৩. ডেণ্টিস্ট আখতার মিঞা

ডেণ্টিস্ট আখতার মিঞা

‘দন্তচিকিৎসক’-এ-নামটি শোনামাত্রই আমাদের বুকের ভেতরটা কাটা কই- মাছের মতো লাফিয়ে ওঠে। তার ওপর চিকিৎসক যদি নিজের তালিম নিজেই দিয়ে থাকেন তাহলে তো আর কথাই নেই। প্রাণপাখিটি উড়ে যায়। এমনি এক ডেন্টিস্ট ছিল আমাদের পাড়ার আখতার মিঞা। তার দোকানে মস্ত সাইন-বোর্ডটির বাঁদিকে একটি মেমসাহেবের মুখাবয়ব আঁকা। রোদ-বৃষ্টি-আর্দ্রতার দাপটে তাঁর মুখের আসল রঙটির অনেকটাই উঠে গেলেও, কোনো-এককালে তাঁর গণ্ড যে খোরাসানী আপেলের মতোই মসৃণ এবং গোলাপী ছিল, একটু নজর দিলে, তা এখনো ধরা পড়ে। নিলামের দোকানে পুরানো ভাঙা পিয়ানোর পর্দা-গুলোর মতোই ময়লা একপাটি পোকা-খাওয়া দাঁত বের ক’রে তিনি এমনই মুখ-ভঙ্গি ক’রে থাকেন যে- হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন একটি মেয়ে-কঙ্কাল মুখ ভ্যাংচাচ্ছে। এ-ছাড়া তাঁর দুই চোখে ছিল দুই দৃষ্টি। দাঁতের ব্যথায় গভীর বিষাদে-ভরা ডান চোখটি অপলক চেয়ে আছে পুবের আকাশ-পানে। পশ্চিমে নিবদ্ধ অন্য চোখটি দুষ্টুমি-ভরা ইশারায় কী যেন বলে। শুনেছি, এক আনাড়ি সাইনবোর্ড-চিত্রকরের হাতে প’ড়ে সুন্দরী বিদেশিনীর এই হাল হয়েছিল নাকি। তাঁর মরচে-ধরা লোহার রঙের কবরীটি গাদা- গাদা কনকচাঁপায় অলংকৃত। যুক্তির দৃষ্টিতে অপরাধ হলেও, চিত্রকরের স্বাভাবিক কামনাটি এমন দোষের কি! হাজার হোক, অবন ঠাকুর থেকে মায় পরিতোষ সেন পর্যন্ত সবাই খোঁপা আঁকলেই তো তাতে ফুল গুঁজে দিয়েছেন। মেমসাহেবের ডান পাশে আসমানীরঙের পট-ভূমিকায় মস্ত বড়ো ইংরেজি হরফে লেখা–”ডাঃ জেড.এম.আতার, ওয়ারল্ড-রিনাউও-ডেন্টিস্ট”। কটকটে লাল রঙে লেখা এই হরফগুলোর একপাশে ঘন কালো ছায়া ফেলে চিত্রকর তাদের অস্বাভাবিক রকম ফুটিয়ে তুলেছে। তাজমহলের অন্দরের নক্সার অনুসরণে, হরফের চারপাশ, অনুরূপ ফুল-লতা-পাতায় ভরা। এক কথায়, সাইনবোর্ডে তিলধারণের স্থান ছিল না। অবিশ্যি আতার “ডেন্টিস্ট আখতার মিঞা” মিঞার মতে, এই জায়গার অভাবের দরুনই তার দন্তচিকিৎসাবিদ্যার যথাযথ খেতাবটি সাইনবোর্ডে স্থান পায়নি। দোষটি পুরোপুরি নাকি চিত্রকরেরই। কিন্তু যে-রোগীর একবার তার চিকিৎসার অভিজ্ঞতা অর্জন করার সুযোগ হয়েছে, তার পক্ষে এ-যুক্তিটি অবিশ্যি মেনে নেয়া মোটেই সহজ হ’ত না।

একদিন আমি এবং আমার শৈশবের অতি প্রিয় বন্ধু শন্তু, একসঙ্গে স্কুলে যাচ্ছি। হঠাৎ এক বিকট চিৎকারে আমরা থেমে গেলাম। একেই তো ভয়ানক আর্তনাদ তার ওপর আবার বামাকণ্ঠ। আখতার মিঞার চেম্বারের মস্ত বড়ো কাঁচের জানলায় নাকমুখ চেপে উঁকি দিতেই দেখি, তার বিশেষ চেয়ারটিতে উপবিষ্ট প্রৌঢ়া এক মহিলা ছাদের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছেন। একটি যুবক পেছন থেকে চেপে ধ’রে আছে তার হাতদুটি। গায়ে ময়লা শাড়ি। কাঁকড়ার ঠ্যাং-এর মতো সাঁড়াশিটি দিয়ে মিঞা দাঁত খিঁচিয়ে, তাঁর মাড়ির দাঁত ধরে টানাটানি করছে। মহিলার চিৎকারও সেই অনুপাতে তীব্র নিষাদে চড়ছে। এ ধরনের ঘটনা মাঝে- মাঝে ঘটলেও দাঁতের ব্যথায় আত্তার মিঞাকে স্মরণ করা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় ছিল না। তৎকালের ঢাকা শহরে, উপযুক্ত শিক্ষাপ্রাপ্ত ডেন্টিস্ট খুব কমই ছিল। তাছাড়া আমাদের ইসলামপুর পাড়ার ত্রিসীমানার মধ্যে সবেধন নীলমণি এই আখতার মিঞাই।

পেশার খাতিরে খানিকটা আসুরিক উপায়ের আশ্রয় নিতে হলেও, তার প্রশস্ত ছাতির তলায় কোমলতার যে একটি পুষ্করিণী ছিল সে-কথা কে না-জানত। গরীব- দুঃখীজনরা তার দুয়ারে এসে কখনো খালি হাতে ফিরে যেত না। প্রতি বছর রমজানের শেষে সে অল্পবিস্তর দানখয়রাত ক’রে থাকে। তাছাড়া, বিপদে-আপদে পাড়াপড়শী অনেকেরই পাশে তাকে দাঁড়াতে দেখেছি।

দুর্গোৎসবের মাসখানেক আগেকার কথা। মধ্যাহ্নভোজন সেরে সবেমাত্র আমরা ওপরে উঠে এসেছি, এমন সময় একের পর এক, প্রচণ্ড বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজে গোটা বাড়ির দরজা-জানালাগুলো ঠক্ঠক্ ক’রে উঠল। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। হাওয়ায় পোড়া বারুদের উৎকট গন্ধ। দেখি মসজিদের তলায় বাজিকর ঝুলুর মিঞার দোকান থেকে ভুষো কালো ধোঁয়া পাকিয়ে-পাকিয়ে উঠে আশেপাশের সমস্ত বাড়িঘর আচ্ছন্ন ক’রে ফেলছে। শুধু আজান দেবার সাদা গম্বুজটি বেরিয়ে আছে। দৌড়ে সেখানে পৌঁছতেই শোনা গেল যে, তুবড়িতে বারুদ্ ঠাসবার সময় আকস্মিকভাবে আগুন ধরে যায়। পাশেই, আপেলের গুচ্ছের মতো, মস্ত-মস্ত সদ্য তৈরি বোমা, দড়ি থেকে ঝুলছিল। চোখের নিমেষে বারুদের আগুন সেখানে পৌঁছে গেল। বাজিকর আহত হয়ে দোকানের ভেতরই আটকা পড়ে যায়। বালতি- বালতি জল-বালি ঢালা সত্ত্বেও আগুন যদিও-বা কিঞ্চিৎ কমল, বিস্ফোরণের কোনোই লাঘব নেই। আখতার মিঞা কোথা থেকে ছুটে এসে ভালোমন্দ বিচার না-ক’রেই এক দুঃসাহসিক কাণ্ড ক’রে বসল। নিজের জীবন বিপন্ন ক’রে, এক লাফে দোকানের ভেতর প্রবেশ ক’রে ঝুলুর মিঞাকে দু-হাতে তুলে আনল। ঘোড়ার গাড়িতে বসিয়ে তৎক্ষণাৎ তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল ।

আখতার মিঞার দোকানে যাবার পথটি ছিল আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই। তার চেহারার জৌলুশ বাড়াবার উদ্দেশ্যেই হোক কিংবা একদা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত থাকার দরুনই হোক, বছরের তিনশো পঁয়ষট্টি দিন, ইউনিফর্মের মতোই, তার পরনে মিলিটারি খাকি হাফসার্ট, মালকোচা-মারা ধুতি, আর পায়ে সাদা ক্যাম্বিসের জুতো। পোশাকআশাকে তার এই বৈশিষ্ট্যটি লক্ষণীয় ছিল দুই কারণে। প্রথমত শহরের বেশিরভাগ মুসলমানই পরত লুঙ্গি আর বোতামওয়ালা রঙিন গেঞ্জি, কিংবা পায়জামা-পাঞ্জাবি। দ্বিতীয়ত কাজেকর্মে, চালেচলনে বস্তুত সব ব্যাপারেই আখতার মিঞার মৌলিকত্ব। প্রতিদিন ভোরে গজগমনে মিঞা যখন দোকানের দিকে এগোয়, আমাদের গোটা বাড়িটা থরথর ক’রে কেঁপে ওঠে। যেন দশ টন একটা রোলার যাচ্ছে! ঢাকার সদর জেলের কাছে পিলখানার সংলগ্নই তার বাড়ি। হয়তো এই কারণেই ওখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে তার কিঞ্চিৎ শারীরিক সাদৃশ্য। তাছাড়া, পাতিয়ালার বিখ্যাত কুস্তিগির জুম্মা খাঁর কাছে কিছুদিন নাকি শাকরেদিও করেছিল।

আখতার মিঞার যাতায়াতের সময় আমাদের সংকীর্ণ জিন্দাবাহার গলিটি সাময়িকভাবে অন্ধকার হয়ে আসে। যেন হঠাৎ আংশিক সূর্যগ্রহণ হচ্ছে। তার দেহের এবং চুলের রঙ দুই-ই এত কাছাকাছি ছিল যে কোনটি বেশি ঘন, তা ঠাহর করা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। তার পর্বতপ্রমাণ বপুটিতে একদিকে ওজনের, আর অন্যদিকে চর্বি এবং মাংশপেশীর চমৎকার বিভাজন। এ দুই-ই যেন দোকানের থানকাপড়ের মতো আপাদমস্তক থাকে-থাকে সাজানো। অনেকটা মোটরগাড়ির মিচেলিন টায়ারের বিজ্ঞাপনের বহুপরিচিত লোকটির মতো। এবং এই লোকটির মতোই তার মুখেও সর্বদা একটি হাসি। নানারকম প্ররোচনা-উত্তেজনার মুখেও এই হাসিটি তার ঠোঁটে ভোরের পারিজাতের মতোই অবশ্যম্ভাবী-রূপে ফুটে থাকে, এবং তার রেণু ছড়ায়।

প্রতি বছর বর্ষার শেষে, নুরুদ্দিন মিঞা আমাদের গলির মুখে একটি আখের দোকান লাগায়। সোনালী রঙের পাকা আখের আঁটিগুলো, বিকেলের আলোয় বেশ রসাল দেখাচ্ছে। আখ কিনে বাড়ি ফিরব, এমন সময় আমার চোখ, গলির বিপরীত দিকের দোকানটির দিকে গেল। আখতার মিঞা একটি ন্যাকড়া বালতিতে ডুবিয়ে মেঝেটি মোছামুছি করছে। মোছা শেষ ক’রে মিঞা, বালতি ভরতি ময়লা জলটা দোকানের ভেতর থেকেই, ধুলো ভরতি রাস্তার দিকে ছুঁড়ে দিল। একটি ভদ্রলোক বয়সে প্রৌঢ়, পরনে দামী চীনা সিল্কের পাঞ্জাবি এবং লুঙ্গি, হাতে রূপোর হাতলওয়ালা ছড়ি, পায়ে হরিণের চামড়ার চটি-ঠিক সেই মুহূর্তে আখতার মিঞার দোকানের সামনে দিয়ে সান্ধ্যভ্রমণে যাচ্ছিলেন। তাঁর এই শৌখিন পোশাকআশাকের যে কী হাল হ’ল তা সহজেই অনুমেয়। ব্যাপারটি এমনই হঠাৎ এবং অপ্রত্যাশিতভাবে ঘঠল যে, ভদ্রলোক তাঁর পাঞ্জাবিটার দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তারপর দোকানদারের দিকে দৃষ্টি যেতেই তাঁর খয়েরি রঙের ডাগর চোখদুটি অবিকল পাকা বটফলের রূপ ধারণ করল। একদিকে হতবুদ্ধি, আরেকদিকে প্রচণ্ড ক্রোধ, এ-দুয়ের সংমিশ্রণে, তিনি একটি ম্যালেরিয়া রোগীর মতো কাঁপতে থাকলেন। সেই অবস্থাতেই তার মুখে চিৎকার-চেঁচামেচির একটি ফোয়ারা ছুটল। ছোটোখাটো একটি ভিড়ও জ’মে গেল। আশ্চর্যের বিষয় এই যে দোকানের ভেতর, অপরাধী লোকটি, একটি মূর্তির মতো সম্পূর্ণ নিশ্চল এবং নীরব। মুখে কুমারীসুলভ সলজ্জ, সবিনয় হাসি। গালিগালাজের অনুপাত বৃদ্ধির সঙ্গে-সঙ্গে তার হাসিটি আস্তে-আস্তে এ-কান থেকে ও-কান অব্দি ছড়িয়ে পড়ল। এ কৌতুকপ্রদ দৃশ্যটি দেখে ভিড়ের মধ্যে কারুর কারুর মুখেও হাসির রেখা ফুটে উঠল। অল্পক্ষণের মধ্যে একটি সংক্রামণের মতোই, এই হাসি সমবেত সকলের মুখে ছড়িয়ে পড়ল। সিল্কের পাঞ্জাবি পরিহিত ভদ্রলোকটি বিহ্বল হয়ে এদিকে-ওদিকে তাকালেন। তারপর তিনি নিজেও হাসতে-হাসতে এগিয়ে গেলেন।

আখতার মিঞাকে দেখে মিচেলিন টায়ারের লোকটির কথা মনে আসার আর- একটি কারণ হ’ল এই যে, তার শরীরের অনুপাতে মাথাটি অত্যাধিক রকমের ছোটো। ঠিক যেন বিরাট জালার মুখে ছোট্ট একটি ঘটি। এ-রকমটি দেখাবার জন্য হয়তো তার বিশেষ ধরনের চুলের ছাঁটই দায়ী। চুল ঘন থাকা সত্ত্বেও মাথার পুরো পেছনের দিকটাই কামানো। কানের দু-পাশেও তাই। শুধু সামনের দিকে তিন-চার ইঞ্চি লম্বা কয়েক গাছা চুল। তার মাঝখান দিয়ে সুতোর মতো সরু সিঁথি। অতি যত্নে গুনে-গুনে ডান পাশে ছ’টি বাঁ পাশেও ছ’টি–ঢেউ খেলিয়ে দিত। কিংবদন্তি ছিল যে তার চুলের এই বাহার দেখে, জয়নাব, জুবেদা, সিতারা-এ রকম অনেক পর্দানশিন যুবতীরাই নাকি হিংসার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। সে যাই হোক, মাথার কেশের স্বল্পতাকে পূরণ ক’রে দিয়েছিল তার শরীরের লোমের অস্বাভাবিক ঘনত্ব এবং বৃদ্ধি। বোতাম-খোলা কামিজের ভেতর থেকে তার কপাটবক্ষের ঘন জঙ্গল যেভাবে উঁকিঝুঁকি মারে তাতে ক’রে দর্শকদের মনে, বাকি শরীরের লোমের পরিমাণ সম্বন্ধে কৌতূহলের সীমা ছিলনা।

বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের অসহ্য ভ্যাপসা গরম। এ-রকম দিনে দোকান থেকে বাড়ি যাবার সময় আত্তার মিঞা আরমানিটোলার মাঠে থেমে যেত। সেখানকার সবুজ নরম ঘাসের ওপর ঠাণ্ডা, খোলা দখিন হাওয়ায় শুয়ে ব’সে তার বিরাট বপুটিকে একটু জুড়িয়ে নিত।

একদিন ঐ-মাঠে ফুটবল ম্যাচ্ খেলে আমরা ফিরছি। সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে। মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে কয়েকটি গোরু ঘাস খাচ্ছে। দূর থেকে আবছা সাদাকালো একটা বস্তু আমার নজরে এল। সেটির কাছে আসতেই দেখি আখতার মিঞা উপুড় হয়ে শুয়ে, পরিত্রাহি নাক ডাকছে। এলিয়ে দেয়া বিস্তৃত খালি গা ঘাসের সঙ্গে মিশে আছে। ধুতিটা গুটানো, কোমরের চারপাশে গোঁজা। খাকি হাফসার্টটি পোটলাকারে পাশে রাখা। সন্ধের অন্ধকারে দু-তিনটে বুভুক্ষু গোরু ঘাস খেতে-খেতে এক-পা দু- পা ক’রে এগিয়ে এসে, মিঞার বড়ো, কোঁকড়ানো, পিঠের এবং বগলের লোম ধ’রে টানাটানি আরম্ভ করল। গোরুগুলোকে দেখে অবশ্যি বোঝা গেল না যে এই কালো ঘাস তাদের মুখে কীরকম লাগল। যাই হোক, এ অচিন্তনীয় এবং অদৃষ্টপূর্ব দৃশ্যটি দেখে আমরা একেবারে হতভম্ব। হঠাৎ দেখি মিঞা ধড়পড় ক’রে উঠে বসল। কয়েক মুহূর্ত চুপ ক’রে রইল। তারপর হো-হো-হো-হো ক’রে সন্ধের আকাশ-বাতাস ভরিয়ে দিল। সে কী প্রাণখোলা নির্মল হাসি।

প্রতিদিন সকালে দোকানে পৌঁছেই আত্তার মিঞা চেয়ার-টেবিল মেঝে জানলার কাঁচ-এ সব-কিছুই নিজের হাতেই ঝাড়পোঁছ ক’রে সংলগ্ন পর্তুগীজ গির্জের কম্পাউণ্ড থেকে জল আনে। তার ত্রুটিহীন যত্নের দরুন, দন্তচিকিৎসার যন্ত্রপাতিগুলো আরশির মতো ঝক্‌ঝক্ করে। নিয়মিত রোগীর অভাবের দরুন তার হাতে অঢেল সময়। তার ওপর তার মস্ত বপুটি ছিল কর্মোদ্যমের একটি আকর। তাই মুহূর্তের জন্যেও নিষ্ক্রিয় থাকা তার পক্ষে একেবারেই অচিন্তনীয়

এদিকে পসারের স্বল্পতা, অন্যদিকে কুমার-জীবন, এ-দুয়ের টানাপোড়েনে একটি চাপা নিঃসঙ্গতা বোধ, একটি ব্যাধির মতো, প্রায়ই চাড়া দিয়ে ওঠে। একাকিত্ব তার কাছে নিতান্তই পীড়াদায়ক। তাই সময় কাটাবার জন্যে আশেপাশের দোকানীদের সঙ্গে গপ্পোগুজব করে। গায় পড়ে দালালিও করে। বে-পাড়ার কোনো লোক, আমাদের পাড়ায় ঠিকানার সন্ধানে এলে সে নিজে সঙ্গে গিয়েই বাড়িটি দেখিয়ে আসে। তাছাড়া পাশের মনোহারী দোকানের মালিক ব্রজবাবুর প্রয়োজনে, তাঁকে নতুন বাড়ির খোঁজ তো সে-ই এনে দিয়েছিল। নিজের কুমার জীবনের অবসান নাই-বা ঘটল, তাতে কি! ফলবিক্রেতা আগর মিঞার কন্যা আফসানার সঙ্গে ঘুড়িবিক্রেতা জমির মিঞার ছেলে কাঁদেরের বিয়ের ঘটকালিও তো সে-ই করেছিলেন।

চেহারায় যে আত্তার মিঞা অবিকল নবাবজাদার মতো নয়, এবং তার কুমার- জীবন দীর্ঘতর হবার এটিই যে প্রধান কারণ, সে-কথা তার জানতে বাকি ছিল না। কিন্তু পা থেকে মাথা পর্যন্ত তার ব্যক্তিত্বে যে বিরাট পৌরুষের ছাপ ছিল তা কি আর অস্বীকার করা যায়! তার ওপর প্রথম মহাযুদ্ধে মেসোপটে মিয়ায় জার্মানদের লড়াইয়ে মিঞার অসাধারণ এবং চাঞ্চল্যকর বীরত্বের কাহিনী এবং নানরকম আজব অভিজ্ঞতার কথা ঢাকা শহরে কে না-জানত!

মরুভূমির এক ভয়ংকর লড়াই-এর কথা। শত্রুপক্ষ পুরো এক হপ্তা ধ’রে অবিরাম তীব্র আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। তার দলের প্রায় সব সেপাইরাই নাকি একের পর এক গুলি খেয়ে, কিংবা বেওনেটের খোঁচায় যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করেছে। কেউ- কেউ নাকি নিখোঁজও হয়ে যায়। নানারকম কৌশল আর ধোকাবাজি ক’রে মিঞা জার্মানদের বর্বর আক্রমণ থেকে এক জনশূন্য ট্রেচের বালির তলায় লুকিয়ে আত্মরক্ষা করেছিল।

চীনে কালির মতো কালো মরুভূমির রাত। চারদিক সুসান্। মাঝে-মাঝে পশ্চিমি হাওয়া উঁচু-নিচু বালির ঢিপিতে ধাক্কা খেয়ে শোঁ-শোঁ আওয়াজ ক’রে উঠে থেমে যায়। একদিকে অসাধারণ ক্লান্তি আর সন্ত্রাস। তার ওপর পুরো এক হপ্তার তৃ ষ্ণায় এবং অনশনে মিঞার এমন অবস্থা হয়েছিল যে, পায়ের তলায় বালিকণাগুলোকে চিনির দানা ভেবে মুখে পুরে দেয় আর কি। যেন সে মরীচিকা দেখছে? খিদা পেলে তো বেড়ালে লোহা খায়! কিন্তু সে-লোহাই বা কোথায়! তাছাড়া বিদেশে-বিভুঁইয়ে, এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, তার লাশ পড়ে থাকবে এবং তাতে শেয়াল-শকুনিদের উদরপুষ্টি হবে, কথাটি সে কিছুতেই মনে আমল দিতে পারছিল না। কেমন ক’রে তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে যাবে এ-দুশ্চিন্তা তার মস্তিষ্কে জমাট হয়ে বসেছে। এমন সময় শত্রুপক্ষের দু-তিনটি আহত সৈন্য অন্ধকারে পালাতে গিয়ে হঠাৎ ট্রেচের মধ্যে পড়ে গেঁথে গেল। মিঞা বেশ খানিকক্ষণ মৃতের মতো ভান ক’রে রইল। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে একটু ক’রে এগোয়, আবার চুপটি মেরে প’ড়ে থাকে। এইভাবে খানিকটা এগুতেই মিঞা বুঝতে পেল, দৈত্যের মতো দেখতে ঐ তিনটি জার্মানই অক্কা পেয়েছে। ‘ওরে চাচা, আপনা জান্ বাঁচা’-পূর্ববঙ্গের বহুপ্রচলিত এই প্রবাদটি, সুদূর মেসোপটেমিয়ার তারকাখচিত, অবসাদজড়িত, মরুভূমির বিনিদ্ররাতে, একটি অবাধ্য মাছির মতো তার মনের চারিদিকে ভভন্ ক’রে পাক খেতে লাগল। মিঞা যতই সেটাকে তাড়াবার চেষ্টা করে, ততই মাছিটার জেদ বাড়ে। একদিকে দাউ-দাউ জ্বলছে জঠরের আগুন, অন্যদিকে দোজখের আগুন। কী সাংঘাতিক দ্বন্দ্ব! এ দুয়ের সংঘাতে মিঞা এক নিদারুণ বিভ্রান্তির গহ্বরে পড়ল। কী করবে! সে কী করবে! তা হলে কি পাগল হয়ে যাবে! নাকি সে পাগল হয়ে গেছে! তার মানবিক বৃত্তিগুলো- বুদ্ধি, বিবেচনা, ঘৃণা এ-সবই একের পর এক শুকনো ফুলের মতো তার হৃদয় থেকে খ’সে পড়তে থাকল। সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে যে, তার দুর্বল, শুষ্ক, মুমূর্ষ শরীর ক্রমশই একটা পশুর শরীরে রূপান্তরিত হচ্ছে। কী সাংঘাতিক যন্ত্রণা! কী অসহ্য! ‘হায় আল্লাহ!’ নীলাম্বরের দিকে চেয়ে সে হাঁটু গেড়ে বসল। ‘এ বেনেয়াদ খোদা এ কেয়ামতের দিনের মালিক, এ তামাম্ জঁহার পালনেওয়ালা। তুমি রহিম, তুমি করিম! তোমার এই হতভাগ্য খিদমতগারের সব কসুর মাপ করো।’ এই ব’লে শত্রুপক্ষের মৃত সৈন্যদের প্রথম একটিকে তার উদরে কবর দিল। এই স্বল্পাহারে তার জঠরাগ্নি এতই ক্ষেপে উঠল যে বাকি দুটিরও পর-পর একই গতি হ’ল। যুদ্ধক্ষেত্রের এই অসাধারণ নৈশভোজনের পর থেকে, দৈর্ঘ্য এবং প্রন্থে, আখতার মিঞা, দিন-দিন একটি হাতির মতো বাড়তে থাকল।

মহাযুদ্ধ শেষে উনিশ শো আঠারোর পাঁচই নভেম্বর মিঞা যখন ঢাকায় ফিরল, তাকে চেনা দায়, এমন-কি তার মার পক্ষেও। উচ্চতায় প্রায় সাড়ে-ছয় ফুট, বুকের ছাতি ষাটের কাছাকাছি।

এই অসাধারণ গল্পের কতক ছিল, তিরিশের টেররিস্ট আন্দোলন দমনে নিযুক্ত, বালুচ্ রেজিমেন্টের এক সেপাই এবং আখ্তার মিঞার মেসোপটেমিয়ার যুদ্ধের সাথী, জনৈক বুজদিল শাহ।

মহাযুদ্ধ শেষ হলেও, বন্দুকের সঙ্গে মিঞার সম্পর্কটি কিন্তু র’য়ে গেল! তার কারণ হয়তো এই যে, একদিকে তার শরীরের এক নতুন আসুরিক শক্তির সঞ্চার এবং অফুরন্ত সময়, অন্যদিকে প্রেমহীন কুমার-জীবনের একঘেয়েমি। তাছাড়া মাঝে-মাঝে শহরের ইটপাটকেলের জঙ্গল এবং ধুলোবালি ছেড়ে, মুক্ত আকাশের তলায়, গাছপালার মধ্যে ঘুরে বেড়াতে তার ভালোই লাগে।

এক নতুন শখ আখতার মিঞাকে পেয়ে বসল। বুড়িগঙ্গার চরে বেলে হাঁস, ডাহুক, পানকৌড়ি ইত্যাদি যাবতীয় খাবার পাখি শিকার করা তার নিয়মিত উইক্- এণ্ড নেশা হয়ে দাঁড়াল।

বিনা কারণে হিংসাত্মক কার্যকলাপ তার কাছে ছিল নিতান্তই অর্থহীন। এ-রকম সময়ে, অনর্থক হিংসার কবল থেকে হিন্দুদের আশ্রয় দিয়ে গুরুতর ঝুঁকি নিতেও সে বিন্দুমাত্র ইতস্ততঃ করেনি। কিন্তু অযথা নিরীহ পাখিদের হত্যার কথা জিজ্ঞেস করলে আখতার মিঞা, খাবার উদ্দেশ্যে প্রাণীহত্যার ন্যায্যতার সমর্থন জানিয়ে তর্ক করে।

সব ব্যাপারে মিঞার মৌলিকত্বের কথা আগেই বলেছি। পাখি শিকারের বেলায়ও এই মৌলিকত্বের কোনো ঘাটতি দেখা দিল না।

একবার এই শিকারে তার সব কার্তুজ ফুরিয়ে গেল অথচ, একটি পাখিও ঘায়েল হ’ল না। পরাজয় শব্দটি তার অভিধানে কখনো স্থান পায়নি এবং এখনো পাবে না, এই প্রতিজ্ঞা করার সঙ্গে-সঙ্গেই মিঞার মাথায় এক উদ্ভট আইডিয়া খেলে গেল। ঝটপট সে নিজেকে বিবস্ত্র ক’রে নিল। দুই কাঁধে দুটি থলি ঝোলাল। চরের ছোটো-ছোটো গাছগুলোর মাঝে গিয়ে, ডালের অনুকরণে হাতদুটি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন অবিকল শীতের পাতাছাড়া ছোট্ট বটগাছটি। শিকারীও উধাও, বন্দুকও! এই দেখে পাখিগুলো একে-একে আবার ফিরে আসছে। হাল্কা বাতাসে পুকুরের জলের মৃদু আলোড়নের মতোই মিঞার মনে আনন্দের ছোট্ট-ছোট্ট ঢেউ খেলে যায়। একটি-দুটি ক’রে হাঁসগুলো এসে গাছের ডালে নিশ্চিন্ত মনে বসতে শুরু করল। আখতার মিঞা এমনই নিশ্চল এবং স্থবির যেন তার পায়ে সত্যিই বটগাছের শেকড় গজিয়েছে। একটি খয়েরি রঙের হাঁস তার বাঁ কাঁধে বসল। মিঞা তার ডান হাত নামাল। একটু থামাল। তারপর খুব আস্তে-আস্তে পিঠ ঘেঁষে সেই হাতটি বাঁ কাঁধের কাছে নিয়ে হাঁসের ল্যাজে ধ’রে, এক হ্যাঁচকা টানে নামিয়ে থলেতে পুরে দিল। কয়েক মিনিট পর আরেকটি এসে বসল। এদিকেও একই কৌশলে ধ’রে ফেলল। এই অভাবনীয় এবং অত্যন্ত মৌলিক উপায়ে সারা বিকেলে মিঞার শিকারের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল মোট চব্বিশটি পাখি। আখতার মিঞার অশ্রুতপূর্ব এবং অবিশ্বাস্য শিকার কাহিনীর যে এইখানেই ইতি নয় সে-কথায় পরে আসছি।

রমজানের মাস। সারাদিন নির্জলা উপোসের পরে আমাদের পাড়ার সব মুসলমানেরা হাত ধুয়ে নামাজ পড়ে। একত্র হয়ে ইফতার করে। আখতার মিঞা, মসজিদের দরজায় ভিখারীদের, ছোলাভাজা, ফুলোরি, পেঁয়াজি, মুড়ি ইত্যাদি কিনে বিলি করে। পুণ্য করবার উদ্দেশ্যে নয়, নিছক মানবিকতার খাতিরে। ধর্মীয় আচার, রীতিনীতির বাহ্যিক প্রকাশে তার তেমন আগ্রহ নেই। কিন্তু যাদের আছে তাদের প্রতি কোনোপ্রকার অবজ্ঞা অথবা অশ্রদ্ধা প্রকাশে সে নিতান্তই বিমুখ। মেসোপটেমিয়ার যুদ্ধের সময় নানা ধর্মের সেপাইদের সঙ্গে একত্রে লড়াই করা এবং সকল অবস্থায় সুখ-দুঃখের সমান অংশীদার হবার যে একক অভিজ্ঞতা তার হয়েছিল, সে-কথা সে কোনোদিনই ভোলেনি। সেদিন থেকেই মানবজাতির সহধর্মিতায় সে বিশ্বাসী। ব্যক্তিগত কোনো কারণেই হোক, কিংবা অন্যদের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধার খাতিরেই হোক, রমজানের এক মাসকাল, আখতার মিঞা শিকার থেকে ছুটি নেয়। সংযমের এই কালটিতে, জীবন তার কাছে নিরানন্দ এবং একঘেয়ে মনে হয়। ঈদ-উল-ফিতর-এর পরদিন থেকেই তার হাত-পা আবার নিশপিশ করে। শিকারের ধান্দায় তার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে।

হপ্তার পর হপ্তা, মাসের পর মাস পাখি শিকারের একঘেয়েমিতে মিঞার মনে এমন ক্লান্তি এল যে, নতুন কিছু শিকারের ধান্দায় সে মেতে উঠল। ঢাকা থেকে ভাওয়ালের দিকে যেতে যে জঙ্গল পড়ে তাতে সবরকম শিকারই তো পাওয়া যায়। তাছাড়া, বনে-বাদাড়ে একা ঘুরে বেড়াবার আনন্দই বা কম কিসের।

আমাদের পাড়ার পর্তুগিজ গির্জের কম্পাউণ্ডের ভেতর একটি মস্ত পেয়ারা গাছ ছিল। আমি আর শম্ভু পেয়ারা খাবার উদ্দেশ্যে সেদিকে এগোচ্ছি, দেখি আখতার মিঞা কম্পাউণ্ডের কল থেকে এক কুঁজো খাবার জল নিয়ে তার দোকানের দিকে যাচ্ছে। কাছাকাছি আসতেই শিকারের গপ্পো শোনাবার জন্যে তাকে, আমরা দু- জনে, গাজিগাজি ক’রে ধরলাম। মিঞার যুদ্ধ এবং শিকার-কাহিনীর মজুতের কোনো শেষ নেই। অতিরঞ্জনেও মিঞার জুড়ি নেই। তা সত্ত্বেও, মৌলিকত্বে গপ্পোগুলো নিতান্তই সরস এবং বলার ঢঙও তেমনি রসাল। কথার সঙ্গে পাকা অভিনয়ের মিশ্রণে, এগুলো তার মুখে এতই জ্যান্ত হয়ে ওঠে যে, ঘটনার প্রবাহ শুধু অব্যাহত থাকে না, যেন সেগুলো শ্রোতার প্রত্যক্ষেই ঘটছে। ডেন্টিস্ট না-হয়ে যদি পেশাদারী গল্পের কথক হ’ত তা হলে মিঞার পশার বেশি ছাড়া কম হত না ।

পাড়ার বেশিরভাগ কিশোরদের কাছে সে ছিল, আক্ষরিকভাবে টার্জানের মতোই এক অসাধারণ হিরো এবং এ-কারণেই মিঞার সঙ্গে তাদের খুব ভাব জ’মে উঠেছিল। তার খাকি হাফসার্টের বোতামওয়ালা বুকপকেট দুটি, তাদের জন্যে, সর্বদাই লজেন্স আর পিপারমেন্টে ঠাসা থাকে। তার এই কিশোরপ্রীতি অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখে; যাই হোক, রোমাঞ্চে, উত্তেজনায় এবং চাঞ্চল্যে তার শিকারকাহিনীগুলো, রণক্ষেত্রের কাহিনীর চাইতে কোনো অংশে কম ছিল না।

সেবার সারাদিন ধ’রে জঙ্গলে ঘুরে-ঘুরে মিঞা, খরগোশ-হরিণ তো দূরের কথা, একটি ছোট্ট ঘুঘু কিংবা তিতির পক্ষীরও সন্ধান পেল না। আজ পর্যন্ত সে কিছু- না-কিছু হাতে ক’রেই ফিরেছে। তাই আজ খালি হাতে ফিরলে লোকেই-বা বলবে কী! এ-কথা ভেবে তার অহমিকায় এমনই এক ধাক্কা লাগল যে, মিঞা তক্ষুনি সংকল্প করল, রাতটা জঙ্গলে কাটিয়ে পরদিন নিদেনপক্ষে একটা তিতির পক্ষী কিংবা বনমোরগ শিকার ক’রে ফিরবে। তাছাড়া জঙ্গলে রাত কাটাবার বেশ-একটা নতুন অভিজ্ঞতাও হবে। সঙ্গে যে-খাবার এবং জল এনেছিল তার অনেকটাই অবশিষ্ট আছে। কাজেই চিন্তা কিসের! যাই হোক, এত বড়ো বপু নিয়ে তো আর গাছে চড়ে রাত কাটানো সম্ভব নয়! এই মনে ক’রে মিঞা নিরাপদে, নিশ্চিন্ত মনে, নিদ্রা দেবার একটি জায়গার সন্ধানে বেরুল। খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি করবার পর, ঝোঁপের আড়ালে, শরের মতো লম্বা ঘাসে ঢাকা, মস্ত বড়ো প্যাকিং বাক্সের মতো একটা জিনিস দেখে মিঞা চমকে গেল। বিস্তৃত এই জঙ্গলের আশেপাশে, জনমানবের তো কোনো বসতি নেই। কোত্থেকে এটা এল? কৌতূহলে খানিকটা এগুতেই সে দেখল যে, ঐ-বাক্সটা একটা ইঁদুর মারবার কলের মতোই। সরু সুলি দিয়ে গাছের ডালের সঙ্গে বেঁধে খাঁচার দরজাটা ফাঁক ক’রে রাখা আছে। আরো কাছে গিয়ে ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারতেই সন্দেহ হ’ল যে খাঁচার অন্ধকারে কী একটা খস্‌খস্ আওয়াজে নড়ছে-চড়ছে। চমকে গেলেও প্রথম মহাযুদ্ধের বীর যোদ্ধা এত অল্পতে ঘাবড়াবার পাত্র নয়। এ-রকম পরিস্থিতিতে তার দুঃসাহসিক বৃত্তিগুলো এক অজানা কারণে সুড়সুড়ি দিয়ে জেগে ওঠে। মিঞা তার বন্দুকটা নেড়েচেড়ে সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিল। তারপর একটা দেয়াশলাইর কাঠি ধরিয়ে উঁচু ক’রে ধরতেই দেখতে পেল, দড়িতে বাঁধা একটা কুচকুচে কালো ছাগল খাঁচার অন্ধকারে মিশে গিয়ে ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে। মিঞাকে দেখেই দড়ি ছিঁড়ে যেন ছুটে এগিয়ে আসতে চাইছে। এবার মিঞার কাছে খাঁচার রহস্যটা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার হয়ে গেল। ‘বাঃ; খাসা, খাসা। দরজাটা নামিয়ে দিয়ে এই খাঁচার মধ্যে শুয়ে নিশ্চিন্ত মনে একটা ঘুম দেওয়া যাবেখন।’ ছাগলটা মিঞাকে কাছে পেয়ে যেন তার প্রাণ ফিরে পেল। কৃতজ্ঞতাবোধে, উঁ হুঁ হুঁ, উঁ হুঁ হুঁ, উঁ হুঁ হুঁ ক’রে, অবিকল উস্তাদ গাইয়ের মতো গলা কাঁপাতে থাকল। মিঞার মোলায়েম লোমশ শরীরের সঙ্গে নিজের গা ঘ’ষে, কালো চতুষ্পদটি অনির্বচনীয় এক আনন্দে মেতে উঠল। মিঞাও তাকে নিতান্তই নিকট মনে ক’রে তাকে জড়িয়ে ধরল, গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। এদিকে সারাদিনের হুজ্জতির পর তার চোখের পাতায় যেন জগদ্দল নেমেছে।

বনের রাত যেমনই নিঝুম তেমনই ঠুনকো। সরব একটানা ঝিল্লির ডাক সারা বনটার মধ্যে এমনভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, মনে হয় দু-তিনটা এরোপ্লেন একইসঙ্গে, একই গতিতে উড়ছে। শরতের ঘন নীল আকাশের নক্ষত্রের মতোই অসংখ্য জোনাকি জ্ব’লে উঠেই নিভে যায়। মাঝে-মাঝে প্যাঁচা আর তক্ষকের ডাক ঝিল্লিরবের একঘেয়েমিকে ভেঙে দিচ্ছে। বিকল জলের কলের মতো ফোঁটা-ফোঁটা শিশিরবিন্দু গাছের পাতা থেকে গড়িয়ে খাঁচার ছাদে প’ড়ে টুপটাপ্‌ আওয়াজ করে। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে মাঝে-মাঝে নিশাচর প্রাণীরা খাবার সন্ধানে ঘুরঘুর করে। আরো যে কত অপরিচিত রহস্যময় শব্দ তার হিসেব করা কঠিন। শহরের আওয়াজ থেকে কী স্বতন্ত্র। কখন যে মিঞা ঘুমের গভীরে তলিয়ে গেল টেরও পেল না।

অনেকক্ষণ একটানা ঘুমোবার পর মিঞার মনে হ’ল ছাগলটা অস্বাভাবিকরকম উঙ্কুশ্ করছে। তার কানের কাছে মুখটা এনে অদ্ভুত একটা চাপা আওয়াজে কিছু বলবার চেষ্টা করছে। টুটি টিপে ধরলে যে-রকম আওয়াজ বেরোয় অনেকটা সে- রকম। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় মিঞা তার গায়ে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতে গেলে, চতুষ্পদটা রীতিমতো মাথা দিয়ে ধাক্কা মারতে থাকল। দু-একটা পাখির অস্পষ্ট ডাক শোনা গেল। রাত কাবার হয়ে গেল নাকি! কিন্তু খাঁচার বাইরে এখনো যে ঘুটঘুটি অন্ধকার! হঠাৎ খাঁচাটা মস্ত এক ঝাঁকুনি খেয়ে মট্‌ট্ ক’রে উঠল। মিঞার চোখে অবশিষ্ট তন্দ্রাটুকু এবার উবে গেল। স্বপ্ন দেখছে না তো? একটু কান পেতে থাকতেই মিঞার মনে হ’ল খাঁচার বাইরে একটা-কিছু নিঃশব্দে ঘুরাফেরা করছে। এ-কথা ভাবতে-ভাবতেই খাঁচার দরজাটাকে নিয়ে কে টানা-টানি শুরু করল। পরমুহূর্তেই খাঁচাটা আগের মতোই আবার নড়বড় ক’রে উঠল। চিড়িয়াখানার জন্তুজানোয়ারদের খাঁচার সামনে দাঁড়ালে যে উৎকট গন্ধ পাওয়া যায় সে-রকম একটা দুর্গন্ধ মিঞার নাকে ভেসে এল। যাই হোক, ব্যাপারটা অবিলম্বে তদারক করা দরকার, এ-কথা ভেবে এগিয়ে গেল। একটা দেয়াশলাইর কাঠি ধরিয়ে খাঁচার দরজায় শিকের ফাঁক দিয়ে তাকাতেই মিঞার চক্ষুস্থির।

গলিত পিচের মতো চক্‌চকে কালো অন্ধকারে টর্চের মতো দুটো কী জ্বলছে! ঐ-আলো কিসের তা ঠাহর করবার আগেই অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু ঝাপ্‌সা-মতো যেটুকু দেখা গেল, তাতেই মিঞার শরীরে উত্তেজনা এবং রোমাঞ্চের বান ডাকল। সত্যি কথা বলতে কি বড়ো কিছু শিকারের জন্যে সেতো তৈরি হয়ে আসেনি। যাই হোক, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করতে হবে। যুদ্ধক্ষেত্রে এ-রকম কত অপ্রত্যাশিত, আচমকা পরিস্থিতিরই তো সে সহজে মোকাবিলা করেছে। শিকার যত বড়োই হোক- না কেন, যদি ঠিকমতো নিশানা ক’রে, দুই চোখের মাঝখানের বিন্দুটিতে কয়েকটি ছাগুলি বসিয়ে দিতে পারে, ঘায়েল হবার পক্ষে তাই যথেষ্ট। তাছাড়া তার হাত- পা’ই বা বন্দুকের চাইতে কম কিসের। এই হাত দিয়েই তো গণ্ডায় গণ্ডায় জার্মানদের শূন্যে উঠিয়ে মাটিতে আছড়ে মেরেছে-ভলিবলের মতো এখান থেকে ওখানে ছুঁড়ে দিয়েছে। কিন্তু কই! কোথায় গেল টর্চের মতো সেই চোখ। নিমেষের মধ্যে জানোয়ারটা কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল! হঠাৎ খাঁচাটা এমন অসম্ভবরকম দুলে উঠল যে তার কাঠের পাঠাতনগুলো খসে পড়ে আর কি। মিঞা তক্ষুনি ট্রিগারে হাত দিল। চারদিকে জমাট নিস্তব্ধতা। হয়তো একটা শুকনো শালপাতা হবে, ঠাস ক’রে মাটিতে পড়ল। পোকামাকড়দের চলাফেরাও থেমে গেছে। দারুণ অনিশ্চয়তাপূর্ণ এক মুহূর্ত! হঠাৎ খাঁচার ছাদে, সাংঘাতিক আওয়াজে, কী একটা ঝাঁপিয়ে পড়ল। ছাদটা মিঞার মাথায় পড়েছিল আর কি! জন্তুটা নিশ্চয়ই গাছে চ’ড়ে, ছাদ দিয়ে খাঁচায় প্রবেশ করবার চেষ্টা করছে। পরমুহূর্তেই দরজার সামনে লাফিয়ে পড়ে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। মিঞা দরজার আড়ালে বন্দুক উঁচিয়ে রইল। অন্ধকারের ভেতর থেকে জানোয়ারটা এবার হঠাৎ দৌড়ে এসে দরজায় প্রচণ্ড জোরে একটা থাবড়া মারল। পুরো খাঁচাটা চুরমার হয়ে গেছিল আর কি! মিঞা শিকারের দিকে নিশানা ক’রে পর-পর বন্দুক চালাল। পাখি মারার ছরাগুলি যতই তার গায়ে লাগছে, জানোয়ারটাও বিরক্তিতে, ততই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। একেকবার খাঁচাটাকে ধাক্কা মারে,গুলি খেয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিঞার কার্তুজগুলো সব খালি হয়ে গেল। এখন মিঞা করে কী! বন্দুকটা নামিয়ে রাখল। খাঁচার দরজাটাকে খানিকটা ফাঁক ক’রে দিয়ে আড়ালে ঘাপটি মেরে রইল। দু-এক ফোঁটা শিশিরজলের টুপটাপ্ আওয়াজ বনের নিস্তব্ধতাকে সরব ক’রে তুলল।

মনে হ’ল খাঁচার তলায় খুব আস্তে-আস্তে কিছু নড়াচড়া করছে। তারপরই মিঞা দেখল যে, নিঃশব্দে, তার পেছনের দু-পায়ে ভর ক’রে জানোয়ারটা খাঁচার দরজাটা ধরে দাঁড়িয়ে উঠেছে। লাফ দিয়ে ভেতরে উঠে আসে আর কি! এই একক মুহূর্তটির জন্যেই মিঞা এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। যেই-না দরজার ফাঁক দিয়ে মাথা গলাল, বিদ্যুৎবেগে দরজাটাকে বিরাট জন্তুটার গর্দানের ওপর নামিয়ে দিল। তার একটা থাবাও চাপা পড়ল। অন্য থাবাটা দিয়ে দরজাটা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করল। মিঞা তার পুরো শক্তি আর ওজন দিয়ে তার ওপর চেপে বসল। সাংঘাতিক এক ধস্তাধস্তিতে খাঁচার মেঝের এক দেওয়ালের কয়েকটা পাঠাতন খ’সে পড়ল, সে এক তুমুল কাণ্ড। মেসোপটেমিয়ার মরুভূমিতে সেই অসাধারণ নৈশভোজনের পর তার গায়ে যে আসুরিক শক্তি জন্মেছিল, তা আজ পরখ করবার প্রথম সুযোগ পেল। সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করল যে, পূর্ণবয়স্ক একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্দান চেপে রাখতে একমাত্র তার বাঁ হাতই যতেষ্ট। এ-রকম দুটো বাঘ একসঙ্গে এলেও কোনো অসুবিধে হ’ত না। তার শরীরের এই প্রচণ্ড শক্তির খবর পেয়ে যেমন সে চমকে উঠল, তেমনি গর্বে তার শরীরের মাংসপেশীগুলো নেচে উঠল। প্রায় সুদীর্ঘ ত্রিশ মিনিট ধস্তাধস্তির পর বাঘটা ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। মিঞা কিন্তু কোনো ঝুঁকি নিতে চাইল না। বুদ্ধি আর ধূর্ততায় পশুজগতে বাঘের যে জুড়ি নেই, এ-কথা মিঞা ভালো ক’রেই জানে। তাই বাঘটা যে ধোঁকাবাজি করছে না, কে বলতে পারে। এইভাবে আরো খানিকক্ষণ কাটল। তারপর ব্যাপারটা যে-ধরনের একটা নাটকীয় মোড় নিল, মিঞা তার জন্যে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না।

একটা বনমোরগ ডেকে উঠল-কুক্কুরু কু, কুক্কুরু কু। সে-ডাক শুনে দু-একটা কাকও ডাকল। তারপর আরো কয়েকটা কাক, বসন্ত বাউল এবং হাড়ি-চাঁচার ডাক শোনা গেল। এই ঘন শালবনে ভোরের আলো প্রবেশ করতে স্বভাবতই বেশ দেরি হচ্ছিল। অনেক দূর থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ মিঞার কানে ভেসে এল। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই আওয়াজ একটা গোলমালের আকার ধারণ করল।

মাদল, ঢাক, ঢোল, নাকারা, ঢ্যারা, ক্যানেস্তারা ইত্যাদির আওয়াজের সঙ্গে মানুষের চিৎকার! এই গোলমালের আওয়াজ ক্রমশই স্পষ্টতর হচ্ছে। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরের আবছা আলোয় শালগুঁড়ির ফাঁক দিয়ে তাকাতেই দেখা গেল যে এক জনতা- হাতে বর্শা, লাঠি, মাছ ধরবার ট্যাটা, কোঁচ্–এ–সব নিয়ে এগুচ্ছে। মেসোপটেমিয়ার যোদ্ধার মনে না এল কোনো আশঙ্কা, না এল কোনো চিন্তা। হঠাৎ ঢাক, ঢোল, টিনের আওয়াজ থেমে গেল। চিৎকার চেঁচামেচিও। লোকগুলো স্থিরদৃষ্টিতে খাঁচার দিকে চেয়ে আছে। ভীষণ তৎপরতার সঙ্গে, নিজেদের মধ্যে কি কানাঘুষো আরম্ভ করল। তারপর, আবার একদম চুপ্। হঠাৎ ঢাক-ঢোল-ন্যাকারা- ক্যানেস্তারা, যুদ্ধের দামামার মতো একই সঙ্গে বেজে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে জনতাও ক্ষিপ্ত হয়ে লাঠি, ট্যাটা, কোঁচ্, বর্শা উঁচিয়ে, ‘মার’ ‘মার’ চিৎকারে এগুতে থাকল। খাঁচার দরজাটি প’ড়ে বন্ধ আছে। তার পিছনে আখতার মিঞা। হঠাৎ তার বুকের মধ্যে একটা ভয় লাফ দিয়ে উঠল। যুদ্ধোত্তর জীবনে এই তার প্রথম ভয়। হয়তো একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। হয়তো তার জান নিয়ে টানাটানি হবে। আখতার মিঞা দু-পা দিয়ে খাঁচার দরজাটাকে চেপে ধরে, তার দু-হাত খাঁচার বাইরে উঁচিয়ে ধরল। তারস্বরে চিৎকার করতে থাকল, ‘আমি মানুষ’ আমি মানুষ।’ মিঞার লোমশ কালো শরীরটাকে দেখে জনতা ততোধিক হচকিয়ে গেল, এ কী! বাঘের খাঁচায় বনমানুষ কি ক’রে এল। ভূতপ্রেত নয় তো? খাঁচার দরজার তলায় নেতিয়ে-পড়া বাঘের শরীরটা কাশের মতো লম্বা-লম্বা ঘাসে ঢাকা পড়ে আছে। এদিকে মিঞা তার সর্ব শক্তি দিয়ে তেমনি আর্তনাদ করে যাচ্ছে-’আমি মানুষ, আমি মানুষ।’ তার বিরাট পেঠের খোলের ভেতর থেকে এই নাদ্ উঠে শালের ডগায় ধাক্কাখেয়ে, উউষ্… উউফ্…উউহ্ ক’রে প্রতিধ্বনি করতে থাকল। জনতা লক্ষ করল যে আখতার মিঞা তার ডান হাতের তর্জনী নিচের দিকে ক’রে কী একটা নির্দেশ করছে। তারা এক পা-দু’পা ক’রে এগুচ্ছে, কিন্তু এই তর্জনী-নির্দেশের কোনোই হদিশ পাচ্ছে না। আচমকা এক দমকা হাওয়ায় খাঁচার সুমুখের ঘাসগুলো নুয়ে পড়তেই বাঘের মুণ্ডুটা মুহূর্তের জন্যে দেখা দিয়ে আবার ঢাকা পড়ে গেল। ব্যাপারটা পুরোপুরি খোলশা না-হ’লেও জনতার বুঝতে দেরি হ’ল না যে খাঁচার ভেতর এই কালো, লোমশ জীবটা বাঘটাকে কোনো বিপদে ফেলেছে। এই মনে ক’রে তারা সন্তর্পণে এগুতে থাকল। তারপর সব খামোশ্। জনতার চোখ ছানাবড়া। হঠাৎ ঢাক- ঢোল-নাকারা-ঢ্যারা-ক্যানেস্তারা ভীষণ জোরে বেজে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হ’ল নৃত্য। আখতার মিঞা খাঁচার ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে ধেই-ধেই ক’রে নাচতে থাকল। সারা শালবনটা একদিকে নৃত্যসংগীতের উল্লাসে আর অন্যদিকে মিঞার নাচের তালে কেঁপে উঠল।

আমি আর শম্ভু স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে অসাধারণ কাহিনীটি শুনছি, এমন সময় আখতার মিঞা ‘ব্যাস’ এই ব’লে নাটকীয়ভাবে উঠে পড়ল। আমরা দু-জনে লাফ দিয়ে তক্ষুনি তার হাত ধ’রে ফেললাম। নাছোড়বান্দার মতো বলি, ‘না না। এইখানে গপ্পো শেষ করলে চলবে না। এমন জবরদস্ত, দুঃসাহসিক শিকার-কাহিনীর কথা কেউ জানল না, এ কী ক’রে সম্ভব হয়।’ আখতার মিঞা ‘সময় নেই আর একদিন হবে’ এইসব ব’লে নানারকম নখরাবাজি করে, আমরাও নাছোড়বান্দা। মিঞা অবিশ্যি আমাদের এ-কাকুতিমিনতির জন্যেই অপেক্ষা করছিল। তারপর সংক্ষেপে যা বলল তা অনেকটা এইরকম।

এ অসাধারণ বীরত্বপূর্ন শিকারকাহিনী ঢাকাবাসীদের কানে যেমন ক’রেই হোক, তাকে পৌঁছে দিতে হবে। তাছাড়া, বাঘের লাশটা দেখালে জেলার সাহেব ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে নগদ পুরস্কারও পাওয়া যাবে।

পরদিন বেলা তিনটে নাগাদ আমাদের ইসলামপুর বাবুরবাজার পাড়ায় অসাধারণ উত্তেজনা। পাড়াশুদ্ধ লোক-এমন-কি পর্দানশিন্ জুবেদা,জয়নাব, সিতারাও রাস্তার দু-পাশে ভিড় ক’রে ভীষণ উৎকণ্ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। নবাব বাড়ির ফটকে খোদ্ নবাব সাওে উপস্থিত। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেল বাবুরবাজারের পুলের ওপর দিয়ে আখ্তার মিঞার জলুস্ এগিয়ে আসছে। আরেকটু এগুতেই দৃশ্যটি স্পষ্ট হয়ে উঠল। সামনে নাকারাবাদকেরা, পিছনে-মিঞা, বন্দুক হাতে। গায়ে তার বহুপরিচিত পোশাক– মিলিটারি খাকি হাফ-শার্ট, মালকোঁচামারা ধুতি, ক্যাম্বিসের জুতো। মুখে মৃদু হাসি। স্ফীত, প্রশস্থ বুক। চলার রকমটি দেখে মনে হয়, ঠিক যেন ছোটোখাটো একটি পাহাড় গজগমনে এগিয়ে আসছে। তার পেছনে কুড়িটি লোকের কাঁধে-রাখা লম্বা বাঁশ-দুটি থেকে বিরাট রয়েল বেঙ্গল টাইগার ঝুলছে। ল্যাজসমেত বারো ফুটের বেশি চাই তো কম নয়। বিকেলের পড়ন্ত আলোতে তার ডোরাকাটা, মর্তমান কলার রঙের লোমশ অবয়বটি কুচকুচে কালো বাহকদের মাঝখানে প’ড়ে এমনই জাঁকালো বৈষম্য সৃষ্টি করেছে যে,

বাঘটা দূর থেকে ঠিক সদ্য পালিশ-করা একটি সোনার ভাস্কর্যের মতো ঝলমলিয়ে উঠছে। কী অসাধারণ সুন্দরী প্রাণী। যেমনই তার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সুষমা, তেমনি বহিঃরেখার ছন্দ। প্রাণহীন অবস্থায়ও যে একটি প্রাণী এত অসাধারণ সুন্দর হ’তে পারে, এ-বাঘটিকে যাঁরা দেখেছেন শুধু তাঁরাই জানেন। এমন প্রাণীকেই তো যথার্থ শার্দুল বলা যায়। এক কথায় সৃষ্টিকর্তা যেন তাঁর সৌন্দর্যের ভাণ্ডার উজাড় ক’রে দিয়েছেন তার গায়ে।

এতক্ষণে মিছিল আমাদের পাড়ার মসজিদের সামনে এসে পড়েছে। আখতার মিঞার বন্ধুরা, মোল্লারা, মসজিদের দোতলার আঙিনা থেকে পুষ্পবৃষ্টি করল। জনতার অবিরাম করতালিতে কানে তালা লেগে যায়। সাত্তার মিঞা, ঝুলুর মিঞা, মির্জাসাহেব, কালু মিঞা, অক্ষয়বাবু, ব্রজবাবু এবং আখ্তার মিঞার আরো অনেক বন্ধুরা সমস্বরে বলে উঠল, ‘জব্বর দেখাইলা মিঞা, জব্বর।’ হঠাৎ একটা মস্ত সাদা গোলাপ আখতার মিঞার প্রশস্ত, স্ফীত বুকের ছাতিতে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ল। কত ফুলই তো এতক্ষণ তার সর্বাঙ্গে প’ড়ে নিচে লুটিয়ে পড়েছে। কই, মিঞা তো সেগুলোকে কুড়োবার কোনো চেষ্টাই করেনি। কিন্তু এ-গোলাপটিকে একটি ছোটো টিয়েছানার মতোই দু-হাতে আল্‌তো ক’রে তুলে খানিকক্ষণ নাকের ডগায় ধ’রে রাখল। তার মুখের মৃদু হাসিটি মুখের এপাশ থেকে ওপাশ অব্দি ছড়িয়ে পড়ল। তারপর, সেটিকে বুকপকেটের বাট-হোলে গুঁজে দিল। এই জনসমুদ্রের ভেতর থেকে কে এই ফুল ছুঁড়ে দিল? এই রহস্যময় প্রশ্নটি, মিছিল শেষ হবার পরেও, অনেকের মনেই ঘোরাফেরা করতে থাকল।

মিছিল আর কয়েক গজ এগুতেই খোদ্‌ নবাবসাহেব উঠে এসে আখতার মিঞার গলায় অত্যন্ত সুগন্ধি ফুলের একটি মালা পরিয়ে দিলেন। তারপর, পাশে নোকরের হাতে-রাখা রুপোলি রেকাবি থেকে লাল রেশমী ফিতে লাগানো একটি স্বর্ণপদক তুলে মিঞার ছাতিতে পরিয়ে দিয়ে বললেন, “শাব্বাশ্ মিঞা, শাব্বাশ্। মুকরররর, মুকরর্র্!’

এই ঘটনার জের শেষ হ’তে-না-হ’তেই আরেকটি জাঁকালো ঘটনা ঘটল। বাঘ নিয়ে ঢাকায় প্রবেশের জয়োল্লাস মিছিলের মতোই আরেক মিছিল বেরুল। মিছিলের সামনে এবং পেছনে ভ্যাপো, ভ্যাপো আওয়াজে দুই বিরাট ব্যাণ্ড পার্টি। রঙবেরঙের জামা-পরা খালি গায়ে সারি-সারি কুলিদের মাথায় ঢেউ-খেলানো গ্যাসের বাতি। মাঝখানে সাদা জুড়িঘোড়ার ফিটন গাড়িতে ঈষৎ বাদশাহী ঢং-এ বসা একটি অসাধারণ পুরুষ। গায়ে রেশমী আচ্‌কান, হাতে মিছিলে প্রাপ্ত ফুলটির মতোই একটি সাদা গোলাপ। মাথায় জমিদার কালো মখমলের জমকালো লক্ষ্ণোই টুপি। গলায় বেলফুলের মালা। মুখে খুলির জোয়ারে বাঁধ দেয়া হাসি। দুলহার বেশে, ওয়ারল্ড- রিনাউণ্ড ডেন্টিস্ট, প্রথম মহাযুদ্ধ-প্রত্যাগত বীর যোদ্ধা এবং শিকারি, মিঃ জেড় এম আতার। পাশে তেমনি জমকালো লাল ওড়নায় ঢাকা শরমিলা দুলহান।

পরদিন আখতার মিঞার বিশ্বস্ত বন্ধু অক্ষয়বাবুর কাছে শোনা গেল যে, মিছিলের দিন ঐ ধপধপে সাদা বড়ো গোলাপটি নাকি জুবেদারই হাত থেকে এসে মিঞার বুকে টোকা মেরেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *