাড়ি চলে যান। এটা গৃহস্থবাড়ি, ডাক্তারখানা নয়।’ রণধীর ব্যঙ্গটা হজম করে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ক্রোধান্ধ সুলেখা বেল্ট দিয়ে বেদম মারলেন সুদীপাকে। দাগ হয়ে গেল পিঠে। রাতে সুভাষ ফিরতেই সুলেখা তেড়েফুঁড়ে উঠলেন, ‘এই মাস্টারকে বিদেয় করো। পড়াতে এসে নোংরামো শুরু করেছে মেয়ের বয়সি ছাত্রীকে নিয়ে। লম্পট একটা! আর তোমার মেয়েও কম নয়…।’
স্ত্রী একটু শান্ত হতে সুভাষ বোঝালেন, নতুন মাস্টারের খোঁজ শুরু করবেন কাল থেকেই। সন্ধান পেলেই ছাড়িয়ে দেবেন রণধীরকে। টাকা শোধের জন্য অপেক্ষা করার আর প্রশ্নই উঠছে না। তবে সামনে ইলেভেনের অ্যানুয়াল পরীক্ষা। ততদিন সুদীপার পড়ার যাতে ক্ষতি না হয় সেটাও তো মাথায় রাখা দরকার। যতদিন না নতুন মাস্টার পাওয়া যাচ্ছে, বাড়িতে টিউশনির সময়টা একটু চোখে চোখে রাখতে হবে মেয়েকে।
পরের দিন যখন রণধীর ফের পড়াতে এলেন, দু’ঘণ্টায় অন্তত দশবার কোনও না কোনও অজুহাতে ঘরে ঢুকলেন সুলেখা। তার মধ্যেই অবশ্য স্যারকে সুদীপা জানিয়েছে বেল্ট দিয়ে মারের কথা। শুনে রণধীর উত্তেজিতভাবে বলেছেন, ‘এ তো চোরের মার! এমন মা থাকার থেকে না থাকাই ভাল। উনি চান না তোমার ভাল হোক। নেহাত আমার কাছে পড়ে ভাল রেজাল্ট করেছ আর তোমার বাবা আমাকে ছাড়াতে চান না বলে আমাদের দেখা হচ্ছে। কিন্তু যা বুঝছি, তোমার মা আমাকে তাড়িয়ে ছাড়বেন। নষ্ট করে দেবেন তোমার জীবনটা।’ সুদীপা প্রতিটা শব্দ শুনেছে মন দিয়ে। তারপর বলেছে, ‘সেটা আমি হতে দেব না। তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইলে মেরেই ফেলব মা-কে। ডাইনি একটা!’ রণধীরও সম্মতিতে মাথা নেড়েছেন, ‘ঠিক বলেছ। এমন মা থাকার থেকে না থাকাই ভাল। এভাবে চললে তো একটা উপায় বার করতেই হবে। বেশি দেরি করা যাবে না।’
’৯১-এর জানুয়ারির এক বিকেলে যা ঘটল, রণধীর-সুদীপার আর উপায়ও থাকল না বেশি দেরি করার। রণধীরের স্ত্রী অলকা এলেন পালবাড়িতে। তুমুল গালিগালাজ করে গেলেন পাড়াপ্রতিবেশী সবাইকে শুনিয়ে, ‘এমন মেয়ে আমার থাকলে গলায় পা দিয়ে মেরে ফেলতাম। বলিহারি যাই এমন বাপ-মায়ের। বাপের বয়সে মাস্টারের পিছনে মেয়েকে লেলিয়ে দিয়ে মজা দেখছে। আর লাইনেই যদি নামাতে হয়, ভদ্রপাড়ায় কেন? সোনাগাছিতে পাঠান।’
অপমানে সর্বাঙ্গ জ্বলে গিয়েছিল সুলেখার। মেয়ে স্কুল থেকে ফিরে ঘুমচ্ছিল। টেনে তুলেছিলেন চুলের মুঠি ধরে, কিল-চড়-থাপ্পড় খরচ করেছিলেন এলোপাথাড়ি, ‘ঠিকই তো বলে গেল, তোর মতো মেয়েকে পেটে ধরাটাও পাপ। পড়াশুনো করে দিগ্গজ হওয়া বার করছি তোর।’ মারের পর্ব শেষ হওয়ার পর মায়ের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল সুদীপা। অদ্ভুত সে দৃষ্টি! যাতে অভিমান তো নয়ই, ক্ষোভ-রাগ-দ্বেষও নয়, ঠিকরে পড়ছিল স্রেফ প্রতিহিংসা।
সুদীপার সে রাতটা কাটল নিদ্রাহীন, সাত-পাঁচ ভাবনায়। স্যারের স্ত্রীর কী দরকার ছিল বাড়ি বয়ে এসে এইসব বলার? এরপর স্যারকে নির্ঘাত ছাড়িয়েই দেবে বাবা। রোজ তো লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখা করা যায় না বাইরে। বাড়িতে টিউশনির নামে তবু দেখা হত সপ্তাহে চারদিন। স্যারকে না দেখে সে থাকবে কী করে? বাবা বলল, কাল নাকি স্কুলে যাবে। গেলে তো জানতেই পারবে, গত তিন মাসে অর্ধেকদিন স্কুলেই যায়নি সে। মানে, আরও এক প্রস্থ বকাবকি। আবার মারধর।
সারা পৃথিবীটাই শত্রু হয়ে গেছে যেন হঠাৎ। কেউ বাদ নেই। মায়ের বকাঝকায় না হয় তার অভ্যেস হয়ে গেছে। কিন্তু বাবা? যে বাবা কোনওদিন চেঁচিয়ে কথা বলেনি তার সঙ্গে, সেই বাবাও তো তাকে খুব বকেছিল সেদিন। ওই যেদিন স্যারের মাথায় ‘অম্রুতাঞ্জন’ মালিশ করার সময় মা দেখে ফেলেছিল। আজ বাড়ি ফিরে সব শুনে বাবাও কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে। মা তাকে অত মেরেছে জেনেও একবারও কথা পর্যন্ত বলেনি এখনও।
আর দাদু-ঠাকুমাই বা কী! রোজ রাতে শোবার আগে সে একবার দাদু-ঠাকুমার কাছে যায়। ওঁরা আদর করে দেন। তারপর সে উপরে শুতে আসে। আজ রাগে-দুঃখে সে যায়ইনি নীচে। শুয়ে পড়েছে। কই, দাদু-ঠাকুমাও তো উপরে এল না একবার? বাবা ফিরে আসার পর মা যখন চিৎকার-চেঁচামেচি করছিল, দাদু-ঠাকুমাও তো চুপ করে ছিল। কিছু তো বলল না? স্যার ছাড়া আর কেউ তার ভাল চায় না। বাকি সবাই শত্রু, সবাই। মরে যাক, সবাই মরে যাক। তার কাউকে চাই না। শুধু স্যার পাশে থাকলেই হবে।
‘স্যার’ ওদিকে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। বুঝে গিয়েছিলেন, পালবাড়িতে টিউশনির পাট চুকতে চলেছে। পরের দিনই সুভাষ বলে দিলেন সরাসরি, ‘আপনি আর আসবেন না মাস্টারমশাই। নানা কথা রটছে। আমাদের পাড়ায় থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। বুড়িকে আপনার কাছে পড়াচ্ছিলাম, যাতে এইচএস-এ রেজাল্টটা ভাল করে। জয়েন্টে চান্স পায়। আজ ওর স্কুলে গিয়ে জানলাম, ও গত কয়েক মাসে স্কুলে যায়ইনি অর্ধেকদিন। আপনার ব্যাপারেও খোঁজখবর করলাম। শুনলাম, টানা অ্যাবসেন্ট করার জন্য আপনারও চাকরি গেছে নবাবগঞ্জের স্কুল থেকে। আপনি আমার মেয়ের অনেক ক্ষতি করেছেন। দোহাই, আর করবেন না। আমাদের পরিবারের সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগ না রাখলেই খুশি হব।’
সুভাষ কিসে খুশি হবেন না হবেন, সে নিয়ে তখন মাথা ঘামানোর সময় ছিল না রণধীর-সুদীপার। পাছে স্কুল থেকে বাবাকে জানিয়ে দেয়, তাই সপ্তাহখানেক নিয়মিত ক্লাস করল সুদীপা। তারপর ফের রণধীরের সঙ্গে লুকিয়ে দেখা শুরু করল। মার্চের শুরুর দিকে একদিন ছাত্রীর হাতে একটা কাগজের প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন রণধীর। বললেন, ‘তোমার মায়ের তো বলেছ হজমের সমস্যা। রোজ রাতে ইশবগুল খেতে হয়। এই প্যাকেটের মধ্যে কিছু গুঁড়ো আছে। সেটা আজ রাতে ওই ইশবগুলের মধ্যে মিশিয়ে দিয়ো।’
—কী আছে এতে?
—পথের কাঁটা সরানোর ওষুধ। চল্লিশটা ক্যামপোজ় ট্যাবলেট গুঁড়ো করা আছে এতে। খেলে আর ঘুম ভাঙবে না তোমার মায়ের। কেউ যাতে দেখে না ফেলে, এইভাবে মিশিয়ে দিয়ো। লোকে ভাববে তোমার মা সুইসাইড করেছেন। মিটে গেল।
সুদীপা চুপচাপ শুনল। বাড়ি নিয়েও গেল ওই প্যাকেট। কিন্তু ওই গুঁড়ো ইশবগুলের গ্লাসে মেশানোর সাহস হল না শেষ পর্যন্ত। যা শুনে পরের দিন রণধীর হালকা বকাবকিই করলেন সুদীপাকে, ‘দেখো, এভাবে কিন্তু বেশিদিন চলবে না। তুমি তো জানোই, তোমাকে নিয়ে আমার বাড়িতেও সমস্যা হচ্ছে। শুধু তোমাকে নিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে চাই বলে বাড়ির রোজকার অশান্তিও সহ্য করে চলেছি। এখন তুমি যদি সামান্য ঘুমের ওষুধ মেশাতেও এত নার্ভাস হয়ে পড়ো, তা হলে তো মুশকিল। তা ছাড়া আমি ভেবে দেখলাম, শুধু তোমার মা মারা গেলে আমাদের কোনও লাভ হবে না। তোমার বাবা কিছুতেই আমাদের আর মিশতে দেবেন না। তোমার দাদু-ঠাকুমাও বাধা দেবেন। ওঁরা বেঁচে থাকলে আমাদের একসঙ্গে থাকার স্বপ্নটা আর বেঁচে থাকবে না। এখন তোমাকে ঠিক করতে হবে তুমি কোনটা চাও। তুমি না চাইলে আমি আর যোগাযোগ রাখব না তোমার সঙ্গে।’
কিশোরীবেলার মোহ যে কী মারাত্মক বস্তু! সুদীপা এক সেকেন্ডও ভাবল না উত্তর দিতে, ‘তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তুমি যেমনটা বলবে, তেমনটাই করব। এবার পারিনি, পরের বার ঠিক পারব। দেখে নিয়ো তুমি।’ রণধীর বুকে টেনে নিলেন ছাত্রীকে। নিজের শরীরের সঙ্গে সুদীপাকে মিশিয়ে নিতে নিতে মনে মনে ঝালিয়ে নিলেন পরবর্তী করণীয়। কালই দেখা করতে হবে কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে। ফুলবাগানের সত্যবাবুর দোকানে যেতে হবে। আগে এক্সপেরিমেন্ট করে নিশ্চিত হয়ে নেওয়াটা জরুরি। বিষ বলে কথা!
সোডিয়াম সায়ানাইড আর মারকিউরিক ক্লোরাইড। রণধীরের অনুরোধে জোগাড় করে দিলেন কৃষ্ণেন্দু। কৃষ্ণেন্দু জানা, বহুদিনের পরিচিত রণধীরের। নোয়াপাড়ারই একটি স্কুলে কেমিস্ট্রির ল্যাবরেটরিতে অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করেন বছর পঁয়তাল্লিশের কৃষ্ণেন্দু। কলেজ স্ট্রিটে ‘Scientronic India’ নামের একটা ছোট দোকানও আছে। নানান ধরনের রাসায়নিক সামগ্রীর দোকান। খুব যে আমদানি হয় সে দোকান থেকে, এমন নয়।
কৃষ্ণেন্দুকে সব খুলে বলেছিলেন রণধীর। টোপ দিয়েছিলেন, ‘কাজটা হয়ে গেলে ভাগ্য খুলে যাবে আমাদের। পুরো সম্পত্তি মেয়েটাই পাবে। গয়নাগাটিই যা আছে শুনেছি, পাঁচ-দশ লাখ টাকার হবে। মেয়েটার বাবা রিসেন্টলি এনএসসি করেছে ছ’লাখ টাকার। বোঝ একবার ব্যাপারটা! একটা মোটা অঙ্কের শেয়ার তুইও পাবি। লাইফ বদলে যাবে।’
টাকার অঙ্ক শুনে মাথা ঘুরে গিয়েছিল কৃষ্ণেন্দুর। রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। বিষের ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু প্রয়োগ করে নিশ্চিত হওয়াটা? ফুলবাগানে সত্য ঘোষের দোকানে রণধীরকে নিয়ে গিয়েছিলেন কৃষ্ণেন্দু। পশুপাখি নিয়েই সত্যবাবুর কারবার। দোকান থেকে কয়েকটা গিনিপিগ কিনেছিলেন রণধীর। সুদীপার সঙ্গে সেদিনই প্ল্যানমাফিক দেখা করেছিলেন ব্যারাকপুর আর্মি ক্যান্টনমেন্টের সামনে। দুটো ছোট শিশি দিয়েছিলেন সুদীপাকে। যাতে ছিল সোডিয়াম সায়ানাইড আর মারকিউরিক ক্লোরাইড। আর দিয়েছিলেন গিনিপিগগুলো, ‘এগুলো বাড়িতে নিয়ে যাও। বলবে, বায়োলজির প্র্যাকটিকালে ডিসেকশন-এর জন্য লাগবে। বিষটা কাল দিয়ে দেখবে, গিনিপিগগুলো মরে কিনা।’
মরল। বিষক্রিয়ায় তিনটে গিনিপিগই মরল। মৃত গিনিপিগগুলো সুদীপা ভোরবেলায় ফেলে দিয়ে এল বাড়ির লাগোয়া মাঠে।
কৃষ্ণেন্দুও আলাদাভাবে পরীক্ষা চালিয়েছিলেন গিনিপিগের উপর। এবং রণধীরকে জানিয়েছিলেন, এ বিষ মনুষ্যদেহে প্রবেশ করার মিনিটখানেকের মধ্যেই মৃত্যু অবধারিত।
১৮ মার্চের দুপুর। সুদীপার সঙ্গে রণধীর দেখা করলেন টালা ব্রিজের কাছে। শেষবারের মতো যাচাই করে নিলেন সুদীপার মন, ‘তুমি পারবে তো? ভেবে নিতেই পারো, এখনও সময় আছে। পরে দোষ দেবে না তো আমাকে? তুমি যদি এতে রাজি না-ও হও, আমি তোমাকে এখন যেমন ভালবাসি, সারাজীবন তেমনই বাসব। দেখাসাক্ষাৎ না হয় না-ই বা হল।’
রণধীর বিলক্ষণ জানতেন, কী প্রতিক্রিয়া হবে মোহগ্রস্ত কিশোরীর। জানতেন, ব্যাকুল হয়ে তাঁর হাত চেপে ধরবে সুদীপা, ‘না না স্যার, কী বলছেন আপনি? আমি রেডি।’ রণধীর নিজের হাতে সুদীপার হাতটা তুলে নিলেন, ‘আমি জানতাম সোনা, তুমি পারবে। সব মনে আছে তো তোমার? তা হলে কাল বাদে পরশু।’
কাল বাদে পরশু। ২০ মার্চ, ১৯৯১। বুধবার। ব্যারাকপুর স্টেশনে সকালে দেখা করলেন সুদীপা-রণধীর। ট্রেনে করে শিয়ালদা। সেখান থেকে বাসে ধর্মতলা। কে সি দাশের মিষ্টির দোকান থেকে পাঁচটা কালোজাম আর একশো গ্রাম সীতাভোগ কিনলেন রণধীর। দুপুরের খাওয়াটা দু’জনে সারলেন তালতলার এক হোটেলে। খেতে খেতেই সুদীপাকে পাখিপড়া করে বোঝালেন প্ল্যানের খুঁটিনাটি। শেষে বললেন, ‘মনকে শক্ত করো। দেখবে, আমরা নতুন করে বাঁচব।’
উত্তর দিতে গিয়ে গলা সামান্য কেঁপে গেল সুদীপার, ‘হ্যাঁ।’ সে কম্পন টের পেলেন রণধীর। এবং উপেক্ষা করলেন। ফিরে যাওয়ার আর রাস্তা নেই। সব ঠিকঠাক চললে পালবাড়ির যাবতীয় সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ আসতে চলেছে তাঁর হাতে।
নোয়াপাড়া ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল রণধীর-সুদীপার। বাড়ি ফিরলেন দু’জনেই। পালবাড়ির সদর দরজা সাধারণত রাত ন’টা থেকে সাড়ে ন’টার আগে বন্ধ হয় না। ভেজানোই থাকে দরজা। রাত পৌনে আটটায় রণধীর ঢুকলেন পালবাড়িতে। হাতে দুটো মিষ্টির বাক্স। কাঁধে একটা ব্যাগ। সুলেখা তখন একতলার রান্নাঘরে। একতলাতেই নিজেদের ঘরে রয়েছেন দেবেন্দ্র-লতিকা। টিভি দেখছেন। সুভাষ আছেন দোতলায় নিজেদের শোবার ঘরে। কাজ সেরে ফিরেছেন একটু আগে। খাটে শুয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন।
রণধীর সোজা উঠে গেলেন সিঁড়ি দিয়ে দোতলায়। সুদীপা অপেক্ষাতেই ছিল। প্ল্যানমতো রান্নাঘর থেকে আগেই একটা থালা এনে রেখে দিয়েছিল নিজের দোতলার ঘরে। থালা হাতে মেয়ে আর মিষ্টির প্যাকেট হাতে গদু মাস্টার, দু’জনকে একসঙ্গে ঘরে ঢুকতে দেখে উঠে বসলেন সুভাষ। অবাক যতটা, তার থেকেও বেশি বিরক্ত। টিউশনি ছাড়িয়ে দেওয়ার পর এই প্রথম রণধীর এলেন এবাড়িতে। কোনওরকম যোগাযোগ না রাখতে তিনি যথেষ্ট কড়াভাবেই বলে দিয়েছিলেন রণধীরকে। তা সত্ত্বেও এভাবে বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ হাজির?
