সিন্ পেণ্টার জিতেন গোঁসাই
ঢাকা শহরে আমাদের বাড়ির দক্ষিণে একটি কালীমন্দির। বাবুরবাজার- ইসলামপুরের জনাকীর্ণ এবং পরিবহনবহুল সদর রাস্তাটি এই মন্দিরের সামনে দিয়েই। বিপরীত দিকে একটি পর্তুগীজ গির্জে। খ্রীস্টানদের সব চাইতে পুরনো প্রার্থনাস্থল ব’লে এটি প্রসিদ্ধ ছিল। মজার ব্যাপার এই যে গির্জের শতকরা একশোজন প্রার্থনাকারীই শ্বেতাঙ্গদের দৃষ্টিতে ছিল নেটিভ খ্রীস্টান। সাহেবরা এ- গির্জের ছায়া মাড়াতেন না। গির্জের সংলগ্ন পুবদিকে একটি মসজিদ। নানা ধর্মের এই মিলনক্ষেত্রে সবধরনের জড়বাদীরাও যে মিলিত হবে তাতে আর আশ্চর্য হবার কি আছে! যেখানেই ধর্মের প্রকাশ্য ব্যবসায়িক বিকাশ, সেখানেই অৰ্থগৃধুতা, লাভলোকসান, প্রবঞ্চনা-সেখানেই তো কাম-লালসার চমৎকার সব আয়োজন। দেশবিদেশে সর্বত্র ঐ একই নিয়ম। তাই নানরকম দোকানপাটের একশো গজের মধ্যেই একটি সদর রাস্তার উত্তরে এবং আরেকটি দক্ষিণে-দুই শ্রেনীর বারবনিতাদের দুটি ঘন বসতি ছিল। সদর রাস্তা হলেও বস্তুত এটি একটি বাজার ছিল। সারি-সারি ফলের দোকান, কাবাব-পরোটার দোকান, বাখরখানির দোকান, মিষ্টির দোকান, দেশি-বিলিতি মদের দোকান, তামাকের দোকান, মনোহারী দোকান, পসারির দোকান, ঘুড়ির দোকান, ফুলের দোকান, হারমোনিয়ামের দোকান ইত্যাদি। কালীমন্দিরের বাঁ-পাশেই অক্ষয়বাবুর চায়ের দোকান। সেখানে সর্বদাই লোকজনের ভিড় আর নির্ভেজাল আড্ডা।
তারই সংলগ্ন এক চিলতে আর-একটি দোকান–প্রন্থে পাঁচ কিংবা ছয় ফুট, কিন্তু গভীরতায় ছিল পনেরো থেকে কুড়ি ফুট। এই বিশেষ দোকানটির ভেতর শুধু একটি লোকেরই ভিড়। আশেপাশের দোকানগুলোর থেকে এটি এতই স্বতন্ত্র, যেন একঝাঁক দাঁড়কাক-চিল-শকুনদের মধ্যে একটি নীলকণ্ঠ ময়ূরের আগমন। যেমনই স্বতন্ত্র ছিলেন এই দোকানের মালিক তেমনই ছিল তাঁর কাজকর্ম। বয়স প্রায় ষাট থেকে পঁয়ষট্টি। লম্বা সুঠাম দেহ। গড়পড়তা বাঙালিদের তুলনায় বেশ ফর্সা।
গায়ের চামড়ায় এখনো কোনো ভাঁজের লক্ষণ নেই। মেজাজ গুরুগম্ভীর। লম্বা তীক্ষ্ণ নাক। তার তলায় স্যার আশুতোষ-মার্কা গোঁফ। কানের পাশে গালপাট্টা। মাথায় থোকা-থোকা আধপাকা ঢেউ-খেলানো লম্বা চুল, ছোট্ট একটি পাহাড়ি জলপ্রপাতের মতো ঘাড় অব্দি নেমে এসেছে। গায়ে ময়লা গেঞ্জি। মালকোঁচামারা ধুতি। কোমরে সাদা-লাল ছককাটা গামছা। নেহাৎ প্রয়োজন না-হলে তিনি তাঁর এক চিলতে দোকানটি থেকে নড়াচড়া করেন না। কিন্তু পরিষ্কার জামাকাপড় প’রে ছাতা হাতে যদিও-বা কোথাও যেতেন, তাঁকে দেখে কেউ যদি আদালতের কড়া বিচারক ব’লে ভুল করে তাতে অবাক হবার কিছু ছিল না।
জিতেনবাবুর, অর্থাৎ জিতেন গোস্বামীর আসল পেশা ছিল থিয়েটারের সিন্- সিনারি আঁকা। বাঁশে আটকানো মস্ত বড়ো থান কাপড় ছাদ থেকে ঝুলে মেঝে অব্দি নেমে এসেছে। চার দিকে অসংখ্য ছোটো-বড়ো হাঁড়িকুড়ি, কৌটো, গ্লাস এবং ময়লা খবরের কাগজ ছড়ানো। ধোপার গামলায়, বাতিতে ময়লা আধময়লা এবং পরিষ্কার জল। নানা সাইজের লম্বা-লম্বা কয়েকটি তুলি জলে ডোবানো। আর কয়েকটি টুলের ওপর সাজানো। তারই সঙ্গে ঠেলাঠেলি করছে কয়েকটি ছোটো- বড়ো জুতোর ব্রুশ। ঘরের শেষপ্রান্তে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একই উচ্চতার অনেকগুলি খালি বোতল। সেগুলো যে ঔষুদের বোতল নয় তা তাদের নগ্ন গা দেখে সহজেই বোঝা যায়। এরই কাছাকাছি জানলার থাকে রাখা আছে ময়লা ছেঁড়াপাতার বেশ-কিছু বাংলা নাটকের বই।
সিন্ আঁকা ছাড়া জিতেনবাবুর কাছে থিয়েটারের টুকিটাকি নানারকম জিনিস- রাজারানীর সিংহাসন, ছোটোখাটো পাহাড়, বিশেষ বিশেষ চরিত্রের জন্যে ঢাল- তলোয়ার, গাছপালা ইত্যাদি তৈরি করবার ফরমায়েশও আসে। কাঠের ফ্রেমে পিচবোর্ড সেঁটে, তার ওপর যে-রঙটি যেখানে যেমন দরকার তেমনটি ক’রে লাগিয়ে দিয়ে হুবহু আসল জিনিসটির মতো তৈরি ক’রে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতেন। বড়ো সিসিনারি আঁকবার বেলায় জিতেনবাবু মোটা ক্রুশে মস্ত বড়ো-বড়ো পোঁচ মারেন। এ-ধরনের টুকিটাকি কাজের বেলায় তেমনই দেখাতেন তাঁর সুক্ষ্ম হাতের কারিগরি। চিত্রকর না-হয়ে যদি তিনি স্বর্ণকার হতেন, তাঁর পসার বেশি ছাড়া কম হ’ত না। বড়ো তুলির কাজই হোক আর ছোটো তুলির কাজই হোক, প্রহরের পর প্রহর তাঁর গভীর তন্ময়তা এবং আত্মনিয়োগ দেখে মনে হ’ত যেন তিনি স্বপ্নাবিষ্ট এবং অর্ধ-অচৈতন্য অবস্থায় অজানা এক শক্তির নির্দেশে কাজ করছেন। তাঁর এই অবস্থার কাছে সময় যেন চিরস্থির। এমনই তাঁর নিষ্ঠা, কাজের প্রতি এমনই তাঁর শ্রদ্ধা যে যেতে-যেতে কোনো পথচারী তাঁর কাজে আকৃষ্ট হয়ে যদি হঠাৎ থেমে যেত অত্যধিক বিরক্তিবোধে তক্ষুনি গুরুগম্ভীর চাপা আওয়াজে আদেশ দিতেন, ‘যাও, আগে বাড়ো!’ বহু-ব্যবহৃত এই উক্তিটি ওজনে তাঁর কণ্ঠস্বরে এমনই ভারী শোনাত যে, গড়পড়তা কৌতূহলী পথচারী বিনা প্রতিবাদেই তা মেনে নিয়ে চটপট অগ্রসর হতেন। ক্বচিৎ-কদাচিৎ যদি এ-কড়া আদেশ তামিল না-হ’ত জিতেনবাবু হাতের তুলির রঙ পথচারীর গায়ে ছিটিয়ে দিতে এতটুকুও ইতস্তত করতেন না। একাকিত্ব এবং নির্জনতা তাঁর কাছে এতই মূল্যবান যে দুটিকে তিনি যক্ষের ধনের মতো আগলে থাকতেন।
একেক দিন লেখাপড়া, খেলাধুলো ভুলে গিয়ে আমি এই লোকটির ভগবান- প্রদত্ত ক্ষমতা এবং প্রতিভার বিকাশ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে দেখি। আশ্চর্যের বিষয় এই যে একাকিত্বের এই ঘোরতর উপাসক আমার প্রতি শুধু প্রশ্রয়পূর্ণই ছিলেন না, এক নিরব কোমলতার হালকা বাতাস আমার হৃদয়তন্ত্রী-গুলোকে অস্ফুটভাবে ঝংকৃত ক’রে তুলত। তার কারণ হয়তো এই যে, নির্বাক হলেও আমি যে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ গুণমুগ্ধ এবং স্বশ্রদ্ধ প্রশংসাকারী সে-খবর তিনি যে-কোনো প্রকারেই হোক টের পেয়েছিলেন।
সেদিন রবিবার। সকালবেলার পড়াশুনোর শেষে জিতেনবাবুর দোকানে একটু উঁকিঝুঁকি মারতেই দেখি শিল্পী টুলের ওপর ব’সে পায়ের ওপর পা চড়িয়ে হুঁকোয় ফুড়ুত-ফুড়ুত টান দিচ্ছেন। আর একদৃষ্টিতে সুমুখের ওপর থেকে ঝোলানো মস্ত বড়ো নিষ্কলঙ্ক থানকাপড়টির দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছেন। সদ্য চুনকাম-করা দেয়ালের মতো দেখতে কাপড়টিতে কিছু দেখতে পাচ্ছেন কি? কী ভাবছেন? কিসের ছবি আঁকবেন? মানুষজন, গাছপালা, পশুপাখি, না বাড়িঘর? এতবড়ো সাদা কাপড়টার কোথায়-কোথায় তিনি তাঁর তুলির প্রথম আঁচড় দেবেন? এ-সব নানা প্ৰশ্ন আমার মনে আনাগোনা করছে। শিল্পীর চোখ বরাবরের মতো সাদা কাপড়টির ওপর এমনই দৃঢ়সংবদ্ধ যে দরজায় আমার বেশ খানিকক্ষণের উপস্থিতি একেবারেই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। পরিষ্কার তুলি, নানা রঙ গোলা, হাঁড়িকুড়ি লাইন ক’রে খবরের কাগজের ওপর সাজানো। হুঁকোর টান ক্রমশই দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। বাঁ পায়ের হাঁটুর ওপর রাখা ডান পা-টি অসম্ভবরকম দুলতে আরম্ভ করল। চোখের ভ্রু দুটির শেষ প্রান্ত বাঁকিয়ে উঠে দুটি ছোটো পাহাড়ের আকার ধারণ করে। দৃষ্টি আগের চাইতে আরো তীক্ষ্ণ। শরতের প্রভাতের হাল্কা কুয়াশার মতো তামাকের ধোঁয়ায় সমস্ত ঘরটি আচ্ছন্ন। তারই ভেতর দিয়ে আসন্ন কিছু ঘটবার যেন জানান দিচ্ছে। হুঁকোটি নামিয়ে রেখে জিতেনবাবু খানিকক্ষণ চোখ বুজে রইলেন। এই অবস্থায় বিড়বিড় ক’রে নিজের মনে মন্ত্রের মতো কী-সব আওড়ান। তারপর, আবার কয়েক মুহূর্ত চুপ ক’রে থাকার পর হঠাৎ চোখ খুলে দাঁড়িয়ে উঠলেন। অনেকটা ঘুম থেকে আচমকা জেগে ওঠার মতো। এক হাতে গেরুয়া রঙের খুরি, অন্য হাতে লম্বা একটি তুলি। আবার চুপ। দেখি, হাঁটু অব্দি নামানো হাতের তুলিটি নড়াচড়া ক’রে উঠে শূনে কী-সব আবোলতাবোল রেখা টানছে! কোন্ মুহূর্তে হাতটি উঠে যে সাদা পর্দায় দাগ কাটতে আরম্ভ করেছে তা যেন তিনি টেরও পেলেন না। কখনো সরলরেখা, কখনো বক্র, কখনো ডাইনে, কখনো বাঁয়ে, কখনো নীচে, কখনো ওপরে, পর-পর রেখা পড়তে থাকল। লাফ দিয়ে টুলের ওপর উঠে পর্দার ডগায়ও এদিক-ওদিক সব রেখা টানলেন– যেমনই বলিষ্ঠ আর তেমনই ঋজু। তড়াক ক’রে নেমে, তুলি খুরি রেখে তামাক সাজলেন। অক্ষয়বাবুর দোকানের চায়ের উনুনের থেকে টিকে ধরিয়ে এনে কল্কিতে ফুঁ দিতে থাকলেন। যেমনই দ্রুত ফুড়ুত-ফুড়ুত আওয়াজ তেমনই দ্রুত চোখের পলক। কিন্তু দৃষ্টি সর্বদাই পর্দার ওপর। সেখানে ক্রমশই রেখার জঙ্গল গজিয়ে উঠেছে। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। হুঁকোটা দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখে জিতেনবাবু উঠে দাঁড়ালেন। জলে ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে এখানে- ওখানে কয়েকটা রেখা মুছে ফেললেন। আবার আঁকেন। এবার বিক্ষিপ্ত রেখাগুলোকে সন্তর্পণে জুড়ে দেন। অর্ধবৃত্তাকার একটি রেখা দুটি খাড়া রেখার সঙ্গে যুক্ত হতেই বোঝা গেল যে এটি ধনুকাকৃতি একটি খিলান। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আরো কয়েকটি খিলান ঐ রেখার জঙ্গল থেকে ফুটে বেরুল। লম্বা-লম্বা খামের ওপর এই খিলানগুলো ভর ক’রে আছে। জিতেনবাবু তুলি বদলালেন। এবার সরু তুলি দিয়ে সেই খামগুলোর পেছনে জালের মতো নক্সা কাটতে আরম্ভ করলেন। দু-পাশে দুটি এ-ধরনের নক্সা তৈরি হ’ল। তার মাঝখানে আঁকা হ’ল একটি দরজা। যেমনই দ্রুত হাতের গতি তেমনই তার আন্দাজ। জিতেনবাবু বাঁ-হাতে অন্য একটি রঙের খুরি, আর ডান-হাতে তুললেন একটি জুতোর ব্রুশ। সেটি খুরিতে ডুবিয়ে বড়ো বড়ো পোঁচে দরজার ভেতরকার সাদা জায়গাটি কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভরাট করে ফেললেন। জালের নক্সার মাঝখানে দুটো ছোটো চৌকো এঁকে সেগুলোকেও ভরাট ক’রে দিলেন ঐ রঙ দিয়ে। নক্সার ভেতর দিয়ে উঁকি দিল ঘন নীল আকাশ। কী আশ্চর্য ক্ষমতা এই স্বল্পভাষী রহস্যময় গম্ভীর লোকটির। এই তো কিছুক্ষণ আগেই ছিল এটি একটি সাদা থানকাপড়। এটুকু সময়ের মধ্যেই তিনি তাতে একটি মস্ত ঘরের ভেতর দিয়ে শুধু নীল আকাশেরই নয়, তার তলায় বহু দূরে নদী গাছপালারও আভাস দিলেন।
জিতেনবাবু এরই মধ্যে অক্ষয়বাবুর দোকান থেকে টিকে ধরিয়ে এনে আবার হুঁকোয় ঘন-ঘন টান দিচ্ছেন। টানে বেশ একটা চাপা উত্তেজনা। চোখ আগের মতোই সামনের দিকে সংবদ্ধ। এবার কী আঁকবেন? কী রঙ লাগাবেন? ঘরটি কী ধরনের লোকের জন্য তৈরি হচ্ছে? জানালা-দরজা জালি এবং থামের নক্সার রকম দেখে মনে হচ্ছে, এটি তো কোনো সাধারণ ঘর নয়! হুঁকো রেখে শিল্পী ঘরের কোণ থেকে সরু ফুটরুলের মতো দেখতে লম্বা একটি কাঠের টুকরো তুলে আনলেন। সেটিকে কাপড়টির ওপর কোণাকুণি ফেলে বাঁ দিকের মাঝামাঝি উচ্চতায় ধ’রে ডানদিকের কোণ থেকে শুরু ক’রে একফুট অন্তর সরল, ঋজু রেখা টেনে সামনের সমস্ত জায়গাটিতে ছড়িয়ে দিলেন। এবার তার উল্টোদিক থেকে তেমনি কোণাকুণি ঠিক ততগুলোই রেখা টেনে একটা ছকের মতো নক্সা তৈরি করলেন। রঙ-তুলি দুই- ই বদলে নিয়ে পালাক্রমে একেকটি ছক কালো রঙে ভরাট ক’রে দিলেন। তার পর সুক্ষ্ম তুলির সাহায্যে প্রথম একটি সাদার ওপরে, তার পর একটি কালো ছকের ওপর ছাইরঙ মিশেয়ে আঁকাবাঁকা হালকা লাইন দিলেন। পরিষ্কার জলে-ভরা আরেকটি তুলির সাহায্যে এই লাইনগুলোকে মোলায়েম ক’রে দিলেন।
হঠাৎ জিতেনবাবু মুখ ঘুরিয়ে আমাকে এক প্রশ্ন ক’রে বসলেন। আমি ভয়ে জড়সড়। ভেতরটা ধক ধক করে উঠল। আশে-পাশে অক্ষয়বাবু, ব্রজবাবু, আখতার মিঞা, সাত্তার মিঞা– এমন কত পরিচিত, বয়োজ্যেষ্ঠ লোকই তো রয়েছে। তাঁদের জিজ্ঞেস না ক’রে আমার মতো অর্বাচীনকে তিনি সমঝদার ধ’রে নিলেন কেন? ‘বল্ তো, এ চৌকোগুলো কী? আপাতদৃষ্টিতে তিনটি শব্দের এই প্রশ্নটি মামুলি হলেও আমি এতই ঘাবড়ে গেলাম যেন আমার মুখে কেউ কুলুপ আটকে দিয়েছে। অধৈর্য হয়ে যেন একটি ধমকের সুরে আবার প্রশ্নটি আমার দিকে ছুঁড়ে মারলেন। আমি আঁৎকে উঠি। কী উত্তর দেব ভাবছি, হঠাৎ আমার মুখ দিয়ে দরজা ঠেলে খাঁচার পাখি ফুড়ুত ক’রে উড়ে যাবার মতো বেরিয়ে গেল, ‘দাবার ছক্’। ‘দাবার ছক্ কেন? সাদা-কালো মার্বেলের মেঝেও হতে পারে! একটু থেমে আবার তেমনই গম্ভীর আওয়াজে বললেন ‘অত বড়ো দাবার ছক্ হয় কখনো?’ কথাগুলো এক চিলতে ঘরটিতে সিংহের গর্জনের মতো শোনাল।
আমার নির্বুদ্ধিতা এবং অজ্ঞতা জাহির করার কি প্রয়োজন ছিল? চুপ ক’রে থাকলেই হ’ত। কিংবা অনায়াসে বলা যেত ‘জানি না’। নিজেকে বেশি চালাক ভেবে কীরকম বোকা বনতে হ’ল, এ-কথা ভেবে নিজের ওপর অসম্ভব রাগে আমার ভেতরটা টকবগিয়ে উঠেছে। এমন সময় জিতেনবাবু মুখ ঘোরালেন। গোঁফের তলায় মুচকি হাসি ধ’রে বললেন, ‘ঠিক বলেছিস্’। ব’লেই আবার হুঁকোতে টান।
ঠিক বলেছি কি! এই যে উনি বললেন অত বড়ো দাবার ছক্ হয় না? শিল্পী কি আমার সঙ্গে প্রবঞ্চনা করছেন! হুঁকোর টান থামিয়ে বেশ নাটকীয় ঢং-এ বললেন, ‘একি যেমন-তেমন দাবার ছক্? এই ছকে দিল্লীর জাঁহাপনা দাবা খেলবেন! সত্যিকারের জ্যান্ত ঘোড়া হাতি মন্ত্রী পেয়াদা সেপাই সৈন্য দিয়ে খেলা! বাদশাহের সঙ্গে তাঁর ওয়াজিরে-আজমের ম্যাচ্। প্রধানমন্ত্রী হারলে তাঁর শুধু চাকরিই যাবে না, সঙ্গে-সঙ্গে যাবে মুণ্ডুটিও। একি যেমন-তেমন খেলা!”
আমি আঁৎকে উঠি। বাবাঃ। কী সাংঘাতিক! দাবাখেলায় যুধিষ্টির তো শুধু রাজ্যই হারিয়েছিলেন! এ যে প্রাণ নিয়ে টানাটানি। মন্ত্রীর জন্যে স্বভাবতই আমার প্রাণে সহানুভূতির পাহাড় জমে ওঠে। তাই সাহস ক’রে জিতেনবাবুকে জিজ্ঞেস ক’রেই ফেললাম, ‘আর যদি?’ কথাটি শেষ না-করতেই আমার মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে তিনি বললেন, ‘স্বয়ং বাদশা হারলে মন্ত্রী পাবেন একলক্ষ সোনার মোহর।’ আমি কায়মনোবাক্যে প্রধানমন্ত্রীর জয় কামনা করি। হঠাৎ জিতেনবাবু আমার দিকে তাকিয়ে ব’লে উঠলেন, ‘তোর হবে।’ আমার কী হবে? স্বল্পভাষী লোকদের নিয়ে কী মুস্কিল! তাঁরা সর্বদাই ধাঁধার মতো ক’রে কথা বলেন কেন? রহস্যময় এ-শব্দদুটির অর্থ কি? আমার মধ্যে কিসের সম্ভাবনা, কিসের প্রতিশ্রুতি দেখলেন? এই সংক্ষিপ্ত উক্তিটি এক গভীর রহস্যের জালে আবৃত হয়ে আমার মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকল।
পরদিন বিকেলবেলা জিতেনবাবুর দাবাখেলার সিটি কতদূর অগ্রসর হয়েছে দেখতে গিয়ে হকচকিয়ে গেলাম। নানারঙের পাথরের এবং মিনে-করা লতা-পাতার অলংকার খিলান থাম আর দেয়ালের গায়ে পড়েছে। ছাদ থেকে নেমে এসেছে বিরাট-বিরাট ঝাড়লণ্ঠন। তার ভেতরের আলোয় স্ফটিকগুলো চারদিকে টুকরো- টুকরো আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। দরজার সামনে জাঁহাপনার তখতের জন্যে উঁচু বেদী। তার ওপরেই জালিকাটা বারান্দা। হয়তো বেগমদের বসবার জায়গা।
এত সব খুঁটিনাটি কখন আঁকলেন জিতেনবাবু! সারারাত জেগে কাজ করেছেন কি? লোকটির কি কখনো ঘুমের প্রয়োজন হয় না? তিনি কি কখনো বাড়ি যান না? কী আশ্চর্য, রাতারাতি এত বড়ো একটা দৃশ্য আঁকা শেষ ক’রে ফেললেন? এই বৃদ্ধলোকটির প্রতিভা দেখে আমি যতই বিস্মিত, ততই বাড়ে তাঁর একাগ্র নিষ্ঠার প্রতি আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা।
এবার জিতেনবাবু মেঝের ওপর কতকগুলো মোটা পিচবোর্ড ফেলে তার ওপর পেন্সিল দিয়ে অনেক আঁকাবাঁকা সব রেখা টানলেন। সেই রেখাগুলোর অনুসরণে মন্ত বড়ো কাঁচি চালিয়ে সেগুলোকে নিখুঁতভাবে কাটলেন। তার ওপর খড়িমাটির প্রলেপ দিলেন। ঘরের কোণে বড়ো চেয়ারের আদলে কাঠের একটি কাঠামো আগে থেকেই তৈরি ছিল। পিচবোর্ডের টুকরোগুলো ছোটো পেরেক ঠুকে এই কাঠামোটির চারপাশ ঘিরে লাগাচ্ছেন। পেছনে ঊর্ধ্বমুখী পানের আকারে মস্ত বড়ো আরেকটি টুকরো বসালেন। কার জন্যে এ-আসনটি তৈরি হচ্ছে! এতে ব’সেই কি দিল্লীর বাদশা দাবার চালের হুকুম দিবেন? জিতেনবাবু হুঁকোর টানের সাথে অপলক দৃষ্টিতে এটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফুড়ুত-ফুডুত আওয়াজ আস্তে-আস্তে ক্ষীণ হয়ে একেবারে থেমে গেল। সাদামাটা চেয়ারটির দিকে তাকিয়ে থাকবার এত কী আছে? খুব ক্ষিপ্রগতিতে একটা খুরিতে সোনালী, আরেকটিতে রুপোলি গুঁড়ো গঁদের আঠা আর জল দিয়ে মেশালেন। চেয়ারটির গায়ে হালকা খয়েরি রঙের লতা-পাতা-ফুল-পাখির অতি সূক্ষ্ম রেখার ডিজাইন এঁকে নিলেন। আসনের পায়াগুলো বাজপাখির আকারের, যেন সিংহাসনটি তাদের মাথায় তুলে ধরেছে। দুটি পাখির মাঝখানে গোলাকার পৃথিবী। জাঁহাপনা; অর্থাৎ সারা বিশ্বেরই তো অধীশ্বর। এই তত তাঁরই উপযুক্ত বটে।
লতাপাতার নক্সাগুলো আস্তে-আস্তে সোনারুপোয় ভ’রে উঠল। মাঝে-মাঝে হীরে মুক্তো চুনি পান্না এমারেল্ড টার্কোয়াজ–পৃথিবীর যাবতীয় দুর্মূল্য সব পাথরে মণ্ডিত হ’ল। সেগুলো ঝাড়লণ্ঠনের আলোয় জগমগিয়ে উঠেছে। আলো-ছায়ার কী অপূর্ব খেলা! কী অপূর্ব রঙের দখল আর আন্দাজ! কী অসাধারণ কারিগরি!
পরদিন সন্ধেবেলায় যথারীতি ভাইবোনেদের সঙ্গে আমি কালীবাড়ির আরতি দেখে ফিরছি। এই সময়টিতে, অল্পক্ষণের জন্যে হলেও অভ্যাসবশত জিতেনবাবুর দোকানে আমি একবার উঁকি মারি। দোকানের পাট ভ্যাজানো।
তার ভেতর থেকে জিতেনবাবুর কন্ঠস্বর যেন দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসছে। স্বর উচ্চ এবং ক্রুদ্ধ। নাটকীয় ঢং-এ উঠছে আর নামছে। জিতেনবাবু কারুর সঙ্গে ঝগড়া করছেন নাকি! তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম। দরজার ফাঁক দিয়ে যা দেখা গেল তা এতই অদ্ভুত এবং এতই অবিশ্বাস্য যে তার সঠিক বর্ণনা দিতে গেলে চাই স্বয়ং শেক্সপিয়রের মতো নাট্যকারের কলম। সন্ধের ধুনুচির থেকে এখনো অল্প ধোঁয়া পাকিয়ে-পাকিয়ে উঠে ঘরের কড়িকাঠে ধাক্কা খেয়ে নিচের দিকে নেমে আসছে। দরজার ফাঁক দিয়ে ধূপের সুগন্ধ আমার নাকে এল। মাথার ওপরে টিমটিম ক’রে একটিমাত্র আলো জ্বলছে। বরাবরের মতো গায়ে ছেঁড়া ময়লা গেঞ্জি। ধুতি উঠে এসেছে হাঁটুর ওপর। মাথায় লাল গামছা পাগড়ির মতো ক’রে জড়ানো। বাদশার সিংহাসনে জিতেনবাবু ঈষৎ কাত হয়ে হেলান দিয়ে বসেছেন। ডান হাতে গ্লাস । বাঁ হাতে ঘোলাটে তরল পদার্থ ভরা একটি বড়ো বোতল। ঢুলুঢুলু চোখে সামনের দেয়ালের দিকে চেয়ে তারস্বরে নিজের মনে আবোল-তাবোল কী-সব বকছেন। এই ভালো মানুষটার মাথায় কোনো গোলমাল হয়নি তো!
‘মনে করবেন না যে, এ-সিংহাসন আমার পুরষ্কার! এ আমার শাস্তি! আমি আজ সিংহাসনের ওপর ব’সে নাই, বারুদের স্তূপের ওপর ব’সে আছি!…’ ‘বারুদ’ শব্দটি বা…রু…উ..উ…উ…দ-এর মতো শোনাল। আমার বুকের ভেতরটা লাফিয়ে উঠল। সত্যিই কি তিনি বারুদের স্তূপের ওপর বসে আছেন? এ-কথা ভাবার সঙ্গে- সঙ্গেই জিতেনবাবু একটু কেশে গলার স্বরটা পরিষ্কার ক’রে নিলেন। তারপর আবার ‘এই আমি আমার রাজমুকুট সিংহাসনের পদতলে রাখলাম’, ব’লেই বোতল আর গ্লাস পাশের টুলের ওপর রেখে মাথা থেকে গামছাটা এমন আলতো ক’রে তুললেন যেন পৃথিবীর সবচাইতে মূল্যবান্ কোহিনুর-মণ্ডিত রাজমুকুটটি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছেন। গামছাটি পায়ের কাছে রেখে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর গ্লাসে একটা চুমুক দিলেন। চোখ লাল, ছলছল। আওয়াজ কম্পমান। কয়েকটি অস্পষ্ট কথার পর শোনা গেল, ‘তার হাতে রাজ্য ছেড়ে দিয়ে আমি সেই মক্কায়ই যেতে চাই। আমি এখানে বসেও সেই দিকেই চেয়ে আছি– আমার জাগ্রতে চিন্তা, নিদ্রায় স্বপ্ন, জীবনের ধ্যান- সেই মহাতীর্থের দিকেই চেয়ে আছি।’ একটি গভীর দীর্ঘনিশ্বাস বাঁকিয়ে-ওঠা ধুনুচির ধোঁয়াকে মাঝখান দিয়ে দু-খণ্ড ক’রে দিল। তারপর, মিনিটখানেক থেমে আবার চাপা গলায়, ‘আমার জন্য ভাববেন না।’ এই শেষ কথা ক’টি মুখ থেকে বেরুবার সঙ্গে-সঙ্গেই জিতেনবাবুর চোখ থেকে দুটি অশ্রুবিন্দু চোখের তলার ভাঁজে একটু থেমে, গাল বেয়ে, তার কোলে মিলিয়ে গেল।
এবার জিতেনবাবু হাতের শূন্য গ্লাসটি রেখে দিয়ে ঘটঘট ক’রে সরাসরি বোতল থেকেই অনেকটা তরল পদার্থ গলায় ঢেলে দিলেন। চোখ প্রায় বুজে এসেছে। মাথাটিও ডান দিকে কাত্ হয়ে ঝুলে পড়েছে। বিড়বিড় করে কী-সব ব’লে যাচ্ছেন। তারপর, সব চুপ। ঘুমিয়ে পড়লেন মনে ক’রে আমি বাড়ি ফিরছি ঠিক সেই সময় জিতেনবাবু হঠাৎ সটান হলেন। সুমুখের দরজার দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তুই বাইরে কি দেখে এলি?…সংসার ঠিক সেই রকম চলছে? আমি এমনই হকচকিয়ে গেলাম যে প্রায় বলে ফেলি আর কি, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ জিতেনবাবু! আপনি কিছু চিন্তা করবেন না …ঠিক চলছে। আপনি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোন!’ কিন্তু তাঁর এই অবস্থায় তিনি কি আমাকে সত্যিই সত্যিই দেখতে পেয়েছেন? আমি তো দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে দেখছি। জিতেনবাবু বোতলের অবশিষ্টটুকু গলায় ঢেলে দিলেন। চোখ রক্তজবার মতো লাল অর্ধনিমীলিত। মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ওপরের দিকে তর্জনী তুলে স্পষ্ট আওয়াজে বললেন, ‘তবে আকাশ তুমি নীলবর্ণ কেন? … সূর্য তুমি এখনো আকাশের ওপর কেন? নির্লজ্জ!…তারপর ধমকের সুরে,’নেমে এসো!” এ-কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে জিতেনবাবুর মাথাটিও নেমে এসে তাঁর বাঁ কাঁধের ওপর হেলে পড়ল।
জিতেনবাবু এইভাবে যখন ঘুমিয়ে পড়েন, একমাত্র তখনই তাঁর শরীর এবং মন সাময়িক বিশ্রান্তি পেয়ে জুড়িয়ে যায়। প্রতিদিন ভোরে আলোর স্পর্শে পাখিরা যেমন নতুন ক’রে নিজেদের প্রাণশক্তি অনুভব করে তিনিও তেমনি নব উদ্যমে পরিপূর্ণ হয়ে জেগে ওঠেন। কাজের ফাঁকে-ফাঁকে চিলমে দম দেওয়া আর সন্ধের পর সুরাদেবীর উপাসনা করা–এ-ছাড়া তাঁর বিশ্রামের আবকাশ নেই। তাঁর প্রতিভার এবং দক্ষতার অনুপাতে স্বল্প পারিশ্রমিক পেলেও তিনি ফরমাশের পর ফরমাশ খাটেন। ধনদৌলতের প্রতি তাঁর মনোভাব উদাসীন। অবসরে তিনি একেবারেই অনভ্যস্ত। বছরের প্রতিদিন তাঁর চোখের সামনে ছাদ থেকে মেঝে অব্দি একটি বড়ো পর্দা না-টাঙানো থাকলে একটি অসহায় শিশুর মতো তিনি ছটফট করেন। এটাই তাঁর স্বভাব। সময়ের অপচয় তাঁর কাছে পাপতুল্য অপরাধ। যে-লোক কর্মের মধ্যে তাঁর জীবনদর্শন খুঁজে পেয়েছেন, তাঁর সঙ্গী কিংবা আড্ডার প্রয়োজন কিসের! একাকিত্বের নিদারুণ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি ও প্রকৃত আনন্দের স্বাদও পেয়েছেন তিনি এরই ভেতর দিয়ে। জীবনের বৃহদংশই কেটেছে প্রবল সক্রিয়তায়, কর্মের প্রবল জোয়ারে।
একদিন স্কুলে যাবার পথে জিতেনবাবুর দোকানে ঢুঁ মারতেই দেখি শিল্পী তাঁর নড়বড়ে টুলটির ওপর ব’সে যথারীতি হুঁকোয় টান দিচ্ছেন। দৃষ্টি স্যাঁৎসেঁতে দেয়ালটি ছাপিয়ে চ’লে গেছে অনেকদূরে, কোন অজানা পরিবেশে। দাবা খেলার সিন্, সিংহাসন আগেই চ’লে গেছে তাদের গন্তব্যস্থলে। মেঝেতে রাখা আছে নতুন সিনের জন্যে থানকাপড়। জিতেনবাবু অযথা বাক্যব্যয় করেন না, এ-কথা আমার জানা থাকা সত্ত্বেও এবং আমার বেয়াদপির ফলাফলের কথা না-ভেবেই আমি, কেন জানি না তাঁকে প্রশ্ন ক’রে বসলাম, ‘জিতেনবাবু, আজ পর্যন্ত আপনি কতগুলো সিন্ এঁকেছেন? তিনি আমার দিকে তাকাবার প্রয়োজন মনে করলেন না। তাঁর হুঁকোয় টানের ছন্দেও কোনো বাধা পড়ল না। আর পাঁচজন দোকান-দারের মতো হিসেবের খাতাপত্র রেখে দোকানদারি করা যাঁর ধাতে সয় না, সে-লোকের কাছে এ-সব প্রশ্ন হয়তো নিতান্তই অবান্তর। কিংবা আমার প্রশ্নটি হয়তো এই আত্মভোলা লোকটির কানেও পৌঁছয়নি। এ-সব কথা ভাবছি, এমন সময় ফুডুত-ফুড়ুত আওয়াজের মাঝে একটা কথা শোনা গেল, ‘কয়েকশো।’ অনির্দিষ্ট হলেও এই অঙ্কটি একটি বিরাট বিস্ময়ের আকার ধারণ করে আমার মনের চার দেয়ালে প্রতিহত হয়ে প্রতিধ্বনি করতে থাকল। যাই হোক, এই স্বল্পবাক্যের লোকটির কাছ থেকে আমার প্রশ্নের জবাব আদায় করতে পেরেছি এই খুশিতে তাঁকে আরেক প্রশ্ন ক’রে বসলাম, আচ্ছা জিতেনবাবু, আপনার কাজগুলো চ’লে গেলে আপনার মন কেমন করে না? তক্ষুনি জবাব এল, ‘ধুৎ!’ জবাব আকস্মিক এবং কিঞ্চিৎ রূঢ় বলা যায়। জিতেনবাবুর জীবনের নক্সায় মায়া-মমতার কিংবা ভাবপ্রবণতার হয়তো কোনো স্থান নেই, এই কথা মনে করে আমি স্কুলের দিকে রওনা দিলাম।
জিতেনবাবুর দোকানের পেছনের বন্ধ জানালাটি আমাদের বাড়ির দক্ষিণের দেয়াল ঘেঁষে। আসন্ন বাৎসরিক পরীক্ষার তাগিদে রাত্রিভোজন সেরে আমি পড়তে বসছি। এমন সময় তাঁর গলা শুনতে পেয়ে আমার পড়া থেমে গেল। একটু মনোযোগ দিতেই শুনি জিতেনবাবু গান ধরেছেন। ব্যাপার কি জানবার ইচ্ছেয় তাড়াতাড়ি নেমে গেলাম। জানলার পাট খোলা। আগেরদিন সকালবেলা যে-থানকাপড়টি মেঝেতে পড়ে ছিল তার ওপর চমৎকার একটি দৃশ্য আঁকা প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। লোকটির দানবিক উদ্যম দেখে আমি হতভম্ব। গাছপালা নদী পাখি ফুল মানুষজন আরো কত কি! গাছের পাতার আড়ালে মুকুটধারী সুদর্শন একটি যুবক। মুখে দুষ্টমিভরা মুচকি হাসি। পাশে গাছের ডালে অনেকগুলো কাপড়চোপড়। নিচের দিকে নজর দিতেই দৃশ্যটি বুঝতে আর বাকি রইল না। যেমনই সুশ্রী যুবক তেমনই সুগঠিতা সব যুবতীরা। স্নানরতা, সুশীলা এই নারীদের চোখেমুখে যেমনই বিস্ময়ের ভান, তেমনি প্রণয়েরও। দু-হাতে প্রাণপণে নগ্নদেহ ঢাকবার চেষ্টায় তাঁদের স্ত্রীসুলভ শ্রী যেন আরো বেড়ে গেছে। যথারীতি জিতেনবাবুর এক হাতে গ্লাস, আরেক হাতে বোতল। আধোবোজা চোখ ছবিটির নিচের দিকে সংবদ্ধ। দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে, মেঝেতে ব’সে, তিনি গান ধরেছেন,
ফাগুনের কু-বাতাসে
বুকের কাপড় যায় লো খসে।
পোড়ারমুখো কোকিল এসে
কুঁহু-কুঁহু করে লো ॥
স্বর চাপা হলেও সুরে কোনো ঘাটতি নেই। বাঃ! জিতেনবাবু তো চমৎকার গান করতে পারেন। গলায় কাজও আছে বেশ! আশ্চর্য এ-লোকটির কাণ্ড-কারখানা। যে- রসের ছবি আঁকেন, তেমনই মানানসই রসের সুরে তাঁর সন্ধে কাটান। আপাতদৃষ্টিতে শুষ্ক এবং গুরুগম্ভীর লোকটির ভেতর যে পাতায়-ঢাকা মৌচাকের মতো অফুরন্ত একটি রসের ভাণ্ডার লুকিয়ে আছে, ক’জন তার খবর রাখে!
জিতেনবাবুর স্বর যেন একটু জড়িয়ে এসেছে। বোতলের তলদেশে এখনো কয়েক ফোঁটা পানীয় প’ড়ে আছে দেখে তিনি বোতলটিকে উপুড় ক’রে হাঁ-করা মুখের ওপর রাখলেন। শেষ ফোঁটা-ক’টি গলায় পড়তেই তিনি আবার গান ধরলেন,
আমার কুল গাছে লেগেছে বসন,
দাঁড়া দিদি, দাঁড়া লো।
পোড়ারমুখো কোকিল এসে
‘কুঁহু-কুঁহু করে লো।
গানের শেষ ক’টি কথা অস্পষ্ট। শরীরটিও আস্তে-আস্তে একদিকে ঝুঁকে পড়েছে, মুহূর্তের মধ্যেই গভীর অবসাদজড়িত দেহটি একটি লতার মতো মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।