৫. অন্য সুর

এরপর প্রিয়মাধব অন্য সুর ধরেছিল। বলত, স্বাভাবিক জীবন থেকে চ্যুত হয়ে স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার। প্রকৃতির প্রতিশোধ হঠাৎ একদিন কিছু একটা কঠিন রোগে না পড়ে যাই।

আমি কটু হতাম।

বলতাম, এ অঞ্চলে স্বাস্থ্যরক্ষার ওষুধের তো অভাব নেই। খুঁজতে হবে না, ইচ্ছে করলেই মিলবে। প্রিয়মাধব এই কটু কথায় আহত হত।

দু-চারদিন চুপ করে থাকত।

 কিন্তু আসামের ওই ভয়ংকর বর্ষার রাতগুলো কি চুপ করে ঘুমিয়ে থাকবার?

আমিই কি পেরেছি চুপ করে ঘুমিয়ে থাকতে?

 জেগে উঠতাম।

 ভয়ংকর কিছু একটার প্রতীক্ষা করতাম। মনে হত বাজ পড়বে, সব জ্বলে খাক হয়ে যাবে।

 কিন্তু পড়ত না সেই বাজ।

শুধু দরজার বাইরে দ্রুত পদধ্বনি আরও দ্রুত হত।

.

তারপর একদিন, খোকা তখন বছরখানেকের, সেই বাজ পড়তে এল। দরজার কাছে পায়ের শব্দ থামল। দরজায় ধাক্কা পড়ল।

সুমিতার খোলস সেই ধাক্কার আঘাত সইতে পারল না। প্রিয়মাধবের স্ত্রী সেজে প্রিয়মাধবের সন্তানকে নিয়ে যে শুয়ে রয়েছে, সে সহসা বিভ্রান্ত হল।

দরজা খুলে ফেলল।

বলল, কী? কী চাই?

প্রিয়মাধব বলল, আর কিছু শুনতে চাই না, তোমায় চাই। তোমায় সুমিতা করে নিতে চাই। নমিতা তো মরে গেছে। তবে নমিতার ভূত সুমিতাকে আগলে থাকবে কেন?

সুমিতার খোলস সেদিন ওই কেনর উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না। সে শুধু বলে উঠেছিল, তোমার পায়ে পড়ি। তোমার পায়ে পড়ি। তোমার পায়ে পড়ি।

সেই ভয়ংকর মুহূর্তে সুমিতার খোলসকে রক্ষা করল সুমিতার ছেলে। সুমিতার ছেলে বোধ করি হঠাৎ ঘরের মধ্যে নতুন কণ্ঠস্বরে চমকে জেগে উঠল। জেগে উঠে পরিত্রাহি কান্না ধরল।

শিশুও বোধ করি পশুর মতো ভাবী অমঙ্গলের ছায়া দেখতে পায়। অকল্যাণ থেকে সাবধান করবার চেষ্টা করে সহজাত শক্তিতে।

অরুণমাধবের সেই কান্নাটা না হলে সে রাত্রে অমন অস্বাভাবিক হয়েছিল কেন? কাঁদতে কাঁদতে তড়কা হয়ে গিয়েছিল কেন?

তারপর থেকে আছড়ানি থামল প্রিয়মাধবের। ধীরে ধীরে বোধ করি স্বাস্থ্যরক্ষার সহজ পথ বেছে নিল সে।

.

কিন্তু প্রথম প্রথম ওর সেই ভয়ংকর সহজটা সহ্য করে নিতে আমি যে যন্ত্রণা ভোগ করেছি সে কি লিখে উঠতে পারব আমি?

আমি দেখছি–চোখ মেলে দেখছি, প্রিয়মাধব বাগানের পিছনের ঘরটায় কোনও একটা দেহাতি মেয়েকে নিয়ে আসছে, দেখছি প্রিয়মাধব অনেক রাত্তির পর্যন্ত বাইরে কাটিয়ে মত্ত অবস্থা বাড়ি ফিরছে, দেখছি প্রিয়মাধব সকালবেলা মানের আগে খোকাকে ছুঁচ্ছে না।

দেখছি বুঝতে পারছি প্রিয়মাধব হৃদয় বেদনায় কাতর হয়ে হৃদয় খুঁজতে বেরোচ্ছে না, ওর যন্ত্রণা নিছক স্থূল। তাই নীচ সংসর্গ করছে প্রিয়মাধব। অসহ্য জ্বালা নিয়ে সহ্য করছি সেই বুঝতে পারা।

বারণ করব কোন মুখে?

ধিক্কার দেব কোন ভাষায়?

ওকে এ রাস্তার পথ দেখিয়ে দিয়েছি তো আমিই। আমি ওকে আছড়ে ভেঙে চুর করলাম, নতুন মূর্তিতে গড়তে পারলাম না। দিদির মন্দিরের দেবতাকে রাস্তার ঢেলা করে ফেলে দিলাম আমি।

আমি কি তবে আত্মহত্যা করব?

 আত্মহত্যা!

আশ্চর্য! এই শব্দটা চিরদিন আমাকে আশার গান শোনাল, আমাকে সোহাগের হাতছানি দিল, আমাকে মুক্তির দরজা দেখিয়ে দেবার অঙ্গীকার করল, অথচ ওর শরণাপন্ন হলাম না আমি। আমি শুধু ওকে যখন ইচ্ছে ভোগ করব এই মনোভাব নিয়ে আদরে লালন করলাম। কিন্তু ভোগ করলাম কই?

আমার ভাগ্যবিধাতা আমার ভোগের ঘরটা শূন্য রেখেছিল বলেই কি ওই কী যত্নে লালিত বস্তুটাও ভোগ করা হল না?

নইলে কেন আমি ওই আত্মহত্যা নামের মধুর আশ্বাসবাহী সোহাগের হাতছানি দেওয়া প্রেমিকের কাছে ধরা দিলাম না? সারাজীবন শুধু ওর ডাককে সরিয়েই রাখলাম।

প্রাণের মায়া কি আমার বড় বেশি?

কই, তাও তো মনে হয় না।

নিজের দিকে যুক্তি খাড়া করতে থোকাকে সামনে খাড়া করেছি, ভেবেছি কারণ খোকা। দিদিকে যদি খুঁজে পাওয়া যায়, তন্মুহুর্তেই আমি গলায় দড়ি পরিয়ে ঝুলে পড়তে পারি।

হ্যাঁ, বহুকালাবধি দিদিকে খুঁজে পাওয়ার কথা ভেবেছি আমি। যদিও প্রিয়মাধব সব সময় বলত, সে এ পৃথিবীতে নেই! সে আর আসবে না। বলত, সে স্বর্গের দেবী ছিল স্বর্গে চলে গেছে।

কিন্তু আমার আশা ছিল, দিদি আসবে।

আমার ভয় ছিল, দিদি আসবে।

এই ভয় আর আশা নিয়ে জীবন কাটিয়েছি আমি। সব দিকেই ভয় আর আশা।

প্রিয়মাধবকে নিয়ে ঘর করছি ভয় আর আশা, অরুণমাধবকে নিয়েও ভয় আর আশা। হ্যাঁ অরুণকে নিয়েও সেই দ্বন্দ্বদোলা।

ও হয়তো সত্যিই মা মনে করছে আমায়। ও হয়তো বুঝতে পারবে আমি ওর মা নই।

 আমার ছদ্মবেশ ধরা পড়ে গেলে ও হয়তো আমাকে ঘৃণা করবে। আমার যন্ত্রণা টের পেলে হয়তো ও আমায় মমতা করবে।

এই জীবন আমার!

আনাড়ি এক মাঝির নৌকোয় চড়ে বর্ষার গঙ্গায় খেয়া পার হওয়া যেন! নৌকোর কানা চেপে ধরে ভাবনা, ডুবল বুঝি, ডুবল বুঝি।

কিন্তু প্রিয়মাধব যেন ক্রমশ সুস্থ হতে লাগল। ওর সেই বিকৃত জীবনটা যেন আর একটা সত্তায় ভর করে রইল ঘরের বাইরে, পারিবারিক গণ্ডির বাইরে, ঘরের ভিতরকার মানুষটা বিরাজ করতে লাগল আর একটা সত্তায়।

আর ক্রমশই আগের মতো হাসিখুশি হতে থাকল, অরুণমাধবকে কেন্দ্র করে চলতে লাগল এই অদ্ভুত সম্পর্কের দুটি নরনারীর সংসার।

আরও বার দুই বাগান বদল হল প্রিয়মাধবের। নতুন নতুন পরিবেশে একেবারে মেমসাহেব হয়ে গিয়ে দিব্যি মানিয়ে গেল নতুন মেমসাহেব।

নমিতা সুমিতার খোলসটাই শুধু আঁটল। সুমিতা হতে পারল না। তবু নমিতার উপর রাগ করল না প্রিয়মাধব। যেন মনকে মানিয়ে নিল। চার আনা বাদ দিয়ে বারো আনাতেই সন্তুষ্ট থাকতে শিখল।

তাই অরুণমাধব জ্ঞানাবধি শুনতে লাগল, সুমিতা, সুমিতা, সুমিতা।

সুমিতা, দেখ তোমার ছেলের কাণ্ড, সুমিতা, দেখ তোমার ছেলের বুদ্ধি, সুমিতা, দেখ তোমার ছেলের দুষ্টুমি!

সুমিতার সংসার, সুমিতার ছেলে, সুমিতার স্বামী!

 যা কিছু হিংসের ছিল আমার, সবই পেলাম আমি।

কিন্তু এই কি পাওয়া?

আমি যদি সুমিতার সঙ্গে লড়াই করে জিতে নিতে পারতাম তার ঐশ্বর্য, সে পাওয়ায় হয়তো শান্তি ছিল না, তবু গৌরব ছিল।

এ পাওয়ায় আছে কী?

 সুমিতার ঘৃণাভরে ত্যাগ করে যাওয়া ছেঁড়া জুতো মাথায় করে বইব আমি ঐশ্বর্য বলে!

এই ঘৃণা সুমিতার ঐশ্বর্যকে ভোগ করতে বাধা দিয়েছে আমায়, এই ঘৃণা আমাকে কিছুতেই সুমিতা হতে দেয়নি।

না, সুমিতা হতে পারলাম না আমি। সুমিতা হারিয়ে গেল। নমিতা মরে গেল।

আর ওই দুটো শবদেহের ভেলায় চড়ে অদ্ভুত একটা প্রাণী সংসার ঠেলতে লাগল। ছেলে মানুষ করে তুলতে লাগল।

.

কম বয়সে কবিতা লিখেছি।

 সুমিতার চা বাগানের সংসারেও লিখেছি।

এখন সে কথা ভাবলে অবাক লাগে।

আরও অবাক লাগে ভেবে, এত কথা আমি লিখছি কেন?

আমি কি আমার বোনের ছেলে অরুণমাধবের কাছে সাফাই গাইতে চাইছি?… না, শুধু যন্ত্রণার কবল থেকে মুক্ত হবার আর কোনও উপায় পাচ্ছি না বলেই?

লোকে বলে, মিসেস মুখার্জি, প্রিয়মাধব বলে, সুমিতা।

আমিও সুমিতার গয়না, কাপড়, আসবাব, শখের জিনিস, সব কিছু দখল করে দেখি সুমিতা হতে পারি কিনা।

মাঝে মাঝে মনে হয়, হয়তো হয়ে গেছি।

যখন অরুণমাধব মা বলে ছুটে আসে, সব আদর আবদার জানায়, বাপের নামে নালিশ করে, কিছুতেই মনে হয় না, আমি বিধবা নমিতা, আমি মৃত হেমন্ত উকিলের বউ।

আর তখনই মনে হয়, এই সুমিতা হয়ে যাওয়া মনটাকে সেই হেমন্ত উকিলের স্ত্রীর দেহে আটকে রেখে লাভ কী হল আমার? আমার মনটা তো ধীরে ধীরে সুমিতা হয়ে এল, দেহটাকেই বা আগলে রেখে হল কী?

কিন্তু এখন আর সে আক্ষেপে লাভ নেই।

এখন প্রিয়মাধব নামের এই অশান্ত প্রাণীটা ঘোলা জলে তার পিপাসা মেটাবার ব্যবস্থা করে নিয়েছে। এখন তার কাছে ঠাণ্ডা শরবতের গ্লাস বাড়িয়ে ধরতে যাব কি আমি?

সে হয় না।

আমি শুধু মিসেস মুখার্জি।

আমি শুধু সুমিতা।

আমি অরুণমাধবের মা।

 প্রিয়মাধবের বউ নই আমি।

আমার এই অদ্ভুত জীবন নিয়ে চরেও তো বেড়াচ্ছি দিব্যি। প্রিয়মাধবের সব পরামর্শ আমার সঙ্গে, প্রিয়মাধবের টাকাকড়ি সব আমার হাতে, প্রিয়মাধবের নেশার বস্তু আমার সামনে।

আমি মেপে দিয়ে বলি, আর নয়! ক্রমশই বাড়াবার তাল তোমার, অত আহ্লাদ চলবে না।

আমি বাড়ি থেকে বার করে দিয়ে বলি, বারোটার মধ্যে ফেরা চাই,–চাই। বলছি, রাত কাবার করলে দেখাব মজা।

প্রিয়মাধব বলে যায়, মজাটা কেমন জিনিস এক আধদিন দেখতে সাধ হয়। কিছুতেই কেন সাহস হয় না বলো তো?

আমি হাসি, পেতনি যে! যারা মরে গিয়েও চলেফিরে বেড়ায়, জ্যান্ত মানুষরা তাদের ভয় করে।

প্রিয়মাধব বলে, তোমার ওই আলমারির চাবি হস্তগত করে একদিন পুরো বোতল গলায় ঢেলে মাতলামি করব দেখো।

আমি সংক্ষেপে বলি, দেখব।

এমনি চলতে চলতে খেয়াল হল অরুণকে এবার মানুষ করে তোলার চেষ্টা দরকার, ভাল স্কুলে দেওয়া দরকার। কিন্তু এখানে কোথায় সেই ভাল স্কুল?

প্রিয়মাধব প্রথমে হেসে ওড়াল। বলল, কেন, এক্ষুনি ছেলে পড়ানোর দায়িত্ব ত্যাগ করতে চাও কেন? তোমার বিদ্যেয় আর কুলোচ্ছে না খোকার?

বললাম, কুলোচ্ছে না-ই তো। আমার আবার বিদ্যে কোথায়?

বাঃ ম্যাট্রিক পাস করেছিলে না তুমি?

 সে সব তামাদি হয়ে গেছে।

 আবার বানাও।

বললাম, না না, স্কুলে না পড়লে পড়ার মনোভাব আসে না। তা ছাড়া ওর মনটাও তো দেখতে হবে? কতখানি নিঃসঙ্গ ও, তা ভাবো তো!

সত্যিই খোকার নিঃসঙ্গতার দিক থেকে চিন্তা করেই স্কুল স্কুল করে ব্যস্ত হয়েছিলাম আমি। নইলে বছর আষ্টেকের ছেলেটাকে আরও কিছুদিন পড়ানো হয়তো আমার পক্ষে শক্ত ছিল না।

কিন্তু নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা আমি বুঝতাম।

সেই ভয়াবহ যন্ত্রণা, যা আমার উপর তার দাঁত বসিয়েই রেখেছে, আর প্রতিক্ষণ সেই দাঁতের চাপে কেটে কেটে খাচ্ছে আমায়, সেই যন্ত্রণাই যে উঠছে ক্রমশ বড় হয়ে ওঠা খোকার মধ্যে, এ আমি অনুভব করছিলাম। তাই

নিজের বিদ্যেকে নস্যাৎ করে দিয়ে বললাম, তা ছাড়া আমাদের আমলের পড়া আবার পড়া ছিল নাকি? তাও আবার মেয়ে স্কুলের।

পাস তো করেছিলে ইউনিভার্সিটিতে? বলল প্রিয়মাধব।

 সেও মেয়ে বলে করুণায়। জানো না তখন মেয়ে বলে খাতায় বিশেষ একটা চিহ্ন থাকত!

এই কথার হাওয়ায় তখনকার মতো হয়তো হাওয়া হালকা হয়ে যেত, কিন্তু আমি জেদ ছাড়লাম না। আমি বদ্ধপরিকর।

আবার সে কথা তুলতাম।

প্রিয়মাধব আবারও বলত, এখন বলছ, দেখো ওকে পাঠিয়ে দিয়ে তুমি টিকতে পারবে না।

বলতাম, কেন? আমাকে কি খুব একটা হৃদয়বতী বলে মনে হয়?

হয় বইকী! শুধু একজনের ক্ষেত্র বাদে।

সব ক্ষেত্রেই সমান। বিধাতা পুরুষ আমার মধ্যে ওই হৃদয় নামের বালাইটা দেননি। খুব সম্ভব যমজের ভাগ করতে করতে ভুলে দুটো ভাগই একই অংশে দিয়ে ফেলেছিলেন।

প্রিয়মাধবকে পাংশু দেখাত এ ধরনের কথায়, পারতপক্ষে ও দিদির কথা তুলত না, শুধু এ ধরনের কথায় স্নান গলায় বলত, তার প্রমাণই বা রইল কই? অনায়াসেই তো খোকাকে ফেলে

আমি ঝংকার দিয়ে বলতাম, অনায়াসে কি অনেক আয়াসে, তা জানো তুমি?

 ও বলত, কী জানি, হয়তো তাই।

এইসব সময় আমি আবার দিদিকে খোঁজার কথা তুলতাম। ধিক্কার দিতাম, কটুকথা বলতাম।

 ও অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে চুপ করে থাকত।

কিন্তু কেন আমি ও রকম করতাম?

সত্যিই কি চাইতাম দিদি ফিরে আসুক।

কোনওদিনই কি চেয়েছি?

না, চাইনি। যদি চাইতাম তা হলে সত্যিই যখন ধূসর একটা আশ্বাসবাহী খবর এল, তখন অমন ভয়ানক নিষ্ঠুর পাপটা করে বসতাম না।

তবে খবরটা তখন আসেনি।

 যখন অরুণকে বোর্ডিঙে দেওয়ার কথা চলছে, তখন সেই পাপের স্পর্শ লাগেনি আমার গায়ে।

তখন শুধু উৎখাত করছি প্রিয়মাধবকে। ছেলের শিক্ষা আর নিঃসঙ্গতার জন্যেও নয়। হয়তো ও বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক একটা ভয়ের সৃষ্টি হচ্ছিল মনের মধ্যে। যদি ও আমাদের দুজনের ভিতরকার সম্পর্কটার ফাঁকি ধরে ফেলে? যদি সে রহস্য উদঘাটনে যত্নবান হয়?

এর পর প্রিয়মাধব বলল, অরুণ তোমায় ছেড়ে থাকতে পারবে না।

বললাম, আমায় না তোমায়?

আমার থেকে তোমাকে অনেক বেশি ভালবাসে, বলল প্রিয়মাধব।

আমি অগ্রাহ্যের হাসি হাসলাম।

 বললাম, তা হয় না। প্রকৃতির নিয়ম তা বলে না। রক্তমাংসের যোগ, নাড়ির যোগ, এটা সহজাত আকর্ষণের। আমার সঙ্গে ওর কোথায় কীসের যোগ?

ও বলল, একেবারেই কি নেই? যমজরা তো শুনেছি ভিন্নদেহে অভিন্ন। সেই পথ ধরেই ।

 থামো! বাজে বোকো না। ও কোনও কথাই নয়। খোকা আমার চেয়ে অনেক বেশি ভালবাসে তোমাকে।

বেশ তবে না হয় বলছি–আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবে না ও।

আমি তখন অরুণমাধবকেই ডাকলাম।

হেসে বললাম, কী রে, বোর্ডিঙে রেখে পড়াতে চাইলে পড়বি না তুই? আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবি না বলে কাঁদবি?

অরুণমাধব লজ্জায় লাল হয়ে বলল, যা!

বাপের মতো বাঁচাল হয়নি ছেলেটা, মায়ের মতো স্বল্পভাষী হয়েছে। তাই ওইটুকুর বেশি কিছু বলল না।

প্রিয়মাধব রেগে বলল, তোমার প্রশ্নপত্রেই কারসাজি। আমি হলে ওভাবে প্রশ্ন করতাম না।

কীভাবে করতে তুমিই বলো–বললাম নিরীহ গলায়।

আমি বলতাম, কী রে খোকা, আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবি তো? নির্ঘাত ও উত্তর দিত, না পারব না। আমি যাব না।

বেশ তুমিই জিজ্ঞেস করো।

আর হয় নাকি? ও সব শুনে নিল।

 অরুণমাধব এবার হঠাৎ নিজে থেকে বলে উঠল, ইস্কুলে অনেক বন্ধু থাকবে তো!

অর্থাৎ সেই অনেক বন্ধুর বিনিময়ে কিছু ত্যাগস্বীকার করতে সে প্রস্তুত আছে।

আর প্রিয়মাধবের আপত্তি টিকল না।

বাগান থেকে কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে শিলঙে চলে এল প্রিয়মাধব আমাদের সঙ্গে করে। সেখান থেকে ছেলের স্কুল আর বোর্ডিঙের সুব্যবস্থা করে ফিরল।

প্রচুর খরচ করল, প্রচুর জিনিস কিনল প্রিয়মাধব, আমার বকুনিতে কান দিল না। আমি যত বলি, বোর্ডিঙে আরও ছেলে থাকবে, তাদের সঙ্গে যাতে সমান হয় সেই তত ভাল। অত বেশি বস্তুর ভার চাপাচ্ছ কেন?

ও বলল, বেশি আর কী! চোখের বাইরে থাকবে, কখন কী দরকার হবে বলতে পারবে না।

তুমি যা জামা জুতো কিনলে, বিয়ে পর্যন্ত চলবে ওর!

 প্রিয়মাধব গম্ভীর হয়ে বলল, ওই তো একটাই। জীবনে তো ভাগীদার আসবে না ওর!

এই আক্ষেপবাণীর সঙ্গে স্থির গভীর আর হতাশ একটা অভিযোগের দৃষ্টি নিয়ে আমার চোখে চোখ রাখল ও, তারপর আবার বলল, একা ওকে দিয়েই বুভুক্ষা মেটাচ্ছি।

আমি কেঁপে উঠলাম।

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, কী রে খোকা, রেলগাড়ি চড়ে কেমন লাগছে?

গম্ভীর অরুণমাধবের মুখটা আহ্লাদে ভরে উঠল। তারপর বলল, খুব ভাল।

 ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল ও যেন মুক্তি পেয়ে বেঁচে যাচ্ছে।

অথচ এমনটাই কি সত্যি হবার কথা?

মা বাপের এক সন্তান কি থাকে না? তারা কি এইভাবে মুক্তির পিপাসায় অধীর হয়ে ওঠে? অন্তত এই বয়েসে?

তা তো নয়!

আমি অনুভব করলাম ওর মা বাপের মধ্যেকার সম্পর্কের ফাঁকাত্বটাই ওকে এমন কঠিন আর শুষ্ক করে তুলেছে।

ঠিক কিছু না বুঝলেও ও যেন প্রাণরসের স্বাদ পাচ্ছিল না। যান্ত্রিক নিয়মের মধ্যে থেকে হাঁপিয়ে উঠছিল।

অথচ আমিই সংসারের এই যান্ত্রিক নিয়মের কর্তা। আমার সংসারে এতটুকু এদিক ওদিক হবার জো নেই, কারও এতটুকু শৈথিল্য।

ওইটুকুই তো হাতিয়ার।

লড়ে টিকতে হলে একটা কিছু চাই বইকী!

যেদিন ওকে ছেড়ে রেখে চলে এলাম, সেদিন অবশ্য এ দৃঢ়তা থাকল না ওর! প্রিয়মাধব তো কেঁদেই ভাসাল, শুধু আমিই রইলাম দৃঢ় হয়ে।

কিন্তু ভিতরে কি সত্যিই ছিলাম তা?

 আমার সামনে ভয়ংকর একটা শূন্যতার হাঁ তাড়া করে আসছিল নাকি?

 আমার পিছন থেকে ভয়াবহ একটা ভয়ের হিমস্পর্শ?

তবু অবিচলতা বজায় রাখলাম আমি।

আর আশ্চর্য, বজায় রাখতে রাখতেই সহজ হয়ে গেল সেটা।

 ফিরে এলাম শুধু দুজনে।

তার মানে বাড়িতে এখন শুধু প্রিয়মাধব আর আমি!

.

সেই রাত্রে, সেই শুধু দুজনের রাত্রে?

সে রাত্রি আমার জীবন-খাতার একটা কলঙ্কময় ক্লেদাক্ত পৃষ্ঠা। পরে ভেবে অবাক হয়েছি কী করে নিজেকে অমন ছোট করলাম আমি, কী করে অমন অপমান করলাম নিজেকে।

অথচ করেছিলাম!

সারারাত্রি ঘরের দরজা আলগা ভেজিয়ে রেখে জেগে বসে ছিলাম আমি সে রাত্রে। আর প্রতিটি মুহূর্তে অপেক্ষা করছিলাম ও আসবে।

হয়তো ঝড়ের মতো।

সারারাত কণ্টকিত হয়েছি এই উভয়বিধ কল্পনায়। আর হ্যাঁ আর ওই দুই অবস্থার জন্যেই প্রস্তুত করেছি নিজেকে, রচনা করেছি নিজের ভূমিকা। আশায় দুলেছি, আশাভঙ্গে ক্ষিপ্ত হয়েছি। সে যেন সমস্ত রাত্রিব্যাপী এক পাগলিনীর ভূমিকা অভিনয়।

তারপর রাত্রি যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে

 শেষ কলঙ্কের কালি মাখলাম নিজের মুখে।

বেরিয়ে এলাম নিজের ঘর থেকে, ওর দরজায় ধাক্কা দিলাম।

একবারেই দরজা খুলে দিল ও।

অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে? শরীর খারাপ?

যদি বলতাম, হ্যাঁ ভীষণ মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে, দেখতে এলাম তোমার কাছে কোনও ওষুধ আছে। কিনা- তা হলে মুখরক্ষে হত!

কিন্তু তা বললাম না।

যে নকল কথাটা ভেঁজে নিয়ে এসেছি, সেটাই বললাম। আর বলার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম, কত বিশ্রি বেমানান খাপছাড়া কথা হল সেটা।

বললাম, হঠাৎ যেন তোমার ঘরে একটা গোঙানির শব্দ পেলাম মনে হল! খারাপ স্বপ্ন দেখেছ?

 প্রিয়মাধব আরও অবাক হয়ে বলল, সে কী? না তো! ঘুমই আসছে না। সারারাতই তো জেগে!

আবার আশায় দুলে উঠল বুক!

ভাবলাম, ও তা হলে তোমারও একই দশা! এতই যদি, তবে খোয়ালে না কেন মানটুকু? আমি তো নিজেকে সঁপে দেবার জন্যে বসেই ছিলাম!

কিন্তু মনের কথা তো মুখে বলা যায় না। তাই ভুরু কুঁচকে বললাম, কেন? সারারাত জেগে কেন? শরীর খারাপ লাগছে?

ভাবলাম–এ প্রশ্নের পর ও আর নিজেকে সামলাতে পারবে না, কাণ্ডজ্ঞান হারাবে। শূন্য হৃদয় আর শূন্য ঘরের ভয়াবহতা থেকে ছুটে পালিয়ে আসবে আমার কাছে।

কিন্তু সে ভাবনা লজ্জায় ধিক্কারে মাথা হেঁট করল।

উত্তর নয়, একটা লাঠি বসাল ও আমার মাথার উপর।

 ও ম্লান মুখে শিথিল গলায় বলল, না এমনি! মানে খোকাটা কী করল, কোথায় শুল, খেল কি না-খেল ভাবতে ভাবতে

খোকা!

সারারাত বাৎসল্যের আবেগে-ভরা সন্তানবিরহী মন নিয়ে ও জেগে বসে থেকেছে।

আর আমি?

আমি খোকার অনুপস্থিতিটাকে সুযোগ ভেবে নিয়ে ভিতরের অবরুদ্ধ সাপের ঝাঁপিটার মুখ খুলে দিয়েছি, আর ছড়িয়ে পড়া সাপগুলোকে নিয়ে খেলাচ্ছি!

একটা নীচ নোংরা মেয়েমানুষের মতো বাৎসল্য স্নেহের মধুর আবেগ, সন্তান বিরহের পবিত্র বেদনা খুলে, কামনায় উত্তাল হয়ে উঠেছি।

.

মাথা হেঁট করে ফিরে এলাম।

ঘরে এসে আছড়ে আছড়ে মারলাম সেই ক্লেদাক্ত সাপগুলোকে। চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেললাম, ধুলো ধুলো করে দিলাম তাদের বহুতর কঠিন প্রতিজ্ঞার ঝাঁপটে।

নতুন জন্ম নিয়ে নতুন সকালের বাতাসে শ্বাস নিলাম।

আশ্চর্য রকমের বদলে গেলাম। হ্যাঁ বদলে গেলাম। মদ্যপ চরিত্রহীন প্রিয়মাধবকে নিজের থেকে উঁচু ভাবতে শুরু করলাম সেদিন থেকে। প্রতিটি কথায় ছোবল হানা থেকে বিরত হলাম।

আর বাসনার তিক্ততাকে সরিয়ে রাখতে রাখতে ওর সত্যিকার হৃদয়ের খোঁজ পেলাম। দেখলাম ওর ভালবাসার প্রাণটি ভরা আছে সুমিতাকে দিয়ে। টের পেলাম এই এতগুলো বছর, ও লুকিয়ে লুকিয়ে অবিরতই সুমিতার খোঁজ করেছে।

অথচ আশ্চর্য, আমি যখন নিশ্চেষ্ট বলে শত ধিক্কারে লাঞ্ছিত করেছি ওকে, ও নীরবে সে লাঞ্ছনা মাথা পেতে নিয়েছে।

জানি না কেন এই নিপীড়ন।

এইটাই কি ও নিজের শাস্তি বলে গ্রহণ করেছিল? না কি ওর একেবারে মর্মলোকের সেই পবিত্রতম বস্তুটিকে আমার নির্লজ্জ হিংসার দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখতে চেয়েছিল?

কিন্তু এও কি আমার পক্ষে ভয়ানক একটা অপমান নয়?

তবু আমি সেই অপমানকে উদঘাটন করে দিইনি। আমি বুঝতে দিইনি ওর সেই গোপনীয়তাটুকু টের পেয়ে গেছি আমি।

ও সব বিষয়ে আমার মুখাপেক্ষী, তাতেই যেন বিভোর আমি। ও যে প্রতি মুহূর্তে ডাক দেয় সুমিতা সুমিতা তাতে যেন নমিতার সব পাওনা পাওয়া হয়ে গেছে।

প্রিয়মাধবের ওই মুখাপেক্ষিতাটুকু কিন্তু কৃত্রিম ছিল না। ওটা নইলে ওদের মতো পুরুষ মানুষ বাঁচে না। একজনের হাতে সব ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়াই ওদের মতো লোকের প্রকৃতি। নমিতা সেই ভারবাহী পশু!

সেই পশুটাকে ও একেবারে যে ভালবাসত না তা নয়। আগে যে আকর্ষণটা ছিল, তার তীব্রতা মুছে গেলেও ওর প্রয়োজন ওকে ভালবাসিয়েছিল।

.

মিথ্যা সুমিতাকে দিয়ে ওর সম্ভ্রম বেঁচেছে, সন্তান বেঁচেছে, সংসার বেঁচেছে, তাই তার কাছে সে কৃতজ্ঞ। আর নমিতা নামের মেয়েটা চিরদিন ওই প্রিয়মাধবকে ভালবেসে এসেছে, নিজের সকল অহমিকা বিসর্জন দিয়েছে তার আকর্ষণে পড়ে, তাই তাকে একটু মমতা করেছে।

ওই নমিতা যদি সম্পূর্ণ সুমিতা হয়ে যেতে পারত, হয়তো হারানো সুমিতা হারিয়েই যেত, নমিতার জীবনটা এমন অনাসৃষ্টি হত না। দু নৌকোয় পা দেওয়া নমিতা এখন বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

তার সেই অফুরন্ত কর্মশক্তি, অগাধ জীবনীশক্তি সব ফুরিয়ে এসেছে। অরুণমাধবের বউয়ের হাতে সংসার তুলে দিয়ে নিশ্বাস ফেলতে চায় সে। কিন্তু নিশ্বাস ফেলা হয়নি নমিতার। প্রিয়মাধবের সেই শালতরুর মতো স্বাস্থ্য-সতেজ দেহহঠাৎ হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল। হয়তো এও নমিতারই অপরাধের ফল।

স্বাস্থ্যরক্ষার যে খোলা দরজাটা দেখিয়ে দিয়েছিল সে প্রিয়মাধবকে, সেই পথ দিয়েই এসেছে এই ভাঙন, এই সর্বনাশ।

এখন যদি প্রিয়মাধব সেই নমিতাকে অহরহ তীব্র আর তীক্ষ্ণ বাক্যের বাণে বিধতে থাকে, যদি তাকে অপমান করেই সুখ পায়, যদি ওকে পীড়ন করেই উল্লাস অনুভব করে,কী করে তাকে দোষ দেবেনমিতা?

কিন্তু অরুণমাধবের বউ?

সে তো অনেক পরের কথা! প্রিয়মাধবের তীব্রতা আর তিক্ততা? সেও তো অনেক পরে।

 মাঝখানে কত কত দিন পার হয়ে গেল না? যখন প্রিয়মাধব শালতরুর মতো সোজা আর সতেজ ছিল। যখন ছুটি হলেই অরুণমাধব চলে আসত বোর্ডিং থেকে, আর চা-বাগানের সাহেব মেমসাহেবের অদ্ভুত সংসারে লাগত উৎসবের স্পর্শ!

ছেলে এলে আহ্লাদে যেন উথলে উঠত ম্যানেজার সাহেব। কী করলে ছেলেকে সম্যক যত্ন করা হবে যেন ভেবে পেত না। রোজ ভোজ লাগাত, রোজ বাড়িতে লোকজন ডাকত, মাইলের পর মাইল গাড়ি করে বেড়িয়ে বেড়াত ছেলেকে নিয়ে। দাস-দাসীকে অপর্যাপ্ত বকশিশ দিত, আর সেই নৈশভ্রমণটা একেবারে চাপা দিয়ে ফেলত।

যেন খোকা জেনে ফেললেই ওর সর্বনাশ ঘটে যাবে।

আমার মনে হত এও যেন সুমিতার প্রতিই সম্মান! সুমিতা পবিত্র, সুমিতার ছেলে পবিত্র, সেখানে নিজের ধুলোমাখা অপবিত্র মূর্তিটাকে দেখাতে পারবে না সে।

মনের অগোচর পাপ নেই।

ভাবতাম নমিতা যদি এমন করে ইস্পাতের বর্মে নিজেকে ঢেকে না রাখত, যদি প্রিয়মাধবের সেই আছড়ে পড়ার দিনে নিজেকে বিকিয়ে দিত, নমিতার গর্ভেও নিশ্চয় আসত সন্তান। সেই সন্তানকে কি প্রিয়মাধব এমন সম্মান করত, সমীহ করত, প্রাণ উজাড় করে ভালবাসত?

এ প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত হয়ে নিজের মনের কাছে একটা উত্তরই পেয়েছি-না না না।

 নিজেকে বিকিয়ে দিলে নমিতা নামের মেয়েটা প্রিয়মাধবের বাঁদির পদ পেত শুধু। তার সন্তান হত ঘৃণ্য গ্লানির। এ তো তবু ওর সংসারের গৃহিণীপদ পেয়ে গৌরবের আসনে আছে।

রাজ্যহীন রাজা!

 ঘরহীন ঘরণী!

তবু সেই ঘর আঁকড়ে থাকবার দুরন্ত লোভ তো গেলও না সারা জীবনে। ক্লান্ত হয়েছি, নির্লিপ্ত হতে চেষ্টা করেছি, তবু দিদির মতো হঠাৎ একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার প্রেরণা সংগ্রহ করতে পারিনি।

এই সময় একদিন এল সেই চিঠিটা!

 যা থেকে এল আর এক কলঙ্কিত স্মৃতি।

সেদিন কবে কঘন্টা আগে ছুটির পর শহরে স্কুলে ফিরে গেছে অরুণমাধব।

কদিনের উল্লাস উত্তেজনা উৎসাহের পর বাসাটা যেন দেওয়ালির পরদিনের তেল সলতে জ্বলে যাওয়া মাটির প্রদীপটার মতো পড়ে আছে।

প্রিয়মাধব চলে গেছে কাজে।

তখন চিঠিটা এল। প্রিয়মাধবের নামে।

 বৃন্দাবনের ছাপ মারা চিঠি। খামের চিঠি।

 কিন্তু কার হাতের লেখা এই ঠিকানা?

মুক্তোর মতো সাজানো অক্ষরে পরিচ্ছন্ন ইংরেজিতে? সাপের ছোবল খাবার মতো শিউরে উঠেই অসাড় হয়ে তাকিয়ে রইলাম সেই খামে বন্ধ চিঠিখানার দিকে।

কার চিঠি এ? কার চিঠি? আমার চিরপরিচিত এই অক্ষরে কে চিঠি লিখল প্রিয়মাধবকে? বিষে আচ্ছন্ন হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শরীরে সমস্ত রক্ত ঝিমঝিম করে এল, চোখের সামনে থেকে সমস্ত পৃথিবী মুছে গেল, মুছে গেল ন্যায় অন্যায় পাপপুণ্য বোধ! ছিঁড়ে ফেললাম খামের মুখটা। আর ছেঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন ভিতরের চিঠির টুকরোটা বড় বড় দাঁত খিঁচিয়ে ব্যঙ্গ হাসি হেসে উঠল।

প্রিয়মাধবের মার চিঠি!

আঁকা বাঁকা অক্ষরে আর বানান ভুলে ভর্তি। বয়েসের চাপে ক্রমশই বাড়ছে ভুল আর বক্রতা।

এ লেখা চেনে নমিতা।

যদিও বছরে একটি কি দুটি চিঠি আসে এই হাতের লেখায়। আসে বিজয়া দশমীতে, আর হয়তো বা এমনি কুশল সংবাদ চেয়ে, নয়তো প্রিয়মাধবের জন্মদিনে, আশীর্বাদ দিয়ে।

যা দেখে প্রিয়মাধব হেসে বলত, তিথিটা তো ভুলেও যায় না বুড়ি।

দেখত, বলত, তুলে রাখত ড্রয়ারে।

কিন্তু সে চিঠি কদাচ কি খামে?

না, এযাবৎকখনও সে দৃশ্য দেখেনি নমিতা। নিশ্চিত একখানি পোস্টকার্ড। প্রায় একই ভাষা, একই ভঙ্গি, একই বক্তব্য। পর পর পাঁচখানা চিঠি সাজিয়ে রাখলে দেখা যাবে তফাত মাত্র নেই।

সহসা খামে কী লিখেছেন উনি?

 আর এই ঠিকানা?

কাকে দিয়ে লিখিয়েছেন?

খামের উপরকার সেই পরিপূর্ণ অক্ষরগুলো যেন গ্রাস করে ফেলছিল নমিতাকে। তবু আস্তে ওই আঁকাবাঁকা লেখাটা চোখের সামনে তুলে ধরল। নতুন কী আছে এতে? হ্যাঁ, এবারে বক্তব্য নতুন।

প্রিয়মাধবের বাবা মৃত্যুশয্যায়, প্রিয়মাধব যেন পত্রপাঠ মাত্র বউমাকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসে। খুব শীঘ্র ব্যবস্থা না করলে হয়তো বাপের সঙ্গে শেষ দেখা হবে না প্রিয়মাধবের। দিন যে কীভাবে যাচ্ছে তিনিই জানেন আর বৃন্দাবনচন্দ্রই জানেন। অবশেষে লিখেছেন, তবে বৃন্দাবনচন্দ্রের কৃপায় একটি সংসার বৈরাগিণী বিধবা মেয়ে উপযাচক হয়ে যে সেবা ও সাহায্য করছে, তা দুর্লভ। মেয়েটির দেখা না পেলে কী যে করতেন বৃদ্ধা! দেখে মনে হয় যেন চিরকালের চেনা, কতজন্মের আপন।

.

নমিতার ঠোঁটটা দাঁতের চাপে কেটে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি আমি, দেখতে পাচ্ছি নমিতা সেই চিঠিটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ছে।…দেখতে পাচ্ছি নমিতা সেই চিঠি আর চিঠির খামের কুচিগুলোয় দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে আগুন ধরাচ্ছে।…

দেখতে পাচ্ছি সেই পোড়া ছাইগুলোকে বাথরুমে জল ঢেলে নিশ্চিহ্ন করছে নমিতা। তারপর দেখতে পাচ্ছি নমিতা বিছানায় পড়ে হাঁপাচ্ছে।

দেখতে পাচ্ছি প্রিয়মাধব এলে বলছে, অসুখ করেছে?

 প্রিয়মাধবও আজ স্তিমিত।

আজ বাসায় ফিরে অরুণমাধবকে দেখবে না, এই বিষণ্ণতা নিয়ে ঢুকেছে। তবু ব্যস্ত হল। বারবার বলতে লাগল, কদিন খুব খাটনি গেল তো! ব্যস্ত হয়ে উঠল, ওষুধ ওষুধ করে।

আর হয়তো সে ব্যস্ততা নিরর্থকও হল না। অসুখ তো সত্যিই করেছিল নমিতার। ভিতরের অসহ্য যন্ত্রণায় জ্বরই এসেছিল ওর।

কী করবে ও?

 কেমন করে জানাবে প্রিয়মাধবকে তার বাবার অবস্থা।

নমিতা কি বলবে, হঠাৎ অন্যমনস্কতায় খামটা ছিঁড়ে ফেলেছিলাম, পড়ে দেখলাম—

 কী বলবে প্রিয়মাধব?

ঠিক আছে খুলেছ ক্ষতি নেই, কিন্তু চিঠিটা?

নমিতাকে তা হলে বলতে হবে, কোথায় রেখেছি খুঁজে পাচ্ছি না!

 প্রিয়মাধবও তবে পাওয়া যাচ্ছে না ভেবে নিশ্চিন্ত হবে? খুঁজবে না?

নমিতা কি বলবে অচেনা অজানা একটা লোক হঠাৎ এসে খবর দিয়ে গেল?

প্রিয়মাধব পাগল নয় যে সেই অবাস্তব কথাটা শুনে বিশ্বাস করবে। তা ছাড়া–হ্যাঁ, তা ছাড়া বাপের ওই মৃত্যুশয্যার খবরটা দিলেই বা চলবে কেন প্রিয়মাধবকে? প্রিয়মাধব তা হলে ছুটবে না? না, প্রিয়মাধবের মার বউমাকে নিয়ে ছুটবে না অবিশ্যি, একাই ছুটবে। মা বাপের সামনে, মরণোন্মুখের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে না সুমিতা হয়ে যাওয়া নমিতাকে নিয়ে।

অতএব একাই ছুটবে। আর সেখানে গিয়ে দেখতে পাবে সেই মেয়েকে। যে নাকি ওর মার কতজন্মের আপন।

না, না, তার চেয়ে নমিতার অসুখ বাড়ুক। নমিতা বিছানা থেকে উঠতে না পারুক।

.

না, বাপের সঙ্গে শেষ দেখা হয়নি প্রিয়মাধবের। কদিন যেন পরে ধিক্কারের ভাষার একখানা পোস্টকার্ড এসেছিল।

যাতে প্রিয়মাধবের বাপের মৃত্যুসংবাদ ছিল, আর ছিল ওর মায়ের তীর্থযাত্রার সংবাদ। সংসারই যখন ত্যাগ করেছেন, তখন ছেলের হাতের আগুন পাবার প্রত্যাশাই ছিল ভুল। সে ভুল ভেঙেছে তাঁর, স্বামীর পারলৌকিক কাজ সাঙ্গ করে গুরুদেবের সঙ্গে তীর্থ পর্যটনে বেরোচ্ছেন তিনি। কোথায় যাচ্ছেন জানেন না। ভগবান যেখানে নিয়ে যান।

অক্ষর আঁকা আঁকা, কিন্তু বক্তব্য স্পষ্ট। প্রিয়মাধবের মার পুরনো চিঠির সঙ্গে এ চিঠির মিল নেই কোথাও।

প্রিয়মাধব মাথায় হাত দিয়ে পড়েছিল। বলেছিল, এ চিঠির মানে কী বলতে পারো?

নমিতা শুকনো গলায় বলেছিল, কী করে বলব?

অনেকক্ষণ উদভ্রান্তের মতো পায়চারি করেছিল প্রিয়মাধব। বলেছিল, খুব অন্যায় হয়ে গেছে আমার, খুব অন্যায় হয়ে গেছে! ওঁরা যে বুড়ো হচ্ছেন, সে খেয়াল করিনি। মাসে মাসে একটা মনিঅর্ডার, আর তাতেই দুছত্র লেখা, এতেই কর্তব্য শেষ হল ভেবেছি। ছেলে দেখাতে বলেছিলেন, দেখাইনি। আমি একটা জানোয়ার সুমিতা, আমি একটা রাসকেল!

সুমিতা!

সুমিতাই বলত বইকী! বলে বলে সহজ অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, ওরও গলায় বেসুরো বাজত না, আমারও কানে বেখাপ্পা লাগত না।

আমি শুকনো মুখে বললাম, তোমার আর দোষ কী? তুমি তো জানতে না অসুখ?

অসুখ জানতাম না, বয়েস জানতাম তো!

ওঁরা তো তোমার সাহায্যের প্রত্যাশী ছিলেন না!

খোকাকে দেখাব এ প্রত্যাশা করেছিলেন।

 খোকা!

আমি ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বললাম, খোকা জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই তো?

হ্যাঁ! খোকার জন্মের পরই–।

মাথার চুলগুলো মুঠোয় চেলে ও তীব্রস্বরে বলে ওঠে, মুখ দেখাবার পথ আর ছিল কোথায়?

.

বাবার সঙ্গে শেষ দেখা হল না, বাবার সঙ্গে শেষ দেখা হল না–এই আক্ষেপটা নিয়ে বড় বেশি বাড়াবাড়ি করল প্রিয়মাধব। যদি ছুটে চলে গিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারত, হয়তো এতটা অশান্তি ভোগ করত না, কিন্তু ওর মা সে পথ বন্ধ করে দিয়ে গেছেন। ওর সেই রুদ্ধ আবেগে তাই অমন করে মাথা কুটে মরছিল।

দীর্ঘকালের বিচ্ছিন্ন সম্পর্ক বাবার মৃত্যু যে ওকে এভাবে বিচলিত করে তুলবে, তা কে জানত!

এতদিনের কর্তব্যের ত্রুটি, আর নিজের এই ভেজাল জীবনের গ্লানি, একে অহরহ অপরাধবোধের তাড়নায় বিঁধছিল, শুধু স্বভাবগত চাপল্যে ভাসা ভাসা হালকা হয়ে থাকত, এই একটা ধাক্কায় বদলাতে শুরু করল।

দিদি চলে যাবার পর কিছুদিন যে বিকৃতি এসেছিল, এ বদল ঠিক তেমন নয়। এ যেন ওর মধ্যে একটা হিংস্র নিষ্ঠুরতা জন্ম নিচ্ছিল। যে হিংস্রতা অকারণ পুলকে উল্লসিত হয় অপরকে যন্ত্রণা দিয়ে, পীড়ন করে।

আর সেই পীড়নের পাত্র নমিতার মতো এমন আর কোথায় পাওয়া যাবে? এত হাতের কাছে, এমন নিরুপায়?

নমিতা যে কোনওদিন প্রিয়মাধবকে ধমক দিত, তীক্ষ্ণ বাক্যের বাণে বিদ্ধ করত, প্রতিপদে হেয় করত, সে কথা ভুলে গেল নমিতা। অতএব প্রিয়মাধবও ভুলল। তাই ভূমিকার বদল হল।

নমিতা সেই চিঠি পোড়ানোর পর থেকে নিজে পুড়ে পুড়ে খাক হল।

অথচ এখন আর উপায় কী?

কলেজে পড়া অরুণমাধবের সামনে, বিয়ের যুগ্যি অরুণমাধবের সামনে নমিতা কি প্রকাশ করতে বসবে এবার নমিতা-সুমিতার রহস্য!

আর হবে না কিছুই হবে না, নমিতাকে এখন শুধু তার ভাঙা নৌকোখানা ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে পৌঁছতে হবে কোনও এক অজানা লোকের উদ্দেশে।

তার আগে কিছু হবে না।

 প্রিয়মাধবকে তার ছেলের সামনে ধিকৃত করবার শক্তি নেই নমিতার মধ্যে। শক্তি নেই তাকে পৃথিবীর চোখে হেয় করবার। তাকে সম্মানের উচ্চ শিখরে বসিয়ে রাখবার সাধনায় সব বিষ পান করে হাসিমুখে সংসার করতে হবে নমিতাকে!

কারণ?

কারণ একদা নমিতা নামের একটা আবেগপ্রবণ মেয়ে প্রিয়মাধব নামের একটা সর্বনাশাকে ভালবেসে বসেছিল।

কিন্তু প্রিয়মাধব তো সেই ভালবাসা বাসেনি!

তাই প্রিয়মাধব ওকে অপমান করেই সুখ পায়, পীড়ন করেই উল্লাস অনুভব করে।

অথচ ওর ভালবাসার এই রীতি।

তাই প্রিয়মাধবকে দোষ দিতে পারি না আমি। এ ছাড়া আর কী হতে পারত ও?

 কিন্তু আমাকেই বা আমি দোষ দেব কেন? আমি যদি দিদির হাতের লেখার সাদৃশ্য দেখে শিউরে উঠি, সে কি খুব বেশি করেছি?

আমার অবস্থায় আমি এর বেশি কী হতে পারতাম?

 দিদিকে আমি ভয় করব না?

 দিদির সেই চোখ?

 সেই ভয়ংকর অর্থবহ শূন্যদৃষ্টি?

সেই চোখ আজীবন আমাকে তাড়া করে ফিরেছে, আমাকে বিদ্রূপ করেছে, করুণা করেছে, ঘৃণা করেছে, আহা করেছে।

অনেকবার ভাবতে চেষ্টা করেছি, দিদির এই চলে যাওয়া সম্পূর্ণ বোকামি। চিরকেলে বোকাটা অভিমান করে সর্বস্ব খোয়াল। কিন্তু ওই চোখ? ও কি বোকার? তাই দিদিকেই আমি দোষী করব। চিরদিন করে এসেছি।

ওকে আমি ক্ষমা করতে পারলাম না কোনওদিন, ভালবাসতেও না। চিরদিন হিংসে করে এসেছি দিদিকে, চিরকাল করব। দিদি আমার জীবনের শনি!

.

সেই চিঠিখানার স্মৃতি ক্রমশ ধূসর হয়ে এসেছিল, ধূসর হয়ে এসেছিল অপরাধবোধের সেই তীব্র আগুন। ক্রমশই মনে হয়েছে হাতের লেখার সেই ছোবল সম্পূর্ণই আমার মনের ভুল। দড়িকে সাপ ভেবেছি আমি, সিঁদুরে মেঘকে আগুন। মানুষে মানুষে কত সাদৃশ্য থাকে, হাতের লেখাতেও থাকে। আমার মনে দুর্বলতা আমাকে ভয় দেখিয়েছে। দিদি নেই! পৃথিবীর কোথাও নেই। থাকলে–

মাঝখানে আর একটা ঘটনা ঘটে গেল।

বৃন্দাবন থেকে এক অচেনা হাতের লেখা চিঠি এল, আপনার মাতাঠাকুরাণী শ্রীমতী বিন্দুবাসিনী দেবী গত পূর্ণিমায় শ্রীশ্রীদ্বারকাধামে দেহরক্ষা করেছেন, গুরুদেবের আদেশে আপনার জ্ঞাতার্থে জানানো হইল। তাঁহার পারলৌকিক কার্যাদি শ্রীশ্রীগুরুদেবের নির্দেশানুযায়ী সম্পন্ন হইয়াছে, ইচ্ছা হইলে মাতাঠাকুরাণীর নামে ভাণ্ডারা দিয়া পুণ্য অর্জন করিতে পারেন। ব্রজবাসী মথুরামোহন দীনদাস, বৃন্দাবন, এই ঠিকানায় টাকা পাঠাইলে চলিবে।

পোস্টকার্ডের চিঠি।

বাপের মৃত্যুতে যতটা বিচলিত হয়েছিল, ততটা বিচলিত হল না প্রিয়মাধব, শুধু বলল, জানতাম আমি জানতাম, আমার যে এই শাস্তি হবে তা জানতাম আমি।

তারপর সেই ব্রজবাসীর নামে তিনশো টাকা পাঠিয়ে দিল।

 সেই সময় সাহসে ভর করে বলেছিলাম, বৃন্দাবনে মা যেখানে থাকতেন, যাও না সেখানে একবার।

ও ভুরু কুঁচকে বলল, কেন? গোড়া কেটে আগায় জল দিতে?

 তবু খৃষ্টের মতো বললাম, তা কেন, স্মৃতির জায়গাটা দেখে আসতে

অত ন্যাকামিতে কাজ নেই, বলে চলে গেল ও।

এই রকমই কথাবার্তা হয়েছে ওর ক্রমশ।

বুঝতে পারি ওর এই ত্রুটির জন্যে মনে মনে আমাকেই দায়ী করে ও। আশ্চর্য! চাকরি বজায় রাখতে ও কী করে বসেছিল তা ও ভেবে দেখে না। কিন্তু ওর এই নির্লজ্জতাকে কেটে চিরে বিশ্বের সামনে উদঘাটিত করতে পারি না ওকে, এমনকী ওর সামনেও পারি না। বলতে পারি না, তা আমায় শোনাতে এসেছ কেন ও কথা? আমাকে তোমার গলায় গাঁথো, পায়ে ধরে বলতে এসেছিলাম এ কথা? নিজের গলায় নিজে পাথর বেঁধেছ তুমি। এখন আমায় দোষ দিতে এলে চলবে কেন?

বলতে পারি না।

আমার সব তেজ সব দর্প সব সাহস কোথায় যেন চলে যাচ্ছিল, আমি শুধু নিজেকে খোলসের মধ্যে ঢুকিয়ে নিচ্ছিলাম। অতএব ও আমাকে যা ইচ্ছে বলে পার পাচ্ছে।…

আবার দু-একদিন পরে হয়তো নিজেই নরম হয়ে কথা কইতে আসে।

 আমি কি তখন কথা বলব না?

মান-অভিমানের লীলা করব?

কীসের দাবিতে?

অথচ মনে হয় ও যেন সেটাই প্রত্যাশা করে। আমি মান করব, ও যে মান ভাঙাবে এই আশা নিয়েই যেন সন্ধি করতে আসে। আর আমি যখন পুরনো কটুক্তির বাষ্পমাত্র ভুলে গিয়ে নিতান্ত সহজভাবে কথা বলি, ও হতাশ হয়, ক্ষুব্ধ হয়, বুঝিবা বিরক্তও হয়।

ওর মা মারা যাবার পরে কদিন গুম হয়ে থেকেছিল, তারপর হঠাৎ একদিন কাছে এসে দাঁড়াল। বলল, সারাদিন কী এত কাজ করো? একটা কথা বলবার সুবিধে হয় না।

হেসে বললাম, হুকুম করলেই বাঁদি হাজির হতে পারে।

ও অসন্তুষ্ট স্বরে বলে, সব সময় ওভাবে কথা বলো কেন? আমি কি তোমার সঙ্গে দাসী বাঁদির মতো ব্যবহার করি?

আরও হাসলাম।

বললাম, তুমি করবে কেন? আমি তো জানি আমার পোজিশান।

 পজিশানতুমি ইচ্ছে করে নাও না।

এবার হাসি থামিয়ে বলি, এই কথাটা বলার জন্যেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলে?

ও বসে পড়ল বিছানায়।

বলল, কথার গোড়াতেই কোপ মেরো না। বলছি–এবার খোকার বিয়ের কথা ভাবলে কী হয়?

খোকার বিয়ের কথা আমিও ইদানীং ভাবছিলাম বইকী! লেখাপড়া শেষ করেছে, ভাল একটা ব্যাঙ্কে কাজ পেয়েছে, বয়েসও হল, তবু নিজে থেকে পাড়িনি কথাটা। কেন পাড়ব? আমি তো ওর সত্যি মা নয়। যার ছেলে সে বুঝুক। যদি মনে পড়ে।

দেখলাম ওর মনও নিষ্ক্রিয় নয়।

তাই হেসে বললাম, শুধু ভাবলেই হবে?

আহা প্রথম সোপান তো ভাবা।

 সেটা তো হয়েই গেছে। এবার দ্বিতীয় সোপানে ওঠো।

কিনে খুঁজব তা হলে বলছ?

জোরে হেসে উঠে বললাম, বলছি! কিন্তু কেউ শুনলে ভাববে লোকটা কী বাধ্য!

ও মুচকি একটু হেসে আমার একটা হাত চেপে ধরে ঈষৎ কাছে টেনে নিয়ে বলে উঠল, স্ত্রৈণ ভাববে, এই আর কী!

আমি আস্তে আস্তে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, তাও ভাবতে পারে।

 যাক ভাবুক। এখন বলল, কেমন বউ চাই তোমার?

বললাম, ওটা খোকাকে জিজ্ঞেস করবার কথা।

সে জিজ্ঞেসটা তুমি করবে। তোমাকে জিজ্ঞেস করছি আমি।

বললাম, সুন্দরী বউ চাই।

কেন? খুব একটা সুন্দরীতে কী দরকার?

তা একটা মাত্তর ছেলের বউ, সুন্দরী করবে না?

লাভ কী? ছেলেটা তা হলে বউয়ের কেনা গোলাম হয়ে যাবে!

 সুন্দরী না হলেও যাবে।

কে বললে?

কেউ বলেনি। ওর প্রকৃতিতে বশ্যতা। দেখোনা একদিনের জন্যে তোমার কোনও কথার প্রতিবাদ করে না।

আমি ওকে অন্যায়ও কিছু বলি না।

হেসে বললাম, সে কথা কি জোর করে বলা যায়? মানুষ কি নিজে বুঝতে পারে অন্যায় করছে কি ন্যায় করছে?

তা বটে! প্রিয়মাধব ম্লানভাবে বলল, অন্তত আমার মতো পশু তো বলতে পারেই না। ঠিক আছে, সুন্দরী মেয়েই দেখি।

আমি হাওয়া হালকা করতে হেসে উঠলাম, বললাম, আহা দেখলেই যেন ডানাকাটা পরী খুঁজে পাচ্ছ। ওর কপালে যেমন বউ লেখা আছে তাই হবে। তবে খোঁজাটা দরকার।

চলল খোঁজ।

মেয়ে জোগাড় হল।

 নাম উত্তরা!

মাঝারি সুন্দরী।

 প্রিয়মাধব বলল, এই বেশ, এই ভাল।

চলল সমারোহের তোড়জোড়।

বাজার চষে ফেলা হচ্ছে তত্ত্বের জিনিস কিনতে। কলকাতার বাজার।

হ্যাঁ, তখন তো কলকাতায় চলে এসেছি আমরা।

 কাজে অবসর নিয়েছে প্রিয়মাধব। একটা বাগানের কিছু শেয়ার কিনেছিল, তার উপস্বত্ব আসে বছরে দুবার করে। অরুণও রোজগার করছে। মোটামুটি সচ্ছলতায় চলছে। বাড়ি করবে করবে করছে প্রিয়মাধব।

বলছে, যতই হোক, লোকে বলবে শ্বশুরের একখানা পচা বাড়ি পেয়েছিল তাই মাথা গুঁজে কাটাল!

শ্বশুরেরই বাড়ি।

কলকাতায় এসে আমাদের সেই সিকদার বাগানের পচা বাড়িটাতেই ওঠা হয়েছিল। আইনত যে বাড়ির মালিক এখন অরুণমাধব। মেয়েতে সম্পত্তি পাওয়ার আইন তো তৈরি হয়নি তখন, ছেলে না থাকলে দৌহিত্র সন্তানই উত্তরাধিকারী হত।

তা বিয়ে সেই পচা বাড়িতেই হল।

জিনিসপত্তরে বোঝাই হয়ে উঠল ছোট্ট বাড়ি। নীচের তলার ভাড়াটেদের উঠিয়ে দেওয়া হল। বাজার করতে একাই যেত প্রিয়মাধব। কোনওদিন বলত না, তুমিও চলো না।

যেত তো তখন গিন্নিরা, মেয়েরা।

ওর হয়তো তখনও ভয় ছিল কেউ বুঝে ফেলবে, চিনে ফেলবে। বলে উঠবে, আচ্ছা ইনি আপনার শালি না?

তা নয় তো, কেন ডাকত না?

 একটা জিনিস নিয়ে বারবার ঘোরাফেরাও তো করত আমার পছন্দ হচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করে করে।

সেই বাজার করতে করতেই হঠাৎ আমার জন্যে একখানা জমকালো শাড়ি এনে হাজির করল। চওড়া লাল পাড়ের কড়িয়াল শাড়ি, আঁচলায় জরির ঝলক।

অবাক হয়ে বললাম, এই কাপড় পরব আমি?

ও বলল, কেন পরবে না? দোকানি বলল, বয়স্কা মহিলাদেরই কাপড় এটা! দেখে খুব পছন্দ হল। ওখানের বাজারে কখনও তো ভাল কিছু পাওয়া যেত না, যা কেনা হয়েছে সবই নেহাত লজ্জা নিবারণের মতো–

হেসে উঠে বললাম, তা সেটাই তো দরকার। লজ্জা বর্ধন তো কাম্য নয়।

 এ শাড়িতে লজ্জা কী! ছেলের বিয়েতে ঘুরে বেড়াবে, এমন নইলে মানাবে কেন? বউ এসে মানবেই বা কেন!

এত মানামানির দরকার কী?

আশ্চর্য! দরকার নেই? নিশ্চয় আছে। এই শাড়ি পরে বউ বরণ না কি সেই বলে তাই করবে?

ওর এই আবেগের মাথায় হাতুড়ি বসালাম আমি।

তীক্ষ্ণ গলায় বললাম, বউ বরণ করব আমি?

 প্রিয়মাধব থতমত খেল।

 প্রিয়মাধব ঢিলে গলায় বলল, করবে না কেন? তুমিই তো ওর সত্যিকার মা!

আমি গম্ভীর ভাবে বললাম, মনেপ্রাণে তা যদি ভেবে থাকো তো করব বরণ!

ও কেমন শুকনো শুকনো মুখে চলে গেল।

.

তারপর এল সেই দিন।

বিয়ের সকালে নান্দীমুখে বসতে যাচ্ছে প্রিয়মাধব, হঠাৎ আমার কাছে এসে বোকাটে গলায় বলে উঠল, ভেবে দেখলাম তোমার কথাই ঠিক।

চমকে উঠলাম আমি।

ওর গলায় এ সুর নতুন।

ও তো হয় ব্যঙ্গে তীক্ষ্ণ, নয় ক্রোধে তীব্র, আর নয়তো কখনও কখনও অনুতাপে ম্লান। এমন আলগা গলা কেন? আর আমার কোন কথাটাই বা হঠাৎ ঠিক লাগল ওর?

শুধু তাকিয়ে রইলাম।

ও অন্যদিকে তাকিয়ে বলে উঠল, মানে ভাবছি ওই বরণ-টরণগুলো অন্য আর কেউ করুক। দেশের বড় খুড়ি বা সত্যদার বউ!

পা থেকে মাথা পর্যন্ত আকস্মিক যে একটা অনুভূতি খেলে গেল আমার, তাকেই কি বিদ্যুৎ শিহরন বলে?

তারপর অনেকদিন পরে আমি ব্যঙ্গে তীক্ষ্ণ হলাম।

বললাম, কেন, আমি কী অপরাধ করলাম?

ও অপ্রতিভ গলায় বলল, না না অপরাধের কথা হচ্ছে না। মানে এসব তো মেয়েলি নিয়ম লক্ষণের ব্যাপার

বুঝলাম সেদিন ঝোঁকের মাথায় একটা বড় দানপত্রে স্বাক্ষর করে বসে ও এখন পস্তাচ্ছে। ছেলের কল্যাণ অকল্যাণের চিন্তা ওর চক্ষুলজ্জার দুর্বলতার উপর জয়ী হচ্ছে। ওর মনে পড়েছে আমি বিধবা, আমার কোনও শুভকর্মে যোগ দেবার অধিকার নেই।

মায়া হল।

ছেলে যে ওর প্রাণ! জানি তো?

 তবু সুরটা বজায় রাখলাম।

মুচকি হেসে বললাম, চওড়া লাল পাড়ের বেনারসী গরদটা তা হলে মাঠে মারা?

ও তাড়াতাড়ি বলল, তা কেন? শাড়িটা পরবে না কেন? নিশ্চয় পরবে, পরে বিয়েবাড়ি ঝলসে বেড়াবে। শুধু

ও বুঝেছি, নিরীহ গলায় বললাম, শুধু বরণ করব না!

তুমি রাগ করছ?

কী মুশকিল, রাগ করব কেন? কী করতে হবে তাই জেনে নিচ্ছি। কিন্তু খোকার আসল মা কেন বউ বরণ করছে না তারও কোনও গল্প বানিয়ে কৈফিয়ত দিতে হবে? সে গল্পটা?

ও ফ্যাকাসে গলায় বলল, গল্প আবার কী? শরীর খারাপ-টারাপ কিছু একটা বলবে।

আমি আরও দুষ্টু হাসি হেসে বললাম, তা যেন বললাম, কিন্তু জরির আঁচলা দুলিয়ে বিয়েবাড়ি ঝলসে বেড়াব, অথচ শরীর খারাপ বলব, সেটা একটু বেমানান লাগবে না?

ওর চোখ দুটো হঠাৎ ছলছলিয়ে উঠল। কাতর গলায় বলল, তুমি তো সবই বোঝো, আমার মনটাও তো বুঝতে পারছ, তবে কেন–

আর নিষ্ঠুর হতে পারলাম না।

বিশেষ করে যখন ও শুভ কাজে বসতে যাচ্ছে। হেসে উঠে বললাম, তুমি-ই বা কিচ্ছু বোঝে না কেন? খোকার শুভাশুভ আমি দেখব না? তুমি বলেছ বলেই কি আমি বউ বরণ করতে বসতাম? তোমাদের দেশের জ্ঞাতি খুড়িমাকেই বলে রেখেছি।

বলে রেখেছ? সত্যি?

ও আমার এই বিবেচনার পরিচয়ে যেন বর্তে গেল। চলে গেল তাড়াতাড়ি ওদিকে ডাকাডাকিতে।

 আমি তাকিয়ে রইলাম সে দিকে।

ভাবতে লাগলাম, এই গোলমালের বাড়ি থেকে কোনও এক ফাঁকে পালিয়ে গেলে কেমন হয়?

এর মধ্যে পালালে সহসা কেউ ধরতে পারবে না।

ভাবতেই লাগলাম।

 যেমন সারাজীবন আত্মহত্যার কথা ভেবেছি।

সে সাহস হল না কোনও দিন।

সাহস দেখাতে যাই আজেবাজেতে।

 যেমন দেখাতে গেলাম বিয়ের নেমন্তন্নর ছুতোয় প্রফুল্ল মাস্টারের সঙ্গে দেখা করে।

না, পুরনো গুরু বলে ভক্তিতে উথলে নয়। ভেবেছিলাম দেখি তো মাস্টার, তোমার প্রেম কত খাঁটি, তোমার দৃষ্টি কেমন নির্ভুল!

প্রিয়মাধব বলল, কী মুশকিল, তুমি যাবে মাস্টারের বাড়ি? বেঁচে আছে কিনা তার ঠিক নেই।

বললাম, আমি বেঁচে রয়েছি, তিনিই বা না থাকবেন কেন? কতই আর বেশি বয়েস? তবে আরও একটা বাঁচা আছে, সেটাই দেখতে যাচ্ছি।

তবে চল!

 ও চলল ওর দীর্ঘ বলিষ্ঠ দেহ নিয়ে এক জোয়ান পুরুষের মতো টগবগিয়ে, আমি গেলাম ধীর শান্ত ভঙ্গিতে। আমাকে তো মনে রাখতে হবে আমি সুমিতা!

.

তুমি সুমিতা!

চমকে উঠেছিল প্রফুল্ল মাস্টার।

গায়ে চাদর জড়ানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি, এক প্রায় অথর্ব বুড়ো।

বলল, তুমি সুমিতা! তুমি সুমিতা!

প্রিয়মাধব মুচকি হেসে নিমন্ত্রণ পত্রটা নামিয়ে দিয়ে আমাদের আসার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করল।

কিন্তু প্রফুল্ল মাস্টার যেন দিশেহারার মতো তাকিয়ে রইল।

আমি সুমিতার ভঙ্গি নকল করতে চেষ্টা করলাম। নকল করতে চেষ্টা করলাম সুমিতার গলা। বিনয়ে মধুর নরম গলায় বললাম, আপনি নিশ্চয় আমাকে ভুলেই গেছেন?

মাস্টার এ কথায় যেন ব্যস্ত হয়ে উঠল। বলল, সে কী সে কী, ভুলে যাব কি! তুমি ছেলের বিয়েতে আমায় মনে করে নেমন্তন্ন করতে এসেছ, আর আমি ভুলে যাব?

প্রিয়মাধব হেসে উঠে লুকোনো বিদ্রুপের গলায় বলল, না মানে আর কি, আগে তো ভুলে গিয়ে থাকতে পারেন? এতদিন কি আর আপনি কবেকার কোন ছাত্রীকে মনে রেখেছেন?

মনে রাখিনি?

 সেই অথর্ব ভাবের মধ্যে সহসা উত্তেজনার বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল।

 মনে রাখিনি! বলেন কি! তবে মানে তুমি অনেক বদলে গেছ সুমিতা!

সুমিতা!

কতকাল ধরেই প্রিয়মাধবের মুখে এই সুমিতা ডাক শুনে আসছি, কানে তো সয়েই গেছে, তবু সেদিন মাস্টারের মুখে ওই ডাক শুনে যেন বুক কেঁপে উঠল।

মনে হল কে যেন কোথা থেকে এসে এই জালিয়াতি ধরে ফেলে ব্যঙ্গ হাসি হেসে উঠছে।

তবু সামলে নিতে হল।

বলতে হল, বাঃ বয়েস হচ্ছে বদলাব না? আপনিও তো কত বদলে গেছেন মাস্টারমশাই!

মাস্টার স্তিমিত হয়ে গেল।

বলল, তা বটে! সকলেই বদলে যায়। গলার স্বরটার সুষ্ঠু বদল হয়! তবু হঠাৎ যেন কেমন খাপ খাওয়াতে না পেরে বলে, আচ্ছা তোমার যে সেই যমজ বোন ছিল? মানে সেই নমিতা–

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, সে তো অনেকদিন হল মারা গেছে।

মারা গেছে।

 মাস্টার থতমত খেল।

মাস্টার অপ্রতিভ গলায় বলল, খবরটবর তো জানা নেই। কিছু মনে কোরো না।

না মনে করার কি? যাবেন তো?

যাব? আমি আর কী যাব? কাউকে চিনি না!

বাঃ আমায় তো চেনেন? অত স্নেহ করতেন আমায়!

দুঃসাহসের এই পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে তাকিয়ে রইলাম নির্নিমেষ! দেখলাম সেই খোঁচা খোঁচা দাড়িওলা বুড়োটে চিবুকটা কেমন নড়ে উঠল, চোখ দুটো কেমন কাঁচ কাঁচ হয়ে উঠল, তারপর স্নান গলায় উচ্চারিত হল, হ্যাঁ, তা তো ঠিক! কিন্তু মানে আমার শরীরের অবস্থাও তো দেখছ। না পারলে কিছু মনে কোরো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *