২. আত্মবিশ্বাসের অভাব

“আমার মনে হয় তোমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আত্মবিশ্বাসের অভাব।” রাতুল ভুরু কুঁচকে শামসের দিকে তাকিয়ে রইল, রাতুল টের পেল কথাটা শুনে তার একটু মেজাজ গরম হয়েছে। শামস যদি বলত আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আত্মবিশ্বাসের অভাব, তা হলে তার মেজাজ এতো গরম হত না। শামস নিজেকে আলাদা করে নিয়েছে, সে একদিকে আর এখানে যারা আছে তারা সবাই অন্য একদিকে। রাতুলের মেজাজটা একটু বেশি খারাপ হল কারণ শামস তাদেরকে তুমি তুমি করে বলছে, সে তো এমন কিছু বয়স্ক মানুষ নয়, তা হলে তাদেরকে তুমি করে কেন বলবে? এখন রাতুলও কী শামসকে তুমি করে বলবে? জিজ্ঞেস করবে, কেন তুমি মনে কর আমাদের আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে?

।রাতুল অবশ্য কিছু জিজ্ঞেস করল না শুধু ভুরু কুঁচকে শামসের দিকে তাকিয়ে রইল।

শামস বলল, “আমি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের দেখেছি। তারা খারাপ না।”

রাতুলের আবার মেজাজ খারাপ হল। খারাপ না কথাটার মাঝে এক ধরনের উন্নাসিকতা আছে, কথাটা খুব সুন্দর হত যদি শামস বলত, “আমি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের দেখেছি। তারা চমৎকার–” কিন্তু শামস সেটা বলছে না। রাতুল শুনল, শামস বলছে, “আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা তাদের বিষয়বস্তু মোটামুটি জানে কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল এরেনাতে তারা ভালো করে না–তার কারণ তারা টিমিড, তারা যথেষ্ট পরিমাণ এগ্রেসিভ না, তারা আউটম্পোকেন না।”

রাতুলের যেরকম মেজাজ গরম হচ্ছে অন্যদের মোটেও সেরকম মেজাজ গরম হচ্ছে না, তারা শামসের কথার সাথে সাথে মাথা নাড়ছে। রাতুল চোখের কোনা দিয়ে লক্ষ করল তুষার চোখে এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময়, আর সেটা দেখে সে নিজের ভিতরে কেমন জানি এক ধরনের জ্বালা অনুভব করে।

শামস বলল, “গ্লোবালাইজেশনের কারণে এখন তোমাদের সবার সাথে কমপিট করতে হবে। টেকনোলজি পৃথিবীটাকে ছোট করে ফেলেছে। এখন তোমরা শুধু নিজেদের সাথে কমপিট কর না, তোমরা সারা পৃথিবীর সাথে কমপিট কর। অন্যেরা ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছে, তোমরা কিন্তু পিছিয়ে পড়ছ।”

একজন গদগদ গলায় বলল, “আমাদের কী করা উচিত শামস ভাই?”

“কী করতে হবে সেটা তো দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। আমাদেরকে গ্লোবাল সিটিজেন হতে হবে, গ্লোবালি সবার সাথে ফাইট করতে হবে। আমাদের কমপিট করতে হবে। সেটা করার জন্যে আমাদের প্রতিযোগিতা করা শিখতে হবে–সব ফিল্ডে কম্পিটিশানের আয়োজন করতে হবে–”

রাতুল বলল, “আমি আপনার সাথে একমত নই।”

সবাই চমকে উঠল আর শামসকে দেখে মনে হল কেউ তার নাকে একটা ঘুষি মেরেছে। সরু চোখে রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কী বললে?”

“আমি বলেছি আমি আপনার সাথে একমত নই।”

শামসের ফর্সা মুখটা কেমন যেন লাল হয়ে উঠল। সে চিন্তাও করতে পারেনি কেউ তার কথার বিরোধিতা করতে পারে। জিজ্ঞেস করল, “কোন বিষয়টাতে একমত না?”

“কম্পিটিশানের ব্যাপারে। আমি কম্পিটিশানের বিরুদ্ধে।”

“কম্পিটিশানের বিরুদ্ধে?”

“হ্যাঁ, সত্যিকার জীবনে আমরা একের সাথে অন্যে কম্পিটিশান করি না, আমরা সবাই মিলে কাজ করি, কো-অপারেশান করি। প্রতিযোগিতা দিয়ে পৃথিবীর কোনো বড় কাজ হয় নাই, সব বড় কাজ হয়েছে সবার সহযোগিতা দিয়ে, তা হলে আমি কেন সবাইকে প্রতিযোগিতা করতে শেখাব? কেন একে অন্যকে কনুই দিয়ে ঠেলে এগিয়ে যাবে?”

রাতুলের কথাটা এত চাঁচাছোলা আর এতো তীক্ষ্ণ যে শামস থতমত খেয়ে গেল, চট করে উত্তর দেবার মতো কিছু খুঁজে পেল না। সে রাতুলের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করছিল কিন্তু তার কপাল ভালো ঠিক তখন জাহাজের বাচ্চাগুলো ছুটতে ছুটতে তাদের কাছে এল। একজনের হাতে একটা কাগজ সেটা সবাই মিলে দেখছে। তারা সবার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তারপর ছুটতে ছুটতে চলে যেতে শুরু করে। তৃষা ডেকে জিজ্ঞেস করল, বলল, “কী দেখছিস?”

মৌটুসি বলল, “তোমাদের কারো জোড়া ভুরু আছে কি না।”

“জোড়া ভুরু?”

“হ্যাঁ।”

“জোড়া ভুরু থাকলে কী হবে?”

“আমাদের গুপ্তধনের পরের ক্ল তার কাছে–”

“গুপ্তধন? কীসের গুপ্তধন?”

বাচ্চারা খুব ব্যস্ত, তাদের তৃষার সাথে কথা বলার সময় নেই। মৌটুসি ছুটতে ছুটতে বলল, “পরে বলব।”

তৃষা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে রাতুলের দিকে তাকাল, “কী করছে ওরা?”

রাতুল হাসল, বলল, “একটা খেলা। জাহাজটা যতক্ষণ চলে বাচ্চারা ততক্ষণ বাইরে তাকিয়ে সময় কাটাতে পারে। দুই পাশে সুন্দরবন শুরু হয়ে গেছে কখনো গাছে বানর দেখছে, কখনো হরিণ, কখনো কুমির। সবাই রয়েল বেঙ্গল টাইগার খুঁজছে। কিন্তু এখন যখন জাহাজটা থেমেছে তখন তাদের সময় আর কাটছে না। অধৈর্য হয়ে গেছে।”

তৃষা বলল, “এখান থেকে দুজন আনসার তুলবে। রাইফেলওয়ালা আনসার। সেই জন্যে থেমেছি।”

রাতুল বলল, “জানি।”

“ট্রলার করে ভিতরে যেতে হয়েছে সেই জন্যে সময় লাগছে।”

“সেটা জানি, বাচ্চারাও জানে। জেনেও তারা অধৈর্য হয়ে যায়। সেই জন্যে তারা বাচ্চা আর আমরা বড় মানুষ।”

গীতি বলল, “এখন তো তাদের মোটেও অধৈর্য মনে হল না, সবাই দেখি খুবই উত্তেজিত। কী খেলা খেলছে?”

“ট্রেজার হান্ট। গুপ্তধন খুঁজে বের করা। জাহাজের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন মানুষের কাছে আমি কু লুকিয়ে রেখেছি। একটা কুয়ের মাঝে পরের কুটা সম্পর্কে লেখা থাকে। মাথা খাঁটিয়ে বের করতে হয়। মোট বারোটা আছে, এর মাঝে সাত নম্বরে পৌঁছে গেছে।”

“গুপ্তধনটা কী?”

“এই জাহাজে গুপ্তধন আর কী পাব? তাই গুপ্তধনটা হচ্ছে একটা অঙ্গীকার।”

“কী অঙ্গীকার?”

“আজ রাতে ডিসকো নাইট হবে।”

“ডিসকো নাইট?”

“হ্যাঁ। সবাই মিলে নাচানাচি। এখন নাচানাচি করার জন্যে কিছু ধুমধাড়াক্কা গান দরকার। চেষ্টা করছি ডাউনলোড করতে। নেটওয়ার্ক এতো দুর্বল–”

“আছে এই তত বেশি।”

রাতুল মাথা নাড়াল, বলল, “হ্যাঁ সমুদ্রের দিকে গেলে না কী নেটওয়ার্ক থাকে। এখানে আছে।”

শামস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাতুলের দিকে তাকিয়ে ছিল, যেখানে সে থাকবে সেখানে সে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়, সে মোটামুটি এটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তাই তাকে বাদ দিয়ে রাতুলের সাথে কথাবার্তাটাতে সে একটু অধৈর্য হয়ে উঠেছিল। তা ছাড়া তৃষা তার সাথে ঠিক করেছে সে সবার সাথে কথা বলবে, অন্য কেউ নয়। শামস তাই সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমার কথাটা যে সত্যি তোমরা দেখেছ?”

তৃষা জিজ্ঞেস করল, “কোন কথাটা?”

“এই যে এ দেশের ইয়াং জেনারেশান–আই মিন তোমরা–তোমাদের মাঝে সেন্স অফ কম্পিটিশান নেই।” শামস রাতুলকে দেখিয়ে বলল, “এই যে এই ছেলেটি, সে কম্পিটিশানকে বিশ্বাসই করে না। ইনক্রেডিবল।”

শামসের কথার মাঝে এক ধরনের তাচ্ছিল্যের ভাব ছিল, শুনে রাতুলের গা জ্বালা করে উঠল কিন্তু তারপরও নিজেকে শান্ত রেখে বলল, “আমি কেন কম্পিটিশান পছন্দ করি না তার একটা যুক্তি দেখিয়েছি। আপনিও আপনার যুক্তি দেখান।”

“যুক্তি? যে জিনিসটা অভিয়াস, যে জিনিসটা স্পষ্ট তার জন্যে যুক্তি দিতে হয়? সারা পৃথিবীটা চলছে কম্পিটিশানের উপর। ওয়ার্ল্ড কাপ? ক্রিকেট হয়, ফুটবল হয়, অলিম্পিক হয়। ম্যাথ অলিম্পিয়াড হয়, ফিজিক্স অলিম্পিয়াড হয়, আমেরিকান আইডল হয়–সব হচ্ছে কম্পিটিশান।”

“অবশ্যই হয়। আপনি যে কয়টা কম্পিটিশানের কথা বলেছেন তাতে কতোজন মানুষ অংশ নেয়? কয়েক হাজার? পৃথিবীতে সাত বিলিওন মানুষ-তারা কোথায় যাবে? তারা কোন কম্পিটিশানে অংশ নেবে?”

শামস এবারে কেমন যেন ক্রুদ্ধ চোখে রাতুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মানে তুমি কী বলতে চাইছ?”

“আমি বিশেষ কিছু বলতে চাইছি না! আপনার কথা সত্যি–পৃথিবীটা চলছে কম্পিটিশান দিয়ে, কিন্তু একটা ব্যাপার চালু থাকলেই সেটা ভালো কে বলেছে? পৃথিবীতে অনেক খারাপ জিনিস চলছে। যেমন মনে করেন–”

তৃষা রাতুলকে থামাল, বলল, “তুই থাম দেখি রাতুল। তোর সব যুক্তি হচ্ছে কু-যুক্তি। কেউ কিছু বললেই তুই বাগড়া দিস।”

“বাগড়া? আমি বাগড়া দিচ্ছি?”

“অবশ্যই বাগড়া দিচ্ছিস। আমরা শামস ভাইয়ের কথা শুনতে বসেছি। তোর কথা শুনতে বসিনি। তোর কথা আমরা দিন-রাত শুনি।”

রাতুল কেমন যেন আহত অনুভব করে, থতমত খেয়ে বলল, “সরি! আমি আসলে বুঝতে পারিনি। তুই বললি আড্ডার মতো হবে–যখন আড্ডা দেয় তখন তো শুধু একজন কথা বলে না–সবাই বলে, সেই জন্যে বলছিলাম।”

“হ্যাঁ আমি বলেছিলাম আড্ডার মতো, তার মানে না–”

তৃষা কথা শেষ করতে পারল না, হঠাৎ করে সবাই ওপর থেকে নারী কন্ঠের তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে পেল। কেউ একজন কোনো একটা কিছু নিয়ে চিৎকার করছে। কী ঘটছে দেখার জন্যে সবাই তখন উপরে ছুটে এল।

দোতলার একটা কেবিনের সামনে গিয়ে দেখে টেলিভিশনের নায়িকা শারমিন রাজাকে তার চুলের মুঠি ধরে রেখে তীক্ষ্ণ গলায় গালাগাল করছে। তৃষা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

“এই হারামজাদা চোর আমার কেবিনে ঢুকে আমার ব্ল্যাকবেরি মোবাইল চুরি করেছে।”

“চুরি করেছে?”

“হ্যাঁ” কথা শেষ করে শারমিন রাজার চুল ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে গালে একটা চড় বসিয়ে দিল–”দে হারামজাদা আমার ব্ল্যাকবেরি।”

রাতুল একটু হতবাক হয়ে শারমিনের দিকে তাকিয়ে থাকে, কী মিষ্টি আর কী মায়াভরা চেহারা মেয়েটির, তার জন্যে একটা ছোট বাচ্চাকে মারার দৃশ্যটি কী বেমানান, মুখে ‘হারামজাদা’ শব্দটি কী অশ্লীল শোনাচ্ছে, একেবারে গা কাঁটা দিয়ে উঠে। রাতুল এগিয়ে গিয়ে রাজাকে শারমিনের হাত থেকে ছুটিয়ে এনে, হাত ধরে বলল, “রাজা। তুমি এই ম্যাডামের ঘরে ঢুকেছ?”

“জে।” রাজা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “কিন্তু আমি চুরি করি নাই। কসম খোদা।”

“তুমি কেন এই ম্যাডামের ঘরে ঢুকেছ?”

“বাক্সের ভিতরে বাক্স আছে কী না দেখতে গিয়েছিলাম।”

বাক্সের ভিতর বাক্স বিষয়টা কী কেউ বুঝতে পারল না, শুধু রাতুল বুঝতে পারল। বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখার জন্যে সে গুপ্তধন খোঁজার যে খেলাটি শুরু করিয়ে দিয়েছে সেখানে এক সময় বাক্সের ভিতর বাক্স খোঁজার কথা। রাজা এবং অন্য সব বাচ্চা সারা জাহাজে বাক্সের ভিতর বাক্স খুঁজছে, সেই জন্যে নিশ্চয়ই শারমিনের কেবিনে ঢুকেছে। অন্য কোনো বাচ্চা ঢুকলে শারমিন এতো খেপে উঠত না কিন্তু রাজার ঢুকতে যাওয়াটা অন্য ব্যাপার। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়টি হচ্ছে চুরির অভিযোগ।

.

রাজা এতক্ষণে ফাঁস ফাস করে কাঁদতে শুরু করেছে, কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বিশ্বাস করেন আমি কিছু চুরি করি নাই।”

রাতুল শারমিনের দিকে তাকাল, “আপনি শিওর আপনার ব্ল্যাকবেরি চুরি গেছে?”

“হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর।” শারমিন থমথমে মুখে বলল, “তাহা ভাইয়ের সাথে শিডিউল নিয়ে কথা বলেছি, আমার ব্ল্যাকবেরিটা টেবিলে রেখে একটু শুয়েছি। ঘরের ভিতর শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি এই হারামজাদা ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। একটু পরে যখন টেবিলের ওপর তাকিয়েছি তখন দেখি ব্ল্যাকবেরিটা নাই।”

রাতুল বলল, “হয়তো অন্য কোথাও রেখেছেন।”

শারমিন তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “না রাখি নাই। আমি এই টেবিলের ওপর রেখেছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে।”

কেবিনের সামনে একটা জটলার মতো হয়েছে, পিছন থেকে কে যেন বলল, “আমি আগেই বলেছিলাম, এই ছেলেটিকে সাথে নেওয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল না।”

রাতুল মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, কবি শাহরিয়ার মাজিদ মুখ সুঁচালো করে রাতুলের দিকে তাকিয়ে আছেন। শারমিন চিলের মতো তীক্ষ্ণ একটা শব্দ করে বলল, “আমার এখানে আসাই ঠিক হয়নি। আমার শিডিউল চেঞ্জ করে এসেছি-এখানে দেখি সব চোর উঁচড়।”

তৃষা নিচু গলায় বলল, “সব চোর হ্যাঁচড় বলা ঠিক না।”

“কেন ঠিক না? একশবার ঠিক। আমার ব্ল্যাকবেরি চুরি গিয়েছে না? যদি এই হারামজাদা না নিয়ে থাকে তা হলে অন্য কেউ নিয়েছে। এই জাহাজের কেউ একজন নিয়েছে। এখানে তো বাইরে থেকে কেউ আসবে না। আসবে?”

রাতুল আবার রাজার দিকে তাকাল, ছেলেটির মুখে এক ধরনের অসহায় আতঙ্ক।

ঠিক এই সময় শারমিনের মা ভিড় ঠেলে এসে ঢুকলেন, “কী হয়েছে?”

“দেখো আম্মু, এই হারামজাদা আমার ব্ল্যাকবেরি” শারমিন কথা শেষ না করে হঠাৎ থেমে গেল। সবাই দেখতে পেল শারমিনের মায়ের হাতে একটা দামি মোবাইল ফোন, এটাই নিশ্চয়ই সেই বিখ্যাত ব্ল্যাকবেরি। শারমিনের মা কিছু একটা অনুমান করে কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। একটু ইতস্তত করে বললেন, “তুই ঘুমাচ্ছিলি তাই তোকে ডাকিনি। গাছে একটা বানরের বাচ্চার ছবি তোলার জন্যে তোর ব্ল্যাকবেরিটা নিয়েছি।”

শারমিন অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তার মায়ের হাত থেকে মোবাইল ফোনটা নিয়ে দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করল। রাতুলের মাথায় হঠাৎ করে রক্ত উঠে যায়, সে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল, “এইটা আপনার সেই ব্ল্যাকবেরি?”

“হ্যাঁ।”

“তার মানে এটা আসলে রাজা চুরি করেনি, আপনার মা নিয়ে গিয়েছিলেন?”

শারমিন কোনো কথা বলল না। রাতুল সরু চোখে শারমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু আপনি ধরেই নিলেন রাজা চুরি করেছে? রাজার গায়ে হাত তুললেন?”

শারমিন এবারেও কোনো কথা বলল না। রাতুল শীতল গলায় বলল, “আপনি কী এখন এই ছেলেটির কাছে মাফ চাইবেন?”

শারমিনের মুখ লাল হয়ে ওঠে, “আপনার কত বড় সাহস আমাকে এর কাছে মাফ চাইতে বলেন? এই ছেলে এখন চুরি করে নাই তো কী হয়েছে? এর পরে যখন সুযোগ পাবে তখন চুরি করবে।”

রাতুল কিছু একটা বলতে চাইছিল, তাকে কোনো সুযোগ না দিয়ে শারমিন ঘরে ঢুকে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয়। কেবিনের সামনে জটলাটা তখন ধীরে ধীরে ভেঙে যেতে শুরু করে।

রাজা চোখ মুছে রাতুলকে বলল, “দেখলেন তো ভাই আমি চুরি করি নাই।”

“হ্যাঁ দেখেছি।” রাতুল গম্ভীর গলায় বলল, “আর তুমি দেখেছ তো এই জাহাজে কোনো কিছু হারিয়ে গেলে, চুরি হলেই তোমাকে ধরবে?”

“জে। দেখেছি।”

“কাজেই খুব সাবধান। কেউ যেন তোমাকে কিছু বলতে না পারে।”

“জে ভাই। কেউ কিছু বলতে পারবে না।”

কিছুক্ষণের মাঝেই আবার বাচ্চাদের ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়, তাদের মাঝে রাজাও আছে, তাকে দেখে মনেই হয় না কোনো কিছু ঘটেছে। কত সহজে কত বড় একটা ঘটনা ভুলে যেতে পারে!

.

ট্রলারে করে দুইজন আনসার জাহাজে ওঠার পর জাহাজটা আবার ছেড়ে দিল। আনসার দুইজনের কাছে দুটো থ্রি নট থ্রি রাইফেল, মানুষ দুজন সাদাসিধে গোবেচারা ধরনের–কখনও দরকার হলে এই রাইফেল দিয়ে গুলি করতে পারবে বলে মনে হয় না। একজন একটু বয়স্ক, অন্যজন কম বয়সী। তবে দুজনই স্থানীয় বলে সুন্দরবনের খুঁটিনাটি অনেক কিছু জানে। রাতুল তাদের সাথে কথা বলে নদীর নাম, গাছের নাম, পাখির নাম থেকে শুরু করে রয়েল বেঙ্গল টাইগাররা কোথায় থাকে, কী করে, কী খায় এগুলোও জেনে নিল। বাঘকে এখানকার মানুষেরা যে মামা বলে ডাকে সেটাও সে এই দুইজন আনসারের কাছে জানতে পারল।

বড় একটা নদী থেকে তাদের জাহাজটা ছোট একটা নদীতে ঢুকে গেল। দুইপাশে ঘন জঙ্গল, গাছগাছালিতে ভরা। ভাটা শুরু হয়েছে। তাই নদীর পানি কমে কাদা দিয়ে ঢাকা নদীর তীর ভেসে উঠছে। সেখানে নানা ধরনের গাছের শাসমূল সুঁচালো ছুরির মতো বের হয়ে আসছে। রাতুল জাহাজের ছাদে বসে মুগ্ধ হয়ে দেখছে। জন্মের পর থেকে সে সুন্দরবনের কথা শুনে আসছে। কিন্তু সেই বনভূমি যে এত বিচিত্র কখনও কল্পনা করেনি। একা একা এত সুন্দর আর এত গহিন জঙ্গলটা দেখতে মন চাইছিল না। তাই সে তৃষাকে খুঁজতে বের হল। নিচতলায় তার সাথে দেখা হল। চা বানানোর জন্যে গরম পানির ফ্লাস্ক থেকে সে প্লাস্টিকের কাপে পানি ঢালছে, রাতুলকে দেখে তৃষা গম্ভীর হয়ে বলল, “এখন কার সাথে ঝগড়া করে এসেছিস?”

“ঝগড়া? ঝগড়া করব কেন?”

“তাই তো দেখছি।”

“কখন আমাকে ঝগড়া করতে দেখলি?”

“প্রথমে ঝগড়া করলি শামস ভাইয়ের সাথে, তারপর ঝগড়া করলি শারমিনের সাথে।”

“আমি ঝগড়া করেছি?” রাতুল অবাক হয়ে বলল, “আমি?”

“হ্যাঁ। তুই ভুলে যাচ্ছিস, এরা আমাদের ইনভাইটেড গেস্ট। এরা সেলিব্রেটি, এরা আমাদের সাথে আছে বলে আমরা আমাদের ফেস্টিভ্যালগুলো করতে পারি।”

“তার মানে তুই বলছিস তোর ওই শামস ভাইয়ের কোনো কথা পছন্দ না হলে আমি সেটা বলতে পারব না? শারমিন একটা বাচ্চা ছেলেকে মিথ্যা দোষ দিয়ে চড় মেরে দেবে আর আমাকে সেটা দেখতে হবে?”

“না তোকে দেখতে হবে না। কিন্তু তার মানে না তুই তাকে পাল্টা অপমান করবি। এরা দেশের সেলিব্রেটি। তুই সেলিব্রেটি না। তুই একজন ফালতু ভলান্টিয়ার।”

“ফালতু ভলান্টিয়ার?” রাতুল প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “তুই আমাকে ফালতু ভলান্টিয়ার বলতে পারলি?”

তৃষা গরম হয়ে বলল, “কেন পারব না? তুই ভুলে যাচ্ছিস যে, তুই এই অরগানাইজেশনের কেউ না। আমি তোর কথা বলেছি আর আমার কথাকে বিশ্বাস। করে তোকে এখানে আসতে দেওয়া হয়েছে। আর তুই এসে বড় বড় বোলচাল শুরু করেছিস, আর ধাক্কাটা সহ্য করতে হচ্ছে আমাকে। বুঝেছিস?”

অপমানে রাতুলের কান লাল হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “বুঝেছি।”

“মাত্রাজ্ঞান খুব ইম্পর্ট্যান্ট। ঠিক কখন থামতে হয় সেটা জানতে হয়, সেটা না জানলে খুব মুশকিল। তোর কোনো মাত্রাজ্ঞান নেই, কার সাথে কী রকম ব্যবহার করতে হয় তুই জানিস না। বুঝেছিস?”

রাতুল চুপ করে রইল। তৃষা প্রায় চিৎকার করে বলল, “বুঝেছিস?”

রাতুল আস্তে আস্তে বলল, “বুঝেছি।”

“শুধু বুঝলে হবে না, মনে রাখতে হবে।”

“মনে রাখব।” রাতুল একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আই অ্যাম সরি তৃষা, আমার জন্যে তোর এত ঝামেলা হচ্ছে। যদি কোনো উপায় থাকত, আমি তা হলে এই জাহাজ ছেড়ে চলে যেতাম, এখন চলে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।”

“আমি তোকে এখন নাটক করতে বলিনি যে রাগ করে চলে যাবি। আমি শুধু বলেছি–”

“তুই বলেছিস আমি একজন ফালতু ভলান্টিয়ার, আমাকে ফালতু ভলান্টিয়ারের মতো থাকতে হবে। আমি থাকব। তুই নিশ্চিন্ত থাক তৃষা।”

তৃষা কয়েক মুহূর্ত রাতুলের দিকে তাকিয়ে পাস্টিকের গ্লাসে চা নিয়ে হেঁটে চলে গেল। রাতুল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল তৃষা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। উপরের কেবিনে সেলিব্রেটিরা থাকে, তৃষা তাদের শান্ত করতে যাচ্ছে। রাতুলের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে তৃষাকে–রাতুলের হঠাৎ মরে যেতে ইচ্ছা করতে থাকে।

.

তৃষার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে শামস চুমুক দিয়ে বলল, “ফার্স্ট ক্লাস চা।”

তৃষা হেসে ফেলল, শামস জিজ্ঞেস করল, “হাসছ কেন?”

“আপনার ফার্স্ট ক্লাস চা শুনে। কারণ আমি জানি এটা মোটেও ফার্স্ট ক্লাস চা না। এটা ফোর্থ কিংবা ফিফথ ক্লাস চা। টেনেটুনে বড়জোর থার্ড ক্লাস হতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই ফার্স্ট ক্লাস চা না।”

“তুমি একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস মিস করে গেছ।”

“সেটা কী?”

“যখন মানুষ কোনো একটা কিছু খায় তখন সেটা তার কাছে কতটুকু ভালো লাগবে সেটা নির্ভর করে সে কোন পরিবেশে খাচ্ছে তার উপর। যখন তুমি খুব দামি একটা রেস্টুরেন্টে খেতে যাও তখন খাবারটা হয়তো খুবই সাধারণ। কিন্তু তোমার কাছে সেটাই অসাধারণ মনে হবে, কারণ তোমার চারপাশের পরিবেশটা

অসাধারণ।” . তৃষা ছোট কেবিনটার চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলল, “এখানে পরিবেশটা অসাধারণ?”

শামস উত্তর না দিয়ে হাসল। তৃষা জিজ্ঞেস করল, “কী হল?”

শামস মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ অসাধারণ। যতক্ষণ তুমি আছ ততক্ষণ অসাধারণ।”

তৃষা একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। কিন্তু দ্রুত নিজেকে সামলে নিল।”আপনার অবস্থা খুবই খারাপ মনে হচ্ছে।”

“কেন?”

“আমার মতো একজন মানুষকে যদি আপনার পরিবেশকে উন্নত করতে হয় তা হলে অবস্থা খারাপ না?”

“মোটেও খারাপ না। তুমি অসাধারণ।”

“আমি অসাধারণ?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

শামস মাথা চুলকানোর ভান করল, “কোথা থেকে শুরু করব? তোমার চেহারা? পার্সোনালিটি? হাসি? ভাবভঙ্গি? কাজকর্ম?”

“থাক থাক, কোনো জায়গা থেকেই শুরু করতে হবে না।”

“না না, ঠাট্টা না। আমি তো তোমাকে লক্ষ করছি। এত দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছ, সবসময়ই মাথা ঠাণ্ডা, সবসময়ই হাসিখুশি। মোটেও তোমার সেই বন্ধুর মতো না।”

“কোন বন্ধু?”

“ওই যে সকালে আমার সাথে তর্ক জুড়ে দিল।”

“ও আচ্ছা। রাতুল।” তৃষা হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে যায়।

“নাম তো জানি না।” শামস বলল, “ওর সমস্যাটা কী? মনে হচ্ছে সবসময়ই কোনো কিছু নিয়ে রেগে আছে। একজন ইয়াংম্যান অথচ কোনো ড্রাইভ নেই। এখনো বিশ্বাস করে, কম্পিটিশান করে বড় হওয়া যায় না? তার কী ইচ্ছা? সে সবসময়ই একজন নো-বডি হয়ে থাকবে? কখনও সাম-বডি হবে না?”

তৃষা একটা নিশ্বাস ফেলল, বলল, “আমি ঠিক জানি না, রাতুলের সমস্যাটা কী।”

শামস সুর পাল্টে বলল, “থাক, রাতুলের কথা থাক। তোমার কথা শুনি। বলল, তোমার কথা বলো।”

তৃষা একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়, তার কথা সে কী বলবে?

.

দুপুরবেলা জাহাজটা এক জায়গায় নোঙর ফেলল। দুরে ফরেস্ট্রির একটা টাওয়ার, দুইপাশে ঘন জঙ্গল। জাহাজের সাথে একটা ট্রলার বেঁধে রাখা আছে, সেটাতে করে সবাইকে তীরে নিয়ে যাওয়া হবে। বাচ্চাদের উৎসাহ সবচেয়ে বেশি কিন্তু প্রথমে সুযোগ পেল আমন্ত্রিত অতিথিরা, তৃষা তাদের সাথে নেমে গেল। সবাইকে নামিয়ে ট্রলারটা ফিরে আসতে আসতে প্রায় পনেরো মিনিট লেগে যায়, এই পনেরো মিনিটে বাচ্চারা একেবারে অধৈর্য হয়ে উঠল।

বাচ্চাদের ট্রলারে তোলার সময় রাতুল সতর্ক থাকে, সবাইকে তুলে সে গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সবাই উঠেছ?”

বাচ্চারা চিৎকার করে বলল, “উঠেছি।”

“দেখা যাক সবাই উঠেছে কি-না, একবার গুনে ফেলা যাক। শুরু করো, ওয়ান টু থ্রি।”

রাতুল একটু আগে সবাইকে এক দুই তিন, এভাবে নম্বর দিয়ে দিয়েছে। তারা নিজের নম্বর বলতে লাগল। মৌটুসি চিৎকার করে বলল, “এক।”

টুম্পা বলল, “দুই।”

টুবলু বলল, “তিন।”

তখন শান্তর বলার কথা”চার–” কিন্তু সে উবু হয়ে পানিতে ভেসে যাওয়া। একটা গাছের ডাল ধরার চেষ্টা করছে। কাজেই চার শোনা গেল না।

রাতুল জিজ্ঞেস করল, “চার? চার কোথায় গেল?”

তখন অন্যেরা শান্তকে টেনে দাঁড় করাল, “এই যে, এই যে চার।”

রাতুল বলল, “শান্ত, তোমার নাম্বার বলো।”

শান্ত বলল, “চার–” তারপর আবার সে উবু হয়ে নদী থেকে গাছের ডালটা ধরার চেষ্টা করতে থাকে।

মিশা বলল, “পাঁচ।”

দীপন বলল, “ছয়।”

রাজা বলল, “সাত।”

এভাবে তেরো নম্বরে গিয়ে শেষ হওয়ার পর রাতুল বলল, “গুড। ফিরে আসার সময় গুনে গুনে এই তেরোজনকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। ঠিক আছে?”

সবাই চিৎকার করে বলল, “ঠিক আছে।”

ট্রলার তীরে থামার আগেই বাচ্চারা লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে শুরু করে। বড় মানুষেরা নেমে চারদিকে তাকিয়ে বনভূমির সৌন্দর্য দেখে আহা-উঁহু করতে থাকে, বাচ্চারা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে মাথা ঘামাল না, তারা চারদিকে ছোটাছুটি করতে লাগল। প্রথমে ছুটে দাপাদাপি করে টাওয়ারের উপর উঠে গেল। সেখানে কিছু করার নেই বলে আবার দাপাদাপি করে নিচে নেমে এলো। তারা যখন গাছের ডাল ধরে টানাটানি করতে থাকে তখন হঠাৎ করে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটা বানর পেয়ে যায়। বাচ্চারা নানাভাবে লোভ দেখিয়ে বানরটাকে নিচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করে। বানরটা নিচে নেমে আসার কোনো আগ্রহ দেখাল না, বরং আরও একটু উপরে উঠে একটা গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে নিস্পৃহভাবে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে রইল। বাচ্চারা তখন বানরটাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করল, বানরটা ভয় পেল বলে মনে হয় না, একটু বিরক্ত হওয়ার ভান করে তাদের দিকে মুখ খিঁচিয়ে গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

.

রাতুল সবাইকে নিয়ে আরেকটু এগিয়ে যায়, বনের গাছগাছালির ভেতর দিয়ে কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর হঠাৎ তারা একটা ফাঁকা জায়গায় হাজির হয়। বিশাল একটা মাঠ, দেখে মনে হয় তেপান্তরে চলে এসেছে। বহুদূরে গাছগাছালির সবুজ রেখা, মাঝখানে সবুজ আর শুকনো ঘাসের উঁচু-নিচু প্রান্তর। মাঝে মাঝে ছোট বড় একটি-দুটি গাছ নিঃসঙ্গ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝামাঝি পাতাবিহীন একটা শুকনো গাছ সম্ভবত বাজ পড়ে পুড়ে গেছে।

রাইফেল হাতে মাঝবয়সী আনসারটি একটা ঢিবির উপর বসে সিগারেট টানতে থাকে। একটা মেঠোপথ বনভূমির দিকে এগিয়ে গেছে, কমবয়সী আনসারটি সেই দিকে এগিয়ে যায়। তার পিছু পিছু উৎসাহী মানুষজন হাঁটতে থাকে।

রাতুল ভেতরে ভেতরে কেমন যেন অবসন্ন অনুভব করে। সে একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে রইল। নিজের অজান্তেই সে তৃষাকে খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু তাকে খুঁজে পেল না। বাচ্চারা ছোটাছুটি করে খেলছে। সে অন্যমনস্কভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।

মৌটুসি এসে জিজ্ঞেস করল, “স্পাইডার ভাইয়া, সবাই বিচের দিকে যাচ্ছে, তুমি যাবে না?”

“নাহ্।”

“তা হলে আমিও যাব না।”

“কেন, তুমি যাবে না কেন? যাও।”

“যেতে ইচ্ছে করছে না।”

“ঠিক আছে তা হলে। বসো।”

মৌটুসি রাতুলের কাছে বসে একটা ছোট কাঠি দিয়ে মাটি খোঁচাতে থাকে। একটু পর রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাইয়া–”

“বলো।”

“তোমার কী মন খারাপ?”

“না না, মন খারাপ না, মন খারাপ কেন হবে–” বলতে গিয়ে রাতুল থেমে গেল। সে মৌটুসির দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, “হ্যাঁ মৌটুসি, আমার একটু মন খারাপ।”

মৌটুসি বড় মানুষের মতো বলল, “আমি বুঝতে পারছিলাম। তোমার কেন মন খারাপ ভাইয়া?”

রাতুল বলল, “সেটাই তো বুঝতে পারছি না। মাঝে মাঝে এ রকম হয়। হঠাৎ করে একদিন ভোরবেলা ঘুম ভেঙে দেখি কেন জানি মন খারাপ। কোনো কারণ নাই, তবু মন খারাপ।”

মৌটুসি বলল, “আমারও মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। যখন আব্বু আমাকে বকা দেয় তখন আমার মন খারাপ হয়। যখন আম্মু আর আব্বু ঝগড়া করে তখন আমার মন খারাপ হয়। যখন স্কুলে আমার বন্ধুরা আমাকে খেলতে নেয় না তখন আমার মন খারাপ হয়।”

“মন খারাপ হলে তুমি কী করো?”

“কিছু করি না। মাঝে মধ্যে একটু কাঁদি। তারপর যখন আম্মু আমাকে আদর করে না হয় আম্মু-আব্বু আর ঝগড়া করে না, আর বন্ধুরা যখন খেলতে নেয় তখন আবার মন ভালো হয়ে যায়।” মৌটুসি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তুমি চিন্তা করো না স্পাইডার ভাইয়া, দেখবে আবার তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।”

রাতুল মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ কোনো কারণ ছাড়া যখন মন খারাপ হয় তখন আবার কোনো কারণ ছাড়াই মন ভালো হয়ে যায়।”

কথাটা মৌটুসির খুব পছন্দ হল। সে অনেকক্ষণ হি হি করে হাসল। রাতুল এক ধরনের হিংসার চোখে এই বাচ্চা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে–কত সহজে এরা কত আনন্দ পেয়ে যায়।

ঠিক তখন তাদের সামনে দিয়ে অনেকগুলো হরিণ ছুটে যেতে শুরু করে।

দেখে মৌটুসি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, চিৎকার করে বলে, “হরিণ! হরিণ!”

“হ্যাঁ, হরিণ!”

“কী সুন্দর হরিণ!”

রাতুল মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। হরিণ খুব সুন্দর। যখন দৌড়ায় তখন আরও সুন্দর দেখায়।”

“হরিণগুলো কেন দৌড়াচ্ছে স্পাইডার ভাইয়া?”

“আমাদের দেখে মনে হয় ভয় পেয়েছে।”

“আমরা তো কিছু করি নাই। করেছি?”

“না। কিছু করি নাই। কিন্তু বনের পশু তো–তাই মানুষ থেকে দূরে থাকে।”

মৌটুসি হঠাৎ চোখ বড় বড় করে বলল, “মনে হয় একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার ধাওয়া করেছে।”

রাতুল হাসল, বলল, “হতে পারে।”

মৌটুসি আঙুলে গুনে গুনে বলল, “আমরা কুমির দেখেছি, বানর দেখেছি, অনেক রকম পাখি দেখেছি, গুইসাপ দেখেছি, শুশুক দেখেছি, হরিণ দেখেছি। কিন্তু এখনও কোনো বাঘ দেখিনি।”

“বাঘ দেখা সোজা না। তারা তোমার সামনে আসবে না।” রাতুল দূরে রাইফেল হাতে বসে থাকা আনসারটিকে দেখিয়ে বলল, “দেখছ না, সবসময় একজন মানুষ রাইফেল নিয়ে বসে আছে। বাঘ তো বোকা না!”

“সুন্দরবন এসে বাঘ না দেখে চলে যাব?”

“মনে হয় না দেখেই যেতে হবে। রাতুল মাথা নেড়ে বলল, “খুব বেশি হলে তুমি বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পারো।”

“পায়ের ছাপ? কোথায়?”

“যেখানে বাঘ পানি খেতে আসে সেখানে।” হঠাৎ রাতুলের মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে।

মৌটুসি জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে স্পাইডার ভাইয়া?”

“চলো আমরা একটা কাজ করি।”

“কী কাজ?”

“এখানে বাঘের পায়ের ছাপ তৈরি করে রাখি। সবাই যখন আসবে তারা বাঘের পায়ের ছাপ দেখে হইচই শুরু করে দেবে। ভাববে সত্যি বাঘ এসেছে!”

মৌটুসির মুখে এগাল-গাল জোড়া হাসি ফুটে উঠল, “তুমি বাঘের পায়ের ছাপ তৈরি করতে পারবে? কেমন হয় বাঘের পায়ের ছাপ?”

“সেটা তো জানি না। কিন্তু কেউই তো জানে না! তাই আমরা যেটা তৈরি করব সেটাই হবে বাঘের পায়ের ছাপ।”

রাতুল তখন মৌটুসিকে নিয়ে একটু সরে গেল। সবাই যে পথ দিয়ে আসছে সেখানে খুঁজে খুঁজে খানিকটা নরম মাটি বের করল। তারপর সেখানে বাঘের পায়ের ছাপ তৈরি করতে বসে গেল। রাতুল বাঘের পায়ের ছাপ দেখেনি। কিন্তু ধরেই নিল সেটা হবে বিড়ালের থাবার মতো। তবে তার থেকে অনেক বড়। বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টার পর যেটা তৈরি হল সেটা দেখতে খারাপ হল না। যারা চেনে না তাদের কাছে বাঘের পায়ের ছাপ হিসেবে অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যাবে। শুধু একটা ছাপ হলে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হবে না। কাজেই আরও কয়েকটা পায়ের ছাপ তৈরি হল, দেখে যেন মনে হয় বাঘটা এই পথ দিয়ে হেঁটে গেছে। তাদের কাজ যখন শেষের দিকে তখন রাতুল আর মৌটুসি দেখতে পেল তাদের দলটি ফিরে আসছে। তারা দুজন সেখান থেকে সরে গিয়ে আগের জায়গায় বসে গেল। এত কষ্ট করে বাঘের পায়ের ছাপ তৈরি করেছে, এখন কেউ যদি লক্ষ না করে সেটা হবে রীতিমতো হৃদয়বিদারক!

দূর থেকে রাতুল আর মৌটুসি লক্ষ করল দলটির একটা বড় অংশ বাঘের পায়ের ছাপটি না দেখেই সামনে এগিয়ে গেল, তখন হঠাৎ এটি একজনের চোখে পড়ল এবং মুহূর্তের মধ্যে সবাই বাঘের পায়ের ছাপকে ঘিরে দাঁড়াল। রাতুল আর মৌটুসি দেখল, আনসারটি তার ঘাড় থেকে রাইফেল হাতে নিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে।

মাঝবয়সী আনসারটিও তখন এগিয়ে যায়, রাতুল আর মৌটুসিও তার সাথে সাথে সামনে হাঁটতে থাকে। রাতুল মৌটুসির হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, “খবরদার মৌটুসি, হাসবে না কিন্তু।”

“না, হাসব না।” বলে মৌটুসি একবার ফিক করে হেসে ফেলল।

বাঘের পায়ের ছাপের কাছে গিয়ে রাতুল আবিষ্কার করল, সবাই মিলে বাঘের পায়ের ছাপের ছবি নিচ্ছে। শামস তৃষাকে বসিয়ে তার ক্যামেরা ফোকাস করতে করতে বলল, “তৃষা, তুমি মুখটা আরেকটু গম্ভীর করো। ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন হবে খানিকটা কৌতূহল, খানিকটা বিস্ময় এবং অনেকটুকু আতঙ্ক।”

তৃষা তার মুখে কৌতূহল, বিস্ময় আর আতঙ্কের একটা মিশ্রণ তৈরি করার চেষ্টা করল, সেটা হল অনেকটা অতি নাটকীয় এবং শামস তার দামি ক্যামেরায় ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে তৃষার অনেকগুলো ছবি তুলে ফেলল।

বয়স্ক আনসারটা বাঘের পায়ের ছাপটা দেখে মাথা চুলকে বলল, “খুবই আজিব।”

আলমগীর ভাই বললেন, “কী আজিব?”

“এই যে বাঘের পায়ের ছাপ।”

শামস জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে বাঘের পায়ের ছাপে?”

“আমি ধরেন অনেক বাঘের পায়ের ছাপ দেখেছি। কিন্তু এ রকম পায়ের ছাপ কখনো দেখি নাই।”

“কেন?”

“এইখানে যে রকম মাটি সেইখানে এই রকম একটা পায়ের ছাপের জন্যে বাঘের সাইজটা হওয়া দরকার হাতির মতোন। এই মাটিতে এত গভীর ছাপ পড়ার কথা না।”

শামস গম্ভীর হয়ে বলল, “পড়ার কথা না বলে তো লাভ নেই–আপনি নিজের চোখে দেখেছেন পড়েছে। হয়তো বাঘটা আসলেই বিশাল ছিল।”

“শুধু যে সাইজ বড় হওয়ার কথা তা না”, আনসারটা আবার মাথা চুলকালো। ”বাঘের ধরেন চার পা, সে চার পা দিয়ে হাঁটে। এইখানে খালি দুই পায়ের ছাপ। মনে হচ্ছে—”

“কী মনে হচ্ছে?”

“এই বাঘ দুই পা দিয়ে মানুষের মতো হেঁটে গেছে।” কথা শেষ করে সে হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু কেউ তার হাসিতে যোগ দিল না। শুধু শামস কাঁধ

ঝাঁকিয়ে বলল, “যত্তোসব রাবিশ!”

রাতুল আর মৌটুসি একজনের দিকে আরেকজন তাকিয়ে গোপনে মুখ টিপে হাসল।

আলমগীর ভাই বললেন, “এখন মুখ থেকে খুব হাসি বের হচ্ছে। যদি সত্যি সত্যিই রয়েল বেঙ্গল টাইগার বের হয়ে আসত তা হলে দেখতাম মুখে কত হাসি বের হয়।”

তৃষা রাতুলকে জিজ্ঞেস করল, “তোমাকে বিচে দেখলাম না।”

“না, আমি যাইনি। আমি আর মৌটুসি এখানে ছিলাম।”

“তোমরা কিছু দেখেছ না কি?”

“নাহ্। শুধু দেখলাম হঠাৎ অনেকগুলো হরিণ ছুটে গেল।” রাতুল মুখ গম্ভীর করে বলল, “তখন বুঝতে পারিনি, এখন বুঝতে পারছি, বাঘটা তখন মনে হয় হরিণগুলোকে তাড়া করেছিল।”

মৌটুসি মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, তাড়া করেছিল।

তৃষা দুশ্চিন্তিত মুখে বলল, “তা হলে বাঘটা হয়তো আশেপাশে আছে, আমাদের তাড়াতাড়ি জাহাজে ফিরে যাওয়া দরকার।”

“হ্যাঁ।” আলমগীর ভাই বললেন, “চলো, জাহাজে চলো সবাই।”

সবাই যখন হাঁটতে শুরু করে তখন শামস তৃষাকে বলল, “তৃষা, তুমি এখানে দাঁড়াও, তোমার একটা ছবি তুলি।”

তৃষা দাঁড়াল, তার মুখে একটা ব্ৰিত ভাব। শামস কয়েকটা ছবি তুলে ক্যামেরাটা রাতুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি আমাদের দুজনের একটা ছবি তুলে দেবে?”

রাতুল কোনো কথা না বলে ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে তৃষা আর শামসের দিকে তাকাল। ক্যামেরার লেন্সের ভেতর দিয়ে পাশাপাশি দুজনের হাসিমুখ দেখে তার বুকের ভেতর কেমন যেন জ্বলে-পুড়ে যেতে থাকে। সে নিঃশব্দে তাদের অনেকগুলো ছবি তুলে দিল।

.

রাতে খাওয়ার পর নিচতলায় বাচ্চাদের জন্যে রাতুল ডিসকো নাচের ব্যবস্থা করল। তাদেরকে কথা দিয়েছিল কথা না রেখে উপায় নেই। সারাদিন ধুমধাড়াক্কা ধরনের যে কয়টা গান সংগ্রহ করা হয়েছে সেগুলো ল্যাপটপ থেকে বাজানোর ব্যবস্থা করা হল। সাউন্ড সিস্টেমের খুঁটিনাটি ঠিক করে রাতুল গানগুলো বাজাতে থাকে। স্পিকারে বিকট সুরে সেই গান বাজতে থাকে এবং বাচ্চাগুলো সেই গানের সাথে নাচানাচি শুরু করে দেয়। প্রথমে তাদের একটু একটু লজ্জা লাগছিল, তখন রাজা এসে অত্যন্ত বিচিত্র ভঙ্গিতে নাচতে শুরু করে। তার বিচিত্র নাচ দেখে অনেকেরই লজ্জা ভেঙে যায় এবং তখন সবাই একসাথে লাফালাফি শুরু করে দেয়।

গানের বিকট সুরই হোক আর বাচ্চাদের আনন্দোল্লাসই হোক, জাহাজের অনেকেই নিচে নেমে তাদের দেখতে থাকে। প্রথমে মৌটুসি তার মা-বাবাকে টেনে নাচের আসরে নামিয়ে দেয়। তারা নাচের ভঙ্গি করে একটু নড়াচড়া করলেন। তখন বাচ্চারা একে একে সবাইকে টেনে আনতে লাগল। কেউ কেউ বেশ আগ্রহ নিয়ে নাচার চেষ্টা করল কেউ কেউ একটু হাত-পা নাড়িয়ে সরে গেল। রাতুল সাউন্ড সিস্টেমে গান বাজাতে বাজাতে লক্ষ করল, বাচ্চারা শামস এবং শারমিনকেও ঠেলে ঠেলে নিয়ে এসেছে। শারমিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে একসময় সরে গেল, শামস আর গেল না, বেশ দক্ষ নৃত্যশিল্পীর মতো নাচতে থাকে। রাতুল লক্ষ করল, শামস নাচতে নাচতে তৃষাকে ডাকছে এবং বাচ্চারা প্রচণ্ড উৎসাহে তৃষাকে টেনে নিয়ে এসেছে। শামস তৃষার হাত ধরল এবং দুজন বেশ সহজভাবে নাচতে লাগল।

বাচ্চাদের কয়েকজন হঠাৎ করে রাতুলকে দেখতে পেল এবং সমস্বরে চিৎকার করে তার দিকে ছুটে তাকে নাচের আসরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে টানাটানি। করতে থাকে।

রাতুল মাথা নেড়ে বলল, “আমি নাচতে পারি না।”

মৌটুসি হাসতে হাসতে বলল, “আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব ভাইয়া। খুব সোজা।”

“তুমি শিখালেও আমি পারব না মৌটুসি। তা ছাড়া আমি সাউন্ড সিস্টেম থেকে চলে গেলে এটা চালাবে কে?”

বাচ্চারা যুক্তিতর্কের ধারেকাছে গেল না, বলল, “কিছু হবে না। তুমি চলো।”

রাতুল মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু, আমি যাব না।”

“কেন যাবে না?”

“আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাব। বুঝেছ?”

“ও।” মৌটুসি কিছুক্ষণ রাতুলের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর নাচের আসরে শামস আর তৃষার দিকে তাকাল, তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে চলে গেল।

রাতুল একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। একটু পরে সে আবিষ্কার করে তাকিয়ে থেকেও সে কিছু দেখছে না। কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে থেকেও যে সেটি না দেখা সম্ভব সেটা সে আগে কখনো লক্ষ করেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *