১৬.
দুপুরে ব্যারাকে ফিরে প্রচুর টিটকারির সম্মুখীন হয়েছিল ফোর্টেমানি, কিন্তু গায়ে মাখেনি। কোন কিছুই মনের মধ্যে বেশিক্ষণ পুষে রাখা ওর স্বভাব নয়। বিপদ কেটে যেতেই খুবই দ্রুত হালকা হয়ে গেছে মন। বন্দী হওয়ার অসম্মানও তাকে তেমন স্পর্শ করেনি, দিব্যি মহিলাদের মন জয়ের চেষ্টায় হাসি-তামাশা করছে তাদের সঙ্গে। কিন্তু মানুষটা যে ভিতরে ভিতরে বদলে গেছে, তা টের পাওয়া গেল সাপারের পর খাবার টেবিলে বসে যখন ভ্যালেনটিনা, গনৎসাগা আর ফ্র্যাঞ্চেস্কো দুর্গত্যাগের বিষয় নিয়ে আলাপ করছে তখন তাকে ধেয়ে আসতে দেখে।
দুপুরে কিল-ঘুসি মেরে জবাব দিয়েছে সে বিদ্রুপের, এবং কিছুক্ষণের মধ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে দলের, সারাদিন পালা করে পাহারা দিয়েছে ওরা, টহল দিয়েছে দুর্গের চারপাশে। কিন্তু রাতে মদ্যপান করে টালমাটাল অবস্থায় হৈ-হল্লা বসছে সবাই, কেউ আর বিছানায় যেতে রাজি হচ্ছে না। ধমক-ধামকে কাজ না হওয়ায় ছুটে এসেছে সে নালিশ জানাতে।
ব্যাপারটা সামাল দেয়ার জন্যে গনৎসাগাকে অনুরোধ করল ভ্যালেনটিনা। এরকোলকে নিয়ে ছুটল গনৎসাগা। মোন্না ভ্যালেনটিনা যে ভাবছে এসব পুরুষালি ঝামেলা সামলানোর ক্ষমতা তার আছে, তাতেই সে খুশি। কিন্তু ব্যারাকে গিয়েই প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেল বেচারা।
কেউ তো তার কথা শুনলই না, ফ্র্যাঞ্চেস্কোর অনুকরণে সে যখন কড়া কথা বলার চেষ্টা করল তখন হেসেই খুন হয়ে গেল সবাই-এরকোলও আড়ালে না হেসে পারল না। ওর চিকন গানের গলা নকল করে ভেঙালো ওরা, দু-চারটে নরম-গরম গালিও বর্ষিত হলো, তারপর যখন দুই-একজন উঠে দাঁড়াল, তখন রণে ভঙ্গ দিয়ে ফোর্টেমানিকে পাশ কাটিয়ে প্রায় দৌড়ে ফিরে এলো সে খাবার ঘরে।
ওর মুখে সব শুনে ফ্র্যাঞ্চেস্কোর দিকে ফিরল ভ্যালেনটিনা। ও তখন চুপচাপ জানালা দিয়ে নিচে চন্দ্রালোকিত বাগান দেখছে।
আপনি কি… অনুরোধ করতে গিয়েও গনৎসাগার অসম্মান হবে ভেবে থেমে গেল ভ্যালেনটিনা।
পিছন ফিরে হাসল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। বলল, চেষ্টা করে দেখতে পারি, ম্যাডোনা। মেসার গনৎসাগা যখন সফল হননি, আমারও পারার সম্ভাবনা কম। তবে মনে হচ্ছে, ওঁর ধমকে নিশ্চয়ই ওরা কিছুটা ভয় পেয়েছে, আমার কাজ হয়তো ততটা কঠিন না-ও হতে পারে। আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি।
ফ্র্যাঞ্চেস্কো বেরিয়ে যেতেই গনৎসাগাকে ভ্যালেনটিনা বলল, দেখো, ও ঠিকই পারবে। যোদ্ধা লোক, ওদের হাড়ে হাড়ে চেনে। এমন কিছু করবে যাতে ওরা ওর হুকুম না মেনে পারবে না।
পারলে তো ভালই, বিমর্ষবদনে বলল গনৎসাগা। তবে আমি বাজি ধরে বলতে পারি, ও কেন, কেউই এখন মাতালগুলোকে সামলাতে পারবে না,।
মিনিট দশেক পর ধীর পায়ে ফিরে এলো ফ্র্যাঞ্চেস্কো। ওরা দুজনই খেয়াল করল, আর কোন হট্টগোলের শব্দ ভেসে আসছে না ব্যারাক থেকে।
কি করে? জানতে চাইল ভ্যালেনটিনা। কি করে থামালেন ওদের?
প্রথমে কিছুটা অসুবিধে হয়েছে, তারপর মেনে নিয়েছে ওরা, বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। পশুদের কাবু করতে পশুশক্তি প্রয়োগ করতে হয়, গনৎসাগার দিকে ফিরে বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। ওরা জানে আপনি ভদ্র,নিরীহ সভাসদ, ওদের গায়ে হাত তুলবেন না, তাই অত সাহস দেখিয়েছিল।
আপনি ওদের গায়ে হাত তুলেছেন? জিজ্ঞেস করল গন্ৎসাগা।
সে এক দেখার মত ব্যাপার, বলে উঠল পেনিনা। কিছুতেই কথা শুনবে না, বদ্ধ মাতাল হয়ে আছে ওরা। একজন তো তেড়ে এসেছিল মারবে বলে। সার ফ্র্যাঞ্চেস্কো ওকে মাথার ওপর তুলে একটা আছাড় দিতেই ঠাণ্ডা। যখন ফোর্টেমানিকে হুকুম দিলেন ওকে পাতাল ঘরে আটকে রাখতে, তখন সুড়সুড় করে সবাই বিছানায় গিয়ে উঠেছে।
প্রশংসা ফুটে উঠল ভ্যালেনটিনার দৃষ্টিতে। আপনি অনেক যুদ্ধ করেছেন, স্যার! প্রশ্ন ও মন্তব্যের মাঝামাঝি সুরে বলল সে।
তা করেছি, ম্যাডোনা।
সুযোগ বুঝে চট করে প্রশ্ন করল গনৎসাগা, কিন্তু আপনার নামটা কোথাও শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না?
চট করে বুঝে ফেলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, নিজের পরিচয় দেয়াটা এখন বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ভ্যালেনটিনা যদি জানতে পারে ও জিয়ান মারিয়ার আপন মামাতো ভাই, তাহলে নানান সন্দেহ এসে ভিড় করবে তার মনে।,তা যদি না-ও করে তার কান ভারি করার জন্যে তো সদাপ্রস্তুত হয়েই আছে রোমিও গনৎসাগা। সবাই জানে, কাউন্ট অভ অ্যাকুইলা জিয়ান মারিয়ার প্রিয়পাত্র, তাকে যে নির্বাসন দেয়া হয়েছে সে-সংবাদ উরবিনোতে পৌঁছানোর আগেই ভ্যালেনটিনা পালিয়েছে ওখান থেকে। এখন ওসব কথা বলতে গেলে ওকে ভাই বলে ধরে নেয়া হবে, নির্বাসনের গল্প মনে হবে বানোয়াট।
আমার নাম তো মনে হয় বলেছি আপনাকে-যাক, আবারও বলছি, আমার নাম ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
নামের বাকি অংশটা? কৌতূহল চিকচিক করছে ভ্যালেনটিনার, চোখের তারায়।
তা আছে, তবে প্রথমটার এত কাছাকাছি যে ওটা আর উচ্চারণ করি না। আমি ফ্র্যাঞ্চেস্কো ফ্র্যাঞ্চেস্কি, একজন ভ্রাম্যমাণ নাইট।
এবং একজন সত্যিকার নাইট, মিষ্টি হেসে বলল ভ্যালেনটিনা, আমি যতদূর জানি।
গা-টা জ্বলে গেল গনৎসাগার। বলল, এই নাম শুনিনি কোনদিন। আপনার বাবা…?
টুসকানির সম্ভ্রান্ত এক ভদ্রলোক।
তবে রাজসভার কেউ নন, তাই না? আঁটি ভেঙে শাঁস খেতে চাইছে গনৎসাগা। কিন্তু নিরাশ হলো।
না-না, উনি রাজসভাতেই আছেন, জবাব দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
এবার অন্য দিক থেকে খোঁচাবার চেষ্টা করল সে। আর আপনার মা…।
রক্ত সরে গেল ফ্র্যাঞ্চেস্কোর মুখ থেকে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আপনার মায়ের চেয়ে অনেক-অনেক উঁচু ঘরে জন্মেছেন তিনি। কথা শুনে খিকখিক করে হেসে উঠল পেপ্পিনো।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল গনৎসাগা, জ্বলন্ত দুই চোখ ভস্ম করে দেয়ার চেষ্টা করছে ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে। স্থির, তির্যক দৃষ্টিতে লক্ষ করছে ওকে ফ্রাঞ্চেস্কো। এসব কিছুই খেয়াল করেনি ভ্যালেনটিনা, আপন মনে ছিল; হঠাৎ বুঝতে পারল কি যেন ঘটে গেছে।
আরে! কি হলো? কে কি বললেন যে চোখে-চোখে যুদ্ধ বেধে গেল আপনাদের?
সামান্য কথাতেই রেগে উঠছেন উনি, বলল গনৎসাগা। মনে হচ্ছে অনেক কিছুই আছে ওঁর গোপন করার। ওঁর পরিচয় সম্পর্কে
কোনও প্রশ্ন করলেই কেউটে সাপের মত ফোঁস করে ওঠেন।
ছি, গনৎসাগা! এসব কি বলছ তুমি? বোধ-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে তোমার? আসুন, স্যার, আপনারা দুজনেই আমার বন্ধু, আপনারা পরস্পরের বন্ধু হতে পারলে আমি খুব খুশি হবো। দয়া করে আমাদের গনৎসাগার কথায় কিছু মনে করবেন না। মেজাজ যেমনই হোক, মনটা ওর খুবই ভাল।
বেশ তো, আপনি যখন বলছেন, মুহূর্তে ভুরু জোড়া সোজা হয়ে গেল ফ্র্যাথেস্কোর। উনি যদি বলেন যে ওঁর কথার পিছনে কোন বিদ্বেষ ছিল না, আমিও বলব সেকথা।
বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে টের পেয়েছে গনৎসাগা, ঝটপট আপোষ করে নিল সে, কিন্তু বিতৃষ্ণা তার বাড়ল বই কমল না। ফ্র্যাঞ্চেস্কো বিদায় নেয়ার পর ভ্যালেনটিনার কাছে বিদায় চাইতে গিয়ে বেরিয়ে এলো ওর মনের কথা।
ম্যাডোনা, লোকটাকে আমি বিশ্বাস করি না।
বিশ্বাস করো না! ভুরু জোড়া কুঁচকে গেল ভ্যালেনটিনার। কেন। বলো তো?
জানি না কেন, কিন্তু অন্তর থেকে টের পাচ্ছি! নিজের হৃৎপিণ্ডের উপর হাত রাখল সে। ও যদি পাই না হয়, আমার নাম বদলে রেখো!
তোমার মাথাটা বিগড়ে গেছে আজ, বলল ভ্যালেনটিনা। যাও, শুয়ে পড়ে গিয়ে, গনৎসাগা। সেঁটে এক ঘুম দিলে মাথা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। পেপ্পিনো, আমার বান্ধবীদের ডাকো।
ঘরে একা হয়ে যেতেই কাছে চলে এলো গনৎসাগা। সারাটা দিন ঈর্ষার দংশনে সত্যিই পাগল-দশা হয়েছে ওর। রক্তশূন্য মুখে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল সে, যা ভাল বোঝো করো, ম্যাডোনা। কিন্তু আগামী কাল আমরা দুর্গ ছেড়ে চলে যাই, বা এখানেই থাকি-ওই লোক আমাদের সঙ্গে থাকছে না!
সোজা হয়ে দাঁড়াল ভ্যালেনটিনা। বিরক্ত।বলল, সেটা নির্ভর করে। আমার বা ওঁর ওপর, তোমার ওপর নয়, গনৎসাগা।
শ্বাস টানল গন্ৎসাগা, আরও কাছে সরে এলো, তারপর ফ্যাঁসফেঁসে, কর্কশ কন্ঠে বলল, সাবধান, ম্যাডোনা! এই অজানা, অচেনা, পরিচয়হীন লোকটা যদি তোমার-আমার মাঝে দাঁড়াতে চেষ্টা করে, কসম খোদার, খুন করব আমি ওকে। সাবধান! কথাটা জানিয়ে রাখলাম তোমাকে!
দরজা খুলে যেতেই সরে গেল গনৎসাগা, মাথা ঝুঁকিয়ে বাউ করে মহিলাদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
চট করে বসে পড়ল ভ্যালেনটিনা একটা জানালার গোবরাটে। রাগে কাঁপছে বুকের ভিতরটা। এই প্রথম নিজের উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে জানাল গনৎসাগা। অথচ ওকে চাকরবাকরদের একজনের বেশি কখনও ভাবেনি ও। পরিষ্কার বুঝতে পারছে এখন, লোকটাকে এত বেশি পাত্তা দেয়া ঠিক হয়নি, দূরত্ব বজায় রাখা উচিত ছিল।
.
১৭.
উঠে পড়ুন, মাই লর্ড! জলদি উঠুন! ঘিরে ফেলেছে আমাদের!
ল্যাঞ্চিওট্টোর চিৎকারে ঘুম ভাঙলো ফ্র্যাঞ্চেস্কোর। লাফিয়ে উঠে দরজা খুলল ও। জানা গেল, রাতেই পৌঁছে গেছে জিয়ান মারিয়া, রোক্কালিয়ন দুর্গের সামনের মাঠে তাঁবু ফেলেছে।
সব শোনার আগেই দৌড়ে এলো একজন পরিচারক; এক্ষুণি তার সঙ্গে দেখা করতে চায় মোন্না ভ্যালেনটিনা, গ্রেট হলে অপেক্ষা করছে সে তার জন্য। দ্রুত পোশাক পরে নিল ফ্রাঞ্চেস্কো, ল্যাঞ্চিওট্টোকে সঙ্গে আসতে বলে রওনা হলো গ্রেট হলের দিকে।
অনুচরকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ভিতরে ঢুকল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। দেখল, ফোর্টেমানির সঙ্গে কথা বলছে ভ্যালেনটিনা। পায়চারি করছে, উত্তেজনার এইটুকুই প্রকাশ পাচ্ছে; চেহারায় ভয়ের লেশমাত্র নেই। ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে দেখে হাসল সে, যেন ও তার কতদিনের বিশ্বস্ত বন্ধু। পরমুহূর্তে অনুশোচনার মত দেখাল হাসিটা।
আপনিও আমাদের ভাগ্যের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন, স্যার। আমার বোধহয় গতকালই আপনাকে ছেড়ে দেয়া উচিত ছিল। শুনেছেন নিশ্চয়ই, ঘেরাও হয়ে গেছি। এখন জিয়ান মারিয়া সরে না যাওয়া পর্যন্ত এখান থেকে বের হওয়ার কোন উপায় নেই। কাজেই একটাই পথ আমার সামনে, এখানে থেকেই আক্রমণ প্রতিহত করা, যুদ্ধ করা।
একজন সত্যিকার সাহসী মহিলা হিসেবে সবার শ্রদ্ধা আপনার প্রাপ্য। অনেকে আপনার এ সিদ্ধান্তকে হয়তো পাগলামি বলবে, তবে আমার ধারণা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপনি। আপনার এ পাগলামিতে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য হলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।
কিন্তু আপনার ওপর তো আমার কোনও অধিকার নেই। কোন্ অধিকারে আপনাকে আমি…
একজন সত্যিকার নাইটের ওপর যে-কোনও বিপদগ্রস্ত মহিলার অধিকার আছে, ম্যাডোনা। তাছাড়া ডিউক জিয়ান মারিয়ার বিরুদ্ধে আপনাকে রক্ষার কাজে অস্ত্র ধরতে আমি বিশেষ আনন্দ লাভ করব। খুশি মনেই আপনাকে সাহায্য করব আমি। আমাকে সঙ্গে নিলে এ লড়াইয়ে দেখবেন আপনার অনেক উপকার হবে।
ওঁকে রোক্কালিয়নের প্রোভোস্ট করুন, ম্যাডোনা, অনুরোধ করল ফোর্টেমানি। ওর ধারণা, কথার জাদু দিয়ে যে-লোক সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে কাউকে ছিনিয়ে আনতে পারে, তার অসাধ্য কিছুই নেই।
শুনলেন ওর কথা? আগ্রহ ভরে ওর মুখের দিকে চাইল ভ্যালেনটিনা। আপনি দায়িত্বটা নেবেন?
এটা মস্ত এক সম্মানজনক দায়িত্ব, ম্যাডোনা। আপনি যদি আস্থার সঙ্গে আমার হাতে এ-দায়িত্ব অর্পণ করেন, সাধ্যমত চেষ্টা করব আমি যাতে আপনার মুখ রক্ষা হয়।
এমনি সময়ে হন্তদন্ত হয়ে কামরায় প্রবেশ করল গনৎসাগা। তাড়াহুড়োয় উল্টোপাল্টা পোশাক পরে ছুটে এসেছে। ফ্র্যাঞ্চেঙ্কোর দিকে একবার ভুরু কুঁচকে চেয়ে লম্বা করে কুর্নিশ করল ভ্যালেনটিনাকে।
সর্বনাশ হয়েছে, ম্যাডোনা! উৎকণ্ঠায় আমার…
ওকে থামিয়ে দিল ভ্যালেনটিনা। বলল, অত ঘাবড়ে যাওয়ার কি আছে? আমরা তো এ সম্ভাবনার কথা জানতামই, তাই না?
কিন্তু আমি তো ভাবতেও পারিনি, নিজেকে এভাবে হাস্যাস্পদ করবে জিয়ান মারিয়া। বিয়ে করার জন্যে দুর্গ আক্রমণ…
মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কো সংবাদ আনার পরও তুমি ভাবছিলে কিছুই হবে না? পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বুলিয়ে নতুন দৃষ্টিতে দেখল ওকে ভ্যালেনটিনা। অথচ উরবিনো থেকে পালাবার সময় তো খুব যুদ্ধংদেহী ভাব দেখিয়েছিলে। মস্তবড় বীর! এখন সত্যিকার বিপদ দেখে জান উড়ে গেল?
কথাগুলো গন্ৎসাগার কলজেয় গিয়ে আঘাত করল। আঘাত দেয়ার জন্যেই বলেছে ভ্যালেনটিনা। গতরাতের বাড়াবাড়ি সে ক্ষমা করতে পারেনি। স্থির করেছিল সুযোগ পেলেই শায়েস্তা করবে, চোখে আঙুল দিয়ে ওকে দেখিয়ে দেবে ওর অযোগ্যতা। লোকটার নতুন রূপ দেখে গোটা পরিকল্পনার পিছনে ওর দুষ্টবুদ্ধির আভাস টের পেয়েছে সে, ফলে প্রচণ্ড রাগে টগবগ করে ফুটছে ওর ভেতরটা, দোষ দিচ্ছে নিজেকে ওর ফাঁদে পা দেয়ায়।
ভ্যালেনটিনার জ্বলন্ত চোখের সামনে মাথা নিচু হয়ে গেল গনৎসাগার, লজ্জায় লাল হয়ে গেছে মুখটা। ফোর্টেমানি আর এই কর্কশ, বেয়াড়া লোকটার সামনে এরকম ধাতানি খেয়ে থমকে গেল সে কিছুক্ষণের জন্যে, তারপর মাথা তুলে বলল, ম্যাডোনা, আমি বলতে এসেছিলাম, দূত পাঠিয়েছে জিয়ান মারিয়া, কিছু বলতে চায়। তোমার হয়ে কি আমি কথা বলব ওর সঙ্গে?
না, থাক। আমিই আসছি। ফ্র্যাঞ্চেস্কোর দিকে ফিরে বলল, আপনি সঙ্গে এলে ভাল হয়। রোক্কালিয়নের প্রোভোস্ট হিসেবে আপনি পরামর্শ দিতে পারবেন আমাকে। তুমিও এসো, গনৎসাগা।
সবার পিছনে শ্লথ পায়ে চলেছে গনৎসাগা। সারা গায়ে আগুন ধরে গেছে যেন ওর। বুঝতে পারছে, গত রাতের বাড়াবাড়ির ফল ভোগ করতে হচ্ছে তাকে আজ। শাস্তি হিসেবে তার মাথার ওপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে তার শত্রুকে।
যেতে যেতে জনা ছয়েক সৈনিককে পিছন পিছন আসতে বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, যাতে দূতের ধারণা হয় কোন দুর্বলতা নেই ওদের মধ্যে, রীতিমত প্রস্তুত ওরা দুর্গরক্ষার জন্যে।
ধূসর রঙের একটা উঁচু ঘোড়ায় লম্বা এক লোক বসে আছে খাড়া হয়ে। ভ্যালেনটিনাকে দেখেই নিচু হয়ে কুর্নিশ করল সে। মাথার চওড়া টুপিটা একটু টেনে মুখ আড়াল করল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
আমার প্রভু মহাপ্রতাপশালী লর্ড, ব্যাব্বিয়ানোর ডিউক, হিজ হাইনেস জিয়ান মারিয়া স্ফোর্তযার নির্দেশক্রমে আমি আপনাকে অনুরোধ করছিঃ অস্ত্র সমর্পণ করে এই মুহূর্তে দুর্গ-তোরণ খুলে দিন।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভ্যালেনটিনা জানতে চাইল লোকটার বক্তব্য শেষ হয়েছে, না কি আরও কিছু বলার আছে। দূত জানাল, কথা এখানেই শেষ, আর কিছু বলার নেই তার।
কি উত্তর দেয়া উচিত বুঝতে না পেরে ফ্র্যাঞ্চেস্কোর দিকে ফিরল ভ্যালেনটিনা। আমার হয়ে উত্তরটা আপনি দেবেন, মাই লর্ড প্রোভোস্ট।
মৃদু হেসে এগিয়ে গেল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। দেয়ালের উপর ঝুঁকে গলার স্বর কিছুটা পরিবর্তন করে বলল, স্যার দূত, আমরা জানতে চাই ব্যাব্বিয়ানোর ডিউক কবে উরবিনোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তা না করে থাকলে কোন অধিকারে উরবিনোর একটা দুর্গকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি।
উরবিনোর ডিউকের অনুমতি ও অনুমোদন নিয়েই হিজ হাইনেস লেড়ি ভ্যালেনটিনা ডেল্লা রোভেয়ারকে এই বার্তা পাঠিয়েছেন, জানাল দূত।
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ভ্যালেনটিনার। কাউন্টকে কনুই মেরে একপাশে সরিয়ে দিয়ে নিজেই উত্তর দিল, যান, আপনার প্রভুকে গিয়ে বলুন, আমার এলাকায় অনধিকার প্রবেশ করে তার এই নির্লজ্জ, অভদ্র আচরণ আমাকে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ করেছে। এভাবে আমাকে চ্যালেঞ্জ করবার কোনও অধিকার তার নেই। নিজের ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করে আপনাকে পাঠিয়ে নিজেরই অমঙ্গল ডেকে আনছে সে।
তাঁকে কি বলব, ম্যাডোনা, নিজে এসে আপনার সঙ্গে কথা বলতে?
তাহলে তো ভালই হয়, বলল ভ্যালেনটিনা। নিজের কানেই শুনে যেতে পারবে তাকে কী দৃষ্টিতে দেখছি আমি। কথা শেষ করেই আর অপেক্ষা না করে ফিরে চলল সে ব্যাঙ্কোয়েট হলের দিকে।
সেখানে ফিরে প্রতিরক্ষার কি ব্যবস্থা করা যায় আলোচনা করল সে ফ্র্যাঞ্চেস্কোর সঙ্গে। কাউন্টের প্রতিটা প্রভাব সমর্থন করল সে। বিপদের সময় অকুতোভয় এই নাইটকে পেয়ে মনটা হাল্কা হয়ে গেছে তার। মনে হচ্ছে, দুশ্চিন্তা দূরে থাক, গোটা ব্যাপারটাকে সহজ একটা খেলা হিসেবে নিয়েছে লোকটা। যে কাজ হাতে নিয়েছে সে সম্পর্কে কিছুই তার অজানা নেই।
কাউন্টের পিছনে আঠার মত লেগে আছে ফোর্টেমানি। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করছে, কী সহজ ভঙ্গিতে সঠিক জায়গায় পাহারা বসাচ্ছে মানুষটা, আর কী প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সাথেই না করছে প্রতিটা কাজ! গোটা দুর্গে সাড়া পড়ে গেছে, প্রতিটা সৈনিকের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে প্রাণচাঞ্চল্য। উপযুক্ত নেতা পেয়ে সবাই খুশি।
শুধু একটা জায়গায় এসে দমে গেল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। গোলাবারুদের গুদাম দেখতে গিয়ে পেল সে শুধু এক কৌটা বারুদ। বাকি সব কোথায় রেখেছে গনৎসাগা প্রশ্ন করায় এপাশ-ওপাশ মাথা দোলাল এরকোল, জানে না সে।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর বাগানে পাওয়া গেল গনৎসাগাকে, কি যেন বোঝাবার চেষ্টা করছে ভ্যালেনটিনাকে।
আপনার পাউডার কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন, যেসার গনৎসাগা? সরাসরি জানতে চাইল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
পাউডার যেন আকাশ থেকে পড়ল সভাসদ। কেন, অস্ত্রাগারেই তো থাকার কথা!”
ওখান থেকেই আসছি আমি, বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। ছোট্ট একটা কৌটায় দেখলাম সামান্য আছে। বড়জোর একবার কি দুবার দাগ যাবে কামান, বন্দুকের জন্যে থাকবে না আর কিছুই। ওই কি আপনার সম্বল?
যা থাকার ওখানেই আছে, জবাব দিল গনৎসাগা।
তাজ্জব হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। অনুভব করল, রক্ত সরে যাচ্ছে ওর মুখ থেকে। ভাষা ফিরে পেয়ে বলল, এই আপনার দুরক্ষার নমুনা? গুদাম ভরা মদের বোতল, একগাদা ভেড়া এনেছেন জবাই করে খাবেন বলে, স্নো-পাউডার-সাবানের অভাব নেই। এসব দিয়েই শত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে চেয়েছিলেন, না কি আক্রমণ আসতে পারে এ চিন্তাই খেলেনি আপনার মাথায়?
বকা খেয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেল সভাসদের। অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই হুমকি দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে, মুখে যা এলে তাই বলতে শুরু করল; সবশেষে আচমকা দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করে বসল।
তিক্ত কণ্ঠে ধমক দিল ভ্যালেনটিনা গন্ৎসাগাকে। ফ্র্যাঞ্চেঙ্কোকে অনুরোধ করল, পাগলের প্রলাপে কান না দিয়ে যা আছে তাই নিয়ে দুর্গরক্ষার ব্যবস্থা করতে। কি রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন, অযোগ্য লোকের প্ররোচনায় প্রবলপ্রতাপ উরবিনোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেছে সে, বুঝতে পেরে মরমে মরে যাচ্ছে এখন ভ্যালেনটিনা। বুঝতে পারছে, জিয়ান মারিয়া আসছে শুনে পালাবার জন্যে কেন এত ওকালতি করছিল কাপুরুষ লোকটা।
ট্রাম্পেটের আওয়াজ ভেসে এলো। বোঝা গেল, আবার এসেছে দূত। আসুন, মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কো, শোনা যাক নতুন কি বার্তা নিয়ে এলো লোকটা।
বার্তা আর কিছুই নয়, ভ্যালেনটিনার জবাব পেয়ে জিয়ান মারিয়া ডিউক গুইভোব্যান্ডোর জন্যে অপেক্ষা করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শীঘ্রি এসে যাবেন তিনি। তিনি পৌঁছলে এই একই বার্তা পাঠাবে সে আবার।
দুপুরে খাওয়ার টেবিলে সবার সঙ্গে হাসি-তামাশা করে আসন্ন। যুদ্ধের আশঙ্কা অনেকখানি হালকা করে দিল ফ্রাঞ্চেস্কো। গনৎসাগা কেবল গোঁজ হয়ে বসে থাকল গোমড়া মুখে।
অবরুদ্ধ অবস্থায় দুর্গের সবাইকে দুশ্চিন্তামুক্ত করা সহজ নয়। তবে ফ্র্যাঞ্চেস্কোর প্রবল আত্মবিশ্বাস,সাহস যোগাল সবাইকে, সবাই পছন্দ করে ফেলল ওকে-অবশ্য গনৎসাগা বাদে। এতদিন ওরা রাজসভার মেকি মানুষ দেখেছে-বাক-চাতুরি, নকল হাসি আর পারস্পরিক দুর্নাম যাদের পুঁজি। এই প্রথম ওরা একজন সত্যিকার যোদ্ধাকে দেখছে কাছ থেকে। মোন্না ভ্যালেনটিনাও এই প্রথম দেখছে এক নতুন ধরনের মানুষ। এই লোক যে কথায়-বার্তায়, চাল-চলনে, আচার-ব্যবহারে বিশিষ্ট এক ভদ্রলোক তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই সঙ্গে খোলা মাঠ আর ক্যাম্পের গন্ধ রয়েছে এর সবকিছুতে। বোঝা যায়, মানুষটা সত্যিকার সৎ একজন যোদ্ধা-কপটতার লেশমাত্র নেই এর মধ্যে কোথাও।
মানুষটা হাসছে যখন, দিল খুলে আন্তরিক হাসি হাসছে-হাসি হাসি হয়ে উঠছে শ্রোতার মুখ। তারুণ্য পেরিয়ে পরিপূর্ণ যৌবনে উপনীত হয়েছে লোকটা, কণ্ঠস্বরে প্রবল পৌরুষ, যখন হুকুম দিচ্ছে তখন ধরেই নিচ্ছে বিনা প্রতিবাদে পালিত হবে সে আদেশ।
পরদিন সকালে এলেন উরবিনোরু ডিউক। ট্রাম্পেটের শব্দ শুনে দুর্গ-প্রাচীরে গেল ওরা দূতের বক্তব্য শুনতে। যুদ্ধের সাজ পরে নিয়েছে ফ্র্যাঞ্চেস্কো, শিরস্ত্রাণটা এমন ভাবে পরেছে যাতে দূর থেকে তাকে চেনা যায়। দেখা গেল, ঘোড়ার ওপর বসে আছেন স্বয়ং প্রিন্স গুইডোব্যাল্ডো।
কাকাকে দেখে তেমন কোনও ভাবান্তর হলো না ভ্যালেনটিনার মধ্যে। কোনদিনই স্নেহ-মমতার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি ওদের মধ্যে। নিজের কাজে ব্যস্ত ডিউক কেবল এটা করো ওটা করো হুকুমই দিয়ে গেছেন ভাইঝিকে। আজও তার ব্যত্যয় হলো না। যেন আত্মীয়র সঙ্গে নয়, দেখা করতে এসেছেন একজন বিদ্রোহীর সঙ্গে।
মোন্না ভ্যালেনটিনা, ধমকের সুরে বললেন তিনি, তোমার ঔদ্ধত্য দেখে আমি খুবই দুঃখ পেয়েছি। ভেবো না তুমি মেয়ে বলে আমার– কাছে কোনরকম ছাড় পাবে। কথা না শুনলে আর সব বিদ্রোহীর মতই দুর্গ সহ ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হবে তোমাকে।
হাইনেস, জবাব দিল ভ্যালেনটিনা, আমি তোমার কোন ছাড় পাওয়ার আশায় এখানে আসিনি। আগেও তোমাকে বলেছি, এখনও বলছি আমি নারী, নারীর মর্যাদা আশা করি সবার কাছে। আমার হৃদয় আমি খুশি মনে কাকে দেব, সে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার একমাত্র আমারই। তুমি তোমার মিত্র ওই জিয়ান মারিয়াকে জানিয়ে দিতে পার-অস্ত্রের হুমকি দিয়ে কারও প্রেম পাওয়া যায় না, কামান দেগে খোলা যায় না নারীর হৃদয়-দুয়ার। তুমি যদি নারীত্বের অমর্যাদা করতে চাও, সে তোমার অভিরুচি। যতক্ষণ না তুমি আমার পছন্দ-অপছন্দ মেনে নিচ্ছ, আর ওই ব্যাব্বিয়ানোর ডিউকটাকে আমার ঘাড় থেকে সরিয়ে নেবে বলে কথা দিচ্ছ, ততক্ষণ আমি এখানেই থাকছি-তুমি, তোমার সৈন্য-সামন্ত বা তোমার মিত্রের হুমকির কাছে নত হওয়ার চেয়ে মৃত্যু আমার কাছে অনেক বেশি কাম্য।
আমার ধারণা তোমার মত পরিবর্তন করাতে খুব বেশি সময় লাগবে না আমাদের। এখানে আমি তোমার সঙ্গে তর্ক করতে আসিনি, মোন্না, জানাতে এসেছি আত্মসমর্পণ না করলে ধ্বংস হয়ে যাবে তুমি।
তাহলে দাও, ধ্বংসই করে দাও, কাকা। আমার সাধ্যমত আমি বাধা দেব। কাউকে পরোয়া করি না আমি। জেনে রাখো, ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছিঃ ভ্যালেনটিনা ডেল্লা রোভেয়ার কোনদিনও ব্যাব্বিয়ানোর ডিউকের স্ত্রী হবে না।
তুমি গেট খুলে দিতে অস্বীকার করছ? রাগে কাঁপছে ডিউকের কণ্ঠস্বর।
হ্যাঁ,অস্বীকার করছি। আর এটাই আমার শেষ কথা।
কিছুতেই মত পরিবর্তন করবে না?
প্রাণ থাকতে না।
বেশ, আমি হাত গুটিয়ে নিলাম। তোমার ভবিষ্যৎ স্বামী জিয়ান মারিয়া ক্ষোত্যার হাতে ছেড়ে দিচ্ছি বিষয়টা। যদি সে বলপ্রয়োগ করতে বাধ্য হয়, সে দোষ তোমার। ওকে আমি জানিয়ে দিচ্ছি ওঁর যে কোনও কাজের পিছনে আমার সমর্থন ও অনুমোদন থাকবে। ঘোড়ার মুখটা ঘুরিয়ে নিতে গিয়েও থেমে আবার বললেন, ওখানেই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। আমি হিজ হাইনেসকে পাঠাচ্ছি। ওঁর বক্তব্য তোমার শোনা দরকার।
ব্যাটলমেন্টের ধারে পায়চারি করতে করতে আলাপ করছে ফ্র্যাঞ্চেস্কো আর ভ্যালেনটিনা, ফোর্টেমানি দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের মত আর গনৎসাগা দেয়ালের ফোকরে চোখ রেখে ভুরু কুঁচকে চেয়ে রয়েছে জিয়ান মারিয়ার ক্যাম্পের দিকে।
হরেক রঙের তাঁবু দেখা যাচ্ছে মাঠে, কিছু টাঙানো হয়ে গেছে, কিছু হচ্ছে। সৈন্যসংখ্যা একশোর বেশি হবে না। তবে গরুর গাড়িতে করে কামান আনা হয়েছে গোটা দশেক, আরও গাড়ি আসছে গোলাবারুদ ও রসদ নিয়ে।
ফ্র্যাঞ্চেস্কো ও ভ্যালেনটিনাও মাঝে মাঝে চোখ রাখছে ফোকরে। দেখতে পেল ঘোড়ায় চেপে ক্যাম্পে পৌঁছলে শুইডোব্যান্ডো। তাঁকে দেখেই বড়সড় একটা তাবু থেকে বেরিয়ে এলো খাটো, মোটা জিয়ান মারিয়া। এত দূর থেকেও পরিষ্কার চিনতে পারল ওকে ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
উরবিনোর ডিউকের সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে, একটা ঘোড়ায় চাপল জিয়ান মারিয়া। ট্রাম্পেট-বাদকের সঙ্গে রওনা হলো সে দুর্গের উদ্দেশে। পরিখার ধারে এসে থামল সে, চোখ তুলে দেখল কয়েকজন লোকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে মোন্না ভ্যালেনটিনা। পালক লাগানো হ্যাটটা খুলে মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান দেখাল সে ওকে।
কথা শোনার জন্যে এগিয়ে গেল ভ্যালেনটিনা প্রাচীরের ধারে।
মোন্না ভ্যালেনটিনা, বলল জিয়ান মারিয়া। বিশাল চাঁদের মত মুখে কুতকুতে ছোট দুই নিষ্ঠুর চোখ ওর বিদ্বেষে জ্বলছে। আপনার কাকার কথায় যখন হয়নি, ধারণা করছি আমার মুখের কথায়ও কোন কাজ হবে না। কাজেই বাক্যব্যয় নিরর্থক। তবে আপনার ক্যাপটেনের সঙ্গে আমি দুয়েকটা কথা বলতে চাই।
আমার ক্যাপটেনরা এখানেই আছেন, বলল ভ্যালেনটিনা। বলুন, কি বলতে চান।
ও, একাধিক ক্যাপটেন বুঝি? তা, সৈন্যসংখ্যা কত?
যথেষ্ট, জবাব দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। আপনাকে এবং আপনার নারী অবরোধকারী চাকরবাকরদের ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
ঘোড়ার উপর নড়েচড়ে বসল ড্রিউক। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে চেনার চেষ্টা করল বক্তাকে। কিন্তু বর্ম আর শিরস্ত্রাণ পরে থাকায় চিনে উঠতে পারল না।
কে তুমি, বদমাশ?
ডিউক হলে কি হবে, আপনার মুখের কথায় তো ভারি দুর্গন্ধ! বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল ভ্যালেনটিনা।
জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত ব্যাব্বিয়ানোর ডিউকের সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলে কেউ প্রাণে বাঁচতে পারেনি। অপমানে বেগুনী হয়ে, গেল জিয়ান মারিয়ার মুখটা।
শুনে রাখো, ছোটলোক! হাঁক ছাড়ল সে, এই গ্যারিসনের আর সবার কপালে যাই থাকুক, দুর্গ দখলের পর তোমাকে আমি কড়িকাঠ থেকে ঝুলাব, এই প্রতিজ্ঞা করলাম।
গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল! জবাব দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। আগে দখল করুন, তারপর বোলচাল। রোকালিয়ন দখল করবেন, এতই সহজ? আমার প্রাণ থাকতে পারে-কাছেও আসতে পারবেন না আপনি এই দুর্গের, দখল তো দূরের কথা।
হাসি মুছে গেছে মুখ থেকে, চাপা গলায় বলল ভ্যালেনটি আর ঘাঁটাবেন না, প্লিজ। রেগে গেলে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে লোকটা।
হা, প্রায় ককিয়ে উঠল গনৎসাগা, খোদার ওয়াস্তে মুখটা সামলান, নইলে সর্বনাশ হয়ে যাবে আমাদের।
ম্যাডোনা, নিচ থেকে হাঁক ছাড়ল ডিউক এবার সরাসরি ভ্যালেনটিনার উদ্দেশ্যে। আপনার মনস্থির করার জন্যে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি আমি। ওই ওদিকে তাকিয়ে দেখুন, কামান বসানো হচ্ছে। কাল সকালে উঠে দেখবেন ওগুলোর লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে আপনার দুর্গের দিকে। আচ্ছা, ভাল কথা, যাওয়ার আগে মেসার গনৎসাগার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
একটু সরে জায়গা করে দিল ভ্যালেনটিনা, প্রাচীরের ধারে চলে এল গনৎসাগা।.নিচ থেকে ভেসে এলো জিয়ান মারিয়ার কণ্ঠ, মেসার গনৎসাগা, আমি শুনেছি আপনার লোকজনই দুর্গরক্ষার দায়িত্বে রয়েছে। আমার নিজের এবং গুইডোব্যান্ডের তরফ থেকে আমি আপনাকে নির্দেশ দিচ্ছি : ড্রব্রিজ নামিয়ে গেট খুলে দিন। বিনিময়ে, কথা দিচ্ছি, আপনার পাশে দাঁড়ানো ওই বেয়াদব লোকটা ছাড়া বাকি সবাই সাধারণ ক্ষমা পাবেন। কিন্তু যদি বাধা দেন, চুরমার করে দেব আমি এ দুর্গ, এবং একজনকেও ছাড়ব না।
বাঁশপাতার মত কাঁপছে গনৎসাগার সারা শরীর ভয়ে, একটা কথা উচ্চারণ করতে পারল না। দেয়ালে ঝুঁকে জবাব দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
আপনার প্রস্তাব শুনেছি আমরা। এবং প্রত্যাখ্যান করেছি। দয়া করে অযথা হুমকি দিয়ে নিজের দম আর আমাদের সময় নষ্ট করবেন না।
তোমার জন্য কোনও প্রস্তাব আমি দিইনি, জানোয়ার! তোমাকে চিনি না আমি, তোমার সঙ্গে কথা বলছি না, তোমার কোন কথা শুনতেও চাই না।
বেশ। এবার কেটে পড়ন তাহলে, হুঙ্কার ছাড়ল কাউন্ট। আর এক মুহূর্ত দেরি করলে গুলি ছোঁড়া হবে পিস্তল থেকে। এই যে, তোমরা! পাশ ফিরে কাল্পনিক সৈনিকদের নির্দেশ দিল সে, ম্যাচ জ্বেলে তৈরি হয়ে যাও! আমি ইঙ্গিত দিলেই গেঁথে ফেলবে নিচের লোকটাকে। হ্যাঁ, মাই লর্ড, দূর হবেন, না কি ফেলে দেব লাশ?
অতি জঘন্য ভাষায় বদমাশটাকে ধরতে পারলে কি করবে তার বয়ান দিতে যাচ্ছিল জিয়ান মারিয়া, কিন্তু কাউন্ট যখন প্রেজেন্ট আর্মস” বলে হাঁক ছাড়ল, ওমনি জবান বন্ধ হয়ে গেল তার; তড়িঘড়ি অসম্মানজনক গতিতে ছুট লাগাল সে ক্যাম্পের দিকে। ট্রাম্পেট বাদকও পালাচ্ছে একই গতিতে। পিছন থেকে হা-হা-হা-হা করে হেসে উঠে ডিউকের অন্তরটা জ্বালিয়ে একেবারে খাক করে দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
.
১৮.
স্যার, নিচে নামতে নামতে গুঙিয়ে উঠল গনৎসাগা, আপনি দেখছি ফাঁসীতে ঝুলিয়ে মারবেন আমাদের সবাইকে! একজন প্রিন্সের সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলে?
ওর নায়কের সঙ্গে এইভাবে কথা বলছে দেখে ভুরু কুঁচকে গেল ভ্যালেনটিনার। কিন্তু কথাটা হেসেই উড়িয়ে দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
ভ্যালেনটিনা বলল, গনৎসাগার সাহসটা একটু ভিন্ন ধরনের। যখন প্রয়োজন নেই তখন বাড়ে, আর যখন প্রয়োজন তখন নেই হয়ে যায়।
ভিত্তিহীন আস্ফালনকে তুমি সাহস বলে ভুল করছ, ম্যাডোনা, বলল গনৎসাগা। পরে হয়তো পস্তাবে এজন্যে।
একা গনৎসাগা নয়, আরও কেউ কেউ যে এই একই কথা ভাবছে তা জানা গেল দুর্গ-প্রাঙ্গণে পৌঁছতেই। ক্যাপ্পোচ্চিও নামে এক গাট্টাগোট্টা লোক ভুরু কুঁচকে ডাকল ওদের।
একটা কথা, মেসার গনৎসাগা, ফোর্টেমানির দিকে ফিরল, তুমিও শোনো, সার এরকোল। কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট ঔদ্ধত্য। সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। তোমার অধীনে এই কাজটা নেয়ার সময় আমাকে বলা হয়েছিল এতে ঝুঁকির লেশমাত্র নেই। বলেছিলে, লড়াইয়ের কোনও সম্ভাবনাই নেই, বড়জোর সামান্য ঘুসাঘুসি হতে পারে ডিউকের লোকের সঙ্গে। এই একই আশ্বাস দেয়া হয়েছিল আমার সঙ্গীদেরও।
কথাটা ঠিক? জিজ্ঞেস করল ভ্যালেনটিনা ফোর্টেমানিকে। তাই বলেছিলেন আপনি ওদের?
হ্যাঁ, ম্যাডোনা, বলল এরকোল, মেসার গনৎসাগা আমাকে সেই আশ্বাসই দিয়েছিলেন।
তাই নাকি? এবার বিস্মিত দৃষ্টি রাখল ভ্যালেনটিনা গনৎসাগার উপর। ওদের এইকথা বলে কাজে নিয়েছিলে তুমি?
অনেকটা তাই, আমতা আমতা করে স্বীকার করল ও। আমি ভেবেছিলাম…
মেসার গনৎসাগা, ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল ভ্যালেনটিনা, এতদিনে মনে হয় তোমাকে চিনতে পারছি!
কিন্তু তাতে ক্যাপ্পোচ্চিওর কিছুই এসে যায় না, অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল সে, নতুন প্রোভোস্ট আর ব্যাব্বিয়ানোর ডিউকের সঙ্গে কি কথা হলো শুনেছি আমরা সবাই। হিজ হাইনেসের প্রস্তাব এবং এঁর সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান-সবই শুনেছি। তোমাকে আমি জানাতে চাই সার এরকোল, আপনাকেও মেসার গনৎসাগা, যে আমি অন্তত এখানে থাকছি না। রোক্কালিয়ন দুর্গের পতন হলে আপনাদের সঙ্গে ফাঁসীতে ঝোলার কোনও ইচ্ছে আমার নেই। আমার সঙ্গীদের অনেকেই আমার সঙ্গে একমত।
লোকটার কর্কশ চেহারায় দৃঢ়সঙ্কল্প দেখতে পেল ভ্যালেনটিনা। এই প্রথম ভয়ের ছাপ পড়ল এর চেহারায়। দিশেহারা অবস্থা হলো ওর, কি করবে বুঝতে পারছে না। এমনি সময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
ছি, ক্যাপ্পোচ্চিও। এই কি একজন সোলজারের পরিচয় হলো? জঘন্য এক ভীরু কাপুরুষের মত কথা বলছ তুনি-তাও আবার একজন অবরুদ্ধ, বিপদগ্রস্ত নারীর সামনে!
আমি কাপুরুষ নই! কর্কশ কণ্ঠে গর্জে উঠল লোকটা। রক্ত সরে গেছে মুখ থেকে। ফ্র্যাঞ্চেস্কোর কথাগুলো ঠিক জায়গায় গিয়ে বিঁধেছে। পয়সা নিয়েছি, খোলা মাঠে যে-কারও মোকাবিলা করতে রাজি আছি আমি কিন্তু এভাবে ইঁদুরের মত ফাঁদে আটকে মরতে রাজি নই।
লোকটার চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ফ্র্যাঞ্চেস্কো কিছুক্ষণ, তারপর ওর পিছনে জমায়েত হওয়া জনা দশেক লোকের উপর নজর বুলাল। ওদের সবার চেহারাতেই মুখপাত্রের প্রতি পূর্ণ। সমর্থন। :
এই হচ্ছে যোদ্ধা! নাক কুঁচকে ঘৃণা প্রকাশ করল ফ্র্যাঞ্চেঙ্কো। মস্ত ভুল হয়েছে ফোর্টেমানির, তোমাকে দুর্গরক্ষার জন্যে নিয়োেগ না করে উচিত ছিল দুর্গের রান্নাঘরে বাসন মাজার কাজের জন্যে নেয়া।
স্যার নাইট!
চুপ! আমার সামনে গলার স্বর উঁচু করবে না। আমাকে কি তোমার নিজের মত মনে করেছ, জানোয়ার, যে আওয়াজ শুনেই ভয়ে মরে যাব?
আমি আওয়াজ শুনে ভয়ে মরছি না।
তাহলে কি শুনে? একগাদা ফালতু হুমকি দিয়ে গেল ব্যাব্বিয়ানোর ডিউক, ওগুলো ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া আর কি? তাই শুনেই ভয়ে জান উড়ে গেল তোমার, ছুটে এসে বলছ : আমি এভাবে মরব না, ওভাবে মরব! সত্যিকার সোলজারের আবার এভাবে-ওভাবে কি? খোল মাঠে মরলে বিশেষ কি সুবিধা, অ্যাঁ? আসলে বলল, ওই অর্থহীন হুমকি শুনে শেয়ালের গর্ত খুঁজছ এখন লুকাবার জন্যে।
না, তা খুঁজছি না।
তাহলে মাঠে মরতে রাজি, এই জায়গাটা কি দোষ করল? আসল কথা, ধোঁকা দিচ্ছ নিজেকেই। তবে এটুকু জেনে রাখো, মেয়েমানুষের অধম, মরণ নেই তোমার কপালে-এখানেও না, ওখানেও না। শেষের দিকে গলাটা চড়িয়ে দিল সে যাতে সবাই শুনতে পায় পরিষ্কার।
রোক্কালিয়ন যখন আত্মসমর্পণ করবে…
রোক্কালিয়ন কখনও আত্মসমর্পণ করবে না! গর্জে উঠল ফ্রাঞ্চেস্কো।
বেশ, যখন এ দুর্গের পতন হবে…
কখনও তা হবে না! এমনই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল সে কথাটা যে বোকা হয়ে গেল সবাই। বরং ওরাই লেজ তুলে পালাবে। আমার কাছ থেকে জেনে রাখো, সময় পেলে বড়জোর দুৰ্গটা অবরোধ করে রেখে আমাদের রসদ বন্ধ করতে পারত জিয়ান মারিয়া। কিন্তু হাতে সময় নেই ওর। ওর নিজের ডাচিই আক্রান্ত হতে চলেছে কয়েকদিনের..খুব বেশি হলে এক সপ্তাহের মধ্যে। নিজের রাজ্য বাঁচাতে ছুটতে হবে ওকে ব্যাব্বিয়ানোর পথে।
তাই যদি হয়, তাহলে তো উনি চাইবেন প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে দুৰ্গটা খুঁড়িয়ে দিতে। এমন কণ্ঠে বলল ক্যাপ্পোচ্চিও, যেন আশা করছে,জোরাল যুক্তি দিয়ে তার ভুল ভেঙে দেবে স্যার প্রোভোস্ট।
বিশ্বাস করো, হেসে উঠে বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, একটা-দুটো গোলা ও মারতে পারে ভয় দেখাবার জন্যে, ব্যাস আর কিছু না। সাধারণ কথাটা বুঝছ না কেন, তোমরা যোদ্ধা হয়ে থাকলে তোমাদের তো জানার কথা, রোক্কালিয়নের মত একটা দুর্গের তেমন কোনই ক্ষতি করতে পারবে না জিয়ান মারিয়া ওই কটা কামান দেগে। আর আমরা কিবসে বসে আঙুল চুষব? আমরা বিশজন যদি শক্ত থাকি, যা আছে তার দশ-বিশগুণ সৈন্য এনেও আমাদের কাবু করতে পারবে না কেউ। তাছাড়া তোমরা তো নিজের কানেই শুনেছ আমাকে ধরতে পারলে কি করবে ডিউক। তোমাদের হয়তো ছেড়ে দেবে কিন্তু আমাকে কিছুতেই ছাড়বে নালেনি একথা? তাকিয়ে দেখো। সামান্যতম ভয় দেখতে পাচ্ছ আমার মধ্যে? আমি তো তোমাদের মতই একজন যোদ্ধা; কেন আমি পরোয়া করছি না ওর হুমকিকে? কারণ আমি জানি, ও আসলে কাগজের বাঘ। শোনো, ক্যাপ্পোচ্চিও, গলার স্বর পাল্টে গেল ফ্রাঞ্চেস্কোর, গুরুতর অপরাধ করেছ তুমি। নির্দয় কোন প্রোভোস্ট হলে এখুনি তোমাকে ফাঁসীতে ঝুলিয়ে দিতাম আমি আত্মসমর্পণের প্ররোচনা দিয়ে গ্যারিসনের মনোবল নষ্ট করার দায়ে। তা না করে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে তোমাকে বোঝাবার চেষ্টা করছি শুধু একটি মাত্র কারণে-এই মুহূর্তে তোমার মত একজন সাহসী যোদ্ধাকে হারাতে চাই না আমি। মন থেকে ভয় দূর করো, বীরত্বের সঙ্গে, দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করো শত্রুর। জিয়ান মারিয়া বাধ্য হবে অবরোধ তুলে নিয়ে সরে যেতে। তখন হাত খুলে পুরস্কার দেয়া হবে তোমাদের প্রত্যেককে।
কথা শেষ করে ক্যাপ্পোচ্চিওর জবাবের প্রতীক্ষায় না থেকে শান্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গেল সে, দলবল সহ প্রাঙ্গণ পেরিয়ে কয়েক ধাপ ডিঙিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল হলঘরের ভিতর।
কিন্তু হলঘরে প্রবেশ করেই ঘুরে দাঁড়াল ফ্র্যাথেস্কো। এরকোলকে বলল, একটা বন্দুক সংগ্রহ করো, ল্যাঞ্চিওট্টোকে সঙ্গে নিয়ে আড়াল থেকে গেটটা পাহারা দাও গিয়ে। ওদের মধ্যে এরপরেও বিদ্রোহের ভাব থাকতে পারে, গেটের দিকে এগোলেই একটাকে অন্তত গুলি করে মেরে ফেলবে, তারপর খবর দেবে আমাকে। ঠিক আছে?
এই মহাবিপদের সময় এমন একজন বিচক্ষণ সাহসী বন্ধু পেয়ে মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে ভ্যালেনটিনা হাজারবার। কথা শেষ করে পিছন ফিরে দেখল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ও তার দিকে। বলল, মনে হচ্ছে স্বয়ং খোদা আমাকে রক্ষা করার জন্যেই পাঠিয়েছেন আপনাকে। কিন্তু সত্যিই কি ওরা এত বোঝনোর পরেও বিদ্রোহ করতে পারে?
মনে হয় না, সান্ত্বনা দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। তবে সাবধানের মার নেই। ভয় পেয়ে মানুষ কে যে কখন কি করে বসে তার ঠিক নেই, তাই লক্ষ রাখতে পাঠালাম এরকেলকে। আপনার চোখে পানি দেখতে পাচ্ছি, ম্যাডোনা। বিশ্বাস করুন, কোনও ভয় নেই আপনার, সত্যিই কান্নার কিছু নেই।
হাজার হোক, আমি তো একটা মেয়েই, মেয়েলি দুর্বলতার ঊর্ধ্বে নই। একটু আগে মনে হচ্ছিল সব বুঝি শেষ হয়ে গেল। আপনি না থাকলে যেতই। ওরা যদি বিদ্রোহ করে বসে…।
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, ম্যাডোনা, অভয় দেয়ার জন্যে একটা হাত তুলল ও। আমি যতক্ষণ আছি, কেউ বিদ্রোহ করবে না।
আশ্বস্ত ভ্যালেনটিনা এবার পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে ফিরে গেল মহিলা মহলে, তার নাইটের দেয়া আশ্বাসের বাণী শোনাল সবাইকে।
কিছুই চোখ এড়াল না গনৎসাগার। ফ্র্যাঞ্চেস্কোর প্রতি ঘৃণায় রিরি করছে ওর অন্তর, প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে ভ্যালেনটিনার উপরও। কি করে ওকে ছেড়ে ওই কর্কশ, বাজে লোকটার প্রতি ঝুঁকতে পারে কেউ? নিজের ঘরে ফিরে পায়চারি করতে করতে মনে এলো ফ্র্যাঞ্চেস্কোর কথাগুলো: বিদ্রোহের কোনও সম্ভাবনা নেই। ওর মনে হচ্ছে, ওরা বিদ্রোহ করলেই ভাল হতো, ভ্যালেনটিনা টের পেত এই লোকের কথার কোন মূল্য নেই। মনে এলো, এই অনাহূত লোকটা আসার আগে কি সুন্দর চলছিল সবকিছু। ভ্যালেনটিনার কাছ থেকে ওর প্রেমের প্রতিদান পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল একশো ভাগ। আর এখন? মনটা কালো হয়ে গেল গন্ৎসাগার।
একটা ব্যাপারে তার কোন সন্দেহ নেই, এই লোকটা বোক্কালিয়নে এলে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যেত ওর ভ্যালেনটিনার সঙ্গে। হাসতে হাসতে বেরিয়ে যেতে পারত ওরা এই দুর্গ থেকে। বিধবাকে বিয়ে করার আগ্রহ বোধ করত না জিয়ান মারিয়া। আর সজ্জন, সহৃদয় গুইডোব্যাল্ডো গত্যন্তর না থাকায় মেনে নিত ওদের বিয়েটা। যেমন ভেবেছিল ঠিক তেমনি ঘটুত সবকিছু কাঁটায় কাঁটায়। এই লোকটাই সমস্ত গোলমালের মূল।
পায়চারি করতে করতে ওর মনে হলো, ভ্যালেনটিনার মন পাওয়ার আশা নেই, কিন্তু যদি দল পরিবর্তন করা যায় তাহলে হয়তো ফাঁসীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। তা নইলে ওর রেহাই পাওয়ার আর কোনও পথ নেই। ওরই প্ররোচনায় উরবিনো থেকে পালিয়েছে ভ্যালেনটিনা, এটা যখন জানাজানি হয়ে গেছে, চামড়া বাঁচাতে হলে এটাই একমাত্র পথ।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতেই কিভাবে কি করবে তার পরিকল্পনা তৈরি হয়ে গেল ওর উর্বর মস্তিষ্কে। চারদিকে চেয়ে দেখে নিল কেউ লক্ষ করছে কি না। তারপর উত্তর-পশ্চিম টাওয়ারের অস্ত্র-গুদামের দিকে হাঁটতে শুরু করল ধীর পায়ে। ওখানেই কাগজ-কলম খুঁজে নিয়ে দ্রুত হাতে লিখে ফেলল চিঠি লিখেছে :
আমি গ্যারিসনের লোকদের দিয়ে বিদ্রোহ করিয়ে রোক্কালিয়নের গেট খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারি। একমাত্র এভাবেই অতি সহজে আপনার পক্ষে দুর্গ দখল করে নেয়া সম্ভব। এর মাধ্যমে আমি এটাই প্রমাণ করতে চাই যে মোন্না ভ্যালেনটিনার অবাধ্যতার প্রতি আগেও আমার কোন সমর্থন ছিল না, এখনও নেই। আমার এই কাজের প্রতিদানে আমি কি আশা করতে পারি অতি সত্বর জানান, ঠিক যে কৌশলে আমি এই বার্তা পাঠাচ্ছি, সেই ভাবে। তবে আমাকে যদি দুর্গ প্রাচীরের উপর দেখা যায়, তাহলে এখনই উত্তর দেবেন না।
—রোমিও গনৎসাগা
কাগজটা ভাঁজ করে তার ওপর লিখল সে ব্যাবিয়ানের মহা পরাক্রমশালী, সম্মানিত ডিউকের প্রতি। তারপর একটা তীরের গায়ে পেঁচিয়ে সেটা বাধল। এবার দেয়াল থেকে একটা ধনুক নামিয়ে নিয়ে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ডিউকের তাবুটা। যত্নের সাথে লক্ষ্য স্থির করল সে তাঁবুর দিকে, তারপর ছুঁড়ল তীর। সোজা গিয়ে তাঁবুর গায়ে বিঁধল ওটা, কাঁপছে তাঁবুর ক্যানভাস। মুহূর্তে হৈ-হৈ করে ছুটে এলো সেখানে কয়েকজন গার্ড, তবু থেকেও বেরলো কয়েকজন। এদের মধ্যে জিয়ান মারিয়া আর গুইডোব্যাল্ডোকে চিনতে অসুবিধা হলো না গনৎসাগার।
তীরটা ব্যাব্বিয়ানোর ডিউকের হাতে দেয়া হলো। ওটা হাতে নিয়ে পলকের জন্যে দুর্গপ্রাচীরের দিকে তাকাল জিয়ান মারিয়া, তারপর ঢুকে গেল তাঁবুর ভিতর।
অস্থিরচিত্তে পায়চারি করছে গনৎসাগা। টাওয়ারের দরজাটা খুলে কান পেতে দাঁড়াল কিছুক্ষণ-নাহ, কারও সাড়া নেই। ওদিকে উত্তর লিখে একটা তীরে বেঁধে একজন তীরন্দাজকে দিয়েছে জিয়ান মারিয়া, লোকটা এইদিকেই তাক করেছে ধনুক। কারও সাড়া পেলে দুর্গ প্রাচীরে চেহারা দেখাবার জন্যে তৈরি গনৎসাগা। কিন্তু তার প্রয়োজন পড়ল না। ছুটে এসে দেয়ালে লাগল তীর, খটাং করে পড়ল পাথুরে মেঝেতে। চট করে কাগজটা ছাড়িয়ে নিয়ে তীরটা ফেলে দিল সে একপাশে। চিঠিতে লেখা :
যদি কোনও কৌশলে দুৰ্গটা আমার হাতে তুলে দিতে পার আমি কৃতজ্ঞ তো হই, মোন্না ভ্যালেনটিনাকে এই বিদ্রোহে সাহায্য করার দায় থেকে তোমাকে মুক্তি দেব, আর সেই সঙ্গে দেব এক হাজার স্বর্ণ ফ্লোরিন।
—জিয়ান মারিয়া
চিঠিটা পড়তে পড়তে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর চোখ-মুখ। এইবার বুঝবে ভ্যালেনটিনা ওকে অবজ্ঞা করে উড়ে এসে জুড়ে বসা ওই দাম্ভিক লোকটাকে এতটা গুরুত্ব দেয়া কতখানি অনুচিত কাজ হয়েছে। আর ব্যাটা ফ্র্যাঞ্চেস্কোও টের পাবে আমার মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়ার কি ফল। খুব তত বড়াই করেছিল, দেখব এবার কি করে রক্ষা করে ও ভ্যালেনটিনাকে। ওহ, নাইট! ব্যাটা গুণ্ডা একটা, নাইট সেজেছে আবার! এবার দেখব কিকরে…
হেসে উঠল গনৎসাগা, পরমুহূর্তে আড়ষ্ট হয়ে গেল। কে যেন আসছে এদিকে! ভয়ে কলজে শুকিয়ে গেল ওর। চট করে কাগজটা মুচড়ে দলা পাকিয়ে ফেলে দিল সে প্রাচীরের বাইরে। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে পিছন ফিরল সে কে আসছে দেখার জন্যে।
পেপ্পি আসছে। কাছে এসে দাঁড়াল সে। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে গনৎসাগার মুখের দিকে।
কি ব্যাপার? আমাকে খুঁজছ? কথাটা কর্কশ ভঙ্গিতে বলার চেষ্টা করল সে, কিন্তু একটু যেন কেঁপে গেল গলা।
মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করল জেসটার।
মোন্না ভ্যালেনটিনা বাগানে অপেক্ষা করছেন আপনার জন্যে, এক্সেলেন্সি। জানতে চেয়েছেন আপনার কি সময় হবে?
.
১৯.
গনৎসাগার কাগজ দলা পাকিয়ে নিচে ফেলাটা দেখে ফেলেছে পেপ্পি। ওর চেহারার ফ্যাকাসে ভাবটাও নজর এড়ায়নি। তাই গনৎসাগা চলে যেতেই উঁকি দিল প্রাচীরের ওপাশে।
প্রথমে কিছুই চোখে পড়ল না ওর। ভাবল, পরিখার স্রোতে ভেসে গেছে বুঝি ওটা। হতাশ হয়ে সরে আসতে যাচ্ছিল এমনি সময়েদেখতে পেল পানির কাছাকাছি একটা পাথরের উপর পড়ে আছে কাগজের দলাটা। লক্ষ করল, ড্রব্রিজের পাশে ছোট্ট গেটের ফুট দশেক নিচেই রয়েছে পাথরটা।
কারও কোনও রকম সন্দেহের উদ্রেক না করে একগাছি রশি সংগ্রহ করল সে, তারপর নিচে নেমে আলগোছে খুলল গেটটা। রশির একটা দিক গেটের সঙ্গে বেঁধে অপর দিক সাবধানে ঝুলিয়ে দিল নিচে। তারপর সবার অলক্ষে রশি বেয়ে নেমে গেল নিচে। রশিতে একটু দোল দিতেই পৌঁছে গেল সে পাথরটার কাছে। একহাতে ছোঁ মেরে কাগজটা তুলে নিয়ে উঠে এলো উপরে। গেট বন্ধ করে চাবিটা ঝুলিয়ে দিল সে গার্ডরূমের দেয়ালে গাঁথা পেরেকে, তারপর রান্নাঘরে গিয়ে ভাঁজ খুলে পড়ল চিঠিটা।
একমুহূর্ত দেরি না করে সোজা গিয়ে ঢুকল সে কাউন্ট অভ অ্যাকুইলার ঘরে। চিঠিটা খুঁটিয়ে পড়ল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, তারপর প্রশ্ন করে করে জেনে নিল ওটা গনৎসাগার হাতে কিভাবে পৌঁছল বলে পেপ্পির ধারণা। অবাক হলো পেপ্পি, চিঠির বিষয়বস্তু বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন করল না কাউন্টকে, বরং মনে হচ্ছে খুশি হয়েছে সে ব্যাপারটা জানতে পেরে।
এক হাজার সোনার ফ্লোরিন দিতে চায়, সেই সঙ্গে গনৎসাগার মুক্তি। তাহলে তো দেখা যাচ্ছে, ঠিকই ধরেছি-কামান দাগবে বলে যে হুমকি দিচ্ছিল, ওটা স্রেফ ভয় দেখানোর জন্যে। হঠাৎ মুখ তুলে চাইল ফ্র্যাঞ্চেস্কো পেপ্পির দিকে, বলল, তুমি মানুষটা খুব ভাল, পেপ্পি। আরহ্যাঁ, এই ব্যাপারটা গোপন রেখো।
মাথা ঝাঁকাল জেসটার। ঠিক আছে। আপনি মেসার গনৎসাগার ওপর নজর রাখবেন তো?”
নজর? কেন, কি দরকার? তোমার কি মনে হচ্ছে এই প্রস্তাব ও লুফে নিতে পারে, এতই বাজে লোক?
ভাঁড়ের মুখে দেখা দিল ধূর্ত, প্যাচানো হাসি। বলল, আপনার কি মনে হয় না, লর্ড, ও-ই যোগাযোগ করেছে আগে?
আরে না, মাথা নাড়ল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। তুমি একথা ভাবতে পারলে কি করে? লোকটা কল্পনাবিলাসী গায়ক-কবি হতে পারে, ভীরু কাপুরুষও হতে পারে, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা…উঁহু, অন্তত মোন্না ভ্যালেনটিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে না এই লোক।
কিন্তু এই কথায় আশ্বস্ত হতে পারল না পেপ্পি! বহুদিন থেকে চেনে সে গনৎসাগাকে, লোকটা যে কাউটের মত মহৎ নয়, বরং নীচ একজন সুযোগসন্ধানী মতলববাজ, সেটা তার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ধরা পড়েছে নানাভাবে, বহুবার। স্থির করল, কাউন্ট যাই বলুন, এখন থেকে ছায়ার মত লেগে থাকবে সে লোকটার পিছনে।
রাতে খেতে বসে দাঁত ব্যথার কথা বলে ভ্যালেনটিনার অনুমতি নিয়ে উঠে পড়ল গনৎসাগা। সবার অলক্ষে পেপ্পিও বেরিয়ে যাচ্ছিল ঘর থেকে, কিন্তু এক থাবা দিয়ে ঘাড় ধরে ওকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এলো ফ্রা ডোমেনিকো।
তোমারও দাঁতে ব্যথা উঠল নাকি, অপদার্থ? থাকো এখানে, খাবার বাড়ায় সাহায্য করো আমাকে!
ছেড়ে দিন আমাকে, প্লিজ! কথাটা এমন সুরে বল পেপ্পি যে বাঁকা কথায় অভ্যস্ত ফ্রায়ার থতমত খেয়ে ছেড়ে দিল ওকে। বেরিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক তখনই ডাকল ওকে ভ্যালেনটিনা, গন্ৎসাগাকে অনুসরণ করা আর হলো না।
উত্তর প্রাচীরে পাহারায় ছিল ক্যাপ্পোচ্চিও, সোজা সেখানে গিয়ে হাজির হলো গনৎসাগা। সোজা-সাপ্টা বলল ওকে, আজ সকালে বোকা বনেছে সে আর তার অনুচররা। মেস!র ফ্রাঞ্চেস্কো কথার রাজা, তার কথায় ওর মত একজন বুদ্ধিমান লোকের ভোলা ঠিক হয়নি।
এই তোমাকে বলে দিচ্ছি, ক্যাপ্পোচ্চিও, সবশেষে বলল সে, হেরে গেছি আমরা। এখানে থেকে বাধা দেয়ার অর্থ ডিউকের হাতে ধরা পড়ে। ফাসীকাঠে ঝোলা।
সন্দেহপ্রবণ লোক ক্যাপ্পোচ্চিও, এর মন বলছে কী যেন মতলব রয়েছে গনৎসাগার, কিন্তু সেটা যে ঠিক.কি, বুঝে উঠতে পারছে না। দুই হাতে বর্শাটা ধরে তার উপর ভর দিয়ে দাঁড়াল সে, চার মৃদু আলোয় তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পরীক্ষা করছে গনৎসাগার মুখ।
আপনি বলতে চাইছেন, মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কোর কথা শুনে আমরা ভুল করেছি? রোক্কালিয়ন থেকে আমাদের মার্চ করে বেরিয়ে যাওয়াই উচিত ছিল?
ঠিক তাই। সময় থাকতে এখনও তাই করা উচিত।
কিন্তু আপনি কিজন্যে প্ররোচনা দেবেন আমাদের?
এইন্যে যে, তোমাদের মত আমাকেও মিথ্যে কথা বলে জড়ানো হয়েছে এর মধ্যে। এখন কাজে-কথায় কোনও মিল পাচ্ছি না। এভাবে মারা পড়ব জানলে কিছুতেই আসতাম না আমি।
আচ্ছা! মাথা ঝাঁকাল ক্যাপ্পোচ্চিও। বুঝতে পারছি কিছুটা। আমাদের সঙ্গে আপনিও বিদায় নিতে চান। তাই না?”
ঠিক, বলল গনৎসাগা।
কিন্তু ফোর্টেমানিকে ডিঙিয়ে আমাকে কেন বলছেন এসব? সন্দেহ যায় না ক্যাপ্পোচ্চিওর।
ফোর্টেমানি? আঁৎকে উঠল গনৎসাগা। ওকে বলে কি হবে? ওকে তো জাদু করে ভেড়া বানিয়ে ফেলেছে ওই বদমাশ ফ্র্যাঞ্চেস্কো। কি রকম নাজেহাল হলো সেদিন সবাই তো দেখলে, তার পরেও কুকুরের মত পায়ে পায়ে ঘুরছে ওর, যা বলছে তাই করছে।
আবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে গনৎসাগার মুখটা পরীক্ষা করার চেষ্টা করল ক্যাপ্পোচ্চিও, কিন্তু অস্পষ্ট আলোয় দেখা যাচ্ছে না পরিষ্কার।
যা বললেন, ব্যাপার এটুকুই? না কি আরও গভীর কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে এর পিছনে? আপনি চাইছেন, আমরা মোন্না ভ্যালেনটিনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি, অথচ আপনিই এই কাজে নিয়োগ করেছেন আমাদের। আসলে…
আসলে এখুনি কিছুই করতে বলছি না আমি তোমাদের, বাধা দিল ওকে গনৎসাগা। এখন কিছুই করার দরকার নেই। কাল সকালে জিয়ান মারিয়ার দূত এসে কি বলে শোনো আগে, তারপর নিজেরাই বুঝতে পারবে কি করা উচিত। আমার উদ্দেশ্য জানতে চাইছ। কেন, নিজের গর্দান বাঁচানোর তাগিদটা তেমন জোরাল উদ্দেশ্য বলে মনে হয় তোমার কাছে?
হেসে উঠল ক্যাপ্পোচ্চিও ভীরু লোকটার অকপট স্বীকারোক্তি শুনে। বলল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই; যথেষ্ট জোরাল। ঠিক আছে, তাহলে আগামীকাল। আমার বন্ধুদের নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি আমি রোক্কালিয়ন থেকে।
আমার কথা মেনে নেয়ার দরকার নেই। কাল দূত এসে কি বলে শোনার আগে কিছুই করতে যেয়ো না। নিজের কানে সব শুনলে নিজেই বুঝতে পারবে কি করা উচিত।
বেশ তো, শোনা যাবে।
আর একটা কথা, আমার পরামর্শের কথা কাউকে, এমন কি তোমার বন্ধুদেরও বোলো না।
ঠিক আছে, বলব না। আপনার গোপন কথা গোপনই থাকবে আমার কাছে। কথাটা বলেই আবার বর্শা হাতে পায়চারি শুরু করল ক্যাপ্পোচ্চিও।
বিছানায় গিয়ে উঠল পুলকিত গনৎসাগা। অভ্যাসবশে গুনগুন করে গানের কয়েকটা কলি ভাজল, টুং-টাং সুর তুলল লিউটে। নাহ্, সত্যিই মনটা ভাল হয়ে গেছে। প্রতিশোধ নিয়েছে সে, ভ্যালেনটিনার সর্বনাশের ব্যবস্থা করেছে। ওকে অবহেলা করার পরিণাম যে কি ভয়ঙ্কর, টের পাবে সে কাল সকালেই। পারলে বাঁচাক ওকে ওর নাইট।
পরদিন সকালে জিয়ান মারিয়ার দূত যখন বিউগল বাজিয়ে ডাকল ওদের, সবার সঙ্গে গনৎসাগাও হাজির হলো গিয়ে দুর্গ প্রাচীরের উপর। জনা কয়েক যোদ্ধাকে এমন ভাবে দাঁড় করিয়েছে ফ্র্যাঞ্চেস্কো যে দেখলে ভক্তি হয়, মনে হয় প্রবল শক্তিশালী গোটা একটা সৈন্যবাহিনী বুঝি রয়েছে দুর্গে। আরও কয়েকজন চারটে ছোট আর গোটা তিনেক বড় কামান গড়গড়িয়ে টেনে এনে ময়দানের দিকে তাক করে বসাচ্ছে। প্রচুর হট্টগোল হচ্ছে তার ফলে। এসবই দূতকে প্রভাবিত করার কৌশল। ব্যাটলমেন্টের ফোকর দিয়ে নাক বের করা কামানগুলোকে ভয়ঙ্কর আক্রমণাত্মক দেখাচ্ছে।
লোকজনকে হুকুম দিয়ে এটা-ওটা করাচ্ছে বটে, কিন্তু কান দুটো খাড়া রেখেছে ফ্র্যাঞ্চেস্কো দূতের বক্তব্য শোনার জন্যে। সেই একই কথা আবার শোনাল সে। আত্মসমর্পণ না করলে বলপ্রয়োগে দুর্গ দখল করে প্রত্যেককে ফাসী দেয়া হবে, একজন বন্দীকেও ক্ষমা করা হবে না। মহামহিম জিয়ান মারিয়া আরও আধঘণ্টা সময় দিয়েছেন ওদেরকে। এরমধ্যে ব্রিজ নামিয়ে গেট খুলে বেরিয়ে না এলে শুরু হবে তুমুল গোলাবর্ষণ।
ঠিক এই কথাগুলো বলার জন্যেই গতরাতে তীরের সাহায্যে দ্বিতীয় বার্তা পাঠিয়েছিল গনৎসাগা জিয়ান মারিয়ার কাছে।
এতক্ষণ একটা কামান ঠিক মত তাক করা হয়েছে কিনা ঝুঁকে পরীক্ষা করার ভান করছিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, সন্তুষ্ট হওয়ার ভঙ্গি কমে এবার প্রাচীরের কাছে এগিয়ে গেল উত্তর দেবে বলে, দাঁড়াল ভ্যালেনটিনার পাশে। লক্ষই করল না, প্রাচীরের ধার থেকে নিঃশব্দে সরে পড়ছে ওর লোজন।
যাও, ব্যাব্বিয়ানোর হাইনেসকে গিয়ে বলো, তার আচরণে উপকথার সেই রাখাল বালকের কথা মনে পড়ছে আমাদের, যে কি না বাঘ, বাঘ! বলে সবাইকে ভয় দেখিয়ে মজা পেত। তাকে বলো, তার পুরস্কার বা শাস্তি কোনটারই পরোয়া করে না এই দুর্ণের গ্যারিসন। কামান দাগার ইচ্ছে থাকলে এখনই সে শুরু করতে পারে, আধঘণ্টা অপেক্ষা করার কোনও দরকার নেই। আমরা তৈরি আছি, দেখতেই পাচ্ছ। তাকে গিয়ে বলবে এই কামানগুলো তাক করা রয়েছে তার ক্যাম্পের দিকে। দুর্গ লক্ষ্য করে একটা গোলা সে ছুঁড়ে দেখুক, তারপর বুঝবে ঠেলা। তাকে বলবে, আমরা রক্ত ঝরাতে চাই না, কিন্তু সে যদি আমাদের বাধ্য করে, নিজেই দায়ী থাকবে নিজের মৃত্যুর জন্যে। সবশেষে তাকে বলবে, অযথা হুমকি দেয়ার জন্য আর যেন তোমাকে না পাঠায়।
মাথা ঝুঁকিয়ে ফিরে গেল দূত। সে কল্পনাও করতে পারেনি কামান আছে রোক্কালিয়নে এবং পাল্টা আঘাত হানার জন্যে প্রস্তুত রয়েছে সেগুলো। কামানে যে গোলা নেই সেটা সে যেমন জানে না, জিয়ান মারিয়ারও জানার কথা নয়; পাল্টা হুমকি শুনে আত্মা চমকে গেল তার। তবে এখনও আশা করছে সে গনৎসাগা হয়তো বেরিয়ে আসতে পারবে বিদ্রোহীদের নিয়ে।
দূত বিদায় নিতেই হেসে উঠল কাউন্টের পিছনে দাঁড়ানো ফোর্টেমানি। ভ্যালেনটিনার কোমল দৃষ্টিতে প্রশংসা ঝরছে।
মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কো, আপনি না থাকলে এই বিপদে আমি কী যে করতাম! আপনার বুদ্ধি আর সাহস…
থাক, থাক, বাধা দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। আর লজ্জা দেবেন না।
গনৎসাগার মুখে বিদ্বেষের বাঁকা হাসি দেখতে পেয়েছে সে।
কিন্তু বারুদ খুঁজে পেলেন কোথায়? সরল এ প্রশ্ন করল ভ্যালেনটিনা। এরকোলের হাসির অর্থ সে বুঝতে পারেনি।
পাইনি, জবাব দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। মৃদু হাসল, আমার হুমকিও জিয়ান মারিয়ার হুমকির মতই মিথ্যা। তবে আমার বিশ্বাস, আমার হুমকি ওর চাছে মিথ্যা মনে হচ্ছে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, ম্যাডোনা, গোলাগুলির খায়েশ ওর মিটে গেছে। দুর্গের দিকে একটা গোলা ছোঁড়ার সাহস হবে না ওর।, নিশ্চিন্তে এবার নাস্তাটা সেরে নেয়া যাক।
বলেন কি! গোলা নেই ওই কামানগুলোয়? চোখ বড় হয়ে গেল ভ্যালেনটিনার। তারপরেও আপনি ওভাবে হুমকি দিতে পারলেন ওকে? ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে।
এই তো ঠিক বুঝেছেন। হাসছেনও। বলুন তো, এমন পরিস্থিতিতে না হেসে পারা যায়? চলুন তাহলে, খিদেয় জ্বলে যাচ্ছে আমার পেটটা।
ফ্র্যাঞ্চেস্কোর কথাটা শেষ হওয়ার আগেই দেখা গেল সিঁড়ি বেয়ে প্রায় উড়ে আসছে পেপ্পিনো। ভয়ে সাদা হয়ে গেছে ওর মুখ।
ম্যাডোনা! খুঁপিয়ে উঠল জেসটার, হাঁপাচ্ছে হাপরের মত। মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কো! সবাইকে.. ক্যাপ্পোচ্চিও…খেপিয়ে তুলছে ও সবাইকে। ষড়যন্ত্র করছে দুৰ্গটা ডিউকের হাতে তুলে দেয়ার জন্যে!
আবার ভয় দেখা দিল ভ্যালেনটিনার দুচোখে। রক্তশূন্য; ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখ। যতই সাহসী মেয়ে হোক, আচমকা এই দুঃসংবাদে ঘুরে উঠল ওর মাথাটা। ওর মনে হলো আর কোনও আশা নেই, সব শেষ হয়ে গেল।
তুমি অসুস্থ বোধ করছ, ম্যাডোনা; আমার হাত ধরো।
কথাটা বেরিয়েছে গনৎসাগার কণ্ঠ থেকে। নিজের অজান্তেই খপ করে ওর বাড়ানো হাতটা ধরে সরে গেল ভ্যালেনটিনা একপাশে-যেখান থেকে নিচের আঙিনাটা দেখা যায় পরিষ্কার।
বাজে একটা গাল বকে উঠল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, তারপর হুকুমের তুবড়ি ছুটল ওর মুখ দিয়ে। এক দৌড়ে যাও, পেপ্পি, ওই অস্ত্রাগারে! দুইহাতে চালাবার তুলোর নিয়ে এসো একটা, যত বড় পাও। এরকোল, তুমি এসো আমার সঙ্গে। গনৎসাগা…না, আপনি থাকুন মোন্না ভ্যালেনটিনার সঙ্গে এখানেই।
এপাশে এসে ভ্যালেনটিনার পাশ থেকে নিচের দিকে চাইল ফ্রাঞ্চেস্কো। দেখা গেল এখনও বক্তৃতা দিচ্ছে ক্যাপ্পোচ্চিও। ফ্রাঞ্চেস্কোকে দেখতে পেয়ে ভয়ঙ্কর এক হুঙ্কার ছাড়ল ওরা।
চলো, চলো গেটের দিকে: হাঁক ছাড়ছে ওরা। নামাও ড্রব্রিজ! জিয়ান মারিয়ার শর্ত মেনে নেব আমরা, এখানে ছুঁচোর মত মরব না!
কসম খোদার, তাই করবে তোমরা, যদি আমি তাই চাই! দাঁতের ফাঁকে চিবিয়ে বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। তারপর অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে চোঁচিয়ে উঠল, কি হলো, পেপ্পি? কবে আনবে ওটা?
ঠিক তখনই দেখা গেল ছয় ফুট লম্বা বিশাল একটা দুধার, দুইহাতি তলোয়ার বয়ে আনছে সে কষ্টেসৃষ্টে। চট করে তলোয়ারটা ধরল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, তারপর নিচু হয়ে ওর কানে কানে কি যেন বলল। পেপ্পিনো মাথা ঝাঁকিয়ে ছুট দিতে যাবে, পিছন থেকে গলা চড়িয়ে বলল, ..নিচের আঙিনায়, বুঝলে? আছে আমার চেম্বারে টেবিলের ওপর রাখা বাক্সটায়।
পিঠের কুঁজ নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ছুটল পেপ্পির্নো। আর বিশাল তলোয়ারটা যেন পাখির পালক এমনি ভঙ্গিতে ওটাকে কাঁধে ফেলে নিচে নামবে বলে পা বাড়াল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। চট করে ভ্যালেনটিনার ফর্সা হাত ধরে ফেলল ওর বাহু।
কি করতে যাচ্ছেন? ফিসফিস করে জানতে চাইল ও। দুচোখে রাজ্যের উকণ্ঠা।
ওই ইতরগুলোর বিশ্বাসঘাতকতার ব্যবস্থা করতে, বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো সংক্ষেপে। আপনি এখানেই থাকুন, ম্যাডোনা। কিছু ভাববেন না; ফোর্টেমানি আর আমি ওদের হয় শান্ত করব, নয়তো শেষ করে দেব। কথাটা এতই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল ও, যে সামান্যতম সন্দেহ রইল না গনৎসাগার মনে যে যা বলছে তাই করে ছাড়বে লোকটা।
মাথা খারাপ আপনার! বলল ভ্যালেনটিনা। বিশ জনের বিরুদ্ধে কি করবেন আপনারা দুজন?
ঈশ্বরের যা ইচ্ছে, বলে ওকে আশ্বস্ত করবার জন্যে হাসল একটু।
খুন করবে ওরা আপনাকে! প্লিজ, আপনি যাবেন না! ওদের যা খুশি করুক, আমার যা হয় হোক, আপনি যাবেন না! চোখে পানি এসে গেছে ভ্যালেনটিনার, দৃষ্টিতে অনুনয়।
কৃতজ্ঞ বোধ করল ফ্র্যাঞ্চেস্কো ওর জন্যে মেয়েটিকে এতটা কাতর হতে দেখে। কয়েক মুহূর্ত মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে ইল ওর অপরূপ সুন্দর মুখের দিকে। ইচ্ছে হলো জড়িয়ে ধরে কপালে চুমো দেয়। কিন্তু নিজেকে সামলে রাখল ও। মৃদু হেসে বলল, আপনার নাইটের ওপর একটু বিশ্বাস রাখুন, ম্যাডোনা। সাহসে বুক বাঁধুন। এখন পর্যন্ত আপনার কোনও কাজে তাকে বিফল হতে দেখেছেন? তাহলে কিসের ভয়?
কথাটা অনেকখানি সাহস যোগাল ভ্যালেনটিনার মনে। ছাড়ার আগে নিজের অজান্তে হাত বুলিয়ে দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কোর বাহুতে।
নাস্তা খেতে বসে এ নিয়ে আমরা হাসাহাসি করব, দেখবেন। চলে এসো, এরকোল! বলেই দ্রুতপায়ে নামতে শুরু করল সে ধাপ বেয়ে।
ঠিক সময়েই পৌঁছল দুজন। আঙিনায় নেমে দেখল হুড়মুড় করে গেটের দিকে আসছে ওরা দল বেঁধে। হৈ-হল্লা করতে করতে আসছে। জানে, কারও সাধ্য নেই এখন ওদের বাধা দেয়। কিন্তু তারপরেও দুঃসাহসী, দীর্ঘদেহী লোকটাকে বিশাল এক তলোয়ার হাতে দাঁড়ানো দেখে টলে গেল ওদের আত্মবিশ্বাস। এগোচ্ছে এখনও, পিছন থেকে চেঁচিয়ে উৎসাহ যোগাচ্ছে ক্যাপ্পোচ্চিও। কাছাকাছি আসতেই কাঁধ থেকে তলোয়ারটা নামিয়ে দুই হাতে সঁই-সাঁই করে মাথার ওপর দুই পাক ঘোরাল সে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে। এক লাফে পিছিয়ে গেল কয়েকজন সামনে থেকে। আবার ওটা কাঁধে ফেলে সতর্ক দৃষ্টি বুলাল সবার উপর। মনে মনে স্থির করে রেখেছে, কেউ এগোতে চাইলে ঘ্যাঁচ করে নামিয়ে দেবে কল্লাটা।
দেখতেই পাচ্ছ এক পা সামনে এগোলে কি ঘটবে! শান্ত, অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ও। লজ্জা বলতে কিছুই নেই তোমাদের, ভীতু জানোয়ারের দল! বিশ্বাসঘাতকতার সময় যা একটু গলা দিয়ে চি চি আওয়াজ বেরোয়, ব্যাস, ওখানেই বীরত্বের শেষ! অথচ একজন ভদ্রমহিলার কাছ থেকে পয়সা নিচ্ছ প্রয়োজনে তাকে রক্ষা করবে এই অঙ্গীকারে। নিজেদের আবার যোদ্ধা বলে পরিচয় দাও, লজ্জা করে না তোমাদের?
এবার শুরু হলো বক্তৃতা। মোটামুটি গতকাল ক্যাপ্পোচ্চিওকে বলা কথাগুলোই আবার বলল ওদের, তবে ভিন্ন আঙ্গিকে; তীব্র, জ্বলন্ত ভাষায়। জোরের সঙ্গে জানাল, ফাপা হুমকি দিচ্ছে জিয়ান মারিয়া, যতটা সাধ্য তার চেয়ে অনেক বড় বোলচাল মারছে, আর তাই শুনে বোকার মত আত্মসমর্পণ করতে চলেছ তোমরা দল বেঁধে আসলে তোমাদের জন্যে নিরাপত্তা বাইরে নয়, দুর্গের ভিতরে। উরবিনোর বিরুদ্ধে মোন্না ভ্যালেনটিনাকে সাহায্য করেছ তোমরা, সে অপরাধ জিয়ান মারিয়া মাফ করার কে? কথার চাতুরী দিয়ে দুর্গরক্ষীদের কাবু করে ভিতরে ঢুকতে চাইছে ব্যাব্বিয়ানোর বিয়ে-পাগলা ডিউক। কিছু করার ক্ষমতা নেই ওর। বড়জোর দুর্গ ঘিরে চুপচাপ বসে থাকতে পারে ও আমাদের রসদ বন্ধ করে দিয়ে। কিন্তু কতদিন? সীজার বর্জিয়ার সৈন্যরা শীঘ্রি মার্চ করছে ব্যাব্বিয়ানোর দিকে, আগামী দুচারদিনের মধ্যেই অবরোধ তুলে জান-প্রাণ নিয়ে ছুটতে হবে ওকে নিজ রাজ্য সামলাতে। অন্তত তিন মাসের রসদ রয়েছে আমাদের কাছে। না খাইয়ে শায়েস্তা করতে পারবে ও আমাদের? অতদিন সময় আছে ওর হাতে?
ও ভয় দেখাচ্ছে, রোক্কালিয়ন দখল করার পর ফাঁসী দেবে তোমাদের। এটা কি সম্ভব? দুর্গ দখল করতে পারলেও তো এমন একটা পাশবিক কাজ তাকে করতে দেবেন না উরবিনোর ডিউক। তোমাদের কি দোষ? তোমরা ভাড়াটে সৈন্য, পয়সার বিনিময়ে যুদ্ধ করো। দোষ যদি কিছু হয়ে থাকে, হয়েছে মোন্না ভ্যালেনটিনা আর ওই ক্যাপটেনের-যে তোমাদের ভাড়া করেছে। ব্যাব্বিয়ানো থেকে এসে একজনের ইচ্ছে হলো, আর ধরে ধরে তোমাদের ঝুলিয়ে দিল ফাঁসীতে-কি করে ভাবলে এটা ঘটতে দেবেন মহান গুইডোব্যাল্ডো? নিজ দেশের ডিউককে চেনো না তোমরা? আজ পর্যন্ত কখনও কোন অন্যায় করেছেন তিনি প্রজাদের ওপর?
নির্বোধের দল! এ দুর্গের মহিলারা যতখানি নিরাপদ, তোমরাও ঠিক ততখানিই নিরাপদ। এখানে যদি কারও ফাঁসী হয়, হবে আমার আর মেসার গনৎসাগার। কই, আমি তো আত্মসমর্পণের কথা কল্পনাতেও আনছি না! কেন? কারণ, আমি জানি, কোনও ভয় নেই আমাদের। ওর ক্ষমতায় কুলালে হুমকি-ধামকি দিয়ে সময় নষ্ট না করে দুৰ্গটা এতক্ষণে দখলই করে নিত।
বলো, তোমরা কি ওর বোলচালেই ভয় পেয়ে আত্মসমর্পণ করে গোটা ইটালীর হাসির খোরাকে পরিণত হতে চাও? চাও তোমরা ভবিষ্যতে যখনই ভীরুতা আর কাপুরুষতার কথা উঠবে, গোটা ইটালী আঙুল তুলে দেখাক মোন্না ভ্যালেনটিনার গ্যারিসনের দিকে?
একবার নরম একবার গরম হয়ে, একবার কষাঘাত একবার আশ্বাস দিয়ে ওদেরকে অনেকটা শান্ত করে আনল কাউন্ট।
প্রাচীরের উপর ওদিকে চলেছে আরেক নাটক। ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে নেমে যেতে দেখে কেঁদে উঠেছিল ভ্যালেনটিনা, গনৎসাগাকে অনুরোধ করেছিল নিচে গিয়ে ওকে সাহায্য করতে। কিন্তু এক ইঞ্চি নড়েনি লোকটা। জানুয়ারি-রোদের মত ফ্যাকাসে হাসি হেসেছে, কঠোর হয়েছে তার নীল চোখের দৃষ্টি দুর্বলতা বা ভীরুতার জন্যে যে নড়ছে না তা নয়; যদি হারকিউলিসের মত শক্তি থাকত, আর থাকত অ্যাচিলেসের সাহস, তবু ফ্র্যাঞ্চেস্কোর জন্যে সে এখন একটা আঙুল নাড়াত না। বার নার তাগিদ দেয়ায় ভুরু কুঁচকে বিরক্ত দৃষ্টিতে চাইল সে ভ্যালেনটিনার দিকে।
কেন যাব, ম্যাডোনা? ঠাণ্ডা গলায় জানতে চাইল সে। কেন আমি এমন একজনের সাহায্যে এগিয়ে যাব যার কদর তোমার কাছে আমার চেয়ে বেশি? এই দুর্গরক্ষার জনে! কেন অস্ত্র ধরব আমি? কোন্ স্বার্থে?
অবাক চোখে ওকে দেখল ভ্যালেনটিনা। এসব কি বলছ তুমি, গনৎসাগা? তুমি না আমার বন্ধু?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বন্ধু। তোমার পোষা কুকুর, তোমার পোষা গানের পাখি; কিন্তু তোমার ক্যাপটেন হওয়ার উপযুক্ত লোক নই। জিয়ান মারিয়ার হাত থেকে রক্ষার জন্যে, বিপদ মাথায় করে তোমাকে এখানে নিয়ে এলাম, কিন্তু প্রতিদানে? আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলে তুমি রুক্ষ এক যুদ্ধবাজ লোকের জন্যে! তারপর কি করে আশা করো তোমাকে সাহায্য করব আমি? পারলে সাহায্য করুক তোমার কল্পনার নাইট মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কো! ও যদি,
চুপ করো, গনৎসাগা, ওর কথাগুলো শুনি।
গনৎসাগা বুঝল, বৃথাই বকবক করেছে সে এতক্ষণ, ওর বেশিরভাগ কথা কানেই যায়নি ভ্যালেনটিনার দুচোখ দিয়ে গিলছে নিচের দৃশ্য। নিচের দৃ ও কেমন যেন অন্যরকম লাগছে এখন।
যেখানে পাঠানো হয়েছিল সেখান থেকে ফিক এসেছে পেপ্পি। ওকে কাছে ডেকে ওর কাছ থেকে একটা কাগজ নিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। তারপর গলা চড়িয়ে বলল, এই যে, যা বলছি তার প্রমাণ দেখিয়ে দিচ্ছি। জিয়ান মারিয়ার যে কামান দাগার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও নেই, তা লেখা আছে এখানে। ভুল, বোঝাচ্ছে তোমাদের বদমাশ ক্যাপ্পোচ্চিও, তোমরাও ছাগলের মত ছুটছ ওর পিছনে। শোনো এবার, এই চিঠির মাধ্যমে এ দুর্গের কোনও একজনকে কিভাবে ঘুষ সাধছে জিয়া মারিয়া।
এবার গড়গড় করে পড়তে শুরু করল সে চিঠিটা! বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল গন্ৎসাগার-এ তো ওর কাছে লেখা জিয়ান মারিয়ার সেই চিঠি! কাঁপন উঠে গেল ওর সর্বাঙ্গে। বোঁ করে ঘুরে উঠল মাথাটা। চট করে সরে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিল সে।
নিচ থেকে ভেসে এলো ফ্র্যাঞ্চেস্কোর গমগমে.গলা।
তোমরাই বলো, কামান দেগে এই দুর্গ অধিকার করতে পারলে এক হাজার সোনার ফ্লোরিন সাধতে যায় কেন জিয়ান মারিয়া কাউকে? গতকাল এসেছে এই চিঠি। আজ আমরা আমাদের কামান দেখিয়ে দিয়েছি ওর দূতকে! গতকালই যে কামান দাগার সাহস পায়নি, আজ কোন্ সাহসে গোলা মারবে সে? নাও, ধরো, চিঠিটা এগিয়ে দিল সে সামনে, তোমাদের মধ্যে কারও পেটে বিদ্যে বলে কিছু থাকলে পড়ে দেখতে পার।
এগিয়ে এলো ক্যাপ্পোচ্চিও, চিঠিটা নিয়ে আভেনটানো বলে এক যুবককে ডেকে তার হাতে দিল ওটা। ভাল করে খুঁটিয়ে দেখল সে চিঠিটা, জোরে পড়ে শোনাল সবাইকে তারপর মন্তব্য করল: জিনিসটা খাঁটি তাতে কোন সন্দেহ নেই।
কার উদ্দেশ্যে লেখা? জানতে চাইল ক্যাপ্পোচ্চিও।
না, না! আপত্তি করল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, নাম দিয়ে কি হবে?
বাধা দেবেন না! বলল ক্যাপ্পোচ্চিও। কারণ আছে আমার জানতে চাওয়ার। পড়ো তুমি নামটা, আভেনটানো।
মেসার রোমিও গনৎসাগা! বিস্মিত কণ্ঠে পাঠ করল যুবক।
ক্যাপ্পোচ্চিওর চেহারায় অশুভ কিছু দেখতে পেয়ে চট করে লোয়ারের হাতলে চলে গেল ফ্র্যাঞ্চেস্কোর হাত। কিন্তু না, মুখ তুলে গনৎসাগার দিকে চেয়ে তিক্ত হাসি হাসল সে। বুঝতে পেরেছে, এক হাজার ফ্লোরিনের জন্যে তাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। মুহূর্তে সে পরিণত হলো ফ্র্যাঞ্চেস্কোর সমর্থকে। তার বন্ধুরা জানল না কেন কি ঘটল, তারা শুধু অবাক হয়ে দেখল প্রোভোস্টের প্রতিটা কথায় সমর্থন দিচ্ছে ক্যাপ্পোচ্চিও, এমন কি দুর্গতেরণ রক্ষা করবে বলে ফ্র্যাঞ্চেস্কো আর এরকোলের পাশে দাঁড়িয়ে গেল সে-ও। গনৎসাগার দিকে চেয়ে হুঙ্কার ছেড়ে আহ্বান জানাল, জিয়ান মারিয়া স্ট্রোত্যার জন্যে যে বিশ্বাসঘাতক গেট খুলে দিতে চায়, সাহস থাকলে আসুক সে সামনে।
ক্যাপ্পোচ্চিওর এই আকস্মিক পরিবর্তনে বিদ্রোহের তেজ গেল কমে। তারপর কুঁজেই গেল যখন ফ্র্যাঞ্চেস্কো স্মরণ করিয়ে দিল যে জিয়ান মারিয়ার বেঁধে দেয়া আধঘণ্টা সময় অনেকক্ষণ হয় পেরিয়ে গেছে, কিন্তু কই, একটা গর্জনও তো শোনা যাচ্ছে না কামানের। দুর্গের খালি কামানগুলো দেখেই আত্মার পানি শুকিয়ে গেছে ওদের। সবার মুখে হাসি ফুটল। আশ্বাস দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, বিশ্বাস করো, আজ গর্জাবে না ওদের কামান, কালও না, সত্যি বলতে কি কখনোই না। যাও, নাস্তা খেয়ে নিয়ে সবাই যে যার কাজে যাও।
লজ্জা পেয়েছে সবাই, মাথা নিচু করে চলে গেল ওরা; মনে মনে স্বীকার করে নিল, হ্যাঁ, এইরকম একজন নেতার অধীনে যুদ্ধ করতে গিয়ে মরেও শান্তি।
.
২০.
ওই চিঠি কি করে এলো তোমার হাতে? আঙিনায় নেমে এসে জিজ্ঞেস করল ভ্যালেনটিনা গনৎসাগাকে। ওর দুচোখে অবিশ্বাস।
কাল উড়ে এসে পড়েছে ওটা বাইরে থেকে। একটা তীরের সঙ্গে বাঁধা ছিল। আমি তখন হাঁটছিলাম দুর্গপ্রাচীরের ওপর।
কথাগুলো বলার সময় একবারও ভ্যালেনটিনার চোখের দিকে তাকাতে পারল না গন্ৎসাগা। কিন্তু ফ্র্যাথেস্কোর চেহারায় কোনরকম সন্দেহের ছিটেফোঁটা নেই। হাসিমুখে সহজ কণ্ঠে জানতে চাইল, গুরুত্বপূর্ণ চিঠি…মোন্না ভ্যালেনটিনাকে দেখালেন না কেন?
গোলাপী ছোপ লাগল গনৎসাগার ফর্সা গালে। কিন্তু কাঁধ ঝাঁকিয়ে রাগ-রাগ ভাব দেখাল সে। ধরা গলায় বলল, আপনি মনে হয় ক্যাম্পে জন্মেছেন, আর মানুষ হয়েছেন গার্ডরূমে। তাই জিয়ান মারিয়ার চিঠিটা একজন ভদ্রলোকের জন্যে কতবড় অপমান, তা বোঝার সাধ্য আপনার নেই। ওটা ছুঁয়েই অপবিত্র হয়ে গেছে আমার হাত। এ নিয়ে সবার সঙ্গে আলাপ করে আরও অপবিত্র হওয়ার কথা আমি ভাবতেও পারিনি। বিশেষ করে আমাকে উদ্দেশ্য করে এরকম একটা চিঠি লেখার জন্যে জিয়ান মারিয়াকে কোনও শাস্তি দেয়ার উপায় যখন আমার নেই, তখন চিঠিটা দলা-মোচড়া করে পরিখায় ফেলে দিয়ে মন থেকেও ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি ওটার কথা। আপনার সদাসতর্ক গুপ্তচরদের চোখে পড়ে যাওয়ায় একদিক থেকে ভালই হয়েছে: সবার সামনে আমাকে ছোট করা হলেও মোন্না ভ্যালেনটিনা তো বাঁচলেন।
কথাগুলো এত সুন্দর করে সাজিয়ে এতই জোরের সঙ্গে বলল ও যে সবার মনে হলো এতটুকু খাদ নেই ওর আন্তরিকতায়। মনে মনে লজ্জিত বোধ করল ভ্যালেনটিনা। আর ফ্র্যাঞ্চেস্কো বড় মনের মানুষ, ওর কঠোর বাক্যগুলো ধর্তব্যের মধ্যে আনল না। বলল, মেসার গনৎসাগা, আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি আপনার তখনকার মনের অবস্থা। আপনাকে বোঝার ক্ষমতা আমার নেই, কথাটা ঠিক নয়। তবে এখনও আমি মনে করি, পাওয়া মাত্র চিঠিটা আপনার ম্যাডোনাকে দেখানো উচিত ছিল। যাক, এ নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভাল। আপনারা এখোন, আমি ঘরে গিয়ে বর্মটা ছেড়েই এক দৌড়ে এসে পড়ব নাস্তার টেবিলে।
গনৎসাগার বক্তৃতায় আর যেই হোক, বন্দুমাত্র প্রভাবিত হয়নি বুন্ধু, পেপ্তি। কিন্তু কাউকে সে বোঝাতে পারল না যে আসলে জিয়ান মারিয়ার সঙ্গে নিজেই যোগ্ৰাযোগ করেছিল গনৎসাগা, যে চিঠিটা ওদের হাতে পড়েছে সেটা ডিউকের উত্তর।
সার দিন ভ্যালেনটিনার পাশে পাশে থাকল গনৎসাগা। ভুলেও কোনও সৈনিকের সামনে গেল না। ফ্র্যাঞ্চেস্কোকেও ওর ভয়-এর ধারণা, সবই বুঝেছে লোকটা, কিন্তু বিশেষ কারণে ওকে লেজে খেলাচ্ছে। সন্ধের দিকে ফ্র্যাঞ্চেস্কো যখন দুর্গ-প্রাচীরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার তদারকি করছে, সবার অলক্ষে নিজের কামরায় ফিরে গেল সে।
একটু আঁধার হতে জিয়ান মারিয়ার কাছ থেকে বার্তা এলো। বুঝে, নিয়েছে সে, যেভাবেই হোক গনৎসাগার পরিকল্পনায় বাধা পড়েছে, সৈন্যদের দিয়ে বিদ্রোহ করাতে পারেনি সে। বার্তায় জিয়ান মারিয়া জানিয়েছে : অনর্থক রক্তপাত সে চায় না বলে ওই বদ্ধ উন্মাদটা, মোন্না ভ্যালেনটিনার প্রোভোস্ট বলে যে বদমাশটা নিজের পরিচয় দিচ্ছে, তার যুদ্ধের প্ররোচনায় কান না দিয়ে কটা দিন গোলাগুলি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। আশা করছে, কদিন না খেয়ে থাকলে হয়তো বিদ্রোহী গ্যারিসনের মনোভাবে পরিবর্তন আসবে।
সবাইকে ডেকে চিঠিটা পড়ে শোনাল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।, হাসি ফুটল ওদের মুখে। যা বলেছিল ঠিক তাই হচ্ছে দেখে ওর নেতৃত্বের প্রতি সৈন্যদের আস্থা বেড়ে গেল শতগুণ।
খবর জেনে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে গাগা। কয়েক দিনের জন্যে নিশ্চিন্ত হতে পারাও কম কথা নয়। খাবার টেবিলে সবার সঙ্গে হাসি-তামাশায় মেতে উঠল সে। বেগুনী রঙের চমৎকার সিষ্কের পোশাক পরেছে সে, সুন্দর চেহারা দেখাচ্ছে আরও সুন্দর।
মোন্না ভ্যালেনটিনার অনুমতি নিয়ে টেবিল ছেড়ে সবার আগে উঠে গেল ফ্র্যাঞ্চেস্কো-দুর্গপ্রাচীরে কাজ আছে ওর। মাথা ঝুঁকিয়ে অনুমতি . দিল বটে, কিন্তু তারপর থেকে কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে গেল ওর চেহারা-রোমিওর হালকা রসিকতা, স্ট্রোকের সনেট গেয়ে শোনানো, কিছুই আর ভাল লাগছে না ভ্যালেনটিনার কাছে। ওর মনটাও যেন চলে গেছে টেবিল ছেড়ে। সকালে মুগ্ধ দৃষ্টি দেখেছে সে ওই দুঃসাহসী লোকটার চোখে, ভুলতে পারছে না কিছুতেই, থেকে থেকে চোখের সামনে ভাসছে সেই চেহারাটা, দোলাচ্ছে ওর মন। স্পষ্ট বুঝতে পারছে, ওর গোপন দুর্বলতার কথাটা ঠিকই টের পেয়ে গেছে স্যার নাইট। কিন্তু, তাহলে সারাটা দিন একবারও কাছে এলো না কেন ও? নিজেই উত্তর দিল: কি করে আসবে, তুমিই তো গন্ৎসাগকে কাছছাড়া করলে না, পাছে ও. আসে! তুমিই তো দূরে সরিয়ে রেখেছ ওকে। হঠাৎ করে লজ্জা পাচ্ছ কেন এতো?
কিন্তু এই মুহূর্তে সব লজ্জা ত্যাগ করে ওর অন্তর চাইছে একছুটে লোকটার কাছে চলে যেতে, ওর পৌরুষদীপ্ত কণ্ঠস্বর শুনতে, ওর চোখে সকালের সেই মুগ্ধ দৃষ্টি দেখতে। আর একটু পরিণত, অভিজ্ঞ মেয়ে হলে অপেক্ষা করত, চাইত লোকটাই ছুটে আসুক তার কাছে: কিন্তু ভ্যালেনটিনার মধ্যে কোন লুকোছাপা নেই, গনৎসাগার গান শেষ না হতেই আলগোছে উঠে পড়ল সে, বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
সুন্দর; মোহময় রাত, বাতাসে উর্বরা জমির সুগন্ধ, আকাশ ভরা তারার মেলা, দিগন্তে রহস্যময় আধখানা চাঁদ। ভ্যালেনটিনার মনে পড়ল চাঁদটাকে ঠিক এইরকমই লেগেছিল সেই রাতে, যে-রাতে অ্যাকুয়াম্পার্টায় হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ার পর উরবিনোর বাগানে বসে ভাবছিল ওর কথা। উত্তর দিকে নিচু পাঁচিলের ধারে পেল ওকে ভ্যালেনটিনা, দুহাত পাঁচিলে রেখে চেয়ে রয়েছে জিয়ান মারিয়ার ক্যাম্পের দিকে। শিরস্ত্রাণ নেই মাথায়, কালো চুলের উপর সোনার জাল দেখে চেনা যাচ্ছে ওকে। পা টিপে ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়াল ও।
স্বপ্ন দেখছেন নাকি, মেসার ফ্রাঞ্চেস্কো?
চমকে ফিরে দেখল ফ্র্যাঞ্চেস্কো হাসছে ভ্যালেনটিনা। হেসে উঠল সেও। বলল, স্বপ্ন দেখার মতই রাত। আর সত্যিই দেখছিলাম একটা স্বপ্ন, দিলেন ভেঙে।
তাই বুঝি? তাহলে তো বড় অন্যায় হয়ে গেল! বলল ভ্যালেনটিনা। নিশ্চয়ই চমৎকার কোনও স্বপ্ন, যেটা দেখবেন বলে চলে এসেছেন এখানে, আমাদের ছেড়ে।
সত্যি, আশ্চর্য মধুর, বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। তবে না-পাওয়ার বেদনা মাখা। জাগিয়ে দিয়ে ভালই করেছেন। যাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনছিলাম, তিনিই সামনে হাজির।
আমাকে নিয়ে? দ্রুত হলো ভ্যালেনটিনার হৃৎপিণ্ডের গতি, গোলাপী ছোঁয়া লাগল গালে।
হ্যাঁ, ম্যাডোনা, আপনাকে নিয়ে। সেই প্রথম যেদিন দেখা হলো আমাদের অ্যাকুয়াম্পার্টার জঙ্গলে, ভাবছিলাম সেদিনের কথা। আপনার মনে পড়ে।
পড়ে, অস্ফুট কণ্ঠে বলল ভ্যালেনটিনা। প্রতিদিন!
আপনার মনে আছে, সেদিন বলেছিলাম: আমি আপনার নাইট। আজ থেকে যে-কোন আপদে-বিপদে আমি হাজির থাকব আপনার পাশে, যদি বুঝি আমাকে আপনার প্রয়োজন আছে? তখন কি ভাবতে পেরেছিলাম, সত্যিই কোনদিন সে সৌভাগ্য হবে আমার?
জবাব দিল না ভ্যালেনটিনা। ও চলে গেছে সেই দিনে, প্রথম দেখায় যেদিন ভাল লেগেছিল তার আহত মানুষটাকে। তারপর থেকে কতবার যে নিজের মনে নেড়েচেড়ে দেখেছে সে কথাটা, হাসি ফুটে উঠেছে ঠোঁটে নিজেরই অজান্তে।
আর ভাবছিলাম নিচের ওই জিয়ান মারিয়া আর ওর নির্লজ্জ অবরোধের কথা।
আপনার-আপনার দুঃখ বা অনুশোচনা হচ্ছে না তো?
অনুশোচনা?”
আমার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে? ওরা যেটাকে আমার অবাধ্যতা আর বিদ্রোহ বলছে, তার দায়-দায়িত্ব কাঁধে চেপে যাওয়ায়?
মৃদু কণ্ঠে হেসে উঠল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। চেয়ে রয়েছে পরিখার স্রোতের দিকে।
যেদিন এই অবরোধ শেষ হবে, বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, যেদিন আমরা বিদায় নিয়ে যে-যার আলাদা পথে চলে যাব, সেইদিন দুঃখে ফেটে যেতে চাইবে আমার বুকটা। কিন্তু আপনাকে সাহায্য করার জন্যে বা ওদের সাধ্যমত বাধা দেয়ার জন্যে সামান্যতম অনুশোচনা নেই আমার মনে। সত্যি কথা বলতে কি, খবর নিয়ে এখানে আসার আগে থেকেই মনে মনে চাইছিলাম, যদি আপনাকে সাহায্য করার কোন সুযোগ পেতাম!
আপনি না থাকলে এতক্ষণে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করত ওরা আমাকে।
হয়তো করত। কিন্তু আমি যতক্ষণ আছি, কিছুতেই পারবে না। ব্যাব্বিয়ানোর খবরের জন্যে অস্থির হয়ে আছি আমি। ওখানে কি ঘটছে জানতে পারলে আপনাকে পুরোপুরি আশ্বস্ত করতে পারতাম। সিংহাসন রক্ষা করতে হলে অবরোধ তুলে নিয়ে জিয়ান মারিয়াকে ফিরতে হবে দেশে। রাজ্য হারালে ওকে ভাইঝি-জামাই করার আগ্রহ হারাবেন আপনার কাকা। এটা আপনার জন্যে খুশির খবর, কিন্তু আমার জন্যে নয়। ফ্র্যাঞ্জেস্কোর গলাটা একটু যেন কেঁপে গেল। অন্ধকারের দিকে চেয়ে বলল, যতক্ষণ আপনার পাশে থাকতে পারছি ততটুকুই আমার গাভ। ম্যাডোনা, পানলে আপনাকে নিয়ে ওই ক্যাম্প চিরে বেরিয়ে যেতাম, চলে যেতাম এমন কোন শান্তির দেশে, যেখানে রাজসভা নেই, রাজপুত্র নেই। কিন্তু তা যখন হবার নয়, তখন মনে মনে আমি চাই, এ অবরোধ থাকুক চিরকাল, কোনদিন যেন এর শেষ না হয়?
আবেগে আপ্লুত কাউন্ট এবার পাঁচিলের ওপর রাখা ভ্যালেনটিনার ফর্সা হাতটা তুলে নিল নিজের হাতে। প্রায় অস্ফুট কণ্ঠে ডাকল, ভ্যালেনটিনা! আবছা অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করল ওর পাশ ফেরানো মুখটা। পরমুহূর্তে নিভে গেল ওর চোখের আলো, হাতটা সরিয়ে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল, ক্যাম্পের দিকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিচু গলায় ক্ষমা চাইল। বেয়াদবি মাফ করুন, ম্যাডোনা, ভুলে যান যা বলেছি।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল ভ্যালেটিনা, তারপর একটু কাছে সরে এসে বলল, আমার কাছে তো আপনার একটি কথাও অসঙ্গত বলে মনে হলো না।
প্রায় ফুঁপিয়ে উঠে ওর দিকে ফিরল ফ্র্যাঞ্চেঙ্কো। চোখে চোখে চেয়ে রইল ওরা কিছুক্ষণ। তারপর মাথা নাড়ল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
মনে হওয়াই উচিত, ম্যাডোনা।
উচিত? কেন উচিত?
কারণ আমি ডিউক নই, ম্যাডোনা।
তাতে কি? আঙুল তুলল ভ্যালেনটিনা, ওই তো ওখানে বসে আছে একজন আস্ত ডিউক। ও কি একটা মানুষ হলো? পদমর্যাদা দিয়ে কি মানুষের মূল্যায়ন হয় তোমাকে আমি একজন সত্যিকার নাইট হিসেবে জানি, মহৎ একজন ভদ্রলোক হিসেবে চিনি, দুর্দান্ত সাহসী একজন বন্ধু হিসেবে মানি। একটা বিপদগ্রস্ত, অসহায় নারীর সম্মান রক্ষার জন্যে অস্ত্র তুলে নিয়েছ হাতে। এর চেয়ে বড় গুণ আর কি আছে পৃথিবীতে আমার কাছে তো অন্তত নেই!
কথাটা বলে ফেলে লজ্জায় লাল হয়ে গেল ভ্যালেনটিনা, এক পাশে ফিরিয়ে নিয়ে আড়াল করল মুখ। কানের কাছে ফ্র্যাঞ্চেস্কোর মৃদু, গম্ভীর কণ্ঠ ঘোষণা করল, ভ্যালেনটিনা, ঈশ্বর জানেন, আমি তোমাকে ভালবাসি! আবার হাতটা তুলে নিল সে। আবার এও জানি, এ ভালবাসার কোন শুভ পরিণতি নেই। আশা করাটা এখানে নিজের সঙ্গেই ছলনা করা। যাকগে, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু ভেবেছ তুমি? অবরোধ তুলে নিয়ে জিয়ান মারিয়া ফিরে গেলে যেখানে খুশি যেতে পারবে তুমি। কোথায় যাবে বলে ভাবছ?”
অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকাল ভ্যালেনটিনা, যেন বুঝতেই পারেনি কথাটা। বলল, কোথায় আবার? তুমি যেখানে বলবে যেতে!
উত্তরটা শুনে থমকে গেল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। বা রে! তোমার কাকা…?
অবাধ্য ভাইঝির জন্যে কিছুই করার নেই তার। আমি ভেবে দেখেছি। আজ সকালের আগে পর্যন্ত জানতাম কনভেন্টে ফিরে যাব! জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছি সান্তা সোফিয়ায়। অল্প কয়েকদিন কাকার রাজসভার যেটুকু দেখেছি, আর দেখতে চাই না। আমি ফিরে গেলে মাদার অ্যাঝেস আমাকে ফেরত নেবেন। কিন্তু আজ সকালে –
থেমে গেল ভ্যালেনটিনা; পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল ফ্র্যাঞ্চেস্কোর দিকে। সে দৃষ্টিতে আত্মসমর্পণ। ফ্র্যাঞ্চেস্কোর মনে হলো স্বর্গে চলে এসেছে সে-এটাই স্বৰ্গ, এর বাইরে আর কোন স্বর্গ নেই। কাঁধ ধরে ওকে ফেরাল নিজের দিকে। দুহাতে জড়িয়ে ধরে চুমো খেল ওকে।
কিছু বলতে যাচ্ছিল, ওর মুখে হাত চাপা দিল ভ্যালেনটিনা। ওর হাতের তালুতে চুমো দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, সুড়সুড়ি লাগায় খিলখিল করে হেসে উঠল ভ্যালেনটিনা। তারপর একহাত তুলে ডিউকাল ক্যাম্প দেখিয়ে বলল, এদের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে চলো, প্রিয় নাইট। উরবিনো থেকে অনেক অনেক দূরে, যেখানে গুইডোব্যাল্ডোর ক্ষমতা আর জিয়ান মারিয়ার বিদ্বেষ পৌঁছতে পারবে না কোনদিন। সেইখানে গিয়ে আমি তোমার হব। তার আগে, কোনও দুর্বলতাকে আর প্রশ্রয় দেব না আমরা, ঠিক আছে তোমার শক্তির ওপর নির্ভর করছি আমি, এ শক্তিকে কোনভাবেই দুর্বল করা চলবে না, তাহলে ডুবব দুজনেই। প্রিয়তম, এই তাহলে কথা থাকল?
কিছু বলতে যাচ্ছিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, আঙুল তুলে সিঁড়ির দিকে ইঙ্গিত করল ভ্যালেনটিনা। কে একজন আসছে এদিকে।
এখন যাও, প্রিয়। শুভরাত্রি!
মাথা ঝুঁকিয়ে বাউ করল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, তারপর লম্বা পা ফেলে চলে গেল, ডানদিকে ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল দেয়ালের আড়ালে। হৃদয়ে ওর জ্বলছে প্রেমের মশাল। দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ ও আজ।
যতক্ষণ দেখা যায় ওর দিকে চেয়ে থাকল ভ্যালেনটিনা, তারপর তৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধন্যবাদ জানাল ঈশ্বরকে। পাঁচিলে দুহাত রেখে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল অন্ধকারের দিকে, তারপর হেসে উঠল আপন মনে। এত আনন্দ সে রাখবে কোথায়?
পিছন থেকে কথা বলে উঠল গনৎসাগা। এই দুর্গে তাহলে একজন হলেও সুখী মানুষ আছে, ম্যাডোনা?”
ঝট করে পিছন ফিরে মুখোমুখি হলো সে কুদ্ধ গনৎসাগার। মুখটা সাদা হয়ে আছে ওর, চোখ দুটো জ্বলছে অঙ্গারের মত। ভয় পেল ভ্যালেনটিনা, একটু আগের দেখা সেই প্রহরীটাকে খুঁজল দেয়ালের উপর। কিন্তু নেই সে ওখানে।
কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ কাটল, অরপর জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার, গনৎসাগা, তুমি এখানে?
হ্যাঁ, তোমার পিছনেই ছিলাম। দেখলাম সব। চাঁদের আলোয়, মৃদুমন্দ বাতাসে ওই কুত্তার বাচ্চাটার সঙ্গে চুমাচুমি-কিছুই চোখ এড়ায়নি আমার!
গনৎসাগা! বড় বেশি বাড় বেড়েছ দেখছি?
বাড় আমার বেড়েছে না তোমার? চেঁচিয়ে উঠল গনৎসাগা। রাগে দিশে হারিয়ে ফেলেছে। গুইডোব্যান্ডে ডি মন্টেফেন্ট্রোর ভাইঝি, রোভেয়ার বংশের মেয়ে…তোমার লজ্জা করে না নিচু জাতের একটা গুত্তার সঙ্গে জড়াজড়ি করতে?
তোমাকে এখানে আমার গার্জেন বানিয়েছে কে, গনৎসাগা? তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল, ভ্যালেনটিনা। এক্ষুণি দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে, নইলে লোক ডেকে বেত মারা তোমাকে!
ডাকো তোমার লোক! বলল গনৎসাগা। বেতই তো আমার প্রাপ্য! মারুক ওরা আমাকে, বেত মারতে মারতে মেরেই ফেলুক! তোমার জন্যে যত বড় বিপদ মাথায় নিয়ে এ পর্যন্ত যা করেছি, বেতই তো আমার উপযুক্ত পুরস্কার!
দেখো, গনৎসাগা, এখানে পালিয়ে আসার পরিকল্পনা আমার ছিল না, তুমিই এই বিপদে টেনে এনেছ আমাকে। এখন দোষ দিচ্ছ আমার। তোমার বিশেষ মতলব ছিল, সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দাওনি আমাকে। আমাকে এখানে এনেই তুমি খালাস, দুর্গরক্ষার ক্ষমতা তোমার নেই, সৈন্যদের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা নেই, ওদের বিদ্রোহ দমন করবার ক্ষমতা নেই- অথচ প্রোভোস্ট হওয়ার শখ। কাউকে দোষ দেয়ার আগে নিজের দিকে তাকাও গনৎসাগা। বিপদের কথা জেনেই এসেছ তুমি।
জানতাম। কিন্তু তোমার প্রতি ভালবাসার কারণে বিপদের পরোয়া করিনি। তুমি ভাব দেখিয়েছিলে, আমার প্রেম বিফলে যাবে না…
কি বললে? চমকে উঠল ভ্যালেনটিনা। শোনা যাক এক-আধটা উদাহরণ? কি ভাব দেখিয়েছি আমি তোমাকে?
আমার প্রতি সবসময় সহৃদয় ভাব দেখিয়েছ তুমি, আমার গান শুনে প্রশংসা করেছ। বিপদের সময় আমার ওপরই নির্ভর করনি উদ্ধার পাওয়ার আশায়?
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল ভ্যালেনটিনা, তারপর বলল, বুঝতে পারছি, লাই পেয়ে মাথায় উঠে গেছ তুমি, গনৎসাগা। কেউ তোমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করলে, তোমার গান শুনে প্রশংসা করলে, তোমার দিকে তাকিয়ে হাসলেই তুমি যদি মনে করো সে তোমার প্রেমে পড়ে গেছে-দোষটা কার?
থমকে গেল গনৎসাগা, তারপর বলল, কিন্তু একটা কথা বলবে আমাকে, ম্যাডোনা-কোনদিক থেকে ওই নাম-গোত্রহীন লোকটার চেয়ে আমি খারাপ ইলাম? আমাকে উপেক্ষা করে ওই কুকুরটার…
ব্যাস! গম্ভীর কণ্ঠে বলল ভ্যালেনটিনা। বোঝা গেল, বামন হয়ে আকাশের চাঁদ ধরার স্বপ্ন দেখছ তুমি, গনৎসাগা। আগামীকাল আমি আর তোমার মুখ দেখতে চাই না। যেভাবে পার, দূর হয়ে যাবে তুমি এই দুর্গ থেকে।
এবার ভয় পেল গনৎসাগা। ও জানে, এখান থেকে বেরিয়ে গেলে ভবিষ্যৎ বলতে কিছুই থাকবে না ওর। চট করে ফণা নামিয়ে নিল সে। স্থির করেছে, সুযোগের প্রতীক্ষায় থাকাই ভাল।
হাসি ফুটে উঠল তার মুখে, নানান ভাবে তোয়াজ করে ভোলাবার চেষ্টা করল ভ্যালেনটিনাকে। আকারে ইঙ্গিতে বোঝাবার চেষ্টা করল, আসলে ফ্রাঞ্চেস্কোর যোগ্যতায় তার বিন্দুমাত্র সংশয় নেই, এমন কি পছন্দও করে সে তাকে, আর সবার কাছে প্রশংসাও করে তার। আজ হঠাৎ স্বল্প পরিচিত লোকটার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় ভ্যালেনটিনাকে দেখে রাগ হয়েছিল ওর, সেজন্যে এখন সে দুঃখিত ও লজ্জিত।
ভ্যালেনটিনার সরল মন, ভাবল সত্যিই বুঝি ভুল বুঝতে পেরে নিজেকে সংশোধন করতে চায় গনৎসাগা। সুযোগ না দিলে ওর প্রতি অন্যায় করা হবে। কাজেই থাকল সে।
পরবর্তী কয়েকটা দিনে সবাইকে খুশি করে ফেলল গনৎসাগা। সম্পূর্ণ বদলে গেছে লোকটার চালচলন, কথাবার্তা। একমাত্র পেপ্পির চোখে ধুলো দিতে পারল না সে, হাড়ে হাড়ে চেনে ও এই লোকটাকে। সদা-সতর্ক, তীক্ষ্ণ নজর রাখল ও গনৎসাগার উপর। কিন্তু ওর এই সতর্কতা টের পেয়ে আরও সতর্ক হয়ে গেছে সে। তক্কে তক্কে থেকে ঠিকই সুযোগ বের করে নিল একদিন, এবং প্ল্যানটা কাগজে লিখে পাঠিয়ে দিল জিয়ান মারিয়ার কাছে।
অনেক ভেবে তৈরি করেছে সে তার পরিকল্পনা। মোন্না ভ্যালেনটিনার কড়া নির্দেশ: রোববারের প্রার্থনায় প্রত্যেককে উপস্থিত থাকতে হবে। অনেক বলে কয়ে একজনকে পাহারায় রাখার অনুমতি নিতে হয়েছে ফ্র্যাথেস্কোর। এই আধঘণ্টার মধ্যেই সারতে হবে কাজটা, ঠিক করেছে গনৎসাগা। আগামী বুধবার ফাস্ট অভ কর্পাস ক্রিস্টি-এ কাজের জন্যে আদর্শ একটা দিন।
একজন প্রহরীকে ঘুষ দিয়ে বশ করতে অসুবিধে হবে না, জানে ও। যদি রাজি না হয়, পিঠে ছোরা মারতে অসুবিধে কি? একা ড্রব্রিজ নামাতে পারবে না ও, আর পারলেও নামানো উচিত হবে না। কারণ, এমনই ক্যাচ-কোচ আওয়াজ করবে ওটা যে উপাসনা ফেলে ছুটে আসবে সবাই। তাই ঠিক করেছে; পিছনের গেটটা খুলে দেবে ও। একটা হালকা ব্রিজ তৈরি করে আনতে লিখেছে ও জিয়ান মারিয়াকে, যাতে পরিখার ওপর ওটা ফেলে পিছন-দরজা দিয়ে ঢুকে আসতে পারে সৈন্যরা নিরবে! .
চিঠি পাওয়ার তিন মিনিটের মধ্যেই হাত নেড়ে জানিয়ে দিয়েছে জিয়ান মারিয়া গাৎসাগার কথা মতোই কাজ করা হবে। প্রতিশোধ নেয়াটা নিশ্চিত হতেই হালকা মনে গুনগুন করে গানের কলি ভাজতে ভাঁজতে মহিলা মহলে গিয়ে ঢুকেছে সে কানামাছি খেলবে বলে।
এতদিনে রোক্কালিয়ন দখলের মওকা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে একটু বেশি পান করে ফেলল জিয়ান মারিয়া রাতে। কিন্তু সকাল হতেই ব্যাব্বিয়ানে থেকে আসা সংবাদ শুনে চুপসে গেল সে ভয়ে। খবর এনেছে আলভারি, জিয়ান মারিয়ার প্রজারা বিদ্রোহ করতে যাচ্ছে। সীজার বর্জিয়ার সৈন্যরা রওনা হয়ে গেছে এমন একটা গুজব শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে তারা। শক্তিশালী একটা দল গঠন করা হয়েছে, নেতারা প্রাসাদ-তোরণে নোটিস গেঁথে দিয়েছে: এখন বিয়ের জন্যে পাগল হওয়ার সময় নয়, আগামী তিনদ্রিনের মধ্যে জিয়ান মারিয়া যদি দেশে ফিরে রাজ্যরক্ষার ব্যবস্থা না নেয়, ওরা তাকে পদচ্যুত করে তার মামাতো ভাই, দেশপ্রেমিক বীর, অ্যাকুইলার লড ফ্র্যাঞ্চেস্কো ডেল ফ্যালকোকে বসাবে ব্যাব্বিয়ানোর সিংহাসনে।
এখন তার একমাত্র ভরসা ওই গনৎসাগা লোকটা। আগামী বুধবার যদি ওর খুলে দেয়া গেট দিয়ে ঢুকে ভ্যালেনটিনাকে ধরতে পারে, তাহলে ওইদিনই বিয়েটা সেরে সে ছুটবে ব্যাব্বিয়ানোর উদ্দেশে, প্রজাদের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাবে রাজধানীতে।
গুইডোব্যান্ডের সঙ্গে আলোচনা করল সে তাকে অনুরোধ করল একজন পুরোহিত তৈরি রাখতে, যাতে চট করে বিয়েটা পড়িয়ে দিতে পারে। প্রথমে কিছুতেই এরকম তড়িঘড়ি বিয়েতে রাজি হলেন না গুইডোব্যাল্ডো, বললেন উরবিনোতে ফিরে জাক-জমকের সঙ্গে ভাইঝির বিয়ে না দিলে তার অসম্মান হবে; কিন্তু অনেক অনুরোধ-উপরোধের পর জিয়ান মারিয়ার ত্রিশঙ্কু অবস্থা বুঝতে পেরে নিমরাজি হলেন।
ওদিকে গনৎসাগা নিখুঁত পরিকল্পনা করেও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। ফ্যাঞ্চেস্কোর দুর্দান্ত সাহস, প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস আর তীক্ষ্ণবুদ্ধির পরিচয় সে পেয়েছে। এই লোকটা যে কখন কি করে বসে তার ঠিক নেই। কিন্তু এই দুশ্চিন্তার হাত থেকে দৈবাৎ মুক্তি পেয়ে গেল সে।
আলভারির পিছু পিছু ব্যাব্বিয়ানো থেকে রোকালিয়নে এসেছে কাউন্ট অভ অ্যাকুইলার ব্যক্তিগত পরিচারক জাক্কারিয়া। সন্ধের আগেই পৌঁছলেও জিয়ান মারিয়ার লোকজনের চোখ এড়াতে আঁধার না হওয়া পর্যন্ত লুকিয়ে থাকতে হয়েছে ওকে জঙ্গলে। এক সময়ে চাঁদটা মেঘে, ঢাকা পড়তেই চট করে নেমে পড়েছে সে পরিখার পানিতে।
পুব দেয়ালের, নৈশপ্রহরী পরিখার পানিতে ছপাৎ-ছপাৎ আর বাতাসে ফেস-ফেস আওয়াজ শুনে জানতে চাইল কে ওখানে, কিন্তু কোন জবাব এলো না নিচ থেকে। বিপদসঙ্কেত দেয়ার জন্যে ঘুরতেই ধাক্কা খেল সে পায়চারিরত,গনৎসাগার সঙ্গে।
হুজুর, কে যেন সাঁতার কাটছে নিচের পরিখায়! বলল সে চাপা কণ্ঠে।
বলো কি! আঁৎকে উঠল গনৎসাগা। হাজারটা সন্দেহ খেলে গেল ওর মনে। জিয়ান মারিয়ার লোক জিজ্ঞেস করল, কি মনে হয়, নাশকতা?
তাই তো মনে হচ্ছে, স্যার!
ছাদের দেয়ালের উপর দিয়ে ঝুঁকে নিচে তাকাল দুজন। আবছা ভাবে কানে এলো, এই যে! কে আছো?”
কে ওখানে? জানতে চাইল গনৎসায়া।
বন্ধু, উত্তর এলো। ব্যাব্বিয়ানো থেকে চিঠি নিয়ে এসেছি লর্ড কাউন্ট অভ অ্যাকুইলার জন্যে। শীঘি একটা দড়ি ফেলুন, ডুবে যাচ্ছি।
কী বলছ তুমি, গাধা! রোক্কালিয়নে কোন কাউন্ট নেই।
কেন, স্যার সেন্টিনেল, জবাব দিল নিচের কণ্ঠ, আমার মনিব, মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কো ডেল ফ্যালকোর তো এখানে থাকার কথা! জলদি একটা রশি ফেলুন!
মেসার ফ্র্যান- গলায় আটকে গেল যেন নামটা। বিদ্যুৎ চমক দিল যেন ওর মাথার ভিতর, হঠাৎ বুঝে ফেলল গনৎসাগা সব কিছু। কর্কশ কণ্ঠে হুকুম দিল সে প্রহরীকে, জলদি! রশি নিয়ে এসো। অস্ত্রাগারেই কোথাও আছে! জলদি! ভয় পাচ্ছে সে, কেউ না আবার এসে পড়ে।
একদৌড়ে দড়ি নিয়ে এলো প্রহরী। দুই মিনিটের মধ্যেই চুপচুপে ভেজা জাক্কারিয়া উঠে এলো রশি বেয়ে।
এদিকে! বলল গনৎসাগা। অস্ত্রাগারের টাওয়ারের দিকে নিয়ে গেল সে ওকে। আলো আছে সেখানে। প্রহরীকে কাছেই থাকতে বলে কামরা থেকে বের করে দিল সে।
অবাক হলো জাক্কারিয়া, এই অভ্যর্থনা আশা করেনি সে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করল, আমার লর্ড কোথায়?
মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কো ডেল ফ্যালকো তোমার লর্ড? জিজ্ঞেস করল রোমিও।
জি, স্যার। গত দশ বছর ধরে কাজ করছি ওঁর কাছে। মেসার ফ্যানফুল্লা ডেল্লি আর্চিপ্রেটি খুব জরুরী বার্তা পাঠিয়েছেন। আপনি দয়া করে তার কাছে নিয়ে যাবেন আমাকে?
ভিজে দেখছি একেবারে সিঁটিয়ে গেছ, নরম গলায় চুলল গনৎসাগা। ঠাণ্ডায় মারা পড়বে। দরজার কাছে গিয়ে ডাক দিল প্রহরীকে। এই যে, শোনো। একে ওপরের চেম্বারে নিয়ে গিয়ে এক্ষুণি কাপড় বদলাবার ব্যবস্থা করো।
কিন্তু আমার চিঠি, স্যার! আপত্তি জানাল জাক্কারিয়া। চিঠিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর জরুরী। এমনিতেই আমি অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি রাতের অপেক্ষায় জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে।
কাপড় পাল্টাবার জন্যে সামান্য সময় ব্যয় করলে মারাত্মক কোন ক্ষতি হবে না নিশ্চয়ই। চিঠির জন্যে প্রাণ দিতে নিশ্চয়ই বলেনি তোমাকে কেউ?
আমাকে বলা হয়েছে, একটা মুহূর্ত যেন নষ্ট না করি।
আচ্ছা, এতই তাড়া! হাসিমুখে বলল গনৎসাগা। বেশ, তাহলে আমার হাতে দাও, এখুনি পৌঁছে দিচ্ছি আমি ওটা কাউন্টের কাছে। ততক্ষণে ভেজা কাপড় ছেড়ে ফেলো তুমি।
একটু দ্বিধা করল জাক্কারিয়া। কিন্তু রোমিও ৎসাগার সুন্দর কান্তি, দামী পোশাক আর সততা মাখা হাসি দেখে আশ্বস্ত হলো সে। টুপি খুলে চাদির ওপর রাখা একটা থলেতে পোরা চিঠির খামটা ধরিয়ে দিল সে গনৎসাগার হাতে। সেন্ট্রিকে অবিলম্বে জাক্কারিয়ার কাপড় বদলাবার ব্যবস্থা করতে বলে বেরিয়ে গেল সে দরজা দিয়ে। বাইরে এক পা ফেলেই পিছনে ফিরল আবার, ডাকল প্রহরীকে।
এই ডাক্যাটটা রাখো, ফিসফিস করে বলল গনৎসাগা। একটা মুদ্রা গুঁজে দিল ওর হাতে। আমার কথা মত কাজ করলে আরও পাবে। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত একে টাওয়ারেই আটকে রাখবে। আর দেখবে, কেউ যেন ওর সঙ্গে দেখা করতে বা কথা বলতে না পারে।
ঠিক আছে, এক্সেলেন্সি, বলল লোকটা। কিন্তু যদি ক্যাপটেন আসে আর আমাকে ডিউটিতে না পায়?
সে আমি সামলাব। মেসার ফোর্টেমানিকে বলব, বিশেষ একটা কাজে পাঠিয়েছি আমি তোমাকে। তোমার বদলে আরেকজন লোক দিতে বলব ওকে। আজ রাতে আর তোমাকে পাহারা দিতে হবে না।
মাথা ঝুঁকিয়ে বাউ করল নৈশপ্রহরী, তারপর ফিরল বন্দীর দিকে-জাক্কারিয়াকে এরই মণ্যে বন্দী হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে সে।
নিচের গার্ডরূমে গিয়ে ফোর্টেমানিকে প্রহরী বদলের কথা বলল গনৎসাগা।
কিন্তু, রেগে লাল হয়ে গেল ফোর্টেমানি, জানতে পারি, কোন ক্ষমতা বলে করেছেন আপনি কাজটা কোন অধিকারে দুর্গপ্রহরীকে আপনি নিজের কাজে পাঠান? প্রহরীকে পাঠিয়ে দিলেন আপনার বিউটি বক্স বা পদ্যের বই আনতে, সেই সময় যদি আক্রমণ আসে, তখন?
আপনার মনে রাখা দরকার মাতব্বরি চালে শুরু করতে যাচ্ছিল গনৎসাগা, এক ধমকে তাকে ঠাণ্ডা করে দিল ফোর্টেমানি।
রাখুন আপনার চালবাজি! জাহান্নামে যান আপনি! এক্ষুণি প্রোভোস্টকে জানাচ্ছি আমি।
প্লিজ, না! ভয় পেল গনৎসাগা, টেনে ধরল ফোর্টেমানির জামার হাতা। সার এরকোল, আমি অনুরোধ করছি, একটু বিবেচনা করে দেখুন, এই সামান্য ব্যাপারে এখনহৈ-চৈ করে দুর্গের লোকজনকে চমকে দিলে কি ঘটবে! সবাই হাসাহাসি করবে তো আপনাকে নিয়ে।
অ্যাঁ? ওকে নিয়ে হাসাহাসির কথা শুনে থমকে গেল এরকৈাল, এই একটা ব্যাপার সে ভয় পায়-কারও টিটকারীর পাত্র হতে চায় না পারতপক্ষে। একমিনিট চিন্তা করে ওর মক্কে হলো, সত্যিই হয়তো এতটা করার মত ব্যাপার এটা নয়। পাশ ফিরে বলল, আভেন্টানো, তোমার বর্শাটা নিয়ে পুব-প্রাচীরে পাহারা দাও গিয়ে। গনৎসাগার দিকে ফিরল আবার, এখন আপনার কথা রাখলাম বটে, কিন্তু মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কো টহলে বেরোলেই জানতে পারবেন।
নিজের চেম্বারে ফিরে গেল গনৎসাগা। মনে মনে নিজের সাফলে বাহবা দিচ্ছে নিজেকে। ফ্র্যাঞ্চেস্কো টহলে বেরোতে এখনও একঘণ্টা দেরি আছে। তখন ফোর্টেমানি তাকে যাই বলুক কিছু এসে যাবে না, একটা কিছু জবাব ততক্ষণে পেয়েই যাবে সে।
বাতি জ্বেলে চিঠির প্যাকেটটা নিয়ে বসল সে টেবিলে। ভিতর থেকে খাম বেরলো, তাতে লাল রঙের মস্ত বড় একটা সীল দেয়া।
তাহলে এই ভ্রাম্যমাণ নাইট, যাকে ছোট জাতের এক সাধারণ সৈনিক বলে সে ধারণা করেছিল-আসলে ব্যাব্বিয়ানোর জনগণের বুকের মাণিক, সিসিলি থেকে আল্পস পর্যন্ত তাবৎ যোদ্ধার আদর্শ পুরুষ, অ্যাকুইলার সেই বিখ্যাত কাউন্ট। অথচ ঘুণাক্ষরেও টের পেল না সে! নিজের বুদ্ধির উপরই আস্থা হারিয়ে ফেলল গনৎসাগা। এই লোকের দুর্দান্ত সাহস ও শক্তির কত গল্পই না শুনেছে সে! অথচ এত কাছ থেকে দেখেও এতদিন চিনতেই পারল না! কিন্তু লোকটা এখানে কেন? নিজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়র বিরুদ্ধে দুর্গরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে যেচে পড়ে-কারণটা কি? ভ্যালেনটিনার প্রতি প্রেম? নাকি জিয়ান মারিয়ার প্রতি বিদ্বেষ? কোথায় যেন শুনেছিল, ফ্র্যাঞ্চেস্কো ডেল ফ্যালকোকে ব্যাব্বিয়ানোর সিংহাসনে বসাতে চায় ওখানকার জনসাধারণ। যাক, আসল সত্য বেরিয়ে আসবে চিঠিটা খুললেই। এখুনি জানতে পারবে সে কি লিখেছে লোকটা বন্ধু ফ্যানফুল্লা চিঠিতে।
চোখের সামনে তুলে সীলটা পরীক্ষা করল ও। তারপর ছোরাটা গরম করে অতি সাবধানে গালার নিচ দিয়ে চালিয়ে খুলে ফেলল খামের মুখ, যাতে প্রয়োজনে আবার ওটা লাগিয়ে দেয়া যায়। ভাজ খুলে মেলে ধরল চিঠিটা এবার চোখের সামনে। পড়তে পড়তে খেয়াল করল, হাত দুটো কাঁপছে ওর। বাতি একটু এগিয়ে এনে আবার পড়ল সে চিঠিটা। ওতে লেখা:
মাই লর্ড প্রিয় কাউন্ট,
নিশ্চিত না হয়ে লিখব না বলে একটু দেরি করলাম চিঠি দিতে। আজ জিয়ান মারিয়াকে প্রজারা সময় বেঁধে দিয়েছে, হয় সে তিনদিনের মধ্যে ফিরে আসবে ব্যাব্বিয়ানোতে, আর না হয় ডাচির আশা ছাড়তে হবে তাকে। জনসাধারণ তখন আপনাকে রাজ্যের ভার গ্রহণ করার জন্যে অনুরোধ করে দূত পাঠাবে অ্যাকুইলায়।
এদিকে রোম থেকে সংবাদ এসেছে, সীজার বর্জিয়া ব্যাব্বিয়ানো আক্রমণের প্রস্তুতি শেষ করেছে। ওর সৈন্যদল রওনা হয়ে যাবে এখন যে-কোন দিন।
মানুষজন এখন দিশেহারা। জিয়ান মারিয়া অনুপস্থিত।
এই দুর্দিনে সবাই আপনার মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে। আপনার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করে আপনার অনুগত ভৃত্য,
—ফ্যানফুল্লা ডেলি আর্চিপ্রেটি