॥ সোমলতা ॥
আমার স্বামীর নাম চকোর মিত্ৰচৌধুরি। চৌধুরিটা অবশ্য ছেঁটে ফেলেছেন। চকোর মিত্র নামেই পরিচয়। আমার আঠারো বছর বয়সে যখন বিয়ে হয় তখন আমার স্বামী ভেরেণ্ডা ভেজে বেড়ান। গুণের মধ্যে তবলা বাজাতে পারেন, আর বি.এ পাশ। ওঁদের বংশে কেউ কখনও চাকরি করেনি। পূর্ববঙ্গে ওদের জমিদারি ছিল। তার জের ছিল আমার বিয়ে অবধি। শোনা গিয়েছিল, এখনও নেই-নেই করেও যা আছে তাতে ছেলেকে আর ইহজীবনে চাকরি করতে হবে না। বউ-ভাতের আয়োজন এবং শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া আমার গয়নাগাঁটি দেখে আমার বাপের বাড়ির লোকদেরও ধারণা হয়েছিল যে, কথাটা বুঝি সত্যি।
পড়তি বনেদি পরিবারের খুব বারফাট্টাই থাকে। লোক-দেখানো বাহাদুরি করার সুযোগ তারা ছাড়ে না। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির ভিতরকার নানা ছোটখাট অশান্তি আর তর্কবিতর্কের ভিতর দিয়ে জানতে পারি যে, আমার বিয়েতে খরচ করতে গিয়ে তাদের সম্বল প্রায় শেষ। উপরন্তু বাজারে বেশ ধারও হয়েছে।
শাশুড়ি মানুষটি বেশ ভালই ছিলেন। শান্তশিষ্ট এবং খুবই সমবেদনাশীলা। গরিব এবং ধার্মিক পরিবারের মেয়ে তিনি। এ বাড়ির সঙ্গে ঠিকঠাক মিলেমিশে যেতে পারেননি। তিনি আমাকে ডেকে একদিন কাছে বসিয়ে বললেন, ফুচু-র (আমার স্বামীর ডাক নাম) সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়েছে। সেটা তোমার কপাল। ফুচু ছেলে খারাপ নয়। কিন্তু আমাদের শুধু এখন খোলাটা আছে, সার নেই। বিয়ে দিয়েছি, যদি বউয়ের ভাগ্যে ওরও ভাগ্য ফেরে। কোমর বেঁধে ওর পেছনে লেগে থাকো। আস্কারা দিও না। একটু লাই দিলেই শুয়ে-বসে সময় কাটাবে। এ বাড়ির পুরুষদের ধাত তো জানি। বড় কুঁড়ে।
কথাটা শুনে আমার দুশ্চিন্তা হল। বিয়ের পর যদি আমার স্বামীর ভাগ্য না-ফেরে তবে কি এরা আমাকে অলক্ষুণে বলে ধরে নেবেন?
শাশুড়ি দুঃখ করে বললেন, এ সংসার চলছে কিভাবে তা জানো? জমি আর ঘরের সোনাদানা বিক্রি করার টাকায়। বেশিদিন চলবে না। যদি ভাল চাও তো ফুচুকে তৈরি করে নাও।
ভয়ে ভয়ে বললাম, আমি কি পারব মা? উনি কি আমার কথা শুনে চলবেন? যা রাগী মানুষ!
শাশুড়ি হেসে ফেললেন, পুরুষের রাগকে ভয় পেতে নেই। ওদের রাগটা হল শুধুই পটকার ফাঁকা আওয়াজ। বেশি পাত্তা দিও না।
কী করতে হবে তা কি আমাকে শিখিয়ে দেবেন?
ওসব শেখাতে হয় না মা। তোমার মুখ দেখে তো মনে হয় বেশ বুদ্ধিসুদ্ধি আছে। নিজেই ঠিক করে নিতে পারবে কী করতে হবে।
শাশুড়ির সঙ্গে সেইদিন থেকেই আমার একটা সখিত্ব গড়ে উঠেছিল। শাশুড়িদের সম্পর্কে যা সব রটনা আছে তাতে বিয়ের আগে খুব ভয় ছিল। আমার ভাগ্য ভাল যে, শাশুড়ি দজ্জাল নন।
তবে দজ্জালের অভাব সংসারে কখনও হয় না। আমার একটিমাত্র জা, বয়সে বড়। ইনি প্রচণ্ড দজ্জাল। আর একজন বালবিধবা এক পিসশাশুড়ি। বলতে গেলে ইনিই সংসারের সর্বময় কত্রী। অল্পবয়সে বিধবা হওয়ায় তাঁর দাদা ও ভাই তাঁকে স্নেহবশে তোলা-তোলা করে রেখেছেন। ফলে এ সংসারে এঁর দাপট দেখার মতো।
উত্তরবঙ্গের যে শহরে শ্বশুরবাড়ির লোকদের বাস তা ঘিঞ্জি, নোংরা এবং ছোট। জীবনযাত্রায় কোনও বৈচিত্র্য নেই। এঁদের বাড়িটা বেশ বড়। পাকিস্তানে এঁদের আরও বড় এবং অনেকগুলো বাড়ি, প্রচুর জমি ইত্যাদি ছিল। এ বাড়িটাও এঁদের আগে থেকেই ছিল। আমার দাদাশ্বশুর তৈরি করিয়েছিলেন। জমিদারবাড়ি যেমন হয় তেমনি। অনেক ঘর, খিলান, গম্বুজওলা জবরজং ব্যাপার। ভাগিদারও কম নয়। দেশ পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় আত্মীয়স্বজনরা এসে সবাই এ বাড়িতেই আশ্রয় নেন। তাঁদের প্রথমে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল দুর্গত হিসেবে। কিন্তু পরে তাঁরা দাবি তোলেন, এ বাড়ি যখন এস্টেটের টাকাতেই তৈরি তখন এতে তাঁদেরও ভাগ আছে। বাড়িটা দাদাশ্বশুরের নামে, ওয়ারিশান আমার শ্বশুর-শাশুড়ি, এক জ্যাঠাশ্বশুর ও তাঁর মেয়ে, ভাসুর ও স্বামী। কিন্তু সেটা হল কাগজপত্রের মালিকানা। যাঁরা দখল করে বসেছেন তাঁরা দখল ছাড়েননি। মামলা-মোকদ্দমা চলছে অনেকদিন ধরে। সেইসঙ্গে কিছু ঝগড়া কাজিয়াও। তবে পালপার্বণে, বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ ইত্যাদিতে গোটা পরিবার একত্র হয়ে যায়।
এসব বুঝে উঠতে এবং লোকগুলোকে চিনে নিতে আমার কিছু সময় লেগেছিল। একটু বড় বড় কথা বলা এবং সুযোগ পেলেই দেশের বাড়ির জমিদারির গল্প করা এঁদের একটা প্রিয় অভ্যাস। এ বাড়ির পুরুষদের চাকরি-বাকরি-ব্যবসা ইত্যাদিতে আগ্রহ ছিল না। বেশি নজর ছিল ফূর্তির দিকে। তবে আমার যখন বিয়ে হয় তখন বাঁচার তাগিদে কেউ কেউ রুজিরোজগারে মন দিয়েছেন।
আমার স্বামী সম্পর্কে বলতে গিয়েই এত কথা বলা। স্বামী জমিদারবাড়ির ছেলে, আদরে আলস্যে মানুষ। লেখাপড়ার চাড় কম ছিল বলে গড়িয়ে গড়িয়ে বি.এ পাশ। মেজাজটা একটু উঁচু তারে বাঁধা। যখন তবলার রেওয়াজ করেন তখন একটুও বিরক্ত করা চলবে না। ঘুম থেকে ডেকে তুললে রেগে যান। উনি উঠবেন ওঁর ইচ্ছেমতো। বউকে নিয়ে কোথাও যাওয়া ওঁর পোযায় না। স্ত্রীর বুদ্ধি পরামর্শ নেওয়া ওঁর কাছে অপমানজনক।
বয়সে উনি আমার চেয়ে বেশ কিছুটা বড়। আমার আঠারো, ওঁর বত্রিশ। বয়সের এ পার্থক্য নিয়ে আমি আপত্তি তুলিনি, কারণ, আমি একটু বয়স্ক মানুষকেই স্বামী হিসেবে পেতে চেয়েছিলাম। আর আমার বাপের বাড়ি এতই গরিব যে, পাত্রর বয়স বা চাকরি নিয়ে খুঁতখুঁত করা আমাদের পক্ষে শৌখিনতা। তবে বলতে নেই, বয়স বত্রিশ হলেও আমার স্বামী দেখতে অতি চমৎকার। টান লম্বা, ফর্সা, ছিপছিপে, একমাথা ঘন কালো চুল, মুখখানাও দারুণ মিষ্টি। গায়ে যে নীল রক্ত আছে তা চেহারা দেখেই বোঝা যায়। বয়সের পার্থক্য এবং ওঁর গুরুগম্ভীর রকমসকম দেখে আমি ওঁকে ‘আপনি’ করেই বলতাম। সেই অভ্যাস আজও রয়ে গেছে।
বিয়ের কয়েকদিন বাদে ওঁর মুড বুঝে আমি একদিন বললাম, আচ্ছা, আমি এ বাড়িতে কার অন্ন খাচ্ছি তা কেন বুঝতে পারি না বলুন তো!
উনি খুবই অবাক হয়ে বললেন, তার মানে?
আমি এ বাড়িতে কার অন্নে প্রতিপালিত হচ্ছি তা জানতে ইচ্ছে করে।
ওটা কোনও প্রশ্ন হল? তুমি আমি সবাই একই অন্নে প্রতিপালিত হচ্ছি।
আমি যে বুঝতে পারছি না।
বুঝবার দরকার কি? ভাত তো জুটছে, তা হলেই হল।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না। ওটা কাজের কথা নয়। কেউ একজন তত জোগান দিচ্ছেন। তিনি কে?
উনি এ সময়ে বিরক্ত হতে পারতেন, আমাকে ধমকও দিতে পারতেন। আমি অন্তত সেরকমই প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু উনি রাগ করলেন না। গভীর চিন্তিত মুখ করে বললেন, কেন, তুমি কি জানো না?
আমি খুব ভয়ে ভয়ে মৃদুস্বরে বললাম, আপনি রাগ করবেন না। যা জানি সেটা একটুও সম্মানজনক নয়। আমি শুনেছি, সোনা আর জমি বেচে এ সংসার চলে।
উনি হ্যাঁ না কিছু বললেন না। বিকেলের চা খাচ্ছিলেন একতলার জানালার ধারে বসে। জানালার বাইরে কাঁচা ড্রেন, তার ওপাশে নোনা ধরা দেওয়াল। ঘরে পিলপিল করছে মশা, ড্রেনের একটা বিচ্ছিরি গন্ধ আসছে। ভারী বিষণ্ণ আর ভার একটা বিকেল।
উনি খুব ধীরে ধীরে চা খেয়ে কাপটা পুরোনো আমলের কাঠের গোল টেবিলটার ওপর রেখে আমার দিকে চেয়ে বললেন, কথাটা ঠিক। তুমি আরও কিছু বলতে চাও বোধহয়?
আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। ওঁর মুখটা গম্ভীর, গলাটা যেন আরও গম্ভীর। কিন্তু ভয় পেতে শাশুড়িই বারণ করেছেন। আমি বললাম, ঘরের সোনাও লক্ষ্মী, জমিও লক্ষ্মী। শুনেছি এসব বেচে খাওয়া খুব খারাপ।
উনি গম্ভীর বটে, কিন্তু অসহায়ও। সেটা ওঁর পরের কথায় প্রকাশ পেল। উনি একটু গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, কী করা যাবে তা তো বুঝতে পারছি না।
আমি একটু সাহস করে বললাম, দেখুন, সোনাদানা অফুরন্ত নেই। জমিও বোধহয় শেষ হয়ে এল। আমাদের কি সাবধান হওয়া উচিত নয়?
উনি আমার দিকে অকপটে চেয়ে থেকে বললেন, আমাদের বলতে? তুমি কি তোমার আর আমার কথাই ভাবছ?
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, তা কেন? এ বাড়ির সকলে মিলেই তো আমরা।
উনি বিমর্ষ মুখে বললেন, বিয়েতেও আমাদের অনেক খরচ হয়ে গেছে। আচ্ছা, হঠাৎ কথাটা তুললে কেন বলো তো!
আমি গরিব ঘরের মেয়ে, সেটা তো জানেন! গরিবদের বড্ড কষ্ট। আপনাদের যদি গরিব হয়ে যেতে হয় তা হলে কষ্টটা সহ্য হবে না। আপনারা তো আদরে মানুষ।
তোমরা গরিব বলে এ বাড়ির কেউ কখনও তোমাকে অপমান করেনি তো!
তা করেনি। কিন্তু গরিব বলে মনে মনে আমার সবসময় সঙ্কোচ হয়।
উনি মৃদুস্বরে বললেন, সঙ্কোচের কিছু নেই। তোমরা তো আর নিজেদের অবস্থা গোপন করনি। আমরাও জেনেশুনেই কাজটা করেছি। তোমার কি মনে হয় আমি একটা অপদার্থ?
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, তা কেন? আপনাকে আমি কতটা শ্রদ্ধা করি তা আপনি হয়তো জানেন না। আপনি অপদার্থ হবেন কেন? তা নয়। আপনি ইচ্ছে করলেই রোজগার করতে পারেন তো!
কিভাবে করব বলো তো! আমি মোটে বি.এ পাশ। এতে বড়জোর একটা কেরানিগিরি জুটতে পারে। তার বেশি কিছুই নয়, এবং সেটাও পাওয়া শক্ত। চাকরি করব বলে তো কখনও ভাবিনি।
চাকরি না করলেই কি নয়? ব্যবসাও তো করা যায়।
ব্যবসা! সে তো দোকানদারি। ওটা পারব না।
আমি ওঁর ভাব দেখে হেসে ফেললাম। বললাম, আচ্ছা, এখন ওসব কথা থাক। আপনি চা খেয়ে বেরোতে যাচ্ছিলেন, আমি আটকে রেখেছি আপনাকে। আপনি ঘুরে আসুন, পরে দুজনে মিলে কিছু একটা পরামর্শ করব। আপনি তাতে রাগ করবেন না তো!
উনি জবাব দিলেন না, চিন্তিত মুখে বেরিয়ে গেলেন। অন্যমনস্ক ছিলেন বলেই বোধহয় আমার কথাটা ভাল করে কানে যায়নি।
মফস্বল শহরগুলোয় থাকা ভারী একঘেয়ে। বেড়ানোর জায়গা নেই, সিনেমা হল ছাড়া আর কোনও আমোদমোদ নেই, তাও পুরোনো বস্তাপচা ছবি। একমাত্র এ বাড়ি ও বাড়ি গিয়ে কুটকচালি করা। এ বাড়িতে তাও বারণ। যার তার বাড়িতে যাওয়া পরিবারের মর্যাদার পক্ষে হানিকর। সুতরাং সন্ধের পর ভারী বিষণ্ণ আর একা লাগে। কাঁদতে ইচ্ছে করে। মা-বাবার জন্য মন কেমন করা তো আছেই। ছেলেরা তবু আড্ডা মারতে বা তাসটাস খেলতে যায়, কিন্তু মেয়েদের সে উপায়ও তো নেই। আমার শাশুড়ি সন্ধের পর জপতপ করেন। জা আমাকে সহ্য করতে পারেন না। সুতরাং আমি বড্ড একলা।
বাড়ির যে অংশটায় আমরা থাকি তা দক্ষিণ দিকে। একতলা, দোতলা এবং তিনতলা মিলিয়ে ছ-সাতটা ঘর আমাদের ভাগে। উত্তর ভাগে আরও সাত-আটখানা ঘরে থাকে শরিকরা। আমাদের ভাগে লোকসংখ্যা কম। ভাসুরের ছেলেপুলে নেই, শুধু দেবা-দেবী। তাঁরা দোতলায় দুখান ঘর নিয়ে থাকেন। দুখানা ঘর নিয়ে থাকেন জ্যাঠাশ্বশুর। একতলায় একখানা ঘরে আমরা। সামনের দিকে দুখানা ঘর শ্বশুর-শাশুড়ির। তিনতলায় থাকেন আমার পিসশাশুড়ি। তিনখানা বড় বড় ঘর তাঁর কিসে লাগে কে জানে! আমি পারতপক্ষে ওঁর কাছে যাই না। গেলেই এমনভাবে তাকান যে, রক্ত জল হয়ে যায়। মাঝে মাঝে কোনও কারণ ঘটলে তিনতলা থেকে উনি এমন চেঁচান যে, গোটা বাড়ির লোক শুনতে পায়। গলার এত জোর আমি আর দেখিনি। বিয়ের পর আমাকে উনি একদিন ওঁর ঘরে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। খুব ভারী একছড়া খাঁটি সোনার হার পরিয়ে দিয়েছিলেন গলায়। এ পর্যন্ত বেশ ভালই ছিল ব্যাপারটা। কিন্তু তারপর আমাকে এমন অনেক ঠেস-দেওয়া কথা বলেন, এত অপমানজনক যে চোখে জল এসেছিল। তেজী মেয়ে হলে গলা থেকে হার খুলে ফেরত দিত। আমি তা পারিনি। উনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যা বললেন, তা হল, কাঙালী বাড়ি থেকে মেয়ে আনাতে উনি মোটেই খুশি হননি। নিশ্চয়ই এ বাড়ির ঠাটবাট দেখে আমার মাথা ঘুরে গেছে। আমার শাশুড়ির মুণ্ডুপাত করলেন কিছুক্ষণ, আমার মতো হা-ঘরে বাড়ির মেয়ে পছন্দ করে আনার মূলে নাকি উনিই, তা হবে না-ই বা কেন, শাশুড়িও নাকি হা-ঘরে বাড়িরই মেয়ে। ইত্যাদি।
আমার মাঝে মাঝে বিকেল বা সন্ধেবেলায় খুব ছাদে যেতে ইচ্ছে করে। ঘরগুলো এত বিষণ্ণ, এত প্রকাণ্ড, আর এত ভুতুড়ে যে আমি বিকেল আর সন্ধেবেলাগুলো কিছুতেই ঘরে বসে কাটাতে পারি না। ছাদে গেলে তবু ফাঁকা বাতাসে কিছুক্ষণ শ্বাস নেওয়া যায়। একটু পায়চারি করতে পারি, গুনগুন করে গান গাইতে পারি। বাড়ির ছাদটা এজমালি বলে শরিকদের পরিবারের লোকজনও আসে। তাদের মধ্যে দু-চারজন আমার বয়সী মেয়ে-বউ আছে। দু-চারটে কথা হতে পারে তাদের সঙ্গেও। কিন্তু ছাদে যাই না পিসির ভয়ে। খুব সন্তর্পণে সিঁড়ি দিয়ে উঠলেও উনি ঠিক টের পান। ঘরের দরজা খোলা রেখে সিঁড়ির দিকে মুখ করেই বসে থাকেন।
কিন্তু সেদিন আমার ঘরে এতই খারাপ লাগছিল যে, পিসির ভয়কে মাথায় নিয়েও আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভেঙে ছাদে যাচ্ছিলাম। আমার অনেক চিন্তা, অনেক ভয়, অনেক উদ্বেগ। বিয়ের পরেকার যে আনন্দ অন্য সব মেয়ের হয় আমার যেন সেরকম নয়। আমার মনে হচ্ছিল, বিবাহিত জীবনে আমাকে অনেক ভার বইতে হবে, যা আমি হয়তো পেরে উঠব না।
তিনতলায় উঠছি খুব সন্তর্পণে। পা টিপে টিপে। সিঁড়ির মুখোমুখিই পিসির ঘর। আলো জ্বলছে। আমি উঁকি মেরে দেখে নিলাম, পিসি রোজকার মতোই সিঁড়ির দিকে মুখ করে বসে আছেন। ফসা রং, বড় বড় চোখ যেন গিলে খাচ্ছে চারদিককে। একসময়ে খুব সুন্দরী ছিলেন। সৌন্দর্যের কোনও আরতি হয়নি, ভোগে লাগেনি কারও, যৌবন বয়ে গেছে বৃথা। পিসির জীবনটা যে কিরকম হাহাকারে ভরা তা আমি জানি। ভাগ্যের ওপর, দেশাচার কুলাচারের ওপর রাগ করে লাভ নেই। তাই তাঁর রাগ নিরীহদের ওপর ফেটে পড়ে। আমি ওঁকে ভয় পাই ঠিকই, কিন্তু ঘেন্না করি না।
সিঁড়ির শেষ কয়েকধাপ বাকি থাকতে আমি থামলাম। সিঁড়ির মুখটা পেরোতে সত্যিই ভয়-ভয় করছিল। আমি আর একবার সন্তর্পণে উঁকি দিয়ে একটু অবাক হয়ে গেলাম। পিসি স্থির হয়ে বসেই আছেন। চোখ খোলা এবং পলকহীন। মুখটা হাঁ হয়ে আছে। কেন কে জানে আমার বুকটা কেঁপে উঠল। দৃশ্যটা স্বাভাবিক নয়।
আমি সিঁড়ি কটা ডিঙিয়ে পিসির ঘরে ঢুকলাম। পিসিমা! ও পিসিমা!
পিসিমা! ও পিসিমা!
পিসিমা জবাব দিলেন না। দেওয়ালে পিঠ দিয়ে মস্ত বড় মোড়ায় যেমন বসেছিলেন তেমনই বসে রইলেন।
আমি সাবধানে তাঁকে ছুঁলাম। নাকের কাছে হাত ধরলাম। তারপর আমার নিজের হাত-পা যেন হিম হয়ে এল। পিসিমা বোধহয় বেঁচে নেই।
তাড়াতাড়ি ছুটে নীচে আসতে যাচ্ছি। হঠাৎ পিছন থেকে পিসিমার গলা পেলাম, দাঁড়াও। খবরটা পরে দিলেও হবে।
আমি চমকে ফিরে তাকালাম। তা হলে কি পিসিমা মারা যাননি। কিন্তু একই রকমভাবে বসে আছেন। চোখ বিস্ফারিত, মুখ হাঁ করা। সেই হাঁ করা মুখ একটুও নড়ল না। কিন্তু পিসিমার কথা শোনা যেতে লাগল, মরেছি রে বাবা, মরেছি। তোমাদের আপদ বিদেয় হয়েছে।
আমি জীবনে এত ভয় পাইনি কখনও। হার্টফেল হবে নাকি আমার।
তিনতলাটা খুব পছন্দ তোদের, না? আমি মলেই এসে দখল নিবি বুঝি? আর গয়না, টাকা ভাগবাঁটোয়ারা করবি? কোনওটাই হবে না। দাঁড়িয়ে আছিস যে বড়! আয় ইদিকে! কাছে আয়!
ওই হুকুমটা যেন চুম্বকের মতোই একটা জিনিস। ধীরে ধীরে পিসির দিকে টেনে নিচ্ছে আমাকে।
কোথায় পালাচ্ছিলি?
আমি জবাব দিতে পারি না। গলা বোজা। শুধু চেয়ে আছি। পিসির মৃত চোখ আমার দিকে নিবদ্ধ হয়ে আছে।
আঁচল থেকে চাবি খুলে নে। উত্তরের ঘরে যাবি। কাঠের বড় আলমারিটা খুলে দেখবি তলায় চাবি-দেওয়া ড্রয়ার, ড্রয়ার খুললে একটা আলপাকা জামায় মোড়া কাঠের বাক্স পাবি। নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখবি। কেউ টের না পায়। ভাবছিস তোকে দিচ্ছি? কচুপোড়া। মরেছি টের পেলে সব এসে ভাগাড়ে শকুনের মতো পড়বে। তাই সরিয়ে দিচ্ছি। লুকিয়ে রাখবি। ও আমার সাধের গয়না, বিধবা বলে পরতে পারিনি। যদি কখনও পরিস তা হলে ঘাড় মটকে দেব। একটা রতিও যেন এদিক ওদিক না হয়। যা।
মৃতা পিসিমার আঁচল থেকে কিভাবে চাবি খুলেছিলাম আর কিভাবে সেই গয়নার বাক্স বের করেছিলাম তার কিছুই আমি বলতে পারব না। আমার কিছুই স্পষ্ট করে মনে পড়ে না। তবে আমি খুব সচেতনভাবে কাজটা করিনি।
বাক্সটা আঁচলে আড়াল করে ঘরে আসবার সময় দুজন আমাকে দেখতে পায়। একজন আমার জা বন্দনা। বন্দনাদি তখন চাকর ভজহরিকে ডাকতে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে মুখ করে ছিলেন। ভজহরি তার ডাকে উঠে আসছিল। আমি জাকে পাশ কাটিয়ে যখন নেমে যাচ্ছিলাম তখন আমি প্রায় দৌড়োচ্ছি। না তাকিয়ে দেখে ভজহরিকে বললেন, ওটা বউ না ঘোড়া? গেছে মেয়েছেলে বাবা!
ভজহরি আমাকে নামতে দেখে দেওয়ালের দিকে সরে দাঁড়িয়েছিল। সেও আমাকে দেখল।
ওপর থেকে জা ভজহরিকে বলল, কাঁকালে ওটা কী নিয়ে গেল রে? ভজহরি বলল, বাক্সমতো কী যেন!
ভজহরি বলল, বাক্সমতো কী যেন!
বাক্স! বাক্স পেল কোথায়?
আমি এটুকুই শুনতে পেয়েছিলাম। ঘরে এসে দরজাটা বন্ধ করে আমার নতুন ট্রাঙ্কের একদম তলায় বাক্সটা লুকিয়ে রেখে চাবি বন্ধ করে দিলাম। নামিয়ে আনার সময় খেয়াল হয়নি, বাক্সটা কতটা ভারী। রাতের দিকে যখন হাতটা ব্যথা করতে লাগল তখন বুঝলাম।
পিসিমা যে মারা গেছেন এ খবরটা কি আমার সবাইকে দেওয়া উচিত? কিন্তু খবর দেব কি? ঘরে এসে এমন বুক কাঁপতে লাগল, এমন হাঁফ ধরে গেল, মাথাটা এত গণ্ডগোল লাগতে লাগল যে, আমাকে কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকতে হল। ঘটনাটা সত্যিই ঘটেছে কিনা, না কি কী হল, সেটাও ঠিক করতে পারছিলাম না।
তিনতলায় সন্ধের পর কেউ যায় না। রাতে পিসিমা খৈ আর দুধ খান। খৈ তাঁর ঘরেই থাকে। রান্নার ঠাকুর নন্দ ঘোষাল রাত্রে দুধ গরম করে পৌঁছে দিয়ে আসে।
নন্দ ঘোষালই খবরটা এসে নীচে দিল, পিসিঠাকরুন কেমন যেন হয়ে আছেন। লক্ষণ ভাল নয়।
খবর শুনে আমার শাশুড়ি ওপরে গেলেন। তারপর চেঁচিয়ে ভজহরিকে ডেকে বললেন, ওরে কর্তাবাবু আর দাদাবাবুদের ডেকে আন। ডাক্তার ভদ্রকেও খবর দে। এ তো হয়ে গেছে দেখছি।
পিসিমা মারা যাওয়াতে বাড়িতে কোনও হুলুস্থুল পড়ল না। চেঁচামেচি হল না। বাড়ির পুরুষরা একটু জোর পায়ে ফিরলেন। ডাক্তারবাবু নিঃশব্দে ওপরে উঠলেন এবং পনেরো মিনিটের মধ্যেই নেমে চলে গেলেন।
মৃত্যুসংবাদ পেয়েও পিসিমার ঘরে আমার না যাওয়াটা নিশ্চয়ই খুব খারাপ দেখাচ্ছিল। কিন্তু তখন আমার ওপরে যাওয়ার সাধ্য ছিল না। বিছানায় পড়ে আমি গড়িয়ে কাঁদছিলাম।
সেই অবস্থায় আমার স্বামীই আমাকে এসে দেখলেন। খুব অবাক হয়ে বললেন, এ কী! এত কাঁদছ কেন? পিসিমার জন্য? এ তো আশ্চর্য কাণ্ড!
আশ্চর্য কাণ্ডই বটে। কারণ আমি ছাড়া বাড়ির আর কেউ কাঁদেনি। আর আমিও মোটেই পিসিমার শোকে কাঁদিনি। কেঁদেছি ভয়ে আর উদ্বেগে। এমন ভুতুড়ে কাণ্ড ঘটল কেন আমার কপালে?
স্বামী খুব অবাক হলেন। বোধহয় তাঁর মনটাও নরম হল। তিনি ধরেই নিলেন যে আমি পিসিমার শোকে কাঁদছি। বললেন, পিসিমা গিয়ে একরকম ভালই হয়েছে। জীবনে ওঁর কী সুখ ছিল বলো তো! তিনতলার তিনখানা ঘর আগলে বসেছিলেন। দিনরাত গয়না ঘাঁটতেন। আর কোনওদিকে কোনও সুখ বা আনন্দ ছিল না। তুমি যে এত কাঁদছ, তোমার সঙ্গে পিসিমার এত ভাব হল কবে?
আমি জবাব দিতে পারলাম না। কিন্তু স্বামীকে দুহাতে আঁকড়ে বললাম, আপনি শ্মশানে যাবেন না। আমি একা থাকতে পারব না। আমার ভয় করছে।
উনি আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার মনটা যে এত নরম তা জানতাম না তো! বেশ ভাল মেয়ে তুমি।
আমার শাশুড়ি আমাকে ডাকছিলেন, ও ছোটো বউমা! কোথায় গেলে? একবার এসো। এ সময়ে আসতে হয়।
ভজহরিও ডাকতে এল। আমাকে তাই তিনতলায় উঠতেই হল শেষ অবধি। স্বামী আমাকে ধরে ধরেই তুললেন। আমার কান্না দেখে সবাই অবাক।
শাশুড়ি বলেই ফেললেন, ওমা! অত কাঁদার কী?
জা কিছু বললেন না, কিন্তু তিনি যে আমাকে খুব তীক্ষ্ণচোখে নজর করছেন তা আমি টের পাচ্ছিলাম। উনি একটা বাক্স নিয়ে আমাকে নীচে নামতে দেখেছেন।
পিসিমাকে একটা মাদুরে শোয়ানো হয়েছে সিঁড়ির মুখে। শরিকরা সবাই ঝেঁটিয়ে এসেছেন। পাড়াপ্রতিবেশীদের ভিড় জমে গেছে। তবু মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার ভয়-ভয় করছিল। এই বুঝি পিসিমা পট করে আমার দিকে তাকাবেন।
বেশ একটু বেশি রাতেই শ্মশানযাত্রীরা রওনা হয়ে গেল। আমার স্বামী তামার অনুরোধ রাখলেন। নিজে গেলেন না। শরীর খারাপের অজুহাতে রয়ে গেলেন। কেউ তাতে কিছু মনেও করল না।
স্বামীকে ঘটনাটার কথা বলব কিনা তা আমি বুঝতে পারছিলাম না। উনি বিশ্বাস করবেন না। আমি নতুন বউ। আমার সম্পর্কে একটা অন্যরকম ধারণাও হতে পারে। আরও একটা ভয়, পিসিমা গয়নার বাক্সটা সাবধানে রক্ষা করতে বলেছেন। দ্বিতীয় কাউকে না জানানোই ভাল।
পিসিমার সৎকার হয়ে গেল। শ্মশানবন্ধুরা ফিরল। ভোর হল।
সকালে দোতলায় আমার জ্যাঠাশ্বশুরের ঘরে একটা পারিবারিক মিটিং বসল। সেই মিটিং-এ আমাকে ডাকা হয়নি। আমি দুরুদুরু বুকে নিজের ঘরে বসে রইলাম। আমার মন বলছিল, ওঁরা পিসিমার গয়নাগাঁটি এবং তিনতলার দখল কে নেবে তাই নিয়ে আলোচনা করছেন।
ঘণ্টাখানেক বাদে টের পেলাম ওঁরা সবাই মিলে তিনতলায় উঠলেন।
আমি কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না পিসিমার চাবির গোছাটা আমি কোথায় ফেলে এসেছি। ফের যে আঁচলে বেঁধে রেখে আসিনি তা জানি।
ঘণ্টাখানেক বাদে আমার স্বামী থমথমে মুখে নেমে এলেন। তাঁর মুখ দেখে অজানা ভয়ে আমার বুক কাঁপতে লাগল। উনি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে হঠাৎ বললেন, পিসিমার গয়নার বাক্স পাওয়া গেল না।
আমার বুকের ভিতরে বোধহয় হঠাৎ এক গেলাস রক্ত চলকে গেল। কাঁপা গলায় বললাম, গয়নার বাক্স?
হ্যাঁ। সোজা কথা নয়, একশ ভরি সোনা। তার মধ্যে পাকা গিনিই তো চল্লিশ পঞ্চাশটা হবে। পিসিমা বিয়েতে যৌতুক পেয়েছিলেন।
আমি অবাক হলাম। একশ ভরি সোনা তো কম ওজন নয়! আমি অত ভারী বাক্স নামিয়ে আনলাম কী করে?
স্বামী খুব চিন্তিত মুখে বললেন, বউদি অদ্ভুত কথা বলছে। বউদি বলছে গয়নার বাক্স কে নিয়েছে তা নাকি জানে। তবে নাম বলছে না। বাবা শুনে বলছে, এ নাকি নন্দ ঘোষালের কাজ। সে-ই তো যেত বেশি পিসিমার ঘরে।
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, না না। নন্দ ঘোষাল তো পুরোনো লোক।
সেটাই তো কথা। নন্দ ঘোষাল চুরি-টুরি করেনি কখনও।
আমি বিনীতভাবে বললাম, আপনি পিসিমার গয়না নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। ওতে আমাদের কী দরকার?
আমার স্বামী আমার দিকে বিস্মিত চোখে চেয়ে থেকে বললেন, তোমার সোনাদানার ওপর লোভ নেই?
আমি কথা খুঁজে পেলাম। বললাম, লোভ ছাড়া মানুষ নেই। সাধুসন্ত গেরস্থ সবারই কম-বেশি লোভ থাকবেই। স্বয়ং ভগবানই মানুষের ভক্তির ওপর লোভ করেন।
আমার স্বামী অকপট শ্রদ্ধার সঙ্গে আমার দিকে তাকালেন। তিনি আমাকে আবিষ্কার করতে শুরু করেছেন। বললেন, খুব ভাল কথা। কিন্তু বাক্সটা যাবে কোথায়?
তা নিয়ে অন্যরা মাথা ঘামাক। আমার মনে হয় পিসিমার গয়নার সঙ্গে তাঁর আত্মার দীর্ঘশ্বাস মিশে থাকবে। আমাদের ও গয়নার দরকার নেই।
আমার স্বামী এ কথাটাও যেন মেনে নিলেন। তারপর বললেন, মা বলছেন তিনতলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে আমরা যেন ওপরে চলে যাই।
আমি চমকে উঠে বললাম, কেন? আমরা তো এখানে বেশ আছি।
কোথায় বেশ আছি? নীচের তলাটা অন্ধকার, মশামাছির উৎপাতও বেশি। তিনতলায় কত আলোবাতাস। জায়গাও অনেক বেশি। তিনতলায় দাদা-বউদি যাবে না। বাবার হার্ট ভাল নয় বলে মা-বারাও একতলা ছাড়বেন না। জ্যাঠামশাই একা মানুষ, তাঁরও দরকার নেই। আমরা না গেলে ওটা ফাঁকা পড়ে থাকবে।
থাকুক। ওখানে থাকতে আমার ভয় করবে।
আমার স্বামী হাসলেন। হাসলে তাঁকে খুবই সুন্দর দেখায়। আমি তাঁর মুখের দিকে খানিকক্ষণ মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকলাম। তিনি বললেন, মৃত মানুষের কিছুই তো থাকে না। তবে ভয় কিসের?
আমি বললাম, আপনি আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন। তবে আমার মনে হয় মানুষ মরে গেলেও তার কিছু ভাব থেকে যায়। আপনি আমাকে তিনতলায় থাকতে বলবেন না।
স্বামী দুঃখিতস্বরে বললেন, কিন্তু পিসিমা মারা গেলে তিনতলায় গিয়ে থাকব এ ইচ্ছে যে আমার বহুদিনের।
আমি করুণ কান্না-ভেজা গলায় বললাম, কিন্তু আমাদের তো এখানেই বেশ চলে যাচ্ছে। তাই না, বলুন!
উনি আর জোর করলেন না।
বাড়িতে ওদিকে গয়নার বাক্স নিয়ে তুমুল একটা আলোচনা আর তর্কবিতর্ক শুরু হয়েছে। তাতে আমি আমার জায়ের গলা না পেয়ে একটু চিন্তিত হলাম। আমার জ্যাঠাশ্বশুর পুলিশে যাওয়ার কথাও বললেন।
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর আমার জা ভজহরিকে দিয়ে আমাকে ছাদে ডেকে পাঠালেন। সেটা হেমন্তকাল, কিন্তু ছাদে খুব রোদ ছিল তা মনে আছে।
জা আমার দিকে সোজা চোখে চেয়ে বললেন, গয়নাগুলো পাচার করে দাওনি তো!
আমি মৃদুস্বরে বললাম, একথা কেন বলছেন?
তুমি খুব সোজা মেয়ে নও। পিসিমাকে গলা টিপে তুমিই মারোনি তো! তোমার সম্পর্কে এখন থেকে সাবধান হতে হবে। কী সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড।
আমি চুপ করে রইলাম। আমার জা সুন্দরী নন, আবার অ-সুন্দরীও নন। একটু মোটা হয়ে গেছেন বলে তাঁর ফিগার বলতে কিছু নেই। মুখখানা ঢলঢলে। সেই মুখে নিষ্ঠুরতাও আছে। সেই নিষ্ঠুরতাটাই এবারে ফুটে উঠল। বললেন, আমি তোমার নাম কাউকে বলিনি। বলার দরকারও নেই। আমি জানি, পিসিমার একশ ভরির ওপর সোনা আছে।
আমি ন্যাকা সেজে বললাম, আমাকে কেন বলছেন?
ন্যাকা সেজো না। বেশি ন্যাকা সাজলে পুলিশে ধরিয়ে দেব। জ্যাঠামশাই খবরও দিচ্ছেন আজ থানায়। তোমাকে কোমরে দড়ি বেঁধে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাবে। চুরি আর খুনের দায়ে।
ভয় পেয়ে বললাম, আমি কিছু করিনি।
কী করেছ তা তোমার বাক্স-প্যাঁটরা খুললেই বোঝা যাবে, যদি না পাচার করে দিয়ে থাকো। তোমার মতো ভয়ঙ্কর মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি। তুমি সাঙ্ঘাতিক। ঠাকুরপোকেও একটু সাবধান করে দেওয়া উচিত।
আমার চোখ ভিজে এল। এ গল্প কাকেই বা বলা যায়? কে বিশ্বাস করবে?
জা বললেন, তোমার চোখের জল দেখে ভুলব তেমন পাত্রী পাওনি। শোনো, চুরিই যখন করেছ তখন আর অন্য উপায় নেই। আমি ও গয়নার অর্ধেক চাই। পুরো পঞ্চাশ ভরি। আমার বিশ্বাসী স্যাকরা আছে। সে এসে সমান ভাগ করে দেবে। কাকপক্ষীতেও জানবে না। কাল সন্ধেবেলায় সে আসবে। ও সময়ে কেউ বাড়ি থাকে না। আমার ঘরে ভাগাভাগি হবে। বুঝেছ?
আমি জবাব দিলাম না।
উনি খানিকক্ষণ জবাবের অপেক্ষা করে বললেন, সবটাই একা ভোগ করতে চাও?
রোদে তেতে ওঠা শানে দাঁড়িয়ে আমার পায়ে ফোস্কা পড়ার জোগাড়। উনি চটি পরে আছেন। আমার খালি পা। জ্বলুনি সইতে সইতে বললাম, আমি গরিব-ঘরের মেয়ে বলেই বোধহয় এই সন্দেহ আপনার!
সন্দেহের কোনও ব্যাপারই নয়। আমি দেখেছি। নিজের চোখে। তুমি শুধু গরিবের মেয়ে নও, তুমি ছোটলোকের মেয়ে। আমার কথায় যদি রাজি না হও তা হলে কিন্তু বিপদ আছে, জেনে রেখো।
আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। একবার মনে হল, বলে দিই। বললে একা একটা গোপন কথার ভার আর আমাকে বইতে হবে না। হয়তো জা বিশ্বাস করবেন না। না করলেই বা আমার কী?
হঠাৎ চোখে পড়ল, প্রকাণ্ড ছাদের আর এককোণে একজন সাদা থান পরা বিধবা দড়িতে একটা কাপড় যেন নেড়ে দিচ্ছেন। হঠাৎ তিনি আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন।
আমি অত গরমেও হিম হয়ে গেলাম। পিসিমা!
এই সময়ে শরিকদের ভাগের সিঁড়ি বেয়ে ওপাশ থেকে একটা মেয়ে চুল শুকোতে ছাদে এল। সে দিব্যি পিসিমার মুখোমুখি বসল, তাকালও। কিন্তু কোনও ভাবলক্ষণ দেখা গেল না। আমি বুঝলাম, মেয়েটা পিসিমাকে দেখতে পাচ্ছে না।
জা বললেন, ওরকম ফ্যাকাসে হয়ে গেলে কেন? ভয় পেয়েছ? ভয় পাওয়া ভাল। ভয় না পেলে কিন্তু সত্যিই বিপদে পড়বে। আর যদি ভাগাভাগি করে দাও তা হলে কোনও ভয় নেই। কাউকে বলব না।
আমি তাঁর দিকে চেয়ে বললাম, আমি কিছু জানি না। আপনি যা খুশি করতে পারেন।
বলে নেমে এলাম। পিসিমাকে দেখে বুক এত কাঁপছিল যে, ঘরে এসে আমার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। স্বামী রোজ দুপুরে ঘুমোন। আজও ঘুমোচ্ছন। জেগে থাকলে তিনি আমার অবস্থা দেখে খুবই অবাক হতেন।
আমি জানালার ধারে চুপ করে বসে রইলাম। খাঁ খাঁ দুপুরে একটা ঘুঘু ডাকছে। কাঁচা নর্দমার গন্ধ আসছে। আমার বুক উথাল-পাথাল করছে।
দুপুরটা এইভাবেই কেটে গেল।
বিকেল হল। স্বামী উঠলেন। আমি রান্নাঘরে তাঁর জন্য চা করতে গেছি, ঠিক এ সময়ে শুনতে পেলাম, দোতলার সিঁড়িতে দৌড় পায়ের আওয়াজ আর একটা চেঁচামেচি। আমার ভাসুর আমার স্বামীকে ডাকছেন। স্বামীও দৌড়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর ভজহরি বেরিয়ে ডাক্তার ভদ্রকে নিয়ে এল।
আমি চুপ করে সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে রইলাম।
ভজহরি নীচে নেমে আসছিল, আমাকে দেখে বলল, বউদি! সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড। বড় বউদির জপ বন্ধ হয়ে গেছে।
জপ বন্ধ! তার মানে কী?
কথা বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুই বলতে পারছেন না। শুধু আঙুল তুলে কাকে দেখাচ্ছেন আর উঁ উঁ করছেন।
আমি একটা স্বস্তির শ্বাস ছাড়লাম। কিন্তু আঙুল তুলে জা কাকে দেখাচ্ছেন?
বিকেলে কেউ বাড়ি থেকে বেরলেন না আজ। সকলের মুখ গম্ভীর। কাল এ বাড়িতে একটা মৃত্যু আর আজ একজনের কথা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবাই একটু বিহুল।
স্বামী এসে বললেন, লতা, তুমি একটু বউদিকে দেখে আসবে নাকি? কেন যে হঠাৎ কথা বন্ধ হয়ে গেল!
আমি মৃদুস্বরে বললাম, উনি আমাকে পছন্দ করেন না। তবে আপনি বললে যাব।
আমি দোতলায় উঠে তাঁর ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই আমার জা শোয়া অবস্থা থেকে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বসে পড়লেন, তারপর আমার দিকে আঙুল তুলে উঁ উঁ করে শব্দ করতে লাগলেন। বুঝলাম উনি গয়নার বাক্সের চোরকে চিনিয়ে দিতে চাইছেন। কিন্তু সেটা কেউ বুঝতে পারছে না।
আমার ভাসুর চাতক মিত্র চমৎকার মানুষ। ইনি আমার স্বামীর চেয়েও বোধহয় সুপুরুষ। সুন্দর মুখখানায় দুশ্চিন্তা আর ভয়ের ছাপ পড়েছে। আমার দিকে চেয়ে অসহায়ভাবে বললেন, কী হল বলল তো বউমা? ও এরকম করছে কেন?
আমি মৃদুস্বরে বললাম, হয়তো কিছু একটা বলতে চাইছেন।
কী বলতে চাইছে? তুমি বুঝতে পারছো?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না। তবে উনি ভাল হয়ে উঠলে হয়তো বলতে পারবেন।
ডাক্তারও বুঝতে পারছেন না হঠাৎ কেন এরকম হল। জিবটা অসাড় হয়ে গেছে। সমস্ত শরীরের মধ্যে কারও শুধু জিবটা অসাড় হয়ে যায় এরকম কখনও শুনিনি।
আমার জা বড় বড় চোখ করে আমাকে দেখছেন আর স্বামীর দিকে ফিরে আমাকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন। আমি একটু একটু ভয় পাচ্ছিলাম।
আমার ভাসুর বড় নিরীহ শান্ত মানুষ। দাপুটে স্ত্রীর সামনে তিনি যেন সবসময়ে মিইয়ে থাকেন। ঘর থেকে বড় একটা বেরোন না। সন্ধের পর একটু আধটু আড্ডা মারতে যান। এ বাড়ির বেশিরভাগ পুরুষই নিষ্কর্মা, দিবানিদ্ৰাপরায়ণ, অলস মস্তিষ্ক। এঁরা বিপদে পড়লে ভীষণ ঘাবড়ে যান। অনভ্যাসে এঁদের বুদ্ধিসুদ্ধিরও তেমন ধার নেই। স্ত্রীর অসুখে আমার ভাসুর এতই ঘাবড়ে গেছেন যে, জায়ের ইঙ্গিত বা ইশারা বুঝতেই পারলেন না।
কিন্তু মুখ বন্ধ হলেও কথা বলার অন্য উপায় আছে। আমার জা তো কাগজে লিখেই সব তাঁর স্বামীকে জানাতে পারেন। হয়তো জিব আচমকা অসাড় হয়ে যাওয়ায় উত্তেজিত মাথায় বুদ্ধিটা খেলছে না। কিন্তু কিছু পরেই নিশ্চয়ই কথাটা খেয়াল হবে। তখন আমার বিপদ আছে।
হঠাৎ আমার ভাসুর টেবিল থেকে একটা কাগজ তুলে আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটা দেখো। কিছু বুঝতে পারছো?
একসারসাইজ খাতার একটা রুলটানা পাতা। তাতে একটা অক্ষর লেখা গ। আর তারপর থেকে সব হিজিবিজি আঁকিবুকি।
আমার ভাসুর বললেন, ও একটা কোনও জরুরি কথা বলতে চাইছে। লিখতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। শুধু গ অক্ষরটা পড়া যাচ্ছে।
উনি বুঝতে না পারলেও ওই গ অক্ষরটা আমি খুব বুঝতে পারছি। বললাম, ওঁর হাতও কি অসাড়?
না তো? হাতে তো কিছু হয়নি। কিন্তু লিখতে পারছে না।
আমি মুখে দুঃখের ভাব ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। দুঃখ যে আমার হচ্ছিল না তাও নয়। আসলে দুঃখের চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে আমার ভয়। এসব কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে তা আমি জানি না। কিন্তু হচ্ছে।
আমার ভাসুর বললেন, তুমি একটু ওর কাছে বসে থাকো। আমি ওষুধ কিনে আনতে যাচ্ছি।
ভাসুরের এ কথায় আমার জা যেন হঠাৎ ভয়ঙ্কর ভীত আর উত্তেজিত হয়ে উঁ উঁ উঁ উঁ করতে লাগলেন। মনে হল, উনি ভাসুরকে যেতে বারণ করছেন। ভাসুর ওঁর দিকে চেয়ে বললেন, কোনও চিন্তা নেই, লতা আছে। আমি এখনও আসছি।
ভাসুর বেরিয়ে গেলেন।
উনি বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি আমার জায়ের মুখে যে আতঙ্ক ফুটে উঠতে দেখলাম সেরকম দৃশ্য আমি জীবনে দেখিনি। ওঁর চোখ দুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে পড়ল, মুখ হাঁ, ঘন ঘন শ্বাস। আমি তাড়াতাড়ি ওঁর কাছে এগিয়ে যেতে যেতে বললাম, ওরকম করছেন কেন দিদি? সব ঠিক হয়ে যাবে। ভয়ের কিচ্ছু নেই।
উনি যেন ভয়ে গুটলি পাকিয়ে গেলেন। পিছু হটে খাটের রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে হঠাৎ আর্তস্বরে বলে উঠলেন, আমাকে মেরো না! আমাকে মেরো গয়নার কথা আমি কাউকে বলব না। কালীর দিব্যি! আমি ওর ভাগ চাই তুমি মন্ত্রতন্ত্র জানো, বাণ মেরে আমার জিব: অসাড় করে দিয়েছে। আমি এই কান মলছি, নাক মলছি, কখনও যদি আর কিছু বলি! তোমার পায়ে পড়ি। আমাকে ছেড়ে দাও..
বোবার মুখে কথা ফুটতে দেখে আমার বুদ্ধি আবার গুলিয়ে গেল। কিছুক্ষণ মানুষটার দিকে বিহ্বল চোখে চেয়ে রইলাম। জা হাউ হাউ করে কাঁদছেন। আমার দিকে হাতজোড় করে চেয়ে আছেন। হাত দুখানা থরথর করে কাঁপছে। মুখ ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে আর লালায়। এত কষ্ট হচ্ছিল! আমি ঠিকে ঝি পরেশের মাকে ডেকে ওঁর কাছে থাকতে বলে ঘরে চলে এলাম।
দুপুরবেলা পুলিশ এসে সকলের জবানবন্দী নিচ্ছিল। তাদের জেরার মুখে পড়ে ভজহরি কী একটা বলতে যাচ্ছিল আমতা আমতা করে। কিন্তু কেন যেন হঠাৎ ফ্যাকাসে মুখে চুপ করে গেল। সন্দেহবশে পুলিশ নন্দ ঘোষাল আর ভজহরিকে ধরে নিয়ে গেল।
আমার শ্বশুর, শাশুড়ি, জ্যাঠাশ্বশুর ভাসুর আর স্বামী চুরি-যাওয়া গয়না নিয়ে নানারকম আলোচনা গবেষণা করতে লাগলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম, পিসিমার গয়নার ওপর এ পরিবারের একটা প্রত্যাশা ছিল। হয়তো বা এ পরিবারের নিঃশেষিত সোনাদানার ভাণ্ডারে ওই গয়না কিছু প্রাণ সঞ্চার করতে পারত। পুরুষেরা সোনা বেচে আরও কিছুদিন পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে বসে খেতেন।
আমি গরিব ঘরের মেয়ে। একশ ভরি সোনা আমার স্বপ্নেরও অগোচর। এই সোনার ভার আমি বইব কী করে? কয়েকটা দিন আমার অস্থিরতা এমন বাড়ল যে, পাগল-পাগল লাগত। কী করব বুঝতে পারি না। গোপন কথার একজন ভাগীদার থাকলে বেশ হয়। কিন্তু আমার গোপন কথাটাও এতই বিপজ্জনক যে কাউকে বলতে সাহস হয় না।
নন্দ ঘোষাল না থাকায় আমাকেই রান্না করতে হয়। জা অসুস্থ, ঘর থেকে বেরোন না। শাশুড়ির বয়স হয়েছে। কাজের লোকও পাওয়া যাচ্ছে না। রাঁধতে পেরে আমি বেঁচেছি। একটা কাজ তো! কিছুক্ষণ সময় কাটে, অন্যমনস্ক থাকা যায়।
একদিন সন্ধেবেলা কষে মাংস রাঁধছি! আমার রান্নার হাত ভাল। যে খায় সেই প্রশংসা করে। গরম মশলা থেঁতো করতে শিল পাটা পেতেছি, এমন সময় দেখি, কপাটের আড়াল থেকে সাদা থান একটু বেরিয়ে আছে। কে যেন কপাটের আড়ালে দাঁড়ানো। এ বাড়িতে বিধবা তো কেউ নেই! আমি হিম হয়ে গেলাম ভয়ে। হাত পা কাঠ।
আড়াল থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ এল। পিসিমার নির্ভুল গলা শুনতে পেলাম। একটু চাপা, মাংস রাঁধছিস?
বুক ধড়ধড় করছে। তবু অভিজ্ঞতাটা একেবারে নতুন নয় বলে কোনও রকমে বললাম, হাঁ।
বেশ গন্ধটা বেরিয়েছে তো!
আমি চুপ করে বসে রইলাম।
কতকাল খাইনি। স্বাদই ভুলে গেছি। ভাল রাঁধিস বুঝি?
কী জানি! কাঁপা গলায় বললাম।
বেশ হবে খেতে। কিন্তু নুন দিতে ভুলে গেছিস যে! ভাল করে নুন দে।
থানটা সরে গেল। রান্নাঘর থেকে দৌড়ে শোওয়ার ঘরে পালানোর একটা ইচ্ছে আমার হয়েছিল। কিন্তু জোর করে নিজেকে শক্ত রাখলাম। কারণ, এই ভবিতব্য নিয়েই বোধহয় আমাকে বাঁচতে হবে। মাংসে নুন দিলাম। কিন্তু মনে হচ্ছিল, একবার যেন দিয়েছি আগে।
সেই রাতে প্রত্যেকেই খেতে গিয়ে বলল, মাংসটা খুবই ভাল রান্না হয়েছিল, কিন্তু নুন বড্ড বেশি হয়ে গেছে। কেউ খেতে পারল না। এত রাগ হল!
রাতে আমি আমার স্বামীকে বললাম, আচ্ছা আপনি কি ভূতে বিশ্বাস করেন?
উনি কেমন যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, না তো! কেন?
ও কিছু নয়।