সদরঘাটে জাহাজটা থামার আগেই সবাই দেখতে পেল সেখানে টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে অনেক সাংবাদিক দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজটা জেটিতে লাগার সাথে সাথে তারা লাফিয়ে জাহাজে উঠে এল। একটু পরেই দেখা গেল শামস জাহাজের রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে ইন্টারভিউ দিচ্ছে। ডুবোচরে জাহাজটা কেমন করে আটকে গেল, কেমন করে ডাকাতের দল আক্রমণ করল, কেমন করে তাদের পরাস্ত করা হল–তার রোমহর্ষক বর্ণনা। রাতুল তার ব্যাকপেকটা ঘাড়ে নিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়। বাচ্চারা তাকে ঘিরে ধরল। সে একজন একজন করে তাদের সবাইকে একবার বুকে চেপে ধরল।
রাতুল তুষার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার জন্যে এদিক-সেদিক তাকাল। সে কোথাও নেই। মনে হয় ওপরে টেলিভিশনের লোকজনের সঙ্গে আছে। শামস ইন্টারভিউ দিচ্ছে। সে হয়তো মুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাতুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করে। জ্বরটা কমেছে, কিন্তু পায়ে এখনও অনেক ব্যথা। মনে হয় অনেক দিন ভোগাবে। জাহাজ থেকে নেমে সে জেটি ধরে হাঁটতে থাকে। তখন কোথা থেকে রাজা দৌড়ে এসে তার হাত ধরল।”ভাই!”
“কী খবর রাজা?”
“আমারে একটা জিনিস বলবেন?”
“কী জিনিস?”
“আপনি সবকিছু করলেন, সব ডাকাত ধরলেন–”
“আমি একা তো না। তুমি ছিলে, অন্যরাও ছিল।”
“কিন্তু আপনি ছিলেন আসল। অন্য সবাই ফাউ।”
“কেউ ফাউ না। সবাই আসল।”
“কিন্তু টেলিভিশনের লোকেরা আপনার সাথে কথা না বলে ওই ভুয়া লোকটার সাথে কথা বলে কেন?”
রাতুল থামল, হাত দিয়ে রাজার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, “আমার দিকে তাকাও। পায়ে জুতা নাই, খালি পা। শার্টটা দেখ, কত ময়লা। প্যান্টের অবস্থা দেখ, ছিঁড়ে গেছে। রক্ত লেগে আছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চুল জট পাকিয়ে গেছে। দেখে মনে হয় একজন ফালতু মানুষ। ঠিক কি না?”
“কিন্তু কিন্তু–”
“কোনো কিছু নাই। টেলিভিশনের লোকেরা আমার মতো ফালতু মানুষের কাছে আসে না। তারা যায় বিখ্যাত লোকের কাছে। যাদের চেহারা সুন্দর, যারা সুন্দর করে কথা বলতে পারে, তাদের দেখলে মানুষ খুশি হয়।”
রাজা মাথা নাড়ল। বলল, “ব্যাপারটা ঠিক হল না ভাই। কিন্তু আপনি ছিলেন বলে সবাই বেঁচে গেছে। আপনার কী সাহস, কী বুদ্ধি! আমি তাজ্জব হয়ে যাই।”
“থ্যাংক ইউ রাজা।”
রাতুল তার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাজার দিকে এগিয়ে দিল। সেও তার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সেটাকে স্পর্শ করল। ভালোবাসার স্পর্শ। রাজা চোখ মুছে রাতুলের দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল।
.
ঠিক তখন পুলিশ ডাকাতের দলটাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। শামস আর তৃষা একটু সরে গিয়ে পুরো দলটাকে যাবার জন্যে একটু জায়গা করে দিল। হাতকড়া পড়া অবস্থায় যেতে যেতে হঠাৎ নসু ডাকাত দাঁড়িয়ে গেল। এদিক-সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ওই ছেলেটা কই?”
তৃষা জিজ্ঞেস করল, “কোন ছেলেটা?”
“যে আমাদের সবাইরে ধরল।”
তৃষা শামসকে দেখিয়ে বলল, “এই যে।”
“ধুর। এই শালারে তো দেখি নাই কিছু করতে। হালকা-পাতলা ছেলেটা কই? যার জন্যে আমরা ধরা পড়লাম।”
শামসের মুখ লাল হয়ে ওঠে, সে তৃষাকে বলল, “চলো যাই।”
তৃষা দাঁড়িয়ে পড়ল, নসু ডাকাতকে জিজ্ঞেস করল, “কোন ছেলেটা?”
নসু ডাকাত হঠাৎ জেটিতে রাতুল আর রাজাকে দেখতে পায়। মুখ দিয়ে দেখিয়ে বলল, “ঐ যে যাচ্ছে। সাথে বিচ্ছু পোলাটাও আছে!”
“রাতুল? রাজা?”
নসু ডাকাত একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “তোমাদের খুব কপাল ভালো জাহাজে ঐ ছেলেটা ছিল। তোমাগোর উপর নিশ্চয়ই আল্লাহর দোয়া আছে। তা না হলে এই জাহাজে এই ছেলে থাকে? বাপরে বাপ! কী সাহস! মাথার মধ্যে কী বুদ্ধি! মানুষ না–একেবারে বাঘের বাচ্চা।”
“বাঘের বাচ্চা?”
“হ্যাঁ। কোনোদিন চিন্তা করি নাই নসু ডাকাতরে কেউ ধরতে পারবে। কিন্তু আমি এর কাছে পারলাম না। একেবারে বাঘের বাচ্চা। এর পা ধরে সালাম করা দরকার।”
পুলিশ তখন হ্যাঁচকা টান দিয়ে নসু ডাকাতকে অন্যদের সাথে টেনে সরিয়ে নিয়ে যায়। তৃষা ঘুরে শামসের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বলল, “আসলে কী হয়েছিল শামস ভাই? আসলে কে আমাদের উদ্ধার করেছিল?”
তৃষা হঠাৎ প্রায় ছিটকে শামস থেকে সরে এল।
শামস আমতা আমতা করে বলল, “না মানে ইয়ে–”
তৃষা একদৃষ্টিতে শামসের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে আর অবাক হয়ে আবিষ্কার করে, সুদর্শন মানুষটি কী বিচিত্রভাবে দুমড়ে-মুচড়ে একজন অসুন্দর মানুষে পাল্টে যাচ্ছে!
.
রাজাকে বিদায় দিয়ে রাতুল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ শুনতে পেল পেছন থেকে কে যেন চিৎকার করে ডাকছে–”রাতুল, রাতুল।”
রাতুল ঘুরে তাকাল। তৃষা ছুটতে ছুটতে আসছে। কাছে এসে সে খপ করে রাতুলকে ধরল। ছুটে এসেছে বলে এখনও হাঁপাচ্ছে। রাতুল জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে তৃষা?”
“তুই… তুই…” তৃষা কথা বলতে পারল না। হঠাৎ ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল।
রাতুল অবাক হয়ে বলল, “কী হল? কাঁদছিস কেন?”
“আমাকে কেউ কিছু বলেনি।”
“কী বলেনি?”
“তুই সবাইকে বাঁচানোর জন্যে কী করেছিস! কী সাংঘাতিক কাণ্ড করেছিস! আমি কিছু জানতাম না। একটু আগে যখন নসু ডাকাত বলল–”
“নসু ডাকাত! কী বলেছে?”
“বলেছে, তুই বাঘের বাচ্চা। বলেছে, সবার তোর পা ধরে সালাম করা উচিত। বলেছে–”
তৃষা আবার কাঁদতে শুরু করে। রাতুল এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, “তুই কান্না থামাবি? চারপাশে সবাই ভাবছে, আমি তোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি, আর তাই তুই কাঁদছিস। এক্ষুনি কান্না থামা। তা না হলে পাবলিক ধরে আমাকে পিটিয়ে দেবে।”
“তুই আমাকে ধরে একটু মায়া করে দে, প্লীজ–”
রাতুল হাত দিয়ে তৃষাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কাঁদিস না প্লীজ। তোকে কাঁদতে দেখলে আমার ভিতরে সব ওলটপালট হয়ে যায়।”
তৃষা চোখ মুছে বলল, “তুই আমাকে ধরে রাখ। তা হলে আমি আর কাঁদব না।”
রাতুল তৃষাকে শক্ত করে ধরে বলল, “এই যে ধরেছি।”
তৃষা তখন চোখ মুছে বলল, “আমি খুব বোকা।”
“ধুর! বোকা কেন হবি?”
তৃষা মাথা নেড়ে বলল, “আমি জানি, আমি আসলে খুব বোকা। কিন্তু তুই আমার চাইতেও বোকা।”
রাতুল বলল, “তা হলে বোকাই ভালো। আমি বোকা তুই বোকি। দুইজন বোকাবুকি!”
তুষা হি হি করে হাসল। দুজনে নিঃশব্দে খানিকটা হেঁটে যায়। একসময় রাতুল বলল, “তা হলে আমরা দুইজন আবার বন্ধু?”
তৃষা মুখ টিপে হাসল। বলল, “বন্ধু থেকে বেশি।”
রাতুল চোখ বড় বড় করে বলল, “বন্ধু থেকে বেশি?”
“হ্যাঁ।”
“কত বেশি? একটুখানি?”
তৃষা মাথা নাড়ল, “না। মনে হয় অনেকখানি।” রাতুল তৃষার চোখের দিকে তাকাল। তৃষা রাতুলের চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চোখ নামিয়ে নেয়।
.
সদরঘাটের ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাতুলের মনে হল চারপাশে কোনো মানুষ নেই, ভিড় নেই, গাড়ি নেই। রিকশা, দোকানপাট–কিচ্ছু নেই। তার মনে হল, বুঝি শুধু তারা দুইজন হাঁটছে।
শুধু দুইজন।