৪. মাদার প্ল্যানেট

১৬. সম্মেলন

যখন শুধুমাত্র মাদার প্ল্যানেট টার্মিনাসের প্রতি চরম অবিশ্বাসের কারণে সাতাশটা স্বাধীন বণিক বিশ্ব একত্রিত হয় নিজেদের মাঝে তারা একটা সম্মেলনের আয়োজন করে। প্রতিটা গ্রহই নিজস্ব ক্ষুদ্রতা থেকে উদ্ভূত সিমাহীন অহংকারে সমৃদ্ধ, রুক্ষ কঠিন গ্রাম্য জীবনযাপনে অভ্যস্ত, এবং জাগতিক সমস্যা মোকাবিলা করে করে তিক্ত বিরক্ত। শুরুতেই অতি তুচ্ছ একটা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে এই মন মরা গ্রহবাসীদের টালমাটাল অবস্থায় পড়তে হয়।

সমস্যাটা ভোটাভুটির নিয়ম, প্রতিনিধিদের ধরন-গ্রহের মান অনুযায়ী নাকি জনসংখ্যা অনুযায়ী হবে-ইত্যাদি বিষয় নির্ধারণ করা নিয়ে নয়, কারণ এই বিষয়গুলোর রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। আবার সমস্যাটা কাউন্সিল এবং ডিনারে কীভাবে টেবিল সাজানো হবে সেটা নিয়েও নয়; কারণ এই বিষয়গুলোর সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে।

সমস্যা দেখা দেয় সম্মেলনের স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে-কারণ এটা অত্যন্ত প্রবল প্রাদেশিক মানসিকতার ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত কূটনীতির সর্পিল পথ তাদের নিয়ে যায় র‍্যাডল নামক গ্রহে যার পক্ষে কয়েকজন বক্তা শুরু থেকেই যুক্তি দেখিয়ে বলছিলেন যে এটা মোটামুটি কেন্দ্রে অবস্থিত।

র‍্যাডল ক্ষুদ্র এক বিশ্ব-সামরিক গুরুত্ব বিবেচনায় যা সাতাশটা গ্রহের মাঝে সবচেয়ে দুর্বল। এবং এই গ্রহ বেছে নেওয়ার এটাও একটা কারণ।

এটা একটা রিবন ওয়ার্ল্ড-গ্যালাক্সি যাকে নিয়ে অহংকার করতে পারে, কিন্তু অধিবাসীদের অল্পসংখ্যকই শারীরিক গঠনে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। অন্য কথায় বলা যায় এটা এমন একটা বিশ্ব যেখানে দুই তৃতীয়াংশ অধিবাসী বিরামহীনভাবে অত্যধিক ঠাণ্ডা এবং অত্যধিক গরমের মোকাবেলা করতে বাধ্য হয়, যেখানে জীবনধারণের সম্ভ্যাব্য স্থিতিশীল স্থান হচ্ছে রিবন বেষ্টিত আধো আলোকিত অঞ্চল।

এমন একটা গ্রহ কারো কাছেই আকর্ষণীয় মনে হতে পারে না। কিন্তু এখানে ভূ তাত্ত্বিক কৌশলে বিশেষ ধরনের কিছু স্থান তৈরি হয়েছে-র্যাডল সিটি এমনি একটি স্থানে অবস্থিত।

একটা পর্বতের মসৃণ পাদদেশে এই শহর বিস্তৃত-যে পর্বত শীর্ষ শীতল আবহাওয়া এবং ভয়ংকর তুষারপাত থেকে রক্ষা করছে শহরটাকে। উষ্ণ এবং শুকনো বায়ু শহরটাকে আরামদায়ক করে তুলেছে, পাহাড় চূড়ার বরফ গলিয়ে পাইপের সাহায্যে পানি সরবরাহ করা হয়-এবং এ দুয়ের মাঝে র‍্যাডল সিটি পরিণত হয়েছে এক চিরস্থায়ী উদ্যানে, অন্তহীন ভোরের আলোয় সিক্ত।

প্রতিটা বাড়ির সামনে রয়েছে উন্মুক্ত বাগান। প্রতিটা বাগান উদ্যানবিদ্যার চমৎকার নিদর্শন, সেখানে চমৎকার প্যাটার্নে মূল্যবান উদ্ভিদ জন্মানো হয়েছে ছিল তাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একমাত্র উপায়-যতদিন না র‍্যাডল সাধারণ বণিক বিশ্ব থেকে উৎপাদনকারী বিশ্বে পরিণত হয়।

কাজেই ভয়ানক এক বিশ্বে র‍্যাডল সিটি হল কোমলতা এবং প্রাচুর্যের ক্ষুদ্র বিন্দু, এক টুকরো স্বর্গ-এবং এই গ্রহ বেছে নেওয়ার এটাও একটা কারণ।

বাকি ছাব্বিশটা বণিক বিশ্ব থেকে নানা বর্ণের লোক এসে হাজির হয়েছে: প্রতিনিধি এবং তাদের স্ত্রী, সেক্রেটারি, সাংবাদিক, স্পেসশিপ এবং সেগুলোর কু-অল্প দিনেই প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেল র‍্যাডলের জনসংখ্যা এবং টান পড়ল তার সীমিত সম্পদে।

হৈ হুল্লোড়ে মেতে থাকা মানুষগুলোর মাঝে অল্প কয়েকজন আছে যারা বাস্ত বিকই জানে না যে গ্যালাক্সিতে নিঃশব্দে একটা যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। এবং যারা জানে তাদের ভেতর তিনটা শ্ৰেণী আছে। প্রথমত যারা জানে কম কিন্তু প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী-

যেমন ঐ তরুণ স্পেস পাইলট, যার টুপিতে হেভেন এর ব্যাজ লাগানো এবং বিপরীত দিকের র‍্যাডলিয়ান তরুণীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কায়দা করে চোখের সামনে গ্লাস ধরে রেখেছে। সে বলছিল : “এখানে আসার সময় আমরা যুদ্ধক্ষেত্রের ভেতর দিয়ে এসেছি। ঠিক হোরলেগর এর ভিতর দিয়ে এক লাইট মিনিট বা একটু বেশিও হতে পারে-দূরত্ব পেরিয়ে আসতে হয়।”

“হোরলেগর?” লম্বা পায়ের স্থানীয় অধিবাসী বলল। “গত সপ্তাহে মিউল ওখানে শক্ত মার দিয়েছে, তাই না?”

“আপনি কার কাছে শুনলেন মিউল শক্ত মার দিয়েছে?” চমৎকার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল তরুণ পাইলট।

“ফাউণ্ডেশন রেডিও।”

“হ্যাঁহ? হ্যাঁ, হোরলেগর দখল করেছে। আমরা ওদের একটা কনভয়ের প্রায় মাঝখানে গিয়ে পড়ি। শক্ত মার দেওয়ার মতো কিছু না।”

খসখসে উঁচু গলায় কথা বলল কেউ একজন, “অমন কথা কইয়েন না। ফাউণ্ডেশন হগল সময়ই আগে মাইর খায়। খালি দেখতে থাহেন। ব্যাবাক ফাউণ্ডেশন জানে কহন পাল্টা মাইর দিতে অইব, তারপর-বুম!” চিকন গলা মুখে পাতলা হাসি ছড়িয়ে তার কথা শেষ করল।

“যাই হোক, কিছুক্ষণ নীরব থেকে হেভেনের পাইলট বলল, “আমরা মিউলের শিপগুলো দেখেছি, এবং বেশ ভালোই মনে হয়েছে, বেশ ভালো। সত্যি কথা বলতে কি একেবারে নতুন দেখাচ্ছিল।”

“নতুন?” চিন্তিত সুরে বলল স্থানীয় অধিবাসী, “ওরা নিজেরা তৈরি করেছে?” মাথার উপরের ডাল থেকে পাতা ছিঁড়ল একটা, নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুকল, তারপর চিবোতে লাগল। এক ধরনের কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল পুরো ঘরে। “তুমি বলতে চাইছ নিজেদের তৈরি জিনিস দিয়ে ওরা ফাউণ্ডেশন-এর যুদ্ধযানগুলোকে পরাজিত করেছে? বলে যাও।”

“আমরা নিজের চোখে দেখেছি, ডক।”

সামনে ঝুঁকল স্থানীয় অধিবাসী, “জানো আমি কী ভাবছি? শোন। নিজেকে তামাশায় পরিণত করো না। সবকিছু সামাল দেওয়ার জন্য আমাদের তুখোড় লোজন আছে। তারা জানে কী করতে হবে।”

সেই খসখসে কণ্ঠস্বর আবার কথা বলল উঁচু গলায়, “খালি দেখতে থাহেন। ফাউণ্ডেশন একেবারে শেষ মুহূর্তের লাইগা অপেক্ষা করতাছে, তারপর বুম!” সামনে দিয়ে একটা মেয়ে যাচ্ছিল, তার দিকে তাকিয়ে হাসল বোকার মতো।

স্থানীয় অধিবাসী বলে চলেছে, “যেমন, তোমার কি ধারণা পরিস্থিতি মিউলের পক্ষে। না-আ-আ। আমি শুনেছি এবং বেশ গুরুত্বপূর্ণ লোকের কাছ থেকেই শুনেছি যে সে আমাদের লোক। আমরা তাকে পয়সা দিচ্ছি, এবং ঐ শিপগুলো সম্ভবত আমরাই তৈরি করে দিয়েছি। অবশ্যই ফাউণ্ডেশনকে সে পরাজিত করতে পারবে না, কিন্তু একটু নড়বড়ে অবস্থায় ফেলে দিতে পারবে, আর সেই অবস্থাতেই আমরা নিজেদের কাজ সেরে ফেলব।”

বিপরীত দিকে বসা তরুণী বলল, “যুদ্ধ ছাড়া তোমাদের আর কোনো আলোচনা নেই, ক্লেভ? বিরক্ত হয়ে গেছি।”

“বিষয় পাল্টানো যাক। মেয়েদের বিরক্ত করে লাভ নেই।” অতিরিক্ত ভদ্রতার সাথে বলল হেভেনের পাইলট।

সুযোগটা লুফে নিল একজন, একটা মগে তাল ঠুকল সে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দুজনের ছোট ছোট দলগুলো খিলখিল হাসিতে গড়িয়ে পড়ল, একইরকম আরো কয়েকটা দল বেরিয়ে এল পিছনের সান হাউস থেকে।

তারপরের আলোচনা হয়ে গেল অতি সাধারণ, বিভিন্নমুখী এবং অর্থহীন—

আর আছে তারা যারা কিছুটা কম জানে এবং কিছুটা কম আত্মবিশ্বাসী।

যেমন এক হাতঅলা ফ্র্যান, হেভেনের অফিসিয়াল প্রতিনিধি, এবং সে নতুন নতুন মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব পাতানো নিয়ে ব্যস্ত-ঠেকায় পড়ে দু-একজন পুরুষের সাথে বন্ধুত্ব করতে বাধ্য হচ্ছে।

সেরকমই একজন বন্ধুর পাহাড় চূড়ার বাড়ির সান প্ল্যাটফর্মে সে উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলে একটু আয়েশি সময় কাটাচ্ছে এবং র‍্যাডলে আসার পর এটা নিয়ে মাত্র দুইবার এভাবে বিশ্রাম নিয়েছে। নতুন বন্ধুর নাম আইয়ো লিয়ন, খাঁটি র‍্যাডলিয়ান। আইয়োর বাড়ি লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে, ফুলের সুবাস এবং কীট পতঙ্গের সুরেলা ঐকতানের মিলিত সমুদ্রের মাঝখানে একা। সান-প্ল্যাটফর্ম পয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে তৈরি করা ঘাস পূর্ণ একটা লন। তার উপর দাঁড়িয়ে ফ্যান সারা গায়ে সূর্যের আলো মাখছে।

“হেভেনে এরকম কিছু নেই।” বলল সে।

ঘুমজড়িত গলায় জবাব দিল আইয়ো, “ঠাণ্ডা অঞ্চলগুলো কখনো দেখেছ। এখান থেকে বিশ মাইল দূরে একটা স্পট আছে যেখানে অক্সিজেন পানির মতো প্রবাহিত হয়।”

“চালিয়ে যাও।”

“সত্যি কথা।”

“বেশ, আমি বলছি, আইয়ো-হাত হারানোর আগে আমি অনেক ঘুরে বেরিয়েছি-এবং তুমি বিশ্বাস করবে না, কিন্তু এরপর সে এক দীর্ঘ কাহিনী শোনালো এবং আইয়ো সেটা বিশ্বাস করল না। হাই তুলতে তুলতে বলল, “সবকিছু বদলে গেছে, পুরোনো দিন আর নেই এটাই সত্যি।”

“না,” রেগে উঠল ফ্র্যান, “ওই কথা বলবে না। আমার ছেলের কথা তোমাকে বলেছি, তাই না? ও অনেকটা পুরোনো ধ্যান ধারণায় শিক্ষিত। অনেক বড় একজন ট্রেডার হবে সে, বিশ্বাস করো। আপাদমস্তক বুড়ো বাপের মতো, আপাদমস্তক, পার্থক্য শুধু যে সে বিয়ে করেছে।”

“মানে লিগ্যাল কন্ট্রাক্ট? একটা মেয়ের সাথে?”

“ঠিক। আমি নিজেও এর কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না। হানিমুনের জন্য ওরা গেছে কালগানে।”

“কালগান? কালগান? গ্যালাক্সির এই পরিস্থিতিতে?”

চওড়া হাসি হাসল ফ্র্যান,অর্থবহ ভঙ্গিতে নিচু গলায় বলল, “ফাউণ্ডেশন-এর বিরুদ্ধে মিউলের যুদ্ধ ঘোষণার ঠিক কয়েকদিন আগে।”

“তাই?”

মাথা নাড়ল ফ্র্যান, ইশারায় আইয়োকে কাছে আসতে বলল, “একটা গোপন খবর দেই, কাউকে বলো না। আমার ছেলেকে একটা উদ্দেশ্য নিয়ে কালগানে পাঠানো হয়েছে। কী উদ্দেশ্য সেটা এই মুহূর্তে বলতে চাই না, তবে আমার মনে হয় তুমি অনুমান করে নিতে পারবে। যাই হোক আমার ছেলেই কাজটার জন্য উপযুক্ত ছিল। আমাদের একটা ফুটো দরকার ছিল।” কুটিল ভঙ্গিতে হাসল সে। “আমরা সেটা পেয়েছি। আমার ছেলে কালগানে গেল, এবং তার পরেই মিউল তার শিপ পাঠালো। আমার ছেলে!”

আইয়ো সত্যিই চমকৃত। “বেশ ভালো। তুমি জানো, তুমি জানো আমাদের পাঁচ শ শিপ পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে আছে।”

“সম্ভবত আরো বেশি।” কর্তৃত্বের সুরে বলল ফ্র্যান। “কৌশলটা আমার পছন্দ হয়েছে।” শব্দ করে পেটের চামড়া খামচে ধরল সে। “কিন্তু ভুলে যেয়ো না মিউল অত্যন্ত চতুর। হোরলেগরে যা ঘটেছে সেটা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে।”

“শুনলাম সে নাকি দশটা শিপ হারিয়েছে।”

“হ্যাঁ, কিন্তু আরো একশ টা আছে, এবং ফাউণ্ডেশন পরাজিত হয়েছে। ওরা হেরে যাক আমি সেটাই চাই, কিন্তু এত দ্রুত না।” মাথা নাড়ল সে।

“কিন্তু, আমার প্রশ্ন হচ্ছে, মিউল এই শিপগুলো পেল কোথায়? গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে আমরাই ওগুলো তাকে বানিয়ে দিচ্ছি।”

“আমরা? বণিকরা? হেভেনের সবচেয়ে বড় শিপ ফ্যাক্টরি স্বাধীন বিশ্বগুলোর কোনো একটাতে আছে, আর আমরা নিজেদের জন্য ছাড়া অন্য কারো জন্য কিছু তৈরি করিনি! তোমার কি মনে হয় কোনো বিশ্ব আমাদের ইউনাইটেড অ্যাকশনের কথা চিন্তা না করেই মিউলের জন্য একটা ফ্লিট তৈরি করে দেবে। এটা পুরোপুরি…কাল্পনিক গল্প।” ।

“বেশ, কোত্থেকে পাচ্ছে?”

শ্রাগ করল ফ্র্যান, “মনে হয়, তৈরি করছে নিজেই। এটাও আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে।”

পিট পিট করে সূর্যের দিকে তাকাল ফ্র্যান এবং পালিশ করা পাদানিতে পা ভাঁজ করে ঘুমিয়ে পড়ল ধীরে ধীরে। পোকামাকড়ের গুঞ্জন এবং তার নাক ডাকার শব্দ একাকার হয়ে গেল।

শেষ দলে রয়েছে সেই অল্প কয়েকজন যারা জানে অনেক বেশি কিন্তু আত্মবিশ্বাস একেবারেই নেই।

যেমন রাণ্ড, অল ট্রেডার কনভেনশন এর পঞ্চম দিনে যে কিনা সেন্ট্রাল হলে প্রবেশ করে দেখতে পেল যে দুজনকে থাকতে বলেছিল তারা অপেক্ষা করছে। পাঁচশ আসনের সবগুলো শূন্য-এবং এরকমই থাকবে।

সবার আগেই দ্রুত কথা বলল রাও, “আমরা তিন জন স্বাধীন বণিক বিশ্বের সম্ভাব্য সামরিক শক্তির প্রায় অর্ধেকের প্রতিনিধিত্ব করছি।”

“হ্যাঁ,” বলল ইজ এর ম্যানগিন, “আমি আর আমার সহকর্মী একটু আগেই এটা নিয়ে কথা বলছিলাম।”

“আমি তৈরি,” বলল রাও, “কথা বলার জন্য। তর্ক করতে বা জটিলতা বাড়াতে চাই না আমি। আমাদের অবস্থান খুবই খারাপ।”

“কারণ-” বলল, নেমন এর ওভাল গ্রী।

“গত এক ঘন্টার পরিস্থিতির পরিবর্তন। প্লিজ! প্রথম থেকেই শুরু করা যাক। প্রথমত বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা যে কিছু করতে পারব না শুধু তাই নয়, পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। শুধু মিউলকেই নয়, আরো অনেককেই আমাদের সামলাতে হবে; বিশেষ করে কালগানের প্রাক্তন ওয়ারলর্ড মিউল যাকে অসময়ে পরাজিত করে আমাদের সমস্যায় ফেলে দেয়।”

“হ্যাঁ, কিন্তু মিউল বিকল্প হিসেবে কার্যকরী,” বলল ম্যানগিন “আমি আপত্তি তুলতে চাই না।”

“পুরোটা জানলে ঠিকই তুলতে।” সামনে ঝুঁকে রাণ্ডু বাহু ঊর্ধ্বমুখী করে টেবিলে ভর দিল। “একমাস আগে আমি আমার ভাতিজা আর ভাতিজা বউকে কালগানে পাঠিয়েছিলাম।”

“তোমার ভাতিজা,” বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল ওভাল গ্রী। “আমি জানতাম না যে ও তোমার ভাতিজা।”

“কী উদ্দেশ্যে,” শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল ম্যানগিন। “এটা?” এবং বুড়ো আঙুল উঁচু করে মাথার উপরে একটা বৃত্ত রচনা করে দেখাল সে।

‘না। তুমি যদি ফাউণ্ডেশন-এর বিরুদ্ধে মিউলের যুদ্ধের কথা বুঝিয়ে থাক, তা হলে না। ছেলেটা কিছুই জানে না-আমাদের সংগঠন বা আমাদের লক্ষ্য কিছুই না। ওকে বলেছি যে আমি একটা ইন্ট্রা-হেভেন প্যাট্রিয়টিক সোসাইটির নিচু পদের সদস্য, এবং কালগানে তার কাজ হবে একটু চোখ কান খোলা রাখা। স্বীকার করছি, উদ্দেশ্য আমার নিজের কাছেও পরিষ্কার ছিল না। মূলত আমি মিউলের ব্যাপারে কৌতূহলী ছিলাম। তার ঘটনাটা অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর-তবে সেটা পুরোনো কথা; সেদিকে আর যাব না। দ্বিতীয়ত এটা তার জন্য প্রশিক্ষণমূলক প্রজেক্ট হিসেবে কাজ করবে যার ফাউণ্ডেশন এবং ফাউণ্ডেশন আণ্ডারগ্রাউন্ডের ব্যাপারে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। তোমরা”

ওভাল গ্রি যখন দাঁত বের করে হাসে তখন অসংখ্য ভাজ পড়ে তার মুখে, “তুমি নিশ্চয়ই ফলাফল দেখে বিস্মিত হয়েছ, কারণ আমার বিশ্বাস এমন কোনো বণিক বিশ্ব নেই যারা জানে না যে তোমার ভাতিজা ফাউণ্ডেশন-এর নাম ভাঙিয়ে মিউলের একজন লোককে ভাগিয়ে এনে তাকে খেপিয়ে তুলেছে। গ্যালাক্সি, রাণ্ড, ইউ স্পিন রোমান্সেজ। এ ব্যাপারে তোমার কোনো হাত নেই এটা আমি বিশ্বাস করি না। শোন, চমৎকার দেখিয়েছ।”

সাদা চুল ভর্তি মাথা নাড়ল রাণু। “আমি কিছু করিনি। আমার ভাতিজার ইচ্ছাতেও কিছু ঘটেনি। সে এখন ফাউণ্ডেশন-এর জেলে বন্দি, এবং সম্ভবত তথাকথিত চমৎকার কাজের চূড়ান্ত ফলাফল দেখার জন্য বেঁচে থাকবে না। ওর কাছ থেকে খবর পেয়েছি। চোরাইপথে কোনোভাবে একটা পারসোন্যাল ক্যাপসুল পাঠিয়েছে, যুদ্ধ ক্ষেত্র পাড়ি দিয়ে প্রথমে পৌঁছেছে হেভেনে, সেখান থেকে এখানে, পুরো একমাস লেগেছে।”

“এবং?–”

বিষণ্ণ স্বরে রাণু বলল, “সম্ভবত আমরাও কালগানের প্রাক্তন ওয়ারলর্ডের মতো একই ভূমিকা পালন করছি। মিউল একটা মিউট্যান্ট।”

সবার পেটের ভেতরে নাড়িভূঁড়ি পাক দিয়ে উঠল, হার্টবিট মিস করল। এগুলো সবই অনুমান করতে পারছে রাণু।

ম্যানগিন অবশ্য কথা বলল স্বাভাবিক সুরে, “তুমি কীভাবে জানো?”

“আমার ভাতিজার কাছে শুনেছি।”

“কী ধরনের মিউট্যান্ট? সব ধরনেরই তো আছে।”

“হ্যাঁ, অনেক ধরনের, হ্যাঁ ম্যানগিন। ঠিকই বলেছ! কিন্তু মিউল একটাই। কী ধরনের মিউট্যান্ট শূন্য থেকে শুরু করে একটা আর্মি গড়ে তুলতে পারে, শুনেছি প্রথমে একটা পাঁচ মাইল লম্বা অ্যাস্টেরয়েডে মূলঘাঁটি স্থাপন করে সে, সেখান থেকে একটা গ্রহ দখল করে, তারপর একটা সিস্টেম, তারপর একটা রিজিওন-তারপর ফাউণ্ডেশন আক্রমণ করে এবং আমাদের পরাজিত করে হোরলেগরে এবং সবকিছুই ঘটেছে মাত্র দুই তিন বছরে!”

শ্রাগ করল ওভাল গ্রী, “তো তুমি ধরে নিচ্ছ সে ফাউণ্ডেশনকে পরাজিত করতে পারবে।”

“আমি জানি না। ধরে নাও পারল?”

“দুঃখিত, মানতে পারলাম না। ফাউণ্ডেশনকে পরাজিত করা যাবে না। দেখ, একটা… একটা অনভিজ্ঞ ছোকরার মন্তব্য শুনে আমাদের নতুন কিছু করতে যাওয়া ঠিক হবে না। বরং এই ব্যাপারটা কিছু সময়ের জন্য স্থগিত রাখা যাক। মিউল যত যুদ্ধই জয় করুক না কেন আমাদের চিন্তার কিছু নেই, তাই না?”

ভুরু কুঁচকে দুজনকেই জিজ্ঞেস করল রাণু, “এখন পর্যন্ত মিউলের সাথে আমরা কোনো যোগাযোগ করতে পেরেছি?”

“না,” দুজন একসাথে উত্তর দিল।

“সত্যি কথা, যদিও আমরা চেষ্টা করেছি, তাই না? সত্যি কথা তার কাছে পৌঁছতে না পারলে এত মিটিং করে কিছুই হবে না। সত্যি কথা যে, দেয়ার হ্যাঁজ বিন মোর ড্রিংকিং দ্যান থিংকিং, অ্যাণ্ড মোর ওয়িং দ্যান ডুয়িং-আজকের র‍্যাডল ট্রিবিউনে এই কথাগুলো লিখেছে-এবং সবকিছুর মূলে কারণ হচ্ছে আমরা মিউলের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। জেন্টলম্যান, আমাদের এক হাজার শিপ প্রস্তুত হয়ে আছে, ঠিক সময়মতো উড়ে গিয়ে ফাউণ্ডেশন-এর হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবে। আমার মতে সেই সিদ্ধান্ত এখনই বদলানো উচিত। এই মুহূর্তে এক হাজার শিপ রওয়ানা করিয়ে দেওয়া উচিত-মিউলের বিরুদ্ধে।”

“মানে স্বৈরাচারী ইণ্ডবার এবং রক্তচোষা ফাউণ্ডেশন-এর পক্ষে কাজ করতে বলছ?” চরম বিদ্বেষের সাথে জিজ্ঞেস করল ম্যানগিন।

ক্লান্ত হাত তুলল রাণু, “আমি বলেছি মিউলের বিরুদ্ধে পাঠাতে হবে, এবং অন্য সকল বিষয় আমার কাছে এখন তুচ্ছ।”

ওভাল গ্রি উঠে দাঁড়াল, “রাও, এই ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই। যদি পলিটিক্যাল সুইসাইড করার খুব বেশি ইচ্ছা হয় তা হলে রাতের কাউন্সিলে সব খুলে বলো।”

আর একটাও কথা না বলে সে চলে গেল, নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করল ম্যানগিন। রাকে একা ফেলে রেখে গেল সমাধানহীন সমস্যার সাগরে।

রাতের কাউন্সিলে সে কিছুই বলল না।

কিন্তু পরেরদিন সকালেই হন্তদন্ত হয়ে তার কামরায় এসে হাজির হল ওভাল গ্রী। এলোমেলো পোশাক, শেভ করেনি, চুল আঁচড়ায়নি।

রাণ্ডু মাত্র ব্রেকফাস্ট শেষ করেছে। টেবিল এখনো পরিষ্কার করা হয়নি। সে এত বেশি অবাক হয়েছে যে পাইপ খসে পড়ল মুখ থেকে।

সাদামাটা কর্কশ গলায় ওভাল থ্রী বলল, “নেমন প্রতারণার শিকার। স্পেস থেকে তার উপর বোমা বর্ষণ করা হয়েছে।”

চোখ ছোট করল রাও, “ফাউণ্ডেশন?”

“মিউল!” বিস্ফারিত হল ওভাল। “মিউল!” কথা বলছে হড়বড় করে, “বিনা প্ররোচনায় উদ্দেশ্য প্রণোদিত আক্রমণ। আমাদের ফ্লিটের অধিকাংশই যোগ দিয়েছে ইন্টারন্যশনাল ফ্লোটিলার সাথে। হোম স্কোয়াড্রন হিসেবে যা ছিল খুবই অল্প, সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত কোনো ল্যাণ্ডিং নেই, হয়তো হবেও না, কারণ শুনেছি যে আক্রমণকারীদেরও অর্ধেকের বেশি ধ্বংস হয়ে গেছে কিন্তু এটা যুদ্ধ-এবং আমি জানতে এসেছি এই ব্যাপারে হেভেনের পদক্ষেপ কী হবে।”

“হেভেন, আমি নিশ্চিত, চার্টার অফ ফেডারেশনের প্রতি অনুগত থাকবে। কিন্তু, তুমি দেখেছ? সে আমাদের আক্রমণ করেছে।”

“মিউল একটা পাগল। মহাবিশ্বকে সে পরাজিত করতে পারবে?” হতাশভাবে বসে রাণুর হাত ধরল সে, “যারা বেঁচে ফিরতে পেরেছে তারা মিউলের…শত্রুর হাতে একটা নতুন ধরনের অস্ত্রের কথা বলেছে। নিউক্লিয়ার ফিল্ড ডিপ্রেসর।”

“কী?”

“আমাদের বেশিরভাগ শিপ পরাজিত হয়েছে কারণ তাদের আণবিক অস্ত্র কাজ করেনি। এটা দুর্ঘটনা বা স্যাবোটাজ হতে পারে না, নিঃসন্দেহে মিউলের নতুন ধরণের কোনো অস্ত্র। নিখুঁতভাবে কাজ করেনি; থেমে থেমে আঘাত করেছে; সম্ভবত নিউট্রালাইজ করার কোনো পদ্ধতি-ডেসপ্যাচার বিস্তারিত বলতে পারেনি। কিন্তু বুঝতেই পারছো এই অস্ত্র যুদ্ধের চিত্র পাল্টে দিয়েছে পুরোপুরি এবং এর সামনে আমাদের পুরো ফ্লিট একেবারে অসহায়।”

রাণু বুঝতে পারল যে সে বুড়ো হয়ে গেছে, একটা চরম হতাশা গ্রাস করল তাকে। “সম্ভবত একটা দানব তৈরি হয়েছে যা আমাদের সবাইকে গিলে নেবে। তবুও লড়াই করে যেতে হবে আমাদের।”

*

১৭. দ্য ভিজি সোনার

টার্মিনাস সিটির মোটামুটি অখ্যাত অঞ্চলে অবস্থিত এবলিং মিস এর বাসস্থান ফাউণ্ডেশন-এর বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, শিক্ষিত সমাজ এবং সাধারণ পাঠকপাঠিকার কাছে বহুল পরিচিত। এর অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে মূলত কী পড়া হচ্ছে তার উপর। একজন মননশীল বায়োগ্রাফার এর মতে এটা হল “নন-একাডেমিক রিয়েলিটিতে ফিরে আসার চমৎকার নিদর্শন, একজন সোসাইটি কলামিস্ট বিরুপভাবে মন্তব্য করেছিল, “এলোমেলো এবং ভীষণরকম পুরুষালি,” বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পিএইচডি-র মতে, “বুকিশ, বাট আনঅর্গানাইজড,” বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে এক বন্ধুর মতে, “যখন তখন একটা ড্রিংক নেওয়ার জন্য আদর্শ এবং তুমি সোফার উপর পা তুলে বসতে পারবে,” হালকা মেজাজের চটকদার এক রঙিন সাপ্তাহিক পত্রিকার মতে “পাথুরে রুক্ষ এবং বামপন্থী উগ্ৰস্বভাবের এবলিং মিস এর বাসস্থান হিসেবে চমঙ্কার মানিয়ে যায়।”

বেইটার কাছে, যে প্রথমবারের মতো এখানে এসেছে তার কাছে শুধুই নোংরা।

প্রথম কয়েকটা দিন বাদ দিয়ে বন্দিদশা বেশ হালকাই মনে হয়েছে। বোধহয় এখন সাইকোলজিস্ট-এর বাড়িতে অপেক্ষা করার চাইতেও হালকা। অন্তত সেই সময় তো টোরান সাথে ছিল–

হয়তো উদ্বেগ তাকে ক্লান্ত করে তুলত যদি না বুঝতে পারত যে ম্যাগনিফিসো তার চেয়ে অনেক বেশি অস্থির হয়ে আছে।

থ্যাবড়ানো চিবুকের নিচে পাইপের মতো সরু পাগুলো ভাঁজ করে রেখেছে ম্যাগনিফিসো। যেন কুণ্ডুলী পাকিয়ে নিজেকে নেই করে ফেলার চেষ্টা করছে। নিজের অজান্তেই আশ্বস্ত করার জন্য কোমল হাত বাড়াল বেইটা। সঙ্কুচিত হয়ে গেল ম্যাগনিফিসো, তারপর হাসল।

“সত্যি, মাই লেডি, মনে মনে বুঝতে পারলেও এখনো আমার দেহ কাউকে হাত বাড়াতে দেখলে শুধু আঘাতের প্রত্যাশা করে।”

“চিন্তা করো না, ম্যাগনিফিসো। আমি যতক্ষণ আছি কেউ তোমাকে আঘাত করতে পারবে না।”

আড়চোখে তার দিকে তাকাল ক্লাউন, তারপর দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল, “কিন্তু ওরা আমাকে আপনার কাছে যেতে দেয়নি-এবং আপনার ভালোমানুষ স্বামীর কাছে–আর কথা বলতে দেয়নি আমাকে, আপনি শুনলে হয়তো হাসবেন, কিন্তু আমার খুব একা একা লেগেছে।”

“হাসব না। আমারও একই রকম লেগেছে।”

ম্যাগনিফিসোর চেহারা উজ্জ্বল হল, হাঁটু দুটো জড়িয়ে ধরল আরো শক্ত করে। “এই লোকটাকে আপনি আগে কখনো দেখেন নি?” সতর্কভাবে প্রশ্নটা করল সে।

“না। কিন্তু উনি বিখ্যাত লোক। নিউজকাস্টে আমি উনাকে দেখেছি, অনেক কথা শুনেছি। আমার মনে হয় উনি ভালোমানুষ, ম্যাগনিফিসো এবং আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না।”

“কী জানি?” ক্লাউনের চোখে অস্বস্তি। “হতে পারে, মাই লেডি, আমাকে সে আগেও অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেছে, কেমন যেন রাগী আর কর্কশ, আমার ভয় লাগে। কথা বার্তা সব অদ্ভুত ধরনের, ফলে কোনো প্রশ্নের উত্তরই আমার গলা দিয়ে বেরোয় না। যেন অনেকদিন আগে শোনা গল্পের মতোই কলিজা আটকে শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে কথা বেরনো বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো।”

“কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। আমরা দুজন, সে একা। আমাদের দুজনকেই সে একসাথে ভয় দেখাতে পারবে না, পারবে?”

“না, মাই লেডি।”

কোথাও একটা দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল, পুরুষালি কণ্ঠের জোরালো তর্জন গর্জন প্রবেশ করল বাড়ির ভিতরে। এই কামড়ার দরজার ঠিক বাইরে তর্জন গর্জন পরিণত হল বোধগম্য কড়া এক ধমকে, “বেরোও এখান থেকে!” এবং দরজা খোলার সময় এক ঝলক দেখা গেল যে দুজন গার্ড পিছিয়ে যাচ্ছে।

চোখ মুখ কুঞ্চিত করে ভেতরে ঢুকল এবলিং মিস, যত্নের সাথে প্যাকেট করা একটা বাণ্ডিল মেঝেতে নামিয়ে রাখল, তারপর এগোলো বেইটার দিকে, করমর্দনের সময় চেষ্টা করল বেইটার হাত গুঁড়িয়ে দেওয়ার কিন্তু বেইটাও পুরুষালি ভঙ্গিতে সমান তালে জবাব দিল। ক্লাউনের উপর প্রয়োগ করল দ্বিগুণ শক্তি।

“বিবাহিত?” বেইটাকে জিজ্ঞেস করল সে।

“হ্যাঁ। পুরোপুরি আইনগত আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে।

একটু নীরব থেকে পুনরায় জিজ্ঞেস করল, “সুখী?”

“তা বলা যায়।”

শ্রাগ করল মিস, এবং আবার ঘুরল ম্যাগনিফিসোর দিকে। প্যাকেটের মোড়ক খুলে জিজ্ঞেস করল, “এটা চিনতে পেরেছে, খোকা?”

প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে অসংখ্য চাবিযুক্ত যন্ত্রটা ছিনিয়ে নিল ম্যাগনিফিসো। আঙুল বুলাতে লাগল নবের মতো দেখতে অসংখ্য কন্টাক্টের উপর, তারপর খুশির চোটে উল্টো ডিগবাজি দিয়ে একটা চেয়ার প্রায় ভেঙে ফেলল।

“ভিজি সোনার, চেঁচিয়ে উঠল আনন্দে, “এমনকি মরা মানুষের হৃদয়কেও আনন্দিত করে তুলতে পারে।” পরম আদরে চাবিগুলোর উপর আঙুল বোলাতে লাগল, দু-একটা কন্টাক্টে চাপ দিচ্ছে হালকাভাবে, মাঝে একটা কি দুটো চাবির উপর আঙুল থামিয়ে রাখছে-এবং তাদের সামনের বাতাসে ঠিক দৃষ্টিসীমার ভেতরে একটা কোমল গোলাপি আভা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

এবলিং মিস বলল, “ঠিক আছে, খোকা, তুমি বলেছ এ ধরনের গেজেট বাজাতে পারো। তোমাকে সুযোগ দিলাম। একটু টিউন করে নাও, কারণ এটাকে জাদুঘর থেকে নিয়ে এসেছি।” তারপর বেইটার কানে কানে বলল, “ফাউণ্ডেশন-এর কেউ এটা ঠিকমতো বাজাতে পারে না।”

সামনে ঝুঁকে দ্রুত বলল, “আপনাকে ছাড়া ক্লাউন কথা বলবে না। আপনি সাহায্য করবেন?”

মাথা নাড়ল বেইটা।

“গুড। ভয় ওর মনের ভেতর পাকাঁপোক্ত আসন গেড়ে বসেছে, এবং আমার সন্দেহ ওর মেন্টাল স্ট্রেন্থ সাইকিক প্রোবের মোকাবেলা করতে পারবে না। ওর কাছ থেকে কথা আদায় করতে হলে, পুরোপুরি আশ্বস্ত করে তুলতে হবে। বুঝতে পেরেছেন?”

আবার মাথা নাড়ল বেইটা।

“ভিজি সোনার হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপ। ও আমাকে বলেছে যে সে বাজাতে পারে; আর এখনকার উচ্ছ্বাস দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এটা ওর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের বিষয়গুলোর একটা। কাজেই ভালোমন্দ যেমনই বাজাক আমরা আগ্রহ নিয়ে শুনব এবং প্রশংসা করব। তারপর এমন ভাব দেখাবেন যে আপনি আমার বন্ধু এবং আমাকে বিশ্বাস করেন। সবচেয়ে বড় কথা প্রতিটা ক্ষেত্রে আমার কথা মেনে চলবেন।” দ্রুত একবার ম্যাগনিফিসোর দিকে তাকাল, ক্লাউন সোফার কোণা ঘেষে বসে দ্রুত হাতে যন্ত্রের ভেতরে কিছু অ্যাডজাস্টমেন্ট করছে, নিজের কাজে পুরোপুরি মগ্ন।

মিস স্বাভাবিক আলাপচারিতার সুরে বেইটাকে বলল, “ভিজি সোনার এর বাজনা কখনো শুনেছেন?”

“একবার,” একই রকম স্বাভাবিক সুরে বলল বেইটা, “দুর্লভ বাদ্যযন্ত্রের একটা কনসার্টে গিয়েছিলাম, সেখানে। খুব একটা ভালো লাগেনি।”

“আপনি ভালো বাদকের বাজনা শুনেছেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। ভালো বাদকের সংখ্যা খুব কম। এটা বাজাতে যে খুব বেশি শারীরিক সামর্থের প্রয়োজন হয় তা না-বরং একটা মাল্টি ব্যাঙ্ক পিয়ানো বাজাতে প্রয়োজন হয় অনেক বেশি-এটার জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষ ধরণের স্বাধীন মানসিকতা।” তারপর নিচু গলায় বলল, “সেইজন্যই মনে হয় এই জীবিত কংকাল আমাদের ধারণার চাইতে অনেক বেশি ভালো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে বাজনা ভালো বাজাতে জানলেও বুদ্ধিশুদ্ধির বেশ ঘাটতি থাকে। এই অস্বাভাবিক সেটআপের কারণেই সাইকোহিস্টোরি বিষয়টা এত আকর্ষণীয়।”

হালকা আলাপচারিতা চালু রাখার জন্য যোগ করল, “কীভাবে কাজ করে আপনি জানেন? আমি যতদুর বুঝতে পেরেছি যে রেডিয়েশন মস্তিষ্কের অপটিক নার্ভ স্পর্শ না করেই অপটিক সেন্টার উদ্দীপ্ত করে তোলে। আসলে এটা এমন একটা অনুভূতি স্বাভাবিক অবস্থায় যা আমরা কখনো বুঝতে পারি না। সত্যিই তুলনাহীন। যা শুনবেন ওতে কোনো সমস্যা নেই। একেবারেই সাধারণ। কিন্তু-শশশ! ও তৈরি। পা দিয়ে ওই সুইচটা বন্ধ করে দিন। অন্ধকারে কাজ করে ভালো।”

অন্ধকারে ম্যাগনিফিসোকে মনে হল বিন্দুর মতো, পাশে এবলিং মিস এর ভারি নিশ্বাস পতনের শব্দ হচ্ছে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে দেখার চেষ্টা করল বেইটা, লাভ হল না। ঘরের বাতাসে একটা তীক্ষ্ণ সুর ভেসে উঠল, কেঁপে কেঁপে সুরের মাত্রা ক্রমশ বাড়ছে, টলমল করে ভেসে থাকল বাতাসে, আবার ঝপ করে নেমে গেল নিচু মাত্রায়। তারপর অকস্মাৎ বজ্রপাতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল, যেন হ্যাঁচকা টানে সামনে থেকে সরে গেল একটা পর্দা।

ছোট একটা বহুরঙা গ্লোব ভেসে উঠল বাতাসে, মাঝপথে এসে বিস্ফোরিত হয়ে আকৃতি হারালো, ভেসে উঠে গেল উপরে, ধীরে ধীরে নিচে নামল পরস্পর যুক্ত ছোট ছোট পতাকার আকৃতি নিয়ে। তারপর আকৃতি বদলে পরিণত হল ছোট ছোট বৃত্তে, প্রতিটা ভিন্ন রঙের-এবং প্রতিটা বস্তু আলাদাভাবে চিনতে শুরু করল বেইটা।

বেইটা লক্ষ্য করল চোখ বন্ধ করলে রঙের প্যাটার্ন ভালোভাবে বোঝা যায়; রঙের প্রতিটা পরিবর্তনের মূল কারণ হল শব্দের নির্দিষ্ট প্যাটার্ন; রংগুলোকে সে চিনতে পারছে না; এবং সবার শেষে গ্লোবগুলো আর গ্লোব থাকল না, হয়ে গেল ছোট ছোট আকৃতি।

ছোট ছোট আকৃতি; ছোট ছোট পরিবর্তনশীল শিখা, অগণিত অসংখ্য নেচে বেড়াচ্ছে ঝলকাচ্ছে; ছুটে বেড়িয়ে যাচ্ছে দৃষ্টিসীমার বাইরে, আবার ফিরে আসছে; ছুটে গিয়ে একটা আরেকটার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে তৈরি করছে নতুন রং।

অনেকটা সামঞ্জস্যহীনভাবেই বেইটার মনে পড়ল রাতের বেলায় জোরে চোখের পাতা চেপে বন্ধ করে রাখলে যে রঙিন ফুটকি ভেসে উঠে তার কথা। সামনে নেচে বেড়ানো পরিবর্তনশীল রঙের বিন্দুগুলো ঠিক তাই, বিন্দুগুলো হঠাৎ হঠাৎ কেঁপে উঠছে।

বিন্দুগুলো জোড়ায় জোড়ায় এগিয়ে এল তার দিকে, দম বন্ধ করে একটা হাত তুলল সে, কিন্তু দুড়দাড় করে সেগুলো ছুটে পালাল। হঠাৎ করে নিজেকে সে আবিষ্কার করল একটা উজ্জ্বল তুষার ঝড়ের মাঝে, অনুভব করল ঠাণ্ডা আলো পিছলে নেমে যাচ্ছে কাঁধ বেয়ে, চকচকে স্কি-স্লাইডের মতো বাহু ধরে নেমে এসে চুমো খেলো শক্ত হয়ে যাওয়া আঙুলে এবং ছুটে গিয়ে বাতাসের মাঝখানে ভেসে থাকল উজ্জ্বল আলোর মতো। নিচ থেকে ভেসে আসছে শত শত বাদ্যযন্ত্রের সুমধুর সঙ্গীত, বুঝতে কিছুটা সময় লাগল এই সঙ্গীত তৈরি হচ্ছে সামনের জমাট আলোর বৃত্ত থেকে।

বিস্মিত হয়ে ভাবলো এবলিং মিস কি একই জিনিস দেখছে, যদি না দেখে কী দেখছে সে। বিস্ময় দূর হয়ে গেল, এবং, তারপর–

আবার দেখছে সে। ছোট ছোট আকৃতি-আসলেই কী কোনো আকৃতি?–ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রমণী দেহ, মাথার চুল আগুনরঙা, চোখের পলক ফেলার আগেই দ্রুত কুর্নিশ করছে? পরস্পরের হাত ধরে তৈরি করল কয়েকটা নক্ষত্রের আকৃতি-সঙ্গীত পরিণত হল হাসির ধ্বনিতে-ঠিক কানের ভেতরে বেজে উঠল রমণীর খিলখিল হাসি।

নক্ষত্রগুলো কাছাকাছি হল, পরস্পরের দিকে আলো ছুঁড়ে দিয়ে খেলা করতে লাগল, ধীরে ধীরে তৈরি করল একটা কাঠামো-এবং নিচ থেকে দ্রুত গতিতে উপরে উঠতে লাগল একটা প্রাসাদ। প্রাসাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইটগুলো প্রতিটা ভিন্ন রঙের, প্রতিটা রং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ চমকের মতে, প্রতিটা বিদ্যুৎ চমক তীব্র আলোর মতো পথ দেখিয়ে দৃষ্টিকে নিয়ে গেল উপরের রত্নখচিত বিশটা মিনারের দিকে।

একটা উজ্জ্বল কার্পেট ছুটে বেরিয়ে এল, ঘুরছে, পাক খাচ্ছে, ঢেউ তুলে একটা জাল তৈরি করে ঢেকে দিল সামনের জায়গাটুকু, তার মধ্যে থেকে একটা উজ্জ্বল আভা শা করে উপরের দিকে ছুটে গিয়ে গাছ তৈরি করল, যে গাছ গাইতে লাগল সম্পূর্ণ নিজস্ব এক সঙ্গীত।

বেইটা এক ঘেরাওয়ের মাঝে বসে আছে। তাকে ঘিরে অবিরত উপচে পড়ছে সুর আর ছন্দ। হাত বাড়িয়ে ভঙ্গুর একটা গাছ ছুঁলো সে এবং সেটা ভেসে উঠে টুংটাং ধ্বনির সাথে খসে পরল।

এবার শুরু হল বিশটা মন্দিরার ঐকতান, এবং তার সামনে কিছু অংশ জুড়ে একটা অগ্নিপ্রভা জ্বলে উঠল এবং তার কোল পর্যন্ত একটা অদৃশ্য সিঁড়ি তৈরি করে অবিরত বিদ্যুৎ শিখার মতো ছলকে উঠল, অগ্নিশিখা লাফিয়ে উঠল কোমর পর্যন্ত এবং কোল ঘিরে তৈরি করল রংধনুর মতো সাতরঙা সেতু, তার উপর ছোট ছোট আকৃতি

একটা প্রাসাদ, একটা বাগান এবং সেতুর উপর যতদূর দৃষ্টি যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নর নারী রাজকীয় ভঙ্গিতে নেচে বেড়াচ্ছে আর তার উপর আছড়ে পড়ছে সুমধুর সঙ্গীত।

এবং তারপর আবার নিকষ অন্ধকার।

একটা ভারী পা এগিয়ে গেল পেডালের দিকে; আলোতে ভেসে গেল পুরো কামরা; যেন ক্লান্ত সূর্যের নিষ্প্রভ আলো । চোখ পিট পিট করতে লাগল বেইটা, চোখে পানি না বেরনো পর্যন্ত। তার নিজের কাছে মনে হচ্ছে যেন সাত রাজার ধন হারিয়ে গেছে। আর এবলিং মিস পুরোপুরি স্তম্ভিত।

একমাত্র ম্যাগনিফিসোকে মনে হল জীবন্ত। পরমানন্দে সে তার ভিজি সোনারে হাত বোলাচ্ছে।

“মাই লেডি,” রুদ্ধশ্বাসে বলল সে, “এটার অবশ্যই জাদুকরী ক্ষমতা আছে। কল্পনাকে বাস্তব করে তোলে। এটা দিয়ে আমি আশ্চর্য সব কান্ড ঘটাতে পারি। আমার কম্পোজিশন কেমন লেগেছে, মাই লেডি?”

“এই কম্পোজিশন তোমার?” দম নিল বেইটা। “তোমার নিজের?”

তার বিস্ময় দেখে ক্লাউনের চেহারা নাকের ডগা পর্যন্ত লাল হয়ে গেল। “একেবারে আমার নিজস্ব, মাই লেডি। মিউল পছন্দ করত না, কিন্তু প্রায়ই আমি নিজের জন্য এটা বাজাতাম। অনেকদিন আগে এই প্রাচুর্যময় প্রাসাদটা দেখেছিলাম-একটা মেলার সময় অনেক দূর থেকে। কী তার মহিমা, কী তার গৌরব-আর এত চমৎকার মানুষ আমি পরে আর কখনো দেখিনি, এমনকি মিউলের কাছে থাকার সময়ও না। আমি সত্যিকারভাবে সব ফুটিয়ে তুলতে পারিনি। এটার নাম দিয়েছি, স্বর্গের স্মৃতি।”

আলাপচারিতার মাঝপথে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নিজেকে সজীব করে তুলল মিস। “শোন,” বলল সে, “তুমি আর সবার সামনে একই রকম করে বাজাতে পারবে?”

এক মুহূর্তের জন্য সংকুচিত হয়ে গেল ক্লাউন, “আর সবার সামনে?” কেঁপে উঠল সে।

“হাজার হাজার মানুষের জন্য, চেঁচিয়ে উঠল মিস, “ফাউণ্ডেশন এর গ্রেট হলে। তুমি নিজের মাস্টার হতে চাও, অঢেল প্রাচুর্য, সম্মান, এবং…এবং-” তার কল্পনা আর বেশিদূর এগোতে পারলো না। “এবং সব কিছু? হ্যাঁহ? কী বলো?”

“কিন্তু আমি এতকিছু কীভাবে হবো, মাইটি স্যার, কারণ, আমি অসহায় এক ক্লাউন, জগতের কোনো বস্তুই আমার কাছে নেই।”

ঠোঁট গোল করে বাতাস ছাড়ল সাইকোলজিস্ট, ভুরু ঘষল হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে। “তোমার বাজনা দিয়ে। মেয়র আর তার বণিকদের এই বাজনা শোনালে জগৎ তোমার পায়ে লুটিয়ে পড়বে। কেমন মনে হচ্ছে?”

ঝট করে বেইটার দিকে একবার তাকাল ক্লাউন, “উনি আমার সাথে থাকবেন?” হাসল বেইটা “অবশ্যই। ঠিক যখন তুমি ধনি আর বিখ্যাত হতে চলেছ তখন কী আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারি?”

“কিন্তু,” সাদামাটা গলায় বলল মিস, “প্রথমে যে একটু সাহায্য করতে হয়—”

“কী রকম?”

একটু দম নিল সাইকোলজিস্ট, এবং হাসল, “একটা ছোট সারফেস পোব, মোটেও ব্যথা লাগবে না।

তীব্র আতঙ্ক ফুটে উঠল ম্যাগনিফিসোর চোখে। না, কোনো ভোব না। ওটার ব্যবহার আমি দেখেছি। মানুষের মাইণ্ড শুষে নিয়ে মাথার খুলির ভেতরটা ফাঁকা করে দেয়। বিশ্বাসঘাতকদের উপর মিউল এটা ব্যবহার করত। পাগল আর উন্মাদ বানিয়ে ছেড়ে দিত রাস্তায়। ওভাবেই বেঁচে থাকত যতদিন না দয়াপরবশ হয়ে মেরে ফেলা হত তাদের।” হাত তুলে মিসকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে সে।

“ওটা ছিল সাইকিক পোব,” ধৈর্য ধরে বোঝাতে লাগল মিস, “এবং শুধুমাত্র ভুলভাবে ব্যবহার করলেই মানুষের ক্ষতি হয়। আমারটা হচ্ছে সারফেস প্রোব, এটা দিয়ে একটা বাচ্চাকেও ব্যথা দেওয়া যাবে না।

কম্পিত একটা হাত বাড়িয়ে ধরল ম্যাগনিফিসো, “আপনি আমার হাত ধরে রাখবেন?”

দুহাত দিয়ে সেটা জড়িয়ে ধরল বেইটা, আর ক্লাউন বিস্ফোরিত চোখে দেখতে পেল বার্ণিশ করা টার্মিনাল প্লেট এগিয়ে আসছে।

.

মেয়র ইণ্ডবার এর ব্যক্তিগত কোয়ার্টারের অতিরিক্ত ব্যয়বহুল চেয়ারে এবলিং মিস নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বসে আছে। তার প্রতি যে সৌজন্য দেখানো হয়েছে ওটা নিয়ে কোনো কৃতজ্ঞতা নেই, বরং বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে আছে অস্থির ছোটখাটো মেয়রের দিকে। টোকা দিয়ে সিগারের ছাই ফেলল সে, থু করে চিবানো তামাক ফেলল মেঝেতে।

“ভালো কথা, ম্যালো হলের আগামী কনসার্টে যদি নতুন কিছু শুনতে চাও তা হলে ইলেকট্রনিক গ্যাজেটিয়ারগুলো যে নর্দমা থেকে এসেছে সেখানে ফেলে দিয়ে আমার ক্লাউনের হাতে একটা ভিজি সোনার তুলে দাও। ইবার-এই বিশ্বে ওর মতো বাজনাদার নেই।”

বিরক্ত হয়ে ইণ্ডবার বললেন, “সঙ্গীতের উপর লেকচার শোনার জন্য তোমাকে ডাকিনি। মিউলের কী হবে? বল। মিউলের কী হবে?”

“মিউল? বেশ, বলছি-সারফেস প্রোব ব্যবহার করে তেমন কিছু বের করতে পারিনি। সাইকিক ভোব ব্যবহার করা সম্ভব না, কারণ জিনিসটাকে ওই ব্যাটা অসম্ভব ভয় পায়, কাজেই কন্টাক্ট হওয়ার সাথে সাথে মেন্টাল ফিউজ উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আমি যা পেয়েছি, ঢোল বাজানো থামাও তো—”

“প্রথমত মিউলের অতিরিক্ত শারীরিক শক্তির কথা সে বাড়িয়ে বলেছে, এবং সম্ভবত অতিরিক্ত নির্যাতনে মনের ভেতর যে ভয় গেড়ে বসেছে সেটার জন্যই তৈরি করেছে এমন কল্পিত গল্প। মিউল অদ্ভুত ধরণের চশমা পড়ে এবং চোখ দিয়েই মানুষ খুন করতে পারে, পরিষ্কার বোঝা যায় তার মেন্টাল পাওয়ার আছে।”

“প্রথম থেকেই যা আমরা জানি,” তিক্ত গলায় মন্তব্য করলেন মেয়র।

“প্রোব সেটা কনফার্ম করল, আর ঠিক এখান থেকেই আমি ম্যাথমেটিক্যালি কাজ শুরু করেছি।”

“তাই? তো কতদিন লাগবে? তোমার কথা এখনো আমার কানে ঝমঝম করছে।”

“প্রায় একমাস, তখন হয়তো তোমার হাতে কিছু দিতে পারব। আবার নাও দিতে পারতে পারি। কিন্তু তাতে কি? যদি বর্তমান সমস্যা সেলডন প্ল্যানের ভেতরে থাকে তা হলে আমাদের সুযোগ খুবই কম, (ছাপার অযোগ্য) কম।”

হিংস্র ভঙ্গিতে মিস এর দিকে ঘুরলেন ইণ্ডবার, “এইবার তোমাকে পেয়েছি, বিশ্বাস ঘাতক। মিথ্যেবাদী! তুমিও ওই বদমাশগুলোর দলে যারা গুজব ছড়িয়ে ফাউণ্ডেশন-এর ভেতর আতঙ্ক তৈরি করছে, আমার কাজ দ্বিগুণ কঠিন করে তুলছে। অস্বীকার করতে পারবে?”

“আমি? আমি?” ধীরে ধীরে রেগে উঠছে মিস।

“কারণ, বাই দ্য ডাস্ট ক্লাউডস অফ স্পেস, ফাউণ্ডেশন জিতবেই-ফাউণ্ডেশনকে অবশ্যই জিততে হবে।”

“হোরলেগরে হেরে যাবার পরেও?”

“আমরা পরাজিত হইনি। তুমিও গুজবগুলো বিশ্বাস করছ? আমরা ছিলাম সংখ্যায় কম এবং বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার”

“কারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে?” উষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল মিস।

“নর্দমার কীট ডেমোক্র্যাটের দল।” পাল্টা চিৎকার করলেন ইণ্ডবার। “আমি বহুদিন থেকেই জানি ওই ফ্লিট চালায় ডেমোক্র্যাট সেল। বেশিরভাগই ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু যুদ্ধের মাঝখানে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই বিশটা শিপ আত্মসমর্পণ করে বসে। পরাজয় ডেকে আনার জন্য সেটাই যথেষ্ট।

“এখন বলো দেখি, ধারালো জিভঅলা, দেশপ্রেমিক, পুরোনো মূল্যবোধর ধারক, তোমার সাথে ডেমোক্র্যাটদের সম্পর্কটা কী?”

শ্রাগ করে প্রশ্নটা উড়িয়ে দিল মিস, “অর্থহীন প্রলাপ, তুমি ভালো করেই জানো। তারপরে যে ক্রমেই পিছু হটতে হচ্ছে, স্যিউয়েনার অর্ধেক ছেড়ে দিতে হল, সেক্ষেত্রে? আবারো ডেমোক্র্যাট?”

“না, ডেমোক্র্যাট না,” ছোটখাটো মানুষটা ধারালোভাবে হাসলেন। “আমরা নিজেরাই পিছিয়ে এসেছি-আক্রান্ত হলেই ফাউণ্ডেশন বরাবর যেভাবে পিছিয়ে আসে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবিতা আমাদের পক্ষে এসে দাঁড়ায়। এরই মধ্যে, আমি চূড়ান্ত ফলাফল দেখতে পারছি। ইতোমধ্যে তথাকথিত আণ্ডারগ্রাউণ্ড অব দ্য ডেমোক্র্যাটস সরকারের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য এবং সহযোগিতা করার জন্য একটা বিবৃতি প্রকাশ করেছে। এটা ভান হতে পারে, আরো বড় কোনো ষড়যন্ত্র ঢেকে রাখার কৌশল হতে পারে, কিন্তু আমি সুযোগটা কাজে লাগাতে পারব, এবং যে প্রোপাগাণ্ডা চালানো হবে তাতে তাদের কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হবে না। এবং তার চেয়েও ভালো-”

“তার চেয়েও ভালো আর কী হতে পারে, ইণ্ডবার?”

“নিজেই বিচার করো। দুইদিন আগে অ্যাসোসিয়েশন অফ ইণ্ডিপ্যাণ্ডেন্ট ট্রেডারস মিউলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং তার ফলশ্রুতিতে এক হাজার শিপ যোগ দিয়ে ফাউণ্ডেশন ফ্লিটের শক্তি বৃদ্ধি করে। বুঝতেই পারছ, মিউল বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। সে দেখল আমরা বিভক্ত, নিজেদের মাঝে ঝগড়া ফ্যাসাদ নিয়ে ব্যস্ত এবং সে আক্রমণ করতেই আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেলাম। তাকে হারতেই হবে। এটাই অবশ্যম্ভাবী-বরাবরের মতো।”

কিন্তু মিস এর চেহারা থেকে সন্দেহ দূর হল না, তা হলে তুমি বলতে চাও সেলডন এমনকি একজন ভাগ্যান্বেষী মিউট্যান্ট এর আবির্ভাবেরও পরিকল্পনা করে রেখেছেন।”

“মিউট্যান্ট! একজন বিদ্রোহী ক্যাপ্টেন, অনভিজ্ঞ এক তরুণ আর এক ক্লাউনের কথা শুনে তাকে আমরা অন্য কিছু ভাবতে পারি না। তা ছাড়া তুমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণের কথা ভুলে গেছ-তোমার নিজের।”

“আমার নিজের?” মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল মিস।

“তোমার নিজের?” নাক সিটকে বললেন মেয়র। “নয় সপ্তাহ পরে টাইম ভল্ট খুলবে। তখন কী হবে? একটা ক্রাইসিসের জন্য সেটা খুলবে। মিউলের আক্রমণ যদি সেই ক্রাইসিস না হয় তা হলে কোনটা, যার জন্য টাইম ভল্ট খুলছে? উত্তর দাও, ব্যাটা ষাঁড়।”

শ্রাগ করল সাইকোলজিস্ট, “ঠিক আছে। যদি বুড়ো সেলডন উল্টো কথাই বলে… তুমি বরং এ্যাণ্ড ওপেনিং-এর দিন আমাকে থাকার সুযোগ করে দাও।”

“ঠিক আছে। বেরিয়ে যাও, নয় সপ্তাহ আমি তোমার চেহারা দেখতে চাই না।”

“(ছাপার অযোগ্য) আনন্দের সাথে, ব্যাটা বুড়ো ভাম,” বেরিয়ে যাওয়ার সময় নিজের মনেই ফিসফিস করল মিস।

*

১৮. ফাউণ্ডেশন-এর পতন

টাইম ভল্টের পরিবেশ ঠিক বুঝিয়ে বলা যাবে না। কালের প্রবাহে এটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তা না, কারণ দেয়ালগুলোর অবস্থা যথেষ্ট ভালো, মজবুত, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রয়েছে, সেই সাথে সুন্দরভাবে রং করা, মনে হয় যেন জীবন্ত, এবং স্থায়ীভাবে বসানো চেয়ারগুলো আরামদায়ক, বোঝাই যায় আজীবন ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এটা প্রাচীন তাও বলা যাবে না, কারণ তিন শতাব্দীর ঘটনাপ্রবাহ কোনো ছাপ ফেলেনি। রহস্যময়তা এবং ভয়ের অনুভূতি তৈরি করারও কোনো চেষ্টা নেই-কারণ এটা সকলের জন্য উন্মুক্ত।

তারপরেও বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক পরিস্থিতি বারবারই দেখা দিয়েছে, কিছু দূর হয়েছে, কিছু এখনো ঝুলে আছে-এবং সেটা হচ্ছে কামড়ার অর্ধেক জুড়ে তৈরি করা ফাঁকা গ্লাস কিউবিকল। তিন শতাব্দীর মাঝে চারবার হ্যারি সেলডনের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি এখানে বসে ভবিষ্যৎ বংশধরদের উদ্দেশ্যে কথা বলেছেন। দুইবার তার কথা শোনার জন্য সেখানে কেউ উপস্থিত ছিল না।

তিন শতাব্দী এবং নয় প্রজন্ম পরেও এই বৃদ্ধ-যিনি ইউনিভার্সাল এম্পায়ার-এর স্বর্ণালি দিনগুলো দেখেছেন তিনি তার গ্রেট-আন্দ্রা গ্রেট গ্র্যাণ্ড চিল্ডরেনদের চাইতে গ্যালাক্সি সম্বন্ধে অনেক অনেক বেশি ধারণা রাখেন।

গ্লাস কিউবিকল ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে তার আবির্ভাবের জন্য।

প্রথমে এলেন মেয়র ইণ্ডবার তৃতীয়, উৎকণ্ঠায় নিরব নিথর হয়ে থাকা জনপথের মাঝ দিয়ে জমকালো গ্রাউণ্ড কার চালিয়ে, সাথে এল তার নিজস্ব আসন, অন্য সবগুলোর চেয়ে উঁচু এবং প্রশস্ত। সেটা বসানো হল একেবারে সামনে। দ্রুত সবকিছুর উপর কর্তৃত্ব বিস্তার করলেন ইণ্ডবার। শুধু সামনের ফাঁকা গ্লাস কিউবিকল বাদে।

বা পাশের গম্ভীর অফিসার কুর্নিশ করল, “এক্সিলেন্স, রাতে আপনার অফিসিয়াল অ্যানাউন্সম্যান্টের সাব-ইথারিক ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়েছে।”

“গুড, এর মাঝে টাইম ভল্ট নিয়ে তৈরি করা বিশেষ ইন্টার প্ল্যানেটারি প্রোগ্রামগুলো চলতে থাকুক, কী হবে বা হতে পারে সে ধরনের কোনো পূর্বানুমান বা হিসাব-নিকাশ প্রচার করা যাবে না। জনগণের মনোভাব কেমন, সন্তোষজনক?”

“এক্সিলেন্স, ভীষণরকম সন্তোষজনক। গুজব ছড়ানো বন্ধ হয়ে গেছে। আত্মবিশ্বাস ফিরে আসছে মানুষের মাঝে।”

“গুড।” ইশারায় অফিসারকে চলে যেতে বললেন তিনি, তারপর সুন্দরভাবে নেকপিস ঠিক করে নিলেন।

দুপুর হতে ঠিক বিশ মিনিট বাকি!

একজন দুজন করে মেয়রাল্টির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বর্গ বণিক সমিতির গুরুত্বপূর্ণ। নেতারা আসতে লাগলেন। মেয়রের সাথে দেখা করলেন সবাই। আর্থিক প্রতিপত্তি এবং মেয়রের সুদৃষ্টির মাত্রা অনুযায়ী সবাই কিছু না কিছু প্রশংসাসূচক বাক্য শ্রবণ করলেন, তারপর গিয়ে বসলেন যার যার জন্য নির্দিষ্ট করা আসনে।

হেভেনের রাও এসেছে। অনুমতি ছাড়াই সে মেয়রের আসনের দিকে এগোল।

“এক্সিলেন্স!” কুর্নিশ করল রাণ্ডু।

ভুরু কোঁচকালেন মেয়র। “তোমাকে তো দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি।”

“এক্সিলেন্স, আমি এক সপ্তাহ আগে অনুরোধ জানিয়েছিলাম।”

“অত্যন্ত দুঃখিত, আসলে রাষ্ট্রের কাজ আর সেলডনের আবির্ভাব নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত-”।

“এক্সিলেন্স, আমি বুঝতে পেরেছি, কিন্তু আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, ইণ্ডিপ্যাণ্ডেন্ট ট্রেডারদের শিপগুলো ফাউণ্ডেশন ফ্লিটের মাঝে ভাগ করে দেওয়ার আদেশ বাতিল করুন।”

রেগে উঠলেন ইণ্ডবার। “এখন আলোচনার সময় নয়।”

“এক্সিলেন্স, এখনই একমাত্র সময়,” আকুতি ঝরে পড়ল রাণুর কণ্ঠে। “স্বাধীন বণিক বিশ্বগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে আমি আপনাকে বলছি, এধরনের পদক্ষেপ মেনে নেওয়া যাবে না। সেলডন আমাদের পক্ষ নিয়ে আমাদের সমস্যা সমাধান করে দেবার আগেই এই আদেশ ফিরিয়ে নিতে হবে। পরে সংশোধনের কোনো সুযোগ থাকবে না এবং আমাদের জোট ভেঙে যাবে।”

শীতল দৃষ্টিতে রাণ্ডুর দিকে তাকালেন ইণ্ডবার, “তুমি কী জানো আমি ফাউণ্ডেশন আর্মড ফোর্সেস এর প্রধান? মিলিটারি পলিসি নির্ধারণ করার অধিকার আমার আছে না নাই?”

“এক্সিলেন্স, আছে, কিন্তু কিছু বিষয় একেবারেই অযৌক্তিক।”

“আমার কাছে তো কোনোটাই অযৌক্তিক মনে হচ্ছে না। এরকম জরুরি সময়ে তোমাদের হাতে আলাদা ফ্লিট ছেড়ে দেওয়া বিপজ্জনক। নিজেদের ভেতর বিবাদ করলে লাভ হবে শক্রর। আমাদের একতাবদ্ধ থাকতে হবে, অ্যাম্বাসেডর, সামরিক এবং রাজনৈতিক দুভাবেই।”

গলার পেশি ফুলে উঠেছে, টের পেল রাণ্ডু। মেয়রের সম্মানসূচক উপাধি এড়িয়ে গেল সে। “আপনি এখন নিরাপদ বোধ করছেন। ভাবছেন সেলডন সমস্যার সমাধান করে দেবেন। কিন্তু এক মাস আগে যখন আমাদের শিপ টারেন এ মিউলকে পরাজিত করে তখন আপনি ছিলেন অনেক নরম। আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই, স্যার, ফাউণ্ডেশন শিপ পাঁচপাঁচটা সরাসরি যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে এবং স্বাধীন বণিক বিশ্বসমূহের ফ্লিট আপনাকে বিজয় এনে দেয়।”

বিপজ্জনক ভঙ্গিতে ভুরু কোঁচকালেন ইণ্ডবার, “টার্মিনাসে আপনার আর থাকার দরকার নেই। আজ সন্ধ্যার ভেতরে ফিরে যাবেন। তা ছাড়া, ডেমোক্রেটদের সাথে আপনার সম্পর্ক অবশ্যই তদন্ত করে দেখা হবে।”

“যখন ফিরে যাবো,” জবাব দিল রাণু, “আমার সাথে আমাদের শিপগুলো ফিরে যাবে। ডেমোক্রেটদের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। শুধু জানি যে কমাণ্ডিং অফিসারদের বিশ্বাস ঘাতকতার জন্য ফাউন্ডেশন শিপ মিউলের কাছে আত্মসমর্পণ করে। সাধারণ সৈনিক, ডেমোক্র্যাট হোক আর যাই হোক, তাদের কোনো দোষ নেই। ফাউণ্ডেশন-এর বিশটা শিপ তাদের রিয়ার এডমিরালের আদেশে হোরলেগরে আত্মসমর্পণ করে, অথচ তারা ছিল নিরাপদ এবং অক্ষত। রিয়ার এডমিরাল আপনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ-আমার ভাতিজার ট্রায়ালের সময় সেই প্রধান বিচারকের দায়িত্ব পালন করে। শুধু এটাই না আরো অনেক কিছু জানি আমরা। কোনো বিশ্বাসঘাতকের অধীনে আমাদের শিপ আর জনগণের জীবনের উপর ঝুঁকি নিতে পারি না।”

“টার্মিনাস ত্যাগ করার সময় আপনাকে কড়া প্রহরায় রাখা হবে।”

সরে এল রাণ্ডু পিঠে টার্মিনাস প্রশাসকের অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টির বাণবিদ্ধ হচ্ছে বুঝতে অসুবিধা হল না।

বারোটা বাজতে দশ মিনিট বাকি!

টোরান বেইটা দুজনই এসেছে। রাণ্ডুকে দেখে হাত পা নেড়ে ডাক দিল।

মৃদু হাসল রাণ্ড, “তোমরাও এসেছে। ব্যবস্থা করলে কীভাবে?”

“আমাদের টিকেট হল ম্যাগনিফিসো,” দাঁত বের করে হাসল টোরান। “টাইম ভল্ট নিয়ে একটা কম্পোজিশন শোনাতে বলেছে ইণ্ডবার, কোনো সন্দেহ নেই নিজেকে মহানায়ক প্রমাণ করতে চায়। কিন্তু ম্যাগনিফিসোর এক কথা আমাদের ছাড়া সে আসবে না। কেউ ওর মত পাল্টাতে পারে নি। এবলিং মিসও ছিলেন সাথে, এইত একটু আগে কোথায় যেন গেলেন। তারপর হঠাৎ উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করল, “কী হয়েছে, আঙ্কেল? তোমাকে খুব একটা ভালো দেখাচ্ছে না।”

মাথা নাড়ল রাণু, “না দেখানোরই কথা। সময় ভালো না, টোরান। মিউলের পালা শেষ হলেই আমাদের পালা আসবে, আমি ভয় পাচ্ছি।”

দীর্ঘদেহী একজনকে আসতে দেখে হাসি ফুটল বেইটার কালো চোখে, একটা হাত বাড়িয়ে বলল, “ক্যাপ্টেন প্রিচার, আপনি তা হলে স্পেস ডিউটি পালন করতে এসেছেন?”

বেইটার হাত ধরে সামান্য মাথা নোয়ালো ক্যাপ্টেন, “ঠিক তা না, ড. মিস কেন যেন আমাকে এখানে উপস্থিত থাকতে বলেছেন, তবে সাময়িক। আগামী কালই হোম গার্ডে ফিরে যাচ্ছি। কয়টা বাজে?”

বারোটা বাজতে তিন মিনিট বাকি!

ম্যাগনিফিসোর অবস্থা ভয়ানক। ভীষণ মনমরা, শরীর বাকাচোরা করে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। বড় বড় চোখ দুটোতে অস্বস্তি। তীর্যক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে চারপাশে।

বেইটার হাত ধরে টানল, এবং যখন শোনার জন্য মাথা নোয়ালো বেইটা। সে ফিস ফিস করে বলল, “আপনার কী মনে হয়, মাই লেডি, আমি…আমি যখন ভিজি সোনার বাজাবো তখন এই এত বড় লোকেরা এখানে থাকবেন?”

“প্রত্যেকেই, কোনো সন্দেহ নেই,” তাকে আশ্বস্ত করল বেইটা, মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। “এবং আমার বিশ্বাস তারা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে নেবে যে তুমি গ্যালাক্সির সবচেয়ে সেরা বাদক এবং তোমার কনসার্টের মতো কনসার্ট জীবনে কখনো দেখেনি। কাজেই তুমি সোজা হয়ে ঠিক মতো বস। নইলে লোকে আমাদের দেখে হাসবে।”

বেইটার ছদ্ম রাগের ভঙ্গি দেখে দুর্বলভাবে হাসল ম্যাগনিফিসো। ধীরে ধীরে হাড্ডিসার দেহের ভাজ খুলে বসল সোজা হয়ে।

দুপুর-

-এবং গ্লাস কিউবিকল এখন আর ফাঁকা নয়।

তার আবির্ভাব কেউ লক্ষ করেছে কিনা সন্দেহ আছে। পরিষ্কার এক বিভাজন; এক মুহূর্ত আগে কিছুই ছিল না, পরমুহূর্তেই আছে।

কিউবিকলের ভেতর একজন লোক, হুইলচেয়ারে বসা, বৃদ্ধ, বলিরেখাপূর্ণ মুখে অসম্ভব উজ্জ্বল একজোড়া চোখ, এবং তার কণ্ঠস্বর সজীব, তারুণ্যদীপ্ত। মেলানো একটা বই উল্টো করে কোলের উপর ফেলে রাখা, কোমল সুরে কথা বললেন তিনি।

“আমি হ্যারি সেলডন!”

জমাট নীরবতার মাঝে তার কণ্ঠস্বর বজ্রপাতের মতো শোনালো।

“আমি হ্যারি সেলডন! জানি না আপনারা কেউ এখানে আছেন কি না, তবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার প্ল্যানে কোথাও বিচ্যুতি ঘটবে সেই ভয় এখনো দেখা দেয়নি। প্রথম তিন শতাব্দীতে নন ডেভিয়েশনের সম্ভাবনা নয় চার দশমিক দুই শতাংশ।

থেমে হাসলেন তিনি, “ভালো কথা, আপনারা কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে বসতে পারেন। কেউ ধূমপান করতে চাইলে করতে পারেন। আমি তো আর রক্ত মাংসের শরীর নিয়ে এখানে উপস্থিত নেই। কাজেই কোনো আনুষ্ঠানিকতারও প্রয়োজন নেই।

“এবার বর্তমান সমস্যা নিয়ে কথা বলা যাক। এই প্রথমবারের মতো ফাউণ্ডেশন একটা গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে বা তার শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তার আগ পর্যন্ত সাইকোহিস্টোরির শক্ত নিয়মের সাহায্যে প্রতিটা আক্রমণ ঠেকানো হয়েছে সুনিপুণভাবে। বর্তমান আক্রমণ হল অতিরিক্ত প্রভুত্ব পরায়ণ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ফাউণ্ডেশন-এরই অতিরিক্ত বিশৃঙ্খল এক আউটার গ্রুপের আক্রমণ। এটার প্রয়োজন ছিল, ফলাফল স্পষ্ট।”

অভিজাত দর্শকদের গাম্ভীর্যের মুখোশ খসে পড়তে লাগল। চেয়ার ছেড়ে অর্ধেক উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন ইণ্ডবার।

সামনে ঝুঁকলো বেইটা। মহান সেলডন কী বলছেন? কয়েকটা শব্দ সে শুনতে পারেনি।

“-যে সমঝোতার প্রয়োজন দুটো উদ্দেশ্যে। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী সরকারের ভেতর স্বাধীন বণিকদের বিদ্রোহ একটা নতুন ধরণের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। লড়াই এর মনোভাব সৃষ্টি করার মতো উপাদানগুলো আবার মানুষের মাঝে ফিরে আসছে। যদিও কঠোর হাতে দমন করা হয়েছে, গণতন্ত্রের পুনরুত্থান-”

গলা চড়াল সবাই। এতক্ষণের ফিসফিসানি পরিণত হয়েছে কর্কশ শব্দে, এবং সবাই পৌঁছে গেছে আতঙ্কের শেষ সীমায়।

টোরানের কানের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করল বেইটা, “উনি মিউলের কথা বলছেন না কেন? বণিকরা তো বিদ্রোহ করে নি।”

শ্রাগ করল টোরান।

বেড়ে উঠা বিশৃঙ্খলতার মাঝে বৃদ্ধ হাসি মুখে কথা বলেই চলেছেন।

“ফাউণ্ডেশন-এর উপর চাপিয়ে দেওয়া গৃহযুদ্ধের ফলাফল হিসেবে একটা নতুন এবং দৃঢ় কোয়ালিশন গভর্নমেন্ট প্রয়োজনীয় এবং সুবিধাজনক আউটকাম। এখন শুধুমাত্র ওল্ড এম্পায়ারের অবশিষ্ট অংশ পরবর্তী অগ্রগতির মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াবে এবং আগামী কয়েক বছরে তার কোনো সম্ভাবনা নেই। অবশ্য আমি পরবর্তী-”

হৈ হট্টগোলের মাঝে সেলডনের কথা আর শোনা যাচ্ছে না। মনে হতে লাগল তিনি নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়ছেন।

এবলিং মিস এসে রাঙুর পাশে দাঁড়াল, চেহারা উত্তেজনায় লাল। চিৎকার করছে সে। “সেলডন ভুল ক্রাইসিসের কথা বলছেন, তোমরা বণিকরা গৃহযুদ্ধের কথা ভাবছিলে?”

“একটা পরিকল্পনা ছিল, হা।” মিনমিনে গলায় বলল রাণ্ডু। “মিউলের কারণে সেটা আমরা বাদ দেই।”

“তা হলে মিউল পৃথক একটা সমস্যা, সাইকোহিস্টোরিতে তার কথা বলা হয়নি। এখন কী হবে?”

জমাট নীরবতার মাঝে বেইটা হঠাৎ খেয়াল করল কিউবিকল আবার ফাঁকা। দেয়ালের আণবিক উজ্জ্বলতা নেই। নিয়ন্ত্রিত বায়ু প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে।

কোথাও সাইরেণ বাজছে তীক্ষ্ণ স্বরে। রাণু এই শব্দের অর্থ সবার কাছে পরিষ্কার করে দিল, “স্পেস রেইড!”

হাতঘড়ি কানের কাছে নিয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল এবলিং মিস, “বন্ধ হয়ে গেছে, বাই দ্য গ্যালাক্সি! এখানে কারো ঘড়ি চলছে?”

কমপক্ষে বিশজন তাদের ঘড়ি কানের কাছে তুলল এবং বিশ সেকেণ্ডেরও কম সময়ের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেল যে-কোনোটাই চলছে না।

“তা হলে,” মুখে সেঁতো হাসি, বলার ভঙ্গি যেন চূড়ান্ত রায় পড়ে শোনাচ্ছে, “কিছু একটা টাইম ভল্টের নিউক্লিয়ার পাওয়ার থামিয়ে দিয়েছে-এবং আক্রমণ শুরু করেছে মিউল।”

গোলমাল ছাপিয়ে শোনা গেল ইণ্ডবারের চিৎকার, “সবাই বস! মিউল এখান থেকে পঞ্চাশ পারসেক দূরে।”

“ছিল,” পাল্টা চিৎকার করল মিস, “এক সপ্তাহ আগে। ঠিক এই মুহূর্তে টার্মিনাসে বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে।”

বেইটা টের পেলো একটা অদ্ভুত গম্ভীর হতাশা ঘিরে ধরছে তাকে। কঠিনভাবে চেপে ধরছে। জোরে নিশ্বাস ফেলার পরই সেটা কিছুটা হালকা হল সেইসাথে গলার দুপাশে ব্যথা অনুভব করল সে।

বাইরেও প্রচণ্ড গোলমালের শব্দ শোনা যাচ্ছে। দরজা খুলল দড়াম করে। দ্রুত পায়ে একজন দৌড়ে গেল মেয়রের দিকে।

“এক্সিলেন্স,” ফিসফিস করে বলল সংবাদ বাহক, “শহরের কোনো ভেহিকলই চলছে না। সকল ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ। টেন্থ ফ্লিট পরাজিত হয়েছে এবং মিউলের শিপগুলো এই মুহূর্তে অ্যাটমোস্ফিয়ারের ঠিক বাইরে। জেনারেল-”

হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলেন ইণ্ডবার, মেঝেতে পড়ে থাকলেন অক্ষমের মতো। পুরো হলে আর কেউ উঁচু গলায় কথা বলছে না। এমনকি দরজার বাইরে জমে উঠা ভিড়ের সবাই প্রচণ্ড ভয় পেলেও নিশ্চুপ, এবং বিপজ্জনকভাবে ঠাণ্ডা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

উঠে দাঁড়ালেন ইণ্ডবার। ঠোঁটের কাছে ওয়াইনের গ্লাস ধরল কেউ একজন। চোখ খোলার আগেই ঠোঁট নাড়লেন তিনি, এবং যে কথাগুলো বললেন তা হল, “আত্মসমর্পণ!”

বেইটার মনে হল সে কেঁদেই ফেলবে-দুঃখ বা অপমানে নয়, বরং একটা ভয়ংকর হতাশা থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দে। তার জামার হাত ধরে টানল এবলিং মিস, “কাম, ইয়ং লেডি।” ।

তাকে প্রায় কোলে করেই চেয়ার থেকে উঠিয়ে নেওয়া হল।

“আমরা চলে যাচ্ছি,” বলল মিস, “আপনার মিউজিশিয়ানকে সাথে নিন।” মোটাসোটা বিজ্ঞানীর ঠোঁট দুটো বর্ণহীন, কাঁপছে।

“ম্যাগনিফিসো, দুর্বল গলায় ডাক দিল বেইটা। প্রচণ্ড আতঙ্কে জড়োসড়ো হয়ে আছে ক্লাউন। চোখদুটো কাঁচের মতো স্বচ্ছ আকার ধারণ করেছে।

“মিউল,” আর্তনাদ করে উঠল সে। “মিউল আমাকে ধরতে আসছে।”

বেইটার স্পর্শ পেয়েই পাগলের মতো দাপাদাপি শুরু করে দিল। টোরান এগিয়ে এসে জায়গামতো একটা ঘুসি মেরে অজ্ঞান করে ফেলল তাকে, তারপর বস্তার মতো ম্যাগনিফিসোকে কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে এল।

পরের দিন, মিউলের ঘিনঘিনে কালো যুদ্ধযানগুলো টার্মিনাস গ্রহের ল্যাণ্ডিং ফিল্ডে অবতরণ করল ঝাঁকে ঝাঁকে। আক্রমণকারী জেনারেল অন্য গ্রহের তৈরি গ্রাউণ্ড কারে চড়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল টার্মিনাস সিটিতে, যেখানে পুরো শহরের এটমিক কারগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে নিপ্রাণ হয়ে।

পূর্বের মহাপরাক্রমশালী ফাউণ্ডেশন-এর সামনে হ্যারি সেলডনের আবির্ভাবের ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা পরে সেটা নতুন শত্রু কর্তৃক দখলের ঘোষণা দেওয়া হল।

ফাউণ্ডেশন বিশ্বগুলোর মাঝে, স্বাধীন বণিকরাই টিকে আছে, এবং এবার মিউল-কনকোয়ারার অফ দ্য ফাউণ্ডেশন- দৃষ্টি ফেরালো তাদের দিকে।

*

১৯. অনুসন্ধান শুরু

নিঃসঙ্গ গ্রহ হেভেন-কোনো এক গ্যালাকটিক সেক্টরের একমাত্র সূর্যের একমাত্র গ্রহ, ভেসে চলেছে অনন্তকাল-এই মুহূর্তে অবরুদ্ধ।

সামরিক বিচারে, অবশ্যই অবরুদ্ধ, কারণ মহাকাশের চারপাশের কোনো অঞ্চলই মিউলের অ্যাডভান্স বেজ এর বিশ মাইলের বাইরে না। মাকড়সার জালের উপর ক্ষুরের ধারালো প্রান্ত ধরলে যেভাবে ছিঁড়ে যায়, ফাউণ্ডেশন-এর পতনের পর গত চার মাসে হেভেনের যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিক সেভাবেই ভেঙে পড়েছে। শিপগুলো পিছু হটে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে হোম ওয়ার্ল্ডে এবং ফাইটিং বেজ হিসেবে এখনো টিকে আছে একমাত্র হেভেন।

অন্যান্য দিক দিয়ে এই অবরোধ আরো স্পষ্ট, কারণ একটা অসহায় নিরাপত্তাহীনতার বোধ চেপে বসছে তাদের উপর-

মধ্যবর্তী সরু পথের দুপাশে সারি সারি টেবিল, রং দুধ সাদা, উপরের পৃষ্ঠতল গোলাপি। অনেকটা অন্ধের মতোই নিজের আসন খুঁজে নিল বেইটা। হাতল বিহীন চেয়ারে বসতে বসতে দু’একটা সম্ভাষণের জবাব দিল যান্ত্রিকভাবে। ক্লান্ত হাতে ক্লান্ত চোখ ডলে হাত বাড়িয়ে ম্যেনু টেনে নিল। হাইলি-কালচারড-ফাংগাস, হেভেনের সেরা খাদ্য, অথচ ফাউণ্ডেশন-এর স্বাদে অভ্যস্ত বেইটার কাছে মনে হয় একেবারে জঘন্য।

এমন সময় পাশে কারো ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ পেয়ে সেদিকে তাকাল বেইটা।

জুডির সাথে এর আগে তার সামান্য পরিচয় হয়েছিল। সেই জুডিই কাঁদছে। ভেজা রুমাল মুখে চাপা দিয়ে ধরে চেষ্টা করছে কান্না দমন করার। ফলে মুখের রং বদলে লাল হয়ে গেছে। আকৃতিহীন রেডিয়েশন প্রুফ পোশাক কাঁধের উপর যেমন তেমনভাবে ফেলে রাখা। স্বচ্ছ ফেস শিল্ড পড়ে আছে টেবিলের খাবারের উপর।

আরো তিনটা মেয়ে আছে তার সাথে, যারা অনন্তকাল ধরে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে, কোমল সান্তনা দিয়ে তাকে থামানোর চেষ্টা করছে। যদিও বরাবরের মতোই তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। বেইটা তাদের কাছে গেল।

“কী হয়েছে?” ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল সে।

একজন ঘুরে কাঁধ নাড়ল, “আমি জানি না, তারপর কাঁধের ইশারায় কিছু পরিষ্কার হয়নি বুঝতে পেরে টেনে একপাশে সরিয়ে আনল বেইটাকে।

“বোধহয়, সারা দিনে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। তা ছাড়া স্বামীর জন্য দুঃশ্চিন্তা।”

“ওর স্বামী স্পেস পেট্রোলে গেছে?”

“হ্যাঁ।”

জুডির দিকে হাত বাড়াল বেইটা।

“তুমি বাড়ি যাচ্ছ না কেন, জুডি?” অনেকটা অবাঞ্চিত পরামর্শ দেওয়ার মতো করে বলল।

কিছুটা বিরক্ত হয়ে মাথা তুলল জুডি, “এই সপ্তায় একবার যাওয়া হয়ে গেছে।”

“তা হলে আরেকবার যাবে। প্রয়োজন হলে সামনের সপ্তায় তিনবার যাবে-বাড়ি যাওয়ার সাথে দেশ প্রেমের কোনো সম্পর্ক নেই। তোমাদের কেউ ওর ডিপার্টমেন্টে কাজ করো? বেশ, তোমরা তা হলে ওর কার্ডের দায়িত্ব নিতে পারবে, তবে সবার আগে তোমাকে ওয়াসরুমে যেতে হবে, জুডি। মুখের মেক আপ ঠিক করে নাও। যাও! যাও!”

বিষণ্ণ অনুভূতি নিয়ে নিজের টেবিলে ফিরল বেইটা। বিষণ্ণতা সংক্রামক ব্যাধির মতো। আর এখন যেরকম কঠিন দুর্দিন পাড়ি দিতে হচ্ছে তাতে একজনের চোখের পানি পুরো ডিপার্টমেন্টকে হতাশ করে তুলবে।

অনীহার সাথে খাবার বাছাই করল সে। কনুইয়ের কাছে একটা বোতামে চাপ দিয়ে অর্ডার দিল তারপর ম্যানুটা রেখে দিল আগের জায়গায়।

“আমাদের কান্না ছাড়া আর কিছু করার নেই, আছে?” বিপরীত দিকের টেবিলে বসা লম্বা কালো মেয়েটা জিজ্ঞেস করল। অস্বাভাবিক মোটা ঠোঁটের কোণে সামান্য বাঁকা হাসি।

কঠিন দৃষ্টিতে কথাটার ভেতরে যে কটাক্ষ আছে সেটা ওজন করার চেষ্টা করল বেইটা। এই সময় খাবার চলে আসায় একটু সামলে নিল। টেবিলের উপরের অংশ ভিতরের দিকে সরে গিয়ে নিচ থেকে উঠে এল খাবারের ডিশ। মোড়ক সরিয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগল ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য।

“আর কোনো কিছু করার কথা তোমার মাথায় আসছে না, হেলা?” জিজ্ঞেস করল সে।

“হ্যাঁ, অবশ্যই।” বলল হেলা। “আসছে!” নিখুঁতভাবে টোকা দিয়ে সিগারেটের টুকরো ছুঁড়ে দিল একটা ছোট কুলঙ্গির দিকে, মাটি স্পর্শ করার আগেই আগুনের চিকন লকলকে শিখা টেনে নিল সেটাকে।

“যেমন,” চিকন কিন্তু সবল হাতদুটো ভাজ করে তার উপর চিবুক রাখল হেলা, “আমার মনে হয়, মিউলের সাথে চমৎকার একটা চুক্তি করে আমরা সব ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে পারি। মিউল হামলা করলে যেখানে কাজ করি সেখান থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসার কোনো উপায় নেই।”

বেইটার মসৃণ কপালে কোনো ভাঁজ পড়ল না, কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক, “নিশ্চয়ই ব্যাটল শিপে তোমার স্বামী বা ভাই নেই, তাই না?”

“না। আর সেই কারণেই অন্যের ভাই বা স্বামীর ত্যাগ স্বীকারের ব্যাপারটা আমি বুঝি না।”

“আত্মসমর্পণ করলে আরো বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।”

“ফাউণ্ডেশন আত্মসমর্পণ করে এখন নিরাপদে আছে। আর আমরা বাধা দেওয়াতে পুরো গ্যালাক্সি দাঁড়িয়ে গেল আমাদের বিরুদ্ধে।”

শ্রাগ করল বেইটা, মিষ্টি সুরে বলল, “মনে হয় প্রথম ব্যাপারটাই তোমাকে ভাবাচ্ছে।” তারপর মনযোগ দিল খাওয়ার দিকে। একই সাথে অনুভব করছে তার চারপাশে একটা স্যাঁতস্যাঁতে নীরবতা। হেলা যে হতাশাবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে সেটা নিয়ে অন্যদের কিছু বলার কোনো আগ্রহ নেই।

খাওয়া শেষ করে আরেকটা বোম চাপল টেবিল সাফ করার জন্য। তারপর বেরিয়ে গেল দ্রুত।

তিন টেবিল পরে খেতে বসা অন্য একটা মেয়ে জিজ্ঞেস করল ফিসফিস করে, “মেয়েটা কে?”

একই ভঙ্গিতে ঠোঁট বাঁকা করে জবাব দিল হেলা, “আমাদের কো-অর্ডিনেটরের ভাস্তি। তুমি চেন না?”

“তাই?” প্রশ্নকারীর দৃষ্টিতে বিরূপভাব। “কেন এসেছে?”

“এমনি দেখতে এসেছে। জান না, দেশপ্রেমিক হওয়া এখন ফ্যাশনে দাঁড়িয়েছে। ডেমোক্র্যাটিকদের কথা মনে হলেই আমার বমি আসে।”

“শোন, হেলা,” গোলগাল মেয়েটা বলল, যে তার ডান দিকে বসেছে, “ও তো ওর চাচাকে আমাদের পেছনে লাগায়নি। তুমি কেন লাগতে যাচ্ছ?”

সঙ্গিনীর কথায় কোনো গুরুত্ব দিল না হেলা, আরেকটা সিগারেট ধরাল।

নতুন মেয়েটা এখন বিপরীত দিকের টেবিলে বসা অ্যাকাউন্টেন্ট-যে কথা বলে খুব দ্রুততার কথা গোগ্রাসে গিলছে। “জানো, ও না টাইম ভল্টে ছিল-সত্যি সত্যি টাইম ভল্ট-যখন সেলডন কথা বলছিলেন-আর শুনেছি ঠক ঠক করে নাকি কাঁপছিলেন মেয়র। তারপর যেরকম দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু হয়, কী বলব। বেশ ঝুঁকি নিয়ে ও পালিয়ে আসে, শক্রদের চোখে ধুলো দিয়ে। ভাবছি ও একটা বই লিখছে না। কেন? যুদ্ধের গল্প উপন্যাস এখন বেশ জনপ্রিয়। আর মেয়েটা নাকি মিউলের গ্রহ-কালগান-সেখানেও গেছিল-এবং-”

টাইম বেল বেজে উঠার পর ধীরে ধীরে খালি হতে লাগল ডাইনিং রুম। অ্যাকাউন্টেন্ট এর মুখ এখনো চলছে, আর নতুন মেয়েটা ঠিক জায়গামতো চোখ বড় বড় করে যোগ করছে, “সত্যিই-ই-ই?”

বেইটা যখন বাড়ি ফিরল তখন বিশাল গুহার স্থানে স্থানে আলো নিভে গিয়ে অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় করে তুলছে। অর্থাৎ এখন নীতিবান এবং কঠোর পরিশ্রমী মানুষগুলোর ঘুমানোর সময়।

দরজা খুলে দিল টোরান, হাতে মাখন লাগানো এক স্লাইস রুটি।

“কোথায় ছিলে তুমি?” চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করল, তারপর খাবার গলা দিয়ে নামিয়ে আরো পরিষ্কারভাবে, “ডিনার বানাতে গিয়ে সব বরবাদ করে ফেলেছি। আমাকে দোষ দিতে পারবে না।”

কিন্তু বেইটা তাকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে, চোখ বিস্ফারিত, “তোমার ইউনিফর্ম কোথায়, টোরান? সিভিল পোশাক পড়ে আছ কেন?”

“অর্ডার, বে। রাণু এই মুহূর্তে এবলিং মিস এর সাথে আলোচনা করছে, কী বিষয়ে, আমি জানি না।”

“আমিও যাচ্ছি?” স্বামীকে জড়িয়ে ধরল বেইটা। জবাব দেওয়ার আগে চুমো খেল টোরান, “বোধহয়। বিপদ হতে পারে।”

“কোথায় বিপদ নেই?

“ঠিকই বলেছ। ও ভালো কথা, ম্যাগনিফিসোকে আনার জন্য লোক পাঠিয়েছি। চলে আসবে।”

“তার মানে এনজাইন ফ্যাক্টরির কনসার্ট বাতিল।”

“অবশ্যই।”

পাশের ঘরে গেল বেইটা। খাবারের সামনে বসল, যা দেখে কোনো সন্দেহই থাকল না যে ওগুলো বরবাদ হয়ে গেছে। অনায়াস দক্ষতায় স্যাণ্ডউইচ কেটে দুভাগ করল সে।

“কনসার্টের জন্য খারাপ লাগছে। ফ্যাক্টরির মেয়েগুলো অনেকদিন থেকে অপেক্ষা করছে। ম্যাগনিফিসো নিজেও।” মাথা নাড়ল সে, “অদ্ভুত একটা মানুষ।”

“শুধু তোমার মাতৃভাব জাগিয়ে তোলে, বে, আর কিছু না। কোনোদিন আমাদেরও সন্তান হবে, তখন ম্যাগনিফিসোর কথা ভুলে যাবে তুমি।”

মুখ ভর্তি স্যান্ডউইচ নিয়ে কিছু একটা বলল বেইটা।

তারপর স্যাণ্ডউইচ নামিয়ে রেখে মুহূর্তের মধ্যেই গুরুগম্ভীর হয়ে উঠে।

“টোরি।”

“উম্‌-ম-ম?”

“টোরি, আজকে সিটি হলে গিয়েছিলাম-ব্যুরো অফ প্রডাকশন এ। সেজন্যই ফিরতে দেরি হয়েছে।”

“কেন গিয়েছিলে?”

“আসলে…” বেইটা কেমন যেন দ্বিধাগ্রস্থ, অনিশ্চিত। “আগেই বুঝতে পেরেছিলাম, কিন্ত ফ্যাক্টরিতে কাজ করার সময় মেনে নিতে পারিনি। নৈতিকতা-জিনিসটার কোনো অস্তিত্বই নেই। মেয়েগুলো বিনা কারণেই অস্থির হয়ে পড়ে, কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। অসুস্থ না হলেও কেমন যেন পাগলাটে আচরণ করে। আমি যে সেকশনে কাজ করি সেখানে উৎপাদন আমি যখন হেভেনে আসি তখন যে উৎপাদন হত তার সিকিভাগও হয় না। প্রতিদিনই দেখা যায় কর্মী সংখ্যা– আগের দিনের চেয়ে কমছে।”

“বুঝলাম, তুমি ওখানে গিয়ে কী করেছ সেটা বল।”

“একটু খোঁজ খবর করলাম। একই অবস্থা, টোরি, পুরো হেভেনে একই অবস্থা। উৎপাদন কমে যাচ্ছে, ক্ষোভ আর অসন্তোষ বাড়ছে। ব্যুরো চিফের সাথে দেখা হওয়ার আগে এক ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। আর সে দেখা করে শুধু এই কারণে যে আমি কো-অর্ডিনেটরের আত্মীয়। লোকটা শুধু কাঁধ নেড়ে জানায় যে বিষয়টা ওর আয়ত্তের বাইরে। আমার মনে হয় এই অবস্থায় ব্যুরো চিফের কিছু আসে যায় না।”

“শোন, ভিত্তিহীন কথা বলো না।”

“ওর কোনো মাথা ব্যথা নেই,” ভীষণ রেগে উঠল বেইটা। “আমি বলছি কোথাও একটা ভুল হয়েছে। সেই একইরকম ভয়ংকর হতাশা গ্রাস করছে আমাকে, টাইম ভল্টে যেমন হয়েছিল, সেলডন যখন আমাদের হতাশ করলেন। তুমি নিজেও সেটা অনুভব করেছ।”

“হ্যাঁ, করেছি।”

“বেশ, সেটা আবার ফিরে এসেছে,” এখনো রেগে আছে সে। “আমরা মিউলকে কখনোই থামাতে পারব না। এমনকি আমাদের হাতে প্রয়োজনীয় অস্ত্র থাকলেও পারব না। কারণ এখন আমাদের সেই সাহস, উদ্যম এবং সদিচ্ছা নেই-টোরি, যুদ্ধ করে কোনো লাভ হবে না-”

বেইটাকে কখনো কাঁদতে দেখেছে টোরানের মনে পড়ে না। এখনো কাঁদছে না। কিন্তু হালকাভাবে তাকে জড়িয়ে ধরল টোরান, ফিস ফিস করে বলল, “ভুলে যাও, লক্ষ্মী। তোমার কথা আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কিছু-”

“হ্যাঁ, আমাদের কিছু করার নেই, সবাই বলছে একই কথা-আর আমরা ছুরির ডগার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছি কখন সেটা নেমে এসে আমাদের বুক এফোড় ওফোঁড় করে দেয়।”

বিষণ্ণ চিত্তে আবার খাওয়ার দিকে মনযোগ দিল বেইটা। টোরান নিঃশব্দে শোয়ার আয়োজনে ব্যস্ত। বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে ভালোমতোই।

রাণু, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কো-অর্ডিনেটর-যুদ্ধকালীন প্রয়োজনে হেভেনের কনফেডারেশন অফ সিটিজ তার অনুরোধে এই পদ সৃষ্টি করেছে। বাড়ির সবচেয়ে উপর তলায় নিজের কামরায় জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে। এখানে দাঁড়িয়ে শহরের সবুজ আর ঘরবাড়ির ছাদের উপর উঁকি মারতে পারে সে। কেভ লাইট কমে আসায় মনে হচ্ছে শহরটা পিছিয়ে এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে ছায়া আর কায়ার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। রাণ্ডু অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না।

এবলিং মিস-যার পরিষ্কার ছোট ছোট চোখ দেখে মনে হচ্ছে হাতের পানপাত্র ছাড়া জগতে আর কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। তাকে উদ্দেশ্য করে রাণু বলল, “হেভেনে একটা কথা খুব প্রচলিত। সেটা হচ্ছে, যখন কেভ লাইট নিভে যায় তখন নিষ্ঠাবান পরিশ্রমী মানুষদের ঘুমানোর সময়।”

“আপনি রাত করে ঘুমান?”

‘না। আপনাকে এত রাতে ডেকে আনার জন্য দুঃখিত, মিস। আসলে কেন যেন দিনের চেয়ে রাতে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কেমন অদ্ভুত, তাই না? হেভেনের মানুষ একটা বিশেষ অবস্থার সাথে কঠিনভাবে নিজেদের অভ্যস্ত করে তুলেছে। সেটা হল আলো কমার অর্থ এখন ঘুমাতে হবে। আমিও ব্যতিক্রম নই। কিন্তু এখন সব যেন কেমন উল্টো হয়ে যাচ্ছে

“আপনি লুকোচ্ছেন,” পরিবর্তনহীন গলায় বলল মিস। “জেগে থাকার সময়ে আপনি অনেক মানুষের মাঝে থাকেন। বুঝতে পারেন তারা আপনার দিকে অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। মনে হয় যেন এক জগদ্দল পাথরের বোঝা আপনার কাঁধে চেপে আছে। ঘুমানোর সময় নিজেকে মনে হয় ভারমুক্ত।”

“আপনিও বুঝতে পেরেছেন, তা হলে? পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ?”

আস্তে মাথা নাড়ল মিস, “পেরেছি। একধরনের গণমনোবৈকল্য, (ছাপার অযোগ্য) ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণহীণ আতঙ্ক। গ্যালাক্সি! রাণু, আর কী আশা করতে পারেন। সম্পূর্ণ একটা সভ্যতা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই অন্ধবিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠেছে যে অতীতের কোনো এক ফোক হিরো তাদের জন্য সব পরিকল্পনা করে রেখেছেন এবং তিনি তাদের (ছাপার অযোগ্য) জীবনের সব বিষয়ের দায়িত্ব নেবেন। তাদের ধ্যান ধারণা গড়ে উঠেছে ধর্মীয় অনুভূতির মতন করে। এবং তার অর্থ কী আপনি ভালোভাবেই জানেন।”

“মোটেই না।”

মিস ব্যাখ্যা করার ধার দিয়েও গেল না। কখনোই তা করে না। দুআঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, “ক্যারেকটারাইজড বাই স্ট্রং ফেইথ রিঅ্যাকশন্স। বড় ঝাঁকুনি দিয়েও রক্তে মিশে যাওয়া বিশ্বাস নাড়ানো যায় না। যার ফলশ্রুতিতে দেখা দেয় মনোবৈকল্য। মাইল্ড কেসেস-হিস্টিরিয়া, নিরাপত্তাহীনতাবোধ। অ্যাডভান্সড কেসেস-পাগলামি এবং আত্মহত্যা।”

বুড়ো আঙুলের নখ কামড়ালো রাণ্ডু। “যখন সেলডন আমাদের নিরাশ করেন, অন্য কথায় বলা যায় আমাদের খুঁটি সরে যায়, যার উপর দীর্ঘদিন ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন দেখা গেল যে আমাদের পেশি ক্ষয় হয়ে গেছে, আমরা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।”

“ঠিকই বলেছেন। আনাড়ি উপমা হলেও মোটামুটি ঠিকই বলেছেন।”

“আর আপনি এবলিং মিস, আপনার পেশির খবর কী?”

সিগারেটের ধোঁয়ায় বুক ভরে নিল সাইকোলজিস্ট, ছাড়ল ধীরে ধীরে। “একটু জং ধরেছে কিন্তু ক্ষয় হয়ে যায়নি। আমার পেশায় অনেক বেশি মুক্ত চিন্তা করতে হয়।”

“আর আপনি এই গোলকধাঁধা থেকে বেরনোর একটা পথ পেয়েছেন?”

“না, কিন্তু একটা পথ থাকতে বাধ্য। হয়তো সেলডন তার পরিকল্পনায় মিউলের জন্য কোনো প্রভিশন রাখেননি। হয়তো এই পরিস্থিতিতে আমাদের বিজয়ের নিশ্চয়তা তিনি দেননি। কিন্তু তিনি একথাও বলেননি যে আমরা হেরে যাব। তিনি শুধু খেলাটা কিছুক্ষণের জন্য আমাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। মিউলকে ঠেকানো যাবে।”

“কীভাবে?”

“একমাত্র যে উপায়ে কাউকে ঠেকানো যায়-সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণ করে। রাণু, মিউল কোনো সুপারম্যান না। শেষ পর্যন্ত তাকে পরাজিত করতে পারলে, সবাই সেটা বুঝতে পারবে। ব্যাপারটা হচ্ছে সে আমাদের কাছে অপরিচিত, এবং দ্রুত কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। মনে করা হয় সে একটা মিউট্যান্ট। বেশ, তাতে কী? মানুষ জানে না বলেই একটা মিউট্যান্টকে ‘সুপারম্যান মনে করে। আসলে সেইরকম কিছু না।

“ধারণা করা হয় যে গ্যালাক্সিতে প্রতিদিন কয়েক মিলিয়ন মিউট্যান্ট এর জন্ম হয়। এই কয়েক মিলিয়ন এর ভেতর এক বা দুই পার্সেন্ট বাদ দিয়ে বাকি সবগুলোর মিউট্যাশন খালি চোখেই ধরা পড়ে, সেগুলো হয় অদ্ভুত গড়নের। বিনোদন কেন্দ্র বা গবেষণা কেন্দ্রের উপযোগী এক বা দুই পার্সেন্ট ম্যাক্রোমিউট্যান্ট এর ভিতর আবার খুব অল্প কয়েকটার মিউটেশন হয় ভালো নিরীহ কৌতূহলোদ্দীপক, কোনো একটা ক্ষেত্রে হয়তো অস্বাভাবিক, অন্যান্য ক্ষেত্রে হয় নরম্যাল-বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাবনরম্যাল। বুঝতে পারছেন, রা?”

“পারছি। কিন্তু মিউলের ব্যাপারটা কী?”

“মিউল একটা মিউট্যান্ট, এটা ধরে নিয়ে আমরা অনুমান করতে পারি যে নিঃসন্দেহে তার মেন্টাল পাওয়ারের উৎস আছে, যা সে বিশ্বগুলো দখল করার কাজে লাগাচ্ছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে তার অসম্পূর্ণতা আছে। সেটাই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। সেই অসম্পূর্ণতা যদি স্পষ্ট এবং হাস্যকর না হত, তা হলে নিজেকে গোপন করে রাখত না। যদি সে একটা মিউট্যান্ট হয়।”

“কোনো বিকল্প পথ আছে?”

“থাকতে পারে। মিউটেশন এর কিছু প্রমাণ ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার-যে ফাউণ্ডেশন ইন্টেলিজেন্স এ কাজ করত-সগ্রহ করেছে। মিউল-বা মিউল নামে কোনো একজনের শৈশবের কিছু তথ্য থেকে সে নিজের উপসংহারে পৌঁছেছে। প্রিচার সেখানে গিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রমাণ সংগ্রহ করে। কিন্তু মিউল সেগুলো নিজের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য রোপণ করে রেখেছিল হয়তো, কারণ নিঃসন্দেহে মিউট্যান্ট-সুপারম্যান হিসেবে মিউলের পরিচিতি রয়েছে।”

“ইন্টারেস্টিং। কতদিন থেকে এই লাইনে চিন্তা করছেন?”

“না, বিশ্বাস করার মতো করে কখনো চিন্তা করিনি। এটা শুধুই একটা বিকল্প যা বিবেচনা করা উচিত। ধরুন, রাণু, মিউল যে যন্ত্র দিয়ে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন দমন করতে পারে সেটার মতোই যদি তার কাছে এমন কোনো রেডিয়েশন ফর্ম থাকে যা দিয়ে মেন্টাল এনার্জি দমন করা যায়, তখন কী হবে, এহ? এর থেকে কী ব্যাখ্যা পাওয়া যায় আমাদের উপর কিসের আক্রমণ হচ্ছে-এবং ফাউণ্ডেশন-এর উপর কিসের আক্রমণ হয়েছিল?”

“মিউলের ক্লাউন নিয়ে আপনি যে রিসার্চ করলেন, তার ফলাফল কী?”

এখানে এসে একটু দ্বিধায় পড়ল এবলিং মিস, “এখন পর্যন্ত তেমন কিছু পাইনি। ফাউণ্ডেশন-এর পতনের আগের দিন মেয়রকে অনেক কিছু বলেছিলাম, প্রধানত তার মনোবল অটুট রাখার জন্য কিছুটা নিজের মনোবল অটুট রাখার জন্যও। কিন্তু, রা, যদি আমি গণিতের পুরো সাহায্য নেই তা হলে এই ক্লাউনকে দিয়েই মিউলের সম্পূর্ণ এনালাইসিস করতে পারব। তখন তাকে ফাঁদে ফেলা যাবে। আর যে

অস্বাভাবিক সমস্যা আমাকে ভাবাচ্ছে সেটারও সমাধান পাওয়া যাবে।”

“কী রকম?”

“থিংক, ম্যান। ইচ্ছা শক্তি দিয়েই ফাউণ্ডেশন নেভিকে পরাজিত করে মিউল, অথচ তার চাইতে দুর্বল ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট ট্রেডারদের ফ্লিটকে সরাসরি যুদ্ধে পিছু হটাতে পারেনি। প্রথম ধাক্কাতেই ফাউণ্ডেশন-এর পতন ঘটে; ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট ট্রেডাররা তার পুরো শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। নেমনের বণিকদের নিউক্লিয়ার ওয়েপনস নিষ্ক্রিয় করার জন্য সে প্রথম একটা এক্সটিংগুইশিং ফিল্ড ব্যবহার করে। বিস্ময়ের কারণেই বণিকরা ওই যুদ্ধে হেরে যায়, কিন্তু ফিল্ডটাকে তারা প্রতিহত করতে পারে। ইণ্ডিপেণ্ডেন্টস দের বিরুদ্ধে মিউল আর এটাকে সফলভাবে ব্যবহার করতে পারেনি।

“কিন্তু ফাউণ্ডেশন ফোর্সের বিরুদ্ধে এটা কাজ করেছে। কেন? এখন পর্যন্ত কোনো কারণ বের করা যায়নি। কাজেই এমন কোনো ফ্যাক্টর আছে যা আমরা জানি না।”

“বিশ্বাসঘাতকতা?”

“অল্প বুদ্ধির লোকের মতো কথা; (ছাপার অযোগ্য) মুখামি। ফাউণ্ডেশন-এর এমন কেউ নেই যে বিজয় সম্বন্ধে নিশ্চিত ছিল না। তা হলে বেঈমানি করবে কেন?”

হেঁটে বাঁকানো জানালার সামনে দাঁড়াল রাণু, ফাঁকা দৃষ্টি মেলে দিল বাইরের অদৃশ্যমানতার দিকে। “আমরা এখন নিশ্চিতভাবেই হেরে যাচ্ছি। যদি মিউলের হাজার কয়েক দুর্বলতা থাকে, যদি সে হয় অনেক গুলো ফুটোর একটা নেটওয়ার্ক”

যেন তার পৃষ্ঠদেশ, অস্থিরভাবে পরস্পরকে আঁকড়ে ধরা হাত দুটো কথা বলছে। ‘টাইম ভল্ট থেকে আমরা খুব সহজে পালাতে পেরেছি, এবলিং। অন্যরাও হয়তো পালিয়েছে। অল্প কয়েক জন পেরেছে। বেশিরভাগই পারেনি। এক্সটিংগুইশিং ফিল্ড হয়তো ব্যর্থ করা হয় কোনোভাবে। যার জন্য ব্যয় করতে হয় অপরিসীম মেধা এবং শ্রম। ফাউণ্ডেশন নেভির অধিকাংশ শিপ পালিয়ে হেভেন বা কাছাকাছি গ্রহগুলোতে চলে যায় এবং লড়াই চালাতে থাকে। মাত্র এক পার্সেন্ট সেটা পারেনি, ফলে শত্রুর হাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

“ফাউণ্ডেশন আণ্ডারগ্রাউণ্ড-যার উপর মানুষের আশা ছিল অনেক বেশিঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ভূমিকাই পালন করেনি তারা। যথেষ্ট রাজনৈতিক বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে মিউল ধনী বণিকদের নিশ্চয়তা দেয় যে তাদের সম্পদ এবং ব্যবসা বাণিজ্য সে রক্ষা করবে, ফলে তারা যোগ দেয় মিউলের পক্ষে।”

“ধনিক গোষ্ঠী সবসময়ই আমাদের বিপক্ষে ছিল।” কাষ্ঠ গলায় বলল মিস।

“ক্ষমতাও সবসময়ই ওদের হাতে ছিল। শুনুন এবলিং। বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে মিউল বা তার কোনো প্রতিনিধি ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট ট্রেডারদের ক্ষমতাশালী লোকদের সাথে যোগাযোগ করেছে। আমার জানামতে সাতাশটা বণিক বিশ্বের দশটা মিউলের সাথে যোগাযোগ করেছে। আমার জানামতে সাতাশটা বণিক বিশ্বের দশটা মিউলের পক্ষে চলে গেছে। সম্ভবত আরো দশটা যাবো যাবো করছে। হেভেনে এমন অনেক লোক আছে যারা মিউলের শাসনেও সুখেই থাকবে। যদি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নিজের আধিপত্য বজায় রাখা যায় তা হলে বিপজ্জনক রাজনৈতিক ক্ষমতা ছেড়ে দিতে আগ্রহী হবে অনেকেই।”

“আপনার ধারণা হেভেন মিউলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবে না?”

“আমার ধারণা হেভেন সেই পথেই যাবে না।” দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখ নিয়ে সাইকোলজিস্টের দিকে ফিরল রাও। “আমার ধারণা হেভেন আত্মসমর্পণ করার জন্য অপেক্ষা করছে। সেইজন্যই আপনাকে ডেকেছি। আমি চাই আপনি হেভেন ত্যাগ করবেন।”

মিস এর মোটা চিবুক আরো মোটা দেখাল বিস্ময়ের কারণে, “এখনই!”

নিজেকে ভীষণরকম ক্লান্ত মনে হল রাঙ্গুর। “এবলিং, আপনি ফাউণ্ডেশন-এর সেরা সাইকোলজিস্ট। সত্যিকার মাস্টার সাইকোলজিস্টরা সেলডনের সাথেই হারিয়ে গেছেন। সেরা হিসেবে আপনাকেই আমরা পেয়েছি। মিউলকে হারাতে হলে আপনিই আমাদের একমাত্র ভরসা। এখানে বসে আপনি সেটা পারবেন না; যেতে হবে এম্পায়ার এর যে অবশিষ্ট অংশ এখনো টিকে আছে সেখানে।”

“ট্রানটরে?”

“ঠিক। এক সময়ে যা ছিল এম্পায়ার এখন তা নগ্ন কঙ্কাল, কিন্তু কেন্দ্রে এখনো কিছু না কিছু আছে। ওখানে প্রচুর রেকর্ড আছে, এবলিং। হয়তো আপনি আরো বেশি বেশি ম্যাথমেটিক্যাল সাইকোহিস্টোরি শিখতে পারবেন। সম্ভবত ক্লাউনের মাইণ্ড ব্যাখ্যা করার মতো যথেষ্ট। সেও অবশ্যই আপনার সাথে যাবে।”

শুকনো গলায় জবাব দিল মিস, “আমার সন্দেহ আছে। মিউলের ভয় বাদ দিলেও আপনার ভাস্তিকে ছাড়া সে যাবে না।”

“আমি জানি। সেজন্য টোরান এবং বেইটা আপনার সাথে যাবে। আর, এবলিং আরেকটা বড় উদ্দেশ্য আছে। তিন শ বছর আগে হ্যারি সেলডন দুটো ফাউণ্ডেশন তৈরি করেন; ওয়ান অ্যাট ইচ এণ্ড অব দ্য গ্যালাক্সি। ইউ মাস্ট ফাইণ্ড দ্যাট সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন।”

*

২০. ষড়যন্ত্রকারী

মেয়রের প্রাসাদ-

-একসময় যা ছিল মেয়রের প্রাসাদ, এখন কালি গোলা অন্ধকারে অস্পষ্ট অবয়বের মতো মনে হচ্ছে। কারফিউর জন্য পুরো শহর নীরব নিথর। ধোয়াটে দুধ সাদা সুবিশাল গ্যালাকটিক লেন্স, এখানে সেখানে দুই একটা নিঃসঙ্গ তারা বিপুল বিক্রমে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে ফাউণ্ডেশন-এর আকাশে।

মাত্র তিন শতাব্দীতে ফাউণ্ডেশন ক্ষুদ্র একদল বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত প্রজেক্ট থেকে ধীরে ধীরে পরিণত হয় বহুমুখী সুবিশাল এক বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যে, যার শাখাপ্রশাখা বাড়তে বাড়তে ছড়িয়ে পড়ে গ্যালাক্সির গভীর থেকে গভীরে। অর্ধবছর আগেই সেটা আবার পূর্বের মর্যাদা হারিয়ে পরিণত হয়েছে পরাজিত এক প্রাদেশিক রাজ্যে।

ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার এই কথা মানতে রাজি না।

শহরের অস্বাভাবিক নীরব রাত, অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রাসাদ এখন অনুপ্রবেশকারীর দখলে, উকটভাবে আসল সত্য প্রকাশ করছে, কিন্তু ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার প্রাসাদের প্রবেশ পথের ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে জিভের নিচে অতি ক্ষুদ্র একটা নিউক্লিয়ার বোমা নিয়েও এটা বুঝতে চাইছে না।

ছায়ার মতো একটা শরীর এগিয়ে আসছে-মাথা নিচু করল ক্যাপ্টেন।

অতিরিক্ত নিচু গলায় ফিসফিস শব্দ ভেসে এল, “অ্যালার্ম সিস্টেম আগের মতোই আছে, ক্যাপ্টেন। এগিয়ে যান। কোনো সমস্যা হবে না।”

মৃদু পায়ে নিচু আর্চওয়ের ভিতর দিয়ে দুপাশে সারি সারি ঝর্না বসানো পথ ধরে প্রিচার যেখানে এসে দাঁড়াল সেটা এক সময় ছিল ইণ্ডবারের বাগান।

চার মাস আগের টাইম ভল্টের সেই ঘটনা এখনো তার মনে দগদগে ঘায়ের মতন জ্বলজ্বল করছে। এক এক করে সেই ভয়ংকর অনুভূতি রাতের দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে আসে প্রতিদিন।

বুড়ো সেলডন তার বংশধরদের যে সুদিনের কথা শোনাচ্ছিলেন সেটা ছিল রক্ত হিমকরা ভুল-তালগোল পাকানো দ্বন্দ্ব-ইবার, অস্বাভাবিক জাঁকজমকপূর্ণ মেয়রাল পোশাক। তার অচেতন মুখ-দ্রুত বেড়ে উঠা ভয় বিহ্বল জনতার ভিড়, নিঃশব্দে অবধারিত আত্মসমর্পণের নির্দেশ শোনার অপেক্ষা, মিউলের ক্লাউনকে কাঁধে ফেলে টোরানের পালানোর দৃশ্য, সব দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে আসে বারবার।

নিজেও কিছুক্ষণ পরে পালাতে সক্ষম হয়, যদিও তার গাড়ি বিকল হয়ে পড়েছিল। নেতাহীন বিশৃঙ্খল জনতার দল পালাতে শুরু করে শহর ছেড়ে-গন্তব্য অজানা। তাদের সাথে মিশে যায় সে।

অন্ধের মতো সে খুঁজতে থাকে অগণিত র‍্যাট হোল যেগুলো ছিল-বা এক সময়ে ছিল ডেমোক্র্যাটিক আণ্ডারগ্রাউণ্ড সদর দপ্তর-আশি বছর চেষ্টা করেও যারা কিছু করতে পারেনি।

কিন্তু র‍্যাট হোলগুলো ছিল ফাঁকা শূন্য।

পরের দিন শত্রুর অচেনা কালো শিপগুলো আকাশে মাঝে মাঝে দেখা দিয়েই হারিয়ে যেতে লাগল নিকটবর্তী শহরের বহুতল কাঠামোর আড়ালে। ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার ডুবে যেতে লাগল সীমাহীন অসহায়ত্ব এবং হতাশার সাগরে।

দৃঢ় সংকল্পে পথ চলা শুরু করে সে।

ত্রিশ দিনে সে পাড়ি দেয় প্রায় দুশ মাইল পথ। পথের পাশে পড়ে থাকা হাইড্রোলিক কারখানার এক শ্রমিকের মৃতদেহ থেকে পোশাক খুলে নিজের সামরিক পোশাক পাল্টে নেয়, মুখে গজিয়ে উঠতে দেয় দাড়ি গোঁফের জঙ্গল।

এবং খুঁজে পায় আণ্ডারগ্রাউণ্ড-এর অবশিষ্ট।

শহরের নাম নিউটন। এক সময়ের অভিজাত জনপদ ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে আবর্জনার স্তূপে। দলের নিচু পদের একজন সদস্যের বাসস্থান, যার চোখগুলো ছোট ছোট, চওড়া হাড়, বিশাল দেহী, এমনকি পকেটের ভেতর থেকেও আঙুলের সবল গিটগুলো পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। প্রবেশ পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে।

“আমি এসেছি মিরান থেকে।” অস্ফুটে বলল ক্যাপ্টেন।

লোকটা জবাব দিল হাসিমুখে, “মিরান এই বছরের শুরুতেই শেষ হয়ে গেছে।”

ক্যাপ্টেন বলল, “না, গত বছরেরও আগে শেষ হয়েছে।”

কিন্তু লোকটা দরজা থেকে না সরেই জিজ্ঞেস করল, “কে আপনি?”

“আপনি ফক্স?”

“আপনি কী প্রশ্নের জবাব প্রশ্নের মাধ্যমে দেন?”

বুক ভরে শ্বাস নিল ক্যাপ্টেন, তারপর শান্ত সুরে বলল, “আমি হ্যান প্রিচার, ফ্লিটের একজন ক্যাপ্টেন এবং আণ্ডারগ্রাউণ্ড ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য। ভেতরে আসতে পারি?”

একপাশে সরে দাঁড়িয়ে ফক্স বলল, “আমার আসল নাম ওরাম পালি।” তারপর হাত বাড়াল হ্যাঁণ্ডশেকের জন্য।

ঘরের ভেতর আভিজাত্যের ছোঁয়া কিন্তু তা পরিমিত। এক কোণায় চমৎকার একটা বুক ফিল্ম প্রজেক্টর। ক্যাপ্টেনের সামরিক দৃষ্টিতে মনে হল ওখানে একটা শক্তিশালী ব্লাস্টার লুকানো থাকতে পারে। প্রজেক্টিং লেন্স প্রবেশ পথের পুরোটাই কভার করছে এবং হয়তো রিমোটের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

দাড়িঅলা অতিথির দৃষ্টি অনুসরণ করে কঠিনভাবে হাসল ফক্স। “হা! কিন্তু তা শুধু ইবার এবং তার রক্তচোষাদের জন্য। মিউলের বিরুদ্ধে এটা কোনো কাজই করবে না, করবে? কোনো অস্ত্রই মিউলের বিরুদ্ধে সাহায্য করবে না। আপনি ক্ষুধার্ত?”

মাথা নাড়ল ক্যাপ্টেন।

“এক মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।” ফক্স কাপবোর্ড থেকে ক্যান নামিয়ে দুটো রাখল ক্যাপ্টেন প্রিচারের সামনে। “এটার উপরে আঙুল রাখবেন তারপর যথেষ্ট গরম হলে ভেঙে ফেলবেন। আমার হিট কন্ট্রোল ইউনিট কাজ করছে না। মনে করিয়ে দেয় একটা যুদ্ধ চলছে-বা চলছিল, এহ?”

তার কথাবার্তা হাসিখুশি, কণ্ঠস্বর আমুদে এবং চোখদুটো শীতল চিন্তাযুক্ত। বসল ক্যাপ্টেনের বিপরীত দিকের সোফায়, যেখানে বসেছেন সেখানে একটা পোড়া দাগ ছাড়া কিছুই থাকবে না, যদি আপনার কোনো কিছু আমার পছন্দ না হয়। মনে রাখবেন।”

কিছু বলল না ক্যাপ্টেন। ক্যান খুলে খেতে শুরু করল।

“স্ট্যু। দুঃখিত, খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।”

“আমি জানি,” বলল ক্যাপ্টেন। খাওয়া শেষ করল দ্রুত।

“আপনাকে একবার দেখেছিলাম। কিন্তু দাড়ি গোঁফের কারণে চিনতে পারছিলাম না।”

“ত্রিশ দিন শেভ করা হয় নি,” তারপর রাগত সুরে, “আপনি কী চান? আমি সঠিক পাসওয়ার্ড বলেছি। আমার আইডেন্টিফিকেশন আছে।”

হাত নাড়ল ফক্স “ওহ্, আপনি প্রিচার এটা আমি মেনে নিচ্ছি। কিন্তু পাসওয়ার্ড অনেকেই জানে, এবং আইডেন্টিফিকেশন আর আইডেনটিটি এখন মিউলের পক্ষে। লিভোর নাম শুনেছেন?”

“হ্যাঁ।”

“সে মিউলের দলে যোগ দিয়েছে।”

“কী? সে-”

“হ্যাঁ। তাকে সবাই বলত, ‘নো সারেণ্ডার’।” হাসির ভঙ্গিতে ঠোঁট বাঁকালো ফক্স, রসকষহীন নিষ্প্রাণ হাসি। “তারপর উইলিগ। মিউলের দলে! গ্যারি আর নথ। মিউলের দলে! তা হলে প্রিচারও যাবে না কেন, শুনি? আমি কীভাবে জানব?”

কোনোমতে শুধু মাথা নাড়ল ক্যাপ্টেন।

“কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না,” মসৃণ গলায় বলল ফক্স। “ওরা অবশ্যই আমার নাম জানে যদি নর্থ দলবদল করে থাকে-কাজেই আপনি বৈধ হলেও আমার চাইতে অনেক বেশি বিপদে আছেন।”

“এখানে কোনো সংগঠন না থাকলে কোথায় পাবো? ফাউণ্ডেশন হয়তো আত্মসমর্পণ করেছে, কিন্তু আমি করিনি।”

“তাই! আপনি আজীবন পালিয়ে বেড়াতে পারবেন না, ক্যাপ্টেন। ফাউণ্ডেশন এর নাগরিকদের এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতে বর্তমানে অনুমতি নিতে হয়। আপনি জানেন? এবং আইডেন্টিটি কার্ড। আপনার তা আছে? এ ছাড়া পুরোনো নেভির সকল অফিসারকে নিকটস্থ সদর দপ্তরে রিপোর্ট করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আপনি করেছেন, এহ?”

“হ্যাঁ।” ক্যাপ্টেনের গলা কঠিন। “আপনার ধারণা আমি ভয়ে পালিয়ে এসেছি। মিউলের হাতে পতনের কিছুদিন পরেই আমি কালগানে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম যে প্রাক্তন ওয়ারলর্ডের একটা অফিসারেরও কোনো অস্তিত্ব নেই। কারণ তারাই যে-কোনো বিদ্রোহের সামরিক নেতৃত্ব দেয়। আন্ডারগ্রাউন্ড সবসময়ই মনে করত যে নেভির সামান্যতম অংশও যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তা হলে কোনো বিপ্লবই সফল হবে না। মিউল অবশ্যই কথাটা জানে।”

চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ল ফক্স, “যুক্তির কথা। মিউলের বুদ্ধি আছে।”

“যত দ্রুত সম্ভব ইউনিফর্ম ত্যাগ করি। দাড়ি গোঁফ গজাতে দেই। ধরে নিচ্ছি অনেকেই আমার মতো একই কৌশল বেছে নিয়েছে।”

“আপনি বিবাহিত?”

“স্ত্রী মারা গেছে, ছেলেমেয়ে নেই।”

“তা হলে আপনার পরিবারকে জিম্মি করা হতে পারে, এই ভয় থেকে মুক্ত আপনি?”

“হ্যাঁ।”

“আমি একটা উপদেশ দেই?”

“যদি দেওয়ার মতো কিছু থাকে।”

“মিউলের পলিসি বা কী উদ্দেশ্য আমি জানি না, কিন্তু দক্ষ শ্রমিকদের পারতপক্ষে কোনো ক্ষতি করা হচ্ছে না। বরং মজুরি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সব ধরনের নিউক্লিয়ার ওয়েপন্স এর উৎপাদন এখন আকাশ ছোঁয়া।”

“তাই? অর্থাৎ আক্রমণ চলতেই থাকবে।”

“জানি না। মিউল কোনো বেশ্যার পেটে জন্ম নেওয়া চতুর বদমাশ এবং সে হয়তো শ্রমিকদের শান্ত রাখতে চাইছে। যদি সেলডন সাইকোহিস্টোরির মাধ্যমে তার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করতে ব্যর্থ হন, আমি চেষ্টা করতে চাই না। কিন্তু আপনার পরনে শ্রমিকের পোশাক। বুঝতে পারলেন কিছু?”

“আমি দক্ষ শ্রমিক না।”

“নেভিতে নিউক্লিয়িকস্-এর উপর কোর্স করেছেন, তাই না?”

“অবশ্যই।”

“ওতেই চলবে। নিউক্লিয়ার-ফিল্ড বিয়ারিং করপোরেশন নামে একটা প্রতিষ্ঠান আছে এই শহরে। ওদেরকে গিয়ে বলবেন আপনি অভিজ্ঞ। যে হারামজাদাগুলো ইণ্ডবারের জন্য ফ্যাক্টরিটা চালাত এখনো তারাই চালায়-তবে মিউলের জন্য। দক্ষ শ্রমিক পেলে কোনো প্রশ্ন করবে না। ওরা আপনাকে আইডি কার্ডের ব্যবস্থা করে দেবে এবং আপনি করপরেশনের হাউজিং এস্টেটে বাসস্থানের আবেদন করতে পারবেন। আমার মনে হয় এখনই শুরু করে দেওয়া উচিত।”

এভাবেই ন্যাশনাল ফ্লিট-এর ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার পরিচয় বদলে পরিণত হয় নিউক্লিয়ার ফিল্ড বিয়ারিং করপোরেশনের ৪৫নং শাখার শিল্ড ম্যান লো মোয়রা। এবং ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট-এর সামাজিক মর্যাদা হ্রাস করে আবির্ভূত হয় একজন ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে-যে কারণে মাসখানেক পরে সে দাঁড়িয়ে আছে ইণ্ডবারের ব্যক্তিগত উদ্যানে।

বাগানে দাঁড়িয়ে হাতের র‍্যাডোমিটারের দিকে তাকাল ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার। ভিতরের ওয়ার্নিং সিস্টেম এখনো সচল, কাজেই অপেক্ষা করতে হবে। মুখের ভেতরের নিউক্লিয়ার বোমার মেয়াদ আর মাত্র আধাঘন্টা। জিভ দিয়ে বোমাটা নাড়তে লাগল সতর্কভাবে।

র‍্যাডোমিটারের আলো নিভে অশুভ কালো বর্ণ ধারণ করল এবং দ্রুত এগোতে শুরু করল ক্যাপ্টেন।

সে ভালোভাবেই জানে যে বোমার জীবন যতটুকু তার জীবনও ততটুকু; ওটার মৃত্যু মানে তার মৃত্যু এবং মিউলেরও মৃত্যু।

চার মাসের এক ব্যক্তিগত লড়াইয়ের চূড়ান্ত পরিণতি আসন্ন; যে-লড়াই এর মূল অংশ শুরু হয় নিউটন ফ্যাক্টরি থেকে।

দুই মাস ক্যাপ্টেন হ্যান কাটিয়েছে সীসাযুক্ত অ্যাপ্রন এবং ভারী ফেস শিল্ড পরে তার সামরিক পরিচয় লুকানোর জন্য। তখন সে একজন দিনমজুর, কাজ শেষে বেতন নেয়, সন্ধ্যা অতিবাহিত করে শহরে এবং রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে না কখনো।

দুই মাস ফক্সের সাথে একবারও দেখা হয়নি।

তারপর একদিন তার বেঞ্চের সামনে একটা লোক হোঁচট খায়। লোকটার পকেটে ছোট এক টুকরো কাগজ, তাতে লেখা “ফক্স” কাগজটা সে ফেলে দেয় নিউক্লিয়ার চেম্বারে, এনার্জি আউটপুট এক মিলিমাইক্রোভোল্ট বৃদ্ধি করে সেটা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তারপর ঘুরে চলে যায় নিজের কাজে।

ওই রাতটা সে অতিবাহিত করে ফক্সের বাড়িতে আরো দুজনের সাথে তাস খেলে। দুজনের একজনকে সে নামে চেনে, অন্যজনকে নাম এবং চেহারা দুভাবেই চেনে।

তাস খেলার সাথে সাথে তাদের আলোচনা চলছিল।

“ভুলটা শুরুতেই হয়েছে,” বলল ক্যাপ্টেন। “আমরা জঘন্য অতীত নিয়ে বাস করছি। আশি বছর আমাদের সংগঠন অপেক্ষা করেছে সঠিক ঐতিহাসিক মুহূর্তের জন্য। সেলডনের সাইকোহিস্টোরি আমরা অন্ধভাবে অনুসরণ করেছি, যার প্রথম অনুমিতিতে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তির কোনো গুরুত্ব নেই, একজন ব্যক্তি ইতিহাস তৈরি করে না এবং এই জটিল সামাজিক, অর্থনৈতিক উপাদান তাকে ভুল পথে পরিচালিত করে।” সাবধানে হাতের কার্ডগুলো সাজিয়ে সেগুলোর মূল্য পরখ করে নেয় সে, তারপর একটা টোকেন ফেলে বোর্ডে, “মিউলকে খুন করছি না কেন?”

“তাতে কী লাভটা হবে?” ঝগড়া বাধানোর সুরে বলে বাঁ পাশের জন।

“দেখলে,” দুটো কার্ড নামিয়ে রেখে ক্যাপ্টেন বলে, “সবার আচরণ একই রকম। কোয়াড্রিলিয়ন মানুষের মাঝে-একজন মানুষের মূল্য কি। একজন মানুষ মারা গেলে গ্যালাক্সির আবর্তন থেমে যাবে না। ন্তুি মিউল একজন মানুষ না, একটা মিউট্যান্ট। এরইমধ্যে সে সেলডন প্ল্যান নষ্ট করে ফেলেছে। একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে যে সে-একজন মানুষ-একটা মিউট্যান্ট-সেলডনের পুরো সাইকোহিস্টোরি এলোমেলো করে ফেলেছে একাই। যদি সে না থাকত ফাউণ্ডেশন কখনো পরাজিত হত না। সে বেঁচে না থাকলে, বেশিদিন এমন পরাজিত থাকবে না।

“আশি বছর ধরে ডেমোক্র্যাটরা মেয়র এবং বণিকদের সাথে লড়াই করেছে পরোক্ষভাবে। এবার গুপ্ত হত্যার চেষ্টা করে দেখা যাক।”

“কীভাবে?” শীতল যুক্তির সুরে আলোচনায় যোগ দেয় ফক্স।

ধীরে ধীরে ক্যাপ্টেন তার পরিকল্পনা বোঝাতে থাকে, “তিন মাস এটা নিয়ে ভেবে আমি কোনো সমাধান বের করতে পারিনি। কিন্তু এখানে আসার পাঁচ মিনিটের মধ্যে সমাধান বেরিয়ে আসে।” ডানদিকের লোকটার দিকে তাকায় সে। আপনি ইণ্ডবার-এর চেম্বার লেইন ছিলেন। জানতাম না যে আণ্ডারগ্রাউণ্ড-এর সাথে জড়িত।

“আপনাদের কথাও আমি জানতাম না।”

“যাই হোক, চেম্বারলেইন হিসেবে আপনি প্রাসাদের এলার্ম সিস্টেম চেক করতেন প্রায়ই।”

“করতাম।”

“আর মিউল এখন ঐ প্রাসাদে বাস করছে।”

“সেরকমই শোনা যায়-যদিও মিউল দখলদার হিসেবে বেশ ভদ্র। কোনো বক্তৃতা দেয়নি, যুদ্ধজয়ের কোনো ঘোষণা দেয়নি এমনকি মানুষের সামনেও আসে না।”

“পুরোনো গল্প বলে লাভ নেই। আপনাকে আমাদের দরকার।”

কার্ড শো করে ফক্স পুরো স্টেক নিজের দিকে টেনে নেয়। তারপর নতুন তাস বাটতে থাকে।

প্রাক্তন চেম্বারলেইন কার্ড তুলে বলে, “দুঃখিত ক্যাপ্টেন। এলার্ম সিস্টেম চেক করতাম ঠিকই, কিন্তু সেটা ছিল রুটিন। ভিতরের খবর কিছুই জানি না।”

“কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যথেষ্ট গভীরে ছেদ করতে পারলে আপনার মাইণ্ড থেকে এলার্ম কন্ট্রোলের স্মৃতি বের করে আনা যাবে সাইকিক প্রোবের সাহায্যে।”

চেম্বারলেইনের গোলাপি মুখ মুহূর্তেই ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করে। হাত শক্তভাবে চেপে ধরায় তাসগুলো দুমড়ে মুচড়ে যেতে থাকে, “সাইকিক প্রোব?”

“ভয়ের কিছু নেই। জিনিসটা কীভাবে ব্যবহার করতে হয় আমি জানি। কয়েকদিন অসুস্থতাবোধ ছাড়া আর কোনো ক্ষতি হবে না। আমাদের মাঝে এমন অনেকেই আছে, যারা এলার্ম কন্ট্রোলের বিস্তারিত বিবরণ পেলে ওয়েভলেংথ কম্বিনেশন তৈরি করে দিতে পারবে। আমাদের মাঝে অনেকেই আছে, যারা একটা ক্ষুদ্র টাইম বোমা বানিয়ে দিতে পারবে, আমি নিজে সেটা নিয়ে মিউলের কাছে যাব।”

লোকগুলো টেবিলের আরো কাছাকাছি ভিড় জমায়।

“একটা নির্দিষ্ট সন্ধ্যায় টার্মিনাস সিটিতে প্রাসাদের কাছাকাছি একটা দাঙ্গা শুরু করতে হবে। সত্যিকার দাঙ্গা না, সামান্য গোলমাল। চলতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত

প্রাসাদ রক্ষীদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়।”

সেদিন থেকে পরবর্তী এক মাস প্রস্তুতির কাজ এগিয়ে চলে, এবং ন্যাশনাল ফ্লিটের ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার এর আগে যে নিজেকে নামিয়ে এনেছে ষড়যন্ত্রকারীর পর্যায়ে, এবার সামাজিক মর্যাদা আরো ক্ষুণ্ণ করে পরিণত হয় গুপ্তঘাতকে।

ক্যাপ্টেন প্রিচার, গুপ্তঘাতক, প্রাসাদে দাঁড়িয়ে নিজের সাইকোহিস্টোরির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ব্যাপক এলার্ম সিস্টেমের অর্থ ভিতরে গার্ডের সংখ্যা কম। এই ক্ষেত্রে বোধ হয় একজনও নেই।

প্রাসাদের ভিতরে কামড়ার বিন্যাস তার মুখস্থ। নিঃশব্দে কালো একটা বিন্দুর মতো কার্পেট বিছানো র‍্যাম্প বেয়ে উপরে উঠে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল।

তার সামনে একটা শয়ন কক্ষের দরজা। মিউট্যান্ট নিশ্চয়ই ওই দরজার পিছনে আছে, যে অপরাজেয়কে করেছে পরাজিত। একটু আগেই এসে পড়েছে সে-বোমার মেয়াদ দশ মিনিট বাকি।

পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেল, এখনো পুরো বিশ্ব নীরব। মিউল বেঁচে থাকবে আর মাত্র পাঁচ মিনিট-ক্যাপ্টেন প্রিচারও তাই।

হঠাৎ অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই সামনে এগোল সে। বোমা বিস্ফোরিত হলে পুরো প্রাসাদ উড়ে যাবে-পুরো প্রসাদ। দশ গজ দূরে যে দরজা আছে সেটা কোনো বাধাই না। কিন্তু মিউলকে সে দেখতে চায়, যেহেতু দুজন একসাথেই মরবে।

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে সে পাগলা ষাঁড়ের মতো ছুটে গিয়ে বিদ্যুৎবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল দরজার উপর।

এবং দরজাটা খুলে গিয়ে উজ্জ্বল আলো তার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। টলমল পায়ে কিছুদূর ছুটে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল ক্যাপ্টেন। কামরার ঠিক মাঝখানে পায়াঅলা মাছ জিইয়ে রাখার একটা পাত্রের সামনে এক লোক, গম্ভীর। চোখ তুলে তাকাল স্বাভাবিক ভঙ্গিতে।

লোকটার পরনে গভীর কালো ইউনিফর্ম এবং অন্যমনস্কভাবে পাত্রে একটা টোকা দেওয়াতে বৃত্তাকার তরঙ্গ তৈরি হল ভিতরের পানিতে, পালকের মতো ডানা অলা এবং সিঁদুর বর্ণের মাছগুলো ছুটোছুটি শুরু করে দিল।

“আসুন, ক্যাপ্টেন!” লোকটা বলল।

ক্যাপ্টেনের সঞ্চরণশীল জিভের নিচে ধাতুর ক্ষুদ্র গোলকটা অশুভ গতিতে এগিয়ে চলেছে শেষ মুহূর্তের দিকে। জানে এখন আর থামানোর কোনো উপায় নেই, কারণ শেষ মিনিটও শেষ হতে চলেছে।

“আপনি বরং মুখের ওই ঘোড়ার ডিম বস্তুটা বের করুন। ওটা ফাটবে না।” বলল ইউনিফর্ম।

এক মিনিট পেরিয়ে গেল এবং হঠাৎ কিন্তু ধীর গতিতে ক্যাপ্টেন মাথা নিচু করে রুপোলি গোলকটা হাতের তালুতে ফেলল। প্রচণ্ড জোড়ে ছুঁড়ে দিল দেয়ালে, মৃদু একটা ধাতব শব্দ করে জিনিসটা গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে, পড়ে থাকল নির্দোষ ভালো মানুষের মতো। শ্রাগ করল ইউনিফর্ম। “যাই হোক, ওটা ফাটলেও কোনো লাভ হত না, ক্যাপ্টেন। আমি মিউল নই। আপনাকে তার ভাইসরয়ের সাথে দেখা করেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।”

“আপনি কীভাবে জানলেন?” হতাশ গলায় ফিসফিস করল ক্যাপ্টেন।

“দোষটা আপনি চাপাতে পারেন দক্ষ কাউন্টার এসপিওনাজ সিস্টেমের উপর। আপনাদের ছোট দলটার প্রত্যেকের নাম আমি জানি, প্রতিটা পদক্ষেপের উপর নজর ছিল-”

“আর তারপরেও এতদূর আসতে দিয়েছেন?”

“কেন নয়? আমার মূল উদ্দেশ্যই ছিল আপনাকে সহ আরো কয়েকজনকে ধরা। বিশেষ করে আপনাকে। কয়েক মাস আগেই ধরতে পারতাম, যখন নিউটন বিয়ারিংস-এ কাজ করতেন, কিন্তু এটা বরং আরো ভালো হয়েছে। পরিকল্পনার মূল কাঠামো যদি আপনি নিজে থেকে বলতে না পারতেন আমারই কোনো এজেন্ট এই ধরনেরই কিছু একটা আপনাকে সরবরাহ করত। ফলাফল বেশ নাটকীয় এবং অনেকখানি হাস্যকর।”

ক্যাপ্টেনের দৃষ্টি কঠিন। “আমার কাছেও সেরকমই মনে হয়েছে। তো, এখানেই সব শেষ?”

“মাত্র শুরু। বসুন, ক্যাপ্টেন। নায়ক হওয়ার সুযোগ আমরা নির্বোধদের জন্য ছেড়ে দেই। ক্যাপ্টেন, আপনি দক্ষ লোক। আমার প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ফাউণ্ডেশনে আপনিই সর্বপ্রথম মিউলের প্রকৃত ক্ষমতা বুঝতে পারেন। আপনি তাদেরই একজন যে তার ক্লাউনকে সরিয়ে আনে, ঘটনাক্রমে এই ক্লাউন এখনো ধরা পড়েনি। স্বাভাবিকভাবেই আপনার দক্ষতা চোখে পড়ে আমাদের এবং মিউল সেই ধরনের মানুষ যে তার শত্রুর দক্ষতাকে ভয় পায়না যেহেতু সে শত্রুকে কনভার্ট করে বন্ধু বানাতে পারে।”

“আপনারা সেটাই করতে চাইছেন? ওহ!”

“ওহ্ হ্যাঁ! এই উদ্দেশ্যেই আজকে রাতের প্রহসন। আপনি বুদ্ধিমান, যদিও মিউলের বিরুদ্ধে আপনার ষড়যন্ত্রটা হাস্যকরভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অবশ্য এটাকে ঠিক ষড়যন্ত্রের পর্যায়েও ফেলা যাবে না। অর্থহীন উদ্দেশ্যে শিপ ধ্বংস করা কী আপনার সামরিক প্রশিক্ষণের অংশ?”

“প্রথমেই একজনকে বুঝতে হবে কোনটা অর্থহীন।”

“বোঝা যাবে,” নরম সুরে নিশ্চয়তা দিল ভাইসরয়। “মিউল ফাউণ্ডেশন দখল করেছেন। এটাকেই ধীরে ধীরে আরো বৃহৎ উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ারে পরিণত করা হবে।”

“কোন বৃহৎ উদ্দেশ্য?”

“পুরো গ্যালাক্সি দখল। বিচ্ছিন্ন বিশ্বগুলোকে জোড়া দিয়ে নতুন এম্পায়ার গড়ে তোলার পরিকল্পনা। স্বপ্ন পূরণ, মোটা মাথার দেশপ্রেমিক, আপনাদের সেলডন সেটা পূরণের জন্য যে সাত শ বছর বেঁধে দিয়েছেন, তার অনেক আগেই। এবং এই স্বপ্ন পুরণে আপনি আমাদের সাহায্য করতে পারেন।”

“নিঃসন্দেহে পারি। এবং নিঃসন্দেহে করব না।”

“বুঝতে পেরেছি,” যুক্তি দেখাল ভাইসরয়, “মাত্র তিনটা স্বাধীন বণিক বিশ্ব এখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আর বেশিদিন টিকতে পারবে না। আর ফাউণ্ডেশন-এর শেষ ভরসা এখন এটাই। তারপরেও আপনি নিজের জেদ বজায় রাখবেন?”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু পারবেন না। স্বেচ্ছায় মত পাল্টালে ভালো। অন্যভাবে হলেও অসুবিধা নেই। দুর্ভাগ্যক্রমে, মিউল এখানে নেই। অবশিষ্ট বণিকদের সাথে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে সর্বদা যোগাযোগ রেখেছেন আমাদের সাথে। আপনাকে বেশিক্ষণ

অপেক্ষা করতে হবে না। “কিসের জন্য?”

“আপনার কনভার্সনের জন্য।”

“মিউলের জন্য,” শীতল গলায় বলল ক্যাপ্টেন, “কঠিন হবে কাজটা।”

“হবে না। আমার বেলায় হয়নি। আমাকে চিনতে পারেননি আপনি? আপনি কালগানে গিয়েছিলেন, কাজেই অবশ্যই আমাকে দেখেছেন। আমার চোখে ছিল মনোকল,* ফারের তৈরি নকশা খচিত রোব, উঁচু চূড়াঅলা মুকুট-”।

বিতৃষ্ণায় পুরো শরীর শক্ত হয়ে গেল ক্যাপ্টেনের। “কালগানের ওয়ারলর্ড।”

“হ্যাঁ, এখন আমি মিউলের অনুগত ভাইসরয়। দেখলেন তো, মিউল কেমন পারসুয়েসিভ।”

———-

[*একচোখের জন্য চশমা বিশেষ, যা চোখের চারপাশের মাংসপেশিকে যথাস্থানে রাখে।]

*

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *