২১.
কি হয়েছে, ফ্র্যাঞ্চেস্কো? খাওয়া শেষ করে সবাই উঠে যেতে ওকে একা পেয়ে নরম কণ্ঠে জানতে চাইল ভ্যালেনটিনা। ভুরু কুঁচকে কি ভাবছ এত?
ব্যাব্বিয়ানোর কোনও খবরই নেই, ভ্যালেনটিনা, বলল সে। বড় দুশ্চিন্তায় আছি। সীজার বর্জিয়ারই বা কি খবর জানতে পারলে হতো।
চেয়ার ছেড়ে পাশে এসে দাঁড়াল ভ্যালেনটিনা, মৃদু হেসে একটা হাত রাখল ওর কাঁধে। এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তা করছ! এই সেদিন না তুমি বললে মনে মনে চাও, এ অবরোধ থাকুক চিরকাল, কোনদিন যেন এর শেষ না হয়!
ওর আঙুলে চুমো দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। বলল, সে তো তোমার মন জানার আগেব কথা, মোন্না। এখন আমি চাই, যত শীঘ্রি এখান থেকে অবরোধ তুলে নিয়ে জিয়ান মারিয়া দূর হয়ে যায় ততই আমাদের জন্যে ভাল। সেই জন্যেই পাগল হয়ে আছি ব্যাব্বিয়ানোর খবর জানার জন্যে।
যা হবার নয়, তাই নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছ। বাইরের দুনিয়ার খবর এখানে পৌঁছবে কি করে শুনি?
ফ্রাঞ্চেস্কো ভাবল এই সুযোগে নিজের সত্যিকার পরিচয়টা জানিয়ে দেবে কি না। এখন বলা যেতে পারে, কারণ এখন আর তাকে জিয়ান মারিয়ার গুপ্তচর মনে করবে না ভ্যালেনটিনা। কারও প্ররোচনাতেই আর অবিশ্বাস করবে না ওকে। বলবে বলে মুখটা খুলেছে ফ্র্যাঞ্চেস্কো, এমনি সময়ে বাইরে পায়ের আওয়াজ পেয়ে সরে গেল ভ্যালেনটিনা ওর পাশ থেকে, দাঁড়াল গিয়ে জানালার ধারে। পরমুহূর্তে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল রোমিও গনৎসাগা। ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে দেখে একটু থমকে দাঁড়াল, তারপর দরজা খোলা রেখেই ঢুকল ভিতরে।
মোন্না ভ্যালেনটিনা, তোমার সঙ্গে জরুরী একটা আলাপ ছিল। সামান্য কেঁপে গেল ওর গলাটা। ফ্র্যাঞ্চেস্কোর দিকে ফিরে বলল, ব্যাপারটা কিছুটা ব্যক্তিগত। আপনি যদি দয়া করে… দরজাটা দেখাল সে চোখের ইশারায়।
ঠিক আছে, কাজও আছে আমার, বলে উঠে দাঁড়াল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, আধঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে টহল পরীক্ষা করতে যাব। বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে, পিছনে ভিড়িয়ে দিল দরাটা।
দরজা খুলে দেখে নিল গন্ৎসাগা, সন্ধ্যিই ফ্র্যাঞ্চেস্কো চলে গেছে, না কি কান পেতে দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। নিশ্চিন্ত হয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে ফিরে এলো।
আমি যা বলব সেটা তোমার বিশ্বাস হতে চাইবে না, ম্যাডোনা। প্রথমেই মনে হবে বিদ্বেষের বশে মিথ্যা বানিয়ে বলছি, কিন্তু আমার অনুরোধ: কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাধা দিয়ে না আমাকে।
ভণিতা শুনে ওর দিকে কয়েক মুহূর্ত বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ভ্যালেনটিনা, তারপর বলল, কথা শুনে ভয়ই লাগছে, গনৎসাগা!”
দুঃখের বিষয়, জঘন্য এক বিশ্বাসঘাতকের নীচ প্রতারণা ধরা পড়েছে আমার হাতে, এবং তোমার সামনে তুলে ধরতে হচ্ছে আমাকেই।
প্রতারণা? ভুরু কুঁচকে চাইল ভ্যালেনটিনা ওর দিকে, কে কাকে প্রতারণা করছে।
অ্যাকুইলার কাউন্টের নাম শুনেছ কখনও?
কেন শুনব না? ইটালীর সবচেয়ে সম্মানিত, স্বনামধন্য বীর উনি।
ব্যাব্বিয়ানোর সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা জানা আছে তোমার?।
শুনেছি, ওখানে সবার প্রিয় তিনি।
এটা জান, যে জিয়ান মারিয়ার আপন মামাতো ভাই তিনি, ব্যাব্বিয়ানোর সিংহাসনের একজন দাবিদার।
আত্মীয়তার কথাটা জানি, কিন্তু তিনি যে সিংহাসনটা দারি করছেন, এমন কথা শুনিনি। কিন্তু, গনৎসাগা, প্রতারণার কথা বলতে গিয়ে এসব অপ্রাসঙ্গিক কথা আসছে কেন?
অপ্রাসঙ্গিক নয়, ম্যাডোনা! জোবের সাথে বলল গনৎসাগা। প্রতারণার কথায় আসছি এখুনি। বললে বিশ্বাস করবে, এখানে এই রোক্কালিয়নে কাউন্ট অভ অ্যাকুইলার একজন চর আছে, জিয়ান মারিয়াকে এখানে আটকে রেখে যে তার মনিবের স্বার্থ রক্ষা করছে?
দেখো গনৎসাগা-
দাড়াও ম্যাডোনা! আমার কথা শেষ করতে দাও। যা বলছি, তার অকাট্য প্রমাণ আছে আমার হাতে, সাক্ষী আছে। সেই এজেন্টের কাজ হচ্ছে দুর্গের অবরোধ যতটা সম্ভব দীর্ঘ করা, প্রতিরক্ষার কাজে তোমাকে সাহায্য করা; যাতে সীজার বর্জিয়ার ভয়ে অস্থির হয়ে ব্যাব্বিয়ানোর জনসাধারণ জিয়ান মারিয়াকে তাড়িয়ে দিয়ে অ্যাকুইলার কাউন্টকে ক্ষমতায় বসায়।
কোথায় পেলে এই বাজে, বানোয়াট গল্প? লাল হয়ে উঠেছে ভ্যালেনটিনার গাল।
ম্যাডোনা, তুমি যাকে বানোয়াট গল্প বলছ, সেটা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। আমার কাছে প্রমাণ আছে: ব্যাব্বিয়ানোর জনগণজিয়ান মারিয়াকে চমপত্র দিয়েছে-তিন দিনের মধ্যে রাজধানীতে না ফিরলে ডিউকাল মুকুট ওরা পরিয়ে দেবে কাউন্ট অভ অ্যাকুইলার মাথায়। সে আয়োজন প্রায় সম্পূর্ণ করে এনেছে তার এজেন্ট।
রেগে গেছে, কিন্তু গলার স্বর শান্ত রাখল ভ্যালেনটিনা। বলল, হতে পারে, ব্যাব্বিয়ানোর রাজনীতি সম্পর্কে যা বলছ তা ঠিক, আমাদের প্রতিরক্ষার কারণে হয়তো সত্যিই সিংহাসন খোয়াতে বসেছে জিয়ান মারিয়া, এবং তার ফলে সুবিধা হয়ে গেছে কাউন্ট অভ অ্যাকুইলার। তাতে তো এটা প্রমাণ হয় না যে তুমি যার প্রতি ইঙ্গিত করছ সেই মেসার ফ্র্যাঞ্চেঙ্কো অ্যাকুইলার গুপ্তচর। এই মিথ্যা বলার জন্যে তোমাকে শাস্তি পেতে হবে, গনৎসাগা!
দিয়ো, বলল সে। মিথ্যা হলে শাস্তি দিয়ে, আমি সেটা মাথা। পেতে নেব। অবশ্য ঠিকই ধরেছ, মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কো অ্যাকুইলার গুপ্তচর, আমার এ কথাটা পুরোপুরি সঠিক নয়।
এই তো, এখনই কথা ঘোরাতে শুরু করেছ!
সামান্য একটু। ও এজেন্ট নয়, ম্যাডোনা-ও নিজেই কাউন্ট অত অ্যাবুইলা, ফ্র্যাঞ্চেস্কো ডেল ফ্যালকো!
বোঁ করে ঘুরে উঠল ভ্যালেনটিনার মাথাটা। রক্ত সরে গেল মুখ থেকে। প্রথমে টেবিলে হেলান দিল, তারপর বসে পড়ল একটা চেয়ারে। একটু সামলে নিয়ে তীব্র দৃষ্টি হানল সে গনৎসাগার দিকে। মিথ্যুক কোথাকার! চাবুক মেরে তোমার পিঠের…!
কাঁধ ঝাঁকাল গনৎসাগা। তারপর ফ্র্যাঞ্চেস্কোর চিঠিটা ছুঁড়ে দিল টেবিলের উপর। এই নাও প্রমাণ।
হঠাৎ ভয় পেল ভ্যালেনটিনা; ও যা বলছে যদি সব সত্যি হয়ে যায়! গনৎসাগার আত্মবিশ্বাসের অভাব নেই। চিঠিটার দিকে হাত বাড়াতে গিয়েও জিজ্ঞেস করল, কি আছে ওতে?
আজই রাতে ওটা নিয়ে এসেছে একজন লোক। পরিখার পানিতে সাঁতার কাটছিল, রশি নামিয়ে তোলা হয়েছে ওকে। আর্মারি টাওয়ারে তাকে আটকে রাখা হয়েছে। চিঠিটা কাউন্ট অভ অ্যাকুইলাকে লিখেছে ফ্যানফুল্লা ডেল্পি আর্চিপ্রেটি বলে একজন লোক। তোমার হয়তো মনে পড়বে, সেই সেদিন অ্যাকুয়াম্পার্টার জঙ্গলে এই সম্ভ্রান্ত, সুদর্শন লোকটা মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কোর সঙ্গে খুব সম্মান করে কথা বলছিল।
মনে পড়ল ভ্যালেনটিনার। আরও মনে পড়ল, এই একটু আগে ক্যাব্বিয়ানোর খবর পাচ্ছে না বলে মন খারাপ করে এখানে বসেছিল ফ্র্যাঞ্চেঙ্কো। রোকালিয়নে বসে কি করে সে বাইরের খবর পাবে জিজ্ঞেস করায় কেমন যেন দ্বিধায় পড়েছিল সে, এমন সময় ঘরে ঢুকল গনৎসাগা। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তুলে নিল সে চিঠিটা, ভুরু কুঁচকে পড়ল প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। চকচকে চোখে চেয়ে থাকল গনৎসাগা ওর দিকে।
চিঠি শেষ করে পুরো দুই মিনিট চুপ করে থাকল ভ্যালেনটিনা। খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে একের পর এক গনৎসাগার সমস্ত কথা। ওর মনে হলো ওর হৃৎপিণ্ডটা চেপে ধরেছে কেউ হাতের মুঠোয়। যে লোকটাকে মন-প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করেছিল, বিপদের সময়ে যার ওপর নির্ভর করেছিল, যার বাহুডোরে ধরা দিয়েছিল সে, সেই লোক তাকে ব্যবহার করেছে নিজ হীন স্বার্থে। কোনও সন্দেহ নেই, লোকটা প্রতারণা করেছে তার সঙ্গে, অভিনয় করেছে ভালবাসার। বুঝতে পারছে সবই তারপরেও বলল, গোটা ব্যাপারটা তোমার বানানো, গনৎসাগা। সব মিথ্যে কথা!
মাথাটা একটু খাটাও, ম্যাডোনা, শান্ত কণ্ঠে বলল গনৎসাগা। চিঠিটা যে এনেছে, সেই লোকটা এখনও আটক রয়েছে। মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে সঙ্গে নিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলে দেখো না কেন? তাছাড়া ভেবে দেখো, কেন নিজের পরিচয় গোপন করেছে লোকটা, কেন বলেছে ওর নাম ফ্র্যাঞ্চেস্কো ফ্র্যাঞ্চেস্কি, কেন এই লুকোছাপা?
ধপ্ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল ভ্যালেনটিনা। ঝড় বইছে মনের ভিতর। এসব কি শুনছে ও!
ভাবচজ কোথাও কোন ভুল হয়েছে? বলল গনৎসাগা। না। সত্যিই তোমাকে ভাওতা দিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করতে চেয়েছে লোকটা। তিনটে দিন জিয়ান মারিয়াকে এখানে আটকে রেখে দুর্গ থেকে কোনও কৌশলে গায়েব হয়ে যাবে ও, ব্যাকিয়ানোতে গিয়ে বসে পড়বে সিংহাসনে। তোমার সঙ্গে যে নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন আচরণ করেছে লোকটা, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
কিন্তু…কিন্তু… ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না ভ্যালেনটিনা, মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কোই যে অ্যাকুইলার কাউন্ট, তা নাও হতে পারে। চিঠিটা হয়তো আর কাউকে লেখা?।
সন্দেহ থাকলে কাউন্টের পত্রবাহকের সঙ্গে কথা বলো না, বলল গড়াগা। ওকে সঙ্গে নিয়ে…
না! শিউরে উঠল ভ্যালেনটিন। কাউন্ট, মানে ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে সঙ্গে নিয়ে আমি আর মুখ দেখতে চাই না ওর!
অন্তত নিশ্চিত হয়ে নেয়া তোমার উচিত। ল্যাঞ্চিওট্টোকে ধরে আনতে বলেছি আমি ফোর্টেমানিকে। তুমি বললে ভেতরে আসতে বলি ওদের। অনুমতি পেয়ে দরজা খুলে ভিতরে ডাকল সে অপেক্ষমাণ ফোর্টেমানিকে, ল্যাঞ্চিওট্টোকে নিয়ে ভেতরে এসো।
ব্যাপার কি বুঝতে না পেরে হতবাক হয়ে গেছে ল্যাধিওট্টো, বোকার মত এর-ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। ভ্যালেনটিনার উপর এসে স্থির হলো ওর দৃষ্টি।
যা জিজ্ঞেস করব, প্রাণের মায়া থাকলে তার ঠিক ঠিক উত্তর দেবে। বলো, তোমার মনিবের নাম কি?
অবাক হলো সে প্রশ্নের ধরন দেখে, গলার স্বরটাও ওর কাছে অন্যরকম ঠেকছে। বলল, কিন্তু লেডি…
উত্তর দাও! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল ভ্যালেনটিনা, অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে কিল দিল টেবিলের উপর।
উত্তর এড়াবার কোন উপায় নেই দেখে বলল, কেন, মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কো ডেল ফ্যালকো, কাউন্ট অভ অ্যাকুইলা।
ফুঁপিয়ে উঠতে যাচ্ছিল; নিজেকে সামলে নিল ভ্যালেনটিনা। চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে এরকোল ফোর্টেমানির। বলে কি লোকটা! নিশ্চিত হওয়ার জন্যে কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, এমনি সময় আদেশ এলো গন্ৎসাগার কাছ থেকে:
যাও, আর্মারি টাওয়ারে তোমার এক সেন্ট্রি আর তার সঙ্গে একজন লোক আছে। ডেকে নিয়ে এসো ওদের।
তোমার মনে সামান্যতম সন্দেহের অবকাশ যেন না থাকে, তার ব্যবস্থা করছি এখুনি।
জাক্কারিয়া আর সেন্ট্রিকে নিয়ে ফিরে এলো এরকোল। কারও কোনও প্রশ্ন করার প্রয়োজন পড়ল না, ল্যাধিওট্টোকে দেখেই ছুটে এসে হাত মিলাল জাক্কারিয়া, জানতে চাইল মনিব কেমন আছে।
ভ্যালেনটিনার দিকে চাইল গনৎসাগা। মাথা নিচু করে বসে আছে ও, রক্ত সরে গেছে মুখ থেকে। মনে হচ্ছে, সর্বস্ব খুইয়েছে যেন এইমাত্র। উচ্চাকাঙ্ক্ষী এক লোক স্বার্থোদ্ধারের জন্যে ব্যবহার করেছে তাকে, ধোকা দিয়েছে প্রেমের অভিনয় করে। অথচ মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেছিল ও মানুষটাকে, ভেবেছিল ওকে রক্ষার জনেই এসেছে লোকটা রোক্কালিয়নে। দুঃখে এখন ফেটে যেতে চাইছে ওর বুকটা।
এমনি সময় পায়ের শব্দ শোনা গেল বাইরে, দড়াম করে খুলে গেল দরজা; ঘরে এসে ঢুকল ফ্রাঞ্চেঙ্কো, পিছনে ভীত-সন্ত্রস্ত পেপ্পি। নিজের অজান্তেই এক পা পিছিয়ে গেল গনৎসাগা, ফ্যাকাসে হয়ে গেল চেহারা।
ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে দেখেই মাই লর্ড!” বলে মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত সামনে ঝুঁকে কুর্ণিশ করল জাক্কারিয়া। কারও মনে আঁর সন্দেহের লেশমাত্র থাকল না।
সবার মুখের দিকে একনজর তাকিয়েই বুঝে নিল কাউন্ট কি ঘটেছে। ঠিকই বলেছে পেল্পি, পরিচয় প্রকাশ পেয়ে গেছে ওর। সবার উপর থেকে ঘুরে ভ্যালেনটিনার মুখে গিয়ে স্থির হলো ওর দৃষ্টি।
রাগে লাল হয়ে গেছে মোন্না ভ্যালেনটিনার মুখটা। সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে।ঞ্যাঞ্চেফোকে দেখেই সেদিনের সেই চুম্বনের কথা মনে এলো ওর, বিষাক্ত সাপের দংশনের মত লাগছে এখন সেটা ভাবতে। ঝট করে উঠে দাঁড়াল সে চেয়ার হেড়ে।
আমার সঙ্গে এরকম নীচ শঠতা না করলেও পারতেন। এটুকু বলতে গিয়েই পানি এসে গেল ভ্যালেনটিনার চোখে। ঝট করে ফিরল এরকোলের দিকে। কান্না সামলে নিয়ে হাম দিল, ফোর্টেমানি, অত্র কেড়ে নাও কাউন্ট অত আকুইলার। এখন থেকে নজরবন্দী রাখবে একে!
ঘাবড়ে গেল দৈত্য, এই লোকের অসামান্য শক্তির কথা জানা আছে তার হাড়ে হাড়ে। কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
কি হলো, ফোর্টেমানি? একে নিয়ে দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে।
মাই লর্ড! বলেই তলোয়ারের ব্যাটে হাত দিল ল্যান্সিওঠো। ইঙ্গিত পাওয়ামাত্র একটানে ওটা বের করে পড়াইয়ের জন্যে পাশে দাঁড়াবে
উহু! শান্ত কঠে ওকে বারণ করল ফ্র্যাঞ্চেঙ্কো। এই যে, মেসার ফোমোনি। কোমর থেকে ছোরাটা খুলে এগিয়ে দিল সে।
গনৎসাগাকে ডেকে নিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল ভ্যালেনটিনা, পথরোধ করে দাঁড়াল ফ্রান্সেস্কো।
ম্যাডোনা, দাঁড়ান, বলল সে। আমার কথা শুনবেন না আমি অস্ত্র সমর্পণ করেছি শুধু এই কারণে যে আমার কথা শুনলে আপনি …
ক্যাপটেন ফোর্টেমানি! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল ভ্যালেনটিনা। ফ্রাঞ্চেঙ্কোর দিকে তাকাবে না বলে দৃষ্টি সরিয়ে রেখেছে অন্যদিকে। আমি এখন যাব। একে সরাও আমার পথ থেকে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা হাত রাখল এরকোল ফ্র্যাঞ্চেস্কোর কাঁধে। তবে তার কোন দরকার ছিল না। কথাটা শোনা মাত্র ঠিক যেন প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেয়েছে এমনি ভঙ্গিতে পিছিয়ে গেল ফ্র্যাথেস্কো। বিস্ফারিত হয়ে গেছে ওর চোখ। পাশ ফিরে চাইল সে গনৎসাগার হাসিমাখা মুখের দিকে। মুহূর্তে হাসি মুছে গেল সভাসদের ঠোঁট থেকে, কাঁপতে শুরু করল হাঁটু জোড়া, আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল সে ভ্যালেনটিনার পিছন পিছন।
.
২২.
গত রাতের তুমুল বৃষ্টিতে ভিতরের আঙিনার পাথরগুলো ঝকঝকে তকতকে দেখাচ্ছে সকালের রোদে।
মুখ কালো করে একপাশে বসে আছে ড় পেপ্পি। ভয়ানক চটে গেছে সে দুনিয়ার উপর। ভ্যালেনটিনার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে সে, বোঝাতে চেয়েছে কাজটা তার ভুল হয়েছে, বলতে চেয়েছে মেসার ফ্রাঙ্কোকে সে অনেক আগে থেকেই চেনে, অ্যাকুয়াশাটায় দেখা হওয়ারও আগে থেকে বলতে চেয়েছে ব্যাকিয়ানো থেকে কাউটের নির্বাসনের কথা, সিংহাসনের প্রতি যে লর্ড ফ্রাঞ্জেঙ্কোর বিন্দুমাত্রও লোভ নেই সে কথা-কিন্তু কিছুই শুনতে চায়নি মোন্না ভ্যালেনটিনা, কিছুই বলতে দেয়নি, খারাপ ব্যবহার করে থামিয়ে দিয়েছে তাকে, এমন কি এক পর্যায়ে তাড়িয়ে দিয়েছে সামনে থেকে।
কাজেই সবাইকে নিয়ে ভ্যালেনটিনা যখন প্রার্থনা করতে গেছে ছায়ায় চুপচাপ বসে পেরি অপেক্ষায় থাকল, বেরোলে আবার চেষ্টা করে দেখবে বোঝাবার। বিরক্ত হয়েছে সে। নীচ অপকৌশলের জন্যে গনৎসাগার উপর যতখানি, নারীসুলভ মতিভ্রমের জন্যে মনিব মোন্না ভ্যালেনটিনার উপর তার চেয়ে একটুও কম নয়।
যত অপেক্ষা করছে ততই বাড়ছে ওর রাগ। কি হবে এখন ওদের কপালে? কাউন্ট অভ অ্যাকুইলা সেদিন সাহসের সঙ্গে শক্ত হয়ে না দাঁড়ালে ব্রিজ নামিয়ে কখন বেরিয়ে যেত গ্যারিসন। কে এখন নিয়ন্ত্রণে রাখবে এদের-মেয়েমানুষের বাড়া ওই গৎসাপা?
গজর গজর করছে ও, নিজের ভুলটা ঠিকই বুঝবে মহিলা, কিন্তু দেরিতে। যখন আর সময় থাকবে না শোধরাবার। মেয়েমানুষের এইতো দোষ! মনিবের প্রতি অন্ধ ভালবাসার কারণে রাগটা আরও বেশি হচ্ছে। বেরোক না উপাসনা-ঘর থেকে, ওর কথা তাকে শুনতেই হবে। চেঁচামেচি করে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দেবে ও। ঠিক কোন বাক্যটা দিয়ে শুরু করলে মনিবের মনোযোগ ধরে রাখা যাবে সেটা মনে মনে উল্টেপাল্টে দেখছিল পেপ্পি, হঠাৎ চমকে উঠল উপাসনা-ঘর থেকে পা টিপে গনৎসাগাকে বেরিয়ে আসতে দেখে। আরে! কোথায় যায় ব্যাটা?
সাবধানে চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে আঙিনা পেরিয়ে বাইরের বৈঠকখানার দিকে চলে গেল গনৎসাগা। আর ওর মতলবটা কি তা বোঝার জন্যে আলগোছে পিছু নিল পেপ্পিনো।
.
ওদিকে সিংহ টাওয়ারের নিচে নিজের চেম্বারে বিনিদ্র রজনী কেটেছে কাউন্ট অভ অ্যাকুইলার। তার এই দুরবস্থার জন্যে গনৎসাগার ভূমিকা সম্পর্কে পরিষ্কার কোন ধারণা নেই ফ্র্যাঞ্চেস্কোর। জাক্কারিয়ার উপস্থিতি দেখে সে বুঝে নিয়েছে শেষ পর্যন্ত চিঠি দিয়েছে ফ্যানফুল্লা, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেটা কোনভাবে গিয়ে পড়েছে মান্না ভ্যালেনটিনার হাতে। সম্ভবত চিঠিতে এমন কিছু ছিল যাতে তাকে প্রতারক বলে মনে হয়েছে
নিজেকে বাছা বাছা কয়েকটা গালি দিল সে। তেতো হয়ে গেছে মনটা। অনেক আগেই নিজের পরিচয় জানানো উচিত ছিল ওর ভ্যালেনটিনাকে। উপযুক্ত সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় থেকে থেকে এখন সব ভণ্ডুল হয়ে গেছে। কিন্তু ওর একটা কথাও শুনবে না-এটা কি রকম কথা? কি রকম অবিবেচক মেয়ে, যাকে ভালবাসে তাকে বুঝিয়ে বলারও সুযোগ দেবে না? সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে ওর দুর্গের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। জাক্কারিয়ার এখানে উপস্থিতির মানে ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে ব্যাব্বিয়ানোতে। এখন যে-কোনও মুহূর্তে শেষ কামড় দেবে জিয়ান মারিয়া। দুর্গ দখল করতে পারলে ভাল, তা নইলে এদিকের আশা ছেড়ে দিয়ে সিংহাসন বাঁচাতে ছুটবে সে রাজধানীর দিকে।
এখনই চূড়ান্ত সতর্ক অবস্থায় দুর্গরক্ষার ব্যবস্থা হওয়া দরকার। কিন্তু ফোর্টেমানির মুখে সব শুনে কাউন্টকে নজরবন্দী করায় রেগে গেছে সৈন্যরা ভ্যালেনটিনার উপর, আনুগত্য ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে ওদের। শক্ত হাতে ওদেরকে এক করে রেখেছিল ফ্র্যাথেস্কো। ওর বিচার-বুদ্ধির ওপর প্রবল আস্থা এসে যাওয়ায় সাহসে বুক বাঁধতে পেরেছিল নির্দ্বিধায়। এখন কার ওপর ভরসা রাখবে ওরা? ফোর্টেমানিকে ওরা নিজেদেরই একজন বলে মনে করে, আর গনৎসাগার মেয়েলী স্বভাব ওদের টিটকারী ও অভিনয় করে দেখিয়ে হাসাহাসির বিষয়। ভ্যালেনটিনার আদেশ মান্য করার তো প্রশ্নই ওঠে না-যুদ্ধের কি জানে?
এরকোল ফোর্টেমানিও ঠিক এই কথাগুলোই ভাবছে কাল রাত থেকে। পরিণতির চিন্তায় ছটফট করেছে সে সারাটা রাত। নিজের উদ্ধত, কর্কশ ভঙ্গিতেই অদ্ভুত এক আনুগত্য অনুভব করে সে এই মানুষটার প্রতি, এবং শুধু সম্মান নয়, রীতিমত ভালবাসা অনুভব করে অন্তরের গভীরে-যদিও মুখে কিছুতেই স্বীকার করবে না সে-কথা। তারপর যখন জানতে পেরেছে এ-লোক হেজি-পেজি কেউ নয়, গোটা ইটালীর সমস্ত যোদ্ধার আদর্শপুরুষ, অ্যাকুইলার লর্ড কাউন্ট; তখন তার ভালবাসা পরিণত হয়েছে অবিচল ভক্তিতে।
অধিনায়কের দায়িত্ব বর্তেছে গনৎসাগার উপর। এই লোকটির হুকুম পালন করা ওর জন্যে বড়ই কষ্টকর। অনুরোধ করল সে ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে, আপনি শুধু একবার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করুন, সৈন্যরা প্রত্যেকে দাঁড়িয়ে যাবে আপনার পেছনে, রোক্কালিয়ন তখন আপনার।
বিশ্বাসঘাতক বদমাশ কোথাকার! হেসে বলেছে ফ্র্যাঞ্চেস্কো। কার অধীনে চাকরি কর তুমি ভুলে গেছ? এসব বাজে কথা বলা দূরে থাক, কল্পনাতেও ঠাঁই দিয়ো না। যা ঘটছে ঘটতে দাও। কিন্তু যদি আমার কোন উপকার করতে চাও, জাক্কারিয়াকে ডেকে দিতে পার এখানে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে জাক্কারিয়াকে নিয়ে এলো এরকোল। ধরা পড়লে চিঠিটা নষ্ট করে ফেলার প্রয়োজন হতে পারে মনে করে ওর লেখা প্রতিটা লাইন মুখস্থ করিয়েছে ফ্যানফুন্না জাক্কারিয়াকে দিয়ে। গড় গড় করে বলে গেল সে, আগাগোড়া সব শুনল ফ্র্যাথেস্কো। শুনে অস্থিরতা বেড়ে গেল আরও। আর দেরি করবে না জিয়ান মারিয়া, সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে এখন দুর্গের উপর। অথচ এ-রকম একটা মুহূর্তে এই ঘরে নজরবন্দী হয়ে নিষ্ক্রিয় থাকতে হচ্ছে তাকে।
ভোর রাতের দিকে একটা বাতি আনতে বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো এরকোলকে। সেই আলোয় ভ্যালেনটিনাকে একটা চিঠি লিখতে বসল সে। সবকিছু ব্যাখ্যা করল সে চিঠিতে। যখন চিঠি শেষ করল, তখন মলিন হয়ে গেছে বাতির আলো। সূর্য উঠে স্নান করে দিয়েছে বাতিকে। চিঠিটা ভাজ করে এরকোলের হাতে দিল সে, যেন এক্ষুণি পৌঁছে দেয় মোন্না ভ্যালেনটিনার হাতে।
ঠিক আছে, লর্ড কাউন্ট। উপাসনা-ঘর থেকে বেরোলেই দেব এটা ওঁর হাতে। চিঠিটা পকেটে পুরে নেমে গেল সে নিচের আঙিনায়। ওখানে পৌঁছেই থমকে দাঁড়াল সে, দৌড়ে এদিকে আসছে ভাড়, হাঁপাচ্ছে হাপরের মত, চেহারা আরও বিকৃত দেখাচ্ছে উত্তেজনার ভাঁজ পড়ায়।
জলদি, ক্যাপটেন এরকোল! বলল পেপ্পিনো, জলদি আসুন আমার সঙ্গে।
জাহান্নামে যাও তুমি, শয়তানের ছাও, ছোট-খাট একটা গর্জন ছাড়ল ফোর্টেমানি, কোথায় যেতে হবে?
যেতে যেতে বলছি। এখন একটা মুহূর্ত নষ্ট করবার সময় নেই। বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারগনৎসাগা- দম নিল ভাড়, তারপর তাড়া দিল, যাবেন আপনি?
আর বলতে হলো না, ওর পিছু-পিছু ছুট লাগাল ক্যাপটেন এরকোল। সুদর্শন, ধড়িবাজ গনৎসাগার বেইমানী হাতে-নাতে ধরার চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে? ফেস-ফোঁস, ঘোঁৎ-ঘোৎ নানারকম শব্দ তুলে চলেছে সে-অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে দম বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই। পেপ্পির পিছনে যেতে যেতে শুনল সে ঘটনাটা। বিশেষ কিছুই নয়: আর্মারি টাওয়ারে গিয়ে ঢুকেছে গনৎসাগা, তীর ছোঁড়ার একটা গর্ত দিয়ে উঁকি মেরে দেখেছে ও, একটা তীর নিয়ে, পরীক্ষা করছে লোকটা, তারপর ওটা টেবিলে রেখে কি যেন লিখতে শুরু করেছে।
হুঁ, তারপর?
তারপর আর কি আমি ছুট দিলাম আপনাকে খবর দিতে।
কসম খোদার। এক কিলে তোকে যদি ভর্তা না করেছি তো আমার নাম…এই দেখাবার জন্যে ঘোড়দৌড় করাচ্ছিস আমাকে, বদমাইশ! থমকে দাঁড়িয়ে আগুন ঝরাচ্ছে এরকোল ওর ভাটার মত দুই চোখ থেকে।
অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল পেপ্পি, এটাকে সামান্য মনে করছেন আপনি? দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন, যাবেন না?
আর এক পা-ও না! রেগে ভোম হয়ে গেছে দৈত্য। আমার সঙ্গে ইয়ার্কি হচ্ছে কোথায় গনৎসাগার বেইমানি?
কী বলছেন আপনি! রেগে গেছে পেঞ্জিও। বুদ্ধ নাকি? একটা তীর, একটা চিঠি-তারপরেও মাথায় ঢুকছে না কিছু জিয়ান মারিয়ার এক হাজার ফ্লোরিন ঘুষ দেয়ার প্রস্তাব কিভাবে এসেছিল এই দুর্গে? এই রকম একটা তীরে বাঁধা অবস্থাতেই উড়ে এসেছিল না ক্যাম্প থেকে! এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে গাধাটা! আরে, এবার দুর্গ থেকে যাচ্ছে কোনও প্রস্তাব।
এইবার টনক নড়ল এরকোলের, বুঝতে পেরেছে এতক্ষণে। খবরদার, গাল দিবি না! বলেই আবার ছুটল পেপ্পির পিছনে। বড় আঙিনা পেরিয়ে ধাপ বেয়ে উঠতে শুরু করল ব্যাটলমেন্টের উদ্দেশে। তোমার মনে হয়…।
আমার মনে হয় আপনার আর একটু আস্তে পা ফেলা দরকার। আর মেসার গনৎসাগাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরতে হলে হাঁসফাঁস একটু কম করুন।
মাথা ঝাঁকাল এরকোল, তারপর পেপ্পিকে ছাড়িয়ে দৌড়ে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। আমারি টাওয়ারের একটা ফোকরে চোখ রেখেই বুঝতে পারল সে, ঠিক সময় মতই পৌঁছেচে। ওদিকে পিছন ফিরে সামান্য ঝুঁকে কি যেন করছে গনৎসাগা। এরকোলের অভিজ্ঞ চোঁখ ঠিকই বুঝল, ধনুকে ছিলা পরাচ্ছে লোকটা। টেবিলের উপর রাখা একটা তীরের গায়ে কাগজ জড়ানো।
দ্রুত, নিঃশব্দ পায়ে দুর্গের বুরুজ ঘুরে এক ধাক্কায় খুলে ফেলল সে দরজাটা।
চমকে গিয়ে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল গনৎসাগা। মুহূর্তে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর এরকোলকে দেখে কিছুটা সামলে নিল নিজেকে। একটু সরে টেবিলে রাখা চিঠিটা আড়াল করে বলল, ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে একেবারে, এরকোল। তোমার পায়ের আওয়াজ তো পাইনি। হাসির ভঙ্গি করতে গিয়েও হাসতে পারল না, বিকৃত দেখাল ওর মুখটা। এরকোলের চেহারায় ভয় পাওয়ার মত কিছু দেখতে পেয়েছে সে। তবু সাহস করে জিজ্ঞেস করল, কি চাও এখানে
জিয়ান মারিয়াকে লেখা তোমার ওই চিঠিটা, গম্ভীর কণ্ঠে বলল ফোর্টেমানি।
হাঁ হয়ে গেল গনৎসাগার মুখটা, কাঁপন উঠে গেল শরীরে।
কি-কি বললে?
ওই চিঠিটা, বলেই পা বাড়াল সে সামনে।
খবরদার! ধমকে উঠল গন্ৎসাগা। আর এক পা সামনে এগোলে এক বাড়িতে মাথার ঘিলু বের করে দেব! লাঠির মত করে ধনুকটা মাথার উপর তুলল সে বেপরোয়া ভঙ্গিতে।
গলার ভিতর ঘড়ঘড় শব্দ তুলে হাসল ফোর্টেমানি। পরমুহূর্তে দুই হাতে গনৎসাগার কোমর জড়িয়ে ধরে তুলে ফেলল ওকে মাথার উপর। ধনুক দিয়ে বাড়ি মারার চেষ্টা করল আনাড়ি সভাসদ, বাতাসে শিস কাটার শব্দ হলো কেবল। পরমুহূর্তে ওকে আছাড়ে মেঝেতে ফেলল দৈত্যটা। কোক করে একটা বিদঘুঁটে শব্দ বের হলো গনৎসাগার মুখ থেকে। ভয়ানক ব্যথা পেয়েছে চতুর সভাসদ। উঠে বসার চেষ্টা করল, কিন্তু তার আগেই এসে পড়ল দৈত্য। ওকে উপুড় করে ঠেসে ধরে হাত-পা বেঁধে ফেলল শক্ত করে।
চুপচাপ শুয়ে থাকো, বিচ্ছু কোথাকার! বলে খানিক হাঁপিয়ে নিয়ে টেবিলের ওপর থেকে তীরটা তুলে নিল হাতে। চিঠিটা খুলে জোরে জোরে পড়ল; টু দ্য হাই অ্যান্ড মাইটি লর্ড জিয়ান মারিয়া স্ফোর্তযা”-হেসে উঠে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে, তাটা লাগিয়ে দিতে ভুলল না।
ওখানেই উপুড় হয়ে পড়ে থাকল গনৎসাগা। পরিষ্কার বুঝতে পারছে রাস্তার শেষে পৌঁছে গেছে সে। মাঝে মাঝে আহ-উহ্ করা আর গরমে ঘামা, ছাড়া আর কিছুই করার উপায় নেই। এখন আর ভ্যালেনটিনার কাছ থেকেও দয়া বা ক্ষমা আশা করছে না সে। এ-চিঠি ওর বিশ্বাসঘাতকতার নিচ্ছিদ্র প্রমাণ। কিভাবে কি করতে হবে সব ভেঙেচুরে পরিষ্কার করে লিখেছে সে চিঠিতে। ব্যাটলমেন্ট থেকে রুমাল না দেখানো পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে বলেছে সে জিয়ান মারিয়াকে। ইঙ্গিত পেলেই পিছন দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে, ভোলা থাকবে দরজা, কেউ কোনও বাধা দেবে না, জলের মত সহজ কাজ-পুরো গ্যারিসনকে নিরস্ত্র অবস্থায় পাওয়া যাকে দুর্গের উপাসনা-ঘরে।
চিঠি পড়েই একটা বুদ্ধি খেলে গেল ফ্র্যাঞ্চেস্কোর মাথায়। এরকোল আর বুদ্ধ পেপ্পিকে অবাক করে দিয়ে হেসে উঠল সে হো-হো করে।
ঈশ্বর এই গর্দভ বিশ্বাসঘাতকের মঙ্গল করুন, বলল সে। ফোর্টেমানির মুখ হাঁ হয়ে যেতে আর পেপ্পির দুই চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে দেখে বলল, বন্ধু এরকোল, জিয়ান মারিয়াকে ফাঁদে ফেলার একটা চমৎকার টোপ দেখতে পাচ্ছি আমি এই চিঠিতে। আমার পক্ষে এর চেয়ে ভাল ফাঁদ তৈরি করা সম্ভব ছিল না।
ঠিক কি বলতে চাইছেন–
এটা ফিরিয়ে নিয়ে যাও ওর কাছে, বলল সে। যেভাবে পার ওকে দিয়ে চিঠিটা জিয়ান মারিয়ার কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করো। ও রাজি না হলে নিজেই পাঠাও এটা। শুধু খেয়াল রাখবে এ-চিঠি জিয়ান মারিয়ার কাছে পৌঁছানো চাই।
ঠিক কি করতে চাইছেন, একটু ভেঙে বলবেন? আমি তো কিছুই…
সময় মত সবই জানতে পারবে, এরকোল। আগে যা বলছি তাই করো। শোনো! সব থেকে ভাল হয় যদি ওকে গিয়ে বল, চিঠিটা পড়ে তোমার মনে হয়েছে ওর সঙ্গে এই বিশ্বাসঘাতকতায় যোগ দেয়া উচিত। বলবে, তোমার ধারণা, জিয়ান মারিয়ার শাস্তি এড়াতে হলে এছাড়া আর কোনও রাস্তাই নেই। ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে আগে কিছু টাকা দিতে রাজি করাবে ওকে। বুঝতে পেরেছ।
কিছুই বোঝেনি, কিন্তু মাথা ঝাঁকাল দৈত্য, কি করতে হবে বুঝেছে।
বেশ, আর দেরি না করে ফিরে যাও টাওয়ারে। শুধু টাকা নয়, তোমার নিরাপত্তার ব্যাপারেও নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করবে, যাতে ওর মনে কোনও সন্দেহ না। তীরটা ছোঁড়া হয়ে গেলে ফিরে এসো, সব বুঝিয়ে বলব তোমাকে। যাও এখন।
ছুটল এরকোল। কিন্তু পেপ্পি ধরে বসল, কাউন্টের মনের কথা জানতে না পারলে ঘুম হবে না ওর। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চলল সে। সব শুনে হাসতে হাসতে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল সে। শেষে বলল, বুঝতে পারছি, স্যার, আমার চাকরিটা খাবেন আপনি! লোক হাসানোয় আমি আপনার কাছে শিশু!
কাজ সেরে ফিরে এলো এরকোল।
চিঠিটা গেছে? জিজ্ঞেস করল কাউন্ট।
মাথা ঝাঁকাল ফোর্টেমানি।
আমরা এখন ভাই-ভাই, গনৎসাগা আর আমি। কাজেই আমার নিরাপত্তার ব্যাপারে আর কোনও দুশ্চিন্তা নেই।
দারুণ! তোমার তুলনা হয় না, এরকোল!কাউন্টের প্রশংসায় সবকটা দাঁত বেরিয়ে পড়ল ফোর্টেমানির। হাত বাড়াল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, এবার আমার লেখা চিঠিটা ফেরত দাও। এর আর কোন দরকার নেই। তবে আজ রাতের শেষ প্রহরে, যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকবে, তখন আমার লোক দুজন, ল্যাঞ্চিওট্টো আর জাক্কারিয়াকে পৌঁছে দিয়ে আমার কাছে। ঠিক আছে?
.
২৩.
বুধবার, কর্পাস ক্রিষ্টির সকালে ঠাণ্ডা পড়ল খুব। সাগর থেকে বাতাসের সঙ্গে ভেসে এসেছে ঘন কুয়াশা। সবকিছু আবছা দেখাচ্ছে আজ। টুং টাং বেজে উঠল উপাসনা-ঘরের ঘন্টা, গ্যারিসনের সবাই প্রার্থনার জন্যে ঢুকল গিয়ে সেখানে।
সখীদের সঙ্গে এলো মোন্না ভ্যালেনটিনা, তার পিছনে পরিচারক দুজন, তার পিছনে ভাঁড় পেপ্পিনো। অত্যন্ত ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে ভ্যালেনটিনাকে, চোখের কোলে কালি পড়েছে, বোঝা যাচ্ছে রাতে ঘুমাতে পারছে না সে। মাথা নিচু করে প্রার্থনার জন্যে প্রস্তুত হলো সৈ; সখীরা লক্ষ করল, চোখ থেকে টপট পানি পড়ছে ওর মা-বুকের উপর। প্রার্থনা শুরু করল ফ্রা ডোমেনিকো।
গনৎসাগা আসেনি, ভ্যালেনটিনাকে জানিয়েছে, ফ্যানফুল্লার চিঠি পড়ে জান; গেছে এখন যে-কোন মুহূর্তে আক্রমণ করে বসতে পারে জিয়ান মারিয়া, কাজেই কোনও ঝুঁকি নিতে সে রাজি নয়; একজন প্রহরীর ওপর নির্ভর করে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে না সে, নিজেও থাকবে পাহারায়। মাথা হেলিয়ে সায় দিয়েছে ভ্যালেনটিনা, কারও কোন কথা আর দাগ কাটছে না ওর মনে, কেউ আক্রমণ করলেই কি, আর না করলেই কি; কিছুতেই যেন এসে যায় না কিছু।
সবাই প্রার্থনা-ঘরে ঢুকতেই দুর্গপ্রাচীরে গিয়ে উঠল গন্ৎসাগা, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখ শঙ্কা ও উৎকণ্ঠায়, দুরুদুরু কাঁপছে. বুক। পাহারায় রয়েছে আভেন্টানো, যে গনৎসাগার কাছে আসা জিয়ান মারিয়ার চিঠিটা পড়ে শুনিয়ে হাসিয়েছিল সবাইকে। ভালই হলো, ভাবল গনৎসাগা, এর পাওনা হিসেবটা ঢুকিয়ে দেয়া যাবে আজ।
দ্রুত কেটে যাচ্ছে কুয়াশা। বেশ অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে এখন। জিয়ান মারিয়ার ক্যাম্পে অস্বাভাবিক কর্মচাঞ্চল্য দেখে মলিন হাসি হাসল ও। আজ ওর ধরা-ছোঁয়ার সম্পূর্ণ বাইরে চলে যাবে মোন্না ভ্যালেনটিনা।
সেন্ট্রির দিকে সহজ ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল গনৎসাগা। মনে মনে গাল দিচ্ছে ফোর্টেমানিকে-কিছুতেই রাজি হলো না ব্যাটা! ওর চেয়ে অনেক ভাল ভাবে করতে পারত লোক্টা এই কাজ, এটা বলায় মাথা নেড়ে মধুর করে হেসেছে দৈত্য। পুরস্কার বেশিরভাগটাই পাচ্ছে। গনৎসাগা, তাই কাজেরও বেশিরভাগটা তারই করা উচিত। বলেছে, ও বরং প্রার্থনা-ঘরের ওপর নজর রাখবে ওই সময়টা।
সহজ গলায় সুপ্রভাত জানাল সে আভেন্টানোকে। খুশি মনে লক্ষ করল বর্ম পরেনি লোকটা। প্রথমে স্থির করেছিল সে ঘুষ সাধবে সেন্ট্রিকে, কিন্তু এখন সাহস হচ্ছে না। যদি প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে? আর যদি রেগে গিয়ে মেরেই বসে? ভাবতেও পারেনি যে, আভেন্টানোকে সাবধান করে দেয়া হয়েছে আগে থেকেই। ওকে বলেছে এরকোল, ঘুষ সাধলে যেন চট করে রাজি হয়ে যায়। রাজি হওয়ার জন্যে সে যে একপায়ে খাড়া, এটা জানা না থাকায় শেষ মুহূর্তে প্ল্যান পরিবর্তন করল গন্ৎসাগা।
ঠাণ্ডায় জমে গেছেন, এক্সেলেন্সি, ওকে কাঁপতে দেখে বলল আভেন্টানো সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে।
খুব ঠাণ্ডা পড়েছে! বলল গনৎসাগা মৃদু হেসে।
ঠিক। তবে ওই যে সূর্য উঁকি দিচ্ছে, শীঘ্রিই গরম হয়ে উঠবে।
হ্যাঁ, অন্যমনস্ক কণ্ঠে বলল গন্ৎসাগা। ডান হাতটা ওর নীল ভেলভেটের পোশাকের ভিতরে ড্যাগারে, বাঁটটা ধরে আছে, কিন্তু ওটা বের করার সাহস হচ্ছে না। বুঝতে পারছে, সময় বয়ে যাচ্ছে, কাজটা ওকে করতেই হবে। কিন্তু এই স্বাস্থ্যবান যুবককে প্রথম আঘাতেই কাবু করতে না পারলে কপালে খারাবি আছে ওর-এই চিন্তা মাথায় আসতেই ছাইবর্ণ ধারণ করল ওর মুখ, আবার কাঁপতে শুরু করল সর্বাঙ্গ। এক পা সরে গিয়েই বুদ্ধি খেলল মাথায়। চেঁচিয়ে উঠল, আরে, কি ওটা! দৃষ্টি দুর্গের বাইরে মাটির দিকে।
এক নিমেষে ওর পাশে চলে এলো আভেন্টানো। কি? কি হলো, এক্সেলেন্সি?
ওই যে, নিচে। চেঁচিয়ে উঠল গনৎসাগা। ওই যে পাথরের ফাঁকে। দেখতে পাচ্ছ না?
কই, না তো! সামনে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করল আভেন্টানো। কিছুই নেই ওখানে। প্লাস্টারটা একটু ফাটা। কিন্তু-উ…হ।
খাপ থেকে ছোরাটা বের করে প্রথমে আতঙ্কে ফুঁপিয়ে উঠেছে। গনৎসাগা, পরমুহূর্তে ঘ্যাঁচ করে বসিয়ে দিয়েছে ওটা সেন্ট্রির পিঠে। গলা দিয়ে ঘর-ঘর আওয়াজ তুলে বসে পড়ল আভেন্টানো, দুহাতে খামচি দিয়ে আকাশ ধরতে চেষ্টা করল, তারপর ঢলে পড়ে গেল পাথরের উপর; বার কয়েক হেঁচকি তুলেই স্থির হয়ে গেল।
দাঁতে দাঁত বাড়ি খাচ্ছে গনৎসাগার, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে লাফাচ্ছে গালের মাংস। জীবনে এই প্রথম মানুষ খুন করল সে। লাশের পিঠ থেকে ছোরাটা বের করার সাহস নেই, গলা দিয়ে আতঙ্কিত চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইছে। ঘুরেই দৌড় দিতে গেল সে, তক্ষুণি মনে পড়ল রুমাল নাড়ার কথা, দুই সেকেন্ডের জন্যে থেমে রুমাল নাড়ল সে জিয়ান মারিয়ার উদ্দেশে, তারপর ছুটল সিঁড়ি বেয়ে নেমে পিছন দিকের গেটটা খুলে দিতে।
কাঁপা হাতে তালা খুলে গেটটা হাঁ করে দিল গনৎসাগা। দেখল পাইন কাঠের একটা হালকা ব্রিজ নিয়ে ছুটে আসছে জিয়ান মারিয়ার সৈন্যদল। ওটাকে পরিখার ওপর বসাতে গিয়ে যথেষ্ট শব্দ হলো। একজন ওর ওপর দিয়ে টলতে টলতে এপারে চলে এলো, গনৎসাগাকে সাহায্য করল সে ব্রিজের এদিকের মাথাটা শক্ত করে বাঁধার কাজে।
বাঁধা হতেই এপারে চলে এলো জিয়ান মারিয়া, তার পিছনে গুইডোব্যাল্ডো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই, ফ্র্যাঞ্চেস্কো ঠিক যেমনটা আশা করেছিল, রোক্কালিয়ন দুর্গের প্রাঙ্গণ ভরে গেল জিয়ান মারিয়ার পাঁচ কুড়ি ভাড়াটে সৈনিকে। একজনকেও ফেলে রেখে আসেনি জিয়ান মারিয়া। সবার মুখে বিজয়ের হাসি।
সব ঠিক আছে তো? গনৎসাগার দিকে ফিরল জিয়ান মারিয়া, মুখে বন্ধুত্বের হাসি। কিন্তু গুইডোক্যাডোর কুটিতে স্পষ্ট রাগের চিহ্ন দেখা গেল।
গনৎসাগা আশ্বস্ত করল জিয়ান মারিয়াকে, দুর্গের সমস্ত সৈনিক এখন উপাসনা-ঘরে প্রার্থনায় ব্যস্ত। নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে সাহস অনেকটা ফিরে এসেছে ওর। গুইডোব্যান্ডের দিকে ফিরে মৃদু হেসে ঠাট্টার সুরে বলল, এই একটা ব্যাপারে আপনাকে প্রশংসা করতেই হয়। ভাইঝিকে ধর্মকর্মের দিকে…
আমাকে কিছু বলছ কঠিন সুরে ওকে বাধা দিলেন উরবিনোর ডিউক। আশা করি ভবিষ্যতে এ সাহস তোমার আর হবে না।
থতমত খেয়ে চুপ হয়ে গেল গনৎসাগা। ওর কাঁধে একটা হাত রেখে হাসল জিয়ান মারিয়া।
ঘাবাড়াও মাত, জুডাস! ভরসা দিল সে গনৎসাগাকে। তোমাকে ব্যাব্বিয়ানোতে জায়গা দেব আমি, যদি এই রকম কাজ দেখাতে পার। যাই হোক, এখন আমাদের এগোনো দরকার। প্রার্থনায় বাধা না দিয়ে আমরা কাছেই ওদের অপেক্ষায় লুকিয়ে থাকব, বের হলেই ধরব।
খুশিতে হাসছে জিয়ান মারিয়া। ইঙ্গিতে পথ দেখাতে বলল গনৎসাগাকে। প্রথম দরজা খুলতে গিয়েই আঁৎকে উঠল সভাসদ-ভিতর থেকে বন্ধ দরজাটা। হাঁটু কাঁপতে শুরু করল ওর।
বন্ধু! ভেতর থেকে বন্ধ এ-দরজা! বলল সে কাঁপা গলায়।
ঢোকার সময় অনেক বেশি আওয়াজ করেছি আমরা, বললেন গুইডোব্যান্ডে। তাই বোধহয় সাবধান হয়ে গেছে।
সৈন্যদের দিকে ফিরল জিয়ান মারিয়া, দরজাটা ভেঙে ফেলার হুকুম দিল। দরজা ভাঙার পর গুনে গুনে দশ কদম এগোতে পারল ওরা। দেখা গেল দ্বিতীয় দরজাও বন্ধ। অনেক কষ্টে এটাও ভাঙা হলো।
দ্বিতীয় প্রাঙ্গণে বাধা দেয়া হবে মনে করে বেশ কিছুটা পিছিয়ে এসে সৈন্যদের আগে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল জিয়ান মারিয়া, কিন্তু দেখা গেল, সেখানেও বাধা দেয়ার কেউ নেই। এরপর সোজা গিয়ে থামবে ওরা একেবারে প্রার্থনা-ঘরের দরজার সামনে।
.
উপাসনালয়ে মাস শুরু হয়ে গেছে। সবাই মগ্নচিত্তে শুনছে ফ্রা ভোমেনিকোর মন্ত্রপাঠ, এমনি সময়ে দরজার বাইরে পায়ের আওয়াজ পেল ওরা, বর্মেরনঝন শব্দ শুনতে পেল পরিষ্কার। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সৈনিকরা। ধারণা করল, কারও বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগে এসে পড়েছে জিয়ান মারিয়ার সৈন্যরা। সঙ্গে অন্ত্র নেই বলে গালি বকে উঠল কয়েকজন-ভুলেই গেছে, প্রার্থনা-ঘরে রয়েছে ওরা।
এমনি সময়ে দড়াম করে খুলে গেল দরজা। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ, উঠে আসছে উপরে। দম আটকে রেখেছে সবাই, প্রার্থনার শেষটুকু উচ্চারণ করতে ভুলে গেছে পুরোহিত, চোখ গোল করে চেয়ে রয়েছে দরজার দিকে।
আগন্তুকদের দেখেই সজোরে হাঁপ ছাড়ল ঘরের সবাই। প্রথমেই ঢুকল কাউন্ট অত অ্যাকুইলা শিরত্রাণটা শুধু বাম হাতে, তাছাড়া সারা দেহ বৰ্ম দিয়ে ঢাকা, কোমরের একপাশে ঝুলছে তলোয়ার, অন্যপাশে হোরা। তার পিছনেই রয়েছে কাউন্টের মাথা ছাড়িয়ে আরও এক মাথা উঁচু দৈত্য এরকোল ফোর্টেমানি, এবং তার পিছনে জাক্কারিয়া ও ল্যান্সিওট্টো-সবাই পরে আছে পুরোদস্তুর যুদ্ধের সাজ।
এভাবে আমাদের প্রার্থনায় বাধা দেয়ার মানে হেড়ে গলায় জানতে চাইল ফ্রায়ার।
বলছি, ধৈর্য ধরুন, ফাদার, শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল ফ্র্যাথেকো। পরিস্থিতি বাধ্য করেছে আমাদের।
এসব কি, ফোর্টেমানি? চেঁচিয়ে উঠল ভ্যালেনটিনা, চোখ দুটো জ্বলছে ওর। তুমিও আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে?
এর মানে, ম্যাডোনা, মনিবের প্রশ্ন রাগিয়ে দিয়েছে দৈত্যকে, এই যে, আপনার পোৰা কুকুর ওই রোমিও গনৎসাগা এই মুহূর্তে পিছন দরজা দিয়ে জিয়ান মারিয়া আর তার সৈন্যদলকে দুর্গে ঢোকাচ্ছে!”
চেঁচিয়ে উঠল গ্যারিসনের সব লোক, সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় ধরা পড়তে চলেছে ওরা সবাই একসঙ্গে কথা বলতে চাইছে; হাত ঝাঁপটা দিয়ে থামিয়ে দিল ওদের ফ্ল্যাঞ্চেস্কো।
বুনো দৃষ্টিতে ফোর্টেমানির দিকে চেয়ে ছিল ভ্যালেনটিনা, এবার অনিহাসত্ত্বেও তার দৃষ্টি এসে স্থির হলো কাউন্টের উপর। কয়েক পা এগিয়ে গেল ফ্র্যাঞ্চেঙ্কো, মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান দেখাল ভ্যালেনটিনাকে।
ম্যাডোনা, এখন বিস্তারিত ব্যাখ্যার সময় নেই। বিপদ এসে পড়েছে ঘাড়ের উপর। যা করবার করতে হবে এক্ষুণি, যত দ্রুত সম্ভব। আপনার কাছে নিজের পরিচয় গোপন করা আমার অন্যায় হয়েছিল। যখন বলতে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনই এই দুর্গের একমাত্র বিশ্বাসঘাতক রোমিও গনৎসাগা আমার পরিচয় জানতে পেরে খারাপ ভাবে তুলে ধরল আমাকে আপনার কাছে, আপনিও আমাকে ব্যাখ্যা করবার সুযোগ দিলেন না। এই মুহূর্তে সত্যিই সে আপনার কাকা আর আমার ফুফাতো ভাইকে ঢুকাচ্ছে দুর্গের ভিতর। আমি আমার ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধারের জন্যে আপনাকে সাহায্যের অভিনয় করেছি, কথাটা সর্বৈব মিথ্যা-আমার অনুরোধ, এটুকু অন্তত এই সঙ্কটের মুহূর্তে বিশ্বাস করুন।
দরদর করে পানি ঝরতে শুরু করল ভ্যালেনটিনার চোখ থেকে। বুঝতে পেরেছে, একবিন্দু মিথ্যে নেই কাউন্টের কথায়। হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল সে প্রার্থনার ভঙ্গিতে।
ম্যাডোনা, ওর কাঁধে আলতো করে হাত রাখল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, আমি যতক্ষণ আছি, কোন ভয় নেই আপনার। আপনার বুদ্ধিমান জেসটার পেপ্পির তৎপরতায় ফাঁস হয়ে গেছে গনৎসাগার মতলব, গত রাতে আমরাও একটা প্ল্যান তৈরি করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। দুর্গের দরজাগুলো বন্ধ পাবে জিয়ান মারিয়ার সৈন্যরা, ওগুলো ভাঙতে যেটুকু সময় লাগবে সেটুকু সময় আমরা কাজে লাগাব। ওই দেখুন, ওদের দেরি করিয়ে দেয়ার জন্যে এই প্রার্থনাঘরের দরজা লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমাদের ওপর একটু বিশ্বাস রাখুন, ম্যাডোনা; আমরা ঠিকই এই বিপদ থেকে রক্ষা করব আপনাকে।
অশ্রুভেজা চোখদুটো অবাক হয়ে তাকাল কাউন্টের চোখে। বলল, কি করে! ওরা ধাওয়া করবে আমাদের।
আপনি কিছু ভাববেন না, মৃদু হাসল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। আমরা চারজন গত রাতে বেশ কিছু আয়োজন করে রেখেছি। চলুন এবার, হাতে সময় নেই।
দীর্ঘ কয়েকটা মুহূর্ত কি যেন খুঁজল ভ্যালেনটিনা কাউন্টের মুখে, তারপর চোখ মুছে দুহাত রাখল ওর দুই কাঁধে। সবাই চেয়ে দেখছে, সেদিকে হৃক্ষেপ নেই।
সত্যি? সত্যিই তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি, ফ্র্যাঞ্চেস্কো?
আমার সম্মান, আমার নাইটহুডের কসম, ভ্যালেনটিনা। এতটুকু মিথ্যে বলিনি আমি। কোনও অসৎ উদ্দেশ্য আমার ছিল না, এখনও নেই। এখানে আসার আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তোমাকে সাহায্য করা। ঈশ্বরের এই বেদীর সামনে দাঁড়িয়ে বলছি কথাটা, বিশ্বাস করো!”
বিশ্বাস করলাম! বলেই ফুঁপিয়ে উঠে দুহাতে মুখ ঢাকল ভ্যালেনটিনা। একটু সামলে নিয়ে বলল, তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম বলে আমাকে মাফ করো, ফ্র্যাঞ্চেস্কো। ঈশ্বরও আমাকে মাফ করুন।
কোমল কণ্ঠে ওর নামটা শুধু উচ্চারণ করল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, ভ্যালেনটিনা!
উজ্জ্বল হয়ে উঠল ভ্যালেনটিনার মুখটা। ওর নাইটের ভরসা পেয়ে ফিরে এসেছে সাহস।
চলো সবাই। উঁচু গলায় ডাকল এবার ফ্র্যাঞ্চেস্কো। আপনি, ফাদার, আলখেল্লাটা খুলে ফেলুন, আর জোব্বাটা একটু খুঁজে নিন কোমরে-সিঁড়ি ভাঙতে হবে। আর তোমাদের দুজন বেদীর নিচের এই প্লেটটা সরিয়ে ফেলো। অসুবিধে হবে না, কাল রাতে কজাগুলো ঢিল দিয়ে রেখেছি আমরা।
অল্পক্ষণেই তুলে ফেলা হলো ঢাকনিটা। নিচে দেখা যাচ্ছে রোক্কালিয়নের পাতালঘর আর বন্দিশালায় যাবার সিঁড়ি।
সবাই নেমে গেল নিচে। সবার শেষে কয়েকজন পাথরের বেদিটা টেনে এনে বন্ধ করে দিল ফাঁকটা। কারও বোঝার উপায় থাকল না কোনদিক দিয়ে কোথায় গেল সবাই।
পিছনের একটা দরজা আগেই খুলে রেখেছে ফোর্টেমানি, সবার আগে চলল সে-তার পিছনে ছয়জন বয়ে নিয়ে চলেছে লম্বা একটা মই। খোলা দরজা দিয়ে হেঁইয়ো বলে ছুঁড়ে দেয়া হলো মইটা। পরিখার প্রবল স্রোতের উপর দিয়ে উড়ে ওপারে গিয়ে পড়ল মইয়ের শেষ মাথা।
দুই হাত দুপাশে মেলে দিয়ে টলোমলো পায়ে ওপারে চলে গেল ফোর্টেমানি, তারপর ও-মাথা শক্ত করে বেঁধে ফেলল একটা পাথরের সঙ্গে।
গতরাতে পাতালঘরে এনে রাখা বারোটা বল্লম হাতে এবার বারোজন সৈনিককে পাঠাল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। ওপারে পৌঁছে ওরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল তৈরি হয়ে। ওদের পর নেমে গেল মহিলারা। তারপর বাকি সবাই। সবার শেষে দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে নামল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, কয়েকজন মিলে টেনে নিয়ে বিশ গজ দূরে একটা নিচু মাঠে ফেলল মইটা।
হেসে উঠল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। ভ্যালেনটিনার পাশে এসে বলল, জিয়ান মারিয়া ভেবেই পাবে না, এতগুলোলোক আমরা কিভাবে, কোথায় গায়েব হয়ে গেলাম! রোক্কালিয়নে একটা সিঁড়ি নেই আর, দড়ি নেই আর এক গর্জও-সব ফেলে দেয়া হয়েছে পরিখার পানিতে। এবার এসো, নাটকের বাকি অংশ দেখবে, হাত ধরে টানল ওকে জিয়ান মারিয়ার ক্যাম্পের দিকে। এতক্ষণে ওদের তৈরি ব্রিজটা সরিয়ে নিয়েছে ফোর্টেমানি ও তার দল। মহামহিম, দুর্ধর্ষ, পরাক্রমশালী শ্রীমান জিয়ান মারিয়া এখনও জানে না আটকে গেছে সে কোন্ ফাঁদে।
.
২৪.
মে মাসের সেই রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে মনের আনন্দে জিয়ান মারিয়ার ক্যাম্প দখল করে নিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো ও তার দলবল। প্রথমেই, যারা নিরস্ত্র ছিল তারা যেখানে যা অস্ত্র পেল তুলে নিল হাতে, যার যেটা খুশি পরে নিল বর্ম ও শিরস্ত্রাণ।
মাত্র তিনজন লোক রেখে গিয়েছিল ডিউক ক্যাম্প পাহারায়, ওরা প্রথম ধাক্কাতেই বন্দী হয়েছে ফোর্টেমানির হাতে। দুর্গ দখল করবার জন্যে পাইনের যে ব্রিজটা তৈরি করিয়েছিল ডিউক, সেটা সরিয়ে নেয়া হয়েছে; এখন হাঁ করে রয়েছে খোলা দরজাটা, নিচে তুমুল বেগে বইছে পরিখার স্রোত।
খানিক পরেই খোলা দরজার সামনে দেখা গেল জিয়ান মারিয়াকে। ফাঁদে আটকে গিয়ে রাগে লাল হয়ে গেছে ওর মুখ। ওর পিছনে দাঁড়ানো সৈন্যদের অবস্থাও তথৈবচ। ওখানে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখছে ওরা, ওদের ক্যাম্পে ব্যস্ত পিঁপড়ের মত পিলপিল করছে বিশ পঁচিশজন লোক; কামানগুলোর কাছেই ভিড় বেশি। রাজসিক চেহারার দীর্ঘদেহী এক লোকের নির্দেশে ড্রব্রিজের উপর তাক করা হচ্ছে কামানগুলো।
হৈ-হৈ আওয়াজ ভেসে এলো দুর্গের দিক থেকে। হুড়োহুড়ি করে অদৃশ্য হয়ে গেল ওরা পিছনের দরজা থেকে, একটু পরেই দেখা গেল ওদেরকে দুর্গপ্রাচীরের ওপর। হা-হা করে প্রাণখোলা হাসি হেসে উঠল ফ্র্যাঞ্চেঙ্কো। একের পর এক দুর্গের কামানগুলো পরীক্ষা করছে ওরা, কিন্তু কোনটাতেই গোলা বারুদ কিছু পেল না। যখন বুঝতে পারল গোলাহীন কামানের ভয় দেখিয়ে এতদিন ওদের ঠেকিয়ে রাখা হয়েছিল, তখন রাগে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করল ওদের।
চুপচাপ কাটল কিছুক্ষণ, তারপর বেজে উঠল বিউগল।
ফোর্টেমানিকে কয়েকটা নির্দেশ দিয়ে জিয়ান মারিয়ার একটা ঘোড়ায় চাপল ফ্র্যাথেস্কো। ওর দুপাশে চলেছে ল্যাঞ্চিওট্টো আর জাক্কারিয়া, দুজনের হাতে দুটো তীর পরানো ক্রস-বো।
রোক্কালিয়নের প্রাচীরের পাশে পরিখার ধারে গিয়ে দাঁড়াল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। আপন মনে হাসছে দুই পক্ষের অবস্থানের পরিবর্তন দেখে। কদিন আগে এখানে দাঁড়িয়েছিল জিয়ান মারিয়া, আর ও ছিল উপরে। শিরস্ত্রাণ রয়েছে মাথায়, কথা বলতে হবে বলে ভাইজরটা সরাল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, এমনি সময়ে ঝপাৎ করে একটা লাশ এসে পড়ল পরিখার জলে। আভেন্টানোর লাশ, জিয়ান মারিয়ার আদেশে সরানো হলো ওটা ওর চোখের সামনে থেকে।
আমি মোন্না ভ্যালেনটিনা ডেল্লা রোভেয়ারের সঙ্গে কথা বলতে চাই, হাঁক ছাড়ল কুদ্ধ ডিউক।
তুমি যা বলার আমাকে বলতে পার, জিয়ান মারিয়া, স্পষ্ট উচ্চারণে বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, গলার স্বর পরিবর্তনের আর প্রয়োজন নেই। আমি তার প্রতিনিধি, কিছুদিনের জন্যে রোক্কালিয়নের প্রোভোস্ট ছিলাম।
গলাটা চেনা চেনা লাগায় সামনে ঝুঁকে এলো জিয়ান মারিয়া, জিজ্ঞেস করল, কে তুমি?
ফ্র্যাঞ্চেস্কো ডেল ফ্যালকো, কাউন্ট অভ অ্যাকুইলা।
হায়, খোদা! তুমি!
অবাক পৃথিবী, তাই না? হাসল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। এখন বলো দেখি, ভাইটি আমার, কোনটা হারাতে চাও তুমি-বাগদত্তা স্ত্রী, নাকি ডাচি?
রাগে বোবা হয়ে গেল জিয়ান মারিয়া কিছুক্ষণের জন্যে। তারপর গুইভোব্যাল্ডোর দিকে ফিরে নিচু গলায় কিছু বলল; কিন্তু গুইডোব্যাল্ডোর পূর্ণ মনোযোগ এখন নিচে দাঁড়ানো নাইটের উপর, জবাব না দিয়ে শুধু কাঁধ ঝাঁকালেন।
কোনটাই হারাব না আমি, মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কো, হুঙ্কার ছাড়ল ডিউক। কসম খোদার, কোনোটা না! কানে গেছে কথাটা, শুনতে পাচ্ছ?-কোনোটা না!
এমন ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছ, না শুনে উপায় আছে? হাসিমুখে জবাব দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। কিন্তু খোদার নাম নিয়ে বাজে কথা বলছ তুমি, জিয়ান মারিয়া। একটা অন্তত তোমাকে হারাতেই হবে। অবস্থা প্রতিকূলে চলে গেছে তোমার, হেরে গেছ তুমি।
আরে! আমার ভাইঝিকে নিয়ে দেখছি দরাদরি চলেছে! আপত্তি জানালেন গুইডোব্যাল্ডো, এখানে আমার মতামতের কোন দাম নেই না কি? আপনার কাজিন ওকে বিয়ে করবে কি করবে না, সেটা কি লর্ড কাউন্ট, আপনি নির্ধারণ করে দেবেন?
না, ইয়োর হাইনেস। যদি চায়, ও আপনার ভাইঝিকে বিয়ে করতে পারে, কিন্তু তাহলে ও আর ডিউক থাকবে না। ডিউক তো থাকবেই না, ওর গর্দান থাকে কি না তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। উল্লেখ করার মত জমিজমা বা কোন পদবী নেই ওর-ডাচি হারালে রাস্তার লোক হয়ে যাবে ও। কিন্তু আমি? ওর মত নড়বড়ে কৈান, সিংহাসন আমার না থাকতে পারে, ছোট-বড় যাই হোক একটা জমিদারী আর একটা পদবী আছে আমার। আপনার ভাইঝিকে ও যদি আমার হাতে তুলে না দেয়, ওকে আটকা থাকতে হবে এই দুর্গে, আর ব্যাব্বিয়ানোর ডিউক হব আমি। রাজ্য হারিয়ে হলেও ও যদি আপনার ভাইঝির প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও তাকে বিয়ে করতে চায়, আপনার ভেবে দেখতে হবে আপনি একজন রাস্তার ফকিরের সঙ্গে ওর বিয়ে দিতে চান কি না।
গুইডোব্যাল্ডোর চেহারা বদলে গেল, ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া ডিউকের মুখে এই বক্তব্যের সত্যতা খুঁজলেন তিনি। তারপর শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, আপনিও কি তাহলে আমার ভাইঝির একজন পাণিপ্রার্থী, লর্ড কাউন্ট?
হ্যাঁ, ইয়োর হাইনেস, আমিও একজন প্রার্থী, শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই রকম: আগামীকাল সকালের মধ্যে জিয়ান মারিয়া ব্যাব্বিয়ানোতে না পৌঁছলে সিংহাসন হারাচ্ছে ও, এবং জনগণের রায়ে ওটা আসছে আমার কাছে। কিন্তু মোন্না ভ্যালেনটিনার দাবি ছেড়ে দিয়ে যদি ওকে আমার হাতে তুলে দেয়, তাহলে আমি ওকে নিয়ে সোজা অ্যাকুইলার পথ ধরব, আর কখনও জিয়ান মারিয়াকে বিরক্ত করব না। কিন্তু ও যদি রাজি না হয়, যদি মোন্না ভ্যালেনটিনার আপত্তি গ্রাহ্য না করে ওকে বিয়ে করার জন্যে জেদ ধরে, তাহলে আমার লোকেরা ওকে ওই দুর্গের মধ্যে আটকে রাখবে, যাতে সময় থাকতে দেশে ফিরে ও গদি রক্ষা করতে না পারে। আর আমি? আমি তখন ব্যাব্বিয়ানোতে গিয়ে, যদিও রাজ্যশাসন আমার মোটও পছন্দের কাজ নয়, প্রজাদের ইচ্ছায় বসব সিংহাসনে, এবং তাদের অসন্তোষ দূর করব। ও চেষ্টা করে দেখতে পারে এর পরেও ইয়োর হাইনেস এ বিয়েতে মত দেন কি না।
জীবনে সম্ভবত এই প্রথম গুইডোব্যাল্ডো সৌজন্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হলেন। বর্তমান পরিস্থিতির কৌতুককর দিকটা ধরতে পেরে হো হো করে হেসে উঠলেন তিনি, যদিও সে হাসি জিয়ান মারিয়ার অন্তরে ছুরির মত বিধল।
হাসি থামিয়ে বললেন, আমাদের কোনও উপায়ান্তর আছে বলে তো মনে হচ্ছে না, লর্ড কাউন্ট। ভালমতই আটকে ফেলেছেন জালে। আপনার মত স্বনামধন্য একজন রণকুশলী যোদ্ধাকে জামাই হিসেবে পেলে সন্দেহ নেই গোটা উরবিনো আনন্দিত হবে। আপনি কি বলেন? এবার ফিরলেন তিনি বাকরুদ্ধ জিয়ান, মারিয়ার দিকে, আমার আরেকটা ভাইঝি আছে, ইয়োর হাইনেস। সে হয়তো খুশি মনেই রাজি হবে বিয়েতে, তাকে দিয়ে দুই ডাচির মৈত্রিবন্ধন এখনও সম্ভব। আর এত প্রবল আপত্তি অগ্রাহ্য করে, মুকুট, সিংহাসন সব হারিয়ে..নাহ, কাজটা ঠিক হবে না। আপনি কি বলেন, হাইনেস, বেশ মানাবে না ওদের দুজনকে? মোন্না ভ্যালেনটিনা আর আপনার ওই দুঃসাহসী কাজিন…
ওর কথায় কান দেবেন না! চেঁচিয়ে উঠলজিয়ান মারিয়া। রাগে প্রায় উন্মাদ-অবস্থা হয়েছে ওর। ও ওর বাক-চাতুরী। কুকুরটা খোদ শয়তানকেও ভুলিয়ে ভালিয়ে বের করে আনতে পারবে দোজখ থেকে। ওর কোনও শর্ত মানার দরকার নেই! একশো লোক আছে আমার, অ্যাই, ঝট করে ঘুরল সে ভাড়াটে সৈন্যদের দিকে, ড্রব্রিজ নামাও, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প শুনছে! কাপুরুষের দল! ড্রব্রিজ নামিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো, তাড়াও ওই জানোয়ারগুলোকে আমার ভাবু থেকে!
জিয়ান মারিয়া, তোমাকে আমি সাবধান করছি, ভেসে এলো ফ্র্যাঞ্চেস্কোর দৃঢ় কণ্ঠ। তোমার সবকটা কামান এখন তাক করা আছে ড্রব্রিজের উপর। সাবধান, ড্রব্রিজ নামাবার চেষ্টা করলে পস্তাবে! ওটা নামতে দেখলেই চুরমার করে দেয়া হবে গোলা মেরে। আমার শর্তে, আমাকে খুশি করে বেরোতে হবে তোমাকে রোক্কালিয়ন থেকে-এছাড়া আর কোন পথ নেই, প্রিয় ভাই আমার। গোয়ার্তুমি করতে গিয়ে তুমি যদি তোমার রাজ্য হারাও, সে দায় তোমার নিজের। তোমাকে বুঝতে হবে, সিংহাসনের ওপর আমার কোন লোভ নেই বলেই তোমাকে মান সম্মান নিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। তোমাকে এখানে আটকে রেখে তোমার রাজ্য কেড়ে নেয়া আমার জন্যে এখন অতি সহজ কাজ তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ?
গুইডোব্যাল্ডোও বারণ করলেন, ড্রব্রিজ নামানোর চেষ্টা করা ঠিক হবে না। পাশ থেকে জিয়ান মারিয়ার কানে কানে পরামর্শ দিল গনৎসাগা, রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করলেই…
রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করব? গাধা কোথাকার! বলেই লাফিয়ে ঘুরল জিয়ান মারিয়া ওর দিকে। মাথায় ভূত চেপেছে ওর, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই একটানে ছোরাটা বের করল, অপেক্ষা করে আমার সিংহাসনটা হারাই আর কি! বিশ্বাসঘাতক কোথাকার! তোর জন্যে। তোরই জন্যে এই ফাঁদে আটকা পড়েছি আজ!
ইস্পাতের একটা ঝিলিক শুধু দেখতে পেল গনৎসাগা, তারপরই তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করল হৃৎপিণ্ডে। ঘ্যাঁচ করে ঢুকে গেছে ছোরাটা ওর বুকের ভিতর। গুইডোব্যাল্ডো বাধা দেয়ার আগেই ঘটে গেল হত্যাকাণ্ড। ঢলে পড়ল গনৎসাগা, ঠিক যেখানে খুন করেছিল ও আভেন্টানোনাকে।
লাশটা সরাও আমার চোখের সামনে থেকে! চেঁচিয়ে উঠল জিয়ান মারিয়া। এখনও কাঁপছে সে রাগে।
ঝপাৎ করে পরিখার পানিতে পড়ল দ্বিতীয় লাশ।
রাগের মাথায় কি করেছে বুঝতে পেরে ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল জিয়ান মারিয়ার। চট করে নিজের বুকে ক্রসচিহ্ন আঁকল, তারপর একজনকে বলল, খেয়াল রেখো, কাল ওর আত্মার জন্যে যেন প্রার্থনা করা হয়।
মাথাটা অনেকখানি ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে, আগের চেয়ে অনেক নরম গলায় মামাতো ভাইয়ের কাছে জানতে চাইল জিয়ান মারিয়া, ঠিক কি কি শর্তে সে তাকে দুর্গ থেকে বেরোবার অনুমতি দেবে, যাতে নির্ধারিত সময়ের আগেই ওর পক্ষে ব্যাব্বিয়ানোতে পৌঁছানো সম্ভব হয়।
প্রথম কথা, মোন্না ভ্যালেনটিনার উপর তোমার দাবি ছাড়তে হবে। দ্বিতীয় কথা, হিজ হাইনেস উরবিনোর ডিউক যে প্রস্তাব দিয়েছেন, ওঁর ছোট ভাইঝিকে বিয়ে করার সুযোগ পেয়েই খুশি থাকবে তুমি-এর ফলে সীজার বর্জিয়াকে প্রতিহত করা তোমার জন্যে সহজ হবে।
জিয়ান মারিয়া উত্তর দেয়ার আগেই দেখা গেল নিচু গলায় কি সব বোঝাচ্ছেন ওকে উরবিনোর ডিউক।
কিন্তু…কিন্তু আপনার আরেক ভাইঝি কি রাজি হবে? প্রশ্ন করল জিয়ান মারিয়া।
হতে পারে, জবাব দিলেন গুইডোব্যাল্ডো। সবাই তো আর এক রকম হয় না।
আর মোন্না ভ্যালেনটিনা? প্রায় ককিয়ে উঠল ব্যাব্বিয়ানোর ডিউক।
এই মাথাগরম যুদ্ধবাজ কাউন্টকেই যদি ওর পছন্দ হয়, আমি আপত্তি করব না বিয়েতে। আসলে আমি আপনার স্বার্থটাই দেখছি, মাই লর্ড। এর ব্যাপারে আপনি অনড় থাকলে রাজ্যটা হারাবেন। আপনি আমি দুজনেই বর্তমানে ওর হাতের পুতুল। হার মেনে নেয়াই তো এখন বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমি মেনে নিয়েছি হার।
আপনার আর আমার হার কি এক হলো?
পরিষ্কার বুঝে নিয়েছে জিয়ান মারিয়া, ফ্র্যাঞ্চেস্কো ডেল ফ্যালকোর মত একজন ভাইঝি-জামাই এই দুর্দিনে উরবিনোর ডিউকের জন্যে এক বিরাট পাওয়া। উত্তরে কাঁধ ঝাঁকালেন শুইডোব্যান্ডো, আরও বোঝালেন। শেষ পর্যন্ত পরাজয় স্বীকার করে নিল জিয়ান মারিয়া, প্রাচীরের ওপর থেকে গলা বাড়িয়ে ফ্র্যাঞ্চেস্কোর কাছে জানতে চাইল কখন সে দুর্গ ছেড়ে বিদায় নিতে পারবে।
এই মুহূর্তে! জবাব দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। আশায় নেচে উঠল জিয়ান মারিয়ার অন্তর, কিন্তু দমে গেল ফ্র্যাঞ্চেস্কোর পরবর্তী নির্দেশ শুনে। তবে তোমার আর আমার লোকের মধ্যে যাতে কোনও গোলমাল বেধে না যায়, সেজন্যে তুমি ও তোমার সমস্ত লোক ড্রব্রিজ দিয়ে নেমে আসবে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায়। হিজ হাইনেস গুইডোব্যাল্ডো হচ্ছেন একমাত্র ব্যতিক্রম, তার জন্যে এই নির্দেশ প্রযোজ্য নয়। কিন্তু তোমার একজন লোকও যদি সশস্ত্র অবস্থায় ব্রিজ থেকে নামে, কামান দাগার হুকুম দেব আমি, ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে তোমরা নিজেদেরই কামানের গোলা খেয়ে।
শেষ হলো নাটক। মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলো জিয়ান মারিয়া তার লোকজন সহ, টু-শব্দ না করে যে-যার ঘোড়া নিয়ে রওনা হয়ে গেল ব্যাব্বিয়াােৈর পথে।
জিয়ান মারিয়া চলে যাওয়ার পর জনা কয়েক অনুচর নিয়ে গুইডোব্যাল্ডো রয়ে গেলেন আরও কিছুক্ষণ। ডিউককে তাঁর ভাইঝির কাছে নিয়ে গেল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
ভাইঝিকে জড়িয়ে ধরলেন গুইডোব্যাল্ডো, বললেন, তোর আপত্তিটা ঠিক কোথায় ছিল, তা বুঝতে পেরেছি আমি, মা। ঠিকই করেছিস তুই আমার কথা না শুনে।
ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল ভ্যালেনটিনা।
আমার সঙ্গে উরবিনোয় যেতে হবে আপনাকে, লর্ড কাউন্ট, বললেন ডিউক ফ্র্যাঞ্চেস্কোর দিকে ফিরে। বিয়ের সব আয়োজন প্রস্তুত আছে ওখানে। আমি চাই উপযুক্ত জাঁক-জমকের সঙ্গে বিয়ে হোক আমার ভাইঝির।
ভ্যালেনটিনার ভেজা চোখে আনন্দের ঝিলিক। কিন্তু তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাইল ফ্র্যাঞ্চেস্কো ডিউকের মুখের দিকে, যেন বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের সৌভাগ্য। জিজ্ঞেস করল, ইয়োর হাইনেস কি সত্যিই আমার প্রতি অসন্তুষ্ট নন?
একবিন্দুও না! বললেন ডিউক অভ উরবিনো। একজন প্রিন্স হিসেবে কথা দিচ্ছি আমি, যথাযযাগ্য সম্মান দেখানো হবে আপনাকে।
সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু ভাঁজ করে নিচু হয়ে ডিউকাল হাতে চুম্বন করল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
ঘোড়ায় চড়ে রওনা হলো ওরা উরবিনোর পথে। আগে আগে চলেছেন ডিউক, তার একটু পিছনেই পাশাপাশি দুটো ঘোড়ায় ফ্র্যাঞ্চেস্কো আর ভ্যালেনটিনা। তার পিছনে পেপ্পি, ফ্রা ডোমেনিকো আর দলবল সহ দৈত্য এরকোল ফোর্টেমানি। সবার শেষে মহিলা ও পরিচারকরা।
হঠাৎ একসময় পাশ ফিরে ফ্র্যাঞ্চেস্কোর দিকে চাইল মোন্না ভ্যালেনটিনা। নিচু গলায় বলল, আমার খুব গর্ব হচ্ছে, মাইলর্ড!
তাই নাকি? কেন?
আমাকে তুমি রাজ্য আর সিংহাসনের চেয়ে অনেক বেশি দাম দিয়েছ বলে।
অবাক হয়ে গেল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। তা তুমি জানলে কি করে?
তোমাদের কথা সব শুনেছি আমি।
ছি, ছি, ছি! আড়ি পেতেছিলে বুঝি?
হাসল রাজকুমারী, লাল হলো গাল। বলল, এমন হেঁড়ে গলায় চেঁচাচ্ছিলে তোমরা–না শুনে উপায় ছিল? কিন্তু কই, মাই লর্ড, তুমি তো বললে না আমাকে ক্ষমা করেছ কিনা?
তোমাকে? কেন, তুমি আবার কি দোষ করলে?
তোমাকে ভুল বুঝে কষ্ট দিয়েছি।
তুমিই কি কম কষ্ট পেয়েছ? হাসল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। আজ প্রার্থনা ঘরে তোমার চোখে জল দেখেছি, রানি। সব দোষ ধুয়ে গেছে ওতেই।
সত্যিই? ধন্যবাদ, প্রিয় নাইট!