—না জানিয়ে এভাবে চলে এলাম সুভাষবাবু, ক্ষমা করবেন। আসলে আমি নতুন কাজ পেয়েছি একটা। বেলঘরিয়ার একটা স্কুলে হেড মাস্টারের চাকরি। আগামী পরশু জয়েন করব। আপনাদের বাড়ির সঙ্গে এতদিনের সম্পর্ক, তাই একটু মিষ্টি নিয়ে এলাম। আমি আর কখনও এই বাড়িতে আসব না, কথা দিচ্ছি। কোনও ভুল-বোঝাবুঝি রাখবেন না মনে প্লিজ়।
রণধীরের কথায় সুভাষ সামান্য অপ্রস্তুত। ততক্ষণে মিষ্টির বাক্স খুলে ফেলেছেন রণধীর। কালোজাম আর সীতাভোগ সুদীপা দ্রুত সাজিয়ে ফেলেছে থালায়। একটা কালোজাম সুভাষের হাতে ধরিয়েও দিয়েছে সুদীপা। মিষ্টি মুখে পুরলেন সুভাষ। এবং তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে মুখ বিকৃত হয়ে গেল যন্ত্রণায়। নীলাভ হয়ে এল শরীর। প্রতিটা কালোজামের উপরের পুরু অংশটা অল্প একটু ভেঙে সোডিয়াম সায়ানাইড আর মারকিউরিক ক্লোরাইড ভিতরে ভরে এনেছিলেন রণধীর। সীতাভোগেও ছিল বিষ মাখানো।
বিষ কাজ করল অব্যর্থ। একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারলেন না সুভাষ। ঢলে পড়লেন খাটেই। সুদীপা নির্বিকার সাক্ষী থাকল বাবার মৃত্যুর।
এবার টার্গেট সুলেখা। রান্নাঘরে রণধীর-সুদীপাকে ঢুকতে দেখে হকচকিয়ে গেলেন সুলেখা। সুভাষকে যা বলেছিলেন একটু আগে, সেটাই রণধীর বললেন সুলেখাকে। সঙ্গে যোগ করলেন, ‘আমি সত্যিই অনুতপ্ত বউদি, প্লিজ় রাগ করে থাকবেন না। একটা মিষ্টি অন্তত খান, না হলে খুব দুঃখ পাব।’ সুলেখাও অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন রণধীরকে দেখে। তবু ভদ্রতার খাতিরে থালা থেকে একটা কালোজাম নিয়ে কামড় দিলেন। সুলেখা চিৎকার করতে পারেন, এই আশঙ্কায় ক্লোরোফর্মে ভেজানো রুমাল ব্যাগে এনেছিলেন রণধীর। সেটাও চেপে ধরলেন সুলেখার মুখে। স্বামীর মতোই পরিণতি হল সুলেখার। মৃত্যু এল চকিতে। সাক্ষী থাকল একমাত্র সন্তান।
রইল বাকি দুই। দেবেন্দ্রমোহন আর লতিকা। নাতনির সঙ্গে রণধীরকে ঢুকতে দেখে অবাক ওঁরাও। ওই একই নতুন চাকরির গল্প শোনালেন রণধীর। এবং ঠাকুমার মুখে কালোজাম গুঁজে দিল নাতনি। স্ত্রীর সারা শরীর যন্ত্রণায় দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে দেখে বিপদের আঁচ পেলেন দেবেন্দ্রমোহন। আধশোয়া অবস্থায় ছিলেন। উঠে বসতে গেলেন, কিন্তু পারলেন না। রণধীর এক ধাক্কায় ঠেলে শুইয়ে দিলেন খাটে। চেপে ধরলেন হাত দুটো। জোর করে দাদুর মুখে সীতাভোগ ঠুসে দিল সুদীপা।
চারজন জলজ্যান্ত মানুষ মিনিটপাঁচেকের মধ্যেই লাশ হয়ে গেলেন। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল প্রায় একটা আস্ত পরিবার। সেই পরিবারেরই নাবালিকা মেয়ে আর তার প্রৌঢ় মাস্টারমশাইয়ের ষড়যন্ত্রে!
কাজ তখনও বাকি ছিল। ছকও কষাই ছিল। কাঁধের ব্যাগ থেকে রণধীর বের করলেন তামার তারের গোছা। পেঁচিয়ে বাঁধলেন চারজনের দেহে। তারের অন্য প্রান্ত গুঁজে দিলেন কাছাকাছির ইলেকট্রিক প্লাগ পয়েন্টে। যাতে মনে হয়, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েই মৃত্যু। পুড়ে গেল দেহগুলোর কিছু অংশ। এরপর একতলা-দোতলায় যত আলমারি-দেরাজ ছিল, তা থেকে জিনিসপত্র বের করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিলেন রণধীর। পুরোটাই করলেন সঙ্গে আনা গ্লাভস পরে, যাতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট না পাওয়া যায় কোথাও। ডাকাতির চেহারা দেওয়া হল গোটা বাড়িতে।
সুদীপা মিষ্টির থালাটা সন্তৰ্পণে ফেলে এল বাড়ি-সংলগ্ন মাঠের এক প্রান্তে, ঘন ঝোপঝাড়ের মধ্যে। তারপর ব্যাগে রাখা দড়ি দিয়ে সুদীপাকে পিছমোড়া করে বাঁধলেন রণধীর। মুখেও বাঁধলেন কাপড়। যা নিয়ে এসেছিলেন ব্যাগেই। রাত পৌনে এগারোটা নাগাদ সদর দরজার বাইরে ফেলে এলেন সুদীপাকে, ‘আমি চললাম, আরও অন্তত ঘণ্টাখানেক চুপচাপ থেকে তারপর আওয়াজ কোরো। পুলিশকে কী বলতে হবে, ভুলে যেয়ো না।’
আওয়াজের উৎস প্রতিবেশীরা আবিষ্কার করলেন মধ্যরাতে। পুলিশ এল। সম্পন্ন ব্যবসায়ী পরিবারের চারজন খুন। বাড়ির একমাত্র কিশোরী কন্যা উদ্ধার হাত-পা-মুখ বাঁধা অবস্থায়। শোরগোল পড়ে গেল। ঘটনার আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে মামলার দায়িত্ব নিল সিআইডি। ইছাপুরের ‘পালবাড়ি’ রাতারাতি পরিণত হল দ্রষ্টব্য স্থানে।
.
সিআইডি-র তরফে তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন সাব-ইনস্পেকটর দুলাল সোম। ইনস্পেকটর দেবব্রত ঠাকুর ছিলেন তত্ত্বাবধানে। ক্লোরোফর্মের একটা শিশি, কিছু তুলো আর লাশে জড়ানো তামার তার ছাড়া বলার মতো উল্লেখযোগ্য কিছু বাজেয়াপ্ত হয়নি পালবাড়ি থেকে। ভাবা গিয়েছিল, হাতের ছাপ কিছু অন্তত পাওয়া যাবে ঘরের আলমারি-দেরাজ থেকে। পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে যথেষ্ট ধোঁয়াশা ছিল। বলা হয়েছিল, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে। তবে দেহের কাটাছেঁড়া করে যা দেখা গেছে, বিষক্রিয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ‘viscera’ (দেহের অঙ্গাংশ, মূলত বুক এবং পেটের) সংরক্ষিত করে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। নির্দিষ্ট মতামত মেলেনি প্রাথমিক পোস্টমর্টেম রিপোর্টে। বিভ্রান্তি থেকেই গিয়েছিল।
বিভ্রান্তি বাড়াচ্ছিল সুদীপাও। ঘটনার পরের দিন পিসি-পিসেমশাই নিজেদের উত্তর কলকাতার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন সুদীপাকে। কখনও সেখানে গিয়ে সুদীপার সঙ্গে কথা বলতেন তদন্তকারীরা, কখনও গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে আসা হত সিআইডি-র নৈহাটির অফিসে। সুদীপাই ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী আপাতদৃষ্টিতে। তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে কল্পনাতীত ছিল, প্রাইভেট টিউটরের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে নিজের মা-বাবা-দাদু-ঠাকুমাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে পারে সতেরো বছরের কোনও নাবালিকা! আততায়ীদের সন্ধান পেতে সুদীপার বয়ানের উপরেই ভরসা করা ছাড়া উপায়ান্তর ছিল না পুলিশের। যখন নৈহাটির অফিসে সুদীপার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতেন অফিসাররা, খুবই সতর্ক থাকতেন, যাতে মেয়েটির মনের উপর কোনওরকম চাপ না পড়ে। যতটা স্বাচ্ছন্দ্যে রাখা যায় সদ্য পরিবার-হারা কিশোরীকে, সে চেষ্টায় ত্রুটি রাখতেন না তদন্তকারীরা। ‘আহা রে, একেবারে অনাথ হয়ে গেল বেচারি’—এই ছিল মনোভাব।
সুদীপা শুরুতে গল্পটা যেভাবে সাজিয়েছিল, বলি। সাত-আটজন দশাসই চেহারার লোক রাত্রে ঢুকে পড়েছিল বাড়িতে। সবার হাতে ছুরি বা পিস্তল ছিল। এদের সবারই মুখ বাঁধা ছিল। এদের সঙ্গে সুভাষের তর্কাতর্কি হয় চোরাই সোনাদানা নিয়ে। সুভাষ নাকি গোপনে সোনার চোরাচালানের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। রাতের দিকে মাঝেমাঝেই সুভাষের কাছে কিছু লোক আসত। চোরাই জিনিসপত্র নিয়ে আলোচনা করত। এরাই সম্ভবত এসেছিল। ওরা সুভাষের কাছে পাওনাগন্ডার হিসেব চায়। তর্কাতর্কি হয় কিছুক্ষণ। তারপর ওরা ছুরি-পিস্তল তুলে সবাইকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। ঘরদোরের আলমারি সব তছনছ করে। টাকাপয়সা-গয়নাগাটি সব নিয়ে ব্যাগে পুরে নেয়। সুভাষ একসময় বলেন, ‘পুলিশকে জানিয়ে দিলে তোরা বাঁচবি ভেবেছিস?’ তখন ডাকাতরা বাবা-মা-দাদু-ঠাকুমার মুখ চেপে ধরে শরীরে তামার তার জড়িয়ে প্লাগ পয়েন্টে লাগিয়ে দেয়। আর সুদীপাকে বেঁধে ঘরের বাইরে ফেলে রেখে যায়।
এই প্রাথমিক বয়ানে সুদীপা অনড় ছিল দিন দশেক। তারপর ফের গল্প ফাঁদে কোনও এক ‘স্বপন’-এর। বলে, এখন মনে পড়েছে, যারা এসেছিল ডাকাতি করতে, তাদের মধ্যে একজনকে নাকি সুভাষ ‘স্বপন’ বলে ডেকেছিলেন। ‘স্বপন’ নামে কোনও দাগি ডাকাত আছে কিনা, সেই খোঁজে ছুটে বেড়ালেন সিআইডি অফিসাররা। তুলেও আনা হল ডাকাতির পূর্ব-ইতিহাস থাকা দু’জন ‘স্বপন’-কে। যাদের জেরা করে আধঘণ্টার মধ্যেই বোঝা গেল, কোনওভাবেই এরা যুক্ত নয় এই ঘটনার সঙ্গে।
‘স্বপন’-পর্ব মিটে গেলে সুদীপার মুখে উঠে এল কোনও এক ‘খান্না আঙ্কল’-এর কথা। যাঁর সঙ্গে সুভাষ নাকি পাথরের ব্যবসায় নামার কথা ভাবছিলেন। বিনিয়োগও করেছিলেন মোটা অঙ্কের টাকা। খোঁজখবর করা হল এ নিয়েও। কিছুই পাওয়ার কথা ছিল না। পাওয়া গেলও না।
নৈহাটির অফিসে জিজ্ঞাসাবাদের সময় রণধীর প্রায়ই দেখা করতে আসতেন সুদীপার সঙ্গে। দীর্ঘদিনের গৃহশিক্ষক ছিলেন, বয়সে পিতৃতুল্য, আসতেই পারেন, একেবারে শুরুর দিকে এমনই ভেবেছিল পুলিশ। কয়েকদিন পরেই অবশ্য স্থানীয় মানুষের কানাঘুষোয় তদন্তকারী অফিসাররা জানলেন, শিক্ষক-ছাত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্কের গণ্ডি ছাড়িয়েছিলেন রণধীর-সুদীপা। এ নিয়ে পালবাড়ির সামনে প্রকাশ্য অশান্তিও করেছিলেন রণধীর-পত্নী অলকা।
পুলিশ বুঝতে পারছিল, সুদীপার এই ঘনঘন বয়ান বদলানোটা অত্যন্ত গোলমেলে। মেয়েটা মিথ্যে বলছে, লুকচ্ছে অনেক কিছু। একবার বলছে, বাবা চোরাই সোনাদানার ব্যবসায় যুক্ত ছিল। একবার বলছে, বাবার পাথরের ব্যবসাও ছিল। কখনও ‘স্বপন’-এর নাম বলছে, কখনও আবার ‘খান্না আঙ্কল’-এর, যাদের কারও অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া ডাকাতরা এসে একটা পরিবারের চারজনকে মেরে লুঠপাট করে গেল, অথচ পরিবারেরই একজনকে ছেড়ে দিয়ে গেল? যে কিনা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, যাকে বাঁচিয়ে রাখলে বরং চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা? সুদীপার গল্পে গোড়াতেই গলদ ছিল বিস্তর। কিন্তু শোকে মুহ্যমান এক নাবালিকাকে কড়া ধাঁচের পুলিশি জেরাও করা যাচ্ছিল না। দুটোর বেশি তিনটে পালটা প্রশ্ন করলেই কেঁদে ফেলছিল।
রণধীরের সঙ্গে সম্পর্কজনিত কোনও গল্প আছে ঘটনার নেপথ্যে? যদি বা থাকে, প্রমাণ কই? তা ছাড়া ওই পঞ্চান্ন বছরের একটা সিড়িঙ্গেমার্কা লোক আর সতেরো বছরের একটা মেয়ে মিলে চার-চারটে লোককে মেরে ফেলা কি সোজা নাকি? কীভাবে মারবে? কোনও চিৎকার-চেঁচামেচি কেউ শুনল না, কেউ কোনও প্রতিরোধের চেষ্টা করলেন না, চারটে মানুষ স্রেফ লাশ হয়ে গেলেন? কীভাবে সম্ভব?
কীভাবে সম্ভব, তার একটা আভাস প্রথম পেলেন সিআইডি-র তরুণ সাব-ইনস্পেকটর প্রবীর সান্যাল। যিনি তদন্তকারীদের ‘কোর’ টিমে যোগ দিয়েছিলেন ঘটনার মাসখানেক পর। প্রবীরের সুবিধে ছিল, বাড়ি নৈহাটিতে। নোয়াপাড়া-জগদ্দল-নৈহাটি, এই অঞ্চলের বহু মানুষকে চিনতেন, জানতেন। পরিচিতি ছিল সর্বস্তরে। এমনই এক পরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গে একদিন সান্ধ্য আলাপচারিতার মধ্যে কথায় কথায় বেরিয়ে এল না-জানা তথ্য। ভদ্রলোক বললেন, ‘কী ট্র্যাজিক, না? একটা পরিবার শেষ হয়ে গেল। একটা মেয়ে একরাতের মধ্যে অনাথ হয়ে গেল পুরোপুরি। আমরা তো ওই পাড়াতেই থাকি। মেয়েটার সঙ্গে রেবার দেখা হয়েছিল ইনসিডেন্টটার কয়েকদিন আগেই। পালবাড়ির পাশের মাঠে মর্নিং ওয়াকের সময়। কী একটা গিনিপিগ না কি ফেলতে এসেছিল।’
গিনিপিগ? সুদীপা ফেলতে এসেছিল বাড়ির পাশের মাঠে? স্নায়ু মুহূর্তে সজাগ হয়ে উঠেছিল প্রবীরের। রেবা মানে ওই ভদ্রলোকের স্ত্রী, যাঁর সঙ্গে সেদিনই কথা বললেন প্রবীর, ঠিক কী হয়েছিল? রেবা জানালেন, পালবাড়িতে ওই মর্মান্তিক ঘটনার কয়েকদিন আগে মর্নিং ওয়াকের সময় মাঠে সুদীপার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর। সুদীপা একটা পলিথিনের প্যাকেট থেকে মাঠে কিছু একটা ফেলছিল। রেবা স্বাভাবিক কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কী রে, কী খবর? কী ফেলছিস?’ সুদীপা বলেছিল, ‘এই তো কাকিমা, বায়োলজির প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার জন্য দুটো গিনিপিগ ছিল বাড়িতে। মরে গেছে। ফেলতে এসেছি।’
ইতিমধ্যে পুলিশের হাতে এসে গিয়েছিল ফরেনসিক-বিশেষজ্ঞ প্রোফেসর ড. রবীন বসুর রিপোর্ট। যাতে পরিষ্কার লেখা ছিল, ভিসেরায় বিষক্রিয়ার স্পষ্ট চিহ্ন পাওয়া যায়নি ঠিকই । কিন্তু তার মানে এই নয়, যে বিষ প্রয়োগ হয়নি। সময়ের ব্যবধানে ভিসেরায় না-ই পাওয়া যেতে পারে বিষচিহ্ন, কিন্তু সেক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে ময়নাতদন্তের সময় দেহে পাওয়া লক্ষণসমূহে। যা এক্ষেত্রে পরিষ্কার জানান দিচ্ছে, ‘সায়ানাইড’ গোত্রের বিষ মৃতদের দেহে ঢুকেছিল।
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নয়, বিষেই মৃত্যু। কীভাবে মেশানো হল বিষ? আর সুদীপার বাড়িতে গিনিপিগই বা এল কী করে? পোষার জন্য কেউ গিনিপিগ রাখে না বাড়িতে। তা ছাড়া স্কুল থেকে কখনও গিনিপিগ সরবরাহ করা হয় ছাত্রছাত্রীদের, বাড়িতে কাটাছেঁড়ার জন্য? কেউ কখনও শুনেছে? গিনিপিগগুলো মরলই বা কী করে? পরীক্ষানিরীক্ষা? বিষ প্রয়োগ?
যে সুদীপা এতদিন নানা আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে চলেছিল লাগাতার, কখনও কেঁদে, কখনও সারাদিন অভুক্ত থেকে, কখনও শোকস্তব্ধতার অভিনয় করে পুলিশকে বিভ্রান্ত করে চলেছিল, ‘গিনিপিগ-প্রসঙ্গ’ উঠতেই সেই সুদীপা আমতা-আমতা করতে শুরু করল। চোখেমুখে স্পষ্টতই দেখা দিল ভয়-দুশ্চিন্তা-আতঙ্ক। এরপর ঘণ্টাখানেকের জিজ্ঞাসাবাদ এবং স্বীকারোক্তি। স্তব্ধ হয়ে শুনলেন অফিসাররা। এমন ঘটনা এরাজ্যে এর আগে হয়নি নিশ্চিত। সম্ভবত দেশেও হয়নি। কী-ই বা বিশেষণ ব্যবহার করা যায়, ‘বিরলতম’ ছাড়া?
যে থালায় কালোজাম-সীতাভোগ সাজিয়েছিল সুদীপা, সেটা উদ্ধার হল বাড়ির লাগোয়া মাঠের ঝোপের মধ্যে থেকে। ফরেনসিক পরীক্ষায় সেই থালায় পাওয়া গেল সায়ানাইড গোত্রের বিষকণা। গ্রেপ্তার হলেন সুদীপা-রণধীর-কৃষ্ণেন্দু। খুন, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, অপরাধে সহায়তা এবং প্রমাণ লোপাটের মামলা দায়ের হল তিন ধৃতের বিরুদ্ধে। রণধীর-কৃষ্ণেন্দু সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেন ঘটনার সঙ্গে তাঁদের কোনওরকম সংস্রব।
সুদীপা সবটাই খুলে বলেছিলেন পুলিশকে দেওয়া জবানবন্দিতে। কিন্তু মুশকিল হল, পুলিশকে দেওয়া বয়ান আদালতে প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হয় না, যদি না সেই বয়ানের সত্যতা অন্য সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে তর্কাতীতভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। সুদীপা এখন যা বলছে, সেটা পরে কোর্টে অস্বীকার করলে মামলা বিশ বাঁও জলে চলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। এখন পর্যন্ত যা খেল দেখিয়েছে এই মেয়ে, কিছুই অসম্ভব নয়। সুদীপার স্বীকারোক্তিই এই মামলার বুনিয়াদ। যা একেবারেই অটুট থাকবে না, যদি সুদীপা কোর্টে হেরফের করে বয়ানের। দোষীদের সাজা হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে এক ধাক্কায়। আবার, পুলিশকে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে অনড় থাকলে নিজেকেও যে জেলে পচে মরতে হবে, সেটা না বোঝার মতো বোকা ছিল না সুদীপা। বারবার বলত প্রবীরকে, ‘আমি তো সব স্বীকার করেছি… সব বলে দিয়েছি… কিন্তু সে জন্য আমার ফাঁসি হবে না তো?’ অফিসাররা আশঙ্কায় ছিলেন সুদীপার মতিগতি নিয়ে।
একটাই উপায় ছিল এই আশঙ্কা দূর করার। সেটাই প্রয়োগ করা হল। দেবব্রত-দুলাল-প্রবীররা বোঝালেন সুদীপাকে, ‘সারাটা জীবন পড়ে আছে তোমার সামনে। সেটা যাতে জেলে পচে নষ্ট না হয়, সেটা নিশ্চিত করার একটাই পথ আছে। রাজসাক্ষী হয়ে যাও। আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করো। আইনে বিধি আছে, রাজসাক্ষীদের অপরাধ মকুব হয়ে যায়। ভেবে দেখো ভাল করে। যা করেছ, সাজা হবেই। হয় ফাঁসি, নয় যাবজ্জীবন। তার চেয়ে দোষ স্বীকার করে নেওয়া ভাল নয় কি? বিচার শেষ হওয়া পর্যন্ত জেলে থাকতে হবে, এই যা। মাত্র কয়েক বছরের ব্যাপার। তারপরই ছাড়া পেয়ে যাবে। সেটাই নিয়ম।’
সুদীপা রাজি হল। রাজসাক্ষী হিসেবে বয়ান দিল আদালতে। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারার প্রয়োগে সুদীপাকে ক্ষমা করলেন বিচারক। আইনি পরিভাষায় যাকে বলে ‘Tender of pardon’। এই মামলায় সুদীপা আর অভিযুক্ত থাকল না আইন অনুযায়ী। ক্ষমাপ্রাপ্তির পর স্রেফ সাক্ষী। শুধু সাক্ষী নয়, রাজসাক্ষী।
তদন্তকারী অফিসার দুলাল সোম ৯১-এর ২০ ডিসেম্বর পেশ করেছিলেন চার্জশিট। যে চার্জশিটের মূল ভিত্তিভূমিই ছিল রাজসাক্ষী সুদীপার স্বীকারোক্তি। যে বয়ানের সমর্থনে সংগৃহীত হয়েছিল প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ।
ফুলবাগানের যে দোকান থেকে গিনিপিগ কিনেছিলেন রণধীর-কৃষ্ণেন্দু, তার মালিক আদালতে চিহ্নিত করেছিলেন দুই অভিযুক্তকে। কে সি দাশ-এর দোকানের এক কর্মচারীও মনে করতে পেরেছিলেন এক দোহারা চেহারার প্রৌঢ় ভদ্রলোককে, যাঁর সারা মুখে শ্বেতির দাগ। এক কিশোরীকে সঙ্গে নিয়ে এসে যিনি কালোজাম আর সীতাভোগ কিনেছিলেন মার্চের এক দুপুরে। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য আরও ছিল। সুদীপার স্কুলের অ্যাটেনডেন্স শিট, রণধীরের স্কুলের হাজিরা-খাতা। পাশাপাশি রাখলেই বোঝা যাচ্ছিল, একই দিনে ‘অ্যাবসেন্ট’ হতেন দু’জন। অলকা যে পালবাড়িতে অশান্তি করেছিলেন দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে, একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী ছিল তার।
রণধীরের বাড়ি থেকে তামার তারও পাওয়া গিয়েছিল কয়েক গোছা, যা মৃতদেহগুলির সঙ্গে পেঁচিয়ে রাখা তারের গঠনের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল হুবহু। সুদীপা বাড়ির যে সব গয়না চুরি করে দিত স্যারকে, সেগুলো স্থানীয় এক দোকানে বন্ধক রেখে টাকা নিতেন রণধীর। চিহ্নিত হয়েছিল সেই দোকান। উদ্ধার হয়েছিল গয়না। সাক্ষ্য দিয়েছিলেন দোকানি।
প্রায় পাঁচ বছরের বিচারপর্ব শেষে জেলা আদালত রায় দিয়েছিল ৯৬-এর ৯ অগস্ট। রণধীর-কৃষ্ণেন্দুকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন বিচারক। রাজসাক্ষীদের ক্ষেত্রে যা প্রথা, বিচারপর্ব শেষে সুদীপা মুক্তি পেয়েছিল জেলজীবন থেকে। রণধীর-কৃষ্ণেন্দু হাইকোর্টে গিয়েছিলেন। যেখানে বহাল থেকেছিল ফাঁসির হুকুম। সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন দুই সাজাপ্রাপ্ত। সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল-জবাব চলেছিল প্রায় দেড় বছর। ফাঁসির সাজা শেষ পর্যন্ত কমে দাঁড়িয়েছিল যাবজ্জীবন কারাবাসে।
একদিকে রণধীর-কৃষ্ণেন্দুর দোষী সাব্যস্ত হওয়া, অন্যদিকে রাজসাক্ষী সুদীপার মুক্তি, কম বিতর্ক হয়নি সে সময় এ নিয়ে। এটা কেমন বিচার হল? মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে চক্রান্ত করে একটা সতেরো বছরের মেয়ে ঠান্ডা মাথায় বিষ খাইয়ে মেরে ফেলল মা-বাবা-দাদু-ঠাকুমাকে, তারপর দোষ স্বীকার করে নিল বলে চার খুন মাফ? যত দোষ শুধু রণধীর-কৃষ্ণেন্দুর? এবার থেকে তা হলে ষড়যন্ত্র করে মানুষ খুনেও বাধা নেই, দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়ে গেলেই যখন ক্ষমা করে দেবে আদালত?
সুদীপার মুক্তিপ্রাপ্তির বিরুদ্ধে জনমত গড়ারও চেষ্টা হয়েছিল তখন, বিক্ষিপ্ত কিছু বিক্ষোভ-আন্দোলনে। কিন্তু আইন আইনই। আদালতও আদালতই। তার রায়ের উপর কথা চলে না। বিচারক সবদিক বিবেচনা করে মনে করেছিলেন, ক্ষমা প্রাপ্য সুদীপার। ক্ষমা করেছিলেন ফৌজদারি বিধির আইনসিদ্ধ প্রক্রিয়া অনুসারেই। সে সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা বা যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা অনুচিত। অসংগতও।
.
রণধীর বসু। এক প্রৌঢ় শিক্ষক। যিনি অর্থকষ্ট থেকে মুক্তির রাস্তা খুঁজতে চেয়েছিলেন মোহগ্রস্ত কিশোরী ছাত্রীর মাধ্যমে। লোকলজ্জাকে বন্ধক রেখেই। চারজন নিরপরাধ মানুষকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার চিত্রনাট্য সাজিয়েছিলেন ঠান্ডা মাথায়।
সপ্তদশী সুদীপা পাল। মায়ের শাসনে যার ক্ষোভ জমতে জমতে পরিণত হয়েছিল ক্রোধে-আক্রোশে-জিঘাংসায়। মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিল অসমবয়সি প্রেমে। জড়িয়ে পড়েছিল মা-বাবা-দাদু-ঠাকুমাকে খুনের চক্রান্তে।
কুড়ি বছরেরও বেশি কারাবাসের পর ২০১২ সালে মুক্তি পেয়েছিলেন রণধীর। লালবাগ সংশোধনাগারে যখন ছিলেন, বন্দিদের অঙ্ক শিখিয়ে সময় কাটাতেন। জেলেই খুলেছিলেন কোচিং ক্লাস।
সুদীপা? ’৯১-৯৬, পাঁচ বছর জেলে থাকাকালীন সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন এক বন্দির সঙ্গে। কারাবাসেই ভেঙে গিয়েছিল সে সম্পর্ক। জেল থেকে মুক্তির পর যে জীবন বাইশ বছরের সুদীপার অপেক্ষায় ছিল, তা সুখের হয়নি। রণধীর কৃতকর্মের ফল জেলের ভিতরে ভোগ করেছিলেন। সুদীপা বাইরে। দারিদ্র্য-অসম্মান-লাঞ্ছনা-গঞ্জনার যে ধারাবাহিক ঝড়ঝাপটার মধ্যে দিয়ে সুদীপাকে যেতে হয়েছিল, যেতে হচ্ছে এখনও, তার বিস্তারিত বিবরণ এখানে নিষ্প্রয়োজন। কোথায় আছেন এখন, কীভাবে আছেন, সে বৃত্তান্তও না হয় থাক।
যা গেছে তা যাক।