২. অগাধ জলে

অগাধ জলে
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

এক

সোমনাথ অগাধ জলে পড়িল। যে কাজের স্থায়িত্বের ভরসায় সে ব্যাঙ্কের চাকরি ছাড়িয়া দিয়াছিল তাহাও গেল। এখন সে কী করিবে, কোথায় যাইবে? সোমনাথের মনে হইল, অদৃষ্ট তাহাকে লইয়া নিষ্ঠুর পরিহাস করিয়াছে, যে অবলম্বনের উপর ভর করিয়া সে ভাসিয়া ছিল, তাহা ভুলাইয়া কাড়িয়া লইয়া তাহাকে তীরে লইয়া যাইবার ছলে গভীর জলে ঠেলিয়া দিয়াছে।

দিদি বলিলেন—তুই অত মনমরা হচ্ছিস কেন? ও চাকরি গেছে ভালই হয়েছে। আরও কত সিনেমা কোম্পানী আছে, খবর পেলে তোকে লুফে নেবে।

সোমনাথ কিন্তু ভরসা পাইল না। এখানে আসিয়া অবধি সে পিলে সাহেবের স্টুডিওতেই দিন যাপন করিতেছে, অন্য কোনও সিনেমা কোম্পানীর খোঁজ খবর রাখে নাই, কাহারও সহিত মুখ চেনাচেনি পর্যন্ত নাই। কে তাহাকে কাজ দিবে? সে-ই বা কোন মুখে অপরিচিতের কাছে উমেদার হইয়া দাঁড়াইবে? আর, কাজ যদি না পাওয়া যায় তবে দিদির বাড়িতেই বা কতদিন নিষ্কর্মার মত বসিয়া থাকিবে? তার চেয়ে কলিকাতায় ফিরিয়া গিয়া যাহোক একটা চেষ্টা করা ভাল। হয়তো চেষ্টা করিলে ব্যাঙ্কের কাজটা আবার পাওয়া যাইতে পারে।

এইরূপে নানা সংশয়ময় দুশ্চিন্তায় হপ্তাখানেক কাটিয়া যাইবার পর একদিন বৈকালে পাণ্ডুরঙ আসিয়া উপস্থিত হইল। ভর্ৎসনা করিয়া বলিল—বা দোস্ত, তুমি এখানে ছিপে রুস্তম হয়ে বসে আছ, আর আমি হাম্বার করে তোমাকে চারিদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।

আহ্লাদে সোমনাথ তাহার হাত চাপিয়া ধরিল।

আমি ভুলে গিয়েছিলাম ভাই। কোত্থেকে আমার ঠিকানা পেলে?

পাণ্ডুরঙ বলিল—কেউ কি তোমার ঠিকানা বলে? যাকে জিগ্যেস করি সেই গুম হয়ে যায়। শেষে এক মতলব বের করলাম; ফাউন্টেন পেনের সেক্রেটারিকে বললাম, তুমি আমার কাছে টাকা ধার করে কেটে পড়েছ। তখন ঠিকানা পাওয়া গেল। যাহোক, পিলে তোমাকে বিল্বিপত্র শুকিয়েছে জানি। এখন সব কেচ্ছা খুলে বল।

সোমনাথ তখন সেই আউটডোর শুটিং-এর দিন হইতে আগাগোড়া কাহিনী শুনাইল। পাণ্ডুরঙ ঘোর বাস্তবপন্থী লোক, সে দুঃখিতভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল—ভুল করেছ বন্ধু, দেবীর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করলেই ভাল করতে। তাতে চাকরি যেত না, বরং উন্নতি হত।

সোমনাথ বলিল—সে আমার দ্বারা হত না পাণ্ডুরঙ। তার চেয়ে চাকরি গেছে, মাথায় মিথ্যে কলঙ্ক চেপেছে এ বরং ভাল।

পাণ্ডুরঙ একটু ম্লান হাসিল—তুমি যে সুযোগ হেলায় ছেড়ে দিলে সেই সুযোগ পাবার জন্যে অনেক মিঞা জান্ কবুল করত। যেমন আমি; কিন্তু আমার পাথর-চাপা কপাল; আমাকে দেখলে দেবীদের হাসি পায়, প্রেম পায় না; কিন্তু সে যাক, এখন কি ঠিক করেছ?

কিছুই ঠিক করিনি, চুপ করে বসে আছি।

পাণ্ডুর বলিল—আমিও তাই ভেবেছিলাম। চল, আমার জানা কয়েকজন প্রডিউসার আছে, তাদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিই। তোমার চেহারা আছে, কাজ জুটে যাবেই।

সোমনাথ কিছুক্ষণ পাণ্ডুরঙের দিকে চাহিয়া রহিল—তুমি প্রকাশ্যভাবে আমাকে সাহায্য করলে তোমার অনিষ্ট হবে না? পিলে সাহেব বা চন্দনা দেবী যদি জানতে পারেন—

জানতে তারা পারবেই, কারণ সিনেমার রাজ্যে হরদম রেডিও চলছে, কে কি করছে কিছুই অজানা থাকে না।

তবে? তুমি তাদের চাকরি কর—

চাকরি করি তো কী? আমার বন্ধুর বিপদের সময় তাকে সাহায্য করব না? এই যদি চাকরির শর্ত হয় তাহলে ঝাড় মারি আমি চাকরির মুখে।

সোমনাথ মাথা নাড়িয়া বলিল—কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে—আমাকে সাহায্য করলে তোমার চাকরি যাবে পাণ্ডুরঙ।

পাণ্ডুরঙ তাহার পিঠ চাপড়াইয়া বলিল—ভাই, আমি সতেরো বছর বয়স থেকে সিনেমা করছি, অনেক ঘাটের জল খেয়েছি—আবার না হয় নতুন ঘাটের জল খাব। তাতে বান্দা ভয় পায় না। অবশ্য এ কথা ঠিক যে পিলের স্টুডিওতে সুখে আছি, লোকটা ছবি তৈরি করতে জানে; কিন্তু তাই বলে আমি তার কেনা গোলাম নই। নাও, চল তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়া যাক, সন্ধ্যে হয়ে গেলে আর প্রডিউসার সাহেবদের খুঁজে পাওয়া যাবে না।

খুঁজে পাওয়া যাবে না কেন?

তাঁরা তখন গুপ্ত বেহেস্তে গা ঢাকা দেন। সব প্রডিউসারের একটি করে গোপন বেহেস্ত আছে কিনা; কিন্তু তুমি সাধু সন্ন্যিসি মানুষ, এ সব বুঝবে না।

দুই বন্ধু বাহির হইল। পাণ্ডুরঙ বলিল—একটা ট্যাক্সি ধরা যাক।

সোমনাথ বলিল—কেন, ট্রামবাসে যাওয়া চলবে না?

পাণ্ডুরঙ বলিল—ভাই সোমনাথ, তোমাকে একটা উপদেশ দিই, মনে রেখো। সিনেমার বড় সাহেবদের সঙ্গে যখন দেখা করতে যাবে, ট্যাক্সিতে যাবে; নইলে কদর থাকবে না।

তুমি বুঝি ট্যাক্সি ছাড়া চল না?

হরগিস না। তাছাড়া ট্রামে বাসে কি আমার চড়বার উপায় আছে? গাড়িসুদ্ধ লোক হাঁ করে মুখের পানে চেয়ে থাকবে আর খিলখিল করে হাসবে। তোমারও ছবি বেরুক না, দেখবে তখন। রাস্তায় বেরুনো প্রাণান্তকর হয়ে উঠবে।

একটা ট্যাক্সি ধরিয়া দুজনে আরোহণ করিল; পাণ্ডুরঙ একটি স্টুডিওর ঠিকানা দিল, ট্যাক্সি চলিতে লাগিল। সোমনাথ পাণ্ডুরঙকে সিগারেট দিয়া নিজে একটা ধরাইল, প্রশ্ন করিল—ছবি কতদিনে বেরুবে কিছু জানো?

ফাউন্টেন পেন বিজ্ঞাপন দিতে আরম্ভ করেছে। তার মানে মাসখানেকের মধ্যেই বেরুবে।

বিজ্ঞাপন বেরুচ্ছে নাকি?

হ্যাঁ, তবে এখন খুব বেশী নয়। ছবি বেরুবার হপ্তাখানেক আগে থেকে চেপে পাবলিসিটি করবে। ফাউন্টেন পেন হুঁশিয়ার লোক, বাজে খরচ করে না।

সোমনাথ একটু বিমনা হইল। বিজ্ঞাপনই চিত্রশিল্পের জীবন। ছবির বিজ্ঞাপনে তাহার নাম কিভাবে থাকিবে কে জানে?

ক্রমে ট্যাক্সি নির্দিষ্ট স্টুডিওতে পেীছিল। ভাগ্যক্রমেই হোক, বা ট্যাক্সির মাহাত্ম্যেই হোক, বেশীক্ষণ

অপেক্ষা করিতে হইল না, স্টুডিওর কতা রুস্তমজি তাহাদের ডাকিয়া পাঠাইলেন।

রুস্তমজি প্রবীণ বয়স্ক পার্সী, মাথায় ডাকবাক্স টুপি, অনশনক্লিষ্ট গুদ্রের মত মুখের ভাব, চোখ দুটি অতিশয় ধূর্ত। ইনি চিত্রশিল্পের নির্বাক যুগ হইতে এই কর্ম করিতেছেন, প্রায় পঞ্চাশটি ছবির জন্মদান করিয়াছেন। যদিও তন্মধ্যে মাত্র গুটি পাঁচেক ছবি ভাল হইয়াছে; তবু বাজারে তাঁহার বেশ নাম-ডাক আছে।

রুস্তমজি প্রথম কিছুক্ষণ পাণ্ডুরঙের সহিত আদিরসাশ্রিত রসিকতা করিলেন, তারপর কাজের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন।

পাণ্ডুরঙ বলিল—ইনি আমার বন্ধু সোমনাথ, আমরা দুজনে পিলের ছবিতে কাজ করেছি। ইনি হিরো ছিলেন। আপনার যদি হিরোর দরকার থাকে।

ইতিমধ্যে রুস্তমজি তাঁহার ধূর্ত চোখ দিয়া সোমনাথকে বেশ ভাল করিয়া দেখিয়া লইয়াছিলেন; বলিলেন—চেহারা তো লা জবাব! কাজও নিশ্চয় ভাল করেছেন?

পাণ্ডুরঙ বলিল—খুব ভাল কাজ করেছেন। যেমন চেহারা তেমনি কাজ—দুই পাল্লা সমান ভারি।

রুস্তমজি বলিলেন—বটে? তুমি জামিন হচ্ছ?

পাণ্ডুরঙ বলিল—আলবৎ—জান জামিন ইমান জামিন। আমার সুপারিশ যদি মিথ্যে হয় ডালকুত্তা দিয়ে আমাকে খাওয়াবেন।

রুমজি হাসিলেন—পাণ্ডুরঙ, তুমি মারাঠী তো?

জি।

তবে এমন মোগলাই বচন-বিন্যাস শিখলে কোত্থেকে? মারাঠী ভাইরা তো এমন চোস্ত-জবান হয় না।

হুজুর, তবে শুনুন, আমার খানদানি কেচ্ছা বলি।–পেশোয়াদের আমলে মারাঠারা একবার দিল্লী দখল করেছিল জানেন বোধ হয়?

জানি না, তবে হতে পারে। মারাঠীদের অসাধ্য কাজ নেই।

আমার পূর্বপুরুষ সেই মারাঠা পল্টনে ছিলেন। তিনি আর ফিরে এলেন না, দিল্লীতেই বসে গেলেন। সেই থেকে আমরা দিল্লীর বাসিন্দা।

বুঝেছি। তোমার বন্ধুও কি দিল্লীর বাসিন্দা?

না, উনি বাঙালী।

রুস্তমজি বলিলেন–মন্দ নয়। তুমি মারাঠী হয়ে দিল্লীর বাসিন্দা, উনি বাঙালী হয়ে বম্বের বাসিন্দা, আর আমি পার্সী হয়ে হিন্দুস্থানের বাসিন্দা। ভাল ভাল; কিন্তু উনি পিলের কাজ ছেড়ে দিলেন কেন?

সোমনাথ ও পাণ্ডুর দৃষ্টি বিনিময় করিল, প্রশ্নের উত্তর সাবধানে দেওয়া প্রয়োজন।

সোমনাথ বলিল—মিঃ পিলের সঙ্গে আমার মাত্র তিন মাসের কনট্রাক্ট ছিল—

রুস্তমজি প্রশ্ন করিলেন—পিলের অপশান ছিল না?

ছিল।

তবে সে ছেড়ে দিলে যে বড়?

সোমনাথ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল—তাঁর সঙ্গে আমার একটু মনোমালিন্য হয়েছিল; কিন্তু কাজের সম্পর্কে নয়।

রুস্তমজি কিছুক্ষণ চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া রহিলেন, তারপর বলিলেন—হুঁ। আপনার নাম ঠিকানা দিয়ে যান, যদি আমার দরকার হয় আপনাকে খবর দেব।—পাণ্ডুরঙ, তুমি এখনও চন্দনার দিকে নজর দিচ্ছ না যে বড়?

পাণ্ডুরঙ বলিল-চাকরি যাবে হুজুর।

রুস্তমজি বলিলেন—তা বেশ তো। ফাউন্টেন পেন যদি তোমাকে তাড়িয়ে দেয়, সটান আমার কাছে চলে আসবে। আমি তোমাকে বেশী মাইনে দেব।

পাণ্ডুরঙ হাত জোড় করিয়া বলিল—হুজুর মেহেরবান।

স্টুডিও হইতে বাহির হইয়া পাণ্ডুরঙ বলিল-বুড়ো ভারি ধড়িবাজ, আন্দাজ করেছে চন্দনা ঘটিত মনোমালিন্য। পিলের কাছে তোমার সম্বন্ধে সুলুক সন্ধান নেবে।

সোমনাথ বলিল—হুঁ। পিলে সাহেব বিশেষ ভাল সার্টিফিকেট দেবেন বলে মনে হয় না। এখানে কোনও আশা নেই পাণ্ডুরঙ।

পাণ্ডুরঙ বলিল—তা বলা যায় না। যাহোক, কাল পরশু আমি আবার তোমাকে নিয়ে বেরুব, আরও দুএকজনের কাছে নিয়ে যাব। একটা না একটা লেগে যাবেই।

তারপর কয়েকদিন ধরিয়া পাণ্ডুর সোমনাথকে অনেকগুলি চিত্রপ্রণেতার কাছে লইয়া গেল; কিন্তু সকলের মুখেই এক কথা। চেহারা তো বেশ ভালই, কিন্তু পিলের চাকরি ছাড়লেন কেন? নাম-ধাম রেখে যান, যদি দরকার হয় খবর দেব। সোমনাথের মনে হইল, কোনও অদৃশ্য শত্রু চারিদিকে প্রাচীর তুলিয়া তাহাকে বন্দী করিবার চেষ্টা করিতেছে, কোনও দিক দিয়াই বাহির হইবার পথ নাই।

একদিন বাড়ি ফিরিবার পথে সোমনাথ জিজ্ঞাসা করিল—আচ্ছা পাণ্ডুরঙ, আমার নামে ওরা কি বলেছে, যাতে আমি একেবারে অস্পৃশ্য হয়ে গেছি? তুমি কিছু শুনেছ?

পাণ্ডুরঙ বলিল—বড় সাংঘাতিক কথা বলেছে?

কি? চন্দনা সম্বন্ধে?

পাগল! ওরা জানে তাতে তোমার কোনও অনিষ্ট হবে না। সিনেমা রাজ্যে স্ত্রীলোক ঘটিত দুর্বলতা কেউ গ্রাহ্য করে না। ওরা রটিয়েছে যে তুমি মন দিয়ে কাজ কর না, আর অর্ধেক ছবি তৈরি হবার পর মোচড় দাও।

সে কি?

হ্যাঁ। এমন আর্টিস্ট আছে যারা অর্ধেক ছবি তৈরি হবার পর বাড়ি গিয়ে বসে থাকে, বলে বেশী টাকা দাও তো কাজ করব নইলে করব না। এই বলে মোচড় দিয়ে বেশী টাকা আদায় করে। তারা জানে অর্ধেক ছবি তৈরি হয়ে গেছে, এখন তাকে বাদ দিয়ে নতুন করে ছবি তৈরি করতে গেলে অনেক খরচ। তাই এ রকম আর্টিস্টকে প্রডিউসারদের ভারি ভয়।

কিন্তু কন্ট্রাক্ট আছে যে!

থাকলই বা কনট্রাক্ট। আর্টিস্ট বলে, আদালতে যাও। আদালতে গেলে দুবছরের ধাক্কা। ততদিনে ছবি বন্ধ রাখলে প্রডিউসারের সর্বনাশ হয়ে যাবে; তার চেয়ে বেশী টাকা দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া ভাল। তোমার নামে সেই অপবাদ দিয়েছে। ও অপবাদ যে আর্টিস্টের হয়, তাকে কেউ কাঠি করে ছোঁয় না।

সোমনাথ হতাশ স্বরে বলিল—তবে আর চেষ্টা করে লাভ কি পাণ্ডুরঙ? তার চেয়ে দেশে ফিরে যাই।

পাণ্ডুরঙ সহজে হার মানে না, বলিল—আর কিছুদিন দেখা যাক। বদনাম দিলেই সকলে বিশ্বাস করে না। ছবিটা বেরুলে সুরাহা হতে পারে।

পরদিন খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন বাহির হইল। ছোট বিজ্ঞাপন, তাহাতে কেবল ছবির নাম ও চন্দনার হাসিমুখ আছে। অন্য-কাহারও উল্লেখ নাই। চন্দনা দেবী যে শীঘ্রই আসিতেছেন এই খবরটি কেবল সাধারণকে জানানো হইয়াছে।

দিনের পর দিন বিজ্ঞাপন আকারে বাড়িতে লাগিল। চন্দনার নাম ছাড়াও ক্রমে প্রযোজকের নাম, পরিচালকের নাম, সঙ্গীত পরিচালকের নাম, অন্যান্য আর্টিস্টদের নাম, এমন কি স্টুডিওর দারোয়ানটার পর্যন্ত নাম ছাপা হইল কিন্তু সোমনাথের নাম কুত্রাপি দেখা হল না। একদিন মহাসমারোহ করিয়া খবরের কাগজের অর্ধেক পৃষ্ঠা জুড়িয়া চিত্রের মুক্তির দিন বিঘোষিত হইল—আগামী শনিবার বম্বের বিখ্যাত রসিক সিনেমায় ছবি মুক্তিলাভ করিবে।

সোমনাথের মনের অবস্থা অনুমান করা কঠিন নয়। সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল। তাহার ভাগ্যলক্ষ্মী অকস্মাৎ কোন্ অশুভ মুহূর্তে তাহার প্রতি বিরূপ হইয়া বিপরীত মুখে যাত্রা শুরু করিলেন, কোনও কারণ দেখাইলেন না, ত্রুটির ছিদ্র অন্বেষণ করিলেন না, কিন্তু সোমনাথের জীবন সকলি গরল হইয়া গেল।

ইতিমধ্যে রত্নার চিঠি আসিল। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, যখন বর্ষণ হয় তখন আকাশ ভাঙিয়া পড়ে। চিঠিখানা হাতে পাইয়া সোমনাথের মনে হইল, দুঃখের বরষায় সত্যই তাহার মাথায় আকাশ ভাঙিয়া জল ঝরিতেছে। রত্নার চিঠি দিদিকে লেখা। দিদি বোধ হয় চিঠির বক্তব্য সোমনাথকে মুখ ফুটিয়া বলিতে পারিবেন না বলিয়া চিঠিখানি তাহার ঘরে রাখিয়া গিয়াছেন।

.

সোমনাথ চিঠি খুলিয়া পড়িল।

শ্রীচরণেষু, ভাই বৌদি, শুনে সুখী হবে আমি পাস করেছি। ফল খুব ভাল হয়নি, টায় টায় পাস। ভাবছি থার্ড ইয়ারে ভর্তি হব।

বম্বেতে তুমি আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলে, তার উত্তর না দিয়েই চলে এসেছিলাম। এখন দিচ্ছি। আমার মত নেই। সোমনাথবাবু যে পথে নেমেছেন সে পথে পতন অনিবার্য। তাছাড়া, যিনি বিয়ে করে বাইরের আক্রমণ থেকে চরিত্র রক্ষা করতে চান তাঁর চরিত্রকেও আমি শ্রদ্ধা করতে পারি না।

ভালবাসা নিও।

ইতি—
তোমার রত্না

রত্নার হাতের লেখা খুব সুন্দর, ছোট ছোট সুগঠিত অক্ষরগুলি মুক্তাশ্রেণীর মত পাশাপাশি সাজানো; কোথাও অপরিষ্কার নাই, কাটাকুটি নাই, দ্বিধা সংশয় নাই। রত্নার হস্তাক্ষর যেন তাহার চরিত্রের প্রতিবিম্ব।

তিক্ত অন্তরে সোমনাথ চিঠিখানি সরাইয়া রাখিয়া দিল। আর কতদিন এভাবে চলিবে? সংসারের অবহেলা ও অপমানের কি শেষ নাই?

.

দুই

শনিবার সন্ধ্যাবেলা সোমনাথ চোরের মত চুপি চুপি ছবি দেখিতে গেল। স্টুডিওর চেনা লোক পাছে তাহাকে দেখিয়া ফেলে এ সঙ্কোচও তাহার মনে ছিল, কিন্তু রসিক সিনেমা আজ লোকে লোকারণ্য, চন্দনার নৃতন ছবি দেখিবার জন্য শহরসুদ্ধ ভাঙিয়া পড়িয়াছে; সোমনাথের সহিত চেনা কাহারও দেখা হইল না। টিকিট বিক্রয় অবশ্য বহু পূর্বেই বন্ধ হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু ফুটপাতে কালাবাজারের কারবার চলিতেছিল। সোমনাথ দ্বিগুণ মূল্যে টিকিট কিনিয়া প্রেক্ষাগৃহে গিয়া বসিল।

ছবি আরম্ভ হইল। পরিচয় পত্রে মধুর বাদ্য-নিক্কণ সহযোগে প্রথমেই চন্দনা দেবীর নাম, তারপর আর সকলে। অন্যান্য নটনটীর সহিত সোমনাথের নামটাও আছে বটে, কিন্তু সে-ই যে এই চিত্রের নায়ক তাহা বুঝিবার উপায় নাই।

কিন্তু ছবি দেখিতে দেখিতে সোমনাথ তন্ময় হইয়া গেল। গল্পের বিষয়বস্তুতে যত না হোক, তাহার প্রকাশভঙ্গিতে এমন একটি সরস মসৃণ নৈপুণ্য আছে যে দর্শকের মনকে সম্পূর্ণরূপে আকর্ষণ করিয়া লয় এবং শেষ পর্যন্ত দৃঢ়মুষ্টিতে ধরিয়া রাখে। চন্দনার অভিনয় অতুলনীয় বলিলেও চলে; সোমনাথের ভূমিকা আকারে ক্ষুদ্র হইলেও তাহার প্রিয়দর্শন আকৃতি ও সহজ অনাড়ম্বর অভিনয় মনের উপর দাগ কাটিয়া দেয়। দর্শকমণ্ডলী যে তাহাকে সমাদরের সহিত গ্রহণ করিয়াছে তাহাও তাহাদের আচরণ হইতে বারবার প্রকাশ পাইল। চিত্ৰদৰ্শী জনতার অনুরাগ বিরাগ প্রকাশ করিবার এমন একটি নিঃসংশয় ভঙ্গি আছে যাহা বুঝিতে তিলমাত্র বিলম্ব হয় না।

ছবি শেষ হইলে রাত্রি সাড়ে নয়টার সময় সোমনাথ অশান্ত হৃদয়ে বাড়ি ফিরিল। জামাইবাবু অফিসের কাজে দুদিনের জন্য পুণা গিয়াছিলেন, দিদিও পুণা বেড়াইবার উদ্দেশ্যে সঙ্গে গিয়াছিলেন। সোমনাথ বাড়িতে একা। শুন্য বাড়ির ড্রয়িংরুমে সে একা বসিয়া রহিল। ভৃত্য আসিয়া আহারের তাগাদা দিল; সোমনাথের ক্ষুধা ছিল না, খাবার ঢাকা দিয়া রাখিতে বলিয়া সে আবার বিষণ্ণমনে ভাবিতে লাগিল।

এখন সে কী করিবে? ছবি উৎকৃষ্ট হইয়াছে, সম্ভবত এই একই চিত্ৰগৃহে বৎসরাধিক কাল চলিবে। সোমনাথের অভিনয় ভাল হইয়াছে, এমন কি তাহার অভিনয় চিত্রটিকে একটি বিশেষ মর্যাদা দিয়াছে একথাও বলা চলে। অথচ তাহার কৃতিত্বের প্রাপ্য পুরস্কার সে কিছুই পাইল না, অজ্ঞাতনামা হইয়া রহিল। যে খ্যাতি ও স্বীকৃতির উপর তাহার ভবিষ্যৎ জীবিকা নির্ভর করিতেছে তাহা হইতে সে বঞ্চিত হইল। এখন সে কী করিবে?

একটা প্রবল অসহিষ্ণুতায় তাহার অন্তর ছটফট করিয়া উঠিল। না, আর এখানে নয়, যথেষ্ট হইয়াছে। কালই সে দেশে ফিরিয়া যাইবে। সেখানে যা হইবার হইবে। বোম্বাই আর নয়, যথেষ্ট হইয়াছে।

এই সময় টিং টিং করিয়া টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। এত রাত্রে কে টেলিফোন করে? সোমনাথ উঠিয়া গিয়া ফোন ধরিল।

হ্যালো?

একটি অপরিচিত কণ্ঠস্বর হিন্দীতে প্রশ্ন করিল—সোমনাথবাবু বাড়িতে আছেন কি?

আমিই সোমনাথ। আপনি কে?

অপরিচিত ব্যক্তি উত্তর দিল না, টেলিফোন রাখিয়া দিল। কিছুক্ষণ বোকার মত দাঁড়াইয়া থাকিয়া সোমনাথ ক্লান্তভাবে ফিরিয়া আসিয়া বসিল। ইহা বোধ হয় বোম্বাই রসিকতা; কিন্তু রসিক ব্যক্তিটি কে? কণ্ঠস্বর পুরুষের, সুতরাং চন্দনা নয়। তবে কি পিলে সাহেব? কিন্তু তিনি এমন অর্থহীন রসিকতা করিবেন কেন? দশ মিনিট এইরূপ চিন্তায় কানামাছির মত পাক খাইবার পর সোমনাথ শুনিতে পাইল, বাড়ির সম্মুখে একটি মোটর আসিয়া থামিয়াছে। পরক্ষণেই সদর দরজার ঘন্টি বাজিয়া উঠিল। সোমনাথ গিয়া দ্বার খুলিয়া দেখিল, ডাকবাক্স টুপিপরা ধুর্ত চক্ষু বৃদ্ধ রুস্তমজি দাঁড়াইয়া আছেন।

রুস্তমজি বলিলেন-আমিই ফোন করেছিলাম।

সোমনাথ সমাদর করিয়া তাঁহাকে বসাইল। রুস্তমজি বাজে কথায় সময় নষ্ট করিলেন না, বলিলেন—আপনার ছবি এইমাত্র দেখে এলাম। আমার ছবিতে আপনাকে হিরো সাজতে হবে। আমি হাজার টাকা মাইনে দেব।

সোমনাথের মাথা ঘুরিয়া গেল। সে উত্তর দিতে পারিল না, ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল। রুস্তমজি পকেট হইতে দশকে একশত টাকার নোট বাহির করিয়া সোমনাথের সম্মুখে রাখিলেন–এই নিন আপনার একমাসের মাইনে। আজ থেকে আপনি আমার কাজে বাহাল হলেন। আসুন, এই রসিদ দস্তখৎ করুন। পাকা কন্ট্রাক্ট পরে হবে।

রুস্তমজি একটি ছাপা রসিদ ও ফাউন্টেন পেন সোমনাথের সম্মুখে ধরিলেন, সোমনাথ প্রায় অবশভাবে দস্তখৎ করিয়া দিল।

রুস্তমজি উঠিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন—আজ আমি চললাম, রাত হয়েছে। কাল আপনি স্টুডিওতে যাবেন, তখন কথা হবে।

দৃঢ়ভাবে সোমনাথের করমর্দন করিয়া রুস্তমজি বিদায় লইলেন। সারা রাত্রি আনন্দে উত্তেজনায় সোমনাথের ঘুম হইল না। এ কী অভাবনীয় ব্যাপার! তাহার ভাগ্য-প্রদীপ চিরদিনের জন্য নিভিয়া গিয়াছে মনে করিয়া সে চারিদিক অন্ধকার দেখিতেছিল, এখন। সেই প্রদীপ আবার দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। ইহাকেই বলে পুরুষের ভাগ্য। রুস্তমজির আশা তো

সে ছাড়িয়াই দিয়াছিল—কিন্তু বৃদ্ধ তাহাকে ভোলেন নাই। কি অদ্ভুত মানুষ! রাত্রি সাড়ে দশটার সময় নিজে আসিয়া টাকা দিয়া গেলেন; কিন্তু এত রাত্রে নিজে আসিলেন কেন? কাল সকালে একবার খবর পাঠাইলেই তো সোমনাথ কৃতার্থ হইয়া যাইত! মহাপ্রাণ ব্যক্তি এই রুস্তমজি।

শুধু মহাপ্রাণ নয়, রুস্তমজি যে অতি দূরদর্শী ব্যক্তি তাহা জানিতে সোমনাথের এখনও বাকি ছিল।

রাত্রি তিনটার সময় সে অনুভব করিল ক্ষুধায় তাহার পেট জ্বলিয়া যাইতেছে। মনে পড়িল রাত্রে আহার করিতে ভুল হইয়া গিয়াছে। তাড়াতাড়ি ভোজনক্ষক্ষে গিয়া দেখিল তাহার খাবার ঢাকা দেওয়া রহিয়াছে। তখন পেট ভরিয়া আহার করিয়া সে তৃপ্তমনে শুইতে গেল।

পরদিন ভোর হইতে না হইতে পাণ্ডুরঙ আসিল, বলিল—কাল আসতে পারিনি। ছবি ভাল হয়েছে। তোমার কাজ দেখে সবাই মুগ্ধ। চল, আজ তোমায় ছবি দেখিয়ে আনি।

সোমনাথ হাসিয়া বলিল—ছবি আমি দেখেছি। বলিয়া গত রাত্রির সমস্ত বিবরণ বলিল।

পাণ্ডুরঙ বলিল—আরে, ভারি ঘাগী বুড়ো তো! পাছে আর কেউ কন্ট্রাক্ট করিয়ে নেয়, তাই রাত্তিরেই এসেছে। তুমি এক হাজারে রাজি হয়ে গেলে? দম দিলে বুড়ো দু হাজারে উঠতো।

সোমনাথ বলিল—না না। এক হাজারই যথেষ্ট, তার বেশী কে দেবে পাণ্ডুরঙ? এখন অনেকেই দেবে। সব ব্যাটা ছবি দেখবার জন্যে ওৎ পেতে ছিল। আমরা যখন দোরে দোরে ঘুরে বেড়িয়েছে তখন কেউ গ্রাহ্যই করেনি। এইবার দেখো না—সবাইকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবো।

আর নাকে দড়ি দেবে কি করে টাকা যে নিয়ে ফেলেছি।

হুঁ–কাজটা ভাল করনি। যাহোক, একটা কথা বলে রাখি, লম্বা কন্ট্রাক্ট কোরো না, একটা ছবির কন্ট্রাক্ট কোরো, বড় জোর দুটো। তোমার এখন সিতারা বুলন্দু, টাকা রোজগারের মরসুম—এখন যদি বুড়ো রুসিবাবার ফাঁদে পড়ে যাও, তাহলে ঐ এক হাজার টাকাতেই জীবন কাটাতে হবে।

পাণ্ডুরঙ নিঃস্বার্থ বন্ধু, তাহার কথা সোমনাথের মনে ধরিল; কিন্তু তবু, তাহার ঘোরতর দুঃসময়ে রুস্তমজিই আসিয়া প্রথম আশার আলো জ্বালিয়াছিলেন তাহাও সে ভুলিতে পারিল না।

পাণ্ডুরঙ চলিয়া গেলে সোমনাথ পর পর গোটা তিনেক টেলিফোন কল পাইল। সকলেই চিত্র-প্রণেতা, সকলেই মধুক্ষরিত কণ্ঠে তাহাকে স্টুডিওতে গিয়া তাঁহাদের সহিত দেখা করিতে অনুরোধ করিলেন; একজন এমন আভাসও দিলেন যে তিনি চুক্তিপত্র হাতে লইয়া বসিয়া আছেন, সোমনাথ গিয়া তাহাতে বেতনের অঙ্কটি বসাইয়া দিবে; কিন্তু সোমনাথ সকলকে সবিনয়ে জানাইল যে সে পূর্বেই চুক্তিবদ্ধ হইয়াছে, তাঁহারা যেন তাহাকে ক্ষমা করেন। সকলেই অত্যন্ত বিমর্ষ হইলেন এবং বারবার অনুরোধ জানাইলেন সোমনাথ যেন মুক্তি পাইলেই তাঁহাদের স্মরণ করে।

সোমনাথ বুঝিল তাহার কপাল খুলিয়াছে। এমন রাতারাতি কপাল ভোলা সিনেমা ছাড়া আর কোনও ক্ষেত্রে হয় না।

স্নানাহার সারিয়া সোমনাথ বাহির হইল। প্রথমেই ব্যাঙ্কে গিয়া টাকাগুলি জমা দিতে হইবে। সোমনাথ কলিকাতায় যে ব্যাঙ্কে কাজ করিত সেই ব্যাঙ্কের একটি শাখা বম্বেতে ছিল, সোমনাথ পূর্ব-সম্পর্কের মমতায় সেই ব্যাঙ্কেই টাকা রাখিয়াছিল।

টাকা ব্যাঙ্কে জমা দিয়া সোমনাথ রুস্তমজির স্টুডিওতে গেল। পাণ্ডুরঙের উপদেশ তাহার মনে ছিল, সে ট্যাক্সি চড়িয়া গেল।

রুস্তমজি আদর করিয়া তাহাকে কাছে বসাইলেন, বলিলেন—আমি তোমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, তুমি আমাকে রুসিবাবা বলে ডেকো। এখানে সবাই তাই বলে। আমার স্ত্রী পুত্র কেউ নেই, সব মরে গেছে, স্টুডিওর ছেলেরাই আমার ছেলে।

সোমনাথ বলিল—যে আজ্ঞে।

রুস্তমজি তখন বলিলেন—দ্যাখো সোমনাথ, আমি ত্রিশ বছর সিনেমা করছি, ভুরু দেখে মানুষ চিনতে পারি। তোমাকে দেখে আমি বুঝেছি তুমি বড় ভাল ছেলে; কিন্তু শুধু ভালমানুষ হলেই চলে না; সিনেমায় হিরো হতে গেলে ঠাট্‌ চাই। তুমি একটা মোটর কিনে ফ্যালো।

সোমনাথ অবাক হইয়া বলিল—মোটর? কিন্তু আমার তো মোটর কেনার টাকা নেই। আজকাল নতুন মোটর কিনতে গেলে

রুসিবাবা বলিলেন—নতুন মোটর কেনবার দরকার নেই, পুরোনো হলেও চলবে।

সোমনাথ বলিল—কিন্তু পুরোনো মোটরই বা কোথায় পাব?

সে জন্যে তোমায় ভাবতে হবে না, আমি যোগাড় করে দেব। আমার জানা একটি সেকেণ্ড-হ্যান্ড মোটর আছে, ভাল অবস্থায় আছে, অস্টিন টেন। আমি সস্তায় তোমায় কিনিয়ে দেব।

সোমনাথ বিব্রত হইয়া বলিল—কিন্তু মোটর কেনা কি নিতান্তই দরকার?

রুস্তমজি বলিলেন—দরকার। আমার স্টুডিওতে যে কেউ সাতশো টাকার বেশী মাইনে পায় তাকেই আমি মোটর কিনিয়ে দিয়েছি। ওতে স্টুডিওর ইজ্জত বাড়ে; তা ছাড়া, যার গাড়ি আছে তাকে পুলিসেও খাতির করে। তুমি ভেবো না। খুব সস্তায় গাড়ি পাবে; হাজারখানেকের মধ্যে। তাও নগদ টাকা দিতে হবে না, আমি মাসে মাসে তোমার মাইনে থেকে কেটে নেব। তুমি জানতেও পারবে না।

সোমনাথ আর না বলিতে পারিল না, রাজি হইল। রুস্তমজি তখন চুক্তিপত্রের খসড়া বাহির করিয়া সোমনাথকে দিলেন, বলিলেন–একবার চোখ বুলিয়ে নাও, যদিও আপত্তি করার কিছু নেই।

সোমনাথ পড়িয়া দেখিল, হাজার টাকা মাহিনায় পাঁচ বছরের চুক্তি, মাহিনা বাড়ার কোনও শর্ত নাই। পাণ্ডুরঙ তাহাকে পূর্বেই মন্তর দিয়াছিল, সে বাঁকিয়া বসিল—আমি একটা ছবির জন্য কন্ট্রাক্ট করতে পারি, তার বেশী নয়।

রুস্তমজি বোধ হয় মনে মনে আপত্তির জন্য প্রস্তুত ছিলেন, তিনি সোমনাথকে বুঝাইতে আরম্ভ করিলেন। নূতন অভিনেতার পক্ষে পাঁচ বছরের চুক্তি যে কতদূর ভাগ্যের কথা, যে শিল্পী দীর্ঘ চুক্তি করিয়া নিজের ভবিষ্যৎ পাকা এবং নিরুদ্বেগ করিয়া লইতে চায় না তাহার ভাগ্য বিপর্যয় যে কিরূপ অবশ্যম্ভাবী, রুস্তমজি তাহা মসৃণ বাকপটুতার সহিত প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করিলেন।

সোমনাথ কিন্তু ভিজিল না। তাহার এখন সিতারা বুলন্দ, সে পাঁচ বছরের জন্য জীবন বন্ধক রাখিতে প্রস্তুত নয়, শিল্পীর জীবনে পাঁচ বৎসর যে অতি দীর্ঘ সময়, অনেক অভিনেতার শিল্প-জীবন পাঁচ বৎসরের মধ্যেই শেষ হইয়া যায় তাহা তাহার অজানা ছিল না। ত্রিশ বছর বয়সের পর যাহারা নবীন হিরো সাজে তাহারা শিং ভাঙিয়া বাছুরের দলে ঢুকিবার চেষ্টা করে এবং হাস্যাস্পদ হয়; সুতরাং বেলা থাকিতে থাকিতে ভবিষ্যতের সংস্থান করিয়া লইয়া আলোয় আলোয় বিদায় লওয়া ভাল।

অনেক ধ্বস্তাধ্বস্তির পর স্থির হইল, সোমনাথ এক হাজার টাকা মাহিনায় রুস্তমজির দুইটি ছবিতে হিরোর কাজ করিবে; তবে এই দুইটি ছবির কাজ যতদিন শেষ না হয় ততদিন সে অন্য কাজ করিতে পারিবে না।

নূতন চুক্তিপত্র তখনই ছাপা হইয়া আসিল। সোমনাথ তাহাতে সহি করিয়া দিল। রুস্তমজি তাহার পিঠ চাপড়াইয়া বলিলেন—সোমনাথ, তোমাকে যতটা গোবেচারি ভেবেছিলাম তুমি তা নও। যাহোক, এ ভালই হল, তুমিও খুশি হলে—আমিও খুশি হলাম। এবার মন দিয়ে কাজে লাগতে হবে।

সোমনাথ জিজ্ঞাসা করিল—কাজ আরম্ভ হবে কবে?

মাসখানেকের মধেই। আর সব ঠিক আছে, কেবল গল্পটা নিয়ে একটু গোলমাল চলছে।

গল্প লিখেছেন কে?

একজন বাঙালী। নাম জানো কি? ইন্দু রায়।

সোমনাথ লাফাইয়া উঠিল। ইন্দু রায়! ইন্দ্র রায়ের নাম শিক্ষিত বাঙালী কে না জানে? সোমনাথ তাঁহার লেখার প্রগাঢ় ভক্ত। সে উল্লসিত হইয়া উঠিল।

তিনি কি বোম্বাইয়ে থাকেন?

হ্যাঁ, প্রায়ই স্টুডিওতে আসেন। লেখক তো ভালই, কিন্তু বড় একগুঁয়ে। ক্রমে সকলের সঙ্গেই তোমার পরিচয় হবে।

.

তিন

কাজ আরম্ভ না হইলেও সোমনাথ প্রত্যহ স্টুডিওতে যাতায়াত করিতে লাগিল। রুস্তমজি প্রায়ই তাহাকে নিজের অফিস ঘরে ডাকিয়া গল্প-গুজব করেন; বৃদ্ধের সহিত তাহার ঘনিষ্ঠতা বেশ গাঢ় হইয়া উঠিল। স্টুডিওর কয়েকজন বিশিষ্ট কর্মচারীর সহিতও আলাপ হইল।

দিগম্বর শম্ভুলিঙ্গম স্টুডিওর খাজাঞ্চি ও হিসাবনবিশ। ইনি মদ্রদেশীয়, সুতরাং অর্থনৈতিক ব্যাপারে অতিশয় পোক্ত; কিন্তু জন্মাবধি তেঁতুল গোলা রশম খাইয়াই বোধকরি শম্ভুলিঙ্গ মহাশয়ের অন্তর বাহির একেবারে টকিয়া গিয়াছিল। এমন কি তাঁহার চেহারাটাও তিন্তিড়ী ফলের ন্যায় বক্র ভাব ধারণ করিয়াছিল। সোমনাথের সহিত প্রথম আলাপে তিনি নিশ্বাস ফেলিয়া বলিয়াছিলেন—আপনি ভাগ্যবান লোক, এই বয়সেই হাজার টাকা মাইনে পেয়ে গেলেন। আর আমি এগারো বছর কাজ করছি—আমার মাইনে ছশো টাকা—যাক—সবই ভাগ্য। আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

শম্ভুলিঙ্গ প্রসঙ্গে রুস্তমজি একদিন হাসিয়া বলিলেন—শম্ভুলিঙ্গ খাঁটি লোক, পরের পয়সা ওর কাছে হারাম; কিন্তু লোকটা সুখী হবার ফন্দি জানে না। ওকে যদি গলা টিপে দু পেগ মদ গিলিয়ে দিতে পারতাম তাহলে হয়তো—

কিন্তু মদও শভূলিঙ্গের কাছে পরধনের মতই অমেধ্য, তাই তাঁহাকে সুখী করা মানুষের সাধ্য নয়।

ইহারই ঠিক বিপরীত চরিত্র-চক্রধর রায়। লোকটি লাহোরের পাঞ্জাবী, চিত্রপরিচালক বলিয়া নিজের পরিচয় দিয়া থাকে। রুস্তমজির সাম্প্রতিক কয়েকটি চিত্র পরিচালনা করিয়াছে। এমন দাম্ভিক ও আত্মপ্রসন্ন ব্যক্তি কম দেখা যায়। লোকটির চেহারা যেমন বাদশাহী আমলের মিনার গম্বুজ দিয়া তৈয়ার মনে হয়, অন্তরও তেমনি দম্ভ ও আত্মম্ভরিতার স্তম্ভের উপর উদ্ধতভাবে দাঁড়াইয়া আছে। নিজের প্রশংসা ও পরের নিন্দা ছাড়া তাহার মুখে অন্য কথা নাই। শিষ্ট সমাজে এরূপ ব্যক্তি একদণ্ডের তরেও আমল পাইত না, কিন্তু সিনেমা রাজ্যে নিজের ঢাক যে যত জোরে পিটাইতে পারে তাহার কদর তত বেশী। তাই চক্রধর রায় এক গুণী ব্যক্তি বলিয়া পরিচিত হইয়াছিল।

প্রথম পরিচয়েই সোমনাথ বুঝিয়াছিল চক্রধর রায়ের সহিত তাহার পোট হইবে না। চক্রধরই পরবর্তী ছবি পরিচালনা করিবে ভাবিয়া সে একটু অস্বস্তি অনুভব করিয়াছিল। এরূপ প্রকৃতির লোকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করিতে গেলে ঠোকাঠুকি অবশ্যম্ভাবী। অথচ রুস্তমজি চক্রধর সম্বন্ধে ভাল ধারণা পোষণ করেন বলিয়াই মনে হয়। এরূপ অবস্থায় যা হইবার হইবে ভাবিয়া সোমনাথ মনের অস্বাচ্ছন্দ্য দমন করিয়া রাখিয়াছিল।

তৃতীয় যে ব্যক্তির সহিত সোমনাথের পরিচয় হইল তিনি লেখক ইন্দু রায়। সোমনাথ লক্ষ্য করিয়াছিল, একটি কোটপ্যান্ট-পরা মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক মাঝে মাঝে আসিয়া স্টুডিওর ওয়েটিং রুমে বসিয়া থাকেন, তারপর রুস্তমজির সহিত দেখা করিয়া চলিয়া যান। তাঁহাকে একটু কড়া মেজাজের লোক বলিয়া মনে হয়, কাহারও সহিত যাচিয়া কথা বলেন না, বরং নিজের চারিপাশে স্বতন্ত্রভাবে এমন একটি দৃঢ় গণ্ডী কাটিয়া রাখেন যে সহজে কেহ তাঁহার দিকে ঘেঁষিতে পারে না।

ইনি যে বাঙালী, তাহাই সোমনাথ প্রথমে বুঝিতে পারে নাই। যখন জানিতে পারিল ইনিই ইন্দু রায়, তখন সাগ্রহে গিয়া তাঁহার সহিত আলাপ করিল। ইন্দুবাবু প্রথমে একটি গম্ভীর হইয়া রহিলেন; তারপর ধীরে ধীরে তাঁহার ছিপি-আঁটা মন উন্মোচিত হইতে লাগিল। সোমনাথ দেখিল, ইন্দুবাবু আসলে বেশ মিশুক ও রসিক লোক, কিন্তু কোনও কারণে নিজেকে তিনি সম্বরণ করিয়া রাখিয়াছেন। হয়তো মন খুলিয়া কথা বলিবার মত লোক পান না বলিয়াই এরূপ হইয়াছে।

সোমনাথ উৎসাহভরে বলিল—আপনার লেখা আমার বড় ভাল লাগে। এমন সহজ স্বাস্থ্যপূর্ণ বলিষ্ঠতা আর কারুর লেখায় দেখতে পাই না।

ইন্দুবাবু ভ্রূ তুলিয়া কিছুক্ষণ সোমনাথকে নিরীক্ষণ করিলেন, তারপর ব্যঙ্গমস্থর কণ্ঠে বলিলেন–আমি পাঁচ বছর বোম্বাইয়ে আছি, কিন্তু এ ধরনের কথা কারুর মুখে শুনিনি। আপনি তাহলে বাংলা বই পড়েন।

সোমনাথ বলিল—আপনার সব বই পড়েছি।

ইন্দুবাবু বলিলেন—ভাল করেননি। বোম্বাইয়ের প্রডিউসারেরা যদি জানতে পারে আপনি বই পড়েন, তাহলে আপনার নামে ঢ্যারা পড়বে।

এই বক্রোক্তিটুকুর ভিতর দিয়া সোমনাথ ইন্দুবাবুর মানসিক অবস্থার পরিচয় পাইল। সেই যে কোন্ গুণী ওস্তাদ বড় মানুষের বাড়িতে গান গাহিতে গিয়া নাকেড়া গাহিবার ফরমাস পাইয়াছিল, ইন্দুবাবুর অবস্থা অনেকটা তাহার মত। ভেড়ার শিংয়ে পড়িলে হীরের ধার ভাঙিয়া যায়, একদল

অশিক্ষিত হস্তিমূখের মাঝখানে পড়িয়া ইন্দুবাবুরও অশেষ দুর্গতি হইয়াছে।

তাঁহার অন্তরের তিক্ততা কিয়ৎ পরিমাণে দূর করিবার জন্য সোমনাথ বলিল—সিনেমা-শিল্প এখনও সাহিত্যের কদর জানে না সত্যি। ক্রমে জানবে বোধ হয়; কিন্তু আমি আপনার গল্পে কাজ করতে ভেবে ভারি আনন্দ হচ্ছে।

ইন্দুবাবু বলিলেন—আনন্দটা বোধ হয় বাজে খরচ করলেন।

সোমনাথ চকিত হইয়া বলিল—কেন? আমি তো শুনেছি আপনার গল্পই এবার হবে!

ইন্দুবাবু বলিলেন-আমার গল্প এরা কিনেছে বটে কিন্তু কিনেই তাকে মেরামত করবার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছে। সুতরাং আমার গল্প শেষ পর্যন্ত কতখানি থাকবে তা বলতে পারি না।

এই সময় চাকর আসিয়া ইন্দুবাবুকে রুস্তমজির ঘরে ডাকিয়া লইয়া গেল। সোমনাথ একাকী বসিয়া ভাবিতে লাগিল, ইন্দুবাবুর লেখার উপর কলম চালাইতে পারে এমন প্রতিভাবান ব্যক্তি এখানে কে আছে? রুস্তমজি? চক্রধর রায়? সোমনাথ মনে মনে স্থির করিল, সুবিধা পাইলে সে এইরূপ আত্মঘাতী ধৃষ্টতার প্রতিরোধ করিবে।

কয়েকদিন কাটিয়া গেল; ছবি আরম্ভ করিবার দিন আগাইয়া আসিতেছে। সোমনাথ টের পাইল, গল্প লইয়া ভিতরে ভিতরে একটা গণ্ডগোল পাকাইয়া উঠিতেছে। একদিন দুপুরবেলা সে রুস্তমজির ঘরে অনাহূত প্রবেশ করিয়া দেখিল, রুস্তমজি, চক্রধর রায় ও ইন্দুবাবু বসিয়া আছেন। গল্প সম্বন্ধে আলোচনা হইতেছে; ঘরের আবহাওয়া বেশ উত্তপ্ত হইয়া উঠিয়াছে। সোমনাথ চলিয়া যাইতেছিল, রুস্তমজি তাহাকে ফিরিয়া ডাকিলেন—এস সোমনাথ, তুমিও শোন।

সোমনাথ একটু দূরে বসিল। ইন্দুবাবু যে বেশ উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছেন তাহা তাঁহার মুখ দেখিয়াই বোঝা যায়, তবু তিনি সংযতভাবেই কথা বলিতেছেন-নায়ক-নায়িকার ড়ুয়েট গান বাস্তব জগতে অসম্ভব হলেও নাটকে যে তা মানানসই করে দেখানো যায় একথা আমি অস্বীকার করি না; কিন্তু আমার এ গল্প সে-ধরনের নয়। নায়ক-নায়িকা দুজনেই গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। তাদের দিয়ে ড়ুয়েট গাওয়ানো অসম্ভব। মাফ করবেন, সে আমি পারব না।

চক্ৰধর রায় মাতব্বরিভাবে বলিল—ঐ তো আপনাদের দোষ, সিনেমার কিছুই বোঝেন না অথচ তর্ক করেন।

ইন্দু রায় তীক্ষ্ণ স্বরে বলিলেন—আপনি আমার চেয়ে সিনেমা বেশি বোঝেন তার কোনও প্রমাণ নেই।

আলোচনা ক্রমশ ঝগড়ায় পরিণত হইবার উপক্রম করিল। সোমনাথ বড় অস্বস্তি অনুভব করিতে লাগিল। শেষে রুস্তমজি তর্কে বাধা দিয়া বলিলেন—দেখুন ইন্দুবাবু, আপনি যা আপনার দিক থেকে বলছেন তা সত্যি হতে পারে কিন্তু সিনেমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখছি ড়ুয়েট না থাকলে ছবি চলে না।

ইন্দুবাবু বলিলেন-ড়ুয়েট থাকলেও অনেক সময় ছবি চলে না দেখা গেছে।

চক্রধর বলিল-সে অন্য কারণে, ছবি তৈরি করবার সময় আমাদের দেখতে হয় পাবলিক কি চায়। আমাদের দেশের পাবলিকের বুদ্ধি দশ বছরের ছেলের সমান। সেই হিসেব করে আমাদের ছবি তৈরি করতে হয়।

ইন্দুবাবু বলিলেন-পাবলিকের বুদ্ধি দশ বছরের ছেলের সমান এ বিশ্বাস যদি আমার থাকত, তাহলে আর কিছু না লিখে শিশুসাহিত্য লিখতাম এবং আপনাদেরও উচিত ছেলেভুলোনো রূপকথা নিয়ে ছবি তৈরি করা।

চক্রধর বলিল—ওসব বাজে কথা। আপনি গল্পের মধ্যে ড়ুয়েট রাখবেন কিনা বলুন। অন্তত দুটো ড়ুয়েট আমার চাই-ই।

ইন্দুবাবু রুস্তমজিকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন—দেখুন, গল্প আপনি কিনেছেন, গল্পের চিত্ৰস্বত্ব এখন আপনার। আপনার পাঁঠা আপনি ইচ্ছে করলে ল্যাজের দিকে কাটতে পারেন, আমার কিছু বলবার নেই; কিন্তু ও কাজ আমাকে দিয়ে হবে না। বলিয়া একরকম রাগ করিয়াই তিনি চলিয়া গেলেন।

চক্রধর কিছুক্ষণ ধরিয়া গল্প-লেখক সম্প্রদায়ের বুদ্ধিহীন একগুঁয়েমি সম্বন্ধে গজ গজ করিয়া শেষে বলিল—নতুন আইডিয়া গ্রহণ করবার ক্ষমতাই ওদের নেই। আমি মুন্সি বিস্মিল্লাকে ডেকে পাঠাচ্ছি, সে হুঁশিয়ার লোক, যা বলব তাই লিখে দেবে।

রুস্তমজি বলিলেন—তাই করতে হবে দেখছি। ইন্দুবাবু এমন অবুঝ লোক জানলে ওঁর গল্প আমি নিতাম না। যাহোক, হুটোপাটি করলে চলবে না, একটু ভেবে দেখি!

চক্ৰধর উঠিয়া গেলে রুস্তমজি সোমনাথকে বলিলেন—তুমি তো সব শুনলে। কি মনে হল?

সোমনাথ বলিল—গল্প না শুনে আমি কিছু বলতে পারি না।

রুস্তমজি বলিলেন—বেশ তো। গল্প এই রয়েছে, তুমি আজ বাড়ি নিয়ে যাও। ভাল করে পড়ে কাল এসে তোমার মতামত আমায় বলবে। তুমি যখন ছবির নায়ক, তখন তোমার মতটাও জানা ভাল।

টাইপ করা চিত্রনাট্যের ফাইল রুস্তমজি তাহাকে দিলেন। ফাইল লইয়া সোমনাথ বাড়ি গেল।

চিত্রনাট্যটি ইংরাজিতে লেখা, কারণ এখানে বাংলা কেহ বোঝে না। সংলাপগুলিও ইংরাজিতে, যথাসময় হিন্দীতে অনূদিত হইবে। তবু সোমনাথ পাঠ করিয়া মুগ্ধ হইয়া গেল। ইংরাজিতে লেখার জন্য ইন্দুবাবুর স্বভাবসিদ্ধ সাবলীলতা কিছু ক্ষুণ্ণ হইয়াছে বটে, কিন্তু আখ্যানবস্তু চমৎকার। একেবারে নূতন ধরনের গল্প। একটি বেকার যুবক কি করিয়া সংসারের সহিত যুদ্ধ করিয়া শেষে প্রতিষ্ঠা লাভ করিল এই লইয়া কাহিনী। প্রেমের কথাও আছে বটে কিন্তু তাহা অন্তঃসলিলা; কোথাও ছ্যাবলামি নাই, ড়ুয়েট গাহিয়া বা ভাঁড়ামি করিয়া নিম্নস্তরের রসসৃষ্টির চেষ্টা নাই; কিন্তু তবু পদে পদে ঘটনার সংঘাতে বহু বিচিত্র চরিত্রের সংঘর্ষে নাটকীয় রস জমাট বাঁধিয়া উঠিয়াছে।

পড়িয়া সোমনাথ উত্তেজিত হইয়া উঠিল। এই গল্প উহারা অদল বদল করিতে চান? ড়ুয়েট গান ঢুকাইয়া খেলো করিতে চায়? কখনই সে তাহা হইতে দিবে না। এজন্য রুস্তমজির সহিত ঝগড়া হইয়া যায় সেও ভাল।

পরদিন একটু সকাল-সকাল সোমনাথ স্টুডিওতে গেল। দেখিল, রুস্তমজি তখনও আসেন নাই বটে, কিন্তু ইন্দুবাবু আসিয়া বসিয়া আছেন। তাহাকে দেখিয়া ইন্দুবাবু বলিলেন—এই যে, কাল তো আপনি ছিলেন, সবই শুনেছেন। আজ আমি একটা হেস্তনেস্ত করব বলে এসেছি।

কিসের হেস্তনেস্ত?

আমি ভেবে দেখলাম, ওরা যদি অদল-বদল করতে চায় আমি গল্প দেব না। টাকা এনেছি, গল্প ফেরত নেব।

সোমনাথ বলিল—আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আগে আমি রুস্তমজির সঙ্গে দেখা করি, তারপর আপনি যা ইচ্ছে করবেন।

ইন্দুবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন—কেন?

সোমনাথ বলিল—আমি আপনার গল্প পড়েছি, আমার খুব ভাল লেগেছে। রুস্তমজি আমার মতামত জানবার জন্য গল্প আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করব যাতে গল্প অদল-বদল না হয়।

ইন্দুবাবু কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন—আপনি চেষ্টা করতে চান করুন, কিন্তু ভস্মে ঘি ঢালা হবে। ঐ ব্যাটা চক্রধর রায় চক্কর ধরে বসে আছে, কাছে গেলেই ছোবল মারবে।

দেখা যাক।

রুস্তমজির আসিতে দেরি হইতেছে, তাই দুজনে বসিয়া একথা সেকথা আলোচনা করিতে লাগিলেন। কথাপ্রসঙ্গে ইন্দুবাবু নিজের সিনেমাক্ষেত্রে আগমনের কাহিনী বলিলেন—কথায় বলে, খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল করলে এঁড়ে গরু কিনে। আমার হয়েছে তাই। বেশ ছিলাম সাহিত্য নিয়ে, হঠাৎ বোম্বাইয়ের এক নামজাদা ফিল্ম কোম্পানী ডেকে পাঠালো গল্প লেখার জন্যে। নাটকের দিকে আমার বরাবরই ঝোঁক—খুব মেতে উঠলাম। ভাবলাম এতদিনে একটা কাজের মত কাজ পেয়েছি; সিনেমা শিল্পকে উন্নত করে তুলব, ভদ্রলোকের পাতে দেবার যোগ্য করে তুলব। সব ছেড়ে দিয়ে বোম্বাই চলে এলাম। যে কোম্পানী আমাকে এনেছিল তাদের অবস্থা তখন টলমল করছে; পর পর চারখানি ছবি মার খেয়েছে, এবার মার খেলেই কোম্পানী লাটে উঠবে। প্রযোজক মহাশয়ের অবস্থা অতি করুণ। যাহোক, আমি তো গল্প লিখলাম। প্রযোজক মহাশয় অবশ্য গল্পটি সর্বাংশে পছন্দ করলেন না; কিন্তু বারবার ঘা খেয়ে তাঁর সারা গায়ে দরকচা, আমার গল্পে তিনি কলম চালাতে সাহস করলেন না। গল্প যেমন ছিল তেমনি ছবি হল।

ছবিখানি উৎরে গেল—রৈ রৈ করে চলতে লাগল। কোম্পানীও দাঁড়িয়ে গেল। ব্যস, আর যায় কোথায়। প্রযোজক মহাশয় মনে করলেন সব কৃতিত্ব তাঁরই। আশ্চর্য মানুষের আত্মপ্রতারণার ক্ষমতা। এতদিন যিনি কেঁচো হয়ে ছিলেন, তাঁর আর মাটিতে পা পড়ে না। আমার দ্বিতীয় গল্প তিনি কেটেকুটে একেবারে শতচ্ছিন্ন করে দিলেন।…লোকটি নির্বোধ নয়, বিষয়বুদ্ধি খুবই তীক্ষ্ণ; কিন্তু বিষয়বুদ্ধি আর সৃষ্টিপ্রতিভা যদি এক বস্তু হত তাহলে জগৎশেঠ জয়দেবের চেয়ে বড় কবি হতে পারত। ছবি যখন বেরুলো তখন লোকে আমাকেই গালাগালি দিতে লাগল। ছবি সাত দিনও চলল না। আমি রাগ করে চাকরি ছেড়ে দিলাম।

তারপর থেকে ফ্রি লান্সিং করছি, ছবির বাজারে গল্প বিক্রি করি; কিন্তু অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। যিনিই গল্প কিনুন, তিনিই চান গল্পকে মেরামত করতে। যাঁর রসবোধ যত কম, মেরামত করবার বাতিক তাঁর তত বেশী। অথচ ছবি খারাপ হলে—বেঁড়ে ব্যাটাকে ধর, সব দোষ গল্প-লেখকের। গত পাঁচ বছরে আমার সাতখানা গল্প ছবি হয়েছে, কিন্তু তাঁর একখানাও পাতে দেবার মত হয়নি। মেরামত করে সবাই আমার গল্পের দফারফা করে দিয়েছে।

একেই বলে চোরা গরুর দায়ে কপিলের বন্ধন; বাজারে বদনাম হয়ে যাচ্ছে—আমার গল্প চলে না। তাই ঠিক করেছি আর কাউকে গল্প বদলাতে দেব না। চুক্তিপত্রে শর্ত থাকবে-কেউ একটা কথা বদলাতে পারবে না। এতে আমার গল্প বিক্রি হয় ভাল, না হয় পাততাড়ি গুটিয়ে দেশে ফিরে যাব।

.

লাঞ্চের পর রুস্তমজি স্টুডিওতে আসিলেন। প্রবীণ ব্যবসায়ীদের মুখ দেখিয়া তাঁহার মনের অবস্থা বড় একটা ধরা যায় না; রুস্তমজির মেজাজ যে বিশেষ কোনও কারণে ভিতরে ভিতরে অগ্নিবৎ হইয়া আছে তাহাও কেহ লক্ষ্য করিল না। বিশেষ কারণটি সাধারণের অজ্ঞাত হইলেও বড়ই গুরুতর।

রুস্তমজি নিজের অফিস ঘরে প্রবেশ করিবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সোমনাথ গিয়া হাজির হইল, ফাইলটি তাঁহার সম্মুখে রাখিয়া বলিল—গল্প পড়েছি।

রুস্তমজির মন অন্য বিষয়ে ব্যাপৃত ছিল, তিনি মনকে জোর করিয়া টানিয়া আনিয়া ঈষৎ অপ্রসন্ন স্বরে বলিলেন—হুঁকি মনে হল?

সোমনাথ দৃঢ়ভাবে বলিল—চমৎকার গল্প। রুসিবাবা, এ গল্পে একটা কথা অদল বদল করা চলবে না।

এই সময় চক্রধর আসিয়া উপস্থিত হইল, মুখ বাঁকাইয়া বলিল—আপনি তো বলবেনই; আপনিও বাঙালী কিনা।

কথাটা এতই বর্বরোচিত যে সোমনাথ দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল; আরক্ত মুখে চক্রধরের দিকে তাকাইয়া বলিল—আপনাকে যখন প্রশ্ন করব তখন তার উত্তর দেবেন, Speak when you are spoken toএখন আমি রুসিবাবার সঙ্গে কথা বলছি।

চক্রধর এরূপ কড়া জবাবের জন্য প্রস্তুত ছিল না, সে ভ্যাবাচাকা খাইয়া গেল। সে এমন নিরেট অসভ্য যে আপত্তিকর কোনও কথা তাহার মুখ দিয়া বাহির হইয়াছে তাহা বুঝিবার শক্তিও তাহার। নাই।

কিন্তু রাগ জিনিসটা ছোঁয়াচে। রুস্তমজির মনের নিগৃহীত উষ্ম এই সূত্রে বাহির হইয়া আসিল, তিনি তিরিক্ষিভাবে বলিয়া উঠিলেন—সোমনাথ, তুমি অবুঝের মত কথা বলছ। লেখক যা লিখবে, তাই ছবি করতে হবে? তাহলে ছবি করবার কি দরকারবই বাঁধা দপ্তরীর কাজ করলেই হয়।

সোমনাথ মনের উত্তাপ দমন করিয়া বলিল—উপমাটা ভাল দিয়েছেন। চিত্র-প্রণেতার কাজ দপ্তরীর কাজের মতই, গল্পটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে দর্শকের সামনে হাজির করা—তার বেশি নয়।

চক্রধর গাল ফুলাইয়া বলিল—আমরা মাছি-মারা দপ্তরী নই। আমরা ছবি তৈরি করি, লেখক আমাদের মনের মত গল্প লিখে দেয়; এই এখানকার রেওয়াজ। লেখকদের আমরা আশকারা দিই না।

সোমনাথ রুস্তমজিকে বলিল—ইনি যাদের কথা বলছেন তারা লেখক নয়—তারা মুহুরী। ইন্দুবাবু মুহুরী নয়, তিনি প্রতিভাবান লেখক। তাঁর গল্প নষ্ট করবার অধিকার আমাদের নেই।

রুস্তমজি টেবিল চাপড়াইয়া বলিলেন—আলবৎ আছে। আমি গল্প কিনেছি—আমার যেমন ইচ্ছে যেখানে ইচ্ছে অদলবদল করব। কারুর কিছু বলবার নেই।

সোমনাথ গোঁ-ভরে বলিল—তাহলে সব নষ্ট হয়ে যাবে—ছবি একদিনও চলবে না।

রুস্তমজি আরক্ত-চোখে তাহার পানে চাহিয়া বলিলেন—আমি ত্রিশ বছর ছবি তৈরি করছি, পঞ্চাশটা ছবি করেছি। তুমি কালকের ছেলে আমাকে শেখাতে এসেছ কি করে ছবি তৈরি করতে হয়!

সোমনাথ এতক্ষণ অতি কষ্টে ধৈর্য ধারণ করিয়া ছিল, এবার আর পারিল না; সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল—আপনি পঞ্চাশটা ছবি করেছেন বটে কিন্তু কটা ভাল ছবি করেছেন?

রুস্তমজিও লাফাইয়া উঠিলেন—ভাল ছবি! আমার পঞ্চাশটা ছবিই ভাল। তুমি তার ভাল মন্দ কী বুঝবে সিনেমার কী জানো তুমি?

আমি অনেক কিছু জানি যা আপনারা জানেন না। আপনার পঞ্চাশটা ছবির মধ্যে পাঁচটিও ওত্রায় নি। তার কারণ কি জানেন? আপনি লেখকের ওপর কলম চালান, খোদার ওপর খোদকারি করেন চক্রধরের দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিল-এই সব অশিক্ষিত অপদার্থ লোকের পরামর্শে আপনি প্রতিভাবান লেখকের ওপর কলম চালাতে সাহস করেন।

রুস্তমজি বলিলেন—ব্যস্, যথেষ্ট হয়েছে। আমার ছবিতে আমি যা-ইচ্ছে করব—যার পছন্দ হবে সে কাজ করবে না।

সোমনাথ বলিল—সেই কথা আমিও বলতে যাচ্ছিলাম। আপনারা যদি গল্পে অদল বদল করেন আমি ছবিতে কাজ করব না।

কি—এ বড় কথা? যাও, আমার ছবিতে তোমাকে কাজ করতে দেব না। এখনি বিদেয় হও।

.

চার

কোথাকার জল কোথায় গড়াইল।

মাথা ঠাণ্ডা হইলে সোমনাথ বিবেচনা করিয়া দেখিল, এতটা বাড়াবাড়ি না হইলেই ভাল হইত বটে, কিন্তু নিজের ব্যবহারের জন্য লজ্জা বা অনুতাপ অনুভব করিবার কোনও হেতু নাই। সত্যের জন্য, ন্যায়ের পক্ষে সে লড়িয়াছে। ইহাতে তাহার যদি ক্ষতি হয় তা হোক।

ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা আর বিশেষ ছিল না। তাহার প্রথম ছবিতে সে দর্শকমণ্ডলীর চিত্ত হরণ করিয়া লইয়াছে; এখন যে-কোনও প্রযোজক তাহাকে লুফিয়া লইবে। সে রুস্তমজির কাজ ছাড়িয়া দিয়াছে একবার খবর পাইলে হয়।

তবু তাহার মনটা বিক্ষিপ্ত হইয়া রহিল। ঝগড়ঝাঁটি সে ভালবাসে না, অথচ অতর্কিতভাবে পরের ঝগড়া তাহার ঘাড়ে আসিয়া পড়িল। ইন্দুবাবুর সহিত পরে আর তাহার দেখা হয় নাই; তিনি হয়তো গল্প ফেরত লইয়াছেন। … রুস্তমজির সহিত এত শীঘ্র এমনভাবে ছড়াছাড়ি হইবে কে ভাবিয়াছিল; কিন্তু যেখানে চক্রধর আছে সেখানে ভদ্রলোকের থাকা অসম্ভব।… এই সময় পাণ্ডুরঙ থাকিলে শুধু সৎ পরামর্শই দিত না, তাহার সহিত কথা বলিয়া সোমনাথের মন অনেকটা হালকা হইত; কিন্তু পাণ্ডুরঙকে খুঁজিয়া বাহির করা দুঃসাধ্য কাজ। সে হয়তো আড্ডা দিতে বাহির হইয়াছে, কিম্বা কাজে গিয়াছে।

জামাইবাবু ও দিদি ইতিপূর্বে পুণা হইতে ফিরিয়াছিলেন, কিন্তু সোমনাথ তাঁহাদের কোনও কথা বলিল না। মিছামিছি তাঁহাদের উদ্বিগ্ন করিয়া লাভ নাই। একেবারে অন্য চাকরি যোগাড় করিয়া তাঁহাদের জানাইবে।

পরদিন সকালে সোমনাথ ব্যাঙ্কে গেল; সেখান হইতে এক হাজার টাকা বাহির করিয়া স্টুডিওতে উপস্থিত হইল।

আজ রুস্তমজি ঠিক সময়েই আসিয়াছেন। এত্তালা দিয়া সোমনাথ তাঁহার ঘরে প্রবেশ করিল।

একহাত কপালের উপর রাখিয়া রুস্তমজি নতমুখে টেবিলে বসিয়া আছেন; সোমনাথের সাড়া পাইয়াও তিনি মুখ তুলিলেন না। সোমনাথ একটু অপেক্ষা করিয়া গলঝাড়া দিয়া বলিল—আপনার টাকা এনেছি।

রুস্তমজি মুখ তুলিলেন। সোমনাথ দেখিল, তাঁহার গালের মাংস ঝুলিয়া গিয়াছে, মুখের ফরসা রঙ পাঙাস বর্ণ; ধূর্ত চক্ষুদুটির ধূর্ততা আর নাই, রাঙা টক্ করিতেছে। একদিনে মানুষের চেহারা এতখানি পরিবর্তিত হইতে পারে তাহা সোমনাথ কখনও দেখে নাই। সে থতমত খাইয়া গেল।

কিসের টাকা?

আপনি যে টাকা আগাম দিয়াছিলেন। রু

স্তমজি কিছুক্ষণ তাহার পানে তাকাইয়া থাকিয়া বলিলেন—বোসো, তোমার সঙ্গে কথা আছে।–না, আগে দরজা বন্ধ করে দাও।

দ্বার বন্ধ করিয়া সোমনাথ রুস্তমজির সম্মুখে বসিল। রুস্তমজি আরও কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন—কাল সারা রাত্রি ঘুমোইনি, স্রেফ মদ টেনেছি।

সোমনাথ কি বলিবে খুঁজিয়া পাইল না। একটা বিষম দুর্বিপাক ঘনাইয়া উঠিয়াছে সন্দেহ নাই। সে নীরবে প্রতীক্ষা করিয়া রহিল।

–কাল তুমি রাগ করে চলে যাবার পর ইন্দুবাবু এলেন। তিনি তাঁর গল্প ফেরত চাইলেন। আমি বললাম—দেব না গল্প, আমি কিনেছি, গল্প আমার। তিনিও রাগারাগি করে চলে গেলেন।

সোমনাথ কুণ্ঠিত স্বরে বলিল—কিন্তু—

হঠাৎ রুস্তমজির স্বর ভাঙিয়া গেল, তিনি বলিয়া উঠিলেন—আমি ড়ুবতে বসেছি, আমার মাথার ওপর খাঁড়া ঝুলছে, আর এই সময় তোমরা আমায় ফেলে পালাচ্ছ! কিন্তু তুমি সব কথা জানো না, তোমাকেও দোষ দেওয়া অন্যায়। সোমনাথ, আমি তোমাকে স্নেহ করি, তাই যে কথা কাউকে বলিনি তাই আজ তোমাকে বলছি—শোন।

নিজেকে একটু সামলাইয়া লইয়া তিনি বলিতে আরম্ভ করিলেন—আমার স্ত্রী পুত্র নেই। স্ত্রী অনেক দিন গেছেন; ছেলেটা ছিল, সেও মদ খেয়ে বদ খেয়ালি করে মরেছে। তাদের জন্যে আমার দুঃখ নেই; কিন্তু এই স্টুডিও আমার প্রাণ-আমার যক্ষের ধন। এ যদি যায়, আমি এক দিনও বাঁচব না।

তুমি কাল বলেছিলে আমি অনেক ছবি করেছি বটে কিন্তু ভাল ছবি একটাও করিনি। তোমার কথা মিথ্যে নয়। ভাল ছবি করবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। প্রথম প্রথম দুএকটা ছবি কিছু পয়সা দিয়েছিল সেই পয়সায় এই স্টুডিও কিনেছিলাম। তারপর থেকে যত ছবি করেছি সব দুকুড়ি সাত—কোনমতে খরচ উঠেছে, তার বেশী নয়।

এইভাবে চলছিল, কিন্তু গত তিনটে ছবিতে খরচ ওঠেনি। এখন এমন অবস্থা হয়েছে, নতুন ছবি করবার পয়সা নেই। বাইরে চাকচিক্য বজায় রেখেছি, কিন্তু ভেতরটা একেবারে ফোঁজা হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় এসে ঠেকেছি যে স্টুডিও বাঁধা রেখে নতুন ছবি তৈরি করতে হবে। বুঝতে পারছ ব্যাপার? এবার যদি ছবি না ওত্রায় আমি ধনে-প্রাণে গেলাম।

বাইরে বুঝতে দিই না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমার অবস্থা পাগলের মত হয়েছে। কী করে ভাল ছবি তৈরি করব? কী করে মান-ইজ্জত বাঁচাব? আমি জানি—সত্যিকার ভাল ছবি তৈরি করবার ক্ষমতা আমার নেই, পঞ্চাশটা ছবি করে আমি তা বুঝতে পেরেছি। তবু ছবি তৈরি করতে আমি ভালবাসি, ওছাড়া অন্য কাজও কিছু জানি না—ছবি তৈরি করা আর বেঁচে থাকা আমার কাছে সমান।

আমি মুখ, লেখাপড়া শিখিনি, সত্যিকার ভাল নাটক কাকে বলে তা আমি জানি না। ত্রিশ বছর আগে যখন একাজ আরম্ভ করেছিলাম তখন সকলেই আমার মত ছিল, সবাই বেঁড়ে ওস্তাদ, না-পড়ে পণ্ডিত; কিন্তু আজকাল সিনেমায় ভাল লোক আসছে, ভাল ছবি দিচ্ছে, দর্শকদের রুচির উন্নতি হচ্ছে। এখন আমার ছবি কেউ চায় না।

চক্রধরকে নিয়েছিলাম। আশা করেছিলাম ও হয়তো ভাল ছবি দিতে পারবে, কিন্তু দুটো ছবি যা তৈরি করেছে তাতেই বুঝতে পেরেছি, ও একটা windbag, একটা ধোঁয়ায়-ভরা ফানুস। ওর দ্বারা কোনও কালে ভাল ছবি হবে না!

কাল আমি স্টুডিও বন্ধক রেখে আড়াই লাখ টাকা নিয়েছি, এই আমার শেষ পুঁজি। এখন এ ছবি যদি ভাল না হয় তাহলে আমার স্টুডিও লাটে উঠবে। তোমরাই বলে দাও, আমি কী করে ভাল ছবি তৈরি করব! ইন্দুবাবু ভাল গল্প লেখেন, তাঁর গল্প নিয়েছি। তুমি ভাল আর্টিস্ট, তোমাকে নিয়েছি। আর কি করব বল? টাকা খরচের ত্রুটি করব না, কিন্তু ভাল ছবি হবে কি?

এই দীর্ঘ আত্মকথা শুনিয়া সোমনাথ বুঝিল রুস্তমজির মানসিক অবস্থা এখন কোথায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। তিনি যে কাল এত সহজে ধৈর্য হারাইয়াছিলেন তার কারণও সে বুঝিতে পারিল।

অনেকক্ষণ নীরবে চিন্তা করিয়া সে বলিল—রুসিবাবা, আমি একটা কথা বলব, আপনি শুনবেন?

রুস্তমজি বলিলেন—শুনব। তোমার কথা শুনব বলেই তো এত কথা তোমাকে বললাম।

আমার ওপর আপনি এ ছবি তৈরি করার ভার ছেড়ে দিন।

তোমার ওপর?

হ্যাঁ আমার ওপর। আমি টেকনিক কিছুই জানি না, কিন্তু সেজন্যে আটকাবে না। যে গল্প আমরা পেয়েছি, আমার বিশ্বাস আমরা ভাল ছবি তৈরি করবে পারব।

রুস্তমজি টেবিলের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া আরক্ত চক্ষু সোমনাথের মুখের উপর স্থাপন করিলেন—ছবি ওত্রাবে এ জামিন তুমি দিচ্ছ?

মাথা নাড়িয়া সোমনাথ বলিল—না। ছবি ওত্রাবে এ জামিন ভগবানও দিতে পারেন না। তবে ছবি ভাল হবে এ জামিন দিচ্ছি। রুসিবাবা, আমি নাটক লিখতে জানি না বটে, কিন্তু ভাল নাটক দেখলে চিনতে পারি। এ নাটক যত্ন করে তৈরি করতে পারলে এমন জিনিস হবে যা আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষে হয়নি।

রুস্তমজি দীর্ঘকাল দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া রহিলেন, তারপর উঠিয়া আসিয়া সোমনাথের কাঁধের উপর হাত রাখিলেন; বলিলেন—সোমনাথ, তুমিই ছবি কর। তোমার সিতারা এখন বুলন্দু, হয়তো লেগে যেতে পারে। সিনেমা মানেই তো জুয়া খেলা লাগে তা না লাগে তুক। যা হবার হবে, আর ভাবতে পারি না। আমার ভাবনার ভার তুমি নাও। সোমনাথ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল—সব ভার আমি নেব। কিন্তু চক্রধর?

ওটাকে আজই দূর করে দিচ্ছি। তোমার যাকে পছন্দ তুমি নাও, গল্প যেমন ইচ্ছে রাখো; কেউ তোমার কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। আমার শুধু ভাল ছবি চাই।

সোমনাথ আবার ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িল। এতক্ষণ সে মনে বেশ দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় অনুভব করিতেছিল, এখন দায়িত্ব ঘাড়ে লইবার পর সহসা তাহার মনে হইল সে একান্ত অসহায়। বিরাট পর্বতপ্রমাণ কাজের ভার সে ঘাড়ে তুলিয়া লইয়াছে অথচ এ কাজের বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা তাহার নাই, একজন নির্ভরযোগ্য সহকারী পর্যন্ত নাই। সিনেমা জগতে কাজের লোক কাহাকেও সে চেনে না। এত বড় কাজ হাতে লইয়া শেষে কি ভরা-ড়ুবি করিবে! ভয়ে তাহার বুক কাঁপিয়া উঠিল!

রুস্তমজি বলিলেন-কি ভাবছ? তোমার বর্তমান কন্ট্রাক্ট অবশ্য থাকবে না, নতুন কন্ট্রাক্ট হবে। তুমি যা চাও তাই দেব।

সোমনাথ বলিল—না, আমার আর কিছু চাই না, যা দিচ্ছেন তাই যথেষ্ট।

রুস্তমজি বলিলেন—তা হতে পারে না। নতুন কনট্রাক্টে তুমি এখন যা পাচ্ছ তাই পাবে, উপরন্তু ছবি থেকে যদি লাভ হয়, লাভের অর্ধেক তোমার। কেমন রাজি?

সোমনাথ বলিল—রুসিবাবা, নিজের কথা আমি ভাবছি না। আপনার যা ইচ্ছে দেবেন, আমার কোনও দাবি নেই। আমি ভাবছি

এই সময় তাহার অনুক্ত ভাবনার উত্তর স্বরূপ দ্বারে টোকা পড়িল। রুস্তমজি দ্বার খুলিয়া দিলেন।

পাণ্ডুরঙ ঘরে প্রবেশ করিল। তাহার একটু ব্যস্তসমস্ত ভাব।-হুজুর, গোস্তাকি মাফ করবেন। ফাউন্টেন পেনের সঙ্গে ঝগড়া করে চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। চন্দনা দেবীর হাঁড়ি হাটের মাঝখানে ভেঙে দিয়ে এসেছি। এবার আমার একটা ব্যবস্থা করুন।

রুস্তমজি হাসিয়া বলিলেন—আমি কিছু পারব না। তোমাকে যে চাকরি দিতে পারে সে ঐ। বলিয়া সোমনাথকে দেখাইলেন।

সোমনাথ ছুটিয়া আসিয়া পাণ্ডুরঙকে জড়াইয়া ধরিল, বলিল—পাণ্ডু, তুমি এসেছ! বাঁচলাম।

. সেদিন অপরাহে নূতন চুক্তিপত্র সোমনাথের দ্বারা সহি করাইতে আসিয়া দিগম্বর শম্ভুলিঙ্গ বলিলেন—আপনার কপাল বটে—এবেলা ওবেলা উন্নতি। আর আমি এগারো বছর ধরে বলিয়া তিন্তিড়ীর ন্যায় অম্ল করুণ হাসিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *