৪. ভুজঙ্গ-প্রয়াত

ভুজঙ্গ-প্রয়াত
চতুর্থ পরিচ্ছেদ

এক

দীপালী উৎসবের কিছুদিন পূর্বে সোমনাথের ছবি শেষ হইল। এই অপরান্ত প্রদেশে দীপালীই বৎসরের সর্বশ্রেষ্ঠ পর্ব ও নূতন খাতা। এই সময় শ্রেষ্ঠী সম্প্রদায় নূতন করিয়া ছুরি শানাইয়া ব্যবসা বাণিজ্য আরম্ভ করেন।

চলচ্চিত্রও ব্যবসা। ছবি তৈয়ার হইলে তাহাকে সম্প্রদান করার পালা। কন্যা বয়স্থা হইলে যেমন পাত্রের সন্ধানে বাহির হইতে হয়, ছবি তৈয়ার হইলেও অনুরূপ ব্যবস্থা। চিত্র-জনকেরা তখন ঘটকের দ্বারস্থ হন। চিত্র সমাজে এই ঘটকের অখণ্ড প্রতাপ।

ভবানীর ভুকুটি ভঙ্গি যেমন শিবই বোঝেন, গিরিরাজ ববাঝেন না, তেমনি ছবি যাহারা প্রস্তুত করে অতি পরিচয়ের ফলে ছবির সৌন্দর্য বুঝিবার ক্ষমতা আর তাহাদের থাকে না। এই সূত্রে ছবির পরিবেশকেরা আসিয়া আসর জুড়িয়া বসেন। ইহারা ছবির জহুরী এবং দালাল। অর্থব্যয় করিয়া ছবি তৈয়ার করা ইহাদের কাজ নয়, আবার ছবিঘর প্রস্তুত করিয়া ছবি প্রদর্শন করাও ইহাদের কর্তব্যের মধ্যে গণ্য নয়। ইহারা কেবল একজনের প্রস্তুত ছবি অন্য একজনকে সাধারণে প্রদর্শন করিবার অধিকার দিয়া দালালিটুকু আত্মসাৎ করেন। ধনিকতন্ত্রের আমলে অধিক পরিশ্রম না করিয়া এবং সর্বপ্রকার লোকসানের ঝুঁকি বাদ দিয়া অর্থ উপার্জনের যতগুলি পন্থা আবিষ্কৃত হইয়াছে, ছবির ডিস্ট্রিবিউশন তাহাদের মধ্যে একটি।

সোমনাথের ছবি দেড় লাখ টাকার মধ্যেই প্রস্তুত হইয়াছিল; কিন্তু সেকথা সোমনাথ, পাণ্ডুরঙ ও রুস্তমজি ছাড়া আর কেহ জানিত না। ছবির কাট-ছাঁট শেষ হইলে একদা রাত্রিকালে রুস্তমজি, সোমনাথ, পাণ্ডুরঙ ও ইন্দুবাবু নিভৃতে ছবিখানি আগাগোড়া দেখিলেন। দেখিয়া কিন্তু ছবির ভাল-মন্দ সম্বন্ধে কেহ কোনও মন্তব্য করিতে পারিলেন না। সোমনাথ গালে হাত দিয়া বসিল। ছবি যদি জনসাধারণের মুখেরোচক না হয়? রুস্তমজির অন্য ছবিগুলি যে পথে গিয়াছে, এটিও যদি সেই পথে যায়? যে আশা-ভরসা ও উদ্যম লইয়া সে ছবি আরম্ভ করিয়াছিল এখন আর তাহার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নাই। যে গল্প তাহার এত ভাল লাগিয়াছিল তাহাই এখন একেবারে আলুনি ও নিরামিষ মনে হইতেছে।

পাণ্ডুরঙ ও ইন্দুবাবুর অবস্থা তাহারই মত। কেবল রুস্তমজি ভরসা দিলেন—তুমি ভেবো না। আমি ব্যবস্থা করছি।

পরদিন সন্ধ্যার পর রুস্তমজির গুটিকয় বন্ধু স্টুডিওতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। রুস্তমজি তাঁহাদের নৈশ ভোজনের নিমন্ত্রণ করিয়াছেন। সকলেই চিত্র-পরিবেশক। সোমনাথ, পাণ্ডুরঙ ও ইন্দুবাবু নিমন্ত্রিত হইয়াছেন।

আহারের আয়োজন রাজকীয়; সঙ্গে তরল দ্রব্যেরও ব্যবস্থা আছে। সকলে লম্বা টেবিলে আহারে। বসিলেন; নানাবিধ রঙ্গ পরিহাসের মধ্যে আহার চলিল। সকলেই জানিতেন এই নিমন্ত্রণের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য আছে; কিন্তু কেহই সে কথার উল্লেখ করিলেন না।

পানাহার শেষ হইলে রুস্তমজি সকলকে আহ্বান করিয়া স্টুডিওর প্রোজেকশান হলে লইয়া গেলেন। ছোট একটি প্রেক্ষাগৃহ; ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে ছবি কেমন হইতেছে তাহা পরীক্ষা করার জন্য প্রত্যেক স্টুডিওতেই এইরূপ একটি প্রেক্ষাগৃহ থাকে।

লম্বাটে ধরনের একটি ঘর; তাহার একপ্রান্তে একটি পদা, অপর প্রান্তে কয়েকটি চেয়ার সাজানো। মাথার উপর টি টিম্‌ করিয়া একটি ক্ষীণ আলো জ্বলিতেছে। সকলে উপবিষ্ট হইতেই আলো নিভিয়া গেল, ছবি দেখানো আরম্ভ হইল।

দুইঘন্টা পরে ছবি শেষ হইলে সকলে আবার অফিস ঘরে আসিয়া সমবেত হইলেন। কেবল পাণ্ডুরঙ রুস্তমজির অনুমতি লইয়া বাড়ি চলিয়া গেল।

রুস্তমজি এবার অতিথিদের স্পষ্ট প্রশ্ন করিলেন—ছবি কেমন লাগল আপনাদের?

সকলেই পরস্পরের পানে আড়চোখে চাহিয়া মুখ কাঁচুমাচু করিলেন; তাঁদের ভাবভঙ্গি দেখিয়া সোমনাথের বুক দমিয়া গেল। ইহারা অবশ্য ব্যবসাদার লোক; কোনও ছবিকে মন খুলিয়া ভাল বলেন না, পাছে ছবির দর বাড়িয়া যায়। কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে তাঁদের ভাব দেখিয়া মনে হইল, সত্যই তাঁহারা ছবি দেখিয়া নিরাশ হইয়াছেন।

বাঞ্চুভাই নামক একজন প্রবীণ পরিবেশক জিজ্ঞাসা করিলেন—ছবি কে ডিরেক্ট করেছেন রুসিভাই?

সোমনাথকে দেখাইয়া রুস্তমজি বলিলেন—ইনি করেছেন?

বাঞ্চুভাই তখন সোমনাথকে একটু আড়ালে লইয়া গিয়া উপদেশ দিতে আরম্ভ করিলেন। লোকটি ঘোর অশিক্ষিত, কিন্তু মিষ্টভাষী। সোমনাথকে তিনি বুঝাইতে লাগিলেন যে প্রথম চেষ্টা হিসাবে ছবিটি মন্দ না হইলেও পাবলিকের চিত্তাকর্ষক ছবি তৈয়ার করা একদিনের কাজ নয়; অনেক অভিজ্ঞতার দরকার। ছবি কিভাবে চিত্তাকর্ষক করিতে হয়, কি কি মালমশলা ভাল ছবির পক্ষে অপরিহার্য তাহা তিনি নানা উদাহরণ সহকারে সোমনাথের হৃদয়ঙ্গম করাইতে লাগিলেন। নিরুপায় সোমনাথ বিদ্রোহভরা অন্তর লইয়া নীরবে শুনিয়া চলিল।

সে একবার চোখ তুলিয়া দেখিল, ইন্দুবাবুকেও দুই-তিন জন পরিবেশক ঘিরিয়া ধরিয়াছেন; ইন্দুবাবু পাচার মত মুখ করিয়া তাঁহাদের কথা শুনিতেছেন। শেষে আর বোধকরি সহ্য করিতে না পারিয়া তিনি রুস্তমজির নিকট বিদায় লইয়া বাড়ি চলিয়া গেলেন। গল্প রচনার সময় তাহাতে দুই একটি রিভলভার ও একটি নারীহরণ না থাকিলে যে সিনেমার গল্প একেবারেই অচল, একথা তিনি বেশিক্ষণ গলাধঃকরণ করিতে পারিলেন না।

ওদিকে রুস্তমজিকে যাঁহারা পরিবেষ্টন করিয়াছিলেন তাঁহারা তাঁহার প্রতি করুণামিশ্রিত সমবেদনা প্রকাশ করিতে ত্রুটি করিতেছিলেন না এবং ঘুরাইয়া ফিরাইয়া জানিবার চেষ্টা করিতেছিলেন যে ছবি তৈয়ার করিতে কত খরচ হইয়াছে। শেষে একজন অনেকটা স্পষ্ট করিয়াই প্রশ্ন করিলেন—ছবিতে নামজাদা আর্টিস্ট কেউ নেই, নাচ-গানও না থাকার সামিল; খরচ নিশ্চয়ই খুব কম হয়েছে।

রুস্তমজি অম্লান বদনে বলিলেন—ছবিতে আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

সকলেই ঠোঁট উল্টাইলেন—বড় বেশি খরচ হয়েছে–নতুন লোকের হাতে কাজ দিলে ঐ হয়। অত টাকা ছবি থেকে উঠবে না রুসিভাই। আজ আমরা তাহলে উঠি।

রুস্তমজি বলিলেন—আমার আড়াই লাখ খরচ হয়েছে। আমি বেশি লাভ চাই না; তিন লাখ পেলেই আমি ছবি ছেড়ে দেব।

আর কেহ উচ্চবাচ্য করিলেন না—সাহেবজি বলিয়া রুস্তুমজিকে অভিবাদন জানাইয়া বিদায় লইলেন।

অত্যন্ত বিষণ্ণ মনে সোমনাথ সে রাত্রে বাড়ি ফিরিয়া আসিল।

.

দুই

পরদিন সকালবেলা সোমনাথ চা পান করিতে বসিয়াছে এমন সময় পাণ্ডুরঙ আসিল।

সে উপবেশন করিলে সোমনাথ তাহার দিকে টোস্টের প্লেট আগাইয়া দিয়া বলিল—কি খবর? কাল অত তাড়াতাড়ি চলে গেলে যে?

পাণ্ডুর উত্তর দিল না, একটা খালি পেয়ালায় চা ঢালিয়া লইল; তারপর এক টুকরো টোস্টে কামড় দিয়া আপন মনে চিবাইতে লাগিল। পাণ্ডুরঙের ভাবভুঙ্গি সোমনাথের অনেকটা আয়ত্ত হইয়াছিল, সে বুঝিল পাণ্ডুরঙের পেটে কোনও কথা আছে। উৎসুকভাবে চাহিয়া সে বলিল—কি, কথাটা কি?

পাণ্ডুরঙ টোস্ট গলাধঃকরণ করিয়া এক চুমুক চা খাইল, তারপর বলিল—ছবি ভাল হয়েছে।

সোমনাথ উচ্চকিত হইয়া উঠিল—আঁ, কে বললে?

পাণ্ডুরঙ একটু হাসিয়া বলিল—আমার বৌ বলল।

তোমার বৌ? সে কি? তিনি জানলেন কি করে?

কাল রাত্রে বৌকে এনে প্রজেকশান হলে লুকিয়ে রেখেছিলাম; তোমারা দেখতে পাওনি। সে ছবি দেখেছে।

তাই নাকি? তারপর?

বৌ কখনও কোনও ছবির প্রশংসা করে না। কিন্তু যে-ছবি তার ভাল লাগে সে-ছবির মার নেই।

এ ছবি তাঁর ভাল লেগেছে?

শুধু ভাল লেগেছে! সারা রাত্রি আমাকে ঘুমোতে দেয়নি কেবলই ছবির কথা বলেছে।

সোমনাথ মনে মনে খুবই আনন্দিত হইল, কিন্তু তবু তাহার সংশয় ঘুচিল না। সে বলিল—তুমি আমাকে উৎসাহ দেবার জন্যে বাড়িয়ে বলছ না তো?

পাণ্ডুরঙ সিগারেট ধরাইয়া বলিল—বিশ্বাস না হয় তুমি নিজেই তাকে প্রশ্ন করে দেখবে চল।

সোমনাথ সোৎসাহে উঠিয়া বলিল—তাই চল। তাঁর মুখে শুনলে তবু ভরসা হবে। হাজার হোক তিনি নিরপেক্ষ দর্শক; কিন্তু ফন্দিটা তুমি খুব বার করেছিলে তো!

পাণ্ডুরঙ বলিল-মনটা ভারি উতলা হয়েছিল ভাই। ছবি কেমন হয়েছে কিছুই আন্দাজ করতে পারছিলাম না। অথচ বাইরের লোককেও দেখানো যায় না। তাই শেষ পর্যন্ত বৌকে পাকড়াও করেছিলাম। অবশ্য মনে ভয় ছিল, ও যদি খারাপ বলে তাহলে আর রক্ষে নেই। তাই আগে থাকতে তোমাদের কিছু বলিনি।

সোমনাথ হাসিয়া বলিল—তিনি যদি খারাপ বলতেন তাহলে তুমি কি করতে?

পাণ্ডুরঙ সরলভাবে বলিল—চেপে যেতাম।

দুই বন্ধু মোটর চড়িয়া বাহির হইল। পাণ্ডুরঙের বাসায় সোমনাথ পূর্বে কয়েকবার গিয়াছিল, তাহার স্ত্রীকেও দেখিয়াছিল, দোহারা মজবুত গোছের স্ত্রীলোক, মুখশ্রী গোলগালের উপর মন্দ নয়; বয়স ত্রিশের নীচেই। কাছা দিয়া শাড়ি পরা স্বল্পভাষিণী এই মারাঠী মহিলাকে সোমনাথের খুব রাশভারি বলিয়া মনে হইয়াছিল।

দুজনে যখন পৌঁছিল তখন দুগবাঈ ঝাঁটা হস্তে ঘর ঝাঁট দিতেছিলেন। অত্যন্ত সপ্রতিভভাবে ঝাঁটা সরাইয়া রাখিয়া তিনি হাসিমুখে সোমনাথকে অভ্যর্থনা করিলেন; নিজেই বলিলেন—আপনার ছবি কাল দেখে এসেছি। খুব ভাল হয়েছে।

সোমনাথ বলিল-পাণ্ডুরঙের মুখে সেই কথা শুনে ছুটে এলাম। সত্যি ভাল হয়েছে?

সত্যি ভাল হয়েছে। এমন কি– পাণ্ডুরঙের প্রতি কটাক্ষপাত করিয়া দুর্গাবাঈ বলিলেন—উনিও এবার ভদ্রলোকের মত অভিনয় করেছেন।

সোমনাথ হাসিয়া উঠিল—দেখলে পাণ্ডুরঙ। ভদ্রলোকের সঙ্গ-গুণে তুমিও ভদ্রলোক হয়ে উঠেছ।

পাণ্ডুরঙ বলিল—আমি যে স্বভাবতই ভদ্রলোক, অনুকূল অবস্থায় সেটা ফুটে উঠেছে মাত্র।

সোমনাথ বলিল-যাহোক, আমাদের হিরোইনকে আপনার কেমন লাগল?

দুর্গাবাঈ বলিলেন—সুন্দরী নয়, তবে বয়স কম। আর, ভারি মিষ্টি অভিনয় করেছে।

আর আমি?

আপনি তো সকলের কান কেটে নিয়েছেন। বলিয়া স্বামীর প্রতি একটি স্মিত অপাঙ্গ দৃষ্টিপাত করিয়া দুর্গাবাঈ চা তৈয়ার করিতে গেলেন।

পাঁপর ভাজা সহযোগে দ্বিতীয় প্রস্থ চা পান করিতে করিতে সোমনাথ আবার প্রশ্ন করিল—আচ্ছা, ছবির মধ্যে কোন জিনিসটা আপনার সবচেয়ে ভাল মনে হল।

দুর্গাবাঈ নিঃসংশয়ে বলিলেন—গল্প।

এ গল্প সকলের ভাল লাগবে?

লাগবে। আমি সাধারণ মানুষ, আমার যখন ভাল লেগেছে তখন সকলের ভাল লাগবে।

আপনাকে যদি আবার ছবি দেখতে অনুরোধ করি আপনি খুশি হয়ে দেখতে যাবেন?

যাব। আবার কবে দেখাবেন বলুন।

সোমনাথ টেবিলে এক চাপড় মারিয়া বলিল—ব্যস, তাহলে আর ভাবনা নেই।

পাণ্ডুরঙের বাসা হইতে স্টুডিও যাইতে যাইতে কিন্তু সোমনাথের মন আবার সংশয়াকুল হইয়া উঠিল। একটি স্ত্রীলোকের ভাল লাগার উপর কি নির্ভর করা চলে! সকলের রুচি সমান নয়–

স্টুডিও পৌঁছিয়া দুজনে রুস্তমজির কাছে গিয়া বসিল। পাণ্ডুরঙ বলিল—হুজুর, একটা বেয়াদপি করে ফেলেছি, মাফ করতে হবে। বলিয়া স্ত্রীকে ছবি দেখানোর কথা বলিল।

রুস্তমজি ধূর্ত চক্ষে হাসি ভরিয়া বলিলেন—তাতে কোনও দোষ হয়নি। তোমার বিবির ভাল লেগেছে তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

রুস্তমজি বলিলেন-আমারও মনে হচ্ছে ছবিটা ভাল হয়েছে।

সোমনাথ সাগ্রহে প্রশ্ন করিলকি করে জানলেন? ওরা কিছু বলেছে নাকি?

রুস্তমজি নিজের বুকে টোকা মারিয়া বলিলেন—আমার মন বলছে ছবি ভাল হয়েছে। ওরা বরং উল্টো কথাই বলছে। আজ বাঞ্চুভাই ফোন করেছিল।

কি বললেন তিনি?

ছবির অনেক খুঁত কেড়ে শেষে বলল-অল ইন্ডিয়া রাইটসের জন্যে দেড় লাখ টাকা দিতে পারে।

মিনিমাম্ গ্যারান্টি?

না, একেবারে সরাসরি বিক্রি। কি বল তোমরা? ছেড়ে দেব?

সোমনাথ ভাবিতে লাগিল, দেড় লাখ টাকায় ছবি ছাড়লে কিছুই লাভ থাকে না। কিন্তু লোকসানও হয় না। লোকসান না হওয়াটা কম কথা নয়।

সোমনাথ প্রশ্ন করিল—আর অন্য ডিস্ট্রিবিউটাররা কোনও অফার দেননি?

রুস্তমজি বলিলেন-উহুঁ। তাদের সাড়াশব্দ নেই। ওদের মধ্যে বাঞ্চুভাই তবু সমঝদার; সে বুঝেছে ছবি নতুন ধরনের হলেও তার মধ্যে জিনিস আছে। তার লোভ হয়েছে। চাপ দিলে দুলাখ। পর্যন্ত উঠতে পারে।

সোমনাথ বলিল—দুলাখ যদি পাওয়া যায় তাহলে বোধকরি ছেড়ে দেওয়াই উচিত।

রুস্তমজি পাণ্ডুরঙের দিকে চক্ষু ফিরাইলেন—তুমি কি বল?

পাণ্ডুরঙ দ্বিধাভরে বলিল—লাখ বেলাখের কথা আমি বুঝি না হুজুর। আপনি কি বলেন?

রুস্তমজি বলিলেন-ছবি যদি ভাল হয়ে থাকে, তাহলে ভয় পেয়ে সস্তায় ছেড়ে দেওয়া বোকামি; ব্যবসাদার হয়ে আমি ওদের কাছে ঠকে যেতে রাজি নই।

তাহলে কি করবেন?

আমি দর কমাব না। দেখি যদি ওরা রাজি হয়। যদি না হয় তখন অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।

অন্য ব্যবস্থা কী করবেন?

রুস্তমজি উত্তর দিলেন না, শুধু একটু হাসিলেন।

.

তিন

তিন লাখ টাকা দিতে কিন্তু কেহই রাজি হইল না। বাঞ্চুভাই এক লাখ ষাট হাজার পর্যন্ত উঠিলেন; অন্য সকলে স্পষ্টই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিল।

সোমনাথের মনের অবস্থা শোচনীয় হইয়া উঠিল। ছবির যথার্থ মূল্য জানিবার কি কোনও উপায় নাই? অন্ধের মত পরের নির্ধারিত মূল্যে নিজের জিনিস পরের হাতে তুলিয়া দিতে হইবে? এত পরিশ্রম করিয়া শুধু দিনমজুরিটুকু লইয়া ঘরে ফিরিতে হইবে? আর কতগুলা দালাল তাহার কৃতিত্বের সুফল ভোগ করিবে? ইহাই কি ব্যবসায়ের দুর্লঙ্ঘ্য রীতি?

বাণিজ্য নীতির সহিত সোমনাথের নূতন পরিচয় ঘটিতেছিল। বাণিজ্য লক্ষ্মী যে ভুজঙ্গ-প্রয়াত ছন্দে আঁকাবাঁকা পথে চলেন, তাঁহার মাথা হইতে মণি হরণ করিতে হইলে যে শুধু দুর্দম সাহস নয়, অপরিসীম চাতুরীও প্রয়োজন, এ অভিজ্ঞতা তাহার নাই।

রুস্তমজি একদিন সোমনাথকে বলিলেন-তুমি বড় ঘাবড়ে গেছ দেখছি; অত ঘাবড়ালে ব্যবসা চলে না। ব্যবসায় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। চল, আজ বাঞ্চুভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসি।

বাঞ্চুভাই নিজের অফিসে পরম সমাদরের সহিত তাহাদের অভ্যর্থনা করিলেন; রুস্তমজিকে পান ও সোমনাথকে সিগারেট খাইতে দিলেন কিন্তু তাঁহার কথার নড়চড় হইল না। সবিনয়ে বলিলেন-রুসিভাই, এ ছবির জন্যে আর বেশী দিলে আমার ছেলেপুলে খেতে পাবে না। তোমার খাতিরে দশ হাজার বেশী দিচ্ছি, আর পারব না।

রুস্তমজি বলিলেন—বেশ, ঐ টাকাই মিনিমাম গ্যারান্টি দাও।

বাঞ্চভাই জিভ কাটিয়া বলিলেন—মিনিমাম গ্যারান্টিতে ছবি নেওয়া আমি ছেড়ে দিয়েছি রুসিভাই। সবাই সন্দেহ করে, সবাই বলে আমি চুরি করি। কাজ কি ওসব ঝামেলায়। বলিয়া মুখে বৈষ্ণবভাব প্রকাশের চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

রুস্তমজি উঠিয়া পড়িলেন—বেশ, এখন দিচ্ছ না। এর পরে কিন্তু এত সস্তায় পাবে না।

স্টুডিওতে ফিরিয়া আসিয়া রুস্তমজি বলিলেন—সোমনাথ, আজ তুমি বাড়ি যাও। আমি একটু ভেবে দেখি। কাল এর হেস্তনেস্ত করব।

পরদিন সোমনাথ রুস্তমজির কাছে গিয়া বসিতেই তিনি বলিলেন—ঠিক করে ফেলেছি। ছবি কাউকে দেব না, আমি নিজেই হাউস ভাড়া নিয়ে ছবি দেখাব।

সোমনাথ কিয়ৎকাল হতবাক হইয়া রহিল, তারপর বলিল-কিন্তু, তাতে আরও অনেক খরচ—

পাবলিসিটিতে ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করব; তাছাড়া হাউসের ভাড়া আছে। সবসুদ্ধ বড় জোর পঞ্চাশ হাজার। যদি লেগে যায়—

যদি না লাগে?

রুস্তমজি সোমনাথের কাঁধে হাত রাখিয়া বলিলেন—তুমি ইয়ং ম্যান হয়ে ভয় পাচ্ছ? এতটুকু সাহস নেই?

সোমনাথ বলিল—নিজের জন্য ভয় পাচ্ছি না রুসিবাবা; কিন্তু আপনার এই শেষ সম্বল, এ নিয়ে জুয়া খেলা উচিত নয়। বরং লাভ যদি নাও হয়—

রুস্তমজি বলিলেন—আমি জুয়াড়ী, সারা জীবন জুয়া খেলেছি। তোমাকে যখন ছবি তৈরি করতে দিয়েছিলাম তখনও জুয়া খেলেছিলাম। আজও জুয়া খেলব; লাগে তা না লাগে তুক। বাঞ্চুভাই আজ আমাকে দমক দিচ্ছে; যদি পাশার দান পড়ে—ছবি উৎরে যায়—তখন আমি বাঞ্চভাইকে দমক দেব। এই তো জীবন।

ইহার পর আর কিছু বলা যায় না। বৃদ্ধ জুয়াড়ী যখন সর্বস্ব পণ করিয়া জুয়ায় মাতিয়াছে তখন তাহাকে ঠেকানো অসম্ভব। সোমনাথ নিজের রক্তের মধ্যেও জুয়ার উত্তেজনা অনুভব করিল।

বেশ, আপনি যা ভাল বোঝেন তাই করুন।

রুস্তমজি তখন জিজ্ঞাসা করিলেন—দেওয়ালী কবে?

সোমনাথ বলিল—আর দিন দশেক আছে।

যথেষ্ট। দেওয়ালীর দিন আমার ছবি রিলীজ করব।

.

দেওয়ালীর দিন ছবি মুক্তিলাভ করিল।

প্রথম সপ্তাহে আয় হইল চৌদ্দ হাজার; দ্বিতীয় সপ্তাহে ছাব্বিশ হাজার।

যে সকল পরিবেশক পূর্বে গা ঢাকা দিয়াছিলেন তাঁহারা পাগলের মত রুস্তমজিকে খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিলেন; কিন্তু রুস্তমজির এখন পায়া ভারি; তিনি কাহারও সহিত দেখা করিলেন না।

পাণ্ডুরঙকে ডাকিয়া রুস্তমজি একটি বিশ ভরির সোনার হার তাহার হাতে দিলেন—এইটি তোমার বিবিকে দিও। তাঁর কথা শুনেই আমি এতবড় জুয়ায় নেমেছিলাম। তারপর সোমনাথকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন—তোমাকে আর কী দেব? আমার যা কিছু সব তোমাকে দিয়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে।

বাঞ্চুভাই অবশেষে একদিন রুস্তমজিকে ধরিয়া ফেলিলেন। রুস্তমজি অফিস ঘরে বসিয়া ছিলেন, বাঞ্চুভাই এক রকম জোর করিয়াই ঘরে ঢুকিয়া পড়িলেন।

দুই বৃদ্ধ কিছুক্ষণ পরস্পরের পানে চাহিয়া রহিলেন; শেষে বাঞ্চুভাই বলিলেন, রুসিভাই, তোমারই জিৎ। ছবির জন্যে কত টাকা চাও?

রুস্তমজির মুখে বিজয় গর্বিত হাসি ফুটিয়া উঠিল; কিন্তু তিনি উত্তর দিলেন না; এই মুহূর্তের বিজয়ানন্দ যেন পূর্ণ মাত্রায় উপভোগ করিতে লাগিলেন।

বাঞ্চুভাই আবার বলিলেন—তুমি বলেছিলে তিনি লাখ টাকায় ছবি বিক্রি করবে। আমি তিন লাখ দিতে রাজি আছি।

রুস্তমজি ধীরে ধীরে মাথা নাড়িলেন।

এখন আর তিন লাখে হবে না।

কত চাও?

পাঁচ লাখ।

বাঞ্চুভাই অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন।

তার কমে হবে না?

না।

আমাকে একটু ভাববার সময় দেবে?

রুস্তমজি বলিলেন—ভাববার সময় নিতে পারো; কিন্তু ইতিমধ্যে কেউ যদি বেশী দিতে রাজি হয়, তখন আর পাঁচ লাখে পাবে না!

বাঞ্চভাই আর দ্বিধা না করিয়া পকেট হইতে চেকবই বাহির করিলেন।…

হিসাব করিয়া সোমনাথের ভাগে লাভের অংশ এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকা পড়িল। রুস্তমজি চেক লিখিয়া তাহার হাতে দিলেন এবং দুই হাতে তাহার করমর্দন করিলেন।

যাও, কিছুদিন কোথাও বেড়িয়ে এস। তারপর নতুন ছবি আরম্ভ করবে।

অফিস হইতে বাহিরে আসিয়া সোমনাথ চেকটি খুলিয়া দেখিল। এক লাখ ত্রিশ হাজার! সে এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকার মালিক!

হঠাৎ তাহার মনটা কেমন যেন বিকল হইয়া গেল। টাকা রোজগার করা এত সহজ! শুধু একটু চাতুরী, আর একটু হঠকারিতা—ইহার বেশী প্রয়োজন নাই? অথচ এই টাকার জন্য কোটি কোটি মানুষ মাথা কুটিয়া মরিতেছে!

তারপরই তাহার মনে প্রতিক্রিয়া আসিল। আর তাহার অন্ন-চিন্তা নাই। সে স্বাধীন-স্বাধীন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *