৪. পড়ন্ত বিকেল

আবার কতদিন এমন হয়েছে বাগানে গেছে সবাই ছুটির সকালে কি পড়ন্ত বিকেলে। খোকার সঙ্গে সঙ্গে আয়া আছে এবং বাগানে খুশির ঝড় বইছে। হঠাৎ একসময় দেখা গেল সুমিতা নেই। সুমিতা কখন যেন উঠে গেছে, ভিতরে চলে গেছে।

নমিতা অনেকক্ষণ লক্ষ না করার ভান করত, গাছপালাকে ঘিরে ছুটোছুটি করত, এবং নেহাত একসময় না বললে নয় বলেই বলে উঠত, ওমা দিদিটা কখন পালাল! বাবাঃ একটু যদি বসতে পারে। নির্ঘাত ওর উলের গোলা ওকে টানছিল।

প্রিয়মাধব বলত, আচ্ছা এই উলবোনাটা তো ছিল না তোমার দিদির!

নমিতা বলত, না মোটেই না। খাসিয়া মেয়েগুলোর দেখে দেখে শখ লেগেছে। এখানে দুধওয়ালি সবজিওয়ালিগুলো পর্যন্ত কী ফার্স্টক্লাস বোনে দেখেছেন তো?

প্রিয়মাধব বলত, তা কই, বুনছেন কী? সেটা তো দেখি না।নমিতা হেসে ফেলত।

সত্যি সেটা দেখা যেত না বটে। খোকার একটা পুলওভার ধরেছে এইটুকু দেখা যায়, ছাড়তে দেখা যায় না।

অথচ–বোধ করি টেক্কা দেবার মনোবাসনা নিয়েই নমিতা কেবলমাত্র রাত্রে ঘুমের সময় বুনে বুনে খোকার এবং খোকার বাবার দু দুটো সোয়েটার বানিয়ে ফেলে চকিত করে দিয়েছিল দুজনকে। তবে বলল না রাত্রে বুনেছি। ওরা অবাক হল। সুমিত্রা, আর তার বর। অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, বুনলে কখন?

নমিতা অবহেলায় বলল, এই কাজের ফাঁকে ফাঁকে এক আধ সময়।

উল কিনে দিল কে?

ওমা সেটা আবার একটা চিন্তার কথা নাকি। কিনিয়েছি দাইকে দিয়ে।

খোকার গায়ে সেই সোয়েটারই শোভা পেতে লাগল, তার মায়ের হাতের পুলওভারটা অসমাপ্তই পড়ে রইল ড্রয়ারের এক কোণে।

প্রিয়মাধবও সহর্ষে শালির অবদান অঙ্গে জড়িয়ে বেড়াতে লাগল।

 তারপর থেকেই সুমিতা যেন আবার গল্পের বইয়ে বেশি মজল।

প্রিয়মাধব বলত, এটা আবার তোমার কী হল? এত বই বই বাতিক তো ছিল না কখনও? এখানে এই পাণ্ডববর্জিত দেশে এত বাংলা বই কোথায় পাই?

দিদি আর কিছু বলত না, চিঠি লিখে টাকা পাঠিয়ে কতকগুলো পত্র পত্রিকার গ্রাহিকা হয়ে পড়ল।

 প্রিয়মাধব বলত, একেই বলে রক্তধারা। মনে হচ্ছে তোমাদের বাবার বাতিক আস্তে আস্তে এসে ধরবে তোমাদের।

.

আড়ালে দিদি আর প্রিয়মাধব কোন কথা বলত তা আমি জানি না, কিন্তু দিদির হাসিটা তো ঠিকই বজায় ছিল। যেটা আমাকে অবাক করত। দিদি যদি সর্বদা বিষণ্ণ থাকত, একটা যেন মানে পেতাম। তা থাকত না সে।

হয়তো কোনওদিন আমাদের কলহাস্যের মাঝখান থেকে উঠে গেছে দিদি, প্রিয়মাধব একটু পরে কাছে গিয়ে বলত, কী হল? তুমি কি কুপিতা হয়ে চলে এলে?

দিদি অবাক হয়ে যেত যেন।

 বলত, কেন? একথা বলছ কেন হঠাৎ?

যে রকম নিঃশব্দে উঠে এলে সভা থেকে!

 দিদি হেসে ফেলত।

সাজানো দাঁতের পাটি ঝকঝকিয়ে উঠত। যেটা হয়তো আমারও হয়, তবে নিজে দেখতে পাই না এই যা।

দিদি হেসে ফেলে বলত, তা উঠে আসাটা সশব্দ করতে হবে নাকি? সেটা কেমন, জানা তো নেই।

ওই হাসিটাই ওর ছদ্মবেশ ছিল।

পরে বুঝতে পেরেছি, ওকে যখন আমরা বোকা, বেচারি, অবোধ ভেবে করুণা করেছি, ও তখন ওর এই ছদ্মবেশটি এঁটে আমাদের বোকা বুঝিয়েছে, আমাদের ঠকিয়েছে।

হ্যাঁ, ঠকিয়েছে।

প্রিয়মাধব আর নমিতা ধরতে পারত না।

খোকার অসুখ করলে সুমিতাকে ঘুমোতে পাঠিয়ে রাত জেগে খাড়া বসে থাকত নমিতা আর প্রিয়মাধব। খোকাকে দেখতে এসে ডাক্তার যদি সুমিতাকে কোনও প্রশ্ন করত, প্রিয়মাধব বলত, তুমি কি ঠিক বলতে পারবে? নমিতা এসে বুঝিয়ে বলুক।

এতে সুমিতা আহত হতে পারে, অপমানিত হতে পারে, এ কথা মাথায় আসত না প্রিয়মাধবের। সুমিতা সম্পর্কে চিরনিশ্চিন্ত ছিল সে।

তারপর সেই একচক্ষু হরিণের গল্পের হরিণের মতো অবস্থা ঘটল প্রিয়মাধবের।

এল সেই ভয়ংকর দিন।

.

খোকার অন্নপ্রাশনের কথা উঠল।

আট মাস বয়েস হয়ে গেল খোকার, আর দেরি করা চলে না।

 প্রিয়মাধব বলল, এই ছুতোয় কটা দিন ছুটি নিয়ে কলকাতায় যাওয়া যাক।

আর এই প্রস্তাবে হঠাৎ যেন সুমিতার হৃদয়-নদীতে বান ডাকল।

সুমিতা সেই অনেকদিন আগের মতো উল্লাসে আর উদ্ভাবনীশক্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

ও জামাপত্র গোছাতে গোছাতে বলে, হ্যাঁ গো, খোকনের খাটটা নিয়ে যাওয়া হবে? দোলা খাটটা?

প্রিয়মাধব অবাক হয়ে বলল, খাটটা? খাটটা নিয়ে যাওয়া হবে?

বাঃ খোকা দোল খাবে না? অপ্রতিভ হাসি হাসে সুমিতা।

খোকা মা-মাসির কোলে দোল খাবে বলেই হাঁক পেড়েছে প্রিয়মাধব, এই নমিতা শুনছ, তোমার দিদি খোকার দোল খাবার জন্যে দোলনা খাটটা নিয়ে যেতে চাইছে।

নমিতা বলে উঠেছে, বেশ করেছে চেয়েছে। কেন চাইবে না? কোম্পানি তো মালের দাম দেবে।

কোম্পানি দেবে?

হা হা করে হেসে উঠেছে প্রিয়মাধব।

 কেন, কোম্পানি দেবে কেন? এ কি আমি ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছি? বেড়াতে যাব ছেলের মুখে ভাত দিতে, কোম্পানি নেবে তার ভার? ছুটি দিচ্ছে এই ঢের!

তা বটে। সেই ঢের।

চা-বাগানের কাজে ছুটিটা বড় দুর্লভ।

সেই দুর্লভ বস্তু সংগ্রহ করে ফেলেছিল প্রিয়মাধব কলকাতায় গিয়ে ছেলের অন্নপ্রাশন দেবে বলে। কিন্তু সেই দুর্লভ বস্তু কি ভোগ হয়েছিল প্রিয়মাধবের? হয়নি।

ছেলের গয়না ও চেলির ফর্দ লেখা প্রস্তুত, ছেলের ভাতের যজ্ঞির ফর্দ প্রস্তুত, কাকে কাকে নেমন্তন্ন করা হবে তার ফর্দ প্রস্তুত, শুধু রাত পোহালেই রওনা।

হঠাৎ রাত্রে ছেলের গায়ে হাত দিয়ে শিউরে উঠল সুমিত্রা!

জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।

.

আচ্ছা, সুমিতার কাছেই কি শুত খোকন?

না, শুত না।

তিনমাস বয়েস থেকেই নমিতা ওকে নিজের কাছে নিয়ে শুতে আরম্ভ করেছিল। শুধু তখন কয়েকটা দিন শুচ্ছিল খোকা সুমিতার কাছে–সেই যে নমিতার কদিন আগে সর্দিজ্বর হয়েছিল, সেদিন থেকে নমিতা নিজেই এ ব্যবস্থা করেছিল। বলেছিল, সর্দি জিনিসটা বড় ছোঁয়াচে, বিশেষ করে বাচ্চাদের খুব তাড়াতাড়ি আক্রমণ করে।সুমিতা নিশ্চয়ই নমিতার ওই সামান্য অসুস্থতাটাকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে মনে করেছিল। খোকাকে কাছে নিয়ে শুতে পাওয়া সুমিতার কাছে তো কম পাওয়া নয়।

প্রথম সকালে নমিতা বলেছিল, কী রে, রাতে ঘুমিয়েছিলি তো? না কি সারারাত অপলক নেত্রে বৎসমুখপানে তাকিয়ে বসে রাত কাবার করেছিলি?

সুমিতা বলেছিল, কেন? আমি কি পাগল?

 নমিতা হেসে দিদিকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, তা পাগল ছাড়া আবার কী? জানিসই তো আপনার ধন পরকে দিয়ে, পাগলা বেড়ায় মাথায় হাত দিয়ে! তুই তো প্রায় তাই!

সুমিতা বলেছিল, পর আবার কে আছে বাপু আমার? এক আছে বর, আর আছিস তুই, নিজেরই অর্ধাংশ। ওই অর্ধাংশ শব্দটার উপর কি একটু বেশি জোর দিয়েছিল সুমিতা? তাই নমিতা চমকে উঠেছিল। ভেবেছিল নমিতাকে তাদের দুজনের মধ্যেকার সম্পর্কের নিবিড়তা বুঝিয়ে দেবার জন্যেই, সুমিতার এই জোর নাকি?

চমকে ওঠা নমিতা নিজেকে সামলে নিয়ে হঠাৎ খুব হেসে উঠেছিল। দিদিকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, উঃ, তুই যে আজকাল বেজায় কথা শিখেছিস দেখছি। বরের সঙ্গগুণে, কেমন?

সুমিতা হেসে বলেছিল, কেন, বরের সঙ্গগুণে কেন? তোর সঙ্গগুণটা কিছু নয় নাকি?

আমার সঙ্গ তো মাতৃগর্ভের সূচনা থেকেই। সে গুণ ধরেছিল কই? চিরদিনই তো তোতে আর আমাতে আকাশ-পাতাল তফাত।

সুমিতা আবার হেসেছিল, তফাতটাই তো আসল মিল। যেমন মেয়ে আর পুরুষ।

সুমিতা প্রায় সব সময়ই হাসত। মনে হত হেসে কথা কওয়াই তার স্বভাব ছিল। কিন্তু সেটা যে সত্যি স্বভাব নয়, সেই হাসিটাকে যে ওকে বুক ছিঁড়ে বার করতে হত, এ কথা যখন স্পষ্ট বোঝা গেল, তখন ওর সেই হাসি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শুধু আসামের চা বাগানের ম্যানেজারের কোয়ার্টার্সেই নয়, পৃথিবীর কোথাও রইল না সেই হাসি।

.

কিন্তু সেদিন হাসেনি সুমিতা।

যেদিন রাত্রে খোকার গায়ে হাত দিয়ে দেখেছিল খোকার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সেদিন ডুকরে কেঁদে উঠেছিল, ওগো, খোকা কীরকম করছে বলে।

আচমকা এই প্রবল জ্বরে, তড়কা হল খোকার। সুমিতা কেঁদে উঠল। উদ্ভ্রান্ত হয়ে ডাক্তার আনাল প্রিয়মাধব। ডাক্তার বলে গেল সারারাত ওয়াচ করতে। বলে গেল, ওষুধটা দেবেন যদি বাড়ে।

সারা বাড়িতে একটা তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল। আয়া চাকর সবাই উঠেপড়ে ছুটোছুটি করছিল। নমিতা ও ঘর থেকে উঠে এসে ছেলের কাছে বসে ছিল। জলপটি আর বাতাস চলল।

জ্বর কমলে প্রিয়মাধব বলল, সুমিতা, তুমি বরং একটু ও ঘরেই না হয় শুতে যাও।

 সুমিতা বলল, না, আমি এখানেই থাকি।

 প্রিয়মাধব নমিতার সামনেই ওকে পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, লক্ষ্মীটি, তোমার শরীর ভাল নয়, রাত জেগে তুমি আবার একটা অসুখ বাধিয়ে বসবে–

সুমিতা কখনও জেদ করে না, সেদিন করল।

বলল, না, কিচ্ছু বাধাব না কথা দিচ্ছি। আমার শরীর খুব ভাল আছে। আমার চলে যেতে ভয় করছে।

তবু প্রিয়মাধব তাকে নিবৃত্ত করল। বলল, ভয় নেই, ভয়ের কিছু নেই। তড়কা তো বাচ্চাদের হয়েই থাকে।

নমিতা কিন্তু সেদিন নিষ্ঠুরতা করেনি। বলেছিল, আহা, থাক না হয় জামাইবাবু! যতই হোক মায়ের প্রাণ!

সুমিতাকে আহা বলতে পারার সুযোগ পেয়েই কি করুণাময়ী হয়ে উঠেছিল নমিতা?

সুমিতা ওই আহা শুনে ওই করুণাবতীর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিল।

সে দৃষ্টিতে নমিতা কেঁপে উঠেছিল।

নমিতা যেন পায়ের তলার মাটি খুঁজে পায়নি।

নমিতা সেদিন সে দৃষ্টির মানে বুঝতে পারেনি, কোনওদিনই বুঝতে পারেনি। এই সুদীর্ঘকাল পরেও কোনওদিন বুঝতে পারল না নমিতা, কী ছিল সেই চোখে?

রাগ? ঘৃণা? করুণা? হতাশা? মানুষের অপরিসীম নির্লজ্জতায় বিস্ময়? না শুধুই শূন্যতা?

সেই চোখকে নমিতার সমস্ত জীবনের উপর পুঁতে রেখে দিয়ে আস্তে উঠে গিয়েছিল সুমিতা ছেলের ঘর থেকে। পরদিন আর ছেলের ঘরে আসেনি!

পরদিন প্রিয়মাধবই ছেলে কোলে করে সুমিতার কাছে এল, অবাক হয়ে বলল, তুমি এই লবিতে পড়ে ছিলে বাকি রাতটা?তারপর বলল, দেখো আজ খোকা একেবারে সুন্দর সুস্থ। জ্বর ছেড়ে গেছে, মুখচোখের চেহারা বদলে গেছে। হাসছে খেলছে। এই নাও, একটু কোলে করো।

সুমিতা ক্লান্ত গলায় বলল, থাক। শরীরটা খারাপ লাগছে।

সুমিতার শরীর খারাপ লাগছে।

ছেলের সোহাগ মাথায় উঠল প্রিয়মাধবের। তাড়াতাড়ি ছেলেকে নমিতার কাছে দিয়ে এসে কাছে বসে পড়ল, ব্যস্ত হল। বারবার বলতে লাগল, দেখছ তো? বুঝতে পারছ শরীরের অবস্থা? বুঝতে পারছ কেন আমরা অত ব্যস্ত হই? কাল সেই যে রাত বারোটা অবধি জেগে ছিলে, তাতেই এইটি ঘটেছে।

তাই দেখছি। বলল সুমিতা, ক্লান্ত চোখ বুজে।

প্রিয়মাধব বলল, এই যদি সারারাত বসে জাগতে, কী হত বলো তো? খোকাটা হয়ে পর্যন্ত শরীরটা যে গেছে! তোমার ক্ষমতা থাকলে কেন তোমাকে আমরা

সুযোগ পেয়ে নিজের নিষ্ঠুরতার কৈফিয়ত দিয়ে নিয়েছিল প্রিয়মাধব। সুমিতা সায় দিয়েছিল।

সুমিতা বলেছিল, হ্যাঁ, বুঝতে পারিনি ক্ষমতা কত কম।

.

দুদিন উঠতে পারল না সুমিতা।

 অর্ধেক রাত জেগেই এমন কাবু হয়ে পড়ল! শুধু চুপ করে শুয়ে রইল।

আর এমনি ভাগ্যের খেলা, ঠিক তখনই হঠাৎ ছুটি ক্যানসেল হয়ে বদলির অর্ডার এল প্রিয়মাধবের।  

পঁচিশ মাইল দূরের একটা বাগানে কুলিরা খেপেছে, বুদ্ধিমান প্রিয়মাধবকে সেখানে দরকার। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চলে যেতে হবে।

দেখো কাণ্ড!

মাথায় হাত দিয়ে পড়ল প্রিয়মাধব। একেই খোকার ওই শরীর, এদিকে তোমার শরীর খারাপ, এখন এই অর্ডার!

সুমিতা বলল, তা কী করবে? চাকরি।

চাকরি তো বুঝলাম, কিন্তু এই কঘণ্টার মধ্যে সব গুছিয়ে নেওয়া

 নমিতা আছে, সব ঠিক হয়ে যাবে।

 প্রিয়মাধব বলল, তা যেন হবে, কিন্তু তোমার এই অবস্থায় যাওয়া যাবে?

সেও ঠিক ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

যাই নমিতাকে বলিগে।বলল প্রিয়মাধব।

 সুমিতা যেন অবাক হল।

 সুমিতা বলল, এতক্ষণ বলনি ওকে?

হ্যাঁ বলেছি। অর্ডারের কথা বলেছি। গুছিয়ে-টুছিয়ে নিতে বলিগে।

ব্যস্ত হয়ে চলে গেল প্রিয়মাধব।

 নমিতাকে বলতে গেল কাজের কথা।

কিন্তু নমিতা কেন সুমিতার ঘরে আসেনি? সুমিতা দুদিন বিছানায় পড়ে আছে, তবুও না। ও কি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল?

ওর সর্বাঙ্গে যে দৃষ্টির দাহ, সেই দৃষ্টির ভয়ই কি করছিল আবার?

না কি ও শুধু ব্যস্ত ছিল?

 আজ খানিক পরে ও এল।

খুব ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল, একেই তো তুই অসুখ বাধিয়ে বসে আছিস দিদি, খোকারও শরীর খারাপ! হঠাৎ এ কী হাঙ্গামা! ক ঘণ্টার মধ্যে সব গুছিয়ে নেওয়া। নে, গণেশ-জননী হয়ে বসে থাক। ধর। আমি রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ি গে।

সুমিতা হাত বাড়িয়ে ছেলেকে নিল না।

সুমিতা বলল, সামলাতে পারব না, শরীরে বল নেই।

 নমিতা এ আশা করেনি। নমিতা থতমত খেল।

 অপ্রতিভ গলায় বলল, একটু দেখতে পারবি না? খানিকটা গুছিয়ে নিতাম।

সুমিতা বলল, আয়ার কাছে দে গে।

সুমিতা ক্লান্তিবোধ করছিল, তাই চোখ বুজল।

 সুমিতার রোগা হয়ে যাওয়া বুকের উপর পাতলা শাড়িটা নিশ্বাসের ভারে কাঁপতে লাগল।

 নমিতা অপ্রতিভ হয়েছিল।

 নমিতার বুকটা কাঁপছিল। তবু নমিতা আগের পার্ট প্লে করে বলল, বাঃ, তোর ছেলে তোর সংসার, তুই একটু সামলাবি না?

তারপর নমিতা আবার কেঁপে উঠল। আপাদমস্তক বিদ্যুতের শক খেল।

নমিতা প্রায় ছুটে পালিয়ে গেল।

নমিতাকে তাড়া করতে আসছে সেই চোখ! সেই সে রাত্রের চোখ।

 নমিতা যতদিন বেঁচে ছিল, সেই চোখ তাকে অবিরাম তাড়া করেছে। নমিতার দিনের শান্তি রাতের ঘুম, সব হরণ করেছে সেই চোখ। সুমিতার সেই চোখ। কোনও দিনই যার ঠিক মানে বুঝতে পারেনি নমিতা।

.

কিন্তু নমিতা আর কদিন বেঁচে ছিল? যেদিন বদলি হল প্রিয়মাধব, সেইদিনই না নমিতার দেওরদের টেলিগ্রাম করতে হল তাকে। নমিতা মারা গেছে। হঠাৎ বিষ পোকার কামড়ে

হ্যাঁ সেই তারিখ। প্রিয়মাধবের বদলির আর নমিতার মৃত্যুর তারিখ একই।

সুমিতা চাঙ্গা হয়ে উঠল। ছেলে কোলে নিয়ে সুমিতা তার বরের সঙ্গে নতুন চা বাগানে চলে গেল, নমিতা মারা গেল।

অথচ নমিতার ওই রাতারাতি মারা যাবার কথাটা বাংলোয় বলতে সাহস করেনি প্রিয়মাধব। বিদায় বেলায় যখন বকশিশের আশায় একধার থেকে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল চাকরানি, গয়লানি, ধোপানি, জমাদারনির দল, ওরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল, মাসি মেমসাহেব কোথায়?

প্রিয়মাধব বলেছিল, ও হঠাৎ শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। শাশুড়ির অসুখের খবর পেয়ে।

চলে গেছে! ওরা হাঁ করে তাকাল।

কেউ দেখল না। চলে গেল।

 কে আর দেখবে? রাত্রের প্লেনে চলে গেছে। হ্যাঁ, উড়োজাহাজে চড়ে উড়ে চলে গেছে মাসি মেমসাহেব।

ওরা নিশ্চয় মাসি মেমসাহেবের শাশুড়ি-ভক্তি দেখে ধন্য ধন্য করেছে। তা ছাড়া প্রশংসাও করেছে বিস্তর। বলেছে, এমন লোক হয় না। বলেছে, এরপর নতুন জায়গায় একা মেমসাহেবের খুব কষ্ট হবে। তারপর বকশিশ পেয়ে চলে গেছে।

নতুন বাগানে কেউ মাসি মেমসাহেবের নাম শোনেনি।

সেখানে শুধু সুমিতা, তার স্বামী-পুত্র নিয়ে সংসার করেছে। করেছে নিপুণ হাতে, অবলীলায়।

 মরে গিয়ে কি নমিতা তার কর্মক্ষমতার ক্ষমতাটুকু তার চিরদিনের ভালবাসার দিদিকে দিয়ে গেল?

এটা একটা জিজ্ঞাসার চিহ্ন বইকী! যে চিহ্নটা আমার মনের মধ্যে চিরদিন খাঁড়ার মত উদ্যত হয়ে রইল।

কিন্তু এই আমিটা কে।

আমি কি সুমিতা? না আমি নমিতা? আমি যদি নমিতা হই, আমি তো তা হলে মারা গেছি। হ্যাঁ, প্রিয়মাধবের সেই বদলির তারিখে তো নমিতা মারা গেল। রইলাম শুধু আমি সুমিতা।

অথচ সুমিতাই হারিয়ে গিয়েছিল।

হ্যাঁ, সেই বদলির দিন গাড়িতে উঠবার আগের মুহূর্তে আসল সুমিতাকে আর দেখতে পাওয়া গেল না। সুমিতা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

.

সুমিতা কি কর্পূরের পুতুল ছিল?

তাই উবে গেল?

কী জানি কী ছিল সুমিতার মনে। বোঝা তো যেত না। মনে হত সোনারুপোর ও নয়, নেহাত মাটির পুতুল। কিন্তু মাটির পুতুল কি উবে যেতে পারে?

সুমিতা তবে কীসের পুতুল ছিল?

স্ফটিকের? ওর গায়ে কিছু লেগে থাকত না, তাই মনে হত খুব শক্ত। লেগে থাকত না? কে জানে। কিন্তু পুতুলটা হারিয়ে গেল। যেন বাতাসে উড়ে গেল।

ঘরে বারান্দায় ছাতে বাগানে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না তাকে।

চা বাগানের এলাকা থেকে হারিয়ে যাওয়া শক্ত, তবু সেই শক্ত কাজটা করে বসল সুমিতা।

অপটু সুমিতা যে এমন ভয়ানক একটা শক্ত কাজ করে বসতে পারবে এ কথা কে কবে ভেবেছিল?

অথচ সুমিতা তো পারল।

 নিজেকে মুছে দিয়ে চলে গেল।

.

বিষ পোকা তা হলে ওকেই কামড়েছিল? যে পোকা আস্ত একটা মানুষকে খেয়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারে, মুছে দিতে পারে সবটা?

কিন্তু ঠিক সেই মোছার দিনটাকে কিছুতেই স্পষ্ট করে মনে আনা গেল না কোনওদিন। সুমিতা কি চলে যাবার সময় তার যমজ বোনের স্মৃতিশক্তিটাও মুছে দিয়ে গেল?

তাই শুধু খাপছাড়া খাপছাড়া কতকগুলো দৃশ্যের টুকরো যেন দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে চোখের সামনে!

সেই দৃষ্টির ধাক্কায় সারাদিন পালিয়ে পালিয়ে, রাত্রে ভাঁড়ার ঘরের জাল আলমারিটার গায়ে ঠেশ দিয়ে বসে পড়ল নমিতা, দু হাতে চোখ চাপা দিল।

কিন্তু সেই ভয়ংকর দৃষ্টি তো আর চোখের সামনে ছিল না। সে যে নমিতার মনের উপর, নমিতার সমস্ত জীবনের উপর পুঁতে রেখে দিয়ে চলে গিয়েছিল সুমিতা।

নমিতা তাকে উপড়ে ফেলতে চেষ্টা করল, পারল না। নমিতা ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকাল, দেখল ওখান থেকে দড়ি ঝোলানো যায় কিনা।

দেখল কোম্পানি বাড়ি করবার সময় ভেবে দেখেনি হঠাৎ কারও এমন একটা দরকার পড়তে পারে। প্লেন পরিষ্কার সিলিং। তখন নমিতা ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে বাগানের দিকে বেরিয়ে এল, বাগানের বাইরের দিকে তাকাল, চোখের সামনে ঘন জঙ্গলাবৃত পাহাড়, দূরে দূরে ছড়ানো ছিটনো বাড়ি। আলো জ্বলছে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেই আলোটা হয়তো দুচার মাইল দূরে। নমিতা হাঁটতে শুরু করলে কেউ কোথাও দেখতে পারে কি? কিন্তু কতটা হাঁটবে নমিতা? কোন দিকে, রাস্তায় কেউ দেখতে পাবে না? চা-বাগানের এলাকা যে শক্ত ঘাঁটি। এখান থেকে কি পালানো সহজ? যদি কেউ জিজ্ঞেস করে কে তুমি?কী পরিচয় দেবে নমিতা? রাতদুপুরে রাস্তায় বেড়ানোর কৈফিয়তই বা কী দেবে? খাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো সুযোগ জোগাড় করার আগেই যদি ওই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়? নমিতা বাগানের সীমানা থেকে সরে এল।

নমিতা ভাবল বিষ নামের জিনিসটা নমিতা আগে থেকে কেন সংগ্রহ করে রাখেনি? নমিতার জীবনে যে কোনও মুহূর্তে ওর দরকার পড়তে পারে, এটা নিশ্চয় ভাবা উচিত ছিল নমিতার।

নমিতা এ যাবৎ কেবল নিজের বুদ্ধির অহংকারে স্ফীত হয়েছে, অথচ নমিতা এত বড় একটা বোকামি করে রেখেছে।

নমিতা যখন বাগানের দরজায় দাঁড়িয়ে নিজের এই অপরিসীম মূঢ়তার জন্যে ধিক্কার দিচ্ছিল নিজেকে, তখন প্রিয়মাধবও সেখানে এসে হাজির হল। খুব ব্যস্ত গলায় বলল, তুমি একা? সুমিতা কই?

নমিতা ভুরু কোঁচকাল।

 বলল, দিদি? সে রাতদুপুরে বাগানে বেড়াতে এসেছে, হঠাৎ এ কথা ভাবার হেতু?

 তা হলে গেল কোথায়? কোথাও তো দেখছি না!

সর্বত্র ঘুরে বেড়াবার অবস্থা রয়েছে নাকি তার? বাথরুমে গেছে বোধহয়। নিশ্চিন্ত গলায় বলল নমিতা।

এক মিনিট আগেও যে নমিতা খাদে লাফিয়ে পড়তে যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল, সে কথা বোঝ গেল না ওর গলার স্বরে।

প্রিয়মাধবই অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠল, না না! সব দেখলাম তো! কোথায় গেল সে?

এ কি শুধুই প্রশ্ন?

না রুষ্ট অভিযোগ?

 যেন সুমিতা কোথায় যায় না যায় তার খবর রাখার সব দায়িত্ব নমিতার। তাই প্রশ্নটা তীব্র। এই তীব্র প্রশ্নের ধাক্কায় বুকটা ধড়াস করে উঠল নমিতার।

আর সেই মুহূর্তে মনে হল তার, সুমিতা হারিয়ে গেছে, সুমিতাকে আর পাওয়া যাবে না!

আশ্চর্য, নমিতার সেই মুহূর্তের অনুমানটাই এমন সত্য হয়ে গেল?

আর একটা ছবির টুকরো দেখতে পায় নমিতা, তীব্র একটা টর্চের আলো দিকভ্রান্তের মতো এদিকে ওদিকে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। বাইরের ঘন অন্ধকারের গায়ে সেই আলোটা যেন প্রেতের চোখের মতো ক্ষণে ক্ষণে জ্বলছে আর নিভছে।

তারপর ঘুরঘুটে অন্ধকারে দীর্ঘ একটা ছায়া ফিরে এসেছিল, পাগলের মতো আছড়ে পড়ে বলেছিল, নিশ্চয় ও খাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নমিতা! আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ওর মন ভেঙে গেছে।

.

সুমিতার মন ভেঙে গিয়েছে বুঝতে পেরেছিল প্রিয়মাধব, সুমিতার প্রাণের স্বামী, তবু সে সেই ভাঙা মনকে টেনে তুলে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেনি। নমিতার তবে কীসের এত অপরাধবোধ?নমিতাও কেন তবে খাদের গভীরত্বর কথাই জপ করছে?

না, নমিতা দিশেহারা হবে না, নমিতা প্রিয়মাধবের মতো ছুটোছুটি করবে না, নমিতা শুধু দাঁতে দাঁত চেপে খোকাকে আগলে বসে থাকবে।

সন্ধের সময় আয়াকে যে ছুটি দিয়েছিল সুমিতা, সে কথা জানা গেল পরে। সুমিতা তাকে নাকি বলেছিল, কাল সকালবেলাই তো সাহেব বদলি হয়ে অন্য বাগানে চলে যাবেন, তুমি আর কী করবে? আজই তোমার বাসায় চলে যাও।বকশিশ দিয়েছিল অনেক।

আর সেইটাই তো সুমিতাকে খোঁজ পড়ার কারণ। বসবার ঘরে বসে অফিসের কাগজপত্র দেখছিল তখন প্রিয়মাধব, ওকে বলল, আচ্ছা। মেমসাহেব যখন ছুটি দিয়ে দিয়েছেন–

কিন্তু খানিক পরে কাগজপত্র তুলে রেখে ঘরের দরজায় এসে বলল, আজ থেকেই আয়াকে ছুটি দিলে কেন সুমিতা? আজ রাত কাল সকাল

ঘরে মশারি ফেলা ছিল, আর ঘরটা অন্ধকার ছিল, সাড়া না পেয়ে আলোটা জ্বালাল প্রিয়মাধব, দেখল শূন্য বিছানাটাকে ঘিরে মশারির ঝালরগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে।

নমিতার ঘরে?

না, নমিতার ঘরে নমিতার দিদির কোনও চিহ্ন নেই।

অথবা আছে।

সুমিতার জ্বলন্ত আর জীবন্ত চিহ্ন।

 দোলা-খাটের বিছানায়, মশারির মধ্যে নিরুদ্বেগে ঘুমোচ্ছ।

প্রিয়মাধব উদ্বিগ্নচিত্তে এঘর ওঘর ভাঁড়ার ঘর রান্নাঘর সব দেখেছিল, দুই বোনের কাউকেই দেখতে পায়নি। ভেবেছিল, শেষলগ্নে দুই বোন তবে নির্ঘাত বাগানে বেড়াতে গেছে। রাগ হয়েছিল, ভেবেছিল এত কবিত্বর কোনও মানে হয় না। সাপখোপের দেশ–

তখন বাগানে এসেছিল।

 হ্যাঁ, এসব পরে জেনেছিল নমিতা।

আরে, কী আশ্চর্য! নমিতা আবার কোথায় তখন? সুমিতা, সুমিতা। সুমিতা নামটাকে কর্পূরের মতো উবে যেতে দিলে চলবে কেন? সুমিতাই তো ম্যানেজার সাহেবের মেমসাহেব। মেমসাহেব হঠাৎ রাতারাতি উবে গেলে সাহেবের মান সম্ভ্রম থাকবে কোথায়?

অথচ নমিতা, যেনাকি শুধু মাসি মেমসাহেব, সে যদি সেই রাত্রেই তার শাশুড়ির জবর অসুখ শুনে উড়ে কলকাতায় চলে যায়, কোথাও কোনও লোকসান নেই।

আর যদি সেই উড়োজাহাজখানা হঠাৎ মাঝরাস্তায় হারিয়ে যায়, যদি কলকাতায় তার শ্বশুরবাড়িতে তাকে নামিয়ে না দেয়, কী উপায় আছে সেখানে টেলিগ্রাম করা ছাড়া?

বিষ পোকার কামড়ে মারা যাওয়া তো আসামের এই চা বাগানে অভূতপূর্ব ঘটনা নয়।

চট করে যে কোনও অবস্থাকে ম্যানেজ করে ফেলতে পারে বলেই তো এখানকার ম্যানেজার সাহেবকে বেকায়দায় জায়গায় চালান করা হচ্ছে চব্বিশ ঘণ্টার নোটিশে।

.

তবু প্রথমটায় ভয়ংকরভাবে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল বইকী ম্যানেজার সাহেব। টর্চের ব্যাটারিটা জবাব না দেওয়া পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়ে আর আলো ফেলে ফেলে, শেষ অবধি অন্ধকারে ফিরে এসেছিল। আছড়ে পড়ে বলেছিল, নিশ্চয় ও খাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছেনমিতা! দিনের আলো হলে দেখতে পেতাম।

নমিতা শুকনো গলায় বলেছিল, খাদে ঝাঁপিয়ে পড়েনি।

পড়েনি? তুমি জানো? তোমায় বলে গেছে?

নমিতার হাত জড়িয়ে ধরেছিল প্রিয়মাধব। আকুল আবেগে আত্মবিস্মৃতের মতো।

নমিতা হাত ছাড়িয়ে নিয়েছিল।

বলেছিল, বলে যায়নি, লিখে রেখে গেছে।

 লিখে রেখে গেছে? লিখে রেখে গেছে? উদভ্রান্ত প্রিয়মাধব ছটফটিয়ে উঠেছিল, কই বলছ না এতক্ষণ?

দেখিনি। এতক্ষণ দেখিনি। এই মাত্র দেখলাম। আমার থান কাপড় আর সাদা ব্লাউজের ব্যাগটা খুলে চুরি করেছে একটা কাপড় আর ব্লাউজ, তার মধ্যে রেখে গেছে চিঠি আর তার শাড়ি গয়না।

নমিতার থান কাপড় পরে চলে গেছে সে! তার মানে হারিয়ে গেল নমিতা নামের পরিচয়টা!

তবে?

 প্রিয়মাধব ছুটে গেল, দেখল সেই শাড়ি, গয়না, দেখল চিঠি, যাতে লেখা ছিল–আমায় খুঁজো না, আমি হারিয়ে গেলাম।

প্রিয়মাধব বলল, নমিতা, আমায় বাঁচাও! আমার মান-সম্ভ্রম, চাকরি, সন্তান, সব কিছু বাঁচাতে পারো একমাত্র তুমিই!

নমিতার অনেক বুদ্ধি, তবু নমিতা অবাক হয়ে বললে, তার মানে?

তার মানে তুমি ভুলে যাও তুমি নমিতা। তুমি সুমিতা হয়ে যাও। সুমিতা তোমার কাপড় চুরি করে পরে চলে গেছে। তুমিও তার শোধ নাও। তুমি তার নাম চুরি করো। নমিতা হারিয়ে যাক। নমিতা মুছে যাক।

আমি,

হ্যাঁ, তখনও আমি নমিতা ছিলাম।

 আমি চমকে উঠলাম। আমি শিউরে উঠলাম। আমি ছিটকে উঠে বললাম, বলছেন কী আপনি?

 প্রিয়মাধব আমায় জড়িয়ে ধরল। অভিনেতা প্রিয়মাধব হাহাকার করে বলল, এ ছাড়া আমার বাঁচবার কোনও উপায় নেই নমিতা! আজ সারাদিন পর্যন্ত এখানে আমার স্ত্রী ছিল, সন্তান ছিল, হঠাৎ কাল সকালে আমি একটা ছমাসের শিশু, আর বিধবা শালিকে নিয়ে নতুন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াব কী করে?

দাঁড়াতে হবে। আমাকেও বিদায় দিন।

 বললাম আমি, নিজেকে রূঢ়ভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে।

প্রিয়মাধব আবার হাহাকার করে উঠল। তা হলে খোকা? খোকাকেও তো তা হলে বাঁচানো যাবে না নমিতা? কেউ বুঝতে পারবে না নমিতা। অবিকল একরকম দেখতে তোমরা, শুধু সাজে তফাত দেখাত। সুমিতার সাজের খোলসে ঢুকে পড়লে কেউ ধরতে পারবে না। এ ছাড়া আমার বাঁচবার আর কোনও উপায় নেই নমিতা! আমাকেও তা হলে খাদে ঝাঁপ দিতে হবে।

তোমার উপায়টা তো খুঁজে বার করলে,আমি কঠিন গলায় বললাম, আর আমার বাঁচবার উপায়?

প্রিয়মাধব থতমত খেল!

প্রিয়মাধব বলল, কী বলছ?

বলছি, গয়না কাপড়ে গা ঢেকে তোমার স্ত্রী আর তোমার সন্তানের মা সেজে একা তোমার বাংলোয় গিয়ে উঠব আমি, আমায় কে রক্ষা করবে?

প্রিয়মাধব আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। বোধহয় ওই রক্ষার প্রশ্নটা তার মাথায় আসেনি। বোধহয় নমিতাকে সুমিতা করে দেওয়ার মধ্যেই ও সব মুশকিলের আসান খুঁজছিল।

তাই কেমন যেন হয়ে গেল।

তারপর আস্তে বললে, আমিই করব।

আমিই করব!

ওই রক্ষাকবচ নিয়ে সুমিতার পরিত্যক্ত শাড়ি গয়না পরে নিলাম আমি। সুমিতার সিঁদুর-কৌটো থেকে সিঁদুর। সুমিতার ছেলে কোলে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। যারা বকশিশ নেবার জন্যে কাতার দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল গাড়ির ধারে, তারা কেউ ধরতে পারল না।

তারা মাসি মেমসাহেবের আকস্মিক অন্তর্ধানে আক্ষেপ প্রকাশ করতে লাগল।

.

নমিতার মৃত্যু হল।

সেই বিদীর্ণ খোলসে সুমিতার জন্ম হল।

 নতুন জন্ম! দুটো সত্তার মেশানো একটা নতুন সত্তা নিয়ে ম্যানেজার সাহেবের ঘর করতে লাগল মেমসাহেব। নমিতার অফুরন্ত জীবনীশক্তি, আর সুমিতার গাম্ভীর্য, নমিতার দৃঢ়তা আর সুমিতার স্থিরতা এই দুইয়ের সংমিশ্রণে গঠিত নতুন মেমসাহেবকে ম্যানেজার সাহেব ভয় করে চলতে শুরু করল।

ক্রমশই ধরা পড়তে লাগল তার কাছে, মৃত্যুর খাদ কেটে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচতে চেয়েছিল সে। প্রিয়মাধব ক্রমশ বিকৃত হতে থাকল।

প্রথমটা বুঝতে পারেনি।

প্রথমদিন যেন অবিভূত গলায় বলেছিল, আরশির সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছ তুমি তোমাকে? চিনতে পেরেছ?

আমি ওর ওই বিহ্বল অভিভূত দৃষ্টিকে প্রশ্রয় দিইনি, কড়াগলায় বলেছি, থামুন!

ও ম্রিয়মাণ হয়ে বলেছিল, এখন ধরা পড়ছে তুমি সুমিতা নও। সুমিতা কোনওদিন জোরে কথা বলত না। সুমিতা কোনওদিন ধমক দিয়ে ওঠেনি কাউকে, চাকরবাকরকেও না। কিন্তু তুমি যখন চুপ করে বসে ছিলেহ্যাঁ, এতক্ষণ তুমি যে ওই জানলার ধারটায় বসে ছিলে, যেন ধরতে পারিনি তুমি সুমিতা নও। অবাক হয়ে দেখছিলাম।

তবু আমি আরও কড়া হলাম।

বললাম, ওসব বাজে কথা রাখুন। যমজ বোন আমরা চিরদিনই একরকম দেখতে, এটা আপনার নতুন আবিষ্কার নয়। দিদিকে খোঁজার কী হবে তাই বলুন।

দিদিকে খোঁজার

ও যেন শেখানো মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করল, দিদিকে খোঁজার?

 রাগে আপাদমস্তক জ্বলে গেল। এই পরিস্থিতিতে ওর ওই ভাব বিহ্বলতা অসহ্য লাগল, বললাম, হ্যাঁ দিদিকে! কথাটা মাথায় ঢুকছে না নাকি?

ও এবার বিহ্বলতা ত্যাগ করল। যুক্তির গলায় বলল, ঢুকবে না কেন। কিন্তু পথ তো খুঁজে পাচ্ছি না। এ বাগানে তো এখন ভয়ংকর গোলমাল। আজই ভোর থেকে হঠাৎ ছোট ডিরেক্টর রবার্ট সাহেবকে নাকি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই সন্দেহ করছে খুন হয়েছে সাহেব। অবস্থা আয়ত্তে আনতে পারব কিনা বুঝতে পারছি না। এই তো এক্ষুনি বেরিয়ে যাব, জানি না কখন ফিরতে পারব।

বললাম, তা হলে খোঁজা হবে না? ম্যানেজার সাহেবের কাছে স্ত্রীর চাইতে চাকরিই বড়?

ও বলল, বড় ছোটর কথা হচ্ছেনা, হচ্ছে সম্ভব অসম্ভবের কথা। এখন যদি আমি চাকরিতে রিজাইন দিতে চাই তার পরিণাম জেল, তা জানো? বন্ডে সই করে চাকরি নিয়ে এসেছি

আমি কিন্তু বিশ্বাস করলাম না ওর কথা, মনে করলাম ও আমাকে নিবৃত্ত করতে বাজে ভয় দেখাচ্ছে। তাই উড়িয়ে দিলাম ও কথা। বললাম, রাখুন ও কথা, দিদির মতন বোকা পাননি আমায় যে, যা ইচ্ছে বুঝিয়ে ভয় খাইয়ে রাখবেন। বেশ তো, নিজে সময় না পান খোঁজবার জন্যে তোক লাগান।

ও বিমূঢ় গলায় বলল, লোক? লোকের কাছে বলব? তবে তোমাকে এই শাস্তি দেবার অর্থ?

আমি মনে মনে কেঁপে উঠলাম ওর কথায়। মনে হল ও তো বলছে শাস্তি, কিন্তু আমার কাছে কি আমার এই অদ্ভুত রূপান্তর সত্যি শাস্তি হয়েই দেখা দিয়েছে? আমি বাদ প্রতিবাদ করছি বটে, তবু কি এই অচিন্তনীয় পরিস্থিতি আমাকে একটা উগ্র রোমাঞ্চের স্বাদ এনে দিচ্ছে না? ঝাল আচারের মতো আকর্ষণীয় এই স্বাদ কি আমার তারিয়ে তারিয়ে পেতে ইচ্ছে করছে না? ঝালে চোখে জল এলেও।

করছে।

বোধ করি মদের আস্বাদ এই রকমই।

শুনেছি সে স্বাদেও নাকি বুক জ্বলে যায় পেট জ্বলে যায়, তবু মাতাল সেই জ্বালাতেই ডুবে থাকতে চায়। আমিও একটা তীব্র জ্বালাময় অনুভূতির রসে জারিত হচ্ছিলাম, তবু মান মর্যাদা রাখতে ওর সঙ্গে বাদ প্রতিবাদ করছিলাম আমি দিদিকে খোঁজা নিয়ে।

কিন্তু শুধুই কি মান মর্যাদা রাখতে?

দিদির জন্যে কি ভয়ংকর একটা শূন্যতা বোধ করছিলাম না? তাও করছিলাম। হাহাকার করছিল প্রাণ, আর ভয়ংকর একটা অপরাধবোধের ভারে শিথিল হয়ে যাচ্ছিলাম। আর সেই ভারাক্রান্ত হৃদয়ের ভার হালকা করতে অনবরত ওকে আঘাত হানতে ইচ্ছে করছিল, ওকে দোষী সাব্যস্ত করতে ইচ্ছে করছিল। তাই বাদ প্রতিবাদের চেহারাটা অনেকটা এই ধরনের হয়েছিল।

ওর ওই বিমূঢ় প্রশ্নের উত্তরে আমি বলেছিলাম, আমার শাস্তির জন্যে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। লোককে জানাবেন তো–কি নিজে উদভ্রান্ত প্রেমিকের মতো পথে পথে সুমিতা সুমিতা করে খুঁজে বেড়াবেন? বেশ তো রাষ্ট্র করুন গে ম্যানেজার সাহেবের শালিই হারিয়ে গেছে

সে পথ তো আগেই বন্ধ করে রেখেছি, লোকে তো জানে সে কলকাতায় চলে গেছে।

ধরে নিন কলকাতা থেকে খবর এসেছে পৌঁছয়নি সেখানে। পথের মাঝখানে অথবা পথের প্রথমেই কোথাও হারিয়ে গেছে।

লোকে হাসবে মুখ ফিরিয়ে। বলবে বয়েসটা অবশ্য হারানোরই মতো। রূপটাও কম যায় না।

তা হলে দিদি সত্যিই মুছে যাবে?

 যদি তার ভুল ভাঙে, অভিমান ভাঙে, যদি নিজে থেকে এসে

ওর কথা থামিয়ে তীব্র স্বরে বলেছিলাম, এ বিশ্বাস আপনার আছে?

 ও কেঁপে উঠল।

 বলল, ভাগ্যের কাছে প্রার্থনা করছি। তারপর হঠাৎ বলে উঠল, সর্বনাশ, কত দেরি করে ফেললাম, এক্ষুনি বেরোতে হবে, দেখি ভেবে।

সাজপোশাক করে ছুটে বেরিয়ে গেল ও, আর বেরিয়ে পড়বার পরই বিছানায় আছড়ে পড়লাম। আমি, ও যে সকাল থেকে কিছু খায়নি, সেটা মনে পড়ল ও বেরিয়ে যাবার পর। মনে হল ওর পিছু পিছু ছুটি, ওকে পায়ে ধরে ফেরাই।

আশ্চর্য, ওকে আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতে ইচ্ছে করে, অথচ ওর জন্যে নিজের প্রাণ এমন বিদীর্ণ হতে চায় কেন? চিরজীবন ওর সঙ্গে এই সম্পর্ক থাকল আমার। ওকে জড়িয়ে ধরতে প্রাণ শত বাহু মেলে এগিয়ে যেতে চায়, আবার ওকেই ছোবল হানবার জন্যে জিভ যেন উগ্র ক্ষুধায় উন্মুখ হয়ে থাকে।

.

সেদিন অনেক রাত্রে ফিরল ও।

 সারাদিন আমিও অভুক্ত থেকেছি, কিন্তু যেমন করে বিছানায় পড়ে থাকতে ইচ্ছে হয়েছিল, ওকে সেই অভুক্ত অভিমানহত মূর্তিটা দেখাতে বাসনা জাগছিল তেমন আর হল কই? দিদি যে লোহার শিকল পরিয়ে দিয়ে গেছে আমার গলায়। খোকার জন্যে উঠতে হয়েছে আমায়, সবই করতে হয়েছে।

নিজের কাছে অস্বীকার করব না, সেই বাধ্য হয়ে করার বিরক্তিতে খোকার উপর ভয়ানক একটা আক্রোশ অনুভব করেছি সেদিন, অবাক হয়ে ভেবেছি এই বিরক্তিকর বস্তুটাকে নিয়ে দিদির সঙ্গে হারজিতের খেলা খেলে মরেছি আমি? দিদিকে মেরেছি সেই খেলার রেজাল্টে!…

কেন?

দিদি থাকতে খোকার সব কাজই আমি করেছি, কিন্তু তা কাজ বলে মনে হয়নি। ফুলের মতো পাখির পালকের মতো বাতাসের মতো হালকা সেই কাজের ভার অবলীলায় বহন করেছি। কিন্তু দিদিহীন শূন্য বাড়িটায় খোকার ভার যেন পাহাড়ের ভার হয়ে উঠছে।…এ ভাব কাটিয়ে উঠতে অনেকদিন লেগেছিল।

সেদিন ও ফিরল অনেকটা দেরি করে।

সম্পূর্ণ নতুন জায়গায় অত রাত পর্যন্ত একা কীভাবে যে কেটেছে আমার অন্তর্যামী জানেন। সামান্য একটু শব্দে মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে পাহাড় পড়ছে। সারা বাড়িটা যেন একটা নিঃশব্দ পৈশাচিক হাসির মূর্তি নিয়ে ঘিরে ধরছে দাঁত বসাবে বলে। ওই ভয়ংকরতার মাঝখানে থেকে থেকে খোকার কান্নাটা যেন একটা জান্তব চিৎকারের মতো লাগছিল।

খোকা তো কই কোনওদিন এমন কাঁদত না।

তবে কি ও সব কিছু বুঝে ফেলেছ? তবে কি ও ওর মাকে চিনত? এরপর ও ধরে ফেলবে আমি ওর মা নই, আমি ছদ্মবেশী! আমি পিশাচী, আমি ওর মার হত্যাকারিণী?

এমনি একটা অস্বাভাবিক চিন্তায় ক্রমশই আমার সব শক্তি হারিয়ে ফেলছিলাম, তারপর যখন রাত বেড়ে উঠল, খোকা ঘুমিয়ে পড়ল, তখন হঠাৎ মনে হতে থাকল এ ঘুম থেকে আর উঠবে না খোকা। খোকা আমাদের উপর ঘৃণায় ধিক্কারে ওর মার কাছে চলে গেছে। খোকা মরে গেছে।

মৃত সন্তানের শিয়রে একা বসে থাকা মায়ের মতোই অসহ্য যন্ত্রণার আবেগে কাঁপতে থাকলাম আমি, আর সেই সময় প্রিয়মাধব এল।

আমি ধৈর্য হারালাম, জ্ঞান হারালাম, এতদিনের সযত্ন লালিত মান মর্যাদা সব হারালাম, ছুটে গিয়ে ওর গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। দু হাতে ওকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলে উঠলাম, কেন? কেন? কেন তুমি আমায় ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলে?

হ্যাঁ, ঠিক সেই মুহূর্তে আবিষ্কার করলাম আমার এতক্ষণকার বহুবিধ যন্ত্রণার জনক ছিল ওই ভয়। আমার সুপ্ত চেতনার মধ্যে ওই ভয় কাজ করছিল। সেই ভয়ে দিশেহারা হচ্ছিলাম আমি।

আমার এই দুর্বলতার সুযোগ ও ছাড়ল না।

অথবা ও সাংঘাতিক রকমের দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তাই ও আমাকে যেন দুহাতের মধ্যে পিষে ফেলতে চাইল। যেন মনে হল ওর সমস্ত দেহমন এই আবেগের আছড়ানির জন্যে তৃষিত হয়ে ছিল।

সুমিতা ওকে ভালবাসা দিয়েছে, আবেগের স্বাদ দেয়নি।

কিন্তু সেদিন আমাকে ঈশ্বর রক্ষা করলেন।

সেদিন ও রাত অবধি সাহেবদের ক্লাবে বসে মদ খেয়ে এসেছিল।

ওর সেই মদ খাওয়া আমার কাছে সেদিন বিরাট একটা শুভগ্রহ হয়ে দেখা দিল। নইলে–

হ্যাঁ,নইলে কে বলতে পারে কী ঘটতে পারত সেদিন। হয়তো অনিবার্যই ছিল সেই ঘটনা, আর সেই অনিবার্যতার পথ ধরে আমাদের এই অস্বাভাবিক জীবনের ইতিহাসই যেত পালটে। জানি না সেই পালটানোটাই শুভ ছিল কিনা। হয়তো তা হলেই সহজ আর স্বাভাবিক হতে পারতাম আমরা। পৃথিবীর আরও অনেক হাজার হাজার মানুষের মতো সাধারণ আর স্বাভাবিক।

কিন্তু তা হল না।

কারণ ও সেদিন মদ খেয়ে এসেছিল।

আর সেই উন্মাদ মুহূর্তের পরক্ষণেই আমার মনে হয়েছিল ওর এই মদ খাওয়াটা আমার পক্ষে বিরাট একটা শুভগ্রহ।

ওর বাহুবন্ধনের মধ্যে আটক পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওর মুখটা ঠেলে দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম আমি। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, তুমি মদ খেয়ে এসেছ?

সেই বোধহয় প্রথম তুমি বললাম।

আবেগে দুঃখে ধিক্কারে ঘৃণায় আর বোধ করি পরমুহূর্তেই ভয়ংকর একটা বিপদ থেকে মুক্ত হওয়ায়।

আমার সেই প্রশ্নটা কতখানি তীব্র হয়েছিল তা আমি জানি না। আমার মনে নেই, সেটা মানুষের স্বর হয়েছিল, না জানোয়ারের।

তবে তারপরে ওর গলার স্বরটা শুনতে পেয়েছিলাম। ক্ষুব্ধ আহত দুঃখী মানুষের মতো।

খেয়েছি! না খেয়ে কী করব? আমাকে তো বাঁচতে হবে!

আমি বলে উঠলাম, বাঁচবার জন্যে বিষের শরণ? বাঃ বেশ চমৎকার! নিজের সেই ক্ষণপূর্বেরক্ষণিক দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলার গ্লানি আবার ওর উপরই ছোবল হানতে চাইল। বললাম–মনে হচ্ছে এমনই একটা নাটকীয় জীবনই তোমার কাম্য ছিল। দিদি সরে গিয়ে পথ পরিষ্কার করে দিয়ে গেল।

হঠাৎ প্রিয়মাধব একটা অপ্রত্যাশিত তীব্র চিৎকার করে উঠল, চুপ! আর একবারও যেন শুনতে না হয় ও নাম। দিদি, দিদি, দিদি! দিদি বলে কেউ নেই, কোনওদিন কেউ ছিল না বুঝলে? তুমি সুমিতা, আমার বিবাহিতা স্ত্রী! তুমি তোমার বাবার একমাত্র মেয়ে। যমজ বোন বলে কিছু ছিল না তোমার।

আমি আমার ফণা বার করলাম।

বললাম, তা বটে। তা হলেই নিষ্কণ্টক সুখ সুবিধেটা জোটে। তাই না? বিধবা শালি তবু ভয়ের, বিবাহিতা স্ত্রীকে যা খুশি করা যায়–

ও আহত হয়ে বলল, আমার সাহস ছিল না! তুমিই

কথাটা সত্যি।

 কিন্তু সেই সত্যি কথাটা মেনে নেওয়া তো মস্ত পরাজয়। তাই গম্ভীরভাবে বলালাম, একবার বাজিয়ে নিলাম!

বাজিয়ে নিলে?

হ্যাঁ! দেখলাম টাকাটা খাঁটি না মেকি।

কী দেখলে? মেকি?

 তা আবার বলতে। বললাম আমি নিষ্ঠুর গলায়, স্রেফ দস্তার টাকা। ছি ছি! এই নিয়েই এত বড়াই ছিল দিদির!

আর যদি তোমার কথা বিশ্বাস না করি? যদি বলি ওই বাজিয়ে নেওয়া বানানো।

বলো। বলতে তো পয়সা লাগে না। ভগবান মুখ দিয়েছে বলবার জন্যে।

ওকে অপদস্থ করতে করতেই নিজের শক্তি ফিরে পাচ্ছিলাম ক্রমশ, তাই ওকে ছাড়লাম না। শেষ পর্যন্ত ওকে ধিক্কারে জর্জরিত করে খোকার মাথায় হাত দিইয়ে শপথ করালাম কোনওদিন আমার দিকে হাত বাড়াবে না।

ও মন্ত্রাহতের মতো করল সেই শপথ। প্রথম মদের নেশা ওকে আবেগে উত্তাল করে তুলেছিল, তাই যখন মোড় ঘুরল, তখন ভাল করেই ঘুরল।

তবু পরে বলেছিল, আর নমিতা, যদি তুমি নিজে না পারো?

ভুরু কুঁচকে বললাম, বটে? তা বেশ তো, তেমন অপারগ অবস্থা হয়, নিজে এসেই তোমার শরণ নেব।

আর আমি যদি শপথ না রাখতে পারি? আমি তো আজ মাতাল হয়েছি, মাতালের শপথের মূল্য কী?

মনে রেখো খোকার কল্যাণ অকল্যাণ এতে জড়িত।

ও চুপ করে গেল।

মনে হল যেন শিউরে উঠল।

আমি পরিস্থিতি হালকা করতে, প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলাম। বললাম, সাহেবদের ক্লাব থেকে তো বেশ ভাল জিনিসই খেয়ে এসেছ, সারাদিনের উপোসের পারণ হয়ে গেছে বোধহয়?

ও চমকে বলল, সারাদিন? ওঃ তাই তো! তুমিও খাওনি?

আমি ভাঙব তবু মচকাব না।

আমি আমার সেই ক্ষণিকের দুর্বলতার শোধ তুলব! তাই আমাকে বলতে হল, কেন আমি খাব না। কেন? ম্যানেজার সাহেবের স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করছি বলে কি সত্যিই হিন্দুবিবাহের পতিব্রতা-স্ত্রী হয়ে গেছি নাকি?

খেয়েছ? তবু ভাল। আমি মানে কিছু খাব না। হয়ে গেছে কিছু খাওয়া দাওয়া। রবার্ট সাহেবকে পাওয়া গেল, তারই আহ্লাদে খানাপিনা হল–

কোথায় পাওয়া গেল সাহেবকে, কৌতূহল হলেও, সে প্রশ্ন করলাম না আমি। আমার সারাদিনের উপবাসক্লিষ্ট দেহ ওর এই নির্লজ্জ স্বীকারোক্তিতে যেন দপ করে জ্বলে উঠল। তাই আবার বিষদাঁত বসালাম।

বললাম, বাঃ চমৎকার! একেই তো বলে পুরুষ! মেয়ে হলে স্বামী বিয়োগে বাকি সারাজীবন হবিষ্যি করে মরত! আর এ দেখ মাত্তর কাল জলজ্যান্ত বউটা হারিয়ে গেল, আর সাহেব আজ খানাপিনা করে টগবগ করতে করতে এলেন যদি আরও কিছু লোভনীয় খাদ্য জোটে এই আশায়।

ও বলল, নমিতা, জানতাম তুমি নিষ্ঠুর। কিন্তু এত নিষ্ঠুর তা জানতাম না।

প্রথম দিনের ইতিহাস এই। ও বলল, জানতাম না তুমি এত নিষ্ঠুর!

.

কিন্তু আমিই কি ছাই জানতাম আমি এত নিষ্ঠুর!

ও তো বারে বারেই ভেঙে পড়েছে, বারে বারে বলেছে, নমিতা, মুখের শপথটাই কি সব? তুমি কি বুঝতে পারছ না আমি আর পারছি না!

আমি খোকার মাথায় হাত দেবার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। অথচ প্রতি মুহূর্তে কামনা করেছি ও ওর শপথ ভাঙুক! ও বন্য হয়ে উঠুক, পশু হয়ে উঠুক। 

আমি জানি না কে আমার মধ্যে বসে থেকে আমাকে সমস্ত সুখের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করেছে। আমার তৃষ্ণার জলের পাত্র মুখের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছে।

সে কি দিদি?

না আমার আজন্মসঞ্চিত সংস্কার?

না কি বিবেক?

বিবেক-টিবেককে আমি বিশ্বাস করি না, মনে হয় দিদিই তার অশরীরী আত্মার ভার দিয়ে আমাকে গ্রাস করে রেখেছে চিরদিন। দিদির সেই চোখকে আমি কোনওদিন উপড়ে ফেলতে পারিনি।

সে চোখ অহরহ আমার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে পাহারা দিয়েছে। খোকাকে কোনওদিন এতটুকু অযত্ন করে ফেললে মনে হয় সেই চোখ ব্যঙ্গ হাসি হেসে বলছে, কেন? এখন কেন? খুব যে কেড়ে নিয়েছিলে?

আর যখন প্রিয়মাধবকে ফিরিয়ে দিই?

তখনও কেন সেই চোখ স্নিগ্ধ হয় না, কোমল হয় না? তখনও কেন আরও তীব্র ব্যঙ্গের ছুরি উঁচিয়ে বলে, সে কী? কেন? আর তো কোনও বাধা নেই। চিরদিনের সাধ মিটিয়ে নিচ্ছ না কেন?

হ্যাঁ ফিরিয়ে দিতে হত প্রিয়মাধবকে।

 প্রায় প্রতিদিনই।

রাত্রে শুতে যাবার আগে খোকাকে দেখবার ছুতোয় ও আমার ঘরে এসে আর উঠতে চাইত না, এটা ওটা কথায় সময়কে ঠেলে ঠেলে দিত। তারপর একটুখানি ভিখিরির হাসি হেসে বলত, ঘরটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।

বলত, পাশাপাশি ঘর, তবু এ ঘরটা এমন মোলায়েম গরম, আর ও ঘরটা অমন হিম হিম ঠাণ্ডা মনে হয় কেন বলো তো?

আমি খোকার জন্যে সোয়েটার টুপি কি মোজা বুনতে বুনতে নির্লিপ্ত গলায় বলতাম, ইচ্ছে হয় ঘরটা বদলে নিতে পারো। বলো তো কালই চাকরদের দিয়ে খাট বদলে নেব।

ও বলত, কী নিষ্ঠুর!

 তারপর বলত, আচ্ছা জগতে শুধু শপথই আছে, তার কাটান আর কিচ্ছু নেই?

আমি বলতাম, থাকবে না কেন? না মানলেই কাটান! পশুপক্ষী জন্তু জানোয়ারের তো আবার শপথেরও বালাই নেই।

হ্যাঁ, এইভাবে প্রতিনিয়ত অপমান করতাম ওকে। আমার সমস্ত ব্যর্থতা, সমস্ত যন্ত্রণা, সমস্ত ক্ষুধা, ওর উপরেই গিয়ে আছড়ে আছড়ে পড়ত পাথরের গায়ে নদীর ঢেউয়ের আছড়ানির মতো।

ধাক্কায় ধাক্কায় ক্রমশ বিকৃত হতে থাকল ও। ২৯৬

কিন্তু আমি?

যে আমি নমিতাও নই, সুমিতাও নই। হয়তো বা কিছুই নই।

আমি অবিকৃত থাকছি?

এখন যে আর ছেলের অসুখ করলে রাত জাগতে প্রিয়মাধবের সঙ্গে একসঙ্গে রাত জাগা চলবে না, একথা তো আমাকেই বলতে হবে?

ছেলের সূত্র ধরে ঘনিষ্ঠতার সীমারেখা লঙ্ঘন করতে এলে ওকে অপমান আমাকেই তো করতে হবে?

আর ও যখন হতভাগ্যের মতো আমার পায়ের কাছে বসে পড়ে বলবে, তোমায় তো আমি সুমিতা ছাড়া আর কিছু ভাবছি না নমিতা, তবে কেন তুমি এমন মুখ ফিরিয়ে থাকবে?

তখন তো আমাকেই বিদ্রুপের হাসি হেসে বলতে হবে, জীবনটা নাটকভেল নয়!

তবু নাটকনভেলের মতোই করেছে প্রিয়মাধব।

দিনের পর দিন আমার কাছে এসে আছড়ে পড়েছে, তুমি সুমিতা হও, তুমি সুমিতা হও, নমিতা! তুমি তো আমায় চিরদিন ভালবেসে এসেছ, আমি তো তোমার মন জানি, তবে এত দ্বিধা কেন তোমার? তোমার চিরদিনের অপূর্ণ জীবন পরিপূর্ণ করে তোলো তুমি সুমিতার পানপাত্রে।

আমি কি কেঁপে উঠতাম?

আমার শিরায় শিরায় রক্তধারা কি উন্মাদ হয়ে উঠত না? আমার কি মনে হত না, কী লাভ আমার এই মিথ্যা মর্যাদার ভানে? চিরদিন যে স্বর্গের দিকে জ্বালাভরা লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে এসেছি, সে স্বর্গ যদি হাতের মুঠোয় আসতে চায়, কেন নেব না আমি?…

মনে হত।

তবু আমার চিরদিনের অহমিকা আমার সেই ভোগের পাত্র ধরতে যাবার বাড়ানো হাত চেপে ধরত। আমি ব্যঙ্গ হাসি হেসে বলতাম, হ্যাঁ, সুমিতা দেবীর ফেলে দেওয়া পানপাত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *