১৫০. বাংলাদেশের পুলিশ
বাংলাদেশের পুলিশকে কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে জাদুঘরে রাখার সময় হয়ে গেছে। পুলিশের কাজ রাতে টহল দেওয়া, চোর ছ্যাঁচড়, গুণ্ডা বদমাশ, ধর্ষক নির্যাতক, খুনী সন্ত্রাসীদের ধরা, শহর বন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ও মা, বাংলাদেশের পুলিশ ধর্ষণের বিরুদ্ধে যে সচেতন ছাত্রছাত্রী গ্রাফিতি আঁকছিল, তাদের মেরে ধরে ভ্যানে উঠিয়ে থানায় নিয়ে রাতভর অত্যাচার করেছে। পুলিশ বলছে ধর্ষণের বিরুদ্ধে গ্রাফিতি আঁকতে অনুমতি নিতে হয়। ধর্ষণ করতে গেলে কি অনুমতি নিতে হয়? অবশ্যই নয়। অনুমতি ছাড়া অন্যায় করা যাবে, অনুমতি ছাড়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যাবে না।
দেশটা নষ্ট হতে হতে একেবারে গলে গেছে। দেশের মস্তিষ্ক থেকে এখন দুর্গন্ধ পুঁজ বেরোচ্ছে। এই দেশই তো মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলাম বলে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে আমাকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আমাকে বলা হয়েছিল, ‘লেখালেখি পত্র-পত্রিকায় ছাপাতে চাইলে আমাদের অনুমতি নিতে হবে’। মৌলবাদীরা যে দেশ জুড়ে নারী নির্যাতন করে বেড়াচ্ছিল, তাতে অবশ্য তাদের অনুমতি নেওয়ার কথা কেউ বলেনি।
ভালো কাজ করার সময় যে সরকার অত্যাচার করে, নির্বাসনে পাঠায়, জেলে ভরে, সেই সরকার নিজের ভালো ছাড়া আর কারও ভালো চায় না। দেশের ভালো তো চায়ই না।
১৫ ১. বিবাহ
আমার মাথায় যখন বুদ্ধিসুদ্ধি বলতে কিছু ছিল না, তখন বিয়ে করেছিলাম। চাপে পড়ে এবং উপায় না দেখে মনে করেছিলাম বিয়েটা বুঝি করতেই হবে। ঘর সংসার না করলেও বিয়ে জাতীয় কিছু একটা করেছিলাম বলে তখন বিশ্বাস করেছিলাম। অবশ্য আইনের চোখে ওগুলো হয়তো বিয়েই ছিল না।
আমি অবাক হই যখন দেখি বয়স হওয়া, অভিজ্ঞতা হওয়া, মাথায় বুদ্ধি সুদ্ধি প্রচুর, উপার্জন প্রচুর, নিজের পায়ে দাঁড়ানো স্বাবলম্বী মেয়েরা এই কুৎসিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিয়ে করে ! আজ দেখলাম শমী কায়সার ভীষণ সেজেগুজে তার তৃতীয় বিয়েটি করছে। কী গ্যারেন্টি যে এই পুরুষটির সঙ্গে দীর্ঘদিন সে বাস করতে পারবে! কিছু ন্যাড়া হয়তো বারবার বেলতলায় যেতে পছন্দ করে।
শমীর যত খুশি তত বিয়ে করার স্বাধীনতা আছে। এ তার জীবন। এই জীবনকে তার পছন্দমতো যাপন সে করবে। কেউ বাধা দেওয়ার নেই। শমী সুখে শান্তিতে আনন্দে আহ্লাদে থাকুক।
বাংলাদেশের মতো নারীবিদ্বেষী সমাজে স্বাধীন এবং সচেতন কোনও মেয়ে এমন কোনও পুরুষ কি পেতে পারে যে-পুরুষ নারীর সমানাধিকারে একশ’ভাগ বিশ্বাস করে? আমার সংশয় হয়। শিক্ষিত, এমন কী উচ্চশিক্ষিত মেয়েদেরও নিজের স্বাধীনতা এবং অধিকার বিসর্জন দিয়ে বিয়ে টিকিয়ে রাখতে হয়।
বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে আমি বিয়ে টিয়ে করি না। আমার সংসার আমার একার সংসার। একার সংসারের মতো চমৎকার আর কিছু নেই। বিশেষ করে স্বনির্ভর এবং সফিস্টিকেটেড মেয়েদের সংসার। যতদিন পুরুষেরা নারীবিদ্বেষী, যতদিন চারদিকে কুৎসিত পুরুষতন্ত্রের জয়জয়কার, যতদিন তারা প্রভুর ভূমিকায়, ততদিন তাদের গলায় মালা পরানোর কোনও অর্থ হয় না। জানি কেউ কেউ বলবে সব পুরুষ মন্দ নয়। অবশ্যই নয়, মন্দ-নয়-পুরুষেরা স্ত্রীদের দেখভাল করে, স্ত্রীদের ভাত কাপড় দেয়, সম্ভব হলে গয়নাও গড়িয়ে দেয়। মন্দ-নয়-পুরুষেরাও কিন্তু অবাধ্য স্ত্রীদের সহ্য করে না। সুতরাং অবাধ্য হলে চলবে না।
আমি আবার অবাধ্য মেয়েদের খুব ভালোবাসি।
১৫২. মৃত্যুদণ্ড
আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে। যে অপরাধই যে লোকই করুক না কেন, কারও মৃত্যুদণ্ড হোক চাই না। যেইনা বললাম, অমনি খবর করা হল ‘তসলিমা বলেছেন ধর্ষকরাও মানুষ, তাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে’। আমি প্রায়ই বলি মানুষ জাতের মতো নিকৃষ্ট জাত আর নেই। তাহলে মানুষ তাও আবার ধর্ষক—তাদের প্রতি আমার এত দরদ উথলে উঠলো কেন? সারা জীবন ধর্ষণের বিরুদ্ধে লিখলাম, আর এখন এক হেডলাইনেই আমার লড়াই উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা। মিডিয়ার কী পাওয়ার! বাপরে বাপ।
মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কি শাস্তি নেই দুনিয়ায়? সেই শাস্তি দাও অপরাধীকে।
সবচেয়ে ভালো হয়, মানুষকে যদি শিক্ষিত আর সচেতন ক’রে গড়ে তোলা যায়। অপরাধ যে কারণে হচ্ছে, সেই কারণটাকে যদি নির্মূল করা যায়। এই কাজটি কেউ করতে চায় না। সবাই সোজা পথটি ধরতে চায়। সোজা পথটি হল, অপরাধীকে মেরে ফেল। চোখের বদলে চোখ নিয়ে নাও। খুনের বদলে খুন। এর নাম কিন্তু বিচার নয়, এর নাম প্রতিশোধ। এটি করে জনগণকে ধোঁকা দেওয়া যায়। জনগণ ভাবে অপরাধ দমনে সরকার বিরাট এক ভূমিকা নিয়েছে।
অপরাধীর জেল হলে এমন তো হতে পারে, সে ভালো মানুষ হয়ে জেল থেকে একদিন বেরোবে। নিরপরাধকেও তো কত মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। জেলে থাকাকালীন যদি প্রমাণ হয় মানুষটি নিরপরাধ, তখন অন্তত ভুল শোধরানোর সুযোগ পাওয়া যায়।
১৪০টি দেশ মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত করেছে। বাকি দেশগুলোও করবে। সবচেয়ে কম অপরাধ কোন দেশে হয়? যে দেশগুলোয় মৃত্যুদণ্ড নেই। সবচেয়ে বেশি অপরাধ? যেসব দেশে মৃত্যুদণ্ডের আইন আছে। অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দিলে কি অপরাধ করা থেকে বিরত থাকে মানুষ? প্রমাণ পাওয়া গেছে, একেবারেই না। খুনীকে মৃত্যুদণ্ড দিলে কি মানুষ আর খুন করবে না? ঠিক করবে। কিন্তু সমাজের মানুষকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুললে খুনখারাবির সংখ্যাটা কমে যায়। একই রকম ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড দিলেও পুরুষেরা ধর্ষণ বন্ধ করবে না। পুরুষ তখন ধর্ষণ বন্ধ করবে যখন মেয়েদের ধর্ষণের বস্তু হিসেবে তারা আর দেখবে না। অলরেডি এই নষ্ট নারীবিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের শিখিয়ে ফেলেছে যে মেয়েরা ধর্ষণের বস্তু, এই শেখাটা মাথা থেকে দূর করতে হবে। ব্যস, তাহলেই ধর্ষণ বন্ধ হবে। নতুন করে কাউকে আর নতুন কিছু শেখাতে হবে না, শেখাতে হবে না যে মেয়েরাও মানুষ, তাদের শ্রদ্ধা কর ব্লা ব্লা।
১৫৩. নগরকীর্তন
কৌশিক গাঙ্গুলির ‘নগরকীর্তন’ ছবিটি দেখলাম। সেই কবে মুক্তি পেয়েছে, দেখলাম আজ। হোক না দেরি, দেখা তো হল, মুগ্ধ তো হলাম। ইউরোপ আমেরিকায় সমকামী বা রূপান্তরকামী সম্পর্কের ওপর অসাধারণ সব ছবি বানানো হয়েছে। বাংলায় সমকামিতাকে বা রূপান্তরকামিতাকে অধিকাংশ মানুষই মেনে নেয় না, সেখানে সাহস করে গোটা একটা ছবি বানিয়ে ফেলা— চাট্টিখানি কথা নয়। প্রত্যেকে ভালো অভিনয় করেছেন। ঋত্বিকের অভিনয়ের তুলনা হয় না। অভিনয় তখনই চমৎকার, যখন মনে হয় না এ অভিনয়।
রূপান্তরকামী, সমকামী, উভলিঙ্গ, উভকামী—কুইয়ারদের জীবনের সুখ দুঃখ কী সুন্দর একটি প্রেমের গল্পের মধ্য দিয়ে বলেছেন কৌশিক। অ্যাং লী’র ব্রোকব্যাক মাউন্টেনকে আমি কখনও সমকামীদের গল্প বলি না, আমি বলি অসাধারণ এক প্রেমের গল্প। নগরকীর্তনও একটি সুন্দর প্রেমের গল্প।
তুমি কারও সঙ্গে তুমুল প্রেম করছো। সে দেখতে কেমন, তার লিঙ্গের আকার আকৃতি কেমন, তার ধনদৌলত কেমন, তার বংশ পরিচয়ই বা কী, এই প্রশ্নগুলো মনে উদয় হলে সেটা আর প্রেম নয়। প্রেম সবকিছু তুচ্ছ করবে, তবেই না প্রেম। হিসেব করে যেটা হয় সেটা চুক্তি, প্রেম নয়।
১৫৪. টাকায় স্লোগান
বাংলাদেশের একটি পাঁচশ টাকার নোটে দেখলাম কেউ একটা সীল বসিয়েছে ‘এসো নামাজ পড়ি’। এরকম সীল নিশ্চয়ই আরও টাকায় বসানো হয়েছে। সত্তর-আশির দশকে আমরা কল্পনা করতে পারতাম না এসব। শুনেছি রিক্সা অটো বাস ট্রাক ট্যাক্সি—সবকিছুর গায়ে এখন ‘নামাজ পড়ো রোজা করো’ এসব উপদেশ লেখা থাকে।
আমার তো মনে হয় না পাকিস্তান বা সৌদি আরবের টাকায় নামাজ পড়ার স্লোগান সেঁটে দেওয়া হয়। জানি, সরকার এই সীল মারেনি। সরকার মারেনি, কিন্তু সরকার এই সীল মারার মানসিকতা তৈরি করেছে, বা তৈরি করতে সর্বোত্তম সহযোগিতা করেছে। এরকম সীল কোনও মুসলিম দেশেই কেউ ব্যবহার করবে না। একমাত্র আইসিসের যদি রাজ্য বা দেশ থাকতো কোনও, তারাই তাদের টাকায় এই কর্মটি করতো। আইসিসের দেশ হতে সমগ্র বাংলাদেশের খুব বেশি দিন বাকি আছে বলে মনে হয় না।
দেশটা স্বাধীন হয়েছিল আমাদের ত্যাগে, সংগ্রামে। তারপর একের পর এক দুষ্ট শাসক এসে দেশটাকে আর দেশ রাখেনি। শেখ মুজিব ভালো নেতা ছিলেন, তিনি না ডাক দিলে মুক্তিযুদ্ধেই হয়তো মানুষ যেত না। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী হাসতে হাসতে দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে চলে যেত। শেখ মুজিব ভালো শাসক ছিলেন না, শাসক হিসেবে তিনি নিতান্তই গণ্ডমূর্খ ছিলেন। সব ভালো নেতাই ভালো শাসক হন না। শেখ মুজিবের পর আর্মি থেকে জিয়া এলেন, তিনি খাল কেটে কেটে বড় বড় কুমীর রাজাকারকে ডাঙায় আনলেন। এরপর আর্মি থেকে এরশাদ এলেন, তিনি সংবিধানের বারোটা বাজিয়ে ছাড়লেন। ধর্মান্ধতা আর সাম্প্রদায়িকতাকে তিনি রীতিমতো বৈধ করলেন। জিয়ার মৃত্যুর পর খালেদা এসে জিয়া যে সর্বনাশটা করে যেতে পারেননি, করলেন। তারপর হাসিনা গণতন্ত্র নামে যে নামকাওয়াস্তে হলেও একটি জিনিস ছিল, সেটিকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিলেন। চুরি ডাকাতি লুটতরাজ দুর্নীতি ধর্মান্ধতা মৌলবাদ সাম্প্রদায়িকতা সন্ত্রাস স্বৈরাচার মহা সমারোহে চলছে দেশটিতে। হাসিনা একা যত সর্বনাশ করেছেন দেশটির, তত সর্বনাশ অন্য শাসকেরা একা পারেননি, সবাই মিলে করেছেন।
হাসিনা নিজে ৫ বেলা নামাজ পড়েন। তিনি জনগণকে উপদেশ দেন নামাজ পড়তে। এই কওমি মাতা টাকার এই সীলকে, বলা যায় না, পাকা করেও দিতে পারেন, অর্থাৎ ছাপিয়েও দিতে পারেন। কোনও কিছুই দেশটিতে আর অসম্ভব নয়।
১৫৫. দেশটা মানুষ হল না
বাংলাদেশে চৌধুরি হাসান সারোয়ার্দি নামে এক লেফটেন্যান্ট জেনারেলকে সেনানিবাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর অপরাধ, বলা হয়েছে, ১। একাধিক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, ২। স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়েছে। ৩। ডিভোর্সের পর দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। তবে বিয়ের আগে সেই নারীর সঙ্গে মেলামেশা করেছে, এমনকি তাকে নিয়ে বিদেশে বেড়াতে গিয়েছে। ৪। যাকে বিয়ে করেছে, সে এক বিতর্কিত নারী।
সেনাবাহিনী জিনিসটা আমি পছন্দ করি না। অস্ত্রটস্ত্র আমার একেবারেই ভালো লাগে না। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর লোকদের তো করার কিছু নেই, ক্যু করা ছাড়া আর বসে বসে সস্তায় খাওয়া ছাড়া আর বোকা-সুন্দরীদের বিয়ে করা ছাড়া। এই লেঃ জেনারেলকে কোনও কারণে অন্য সেনাদের পছন্দ নয়, তাঁকে তাই লাথি মেরে তাড়িয়েছে। কিন্তু যে কারণগুলো বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, তা যদি সত্যি হয় তবে সত্যিই চিন্তার বিষয়। চিন্তার বিষয় এই জন্য যে, এগুলো অতি স্বাভাবিক ঘটনা, এগুলো কোনও অন্যায় নয়, কোনও অপরাধও নয়। সবারই অধিকার আছে ডিভোর্স করার, প্রেম করার, প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর, পুনরায় বিয়ে করার, যাকে খুশি তাকে বিয়ে করার। লক্ষ্য করেছি বিবৃতিতে যত না ঘৃণা প্রকাশ হয়েছে লেঃ জেনারলের প্রতি, তার চেয়ে বেশি উনি যে নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক করেছেন, তাদের প্রতি।
দেশটা মানুষ হল না।
১৫৬. সাবাস কলকাতা
কলকাতার দোষ অনেক, কিন্তু কিছু গুণ সব দোষ আড়াল করে দেয়।
একজন অভিনেতা, নেতা নন, অভিনেতা,—তাঁকে যেভাবে আজ সম্মান দেখালো কলকাতা—তার তুলনা হয় না।
কবিতা পড়ে, গান গেয়ে, ফুলে ফুলে সাজিয়ে, চোখের জলে ভিজিয়ে প্রিয় শিল্পীকে যেভাবে বিদেয় দিল কলকাতা— তার তুলনা হয় না।
করোনার ঝুঁকি নিয়ে কলকাতা যেভাবে প্রাণের টানে রাস্তায় নেমেছে শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানাতে—তার তুলনা হয় না।
শিল্পী হয়ে উঠতে পারেন রাষ্ট্রনেতার চেয়েও জনপ্রিয়, এখানেই কলকাতা অনন্য।
এ কারণেই হয়তো আজও কলকাতা দরিদ্র হয়েও ধনী, এ কারণেই হয়তো আজও কলকাতাকে লোকে বলে ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রগতিশীল শহর।
১৫৭. সাকিব এবং মহসিন
সাকিবের ক্ষমা চাওয়ার ভিডিওটি দেখে লজ্জা পেলাম। আমার বিরুদ্ধে নব্বই সাল থেকে টানা তিন বছর মৌলবাদী আন্দোলন চলেছিল, আমাকে হত্যা করার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছিল লাখো মৌলবাদী, নির্বিঘ্নে আমার মাথার মূল্য ঘোষণা করেছিল জিহাদি নেতারা—কই আমি তো একবারও ভাবিনি আমাকে ক্ষমা চাইতে হবে! সরকার আমার বিরুদ্ধে মামলা করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল, আমাকে দু’মাস জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্তরীণ থাকতে হয়েছিল, কই একবারও তো মনে হয়নি ক্ষমা চেয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে হবে আমাকে? আমার শুধু মনে হয়েছিল, আমি কোনও অন্যায় করিনি, আমার ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। ক্ষমা যদি কারও চাইতেই হয়, ওদের চাইতে হবে আমার কাছে।
সাকিব আল হাসান বিখ্যাত লোক। নিরাপত্তা রক্ষী দ্বারা বেষ্টিত। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সারা দেশের মানুষ তাঁকে ভালোবাসে। এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ভালোবাসেন। একটা লোক সোশ্যাল মিডিয়ায় থ্রেট করলো তো উনি একেবারে আমি গর্বিত মুসলমান, আমি পূজা মণ্ডপ উদ্বোধন করিনি, অন্য একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, পথে এক মিনিটের জন্য মণ্ডপে অনেকের অনুরোধে যেতে বাধ্য হয়েছি, নাকে খৎ দিচ্ছি আর যাবো না। সবার ওপরে ইসলাম ধর্ম তাহার ওপরে নাই। আমাকে ক্ষমা করে দিন। ‘—এসব বলার কোনও দরকার ছিল না। লোকে বলে নিজের ‘কল্লা’ বাঁচাবার জন্য বলেছেন, তাঁর দোষ নেই। না, আমি মনে করি না, তাঁর কল্লা নিয়ে সত্যিই কোনও সমস্যা হত। তিনি তো আর অভিজিৎ রায় নন, নিরাপত্তা রক্ষী ছাড়া রাস্তায় একা হাঁটেন। তিনি তো হজ্ব করে আসা সাচ্চা মুসলমান, তিনি তো অভিজিতের মতো ইসলামের সমালোচনা করেননি কোনওদিন। তবে কেন জঙ্গি জিহাদির কাছে তিনি মাথা নোয়ালেন? কেউ যদি এখন রাম দা নাচিয়ে বলে তুই আর কোনওদিন ক্রিকেট খেলবি তো তোকে কুপিয়ে মেরে ফেলবো, সাকিব কি খেলা ছেড়ে দেবেন? এতদিন খেলেছেন বলে অনুতপ্ত হবেন? ইসলামে তো গান বাজনা নাচা ছবি আঁকা সবই নিষিদ্ধ, খেলা নিষিদ্ধ হতে কতক্ষণ!
বাংলাদেশের পূজা মণ্ডপে মুসলমানরা যায়। প্রধানমন্ত্রীও যান। পূজা দেখা তো কোনওদিন হারাম ছিল না। কবে থেকে এটি বাংলাদেশে হারাম? নাকি ওই রামদাওয়ালা জিহাদিটি মুসলমানদের পূজা মণ্ডপে যাওয়া পছন্দ করে না বলে কোনও মুসলমানের পূজা মণ্ডপে যাওয়া চলবে না? কী হত যদি সাকিব বলতেন ‘পূজা উদ্বোধন করেছি, সম্মানিত বোধ করেছি। হিন্দুরা কী সহজে বিধর্মীদের পূজায় আমন্ত্রণ জানান, মুসলমানদের দিয়ে তাঁদের সবচেয়ে পবিত্র ধর্মানুষ্ঠান উদ্বোধন করান। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এটি চমৎকার উদাহরণ, আমাদেরও শিখতে হবে ওঁদের কাছ থেকে, আমাদেরও ইসলামি পরবে অনুষ্ঠানে বিধর্মীদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে। ঈদের অনুষ্ঠানাদি বিধর্মীদের দিয়ে উদ্বোধন করাতে হবে। উদারনৈতিক ইসলামকে গ্রহণ এবং হিংসের আর ঘৃণার ইসলামকে বর্জন করাটা মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।’
যদি বলতেন তাহলে নিঃসন্দেহে একটা ভালো কাজ করতেন সমাজের জন্য। কিন্তু তিনি এখন তাঁর কোটি ভক্তকে বলে দিলেন এক/দুই মিনিটের জন্য পূজা মণ্ডপে যাওয়ার জন্য তিনি অনুতপ্ত, তিনি ভুল করেছেন ওই মণ্ডপে গিয়ে। এর মানে মুসলমানের পূজা মণ্ডপে যাওয়া ঠিক নয়। তিনি জিহাদিদের শক্তি লক্ষ গুণ বাড়িয়ে দিলেন। এখন কোনও মুসলমান পূজা মণ্ডপে গেলে রক্ষে নেই, কোনও মুসলমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বললে রক্ষে নেই। কোনও মুসলমান হিন্দুর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করলে রক্ষে নেই।
জিহাদির হুমকি, সাকিবের ক্ষমা চাওয়া—এসবই প্রমাণ করলো দেশটাকে জিয়া, এরশাদ, খালেদা আর হাসিনা মিলে ভয়ংকর এক ‘দারুল ইসলাম’ বানিয়ে ফেলেছেন। এই দেশ জিহাদি এবং জিহাদি-সমর্থক ছাড়া আর কারও বসবাসের যোগ্য নয়।
১৫৮. ছোটখাটো বোড়ে
সাকিবের ক্ষমা-চাওয়ার ভিডিও দেখার কয়েক ঘণ্টা পর দেখেছি রাম’দা হাতে নিয়ে জিহাদি মহসিন তালুকদারের ভয়ংকর অশ্লীল কুৎসিত বীভৎস জঘন্য একটি ভিডিও। এই ভিডিওতে সাফ সাফ বলে দেওয়া হয়েছে, সাকিবের বাঁচার একমাত্র পথ ক্ষমা চেয়ে ফেসবুক পেজে ভিডিও প্রকাশ করা। জিহাদির হুকুম মেনেছেন সাকিব। সাকিবের জায়গায় অন্য কেউ হলেও মানতো।
মহসিন তালুকদারকে কে জন্ম দিয়েছে? এর উত্তর খুব সহজ। মূলত মসজিদ, মাদ্রাসা, ওয়াজ মাহফিল।
মহসিন তালুকদার কি দেশে এক পিসই?
একেবারেই না, প্রচুর পিস। সময়মতো তারা দা কুড়োল চাপাতি বের করে।
মহসিন মৃত্যুকে ভয় পায় না। ইসলামের জন্য সে নিজেকে হত্যা পর্যন্ত করতে রাজি। জিহাদিরা বিশ্বাস করে ইসলামকে বাঁচানোর জন্য জীবন দিলে শর্টকাটে জান্নাত পাবে।
বাংলাদেশ যে জিহাদিস্তান হয়ে উঠছে এগুলো তার ছোটখাটো নমুনা।
জিহাদিস্তান হওয়া থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়, জিহাদের উৎসে যাওয়া এবং একে নির্মূল করা।
ধর্মে খারাপ কথা লেখাই থাকে, সেগুলোকে মানলে চলবে না। এই কথাটি স্পষ্ট করে বলতে হবে। যদি বলতেই থাকো, ‘ধর্ম ভালো ধর্ম সব ভালো কথা বলেছে, ধর্ম অনুযায়ী পথ চলো’, তাহলে জিহাদিদের দোষ দিতে পারবে না, কারণ তারা ধর্ম মেনেই অন্যের ঘাড়ে কোপ বসাচ্ছে।
সাকিবের মতো জনপ্রিয় লোকের ওপর যদি হুমকি আসে, যে কারও ওপর আসতে পারে। কেউ শ্বাস নিলেও সেই শ্বাস ওদের অনুভূতির পালকে আঘাত করতে পারে। সুতরাং কারও রেহাই নেই।
অনুভূতির রাজনীতি আর অনুভূতির ব্যবসা চলছে দুনিয়া জুড়ে। মহসিন তালুকদাররা অনুভূতির ছোটখাটো বোড়ে, এদের মাঠে নামিয়ে দিলে রাজা মন্ত্রীকে খেয়ে কিস্তিমাৎ করে দিতে পারে। এইতো বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য হেলে পড়ছে, এরপর হেলবেন প্রধানমন্ত্রী।
১৫৯. সাকিবকে ক্ষমা চাইতে হল কেন
আমি প্রথম সাকিব আল হাসানের ক্ষমা চাওয়ার ভিডিওটি দেখেছি, কয়েক ঘণ্টা পর পেলাম সাকিবকে খুন করার হুমকি দেওয়া ভিডিও। এই দুটো ভিডিও দেখে দেশের পরিস্থিতি অনুমান করা যায়। কেন লোকেরা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগা কিছুতেই সহ্য করতে পারে না, একেবারে খুন করার পরিকল্পনা করে ফেলে। আর কেনই বা এদের মতো বর্বরদের কাছে নমস্যদের ক্ষমা চাইতে হয়। সাকিব নাস্তিক নন, রীতিমতো আস্তিক। সাকিব হিন্দু নন, বৌদ্ধ নন, খ্রিস্টান নন, ইহুদি নন, তিনি একজন গর্বিত মুসলমান, হজ পর্যন্ত করে এসেছেন। তাহলে তাঁকে কেন টার্গেট করা হল? এ সময় আমার মনে পড়ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটে যাওয়ার পর নাৎসিদের অত্যাচার এবং বুদ্ধিজীবীদের স্বার্থপরতা নিয়ে জার্মান প্যাস্টর মার্টিন নিমোলারের সেই বিখ্যাত স্বীকারোক্তি—
‘প্রথমে ওরা কম্যুনিস্টদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি কম্যুনিস্ট নই।
তারপর ওরা সোশ্যালিস্টদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি সোশ্যালিস্ট নই।
তারপর ওরা ট্রেড ইউনিওনিস্টদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি ট্রেড ইউনিওনিস্ট নই।
তারপর ওরা ইহুদিদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি ইহুদি নই।
তারপর ওরা আমার জন্য এলো, তখন কেউ আর ছিল না প্রতিবাদ করার।’
ঠিক এরকম করে বলা যায়,
‘প্রথমে ওরা হিন্দুদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি হিন্দু নই।
তারপর ওরা বৌদ্ধদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি বৌদ্ধ নই।
তারপর ওরা খ্রিস্টানদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি খ্রিস্টান নই।
তারপর ওরা নাস্তিকদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি নাস্তিক নই।
তারপর ওরা মুক্তচিন্তকদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি মুক্তচিন্তক নই।
তারপর ওরা সমকামীদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি সমকামী নই।
তারপর ওরা নামাজ-রোজা-না-করা-মুসলমানদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি নামাজ-রোজা-না-করা-মুসলমান নই।
তারপর ওরা যখন আমার জন্য অর্থাৎ নামাজ-রোজা-হজ করা মুসলমানের জন্য এলো, তখন মাথা নুইয়ে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিল না।’
আমরা যদি অশুভ শক্তিকে শুরুতেই দমন না করি, তবে অশুভ শক্তি একদিন সবাইকে গ্রাস করে নেবে, আমাকেও ছাড়বে না। এই সত্যটি বাংলাদেশের রাজনীতিক, সমাজবিদ, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, শিল্পী সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী কারও কেন বোধগম্য হয় না, আমি জানি না। আজকের এই পরিস্থিতির জন্য তাঁরা সকলেই দায়ী।
যদি আজকে কেউ ওরকম লম্বা রাম’দা দেখিয়ে বলতো, সাকিবকে ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিতে হবে, তা না হলে তাঁকে কুচি কুচি করে কেটে ফেলবো। তাহলে কি সাকিব খেলা ছেড়ে দেবেন? দেবেন না। কেউ যদি কোনও মন্ত্রীকে মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেয়, কাউকে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেয়, বা কাউকে চাকরিবাকরি ব্যাবসাপাতি ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেয়, তাহলে কি কেউ কিছু ছেড়ে দেবেন ? দেবেন না। কিন্তু কেউ যদি বলে আমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছিস, তোর আর রক্ষে নেই, তখন সবাই পড়ি কী মরি করে ক্ষমা চাওয়া, যাবতীয় কিছু ত্যাগ করা, দেশান্তরি হওয়া—সব করতে রাজি। কেন? কারণ দিনে দিনে বাংলাদেশে পঙ্গপালের মতো বেড়েছে অনুভূতি নিয়ে রাজনীতি করার বা ব্যবসা করার লোকদের সংখ্যা। এরা অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত এই অজুহাতে যে কাউকে নৃশংস ভাবে হত্যা করতে পারে। আমরা গত কয়েক বছরে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলো দেখেছি। কত প্রতিভাবান মুক্তচিন্তকের রক্তে লাল হয়েছে বাংলাদেশের রাজপথ! সমাজের মাথারা, রাষ্ট্রের সেবকরা, দেশের শাসকেরা তখন অনুভূতিওয়ালাদের দোষ না দিয়ে দোষ দিয়েছেন মুক্তচিন্তকদের, কেন তারা মুক্তচিন্তা করতে গেল, কেন অন্যের অনুভূতিতে আঘাত দিল। তখন তো অনুভূতি-ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো।
অপরাধীর নিন্দে না করে অপরাধীর শিকারীদের নিন্দে কি আজ থেকে হচ্ছে! মোল্লা মৌলনা, পীর হুজুর, জামাতি হিফাজতিদের পথে ঘাটে, অন্দরে বন্দরে, মাঠে ময়দানে, মাজারে বাজারে, মাদ্রাসা মসজিদে, শিক্ষালয়ে সেবালয়ে, অফিসে আদালতে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মানুষকে তাদের ভার্সান অব ইসলাম শেখাতে। তাদের ভার্সানটি অসহিষ্ণুতা আর উগ্রতা ছাড়া আর কিছু নয়। তারা দিনরাত যুবসমাজকে হিংসে, ঘৃণা আর বর্বরতার কুবুদ্ধি দিয়ে মগজধোলাই করছে। মগজধোলাই এর কাজ প্রকাশ্য দিবালোকেই করে, লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু করতে হয় না। মগজধোলাই করার লাইসেন্স তারা বৈধ ভাবেই পেয়েছে।
কোথায় আজ উদারনৈতিক ইসলাম? ধীরে ধীরে সেটি বিলুপ্ত হচ্ছে বাংলাদশে। সে কারণে সুফি মতবাদের ওপর, বাউল ফকিরদের ওপর হুমকি আসে। উদারনৈতিক ইসলামকে হটিয়ে দিয়ে আনা হয়েছে সালাফিদের কট্টরপন্থী ইসলামকে, যে ইসলামে বিশ্বাস আইসিস, আল কায়দা, আল শাবাব, বোকো হারামের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর।
মহসিন তালুকদারকে কে বা কারা জিহাদি বানিয়েছে তা তার ভয়াবহ কুৎসিত বীভৎস বিবৃতিতেই স্পষ্ট। দু’জন ওয়াজ-ব্যবসায়ী হুজুরের নাম সে উল্লেখ করেছে। ওয়াজ-ব্যবসায়ী হুজুরেরা তো সরকারের দেওয়া ছাড়পত্র নিয়েই শহরে নগরে গ্রামে গঞ্জে যুবসমাজকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করছে।
সাকিবের মতো সাচ্চা মুসলমানকে আজ জিহাদিদের আদেশ অনুযায়ী ক্ষমা ভিক্ষে চেয়ে বাংলাদেশে বাস করতে হয়। এই বাংলাদেশকে দেখলে বিশ্বাস হয় না যে লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ বুকে নিয়ে একদিন এর জন্ম হয়েছিল। মহসিন বলেছে, সে মরে যাবে এতে তার আপত্তি নেই, কিন্তু তার অনুভূতিতে যে আঘাত করেছে, তাকে মেরে মরবে। ধর্মের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করলে যে পরকালে জান্নাত মিলবে, এও তাদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, এ কারণে অনুভূতিতে আঘাত লাগার ছুতোয় তারা রাম দা, চাপাতি, তলোয়ার, বোমা কিছুই হাতে নিতে দ্বিধা করে না।
প্রকৃত শিক্ষা থেকে শিশু কিশোর আর যুব সমাজকে বঞ্চিত করছে বাংলাদেশ। গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা, বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনও ধারণা না নিয়ে বড় হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। সাকিব আল হাসানকে আজ জিহাদিদের সামনে মাথা নোয়াতে হত না যদি আজ দেশের অধিকাংশ মানুষ গণতন্ত্রে, ধর্ম নিরপেক্ষতায়, অসাম্প্রদায়িকতায়, বাক স্বাধীনতায়, মত প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করতো। সাকিবের পরাজয় দেশের পরাজয়। এই দেশের অধিকাংশ মানুষকে অসহিষ্ণু, সাম্প্রদায়িক, উগ্র, মূর্খ, আর বর্বর বানাবার দায় সরকারের, এবং সেই সাথে বুদ্ধিজীবী নামক লোকদের নীরবতার। সাকিবকে আজ জবাবদিহি করতে হয় কেন তিনি মণ্ডপে গিয়েছিলেন, কেন তিনি পূজা উদ্বোধন করেছেন। সাকিব আজ বলতে পারেননি তিনি কী করবেন, কী খাবেন, কী পরবেন, কোথায় যাবেন, কী উদ্বোধন করবেন, কী বিশ্বাস করবেন, কতটুকু বিশ্বাস করবেন—সব তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। এই ব্যক্তি-স্বাধীনতা যদি না থাকে, তবে গণতন্ত্র বলে কিছু থাকে না। সভ্য হওয়ার জন্য গণতন্ত্র প্রথম পদক্ষেপ।
উগ্রবাদকে আশ্রয় দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ নিরবধি খুঁড়ে চলেছে গণতন্ত্রের কবর। সে কি আর আজ থেকে! এর সমাধান কী, তা ভাবতে হবে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী সরকারকে। ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার স্থূল স্বার্থে যাঁরা উগ্রবাদীদের মদত দিয়েছেন, তাঁদেরই দূরদৃষ্টিহীন সিদ্ধান্তে দেশ আজ জিহাদি মৌলবাদীদের খপ্পরে। এই ভয়ংকর অপশক্তিই আজ সমাজের নিয়ন্ত্রক। সে কারণে মহসিন তালুকদারকে বন্দি করা যায়, কিন্তু দেশের সর্বত্র বিরাজমান অসংখ্য অজস্র মহসিনি-মানসিকতাকে বন্দি করা যায় না। এক একটি মহসিনি-মানসিকতা থেকে লক্ষ মহসিন জন্ম নেবে। যেটুকু গণতন্ত্র অবশিষ্ট আছে, সেটুকু উড়ে যেতে বেশিদিন নেই। সাকিবের মতো সবাইকে তখন নাকে খত দিয়ে, করজোড়ে ক্ষমা ভিক্ষে চেয়ে, কী করেছে, কী খেয়েছে, কী পরেছে, কোথায় গিয়েছে, কী ছুঁয়েছে, কী বিশ্বাস করেছে, তার ফিরিস্তি দিয়ে, তলোয়ারের তলায় গর্দান রেখে বাঁচতে হবে। যাদের তলোয়ার, তাদের বিশ্বাসের চেয়ে তোমার বিশ্বাস কিছু অন্যরকম হয়েছে তো সর্বনাশ, তাদের আদেশের সামান্য অমান্য হল তো সর্বনাশ, গর্দান কাটা পড়বে।
বাংলাদেশের এই করুণ পরিণতি কেন? কে এর জন্য দায়ী? যারা দায়ী তাদের তার ভুল সংশোধন করতে হবে। জিহাদের বীজ যাদের সবুজ সংকেত পেয়ে মগজে মগজে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাদেরই এখন মগজ মগজে গিয়ে জিহাদের বীজ সরিয়ে ফেলতে হবে। সাকিবের মতো আর কাউকে, কোনও আস্তিককে বা নাস্তিককে, কোনও হিন্দুকে বা কোনও মুসলমানকে, কোনও বিখ্যাতকে বা অখ্যাতকে যেন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাদের কোনও অসাম্প্রদায়িক কাজের জন্য, সুস্থ সমাজের স্বপ্ন দেখার জন্য, সৌহার্দ আর সমমর্মিতা, সমতা আর সমানাধিকারকে সম্মান জানানোর জন্য ক্ষমা চাইতে না হয়। আর যেন কাউকে কোনও অপশক্তির সামনে মাথা নত করতে না হয়।
এত হতাশা, এত বীভৎসতা চারদিকে, তারপরও শুভদিনের আশায় বসে থাকি।