২. ক্ষুদ্র মহাকাশযান দুটো

৬. দ্য ফেভারিট

ক্ষুদ্র মহাকাশযান দুটো গভীর শূন্য থেকে আবির্ভূত হয়ে অকস্মাৎ রণতরীবহরের মাঝ দিয়ে ছুটে চলল তীব্র গতিতে। এনার্জির সামান্য সূরণ ছাড়াই সেগুলো একে বেঁকে ছুটে চলল যুদ্ধযান বেস্টিত অঞ্চলের মাঝ দিয়ে তারপর বিস্ফোরিত হল, আর ইম্পেরিয়াল ওয়াগনগুলো সেদিকে ঘুরল ভারবাহী পশুর মতো। ছোট যানগুলো যেখানে এটমিক ডিজইন্টিগ্রেশনে পরিণত হয়েছে সেখানে ক্ষণিকের জন্য দেখা গেলো নিঃশব্দ আলোর ঝলক, তারপর সব আগের মতো।

বিরাটাকৃতির যুদ্ধযানগুলো অনুসন্ধান করল কিছুক্ষণ, তারপর ফিরে গেল তাদের মূল কাজে এবং গ্রহের পর গ্রহ ঘিরে সুবিশাল অবরোধের জাল তৈরির কাজ এগিয়ে চলল সুচারুরূপে।

ব্রুডরিগের পরনে রাজকীয় ইউনিফর্ম; নিখুঁত সেলাই এবং নিখুঁতভাবে পরিধান করা। সাময়িক ইম্পেরিয়াল হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়েছে যেখানে সেই ওয়ানডা গ্রহের বাগানে অলস পায়ে হাঁটছে সে; চেহারায় গাম্ভীর্য।

বেল রিয়োজ হাটছেন পাশাপাশি। তার ফিল্ড ইউনিফর্ম এর কলার এর কাছে বোতাম খোলা, ধূসর কালো রংটা যেন শোকবার্তা বহন করছে।

সুগন্ধি উদ্ভিদের পাতায় ছাওয়া একটা কালো মসৃণ বেঞ্চ দেখালেন রিয়োজ। “ওটা দেখেছেন, স্যার? ইম্পেরিয়াম-এর একটা প্রাচীন নিদর্শন। সুসজ্জিত বেঞ্চ, প্রেমিক প্রেমিকার জন্য তৈরি করা হত, টেকসই, মজবুত, এখনো ব্যবহারযোগ্য, অথচ রাজপ্রাসাদ, কারখানাগুলো কত আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে।”

তিনি বসলেন কিন্তু দ্বিতীয় ক্লীয়ন এর প্রিভি সেক্রেটারি দাঁড়িয়ে থাকল কাঠের পুতুলের মতো। হাতের লাঠি দিয়ে কিছু পাতা সরাল সে।

পায়ের উপর পা তুলে বসলেন রিয়োজ। সিগারেট বের করে নিজে একটা নিলেন অতিথিকে একটা দিলেন। “একমাত্র হিজ ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টির কাছ থেকেই এরকম বিচক্ষণতা আশা করা যায় যে তিনি আপনার মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে পাঠিয়েছেন। এর থেকেই প্রমাণ হয় যে আমি ছোট একটা সামরিক অভিযান শুরু করে আরো অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সমস্যা তৈরি করিনি। নিশ্চিন্ত বোধ করছি।

“সম্রাট সবকিছুর উপর সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন, যান্ত্রিক সুরে বলল ব্রুডরিগ। “এই অভিযানকে আমরা খাটো করে দেখিনি; তারপরেও মনে হয় যেন বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই শত্রুদের ছোট ছোট যুদ্ধযানগুলো তেমন কোনো বাধা দিতে পারবে না যা ঠেকানোর জন্য একটা জটিল অবরোধ তৈরি করতে হবে।”

রাগ হল রিয়োজের, কিন্তু নিজেকে সামলালেন তিনি, “আমার সৈনিকদের জীবনের উপর ঝুঁকি নিতে পারি না যারা সংখ্যায় কম বা দ্রুত আক্রমণ করে কোনো যুদ্ধযান খোয়ানোর ঝুঁকি নিতে পারি না, কারণ তার বদলে নতুন যুদ্ধযান আমি পাবনা। এই অবরোধ আসল আক্রমণের সময় আমার অর্ধেক কাজ কমিয়ে দেবে। সামরিক গুরুত্ব আমি গতকালকেই ব্যাখ্যা করে বলেছি।”

“বেশ, বেশ, আমি সামরিক লোক নই। সে ক্ষেত্রে আপনি নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হচ্ছে সঠিক, বাস্তবক্ষেত্রেও সেটা ভুল নয়। অথচ আপনার সতর্কতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। দ্বিতীয়বার যোগাযোগের সময় আপনি রি ইনফোর্সমেন্ট চেয়েছেন। চেয়েছেন দুর্বল, অনগ্রসর শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য, যাদের ব্যাপারে সেই সময়ে আপনি বিন্দুবিসর্গও জানতেন না। এই পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত ফোর্স চাওয়া অদক্ষতা বা আরো খারাপ কিছুর আভাস দেয়, কর্মজীবনের পূর্ববর্তী ঘটনা থেকে কি আপনি আপনার ধৃষ্টতা এবং অতি কল্পনার প্রমাণ পাননি?”

“ধন্যবাদ,” ঠাণ্ডা সুরে বললেন জেনারেল। কিন্তু আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই ধৃষ্টতা এবং ‘অন্ধত্ব দুটোর মাঝে অনেক পার্থক্য। নিশ্চিত হয়ে জুয়া খেলা যাবে তখনই যখন শত্রুপক্ষের সম্বন্ধে আপনার স্পষ্ট ধারণা থাকবে, অন্তত ঝুঁকির পরিমাণ হিসাব করে নিতে পারবেন; কিন্তু সম্পূর্ণ অচেনা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাওয়াটাই ধৃষ্টতা। আপনি বরং প্রশ্ন করতে পারেন একটা লোক সারাদিনের ঝুট ঝামেলা নিরাপদে শেষ করে কেন রাতে ঘুমাতে যায়?”

হাত নেড়ে কথাগুলো উড়িয়ে দিল ব্রুডরিগ। “নাটকীয়, কিন্তু সন্তোষজনক নয়। আপনি নিজে এই অনগ্রসর প্রদেশগুলোয় আছেন অনেকদিন। তা ছাড়া শত্রুদের একজনকে আপনি বন্দি করেছেন, একজন বণিক। কাজেই অজানা কিছু তো থাকার কথা নয়।”

“না? বিনীতভাবে বলছি, একটু বোঝার চেষ্টা করুন। যে গ্রহ দুই শতাব্দী বিচ্ছিন্নভাবে অগ্রসর হয়েছে, মাত্র একমাস পর্যবেক্ষণ করে সেখানে আক্রমণ করা ঠিক বুদ্ধিমানের কাজ না। আমি সাবইথারিক ট্রাইমেনশনাল থ্রিলারের সুদর্শন, সুঠামদেহী নায়ক নই। একজন বন্দি এবং এমন একটা গ্রহের বাসিন্দা যে গ্রহের সাথে শত্রু পক্ষের কোনো প্রত্যক্ষ্য যোগাযোগ পাওয়া যায়নি, তারা দুজনে শত্রুপক্ষের ভেতরের সব গোপন খবর আমাকে দিতে পারবে না।”

“আপনি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন?”

“অবশ্যই।”

“তো?”

“খুব বেশি লাভ হয়নি। ওর মহাকাশযান অনেক ছোট, গোণার মধ্যেই পড়ে না, যে সব জিনিস বিক্রি করে সেগুলোকে খেলনা বলাই ভালো। কয়েকটা জিনিস আমি সম্রাটের কাছে পাঠাবো বলে আলাদা করে রেখেছি। সমস্যা হচ্ছে মহাকাশযান নিয়ে। ওটা কীভাবে চলে আমি বুঝতে পারছি না, আমি তো আর টেক-ম্যান নই।”

“কিন্তু আপনার কাছে সে ধরনের লোক আছে,” স্মরণ করিয়ে দিল ব্রুডরিগ।

“আমিও সে বিষয়ে সচেতন,” কিছুটা তিক্ত স্বরে জবাব দিলেন জেনারেল। “কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বোকাগুলোর অনেক সময় লাগবে। ওই মহাকাশযানের অদ্ভুত নিউক্লিয়ার ফিল্ড সার্কিট বুঝতে পারে এমন বিশেষজ্ঞের খোঁজে সংবাদ পাঠিয়েছি। কোনো উত্তর পাইনি।”

“এ ধরনের লোক সহজে হাতছাড়া করা যায় না, জেনারেল। আপনার নিয়ন্ত্রণাধীন এই বিশাল প্রদেশে নিশ্চয়ই এমন একজনকে পাওয়া যাবে যে নিউক্লিয়িক বুঝে।”

“সেরকম লোক থাকলে তো কবেই তাকে দিয়ে আমার দুটো ছোট ফ্লিটের মোটর ঠিক করিয়ে নিতে পারতাম। দুটো যুদ্ধযান পর্যাপ্ত পাওয়ার সাপ্লাইয়ের অভাবে বড় কোনো লড়াইয়ে অংশ নিতে পারবে না। আমার ফোর্সের এক পঞ্চমাংশ ফ্রন্ট লাইনের পিছনে থেকে অতি সাধারণ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।”

অস্থিরভাবে হাত নাড়ল সেক্রেটারি। “সমস্যাটা শুধু আপনার একার না, জেনারেল। সম্রাট নিজেও একই সমস্যায় ভুগছেন।”

জেনারেল হাতের দোমড়ানো না ধরানো সিগারেটটা ফেলে দিয়ে নতুন আরেকটা বের করে ধরালেন। একজন প্রথম শ্রেণীর টেক মেন না থাকাটা এই মুহূর্তে কোননা সমস্যা না। শুধু যদি আমার সাইকিক পোবটা ঠিক থাকত তা হলে বন্দির কাছ থেকে আরো অনেক কথা বের করে আনা যেত।”

সেক্রেটারির একটা ভুরু উঁচু হল, “আপনার কাছে পোব আছে?”

“পুরোনো একটা। একেবারে জরাজীর্ণ, ঠিক প্রয়োজনের সময়ই কাজ করে না। বন্দি যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন এটা ব্যবহার করে কোনো লাভ হয়নি। আমার নিজের একজন সৈনিকের উপর প্রয়োগ করে ভালো ফলাফল পেয়েছি। কিন্তু টেক-ম্যানরা কেউই বলতে পারছেনা এটা বন্দির উপর কাজ করছে না কেন। ডুসেম বার কোনো মেকানিক না, একজন তাত্ত্বিক, তার মতে যেহেতু বন্দি একটা ভিন্ন পরিবেশ এবং নিউরাল স্টিমুলির ভেতর বেড়ে উঠেছে, তাই প্রোব কাজ করছে না। তবে ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে ভেবেই তাকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছি।”

লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়াল ফ্রডরিগ। “আমি দেখব রাজধানীতে কোনো বিশেষজ্ঞ পাওয়া যায় কিনা। অন্য লোকটা, স্যিউয়েনিয়ানের কথা কিছু বলুন। অনেক শক্রকে আপনি নিজের কাছে থাকতে দিচ্ছেন।”

“শত্রুপক্ষকে সে চেনে। তাকেও ভবিষ্যতের জন্য হাতের কাছে রেখেছি।”

“কিন্তু সে সিউয়েনিয়ান এবং ভয়ংকর এক বিদ্রোহীর সন্তান।” ‘সে বৃদ্ধ এবং ক্ষমতাহীন। এ ছাড়া তার পরিবারকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে।”

“আচ্ছা। তথাপি এই বণিকের সাথে আমার নিজের কথা বলা উচিত।”

“অবশ্যই।”

“একা,” ঠাণ্ডা সুরে বলল সেক্রেটারি।

“অবশ্যই,” নরম সুরে বললেন জেনারেল। “সম্রাটের অনুগত হিসেবে তার ব্যক্তিগত প্রতিনিধিকে আমি আমার ঊর্ধ্বতন হিসেবে বিবেচনা করি। যাই হোক,বন্দিকে যেহেতু পার্মানেন্ট বেস এ রাখা হয়েছে সেহেতু একটা ইন্টারেস্টিং মুহূর্তে ফ্রন্ট এড়িয়া ত্যাগ করতে হবে আপনাকে।”

“তাই? ইন্টারেস্টিং কেন?”

“ইন্টারেস্টিং কারণ অবরোধ তৈরির কাজ শেষ হবে আজকে। ইন্টারেস্টিং কারণ ঠিক এক সপ্তাহের ভেতর টুয়েন্টিথ ফ্লিট অব দ্য বর্ডার শত্রুপক্ষের কেন্দ্রস্থলের দিকে অগ্রসর হবে।” মুচকি হেসে চলে গেলেন রিয়োজ।

হালকা অপমানিত বোধ করল ব্রুডরিগ।

*

৭. ঘুষ

সার্জেন্ট মোরি লিউক একজন আদর্শ সৈনিক। সে এসেছে বিশাল কৃষিপ্রধান গ্রহ প্লেইডাস থেকে, যেখানে একমাত্র সামরিক জীবনই কেবল পারে মাটির সাথে বন্ধন ছিন্ন করতে। সেও তার ব্যতিক্রম নয়। দ্বিধাহীন চিত্তে বিপদের মুখোমুখি হতে পারে। নির্দেশ পালন করে বিনা প্রশ্নে, অধীনস্থদের খাঁটিয়ে মারে নির্দয়ের মতো, আর নিজের জেনারেলকে মনে করে সাক্ষাৎ ঈশ্বর।

তার পরেও সে বেশ হাসিখুশি মানুষ। দায়িত্ব পালনের সময় নির্দ্বিধায় মানুষ খুন করলেও তার ভেতর কোনো রকম হিংসা বিদ্বেষ কাজ করেনা।

সেই সার্জেন্ট লিউক যে ভেতরে ঢোকার আগে দরজায় শব্দ করবে সেটাই স্বাভাবিক, যদিও কোনো রকম সাড়াশব্দ না করেই সে ঢুকতে পারে।

ভিতরের দুজন খাওয়া থেকে মুখ তুলে তাকাল। একজন উঠে গিয়ে পকেট ট্রান্সমিটারের আওয়াজ বন্ধ করে দিল।

“আরো বই”? জিজ্ঞেস করল লাথান ডেভর্স।

এক হাতে পেঁচানো সিলিন্ডার আকৃতির ফিল্ম বাড়িয়ে ধরে আরেক হাতে ঘাড় চুলকালো সার্জেন্ট। “এটা ইঞ্জিনিয়ার অরির, তাকে আবার ফিরিয়ে দিতে হবে। এটা সে তার বাচ্চাদের কাছে পাঠাতে চায়, বুঝতে পারছেন, ঐ যে আপনারা যাকে বলেন স্যুভেনির; বুঝতে পারছেন।”

সিলিণ্ডারটা হাতে নিয়ে কৌতূহলের সাথে ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে দেখলেন ডুসেম বার। “এটা তিনি কোথায় পেয়েছেন? তার কাছে তো ট্রান্সমিটার নেই, আছে?”

জোরে জোরে মাথা নাড়ল সার্জেন্ট। বিছানার পায়ের কাছে রাখা ভাঙাচোড়া যন্ত্রটা দেখিয়ে বলল, “এখানে ওই একটাই আছে। অরি এই বইটা এনেছে আমরা যে বর্বর গ্রহগুলো দখল করেছি তার একটা থেকে। গ্রহের অধিবাসীরা বইটা রেখেছিল একটা বড় ভবনের ভেতর। তাদের কাছ থেকে এটা কেড়ে নেয়ার সময় কয়েকজনকে খুন করতে হয়।”

প্রশংসার দৃষ্টিতে জিনিসটা কিছুক্ষণ নিরূপণ করল সে। “চমৎকার স্যুভেনির বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্য।”

তারপর কিছুটা কৌতুকের সুরে বলল, “ভালো কথা, একটা খবর শোনা যাচ্ছে। জেনারেল আবার কাজটা করেছেন।” বলেই গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল সে।

“তাই?” বলল ডেভর্স। “কী করেছেন তিনি?”

“অবরোধের কাজ শেষ করেছেন।” হালকা গর্বের সাথে বলল সার্জেন্ট। “তিনি আশ্চর্য দক্ষ লোক, তাই না? আমাদের একজন তো বলেছে যে কাজটা তিনি এমনভাবে করেছেন যেন অনবদ্য সঙ্গীত রচনা করেছেন।”

“আসল লড়াই শুরু হতে যাচ্ছে?” হালকা চালে জিজ্ঞেস করলেন বার।

“আশা করি,” সার্জেন্টের উল্লসিত জবাব। “আমাকে নিজের জাহাজে ফিরতে হবে। এখানে বসে থেকে আমি ক্লান্ত।”

“আমিও।” হঠাৎ রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলল ডেভর্স।

চোখে সন্দেহ নিয়ে তার দিকে তাকাল সার্জেন্ট। “এবার যেতে হবে। যে কোনো মুহূর্তে রাউণ্ডে আসবে ক্যাপ্টেন। আমি যে এসেছি সেটা তাকে জানাতে চাই না।”

দরজার কাছে আবার একটু থামল। “ভালো কথা, স্যার,” মুখে লাজুক ভাব নিয়ে বলল সে, “আমার স্ত্রীর কাছ থেকে খবর পেয়েছি। আপনি যে ছোট ফ্রিজিয়ার পাঠিয়েছেন খুব চমৎকার কাজ করছে সেটা। কোনো ঝামেলা হচ্ছে না। এখন সে পুরো একমাসের সাপ্লাই মজুদ করে রাখতে পারছে।”

“ঠিক আছে, ওটা কোনো ব্যাপার না।” গাল ভরা হাসি নিয়ে বেরিয়ে গেল সার্জেন্ট।

চেয়ার ছেড়ে উঠলেন ডুসেম বার। “বেশ, ফ্রিজিয়ারের বদলে ভালোই প্রতিদান দিয়েছে। নতুন বইটা একটু দেখা যাক। ওহহো, নাম পড়া যাচ্ছে না।”

প্রায় একগজের মতো ফিল্ম বের করে আলোর সামনে মেলে ধরলেন তিনি। “ডেভর্স, এটা হল ‘দ্য গার্ডেন অব সুম্মা’।”

“তাই?” নিরুৎসুক গলায় জবাব দিল বণিক। খাবারের উচ্ছিষ্ট সরিয়ে রাখল একপাশে। “বসুন বার। প্রাচীন সাহিত্য শুনে কোনো লাভ হবে না। সার্জেন্ট কি বলেছে আপনি শুনেছেন?”

“হ্যাঁ, শুনেছি। কী হয়েছে তাতে?”

“যে-কোনো মুহূর্তে আক্রমণ শুরু হবে। আর আমরা এখানে বসে আছি!”

“তো, তুমি কোথায় বসতে চাও?”

“আমি কি বলতে চাই আপনি সেটা ভালোভাবেই জানেন। এখানে অপেক্ষা করার কোনো মানে নেই।”

“নেই?” বার সাবধানে ট্রান্সমিটার থেকে পুরোনো ফিল্ম বের করে নতুন ফিল্ম ভরছেন। “এক মাসে ফাউণ্ডেশন ইতিহাসের অনেক কিছুই জেনেছি। তাতে আমার মনে হয়েছে অতীতে ক্রাইসিসের সময় তোমাদের নেতারা বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করত না।”

“আহ্, বার, ঘটনা কোন দিকে মোড় নেবে সেটা তারা জানতেন।”

“আসলেই? আমার তো মনে হয় সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর তারা এই কথা বলতেন। জানতেন হয়তো। আবার না জানলেও যে পরিস্থিতি অন্যরকম হত তার কোনো প্রমাণ নেই। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক শক্তি কখনো একজন মানুষের উপর নির্ভর করে না।”

নাক দিয়ে বিশ্রী শব্দ করল ডেভর্স।”পরিস্থিতি আরো খারাপ হতো সেটাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। আপনি আসলে ঘটনার লেজ থেকে মাথার দিকে আসার চেষ্টা করছেন। ধরুন লোকটাকে আমি ব্লাস্টার দিয়ে মেরে ফেললাম।”

“কাকে? রিয়োজকে?”

“হ্যাঁ।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বার। দৃষ্টি হারিয়ে গেছে অতীতে, স্মৃতি রোমন্থন করছেন। “গুপ্ত হত্যা করে সমস্যার সমাধান হবে না, ডেভর্স। আমি একবার চেষ্টা করেছিলাম, বাধ্য হয়ে। তখন বিশ বছর বয়সের তরুণ-কোনো লাভ হয়নি। সিউয়েনার দৃশ্যপট থেকে একটা খলনায়ককে সরাতে পেরেছিলাম শুধু, কিন্তু ইম্পেরিয়াল শাসনের জোয়াল সরাতে পারিনি। খলনায়ককে বাদ দিয়ে ইম্পেরিয়াল শাসনের জোয়াল নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে।”

“কিন্তু রিয়োজকে শুধু খলনায়কের পর্যায়ে ফেললে চলবে না। তার সাথে বিশাল একটা আর্মি আছে। তাকে ছাড়া আর্মি কিছুই করতে পারবে না। সৈনিকেরা শিশুর মতো তার উপর ভরসা করে। সার্জেন্ট যতবারই তার নাম বলেছে ততবারই মুখ দিয়ে লালা বের করে ফেলেছে।”

“তারপরেও। আমি আরো আছে, আছে আরো অনেক লিডার। তোমাকে অনেক গভীরে ঢুকতে হবে। যেমন ব্রুডরিগ-ম্রাট অন্য যে কারো চেয়ে তার কথার গুরুত্ব দেন সবচেয়ে বেশি। রিয়োজ যেখানে দশটা যুদ্ধযান নিয়ে এসেছে, সেখানে সে একশটা যুদ্ধযান নিয়ে আসতে পারবে।”

“তাই? লোকটার কথা কিছু বলুন শুনি।” বণিকের হতাশ দৃষ্টি এখন কৌতূহলে চিচি করছে।

“ব্রুডরিগ একটা নিচু জাতের হারামজাদা। তোষামুদি করে সম্রাটের সন্তুষ্টি অর্জন করেছে। দরবারের কেউই তাকে পছন্দ করে না, নগণ্য কীটের মতো ঘৃণা করে; কারণ তার জন্মের ঠিক নেই। সে হল ম্রাটের সকল কাজের পরামর্শদাতা এবং সম্রাটের সকল ঘৃণ্য কাজগুলো সেই করে দেয়। তাকে ডিঙিয়ে কেউ সম্রাটের সুনজরে পড়তে পারে না।”

“ওয়াও!” চিন্তিতভাবে ডেভর্স তার আচড়ানো দাড়ি টানতে লাগল। “আর রিয়োজের উপর নজর রাখার জন্য সম্রাট তাকে এখানে পাঠিয়েছেন। আপনি জানেন, আমার একটা পরিকল্পনা আছে?”

“এখন জানলাম।”

“ধরা যাক ব্রুডরিগ এই তরুণ জেনারেলকে অপছন্দ করা শুরু করল।”

“অপছন্দ করবেই। ব্রুডরিগ কাউকে পছন্দ করে এরকম কখনো শোনা যায়নি।”

“ধরুণ পরিস্থিতি আরো খারাপ হলো, সেটা সম্রাটের কানে যাবে। তখন মহাসংকটে পড়বে রিয়োজ।”

“স্বাভাবিক। কিন্তু তুমি সেটা কিভাবে সম্ভব করবে?”

“জানি না। ঘুষ দিয়ে দেখা যায়।”

প্যাট্রিশিয়ান মধুর ভঙ্গিতে হাসলেন।”দেওয়া যায়, তবে সার্জেন্টকে যেরকম ঘুষ দিয়েছ সেরকম হলে চলবে না। আবার তার দাবি পূরণ করতে পারলেও কোনো লাভ হবে না। সত্যি কথা বলতে কি ব্রুডরিগের ভেতর সামান্যতম সততাও নেই। ঘুষ নিয়েও কাজ করবে না। অন্য কিছু ভাবতে হবে।”

এক হাঁটুর উপর অন্য পা তুলে জোরে জোরে গোড়ালি নাচাতে লাগল ডেভর্স। “এটা একটা ধারণা, যদিও-”

ব্রেক কষতে বাধ্য হল সে, কারণ দরজার সংকেত বাতি জ্বলছে। আগের সেই সার্জেন্টকে আবার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। অতিরিক্ত উত্তেজনায় লাল হয়ে আছে চেহারা।

“স্যার,” একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবে শুরু করল সে, “ফ্রীজার-এর জন্য আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ, কিন্তু আমি কৃষকের সন্তান, আপনারা গ্রেট লর্ডস।”

তার প্লেইডাস বাচনভঙ্গি বোঝা যাচ্ছে না কিছুই; আর উত্তেজনার কারণে এতদিনের সযত্নে গড়ে তোলা সৈনিক সুলভ আচরণ সড়ে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল গ্রাম্য আচরণ।

“কী ব্যাপার, সার্জেন্ট?” আশ্বস্ত করার সুরে বার বললেন।

“লর্ড ব্রুডরিগ দেখতে আসছেন আপনাদের। আগামী কাল! আমি জেনেছি, কারণ ক্যাপ্টেন নির্দেশ দিয়েছেন আমি যেন সৈনিকদের পোশাকের দিকে লক্ষ্য রাখি, তাকে…তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। আমার মনে হয়েছে আপনাদের সতর্ক করে দেওয়া উচিত।”

“ধন্যবাদ, সার্জেন্ট।” বললেন বার, “আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু তার কোনো প্রয়োজন ছিলনা–”

কিন্তু সার্জেন্টের চেহারায় স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ। ফিসফিস করে বলল, “তার সম্বন্ধে সবাই যে গল্পগুলো বলে সেটা আপনারা জানেন না। নিজেকে সে স্পেস ফিয়েণ্ডের* (*ফিয়েণ্ড-শয়তান) কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। আরো অনেক ভয়ংকর গল্প শোনা যায়। লোকে বলে তার সাথে সবসময় ব্লাস্ট গান সহ দেহরক্ষী থাকে। বিনোদনের প্রয়োজন হলেই সামনে যাকে পায় তাকে খুন করার নির্দেশ দেয়-মানুষের মৃত্যু দেখে সে আনন্দ পায়। এমনকি সম্রাটও নাকি তাকে ভয় পান। তার কারণেই সম্রাট কর বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়েছেন।

“আর জেনারেলকে সে অপছন্দ করে, খুন করতে চায়। কারণ আমাদের জেনারেল তারচেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান। তিনি অবশ্য জানেন ফ্রডরিগ একটা বদমাশ।”

চোখ পিটপিট করল সার্জেন্ট; বেশি কথা বলে এখন লজ্জা পাচ্ছে। জোরে জোরে মাথা নেড়ে পিছিয়ে গেল দরজার দিকে। “আমার কথা শুনে কিছু মনে করবেন না। সতর্ক থাকবেন।”

বেরিয়ে গেল সে।

ডেভর্সের দৃষ্টি কঠিন। “আমাদের পছন্দ মতো ঘটনা ঘটছে, তাই না, ডক?”

“নির্ভর করছে,” শুকনো গলায় বললেন বার, ব্রুডরিগের উপর, তাই না?”

কিন্তু ডেভর্স কিছুই শুনছে না, চিন্তা করছে, গম্ভীরভাবে।

.

টেডিং শিপের অপ্রশস্ত লিভিং কোয়ার্টারে ঢুকে প্রথমে চারপাশে ভালো করে দেখল লর্ড ব্রুডরিগ। সশস্ত্র রক্ষীরা দ্রুত তাকে অনুসরণ করল অস্ত্র হাতে, আচরণেই বোঝা যায় এরা কঠিন পাত্র।

প্রিভি সেক্রেটারিকে দেখে মনে হল না ভয়ংকর। স্পেস ফিয়েও তাকে কিনে নিলেও তার কোনো লক্ষণ নেই। বরং ব্রুডরিগকে দেখে মনে হয় প্রাণবন্ত কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসেছে সামরিক ঘাটি পরিদর্শনে।

নিভাঁজ, পরিপাটি, জাকজমকপূর্ণ পোশাকের কারণে তাকে মনে হয় বেশ লম্বা, যেন অনেক উপর থেকে ঠাণ্ডা নিরাবেগ চোখে বণিকের লম্বা নাকের দিকে তাকিয়ে আছে। আইভরি স্টিকের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ানোর সময় কব্জিতে বাধা মণিমুক্তা খচিত অলংকার ঝকমক করে উঠল।

“না,” সামান্য ইশারা করে বলল সে। “ওখানেই থাকো। খেলনাগুলোর কথা ভুলে যাও; আমার কোনো আগ্রহ নেই।”

একটা চেয়ার টেনে নিল সে। লাঠির আগায় জড়ানো কাপড়ের টুকরা দিয়ে যত্নের সাথে ধুলা সাফ করে বসল। বাকি চেয়ারটার দিকে তাকাল ডেভর্স, কিন্তু ব্রুডরিগ অলস কন্ঠে বলল, “পীয়ার অব দ্য রিএম-এর সামনে তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।”

হাসল সে।

শ্রাগ করল ডেভর্স। “আমার স্টকের প্রতি আগ্রহ না থাকলে আমি এখানে কেন?”

শ্বাপদের মতো অপেক্ষা করছে প্রিভি সেক্রেটারি। ডেভর্স আস্তে করে যোগ করল, “স্যার।”

“প্রাইভেসির জন্য, সেক্রেটারি বলল। “তোমার কি মনে হয় তুচ্ছ মনিহারী সামগ্রী দেখার জন্য আমি দুই শ পারসেক পাড়ি দিয়ে এসেছি। আমি তোমাকে দেখতে এসেছি।” কারুকার্যময় বাক্স থেকে গোলাপি রঙের একটা ট্যাবলেট বের করে যত্নের সাথে দুই দাঁতের ফাঁকে রাখল সে, তারপর মজা করে চুষতে লাগল।

“যেমন,” পুনরায় শুরু করল ব্রুডরিগ, “কে তুমি? তুমি কি আসলেই ওই বর্বর গ্রহের অধিবাসী যে গ্রহের কারণে সামরিক উত্তেজনা শুরু হয়েছে?”

গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল ডেভর্স।

“এবং তুমি এই ঝামেলা যাকে সে বলছে যুদ্ধ, এটা শুরু হওয়ার পরই তার হাতে ধরা পড়েছ। আমি তোমার তরুণ জেনারেলের কথা বলছি।”

আবারও মাথা নাড়ল ডেভর্স।

“তাই! বেশ, বুঝতে পারছি কথা বলতে তোমার অসুবিধা হবে। তোমার জন্য সহজ করে দিচ্ছি। মনে হচ্ছে আমাদের জেনারেল প্রচুর শক্তি ব্যয় করে এখানে একটা অর্থহীন যুদ্ধ করছেন-শেষ প্রান্তের এমন একটা ক্ষুদ্র গ্রহের বিরুদ্ধে যে গ্রহের জন্য কোনো বিবেচক ব্যক্তি বন্দুকের একটা ব্লাস্টও খরচ করবে না। অথচ জেনারেল অবিবেচক নন। সত্যি কথা বলতে কি তিনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। আমার কথা বুঝতে পারছ?”।

“পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি, একথা বলা যাবে না, স্যার।”

মনযোগ দিয়ে হাতের নখ পর্যবেক্ষণ করছে সেক্রেটারি। বলল, “আরো শোন। জেনারেল সামান্য যশ বা গৌরবের লোভে নিজের সৈনিক বা যুদ্ধযানগুলোকে বিপদে ফেলবেনা। আমি জানি সে সবসময় ইম্পেরিয়াল যশ এবং গৌরবের কথা চিন্তা করে আবার হিরোয়িক এজের নরদেবতাদের অসহ্য মেকী আচরণের কথাও সে ভুলে যায়নি। এখানে যশ বা গৌরবের চেয়ে বড় কিছু আছে-আর তোমার সাথে সে অস্বাভাবিক রকম ভালো ব্যবহার করছে। তুমি যদি আমার বন্দি হতে আর জেনারেলকে যেরকম অপ্রয়োজনীয় কথা বলেছ আমার কাছে সেরকম বললে আমি তোমার পেট চিরে নাড়িভুড়ি বের করে আবার সেগুলো তোমার গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে মারতাম।”

কাঠের পুতুলের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল ডেভর্স। আড়চোখে পালাক্রমে তাকাল সেক্রেটারির রক্ষী দুজনের দিকে। দুজনেই খুন করার প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে।

সেক্রেটারির মুখে কৌতুকের হাসি। “তুমি আসলেই একটা বদমাইশ। জেনারেলের কথা অনুযায়ী সাইকিক পোবও তোমার উপর কাজ করেনি। এটা অবশ্য জেনারেলের একটা ভুল, কারণ আমার মনে হয়েছে আমাদের তরুণ বিচক্ষণ সমরনায়ক মিথ্যে কথা বলছেন।

“মাই অনেস্ট ট্রেডসম্যান, সেক্রেটারি বলে চলেছে, “আমার নিজস্ব সাইকিক প্রোব আছে যা শুধু বিশেষ করে তোমার উপরই প্রয়োগ করা যাবে। এটা দেখো-”

বুড়ো আঙুল এবং মধ্যমা দিয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে সে গোলাপি হলুদ রঙের যে আয়তকার বস্তুগুলো ধরে রেখেছে সেগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে যে কেউই চিনতে পারবে। ডেভর্সও পারল।

“মনে হচ্ছে নগদ অর্থ।” বলল সে।

“নগদ অর্থ এবং এম্পায়ারের সবচেয়ে সেরা। কারণ এই অর্থ আমার এস্টেটের সমর্থনপুষ্ট, যা সম্রাটের নিজের এস্টেট থেকেও বড়। একলাখ ক্রেডিট। পুরোটাই এখানে। দু আঙুলের মাঝে! তোমার!”

“কিসের জন্য, স্যার? আমি একজন বণিক, অবশ্য বণিকরা দুই পথেই পা বাড়ায়।”

“কিসের জন্য? সত্যি কথা বলার জন্য। জেনারেল কিসের পিছনে ছুটছেন? তিনি কেন এই যুদ্ধ শুরু করেছেন?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল লাথান ডেভর্স। দাড়ি আচড়াতে লাগল চিন্তিত ভঙ্গিতে।

“কিসের পিছনে ছুটছেন তিনি?” সেক্রেটারি ক্রেডিটগুলো গুনছে আর তার হাতের উপর ডেভর্সের চোখ আঠার মতো সেটে আছে। এক কথায়, এম্পায়ার।”

“হুমম্। খুবই সাধারণ। তাই হয় সবসময়। কোন পথে তিনি গ্যালাক্সির সীমান্ত থেকে এম্পায়ারের শীর্ষে পৌঁছবেন?”

“ফাউণ্ডেশন-এর,” তিক্ত স্বরে বলল ডেভর্স, “কিছু গোপন ব্যাপার আছে। তাদের কাছে কিছু বই আছে, পুরোনো-এতই পুরোনো যে বইয়ের ভাষা শুধু উচচপদস্থ কয়েকজন জানে। কিন্তু এই বিষয়গুলো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে আচ্ছাদিত, কেউ ব্যবহার করে না। আমি চেষ্টা করেছিলাম, পরিণতি আজকের এই অবস্থা। ওখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে মৃত্যুদণ্ড।”

“আচ্ছা, আর গোপন বিষয়গুলো। এক লাখ ক্রেডিটের জন্য তোমাকে সব খুলে বলতে হবে।”

“ট্রান্সমিউটেশন অভ এলিম্যান্টস, সংক্ষেপে জবাব দিল ডেভর্স।

সেক্রেটারির চোখ ছোট হয়ে গেল, “আমি জানতাম নিউক্লিয়িকস এর নিয়ম অনুযায়ী ট্রান্সমিউটেশন অসম্ভব।”

“অসম্ভব, যদি নিউক্লিয়ার ব্যবহার করা হয়। কিন্তু প্রাচীন মানুষরা বোধহয় ছিল আমাদের থেকেও বুদ্ধিমান। তারা নিউক্লি থেকেও বড় এবং মৌলিক কোনো শক্তির উৎস আবিষ্কার করেছিল। যদি ফাউণ্ডেশন আমার পরামর্শমতো সেই উৎসগুলো ব্যবহার—”

ডেভর্স বুঝতে পারল তার পেটের ভেতর কেমন মোচড় দিচ্ছে। ভয়ংকর একটা জুয়া খেলা শুরু করেছে সে।

“বলে যাও।” আদেশ দিল সেক্রেটারি। কোনো সন্দেহ নেই জেনারেল এগুলো জানে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সে কী করবে?”

দৃঢ়কণ্ঠে বলতে লাগল ডেভর্স, “ট্রান্সমিউটেশন দিয়ে সে পুরো এম্পায়ারের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। ধাতব খনিজ মজুত করে রাখার আর কোনো মূল্য থাকবে না কারণ রিয়োজ অ্যালুমিনিয়ামকে টাংস্টেন এবং লোহাকে ইরিডিয়ামে রূপান্তরিত করতে পারবে। কোনো নির্দিষ্ট বস্তুর দুষ্প্রাপ্যতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা শিল্পগুলো নিঃশেষ হয়ে যাবে পুরোপুরি। এখানেই নতুন পাওয়া শক্তি ব্যবহারের প্রশ্ন আসছে, রিয়োজ ধর্মের কথা চিন্তা না করেই ব্যবহার করবে।

“রিয়োজকে থামানোর কোনো উপায় নেই। ফাউণ্ডেশনকে সে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। এবং আগামী দুই বছরের ভেতর সে হবে ম্রাট।”

“তাই,” হাসল ফ্রডরিগ। “লোহা থেকে ইরিডিয়াম, তাই না? শোন তোমাকে একটা গোপন খবর দেই। তুমি কি জানো জেনারেলের সাথে যোগাযোগ করেছে ফাউণ্ডেশন।”

শরীর শক্ত হয়ে গেল ডেভর্সের।

“তুমি অবাক হয়েছ। স্বাভাবিক। সন্ধি করার জন্য ওরা তাকে প্রতি বছর এক শ টন ইরিডিয়াম দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এক শ টন লোহা থেকে রূপান্তরিত ইরিডিয়াম, নিজেদের ঘাড় বাঁচানোর জন্য ধর্মীয় নীতি ভঙ্গ করেছে। চমৎকার প্রস্তাব, কিন্তু আমাদের দুর্নীতিবাজ জেনারেল যে সেটা মানবে না তা খুবই স্বাভাবিক-কারণ সে তো একসাথে ইরিডিয়াম এবং এম্পায়ার দুটোই দখল করতে পারছে। নাও, এই অর্থ তুমি উপার্জন করেছ।

ক্রেডিট বিলগুলো সে ছুঁড়ে দিল আর চমৎকারভাবে লুফে নিল ডেভর্স।

দরজার কাছে গিয়ে থামল লর্ড ব্রুডরিগ। “একটা কথা, আমার এই লোক দুটো কথা বলতে পারে না, কানে শোনে না, বুদ্ধি নেই, শিক্ষা নেই, এমনকি সাইকিক প্রোবেও সাড়া দেয় না। কিন্তু যে-কোনো রকম মৃত্যু দণ্ড কার্যকর করতে এরা বেশ আগ্রহী। তোমাকে আমি এক লাখ ক্রেডিটে কিনেছি। ভালো ব্যবসায়ী হিসেবে থাকবে। যদি আমাদের আলোচনা রিয়োজের কাছে বল তোমার শাস্তি হবে, এবং সেটা হবে আমার পদ্ধতিতে।”

এতক্ষণে ভালোমানুষের মুখোশ খসে পড়ল ব্রুডরিগের চেহারা থেকে, মুখে ফুটে উঠল নির্দয় নিষ্ঠুরতা। এক মুহূর্তের জন্য ডেভর্সের মনে হল যে সেক্রেটারির দৃষ্টি দিয়ে স্পেস ফিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

নিঃশব্দে ফ্রডরিগের কসাইদের অনুসরণ করে সে ফিরে এল নিজের কোয়ার্টারে। ডুসেম বারের প্রশ্নের জবাবে সে তৃপ্তি সহকারে জবাব দিল, “না, অদ্ভুত ব্যাপারটা এখানেই। সেই আমাকে ঘুষ দিয়েছে।”

দুমাসের কঠিন লড়াই বেল রিয়োজের চেহারায় স্পষ্ট ছাপ ফেলেছে। গম্ভীর এবং অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে সে।

অধৈর্য সুরে ভক্ত সার্জেন্ট লিউককে বলল, “বাইরে অপেক্ষা করো, সৈনিক। আমার কথা শেষ হলে এই দুজনকে তাদের কোয়ার্টারে নিয়ে যাবে। তার আগে আমি না ডাকা পর্যন্ত কেউ যেন ভিতরে না ঢুকে, কেউ না। বুঝতে পেরেছ।”

স্যালিউট করে বেরিয়ে গেল সার্জেন্ট। রিয়োজ বিরক্তিতে গজ গজ করতে করতে ডেস্কের এলোমেলো কাগজগুলো গুছিয়ে রাখল উপরের ড্রয়ারে, তারপর বন্ধ করল খটাশ করে।

“বসুন,” অপেক্ষারত দুজনকে বলল। “আমার হাতে বেশি সময় নেই। আসলে এখানে আসাই উচিত হয়নি। কিন্তু আপনাদের দুজনের সাথে দেখা করাটা জরুরি।”

ডুসেম বারের দিকে ঘুরলেন তিনি। বার আনমনে ট্রাইমেনশনাল কিউবে অঙ্কিত হিজ ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টির বলিরেখাপূর্ণ কঠোর মুখচ্ছবির উপর আঙুল বোলাচ্ছিলেন।

“প্রথম কথা, প্যাট্রিশিয়ান,” জেনারেল বললেন, “আপনার সেলডন হেরে যাচ্ছে। লড়াই ভালোই করেছে, কারণ ফাউণ্ডেশন-এর লোকগুলো মৌমাছির মতো উড়ে বেড়িয়েছে আর যুদ্ধ করেছে পাগলের মতো। প্রতিটা গ্রহ প্রবল বাধা দিয়েছে, তারপর এমনভাবে বিদ্রোহ শুরু করেছে যে দখলে রাখাই ছিল মুশকিল। সেগুলো সব সামাল দেওয়া গেছে।”

“কিন্তু এখনো তিনি পুরোপুরি হারেননি।” নরম সুরে বললেন বার।

“ফাউণ্ডেশন নিজে সবচেয়ে কম বাধা দিয়েছে। সেলডনকে যেন চূড়ান্ত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে না হয় সেজন্য অনেক রকম প্রস্তাব দিয়েছে আমাকে।”

“সেরকমই গুজব শোনা যাচ্ছে।”

“আহ্, গুজব চলে এসেছে আমার আগেই। সবচেয়ে নতুনটা শুনেছেন?”

“নতুন গুজবটা কী?”

“লর্ড ব্রুডরিগ, সম্রাটের প্রিয়পাত্র নিজে আমাকে অনুরোধ করেছেন আমার সেকেণ্ড-ইন-কমান্ড হওয়ার জন্য।”

এই প্রথম কথা বলল ডেভর্স, “নিজে অনুরোধ করেছেন, বস? কীভাবে সম্ভব? নাকি আপনি লোকটাকে পছন্দ করতে শুরু করেছেন।”

“না,” শান্ত সুরে বললেন জেনারেল। “তবে সে আমার গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করে দিয়েছে।”

“যেমন?”

“সম্রাটের কাছে রিইনফোর্সম্যান্টের আবেদন করেছে।”

ডেভর্সের উদ্ধত হাসি আরো চওড়া হল। “সে তা হলে সম্রাটের সাথে যোগাযোগ করেছে। আর আপনি, বস, রিইনফোর্সম্যান্টের জন্য অপেক্ষা করছেন, এসে পড়বে যে-কোনোদিন। ঠিক?”

“ভুল! এরই মধ্যে এসে পড়েছে। পাঁচটা শক্তিশালী যুদ্ধযান। সেই সাথে সম্রাটের ব্যক্তিগত অভিনন্দন বার্তা। আরো যুদ্ধযান আসার পথে। কী ব্যাপার, বণিক?” উপহাসের সুরে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

“কিছু না!” ডেভর্স যেন হঠাৎ বরফের মতো জমাট বেধে গেছে।

রিয়োজ ডেস্কের পেছন থেকে উঠে এসে বণিকের সামনে দাঁড়ালেন, হাত ব্লাস্ট গানের বাটের উপর।

“আমি জিজ্ঞেস করেছি, কী হয়েছে, বণিক? সংবাদটা তোমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। হঠাৎ করে নিশ্চয়ই ফাউণ্ডেশন-এর পক্ষে চলে যাওনি?”

“না।”

“হ্যাঁ-তোমার আচরণ কেমন অস্বাভাবিক।”

“তাই নাকি, বস?” কঠিনভাবে হাসল ডেভর্স, হাত মুঠো পাকালো। “ওদেরকে আমার সামনে এনে দাঁড় করান, শুইয়ে দেব সবগুলোকে।”

“সন্দেহ তো এখানেই। তুমি খুব সহজে ধরা পড়েছ। প্রথম হামলার পরেই আত্মসমর্পণ করেছ বিনা প্রশ্নে। নিজের গ্রহকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া। ইন্টারেস্টিং, তাই না?”

“আমি বিজয়ী পক্ষে থাকতে চাই, বস। আপনিই তো বলেছেন আমি বিচক্ষণ মানুষ।”

“মানলাম!” কঠিন গলায় বললেন রিয়োজ। “আজ পর্যন্ত কোনো বণিক ধরা পড়েনি, তাদের কাছে দ্রুতগতির কোনো মহাকাশযান নেই। কোনো ট্রেডিং শিপই আমাদের লাইট ক্রুজারের হামলা ঠেকাতে পারবে না। অথচ প্রয়োজনে বণিকরা জীবন দিতে প্রস্তুত। দখলকৃত গ্রহগুলোতে গেরিলা যুদ্ধে এবং আমাদের অধীনস্থ স্পেসে এয়ার রেইডে নেতৃত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে বণিকদের।

“তা হলে কি তুমি একাই বিচক্ষণ মানুষ? তুমি যুদ্ধ করোনি, পালিয়েও যাওনি, বরং নিজের দেশের সাথে বেঈমানী করেছ। তুমি অন্যরকম, বিষ্ময়কর-সত্যিকথা বলতে কি সন্দেহজনক।”

নরম সুরে বলল ডেভর্স, “আপনার কথার অর্থ আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই। আমি এখানে আছি ছয়মাস এবং এই ছয়মাস ভালো ছেলে হয়ে থেকেছি।”

“এবং আমি তার প্রতিদানও দিয়েছি। তোমার মহাকাশযানের কোনো ক্ষতি হয়নি। তোমার সাথে ভালো আচরণ করেছি। কিন্তু তুমি সব কথা জানাওনি। যেমন তোমার যন্ত্রপাতিগুলোর ব্যাপারে সব জানালে অনেক উপকার হতো। যে এটমিক প্রিন্সিপল অনুযায়ী সেগুলো তৈরি সেই একই প্রিন্সিপল ফাউণ্ডেশন-এর জঘন্য কয়েকটা অস্ত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। ঠিক?”

“আমি একজন বণিক, টেকনিশিয়ান নই। জিনিসগুলো শুধু বিক্রি করি; ওগুলো তৈরি করিনা।”

“শিগগিরই জানা যাবে। সেকারণেই এসেছি। একটা পারসোনাল ফোর্স শিল্ডের জন্য তোমার মহাকাশযান অনুসন্ধান করা হবে। তোমাকে কখনো পরতে দেখা যায়নি, অথচ ফাউণ্ডেশন-এর সব সৈনিকই সেটা পরে। তুমি যে আমাকে সব কথা বলনি এটা তার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। ঠিক?”

কোনো উত্তর নেই। রিয়াজ বলে চলেছেন, “আরো প্রমাণ বের করা যাবে। সাইকিক প্রোব সাথে এনেছি। আগে ব্যর্থ হলেও গত কয়েকদিনে শত্রুদের কাছ থেকে শিখেছি অনেক কিছু।

বলার ভঙ্গি নরম হলেও কণ্ঠস্বরে যে শীতল হুমকি রয়েছে সেটা না বোঝার কোনো কারণ নেই, আর ডেভর্স ঠিক শিরদাঁড়ার মাঝখানে অস্ত্রের শক্ত খোঁচা অনুভব করল-জেনারেলের অস্ত্র, হোলস্টার থেকে কখন বের করেছে সে টের পায়নি।

শান্ত সুরে বললেন জেনারেল, “কোমরের বেল্ট আর যে যে ধাতব গহনা পরেছ। সব খুলে ফেল। ধীরে ধীরে! ঠিক আছে, আমি নিচ্ছি।”

ডেস্কের রিসিভারের আলো জ্বলে উঠল, একটা ম্যাসেজ ক্যাপসুল সুট থেকে গড়িয়ে এসে পড়ল যেখানে বার ট্রাইমেনশনাল ইম্পেরিয়াল মূর্তি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তার কাছাকাছি।

ডেস্কের পিছনে গেলেন রিয়োজ, হাতে অস্ত্র প্রস্তুত। বারকে বললেন, “আপনিও প্যাট্রিশিয়ান। আপনি অনেক সাহায্য করেছেন, আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। তারপরেও সাইকিক প্রোবের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে আপনার পরিবারের ভাগ্য নির্ধারণ করব আমি।”

এবং ম্যাসেজ ক্যাপসুল নেওয়ার জন্য রিয়োজ নিচু হতেই বার ক্রিস্টালের তৈরি ক্লীয়নের ভারি মূর্তিটা ঠাণ্ডা মাথায় নিখুঁতভাবে নামিয়ে আনলেন জেনারেলের মাথায়।

এত দ্রুত ঘটল ব্যাপারটা যে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল ডেভর্সের। যেন হঠাৎ করেই বৃদ্ধের ভেতরে একটা পিশাচ জেগে উঠেছে।

“বেরোও!” হিস হিস করে বললেন বার। “জলদি!” রিয়োজের ব্লাস্টার মাটি থেকে তুলে নিজের পোশাকের ভেতর লুকিয়ে ফেললেন তিনি।

কামড়া থেকে ওরা বেরোতেই সার্জেন্ট লিউক ঘুরে দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করল।

“পথ দেখাও, সার্জেন্ট!” সহজ গলায় বললেন বার। ডেভর্স পিছনের দরজা বন্ধ করে দিল।

সার্জেন্ট লিউক নিঃশব্দে কোয়ার্টারের পথ দেখাল, দরজার সামনে একটু থামলেও পিঠে ব্লাস্ট-গানের মাজলের খোঁচা খেয়ে সামনে বাড়তে বাধ্য হল সে। একটা কণ্ঠ তার কানে কঠিন সুরে বলল, “ট্রেড শিপের দিকে।”

এয়ারলক খোলার জন্য সামনে বাড়ল ডেভর্স, বার বললেন, “ওখানেই দাঁড়াও লিউক। তুমি ভালো মানুষ। আমরা তোমাকে মারতে চাই না।”

কিন্তু বন্দুকের মনোগ্রাম চিনতে পারল সার্জেন্ট। আতঙ্কিত স্বরে কেঁদে উঠল, “আপনারা জেনারেলকে মেরে ফেলেছেন।”

তারপর একটা তীব্র বন্য হুংকার ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। ফায়ার করলেন বার। পোড়া একদলা মাংসপিণ্ড হয়ে লুটিয়ে পড়ল সার্জেন্ট।

সিগন্যাল লাইটগুলো পাগলের মতো লাফালাফি শুরু করার আগেই এবং উপরে সূক্ষ্ম জালের মতো বিছানো বিশাল আতশ কাঁচের মতো গ্যালাক্সিতে আরো অনেক কালো কালো আকৃতি উঠার আগেই মৃত গ্রহ ছেড়ে উপরে উঠল ট্রেড শিপ।

হাসিমুখে বলল ডেভর্স, “শক্ত হয়ে বসুন, বার। দেখি ওরা আমার সাথে দৌড়ে পারে কিনা।”

ওরা যে পারবে না ভালোভাবেই জানে সে।

খোলা স্পেসে বেরিয়ে আসার পর ডেভর্সের কণ্ঠ শুনে মনে হল যেন তার মন হারিয়ে গেছে অনেক দূরে। “বেশ ভালোভাবেই টোপ গিলেছে ডরিগ।”

শিগগিরই তারা পৌঁছে গেল গ্যালাক্সির নক্ষত্রবহুল অংশে।

*

৮. ট্রানটরের পথে

সামান্য একটু নড়াচড়া দেখার আশায় ডেভর্স মৃত ভূ-গোলকের প্রতিচ্ছবির উপর ঝুঁকে দাঁড়াল। ডাইরেকশনাল কন্ট্রোলের দৃঢ় সিগন্যালের সাহায্যে সে আশেপাশের স্পেস ধীরে ধীরে, সুশৃঙ্খলভাবে প্রায় চালুনি দিয়ে ছাকার মতো পর্যবেক্ষণ করছে।

কোণায় একটা নিচু কটে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছেন বার। “ওদের কোনো চিহ্ন নেই?” জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

“এম্পায়ার বয়েজ? না।” অধৈর্য সুরে বলল ডেভর্স। “অনেক আগেই ওদেরকে হারিয়ে ফেলেছি। স্পেস! প্রায় অন্ধের মতো হাইপারস্পেসে জাম্প করেছি, ভাগ্য ভালো যে-কোনো সূর্যের পেটে গিয়ে ল্যান্ড করিনি। দ্রুতগতির যান থাকলেও ওরা আমাদের আর ধরতে পারবে না।”

হেলান দিয়ে বসে একটু ঝাঁকুনি দিয়ে পোশাকের কলার ঢিলা করল সে। “এম্পায়ার বয়েজরা এখানে কিরকম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েছে আমি জানি না। মনে হয় ফাঁক একটা পাওয়া যাবে।”

“ধরে নিচ্ছি তুমি ফাউণ্ডেশনে পৌঁছার চেষ্টা করছ।”

“আমি এসোসিয়েশন এর সাথে যোগাযোগ করছি-বা বলা উচিত করার চেষ্টা করছি।”

“এসোসিয়েশন? ওরা আবার কারা?”

“এসোসিয়েশন অব ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট ট্রেডার্স। কখনো শোনেননি, তাই না? আপনি একা না। আমরা আসলে এখনো নিজেদের সেভাবে প্রচার করিনি।”

খানিক নীরবতা, শুধু রিসিপশন ইণ্ডিকেটর এর মৃদু গুঞ্জন। তারপর বার বললেন, “তুমি রেঞ্জের ভেতরে আছ?”

“জানি না। কোথায় যাচ্ছি সেই সম্বন্ধে কোনো ধারণা নেই। সেজন্যই তো ডাইরেকশনাল কন্ট্রোল ব্যবহার করছি। এভাবে পথ খুঁজে বের করতে এক বছরও লাগতে পারে।”

“তাই?”

বার এর নির্দেশ অনুসরণ করে তাকিয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ইয়ারফোন ঠিক করে নিল ডেভর্স। স্ক্রিনের নির্দিষ্ট বৃত্তের ভেতর জ্বল জ্বল করছে একটা সাদা বিন্দু।

প্রায় আধঘণ্টা ধরে যত্নের সাথে নাজুক যোগাযোগ ব্যবস্থা পরিচালনা করে দুটো বিন্দুকে যুক্ত করার চেষ্টা করল ডেভর্স, মাঝখানের দূরত্ব এত বেশি যে এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে আলো পৌঁছতে সময় লাগবে মাত্র পাঁচ শ বছর।

তারপর নিরাশভাবে হেলান দিয়ে বসল, ইয়ারফোন সরিয়ে ফেলল কান থেকে।

“খেয়ে নেওয়া যাক, ডক। শাওয়ারের ব্যবস্থা খুব একটা ভালো না। চাইলে গোসল করতে পারেন, তবে গরম পানি ব্যবহার করার সময় সাবধান।”

পথ দেখিয়ে দেয়ালের কাছে দাঁড় করানো বিভিন্ন সামগ্রীতে বোঝাই একটা ক্যাবিনেটের সামনে নিয়ে এলো। “আশা করি আপনি নিরামিষভোজী নন?”

“আমি সর্বভোজী।” বললেন বার। “কিন্তু এসোসিয়েশনের ব্যাপারটা কী? তুমি ওদের হারিয়ে ফেলেছ?”

“সেরকমই মনে হচ্ছে। রেঞ্জ অনেক বেশি যদিও সেটা কোনো ব্যাপার না। এগুলো আমি ভেবে রেখেছি।”

সোজা হয়ে টেবিলের উপর দুটো ধাতব কন্টেইনার রাখল সে। “পাঁচ মিনিট সময় দিন, ডক। তারপর এখানে চাপ দিয়ে খুলবেন। এটাই তখন আপনার খাবার প্লেট, এবং চামচের কাজ করবে। ন্যাপকিন দিতে পারছি না। আপনি বোধহয় এসোসিয়েশনের কাছ থেকে কি সংবাদ পেয়েছি সেটা জানতে চান।”

“যদি গোপন কিছু না হয়।” মাথা নাড়ল ডেভর্স। “আপনার কাছে না। রিয়োজ সত্যি কথাই বলেছে।”

“কর প্রদানের প্রস্তাব সম্বন্ধে?”

“হ্যাঁ। ওরা প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। লরিস এর বাইরের সূর্যগুলোর কাছে লড়াই চলছে প্রচণ্ড।”

“লরিস ফাউণ্ডেশন-এর অনেক কাছে?”

“হ্যাঁ। ও, আপনি তো জানেন না। এটা হচ্ছে মূল চার রাজ্যের একটা। আপনি এটাকে অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা ব্যুহ্যের অংশ ধরতে পারেন। এটা অবশ্য সবচেয়ে খারাপ খবর না। আগেও ওরা বড় বড় যুদ্ধযানের মোকাবেলা করে টিকে থেকেছে। তার মানে রিয়োজ সব কথা বলেনি। সে আরো যুদ্ধযান পেয়েছে, ব্রুডরিগ কাজ করছে তার পক্ষে, আর আমি সব গোলমাল করে ফেলেছি।”

ফুড কন্টেইনার খোলার সময় তার দৃষ্টি কেমন ফাঁকা মনে হল। ধোঁয়া উঠা স্টু এর সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল সারা ঘরে। দেরি না করে খাওয়া শুরু করলেন বার।

“যতদূর বুঝতে পারছি,” বার বললেন, “আমাদের কিছু করার নেই; ইম্পেরিয়াল প্রতিরক্ষা ভেদ করে ফাউণ্ডেশনে ফিরতে পারব না; এখানে অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার নেই; সেটাই হবে বিচক্ষণতা। আর রিয়োজ যেহেতু এত ভেতরে ঢুকতে পেরেছে, আমার মনে হয় না বেশি অপেক্ষা করতে হবে।”

হাতের কাঁটাচামচ নামিয়ে রাখল ডেভর্স। “অপেক্ষা, তাই না?” ফোঁস ফোঁস করে বলল সে। “আপনার জন্য ঠিক আছে। আপনার ভো কোনো ঝুঁকি নেই।”

“নেই?” বিষণ্ণ হেসে জিজ্ঞেস করলেন বার।

“না। আপনাকে সত্যি কথা বলি।” ডেভর্সের অসহিষ্ণুতা চাপা থাকলনা। “পুরো ঘটনাটাকে মাইক্রোস্কোপিক স্লাইডে দেখা মজার কিছু ভাবতে ভাবতে আমি ক্লান্ত। ওখানে কোথাও আমার বন্ধুরা আছে, মারা যাচ্ছে, এবং একটা পুরো বিশ্ব, আমার মাতৃভূমি, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আপনি তো বাইরের লোক, বুঝবেন না।”

“চোখের সামনে বন্ধুদের মরতে দেখেছি আমি।” বৃদ্ধের হাত তার কোলের উপর, চোখ বন্ধ। “তুমি বিয়ে করেছ?”

“বণিকেরা কখনো বিয়ে করে না।” বলল ডেভর্স।

“আমার দুটো ছেলে আর একটা ভাতিজা আছে। ওদেরকে সতর্ক করা হলেও কোনো একটা কারণে কিছু করতে পারছে না। আমাদের পালানো মানে ওদের মৃত্যু। আমার মেয়ে এবং দুই নাতনী আশা করি অনেক আগেই নিরাপদে গ্রহ থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু তারপরেও ওদেরকে বাদ দিয়েই আমি অনেক বড় ঝুঁকি নিয়েছি এবং হারিয়েছি তোমার চেয়ে অনেক বেশি।”

রুক্ষ স্বরে ডেভর্স বলল, “আমি জানি। কিন্তু সেটা আপনার ইচ্ছের ব্যাপার। রিয়োজের সাথে হয়তো আপনি খেলা চালিয়ে যেতে পারতেন। আমি তো বলিনি-”

মাথা নাড়লেন বার। “আমার ইচ্ছের ব্যাপার না, ডেভর্স। একটু ভোলা মনে চিন্তা কর; তোমার জন্য আমি নিজের সন্তানের জীবনের ঝুঁকি নিইনি; যতক্ষণ সাহসে কুলিয়েছে আমি রিয়োজের সাথে সহযোগিতা করেছি। কিন্তু সে সাইকিক প্রোব নিয়ে এসেছে।”

সিউয়েনিয়ান প্যাট্রিশিয়ান চোখ খুললেন, দৃষ্টিতে সীমাহীন যন্ত্রণার ছাপ। “এক বছর আগে রিয়োজ আমার কাছে এসেছিল। জাদুকরদের ঘিরে যে কাল্ট’ গড়ে উঠেছে সেই বিষয়ে জানতে, কিন্তু আসল সত্যটা সে ধরতে পারেনি। এটা শুধুই একটা কাল্ট নয়। আজকে তোমার গ্রহ যে অত্যাচারী পেশিশক্তির কবলে পড়েছে, প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমার গ্রহ একই শক্তির কবলে পড়েছিল। পাঁচটা বিদ্রোহ দমন করা হয় শক্ত হাতে। তখনই আমি হ্যারি সেলডনের প্রাচীন রেকর্ডগুলোর ব্যাপারে জানতে পারি-এখন সেই কাল্ট’ অপেক্ষা করছে।

“অপেক্ষা করছিল জাদুকরদের আগমনের জন্য। আমার ছেলে তাদের নেতা। এটাই আমার মাথায় গোপন করা আছে। দেখতে হবে প্রোব দিয়ে যেন সেটা বের করা না যায়। সে কারণেই আমার পরিবার জিম্মি হিসেবে মারা যাবে; নইলে তারা মরবে বিদ্রোহী হিসেবে সেই সাথে অর্ধেক স্যিউয়েনিয়ান। এছাড়া আমার কোনো উপায় নেই! আর আমি বাইরের কেউ না।”

চোখ নামিয়ে নিল ডেভর্স, বার বলে চলেছেন, “ফাউণ্ডেশন-এর বিজয়ের উপর স্যিউয়েনার আশা ভরসা নির্ভর করছে। ফাউণ্ডেশন-এর বিজয়ের জন্য আমার সন্তান প্রাণ দিচ্ছে। হ্যারি সেলডন ফাউণ্ডেশন-এর উদ্ধারের জন্য যেভাবে পথ দেখিয়েছেন, সিউয়েনার জন্য তা করেননি। আর আমার জনগণের জন্য কোনো নিশ্চয়তা নেই, আছে শুধু আশা।”

“কিন্তু আপনি এখনো অপেক্ষা করেই সন্তুষ্ট। এমনকি লরিস এ ইম্পেরিয়াল নেভি পৌঁছে গেলেও।”

“আমি গভীর বিশ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করব,” সাদামাটাভাবে বললেন বার, “ যদি ওরা টার্মিনাস গ্রহে পৌঁছে যায়।”

অসহায় ভঙ্গিতে ভুরু কোঁচকালো বণিক। “জানি না, এভাবে জাদুর মতো কাজ হয় না। সাইকোহিস্টোরি হোক বা আর যাই হোক, প্রতিপক্ষ ভীষণ শক্তিশালী, আর আমরা দুর্বল। এক্ষেত্রে হ্যারি সেলডন কি করতে পারেন?”

“কিছুই করতে হবে না। যা করার আগেই করা হয়েছে। এখন শুধু ঘটনা এগিয়ে চলছে। বুঝতে পারছ না সময়ের চাকা ঘুরে চলেছে আর চারপাশে বিপদের ঘণ্টাধ্বনির অর্থ এই না যে আমাদের নিশ্চয়তা কমে গেছে।”

“হতে পারে। তবে আপনার উচিত ছিল রিয়োজের খুলি চুরমার করে দেওয়া। পুরো আর্মির চেয়ে সে একাই অনেক বেশি ভয়ংকর।”

“খুলি চুরমার করে দেব? যেখানে ব্রুডরিগ তার সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড?” বার এর চেহারায় তীব্র ঘৃণা। “পুরো স্যিউয়েনা নির্ভর করছে আমার উপর। ব্রুডরিগ অনেক আগেই নিজেকে প্রমাণ করেছে। একটা গ্রহ ছিল যেখানে পাঁচ বছর আগে প্রতি দশজন পুরুষের মধ্যে একজন মারা যেত-তার কারণ ছিল শুধুমাত্র বকেয়া কর প্রদানে ব্যর্থতা। কর সংগ্রহের দায়িত্বে ছিল ব্রুডরিগ। তার তুলনায় রিয়োজ দুগ্ধ পোষ্য শিশু।”

“কিন্তু ছয় মাস, শক্ত ঘাঁটিতে ছয় মাস কাটল, অথচ আমাদের হাতে কিছুই নেই।” হাতদুটো পরস্পরের সাথে এত জোরে চেপে ধরল ডেভর্স যে আঙুলগুলো মটমট করে উঠল। “কিছুই নেই আমাদের হাতে।”

“দাঁড়াও, মনে পড়েছে-” বার তার পাউচের ভেতর হাত ঢোকালেন। “এটা হয়তো তুমি দেখতে চাইবে।” গোলাকার ধাতব বস্তুটা টেবিলের দিকে ছুঁড়ে দিলেন তিনি।

লুফে নিল ডেভর্স। “কি এটা?”

“ম্যাসেজ ক্যাপসুল। আমি আঘাত করার আগে রিয়োজের কাছে যেটা এসেছিল। এটার কোনো গুরুত্ব আছে?”

“নির্ভর করছে এর ভিতরে কি আছে তার উপর,” বসল ডেভর্স, ধাতব বস্তুটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে।

.

ঠাণ্ডা পানিতে সংক্ষিপ্ত গোসল সেড়ে কৃতজ্ঞচিত্তে এয়ার ড্রায়ারের উষ্ণ প্রবাহের সামনে দাঁড়িয়ে বার দেখলেন ডেভর্স তার ওয়র্কবেঞ্চে কাজে নিমগ্ন।

শরীরে কয়েকটা আরামদায়ক চাপড় মেরে এয়ার ড্রায়ারের মৃদু গুঞ্জনকে ছাপিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কী করছ?”

চোখ তুলল ডেভর্স। দাড়িতে ঘামের ফোঁটা চিক চিক করছে। “ক্যাপসুলটা খুলছি।”

“রিয়োজের পারসোন্যাল ক্যারেকটারিস্টিকস ছাড়া তুমি এটা খুলতে পারবে?” স্যিউয়েনিয়ানের কন্ঠে বিস্ময়।

“যদি না পারি, তা হলে এসোসিয়েশন থেকে পদত্যাগ করব আর বাকি জীবনে কোনোদিন মহাকাশযান চালাব না। ভেতরের একটা ত্রিমুখী বৈদ্যুতিক বিশ্লেষণ শেষ করেছি, বিশেষ করে ক্যাপসুল খোলার জন্য আমার কাছে যে ছোট যন্ত্র আছে তা এম্পায়ারের কেউ বাপের জন্মেও দেখেনি। আগে আমি চুরি করতাম। আসলে একজন বণিকের জানতে হয় সবকিছু।”

সামনে ঝুঁকে অতি সাবধানে একটা সমতল যন্ত্র ক্যাপসুলের ভেতরে ঢোকালো সে, স্পর্শের সাথে সাথে লাল রঙের অগ্নি স্ফুলিঙ্গ বের হতে লাগল।

“এই ক্যাপসুল খোলার কাজ খুব সহজ। ইম্পেরিয়ালের লোকরা ছোটখাটো জিনিস ভালো তৈরি করতে পারে না। ফাউণ্ডেশন-এর ক্যাপসুল দেখেছেন কখনো? আকারে এটার অর্ধেক, বিদ্যুৎ তরঙ্গ ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না।”

পুরো শরীর একটু শক্ত হয়ে গেল তার, টিউনিকের নিচে কাঁধের পেশি দৃশ্যতই কাঁপতে শুরু করেছে, অতি ক্ষুদ্র প্রোব ক্যাপসুলের ভেতরে ঢুকছে ধীরে ধীরে

ক্যাপসুল খুলে গেল নিঃশব্দে, কিন্তু সশব্দে নিশ্বাস ফেলল ডেভর্স। হাতের গোলাকার বস্তুর ভাঁজ খুলে গেল পাঁচম্যান্ট কাগজের মতো, তাতে জ্বল জ্বল করছে প্রিন্ট করা ম্যাসেজ।

“ব্রুডরিগের কাছ থেকে এসেছে,” বলল সে, তারপর একটু উম্মার সাথে বলল, “ম্যাসেজ এর মাধ্যম স্থায়ী। ফাউণ্ডেশন ক্যাপসুলে এক মিনিটের মধ্যেই ম্যাসেজটা অক্সিডাইজড হয়ে যেত।” কিন্তু ডুসেম বার হাত নেড়ে থামিয়ে দিলেন তাকে। দ্রুত পড়ে ফেললেন ম্যাসেজটা।

হতে : অ্যামেল ব্রুডরিগ, হিজ ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টির বিশেষ দূত, কাউন্সিলের প্রিভি সেক্রেটারি, এবং পীআর অভ দ্য রিএলম।
প্রতি : বেল রিয়োজ, মিলিটারি গভর্নর, সিউয়েনা, জেনারেল অভ দ্য ইম্পেরিয়াল ফোর্স, এবং পীআর অভ দ্য রিএলম। আমার অভিনন্দন।
প্ল্যানেট # ১১২০ আর প্রতিরোধ করছে না। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক আক্রমণের কাজ এগিয়ে চলেছে। শত্রুপক্ষ দৃশ্যতই দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং শিগগিরই অর্জিত হবে চূড়ান্ত লক্ষ্য।

প্রায় মাইক্রোস্কোপিক প্রিন্ট থেকে চোখ তুলে তিক্ত সুরে চেঁচিয়ে উঠলেন বার, “গর্দভ! মাথামোটা ফুলবাবু! এটা একটা ম্যাসেজ?”

“হাহ?” বলল ডেভর্স, কিছুটা হতাশ।

“এখানে কিছুই নেই,” গুঙিয়ে উঠলেন বার। “আমাদের থুতু চাটা আমাত্য এখন জেনারেলের পক্ষে। জেনারেল দূরে থাকায় সেই ফিল্ড কমাণ্ডার এবং জাঁকালো একটা মিলিটারি রিপোর্ট পাঠিয়ে নিজের তুচ্ছ মনোবাসনা পূর্ণ করেছে, যে বিষয়ে সে কিছুই জানে না। এই-এবং-এই গ্রহ আর প্রতিরোধ করছে না। হামলা চলছে।’ ‘শত্রুপক্ষ দুর্বল হয়ে পড়েছে। ব্যাটা ফাঁকা মাথার ময়ূর।”

“দাঁড়ান এক মিনিট–”

“ফেলে দাও এটা।” চরম বিতৃষ্ণা নিয়ে ঘুরলেন বৃদ্ধ। “গ্যালাক্সি জানে আমি এখানে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু পাবো সেই আশা করিনি। কিন্তু যুদ্ধের সময় একটা সাধারণ রুটিন অর্ডার ও যদি সময়মতো না পৌঁছায় অনেক সমস্যা হয়। সেই কারণেই আসার সময় জিনিসটা তুলে নিয়েছিলাম। কিন্তু এটা! ফেলে আসলেই ভালো হত। যে সময়টা রিয়োজ আমাদের ধ্বংসের পরিকল্পনা করত তার কিছুটা : হলেও নষ্ট হত।”

উঠে দাঁড়ালো ডেভর্স। “থামবেন আপনি। সেলডনের কসম-”

ম্যাসেজটা বৃদ্ধের নাকের সামনে ধরল সে। “আবার পরুন এটা। চুড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন’ বলতে সে কি বুঝিয়েছে?”

“ফাউণ্ডেশন দখল।”

“হ্যাঁ। এবং হয়তো সে বুঝিয়েছে এম্পায়ার দখল। আপনি জানেন সে বিশ্বাস করে এটাই চূড়ান্ত লক্ষ্য।”

“করলেই বা কী?”।

“যদি বিশ্বাস করে!” ডেভর্সের ঠোঁটের একপেশে হাসি দাড়ির আড়ালে হারিয়ে গেল। “বেশ, শুধু দেখে যান আমি কী করি।”

আঙুলের একটা টোকায় মেসেজ শিট পুনরায় ফিরে গেল স্লটে। মৃদু টুং শব্দ করে আবার পরিণত হল পূর্বের মতো মসৃণ নিখুঁত গোলাকার অবয়বে। ভেতরের কোথাও ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতিগুলো নড়াচড়ার ফলে তরল পদার্থ গড়িয়ে পড়ার মতো শব্দ হচ্ছে।

“এখন রিয়োজের পারসোন্যাল ক্যারেকটারিসটিক্স ছাড়া এই ক্যাপসুল খোলার কোনো উপায় নেই, আছে?”

“টু দ্য এম্পায়ার, নেই।” বললেন বার। “তা হলে এটার ভেতরে কী আছে আমাদের অজানা এবং পুরোপুরি অকৃত্রিম।”

“টু দ্য এম্পায়ার, হ্যাঁ।”

“এবং সম্রাট এটা খুলতে পারবেন, তাই না? উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পারসোন্যাল ক্যারেকটারিসটিক্স এর ফাইল সংরক্ষণ করা হয়। ফাউণ্ডেশনে আছে সেরকম।”

“স্বভাবতই ইম্পেরিয়াল রাজধানীতে।” একমত হলেন বার।

“তা হলে যখন আপনি, একজন সিউয়েনিয়ান প্যাট্রিশিয়ান এবং পীআর অব দ্য রিএলম সম্রাট ক্লীয়নকে গিয়ে বলবেন যে তার প্রিয় পোেষা তোতা পাখি এবং সবচেয়ে সম্ভাবনাময় জেনারেল মিলে তাকে গদি থেকে সরানোর পরিকল্পনা করেছে এবং প্রমাণ হিসেবে এই ক্যাপসুল দেন, তখন তিনি ব্রুডরিগের চূড়ান্ত লক্ষ্য বলতে কি বুঝবেন?”

দুর্বলভাবে বসে পড়লেন বার। “দাঁড়াও, সব কথা বুঝতে পারছি না।” চোয়াল ঘষলেন এক হাতে। “তুমি আসলে সিরিয়াস নও, তাই না?”

“সত্যি।” ডেভর্স উত্তেজিত। “গত দশ জন সম্রাটের নয় জনই তাদের প্রিয় জেনারেলদের হাতে খুন হয়েছেন। আপনি নিজেই বলেছেন এই কথা। বৃদ্ধ সম্রাট আমাদের কথা দ্রুত বিশ্বাস করবেন।”

দুর্বল গলায় ফিসফিস করলেন বার। “এই ব্যাটা সত্যিই সিরিয়াস। গ্যালাক্সির কসম, তুমি দীর্ঘ অবাস্তব গল্প ফেঁদে সেলডন ক্রাইসিস মোকাবেলা করতে পারবে না। ধরে নাও এই ক্যাপসুলটা তোমার হাতে আসেনি; ধরে নাও ব্রুডরিগ চূড়ান্ত’ শব্দটা ব্যবহার করেনি। সেলডন কখনো এমন অস্বাভাবিক ভাগ্যের উপর নির্ভর করতেন না।”

“যদি অস্বাভাবিক ভাগ্যের সহায়তা পাওয়া যায়, তা হলে কোনো আইনেই বলা হয়নি যে সেলডন সেই সুযোগ কাজে লাগাতেন না।”

“অবশ্যই। কিন্তু…কিন্তু থামলেন বার তারপর শান্ত এবং নিয়ন্ত্রিত সুরে বললেন, “ঠিক আছে প্রথম কথা ট্রানটরে পৌঁছবে কীভাবে? স্পেস এ এই গ্রহের অবস্থান তুমি জান না। আমারও কো-অর্ডিনেটসগুলো মনে নেই। এমনকি স্পেস এ নিজের অবস্থানও এই মুহূর্তে তোমার জানা নেই।”

“স্পেস এ আপনি পথ হারাবেন না,” দাঁত বের করে হাসল ডেভর্স। এরই মধ্যে কন্ট্রোলের সামনে পৌঁছে গেছে সে। “এখান থেকে সবচেয়ে কাছের গ্রহে যাব। ব্রুডরিগের দেওয়া ক্রেডিট দিয়ে কিনব সবচেয়ে ভালো বিয়ারিং এবং সবার সেরা নেভিগেশন চার্ট।”

“আর পেটে ব্লাস্টারের গুলি খাবো। সম্ভবত এম্পায়ারের এই অংশের প্রতিটা গ্রহে আমাদের চেহারার বর্ণনা পৌঁছে গেছে।”

“ডক,” ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে বলল ডেভর্স, “গ্রাম্য চাষার মতো কথা বলবেন না। রিয়োজ বলেছিল আমি সহজেই আত্মসমর্পণ করেছি এবং ব্রাদার, ঠাট্টা করেনি। এই মহাকাশযানে যথেষ্ট ফায়ার পাওয়ার এবং শক্তিশালী শিল্ড আছে যা দিয়ে ফ্রন্টিয়ারের ভেতরেই যে-কোনো বিপদের মোকাবেলা করতে পারব। তা ছাড়া আমাদের কাছে পারসোন্যাল শিল্ড আছে। এম্পায়ার এর ছেলেরা খুঁজে পায়নি, তারা একটু খুঁজেই পেয়ে যাবে এমনভাবে রাখাও হয়নি।”

“ঠিক আছে,” বললেন বার। “ঠিক আছে। ধরা যাক ট্র্যানটরে পৌঁছলে তুমি। সম্রাটের সাথে কীভাবে দেখা করবে? তোমার কি ধারণা তিনি সকাল বিকাল অফিস করেন?”

“ধরে নিন সেটা নিয়ে ট্রানটরে পৌঁছেই মাথা ঘামাব।”

অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ নাড়লেন বার। “ঠিক আছে। বহুদিনের সাধ মরার আগে ট্র্যানটরে একবার যাবই। তুমি তোমার পথে চলো।”

হাইপার নিউক্লিয়ার মোটর চালু হল, মিটমিট করতে লাগল আলোগুলো, হাইপারস্পেসে ঢোকার ফলে অভ্যন্তরীণ ঝাঁকুনি অনুভব করল যাত্রীদ্বয়।

*

৯. ট্রানটরের বুকে

গ্যালাক্সির এই অংশের নক্ষত্রের সংখ্যা কিছুটা কম। অল্প যে কয়েকটা আছে। সেগুলোকে মনে হয় অরক্ষিত ফসলের ক্ষেতে গজিয়ে উঠা আগাছার মতো। যদিও প্রথমবারের মতো লাথান ডেভর্স তাদের যাত্রাপথ নিখুঁতভাবে হিসেব করতে পারছে। তার মতে সামনের এক লাইটইয়ার দূরত্ব দ্রুত পেরিয়ে যাওয়া দরকার। চতুর্দিকের আকাশে একটা উজ্জ্বল আভা, কর্কশ, মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। যেন বিপজ্জনক রেডিয়েশন সমুদ্রে ভাসছে এমন একটা অনুভূতি।

দশ হাজার নক্ষত্রের এক ঝাকের ঠিক মাঝখানে-যে নক্ষত্রের আলো ঘিরে থাকা ক্ষীণ অন্ধকারকে ভেঙে টুকরো করেছে শতভাগে-রয়েছে সুবিশাল ইম্পেরিয়াল প্ল্যানেট, ট্র্যানটর।

এটা শুধু একটা গ্রহই নয়; এটা হচ্ছে বিশ মিলিয়ন স্টেলার সিস্টেম নিয়ে গড়ে উঠা এক বিশাল সাম্রাজ্যের প্রাণ। এর শুধু একটাই কাজ, প্রশাসন; একটাই লক্ষ্য, সরকার; একটাই উৎপাদিত পণ্য, আইন।

পুরো গ্রহটাকেই প্রকৃত অবস্থা থেকে রূপান্তরিত করা হয়েছে। মানুষ, পোয্য প্রাণী এবং কিছু অণুজীব ছাড়া সারফেসে আর কোনো জীবন্ত বস্তু নেই। ইম্পেরিয়াল প্যালেসের কয়েকশ বর্গকিলোমিটার এলাকা বাদে পুরো গ্রহের আর কোথাও একটা ঘাস পর্যন্ত নেই। নেই পানির কোনো উন্মুক্ত উৎস। শুধু কয়েকটা ভূগর্ভস্থ জলাধার যেখান থেকে পুরো গ্রহে পানি সরবরাহ করা হয়।

চকচকে অবিনশ্বর ধাতু দিয়ে পুরো ট্রানটর আচ্ছাদিত। এটাই আবার বিশাল বিশাল ধাতব কাঠামো যা পুরো গ্রহে গোলকধাঁধা তৈরি করেছে তার ভিত্তি। পায়ে চলা পথ দিয়ে কাঠামোগুলো পরস্পরের সাথে যুক্ত। রয়েছে জালের মতো ছড়ানো হাজার হাজার করিডোের; বদ্ধ অফিসকক্ষ; কয়েক বর্গমাইল জুড়ে বিস্তৃত বিক্রয়কেন্দ্র যেগুলো প্রতিরাতে প্রাণের স্পর্শে সজীব হয়ে উঠে।

পায়ে হেঁটে কেউ ট্র্যানটরের একটা শহর দেখেই শেষ করতে পারবে না, পুরো গ্রহতো অসম্ভব ব্যাপার।

সমগ্র এম্পায়ারের যে ওয়ার ফ্লিট ছিল তার চেয়েও অধিকসংখ্যক মহাকাশযানের বহর ট্রানটরের চল্লিশ বিলিয়ন মানুষের খাবার পৌঁছে দিত প্রতিদিন বিনিময়ে যারা সর্বকালের সবচেয়ে জটিল সরকার ব্যবস্থার সূক্ষ্ম প্রশাসনিক জাল নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া আর কিছুই করত না।

বিশটা কৃষিভিত্তিক বিশ্ব ছিল তার খাদ্য ভাণ্ডার। পুরো মহাবিশ্ব ছিল তার দাস

চারপাশে কঠিন ধাতব অনুভূতি নিয়ে, ট্রেড শিপ ধীরে ধীরে অবতরণ করল একটা বিশাল র‍্যাম্পে, সেখান থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হল বিশাল হ্যাঁঙ্গারে। এরই মধ্যে এই গ্রহের জটিল পেপার-ওয়ার্কের ঠেলায় বিরক্ত হয়ে পড়েছে ডেভর্স।

প্রথমে তাদের থামানো হয় স্পেস এ। সেখানে শত শত প্রশ্ন পাল্টা প্রশ্নের ঠেলায় দম বেরিয়ে যাবার উপক্রম।মুখোমুখি হতে হয় সাইকিক প্রোবের অতি সাধারণ পরীক্ষার। ক্যারেকটারিস্টিক্স এনালাইসিস করা হয় যাত্রীদুজনের, মহাকাশযানের ছবি তোলা হয়। যথা নিয়মে ট্যাক্স প্রদানের পর আইডেন্টিটি কার্ড এবং ভিসার প্রশ্ন উঠে।

ডুসেম বার একজন স্যিউয়েনিয়ান এবং সম্রাটের একজন প্যাট্রিশিয়ান, কিন্তু লাথান ডেভর্স অপরিচিত লোক এবং তার কাছে কোনো পরিচয়পত্র নেই। কর্তব্যরত অফিসার আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করলেও পরিষ্কার বলে দিল যে ডেভর্স গ্রহে ঢুকতে পারবে না। সত্যি কথা বলতে কি তদন্তের জন্য আটকে রাখা হবে।

ভোঝবাজির মতো লর্ড ব্রুডরিগের দেওয়া নতুন একশ ক্রেডিট পকেট থেকে বের করে আনল ডেভর্স। হাত বদল হল দ্রুত। সাথে সাথে পাল্টে গেল অফিসারের আচরণ। নতুন আরেকটা ফরম বের করে সে নিজের হাতেই দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে পূরণ করে ফেলল।

বণিক এবং প্যাট্রিশিয়ান প্রবেশ করল ট্র্যানটরে।

হ্যাঙ্গারে আবার মহাকাশযানের ছবি তুলে তার সাথে যুক্ত করে রাখা হল যাত্রী দুজনের নাম পরিচয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি আদায় করে একটা রিসিপ্ট কপি ধরিয়ে দেওয়া হল তাদের হাতে।

এবং তারপর ডেভর্স নিজেকে আবিষ্কার করল একটা বিশাল টেরেসে, মাথার উপর থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে সূর্যের উজ্জ্বল সাদাটে আলো, নিচে মহিলারা গল্প করছে, ছুটোছুটি করছে শিশুরা, পুরুষরা অলসভাবে পানীয়ের গ্লাস হাতে নিয়ে বিরাট আকারের টেলিভাইজরে এম্পায়ারের খবর দেখছে।

নির্দিষ্ট পরিমাণ ইরিডিয়াম কয়েন জমা দিয়ে বার একটা শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র বেছে নিলেন। ট্র্যানটর ইম্পেরিয়াল নিউজ। সম্রাটের আনুষ্ঠানিক মুখপাত্র বলা হয় এটাকে। নিউজ রুমের পেছন থেকে অতিরিক্ত কপি ছাপানোর মৃদু শব্দ ভেসে আসছে। ইম্পেরিয়াল নিউজ অফিস এখান থেকে করিডোরের হিসেবে দশ হাজার মাইল এবং আকাশযানের হিসেবে ছয় হাজার মাইল দূরে-ঠিক এই মুহূর্তে গ্রহের বিভিন্ন প্রান্তে দশ মিলিয়ন নিউজরুমে একই কপির দশমিলিয়ন সেট ছাপা হচ্ছে।

খবরের শিরোনামগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে হালকা গলায় জিজ্ঞেস করলেন বার,”আমরা প্রথমে কী করব?”

একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নিজের হতাশা দূর করার চেষ্টা করল ডেভর্স। নিজের জগৎ ছেড়ে সে অন্য এক জগতে এসে পড়েছে, এমন এক বিশ্ব যার জটিলতা, অধিবাসী এবং ভাষার কিছুই সে বুঝছে না। চারপাশের চর্চকে ধাতব টাওয়ার এবং দৃষ্টিসীমা ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা সীমাহীন প্রাচুর্য দমিয়ে দিয়েছে তাকে। ওয়ার্ল্ড মেট্রোপলিস এর প্রাচুর্যময় জীবন দেখে নিজেকে মনে হচ্ছে কেমন নিঃসঙ্গ আর তুচ্ছ।

“সেটা ঠিক করার ভার আপনার উপর ছেড়ে দিলাম, ডক।” বলল সে।

বার পুরোপুরি শান্ত, কণ্ঠস্বর নিচু। “তোমাকে বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু নিজের চোখে না দেখলে তোমার বিশ্বাস হত না। তুমি জানো দৈনিক কতজন লোক

ম্রাটকে দেখার জন্য ভিড় জমায়? প্রায় এক মিলিয়ন। তিনি কতজনকে দেখা দেন? প্রায় দশ। আমাদেরকে সিভিল সার্ভিসের মাধ্যমে যেতে হবে, ফলে কাজটা আরো কঠিন। অভিজাতদের সাথে পাল্লা দিয়ে পারব না।”

“আমাদের কাছে প্রায় এক লাখ ক্রেডিট আছে।”

“মাত্র একজন পিআর অব দ্য রিএলম এর পেছনেই সেটা ব্যয় হয়ে যাবে। আর সম্রাটের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করতে আরো তিন বা চার লাখের প্রয়োজন হবে। হয়তো পঞ্চাশ জন চিফ কমিশনার এবং সিনিয়র সুপারভাইজরকে সন্তুষ্ট করতে হবে, তবে তাদেরকে মাত্র এক শ ক্রেডিট করে দিলেই হবে। কথা বলব আমি। প্রথম কারণ তোমার কথা ওরা বুঝবে না, দ্বিতীয় কারণ ইম্পেরিয়াল ব্যক্তিদের ঘুষ কীভাবে দিতে হয় তুমি জান না। বিশ্বাস করো এটা একটা আর্ট। আহ পেয়েছি!”

ইম্পেরিয়াল নিউজের তৃতীয় পাতায় যা খুঁজছিলেন সেটা পাওয়া গেল। পত্রিকাটা বাড়িয়ে ধরলেন ডেভর্সের দিকে।

ধীরে ধীরে পড়ল ডেভর্স। বাক্যগুলো অদ্ভুত হলেও বুঝতে অসুবিধা হল না। রাগের সাথে পত্রিকাটা ভাজ করল সে, করতলের পেছন দিক দিয়ে পত্রিকায় একটা বাড়ি দিয়ে বলল, “এই কথা বিশ্বাস করা যায়?”

“কিছুটা”, শান্ত গলায় জবাব দিলেন বার। “ফাউণ্ডেশন ফ্লিট পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এটা বিশ্বাস করা অসম্ভব। যদিও এই কথাটা তারা হয়তো বহুবার প্রকাশ করেছে। সম্ভবত তারা যুদ্ধকালীন সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রের বহুদূরে বসে ক্যাপিটাল ওয়ার্ল্ডে যেভাবে যুদ্ধের সংবাদ দেওয়া হয় সেই কৌশল অবলম্বন করছে। রিয়োজ আরেকটা যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন, অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। এখানে বলা হয়েছে তিনি লরিস দখল করেছেন। এটাই কি কিংডম অব লরিস এর ক্যাপিটাল প্ল্যানেট?”

“হ্যাঁ,” গোমড়ামুখে বলল ডেভর্স, “আর কিংডম অব লরিস এত বড় নাম বলার দরকার নেই। ফাউণ্ডেশন থেকে এটার দূরত্ব বিশ পারসেক এর ও কম, ডক, আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে।”

শ্রাগ করলেন বার, “ট্রানটরে কোনোকিছুই দ্রুত করা যায় না। সেই চেষ্টা করলে নিজেকে তুমি এটমিক ব্লাস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবে।”

“কতদিন লাগবে?”

“ভাগ্য ভালো হলে, একমাস। এক মাস এবং আমাদের এক লাখ ক্রেডিটস-সেটাতেও কুলোবে কিনা জানি না। এবং আমি ধরে নিচ্ছি যে এই মুহূর্তে

সম্রাট গ্রীষ্মকালীন অবকাশ গ্রহে বেড়াতে যাবার কথা ভাবছেন না। সেই সময় তিনি কোনো আবেদনকারীর সাথেই দেখা করেন না।”

“কিন্তু ফাউণ্ডেশন-”

“নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। এসো, ডিনারের সময় হয়েছে। আমি ক্ষুধার্ত। এবং তারপরে পুরো সন্ধ্যাটাই আমাদের সামনে পড়ে আছে। ইচ্ছে মতো কাটানো যাবে। ট্রানটর বা এরকম কোনো গ্রহ জীবনে আর কখনো দেখার সুযোগ হবে না।”

.

আউটার প্রভিন্স বিষয়ক দফতরের হোম কমিশনার অসহায় ভঙ্গিতে বেটে ও মোটা হাতগুলো দুপাশে ছড়িয়ে দিলেন, তারপর ক্ষীণদৃষ্টি সম্পন্ন লোকের মতো তাকালেন পিটপিট করে। কিন্তু, ভদ্রমহোদয়গণ, সম্রাট অসুস্থ। আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানিয়ে কোনো লাভ হবে না। হিজ ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি গত সপ্তায় কারো সাথে দেখা করেননি।”

“তিনি আমাদের সাথে দেখা করবেন।” আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন বার। “আপনি শুধু প্রিভি সেক্রেটারির দপ্তরের কারো সাথে আমাদের যোগাযোগ করিয়ে দিন।”

“অসম্ভব,” জোর গলায় বললেন কমিশনার। “আমার চাকরি চলে যাবে। কী কাজে এসেছেন সেটা আরো বিস্তারিত বলতে হবে। আপনাদের আমি সাহায্য করতে চাই। কিন্তু আমাকে এমন একটা স্পষ্ট কারণ দেখাতে হবে যেন আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বোঝাতে পারি।’

“আপনাকে যদি বলাই যায় তা হলে সেটা হিজ ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টির সাথে দেখা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ হয় কীভাবে? আমাদের কাজটা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। আমি আপনাকে একটা সুযোগ নিয়ে দেখতে অনুরোধ করছি। আমাদের কাজ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। যদি হিজ ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টির কাছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয় তা হলে আজকে আমাদের সাহায্য করার পুরস্কার আপনি পাবেন।”

“হ্যাঁ, কিন্তু কথা শেষ না করে শুধু শ্রাগ করলেন কমিশনার।

“ঝুঁকি আছে,” স্বীকার করলেন বার। স্বাভাবিক ভাবেই, ঝুঁকি নিলে তার ক্ষতিপূরণ পাওয়া উচিত। আপনি দয়া করে আমাদের সমস্যা বলার সুযোগ দিয়েছেন সেজন্য আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু আপনি যদি আমাদের আরেকটু সুযোগ দিতেন-”

ভুরু কুঁচকালো ডেভর্স। এই একই কথা একটু অদলবদল করে গত এক মাসে সে অনেকবারই শুনেছে। সবসময়ই আলোচনা শেষ হতে চঞ্চকে ক্রেডিট বিলের হাতবদলের মাধ্যমে। আগের ঘটনাগুলোতে বিলগুলো দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যেত গ্রহীতার পকেটে। কিন্তু এবারের ঘটনা ভিন্ন। বিলগুলো পড়ে আছে সামনের টেবিলে, উন্মুক্ত। ধীরে ধীরে সেগুলো গুনলেন কমিশনার, উল্টেপাল্টে দেখলেন ভালোভাবে।

তার কণ্ঠস্বরে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য লক্ষ্য করা গেল। “বেক বাই প্রিভি সেক্রেটারি, হ্যাঁহ্? গুড মানি!”

“আসল কথায় আসা যাক-” তাগাদা দিলেন বার।

“না, দাঁড়ান,” কমিশনার বাধা দিলেন, “ধীরে ধীরে। আমি আসলেই জানতে চাই আপনারা কেন এসেছেন। এই অর্থগুলো একেবারে নতুন, এবং আপনাদের কাছে নিশ্চয়ই অনেক আছে। এখন মনে পড়েছে আমার আগে আপনারা আরো কয়েকজন অফিসারের সাথে দেখা করেছেন। এবার ঝেড়ে কাশুন তো।

“আপনি আলোচনা কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছেন, বুঝতে পারছি না।” বললেন বার।

“কেন? শুনুন, এর থেকে প্রমাণ হয় যে আপনারা অবৈধভাবে এই গ্রহে এসেছেন, যেহেতু আপনার বোবা সঙ্গীর এন্ট্রি কার্ড এবং আইডিন্টিফিকেশন যথেষ্ট নয়। তিনি সম্রাটের গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন।”

“আমি অস্বীকার করছি।”

“কোনো লাভ হবে না,” কমিশনার হঠাৎ রুক্ষ স্বরে বললেন। “যে অফিসার এক শ ক্রেডিটের বিনিময়ে আপনাদের কার্ড সই করেছে, সব স্বীকার করেছে সে-অবশ্যই চাপের মুখে । আমরা অনেক কিছুই জানি।”

“আপনি যদি বোঝাতে চান যে, ঝুঁকির তুলনায় আমরা যা দিচ্ছি সেটা যথেষ্ট নয়-”

হাসলেন কমিশনার, “ঠিক উল্টোটা, যথেষ্ট হয়েও অনেক বেশি। “বিলগুলো তিনি সরিয়ে রাখলেন একপাশে। “যা বলছিলাম, সম্রাট নিজেই আপনাদের ব্যাপারে আগ্রহী। কিছুদিন আগে আপনারা জেনারেল রিয়োজের অতিথি ছিলেন, এটা কি মিথ্যে? তার বাহিনীর কাছ থেকে পালিয়ে এসেছেন, এটা কি মিথ্যে? লর্ড ব্রুডরিগের দেওয়া বেশ ভালো পরিমাণ সম্পত্তি আছে আপনাদের কাছে, এটা কি মিথ্যে? সংক্ষেপে আপনারা একজোড়া স্পাই এবং গুপ্তঘাতক এখানে এসেছেন-বেশ, কে আপনাদের ভাড়া করেছে সেটা বললেই ভালো করবেন।”

“একজন সামান্য কমিশনার-এর,” রাগের সাথে বললেন বার, “আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার অধিকার আছে আমি সেটা অস্বীকার করছি। আমরা যাচ্ছি।”

“আপনারা যেতে পারবেন না,” উঠে দাঁড়ালেন কমিশনার, এখন আর তাকে ক্ষীণদৃষ্টির মনে হচ্ছে না। “এখন কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না। পরবর্তীতে কঠিন সময়ের জন্য তুলে রাখুন সেগুলো। আর আমি কমিশনার নই। ইম্পেরিয়াল পুলিশের একজন লেফটেন্যান্ট। আপনাদের গ্রেপ্তার করা হল।”

মুখের হাসির সাথে লেফটেন্যান্ট এর হাতে এখন শোভা পাচ্ছে চৰ্চকে ব্লাস্টার। “আপনাদের চেয়েও নামি দামি লোকদের এখন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আমরা একটা ভীমরুলের চাক পরিষ্কার করছি।”

আস্তে আস্তে নিজের অস্ত্রের দিকে হাত বাড়ালো ডেভর্স। মুখের হাসি আরো চওড়া হল লেফটেন্যান্ট-এর। কন্টাক্ট এ চাপ দিল, নিখুঁতভাবে তীব্র রশ্মি আঘাত করল ডেভর্স এর বুকের ঠিক মাঝখানে-তার পার্সোন্যাল শিল্ডে বাধা পেয়ে আলোর শত টুকরা হয়ে ছিটকে পড়ল চারদিকে।

এবার ফায়ার করল ডেভর্স, লেফটেন্যান্ট এর মাথা ছিটকে পড়ল মাটিতে, মুখের হাসি এখনও মলিন হয়নি, দেয়ালে তৈরি হওয়া নতুন ফুটো দিয়ে আলো এসে পড়ায় মনে হচ্ছে যেন দাতালো কোনো জন্তু।

পিছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল তারা।

“জাহাজে পৌঁছতে হবে দ্রুত,” হিসহিস করে বলল ডেভর্স। ভাগ্যকে অভিশাপ দিল। “আরেকটা পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। কসম খেয়ে বলতে পারি স্পেস ফিয়েও আমাদের বিপক্ষে কাজ করছে।”

খোলা জায়গায় বেরিয়ে আসার পর তারা বুঝতে পারল বিরাট টেলিভাইজরের সামনে ভিড় বাড়ছে ক্রমশ। দাঁড়ানোর সময় নেই; টুকরো কিছু কথা কানে ভেসে এলেও মনযোগ দিল না। কিন্তু হ্যাঁঙ্গারের প্রশস্ত দরজার দিকে দৌড়ানোর সময় বার ইম্পেরিয়াল নিউজের একটা কপি ছিনিয়ে নিলেন। হ্যাঁঙ্গারের একটা শূন্য জায়গায় তাদের মহাকাশযান দাঁড়িয়ে আছে।

“ওদের কাছ থেকে পালাতে পারবে?” জিজ্ঞেস করলেন বার।

ট্রাফিক পুলিশের দশটা শিপ ভীষণ জোরে পালাতে থাকা শিপ-এর পিছু নিল, যে শিপ আইনসঙ্গত রেডিও-বিমড পথ ছেড়ে হঠাৎ এত দ্রুত ছুটল যে দ্রুতগতির পূর্বের সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে গেল। আরো পিছনে সিক্রেট পুলিশের হালকা পাতলা শিপগুলো নির্দিষ্ট বর্ণনার একটা শিপ এবং দুজন খুনীকে ধরার জন্য ছুটোছুটি শুরু করেছে।

“ওয়াচ মি,” বলল ডেভর্স, এবং ট্র্যানটরের সারফেস থেকে মাত্র দুই হাজার মাইল উপরে উঠেই শিফট করল হাইপারস্পেসে। গ্রহের এত কাছে শিফট করার কারণে প্রায় অচেতন হয়ে পড়লেন বার, আর ব্যাখ্যার অতীত একধরনের আতঙ্ক ঘিরে ধরল ডেভর্সকে, কিন্তু এক আলোক বর্ষ দূরে তাদের সামনে মহাকাশ একেবারে পরিস্কার।

নিজের মহাকাশযান নিয়ে সীমাহীন গর্ব প্রকাশ পেল ডেভর্সের কথায়। কোনো ইম্পেরিয়াল শিপ আমাকে ধরতে পারবে না।”

তারপর তিক্ত সুরে বলল, “কিন্তু পালিয়ে যাব কোথায়, ওদের সাথে আমরা পারব না। কি করার আছে?”

বার দুর্বলভাবে নিজের কটে নড়েচড়ে বসলেন, হাইপারশিফটের প্রভাব এখনো দূর হয়নি। শরীরের প্রতিটি মাংসপেশি শক্ত হয়ে আছে। “কাউকে কিছু করতে হবে না। সব শেষ হয়ে গেছে। দেখ!” বললেন তিনি।

ইম্পেরিয়াল নিউজের কপিটা এগিয়ে দিলেন, প্রথম পাতার হেডলাইনটাই বণিকের বিষম খাওয়ার জন্য যথেষ্ট।

“দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি এবং গ্রেপ্তার-রিয়োজ এবং ব্রুডরিগ,” বিড় বিড় করে পড়ল সে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল বার এর দিকে, “কেন?”

“এখানে বিস্তারিত লেখা নেই। কিন্তু তাতে কি? ফাউণ্ডেশন-এর সাথে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। এই মুহূর্তে বিদ্রোহ চলছে সিউয়েনায়। তুমি নিজেই পড়,” তার কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। কোনো একটা প্রদেশে নেমে বিস্তারিত জেনে নেব। এখন ঘুমাব আমি।”

ঠিক কথামতো কাজ করলেন তিনি।

ঘাসফড়িঙের মতো একটা চক্কর দিয়ে ট্রেড শিপ ফিরে চলল ফাউণ্ডেশন-এর দিকে।

*

১০. যুদ্ধ শেষ

অস্বস্তি বোধ করছে লাথান ডেভর্স, সেই সাথে অসন্তুষ্ট। দার্শনিক সুলভ ঔদাসিন্যের সাথে সে মেয়রের আড়ম্বরপূর্ণ প্রশংসা এবং যুদ্ধে স্বীকৃতি স্বরূপ ক্রিমসন রিবন গ্রহণ করেছে। পুরো উৎসবে তার অংশগ্রহণ এখানেই শেষ হয়ে যায় তারপরে। কিন্তু ভদ্রতার কারণেই তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। প্রধানত: এই ভদ্রতার কারণেই অভ্যাস অনুযায়ী শব্দ করে হাই তুলতে পারছে না বা চেয়ারের উপর পা তুলে বসতে পারছে না।

দীর্ঘদিন মহাকাশে কাটানোর ফলে এই অভ্যাস গড়ে উঠেছে তার। ওখানেই সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

ডুসেম বারের নেতৃত্বে স্যিউয়েনিয়ান প্রতিনিধিরা চুক্তিতে সই করেছে এবং স্যিউয়েনা হল প্রথম প্রদেশ যে এম্পায়ার এর পলিটিক্যাল শাসন থেকে বেরিয়ে এসে ফাউণ্ডেশন-এর অর্থনৈতিক প্রভাবে যোগ দিল।

স্যিউয়েনা যখন বিদ্রোহ করে তখন এম্পায়ার এর বর্ডার ফ্লিটের পাঁচটা যুদ্ধযান ধরা পড়ে। চকে বিশাল এবং ভয়ংকর যুদ্ধযানগুলো শহরের রাস্তা প্রদক্ষিণের সময় উৎফুল্ল জনতা হর্ষধ্বনি দিয়ে সেগুলোকে স্বাগত জানায়।

এখন বসে বসে শুধু পান করা, ভদ্রতা দেখানো আর সামান্য আলোচনা।

একটা কণ্ঠস্বর ডাকল তাকে। ফোরেল; যার এক সকালের মুনাফা দিয়ে তার মতো বিশ জনকে একবারে কেনা যাবে। সেই ফোরেল এখন সদয় ভঙ্গিতে আঙুল তুলে তাকে ডাকছে।

ব্যালকনিতে বেরিয়ে আসতেই রাতের ঠাণ্ডা বাতাস ঝাঁপটা মারল মুখে। নিয়ম অনুযায়ী কুর্নিশ করল সে, একই সাথে এলোমেলো দাড়ি ঠিক করে নিল। বার ছিলেন সেখানে, হাসছেন। তিনি বললেন, “ডেভর্স, আমাকে তোমার বাঁচানো উচিত। অভিযোগ আমি নাকি অতিরিক্ত বিনয়ী, ভয়ংকর অপরাধ।”

“ডেভর্স,” কথা বলার সময় মুখ থেকে সিগার নামালো ফোরেল, “লর্ড বার-এর মতে ক্লীয়নের রাজধানীতে তোমার যাওয়ার সাথে রিয়োজের বরখাস্তের কোনো সম্পর্ক নেই।”

“মোটেই নেই, কাটা কাটা স্বরে বলল ডেভর্স। “ফিরে আসার পথে আমরা বিচারের ব্যাপারে জানতে পারি, পরিষ্কার বোঝা যায় পুরো ঘটনাটা সাজানো। প্রচার করা হচ্ছে সম্রাটের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কার্যকলাপের জন্য জেনারেলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”

“অথচ সে নির্দোষ?”

“রিয়োজ?” মাঝখানে নাক গলালেন বার। “হ্যাঁ, গ্যালাক্সির কসম, হ্যাঁ। ব্রুডরিগ হচ্ছে আসল বেঈমান, কিন্তু কখনো ধরা যায়নি। এটা হচ্ছে আইনের ফাঁদ। প্রয়োজনীয় এবং অবশ্যম্ভাবী।”

“বাই সাইকোহিস্টোরিক্যাল নেসেসিটি, আমার ধারণা।” প্রচলিত ভঙ্গিতে রসিকতা করল ফোরেল।

“ঠিক,” বার সিরিয়াস, “আগে বোঝা যায়নি, কিন্তু পুরো ঘটনা শেষ হওয়ার পর আমি-বেশ, বলা যায় যে বই এর পিছনে উত্তর দেখে নিলেই সমস্যাটা যেমন সহজ হয়ে যায়, সেরকমই আরকি। এখন আমরা দেখছি যে এম্পায়ার এর সামাজিক ব্যবস্থা রাজ্য দখলের জন্য যুদ্ধকে অসম্ভব করে তুলেছে। সম্রাট যদি দুর্বল হন, তা হলে জেনারেলদের মাঝে সিংহাসন দখলের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। সম্রাট শক্তিশালী হলে হয়তো সাময়িকভাবে এম্পায়ার এর বিভিন্ন অংশগুলো বিচ্ছিন্ন হবে না, একটা স্থবিরতা তৈরি হবে, থেমে যাবে সকল অগ্রগতি।”

ভুর ভুর করে ধোয়া ছাড়ল ফোরেল। “ঠিকমতো বোঝাতে পারেননি, লর্ড বার।”

সামান্য হাসলেন বার। “আমারও মনে হয়। সাইকোহিস্টোরির প্রশিক্ষণ না থাকাতে এই সমস্যা। সাদামাটা কথা দিয়ে গাণিতিক সমীকরণ বোঝানো কঠিন। ঠিক আছে দেখা যাক

বার চিন্তা করছেন। রেলিং এ আয়েশি ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে ফোরেল। ডেভর্স মখমলের মতো কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে ট্র্যানটরের কথা।

তারপর বার বললেন, “দেখুন, স্যার, আপনি-এবং ডেভর্স-এবং কোনো সন্দেহ নেই যে সবাই ধারণা করেছিল যে এম্পায়ারকে পরাজিত করতে হলে সম্রাট এবং তার জেনারেলের মাঝে বিভেদ তৈরি করতে হবে। আপনি এবং ডেভর্স এবং প্রত্যেকের ধারণা ঠিকই ছিল-প্রথম থেকেই, অন্তত ইন্টারনাল ডিজইউনিয়নের মূলনীতিগুলো বিবেচনা করলে এই কথা বলা যায়।

“কিন্তু আপনারা ধরে নিয়েছিলেন যে একজন ব্যক্তির আচরণকে প্রভাবিত করে এই ইন্টারনাল ডিজইউনিয়ন তৈরি করা যাবে। ভুল হয়েছিল এখানেই। আপনারা ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। উচ্চাকাঙ্খ এবং ভয় প্রদর্শনের উপর নির্ভর করেছেন। কিন্তু দুর্ভোগ ছাড়া আর কিছু অর্জিত হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে সাথে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে থাকে।

“আর এই উদ্দাম বিশৃঙ্খলার মাঝেও সেলডন টাইডাল ওয়েভ নীরবে নিরবিচ্ছিন্নভাবে-কিন্তু অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছিল।”

ঘুরলেন ডুসেম বার। রেলিং এ ভর দিয়ে তাকালেন বিজয় উৎসবে মেতে উঠা নগরীর আলোক মালার দিকে। তিনি বললেন, “একটা অদৃশ্যহাত আমাদের ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে; ক্ষমতাশালী জেনারেল এবং মহান ম্রাট; আমার বিশ্ব এবং আপনাদের বিশ্ব, সবাইকে-সেটা হচ্ছে হ্যারি সেলডনের অদৃশ্য হাত। তিনি জানতেন রিয়োজের মতো ব্যক্তিকে পরাজিত হতেই হবে, যেহেতু সাফল্যই তার ব্যর্থতা ডেকে আনবে, এবং যত বেশি সফল হবে ব্যর্থতা ততই নিশ্চিত হবে।”

“এবারও পরিষ্কার হলনা।” শুকনো গলায় বলল ফোরেল।

“এক মিনিট,” আন্তরিকভাবে কথা বলছেন বার, “পুরো পরিস্থিতিটা আবার চিন্তা করুন। একজন দুর্বল জেনারেল কখনোই আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। দুর্বল সম্রাটের ক্ষমতাবান জেনারেলও আমাদের ক্ষতি করতে পারবেনা; কারণ সে তখন আরো লাভজনক বিষয়ে মনযোগ দেবে। বিভিন্ন ঘটনায় আমরা দেখেছি শেষ দুই শতাব্দীর তিন চতুর্থাংশ সম্রাট সিংহাসনে বসার আগে বিদ্রোহী জেনারেল নয়তো বিদ্রোহী ভাইসরয় ছিলেন।

“কাজেই একমাত্র শক্তিশালী জেনারেল এবং শক্তিশালী সম্রাট এই দুয়ের কম্বিনেশন ফাউণ্ডেশন-এর ক্ষতি করতে পারে। কারণ শক্তিশালী সম্রাটকে সহজে সিংহাসনচ্যুত করা যায় না আর শক্তিশালী জেনারেলকে সবসময় ক্ষমতা থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করা হবে।

“কিন্তু কীভাবে সম্রাটের ক্ষমতা ধরে রাখা যাবে? ক্লীয়নের ক্ষমতার উৎস কোথায়? পরিস্কার। ক্লীয়ন শক্তিশালী, কারণ সে তার আশে পাশে কাউকে ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে দেয়নি। হঠাৎ ধনী হয়ে উঠা কোনো সভাসদ বা অধিক জনপ্রিয়তা অর্জনকারী জেনারেল সবাই বিপজ্জনক। এম্পায়ার এর সাম্প্রতিক ইতিহাস প্রমাণ করে যে সম্রাটকে শক্তিশালী হতে হলে তাকে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী হতে হয়।

“রিয়োজ অনেক যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছেন, ফলে সম্রাটের মনে সন্দেহ দানা বাধতে শুরু করে। সমসাময়িক পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে সন্দেহবাদী হয়ে উঠতে। রিয়োজ ঘুষ নিতে অস্বীকার করেছে? খুবই সন্দেহজনক; নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে। তার সবচেয়ে বিশ্বস্থ সভাসদ রিয়াজের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছে? খুবই সন্দেহজনক; নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে। মাত্র একজনের আচরণের কারণেই সন্দেহ তৈরি হয়নি-সেকারণেই একজন ব্যক্তির আচরণকে প্রভাবিত করার আমাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। রিয়াজের মাত্রাতিরিক্ত সফলতাই ছিল সন্দেহজনক। সেজন্যেই তাকে রাজধানীতে ডেকে নিয়ে অভিযুক্ত করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয় এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

“দেখুন, ঘটনা প্রবাহের এমন কোনো কম্বিনেশন নেই যা ফাউণ্ডেশন-এর বিজয়কে প্রতিহত করতে পারে। আমরা বা রিয়োজ যতই চেষ্টা করি না কেন এটা ঘটতই।”

নীরবভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ফাউণ্ডেশন ধনকুবের। “তাই! কিন্তু সম্রাট এবং জেনারেল একই ব্যক্তি হলে কি ঘটত? হ্যাঁ? কী হত তা হলে? এ বিষয়ে আপনি কিছু বলেননি। কাজেই কিছুই প্রমাণ হয় না আপনার কথায়।”

শ্রাগ করলেন বার। “আমি কিছুই প্রমাণ করতে পারব না। যেখানে এম্পায়ার এর প্রতিটি আমলা, প্রতিটি ক্ষমতাবান ব্যক্তি, প্রতিটি দস্যু সিংহাসন দখলের চেষ্টা করে এবং প্রায়ই সফল হয়-তা হলে সম্রাটকে যদি আগে থেকেই গ্যালাক্সির সুদূরতম প্রান্তে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়, তিনি শক্তিশালী হলেই বা কি হবে। রাজধানীতে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তিনি কতদিন দূরে থাকতে পারবেন। এম্পায়ার এর সামাজিক পরিবেশ সেই সময় কমিয়ে আনবে।

“রিয়োজকে আমি বলেছিলাম যে এম্পায়ার এর পুরো শক্তি দিয়েও ফাউণ্ডেশনকে পরাজিত করা যাবে না।”

“চমৎকার! চমৎকার!” অত্যন্ত খুশি হয়েছে ফোরেল। “তা হলে আপনি বলছেন যে এম্পায়ার আর আমাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে না।”

“আমার সেরকমই ধারণা,” স্বীকার করলেন বার। “সত্যি কথা বলতে কি এই বছরটা পার করতে পারবেন না ক্লীয়ন। তারপর খুব দ্রুত কয়েকবার ক্ষমতার পালাবদল ঘটবে, অর্থাৎ এটা হতে পারে এম্পায়ার এর সর্বশেষ সিভিল ওয়ার।”

“তা হলে,” বলল ফোরেল, “আর কোনো শত্রু নেই।”

বার চিন্তিত। “সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন আছে।”

“এ্যাট দ্য আদার এ্যাণ্ড অব দ্য গ্যালাক্সি? নট ফর দ্য সেঞ্চুরি।”

এই কথায় ঝট করে ঘুরল ডেভর্স, থমথমে চেহারা নিয়ে দাঁড়ালো ফোরেল-এর মুখোমুখি। “ঘরের ভিতরে শত্রু থাকতে পারে।”

“তাই?” ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল ফোরেল। “কে হতে পারে, উদাহরণ দাও দেখি।”

“যেমন, জনগণ, হয়তো তারা নিজেদের আয় রোজগার বাড়ানোর চেষ্টা করবে, ধনসম্পদ মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে জমা হতে বাধা দেবে। কী বলছি বুঝতে পারছেন?”

আস্তে, আস্তে, ফোরেলের চোখের আলো নিভে গেল, তার বদলে স্থান করে নিল সীমাহীন ঘৃণা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *