লাভ অ্যাট আর্মস – রাফায়েল সাবাতিনি
রূপান্তর: কাজী আনোয়ার হোসেন
০১.
সন্ধ্যার ঝিরঝিরে বাতাসে নিচের উপত্যকা থেকে ভেসে আসছে গির্জার মৃদু ঘণ্টাধ্বনি। পাহাড়ের উপর মেষপালকদের বিশ্রামের জন্য তৈরি ছোট্ট একটা কুটিরে ছয়জন লোক টুপি খুলে মাথা ঝুঁকিয়ে মন দিয়েছে প্রার্থনায়। তিন সলতের একটা বাতিদান ঝুলছে সীলিং থেকে, আলো যা দিচ্ছে তারচেয়ে বেশি ছড়াচ্ছে কটুগন্ধী ধোঁয়া। অত্যন্ত দামী পোশাক পরা মানুষগুলো এই জীর্ণ কুটিরে একেবারেই বেমানান।
ঘণ্টা থামতে বুকে ক্রুশ এঁকে ধীরেসুস্থে সবাই মাথায় পরে নিল যে-যার টুপি। চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাচ্ছে একে অপরের দিকে। কিন্তু প্রশ্নটা উচ্চারিত হওয়ার আগেই টোকা পড়ল পচা কাঠের দরজায়।
এসে গেছেন! হাঁপ ছাড়লেন বৃদ্ধ ফ্যাব্রিৎসিও ডা: লোডি। তাঁর ইঙ্গিত পেয়ে জমকালো পোশাক পরা এক তরুণ খুলে দিল দরজা।
ঘরে ঢুকল দীর্ঘদেহী এক যুবক। মাথায় চওড়া কার্নিসের পালকহীন হ্যাট। আলখেল্লাটা ঢিল দিতে দেখা গেল নিচে সাদাসিধে পোশাক, কোমরেস্টীলের পাত বসানো চামড়ার বেল্ট থেকে বামপাশে ঝুলছে লম্বা এক তলোয়ার, ডানপাশে বড়সড় একটা ছোরা। লাল প্যান্টের নিচের দিকটা হাঁটু পর্যন্ত উঁচু বুটের ভিতর গোঁজা। সাজপোশাক দেখলে যে-কেউ ধরে নেবে, লোকটা একজন পেশাদার ভাড়াটে সৈনিক। অথচ যুবককে দেখামাত্র কুটিরের প্রত্যেকে উঠে দাঁড়িয়ে টুপি খুলে সম্মান জানাল।
আলখেল্লাটা খুলতে সাহায্য করল ওকে তরুণ। টুপি খুলে কাঁধে ঝুলিয়ে রাখল যুবক। দেখা গেল কুচকুচে কালো দীর্ঘ চুল সোনার তার বুনে তৈরি করা জাল দিয়ে ঢাকা। এটা দেখলে যে-কেউ বুঝে নেবে এ লোক সাধারণ কেউ নয়, অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত কোনও পরিবারের সন্তান।
টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল যুবক, সবার মুখের উপর দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, আপনাদের ডাক পেয়ে হাজির হয়ে গেছি। আমার ঘোড়াটা মাইল দুয়েক থাকতে খোঁড়া হয়ে যাওয়ায় হেঁটে আসতে হয়েছে বাকি পথ, একটু দেরি হয়ে গেল তাই।
তাহলে তো খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, ইয়োর এক্সেলেন্সি, বললেন ফ্যাব্রিৎসিও। এক পাত্র পুগলিয়া ওয়াইন দেব, মাই লর্ড? এই যে ফ্যানফুল্লা, সম্ভ্রান্ত তরুণকে মদ পরিবেশন করতে বলতে যাবেন বৃদ্ধ, কিন্তু হাত তুলে বাধা দিল যুবক।
ওসব পরে, কেমন? হাতে সময় কম। আপনারা জানেন না, পায়ে হেঁটে না এলে এখানে আমি পৌঁছতেই পারতাম না।
বলেন কি! চেঁচিয়ে উঠল একজন। বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কেউ?
অসম্ভব নয়, বলল যুবক। মেটয়োর ওই ব্রিজটা পেরিয়ে এই রাস্তায় ওঠার পরপরই দেখলাম, ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে কি যেন ঝিক করে উঠল। আড়চোখে চেয়ে বুঝলাম শেষ বিকেলের রোদ পড়েছে একটা ইস্পাতের হেলমেটের ওপর। কেউ একজন ওঁৎ পেতে বসে আছে কারও অপেক্ষায়। হ্যাটটা আর একটু টেনে মুখ আড়াল করলাম। আমাকে চিনতে পারেনি, কিন্তু আমি ঠিকই চিনলাম– বসে আছে বদমাশ মাসুচ্চিও টোরি। নড়েচড়ে উঠল সবাই, উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে নিরাপত্তার চিন্তায়। একটু ভাবতেই বুঝলাম, সম্ভবত আমারই অপেক্ষায় ছিল ও। কোনও ভাবে জানতে পেরেছে এ-রকম সময়ে আসব আমি এই পথে। কিন্তু এই পোশাকে, এভাবে পায়ে হেঁটে আমি আসতে পারি তা কল্পনাও করতে পারেনি; তাই বাধা না দিয়ে নির্বিঘ্নে যেতে দিয়েছে।
অসম্ভব! বলে উঠলেন বৃদ্ধ ফ্যাব্রিৎসিও। আমি গসপেল হাতে নিয়ে বলতে পারি, আমরা এই ছয়জন কাউকে কিছু বলিনি। আমরা ছাড়া আর কেউ তো জানেই না আপনি আজ এখানে আসছেন।
সবাই সমর্থন করল বৃদ্ধকে। একটা হাত তুলল যুবক, আমিও বলিনি কাউকে। তাহলে রাস্তার ধারে ওভাবৈ ঘাপটি মেরে বসেছিল কেন মাসুচ্চিও? গলার স্বর একটু পাল্টে গেল যুবকের। যাই হোক, আমি জানি না, কেন আজ আপনারা এতজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি আমাকে ডেকেছেন এখানে। যদি এটা ডিউকের বিরুদ্ধে কিছু হয়, আপনাদের এখনই সাবধান হওয়া দরকার। কোনও সন্দেহ নেই, সে আপনাদের মতলব জানে, বা না জানলেও আঁচ করেছে কোনভাবে। মাসুচ্চিও যদি আমার অপেক্ষায় না থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, আজকের মীটিঙে কে কে উপস্থিত হয় ডিউকের কাছে তা রিপোর্ট করার জন্যেই ওকে বসানো হয়েছে।
করুক রিপোর্ট! বেপরোয়া ভঙ্গি ফুটে উঠল ফ্যাব্রিৎসিওর পাশে বসা ফেরাব্রাচ্চিওর চেহারায়। খবর যখন পৌঁছবে তখন আর কিছু করার থাকবে না ডিউকের।
অবাক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ যুবক, তারপর বলল, তাহলে এই ব্যাপার? কঠোর শোনাল তার কণ্ঠ। রাষ্ট্রদ্রোহিতা?।
লর্ড অ্যাকুইলা, জবাব দিলেন ফ্যাব্রিৎসিও। রাষ্ট্রের প্রতি সৎ থাকার জন্যেই আমরা একটা বাজে লোকের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে যাচ্ছি।
বাজে লোক? কে সে?
ব্যাব্বিয়ানোর ডিউক, সোজাসাপ্টা উত্তর এল।
রাজ্যকে ভালবেসেই রাজার বিরুদ্ধে যাচ্ছেন-এর কি অর্থ আমি জানি না। আর, তাছাড়া, এসবের মধ্যে আমাকে কেন? ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল যুবক।
সবাই এ-ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। হতভম্ব হয়ে গেছে। যেন ধরেই নিয়েছিল সমর্থন পাওয়া যাবে কাউন্ট অ্যাকুইলার। যুবকের কণ্ঠের কাঠিন্য থমকে দিয়েছে ওদের, ভাবছে আর এগোনো ঠিক হবে কিনা। মুখ খুললেন প্রবীণ ফ্যাব্রিৎসিও ডা লোডি।
লর্ড কাউন্ট, আমি একজন বুড়োমানুষ; উচ্চবংশীয়, সম্মানিত লোক। এই বয়সে নিজ পরিবারের নাম ডুবানোর কোনও ইচ্ছে আমার নেই, এটুকু অন্তত বিশ্বাস করতে পারেন। এই ছয়জনের একজনও আমরা বিশ্বাসঘাতক নই। আপনি আমার বক্তব্য শুনলেই সব বুঝতে পারবেন, ইয়োর এক্সেলেন্সি। আমার অনুরোধ, সব শুনে তারপর বিচার করুন। এটুকু জানবেন, দেশটাকে বাঁচাবার জন্যেই আমরা মিলিত হয়েছি। আর, আমাদের ওপর এটুকু বিশ্বাস রাখবেন, আপনার অমতে একটা পাও ফেলব না আমরা।
অ্যাকুইলার কাউন্ট ফ্র্যাঞ্চেস্কেল ডেল ফ্যালকোর দৃষ্টিটা কঠোরতা হারিয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠল। মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে বুঝিয়ে দিল, সম্ভ্রান্ত বৃদ্ধের বক্তব্য শুনরে সে। ( কথার মাঝখানে হঠাৎ বলে উঠলেন ফেরাব্রাচ্চিও, সব শোনার আগে কাউন্টকে কথা দিতে হবে, এখানে যা উচ্চারিত হবে বা যে প্রস্তাব উত্থাপিত হবে তা যদি তিনি সমর্থন না করেন, এ বিষয়ে কারও কাছে মুখ খুলবেন না। কথা দিল যুবক, সবাই বসল টেবিল ঘিরে, শুরু করলেন ওদের বৃদ্ধ মুখপাত্র।
সংক্ষেপে ব্যাব্বিয়ানোর বর্তমান শাসক ডিউক জিয়ান মারিয়া স্কোত্যার দুঃশাসন সম্পর্কে ধারণা দিলেন তিনি যুবককে। উচ্ছল, আত্মপ্রেমী, দায়িত্বজ্ঞানহীন, বেহিসেবি, রাষ্ট্র পরিচালনায় অমনোযোগী– এক কথায় অক্ষম এই ডিউক সম্পর্কে বলতে গিয়ে নিজেকে সংযত রাখতে হলো বৃদ্ধকে, কারণ, যার সম্পর্কে বলছেন, তিনি এই যুবকের আপন ফুফাত ভাই।
প্রজা সাধারণ এই ডিউকের প্রতি কি পরিমাণ অসন্তুষ্ট, আমার বিশ্বাস, সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা আছে ইয়োর এক্সেলেন্সির। গত বছর ব্যাকোলিনোর ষড়যন্ত্র যদি সফল হতো, আজ আমরা ফ্লোরেন্সের পদানত থাকতাম। ওটা বিফল হয়েছে বলেই দ্বিতীয় আর একটা চক্রান্ত সফল হবে না তা বলা যায় না। আর যাই হোক, আমরা চাই না শাসকের অক্ষমতায় আমাদের এই স্বাধীন রাজ্য পরাধীন হোক। কিন্তু ঠিক তাই হতে চলেছে। সীজার বর্জিয়া যেভাবে চারদিকে তার প্রতিপত্তি বিস্তার শুরু করেছে, যেভাবে এক এক করে গ্রাস করছে আশপাশের রাজ্যগুলো, তাতে আমরা জানতাম, আমাদের দিকে হাত বাড়ানোর আর বেশি দেরি নেই। কিছুদিন হলো নিশ্চিত খবর পেয়েছি, আমাদের ওপর চোখ পড়েছে তার। দুর্বল সেনাবাহিনী নিয়ে ডিউক অভ ভ্যালেন্টিনোকে ঠেকাবার সাধ্য আমাদের নেই, একথা বহুবার আমরা বোঝাবার চেষ্টা করেছি আপনার ভাইকে, বিপদ এড়াবার পথ দেখিয়েছি– কিন্তু না, তিনি আমাদের কথা গ্রাহ্যই করছেন না; কিছু বলতে গেলে উল্টে মেজাজ দেখান। তিনি ব্যস্ত তার রাতের অভিসার, নাচ-গান-মদ লাম্পট্য, খানা-পিনা-শিকার এসব নিয়ে।
বৃদ্ধ থামতেই তাঁর সমর্থনে গুঞ্জন উঠল ঘরে।
ভুরু কুঁচকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, বলল, আমি জানি। শুনেছি এসব কথা। কিন্তু আমার কি করার আছে, বলুন? আমাকে নালিশ জানিয়ে কি লাভ? আমি তো আর রাজনীতিক নই।
রাজনীতিকের দরকার নেই আমাদের, লর্ড! এখন ব্যাব্বিয়ানোর প্রয়োজন একজন সত্যিকার বীর যোদ্ধার। এমন একজনের, যিনি সেনাদল গড়ে নিয়ে রুখে দিতে পারবেন সীজার বর্জিয়াকে। ওরা এই আসলো বলে! লর্ড কাউন্ট, আমাদের দরকার আপনার মত একজন যোদ্ধাকে। গোটা ইটালীর আবালবৃদ্ধবণিতা কে না জানে আপনার নাম, কে না শুনেছে পিসা আর ফ্লোরেন্সের যুদ্ধে আপনার বীরত্বের কথা? ভেনিশিয়ানদের সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব নিয়ে যে অসমসাহস…
রক্ষে করুন, মেসার ফ্যাব্রিৎসিও! লজ্জা পেয়ে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল যুবক, কিন্তু থামলেন না ডা লোড়ি।
সত্যি কথাই বলছি। বাড়িয়ে কিছু বলছি না। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কি আপনার দক্ষতা, আপনার বীরত্ব, আপনার সাহস আপন জন্মভূমির স্বাধীনতা রক্ষায় কাজে লাগাবেন না? আমরা জানি আপনি দেশপ্রেমিক, আপনি কিছুতেই মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবেন না, ফ্রাঞ্চেস্কো ডেল ফ্যাল্কো!
ঠিকই জানেন আপনারা, দৃঢ়কণ্ঠে বলল যুবক। প্রয়োজর্মের সময় আপনারা আমাকে ঠিকই পাশে পাবেন। কিন্তু এজন্যে প্রস্তুতি দরকার। আপনারা আমাকে না বলে এসব কথা হিজ হাইনেসকে বলছেন না কেন?
জিয়ান মারিয়াকে যুদ্ধ করে দেশরক্ষার কথা বলে কোন লাভ নেই। সেটা গোবরে আগরবাতি দেয়ার মত হাস্যকর ব্যাপার। ভ্যালেন্টিনোর আক্রমণ থেকে ব্যাব্বিয়ানোকে রক্ষার জন্য তাকে আমরা ভিন্ন পথ দেখিয়েছি।
তাই? প্রশ্ন করল কাউন্ট, কি সেই পথ?
উরবিনের সঙ্গে মৈত্রী, বললেন লোডি। গুইডোব্যাল্ডোর দুই ভাইঝি আছে, সুন্দরী, বিবাহযোগ্যা। আমরা বাজিয়ে দেখেছি তাকে, জিয়ান মারিয়ার সঙ্গে ওদের যে-কোন একজনের বিয়েতে তার আগ্রহ আছে। উরবিনোর সঙ্গে আত্মীয়তা করতে পারলে প্রয়োজনে বোলোনিয়া, পেরুজিয়া, ক্যামেরিনো ছাড়াও আরও কয়েকটা ছোট রাজ্যের লর্ডদের সাহায্য পাব আমরা। ফলে সীজার বর্জিয়ার সাহস হবে না আমাদের ওপর হামলা করার।
প্ল্যানটা ভাল ছিল, বলল পাওলো। খুবই বিচক্ষণ বলতে হবে। কিন্তু, শুনেছি, ব্যাপারটা ভেস্তে গেছে।
কেন ভেস্তে গেল? গর্জে উঠল ফেরাব্রাচ্চিও, সেই সঙ্গে প্রচণ্ড এক চাপড় মারল টেবিলে। কারণ, আমাদের জিয়ান মারিয়ার নাকি এখন বিয়ে করার মৃড় নেই! পরির মত সুন্দরী মেয়েটাকে বাদ দিয়ে ব্যাব্বিয়ানোর বাজে এক মেয়েলোক…
মাই লর্ড, কথার মাঝখানে বাধা দিলেন ফ্যাব্রিৎসিও। ঠিকই বলেছে ফেরাব্রাচ্চিও। হিজ হাইনেস বিয়ে করবেন না। কাজেই আমরা আজ এই বৈঠকের আয়োজন করতে বাধ্য হলাম। ডাচি রক্ষার জন্যে কিছুই করবেন না তিনি, তাই আপনার শরণাপন্ন হতে হলো আমাদের। জনসাধারণ আমাদের পক্ষে। ঘরে ঘরে সবাই আপনার নাম উচ্চারণ করছে এখন, সবাই আশা করছে আপনি এই মহাবিপদে দেশটাকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেবেন। আমরা, গোটা দেশের সবার হয়ে, সরার সম্মতিক্রমে ব্যাব্বিয়ানোর মুকুট আপনার মাথায় পরাতে চাই, মাই লর্ড। ওই বদমাশ মাসুচ্চিও আর জনা পঞ্চাশেক ভাড়াটে সুইস সৈন্য ছাড়া জিয়ান মারিয়ার পক্ষে এ-রাজ্যে সত্যিই কেউ নেই। যে রাজা তার সিংহাসন রক্ষা করার ক্ষমতা রাখে না, কয়েকটা বিদেশী ভাড়াটে যোদ্ধার ওপর যার একমাত্র ভরসা, তাকে গদিচ্যুত করায় আমরা তো কোন অন্যায় দেখি না।
লোডির বক্তব্য শেষ হতেই নীরবতা নেমে এল কুটিরে। উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করছে সবাই কাউন্টের উত্তর শোনার জন্য। হঠাৎ এই প্রস্তাব পেয়ে থমকে গেছে কাউন্ট অ্যাকুইলা, গভীর চিন্তায় ভাঁজ পড়েছে কপালে, মাথা নিচু হয়ে চিবুক ঠেকেছে গিয়ে বুকে। মনে মনে নেড়েচেড়ে দেখছে ব্যাব্বিয়ানোর লর্ড হতে তার কেমন লাগবে। মনের চোখে দেখতে পেল অক্লান্ত পরিশ্রমে এই ছোট রাজ্যটাকে ইটালীর প্রথম শ্রেণীর শক্তিতে পরিণত করেছে সে, ভেনিস, মিলান ও ফ্লোরেন্সের সমকক্ষ হিসেবে মর্যাদা দেয়া হচ্ছে ব্যাব্বিয়ানোকে। দেখতে পেল মাইলের পর মাইল দাবড়ে নিয়ে গিয়ে আগ্রাসী বর্জিয়াকে ভ্যাটিকানে তার বাপের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসছে ব্যাব্বিয়ানোর সৈন্যদল। বড় বড় রিপাবলিক ফরাসী ও স্প্যানিয়ার্ডদের আগ্রাসন ঠেকাতে তার সাহায্য কামনা করছে।
এসব ভাবতে ভালই লাগছিল, কিন্তু যখনই মনে এল তার এই মুক্ত-স্বাধীন নাইটের জীবন ছেড়ে, খোলা আকাশের নিচে তার প্রিয় তবু ছেড়ে তাকে বাস করতে হবে হাঁপ-ধরা প্রাসাদে, পারিষদ নিয়ে বসে রাজকার্য পাঁচালনা করতে হবে, বিচার করতে হবে, সারাক্ষণ রাজনৈতিক কূটচাল প্রস্তুতে ব্যস্ত থাকতে হবে, তখনই বিষিয়ে উঠল মনটা। অসম্ভব! এ-জীবন সে চায় না।
শেষে মনে হলো: যার কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে হবে সে তার আপন ফুফাত ভাই, একই রক্ত বইছে দুজনের শরীরে। ব্যস, সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেল। মাথা তুলে চাইল সবার মুখের দিকে।
আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। কিন্তু আপনারা যে দুর্লভ সম্মান আমাকে দিতে চাইছেন, সম্ভবত আমি তার যোগ্য নই। আপত্তি জানাবার জন্যে সবাইকে মুখ খুলতে দেখে যোগ করল, যদি যোগ্য হতাম, তবু এ সম্মান গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব হত না।
কেন, মাই লর্ড? কেন সম্ভব নয়? প্রায় ককিয়ে উঠলেন ফ্যাব্রিৎসিও।
প্রথম কারণ, যাকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করতে হবে, তার সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক রয়েছে।
আমার ধারণা ছিল, বলে উঠল তরুণ ফ্যানফুল্লা, জন্মভূমির দাবি রক্তের দাবির চেয়ে অনেক বেশি জোরাল ও গুরুত্বপূর্ণ।
তোমার কথায় যুক্তি আছে, ফ্যানফুল্লা। তবে আমার অনিচ্ছার দ্বিতীয় কারণ: রাজ্যশাসনের অভিজ্ঞতা আমার নেই, কি করে বুঝি আমি পারব কি না? বর্তমান সঙ্কট মোকাবিলার জন্য এখানে একজন যোদ্ধার নেতৃত্ব প্রয়োজন, মানি, কিন্তু শান্তির সময় কি করবে সে যোদ্ধা? প্রতিবেশীকে খুঁচিয়ে ঝগড়া বাধাবার চেষ্টা করবে, অশান্তি সৃষ্টি করবে জনমনে।
আর তৃতীয় কারণ: আমি স্বাধীনচেতা মানুষ, রাজসভার সুবাসিত, গুমোট পরিবেশ আমার একদম পছন্দ নয়। খোলা আকাশের নিচে, মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াতে আমার ভাল লাগে, ডিউকাল মুকুটের জন্যে আমি আমার স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে রাজি নই। সবাইকে আশাহত দেখে শেষ কথাটা বলল যুবক, তবে একটা কাজ আমি করতে পারি। আপনাদের সঙ্গে ব্যাব্বিয়ানোতে গিয়ে আমার ভাইকে বলতে পারি, কিছুদিনের জন্যে তার সেনাপতির দায়িত্ব আমাকে দিলে আমি এমন একটা বাহিনী গড়ে দেব, এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে এমন একটা প্রীতির সম্পর্ক তৈরি করে দেব যে, হুট করে বাইরের কেউ আক্রমণ করে বসতে সাহস পাবে না।
কিছুক্ষণ তর্ক করার পর যুবকের অনমনীয় ভাব টের পেয়ে এই কথাতেই রাজি হয়ে গেল সবাই। সবার হয়ে তাকে ধন্যবাদ জানালেন ডা লোডি। সভার সমাপ্তি ঘোষণা করতে যাচ্ছেন, এমনি সময়ে লাফিয়ে উঠে পঁড়াল তরুণ ফ্যানফুল্লা ডেলি আর্চিপ্রেটি। ভুরু কুঁচকে এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে ছুটে চলে গেল দরজার কাছে। দরজা খুলে কি যেন শোনার চেষ্টা করছে কান পেতে।
অবাক হয়ে যারা ওর কাণ্ড দেখছিল, এইবার তারাও শুনতে পেল শব্দটা। এই কুটিরের দিকে মার্চ করে এগিয়ে আসছে একদল সৈন্য।
.
০২.
সোলজার! চাপা গলায় বলল ফ্যানফুল্লা। জেনে গেছে ওরা!
এ ওর দিকে চাইল সবাই, চোখে উৎকণ্ঠা। ধীরে উঠে দাঁড়াল অ্যাকুইলা। বাকি সবাই উঠল দেখাদেখি, অস্ত্রগুলোর উপর চোখ।
মৃদুকণ্ঠে একটা নাম উচ্চারণ করল যুবক, মাসুচ্চিও টোরি।
ঠিক! বললেন লোডি তিক্তকণ্ঠে। আপনার সতর্কবাণীতে যদি কান দিতাম তখন! পঞ্চাশজন মার্সেনারি নিয়ে ধেয়ে আসছে এখন মাসুচ্চিও।
পায়ের আওয়াজেই টের পাওয়া যাচ্ছে, তার কম নয়, বলল ফেরাব্রাচ্চিও। আর আমরা মাত্র ছয়জন, বর্ম নেই কারও কাছেই।
সাতজন, বলে হ্যাটটা মাথায় চড়াল কাউন্ট, খাপে পোরা তলোয়ারটা ঢিল করল।
না, মাই লর্ড, বললেন লোডি। একটা হাত রাখলেন কাউন্টের বাহুতে। আমাদের সঙ্গে আপনার থাকা চলবে না। আপনি আমাদের একমাত্র ভরসা, ব্যাব্বিয়ানোর ভবিষ্যৎ। কেউ জানে না আপনি এখানে আছেন, সামান্য সন্দেহ যদি করেও থাকে, একথা প্রমাণ করতে পারবে
জিয়ান মারিয়া। আপনি সরে যান এখান থেকে, আমরা মরণপণ যুঝবো ওদের সঙ্গে। শুধু মনে রাখবেন, আপনি কথা দিয়েছেন, সেনাপতির দায়িত্ব চাইবেন জিয়ান মারিয়ার কাছে। মাথা নুইয়ে যুবকের হাতের পিঠে ভক্তির সঙ্গে চুম্বন করলেন বৃদ্ধ।
কিন্তু এত সহজে নিরস্ত হওয়ার মানুষ নয় কাউন্ট অ্যাকুইলা। দৃঢ়কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, আপনাদের ঘোড়াগুলো কোথায়?
বাঁধা আছে ঘরের পিছনে। কিন্তু এই রাতে ঘোড়ায় চড়ে পাহাড় বেয়ে নামবে– কার এত সাহস?
এই যেমন আমি, জবাব দিল যুবক। আপনাদেরও সাহস করতে হবে, যেহেতু এছাড়া আর কোনও উপায় নেই। চেষ্টা করতে গিয়ে বড়জোর ঘাড়টাই তো ভাঙবে, ওদের হাতে ধরা পড়লেও ওই একই পরিণতি– ব্যাব্বিয়ানোয় ধরে নিয়ে গিয়ে ফাঁসীতে ঝুলিয়ে দেয়া হবে।
ঠিক বলেছেন, বলল ফেরাব্রাচ্চিও, সবাই চলুন ঘোড়ার কাছে।
কিন্তু যাব কোন্ পথে? জানতে চাইল তরুণ ফ্যানফুল্লা, ওরা যেদিক দিয়ে আসছে ওটাই একমাত্র রাস্তা, বাকি সব তো খাড়া পাহাড়।
চিন্তা কোরো না, আমরা ওদের দিকেই যাব, বলল ফেরাব্রাচ্চিও সহজ গলায়। ওরা তো পায়ে হেঁটে আসছে। পাহাড়ি ঝরনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ব আমরা ওদের ওপর। জলদি! এসে পড়ল বলে!
কিন্তু ঘোড়া যে মাত্র ছয়টা? আপত্তি তুলল আরেকজন। মানুষ তো সাতজন।
হ্যাঁ, ঘোড়া নেই আমার, বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। পায়ে হেঁটে আপনাদের পিছু পিছু যাব আমি।
বলেন কি! নিজের অজান্তেই নেতৃত্ব নিয়ে ফেলেছে ফেরাব্রাচ্চিও। পায়ে হেঁটে যাওয়া তো হবে আত্মহত্যার সামিল। তারচেয়ে ডা লোডি, আপনি বয়স্ক মানুষ, আপনি থেকে যান পিছনে।
প্রথমে আপত্তি করলেও, সমস্যাটা বুঝতে পেরে রাজি হয়ে গেলেন ফ্যাব্রিৎসও।
কিন্তু ওঁর কি হবে? জানতে চাইল কাউন্ট অ্যাকুইলা। ধরা পড়লে।
সে সম্ভাবনা খুবই কম, জবাব দিলেন বৃদ্ধ নিজেই। আপনারা ঠিকমত দায়িত্ব পালন করলে ওদের মাথাতেই আসবে না পেছনে আর কেউ থেকে যেতে পারে। ওদের কুঁড়ে বেরিয়ে গেলে দিশে হারিয়ে আপনাদের পিছনেই ছুট লাগাবে ওরা। রওনা হয়ে যান, নইলে সব কূল হারাতে হবে।
ঘোড়ার বাঁধন খুলে লাফিয়ে পিঠে উঠল ওরা। শুরু হলো দুর্গম, পাহাড়ি পথে বিপজ্জনক যাত্রা। চাঁদ নেই, কিন্তু নির্মেঘ আকাশ থেকে অসংখ্য তারার খুদে প্রদীপ ম্লান আলো ছড়াচ্ছে, আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে সামনে বেশ কিছুদূর পর্যন্ত– যদিও উঁচু-নিচু পথে আলোর চেয়ে ঘন ছায়াই চোখে পড়ছে বেশি।
পথঘাট ফেরাব্রাচ্চিওর বেশি চেনা তাই সে থাকল সামনে, তার পাশে পাশে চলেছে কাউন্ট; তাদের পিছনে পাশাপাশি দুজন করে আসছে বাকি চারজন। কিছুদূর এগিয়ে বামদিকের উঁচু একটা খাড়া পাহাড়ের ছায়ায় ছোট্ট একটা তাক মত জায়গায় দাঁড়াল ওরা। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে রাস্তাটা। মার্চের আওয়াজ বেশ জোরাল ভাবেই শোনা যাচ্ছে এখন, কাছে এসে পড়েছে ওরা। সামনে একশো গজ মত ঢালু জায়গা, তারপরেই বাঁক নিয়েছে রাস্তাটা। ডানদিকে বেশকিছুটা নিচে উঁচু-নিচু রাস্তার ছোট্ট একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। সেখানেই ইস্পাতের ফলায় তারার আলোর প্রতিফলন দেখে ফেরাব্রাচ্চিওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল ফ্যানফুল্লা। সেই মুহূর্তে এগোবার নির্দেশ দিল সে। কিন্তু বাধা দিল কাউন্ট ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
এখুনি রওনা হলে মোড়টা পেরিয়ে তারপর ওদেরকে মোকাবিলা করতে হবে আমাদের। মোড়ের কাছে গতি কমাতেই হবে, ফলে আক্রমণের তোড়টা কমে যাবে। তারচেয়ে আর একটু অপেক্ষা করুন, ওরা মোড় ঘুরে আমাদের দিকে এগোতে শুরু করলেই ছায়ার মধ্যে দিয়ে ঝড়ের বেগে মামব আমরা ঢাল বেয়ে; পূর্ণগতিতে ওদের ভেদ করে বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে তাহলে।
ঠিক বলেছেন, লর্ড কাউন্ট, সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিল ফেরাব্রাচ্চিও। অপেক্ষার সময়টুকু গজগজ করতে থাকল, কী একটা ফাঁদে পড়া গেছে! এমন জায়গায় মানুষে মীটিং করে? একটা ছাড়া আর কোনও পথ নেই!
পিছনের পাহাড় বেয়ে নিচে নামা যেত না? জানতে চাইল কাউন্ট।
যেত, জবাব এল তৎক্ষণাৎ, আমরা যদি চড়ইপাখি বা পাহাড়ি ছাগল হতাম। কিন্তু মানুষ হওয়ায় ওদের চেয়েও তাড়াতাড়ি পৌঁছব নিচে, তবে চামড়ামোড়া ভাঙা হাড়গোড়ের বান্ডিল হিসেবে।
তৈরি হয়ে যান! চাপা গলায় বলল কাউন্ট, ওই যে, মোড় ঘুরে আসছে ওরা।
সবাই দেখল, ইস্পাতের হেলমেট পরা একদল সশস্ত্র ভাড়াটে সৈন্য এগিয়ে আসছে জোরকদমে। কাঁধে রাখা বর্শার ফলাগুলো ঝকঝক করছে তারার আলোয়। কিছুদূর এগিয়েই থামল ওরা। বোঝা গেল, পিছিয়ে পড়া সৈন্যদের জন্যে অপেক্ষা করছে।
এইবার! বলল কাউন্ট মৃদুকণ্ঠে। টুপিটা টেনে দিল ভুরুর উপর। তারপর মাথার উপর তলোয়ার তুলে রেকাবে উঠে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড এক হাঁক ছাড়ল, আগে বাড়ো!
এমন বিকট হাঁক শুনে, আর সেই সাথে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শুনে আত্মা চমকে গেল ভাড়াটে সৈন্যদের।
মাসুচ্চিওর গলা শোনা গেল, রুখে দাঁড়াতে বলছে সৈন্যদের, বর্শা বাগিয়ে ধরে নিচু হয়ে হাঁটু গেড়ে বসতে বলছে, সাহস যোগানোর জন্যে বলছে-শত্রু মাত্র ছয়জন। কিন্তু পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে নেমে আসা ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে গোটা এক রেজিমেন্ট আসছে ধেয়ে। পালাবার জন্যে পিছন ফিরল সামনের সৈন্যরা। এমনি সময়ে জলপ্রপাতের মত পৌঁছে গেল অশ্বারোহীরা, ওদের ভিতর দিয়ে তেড়ে-ফুঁড়ে এগিয়ে গেল সামনে।
দশ-বারোজন কুপোকাত হলো প্রথম ধাক্কাতেই। আরও বারো চোদ্দজন দিশে হারিয়ে লাফ দেয়ায় এই মুহূর্তে পাশের খাদে পড়ে দ্রুত নামছে নিচের দিকে। বাকি সৈন্যরা এতক্ষণে শত্রুপক্ষের সংখ্যার স্বল্পতা টের পেয়ে অস্ত্র বাগিয়ে ধরে রুখে দাঁড়াল। অপ্রশস্ত রাস্তার উপর তুমুল যুদ্ধ হলো কিছুক্ষণ। ঘোড়া ও মানুষের পায়ের দাপাদাপি, অস্ত্রের ঝনঝনাৎ, আহতদের আর্তনাদ– সব মিলে যেন নরক গুলজার হচ্ছে। সবার আগে অ্যাকুইলার লর্ড, বীরদর্পে যুদ্ধ করে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে, মাঝে মাঝেই পিছনের দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড় করাচ্ছে ঘোড়াটাকে, সেই সঙ্গে পাশ ফিরে বিদ্যুদ্বেগে চালাচ্ছে তলোয়ার, ঘোড়ার পা যখন নেমে আসছে ডাইনে বা বামে– প্রাণভয়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে পদাতিক সেনারা।
এইভাবে পথ পরিষ্কার করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে সে, অনেকটা ভাগ্যের জোরেই মারাত্মক জখম এড়িয়ে প্রায় বেরিয়ে এসেছে শত্রুর ঘের থেকে, এখন সামনে শুধু তিনজন। আবার নাক দিয়ে ঘোৎ শব্দ করে লাফিয়ে উঠল ঘোড়াটা, আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে উঁচু করে রেখেছে সামনের পা দুটো, এখুনি নামিয়ে আনবে ওগুলো ওদের উপর। তাই দেখে রণে ভঙ্গ দিল দুজন, ছিটকে সরে গেল সামনে থেকে, কিন্তু তৃতীয়জন চট করে এক হাঁটু গেড়ে বসে বর্শাটা তাক করল ঘোড়ার বুকের দিকে। ঘোড়াটাকে বাঁচাবার চেষ্টা করল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, কিন্তু পারল না–বর্শার আগায় নেমে এল ওটা, তীক্ষ্ণ এক চিৎকার দিয়ে হুড়মুড় করে পড়ল সামনের লোকটার উপর। বিশাল ঘোড়র নিচে চাপা পড়ে মারা গেল লোকটা তৎক্ষণাৎ, ছিটকে গিয়ে পাথরের উপর আছাড় খেল কাউন্ট। চট করে উঠে দাঁড়াল সে, কিন্তু দিশেহারা। কাঁধটা কখন যে জখম হয়েছে টেরই পায়নি এতক্ষণ যুদ্ধের উত্তেজনায়। প্রচুর রক্তক্ষরণহওয়ায় দুর্বল হয়ে পড়েছে কাউন্ট, টলমল করছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। এই সুযোগ বুঝে এগিয়ে এল শেষ সৈনিক দুজন। ওদের সামাল দেয়ার জন্যে সোজা হয়ে দাঁড়াল কাউন্ট অ্যাকুইলা, অন্তত একজনকে শেষ করে তারপর মরবে। কিন্তু তরুণ ফ্যানফুল্লা ডেলি আর্চিপ্রেটি ছিল ওর ঠিক পিছনেই, দ্রুত এগিয়ে এসে পিছন থেকে ঘায়েল করল শত্রু দুজনকে। তারপর কাউন্টের পাশে ঘোড়া থামিয়ে হাত বাড়াল।
আমার পেছনে উঠে পড়ন, ইয়োর এক্সেলেন্সি! ডাকল সে।
সময় নেই, বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, দেখতে পেল ছয়-সাতজন তেড়ে আসছে ওদের দিকে। তোমার জিনের চামড়া ধরে ঝুলছি আমি, তুমি ছোটাও ঘোড়া! কথাটা বলেই ফ্যানফুল্লার অপেক্ষায় মা থেকে তলোয়ারের চ্যাপ্টা দিক দিয়ে চড়াৎ করে বাড়ি লাগিয়ে দিল ঘোড়ার পিছন দিকে। ছুটল ঘোড়া,। যুদ্ধক্ষেত্র পিছনে ফেলে নেমে যাচ্ছে ওরা পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে। আধমাইল মত সরে গিয়ে থামল ফ্যানফুল্ল, ঘোড়ার পিঠে উঠে বসল কাউন্ট। পরিষ্কার বোঝা গেল, ছয়জনের মধ্যে প্রাণে বেঁচেছে কেবল ওরা দুজন। আক্রমণ শুরু হওয়ার আগেই মারা গেছে শতাধিক যুদ্ধে বিজয়ী বীর দুর্ধর্ষ ফেরাব্রাচ্চিও। শুরুতেই ঘোড়াটা ঘাবড়ে গিয়ে ওকে নিয়ে কিনার থেকে পড়ে গিয়েছে খাদে– কিভাবে পিছনের পাহাড় বেয়ে খুব দ্রুত নামা যায়, রসিকতা করে তার যা বর্ণনা সে দিয়েছিল, ঠিক তাই ঘটেছে তার ভাগ্যে চামড়ামাড়া ভাঙা হাড়গোড়ের বান্ডিল হয়ে গেছে সে। আমেরিনিকে নিহত হতে দেখেছে ফ্যানফুল্লা নিজ চোখে। বাকি দুজন বন্দী হয়েছে।
সান্ত অ্যাঞ্জেলো ছাড়িয়ে তিন মাইল সরে এল ওরা। মেটরোর একটা অগভীর ঝর্নায় ক্লান্ত ঘোড়াটাকে পানি খাইয়ে নিয়ে এগিয়ে চলল সামনে। অনেক রাতে উরবিনোর সীমানায় প্রবেশ করে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো, এখানে ওদের পিছু ধাওয়া করবে না কেউ।
.
০৩.
আজও ঝগড়া বেধে গেছে কুঁজো ভাঁড়ের সঙ্গে মোটা পুরোহিতের। স্ত্রীজাতি নিয়ে ছিল তর্কটা। যুক্তিতে কিছুতেই এঁটে উঠতে না পেরে পা থেকে স্যাভেল খুলে তাড়া করল দৈত্যের মত ফ্রায়ার ছোটখাট, কুঁজো ভাঁড়কে– ওটা দিয়ে পিটিয়ে ওর মাথায় নিজের যুক্তি প্রবেশ করাবে। অগ্নিমূর্তি ফ্রায়ারকে এগোতে দেখেই বাতাসের বেগে ছুটে, নিমেষে জঙ্গলে মিলিয়ে গেল ভাঁড়।
পিছনে তাকিয়ে দৌড়াচ্ছিল, তাই টেরও পেল না কিসের সঙ্গে হোঁচট খেয়ে হুড়মুড় করে মুখ থুবড়ে পড়ল সে মাটিতে। ককিয়ে উঠল সে, পরমুহূর্তে কলজে শুকিয়ে গেল তার ঝোঁপের আড়ালে শুয়ে থাকা এক লোককে উঠে বসে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে চাইতে দেখে।
চোখের মাথা খেয়েছ?
বাপরে! কী গম্ভীর গলা! তাড়াতাড়ি বলল, মাফ চাইছি, জনাব। সবিনয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমাকে তাড়া করছিল তো…
তাড়া করছিল? ভুরু কুঁচকে উঠল লোকটার, একটু যেন অস্বস্তি ফুটল চোখের দৃষ্টিতে। কে তাড়া করছে তোমাকে?।
ডোমেনিকান ব্রাদারের চামড়ায় মোড়া আস্ত এক পিশাচ!
ইয়ার্কি মারছ আমার সঙ্গে? রেগে উঠছে লোকটা।
ওর স্যান্ডেলের এক-আধ ঘা যে খেয়েছে, সে আর যাই করুক ঠাট্টা-ইয়ার্কি করবে না সেটা নিয়ে।
শোনো, একটা কথার সোজা জবাব দাও এদিকে কাছেপিঠে কোনও পুরোহিত আছে
আছেই তো। তার তয়েই তো পালাচ্ছিলাম। বেশি মোটা বলে পিছিয়ে পড়েছে, কিন্তু ব্যাটা খুবসম্ভব আসছে এইদিকেই।
যাও, ওকে ডেকে নিয়ে এসো এখানে, হুকুম দিল লোকটা।
হা, যীশু! ককিয়ে উঠল ভাঁড়। রাগ না কমা পর্যন্ত ওর ধারে কাছে তো যাওয়াই যাবে না। আমার অন্তত সে সাহস নেই।
বিরক্ত হলো লোকটা। গলা কিছুটা চড়িয়ে ডাকল, ফ্যানফুল্লা! ও হে, ফ্যানফুল্লা!
এই তো আসছি, মাই লর্ড, ডানদিকের একটা ঝোঁপের আড়াল থেকে জবাব এলো। পরমুহূর্তে ঝলমলে পোশাক পরা চমৎকার চেহারার এক যুবা এগিয়ে এসে কুঁজো ভাঁড়কে দেখে থমকে দাঁড়াল।
অবাক হয়ে ওর সাজ-পোশাক দেখছে বেঁটে বামন, আর ভাবছে, এই রাজপুত্রের মত লোকটা ওই সাধারণ পোশাক পরা লোকটাকে এত সম্মান দেখাচ্ছে কি জন্যে! ব্যাপার কি? এবার ভাল করে তাকিয়ে দেখেই চিনে ফেলল সে মাটিতে বসা লোকটাকে। চমকে উঠে দাঁড়াল সে বলল, আপনি মাই লর্ড অভ অ্যাকুইলা!
কথাটা শেষ হতে না হতেই একটা হাত চেপে ধরল জেসটারের কাঁধ, বিস্ফারিত চোখে দেখতে পেল সে, গলার কাছে ধরা রয়েছে ঝকঝকে একটা ছোরা। আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেল ওর।
কানের কাছে হিসহিস করে উঠল ফ্যানফুল্লার চাপা কণ্ঠস্বর, যদি বাঁচতে চাও, যীশুর নামে শপথ করো, হিজ এক্সেলেন্সির এখানে উপস্থিতির কথা কারও কাছে প্রকাশ করবে না! নইলে এখুনি দুফাঁক করে দেব গলাটা!
কিরে…কিরে… তোতলাতে শুরু করল ভাঁড়, যী-যীশুর নামে কিরে কাটছি, কা-ক্কাউকে বলব না!
যাও, এবার ডেকে নিয়ে এসো পুরোহিতকে, মৃদু হেসে বলল কাউন্ট। আমাদের তরফ থেকে আর কোন ভয় নেই তোমার।
লোকটা বিদায় নিতেই সঙ্গীর দিকে ফিরল ফ্র্যাঞ্চেঙ্কো, ভারি সাবধানী লোক তো তুমি, ফ্যানফুল্লা। কিন্তু এখানে আমাকে কেউ চিনে ফেললে কি ক্ষতি?
বলেন কি? সাত্ত অ্যাঞ্জেলোর এত কাছে আমরা যে ছয়জন গতকাল মীটিং করেছি, তাদের সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমি আর সব লোড়ি ছাড়া ধরে নিতে পারেন, বাকি চারজনের আর কেউ বেঁচে নেই। পালাচ্ছি আমি, এখন এছাড়া আর কোন পথও নেই। জিয়ান মারিয়া যতদিন ডিউক থাকবে, ততদিন ব্যাব্বিয়ানা রাজ্যে পদার্পণ আমার জন্যে নিষিদ্ধ। কিন্তু সপ্তমজন সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। এখন যদি কোনভাবে হিজ হাইনেসের কানে যায় যে এই এলাকায় আমার সঙ্গে আপনাকে দেখা গেছে, তাহলে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নেবে সে।
এবং তাহলে?
তাহলে? বিস্মিত দৃষ্টিতে চাইল ফ্যানফুল্লা কাউন্টের মুখের দিকে। তাহলে আমাদের সবার সব আশা-ভরসা শেষ হয়ে যাবে, মাই লর্ড; ব্যাব্বিয়ানোর ভাগ্যে নেমে আসবে পরাধীনতার গ্লানি। এই যে, আমাদের জোকার এসে পড়েছে, সঙ্গে একজন ফ্রায়ার।
ধীর পায়ে ফ্যানফুল্লার সামনে এসে মস্ত কামানো মাথাটা নুইয়ে অভিবাদন করলেন ফ্রা ডোমেনিকো।
আপনার কি চিকিৎসা সম্পর্কে জ্ঞান আছে? জিজ্ঞেস করল ফ্যানযুল্লা।
কিছু কিছু আছে, জনাব।
তাহলে এই ভদ্রলোকের জখমটা একটু দেখুন।
অ্যাঁ? ডিও মিও (মাই গড)! আপনি আহত হয়েছেন বুঝি?
এরপরেই আসবে কিভাবে, কোথায় ইত্যাদি প্রশ্ন টের পেয়ে চট করে পোশাক সরিয়ে কাঁধের জখমটা বের করে ফেলল কাউন্ট ফ্র্যাঞ্চেস্কো, এই যে, স্যার প্রীস্ট, এই দেখুন।
গভীর মনোযোগ দিয়ে জখমটা পরীক্ষা করে রায় দিলেন ফ্রায়ার, যদিও এসব জখম ভোগায় খুব, কষ্টও দেয়, কিন্তু আসলে মারাত্মক কিছু নয়।
ক্ষতটা বেঁধে দিতে বলায় ফ্রা ডোমেনিকো জানালেন ওষুধ বা ব্যান্ডেজ কিছুই নেই তাঁর কাছে। ফ্যানফুল্লা বলল, আমার সঙ্গে চলুন, অ্যাকুয়াম্পার্টার কনভেন্ট থেকে ওসব চেয়ে নিয়ে আসি। পুরোহিত রাজি হতেই কুঁজো ভাঁড়কে কাউন্টের কাছে রেখে রওনা হয়ে গেল ফ্যানফুল্লা।
তোমার মনিব কে? আলখেল্লার উপর গা এলিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল কাউন্ট।
একজন আছেন, আমাকে খাওয়ান পরান। কিন্তু আমার মনিব আসলে নিরেট নির্বুদ্ধিতা।
তাহলে তিনি তোমার ভরণপোষণ করেন কেন?
করেন এইজন্যে যে, আমি সবসময় এমন ভাব দেখাই যেন আমি তার চেয়েও নির্বোধ, যাতে আমার সঙ্গে তুলনা করে নিজেকে তাঁর ভীষণ চালাক আর মস্ত জ্ঞানী মনে হয়। তাছাড়া আমার মত কুৎসিত চেহারার কেউ একজন কাছে পিঠে থাকলে তার তুলনায় নিজেকে তিনি অপূর্ব সুন্দর বলে ভাবতে পারেন।
অদ্ভুত যুক্তি।
কিন্তু তারচেয়েও অনেক বেশি অদ্ভুত, মাই লর্ড, এমন সাদামাঠা পোশাক পরে, কাঁধে জুখ নিয়ে অ্যাকুইলার লর্ডের এই মাটিতে শুয়ে আমার মত এক বুন্ধুর সঙ্গে আলাপ করা।
বুদ্ধিমান বুদ্ধুর দিকে হাসিমুখে চেয়ে থাকল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
তোমার কপাল ভাল যে ধারে-কাছে ফ্যানফুল্লা নেই। থাকলে, এইমাত্র যা বললে এটাই তোমার জীবনের শেষ কথা হতো। দেখতে যতই সুন্দর হোক না কেন, ওর মত নিষ্ঠুর, রক্তপিপাসু লোক আমি খুব কমই দেখেছি। আমার কথা আলাদা, তুমি হয়তো শুনেছ, আমি অতি শান্তশিষ্ট, নরম প্রকৃতির লোক। কিন্তু আমার নাম আর পদবী যদি এক্ষুণি ভুলে না যাও তোমার কপালে খারাবি আছে মেসার বাফুন।
ক্ষমা করে দিন, মাই লর্ড! আর ভুল হবে না।
ঠিক এমনি সময় জঙ্গলের ভিতর মিষ্টি একটা সুরেলা নারীকণ্ঠ ডেকে উঠল, পেনিনা! পেনিনা!
ডাকছে আমাকে, আমার মনির। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল বিচিত্র পোশাক পরা কুঁজো ভাঁড়।
হাসল কাউন্ট বিদ্রুপের, হাসি। এই না বললে তোমার মনিব নিরেট নির্বুদ্ধিতা? তোমার নির্বুদ্ধিতার চেহারাটা দেখতে পেলে মন্দ হত না!
পাশ ফিরে চাইলেই দেখতে পাবেন, মাই লর্ড! ফিসফিস করে বলল পৈপ্লিনো।
ধীরে কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে ঘাড় ফিরাল অ্যাকুইলার লর্ড, পেপ্পিনো যেদিকে যাচ্ছে ঠোঁটে হাসি নিয়ে তাকাল সেদিকে। মুহূর্তে মুখ থেকে মুছে গেল বিদ্রুপের হাসি, সেই জায়গায় এখন রাজ্যের বিস্ময়!
জঙ্গলের ধারে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে অপূর্ব সুন্দরী এক যুবতী। দামী পোশাক-পরিচ্ছদ, সোনার গহনা এসব কিছুই চোখে পড়ল না যুবকের, অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সে মেয়েটির অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রীর দিকে, কোমল একজোড়া মৃদুবিস্মিত চোখের দিকে। যেমন ছিল তেমনি কনুইয়ে ভর দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ কাউন্ট চেয়ে থাকল নিষ্পাপ মুখটার দিকে, ওর মনে হলো স্বপ্ন দেখছে, স্বর্গের কোনও অপ্সরী হঠাৎ পথ ভুলে চলে এসেছে বুঝি এখানে!
ঘোরটা কেটে গেল পেপ্পিনো কথা বলে ওঠায়। জখমের কথা ভুলে এক লাফে উঠে দাঁড়াল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, সামনে ঝুঁকে সসম্মানে বাউ করল, পরমুহূর্তে ব্যথায় ককিয়ে উঠে হাঁ করল শ্বাস নেবে বলে, টাল সামলানোর চেষ্টা করল, তারপর জ্ঞান হারিয়ে দড়াম করে পড়ে গেল মাটিতে।
.
০৪.
প্রচুর রক্তক্ষরণে কতখানি দুর্বল হয়ে পড়েছিল, টের পায়নি ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
লোকটা কে, পেপ্পি? জানতে চাইল মেয়েটি।
শপথের কথা মনে পড়ায় মিথ্যে বলল পেনিনা, ও চেনে না, এমনি এক আহত লোক।
আহত? মেয়েটির শান্ত চোখে উদ্বেগ ফুটল। সঙ্গে কেউ নেই?
ছিলেন, ম্যাডোনা। এক ভদ্রলোক ছিলেন এঁর সঙ্গে, ফ্রা ডোমেনিকোকে নিয়ে কনভেন্টে গেছেন ওষুধ আর ব্যান্ডেজের পড আনতে।
আহা, কী দুর্ভাগ্য! বলে এগিয়ে এল মেয়েটি। কি করে আহত হলো লোকটা?
তা তো জানি না, ম্যাডোনা। এর বন্ধু ওষুধ নিয়ে ফিরে আসার আগে আমাদের কি কিছুই করার নেই? বলতে বলতে ফ্র্যাঞ্চেস্কোর মাথার কাছে বসে পড়ল মেয়েটি। পেপ্পিনো, তুমি এক দৌড়ে ঝর্না থেকে খানিকটা পানি নিয়ে এসো তো।
এদিক ওদিক চেয়ে পানি আনার পাত্র হিসেবে কাউন্টের প্রশস্ত হ্যাটটাই পছন্দ হলো জেসটারের, ছো দিয়ে ওটা তুলে নিয়ে ছুটল সে ঝর্নার দিকে। ফিরে এসে দেখল কাউন্টের মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছে তার কত্রী। এখন হ্যাঁটের পানিতে রুমাল ভিজিয়ে অজ্ঞান লোকটার কপাল ও ভুরু মুছে দিতে শুরু করল।
দেখো, পেপ্পি, রক্তে চুপচুপে হয়ে গেছে ওর জামাটা। এখনও রক্ত পড়ছে। ইশশ, দেখো, ক্ষতটা দেখো! ওদের ফিরতে দেরি হলে ঠিক মরে যাবে লোকটা। অথচ কী কম বয়স, আর কী সুন্দর চেহারা!
নড়ে উঠল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল, তারপর চোখ মেলতেই মিলন হলো চার চোখের। পুরো জ্ঞান ফেরেনি এখনও, অনেকটা ঘোরের মধ্যে বিড় বিড় করে বলল, আশ্চর্য! সৌন্দর্যের দেবি!” কপালে ঠাণ্ডা রুমালের স্পর্শ অনুভব করে অভিভূত কণ্ঠে বলল, মঙ্গলের দেবি!
এসবের কোন জবাব দিল না মেয়েটি, কিন্তু ওর মুখে রক্তিম ছোপ লাগতে দেখে বুঝে ফেলল জেসটার, জবাব পেয়ে গেছেন কাউন্ট অভ অ্যাকুইলা, কথার কোন প্রয়োজন নেই। মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মেয়েটি, কষ্ট হচ্ছে খুব?
কষ্ট? এতক্ষণে পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে আসছে ফ্র্যাঞ্চেস্কোর। বলল, বলেন কি! কষ্ট? মাথা আমার দয়াময়ীর কোলে, স্বর্গের দেবি আমার পরিচর্যা করছেন! না, মাড়োনা, কোন কষ্ট নেই আর, বরং এত আনন্দ আমার জীবনে এই প্রথম।
আরি সব্বোনাশ! পিছন থেকে খোঁচা দিল ভাঁড়, যীশুগো! কথার রাজা দেখছি!
তুমি এখনও আছ, মাস্টার কাফুন? বাস্তবে ফিরে এল কাউন্ট। আর ফ্যানফুল্লা? ফেরেনি ওঃ ও না ফ্রায়ারকে নিয়ে ওষুধ আনতে গেল? কনুইয়ে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
না-না, নড়াচড়া করবেন না এখন, বারণ করল মেয়েটি।
আপনি বলছেন যখন, বেশ, নড়ব না। বলল কাউন্ট, তারপর কিছুক্ষণ মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ নাম জানতে চাইল
আমি ভ্যাজেন্টিনা ডেন্না রোভেয়ার, উরবিনোর ডিউক গুইডোব্যালডোর ভাইঝি।
অ্যাঁ? আমি জেগে আছি, না স্বপ্ন দেখছি? নাকি কল্পনায় চলে গেছি অতীতে-যেখানে একজন আহত নাইটের পরিচর্যা করছেন এক অপরূপ সুন্দরী রাজকন্যা!
আপনি একজন নাইট? মেয়েটির চোখে ফুটে উঠল নিখাদ বিস্ময়। কনভেন্টের শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে মানুষ হয়েছে বটে, কিন্তু দুঃসাহসী যোদ্ধা নাইটদের অসমসাহসিক বীরত্বের নানান কাহিনী কানে এসেছে ওর।
অন্তত আপনার নাইট তো বটেই, ম্যাডোনা। আজ থেকে যে কোন আপদে-বিপদে আমি হাজির থাকব আপনার পাশে, যদি বুঝি আমাকে আপনার প্রয়োজন আছে।
ভ্যালেন্টিনার দুই গালে আবার গোলাপী আভা ফুটল। কিন্তু কেন জানি এমন সরাসরি ভাবে বলা হলেও কথাগুলো খারাপ লাগল না ওর। পরিষ্কার বুঝতে পারল, লোকটার মনের কথা বেরিয়ে আসছে মুখ দিয়ে, এখানে কোন ছল-চাতুরী নেই! পিছনে দাঁড়ানো পেপ্পিনোও টের পেয়েছে, কি যেন একটা ঘটে গেছে লর্ড অভ অ্যাকুইলার হৃদয়ের গভীরে। দুষ্টামির হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে।
আপনার নামটা বলবেন, স্যার নাইট?
এইবার বিপদে পড়ল কাউন্ট। দেখতে পেল, দুই কানে গিয়ে ঠেকেছে পেপ্পিনোর হাসি। বলল, নার নাম ফ্র্যাঞ্চেস্কো। পরমুহূর্তে পরবর্তী প্রশ্নটা ঠেকাবার জন্যে বলল, কিন্তু, ম্যাডোনা, বলুন দেখি, আপনি এই জঙ্গলে একা কি করছেন?
একা নই, বলল ভ্যালেন্টিনা। আমার লোকজন, জঙ্গলের ওইপাশে বিশ্রাম নিচ্ছে। আমি সান্তা সোফিয়ার কনভেন্ট থেকে আমার কাকার প্রাসাদে যাচ্ছি। বিশজন সশস্ত্র সৈন্যসহ মেসার রোমিও গনৎসাগাকে পাঠিয়েছেন তিনি আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। পেপ্পি আর ফ্রা ডোমেনিকোও চলেছেন আমার সঙ্গে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মুখ খুলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
আপনি কি হিজ হাইনেসের ভাইঝিদের মধ্যে ছোটজন?
না, মেসার ফ্রাঞ্চেস্কো, আমিই বড়।
কথাটা শুনে ভুরুজোড়া কুঁচকে গেল কাউন্টের। জানতে চাইল, আচ্ছা, জিয়ান মারিয়ার সঙ্গে বিয়ে দেয়ার জন্যেই কি আপনাকে প্রাসাদে ডেকে নেয়া হচ্ছে?
কথাটা ঠিক ধরতে না পেরে জানতে চাইল মেয়েটা, কি বললেন?
কই, না, কিছু মা, বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল কাউন্ট। এমনি সময়ে জঙ্গলের ভিতর থেকে লোকজনের সাড়া পাওয়া গেল।
ম্যাডোনা ম্যাডোনা ভ্যালেন্টিনা! একটা পুরুষকণ্ঠ ডাকছে।
গলার স্বর লক্ষ করে ঘাড় ফিরাল ওরা দুজনই। চমৎকার, দামী, সোনার কারুকাজ করা, ঝলমলে পোশাক পরা এক সুদর্শন তরুণ আছে এদিকে। গুইডোব্যাল্ডোর ভাইঝিকে অচেনা এক লোকের মাথা কোলে নিয়ে বসে থাকতে দেখে দুহাত শূন্যে তুলে থমকে দাঁড়াল যুবক। দুচোখে ওর অবিশ্বাস। পরমুহর্তে প্রায়-দৌড়ে চলে এল কাছে। ব্যাপারটা কি? কি করছ তুমি এখানে, ম্যাডোনা? আর এই কুৎসিত লোকটাই বা কে?
কুৎসিত? বিস্মিত কণ্ঠে শুধু এইটুকুই উচ্চারণ করতে পারল মেয়েটি।
কে ও? ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে জানতে চাইল যুবক। কি করছ তোমরা? হিজ হাইনেস জানতে পারলে কী জবাব দেব আমি? কে এই লোক, ম্যাডোনা?
নিজেই দেখতে পাচ্ছ, গনৎসাগা, একজন আহত নাইট! তেজের সঙ্গে জবাব দিল মেয়েটি।
নাইট? এই লোকটা? তাজ্জব বনে গেল গনৎসাগা। দেখে তে মনে হচ্ছে কোনও চোর-চোট্টা! অ্যাই, নাম কি তোমার? জিজ্ঞেস করল সে কাউন্টাকে।
ভ্যালেন্টিনার কোল থেকে মাথাটা সরিয়ে নিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে মাথা রাখল হাতের তালুতে। অপর হাতের ইশারায় লোকটাকে আর কাছে আসতে বারণ করল।
ম্যাডোনা, বলল সে, দয়া করে আপনার কাজের ছেলেটাকে একটু দূরে থাকতে বলুন। এখনও মাথাটা ঘুরছে আমার, ওর গায়ে মাখা সুগন্ধী কটু লাগছে।
রেগে গেল গনৎসাগা ওর কথা শুনে। আমি কারও চাকর না, বুন্ধু কোথাকার! বলে হাততালি দিয়ে গলা উঁচু করে হাঁক ছাড়ল, বেলট্রেম! এদিকে এসো তো!
কি করতে চাও? উঠে দাঁড়াল ভ্যালেনটিনা।
বদমাশটাকে বেঁধে নিয়ে যাব উরবিনোয়! সাফ জবাব দিল রোমিও গনৎসাগা।
জনাব, আমাকে বাধতে গেলে আপনার সুন্দর, কোমল হাতগুলো জখম হয়ে যেতে পারে, শান্ত কণ্ঠে বলল কাউন্ট, যেন একটা কথার কথা বলছে।
কী বললি? দুই পা পিছিয়ে গিয়ে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল তরুণ। আমাকে হুমকি দিচ্ছিস! ছোটলোক কোর্থাকার! যতবড় মুখ নয় তত বড় কথা! বেলট্রেম! কি হলো, এত দেরি কিসের?
জঙ্গল থেকে জবাব এল, পরমুহূর্তে জনা ছয়েক সৈন্য সঙ্গে নিয়ে মার্চ করে এগিয়ে এল বেলট্রেম। হুকুম করুন, স্যার, বলল সে তরুণকে। মাটিতে শোয়া কাউন্টকে দেখছে কৌতূহলী চোখে।
এই কুকুরটাকে বেঁধে ফেলো! হুকুম দিল গনৎসাগা। কিন্তু লোকটা একপা এগোতেই বাধা দিল ভ্যালেনটিনা। ধমকে উঠল, খবরদার, ওঁর গায়ে হাত দেবে না! এতক্ষণের কোমল ভাব সম্পূর্ণ দূর হয়ে গেছে। মেয়েটিকে মুহূর্তে রুদ্রমূর্তি ধারণ করতে দেখে চমকে গেল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, হাঁ করে চেয়ে থাকল ওর মুখের দিকে। আমার কাকার নামে আমি হুকুম দিচ্ছি, উনি যেখানে আছেন সেখানেই থাকবেন। এই ভদ্রলোক আহত একজন নাইট আমি তার কিছুটা শুশ্রূষা করেছি, সম্ভবত মেসার গনৎসাগার ক্রোধের কারণ এবং ওঁর বিরুদ্ধে একমাত্র অভিযোগ এটাই।
থমকে দাঁড়িয়ে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে একবার এর একবার ওর মুখের দিকে চাইছে বেলট্রেম।
ম্যাডোনা, অতি বিনয়ের সঙ্গে বলল গনৎসাগা, তোমার মুখের কথাই আমাদের জন্যে আইন। তবে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তোমাকে ভেবে দেখতে অনুরোধ করব, কাজটা করছি আমি হিজ হাইনেসের স্বার্থই। চোর-ডাকাত-গুণ্ডা-বদমাশে ভরে গেছে এ-রাজ্য। এতদিন কনভেন্টের নিরাপদ আশ্রয়ে কাটিয়েছ বলে এসব কথা হয়তো তোমার কানে পৌঁছায়নি, তাছাড়া ওখানে অসৎ লোক চেনার শিক্ষাও তোমাকে দেয়া হয়নি, তাই ভাল-মন্দের তফাত বুঝতে পারছ না। বেলট্রেম, যা বলেছি করো।
অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে পা ঠুকল ভ্যালেন্টিনা মাটিতে, ক্রোধ এসে ভর করেছে দুই চোখে, দেখতে অনেকটা তার দুঃসাহসী যোদ্ধা কাকার মতই লাগছে এখন। কিন্তু সে মুখ খোলার আগেই কথা বলে উঠল পেপ্পি।
শোনো, বেলট্রেম, মেসার গনৎসাগার ভাল-মন্দ বোঝার ক্ষমতা কতটুকু হয়েছে জানি না, তবে আমার একটা ভবিষ্যদ্বাণী শুনে রাখো-ওঁর কথায় যদি এই ভদ্রলোককে বন্দী করো, অচিরেই বন্দী হবে তুমি নিজেই।
ঘোড়ার চাবুক তুলে জেসটারকে মারতে গেল গনৎসাগা, কিন্তু লাফিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেল সে। ইতোমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে কাউন্ট। হাসিমুখে চেয়ে দেখছে কে কি বলে বা করে, যেন তার সঙ্গে এসবের কোন সম্পর্ক নেই। এগোবে কি না ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না বেলট্রেম, গনৎসাগাও কাউন্টের শরীরের কাঠামো ও উচ্চতা দেখে কেমন যেন ঘাবড়ে মত গেছে। ঠিক এমনি সময়ে ওষুধ নিয়ে ফিরে এল ফ্রা ডোমেনিকো ও ফ্যানফুল্লা।
ঠিক সময়েই এসেছ, ফ্যানফুল্লা, বলল কাউন্ট। এই সুদর্শন, তরুণ ভদ্রলোক আমাকে বাঁধতে চায়।
অ্যাঁ? আপনাকে বাধতে চায়! মুহূর্তে অগ্নিমূর্তি ধারণ করল ফ্যানফুল্লা। গনৎসাগার দিকে ফিরে চিবিয়ে উচ্চারণ করল, কোন অপরাধে, জানতে পারি?
ফ্যানফুল্লার ঝলমলে, অভিজাত পোশাকের জাঁকজমক দেখে অভিভূত হয়ে পড়ল গনৎসাগা, মহূর্তে বিগলিত হয়ে উঠল বিনয়ে।
মনে হচ্ছে, এর সম্পর্কে ভুল ধারণা করেছিলাম আমি, স্যার। এর পদমর্যাদা বিচার…
বিচার! খেপে উঠল ফ্যানফুল্লা। আপনাকে কে বিচার করতে বলেছে শুনি? দুধের দাঁত পড়েনি এখনও, নাবালক, আপনি এসেছেন একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোককে বিচার করতে! যান, বড়দের ব্যাপারে আর কখনও নাক গলাবেন না, তাহলে কোনও একদিন যে সাবালক হয়ে উঠবেন, সে সুযোগ পাবেন না।
হাসি ফুটল ভ্যালেনটিনার মুখে। কথা শুনে হো-হো করে হেসে উঠল পেপ্পিনো। বেলট্রেম ও তার সঙ্গীরাও মুচকি হেসে পিছন ফিরল।
শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে রোমিও গনৎসাগার মুখটা, তারই ফাঁকে নিজের মান বাঁচাবার যথাসাধ্য চেষ্টা করল সে। ম্যাডোনা উপস্থিত, তাই নিজেকে সামলে রাখতে বাধ্য হলাম, স্যার! বলল সে ফ্যানফুল্লার উদ্দেশে, আবার যদি কখনও দেখা হয় তাহলে টের পাবেন সাবালক কাকে বলে।
হয়তো-যদি ততদিনে ওটা অর্জন করতে পারেন, বলেই পিছন ফিরে কাউন্টের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল ফ্যানফুল্লা।
গনৎসাগাকে এই বেকায়দা অবস্থা থেকে উদ্ধার করবার জন্যে সবাইকে যাত্রার প্রস্তুতি নিতে ও গাড়িঘোড়া তৈরি রাখতে বলার জন্য পাঠাল ওকে ভ্যালেনটিনা। ফ্রা ডোমেনিকোর কাজ শেষ হলেই রওনা হয়ে যাবে ওরা।
মাথা নুইয়ে সম্মান দেখাল তরুণ। {লেনটিনাকে, বিদ্বেষ ভরা দৃষ্টিতে একবার চাইল অচেনা লোকদুটের দকে, তারপর ক্রুদ্ধ কণ্ঠে হুকুম দিল বেলট্রেমকে, চলো আমার সঙ্গে।
যতক্ষণ ক্ষতটা বাধা না হলে পেপ্ন তার ফ্যানফুল্লার সঙ্গে থাকল ভ্যালেনটিনা, তারপর নবাগতদের হাতেই রেখে রওনা হয়ে গেল। বিদায়ের আগে অকুষ্ঠ ব্যবাদ জানাল কাউন্ট, সামনে এক হাঁটু ভাঁজ করে বসে ভ্যালেনটিনার ফর্সা আঙুলে চুমো খেল।
লোকজনের উপস্থিতিতে অনেক কথাই বলা হলো না কাউন্টের, কিন্তু তারপরও বেশ কিছু কথা পড়ে নিয়েছে ভ্যালেনটিনা ওর চোখের মুগ্ধ দৃষ্টিতে। সারাটা পথ চুপচাপ কি যেন ভাবল সে, ঠোঁটের কোণে মাঝে মাঝে ফুটে উঠছে দুর্বোধ্য একটুকরো হাসি। বারবার মনের চোখে ভেসে উঠছে সুপুরুষ নাইটের আকর্ষণীয় চেহারাটা।
.
০৫.
গুইডোব্যাল্ডোর ভাইঝির সঙ্গে সাক্ষাতের পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। কাঁধের, ক্ষতটা প্রায় সেরে যাওয়ায়, সেদিনের মীটিঙে দেয়া কথাটা রাখতে এক সকালে ব্যাব্বিয়ানো শহরের প্রবেশ পথের বিশাল তোরণ দিয়ে ঢুকল কাউন্ট অভ অ্যাকুইলা। গেটের ক্যাপটেন অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে অভিবাদন করল তাকে। কিন্তু কাউন্ট সেটা দেখতেই পেল না, কারণ তার দৃষ্টি তোরণের শীর্ষে বর্শায় গাথা চারটি মানুষের মাথার উপর নিবদ্ধ। অনেকগুলো কাক উড়ছে চারপাশে, কা-কা করছে।
একটু কাছে আসতেই ওদের চিনতে পারল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। ভয়ঙ্কর ভঙ্গিতে হাসছৈ মুণ্ডুগুলো, লম্বা চুল উড়ছে, এপ্রিল-বাতাসে। বীর ফেরাব্রাচ্চিও আর অ্যামেরিনো অ্যামেরিনির পাশেই রয়েছে সেদিন বাকি যে দুজন বন্দী হয়েছিল তাদের কাটামাথা।
বোঝা গেল সেদিনের গোপন মীটিং শেষ পর্যন্ত কি পরিণতি পেয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যে ইচ্ছে হলো ফিরে যায়। মনে হলো একা এই বাঘের খাঁচায় প্রবেশ করা ঠিক হচ্ছে না। জিয়ান মারিও কতটা কি জানতে পেরেছে কে জানে! ও কি জানে, রাজ্যটা কাউন্ট অভ অ্যাকুইলার হাতে তুলে দেয়ার উদ্দেশ্যেই ডাকা হয়েছিল সেদিনের মীটিং? যা হয় হবে, এমনি একটা বেপরোয়া ভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে গেল সে।
জিয়ান মারিয়ার অভ্যর্থনার নমুনা দেখে আশ্বস্ত হলো কাউন্ট। লালগালিচা অভ্যর্থনা দিল ওকে হিজ হাইনেস। ওর বিচার-বিবেচনার উপর বরাবর আস্থা রাখে জিয়ান মারিয়া, মনে হলো এই মুহূর্তে ওর পরামর্শের প্রয়োজন অনুভব করছে সে।
লাল চামড়ামোড়া মস্ত এক চেয়ারে বসে রয়েছে জিয়ান মারিয়া। বয়সের তুলনায় অনেক বেশি মোটা হয়ে গেছে সে। মুখটা গোল, ফ্যাকাসে, ঠোঁটের কোণে নিষ্ঠুরতা-যত দামী পোশাকই পরুক না কেন, এক নজরেই বোঝা যায়, মানুষটা সে দুষ্ট, নীচ এবং অকাট মূর্খ।
দুজন পরিচারককে কাউন্টের জন্য শীঘ্রি খাবার নিয়ে আসার জন্যে হুকুম দিল সে প্রথমেই। ফ্র্যাঞ্চেস্কো যখন জানাল সে খেয়ে এসেছে, তখন এক কাপ ম্যালভেসিয়া পান করার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করল। সোনার পাত্র থেকে এক কাপ মদ ঢেলে কাউন্টের সামনে রাখা হতেই পরিচারকদের বিদায় দিয়ে আরাম করে বসল ডিউক জিয়ান মারিয়া।
শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর চক্রান্তের কথা তুলল অ্যাকুইলা।
শুনলাম তোমার ডাচিতে কারা ষড়যন্ত্র করায় তুমি নাকি চারজন ভ্রান্ত লোকের মাথা কেটে বর্শায় গেঁথে রেখেছ?
শুনলে! শুনলে মানে? দেখোনি? ছোট হয়ে গেল জিয়ান মারিয়ার চোখ।
হ্যাঁ, দেখলামও। এই লোকগুলোকে আমি অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা করতাম।
অথচ দেখো, নিজ কর্মদোষে কী অবস্থা এখন! কাকে ঠোকরাচ্ছে। শিউরে উঠে বুকে ক্রুশ আঁকল জিয়ান মারিয়া। খাওয়ার টেবিলে মরা মানুষের কথা বলতে নেই, ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
বেশ, তাহলে শুধু ওদের অপরাধের কথা শোনা যাক। প্রসঙ্গ থেকে নড়ল না ফ্র্যাঞ্চেস্কো। কি করেছিল ওরা?
ষড়যন্ত্র করছিল আমার বিরুদ্ধে। টের পেয়ে যায় মানুচ্চিও। ও এসে বলল ছয়জন বিশ্বাসঘাতক একত্র হয়েছে পাহাড়ের ওপর, আরও একজনের নাকি আসার কথা আছে। কিন্তু সে ব্যাটা বোধহয় আর আসেনি। পঞ্চাশজন সৈন্য নিয়ে গেল ও ওদের গ্রেপ্তার করতে। কিন্তু টের পেয়ে উল্টে আক্রমণ করে বসল বদমাশগুলোই। বললে বিশ্বাস করবে না, ভয়ঙ্কর লড়াই করেছে ওই ছয়জন। আমাদের নয়জনকে খুন তো করেইছে, মারাত্মকভাবে জখম করেছে আরও দশ-বারোজনকে। পঞ্চাশজন সুইস সৈন্য পাঠিয়েও ধরা যায়নি ওদের সবকটাকে। দুজন ওদের ঘেরাও ফুড়ে বেরিয়ে গেছে, দুজন মারা পড়েছে আমার সৈন্যদের হাতে, আর বাকি দুজনকে বন্দী করে নিয়ে এসেছিল আমার কাছে-ওই যে, স্যান বাকোলোর গেটের ওপর বিশ্রাম নিচ্ছে ওরা।
একটা জলপাই দুআঙুলে ধরে মুখে পোরার আগে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল এতক্ষণ হিজ হাইনেস, কথা শেষ করেই হাঁ করল। কিন্তু চট করে প্রশ্ন করল ফ্র্যাঞ্চেকো, কারা পালিয়েছে, এটা নিশ্চয়ই বলতে পেরেছে মাসুচ্চিও?।
ভোগী মানুষকে কথা দিয়ে ভুলানো যায় না। জলপাইটা মুখে পুরে আলতো করে কামড় দিল, টক-ঝাল-লবণের স্বাদ নিল, মুখ ভরে গেল রসে। একটা ঢোক গিলে জলপাইটা মুখে রেখেই জবাব দিল, কি করে বলবে? কুত্তাটা নিজেও তো মারা পড়েছে ওই লড়াইয়ে!
কিন্তু এই না বললে দুজন বন্দী হয়েছিল? বিচারের সময় ওরা নিশ্চয়ই…
কিসের বিচার? জলপাইয়ের বিচিটা ফেলে দিল জিয়ান মারিয়া। বিচার-টিচার হয়নি। এতই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম, আর হবোই বা
কেন-ভেবে দেখো, প্রজাদের ভালমন্দ দেখছি, ন্যায় বিচার করছি, দয়া-দাক্ষিণ্যে ভরিয়ে রেখেছি ওদের, সেই আমারই বিরুদ্ধে চক্রান্ত। হ্যাঁ, উত্তেজনার বশে আমার খেয়ালই ছিল না যে এই দুটোকে নির্যাতন করলে বেরিয়ে পড়বে বাকি সবার নাম। ধরে আনার আধঘন্টার মধ্যেই ওদের কল্লা টাঙিয়ে দিয়েছি বর্শার আগায়।
কোনও বিচার ছাড়াই ক্রুদ্ধ বিস্ময়ে আর কোন কথা বেরোল না কাউন্টের মুখ দিয়ে। তারপর নিচু গলায় বলল, মাথা খারাপ তোমার। এত বড় বড় পরিবারের দেশবরেণ্য প্রধানদের বিনা বিচারে খুন করে ফেললে! একবার ভাবলে না প্রজাদের মধ্যে এর কি প্রতিক্রিয়া হবে?
চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে বসে হাঁ করে চেয়ে রইল জিয়ান মারিয়া তার মামাতো ভাইয়ের মুখের দিকে। ভারি স্পর্ধা হয়েছে তো! রাগে লাল হয়ে উঠল হিজ হাইনেসের গোল মুখটা।
কার সঙ্গে কথা বলছ, ফ্র্যাঞ্চেস্কো?
বলছি একজন নিষ্ঠুর, অত্যাচারী ডিউকের সঙ্গে; যে নিজেকে সুবিবেচক, ন্যায়পরায়ণ, প্রজাঅন্তঃপ্রাণ বলে দাবি করে। অথচ যার ঘটে এতটুকু বুদ্ধি নেই যে, এটা স্রেফ হত্যাকাণ্ড; এর ফলে বিশৃঙ্খলা, আর তার থেকে শেষে গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত বেধে যেতে পারে।
রেগে গেছে ডিউক, কিন্তু তার চেয়ে বেশি পেয়েছে ভয়। রাগ চেপে বলল, বিদ্রোহ ঠেকাবার ব্যবস্থা আছে আমার। ম্যাটিনো আর্মস্টাভকে আমি গার্ডদের কমান্ডার বানিয়েছি। ও পাঁচশো নতুন সুইস সৈন্য নিয়োগ করেছে।
ব্যাস, তোমার ধারণা-এতেই নিরাপত্তা এসে গেল? বিদ্রুপের হাসি হাসল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, বিদেশী এক কমান্ডার বিদেশ থেকে সৈন্য ভাড়া করে এনে রক্ষা করবে তোমার সিংহাসন?
ঈশ্বরের কৃপা থাকলে কেন পারবে না?
বাহ! অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল ফ্র্যাঞ্চেঙ্কো, মাথাটা একটু খাটাও, ইয়োর হাইনেস। প্রজাদের মন জয় করবার চেষ্টা করো, সেটাই হবে তোমার সত্যিকার প্রতিরক্ষা।
চুপ, চুপ! ফিসফিস করল জিয়ান মারিয়া। তুমি রাজনিন্দা করছ, ফ্র্যাঞ্চেস্কো। প্রজাদের মঙ্গল চিন্তাই আমার সারাজীবনের একমাত্র চিন্তা, ওদের জন্যেই প্রাণ ধারণ করছি আমি। কিন্তু, ওদের জন্যে আমাকে মরতেও হবে, এতটা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাবে, তারপরও আমার দয়া-দাক্ষিণ্য বিলাতে হবে, এতটা পারব না আমি। ইশশ, পালিয়ে গেল যে দুজন, ওঁদের যদি হাতের মুঠোয় পেতাম! আর ওইটাকে, আমার বদলে যাকে এই সিংহাসনে বসাবার প্ল্যান করেছিল ওরা! কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না, কে হতে পারে লোকটা! তোমার কি মনে হয়, ফ্র্যাঞ্চেনিনা?
আমি কি করে জানব? প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
অনেক জানো তুমি, ভাই। একটু ভেবে দেখো না। এসব ব্যাপারে তোমার মাথা খেলে ভাল। আচ্ছা, ডুকা ভ্যালেনটিনো হতে পারে।
মাথা নাড়ল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
এসব বাজে ছল-চাতুরির ধার ধারে না সীজার বর্জিয়া। ও এলে সামরিক শক্তি নিয়ে আসবে, বাহুবলে ছিনিয়ে নেবে এ-রাজ্য তোমার হাত থেকে।
খোদা রক্ষে করুন!আঁৎকে উঠল ডিউক। এমন ভাবে বলছ, যেন ও রওনা হয়ে গেছে, এগিয়ে আসছে মার্চ করে, পৌঁছতে আর দেরি নেই!
কথাটা এভাবে যদি নাও, আমার মনে হয় না খুব একটা ভুল করবে তুমি। আসলেও খুব একটা দেরি নেই। শোনো, জিয়ান মারিয়া। তোমার সঙ্গে গল্পগুজব করে সময় কাটাতে আসিনি আমি অ্যাকুইলা থেকে। ফ্যাব্রিৎসিও ডা লোডি আর ফ্যানফুল্লা ডেল্লি আরচিপ্রেটির সঙ্গে ওখানে কথা হয়েছে আমার কদিন আগে।
তোমার সঙ্গে কথা হয়েছে সরু হয়ে গেল ডিউকের চোখজোড়া। একদৃষ্টে দেখছে মামাতো ভাইকে। ওরা তোমার ওখানে? দুই হাত শূন্যে তুলল ডিউক। অথচ আমি কি ভেবে বসে আছি! সেই ষড়য়ন্ত্রের পর থেকে ওরা কেউ আসছে না দেখে আমি মনে করেছি ওরাও বুঝি এর সঙ্গে জড়িত।
তোমার রাজ্যে ওদের দুজনের চেয়ে ব্যাব্বিয়ানোর প্রতি বিশ্বস্ত আর অনুরক্ত মানুষ খুঁজে পাবে না তুমি। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবার বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, তোমার বর্তমান বিপদ সম্পর্কে আলোচনা করতেই এসেছিল ওরা আমার কাছে।
তাই নাকি? আগ্রহী হয়ে উঠল জিয়ান মারিয়া। তা কি বলল?
সেদিন সান্ত অ্যাঞ্জেলোতে ভা লোডি ওকে যা যা বলেছিল, প্রায় সবই বলল কাউন্ট। বর্জিয়ার তরফ থেকে আক্রমণের আশঙ্কা, প্রতিরক্ষার প্রস্তুতির অভাব, ওদের পরামর্শ জিয়ান মারিয়ার কানে না তোলা, প্রজাদের অসন্তোষ-এসব সমস্যার প্রতিটি এখুনি জরুরী ভিত্তিতে সমাধান করা দরকার। সব শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে প্লেটের দিকে চেয়ে বসে থাকল ডিউক, তারপর চোখ তুলল।
এটা ভুল, ওটা ঠিক হচ্ছে না, এসব বলা খুবই সহজ, ফ্র্যাঞ্চেস্কো, কিন্তু আমার হয়ে কে এসব ঠিক করবে বলো?
তুমি যদি বলো, আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি।
তুমি? মুহূর্তে কালো হয়ে গেল ডিউকের মুখটা। যে প্রস্তাব পেয়ে খুশি হয়ে ওঠার কথা, সেটা তার কাছে লাগছে বিষের মত দৃষ্টিতে ক্রোধ আর সন্দেহ নিয়ে চাইল সে কাউটের চোখের দিকে। বেশ, মিষ্টি ভাইটি আমার, বলো শুনি কিভাবে তুমি আমার সব সমস্যার সমাধান করে দেবে?
.
প্রথমে ট্যাক্স আরোপের ব্যাপারটা আমি মেসার ডেসপুল্লিওর হাতে ছেড়ে দেব এবং তোমার সমস্ত বেহিসেবি খরচ আগামী কয়েক মাসের জন্যে বন্ধ করে দিয়ে টাকাটা আমি এ-দেশী লোকদের নিয়ে একটা সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলার কাজে লাগাব। তোমার সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফ হিসেবে আমি প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর সঙ্গে তোমার হয়ে মৈত্রি-বন্ধনে আবদ্ধ হব। আমাদের শক্তি দেখলে ওরা নিজেদের স্বার্থেই এগিয়ে আসবে বন্ধুত্ব করতে। তখন যে-কোন রাজ্য একশো এক বার চিন্তা করবে আমাদের বিরুদ্ধে জোর খাটাবার আগে। আমার ওপর যদি দায়িত্ব দাও, একমাসের মধ্যেই আমি তোমাকে জানাতে পারব তোমার ডাচি রক্ষা করতে পারব কি পারব না।
ফ্র্যাথেস্কোর বক্তব্য শুনতে শুনতে চোখদুটো সরু হয়ে গেল জিয়ান মারিয়ার। অশুভ, নীচ সন্দেহ প্রকাশ পাচ্ছে ওর দৃষ্টিতে। কাউন্ট থামতে টিটকারীর তিক্ত হাসি হাসল সে।
তোমার ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেব ব্যাব্বিয়ানোকে রিপাবলিক বানাতে চাও নাকি? যাতে ওর চীফ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পার?
আমাকে যদি তুমি ভুল বোঝো…
তোমাকে ভুল বুঝব? না, না, মেসার ফ্র্যাঞ্চেনিনা, বরং স্পষ্ট, পরিস্কার বুঝতে পারছি তোমার উদ্দেশ্য খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ডিউক। গুজব আমার কানেও এসেছে। আমার প্রজারা নাকি আমার চেয়ে আমার ভাই অ্যাকুইলার কাউন্টের ওপর আজকাল প্রসা রাখছে বেশি। মানুচ্চিও আমাকে সাবধান করেছিল, আমি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম ওর কথা। কিন্তু এখন অনেক কিছুই যেন বুঝতে পারছি, হে। তোমার বংশমর্যাদা আমার চেয়ে কোনও দিক দিয়েই কম নয়, কাজেই তোমার হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে আমি রাজ্য হারাতে রাজি নই। তোমার চোখটা কোথায়, টের পেতে আর বাকি নেই আমার, ফ্র্যাঞ্চেনিনা। আমাকে মূর্খ রা নির্বোধ মনে করার কোনই কারণ নেই, প্রিয় ভাইটি আমার, তোমার মতলব পূরণ হবে না।
নীরব ভত্সনা ঝরল কাউন্টের দৃষ্টিতে। ও বলতে পারত, ওর যদি সেই মতলবই থাকত, তাহলে জিয়ান মারিয়ার সেটা ঠেকানোর সাধ্য ছিল না, এতদিনে বেদখল হয়ে যেত ব্যাব্বিয়ানোর সিংহাসন। কিংবা হয়তো চ্যালেঞ্জ দিতে পারত। কিন্তু শান্ত ভাবে শুধু বলল, বুঝলাম, আমাকে আজও চিনতে পারনি, জিয়ান মারিয়া। তোমার ভয়, তোমার এই অন্তসারশূন্য, ফাঁপা জাঁকজমকের মোহে পড়ে আমি এখন এই রাজ্যের জন্যে লালায়িত হয়ে উঠেছি। আমি বহুবার বলেছি তোমাকে, রাজত্বের বাঁধন আমি কোনদিন চাইনি, এখনও চাই না। স্বাধীন, মুক্ত, খোলামাঠের জীবন আমার অনেক-অনেক বেশি প্রিয়। যাক, অযথা এসব বলা। তবে শীঘ্রি যখন ক্ষমতা, মুকুট, সম্মান সব হারাবে, বর্জিয়ার পদানত হবে প্রিয় ব্যাব্বিয়ানো সেদিন একটু স্মরণ কোরো, আমি তোমাকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম, উদ্ধার করতে চেয়েছিলাম আসন্ন বিপদ থেকে-বিনিময়ে নোংরা সন্দেহ প্রকাশ করে অপমান করেছ তুমি আমাকে। শুধু আমাকেই নয়, বর্ষীয়ান উপদেষ্টাদের পরামর্শ পায়ে দলে তাদেরও অপমান করেছ।
ভারি কাঁধ ঝাঁকাল জিয়ান মারিয়া।
তবে একটা কথা জেনে তোমার দেশপ্রেমিক অন্তরটা হয়তো একটু শান্তি পাবে, ফ্রাঞ্চেকো, বলল সে, সম্প্রতি তাদের একটা পরামর্শ আমি গ্রহণ করেছি। গুইডোব্যান্ডের সঙ্গে মৈত্রী করব বলে স্থির করেছি আমি, ওর ভাইঝিকে বিয়ে করছি। খিকখিক করে হাসল জিয়ান মারিয়া। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, পোপ আলেকজান্ডারের দুর্ধর্ষ পুত্রকে কেন ভয় করার দরকার নেই আর আমার উরবিনো আর তার মিত্রদের সহায়তা পেলে সীজার বর্জিয়াকে ঘোড়াই পরোয়া করব আমি সুন্দরী বউ নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাব আমি রাতে, কারণ নিরাপত্তার নিয়তা দেবে আমার কাকাওর। কাজেই, দুঃসাহসী ভাইটি আমার, তোমার হাতে সেনাবাহিনীর ভার ছেড়ে দেয়ার কোন দরকারই পড়বে না।
বিয়ের কথা শুনে কাউন্ট অভ অ্যাকুইলার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তাই দেখে জিয়ান মারিয়া ভাবল, ঠিকই সন্দেহ করেছিল, মতুলব হাসিল করতে না পেরে কাহিল বোধ করছে ফ্র্যাঞ্চেস্কো।
বেশ তো, স্নান কণ্ঠে বলল কাউন্ট। আমার অভিনন্দন। বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিয়েছ তুমি। খবরটা যদি জানতাম, তাহলে আর কষ্ট করে এখানে এসে নিরাপত্তার প্রসঙ্গ তুলতাম না। তবে একটা প্রশ্ন, জিয়ান মারিয়া, এতদিন কারও কথা কানে তুললে না, হঠাৎ মত পরিবর্তন করে রাজি হয়ে গেলে কি মনে করে?
আর বোলো না। এতদিন কানের কাছে ভ্যানর ভ্যানর, করেছে লোডিরা, পাত্তা দিইনি। তারপর দেখি আমার মার মুখেও ওই একই গায়েন। শেষ পর্যন্ত রাজি না হয়ে উপায় থাকল না। মানুষকে তো বিয়ে একসময় করতেই হয়, ভাবলাম, ঠিক আছে, চোখ, কান বুজে করেই ফেলি, চুকে যাক ল্যাঠা। রাজনৈতিক বিবাহ আর কি, বুঝলে না, দেশের শান্তি আর নিরাপত্তার খাতিরে।
আমার তো খুশি হওয়া উচিত, ভাবছে ফ্র্যাঞ্চেস্কো ওর জন্যে নির্ধারিত ঘরে ফিরে। ব্যাব্বিয়ানোর নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে চলেছে, মোন্না ভ্যালেনটিনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে জিয়ান মারিয়া, এ তো খুবই খুশির খবর। কিন্তু মনটা এমন খিঁচড়ে গেল কেন? এত ভাল একটা মেয়ে জিয়ান মারিয়ার মত নীচ এক লম্পটের হাতে পড়বে বলে? তাতে আমার দুঃখ পাওয়ার কি আছে?
উত্তর পেল না ফ্র্যাঞ্চেস্কো। শুধু টের পেল, ফুফাত ভাইয়ের প্রতি ঘৃণায় মনটা বিষিয়ে উঠছে। কেন যেন জ্বলছে বুকের ভিতরটা।