৩. দাহ অনুভব

নমিতা দাহ অনুভব করত।

 কিন্তু সে দাহ বেশিদিন রইল না।

নমিতার ভাগ্য নমিতাকে একটা কাঁটাবনে নিয়ে গিয়ে আছড়ে ফেলল।

হেমন্ত নামের ওই বিরক্তি উৎপাদনকারী সম্পূর্ণ অপছন্দের বরটাও ভাগ্যে বেশিদিন টিকল না তার, মারা গেল।

হঠাৎই মারা গেল।

 ডাক্তার বলল কলেরা। হেমন্তর মা বলল, হারামজাদী বউ বিষ খাইয়েছে।

ছবির মতো চেহারার তরুণী বউ। ঔদ্ধত্য আর বাঁচালতা ছাড়া আর কোনও দোষ যার খুঁজে পাওয়া যায় না, বিনা দ্বিধায় তার নামে এই বদনাম রটিয়ে দিল শাশুড়ি।

.

কিন্তু নমিতা কি মরমে মরে গিয়েছিল?

অনেকদিন পরে কলম হাতে নিয়ে সেই নমিতাকে দেখতে দেখতে ভাবছি, কই? এত বড় অপবাদেও তো মরমে মরে যায়নি সে! মনের ঘেন্নায় নিজেই বিষ খেয়ে শোধ নিতে পারেনি তো?

তাই তো উচিত ছিল।

সাধারণ বাঙালির ঘরের মেয়ে তো তাই করত।

আর কোনও মেয়ে এত বড় অপবাদের পরও মুখ দেখাত কি? বিশেষ করে স্বামী মদ্যপ ছিল না, অসচ্চরিত্র ছিল না, স্ত্রীর প্রতি অবহেলা বা অত্যাচারকারীও ছিল না, শুধু একটু বেশি সিরিয়স ছিল।

জীবনকে সে রঙিন চশমা দিয়ে দেখত না তার বড় ভায়রা-ভাইয়ের মতো।

নমিতার প্রতি আকর্ষণের অভাব ছিল না তার। এবং নমিতার চপলতাটুকু অন্তর্হিত হলে হয়তো গলেই থাকত। সেই স্বামীর এই আকস্মিক মৃত্যুই তো যথেষ্ট মর্মান্তিক ছিল, তার উপর এই বিষের অপবাদ!

নমিতার নিজেরই বিষ খাওয়া উচিত ছিল।

কিন্তু নমিতা বিষ খেল না।

 বরং অভিযোগকারিণীর গায়ে বিষের ঝাপটা মারল।

বলল, খাইয়েছি যদি তো জেনেশুনে বসে আছেন কেন? পুলিশ-কেস করুন?

শাশুড়ি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে অন্য ছেলে দুটোকে ডেকে বউয়ের এই ভয়ংকর বাণী গোচরে আনল। নমিতা তাদেরও ওই এককথা বলল, জেনেশুনে পুলিশ-কেস করছ না কেন বলো তো? জেলে দাও ফাঁসি দাও, একটা কিছু করো।

তোমার মতন মেয়েমানুষকে তাই করাই উচিত, বলেছিল মেজ দেওর। আর সদ্য বিধবা নমিতা হেসে উঠে বলেছিল, তবু সেই উচিত কাজটা করছ না। তার মানে, ভাবছ ভালই হয়েছে, ষাঁড়ের শত্রু বাঘে মেরেছে, কেমন? দুখানা বাড়ি তিনটে ভাগীদার অসুবিধে হচ্ছিল তো!

হ্যাঁ, ওই ভাবেই ওদের বিষের ঝাঁপট মেরেছে নমিতা, অপবাদের শোধ নিয়েছে।

হয়তো ওই ভাবেই চালিয়ে যেত সে।

তার রুচিবোধ, কাব্যবোধ, শিল্প-সুষমা সব কিছুর বোধ জলাঞ্জলি দিয়ে শাশুড়ি আর দেওরদের সঙ্গে বিষের লড়াইয়ে জেতবার জন্যে মরণ পণ করত। ভাগ্য নামক পৈশাচিক বিধাতার উপর নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নিতে নিজেকে কুৎসিত কদাকার করে তুলত। তবু তাও হয়তো ভাল হত। কিন্তু তার জীবনের শনি দিদি তা করতে দিল না। দিদি তার বরকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কেঁদে পড়ল। বলল, এখানে থাকলে তুই বাঁচবি না নমু, আমার কাছে চল তুই।

তোমার কাছে, কী বল?

নমিতা হেসে উঠেছিল, তোমার সুখের সংসারে কালসাপ হয়ে ঢুকতে যাব আমি? তুমি পাগল না আমি পাগল?

সুমিতা বলল, তুই তো চিরকেলে পাগল! তোর কথা শুনব না। এই জিজ্ঞেস কর তোর জামাইবাবুকে, ও কী বলে শোন।

নমিতার তখনও অশৌচ চলছিল।

তখনও নমিতা বৈধব্যের বেশ গায়ে চড়ায়নি, শুধু চুলগুলো রুক্ষু হয়ে চেহারাতেও একটু রুক্ষতা এনেছিল।

তবু সুন্দরী দেখাচ্ছিল বইকী!

 ঘরের মধ্যেকার বড় আরশিদার আলমারির পাল্লায় নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছিল নমিতা। নমিতা তাই মুচকি হাসি হেসেছিল, জামাইবাবু কি আমার গুরুদেব যে, যা বলবেন শুনতে হবে?

তা গুরুদেব না হোক, গুরুজন তো বটে। চিরদিন ভালবাসিস, ভক্তি করিস।

নমিতা হেসে উঠেছিল। সদ্য বিধবার মুখে সেই বাঁচালের হাসি মানায় কিনা খেয়াল করেনি।

নমিতা বলেছিল, ভালবাসার সঙ্গে ভক্তিটা জুড়ে বুঝি একটু মোলায়েম করছিস দিদি?

দিদি তবুও থতমত খায়নি।

 আশ্চর্য মনোবল দিদির!

 দিদি বলেছিল, তা ভালবাসা থাকলেই ভক্তি আসতে বাধ্য। ভক্তিশ্রদ্ধাহীন ভালবাসা আবার ভালবাসা নাকি?তারপর বলেছিল, তর্ক রাখ নমু, আমি বুঝতে পারছি এখানে থাকলে তুই বাঁচবি না।

তা বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মেয়ের মধ্যে একটা মেয়ে না-হয় নাই বাঁচল।

দিদি কেঁদে ফেলল।

চাঁদের শুক্ল অংশের মতো যমজ দুই বোনর পবিত্র অংশটুকুর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল। বললে, তুই ছাড়া আমার আর কে আছে নমু?

যেন ওই নমু ওর থেকে বছর পাঁচ-দশের ছোট বোন।

.

ওই নমিতাটাকে আমি বলতে ইচ্ছে হয় না, তাই নমিতা বলে চলেছি।

যদিও জানি না কেন লিখছি এসব। হয়তো ভয়ংকর যে যন্ত্রণাটা কোনওদিন ফেটে পড়তে পায়নি, সে-ই আমাকে এই প্ররোচনা দিয়েছে।

জানি না কার জন্যে লিখছি আমি এসব।

 প্রিয়মাধবের জন্যে?

 তার ছেলের জন্যে?

না কি যে হারিয়ে গিয়েও না হেরে জিতে গেল, তার জন্যে?

হয়তো কারও জন্যেই লিখছি না।

শুধু প্রিয়মাধব যখন জিজ্ঞেস করে, রোজ কী লেখো? তখন বলি, আমি মরে গেলে দেখতে পাবে।

কিন্তু লিখছি তো এখন।

তখন তো লিখিনি।

যখন নমিতা নামের একটা ভয়ংকরী মেয়ে ছিলাম আমি।

 কিন্তু তখনই কি লিখতাম না?

প্রেমের কবিতায় খাতা ভরাতাম না?

অজস্র সেই প্রেমের কবিতায় ভরা খাতাখানা একদিন আমার উকিল বরের হাতে পড়েনি?

উলটেপালটে দেখে বলেছিল সে, তোমার সংগ্রহশালাটি প্রশংসার যোগ্য নয়, যত রাজ্যের ওঁচা, অসভ্য কবিতাগুলো বেছে বেছে খাতায় তুলেছ?.

তাই ভেবেছিল ওপরের কবিতা নকল করে খাতায় তুলেছি।

তার বেশি দৌড় ছিল না ওর কল্পনার।

ওর মার যেমন একখানা খাতায় রাজ্যের স্তব-স্তোত্র বন্দনা-মহিমা ইত্যাদি ভোলা আছে, আমার খাতাটাকেও ও তাই ভেবেছিল।

আমি যখন সগর্বে বলেছিলাম, তোলা মানে? এ তো আমার নিজের লেখা–, একটু অনুকম্পা মিশ্রিত অবিশ্বাসের হাসি হেসেছিল উকিল।

তারপর বলেছিল, তা তোমার এরকম টেস্ট হওয়াই স্বাভাবিক। দেখেছি তো তোমার বাবার বইয়ের কালেকশান! একখানা ভাল বই নেই। ওই সব পড়েই তো মানুষ!

কিন্তু স্বর্গের দেবী সুমিতা দেবীও ওই বাড়িতেই মানুষ! তীব্র হাসি হেসে বলেছিলাম আমি।

হেমন্ত উকিল বলেছিল, ব্যতিক্রম! পৃথিবীতে ব্যতিক্রম থাকেই।

কবিতা লিখেছি আমি ছেলেবেলায় দু-চারটে, বেশির ভাগ দিদির বিয়ের পর।

আগেরগুলো লিখেই তৎক্ষণাৎ দিদিকে দেখাতাম। পরে কদাচিৎ!

 মনে হত অরসিকেযু রসস্য নিবেদন-এ কাজ কী?

 তবে জামাইবাবুর আসবার কথা থাকলে ইচ্ছে করে টেবিলে কি খাটে ফেলে রেখেছি।

জামাইবাবুর চোখে পড়ে গেলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়ত, আর দিদিকে ডাকত, দেখো গো দেখো, তোমার বোনের কাব্য। হৃদয় একেবারে রসভারে টলটল করছে।

দিদি বলত, তুই নিজে লিখেছিস? সত্যি? আশ্চর্য!

আশ্চর্যই হয়েছে দিদি, সন্দেহ করেনি কখনও।

অথচ দিদি

কী বলেছিল তখন দিদি

হ্যাঁ, তখন দিদি বলেছিল, তুই ছাড়া আমার আর কে আছে নমু?

বললাম, দিদি, এদের কাছ থেকে চলে যাওয়া মানে তো লড়াইয়ে হেরে পালিয়ে যাওয়া।

দিদি বলল, তা হোক! ঝগড়ায় হারা ভাল। মনে নেই ছেলেবেলায় পিসি বলত, কিছুতে হেরো না, ঝগড়ায় হেরো।

পিসি!

দিদির এই পিসি সেন্টিমেন্টে বরাবর হেসে উঠতাম আমি, কিন্তু সম্প্রতি পিসি মারা গেছে, তাই হাসলাম না।

বললাম, কিন্তু তোর বাড়িতে নিয়ে যাবার পিছনে যুক্তি কী? আমি ছাড়া তোর কেউ নেই বলে? লোকে শুনলে হাসবে।

লোকের হাসিতে কী আসছে যাচ্ছে?

দিদি বলেছিল, দুঃখের সময় সুখবর বলতে পারিনি। তোর জামাইবাবুর অন্য একটা কাজ হয়েছে। চা বাগানের ম্যানেজারি।

চা বাগানের ম্যানেজারি!

কাজটাকে খুব একটা ভাল এবং খবরটাকে বেশ একটা সুখবর বলে ভাবিনি আমি। কিন্তু দিদির ওই আহ্লাদে জ্বলজ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হয়েছিল সে কথা বলতে।

দিদি তারপর অনেক কথা বলেছিল। বলেছিল

কখনও তো কোথাও যাইনি আমরা, বিদেশ কেমন তা চক্ষে দেখিনি। আমি তবু জন্মের মধ্যে কর্ম একবার দিল্লি আগ্রা বৃন্দাবন, তুই তাও না।

এই সব কূটকচালে আত্মীয়-স্বজনদের আওতা থেকে সরে গিয়ে ভালই থাকব আমরা। একেবারে প্রকৃতির কোলে শান্ত পরিবেশে থাকব, কেউ আমাদের জীবনের জানলায় উঁকি দিতে আসবে না।

এমনি সব অনেক কথা অগোছালো করে বলেছিল দিদি।

আর তার মধ্যেই দিদির ভালবাসার মনের ইচ্ছে বারবার উঁকি দিয়েছিল।

দিদি নিজে না বুঝলেও, আমি বুঝেছিলাম দিদির সেই বড় স্নেহের বড় ভালবাসার ছোট্ট বোনটা যে এই বয়েসে সর্বত্যাগিনী হয়ে বসে থাকবে, এ দিদির সহ্য হচ্ছিল না, তাই দিদির ইচ্ছে উঁকি দিচ্ছিল সমাজ-সংসারের চোখের আড়ালে নিয়ে গিয়ে তাকে নিয়মবন্ধন থেকে মুক্ত করে দেবে।

ওর সেই ভালবাসার মনের ইচ্ছেটি কথার ফুল হয়ে ফুটে উঠছিল, এখানে থাকলে তোর ওই শাশুড়িবুড়ি নির্ঘাত তোকে নিয়ে যা তা করবে। কিন্তু তুই তো বলতে গেলে কুমারীই আছিস। বরের সঙ্গে কদিনই বা ঘর করেছিস, আর কতই বা মিশেছিস? তুই খাবি পরবি সবই করবি।

.

খাওয়া-পরা, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মাধ্যমে দিদি আমার বৈধব্যযন্ত্রণার লাঘব চেয়েছিল। হয়তো ভেবেছিল তবু সেটাই লাভ।

আর সেই লাভটুকু পেতে আসামের জঙ্গলও আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল দিদির।

কিন্তু দিদির সেই ছেলেমানুষীকে প্রশ্রয় দিইনি আমি। আমি অশৌচান্তেই সাদা থান সার করেছিলাম, হাত শুধু করেছিলাম, কোমর ছড়ানো চুলগুলোর অর্ধেক নির্মূল করে ফেলেছিলাম।

দিদি সেই মূর্তি দেখে বসে পড়েছিল। বলেছিল, হেমন্তকে তো তুই এত ভালবাসতিস না নমু যে, তার জন্যে সর্বত্যাগিনী হবি?

দিদির দুঃখ দেখে মন কেমন করেনি তা নয়, কিন্তু দিদির ভালবাসার পুতুল হয়ে থাকতে মন ক্রমশ বিদ্রোহী হয়ে উঠছিল আমার।

ওর ওই স্নেহের ভার ক্রমশই ভার হয়ে উঠছিল আমার কাছে।

দিদি আমায় ভালবাসবে, মমতা করবে, করুণা করবে, আহাকরবে, আর আমি দিদিকে ঈর্ষা করব, এ অসহ্য!

দিদি যদি আমায় এত ভালবাসতে না আসত, এত আহা না করত, বাঁচতাম আমি।

.

ভেবেছিলাম ওদের সঙ্গে কিছুতেই যাব না। চলে যাক দিদি অনেক দূরে।

তার সুখ, সমৃদ্ধ, ভালবাসার বর, আর বরের ভালবাসা নিয়ে। আমি এখানে লড়াই করে বেঁচে থাকব। কিন্তু আশ্চর্য! তবু গেলাম আমি দিদির সঙ্গে। আমার অহংকারকে পরাস্ত করে লোভ জয়ী হল। থান কাপড় আর শুধু হাত আমাকে রক্ষা করতে পারল না।

যেখান থেকে আগ্রহের অনুরোধ এল, স্থির থাকা শক্ত হল আমার। রক্তের মধ্যে এল চাঞ্চল্যের জোয়ার।

তখন কি জানতাম ছাই, ওই আগ্রহের অনুরোধ এসেছিল দিদির নির্দেশে? দিদির কৌশল ওটা?

জানতাম না।

ভেবেছিলাম এ ওরই গোপন আগ্রহ। আমার সাজবদলে দিদি বসে পড়েছিল। আর জামাইবাবু আড়ালে শুকনো মুখে বলেছিল, একটু ঠাট্টা-আহ্লাদ করে বাঁচতাম শালি, সে পথও ঘোচালে! দেখে ভয় ভয় করছে।

বললাম, সবই তো এহ বাহ্য।

তবু মনে হচ্ছে তুমি যেন দূর আকাশের তারা হয়ে গেলে?

ভালই তো, ঊর্ধ্বমুখে চেয়ে থাকবেন, আর অর্ঘ্য দেবেন।

জামাইবাবু বলেছিল, দূর এ যেন অসহ্য।

তারপর ও আমায় ঠকাল।

 ওর ভালবাসার বউয়ের নির্দেশে আমায় ভালবাসা জানাতে এল।

অনেকদিন পরে জেনেছি আমি, দিদির অনুরোধেই আমায় অনুরোধ করেছিল ও। দিদি বলেছিল, জানো তো ও তোমায় কত ভালবাসে, তোমার কথা এড়াতে পারবে না।

সেই কথার জাল ফেলতে এল ও।

বলল, নমু, চল-না আমাদের সঙ্গে।

নমু ডাক ও কবে ডেকেছে?

চমকে গেলাম।

বললাম, কেন? খাল কেটে কুমির নিয়ে যাবার ইচ্ছে কেন?

 ও বলল, তা কেন? খাল কেটে গঙ্গা নিয়ে যেতে চাইছি।

 হেসে ফেলে বললাম, ওটা তো সাজানো কথা। ডাইনে বাঁয়ে চিনির নৈবিদ্যি, সেটাই বলুন। সেটা বলতে পারলে তো বেঁচে যেতাম! প্রিয়মাধব তার নামের অর্থ বহন করে চোখে চোখে তাকাল। বললে, কদিনই বা বলতে পেলাম? সুখের দিনগুলো বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল।

ওই দৃষ্টিতে সম্মোহিত হয়েছিলাম আমি।

 তাই ওদের সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে গেলাম। পরে ভেবেছি, ওই দৃষ্টি কি অভিনয়? না কি সত্যি?

সত্যি যদি তো স্ত্রীর অনুরোধে অনুরোধ করতে এসেছিল কেন ও? অভিনয় তবে কার সঙ্গে করেছিল? আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না ওর কোনটা সত্যি, কোনটা অভিনয়। না কি নিজেই জানে না ও? হয়তো তাই! ওর অগাধ প্রাণপ্রাচুর্য ওকে হয়তো সীমারেখার মধ্যে স্থির থাকতে দিত না।

আমি রাজি হয়েছি দেখে দিদি যেন কৃতার্থ হল।

দিদি এসে আমার শাশুড়ির কাছে আবেদন করল।

শাশুড়ি বলল, নিয়ে যাবে তো যাও মা, বাঁচি আমি। ওই আগুনের খাপরাকে বুকে নিয়ে সারাজীবন বইতে হবে আমায়, ভেবে ভয়ে মরে যাচ্ছি।

আমি বললাম, আপনার কি ধারণা চিরদিনের জন্যে বোনের বাড়ি থাকতে যাচ্ছি আমি?…যখন ইচ্ছে হবে চলে আসব।

শাশুড়ি নিশ্বাস ফেলল। বোধহয় নিজের ভবিষ্যৎ ভেবে।

কিন্তু জামাইবাবু সে পথ ঘোচাল আমার। আমার দেওরদের সঙ্গে ভাগ-ভিন্ন করে, অধিকারচ্যুত করল আমায়। বলেছিলাম, দিদির সঙ্গে যে আমার চিরকাল বনবে তার গ্যারান্টি কে দিচ্ছে? যদি তেজ করে চলে আসি?

দিদি হেসে বলেছিল, তা বেশ তো, চলে আসিস। সিকদার বাগানের বাড়ির চাবি খুলে নিয়ে দিব্যি থাকবি। বাবার বাড়িটা তো বেচে খাইনি আমরা?

পিসি মরার পর পিসে অতএব তার ত্যাগ করে-আসা ভাইদের বাড়ি চলে গিয়েছিল, বাড়িটার নীচের তলায় ভাড়াটে বসিয়ে। দোতলাটা চাবি দেওয়া ছিল।

.

দেওররা বলল, হাড়ে বাতাস লাগল আমাদের।

 শাশুড়ি বলল, বাঁচলাম।

 এই পাথেয় নিয়ে ভগ্নিপতির আশ্রয়ে বসবাস করতে চললাম আমি।

 এই জীবন আমার। অথচ দিদির সঙ্গে ওই এক ঘণ্টার তফাত ছাড়া আর কোনও বিষয়ে তফাত ছিল না আমার।

 দিদির জন্মলগ্নটা কি এমনই এক শুভগ্রহের গতিপথের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছিল যে, দিদির জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই পিছলে পড়ে গিয়েছিল সে গ্রহ?

পর মুহূর্ত থেকে শুরু হয়েছিল কোনও এক কুটিল গ্রহের শাসনকাল?

.

গাড়িতে এমন আদর করে ওরা দুজনে নিয়ে গেল আমায়, যেন আমি এক মস্ত কুটুম যাচ্ছি, কি একটা রুণ শিশু যাচ্ছি। সেই অবস্থা সহ্য করতে হয়েছিল আমাকে।

ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল। আর আমার মুখে সেই ইচ্ছের ছাপ পড়ছিল খুব সম্ভব। অতএব ওরা আরও যত্ন করতে এগিয়ে আসছিল। ভাবছিল আহা বেচারা।

আমার তাপিত প্রাণে প্রলেপ লাগাতে ওরা প্রাণ ঢালছিল।

কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, আমি যে দুঃখী, আমি যে ভাগ্যবঞ্চিত, এ যেন ওরা ভুলতে দিতে রাজি নয়। ওরা ওদের মিলিত হাত বাড়িয়ে আমার সেবা করে করে অহরহ জাগরূক রাখবে সেটা।

হয়তো ওদের দোষ নয়, দোষী আমার বৈধব্যের বেশ।

আমার কাটা চুল, আমার খালি হাত, আমার থান কাপড়, ওদের ও কথা ভুলতে দিচ্ছিল না। ওরা বুঝতে পারছিল না, এই সাজ আমার ওদের প্রতি বিদ্রোহ। ভাবছিল বৈরাগ্য।

.

আমার বিদ্রোহ ছিল, ঔদ্ধত্য ছিল, ঈর্ষা ছিল, অহংকার ছিল, ছিল না শুধু লোভ জয় করবার শক্তি।

আমি নিজেকে ধিক্কার দিয়েছি, তবু অনিমেষ নয়নে সেই প্রিয় মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। যে মুখের অধিকারীর নাম সত্যিই প্রিয়।

প্রিয়মাধব।

অবশ্য এক-আধ সময় মমতার কাছেও হার মানিনি তা নয়।

দিদি যখন আমায় মমতা করতে হৃদয় বাড়াত, সে হৃদয়কে দুহাত দিয়ে ঠেলে ফেলে দেবার দুর্দমনীয় ইচ্ছে দমন করেছি তো শুধু মমতারই বশে।

.

চা বাগানের বহুবিঘ্নিত রাস্তার বহুবিধ দোলা এবং হৃদয় দ্বন্দ্বের দোলা, এই দুই দোলায় দুলতে দুলতে প্রিয়মাধব মুখার্জির কর্মস্থলে পৌঁছনো গেল।

সারি দিয়ে লোক এসেছিল সাহেব আর মেমসাহেবকে স্বাগত জানাতে। কলকাতার টি বোর্ডের একজন মাঝারি অফিসার কোন পাতাচাপা কপালের জোরে একেবারে একখানা বাগানের ম্যানেজার হয়ে আসে, তাই ছিল তখন বোধ করি এদের জল্পনার বিষয়।

তবে তটস্থ হবার ব্যাপারে এতটুকু ত্রুটি দেখাল না। আমাকেও ত্রুটি করল না। অবশ্য আমার মনে হল আমাকে নিশ্চয় মেমসাহেবের আয়া ভাবছে ওরা।

ম্যানেজারের বাংলোর দিকে চললাম আমরা, আস্তে গাড়ি চালিয়ে। এই পথ দিয়ে যেতে সমস্ত উপত্যকাভূমি দেখা যাচ্ছে, নীচে গভীর খাদ অবধি চা বাগান। চা বাগান! চির পরিচিত শব্দ। অথচ চির অপরিচিত দৃশ্য। দিগন্ত বিস্তৃত সেই সিঁড়িকাটা বাগানের হরিৎ আর গাঢ় সবুজের শ্যামল শোভা যেন চিত্তের সমস্ত গ্লানি মুছে দিতে চেয়ে মেহদৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।

চা বাগানের এই সুবজ শোভা নাকি হতভাগ্য মানুষদের রক্তের লালের পরিবর্ত।

 কিন্তু সে কথা এখন বোঝা যাচ্ছে না। ওর থেকে চোখ তুললেই তো থাকের পর থাক পড়ে রয়েছে হিমালয়ের ছোট ছোট গিরিচূড়া, তারও উপরে একেবারে আকাশের কোণে তুষারমৌলী গিরিরাজ চিরসুন্দর, চিরপবিত্র।

হঠাৎ দেখলে সেই পবিত্রতা আর শুভ্রতাটুকুই মনে ছাপ দেয়।

 মনে হল দিদি ঠিকই বলেছে।

প্রকৃতির কোলই বটে।

সেই প্রকৃতির কোলে

বেশ রাজকীয় সম্মানেই ম্যানেজার সাহেবের বাংলোয় প্রবেশ করলাম আমরা। সাহেব মেমসাহেব, আর তাঁদের স্নেহপাত্রী দুঃখিনী আশ্রিতা। না, সেই পরিবেশে তখন ও ছাড়া নিজেকে আর কিছুই ভাবতে পারিনি আমি।

কিন্তু বাংলোর মধ্যে এসে জিনিসপত্র ছড়িয়ে দিদি যখন এলিয়ে পড়ল, এবং কোম্পানি নিয়োজিত অসমিয়া দুটো চাকরানীর বহুবিধ কথার কোনও উত্তরই দিয়ে উঠতে পারল না, তখন আমাকেই হাল ধরতে হল।

আর তখন ধীরে ধীরে দিদিই যেন আমার আশ্রয়ে এসে পড়া বেচারিতে পরিণত হয়ে উঠল।

.

কাজের মধ্যে সহজ হয়ে গেলাম আমি।

 ডাক-হাঁক শুরু করলাম। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সামান্য কাজে হইচই, সামান্য কথায় তোলপাড় হাসি, এটা যেন আপনি এসে গেল। গোছগাছ নিয়ে দিদির শিথিলতা, জামাইবাবুর হইচই এবং আমার ম্যানেজমেন্ট, বাংলোকে বেশ সরগরম করে তুলল।

জামাইবাবু বলল, শালিকে আবার যেন শালি শালি মনে হচ্ছে।

হঠাৎ যেন আমিও আমার সাজটা ভুলে গেলাম। ভুলে গেলাম অবস্থা। মনে হল দিদির বিয়ের ঠিক পরের সেই নমিতা আমি। যে নমিতা ছিল অকারণেই চঞ্চল। যে কথায় কথায় হাসত, কথায় কথায় গান গেয়ে উঠত, কবিতা পড়ত আর কবিতা লিখত।

মনে হল, আবার হয়তো কবিতা লিখতে পারব আমি।

দিদি আমার এই কিশোরী মূর্তি দেখে কি অবাক হল? না শুধুই খুশি হল?

জানি না কী হল আর না হল, তবে দিদির একটি কীর্তি দেখে আমি অবাক হলাম শুধু। দিদি যে ভিতরে ভিতরে এই মতলব করছে, তা কে জানত।

.

আমি যখন রান্নায় ব্যস্ত, দিদি তখন কোম্পানির ওই চাকরানী দুটোকে দিয়ে বেডিং খুলিয়ে বিছানা পাতিয়েছে। একটা ঘরে জোড়াচৌকিতে দিদির আর আমার, পাশের ঘরে একা জামাইবাবুর।

শুতে এসে আমি তো থ!

 হইচই করে উঠতেই হল।

বললাম, ম্যানেজার সাহেব, এটা কী?

জামাইবাবু এই নতুন সম্বোধনে হেসে উঠে বলল, এটা মোেটই আমার ম্যানেজমেন্টের অবদান নয়। এ সম্পূর্ণ মেমসাহেবের ব্যাপার।

তা আপনি তো ছিলেন এখানে?

ছিলাম। দর্শক হিসেবে।

অথবা বলির ছাগ হিসেবে হেসে উঠলাম আমি। দিদিকে ডাক দিলাম। ধীরে সুস্থিরে দিদি আস্তে আসছিল খাবার ঘর থেকে, বারান্দা পার হয়ে।

তীব্র তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করলাম, দিদি, এটা কী?

 দিদি মিষ্টি হেসে বলল, সুমিতা দেবী এবং নমিতা দেবীর সুখশয্যা।

 ওঃ! তাই বুঝি? তা শ্রীমতী সুমিতা দেবী, চা-বাগানের ম্যানেজার সাহেব রাতারাতি আমাকে ধরে তুলে খাদে ফেলে দিয়ে আসুন, এই তা হলে চান আপনি?

দিদি অপ্রতিভ হাসি হেসে বলল, বাঃ, তুই তা হলে এই নতুন দেশে একলা শুবি না কি?

আমি গম্ভীরভাবে বললাম, অবিশ্বাস হয়, দোরে চাবি লাগিয়ে চাবিটা নিয়ে শুয়ো। সকালে খুলে দিলেই হবে। রাতে আমার ঘুম ভাঙে না।

দিদি অবাক হয়ে বলল, অবিশ্বাস মানে? শুনছ গো, নমির কথা?

 জামাইবাবু বলল, শুনছি বইকী! যত শুছি, তত মোহিত হচ্ছি।

দিদি বলল, অবিশ্বাসের জন্যে একা শুতে দেব না, এমন অনাসৃষ্টি কথা তোর মাথাতেই আসা সম্ভব। তুই এই অজানা অচেনা জায়গায় একা একটা ঘরে থাকবি, এতে আমার স্বস্তি আসবে?

বললাম, দিদি, স্বস্তি জিনিসটা একা তোরই প্রাপ্য সর্বদা এটা ভাবিস না! তা ছাড়া বিধাতার উপর হাত চালাবি তুই? সে যাকে একা থাকার বিধান দিয়েছে, তুই যাবি তার শয়নসঙ্গী হতে? পাগলামি করিস না, যা। যা-না, তোর বালিশ-বিছানা উঠিয়ে দিচ্ছি চল।

প্রিয়মাধব এতক্ষণ সকৌতুকে এ দৃশ্য উপভোগ করছিলেন। হেসে বললেন, থাক থাক, শালি, আজ যখন সুখশয্যা রচনা করা হয়েছে, ওটাই চলুক।

না, চলবে না। আমি দৃঢ় হলাম, যা অচল, তা একদিনই বা চলবে কেন? দিদি আরও অপ্রতিভ গলায় বলল, রাত্তিরে তোর ভয় করবে দেখিস।

দেখব! ভয়টাও তো একটা দ্রষ্টব্য। হেসে বললাম আমি, ভয়ানক একটা কিছু দান করে বসতে নেই রে দিদি, শেষে হাত কামড়াতে ইচ্ছে করবে।

দিদি তবু অনুরোধ করে। তবু ছেলেমানুষের মতো করতে থাকে।

আমি যেন নতুন কনেকে বরের ঘরে শুতে যেতে সাধছি। দিদি বলে, আহা, ভারী একেবারে ভয়ানক! পাঁচ বছর বিয়ে হয়ে গেছে।

আমি বলি, তোর কথাটা কেমন হল জানিস? আহা, বড্ড একেবারে তেষ্টা। জন্মাবধি জল খাচ্ছি।

 দিদি হেসে ফেলে বলে, আমার অত নেই, যাঃ।

তা না হয় নেই, তুই না হয় মহামানবী। কিন্তু যে বেচারি বলির ছাগের ভূমিকা নিয়ে বসে আছে?

দিদি আবার হেসে ফেলে।

বাবাঃ, এতও জানিস তুই। দিদি তবু পাতা বিছানাটাতেই বসে গড়ানে ভঙ্গিতে বলে, বেশ ঠিকঠাক আছে, শুয়ে পড়-না বাবা!

আমাকে অতএব রাগ দেখাতে হয়। বলতেই হয়, ম্যানেজার সাহেব, আমাকে এই দণ্ডে স্টেশনে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিন। নচেৎ গিয়ে খাদে পড়তে হবে।

বাবাঃ। বাবাঃ। দিদি উঠে পড়ে বোকা বোকা অপ্রতিভ হাসি হেসে বলে, একদিন এদিক-ওদিকে কী হয় শুনি?

কী হয়?আমি প্রিয়মাধবের দিকে চোরা কটাক্ষ হেনে বলি, হয়–অভিসম্পাত। কী দরকার বাবা সে অভিশাপ কুড়িয়ে? একে তো পূর্বজন্মে না জানি কোন ক্রৌঞ্চহত্যার পাপে এ জন্মে এই দুর্গতি! আবার এই পাপে

দিদি বালিশটা হাতে ধরে উঠে পড়ে।

শুধু বালিশ নিচ্ছিস? চৌকি বিছানা?

দিদির মুখে নবোঢ়ার রক্তিম ছাপ পড়ে। লজ্জা লজ্জা হেসে বলে, একদিন যা হোক করে হয়ে যাবে, কে আবার এখন অত টানাটানি করে?

দিদির সেই যা হোক করে কাটানোর উপকরণের দিকে তাকালুম। ফুট তিনেকের বেশি চওড়া নয় প্রিয়মাধবের চৌকিটা।

আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে প্রিয়মাধব বললেন, তার মানে আমাকে চৌকি থেকে ফেলে দেবেন আর কি!

ওদের এই লীলা রঙ্গে ভারী রাগ হল। বললাম, দিদি, দয়া করে শুয়ে পড়বি? ঘুমে মরে যাচ্ছি যে আমি!

দিদি এবার তাড়াতাড়ি উঠল। তবু

ভাব দেখাচ্ছে কতই যেন কষ্ট হচ্ছে আমার জন্যে। অন্য ঘরে বিছানা করে ফেলে মুখ তো শুকিয়ে গিয়েছিল। বুঝি না আমি? সব ছল। সব সাজানো। এক্ষুনি গিয়ে ও ওই প্রিয়মাধবের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে

বলবে, বাঁচলাম।

তুই আগে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ কর। তবে যাব আমি, বলল দিদি।

আমি বললাম, আমার দেরি আছে।

 ওমা এখন আবার কী করবি তুই?

বাড়ির বিধবা গিন্নির ধরনে বললাম, আমি সকালের জলখাবারের ব্যবস্থা করে রাখব।

অ্যাঁ! বলিস কী? ও কাল সকালেই হবে। এই যে বললি ঘুমে মরে যাচ্ছিস?

যাচ্ছিলাম, এখন আর যাচ্ছি না। তা তুই বুঝি আমার দরজায় তালা লাগাবার জন্যে শুতে পারছিস না?

ধ্যেৎ, বলে দিদি যেন অগত্যাই ঘরে ঢুকে পড়ল।

বরের ঘরে।

আস্তে দরজাটা ভেজিয়ে দিল।

 সন্তর্পণে খিলটা লাগাল। তবু খুট করে একটু শব্দ হল। শব্দটা বিষের মতো লাগল।

আমি অনেকক্ষণ ওই বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলাম ঈর্ষাতুর দৃষ্টিতে।

 তারপর শব্দ করে খিল লাগালাম আমার ঘরে।

.

পরদিন ইচ্ছে করেই একেবারে অন্ধকার ভোরে উঠে পড়ে কাজে লেগে গেলাম। নতুন পত্তন সংসারে কাজের অভাব ছিল না, তা ছাড়া কাজ তো আর টাকা নয় যে, অভাব থাকলে অভাবই।

কাজের অভাব থাকলে কাজ সৃষ্টি করে নিতে কতক্ষণ? আমি যদি সকালের চায়ের উপকরণ হিসেবে কোনও একটা শৌখিন খাবার করতে বসি, বেশ কেটে যাবে সময়।

কাটল সময়।

 আকাশের আবছা অন্ধকারও কাটল।

 আলোয় ঝকমক করে উঠল বাড়িটা।

তখনও ওদের ঘরের দরজা বন্ধ। একটা দাসী এসে ঝটপাট শুরু করল, এবং আশ্বাস দিল আর একজন এক্ষুনি এসে পড়বে।

কী যে কাজ করবে দু দুটো দস্যি মেয়ে, কে জানে! কথাটা কাউকে বলতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কে শুনছে? বাড়ির যাঁরা মালিক, কর্তগিন্নি তো এখনও সুখনিদ্রায় অভিভূত।

বেহায়া!

 নির্লজ্জ।

ঢং করে আবার অন্যঘরে বিছানা পাতা হয়েছিল।

ইচ্ছে হচ্ছিল ওই বন্ধ দরজার উপর গুম গুম করে কিল মেরে চেঁচিয়ে বলি, কী গো লজ্জাবতী লতা! বর ছেড়ে অন্যত্র শুচ্ছিলে না তুমি? লজ্জার বালাই তো খেয়ে বসে আছ! লজ্জা করছে না এই অজানা অচেনা জায়গায় হঠাৎ এসে পড়ে সব ভার একটা মানুষের উপর ছেড়ে দিয়ে বাসরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে দুপুরের রোদ দেখতে!

ইচ্ছে হচ্ছিল।

অথচ তা করিনি আমি। যা করেছিলাম তা যে-কেউ শুনলে গালে হাত দিত। আমিও জানি না ওই দুরন্ত রাগের সময় কী করে আমি সকালের রোদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গুগুন্ করে গান গাইছিলাম। অথচ গাইছিলাম।

একটু পরে দিদি উঠে এল।

সত্যিই নতুন কনের মতো লজ্জা লজ্জা মুখে এসে দাঁড়িয়ে কুণ্ঠিত হাসি হেসে কৈফিয়তের সুরে বলল,ইস কী বেলাই হয়ে গেল! তুই তো কখন উঠেছিস, আমায় একটু ডেকে দিসনি কেন?

আমি ভুরু তুলে বললাম, আমি যে কোন উঠেছি, সেটা কী করে জানলে?

দিদি বলল, ওমা শোনো কথা! কাজই পরিচয়। অনেক আগে না উঠলে কখনও কচুরি ভাজা যায়?

খুব কড়া একটা কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল, তবু সামলে নিয়ে বললাম, আমি মন্ত্রবলে এক নিমেষে সব করে ফেলতে পারি।

ইস তাই বইকী! বলে ছেলেমানুষের মতো হাসল দিদি।

দাঁড়িয়ে থাকল একটু বোকার মতো, তারপর স্নানের ঘরের দিকে চলে গেল।

পাহাড়ি দেশের বাড়ি, দেয়াল জোড়া, শার্সির জানলা, বারান্দার এক দিকটা তো পুরো কাঁচের। বারান্দার রেলিংগুলো হালকা কাঠের, মেঝেগুলো মসৃণ সবুজ। কিন্তু মেঝের রং কতটুকুই বা দেখা যাচ্ছে, প্রায় সর্বত্রই তো কার্পেট বিছানো।

রান্নাঘর ভাঁড়ারঘর?

সেও কাঠ পাতা।

 দিদি চলে গেল বোকার মতো, ছেলেমানুষের মতো। তবু ওই কাঁচের মধ্যে থেকে এসে পড়া আলোয় ওকে যেন সম্রাজ্ঞীর মতো মনে হল। আমার নিজের হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গিটা কেমন আমি জানি না। তবু কোনওদিনই আমি দিদির মতো কুণ্ঠিত অপ্রতিভ কি ন নম্র ভঙ্গিতে হাঁটি না। শ্বশুরবাড়িতে থাকতে পর্যন্ত হাঁটাচলায় ইচ্ছে করে আনতাম দৃপ্তভঙ্গি।

তবু দিদির ওই হেঁটে যাওয়াটা দেখে মনে হল, আমার ঠিক এরকমটা যেন না হয়।…

এই ভঙ্গি কি ভিতরের পূর্ণতার রূপ?

 ওর সবটা ভরাট, ও আত্মস্থ, তাই ওর চলনে বলনে নম্রতার মধ্যেও অহংকারের ছায়া?

না কি সবটাই আমার মনের ভ্রম?

.

দিদি স্নানের ঘরে থাকতে থাকতেই জামাইবাবু বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

এসেই যে আমার সন্ধান করবে তা জানতাম। করলও তাই। রান্নাঘরের দরজায় উঁকি মেরে বলে উঠল, আরে ব্যস, উষাকালেই অন্নপূর্ণা মূর্তি! কচুরি, হালুয়া, আলুর দম, বাঃ বাঃ বেড়ে।…রাত্তিরে ঘুমিয়েছ, না কি বিনিদ্র রজনী কেটেছে কচুরির ডাল বেটে?

রাগ দেখিয়ে বললাম, কেন, আমি কি এমনি কুঁড়ে যে ওই সামান্য কাজটুকুর জন্যে রজনী বিনিদ্র করতে হবে?

প্রিয়মাধব হেসে বললেন, তা নও বটে। তবে তোমার দিদির নিশ্চিত এই এতগুলি ব্যাপার ঘটিয়ে তুলতে দুরাত জাগতে হত।

আমি আবার রাগ দেখালাম, ভাল হবে না জামাইবাবু, দিদিকে বলে দেব।

ওদিক থেকে দিদির গলা শোনা গেল। বলে দিতে হবে না, সব শুনতে পাচ্ছি।

প্রিয়মাধব হা হা করে হেসে উঠে বললেন, তার মানে পাহারা দিচ্ছ?

দিদি তেমনি গলায় বলে উঠল, তা দেওয়াই তো উচিত, তোমাকে বিশ্বাস কী? যে লোভী তুমি! হয়তো মুখ না ধুয়েই বলে বসবে, দেখি দুখানা গরম গরম!

ঈশ্বর জানেন, কেন হঠাৎ চড়াৎ করে ভয়ানক একটা অপমানের অনুভূতিতে আমার পা থেকে মাথা অবধি জ্বলে উঠল। মনে হল দিদির এই সরল সাজাটা সম্পূর্ণ ছল। ও আমাদের দুজনকেই ব্যঙ্গ করল।

ওই অপমানের অনুভূতি কি শুধু একদিন? একবার?

 প্রতিদিন, যে কোনও মূহুর্তে নয়?

 দিদি যে আমাদের উপর পাহারা দিত না, আমাদের সন্দেহ করত না, এইটাই আমায় খেপিয়ে তুলত। আমি জোর করে করে বলেছি, দেখ দিদি, অত বিশ্বাস ভাল নয়।

দিদি ঠাট্টা ভেবে হেসেছে।

প্রিয়মাধবও বলত ঠাট্টা। তবে বেশিরভাগ আড়ালেই বলত, তোমার ঠাট্টাগুলো বড় কড়া শালি, আমি কড়া চোখে তাকিয়ে বলতাম, কে বললে ঠাট্টা?

সত্যি হলে তো আরও বিপজ্জনক কড়া, বলে পালাত। সত্যি শোনবার সাহস ছিল না।

.

তবু আমি ওই চা বাগানের কোয়ার্টার্সে প্রথম প্রথম ভালই ছিলাম। আমি যেন সহসাই আমার অতীত কৈশোরকে ফিরে পেয়েছিলাম।

আমি কবিতা লিখেছি তখন, গান গেয়েছি, আবৃত্তি করেছি। আমি তখন অকারণে চঞ্চল হয়েছি।

 দিদি আমার এই স্ফুর্তির মূর্তি দেখে আনন্দে বিগলিত হয়েছে। বলেছে–মনে হচ্ছে কি জানিসনমু, আমরা যেন সেই আমাদের ছেলেবেলায় ফিরে গেছি। কী ভালই যে লাগছে!

আমি ভাবতাম, তোর ওই প্রিয়মাধবটি না থাকলে কেমন ভাল লাগত দেখতাম! তোর ভরাট মনের উপর আমি হচ্ছি ফাউ। চাঁদের উপর চুড়ো, নৈবিদ্যির উপর মণ্ডা। ছেলেবেলা। ছেলেবেলায় ও ছিল তোর প্রাণ জুড়িয়ে?

কিন্তু আমার সব কথাই তো মনের মধ্যে। তাই দিদি অবোধ থাকে। দিদি আমাকে আমার কৈশোর কালের স্বাদ দিতে চায়। তাই

.

দিদি আমার হাতে ধরে মিনতি করেছে ওদের সঙ্গে মাছ-মাংস খেতে, ওর শাড়ি থেকে রঙিন শাড়ি পরতে। বলেছে, মনে কর না ভাই, তুই কুমারীই আছিস। তোর সেই অতীতটা কিছু নয়। শুধু একটা বিরাট স্বপ্ন মায়া।

বলত, তার কারণ দিদি খেয়ে-পরে সুখ পেত না।

কিন্তু আমি খেয়ে-পরে দিদিকে খাওয়া-পরার সুখ দিতে যাব কেন?

সেই সুখ দেওয়া মানেই তো দিদির হাতের মুঠোয় চলে যাওয়া। দিদির প্রজা হয়ে যাওয়া। সেই সস্তা হতে আমি রাজি হইনি। আমি আমার আলাদা খাওয়া-পরার বর্মের মধ্যে একটা আলাদা সত্তা হয়ে বিরাজিত থাকব দিদির প্রিয়মাধবের সামনে।

.

প্রিয়মাধবকে আমি বুঝতে পারতাম না। মস্ত বড় একটি অভিনেতা ও, তাতে আর সন্দেহ কি? কিন্তু সেই অভিনয়টা কার সঙ্গে করত ও? বারে বারে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি আমি, বারে বারে বিভ্রান্ত হয়েছি।

কখনও ওর চোখে গভীর আবেগের গোপন ছায়া, কখনও সহজ কৌতুকের সহজ আলো, কখনও মনে হত ও ওই স্তিমিত-চিত্ত সুমিতা দেবীতে ক্লান্ত। কখনও মনে হত, ওখানেই ও নিমগ্ন।

অবিরত এই আলোছায়ার মধ্যে থেকেছি আমি।

কিন্তু আমি নিজে কী চাইতাম?

সে কথা আমি জানি না। আমার চাওয়া চিরদিনই আমার সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যঙ্গের খেলা খেলেছে।

আমি যখন সেই গভীর ছায়ার আভাস দেখতাম, কৌতুকের ছুরি বিধিয়ে দীর্ণ করতাম তাকে। যখন সেখানে স্বচ্ছ দীপ্তির আলো দেখতাম, আমি বাঁচাল হতাম, বেহায়া হতাম, এগিয়ে যাবার ভান করতাম।

.

আবার দিদির মনস্তত্ত্বও মাঝে মাঝে অবোধ হত। দিদি যেন ইচ্ছে করে এগিয়ে দিত আমায়, বলত, ওই রে সাহেব চেঁচামেচি লাগাচ্ছে, দেখ না ভাই কী বলছে! আমি আর পারি না উঠতে।

বলত, তুই বাবা বলে কয়ে বেশি খাওয়াতে পারিস, তুই-ই খাওয়া।

এটা কেন?

এটার মানে কী?

 দিদি কি আমার উপবাসী চিত্তকে এক মুঠি খুদের খোরাক দিতে চায়?

না, ওর বরের মনোরঞ্জন করতে চায়?

সুমিতা দেবীর ওই স্তিমিত আর সীমিত সত্তা দিয়ে প্রচুর প্রাণ প্রিয়মাধবের দেহ মন দুইয়ের চাহিদা মিটছে না সন্দেহে এই প্রয়াস ওর?

.

এক এক সময় সন্দেহ হত, এই উদ্দেশ্যেই হয়তো দিদি আমাকে আমার কেন্দ্রচ্যুত করে নিয়ে এসেছে। এই বন্ধু-সমাজহীন অরণ্যে, প্রিয়মাধবের মতো প্রবল-প্রাণের মানুষকে ও নিজে একা ভরে রাখতে পারবে না, বেঁধে রাখতে পারবে না, তাই বলতে পেরেছিল, তোমাকে নমি ভালবাসে, তুমি বললেই যাবে।

যার অনেক ঐশ্বর্য তার আবার খানিকটা দিতে কী? ফেলে ছড়িয়েও তো ষোলো আনা থাকে তার।

এ সন্দেহ প্রবল হলেই আমি সোজা বলে দিতাম, আমার বয়ে গেছে। তোর বরের যত্ন তুই করগে যা।

দিদি হেসে হেসে বলত, সাহেব, শুনছ তোমার শালি কী বলছে?

সাহেব বলত, ঠিক শালিজনোচিত কথাই বলছে।

এখানে আসার পর থেকে ঠাট্টা করে আমি যেমন ম্যানেজার সাহেব বলতাম, দিদিও তেমনি ওগো হ্যাঁগো ছেড়ে সাহেবটাই রপ্ত করে ফেলেছিল। এও একটা লীলা।

আমি, দিদি আর প্রিয়মাধব।

এই তিনটি মুখ সংসারে।

তা ছাড়া চাকরানি, গোয়ালিনি, জমাদারনি, ধোপানি। এখানে মেয়েরাই বেশি কাজ করে। এদের মুখ ছাড়া ভদ্রলোকের মুখ দুর্লভ।

তবু অন্য বাগানের থেকে কোনও কোনও বাঙালি পরিবার কদাচ বেড়াতে আসতেন। এবং যথারীতি দিদির গৃহে আমার এই উপস্থিতিকে দিদির পরম ভাগ্য বলে ঘোষণা করে, আমাকে আহা করে যেতেন।

সে রকম দিনে ওরা চলে গেলে দিদি বড় বেশি মনমরা হয়ে থাকত। বলত, এখন মনে হচ্ছে হয়তো আমার ভালবাসাটা ছল, হয়তো নিজের স্বার্থের জন্যেই তোকে এখানে টেনে এনেছি আমি। নিজের মন তো বোঝা যায় না। আমি অপারগ তুই পারগ, তাই হয়তো তোর উপর আমার লোভ হয়েছিল। তাই ই তো করছি আমি। সব ভার তোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজে আরাম খাচ্ছি।

দিদির সেই ক্ষুব্ধ ক্ষুণ্ণ মুখ দেখে মায়া হত বইকী! তখন হয়তো আমিই ওর মন ভাল করতে বেশি হইচই করতাম, ম্যানেজার সাহেব ম্যানেজার সাহেব করে হাঁক পেড়ে দিদির এই বৃথা দুঃখের বার্তা জানিয়ে হাসতাম। এবং যারা এসে দিদির মন খারাপ করে দিয়ে যাচ্ছে তাদের মুণ্ডপাত করতাম।

এই ভাবেই ঘুরে এল বছরখানেক। আসাম উপত্যকার প্রকৃতিতে ষড়ঋতুর খেলা দেখা হয়ে গেল।

আর এর মধ্যেই বিধাতার সেই চিরন্তন খেলার সূচনা দেখা দিল।

এটা যত অপ্রত্যাশিত, তত আনন্দের।

 ম্যানেজার সাহেব আহ্লাদে দিশেহারা হলেন, দিদি বিগলিত হল।

এতদিন বিয়ে হয়েছে দিদির, ছেলেমেয়ে সম্পর্কে ওরা তো প্রায় আশা ছেড়েই দিয়েছিল।

সেই আশার আলোক দেখা দিয়েছে।

দিদির এই নতুন সৌভাগ্য ম্যানেজার সাহেবের বাংলোয় উচ্ছ্বাসের জোয়ার বহালো। সত্যি বলতে, আমি যেন দিদির এই নতুন ঘটনায় নির্মল হয়ে গেলাম, পবিত্র হয়ে গেলাম। দিদির এই মাতৃত্বের সূচনা ওকে এমন অসহায় অসহায় আর ছেলেমানুষ ছেলেমানুষ মতো করে তুলল যে, ওর উপর থেকে চিরকালের সেই ঈর্ষাটা সরে গেল আমার, মমতায় মন ভরে উঠল। প্রিয়মাধব আর আমি দুজনে আমরা যেন একটা নাবালিকার অভিভাবক। ওই বালিকা নাবালিকাটি হঠাৎ একটা মস্ত সম্পত্তির অধিকারিণী হয়ে বসেছে, অথচ বেচারা কিছুই জানে না, কিছুই সামলাতে পারে না, এমনি একটা ভাব আমাদের। অতএব–উঠতে বসতে দিদিকে সাবধান করি আমরা, যখন তখন ডাক্তার আনা হয়। এ অবস্থায় কী করা উচিত আর না উচিত, তার একটা বিরাট তালিকা প্রস্তুত হয়।

সৌভাগ্যবতীর সৌভাগ্য নতুন করে ঝলসে ওঠে।

বিয়ের ছ বছর পরে

আসামের চা-বাগানে দিদির প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়।

.

আমি আর প্রিয়মাধব দিদির দুই অভিভাবক অনভিজ্ঞ দিদিকে দিদির ওই সদ্যোজাত শিশুটির মতোই উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে দেখতে থাকি, উদ্বিগ্নমনে তদ্বির করি ওর।

আর সেই সূত্রে যেন প্রিয়মাধব আর আমি অন্য এক ঘনিষ্ঠতার সূত্রে আবদ্ধ হয়ে যাই। আগে দিদি বড় ছিল, আমাকে নিতান্তই বালিকা হিসেবে দেখত দিদি। এখন পট পরিবর্তন হল, দিদি ছেলেমানুষ হয়ে গেল। এই পরিবর্তনটা তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করতাম আমি।

ছেলেকে দিদির কাছে দিতেই চাইতাম না আমরা।

দিদি যে কিছুই পারে না এটা যেন পাথরের গায়ে খোদাই করে লেখা হয়ে থাকা দরকার।

 দিদি শুধু সেবার পাত্রী, আমি বাদবাকি সব। আমার ইচ্ছেয় সব।

দিদি নরম গদির বিছানায় বসে অপ্রতিভ অপ্রতিভ কুণ্ঠিত মুখে আবেদন করত, খোকাকে আমার কাছে দে না একটু?

আমি শাসনের সুরে বলতাম, উঁহু! এখন টাইম নয়। তোমার কাছে দিলেই তুমি এক্ষুনি বক্ষদুগ্ধ পান করাতে বসাবে, সেটা ক্ষতিকর।

দিদি বলত, দেব না সত্যি বলছি, দেখিস।

 কাতরতায় গলতাম না আমি।

কারণ দেব না বলেও দিয়েছে লুকিয়ে লুকিয়ে, এ দৃষ্টান্ত আছে।

প্রিয়মাধবেরও প্রিয়ার স্বাস্থ্য এবং প্রিয়পুত্রের সর্ববিধ কল্যাণের চিন্তায় মনের চেহারা বদলে গিয়েছিল নমিতার। সুমিতার সব কিছুই ছেলেমানুষি বলে উড়িয়ে দেবার পরম সুখটার আস্বাদ তাকে নিষ্ঠুর করে তুলেছিল। সূচনা কালের সেই মমতাটা ক্রমশ ঝরে যাচ্ছিল, দিদির ওই আকুলতা আর আবেদনের যন্ত্রণা দেখে নিষ্ঠুর একটা আমোদ পেতাম আমি। অতএব ছেলেকে ঘড়ি ধরে আদর করতে পাওয়া ছাড়া আর পাবার হুকুম ছিল না সুমিতার!

সুমিতা যদি একদিন শখ করে ছেলেকে নাওয়াতে আসত, নমিতা বলত, ম্যানেজার সাহেব, ক্যামেরা আনুন! আর অনেক হাসির পর ছেলে এবং সরঞ্জাম কেড়ে নিয়ে বলত, রক্ষে কর দিদি, ঠিক তুই ওকে হাত ফসকে ফেলে দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিবি।

দিদি ছেড়ে দিত।

 দিদি অপ্রতিভ হাসি হেসে বলত, বাঃ আমি যেন ওর মা নই?

মা তাতে কী? মহারানিরাও তো মা হয়, তারা কি ছেলে নাওয়াতে বসে?

আহারে, আমি যেন মহারানি?

 ওরে বাবা, তা আবার বলতে? মহারানির ছেলেরা ধাইমার কাছেই মানুষ হয়।

দিদি এক একসময় কুণ্ঠিত গলায় বলত, তা একেবারেই শিখব না? ধর একদিন তোর শরীর খারাপই হল

নার্স আনবেন ম্যানেজার সাহেব।

তা বলে আমি শিখব না?

শিখিস। আরও দু-চারটে হোক, তখন শিখিস। এটার উপর দিয়ে আর হাত পাকাতে চাসনি।

বলে সেই চাঁদের টুকরো আর পাথরের কুচির মতো ছেলেটাকে নাচিয়ে নাচিয়ে স্নান করাতাম আমি।

দিদি ঘরে চলে যেত।

গল্পের বই নিয়ে শুয়ে পড়ত।

এতকাল গল্পের বইয়ে ঝোঁক দেখিনি দিদির। ইদানীং সে ঝোঁক দেখছি।

.

এটা কি আমার বড় বেশি নিষ্ঠুরতা হত?

সুযোগ পেয়ে আমি আমার আজন্মের জ্বালার শোধ নিতাম কি এই অভিনব উপায়ে?

হয়তো তা নয়।

এই দুরকালের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে সেই থানপরা নমিতাকে দেখতে পাচ্ছি আমি, শুধু নিষ্ঠুরতার উল্লাসেই নয়, অনেকটা লোভের বশেও এই নিষ্ঠুরতা করেছে সে। তার বুভুক্ষু চিত্ত একটা শিশুর অধিকার পেয়ে তার তিলার্ধ ছাড়তে রাজি হত না। সবটা দখল করে থাকতে চাইত। কেবলমাত্র মাতৃদুগ্ধের জোগানে হেরে যেতে হচ্ছে দেখে, ছেলেটাকে অবিরত বাইরের খাদ্যে ভরিয়ে রাখত। সুমিতা যখন তার মাপা এক-আধবারের ভূমিকা নিয়ে বুকের দুধ খাওয়াতে যেত, শিশু স্বভাবতই মুখ ফেরাত, আর নমিতা যেন বিজয়িনীর উল্লাস অনুভব করত।

অথচ সভ্য মার্জিতবুদ্ধি সুমিতা আপন সন্তানকে নিয়ে কাড়াকাড়ির কথা ভাবতে পারত না।

নমিতার কি সুমিতার ওই বঞ্চিত মুখের দিকে তাকিয়ে একবারও মমতা আসত না?

মনে কি হত না, আহা নিক ও ওর ছেলেকে!

হত

কিন্তু এও যে জানত সে, মা যতই অপটু হোক, ছেলে তার হাতে পড়লে ঠিকই চালিয়ে নেবে, আর ঠিকই মায়ে-ছেলেয় আপস হয়ে যাবে।

অতএব আবার নমিতার ভাগ্যে সেই মুষ্টি ভিক্ষা!

.

তা ছাড়া প্রিয়মাধব।

প্রিয়মাধব তো ধারণা করে নিয়েছে, সুমিতা অচল! সুমিতার হাতে পড়লে খোকা বেশিদিন নয়। নমিতা না থাকলে খোকাকে বাঁচানো যেত না। প্রিয়মাধবের ওই ধারণাটা তো আলগা হয়ে যাবে। প্রিয়মাধব ত বুঝে ফেলবে সুমিতার ছেলেকে সুমিতা ঠিকই সামলাতে পারে।

এই জেনে ফেলতে দেওয়া যে নমিতার পরম লোকসান। নমিতা শুধু আদরের পুতুল হয়ে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিল, শুধু করুণার পাত্রী হয়ে থাকতে অস্থির হয়ে যাচ্ছিল। সংসার পরিচালনার ভূমিকাটা ধর্তব্য করছিল না নমিতা, সেটা তো মাইনে করা লোকও পারে। খোকার সূত্রে নমিতা দরকারি হয়ে উঠেছে। অবশ্য-প্রয়োজনীয়ের পরম ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছে। অতএব মার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাক খোকা, যাতে মার থেকে মাসিকেই বেশি ভজে সে।

আর সেই ভজনার সূত্রে তার বাবাও সেই মাসিকে ভজতে থাকুক মন-প্রাণ দিয়ে।

তা সেটা হত বইকী!

প্রায়ই তার প্রমাণ পাওয়া যেত।

যেমন খোকা রয়েছে মাসির কোলে, প্রিয়মাধব দুহাত বাড়িয়ে ডাকত, আয়, আমার কাছে আয়। দুষ্টু মাসিটার কাছে থাকবি না। সঙ্গদোষে উচ্ছন্ন যাবি। বাবার বোলচালে মুগ্ধ খোকা দু হাত বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে এসে পড়ত বাবার বুকে।

নমিতা বলত, নেমকহারাম ভূত! দেখব কে তোকে আর কোলে নেয়।

ততক্ষণে কিন্তু খোকা আবার মাসির দিকে দু বাহু প্রসারিত করে বাবার কোল থেকে ঝুলে পড়েছে।

পঞ্চাশবার এই একই খেলার পুনরাবৃত্তি হয়েছে, আর প্রতিবারই একটি সপ্রেম কটাক্ষ, একটু মিঠে কড়া রসিকতা, একটু বা চকিত স্পর্শ লাভ হয়েছে নমিতার ভাগ্যে।

সময়ের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে নমিতা এবং খেলাটাকে যথেষ্ট পরিমাণে সরব সহাস্য করে তুলে নার্ভগুলোকে ঠিক রাখবার চেষ্টা করেছে। খোকা, খোকার বাবা, খোকার মাসি, তিনজনের মিলিত কলহাস্যে বাসাটা মুখর হয়ে উঠেছে।

খোকার মা কি এ সভায় থাকত না?

থাকত! কখনও থাকত কখনও থাকত না। তবে তার ভূমিকা তো সর্বদাই দর্শকের।

মুখটা হাসি হাসি করে হাতে একটা উলের গোলা আর দুটো বোনার কাঠি নিয়ে বসে থাকত হয়তো।

প্রিয়মাধব তাকে উদ্দেশ করে বলত, দেখো তোমার ছেলে কী সাংঘাতিক বেইমান। বাবাকে গ্রাহ্য মাত্র করছে না।

সুমিতা হেসে বলত, সে তো হবেই। ছেলেটা যে আবার তোমারও।

 প্রিয়মাধব রাগের ভান দেখিয়ে বলে উঠত, তার মানে? এটা যেন আমার প্রতি কটাক্ষপাত মনে হচ্ছে।

কটাক্ষপাত নয়, আলোকপাত।বলে মৃদু হেসে মুখ নামিয়ে হাতের কাজে মন দিত দিদি।

মাঝে মাঝে নমিতা আবার ছেলেটাকে এগিয়ে নিয়ে দিদির কাছে দাঁড়িয়ে বলত, যা বুদ্ধ যা, মার কাছে যা। মার থেকে মাসির দরদ হাসির কথা, বুঝলি হাবা? যা!

বলা বাহুল্য ছেলেটা স্বভাবতই বসে থাকা মায়ের থেকে দাঁড়িয়ে থাকা মাসিকেই বেশি পছন্দ করত। অতএব মাসির গলাটা প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে মুখ ফিরিয়ে নিত।

নমিতা হেসে হেসে বলত, বটে বটে! বাবা তো তবে ঠিকই নামকরণ করেছে। বেইমান!

বোকা সুমিতা এসব রঙ্গরসে যোগ দেওয়ার থেকে অনেক বেশি দরকারি মনে করত পশমের প্যাটার্নটা নির্ভুল হচ্ছে কিনা লক্ষ রাখতে।

কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ এক সময় নমিতার মনে হত, দিদি প্যাটার্নফ্যাটার্ন কিছুতে খেয়াল রাখছে না, শুধু ঘর বুনে যাচ্ছে। আর দিদির মুখটা সেই অর্থহীন ঘরগুলোর দিকে আরও ঝুঁকে পড়ছে।

ওই মুখটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ একসময় হয়তো নমিতার এই কলরব কলহাস্য নেহাত খেলোমি মনে হত। আর রাগ এসে যেত নিজের উপর।

বলত, হয়েছে, খুব নাচানো হয়েছে। কাজ নেই যেন আর! নে দিদি তোর ছেলে ধর! অনেক কাজ পড়ে আছে আমার

ছেলেটাকে ফেলে দিতে আসত সুমিতার কোলে। কিন্তু সুমিতার হাতে যে দুদুটো উঁচলো কাঁটা। সুমিতা তাই, আরে আরে কাঁটা কাঁটাবলে শিউরে দাঁড়িয়ে পড়ত। তারপর কাঁটা-পশম গুছিয়ে নিতে নিতে বলত, ছেলেধরা তো সামনেই রয়েছে। ওকে দে না।

ছেলেকে কোলে করবার জন্যে এত আকুলতা দেখাত মাঝে মাঝে, কিন্তু ওই হুড়োহুড়ি খেলার মধ্যে কিছুতেই ভূমিকা নিতে চাইত না সুমিতা।

সুমিতা কেবল নিভৃতে একান্ত করে পেতে চায় তার ছেলেকে।

সুমিতা লোকলোচনের অন্তরালে তার মাতৃস্নেহ উজাড় করে দিতে চায় মাতৃসুধাঁধারার মাধ্যমে। যেটা নাকি প্রিয়মাধব আর নমিতা দুজনের কাছেই বিশ্রি রকমের গাঁইয়া ঠেকে।

সেই ঠেকাটাকে অবশ্য ওরা চাপতেও চেষ্টা করে না।

যদি হঠাৎ আবিষ্কৃত হয়ে পড়ে সুমিতা আয়ার কাছ থেকে লুকিয়ে ছেলেকে হাত করে ঘরে পুরেছে, প্রিয়মাধব হাঁ হাঁ করে ওঠে, আরে বেশ তো বাগানে বেড়াচ্ছিল, হঠাৎ আবার বন্ধ ঘরের মধ্যে পুরলে কেন? এদিকে তো এত বিদ্যে বুদ্ধি, এটার ব্যাপারে এমন বুদ্ধিভ্রংশ কেন?

সুমিতা ক্ষুব্ধকণ্ঠে জবাব দেয়, বুদ্ধিভ্রংশ ছাড়া বুঝি কেউ ছেলেকে কোলে নেয় না?

প্রিয়মাধব বলে, ওই অসময়ে কোলে নেওয়া, দুধ খাওয়ানো সবই গ্রাম্যতাদুষ্ট।

 সুমিতা বলে, বেশ তো, মনে করো গ্রাম্যই। খোকার ঝি বলেই চালিও।

নমিতা অন্য সুর ধরত।

নমিতা ব্যঙ্গ হাসি হেসে বলত, এই যে গণেশ-জননী! আহা এই দেবীরূপ চোখে দেখলেও পুণ্যি!

সুমিতা বলত, এক্ষুনি নামিয়ে দেব।

আহা নামিয়ে দিবি কেন, থাক না, থাক। শুধু হাতজোড় করছি দয়া করে এখন আর খাওয়াতে বসিস না।

সুমিত্রা অপ্রতিভ গলায় বলত, না না, খাওয়াব কেন?

কেন তা তুইই জানিস! নমিতা মুখ টিপে হেসে বলত, বোধহয় বক্ষভার লাঘব করতে! আমি কী করে বুঝব বল ওই পরমতম রহস্য?

সুমিতা উঠে গিয়ে ছেলেকে আয়ার কাছে দিয়ে আসত। হ্যাঁ, উঠে গিয়েই দিয়ে আসত, চেঁচিয়ে ডাকত না কখনও কোনও ঝি-চাকরকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *