৩. বাসে করেই য়ুনিভার্সিটি

০৩.

ফাঁক পেয়ে অর্চনা সেদিন বাসে করেই য়ুনিভার্সিটি যাচ্ছিল।

মা গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছেন তাঁর সামাজিক কর্তব্য পালনে। সময়মতই ফিরবেন বলে গিয়েছিলেন। অর্চনা ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে নটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে, তার পরেই বেরিয়ে পড়েছে। বাসে করে যেতে তার একটুও খারাপ লাগে না। মারের কচকচির জন্য কলের পুতুলের মত গাড়িতেই যেতে হয় বেশির ভাগ। কিন্তু ফাঁক পেলে ছাড়েও না। দশজনের ব্যস্তসমস্ততার মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে এ-ভাবে যেতে শুধু ভাল লাগে না, বেশ আত্মনির্ভরশীলতার বোধটুকুও জাগে।

অথচ অবস্থা তাদের এমন কিছু ভাল নয়। যেটুকু দেখায় সে শুধু মায়ের কেরামতিতে। ঠাট বজায় রাখার জন্য বাবা বেচারীকে এ-বয়সেও কম খাটতে হয় না। পেনসানের পর শুধু বড় বই ক’টার আয়েও চলছে না-স্বনামে বে নামে আরো এটা সেটা লিখতে হয়ই। বাবা বলেন, এই সব আজে-বাজে শর্টকাট আর নোট লিখে ছেলেগুলোর মাথা খাওয়া হচ্ছে। বাবা চেষ্টা করলেও আজে-বাজে লিখতে পারেন এটা অবশ্য অর্চনা বিশ্বাস করে না। কিন্তু খুশী মনে যে লেখেন না সেটা বোঝা যায়। না লিখে উপায় কি, প্রিন্সিপালের আর কতই বা পেনসান–তাছাড়া মায়ের যা তাগিদ! একটা গাড়িতে আর চলে না, মেয়েদের অসুবিধে নিজের অসুবিধের ফিরিস্তি দেন ফাঁক পেলেই। বাবার সঙ্গে একটু আধটু লেগেও যায় এই নিয়ে। অর্চনাকেও মা খুব রেহাই দেন না, এই আদরিণী মেয়ে যদি বাপকে গিয়ে ধরে আর একটা গাড়ির জন্যে, তাহলে হয়তো কিছুটা এগোয়। গাড়ির জন্যে একটা কিছু নতুন বই লেখা খুব অসম্ভব বলে তিনি মনে করেন না। অর্চনা মাকে খুশী করার জন্যেই বাবাকে আচ্ছা করে বলবে বলে আশ্বাস দেয়। আর বাবাকে বলে, মায়ের সঙ্গে কিছু কথা কাটাকাটি কোরো না, যা বলে বলুক না, একটা গাড়ি আছে এই বেশি-আমরা অনায়াসে ট্রামে-বাসে যাতায়াত করতে পারি। বাবাকে আবার সাবধানও করে দেয়, আমি বলেছি বোলো না যেন মাকে, তাহলে দেবে শেষ করে–।

যে-বাসে যাওয়া নিয়ে মায়ের এই আপত্তি, সেই বাসেই আজ এক মন্দ মজা হল না।

অফিস টাইম। দোতলা বাসেও ঠাসাঠাসি ভিড়। বাইরে লোক ঝুলছে, ভিতরেও বহু লোক দাঁড়িয়ে। একটা লেডিস সীটে অর্চনা একা বসে, পাশের জায়গাটুকু খালি। ঠিক তার পরেই এক হাতে মাথার বড় ধরে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক, অন্য হাতে বুকের সঙ্গে ঠেকানো এক গাদা বই। লম্বা-চওড়া চেহারা, সাদাসিধে বেশভূষা। পিছনের চাপে ভদ্রলোকের দাঁড়াতে রীতিমত কষ্ট হচ্ছে বোঝা যায়, এক-একবার টাল সামলানো দায় হচ্ছে।

অর্চনা এক একবার ভাবছে বসতে বলবে, আবার বলছে থাকগে বাবা দরকার নেই, সে-দিনের মত হয় যদি–।

আগে সীট খালি থাকলে এবং কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে বসতেই বলত। আর যাকে বসতে বলা, তার কৃতার্থ ভাবটাও দিব্বি উপভোগ করত। কিন্তু সে দিন কি কাণ্ড, মাগো! ভয়ানক মোটা এক ভদ্রলোকের দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল দেখে বসতে বলেছিল। ভদ্রলোক ইচ্ছে করেই হোক বা সত্যি বেশি মোট বলেই হোক-অর্চনার প্রাণান্ত অবস্থা। জানালার সঙ্গে একেবারে মিশে গিয়েও শান্তি নেই। আর কোন দিকে না তাকিয়েও অর্চনা বুঝতে পারছিল বাসসুদ্ধ লোক মজা দেখছে। এমনিতেই তো যেদিকে তাকায় জোড়া-জোড়া চোখ গায়ে বিধে আছে দেখে!

সেই দিনই অর্চনা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে আর কক্ষনো কাউকে পাশে বসতে বলবে না…তাছাড়া এই ভদ্রলোকও তেমন মোটা না হোক, হৃষ্টপুষ্ট কম নয়–আর হাবভাবও কেমন রুক্ষ-রুক্ষ। এক-একবার বেশ রাগ-রাগ ভাবেই তাকাচ্ছে খালি জায়গাটুকুর দিকে।

কিন্তু অতগুলো বই নিয়ে লোকটির দাঁড়ানো মুশকিল হচ্ছিল ঠিকই। বাস যত এগোচ্ছে, অফিসযাত্রীর ভিড়ও বাড়ছে, আর সেই অনুযায়ী ভারসাম্য রক্ষার ধকলও বাড়ছে। শেষে একটা জোরে ধাক্কা খেয়ে অর্চনার পাশে ধুপ করে বসেই পড়ল সে। অর্চনা ফিরে তাকাল।

কিছু মনে করবেন না, দাঁড়ানো যাচ্ছিল না–।

অর্চনা কিছু না বলে আর একটু ব্যবধান রচনার চেষ্টা করল।

কিন্তু বাসের লোকগুলোর ধরনই আলাদা। ট্রামে উঠলে অন্যরকম। থাকেও কত রকমের লোক! ভিড়ে চ্যাপটা, কিন্তু রসিকতাটুকু আছে। পিছন থেকে একটা ছোকরা টিপ্পনী কেটে উঠল, দাদা, ওটা লেডিস সীট—

কিছু না বলে লোকটি শুধু ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল একবার। অর্থাৎ সেটা জেনেই বসা হয়েছে।

বাসে ফাজিল লোকের অভাব নেই। রসিকতার লোভে ঝগড়াটা যেন আর একজন সেধে নিল। দাঁড়ানো যাচ্ছিল না দেখে দাদা বসেছেন, তাতে আপনার মাথাব্যথা কেন মশাই, লেডিস সীট লেড়ি বুঝবেন

সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের পাঁজা নিয়েই লোকটি উঠে দাঁড়াল এবং টাল সামলাবার জন্য অন্য হাতে রডটা ধরে বক্তার খোঁজে ফিরে তাকাল। রড ধরা হাতের ঢোলা পাঞ্জাবিটা নেমে আসতে তার পেশীবহুল পুষ্ট বাহুখানা অনাবৃত হল। অর্চনা বেশ ভয়ে ভয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে।

দ্বিতীয়বার আর টিকা টিপ্পনী শোনা গেল না। লোকটি পিছনের দিকে একবার সরোষে চোখ বুলিয়ে নিয়ে যেন চ্যালেঞ্জের মাথাতেই অর্চনার পাশে বসে পড়ল আবার। এইভাবে পঁড়ানো তাকানো আর আবার বসার অর্থ খুব স্পষ্ট। অর্থাৎ অমন ইতর উক্তি আর কানে এলে ফলটা খুব ভাল হবে না।

অর্চনা সবিস্ময়ে এক-একবার আড়ে আড়ে দেখছে লোকটাকে, তার এই জিদ করে বসাটাও খুব অপছন্দ হয়নি যেন।

বাড়ি এসে বরুণাকে বলেছিল কাণ্ডটা। ভাইবোনের মধ্যে বরুণাই ছোট সব থেকে। আই. এ পড়ে, কিন্তু ইয়ারকিতে টইটুম্বুর। অর্চনা অবশ্য খুব নীরস করে বলেনি বাসের গুণ্ডাগোছের ভদ্রলোকের কাণ্ডটা।

বরুণা আকাশ থেকে পড়েছে, গুণ্ডাগোছের ভদ্রলোক কি রে! তারপর গম্ভীব মুখে জেরা করেছে বেছে বেছে সে তোর সীটের গায়ে গিয়েই দাঁড়িয়েছিল কেন-বাসে আর লেডিস সীট ছিল না?

তিলকে তাল করতে বরুণার জুড়ি নেই। প্রথম সুযোগেই শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে সমাচারটা শোনাল ননিদাকে। দাদার বন্ধু এবং সাইকেল রিকশর ব্যবসায় পাটনার ননিমাধব। দাদার থেকে বয়সে কিন্তু ছোট হলেও দাদার অসম্ভব একনিষ্ঠ ভক্ত। কিন্তু আসল ভক্ত কার, এবং দাদা বাড়ি থাক বা না যখন তখন বাড়ি এসে বসে থাকে কোন প্রত্যাশায়, সেটা অর্চনাও যেমন জানে ননিদাও তেমনি জানে। অর্চনাকে দেখলেই তার ফর্সা মুখ লাল হয়। আর পকেট থেকে রুমাল বেরোয়। আর তার সামনা-সামনি কোন লজ্জার কারণ ঘটলে ( দিদির সামনে লজ্জার কারণটা বেশির ভাগ বরুণাই ঘটিয়ে থাকে। রুমালের ঘষায় ঘষায় ননিমাধবের ফল। মুখ রক্তবর্ণ হয়। দাদার সাময়িক অনুপস্থিতির ফাঁকে তার কাছেই করুণা প্রথম দু-চোখ কপালে তুলে বাসের মধ্যে দিদিকে গুণ্ডায় ধরার ব্যাপারটা নিবেদন করেছে।

কিন্তু বরাতক্রমে সেখানে যে মা এসে পড়বেন সে কি বরুণা জানত। এসে যখন পড়েছেন তাকেও সানন্দে ঘটনাটা না বলে পারল না, আর এখানে গুণ্ডা গোছের ভদ্রলোক না বলে শুধু গুণ্ডাই বলল। শোনার সঙ্গে সঙ্গে মা যেমন উত্তেজিত তেননি ক্রুদ্ধ। প্রথমে অর্চনার উদ্দেশেই হাঁকডাক করলেন এক প্রস্থ। অৰ্চনা তখন নিজের ঘরে বসে বরুণার উদ্দেশ্যে কিল জমাচ্ছে। ওদিকে ননিমাধব ইন্ধন যোগালো আরো। মন্তব্য করল, ট্রামে-বাসে আজকাল ভদ্রলোকের মেয়েদের চড়াই উচিত নয়।

হাতের কাছে আর কাউকে না পেয়ে মিসেস বাসু তাকেই দিলেন এক ধা। –তোমরা তো ব্যবসাই করছ দেখি বছরের পর বছর, একটা গাড়ি পর্যন্ত কিনে উঠতে পারলে না–ট্রামে বাসে না চড়ে কিসে চড়বে?

ননিমাধব আর ভরসা করে বলতে পারল না যে গাড়ি একটা আছেই।

গাড়ির জন্য স্বামীকে নতুন করে এক প্রস্থ ঝালিয়ে নেবার সুযোগ ছাড়লেন না মিসেস বাসু। অর্চনাকে ছেড়ে আপাতত তার উদ্দেশেই চললেন।

দোতলার কোণের দিকে একটা ঘরে থাকেন ডক্টর বাসু। তার ডক্টরেক্টর বিষয়বস্তু দর্শনশাস্ত্র। অবশ্য ইংরেজিতেও এম এ, ভদ্রলোক, কিন্তু দর্শনেরই যে প্রভাব বেশি সেটা তার অবিরাম চুরুট-খাওয়া মূতি আর ঘরের আগোছালো অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। একদিকে অবিন্যস্ত শয্যা, তারই ওপর স্থূপীকৃত বই–র্যাকের বইগুলো উলট-পালট-টেবিলেও বইয়ের গাদা আর বইপত্র ছড়ানো। তারই মধ্যে কখনো বিছানায়, কখনো বা টেবিলে-চেয়ারে বসে দিব্বি নিবিষ্ট মনে কাজ করে যান ভদ্রলোক। শুধু অর্চনা ছাড়া কেউ আর এই সব বইপত্র ছুঁতেও সাহস করে না। সপ্তাহের মধ্যে কম করে তিনদিন বাবার ঘর গোছায় অৰ্চনা আর অনুযোগ করে, কবে হয়তো দেখব তুমি বই চাপা পড়ে আছ

বইপত্রের মধ্যেই আধশোয়া হয়ে আত্ম-তত্ত্বের একটা ইংরেজী প্রবন্ধ পড়ছিলেন তিনি। আর মনে মনে ভাবছিলেন, অর্চনা যদি এসে থাকে তাকে পড়ে শোনাবেন। বাবার কাছে বসে এই শোনার ধকলটা অর্চনাকে মুখ বুজে সইতে হয়। সয়ও, কারণ রিটায়ার করার পর আর সময় কাটে না, বেচারা বাবা করবেনই বা কি সারাক্ষণ। কিন্তু ওর বদলে যিনি এলেন, ভদ্রলোকের আত্মতত্ত্বোপলব্ধির মেজাজটা রসাতলে গেল।

মিসেস বাসু ঘরের বাইরে থেকেই কণ্ঠস্বরে আগমন ঘোষণা করতে করতে এলেন।–কতদিন বলেছি একটা গাড়িতে চলে না, চলে না–আর একটা গাড়ি কেনো! একটা বিপদ না বাধলে আমার কথা কি কানে যাবে।

ডক্টর বাসু আত্মতত্ত্ব থেকে মুখ তুলে বুঝতে চেষ্টা করলেন কি ব্যাপার, তারপর নিস্পৃহ মুখে জবাব দিলেন, কথা কানে গেলেই তো আর গাড়ি কেনা যায় না, টাকা লাগে

টাকা লাগে, টাকা লাগবে। এই এক অজুহাত আর যেন বরদাস্ত করতে রাজী নন মিসেস বাসু। মেয়েটা ধেই-ধেই করে ট্রামে-বাসে যাক আর যতসব পাজী গুণ্ডার খপ্পরে পড়ক, কেমন?

ডক্টর বাসু অবাক, ট্রামে-বাসে গুণ্ডা!

 মাকে গজগজিয়ে বাবার ঘরের দিকে যেতে দেখেই তাল সামলাবার জন্যে অর্চনাকেও মায়ের অগোচরে দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াতে হয়েছে। পিছন থেকে তার গা ঘেষে বরুণাও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। মা সামনের দিকে মুখ করে আছেন, কিন্তু বাবা দেখতে পাচ্ছেন তাদের। অর্চনা ইশারায় হাত নেড়ে বাবাকে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করল ব্যাপারটা কিছুই নয়।

স্বামীর অজ্ঞতায় মিসেস বাসু প্রায় হতাশ। জবাব দিলেন কোথায় কি সে জ্ঞান যদি তোমার থাকত তাহলে আমার আর ভাবনা ছিল কি। মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে দেখ কি হয়েছে আজ

বলতে বলতে স্বামীর দৃষ্টি অনুসরণ করে ফিরে দেখেন দরজার ওধারে অর্চনা আর বরুণা দাঁড়িয়ে। মায়ের চোখে চোখ পড়তে পড়তে বরুণা কেটে পড়ল, অর্চনা সামলে নিয়ে নিরীহ হতে চেষ্টা করল। মেয়েকে ডাকার কাজটা মিসেস বাই করলেন।–এই যে, এসে বল কি হয়েছে আজ–

অর্চনা দরজার কাছ থেকেই ঢোঁক গিলে বলল, তুমিই বলো না আমি কি আর তোমার মত করে বলতে পারব–।

ব্যাপার কিছু নয় বুঝে ডক্টর বাসু আত্মতত্বে ডুব দিতে চেষ্টা করলেন আবার। কিন্তু সেই চেষ্টার আগেই স্ত্রীটি কাগজটা নিয়ে টেবিলের ওপর ছুঁড়ে রাখল।–মেয়েরা আর একদিনও ওভাবে ট্রামে-বাসে যাবে না আমি বলে দিচ্ছি।

ডক্টর বাসু বিরক্ত হলেন, গাড়ি কি নেই নাকি! তাছাড়া হাজার হাজার মেয়ে দিনের পর দিন ট্রামে বাসেই যাচ্ছে।

যে যাচ্ছে যাক, আমি জানতে চাই তুমি আর একখানা গাড়ি কিনবে কি না!

স্ত্রীর এই অবুঝপনাই ডক্টর বাসু বরদাস্ত করে উঠতে পারেন না সব সময়। উঠে বসে অসহিষ্ণু বিরক্তিতে বলে উঠলেন, কিনব কি দিয়ে, টাকার জন্যে তো দিনরাত নোট লিখে লিখে ছেলেগুলোর মাথা খাচ্ছি–তাতেও রেহাই নেই। তোমার বাড়ি, তোমার গাড়ি, তোমার শাড়ি, তোমার পাটি–

অর্চনা পালিয়ে বাঁচল। আর বরুণাকে হাতের কাছে পেয়ে সত্যিই গোটাকতক কিল বসিয়ে দিল গুমগুম করে।–পাজী মেয়ে, তোর জন্যেই তো

কিলগুলো খুব আস্তে পড়েনি, তবু সেগুলি হজম করে বরুণা হেসে গড়াগড়ি।

ব্যাপারটা এখানেই শেষ হবার কথা, কিন্তু উদ্দেশ্য নিয়ে ওপরওয়ালা যে যোগাযোগ ঘটান, সেটা সুদূরপ্রসারীও হয়।

বাড়ির গাড়িতে যুনিভার্সিটি যাবার পথে অর্চনা বাস-স্টপে সেই একরোখা লোকটাকে বাসের অপেক্ষায় একগাদা বই হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে পর পর আরো দুদিন। এক পথেই যায়, আর লোকটা এক জায়গা থেকেই ওঠে যখন, দেখতে পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। অৰ্চনা একদিন ভেবেছে, এই বয়সেও কলেজে পড়ে নাকি! আর একদিন ভেবেছে, মোটরে তুলে নিলে কি হয়? কিন্তু একা সাহস হয় না, বরুণা থাকলে ঠিক মজা করা যেত। বরুণার কলেজ বাড়ির কাছেই, সে অনেক আগেই নেমে পড়ে। তা বলে সত্যিই লোকটার সম্বন্ধে তেমন কোন কৌতূহলই ছিল না–ওই দেখার মুহূর্তটুকু যা।

কিন্তু কৌতূহলের কারণ ঘটল একদিন।

বাবার ঘরে বসে সেদিন সন্ধ্যায় অর্চনা তার কি একটা লেখা নকল করে দিচ্ছিল। মা-ও ছিলেন ঘরে। বাবার ট্রাক খুলে ব্যাঙ্কের পাস-বইয়ের জমা খরচ দেখছিলেন। টেলিফোন বেজে উঠতে বাবা টেলিফোন ধরলেন। কথাবার্তায় মনে হল বাবা কারো স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষার খবর শুনে খুণী হয়েছেন। অর্চনার মনে পড়ল, ইলা-মাসীর ছেলে মিন্টু, এবারে স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষা দিয়েছে বটে। ইলা-মাসী বাবার ব্যারিস্টার বন্ধুর জী, মারে অন্তরঙ্গ বান্ধবী। অর্চনা-বরুণারও যাতায়াত আছে সেখানে।

টেলিফোনে কিছু শুনেই বাবা যেন থমকে গেলেন। বিব্রত কণ্ঠ কানে এলো, অ্যাঁ? পা-পার্টি-হ্যাঁ, নিশ্চয় নিশ্চয়, কবে?

মায়ের কানে কিছুই যায়নি বোধ হয় এতক্ষণ, পাটি শুনে ঘাড় ফেরালেন। তারপর ইশারায় জানতে চাইলেন, কে?

বাবার মুখভাব বদলেছে, কিন্তু মুখে খুশীর ভাবই প্রকাশ করেছেন। মায়ের ইশারার জবাব না দিয়ে ফোনের জবাবটাই শেষ করলেন, খুব ভাল কথা, তা আপনি বরং আমার স্ত্রীর সঙ্গেই পরামর্শ করুন–(হাসি) হা–আমি তো তার ওপরেই সব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছি, ধরুন একটু

মিসেস বাসু ততক্ষণে কাছে উঠে এসেছেন। টেলিফোনের মুখটা চেপে তার দিকে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে ডক্টর বাসু সংক্ষিপ্ত উক্তি করলেন পার্টি

অর্চনার মজা লাগছিল, পাছে বাবার চোখে চোখ পড়ে যায় সেই জন্য তাড়াতাড়ি মুখ নামালো। টেলিফোনে মায়ের আনন্দটুকু আরো উপভোগ্য। মিন্টু, স্কুল ফাইন্যালে একেবারে প্রথম হয়েছে শুনে একটু একটু আনন্দ প্রকাশ করলে চলে! আর সকলে মিলে আনন্দের ব্যবস্থা একটু? তা তো করতেই হবে, ওকে এনকারেজ করতে হবে না! সে-জন্যে ভাবনা কি, কিছু ভাবনা নেই–সব ঠিক হয়ে যাবে। উনি?

এবারে বাবার কথা বোধহয়। বাবা বইয়ে মন দিয়েছেন। অর্চনা ঘরে আছে তাও মায়ের খেয়াল নেই বোধ হয়। বাবার হয়ে একেবারে নিশ্চিন্তে কথা দিয়ে দিচ্ছেন, আর বাবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ—হ্যাঁ, নিশ্চয় যাবেন, নিজে কতবড় স্কলার। জানো তো, এসব ব্যাপারে ওঁর খুব উৎসাহ! মেয়েরা একবার একটু খারাপ রেজাল্ট করলে ওঁর ভয়ে আমি সুদ্ধ চুপ–।

অর্চনার হাসি সামলানো দায়। চেয়ে দেখে বাবাও ওর দিকে চেয়ে হাসছেন। মা টেলিফোন রেখে বিছানায় বসলেন। দরজার ওধারে চোখ পড়তেই ডাকলেন এই দাশু, শোন–

দাশু ঘরে এসে দাঁড়াল।

দাদাবাবু কি করছে?

দাশু নির্বিকার জবাব দিল, ব্যবসা কচ্ছেন—

 কি–? মায়ের বিরক্তি।

দাশু ব্যাখ্যা করে বোঝালো, নিচে দাদাবাবু আর ননিবাবুতে বসে কাগঞ্জে ব্যবসা লিখছেন।

মায়ের মাথায় অনেক ভাবনা। হুকুম করলেন, গিয়ে বল, আমি ডাকছি–

দাও চলে গেল, মা ঘুরে বসলেন বাবার দিকে।– শুধু হাতে তো আর যাওয়া যায় না, ছেলেটাকে একটা ঘড়িই দেওয়া যাক। বিজন গিয়ে দেখেশুনে আজই নিয়ে আসুক। কি বলো?

বই রেখে বাবা চুরুটের বাক্সর দিকে হাত বাড়ালেন। বইয়ের সাইজের সুন্দর একটা কাশ্মীরী কাজ-করা কাঠের বাক্সে চুরুট থাকে। ভয়ে ভয়ে অর্চনা বাক্সটা বাবার দিকে এগিয়ে দিল। মুখ বন্ধ করার জন্যই যেন তিনি আস্ত একটা চুরুট নিজের মুখগহ্বরে ঠেলে দিলেন।

ইলা-মাসির বাড়ির এই পার্টিতে অর্চনা এসেছিল। স্বেচ্ছায় আসেনি, আসতে হয়েছিল। মায়ের এই সব আভিজাত্য রক্ষার ব্যাপারে বরুণা তবু পার পায় কিন্তু ও বড় পায় না। অবশ্য এবারে বরুণাও রেহাই পায়নি। বাবা আসেননি। আসবেন না অর্চনা জানতই। ইলা-মাসি খোঁজ করেছিলেন। মা জবাবদিহি করেছেন, আর বলো কেন ভাই, আসতে পারলেন না বলে তার নিজেরই কি কম দুঃখ-হঠাৎ শরীরটাই খারাপ হয়ে পড়ল।…্যাই হোক, মায়ের সঙ্গে অর্চনা আজ পর্যন্ত যত জায়গায় গেছে, তার মধ্যে এবারে এই ইলা মাসির বাড়ি থেকেই মনে মনে একটু খুশী হয়ে ফিরেছে।

ছেলের পরীক্ষার কৃতিত্ব উপলক্ষে ঘরোয়া পাটি হলেও অভ্যাগত একেবারে কম জোটাননি ইলা-মাসি। এখানে যাদের দেখল, তাঁদের সকলকেই কারো না কারো জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও দেখেছে, সাংস্কৃতিক জলসা বা নাচের আসরেও দেখেছে, আবার রিলিফ চ্যারিটি শোতেও দেখেছে। নতুনের মধ্যে শুধু মিণ্টর দু-চারজন বন্ধু-বান্ধব। কাজেই এ অনুষ্ঠানেও অভিনবত্ব কিছু ছিল না, আর অর্চনা ভাবছিল কতক্ষণে শেষ হবে, কতক্ষণে বাড়ি যাবে।

বৈচিত্র্যের কারণ ঘটল খাবার টেবিলে।

হল-ঘরে মস্ত একটা ডিম্বাকৃতি ডাইনিং টেবিল। চারদিকে গোল হয়ে বসেছেন সব। একটা ধার নিয়ে বসেছিল অৰ্চনা আর বরুণা। মায়ের হয়তো টেবিলের মাঝামাঝি বসার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মেয়েরা বসে পড়েছে দেখে বরুণার পাশে এসেই বসলেন তিনি। টেবিল ঘুরে তাদের উল্টো দিকে কয়েকটা আসন খালি, কেউ তখনো আসেননি হয়তো।

খাবার টেবিলের প্রধান আলোচনা, ছেলে মিণ্ট, ভবিষ্যতে কোন্ লাইনে যাবে আর কি পড়বে। ছেলে আর ছেলের বন্ধুরাও হাঁ করে সেই আলোচনা শুনছে। বরুণার ভাল লাগছিল না, অর্চনা অন্যদিকে তাকাতেই সে টুক করে তার প্লেটের কাটলেটটা নিজের প্লেটে তুলে নিল। অর্চনা দেখে ফেলে হাসি চেপে ভ্রুকুটি করে তাকাল তার দিকে। বরুণা চাপা গলায় বলল, তুই আর একটা চেয়ে নে না।

দুই বোনে এমনই চলত বোধহয়। ঠিক সেই সময়ে নতুন আগন্তুকের আবির্ভাব। আর তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই অর্চনা প্রায় হাঁ!…বাসের সেই লোকটা। বাসের মতই তেমনি সাদাসিধে বেশ-বাস। এ-রকম পরিবেশে একেবারে বেমানান।

মিন্টুর বাবা উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানালেন, আসুন মিঃ মিত্র, আপনি কিন্তু লেট, বসে যান–।

লেট হওয়ার দরুন মিঃ মিত্রের কিছুমাত্র কুণ্ঠা দেখা গেল না। হাসিমুখে সে মিন্টুর দিকে এগিয়ে গেল। অর্চনা বরুণার কানে কানে যোগাযোগের বৈচিত্র্যটা জ্ঞাপন করতেই সে যুগপৎ আনন্দ আর বিস্ময়ে আগন্তুকের দিকে চেয়ে দুই চোখের বিশ্লেষণের কাজটা সেরে নিল। লোকটা তখন মিন্টুর পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে।

আনন্দমিশ্রিত উত্তেজনায় বরুণা মাকে ফিসফিস করে বলল, মা-দিদির বাসের সেই গুণ্ডা।

মিসেস বাসু আগে লোকটাকে এক নজর দেখেছেন কি দেখেননি। এবারে ভাল করে দেখায় মন দিলেন। মিন্টুর কাছ থেকে এগিয়ে গিয়ে লোকটি তখন খালি আসনের একটাতে বসল। অর্চনা-বরুণার ঠিক উল্টো দিকে নয়–কিছুটা আড়াআড়ি। মিসেস বাসুর দৃষ্টিও সেখানেই এসে থামল। এ-রকম বেশভূষার একটা লোক এখানে কেন, সেটাও বোধ করি তার কাছে বিস্ময় একটু।

এদিকে অর্চনা আর বরুণাও চেয়ে আছে।

সকলের অগোচরেই ছোট্ট প্রহসনের সূচনা একটু। খাবারের প্লেট কাছে টানতে গিয়ে ওধারে অর্চনার চোখে লোকটির চোখে পড়ল। অর্চনা খাবারের প্লেটে দৃষ্টি নামাল। কিন্তু বরুণার সে কাণ্ডজ্ঞান নেই। হাঁ করে সে আর একটি দুর্লত খাদ্যবস্তুই দেখছে যেন।

খেতে খেতে লোকটি আরো দুই একবার দেখল তাদের। কিছু স্মরণ করতে চেষ্টা করছে বোঝা যায়। অর্চনার সঙ্গে আর একবার চোখাচোখি হতেই সামনের দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?

ওখান থেকে ওভাবে প্রশ্ন নিক্ষেপ করা সুশোভন নয়। দুই একজন প্রৌঢ় এবং প্রৌঢ়া হাসি গোপন করে গেল। না দেখে থাকলেও দেখার লোভটা যেন স্বাভাবিক সেটা তারাও অস্বীকার করেন না। এটা তারা প্রাথমিক আলাপের চেষ্টা বলেই ধরে নিলেন। অর্চনা অতদূর থেকে হঠাৎ এ-ভাবে আক্রান্ত হয়ে বিব্রত মুখে মাথা নাড়ল। অর্থাৎ, মনে পড়ছে না।

মিসেস বাসু ভুরু কোচকালেন। বরুণা চাপা পুলকে দিদিকে বেশ করে চিমটি কাটল একটা।

ওদিকে টেবিলের আলোচনাটা মিন্টুর ভবিষ্যতের দিকেই ঘুরেছে আবার। এক ভদ্রলোক মিন্টুর বাবাকে পরামর্শ দিলেন, আপনি এক কাজ করুন মিঃ খাস্তগীর, বি. এ. পাস করিয়ে ওকে সোজা আই. এ. এস্-এ বসিয়ে দিন

তাঁর পাশের মহিলাটির তাতে আপত্তি। তিনি মত প্রকাশ করলেন, ও চাকরিতে আছে কি–আই, এসি, পাস করিয়ে ওকে বরং ডাক্তারি পড়তে দিন।

এ ধার থেকে এক ভদ্রলোক মন্তব্য করলেন, ডাক্তারি থেকে আজকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ভাল–পাস করে একবার বাইরে ঘুরে এলেই ব্রাইট ফিউচার।

বরুণা দেখল তার দর্শনীয় লোকটা খাওয়া ফেলে হাঁ করে মতামত শুনছে। পাশ থেকেই এবারে তারই মা বলে উঠলেন, আমি বলি ইলা, আই, এসি, পাস করিয়ে মিন্টুকে তুমি মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংএ দিয়ে দাও। আমার সেই বোনপোকে তো জানো, ওই তো বয়েস-এরই মধ্যে কত বড় অফিসার।

নতুন কিছুই বলেছেন। মিসেস বাসু অন্তরতুষ্টিতে সকলের দিকে তাকালেন। আর শুধু বরুণা নয়, অর্চনাও দেখল, এবারে ঐ লোকটার নীরব বিস্ময় আর কৌতুকের কেন্দ্র তাদের মা।

এতজনের পরামর্শের মধ্যে পড়ে মিন্টুর বাবাকেও একটু চিন্তিত দেখা গেল। তিনি বললেন, তাই তো, এ এক সমস্যা। কিন্তু সমস্যা সমাধানের জন্য একটি লোক উপস্থিত এখানে, সেটা যেন এতক্ষণ খেয়াল ছিল না। খেয়াল হতে ঘাড় ফেরালেন, মিঃ মিত্র অমন চুপচাপ কেন আপনিই তো বলবেন–

সকলের চোখ এদিকে আকৃষ্ট হতে মিন্টুর বাবা আবার বললেন, ও…একে আপনারা চেনেনা বোধহয়-প্রফেসর সুখেন্দু মিত্র-মিন্টু, যে প্রথম হতে পেয়েছে সে তো ওঁরই হাতষশ।

প্রশংসা শুনেও হাত-যশস্বী লোকটা তেমন প্রীত হয়েছে মনে হল না অর্চনার। বরুণা ফিস ফিস করে মাকে আবার বলল, গুণ্ডা নয় মা, প্রফেসর

মিসেস বাসু প্রায় আত্মগত মন্তব্য করলেন, মাস্টারের চেয়ে গুণ্ডা ভাল

সকলেরই খাওয়া শেষ প্রায়। সুখেন্দু মিত্র ঝুঁকে দেখল, মিন্টুরাও হাত গুটিয়ে বসে আছে। বাপের কথার জবাব না দিয়ে ছেলের উদ্দেশ্যেই আগে বলল, তোমাদের তো খাওয়া হয়ে গেছে দেখছি মিন্টুবাবু…ভাল ভাল দুটো বই এনেছি তোমার জন্য, পড়ার টেবিলে আছে–দেখগে যাও। বন্ধুদেরও নিয়ে যাও–

এই রকম একটা অবতরণিকা অপ্রত্যাশিত। মিল্টর বেরিয়ে গেল। অভ্যাগতরা একটু যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। এইবার ছেলের বাপের দিকে ঘুরল সুখেন্দু মিত্র, হেসেই বলল, পরীক্ষায় প্রথম হওয়াটা যে বিশেষ কিছু সেটা ও এভাবে না জানলেই ভাল হত।…মিণ্ট, আই. এসি পড়বে আপাতত এর বেশী ভাবার দরকার আছে বলে তো আমার মনে হয় না।

সকলেরই একটু-আধটু অপ্রতিভ অভিব্যক্তি। কালচারের সংজ্ঞায় প্রতিবাদ সৌজন্যবিরোধী, কাজেই এ-রকম শুনতে তেমন অভ্যন্তও নয় কেউ। বরুণ প্রথমে হাঁ, তার এবারের চিমটি খেয়ে অর্চনা অস্ফুট শব্দ করে উঠল একটু। অসহিষ্ণু মিসেস বাসুর ঠোঁটদুটো একবার নড়ল শুধু। অশ্রুত উক্তি, কাজেই শোনা গেল না।

.

নিচের ঘরে টেবিলের একদিকে বসে কাগজ কলম নিয়ে নিবিষ্ট একাগ্রতায় সাইকেল-রিকশর ব্যবসা বাড়ানোর স্কীম ছকে যাচ্ছে অর্চনা-বরুণার দাদা বিজন। ব্যবসা অনেকদিনই করেছে, স্কীমও নতুন নয়। তবে এতদিনে সেটা কিছুটা পরিণতির মুখে এসেছে। টাকার আশ্বাস কিছুটা পেয়েছে। তাই স্কীম করার একাগ্রতাও বেড়েছে। তার সামনের চেয়ারে বসে তেমনি মন দিয়ে ঘরের কড়িকাঠ দেখছে ননিমাধব। বিজনের অগোচরে এক-আধবার ঘড়িও দেখছে। য়ুনিভার্সিটি চারটেয় ছুটি হলেও মোটরে বড়জোর আসতে লাগে আধ ঘণ্টা…তার মানে এখনো আধ ঘণ্টার ধাক্কা। গতকাল ছুটির দিনটা মাটি হয়েছে। ফ্যাক্টরি থেকে টেলিফোনে বরুণার অনুমতি চেয়েছিল, থিয়েটারের টিকিট কাটবে কিনা। অনুমতিটা আসলে কার দরকার সেটা বরুণাও ভালই জানে। তবু দিদিকে জিজ্ঞাসা না করেই সাফ জবাব দিয়েছে, কোন আশা নেই, কাল ইলা-মাসির বাড়িতে পার্টি।

আবার ছুটির দিন আসতে তো ছ’টা দিন…!

ঘরের কোণে ঈজিচেয়ারে গা ঢেলে দিয়ে নিবিষ্ট চিত্তে একটা নতুন উপন্যাসে ডুবে আছে বিজনের স্ত্রী ইন্দ্রাণী দেবী, সংক্ষেপে রাণু বউদি। কি একটা কাজে বিজন ফ্যাক্টরি থেকে আগেই বেরিয়েছিল। ননিমাধকে বলে গিয়েছিল সে যেন সাড়ে তিনটেয় বাড়ি আসে–জরুরী আলোচনাটা সেখানে বসেই হবে। ননিমাধব সাড়ে তিনটেয় না এসে তিনটেয় এসেছিল। য়ুনিভার্সিটি তে কত কারণেই ছুটি থাকে, বরাত ভাল থাকলে আজও ছুটি থাকতে বাধা কি। বিজুদ আসব আগে আধ ঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে তাহলে। কিন্তু বরাত ভাল নয়। এসে শুনল য়ুনিভার্সিটি খোলাই। বাড়িতে আর কেউ না থাকায় দাশু রাণু বউদিকে খবর দিয়েছে। ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রানু দেবীকে বই হাতে করেই উঠে আসতে হয়েছে। গল্পের বই হাতে পেলে আহার-নিদ্রা ঘুচে যায় মহিলার। তার ওপর তেমনই বই এটা। আগুন, আগুন- ডবল আগুনের তাপ বোধহয় অনেকদূর পৌঁছেছে। বিজনের সাড়া পেয়ে শাস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অতিথি-আপ্যায়নের দায় শেষ করে ঈজিচেয়ারে আশ্রয় নিয়েছে। এখানেই নিরাপদ, ওপরের ঘরে ঘরে এক্ষুণি শাশুড়ী ঠাকরুণ টহল দেবেন–তার হাতে বই দেখলে সকলেরই চোখ টাটায়। অবশ্য, আবার আগুন-আগুনে ঝাঁপ দেবার আগে দাশুকে খাবার আর চায়ের নির্দেশ দিয়ে এসেছে, নইলে পাঠে বিঘ্ন ঘটবে জানা কথাই।

খানিকক্ষণ হল দুজনের সামনেই খাবার রেখে গেছে দাও। এবারে ট্রেতে চা এনে দেখে খাবারের প্লেট ছোঁয়াও হয়নি। সকলের অগোচরে একটা নীরব অভিব্যক্তি সম্পন্ন করে ব্যবসায়ী দুটিকে সচেতন করাবে আশায় দাশু যার দিকে ফিরে তাকাল–সে আরো অনেক দূরে। মলাটের গায়ে ভবল আগুন থেকে এতে দাশু এদিকেই ফিল আবার তার পর গলা দিয়ে একটা ফ্যাসফেসে শব্দ বার করে নীরবতায় ব্যাঘাত ঘটাল।

বিরক্তমুখে বিজন মুখ তুলে তাকাল।–রেখে যা।

চা রেখে দাশুর প্রস্থান। এই সুযোগে ননিমাধব নড়েচড়ে বসে খাবারের প্লেটটা কাছে টেনে নিয়ে গেল। কিন্তু হল না। বিজনের লেখার কাজ শেষ হয়েছে। ব্যবসায়ের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের চিত্রটা এঁকে ফেলে টাকার অঙ্কটা মোটামুটি হিসেব করে ফেলেছে। বলল, আচ্ছা শোনো–

ননিমাধব শোনার জন্য হাত গুটিয়ে নিল।

এখন আমাদের সাইকেল-রিকশর প্রোডাকশন ডেলি ধরে। তিনটে—

 ননিমাধব চিন্তা করল একটু।–সাড়ে তিনটেও ধরতে পারে।

ও সাড়ে-টাড়ে ছাড়ো–তিনটেই। আমাদের করতে হবে ডেলি কম করে দশখানা–তাহলে লোক বাড়াতে হবে অন্তত তিনগুণ, ফ্যাক্টরির স্পেস চাই দ্বিগুণ। এই মেসিনপত্রের লিস্ট–এগুলো তো আনাতেই হবে।…সব খরচা ফেলেছি দেখ, আপাতত তিরিশ হাজার টাকার নিচে হবে না। স্কীমটা নিয়ে গিয়ে তোমার বাবাকে বেশ বুঝিয়ে টাকার কথা বলো–

টাকার অঙ্কটা শুনে ননিমাধব টেক গিলে বলল, বলেই ফেলি, অ্যাঁ?

 নিশ্চয়। এরপর আর যত দেরি হবে তত ক্ষতি–

ক্ষতিপূরণের মত করেই খাবারের ডিশটা হাতের কাছে টেনে নিল সে। কিন্তু এবারে তার সেই চেষ্টায়ও ব্যাঘাত ঘটল। ননিমাধব আমতা আমতা করে বলল, আচ্ছা বিজুদা টার্গেটটা একেবারেই দশটা না করে আমরা যদি এখন ছ’টা করি।

ছটা! পার্টনারের প্রস্তাব শুনে বিজন আহত-দশটাই তো কিছু নয়। নতুন প্ল্যানে হাজার হাজার মাইল রাস্তা হচ্ছে এখন–সর্বত্র তো সাইকেল-রিকশই চলবে! যে-রেটে ডিম্যাণ্ড বাড়ছে, দাঁড়াও, দেখাই–

স্ত্রীর উদ্দেশে বলল–রাণু, আমার সেই চার্ট আর–

থেমে গেল। স্ত্রী এ রাজ্যে নেই। বিরক্তমুখে নিজেই চেয়ার ঠেলে উঠে চার্ট আর প্ল্যান আনতে বেরিয়ে গেল সে।

বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে এবারে নানাবিধ খাবারের ডিশটা সামনে টেনে আনল। চা তো জুড়িয়ে জল। কিন্তু খাওয়া আজ কপালে লেখা নেই বোধহয়। বাইরের বারান্দা ধরে টকটক জুতোর শব্দ শোনা গেল। বলা বাহুল্য সে শব্দ কোন পুরুষ-চরণের নয়। ননিমাধবের মুখের রঙ বদলায় সঙ্গে সঙ্গে। খাবার ছেড়ে তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রুমাল বার করল সে। কিন্তু সেটা মুখ পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই দোরগোড়ায় যে এসে দাঁড়িয়েছে, সে বরুণ।

বরুণা জানান দিল, দিদি নয়, আমি।

হাসতে চেষ্টা করে ননিমাধব বলল, হ্যাঁ— রুমালটা পকেটে।

বরুণা ঘরে ঢুকে সরাসরি দাদার চেয়ারেই বসে পড়ল। ঝুঁকে বউদির হাতের বইখানার নাম পড়ে ছোটখাটো মুখভঙ্গি করল একটা। তারপর ননিমাধবের দিকে তাকাল।

ননিমাধব জিজ্ঞাসা করল, কাল পাটিতে গেছলে?

তাকে দেখে এই রসটা পরিবেশন করার আগ্রহেই বরুণার ঘরে ঢোকা। সোৎসাহে জবাব দিল, হা-আর, কি কাণ্ড জানেন?

ননিমাধবের চোখে কাণ্ড শোনার আগ্রহ।

বরুণা বলল, পার্টিতে সেই বাসের গুণ্ডা–সেই যে সেই–

ননিমাধব এস্তে মাথা নাড়ল, অর্থাৎ বুঝেছে। গলা নামিয়ে বরুণা হতাশ ভঙ্গিতে যোগ করল, গুণ্ডা নয়, প্রফেসার! মা অবশ্য বলে, প্রফেসারের থেকে গুণ্ডা ভাল। চেয়ারে ঠেস দিয়ে আর একটুও জুড়ে দিল, সাইকেল-রিকশঅলাও বোধহয় ভাল।

ঠাট্টায় কান না দিয়ে নমিমাধব জিজ্ঞাসা করল-মানে, সে সেখানে ছিল?

শুধু ছিল। জাঁকিয়ে ছিল।– তারপর নির্লিপ্তমুখে খবরই দিল যেন, আমাদের সঙ্গে কত খাতির হয়ে গেল, আর দিদি তো সারাক্ষণ তার সঙ্গেই গল্প-সল্প করল।

বাইরে গাড়ি দাঁড়ানোর শব্দ। বিজুদা হয়তো হাতের কাছে কাগজপত্র খুঁজে পায়নি। ননিমাধব মনে মনে প্রার্থনা করল, চট করে যেন না পায়, কারণ এবারের শব্দটা আর ভুল হবার নয়। বরুণাও সেই শব্দের উদ্দেশে একটা অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত করল। অর্থাৎ, ওই আসছে

ননিমাধবের হাতটা আপনা থেকেই পকেটে গিয়ে ঢুকল আবার।

অর্চনাই। দরজার কাছ থেকে এক পলক সকলকে দেখে নিয়ে হাসিমুখেই বউদির পিছনে এসে দাঁড়াল। বইখানা দেখল। তারপর একটু গম্ভীর হয়ে এগিয়ে এসে ঈজিচেয়ারের হাতলের ওপরেই বসল। রানু দেবীর হুশ ফিরল এতক্ষণে।

আহা, আগুন নিভিয়ে ফেললাম?

বিব্রত হলেও রানু দেবীর চোখের সামনেই জবাব মজুত। ননিমাধবের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি মশাই, আগুন নিভেছে?

ননিমাধব বিগলিত, এর পরেই হাতের রুমাল মুখে না উঠে থাকে কি করে। দেখাদেখি বরুণাও গম্ভীর মুখে তার রুমাল বার করে মুখ মুছতে লাগল। হাসি চেপে অর্চনা কুটি করে তাকাল তার দিকে, এই–তুই ওখানে কি কচ্ছিস রে?

রুমাল নামিয়ে বরুণা ধীরে-সুস্থে জবাব দিল, কালকের পার্টিতে সেই গুণ্ডা প্রফেসারের সঙ্গে তোর কেমন ভাব হয়ে গেছে ননিদাকে সেই কথা বলছিলাম। রাগতে গিয়েও অর্চনা হেসেই ফেলল। ননিমাধব এতক্ষণে কথা বলার ফুরসত পেল।–আজ এত দেরিতে ছুটি যে?

রাণু দেবী যোগ করল, ভারি অন্যায়–।

অর্চনা হাসিমুখে ফিরে ননিমাধবকেই জিজ্ঞাসা করল, আপনার এত সকাল সকাল ছুটি যে, ফ্যাক্টরি তো পাঁচটা পর্যন্ত?

ননিমাধব জবাব হাতড়ে পাওয়ার আগেই রসভঙ্গের জবাবটি এসে হাজির। বিজন। হাতের কাছে সত্যিই কাগজপত্রগুলো না পেয়ে বিলক্ষণ বিরক্ত। তার ওপর এরা। বরুণা অবশ্য জিভ কামড়ে তৎক্ষণাৎই উঠে পড়েছে, তবু রেহাই পেল না। বিজন বলল, কাজের সময় সব এখানে কেন, বাড়িতে আর জায়গা নেই। যা পালা–

অর্চনা উঠে দাঁড়িয়ে দাদার বিরক্তি আর ব্যস্ততা নিরীক্ষণ করল একটু। তারপর টিপ্পনী কাটল, বা-ব্বা! সাইকেল-রিকশতেই এই–এরোপ্লেন হলে না-জানি কি হত!

.

বরুণা ননিমাধবের কাছে যেমন ঠাট্টাই করুক, ফাঁক পেলে এবারে সেই লোকটার সঙ্গে একটু যোগাযোগের বাসনা হয়তো মনে মনে অর্চনারও ছিল। লোকটার আচরণে মা স্পষ্টই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন বলে দোষ কাটানোর জন্যে সেদিনই ইলা-মাসি তার ঢল। প্রশংসা করেছেন মায়ের কাছে। বলেছেন, আজকালকার দিনে ছেলেটি রত্ন-বিশেষ, একাড়ি টাকা খরচ করলেও এ-রকম লোক মেলে না। এর পর ইলা-মাসি যখন অনুযোগ করবেন এই নিয়ে তখন সে নাকি ভয়ানক অপ্রস্তুতও হবে। অর্চনার একটু-আধটু কৌতূহল ইলা-মাসির প্রশংসা শুনেই নয় বোধহয়… ঘরে-বাইরে-য়ুনিভার্সিটিতে ওর সামনে পুরুষের সলজ্জ বা বিব্রত মূর্তি অনেক দেখেছে। আর তাদের চোরা কটাক্ষ তো এখন আর বেঁধেও না। কিন্তু এই লোকটার রূঢ় সরলতার একটু ভিন্ন আবেদন। যে কারণে এরা সব প্রায় করুণার পাত্র, তার বিপরীত কারণেই এই লোকটির প্রতি একটুখানি বিপরীত কৌতূহল বাসে রেষারেষি করে ওর পাশে বসার পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে কোথায় দেখেছে স্মরণ করতে না পারার নিরাসক্ততাও রমণীমনের নিভৃতে একটু লেগেছিল কি না বলা যায় না। জার্চনা অন্যরকম দেখেই অভ্যন্ত। কিন্তু এইসব সূক্ষ্ম অনুভূতির ব্যাপার অবচেতন মনেই প্রচ্ছন্ন ছিল। য়ুনিভার্সিটির পথে পরিচিত বাস-স্টপের সামনে এসে এক-আধবার শুধু লক্ষ্য করেছে মানুষটাকে দেখা যায় কি না। দেখা গেলে কি করবে অর্চনা নিজেও জানে না। পর পর দুদিনের এক দিনও দেখেনি। আগে বা পরে ক্লাস থাকতে পারে, তাছাড়া মিনিটে মিনিটে বাস, দেখা না হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।

তৃতীয় দিনে দেখল।

দেখল এক হাতে বুকের সঙ্গে ঠেকানো একগাদা বই, অন্য হাতে বড়সড় পোর্টফোলিও ব্যাগ একটা–দুই হাতই জোড়া, বাসের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।

গাড়িটা আচমকা পাশে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যেতে প্রায় আঁতকে উঠেছিল। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপের আগেই অর্চনা দরজা খুলে দিয়ে ডাকল, আসুন–

মায়ের পাল্লায় পড়ে বছরে একটা করে পাড়ার অভিজাত ক্লাবের সাংস্কৃতিক অভিনয়ে যোগ দিতে হয়। আসরে একবার নেমে পড়লে অর্চনা আলগা সংকোচের বড় ধার ধারে না। কিন্তু যাকে ডাকল তার অবস্থা নয়নাভিরাম।

আমাকে বলছেন?

হ্যাঁ, আসুন–

যে-মেজাজের মানুষই হোক, সেই মুহূর্তে সুখেন্দু মিত্রের সঙ্কটাপন্ন অবস্থা। কি করবে ভেবে না পেয়ে বিব্রত মুখে আহ্বানকারিণীর দিকেই তাকাল সে।

পিছনে একটি বাস আটকে পড়ে হর্ন বাজিয়ে বিরক্তি ঘোষণা করল। অর্চনা বলল, তাড়াতাড়ি উঠুন, এটা বাস-স্টপ!

বেগতিক দেখে সুখেন্দু মিত্র উঠেই পড়ল। গাড়ি চলল।

অর্চনা ধারে সরে গেছে। সেদিকে চেয়ে সুখেন্দু মিত্র আরো একটু বিব্রত, এভাবে টেনে তোলার পর পার্শ্ববর্তিনীর সাধারণ আলাপের ইচ্ছেটুকুও নেই যেন। এ-রকম একটা বিড়ম্বনার মধ্যে সে কখনো পড়েনি।

একটু বাদে অর্চনা নিস্পৃহ দৃষ্টিতে ফিরে তাকাল। কিছু যেন স্মরণ করতে চেষ্টা করে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?

নিরুপায় সুখেন্দু মিত্র হাসতে লাগল।

অর্চনা হাসিমুখেই ঘুরে বসল একটু। এই কাণ্ড করে বসারস্পরে সহজতাই স্বাভাবিক। বলল, গাড়িতে উঠতে চাইছিলেন না কেন, বাসের ভিড় ঠেলতেই ভাল লাগে বুঝি?…তাই বা পারতেন কি করে, দু-হাতই তো জোড়া।

সেদিনের বাসের ব্যাপারটা মনে পড়তে সুখেন্দু মিত্র জোরেই হেসে উঠল। তার পর আলাপটা অন্যদিকে যোরাবার জন্য তার হাতের বইগুলোর দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি পড়েন?

ভদ্রলোক কলেজের প্রফেসার তাই বোধহয় আলাপের এই বিষয়বস্তু তেমন পছন্দ হল না অর্চনার। বইগুলোর কোলের ওপর থেকে পাশে আড়াল করে জবাব দিল, না … আমার বোন পড়ে।

বোনটিকেও সেদিনের পার্টিতে এর পাশে দেখেছিল মনে পড়ছে! কি ভেবে আবারও জিজ্ঞাসা করল, আপনার বোন কি পড়েন?

আই এ।

সুখেন্দু কৌতুক অনুভব করছে বেশ। টয়েনবী আজকাল তাহলে আই এ তে পড়ানো হয়, আমাদের সময় ওটা এম, এ-তে পড়ানো হত।

ধরা পড়ে অর্চনা আবারও হেসে ফেলল।

একটু বাদে সুখেন্দু মিত্র নিজে থেকেই বলল, সেদিন মিন্টুদের বাড়িতে শুনলাম ডক্টর জি, এন, বাসু আপনার বাবা–

সঙ্গে সঙ্গে অর্চনার মনে দুই একটা নীরব প্রশ্নের উঁকিঝুঁকি…। শুনেছে যখন খুব সম্ভব ইলা-মাসির কাছেই শুনেছে। কিন্তু ও কার মেয়ে সেটা শোনার কারণ ঘটল কি করে? শোনার আগ্রহ না থাকলে ইলা-মসি শোনাতেই বা যাবে কেন? মনে মনে তুই একটু।-হ্যাঁ, বাবাকে চেনেন নাকি আপনি?

ছেলে পড়াই আর তার নাম জানব না। তবে তার ছাত্র না হলেও তাকে চেনার আমার একটা বিশেষ কারণ ঘটেছিল। অনেক কালের কথা, এখন বোধহয় তাঁর মনেও নেই।

অর্চনা ঈষৎ আগ্রহ নিয়েই জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছিল বলুন তো?

না, তেমন কিছু নয়। প্রসঙ্গটা চাপাই দিল সে, আপনি তো য়ুনিভার্সিটিতে যাবেন, আমি একটু এদিকেই নামব। সেজন্য প্রকাশ করল, আজ ভালই আসা গেল…। আপনার বাবাকে প্রণাম দেবেন, চিনলে চিনতেও পারেন, খুবই চিনতেন—

এর পরেও একটা আমন্ত্রণ না জানানো বিসদৃশ।-একদিন আসুন না আমাদের বাড়ি, বাবার সঙ্গে দেখা হবে~-আসবেন?

আসবে বলেই মনে হল, কারণ বাড়ির ঠিকানা নিয়ে রাখল সে।

 কিন্তু আসেনি। আসেনি বলেই অর্চনাও আর বাস-স্টপের মোড়ে গাড়ি থামায়নি। পাছে দেখা হয় তাই রাস্তার উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে বাস-স্টপটা পেরিয়ে গেছে। অবশ্য সেই দিনই সে কলেজ থেকে ফিরে বাবাকে সুখেন্দু মিত্রের কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। আর তার ফলে মায়ের হাতে ধরা পড়ে নাজেহাল।

বাবা কিছু একটা লিখছিলেন। অন্যমনস্কও ছিলেন। অর্চনা তার লেখার টেবিলেই পা ঝুলিয়ে বসে পড়ে সরাসরি জিজ্ঞাসা করেছে, আচ্ছা বাবা, তুমি সুখেন্দু মিত্র বলে কাউকে চিনতে?

বাবা মনে করতে পারেননি তাকে খুব চেনে শুনেই অর্চনা ভদ্রলোককে বাড়িতে আমন্ত্রণ করেছে। এখন বাবা তাকে আদৌ না চিনলে মেয়ের নিজেরও একটু সংকোচের ব্যাপার। অচন। তাই চেনাতে চেষ্টা করেছে, বলেছে, একজন প্রফেসার, তোমাকে খুব চেনেন বললেন–তোমার ছাত্র না হলেও অনেকদিন আগে কি ব্যাপারে তোমার সঙ্গে খুব আলাপ হয়েছিল বললেন

এর পরেও ডক্টর বাসুর মনে পড়েনি।

 কিন্তু এ নিয়ে যে আবার আর এক ঝামেলায় পড়তে হবে অর্চনা জানবে কি করে। মা ওদিকে ওর জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন এতক্ষণ। এক বান্ধবীর বাড়ি যাবেন, মেয়েকেও নিয়ে যাবেন কথা দিয়েছেন। নিজে সাজসজ্জা করে প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। মেয়েকে বাপের ঘরে ঢুকতে দেখে প্রস্তুত হবার জন্যে তাড়া দিতে এসে তার জিজ্ঞাসাবাদ শুনলেন। বলা বাহুল্য, শুনে খুব প্রীত হলেন না।

তার সঙ্গে তোর আলাপটা হল কখন?

অর্চনা প্রায় চমকই ফিরে তাকিয়েছিল, তার পর বিব্রতমুখে জবাব দিয়েছে, না, আলাপ না…য়ুনিভার্সিটি যাবার মুখে দেখা হয়ে গেল!

তুই তো গাড়িতে গেছলি?

অর্চনার কাহিল অবস্থা, তবু চেষ্টা করেছে সামলাতে।-হ্যাঁ, রাস্তায় খুব ভিড় ছিল ভদ্রলোক একেবারে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, এদিক থেকেই বাসে ওঠেন কিনা–

অকূলে কূল পেয়েছে, মায়ের সাজসজ্জার দিকে চোখ গেছে। তাড়াতাড়ি কাছে এসে সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করেছে, বাঃ, কি সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে মা বেরুচ্ছ নাকি?

মুশকিল আসান। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে তাড়া দেওয়ার কথাটাই মনে পড়েছে তাঁর। আর প্রীতও একটু হয়েছেন।–থাক, তাড়াতাড়ি নিজে একটু সুন্দর হয়ে নে–মিতার ওখানে পাঁচটায় যাব কথা দিয়েছি, পাঁচটা তো এখানেই বাজল!

তক্ষুণি রেডি হবার উৎসাহে অৰ্চনা পালিয়ে বেঁচেছিল। কেন মরতে চেনাতে গিয়েছিল বাবাকে ভেবে সেই লোকটার ওপরেই রাগ হচ্ছিল তার।

ডক্টর বাসু সেদিন অর্চনার মুখে শুনে স্মরণ করতে না পারলেও লোকটিকে চিনতেন যে খুবই সেটা এমন করে প্রকাশ হবে অর্চনা ভাবেনি।

এমন মজার ব্যাপার আর হয় না যেন।

কলকাতা শহরে জল হয়, জল হলে অনেক রাস্তা জলমগ্ন হয়, আর তখন অনেক রাস্তার মাঝখানেই যানবাহন অচল হয়। সেই অবস্থায় পড়লে অনেকেরই মেজাজ বিগড়োয়। পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে বিধাতার চক্রান্ত সম্বন্ধে অথবা রাস্তাঘাটের দুরাবস্থার সম্বন্ধে তিক্ত অভিযোগ শোনা যায়। কিন্তু লজ্জায় কারো মাথা কাটা যায় না বোধহয়।

মিসেস বার সেদিন লজ্জায় মাথা কাটাই গিয়েছিল। তাঁদের গাড়িটা যে নতুন নয় সেই দুর্বলতা আর ক্ষোভ ছিল বলেই তার মনে হয়েছে, পথচারীরা পুরনো গাড়ির অচল অবস্থা দেখে মনে মনে হাসছে। তার ধারণা, শুধু ড্রাইভারের কাণ্ড জ্ঞানহীনতার ফলেই এই দুর্ভোগ। তাই প্রথম অসহিষ্ণুতার ঝড়টা সেই বেচারার ওপর দিয়েই গেল।

গাড়ির দু-ধারে বসে অর্চনা আর তার মা। মাঝখানে বাবা। সামনে বিজন আর ননিমাধব। ছুটির দিনে মার্কেট থেকে ফেরার পথে এই বিড়ম্বনা।

রাস্তা জলে থৈ থৈ। দূরে দূরে আরো দুই একটা মোটর আটকেছে। এই গাড়ির চাকা এখনো অর্ধেকের বেশি জলের নিচে। জল এখনো টিপটিপ করে পড়ছে, কিন্তু গাড়ি নড়ে না। ড্রাইভার বিরস বদনে বনেট খুলে টুকটাক তদারক করে এসেও গাড়ি নড়াতে পারল না। অর্চনা ভয়ে ভয়ে এক-একবার মায়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছে আর ভাবছে, ড্রাইভারের কপালে আজ আরো কিছু আছে।

মিসেস বাসু ঝাঁজিয়ে উঠলেন, গাড়ি চলবে না? এভাবেই তাহলে বসে থাকি সমস্ত দিন? এ রাস্তেমে তুমকো কোন্ আনে বোল?

 সুপারিশের আশায় ভিজে চুপসানো অবস্থায় বেচারা ড্রাইভার বিজনের দিকে তাকাল। কিন্তু তারও মুখে রাজ্যের বিরক্তি। শুধু ননিমাধবেরই বোধহয় খারাপ লাগছে না খুব, কিন্তু মুখভাবে সেটা প্রকাশ করার নয়।

স্ত্রীর কোপ থেকে ড্রাইভারকে আগলাতে চেষ্টা করলেন ডক্টর বাসু। বললেন, ওকে বকছ কেন সেই থেকে, ও কি করে জানবে এরই মধ্যে এখানে এতটা জল জমে গেছে।

তুমি থামো।…উন্টে মেজাজ আরো চড়ানো হল তার ড্রাইভারি করছে আর ও জানবে না জল হলে কতটা জল জমে এখানে! তুমি আর তোমার ওই ড্রাইভারই জান না, আর সকলেই জানে। ড্রাইভারের উদ্দেশে ধমকে উঠলেন, দেখতা কেয়া? আদমী বোলাও!

অসীম বিরক্তিতে নিজেই ফুটপাথের দিকে চেয়ে হাঁক দিলেন, কুলি, কুলি

মহিলাটি যেখানে উপস্থিত, গাড়িতে আর সকলেরই সেখানে প্রায় নীরব দর্শকের ভূমিকা। দাদা আর তার পাশের মূর্তিটির ওপরেই বেশি রাগ হচ্ছে অর্চনার। একটা ব্যবস্থা কিছু করলেও তো পারে। মায়ের উগ্র কণ্ঠস্বরে রাস্তার লোকগুলোও যে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে।

শুধু রাস্তার লোকগুলোই নয়, আর একজনও ফিরে তাকিয়েছে। আধ ভেজা অবস্থায় ওদিকের গাড়িবারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে ছিল। অর্চনা হঠাৎ খুশীও, আবার অপ্রস্তুতও।

সুখেন্দু মিত্র তাদের দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলো। অর্চনা হাসতে গিয়েও মায়ের মূর্তি স্মরণ করে থমকে গেল। তাড়াতাড়ি বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল সে।

বাবা–

আঙুল দিয়ে বাইরের আগন্তুকটিকে দেখিয়ে দিল। জলের ওপর দিয়েই। জুতোসুদ্ধ পা চালিয়ে গাড়ির দিকে আসছে সে। মিসেস বাসু অপ্রসন্ন স্বগতোক্তি করে উঠলেন, লজ্জায় মাথা কাটা গেল!

গাড়ির কাছে এসে সুখেন্দু মিত্র সকলের উদ্দেশেই দু-হাত জুড়ে নমস্কার জানাল। প্রতিনমস্কারের জন্য হাত তুলতে গিয়েও ডক্টর বাসু বিস্মিত নেত্রে তাকালেন তার দিকে। চিনতে চেষ্টা করলেন।–আপনি, তুমি, তুমি সুখেন্দু না?

হ্যাঁ স্যর।

খুশির আতিশয্যে ডক্টর বাসু মেয়েকে বললেন, সেদিন তুই সুখেন্দুর কথা বলছিলি? ওকে চিনব না, কি কাণ্ড …।

যেন অর্চনাই দোষী।

কিন্তু তুমি দাঁড়িয়ে ভিজছ যে!

সুখেন্দু বলল, আমি আগেই ভিজেছি–।

সামনের সীটের দুজনও ঘাড় ফিরিয়েছে। পরম উৎসাহে স্ত্রীর দিকে তাকালেন ডক্টর বাসু।–তোমার মনে নেই, সে যে একবার ছেলেগুলো স্ট্রাইক করেছিল জোট বেঁধে, আমি চাকরি রিজাইন করতে যাচ্ছিলাম–এই সুখেই তো সব দিক সামলালে। ভুলে গেছ? কি বিপদেই পড়েছিলাম…

মিসেস বাসুর বিগত বিপদ স্মরণ করার কোন বাসনা নেই। চাপা রাগে বললেন, এখন জলে পড়ে আছ-তোমার এই ড্রাইভার দিয়ে আর চলবে না।

দোষটা যে গাড়ির নয়, ড্রাইভারের, সেটাই শোনালেন কিনা তিনিই জানেন।

ডক্টর বাসু বস্তুজগতে ফিরলেন। বিব্রতমুখে হাসতেই চেষ্টা করলেন, ও হ্যাঁ, কি মুশকিল দেখ, ড্রাইভার আবার . ইনি আমার স্ত্রী।

সুখেন্দু জানাল, সেদিন ছাত্রের বাড়িতে তাকে দেখেছিল। কিন্তু মিসেস বাসু শুনলেন না বোধ হয়, ড্রাইভারের খোঁজেই তার উষ্ণ দৃষ্টি অন্যত্র প্রসারিত।

ডক্টর বাসু হৃষ্টচিত্তে সামনের দুজনের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিলেন! জলে পড়ার লজ্জা বা দুর্ভাবনা তার তেমন নেই। আমার ছেলে বিজন, আর ও ননিমাধব, আমাদের আত্মীয়ের মতই–দুজনে জয়েন্টলি সাইকেল-রিকশর ব্যবসা করছে।

বিজনের মনে হল, বাবা যেভাবে বললেন কথাটা যেন হাস্যকর কিছুই করছে ‘তারা। প্রতিনমস্কারের হাত তুলল কি তুলল না। সামনের দিকে ফিরে এতক্ষণে সেও বিষম বিরক্তি সহকারে মন্তব্য করল, ড্রাইভারটা একটা আস্ত ইডিয়ট।

ননিমাধব অবশ্য হাত তুলেছে, নমস্কার করেছে, আর ডক্টর বাসুর হাস্যোক্তির সঙ্গে সঙ্গে হেসেছেও। তার পর ভাল করে লোকটাকে নিরীক্ষণ করেছে।

ডক্টর বাসু একদা-স্নেহভাজন লোকটির খোঁজখবর নিতে ব্যস্ত।–হ্যাঁ, কি করছ সুখেন্দু তুমি আজকাল?

এবার অর্চনাই স্মরণ করিয়ে দিল, বাঃ, সেদিন বললাম না তোমাকে!

মনে পড়ল।–ও, হ্যাঁ হ্যাঁ, বলেছিলি। তুমিও মাস্টারি করছ। কোন্ কলেজে?–বেশ বেশ, তুমিও এই রাস্তাই নিলে শেষ পর্যন্ত–ভাল করোনি, মাস্টাররা আজকাল নো-বডির দলে।

আনন্দ দেখে অর্চনাই শুধু বুঝল, মাস্টারি করছে শুনেই বাবা সব থেকে খুশী। আর মাস্টার ছাড়া অন্য সকলকেই যে নিজে তিনি নো-বডি মনে করেন সেটাও ভালই জানে। কিন্তু মায়ের জন্যই অর্চনা স্বস্তিবোধ করছে না, কথাবার্তা না বলে প্রায় চুপ করেই আছে। লোকটি হাসিমুখে বার বার তার দিকে তাকাচ্ছে দেখেও, এতদিনে একবার বাড়ি না আসার অনুযোগটা করে ওঠা গেল না।

একে দেখে বাবা এতটা খুশী হবেন তা ও ভাবেনি। তিনি খোঁজখবর নিচ্ছেন তখনো–এদিকেই থাকো বুঝি? এই কাছে? কোথায়? কত নম্বর বাড়ি বলো তো?

যেন নিজেই তিনি যাবেন একবার দেখা করতে। ননিমাধব তখনো ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে এদিকে। অর্চনার চোখেও চোখ পড়ছে, অর্চনা নিরীহ মুখে চেষ্টা করছে যাতে না পড়ে।

মা আর দাদার নীরব ধৈর্যচ্যুতির শেষ অবস্থায় দেখা গেল ড্রাইভার গাড়ি ঠেলার জন্য দুটো লোক এনে হাজির করেছে। ড্রাইভার স্টিয়ারিংএ বসল, লোকদুটো পিছনে ঠেলতে গেল। ডক্টর বাসু সুখেন্দুকে বললেন, বড় খুশী হলাম, একদিন এসো কিন্তু আমাদের বাড়ি, ঠিক এসো–

কিন্তু এই জল-লীলার শেষ দৃশ্যটি বাকি তখনো।

গাড়ির দু-হাতও নড়ার ইচ্ছে দেখা গেল না। একে গাড়িটা নেহাত ছোট নয়, তার ওপর ড্রাইভার নিয়ে ভিতরে ছ-জন লোক বসে। বার দুই চেষ্টা করেই পিছনের লোকদুটো হাল ছাড়ল। সুখেন্দু দাঁড়িয়ে দেখছিল, হাত গোটাতে গোটাতে বিজন আর ননিমাধবের উদ্দেশে বলল, দুজনে হবে কেন, আসুন আমরাও একটু ঠেলে দিই–

প্রস্তাব শুনে গাড়ির সকলেই হকচকিয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। শুধু ডক্টর বাসু ছাড়া। তিনি সানন্দে বিস্ময় প্রকাশ করলেন, তুমি–তোমরা! হা-হা করে হেসে উঠলেন তার পরেই, ছেলেকে বললেন, যা না-ব্যবসা তো খুব করিস, গায়ে কেমন জোর আছে দেখি–

অর্চনার মজা লাগছে। কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রায় শঙ্কিত। নিরুপায় বিরক্তিতে বিজন গাড়ি থেকে জলে নামল। ননিমাধব নড়েচড়ে পিছনের দিকে তাকাতে অর্চনা মাকে বাবার আড়াল করে ইশারায় বলতে চাইল, আর বসে কেন, নামুন।

ননিমাধব বীরের মতই নেমে পড়ল।

তারা দুজন গাড়ির ও-পাশ থেকে ঠেলছে। অর্থাৎ মিসেস বাসুর দিক থেকে। পিছনে কুলি দুজন–এ-পাশে সুখেন্দ। অর্চনা মহা আনন্দে একবার তাকে আর একবার স-পার্টনার দাদাকে দেখছে। ডক্টর বাসু উৎফুল্ল হাতে স্ত্রীর দিকে ফিরে তাকাতেই মিসেস বাসু সরোষে রাস্তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেদিক থেকে একটা চলন্ত লরী একেবারে চান করিয়ে দিয়ে গেল বিজন আর ননিমাধবকে। জলের ঝাপটা বাঁচাতে গিয়ে মিসেস বাসু স্বামীর গায়ের ওপর এসে পড়লেন।

ওদিকে কিম্ভুতকিমাকার অবস্থা বিজন আর ননিমাধবের।

.

সারাপথ মিসেস বাসু রাগে গজগজ করতে করতে যে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, তাই ফলল।

সেই থেকে বিজনের হাঁচি, কাসি আর অরভাব। একবার গাৰ্গলের জন্য তিনবার করে গরম জল করতে করতে দাও মহাবিরক্ত। গা-হাত-পা টেপা আর নভেল পড়া দুটোই একসঙ্গে করতে গিয়ে রাণু দেবীও অনেকবার ধমক খেয়েছে। তার হাঁচির দমকে দাশুর হাতের গ্লাস থেকে ক-বার গরম জল চলকে পড়েছে ঠিক নেই। হাঁচির ভয়ে অতঃপর সন্তর্পণেই ঘরে, ঢুকেছে সে।

বিজন তিক্তবিরক্ত।–কি ওটা?

গরম জল।

ফেলে দে।

নভেলের আশা বিসর্জন দিয়ে রাণু দেবী ভয়ে ভয়ে দু-হাত লাগিয়েছেন। ফেলে দেবে কেন, গরম জল খাবে যে বললে?

তুমি উপন্যাস পড়ো!… দাশুর ওপরেই মেজাজ ফলিয়েছে, এই–ওটা রেখে টেপ এসে। গা হাত-পা গেল, কোথাকার কে একটা থার্ডক্লাস লোক, সে বলল আর একগলা জলে নেমে গাড়ি ঠেলো!

যার কথায় একগলা জলে নেমে গাড়ি ঠেলা তাকেও খুব রেহাই দেননি তার গৃহিণীটি। নিরুপায় মুখে ডক্টর বাসু বসে বসে চুরুট টেনেছেন আর স্ত্রীর তর্জন এনেছেন। এর ওপর ননিমাধবেরও জ্বর হয়েছে শুনে নতুন করে আর এক দফা শোনাতে বসলেন তিনি। তোমার জন্যে, শুধু তোমার জন্যে, বুঝলে? তিনদিন ধরে বিছানায় পড়ে কাতরাচ্ছে ছেলেটা, ওদিকে ননিমাধবও জ্বরে পড়েছে–কে না কে বলল আর অমনি হুট করে ছেলে দুটোকে তুমি জলে নামিয়ে দিলে! ওরা কি করেছে এসব কোনদিন?

ডক্টর বাসুও শেষে বিরক্ত হয়েই পাল্টা জবাব দিয়েছেন, জ্বর হয়েছে সেরে যাবে। আমি ভাবছি আমাদের জন্য ওই পরের ছেলেটির আবার অসুখ-বিসুখ করল কিনা। কি ঠিকানাটা বলেছিল, ড্রাইভারকে একবার পাঠিয়ে দাও না খবর নিয়ে আসুক।

জবাবে মিসেস বাসু একটা উগ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রস্থান করেছেন।

ডক্টর বাসু জানতেন না, ড্রাইভারকে পাঠিয়ে নয়, সকলের অগোচরে ড্রাই ভারকে নিয়ে একজন খবর করতেই গেছে। একজন নয়, দুজন। বরুণাও গেছে। শুধু তাই নয়, বরুণাই ইন্ধন যুগিয়ে নিয়ে গেছে তার দিদিকে। সব শুনে আসল ফুতিটা তারই হয়েছিল। এমন কাণ্ডটা নিজের চোখে দেখা হল না বলে আপসোসেরও শেষ নেই। এর আগে বাস-স্টপ থেকে দিদির সেই লোকটাকে গাড়িতে তলে নেওয়ার সমাচার শুনেও বোধ হয় এত আনন্দ আর নিজের অনুপস্থিতির দরুন এত দুঃখ হয়নি। আগের সেই খবর শুনে সেও লোকটার জন্য উৎসুকভাবে দিনকতক প্রতীক্ষা করেছিল। আসেনি দেখে দিদিকে জ্বালাতেও ছাড়েনি। বলেছে, এমন রসকষশূন্য লোকের বাসে পাশে বসা কেন? আর তুই বা কোন্ মুখে তাকে সেধে গাড়িতে এনে তুললি আর বাড়ি আসার জন্যে সাধলি? বেশ হয়েছে, খুব জব্দ।

কিন্তু এবারে আর ঔৎসুক্য চাপতে পারেনি। বার বার পরামর্শ দিয়েছে, নিশ্চয় বিছানায় পড়েছে, চল না একবারটি দেখে আসি, কাছেই তো–

অর্চনা ভ্রূকুটি করেছে, বিছানায় পড়ে থাকলে কি করবি, সেবা করবি?

সেবা করতে হবে না, তোক দেখলেই বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠবে। চল না, খেয়ে ফেলবে না!

বাড়ি কাছে হলেও একেবারে কাছে না। তবে মোটরে সামান্য সময়ই লাগল। লক্ষ্যের কাছাকাছি এসে বরুণাই আবার নিরুদ্যম একটু। একটা বিষয় মনে ছিল না, এখন মনে পড়েছে। তাই চুপ করেও থাকতে পারেনি। ভদ্রলোক আবার প্রফেসর যে রে…আমি আই. এ. পড়ি জানে?

বেরিয়ে পড়ে অর্চনার সঙ্কোচ গেছে। জবাব দিল, খুব জানে, মোটরে বসে সেদিন সারাক্ষণ তোর কথাই তো জিজ্ঞাসা করছিল–তোদের কলেজেই আবার মাস্টারির চেষ্টা করছে এখন।

রাস্তার ওপর ছোট বাড়িটা খুঁজতে হল না। দরজার গায়ে লেটার বক্স-এ নাম আর নম্বর লেখা। অর্চনার নির্দেশে ড্রাইভার নেমে গিয়ে কড়া নাড়ল। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে যে বাইরে এল, সে স্বয়ং সুখেন্দু মিত্ৰই। খুব সম্ভব বেরুচ্ছিল।

গাড়িতে আরোহিণী দুজনকে দেখে অবাক। তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল।

অর্চনা নেমে দাঁড়াল। লোকটা সুস্থ শরীরে নিজেই হাজির দেখে তারও বিসদৃশ লাগছে একটু।

আপনি…

অর্চনা হাসিমুখে বলল, দেখতে এলাম, বাড়িতে তো তিনদিন ধরে হ্যাঁচ্চা ম্যাচ্চো চলছে–আপনি কেমন আছেন?

কেন!…প্রথমে হঠাৎ বুঝে ওঠেনি। তার পরেই মনে পড়তে হেসে উঠল।… ও, সেদিনের সেই জলে ওঁদের শরীর খারাপ হয়েছে বুঝি?

রীতিমত। আপনি ভাল আছেন তো একবারও গেলেন না কেন? বাবা ওদিকে ভেবে অস্থির, ভাবছেন, আপনারও ভাল রকম কিছু হয়েছে

সুখেন্দু হাসতে লাগল। –না, আমি ভাল আছি। ভিতরে ডেকে বসতে বলবে কি না ভাবছে। এ-রকম অতিথি আপ্যায়নের বৈচিত্র্যে পড়তে হয়নি। কখনো। পিসিমার পর্যন্ত গঙ্গাস্নান সেরে ফেরার নাম নেই। আর সে যাচ্ছিল চা ফুরিয়েছে চা কিনতে–অতএব একটু চা-ও দেওয়া যাবে না। কিংবা এদের বসিয়ে আবার চা আনতে যেতে হবে। কিন্তু না-ডাকাটা নিতান্ত অভদ্রতা। বরুণ এবং অর্চনা দুজনের উদ্দেশে বলল, ভিতরে এসে বসুন, পিসিমা অবশ্য বাড়ি নেই, এক্ষুনি এসে পড়বেন।

বোঝা গেল বাড়ির কর্ত্রী পিসিমা এবং তিনি ছাড়া ওদের সঙ্গে কইতে পারে এমন আর কেউ নেই। পিসিমা থাকুন আর নাই থাকুন অর্চনা সরাসরি বাড়ি গিয়ে ঢুকতে রাজী নয়। তাড়াতাড়ি বাধা দিল, না আমরা এমনি একবার দেখতে এলাম, বাড়িতে হয়তো এতক্ষণ খুঁজছে আমাদের। থামল একটু, আপনি বেরুচ্ছেন কোথাও? ফাঁক পেয়ে হাসিমুখে সত্যি কথাটাই বলে দিল সুখেন্দু মিত্র, আমার চা শেষ, চা আনতে যাচ্ছিলাম।

তাহলে আপনিই চলুন না আমাদের বাড়ি, বাবা খুব খুশী হবেন–

আপত্তি নেই সেটা মুখ দেখেই বোঝা গেল। ভিতরের কারো উদ্দেশে দরজা বন্ধ করতে বলে গাড়ির সামনের আসনে বসতে গেল সে।

অর্চনা বাধা দিল, আপনি পিছনে বসুন, আমি সামনে বসছি—

ঠিক আছে। দরজা খুলে সুখেন্দু ড্রাইভারের পাশে বসে পড়ল।

গাড়ি বাড়ির পথ ধরতে হাসি চেপে অৰ্চনা বরুণার দিকে তাকাল। বরুণ যতটা সম্ভব নির্বিকার মুখে রাস্তা দেখছে। আর দিদিটা যে ওর থেকেও অনেক বেশি মানুষ হয়ে গেছে, গম্ভীর পুলকে মনে মনে তাই ভাবছে। সামনের দিকে চোখ ফিরিয়ে অর্চনা জিজ্ঞাসা করল, একে চেনেন?

সুখেন্দু মিত্র ঘুরে বসল একটু। তার পর বরুণাকে দেখে নিয়ে বলল, আপনার বোন?

হ্যাঁ, বরুণা। আপনি কলেজের প্রফেসর আর ও মোটে আই. এ. পড়ে, বড় লজ্জায় পড়ে গেছে।

সুখেন্দু হেসে উঠল। সে সামনের দিকে চোখ ফেরাতেই বরুণার রামচিমটি। অর্চনা একটা কাতরোক্তি করে ছদ্ম কোপে জোরেই ধমকে উঠল তাকে, এই। লাগে না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *