॥ বসন ॥
বনভোজনের পর সন্ধেবেলা মস্ত চাঁদ উঠল পাহাড়ের মাথায়। এত বড় চাঁদ আমরা কেউ কখনও দেখিনি। চারদিকে পাহাড়, জঙ্গল, নদী, নুড়িপাথর আর বালিয়াড়ি সব যেন রূপকথায় ডুব দিয়ে নতুন রূপ ধরে ভেসে উঠল। কী সুন্দর যে হল সন্ধেটা! আমাদের অনেকের গলায় গুনগুন করে উঠল গান। প্রথমে গুনগুন, তারপর জোরে, তারপর চেঁচিয়ে কোরাস।
লরিতে আমাদের ডেগ, কড়াই, হাতখুন্তি তোলা হচ্ছে। রান্নার লোক আর যোগালিরা ওসব কাজ করছে। এখনও ফিরতে একটু দেরি আছে আমাদের। আমরা মেয়েরা হাত ধরাধরি করে গান গাইতে গাইতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিলাম।
দিদিমণিরা চেঁচিয়ে বলছিলেন, বেশি দূর যেও না তোমরা। আর আধঘণ্টার মধ্যেই আমরা রওনা হব।
কে কার কথা শোনে! এই সন্ধেটা কি আর ফিরবে? এমন জ্যোৎস্না, এমন চমৎকার জায়গা ছেড়ে কে গিয়ে ঘুপচির মধ্যে ঢুকতে চায় বাবা?
একসঙ্গে সকলের থাকা হয় না। বড় দল ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যায়। এটাই নিয়ম। আমরাও ভাগ হয়ে ভাগে পড়লাম চারজন। পাহাড়ি নদীর ধার দিয়ে দিয়ে অনেকটা এগিয়ে গেলাম আমরা। দিনের বেলাতেও হেঁটেছি। কিন্তু তখন জ্যোৎস্না ছিল না, জলে ছিল না চাঁদের ছায়া, তখন ছিল এমন রূপকথার মতো জগৎ।
বড় বড় পাথরের টুকরো নদীর মধ্যে ছড়ানো। একটা ছিপছিপে নদী কত পাহাড় ভেঙে পাথর বয়ে এনেছে এই অবধি। এখন শীতের টানে তত স্রোত নেই। কী ঠাণ্ডা আর স্ফটিকের মতো পরিষ্কার জল!
আমরা চারজন দুটো পাথরের ওপর ভাগ হয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ গলা মিলিয়ে গাইলাম আমরা, চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে… ও চাঁদ চোখের জলে… চাঁদ নিয়ে আর গান মনে পড়ছিল না। গলা মিলছে না, গানের কথা ভুল হচ্ছে। আমরা ‘ধ্যাত্তেরি’ বলে হেসে উঠলাম।
আমার পাশে প্রীতি। অন্য পাথরটায় সুপ্রিয়া আর সীমন্তিনী। বসে বসে আমরা বকবক করতে লাগলাম।
খুব শীত। থম ধরে থাকা শীত তবু সহ্য করা যায়। কিন্তু উত্তুরে হাওয়া দিলে হাড় অবধি কাঁপিয়ে দেয়। সন্ধের পর সেই হিমেল হাওয়াটা ছেড়েছে। কার্ডিগান আর স্কার্ফ ভেদ করে হাওয়া আমাদের ঝাঁঝরা করে ঢুকে যাচ্ছে শরীরের ভিতরে। আমি তো পেটের মধ্যে অবধি ঠাণ্ডা টের পাচ্ছিলাম। আজ রাতেই আমার সর্দি হবে। নাক সুরসুর করছে। জ্বরও হতে পারে। হোক গে। কী ভাল লাগছে বসে থাকতে!
নিজেদের অজান্তেই আমরা চারজন আবার দুজন দুজন করে ভাগ হয়েছি। কথা হচ্ছিল চারজনের সঙ্গে চারজনের। এখন হচ্ছে প্রীতিতে আমাতে। সুপ্রিয়া আর সীমন্তিনীতে।
প্রীতির সঙ্গে কথা বলে সুখ নেই। কোনও না কোনওভাবে ও ওর নীতীশের কথা এনে ফেলবেই। নীতীশ ওর হবু বর। পাঁচ বছর ধরে প্রেম করার পর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এখন ওর মুখে কেবল নীতীশ আর নীতীশ। নীতীশ ওকে একটা সেন্ট দিয়েছে, বিয়ের পর নীতীশ ওকে কাশ্মীর নিয়ে যাবে, নীতীশ চাকরিতে একটা প্রমোশন পেয়ে ওকে বলেছে, তুমি ভীষণ পয়া… এইসব। ওর নীতীশকে আমরা ভালই চিনি। এমন কিছু নয়। কিন্তু ও এমন বলবে যেন নীতীশের মতো আর কেউ হয় না।
পুরুষ মানুষদের মেয়েরা কি পছন্দ করে? এ কথাটার জবাব কোনও মেয়ে কি দিতে পারে? যদিও কলেজের মেয়েরা আলাদা করে বনভোজন করি, কিন্তু আমাদের কলেজটা কো-এডুকেশন। একবার বনভোজনে ছেলেরা খুব অসভ্যতা করেছিল বলে এখন আর একসঙ্গে পিকনিক হয় না। ছেলেদের হ্যাংলামির জন্য বনভোজনের আনন্দটাই মাটি হয়ে যায়। শুধু বনভোজন, রোজ কলেজেই কি কিছু কম ব্যাপার হয়? মেয়েদের নজরে পড়ার জন্য, হীরো হওয়ার জন্য ছেলেরা কত কীই না করে! কেউ কেউ তো পাউডার মেখেও আসে। যার স্বাস্থ্য ভাল সে মাসল ফুলিয়ে বেড়ায়। মেয়েদের কমনরুমে আমরা সেসব নিয়ে হেসে গড়াই।
নীতীশের কথা ফেঁদে বসার জন্য প্রীতি উসখুস করছিল। হঠাৎ বলল, জানিস বসন,…।
আমি বুঝলাম এবার নীতীশের কথা আসছে।
আমি দুম করে জিজ্ঞেস করলাম, তোদের বিয়ে কবে যেন!
প্রীতি বলল, বিয়ে! সে বৈশাখের আগে নয়। আষাঢ়ও হতে পারে। ওর তো ছুটিই নেই। প্রমোশন পাওয়ার পর যা কাজ বেড়েছে। আর ওকে ছাড়া অফিস অন্ধকার। ম্যানেজার তো বলেইছে, নীতীশ, তুমি না থাকলে অফিস অচল।
বিয়ের পরও কি তুই পড়াশুনো চালিয়ে যাবি?
ও মা, চালিয়ে যাব না! আমার শ্বশুর আর শাশুড়ি তো বলেই দিয়েছে, বউমা, যত পারো কোয়ালিফিকেশন বাড়াও। সংসারের কিছুই তোমাকে করতে হবে না। শেখো, জানো, বড় হও।
আমার খুব হাসি পেল। প্রীতি খুব সাধারণ ছাত্রী। ওর কোয়ালিফিকেশন খুব বেশি বাড়বার কথা নয়। আর প্রীতি হল সংসারী টাইপের। বিয়ের পরই ও এমন মজে যাবে সংসারে যে, পড়াশুনোর কথা ওর মনেই পড়বে না।
প্রীতি তার নীতীশের কথা শুরু করে দিল। আমি চারদিকে জ্যোৎস্নার অপার্থিব আলোয় কোন অচেনা জগতে চলে যাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে প্রীতির ছেঁড়া ছেঁড়া কথা কানে আসছিল, নীতীশকে তো জানিস, কেমন অনেস্ট আর আপরাইট… ও তো বলে, তুমি আমার গাইডিং কোর্স… ওরা কিচ্ছু চায় না রে, এমন কী ঘড়ি-আংটি অবধি নেবে না বলেছে… টাকাপয়সা একদম চেনে না নীতীশ, সব আমাকে সামলাতে হবে…
কোনও পুরুষের প্রতি আমার কেন এরকম আকর্ষণ নেই?
আজ যখন আমরা এক দঙ্গল মেয়ে পিকনিকে আসছিলাম, তখন একটা জিপ গাড়িতে কয়েকটা অবাঙালি ছেলে অনেক দূর পর্যন্ত আমাদের পিছু নিয়েছিল। দিদিমণিরা বারণ করলেন, যেন আমরা ওদের দিকে না তাকাই। ছেলেগুলো শিস দিয়ে, হিন্দি গান গেয়ে, হাতের মুদ্রায় অনেক ইশারা ইঙ্গিত করেছে। মেয়েরা সবাই তাই দেখে কী হাসাহাসি, ঢলাঢলি! শুধু আমারই রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল।
আমার পিসতুতো দাদার কলিগ এক ইনজিনিয়ার সবে এ শহরে এসেছে বদলি হয়ে। কয়েকদিনের মাত্র পরিচয়। মাসখানেক আগে লোকটা এক সন্ধেবেলায় আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, আপনি কি ফ্রি আছেন?
ছেলেদের হাড়ে হাড়ে চিনি। গলার স্বর শুনেই বুঝলাম, হৃদয়ঘটিত ব্যাপার। বেশ কড়া গলায় বললাম, তার মানে?
লোকটা বেশ স্মার্ট। একটু হেসে বলল, মানে এগোনো যাবে কিনা। কোনও চান্স দেবেন কি?
আমি বললাম, আমি ফ্রি আছি, আর এরকমই থাকতে চাই।
স্মার্ট লোকটা ঘাবড়াল না। অপমানটা হজম করে বলল, থ্যাংক ইউ।
সেইখানেই সম্পর্কটা শেষ।
পর্যায়ক্রমে দুজন অধ্যাপক এবং একজন ডাক্তারও আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। সরাসরি আমাকে নয়, আমার বাবার মারফত। আমার বাবা বলেছেন, মেয়েকে বলে দেখি।
আমি নাকচ করে দিয়েছি।
পুরুষ জাতটাকে যে আমি কেন বিশ্বাস করতে পারি না তা আমার আজও বুঝে ওঠা হল না।
আমি পাথর থেকে নেমে পড়ে বললাম, একটু ঘুরি। বসে থেকে ভাল লাগছে না।
এবার আমি দলছুট। একা। ওরা কেউ এল না।
দিদিমণিদের একজন মণিকাদির সরু গলা পাচ্ছি, মেয়েরা, তোমরা চলে এসো। লরিওলা আর দেরি করতে রাজি নয়। রাত দশটা অবধি কন্ট্রাক্ট।
জানি, সবকিছুরই একটা বাধ্যবাধকতা আছে। এই যে মুক্তি, ছুটি, জ্যোৎস্নায় অপরূপ প্রকৃতির মধ্যে স্বপ্নময় পদচারণা এ থেকে নিজেকে ছিঁড়ে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। তেমনি একদিন সিঁথিমৌর পরে, গয়নায় শাড়িতে চন্দনের ফোঁটায় সেজে বসতে হবে বিয়ের পিড়িতে।
নারী ও পুরুষ নাকি পরস্পরের পরিপূরক। আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয়, পুরুষকে ছাড়াই আমার চলে যাবে।
হাঁটতে হাঁটতে আমি অনেকটা দূর চলে আসি। নিঃসঙ্গতাই আমার হাত ধরে থাকে। পাশাপাশি হাঁটে আমার সঙ্গে। নিঃসঙ্গতাই আমার প্রিয় বন্ধু।
আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই স্কুলে যেত অমলেশ। লম্বা রোগা চেহারা, জামার বোতাম গলা অবধি আটকানো, পরনে মোটা ধুতি, মাথায় চুল পাট করে আঁচড়াননা। কোনওদিকে তাকাত না, সোজা হেঁটে যেত। আমাদের তিনটে বাড়ির তফাতে তার বাড়ি। টিনের চাল আর বাঁশের বেড়ার ঘর। তার বাবা মাইনর স্কুলের মাস্টারমশাই। কখনও জামা গায়ে দিতেন না, খালি গায়ে একটা উড়নি জড়িয়ে সর্বত্র যেতেন। অমলেশের মা মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ি আসতেন চাল, তেল, নুন বা চিনি ধার করতে। তাঁর মুখেই শুনতাম অমলেশ প্রায়ই না-খেয়ে স্কুলে যায়, কারণ ঘরে চাল বাড়ন্ত হয় মাঝে মাঝে। তিনি দুঃখ করে বলতেন, ছেলেটা লেখাপড়ায় ভাল, কিন্তু তেমন করে খেতে দিতে পারি কই! কচুঘেঁচু খেয়ে আর কতদূর কী করবে?
অমলেশ স্কুলের ভাল ছাত্র। কিন্তু শুধুই ভাল ছাত্র। তার সারাক্ষণের সঙ্গী। কেবল বই। সে ফুটবল মাঠের পাশ দিয়ে নির্বিকার হেঁটে চলে যেত, একবার ফিরেও তাকাত না খেলার দিকে। সে সিনেমা দেখত না, আড্ডা মারত না, শুধু দেদার নম্বর পেয়ে ফাস্ট হয়ে এক ক্লাস থেকে আর এক ক্লাসে উঠত। সবাই বলত, গুড বয়। ভেরি গুড বয়।
আমি ছোটোবেলা থেকে তাকে দেখে আসছি। একইরকম পোশাক। একইরকম আঁচড়ানো চুল। কোনওদিন ফুলহাতা শার্টের হাতদুটো গুটিয়ে পরতে দেখিনি তাকে।
আমি তখন খুবই ছোটো, ছ সাত বা আট বছর বয়স, তখন অমলেশ এইট নাইনের ছাত্র। বয়সের তুলনায় খুব গম্ভীর। সে কারও বাড়িতে যেত না। তবে তার দুটো বোন আর একটা ছোট ভাই আমাদের বাড়িতে বহুবার সত্যনারায়ণ পুজোর সিন্নি বা হরির লুটের বাতাসা খেয়ে গেছে। আমাদের পুরোনো জামাকাপড় মা তাদের দিয়ে দিত, তারা সেসব পরে দিব্যি বেড়াত। শুধু অমলেশদাই ছিল অন্যরকম। যেন কারও সঙ্গেই তার কোনও সম্পর্ক নেই। এই পৃথিবীতে সম্পূর্ণ উদাস ও পথভ্রষ্ট হয়ে সে এসে পড়েছে।
মনে আছে, একদিন অমলেশদা যাচ্ছে, পাড়ার ছেলেরা টেনিস বল দিয়ে ফুটবল খেলছে রাস্তার পাশে। কাদামাখা সেই বলটা হঠাৎ দুম করে এসে অমলেশদার সাদা জামার বুকে লাগল। অন্য কেউ হলে দাঁড়াত, বিরক্ত হত, একটু বকাঝকাও করত। কিন্তু অমলেশদা এক সেকেন্ডের জন্য দাঁড়িয়ে জামায় বলের দাগটা মাথা নিচু করে একবার দেখল। তারপর চুপচাপ চলে গেল।
অমলেশদা যেবার স্কুলের শেষ পরীক্ষায় গোটা পশ্চিম বাংলায় নাইনথ স্ট্যান্ড করে পাশ করল তখনও আমি ফ্রক পরি। অমলেশদার মা এসে আমার মাকে বললেন, কলকাতার বড় কলেজে পড়তে ডাকছে অমলকে। তা সে কি আর আমাদের কপালে হবে! অত খরচ।
গোটা শহরে খবরটা নিয়ে বেশ হৈ-চৈ হল। এই ছোট শহর থেকে কেউ সচরাচর এমন কৃতিত্বের পরিচয় দেয় না। স্কুলে আর টাউন হলে দুটো সভা হল অমলেশদাকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য। টাউনহলের সভায় আমি আর দুজন মেয়ের সঙ্গে উদ্বোধনী সংগীত গেয়েছিলাম। অমলেশদার কপালে চন্দনের ফোঁটা পরানো আর গলায় মালা দেওয়ার ভার পড়ল আমার ওপর। অমলেশদার কপালে ফোঁটা দিতে অনেকটা ঝুঁকতে হয়েছিল। লজ্জায় মাথা নত করে ছিল অমলেশদা। মালাটা গলায় দিতে না দিতেই খুলে পাশে সরিয়ে রাখল। মুখে চোখে কৃতিত্বের কোনও দীপ্তি বা অহংকার নেই। যেন নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে পারলে বাঁচে।
অমলেশদার কলকাতার কলেজে পড়তে যাওয়া হল না। এ শহরের কলেজেই ভর্তি হল। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই যেত আগের মতো। পরিবর্তনের মধ্যে একটু লম্বা হল, সামান্য গোঁফ দাড়ির আভাস দেখা দিল। পরের পরীক্ষায় আবার দারুণ রেজাল্ট। শহরে আবার হৈ-চৈ।
অমলেশদার বোন সুমিতাকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতাম, হ্যাঁ রে, অমলেশদা বই ছাড়া আর বুঝি কিছু চেনে না?
না। ওর শুধু বই।
তোদের সঙ্গে গল্প করে না?
খুব কম। যা ভয় পাই দাদাকে! যখন আমাদের পড়ায় তখন সারাক্ষণ বুক দুরদুর করে।
খুব বকে বুঝি?
না না, একদম বকে না। কিন্তু এমন করে ঠাণ্ডা চোখে তাকায় যে তাতেই আমাদের হয়ে যায়। ভীষণ কম কথা বলে তো। যা কথা সব মায়ের সঙ্গে।
অমলেশদা সম্পর্কে আমার কেন জানি না, খুব জানতে ইচ্ছে করত। গম্ভীর লোকটা আসলে কেমন, রাগী না রসকষ আছে, কাঠের পুতুল না রক্তমাংসের মানুষ। কিন্তু ওদের বাড়িতে যাওয়া আমাদের বিশেষ হয়ে উঠত না। ওদের ঘরে বসবার জায়গা নেই। কেউ গেলে ওরা এমন ছোটাছুটি করত, দোকানে যেত ধারে মিষ্টি আনতে বা চায়ের চিনি জোগাড় করতে যে আমাদের অস্বস্তিতে পড়তে হত। হতদরিদ্র বলেই বোধহয় অতিথি এলে ওরা আপ্যায়ন করার জন্য অস্থির হয়ে পড়ত। এ জন্য মা বলত, যাওয়ার দরকার কী?
অমলেশদার তিন ভাই বোন অমিতা, সুমিতা, অলকেশ সবাই নিজের নিজের ক্লাসের ফাস্ট গার্ল বা বয়। কিন্তু কেউ অমলেশদার মতো মুখচোরা আর বই-সর্বস্ব নয়। অলকেশ ভাল ফুটবল আর ব্যাডমিন্টন খেলত। সুমিতা আর অমিতা গান গাইত, সেলাই ফোঁড়াই করত।
তখন আমার বয়ঃসন্ধি উঁকি ঝুঁকি মারছে। আনচান করে মন, শরীর। প্রথম ঋতুদর্শন বয়ে আনল ভয় ও শিহরণ। জীবনের অজানা সব জানালা দরজা হাট করে খুলে দিল কে। শরীরে লজ্জাজনক নানারকম পরিবর্তন ঘটে যায়, বদলে যায় বাইরের পৃথিবীও।
সেই সময়ে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বোকার মতো কাজটা করে ফেলি। সেই লজ্জা আজও আমাকে কুঁকড়ে রাখে। আমি অমলেশদাকে একটা চিঠি দিই। চিঠিতে তেমন দোষেরও কিছুই ছিল না। শুধু লিখেছিলাম, আমি আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করতে চাই। আপনাকে আমার খুব ভাল লাগে।
চিঠির কোনও জবাব এল না।
আমি মাকে ধরলাম, মা, অমলেশদাকে বলো না আমাকে পড়াতে। অত ভাল ছাত্র।
মা আপত্তি করল না। কিন্তু খোঁজ নিয়ে বলল, না, ও টিউশনি করে না। খুব লাজুক ছেলে তো।
ব্যাপারটা সেখানেই মিটে যেতে পারত। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, অমলেশদা আমার চিঠি পায়নি।
কিন্তু তা নয়। একদিন সুমিতা আমাকে এসে বলল, হ্যাঁরে, কী অদ্ভুত কাণ্ড! দাদা কাল তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল আমাকে।
আমি ভীষণ চমকে উঠলাম, কী কথা?
জিজ্ঞেস করছিল তুই কে, কোন বাড়ির মেয়ে, এইসব।
বুকের মধ্যে কেমন করছিল আমার। ভয়, অনিশ্চয়তা, শিহরন। আমার চিঠির কথা অমলেশদা বলে দেয়নি তো ওকে? গলা প্রায় বুজে আসছিল। জিজ্ঞেস করলাম, আর কী বলছিল?
আচ্ছা, তুই কি দাদাকে কখনও মুখ ভেঙিয়েছিলি? বা আওয়াজ দিসনি তো!
কেন বল তো!
দাদার যেন একটু রাগ-রাগ ভাব দেখলাম। আমি ভাবলাম, এই রে, বসন হয়তো মুখটুখ ভেঙিয়েছে।
আমার বুকটা পাথর হয়ে গেল হঠাৎ। রেগে গেছে? রাগবে কেন? একটা মেয়ে ভাব করতে চাইলে এমন কী দোষ?
সুমিতা বলল, আমি অবশ্য বলেছি, বসন ভীষণ ভাল মেয়ে। লেখাপড়া, গান বাজনায় সব দিকে চৌখস। স্বভাবও শান্ত। কক্ষনো কোনও অসভ্যতা করে না।
পরদিন থেকে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে অমলেশদা আর যেত না। বাড়ির সামনে মস্ত মাঠ। সেটা ঘুরে অনেক দূর দিয়ে যেত।
আমার জগৎ-সংসার যেন চুরমার হয়ে গেল এই অপমানে। বয়ঃসন্ধির প্রথম রহস্যের ঘেরাটোপ যখন আমাকে ঘিরে ধরেছে, যখন আমার কল্পনার রাজ্যে হাজার রঙের আলোর খেলা, তখনই হঠাৎ এই নির্মম অপমান যেন আমার উদ্ভিন্ন নারীত্বকেই ধিক্কার দিল। ভেঙে পড়ল আমার চারদিককার চেনা পৃথিবী। যেন বৈধব্যের দীর্ঘ বিষণ্ণতা ধীরে ধীরে উঠে এল পাতালপুরীর অন্ধকার থেকে।
অন্য মেয়ে হলে এ রকম হত না। এ বয়স তো উড়ে উড়ে বেড়ানোরই বয়স। চঞ্চল, মতিচ্ছন্ন, হাল্কা চলন হয় বয়ঃসন্ধিতে। তখন কাকে বাছব তা ঠিক করতেই হিমসিম খেতে হয়। অনেকের মনোযোগ পেতে ভাল লাগে। কিন্তু আমি তো অন্য মেয়ে নই, আমি বসন। আমি এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা নিয়েই জন্মেছি।
যদি কেউ আজও জিজ্ঞেস করে, তুমি কি অমলেশের প্রেমে পড়েছিলে? আমি বুকে হাত রেখে বলতে পারব না, হ্যাঁ। কারণ, সেটা সত্যি কথা বলা হবে না। তার সঙ্গে আমার জীবনে একটিও বাক্য বিনিময় হয়নি, চোখাচোখি অবধি না। অমলেশদা দেখতে সুন্দর নয়, স্বাস্থ্যবান নয়, স্মার্ট নয়, শুধু গুড বয়। মেয়েরা শুধুমাত্র গুড বয়ের প্রেমে কমই পড়ে। আমি শুধু ভাব করতে চেয়েছিলাম। কেন জানি না। কারও সঙ্গে ভাব করার একটা ইচ্ছে যখনই হয়েছিল তখন ওই মানুষটার কথাই আমার মনে হয়েছিল।
লোকটা আমার চিঠির জবাব দিল না। পথ বদল করল। রাগ করল আমার ওপর। আমার ওই বয়সে পুরুষ জাতটার ওপর বিতৃষ্ণা জাগিয়ে দিতে ওইটুকুই ছিল যথেষ্ট।
অমলেশদা স্কলারশিপ পেয়ে চলে গেল কলকাতায়। কিছুদিন পর বিদেশে কোথায় যেন। অমলেশদাদের ভাঙা ঘর পাকা হল। দোতলা উঠল। হতদরিদ্র পরিবারে দেখা দিল কিছু সচ্ছলতা। সুমিতা, অমিতা স্ট্যান্ড না করলেও টপাটপ ভাল রেজাল্ট করে স্কুলের গণ্ডি ডিঙোল। অলকেশ এবার পরীক্ষা দেবে। সবাই জানে সেও ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পাবেই। ওদের পরিবারের সঙ্গে এখনও আমাদের বেশ ঘনিষ্ঠতা। আমার আর অমলেশদার মধ্যে কী হয়েছিল কেউ জানে না। আসলে কিছুই হয়নি এমন, যা চোখে পড়ার মতো।
অথচ আমার জীবনটাই পাল্টে দিল সেই নীরব, ঘটনাহীন ঘটনা।
নিঃসঙ্গতার হাত ধরে আমি জ্যোৎস্নায় হেঁটে হেঁটে অনেকটা চলে গেলাম। একা থাকতে আজকাল আমার বেশ লাগে। এই যে একটু বিষণ্ণতা, একটু মন খারাপ, অতীতের নানা অপমানের স্মৃতিতে একটু ভার হয়ে থাকা বুক, চাপা অভিমান, সামান্য হিংসের হুল— এসবই যেন আমার বেঁচে থাকার ঝালমুন। নইলে বড় আলুনি লাগত।
শীতের নদী বালিয়াড়ির মস্ত আঁচল বিছিয়ে রেখেছে। ফটফট করছে জ্যোৎস্না। এত আলো যে, ছুঁচ পড়লেও কুড়িয়ে নেওয়া যায়। নদীর বাঁকের মুখে আমি এসে দাঁড়ালাম। ওদিকে একটা নির্জন পাহাড়। স্তব্ধ, মৌন, স্থির। পায়ের কাছ দিয়ে নদী তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। জলের মধ্যে নুড়ি পাথর অবধি দেখা যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। আর চারদিককার জনহীন খাঁ খাঁ শূন্যতার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার মনে হল, এই যে আমি এত একা, আমার জন্য যে পৃথিবীতে কোথাও কেউ অপেক্ষা করে নেই, আমাকে কেউ যে ভালবাসে না, এটাই আমার পক্ষে ভাল। খুব ভাল।
শোভনা দিদিমণির গলার স্বর বিপন্ন মানুষের আর্তনাদের মতো কানে এল, বসন! বসন! কোথায় গেলে তুমি, সবাই লরিতে উঠে পড়েছে! শিগগির এসো।
জ্যোৎস্না ও নির্জনতার কাছে, রূপকথার রাজ্যে আমার একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস রেখে ফিরে এলাম।
দিদিমণিরা খুব বকলেন, বড্ড ইররেসপনসিবল মেয়ে তুমি! কত রাত হয়েছে জানো! একজনের জন্য সকলের কত দেরি হয়ে গেল! তোমরা আজকালকার মেয়েরা কী যে হয়ে যাচ্ছ দিনকে দিন!
একা থাকতে আমার বেশ লাগে, আবার দঙ্গলেও খারাপ লাগে না। হাসি, খুনসুটি, গল্প করতে করতে একা-আমিকে ভুলেই যাই। আমি যেন দুটো মানুষ। হাঁচোড় পাঁচোড় করে শাড়ি সামলে উঁচু লরিতে উঠতে খুব হাসাহাসি হল। শতরঞ্জিতে বসলেন আমাদের সাতজন দিদিমণি, ডেগ কড়াই ইত্যাদির ফাঁকে ফাঁকে মেয়েরা। লরির ডালায় বসলাম আটদশজন। সামনের দিকে কয়েকজন দাঁড়িয়ে রইল। বেশ ঠাসাঠাসিই হয়ে গেল। ডালায় বসতে দিদিমণিরা বারণ করায় কয়েকজন নেমে ওল্টানো ডেগ কড়াই আর বালতির ওপর বসে পড়ল। কড়াই আর বালতির হাতল থাকায় সেগুলো উপুড় করলে খাপে খাপে বসে না। লরির ঝাঁকুনিতে ঢকঢক করে নড়তে লাগল। আর তা নিয়ে হাসির ধুম।
খানিকক্ষণ হাসাহাসির পর আমরা আবার গান ধরলাম। লরি শহরের দিকে এগোচ্ছে। আমরা জ্যোৎস্নায় প্লাবিত এক অপার্থিব উপত্যকা ছেড়ে চলেছি অপরিসর ঘরের দিকে, ঘুপচির দিকে। মানুষ যে কেন ঘরবাড়ি বানাতে শিখল! সেই আদ্যিকালে পাহাড়ে, গুহায়, গাছের তলায় থাকত মানুষ। বেশ ছিল সেটা। বহু জন্ম আগে আমিও হয়ত ছিলাম এক গুহা-মানবী। পাথর ছুঁড়ে শিকার করতাম, আগুনে ঝলসে খেয়ে নিতাম মাংস, পাহাড়-জঙ্গলে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতাম। বন্ধনহীন জীবন।
গানে গানে, গল্পে, ঠাট্টায় অর্ধেক পথ পেরিয়ে এলাম আমরা। শহরে পৌঁছতে রাত দশটা হয়ে যাবে, তারপর যে-যার বাড়ি ফেরা। কিন্তু সব লক্ষ্যেরই অনিশ্চয়তা থাকে। বন্দনা দিদিমণি যখন ঘড়ি দেখে শিখা দিদিমণিকে বললেন, “আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাব, ঠিক তখনই লরিতে একটা হেঁচকি উঠতে লাগল।
লরির হেঁচকি তোলা দেখেও আমরা হাসাহাসি করতে লাগলাম।
শোভনাদি বিরক্ত হয়ে বললেন, উঃ, তোমাদের হাসির চোটে অস্থির হয়ে গেলাম। লরিটা এরকম করছে কেন? ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করো তো!
জিজ্ঞেস করতে হল না। লরি রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। ড্রাইভার ক্লিনার নেমে বনেট খুলে আলো জ্বেলে কী যেন দেখতে লাগল।
মাধুরীদি জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে ড্রাইভার?
ড্রাইভার জবাব দিল, টানছে না। তেলে ময়লা আসছে।
যাবে তো।
যাবে। ঠিক করে নিচ্ছি।
দেরি হবে না তো?
না না, পাঁচ মিনিট লাগবে। বসুন।
পাঁচ মিনিট গড়িয়ে পনেরো মিনিট। তারপর আধঘন্টা।
উদ্বিগ্ন দিদিমণিরা গলা বাড়িয়ে বললেন, কী হয়েছে বলবে তো! এতগুলো মেয়ে, আমাদের একটা রেসপনসিবিলিটি আছে। চলবে?
ড্রাইভার একটু অনিশ্চয়তার গলায় বলে, দেখছি দিদিমণি। সাকশনে গড়বড় করছে।
শোভনাদি রেগে গিয়ে বললেন, তোমরা যে কেন এত দায়িত্বহীন! একটা খারাপ লরি নিয়ে ট্রিপ দিলে? এখন কী হবে? কতটা পথ এখনও বাকি!
মেশিনের ব্যাপার দিদিমণি, কিছু কি বলা যায় আগে থেকে। গত সপ্তাহে ওভারহল করানো হয়েছে।
কিছুক্ষণ পর বোঝা গেল, লরি বেশ ভালরকম গণ্ডগোলে পড়েছে। মেয়েদের হাসি বন্ধ হয়ে গেল। দিদিমণিরা রাগারাগি করতে লাগলেন।
ইন্দিরাদি বললেন, লরি যদি না চলে তাহলেও আমাদের তো ফিরতেই হবে। ড্রাইভার, তুমি অন্য কোনও লরি থামাও।
ক্লিনার ছেলেটা সেই চেষ্টাও করল। ছুটির দিন এবং বেশি রাতে খুব কম ট্রাকই যাচ্ছে। তার মধ্যে একটা থামল। সেটা চায়ের বাক্সে বোঝাই। ট্রাকের ড্রাইভার নেমে এসে আমাদের ড্রাইভারকে খানিকক্ষণ সাহায্য করে ফের ট্রাক চালিয়ে চলে গেল। আর দুটো ট্রাক থামল না। একটা প্রাইভেট গাড়ি থামল। কিন্তু তাতে চারটে মাতাল। একজন মাতাল বলল, এত মেয়েছেলে কোথায় চালান যাচ্ছে ভাই? রাতের অন্ধকারে আবু ধাবি পাচার হচ্ছে নাকি?
আর একজন অল্প মাতাল তাকে ধমক দিয়ে বলল, যাঃ, সব ভদ্রলোকের মেয়ে দেখছিস না! পিকনিক পাটি।
তিন নম্বর মাতাল বলল, আরে ড্রাইভার সাহেব, ট্যাঙ্কের মুখ খুলে একটা পাঁইট ঢেলে দাও, লরি উড়ে যাবে।
মাতালরা দাঁড়াল না। তাদের ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল।
ঘণ্টা খানেক বাদে ড্রাইভার লরিতে স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।
স্টার্টারের শব্দ হুড়ম হুড়ম করে খানিকক্ষণ আমাদের ভরসা দিল মাত্র। লরি নড়ল না।
ইন্দিরাদি আর্তনাদ করে উঠলেন, দশটা যে এখানেই বেজে গেল! এখন কী হবে?
ড্রাইভার খুব লজ্জা-লজ্জা মুখ করে বলল, ব্যাটারিটা ডাউন আছে।
শোভনা দিদিমণি বললেন, তাহলে কী হবে?
একটু ঠেলে দিলেই চলবে।
ঠেলবে কে?
দিদিমণিরা কি একটু হাত লাগাবেন? বেশি দরকার নেই। একটু ঠেললেই হবে।
শুনে আমরা হৈ-হৈ করে উঠলাম। কেন ঠেলতে পারব না? আমরা কি অবলা? দুপুরে আজ মাংস খাইনি? ঝুপ ঝুপ করে নেমে পড়তে লাগলাম আমরা। দিদিমণিরা নানারকম আপত্তির শব্দ করতে লাগলেন, এই সাবধান! লরি হঠাৎ স্টার্ট নিয়ে চলতে শুরু করলে কী হবে? লরি ঠেলা কি মেয়েদের কাজ?
কী জগদ্দল ভারী লরিটা! আমাদের ঠেলায় প্রথমে একটুও নড়ল না।
শিখাদি ওপর থেকে বললেন, দাঁড়াও, আমরাও নামছি। আর শোননা, সবাই মিলে একসঙ্গে ঠেলতে হবে। অত হেসো না তোমরা। হাসলে গায়ে জোর থাকে না।
শুনে আমরা আরও হাসতে লাগলাম।
দিদিমণিরা নেমে এলেন। ইন্দিরাদি বললেন, কুলিদের দেখোনি? কেমন হেঁইও হেঁইও করে রেল লাইনের স্লিপার লাগায়? দাঁড়াও, সবাই মিলে ওরকম কিছু করতে হবে।
এই বলে তিনি “খরবায়ু বয় বেগে” গানটার একটা লাইন ধরে ফেললেন, আমি কষে ধরি হাল, তুমি তুলে ধরে পাল, হেঁই মারো মারো টান, হেঁইও… হেঁইও… সবাই মিলে একসঙ্গে বলো হেঁইও…
বলব কী, হাসিতে পেট ফেটে যাচ্ছে।
শুক্লা বলল, আমরা তত টানছি না দিদিমণি, ঠেলছি।
ওই হল।
হাসলে সত্যিই গায়ের জোর থাকে না। আমরা এত হাসছি যে, লরিটা আমাদের ঠেলা টেরই পাচ্ছে না।
শেষ অবধি অবশ্য সকলের হাসি থামল। ঠেলার চোটে লরি একটু একটু এগোতে লাগল। স্টার্টারের ধাক্কায় চমকে চমকে উঠতে লাগল। ভু রু র রু ত… ভু র র র রু ত… তারপর হঠাৎ আমাদের সবাইকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে ঘড়ঘড় করে স্টার্ট নিয়ে ফেলল। আমরা তুমুল হর্ষধ্বনি করে উঠলাম।
লরি ফের জঙ্গলের রাস্তা ধরে ছুটতে লাগল। লরির কানায় বেসামাল বসে আমার মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ফিরে যাচ্ছি। ফিরে যাচ্ছি কেন?
প্রীতি কখন আমার পাশে এসে বসেছে কে জানে। কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, এই বসন, শোন, আমার বাঁ কানের রিংটা কোথায় খুলে পড়ল বল তো!
কী করে বলব?
হুকটা একটু লুজ ছিল। লরি ঠেলার সময় পড়ে গেছে বোধহয়। কী হবে এখন?
আমি বললাম, অত ভাবছিস কেন? আজকে এমন বনভোজন, এমন জ্যোৎস্না, তোর রিংটাকে এই জ্যোৎস্নার কাছে উৎসর্গ করে দে।
তুই ভীষণ অদ্ভুত আছিস! কী হবে এখন! মা যে খুব বকবে!
বকুক না। তোর নীতীশ তোকে কত গয়না দেবে।
প্রীতি রাগ করে বলে, হ্যাঁ দেবে। কত দেবে জানা আছে! মাকে গিয়ে যে কী বলব!
কানের একটা রিং-এর জন্য এই রাত্রিটা, এর এত জ্যোৎস্না, এত ঐশ্বর্য সব ব্যর্থ হয়ে গেল প্রীতির কাছে। মুখ গোমড়া করে বসে রইল পাশে। প্রীতির মতো মেয়েদের জন্য বোধহয় এ সব নয়। প্রীতির জন্য ঘুপচির ঘর, বশংবদ স্বামী, ভরা ভর্তি সংসার।
আর আমার জন্য? আমি তা জানি না।
কিছুক্ষণ পর আমার প্রীতির জন্য একটু মায়া হল। মুখটা বড্ড ভার করে বসে আছে। বললাম, শোন, তুই ভেবে নিতে পারিস না যে, দুলটা হারায়নি?
কী করে ভাবব? ওরকম ভাবা যায় নাকি?
কেন যাবে না? দুলটা যদি রাস্তায় পড়ে গিয়ে থাকে বা আর কোথাও, তাহলে সেখানেই পড়ে আছে। তাই না?
সেই তো!
তাহলে এক জায়গায় তো আছেই সেটা! তুই মনে কর তোর রিংটা ওখানে তুই-ই রেখে এসেছিস।
দূর! কী যে সব বলিস পাগলের মতো! কোনও মানে হয় না।
অনেক রাতে বাড়ি ফিরে একটু বকুনি শুনে শুয়ে পড়লাম। গভীর রাত অবধি ঘুম এল না। মাতাল-মাতাল লাগছিল নিজেকে। আমার ছোট কৌটোয় আজ অনেক আনন্দ ভরা হয়েছে। ঢাকনা বন্ধ হচ্ছে না। আমি ঘুমোবো কী করে? মা যেমন কখনও ঠোঙার চিনি কৌটোয় ঢালতে গিয়ে বিপদে পড়ে যায়, কৌটো উপচে যাচ্ছে, ঠোঙার চিনি তখনও ফুরোয়নি। কৌটো ঠুকে ঠুকে জায়গা করে ফের চিনির শেষটুকু সাবধানে ঢালে, তবু ফুরোয় না। কী জ্বালাতন তখন! আমার অবিকল সেই অবস্থা।
প্রীতি তার কানের একটা রিং হারিয়ে এসেছে। আর আমি! আমি তো আমার গোটা অস্তিত্বই ফেলে এসেছি ওই জ্যোৎস্নাপ্লাবিত জনহীন উপত্যকায়। টের পাচ্ছি, আমি এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছি সেখানে। এলোচুল শ্লথ পা, গলায় একটু গানের গুনগুন, চারদিকে সোনার গুঁড়ো ঝরিয়ে দিচ্ছে মস্ত চাঁদ। নদীর জলে নুড়ি পাথরে ঢেউ ভাঙার মৃদু শব্দ। কী গহিন, কী গভীর স্বপ্নের মতো সুন্দর।
আমি যদি মরি ঠিক ভূত হব। পৃথিবীর সবচেয়ে নির্জন উপত্যকায় পাহাড়ে, জঙ্গলে, বালিয়াড়িতে ঘুরে ঘুরে বেড়াব। ঝড়ের মুখে দাঁড়িয়ে হাঃ হাঃ করে হেসে উঠব। বৃষ্টিতে ঠায় দাঁড়িয়ে ভিজব। কিছুতেই মেয়ে হয়ে জন্মাব না আর।
হঠাৎ শুনতে পেলাম, এই নিশুতরাতে চাটুজ্জে বাড়ির পাগল বউটা বেসুরো গলায় গান গাইছে, যত পারো পয়সা বাঁচাও, যত পারো পয়সা বাঁচাও… কচুপোড়া কাঁচকলা খাও, ডেঁড়েমুশে গতর খাটাও… যত পারো পয়সা বাঁচাও, যত পারো পয়সা বাঁচাও…
বিছানায় থাকতে পারলাম না। ওই বউটার জন্য আমার বড় কষ্ট হয়। আমার ঘরের জানালার সোজাসুজি বউটার ঘর। কয়েক হাত মাত্র তফাত। চার বছর আগে বিয়ে হয়ে শ্রীময়ী যখন এল তখনই সবাই বলাবলি করেছিল, বউটার এবার হাড়ে কালি লাগবে। চাটুজ্জেরা কৃপণ এবং সেটা প্রায় বংশগত। দাদু কৃপণ ছিল, বাপ কৃপণ, ছেলে কৃপণ। চারু চাটুজ্জে উকিল। মক্কেলরা শুধু পয়সা দিয়ে পার পায় না, কার বাড়িতে কলাটা, কার বাড়িতে মুলোটা হয় সেসব খবর রাখে চারু চাটুজ্জে। দরকার হলে বাড়ি গিয়ে হানা দিয়ে নিয়ে আসে। চারু চাটুজ্জের রোজগার ভাল। ছেলে সুমিতও সরকারি অফিসার। ফ্যানশুদ্ধ ভাত, তরকারির খোসা, আটার ভুশি কিছু ফেলে না ওরা, সব খায়। বউটা ওই অসহ্য কৃপণতা সহ্য করতে পারেনি। পাগল হল, ছেলে হতে গিয়ে। পেটে বড়সড় বাচ্চা ছিল, নরমাল ডেলিভারি হচ্ছিল না। দিশি ধাই তখন ভয় পেয়ে বলেছিল ডাক্তার ডাকতে। সিজারিয়ান করাতে। শেষ অবধি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু হাসপাতালে জায়গা ছিল না। এ শহরে বেশ কয়েকটা নার্সিং হোম আছে। কিন্তু চাটুজ্জেরা সেসব জায়গায় নেয়নি। টানাহ্যাঁচড়ার ধকলে শ্রীময়ী মরতে বসেছিল হাসপাতালের বারান্দায়। অবশেষে অল্পবয়সী একজন গায়নোকলজিস্ট সকালে রাউন্ডে এসে মেয়েটির অবস্থা দেখে নিজেই সিজারিয়ান ডেলিভারি করায় হাসপাতালে। বাচ্চাটা বাঁচেনি। শ্রীময়ী বেঁচে গেল। কিন্তু শ্বশুর আর স্বামীর কৃপণতায় সে এমন ধাক্কা খেয়েছিল আর সেইসঙ্গে সন্তানের শোক মিলে মাথাটা বিগড়ে গেল। এখন ওই গান গায়, হাসে, কাঁদে। আবার ঘরের কাজও করে।
আমি জানালাটা খুলে চাটুজ্জে বাড়ির দিকে চেয়ে রইলাম। ওপাশেও জানালা খোলা। শ্রীময়ী এলোচুলে এই ঠাণ্ডায় খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল শ্রীময়ী। মামারা প্রচুর খরচ করে তার বিয়েটা দিয়ে দেয়। বছর দুই হল শ্রীময়ীর মা মারা গেছে। ওর এখন বাপের বাড়ি বলতেও কিছু নেই। মেয়েটা জ্বলছে, পুড়ছে, মরছে।
আমি মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে চেঁচিয়ে বলি, এই শ্রীময়ী, তুমি ও বাড়িটায় আগুন লাগাতে পারো না? চারদিকে কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দাও। পুড়ে মরুক সবাই।
মা শুনতে পেয়ে একদিন আমাকে বকেছিল। আমার ওপর চাটুজ্জেদের খুব রাগ। তাতে বয়েই গেল। শ্রীময়ী না লাগালে আমিই একদিন গিয়ে আগুন লাগিয়ে আসব।
আমি আস্তে করে ডাকলাম, এই শ্রীময়ী!
শ্রীময়ী গান থামাল। তারপর একটু চুপ থেকে বলল, কী বলছ?
ঘুমোওনি কেন? এত রাতে কেউ গান গায়?
শ্রীময়ী বলল, আজ কেমন জ্যোৎস্না!
জ্যোৎস্না তোমার ভাল লাগে?
নাঃ। আমার কিছু ভাল লাগে না। কান্না পায়।
যাও, শুয়ে পড়ো। ঘুমোও।
আজ আমি পরী হয়ে উড়ে যাব।
কোথায় যাবে?
উড়ে বেড়াব। তুমি এরোপ্লেনে চড়েছ?
না তো!
কেমন লাগে গো?
জানি না।
ভয় করে?
আমার তো খুব ভয় করবে। তুমি শুয়ে পড়ো।
এখন শোবো না। এমন জ্যোৎস্না! বলে শ্রীময়ী আবার গান গাইতে লাগল, যত পারো পয়সা বাঁচাও…
আমি চাপা স্বরে বললাম, এই শ্রীময়ী!
কী বলছ?
তুমি আর কোনও গান জানো না?
জানি।
আর কী গান জানো?
জানি। কিন্তু মনে পড়ছে না।
এটা কিন্তু বিচ্ছিরি গান। একটা ভাল গান গাও না! চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে গানটা জানো?
না তো!
আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব।
আমি শিখব না।
এ গানটা আর গেও না। এটা বিচ্ছিরি গান।
আমার এটাই আসে।
ওরা বুঝি তোমাকে সব সময়ে পয়সা বাঁচাতে বলে?
পয়সা কত দামি জিনিস।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। বাথরুমে চোখে মুখে জল দিতে দিতে মনে হল, না, এ জীবনে আর বিয়ে করব না। কিছুতেই না। বিয়ের চেয়ে মরণ ভাল। মরে যদি ভূত হতে পারি তাহলে চলে যাব সেই উপত্যকায়, পাহাড়ে, জঙ্গলে, নদীর ধারে ধারে এলোচুলে খালি পায়ে গান গাইতে গাইতে…