৫. আমি

আমি

দু-খণ্ডে বিভক্ত সেকেলে মস্ত বাড়ি। দেখতে আশেপাশের আর-পাঁচটা বাড়ির মতোই বৈশিষ্ট্যহীন। ছোটো-ছোটো ঘর। সংখ্যায় অনেক। অবিরাম লোক-জনের চলাচল। সিঁড়িতে, বারান্দায়, উঠোনে, কলতলায়-যেখানে যাই-না কেন-একটা ধাক্কাধাক্কি লাগে আর-কী! এই ভিড়-ভাড়াক্কার মধ্যে আমি প্রায়ই হারিয়ে যাই। আমি আছি কি নেই, সে-কথাও অনেকে ভুলে যায়। ভোর হতে-না-হতে গোটা বাড়িটা একটা অসাধারণ কর্মচাঞ্চল্যে জেগে ওঠে। নানরকম আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে যায়। ইচ্ছে থাকলেও বেশিক্ষণ গড়াগড়ি দেবার উপায় নেই। প্রায় কাক ডাকার সঙ্গে-সঙ্গেই, বিছানা তোলার পাট থেকে নিয়ে, ঘর-ঝাঁট দেওয়া, মোছামুছি শুরু হয়ে যায়। উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়াই। নিচে কলতলায় গুচ্ছের বাসনকোসন ছড়ানো– গণ্ডায়-গণ্ডায় থালা-ঘটি-বাটি-গেলাস, কড়াই, হাতা, গামলা, ডেক্‌চি-আরো যে সংসারের কত টুকিটাকি তার ইয়ত্তা নেই। গোপাল সেগুলো মাজতে বসেছে। এঁটোকাঁটার মধ্যে দেখি রুইমাছের মস্ত একটা শিরদাঁড়ার কাঁটা। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে সেটি অবিকল একটা হাতির দাঁতের চিরুনির মতো দেখায়। এক পা-দু-পা ক’রে নিচে নেমে আসি।

কলতলার পাশেই খাবার ঘর। সেখানে এক কোণে, বাড়ির মেয়েরা কেউ কাপড় কাঁচে, কেউ-বা গায়ে জল ঢালে। আমার সামনে তাদের কোনো আব্রু নেই। সকালবেলার মোলায়েম আলো তাদের ভেজা বক্ষস্থলে নেচে-নেচে বেড়ায়। রান্নাঘরের দিকে এগুতেই দেখি বড়োবৌদি একটা কুলোয় চাল ঝাড়তে বসেছেন। নিখুঁত লয়, ছন্দ আর ধ্বনিতে, তাঁর হাতে এই কাজটি, বিশেষ ধরনের নৃত্যসংগীতের মতো শোনায় ।

আমার দিকে পেছন ফিরে কে-একজন মশলা বাটছেন। মা, মাথা নিচু করে জাঁতিকাটা সুপুরির মতো, সুক্ষ্ম আলুর কাঠি কাটছেন। তাঁর কি আমার দিকে তাকাবার সময় আছে? তিনি তো দিনরাত সংসারের কাজেই ডুবে আছেন! সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি তিনি কাছে নেই। রাতে যখন শুতে যাই তখনো তিনি কাছে নেই। একদিকে এই বিরাট সংসারের দায়িত্ব, আরেকদিক কর্তার সেবা-কোনদিক তিনি সামলাবেন!

আলোবাতাসের অভাবে আমাদের বাড়ির নিচতলাটা বিশ্রী অন্ধকার হয়ে থাকে। শীতে, গ্রীষ্মে, সর্বদাই একটা সোঁদা গন্ধে ভরা। তারই সঙ্গে রান্নাঘরের ধোঁয়া এবং নানারকম ভাজা-মশলার গন্ধ মিশে মাঝে-মাঝে নিশ্বাস নেয়া দায় হয়ে পড়ে। বর্ষাকালের ভিজে হাওয়ার দরুন ঘরের দেয়ালগুলোর ওপর নানারকম আবছা ছবি ফুটে ওঠে। কখনো অপরিচিত অনেক মুখাবয়ব, কিংবা ভয়ংকর সব অবাস্তব জন্তু-জানোয়ার, কিংবা পেঁজা তুলোর মতো শরতের মেঘমালা। কখনো-বা রাজপুত্তুর ঘোড়ায় চ’ড়ে, তলোয়ার উঁচিয়ে চ’লে যায় ধুলোর মেঘ ওড়াতে-ওড়াতে। তারই ভেতর দিয়ে, সীমান্তে পাহাড়ের চূড়ায়, নামহীন কেল্লার অস্পষ্ট রেখা উঁকিঝুঁকি মারে। সেই দুরন্ত ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ আমি স্পষ্ট শুনতে পাই। প্রতি বছর দেয়ালির আগে, কিংবা পরে, রাজমিস্ত্রীদের মোটা-মোটা চুনে-ডোবা তুলির পোঁচে এ-ছবিগুলো ঢাকা পড়ে যায়। আষাঢ়-শ্রাবণে কোন্-এক অদৃশ্য চিত্রকর এসে আবার নতুন সব ছবি আঁকে। ছুটির দিনের অলস দুপুরে নানা আজব ছবি আমার চোখে ধরা দেয়। রহস্যময় ঘোমটা-দেয়া এই জগৎটা আমাকে এক রূপকথার রাজ্যের জানান দেয়। আমার কল্পনা, পায়রার ডানা পেয়ে শাঁই-শাঁই ক’রে আকাশের দিকে ছুটে যায়। উত্তেজনা ও গর্বে আমার বুকের ছাতি ফুলে ওঠে; পরদিন সেগুলো আর খুঁজে পাব না, এই আশঙ্কায়, পোড়া কাঠকয়লা কিংবা পেন্সিল দিয়ে তার বহিঃরেখা স্পষ্ট ক’রে এঁকে দিই। কী চমৎকারই-না কাটে অফুরন্ত অবসরের এই দুপুরগুলো।

আমার বয়েস এখন আট কিংবা নয়। নিজের এবং বৈমাত্র ভাইবোনদের উপস্থিতি ছাড়া, আত্মীয়-স্বজনের অনবরত আসা-যাওয়া এবং বিয়ে-থা লেগেই আছে। এ-রকম সময়ে, আমাদের বাড়িটা, অবিকল আজকালকার ভাড়াটে বিয়েবাড়ির রূপ নেয়। স্বাভাবিক সময়েও দু-বেলা প্রায় ষাট-সত্তর জন লোকের পাত্ পড়ে। দুপুরে কিংবা রাত্তিরে, নিচে নামতেই দেখি, অন্ধকার খাবার ঘর ছাড়াও, আশেপাশে, সর্বত্র সারি-সারি কাঁসার থালা, জলে-ভরা গেলাসের ওপর ভর করে আছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, ঘন সবুজ পুকুরের জলে, সোনালী পদ্ম-পাতা চিক্‌চিক্ করছে। এ-দৃশ্যটি আমার চোখে এতই ভালো লাগে যে, যতক্ষণ- না খাবার ডাক পড়ে, ততক্ষণ এ-জায়গাটিতে ঘুর-ঘুর করি। একদল পুরুষের খাওয়া শেষ না- হতেই, চট্‌পট্ থালা-গেলাস মেজে নিয়ে, আরেকদলের পাত্ পড়ে। ঠিক যেন স্টীমারঘাটের একটি হোটেল।

এইমাত্র অক্রূর বাজার করে ফিরেছে। প্রতিদিনের মতো মেয়েরা বাজার দেখার উদ্দেশ্যে ছুটে এল। তার থলিতে নানারকম তরিতরকারি। হুবহু মুগুরের মতো দেখতে একটি আস্ত লাউ। পুঁইশাকের আঁটিটা সাপের মতো কুণ্ডুলি পাকিয়ে আছে। দুটো মোচা আরো কত-কী। ঘন তামার রঙের মোচার গায়ে মাখনী রঙের ফুলগুলো মেয়েদের খোঁপায় কনকচাঁপার মতো দেখায়। এক আঁটি কচু-শাকের পাশে, অর্ধবৃত্তাকারে চালকুমড়োর ফালিটা যেন শুক্লপক্ষের একাদশীর চাঁদ। আর ঐ-যে থোড়ের টুকরোটা! অচেতন অবস্থায় অনেকেই তো সেটিকে হাতির দাঁত ব’লে ভুল করতে পারে। মেয়েরা অধৈর্য হয়ে বলে, মাছ কই, মাছ কই? অক্রূর কিছু না-বলে মশলাপাতি, এবং আরো টুকিটাকি বের করে। মুখে দুষ্টুমি-ভরা হাসি।

সবশেষে তার থলি থেকে বেরুলো একজোড়া ধলেশ্বরীর ইলিশ। রুপোলী মাছদুটি মেঝেতে রাখতেই আমার দিদি এবং ভাইঝিদের মধ্যে, মাছকাটা নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি লেগে যায়। তাঁদের মধ্যে এই ছুতোনাতা নিয়ে অনবরত রেষারেষি লেগেই থাকে। মজার ব্যাপার এই যে, যেদিন অক্রূর সরপুঁটি, ফলি, ট্যাংরা কিংবা মৌরলা আনে, সেদিন এই কুমারীদের হাজার ডাকাডাকি ক’রেও, সাড়া পাওয়া দায়।

এখন বেলা প্রায় নটা। একটা ঘোড়ার গাড়ি আমাদের বৈঠকখানার সুমুখে অনেকক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছে। বাবা যথারীতি রোগীবাড়ি ভিজিটে যাবার উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছেন। আমি এবং আমার অগ্রজ মেঝেতে পড়তে বসেছি। আতরে-ভেজা তুলো কানে গুঁজতে-গুঁজতে তিনি আমাদের বলেন, চট্‌পট্ জামাকাপড় প’রে নাও। আমার সঙ্গে যাবে।’ এই ব’লে তিনি বৈঠক-খানার দিকে নেমে যান। আমাদের প্রতি তাঁর এই পিতৃসুলভ স্নেহের প্রকাশ মাসে দু-মাসে একবার দেখা যায়। তাড়াতাড়ি পার্ট-করা হাফ্ প্যান্ট সার্ট আর জুতো-মোজা পরে নিই। এমন দিনে আনন্দে, পুলকে, এক অনিশ্চয়তার রহস্যে আমার মন নেচে ওঠে। বাড়িতে খেলার সাথীর অভাব না-হ’লেও অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে বাড়ির এবং ছোটো পাঠশালার দেয়ালের সীমায় বদ্ধ, এই ক্ষুদ্র জগৎ থেকে সাময়িক মুক্তি পাবার উত্তেজনায় আমার হৃদয় ছট্‌ফট্ করতে থাকে। এই উত্তেজনায় এবং সর্বগ্রাসী এক কৌতূহলের মিশ্রণে, ঘোড়ার গাড়ির, একবার এদিকের আরেকবার ওদিকের জানালায় মুখ বাড়িয়ে কত-কী যে দেখি!

গাড়ি-ঘোড়া এবং লোকজনের বেজায় ভিড়। তারই মধ্যে থেকে কে-একজন বাবাকে সেলাম করে। নানারকম আওয়াজ, হাজার রকম নক্সাকাটা ঘুড়ির দোকান। হাতে-বোনা লুঙ্গি-শাড়ির দোকান। এই দোকানগুলোতে যেন রঙের হাট লেগেছে। যেন কোনো ওস্তাদ শিল্পী কখনো সরু কখনো মোটা তুলি, সারি-সারি রঙের বালতিতে ডুবিয়ে, তাঁর সব নিষিদ্ধ প্রবৃত্তির বাঁধ ভেঙে, রঙের পোঁচ মেরেছেন। তারপর তেলেভাজা বেগুনি পেঁয়াজি, বাখরখানি, পরোটার গন্ধের সঙ্গে মোগলাই রান্নার জাফরানী সুগন্ধ নাকে যেতেই জিভে জল আসে। খাবার ভঙ্গিতে আমার চোয়াল অজান্তে নড়তে থাকে।

জাপানী খেলনা আর নানা রঙের বেলুন-বলের দোকান। কাবুল থেকে আমদানী করা বেদানা আর আঙুরের দোকান। সূক্ষ্ম-সুগন্ধি আতরের দোকান। নৌকাঘাট থেকে দৌড়ে-আসা কুলিদের মাথায় নানা সাইজের, নানা রঙের আমের ঝুড়ি। সোনারুপোর গয়নাগাটির দোকান। আর ঐ-যে, নবাববাড়ির ফটকের একটু পরেই যাত্রা-থিয়েটারের পোশাকের দোকান! সেখানে কী যে নেই! রাজা-রাজড়া, নবাব- বাদশাহের-মখমলের জোব্বা। সোনারুপোর জরির নক্সায় সেগুলো কী জম্‌কালোই- না দেখায়। তাদের মধ্যে একটি কালো রঙের জোব্বা যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। সেটি কি শাহজাহানের? ঢাল-তলোয়ার, তীর-ধনুক, নানারকমের টুপি, পাগড়ি, মুকুট, চামর, বিশ্বামিত্রের দাড়ি আর উষ্ণীষ-না কি নারদের? পর-পর সাজানো । এত বড়ো গোঁফজোড়াই বা কার? ভীম না কুম্ভকর্ণের? পাশেই যে শ্মশানকালীর মতো এলোচুল। এটি তো সূর্পণখার মাথায়ই শোভা পায়। তারপরই বাদামী রঙের শিবের জটা, বাঘের ছাল, আর ত্রিশূল! এটাই কি তাঁর তাণ্ডব নৃত্যের বেশ? নিচের সারিতে মেয়েদের নানারকম জামাকাপড়। এমন-কি কোনো কৃশতনু যুবতীর বক্ষস্থল।

রাবণের দশানন দেখে বুকের ভেতরটা বেশ-একটু ঢিঢিপ্‌ ক’রে ওঠে। কী ভয়ংকর তার রুদ্র মূর্তি। পুলোমা, তাড়কা, বকাসুরের মুখোশগুলো চোখে পড়তেই আমি চোখ বুজে ফেলি, যদি ঘুমের ঘোরে তারা আবার দেখা দেয়! এ- দোকানগুলোতে লোকজনের কী ভিড়!

আরেকটু এগুতেই কালাচাঁদ সাহার বিখ্যাত মেঠাই-মণ্ডার দোকান। তাছাড়া, কালীমন্দির, গির্জে, মসজিদ-এ-সবের ছবি বয়োস্কোপের মতো, একের পর এক, চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যায়। মাঝে-মাঝে দ্রুত বিলীয়মান দৃশ্য-গুলো অস্পষ্ট হয়ে যায় দেখে মনে হয় বাড়ি থেকে কত দূরে চলে এসেছি।

দু-তিনটি রোগীবাড়ি ভিজিটের পর বাবা কোচোয়ানকে নবাববাড়ির দিকে গাড়ি ঘোরাতে বলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা এই বাড়ির বিশাল ফটকটি পার হই। বিস্তৃ ত সবুজ মাঠের এক প্রান্তে, পোড়ামাটি রঙের ছোটো ছোটো মিনার-গম্বুজওয়ালা একটি অট্রালিকা। তার ওপাশেই, নিচে, বুড়িগঙ্গা নদী চিক্‌চিক্ করে। পাট-চূন- মালবাহী পালতোলা নৌকো জাহাজের মতো ঢেউ তুলে উজানে এগিয়ে যায়। স্বচ্ছ নীল আকাশের তলায় এ-দৃশ্যটি, সূক্ষ্ম তুলিতে আঁকা একটি কিষানগড় ঘরানার ছবির মতো লাগে।

সেখানে পৌঁছতেই দেখি চারদিকে নোকর-চাকর, বন্ধুকধারী সেপাই-সামন্ত, ঘোড়ার আস্তাবল, ত্রেপলের হুড়-দেয়া ফোর্ড গাড়ি, আরো কত লোকজন। তাদের মধ্যে একজন আমাদের দোতলায় অন্দরমহলে নিয়ে আসে। মন্ত-মস্ত খিলান-থাম– ওয়ালা ঘর, নানারকম ফুল-লতা-পাতার নক্সায় ঘেরা। দরজার ওপর রেশমী পাড়- দেয়া খুব সরু চিকের পর্দা। তার ভেতর দিয়ে আবছা লোকজনের চলাচল অত্যন্ত রহস্যময় দেখায়। নোকারানি আদাব জানিয়ে চিক্ তুলে ধরতেই, থিয়েটারের মতো, অসাধারণ জাঁকালো এক দৃশ্য উদ্ঘাটিত হ’ল। দৃশ্যটি আমার কল্পনালোকের বিলাসময় নবাবী জগতের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।

রুহিতনের আকারের, রঙবেরঙের, কাঁচ-বসানো দরজা আর জানালা। তার ভেতর দিয়ে রামধনুর মোলায়েম আলোয় সমস্ত ঘরটি উদ্‌ভাসিত। সেই রঙে রঞ্জিত মস্ত ঝাড়লণ্ঠনটির স্ফটিকগুলো নানাবর্ণের তারার মতো ঝিকমিক করে। পায়ের তলায় জটিল নক্সাকাটা, মখমলের মতো নরম গালিচা। দুধের রঙের দেয়াল, উঁচু- নিচু সোনার লতাপাতায় অলংকৃত। গিলটি-করা মস্ত খাট, যেন চারটি ফুলদানির ওপর ভর ক’রে আছে। খাটের ওপর হাল্কা গোলাপী রঙের, মসলিনের মতো ফিফিনে, ভাঁজ-করা মশারি, একটি চাঁদোয়ার মতো ঝুলছে। ডানদিকে মোষকালো গোল মার্বেলের টেবিল। তার ওপর সূক্ষ্ম খোদাই করা রুপোর গড়গড়া। তারই পাশে আরেকটি টেবিলে পানদান, রুপোর গেলাস, আতরদান আর চমৎকার একটি তামা এবং পেতলের হাত-ওয়ালা গাড়ু। তার গায়ে কী উৎকৃষ্ট মানেরই-না কারিগরি! গাড়ু র সংলগ্ন একটি শ্বেতপাথরের বাটি। তাতে কয়েকটি পোলাপের পাপড়ি ভাসছে। সাদার ওপর সাদার কী বাহার! খাটের তলায় মস্ত পিক্‌দান এবং জরির কাজ-করা চটি। আমার দৃষ্টি ঘরের কোণে যেতেই সেঁটে গেল। দেখি সেখানে নানা রঙের মাঞ্জায় ভরা লক্ষ্ণোই লাটাই আর চীনে কাগজের ঘুড়ি। সেগুলো ছোঁয়ার এবং পাবার লোভে আমার মন অশান্ত হয়ে ওঠে, হাত নিশপিশ করে। ঘুড়ি ওড়ানোয় নবাব- সাহেবের নেশা এবং ওস্তাদির কথা ঢাকা শহরে কে-না জানে।

অর্ধশায়িত অবস্থায় নবাব মখমলে মোড়া, বিশাল তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে আছেন। নবাব-বাদশাহদেরই এমন চেহারা হয় বটে। বেদানার মতো গোলাপী গায়ের রঙ নীল টানা চোখ আর কটা চুল। হাতে আতরে-ভেজা রেশমী রুমাল! সেটি মাঝে- মাঝে নাকের ডগায় তুলে ধরছেন। তার সুবাস ঘরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর শরীরটি একটি দামী কাশ্মীরী শালে ঢাকা। জ্বর হয়েছে কি? ঐ অবস্থায় ডান হাতটি ঈষৎ তুলে তিনি বাবাকে সশ্রদ্ধ আদাব জানালেন! চোখ বুজে বাবা নবাবসাহেবের নাড়ী পরীক্ষায় মনোনিবেশ করলেন। তারপর ডান হাতটি ছেড়ে, বাঁ হাতটি টিপে ধরলেন। আমার চোখ একবার নবাবের, আরেকবার ঘুড়ি-লাটাইটার ওপর ঘোরাফেরা করে। এমনসময় অন্দরমহলের চিক্ সরিয়ে অল্পবয়েসী একটি ফুটফুটে মেয়ে, রঙবেরঙের প্রজাতির চালে, কামরায় ঢুকল। পরনে রেশমী সালোয়ার, কামিজ, মাথায় ওড়না। হাতে একটি রেকাবী। তার ওপর তিনটি কাঁচের গেলাস। আমাদের সামনে এসে, প্রথমে নবাবসাহেবকে, তারপর, আমাদের আদাব জানিয়ে চোস্ত উর্দুতে বলল, ‘ফসে কি সরবৎ! নোশ্ ফরমাইয়ে।’ নবাবসাহেবের ভ্রূ-দুটি বাঁকিয়ে উঠল। তিনি ঈষৎ তিরস্কারের স্বরে হুকুম করলেন, ‘চাঁদিকা গ্লাসমে লে আও!’ ‘জো হুকুম!’ ব’লে মেয়েটি অন্দরমহলে ফিরে গিয়ে, ক্যাওড়ার খোশ্বোদার, ফলসার সরবৎ রুপোর গেলাসে ঢেলে আনল।

নবাববাড়ির নিখুঁত আদব-কায়দা নিয়ে ঢাকা শহরে, নানারকম খোশগপ্পো প্রচলিত আছে। শুনেছি বর্তমান নবাবের পিতামহ নাকি এ-ব্যাপারে নোকর- চাকরদের বিশেষরকম তালিম দিয়েছিলেন, যে-তালিম ঢাকা শহরের অনেক বিত্তবান লোকেরাই আদব-কায়দার চরম নিদর্শন ব’লে মেনে নিয়েছিলেন।

একদিন বৃদ্ধ নবাব যথারীতি খানাপিনায় বসেছেন। নবাবের আনাভিলম্বিত সাদা দাড়ি। ইস্পাহানি মালাই কোরমার সঙ্গে বোগ্দাদি বিরিয়ানি খাবার বেলায় নবাবের দাড়ির জঙ্গলে অকস্মাৎ কয়েকটি ভাত ঝুলে থাকতে দেখা গেল। তারপর আরো কয়েকটি। এইবারে তাঁর শত্রুগুচ্ছ ক্রমশই একটি ভাতের মৌচাকের মতো হয়ে উঠল। নবাবের সেদিকে কোনোই খেয়াল নেই ব’লে সদ্য-নিযুক্ত এক নোকর নবাবসাহেবকে খুশি করার উদ্দেশ্যে অতি উৎসাহে ব’লে ওঠে, ‘হুজুর, আপকা দাড়িমে চাউল লটক রহা হ্যায়।’ সেই শুনে বৃদ্ধ নবাব তেলেবেগুনে জ্ব’লে উঠলেন। এত বড়ো আস্পর্ধা। নোকরকে গালিগালাজ করতে-করতে বলেন, ‘বে-বেয়াকুফ। বত্তমিজ! জাহিল, জঙ্গলী কাঁহিকা! খবরদার! আয়েন্দা ইস্ কিসিমকা বাত কিয়া তো মু তোড় দেগা! নোকর ভয়ে জড়সড়। তার মনে হ’ল এই-বুঝি সে বরখাস্ত হয়। সঠিক কি বলা উচিত ছিল, সে-ব্যাপারে,নবাবসাহেব খানাপিনা থামিয়ে তক্ষুনি তাকে তালিম দিতে শুরু করলেন। যদি ভবিষ্যতে কোনো অতিথির সামনে বেয়াদপি ক’রে বসে। এ-ধরনের পরিস্থিতিতে সরাসরি কিছু না-ব’লে, সে-কথাটি ঘুরিয়ে, চোত্ উর্দুতে, রূপকের অলংকরণে বলতে হবে যে, ‘হুজুর, শাখেমে গুল্, আউর হ্যায় দো বুলবুল।’ নবাবের হুকুমে হতভাগা নোকরকে এটি একশোবার কান ধরে ওঠ-বোসের সঙ্গে পুনরাবৃত্তি করতে হ’ল।

বৃদ্ধ কবিরাজ মশাইয়ের সামনে বেগম সাহাজাদীরা স্বভাবতই পর্দানশিন্ হবার প্রয়োজন মনে করেন না। মধ্যবিত্ত বাঙালী পরিবারের ফিকে মেয়েদের দেখার পর, এই মেয়েদের কী রকম অবাস্তব মনে হয়। এই অসাধারণ রূপসীদের ছবি তেলরঙে আঁকা বতিচেল্লির ‘ভেনাস’-এর মতো আমার হৃদয়ের চিত্রশালায় আজও ঝুলছে। এ-যে সব রূপকথার মানুষ। রক্তমাংসে গড়া মানুষ কি এতই সুন্দর হয়। এ কি মানুষ, না ফুল! না কি কোনো ফুলের বাগিচা। এমন-কোনো বাগিচার দিকে তাকিয়েই কি মির্জা গালিব লিখেছেন, তমাশা গুলশন, তমান্না-এ চিদন-অর্থাৎ ফুলবাগিচার রূপ দেখতে চাই, আবার ফুল তুলতেও চাই। কী কোমল কৃশতনু। গণ্ড যেন সদ্য-পারা রৌদ্রচুম্বিত কোনো বেহস্তের আপেল। দেহের বহিঃরেখা যেন কালবৈশাখীর বিদ্যুতের মতো, শুধুই বক্ররেখার নির্যাস-থেকে-থেকে ঝিলিক মারে। সপ্তসিন্ধুর উত্তাল ঢেউয়ের মতো কেবল উত্থান আর পতন। দেহের রঙও সিন্ধুর ফেনার মতোই ধবধবে। সুমায়-ঘেরা তাদের হাল্কা রঙের চোখগুলো যেন রাতের আকাশে নক্ষত্রের নীল ফুল। ত্বক যেমনই মসৃণ তেমনই আঁটসাঁট। সব মিলে নিখুঁত সুরে বাঁধা আঁটো- তারের একটি বাদ্যযন্ত্র। হাত দিলেই ঝনঝনিয়ে উঠবে। বিকল্প কত উপমাই তো মনে আসে-ওস্তাদ কারিগরের হাতে বারুদে ঠাসা সদ্য-তৈরি তুবড়ি। এটাই-বা মন্দ কী। দেশলাইয়ের কাঠি ছোঁয়ালেই হয়। শোঁ-শোঁ ক’রে কতরকম রুপালী তারা–রুনকি-ঝিল্লি ছড়াতে ছড়াতে, আকাশে উঠে মেঘের গায়ে ঠেকবে। নিম্ন-গামী হয়ে কত পিয়াসী তরুণের হৃদয়ে আগুন ধরিয়ে দেবে।

এই পরীরা আমাদের দু-ভাইকে, অনেকরকম জিনিস টুকরি বোঝাই ক’রে উপহার দেন। তুলোর গদিতে সাজানো কাবুলি আঙুর। এই গদিতে সেগুলো মহামূল্যবান্ রত্নের মতো দেখায় । তাছাড়া বেদানা, মনাক্কা, কিশমিশ, আখ-রোট বাদাম পেস্তায় ঢাকা গাজরের হালুয়া। আরো কত-কী! পরবর্তীকালে, কখনো- কখনো আবার মাঞ্জা দেওয়া, সুতোয় ভরা লাটাই, আর খোদ নবাব সাহেবের জন্যে তৈরি বিশেষ নক্সার ঘুড়িও পেয়েছি। ঝুড়ির জিনিসের তুলনায় এগুলোই আমাদের মন বেশি জয় করে।

নবাববাড়ির রূপকথার এই জগৎ থেকে বেরিয়ে আমাদের ঘোড়ার গাড়ি ডানদিকে ঘুরে যায় কোতোয়ালির দিকে। অল্পক্ষণের মধ্যেই গাড়িটা এই থানার বাঁ পাশের সরু রাস্তাটিতে প্রবেশ করে। অপরিচিত নানারকম আওয়াজ কানে ভেসে আসে-ঠঠক্, খুটখাট্, খ-অ-অ-স, খ-অ-অ-স। আরো যে কত-রকমের শব্দ আর গন্ধ তার হিসেব কে করে। কী আজব দুনিয়া! এমনটি ভূভারতে আর কি কোথাও আছে? বাড়িগুলো যেমনই সরু, তেমনই লম্বা; প্রস্থে খুব বেশি হ’লেও চার কিংবা পাঁচ-ছ-তলা। গায়ে-গায়ে এমনই সাঁটা যে দেখলে মনে হয় কোনো অতিকায় এক দানবের হাতের প্রচণ্ড চাপে বাড়িগুলো চেপ্‌টে গিয়ে এই অদ্ভুত আকার ধারণ করেছে। খিলান-ওয়ালা, কিংবা চৌকো পায়রার খোপের মতো ছোটো-ছোটো জানালা এবং জালি। তারই চারপাশে নানারকম মুসলমানী নক্সা। দরজাগুলো নিতান্তই সংকীর্ণ। বড়োজোর একটি রোগা-পটকা লোক তার ভেতর দিয়ে সহজে পার হতে পারে। বাড়ির ভেতরটা এমনই অন্ধকার যে, রোদ-বাতাসের সম্পর্কে আসা যেন ঘোরতর অপরাধ। এই অন্ধকূপের মধ্যে মানুষ কী ক’রে থাকে! তা সত্ত্বেও এ-বাড়িগুলোর স্থাপত্যসংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য এবং বৈচিত্র্য দেখে তাক্ লেগে যায় । বাড়ির বাসিন্দারা ততোধিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।

প্রত্যেক বাড়ির সুমুখের বারান্দায় এবং ঘরে নানা বয়সের কর্মব্যস্ত লোক। তাদের খালি গা। হাতে অর্ধচন্দ্রাকার লোহার তৈরি মস্ত একটি অস্ত্র। দেখলেই মেরুদণ্ডটা সিরসির ক’রে ওঠে। তার নিচের দিকটা তলোয়ারের মতো ধারালো। রাস্তার প্রতিক্ষিপ্ত আলোয়, সেটি থেকে-থেকেই চমক্‌ দিয়ে ওঠে।

প্রাপ্তবয়সে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি-আবিষ্কৃত, এ-ধরনের একটি অস্ত্রের নক্সা দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। তফাৎ এইটুকু যে, এটি ছিল যন্ত্রচালিত। জোড়া-জোড়া ঘোড়ায় টানা একটি রথ। তার পিছন দিকে ইস্পাতের অর্ধচন্দ্রাকার ফলা-চক্রাকারে সমান্তরালভাবে সাজানো। দেখতে অবিকল, শায়িত মস্ত একটি টেবিল-ফ্যানের মতো। তার তলায় দাঁতওয়ালা আরেকটি খাড়া চক্র। ঘোড়ার গতির সঙ্গে-সঙ্গেই এই ফলাগুলো এমন বেগে ঘুরতে থাকে যে, নাগালের মধ্যে যা-কিছু আসবে, ফলার এক কোপেই সেটি খণ্ড-খণ্ড হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে।

লোকগুলো তাদের দু-পায়ের পাতার মাঝে শ্যাওলা রঙের একটি কঠিন বস্তুকে চেপে ধরেছে। এই ভয়ংকর অস্ত্রটির সাহায্যে সেটিকে কাটছে। তাদের হাত-দুটি ঢেউয়ের ছন্দে একবার উঠছে আর নামছে। দৃশ্যটি যেমনই অদ্ভুত, তেমনই আকর্ষণীয়। আমি কিছুতেই চোখ সরাতে পারছি না। বাবাকে জিজ্ঞেস করতেই সংক্ষেপে তিনি বলেন, শাঁখ কেটে শাঁখা তৈরি করছে।’ কেউ-কেউ কাটা-শাঁখকে পাথরে ঘষে পালিশ করছে। আবার কেউ-বা ঘষছে গোটা একটি শাঁখ। শাঁখের বিশুদ্ধ এবং পবিত্র সাদা বর্ণটি যে শ্যাওলার মতো একটি বিশ্রী প্রলেপে ঢাকা থাকে, বাবার কাছে এ রহস্যটি শুনে আমার বিস্ময়ের সীমা নেই। তাদের মধ্যে দু-একজন চোখে চশমা এঁটে, সোনার বালার মতোই, সেগুলোকে নানারকম সুক্ষ্ম কারিগরিতে ভরিয়ে দিচ্ছে। শাঁখ কাটার এ-দৃশ্যটি আমার মনে এমনই দাগ কেটেছিল যে, পরবর্তীকালে, তার দু-একটা ছবিও এঁকেছিলাম।

পরদিন সকালে উঠে দেখি এক তাজ্জব ব্যাপার। রাতারাতি কোথা থেকে হারমোনিয়ম ও গানের মাস্টার হাজির হয়েছেন। ব্যাপার কী, সেটি তদারকের উদ্দেশ্যে দক্ষিণের দালানে গেলাম। হারমোনিয়মের ওপর গানের ময়লা খাতা। ‘শেফালি তোমার আঁচলখানি, বিছাও শারদ প্রাতে’, এই কলিটির সুর ধরার জন্যে ছোড়দি আপ্রাণ চেষ্টা করছে। মাস্টারমশায়ের ভাবখানা অবিকল ওস্তাদ্ মুসলমান গাইয়েদের মতো। মুখে পান, সামনে পানের ডিব্বা। মাঝে-মাঝে, একটু কেশে গলা পরিষ্কার ক’রে নিয়ে, এক কান চেপে ধরে, গানের কলিটি বার-বার গাইছেন। অন্য হাতে সেই সুরের পর্দাগুলো টিপে ধ’রে দিদিকে চিনিয়ে দিচ্ছেন। চোখে গুরুসুলভ কিঞ্চিৎ বিরক্তির ছাপ। যাই হোক, এই ক’রে তিনি মাস-খানেকের মধ্যেই দিদিকে বেশ-কয়েকখানা গান শিখিয়ে দিলেন। মজার ব্যাপার এই যে, এইসব গান, দিদি বেসুরো গেয়েও, বিয়ের পরীক্ষায় দিব্যি অনার্স নিয়ে পাস ক’রে গেল। হারমোনিয়ম এবং গানের মাস্টারও, সেইসঙ্গে উধাও।

সংগীতকলার সঙ্গে আমাদের পরিবারের সম্পর্কটা ছিল এ-পর্যন্তই। ললিতকলার সঙ্গে সম্পর্কটাও একইরকমের। বৈঠকখানার ঘরে ঝুলে-ঢাকা, দেবদেবীর বাঁধানো কয়েকখানা ছবি, আর উৎকট রঙ-করা কয়েকটা বাস্তবধর্মী বড়ো পুতুল। অথচ, সে-সময়ে ঢাকা, তথা পূর্ববঙ্গের, লোকশিল্প আঙ্গিকে রঙে-নক্সায় ছিল যেমনই সমৃদ্ধ তেমনই প্রাণবন্তু। সে-কথায় পরে আসছি।

এখন দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পাট চুকে গেছে। কর্মচঞ্চল, জনবহুল, আমাদের বাড়িটা এইসময়ে, দিনের বেলায় ভূত-পেত্নির রাজ্যের মতো, কিছুক্ষণের জন্যে একেবারে নিঝুম হয়ে পড়ে। আমাদের চোখে একটুকুও ঘুম নেই। গল্পের বই পড়ার এক অদমনীয় বাসনা আমাকে পেয়ে বসল। সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও একখানা বই, এমন-কি রামায়ণ-মহাভারতও খুঁজে পেলাম না। চিকিৎসা-সংক্রান্ত বাবার কয়েকখানা ছেঁড়া পাতার বই আর খাতা, আর তেমনি জীর্ণ লক্ষ্মীর পাঁচালি আর পঞ্জিকা–বইয়ের সংগ্রহ বলতে এই মাত্র। এক কথায়, বিয়ে-থা, কিংবা কোনো পুজো-পার্বণ ছাড়া, সেন-পরিবারে দৈনন্দিক জীবনের ধারা একঘেয়েমির জাঁতাকলে পিষে হয়ে উঠেছিল নিতান্তই নীরস এবং ধূসর। এই ধূসরতা আমাকে মাঝে-মাঝে অস্থির ক’রে তোলে। মন উশখুশ করে, হাত নিশপিশ্ করে।

এমন অবস্থায় একদিন বাড়ি থেকে বের হলাম। আমাদের বাড়ির কয়েকশো গজের মধ্যেই বাবুরবাজার। হাঁটতে-হাঁটতে সেখানে গিয়ে পৌঁছই। সারি-সারি মুসলমানী খাবারের দোকান। ঘি, গরম মসলা, পেঁয়াজ-রসুন এবং হিং-এর গন্ধে সন্ধেবেলার হাওয়াটা মতোয়ারা হয়ে উঠেছে। বড়ো বড়ো লোহার পরাতে কালেজা- কা সালন, শামি আর শিক্ কাবাব, মাটন কাটলেট আর রোস্ট, পরোটা, রুমালী রোটি, ফুরকা, ভাত, আরো কত কী। সালনের রঙটি দেখে মনে হয় যে, লাল লঙ্কার নির্যাসের একমাত্র উপকরণে এই খাবারটি তৈরি। এই থালার সারির শেষটিতে, জাফরানী রঙের রগরগে ঝোলে মাখা বড়ো-বড়ো চাঁপ। তারই পাশে একটি ধিমিধিমি আঁচের কাঠ-কয়লার উনুন। তার ওপর একটি লোহার ডেগচিতে, হলদে আর গাঢ় গোলাপী, চিকন ভাতের বিরিয়ানি। তার থেকে গরম ভাপ হাল্কা ধোঁয়ার মতো কুণ্ডুলি পাকিয়ে উঠে আমার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করল। এই জাঁকালো দৃশ্যটি আমার চক্ষু এবং ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে অস্বাভাবিক-রকম সজাগ ক’রে তুলল। রসনেন্দ্রিয়ও ক্ষেপে উঠল ততোধিক। আমার চোখ ডেগচি এবং জাফরান রঙের পরাতটির ওপর সেঁটে গেল। আমার দশা কখন বাঘের কবলে হরিণ শাবকের মতো। এমন অবস্থায় যা অবশ্যম্ভাবী তাই ঘটল। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমিও এই প্রচণ্ড লোভের শিকার হলাম।

তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসি। একটা কৌটোতে, মা-র রাখা একটি অচল দু- আনি অনেকদিন ধরেই দেখি। চুপি-চুপি সেটিকে তুলে নিই। দ্রুতবেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে, আমাদের পাড়ার মসজিদের সামনে হাজির হই। সেখানে, প্রত্যহই, একটি অন্ধ ভিখিরি, হাঁটু ভাঁজ ক’রে বসে। দেখতে অবিকল একটি দরবেশের মতো। সিমাইয়া রঙের তার চুল এবং দাড়ি। খোলা হাত-দুটি প্রার্থনার ভঙ্গিতে বুকের সঙ্গে সংযুক্ত। পাশে একটি বাঁশের লাঠি। আকাশের দিকে মুখ তুলে বলে, ‘এক প্যায়সা ইস্ আন্ধাকো দেওগে তো, মালিক তুমকো লাখ্ দেগা।’ সামনে একটি টিনের কৌটো। সেটির ভিতর পাইপয়সা আধ-পয়সা, এক পয়সা এবং কয়েকটি এক আনি প’ড়ে আছে। কৌটোর অন্ধকার গহ্বরে এই পয়সাগুলো, টাঁকশালের সদ্য-তৈরি মুদ্রার মতো ঝকঝক করে। সন্ধের স্তিমিত আলোয় বাড়িঘর লোকজন, ছায়ার মতো আবছা দেখায়। এক-হাত উঁচু থেকে অচল দু-আনিটা আমি কৌটোর ভেতর ফেলি। সঙ্গে-সঙ্গে খঞ্জনি এবং একতারার মতো সমবেত একটি ধ্বনি কৌটোর ভেতর থেকে সরল রেখায় উঠে এল। বৃদ্ধ অন্ধটি, খোদার কাছে, আমার এবং সন্তান-সন্ততির মঙ্গল ভিক্ষে করল। আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে কৌটোটি থেকে আলতো ক’রে দু-তিনটি এক আনি তুলে নিয়ে, এক দৌড়ে বাবুরবাজারের দোকানটির সামনে হাজির হলাম। এই বাদশাহী খাবার লোভে মানুষ কী-না করতে পারে। দোকানটিতে ঢুকে আমি আকণ্ঠ সেই খাবার খেলাম। আঃ। কী অপার্থিব, কী অবর্ণনীয় স্বাদ! রসনের কী অসাধারণ তৃপ্তি। এই একক অভিজ্ঞতাটি ভবিষ্যৎ জীবনে, আমার মনে এমনই এক গভীর ছাপ ফেলে যে, আজ পর্যন্তও তা মুছে ফেলতে পারিনি।

শ্রাবণের একটি রৌদ্রচুম্বিত বিকেলবেলা। যেদিকেই তাকাই-না কেন- রাস্তা- ঘাটে, ছাদে-কার্নিশে, বারান্দায়-রোয়াকে, দরজায় জানলায়, গাছে-ল্যাম্প- পোস্টে– সর্বত্রই কালো বিন্দু। এক কথায় কালো বিন্দুর এক মহাসমুদ্র। গোটা ঢাকা শহর এক অস্বাভাবিক উত্তেজনায় আর উম্মাদনায় মেতে উঠেছে। আজ জন্মাষ্ঠমীর মিছিল বেরুবে। এমন জাঁকালো, এমন বিশালকায় এবং অসাধারণ চমৎকারিত্বপূর্ণ একটি ঘটনা, এই উপমহাদেশে আর কোথাও কি দেখা যায়! যে জাদুকরি হাত জগদ্‌বিখ্যাত মসলিন কাপড়ের স্রষ্টা, এই মিছিল সে-হাতেরই এক আশ্চর্য কারিগরির যোগফল যেন। দু-দিন ধরে এই বিন্যাসপূর্ণ, সাত-রঙা মিছিল, ক্ৰমাগত পরিবর্তনশীল, অতিকায় একটি নক্‌সিকাঁথার মতো চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যায়। ঠিক যেন একটি ক্যালিডোস্কোপের ভেতর দিয়ে দেখছি। সক্রিয় অংশীদাররা হিন্দু হ’লেও, আক্ষরিকভাবে এ-মিছিল সর্বজনীন।

অপরাহ্নের সূর্য পশ্চিমের আকাশে হেলে পড়েছে। ধুলোর চিকের ভেতর দিয়ে দূরে, কালো বিন্দুর সমুদ্রে উত্তেজনার মন্ত ঢেউ ওঠে। এই পাহাড়টি ভিড় ঠেলে কচ্ছপের চালে এগিয়ে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই আবছা মূর্তিটা জাঁকজমক পোশাকে সজ্জিত একটি বাস্তব হাতিতে রূপান্তরিত হয়। ‘আসছে, ঐ আসছে-সহস্র কণ্ঠের এই আওয়াজ, বাবুরবাজারের দিক থেকে, আকাশে উঠে, একটি শব্দতরঙ্গের মতো আমাদের দিকে ভেসে আসে। কী উম্মাদনা! কী ঠেলাঠেলি! যতদূর চোখ যায়, শুধু রঙ আর রঙ থাকে-থাকে সাজানো। আক্ষরিকভাবে রঙের গাঙে যেন জোয়ার আসছে। হাতির পেছনেই কী অপরূপ এক দৃশ্য-গ্যালারির পর গ্যালারি। উচ্চতায় পঁচিশ থেকে ত্রিশ ফুট। বহুযুক্ত-গোরুর গাড়ির ওপর বসানো। এ- গাড়িগুলোকে টানছে জোড়া-জোড়া বলদ। এই গ্যালারির মাঝখানে একটি মঞ্চ। তার গর্ভগৃহে, খাঁটি সোনা কিংবা রুপোর চৌকি কিংবা সিংহাসন। সেখানে বৈষ্ণব দেবদেবীর মূর্তি! তার সামনে পৌরাণিক কাহিনীর মূকাভিনয় অথবা ভক্তিমূলক নাচ- গান চলে। কখনো-বা নিছক খ্যামটা নাচ। কী অসাধারণ এক জমজমাট ব্যাপার। অনেকটা প্রতিমার চালার আকারে, দু-পাশ দিয়ে উঠেছে কাঠ কিংবা বাঁশের কাঠামো। তাতে নানা নক্সার রাংতা আর শোলার অলংকরণ। এই কাঠামোর একের-পর-এক, নিশ্চল পুতুলের মতো, নানাভাবের নানা জ্যান্ত মূর্তি, মেয়েদের পোশাকে। জরি, পুঁতি এবং চুমকির কাজে, এবং কারবাইডের আলোর মালায়, এই পোশাকগুলো এমনই ঝলমল করে যে, চোখ ধাঁধিয়ে যায়!

গ্যালারির সারি পার হবার পরই, ঢেউ-এর মতো, নৃত্যরত সঙ-এর দল আসে। তাদের মুখে কবিগান, কীর্তন, বিদ্রূপাত্মক সামাজিক ছড়া, গাতীয়তাবাদী গান। হাতে খঞ্জনি আর করতাল। বাদ্য এবং কণ্ঠসংগীতের কী নিখুঁত ঐক্য। মনে হয় একটিমাত্র কন্ঠ, একটিমাত্র বাদ্যের ধ্বনি। তারপরেই, রাজপুত বীরের বেশভূষায়, তলোয়ার উঁচিয়ে আসে অশ্বারোহীর দল। তাদের দু-পাশে সারি-সারি রঙের ঝলমল নিশান, অতিকায় মখমলের ছত্র, পাখা, চামর, বর্শা, আরো কত কী। সঙ্গে আছে ঢাক-ঢোল-নাকারা-শিঙা, এমন-কি ব্যাণ্ড-পার্টিও। সামরিক সংগীতের গমগমে শব্দচাঞ্চল্যে আকাশ-বাতাস ভ’রে ওঠে। যেন কয়েকশো পাখোয়াজ একইসঙ্গে, একই বোলে বেজে উঠেছে। তারপর, আরো সঙ, আরো ঘোড়া, আরো হাতি, আরো গ্যালারি–এক অন্তহীন, সচল, সাড়ম্বর, অদৃশ্যপূর্ব প্ৰদৰ্শনী।

একবার, এই মিছিল, আমাদের পাড়ার মসজিদের সামনে দিয়ে যাবার সময় শত-শত মুসলমান, লাঠিসোঁটা, ইটপাটকেল হাতে নিয়ে এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে হাজার-হাজার লোক-দ্রুতগামী গাড়ির তলায় চাপা পড়ার ভয়ে মুরগীছানা যেমন দিক্‌বিদিক্-জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটে-ঠিক তেমনি ক’রে পালাতে থাকে। বে-পাড়ার অনেক হিন্দুই জখম হ’ল। অথচ মুসলমান-প্রধান পাড়ায় থেকেও, গোনাগুতি, আমরা কয়েকটি হিন্দুপরিবারের গায়ে, একটি সামান্য আঁচড়ও পড়ল না। বলা বাহুল্য, এই দাঙ্গা লাগাবার প্রস্তুতি আগে থেকেই করা হয়েছিল, সরকারি প্ররোচনায়। যতদিন-না স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এল, ততদিন পর্যন্ত, মুসলমান পাড়াপড়শীরা দুধ-চাল-তেল-নুন থেকে নিয়ে বেঁচে থাকার যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস জোগাড় ক’রে দিল। কৈশোরের আমার এই একক অভিজ্ঞতাটি মানুষকে ভালোবাসতে এবং বিশ্বাস করতে বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছে।

দু-দিনব্যাপী মিছিলের পর জন্মাষ্টমী উৎসবের আরেকটি অত্যাশ্চর্য আকর্ষণ নবাবপুরের ‘বড়ো-চৌকি’। মিছিলের মতো এটিও আরেক অসাধারণ চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা।

সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের সৃজনীশক্তির কি কোনো ঠিক-ঠিকানা আছে। যেমনি নক্সার ভাব, তেমনি অলংকরণ, আর তেমনি অনুপাত-জ্ঞান। হিন্দু-মুসলমানী নক্সার কী অপূর্ব সমন্বয়। আর রঙের তো রীতিমতো দাঙ্গা লেগেছে। আগাগোড়া রাংতা, রঙীন কাগজ এবং কাপড় দিয়ে মোড়া। তার ওপর সোনারূপোর ছড়াছড়ি। নবাবপুরের সাবেকী ছাতা-পড়া বাড়িগুলো এবং রাতের কৃষ্ণবর্ণ আকাশের পটভূমিকায় চৌকিটি, নানা রঙের আলোর ঝলকানিতে, এক পরীর রাজ্যের মতো ডগমগিয়ে উঠেছে। চৌকির মাঝামাঝি উচ্চতায় দ্বিগুণ পূর্ণাবয়ব পুতুলখেলার মাধ্যমে, মহাভারত, রামায়ণ এবং অন্যান্য পালা রাতের পর রাত চলে। এইসব পুতুলের গঠন-গাঠন, আঙ্গিক, রঙ, হাত-পা-মাথা ইত্যাদি নাড়াবার ভঙ্গি–এক কথায় তাবৎ নান্দনিক বিচার এবং সংযম দেখে, অজ্ঞাত, অশ্রুতকীর্তি শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধায়, আপনা-আপনিই মাথা নুয়ে পড়ে।

এই চৌকিতে আজ রাবণবধ পর্ব চলেছে। সে কী ভয়ানক দৃশ্য! যেমনি রাম- লক্ষ্মণের হাত-পা এবং মুখের ক্ষিপ্র গতি এবং মারাত্মক সব অস্ত্র নিক্ষেপ, তেমনি রাবণ তাঁর বিরাট খড়্গ, দ্রুত চালিযে, চারপাশের হাওয়াটাকে খণ্ড খণ্ড ক’রে ফেলে। তার হাতের চকচকে এই অস্ত্রটির থেকে ঝটিকাক্ষুব্ধ মেঘাচ্ছন্ন আকাশে বিদ্যুতের আলো-জিহ্বা লকলক করে। সেই আগুনে রাম-লক্ষ্মণ পুড়ে ছাই হয়ে যায় আর-কী! তাই দেখে আমার চোখের পলক থেমে যায়, বুক ধড়-ফড় ক’রে ওঠে। সব মিলে এক অদৃশ্যপূর্ব, অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। তাই তো, আজ এতকাল পরেও তার ছাপ, আমার মনে, গতকালের ঘটনার মতোই উজ্জ্বল হয়ে আছে। এতটুকুও ম্লান হয়নি।

জন্মাষ্টমী মিছিলের উত্তেজনা শেষ হতে-না-হতেই, আরেক নতুন উত্তেজনা আর অস্থিরতা আমাকে পেয়ে বসে। গত বৎসরের পুজোর দিনগুলোর অনুভূত আনন্দের অস্পষ্টস্মৃতি, ভবিষ্যতের নানা রঙের আশায় আমার মনকে ভরিয়ে দেয়। এক খুশির জোয়ার আসে। আমাদের বেলতলী গ্রামে পৌঁছতেই এই খুশি এক অফুরন্ত আনন্দে রূপায়িত হয়ে আমার মনের পাত্রটি উপচিয়ে পড়ে। এ-নিত্যলোক সত্যিই কী রসময়! কী মধুর! কী মুক্ত জীবন!

চারদিক-জল-খাল, বিল, আর পুকুর। তারই মাঝে নানারকম অসংখ্য গাছ- পালা এবং লতায় ঘেরা বাড়িগুলো একেকটি দ্বীপের মতো দেখায়। কতরকম পাখি, কতরকম ফুল, কতরকম উগ্রমধুর সৌরভ! রূপসী বাংলার কী সম্মোহনী, সুকুমারী, সীমন্তিনী রূপ। সৃষ্টিকর্তা যেন আমাদের বেলতলী গ্রামের বেলায় উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতের তাবৎ সমৃদ্ধির ভাণ্ডারকে উজাড় ক’রে দিয়েছেন।

একদিন সারা দুপুর নৌকো করে খাল-বিলের মধ্যে ভেসে বেড়িয়ে এসে ঘাটে ডিঙিটা বেঁধে গলুইয়ের ওপর নিজেকে এলিয়ে দিলাম। ঘন বাঁশঝোঁপের তলায় ছায়াশীতল এ-জায়গাটি টাঙ যুগের চমৎকার একটি চীনে ছবির মতো লাগে। মাথার ওপরে বাঁশপাতাগুচ্ছের ভেতর দিয়ে সুর্যের প্রখর রশ্মিগুলো তারাবাতির মতো আলো ছড়ায়। চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তাই উপুড় হয়ে শুই।

জলের ওপর আলোছায়ার জটিল এক নক্সা। গলুইয়ের তলায় এক চিলতে শান্ত স্বচ্ছ জলটুকুতে চোখ পড়তেই আমি প্রকৃতির অপার বিস্ময়ের মুখোমুখি হলাম। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক মেনডেল তাঁর অণুবীক্ষণের ভেতর দিয়ে, এক ফোঁটা জলে, অসংখ্য ক্ষুদ্র জীবনের অস্তিত্ব দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। আমার অবস্থা তাঁর চাইতে কম কিসের? শত-শত জীবাণু, জলচর পোকা, ঝাঁকে-ঝাঁকে মৌরলা, ট্যাংরা, খুদে পুঁটি, বাঁশপাতা মাছ, কুচোচিংড়ি, বাম্, খুদে পোনা-আরো যে কত-কী তার ইয়ত্তা নেই! কী ভিড়! কী ঠেলাঠেলি আর মারামারি! জল ছেড়ে আমার চোখ ডাঙায় পড়তেই দেখি সেখানেও ঐ একই ছবি। মাত্র এক বর্গগজ প্রমাণ জমিতে কত-কী যে পিলপিল করে! কেঁচো, ক্যাড়া, শ্যামাপোকা, কাঠপিঁপড়ে, খুদে পিঁপড়ে, নালসো পিঁপড়ে, শামুক, নেউলে পোকা, গঙ্গাফড়িৎ, শুঁয়োপোকা, এমন- কি গুই সাপের বাচ্চা! প্রাণের কী অন্তহীন প্রাচুর্য। সৃষ্টির কী জটিল নক্সা!

এ-সব কথা ভাবছি, এমনসময় আমাদের পুরুতমশাইয়ের রান্নাঘরের দিক থেকে এক বিরাট চিৎকার ভেসে এল। দৌড়ে সেখানে উপস্থিত হলাম। আরো অনেকেই ছুটে এল। ঘরের দরজার পাশেই একটি থাম। তার গোড়ায় একটা ছোট্ট গর্ত। পুরুতমশাই চৌকাঠ পেরোতেই ঘন কাজলের মতো কুচকুচে, চক্‌-চকে একটা কালকেউটের বাচ্চা বেরিয়ে ফণা তুলে ধরে। থেকে-থেকেই ফোঁস-ফোঁস ক’রে উঠছে। এক বিঘত সাপটার কী সাংঘাতিক তেজ। কী হিংস্র তার চেহারা। ফণাটাকে এক অবিরাম ছন্দে দোলাচ্ছে। তার শরীরে বিদ্যুতের মতো যে-তরঙ্গ বইছে, তার শোভাই-বা কম কিসের।

আমাদের খুড়তুতো ভাইরা বেলতলী গ্রামেই থাকে। তাদের হাবভাব দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়। তাদের চোখে কেউটে যেন একটি কেঁচোরই সামিল। তারা নিশ্চিত যে এই গর্তে আরো একটা-দুটো নয়, কয়েকগণ্ডা, সাপ-শাবক লুকিয়ে আছে। তাদের মধ্যে একজন চটপট খানিকটা চিনির শিরা বানিয়ে এনে গর্তে ঢেলে দেয়। অল্পকালের মধ্যেই ছোটো-বড়ো লাল পিঁপড়েরা, এক অবিশ্রান্ত অবিরাম সামরিক বাহিনীর মতো, দলে-দলে এই গর্তে ঢুকতে থাকে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ঘরের ভেতরে-বাইরে একটা ফাটল দেখা গেল। খুড়তুতো ভাইদের মতে, কালো সরীসৃপগুলোর, পিঁপড়েদের কামড় থেকে বাঁচার এটাই একমাত্র পালাবার পথ। তারা লাঠি হাতে সে-জায়গাটিতে, সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়াল। উপস্থিত সকলের মুখেই এক গভীর উৎকণ্ঠা আর প্রত্যাশার ছাপ । প্রতীক্ষমাণ জোড়া-জোড়া চোখ ঐ ফাটলের ওপর কেন্দ্রীভূত। বেশ খানিকক্ষণ এইভাবে কাটল। হঠাৎ ফাটলের ভেতর দিয়ে কয়েকটা বিষ পিঁপড়ে উঁকিঝুঁকি মেরে, এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে, আবার ফাটলের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

খুড়তুতো ভাইরা অসাধারণ উত্তেজিত। বলল, এগুলো স্কাউট, এগুলো স্কাউট। ময়দান ফাঁকা কিনা, দেখে গেল। এইবার কালাচাঁদ বেরুবে। ভাইদের এই অবিশ্বাস্য আত্মপ্রত্যয় দেখে আমাদের চোখ ছানাবড়া। তাদের এই কথা-ক’টি শেষ হতে-না-হতেই চায়ের চামচের মতো চ্যাপটা একটি মাথা ফাটলের মুখে দেখা দিল। আরেকটু বেরুতে দেখা গেল, তার সারা গায়ে বিষ পিঁপড়ে জোঁকের মতো, লেপ্টে আছে। দূর থেকে ঠিক একটা কালো ফিতের গায়ে লাল রেশমী সুতোর নক্সার মতো দেখাচ্ছে। বিষ পিঁপড়েরা যে কী মারাত্মক হয়, এবং ম’রে গেলেও যে কামড় ছাড়ে না, এই অবিসংবাদিক সত্যটি নিজের চোখে দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হলাম। কেউটে শাবকটা হাজার-হাজার পিঁপড়ের দংশনে এবং অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে। এইটুকু সময়ের মধ্যেই লাল বিন্দুর মতো এই ক্ষুদ্র প্রাণীগুলো সাপটার এমনই হাল করেছে যে, ফাটল থেকে পুরো শরীরটাকে বের করবার মতো শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট রাখেনি। এমন অবস্থায় তার মাথায় লাঠির একটি বাড়ি পরতেই কালো ফিতের মতো বস্তুটি মাটিতে নেতিয়ে পড়ল। এইভাবে একের-পর-এক, মোট ছাপান্নটি খুদে কেউটে, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ভাইদের লাঠির শিকার হ’ল।

সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে। পূজোমণ্ডপের সামনে স্ত্রী-পুরুষ, ছোটো ছেলেমেয়েদের ভিড় জমেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢাকীদের সমবেত বোলের সঙ্গে, কাঁসর-ঘণ্টা, তুবড়ি, আতশবাজি, বোমা ইত্যাদির চমকপ্রদ প্রদর্শনী মিলে সমস্ত পুজো-বাড়িটা এক সামগ্রিক উত্তেজনায় মেতে উঠেছে। সারাদিনের নানারকম উত্তেজনা এবং সন্ধেবেলার এই হৈ-হল্লা, এ-দুয়ের প্রভাবে নিদ্রায় আমার চোখের পাতায় জগদ্দল নেমে আসে। আমি আরতির মাঝেই, পশ্চিমের দালানে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ি। ভয়ে আমার ঘুম আসে না কারণ, বাড়ির সবাই পুজোমণ্ডপে। তাছাড়া আমার এই শোবার জায়গাটি, মণ্ডপ থেকে, অন্তত তিনশো গজ দূরে। আমি একা চোখ বুজে প’ড়ে আছি, এমনসময় আমার মশারির তলায় কে এসে জায়গা নিল। ঘরের কোণে রাখা লণ্ঠনের অস্পষ্ট আলোয় দেখা গেল যে আমার পার্শ্ববর্তিনী ভরাযৌবনা এক নিকট আত্মীয়া। কয়েক মিনিট পর আমার এক দাদাও তাঁর পাশে ঘেঁষাঘেঁষি ক’রে শুয়ে পড়ল। তারপর খসষসানি, চুড়ি-বালার ঠুনঠুনানি, ঝুনঝুনানি। তাঁদের সমবেত ঘন-ঘন গরম নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে, কার্তিকের গুমট রাত্রিটি ছোট্ট মশারিটির ভেতর অসহ্য হয়ে উঠল। আরো নানা অপরিচিত আওয়াজ কানে এল। ঘরের বাইরেই হঠাৎ ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, আস্তে-আস্তে বাড়তে থাকল। অল্পক্ষণের মধ্যেই এই ডাক এমন সরব হয়ে উঠল যে, কানে তালা লাগে আর-কী; বিনা কারণে হঠাৎ আবার থেমে গেল। তারপর, কখন যে আমি গভীর নিদ্রায় অচেতন হয়ে পড়েছিলাম টেরও পায়নি।

আমাদের বেলতলী গ্রামের বাড়িতে শুধু শোবার জন্যেই তিনখানা পাকা দালান। দুটি দালানের মাঝে প্রশস্ত উঠোন। সন্ধের পর যেখানেই যাই-না- কেন-সামনে, পেছনে, ডাইনে, বাঁয়ে, খাটে, মেঝেতে, শুধু বিছানা আর মশারির জঙ্গল। বয়োজ্যেষ্ঠ এবং বিবাহিত কয়েকজন ছাড়া শোবার কারো তেমন কোনো নির্ধারিত জায়গা নেই, সবাই খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে যে যেখানে পারে, শুয়ে পড়ে।

এই জায়গা-বদলের পালায় একদিন আমি ঐ ভরাযৌবনা আত্মীয়াটির পাশে স্থান পেলাম। মাঝ রাত্তিরে তিনি আস্তে ক’রে, আমাকে ঠেলে জাগিয়ে তুললেন। আমার কানে ফিসফিসিয়ে বললেন যে, তাঁকে মেয়েদের বিশেষ জায়গাটিতে যেতে হবে এবং প্রহরী হিসেবে আমাকে সঙ্গে যেতে হবে। অনুরোধটি নিতান্তই স্বাভাবিক কারণ এই জায়গাটির চারদিকে বাঁশ এবং চালতা গাছের ঘন ঝোঁপ। দিনেদুপুরেও সেখানে তক্ষক আর হুতোম পেঁচার ডাক শোনা যায়। তাছাড়া এ-জায়গাটির সঙ্গে ভূতপ্রেতের নানা কাহিনীও জড়িত আছে। প্রায় নিরাবরণ হয়ে, আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে আত্মীয়াটি হাঁটু ভাঁজ ক’রে বসলেন। আমলকী বনে, বসন্তের হাওয়ার মতো, একটানা একটি ধ্বনি। কর্ণেন্দ্রিয়তে সেটি পৌঁছতেই আমার শরীরে, এক অজানা রোমাঞ্চের তরঙ্গ বইতে থাকে। সমস্ত স্নায়ুকেন্দ্র সিরসির ক’রে উঠে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। পা শিথিল হয়ে আসে। আমার হাতের লণ্ঠনটির আলোয়, তাঁর দেহের অনাবৃত নিটোল, মসৃণ অংশটি, চমৎকার একটি তানপুরার খোলের মত চক্‌চক্ ক’রে উঠল। বাঁশ-চালতা বনের নিস্তব্ধতা, মধ্যপ্রহরের জমাট অন্ধকার, একটানা ঝিল্লিরব এবং লণ্ঠনের স্তিমিত আলো-সব-কিছু মিলে, আমার চোখের সামনের দৃশ্যটি এমনই এক নাটকীয় রূপ নিল যে স্ত্রী-অঙ্গের, বিভিন্ন অংশ, ইতিপূর্বে, আকষ্মিকভাবে চোখে পড়লেও, এই অবিস্মরণীয় প্রহরটিতে, বেশ নজর দিয়ে দেখতে বাধ্য হলাম। তানপুরা। তা দেখতেও যেমন সুশ্রী শুনতেও তেমনি মধুর।

আজ কোজাগরী পূর্ণিমা। পুকুরপাড়। সন্ধেবেলায় আমি প্রায়ই এখানটায় বসি। মাছের ঘেই শুনি। লক্ষীর প্যাচালী পাঠের একটানা সুরের মাঝে-মাঝে বিশুদ্ধ গাওয়া ঘিতে লুচি আর বেগুন ভাজার সুগন্ধ ভেসে আসে। উত্তর-পুব কোণে বিশাল অর্জুন গাছটার ছায়া, পুকুরের জলে এমনভাবে পড়েছে যে, গাছটার কোথায় শুরু আর কোথায় যে শেষ তা বোঝা দায়। এই ছায়ার পশ্চাৎপটে অতি হাল্কা একটি রূপালী আভা খুব ধীরে-ধীরে ফুটে উঠেতেই, এই পুঞ্জিত, তরল ছায়া, পুকুরের চক্‌চকে জলে চীনে শিল্পীর মস্ত একটি তুলির আঁচড়ের মতো দেখাল। মনে হয়, অল্পক্ষণের মধ্যেই চন্দ্রোদয় হবে, এমনসময়, আমার সমবয়সী ভাগ্নে পচা এসে আমাকে হাত ধ’রে সোজা নৌকোর ঘাটে টেনে নিয়ে গেল।

ডিঙি ক’রে আমরা একটু-একটু ক’রে, জলে আধাডোবা ধানক্ষেতের দিকে এগিয়ে যাই। সঙ্গে আমাদের প্রজা মধুসুদন ভাটিয়ালও আছে। সে দোতারাটি সুরে বাঁধে। দূরে বাঁশঝোঁপের ভেতর দিয়ে পুকুরপাড়ে, লণ্ঠনের আলোয় ঘোমটা-পরা এক বৌকে বাসন মাজতে দেখা যায়। তারই কাছাকাছি কোথা থেকে সমবেত উলুধ্বনি ধোঁয়ার মতো উঠে জামরুল-জিয়লের পাতার মধ্যে হারিয়ে যায়। দক্ষিণ পাড়ার কামাখ্যা সেনদের তুলসীমঞ্চের সাঁঝের প্রদীপটি এখনো টিপটিপ ক’রে জ্বলে। চারদিক সুনসান্। হঠাৎ দূর থেকে কানে সন্‌স আওয়াজ ভেসে আসে। আকাশের দিকে তাকাতেই দেখি, নক্ষত্রের চাঁদোয়ার তলায়, এক ঝাঁক পাখি, হয়তো-বা হাঁস, একটি সরলরেখার আকারে, দক্ষিণ দিগন্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের ডানায় কোজাগরীর হাল্কা সোনার রঙের ছোঁয়াচ লেগেছে। তাই দেখে মধুসূদন গান ধরে। গানটির যথোচিত নির্বাচনে সবাই সমন্বরে ব’লে ওঠে, বাঃ। বাঃ।

‘সোনালী রঙের পক্ষীখানি,
ক্যামনে উইরা যায়।
যাও যদি পূবালী দ্যাশে,
কইও বন্ধুর কাছে,
দুঃখের নিশি ঝইরা যায়।
সোনালী রঙের পক্ষীখানি
ক্যামনে উইরা যায়।’

আকাশ থেকে চোখ নামাতেই এক অপূর্ব, অপার্থিব দৃশ্যের মুখোমুখি হলাম। জলে আধোডোবা বিস্তৃত, নরম ধানক্ষেত। শিশিরসিক্ত ধানের শীষগুলো চিক্‌ চিক্ ক’রে ওঠে। যেন একটি সূক্ষ্ম, দামী রেশমী চাদর বিছানো। জলের ওপর ঘন ছাই- নীল-সবুজ রঙের ধানক্ষেতের প্রতিচ্ছায়া। এই প্রশস্ত, সমান্তরাল, ছকের ওপর, আকাশজোড়া একটি তামা- সোনা-রূপো-পারদ মিশ্রিত বৃত্ত। প্রাপ্তবয়সে, দেশবিদেশে কত চন্দ্রোদয়ই তো দেখেছি। সবই যেন পুষ্পরাজ ম্যাগনোলিয়ার কাছে, নেহাত একটি টগর ফুল। রূপসী বাংলার এ বিশিষ্ট ছবিটি মনে এলে, আজও আমাকে উদ্‌ভ্রান্ত ক’রে তোলে। আমাকে নিয়ে যায় অনেক দূরে, অনাবিল এক সৌন্দর্যের জগতে, যেখানে জীবন খুলে দেয় হাজার খুশির দুয়ার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *