রাতুলের রাত রাতুলের দিন – কিশোর উপন্যাস – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
রাতুল ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল। চোখ কচলে সে ঘড়িটার দিকে তাকায়, তার চোখে-মুখে প্রথমে অবিশ্বাস তারপর আতঙ্কের একটা ছায়া পড়ল। আটটার সময় তার সদরঘাট লঞ্চঘাটে পৌঁছানোর কথা-নয়টার সময় চিলড্রেনস ফিল্ম সোসাইটির একটা জাহাজ সেখান থেকে ছেড়ে যাবে। তার সেই জাহাজে করে যাবার কথা ছিল। রাতুল অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে, ঘড়িটাতে ঠিক নয়টা বাজে, ঘণ্টার কাঁটা আর মিনিটের কাঁটা নিখুঁত নব্বই ডিগ্রি। সাতটার সময় তার ঘুম থেকে ওঠার কথা ছিল, মোবাইল ফোনে সে সাতটার অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়েছিল, সে উঠেছে নয়টার সময়, দুই ঘণ্টা পর।
রাতুল বালিশের নিচ থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে, রাতে কোনো একসময় ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রাতুল অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তার মোবাইল ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকে, এরকম বিশ্বাসী একটা ফোন তার সঙ্গে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করবে সে এখনও বিশ্বাস করতে পারে না। তৃষা নিশ্চয়ই অনেকবার তাকে ফোন করেছে, ফোন বন্ধ, কোনো লাভ হয়নি।
সপ্তাহ খানেক আগে তৃষা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল তাদের ফিল্ম সোসাইটি জাহাজ ভাড়া করে সুন্দরবন যাচ্ছে, ভলান্টিয়ার হয়ে সে সঙ্গে যেতে চায় কি-না। পরিচিত অনেকে মিলে জাহাজ ভাড়া করে সুন্দরবন যাওয়া খুব মজার একটা ব্যাপার কিন্তু এখানে তার জন্যে ব্যাপারটা অন্যরকম। তৃষাদের ফিল্ম সোসাইটির সবাই সবাইকে চেনে, তারা সবাই মিলে হইচই করতে করতে যাবে, শুধু সে তার মাঝে কাবাব-মে-হাড্ডি হয়ে ঘুরে বেড়াবে–ব্যাপারটা চিন্তা করেই তার উৎসাহ কমে যাবার কথা ছিল। রাতুলের উৎসাহ কমেনি, তার কারণ হচ্ছে তৃষা। সারা জাহাজে তার একমাত্র পরিচিত মানুষ হবে তৃষা এবং সেই তৃষার সাথে চব্বিশ ঘণ্টা সে এক জাহাজে থাকবে সেটা চিন্তা করেই সে এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল। তৃষা তখন সব ব্যবস্থা করেছে–আটটার ভেতরে তার সদরঘাট পৌঁছানোর কথা, নয়টার ভেতর জাহাজ ছেড়ে দেবার কথা। অথচ সে ঘুম থেকে উঠেছেই নয়টার সময়-কাঁটায় কাঁটায় নয়টায়। কী ভয়ংকর কথা!
ফোনটা চার্জারে লাগিয়ে সে তৃষাকে ফোন করতে পারে। ফোন করে সে কী বলবে?”আমি খুবই দুঃখিত তৃষা, ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল তাই অ্যালার্ম বাজেনি। সেই জন্যে উঠতে পারিনি।” তৃষা কী বলবে রাতুল অনুমান করতে পারে, “আমি জানতাম! তুই কোনো কাজ ঠিক করে করতে পারিস না। কেন করতে পারিস না সেই কৈফিয়তটা শুধু ঠিক করে দিতে পারিস।” তারপর একটুও রাগ না হয়ে খুব ঠাণ্ডা গলায় বলবে, “ভালো থাকিস রাতুল।”
রাতুল শরীর থেকে কম্বলটা সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে প্রথমবার পুরো ব্যাপারটা একটু চিন্তা করার চেষ্টা করে। মাথার মাঝে চিন্তাগুলো কেমন জানি জট পাকিয়ে যাচ্ছিল, তারপরও সে মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করল। এই দেশে কোনো কাজ কেউ সময়মতো করতে পারে না, তাই যে জাহাজটা নয়টার সময় ছেড়ে যাবার কথা সেটা নিশ্চয়ই কোনোভাবেই নয়টার সময় ছেড়ে যেতে পারবে না, সেটা নিশ্চয়ই এখনও লঞ্চঘাটে আছে। আজ শুক্রবার, তাই রাস্তাঘাটে ভিড় খুব বেশি নেই, সে যদি এই মুহূর্তে রওনা দেয় তা হলে–ভাগ্য ভালো হলে ”হয়তো”–জাহাজটা ধরে ফেলতে পারবে।
রাতুল তখন লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামল। যে ঢিলে পায়জামা আর টি শার্ট পরে ঘুমিয়েছিল তার ওপরেই জিনসের প্যান্ট আর একটা শার্ট পরে নেয়। বোম লাগিয়ে সময় নষ্ট করল না, মোজা পরে টেনিস স্যু-টা পায়ে পরে নেয়। বাথরুম থেকে এক খাবলা দিয়ে টুথব্রাশ টুথপেস্ট রেজরগুলো তুলে ব্যাকপেকে ঢুকিয়ে নিল। চেয়ারের ওপর রাখা সোয়েটারটা গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে টান দিয়ে বিছানার চাদরটা ব্যাকপেকে ঢুকিয়ে ফেলে। বের হয়ে যাবার সময় শেষ মুহূর্তে তার মানিব্যাগটার কথা মনে পড়ল, ড্রয়ার খুলে সেটা বের করে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে সে ছুটতে থাকে। গেটের কাছে কে যেন বলল, “এই যে ভাই জুতার ফিতা খোলা।” রাতুল ছুটতে ছুটতে বলল, “জানি।”
মোড়ে সবসময় কয়েকটা সিএনজি থাকে, আজকে নেই। রাতুল একটা নিশ্বাস ফেলে এদিক-সেদিক তাকায়, একটা বাস আসছে, কত নম্বর বাস কোন দিকে যাচ্ছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না, চলন্ত বাসে লাফ দিয়ে উঠে গেল। বাসটা ভুল দিকে রওনা দেওয়ার সময় কন্ডাক্টরের সাথে ঝগড়া করে সে নেমে গেল। নামতেই একটা কালো রঙের ক্যাব। দরজা খুলে ঢুকে সে চিৎকার করতে থাকে, গুলিস্তানের কাছে একটা ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়তেই ভাড়া মিটিয়ে নেমে সে ছুটতে থাকে। ভিড়টা পার হয়ে সে একটা সিএনজি পেয়ে গেল, খানিকদূর পর আবার জটলা, আবার নেমে সে ছুটতে থাকে। রাস্তা ফাঁকা হবার পর সে হাট্টাকাট্টা জোয়ান একটা রিকশাওয়ালা পেয়ে গেল, সে বাকি পথটা তাকে মোটামুটি উড়িয়ে নিয়ে এলো।
সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালে নেমে সে ছুটতে ছুটতে ভেতরে ঢুকে যায়। জেটিতে সারি সারি লঞ্চ আর জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে তার মাঝে কোনটা তাদের বোঝার উপায় নেই। টেলিফোনে চার্জ থাকলে তৃষাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারত কিন্তু এখন তারও উপায় নেই। মানুষজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে সে এগিয়ে যায়, যখন আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে তখন রাতুল জাহাজটাকে দেখতে পেল। জাহাজের ওপর বড় একটা ব্যানার টানানো, সেখানে চিলড্রেন ফি। সোসাইটির নাম এবং লোগো। রাতুলের মনে হল জাহাজটা না দেখতে পেলেই হয়তো ভালো হত, কারণ সেটা এইমাত্র ছেড়ে দিয়েছে এবং জেটি থেকে সরতে শুরু করেছে। রাতুল যখন ছুটে কাছে গিয়েছে তখন সেটা আট দশ ফুট সরে গিয়েছে, আর কয়েক সেকেন্ড আগে এলেই সে লাফিয়ে উঠে যেতে পারত।
রাতুল হতবুদ্ধি হয়ে জাহাজটার দিকে তাকিয়ে থাকে। বুড়িগঙ্গার কুচকুচে কালো পানিতে আলোড়ন তৈরি করে দুটি লঞ্চের মাঝখান থেকে জাহাজটা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। রাতুল লঞ্চ দুটির দিকে তাকাল, তার হঠাৎ মনে হল, সেগুলোর কোনো একটা থেকে হয়তো এখনও লাফিয়ে জাহাজটাতে ওঠা সম্ভব।
রাতুল চিন্তা করে সময় নষ্ট করল না। ডান পাশের লঞ্চে উঠে সে পেছনের দিকে ছুটতে থাকে। একতলা থেকে লাফ দেওয়া সম্ভব নয়, তাই মানুষজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সে দোতলায় উঠে যায়। জাহাজটা এখন ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করেছে। লঞ্চ থেকে সেটা অনেকখানি সরে গেছে, শুধু পেছনের অংশটুকু এখনও কাছাকাছি আছে। রাতুল ছুটতে ছুটতে লঞ্চের পেছনে এসে দাঁড়াল। জাহাজটার মাঝামাঝি অংশ তার সামনে, সে যদি ঠিক করে লাফ দিতে পারে তা হলে হয়তো জাহাজটার রেলিংটা ধরে ফেলতে পারবে। যদি না পারে তা হলে–রাতুল মাথা থেকে চিন্তাটা সরিয়ে দিল, এখন চিন্তা করে নষ্ট করার সময় নেই। যদি সে লাফ দিয়ে জাহাজটা ধরতে চায় তা হলে এখনই লাফ দিতে হবে, কোনো ভালো-মন্দ, সম্ভব-অসম্ভব চিন্তা না করেই।
রাতুল লাফ দিল, অসংখ্য মানুষের চিৎকার শুনতে পেল সে, সেটা সত্যি না কী মনের ভুল বুঝতে পারল না। যে রেলিংটা ধরার কথা সেটা সে ধরতে পারল, হাত ফসকে পড়ে যাচ্ছিল, নিচে কুচকুচে কালো পানিতে বিপজ্জনক আলোড়ন, এক্ষুনি সে সেখানে ডুবে যাবে, ঠিক তখন তার হাতে কিছু একটা আটকে গেল। রাতুল খপ করে সেটাই ধরে ফেলল। কী ধরেছে সেটা সে জানে
কিন্তু আপাতত সে রক্ষা পেয়েছে, বুক থেকে সে একটা নিশ্বাস বের করে দেয়। শরীরের কোথায় জানি খুব চোট লেগেছে জায়গাটা সে ধরতে পারল না কিন্তু সেটা নিয়ে এই মুহূর্তে মাথা না ঘামালেও চলবে। যে রেলিংটা তার ধরার কথা ছিল রাতুল হাত বাড়িয়ে সেটা ধরল এবং নিজেকে টেনে খানিকটা ওপরে তুলে আনল। জাহাজটার গতি অনেক বেড়ে গিয়েছে, বাড়ক, তার কোনো সমস্যা নেই–সে এখনও রেলিং ধরে ঝুলে আছে সত্যি কিন্তু সে আর পড়ে যাবে না।
রাতুল প্রথমবার লক্ষ করল রেলিংয়ের অন্য পাশে অনেকগুলো বাচ্চা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাতুল বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল, কিন্তু সেটা খুব কাজ করল বলে মনে হল না, বাচ্চাগুলো হাসির উত্তর না দিয়ে এখনও ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
রাতুল এবার সাবধানে রেলিংয়ের ওপর নিজেকে টেনে তুলে জাহাজের শক্ত মেঝেতে পা দিয়ে বুকের ভেতর থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দেয়।
আট-দশ বছরের একটা ছেলে রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্পাইডারম্যান।”
অন্য সবাই তখন মাথা নাড়ল, বলল, “স্পাইডারম্যান।”
ছোট একটা মেয়ে বলল, “স্পাইডারম্যান, তোমার হাত কেটে গেছে।”
রাতুল দেখল তার কনুইয়ের কাছে সত্যি সত্যি বেশ খানিকটা জায়গা থেকে ছাল উঠে গিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। সে হাত দিয়ে রক্তটা মোছার চেষ্টা করে বলল, “স্পাইডার রাড।”
বাচ্চাদের মুখে এবার হাসি ফুটে ওঠে, তারা মাথা নেড়ে বলল, “স্পাইডার ব্লাড। স্পাইডার ব্লাড।”
“উঁহু স্পাইডার ব্লাড না।” গলার স্বর শুনে রাতুল পিছন ফিরে তাকাল, কখন সেখানে তৃষা এসে দাঁড়িয়েছে সে জানে না। কটকটে কমলা রঙের একটা টি-শার্ট, মাথায় নীল রঙের বেসবল ক্যাপ, হাতে একটা ফাইল এবং মুখে কামড়ে ধরা একটা বলপয়েন্ট কলম। তৃষা বলপয়েন্ট কলমটা মুখ থেকে সরিয়ে কানের ওপর খুঁজে নিয়ে বলল, “স্পাইডার ব্লাড লাল রঙের হয় না, স্পাইডার ব্লাড হয় সাদা।”
রাতুল হাসি হাসি মুখ করে বলল, “তৃষা!”
তৃষা মুখ শক্ত করে বলল, “তোর এখানে আসার কথা ছিল সকাল আটটায়। যখন সবাই জাহাজে উঠতে থাকে তখন। তখন ভলান্টিয়ারদের দরকার হয়। তুই একজন ভলান্টিয়ার–”
“আসলে হয়েছে কী–”
“সকাল সাতটা থেকে আমি তোকে ফোন করছি। তোর ফোন বন্ধ”আসলে, ইয়ে মানে ফোনের চার্জ-”
“আসার কথা আটটার সময়, আর তুই এসেছিস দশটার সময়।” রাতুল দুর্বলভাবে বলার চেষ্টা করল, “এখনও দশটা বাজেনি।”
তৃষা রাতুলের কথাকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে বলল, “শুধু যে দশটার সময় এসেছিস তা নয়, এসে একটা মহা কেরানি দেখালি। এক জাহাজ থেকে লাফ দিয়ে অন্য জাহাজে উঠে গেলি–আমাদের রিয়েল লাইফ স্পাইডারম্যান।”
“আসলে ঠিক তখন জাহাজটা ছেড়ে দিল–”
“জাহাজ তো ছেড়ে দিবেই। জাহাজ তোর জন্যে বসে থাকবে না। আর যদি জাহাজ ছেড়ে দেয় তা হলে তোর উচিত ছিল জেটিতে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে আমাদের গুডবাই বলা। তোর স্পাইডারম্যান হয়ে এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে লাফ দেবার কথা না। যদি কিছু একটা হত? যদি পানিতে পড়ে যেতি”
“আমি খুব ভালো সাঁতার জানি। বুড়িগঙ্গার পানিতে এত পলিউশান যে, সাঁতার না জানলেও ভেসে থাকার কথা।”
“ফাজলেমি করবি না। সাঁতার জানা না জানার কথা হচ্ছে না। কাছাকাছি এতগুলো লঞ্চ, জাহাজ–তাদের প্রপেলার ঘুরছে। পানির টানে যদি প্রপেলারে ঢুকে যাস তা হলে টুকরো টুকরো হয়ে যাবি। মানুষ বোকা না হলে এরকম রিস্ক নেয়?”
রাতুল হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমি তো কখনও দাবি করিনি আমি বুদ্ধিমান।”
“তাই বলে এত বোকা–”
“আসলে, আসলে–”
“আসলে কী?”
রাতুল আশেপাশে তাকাল, তারপর গলা নামিয়ে বলল, “তুই আশেপাশে থাকলেই আমি কেমন জানি বোকা হয়ে যাই। খোদার কসম।–”
তৃষা সরু চোখে কিছুক্ষণ রাতুলের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “দেখ রাতুল, তোকে একটা ব্যাপার খুব ভালো করে বলে দেওয়া দরকার।”
“কী?”
“তুই আর আমি হচ্ছি বন্ধু। বুঝেছিস? বন্ধু।”
“বুঝেছি।”
“শুধু বন্ধু।” তৃষা ”শুধু” কথাটাতে অনাবশ্যকভাবে জোর দিল। রাতুল মাথা নাড়ল, বলল, “মনে আছে। শুধু বন্ধু।” রাতুলও শুধু কথাটাতে জোর দিল, অপ্রয়োজনীয় এবং অনাবশ্যক জোর!
.
রাতুল যেহেতু এই জাহাজের কাউকে চেনে না তৃষা তাই তাকে নিয়ে বের হল সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। প্রথমে দেখা হল আলমগীর ভাইয়ের সাথে। আলমগীর আলম মৌটুসি অ্যাড ফার্মের মালিক, মৌটুসি তার মেয়ের নাম। মেয়ের বয়স আট। যার অর্থ আট বছরের মাঝে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে আলমগীর আলম ফার্মটি দাঁড় করিয়েছেন। সেখান থেকে যে টাকা-পয়সা আসে তার বেশিরভাগ ফিল্ম সোসাইটির পেছনে খরচ করেন। গত বছর মাহী এবং তার লাল বেলুন’ নামে বাচ্চাদের জন্যে একটা সিনেমা তৈরি করেছেন–সিনেমাটা পুরোপুরি ফ্লপ গেছে কিন্তু সেটা নিয়ে তার খুব একটা মাথাব্যথা নেই। সিনেমার জগতে তার সাফল্যের কোনো ইতিহাস না থাকলেও আলমগীর আলমের অন্য একটা বড় গুণ আছে, যে কোনো বয়সের মানুষকে একত্র করিয়ে তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারেন।
আলমগীর ভাই ডেকে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলেন, তৃষাকে দেখে বললেন, “সব ঠিক আছে তুষা?”
“ঠিক আছে। নো প্রবলেম।” তারপর রাতুলকে দেখিয়ে বলল, “এই হচ্ছে রাতুল, যার কথা বলেছিলাম। নতুন ভলান্টিয়ার।”, আলমগীর ভাই রাতুলকে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলেন, তারপর বললেন, “আমার মেয়ে মৌটুসি একটু আগে আমাকে বলে গেছে তুমি না কি স্পাইডারম্যানের মতো উড়তে পার। আকাশ থেকে উড়ে না কি ল্যান্ড করেছ।”
রাতুল অপ্রস্তুতের মতো হেসে বলল, “কাজটা খুব স্টুপিডের মতো হয়েছে–”
“বাচ্চাদের তা মনে হয়নি। তারা খুবই ইমপ্রেসড। সবাই এখন ওড়া প্র্যাকটিস করছে। জাহাজের ভেতরে থাকলে ঠিক আছে–জাহাজ থেকে বাইরে না উড়ে যাবার চেষ্টা করে!”
রাতুল মাথা নাড়ল, “করবে না। বাচ্চারা ছোট হতে পারে কিন্তু তারা আমার মতো গাধা না।”
আলমগীর ভাই হাসলেন, সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, “না, না–গাধা কেন হবে। তৃষা সারাক্ষণ রাতুল রাতুল করতে থাকে। তুমি গাধা হলে তৃষা তোমাকে পাত্তা দিত মনে করেছ?”
তৃষা চোখ পাকিয়ে বলল, “আমি কখন রাতুল রাতুল করেছি আলমগীর ভাই? মোটেও করিনি। শুধু গত সপ্তাহে
আলমগীর ভাই তৃষাকে থামালেন, “ঠিক আছে করনি। মাই মিসটেক।” তারপর রাতুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওকে রাতুল। ওয়েলকাম টু আওয়ার ফ্যামিলি। তৃষা হচ্ছে আমাদের কমান্ডার ইন চিফ। তার আন্ডারে আমাদের ভলান্টিয়ার বাহিনী-–তুমিও সেই বাহিনীতে যোগ দিয়ে দাও।”
“জি দেব। সেই জন্যে উড়ে চলে এসেছি।”
“গুড। আবার উড়ে চলে যাবে না তো!”
“না যাব না।”
তৃষা তারপর রাতুলকে নিয়ে অন্য ভলান্টিয়ারদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। বেশিরভাগই তাদের মতো ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রী। হাসি-খুশি উজ্জ্বল চেহারার ছেলেমেয়ে। তৃষার বন্ধু-বান্ধব। ছোট বাচ্চাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হল না। তারা সবাই তাকে স্পাইডার ভাইয়া ডাকছে। সেজেগুঁজে থাকা কিছু পুরুষ-মহিলাও আছেন। তৃষা রাতুলকে নিয়ে তাদের কাছে গেল না। গলা নামিয়ে বলল, “এরা হচ্ছে আমাদের স্পন্সরদের ফ্যামিলি। আমি নিজেও চিনি না। এদের বেশি খাতির-যত্ন করতে হবে, যেন সামনের বছরও আমাদের স্পন্সর করে।”
দোতলার কেবিনের কাছে গিয়ে বলল, “এই কেবিনে আমাদের ইনভাইটেড গেস্টরা আছে। বড় বড় মানুষজন, কবি-সাহিত্যিক ফিল্ম মেকার। বিকেলে যখন সবাইকে নিয়ে গেট টুগেদার হবে, তখন তাদের সাথে পরিচয় হবে। আমরা এদের ঘাটাই না।”
“কেন?”
“কবি-সাহিত্যিক ফিল্ম মেকার এরা হচ্ছে ক্রিয়েটিভ মানুষ। ক্রিয়েটিভ মানুষদের থেকে দূরে থাকতে হয়।”
“কেন?”
“এরা কখন কী করবে বলা মুশকিল। সবসময় ভালো করে কিছু দেখে না, বোঝে না, কিছু নিয়ে মাথা ঘামায় না। উদাস উদাস ভাব। কিন্তু আসলে চোখের কোনা দিয়ে সবকিছু দেখে, সবকিছু বোঝে। আয়নার সামনে আধাঘণ্টা দাঁড়িয়ে, চুল এলোমেলো করে চেহারায় উদাস উদাস ভাব আনার জন্যে!”
তৃষার কথার ভঙ্গি শুনে রাতুল হেসে ফেলল। বলল, “তুই কবি সাহিত্যিকদের ওপর খুব খ্যাপা মনে হচ্ছে।”
“শুধু কবি-সাহিত্যিক না। কবি-সাহিত্যিক আর ফিল্ম মেকার।”
“কেন?”
“কাছে থেকে দেখিসনি তো সেই জন্যে জিজ্ঞেস করছিস। এখানে এসেছিস, এখন কাছে থেকে দেখবি। তা হলে বুঝতে পারবি।”
.
দুপুরবেলাতেই রাতুল তৃষার কথাটার অর্থ বুঝতে পারল। সদরঘাট থেকে রওনা দিয়ে জাহাজটা তখন অনেক দক্ষিণে চলে এসেছে। প্রথম কয়েক ঘণ্টা নদীর দুপাশে শুধু ইটের ভাটা, পৃথিবীতে ইটের ভাটা থেকে কুৎসিত কিছু হতে পারে কি-না রাতুলের জানা নেই। ধীরে ধীরে ইটের ভাটা কমে এলো, তখন মাঝে মাঝে গ্রাম উঁকি দিতে থাকে, একসময় প্রায় হঠাৎ করে দেখা গেল নদীর দুই পাশে শুধু গ্রাম আর গ্রাম। বাংলাদেশের সবুজ গ্রাম। রাতুল রেলিংয়ে ভর দিয়ে নদী তীরে তাকিয়ে ছিল, তখন তৃষা তাকে নিচে ডেকে পাঠাল।
রাতুল নিচে গিয়ে দেখে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, ছোট বাচ্চারা হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করছে। বড়দের আলাদা লাইন, সেখানে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের মুখে এক ধরনের অপ্রস্তুত ভাব, বোঝাই যাচ্ছে খাবারের জন্যে তাদের লাইনে দাঁড়ানোর অভ্যাস নেই। রাতুলকে দেখে তৃষা বলল, “রাতুল, তুই বাচ্চাদের সামলা।”
“কী করতে হবে?”
“প্লেটে খাবার তুলে দে। আমি আসছি।”
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“কেবিনে।” তারপর গলা নামিয়ে বলল, “কবি-সাহিত্যিক, ফিল্ম মেকারদের ডেকে আনি।”
টেবিলের ওপর বড় বড় গামলায় খাবার, তাকে খাবার তুলে দিতে হবে। বাচ্চাদের লাইনে সবার আগে দাঁড়ানো ছোট মেয়েটা, খাবারের দিকে তাকিয়ে নাক কুঁচকে বলল, “আর কিছু নাই?”
রাতুল থতমত খেয়ে বলল, “আর কী চাও?”
“হাম বার্গার।”
“না।” রাতুল মাথা নাড়ল, বলল, “না আজকে শুধুমাত্র ডাইনোসরের মাংস।”
সামনে দাঁড়ানো বাচ্চাগুলো একসাথে চিৎকার করে উঠল, “ডাইনোসর?”
“হ্যাঁ।” রাতুল গম্ভীর হয়ে একটা মুরগির রান ওপরে তুলে বলল, “এই দেখো ডাইনোসরের ঠ্যাং।”
সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা হি হি করে হেসে বলল, “এটা চিকেন?”
“মোটেও চিকেন না। এটা ডাইনোসর।”
“ডাইনোসর কত বড় হয়—”
“এগুলো ডাইনোসরের বাচ্চা। দাও প্লেট দাও।”
মেয়েটা প্লেট এগিয়ে দিল। রাতুল প্লেটে এক চামচ ভাত দিয়ে বলল, “শুধু ডাইনোসরের ঠ্যাং খেলে তো হবে না। সাথে কিছু ঘাসের বিচি দিয়ে দিই। ফ্রেশ জঙ্গল থেকে তুলে এনেছি।”
মেয়েটা আনন্দে হাসতে থাকে, সবজিটা দেখিয়ে বলে, “আর এটা কী?”
রাতুল এক চামচ সবজি তুলে বলল, “এর সাথে অনেক কিছু আছে। মাদাগাস্কার থেকে এসেছে টিউবারসাম, অস্ট্রেলিয়া থেকে লাইকোপারসিকাম, উরুগুয়ে থেকে ব্রাসিকা ওলেরাসিয়া, আর্জেন্টিনা থেকে মেলংগিনা–”
রাতুল আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, মেয়েটা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “মিথ্যা কথা, মিথ্যা কথা–এটা সবজি।”
“এটা মোটেও সবজি না।” রাতুল মুখ গম্ভীর করে বলল, “এর মাঝে অনেক কিছু আছে। ভাইটামিন এ থেকে জেড পর্যন্ত সবকিছু আছে।”
মেয়েটা এবার একটু মজা পেয়ে গেছে, ডালটা দেখিয়ে বলল, “আর এটা কী?”
“এটা খুবই স্পেশাল স্যুপ। স্পেনের রাজার জন্যে তৈরি করেছিল, আমাদের স্পেশাল এজেন্ট তোমাদের জন্যে চুরি করে এনেছে। এর মাঝে আছে টারমারিক এলিয়াম আর গার্বাঞ্জো।”
মেয়েটা তার প্লেট হাতে নিয়ে চলে যাচ্ছিল, রাতুল তাকে থামাল, “দাম না। দিয়ে চলে যাচ্ছ?”
“দাম?”
“হ্যাঁ। এই খাবারের দাম দিতে হবে না?”
রাতুল ঠাট্টা করছে বুঝতে তার একটু সময় লাগল। বোঝা মাত্র তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, “কত দাম?”
“একশ ডলার।”
মেয়েটা হাত মুঠো করে তার দিকে হাত এগিয়ে দেয়, “এই নাও-এক মিলিয়ন ডলার।”
রাতুল খুশি হওয়ার ভান করে বলল, “থ্যাংকু। থ্যাংকু। তুমি নিশ্চয়ই একজন প্রিন্সেস। তা না হলে কেউ এত টাকা দেয়। কী নাম তোমার প্রিন্সেস?”
“মৌটুসি।”
“থ্যাংকু প্রিন্সেস মৌটুসি।” তারপর হাত ওপরে তুলে অদৃশ্য একটা কিছু ধরে গলা উঁচু করে বলল, “এই যে সবাই দেখ, প্রিন্সেস মৌটুসি আমাকে এক মিলিয়ন ডলার দিয়েছে।”
বাচ্চারা আনন্দের মতো শব্দ করল, বড়দের লাইনে দাঁড়ানো অনেকেই হাসি হাসি মুখ করে রাতুলের দিকে তাকাল।
একটু পর তৃষা এসে কয়েকটা প্লেটে খাবার সাজিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, রাতুল জিজ্ঞেস করল, “কার জন্যে নিচ্ছিস?”
“কবি-সাহিত্যিক ফিল্ম মেকার।”
“অন্যদের মতো লাইনে দাঁড়িয়ে নেয় না কেন?”
“তোর মাথা খারাপ হয়েছে? তারা লাইনে দাঁড়াবে?”
রাতুল দেখল কয়েকজন আধবুড়ো মানুষকে আলাদা করে বসিয়ে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে, তারা খুব গম্ভীরভাবে খাচ্ছে এবং অন্যরা তাদের সমাদর করছে।
একটু পরেই তৃষা এসে রাতুলের পাশে দাঁড়াল, বাচ্চারা রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি করে খাবার নিচ্ছে দেখে তৃষা একটু অবাক হয়ে বলল, “কী ব্যাপার? এরা রীতিমতো মারামারি করছে খাবার নিতে? আমরা ভেবেছিলাম এদের খাওয়া নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হবে। হামবার্গার, ফ্রায়েড চিকেন আর পিঞ্জা ছাড়া এরা আর কিছু খেতে চায় না।”
রাতুল হাসি হাসি মুখ করে বলল, “তোমরা যদি ভাত, মুরগির মাংস, সবজি, ডাল এসব খেতে দাও তা হলে তো বাচ্চারা আপত্তি করবেই।”
তৃষা বুঝতে না পেরে ভুরু কুঁচকে বলল, “মানে?”
“দেখছ না আজকের মেনু। ডাইনোসরের মাংস, ঘাসের বিচি” রাতুল সামনের ছোট ছেলেটার প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল, “সব শেষ করতে হবে কিন্তু। ঠিক আছে?”
ছেলেটা মাথা নেড়ে চলে যাচ্ছিল, রাতুল থামাল, “কী হল সুপারম্যান, টাকা দিলে না? একশ ডলার প্লেট।”
ছেলেটা লাজুক মুখে রাতুলের হাতে অদৃশ্য ডলার তুলে দিয়ে হাসল, দেখা গেল তার সামনের দুটি দাঁত নেই। রাতুল ভয় পাওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “সুপারম্যান, তোমার সামনের দুটি দাঁতের কী হয়েছে? ইঁদুরে খেয়ে ফেলেছে না কি? মুখ হাঁ করে ঘুমাচ্ছিলে নিশ্চয়ই
“না।” ছেলেটা ঝপ করে মুখ বন্ধ করে ফেলল।
”তা হলে?”
“পড়ে গেছে।”
“সর্বনাশ! এখন কী হবে?”
“আবার উঠবে।”
“যদি না ওঠে?”
ছেলেটা মুখ যথাসম্ভব বন্ধ রেখে বলল, “উঠবে, উঠবে।”
পেছনে দাঁড়ানো একটি মেয়ে বলল, “স্পাইডার ভাইয়া, তুমি জান না দাঁত পড়ে গেলে আবার ওঠে? যে দাঁতটা পড়ে যায় সেটাকে বলে দুধদাঁত।”
“আর যেটা ওঠে সেটাকে?”
“সেটা শুধু দাঁত।”
“উঁহু” রাতুল মাথা নাড়ল, সেটা হচ্ছে, “মাংস দাঁত।”
তৃষা খানিকক্ষণ রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই পারিসও বটে। ভাগ্যিস তোকে আসতে বলেছিলাম–বাচ্চাগুলোকে ম্যানেজ করতে পারবি।”
রাতুল গলা নামিয়ে বলল, “তুই যদি আমার পাশে থাকিস তা হলে আমি যে কোনো মানুষকে ম্যানেজ করতে পারব। চাইলে ওই কবি-সাহিত্যিক ফিল্ম মেকারদেরকেও
“ফাজলেমি করবি না।”
.
খাবার যখন শেষের দিকে তখন আধবুড়ো টাইপের একজন রাতুলের দিকে এগিয়ে এলেন, তুষার কবি-সাহিত্যিক ফিল্ম মেকারদের একজন। রাতুলের দিকে কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তুমি কী জান শিশুদেরকে কোমলমতি শিশুদেরকে কখনও প্রতারণা করতে হয় না?”
রাতুল ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। কোমলমতি, প্রতারণা–এসব শব্দ সে বইয়ে পড়েছে, মুখের কথায় কেউ ব্যবহার করতে পারে ধারণা করেনি। সে অবাক হয়ে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল।
আধবুড়ো টাইপের মানুষটি বললেন, “আমি লক্ষ করলাম শিশুগুলো বলছে তারা ডাইনোসরের মাংস খাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ডাইনোসরের মাংস খাওয়ার ভান করার জন্যে তারা তাদের আচরণে একটা বর্বরতার রূপ ফোঁটানোর চেষ্টা করছে।”
রাতুল চেষ্টা করে বলল, “আমি মানে ইয়ে–”
আধবুড়ো মানুষটি বললেন, “তারা মোটেও ডাইনোসরের মাংস খাচ্ছে না। কাজেই তাদেরকে সেটি বলা ভুল। তারা শিশু বলে তাদেরকে ভুল-মোটা দাগে আমি ভুল শব্দটি ব্যবহার করছি, যদি সূক্ষ্মভাবে বিবেচনা করি আমি মিথ্যা শব্দটাও ব্যবহার করতে পারতাম, কিন্তু আমি ভুল শব্দটিই ব্যবহার করছি–শিশুদেরকে ভুল তথ্য দেওয়া ঠিক নয়।”
রাতুল একবার ঢোক গিলে বলল, “আমি আসলে মজা করছিলাম।”
“আমি সেটি অনুমান করেছি। শিশুদের ব্যাপারে আমি খুব স্পর্শকাতর। তাদের সাথে সঠিক ব্যবহার করা হয় না বলে নতুন প্রজন্মের সুকুমার প্রবৃত্তির বিকাশ হয় না।”
রাতুল এতক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে, কী বলবে সেটাও ঠিক করেছে। বাচ্চাগুলো খুব ভালো করে জানে, এটা ডাইনোসরের মাংস নয়, তাদেরকে কোনো ভুল তথ্য দেওয়া হয়নি, এটা এক ধরনের খেলা, বিষয়টা যখন সে বলতে শুরু করেছে আধবুড়ো মানুষটি তখন হাত নেড়ে রাতুলকে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে হেঁটে চলে গেলেন। রাতুল মাথা ঘুরিয়ে তৃষার দিকে তাকাল, তৃষা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাসি থামানোর চেষ্টা করছে। রাতুল বলল, “দেখলি? দেখলি ব্যাপারটা?”
“তোকে আমি আগেই বলেছিলাম–”
”কে মানুষটা?”
“সর্বনাশ, তুই কবি শাহরিয়ার মাজিদকে চিনিস না?”
“না। আমি মাজিদ, বা বাজিদ কাউকেই চিনি না।”
“বিখ্যাত কবি। অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। তোর সাথে যে কথা বলেছে। সেই জন্যেই তোর জীবন ধন্য হয়ে যাওয়ার কথা।”
“আমার সাথে মোটেই কথা বলেনি–আমাকে গালাগাল করে চলে গেছে। আমি যখন কথা বলতে চেয়েছি তখন আমার কথা না শুনে চলে গেছে। মানুষ যেভাবে মাছি তাড়ায় ঠিক সেইভাবে হাত দিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।”
তৃষা হাসি চেপে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন প্রথমে সরু গলায় একটা চিৎকার, তারপর সম্মিলিত অনেকগুলো চিৎকার শোনা গেল। জাহাজের পেছনে একটা জটলা তৈরি হয়ে গেল এবং সেখান থেকে উত্তেজিত গলার স্বর শোনা যেতে থাকে। রাতুল আর তৃষা ছুটে গেল, ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পায় একটা বেঞ্চের নিচে উবু হয়ে অনেকে কী যেন দেখছে।
“কী?” তৃষা বেঞ্চের নিচে উঁকি দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে এখানে?”
“মানুষ।” একটা বাচ্চা উত্তেজিত গলায় বলল, “একটা মানুষ বেঞ্চের নিচে লুকিয়ে আছে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
এবার রাতুলও উঁকি দিল। সত্যি সত্যি বেঞ্চের নিচে খানিকটা দুরে অন্ধকারে একজন মানুষ গুটিশুটি মেরে লুকিয়ে আছে। তৃষা বলল, “সাবধান। হাতে কিছু থাকতে পারে।”
এ রকম সময় জাহাজের একজন খালাসি ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো, সে একনজর দেখেই মনে হয় ব্যাপারটা বুঝে গেল। বেঞ্চের সামনে উবু হয়ে বসে সে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে মানুষটার চুলের মুঠি ধরে টেনে বের করে আনে। বাইরে টেনে আনার পর বোঝা যায় এটা একজন বড় মানুষ না, এটা একটা বাচ্চা। বয়স আট-দশ বছরের বেশি না। বেঞ্চের নিচে আবছা অন্ধকারে তাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না বলে বোঝা যায়নি। খালাসিটা কোনো কথা না বলে ছেলেটার চুল ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মারতে শুরু করে।
তৃষা আর রাতুল ঝাঁপিয়ে পড়ে খালাসিটাকে থামাল। তৃষা বলল, “কী করছেন আপনি? মারছেন কেন ওকে?”
“মাইর ছাড়া এরা আর কিছু বোঝে না।” খালাসিটা নাক-মুখ কুঁচকে বলল, “এরা যে কী বদমাইশ আপনারা জানেন না।”
“কেন? কী হয়েছে ওদের?”
”সবসময় এইভাবে লুকিয়ে জাহাজে উঠে যায়। তারপর চুরি করে পালায়।”
বাচ্চা ছেলেটা মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করল, “না।”
রাতুল জানতে চাইল, “তা হলে জাহাজে উঠে লুকিয়ে আছ কেন?”
ছেলেটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, কিছু বলল না। হাত দিয়ে নাকটা মুছল, সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। রাতুল বলল, “কী হল? কথা বলছ না কেন? বল কেন উঠেছ?”
ছেলেটা আরও মাথা নিচু করে কিছু একটা বলল। রাতুল ঠিক বুঝতে পারল না। সে আবার জিজ্ঞেস করল, “কী বললে?”
ছেলেটা মাথাটা একটু উঁচু করে বলল, “আপনাগো লগে সুন্দরবন যামু।”
খালাসিটা এ কথা শুনে একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল, বাচ্চাটার ঘাড় ধরে চিৎকার করে বলল, “কী, কী কইলি হারামজাদা? সুন্দরবন যাবি? শখ দেখে বাঁচি না।”
রাতুল ছেলেটাকে মুক্ত করে বলল, “তুমি আমাদের সাথে সুন্দরবন যেতে চাও?”
“হ্যাঁ।”
তাদের ঘিরে একটা ছোটখাটো ভিড় হয়েছে, সেখান থেকে এবার একটা হাসির শব্দ শোনা গেল। খালাসিটা আবার এগিয়ে আসে, বলে, “আয় আমার সাথে, তোরে আমি এক লাথি দিয়া সুন্দরবন পাঠামু।”
রাতুল বলল, “আপনি কী বলছেন এসব? ছিঃ।”
“আমার হাতে দেন, আমি এর ব্যবস্থা করি।”
“কী ব্যবস্থা করবেন?”
“জাহাজ থামায়া কোনো একটা নৌকাতে তুলে দেব।”
“নৌকায় তুলে দেবেন? তারপর?”
“নৌকা ওরে পাড়ে নামায়া দেবে।”
“তারপর সে কেমন করে সদরঘাট যাবে?”
“সেইটা আমার চিন্তার ব্যাপার না। সেইটা এই হারামজাদার চিন্তা।”
ওদের ঘিরে থাকা মানুষগুলোর ভেতর থেকে কে যেন বলল, “ওরা স্ট্রীট স্মার্ট–নিজেরা ম্যানেজ করে নেবে।”
“পথশিশু যে রকম থাকে এরা হচ্ছে সে রকম জলশিশু।” রাতুল তাকিয়ে দেখল কবি শাহরিয়ার মাজিদের মুখে এক ধরনের স্নিগ্ধ হাসি, সেই হাসিটাকে আরও বিস্তৃত হতে দিয়ে বললেন, “এই জলশিশু এক জলযান থেকে অন্য জলযানে করে গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।”
রাতুল সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাচ্চা একটা ছেলে আমাদের সাথে সুন্দরবন যেতে চাচ্ছে, একে নিয়ে গেলে সমস্যা কী?”
সবাই চুপ করে রইল, শুধু খালাসিটা মাথা নেড়ে বলল, “না। না।”
রাতুল বলল, “একজন মানুষ, কী আসে যায়?”
কবি শাহরিয়ার মাজিদের মুখের স্নিগ্ধ হাসি হঠাৎ করে উবে গেল, মুখ সূঁচালো করে বললেন, “এদের প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। জাহাজের প্রচলিত নিয়ম মেনে নৌকায় তুলে দেওয়াই সঠিক সিদ্ধান্ত।”
রাতুলের ইচ্ছে হল বলে, “এই শিশুদের বেলায় আপনি স্পর্শকাতর নন? এর সুকুমার মনোবৃত্তি বিকাশ নিয়ে আপনার কোনো দুর্ভাবনা নেই?” কিন্তু সে কিছুই বলল না।
এ রকম সময় আলমগীর ভাই এসে ভিড় ঠেলে ঢুকলেন। তার মেয়ে মৌটুসি গিয়ে বাবার হাত ধরে তাকে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল।
আলমগীর ভাই মাথা নাড়লেন, বললেন, “ঠিক আছে।”
তৃষা বলল, “আলমগীর ভাই, এই ছেলেটা লুকিয়ে জাহাজে উঠে গেছে–”
“শুনেছি, লুকিয়ে না উঠে এর কী অন্য কোনোভাবে ওঠার উপায় আছে?”
“তা নেই। কিন্তু—”
”কিন্তু কী?”
“জাহাজের লোকজন ওকে একটা নৌকায় নামিয়ে দিতে চাচ্ছে।”
আলমগীর ভাই বললেন, “কিন্তু আমার মেয়ে বলছে ওকে নিয়ে নিতে। কী বল?”
রাতুল কথাটা লুফে নিয়ে বলল, “আমিও তাই বলছি। বাচ্চা একটা ছেলে সুন্দরবন যেতে চাইছে–”
“ঠিক আছে তা হলে।” আলমগীর ভাই ছেলেটার দিকে তাকালেন, “তোমার নাম কী?”
“রাজা।”
“একেবারে রাজা? মন্ত্রী-কোটাল না?”
বাচ্চাটা থতমত খেয়ে বলল, “না। রাজা।”
“তুমি যাবে আমাদের সাথে, কিন্তু কোনোরকম দুষ্টুমি করতে পারবে না। আমাদের কথা মেনে চলতে হবে। ঠিক আছে?”
ছেলেটার এগাল থেকে ওগাল জোড়া হাসি ফুটে ওঠে, “ঠিক আছে।”
রাতুল খুশি খুশি গলায় বলল, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি ওকে দেখে রাখব।”
কবি শাহরিয়ার মাজিদ একটা নিশ্বাস ফেলে আস্তে আস্তে বললেন, “কাজটা ঠিক হল না।”
রাতুল কথাটা না শোনার ভান করে ছেলেটাকে বলল, “রাজা।”
“জে।”
“তুমি শেষবার কবে গোসল করেছ?”
“জে, আমি পেরতেক রোজ গোসল করি।”
“গোসল করার কথা পানি দিয়ে। তুমি নিশ্চয়ই আলকাতরা দিয়ে গোসল কর?”
“জে না–”
তৃষা বলল, “বুড়িগঙ্গার পানি দিয়ে গোসল করা আর আলকাতরা দিয়ে গোসল করার মাঝে কোনো পার্থক্য নাই।”
রাতুল বলল, “তোমাকে অন্তত একবার সাবান দিয়ে গোসল করতে হবে আমার সামনে।”
“জে, করব।”
“তার আগে খেয়ে নাও।”
মৌটুসি দাঁত বের করে হেসে বলল, “ঘাসের বিচি আর ডাইনোসরের মাংস। তাই না স্পাইডার ভাইয়া?”
রাতুল মাথা নাড়ল, চোখের কোনা দিয়ে দেখল কবি শাহরিয়ার মাজিদ হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে যাচ্ছেন।
.
রাজাকে গোসল করানোর সময় বাচ্চাদের প্রায় সবাই সেখানে উপস্থিত থাকল। দড়ি লাগানো বালতি দিয়ে রাতুল নদী থেকে পানি তুলে রাজার মাথায় ঢালতে লাগল আর রাজা প্রবল বেগে সারা শরীরে সাবান মেখে গোসল করতে লাগল। গোসল করার পর তৃষা তাকে একটা টি-শার্ট দিল, বাচ্চাদের ভেতর থেকে একটা প্যান্ট খুঁজে বের করা হল। পরিষ্কার কাপড় পরার পর দেখা গেল তাকে অন্য বাচ্চাদের থেকে খুব আলাদা করা যাচ্ছে না!
.
বিকেলবেলা জাহাজের নিচতলায় সবাই একত্র হয়েছে। প্রাস্টিকের চেয়ারে বড়দের বসার ব্যবস্থা, মাঝখানে কার্পেট বিছানো হয়েছে, সেখানে ছোটদের বসার ব্যবস্থা। তাদের অবশ্য বসার আগ্রহ নেই, এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছে।
আলমগীর ভাই মাইক্রোফোন নিয়ে বললেন, “বস, সবাই বস।”
একটি বাচ্চা জিজ্ঞেস করল, “কেন আংকেল? বসতে হবে কেন?”
“এখন সবার সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে।”
“কেন আংকেল?””আমরা সবাই মিলে যাচ্ছি, সবার সাথে সবার পরিচয় থাকতে হবে না?”
রাতুল ব্যাখ্যা করে দিল, “মনে কর সুন্দরবনে বাঘ একজনকে খেয়ে ফেলল, তা হলে আমাদের জানতে হবে না কাকে খেয়েছে?”
এই ব্যাখ্যাটি বাচ্চাদের পছন্দ হল, এবার তারা কার্পেটে বসে যায়। আলমগীর ভাই মাইক্রোফোনে বললেন, “সবাইকে আমাদের সুন্দরবন ভ্রমণে আমন্ত্রণ। এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য কী কে বলতে পারবে?”
ছোটরা চিৎকার করে নিজেদের মতো উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে থাকে, বড়রা হাসি হাসি মুখে বসে থাকে। আলমগীর ভাই এক-দুইজনের কথা শুনে মাথা নেড়ে বললেন, “হয় নাই। আমাদের উদ্দেশ্য খুব সহজ। যে কয়জন যাচ্ছি ঠিক সেই কয়জন ফিরে আসা! আমরা কাউকে সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের খাবার হিসেবে রেখে আসতে চাই না। বুঝেছ?”
সবাই হি হি করে হেসে মাথা নাড়তে থাকে। আলমগীর ভাই বললেন, “এবার আমরা পরিচয় পর্ব সেরে নিই। অনেকে অনেককে চেনে আবার অনেকে চেনেও না। এই হচ্ছে সুযোগ, সবাই সবার পরিচয় দেবে।”
রাতুল ভেবেছিল পরিচয় পর্বটা হবে একঘেয়ে আর বিরক্তিকর কিন্তু দেখা গেল সেটা মোটামুটিভাবে উপভোগ্যই হল। টেলিভিশনে অত্যন্ত সুন্দর অভিনয় করে একটি মেয়ে, নাম শারমিন, খুব সুন্দর চেহারা। কিন্তু মুখ ফুটে কথাই বলতে পারে না। তার পাশেই সবসময় বসে আছেন তার মা, তীক্ষ্ণ চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন, মনে হয় তিনি তার মেয়েকে চোখে চোখে রাখছেন পাছে কেউ তাকে হাইজ্যাক করে নিয়ে যায়। নাট্যকার বাতিউল্লাহ একটু জোকার টাইপের, সাধারণভাবে কথা বলতেই পারেন না, প্রত্যেকটা কথার মাঝেই একটা প্যাঁচ লাগিয়ে দেন। কবি শাহরিয়ার মাজিদ নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন, “আমি শব্দের কারিগর। একটা অতি সাধারণ শব্দের পাশে আরেকটা অতি সাধারণ শব্দ এমনভাবে এনে দাঁড় করিয়ে দিই যখন দুটো শব্দই হঠাৎ করে অসাধারণ হয়ে ওঠে।” রাতুল তার কথা শুনে দাঁত কিড়মিড় করে মনে মনে বলল, “আহারে! ন্যাকামো দেখে মরে যাই!” একজন হচ্ছেন চিত্রপরিচালক, নাম আজাদ আজাদ–এ রকম নাম রাতুল জন্মেও শোনেনি। ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে চলচ্চিত্র জগতের সংকটের ওপর একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন। কিছু কিছু মানুষ খুবই নার্ভাস টাইপের, উঠে দাঁড়িয়ে শুধু নামটা বলতে গিয়েই ঘেমেটেমে একসার। ভলান্টিয়ার একটা মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, নাম গীতি, কথায় কথায় হাসিতে ভেঙে পড়ে। হাসি খুবই সংক্রামক একটা বিষয়, তার হাসি শুনে অন্যরাও হেসে গড়াগড়ি খেতে থাকে। নিজের পরিচয় দেওয়ার বেলায় ছোট বাচ্চাদের উৎসাহ সবচেয়ে বেশি, তারা সবাই নিজেদেরকে জুনিয়র ভলান্টিয়ার হিসাবে দাবি করতে থাকে। রাতুল জানতে পারল, সবচেয়ে দুরন্ত ছেলেটির নাম হচ্ছে শান্ত–এ রকম ভুল নামকরণ না কী পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। জানা গেল টুম্পা নামে আরেকজন বাচ্চা ভলান্টিয়ার গত ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রধান অতিথিকে বাথরুম দেখাতে নিয়ে গিয়ে ভুল করে বাইরে থেকে তালা মেরে দিয়েছিল। টুলু অতিথিদের চা এনে দিতে গিয়ে একজন স্পন্সরের কোলে গরম চা ফেলে দিয়েছিল–এ তথ্যগুলোর সব পুরোপুরি সত্য নয়–কিছু কিছু অতিরঞ্জিত কিন্তু দেখা গেল সবাই সেগুলো নিয়ে হইচই করতে পছন্দ করে।
সবার সাথে রাজাকেও তার পরিচয় দিতে বলা হল। সে নিজে থেকে কিছু বলতে পারছিল না, কিন্তু প্রশ্ন করে করে যে উত্তর পাওয়া গেল তা অসাধারণ। যেমন–তারা তিন ভাই এবং অন্য দুজনের নাম বাদশা এবং সম্রাট। তার দুজন বোন যথাক্রমে রানী এবং রাজকইন্যা। নামগুলো রেখেছেন তার বাবা এবং বাবা দীর্ঘদিন থেকে পলাতক। সংসারে চাপ কমানোর জন্যে সে নিজেও পলাতক। অন্যদের কথা তার বেশি মনে পড়ে না কিন্তু ছোট বোন রাজকইন্যার জন্যে তার মাঝে মাঝেই ‘পেট পোড়ে। সুন্দরবন এবং বান্দরবান ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় পুরোটাই দেখে ফেলেছে সে। সাধারণত ট্রেনের ছাদে বসে সে দেশ ভ্রমণ করে, থাকা এবং খাওয়া নিয়ে সে চিন্তা করে না। কোনো না কোনোভাবে তার ব্যবস্থা হয়ে যায়। চব্বিশ ঘণ্টার বেশি তার কখনও না খেয়ে থাকতে হয়নি। অ আ ক–এ রকম তিন-চারটা বাংলা অক্ষর সে পড়তে পারে। ইংরেজি পড়তে পারে না কিন্তু ‘নো ফুড মি হাংগ্রি টেন টাকা’ এ রকম তিন-চারটা ইংরেজি বাক্য বলতে পারে।
রাজা তার পরিচয় দেওয়ার পর অন্য সবার পরিচয় রীতিমতো পানশে মনে হতে থাকে। এলোমেলো চুলের একজন কম বয়সী সুদর্শন ছেলের পরিচয়ও খুব সাদামাটাভাবে শেষ হয়ে যেত কিন্তু আলমগীর ভাই সেটাকে আকর্ষণীয় করে দিলেন। ছেলেটা দাঁড়িয়ে বলল, “আমার নাম শামস। আমি দেশের বাইরে থাকি, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের কথা শুনে চলে এসেছি।” শামস নামের ছেলেটা বসে যাচ্ছিল, আলমগীর ভাই তাকে বসতে দিলেন না, বললেন, “কী হল, আরও একটি-দুটি কথা বলো নিজের সম্পর্কে।”
“কী বলব?”
“তোমার ফিলের কথা বলো, অ্যাওয়ার্ডের কথা বলো, ইউনিভার্সিটির কথা বলো।”
ছেলেটা একবার কাঁধ ঝাঁকালো, রাতুল বিদেশি সিনেমায় অভিনেতাদের এ রকম কাঁধ ঝাঁকাতে দেখেছে, দেশে কখনও দেখেনি। শামস নামের ছেলেটা বলল, “আমি প্রিন্সেস নামে একটা শর্ট ফিল্ম তৈরি করেছিলাম, গ্রিন আর্থ নামে একটা ছোটখাটো ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি।”
তৃষা রাতুলের দিকে ঝুঁকে বলল, “ছেলেটা কি হ্যান্ডসাম, দেখেছিস?”
রাতুল বলল, “হ্যান্ডসাম? তুই এর মাঝে হ্যান্ডসাম কী দেখলি। চেহারাটা কী রকম জংলি জংলি।”
“জংলি?” তৃষা রীতিমতো রেগে উঠল, “কী ম্যানলি চেহারা। মনে হয় কচ করে খেয়ে ফেলি।”
রাতুল চোখ কপালে তুলে বলল, “কি বললি? কচ করে খেয়ে ফেলি?”
“হ্যাঁ।” তৃষা মাথা নাড়ল, “হ্যান্ডসাম মানুষ দেখলেই মনে হয় কামড় দিয়ে খেয়ে ফেলি।”
রাতুল বলল, “খেয়ে ফেলি?”
তৃষা হাত তুলে রাতুলকে থামাল, বলল, “কথা বলিস না, শুনি হ্যান্ডসাম কী বলে?”
রাতুলও শুনল শামসও বলছে, “আমি ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে স্কুল অব সিনেম্যাটিক আর্টে পিএইচডি করেছি।”
আলমগীর ভাই বললেন, “তার মানে তুমি শামস নও, ডক্টর শামস।”
ডক্টর শামস আবার বিদেশি কায়দায় কাঁধ ঝাঁকাল। আলমগীর ভাই বললেন, “তুমি এখন কী করছ বল।
“আমি ফ্লোরিডায় ছোট একটা ইউনিভার্সিটিতে ফ্যাকাল্টি হিসেবে জয়েন করেছি। আমার ইন্ডিপেনডেন্টভাবে কাজ করার ইচ্ছা। কাজেই শেষ পর্যন্ত মাস্টারি করার ইচ্ছা নেই।”
তৃষা দাঁতের ফাঁক দিয়ে নিশ্বাস বের করে বলল, “হ্যান্ডসাম শুধু চেহারায় হ্যান্ডসাম না, দেখেছিস? দেখে মনে হয় বাচ্চা ছেলে-”
“মোটেও বাচ্চা ছেলে মনে হয় না।” রাতুল বলল, “বেশ বয়স।”
“অবশ্যি বাচ্চা ছেলে মনে হয়। আমাদের থেকে বড়জোর তিন-চার বছর বেশি হবে। কিন্তু এর মাঝে পিএইচডি করে ইউনিভার্সিটির মাস্টার। বাপরে বাপ!”
“ওই দেশে তো আর সেশন জ্যাম নাই। যদি থাকত তা হলে দেখতাম।”
তৃষা কথার উত্তর দিল না। চোখ বড় বড় করে ডক্টর শামসের দিকে তাকিয়ে রইল। রাতুল তৃষার দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলল। আজকেও সকালে তৃষা তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে, সে আর তৃষা হচ্ছে বন্ধু। শুধু বন্ধু। তার জেলাস হওয়ারও অধিকার নেই!
পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর সবাই চা খেতে উঠে গেল, তখন তৃষা গলা উঁচিয়ে বলল, “ভলান্টিয়াররা যাবি না, এক মিনিট।”
গীতি বলল, “কেন?”
“দায়িত্বগুলো একটু নতুন করে ভাগাভাগি করি।”
যারা ভলান্টিয়ার তারা তৃষাকে ঘিরে দাঁড়াল। তৃষা বলল, “আমাদের রাতুল ছোট বাচ্চাদের খুব ভালো ম্যানেজ করতে পারে, তাই তাকে বাচ্চাদের দায়িত্বে দিয়ে দিই।”
রাতুল প্রবল বেগে মাথা নাড়ল, “না, না! সর্বনাশ! আমি মোটেও বাচ্চাদের ম্যানেজ করতে পারি না।”
“আমি নিজের চোখে দেখলাম–”
”কী দেখেছিস?”
“সব বাচ্চা তোর পিছে পিছে ঘুরছে। হ্যাঁমিলনের বংশীবাদকের মতো।”
“বাচ্চাদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করা এক জিনিস আর দায়িত্ব নেওয়া অন্য জিনিস।”
গীতি বলল, “তোমার দায়িত্ব হচ্ছে বাচ্চাদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করা।” কথা শেষ করে সে হি হি করে হাসতে থাকে।
তৃষা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, তাদের ব্যস্ত রাখা।”
“আমাকে অন্য কোনো দায়িত্ব দে। টয়লেট পরিষ্কার হলেও আপত্তি নাই, কিন্তু বাচ্চাকাচ্চার দায়িত্ব? অসম্ভব।”
তৃষা ভুরু কুঁচকে বলল, “মোটেও অসম্ভব না। তাদের ব্যস্ত রাখবি। গেম খেলতে দিবি। কোনো কাজে ব্যস্ত রাখবি।”
সজল নামের ছেলেটি বলল, “তা ছাড়া তুমি নিজে থেকে রাজার দায়িত্ব নিয়েছ। মনে আছে?”
“হ্যাঁ।”
“একজন রাজার দায়িত্ব যদি নিতে পার তা হলে এক ডজন প্রজার দায়িত্ব নিতে সমস্যা কী?”
গীতি আবার হি হি করে হাসতে থাকে। সজল তৃষার দিকে তাকিয়ে বলল, “কেবিনের গেস্টদের দায়িত্বে আমার সঙ্গে আর কাউকে দিতে হবে।”
“কেন?”
“তাদের সবসময়ই কিছু না কিছু লেগেই আছে, চা দাও, কফি দাও, মশার কয়েল দাও, সিগারেট দাও, ম্যাচ দাও, খবরের কাগজ দাও।”
তৃষা বলল, “হ্যাঁ, সকালে দেখলাম তুই ঝাড় নিয়ে ঘুরছিস!”
“একজনের ঘরে না কী গোবদা একটা মাকড়সা। তিনি আবার মাকড়সাকে ভয় পান। সেটাকে মারতে হবে।”
“মেরেছিস?”
“ধুর! মাকড়সা মারা কী এত সোজা না কি। পালিয়ে গেছে। আমি বলেছি মেরেছি।”
“আবার যখন হাজির হবে?”
“যখন হাজির হবে তখন দেখা যাবে।”
“কী বলবি তখন?”
“বলব আগেরটার গার্লফ্রেন্ড এসেছে।”
সজল বলল, “কিন্তু আরেকজন দরকার আমার। আমি একা ম্যানেজ করতে পারছি না।”
তৃষা বলল, “ঠিক আছে, আমি থাকব তোর সঙ্গে।”
.
সাত নম্বর কেবিনটি সিঙ্গেল কেবিন, জানালায় গালে হাত দিয়ে শামস বসে ছিল, তৃষা থেমে গেল, “একা একা বসে আছেন?”
শামস হাসার চেষ্টা করল, “কী করব? তোমরা এই জাহাজে হয় বেশি বুড়ো না হয় বেশি বাচ্চা এনেছ।”
“আমি কোন ক্যাটাগরিতে পড়েছি? বুড়া না বাচ্চা?”
“তুমি ঠিক আছ। কিন্তু তোমরা এত ব্যস্ত, ছোটাছুটি করছ, তাই ডিস্টার্ব করছি না।”
“মোটেও ব্যস্ত না। ব্যস্ত থাকার ভান করি, তা না হলে কেউ গুরুত্ব দেয় না।”
“সেটাও তো একটা কাজ।”
তৃষা সুর পাল্টাল, “চা খাবেন?”
“খেতে পারি।”
“দুধ-চিনি?”
“দুধ নো। চিনি ইয়েস।”
“আপনি বসেন, নিয়ে আসি।”
“ছিঃ ছিঃ। তুমি কেন আনবে। আমি আনছি।” শামস বের হওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াল।
তৃষা হাসার ভঙ্গি করল, “আপনারা এত গুণী মানুষ, আপনাদের চা খাওয়াতে পারাই আমাদের সৌভাগ্য।”
“কেন আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছ?”
“ঠাট্টা না। সত্যি কথা।”
“থাক এত সত্যি কথা বলে কাজ নেই।”
নিচে নেমে প্লাস্টিকের কাপে গরম পানি, টি ব্যাগ ও চিনি দিয়ে তৃষা বলল, “সস্তা চা খেতে পারবেন তো?”
“আমি এমন কিছু খুঁতখুঁতে মানুষ না। গরম হলেই হল।”
শামস চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “তুমি কী কর?”
“ইউনিভার্সিটিতে পড়ি।”
“কোন সাবজেক্ট?”
“ফিজিক্স।”
শামস ভয় পাওয়ার ভান করল, “বাবারে বাবা। ফিজিক্স-ম্যাথমেটিক্স খুব ভয় পাই।”
“ঠাট্টা করছেন?”
“কেন ঠাট্টা করব? আসলেই ম্যাথ, ফিজিক্স এগুলো ভয় পাই।”
“এ বয়সে পিএইচডি করে ফেলেছেন–”
“পিএইচডি করা সোজা। বোঝাবুঝির ব্যাপার নেই। কামলার মতো পরিশ্রম করলেই অ্যাডভাইজার খুশি। আর অ্যাডভাইজার খুশি হলেই সবাই খুশি।”
“কী নিয়ে কাজ করেছিলেন?”
“মোটামুটি ইন্টারেস্টিং–”
তৃষা শামসকে থামাল, “একটা কাজ করলে কেমন হয়?”
“কী কাজ?”
“আমাদের সবার সামনে একটা প্রেজেন্টেশান দেন।”
“প্রেজেন্টেশান? এ জাহাজে? বেড়াতে এসে এ কী বিপদে পড়লাম!”
তৃষা হি হি করে হাসল। বলল, “না না, সে রকম প্রেজেন্টেশান না। আমরা আপনার সাথে বসলাম, একটু কথা বললাম। আপনি কিছু বললেন, আমরা কিছু বললাম, এ রকম আর কী। আড্ডার মতো। কোনো কুটনামি না করে আড্ডা দেওয়া আর কী।”
শামস হাসল, বলল, “ঠিক আছে।”
.
ঠিক এ রকম সময় রাতুল জাহাজের ছাদে সব বাচ্চাকে নিয়ে বসেছে। বাচ্চারা গোল হয়ে বসেছে, সামনে রাতুল গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বক্তৃতার মতো করে বলল, “একটু আগে আমাকে তোমাদের ম্যানেজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।”
বাচ্চারা আনন্দের মতো শব্দ করল। রাতুল বলল, “আমি তাদের কী বলেছি জান?”
“কী?”
“আমি বলেছি আমাকে একটা চাবুক দিতে হবে।”
বাচ্চারা আবার আনন্দের মতো শব্দ করল। শান্ত জিজ্ঞেস করল, “দিয়েছে?”
“এখনও দেয় নাই, দেবে।”
শান্ত বলল, “আমি হবো আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট। আমাকে বলবেন কাকে চাবুক মারতে হবে, আমি মেরে দেব।”
“মনে হচ্ছে তোমাকে দিয়েই শুরু করতে হবে।” সবাই হি হি করে হাসল। রাতুল বলল, “আর কী বলেছে জান?”
“কী?”
“বলেছে তোমরা যদি ভালো না হয়ে থাক, শান্ত না হয়ে থাক তা হলে আমাকে সুন্দরবনে রেখে আসবে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্যে ব্রেকফাস্ট।”
মৌটুসি বলল, “তোমার চিন্তা করতে হবে না স্পাইডার ভাইয়া। আমরা সবাই খুবই ভালো হয়ে থাকব।”
“গুড।” রাতুল মাথা নেড়ে বলল, “আমরা দেখি এ জাহাজে মজার মজার কী করতে পারি। কার কী আইডিয়া আছে বলো।”
রাজা বলল, “নাচানাচি করতে পারি।”
রাতুল অবাক হয়ে বলল, “নাচানাচি?”
“জে।”
“কী রকম নাচানাচি?”
“দেখাব?”
“দেখাও।”
রাজা উঠে দাঁড়াল, অন্য সবাই তাকে জায়গা করে দিল। রাজা তখন অত্যন্ত বিচিত্র ভঙ্গিতে নাচা শুরু করে। পৃথিবীর কোনো নাচের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। বাচ্চারা রাতুলের মতো অবাক হল না, তারা সমঝদারের মতো মাথা নেড়ে হাততালি দিতে লাগল। রাজা জিজ্ঞেস করল, “এই নাচ তুমি কোথায় শিখেছ?”
“একটা বিদেশিদের জাহাজে উঠেছিলাম সেইখানে।”
“লুকিয়ে?”
“জে।”
“তুমি তো দেখি মহা কামেল মানুষ!”
রাজা সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, রাতুল মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়, রাজার আরও গুণাবলি আছে, যেগুলো সে এখনও জানে না এবং ধীরে ধীরে সেগুলো প্রকাশ পেতে থাকবে।
রাতুল একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমরা ট্রেজার হান্ট খেলতে পারি, ঠাণ্ডা গরম খেলতে পারি, মৌনী বাবা খেলতে পারি, প্রশ্নের উত্তর প্রশ্নে খেলতে পারি, রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা খেলতে পারি।”
টুম্পা জানতে চাইল, “রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা কেমন করে খেলে?”
“চোর-পুলিশের মতো। শুধু চোর-ডাকাতের জায়গায় হবে রাজাকার, আলবদর আর পুলিশ-দারোগার জায়গায় হবে মুক্তিযোদ্ধা আর সেক্টর কমান্ডার। খুবই সোজা।”
“ট্রেজার হান্ট কীভাবে খেলে?”
যখন সময় হবে তখন বলব। এখন চলো মৌনী বাবা খেলি।
মৌটুসি জানতে চাইল, “সেটা কেমন করে খেলে?”
“খুবই সোজা। কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না। কথা না বলে কে কতক্ষণ থাকতে পারে। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে।” সবাই রাজি হল এবং হঠাৎ করে সবাই চুপ করে গেল। মনে হল ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া জাহাজে কোনো শব্দ নেই। অল্প ক’জন বাচ্চা এত শব্দ করে কে জানত?
.
রাত্রে খাওয়া শেষ হওয়ার পর হঠাৎ করে সবাই আবিষ্কার করল কারও কিছু করার নেই। দিনের বেলা যখন আলো ছিল তখন জাহাজটাকে একরকম দেখাত, রাত্রে জাহাজটাকে কেমন জানি অপরিচিত মনে হতে থাকে। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস তাই আর বাইরে কেউ নেই, কেবিনের মানুষজন কেবিনের ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করেছে। অন্য সবাই ডেকে, সেখানে সবার জন্যে আলাদা আলাদা বিছানা। ডেকের পর্দা টেনে দেওয়া হয়েছে তারপরেও ভেতরে বেশ শীত। সবাই কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছে। রাতুল বাচ্চাদের সবাই শুয়ে পড়েছে কী না দেখে ফিরে যাচ্ছিল, তখন টুলু তাকে ডাকল, “স্পাইডার ভাইয়া, স্পাইডার ভাইয়া।”
“কী হল?”
“ঘুম আসছে না।”
“চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো, ঘুম চলে আসবে।”
“একটা গল্প বলবেন, প্লীজ?”
তখন একসঙ্গে অনেকে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসল, “হ্যাঁ, প্লীজ। একটা গল্প বলেন।”
“গল্প? এখন?”
“হ্যাঁ।” রাতুল হাত নাড়ল, “আমি গল্প বলতে পারি না।”
টুম্পা বলল, “তা হলে আমি কেমন করে ঘুমাব? ঘুমানোর সময় আমার আম্মু আমাকে গল্প শোনায়।”
“তোমার আম্মুকে মিসকল দিব? ফোনে গল্প শুনিয়ে দেবেন?”
টুম্পা হাসল, “না, না স্পাইডার ভাইয়া। তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই।”
“আমি গল্প বলতে পারি না।”
“পার পার। আমি জানি তুমি পার।”
কয়েকজন উঠে এবার রাতুলের হাত ধরে টেনে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে থাকে। রাতুল বাচ্চাদের বুঝিয়ে-সুজিয়ে চলে যেত কিন্তু ঠিক তখন সে তৃষাকে হেঁটে আসতে দেখল। তৃষা এসে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
বাচ্চারা চিৎকার করে উঠল, “গল্প! গল্প! স্পাইডার ভাইয়া গল্প বলবে।”
তৃষা চোখ বড় বড় করে বলল, “তাই না কী? কীসের গল্প?”
একজন চিৎকার করে বলল, “ভূতের।” সঙ্গে সঙ্গে অন্য সবাই চিৎকার করতে থাকে, “ভূতের, ভূতের।”
“তা হলে তো আমারও শুনতে হয়।”
রাতুল বলল, “আমি মোটেও গল্প বলতে পারি না।”
“মিথ্যা কথা বলবি না। তোর মতো গুলপট্টি আর কেউ মারতে পারে না। বানিয়ে বানিয়ে গল্প করার মাঝে তুই হচ্ছিস এক্সপার্ট। ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন।”
বাচ্চারা এবার টেনে রাতুলকে বসিয়ে দিল, কিছু বোঝার আগে সবাই তাকে ঘিরে বসে যায়। শুধু বাচ্চারা না-আশেপাশে থাকা অন্যরাও চলে আসে। এমন কী তৃষাও রাতুলের পাশে বসে গেল।
রাতুল একটা নিশ্বাস ফেলে সবার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “সত্যি শুনতে চাও?”
“হ্যাঁ। হা।”
“ভূতের গল্প?”
“হ্যাঁ।”
“ভয় পাবে না তো?”
“না। না।”
রাতুল কিছুক্ষণ সবার দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর মাথা নেড়ে বলল, “আমি তখন মাত্র ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি।”
গীতি তাকে থামাল, “তুমি তোমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলবে?”
“অবশ্যই।”
“তুমি ভূত দেখেছ?”
“আমি ঘটনাটি বলি-তোমরাই বলো, এটা ভূত না অন্য কিছু?”
“তার মানে তুমি ভূতে বিশ্বাস কর?”
“তুমি কর না?”
গীতি মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু।”
তৃষা বলল, “যদি ভূত বলে কিছু থাকত তা হলে বৈজ্ঞানিকরা এত দিনে সেটাকে ধরে একটা বোতলে ভরে হাই ভোল্টেজ ডিসচার্জ করে বের করে ফেলত ভূত কী দিয়ে তৈরি!”
গীতি মাথা নাড়ল, “জেনেটিক কোডিং বের করে ফ্যামিলি হিস্ট্রিও বের করে ফেলত।”
বাচ্চারা বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা শুনতে চাইছিল না, তারা রাতুলকে তাড়া দিল, “বলল, গল্প বলো।”
রাতুল আবার শুরু করল, “আমি তখন মাত্র ইউনিভার্সিতে ভর্তি হয়েছি। হলে জায়গা পাচ্ছি না তাই–”
এরপর রাতুল কীভাবে হলে জায়গা পেল এবং অত্যন্ত বিচিত্র একজন রুমমেট তাকে প্ল্যানচেট করা শেখাল এবং কীভাবে এক অমাবস্যার রাতে মৃত মানুষের আত্মা আনতে গিয়ে ভয়াবহ বিপদের মাঝে পড়েছিল তার একটা অত্যন্ত নিখুঁত বর্ণনা দিল। গল্প শুনতে গিয়ে সবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল এবং গল্প শেষ হবার পর সবাই চুপ করে রইল। বেশ খানিকক্ষণ পর তৃষা বলল, “গুলপট্টি। চাপাবাজি। পরিষ্কার চাপাবাজি–এটা হতেই পারে না।”
কিন্তু ততক্ষণে একটা ভৌতিক পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে এবং সজল নামে ভলান্টিয়ারদের একজন তার বড় বোনের অভিজ্ঞতাটি সবিস্তারে বর্ণনা করল। এরপর গীতির আরেকটা ছোট ঘটনা। তারপর আবার রাতুলের গল্প, পরপর তিনটি। যে গল্পটা শুনে সবার হাত-পা শরীরের ভেতর সেঁধিয়ে গেল সেটা এ রকম :
“দুই বছর আগের ঘটনা। রোজার ঈদের ঠিক আগে আগে আমার নানার হার্ট অ্যাটাক হল। সময়মতো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ডাক্তাররা সিপিআর করে কোনোমতে নানাকে বাঁচিয়ে তুললেন। এনজিওগ্রাম করে দেখা গেল হার্টে পাঁচটা ব্লক, সার্জারি করতে হবে। সবাই মিলে ঠিক করল, নানাকে অপারেশন করার জন্যে ইন্ডিয়া নিয়ে যাবে। নানা ভীতু মানুষ তাই সাথে যাবেন আমার মা। আমার মা একা একা কোথাও যান না তাই বাবাকে সাথে যেতে হবে। বাবার ছুটি নিয়ে ঝামেলা তাই ঠিক হল ঈদের ছুটিতে যাওয়া হবে। আমার আর একটি মাত্র বোন, তার বিয়ে হয়ে গেছে, হাজব্যান্ড-ওয়াইফ দুজনেই ডাক্তার। দুটি বাচ্চাকে নিয়ে সিলেট থাকেন। তাই ঈদের আগে আমি আবিষ্কার করলাম, ঈদের ছুটিতে আমার যাওয়ার জায়গা নেই–ঠিক করলাম হলেই থেকে যাব। এটা এমন কিছু ব্যাপার না। পরীক্ষার আগে অনেকেই বাড়িতে যায় না, হলে থেকে যায়। তা ছাড়া কিছু ছাত্র আছে এরা পরীক্ষা থাকুক না থাকুক, ছুটিছাটা থাকুক না থাকুক সবসময়ই হলে থাকে।
রোজা যতই শেষ হতে থাকল, হল খালি হতে থাকল। ২৭ রোজার পর মনে হল হল বুঝি একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। আমি যখন হল থেকে বের হই কিংবা ঢুকি তখন দারোয়ান জিজ্ঞেস করে, “স্যার, বাড়ি যাবেন না?” আমি যখন মাথা নেড়ে বলি”নাহ্!” তখন দারোয়ানের মুখটা ভোতা হয়ে যায়। হলে কেউ না থাকলে সে গেটে তালা মেরে চলে যেতে পারে। কিন্তু একজনও যদি ভেতরে থাকে তা হলেই তার গেটে ডিউটি করতে হয়। তাই তার মেজাজ খারাপ হতেই পারে।
যাই হোক, ঈদের আগে আগে ঢাকা শহর ফাঁকা হতে শুরু করে। কিন্তু দোকানপাটে মানুষের ভিড়। আমার কোনো কাজকর্ম নেই, তাই শপিং মলে ঘুরে বেড়িয়ে রাতে কোনো হোটেলে খেয়ে হলে ফিরে আসি। ঢাকা শহরে আমার যে বন্ধুবান্ধবরা থাকে তারা আমাকে তাদের বাসায় থাকার জন্যে বলেছে। কিন্তু ঈদ একটা পারিবারিক উৎসব, ফ্যামিলির সবাই একসঙ্গে থেকে ঈদ করবে, আমি বাইরের একজন মানুষ অন্যের ফ্যামিলিতে ঢুকে যাই কেমন করে?
ঈদের দিনটা ভালোই কাটল, ঈদের পরদিন ঢাকা শহরে আমার যাওয়ার জায়গা নেই। বিকেল পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যার আগে আগে হলে ফিরে এসেছি। গেটে কেউ নেই, অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করে শেষ পর্যন্ত দারোয়ানকে পাওয়া গেল। সে এসে গোমড়া মুখে গেট খুলে দিল। আমি এসে রুমে ঢুকে বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেলাম।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বিচিত্র স্বপ্ন দেখছি–অসময়ে ঘুমালে যা হয়। হঠাৎ করে আমার ঘুম ভাঙল। বেশ কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে, আমি কোথায়। যখন সবকিছু মনে পড়ল তখন আমি উঠে বসেছি, প্রথম আমার যে কথাটা মনে হল, সেটা হচ্ছে চারদিক আশ্চর্য রকম নীরব। আমি এতদিন এখানে আছি কখনও মনে হয়নি এ রকম নিঃশব্দ একটা রাত দেখেছি। আমি বিছানা থেকে উঠে ঘড়ি দেখলাম, রাত এগারোটা। রাতে বাইরে গিয়ে খেয়ে আসার কথা ছিল, এত রাতে আর কোথায় যাব? ঈদ উপলক্ষে গত দুদিনে এত খাওয়া হয়েছে, সপ্তাহখানেক না খেলেও কিছু হওয়ার কথা নয়। আমি ঠিক করলাম দুই গ্লাস পানি খেয়ে ঘুমিয়ে যাব।
বোতল থেকে যখন গ্লাসে পানি ঢালছি ঠিক তখন শুনতে পেলাম কে যেন বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসছে। আমি বেশ অবাক হলাম। কারণ আমি জানি হলে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। পায়ের শব্দ যখন ঠিক আমার রুমের সামনে এসেছে। আমি তখন দরজা খুলে বের হলাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। বারান্দার এ মাথা থেকে ওই মাথা পুরোপুরি ফাঁকা। আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। হঠাৎ আমার মনে হল বাইরে যেন কনকনে ঠাণ্ডা। আমার সারা শরীরে কেমন যেন কাঁটা দিয়ে ওঠে। তখন আমার মাঝে প্রচণ্ড একটা আতঙ্ক এসে ভর করল, আমি তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম।
সেটা অত্যন্ত বিস্ময়কর একটা অনুভূতি, মনে হতে থাকে আশেপাশে যেন কোনো একটা কিছু আছে, মনে হতে থাকে যেন আমাকে কিছু একটা দেখছে, মনে হতে থাকে কেউ যেন পেছন থেকে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমার মনে হতে থাকে কেউ যেন খুব কাছে থেকে ফিস ফিস করে কথা বলছে। মনে হয় কেউ যেন নিশ্বাস ফেলছে। আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বিছানায় বসেছি। গ্লাসে পানি ঢেলে রেখেছিলাম, সেটা ঢক ঢক করে খেয়ে নিলাম। কী করব বুঝতে পারছি না। ঠিক তখন আবার পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। এবারে একজনের পায়ের শব্দ নয় বেশ কয়েকজনের। শুধু পায়ের শব্দ নয়, এবার গলার স্বরও শুনতে পেলাম। বেশ কয়েকজন কথা বলতে বলতে আসছে। আমার তখন বুকের মাঝে সাহস ফিরে এল। গেটের দারোয়ান নিশ্চয়ই অন্য কয়েকজনকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে দেখছে। আমি ঠিক করলাম একা একা আর থেকে কাজ নেই, আমি দারোয়ানের সঙ্গে বের হয়ে যাব।
যখন পায়ের শব্দ আর গলার আওয়াজ আমার দরজার সামনে এসেছে আমি তখন দরজা খুলেছি। দেখি বাইরে কেউ নেই। শুধু যে কেউ নেই তা নয়। একটা শব্দও নেই। পুরোপুরি নিঃশব্দ। আমি আতঙ্কে একেবারে জমে গেলাম। অনেক কষ্ট করে কোনোভাবে তখন নিজেকে শান্ত করেছি। নিজেকে বোঝালাম, নিশ্চয়ই কেউ না কেউ হলে এসেছে। তারা আমার ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে আমার পাশের কোনো একটা রুমে ঢুকে গেছে। আমার আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। নিজেকে নিশ্চিত করার জন্যে আমি বারান্দা দিয়ে কয়েক পা হেঁটে গেলাম, বারান্দায় টিমটিমে একটা লাইটের আবছা আলোতে হলের ঘরের দরজাগুলো লক্ষ করলাম। কোনো একটা ঘরের নিশ্চয়ই তালা খোলা। ভেতরে নিশ্চয়ই মানুষগুলো আছে।
আমি ঠিক তখন আবার নিচু গলার মানুষের কথা শুনতে পেলাম। আমার অনুমান সত্যি। সামনে কোনো একটা ঘর থেকে গলার শব্দ আসছে। আমি কয়েক পা এগিয়ে গেলাম এবং হঠাৎ করে আতঙ্কে পুরোপুরি পাথর হয়ে গেলাম। সামনে সত্যি সত্যি একটা ঘরের দরজায় তালা নেই। দরজার নিচ দিয়ে রক্তের একটা ধারা গড়িয়ে গড়িয়ে বের হয়ে আসছে।
আমি ঘরের সামনে দাঁড়ালাম আর ভেতরে হঠাৎ করে গলার শব্দ থেমে গেল। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। মাথার ভিতরে সবকিছু কেমন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে, পরিষ্কার করে চিন্তা করতে পারছি না। ছুটে পালিয়ে যাবার কথা কিন্তু কী আশ্চর্য! আমি পুরোপুরি নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলাম, কাঁচ ক্যাচ শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে আবছা অন্ধকার, বারান্দার আলো ঘরের ভেতরে পড়েছে, সেই আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ঘরের মেঝেতে একটা কিছু শুয়ে আছে। চাদর দিয়ে পুরোটা ঢাকা-চাঁদরের নিচে কী আছে জানি না কিন্তু সেটা নড়ছে। নড়া না বলে বলা উচিত ছটফট করছে। চাঁদরে ছোপ ছোপ রক্ত। সেখান থেকে রক্তের একটা ধারা ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।
আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করলাম। তারপর এক পা এক পা করে পিছিয়ে এলাম। পায়ের নিচে রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল। আমি তখন আর সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। ঘর থেকে বের হয়ে আমি একটা দৌড় দেব তখন হঠাৎ আমার মনে হল, আমি এটা কী করছি? আমি তো ভীতু মানুষ না। কিন্তু আজ আমি জন্মের মতো ভীতু হয়ে যাব। হয়তো এখানে একজন মানুষের সাহায্য দরকার। আমি তাকে সাহায্য না করে পালিয়ে যাচ্ছি। এই কাজটা তো ঠিক হচ্ছে
। তখন আমি আবার ঘরের ভেতর এসে ঢুকলাম। নিচু হয়ে চাদরটা ধরেছি, প্রচণ্ড ভয় করছে। সেই ভয়ের মাঝেই যখন চারদরটাকে একটা টান দেব ঠিক তখন কে যেন প্রচণ্ড জোরে একটা ধমক দিল।
“এই ছেলে–কী করছ তুমি?”
আমি চমকে উঠে মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম। ঘরের দরজায় একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, আবছা অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না, শুধু বোঝা যাচ্ছে মানুষটার মুখে কুচকুচে কালো লম্বা দাড়ি।
মানুষটা আবার বলল, “কী করছ এখানে? কী করছ?”
এতক্ষণ আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে সাহস দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছিলাম–হঠাৎ করে আমার পুরো সাহস উবে গেল। ভয়ে-আতঙ্কে আমি থর থর করে কাঁপতে শুরু করেছি। আমি বললাম, “আমার খুব ভয় করছে।”
মানুষটা বলল, “ভয় তো করবেই, তুমি জান এটা কি?”
“না, জানি না। এটা কী?”
“সেটা তোমার জানার দরকার নেই। তুমি বের হয়ে আস। এই মুহূর্তে বের হয়ে আস।”
আমি তখন কোনোমতে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। আবার হঠাৎ করে মনে হল আমার ডানে-বামে অনেক ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় আছে আবার তাকালে মনে হয় নাই। তাদের নিশ্বাসের এক ধরনের শব্দ শোনা যায়, অনেক লম্বা লম্বা নিশ্বাস। আমি মানুষটাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এরা কারা?”
মানুষটা বলল, “তোমার জানার দরকার নেই। তুমি হাঁট। সোজা আমার পিছনে পিছনে হাঁট।”
মানুষটা তখন দুই পা হেঁটে গেল। প্রচণ্ড ভয়ে আমি তখন প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছি। ভাঙা গলায় বললাম, “আমাকে নিয়ে যান প্লীজ। আমাকে রেখে যাবেন না। আমার খুব ভয় করছে।”
“তুমি আমার সাথে আস। তোমার কোনো ভয় নেই। আমি তোমাকে নিয়ে যাব।”
মানুষটা তখন হাঁটতে থাকে। আমি পিছনে পিছনে হাঁটতে থাকি। আর তখন আমি হঠাৎ লক্ষ করলাম–”
এইটুকু বলে রাতুল একটু থামল। বাচ্চাগুলো ফ্যাকাসে মুখে জিজ্ঞেস করল, “কী দেখলে?”
“দেখলাম সামনে যে মানুষটা যাচ্ছে তার পা দুটো মানুষের পায়ের মতো না। ঘোড়ার পায়ের মতো। পায়ে খুর, পুরো পা কুচকুচে কালো লোমে ঢাকা। করিডোরে সেই খুর দিয়ে খুট খুট শব্দ করে হেঁটে যাচ্ছে।
আমি তখন কী করেছিলাম মনে নেই। মনে হয় রেলিংয়ের উপর দিয়ে লাফ দিয়ে নিচে পড়েছি। সেখান থেকে ছুটে গেটের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। আমি নিজে অবশ্য কিছুই জানি না। আমার যখন জ্ঞান হয়েছে তখন আমি হাসপাতালে। আমার এক পাশে হলের হাউস টিউটর, অন্য পাশে আমার এক বন্ধু।
.
রাতুল হাত নেড়ে বলল, “পরে শুনেছি আমি যেই রুমটাতে ঢুকেছিলাম সেখানে কেউ থাকে না। একটা ছেলে সেখানে সুইসাইড করেছিল। যাই হোক সেটা অন্য গল্প। ভূতের গল্প এটুকুই।”
মৌটুসি শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে ভিজিয়ে বলল, “তোমার অনেক সাহস!”
রাতুল উঠে দাঁড়াল, বলল, “আমার মোটেও বেশি সাহস নেই। আসলে আমি একটু বোকা টাইপের, সেটাই হচ্ছে আমার সমস্যা। না বুঝে আমি বিপদের মাঝে পড়ে যাই।”
গীতি বলল, “আজ রাতে ঘুমাতে পারব না।”
তৃষা উঠে দাঁড়াল, বলল, “দিলি তো ভয় দেখিয়ে। এখন আমার পুরো জাহাজ চক্কর দেবার কথা–ভয় করছে।”
রাতুল হাসল, বলল, “ভয় কীসের। আয় আমি তোর সাথে যাই।”
“চল।”
ডেকে সবাই শুয়ে পড়েছে। তাদের মাঝ দিয়ে তৃষা আর রাতুল হেঁটে যায়। তৃষা জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা রাতুল। তুই সত্যি করে বল দেখি–আসলেই হলে তোর ঐ ঘটনাটা ঘটেছিল?”
রাতুল হেসে ফেলল, বলল, “তোর মাথা খারাপ হয়েছে? এরকম ঘটনা ঘটা সম্ভব?”
তৃষা চোখ বড় বড় করে বলল, “তার মানে তুই বসে বসে এরকম চাপাবাজি করে এসেছিস? মিথ্যা কথা বলে এসেছিস?”
“আমি মোটেও মিথ্যা কথা বলিনি। চাপাবাজি করিনি। আমি গল্প বলেছি। ভূতের গল্প মানুষ শুনে ভয় পাওয়ার জন্যে-ভয়টা অনেক অনেক বেশি হয় যদি সেটা পার্সোনাল গল্প হয়, সত্যি গল্প হয়। তাই একটা ভাব সৃষ্টি করতে হয় যেন গল্পটা সত্যি। তার বেশি কিছু না।”
“তাই বলে এভাবে?”
“কেন সমস্যা কী?”
“সবাইকে এতো ভয় দেখিয়ে দিলি!”
“শোন। ভূত বলে কিছু নেই কিন্তু ভূতের গল্প আছে। আমাদের মতো সৃজনশীল মানুষেরা যদি বানিয়ে বানিয়ে এই গল্প না বানায় তা হলে ভূতের গল্প তৈরি হবে কেমন করে?”
তৃষা হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। দুজনে হেঁটে যখন রেলিংয়ের কাছে দাঁড়িয়েছে তখন শুনতে পেল কোথায় যেন কে গান গাইছে। ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে সেই গানের সুর ভেসে আসছে। দুজনে গানের শব্দ খুঁজে খুঁজে নিচে হাজির হল, এক কোনায় কিছু মানুষের জটলা, মাঝখানে একজন খালাসি হারমোনিয়াম দিয়ে গান গাইছে, পাশে একজন একটা অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচি উল্টো করে তাল দিচ্ছে। তাকে ঘিরে জাহাজের অন্য মানুষজন।
তৃষা বলল, “কী সুন্দর গলা দেখেছিস?”
“হ্যাঁ। হারমোনিয়াম দিয়ে গাইছে তার মানে লোকটা রীতিমতো চর্চা করে।”
“আয় একটু শুনে যাই।”
দুজনে এগিয়ে যেতেই সবাই তাদের বসার জন্যে জায়গা করে দিল। যে গাইছিল সে থেমে গেল, তৃষা বলল, “থামলেন কেন? প্লীজ গাইতে থাকেন।”
লোকটা তখন আবার গাইতে শুরু করল, প্রিয়াকে দূর দ্বীপে ফেলে রেখে ঝাবিক্ষুব্ধ নদী পাড়ি দেওয়া সংক্রান্ত একটি গান। গান শেষ হবার পর শুনতে পেল, কে যেন বলছে, “কোথায় তুমি কী খুঁজে পাবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কে জানত এখানে এরকম একজন গায়ক পেয়ে যাব।”
তৃষা আর রাতুল ঘুরে তাকাল, নাট্যকার বাতিউল্লাহ কাছাকাছি বসে গান শুনছেন। তৃষা জিজ্ঞেস করল, “ঘুমাতে যাননি এখনো?”
“ঘুম?” বাতিউল্লাহ এমনভাবে কথা বললেন যেন ঘুম অত্যন্ত অশ্লীল একটা শব্দ।
“হ্যাঁ।” তৃষা বলল, “ঘুমাবেন না?”
বাতিউল্লাহ মাথা নাড়লেন, “আমার ঘুম আসে না।”
“ঘুম আসে না?”
“নাহ্। ইনসোমনিয়া। ঘুমের ওষুধ খেলে একটু ঝিমুনির মতো হয়, এর বেশি কিছু না।” বাতিউল্লাহ পকেট থেকে এক গাদা ওষুধ বের করে দেখালেন, “এই দেখ। ঘুমের ওষুধ।” একটা ট্যাবলেট দেখিয়ে বললেন, “এই একটা ট্যাবলেট খেলে ঘোড়া ঘুমিয়ে যাবে। আমি দুইটা খাই তারপরেও ঘুম আসে না।”
রাতুল জিজ্ঞেস করল, “আপনি এই ওষুধ পকেটে নিয়ে ঘুরেন?”
“হ্যাঁ। সব ওষুধ আছে আমার কাছে। পকেটে থাকে। পকেটে ওষুধ না থাকলে কেমন জানি অসহায় অসহায় লাগে। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে ওষুধগুলো নাড়াচাড়া করি তখন ভালো লাগে। সাহস হয়।” কথা শেষ করে বাতিউল্লাহ হা হা করে হাসলেন।
রাতুল আর তৃষা একটু অবাক হয়ে বাতিউল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকে। গায়ক ঠিক এই সময় আরেকটা গান শুরু করল তাই কথা আপাতত বন্ধ হয়ে গেল। সবই মিলে গুটিশুটি মেরে গান শুনতে থাকে।