অনড় দাঁড়ালাম- তসলিমা নাসরিন / প্রথম প্রকাশ : ডিসেম্বর ২০২০
উৎসর্গ : রাস্তার বেড়াল-কুকুরদের
১. বন্ধ হোক হত্যাকাণ্ড
প্যারিস, নিস, ভিয়েনা, কাবুল। জঙ্গি হামলা চলছেই। যত জঙ্গি হামলা চলবে, যত নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে খুন করবে মুসলিম জঙ্গিরা, দক্ষিণপন্থী-কট্টর-রাজনীতি তত জনপ্রিয় হবে। ইসলামের নামে সন্ত্রাস যত বেশি ঘটবে, তত বেশি ইসলামবিদ্বেষীরা ক্ষমতায় আরোহণ করবে, তত বেশি বর্ণবিদ্বেষ এবং ইসলামবিদ্বেষ গ্রহণযোগ্যতা পাবে। বিশ্ব জুড়ে একের পর এক জিহাদি আক্রমণ ঘটতে দেখে ইসলামকে নিয়ে যত কটূক্তি মানুষ করে, তত কটূক্তি গত পাঁচশ’ বছরে মানুষ করেছে কিনা সন্দেহ। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘পুট ইওরসেলফ ইন মাই সুজ’। নিজেকে আমার জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেখ। মুসলিমরা যদি অমুসলিমদের জায়গায় নিজেদের দাঁড় করায়, তাহলে? মুসলিম বিশ্বে যদি অমুসলিমদের আশ্রয় দেওয়া হতো, আর সেই অমুসলিম লোকেরা তাদের ধর্মের নামে যদি মুসলিমদের হত্যা করতো, আমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারি কী হতো মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া। অমুসলিমদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে মুসলিম বিশ্ব থেকে বের করে দিত, অমুসলিমদের শায়েস্তা করার জন্য তারা অমুসলিমবিরোধী রাজনীতিককে দেশের প্রধান বানাতো, যেন অমুসলিমদের জন্য মুসলিম বিশ্বের দুয়ার চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। মুসলিমরা যা যা করতো, আজ অমুসলিমদের দেশে অমুসলিমরা ঠিক তা-ই করতে চাইছে।
আমি বুঝি না নিজেদের মুসলিমপ্রধান দেশ ফেলে, ইসলামি আইন যেসব দেশে বলবৎ সেসব দেশে নির্বিঘ্নে ধর্মচর্চা না করে মুসলমানেরা কেন পাড়ি দেয় অমুসলিমের দেশে যেখানে ইসলামি আইন এবং সংস্কৃতির লেশমাত্র নেই? পাড়ি যদি কোনও কারণে দিলই তবে সন্তানদের কেন সে দেশের সংস্কৃতি থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে? সে দেশের সংস্কৃতিকে পছন্দ হয়না তো সেই দেশে বাস করা কেন? তাদের উদারনীতি, আর তাদের অর্থনীতির সুবিধে ভোগ করার জন্যই তো? এ তো নিতান্তই স্বার্থপরতা। এই স্বার্থপরতা এতকাল অমুসলিম দেশের লোকেরা গ্রহণ করেছে কিন্তু এখন আর করতে চাইছে না। কেনই বা করবে যখন তুমি ওদের ধরে ধরে জবাই করছো? তুমি কি তোমার মুসলিম বিশ্বে পাড়ায় পাড়ায় গির্জা আর মন্দির বানাতে দিতে? ওরা কিন্তু অমুসলিম হয়েও তোমাকে পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ বানাতে দিয়েছে। তুমি ধর্মীয় স্বাধীনতা উপভোগ করেছো। ওদের ভাতা খেয়েছো। ওদের দয়ায় খেয়েছো, পরেছো। তারপর ওদেরই গলায় ছুরি বসিয়েছো, ওদেরই বুক লক্ষ করে গুলি ছুঁড়েছো। তুমি না ছুঁড়লেও তোমার ভাই ছুঁড়েছে, তোমার ধর্মের নাম নিয়ে ছুঁড়েছে। তুমি তখন তোমার ভাইয়ের অন্যায়ের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী না হয়ে যাকে হত্যা করা হয়েছে, তাকে দোষ দিচ্ছ, তার দেশকে দোষ দিচ্ছ, অতীতে সেই দেশ কী কী অন্যায় করেছে সেই তালিকা দিচ্ছ, আর হত্যাকাণ্ডের ন্যায্যতা প্রমাণের চেষ্টা করছো।
ইউরোপ আর আমেরিকা গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে বহুকাল অন্যায় করেছে। সাম্রাজ্যবাদ আর আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা করা, নিজেদের পুতুল সরকার বসিয়ে রাজত্ব করা, লাগাতার শোষণ করা, বিপ্লবীদের খতম করে দেওয়া, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকে ধ্বংস করে দেওয়া। সে তো সুদূর অতীত, নিকট অতীতেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে। যেহেতু ওরা ভুল করেছে, তাই তোমাদেরও ভুল করতে হবে? একটি ভুলের প্রতিশোধ নিতে আরেকটি ভুল করা, এই অংকটা খুব ভুল অংক। ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করেছে নাৎসি জার্মানি। ইহুদিরা কিন্তু প্রতিশোধ নিতে নিরীহ জার্মানদের খুন করতে নামেনি। বরং নিজেরা পারদর্শী হয়েছে সর্ববিদ্যায়, আজ তাঁরা নমস্য। জার্মানরা আজ ইহুদিদের কুর্ণিশ করে। এর চেয়ে চমৎকার প্রতিশোধ আর কী হতে পারে! বাইবেল বলে চোখের বদলে চোখ নিতে। গান্ধী বলেছিলেন, সবাই যদি চোখের বদলে চোখ নিতে শুরু করে, তাহলে গোটা বিশ্বই তো অন্ধ হয়ে যাবে!
সবচেয়ে ভালো কথা বলেছেন অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর সিবাস্টিয়ান কুর্জ। বলেছেন ‘এই সংগ্রাম খ্রিস্টান আর মুসলিমের মধ্যে নয়, অস্ট্রিয়ান আর মাইগ্রেন্টদের মধ্যে নয়, এই সংগ্রাম যারা শান্তি চায় এবং যারা শান্তির বদলে যুদ্ধ চায়—তাদের মধ্যে। এই সংগ্রাম সভ্যতা এবং বর্বরতার মধ্যে।’ এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সভ্যতা নাকি বর্বরতা, কোনটি চাই।
চোখের বদলে চোখ না নিয়ে বরং অন্ধজনকে আলো দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। নিজেকে সত্যিকার শিক্ষিত সচেতন করে গড়ে তুলে বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে হবে জঙ্গিবাদ তোমার ধর্ম নয়। এ না হলে আর কোনও উপায় নেই বাঁচার। মুসলিমদের বাস করতে হবে এই বিশ্বে, নানা মতের নানা বিশ্বাসের মানুষের সঙ্গে পাশাপাশি। আমার ধর্মই ঠিক ধর্ম, বাকি ধর্ম ভুল ধর্ম, আমার ঈশ্বরই ঠিক ঈশ্বর, বাকি ঈশ্বর ভুল ঈশ্বর—এইসব অহংকার একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক বিশ্বের জন্য অচল। আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্র একটি অতি প্রয়োজনীয় তন্ত্র। এই তন্ত্রটি বিশ্বের সকল মানুষকে সমান মর্যাদা দেয়। এই গণতন্ত্রকে অস্বীকার করলে একঘরে হয়ে যেতে হবে। এ তো কাম্য নয়।
বাম রাজনীতির মুখোশ খুলে গেছে, এই রাজনীতি ইসলামি সন্ত্রাসবাদকে ছলে বলে কৌশলে সমর্থন করে। বাম রাজনীতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিরোধী, কিন্তু কী কারণে এই রাজনীতি ইসলামি দর্শন—যে দর্শন আগাগোড়া দক্ষিণপন্থী—তা অনুধাবন করতে পারছে না? নাকি জেনেশুনেই বিষ পান করছে! ইসলামি দর্শন চরম দক্ষিণপন্থী তো বটেই। দক্ষিণপন্থী বলেই ধর্মীয় মৌলবাদের স্থান এই দর্শনে সবার ওপরে। শ্রেণী বৈষম্যও বেশ বহাল তবিয়তে উপস্থিত। দক্ষিণপন্থী বলেই নারীর সমানাধিকার এই দর্শনে স্বীকৃত নয়, সমতা স্বীকৃত নয়, শিল্প সংস্কৃতি, নৃত্যসংগীত এবং কোনও সুকুমারবৃত্তি আদৃত তো নয়ই, বরং ধিকৃত। বাম রাজনীতিকরা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন না হয়ে ইসলামি মৌলবাদের মতো চরম দক্ষিণপন্থী মৌলবাদী মতবাদকে আলিঙ্গন করে ঐতিহাসিক এক ভুল করেছেন। এই ভুলের খাদ থেকে অচিরে তাঁদের পাড়ে ওঠা উচিত।
পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো যেদিন থেকে সমাজতন্ত্রকে হটিয়ে দিল, সেদিন থেকে বাম রাজনীতির পতন শুরু হয়েছে। আর যেদিন থেকে এই রাজনীতি মুসলিম মৌলবাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, সেদিন থেকে এর জনপ্রিয়তা তলানিতে নেমে গেছে। মানুষ এখন ভরসা করছে দক্ষিণপন্থীর ওপর, তাও আবার কট্টর দক্ষিণপন্থীর ওপর। কারণ একমাত্র তারাই আস্থা দিয়েছে মুসলিম সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়াবে। ট্রাম বর্ণবিদ্বেষী হয়েও, নারীবিদ্বেষী হয়েও, রাজনীতিক না হয়েও, ইনকামট্যাক্স না দিয়েও, মারণ ভাইরাসের কামড়ে গোটা বিশ্ব যখন কুঁকড়ে আছে, যখন নিজের এবং অন্যের বাঁচার জন্য মাস্ক পরা অবশ্য কর্তব্য, তখন মাস্কের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করে করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব নিয়ে হাসি তামাশা করেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রচুর ভোট পেয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করছেন ডেমোক্রেট প্রার্থীর সঙ্গে।
ইসলামকে কেন মানুষ ভয় পাচ্ছে? কারণ ইসলামের নামে সন্ত্রাসীরা মানুষ হত্যা করছে। যে কেউ যে কোনও সময় খুন হয়ে যেতে পারে। আফগানিস্তানে ২২ জন শিক্ষার্থী খুন হয়ে গেল সন্ত্রাসী আক্রমণে। তার কিছুদিন আগে ২৪ জনের প্রাণ হরণ করেছে সন্ত্রাসীরা। যে মানুষই তাদের জিহাদে সায় দেয় না, সে মানুষকেই তারা শত্রু বলে মনে করে। শত্রুরা মুসলমান, অমুসলমান, অবিশ্বাসী, নাস্তিক যে কেউ হতে পারে। জিহাদে বিশ্বাস করা মানুষই শুধু তাদের বন্ধু, বাকিরা সবাই শত্রু। সুতরাং জিহাদ কোনও দেশের জন্যই নিরাপদ নয়।
মুসলিম দেশগুলো কোথায় ফ্রান্সে অস্ট্রিয়ায় জিহাদি কর্মকাণ্ডের নিন্দে করবে, তা নয়তো ইউরোপেকেই দোষ দিচ্ছে তাদের মত প্রকাশের অধিকারের জন্য। তুরস্ক, পাকিস্তান, মালোশিয়ার মুসলিম নেতারা জঙ্গিবাদকে তো সমর্থনই করলেন। রাষ্ট্রনেতার কাজ বর্বরতার বিরুদ্ধে কথা বলা, অথচ ওঁরাই বর্বরতার পক্ষে দাঁড়ালেন। এতে ওঁরা মুসলিম মৌলবাদীদের বাহবা পাবেন। আজকে মৌলবাদ তোষণ করলে কাল জঙ্গির জন্ম হয়। এই জঙ্গি কি শুধু পাশ্চাত্যেই হত্যাকাণ্ড চালাবে? প্রাচ্যেও চালাবে। আফগানিস্তানের মতো মৌলবাদি দেশও বাদ যায় না জঙ্গি হামলা থেকে। জঙ্গিবাদ মুসলিম অমুসলিম উন্নত অনুন্নত কোনও দেশের জন্যই শুভ নয়। অতএব একে রোধ করতেই হবে। মৌলবাদিদের ভোট পাওয়ার জন্য, ক্ষমতায় দীর্ঘদিন টিকে থাকার জন্য দেশে জ্ঞান চর্চা, বিজ্ঞান চর্চা বন্ধ করে কেবল ধর্ম চর্চা বিস্তার করে আখেরে লাভ হয় না, বরং ক্ষতিই হয়। এই ক্ষতির চিহ্ন প্রতিটি মুসলিম দেশে স্পষ্ট।
যে মুসলমানরা জিহাদি আদর্শে বিশ্বাসী নয়, তাদের প্রতিবাদ কোথায়? বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ লোকের মিছিল হয়েছে জিহাদিদের পক্ষে। এককালের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ মাত্র তিন দশকের মধ্যেই মৌলবাদের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। কুমিল্লায় বাংলাদেশি জিহাদিরা পুড়িয়ে দিয়েছে অমুসলিমদের ঘরবাড়ি। সম্ভবত তারা চায় না দেশে কোনও অমুসলিম বাস করুক। প্রগতিশীল মানুষেরা নিহত নয়তো দেশান্তরি। তাহলে এটাই সত্য যে দেশের ভেতর কোনও প্রগতিশীলতার ঠাঁই নেই, কোনও মুক্তচিন্তার ঠাঁই নেই, কোনও মত প্রকাশের অধিকারের ঠাঁই নেই!
সরকারের দায়িত্ব মৌলবাদ দমন করা। মৌলবাদ দমন না করলে দেশ অচিরে দারুল ইসলামে রূপ নেবে, এ বিষয়ে কারও সংশয় থাকার কোনও কারণ দেখি না। আর সেই দারুল ইসলামে নারী নেতৃত্বের কিন্তু কোনও স্থান নেই। আমাদের নারী নেত্রীরা নিশ্চয়ই এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল।
২. হাসিনা
হাসিনা যত ক্ষতি করেছেন বাংলাদেশের, তত ক্ষতি অন্য কোনও প্রধানমন্ত্রী করেননি। হাসিনা জমায়েতের ডাক দিলে আজ যত লোক হবে, তার চেয়ে বেশি হবে কোনও পীর বা হুজুর ডাক দিলে। এই ব্যবস্থাটি হাসিনাই করেছেন। ওই লিঙ্গপালগুলোর দয়ায় আর কিছু গোলাম-সাংবাদিকদের করুণায় তিনি অবৈধভাবে অনন্তকাল ক্ষমতায় টিকে থাকতে চান। আছেনও। রাজনৈতিক সব বিরোধীদলকে পঙ্গু করে দিয়ে শক্তিশালী করেছেন ধর্মান্ধ জিহাদিদের। এই ক্ষতিপূরণ ২০০ বছরেও সম্ভব নয়।
চরমোনাইয়ের পীরের ডাকে ২/৩ লাখ লোক নেমেছিল রাস্তায়। হেফাজতি ইসলামের ডাকে ৫/৬ লাখ। এরা জিহাদিদের সমর্থনে মাঠে নেমেছিল, যে জিহাদিরা নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে ইউরোপের শহরগুলোয় নির্মমভাবে হত্যা করছে। হাসিনা পাশ্চাত্যের দয়া দাক্ষিণ্য দু’হাত পেতে নিচ্ছেন, তারপরও পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধদের জিহাদি জমায়েতকে তিনি ঠেকানোর চেষ্টা করেননি। কোথায় পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে, মেরে ধরে ছত্রভঙ্গ করবে মিছিল, তা নয়, ওদের রাজনৈতিক মোনাজাতে পুলিশও অংশগ্রহণ করেছে। ধর্ম শেষপর্যন্ত চোর গুণ্ডা ধর্ষক খুনী আর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে কোনও ফারাক রাখে না।
হাসিনা ক্ষমতায় এলে দেশের হিন্দুরা নিরাপদে থাকবে—এমন আশার বাণী কত যে শুনেছি জীবনে! গতকাল বাংলাদেশের কুমিল্লায় ১০টা হিন্দু বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে জিহাদিরা। যে ক’জন হিন্দু আছে দেশে, ওরাও এরপর আর ওই দেশে থাকতে চাইবে না। জিহাদিদের আম্মির কাছ থেকে কোনও সুস্থ সুন্দর শান্তির সমাজ আশা করাটাই তো বোকামো। উনি ভেবেছেন অর্থনীতি ভালো করলেই বুঝি তাঁর সাত খুন মাফ। আরব দেশের কত ধনী দেশকে জিহাদিরা খেয়ে ছিবড়ে করে দিয়েছে। এত যে বলছি, কী লাভ! যিনি কানে দিয়েছেন তুলো পিঠে বেঁধেছেন কুলো—তিনি মরে যাবেন কিন্তু শোধরাবেন না।
৩. পবিত্র কিতাব
পবিত্র কিতাবের কিছু কিছু পবিত্র পৃষ্ঠায় বিধর্মীদের বা অবিশ্বাসীদের মেরে ফেলার পবিত্র বাণী রয়েছে। এই বাণী যখন উচ্চারণ করি, পবিত্র কিতাবের বিশ্বাসীগণ ধেয়ে আসেন বলতে বলতে, ”আউট অব কন্টেক্সট, আউট অব কন্টেক্সট”। তাঁদের ভাষ্য মাঝখান থেকে একটি বাণী উঠিয়ে আনলে বাণীর সত্যিকার অর্থ বোধগম্য হবে না, বাণীটির আগে পরের বাক্যও উচ্চারণ করতে হবে, তা হলেই অর্থটা সঠিক বোঝা যাবে। বিশ্বাসীরা ঠিকই বলেছেন। আগে পরে যা আছে, সব সহ বাণীটি উচ্চারণ করার পর অর্থ দাঁড়িয়েছে, ”চারদিকে লাল নীল হলুদ ফুলের বাগান, ফুলে খুব সুগন্ধ, আমরা ফুল খুব ভালোবাসি”।
৪. বর্বরতা
বাংলাদেশে তো মিছিল করার, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার লোক প্রচুর। সেদিন তো এক পীরের ডাকেই চল্লিশ হাজার বেরিয়ে পড়লো।
গতকাল যে লালমনিরহাটে এক মুসলমান লোক, যে কিনা মসজিদে নামাজ সেরে বেরোচ্ছিল—মসজিদের বইয়ের তাকে তার পা পড়েছিল বলে, আর সেই পায়ের কড়ে আঙুল তাকে রাখা কোরানে লাগলেও লাগতে পারতো এই গুজব ছড়িয়ে পুলিশের নিরাপত্তা থেকে তাকে যে উঠিয়ে নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে আল্লাহু আকবর বলে চিৎকার করতে করতে আগুন জ্বালিয়ে দিল শত শত উন্মত্ত নামাজি—এই বর্বরতার প্রতিবাদে মিছিল বেরোবে না? গতকাল যে ফ্রান্সের নিস শহরে তিন জন নিরপরাধ মানুষকে এক মুসলিম নির্মমভাবে আল্লাহু আকবর বলতে বলতে হত্যা করলো, বেরোবে না এর প্রতিবাদে মিছিল? আর আল্লাহু আকবর বলতে বলতে শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটির মুণ্ডু কেটে যে রাস্তায় ফেলে রাখলো আরেক মুসলিম—বেরোবে না এর প্রতিবাদে মিছিল?
গাজায় মুসলিমদের ওপর অত্যাচার হলে তো মিছিল বেরোয়। মুসলিমরা অন্যের ওপর অত্যাচার করলে মিছিল বেরোয় না কেন? তাহলে কি বুঝতে হবে মুসলিমদের করা অত্যাচারে সমর্থন আছে মুসলিমদের?
অন্তত আল্লাহু আকবর—এই ‘পবিত্র শব্দদুটি’—সন্ত্রাসের কাজে, মানুষ হত্যার কাজে, বর্বরতা এবং নৃশংসতার কাজে তাদের মুসলিম ভাইয়েরা যেন আর ব্যবহার না করে, এই আর্জিটা তো করতে পারে তারা!
৫. সন্ত্রাস
তিউনেসিয়া থেকে ইতালিতে এল সেপ্টেম্বরে। ওখানে ভাইরাসের কারণে রয়ে যেতে হল অনেকদিন। ইতালি থেকে ফ্রান্সে পা রাখলো অক্টোবরের শুরুতে। বয়স কত? ২১। তিন সপ্তাহ যেতেই ছুরি নিয়ে এসে তরতাজা ৩ জন মানুষকে খুন করে ফেললো। এর তো কোনও জঙ্গি প্রশিক্ষণ হয় নি। মাত্র ১৩ দিন আগে যে ১৮ বছর বয়সী চেচেনটি শিরোচ্ছেদ করেছিল একজনের, ওরও তো জঙ্গি প্রশিক্ষণ হয়নি। তাহলে কী করে পারে মানুষের ধড় থেকে মুণ্ডু কেটে আলাদা করতে? কে তাদের শরীরে অত বীভৎস শক্তি দেয়? কী তাদের মনকে অমন হিংসেয় আর হিংস্রতায় কুৎসিত বানিয়ে ফেলে? ধর্ম?
৬. নবীপ্রেম
বাংলাদেশের লিঙ্গপালগুলো, যেগুলো ঢাকা শহরে মিছিল করলো ফরাসি পণ্য বর্জন করবে বলে কারণ ফরাসি সরকার চায়নি ফরাসি নাগরিকরা এক এক করে জবাই হয়ে যাক, সেগুলো, সেই লিঙ্গপালগুলো কৈশোর থেকে গরু জবাই করতে করতে হাত পাকিয়েছে, আর ধর্ষণ করতে করতে লিঙ্গ পাকিয়েছে। এই লিঙ্গপালগুলো ফ্রান্সে থাকলে ফরাসি মেয়েদের হুর ভেবে ধর্ষণ করতো আর হাতের কাছে যাকে পেতো তাকেই জবাই করতো। এদের ফেলো নবীপ্রেমিকগুলো তো ফ্রান্সের খেয়ে ফ্রান্সের পরে এই মহান কম্মটিই করছে।
৭. পণ্য বয়কটের ডাক
আমি যদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতাম, এই সময় আমি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে আমন্ত্রণ জানাতাম, বিশাল সম্বর্ধনা দিতাম তাঁকে, রাজধানীকে ফুল আর রঙিন কাগজ দিয়ে সাজাবার বদলে শার্লি এব্দোর কার্টুন দিয়ে সাজাতাম। আর পঙ্গপাল থুড়ি লিঙ্গপালের কেউ যেন কেশাগ্র বের করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করতাম। এভাবেই যদি লিঙ্গপালকে গণতন্ত্র কাকে বলে, মত প্রকাশের অধিকার কাকে বলে, বাকস্বাধীনতা কাকে বলে শেখানো যায়।
কিন্তু ঘটনা তো উলটো। কওমি মাতা তুরস্কের এরদোয়ানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, যে এরদোয়ান প্রথম ফরাসি পণ্য বয়কটের ডাক দিয়েছেন। ওঁর ডাকে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ লিঙ্গপালের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাই তো রাস্তায় আরব দেশের পোশাক পরে নেমে গেছে। ওই পোশাক যে আসলে আরবের ৩৬০টি ভগবানের পূজা করা বিধর্মীদের পোশাক, তা বোঝার মস্তক কোথায় ওদের। মস্তক তো বন্ধক দেওয়া। এরদোয়ান কোভিডের জন্য খয়রাত দেবেন বাংলাদেশকে। খয়রাতই যদি ঘটনা, খয়রাত তো ম্যাক্রোঁ আরও বেশি দিয়েছেন!
৮. লিঙ্গপাল
বাংলাদেশে মূর্খ মোল্লাদের মিছিল হল, তারা নাকি ফরাসি জিনিসপাতি আর কিনবে না। আরও কিছু মুসলিম দেশেও ফরাসি কিছু কিনবে না, ফরাসি কিছু বিক্রি করবে না—এই স্লোগান উঠেছে। মূর্খের সংখ্যা যখন বেশি হয়ে যায়, তখন সমস্যা। এই মূর্খগুলোর দাবি শুনে সরকার প্রমাদ গোণে। মূর্খ তৈরির কারখানা তো অতি- চালাক-সরকারদেরই তৈরি করা। এদের গণতন্ত্র না শিখিয়ে, বাকস্বাধীনতা কী কাহাকে বলে না শিখিয়ে মূর্খ হওয়ার ছবক দিয়েছে। কার ক্ষতি ফরাসি পণ্য বর্জন করলে? তোদের স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধুকে নামিয়ে ফেল। ওটা তো ফরাসি দেশে তৈরি। ৫৭ লাখ মুসলিমকে যদি ফরাসি দেশ বর্জন করে, তাহলে কী উপায় হবে? বর্জন এক তরফে কেন, দুই তরফেই তো হওয়া উচিত। ফরাসি দেশে বসে থাকা মূর্খগুলো কী করতে চায়? ওরা তো দ্রব্যও বর্জন করতে চায় না, দেশও বর্জন করতে চায় না। ওরা বরং ছুরি শানায় আর কারও মুণ্ডু আল্লাহু আকবর বলে ধড় থেকে আলাদা করা যায় কি না।
মূর্খদের মস্তিষ্ক থাকে ওদের লিঙ্গে। ওই লিঙ্গ দিয়েই ওরা চিন্তাভাবনা করে। খোয়াব দেখে ৭২ হুরের সঙ্গে অনন্তকাল বিরতিহীন সঙ্গমের, খোয়াবটা দেখায় ওই লিঙ্গ। যে এই খোয়াবের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, তাকে নিয়ে মশকরা? রক্তের সাগরে ওরা ডুবিয়ে ফেলবে দুনিয়া!
৯. কার্টুন
ইউরোপের এক বিশাল বিলবোর্ডে দেখলাম ওই কার্টুনটি দেখানো হচ্ছে। ওই কার্টুনের কারণে উম্মতেরা কাকে হত্যা করেছে, তাও দেখানো হচ্ছে। কার্টুন দেখতে দেখতেই উম্মতদের চোখ সইবে। চোখ সওয়ানোটা খুব জরুরি। মধ্যযুগে উনির উম্মতেরা তো উনির প্রচুর মিনিয়েচার এঁকেছেন! তখন তো আগুন জ্বলেনি! কে বলেছে আমরা মধ্যযুগে ফিরে গেছি। মধ্যযুগ এই যুগের চেয়ে ঢের ভালো ছিল। মুসলিমদের মধ্যে জ্ঞানচর্চা বাড়ছিল, মুসলিমরা আলোকিত ছিল, সেই মুতাজিলার সময়ে তো কোরান মানুষের লেখা বলে প্রচুর মুসলিম ঘোষণা করেছিল, না, কেউ তাদের হত্যা করেনি। আমরা ১৪০০ বছর আগেও ফিরিনি। ১৪০০ বছর আগে উনি রাজত্ব দখল করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার আগে তো মানুষ যুক্তি দিয়ে কথা বলতে পারতো, উনির আসমানের গল্প নিয়ে বিদ্রুপ করতে পারতো, উনিকে পেটাতেও পারতো, একবার তো মেরে দন্ত মোবারক ভেঙে দিয়েছিল।
আমরা আসলে বর্তমানেই আছি, যে বর্তমানটি সব যুগের চেয়ে ভয়ংকর যুগ। এই যুগে কথা বলা যাবে না, চোখ তোলা যাবে না, চুল দেখানো যাবে না, বাহু দেখানো যাবে না, ছবি আঁকা যাবে না, কার্টুন আঁকা যাবে না, নাচা যাবে না, গাওয়া যাবে না।