দ্বিতীয় পর্ব : দ্য মিউল
মিউল–গ্যালাকটিক ইতিহাসের সমপর্যায়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের তুলনায় মিউল সম্বন্ধে বেশি কিছু জানা যায়নি। যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তার বেশিরভাগই পাওয়া গেছে মিউলের প্রতিপক্ষের কাছ থেকে এবং বিশেষ করে সেই নববিবাহিত তরুণী–
এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাকটিকা
১১. বর কনে
প্রথম দর্শনেই হেভেন পছন্দ হল না বেইটার। তার স্বামী দেখিয়ে দিল-গ্যালাক্সির প্রান্তে অসীম শূন্যে হারিয়ে যাওয়া একটা নিপ্রভ নক্ষত্র। পাতলাভাবে ছড়িয়ে থাকা নক্ষত্রের শেষ আঁক থেকে অনেক দূরে, যেখানে নিঃসঙ্গ অবস্থায় অনিয়মিত আলো বিকিরণ করছে। সব মিলিয়ে কেমন যেন হতচ্ছাড়া আর অনাকর্ষক।
টোরান ভালোভাবেই জানে যে এই রেড ডোয়ার্ফএ নববিবাহিত জীবন শুরু করাটা চিত্তাকর্ষক হবে না। এটা ভেবেই ঠোঁট বাঁকা করল। “আমি জানি, যে-এখানে তোমার ভালো লাগবে না। মানে ফাউণ্ডেশন থেকে এখানে এসে।”
“জঘন্য, টোরান। তোমাকে আমার বিয়ে করা উচিত হয়নি।”
এই কথায় তার স্বামীপ্রবর আঘাত পেল এবং সেটা গোপন করার আগেই তার সেই বিশেষ উষ্ণ গলায় বলল, “এবার ঠোঁট ফুলিয়ে তীর বেঁধা পাখির মতো কাতর দৃষ্টিতে তাকাও-আমার কাঁধে মাথা রাখার আগে যেভাবে তাকাতে, আর আমি তোমার চুলে হাত বুলিয়ে দেই। তুমি অন্য কিছু শুনতে চেয়েছিলে, তাই না? আশা করেছিলে আমি বলব, তুমি আমাকে যেখানে নিয়ে যাবে আমি সেখানেই সুখী হব, টোরান!’ অথবা তুমি পাশে থাকলে ইন্টারস্টেলার গহ্বরে গিয়েও ঘর বাঁধতে পারি! স্বীকার করে নাও।”
স্বামীর দিকে একটা আঙুল তুলল সে এবং টোরান কামড় দেওয়ার আগেই ঝট করে সরিয়ে আনল।
“যদি আমি হার মেনে নেই, স্বীকার করি তোমার কথাই ঠিক, তা হলে তুমি ডিনার তৈরি করবে?” বলল টোরান।
রাজি হয়ে মাথা নাড়ল বেইটা আর সে শুধু হাসি মুখে তাকিয়ে রইল।
এমনকি দ্বিতীয়বার তাকিয়েও বেইটাকে গড়পড়তা মেয়েদের মতো সুন্দরী বলা যাবে না-এটা টোরানকে স্বীকার করতেই হবে। মসৃণ চৰ্চকে কালো চুল। মুখ কিছুটা প্রশস্ত। কিন্তু মেহগনি রঙের চোখদুটো হাসছে সবসময়, ঘন ভুরু সে দুটোকে আলাদা করে রেখেছে ফর্সা মসৃণ কপাল থেকে।
তার জীবনবোধ দৃঢ় এবং কঠোর বাস্তবমুখী, তারপরেও হৃদয়ের এক কোণায় ধারণ করে রেখেছে ভালবাসার উষ্ণ প্রস্রবণ, খোঁচা মেরে যা কখনো বের করে আনা যাবে না। শুধু জানতে হবে সেই প্রস্রবণে পৌঁছানোর সঠিক উপায়।
অপ্রয়োজনেই কিছুক্ষণ কন্ট্রোলগুলো নাড়ল টোরান, তারপর বসল আয়েশ করে। আর মাত্র একটা ইন্টারস্টেলার জাম্প এবং বহু মিলিমাইক্রো পারসেক সোজা পথে এগোনোর পর ম্যানুয়ালি চালাতে হবে। চেয়ারের পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে মাথা হেলিয়ে স্টোররুমের দিকে তাকাল সে, বেইটা সেখানে অভ্যস্ত হাতে ডিনারের ব্যবস্থা করছে।
বেইটার প্রতি তার আচরণ অনেকটা যুদ্ধজয়ী সৈনিকের মতো-কারণ,তিন বছরের সীমাহীন হীনম্মন্যতা থেকে সে বেরিয়ে আসতে পেরেছে বিজয়ীর মতো।
সে একজন প্রভিন্সিয়াল-শুধু তাই নয় একজন দলত্যাগী বণিকের সন্তান। আর বেইটা খোদ ফাউণ্ডেশন-এর নাগরিক-শুধু তাই নয় হোবার ম্যালোর বংশধর।
এসব কারণেই অস্বস্তি বোধ করছে। হেভেনের মতো একটা পাথুরে বিশ্ব যার শহরগুলো সব পাহাড়ের গুহার ভেতর-যেগুলোকে বলা হয় কেভ সিটি-সেখানে নিয়ে আসা যথেষ্ট খারাপ। ফাউণ্ডেশন-এর প্রতি বণিকদের আক্রোস-অত্যাধুনিক নগরবাসীদের প্রতি তাদের চরম ঘৃণার মুখোমুখি তাকে দাঁড় করানোটা হচ্ছে জঘন্য।
কিন্তু কিছু করার নেই-সাপারের পরেই, শেষ জাম্প।
হেভেনকে মনে হচ্ছে টকটকে লাল আগুনের গোলা, এবং দ্বিতীয় গ্রহটার অর্ধেক মনে হচ্ছে জোড়াতালি দেওয়া আলোর বৃত্ত, কিনারা দিয়ে বায়ুমণ্ডলের আভা বেরিয়ে আসছে, বাকি অর্ধেক অন্ধকার। সামনে ঝুঁকে ভিউটেবলের দিকে তাকাল বেইটা, সেখানে মাকড়সার জালের মতো অনেক রৈখার মাঝখানে হেভেন দুই এর চমৎকার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।
“প্রথমে তোমার বাবার সাথে দেখা করতে চাই,” গম্ভীর গলায় বলল সে। “যদি তিনি আমাকে পছন্দ না করেন—”
“তা হলে,” নিরাসক্ত গলায় বলল টোরান, “তুমিই হবে প্রথম সুন্দরী মহিলা যে তার মনে এই ধারণা তৈরি করবে। একটা হাত খোয়ানোর আগে এবং গ্যালাক্সি চষে বেড়ানো থামানোর আগে বাবা-নিজেই জিজ্ঞেস করো, কানের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। এক সময় আমি মনে করতাম সব বানিয়ে বলছে। কারণ একই গল্প কখনো দ্বিতীয়বার বলার সময় ঠিক আগের মতো করে বলত না।”
হেভেন দুই দ্রুত তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। নিচে ভূমি বেষ্টিত সাগর মনে হচ্ছে ভারী ফিতার মতে, নিচের ধূসর বর্ণ হালকা হতে হতে একসময় হারিয়ে গেল দৃষ্টির আড়ালে, ছেঁড়াখোঁড়া মেঘের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে উপকূলবর্তী পাহাড়ের চূড়া।
আরো কাছে এগিয়ে যাওয়াতে সাগরের ঢেউ পরিষ্কার হল, শেষ মাথায় বিলীন হয়ে গেছে দিগন্তের ওপারে, বাঁক নেওয়ার সময় ভূমি আঁকড়ে থাকা বরফের মাঠ দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।
তীব্র গতি ধীরে ধীরে কমে আসার ফলে প্রবল ঝাঁকুনি সহ্য করতে হচ্ছে যাত্রীদের। দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করল টোরান, “তোমার স্যুট ঠিকমতো লক করা হয়েছে?”
গায়ের চামড়ার সাথে সেটে থাকা ইন্টারনালি হিটেড পোশাকের আর্দ্রতা শোষক স্পঞ্জ এর কারণে বেইটার সুঢৌল মুখমণ্ডল আরো ফোলা ফোলা এবং রুক্ষ্ম মনে হল।
মালভূমির ঠিক উপরেই একটা সমতল খোলা জায়গায় মহাকাশযান অবতরণ করল ঝরে যাওয়া পাতার মতো।
আউটার গ্যালাকটিক রাতের অস্বস্তিকর নিকষ কালো অন্ধকারে বেরিয়ে এল যাত্রীরা। প্রচণ্ড শীত আর ঠাণ্ডা বাতাসে হাঁপাতে লাগল বেইটা। তার একটা বাহু ধরে টোরান সংকীর্ণ মসৃণ পথ বেয়ে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলল দূরের এক সারি কৃত্রিম আলোর দিকে।
অর্ধেক পথ যাওয়ার পরেই মোলাকাত হল এগিয়ে আসা গার্ডদের সাথে। ফিসফিস করে কিছু বাক্য বিনিময়ের পরেই নিয়ে যাওয়া হল তাদের। ভেতরে ঢোকার পর পিছনে পাথুরে দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই দূর হয়ে গেল শীত আর ঠাণ্ডা বাতাস। ভেতরটা উষ্ণ, দেয়ালের আলোয় সাদাটে ভাব, বেসুরো গুনগুন শব্দে ভারী হয়ে আছে বাতাস। ডেস্কের লোকগুলো হাতের কাজ রেখে চোখ তুলে তাকাল, নিজেদের কাগজপত্র এগিয়ে দিল টোরান।
এক ঝলক দেখেই হাত নেড়ে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল তাদের। স্ত্রীর কানে ফিসফিস করল টোরান, “বাবা সম্ভবত আগেই ব্যবস্থা করে রেখেছে। পাঁচ ঘণ্টার আগে ছাড়া পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার।”
তাড়াহুড়ো করে ভোলা জায়গায় বেরিয়েই বেইটা থমকে দাঁড়াল। বিষ্ময়াভিভূত সুরে বলল, “ওহ মাই–”
দিনের আলোয় ভেসে যাচ্ছে কেভ সিটি-নবীন সূর্যের সাদাটে দিনের আলো। যদিও আসলে কোনো সূর্য নেই। যে জায়গায় আকাশ থাকতে পারত সেখানটা অসম্ভব উজ্জ্বল, তাকানো যায় না। সঠিক ঘনত্বের উষ্ণ বাতাসে সবুজ উদ্ভিদের সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।
“টোরান, কী চমৎকার।”
উদ্বেগ পুরোপুরি না কাটলেও কিছুটা উৎফুল্ল হয়ে দাঁত বের করে হাসল টোরান। “আসলে বে, ফাউণ্ডেশন-এর সাথে কোনো তুলনাই চলে না, কিন্তু এটা হেভেন দুই এর সবচেয়ে বড় শহর-জনসংখ্যা বিশ হাজার-তোমার ভালো লাগবে। যদিও বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই, অন্যদিকে গুপ্ত পুলিশের ঝামেলাও নেই।”
“ওহ্ টোরি, আমার কাছে খেলনা নগরীর মতো মনে হচ্ছে। পুরোটাই সাদা আর গোলাপি-আর কত পরিষ্কার।”
টোরান ও শহর দেখতে লাগল। অধিকাংশ ঘরবাড়ি দোতলা এবং স্থানীয় মসৃণ পাথর দিয়ে তৈরি। ফাউণ্ডেশন-এর মতো মোচাকৃতি চূড়া অনুপস্থিত এখানে, নেই ওল্ড কিংডমের মতো বিশাল কমিউনিটি হাউজ-কিন্তু নিজস্ব স্বকীয়তা রয়েছে।
মনযোগ আকর্ষণের জন্য হঠাৎ বেইটার হাত ধরে টানল সে। “বে-ওই যে বাবা! ওখানে-আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। তুমি দেখছ না?”
এখান থেকেই মনে হল মানুষটা বিশালদেহী, পাগলের মতো হাত নাড়ছে, আঙুলগুলো ছড়ানো যেন বাতাস খামচে ধরবে। বজ্রের মতো গমগমে গলার চিৎকার পৌঁছল তাদের কানে। একটা লনের উপর দিয়ে স্বামীকে অনুসরণ করছে বেইটা। ছোটখাটো একজন মানুষের উপর চোখ পড়ল তার, চুল সাদা, বিশালদেহী প্রথমজন যে এখনো চিৎকার করছে আর হাত নাড়ছে তার একটা বাহুর আড়ালে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে দ্বিতীয়জন।
কাঁধের উপর দিয়ে চিৎকার করল টোরান, “উনি হলেন বাবার হাফ ব্রাদার। ফাউণ্ডেশনে ছিলেন।”
ঘাসের উপর দুই দল মিলিত হল, হাসছে উম্মাদের মতো। টোরানের বাবা একটা শেষ চিৎকার দিয়ে সীমাহীন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা থামাল। হেঁচকা টান মেরে খাটো জ্যাকেটের চেইন লাগাল তারপর নকশা খোদাই করা ধাতুর তৈরি বেল্ট ঠিক করে নিল! এই দুটোই তার একমাত্র বিলাসিতা।
পালাক্রমে দুজনের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “বাড়ি ফেরার জন্য একটা বাজে দিন বেছে নিয়েছ, বয়!”
“কী! ওহ সেলডনের জন্মদিন, তাই না?”
“হ্যাঁ। এখানে আসার জন্য গাড়ি ভাড়া করতে হয়েছে আর চালানোর জন্য আনতে হয়েছে ড্রাগুন রাকে।”
এবার চোখ পড়ল বেইটার উপর আর সরল না, আরো নরম সুরে বলল, “ক্রিস্টাল সাথে এনেছি-চমৎকার হয়েছে, কিন্তু বুঝতে পারছি ছবি যে তুলেছে সেই ব্যাটা কোনো কম্মের না।”
জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা স্বচ্ছ কিউব বের করল সে, আলোর স্পর্শ পেয়ে ভেতরের হাস্যোজ্জ্বল ছোট মুখাবয়ব জীবন্ত হয়ে উঠতে লাগল নানা বর্ণে, যেন জীবন্ত বেইটার ক্ষুদে সংস্করণ।
“এটা!” বলল বেইটা। “এখন বুঝতে পারছি টোরান ছবিটা কেন পাঠিয়েছিল। খুব অবাক হয়েছি আপনি আমাকে কাছে আসতে দিয়েছেন দেখে, স্যার।”
“এসে পড়েছ? আমাকে ফ্র্যান ডাকতে পারো। আমার কোনো শুচিবাই নেই। তাই আমার হাত ধরে গাড়িতে উঠতে পারো। আজকের আগে কখনো বুঝতে পারিনি আমার ছেলে কিসের পেছনে ছুটছে। বোধহয় সেই ধারণা পাল্টানো উচিত। নাহ্, অবশ্যই পাল্টাতে হবে।”
টোরান তার হাফ আংকেলকে নরম সুরে জিজ্ঞেস করল, “বুড়োর দিন কেমন কাটছে আজকাল? এখনো মেয়েদের পেছনে দৌড়ায়?”
রাণু যখন হাসে তখন তার মুখে অসংখ্য ভাঁজ পড়ে। “যখনই সময় পায়, টোরান, যখনই সময় পায়। মাঝে মাঝে মনে পড়ে যে আগামী জন্মদিন হবে ষাটতম, তখন মুষড়ে পড়ে। কিন্তু হৈহুল্লোড়ে মেতে থেকে এই ভাবনা উড়িয়ে দেয়। ও হচ্ছে সেকেলে ধরণের বণিক। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা কী, টোরান। এই চমৎকার মেয়েটাকে তুমি কোথায় খুঁজে পেলে?”
তরুণ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বৃদ্ধের বাহু নিজের হাতের ভাজে আটকে নিল। “তুমি তিন বছরের পুরো গল্পটা একবারে শুনতে চাও, আংকেল?
বাড়ির ছোট লিভিংরুমে ঢুকে বেইটা হাতের বোঝা নামিয়ে রেখে চুলের বাঁধন আলগা করে পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ করে বসল। তারপর আন্তরিক ভঙ্গিতে তাকাল বিশালদেহী স্বাস্থ্যবান বৃদ্ধের দিকে।
“বুঝতে পারছি আপনি কী হিসাব করছেন। আমি সাহায্য করছি।” সে বলল। বয়স, চব্বিশ, উচ্চতা পাঁচ ফুট চার, ওজন একশ দশ, শিক্ষাক্ষেত্র ইতিহাস।” সে খেয়াল করে দেখেছে নিজের খোয়া যাওয়া হাতটা গোপন রাখার জন্য বৃদ্ধ একটু তেড়ছাভাবে দাঁড়ায়।
কিন্তু এবার আরো কাছে এসে সামনে ঝুঁকে বলল, “যেহেতু তুমি বললে তাই বলছি-ওজন, একশ বিশ।”
বেইটার লজ্জায় আরক্তিম মুখ দেখে গলা ছেড়ে হেসে উঠল সে। তারপর সবাইকে উদ্দেশ করে বলল, “মেয়েদের বাহুর উপরের অংশ দেখে তাদের ওজন বলতে পারবে-তবে সেজন্য অবশ্যই যথেষ্ট অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন। তুমি কিছু পান করবে, বে?”
“সাথে আরো অনেক কিছু,” বলল বেইটা, তারপর দুজন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল, টোরান তখন বুক শেলফের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন কোনো এডিশন আছে কিনা দেখছে।
ফ্র্যান ফিরে এল একা, “ও আসছে কিছুক্ষণ পর।”
বিশাল কর্ণার চেয়ারে দড়াম করে বসল সে, পা তুলে দিল সামনের টেবিলের উপর। লালমুখে এখনো হাসি লেগে আছে, এবং তার মুখোমুখি হওয়ার জন্য ঘুরল টোরান।
“বেশ, তুমি ফিরে এসেছে, বয়, সেজন্য আমি খুশি,” বলল ফ্র্যান, “তোমার বান্ধবীকে আমার পছন্দ হয়েছে, ছিচকাঁদুনে শহরে ননীর পুতুল নয় সে।”
“আমি তাকে বিয়ে করেছি।” স্বাভাবিক গলায় বলল টোরান।
“বেশ, সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার।” তার দৃষ্টি কিছুটা মলিন হল। “এভাবে নিজের ভবিষ্যৎ বেঁধে ফেলা বোকামি, দীর্ঘ অভিজ্ঞ জীবনে আমি কখনো এধরনের কাজ করিনি।”
রাণু চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল ঘরের কোণায়, সেখান থেকেই আলোচনায় যোগ দিল। “কী ব্যাপার ফ্র্যানসাট, এটা কী ধরনের তুলনা? ছয় বছর পূর্বে ক্র্যাশ ল্যাণ্ডিংএর সময় বিয়ে করার জন্য তোমার কোনো ঘরবাড়ি ছিল না। আর করতে চাইলেও কে রাজি হত?”
এক হাতঅলা লোকটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সোজা হয়ে বসল, উম্মার সাথে বলল, “অনেকেই রাজি হত, ব্যাটা নির্বোধ–”
ঝগড়া থামানোর উদ্দেশ্যে দ্রুত বলল টোরান, “বাবা, এটা একটা লিগ্যাল ফরমালিটি। অনেক সুবিধা আছে।”
“তার বেশিটাই মেয়েদের পক্ষে,” বিড় বিড় করে অসন্তোষ প্রকাশ করল ফ্র্যান।
“তা ঠিক,” একমত হল রাণু, “তারপরেও এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক তোমার ছেলে। বিয়ে ফাউণ্ডেশনারদের একটা পুরোনো রীতি।”
“সৎ বণিকরা ফাউণ্ডেশনারদের কোনো আদর্শ হিসেবে মনে করে না।”
আবার বাধা দিল টোরান, “আমার স্ত্রী একজন ফাউণ্ডেশনার।” পালাক্রমে তাকাল দুজনের দিকে, তারপর শান্তভঙ্গিতে বলল, “ও আসছে।”
খানাপিনার পর আলোচনা মোড় নিল সাধারণ কথাবার্তায়। খুন-জখম, মেয়েমানুষ, অর্থ ইত্যাদি উপাদেয় মশলা মিশিয়ে মনোমুগ্ধকর ভঙ্গিতে পুরোনো দিনের তিনটা গল্প শোনালো ফ্র্যান। ছোট টেলিভাইজরটা চালানো, কোনো একটা ক্লাসিক ড্রামা চলছে, কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে নিচু ভলিউমে শব্দ করে চলেছে। রাণু নিচু বিছানায় আরাম করে শুয়ে অলস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে পাইপ থেকে বেরোনো ধোয়ার দিকে। ফারের তৈরি সাদা একটা মোলায়েম গালিচায় হাঁটু গেড়ে বসেছে বেইটা। অনেক দিন আগে একটা ট্রেড মিশনে গিয়ে গালিচাটা এনেছিল ফ্র্যান। এখন শুধু বিশেষ উৎসবের দিনেই এটা বের করা হয়।
“তুমি ইতিহাস নিয়ে পড়ালেখা করেছ, মাই গার্ল?” আমুদে গলায় জিজ্ঞেস করল রাণু।
মাথা নাড়ল বেইটা। “আমার ব্যাপারে শিক্ষকরা ছিলেন হতাশ। তবে সামান্য হলেও শিখতে পেরেছি।”
“একটা স্কলারশিপ,” আত্মপ্রসাদের সুরে বলল টোরান, “ব্যস এইটুকুই।”
“তুমি কতদূর শিখেছ?” আলোচনা চালু রাখার জন্য বলল রাণু।
“বলা যায় প্রায় সবকিছু।” হাসল বেইটা।
বৃদ্ধও জবাবে চমৎকার ভঙ্গিতে হাসল, “বেশ, গ্যালাকটিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে তোমার কী মনে হয়?”
“আমার ধারণা,” সংক্ষিপ্ত জবাব দিল বেইটা,” একটা সেলডন ক্রাইসিস অমিমাংসিত রয়ে গেছে-এবং যদি সেটা সত্যি হয় তা হলে সেলডন প্ল্যানও একই সাথে ক্ষগ্রিস্থ হয়েছে। এটা আমাদের একটা ব্যর্থতা।”
(“ফুহ্,” নিজের কোণা থেকে ফিসফিস করল ফ্র্যান। সেলডন সম্পর্কে কথা বলার কী ছিরি। তবে কাউকে শোনানোর মতো জোরে কিছু বলল না।)
চিন্তিত ভঙ্গিতে পাইপে কয়েকটা টান মেরে ধোয়া ছেড়ে রাণু বলল, “তাই? এরকম মনে হওয়ার কারণ কী? তরুণ বয়সে আমিও ফাউণ্ডেশনে ছিলাম, তখন আমিও অনেক রোমান্টিক নাটকীয় চিন্তাভাবনা করেছি। কিন্তু তোমার এখন এই ধারণা হল কেন?”
“আসলে,” গভীর চিন্তায় বেইটার দৃষ্টি আচ্ছন্ন, গালিচার নরম পশমের ভিতর নগ্ন গোড়ালি ডুবিয়ে একহাতের তালুর উপর চিবুক রাখল সে, “আমার মনে হয়েছে যে সংক্ষেপে সেলডন প্ল্যানের মুখ্য উদ্দেশ্য হল প্রাচীন গ্যালাকটিক এম্পায়ারের তুলনায় আরো আধুনিক এবং উন্নত একটা বিশ্ব গড়ে তোলা। তিন শতাব্দী পূর্বে যখন সেলডন ফাউণ্ডেশন তৈরি করেন তখন এই বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল-এবং ইতিহাসে যদি সত্যি কথা বলা হয়ে থাকে, এই ধ্বংসের মূল কারণ ছিল তিনটা-অভ্যন্তরীণ জড়তা, স্বৈরতন্ত্র এবং মহাবিশ্বের সম্পদসমূহের অসম বণ্টন।”
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রাণ্ডু আর টোরান গর্ব আর অহংকার নিয়ে তাকিয়ে আছে স্ত্রীর দিকে, ফ্র্যান জিভ দিয়ে শব্দ করে যত্নের সাথে নিজের গ্লাসে পানীয় ঢালতে লাগল।
বেইটা বলে চলেছে, “সেলডনের গল্প যদি সত্যি হয় তা হলে বলা যায় তিনি তার সাইকোহিস্টোরির নীতির সাহায্যে এম্পায়ারের সম্পূর্ণ পতন এবং মানবজাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নতুন সেকেণ্ড এম্পায়ার গড়ে তোলার পূর্বে ত্রিশ হাজার বছর স্থায়ী বর্বরযুগের অনুমান করতে পেরেছিলেন, তার সারাজীবনের কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য ছিল যেন দ্রুতগতিতে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায় সেটা নিশ্চিত করা।”
ফ্র্যান এর গমগমে কণ্ঠস্বর বিস্ফোরণের মতো আছড়ে পড়ল, “আর তাই তিনি দুটো ফাউণ্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন, তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।”
“আর তাই তিনি দুটো ফাউণ্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন,” পুনরাবৃত্তি করল বেইটা। “আমাদের ফাউণ্ডেশন তৈরি করা হয় মূমুর্মু এম্পায়ার এর বিজ্ঞানীদের নিয়ে যাদের উদ্দেশ্য ছিল অর্জিত জ্ঞান এবং বিজ্ঞান সংরক্ষণ করে মানুষের প্রয়োজনে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। মহাকাশে ফাউণ্ডেশন-এর অবস্থান এবং ঐতিহাসিক পরিবেশ এমন ছিল যে সতর্কতার সাথে মেধা ও মননশীলতার প্রয়োগ করে সেলডন অনুমান করেছিলেন যে এক হাজার বছরের মধ্যে এটা নতুন এবং আরো উন্নত বিশাল একটা এম্পায়ারে পরিণত হবে।”
বিস্ময় এবং শ্রদ্ধায় নিশ্চুপ হয়ে আছে সবাই।
আবার শুরু করল বেইটা, “পুরোনো গল্প। আপনারা সবাই জানেন। প্রায় তিন শতাব্দী ধরে ফাউণ্ডেশন-এর প্রত্যেকেই গল্পটা জানে। তবুও আমার মনে হয়েছিল যে সংক্ষেপে আরেকবার বলে নেওয়া দরকার। আজকে সেলডনের জন্মদিন, আমি ফাউণ্ডেশনার, আপনারা হেভেন এর বাসিন্দা, অথচ এই ক্ষেত্রে আমাদের মিল আছে-”
সিগারেট ধরিয়ে অন্যমনস্কভাবে ধোয়ার দিকে তাকিয়ে আছে বেইটা। “ইতিহাসের নিয়ম পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়মের মতোই অকৃত্রিম, এবং ভুলের সম্ভাবনা যদি বেশি হয় তার কারণ হচ্ছে পদার্থ বিজ্ঞান যতসংখ্যক এটম নিয়ে কাজ করে ইতিহাস তত সংখ্যক মানুষ নিয়ে কাজ করে না, তাই ইণ্ডিভিজুয়াল ভেরিয়েশন্স অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এক হাজার বছরের অগ্রগতির মাঝে সেলডন ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলো ক্রাইসিস অনুমান করে রেখেছেন যার প্রতিটি ইতিহাসকে নতুন পথে মোড় নিতে বাধ্য করে। এই ক্রাইসিস গুলোই আমাদের পরিচালিত করছে-তাই এখন অবশ্যই একটা ক্রাইসিস তৈরি হতে বাধ্য।”
এবার গলায় জোর এনে বলতে লাগল সে “সর্বশেষ ক্রাইসিসের পর প্রায় এক শতাব্দী পেরিয়ে গেছে, এবং সেই শতাব্দীতেও এম্পায়ারের প্রতিটা ব্যধির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ফাউণ্ডেশনে। অভ্যন্তরীণ জড়তা! আমাদের শাসক শ্রেণী একটা আইন জানে: নো চেঞ্জ। স্বৈরতন্ত্র! তারা শুধু একটা নিয়ম জানে: বল প্রয়োগ। সম্পদের অসম বণ্টন! তাদের শুধু একটাই আকাক্ষা; সবকিছু গ্রাস করে নেওয়া।
“আর সবাই না খেয়ে মারা যাক!” গর্জে উঠল ফ্র্যান সেই সাথে বিশাল থাবা দিয়ে ওজনদার ঘুষি মারল চেয়ারের হাতলে। “গার্ল, তোমার প্রতিটা শব্দ একেকটা মুক্তোর দানা। ওদের পেট মোটা মানিব্যাগ ফাউণ্ডেশন ধ্বংস করে দিচ্ছে, যেখানে সাহসী বণিকরা হেভেনের মতো গ্রহের পাথরের নিচে চাপা দিয়ে রেখেছে নিজেদের অভাব অনটন। সেলডনের কী চরম অপমান, তার মুখে কাঁদা ছুঁড়ে মারার মতো, তার দাড়িতে বমি করার মতো অপমান।” উত্তেজিত হয়ে একমাত্র হাতটা উঁচু করল সে, তারপর কষ্টের ছাপ পড়ল মুখে। “যদি আমার অন্য হাতটা থাকত। যদি-একবারের জন্য ফিরে পেতাম-সবাই আমার কথা শুনত!”
“বাবা,” বলল টোরান, “শান্ত হও।”
“শান্ত হও। শান্ত হও।” তার বাবা হিংস্র ভঙ্গিতে মুখ ভেংচালো। “আমরা এখানে পচে গলে মরব-আর উনি বলছেন শান্ত হও।”
“ও হল আমাদের আধুনিক লাথান ডেভর্স, পাইপ উচিয়ে বলল রাণু, “আমাদের এই ফ্র্যান। ডেভর্স আশি বছর আগে তোমার স্বামীর পরদাদার সাথে খনিতে মারা যায়, কারণ তার বিচক্ষণতা না থাকলেও হৃদয় ছিল।”
“হ্যাঁ,বাই দ্য গ্যালাক্সি, ওর জায়গায় আমি থাকলেও একই কাজ করতাম,” শপথ বাক্য আওড়ালো ফ্র্যান। “ডেভর্স ছিল ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বণিক-অতিরিক্ত প্রশংসা করে বাতাস ভর্তি ব্যাগের মতো ফোলানো ফাউণ্ডেশন-এর পরম পূজনীয় ম্যালোর থেকেও বড় মাপের। গলা কাটা খুনীর দল যারা ফাউণ্ডেশন চালায় তারা যদি ওকে খুন করে থাকে তা হলে চরম মূল্য দিতে হবে।”
“তুমি আলোচনা চালিয়ে যাও, গার্ল,” বলল রাণ্ডু। নইলে সারারাত বকবক করবে আর ওর পাগলামির ঠেলায় মাটি হবে কালকের দিনটা।”
“আর কিছু বলার নেই,” হতাশ সুরে বলল বেইটা। “একটা ক্রাইসিস তৈরি হতে বাধ্য, কিন্তু কিভাবে তৈরি হবে আমি জানি না। ফাউণ্ডেশনে প্রগতিশীল শক্তি বিপজ্জনকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বণিকদের হয়তো সদিচ্ছা আছে কিন্তু তারা কোণঠাসা আর বিচ্ছিন্ন। যদি ফাউণ্ডেশন-এর ভিতরের বাইরের সব সদিচ্ছা গুলোকে একত্রিত করা যেত–”
বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে কর্কশ সুরে হেসে উঠল ফ্র্যান, “ওর কথা শোন, রাণু, ওর কথা শোন। বলছে ফাউণ্ডেশন-এর ভিতরে বাইরে। গার্ল, গার্ল, ফাউণ্ডেশন-এর কোনো আশা নেই। তাদের অল্প কয়েকজনের হাতে আছে চাবুক বাকিরা চাবুকের আঘাতে জর্জরিত। ভালো একজন বণিকের মুখোমুখি হওয়ার মতো তেজ ওই ঘুণে ধরা গ্রহের নেই।”
কথার প্রবল স্রোতে বেইটার বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।
সামনে ঝুঁকে তার মুখে হাত চাপা দিল টোরান। “বাবা,” ঠাণ্ডা সুরে বলল সে, “তুমি কখনো ফাউণ্ডেশনে যাওনি। তুমি কিছুই জান না। আমি জানি ভেতরে ভেতরে তারা যথেষ্ট সাহসী এবং বেইটা তাদেরই একজন।”
“অল রাইট, বয়, নো অফেন্স। রাগ করার কী আছে?” সে সত্যিই উত্তেজিত।
আন্তরিক সুরে বলতে লাগল টোরান, “বাবা তোমাকে নিয়ে সমস্যা হচ্ছে সবকিছু তুমি বিচার করো প্রভিন্সিয়াল দৃষ্টিভঙ্গিতে। তুমি মনে করো কয়েক লাখ বণিক গ্যালাক্সির নিঃসীম শূন্যের শেষপ্রান্তে হারিয়ে যাওয়া অবাঞ্চিত এক গ্রহের খানাখন্দে ছুটে বেড়ায় বলেই তারা সাহসী যোদ্ধা। ফাউণ্ডেশন থেকে কর সংগ্রহের জন্য যারা আসে অবশ্যই তারা আর কখনো ফিরতে পারেনা, কিন্তু সেটা সস্তা নাটকীয়তা। যদি ফাউণ্ডেশন পুরো একটা ফ্লিট পাঠায়। তখন?”
“আমরা ওদের উড়িয়ে দেব?” ধারালো গলায় জবাব দিল ফ্র্যান।
“নিজেরাও উড়ে যাবে-লাভ হবে ওদের। তোমরা সংখ্যায় কম, তোমাদের অস্ত্র কম, তোমরা অসংগঠিত-ফাউণ্ডেশন হামলা করলেই বুঝতে পারবে। তোমাদের মিত্র খুঁজে বের করতে হবে-সম্ভব হলে ফাউণ্ডেশন-এর ভিতরে।”
“রাণ্ডু,” বলল ফ্র্যান, ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে একটা অসহায় ষাঁড়ের মতো।
মুখ থেকে পাইপ সরাল রাণু “ছেলেটা ঠিকই বলেছে, ফ্র্যান। মনের গভীরে যে চিন্তাগুলো লুকিয়ে আছে সেগুলো ভাবলেই বুঝতে পারবে যে ও ঠিকই বলেছে। কিন্তু চিন্তাগুলো সব কষ্টকর এবং হতাশাজনক। তাই তর্জন গর্জন করে সেগুলো ধামাচাপা দিয়ে রাখতে চাও। কিন্তু ওগুলো তোমার মনের ভেতরেই আছে। টোরান আমি সব খুলে বলছি।”
চিন্তিত ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ ধূমপান করল সে, তারপর ট্রের কোণায় পাইপটা বাড়ি দিয়ে ছাই ফেলে অপেক্ষা করতে লাগল ফ্ল্যাশ এর জন্য। পরিষ্কার পাইপ তুলে নিয়ে ছোট আঙুল দিয়ে টিপে টিপে তামাক ভরল আবার।
“আমাদের প্রতি ফাউণ্ডেশন-এর আগ্রহ নিয়ে তুমি যা বলেছ টোরান,” কথা শুরু করল সে, “পুরোপুরি ঠিক। সাম্প্রতিক সময়ে পরপর দুইবার কর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে এসেছিল ওরা, বিপদের কথা হচ্ছে দ্বিতীয়বার যে এসেছিল তার সাথে ছিল একটা লাইট ট্রেলশিপ। ল্যান্ড করেছিল গ্লেয়ার সিটিতে আমাদের বুঝিয়েছিল যে মেরামতের জন্য নেমেছে-এবং স্বাভাবিকভাবেই তাদের আর ফিরতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু এবার তারা ব্যাপক শক্তি নিয়ে ফিরে আসবে কোনো সন্দেহ নেই। তোমার বাবা তা ভালোভাবেই জানে টোরান, সত্যি জানে।
“জেদি লোকটার দিকে তাকাও। সে জানে হেভেনের সামনে ভীষণ বিপদ এবং আমরা অসহায়, কিন্তু,সে নিজের ফরমুলার পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। এটা তাকে ভিতরের দুশ্চিন্তা থেকে রক্ষা করে। কিন্তু নিজের কথা বলা হয়ে গেলে, তর্জন গর্জন করে অবজ্ঞা প্রকাশের পর যখন বুঝতে পারে যে একজন মানুষ এবং একজন বণিক হিসেবে তার দায়িত্ব শেষ হয়েছে তখন সে আমাদের বাকিদের থেকে অনেক বেশি যুক্তিশীল।”
“বাকিরা কারা?” জিজ্ঞেস করল বেইটা।
তার দিকে তাকিয়ে মধুর ভঙ্গিতে হাসল বৃদ্ধ। “আমরা ছোট একটা সংগঠন তৈরি করেছি বেইটা-শুধু আমাদের শহরে। এখনো তেমন কিছু করতে পারিনি, অন্যান্য শহরের সাথেও যোগাযোগ করতে পারিনি, কিন্তু এটা একটা সূচনা।”
“কিন্তু কী অর্জন করতে চান?” মাথা নাড়ল রাণু। “আমরা এখনো জানি না। শুধু অলৌকিক কিছু ঘটার আশা করছি। তোমার মতো আমরাও বুঝতে পেরেছি যে একটা সেলডন ক্রাইসিস তৈরি হতে যাচ্ছে।” দুহাত তুলে উপরে দেখাল সে। “গ্যালাক্সি ভরে আছে বিচ্ছিন্ন এম্পায়ারের ভাঙা টুকরায়। চতুর্পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে জেনারেলরা। তোমার কী মনে হয় তাদের কেউ হঠাৎ করে দুঃসাহসী এবং উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠতে পারে?
প্রশ্নটা বিবেচনা করল বেইটা, তারপর মাথা নাড়ল দৃঢ় ভঙ্গিতে, ফলে মসৃণ কালো চুল সামনে এসে কান ঢেকে দিল। “না, কোনো সম্ভাবনা নেই। ওই জেনারেলদের প্রত্যেকেই জানে ফাউণ্ডেশনে হামলা করা মানে আত্মহত্যা। বেল রিয়োজ ছিলেন তাদের ভেতর সবচেয়ে দক্ষ, আর তিনি আক্রমণ করেছিলেন পুরো গ্যালাক্সির শক্তি নিয়ে, কিন্তু সেলডন প্ল্যানের বিরুদ্ধে জিততে পারেননি। এমন কোনো জেনারেল আছে যে এটা জানে না।”
“কিন্তু আমরা যদি তাদের প্ররোচিত করি, চালিত করি?”
“কোথায়? এটমিক ফারনেসে? কী দিয়ে তাদেরকে প্ররোচিত করবেন?”
“বেশ, একজন আছে-নতুন একজন। গত দু-এক বছর ধরে অদ্ভুত এক লোকের কথা শোনা যাচ্ছে, সবাই তাকে ডাকে মিউল নামে।”
“মিউল? “ চিন্তা করল কিছুক্ষণ। “কখনো শুনেছ, টোরি?”
মাথা নাড়ল টোরান, বেইটা বলল, “খুলে বলুন।”
“সবটা আমিও জানি না। তবে লোকমুখে শোনা যায় সে নাকি অসম্ভব এবং অদ্ভুত উপায়ে যুদ্ধে জয়লাভ করছে। হয়তো গুজব, যাই হোক না কেন তার সাথে যোগাযযাগ করতে পারলে বোধহয় লাভ হবে। যাদের সীমাহীন দক্ষতা এবং সীমাহীন উচ্চাকাঙ্খ আছে তারা হ্যারি সেলডন এবং তার সাইকোহিস্টোরি বিশ্বাস নাও করতে পারে। আমরা সেই অবিশ্বাস আরো বাড়িয়ে দেব। ফলে সে হয়তো আক্রমণ করবে।”
“এবং ফাউণ্ডেশন জয়ী হবে।”
“হ্যাঁ-কিন্তু খুব একটা সহজ হবে না। এটা একটা ক্রাইসিস হতে পারে, এবং পরিস্থিতির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমরা ফাউণ্ডেশন-এর স্বৈরশাসকদের সাথে একটা সমঝোতা করতে পারি। নিদেন পক্ষে দীর্ঘ সময়ের জন্য তারা আমাদের কথা ভুলে যেতে বাধ্য হবে এবং আমরা আমাদের পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।”।
“তোমার কী মনে হয়, টোরি?”
ফ্যাকাশে ভাব নিয়ে হাসল টোরান, এক গোছা বাদামি চুল সরাল চোখের উপর থেকে। “যেভাবে বলছে তাতে তো মনে হয় কোনো বিপদ হবে না; কিন্তু কে এই মিউল? তার ব্যাপারে কী জানো, রাণু?”।
“এখনো কিছুই জানি না। সেই উদ্দেশ্যে তোমাকে আমরা কাজে লাগাতে পারি, টোরান। এবং তোমার স্ত্রীকে, যদি তার আপত্তি না থাকে। এ ব্যাপারে আমরা কথা বলেছি, আমি আর তোমার বাবা। এ ব্যাপারে আমরা বিস্তারিত কথা বলেছি।”
“কীভাবে রা? তুমি আমাদের কাছে কী চাও?” তরুণ দ্রুত কৌতূহলী দৃষ্টি হানল স্ত্রীর দিকে।
“তোমাদের হানিমুন হয়েছে?”
“উমম–হ্যাঁ–যদি ফাউণ্ডেশন থেকে হেভেনে আসার ট্রিপটাকে বিবেচনায় ধরো।”
“কালগানে আরো ভালো একটা হানিমুন হলে কেমন হয়? সেমি ট্রপিক্যাল-সমুদ্র সৈকত-ওয়াটার স্পোর্টস-পাখি শিকার-ছুটি কাটানোর আদর্শ জায়গা। এখান থেকে সাত হাজার পারসেক-খুব বেশি দূরে না।”
“কালগানে কী আছে?”
“মিউল! বা অন্তত তার কোনো লোক। সে এটা দখল করেছে গত মাসে এবং বিনা লড়াইয়ে, যদিও কালগানের ওয়ারলর্ড হুমকি দিয়ে প্রচার করেছিল যে আত্মসমর্পণ করার আগে সে পুরো গ্রহ আয়োনিক ধুলায় মিশিয়ে দেবে।”
“সেই ওয়ারলর্ড এখন কোথায়?”
“নেই,” শ্রাগ করল রাণু। “কী বলল তোমরা?”
“কিন্তু আমরা কী করব?”
“আমি জানি না। ফ্র্যান আর আমার বয়স হয়েছে। আমরা প্রভিন্সিয়াল। হেভেনের সব বণিকই প্রভিন্সিয়াল । আমাদের বাণিজ্য সীমিত আর পূর্বপুরুষদের মতো আমরা গ্যালাক্সিতে ছুটে বেড়াইনি। চুপ কর, ফ্র্যান! কিন্তু তোমরা গ্যালাক্সি ভালোভাবেই চেন। বিশেষ করে বেইটা চমৎকার ফাউণ্ডেশন বাচনভঙ্গিতে কথা বলে। শুধু আশা যে তোমরা কিছু বের করতে পারবে। যদি তোমরা যোগাযোগ করতে পারো কোনোভাবে–সেটা অবশ্য আশা করি না। ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করো। ইচ্ছা হলে দলের অন্যদের সাথেও দেখা করতে পারবে, ওহ, এক সপ্তাহের আগে হবে না। তোমাদের একটু দম ফেলার ফুরসত দেওয়া উচিত।”
সাময়িক নীরবতা, তারপর ফ্র্যান এর বজ্র গম্ভীর গলার আওয়াজ শোনা গেল, “আর কেউ কী একটা ড্রিংক নেবে? মানে আমি ছাড়াও?”
*
১২. ক্যাপ্টেন এবং মেয়র
নিজের চারপাশে ছড়ানো বিলাসিতার সাথে ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচারের কোনো পরিচয় নেই এবং সে কিছুটা চমকিত, অভিভূত। সাধারণত তার কাজের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না হলে সে আত্মবিশ্লেষণ এবং সকল ধরণের দার্শনিক সুলভ মনোভাব এড়িয়ে চলে।
তার কাজ হচ্ছে মূলত ওয়ার ডিপার্টমেন্ট যাকে বলে “ইন্টেলিজেন্স,” সফিসটিকেটরা বলে “এসপায়োনেজ,” রোমান্টিসিস্টরা বলে, “স্পাই স্টাফ,” এবং দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে টেলিভাইজরে যত রোমহর্ষকভাবেই তা উপস্থাপন করা হোক না কেন “ইনটেলিজেন্স,” “এসপায়োনেজ,” এবং “স্পাই স্টাফ,” হল মূলত বিশ্বাসঘাতকতা এবং অবিশ্বাসের ধারাবাহিক চক্র। সবাই এটা মেনে নিয়েছে কারণ রাষ্ট্রের জন্য এটা প্রয়োজন। কিন্তু যেহেতু একজন তার নীতিবোধ দ্বারা সমাজের উপকার করতে পারে-তাই সে ফিলোসফি এড়িয়ে চলে।
আর এই মুহূর্তে মেয়রের বিলাসবহুল এন্টিরুমে বসে অনিচ্ছাসত্ত্বেও চিন্তাভাবনা ফিরিয়ে আনল নিজের দিকে।
অযোগ্য আর অর্বাচীন লোকদের পদোন্নতি দিয়ে বারবারই বসিয়ে দেওয়া হয়েছে তার মাথার উপর। কিন্তু সে পড়ে আছে আগের জায়গাতেই। এ পর্যন্ত বহুবার সে অফিসিয়াল নিয়ম শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েও পার পেয়েছে। এবং একগুয়ে লোকের মতো দৃঢ়ভাবে এই বিশ্বাস আকড়ে ধরে রেখেছে যে রাষ্ট্রের পবিত্র প্রয়োজনে তার এই অবাধ্য আচরণের মূল্য একদিন সবাই দেবে।
আর তাই সে বসে আছে মেয়রের এন্টিরুমে-সাথে পাঁচজন শ্রদ্ধাবনত গার্ড এবং সম্ভবত: তার জন্য অপেক্ষা করছে একটা কোর্ট মার্শাল।
মার্বেল পাথরের তৈরি বিশাল দরজা নিঃশব্দে এবং মসৃণভঙ্গিতে খুলে গিয়ে সামনের চক্চকে দেয়াল উন্মুক্ত করে দিল, ভেতরে লাল কার্পেট বিছানো, ধাতুর নকশা খচিত আরো দুটো মার্বেল পাথরের দরজা। তিন শতাব্দী পুরোনো ঢঙে পোশাক পরিহিত দুজন অফিসার বেরিয়ে এসে ঘোষণা করল :
“তথ্য দপ্তরের ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচারকে সাক্ষাতের জন্য ডাকা হচ্ছে।”
ক্যাপ্টেন এগিয়ে যেতেই কুর্নিশ করে পিছিয়ে গেল তারা দুজন। তার এসকর্ট থেমে গেল দরজার বাইরে, ভেতরে প্রবেশ করল সে একা।
দরজার ওপাশে আশ্চর্যরকম বিশাল কামরায় অদ্ভুত কোথাওয়ালা বিরাট এক টেবিলের পিছনে ছোটখাটো একজন মানুষ-পরিবেশের বিশালতার মাঝে প্রায় হারিয়ে গেছে।
মেয়র ইণ্ডবার-এই নাম ধারণকারী তৃতীয় ব্যক্তি। তার দাদা প্রথম ইওবার একই সাথে ছিলেন নিষ্ঠুর এবং দক্ষ এবং তিনি বিপুল সমারোহে ক্ষমতা দখলের এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, পরবর্তীতে দক্ষতার সাথে স্বাধীন নির্বাচনের প্রথা রহিত করেন এবং আরো দক্ষভাবে শান্তিপূর্ণ শাসন পরিচালনা করেন।
মেয়র ইণ্ডবার এর পিতা দ্বিতীয় ইবার, যিনি জন্মসূত্রে ফাউণ্ডেশন-এর মেয়র হওয়ার গৌরব অর্জনকারী প্রথম ব্যক্তি-এবং যে তার বাবার মাত্র অর্ধেক, কারণ তিনি ছিলেন শুধুই নিষ্ঠুর।
কাজেই মেয়র ইণ্ডবার তৃতীয় জন্মসূত্রে এই পদ লাভকারী দ্বিতীয় ব্যক্তি এবং তিনজনের মাঝে সবচেয়ে অযোগ্য, কারণ তাকে নিষ্ঠুর বা দক্ষ কোনোটাই বলা যাবে না বরং মনে হবে একজন বুককীপার ভুল করে ভুল জায়গায় চলে এসেছেন।
সকলের কাছেই ইণ্ডবার দ্যা থার্ড অদ্ভুত কিছু নিম্নমানের চরিত্রের সংমিশ্রণ।
তার কাছে আড়ম্বরপূর্ণ জটিল কিছু ব্যবস্থাই হল “সিস্টেম, ক্লান্তিহীনভাবে দৈনিক আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বিশেষ সমস্যাগুলো সামলানো হল “ইণ্ডাস্ট্রি”, সঠিক মুহূর্তে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা হল “সতর্কতা”, এবং একগুয়ের মতো ভুল পথে পা বাড়ানো হল “দৃঢ়তা”।
এসব কিছু সত্ত্বেও তিনি অপচয় করেন না, অপ্রয়োজনে কাউকে হত্যা করেন না, এবং সকলের সাথে মধুর ব্যবহার করেন।
ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচারের চেহারা ভাবলেশহীন কাঠের পুতুলের মতো। অসীম ধৈর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডেস্কের সামনে। কাশল না, শরীরের ওজন এক পা থেকে আরেক পায়ের উপর বদল করল না। যতক্ষণ না মেয়র কাজ শেষ করে মুখ তুললেন।
যত্নের সাথে হাত বেঁধে বসলেন মেয়র ইণ্ডবার, যেন ডেস্কের জিনিসপত্র এলোমেলো না হয়। তারপর বললেন, “ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার অফ ইনফর্মেশন।”
প্রোটকল মোতাবেক ক্যাপ্টেন প্রিচার অনুগত সৈনিকের মতো হাঁটু গেড়ে বসে কুর্নিশ করল, পরবর্তী নির্দেশ না শোনা পর্যন্ত থাকল সেভাবেই।
“উঠ, ক্যাপ্টেন প্রিচার!”
সহানুভূতির সুরে মেয়র বললেন, “উধ্বতন অফিসাররা তোমার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। স্বাভাবিক নিয়মেই সংশ্লিষ্ট প্রমাণপত্র পৌঁছেছে আমার নিকট এবং যেহেতু ফাউণ্ডেশন-এর ছোট বড় সব বিষয়ই আমার নিকট গুরুত্বপূর্ণ তাই তোমার ব্যাপারে আমি আরো কিছু জানতে চাই। আশা করি তুমি অবাক হওনি।”
নিরাবেগ গলায় ক্যাপ্টেন প্রিচার বলল, “এক্সিলেন্স, না। আপনার বিচার বিবেচনা লোক প্রসিদ্ধ।”
“তাই নাকি? তাই নাকি?” খুশি হয়ে বললেন মেয়র, এবং তার রঙিন কন্টাক্ট ল্যান্স চিচিক করে উঠল এমনভাবে যেন সেটা তার শুকনো কঠিন দৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পাখা দিয়ে বাতাস করার মতো করে সামনে রাখা ধাতু দিয়ে বাঁধানো কয়েকটা ফোল্ডার নাড়লেন তিনি। পাতা উল্টানোর সময় ভিতরের পার্চমেন্ট শিটগুলো তীক্ষ্ণ পট পট শব্দ করতে লাগল, কথা বলার সময় তিনি আঙুল দিয়ে প্রতিটি লাইন অনুসরণ করছেন।
“তোমার রেকর্ড আমার কাছে আছে, ক্যাপ্টেন-সম্পূর্ণ। বয়স তেতাল্লিশ এবং সতের বছর ধরে আর্মড ফোর্স এর একজন অফিসার হিসেবে কর্মরত। তোমার জন্ম লরিস এ, পিতামাতা এনাক্রোনিয়ান, শিশু বয়সে মারাত্মক কোনো অসুখ বিসুখ হয়নি, একবার শুধু–তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না…শিক্ষাদীক্ষা, প্রিমিলিটারি, একাডেমী অফ সায়েন্স, অধ্যয়নের বিষয় হাইপার ইঞ্জিন, ফলাফল…উ-ম-ম চমৎকার, প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। ফাউণ্ডেশন ইরার ২৯৩ তম বছরের একশ দুই তম দিনে আন্ডার অফিসার হিসেবে আর্মিতে যোগদান।”
প্রথম ফোল্ডার সরিয়ে দ্বিতীয় ফোল্ডার খোলার সময় একবার চোখ তুললেন তিনি।
“বুঝতেই পারছ, তিনি বললেন, “আমার প্রশাসনে খুঁটিনাটি সব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়। অর্ডার! সিস্টেম!”
জেলির মতো আঠালো একটা সুগন্ধী ট্যাবলেট বের করে মুখে দিলেন তিনি। এটা তার একটা বদঅভ্যাস, কিন্তু সেটা ত্যাগ করার কোনো ইচ্ছা নেই। মেয়রের ডেস্কে এটমিক ফ্ল্যাশ এর ব্যবস্থা নেই পোড়া তামাক অপসারণের জন্য। কারণ মেয়র ধূমপান করেন না।
এবং স্বাভাবিকভাবেই তার দর্শনার্থীরাও করতে পারে না।
অস্ফুট স্বরে বিরতিহীন একঘেয়ে গলায় বলে চলেছেন মেয়র-মাঝে মাঝে একই রকম ফিসফিসে গলায় অবজ্ঞাসূচক বা প্রশংসাসূচক মন্তব্য করছেন। পড়া শেষ করে তিনি ফোল্ডারগুলো ঠিক আগের মতো করে গুছিয়ে রাখলেন।
“তো, ক্যাপ্টেন”, সতেজ গলায় বললেন তিনি, “তোমার রেকর্ড সম্পূর্ণ অন্যরকম। তোমার কাজ এবং তোমার দক্ষতা প্রশ্নাতীত। দায়িত্ব পালন কালে দুবার আহত হয়েছ, দায়িত্বের বাইরেও অসীম সাহসিকতার জন্য অর্ডার অব মেরিট পদক পেয়েছ। এই-ব্যাপারগুলো হালকা করে দেখলে চলবে না।”
ক্যাপ্টেন প্রিচার এর ভাবলেশহীন মুখের কোনো পরিবর্তন হল না। দাঁড়িয়ে থাকল পাথরের মূর্তির মতো, প্রোটকল অনুযায়ী সাক্ষাৎপ্রার্থীরা কেউ মেয়রের সামনে বসতে পারে না-সম্ভবত বিষয়টা জোড় করে সবাইকে মনে রাখতে বাধ্য করা হয়,কারণ কামড়ায় মাত্র একটাই চেয়ার, মেয়রের পাছার নিচে। প্রোটকল আরো বলে যে সরাসরি প্রশ্ন ছাড়া অন্য কোনো মন্তব্যের জবাব দেওয়া যাবে না।
কঠিন দৃষ্টিতে সৈনিকের দিকে তাকালেন মেয়র। তীক্ষ্ণ, গুরুগম্ভীর গলায় বললেন, “যাই হোক, দশ বছরে তোমার কোনো পদোন্নতি হয়নি এবং ঊর্ধ্বতন অফিসাররা বার বার তোমার সীমাহীন জেদি এবং একগুঁয়ে চরিত্রের ব্যাপারে অভিযোগ করেছে। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী তুমি অবাধ্য, সুপিরিয়র অফিসারদের সাথে সবসময় খারাপ ব্যবহার করো, সহকর্মীদের কারো সাথেই বেশি দিন ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে পারো না এবং তুমি একটা সমস্যা সৃষ্টিকারী উপাদান। কিভাবে এর ব্যাখ্যা দেবে, ক্যাপ্টেন?”
“এক্সিলেন্স, আমার কাছে যা সঠিক মনে হয়েছে, আমি তাই করেছি। আমি রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ। শরীরের ক্ষতচিহ্নগুলো প্রমাণ করে যে আমি যা সঠিক মনে করেছিলাম তা রাষ্ট্রের জন্যও গুরুত্বপুর্ণ ছিল।”
“সৈনিকসুলভ মন্তব্য, ক্যাপ্টেন, কিন্তু বিপজ্জনক। আরো শুনতে হবে, পরে। এই মুহূর্তে তোমার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হল আমার মনোনীত প্রতিনিধি দস্তখত করার পরেও, পরপর তিনবার একটা এসাইনমেন্টের দায়িত্ব নিতে তুমি অস্বীকার করেছ। কী বলার আছে এ ব্যাপারে?”
“এক্সিলেন্স, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে এই এসাইনমেন্টের কোনো প্রয়োজন নেই, বরং আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অবহেলা করা হচ্ছে।”
“আহ, তোমাকে কে বলল যে বিষয়গুলোর কথা বলছ সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ আর হলেও সেগুলোকে অবহেলা করা হচ্ছে।”
“এক্সিলেন্স, আমি যথেষ্ট প্রমাণ পেয়েছি। আমার অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা নিয়ে সুপিরিয়র অফিসাররাও প্রশ্ন তুলতে পারবে না। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই বিষয়গুলো আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে।”
“কিন্তু, মাই গুড ক্যাপ্টেন, তুমি অন্ধ, তাই বুঝতে পারছ না যে অবাঞ্চিতভাবে ইন্টেলিজেন্স পলিসিতে নাক গলিয়ে তুমি তোমার সুপিরিয়রদের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করছ।”
“এক্সিলেন্স, আমার প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রের প্রতি, সুপিরিয়রদের প্রতি না।”
“বিভ্রান্তিকর, কারণ তোমার সুপিরিয়রদেরও সুপিরিয়র আছে এবং আমি হচ্ছি সেই সুপিরিয়র, এবং আমিই রাষ্ট্র। আমার এই বিশ্লেষণ নিয়ে তোমার অভিযোগ থাকার কথা নয়, কারণ তুমিই বলেছ আমার বিচার বিবেচনা তুলনাহীন, যে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ তোমার বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে সেটা নিজের মতো করে বল।”
“এক্সিলেন্স, কালগান গ্রহে অবসরপ্রাপ্ত মার্চেন্ট মেরিনার হিসেবে জীবন কাটানো নয় বরং আমার প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রের সেবা। আমার উপর নির্দেশ ছিল ওই গ্রহে ফাউণ্ডেশন অ্যাকটিভিটি পরিচালনা করা, কালগানের ওয়ারলর্ড, বিশেষ করে তার বৈদেশিক নীতি সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।”
“আমি জানি এগুলো, বলে যাও।”
“এক্সিলেন্স, আমার রিপোর্টে বারবার আমি কালগানের স্ট্র্যাটেজিক পজিশন এবং এর শাসন প্রণালীর উপর জোর দিয়েছি। ওয়ারলর্ড এর উচ্চাভিলাষ, তার ক্ষমতা, রাজ্য বিস্তারের আকাক্ষা, বন্ধুসুলভ আচরণ বা বলা যায় ফাউণ্ডেশন-এর প্রতি তার স্বভাবসুলভ আচরণ-ইত্যাদি বিষয়ে রিপোর্ট করেছি।
“তোমার সব রিপোর্ট আমি পড়েছি, বিস্তারিতভাবে। তারপরে বল।”
“এক্সিলেন্স, আমি ফিরে আসি দুমাস আগে। সেই সময় যুদ্ধের কোনো চিহ্নই ছিল না। আক্রমণ হতে পারে এধরণের একটা বিরক্তিকর ধারণা ছাড়া আর কোননা চিহ্নই ছিল না। এক মাস আগে অপরিচিত এক ভাগ্যান্বেষী সৈনিক কালগান দখল করে নেয় বিনা যুদ্ধে। কালগানের সেই ওয়ারলর্ড স্পষ্টতই এখন জীবিত নেই। বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলছেনা কেউ বরং এই অদ্ভুত দখলদার-মিউল-তার শক্তি এবং বুদ্ধির প্রশংসা করছে সবাই।”
“কে?” সামনে ঝুকলেন মেয়র, চেহারায় বিরক্তির ভাব।
“এক্সিলেন্স, সে মিউল নামে পরিচিত। খুব পরিচিত না, তবে আমি অল্প স্বল্প যা শুনেছি সেগুলো থেকে মোটামুটি একটা ধারণা করা যায়। তার জন্ম ইতিহাস অজানা। কে তার বাবা কেউ জানে না। জন্মের সময় তার মা মারা যায়। ভবঘুরে হিসেবে বেড়ে উঠে। শিক্ষাদীক্ষা লাভ করে ছন্নছাড়া অনুন্নত গ্রহগুলোতে। মিউল ছাড়া তার অন্য কোনো নাম নেই, জনমত অনুযায়ী নামটা তার নিজের বেছে নেওয়া, এবং জনপ্রিয় ব্যাখ্যা হচ্ছে নিজের অপরিসীম শারীরিক শক্তি এবং দৃঢ়তা প্রকাশের জন্যই এই নাম।”
“তার সামরিক শক্তি কতটুকু, ক্যাপ্টেন? শারীরিক শক্তি নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।”
“এক্সিলেন্স, সাধারণ মানুষের ধারণা তার অনেক বড় একটা ফ্লিট আছে, তবে কালগানের অদ্ভুত পরাজয়ের কারণেই এমন ধারণা হতে পারে। তার নিয়ন্ত্রিত টেরিটোরি খুব বেশি বড় না, যদিও সঠিক সীমানা কত দূর নির্দিষ্ট করে বলা অসম্ভব। যাই হোক এই লোকের ব্যাপারে অবশ্যই তদন্ত করতে হবে।”
“হুম্-ম-ম। তাই! তাই!” মনে হল মেয়র যেন স্বপ্নলোকে হারিয়ে গেছেন। প্যাডের উপরের পাতায় স্টাইলাসের চব্বিশ খোঁচায় ষড়ভুজের মতো সাজিয়ে ছয়টা বর্গক্ষেত্র আঁকলেন, তারপর সেটা ছিঁড়ে নিয়ে তিন ভাঁজে ভাঁজ করে ডান দিকের ওয়েস্ট পেপার স্লটে ফেলে দিলেন। কাগজটা নিঃশব্দে পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
“এবার, ক্যাপ্টেন, বল, বিকল্প কী? তুমি আমাকে বলেছ কোনটা অবশ্যই তদন্ত করতে হবে। তোমাকে কী তদন্ত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে?”
“এক্লিলেন্স, স্পেসে একটা ইঁদুরের গর্ত আছে, যারা সম্ভবত ট্যাক্স দেয় না।”
“এইটুকুই? তুমি কী জান না বা তোমাকে কেউ বলেনি যে এই লোকগুলো যারা ট্যাক্স দেয় না তারা আমাদের প্রথম যুগের বণিকদের বংশধর-নৈরাজ্যবাদী, বিদ্রোহী, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী যারা দাবি করে ফাউণ্ডেশন তাদের বাপ দাদার সম্পত্তি এবং হাস্যকর ফাউণ্ডেশন কালচারগুলো আবার ফিরিয়ে আনতে চায়। তুমি কী জানোনা বা তোমাকে কেউ বলেনি যে স্পেসে এই ইঁদুরের গর্ত একটা না অনেকগুলো; আমাদের ধারণার চাইতেও বেশি; প্রত্যেকটা এক সাথে জোট বেঁধে ষড়যন্ত্র করছে, এবং অপরাধীতে গিজ গিজ করছে যা এখনো ঘিরে রেখেছে। ফাউণ্ডেশন টেরিটোরি। এমনকি এখানেও, ক্যাপ্টেন, এখানেও!”
মেয়রের সাময়িক উম্মাহ্রাস পেল দ্রুত। “তুমি জানতে, ক্যাপ্টেন?”
“এক্সিলেন্স, আমাকে জানানো হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসেবে, আমাকে বিশ্বস্ততার সাথে সেবা করে যেতে হবে-এবং সে-ই বিশ্বস্তভাবে রাষ্ট্রের সেবা করতে পারে যে সত্যকে অনুসরণ করে। প্রাচীন বণিকদের এই নগণ্য বংশধরদের রাজনৈতিক অবদান কতটুকু-যে ওয়ারলর্ডরা ওল্ড এম্পায়ারের ছোটখাটো ভাঙা অংশের দখল পেয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের ক্ষমতা আছে। এই বণিকদের না আছে অস্ত্র না আছে সম্পদ। আমি কোনো ট্যাক্স কালেক্টর নই যে আমাকে সেখানে যেতে হবে।”
“ক্যাপ্টেন প্রিচার তুমি একজন সৈনিক এবং অস্ত্রটাকেই বড় করে দেখ । আমার কথা অমান্য করতে পারো এমন অবস্থায় তোমাকে নিয়ে আসাটা একধরনের দুর্বলতা। সতর্ক হও। আমার বিচারকে দুর্বলতা মনে করো না। ক্যাপ্টেন, এটা প্রমাণিত যে ইম্পেরিয়াল যুগের জেনারেল এবং বর্তমান যুগের ওয়ারলর্ড আমাদের বিরুদ্ধে সবই গুরুত্বপূর্ণ। সেলডনের বিজ্ঞান যা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে তার উপর ভিত্তি করেই ফাউণ্ডেশন এগিয়ে চলেছে, তোমার ধারণা অনুযায়ী ব্যক্তিগত বীরত্ব নয় বরং ইতিহাসের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ধারার উপর নির্ভর করছে। এরই মধ্যে আমরা সফলভাবে চারটা ক্রাইসিস পেরিয়ে এসেছি, আসিনি?”
“এক্সিলেন্স, এসেছি। তবুও সেলডনের বিজ্ঞান জানেন একজনই–তিনি সেলডন। আমাদের আছে শুধু বিশ্বাস। আমাকে যত্নের সাথে শেখানো হয়েছে যে প্রথম তিনটা ক্রাইসিসের সময় এমন নেতারা ফাউণ্ডেশনকে নেতৃত্ব দিয়েছেন যারা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন ক্রাইসিসটা কী হবে এবং সেই অনুযায়ী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। অন্যথায়-কী হত কে জানে।”
“হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন, কিন্তু তুমি চতুর্থ ক্রাইসিসের কথা এড়িয়ে গেছ। সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্রশস্ত্র এবং সেনাবাহিনী নিয়ে যখন আমাদের সবচেয়ে চতুর প্রতিপক্ষ আমাদের আক্রমণ করে তখন ফাউণ্ডেশন-এর কোনো ইতিহাস বিখ্যাত নেতা ছিলেন না। তারপরেও ইতিহাসের অনিবার্যতায় আমরাই জয়ী হয়েছি।”
“এক্সিলেন্স, কথাটা সত্যি। কিন্তু আপনি যে ইতিহাসের কথা বলছেন সেটা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায় পুরো এক বছরের প্রাণঘাতী লড়াইয়ের পর। আমরা যে অনিবার্য বিজয় লাভ করি তার মূল্য হিসেবে দিতে হয় প্রায় অর্ধ সহস্র যুদ্ধযান এবং অর্ধ মিলিয়ন মানুষের প্রাণ। এক্সিলেন্স, যে নিজেকে সাহায্য করে সেলডন প্ল্যান তাকেই সাহায্য করে।”
মেয়র ইণ্ডবার ভুরু কুঁচকালেন। ধৈর্য ধরে রাখতে রাখতে তিনি ক্লান্ত। তার মনে হল অধীনস্তের প্রতি অতিরিক্ত সৌজন্য দেখানোতেই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে কারণ এটাকে সে তর্ক করার অনুমতি হিসেবে ধরে নিয়েছে।
কঠিন গলায় বললেন তিনি, “যাই হোক, ক্যাপ্টেন, ওয়ারলর্ডদের বিরুদ্ধে বিজয়ের ব্যাপারে সেলডন আমাদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন এবং এই ব্যস্ত সময়ে আমি কোনো বিশৃঙ্খলা প্রশ্রয় দিতে পারি না। যে বণিকদের কথা তুমি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছ তারা ফাউণ্ডেশন থেকে উদ্ভূত। তাদের সাথে যুদ্ধ মানে গৃহযুদ্ধ। সেলডন প্ল্যান এই ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা দেয়নি-যেহেতু ওরা এবং আমরা উভয়ই ফাউণ্ডেশন। কাজেই তাদেরকে অবশ্যই আয়ত্তে আনতে হবে। তুমি নির্দেশ পেয়েছ।”
“এক্সিলেন্স-”
“আর কোনো প্রশ্ন নেই, ক্যাপ্টেন। তুমি নির্দেশ পেয়েছ। তুমি তা পালন করবে আমার সাথে বা আমার প্রতিনিধির সাথে আর কোনো বাকবিতণ্ডা করলে সেটাকে ধরা হবে বিশ্বাসঘাতকতা। তুমি এবার যেতে পারো।”
পুনরায় হাঁটু গেড়ে কুর্নিশ করল ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার, তারপর ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল দরজার দিকে।
মেয়র ইণ্ডবার, তৃতীয়, এবং ফাউণ্ডেশন-এর ইতিহাসে জন্মসূত্রে মেয়র পদাধিকারী দ্বিতীয় ব্যক্তি নিজের ভারসাম্য ফিরে পেলেন। বাঁদিকে চমৎকারভাবে গোছানো। একতাল কাগজ হতে একটা শিট টেনে নিলেন। পুলিশ বাহিনীর ইউনিফর্মে মেটাল ফোম ব্যবহার কমিয়ে দিলে যে সাশ্রয় হবে তারই রিপোর্ট এটা। এক জায়গার কমা কেটে বাদ দিলেন তিনি, ভুল বানান ঠিক করলেন একটা, মার্জিনের বাইরে নোট লিখলেন তিন জায়গায়। তারপর রেখে দিলেন ডান দিকে চমৎকারভাবে গোছানো একতাল কাগজের উপর। বাদিক থেকে টেনে নিলেন আরেকটা।
ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার ব্যরাকে ফিরে দেখল তার জন্য একটা পারসোন্যাল ক্যাপসুল অপেক্ষা করছে, উপরে জরুরি সিল মারা। তাকে হেভেন নামক বিদ্রোহী গ্রহে যাওয়ার কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার ঠাণ্ডামাথায় একজন যাত্রী বহনে সক্ষম তার হালকা স্পিডস্টারের কোর্স সেট করল কালগানের পথে। সেইরাতেই সে ঘুমাতে পারল একজন জেদি সফল মানুষের মতো।
*
১৩. লেফটেন্যান্ট এবং ক্লাউন
যদি, সাত হাজার পারসেক দূরে মিউল এর আর্মির হাতে কালগানের পতন বৃদ্ধ এক বণিকের কৌতূহল বাড়িয়ে তুলে, নাছোড়বান্দা এক ক্যাপ্টেনের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলে এবং খুঁটিনাটি বিষয়ে অতি যত্নশীল এক মেয়রের বিরক্তি উৎপাদন করে-কালগানের কাছে তা পুরোপুরি মামুলি ব্যাপার। সেখানে কারোরই এসব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। মানবজাতির জন্য অপরিবর্তনীয় শিক্ষা হল যে দূরবর্তী সময় এবং সেই সাথে স্পেস মনযোগের কেন্দ্র বিন্দু হওয়া উচিত। কিন্তু ঘটনাক্রমে এর কোনো রেকর্ড নেই, তাই নিশ্চিত করে বলা যায় না যে এই শিক্ষা স্থায়ীভাবে অর্জিত হয়েছে।
কালগান সবসময়ই ছিল-কালগান। গ্যালাক্সিতে মনে হয় একমাত্র সেই জানে যে ধ্বংস হয়ে গেছে এম্পায়ার, ভেঙে খান খান হয়ে গেছে বিশাল এক স্থাপনা, অদৃশ্য হয়ে গেছে শান্তি নামক আরাধ্য বস্তু।
কালগান ছিল লাক্সারি ওয়ার্ল্ড। যেখানে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে মানবজাতীর বহুদিনের গড়ে তোলা স্বপ্নসৌধ, সেখানে সে তার নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখেছিল বিনোদনের উৎপাদক, স্বর্ণের ক্রেতা, এবং অবসর সময়ের বিক্রেতা হিসেবে।
ইতিহাসের উত্থান পতন তার উপর কোনো প্রভাব ফেলেনি, কারণ কোন দখলদার এমন একটা গ্রহের ক্ষতি করবে যেখান থেকে চাইলেই যে-কোনো পরিমাণ নগদ অর্থ পাওয়া যাবে, যে অর্থ দিয়ে কেনা যাবে নিরাপত্তা।
কিন্তু শেষপর্যন্ত কালগানও পরিণত হল একজন ওয়ারলর্ডের সদর দপ্তরে এবং যুদ্ধের জরুরি প্রয়োজনে তার কোমলতা কিছুটা মলিন হল।
তার কৃত্রিম বনাঞ্চল, নির্দিষ্ট আদলে গড়ে তোলা বেলাভূমি, জাকজমকপূর্ণ নগরীর রাজপথ মুখরিত হল আমদানি করা মার্সেনারিদের পদভারে, নতুন চমকে চমকিত হল নাগরিকরা। সমরসজ্জা বাড়ানো হল প্রাদেশিক বিশ্বগুলোতে এবং গ্রহের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো অর্থ বিনিয়োগ করা হল ব্যাটলশিপ তৈরির জন্য। নতুন শাসক প্রমাণ করে দিল যে সে তার নিজের যা আছে তা দখলে রাখার জন্য এবং অন্যের যা আছে তা দখল করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
সে ছিল গ্যালাক্সির সেরাদের একজন, একইসাথে যুদ্ধের মদদদাতা এবং শান্তি স্থাপনকারী, একটা এম্পায়ারের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং একটা ডাইন্যাস্টির প্রতিষ্ঠাতা।
তার কোনো নাম নেই, শুধু একটা অদ্ভুত ধরনের ছদ্মনাম নিয়েই সে গড়ে তুলেছে একটা বিকাশোখ এম্পায়ার-অথচ একটা যুদ্ধও লড়তে হয়নি।
কাজেই কালগান আবার হয়ে গেলো আগের মতো, এবং বাহারি পোশাক পড়া নাগরিকরা দ্রুত ফিরে গেল তাদের আগের জীবনে আর বহিরাগত যুদ্ধ বিশেষজ্ঞরা সহজেই মিশে যেতে পারল এই জীবন স্রোতের সাথে।
আবারও বরাবরের মতো জঙ্গলে পোষা প্রাণী শিকারের বিলাসবহুল আয়োজন, যে প্রাণীগুলো কখনো মানুষ বধ করেনি; স্পিডস্টারে করে আকাশে চড়ে পাখি শিকার, যা শুধু মাত্র বড় আকারের পাখিগুলোর জন্য বিপদের কারণ।
শহরগুলোতে গ্যালাক্সির সমস্যাসংকুল জনজীবন থেকে যারা পালিয়ে এসে স্বস্তি পেতে চায় তারা নিজেদের পকেটের ওজন অনুযায়ী যে-কোনো ধরনের বিনোদনের সুযোগ নিতে পারে, হাফ ক্রেডিটের বিনিময়ে মেঘের উপর ভাসমান জমকালো প্রাসাদ ভ্রমণ-যা তাদের সামনে খুলে দেয় কল্পলোকের দুয়ার থেকে শুরু করে, বিশেষ এবং, গোপনীয় শিকারের সুযোগ যেখানে শুধু অত্যধিক সম্পদশালীরাই প্রবেশ করতে পারে।
এই বিপুল স্রোতের মাঝে, টোরান এবং বেইটা নতুন কোনো মাত্রা যোগ করতে পারল না। ইস্ট পেনিনসুলার কমন হ্যাঁঙারে মহাকাশ যান রেজিস্টার করিয়ে তারা চলে গেল মধ্যবিত্তদের জন্য উপযুক্ত ভ্রমণ কেন্দ্র বড় বড় দ্বীপ দ্বারা বেষ্টিত সাগর সৈকতে-যেখানে বিনোদন এখনো আইনসিদ্ধ এবং রুচিশীল-এবং মানুষের ভিড় কম।
আলো থেকে বাঁচার জন্য বেইটা চোখে লাগিয়েছে গাঢ় রঙের গ্লাস আর তাপ থেকে বাঁচার জন্য গায়ে চড়িয়েছে পাতলা সাদা রোব। উষ্ণ সোনালি এক জোড়া বাহু তার হাঁটু জড়িয়ে ধরল, মুগ্ধ দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকল তার স্বামীর দীর্ঘ পেশিবহুল শরীরের দিকে-সাদা সূর্যের আভায় প্রায় জ্বলজ্বল করছে।
“বেশি রোদ লাগিয়ো না”, বলল সে, কিন্তু টোরানের গাত্রবর্ণ এরই মাঝে মৃতপ্রায় লাল নক্ষত্রের বর্ণ ধারণ করেছে। তিন তিনটা বছর ফাউণ্ডেশনে কাটানোর পরেও সূর্যের আলো তার কাছে চরম বিলাসিতা। আজকে নিয়ে পরপর চারদিন সে ঘুরে বেড়িয়েছে পুরোপুরি উদোম শরীরে। ছোট একটা শর্টস ছাড়া কিছুই পড়েনি।
বালিতে হামাগুড়ি দিয়ে কাছাকাছি হল বেইটা, কথা বলল ফিসফিস করে।
হতাশ সুরে টোরান বলল, “না, স্বীকার করছি এখনো কিছু পাইনি। কিন্তু কোথায় সে? কে সে? এই উন্মাদ বিশ্বে তার ব্যাপারে কোনো আলোচনা নেই। হয়তো কোনো অস্তিত্বই নেই তার।”
“আছে, প্রায় ঠোঁট না নেড়েই জবাব দিল বেইটা। “খুব বেশি চতুর, ব্যস। তোমার চাচা ঠিকই বলেছেন। এই লোককে আমরা ব্যবহার করতে পারব-যদি এখনো সময় থাকে।”
সাময়িক নীরবতা। তারপর ফিসফিস করে বলল টোরান, “আমি কি করছি জানো, বে? দিবাস্বপ্ন দেখছি। এত চমৎকারভাবে ঘটনাগুলো ঘটছে।” তার কণ্ঠস্বর নিমজ্জিত হয়েই আবার ফিরে এল আগের মাত্রায়। “বে, কলেজে ড. আমান কীভাবে কথা বলতেন মনে আছে? ফাউণ্ডেশন কখনো পরাজিত হতে পারে না, কিন্তু তার মানে এই না যে ফাউণ্ডেশন-এর শাসকদের পরাজিত করা যাবে না। ইতিহাস কী বলে? ফাউণ্ডেশন-এর প্রকৃত ইতিহাস শুরু হয়েছে তখন থেকে যখন এনসাইক্লোপেডিস্টদের বিতাড়িত করে স্যালভর হার্ডিন প্রথম মেয়র হিসেবে টার্মিনাস গ্রহ দখল করেন। এবং পরবর্তী শতাব্দীতে হোবার ম্যালো জোরালো প্রচেষ্টার দ্বারা ক্ষমতা দখল করেননি? দুইবার শাসকরা পরাজিত হয়েছে, কাজেই এটা সম্ভব। তা হলে আমাদের দ্বারা হবে না কেন?”
“এটা পাঠ্য বইয়ের পুরোনো বিতর্ক, টোরি। চমৎকার একটা কল্পনার কী চরম অবনতি।”
“তাই? খেয়াল করো। হেভেন কী? ফাউণ্ডেশন-এর অংশ, তাই না? আমরা জয়ী হলে জিতবে কে, ফাউণ্ডেশন। শুধু বর্তমান শাসকরা পরাজিত হবে।”
“করতে পারব এবং করব’ এ দুটোর মাঝে অনেক পার্থক্য, টোরি। তুমি প্রলাপ বকছ।”
মুখ বাঁকা করল টোরান। “নাহ্, বে, তুমি এখন তোমার সেই বাজে মুডে আছ। আমার আনন্দটা কেন মাটি করতে চাও? বাদ দাও, আমি এখন ঘুমাবো।”
কিন্তু বেইটা সারসের মতো গলা বাড়িয়ে হঠাৎ আগাম কোনো নোটিশ না দিয়েই হেসে উঠল খিল খিল করে। গগলস্ নামিয়ে এক হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে তাকাল বিচের দিকে।”
একটা লম্বা কৃশকায় অবয়ব দেখছে সে, পা দুটো উপরে তুলে দুহাতে ভর দিয়ে টলমল করে হাঁটছে আশপাশের মানুষদের আনন্দ দেবার জন্য। উপকূলের হাজার হাজার অ্যাক্রোবেটিক ভিক্ষুকদের একজন, শরীরের নমনীয় জোড়াগুলো বাঁকিয়ে ঝট করে তুলে নিচ্ছে ছুঁড়ে দেওয়া কয়েন।
একজন বিচ গার্ড এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকে আর ক্লাউন আশ্চর্যরকম দক্ষতায় এক হাতে ভারসাম্য রেখে আরেক হাতের বুড়ো আঙুল দেখাল। খেপে গিয়ে গার্ড এগোলো আক্রমণের ভঙ্গিতে। দুই পায়ে খাড়া হল ক্লাউন। ডিগবাজি খেয়ে সোজা হওয়ার সময় পা দুটো সরাসরি নামিয়ে আনল গার্ডের পেটে। লাথি খেয়ে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হল গার্ড। ক্লাউন তারপর দ্রুত কেটে পড়ল। আনন্দ মাটি করার জন্য নাখোশ জনতা ঘিরে ধরল গার্ডকে।
এলোমেলো পদক্ষেপে দ্রুত বিচ থেকে বেরিয়ে আসছে ক্লাউন। ধাক্কা দিয়ে পথ থেকে সরিয়ে দিল অনেককে, ইতস্তত করছে, কিন্তু থামছে না। খেলা দেখার জন্য যারা ভিড় করেছিল অদৃশ্য হয়ে গেছে তারা, গার্ডও সরে পড়েছে।
“অদ্ভুত লোক”, খুশি খুশি আমেজ নিয়ে বলল বেইটা, একমত হল টোরান। পরিষ্কার চোখে পড়ার মতো কাছে চলে এসেছে ক্লাউন। চিকন মুখের সম্মুখভাগে বড় মাংসল নাক, লম্বা কৃশকায় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং মাকড়সার পায়ের মতো শরীরের উপর চাপানো পোশাক সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য, চলাফেরা ধীর স্থির এবং গুরুগম্ভীর, কিন্তু মনে হয় যেন পুরো শরীর একসাথে ছুঁড়ে ফেলছে।
দেখলেই হাসি পায়।
ক্লাউন সম্ভবত বুঝতে পারল যে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে, কারণ ওদেরকে পেরিয়ে গিয়েই থামল সে, ঝট করে ঘুরে এগিয়ে আসতে লাগল। তার বিশাল বাদামি চোখগুলো স্থির হয়ে আছে বেইটার উপর।
বিব্রত বোধ করল বেইটা।
হাসার ফলে ক্লাউনের চিকন মুখ আরো বিষণ্ণ হয়ে উঠল, মুখ খুলতেই বোঝা গেল যে সে সেন্ট্রাল সেক্টরের বাচনভঙ্গিতে কথা বলে।
“গুড স্পিরিটের কসম, সে বলল, “কখনো বিশ্বাস করতে পারিনি যে এত রূপসী নারী আছে-কারণ কল্পনা কখনো সত্যি হয় এটা কোনো পাগলেও চিন্তা করবে না, অথচ নিজের চোখে দেখে অবিশ্বাস করি কীভাবে, ওই মোহিনী চোখ দেখে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
বেইটার চোখ দুটো প্রশস্ত হল। শুধু একটা বিস্ময়কর শব্দ করতে পারল সে। হাসল টোরান, “ওহে, সুন্দরী, এই ব্যাটার পাঁচ ক্রেডিট পাওনা হয়েছে। দিয়ে দাও।”
কিন্তু এক লাফ দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল ক্লাউন। “না, মাই লেডি, ভুল বুঝবেন না। আমি পয়সা চাই না, চমৎকার চোখ এবং সুন্দর মুখ দেখেই ধন্য।”
“ধন্যবাদ”, বলল বেইটা।
“শুধু মুখ আর চোখই নয়, হড়বড় করে বলে চলেছে ক্লাউন, যেন তার শব্দগুলো ক্ষিপ্রগতিতে একটা আরেকটাকে অনুসরণ করছে। “আপনার মন পরিষ্কার, দৃঢ় এবং দয়ালু।”
উঠে দাঁড়াল টোরান, চারদিন ধরে হাতে যে রোব বহন করছে গায়ে চাপালো সেটা। “ঠিক আছে, ভায়া, কী চাও আমাকে বল। ভদ্রমহিলাকে বিরক্ত করবে না।”
ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল ক্লাউন, রোগা শরীর আরো সংকুচিত হয়ে গেল। “আমি কোনো ক্ষতি করব না। আমি এখানে নতুন। সবাই বলে আমি নাকি বোকা; কিন্তু এই মহিলার মুখ দেখে বুঝতে পারছি যে কঠিন মুখের পেছনে একটা কোমল হৃদয় আছে যা আমার সমস্যার সমাধান করতে পারবে। তাই এত কথা বলছি।”
“পাঁচ ক্রেডিটে তোমার সমস্যার সমাধান হবে?” জিজ্ঞেস করল টোরান, তারপর একটা মুদ্রা বাড়িয়ে ধরল।
কিন্তু সেটা নেওয়ার কোনো আগ্রহ দেখা গেল না ক্লাউনের ভেতর, বেইটা বলল, “আমাকে কথা বলতে দাও, টোরি।” তারপর দ্রুত নিচু স্বরে যোগ করল, “ওর কথা শুনে বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই, এটাই ওর কথা বলার ভঙ্গি। আমাদের কথা শুনেও সে সম্ভবত অবাক হচ্ছে।”
তারপর ক্লাউনকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার সমস্যা কী? গার্ডকে তুমি ভয় পাওনি। ওটা কোনো সমস্যা নয়, তাই না?”
“না, সে না। ওই ব্যাটা আমি হাঁটলে যে ধুলো ওড়ে তার বেশি কিছু না। আরেকজন আছে যার কাছ থেকে পালিয়ে এসেছি এবং সে হচ্ছে একটা ভয়ংকর ঝড়ের মতো। তার এত ক্ষমতা যে একটা গ্রহকে উড়িয়ে নিয়ে আরেকটা গ্রহের উপর আছড়ে ফেলতে পারে। এক সপ্তাহ আগে আমি পালিয়ে এসেছি, ঘুমিয়েছি শহরের রাস্তায়, আত্মগোপন করে থেকেছি শহরের ভিড়ের মাঝে। অনেকের মুখের দিকে তাকিয়েছি সাহায্যের আশায়। সেটা পেলাম এখানে।” উদ্বিগ্ন স্বরে শেষ কথাটা আবার পুনরাবৃত্তি করল সে, বড় বড় দুটো চোখে শঙ্কা, “সেটা পেলাম এখানে।”
“দেখো”, বোঝনোর সুরে বলল বেইটা, “আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই, কিন্তু বন্ধু, একটা গ্রহ ধ্বংস করে দেওয়ার মতো ঝড়ের বিরুদ্ধে আমি কিছুই করতে পারব না। সত্যি কথা বলতে কি-”
একটা বলিষ্ঠ পুরুষালী কণ্ঠের ধমক শুনে থেমে যেতে বাধ্য হল বেইটা।
“এই যে, হারামজাদা নর্দমার কীট, পেয়েছি তোকে।”
আবার সেই বিচ গার্ড, চেহারা রাগে লাল, মুখে গালিগালাজের তুবড়ি ছুটছে। দৌড়ে আসার সময় লো পাওয়ার স্টান্ট পিস্তল তুলে নির্দেশ দিল।
“আপনারা ওকে ধরে রাখুন। ছাড়বেন না।” সরু কাঁধে গার্ডের ভারী হাত পড়তেই ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল ক্লাউন।
“ও কী করেছে?” জিজ্ঞেস করল টোরান।
“কী করেছে? কী করেছে?” পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাড় মুছল গার্ড। “বলছি কী করেছে। পালিয়ে এসেছে। পুরো কালগানে প্রচার করা হয়েছে ওর পালানোর খবর। আমি আগেই চিনতে পারতাম যদি মাথায় ভর না দিয়ে দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত।”
“কোত্থেকে পালিয়ে এসেছে, স্যার?” হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল বেইটা।
গলা চড়াল গার্ড। ক্রমশ ভিড় বাড়ছে। রসগোল্লার মতো বড় বড় চোখ করে একযোগে কথা বলার চেষ্টা করছে সবাই। ভিড় যত বাড়ছে গার্ডের নিজেকে জাহির করার চেষ্টাও সমান তালে বাড়ছে।
“কোত্থেকে পালিয়েছে?” মুখ ভেংচে বলল গার্ড। “আশা করি আপনারা মিউলের নাম শুনেছেন?”
ভিড়ের সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেল, আর পেটের ভেতরটা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে জমে যাচ্ছে টের পেল বেইটা। ক্লাউন তার দিকেই তাকিয়ে আছে-হাত পা ছুঁড়ে চেষ্টা করছে গার্ডের বজ্রমুষ্ঠি থেকে ছাড়া পাবার।
“আর এই ব্যাটা,” গম্ভীর গলায় বলে চলেছে গার্ড, “হিজ লর্ডশিপের দরবারে একজন ভড়। সেখান থেকেই পালিয়েছে।” বন্দিকে দুহাতে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিল সে, “কিরে গর্দভ, ঠিক বলেছি না?”
জবাবে ক্লাউনের চেহারা আরেকটু ফ্যাকাশে হল, টোরানের কানে ফিস ফিস করে কিছু বলল বেইটা।
সামনে বাড়ল টোরান। “ঠিক আছে, ওর উপর থেকে হাত সরান। নাচ দেখানোর জন্য ওকে পয়সা দিয়েছি, সেটা এখনো দেখা হয়নি।”
“কী বলছেন!” ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল গার্ড। “ওকে ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার
“আপনি সেটা পাবেন, যদি প্রমাণ করতে পারেন যে ওই সেই লোক। তার আগে কিছু করতে পারবেন না। আপনি একজন অতিথিকে অপমান করেছেন, সেজন্য আপনার বিপদ হতে পারে।”
“কিন্তু আপনারা হিজ লর্ডশিপের কাজে বাধা দিচ্ছেন। তারজন্য আরো বড় বিপদ হতে পারে আপনাদের।” ক্লাউনকে ধরে আরেকটা ঝাঁকুনি দিল সে। “ভদ্রলোকের পয়সা ফেরত দে, বদমাশ।”
দ্রুত হাত বাড়ালো টোরান, বেমক্কা টান পড়ায় হাত মচকে গেল গার্ডের, স্টান্ট পিস্তল পড়ে গেল। রাগ আর ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল। নির্দয়ের মতো ধাক্কা দিয়ে তাকে এক পাশে সরিয়ে দিল টোরান, ছাড়া পেয়ে তার পিছনে এসে লুকালো ক্লাউন।
পরিস্থিতির এই নতুন অগ্রগতিতে ভিড়ের প্রায় সবাই কয়েক পা পিছিয়ে গেল যেন ঝামেলা থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তারপর একটা বলিষ্ঠ আদেশ শোনা গেল। জনতা দুভাগ হয়ে মাঝখানে রাস্তা তৈরি করে দিল, এবং সেই পথে এগিয়ে আসতে দেখা গেল দুজন লোককে। হাতের ইলেকট্রনিক হুইপ বাগিয়ে রেখেছে বিপজ্জনকভাবে। ধূসর পোশাকের বুকের কাছে আড়াআড়িভাবে একটা বজ্রপাতের চিহ্ন তার নিচে ভেঙে দু টুকরা হয়ে যাওয়া একটা গ্রহের ছবি।
বিশালদেহী কালো লোকটার পরনে লেফটেন্যান্টের ইউনিফর্ম। লোকটার সব কিছু কালো, চামড়া, চুল, ভুরু।
বিপজ্জনক মসৃণ গলায় কথা বলল কালো সৈনিক, বোঝাই যায় আদেশ পালন করানোর জন্য তাকে চিৎকার করতে হয় না। “তুমি আমাদের খবর দিয়েছ?” জিজ্ঞেস করল সে। মচকানো হাত এখনো মালিশ করছে গার্ড, ব্যথায় কাতর মুখ নিয়ে বলল, “পুরস্কারটা আমার পাওনা, আর এই লোকের বিরুদ্ধে ‘
“পুরস্কার তুমি পাবে”, তার দিকে না তাকিয়েই বলল লেফটেন্যান্ট। তারপর নিজের লোকদের নির্দেশ দিল, “ওকে নিয়ে যাও।”
টোরান টের পেল তার রোবের শেষ প্রান্ত শক্ত করে টেনে ধরেছে ক্লাউন। গলা চড়াল সে, “দুঃখিত, লেফটেন্যান্ট; এই লোক আমার সাথে যাবে।”
নিরাসক্তভাবে মন্তব্যটা গ্রহণ করল সৈনিক। হুইপ তুলল একজন, কিন্তু লেফটেন্যান্টের কড়া নির্দেশ পেয়ে নামিয়ে নিল।
কালো বিশাল শরীর নিয়ে টোরানের সামনে এসে দাঁড়াল সে। “কে আপনি?” জিজ্ঞেস করল।
উত্তর এল, “ফাউণ্ডেশন-এর একজন নাগরিক।”
কাজ হল তাতে-অন্তত ভিড়ের উপর কিছুটা প্রভাব তো পড়লই। এতক্ষণের জমাট নীরবতা পরিণত হল গুনগুন ধ্বনিতে। মিউলের নাম শুনে সবাই হয়তো ভয় পেয়েছে, কিন্তু যত যাই হোক নামটা নতুন, ফাউণ্ডেশন-এর মতো ভয় জাগাতে পারে নি-যে ফাউণ্ডেশন এম্পায়ারকে পরাজিত করেছিল, আর এখন নিষ্ঠুর স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এক চতুর্থাংশ গ্যালাক্সি শাসন করছে।
লেফটেন্যান্টের চেহারা ভাবলেশহীন। সে বলল, “ওই লোকটার পরিচয় জানেন আপনি?”
“আমাকে বলা হয়েছে সে আপনাদের নেতার দরবার থেকে পালিয়ে এসেছে, কিন্তু আমি শুধু জানি সে আমার বন্ধু। ওকে নিতে হলে শক্ত প্রমাণ দেখাতে হবে।”
কর্কশ দীর্ঘ নিশ্বাস পতনের শব্দ উঠল ভিড়ের মাঝ থেকে। সেটা না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করল লেফটেন্যান্ট। “আপনি যে ফাউণ্ডেশন-এর নাগরিক সেটা প্রমাণ করার মতো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে?”
“আমার মহাকাশযানে আছে।”
“বুঝতে পারছেন যে আপনি বে-আইনি কাজ করছেন। একারণে আমি আপনাকে গুলি করতে পারি।”
“নিঃসন্দেহে, কিন্তু সেক্ষেত্রে ফাউণ্ডেশন-এর একজন নাগরিককে গুলি করতে হবে আপনার। তারপর আপনার দেহ টুকরো টুকরো করে কিছু অংশ ফাউণ্ডেশনে পাঠানো হবে-আংশিক ক্ষতিপূরণ হিসেবে। পূর্বের ওয়ারলর্ডদের বেলায় এমন ঘটেছে।“
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল লেফটেন্যান্ট। কারণ কথাটা সত্যি।
“আপনার নাম?” জিজ্ঞেস করল সে।
সুযোগটা কাজে লাগাল টোরান। “মহাকাশযানে গিয়ে বাকি প্রশ্নের উত্তর দেব। হ্যাঁঙ্গার থেকে সেল নাম্বার আপনি জেনে নিতে পারবেন। বেইটা’ নামে রেজিস্টার করা হয়েছে।”
“আসামিকে ফেরত দেবেন না?”
“দেব, মিউলের কাছে। আপনার মাস্টার কে পাঠান।”
ঝট করে ঘুরল লেফটেন্যান্ট। কড়া গলায় নিজের লোকদের আদেশ দিল, “ভিড় হটাও।”
ইলেকট্রিক হুইপ উপরে উঠেই নেমে এল। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল ভিড়ের মাঝে। দ্রুত ফাঁকা হয়ে গেল জায়গাটা।
.
হ্যাঙ্গারে ফেরার পথে শুধু একবার চিন্তার রাজ্য থেকে বেরিয়ে এল টোরান। অনেকটা নিজেকে শোনানোর মতো করেই বলল, “গ্যালাক্সি, বে, কী একটা দিন গেল। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম।”
“হ্যাঁ”, বলল বেইটা, এখনো ভয়ে গলা কাঁপছে। চোখের দৃষ্টিতে প্রশংসা। “তোমার চরিত্রের সাথে মেলে না।”
“অমি এখনো জানি না কী হয়েছে। হাতে স্টান্ট পিস্তল ছিল, সেটা কীভাবে ব্যবহার করতে হয় আমি জানি না। সেভাবেই অফিসারের সাথে কথা বললাম। কেন এরকম করলাম আমি জানি না।”
ছোট একটা স্বল্প পাল্লার এয়ার ভেসেলে করে ওরা হ্যাঁঙ্গারে ফিরছে। আইলের ওপাশের আসনগুলোর একটাতে গুঁড়িসুড়ি মেরে শুয়ে আছে মিউলের ভাঁড়। সেদিকে তাকিয়ে তিক্ত স্বরে যোগ করল সে, “এর চাইতে কঠিন কাজ আমি আগে কখনো করিনি।”
.
লেফটেন্যান্ট দাঁড়িয়ে আছে গ্যারিসনের কর্নেলের সামনে। তার দিকে তাকিয়ে কর্নেল বললেন, “চমৎকার দেখিয়েছ। তোমার কাজ শেষ।”
কিন্তু লেফটেন্যান্ট সাথে সাথেই চলে গেলনা। তিক্ত গলায় বলল, “জনতার ভিড়ের সামনে মিউলের সম্মান হানির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।”
“সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।” যাওয়ার জন্য ঘুরল লেফটেন্যান্ট, তারপর আবার ফিরে অনেকটা মরিয়া হয়েই বলল, “আমি একমত, যে আদেশ আদেশই। কিন্তু, ওই লোকটার স্টান্ট পিস্তলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা, এর চেয়ে কঠিন কাজ আমি আগে কখনো করিনি।”
*
১৪. দ্য মিউট্যান্ট
কালগানের “হ্যাঙ্গার” একটু অদ্ভুত ধরনের। পর্যটকদের সাথে এখানে বিপুলসংখ্যক মহাকাশযানের আগমন ঘটে, সেগুলোর থাকার জায়গা করে দেওয়ার জন্যই এটা তৈরি হয়েছে। বুদ্ধিটা প্রথম যার মাথায় আসে, অল্প কয়েকদিনেই সে মিলিয়নেয়ারে পরিণত হয়। তার বংশধরেরা-জন্মসূত্রে বা অর্থের জোরে, যেভাবেই হোক- পরিণত । হয় কালগানের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে।
এক বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত “হ্যাঙ্গার” এবং শুধু “হ্যাঙ্গার” বললে সবটুকু পরিষ্কার হবে না। প্রকৃতপক্ষে এটা একটা হোটেল-মহাকাশযানের জন্য। নির্দিষ্ট ফি প্রদান করলে ভ্রমণকারীদের মহাকাশযানের জন্য একটা বার্থ বরাদ্দ করা হয়, যেখান থেকে তারা যে-কোনো মুহূর্তে টেক অফ করতে পারে। সাধারণ হোটেল সেবা যেমন ভালো খাবার, ওষুধপত্তর, শহরে বেড়ানোর ব্যবস্থা সবই নির্দিষ্ট ফি এর বিনিময়ে এখানে পাওয়া যাবে।
ফলে পর্যটকরা একই সাথে হ্যাঁঙ্গার এবং হোটেল সেবা পেয়ে যাচ্ছে অল্প খরচে। মালিক তার গ্রাউণ্ড সাময়িক ভাড়া দিয়ে অর্জন করছে প্রচুর মুনাফা। সরকার সংগ্রহ করছে বিপুল পরিমাণ ট্যাক্স। কারো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। সবাই খুশি। সোজা ব্যাপার।
প্রশস্ত কয়েকটা করিডর হ্যাঁঙ্গারের অগণিত ডানাগুলোকে যুক্ত করেছে। প্রতিটা ডানায় জায়গা পেয়েছে শতাধিক মহাকাশযান। আধো অন্ধকারে ঢাকা প্রশস্ত করিডর ধরে যে লোকটা হেঁটে যাচ্ছে, এর আগেও সে উপরে বর্ণিত সুযোগ সুবিধা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছে, কিন্তু তা ছিল অলস সময় কাটানোর উপায় কিন্তু এখন এত ভাবার সময় নেই।
বেঢপ উচ্চতার জাহাজগুলো সারিবদ্ধভাবে তৈরি করা প্রকোষ্ঠে আড়াআড়িভাবে শুয়ে আছে। একটার পর একটা লাইন পেরিয়ে যাচ্ছে লোকটা। নিজের কাজে সে দক্ষ-হ্যাঙ্গারে রেজিস্ট্রি করা সম্বন্ধে যে তথ্য সে সংগ্রহ করেছে সেগুলো সাহায্য না করলেও নিজের অভিজ্ঞতা এবং বিশেষ জ্ঞানের সাহায্যে সে নির্দিষ্ট ডানা এবং শত শত মহাকাশযানের ভেতর থেকে নির্দিষ্ট শিপ ঠিকই খুঁজে নিতে পারবে।
দু-একটা পোর্টহোলে আলো দেখা যাচ্ছে, তার মানে উঁচুমানের বিনোদন ছেড়ে সাধারণ বিনোদনের জন্য-অথবা নিজস্ব কোনো ব্যক্তিগত আনন্দের জন্য কেউ কেউ ফিরে এসেছে। লোকটা থেমে দাঁড়াল, হাসতে জানলে হয়তো হাসত। তবে তার মস্তিষ্কের উদ্দীপনাকে হাসির সমকক্ষ বলা যায়।
যে মহাকাশযানের সামনে সে থেমেছে সেটা চকচকে মসৃণ। নিঃসন্দেহে দ্রুতগতির। আলাদা ডিজাইনের, এটাই খুঁজছিল। মডেলটা আলাদা-এবং বর্তমানে গ্যালাক্সির এই পরিধির সকল মহাকাশযান ফাউণ্ডেশন-এর নকল করে বা ফাউণ্ডেশন-এর কারিগরদের দ্বারা তৈরি করা হয়। কিন্তু এটা খোদ ফাউণ্ডেশনে তৈরি করা হয়েছে। তার প্রমাণ ইস্পাতের চামড়ায় ছোট ঘোট বুদবুদ, নিরাপত্তা স্ক্রিণের সংযোগস্থল হিসেবে এগুলো কাজ করে। এবং একমাত্র ফাউণ্ডেশন শিপেই এধরনের নিরাপত্তা স্ক্রিন ব্যবহার করা হয়।
লোকটা একটুও ইতস্তত করল না।
বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। সাথে করে আনা বিশেষ ধরনের নিউট্রালাইজিং ফোর্স এর সাহায্যে এলার্ম অ্যাকটিভেট না করেই সে খুব সহজে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল।
কেউ এসেছে কোমল সুরে বাজার বেজে উঠার পরেই শুধুমাত্র ভেতরের মানুষগুলো তা টের পেল। মেইন এয়ারলকের পাশে একটা ফটোসেল আছে, সেটাতে হাতের তালু দিয়ে স্পর্শ করলে বাজার বেজে ওঠে।
তার আগে “বেইটার” ধাতব দেয়ালের ভেতরে টোরান এবং বেইটা নিশ্চিন্তে সময় কাটাচ্ছিল। মিউলের ক্লাউন টুলে কুঁজো হয়ে বসে গোগ্রাসে খাবার গিলছে। ইতোমধ্যে তাদের জানা হয়ে গেছে যে ক্লাউনের দেহটা ছোট হলেও নামটা রাজাদের মতো-ম্যাগনিফিসো জায়গান্টিকাস।
বেইটা রান্না ঘরে যখন ঢুকছে বেরোচ্ছে শুধুমাত্র তখনই বিষণ্ণ চোখ তুলে সে তাকাচ্ছে বেইটার গমনপথের দিকে।
“জানি আমার মতো নগণ্য মানুষের ধন্যবাদের কোনো মূল্য নেই”, ফিসফিস করে বলল সে। “তবুও আপনাকে ধন্যবাদ। গত এক সপ্তাহে মানুষের উচ্ছিষ্ট ছাড়া কিছু জোটেনি কপালে। দেহটা ছোট হলে কি হবে, ক্ষুধা খুব বেশি।”
“বেশ, তা হলে খাও”! মৃদু হেসে বেইটা বলল। “ধন্যবাদ দিয়ে সময় নষ্ট করো না। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ নিয়ে সেন্ট্রাল গ্যালাক্সির একটা প্রবাদ আছে, তাই না?
“সত্যিই আছে, মাই লেডি, একজন শিক্ষিত লোকের কাছে শুনেছিলাম, ফাঁকা বুলি না আওড়ালেই কৃতজ্ঞতা সবচেয়ে সুন্দর এবং কার্যকরী হয়ে উঠে। কিন্তু দুঃখের বিষয় মাই লেডি, আমার কাছে ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছু নেই। এই ফাঁকা বুলি শুনিয়েই মিউলকে খুশি করেছিলাম, ফলে একটা বাহারি নাম আর দরবারে জায়গা পেয়েছি। আমার পূর্বের নাম ছিল বোবো, এটা তাকে খুশি করতে পারেনি। আর তাকে খুশি করতে না পারলে সহ্য করতে হত চাবুকের আঘাত।”
পাইলট রুম থেকে ডাইনিংরুমে প্রবেশ করল টোরান। “এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। ফাউণ্ডেশন শিপ মানেই ফাউণ্ডেশন টেরিটোরি, আশা করি মিউল কথাটা জানে।”
ম্যাগনিফিসে জায়গান্টিকাস চোখ বড় করে বিস্মিত সুরে বলল, “ফাউণ্ডেশন কত শক্তিশালী যার সামনে মিউলের অনুগত নিষ্ঠুর লোকদেরও হাঁটু কাঁপতে শুরু করে।”
“তুমিও ফাউণ্ডেশন-এর কথা শুনেছ?” মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল বেইটা।
“কে শোনেনি?” ফিসফিস করে বলল ম্যাগনিফিসো। “অনেকেই বলে ওটা জাদু আগুন এবং গোপন শক্তিতে পরিপুর্ণ একটা বিশ্ব যা অন্য গ্রহগুলোকে গ্রাস করে ফেলতে পারে। আমার মতো একটা নগণ্য মানুষও শুধুমাত্র ‘আমি ফাউণ্ডেশন-এর নাগরিক, এই কথাটা বলে যে সম্মান আর নিরাপত্তা অর্জন করতে পারবে গ্যালাক্সির অন্য কোনো ক্ষমতাশালী এবং সম্পদশালী ব্যক্তিও তা পারবে না।”
“শোন, ম্যাগনিফিসো, এভাবে বক্তৃতা দিলে খাওয়া আর শেষ হবে না কোনোদিন। দাঁড়াও, দুধ এনে দিচ্ছি। খেতে ভালো লাগবে।”
টেবিলের উপর দুধের পাত্র রেখে টোরানকে সরে আসার জন্য ইশারা করল বেইটা।
“টোরি, এখন আমরা কী করব ওর ব্যাপারে?” রান্নাঘরের দিকে ইঙ্গিত করল সে।
“মানে?”
“মিউল যদি আসে আমরা কী ওকে মিউলের হাতে তুলে দেব?”
“আর কী করার আছে, বে?” উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর আর যেভাবে কপালের উপর থেকে একগোছা কোঁকড়া চুল সরাল তাতে তার উদ্বেগ আরো পরিষ্কার হল।
অধৈর্য সুরে বলতে লাগল টোরান, “এখানে আসার আগে ভেবেছিলাম মিউলের খোঁজ খবর করে কিছু তথ্য পাওয়া যাবে। তারপর কাজ শুরু করতাম। কী কাজ সেটার অবশ্য কোনো ধারণা ছিল না।”
“বুঝতে পেরেছি, টোরি । মিউলকে স্বচক্ষে দেখব আশা করিনি, কিন্তু আমিও ভেবেছিলাম এখানে এসে একটা না একটা পথ পাওয়া যাবেই। আমি তো আর গল্পের বই-এর কোনো স্পাই না।”
“তুমি আমার থেকে খুব একটা পিছিয়ে নেই, বে।” বুকে হাত বেঁধে ভুরু কোঁচকালো টোরান। “কী একটা পরিস্থিতি! শেষের অস্বাভাবিক ঘটনাটা না ঘটলে তুমি বুঝতেই না যে মিউল নামে কেউ আছে। তোমার কী মনে হয় ক্লাউনকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সে আসবে?
মুখ তুলল বেইটা। “জানি না। বুঝতে পারছি না কী করা উচিত বা বলা উচিত। তুমি পারছ?”
কর্কশ শব্দে বাজার বেজে উঠল। নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়ল বেইটা, “মিউল”! দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
ম্যাগনিফিসোর দৃষ্টি বিস্ফোরিত, ভয়ে গলা কাঁপছে! “মিউল!”
“ওদেরকে ভিতরে নিয়ে আসা উচিত।” ফিসফিস করে বলল টোরান।
একটা কন্টাক্ট এয়ার লক খুলে দিল আর বাইরের দরজা বন্ধ করে দিল আগন্তুকের পিছনে। ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা শুধু মাত্র একজন মানুষের আবছা অবয়ব ফুটে উঠেছে স্ক্যানারে।
“মাত্র একজন,” স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল টোরান, সিগন্যাল টিউবের উপর ঝুঁকে যখন কথা বলল তখনো অবশ্য গলা কাঁপছে, “কে আপনি?”
“ভেতরে আসতে দিলেই জানতে পারবেন, তাই না?” রিসিভারের মাধ্যমে চিকন গলার জবাব ভেসে এল।
“আপনাকে মনে করিয়ে দেওয়া উচিত যে এটা ফাউণ্ডেশন শিপ এবং আন্ত মহাকাশীয় চুক্তি অনুযায়ী ফাউন্ডেশন টেরিটোরি হিসেবে গণ্য।”
“আমি জানি।”
“অস্ত্র বাইরে রেখে আসবেন, নইলে শুট করব। আমার কাছে অস্ত্র আছে।”
“ঠিক আছে।”
ভিতরে ঢোকার দরজা খুলে দিল টোরান, ব্লাস্টারের কন্টাক্ট বন্ধ করলেও বুড়ো আঙুল সরাল না। এগিয়ে আসার পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সাবলীলভাবে দরজা খুলে গেল, এবং সাথে সাথে চিৎকার করে উঠল ম্যাগনিফিসো, “ও মিউল না, অন্য মানুষ”।
‘মানুষটা’ ক্লাউনের দিকে ফিরে সুন্দর করে মাথা ঝাঁকাল। “ঠিকই ধরেছ, আমি মিউল না।” হাতদুটো শরীর থেকে দূরে সরিয়ে বলল, “আমি নিরস্ত্র আর আপনাদের বিপদে ফেলার কোনো উদ্দেশ্য নেই। শান্ত হোন, দয়া করে অস্ত্রটা সরান। হাত যেভাবে কাঁপছে তাতে মনে শান্তি পাচ্ছি না।”
“কে আপনি?” চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করল টোরান।
“প্রশ্নটা তো আমি আপনাকে করব”, শীতল কণ্ঠে জবাব দিল আগন্তুক। “যেহেতু আমি না, আপনি একটা ভুল ধারণা তৈরির চেষ্টা করছেন।”
“কীভাবে?”
“নিজেকে আপনি ফাউণ্ডেশন-এর নাগরিক হিসেবে দাবি করেছেন অথচ এই গ্রহে কোনো অথরাইজড ট্রেডার এই মুহূর্তে বেড়াতে আসেনি।”
“ঠিক এইরকম কিছু না। কিন্তু আপনি জানলেন কীভাবে?”
“আমি ফাউণ্ডেশন-এর নাগরিক এবং সেটা প্রমাণ করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে। আপনার আছে?”
“আমার মনে হয় আপনি চলে গেলেই ভালো করবেন।”
“আমার তা মনে হয় না। ফাউণ্ডেশন-এর আইন সম্বন্ধে আপনার ধারণা থাকুক আর নাই থাকুক, আপনাকে জানানো উচিত যে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমি ফিরে না গেলে ফাউণ্ডেশন-এর নিকটস্থ সদর দপ্তর সতর্ক হয়ে উঠবে-তখন আপনার অস্ত্র কোনো কাজেই আসবে না।”
থমথমে নীরবতা নেমে এল, তারপর বেইটা শান্ত স্বরে বলল, “বন্দুক সরাও, টোরান, উনি বোধহয় সত্যি কথাই বলছেন। মুখের কথায় বিশ্বাস করা যায়।”
“ধন্যবাদ।” আগন্তুক বলল।
পাশের চেয়ারে অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলল টোরান, “আমার বিশ্বাস এবার সব ভোলাসা করে বলবেন আপনি।”
আগম্ভক দাঁড়িয়ে থাকল। পেশিবহুল লম্বা চওড়া দেহ, সমতল মুখে নির্দয় নিষ্ঠুরতার স্থায়ী ছাপ স্পষ্ট, পরিষ্কার বোঝা যায় এই লোক জীবনে কোনোদিন হাসেনি। কিন্তু তার চোখে নিষ্ঠুরতার কোনো ছাপ নেই।
“খবর বাতাসের আগে দৌড়ায়,” বলল সে, “বিশেষ করে যদি তা হয় অবিশ্বাস্য খবর। আমার মনে হয় এই মুহূর্তে কালগানের কারো জানতে বাকি নেই যে ফাউণ্ডেশন-এর দুজন ট্যুরিস্ট মিউলের লোকদের মুখে ঝাটা মেরেছে। সন্ধ্যার আগেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আমরা জেনে ফেলি।”
“আমরা’ মানে কারা?”
“আমরা’-’আমরাই’! আমি তাদেরই একজন। জানি আপনারা হ্যাঁঙ্গারে আছেন। রেজিস্ট্রি চেক করার সময় এবং এই জাহাজ খুঁজে বের করার জন্য নিজস্ব কায়দা কাজে লাগিয়েছি।”
হঠাৎ পুরো শরীর নিয়ে বেইটার দিকে ঘুরল, “আপনি ফাউণ্ডেশন-এর নাগরিক-জন্মসূত্রে, তাই না?”
“তাই নাকি?”
“বিরোধী ডেমোক্রেটিক দলের সদস্য-আপনারা বলেন ‘দ্য আণ্ডারগ্রাউণ্ড। নাম মনে নেই, তবে চেহারা মনে আছে। কিছুদিন আগে বেরিয়ে এসেছেন-তবে আরো গুরুত্বপূর্ণ কেউ হলে বেরোতে পারতেন না।”
শ্রাগ করল বেইটা, “অনেক কিছুই জানেন।”
“জানতে হয়। আপনি কী তাকে নিয়েই ফাউণ্ডেশন থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন?”
“আমি যাই বলি তার কোনো মূল্য আছে?”
“না। আমি শুধু চাই আমরা পরস্পরকে বোঝার চেষ্টা করব। আমার বিশ্বাস আপনি যে সপ্তাহে চলে আসেন তখন পাসওয়ার্ড ছিল, ‘সেলডন, হার্ডিন, এবং মুক্তি। পোরফিরাট হার্ট ছিল আপনার সেকশন লিডার।”
“আপনি কীভাবে জানেন?” হঠাৎ করেই মারমুখো হয়ে উঠল বেইটা। “পুলিশ তাকে ধরে ফেলেছে?” পিছন থেকে ধরে রাখার চেষ্টা করল টোরান, কিন্ত ঝাড়া মেরে নিজেকৈ ছাড়িয়ে সামনে এগোলো।
ফাউণ্ডেশন-এর আগম্ভক শান্ত গলায় বলল, “কেউ তাকে ধরেনি। আসলে আণ্ডারগ্রাউণ্ড তার ডালপালা ভালোভাবেই ছড়িয়েছে। এমনকি অস্বাভাবিক জায়গাতেও। আমি ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার অফ ইনফর্মেশন, এবং আমি একজন সেকশন লিডার-কী নামে সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।”
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল সে, তারপর বলল, ‘না, আমাকে বিশ্বাস করতে হবে না। আমাদের যে কাজ তাতে অতিরিক্ত সন্দেহ করাটাই জান বাঁচানোর জন্য নিরাপদ। তবে আমার বোধহয় এসব প্রাথমিক ব্যাপারগুলো বাদ দেওয়া উচিত।”
“হ্যাঁ,” বলল টোরান, “সেটাই করুন।”
“বসতে পারি? ধন্যবাদ।” পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারের পেছনে একটা হাত ঝুলিয়ে বসল ক্যাপ্টেন প্রিচার। প্রথমেই বলে রাখি পুরো ব্যাপারটা আপনারা কীভাবে দেখছেন, আমি জানি না। আপনারা ফাউণ্ডেশন থেকে আসেননি, কিন্তু এটা অনুমান করতে কষ্ট হবার কথা নয় যে এসেছেন কোনো একটা স্বাধীন বণিক বিশ্ব থেকে। এটা নিয়েও আমি খুব বেশি মাথা ঘামাচ্ছি না। শুধু জানার কৌতূহল হচ্ছে, এই লোকের কাছে আপনারা কী চান, যে ক্লাউনকে বিপদ থেকে রক্ষা করছেন, কাছে রাখার জন্য নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি নিচ্ছেন?”
“সেটা আপনাকে আমি বলতে পারব না।”
“হুম-ম-ম। বলবেন আশা করিনি। কিন্তু যদি ভেবে থাকেন ঢাকঢোল বাজিয়ে মিউল আপনাদের কাছে আসবে-তা হলে ভুল করছেন! মিউল এভাবে কাজ করে না।”
“কী?” টোরান এবং বেইটা এক সাথে বলল, আর ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যাগনিফিসোর মুখে হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ল উফুল্ল হাসি।
“ঠিকই বলছি। আমি নিজে তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি, এবং আপনাদের মতো নবিশের চাইতে আরো সূক্ষ্ম কৌশল অবলম্বন করেছি। লাভ হয়নি। লোকটা কখনো জনসম্মুখে দেখা দেয় না, নিজের ছবি বা মূর্তি তৈরি করতে দেয় না, এবং ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সহকারী ছাড়া কেউ তাকে সরাসরি দেখেনি।”
“আর সেইজন্যই আপনি আমাদের দিকে মনযোগ দিয়েছেন, তাই না, ক্যাপ্টেন?” প্রশ্ন করল টোরান।
“না। দ্যাট ক্লাউন ইজ দ্য কি। যে কয়েকজন মিউলকে স্বচক্ষে দেখেছে এই ক্লাউন সেই অল্প কয়েকজনের একজন। তাকে আমার চাই। হয়তো কিছু প্রমাণ পাওয়া যাবে এবং আমার একটা কিছু দরকার। গ্যালাক্সির কসম, ফাউণ্ডেশনকে জাগিয়ে তোলার জন্য একটা কিছু দরকার।”
“জাগিয়ে তুলতে হবে?” ধারালো গলায় বলল বেইটা। “কিসের বিরুদ্ধে? আর এলার্ম হিসেবে আপনি কোন ভূমিকা পালন করবেন, বিদ্রোহী ডেমোক্র্যাট নাকি গুপ্তপুলিস?”
ক্যাপ্টেনের মুখের রেখাগুলো আরো কঠিন হল। “ফাউণ্ডেশন-এর বিপদ হলে ডেমোক্র্যাট এবং স্বৈরশাসক দুই পক্ষই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। বরং স্বৈরশাসককেই রক্ষা করা উচিত, কারণ একসময় না এক সময় তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যাবে।”
“সবচেয়ে বড় স্বৈরশাসক কে?” রাগে ফেটে পড়ল বেইটা।
“মিউল। আমি বেশকিছু তথ্য জেনেছি, দ্রুত পদক্ষেপ না নিতে পারলে কয়েকবার মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ক্লাউনকে যেতে বলুন, প্রাইভেসি দরকার।”
“ম্যাগনিফিসো,” ইশারা করল বেইটা, নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল ক্লাউন।
ক্যাপ্টেনের কণ্ঠস্বর গম্ভীর, তীক্ষ্ণ এবং এতই নিচু যে টোরান এবং বেইটা আরো কাছে এগিয়ে আসতে বাধ্য হল।
“মিউল বুদ্ধিমান এক চৌকস খেলোয়ার-নেতৃত্বের গ্ল্যামার এবং আকর্ষণী ক্ষমতার যে অনেক সুবিধা আছে সেটা বোঝার মতো যথেষ্ট বুদ্ধিমান। ব্যাপারটা এড়িয়ে চলার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। সম্ভবত জনসম্মুখে তার উপস্থিতি এমন কিছু প্রকাশ করে দেবে যা প্রকাশ না করাটাই জরুরি।”
হাত নেড়ে প্রশ্ন করতে নিষেধ করল সে, এবং দ্রুত কথা বলতে লাগল, “আমি ওর জন্মস্থানে গিয়েছিলাম। অনেককে প্রশ্ন করেছি। সব কথা মনে নেই তাদের। তাকে যারা চিনত-জানত, তাদের বেশিরভাগই মারা গেছে। তবে ত্রিশ বছর আগে জন্ম নেওয়া শিশুটি, তার মায়ের মৃত্যু, এবং তার অস্বাভাবিক যৌবনকালের কথা মনে আছে। মিউল আসলে মানুষ না।”
আতঙ্কে শ্রোতা দুজন ঝট করে পিছিয়ে গেল, শেষ কথাটার অর্থ পরিষ্কার বুঝতে না পারলেও কথাটার মাঝে যে বিপদ এবং হুমকি লুকিয়ে আছে সেটা ঠিকই বুঝতে পেরেছে।
ক্যাপ্টেন বলে চলেছে, “হি ইজ এ মিউট্যান্ট, এবং নিঃসন্দেহে সফল একজন। তার ক্ষমতা কতদূর আমার জানা নেই, বলতে পারব না ত্রিমাত্রিক ‘থ্রিলারে যে সুপারম্যানদের দেখানো হয় তাদের সাথে মিউলের মিল কতখানি। তবে শূন্য থেকে শুরু করে কালগানের ওয়ারলর্ডদের পরাজিত করার মাধ্যমে অনেক কিছুই প্রকাশ করে। বিপদটা কোথায় আপনারা বুঝতে পারছেন না? জেনেটিক দুর্ঘটনার কারণে অস্বাভাবিক ক্ষমতা নিয়ে বেড়ে উঠা কোনো বস্তুর কথা সেলডন প্ল্যানে বিবেচনা করা হয়েছে?”
ধীরে ধীরে কথা বলল বেইটা, “আমি বিশ্বাস করি না। এটা কোন ধরনের কূটকৌশল। যদি সুপারম্যানই হয় তা হলে সুযোগ পেয়েও মিউলের লোকেরা আমাদের হত্যা করেনি কেন?”
“বলেছি তো, তার মিউটেশনের মাত্রা কতদূর আমি জানি না। হয়তো ফাউণ্ডেশন-এর সাথে লড়াই করার জন্য সে এখনো প্রস্তুত হয়নি, এবং প্রস্তুতি না নিয়ে কোনো ধরনের উসকানিমূলক আচরণ না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এবার আমাকে ক্লাউনের সাথে কথা বলতে দিন।”
ভয়ে কাঁপছে ম্যাগনিফিসো, মুখোমুখি দাঁড়ানো বিশালদেহী নিষ্ঠুর চেহারার মানুষটাকে সে একটুও বিশ্বাস করতে পারছে না।
ধীরে ধীরে শুরু করল ক্যাপ্টেন, “মিউলকে তুমি স্বচক্ষে দেখেছ?”।
“দেখেছি, রেসপ্যাকটেড স্যার, এবং নিজ দেহের উপর তার বাহুর ওজন অনুভব করেছি।”
“তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেমন দেখতে একটু বর্ণনা করতে পারবে?”
“মনে হলেই কলজে শুকিয়ে যায়, রেসপ্যাকটেড স্যার। এই এ্যাত্তো বড় শরীর। ওর সামনে এমনকি আপনাকেও কচি খোকা মনে হবে। আগুনের মতো লাল চুল, একবার হাত এভাবে উপরে তুলে রেখেছিল আর আমি পুরো শক্তি আর পুরো ওজন দিয়েও একচুল নামাতে পারিনি। জেনারেলদের সামনে বা তার সামনে মজা দেখানোর সময় বেল্টে এক আঙুল ঢুকিয়ে আমাকে তুলে নিত উপরে। সেই অবস্থায় কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতে হত। ওই অবস্থায় পুরো কবিতা আবৃত্তি করতে হত। ভুল হলে শুরু করো আবার প্রথম থেকে। অসীম শক্তিশালী মানুষ এবং তার চোখ, রেসপ্যাকটেড স্যার, কেউ কোনোদিন দেখেনি।”
“কী? শেষ কথাটা কী বললে?”
“সে চশমা পরে, রেসপ্যাকটেড স্যার, অদ্ভুত ধরনের চশমা। বলা হয়ে থাকে, সেগুলো স্বচ্ছ এবং শক্তিশালী জাদুর সাহায্যে সে সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি দেখতে পারে। আমি শুনেছি,” তার কণ্ঠস্বর আরো নিচু এবং রহস্যময় হয়ে উঠল, “যে তার চোখের দিকে তাকানো মানেই মৃত্যু।”
শ্রোতাদের মুখের দিকে দ্রুত দৃষ্টি বোলালো ম্যাগনিফিসো। কৃশকায় দেহ কেঁপে উঠল একবার, “কথাগুলো সত্যি, স্যার। আমি বেঁচে আছি এটা যেমন সত্য, ঠিক সেরকম সত্য।”
লম্বা দম নিল বেইটা, “মনে হচ্ছে আপনার কথাই ঠিক, ক্যাপ্টেন। এখন আপনি কী করতে বলেন?”
“ঠিক আছে, পুরো পরিস্থিতিটা আরেকবার দেখা যাক। এখানে তো আপনাদের কোনো দেনা পাওনা নেই? হ্যাঁঙ্গারের উপরে বাধামুক্ত?”
“আমি যে-কোনো মুহূর্তে চলে যেতে পারি।”
“তা হলে চলে যান। মিউল হয়তো ফাউণ্ডেশন-এর সাথে বিরোধে জড়াতে চাইছে না, কিন্তু ম্যাগনিফিসোকে ছেড়ে দিয়ে সে বিরাট ঝুঁকি নিয়েছে। কাজেই ধরে নেওয়া যায় যে উপরে মিউলের কোনো শিপ আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। স্পেসে আপনারা হারিয়ে গেলে কে মাথা ঘামাবে?”
“ঠিকই বলেছেন,” ফাঁকা গলায় বলল টোরান।
“যাই হোক আপনাদের শিল্ড আছে আর গতিতে ওদেরকে হারিয়ে দিতে পারবেন, কাজেই বায়ুমণ্ডল থেকে বেরনোর সাথে সাথে বৃত্তাকার গতিতে বিপরীত গোলার্ধে চলে যাবেন। তারপর ছুটবেন যত দ্রুত সম্ভব।”
“তারপর, “ ঠাণ্ডা গলায় বলল বেইটা, “ফাউণ্ডেশনে ফেরার পর আমাদের কী হবে, ক্যাপ্টেন?”
“কেন, আপনারা তখন ফাউণ্ডেশন-এর সু-নাগরিক, তাই না? আমি তো অন্য কিছু জানি না, জানি কি?”
কেউ কিছু বলল না। কন্ট্রোলের দিকে ঘুরল টোরান।
প্রথম হাইপার স্পেসাল জাম্প করার জন্য কালগান থেকে যথেষ্ট দূরে আসার পর এই প্রথম ক্যাপ্টেন প্রিচারের মুখে ভাঁজ পড়ল-কারণ মিউলের কোনো শিপ তাদের বাধা দেয়নি।
“মনে হচ্ছে ম্যাগনিফিসোকে নিয়ে যেতে আমাদের বাধা দেবে না সে। আপনার কাহিনীর জন্য খুব একটা ভালো হল না।”
“যদি না,” সংশোধন করে দিল ক্যাপ্টেন, “সে চায় যে আমরা তাকে নিয়ে যাই, সেক্ষেত্রে তা ফাউণ্ডেশন-এর জন্য খুব একটা ভালো হবে না।”
শেষ হাইপারজাম্পের পর ফাউণ্ডেশন-এর নিউট্রাল ফ্লাইট ডিসট্যান্সে যখন পৌঁছল, তখন তাদের শিপে এসে পৌঁছল প্রথম হাইপার ওয়েভ সংবাদ।
এবং তারমধ্যে শুধু একটা সংবাদ উল্লেখ করার মতো। খবরের মূল বক্তব্য-ফাউণ্ডেশন-এর এক ওয়ারলর্ড-তিতবিরক্ত খবর পাঠক অবশ্য তার পরিচয় দিতে পারেনি-জোরপূর্বক মিউলের পরিষদের একজন সদস্যকে ধরে নিয়ে গেছে। তারপরই ঘোষক খেলার খবর পাঠ করতে লাগল।
“মিউল আমাদের চাইতে একধাপ এগিয়ে গেছে।” শীতল গলায় বলল ক্যাপ্টেন প্রিচার। “ফাউণ্ডেশন-এর জন্য সে তৈরি এবং এটাকে একটা উসিলা হিসেবে ব্যবহার করছে। পরিস্থিতি আমাদের জন্য আরো কঠিন হয়ে গেল। এখন প্রস্তুত হওয়ার আগেই অ্যাকশনে নেমে পড়তে হবে।”
*
১৫. দ্য সাইকোলজিস্ট
বহুবিধ কারণেই “বিশুদ্ধ বিজ্ঞান” হিসেবে পরিচিত উপাদানগুলো ফাউণ্ডেশনে সবচাইতে মুক্ত জীবনযাপন করে। যে গ্যালাক্সিতে ফাউণ্ডেশন-এর কর্তৃত্ব-এবং এমনকি অস্তিত্ব পর্যন্ত নির্ভর করছে তার অতি উন্নত প্রযুক্তির উপর-এমনকি গত দেড় শতাব্দীতে ফিজিক্যাল পাওয়ারে প্রভূত উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও-উত্তরাধিকার সূত্রে বিজ্ঞানীরা একটা বিশেষ ধরনের নিরাপত্তা বোধ অর্জন করে। তাদের প্রয়োজন আছে, এবং সেটা তারা জানে।
তেমনিভাবে, বহুবিধ কারণে এবলিং মিস-যারা তাকে চেনে না শুধু তারাই নামের সাথে উপাধি যোগ করে-ফাউণ্ডেশন-এর “বিশুদ্ধ বিজ্ঞান” এর সবচাইতে মুক্ত উপাদান। সে বিজ্ঞানী, এমন এক বিশ্বের, যেখানে বিজ্ঞানকে সম্মান করা হয়-এবং প্রথম সারির। তার প্রয়োজন আছে, এবং সেটা সে জানে।
আর তাই যখন অন্যরা হাঁটু গেড়ে কুর্নিশ করে, সে জোর গলায় বলে বেড়ায় যে তার পূর্বপুরুষরা কখনো কোনো ঘৃণ্য মেয়রকে কুর্নিশ করেনি। এবং তার পূর্বপুরুষদের সময়ে ভোটের মাধ্যমে মেয়র নির্বাচিত হত, এবং ইচ্ছা হলেই তাদের লাথি মেরে গদি থেকে সরিয়ে দেওয়া যেত এবং জন্মসূত্রে যে লোক উত্তরাধিকার হিসেবে এই পদ লাভ করে সে একটা জাত গর্দভ।
সেজন্যই যখন এবলিং মিস স্থির করল যে নিজেকে দর্শন দিয়ে ইণ্ডবারকে সে ধন্য করে দেবে তখন স্বাভাবিক জটিল অফিসিয়াল নিয়ম কানুনের ধার ধারল না। মানুষের বিরক্তি উৎপাদনে সক্ষম এমন দুটো জ্যাকেট কাঁধের উপর ফেলে মাথায় চাপাল অদ্ভুত ডিজাইনের বিদঘুঁটে একটা টুপি, কটু গন্ধের একটা সিগার ধরিয়ে, দুজন গার্ডের বাধা উপেক্ষা করে হুড়মুড় করে এগিয়ে চলল মেয়রের প্রাসাদের দিকে।
অনধিকার প্রবেশের ব্যাপারটা হিজ এক্সিলেন্স টের পেলেন তখন যখন তিনি নিজের শৌখিন বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত। সেখান থেকেই তিনি শুনতে পেলেন একটা উচ্চৈঃস্বরের কোলাহল ক্রমশ এগিয়ে আসছে।
ধীরে ধীরে ইণ্ডবার চাড়া তোলার যন্ত্রটা নামিয়ে রাখলেন; ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন; ধীরে ধীরে ভুরু কোঁচকালেন। কারণ ইণ্ডবার প্রতিদিন কাজ থেকে কিছু সময়ের ছুটি নেন, এবং আবহাওয়া ভালো থাকলে দুই ঘণ্টা বাগানে কাটান। বাগানে তিনি বর্গাকারে এবং ত্রিভুজাকারে ফুল ফুটিয়েছেন, লাল এবং হলুদ রঙের মিশ্রণ, পার্থক্য বোঝানোর জন্য মাঝখানে একটা করে বেগুনি ফুল, আর পুরো বাগান ঘিরে রেখেছে ঘন সবুজ উদ্ভিদের বর্ডার। বাগানে কেউ তাকে বিরক্ত করতে পারে না-কেউ না। মাটি মাখা গগ্লাভস খুলে বাগানের ছোট্ট দরজার দিকে এগোলেন ইবার। স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলেন “কী হচ্ছে এসব?”
মানবসভ্যতার শুরু থেকেই এধরনের পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মানুষ ঠিক এই সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন বা শব্দগুলো ব্যবহার করে আসছে। এর কোনো রেকর্ড নেই কারণ কখনোই এই প্রশ্ন থেকে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়নি।
কিন্তু এবার আক্ষরিক উত্তর পাওয়া গেল, কারণ একটা লাফ দিয়ে মিস এর শরীর এগিয়ে এল সামনে, হাতের ঝাঁপটা দিয়ে সরিয়ে দিল তার ভেঁড়াখোঁড়া ঝোলার কোণা টেনে রাখা এক সৈনিককে।
বিরক্ত ভঙ্গিতে ভুরু কুঁচকে সৈনিকদের সরে যেতে ইশারা করলেন ইণ্ডবার, আর মিস ঝুঁকে তোবড়ানো টুপি তুলল মাটি থেকে, লেগে থাকা কাদা মাটি পরিষ্কার করল ঝাড়া দিয়ে, টুপি দিয়ে নিজের বাহুতে কয়েকটা বাড়ি মারল, তারপর বলল:
“শোন, ইণ্ডবার, তোমার ঐ (ছাপার অযোগ্য) ভৃত্যগুলো আমার এই ঝোলা নষ্ট করার জন্য দায়ী। ভেতরে অনেকগুলো ভালো পোশাক ছিল।” নাটুকে ভঙ্গিতে কপাল মুছল সে।
মুখ বিকৃত করে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছেন মেয়র, পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার শীর্ষবিন্দু থেকে রাগত স্বরে বলেন, “আমাকে জানানো হয়নি যে তুমি দেখা করার অনুরোধ জানিয়েছ। নিশ্চয় তোমাকে কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হয়নি।”
চরম অবিশ্বাস নিয়ে এবলিং মিস তাকাল মেয়রের দিকে, “গ্য-লাক্সি,ইণ্ডবার গতকাল আমার নোট পাওনি? তার আগের দিন আমি সেটা এক ধূসর ইউনিফর্মের হাতে দিয়েছিলাম। সরাসরি তোমার হাতেই দিতাম, কিন্তু জানি যে তুমি আনুষ্ঠানিকতা খুব পছন্দ করো।”
“আনুষ্ঠানিকতা!” অসহিষ্ণু দৃষ্টি সরালেন মেয়র। তারপর ঝাঁজালো গলায় বললেন, “নিখুঁত সংগঠন কখনো দেখেছো? ভবিষ্যতে সাক্ষাৎ লাভের জন্য তুমি অনুরোধের তিনটা কপি নির্দিষ্ট অফিসে জমা দেবে। তারপর অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। এবং দেখা করতে আসার সময় উপযুক্ত পোশাক পরে আসবে-উপযুক্ত পোশাক, বুঝতে পেরেছ-এবং যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করবে। এবার যেতে পারো।”
“পোশাক আবার কী দোষ করল?” সমান তেজে জিজ্ঞেস করল মিস। “ঐ (ছাপার অযোগ্য) শয়তানগুলো থাবা বসানোর আগে এটাই ছিল আমার সেরা পোশাক। যা বলতে এসেছি সেটা বলা হয়ে গেলেই চলে যাবো। গ্যালাক্সি, সেলডন ক্রাইসিস এর ব্যাপার না হলে এই মুহূর্তে চলে যেতাম।”
“সেলডন ক্রাইসিস!” প্রথমবারের মতো আগ্রহ বোধ করলেন মেয়র। মিস একজন প্রথম শ্রেণীর সাইকোলজিস্ট-একজন ডেমোক্র্যাট, বর্বর কিসিমের লোক, এবং নিঃসন্দেহে বিদ্রোহী, কিন্তু একজন সাইকোলজিস্টও বটে। এতটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়লেন মেয়র যে মিস হঠাৎ করেই একটা ফুল ছিঁড়ে নেওয়ায় বুকের ভেতর খচ করে যে কাঁটা বিঁধল সেটার কথাও বলতে পারলেন না। গন্ধ শোকার জন্য ফুলটা তুলে ধরল মিস, তারপর নাক কুঁচকে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
“এসো আমার সাথে। জরুরি আলোচনার উপযুক্ত করে বাগানটা তৈরি হয়নি।” শীতল কণ্ঠে বললেন ইণ্ডবার।
বিশাল ডেস্কের পেছনে চেয়ারে বসে তিনি ভালো বোধ করলেন যেখান থেকে তিনি মিস-এর খুলি আঁকড়ে থাকা অল্প কয়েক গোছা চুলের দিকে তাকাতে পারছেন; আরও ভালো বোধ করলেন যখন চারপাশে তাকিয়ে বসার জন্য দ্বিতীয় কোনো চেয়ার না পেয়ে অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল মিস; সবচেয়ে ভালো লাগল যখন নির্দিষ্ট কন্টাক্ট স্পর্শ করতেই একজন কর্মচারী দ্রুতপায়ে ভেতরে এসে যথাযথ নিয়মে কুর্নিশ করল, তারপর ডেস্কের উপর ধাতু দিয়ে বাঁধাই করা একটা মোটাসোটা ভলিউম রেখে চলে গেল।
“এবার ঠিক আছে,” ইণ্ডবার বললেন, পরিস্থিতি আবার আয়ত্তে আনতে পেরে খুশি। “তোমার এই অযাচিত সাক্ষাৎকার সংক্ষিপ্ত করার জন্য যা বলার সংক্ষেপে বল।”
“আজকাল আমি কী করছি তুমি জানো?” অলস ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল মিস ।
“তোমার রিপোর্ট এখানে আছে,” সন্তুষ্টির সাথে জবাব দিলেন মেয়র, “সেইসাথে একটা সারসংক্ষেপ। যতদূর বুঝতে পেরেছি, সাইকোহিস্টোরির গণিতের সাহায্যে তুমি হ্যারি সেলডনের কাজ ডুপ্লিকেট করার চেষ্টা করছ, এবং ফাউণ্ডেশন এর জন্য ভবিষ্যৎ ইতিহাসের নির্ধারিত গতিপথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছ।”
“ঠিক,” শুকনো গলায় বলল মিস। “সেলডন যখন ফাউণ্ডেশন তৈরি করেন তিনি এখানে পাঠানো বিজ্ঞানীদের সাথে কোনো সাইকোলজিস্টকে পাঠাননি-যেন ঐতিহাসিক গতিপথে ফাউণ্ডেশন অন্ধভাবে এগিয়ে যেতে পারে। আমার গবেষণায় আমি টাইম ভল্ট থেকে পাওয়া অনেক উপাদান ব্যবহার করেছি।”
“এগুলো আমি জানি, মিস। দ্বিতীয়বার বলে সময় নষ্ট করার দরকার নেই।”
“দ্বিতীয়বার বলছি না,” চিৎকার করল মিস, “কারণ এখন যা বলব তা রিপোর্টে নেই।”
“রিপোর্টে নেই মানে?” বোকার মতো বলল ইণ্ডবার। “কীভাবে-”
“গ্যালাক্সি! আমাকে নিজের মতো করে বলতে দাও, বাটকু। আমার প্রতিটা মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন করা বন্ধ কর, নইলে এখান থেকে বেরিয়ে যাব, তারপর তোমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ক, কিছু যায় আসে না। মনে রাখবে ফাউণ্ডেশন যেভাবেই হোক দুর্যোগ কাটিয়ে উঠবে, কিন্তু আমি বেরিয়ে গেলে তুমি তা পারবে না।”
টুপি আছড়ে ফেলায় কাদা লাগল মেঝেতে, যে ডায়াসের উপর ডেস্ক বসানো দুদ্দাড় সিঁড়ি ভেঙে তার উপর উঠল মিস। রাগের সাথে কাগজপত্র একপাশে সরিয়ে বসল ডেস্কের কোণায়।
ইবার একবার ভাবলেন গার্ডদের ডাকবেন অথবা ডেস্কের বিল্ট ইন ব্লাস্টার ব্যবহার করবেন। কিন্তু এবলিং মিস-এর মুখ এমনভাবে তার দিকে নেমে এসেছে যে তিনি সংকুচিত হয়ে গেলেন।
“ড. মিস,” এখনো তিনি দুর্বলভাবে মানসম্মান বজায় রাখার চেষ্টা করছেন, “তুমি অবশ্যই-”।
“চোপ,” কড়া ধমক লাগাল মিস, “মন দিয়ে শোন। যদি এগুলো,” ধাতু দিয়ে বাঁধানো মোটা ভলিউমের উপর ঘুসি মারল সে, “আমার পাঠানো গাদা গাদা রিপোর্ট ছুঁড়ে ফেলে দাও। আমি যে রিপোের্ট পাঠাই সেটা বিশ জন অফিসার চোখ বুলিয়ে তারপর তোমাকে দেয়, তখন আবার কমবেশি বিশ জন অফিসার তোমার সুবিধার জন্য সারসংক্ষেপ তৈরি করে দেয়। ভালো ব্যবস্থা, যদি তোমার গোপন করার কিছু না থাকে। কিন্তু আমি যা বলব সেটা কনফিডেনশিয়াল। এত বেশি কনফিডেনশিয়াল যে, যে ছেলেগুলো আমার জন্য কাজ করেছে তারাও জানে না। যদিও পুরো কাজটা ওরাই করেছে, কিন্তু প্রত্যেকে আলাদা আলাদা অংশ-আমি সেগুলো জোড়া দিয়েছি। টাইম ভল্ট কী তুমি জানো?”
মাথা নাড়লেন ইণ্ডবার। মিস সেদিকে লক্ষ করল না। পরিস্থিতি সে উপভোগ করছে, “ঠিক আছে, বলছি আমি, কারণ এই (ছাপার অযোগ্য) পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছি অনেক দিন থেকে। আমি বুঝতে পারছি তুমি কী ভাবছ, ব্যাটা ভণ্ড। ছোট্ট একটা নবের কাছে হাত রেখেছ, সেটা চাপলেই পাঁচ শ বা ছয় শ সশস্ত্র লোক চলে আসবে আমাকে মেরে ফেলার জন্য, কিন্তু ভয় পাচ্ছ আমি কি জানি-তুমি ভয় পাচ্ছ সেলডন ক্রাইসিসকে। তা ছাড়া যদি তুমি ডেস্কের কোনো কিছু স্পর্শ করো, তা হলে কেউ আসার আগেই তোমার ওই (ছাপার অযোগ্য) মাথাটা আছাড় দিয়ে গুঁড়ো করে ফেলব।”
“এটা বিশ্বাসঘাতকতা,” হড়বড় করে বলল ইবার।
“অবশ্যই,” আত্মপ্রসাদের সুরে বলল মিস, “ততা কী করবে? টাইম ভল্টের ব্যাপারে জ্ঞান দিচ্ছি শোন। আমাদের সাহায্য করার জন্য হ্যারি সেলডন শুরু থেকেই এখানে টাইম ভল্ট বসান। প্রতিটা ক্রাইসিসে বিস্তারিত ব্যাখ্যা এবং সাহায্য করার জন্য হ্যারি সেলডন নিজের প্রতিচ্ছবি তৈরি করে রাখেন। চারটা ক্রাইসিস-এবং চারবার তিনি আবির্ভূত হয়েছেন। প্রথমবার তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন প্রথম ক্রাইসিসের শীর্ষ অবস্থায়। দ্বিতীয়বার তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন দ্বিতীয় ক্রাইসিসের সফল পরিসমাপ্তির পর। দুবারই তার কথা শোনার জন্য আমাদের পূর্ব পুরুষরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তৃতীয় আর চতুর্থ ক্রাইসিসের সময়, তার কথা আর কেউ মনে রাখেনি-বোধহয় মনে রাখার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে-তোমার কাছে যে রিপোর্ট আছে তাতে এই কথাগুলো নেই-দেখা যায় তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন, এবং নির্দিষ্ট সময়ে। মাথায় ঢুকেছে?”
অবশ্য জবাবের প্রতীক্ষা করল না। শেষ পর্যন্ত মুখ থেকে ছিন্ন ভিন্ন সিগার ফেলে দিয়ে নতুন আরেকটা ধরাল। ধোয়া ছাড়ল ভুর ভুর করে।
“অফিসিয়ালি, আমি সায়েন্স অফ সাইকোহিস্টোরি পূনর্গঠনের চেষ্টা করছি। একজন মানুষের কাজ না এটা, এবং এক শতাব্দীতেও শেষ হবে না। তবে সাধারণ উপাদানগুলোর ব্যাপারে আমি কিছুটা অগ্রসর হতে পেরেছি এবং সেটাকে টাইম ভন্টে অনধিকার প্রবেশের কৈফিয়ত হিসেবে ব্যবহার করেছি। আমি মোটামুটি নিশ্চিতভাবে হ্যারি সেলডনের পরবর্তী আবির্ভাবের নিখুঁত দিন তারিখ বের করতে পেরেছি। অন্য কথায়, সেলডন ক্রাইসিস ঠিক কোনদিন চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছাবে আমি তোমাকে বলতে পারব।”
“কতদূরে আছে?” উদ্বিগ্ন সুরে জিজ্ঞেস করলেন ইণ্ডবার।
আর মিস হাসিমুখে বোমা ফাটালো, “চার মাস। চারটা (ছাপার অযোগ্য) মাস, তার থেকে দুইদিন বাদ।”
“চার মাস, কর্কশ স্বরে বললেন ইণ্ডবার। “অসম্ভব।”
“কেন, অসম্ভব কেন?”
“চার মাস? তার অর্থ তুমি বুঝতে পারছ। একটা ক্রাইসিস চার মাসের মাথায় চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছবে, অর্থাৎ কয়েক বছর থেকেই সেটা তৈরি হচ্ছিল।”
“হবে নাই বা কেন? প্রকৃতির এমন কোনো নিয়ম আছে যে শুধু দিনের আলোতে বেড়ে উঠতে হবে?”
“কিন্তু আমাদের মাথার উপর আসন্ন কোনো বিপদ ঝুলে নেই।” উদ্বেগে ইণ্ডবার তার হাত মোচড় দিয়ে প্রায় ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। হঠাৎ গলার মাংসপেশি ফুলিয়ে চিৎকার করে উঠল, “ডেস্কের উপর থেকে সর তো, একটু গোছই। নইলে চিন্তা করব কীভাবে?
চমকে উঠল মিস, তারপর ভারী শরীর নিয়ে সরে গেল আরও কোণার দিকে।
ডেস্কের প্রতিটা জিনিস আবার যথাযথভাবে গুছিয়ে রাখলেন ইণ্ডবার। কথা বলছেন দ্রুত, “এভাবে এখানে আসার কোনো অধিকার তোমার নেই। যদি তোমার থিওরি বলা শেষ হয়–”
“এটা কোনো থিওরি না।”
“আমি বলছি এটা একটা থিওরি। পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণসহ যথাযথ নিয়মে উপস্থাপন করলে সেটা ব্যুরো অফ হিস্টোরিক্যাল সায়েন্স এর কাছে যাবে। সেখানেই এর উপযুক্ত ব্যবস্থা হবে। আমার কাছে একটা সারসংক্ষেপ আসার পর আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারব। খামোখাই আমাকে বিরক্ত করলে। আহ্, এই যে পাওয়া গেছে।”
একটা রুপালি রঙের স্বচ্ছ কাগজ তুলে তিনি পাশের সাইকোলজিস্ট এর দিকে নাড়লেন।
“আমাদের বৈদেশিক নীতির অগ্রগতি সম্বন্ধে আমি একটা সামারি তৈরি করেছি-খুব একটা ভালো হয়নি। শোন-মোরেস এর সাথে আমাদের একটা বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, লিনেইজ এর সাথে একই বিষয়ে আলোচনা চলছে, কোনো উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য বণ্ড এ একদল প্রতিনিধি পাঠিয়েছি, কালগান থেকে কিছু অভিযোগ পেয়েছি এবং কথা দিয়েছি ব্যাপারটা আমরা দেখব, অ্যাসপেরেটার বাণিজ্য নীতির ব্যাপারে অভিযোগ জানিয়েছি এবং তারা কথা দিয়েছে। বিষয়টা বিবেচনা করে দেখবে-ইত্যাদি, ইত্যাদি। মেয়রের দৃষ্টি কোড করা লিস্টের নিচের দিকে নামল, তারপর তিনি কাগজটা সঠিক ফোল্ডারের সঠিক পিজিয়ন হোলে সঠিকভাবে রাখলেন।
“আমি তোমাকে বলেছি, মিস, নিয়মের বাইরে কিছুই হচ্ছে না। সবকিছুই চলছে সুষ্ঠু এবং নিখুঁতভাবে
বিশাল কামরার শেষ প্রান্তের দরজা খুলে গেল, আর অনেকটা বাস্তব জীবনের ছোঁয়া বর্জিত নাটকে যেমন দৈব ঘটনা ঘটতে দেখা যায় সেরকমভাবেই আড়ম্বরহীন কেউ একজন প্রবেশ করল ভেতরে।
ইণ্ডবার অর্ধেক উঠে দাঁড়িয়েছেন। যখন একসাথে অনেকগুলো অযাচিত ঘটনা ঘটে তখন যে-রকম একটা বোধ তৈরি হয় সেরকমই একটা অবাস্তব অনিশ্চয়তা বোধ তার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। মিস এর অযাচিত অনুপ্রবেশ এবং বুনো তর্জনগর্জনের পর ঠিক একই রকম বিভ্রান্তি তৈরি করে তার সেক্রেটারি ভিতরে প্রবেশ করল, যে অন্তত নিয়মগুলো জানে।
হাঁটু গেড়ে বসল সেক্রেটারি।
“কী ব্যাপার!” ধারালো গলায় জিজ্ঞেস করলেন ইণ্ডবার।
মেঝের দিকে তাকিয়ে সেক্রেটারি বলল, “এক্সিলেন্স, ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার কালগান থেকে ফেরার পর গ্রেপ্তার হয়েছেন। তিনি আপনার পূর্ববর্তী আদেশ এক্স-২০-৫১৩ অমান্য করে সেখানে গিয়েছিলেন। তার সাথে যারা ছিল তাদেরকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। পরিপূর্ণ রিপোর্ট আপনার কাছে পাঠানো হবে।”
ভেতরের অস্থিরতা দূর করে ইণ্ডবার বললেন “রিপোর্ট পাঠানো হবে তো।”
“এক্সিলেন্স, ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচার অস্পষ্টভাবে কালগানের নতুন ওয়ারলর্ডের ভয়ংকর পরিকল্পনা সম্বন্ধে কিছু তথ্য দিয়েছেন। আপনার নির্দেশ এক্স-২০-৬৫১ অনুযায়ী তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো শুনানির সুযোগ দেওয়া হয়নি, তবে তার মন্তব্যগুলোর সম্পূর্ণ রিপোর্ট তৈরি হয়েছে।”
চিৎকার করে উঠলেন ইণ্ডবার, “সম্পূর্ণ রিপোর্ট তৈরি হয়েছে তো!”
“এক্সিলেন্স, পনের মিনিট আগে সিলিনিয়ান ফ্রন্টিয়ার থেকে রিপোর্ট এসেছে। সেখানে কিছু কালগানিয়ান মহাকাশযানকে অবৈধভাবে ফাউণ্ডেশন টেরিটোরিতে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। মহাকাশযানগুলো সশস্ত্র। ছোটখাটো লড়াই হয়েছে।”
সেক্রেটারি দ্বিগুণ ঝুঁকে প্রায় মাটির সাথে মিশে গেল। ইণ্ডবার দাঁড়িয়ে রইলেন, একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সোজা হল মিস, সেক্রেটারির কাছে এগিয়ে গিয়ে দুপায়ে দাঁড় করালো তাকে।
“শোন, তুমি গিয়ে বরং ক্যাপ্টেন প্রিচারকে মুক্ত করে এখানে পাঠিয়ে দাও। যাও, বেরোও।”
চলে গেল সেক্রেটারি, মিস ঘুরল মেয়রের দিকে। “তোমার এখন কাজ শুরু করা উচিত না, ইণ্ডবার? চার মাস, তুমি জানো”
ইণ্ডবার দাঁড়িয়েই থাকলেন, নিপ্রাণ দৃষ্টি। শুধুমাত্র একটা আঙুল জীবিত মনে। হচ্ছে- ডেস্কের মসৃণ তলে যা ক্রমাগত দাগ কেটে চলেছে।