২. হাতে মাত্র ৯৬ ঘণ্টা

হাতে মাত্র ৯৬ ঘণ্টা

—একটা জিনিস বোঝো। এটা পার্সোনাল ইগোর ব্যাপার নয়। আমি জানি, তোমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছ। কিন্তু এটাও তো বুঝতে হবে যে গভর্নমেন্ট কেসটা নিয়ে প্রেশারে আছে। অলমোস্ট সেভেন্টি টু আওয়ার্স হয়ে গেল মার্ডারটার পর। স্টিল ক্লুলেস!

—কিন্তু স্যার…উই আর ট্রাইং আওয়ার বেস্ট…

—বললাম তো…আই নো দ্যাট, বাট ইয়োর বেস্ট মে নট অলওয়েজ় বি গুড এনাফ। যা বলছি শোনো। আমাকে এটা নিয়ে কথা শুনতে হচ্ছে। খুব বেশি অপেক্ষা করা যাবে না আর। তুমি পরিষ্কার করে বলো আর কতদিন লাগতে পারে?

—এধরনের কেসে তো ওইভাবে টাইমলাইন বলা মুশকিল স্যার।

—ট্রু… কিন্তু ওই যে বললাম, আর খুব বেশি সময় দিতে পারব না। ম্যাক্সিমাম চার-পাঁচ দিন… তার মধ্যে হল তো হল… না হলে সিআইডি উইল টেক ওভার।

—রাইট স্যার।

ফোনটা রেখে দেওয়ার পর মেজাজটা তেতো হয়ে যায় এসপি-র। এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন গত রাত্রে। মিডিয়া যা হইচই শুরু করেছে, কেসটা সিআইডি-কে না দিয়ে দেয়। সাতসকালে মোবাইলে খোদ ডিজি-র নম্বর ভেসে উঠতেই প্রমাদ গনেছিলেন। এবং যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হল। সময় বেঁধে দেওয়া হল। পারলে চার-পাঁচ দিনের মধ্যে সল্‌ভ করো। না হলে ছেড়ে দাও। সিআইডি দেখবে।

লালবাজারের যেমন ডিডি, অর্থাৎ ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের তেমন সিআইডি (ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট)। কোনও জটিল কেস যদি দ্রুত সমাধান করতে ব্যর্থ হয় থানা, কলকাতায় সেটা অবধারিত চলে যায় ডিডি-র হাতে। কখনও কখনও ঘটনা ঘটার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। আর রাজ্য পুলিশের এলাকায় হলে একই ভাবে জেলা পুলিশের কেসের তদন্তের দায়িত্ব পড়ে সিআইডি-র উপর। স্বাভাবিক এবং প্রচলিত প্রথা। থানার হাজারটা কাজ থাকে। কেসের তদন্ত তার মধ্যে একটা। কিন্তু ডিডি বা সিআইডি-র মূল কাজই হল ঘোরালো মামলার তদন্ত। ডিজি যেমন বললেন, পার্সোনাল ইগোর ব্যাপার নেই এখানে।

ভুল। কে বলল নেই? ইগোর ব্যাপার আছে। সে কলকাতা পুলিশ হোক বা রাজ্য, একটা সুস্থ প্রতিযোগিতার ব্যাপার থাকেই থানা বনাম ডিডি বা সিআইডি-র। যাদের কাছে কোনও কেস চলে গেলে থানার মনে হয়ই, আমরা পারলাম না, তাই ওদের দিল। সূক্ষ্মভাবে হলেও এই ‘আমরা-ওরা’-টা আছেই।

এসপি-রও ঠিক সেটাই মনে হয় ডিজি-র সঙ্গে মিনিটখানেকের ফোনটা শেষ হওয়ার পর। তিনদিনেও পারিনি যখন, ধরে নেওয়া হচ্ছে, ‘আমরা’ পারব না। ‘ওরা’ পারবে।

সিনেমায় হলে কী হত এসব ক্ষেত্রে? পুলিশ অফিসারকে চব্বিশ বা আটচল্লিশ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেওয়া হত কেসের কিনারার জন্য। এবং ‘কী হইতে কী হইয়া’ যেত, অলৌকিক দক্ষতায় নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই ঠিক ধরে ফেলত পুলিশ।

এটা সিনেমা নয়। এসপি ভাবতে থাকেন, হাতে চার-পাঁচ দিন মাত্র সময়। তার মধ্যে হবে আদৌ? সবে তিনদিন হয়েছে। হ্যাঁ, বলার মতো কোনও ‘লিড’ নেই এখনও। কিন্তু মরিয়া চেষ্টা চলছে দিনরাত। ডিজি সাহেব ঠান্ডা মাথার মানুষ। কিন্তু আজ ফোনে যথেষ্ট অধৈর্য শোনাচ্ছিল। ওঁর দিক থেকেও ভাবার চেষ্টা করেন পুলিশ সুপার। এই দু’দিনেই যা লেখালেখি আর প্রচার হচ্ছে কেসটা নিয়ে, রাজ্যের পুলিশপ্রধান হিসেবে নিশ্চয়ই প্রবল চাপে আছেন। সিআইডি-কে কেসটা দিলেই যে কোনও জাদুদণ্ডে দু’দিনের মধ্যে কিনারা হয়ে যাবে মামলার, এমনটা ডিজি-ও নিশ্চয়ই আশা করেন না। কিন্তু সিআইডি-র মতো ‘স্পেশ্যালাইজ়ড ইনভেস্টিগেটিং ইউনিট’-কে দায়িত্ব দিলে চাপমুক্তি হয় সাময়িক। সরকার কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখছে ঘটনাটা, সেটা প্রমাণিত হয়। জনসমক্ষে বার্তা যায় একটা।

ডিজি বললেন, চার-পাঁচ দিন। অঙ্কের হিসেবে কত? ৯৬ থেকে ১২০ ঘণ্টা। বেশ। তা-ই সই। আরেকবার মিস্টার গুপ্তার বাড়ি যাওয়া দরকার। আজই। এবং এখনই। বলে রাখা দরকার ওসি আর এসডিপিও (সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার)-কে। ডিস্ট্রিক্ট কন্ট্রোল রুমের নম্বর ডায়াল করেন পুলিশ সুপার, ‘এসপি বলছি…।’

বারাসতের এসপি বাংলো থেকে গাড়ি রওনা দিল সকাল সাড়ে আটটায়। গন্তব্য, বাগুইআটি। গাড়ি যখন মধ্যমগ্রাম পেরচ্ছে, পুলিশ সুপার ফ্ল্যাশব্যাকে সাজিয়ে নেন ঘটনাক্রম। গত দু’দিন ধরে কেসটা নিজে মনিটর করছেন। মাথায় গেঁথে আছে সব। কিন্তু তাতে আর লাভ কী হল? ডিজি-র কথাটা কানে বেজেই চলেছে, ‘সিআইডি উইল টেক ওভার।’

.

১১ ফেব্রুয়ারির সাতসকালে ঘোলা থানায় ফোনে খবরটা এসেছিল। উত্তর ২৪ পরগনার বেলঘরিয়া মহকুমার এই থানাটা খুব বেশিদিন হল তৈরি হয়নি। কয়েক বছর আগে খড়দা থানা ভেঙে এই ঘোলা থানার পত্তন।

কারণও ছিল নতুন থানা তৈরির। আয়তনের নিরিখে একটা বিশাল এলাকা ছিল খড়দা থানার অন্তর্গত। বিটি রোডের দু’ধারের ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা তো ছিলই। সঙ্গে ছিল সোদপুর-পানিহাটি মোড় থেকে পূর্বদিকে চলে যাওয়া রাস্তাটাও। ঘোলা হয়ে বারাসতমুখী যে রাস্তার সংলগ্ন ছিল বিলকান্দা-তালবান্দা-নিউ ব্যারাকপুরের বিস্তৃত অঞ্চল। যেখানে বেআইনি মদের ভাটির রমরমা, মস্তানদের দাপাদাপি, খুনজখম-মারামারি ব্যস্তসমস্ত রাখত খড়দা থানাকে। মূলত আইনশৃঙ্খলাজনিত সুবিধার্থেই খড়দাকে দ্বিখণ্ডিত করে ঘোলাকে দেওয়া হয়েছিল নতুন থানার মর্যাদা।

ঘোলা থানার ডিউটি অফিসারকে সোয়া ছ’টা নাগাদ যিনি ফোনটা করেছিলেন, তিনি উদ্বিগ্ন গলায় শুধু এটুকু বলেছিলেন, ‘মুড়াগাছা থেকে বলছি। এখানে পুকুরপাড়ে একটা বড় বস্তা পড়ে আছে। নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা। মনে হচ্ছে বস্তায় মুড়ে কেউ কিছু ফেলে রেখে গেছে। রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে বস্তাটা থেকে। থানা থেকে কেউ এলে ভাল হয়। এখানে লোক জমে গেছে।’

লোক যে সত্যিই জমেছে বিস্তর, মুড়াগাছায় গিয়ে টের পেলেন ঘোলা থানার অফিসাররা। থানা থেকে বেশি দূরে নয় মুড়াগাছা। কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই। হঠাৎ চাঞ্চল্যকর কিছু ঘটার আভাসে-ইঙ্গিতে যেমন হয় আধা-শহর আধা-গ্রামীণ এলাকায়, পুকুরের ধারে ভিড়-জমানো কৌতূহলী মুখগুলোয় চাপা উত্তেজনা। পুলিশ এসেছে, পুলিশ এসেছে! কী আছে ওই বস্তায়, জানা যাবে এবার।

জানার পর উত্তেজনা বদলে গেল আতঙ্কে। বস্তা থেকে বেরল হাফহাতা গোলাপি রঙের শার্ট আর কালো ট্রাউজ়ার পরিহিত এক পুরুষের লাশ। দেখে মনে হয়, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। সর্বাঙ্গ নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা। গলাতেও দড়ির প্যাঁচ। ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে চোখ। শ্বাসরোধ করে খুন। মুখটা থেঁতলে গেছে ভোঁতা কিছুর আঘাতে। পোশাকের অনেকটা লাল হয়ে গেছে রক্তে। বুকের উপর পড়ে আছে লাল রঙের একটা ব্লাউজ়। আর একটা রুমাল। ছোট, ত্রিকোণ। মহিলারা সাধারণত যেমন ব্যবহার করেন।

খুনটা যে এই পুকুরপাড়ে হয়নি, হয়েছে অন্য কোথাও, এবং খুনি বা খুনিরা বডিটা বস্তাবন্দি করে এখানে ফেলে গেছে, সেটা বুঝতে গোয়েন্দা হওয়ার দরকার হয় না। কে বা কারা করেছে, খুনটা আদতে হয়েছে কবে-কোথায়-কখন, মৃতের পরিচয়ই বা কী, সেসব পরে ভাবার। প্রাথমিক কাজগুলো আগে সারল ঘোলা থানার পুলিশ। দেহের ছবি তোলা, বডি তুলে থানায় নিয়ে গিয়ে পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া এবং ঘটনাটা থানার বড়বাবুকে জানানো।

মৃত অজ্ঞাতপরিচয় থাকলেন না বেশিক্ষণ। হাতে ঘড়ি বা আংটি ছিল না। হয় পরেননি, নয় যে বা যারা খুনটা করেছে, সে বা তারা খুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু ট্রাউজ়ারের পিছনের পকেটে রাখা মানিব্যাগটা নিয়ে যায়নি। টাকাপয়সা ছিল না ওতে, বা থাকলেও নিয়ে গেছে খুনি বা খুনিরা। ব্যাগে শুধু পড়ে ছিল ভিজিটিং কার্ডটা। যা জানিয়ে দিল নিহতের পরিচয়।

.

রাকেশ গুপ্তা, কোম্পানি সেক্রেটারি। নিউটাউনের এক নামি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। মোবাইল নম্বর আর মেইল আইডি দেওয়া আছে কার্ডে। দ্রুত যোগাযোগ করা হল ওই কোম্পানির অফিসে। পাওয়া গেল বাড়ির ঠিকানা। ল্যান্ডলাইন নম্বর।

বাগুইআটির ভিআইপি এনক্লেভ-এর বাসিন্দা ছিলেন রাকেশ। ভিআইপি রোড ধরে এয়ারপোর্টের দিকে যেতে রাস্তার উপরেই পুরনো এবং পরিচিত আবাসন। খবর দেওয়া হল বাড়িতে। ঘোলা থানায় ছুটে এলেন রাকেশের আত্মীয়-বন্ধুরা। এলেন অফিসের সহকর্মীরাও। দেহ শনাক্ত হল। দায়ের হল খুন এবং প্রমাণ লোপাটের মামলা। ঘোলা থানা। কেস নম্বর ২০, তারিখ ১১/২/২০০৮। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২/২০১ ধারায়।

খবর পাওয়ামাত্র ওসি আর অ্যাডিশনাল ওসি তো বটেই, ঘটনার গুরুত্ব বুঝে থানায় চলে এসেছিলেন এসডিপিও বেলঘরিয়া, অ্যাডিশনাল এসপি, ব্যারাকপুর এবং উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার স্বয়ং। খুঁটিয়ে দেখেছিলেন বডি।

পোস্টমর্টেমে দ্রুত পাঠানো হয়েছিল দেহ। মৃত্যুর কারণ হিসেবে ডাক্তার কী লিখবেন, জানাই ছিল। ‘Death due to asphyxia caused by ligature strangulation…।’ যেটা জানা ঢের বেশি জরুরি ছিল, সেটা খুনের সম্ভাব্য সময়। ডাক্তার বললেন, রাকেশের মৃত্যু ঘটেছে দেহ আবিষ্কারের অন্তত চোদ্দো-পনেরো ঘণ্টা আগে। অর্থাৎ, খুনটা সম্ভবত হয়েছে আগের দিন, মানে ১০ ফেব্রুয়ারির দুপুর থেকে সন্ধের মধ্যে।

সাধারণ বুদ্ধিতে এটা বোঝাই যাচ্ছিল, এই খুনে এক নয়, একাধিকের যুক্ত থাকার সম্ভাবনা নিরানব্বই শতাংশ। বছর চল্লিশের রাকেশ যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান ছিলেন। তাঁকে এভাবে মেরে দড়ি দিয়ে বেঁধে বস্তাবন্দি করে ফেলে আসা সম্ভব কোনও একজনের পক্ষে? তর্কের খাতিরে না হয় ধরে নেওয়া গেল, খুনটা একজনই করেছে। এবং সে যথেষ্ট শক্তিশালী। তা হলেও খুনের পরে লাশ সরিয়ে ফেলার বন্দোবস্ত করতে আরও এক বা একাধিকের সাহায্য লেগেছিল নিশ্চিত।

পুলিশ সুপার যখন সহকর্মী অফিসারদের নিয়ে পৌঁছলেন বাগুইআটির ভিআইপি এনক্লেভে, বেলা প্রায় সাড়ে দশটা। টিভি মারফত খবরটা জানাজানি হয়ে গেছে ততক্ষণে। আবাসিকরা ভিড় জমিয়েছেন রাকেশের একতলার ফ্ল্যাটের সামনে। গেটের বাইরে কৌতূহলী জটলা দানা বাঁধছে ক্রমশ। প্রেসের গাড়ি এসে থামছে একে একে।

ছিমছাম টু-বেডরুম ফ্ল্যাট। সচ্ছলতার যতটা ছাপ আছে ঘরে, বৈভবের ততটা নয়। রাকেশ গুপ্তা এই ফ্ল্যাটে থাকতেন সাত বছর হল। স্ত্রী কবিতা এবং আট বছরের মেয়ে দিয়াকে নিয়ে। কবিতা এখন সন্তানসম্ভবা। দ্বিতীয় সন্তানের সম্ভাব্য জন্মক্ষণ মাস তিনেকের মধ্যেই। রাকেশের বাবা বেঁচে নেই। মা আছেন। এই আবাসনেই পাশের ব্লকের একটা ফ্ল্যাটে থাকেন। রাকেশরা দুই ভাই-বোন। বোন দীপিকার বিয়ে হয়েছে হায়দরাবাদে।

ফ্ল্যাটটা দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে নেহাতই মাঝারি সাইজ়ের। তার মধ্যেই পাড়াপ্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবদের থিকথিকে ভিড়। যে ভিড়টা পুলিশ ঢুকতেই রাতারাতি আরও বেড়ে গেল কিছুটা। ওই ভিড়ভাট্টা আর কান্নাকাটির মধ্যে রাকেশের স্ত্রী-র সঙ্গে আলাদা কথা বলার সুযোগই ছিল না। তা ছাড়া স্বামীর এভাবে খুন হওয়ার খবর পেয়েছেন সবে কয়েক ঘণ্টা হল। এখন পুলিশি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থায় থাকবেন, আশা করাটাই অমানবিক। এসপি ঠিক করলেন, শেষকৃত্য হয়ে যাওয়ার পর রাতের দিকে এসে কথা বলবেন। প্রাথমিক তথ্যগুলো বরং জেনে নেওয়া যাক আত্মীয়দের থেকে।

প্রাথমিক তথ্য বলতে? ১০ ফেব্রুয়ারি রবিবার ছিল। অফিস যাওয়ার কোনও ব্যাপার ছিল না রাকেশের। দুপুর সোয়া একটা নাগাদ ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়েছিলেন মা-কে এয়ারপোর্টে ছেড়ে আসতে। মা সপ্তাহখানেকের জন্য হায়দরাবাদ যাচ্ছিলেন মেয়ের কাছে। দুপুর দুটোর একটু পরে স্ত্রী-র মোবাইলে ফোন করে রাকেশ জানান, ‘আমার কিছু কাজ আছে। ফিরতে একটু দেরি হবে।’

আর বাড়ি ফেরেননি রাকেশ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে, সন্ধে গড়িয়ে রাত আটটা বেজে যাওয়ার পর উদ্বিগ্ন কবিতা ফোন করেছিলেন রাকেশকে। ফোন ‘সুইচড অফ’ ছিল। কবিতা আতঙ্কিত হয়ে যোগাযোগ করেছিলেন আত্মীয়দের সঙ্গে, রাকেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে। রাকেশের দুই খুড়তুতো ভাই বাগুইআটি ফাঁড়িতে রাতেই ‘মিসিং ডায়েরি’ করেছিলেন। যে ‘মিসিং ডায়েরি’ মূল্যহীন হয়ে যায় পরের দিন মুড়াগাছায় রাকেশের দেহ উদ্ধারের পর। প্রাসঙ্গিক তথ্য পাওয়া গেল আরও কিছু। রাকেশ ডানহাতে ঘড়ি পরতেন। গলায় থাকত রুপোর চেন। ডানহাতে আংটি পরতেন দুটো। চোখে চশমা উঠেছিল কলেজে পড়ার সময়েই। অথচ উদ্ধার হওয়া দেহে

বারাসতের অফিসে ফিরে পুলিশ সুপার এই মামলার তদন্তে গঠন করলেন একটা ‘কোর টিম’। যাতে থাকলেন এই কেসের তদন্তকারী অফিসার সাব-ইনস্পেকটর রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, ঘোলা থানার অ্যাডিশনাল ওসি সমীর ভট্টাচার্য, ওসি তপনকুমার বিশ্বাস, নিউ ব্যারাকপুর ফাঁড়ির সাব-ইনস্পেকটর সুবীর চক্রবর্তী, জগদ্দল থানার ওসি সুবীর চ্যাটার্জি এবং জেলার বাছাই করা চারজন সাব-ইনস্পেকটর, ‘ক্রাইম ওয়ার্ক’-এ যাঁদের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। ঠিক হল, এই টিমের কাজকর্মের তদারকিতে থাকবেন অ্যাডিশনাল এসপি, ব্যারাকপুর। যাঁকে সাহায্য করবেন এসডিপিও ব্যারাকপুর আর এসডিপিও বেলঘরিয়া। সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে পুলিশ সুপার স্বয়ং, যিনি প্রতি সন্ধেয় বসবেন টিমের সঙ্গে। দৈনিক সান্ধ্য-বৈঠকে কাটাছেঁড়া করা হবে তদন্তের অগ্রগতি।

কীভাবে এগোনো হবে, সেটা ছকে নেওয়া হল। তৈরি হল আশু করণীয়ের তালিকা। কে কোনটা করবে, ভাগ করে দেওয়া হল দায়িত্ব।

এক, রাকেশের মোবাইলের সিডিআর (কল ডিটেলস রেকর্ড) অবিলম্বে জোগাড় করা। এবং অন্তত গত এক মাসের রেকর্ড চেক করা। দিন ধরে ধরে। অফিস এবং বাড়ির লোকজন ছাড়া বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কাদের সঙ্গে তুলনায় বেশি যোগাযোগ ছিল, জানতে হবে। তৈরি করতে হবে ‘ফ্রিকোয়েন্ট কলার্স’-দের লিস্ট। ঘটনার দিন এয়ারপোর্টে মা-কে ছেড়ে বেরনোর পর স্ত্রী-কে ফোন করেছিলেন। সেই ফোনের কতক্ষণ পর থেকে মোবাইল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? বন্ধ হওয়ার মুহূর্তের ‘টাওয়ার লোকেশন’? পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী খুনটা হয়েছে রবিবার দুপুর থেকে বিকেলের মধ্যে। প্রকাশ্যে কেউ দিনের বেলায় খুন করে না এভাবে। খুনটা নিশ্চিতভাবে কোনও ঘরের মধ্যে হয়েছে এবং রাতের অন্ধকারে বডি পাচার করা হয়েছে খুনের জায়গা থেকে মুড়াগাছায়। কোন এলাকায় খুন? টাওয়ার লোকেশন থেকে একটা আভাস অন্তত পাওয়া যেতে পারে।

দুই, রাকেশের পেশাগত জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য চাই। একেবারে খুঁটিনাটি পর্যায়ে। অফিসে ওঁর ঊর্ধ্বতন, অধস্তন… সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। জানতে হবে, কোনও গোলমাল চলছিল কিনা অফিসে? কোনও পেশাগত চাপে ছিলেন? থাকলে কী বা কেমন সেই চাপ? অফিসে কোনও সহকর্মিণীর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক ছিল? এমন ঘনিষ্ঠতা কোনও, যা নিয়ে অফিসে গসিপ, আড়ালে-আবডালে আলোচনা?

তিন, তথ্য চাই ব্যক্তি রাকেশ সম্পর্কেও। এত জিনিস থাকতে মৃতদেহের উপর লাল ব্লাউজ় কেন? লেডিজ় রুমাল কেন? কোনও মহিলাঘটিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিলেন রাকেশ? যা কারও বা কাদের তুমুল ক্রোধ বা ঈর্ষার কারণ হয়েছিল? সেই থেকে খুন? পাড়াপ্রতিবেশী আর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথা বলে রাকেশের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে যতটা সম্ভব খবর নিতে হবে। কোনও তথ্যই ফেলে দেওয়ার নয়, তদন্তের এই গোড়ার শর্তটা মাথায় রেখে।

চার, এত জায়গা থাকতে মুড়াগাছার পুকুরপাড়ে বডি ফেলে আসা কেন? জায়গাটা আগে থেকে ঠিক করা ছিল? সম্ভবত তাই। এবং যদি তা-ই হয়, তা হলে স্থানীয় দুষ্কৃতীদের এক বা একাধিকের জড়িত থাকার সম্ভাবনা প্রবল। যার বা যাদের এলাকার ভূগোল সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ছিল। সুতরাং ঘোলা-খড়দা-টিটাগড়-ব্যারাকপুর—স্থানীয় সমস্ত দাগি দুষ্কৃতীর গত আটচল্লিশ ঘণ্টার গতিবধি সম্পর্কে খবর চাই। এমন পুরনো পাপী কেউ আছে, যাকে এলাকায় দেখা যাচ্ছে না গতকাল থেকে? যার যেখানে যা সোর্স রয়েছে, পত্রপাঠ মাঠে নামাতে হবে।

পাঁচ, যথাসম্ভব দ্রুত ‘ডিটেকশন’ চাই। বারো ঘণ্টাও হয়নি বডি উদ্ধার হয়েছে, এর মধ্যেই মার্ডারটা নিয়ে হইচই শুরু হয়েছে। সেটা যে আরও বাড়বে তাড়াতাড়ি কিনারা না হলে, সেটা আন্দাজ করার জন্য কোনও পুরস্কার নেই।

হইচই যে এর মধ্যেই বেড়েছে অনেকটাই, সেটা এসপি টের পেলেন রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ ফের বাগুইআটি গিয়ে। যখন ঢুকছেন, বিভিন্ন নিউজ় চ্যানেলের একডজন ‘বুম’ নিমেষে ধেয়ে এল মুখের দিকে। পাশ কাটিয়ে ঢুকলেন কোনওমতে। ফ্ল্যাটে তখনও লোকভরতি। ময়নাতদন্ত-পর্ব চুকতে দুপুর গড়িয়ে গেছে। শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে সন্ধেয়। রাকেশের মা এবং বোন পরেরদিন সকালেই ফ্লাইট ধরে হায়দরাবাদ থেকে ফিরে আসছেন কলকাতায়।

মিসেস গুপ্তার সঙ্গে আধঘণ্টা একান্তে কথা বলা গেল বিস্তর অনুরোধ-উপরোধের পর। মহিলা নিশ্চুপ বসেছিলেন বিছানায়। প্রাথমিক সমবেদনা জানানোর পর যা কিছু প্রশ্ন করলেন এসপি, হয় মাথা হেলিয়ে, নয় দু’-একটা শব্দে উত্তর দিলেন কবিতা। কাউকে সন্দেহ হয়?— না। রাকেশের কোনও শত্রু ছিল?—না। এবং শেষ পর্যন্ত যাবতীয় দ্বিধা কাটিয়ে, ‘আপনাদের দাম্পত্য সম্পর্ক কেমন ছিল?’একটাই শব্দ খরচ করলেন সদ্য স্বামীহারা মহিলা, ‘ভাল।’

এসপি খুঁটিয়ে লক্ষ করছিলেন মিসেস গুপ্তাকে। শোকের নানারকম চেহারা হয়। হয় উদ্বেল, নয় সংযত, অথবা দুটোর মাঝামাঝি। বা অন্য কোনও প্রকাশ। শোক তো শোকই। নির্দিষ্ট বিশেষণে বাঁধা যায় কখনও?

যদি যেত, মিসেস গুপ্তাকে ‘সংযত’-র গোত্রে ফেলা যেত দ্বিধাহীন। বাহ্যত অন্তত শোকতাপের আকুলতা নেই তেমন। অবশ্য ‘শোকে পাথর হয়ে যাওয়া’ বলেও তো কথা আছে বাংলায়। ভিতরের উথালপাথাল বাইরে আসে না সবার। আধঘণ্টার বাক্যালাপের পর তবু মনে হয় এসপি-র, ভদ্রমহিলাকে একটু যেন বেশিই নিরুত্তাপ লাগছে। নাকি ভুল ভাবছেন? মহিলা শোকে পাথর হয়ে গেছেন এবং বাহ্যিক প্রকাশটা তাই উচ্চকিত নয়?

রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ভিআইপি এনক্লেভ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার সময়ও ফের হামলে পড়ল মিডিয়া। বক্তব্য চাই এসপি-র। ‘তদন্ত সবে শুরু হয়েছে, সমস্ত দিকই খতিয়ে দেখা হচ্ছে’ জাতীয় একটা গতানুগতিক ‘কোট’ দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লেন পুলিশ সুপার।

নামকরা বাণিজ্যিক সংস্থার পদস্থ কর্তার নৃশংস খুন। বস্তাবন্দি অবস্থায় দড়ি-বাঁধা দেহ উদ্ধার। দেহের উপর ব্লাউজ় এবং মহিলাদের ব্যবহার করা রুমাল। এটা তেমন খবর নয়, প্রথম দু’-এক দিন হইচইয়ের পর যা স্বাভাবিক গতিতে চলে যাবে প্রথম পাতা থেকে ভিতরের পাতায়। প্রাইম টাইম থেকে সরে যাবে চ্যানেলের আর পাঁচটা খবরের ভিড়ে। এই খুনে রহস্য আর জল্পনা হাঁটছে হাত-ধরাধরি করে। সমাধান না হওয়া পর্যন্ত মিডিয়ার অণুবীক্ষণের নীচে থাকবেই পুলিশের প্রতিটি নড়াচড়া, খুনের সম্ভাব্য কারণ নিয়ে হাজার তত্ত্ব উড়তে থাকবে হাওয়ায়।

ঠিক এখানেই চ্যালেঞ্জ বর্তমান প্রজন্মের তদন্তকারীদের। মিডিয়ার গোয়েন্দাগিরি সামলে নিজেদের গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে যাওয়া। শুধু তদন্ত করা এবং কেসের সমাধানই যথেষ্ট নয়। কী লাইনে তদন্ত এগোচ্ছে, তার আঁচ যাতে মিডিয়া না পায়, কাগজে পড়ে বা চ্যানেলে দেখে যাতে সাবধান না হয়ে যায় সম্ভাব্য অপরাধীরা, সেটাও নিশ্চিত করা। কাজটা যে আজকের যুগে কী প্রাণান্তকর কঠিন, সেটা তদন্তকারী অফিসার মাত্রেই জানেন।

সোমবারে তৈরি ‘করণীয়’-র তালিকার কতটা কী এগোল, খতিয়ে দেখতে ‘কোর টিম’-এর সঙ্গে মঙ্গলবার সান্ধ্য-মিটিংয়ে বসলেন এসপি।

রাকেশের সিডিআর বলছে, মোবাইল বন্ধ করেছিলেন তিনটে সতেরো মিনিটে। তখন টাওয়ার লোকেশন ছিল বিমানবন্দর থেকে কয়েক কিলোমিটার উত্তরে মাইকেলনগরের কাছে। স্ত্রী-কে ফোন করেছিলেন দুটো দশে, বলেছিলেন, ফিরতে দেরি হবে। তার ঘণ্টাখানেক পর থেকে ফোন বন্ধ। নিজেই সুইচ অফ করেছিলেন? না কি অন্য কেউ বাধ্য করেছিল? আগে থেকে কারও সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল? জিজ্ঞাসাচিহ্ন একাধিক। উত্তর এখনও অধরা।

রাকেশের গত এক মাসের কল ডিটেলস থেকে এমন কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না, যা তদন্তে নির্দিষ্ট দিশা দেখাতে পারে। বন্ধুবান্ধব যাঁদের সঙ্গে কথা বলতেন, তাঁদের অধিকাংশেরই ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেক’ হয়ে গেছে প্রাথমিক। দেখা হয়েছে সবার রবি-সোমের টাওয়ার লোকেশন। সন্দেহ করার মতো কিছু? নাহ! রাকেশের শনি-রবির ফোন-তালিকা দেখা হয়েছে বিশেষ মনোযোগে। কিন্তু সবই রুটিন ফোন, অফিস-বাড়ি-বন্ধু। এসএমএস-ও রুটিনের পর্যায়েই।

বন্ধুদের মধ্যে বিশেষ ঘনিষ্ঠ দু’জনের নাম পাওয়া যাচ্ছে, যাঁদের সঙ্গে প্রায় রোজই ফোন বা মেসেজ-চালাচালি হত রাকেশের। অরুণ কাটিয়াল আর সঞ্জীব সুরেকা। অরুণ থাকেন লেকটাউনে, সঞ্জীব দমদমে। দু’জনেই রাকেশের বহুদিনের বন্ধু সেই কলেজজীবন থেকে। দু’জনেই দেহ উদ্ধারের খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন থানায়। ছিলেন শেষকৃত্য পর্যন্ত। অরুণ-সঞ্জীব দু’জনেরই সুখী দাম্পত্য জীবন। পারিবারিক কোনও জটিলতার আভাস মেলেনি এখনও পর্যন্ত। খোঁজখবর অব্যাহত আছে।

সঞ্জীবের থেকে মাসখানেক আগে রাজারহাট এলাকায় একটা ফ্ল্যাট বুক করার জন্য আড়াই লক্ষ টাকা ধার করেছিলেন রাকেশ। ওই অ্যাডভান্স বুকিং গত মাসে বাতিল করে টাকা তুলে নিয়েছিলেন। তবে সঞ্জীবকে এখনও ধারের টাকা ফেরত দেননি। অনেকদিনের বন্ধু, রাকেশকে তাগাদাও দেননি সঞ্জীব। রাকেশ বন্ধুকে বলেছিলেন, ফ্ল্যাট নয়, ভাল জমির খোঁজে আছেন। জমি-বাড়ি সংক্রান্ত কোনও ঝামেলায় ফেঁসে গেছিলেন কি না, জানা যায়নি এখনও। আরও খোঁজ নেওয়া দরকার। রাকেশ আর্থিকভাবে মোটামুটি সচ্ছলই ছিলেন। মাসে মাইনে পেতেন পঁয়ষট্টি হাজারের কাছাকাছি। ধার-টার যদি কিছু থেকেও থাকে, সেটা শোধ করাটা গুরুতর সমস্যা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কম।

অফিসে কোনও ঝামেলা? যতটুকু খোঁজখবর করা গেছে আপাতত, সেখানেও কোনও ‘লিড’ নেই। এই কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিলেন বছরখানেক হল। অমায়িক ব্যবহারের জন্য জনপ্রিয় ছিলেন সহকর্মীদের মধ্যে। পরিশ্রমী এবং দক্ষ আধিকারিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন কোম্পানিতে।

কর্মক্ষেত্রে কোনও মহিলা সহকর্মীর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের আভাস? মহিলা কর্মী অনেকেই আছেন সংস্থায়। রাকেশের পেশাগত সংস্রব ছিল মূলত পিএ অরুণিমার সঙ্গে। অরুণিমা সপ্রতিভ, সুন্দরী, কথাবার্তায় চৌকস। কিন্তু নানাভাবে খোঁজ নিয়েও রাকেশের সঙ্গে অরুণিমার কাজ-বহির্ভূত কোনও সম্পর্কের হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। অন্য কোনও সহকর্মীর সঙ্গেও না। অন্তত এখনও পর্যন্ত।

রাকেশের অফিসের ডেস্কটপটা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পরীক্ষার জন্য। অফিসিয়াল ল্যাপটপও শনিবার রেখে গিয়েছিলেন অফিসে। দুটোই পাঠানো হয়েছিল প্রযুক্তি-বিশেষজ্ঞদের কাছে। যদি ‘ডিলিট’ করে দেওয়া কোনও ফাইল-ফোল্ডারের খোঁজ পাওয়া যায়। কিন্তু কোথায় আর? ‘হার্ড ডিস্ক’ ঘাঁটাঘাঁটি করেও কিচ্ছু পাওয়া যায়নি বলার মতো।

পাড়া-প্রতিবেশী? আবাসনের বাসিন্দারা? ওঁরা কী বলছেন, কী ভাবছেন? এখনও অনেকের সঙ্গে কথা বলা বাকি। তবে নিকটতম প্রতিবেশীদের মধ্যে যাঁদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই কথা বলা হয়েছে, সবাই একটা ব্যাপারে একমত। রাকেশ অত্যন্ত ভদ্র এবং নম্র স্বভাবের মানুষ ছিলেন। কারও সাতে-পাঁচে থাকতেন না। কারও সঙ্গে সামান্যতম ঝগড়াঝাঁটিও কখনও হয়েছে বলে কেউ শোনেননি।

স্থানীয় সোর্স লাগানো হয়েছিল সোমবার বিকেলেই। মূলত বলা হয়েছিল রাকেশের ব্যক্তিজীবন নিয়ে খোঁজ নিতে। পাড়ায় কোনও চর্চা হত কিনা রাকেশকে নিয়ে, হলে কী নিয়ে চর্চা, এইসব। সোর্সরা যা খবর পেয়েছে এ পর্যন্ত, মিলে যাচ্ছে পাড়াপ্রতিবেশীদের ধারণার সঙ্গে। রাকেশ গুপ্তা অজাতশত্রু ছিলেন।

আর রাকেশের স্ত্রী কবিতা? তাঁর ব্যক্তিজীবন? কল ডিটেলস রেকর্ড থেকে অন্তত অন্য কোনও সম্পর্কের ন্যূনতম ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। সুখী দম্পতি হিসেবেই পাড়ায় এবং বন্ধুমহলে পরিচিত ছিলেন ওঁরা। বাহ্যিক সুখী দাম্পত্যের আড়ালে কোনও টানাপোড়েন ছিল? থাকলেও আভাস-ইঙ্গিত পাননি পরিচিতরা। বা পরিচিতদের মধ্যে কেউ কিছু জানলেও লুকিয়ে যাচ্ছেন। রাকেশের দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু অরুণ-সঞ্জীবের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক ছিল কবিতার? সোর্স বলছে, কল রেকর্ডসও বলছে, ‘ভাবীজি-ভাইয়া’-র স্বাভাবিক সম্পর্ক। ‘ডাল মে কুছ কালা’-র ইঙ্গিত নেই।

ব্যারাকপুর-বেলঘরিয়ার দাগি অপরাধীদের তালিকা তৈরি করে খোঁজখবর হয়েছে বিস্তারিত। কেউ জেলে, কেউ জামিনে বাইরে। যারা বাইরে, তারা দিব্যি আছে এলাকায়। এবং শনি থেকে সোমের গতিবিধি সন্দেহের উদ্রেক করছে না।

অতঃকিম? পেশাগত ঝামেলার আঁচ নেই। ধারদেনার সমস্যা নেই। দাম্পত্য অশান্তির ইঙ্গিত নেই। পরকীয়ার খোঁজ নেই। স্থানীয় অপরাধজগতের রাঘববোয়ালদের জড়িত থাকার আভাস নেই। এবং এত ‘নেই’-এর শেষে তদন্তকারীদের হাতেও পেনসিল ছাড়া আর কিছুই পড়ে নেই।

রাত হয়ে গেছে অনেক। অফিসারদের ছেড়ে দেন এসপি। উঠতে উঠতে ওসি ঘোলা বলেন, ‘আরও লোক লাগিয়েছি স্যার। দেখা যাক। মিডিয়া যা বাড়াবাড়ি শুরু করেছে, মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব মার্ডার বোধহয় চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ডিটেক্ট হয়ে যায়!’

এসপি হাসেন, ‘শোনো তপন, মিডিয়া কী করছে, কতটা ‘‘সেনশনালাইজ়’’ করছে, সেটা নিয়ে বেশি ভেবে লাভ নেই। ওটা হাতে নেই আমাদের। আমার চিন্তা হচ্ছে অন্য ব্যাপারে…’

ব্যারাকপুর এবং বেলঘরিয়ার এসডিপিও-রা প্রায় সমস্বরে বলে ওঠেন, ‘কী স্যার?’

—বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্সের একটা হাই-লেভেল ডেলিগেশন মার্ডারটা নিয়ে আজ ডেপুটেশন দিয়ে এসেছে রাইটার্সে… শিল্পক্ষেত্রে কর্মরতদের নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে.. এইসব আর কী… গভর্নমেন্ট কেসটা না সিআইডিকে দিয়ে দেয়…

‘কিন্তু স্যার…’, হতাশ দেখায় বেলঘরিয়ার এসডিপিও-কে।

থামিয়ে দেন পুলিশ সুপার। তরুণ এসডিপিও-র পিঠে হাত রাখেন, ‘বাড়ি যাও, কাল ভাবা যাবে আবার।’

রাতে শোওয়ার আগে একটু বই পড়া বরাবরের অভ্যেস এসপি-র। কিন্তু আজ ইচ্ছে করছে না। কেসটা ঘুরছে মাথার মধ্যে। তলিয়ে ভাবার চেষ্টা করছেন। এবং যত ভাবছেন, তত মাথায় ঘুরেফিরে আসছে রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর সেই বিখ্যাত কবিতার কয়েকটা লাইন। কয়েকটা শব্দ।

‘I kept six honest serving men.

They taught me all I knew.

Their names were what and why

And when

And how and where and who….’

অপরাধের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই কিপলিং-এর এই বহুচর্চিত কবিতার, যার ব্যঞ্জনা বহুমাত্রিক। কিন্তু লাইনগুলো এখন কী যে প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে এই মামলার তদন্তে! ‘হোয়াট, হোয়াই, হোয়েন, হাউ, হোয়ার, হু’। কী? কেন? কখন? কীভাবে? কোথায়? কে?

‘কী?’— জানা আছে।

‘কেন?’—মোটিভ অমিল। রাকেশের মানিব্যাগে যা টাকা ছিল, আততায়ীরা নিয়ে গেছে ধরে নেওয়া গেল। ছুটির দিনে মা-কে ছাড়তে এয়ারপোর্ট গেছিলেন। কত টাকা সঙ্গে থাকতে পারে? খুব বেশি ধরলেও হাজার দুই-তিন। আরও একটু বাড়িয়ে ভাবলে টেনেটুনে পাঁচ। লাখখানেক ক্যাশ তো আর সঙ্গে থাকার কথা নয়। রাকেশের চেন-ঘড়ি-আংটি পাওয়া যায়নি। ওগুলো বেচেই বা কত টাকা হতে পারে? যতই হোক, তার জন্য বড়জোর ছিনতাই হয়। এভাবে খুন নয়। সুতরাং ‘মার্ডার ফর গেইন’ হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। তা হলে? ঘুরেফিরে আটকে যাওয়া সেই মোটিভেই।

‘কখন?’—উত্তর পাওয়া গেছে।

‘কীভাবে?’—ময়নাতদন্তের রিপোর্ট জানিয়েছে।

‘কোথায়?’— উত্তর মেলেনি এখনও।

‘কে?’ বা ‘কারা?’—‘কেন’-র রহস্যই এখনও ভেদ করা গেল না, ‘কে বা কারা’ তো পরের ব্যাপার। নতুন করে সব শুরু করতে হবে।

নতুন করে শুরুই শুধু নয়, শেষও যে করতে হবে দুঃসাধ্য দ্রুততায়, পরের দিন সকালেই বুঝে গেলেন এসপি। যাঁকে রাখঢাকহীন ভাষায় জানিয়ে দিলেন ডিজি, ‘খুব বেশি সময় দিতে পারব না আর…ম্যাক্সিমাম চার-পাঁচ দিন.. তার মধ্যে হল তো হল…নয়তো সিআইডি উইল টেক ওভার।’

পুলিশ সুপারের গাড়ি বাংলো থেকে বেরল সাড়ে আটটা নাগাদ। গন্তব্য, ভিআইপি এনক্লেভ। মিসেস গুপ্তার সঙ্গে আরেকবার খোলাখুলি কথা বলা দরকার।

.

আত্মীয়দের আনাগোনা এখনও লেগেই আছে গুপ্তা-পরিবারে। দাদার মৃত্যুর খবর পেয়েই সোমবার সন্ধেতেই মা-কে নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন বোন দীপিকা। সংসারটা মূলত দীপিকাই সামলাচ্ছেন এখন। উপায় কী আর? ছেলের অকালমৃত্যুতে মা শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। জ্ঞান হারাচ্ছেন যখন-তখন। কবিতাও সারাদিন নিজের ঘরে শুয়ে থাকছেন নিস্তব্ধ। মেয়ে দিয়া ছাড়া আর কারও সঙ্গে কথা প্রায় বলছেনই না।

ড্রয়িং-কাম-ডাইনিং রুমের একটা সোফায় বসেছিলেন পুলিশ সুপার। রাকেশের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের খুব বেশি দেরি নেই আর। শ্রাদ্ধের পরের দিন আবাসনে আয়োজিত হবে স্মরণসভা। সেই সভার জন্য দাদার ছবির একটা কোলাজ তৈরি করছেন বোন দীপিকা, পুরনো ফ্যামিলি অ্যালবাম ঘেঁটে।

চা-বিস্কুট এসেছে। খুচরো কথার মধ্যে দীপিকা ছবিগুলো দেখাতে থাকেন এসপি-কে। ‘এইটা ভাইয়ার কোলে আমি, ছোটবেলায় রাজস্থান বেড়াতে গিয়ে। এইটা ভাইয়ার ফিফটিন্থ বার্থডের। এটা কলেজের এক্সকারশনে বন্ধুদের সঙ্গে ভাইজ্যাগে। আর এটা ভাইয়ার বিয়ের দিন আমার সঙ্গে…’ গলা বুজে আসে দীপিকার। মাথা নিচু করে ফেলেন।

‘আর এটা?’

ফ্রেমের ডানদিকের একটা ছবিতে চোখ আটকে গেছে এসপি-র। একটা বই হাতে নিয়ে কিছু একটা পড়ছেন রাকেশ। দাঁড়ানো অবস্থায়, সামনে মাইক্রোফোন।

দীপিকা মুখ তোলেন, ‘এটা মুশায়েরার।’

—মুশায়েরা?

—হ্যাঁ, দাদা কবিতা লিখত তো! ডাকও পেত ঘরোয়া কবিতা পাঠের আসরে। অবসর সময়ে সাহিত্য চর্চা করত।

—তাই? আপনার দাদা তো বেশ গুণী মানুষ ছিলেন। ওঁর লেখা কবিতাগুলো নিয়ে একটা বই বের করার কথা ভেবে দেখতে পারেন কিন্তু।

ফের গলা ধরে আসে দীপিকার, ‘হ্যাঁ, এটা ভাল বলেছেন। দাদারও ইচ্ছে ছিল একটা বই বেরোক।’

—আপনাদের কাছে ওঁর লেখাগুলো নেই?

এতক্ষণ এক ভদ্রলোক কথোপকথন শুনছিলেন পাশের সোফায় বসে। দেহ উদ্ধারের দিন যখন এসেছিলেন এই ফ্ল্যাটে, তখনও এঁকে দেখেছিলেন এসপি। নিজেই পরিচয় দেন ভদ্রলোক, ‘স্যার, আমি রঞ্জিত। রঞ্জিত পোদ্দার। আমার কাছে আছে রাকেশের রিসেন্ট বেশ কিছু লেখা। আমিও একটু-আধটু লেখার চেষ্টা করি। রাকেশ আর আমি ঠিক করেছিলাম, পরের বইমেলায় কবিতার বই বার করব দু’জনে। আমি কিছু লিখলে সবার আগে ওকে পড়তে দিতাম। রাকেশও যখন কিছু লিখত, আমাকে দিয়ে বলত, ‘‘কেমন হয়েছে?’’ ’

—বেশ তো, সময় নিয়ে বের করে ফেলুন বইটা।

—হ্যাঁ স্যার…

—আচ্ছা, ওঁর লেখাগুলো একটু দেখা যেতে পারে?

—হ্যাঁ, হোয়াই নট? রিসেন্ট লেখাগুলো আমার বাড়িতেই আছে। কিন্তু হাউ উইল দ্যাট হেল্‌প?

—না না, ইনভেসটিগেশনের জন্য নয়। এমনি দেখতাম। সাহিত্য আমারও পছন্দের বিষয়। অবশ্য আপনার আপত্তি থাকলে…

কথা শেষ হওয়ার আগেই রঞ্জিত বলে ওঠেন, ‘না স্যার, আপত্তি কিসের? আমার বাড়ি কাছেই, উল্টোডাঙায়। কাউকে যদি কাইন্ডলি পাঠিয়ে দেন, তার হাতে দিয়ে দেব লেখাগুলো। কিন্তু হিন্দি কবিতা… মানে আপনি…’

এসপি মৃদু হাসেন, ‘আমি বাঙালি, কিন্তু হিন্দি মোটামুটি পড়তে পারি।’

যে জন্য সকাল-সকাল ছুটে আসা বাগুইআটির এই ফ্ল্যাটে, সেটা হল। মিসেস গুপ্তার সঙ্গে একান্তে মিনিট পনেরো কথা। হুঁ-হাঁ আর হ্যাঁ-না-তেই উত্তর সীমাবদ্ধ রাখলেন মহিলা। নতুন তথ্য পাওয়া গেল না কিছু। মরিয়া পুলিশ সুপার শেষ চেষ্টা করলেন আন্দাজে ঢিল ছুড়ে, ‘ম্যাডাম, আমরা যা খবর পাচ্ছি, মিস্টার গুপ্তার একটা এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার ছিল… আপনি জানতেন কিছু?’ কবিতা স্থিরচোখে তাকালেন, ‘বিশ্বাস করি না। আপনারা ভুল খবর পেয়েছেন।’ কী আর বলার থাকে এরপর?

ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রঞ্জিত পোদ্দারকে দেখিয়ে ওসি ঘোলাকে নির্দেশ দিলেন এসপি, ‘ইনি উল্টোডাঙায় থাকেন। ঠিকানা নিয়ে নাও, লোক পাঠাও এখনই। উনি কিছু কাগজ দেবেন। ওগুলো আমার অফিসে পাঠিয়ে দিয়ো। অ্যাজ় আর্লি অ্যাজ় পসিবল।’

কিছুতেই যখন কিছু হচ্ছে না, তদন্ত যখন সর্বার্থেই ক্লুলেস, কেস যখন চলে যেতেই বসেছে সিআইডি-র কাছে, কী লিখতেন রাকেশ, সেটাই না হয় পড়ে দেখা যাক। কবিতা থেকে কবিমনের গতিপ্রকৃতির সন্ধান মেলে যদি!

.

সাদা কাগজে লেখা রাকেশের কবিতাগুলো পুলিশ সুপারের অফিসে পৌঁছল দুপুর আড়াইটের সামান্য পরে। হোঁচট খেতে খেতে কিছু শব্দ আর বাক্য পড়তে পারা এক, কবিতার রসাস্বাদন আরেক। লেখাগুলো উলটে-পালটে দেখতে গিয়ে এসপি বুঝে গেলেন, এর মর্মোদ্ধার তাঁর কম্মো নয়।

অরিজিৎকে ফোনে ধরলেন পুলিশ সুপার। অরিজিৎ, এসপি-র কলেজজীবনের সহপাঠী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ান।

‘এই অরিজিৎ, শোন না, একটা কাজ করে দিতে হবে। ইউনিভার্সিটিতে কতক্ষণ থাকবি?… কিছু হিন্দি কবিতা পাঠাব তোর কাছে। তোদের হিন্দি ডিপার্টমেন্টের কোনও প্রোফেসরকে পড়াতে পারবি ওগুলো? তারপর সেই প্রোফেসরের সঙ্গে একবার কথা বলব। আর ইংরেজির কাউকে বলে লেখাগুলো অনুবাদ করে দিতে বল প্লিজ়। হাতে সময় বেশি নেই। আজ রাতের মধ্যে হলে ভাল, না হলে লেটেস্ট কাল সকাল। করে দে ভাই।’

অরিজিৎ একটু অবাকই হন শুনে। তারপর রসিকতা করেন হালকা, ‘তা হলে চাকরিটা ছেড়েই দিচ্ছিস ফাইনালি? লেখার হাত তো তোর বরাবরই ভাল। লেখালিখি শুরু করবি নাকি পাকাপাকি? খুব ভাল। গুড ডিসিশন। চোর-ডাকাত ছেড়ে যখন কবিতায় মন দিয়েছিস…’

এসপি হাসেন, ‘আরে ধুর, এই লেট থার্টিজ়-এ আর কে চাকরি দেবে নতুন করে? দরকার আছে বলে বলছি। চাপে আছি রে একটু…’

অরিজিৎ বললেন, ‘ঠিক আছে। এখনই পাঠা। দেখছি।’

সে-রাতে হয়ে উঠল না। কিন্তু পরের দিন, বৃহস্পতিবার সকাল ন’টার মধ্যে এসপি-র বারাসতের বাংলোয় পৌঁছে গেল রাকেশ গুপ্তার সাম্প্রতিক হিন্দি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ।

দীর্ঘ কবিতা নয়। ষোলো থেকে আঠারো লাইন গড়ে। অনুবাদগুলো প্রত্যেকটাই পড়লেন এসপি। একবার নয়, দু’-তিনবার করে। ভদ্রলোক আহামরি কিছু লিখতেন না। প্রেমের কবিতা প্রত্যেকটাই। নির্দিষ্ট কাউকে ভেবে, কাউকে উদ্দেশ করে লেখা? অবশ্য তা-ই বা হতে হবে কেন ? নির্দিষ্ট কাউকে উদ্দিষ্ট হতেই হবে, এমন নিয়ম আছে নাকি প্রেমের কবিতায়?

কিন্তু তা হলে খটকা লাগছে কেন? কেন মনে হচ্ছে, কোথাও একটা যোগসূত্র লুকিয়ে আছে শব্দগুলোয় ? আবার পড়তে থাকেন এসপি। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি লাইন। এবং পড়তে পড়তেই ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি!’ তা হলে কি…?

অরিজিৎকে ফোনে ধরেন এসপি, ‘তোর ওই হিন্দি প্রোফেসরের নম্বরটা টেক্সট কর তো শিগগির। আর ওঁর নামটা বল।’

এসএমএস-এ নম্বরটা আসতেই মোবাইলের বোতাম টেপেন পুলিশ সুপার। হিন্দির অধ্যাপকের সঙ্গে কথোপকথন হয় এরকম।

—ভেরি সরি ত্রিপাঠীজি… বিরক্ত করছি একটু। কবিতাগুলোর অনুবাদ পড়লাম। একটা বিষয়ে আপনার মতামত জানা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে । তাই আপনাকে বিরক্ত করা…

—না না, বিরক্ত কিসের? বলুন না।

—কবিতাগুলো পড়ে আমার একটা জিনিস স্ট্রাইক করছে। আপনারও সেটা মাথায় এসেছে কিনা, সেটাই জাস্ট…

—বলুন না..

—দেখুন, কবিতাগুলো তো প্রেমের। কিন্তু শব্দের প্রয়োগ বলুন বা উপমার ব্যবহার… আমি স্পেসিফিকসে যাচ্ছি না, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এই কবিতা কোনও নারীকে উদ্দেশ করে কোনও পুরুষ লিখতে পারে না।

— হুঁ…

—আমার মনে হচ্ছে, এই কবিতা কোনও পুরুষ কবি শুধুমাত্র কোনও পুরুষকে উদ্দেশ করেই লিখতে পারেন। নির্দিষ্ট কেউ না-ই হতে পারে। কিন্তু এটা পুরুষের প্রতি পুরুষের প্রেমের কবিতা। সমকামের কবিতা। পুরুষের শরীরী বর্ণনা এত ডিটেলে… প্রায় প্রতিটা কবিতায়… আর উপমাগুলোও…

উত্তর আসে মোবাইলের অন্য প্রান্ত থেকে, ‘এসপি সাহেব, ইউ আর রাইট। পড়ে আমারও মনে হয়েছে এটা। খুব ডিস্টিঙ্কটলি মনে হয়েছে। অলমোস্ট আনমিস্টেকেবল।’

—থ্যাঙ্কস আ লট ত্রিপাঠীজি… এটাই জানার ছিল।

ফোনটা রেখে দিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসেন এসপি। রাকেশ গুপ্তার মেয়ে আছে আট বছরের। দ্বিতীয় সন্তান আগতপ্রায়। সেই লোক এমন কবিতা লিখতেন, যার ছত্রে ছত্রে সমকামের ঘোষণা? রাকেশ কি তা হলে উভকামী ছিলেন? এই উভকামিতার কথা কোনওভাবে জেনে গিয়েছিলেন বলেই কি ততটা শোকসন্তপ্ত দেখায়নি রাকেশের স্ত্রী-কে?

যদি ধরেই নেওয়া যায় যে রাকেশ উভকামী ছিলেন, তাতেই বা তদন্ত এগচ্ছে কোথায়? রাকেশের চরিত্রের একটা সম্ভাব্য দিকের ব্যাপারে আভাস পাওয়া গেছে মাত্র। ‘সূত্র’ কোনওভাবেই এখনও বলা যায় না একে। তদন্তকারী টিমকে এসপি জানালেন ব্যাপারটা, ‘মিস্টার গুপ্তা প্রবাবলি বাইসেক্সুয়াল ছিলেন… খোঁজখবর করার সময় এই অ্যাঙ্গলটা মাথায় রেখো।’

সোম, মঙ্গল, বুধ পেরিয়ে বৃহস্পতি শেষ হতে চলল। ব্রেক-থ্রু হল না এখনও। এই সপ্তাহের মধ্যে না হলে আগামী সোমবার জেলা পুলিশের থেকে কেস ডায়েরি চেয়ে নেওয়া হবে ভবানী ভবনে সিআইডি-র সদর দফতরে, বুঝতে পারছিলেন এসপি। একটু হতাশই লাগছিল।

হতাশা কাটার সামান্য সম্ভাবনা দেখা দিল শুক্রবার বিকেলে, আইসি জগদ্দল সুবীর চ্যাটার্জির ফোনে। উত্তেজিত শোনাচ্ছে সুবীরকে, ‘স্যার, আপনি বললেন না গুপ্তাসাহেব বাইসেক্সুয়াল ছিলেন হয়তো। ওঁর কোম্পানির অফিসে আমি সোমবার বিকেল থেকেই দু’জনকে ফিট করে রেখেছিলাম। এরা রাকেশের অর্ডারলির কাজ করত বেসিক্যালি। এই চা-টা দেওয়া, ভিজিটর হ্যান্ডল করা.. এসব আর কী! এ ক’দিন ফিমেল অ্যাঙ্গলেই কনসেনট্রেট করছিলাম… আজ অন্য অ্যাঙ্গলে খোঁজ নিলাম… অনেকক্ষণ কথা বললাম…’

—হুঁ… কী পেলেন?

—ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার! এরা বলছে একটা পঁচিশ-তিরিশ বছরের লোক গত তিন মাস ধরে মাসে অন্তত দু’বার রাকেশের চেম্বারে আসত। দুপুর বারোটা থেকে সোয়া বারোটার মধ্যে আসত। মিনিট দশ-পনেরো ঘরে থাকত। তারপর চলে যেত।

—সে তো একটা কর্পোরেট অফিসে একজন সিনিয়র এগজ়িকিউটিভের কাছে কত লোকই আসে। তাতে কী প্রমাণ হল?

—ঠিক স্যার, কিন্তু সঙ্গে আরও একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস বলছে। বলছে, যতক্ষণ এই লোকটা ঘরে থাকত, সাহেব নাকি বাইরে লাল বাতি জ্বালিয়ে দিতেন। অর্ডারলিকে বলেও দিতেন, যাতে ভিতরে কেউ না আসে। এটা নাকি কখনও অন্য কোনও ভিজিটরের ক্ষেত্রে করতেন না।

এসপি-কে এখনও নিরুত্তাপ শোনায়, ‘তাতেই বা কী এমন গুরুতর প্রমাণ হচ্ছে?’

—বলছি স্যার। গুপ্তাজি-র লাস্ট তিন মাসের ভিজিটর্স লিস্ট স্ক্যান করেছি গত ঘণ্টা দুয়েক ধরে। এই লোকটার আইডেন্টিটি এস্ট্যাব্লিশ করা গেছে স্যার। এর নাম চন্দন। চন্দন বসু। বনগাঁয় বাড়ি, ক্রিমিনাল হিস্ট্রি আছে স্যার…’

—কী হিস্ট্রি?

—আইসি বনগাঁ-কে ফোন করে নামটা দিয়েছিলাম স্যার। এসডিপিও বনগাঁ সাহেবকেও বলেছিলাম। এই কিছুক্ষণ আগে আইসি বনগাঁ ফোন করেছিলেন স্যার। থানার ‘অ্যারেস্ট রেজিস্টার’-এ নাম আছে এই চন্দনের। মাস ছয়েক আগে একে ডিস্ট্রিক্ট এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ অ্যারেস্ট করেছিল। ব্লু ফিল্‌মের অনেক সিডি সিজ় হয়েছিল সেই কেসে।’

এসপি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছেন এবার। কথা বলতে বলতেই পায়চারি করছেন দ্রুত। স্নায়ুতে উত্তেজনার লাবডুব টের পাচ্ছেন দিব্যি। রাকেশের উভকামী হওয়ায় আভাস কবিতায়, স্বামীর মৃত্যুর খবরেও স্ত্রী-র আপাত-নিরুত্তাপ থাকা, ব্লু ফিল্‌মের ব্যবসায় গ্রেফতার হওয়া যুবকের সঙ্গে মাসে দু’বার করে রাকেশের অফিস-বৈঠক….বিন্দুগুলো যোগ করলে সমাধান-রেখার একটা অবয়ব ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।

সুবীর প্রশ্ন করেন, ‘এই চন্দনটাকে তুলে নিই স্যার?’

—না, ডোন্ট রাশ। আগে ছেলেটার ফোন নম্বরটা নিয়ে নাও বনগাঁ থানা থেকে। পেয়ে যাবে অ্যারেস্ট রেজিস্টারে। রবিবার ১০ ফেব্রুয়ারি দুপুর থেকে সোমবার সকাল অবধি টাওয়ার লোকেশন নিয়ে জানাও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কোন সার্ভিস প্রোভাইডারের ফোন ইউজ় করে সেটা জানাও কুইকলি। আমি বলে দিচ্ছি ওদের টপ লেভেলে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পেয়ে যাবে সিডিআর।

ঘণ্টাখানেক পেরনোর আগেই সুবীর ফোন করলেন আবার। এবং যে চূড়ান্ত উত্তেজিত ভঙ্গিতে ‘স্যার!’ বলে কথা শুরু করলেন, পুলিশ সুপার বুঝে গেলেন, সমাধান আসন্ন।

‘স্যার, খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে! রবিবার দুপুর দুটো থেকে সোয়া তিনটে পর্যন্ত মাইকেলনগর, তারপর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত নিউ ব্যারাকপুর সেক্টরে স্ট্যাটিক। রাত দেড়টায় মুড়াগাছার কাছাকাছি!’

এসপি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন, ‘এবার তুলে নাও চন্দনকে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। বাড়িতে দুম করে রেইড করতে যেয়ো না। যদি না থাকে, তা হলে আসবেই না আর রেইড হওয়ার পর। হাওয়া হয়ে যাবে। আগে জেনে নাও, কোথায় আছে বা কোথায় থাকতে পারে। লোকাল ছেলে। খবর পাওয়াটা কঠিন হবে না। আমি এসডিপিও বনগাঁ-কে বলে দিচ্ছি। রেডি হয়ে টিম নিয়ে আধঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ো। সিভিল গাড়িতে। সিভিল ড্রেসে। কুইক!’

ওসি-র সোর্স নেটওয়ার্ক শক্তপোক্ত হলে একটা মহকুমা শহরে কারও অবস্থান ট্র্যাক করা কঠিন ব্যাপার নয় কিছু। দ্রুত জানা গেল, চন্দন বাড়িতে নেই। আছে শ্বশুরবাড়িতে, গোবরডাঙ্গায়। চন্দনকে গ্রেফতার করে পুলিশ যখন বারাসত রওনা দিল, তখন রাত সাড়ে ন’টা পেরিয়ে প্রায় পৌনে দশ।

‘না স্যার আমি কিছু করিনি’ বা ‘আমি কিছু জানি না’ জাতীয় বাক্যবন্ধ ব্যবহারের সুযোগই পেল না বছর তিরিশের চন্দন। কলার চেপে ধরে তাকে প্রথম প্রশ্নটাই করা হয়েছিল, ‘রাকেশ গুপ্তা বলে কাউকে চিনিস?’ এবং হতচকিত চন্দন ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছু বলার আগেই ঝটিতি প্রশ্ন নম্বর দুই, ‘গুপ্তাসাহেবেকে কোথায় নিয়ে গেছিলি মাইকেলনগর থেকে? রাত দেড়টায় মুড়াগাছায় কী করছিলি?’ চন্দন ততক্ষণে থরথরিয়ে কাঁপতে শুরু করেছে। কথা বেরচ্ছে না মুখ দিয়ে। ধেয়ে এল তিন নম্বর প্রশ্ন, ‘আমরা পুরোটাই জানি। শুধু তোর মুখ থেকে শুনতে চাই। একটা মিথ্যে বললে চামড়া গুটিয়ে দেব। এবং শুকোব তোর বাড়ির উঠোনেই। কে কে ছিলি, কেন মারলি, শুরু থেকে বল।’

এসপি-র পা জড়িয়ে ধরে এবার কেঁদে ফেলল চন্দন, ‘বলছি স্যার। কিছু মালকড়ি সালটে নেওয়ার প্ল্যান ছিল। জানে মেরে দেওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু গুপ্তা স্যার এমন চিল্লামিল্লি করলেন যে না মারলে ফেঁসে যেতাম।’

রাকেশ গুপ্তা হত্যা রহস্যের যবনিকা পতন। চন্দন শুরু করল একেবারে গোড়া থেকেই। মাস চারেক আগে যখন রাকেশ গুপ্তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সল্টলেকে।

‘আমি বন্ধুদের সঙ্গে সল্টলেকের সিটি সেন্টারে সিনেমা দেখে বেরচ্ছিলাম। সন্ধে হয়ে গেছে তখন। গুপ্তা স্যারও সিটি সেন্টারে এসেছিলেন। বেরচ্ছিলেন গাড়ি নিয়ে। সঙ্গে ওঁর মিসেস ছিলেন। ওঁর গাড়িটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। উনি নেমে বনেট খুলে ঠিকঠাক করার চেষ্টা করছিলেন। বৃষ্টি পড়ছিল। আমি গাড়ি সারাইয়ের টুকটাক কাজ শিখেছিলাম বারো ক্লাসের পর। দাঁড়িয়ে গিয়ে বলেছিলাম, কী হয়েছে, দেখব একটু স্যার? মিনিট কুড়ি নাড়াঘাঁটা করে গাড়িটা স্টার্ট করিয়ে দিয়েছিলাম। স্টার্ট নেওয়ার সময় পিছন থেকে ঠেলেও দিয়েছিলাম গাড়িটা।

গুপ্তা স্যার খুব খুশি হয়েছিলেন। টাকা দিতে চেয়েছিলেন। নিইনি। জানতে চেয়েছিলেন, কী করি, কোথায় থাকি। বলেছিলাম, তেমন কিছু করি না বলার মতো, বেকারই ধরতে পারেন। উনি ভিজিটিং কার্ড বার করে আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘একদিন অফিসে এসো, কী করা যায় দেখি।’’ সেই ওঁর সঙ্গে প্রথম আলাপ।’

—তা গেলি ওঁর অফিসে?

—দিন পনেরো পরে গেলাম। বড় চাকুরে, একটা কিছু ব্যবসাপাতিতে যদি হেল্‌প করেন, একটু ভালভাবে থাকতে পারব। বেকার ছেলে স্যার। পড়াশুনো ওই বারো ক্লাস অবধি। গ্যারেজে সারাইয়ের টুকটাক শিখেছিলাম। বাকি এদিক-সেদিক সাপ্লাইয়ের কাজ করতাম। খুব কম ইনকাম। তার মধ্যে বিয়ে করে ফেলেছিলাম বছর দুই আগে। টাকার খুব দরকার ছিল।

—সাপ্লাইয়ের কাজ ছাড়া আর কী করিস?

—ক্যাসেট আর সিডি-র দোকানে পার্ট টাইম কাজ করি। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকার কাজ।

—আর?

চন্দন একটু চুপ করে থেকে ফের বলতে শুরু করে।

—বনগাঁয় কয়েকটা জায়গা আছে স্যার, যেখানে লুকিয়ে ব্লু ফিল্‌ম শো চলে রাতের দিকে। সেখানে অপারেটরের কাজ করি মাঝে মাঝে। কোথায় এইসব সিডি পাওয়া যায়, কোথায় চটি বই পাওয়া যায়, সব জানি। হেব্বি ডিমান্ড এসব সিডি-র। সেগুলো ডেলিভারির কাজও করতাম। শো যারা চালাত, তারা যেমন যেমন বলত, যেখান থেকে যা সিডি আনতে বলত, আনতাম। পুলিশ আমাকে ধরেওছিল কিছুদিন আগে। কেস দিয়েছিল। সাতদিন জেলে ছিলাম। আমি স্যার একটু ভাল পথে রোজকারের রাস্তা খুঁজছিলাম।

— হুঁ…

—প্রথম দিন গুপ্তা স্যারের দেখা পেলাম না। অফিসে ছিলেন না। দিনসাতেক পরে আবার গেলাম। হাতজোড় করে বললাম, একটা কাজকর্মের ব্যবস্থা করে দিন না স্যার। উনি চা খাওয়ালেন। কতদূর পড়াশুনা করেছি, কী কাজ করি, সব খুঁটিয়ে জানতে চাইলেন। আমি যখন বললাম, ক্যাসেট আর সিডি -র দোকানে পার্টটাইম কাজ করি, উনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, কী ধরনের সিডি?

— তুই কী বললি?

—আমি স্যার প্রথমে বুঝতে পারিনি উনি ঠিক কী বলতে চাইছেন। বললাম, সিনেমার সিডি। তখন উনি আবার একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘কী ধরনের সিনেমা? ফিল্‌ম তো অনেক রকমের হয় । বড়দের ফিল্‌ম, ছোটদের ফিল্‌ম…’

গুপ্তা স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে এবার আমি কিছুটা আন্দাজ করতে পারলাম, উনি কী বলতে চাইছেন। আমি সাহস করে বলে ফেললাম, ‘যেমন চাইবেন, তেমন এনে দিতে পারি স্যার। যেমন বলবেন। থ্রি এক্স আছে স্যার।

গুপ্তা স্যার একটু হাসলেন। হেসে বললেন, ‘থ্রি এক্স-ও অনেক রকমের হয়।’ আমি আবার একটু থমকে গেলাম। চুপ করে আছি দেখে উনি বললেন, ‘আদমি-অওরত ছাড়াও থ্রি এক্স হয়। আদমি-আদমি হয়। অওরত-অওরত হয়।’ এবার ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে। গুপ্তা স্যার ‘আদমি-আদমি’ র ক্যাসেট পাওয়া যাবে কিনা জানতে চাইছেন। মার্কেটে আমরা যাকে ‘হোমো-সিডি’ বলি ।

এরপর একদম খোলাখুলি কথা হল। গুপ্তা স্যার বললেন, ‘তুমি আমাকে ক্যাসেট-সিডি এনে দেবে। অফিসেই আসবে। অফিসের ল্যান্ডলাইনে ফোন করে আমার পিএ-র থেকে টাইম চাইবে। কী জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট জানতে চাইলে বলবে, সাহেব সাপ্লাইয়ের কাজে ডেকেছেন। দিন আর সময় পিএ বলে দেবে। ভাল সিডি হলে ভাল টাকা দেব। আর তোমার অন্য কোনও কাজের ব্যাপারটাও দেখছি আমি।’

—বেশ… তারপর?

—আমি ওঁকে এ পর্যন্ত ছ’বার সিডি দিয়েছি। উনি প্রথমবার দু’হাজার টাকা দিয়েছিলেন। পরের বার থেকে তিন। আমার মাসে চার-পাঁচ হাজার বাড়তি রোজগার হচ্ছিল। আমি ওতেই খুশি ছিলাম, কিন্তু শিবু বলল, ‘কী পাতি চার-পাঁচ হাজারে খেলছিস…বড় দাঁও মারার কথা ভাব।’

—শিবু?

—শিবু আমার অনেকদিনের বন্ধু। একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি। এখন খড়দায় থাকে। একটা কারখানায় কাজ করে। মাঝে মাঝে আমরা ব্যারাকপুর স্টেশনে আড্ডা দিই শনি-রবিবার। আড্ডায় গুপ্তা স্যারের কথা বলতে শিবু লাফিয়ে উঠেছিল, ‘তুই কি গাধা নাকি! এটা মাসে চার-পাঁচ হাজারের কেসই না। মিনিমাম চার-পাঁচ লাখ!’ আমি বললাম, মানে?

শিবু বলল, মালটা এত বড় চাকরি করে। নিজের ফ্ল্যাট ভিআইপি রোডের উপর। ওকে একটা টোপ দে। বল, একটা দারুণ সিডি আছে, কিন্তু ভাড়া দেওয়া যাবে না। কোনও একটা জায়গায় গিয়ে দেখতে হবে। আমি বললাম, কিন্তু যদি না আসে? শিবু হাসল। বলল, আরে আসবে আসবে, ওর বাপ আসবে… ঠিক আসবে। তুই লোভ দেখাবি, বলবি, রিয়েল সিনও থাকবে। আমি বললাম, রিয়েল সিন মানে? শিবু বলল, আরে গাধা, বলবি পার্টনার রেডি থাকবে তোর স্যারের জন্য। মাথায় ঢুকল? আমি বললাম, সে না হয় এল, তারপর?

শিবু বলল, ‘তারপর তো সোজা। বলব, লাখ চারেক ছাড়ুন, না হলে আপনার কীর্তি ফাঁস করে দেব। বাড়িতে আর অফিসে সবাই জানবে, বউ প্রেগন্যান্ট, একটা বাচ্চা মেয়েও আছে আর আপনি মাসে মাসে হোমো-সিডি আনিয়ে দেখছেন। দেখবি সুড়সুড় করে মাল খসাতে রাজি হয়ে যাবে। দু’-একটা আরও ছেলেপুলে লাগবে কাজটায়। ভাব একবার, যদি চারজন-ও হয়, পার হেড লাখখানেক। যদি দু’লাখ পাওয়া যায়, তা হলেও পঞ্চাশ হাজার!’

শিবুর কথা শুনে মাথাটা ঘুরে গেল আমার। এক লাখ পার হেড? মাসে সাকুল্যে আট-দশ হাজার রোজগার হয় এদিক-ওদিক করে। তা-ও সব মাসে নয়। সেখানে একেবারে লাখখানেক পেয়ে গেলে তো নিজের একটা ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করার কথা ভাবা যাবে অন্তত। রাজি হয়ে গেলাম শিবুর কথায়।

আইসি ঘোলা আর থাকতে পারেন না, ‘তুই যেভাবে বলছিস, মনে হচ্ছে ভাজা মাছ উলটে খেতে জানিস না। সবই শিবুর প্ল্যান। সবই শিবু বুঝিয়েছে, শিবু করিয়েছে। শিবু ধরা পড়লে ঠিক উলটো বলবে। বলবে, পুরোটাই তোর প্ল্যান।’

—না স্যার… বিশ্বাস করুন! শিবুই আমাকে…

—হয়েছে হয়েছে… বাকিটা বল…

—শিবু আর আমি ভাবতে বসলাম, কোথায় আনা যায় গুপ্তা স্যারকে? একটা বাড়ির ব্যবস্থা তো করতে হবে। কে করবে, কোথায় করবে? শিবু আমাকে বলল বাসুদার হেল্‌প লাগবে। ‘বাসুদা’ নিউ ব্যারাকপুর এলাকার নামকরা মস্তান ছিল একসময়। আমি আর শিবু গেলাম বাসুদার কাছে। বাসুদা ফুটিয়ে দিল আমাদের। বলল, ‘কোনও ঝামেলার মধ্যে আমি থাকি না আর, তোরা তো জানিসই।’

শিবু দমল না। বাসুদার বোন ফুলমণিকে চিনত আগে থেকে। গিয়ে ধরল একটু পরে। বলল, দিদি, একটা কিছু ব্যবস্থা করো। আমাদের ছোট একটা কাজ আছে। কোনও বাওয়াল হবে না। তোমাকে হাজার পাঁচেক দেব কাজ হয়ে গেলে। ফুলমণি মধ্যমগ্রাম বাজারে সবজি বিক্রি করে। টানাটানির সংসার। বলল, দাঁড়া, দেখছি। তোরা কাল আয়।

পরের দিন আবার গেলাম। ফুলমণি বলল, ‘ব্যবস্থা হয়েছে। নিউ ব্যারাকপুরে দাদার একটা পুরনো দোতলা বাড়ি আছে। বছরের অর্ধেক সময় খালি থাকে। মাঝে মাঝে আমি গিয়ে ঝাড়পোঁছ করে আসি। ওই বাড়িটার চাবি নিয়ে রাখব আমি। তোদের আজ বাড়িটা দেখিয়ে দিচ্ছি চল।’ বাড়ি দেখে এলাম।

—তারপর?

—যেমনটা প্ল্যান ছিল তেমনটাই হল। শিবু ঠিকই ধরেছিল। গত শনিবার ওঁর অফিসে গিয়ে সিডি আর ‘রিয়েল সিন’-এর কথা বলতে গুপ্তাজি রাজি হয়ে গেলেন। রবিবার দুপুর একটা নাগাদ মাইকেলনগরে আসতে বললাম। উনি বললেন, আড়াইটের আগে হবে না। ওই আড়াইটে নাগাদই ট্যাক্সি করে এলেন। আমি নিয়ে গেলাম বাসুদার বাড়িটায়। মাইকেলনগর মোড় থেকে হেঁটে মিনিট পনেরো-কুড়ি বড়জোর। ঢুকে দেখলাম, শিবুর সঙ্গে আর একটা ছেলে আছে। শিবু আলাপ করাল। বলল, নাম জিৎ। খড়দার ছেলে। আর ছিল লক্ষ্মী।

—লক্ষ্মী আবার কে?

—স্যার, ঘোলা এলাকাতেই থাকে। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া। একসঙ্গে থাকে না। শিবুর সঙ্গে আগে অনেকবার দেখেছি। ওদের মধ্যে রিলেশন আছে একটা।

—বলতে থাক…

—ঘরটা খুব নোংরা অবস্থায় ছিল। তিন-চারটে খালি বিয়ারের বোতল মেঝেতে পড়ে ছিল। খাটের উপর বেশ কয়েকটা সিডি আর কয়েকটা হিন্দি চটি বই ছিল। গুপ্তাস্যার বুঝলাম হকচকিয়ে গেছেন। অভ্যেস নেই তো এইসব জায়গায় আসার। শিবু বলল, ‘বসুন স্যার, বসুন। আপনার একটু অসুবিধে হবে এখানে। কিন্তু এসব কাজ তো খুব ভদ্র জায়গায় করা মুশকিল, বোঝেনই তো…’

গুপ্তাজি বসলেন না। ওঁর মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলাম, খুব অস্বস্তি হচ্ছে। একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘এখানে প্রোজেক্টর কোথায়? সিডি-টা দেখব কী করে?’

শিবু বলল, ‘ওসব আধঘণ্টার মধ্যে এসে যাবে। ততক্ষণ আপনি এই বইগুলো দেখতে পারেন, হেব্বি হেব্বি ছবি আছে।’ তারপর জিৎ বলে ছেলেটাকে বলল, ‘সাহেবকে ঢেলে দে না একটা।’

জিৎ বলল, ‘বিয়ার খাবেন একটু স্যার? আপনার অনারে আজ ইংলিশ মালও আছে। হুইস্কি চলবে? একটু নেশাটা ধরুক, তারপর ‘‘রিয়েল সিন’’ হবে।’

গুপ্তা স্যার রেগে গেলেন। সোজা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চন্দন, হোয়াট ইজ় দিস? আমি এখানে মদ খেতে আসিনি। এসব কী? তুমি আমাকে সিডিগুলো দাও, আমি দেখে নেক্সট উইক ফেরত দিয়ে দেব।’

আমি বললাম, ‘স্যার, প্রোজেক্টর এসে যাবে একটু পরেই। আপনি একটু ধৈর্য ধরে বসুন। আর এই সিডিগুলো বাইরে দেওয়া যাবে না, আপনাকে তো বলেছিলাম আগে!’

উনি এবার আরও খচে গেলেন, ‘আমি এখানে আর অপেক্ষা করতে পারব না। তোমার কথায় এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে, আমি চলে যাচ্ছি।’

গুপ্তা স্যার দরজার দিকে এগনো মাত্রই মেঝেতে বসা শিবু লাফ দিয়ে উঠল। সঙ্গে জিৎ-ও। দেখলাম, শিবু কোমরে গোঁজা ছুরি বার করেছে। লক্ষ্মী ছুটে দরজা আটকে দাঁড়াল। আর নিমেষের মধ্যে গুপ্তা স্যারের হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিল জিৎ। আমাকে দিয়ে বলল, ‘ফোনটা সুইচ অফ কর।’

গুপ্তা স্যার তখন ভয় পেয়ে গেছেন। আমার দিকে তাকালেন, বললেন, ‘মুঝে যানে দো।’

শিবু বলল, ‘স্যার, আপনাকে আমরা আটকে রাখব বলে আনিনি, আপনি শুধু পাঁচ লাখ টাকা আমাদের দেবেন সাতদিনের মধ্যে, ব্যস।’

গুপ্তা স্যার একটু সামলে উঠেছেন তখন। বললেন, ‘টাকা! কিসের টাকা! এক পয়সাও দেব না।’

শিবুর উত্তর রেডিই ছিল, ‘দিতে তো হবেই স্যার। না হলে আপনার মানইজ্জত সব মায়ের ভোগে যাবে। বাড়িতে বউ আছে…মেয়ে আছে… আরেকটা বাচ্চা হবে আর আপনি হোমো সিডির ডেলিভারি নিচ্ছেন মাসে মাসে, এটা পাড়ায়-অফিসে জানাজানি হলে লাইফ বিলা হয়ে যাবে স্যার… একটু ভেবে দেখুন… মাত্র তো লাখ পাঁচেক।’

গুপ্তা স্যার আবার খার খেয়ে গেলেন, চিল্লামিল্লি শুরু করলেন, ‘দেব না! শুনে রাখো, দেব না! একটা পয়সাও না! তোমরা যেখানে ইচ্ছে যা খুশি বলতে পারো। লোকে তোমাদের মতো পেটি ক্রিমিনালদের বিশ্বাস করবে নাকি আমাকে, সেটা আমিও দেখব। তোমাদের ধারণা নেই তোমরা কাকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছ। অনেক মন্ত্রী, অনেক বড় অফিসারদের আমি পারসোন্যালি চিনি, তোমাদের সবক’টার মুখ চিনে রাখছি। এই জায়গাটাও আমার মনে থাকবে। সবাইকে জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়ব। চন্দন, তোমাকে সারাজীবন আফশোস করতে হবে এটার জন্য…’

শিবু এক পা পিছিয়ে গেল। চোখাচোখি হল আমার আর জিতের সঙ্গে। আমরা বুঝে গেলাম, গুপ্তা স্যার ঠিকই বলছেন। আমরা পাতি চ্যাংড়া। পুলিশ কেস খেয়েছি আগে। আর উনি বড় অফিসার। অনেক জানাশুনো। ঠিকই তো, আমাদের কথা কে বিশ্বাস করবে? আর উনি সিডি নিয়েছেন, দেখেছেন, আবার নিয়েছেন, কোনও প্রমাণ তো নেই এসবের! উনি এখন যদি পুলিশে কমপ্লেন করেন, আমরা ওঁকে কিডন্যাপ করে এখানে আটকে রেখে টাকা চেয়েছি, আমাদের জিন্দগি পুরো বরবাদ। ওঁকে বাঁচিয়ে রাখলে আমরা ফিনিশ হয়ে যেতাম স্যার!

—সে তো এখনও ফিনিশই হবি! বাকি জীবনটা জেলেই কাটাবি! যাক গে… তারপর?

—চোখে চোখে কথা হয়ে গেল আমাদের। শিবু লক্ষ্মীকে বলল, ‘ভিতরের ঘরে দড়ি আছে, চট করে!…. এই চন্দন… মুখটা চেপে ধর শিগগির…।’ আমি আর জিৎ মিলে মুখ চেপে ধরে খাটের উপর ফেলে দিলাম গুপ্তা স্যারকে। উনি হাত-পা নাড়িয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। শিবু ছুরিটা গলার কাছে ধরল, উনি ভয়ে স্থির হয়ে গেলেন।

লক্ষ্মী ততক্ষণে নাইলনের দড়ি নিয়ে এসেছে একগোছা। শিবু আমাকে বলল, ‘দড়িটা দিয়ে ফাঁস দে গলায়, না হলে আমরা ফিনিশ হয়ে যাব।’ আমার হাত-পা কাঁপছিল স্যার। এমন হবে ভাবিনি তো আগে, মাথা কাজ করছিল না। শিবু ছুরি চালিয়ে দিল গুপ্তা স্যারের বুকে। আমি আর জিৎ মিলে দড়ির ফাঁস দিলাম গলায়। চোখ ঠেলে বেরিয়ে এল একটু পরেই। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল।

—হুঁ…

—আমরা চুপচাপ বসে রইলাম কিছুক্ষণ। শিবু-আমি-জিৎ-লক্ষ্মী আমরা চারজনই ঘামছিলাম। কী করতে কী হয়ে গেল! এখন উপায়? সবসুদ্ধ তো সেই জেলেই যেতে হবে।

শিবুই প্ল্যান বাতলাল একটা। বলল, ‘বাঁচার একটাই রাস্তা এখন। বেশি রাতের দিকে বডিটা খালাস করে দিতে হবে।’

—কীভাবে খালাস করলি?

খালাস-পর্বের সারসংক্ষেপ এই।

—সন্ধের পর শিবু বেরিয়ে গিয়ে একটা বস্তা জোগাড় করে আনল। দড়িও আনল বাড়তি। বডি পাওয়া গেলেও যাতে চট করে চেনা না যায়, তাই একটা থান ইট দিয়ে রাকেশের মুখটা থেঁতলে দিল জিৎ। তারপর বেরিয়ে গেল গাড়ির খোঁজে, যাতে নিয়ে যাওয়া হবে বডি।

…কিন্তু কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে? লক্ষ্মী বলল, মুড়াগাছার পুকুরপাড়ের কথা। জিৎ একটা ম্যাটাডোর জোগাড় করে আনল রাত সাড়ে দশটায়। শিবু লক্ষ্মীকে বলল, একটা ব্লাউজ় আর লেডি‌জ় রুমাল আনতে। নাইলনের দড়ি দিয়ে বডিটাকে বাঁধার পর ব্লাউজ় আর রুমালটা রাখলাম বডির উপর। বডি পাওয়া গেলে যাতে পুলিশ ভাবে, মেয়ে-কেসে উনি ফেঁসে গেছিলেন। এরপর বডি বস্তাবন্দি করা, বস্তাকে নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা। আর রাত একটার পর ম্যাটাডোরে চাপিয়ে মুড়াগাছায় বস্তা ফেলে আসা।’

চন্দনের বয়ান শেষ হওয়া মাত্রই স্থির হয়ে গেল পরবর্তী করণীয়। চন্দনকে নিয়ে একটা টিম বেরল নিউ ব্যারাকপুরের সেই বাড়িতে, যেখানে রাকেশকে মারা হয়েছিল। খাটে এবং মেঝেতে রক্তের দাগ শুকিয়ে আছে এখনও। পড়ে আছে বিয়ার আর হুইস্কির বোতল। চশমার ভাঙা টুকরো। পড়ে রয়েছে নাইলনের দড়ি কয়েকগাছা। হিন্দি বই কয়েকটা, অশ্লীল ছবি ভরতি। সিডিগুলো কোথায়? চন্দন জানাল, ‘বনগাঁর বাড়িতে আছে।’

অন্য আরেকটা টিম ততক্ষণে খড়দা থানায় পৌঁছে গেছে। অ্যারেস্ট রেজিস্টার থেকে জানা হয়ে গেছে, মিঠুন ওরফে জিৎ ঘোষ নামে এক যুবক কয়েকমাস আগে ছিঁচকে চুরির কেসে অ্যারেস্ট হয়েছিল। ভোরের মধ্যেই খড়দা থানার হাজতে ঠাঁই হল জিতের। বাড়ি থেকে উদ্ধার হল একটা দামি ঘড়ি আর সোনার আংটি।

বাকি ছিল লক্ষ্মী আর শিবু। লক্ষ্মীকে থানার স্থানীয় সোর্সরা সবাই চিনত। পাওয়া গেল বাড়িতেই। একটা গলার চেন উদ্ধার হল বাড়ি থেকে। শিবুকে পাওয়া গেল না ভোররাতের ‘রেইড’-এ। গত দু’-তিনদিন ধরে বাড়িতে নেই। মোবাইল নম্বরও সুইচ্‌ড অফ সেই থেকেই। শেষ টাওয়ার লোকেশন, হাওড়া স্টেশন চত্বর। শহরের বাইরে পালিয়েছে কিছু আঁচ করে?

পরের দিন সকাল আটটা নাগাদ ডিজি-কে ফোনে ধরলেন পুলিশ সুপার।

—স্যার, ওই মার্ডারটা… ডিটেকটেড স্যার… থ্রি আউট অফ ফোর অ্যারেস্টেড…কনফেসও করেছে।

—ইজ় ইট? আমি তো ভাবছিলাম আজ আবার তোমাকে ফোন করব প্রোগ্রেস জানতে। হোয়াটস দ্য স্টোরি? কারা করল? কেন করল? উইমেন? অর ওয়েলথ?

—নাইদার স্যার। বাইসেক্সুয়ালিটি অ্যান্ড ব্ল্যাকমেল।

ডিজি একটু থমকে যান শুনে। পুলিশ সুপার পুরোটা বলেন। বাক্যালাপ শেষে উচ্ছ্বসিত শোনায় রাজ্যের পুলিশ প্রধানকে, ‘হার্টিয়েস্ট কনগ্র্যাচুলেশনস! প্রাউড অফ ইয়োর টিম!’

ফোনটা রেখে একটা লম্বা শ্বাস নেন এসপি। ভাগ্যিস সেদিন রাকেশের বোন দাদার ছবির কোলাজ বানাচ্ছিলেন, ভাগ্যিস চোখ পড়েছিল রাকেশের কবিতাপাঠের ছবিতে!

প্রমাণ সংহত করে যত দ্রুত সম্ভব চার্জশিট জমা দেওয়ার জরুরি দায়িত্বটা আইসি ঘোলা তপনকুমার বিশ্বাসকে দিয়েছিলেন পুলিশ সুপার। কিনারা-পরবর্তী অধ্যায়ে তপনই ছিলেন মামলার তদন্তকারী অফিসার।

নিউ ব্যারাকপুরের যে বাড়িতে খুন হন রাকেশ, তার পূর্ণাঙ্গ ফরেনসিক পরীক্ষা হয়েছিল। খাটে আর মেঝেতে পড়ে থাকা রক্তের নমুনা যে মানবদেহের, প্রমাণিত হয়েছিল। এবং সেই নমুনার সঙ্গে মিলে গিয়েছিল পোস্টমর্টেম পর্বে সংগৃহীত রাকেশের ‘ব্লাড স্যাম্পল’, মিলে গিয়েছিল গ্ৰুপ। যে চশমার ভাঙা টুকরো পাওয়া গিয়েছিল ঘরে, তা যে রাকেশেরই, চিহ্নিত করেছিলেন আত্মীয়বন্ধুরা। জিতের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া ঘড়ি-আংটি এবং লক্ষ্মীর বাড়ির তল্লাশিতে পাওয়া চেনও যে রাকেশরই, শনাক্ত হয়েছিল অনায়াসে। ঘর থেকে বাজেয়াপ্ত হওয়া বিয়ার-হুইস্কির বোতলে আঙুলের ছাপ মিলেছিল শিবু-চন্দন-জিতের। চন্দনের বনগাঁর বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছিল প্রায় একডজন সমকাম-বিষয়ক সিডি।

যে ম্যাটাডোরে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাকেশের দেহ, সেটা চিহ্নিত করে বাজেয়াপ্ত করা গিয়েছিল সহজেই। দেহ পাচারের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ম্যাটাডোর-চালকের সাক্ষ্য। যিনি ‘টেস্ট আইডেন্টিফিকেশন’ প্যারেডে চিনিয়ে দিয়েছিলেন চার অভিযুক্তকে। সর্বোপরি, ফৌজদারি বিধির ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গোপন জবানবন্দিতে নিজেদের অপরাধ কবুল করেছিল চন্দন-জিৎ-লক্ষ্মী।

শিবু কিছুটা বেগ দিয়েছিল পুলিশকে। ধরা যায়নি তাড়াতাড়ি। শিবুকে ‘ফেরার’ দেখিয়েই চার্জশিট জমা দিয়েছিলেন তপন। প্রায় বছরখানেক চোর-পুলিশ খেলার পর ধরা পড়েছিল শিবু।

বিচারপর্ব শেষ হয়েছিল দ্রুত। রায় বেরিয়েছিল ২০১০-এর ৩০ এপ্রিল। শিবু-জিৎ-চন্দন-লক্ষ্মী, চারজনের জন্যই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বরাদ্দ করেছিলেন বারাসত ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারক। চক্রী-চতুষ্টয় এখনও সংশোধনাগারেই।

.

সামাজিক চাপ বড় বিষম বস্তু। সামাজিক নির্মাণও। রাকেশ গুপ্তা এই চাপের শিকার হয়েছিলেন। এই নির্মাণেরই বলি হয়েছিলেন শেষ বিচারে। ভদ্রলোকের লেখা কবিতাগুলোয় স্পষ্ট বেরিয়ে আসে ওঁর সমকামী সত্তা। সামাজিক নির্মাণের ব্যাকরণে যে সত্তাকে প্রথম জীবনে নিজে চিনতে পারেননি, বা পারলেও সেই সত্তাকে তার প্রাপ্য দিতে পারেননি। সেই সত্তাকে স্বীকার করে যখন তাতে সাড়া দিতে চেয়েছিলেন, দুর্লঙ্ঘ্য পাঁচিল তুলে দাঁড়িয়েছিল সামাজিক চাপ।

শরীরে-মনে কী চূড়ান্ত টানাপোড়েনই না সহ্য করতে হয়েছিল ভদ্রলোককে! বাহ্যত সুখী দাম্পত্যজীবন

স্ত্রী-কন্যা নিয়ে। পেশাগত জীবনে প্রতিষ্ঠিত। নিজে আদপে যা, সেটা সমাজ-সংসারে গোপন রাখার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা একদিকে, অন্যদিকে নিজের জৈবিক চাহিদার তাড়নায় দগ্ধ হতে থাকা নিরন্তর। এবং শেষমেশ প্রাণ দেওয়া এই সংঘাতের যূপকাষ্ঠে।

কী মর্মান্তিক ট্র্যাপিজ়-জীবন! মৃত্যুই বোধহয় ছিল একমাত্র পরিত্রাণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *