৪. ঘরের ইজিচেয়ারে ননিমাধব

০৪.

নিচের ঘরের ইজিচেয়ারে ননিমাধব চিৎপাত হয়ে প্রায় শুয়েই আছে আর ভাবছে। ভাবছে, ছুটির দিনের দুপুরগুলি এমন নীরস কাটত না। এই বাড়ির তলায় তলায় বেশ একটা পরিবর্তনের ধারা বইছে। সেটা ঠিক প্রত্যক্ষগম্য না হলেও অনুভব করা যায়। ননিমাধব অনুভব করছে।

আজও আপাতদৃষ্টিতে বিজনের জন্যেই অপেক্ষা করছে সে। আর তার আজকের প্রতীক্ষার মধ্যে বেশ জোরও ছিল একটু। পকেটে বাবার দেওয়া আঠারো হাজার টাকার চেকটা করকর করছে। দু-মাস আগেকার সেই প্ল্যানের রসদ বার করতে এতটা সময় লেগে গেল। তাও বাবা তিরিশ হাজার দেননি, বলেছেন, কাজ এগোক আস্তে আস্তে দেবেন। বিজনের ধারণা, পার্টনার যতটা তৎপর হলে সব সমস্যা সহজে মিটে যেতে পারে, ততটা তৎপর সে নয়। ধারণাটা খুব মিথ্যেও নয়। তাদের বিজনেস এক্সটেনশানের প্ল্যানের এই টাকাটাও বার করে আনতে আরো কতদিন লাগত বলা যায় না। আর আনা যে গেছে সেটা শুধু বিজনের অসহিষ্ণুতার ভয়েই নয়। পায়ের নিচে আজকাল নিরাপদ মাটির অভাব বোধ করছিল ননিমাধব। অলক্ষ্য থেকে আর কেউ যেন সেই মাটিতে পা ফেলে চলেছে। ননিমাধবের উদ্যম আর বাবার সঙ্গে ফয়সালা করে টাকা নিয়ে আসার আগ্রহের পিছনে বড় কারণ সম্ভবত এটাই। বিজুদাকে একটু শান্ত না করতে পারলে আর কোন সমস্যা তার মাথায় ঢোকানো যাবে না। আভাসে ইঙ্গিতে একটু আধটু চেষ্টা করেছিল, বিজন কি বুঝেছে সে-ই জানে, ওর সমস্যার ধার-কাছ দিয়েও যায়নি। উল্টে বলেছে, দেখ, এই ব্যবসা দাঁড় করানো ছাড়া এখন আর কিছু ভেবো না-মা তো এখনো ভাবে তোমাতে আমাতে ছেলেমানুষিই করছি একটা।

ফলে ভবিষ্যৎ রচনার এই নব-উন্মাদনা ননিমাধবের। বিজনকে কথা দিয়েছে, আজ সে চেক নিয়ে আসছে। অবশ্য বাকি টাকাটা কিছুদিন বাদে সংগ্রহ হবে তাও জানিয়েছে। হাতে যা এসেছে তাও কম নয়, বিজন খুশী। টাকা ননিমাধব চেষ্টা করলে সংগ্রহ করতে পারে সেটা তার জানাই আছে। তার ফুরসৎ নেই একটুও, ঘোরাঘুরি করে সব বিধিব্যবস্থা তাকেই করতে হয়।

বাবার কাছ থেকে চেক পেয়েই ননিমাধব সোজা এ-বাড়ি চলে এসেছে। ছুটির দিন, ফ্যাক্টরি বন্ধ। বিজন বাড়ি নেই জেনেও দুঃখিত হয়নি, কিন্তু বাড়িতে যেন আর কেউ নেই। একা বসে বসে বিরক্তি ধরে গেছে। দাশু অবশ্য রাণু বউদিকে খবর দিতে যাচ্ছিল, ননিমাধবই বাধা দিয়েছে, উনি পড়ছেন পড়ন ডাকাডাকি করে বিরক্ত করা কেন!

কিন্তু ছোট দিদিমণিও নাকি পড়ছে আর বড় দিদিমণি বাবুর ঘরে আটকে আছে। ননিমাধব দাশুকে পাঠিয়েছে এক পাকেট সিগারেট আনতে। সে এলে একবার খবর দিতে বলা যেত। কিন্তু দাশু সিগারেট আনতে গেছে তো গেছেই, দুটো গোটা সিগারেট খাওয়া হয়ে গেল ননিমাধবের, নবাবের এখনো দেখা নেই।

বাইরে থেকে গুনগুন একটা গানের শব্দ কানে আসতে ননিমাধব সোজা হয়ে বসল। লঘু চরণে যে আসছে সে বরুণা। মেয়েটা যত ফাজিলই হোক, ওর মন বোঝে।

কিন্তু বরুণার তখন মন বোঝার আগ্রহ একটুও ছিল না। অন্য আগ্রহ নিয়েই সে নীচে এসেছিল একবার। তিনটে নাগাদ যার আসার কথা সে ননিমাধব নয় আর একজন! তিনটে বেজে গেছে, বরুণা নিচের ঘরটা একবার দেখে যেতে এসেছিল। তার বদলে সেখানে ননিমাধবকে দেখে দরজার ওপরেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল সে। তারপর দু হতাশার সুরে বলল, ও আপনি…

ননিমাধব হাসিমুখেই রসিকতা করল, আর কেউ ভেবেছিলে বুঝি?

বরুণা ঘরের মধ্যে দু-পা এগিয়ে এলো। বড় করে নিশ্বাস ফেলল।–হ্যাঁ।

কিন্তু রসিকতার ঠিক মুড নয় ননিমাধবের। কারণ সব ছুটির দিনে আর একজনের আবির্ভাবই তার অনেক আনন্দ পণ্ড করেছে। বলল, ও, ইয়ে–আর কারো আসার কথা আছে বুঝি?

হ্যাঁ।

অগত্যা ননিমাধব হাসতেই চেষ্টা করল।–আমি বিজুদার জন্যে বসে আছি–

বসে থাকুন, এসে যাবে–

বরুণা সরে পড়ার উদ্যোগ করতেই ননিমাধব বাধা দিল, তুমি বোসো না, দাঁড়িয়ে কেন।

ও বাবা, দাদা এসে দেখলেই–

বরুণা ছলনায় সেয়ানা। মুখের ত্রাসে মনে হল দাদা এসে ওকে সরাসরি খুনই করবে। আশঙ্কাটা শেষ না করেই বলল, আপনি বরং বসে বেশ করে ব্যবসার কথা ভাবুন।

তাড়াতাড়ি প্রস্থান করতে গিয়েও থামল একটু। হাত বাড়িয়ে পাখার। রেগুলেটারটা আরো খানিকটা ঘুরিয়ে তরতরিয়ে চলে গেল।

ঈজিচেয়ার ছেড়ে ঘরের মধ্যেই বার দুই চক্কর খেল ননিমাধব। টেবিলের ওপর থেকে শূন্য সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিল। হাঁ-করা খালি সেটা। দ্বিগুণ বিরক্তি। ফিরে দেখে দাশু সিগারেট নিয়ে ঘরে এসেছে। তার হাত থেকে সিগারেট আর ফিরতি পয়সা নিয়ে যতটা সম্ভব মেলায়েম করেই জিজ্ঞাসা করল, এত দেরি?

দাশু কৈফিয়ত দিল, দুপুরে কাছের দোকান বন্ধ।

ননিমাধব ঈজিচেয়ারে বসল আবার। পয়সা পকেটে রাখতে গিয়ে কি ভেবে মুখ তুলল। দাঁত ফিরে যাচ্ছিল, ডেকে থামাল। পয়সাগুলো তার দিকে বাড়িয়ে দিল–এ ফেরত দিলে কেন, তুমি রাখো-না, রাখো–

দাশুর নিস্পৃহ পর্যবেক্ষণ।– রাখব?

হ্যাঁ, ধরো–।

দাশু পয়সা নিয়ে ট্যাঁকে গুঁজল এবং আরো কিছু জবাব দিতে হবে বুঝেই প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াল।

একটা সিগারেট ধরিয়ে ননিমাধব অন্তরঙ্গ সুরে বলল, আচ্ছ। এ বাড়িতে তো তুমি বহুকাল আছ, না?

সম্ভব হলে দাশুকে একটা সিগারেটও দিত সে, মনিবের চুরুটের বাক্স থেকে তার চুরুট সরানোর অপবাদ ননিমাধব একাধিকবার শুনেছে। কিন্তু অতটা পেরে উঠল না।

দাশু জবাব দিল, হ্যাঁ–বড় দিদিমণির জন্ম থেকেই বলতে পারেন।

তুমি তো তা হলে একেবারে ঘরের লোক হে!…যেন ঘরের লোক বলে তারও বিশেষ আনন্দের কারণ কিছু আছে। একটু থেমে বক্তব্যের দিকে এগোতে চেষ্টা করল আবার।-আচ্ছা দাশু, এই তোমার গিয়ে মাস দুই হল তোমার দিদিমণির দেখাই নেই প্রায়…লেখাপড়া-টড়া নিয়ে খুব ব্যস্ত বুঝি?

দাশু নিষ্প্রাণগোছের জবাব দিল, হ্যাঁ…ওই নতুন মাস্টারবাবুর সঙ্গে।

মাস্টারবাবু! ও সেই প্রফেসার?…নিজের অগোচরে গুণ্ডা কথাটাই বেরিয়ে যাচ্ছিল মুখ দিয়ে।

দাশু গম্ভীরমুখে মাথা নাড়ল।

ননিমাধব উঠে গিয়ে সিকি-খাওয়া সিগারেটটাই জানলা দিয়ে ফেলে এলো। ও প্রস্থানোত।

দাশু—

ঘুরে দাঁড়াল।

ইয়ে—তোমার দিদিমণি এখন কি করছেন বলো তো?

ছোড়দিদিমণি?

পারলে ওরই মুণ্ডপাত করে।–না, বড় দিদিমণি।

হাত দিয়ে দোতলায় কোণের ঘর ইঙ্গিত করে দাশু শুদ্ধ ভাষায় জবাব দিল, কর্তাবাবুর বাক্য শুনছেন।

ননিমাধব বিরক্ত হয়েছে বটে, কিন্তু দাশু খুব মিথ্যে বলেনি।

বাবার ঘরে বসে অর্চনা বাক্যই শুনছিল আর বাবার অগোচরে মাঝে মাঝে দরজার দিকে তাকাচ্ছিল।

বিছানায় একসঙ্গে তিনটে বালিশে মাথা রেখে আধ-শোয় ভাবে অনর্গল কথায় নিজেকেই যেন স্পষ্ট করে দেখছেন ডক্টর বাসু। আর সামনের মোড়ায় বসে অর্চনাকে শুনতে হচ্ছে সেই আত্মদর্শন তত্ত্ব। অনেক সময়েই শুনতে হয়, ফাঁক খুঁজে না পালানো পর্যন্ত রেহাই নেই। কিন্তু ফাঁক আর পেয়ে উঠছে না বাবার বলার ঝোঁকটা ক্রমশ বাড়ছে।

ডক্টর বাসু বইখানা বুকের ওপর রেখে ব্যাখ্যায় তন্ময়। তাঁর বক্তব্য, যে-ভাবেই থাকুক আর যে-কাজই করুক মানুষ, ভিতরে ভিতরে সে খুজছে কাউকে। নিজের অজ্ঞাতে তার খোঁজার বিরাম নেই। ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন, কিন্তু কাকে খুঁজছে?

অর্চনার দৃষ্টি তখন দরজার দিকে। মনে মনে সেও এক খোঁজেই অন্যমনস্ক। কথাটা কানে যেতে অপ্রতিভ মুখে ঘুরে বসল।–হ্যাঁ বাবা, খুজছে…

তাই তো বললাম, কিন্তু কাকে? একটা যেন ধাঁধার পরদা সরাচ্ছেন তিনি, এমনি আগ্রহ।…কার জন্য তার এই আকূতি?

ভ-ভগবানের জন্য? অর্চনার নিরুপায় মনোযোগ।

মেনেই নিলেন যেন। বললেন, বেশ কথা, ধরা যাক ভগবানকেই খুঁজছে। কিন্তু ভগবান কোথায় থাকে?

বিষয়ের গভীরতায় ক্রমশই তলিয়ে যাচ্ছেন ডক্টর বাসু। ভগবানের কোথায় থাকা সম্ভব সেই উপলব্ধি আগে স্পষ্ট হলে পরের আলোচনা। তাঁর বিশ্লেষণ, মানুষ তো সেই কোন কাল থেকে আছে–প্রথমে ছিল অনার্য, তারা মারামারি করত কাটাকাটি করত, হিংসা ছাড়া আর কিছুই জানত না কিন্তু তাদেরও ভগবান ছিল, তাদের সেই ভগবানের মূতি আরো হিংস্র আরো বীভৎস। কিন্তু মানুষ যত সভ্য হতে লাগল, দেখা গেল তাদের ভগবানও আরো সভ্য হচ্ছে আরো সুন্দর হচ্ছে। তাহলে কি বলতে হবে ভগবানও মানুষের মতই আগে অনার্য ছিল শেষে আর্য হল? হেসে উঠলেন তিনি–তা নয়… আসলে আমরা যেমন দেখি। ভগবান বলতে আমরা যাকে ভাবি সে তো তাহলে মানুষেরই প্রতিবিম্বিত মহিমা।

ব্যাখ্যার প্রসন্ন আনন্দে আধ-শোয় অবস্থাতেই একটা চুরুট ধরালেন। অর্চনার ঝিমুনি আসছিল, চুরুটের কড়া গন্ধে চোখ টান করে তাকাল। একমুখ ধোয়া ছেড়ে ডক্টর বাসু চোখ বুজে বিশ্লেষণটুকুই ভাবতে লাগলেন।

দাশু অর্চনার এই বাক্য শোনার কথাই বলেছিল ননিমাধবকে।

বিজন ফিরেছে। আঠারো হাজার টাকার উষ্ণতায় তার উৎসাহ অনেকটাই পুনরুজ্জীবিত। কিন্তু পাছে পার্টনার ঢিলে দেয় সেই আশঙ্কায় টাকা যে কত ব্যাপারে কত কারণে দরকার সেটাই নানাভাবে বেশ করে বোঝাচ্ছে তাকে। ননিমাধব শুনছে। ম্রিয়মাণ। একটু আগে ওই বাইরের বারান্দা দিয়ে হাসি খুশি মুখে বরুণা যে লোকটাকে একেবারে ওপরে নিয়ে গেল–ম্রিয়মাণ তাকে দেখেই।

দেখেছে বিজনও। কিন্তু নিজের আগ্রহে আর উৎসাহে অত খেয়াল করেনি। দেখেছে এই পর্যন্ত। ফ্যাক্টরির ভবিষ্যৎ-চিত্রের সব সমস্যার ফিরিস্তি শেষ করে বলল, এখনই তিরিশ হাজার পেলে ভাল হত হে।

ননিমাধব অন্যমনস্কর মত জবাব দিল, বাকিটাও শিগগিরই পাওয়া যাবে–

ভেরি গুড! চেকটা তুমি বিজনেস একাউন্টে জমা করে দাও, তোমাকে আর কিছু ভাবতে হবে না।

কিন্তু তার মুখের দিকে চেয়ে মনে হল ভাবনা তার একটুও নিরসন হয়নি। আর ভাবনা কিসের তাও যেন বোধগম্য হল এতক্ষণে। বরুণার সঙ্গে একটু আগে যে লোকটা ওপরে উঠে গেছে তার ওপরেই মনে মনে বিরূপ হল একটু। কিছুদিন আগে ননিমাধবের সেই আভাসও মনে পড়ছে। এমন এক সময়ে ওই মেয়ে দুটোর কাণ্ডজ্ঞানহীনতা চক্ষুশূল। ব্যবসায় নেমে কোন আলোচনাতেই কিছুমাত্র সঙ্কোচ নেই। ঝোঁকের মাথায় সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বিনা ভণিতায় পার্টনারকে কিছুটা আশ্বাসই দিয়ে ফেলল সে। গলা খাটো করে বলল, দেখ, একটা কথা শুনে রাখো-ওসব মাস্টার-টাস্টার মা দু’চক্ষে দেখতে পারে না, তোমার কিচ্ছু ভাবনা নেই, বুঝলে?

কিন্তু বুঝেও খুব যেন স্বস্তি বোধ করল না ননিমাধব। তবে প্রসঙ্গটা সুবাঞ্ছিত বটে। শুকনো মুখে একটু হাসল, আমতা আমতা করে বলল, আমি বলছিলাম কি বিজুদা, কথাটা একবার মাসিমার কাছে পেড়ে রাখলে হত না? মা–মা বলছিলেন আর কি…।

তাকে আশ্বাসটা একেবারে মিথ্যে দেয়নি বিজন, অবস্থা ফেরাতে পারলে মায়ের মত পাওয়াই যাবে এটা তার বিশ্বাসই। আর অবিশ্বাসই বা হবে কেন, ননিমাধব ছেলে তো খারাপ নয়। তাছাড়া মেয়ে দুটোর ইয়ারকি ফাজলামো দেখেও মনে হয়েছে কোনদিকে আটকাবে না! তবু নিজেদের জোরে দাঁড়ানোর জোরটাই আগে অভিপ্রেত মনে হয়েছে বিজনের। জবাব দিল, কথা তো পাড়লেই হয়, কিন্তু ব্যবসাটা জাঁকিয়ে দাঁড়াক একটু। মুশকিল কি জানো, তোমাকে তো সেদিন বললাম–আমরা যে কিছু একটা করছি তা এরা বিশ্বাসই করে না। আর করবেই বা কি দেখে, লাভ তো সবই প্রায় ব্যবসাতেই খেয়ে যাচ্ছে, অথচ এখনো তো আমাদের কোম্পানির একটা গাড়ি পর্যন্ত হল না।

ননিমাধব তৎক্ষণাৎ প্রস্তাব দিল, গাড়ি কিনে ফেল।

বিজন অবাক। গাড়ি কিনে ফেলব। এই টাকা থেকে?

না তা কেন, টাকা তো আমি দু-চার দিনের মধ্যেই আনছি–তুমি একটা গাড়ি দেখ।

পার্টনারের এতবড় সহযোগিতায় বিজন যথার্থই বিচলিত এবারে। ওর জন্যে যা বলার মাকে সে বলবে; শুধু বলবে না, রাজীও করাবে। ভারি তো–। একটু চিন্তা করে সম্মতি জ্ঞাপন করল, আচ্ছা…। আর মায়ের সঙ্গেও আমি কথা বলব’খন।

কলেজের মাস্টারের প্রতি মায়ের বিতৃষ্ণা সম্বন্ধে বিজন যথার্থই নিঃসংশয়। কিন্তু মায়ের সঙ্গে কথা বলার আগে কথা যে আর একপ্রস্থ সেই দিনই ওপরেও হয়ে গেল, সেটা জানলে বোধ করি তারও অস্বস্তির কারণ হত।

সেই কথা বলেছেন ডক্টর বাসু নিজে।

তিনি নিজে থেকে বলেননি, বা বলার কথা হয়তো চট করে তার মনেও হত না। সেই বাস্তা করে দিয়েছেন মিসেস বাসু। স্ত্রীর অসহিষ্ণুতা একদিনের দুদিনের নয়। বড় মেয়েটি তার কোন কথার মুখোমুখি অবাধ্য না হলেও তাকে যে সব সময় ইচ্ছেমত আগলে রাখা সহজ নয় মনে মনে এটুকু তিনি ঠিকই উপলব্ধি করতেন। বাড়িতে যে-একজনের আদৌ শাসন নেই, তার কথাই বরং মেয়েটা শোনে অনেক বেশি। অথচ সেই-একজনেরই প্রশ্রয়ে দিনের পর দিন ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে কোথাকার কে একটা প্রাইভেট কলেজের মাস্টার, এটা মায়ের পক্ষে বরদাস্ত করাও খুব সহজ নয়। মেয়েটা না হয় নিজের ভাল মন্দ বোঝে না, কিন্তু এই একটা মানুষেরও একটু কাণ্ডজ্ঞান থাকতে নেই। এ নিয়ে অনেকদিনই স্বামীকে দু-পাঁচ কথা বলেছেন, কিন্তু যত জ্বালা তারই, মাথায় কিছু ঢোকে কি না সন্দেহ।

তার ওপর সেদিন শূন্য-মোড়ার উদ্দেশে স্বামীকে বক্তৃতা করতে শুনে মেজাজ যথাথই বিগড়ালো। মেয়েটা উঠে পালিয়েছে সে-খেয়াল পর্যন্ত নেই। চোখের ওপর হাত রেখে তত্ত্বকথা শোনাচ্ছেন বিড়বিড় করে। একটা হেস্তনেস্ত করার। জন্যেই যেন মিসেস বাসু মোড়ার ওপর এসে বসলেন। লোকে এর পর পাগল ভাববে না তো কি?

এক ঘায়েই তত্ত্বের সব জাল ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। চোখ থেকে হাত নামিয়ে ডক্টর বায় মোড়ার ওপর কন্যার বদলে স্ত্রীকে দেখে অপ্রস্তুত।–অর্চনা গেল কোথায়…

মিসেস বাসু ঝাঁজিয়ে উঠলেন, কোথাও যায়নি, নিজের ঘরে বসেই তোমার সেই আদরের মাস্টারের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে–এখন বোকে মেয়ের মতিগতি।

মেয়ের মতিগতি বোঝার বদলে মানুষটা যেন পিত্তি জ্বালিয়ে দিলেন। হৃষ্টকণ্ঠে বললেন, ও, সুখেন্দু এসেছে বুঝি…ওদের এখানে আসতে বলো না?

মিসেস বাসু গম্ভীর মুখে তার দিকে খানিক চেয়ে থেকে রাগ সামলাতে চেষ্টা করলেন প্রথম খুব আনন্দ, কেমন? চোখ দুটো আছে, না নোট লিখে লিখে তাও গেছে?

ভদ্রলোক এবারে বুঝলেন সমাচার কুশল নয়। তবু হালকা জবাব দিলেন, নোট তো তোমার তাগিদেই লিখি। কি হয়েছে?

এইটুকুরই অপেক্ষা। তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে উঠলেন, কি হয়েছে আর কি হচ্ছে সবই আমি বলব–তোমার চোখ নেই? দু-মাস ধরে দেখছি মেয়ে যখন-তখন হট হুট করে বেরিয়ে যায়–য়ুনিভার্সিটি থেকে আসতেও এক-একদিন সন্ধ্যে কোথায় যায় কি করে ভেবে দেখেছ? আজকাল শুধু বাইরে নয়, বাড়িতেও ঘন ঘন ডেকে আনা হচ্ছে আর তাই শুনে উনি আনন্দে আটখানা একেবারে! শুধু তোমার জন্যেই মেয়ের এত সাহস, শুধু তোমার জন্যে!

একদমে এতখানি উদগিরণের পর তিনি হাপাতে লাগলেন।

আর ডক্টর বাসু আচমকা একটা সমস্যার মধ্যে পড়ে যথার্থই বুডুবু খেলেন খানিকক্ষণ। এই ভাবনার কথাটা ভাবা হয়নি বটে। ভাবতে ভাবতে উঠে বসে চুরুট পরানোর উদ্যোগ করলেন তিনি।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত চুরুট আর ধরানো হল না। তার আগেই সমাধান একটা খুঁজে পেলেন। দুই চোখে আবিষ্কারের আনন্দ। চুরুট ভুলে স্ত্রীর দিকে আর একটু ঝুঁকেই বলেন তিনি।–এ তো বেশ ভাল কথা। আমার মনেই হয়নি কথাটা-সুখেন্দু খাসা ছেলে, চমৎকার ছেলে, ওদের যদি বিয়ে হয়… আমি বলব সুখেন্দুকে?

মিসেস বাসু যেন পাগলের প্রস্তাব শুনলেন। প্রথমে হতভম্ব তার পর ক্রুদ্ধ।–মাথা খারাপ নাকি! অ্যাঁ? ওই চারশ টাকা মাইনের কলেজের মাস্টারের সঙ্গে বিয়ে। তার ওপর কালচার বলতে ‘ক’ নেই, ওই রকম গোঁয়ারে হাবভাব

এই সরস প্রস্তাবটা এভাবে নাকচ হতে দেখে ডক্টর বাসু বিরক্ত হয়ে মাঝখানেই বাধা দিলেন। তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি, ছেলেটা খারাপ কিসে হল। চার শ টাকা মাইনে কম নাকি! ক’টা ছেলে পায়? অমন উপযুক্ত বিদ্বান ছেলে–পরে আরো হবে।

আমার মাথা হবে আর মুণ্ডু হবে। আর পেরে ওঠেন না মিসেস বাসু।– তার চেয়ে মেয়েটার হাত পা বেঁধে জলে ফেলে দিয়ে এসো।

আর তুমি তোমার কালচার ধুয়ে জল খাও বসে বসে।…রাগের মাথায় ডক্টর বাসু হাতের চুরুট বিছানায় রেখে বিছানা থেকে দেশলাই তুলে জ্বালতে গেলেন। তার পর মুখে চুরুট নেই খেয়াল হতে দেশলাই ফেলে চুরুট তুলে মুখে দিলেন। শেষে দেশলাইয়ের অভাবে চুরুট হাতে নিলেন।-এই তো, তোমার বোন মস্ত বড়লোক দেখে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে, ভগ্নীপতির ওদিকে দেনার দায়ে চুল বিক্রি–আমারও সেইরকম অবস্থা হোক, কেমন? কোথা থেকে আনব, কোথা থেকে দেব—

মুখের কথা মুখেই থেকে গেল। শুধু তাই নয়, এতবড় খোঁচাটা দিয়ে ফেলে তার ফলাফল থেকেও অব্যাহতি পেলেন। সহাস্যে ঘরে আসছে বরুণা, অর্চনা–তাদের সঙ্গে সুখেন্দু। ঢুকে পড়ে সুখেন্দু না বুঝলেও মেয়ে দুটো ঘরের তাপ উপলব্ধি করে একটু থমকেছে।

ডক্টর বাসু সামলে নিয়ে ডাকলেন, এসো সুখেন্দু এসো

স্ত্রীর দিকে চেয়ে অতঃপর কিছু একটা আলোচনারই উপসংহার টানলেন যেন।– ভাল করে ভেবেচিন্তে দেখা দরকার বইকি, তুমি যা বলেছ তাও ঠিক, এক কথার ব্যাপার তো নয়।

বলা নেই কওয়া নেই এইভাবে বাইরের লোক নিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢোকার দরুন মিসেস বাসু মেয়ে-দুটোর ওপরেই মনে মনে জ্বললেন একপ্রস্থ। মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কষ্টকৃত আপসের সুরে স্বামীর উপসংহারের ওপর মন্তব্য করলেন, তোমার কথাও মিথ্যে নয়, আমার যা মনে হল তাই বললাম, নইলে এসব ব্যাপার তোমরাই ভাল বোঝে–

বাইরের লোকের সামনে অৰ্চনা-বরুণা বাবা মায়ের এ ধরনের পরোক্ষ অতি-বিনিময় শুনে অভ্যস্ত। তারা যে-যার অন্যদিকে চোখ ফেরাল। ডক্টর বাসু একটু সরে বসে আপ্যায়ন জানালেন, সুখেন্দু দাঁড়িয়ে কেন, বসো–আজ কলেজ নেই? ও আজ ছুটি বুঝি, আমার সবদিনই ছুটি তো, মনেই থাকে না। এতক্ষণের বাক্‌বিতণ্ডার কারণ ভুলে হেসে উঠলেন তিনি।

মায়ের চোখে চোখ পড়তেই অর্চনার সঙ্কট। তার মুখের ওপর এক ঝলক উগ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তিনি কাজের অছিলায় ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অর্চনা আর বরুণা এবারে পরস্পরের দিকে চেয়ে হাসি চাপতে চেষ্টা করল। বাবা প্রসন্নমুখে চুরুট ধরাবার উদ্যোগ করছেন।

কটা দিনের মধ্যে ননিমাধবের উদ্যমের বেপরোয়া পরিবর্তন দেখে বিজন পর্যন্ত ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। স্ত্রী দিনরাত নভেলে ডুবে থাকলেও, বাড়িতে যখন থাকে, অন্দরমহলের সমাচার কিছু কিছু কানে আসেই। তার কাছ থেকে যেটুকু খবর পায় তাতেই অনুগত পার্টনারটির জন্য মনে মনে একটু চিন্তিত। অতটা হত না, যদি না ব্যবসায়ে ননিমাধবকে হঠাৎ অমন উৎসাহের বন্যায় ফুলে-ফেঁপে উঠতে দেখত। এত উৎসাহ আর উদ্যমের উৎস কোথায় সেটা সে ভালই জানে। আর সেখানে কোন প্রতিকূল ছায়া পড়লে সবেতেই যে শুকনো টান ধরে যাবে তাও সহজেই অনুমান করতে পারে।

গত এক মাসের মধ্যে ননিমাধব অসাধ্যসাধনই করেছে প্রায়। তার সমস্ত আশা কেন্দ্রীভূত একখানা মোটর গাড়ি কেনা আর ব্যবসায়ে টাকা ঢালার মধ্যে। নিজের মাকে ধরে বাবার সঙ্গে পাপষ্টি একটা ফয়সালা করে নিয়েছে সে। বাপের টাকা যত, ছেলের প্রতি আস্থা তত নয়। তবে বিশ্বাস কিছু বিজনের ওপরে আছে, তার হাতে টাকাটা একেবারে নষ্ট হবে না। কিন্তু আপাতত নিদিষ্ট অঙ্কের বাইরেও তাকে চেক কাটতে হয়েছে ছেলের মতিগতির ব্যতিক্রম দেখেই।

গাড়ি হয়তো এতে শিগগির সত্যিই কেনার ইচ্ছে ছিল না বিজনের। কিন্তু গাড়ির খাতে পটনার আলাদা টাকা বার করে এনেছে, গাড়ি না কিনেই বা কর কি! না কেনা পর্যন্ত ননিমাধবের তাগিদেরও বিরাম ছিল না।

অতএব ফ্যাক্টরি বাড়ানোর জন্য আশাপ্রদ মূলধনই শুধু জোটেনি, নতুন গাড়িও একটা হয়েছে।

গাড়ি কেনার পর ননিমাধবের সর্বাগ্রগণ্য ডিউটি মাসিমা অর্থাৎ অর্চনার মাকে সেই গাড়িতে চড়ানো। তাতেও কিছুমাত্র বেগ পেতে হয়নি, কারণ ছেলেদের যে ব্যবসাটা মহিলা অবহেলার চোখে দেখে এসেছেন এতদিন, গাড়ি কেনার পরেই আর সেটা হেলাফেলার বলে মনে হয়নি। অতএব খুব খুশী হয়েই গাড়িতে চড়েছেন তিনি, আর চড়ার পরে ননিমাধবকেও একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেছেন। প্রসন্ন মুখে গাড়ির প্রশংসা করেছেন, চমৎকার গাড়ি হয়েছে, এতটা পথ ঘুরে এলাম একটুও ঝাঁকুনি নেই

ননিমাধব বিগলিত। সাফল্যটা নাগালের কাছাকাছি এসে গেছে যেন। বলেছে, আর কটা দিন অপেক্ষা করুন না মাসিমা, আমি নিজেই ড্রাইভিংটা শিখে নিচ্ছি-ও ব্যাটার থেকে অনেক ভাল চালাব।

অর্থাৎ ড্রাইভারের থেকেও সে অনেক ভাল চালাবে।

এর পর মায়ের কাছে আর একটা প্রসঙ্গ উত্থাপনে বিলম্ব করাটা একটুও সমীচীন বোধ করেনি বিজন। অবশ্য দুপুরে খেতে বসে সেই উত্থাপনের সুযোগ মা-ই দিয়েছেন। অর্চনা-বরুণ। কলেজে, কাজেই আলোচনায় ব্যাঘাতও ঘটেনি। সকালে নতুন গাড়ি চড়ে আসার আনন্দটা মায়ের মনে লেগেছিল। তিনি বলেছেন, হা রে, এরই মধ্যে তোদের গাড়ি হয়ে গেল, ব্যবসা বেশ ভাল চলছে বল?

বিজন জবাব দিয়েছে, সবে তো শুরু, আর একটা বছর সবুর কর না, দেখ কি হয়–

আলোচনার সাক্ষী শুধু দাশু। অদূরে বসে কি একটা নাড়াচাড়া করছিল। দাদাবাবুর পরের কথাগুলো কানে যেতে গম্ভীর কৌতুকে মুখখানা তার আরো গম্ভীর। ওই এক প্রসঙ্গ থেকেই বিজন পার্টনারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।-ননিমাধবকে তো আর জান না, ওই রকম থাকে বলে। ওর মত ছেলে ক’টা হয়, ব্যবসায়ও তেমনি মাথা—

যেন সমস্ত ব্যবসাটা ওর মাথার জোরেই চলেছে। পাছে নজরে পড়ে যায় সেই ভয়ে দাশু একেবারে ঘুরে বসে নিঃশব্দ মুখভঙ্গি করেছে একটা। মা ওদিকে ছেলের প্রশংসাটা মেনেই নিয়েছেন, কারণ এরই মধ্যে একখানা গাড়ি করে ফেলা তো কম কথা নয়।

বিজন জানিয়েছে, একখানা কেন, আরো হবে। তার পরেই একেবারে আসল বক্তব্যে এসে পৌঁছেছে।-দেখ মা, ব্যবসা ছাড়া কোনদিন কেউ কিছু করতে পারে না, বুঝলে? একটা কলেজের মাস্টারকে এভাবে মাথায় তুলছ কেন তোমরা–অর্চনার বিয়ের ভাবনা তো? সব ঠিক আছে, সে-ভার তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও।

মিসেস বাসু অকুলে কুল পেয়েছেন। অতঃপর গৃহকর্তার কাণ্ডজ্ঞানহীনতা ফলাও করে বিস্তার করেছেন তিনি। ছেলে গম্ভীর মুখে পরামর্শ দিয়েছে, বাবার কথায় কান দিও না, অর্চনাকেও একটু বুঝিয়ে-সুজিয়ে বলে।

অর্চনাকে বুঝিয়ে বলার আগেই বিকেলে দাশু ছোট দিদিমণির খাবার দিতে গিয়ে তার কাছে বিপদের পূর্বাভাস জ্ঞাপন করে রেখেছে একটু। দাদাবাবুরা তকতকে গাড়ি কিনেছেন, সকালে মাকে চড়ালেন, দাদাবাবু মায়ের কাছে খেতে বসে খুব সুখ্যাতি করছিল ননিবাবুর, বড় দিদিমণির আর ভাবনা নেই, বিয়ের পর গাড়ি চেপে খুব হাওয়া খাবে, ইত্যাদি।

দাশুর বচন নিয়েই মনের আনন্দে বরুণা দিদির পিছনে লেগেছিল। ভদ্রলোকের আর কোন আশাই নেই, আমি না হয় পষ্টাপষ্টি জানিয়ে দিয়ে আসি, মশাই গাড়িটাড়ি কিনতে পারেন তো এগোন, নয় তো কেটে পডুন! দাশ বলছিল, তোর আর একটুও ভাবনা নেই, ননিদা তোকে দিনরাত হাওয়া খাওয়াবে–

অর্চনার তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে দোরগোড়ায় মায়ের সঙ্গে বরুণার ধাক্কা লাগার উপক্রম। তিনি মেয়েকে বোঝাতে এসেছিলেন। বরুণা পাশ কাটিয়ে পালালো। মিসেস বাসু বিরক্তি প্রকাশ করলেন, মেয়ের চলাফেরা দেখ না!

মায়ের সাড়া পেয়েই অর্চনা পড়ার টেবিলে বসে বই টেনে গম্ভীর হতে চেষ্টা করল। ঘরে এসে মিসেস বাসু দুই-এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলেন, তার পর হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, খবর শুনেছিস?

অর্চনা খবর শোনার জন্য ঘুরে বসল।

খাটের বিছানায় উপবেশন করে প্রসন্ন মুখে মেয়ের দিকে তাকালেন তিনি, বিজু আর ননি চমৎকার নতুন গাড়ি কিনেছে–

তাই নাকি! অর্চনার বিস্ময়ে ভেজাল নেই।

হ্যাঁ, সুন্দর গাড়ি–কাল তোদের চড়াবে’খন। ওদের ব্যবসায়ও দিন-কে দিন উন্নতি হচ্ছে, আর ননিমাধবের কত প্রশংসা করছিল বিজু

ছদ্মত্রাসে অর্চনার চোখ বড় বড়।–তুমি যেন করে বোসো না মা প্রশংসা, তাহলে এক ডজন রুমাল প্রেজেন্ট করতে হবে ভদ্রলোককে!

ঠাট্টাটা আজ মায়ের একটুও ভাল লাগল না। বললেন, তোর সবেতে বাড়াবাড়ি, ঠাস ঠাস কথা বলতে পারলেই ভাবিস কি নাকি–

কিন্তু কথার মাঝে তাঁকেই হঠাৎ থেমে যেতে হল। একটু আগে জলন্ত ধুনুচি হাতে দাণ্ড ব্যস্তসমস্ত ভাবে ঘরে ঢুকেছিল। ঘরে ধুনো দেওয়া আর কোণের তাকে বুদ্ধমূর্তির কাছে ধুনুচি রেখে প্রণাম করাটা তার নৈমিত্তিক সান্ধ্য কাজ। আর প্রণামটা বুদ্ধমুর্তি বলে নয়, ঠাকুর-দেবতা বা সেই সদৃশ মূর্তি দেখলেই করে থাকে। তাকে ঢুকতে দেখা গেছে, কিন্তু বেরুলো কি না সেটা মিসেস বাসু লক্ষ্য করেননি। এবারে থেমে গিয়ে লক্ষ্য করলেন। তাকের বুদ্ধমূর্তির সামনে ধুনুচি রেখে জোড় হাতে মাথা রেখে দাশু প্রণাম করেই আছে। অর্চনার হাসি চাপা দায়। এদিকের সাড়াশব্দ না পেয়ে দাশু আস্তে আস্তে মুখ তুলতেই কীর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময়।

বেরো এখান থেকে, এক ঘণ্টা ধরে প্রণামই করছে!

 ধুনুচি হাতে দাশুর শশব্যস্ত প্রস্থান।

মাকে আবার প্রস্তুত হতে দেখে অর্চনা হাসি সামলে গম্ভীর হল কোন প্রকারে।

…হ্যাঁ, যা বলব ভাবছিলাম তোকে, তোর বাবার একেবারে ভীমরতি ধরেছে। একটু আধটু আলাপ-সালাপ কত লোকের সঙ্গেই হয়, তা বলে ওই মাস্টারই নাকি খুব ভাল ছেলে, তার সঙ্গে তোর বিয়ের কথা পড়তে চায়।

রাত বলেই রক্ষা, শোনামাত্ৰ অৰ্চনার মুখের রঙ বদল হয়েছিল কি না ধরা পড়ল না। আচমকা খুশীর আলোড়ন গোপন করার জন্য তরল বিস্ময়ে নাকমুখ কুঁচকে ফেলল একেবারে, এ-মা, তাই নাকি?

অভিব্যক্তি দেখে মা একটু হয়তো আশ্বস্তই হলেন। আরো ঝুঁকে বসে মেয়েকে সংসার বিষয়ে একটু সচেতন করার উদ্দেশ্যে নিজের সংসার-জীবনের কষ্টক্লিষ্ট অভিজ্ঞতার সমাচার ব্যক্ত করতে ভুললেন না। মাস্টারের সংসার সচল রাখা যে কত কষ্টের সে শুধু উনিই জানেন, এর ওপর শেষজীবনে কি আছে কপালে কে জানে। পেনশনের তো ওই ক’টি টাকা, উনি দিন-রাত ঘাড়ে চেপে এটা ওটা লিখিয়ে কোনরকমে সংসারযাত্রা নির্বাহ করছেন–কত যে ভাল সে আর কে বুঝবে। তা ছাড়া বই লেখাও তো সকলের কম্ম নয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। উপসংহারে মেয়েকে সতর্ক করে দিলেন, তোর কাছে বলতে এলে খবরদার কান পাসি না।

অর্চনা বলল, তুমি ক্ষেপেছ মা?

টেবিল থেকে পড়ার বই হাতে তুলে নিয়েছে সে। প্রকাশ, তার পড়াশুনার ড়াটাই আপাতত বেশি। মা বর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বইটা টবিলের ওপরেই আছড়ে ফেলেছে আবার। উঠে সটান বিছানায় শুয়ে পড়েছে। বরুণাটা এক্ষুনি এসে হাজির হবে ভেবেই তাড়াতাড়ি আবার চেয়ারে এসে বসেছে।

মিসেস বাসু শুধু মেয়েকে সতর্ক করেই নিশ্চিন্ত হতে পারেননি, সেই রাতেই স্বামীকেও একটু-আধটু সমঝে দিতে চেষ্টা করেছিলেন। গাড়ি কেনার প্রসঙ্গে ননিমাধবের সম্বন্ধে ছেলের উক্তিটাই স-পল্লবে আগে সমর্থন করে নিয়েছেন। শুধু বাড়ির অবস্থাই ভাল নয়, ছেলেটাও যে কাজের সেটা এতদিন বোঝেননি বলে একটু আক্ষেপও করেছেন। আর শেষে, বিয়েটা যে ছেলেখেলা নয়, গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার একটা–সেই প্রসঙ্গে ছোটখাটো ভাষণ দিয়ে বলেছেন, কর্তাটি যা বোঝেন না তাতে যেন মাথা ঘামাতে না আসেন, অথবা কাউকে কোনরকম আবোলতাবোল প্রশ্রয় দিয়ে না বসেন।

ফল উল্টো হল।

এই এক মাসের মধ্যে সমস্যাটা ঠিক স্মরণের মধ্যে ছিল না ভদ্রলোকের। মনে পড়ল। স্ত্রীর সব কথাই শুনতে হয় বলে শোনেন, কিন্তু করণীয় যা সেটা বেশির ভাগই নিজের মত অনুযায়ী করেন। অন্তত গুরুতর কোন ব্যাপারে স্ত্রীর মত। মতের ওপর তার আস্থা কমই। এদিক থেকে স্ত্রী একটা যথার্থ কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তাকে, বিয়ে তো ছেলেমানুষি ব্যাপার নয়। নয় বলেই ভাবনা। তার ওপর গাড়ি কেনার দরুন হঠাৎ আবার যে ছেলেটার প্রশংসার সূচনা, তাও চিন্তার কারণ একটু।

পরদিন সকালে বই পড়তে পড়তেও এই সমস্যাটাই থেকে থেকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। টেবিলের ওপর চুরুটের সামান্য একটু নেভানো অংশ পড়ে আছে। সেই কখন বাক্স নিয়ে দাশু দোকানে গেছে চুরুট ভরে আনতে, এখনো দেখা নেই। চুরুটের অভাবে ভাবা বা পড়া কোনটাই সুস্থির মত হচ্ছে না। বিরক্ত হয়ে শেষে দাশুর উদ্দেশে হাঁক-ডাক শুরু করে দিলেন তিনি।

তাই শুনে ওদিকের ঘর থেকে অর্চনা উঠে এলো। বইয়ের ওপর চোখ রেখে তিনি হাত বাড়ালেন।

কি বাবা?

 ও তুই… দাশুটা গেল কোথায়, আর কেউ কোথাও পাঠিয়েছে?

টেবিলে চুরুটের বাক্স না দেখে অর্চনা বুঝল দাশুর খোঁজে বাবা অত গরম কেন। বলল, আচ্ছা আমি দেখছি–

সে দরজার দিকে এগোতে কি ভেবে তিনি বাধা দিলেন, থাক তোকে দেখতে হবে না, এদিকে আয় কথা আছে

অর্চনা ফিরল।

বোস–

একটু অবাক হয়েই অর্চনা মোড়াটা তাঁর সামনে টেনে বসল।

হাতের মোটা বইটা একদিকে সরিয়ে রেখে তিনি সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলেন, তোর মা তোকে কিছু বলেছে?

অর্চনা শঙ্কিত একটু, কি বলবে?

তার মানেই বলেনি, বলবে না আমি আগেই জানি, তার তত সব বড় বড় ইয়ে–

আসল প্রসঙ্গটা দুর্বোধ্য রেখেই স্ত্রীর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে নিলেন একটু। অর্চনা ভয়ে ভয়ে একবার দরজার দিকটা দেখে নিল, তার পর বাবার দিকে তাকাল।

যাকগে শোন, ওই সুখেন্দু খুব ভাল ছেলে তুই কি বলিস?

লজ্জায় আরক্ত হলেও জিজ্ঞাসার নমুনায় অর্চনা বাবার: দিকে চেয়ে হেসেই ফেলল। মেয়ের কিছু বলা না বলার জন্য অপেক্ষা করলেন না তিনি। নিজের মনের কথাটাই ব্যক্ত করলেন।–তোর মা অবশ্য বলবে ওর মোটর নেই, মাস্টারি করে–মাস্টারি তো আজীবন আমিও করলাম, মোটর হয়নি?

জবাব না দিয়ে অর্চনা ভয়ে ভয়ে দরজার দিকেই তাকাল আবার।

…তা শোন, আমি বলছিলাম ওর সঙ্গেই তোর বিয়ের কথাটা পেড়ে দেখি। তোর কি মত?

বাবার কাছে সর্ব বিষয়ে নিজের মতামতটা স্পষ্ট ব্যক্ত করতেই অভ্যস্ত সে। কিন্তু বাবার কাণ্ডই আলাদা, এও যেন বইয়ের আলোচনা একটা। লজ্জায় অর্চনা ঘেমে ওঠার দাখিল। কিন্তু এবারে জবাব না দিয়েও উপায় নেই, বাবার যা বলার বলা হয়ে গেছে।

অর্চনা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, তার পরে মোড়া ছেড়ে দ্রুত দরজার দিকে পা বাড়াল।

খুশীতে ভদ্রলোক টুকরো পোড়া চুরুটটা মুখে তুলে নিলেন।

বাইরে এসে হাঁপ ফেলতে গিয়ে অর্চনা থমকে দাঁড়াল। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁত। হাতে চুরুটের বাক্স। তার মুখে খুণীর চাপা অভিব্যক্তি, এবং সেই খুশীর কারণে সে চুরুটের বাক্স থেকে একটা চুরুট সরিয়ে সবে পকেটে পুরছে।

দাশু মুখ তুলেই দেখে সামনে দিদিমণি। চুরি ধরা পড়ে গেল।

 অর্চনা ভ্রুকুটি করে তাকাল তার দিকে, দাঁড়াও বাবাকে বলছি—

 বিব্রত গোবেচারী মুখ দাশুর।

ছদ্ম রাগে অর্চনা তার পাশ কাটাতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল। খোলা চুরুটের বাক্স থেকে আর একটা চুরুট তুলে নিয়ে দাশুর বুকপকেটে গুঁজে দিয়েই হন হন করে এগিয়ে গেল। হাস্যবদন দাশু ঘুরে দাঁড়াল, আর খানিকটা গিয়ে ফিরে তাকাল অর্চনাও। তার মুখভরা হাসি।

ঘোষণা যা করার সেটা অতঃপর ডক্টর বাই করেছেন। আর সেটা করেছেন সুখেন্দুকে নিজের ঘরে ডেকে কথাবর্তা বলে এবং তার সম্মতি নিয়ে তার পর। শুনে তার গৃহিণী স্তব্ধ পাথর। বিজন বিস্ময়াহত।

মায়ের সামনা-সামনি অর্চনা মুখখানা এমন করেছে যেন অবুঝ বাবা হাত-পা বেঁধে তাকে জলে ফেলারই ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু তাতেও মাকে তুষ্ট করা সম্ভব হয়নি, বাপের সঙ্গে মেয়ের চক্রান্তটা বুঝেছেন তিনি।

বাড়ির এই হাওয়াটা একটু গোলমেলে ঠেকল ননিমাধবের কাছেও।… বিজুদার হাবভাবে কেমন যেন সঙ্কোচ একটু! কাজের কথা ছাড়া কাছে ঘেষতে চায় না, কাচুমাচু ভাব, বাড়ি গেলে বরুণা রাণু বউদিও কেমন এড়িয়ে চলে। আর, যার প্রত্যাশায় যাওয়া তার তো দেখাই মেলে না। এমন কি, তার মায়েরও না।

ষষ্ঠ চেতনার কারিগরি কি না বলা যায় না, বিকেলের দিকে সেদিন সে এসেও হাজির বড় মর্মান্তিক ক্ষণে। মনে হল নিচের ঘরটা একটু বেশি পরিপাটি সাজানো গোজানো। সেই নিরিবিলিতে বসে একটু পড়ছিল রাণু বউদি, ওকে দেখে চমকেই উঠল যেন। ননিমাধব নিশ্চিন্ত মনে পড়তেই বলেছিল তাকে, তবু কতটিকে খবর দেবার জন্যে প্রায় শশব্যন্তেই পালিয়েছে সে। বরুণাও বউদির উদ্দেশে বকাবকি করতে করতেই একবার ঘরে ঢুকেছিল! বউদির বদলে ওকে দেখেই অন্ত, বিব্রত। দাদাকে খবর দেবার অছিলায় সেও দ্রুত প্রস্থান করেছে। ওদিক থেকে মিসেস বানুর গলা শোনা গেছে। কাজের সময় সকলের অলস নিশ্চিন্ততার কারণে ক্ষোভ তাঁর। এমন কি, ওপর থেকে কর্তার গলাও শোনা গেল, কতক্ষণের মধ্যে কে এসে পড়বে সেই কথা জানাচ্ছেন।

অন্যমনস্কর মত একটা সিগারেট ধরিয়ে খালি প্যাকেটটা জানালা গলিয়ে ফেলতেই ওদিক থেকে যে-মূর্তিটি মুখ তুলল, সে দাশ। জানালার ওপাশে বসে আয়েস করে বিড়ি টানছিল সে। কীর সামনে পড়লেই তো ছোটাছুটির একশেষ, সবে ফুরসৎ পেয়ে আড়ালে সরেছিল।

…ও তুমি–

জবাব না দিয়ে গম্ভীর মুখেই দাশু আবার জানালার ধারে বসে পড়েছে। ঘরে কে আছে বাইরে গাড়ি দেখেই বুঝেছিল।

কিন্তু ব্যতিক্রমটা বড় বেশি স্পষ্ট লাগছে। ননিমাধব দাশুকে না ডেকে নিজেই বাইরে এসে দাঁড়াল। বিড়ি ফেলে দাও প্রস্তুত।

আচ্ছা দাশু…এঁরা সবাই একটু ব্যস্ত দেখছি যেন, কি ব্যাপার? কি কথাবার্তা হচ্ছে শুনলাম

দাশু সাদাসিধে জবাব দিল, হা, দিদিমণির বিয়ের কথাবার্তা–বড় দিদিমণির।

 ননিমাধবের সঙিন অবস্থা।–কার সঙ্গে, মানে কে বলছে কথা?

 সকলেই। মা, বাবু, দাদাবাবু—

 একটু আশ্বস্ত।–দাদাবাবু বলছেন?

 দাশু নিস্পৃহ।–দাদাবাবুই তো সব থেকে বেশি রাগারাগি করছিলেন।

 ননিমাধব হকচকিয়ে গেল আবারও।– রাগারাগি কেন?

আর বেশি সংকটের মধ্যে রাখতে দাশুরও মায়া হল বোধ হয়। ঘ্যাঁচ করে খাঁড়াটা এবারে বসিয়েই দিল সে। ওই মাস্টারবাবুর সঙ্গেই দিদিমণির বিয়ে ঠিক হয়ে গেল–তাই আজ আশীর্বাদ।

ননিমাধব পাংশু হতভম্ব বেশ কিছুক্ষণ।

হাতের আস্ত সিগারেটটা ফেলে দিয়ে এক-পা দু-পা করে গাড়িতে গিয়ে উঠল।… চালকের আসনে।

ইতিমধ্যে ড্রাইভিংটা শিখে নিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *