৪. বসন

॥ বসন ॥

তিনতলার ঘরগুলো যে কেমন হু-হু করে তা আমি বোঝাতে পারব না। তিনখানা মস্ত ঘর নিয়ে আমি একা থাকি। এই একা থাকা আমার মা একটুও পছন্দ করে না। একটা দরদালান আর তিন তিনটে প্রকাণ্ড লোভনীয় ঘর বহুকাল ফাঁকা পড়ে ছিল। ঝাড়পোঁছ, ঝাঁটপাট হত, আবার তালাবন্ধ হয়ে পড়ে থাকত। আমি বায়না ধরলাম, তিনতলায় থাকব।

অনেক বারণ, বকাঝকা হল। তারপর পেয়েও গেলাম তিনখানা ঘর নিয়ে আমার রাজত্ব। পাছে ভয় পাই সেইজন্য প্রথম প্রথম মা বা বড়মা এসে থাকত আমার সঙ্গে। কিন্তু আমার ভয় করে না তো! একা থাকতে আমার ভীষণ ভাল লাগে। আমি টের পাই, তিনখানা ঘর আর দরদালানের ভিতরে এক অদ্ভুত নির্জনতা হুহু করে সারাদিন বয়ে যায়। বাতাসের শব্দ নয়, তবু কী যে হুহু করে তা কে জানে!

তিনটে ঘরে মেলা আসবাব। বিশাল ভারী পালঙ্ক, বড় বড় কাঠের কয়েকটা আলমারি, পাথর-টপ টেবিল, দেয়ালে পেণ্ডুলামওলা মস্ত ঘড়ি। একটা কাচের আলমারিতে সাজানো আছে বিলিতি পুতুল। এসবই আমার এক ঠাকুমার। আমার জন্মের আগেই মারা যান। কী দুঃখের জীবন ছিল তাঁর! সাত বছর বয়সে বিয়ে, বারো বছর বয়সে বিধবা। আমি ভাগ্যিস সে যুগে জন্মাইনি! কী বিচ্ছিরি সিস্টেম ছিল বাবা! আজকালকার মেয়েরা কি আর সাধে নারী-মুক্তি আন্দোলন করে?

আমার বন্ধুরা মাঝে মাঝে আড্ডা মারতে চলে আসে আমার কাছে। তিনতলায় এত বড় জায়গা নিয়ে আমি থাকি বলে তারা খুব অবাক হয়। একটু হিংসেও করে কেউ কেউ। আর কেউ কেউ বলে, ও বাবা এ ঘরে একা থাকতে হলে আমি ভূতের ভয়েই মরে যাব। তুই যে কী করে থাকিস! বুকের পাটা আছে বাবা।

সেদিন খুব আড্ডা হচ্ছিল। হঠাৎ চঞ্চল বলল, এই দ্যাখ বসন, তোকে কিন্তু কিডন্যাপ করা হতে পারে।

আমি অবাক হয়ে বলি, কিডন্যাপ করবে? কে করবে রে?

আমার হঠাৎ তোর কথা ভেবে কালকে মনে হল, আরে, বসনটা তো দারুণ টারগেট। ওদের এত টাকা, আর বসন এত আদরের মেয়ে। দিনকাল যা পড়েছে বসনকে কিডন্যাপ করতেই পারে বদমাশরা।

ইন্দ্রাণী বলে, কিডন্যাপ ফিডন্যাপ করবে না। বসনের আসল ভয় অন্য জায়গায়।

কোন জায়গায়?

ওকে বিয়ে করলে তো একটা রাজত্বই পেয়ে যাবে পাত্রপক্ষ। তাই ওকে বিয়ে করতে অনেকে হামলে পড়বে।

কথাটা খুব মিথ্যেও নয়। আমার জ্যেঠুর ছেলেপুলে নেই। বাবা-মার আমি একমাত্র সন্তান। আমি সবই পাব।

তিলক বলে, ডি কে সি কী আর ওকে সাধে বিয়ে করতে চেয়েছিল! না রে বসন, তোর খুব কেয়ারফুল থাকা দরকার।

এমন মুরুব্বির মতো বলল যে আমরা হেসে ফেললাম। আমি বললাম, মারব থাপ্পড়! সবাই বুঝি কেবল আমাকে টাকার জন্য বিয়ে করতে চায়? আর কিছু নয়?

ঝিনুক বলে, তোর মাইরি বই একটু বেশি বেশি আছে। ভগবানের বিচারটাই এমনি।

বাচ্চু নির্বিকার মুখে বলে, বসনটা এমনিতে সুন্দর তবে ওসব ক্লাসিক্যাল সৌন্দর্য এ যুগে চলে না।

আমি অবাক হয়ে বলি, সে কী রে, আমি অচল?

বাচ্চু বিজ্ঞের মতো বলে, তা বলছি না। তবে ওসব টানা টানা চোখ, টোপা টোপা গাল, কোঁকড়া চুল জমিদার মাকা চেহারার কদর নেই। এখনকার টেস্ট আলাদা। দেখিস না হনু উঁচু, গাল বসা, চোখ গর্তে ঢোকানো চেহারার মেয়েদের আজকাল বেছে বেছে সিনেমার নায়িকা করা হচ্ছে।

তিলক বিরক্ত হয়ে বলে, রাখ তো। চেহারা নিয়ে আলোচনাটা বিলো ডিগনিটি। চেহারা জিনিসটাই স্কিন-ডীপ। আসল জিনিস হল পারসোনালিটি।

বন্ধুদের আড্ডা থেকে আমি মনে মনে দূরে সরে যাই। আমি আমার কথা ভাবতে থাকি। আমার এত বেশি আছে কেন? টাকাপয়সা, রূপ, আদর। আমি কি একটু হাঁফিয়ে উঠি? জ্যেঠু, বাবা, ঠাকুমা, বড়মা সকলের নজর সবসময়ে আমার ওপর। আমার দুজন দাদু ছিল। বড় আর ছোটো। দুজনে মিলে আমার মাথা খেয়েছিল আরও বেশি। দুজনেই মারা গেল এক বছরের তফাতে। তবু কি আদর কমছে? একটুও না।

শুধু মা একটু আলাদা। মা ভালবাসে খুব, কিন্তু আসকারা দেয় না। আমার মা কিছু অদ্ভুত। আমার সঙ্গে আমার মায়ের কিছুই মেলে না।

বন্ধুরাও বলে, তোর মা খুব অদ্ভুত, তাই না? এখনও কী রকম পতি ভক্তি!

একথা ঠিক, আমার বন্ধুদের কারও মা বাবার মধ্যেই এমন মিল নেই। বাবাকে মা এত বেশি ভক্তি করে, এত বেশি শ্রদ্ধা করে, আপনি-আজ্ঞে করে, যা আমি কখনও পারব না। অথচ এই সেকেলে মহিলাই গোটা পরিবারটাকে কী নিপুণ দক্ষতায় চালায়। শুনেছি, আমাদের দু-দুটো দোকানের পিছনে মায়েরই চেষ্টা আর পরিশ্রম ছিল। আজ আমাদের যে ফলাও অবস্থা তাও মায়েরই দূরদৃষ্টির ফল। এ সংসার মায়ের কথায় ওঠে-বসে। এক ভেঙেপড়া অবস্থা থেকে মা ধীরে ধীরে এই সংসারটাকে টেনে তুলেছে।

আমার মা যে আমার বাবাকে আপনি-আজ্ঞে করে সেটা আমার কানে অস্বাভাবিক ঠেকত না। কারণ, ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি। কিন্তু বন্ধুদের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকে। তারা জিজ্ঞেস করে, মাসীমা কেন মেসোমশাইকে আপনি করে বলে রে?

আমার লজ্জা করে তখন। মাকে জিজ্ঞেস করি, কেন বাবাকে আপনি বলো মা?

মা জবাব দেয়, বয়সে বড় ছিলেন, ব্যক্তিত্ববান ছিলেন। আপনিটাই এল মুখে। তাতে কোনও ক্ষতি হয়নি কিন্তু।

সকলেরই কি স্বামীকে আপনি বলা উচিত?

তা কেন? যার যেটা ভাল লাগে বলবে। তবে আমি ওঁকে চিরকাল শ্রদ্ধা করেছি বলেই কত জোর পেয়েছি। নইলে সব ভেসে যেত।

একথাটা আমি বুঝতে পারি না। মাকে আর জিজ্ঞেসও করি না কিছু। এ বাড়ির ভিতরে এখনও একটা পুরোনো বনেদি হাওয়া বন্ধ হয়ে আছে। বাইরের পৃথিবী কত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে!

তিনতলার ঘরে আজ সকালে আমার ঘুম যখন ভাঙল তখন পূবের জানালা দিয়ে শীতের রোদ ঘর ভাসিয়ে দিচ্ছে। অনেক বেলা হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও আমার মাথায় ভরে আছে কাল রাতের জ্যোৎস্না, নির্জনতা।

মুখটুখ ধুয়ে নীচে নামতে যাচ্ছি বড়মা উঠে এল ওপরে। বাতের হাঁটু নিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে বড়মার কষ্ট হয়। হাঁফাচ্ছে।

বললাম, কেন বড়মা, কষ্ট করে ওপরে ওঠো। সিঁড়ির মুখ থেকে ডাকলেই তো শুনতে পাই।

মুখপুড়ি, কাল রাতে চাটুজ্জে বাড়ির বউটাকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী বলছিলি?

হেসে ফেলি, বেশ করেছি বলেছি। ওরা বউটাকে এত কষ্ট দেয় কেন?

অন্য বাড়ির ব্যাপার নিয়ে তোর মাথা ঘামানোর কী দরকার? শেষে একটা ঝগড়া বাধাবি নাকি? চেঁচিয়ে বলছিলি, পাড়াশুন্ধু শুনেছে। ছিঃ মা, ওরকম বলতে নেই।

আমার খুব ইচ্ছে হয়, বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে এনে ওদের বাড়িতে একদিন হামলা করি।

সে তুমি পারো মা, তোমার অসাধ্য কিছু নেই। শুনলাম কাল নাকি লরিও ঠেলেছিস!

না ঠেললে যে সারা রাত পথে পড়ে থাকতে হত।

বড়মা চোখ বড় করে বলে, আর কী বাকি রইল? মেয়েরা লরি ঠেলে এই প্রথম শুনলাম।

এ কি তোমাদের আমল বড়মা? এ যুগের মেয়েরা সব পারে।

সব পেরো মা, সব পেরো। শুধু দয়া করে মেয়ে থেকো। ব্যাটাছেলে হয়ে যেও না। যা রকম সকম দেখছি, এরপর মেয়েদের গোঁফদাড়ি না গজালে বাঁচি।

আমি হাসি চাপতে পারলাম না। বললাম, কী যে সব বলল না, বড়মা? এ যুগের মেয়েদের তোমার খুব হিংসে হয়, না?

তা একটু হয়। এই বলে বড়মা আঁচলের আড়ালে থেকে একটা ছোট্ট রেকাবি বের করে বলল, এ দুটো খেয়ে নে তো। টাটকা করেছি।

দেখি, গোকুল পিঠে। আপনা থেকেই নাক কুঁচকে আসছিল। দু চক্ষে দেখতে পারি না পিঠে-পায়েস। কিন্তু সে কথা প্রকাশ করার উপায় আছে? শুধু বললাম, আমাকে মুটকি আর ধুমসি না বানালে তোমার সুখ নেই, না?

ওমা! কথা শোনো! মুটকি কেন হতে যাবি।

যাব না? মিষ্টি বেশি খেলে ক্যালোরি ইনটেক কত বেড়ে যায় জানো।

জন্মে শুনিনি। খা। শীতকালে একটু খেতে হয়। আজ পৌষ পার্বণ।

আমার কী পছন্দ জানো?

খুব জানি। ওই কেঁচোর মতো কিলবিলে জিনিস আর গোপালের ঝাল সিঙ্গাড়া। ওইসব খেয়েই তো চেহারা হাড়গিলে হচ্ছে।

হাড়গিলেদেরই আজকাল কদর। হাঁ করছি, মুখে দিয়ে দাও। রসের জিনিস আমি হাতে ধরব না। হাত চটচট করবে।

বড় করে হাঁ কর। গরম কিন্তু। বিষম খাস না আবার।

বলতে নেই, মায়ের চেয়ে বড়মার সঙ্গেই আমার বেশি মাখামাখি। বড়মা খোলামেলা, কথা চেপে রাখতে পারে না। তার আদরের মধ্যে জোর করে খাওয়ানো, শরীর নিয়ে চেঁচামেচি, মেয়েদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে মতামত সবই আছে। তবু বড়মাকে আমি যখন তখন পটিয়ে ফেলতে পারি। যে কোনও আবদার করে আদায় করতে পারি।

বছর দেড়েক আগে জ্যেঠু যখন আমাকে স্কুটার কিনে দেয় তখন বড়মার মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। জ্যেঠুর সঙ্গে তুমুল বাকবিতণ্ডাও হয়েছিল। এমন কাণ্ড নাকি বড়মা কখনও দেখেনি। পরে সেই বড়মাকেই আজকাল আমি স্কুটারের পিছনে চাপিয়ে এখানে সেখানে নিয়ে যাই।

বড়মা বলে, তুই আসলে ব্যাটাছেলেই। ভুল করে মেয়ে হয়ে জন্মেছিস।

বড়মা জানে না, আমি কী ভীষণ মেয়ে। আমি মেয়ে বলে আমার একটুও দুঃখ নেই। যা বড়মার হয়তো বা আছে। মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে আমি ভীষণ খুশি। যদি জন্মান্তর থাকে আমি বারবার মেয়ে হয়েই জন্মাতে চাই। আমি তো চাই পৃথিবীটা শুধু মেয়েদের হোক। পুরুষ থাকার কোনও দরকার নেই। শুধু মেয়েদেরই পৃথিবী হলে কী ভাল হত! না, তা বলে বাবা, জ্যেঠু আর আমার দুটো দাদুকে বাদ দিয়ে নয়। পুরুষ বলতে পৃথিবীতে থাকবে শুধু ওই চারজন। বাবা, জ্যেঠু, দুটো দাদু। ব্যস।

আজ ছুটি। আজ আমার অনেক প্রোগ্রাম। গান শিখতে যাব, শর্বরীদের বাড়িতে যাব আবার দুটো সায়েন্সের খাতা আনতে, সুমিতা আমার একটা কার্ডিগান বুনছে—সেটার ডিজাইনটা একটু বদলাতে বলে আসতে হবে।

নীচে নামতেই ডাকল, বসন, জলখাবার খেয়ে একবার আমার ঘরে এসো।

গলাটা কি একটু গম্ভীর শোনাল? আমার মা একটু গম্ভীর।

মায়ের ঘরটা এঁদো, অন্ধকার, বিচ্ছিরি। তার মধ্যে আবার বাক্স প্যাঁটরা, সিন্দুক কত কী। খাটে বড়মা পা ঝুলিয়ে বসে। সিন্দুকের সামনে মা। মায়ের সামনে মেঝেতে রাখা একটা মস্ত গয়নার বাক্স।

দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসো।

আমি দরজা বন্ধ করে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

মা অদ্ভুত এক চোখে আমার দিকে চেয়ে বলল, এই বাক্সটা চিনতে পারো? কিছু মনে পড়ে?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, না তো! কী মনে পড়বে?

এই বাক্সটা একদিন তোমার ছিল।

আমি অনিচ্ছেয় মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বললাম, কই জানি না তো!

হয়তো এ জন্মে নয়।

আমি বিস্ময়ে মায়ের মুখের দিকে চাইলাম। আমার মা বাস্তব জগতের মানুষ। কখনও উল্টোপাল্টা কথা বলতে শুনি না। কিন্তু একথাটার কী মানে হয়!

তবে কি আর জন্মে?

বড়মা বিরক্ত হয়ে মাকে বলল, তোর অত ভেঙে বলার দরকারটা কী? বড্ড বোকা তুই।

মা বাক্সর ডালাটা খুলে বলল, দেখ। দেখে নাও।

দেখলাম বাক্সটা ভর্তি মোটা মোটা ভারী ভারী সব পুরোনো গয়না। দেখলে গা বমি-বমি করে। কী বিচ্ছিরি সব জিনিস!

বললাম, দেখার কী আছে। ও তো পুরোনো সব গয়না।

একশ ভরির ওপর। এক রত্তিও এদিক ওদিক হয়নি।

আচ্ছা মা, সকালেই আজ গয়না নিয়ে পড়লে কেন? আমার নিজেরও তো অনেক আছে। পরি কি? গয়না টয়না আমার একদম ভাল লাগে না।

আমার একটা দায়িত্ব ছিল। তাই দেখালাম।

ওসব গয়না কার? তোমার বিয়ের?

না।এসবই তোমার।

আমার চাই না। রেখে দাও।

মায়ের মুখটা এই অন্ধকার ঘরেও হঠাৎ উজ্জ্বল দেখলাম। একটা যেন বদ্ধ উদ্বিগ্ন শ্বাসও ছাড়ল মা।

বড়মা বলল, তোর নাটুকেপনা একটু বন্ধ করবি লতা? মাঝে মাঝে যে তোর মাথায় কী পাগলামি চাপে! ও একরত্তি মেয়ে, আজকালকার ওরা কি ওসব গয়নার দাম দেয়? তুই ক্ষিতীশ স্যাকরাকে ডেকে নতুন করে গড়তে দে কয়েকটা। বেশি করে করার দরকার নেই। স্যাঁকরাদের ঘরের সোনা বেশি না দেখানোই ভাল।

আজকের সকালের নাটকটা কিছু বুঝতে পারছি না আমি। দুজনের মুখের দিকে ঘুরে ঘুরে দেখছি। কী মানে হয় এসব কথার?

মা আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে কেন? কী দেখছে আমার মুখে? আমি তো নতুন কেউ নই!

মা বলল, তোমার অনুমতি নিয়ে আজ বাক্সটা বের করলাম।

আমার অনুমতি! কেন মা? ও গয়না তো আমি জন্মেও দেখিনি। ওটা কার?

মা মাথা নিচু করে বলল, এসব তোমাকে একজন দিয়ে গেছেন। এতদিন আমার কাছে গচ্ছিত ছিল মাত্র।

ও দিয়ে আমি কী করব? কে দিয়ে গেছে?

তোমার এক ঠাকুমা। দুঃখী মানুষ ছিলেন। এইসব গয়না ছিল তাঁর বুকের পাঁজর।

কে ঠাকুমা?

তুমি তাঁকে দেখোনি। রসময়ী।

আমি হাসলাম, ছবি দেখেছি। দারুণ সুন্দরী ছিলেন। আমি তো তাঁরই ঘরদোর বিছানা দখল করে আছি। না?

তুমি নিজের অধিকারেই আছ। দখল করতে যাবে কেন?

গয়নাগুলো আজই বের করলে কেন?

মা আর বড়মা নিজেদের মধ্যে একটু রহস্যময় চোখাচোখি করে নিলেন। খুব মৃদু একটা ষড়যন্ত্রের আভাস পেলাম যেন!

আসছি মা। আমার অনেক কাজ আছে।

এসো।

মাথায় হেলমেট চাপিয়ে স্কুটারে ভেসে যেতে যে কী রোমান্টিক মাদকতা আছে কেউ বুঝবে না। ঝাঁঝালো ঠাণ্ডা বাতাস নাক মুখ দিয়ে ঢুকে মগজ থেকে গয়নাগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। মা বড়মা এদের আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। বড্ড সেকেলে। কেবল সোনাদানা, গয়না নিয়ে পড়ে থাকবে। পৃথিবীটা যে কত সুন্দর তা উপভোগ করে কই এরা?

দু জায়গায় ঘুরে, আড্ডা মেরে যখন সুমিতাদের বাড়ি পৌঁছলাম তখন দুপুর। স্কুটারটা স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ডাকলাম, সুমিতা, এই সুমিতা।

বাইরের ঘরে একটি শান্ত চেহারার দীর্ঘকায় পুরুষ বসে আছে সোফায়। অল্প একটু দাড়ি মুখে। মাথায় এলোমেলো চুল। উদাসীন মুখ। অনেক পাল্টে গেছে, তবু এ মুখ আমি ইহজন্মে ভুলব না। আমি থমকে গেলাম। কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকাল আমার হৃৎপিণ্ড। তারপরই কোন অতীত থেকে মার মার করে লুঠেরা সৈনিকদের মতো ছুটে এল অপমানের স্মৃতি।

এক গাঢ় গম্ভীর স্বর বলল, সুমিতা? সুমিতা বোধহয় ওপরে আছে।

আমি ঘরটা পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম, কি করছি তা টের না পেয়েই।

সুমিতা উল ছড়িয়ে বিছানায় বসা। আলুথালু চেহারা। আমাকে দেখেই করুণ গলায় বলে উঠল, আজও হয়ে ওঠেনি রে! কী করব বল, পরশু দাদা এসেছে এতদিন বাদে। শুধু হৈ-চৈ হচ্ছে। কিছু করতে পারছি না। বোস না। দাদা তোকে দেখল?

আমি মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ।

কথা বললি?

কেন?

সুমিতা উলের কাঁটায় মন দিতে মাথা নিচু করে বলে, এমনি।

না এমনি নয়। ঘটনার ভিতর দিয়ে আমি একটা আবছা প্যাটার্ন দেখতে পাচ্ছি। আমার ভিতরটা শক্ত হয়ে উঠছে। আমি রেগে যাচ্ছি। কিন্তু বলতে পারছি না।

সুমিতা মৃদু স্বরে বলল, এতদিন অমেরিকায় ছিল। কত কষ্ট করেছে বল। বিদেশে গিয়েও প্রথম দিকে খুব কষ্ট করতে হয়েছে।

এসব শুনে আমার কোনও লাভ নেই। তাই চুপ করে বসে রইলাম।

সুমিতা বলে, কাল নাকি তোদের লরি খারাপ হয়েছিল রাস্তায়।

হ্যাঁ।

ইস, আমি এ বছর যেতে পারলাম না। দাদা এল তো। কী করে যাব বল! কথাই ফুরোচ্ছে না।

আজকাল দাদার সঙ্গে কথা বলিস? আগে তো ভয় পেতি।

তখন কি দাদা এরকম ছিল, না আমরাই ছিলাম! বড় হয়েছি না?

তোর দাদার অহংকার কমেছে?

সুমিতার মুখটা কালো হয়ে গেল।

একটু চুপ করে থেকে বলল, অহংকার! দাদার অহংকার করার মতো কী ছিল বল! খেতে পেতাম না আমরা, চেয়েচিন্তে চলত। দাদা এত লাজুক ছিল যে কোনওদিন কিছু মুখ ফুটে চাইতে পারত না। ওর খিদে পেলে আমরা কখনও টের পেতাম না। না রে, দাদা অনেক কষ্ট পেয়েছে।

ভাল।

তুই কি দাদাকে ওরকম ভাবিস?

আমি তো অমলেশদা সম্পর্কে কিছু জানি না, কী ভাবব?

তবে যে অহংকারের কথা বললি!

ভাল ছাত্র ছিলেন, অহংকার থাকতেই পারে।

ওরকম বলিস না রে! আমেরিকায় যা স্কলারশিপ পেত তার বেশির ভাগটাই পাঠিয়ে দিত আমাদের। নিজে আধপেটা খেয়ে থাকত। দিনরাত পড়ত।

ওসব শুনে আমার কী হবে?

দাদাকে কেউ কখনও খারাপ বলেনি রে!

কার্ডিগানটা হলে ওটা তুই আমাকে দিয়ে আসিস। শুধু হাতটা পুরো করিস না থ্রি কোয়াটার করিস।

সুমিতা মাথা নেড়ে বলে, ঠিক আছে। একটু দেরি হবে কিন্তু। দাদা আছে তো, তাই।

সুমিতা আমাকে এগিয়ে দিতে এল নীচে। স্কুটারে ওঠার আগে যখন হেলমেট পরছি তখন শুনলাম সুমিতা বারান্দা থেকে তার দাদাকে চাপা গলায় ডেকে বলল, দাদা, এই বসন।

গাঢ় স্বরটি বলল, জানি।

আজ বহুকাল বাদে সেই অপমান আমার সর্বাঙ্গে বেশ জলবিছুটির মতো জ্বলছে। বার বার দাঁতে দাঁত পিষে ফেলছি। স্কুটার আমি এত জোরে চালাইনি কখনও। কাছেই বাড়ি, মাত্র তিনটে বাড়ি পর। তবু এত জোরে স্কুটার ছেড়েছি যে সময়মতো থামতে পারলাম না। বেমক্কা ব্রেক কষলাম। স্কুটারটা সেই ধাক্কায় ঘোড়ার মতো লাফিয়ে উঠল। তারপর স্কুটার এক দিকে, আমি অন্যদিকে ছিটকে গেলাম। কী জোর লাগল বাঁ হাতটায়! চোখ ভরে এল জলে। রাস্তার অপমানশয্যা ছেড়ে যখন উঠলাম, তখন শরীরের চেয়েও ব্যথা অনেক বেশি হচ্ছিল মনে।

রাস্তায় লোক জড়ো হওয়ার আগেই স্কুটারটা টেনে তুলে আমি ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরে এলাম।

তিনতলায় আমার নির্জনতায় ফিরে এসে দেখলাম, বাঁ হাত কনুই পর্যন্ত ছড়ে ছত্রখান হয়েছে। রক্ত পড়ছে খুব। মাথাতেও লেগেছে, হেলমেট ছিল বলে ততটা নয়। কোমরেও কি বেশ চোট? হবে। কিন্তু সেসব আমাকে একটুও কাহিল করল না। আমি ঘরে এসে চুপ করে বসে রইলাম চেয়ারে। ভূতগ্রস্তের মতো। তিনতলায় ঘরদোরের সেই শ্রুতির অতীত কিছু একটা হু-হু, করে বয়ে যাচ্ছে। বড় বেশি হু-হু। বড় বেশি খাঁ-খাঁ।

ধরা পড়লে বকুনি খেতে হবে, বন্ধ হবে স্কুটার চড়া। তাই ক্ষতস্থান ধুয়ে অ্যান্টিসেপটিক লাগাতে হল। শীতকাল বলে সুবিধে, একটা ফুলহাতা ব্লাউজ পরে রইলাম। কিন্তু সব ক্ষতই কি চেপে ঢেকে রাখা যায়? বয়ঃসন্ধিতে বুদ্ধিভ্রংশতাবশে লেখা একটি নিদোষ চিঠির জবাবহীনতার অপমান আজ শতগুণে ফিরে আসে কেন?

নতুন একটা রেস্টুরেন্ট খুলেছে শহরে। খুব নাম হয়েছে। বিকেলে জ্যেঠু নিয়ে গেল সেখানে খাওয়াতে। বেশ ঝা চকচকে দোকান। মফস্বল শহরের পক্ষে দারুণ রেস্টুরেন্ট।

জ্যেঠুর ব্লাডসুগার ধরা পড়েছে। খাওয়া দাওয়ায় অনেক বারণ আছে। আমি চোখ পাকিয়ে বললাম, তুমি কিন্তু সব খাবে না। মেনু দাও, আমি বেছে দিচ্ছি।

জ্যেঠু মুখখানা তোম্বা করে বলে, ওরে, একদিনে কিছু হয় না।

না জ্যোঠু, ব্লাডসুগার খুব খারাপ জিনিস। তুমি স্টু আর স্যালাড খাও। আর দুখানা তন্দুরী রুটি।

দু চামচ ফ্রায়েড রাইস খাই?

আচ্ছা, আমার প্লেট থেকে তুলে দিচ্ছি।

তোর কী হয়েছে বল তো! মুখচোখ ফ্যাকাসে লাগছে।

তোমরা সবসময়ে আমাকে লক্ষ্য করো কেন জ্যেঠু? আর কোনও কাজ নেই বুঝি তোমাদের?

আচ্ছা খা। কী যেন একটা বলি বলি করছিল জ্যেঠু। বার বার চেষ্টা করল। বলল না।

সন্ধেটা বেশ কাটল। সুস্বাদু খাবারের পর জ্যেঠু নিয়ে গেল ভিডিও গেম খেলতে। আজ কী যে হল, একদম ভাল স্কোর করতে পারলাম না।

রাতে সারা শরীর জুড়ে ব্যথার তানপুরা বাজতে লাগল। তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে, ঝঙ্কার তুলছে ব্যথা। চোটটা কতখানি তা আমি পড়ে গিয়ে এমন টের পাইনি ভাল করে। একটু জ্বর-জ্বরও লাগছে কি? একটু বেশি শীত করছে না? তার চেয়েও বেশি, ঘরে একটা হু-হু করে বয়ে যাওয়া কিছু। কী বয়ে যায় আমার ঘরে?

ঘুম আসছিল না। উঠে তিনটে ঘরের আলো জ্বেলে দিলাম। তারপর এ ঘর থেকে ও ঘর ঘুরে বেড়াতে লাগলাম ভূতগ্রস্তের মতো। এইসব ঘরে একদিন ঘুরে বেড়াত আমার সেই বালবিধবা ঠাকুমা রসময়ী। তার জীবনে কোনও রসকষ ছিল না, আনন্দ ছিল না। রসময়ী রেস্টুরেন্টে খেতে পারত না। স্কুটার চালাত না। ভিডিও গেম খেলতে যেত না। রসময়ী শুধু গয়না হাঁটকাত। শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলত। শুধু নিঃসঙ্গতার হাত ধরে বসে থাকত। রসময়ীর বুকের সেই শূন্যতাই কি হু হু করে বয়ে যায় এই ঘরে? তার দীর্ঘশ্বাসই কি কানে আসে আমার?

আলমারির গায়ে মস্ত আয়না। আমি মুখোমুখি টুল পেতে বসলাম। দাদু বলত, বসনের মুখে রসময়ীর আদল আছে।

আছে, আমি জানি। রসময়ীর কয়েকটা ফটো আছে অ্যালবামে। একটু বেশি বয়সের ফটো। তবু মুখের আদল তো বদলায় না। নিখুঁত সুন্দরী। আজ রসময়ীর জন্য আমার একটু কষ্ট হচ্ছিল। আমার জন্য নাকি গয়না রেখে গেছেন তিনি। বড় অবাক কথা। আমি যে জন্মাব তা রসময়ী জানতেন কী করে?

সকালে বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছিলাম না। হাত টাটাচ্ছে, কোমর ব্যথায় অবশ, মাথা ধরেছে। শরীরে বাজছে জ্বরের বাঁশি। তার চেয়েও বড় কথা এই শীতের রোদ-ঝলমল সকালেও আমার চারদিকে সেই হু-হু। সেই খাঁ-খাঁ।

শরীর খারাপ টের পেলে সমস্ত বাড়িটা এসে হামলে পড়বে আমার ওপর। ডাক্তার আসবে, ওষুধ আসবে, বড়মা আর ঠাকুমা এসে থানা গাড়বে ঘরে। সে বড় জ্বালাতন। ছোটোখাটো অসুখ বিসুখ আমি তাই চেপে যাই।

কলেজে যাওয়ার জন্য ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে নিচ্ছিলাম। বড়মা ঘরে এল, কলেজে যাচ্ছিস নাকি?

হ্যাঁ বড়মা।

বেশ।

বড়মা কিছু একটা বলতে চায় আমাকে। সাপের হাঁচি বেদেই চেনে। ওই মুখচোখ, এই অকারণে এসে কলেজে যাচ্ছি কি না খোঁজ নেওয়া এসব পূর্বলক্ষণ আমার চেনা।

জানিস তো, যতীন বোসের বড় ছেলেটা ফিরেছে।

ওটা কোনও খবর নয় বড়মা। সুমিতা আমার বন্ধু।

ও হ্যাঁ, তাই তো! ছেলেটা কিন্তু বেশ।

আমি জবাব না দিয়ে শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে লাগলাম।

বড়মা বললেন, এইসব বলছিল আর কী, বিয়ের কথা টথা চলছে।

আমি বড়মার দিকে ফিরে একটু হাসলাম, কথাটা কী বড়মা?

বড়মা একটু ভয় খেয়ে বলে, ওরে, সে আমি বলিনি। তোর জ্যেঠুই বলছিল, ছেলেটা বড় ভাল। গরিবের ছেলে, স্ট্রাগল করে এত বড় হয়েছে।

বড়মা, আমি আঁচ করতে পারছিলাম।

রাগ করলি নাকি?

না। তোমাদের ওপর রাগ করব কেন? কিন্তু দোহাই তোমাদের, ভুলেও কোনও প্রস্তাব দিও না।

কেন রে?

কারণ আছে।

কলেজেই বেশ বেড়ে গেল জ্বরটা। ক্লাসের পড়া শুনব কী, সারাক্ষণ কানে এক হুতাশনের হু-হু শব্দ। বুকের মধ্যে খাঁ-খাঁ। অফ পিরিয়ডে কলেজের মাঠে রোদে পিঠ দিয়ে গাছতলায় বসে রইলাম। পাশে বসে প্রীতি তার নীতীশের কথা বলতে লাগল। বকবক বকবক। আমার কানে ঢুকলই না। কানে কেবল সেই হু-হু। ঘর-সংসারের মধ্যে যে কী পায় মানুষ!

আমি হঠাৎ প্রীতির দিকে চেয়ে নিষ্ঠুরের মতো বললাম, তোর নীতীশ তোকে কতটা ভালবাসে?

প্রীতি লজ্জা পেয়ে বলে, আর বলিস না। যা পাগল। ওর শ্বাসে প্রশ্বাসে নাকি আমার চিন্তা।

দেখ প্রীতি, যদি ধর হঠাৎ কেউ তোর মুখে অ্যাসিড বাল্‌ব ছুঁড়ে মারে আর তোর মুখটা যদি ভয়ংকরভাবে পুড়ে যায় একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায়, যদি তুই দেখতে বীভৎস হয়ে যাস, তাহলেও কি তোর নীতীশ তোকে বিয়ে করবে? ভালও বাসবে?

প্রীতির মুখটা যা দেখতে হল বলার নয়। আমার দিকে চেয়ে হাঁ করে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, মাগো! তুই কি ডাইনী? ওসব অলক্ষুণে কথা বলে কেউ?

আমি একটা ঘাসের ডাঁটি চিবোতে চিবোতে আনমনে বললাম, ওসব ভালবাসার কোনও দাম আছে যা রূপ-নির্ভর, অবস্থা-নির্ভর, কন্ডিশনাল? আমি বিশ্বাস করি না রে, আমি ভালবাসায় একদম বিশ্বাস করি না। প্রেমিক-প্রেমিকাদের সম্পর্কটা ভীষণ ঠুনকো।

তুই একটা রাক্ষুসী। বুকটা এমন করছে আমার! কী সব যা তা বললি বল তো!

একটু ভেবে দেখিস প্রীতি।

আমার মনটা এত খারাপ লাগছে।

তুই বোকা। তাই জীবনে সুখী হবি। বোকা না হতে পারলে সুখ নেই।

রাতে যখন মস্ত টেবিলে সবাই খেতে বসেছি তখন খেতে খেতে হঠাৎ জ্যেঠু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, শোন বসন। একটু ভেবে একটা কথার জবাব দিস।

আমার খাওয়া থেমে গেল। জ্যেঠুর দিকে চেয়ে বললাম, কী বলবে তা আমি জানি। আমার জবাব হল, না। কিছুতেই না।

সবাই চোখাচোখি করল। নীরব হয়ে গেল।

জ্যেঠু খুব মৃদুস্বরে বলল, ঠিক আছে। তবে ছেলেটা অনেক দিন অপেক্ষা করে ছিল। বিয়ের নাকি প্ল্যানই ছিল না। বাড়ি থেকে খুব চাপাচাপি করায় বলেছে, আমি যার জন্য এতকাল অপেক্ষা করেছি… থাক গে। অমত জানিয়ে দেওয়াই ভাল।

আমি ঘরে চলে এলাম। আমার তিনটে ঘর জুড়ে হু-হু করে এক নির্জনতা বয়ে যেতে লাগল।

দু দিন পর এক ছুটির দুপুরে সুমিতা আমার কার্ডিগান নিয়ে এল। মুখটা শুকনো। বলল, পরে দেখ তো, ফিট করছে কিনা।

পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। বেশ ভাল হয়েছে। সুমিতার হাত খুব ভাল।

পছন্দ?

খুব।

সুমিতা বসল। বলল, কার্ডিগানটা শেষ করার জন্য দুদিন রাত জাগলাম। ভাবলাম, এবার শীত পড়েছে, বসনটা হয়তো কার্ডিগানটা ছাড়া কষ্ট পাবে।

আমি ঠোঁট উল্টে বললাম, দূর, তাড়া ছিল না তো! আমার কত আছে।

তা কি জানি না? তবু ভাবছিলাম, হয়তো এটার জন্যই বসে আছিস। শখের জিনিস তো!

কেন কষ্ট করতে গেলি?

কারও কারও জন্য কষ্ট করেও আরাম আছে। তোরা আমাদের জন্য কম করেছিস? অভাবের দিনে মা তো কাকিমার কাছেই ছুটে আসত!

দেখ সুমি, ওসব শুনলে আমার রাগ হয় তা জানিস? যাদের আছে তারা তো দিতেই পারে। ওতে মহত্ত্বটা কী আছে শুনি!

সুমিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কাকিমার একটা কথা আমার খুব ভাল লাগত। কাকিমা বলত, আমি অন্যের দীর্ঘশ্বাস সইতে পারি না।

আমার মা একজন মহৎ মহিলা, আমি জানি। আমি সেরকম মহৎ হতে পারব না হয়তো! অমন পতিভক্তি, অমন সংসারের মায়া, অমন অভাবের সঙ্গে লড়াই-না, আমি পেরে উঠব না।

সুমিতা হঠাৎ বলল, দাদা কাল চলে যাচ্ছে।

আমি আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গায়ের কার্ডিগানটা দেখতে লাগলাম।

সুমিতা মৃদুস্বরে বলল, তুই ফিরিয়ে দিলি দাদাকে?

আমি জবাব দিলাম না।

সুমিতা একটু ছলছল চোখ করে বলল, আমরা তো জানতাম না যে, দাদার তোকেই পছন্দ। কে জানে কেন। অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, বসনকে তুমি কবে দেখলে দাদা, তুমি তো মেয়েদের মুখের দিকেই তাকাও না। ছিলেও না তো এদেশে। বসনকে তাহলে কবে পছন্দ করলে। দাদা শুধু বলে, ও তুই বুঝবি না। বসনের একটা শোধবোধ পাওনা আছে। কী মানে কথাটার তা জানি না। তুই জানিস?

না তো! আমার সমস্ত শ্রবণ জুড়ে সেই অদৃশ্য হু-হু শব্দের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। বধির করে দিচ্ছে আমাকে।

কত বিয়ের প্রস্তাব আসছে, সব ফিরিয়ে দিল দাদা।

শোন সুমি, তোর দাদাকে খুব গোপনে একটা কথা বলতে পারবি?

কি কথা?

আগে আমার গা ছুঁয়ে দিব্যি কর যে, তোর দাদা ছাড়া কাউকে কখনও বলবি না।

আমার ভয় করছে। আচ্ছা, দিব্যি করছি। খারাপ কিছু বলবি না তো!

খারাপ। আমাকে ছুঁয়েছিস, বাড়িতে গিয়ে ভাল করে ডিজইনফেকট্যান্ট দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলিস।

সুমিতা চমকে উঠে বলে, কেন রে?

শোন, খুব বিশ্বাস করে বলছি তোকে। আমার বাড়ির কাউকে বলিনি। বললে খুব হৈ-চৈ হবে। জানিস তো, আমি কত আদরের।

বল না বসন। আমার বুক কাঁপছে।

আমি চমৎকার একখানা অভিনয় করলাম। হঠাৎ শাড়ির আঁচল তুলে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললাম। তারপর কান্নার মধ্যেই বললাম, আমার কুষ্ঠ হয়েছে রে।

সর্বনাশ!

গোপনে ডাক্তার দেখিয়েছি। কাউকে বলিনি।

সুমিতা পাথরের মতো বসে রইল।

খানিকক্ষণ কেঁদে আমি আমার ট্র্যাজিক মুখখানা উন্মোচন করে ধরা গলায় বললাম, তোর দাদাকে বলিস।

সুমিতা ভীত মুখে চেয়ে ছিল আমার দিকে। তারপর বলল, কেন হল রে? ঠিক জানিস তো?

তিনজন ডাক্তার একই কথা বলেছে।

আমি বাঁ হাতখানা খুলে একটু দেখালাম ওকে। ক্ষতের ওপর পুরু ক্রিম দেওয়া ছিল বলে এমনিতেই বিচ্ছিরি দেখাচ্ছিল হাতটা। তার ওপর সুমিতার সাহসই হল না ভাল করে দেখার। সে মুখ ঢেকে ফেলল। হয়তো চোখে জল এল ওর।

বোকা সুমিতা থমথমে মুখ করে চলে যাওয়ার পর একা ঘরে আমার হেসে ওঠাই হয়তো উচিত ছিল। কিন্তু তার বদলে কান্না এল। প্রেমকে আমার কেন বিশ্বাস হয় না?

আমি যখন ছোট ছিলাম তখন প্রায়ই দেখতাম, আমাদের সদর দরজার চৌকাঠের পাশে রোজ ভোরবেলা কে বেশ একটা রক্তগোলাপ রেখে যায়। পরে বড় হয়ে একটু একটু করে জেনেছি, যে আমার মায়ের কোনও ব্যর্থ প্রেমিক। প্রতিদিন সে তার রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ডের প্রতীক রেখে যেত দরজার বাইরে। ওই গোলাপটি কুড়িয়ে নেওয়ার লোভে রোজ আমি ভোরবেলা উঠে সদর দরজা খুলতাম। একদিন বোধহয় একটু আগেই দরজা খুলে ফেলেছিলাম। সেদিন লোকটাকে দেখতে পেয়ে যাই। লম্বা, সুন্দর চেহারার একজন মানুষ। হাতে গোলাপ, আমাকে দেখে যেন প্রথমটায় ভয় পেল। তারপর লজ্জায় একটু হাসল। গোলাপটা আমার হাতে দিয়ে কিছু না বলেই চলে গেল। কী যে ভাল লেগেছিল আমার সেদিন!

অনেকদিন হয় আর কেউ গোলাপ রেখে যায় না আমাদের দরজায়। প্রেম কি ফুরিয়ে যায়? ক্লান্ত হয়? শেষ হয়? প্রেম ভয় পায়?

সন্ধেবেলা আমাদের বাড়িটা বড় নিঝুম। আমার তিনতলার ঘর যেন আরও শব্দহীন আজ। শুধু নীরবে বয়ে যাচ্ছে এক বিরহের স্রোত। হু-হু হু-হু…

সিঁড়িতে একটা পায়ের শব্দ উঠে আসছিল। চেনা শব্দ নয়। আমি সচকিত হলাম। এভাবে কেউ উঠে আসে নাকি? এভাবেই কি আসা উচিত? প্রতিরোধ ভেঙে, ভয় ভেঙে, আমার প্রত্যাখ্যান ডিঙিয়ে কেন আসে ও? কে আসছে আমি যে জানি! কি করে জানি তা তো জানি না।

আমি পড়ার টেবিল থেকে তড়িৎ-গতিতে উঠে পড়লাম। আমি দৌড়ে চলে গেলাম ভিতরের ঘরে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইলাম চুপ করে। চোখ ভেসে যাচ্ছিল জলে।

পায়ের শব্দটা আমার চৌকাঠে এসে থেমে আছে। সেই নিরন্তর হু-হু শব্দটা ধীরে ধীরে কোথায় মিলিয়ে গেল।

———

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *