৫০. রাষ্ট্রধর্ম

৫০. রাষ্ট্রধর্ম

বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী অশোক কুমার ঘোষ সংবিধান থেকে রাষ্ট্র ধর্ম বাদ দেওয়ার জন্য সরকারের লোকদের আইনী নোটিশ পাঠিয়েছিলেন। সেই আইনী নোটিশ পরদিনই ঘোষবাবুকে প্রত্যাহার করতে হয়েছে। দেশের অবস্থা বোঝার জন্য এর চেয়ে চমৎকার উদাহরণ আর কিছু নেই।

১৯৮৪ সাল থেকে রাষ্ট্রধর্ম থাকার বিরুদ্ধে আমি লিখছি, বলছি। তাতে ঘোড়ার ডিম হয়েছে। বরং আমার আত্মজীবনীর যে খণ্ডটিতে রাষ্ট্রধর্ম না থাকার পক্ষে আমি মত ব্যক্ত করেছিলাম, সেই খণ্ডটি পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার নিষিদ্ধ করেছে ২০০৩ সালে। এমনিতে কমিউনিস্টরা রাষ্ট্রধর্ম মানেন না, কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম যদি ইসলাম হয়, তাহলে তাঁদের আপত্তি নেই।

অশোক কুমার ঘোষ ব্যর্থ হয়েছেন, এক পা এগিয়ে দু’পা পিছিয়েছেন। কিন্তু আইনী নোটিশ পাঠাবার জন্য এক পা যে এগিয়েছিলেন অর্থাৎ যে সাহসী পদক্ষেপটি করেছিলেন, সেই পদক্ষেপটির জন্য তাঁকে কুর্ণিশ করি। কেন তিনি পরে নোটিশটি উইথড্র করেছেন? তিনি আসলে বাধ্য হয়েছেন করতে। তাঁর এই ব্যর্থতার দায় তাঁর নয়, এই ব্যর্থতার দায় তাঁর কপালপোড়া দেশটির।

৫১. সংশয়

কট্টর সুন্নি মুসলমানরা হিন্দুবিরোধী, ইহুদিবিরোধী, খ্রিস্টান বিরোধী, নাস্তিকবিরোধী, সুফিবিরোধী, শিয়াবিরোধী, আহমদিয়া বিরোধী, জোরোয়াস্ত্রিয়ান বিরোধী, বাহাই বিরোধী…..।

আর কট্টর হিন্দুরা মুসলমান বিরোধী, মুসলমান বিরোধী এবং মুসলমান বিরোধী।

হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান নাস্তিক আস্তিক লিবারেল কট্টর ইত্যাদি মিলিয়ে যে বাঙালি সমাজ—সেটিকে দেখতে পাই ফেসবুকে।

আর কিছুটা অবাঙালি ভারতবর্ষকে দেখি টুইটারে। ফেসবুকের তুলনায় টুইটার ভয়াবহ জায়গা। আমাকে হিন্দুত্ববাদীদের গালি খেতে হয় সকাল বিকাল। যা কিছুই বলি না কেন, তারা খোঁজে ভারত সম্পর্কে বা হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে তিল পরিমাণের হলেও কোনও কটাক্ষ করেছি কিনা। কটাক্ষ না করলেও তাদের কাছে মনে হতে থাকে এই বুঝি কটাক্ষ ওই বুঝি কটাক্ষ।

কাল কিছু মুসলমান তরুণ মানব বন্ধন করে একটি মন্দিরকে রক্ষা করতে চাইছে উন্মত্ত মুসলিমদের হাত থেকে—এই ছবিটি টুইটারে পোস্ট করার পর উথালপাথাল গালি শুরু হল হিন্দুদের। ওটা নাকি ফেইক নিউজ। বড় মিডিয়াগুলো ছাপিয়েছে, ভিডিওও বেরিয়েছে, ফেইক নিউজ নয়। কিন্তু কোনও মুসলমান যে মানবিক হতে পারে এ তারা বিশ্বাস করে না বলেই ওটি ফেইক নিউজ। কাল ব্যাঙ্গালোরের মুসলিম সন্ত্রাসের ঘটনা স্মরণ করে লিখেছিলাম রিলিজন ইজ দ্য রুট কজ অব রিলিজিয়াস টেরোরিজম। অমনি বন্যার জলের মতো গালি এসে ভেসে গেল আমার আঙিনা। দোষটা কী আমার? তারা ধরেই নিয়েছে ওই রিলিজন শব্দের মধ্যে হিন্দু ধর্ম আছে (যদিও তারা তাদের ধর্মকে ধর্ম বলে, রিলিজন বলে না। ধর্ম এবং রিলিজন যে আলাদা তাও বলে)। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম তোমরা কি রিলিজিয়াস টেরোরিজম করো? উত্তর এলো, না। প্রশ্ন, তাহলে কেন ভাবছ হিন্দু ধর্মের কথা বলা হয়েছে এখানে? যারা ধর্মীয় সন্ত্রাস করে, শুধু তাদের কথা বলা হয়েছে। কে শুনবে কার কথা? প্রধানমন্ত্রী এবং গৃহমন্ত্রীকে ট্যাগ করে আমার ভিসা বাতিল করার শত শত উপদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হল।

আজ টুইট করেছি ট্রাম্পকে নিয়ে। কমলা হারিসের নাগরিকত্ব নিয়ে ট্রাম্প সংশয় প্রকাশ করছেন, ঠিক যেমন ওবামার নাগরকিত্ব নিয়ে করেছিলেন।—এটিকে ট্রাম্পের বর্ণবাদী মানসিকতা বলে যে-ই না উল্লেখ করেছি, যেই না বলেছি ট্রাম্পের মা-ও তো ইমিগ্র্যান্ট ছিলেন, স্কটল্যান্ড থেকে আসা, তাহলে কি ইউরোপ থেকে মা বাবা এলে ঠিক আছে, শুধু এশিয়া আর আফ্রিকা থেকে এলেই ঠিক নেই? (ডেমোক্রেট পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী কমলা হারিসের মা ভারত থেকে, বাবা জামাইকা থেকে, কমলা জন্মেছেন আমেরিকাতেই।) ও মা, আমার দিকে ধেয়ে এল গালির তুফান। কমলা নাকি এন্টি ইন্ডিয়া। ট্রাম্পকে সাপোর্ট না করে কমলাকে ডিফেণ্ড করেছি কেন, নিশ্চয়ই আমি ভেতরে ভেতরে মুসলমান! আবারও ট্যাগ। আবারও একই উপদেশ, এর ভিসা বাতিল করো।

হিন্দুদের ইনসিকিউরিটি দেখি। দেখি আর বুঝে পাই না, কীভাবে এর আশু সমাধান হবে। যেভাবে হিন্দুদের মধ্যে বাস করে কিছু মুসলমান জ্বালাও পোড়াওয়ে মেতে ওঠে, এতে হিন্দুদের ঘৃণা আর বেড়ে যায়, রাগ আরও বেড়ে যায়, ইনসিকিউরিটিও আরও বেড়ে যায়। আমার ভয় হয় হিন্দু মুসলমানে আবার কোনদিন না রায়ট লেগে যায়। আমরা তো দেশভাগ না দেখলেও দেশভাগের ভয়াবহ রক্তপাত দেখেছি। ভয় হয়।

মাঝে মাঝে ভাবি ভাগই যখন হয়েছিল দেশ, তখন ঠিক ঠাক ভাগ হওয়াই হয়তো উচিত ছিল। সব মুসলমান পাকিস্তানে, সব হিন্দু ভারতে। সেক্যুলার ভারত কি সত্যিই সেক্যুলার ভারত? সেক্যুলার হলে মুসলিমদের জন্য ধর্মীয় আইন থাকতো না। সেক্যুলার হলে মন্দির মসজিদ ধর্ম টর্ম নিয়ে রাষ্ট্র মাথা ঘামাতো না। দেশভাগ হয়েছে ৭৩ বছর আগে, আজও ভারতে পাকিস্তানে, পাকিস্তান থেকে টুকরো হওয়া বাংলাদেশে, ধর্মটা কোনও ধর্ম নয়, স্রেফ রাজনীতি।

এ অঞ্চলের মুসলমানের প্রায় সকলেরই পূর্বপুরুষ/পূর্বনারী ভারতীয় হিন্দু। একই রক্ত বইছে দু’পক্ষের শরীরে। একই ভাষা আর সংস্কৃতি দু’পক্ষের। তাই হিন্দু-মুসলমানের বন্ধুত্বের আশা করেই যাচ্ছি নিরবধি। এ কি দেখা হবে আমার জীবনকালে? সংশয়।

৫২. রায়ট

ব্যাঙ্গালোরে ক্ষুব্ধ মুসলমানরা রাস্তায় বেরিয়ে গাড়ি টাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। কেন? কে নাকি ফেসবুকে শেষনবী মুহম্মদ সম্পর্কে কী লিখেছে। পুলিশ গুলি ছুঁড়লে তিন জন মারা গেছে। বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস না থাকলে মানুষ এভাবে জ্বালাও পোড়াও করে। আর পুলিশও পছন্দ না হলে গুলি ছোঁড়ে। দোষ কার? যে ফেসবুকে লিখেছে, নাকি যারা জ্বালাও পোড়াও করেছে, নাকি পুলিশের লোক যারা গুলি ছুঁড়েছে? আমি এসব নিয়ে গবেষণা করতে চাই না। এসব দেখতে দেখতে আমি অতিষ্ঠ। কয়েকবছর আগে বোরখা নিয়ে আমার একটি লেখা কর্ণাটকের লোকাল পত্রিকা রিপ্রিন্ট করার পর কর্ণাটকের দুটো শহরে রায়ট লেগেছেল, দু’জনের মৃত্যু হয়েছিল।

এই মৃত্যুগুলো বড় অহেতুক। এগুলো অসুখ বিসুখের মৃত্যু নয়, দুর্ঘটনার মৃত্যু নয়, এগুলো ডেকে আনা মৃত্যু। অনেকটা আত্মহত্যার মতো। যে কেউ যে কাউকে নিয়ে যা খুশী বলবে, তাতে তোমার কী এলো গেলো? আসলে মুশকিলটা হল ছোটবেলাতেই মানুষের মগজধোলাই হয়ে যায় এই মন্ত্র দিয়ে—’তোমার ধর্মের জন্য, তোমার রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য, যে দেশে তোমার জন্ম হয়েছে সেই দেশের জন্য প্রয়োজনে প্রাণ দেবে’। নিজের প্রাণের চেয়ে কিছুই যে বড় নয়, না ধর্ম না রাজনীতি না দেশ—তা তাদের বোঝাবে কে!

আজ নবী মুসাকে গালি দাও, ইহুদিরা কোথাও আগুন জ্বালাবে না, আজ নবী ঈসাকে গালি দাও, ক্রিশ্চানরা কোথাও আগুন জ্বালাবে না, কিন্তু শেষনবী নিয়েই ঝামেলা। আমি এখনও জানিনা দেবদেবীকে গালি দিলে কী ঘটনা ঘটবে।

কে কত সভ্য তা কী করে বুঝবো? তুমি কি সভ্য? তোমাকে আমি সভ্য বলবো তখন, যখন তোমার বিশ্বাসকে পায়ে মাড়িয়ে কেউ চলে যাবে, আর তাতে তোমার কিচ্ছু যাবে আসবে না।

৫৩. ভ্রাতৃত্ব

ব্যাঙ্গালোরের কংগ্রেস নেতা অখণ্ড শ্রীনিবাস মূর্তির ভাইপো নবীন লিখেছে ফেসবুকে শেষনবীকে নিয়ে। ক্ষুব্ধ মুসলিম রাস্তার গাড়ি তো পুড়িয়েইছে, অখণ্ডর বাড়িও পুড়িয়ে দিয়েছে।

কিন্তু সব মুসলিমই কি পুড়িয়েছে? না। কিছু মুসলিম হাতে হাত ধরে মানব বন্ধন তৈরি করেছে। কেন? একটি মন্দিরকে বাঁচানোর জন্য। উন্মত্ত মুসলিমরা যেন মন্দিরের কোনও ক্ষতি না করতে পারে।

মুসলিম মন্দির রক্ষা করবে, হিন্দু মসজিদ রক্ষা করবে। এই ভ্রাতৃত্ব বড় দরকার এ অঞ্চলে।

৫৪. নাস্তিকতা

কিছু নাস্তিক মনে করে আমি যেহেতু নাস্তিক, আমার দিন রাতের কাজ হল আল্লাহ ঈশ্বর ভগবান বলতে যে কিছু নেই, ধর্মগ্রন্থগুলো যে ফালতু, হাস্যকর, ভুলে ভর্তি—তা নিয়ে লেখা, তা নিয়ে বলা, তা নিয়ে মেতে থাকা। আমি সেটা কদাচিৎ করি। নাস্তিকতা প্রচার আমার মূল উদ্দেশ্য নয়। আমার মূল উদ্দেশ্য নারীর সমানাধিকারের জন্য, মানবাধিকারের জন্য, মানবতার জন্য, মত প্রকাশের অধিকারের জন্য, রাষ্ট্র আর ধর্মের পৃথকীকরণের জন্য, মানুষকে কুসংস্কারমুক্ত করার জন্য, বিজ্ঞানমনস্ক করার জন্য, নারী-পুরুষের সমানাধিকারের ভিত্তিতে আইন তৈরির জন্য, সমকামী-উভকামী-রূপান্তরকামী-উভলিঙ্গ-কুইয়ার যারাই নিপীড়িত তাদের অধিকারের জন্য, নিচুজাত-আদিবাসী-উপজাতি ইত্যাদি ট্যাগ লাগিয়ে যাদের অত্যাচার করা হয় তাদের অধিকারের জন্য, দারিদ্র দূরীকরণের জন্য, সমতার সমাজ নির্মাণের জন্য সরব হওয়া। এর ফলে কিছু মানুষও যদি সচেতন হয়, তাহলেই আমি সার্থক।

৫৫. নিষিদ্ধ মত

১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে যা ঘটেছিল, সে নিয়ে আমার দ্বিখণ্ডিত বইটির কয়েকটি পৃষ্ঠায় আমার মত প্রকাশ করেছিলাম, আমার মত পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের পছন্দ হয়নি। তারা আমার গোটা বইটিই নিষিদ্ধ করেছিল ২০০৩ সালে। ওই নিষিদ্ধ বইয়ের নিষিদ্ধ মত সেন্সরহীন অবস্থায় এখানে—

”রাস্ট্রপতি এরশাদ জনগণের এরশাদ হঠাও আন্দোলনের চাপে পারলৌকিক মুলো ঝুলিয়েছেন সামনে। সংবিধানে নতুন একটি জিনিস তিনি বলা নেই কওয়া নেই ঢুকিয়ে দিলেন, জিনিসটির নাম রাষ্ট্রধর্ম। এখন থেকে এ দেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। কেউ কি দাবি করেছে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা চাই? না কেউ করেনি। দেশে কি মুসলমানদের ধর্ম পালনে কিছু অসুবিধে হচ্ছিল যে রাষ্ট্রধর্ম না হলে তাদের আর চলছিল না? তাও নয়, খুব চলছিল, বেশ চলছিল। বহাল তবিয়তেই ছিল মুসলমানরা। মসজিদ মাদ্রাসা গড়ে গড়ে দেশের বারোটাই বাজাচ্ছিল, যেখানে সেখানে যখন তখন গজাচ্ছিল লোক ঠকানোর পীর, এখন এরশাদ নিজেই ধর্মের ঢোল নিয়ে মাঠে নেমে পড়লেন। নাচুনে বুড়োদের তাল দিচ্ছেন বেশ। রাষ্ট্রের কি কোনও ধর্মের প্রয়োজন হয়! মানুষের না হয় হয়, কিন্তু রাষ্ট্র কি কোনও মানুষ! রাষ্ট্র তো সব ধর্মের সব সংস্কৃতির সব ভাষার মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। রাষ্ট্র যদি নিরপেক্ষ না হয়, রাষ্ট্র যদি অনেকগুলো সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সম্প্রদায়ের পক্ষ নেয়, তবে সেই রাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে বিরোধ আর বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। হতে বাধ্য।

অমুসলমানরা এ দেশে নিরাপত্তার অভাবে ভুগবে, ভুগতে বাধ্য। সভ্যতার দিকে যেতে হলে যে প্রথম পদক্ষেপটি গ্রহণ করতে হয়, তা রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করা। সভ্য দেশগুলোয় তাই হয়েছে। যে যুগে ধর্ম ছিল রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র, সে যুগকে বলা হয় অন্ধকার যুগ। অন্ধকার যুগে শত শত মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হত। অন্ধকার যুগে মানুষের বাকস্বাধীনতা বলে কিছু ছিল না। আমার আশঙ্কা হয় এই দেশটি ধীরে ধীরে অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে। আমার আশঙ্কা হয় ধর্ম নামের কালব্যাধির যে জীবাণু ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এতে ভীষণ রকম আক্রান্ত হতে যাচ্ছে দেশের মানুষ। এরশাদ নিজের গদি বাঁচাতে নানারকম ছলচাতুরীর আশ্রয় নিচ্ছেন, সংসদ বাতিল করে নির্বাচন করলেন, কোনও বড় দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি যেহেতু, ছোট কিছু দল আর সতন্ত্র কিছু লোক নিয়েই লোক ভুলোনো নির্বাচনের খেলা সারলেন। খেলায় জিতে দেখাতে চাইলেন তাঁর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা কিছুমাত্র অবৈধ নয়। কিন্তু তাঁর এই টোপ কেউ গিলছে না। ক্ষমতার লোভ এমনই লোভ যে আন্দোলনের ভূমিকম্প যখন তার গদি নাড়িয়ে দিচ্ছে, খুঁটি আঁকড়ে ধরার মত করে তিনি রাষ্ট্রধর্ম আঁকড়ে ধরলেন। জনগণের নাকের ওপর পারলৌকিক মুলোটি ঝুলিয়ে দিলেন। এবার যাবে কোথায় ধর্মভীরুর দল! বিরোধী দলগুলো জোট বেঁধেছে, নানারকম সাংস্কৃতিক দলও জোট বেঁধেছে শহরে গ্রামে সবখানে। এরশাদ-বিরোধী রাজনৈতিক জোট থেকে রাষ্ট্রধর্ম বিষয়ে খুব যে কথা বলা হচ্ছে, তা নয়। কারণ ইসলাম যদি কোথাও এসে বসে, সে বসা অবৈধ হোক, একে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করার বুকের পাটা সবার থাকে না। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক দলগুলো থেকে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর। হাতে গোণা কিছু সাহিত্যিক সাংবাদিক রাষ্ট্রধর্মের বিরুদ্ধে লেখালেখি করছেন, এটুকুই। এর বেশি উচ্চবাচ্য নেই।

একাত্তরে বাঙালি মুসলমান অত্যাচারী অবাঙালি মুসলমান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রমাণ করেছে মুসলমান হলেই এক সঙ্গে বাস করা যায় না। একাত্তরে বাঙালিরা প্রমাণ করেছে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতভাগ ছিল সম্পূর্ণ ভুল একটি সিদ্ধান্ত। একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া বাঙালির স্বপ্ন ছিল অবাঙালি মুসলমানদের বিদেয় করে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভালোবেসে বাংলা নামের একটি দেশ গড়ে তোলা। দীর্ঘ ন মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীন একটি দেশ জুটল। শেখ মুজিবুর রহমান দেশ চালাতে শুরু করলেন। একশ একটা ভুল তাঁর থাকতে পারে, নেতা হিসেবে তিনি অসম্ভব জনপ্রিয় হলেও রাষ্ট্রপরিচালনায় তাঁর হাত কাঁচা হতে পারে, কিন্তু বলিষ্ঠ একটি সংবিধান তৈরি করেছিলেন, যে সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর সমাজতন্ত্র সহ ধর্মনিরপেক্ষতা স্থান পেয়েছিল। কোথায় সেই ধর্মনিরপেক্ষতা এখন! কোত্থেকে কোন এক মেজর জিয়া এসে ক্ষমতা দখল করে কোনও কারণ নেই কিছু নেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে ঘাড় ধরে বিদেয় করে দিলেন। জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরও এক সেনানায়ক একটি চরম অন্যায় করলেন সংশোধনের নামে সংবিধানে একটি কালসাপ ঢুকিয়ে দিয়ে। হা কপাল! দেশের কপালে এই ছিল! বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি! এই গান গাওয়ার মতো আর বুঝি কোনও মঞ্চ রইল না। জুন মাসের সাত তারিখ, ১৯৮৮ সাল, বাংলার ইতিহাসে একটি কালি মাখা দিন। চমৎকার একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ার সম্ভাবনাকে গলা টিপে হত্যা করার দিন। অনেকটা সামনে এসে বিস্তর অর্জন করে পেছনে শূন্যতার দিকে ফেরার দিন, অসত্য অন্যায় অবিচার আর অন্ধকারের দিকে ফেরার দিন। এক দুই বছর পেছনে নয়, হাজার বছর পিছিয়ে যাবার দিন।

এ সময় শেখ হাসিনাই হতে পারেন সহায়। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছেন একাশি সালে, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়েছেন। ফিরে আসার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষ, যারা জিয়াউর রহমানের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন তিনি স্বাধীনতার শত্রুদের এমনকি গোলাম আযমের মতো একাত্তরের গণহত্যাকারীকে দেশে ঢোকার অনুমতি এবং অবৈধ ধর্মীয় রাজনীতিকে বৈধতা দিয়েছিলেন বলে, সংবিধানে বিসমিল্লাহ যোগ করা, ধর্ম নিরপেক্ষতা তুলে দেওয়া এসব দুষ্কর্ম তো আছেই—শেখ হাসিনার ওপর ভরসা করলেন। কিন্তু এই হাসিনাই এরশাদের ফাঁদে পা দিয়ে জামাতে ইসলামিকে নিয়ে নির্বাচনে যোগ দিলেন ছিয়াশি সালে। খালেদা জিয়া কিন্তু এরশাদের টোপ মোটেও গেলেননি। এরশাদ নিজের ক্ষমতাকে বৈধ করার জন্য নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন, তা বুঝে হাসিনা শেষপর্যন্ত সংসদ বর্জন করলেন কিন্তু জামাতে ইসলামির মতো দলের সঙ্গে ভিড়ে যে কালিটি তিনি লাগিয়েছেন গায়ে, তা খুব সহজে দূর হবে না। তারপরও প্রগতিশীল মানুষের আশা তিনি ক্ষমতায় এলে তাঁর বাবার আদর্শে সংবিধানের হারিয়ে যাওয়া সম্পদ আবার পুনরুদ্ধার করতে পারেন। কিন্তু আপাতত এরশাদ বিরোধী জোটকে সমর্থন করা যাক, জোটের আন্দোলন যেন দুশ্চরিত্র স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাতে পারে। সাত বছর আগে ক্ষমতা দখল করেছে ব্যাটা, আজও ছাড়ার নাম নেই। দেশের লোক চাইছে না তাকে, তাতে কী আসে যায়, আমার কাছে অস্ত্র আছে, ধর্ম আছে, আমি এগুলোর ভয় দেখিয়ে দেখিয়ে গদিতে বসে আয়েশ করব।

কোনও রাজনৈতিক দলের আমি কোনও সদস্য নই, তবু এ মুহূর্তে দুর্যোগের দিন পার হয়ে একটি সুন্দর আগামীর দিকে যাবে বলে যারা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তাঁদের ওপর বিশ্বাস রেখে একটি সম্ভাবনার অঙ্কুরের গোড়ায় আমি জল সার দিই।

এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে রাজনৈতিক জোটের সভা চলছে, মিছিলে কাঁপছে নগরী। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক ছাত্রছাত্রী সংগঠনও বড় ভূমিকা পালন করছে এই আন্দোলনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিলের ওপর ট্রাক চালিয়ে দিয়ে অনেককে হত্যা করেছে এরশাদের পুলিশবহিনী। এখনও রক্তের দাগ মোছেনি ওই এলাকা থেকে। সাংস্কৃতিক জোটও নিরলস অনুষ্ঠান করে যাচ্ছে বিক্ষোভের, প্রতিবাদের। গাঢ় অন্ধকারে নিরাশার খরস্রোতা নদীতে সাঁতরে সাঁতরে আশার একটি ক্ষীণ আলোর দিকে যেতে থাকি। এই আলো কি সত্যিই আলো, নাকি মরীচিকা! যতীন সরকার আগামীর দিকে তাকিয়ে আছেন, সমাজতান্ত্রিক দল ক্ষমতায় এলে, তাঁর বিশ্বাস, এরশাদের এই পারলৌকিক মুলোকে পরলোকে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু কবে ক্ষমতায় আসবে ওই দল! দলটি জামাতে ইসলামির চেয়েও দিনে দিনে ছোট আকার ধারণ করেছে। কমরেড ফরহাদ মারা গেলে বিশাল জানাজার আয়োজন হল ইসলামি নিয়মে। কমিউনিস্টরাই যদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে, হোক না সে লোক দেখানো, বেরোতে না পারে, তবে বাকি দলগুলো কী করে বেরোবে! ধর্ম এমনই এক সর্বনাশা জিনিস, এটিকে না মানো ক্ষতি নেই, কিন্তু এটিকে দূর করতে গেলেই গোল বাঁধে। অশিক্ষা আর অজ্ঞানতার কারণে মানুষের ভেতরে একটি অন্ধবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে। এই বিশ্বাস কোনও যুক্তি মানে না। মুক্তবুদ্ধিকে পরোয়া করে না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে যদি বিদেয় না করা হয়, তবে দেশটি হয়তো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হতে সময় নেবে না। ধর্ম হল কর্কট রোগের মতো, একবার পেয়ে বসলে একের পর এক ধ্বংস করতে থাকে হাতের কাছে যা পায় তা-ই। এর কোনও নিরাময় নেই। সুস্থতার দিকে কিছুতে মুখ ফেরাতে দেয় না এই রোগ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের কারণে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ধর্ম বিশ্বাসী মানুষকে অথবা ধর্মে বিশ্বাস না করলেও যারা ওই ধর্মাবলম্বীদের সন্তান, তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকতে হবে। কেউ যদি ইসলামের প্রেরণায় আল্লাহর আদেশ পালন করে সাচ্চা মুসলমান হতে চায়, তবে পবিত্র গ্রন্থ কোরান থেকে খুব সহজেই দীক্ষা নিতে পারে যেখানে লেখা ইহুদি আর খিস্টানদের সঙ্গে অর্থাৎ বিধর্মীদের সঙ্গে কোনওরকম বন্ধুত্ব না করার, করলে তাদেরও আল্লাহ ওই বিধর্মীদের সঙ্গে দোযখের আগুনে নিক্ষেপ করবেন। কেবল এই নয়, যেখানে বিধর্মী পাও, ধ্বংস কর, খতম কর। যেখানেই অবিশ্বাসী পাও, কেটে ফেলো এক কোপে বাম হাত আর ডান পা, আরেক কোপে ডান হাত আর বাম পা। মুসলমানরাই যে খুব সুখে থাকবে তা নয়। মেয়েদের ওপর চলবে ধর্মের বুলডোজার। বুলডোজারের তলায় পড়ে মেয়েরা আর মেয়ে থাকবে না, খণ্ড খণ্ড মাংসপিণ্ডে পরিণত হবে।

কিছুতেই আমি মেনে নিতে পারি না ধর্ম কোনও আলো এনেছিল কোনও কালে। অন্ধকার ছাড়া আর কিছু পৃথিবীতে ছড়ায়নি ধর্ম। মানুষের অজ্ঞানতা আর মৃত্যুভয় থেকে জন্ম নিয়েছে ধর্ম। একেশ্বরবাদী পুরুষেরা ধর্ম তৈরি করেছে তাদের আনন্দের জন্য, ইহলৌকিক সুখভোগের জন্য। ইসলামের ইতিহাস বলছে আরবের লোকেরা গুহায় বাস করত, কন্যা জন্ম নিলে জীবন্ত কবর দিত আর সেই দুরবস্থার অবসান ঘটিয়েছেন মোহাম্মদ। দুরবস্থা, আমার যা বিশ্বাস, আগের চেয়ে বেশি এসেছে ইসলাম আসার পর। আগে মেয়েরা বাণিজ্য করত, যুদ্ধে অংশ নিত, নিজের পছন্দমতো বিয়ে করত, তালাকও দিত স্বামীদের। মোহাম্মদের প্রথম স্ত্রী খাদিজা ব্যবসায়ী ছিলেন, মোহাম্মদ ছিলেন তাঁর তিন নম্বর স্বামী, বয়সেও তাঁর অনেক ছোট ছিলেন। মেয়েদের জ্যান্ত পুঁতে ফেললে তো মেয়ের সংখ্যা কম হওয়ার কথা। এই যে এত গুলো বিয়ে করত পুরুষেরা, এত মেয়ে কোথায় পেত তবে! মেয়ে পুঁতে ফেললে তো মেয়ের অভাব হওয়ার কথা। তা কিন্তু হয়নি। আরবের লোকেরা স্ফূর্তিতে আমোদে দিন কাটাতো, খেতো, পান করত, বিশ্বাস করত এই জীবনের পরে আর কোনও জীবন নেই, এই জীবনেই যত আনন্দ আছে করে নিত। এই বিশ্বাসের ওপর ধ্বস নামালেন মোহাম্মদ। নিজের সৃষ্ট এই ধর্মকে ক্ষমতা দখল করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন তিনি। নির্দ্বিধায় মানুষ খুন করে, ভিন্ন গোত্রের লোকদের রক্তে স্নান করে, ভিন্ন ধর্মের মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে, ইহুদি এলাকায় নিজের সৈন্য নামিয়ে দিয়ে তাদের সম্পদ লুঠ করে মেয়েদের ধর্ষণ করে তিনি বিজয় নিশান উড়িয়ে দিলেন। এই ধর্ম কখনও তাঁর আধ্যাত্মিক ব্যাপার ছিল না, ছিল প্রথম থেকে শেষ অবদি, রাজনৈতিক। ইহলৌকিক কোনও আনন্দ থেকে নিজেকে তিনি বঞ্চিত করেনি। যখন যা ইচ্ছে হয়েছে, করেছেন। দোহাই দিয়েছেন আল্লাহর। কাউকে খুন করে এসে বলেছেন আল্লাহ তাঁকে খুন করতে বলেছেন, তাই করেছেন। আল্লাহর আদেশের ওপর যে কোনও কথা বলা যাবে না তা আগে ভাগেই অবশ্য বলে রেখেছিলেন। হারেমের এক ডজনেরও বেশি স্ত্রীর সঙ্গে কাটানোর জন্য মোহাম্মদ রাত ভাগ করে নিয়েছিলেন। স্ত্রী হাফসার সঙ্গে যে রাতটি তাঁর কাটাবার কথা, সেদিন তিনি একটি কাণ্ড ঘটিয়েছিলে। সে দিন হাফসা বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগে বাড়ি ফিরে দেখেন শোবার ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বন্ধ কেন? ঘরে কে? ঘরে তাঁর পয়গম্বর স্বামী, আল্লাহর পেয়ারা নবী, মোহাম্মদ, মারিয়া নামের এক ক্রীতদাসীর সঙ্গে সম্ভোগে রত। হাফসা রেগে আগুন হয়ে হারেমের বাকি বউদের এ কথা জানিয়ে দিলেন। নিজের দোষ ঢাকতে মোহাম্মদ আকাশ থেকে আল্লাহকে নামালেন, বললেন, এ তাঁর নিজের ইচ্ছেয় ঘটেনি, ঘটেছে আল্লাহর ইচ্ছেয়, আল্লাহর হুকুম তিনি পালন করেছেন, এর বেশি কিছু নয়। বাংলায় একটি কথা আছে, চুরি আবার সিনা জুড়ি। ব্যাপারটি এরকমই। দোষ করার পর কোথায় একটু নতমস্তকে দাঁড়িয়ে নম্রস্বরে কথা বলবেন স্ত্রীদের সঙ্গে, তা নয়, বরং উঁচু গলায় সাবধান বাণী দিয়ে দিলেন সঙ্গে সঙ্গে, আল্লাহ নাকি তাঁকে বলেছেন, ‘যদি তুমি তোমার কোনও স্ত্রীকে তালাক দাও, তবে আল্লাহ তোমার জন্য আরও সুন্দরী, আরও সহনশীল, আরও পবিত্র, আরও নত, আরও লজ্জাবতী, আরও বিশ্বস্ত কুমারী বা বিধবা মেয়ে দেবেন বিয়ে করার জন্য।’ নিজের ছেলের বউ জয়নবকে বিয়ে করেও মোহাম্মদ তাঁর অপকর্মকে জায়েজ করেছেন আল্লাহর ওহি নাজেল করে, আল্লাহ নাকি তাঁকে বলেছেন তাঁর ছেলের বউকে বিয়ে করার জন্য। মোহাম্মদের অল্পবয়সী সুন্দরী এবং বিচক্ষণ স্ত্রী আয়শা চমৎকার একটি কথা বলেছিল, বলেছিল, ‘তোমার প্রভুটি তোমার সব শখ মেটাতে দেখি খুব দ্রুত এগিয়ে আসেন।’ এই আয়শার দিকে তাঁর বন্ধুরা তাকাতো বলে হিংসেয় জ্বলে পুড়ে নিজের স্ত্রীদের পর্দার আড়াল করলেন, এরপর ধীরে ধীরে সব মুসলিম মেয়ের শরীরে বাড়তি কাপড় ঝুলিয়ে দেওয়ার আইন করলেন। ইসলাম নাকি মেয়েদের মর্যাদা দিয়েছে খুব। এই হল মর্যাদার নমুনা। আল্লাহর গমগমে আওয়াজ ভেসে আসে সাত আসমানের ওপর থেকে, ‘পুরুষের অধিকার আছে নারীর ওপর আধিপত্য করার, কারণ আল্লাহ পুরুষকে নারীর চেয়ে উন্নততর মানুষ হিসেবে তৈরি করা করেছেন এবং পুরুষ তার ধন সম্পদ ব্যয় করে।’

কী বলব, এই হল আমাদের পয়গম্বর ব্যাটার চরিত্র, আর তার জোব্বার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আল্লাহ নামের ধোঁকা। এই ইসলামকে পৃথিবীর কোটি কোটি বুদ্ধু আজও টিকিয়ে রাখছে, এর পেছনে আর কিছু না, আছে রাজনীতির খেলা।

‘বাংলাদেশের অবস্থাও তথৈবচ। তরী ডুবছে এরশাদের তাই উপায়ান্তর না দেখে ইসলামকে আঁকড়ে ধরে তিনি কূলে ভিড়তে চাইছেন।’

৫৬. যদি

যদি বাংলাদেশের মুসলমানদের বলি—

‘তোমাদের এত যে বিজ্ঞানমনস্ক করতে চাইতাছি, হইবা না, নামাজ রোজা যখন করবাই করো, মসজিদ বানাইবাই যখন বানাও, এমনকি রাষ্ট্রকেও যদি ইসলামিক রাষ্ট্র বানাইয়া ফেল, তাইলেও হিন্দুদের মাইরো না, লক্ষ রাইখো নানান গোষ্ঠী বর্ণ জাত ধর্ম সংস্কৃতির মানুষ যেন শান্তিতে সেই রাষ্ট্রে বাস করতে পারে’।

যদি ভারতের হিন্দুদের বলি—

‘তোমাদের এত যে বিজ্ঞানমনস্ক করতে চাইতাছি, হইবা না, পূজা আচ্চা যখন করবাই করো, মন্দির বানাইবাই যখন বানাও, এমনকি রাষ্ট্রকেও যদি হিন্দুরাষ্ট্র বানাইয়া ফেল, তাইলেও মুসলমানদের মাইরো না, লক্ষ রাইখো নানান গোষ্ঠী বর্ণ জাত ধর্ম সংস্কৃতির মানুষ যেন শান্তিতে সেই রাষ্ট্রে বাস করতে পারে’।

ওপরের দুইটা লেখা পড়লে কি রাগ ওঠে? কার ওপর রাগ ওঠে, লেখকের ওপর, সিস্টেমের ওপর নাকি সরকারের ওপর? যদি কারও ওপর রাগ না ওঠে তাইলে সমস্যা। যদি দুইটার মধ্যে একটার জন্য রাগ ওঠে আরেকটার জন্য ওঠে না, তাইলেও সমস্যা।

৫৭. গির্জা

যেদিন অযোধ্যার রায় বেরোলো, ২০১৯-এর ৯ নভেম্বরে, সেদিনই লিখেছিলাম ”আমি যদি বিচারক হতাম, তাহলে ২.৭৭ একর জমি সরকারকে দিয়ে দিতাম আধুনিক বিজ্ঞান স্কুল বানানোর জন্য, যে স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা ফ্রি পড়তে পারবে। আর ৫ একর জমিও সরকারকে দিয়ে দিতাম আধুনিক হাসপাতাল বানানোর জন্য, যে হাসপাতালে রোগীরা বিনে পয়সায় চিকিৎসা পাবে”। আমার এই মতের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে, আগামী ১০০০ বছরে সম্ভব নয় ধর্মীয় উপাসনালয়ের জায়গায় অন্য কিছু নির্মাণ করা। কেউ কেউ বলেছে, স্কুল, একাডেমি, গবেষণাগার, হাসপাতাল, ফুলের বাগান এগুলো বানানোর জায়গার কি অভাব পড়েছে? তা ঠিক, অভাব পড়েনি। তাই ২.৭৭ একর জমিতে মন্দির হতে যাচ্ছে, আর ৫ একর জমিতে হতে যাচ্ছে মসজিদ। মানুষ প্রার্থনা করবে অলৌকিক ঈশ্বরের কাছে, যে ঈশ্বরের অস্তিত্বের আজও কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

উত্তর-ইউরোপের গির্জাগুলো দেখলে চমকিত হই। খালি পড়ে থাকে বছর ভর। রোববারে হাতে গোণা কয়েকজন আসে কী আসে না। গির্জা চলে পযটকদের জন্য। ওরাই শিল্প স্থাপত্য দেখতে আসে। উপাসনালয়গুলো ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে জাদুঘরে। আমাদের অঞ্চলের উপাসনালয়গুলোয় হয়তো একদিন ভিড় কমতে থাকবে। মানুষ ব্যস্ত থাকবে মানুষের সেবায়। সেবাই তো সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপাসনা।

৫৮. নিলয় নীল

পাঁচ বছর আগে আগস্ট মাসের সাত তারিখে, এই দিনে, এরকম দুপুরবেলায় বাংলাদেশের নাস্তিক ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় নীলের ঢাকার ফ্ল্যাটে চার পাঁচ জন মুসলিম সন্ত্রাসী ঢুকে ওকে কুপিয়ে মেরেছিল। নিজের রক্তের ওপর নিথর পড়ে ছিল আমাদের নিলয়। ২০১৫ সালটা ছিল ভয়াবহ। এক এক করে খুন করা হচ্ছিল নাস্তিক ব্লগারদের। অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয়। তারপর নিলয় নীল। পুলিশকে নিলয় জানিয়েছিলেন তিনি নিরাপত্তার অভাব অনুভব করছেন, কারণ তিনি লক্ষ করেছেন কিছু লোক তাঁকে অনুসরণ করছে। এরপরও পুলিশ নিলয়ের জন্য নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা করেনি। নিলয় দর্শনে মাস্টারস করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, তুখোড় মেধাবী এবং বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ ধর্ম বিষয়ে বুদ্ধিদীপ্ত ব্লগ লিখতেন। দুনিয়ার সব ধর্মেরই সমালোচক ছিলেন, কিন্তু একটি ধর্মের সন্ত্রাসীরাই তাঁকে আর বাঁচতে দেয়নি। খুনীদের কি শাস্তি হয়েছিল? না, আজ পর্যন্ত নাস্তিক ব্লগারদের একটি খুনীকেও শাস্তি দেওয়া হয়নি। সরকারের অশেষ কৃপায় তারা নিশ্চয়ই এখন নিরাপদে নিশ্চিন্তে আর বহাল তবিয়তে আছে।

এই আমার সোনার বাংলাদেশ। সোনার ছেলেরা মৃত। দু’একজন ছাড়া কোনও বুদ্ধিজীবীই প্রতিবাদ করেননি ওই সব বীভৎস হত্যাকাণ্ডের। জনগণ ব্লগারদের দোষ দিয়েছিল, ইসলামের সমালোচনা করা ব্লগারদের নাকি উচিত হয়নি, দোষ খুনীর নয়, দোষ নাকি সমালোচনার। ইসলাম নিয়ে প্রশ্ন করলে নৃশংসভাবে খুন হয়ে যেতে হবে, যাওয়া উচিত—অধিকাংশ মানুষের এমনই বিশ্বাস।

মনে আছে ২০১৫ সাল জুড়ে কী ভীষণ উদ্বিগ্ন আমি, দিন রাত ঘুম নেই। অভিজিৎ আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু ছিল, ওয়াশিকুর ছিল আমার ফেসবুকের বন্ধু, অনন্ত ছিল সমমনা যুক্তিবাদী। তখন প্রতিদিন ব্লগ লিখছি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে, আর বাকস্বাধীনতার পক্ষে চিৎকার করে। আমার ফ্রি থট ব্লগ থেকে ইউরোপ আমেরিকার মুক্তচিন্তক-নাস্তিক মানুষেরা জানতে পারছেন কী ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চলছে বাংলাদেশে। তাঁরাও পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরাও উদ্বিগ্ন। আবেদন করছি বিভিন্ন সংগঠনের কাছে যেন তারা বাংলাদেশের নাস্তিক ব্লগারদের জীবন বাঁচানোর জন্য যা করা দরকার করে। সে বছর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাখারভ পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে দু’দুবার আমি আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম পার্লামেন্টে বক্তৃতা করার জন্য, শুধু তাই নয়, বেলজিয়ামের সেনেট, ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয় এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো বরাবরের মতো আমন্ত্রণ জানিয়েছিল আমাকে সেমিনারে, লেকচারে; প্রতিটি প্লাটফর্ম আমি ব্যবহার করেছি বাংলাদেশের নাস্তিক ব্লগারদের জীবন বাঁচানোর জন্য আবেদন করে, যেন ব্লগারদের বাংলাদেশ থেকে বের করে ইউরোপ-আমেরিকায় নিয়ে আসা হয়। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট এবং সদস্যদের সঙ্গে দিনভর বাইল্যাটারাল মিটিংও করেছি ও নিয়ে। যে সংস্থাগুলো ব্লগারদের ইউরোপে আশ্রয় দিয়েছে, নিরাপদ জীবন দিয়েছে, সেই সংস্থাগুলোর ফাণ্ড ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট থেকে যায়। কী স্বস্তি যে পেয়েছি নাস্তিক ব্লগাররা যখন নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে গেছেন, যে দূরত্বে গেলে ইসলামি সন্ত্রাসীদের হাত তাঁদের নাগাল পায় না। আমি সামান্য মানুষ। ক্ষমতাবান নই, প্রভাবশালী নই। আমার ওই চেষ্টার ফলে কতটুকু কী হয়েছে হিসেব করে দেখিনি। তবে আমার ওই যে ঝাঁপিয়ে পড়া, যে মানুষগুলোর পাশে দেশের কেউ দাঁড়াচ্ছে না, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের মূল্যবান জীবনকে বাঁচানোর জন্য যে মরিয়া হয়ে ওঠা—এরকম দিন এলে মনে পড়ে সেসব।

মাঝে মাঝে লক্ষ করি বিদেশের নিরাপদ জীবনে বসে কিছু ব্লগার আমার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন। তা করুন। বাকস্বাধীনতার জন্য লড়াই যখন করি, তাঁদের বিষোদ্গার করার স্বাধীনতার জন্যও লড়াই করি। তাঁরা নিরাপদে আছেন, এ ভেবেই আমি সুখী। শুধু আফসোস, নিলয় নীলের জন্য কিছুই করতে পারিনি। পুলিশ যদি নিরাপত্তা দিত, তাহলে হয়তো বেঁচে যেতেন নিলয়। প্রতিভাবান মুক্তচিন্তককে অকালে আমাদের হারাতে হত না। কিন্তু পুলিশ বাহিনী তো কোনও নাস্তিকের জন্যই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেনি। পর পর আরও ক’জন নাস্তিককে হত্যা করা হয়েছে। তাঁদের রক্তের ওপর ইসলামের বিজয় নিশান সেই যে ওড়ানো হয়েছে, এখনও উড়ছে সেই নিশান। আমার সোনার বাংলার নিশান!

৫৯. দেওয়ালে পিঠ

ধর্মান্ধ বদগুলো যেমন তক্কে তক্কে থাকে আমার স্খলন কিছু হল কিনা দেখার জন্য, যেন খপ করে ধরে দামামা বাজিয়ে আমার আরও কিছু সর্বনাশ করতে পারে, তেমন সেক্যুলার নামধারী কিছু হিন্দু-মুসলমানও একই মতলব নিয়ে তক্কে তক্কে থাকে। এরকম কিছু গতকাল ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমার পোস্টের ওপর। কী পেয়েছে তারা? ‘কম্প্রোমাইজ’। তসলিমা কম্প্রোমাইজ করে না বলেই লোকে জানে, এই জানাটাকে যদি গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়, তবেই না আনন্দ! দুদিন আগে তসলিমা যুক্তিবাদ আর নাস্তিকতার পক্ষে পোস্ট দিয়েছে, তার আগের দিন ধর্মের রূপকথাকে নস্যাৎ করে। আজ তসলিমা ‘সাম্প্রদায়িক’! যারা অভিযোগ করছে তারা নিশ্চয়ই আমার চেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক, আমার চেয়েও বড় সেক্যুলার, বা আমার চেয়েও বড় নাস্তিক, আমার চেয়েও বড় মানববাদী, আমার চেয়ে বেশি ভুগেছে নিজের মতবাদের জন্য, সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে আমার চেয়ে বেশি বই লিখেছে, আমার চেয়েও বেশি ফতোয়ার শিকার তারা, তাদের মাথার দাম আমার মাথার দামের চেয়ে বেশি, আমার চেয়েও বেশি তারা গৃহহীন, দেশহীন, আমার চেয়েও বেশি নিষিদ্ধ!!

এরাই তো বলে লজ্জা লিখে বিজেপির কাছ থেকে টাকা পেয়েছি, যেন লজ্জা লেখার আর কোনও কারণ ছিল না, যেন ভয়ানক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর হিন্দুদের দেশত্যাগ যথেষ্ট কারণ নয় লজ্জা লেখার জন্য! এরা বিশ্বাসই করতে পারে না স্বার্থের জন্য নয়, আদর্শের জন্য কেউ কেউ জীবন বাজি রাখতে পারে। মুসলিম মৌলবাদীরা আমার মাথার দাম ঘোষণা করলে এরাই তো দূর থেকে সার্কাস দেখে, প্রতিবাদের একটি শব্দও উচ্চারণ করে না। যখন দেখে বিজেপি ক্ষমতায় এসে আমার এক বছরের ভিসার মেয়াদ কমিয়ে দু’মাস বা তিন মাস করে, তখন কি এরা নিন্দে করে বিজেপির তসলিমা-বিরোধিতার? না। যখন করভাচৌত, সিঁদুর খেলা, রাখি নিয়ে প্রশ্ন করে, ভাইফোঁটার মতো বোনফোঁটা উদ্যাপন করার কথা বলে, মনুসংহিতার সমালোচনা করে, সতীদাহের নিন্দে করে, যখন রামদেব, সত্য সাঁই বা বাবাদের নিয়ে সংশয় প্রকাশ ক’রে, অযোধ্যার রামমন্দিরের জায়গায় বিজ্ঞান স্কুলের এবং মসজিদের জায়গায় আধুনিক হাসপাতালের প্রস্তাব দিয়ে প্রচণ্ড আক্রান্ত হই কট্টর হিন্দু দ্বারা, তখনও আমাদের ‘সেক্যুলার হিন্দু-মুসলমান’ চোখ নাচিয়ে সার্কাস দেখে।

মসজিদ বানানো হলে কটা ‘সেক্যুলার হিন্দু মুসলমান’ প্রতিবাদ করে? নিশ্চয়ই একটিও না। তাহলে হিন্দুরা তাদের মন্দির বানালে এত গেল গেল রব কেন? হিন্দুদের মহাসমারোহে মন্দির বানানো, ধর্মান্ধ হওয়া, মুসলিম-বিরোধিতা সবই এই সময়ের বাস্তবতা। ভুলে গেলে চলবে না এই উপমহাদেশ হিন্দু মুসলমান পরস্পরকে কচুকাটা করে দেশভাগ করেছে। দশ লক্ষ মানুষের রক্তের ওপর বসানো হয়েছে বিভেদের কাঁটাতার। বাংলাদেশের মসজিদ, হিজাব, বোরখা, হিন্দু-বিরোধিতাও এই সময়ের বাস্তবতা। এই বাস্তবতা তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা উপমহাদেশের স্বার্থান্বেষী দূরদৃষ্টিহীন রাজনীতিকদের। এই দুঃখজনক বাস্তবতার মধ্যে বর্বরতা আর হিংস্রতা যত কম হয়, সেই চেষ্টা করতে হয়।

মাদ্রাসার ইমাম যখন ধর্ষণ করে, তখন বলি, মাদ্রাসায় যেন আর একটিও ধর্ষণ না হয়। আমি মাদ্রাসা বিলুপ্ত করার কথা না বলে ধর্ষণ বন্ধ করার কথা বলেছি, তার মানে এই নয় যে আমি মাদ্রাসা সিস্টেমে বিশ্বাস করি। কোথাও নারী নির্যাতন হলে বলি নারী নির্যাতন বন্ধ করো। কমিউনিস্টরা যেমন বলে—”নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার দরকার নেই, কমিউনিজম এলে নারী নির্যাতন এমনিতেই বন্ধ হবে’, তেমন করে বলি না ‘আগে পুরুষতন্ত্র বিলুপ্ত হোক, তখন নারী নির্যাতন এমনিতেই বন্ধ হবে’। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলতে থাকলেও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আলাদা করে প্রতিবাদ করতে হয়।

মন্দির বানানো বন্ধ করো বললেই মন্দির বানানো বন্ধ হয় না, ঠিক যেমন মসজিদ বানানো বন্ধ করো বললেই মসজিদ বানানো বন্ধ হয় না কোথাও। ধর্ম বিলুপ্ত হোক বলে চেঁচালেও ধর্ম অদূর ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হবে না। তার চেয়ে ধর্মে ডোবা এই সমাজ থেকে যেন যুক্তিবাদি আর মুক্তচিন্তকের জন্ম হয়, সেই চেষ্টা করি। এই যুক্তিবাদিরাই একদিন সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে, সমাজ বদলাবে—এই স্বপ্ন নিয়ে।

এদেশে ধর্ম এবং কুসংস্কার প্রায় সবাই মানে। শিক্ষিত অশিক্ষিত সবাই। শনি-মঙ্গল-বৃহস্পতিবারে আমিষ খায় না, একশো রকম পুজো আচ্চায় উপোস করে, বারো মাসে তেরো নয়, তেরোশো পুজোর আয়োজন করে। গাছের গায়ে লাল দাগ দেখলেও নমস্কার করে। দোকানীরা দোকান খুলে টাকার পুজো আগে সেরে নেয়। বিজ্ঞানীরাও গাড়ি কিনে গাড়ির পুজো করে তারপর গাড়ি চালায়। এটাই বাস্তবতা। রাম মন্দির ঠিক সেরকমই বাস্তবতা। বাংলাদেশে পাড়ায় পাড়ায় একশ মসজিদ যেমন বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মানুষকে ধর্মবিমুখ করা, বিজ্ঞান মনস্ক করা দীর্ঘ মেয়াদি সংগ্রাম। আপাতত কী করতে হবে? যেন হিন্দু মুসলমান পরস্পরকে কচুকাটা না করে, কেউ কাউকে নির্যাতন না করে, যেন ভায়োলেন্স থেকে বিরত থাকে, যেন ঘৃণা দূর করে মন থেকে, যেন বিদ্বেষ বিদেয় করে। তুমি যখন ধর্ম মানবেই, মন্দির মসজিদ বানাবেই, সংখ্যাগরিষ্ঠের মত নিয়ে রাষ্ট্রকে ধর্মভিত্তিকও যদি করে ফেলো, বিধর্মীদের নির্যাতন কোরোনা, পারলে সৌহার্দের সম্পর্ক রেখো।

দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে দাবির প্রশ্ন অবান্তর, করজোড়ে শুধু অনুরোধ করা যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *