৩. মন্দাক্রান্তা

মন্দাক্রান্তা
তৃতীয় পরিচ্ছেদ

এক

তোড়জোড় করিয়া ছবি আরম্ভ করিতে বর্ষা নামিল।

বোম্বাই বর্ষা—একেবারে চাতুর্মাস্য। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষাশেষি হঠাৎ একদিন মেঘগুলা পশ্চিমের সমুদ্র হইতে আরব্য উপন্যাসের জিনের মত উঠিয়া আসে এবং কয়েকদিন ঘোরাফেরা করিয়া বর্ষণের কিছু নমুনা দিয়া চলিয়া যায়। অতঃপর দিন দশেক পরে তাহারা দলে দলে পালে পালে ফিরিয়া আসিয়া সেই যে আসর জমকাইয়া বসে তখন তিন মাসের মধ্যে আর সূর্যের মুখ দেখিবার উপায় থাকে না। দিনগুলাকে তখন রাত্রির কনিষ্ঠ ভ্রাতা বলিয়া মনে হয় এবং জল ও স্থলের প্রভেদ এতই অকিঞ্চিত্বর হইয়া যায় যে মানুষগুলাকে জলচর জীব বলিয়া মানিয়া লইতে আর কোনই কষ্ট হয় না।

কবি বলিয়াছেন—এমন দিনে তারে বলা যায়। কবির কথা মিথ্যা নয়, উপযুক্ত পাত্রপাত্রী পাইলে নিশ্চয় বলা যায়; একবার নয়, বারবার বলা যায়, ঘুরিয়া ফিরিয়া মন্দাক্রান্তা ছন্দে ইনাইয়া বিনাইয়া বলা যায়; কিন্তু বলা ছাড়া আর কোনও উদ্যমসাপেক্ষ কাজ করিবার ইচ্ছা বোধকরি কাহারও মনে। উদয় হয় না। দেহ মনের এমন একটি আলস্যমন্থর জড়তা উপস্থিত হয় যে কবির শরণাপন্ন না হইয়াও বলিতে ইচ্ছা করে সমাজ সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলরব।

এই তো গেল আটপৌরে ব্যবস্থা। তার উপর মাঝে মাঝে যখন সাইক্লোন আসিয়া উপস্থিত হয়। তখন বর্ষার ঢিলা আসর এক মুহূর্তে জমাট বাঁধিয়া যায়। তখন মেঘের সঙ্গে পাল্লা দিয়া বাতাস চৌদুনে ছুটিতে থাকে, দিগঙ্গনার নৃত্যে সভাতল আলোড়িত হইয়া ওঠে এবং আকাশের মৃদঙ্গ হইতে যে বো উত্থিত হইতে থাকে তাহাকে কোনও মতেই ধামার বা দশকুশীর সঙ্গে তুলনা করা চলে না।

কিন্তু ইহা যেমন আকস্মিক তেমনি ক্ষণিক। আবার ধীরে ধীরে সভা ঝিমাইয়া পড়ে; ঝিল্লীরব শোনা যায়; কেতকীর গন্ধবিমূঢ় বাতাস নেশায় ঝিম্ হইয়া থাকে।

এদিকে পৃথিবী ঘুরিতেছে; জড় জগতে অণু পরমাণুও চুপ করিয়া বসিয়া নাই। সুতরাং মানুষকেও কিছু-না-কিছু করিতে হয়। কিন্তু সব কাজই মন্দাক্রান্তা ছন্দে বাঁধা, গুরুগম্ভীর মন্থরতায় আরম্ভ হইয়া কিছুক্ষণ অপেক্ষাকৃত দ্রুত লয়ে চলিবার পর আবার শিথিল হইয়া এলাইয়া পড়ে। পিঙ্গল বিহ্বল ব্যথিত নভতল—

যাহোক, সোমনাথের কাজ একরকম ভালই চলিতেছিল। তাহার নূতন কাজে হাতেখড়ি, তাই সে আটঘাট বাঁধিয়া কাজে নামিয়াছিল। পাণ্ডুরঙের সহিত সকল বিষয় পরামর্শ করিয়া সে কাজ করিত, পাণ্ডুরঙ ছিল তার দক্ষিণ হস্ত। তা ছাড়া ইন্দুবাবু প্রায়ই সেটে আসিয়া বসিতেন এবং কালোপযোগী উপদেশ দিয়া তাহাকে সাহায্য করিতেন। রুস্তমজি কদাচিৎ আসিয়া বসিতেন এবং নীরবে তাহাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করিতেন। রুস্তমজির একটি মহৎ গুণ ছিল, একবার যাহার হাতে কার্যভার অর্পণ করিয়াছেন তাহার কার্যে আর হস্তক্ষেপ করিতেন না।

সোমনাথ মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, এবার ছবির খরচ সে কিছুতেই দেড় লক্ষ টাকার উপর উঠিতে দিবে না। রুস্তমজি অবশ্য আড়াই লক্ষ পর্যন্ত খরচ করিতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু সোমনাথ লক্ষ্য করিয়াছিল, ছবি নির্মাণ ব্যাপারে অনেক অনাবশ্যক খরচ হয়, অনেক টাকা—ন দেবায় ন ধর্মায়যায়। এবার সে কিছুতেই তাহা ঘটিতে দিবে না। তাহার ছবি ভাল হইবে এ বিশ্বাস তাহার ছিল; কিন্তু ভাল হইলেই ছবি চলিবে এমন কোনও কথা নাই। তাই খরচ যদি কম হয় তাহা হইলে লোকসানের সম্ভাবনা অনেক কমিয়া যায়। লাভ যদি নাও হয়, অন্তত খরচটা উঠিয়া আসিতে পারে।

অত্যন্ত সতর্কভাবে সদা শঙ্কিতচিত্তে সোমনাথ কাজ করিয়া চলিল। মাঝে মাঝে ভগবানের কাছে অতি সঙ্গোপনে প্রার্থনা জানাইতে লাগিল—হে ভগবান, আমি অতি অধম, কিন্তু যদি এতবড় সুযোগটা দিয়াছ, মাথায় পা দিয়া ড়ুবাইয়া দিও না।

এদিকে সোমনাথের পারিবারিক পরিস্থিতিতেও কিছু পরিবর্তন ঘটিয়াছিল। আষাঢ় মাসের শেষের দিকে জামাইবাবু হঠাৎ পুণায় বদলি হইলেন; ঘোর বর্ষার মধ্যে তিনি দিদিকে লইয়া চলিয়া গেলেন; কিন্তু বাড়িখানা ছাড়া হইল না। কারণ জামাইবাবুর আবার শীঘ্রই ফিরিয়া আসিবার সম্ভাবনা আছে, তাছাড়া সোমনাথের একটা আস্তানা চাই। সোমনাথ ভরা ভাদরে শূন্য মন্দিরে পড়িয়া রহিল।

মাঝে মাঝে পাণ্ডুরঙ আসিয়া তাহার বাসায় রাত্রিবাস করিয়া যাইত। দুই বন্ধু একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করিয়া অনেক রাত্রি পর্যন্ত ছবির কথা আলোচনা করিতে করিতে ঘুমাইয়া পড়িত। তারপর সকালবেলা আবার একসঙ্গে কাজে বাহির হইত। রুস্তমজি সোমনাথকে একটি দ্বিতীয় পক্ষের মোটর কিনাইয়া দিয়াছিলেন। পুরাতন হইলেও গাড়িটি বেশ কর্মক্ষম, এই ভরা বর্ষার মরসুমে ভারি কাজে লাগিতেছিল।

এই সময় সোমনাথের আর একটি উপসর্গ জুটিয়াছিল। এতদিন তাহার জীবনে চিঠি লেখালিখির কোনও পাট ছিল না; এখন চারিদিক হইতে তাহার কাছে চিঠি আসিতে আরম্ভ করিল। অধিকাংশ পত্ৰলেখকই অচেনা, কিন্তু দুচারজন পরিচিত ব্যক্তিও আছেন। সোমনাথ বুঝিল তাহার প্রথম চিত্র সাধারণে প্রকাশ হইবার সঙ্গে সঙ্গে আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষে তাহার কীর্তি ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছে।

অপরিচিত পত্র-লেখকগণতাঁহাদের মধ্যে তরুণীর সংখ্যা কম নয়—কেবল অনুরাগ ব্যক্ত করিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছেন; কিন্তু যাঁহারা পরিচিত তাঁহারা আবার আর একটু দূরে গিয়াছেন। লক্ষ্ণৌ ও কলিকাতায় সোমনাথের পরিচিত ব্যক্তির অভাব ছিল না, এতদিন তাঁহারা তাহার খোঁজখবর লওয়া প্রয়োজন বোধ করেন নাই; কিন্তু এখন কোনও অলৌকিক উপায়ে তাহার ঠিকানা আবিষ্কার করিয়া তাঁহারা পত্রাঘাত করিতে শুরু করিলেন। তাঁহাদের সহৃদয়তা ছাপাইয়া একটি ইঙ্গিত কিন্তু খুবই স্পষ্ট হইয়া উঠিল; সুযোগ ও সুবিধা পাইলে তাঁহারাও সিনেমায় যোগ দিয়া অবিনশ্বর কীর্তি অর্জন করিতে প্রস্তুত আছেন। একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোকের আগ্রহই সবচেয়ে বেশী। তিনি সোমনাথের কলিকাতাস্থ ব্যাঙ্কের একজন কেরানী, শীঘ্রই কর্ম হইতে অবসর গ্রহণ করিবেন। যৌবনকালে তিনি সখের থিয়েটার করিতেন; এই ওজুহাতে তিনি সোমনাথকে ধরিয়া পড়িয়াছেন, কর্ম হইতে অবসর গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে যেন সোমনাথ তাঁহাকে সিনেমায় টানিয়া লয়। ভদ্রলোক একেবারে নাছোড়বান্দা।

এই সব অপ্রত্যাশিত পত্ৰবৃষ্টির ফলে সোমনাথ প্রথমটা কিছু সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিয়াছিল, ক্রমে পাণ্ডুরঙের উপদেশ পাইয়া ধাতস্থ হইল। পাণ্ডুরঙ বলিল—সিনেমায় সিদ্ধিলাভের ইহা একটি অনিবার্য পরিণাম এবং মানসিক শান্তি বজায় রাখিতে হইলে পত্রগুলির উত্তর না দেওয়াই সমীচীন। চিঠি লেখার অভ্যাস সোমনাথের কোনকালেই ছিল না, সে পরম আগ্রহের সহিত পাণ্ডুরঙের সারগর্ভ উপদেশ গ্রহণ করিল।

কেবল একখানি চিঠি পড়িয়া সোমনাথ কিছু বিমনা হইল। কলিকাতা হইতে তাহার এক সমবয়স্ক বন্ধু লিখিয়াছে, বন্ধুটি আবার দূর সম্পর্কে জামাইবাবুর আত্মীয় হয়। বেচারা স্কুলের শিক্ষক, চিত্রাভিনেতা সাজিবার দুরভিসন্ধি তাহার নাই; নিতান্তই বন্ধুপ্রীতির বশবর্তী হইয়া চিঠি লিখিয়াছে। চিঠিখানি অংশত এইরূপ—

—ছবিটা চমৎকার হয়েছে; কলকাতার তোক হুমড়ি খেয়ে দেখছে। চন্দনা দেবীর ছবি অবশ্য জনপ্রিয় হয়, কিন্তু হিন্দী ছবি বাঙালীরা বেশী দেখে না। এবার বাঙালীরাও দেখছে। তার কারণ বোধ হয় এই যে, তুমি বাঙালী এবং তোমার অভিনয় সুন্দর হয়েছে। ছবিখানা বার তিনেক দেখেছি।

একটা খবর দিই। যে তিন দিন আমি তোমার ছবি দেখতে গিয়েছিলাম সেই তিনদিনই রত্নাকে সিনেমায় দেখলাম; সেও ছবি দেখতে গিয়েছিল। রত্না সিনেমা পছন্দ করে না জানতাম। ব্যাপার কি? শুনলাম কিছুদিন আগে সে বোম্বাই গিয়েছিল। এর ভেতরে কোনও নতুন তত্ত্ব আছে নাকি? যদি থাকে, ইতর জনের দাবি এখন থেকে জানিয়ে রাখছি–

বন্ধুসুলভ চটুলতা বাদ দিয়া খবরটা দাঁড়ায় রত্না তিনবার তাহার ছবি দেখিতে গিয়াছিল; তিনবারের বেশীও হইতে পারে। এখন প্রশ্ন এই, কেন গিয়াছিল? খুব বেশী ভাল না লাগিলে একই ছবি কেহ তিনবার দেখে না। রত্না স্বভাবতই সিনেমার প্রতি বিরূপ; তার উপর সম্প্রতি বোম্বাইয়ে। যে ঘটনা ঘটিয়াছিল, তাহার ফলে সে সহসা সিনেমার অনুরাগিণী হইয়া পড়িবে এরূপ মনে করাও কঠিন। সোমনাথের প্রতি তাহার মন সদয় নয়। তবে, যে ছবিতে সোমনাথ নায়কের ভূমিকায়। অবতীর্ণ হইয়াছে সে ছবি বারবার দেখিবার অর্থ কি? ছবিতে এমন কী অনিবার্য আকর্ষণ আছে যে রত্না না দেখিয়া থাকিতে পারিতেছে না?

অনেক চিন্তা করিয়া সোমনাথ একটি সুদীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিল। পর-চিত্ত অন্ধকার; উপরন্তু রমণীর মন চিরদিনই গভীর রহস্যে আবৃত। সোমনাথ বিমর্ষচিত্তে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইল যে, রত্নার ছবি দেখার কার্যকারণ সম্বন্ধ আবিষ্কার করা তাহার কর্ম নয়।

.

দুই

কয়েকদিন ধরিয়া কোলাবার আবহ-মন্দির হইতে ভবিষ্যদ্বাণী হইতে ছিল—আরব সাগরের বায়ুমণ্ডলে সাম্য নষ্ট হইয়াছে, সুতরাং শীঘ্রই একটা ঝড়ঝাপ্টা আশা করা যাইতে পারে। এইরূপ ভবিষ্যদবাণী নিয়মিত আবহ-মন্দির হইতে বাহির হইয়া থাকে এবং সংবাদপত্রে ছাপা নয়; কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও ভবিষ্যদ্বাণী সফল হইয়াছে এরূপ নজির না থাকায় কেহই উহা গ্রাহ্য করে না।

যাহোক, ঝড়ে কাক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে। আবহতা তিন দিনের বাসি হইয়া যাইবার পর একদিন অপরাত্নের দিকে একটা এলোমেলো বাতাস উঠিল। বৃষ্টি সারাদিন ধরিয়াই পড়িতেছিল, এখন যেন আর একটু চাপিয়া আসিল। ক্রমে যতই সন্ধ্যা হইতে লাগিল ততই অলক্ষিতে বায়ুর বেগ বাড়িয়া চলিল।

সারাদিন স্টুডিওতে সোমনাথের শূটিং ছিল। সন্ধ্যা ছটার সময় কাজ শেষ করিয়া সে বাহির হইল। পাণ্ডুরঙকে বলিল—চল, আজ রাত্রে আমার বাসায় থাকবে।

পাণ্ডুরঙ বলিল—উহুঁ। আকাশের গতিক ভাল নয়, রাত্রে সাইক্লোন দাঁড়াতে পারে। আমার বৌটা খাণ্ডার, আজ রাত্রে যদি বাড়ি না ফিরি কাল আর আমাকে আস্ত রাখবে না। সোমনাথ বলিল—বেশ, চল তাহলে তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে যাই।

পাণ্ডুরঙকে বাসায় পৌঁছাইয়া সোমনাথ যখন নিজের বাসায় ফিরিল তখন দিনের আলো আর কিছুমাত্র অবশিষ্ট নাই। বায়ুর বেগ আর একটু বাড়িয়াছে। রাস্তায় গাড়ি ও মানুষের চলাচল অনেক কমিয়া গিয়াছে। কেবল রাস্তার আলোকস্তম্ভগুলি অসহায়ভাবে দাঁড়াইয়া ধারাস্নান করিতেছে।

গ্যারাজে মোটর বন্ধ করিয়া সোমনাথ তাড়াতাড়ি বাড়ির বারান্দায় আসিয়া উঠিল। বারান্দা অন্ধকার; জলের ছাট আসিয়া মেঝে ভিজাইয়া দিতেছে। সদর দরজার তালা বন্ধ ছিল; সোমনাথ পকেট হইতে চাবি বাহির করিয়া সন্তর্পণে দ্বারের দিকে অগ্রসর হইল।

তালা খুলিয়া সে ঘরে প্রবেশ করিতে যাইবে এমন সময় স্ত্রীকণ্ঠের আওয়াজ আসিল—সোমনাথবাবু!

সোমনাথ চমকিয়া উঠিল। এতক্ষণে তাহার চক্ষু অন্ধকারে অভ্যস্ত হইয়াছিল; রাস্তা হইতে আলোর একটা ক্ষীণ আভাও আসিতেছিল। সোমনাথ চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া দেখিল, দ্বারের অনতিদূরে বারান্দার দেয়াল ঘেঁষিয়া একটি স্ত্রীলোক সুটকেসের উপর বসিয়া আছে। তাহার পাশে বর্ষাতি হোলঅলের মত একটা কিছু পড়িয়া রহিয়াছে।

সোমনাথ শঙ্কিত কণ্ঠে বলিল—কে?

স্ত্রী মূর্তি উঠিয়া দাঁড়াইল—আমি রত্না।

মুহূর্তের জন্য সোমনাথের মাথাটা একেবারে খালি হইয়া গেল, তাহার মুখ দিয়া কেবল বাহির হইল—রত্না!

অন্ধকারের রত্নার মুখ দেখা গেল না, কিন্তু তাহার কণ্ঠের তীক্ষ্ণ অধীরতা গোপন রহিল —হ্যাঁ। ব্যাপার কি? দাদা-বৌদি কোথায়?

সোমনাথের মস্তিষ্ক আবার ইঞ্জিনের বেগে কাজ করিতে আরম্ভ করিল। সে দ্বার ঠেলিয়া ভিতরে ঢুকিয়া তাড়াতাড়ি কয়েকটা সুইচ টিপিয়া ঘরের ও বারান্দার আলো জ্বালিয়া দিল। তারপর আবার বারান্দায় বাহির হইয়া আসিল।

রত্নার কাপড়-চোপড় বৃষ্টির ছাটে ভিজিয়া গিয়াছে; কিন্তু তাহার মুখ কঠিন, চোখের দৃষ্টিতে শুষ্ক বিরক্তি। ক্ষিপ্র চক্ষে একবার সোমনাথের আপাদমস্তক দেখিয়া লইয়া সে বলিল—দাদা বৌদি কোথায়?

সোমনাথ দুই হাতে রত্নার সুটকেস ও বিছানা তুলিয়া বলিল-বলছি, আগে ভেতরে এস! একেবারে ভিজে গেছ যে। কতক্ষণ এসে বসে আছো?

উভয়ে ঘরে প্রবেশ করিল। রত্না বলিল—তিনটের সময় ট্রেন এসেছে; বাড়ি পৌঁছুতে চারটে বেজেছে। তারপর থেকেই বসে আছি।

কি সর্বনাশ! তিন ঘণ্টা বাইরে বসে আছ?—সোমনাথ লটবহর এক পাশে নামাইয়া রাখিল।

হ্যাঁ; কিন্তু দাদা বৌদি কি বোম্বাইয়ে নেই?

জামাইবাবু আজ দশ দিন হল পুণায় বদলি হয়ে গেছেন। কেন, তোমরা খবর পাওনি?

রত্ন কিছুক্ষণ উৎকণ্ঠা ভরা চোখে সোমনাথের মুখের পানে চাহিয়া রহিল, তারপর আস্তে আস্তে বলিল-না, আমি খবর পাইনি। আমি কলকাতায় ছিলাম না, এলাহাবাদে এক বন্ধুর কাছে বেড়াতে এসেছিলাম। সেখান থেকে আসছি।–তাহলে এখন তুমি একা বাড়িতে আছ?

সোমনাথ বলিল–হ্যাঁ।

নতমুখে ক্ষণিক চিন্তা করিয়া রত্না মুখ তুলিল—বাড়িতে চাকরবাকরও কি নেই?

সোমনাথ বলিল—চাকরবাকর? হ্যাঁ আছে বৈকি। একটা চাকর আর বামুন আছে। আমি সকালবেলাই বেরিয়ে যাই, তারাও খেয়ে-দেয়ে দুপুরবেলা বেরোয়; কিন্তু সন্ধ্যের আগেই ফিরে আসে। আজ কি জানি এখনও ফেরেনি। ওঃ-মনে পড়েছে–

কী?

আজ সকালে ওরা দুজনে যোগেশ্বরীর গুহা দেখতে যাবে বলে ছুটি চেয়েছিল, সেখানে নাকি কোন্ সাধু এসেছেন। যোগেশ্বরী বেশী দূরে নয়, কিন্তু ট্রেনে যেতে হয়। হয়তো ঝড় বাদলে আটকে পড়েছে।

বেশ যা হোক। এখন আমি কি করি? বলিয়া রত্না একটা চেয়ারে বসিয়া পড়িল।

সোমনাথ একটু ইতস্তত করিয়া বলিল—আপাতত ভিজে কাপড়-চোপড়গুলো ছেড়ে ফেলতে পারো।

বিরক্তিকণ্টকিত কণ্ঠে রত্না বলিল—তা যেন পারি; কিন্তু আজ রাত্রে আমি থাকব কোথায়?

সোমনাথ কিছুক্ষণ রত্নার পানে চাহিয়া রহিল, তারপর প্রশ্ন করিল—এ বাড়িতে থাকা কি চলবে না?

রত্না উত্তর দিল না, গালে হাত দিয়া বসিয়া রহিল। এমন মুশকিলে সে জীবনে পড়ে নাই।

সদর দরজাটা এতক্ষণ খোলাই ছিল, হাওয়ার দাপটে কপাট দুটা বারবার আছাড় খাইতেছিল। সোমনাথ গিয়া কপাট বন্ধ করিয়া দিল। সে ফিরিয়া আসিয়া দাঁড়াইলে রত্না মুখ তুলিল–আজ রাত্রে পুণার ট্রেন পাওয়া যায় না?—পুণা তো কাছেই।

সোমনাথ ধীরে ধীরে একটা চেয়ারে বসিল, নীরস কণ্ঠে বলিল—পুণা এখান থেকে একশো কুড়ি মাইল। ট্রেন যদি বা পাওয়া যায়, পৌঁছতে রাত দুপুর হবে। জামাইবাবুর ঠিকানা তোমায় দিতে পারি, কিন্তু এই ঝড়ের রাত্রে বাড়ি খুঁজে পাবে কিনা সন্দেহ। স্টেশনের ওয়েটিং রুমে রাত কাটাতে হবে। তোমার যদি তাতেই সুবিধে হয়—

রত্না নিশ্বাস ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল—কাল সকালেই যাব তাহলে কি শুভক্ষণেই বোম্বাইয়ে পা দিয়েছিলাম। বলিয়া নিজের সুটকেসটা তুলিয়া লইয়া স্নানঘরের অভিমুখে চলিয়া গেল।

সোমনাথ আরও কিছুক্ষণ বসিয়া রহিল। তারপর সেও একটা নিশ্বাস ফেলিয়া উঠিয়া পড়িল। বাড়িতে অতিথি, চুপ করিয়া বসিয়া থাকিলে চলিবে না।

আজ বারান্দায় রত্নাকে চিনিতে পারিয়া ক্ষণকালের জন্য সোমনাথের মস্তিষ্কের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া গিয়াছিল; তারপর বাঁধভাঙা স্রোতের মত তাহার মনের মধ্যে অহেতুক আনন্দের বন্যা বহিয়া গিয়াছিল; কিন্তু তাহাও ক্ষণকালের জন্য। রত্নার মুখের ভাব ও তাহার কথা বলার ভঙ্গি তাহাকে স্মরণ করাইয়া দিয়াছিল যে সোমনাথ রত্নার দাদার শ্যালক এবং রত্না সোমনাথের দিদির ননদ; ইহার অধিক সম্পর্ক তাহাদের মধ্যে নাই। মাঝে একটা নুতন সম্পর্কের সূত্রপাত হইয়াছিল বটে, কিন্তু রত্না তাহা এতই রূঢ়ভাবে ভাঙিয়া দিয়াছে যে তাহা স্মরণ করিতেও মন সঙ্কুচিত হয়। এরূপ অবস্থায় কেবল লৌকিক সম্বন্ধটুকু বজায় রাখিয়া চলাই ভাল; রত্না খবর না দিয়া এবং খবর না লইয়া বোম্বাই উপস্থিত হইয়া যে বিচিত্র পরিস্থিতির উদ্ভব করিয়াছে তাহা যথাসম্ভব সহজ ও মামুলি করিয়া আনাই সোমনাথের কর্তব্য। অতীত প্রত্যাখ্যানের কাঁটা বুকের মধ্যে খচ্‌ খচ করে করুক, বাহিরে কিছু প্রকাশ করা চলিবে না।

.

তিন

আধ ঘন্টা পরে বস্ত্রাদি পরিবর্তন করিয়া, রত্না স্নানঘর হইতে বাহির হইয়া দেখিল টেবিলের উপর এক পট চা এবং প্লেটের উপর রাশীকৃত পাঁউরুটি ও মাখন রহিয়াছে। রত্না একটু বিস্মিত হইয়া বলিল—এ কি, চাকর বামুন ফিরে এসেছে নাকি?

সোমনাথ বলিল-না; কিন্তু তাদের ভরসায় থাকলে আজ আর কিছু জুটবে না। তোমার নিশ্চয় খুব খিদে পেয়েছে। নাও, আরম্ভ করে দাও। বলিয়া পেয়ালায় চা ঢালিতে প্রবৃত্ত হইল।

রত্নার মুখে একটু হাসি ফুটিল।

তুমি আজকাল ঘরকন্নার কাজ খুব শিখেছ দেখছি!

সোমনাথ চায়ের পেয়ালা তাহাকে দিয়া ঈষৎ গর্বের সহিত বলিল—ঘরকন্নার কাজ আমি অনেকদিন থেকে জানি। খেয়ে দ্যাখো চা ঠিক হয়েছে কিনা।

রত্ন পেয়ালার প্রান্তে একবার ঠোঁট ঠেকাইয়া বলিল—মন্দ হয়নি। তাহার স্বর নিরুৎসুক।

দুজনেরই বিলক্ষণ পেট জ্বলিতেছিল, সেই দুপুরবেলার পর আর কিছু পেটে পড়ে নাই। অধিক বাক্যব্যয় না করিয়া উভয়ে চা ও মাখন পাঁউরুটিতে মনোনিবেশ করিল। ক্ষুন্নিবৃত্তির ফাঁকে ফাঁকে দু একটা কথা হইতে লাগিল–

কলকাতার খবর কি?

ভালই।

তুমি কোন কলেজে ভর্তি হলে?

ভর্তি হইনি। তোমার কেমন চলছে?

মন্দ নয়। চন্দনাদের কোম্পানী ছেড়ে দিয়েছি, শুনেছ বোধহয়।

না—শুনিনি। এখন কোথায় কাজ করছ?

এখন নিজে ছবি তৈরি করছি।

ও।…

আর চা নেবে? এখনও অনেকখানি আছে।

দাও।

বাহিরে ঝড়বৃষ্টির মাতামাতি ক্রমেই বৃদ্ধি পাইতেছে; কিন্তু ঘরের ভিতরটি শান্ত, কোনও চাঞ্চল্য নাই। দুইটি উদাসীন যুবক-যুবতী চা পান করিতেছে ও ছাড়া-ছাড়া গল্প করিতেছে। তাহারা যেন এরোপ্লেনে চড়িয়া চলিয়াছে, বাহিরের প্রচণ্ড গতিবেগে ভিতরে অনুভব করা যায় না। যাত্রীদের মনে হয় তাহারা নিশ্চল হইয়া বসিয়া আছে।

লেখাপড়া কি ছেড়ে দিলে?

না। এবার কলেজে জায়গা পেলাম না।

ও। তোমাকে এবার একটু রোগা দেখাচ্ছে।

তা হবে। তোমার স্বাস্থ্য তো ভালই দেখছি।

হ্যাঁ। খাটলে খুটলে শরীর বেশ ভাল থাকে।

সত্যি। তার ওপর যদি মনের মত কাজ হয়।

সোমনাথ একটু ফিকা হাসিল। কাজ মনের মত কিনা এ কথা লইয়া তর্ক করিয়া লাভ নাই।

চায়ের পর্ব শেষ হইলে রত্না বলিল—এখনকার মত তো হল; কিন্তু রাত্তিরের কি ব্যবস্থা হবে?

সোমনাথ বলিল—সে তুমি ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

ঠিক হবে কি করে? বামুনের তো দেখা নেই।

তা হোক, হয়ে যাবে।

রত্না ভ্রূ তুলিল—তুমি রাঁধবে নাকি?

আমি কি রাঁধতে জানি না? খুব ভাল রাঁধতে জানি। খেয়ে দেখলে বুঝবে।

দরকার নেই আমার। বোম্বাই এসে অবধি অনেক দুর্গতি হয়েছে, তার ওপর তোমার রান্না সহ্য হবে না। বলিয়া রত্না ভাঁড়ার ঘর তদারক করিতে গেল।

সোমনাথ ক্ষুণ্ণভাবে সিগারেট ধরাইল। কিছুক্ষণ পরে রত্না ফিরিয়া আসিয়া বলিল—খিচুড়ি আর ডিম ভাজা ছাড়া আর কিছু হবে না। শুধু চাল ডাল আর ডিম আছে।

সোমনাথ বলিল—আমার ভাঁড়ারের দৈন্য দেখে লজ্জা পেলাম। অবশ্য খিচুড়ি আর ডিম ভাজা আমার পক্ষে যথেষ্ট। তোমারই কষ্ট হবে।

রত্না বলিল-তা হোক। আমি কিছু মনে করব না।

সে তোমার মহত্ত্ব; কিন্তু রান্নাটা আমি করলেই ভাল হত। ভেবে দ্যাখো, তুমি আমার অতিথি। তুমি রাঁধবে আর আমি খাব—এ যে বড় লজ্জার কথা।

আমি কাউকে বলব না।

সোমনাথ বসিয়া রহিল; রত্না আঁচলটা গাছ-কোমর করিয়া জড়াইয়া রান্নাঘরে চলিয়া গেল।

উনান ধরানোর কোনও হাঙ্গামা ছিল না, রান্নাঘরে গ্যাসের উনান। রত্না ক্ষিপ্তহস্তে যোগাড়যন্ত্র করিয়া রান্না চড়াইয়া দিল।

রাত্রি দশটার সময় বসিবার ঘরের একটা সোফায় যথাসম্ভব লম্বা হইয়া শুইয়া সোমনাথ মুদিত চক্ষে ঝড়ের শব্দ শুনিতেছিল। বাহিরে বাতাসের মত্ততা বাড়িয়াই চলিয়াছে; মাঝে মাঝে তাহার উন্মত্ত পাটে বাড়িখানা মড় মড় করিয়া উঠিতেছে। পশ্চিম দিক হইতে একটা গভীর একটানা গর্জন বাড়ির বদ্ধ দরজা জানালা ভেদ করিয়া কানে আসিতেছে।

রত্না আসিয়া কাছে দাঁড়াইল।

বাঃ বেশ মানুষ! ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?

সোমনাথ উঠিয়া বসিল।

ঘুমোইনি। চোখ বুজে ঝড়ের মনের কথাটা শোনবার চেষ্টা করছিলাম।

রত্নার চোখে বিদ্রূপ খেলিয়া গেল—তাই নাকি? তা কী শুনলে?

এলোমেলো কথা, ভাল বুঝতে পারলাম না।

তাহলে এবার খাবে চল। খাবার তৈরি।

দুজনে গিয়া খাইতে বসিল। তপ্ত খিচুড়ির ঘ্রাণ নাকে যাইতেই সোমনাথের মন তৃপ্তিতে ভরিয়া উঠিল, কিন্তু সে তৃপ্তির ভাব গোপন করিয়া বিচারকের ভঙ্গিতে চামচের আগায় একটু খিচুড়ি তুলিয়া মুখে দিল।

রত্ন জিজ্ঞাসা করিল—কেমন হয়েছে খিচুড়ি? সোমনাথের এবার জবাব দিবার পালা, তাহার অধরে একটি চকিত হাসি খেলিয়া গেল। সে আর এক চামচ মুখে দিয়া গম্ভীরভাবে বিবেচনাপূর্বক বলিল—মন্দ হয়নি।

রত্না চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া চাহিল, তারপর হাসিয়া ফেলিল। তাহারই মুখের কথা এতক্ষণ পরে তাহার কাছে ফিরিয়া আসিয়াছে।

কিছুক্ষণ নীরবে আহার চলিল। সোমনাথ ভাবিতে লাগিল রত্না এত ভাল রাঁধিতে শিখিল কেমন করিয়া? আজকালকার মেয়েরা তো লেখাপড়া লইয়া থাকে কিম্বা সিনেমা দেখে; রান্নাঘরের খোঁজ রাখে না। রত্না কোন্ ফাঁকে এমন রাঁধিতে শিখিল? অথবা মেয়েদের হাতে কোনও সহজাত ইন্দ্রজাল আছে, তাহারা স্পর্শ করিলেই অন্নব্যঞ্জন সুস্বাদু হইয়া ওঠে? অথবা সোমনাথ দীর্ঘকাল ধরিয়া বামুন ঠাকুরের রান্না গলাধঃকরণ করিতেছে, তাই আজ রত্নার নিরেস রান্নাও তাহার সরস মনে হইতেছে? কিম্বা–

ঝড় আর কতক্ষণ চলবে?

ঠিক বলতে পারি না। শুনেছি পাঁচ-ছয় ঘণ্টার বেশী থাকে না।

ওটা কিসের শব্দ হচ্ছে—ঐ যে গোঁ গোঁ শব্দ?

ওটা সমুদ্রের গর্জন।

ও–রত্ন সোমনাথের পানে একটা তির্যক কটাক্ষপাত করিল—

তা–সমুদ্রের মনের কথা কিছু শুনতে পাচ্ছ নাকি?

পাচ্ছি।

সত্যি? কি শুনলে?

সোমনাথ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল—রাগ আর ভালবাসা–ভালবাসা আর রাগ।

ক্ষণেকের জন্য দুজনের চোখে চোখে বিদ্যুৎ বিনিময় হইয়া গেল, তারপর দুজনেই চক্ষু সরাইয়া লইল।

আহারান্তে বসিবার ঘরে আসিয়া সোমনাথ বলিল—তোমার শোবার ঘরে বিছানা পেতে দিয়েছি।

রত্না চোখ মেলিয়া সোমনাথের মুখের পানে কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল, তারপর ভ্রূকুটি করিল।

তোমার বিছানা পাতবার দরকার ছিল না। আমি নিজেই পেতে নিতে পারতাম।

সোমনাথ বলিল—তা পারতে জানি; কিন্তু আমারও তো কিছু করা চাই। যাহোক, সাড়ে দশটা বেজে গেছে, তুমি শুয়ে পড় গিয়ে। একে ট্রেনের ক্লান্তি, তার ওপরে রান্নার পরিশ্রম।

রত্না আর কোনও কথা না বলিয়া শয়নকক্ষে গিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিল। খাটের উপর বিছানা পাতা, বিছানার পদপ্রান্তে একটি গায়ের চাদর সযত্নে পাট করা। রত্নার হোলড়অলে একজোড়া বেড়রুম শ্লিপার ছিল, সে দুটি খাটের নীচে রাখা রহিয়াছে।

রত্না কিয়ৎকাল শয্যার পানে চাহিয়া রহিল, তারপর উষ্ণ-অধীর একটি নিশ্বাস ফেলিয়া ঘরময় ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। বাহিরে সমুদ্রের রাগমিশ্রিত ভালবাসার দুরন্ত আফসানি কিছুতেই শান্ত হইতেছে নাবাড়িখানা থাকিয়া থাকিয়া শিহরিয়া উঠিতেছে।

ক্লান্ত হইয়া অবশেষে রত্না আলো নিভাইয়া শুইতে গেল; কিন্তু ঘর বড় অন্ধকার, অন্ধকারে বাহিরের শব্দগুলা যেন আরও স্পষ্ট হইয়া উঠিতে লাগিল। রত্না ফিরিয়া আসিয়া আবার আলো জ্বলিল, তারপর আলো জ্বালিয়া রাখিয়াই চাদর গায়ে দিয়া শুইয়া পড়িল।

সোমনাথও নিজের ঘরে আলো নিভাইয়া শুইয়া পড়িয়াছিল। বিছানাটি ভারি ঠাণ্ডা, একটা গায়ের কাপড় হইলে ভাল হইত; কিন্তু নিজের গায়ের কাপড়টি সে রত্নাকে দান করিয়াছে। যাহোক, যদি নিতান্তই প্রয়োজন হয়, বিছানার চাদর টানিয়া গায়ে দিলেই চলিবে।

রত্না না মনে করে—সোমনাথের কাছে সে অনাদৃতা হইয়াছে। সোমনাথ কোনও অবস্থাতেই রত্নাকে অনাদর করিতে পারিবে না; কিন্তু রত্না আসিয়া পর্যন্ত বারবার তাহাকে আঘাত হানিতেছে কেন? পূর্বে যাহা ঘটিয়াছিল—এক সন্ধ্যার বরবধু অভিনয়—তাহার জন্য তো সোমনাথ দায়ী নয়। আর বর্তমানে জামাইবাবু পুণায় বদলি হইয়াছেন, ইহার জন্যই বা তাহাকে কি প্রকারে দোষী করা যাইতে পারে? কিন্তু সে যা-ই হোক রত্না যে এই রাত্রে ইস্টিশানে গিয়া বসিয়া থাকে নাই, সে যে এই শূন্য বাড়িতে তাহার সহিত একাকী কাটাইতে সম্মত হইয়াছে ইহাই ভাগ্য বলিতে হইবে।

আজিকার রাত্রিটা সোমনাথের সুখের রাত্রি, না দুঃখের রাত্রি? ঝড়ের ঝাপটায় বাসা-ভাঙা পাখি যেমন অন্ধভাবে উড়িয়া আসিয়া ঘরের মধ্যে আশ্রয় লয়, রত্না তেমনি তাহার গৃহে আশ্রয় লইয়াছে; আবার কাল সকালে ভোরে আলো ফুটিতে না ফুটিতে উড়িয়া চলিয়া যাইবে; কিন্তু তবু, সুখের হোক আর দুঃখের হোক আজিকার রাত্রিটা সোমনাথের চিরদিন মনে থাকিবে। রত্না যখন পরের ঘরণী হইয়া বহু দূরে চলিয়া যাইবে, আর তাহাকে বিরক্তভাবেও স্মরণ করিবে না, তখনও আজিকার রাত্রিটি সোমনাথের মনে জাগিয়া থাকিবে।

.

চার

রাত্রি তখন একটা কি দেড়টা।

সোমনাথ ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, চমকিয়া ঘুম ভাঙিয়া গেল। অন্ধকারে বিছানায় উঠিয়া বসিয়া সোমনাথ অনুভব করিল, চারিদিকে ভীষণ খট্‌ ঝন্‌ঝন্ শব্দ হইতেছে; যেন একদল ডাকাত যুগপৎ বাড়ির দরজা জানালাগুলাকে আক্রমণ করিয়া ভাঙিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিতেছে।

ঘুমের মধ্যে এই শব্দগুলা সে অনেকক্ষণ ধরিয়া শুনিতেছিল, সুতরাং তাহার ঘুম ভাঙার কারণ এই শব্দগুলা নয়। সোমনাথ কান পাতিয়া শুনিল, ঝড়ের শব্দের সহিত মিশিয়া আর একটা শব্দ হইতেছে—কেহ তাহার দরজায় ধাক্কা দিতেছে; ইহা ঝড়ের ধাক্কা নয়, মানুষের হাতের ধাক্কা!

এক লাফে বিছানা হইতে নামিয়া অন্ধকারেই সে দরজা খুলিয়া দিল।

রত্না?

জলে অনেকক্ষণ ড়ুবিয়া থাকিবার পর মাথা জাগাইয়া মানুষ যেমন হাঁপাইয়া নিশ্বাস টানে তেমনি ভাবে হাঁপাইয়া রত্না বলিল—হ্যাঁ। আলো নিভে গেছে।

আলো নিভে গেছে?

দ্বারের পাশেই আলোর সুইচ। সোমনাথ হাত বাড়াইয়া সুইচ টিপিল, কিন্তু আলো জ্বলিল না। সে বলিল—ইলেকট্রিক তার ছিঁড়ে গেছে।

রত্নার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শোনা গেল—কী হবে? বাড়ি কি ভেঙে পড়বে?

না না, তুমি ভয় পেয়ো না। সাইক্লোনে বাড়ি ভাঙতে পারে না। রাস্তায় কোথাও গাছের ডাল ভেঙে ইলেকট্রিকের তার ছিঁড়ে গিয়েছে, তাই আলো নিভে গেছে।

রত্না বলিল—তুমি কোথায়? কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

অন্ধকারে হাত বাড়াইয়া দুজনে কিছুক্ষণ হাতড়াইল; তারপর হাতে হাত ঠেকিল। সোমনাথ হাত ধরিয়া রত্নাকে ঘরের ভিতরে আনিল। রত্না কতকটা যেন নিজমনেই ভাঙা গলায় বলিল—আলো জ্বেলে ঘুমিয়েছিলাম, হঠাৎ চারিদিকে মড়মড় শব্দে ঘুম ভেঙে গেল—দেখি আলো নিভে গেছে–

সোমনাথ অনুভব করিল রত্নার হাত বরফের মত ঠাণ্ডা, অল্প অল্প কাঁপিতেছে। সে সাহস দিয়া বলিল–হঠাৎ অন্ধকারে ঘুম ভেঙেছে বলে ভয় পেয়েছ, নইলে ভয়ের কিছু নেই। এবার আস্তে আস্তে ঝড়ের বেগ কমবে।

যদি বাড়ে?

আর বাড়তে পারে না।–তুমি দাঁড়াও, আমি দেশলাই আনি। আমার জামার পকেটেই আছে।

অনিচ্ছাভরে রত্না হাত ছাড়িয়া দিল। সোমনাথ শয়নের পূর্বে গায়ের জামা খুলিয়া আন্নায় টাঙাইয়া রাখিয়াছিল, এখন ঠাহর করিয়া গিয়া জামাটা পাইয়া পরিয়া ফেলিল। তারপর পকেট হইতে দেশলাই বাহির করিয়া জ্বালিল।

অমনি রত্না ছুটিয়া আসিয়া তাহার কাছে দাঁড়াইল। দেশলাইয়ের আলোতে রত্নাকে দেখিয়া সোমনাথের বুকের ভিতরটা চমকিয়া উঠিল। তাহার চক্ষু দুটি বিস্ফারিত, মুখে রক্তের লেশমাত্র নাই; গায়ে বিস্রস্ত বসনের উপর চাদরটা কোনও মতে জড়ানো। এ রত্না যেন তাহার পরিচিত আত্মপ্রতিষ্ঠ অচপল রত্না নয়; প্রকৃতির ভয়ঙ্কর প্রলয় মূর্তির সম্মুখে একান্ত অসহায় এক মানবী। প্রকৃতির বিরাট শক্তি দেখিয়া মানুষ কেবল অভিভূতই হয় না, নিজের অকিঞ্চিৎকর ক্ষুদ্রতাও অনুভব করে। তখন তাহার সঙ্কুচিত সত্তার অঙ্গ হইতে দর্পের আভরণও খসিয়া পড়িয়া যায়।

সোমনাথের ইচ্ছা হইল রত্নাকে ভীত শিশুর মত বুকে জড়াইয়া সান্ত্বনা দান করে; কিন্তু সে-ইচ্ছা দমন করিয়া সে একটু আশ্বাসজনক হাসি হাসিবার চেষ্টা করিল।

অন্য সময় মনে হয় না যে দেশলায়ের কাঠিতে এত আলো হয়। কাঠি কিন্তু বেশী নেই— আঁ! কি হবে তাহলে? বলিতে বলিতে কাঠি নিভিয়া গেল। দ্বিতীয় কাঠি জ্বালিয়া সোমনাথ বলিল—তুমি এখানে এসে বোলোবলিয়া তাহার হাত ধরিয়া আনিয়া খাটের উপর বসাইয়া দিল।

মোমবাতি নেই?

যতদূর জানি নেই। তবে মনে হচ্ছে একটা টর্চ আছে। তুমি যদি একটু একলা থাকো, আমি খুঁজে দেখতে পারি; বোধহয় দিদির ঘরে আছে।

শঙ্কা-বিলম্বিতকণ্ঠে রত্না বলিল—আচ্ছা, বেশী দেরি কোরো না।

কয়েক মিনিট রত্না অন্ধকারে শক্ত হইয়া বসিয়া রহিল, তারপর সোমনাথের ফিরিয়া আসিবার পদশব্দ শুনিতে পাইল।

পেলে?

উত্তরে সোমনাথ দপ করিয়া রত্নার মুখের উপর টর্চ জ্বালিয়া ধরিল। টর্চের আলো খুব উজ্জ্বল, প্রায় সাধারণ বিদ্যুৎ বাতির সমান। সোমনাথ হাসিয়া বলিল—এই নাও আলো। আর ভয় করছে না তো?

রত্ন আলোর দিক হইতে চোখ সরাইয়া লইয়া এবার ঘরের চারিদিকে তাকাইল। টর্চের ছটার বাহিরেও ঘরটি আলোকিত হইয়াছে। রত্নার অধরোষ্ঠ একবার কাঁপিয়া উঠিল, সে অবরুদ্ধ কণ্ঠে বলিল—না, ভয় আর করছে না—তবে–

তবে? বলিয়া জ্বলন্ত টর্চটি শয্যার ওপর রাখিয়া সোমনাথ একপাশে বসিল।

রত্না একবার তাহার পানে তাকাইল, তারপর হঠাৎ বিছানায় উপুড় হইয়া পড়িয়া ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।

স্ত্রীজাতির স্নায়বিক বিপর্যয় সম্বন্ধে সোমনাথের কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না; কিন্তু সে বুঝিল, ইহা ভয়ের কান্না নয়, ভয়-ভ্রাণের কান্না। হয়তো সেই সঙ্গে নিবিড়তর কোনও মনস্তত্ত্ব মিশিয়াছিল, হয়তো লজ্জা বা পশ্চাত্তাপের আগুনে হৃদয়ের অবরুদ্ধ বাষ্প উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছিল; কিন্তু তাহা নির্ণয় করিবার মত বিশ্লেষণী শক্তি সোমনাথের ছিল না। তাহার হৃদয় স্নেহে ও করুণায় বিগলিত হইয়া গেল। সে রত্নার পিঠের উপর হাত রাখিয়া ডাকিল—রত্ন—কেঁদো না লক্ষ্মীটি রত্ন—

রত্নার কান্না কিন্তু থামিল না। মিনিট পনেরো পরে রত্নর ফোঁপানি যখন অনেকটা শান্ত হইয়া আসিয়াছে তখন সোমনাথ হঠাৎ উত্তেজিতভাবে বলিয়া উঠিল-রত্না, এস এক কাজ করা যাক।

রত্না চোখ মুছিয়া উঠিয়া বসিল। চোখের জলে ভিজিয়া মুখখানি আরও নরম হইয়াছে; সে ভাঙা গলায় জিজ্ঞাসা করিল—কী?

সোমনাথ বলিল—এস, চা তৈরি করে খাওয়া যাক। ভারি মজা হবে কিন্তু। খাবে?

রত্না ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইল। সোমনাথ খাট হইতে নামিয়া বলিল—আচ্ছা, তুমি তাহলে বোসো আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে চা তৈরি করে আনছি।

রত্নাও খাট হইতে নামিল।

না, আমি চা তৈরি করব।

বেশ, দুজনেই তৈরি করিগে চল। একলা ঘরে বসে থাকার চেয়ে সে বরং ভাল হবে।

দুজনে রান্নাঘরে গিয়া টর্চের আলোতে চা তৈয়ার করিল, তারপর চায়ের বাটি হাতে আবার খাটে আসিয়া বসিল।

সোমনাথ এক চুমুক খাইয়া হর্ষধ্বনি করিয়া উঠিল—বাঃ, কি সুন্দর চা হয়েছে। তোমার ভাল লাগছে না?

রত্না মৃদুস্বরে বলিল—খুব ভাল লাগছে।

প্রতি চুমুকের সঙ্গে চায়ের আতপ্ত মাধুর্য তাহাদের স্নায়ু শিরায় সঞ্চারিত হইতে লাগিল। সোমনাথ ভারি উৎসাহ অনুভব করিতে লাগিল। সে উঠিয়া টর্চটাকে খাটের ছত্রিতে ঝুলাইয়া দিল, টর্চের আলো শূন্য হইতে চন্দ্রকিরণের মত শয্যার উপর ছড়াইয়া পড়িল।

রত্নার মুখখানি শান্ত। সে সহজকণ্ঠে বলিল—তুমি চায়ের সঙ্গে সিগারেট খাও না?

খাই—চায়ের সঙ্গে সিগারেট জমে ভাল।

তবে খাচ্ছ না কেন?

খাবো?

খাও।

সোমনাথের মনও মাধুর্যে ভরিয়া উঠিল। সে সিগারেট ধরাইল।

চা খাওয়া শেষ হইলে রত্ন খাটের শিয়রের দিকে গুটিসুটি হইয়া শুইয়া পড়িল। সোমনাথ বলিল—রত্না, শুনতে পাচ্ছ, ঝড়ের শব্দ ক্রমে এগিয়ে আসছে?

রত্না বলিল-হুঁ।

এদিকে দুটো বেজে গেছে। দেখতে দেখতে ভোর হয়ে যাবে।

রত্না চোখ বুজিয়া বলিল—হুঁ।

যাই বল, আজকের রাত্তিরটা মনে রাখবার মত। মনে হচ্ছে যেন মস্ত একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়ে গেল।–ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?

মুদিতচক্ষে রত্না বলিল—না, তুমি কথা বল আমি শুনি।

সোমনাথ এতক্ষণ সহজভাবে কথা বলিতেছিল, এখন আবার আত্ম-সচেতন হইয়া পড়িল। কথা বলিতে হইবে মনে হইলেই আর কথা যোগায় না। রত্নার শুনিতে ভাল লাগে এমন কী কথা সে বলিবে?

রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করিবে? ওরে বিহঙ্গ ওরে বিহঙ্গ মোর, এখনি অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা? কিম্বা-শয়ন শিয়রে প্রদীপ নিভেছে সবে, জাগিয়া উঠেছি ভোরের কোকিল রবে? কিন্তু না, রত্নাকে কবিতা শোনানো বর্তমান ক্ষেত্রে উচিত হইবে না, রত্না এরূপ আচরণের কদৰ্থ করিতে পারে। তবে এখন সে কি কথা বলিবে?

একটা কথা বলা যাইতে পারে, রত্না নিশ্চয় কিছু মনে করিবে না। সোমনাথ মনে মনে একটু ভণিতা করিয়া লইয়া বলিল—আমার প্রথম ছবিটা বাজারে বেরিয়েছে—বেশ নাম হয়েছে।

রত্না নীরব রহিল। সোমনাথ তখন সাহস করিয়া বলিল—কলকাতাতেও ছবিটা চলছে। তুমি তুমি দেখেছ নাকি?

রত্না সাড়া দিল না। সোমনাথ উত্তরের জন্য কিয়ৎকাল অপেক্ষা করিয়া রত্নার মুখের দিকে ঝুঁকিয়া দেখিল রত্নার চক্ষু-পল্লব স্থির, শান্তভাবে নিশ্বাস পড়িতেছে। রত্না ঘুমাইয়া পড়িয়াছে।

সোমনাথ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল, তারপর সন্তর্পণে বিছানা হইতে নামিল। ক্লান্ত হইয়া রত্না ঘুমাইয়াছে, তাহাকে জাগানো উচিত হইবে না; কিন্তু এ-ঘরে সোমনাথের থাকা কি ঠিক হইবে? বরং সে গিয়া রত্নার বিছানায় শুইয়া কোনও মতে রাত্রিটা কাটাইয়া দিবে।

কিন্তু দ্বার পর্যন্ত গিয়া সোমনাথ আবার ফিরিয়া আসিল। হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়া রত্না যদি দেখে সোমনাথ নাই, সে হয়তো ভয় পাইবে–ঝড় কমিয়াছে বটে, কিন্তু থামে নাই–

সোমনাথ আবার সন্তর্পণে খাটের একপ্রান্তে উঠিয়া বসিল। রত্না নিশ্চিন্তভাবে ঘুমাইতেছে; তাহার একটি হাত গালের নীচে চাপা রহিয়াছে। সোমনাথ একবার সেই দিকে তাকাইল; তারপর বাহু দিয়া দুই হাঁটু জড়াইয়া লইয়া ঊর্ধ্বে আলোর দিকে চাহিয়া রহিল। এমনি ভাবে বসিয়াই সে বাকি রাতটা কাটাইয়া দিবে।

টর্চের ব্যাটারি দীর্ঘকাল জ্বলিয়া জ্বলিয়া নিস্তেজ হইয়া আসিতেছে। তাহারও চক্ষু যেন ঘুমে জড়াইয়া আসিতেছে।

.

পরদিন বেলা সাতটার সময় ঘুম ভাঙিয়া সোমনাথ ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দেখিল, রত্না কখন উঠিয়া গিয়াছে।

বাহিরে ঝড় স্তব্ধ হইয়াছে। বৃষ্টি পড়িতেছে না, আকাশ থমথম করিতেছে।

মুখ হাত ধুইয়া সোমনাথ যখন বসিবার ঘরে প্রবেশ করিল, তখন রত্না বাহিরে যাইবার সাজ পোষাক পরিয়া বসিয়া আছে। সে সোমনাথের মুখের পানে না তাকাইয়া বলিল—আমি এখনি পুণা। যাব।

সোমনাথ নীরবে চাহিয়া রহিল। এ সেই পুরনো পরিচিত রত্না, কাল রাত্রে হঠাৎ যে রত্নাকে দেখিয়াছিল সে-রত্না নয়। মুখের ডৌল দৃঢ় এবং নিঃসংশয়, কোথাও এতটুকু দুর্বলতার চিহ্নমাত্র। নাই। এই রত্নাই কি তাহার বিছানায় শুইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল? কাল রাত্রে কি ঘটনাগুলি ঘটিয়াছিল তাহা কি সত্য, না স্বপ্নের মরীচিকা-বিভ্রম?

রত্না বলিল—টাইম টেবল দেখেছি, সাড়ে আটটার সময় একটা ট্রেন আছে–

সোমনাথ লক্ষ্য করিল, রত্ন তাহার মুখের দিকে চাহিয়া কথা বলিতেছে না; বোধহয় চোখে চোখ মিলাইতে লজ্জা করিতেছে; কিন্তু লজ্জা করিবার কিছু আছে কি?

রত্না আবার বলিল—আর দেরি করলে ট্রেন পাব না। একটা গাড়ি কি ট্যাক্সি—

সোমনাথ চোখের উপর দিয়া একবার হাত চালাইয়া বলিল—চল, আমি তোমাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসছি।

মোটরে যাইতে যাইতে কেবল একবার কথা হইল; রত্ন জিজ্ঞাসা করিল—এ মোটর কার?

সোমনাথ কেবল বলিল—আমার।

ট্রেন ছাড়িবার আধ মিনিট আগে রত্না গাড়ির জানালা হইতে মুখ বাড়াইয়া সোমনাথের জামার বুকপকেটের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া বলিল—তোমার আতিথ্যের জন্য ধন্যবাদ। বলিয়া ভিতরের দিকে মুখ ফিরাইয়া বসিল।

কাল গভীর রাত্রে সোমনাথের অন্তর-গহনে যে ভীরু ফুলটি সঙ্গোপনে ফুটিয়াছিল, তাহা এতক্ষণে সম্পূর্ণ শুকাইয়া টুপ করিয়া ঝরিয়া পড়িল।

ট্রেন চলিয়া গেল। আকাশে মেঘগুলা এতক্ষণ স্তম্ভিত হইয়াছিল, তাহারা আবার ধীরে ধীরে বর্ষণ শুরু করিল।

সোমনাথ ফিরিয়া গিয়া মোটরে স্টার্ট দিল; তারপর ক্লান্ত দেহমন লইয়া স্টুডিওর দিকে চলিল। আজও সারাদিন শুটিং আছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *