২. অর্চনা বসু

০২.

বড় নির্মমভাবে ধরা পড়েছে অর্চনা বসু।

এক ডানা-ভাঙা পাখি যেন ধরা পড়েছে একদল দুরন্ত অবুঝের হাতে।

এত কাছে থেকেও একদিন যাঁরা তাঁর হদিস পাননি, দিগন্ত-ঘেঁষা নীলিমার ব্যবধান কল্পনা করেছেন ঈর্ষাতুর সম্ভ্রমে–হঠাৎ এই আবিষ্কারের বিস্ময় তাঁদের আনন্দের কারণ হবে বইকি। তাঁদের প্রগলভ কৌতূহলে একটা দুমড়নো ব্যথা খচখচিয়ে উঠলেও মৌন যাতনায় সেটা সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। ডানা-ভাঙা পাখির মতই মুখ বুজে একপাশে সরে থাকতে চেয়েছে অর্চনা বসু। সরে থাকতে চাইছে।

মনের নিভৃতে অতলে সারাক্ষণ আলেয়ার যে আলো জ্বলে তারই মায়ায় নিজেকে উদঘাটিত করে ফেলেছিল।

করে ধরা পড়েছিল।

কিন্তু সে-মায়ার প্রলোভন একদিনের নয়। গোপন প্রশ্রয়ে দিনে দিনে বুকের কাছটিতে এসে জমেছিল। ইশারায় বিভ্রান্ত করেছিল। এখানে আসার পরেও একটানা প্রায় দু-বছর যুঝেছিল অর্চনা বসু। দু-বছরের প্রত্যেকটা দিন।

আর এই দু-বছর ধরেই তার আত্মমগ্নতার একটা প্রচ্ছন্ন দম্ভ দেখে এসেছেন অন্য সকলে। সেই প্রথম যেদিন অর্চনা বসু পা দেয় এই মেয়ে-ইস্কুলে সে-দিন থেকেই।

এই দু-বছরের চিত্রটি আগে আর একটু স্পষ্ট হওয়া দরকার।

সেও ছিল এক ভরা দুর্যোগের দিন।

সকাল থেকে এক ফোঁটা আকাশ দেখা যায়নি। কালি বর্ণ মেঘ গোটা দিন বর্ষানোর পরেও পাতলা হয়নি। দুপুর থেকেই খেয়া পারাপার বন্ধ ছিল। ওপার থেকে এপারে আসতে হলে ট্রেনে ব্রীজ পার হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।

সকলেই ভেবেছিলেন ইন্টারভিউ আর সে-দিন হল না। যাঁদের ডাকা হয়েছে তাঁরা আসবেন কেমন করে? তবে স্থানীয় বা আশপাশ থেকে যে দু-তিনজনকে ডাকা হয়েছে তাঁরা আসতে পারেন। হেডমিসট্রেস অবশ্য কমিটিকে, অন্যথায় সেক্রেটারিকে টেলিফোনে জানিয়েছেন ইন্টারভিউ হবে। কারণ, এই দুর্যোগ মাথায় করেও যাঁরা আসবেন তাঁদের ফেরাবেন কি বলে?

তাঁর আগ্রহের কারণও ছিল একটু। পদ-প্রার্থিনীদের মধ্যে তাঁর এক বান্ধবী আছেন। তিনি এসেই আছেন, এবং যথাসময়ে হাজিরও দেবেন। জলের দরুণ মনে মনে তেমনি খুশী হয়েছিলেন বিজ্ঞানের টিচার শোভা ধর। ইন্টারভিউ দেবার জন্য তাঁরও এক দূর-সম্পর্কের আত্মীয়া তাঁর বাড়িতেই এসে উঠেছেন। যথাসময়ে তিনিও আসছেন।

কোন ক্লাসেই সেদিন দু-তিনটির বেশি মেয়ে আসেনি। ছাতা সত্ত্বেও তারা ভিজে চুপসে এসেছে আর এসেই টিচারদের কাছে কড়া ধমক খেয়ে সেই অবস্থাতেই বাড়ি ফিরে গেছে। নিশ্চিন্ত মনে এবং প্রসন্ন চিত্তে টিচাররা নিজেদের ঘরে বসে জল দেখছিলেন আর জটলা করছিলেন।

কর্মপ্রার্থিনীদের আবির্ভাব ঘটতে লাগল একে একে।

 সাতজনের মধ্যে পাঁচজন এসে গেলেন। হেডমিসট্রেস আর শোভা ধর দেখলেন তাঁদের বান্ধবী বা আত্মীয়ার মত চালাক প্রায় সকলেই। আগে থাকতেই যে-যার আত্মীয়-পরিজনের কাছে এসে উঠেছিলেন নিশ্চয়। টিচারদের ঘরেই তাঁদের বসার ব্যবস্থা। টুকরো টুকরো আলাপ পরিচয় চলল। কে কোথা থেকে আসছেন, কোথাও কাজ করছেন কি না, ইত্যাদি। শিক্ষয়িত্রীদের সহজতায় পদপ্রার্থিনীদের সঙ্কোচ বাড়ছে বই কমছে না।

সেক্রেটারি রামতারণবাবু হেডমিসট্রেসের টেলিফোন পেলেন আবার। সাতজনের মধ্যে পাঁচজনই এসে গেছেন। অতএব যেতে হয়। বুড়ো মানুষ, চাদরমুড়ি দিয়ে আয়েশ করে গড়গড়া টানছিলেন আর বৃষ্টিঝরা আকাশ দেখছিলেন। কিন্তু গড়গড়া ছেড়ে এ দুর্যোগে আবার বেরুতে হবে বলে বিরক্তি নেই একটুও। বরং হেডমিসট্রেসের টেলিফোন পেয়ে খুশী।…ভবতারণ গার্লস স্কুলের চাকরি, ঝড়জল মাথায় করেও আসবে বই কি সব ইন্টারভিউ দিতে। পাঁচজন এসেছে, গিয়ে হয়তো শুনবেন আর দুজনও এসে গেছে।

চাকরকে ডেকে তিনি গাড়ি বের করতে বললেন।

খুশী হওয়ার কারণ আছে রামতারণবাবুর। এই ছোটখাটো উপলক্ষ থেকেই ইস্কুলের কদর বোঝা যায়। বাছাই করা কোনো টিচার উন্নতির বা ভবিষ্যতের আশায় অন্যত্র চলে গেলে বিলক্ষণ রেগে যান তিনি। তবু বছরে দু-বছরে এ রকম এক-আধজন তো যায়ই। এবারেও ইতিহাসের শিক্ষয়িত্রীটি কলেজে চাকরি পেয়ে চলে গেছেন বলেই নতুন শিক্ষয়িত্রী নিতে হচ্ছে। কিন্তু এই ইস্কুলে যোগ্য শিক্ষয়িত্রীর অভাব হয় না তা বলে। বরং একজন গেছে বা যাচ্ছে শুনলে বাড়িতে সুপারিশের হিড়িক পড়ে যায়।

গোটা শহরে একটাই মেয়ে-ইস্কুল। সমস্ত জেলায় নামডাক। মেয়েদের একটা হোস্টেল করে দিলে বাইরে থেকেও কত মেয়ে পড়তে আসত ঠিক নেই। এ-জন্যেও অনেক আবেদন নিবেদন এসেছে সেক্রেটারির কাছে। কিন্তু এমনিতেই ইস্কুল ভর-ভর্তি, বছরের গোড়ায় ভর্তি হতে এসে ফিরে যায় অর্ধেক মেয়ে– হোস্টেল খুলবেন কি। ইস্কুলের এত সুনাম শুধু শিক্ষকতা বা বাৎসরিক ফলাফলের দরুনই নয়। সরকারের থেকে এক পয়সা সাহায্য না নিয়েও সরকারী ইস্কুলের দেড়গুণ মাইনে আর কোন ইস্কুলের টিচার পায়? কাগজে একটি শিক্ষয়িত্রী-পদের বিজ্ঞাপনের জবাবে দরখাস্ত এসেছিল দেড়-শ। ডাকা হয়েছে সাতজনকে। নেওয়া হবে একজন।

রামতারণবাবু একেবারে মিথ্যে অনুমান করেননি। তিনি এসে পৌঁছুবার আগে সাতজন পদপ্রার্থিনীর বাকি দুজন না হোক, আর একজন এসেছিল।

অর্চনা বসু এসেছিল।

তিন দাগ কাটা একটা ঝরঝরে ঘোড়ার গাড়ি বাগান পেরিয়ে টিচার্স-রুমের একেবারে সামনে এসে দাঁড়াতে সকলেই বুঝেছিলেন ঝড়-বাদলা উপেক্ষা করে আর একজন এলো ইন্টারভিউ দিতে। যে পাঁচজন এসে আছেন তাঁদের সকলকেই যে যাঁর মত ওজন করে নিয়েছেন শিক্ষয়িত্রীরা। নতুন কৌতূহলে ঘোড়ার গাড়ির দিকে চোখ ফেরালেন তাঁরা।

অর্চনা বসু নামল। গায়ে কাচ-রঙের হালকা লেডিস বর্ষাতি। ভিজে সপসপ করছে। মাথা-ঢাকা সত্ত্বেও জলের ঝাপটা থেকে মুখ বা সামনের চুলের গোছ বাঁচেনি। ভাড়া মিটিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো হলঘরের দিকে।

হল-জোড়া বড় টেবিলের সামনের দিকে বসেন কল্যাণীদি। ছাত্রী শিক্ষয়িত্রী সকলেরই দিদি। এমন কি হেডমিসট্রেসেরও। বয়সের দরুন নয়, বয়স বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশের এধারেই হবে। রামতারণবাবুর ভাই-ঝি তিনি, ভবতারণ মিত্রের মেয়ে–যাঁর নামে এই ইস্কুল। তাড়াতাড়ি উঠে এসে তিনি অভ্যর্থনা জানালেন।

আর যাঁরা ইন্টারভিউ-এর জন্য এসেছেন তাঁদের চোখে পড়ল সেটুকু। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কেউ কিনা অনুমান করতে চেষ্টা করলেন। অন্যান্য টিচাররা জানেন, তা নয়। কিন্তু নীরব আগ্রহে ঘাড় ফিরিয়েছেন তাঁরাও।

ঘরে ঢুকতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল অর্চনা বসু। বর্ষাতিটা বেজায় ভেজা গা থেকে খুলে ফেলল ওটা, কোথায় রাখা যায় ঠিক বুঝতে না পেরে ঈষৎ কুণ্ঠায় কল্যাণীদির দিকে তাকাল।

বর্ষাতি খোলার সঙ্গে সঙ্গেই যেন একটা সাদার মায়া ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। কাচ-রঙা বর্ষাতির আড়ালে এই সাদারই আভাস পাচ্ছিলেন সকলে। সেটা সরে যেতেই সাদায়-সাদায় একাকার। খুঁটিয়ে দেখলে এই সাদার পরিপাটিতে আতিশয্যটুকু বড় হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু তার বদলে একটা অভিব্যক্তি বড় হয়ে উঠল।

হাত বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি বর্ষাতিটা নিলেন কল্যাণীদি। দরজার আড়ালে ব্র্যাকেটে ঝুলিয়ে রাখলেন সেটা। হালকা আনন্দে সুশোভন কিছু বলেও বসতে পারতেন কল্যাণীদি। মহিলা সুরসিকা। চেনা-অচেনা সকলের সঙ্গেই সহজে জমিয়ে তুলতে পারেন। কিন্তু সহজ হওয়া গেল না, চেষ্টাও করলেন না। সাদরে ভিতরে এনে বসালেন শুধু।

আলাপ-সালাপ হল একটু-আধটু। আর পাঁচজনের সঙ্গে যেমন হয়েছে, প্রায় তেমনি। সেদিক থেকেও কোন ত্রুটি চোখে পড়েনি কারো। বরং ওই বেশবাসের মতই পরিচ্ছন্ন মনে হয়েছে। তবু টিচাররা বেশ একটু ব্যবধান অনুভব করেছিল সেই প্রথম দিনেই। সেটুকুই আর ঘোচেনি। বরং বেড়েছে।

ইতিহাসের শিক্ষয়িত্রী নির্বাচনের ব্যাপারটা মোটামুটিভাবে যেন ওখান থেকেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেই নির্বাচনে নীরবে অংশগ্রহণ করেছেন টিচার্স রুমের সকলেই। যাঁরা এসেছেন ইন্টারভিউ দিতে তাঁরাও। শিক্ষয়িত্রীরাও। শেষ পর্যন্ত ক-জন এলো না-এলো খোঁজ করতে এসেছিলেন হেডমিসট্রেস মালতী রায়। নাম লিখে নিতে এসেছিলেন। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দুই চোখও ওই একজনের মুখের ওপরে গিয়ে আটকেছিল। একে একে নাম লিখে নিয়েছেন তারপর। কিন্তু লেখার যেন আর দরকার বোধ করেননি খুব।

অনুমানে ভুল হয়নি। চাকরি অর্চনা বসুই পেয়েছে। চারজনের সিলেকশন কমিটি। সেক্রেটারি রামতারণবাবু, তাঁরই সমবয়সী অবসরপ্রাপ্ত এক প্রফেসার বন্ধু, ভাইপো নিখিলেশ–বাইরের এই তিনজন। ভিতর থেকে হেডমিসট্রেস মালতী রায়। ইন্টারভিউ-এর একরাশ দরখাস্ত যাচাই বাছাই করার দায়িত্ব ছিল হেডমিসট্রেসের ওপর। এই কর্তব্যপালনে সতোর কার্পণ্য করেননি– নিজের বান্ধবী পদপ্রার্থিনী, তা সত্ত্বেও না। কিন্তু নির্বাচনের আসরে বান্ধবীর জন্য পরোক্ষে যুঝতেও ছাড়েননি তিনি। যথার্থই সেটা বান্ধবীর জন্যে কি আর কোন কারণে সঠিক বলা শক্ত। অর্চনা বসুকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে প্রধান শিক্ষয়িত্রীর প্রাধান্যে কোন ছায়া পড়ার সম্ভাবনা দেখেছিলেন কি না তিনি জানেন। যদি পড়েও থাকে, সেটা রূপেরও নয়, যোগ্যতারও নয়। টিচারদের মধ্যে রূপসী তাঁর থেকে প্রায় সকলেই। অন্যদিকে, তাঁর যোগ্যতা আর কর্মতৎপরতা বিবেচনা করেই স্কুল-কমিটি নিজ-খরচায় তাঁকে বাইরে থেকে ট্রেনিং দিয়ে এনে প্রধান শিক্ষয়িত্রীর আসনে পাকাপোক্তভাবে বসিয়েছেন।

তবু একট হয়তো অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছিলেন হেডমিসট্রেস মালতী রায়।

সেক্রেটারি বা অন্য বৃদ্ধটির জন্যে তেমন ভাবেননি তিনি। তাঁর অমতে কিছু একটা করে বসতেন না তাঁরা। অন্তত তাঁর মতামতটা ভেবে-চিন্তে দেখতেন। কিন্তু বাধ সেধেছিল তৃতীয় লোকটি। লোকটি কেন, মালতী রায় মনে মনে ছোকরাই ভাবেন তাকে।–নিখিলেশ। সেক্রেটারির ভাইপো, যাঁর নামে এই স্কুল তার ছেলে। কল্যাণীদির বৈমাত্রেয় ভাই। কল্যাণীদির চেয়ে অনেক ছোট, বয়স তিরিশের নিচেই। এম. এস-সি পাস, সুদর্শন। বড়লোকের ছেলে হলেও উদ্যম আর কর্মঠ বলে পাঁচজনে সুখ্যাতি করে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছিল বছর দুই, মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে এইখানেই কন্ট্রাক্টরি ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। এরই মধ্যে রোজগারও ভালই বলতে হবে। দিনের মধ্যে বহুবার নিজের ছোট একটা মার্কামারা হলদে গাড়িতে শহরময় চক্কর খেতে দেখা যায় তাকে। দু তিনটে বড় বড় ফ্যাক্টরিতে মাল সরবরাহ করে–এই কাজে মোটর হাঁকিয়ে কলকাতায় আসে সপ্তাহের মধ্যে কম করে চার দিন। স্থানীয় বাড়িঘরের কোন কাজ হলে ডাক পড়বেই তার। ইস্কুলের পুরনো দালানটাকেও ঢেলে নতুন করা হয়েছে তারই পরিকল্পনায় আর তত্ত্বাবধানে। নিজের যে-কাজেই ব্যস্ত থাকুক, বাবার নামের ইস্কুলটির যে-কোন প্রয়োজনে সে এক ডাকে হাজির।

এই নিখিলেশ দত্তও সিলেকশন কমিটির একজন। সে-ই বাদ সেধেছিল। সে-রকম আশঙ্কা অবশ্য মালতী রায় আগেই করেছিলেন। অর্চনা বসুকে টিচার্স-রুমে দেখার পরেই। কমিটির আলোচনায় তাকে নিয়ে যে সংশয়ের কথা তিনি বলেছিলেন, ছেলেটা এক কথায় সেটা নাকচ করে দিয়েছে। যেন সেটা কোন সমস্যাই নয়। অথচ অর্চনা বসুর ইন্টারভিউ-এর আগে পর্যন্ত তার হাবভাবে বেশ আশান্বিত হয়েছিলেন মালতী রায়। একে একে যে কজন ইন্টারভিউ দিয়ে গেল, তাদের সকলকেই প্রায় মোগ্য মনে করেছে নিখিল। হাবভাবে সেরকমই বুঝেছিলেন মালতী রায়। তার বান্ধবী ইন্টারভিউ দেবার পর তো নিয়োগের ব্যাপারটা একরকম সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই ভদ্রমহিলা এম. এ পাস, অন্য ইস্কুলে কিছুদিনের চাকরির অভিজ্ঞতাও আছে।

সব শেষে এসেছে অর্চনা বসু। সব শেষেই ডাকা হয়েছে তাকে।

ডাকতে পাঠিয়ে তার দরখাস্তটা সেক্রেটারির সামনে ঠেলে দিয়েছেন মালতী রায়। নিস্পৃহ মুখে বলেছেন, এঁর এমনি কোয়ালিফিকেশন হয়তো সব থেকে বেশি–কিন্তু অভিজ্ঞতা নেই…তাছাড়া বেশি কোয়ালিফিকেশন হলে থাকেও না বড়।

সেক্রেটারির এ দুর্বলতা জানেন মালতী রায়। এটুকু সম্ভাবনার কাঁটা সেকালের মানুষটির চোখে অনেক গুণ নিষ্প্রভ করে দেবার মতই। যারা কাজ ছাড়ে, উন্নতির আশাতেই ছাড়ে। কিন্তু উন্নতি মানে কি? বিশ পঞ্চাশ এক শ টাকা বাড়তি? তারই জন্যে মেয়েগুলোর মায়া মমতা ছেড়ে হুট করে মাঝখানেই তাদের পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়ে চলে যেতে হবে? এ রকম মন নিয়ে ইস্কুলে পড়াতে আসা কেন? মেয়ে তৈরি করতে আসা কেন? গুণ যতই হোক, এই ত্রুটির দিকটা বরদাস্ত করতে রাজী নন সেক্রেটারি রামতারণবাবু।

কিন্তু অর্চনা বসু ঘরে ঢোকার সঙ্গে এ-সবই বেমালুম ভুলে গেলেন তিনি। শান্ত নম্র অভিবাদনের জবাবে বৃদ্ধটি তার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন শুধু। সমবয়সী প্রফেসর বন্ধুটিও। নিস্পৃহমুখে গদি-আটা চেয়ারে গা এলিয়ে বসে ছিল নিখিলেশ। নিজের অগোচরে আস্তে আস্তে সোজা হয়ে বসল। যে-ভাবে বসে ছিল, সেই ভাবে বসে থাকাটা যেন অসম্মানজনক হত। এমন কি হেডমিসট্রেস মালতী রায়ও ভিতরে ভিতরে একটু বিব্রত বোধ করতে লাগলেন–একটু আগে তিনি যে প্যাঁচ কষেছিলেন, এই সাদার ওপর একটা কালো আঁচড় ফেলার মতই সেটা যেন অশোভন মনে হতে লাগল।

দু-চার মুহূর্ত নিষ্পলক চেয়ে থেকে ওই মুখে মহাশ্বেতার শুভ্র বেদনা পুঞ্জীভূত দেখলেন যেন সেক্রেটারী রামতারণবাবু। সাদর অভ্যর্থনা জানালেন, বোসো মা, বোসো।

তাঁর সামনের শূন্য চেয়ারটিতে অর্চনা বসল। মা-ডাকটা হেডমিসট্রেসের কান এড়াল না।

ইন্টারভিউ হয়ে গেল। আর সকলের যতক্ষণ লেগেছিল তার অর্ধেক সময়ও লাগেনি। সংশয় যেখানে রেখাপাত করে না সেখানে যাচাই করবেন কতক্ষণ? সাধারণ দু-চারটে মাত্র প্রশ্ন করা হয়েছিল। সেও শুধু রামতারণবাবুই করেছিলেন, আর কেউ না। দরখাস্তের উপর চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, এম. এ. পাস করেছ চার বছর আগে–এর মধ্যে আর কোথাও কাজ করেছ?

অর্চনা মাথা নেড়ে জানিয়েছে, কিছুই করেনি।

প্রশ্ন শুনে মনে মনে একটুখানি হিসেব করে নিয়েছিল নিখিলেশ। চার বছর আগে এম. এ. পাস করলে এখন কত হতে পারে?–ছাব্বিশ-সাতাশ। আর কারো দরখাস্ত চোখ চেয়ে দেখেনি। বয়েস দেখার জন্য এটাই বা কাকার কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে নেয় কি করে–! কিন্তু এই বয়সে ঠিক এ রকম কেন? ভাল করে দেখেও ঠাওর করতে পারেনি কি রকম।

রামতারণবাবু জিজ্ঞাসা করেছেন, এর আগে তাহলে ছেলেমেয়ে পড়াও নি কখনো?

না।

 এরপর হেডমিসট্রেসের কথাটা মনে পড়েছিল রামতারণবাবুর। দরখাস্তের ওপর আর একবার চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, তোমার যা কোয়ালিফিকেশন কলেজে চাকরি পাওয়া তত কঠিন নয়, ইস্কুলে আসতে চাও কেন?

ইস্কুল ভাল লাগবে মনে হয়েছে।

জবাবটুকুও ভাল লেগেছিল রামতারণবাবুর। দু-চার কথার পর তাকে বিদায় দিয়ে সকলের মনোভাব আঁচ করতে চেষ্টা করেছেন। তার পর প্রাসঙ্গিক মন্তব্য করে ফেলেছেন একটা।– মেয়েটির লক্ষ্মীশ্রী আছে—

প্রফেসর বন্ধু হালকা হেসে শুধরে দিয়েছেন, সরস্বতী-শ্ৰী বলো–

 রামতারণবাবু খুশীমুখে স্বীকার করে নিয়েছেন, তারপর সকলের উদ্দেশে জিজ্ঞাসা করেছেন, তাহলে–?

তাহলে যে কি, হেডমিসট্রেস অনুমান করেছেন। জবাব এড়িয়ে সমনোযোগে কথাগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগলেন তিনি। জবাবটা এবার প্রফেসর বন্ধুর কাছ থেকেই আসার কথা। কিন্তু তিনিও বললেন না কিছু। অতএব রামতারণবাবুই নিজের মত ব্যক্ত করে ফেললেন, আমার তো মনে হয় এই মেয়েটাকে নেওয়া উচিত।

প্রফেসার বন্ধু সায় দিলেন, আমারও সেই রকমই মনে হয়।

মালতী রায় বললেন, উনি থাকেন যদি ওঁকেই সিলেক্ট করা উচিত শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবেন কিনা সেটাই কথা—

নিখিলেশ চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছে আবার। হেসে বলল, তাহলে আর ইন্টারভিউতে ডাকলেন কেন?

তেমনি হেসেই জবাব দিলেন মালতী রায়, আমি দরখাস্ত বাছাই করেছি–। বিবেচনার দায়িত্ব সকলের।

সুদক্ষা হেডমিসট্রেস হিসেবে তার জোর কম নয়। সেই জন্যেই সেক্রেটারির বিশেষ স্নেহের পাত্রীও তিনি। তাঁর খটকাটা একেবারেই উড়িয়ে দিতে পারেন না রামতারণবাবু। কিন্তু কথাবার্তায় মার্জিত হলেও, বলার যা নিখিলেশ খোলাখুলিই বলে। বলল, থাকবে কি থাকবে না সে আর আপনাকে লিখে-পড়ে দিচ্ছে কে?

মালতী রায় সাফ জবাব দিলেন, যাঁকেই নেওয়া হোক, লেখাপড়া করেই নেওয়া উচিত এবার থেকে– সিজনের মাঝখানে ছেড়ে গেলে বড় অসুবিধে হয়।

বিসদৃশ শোনাবে জেনেও নিখিলেশ বলেই ফেলল, হলেও এই লেখাপড়ার কোন মানে নেই। আপনি যদি এখন স্কুল ছেড়ে কলেজে প্রিন্সিপাল হয়ে যেতে চান, লেখাপড়ার দায়ে আপনাকে আটকে রাখার কোন অর্থ হয়, না তাতে ফল ভাল হয়? সে-কথা যাক, কাকে নেওয়া হবে সেটাই ঠিক করুন।

মনে মনে রামতারণবাবু ভাইপোর ওপর ক্ষুণ্ণ হলেন একটু। আবার প্রধান শিক্ষয়িত্রীর মতেও সায় দিতে পারলেন না। ফলে সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে যে প্রস্তাব করে বসলেন সেটা আশা করেনি বোধহয় কেউ-ই। ছেড়ে গেলে অসুবিধে তো হয়ই, আবার দেখেশুনে বাছাই করে না নিলে পারা যায় কি করে।–তা এক কাজ করো তোমরা, তেমন কোয়ালিটির কাউকে না পেলে একই গ্রেড-এ আমরা হায়ার স্টার্টও দিতে পারি–একে তাই দাও, মাইনেটা গোড়া থেকেই ভাল হয়ে যাওয়ার কথা বললে যেতে না-ও পারে।

হেডমিসট্রেস কয়েক নিমেষ অবাক হয়ে চেয়ে থেকে পরে হেসেই নিজেকে চট করে সামলে নিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, আচ্ছা।

ওদিকে ইন্টারভিউ শেষ করে আবার টিচার্স-রুমেই ফিরে এলো অর্চনা বসু। যাবে কি করে, অঝোরে জল পড়ছে। গোটা আকাশটা মেঘে পুঞ্জীভূত।.স্টেশন কম করে পাঁচ মাইল। জলের দরুণ চট করে গাড়ি পাওয়াও সহজ নয়। আর এই জলে গাড়ি ডেকেই বা আনে কে।

ইন্টারভিউ-পর্ব শুরু হতেই টিচাররা বেশির ভাগ যে-যার সুবিধে মত ছুটছাট সরে পড়েছেন। কেউ গেছেন সাইকেল রিকশয়, কেউ বা আকাশের মতিগতির দিকে লক্ষ্য রেখে ছাতা ভরসা করেই বেরিয়ে পড়েছেন! পদ-প্রার্থিনীদের আত্মীয়-স্বজনরা ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে এসেছেন একে একে–কে কোন্ দিকে যাচ্ছেন জেনে নিয়ে কেউ কেউ তাঁদেরও সঙ্গ নিয়েছেন।

অর্চনা বসু ফিরে এলো যখন, টিচার্স-রুম ফাঁকা বললেই হয়। কল্যাণীদি এবং আর দুই-একজন আছেন। কল্যাণীদির দুশ্চিন্তার কারণ নেই, ইন্টারভিউ শেষ হলে কাকাই তাঁকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবেন, নয়তো বাড়ি ফিরে গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। অবশ্য কাকার সঙ্গে এক বাড়িতে থাকেন না তিনি, নিজের ছোট্ট আলাদা বাসা আছে। ভাই থাকে কাকার সঙ্গে। ঝড়জল দেখলে কাকা গাড়ি পাঠাতে ভোলেন না। আর যে দু-তিনজন টিচার বসে আছেন, তাঁরাও কল্যাণীদির কাকার গাড়ির আশাতেই আছেন।

এরই মধ্যে অর্চনা বসুকে ফিরতে দেখে কল্যাণীদি অবাক। অন্য সকলকেই এর থেকে অনেক বেশী সময় আটকে রাখা হয়েছিল। এ তো গেল আর এলো!

হয়ে গেল?

আগের চেয়ারটিতে বসে অর্চনা মাথা নাড়ল শুধু। বাইরের দিকে চেয়ে, ফিরবে কি করে সেই সমস্যাই তখন বড় হয়ে উঠেছে। ইন্টারভিউ প্রসঙ্গে কল্যাণীদি বা আর কারো আগ্রহ খেয়াল করল না।

কল্যাণীদি নিরাশ হলেন একটু। ইতিহাস-শিক্ষয়িত্রীর শূন্যস্থানে একেই আশা করেছিলেন তিনিও। কি জানি কেন মনে হয়েছিল একে পেলে ইস্কুলেরই লাভ আর বৃদ্ধি। কমিটির চারজনের মধ্যে দুজনেই তাঁর আপনজন, সে-কথা আভাসে ব্যক্ত করতেও লজ্জা। সে-ভাবে নিজেকে কোনদিনই জাহির করেন না তিনি। মেয়েদের ড্রইং টিচার পরিচয়েই খুশী। এমন কি গোড়ায় গোড়ায় এখানকার হেডমিসট্রেসও অনেকদিন জানতে পারেননি যে কল্যাণীদির বাবার নামেই এই ইস্কুল। আর জেনে লজ্জিতও হয়েছিলেন বড় কম নয়। কারণ সেক্রেটারির সঙ্গে তিনি পরামর্শ করতে গিয়েছিলেন, মেয়েদের ভালমত ড্রইং শেখানোর জন্য পাস করা আর্টিস্ট নিয়ে আসা উচিত কি না। সেক্রেটারী বিব্রতমুখে বলেছিলেন, কেন, ও তো বড় ভাল আঁকে, বাড়িতে অনেক যত্ন করে শিখেছে–তাছাড়া ইস্কুলটার জন্যে সেই গোড়া থেকে করেছেও অনেক, ওরই বাবার ইস্কুল তো–মায়া খুব।

হেডমিসট্রেস বিব্রত হয়েছিলেন চতুর্গুণ। আলোচনা ছেড়ে পালিয়ে আসতে পথ পাননি। মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়েছেন, কেউ তাঁকে জানায়নি পর্যন্ত। আর আশা করেছেন কথাটা যেন চাপা থাকে।

কিন্তু চাপা থাকেনি। কথা-প্রসঙ্গে রামতারণবাবুই ভাইপোকে বলেছিলেন। নিখিলেশ দিদিকে ঠাট্টা করেছে, চাকরিটি যে এবারে গেল তোমার!

একগাল হেসে হেডমিসট্রেসকেই বলে এসেছেন কল্যাণীদি; এ চাকরি গেলে বাগানে জল দেবার কাজটা অন্তত দিতে হবে, ইস্কুল ছাড়তে পারব না … সানন্দে শিক্ষয়িত্রীদেরও না জানিয়ে পারেননি দুশ্চিন্তার খবরটা। বলেছেন, মালতীদিকে বলে এলাম চাকরি গেলে বাগানে জল দেব, হব মালাকর–এই যাঃ! মালাকর, না মালাকরী?

এ-হেন কল্যাণীদি অর্চনা বসুর চাকরি হওয়া সম্ভব কি না স্থির করতে না পেরে নিজের অগোচরেই ছোটখাটো ইন্টারভিউ নিয়ে ফেললেন আবার একটা। হালকা আলাপের সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, বি-এ-তে অনার্স ছিল আপনার?

বাইরে থেকে চোখ ফেরাল অর্চনা। মাথা নাড়ল। ছিল না।

তাহলে আর কেমন করে হবে চাকরি। মনে মনে ভাবছেন কলাণীদি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে খটকাও বাধল, তাহলে ইন্টারভিউ পেল কি করে? দরখাস্ত বাছাই করে ইন্টারভিউতে ডাকা হয়েছে, চেহারা দেখে তো ডাকা হয়নি। তাহলে এম. এ. বোধহয়…।

আপনি এম, এ.?

এবারেও বাধা না দিয়ে অর্চনা মাথা নেড়ে জানাল, তাই। বাইরের দিকে তাকাল, চট করে জল থামার কোন সম্ভাবনা দেখছে না।

আবারও সমস্যা কল্যাণীদির। কেমন এম. এ.? হেডমিসট্রেসের বান্ধবী ক্যাণ্ডিডেটা মাঝারি এম. এ। তার ওপর মেয়ে পড়ানোর অভিজ্ঞতা আছে। …দু-পাঁচ মাসের অভিজ্ঞতার ভারি তো দাম! হেডমিসট্রেস তলায় তলায় কিছু কারসাজি করলেন কি না, চকিতে সে-সংশয় জাগল।

কিন্তু এদিকে যে কথাই বলে না, কি হল-না-হল বোঝা যাবে কি করে!

অবশ্য মুখ দেখে আঁচ করা যাচ্ছে খানিকটা। কিন্তু এই ইস্কুলের চাকরির ব্যাপারে এ ধরনের নিস্পৃহতা ভাল লাগে না কল্যাণীদির। বুঝতে যখন চেয়েছেন, না বুঝে অথবা না বুঝিয়ে ছাড়ার পাত্রীও নন মহিলা। তাঁর কৌতূহলে রাখা ঢাকা নেই। তাছাড়া বলতেও পারেন দিব্যি রসিয়ে মজিয়ে। বললেন, আমি ভাই ড্রইং টিচার এখানকার, বিদ্যেবুদ্ধি বুঝতেই পারছেন। এঁদের নাকি বি এ অনার্স নয়তো ভাল সেকেণ্ড ক্লাস এম. এ. চাই। আপনাকে দেখেই ভাল লেগেছে, আপনার হলে বেশ হয়। আপনি সেকেণ্ড ক্লাস তো?

এর পরের প্রশ্নটাই হত, কেমন সেকেণ্ড ক্লাস। কিন্তু সে প্রশ্নের আর অবকাশ পেলেন না কল্যাণীদি। তাঁর কথা শুনে অর্চনা বসু মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল একটু। তারপর মাথা নাড়ল, সেকেণ্ড ক্লাস নয়।

ও হরি। কল্যাণীদির ভাবনা-চিন্তা গেল। একটু যেন সঙ্কোচও বোধ করলেন, না তুললেই হত কথাটা। তাঁর ধারণা দ্বিতীয় শ্রেণীও নয় যখন, তৃতীয় শ্রেণী ছাড়া আর কি। কিন্তু যাকে জিজ্ঞাসা করেছেন তার হাসির মধ্যে যেন বিব্ৰত ভাব দেখালো না একটুও। চকিতে আবারও মনে হল। তৃতীয় শ্রেণী হলে তো ইন্টারভিউতে ডাকার কথা নয়। বিশেষ করে দ্বিতীয় শ্রেণীর দরখাস্তের যেখানে অভাব নেই।

তাহলে? তাহলে আর যা সেটা ভরসা করে জিজ্ঞাসা করে ওঠাও সহজ নয়। চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকেন খানিক। একটাই মাত্র শ্ৰেণী মানায় বটে। শেষে বলেই ফেললেন ঝপ করে, তবে কি ফার্স্ট ক্লাস নাকি?

অর্চনা হেসেই ফেলেছিল।

অন্য দু-তিনজন টিচার ঘুরে বসে সরাসরি নিরীক্ষণ করেছেন তাকে। আর আনন্দের উত্তেজনা কল্যাণীদির কণ্ঠস্বরে। বিস্ময়ভরা চ্যালেঞ্জ গোছের।– তাহলে আপনার চাকরি হবে না কেন?

ঈষৎ বিব্রত মুখে অর্চনা বলেছে, হবে না কেউ তো বলেননি–।

কল্যাণীদি লজ্জা পেলেন। বললেন, কেউ বলেনি অবশ্য, আমারই মনে হচ্ছিল। ইন্টারভিউ থেকে এসেই যে-ভাবে আকাশ দেখছিলেন, ভাবলাম, এখানে যা হবার হয়ে গেছে, ভালয় ভালয় বাড়ি ফিরতে পেলে বাঁচেন।

তাঁর মুখের দিকে চেয়ে অৰ্চনা আবারও হাসল একটু। ভদ্রমহিলার ওই বয়সের সঙ্গেও যেন সরল তারুণ্যের আপস দেখল। তাঁর অভিযোগটুকুও স্বীকারই করে নিল সে, তাই তো ভাবছিলাম, এ জল শিগগির থামবে না বোধহয়–

বোধহয় কেন, আজ আর মোটেই থামবে না। আকাশ-বার্তাটি যেন কল্যাণীর দৃষ্টি-দর্পণে–আপনি তো যাবেন কলকাতায়?

অর্চনা মাথা নাড়ল।

তাহলে তো মুশকিল। এখানে কেউ নেই আপনার?

না–। বলতে যাচ্ছিল, স্টেশন পর্যন্ত কেউ যদি একটা গাড়ি ডেকে দেয়–। বলা হল না। বাইরের দিকে চেয়ে চুপ করে রইল। এই জলে কারো পক্ষে বেরুনোও সম্ভব নয়। কালীবর্ণ আকাশের ভাববিকার নেই।

কল্যাণীদি বললেন, না-ই যদি যেতে পারেন একটা দিন থেকে যাবেন।আপনার কোন অসুবিধে হবে না, আমি ব্যবস্থা করে দেব।

ঈষৎ বিড়ম্বিত মুখে অর্চনা জানালো, না, যেতে হবে–।

কল্যাণীদি ভেবে বলেননি। মনের আনন্দে বলে ফেলেছেন, এই পর্যন্ত। ফার্স্ট ক্লাস শোনার পর থেকেই ভিতরে ভিতরে দারুণ আনন্দ হচ্ছে তাঁর। অত গুণের সঙ্গে বাইরের শ্রীর বরাবরই একটা শুকনো বিরোধ কল্পনা করে এসেছিলেন বোধহয়, সেটা সত্যি নয় দেখেই খুশী। যেতে হবে শুনে খেয়াল হল সত্যিই থাকা চলে না। ইন্টারভিউ দিতে এসে অজানা অচেনা জায়গায় গোটা একটা রাত কাটানোর সম্ভাবনায় যে-কোন মেয়েই অথৈ জলে পড়বে। কল্যাণীদি ঘড়ির দিকে তাকালেন। সবে তিনটে। মনে হচ্ছিল সন্ধ্যে। ঢের সময় আছে, জল একেবারে না ছাড়ুক ধরবে একটু নিশ্চয়ই।

বললেন, তা হলেও আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না, আপনাকে স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা অন্তত আমি করে দিতে পারব।

মনে মনে অর্চনা নিশ্চিন্ত হল খানিকটা। নীরবে তাঁর দিকে চেয়ে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল।

বেয়ারার হাত দিয়ে হেডমিসট্রেসের ঘরে কাকার কাছে চিরকুট লিখে পাঠালেন কল্যাণীদি।–জনাকতক আছি। বাড়ি পৌঁছেই গাড়িটা পাঠাও আর নিখিলকে বাড়ি থাকতে বোলো।

গাড়িটা মস্ত একটা সাবেকী আমলের চকমিলানো দালানের আঙিনায় ঢুকে পড়ল যখন, অর্চনা তখনো জানে না কোথায় এসেছে। কল্যাণীদির আহ্বানে গাড়ি থেকে নেমে দ্বিধান্বিত চরণে তাঁকে অনুসরণ করল।

রামতারণবাবু নিচের ঘরেই বসেছিলেন। উঠে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন।

এসো মা এসো, জলটা তোমাকে অসুবিধেয় ফেলেছে, কিন্তু আমার লাভ হল। বোসো–

কোথায় এসেছে জানতে পেরে অর্চনার কুণ্ঠা আরো বেড়েছিল। কিন্তু বৃদ্ধটিকেও ভাল লেগেছিল। দু-কথার পরেই ইস্কুলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তিনি। প্রথম কি ছিল, এখন কি হয়েছে আরো কি হতে পারে। এই স্কুলের জন্য অর্চনার দরদ থাকা চাই–দুদিন বাদে হুট করে পালালে চলবে না। এখানে বাড়ির জন্য ভাবনা নেই, বাড়ি তিনিই দেখে দেবেন, ইত্যাদি।

চাকরিটা যে কার হল সেটা জানানোর কথা আর খেয়ালই হয়নি।

ওদিকে কল্যাণীদি ভিতরে ঢুকে দেখেন, নিখিলেশ হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। মনে মনে মতলব ভেঁজেই ঘরে ঢুকেছেন। ভাল মন্দ যাই বলুন তিনি, ভাইটি উল্টো রাস্তা খোঁজে। তাই ঘরে ঢুকেই বললেন, আজ আবার তোর কলকাতা যাওয়া নেই তো?

জবাব এলে, যাওয়া দরকার। দেখি—

 এই ঝড়জলে আর যায় না, শুয়ে থাক।

টিপ্পনী–এ তো আর তোমার ইস্কুলমাস্টারি নয়, এর নাম খেটে খাওয়া।

তাহলে যাচ্ছিস?

 ভাইটি বোকা নয়, কিছু একটা কলে পড়তে যাচ্ছে অনুমান করে উঠে বসল–কি মতলব?

কল্যাণীদি হেসে ফেললেন, যাবি তো যা, ভাল সঙ্গী দিচ্ছি–জল দেখে বেচারী ঘাবড়ে গেছে। আমি আশা দিয়ে নিয়ে এলাম–

কার জন্য সুপারিশ তাও অনুমান করে নিতে দেরি হল না। তবু ইস্কুলের কর্মকর্তার গাম্ভীর্যে নিখিলেশ জিজ্ঞাসা করল, কাকে নিয়ে এলে?

কাকে আর, যাকে তোরা চাকরি দিলি।…ভাই উচ্চবাচ্য করছে না দেখে সংশয়ের ছায়া পড়ল।–দিয়েছিস তো, না কি?

তুমি ড্রইং মাস্টার, ড্রইং মাস্টারের মত থাকো, তোমার অত খোঁজে দরকার কি।

মরব চাঁটি, বল না?

নিখিলেশ হাসতে লাগল। কল্যাণীদি নিশ্চিন্ত হয়ে টিপ্পনী কাটলেন, আমি আগেই জানি, চারজনের মধ্যে তিনজনই পুরুষ যখন, ওই মুখ দেখে সকলেই ভুলবে।–কলকাতা না যাস তো স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আয়।

জোর করে চা-জলখাবার খাইয়ে কল্যাণীদি অর্চনাকে ছাড়লেন আরো ঘণ্টাখানেক বাদে। ছাতা মাথায় নিজেই গাড়িতে তুলে দিলেন। কিন্তু চালকের আসনে লোকটিকে দেখে অর্চনা আবারও বিব্রত। সামনের দরজা খুলে দিয়ে কল্যাণীদি বললেন, আমার ছোট ভাই নিখিলেশ দত্ত–স্কুল-কমিটির সদস্য, সে তো ইন্টারভিউতেই দেখেছেন। উঠুন–

নমস্কার জানিয়ে অর্চনা কুণ্ঠিত মুখে উঠে বসল। চাকরির চেষ্টায় এসে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ-ধরনের যোগাযোগ সঙ্কোচের কারণ।

জলের জোর কমেছে, কিন্তু থামেনি। থামার লক্ষণও নেই। গাড়ির সব ক-টা কাচ বন্ধ। কাচ বেয়ে অঝোরে জলের ধারা নেমেছে। রাস্তার দু-পাশে মেঠো জমিগুলি পুকুরের মত দেখাচ্ছে। গাছপালাগুলোও একঘেয়ে বৃষ্টির তাড়নায় বিষম ক্লান্ত। অর্চনা বাইরের দিকে চেয়ে দেখছিল।

একটানা অনেকক্ষণ চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে নিখিলেশই প্রথম কথা বলল। আজকের এই জলটা আপনাদের খুব অসুবিধেয় ফেলেছে।

অর্চনার কুণ্ঠা একটুও কমেনি। মৃদু জবাব দিল, আপনার খুব কষ্ট হল–

না, আমি বেরুতামই।

নিজের পদমর্যাদা সম্বন্ধে নিখিলেশ যথেষ্ট সচেতন। তাই চুপচাপ গাড়ি চালিয়েছে অনেকক্ষণ। চাকরিটা যে এরই হয়েছে সেটা কাকা বা দিদির মুখে নিশ্চয়ই জেনেছে। ভেবেছিল, মহিলা ইস্কুল সম্বন্ধে দু-পাঁচ কথা জিজ্ঞাসা করবে বা একটু অনুগ্রহ দেখাবে। ওর পদমর্যাদার আবরণ সরানো তাহলে সহজ হত। কিন্তু কথা শুরু করেও আলাপ করা সহজ হল না। পার্শ্ববর্তিনী আবারও চুপ একেবারে।

কিন্তু অর্চনা ভাবছে অন্য কথা। ভাবছে না, মনে মনে অবাক হচ্ছে সে। আসার সময় স্টেশন থেকে ঘোড়ার গাড়িতে এসেছিল। কিন্তু তাও এতক্ষণ লেগেছিল বলে মনে হয় না। জলের দরুন অনেকটা ঘোরাপথে চলেছে কি না বুঝছে না। আরো খানিক চুপ করে থেকে শেষে জিজ্ঞাসা করে ফেলল, স্টেশন কি অনেক দূর নাকি?

না। স্টেশন অনেকক্ষণ ছাড়িয়েছি।

বিস্মিত নেত্রে অর্চনা এবারে সোজাসুজি ফিরে তাকাল তার দিকে। এবারে নিখিলেশও অবাক। আমরা তো কলকাতায় যাচ্ছি, দিদি বলেনি আপনাকে?

অর্চনা ঘাড় নাড়ল শুধু। বলেন নি। মুখ দেখেই বোঝা গেল আবারও বিব্রত হয়েছে। শুধু তাই নয়, ব্যবস্থাটাও মনঃপূত হয়নি। স্কুল-কমিটির গণ্যমান্য সদস্যের পক্ষে সেইটুকুই হজম করা শক্ত। নিখিলেশ বলল, আমাকে প্রায়ই কলকাতা যেতে হয়, আপনি অসুবিধে বোধ করেন তো এখনো স্টেশনে পৌঁছে দিতে পারি, আমি অবশ্য কলকাতা যাবই–।

এবারে অর্চনা লজ্জা পেল একটু। বলল, না, চলুন।

কলকাতায় পৌঁছে তার নির্দেশমত বাড়ির দরজায় গাড়ি দাঁড় করাল। বাড়ির সামনের নেমপ্লেটে চোখ আটকাল নিখিলেশের জিজ্ঞাসা করল, ডক্টর গৌরীনাথ বসু আপনার কে হন?

দরজা খুলে অর্চনা নেমে দাঁড়িয়েছে। মৃদু জবাব দিল, বাবা। আপনি চেনেন?

চিনি নে, তবে অনেককাল তাঁর বই মুখস্থ করতে হয়েছে।

প্রায় নিস্পৃহ মুখেই অর্চনা জিজ্ঞাসা করল, আপনি বসবেন না একটু?

না আজ আর বিরক্ত করব না, নমস্কার—

 গাড়িতে স্টার্ট দিল। দেখতে দেখতে গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেল। অর্চনা কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সাদর অভ্যর্থনা জানালে আসত বোধহয়। কিন্তু সে-ভাবে ডাকেনি। ডাকতে চায়ওনি।

.

যথাসময়ে নিয়োগপত্র এসেছে, স্কুলের কাজও শুরু করেছে। আড়াইখানা ঘরের একটা বাড়ি সেক্রেটারিই ঠিক করে দিয়েছেন।

কিন্তু অর্চনার সেই প্রথম দিনের বিচ্ছিন্নতা ঘোচেনি। টিচাররা তো এক রকমই দেখে আসছেন তাকে। সেই ধপধপে সাদা বেশবাস আর সেই সাদাটে ব্যবধান। সহ-শিক্ষয়িত্রীরা প্রথম প্রথম দলে টানতে চেষ্টা করেছেন, শেষে দেমাক ভেবে নিজেদের মধ্যে আড়ালে-আবডালে টিকাটিপ্পনী কেটেছেন। প্রতিভাদির সঙ্গে শোভাদি, আর মীরাদির সঙ্গে প্রভাদি। এখানকার মহিলা সমিতিটির সঙ্গে যোগ আছে প্রায় সকল মহিলারই। শুধু শিক্ষয়িত্ৰী নয়, বহু মধ্যবিত্ত এবং বড়লোকের ধনীরাও ছুটির দিনে সেখানে নিয়মিত আসেন এবং জটলা করেন। কল্যাণীদি তো বলতে গেলে পাণ্ডাই একজন। অর্চনার কাছে সেখান থেকেও তলব এসেছে। অর্চনা সভ্যা হয়েছে, চাঁদাও দিয়ে আসছে নিয়মিত–কিন্তু যোগ নেই।

কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে মেয়েদের সঙ্গে বিশেষ করে একেবারে ছোট মেয়েদের সঙ্গে সেই ব্যবধান ঘুচে যেতে দেখা গিয়েছিল। ছুটির দিনে দলে দলে মেয়েদের পাতা পেতে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানোটাও প্রায় নিয়মে দাঁড়িয়েছিল। এর জের সামলাতে হত প্রৌঢ় চাকর দাশুকে। বলা বাহুল্য সে খুব খুশী হত না। কলকাতায় প্রথম অর্চনাদের বাড়িতে আসে যখন, অর্চনা তখন ফ্রক পরত। এখানে অর্চনার চাকর বলতেও সে, পাঁচক বলতেও সে, আর অভিভাবক বলতেও সে-ই। বাড়তি সওদা নিতে এসে মুদী-দোকানের বুড়ো মাখন শিকদারের কাছে সে রাগে গজগজ করত এক-একদিন। –তোমরা তো ভাল বলবেই, সওদা তো আর কম বিক্রি হচ্ছে না– তা যেও একদিন নাতনীকে নিয়ে, দিদিমণির যত্ন-আত্তিটা নিজের চোখেই দেখে এসো। বাচ্চা-কাচ্চা দেখলে তেনার আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না, নাতনীকে শিখিয়ে পড়িয়ে তিনিই ইস্কুলের যুগ্যি করে নেবেন।

অর্চনাদির কাছে নিজেদের কদর মেয়েরাও বুঝত। তাই অসময়ে গিয়ে হাজির হতেও বাধত না। লাগোয়া বাড়ির মালা মেয়েটার বয়েস মাত্র দশ, পড়ে ক্লাস সিক্স-এ। তার দেড় বছরের থপথপে ভাইটাকে নিয়ে অর্চনাদি যা করে, দেখে ওই ছোট মেয়েরাও মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে আর হাসে। দু দিন তাকে না দেখলে দাশুকে দিয়ে ভাইসুদ্ধ মেয়েটাকে ডেকে পাঠায়। আর বাড়ির জলখাবার মনের মত না হলে মেয়েটাও ভাই-কোলে এসে হাজির হয়। একা এসেও দেখেছে, কিন্তু ভাইকে নিয়ে এলেই লাভ বেশী।

শিক্ষায়ত্রীদের পক্ষে এতটা বরদাস্ত করা সহজ নয়। অনেক সময় সামনা সামনি ঠেস দিতে ছাড়েন না তাঁরা। বিশেষ করে বিজ্ঞানের টিচার আর মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী শোভা ধর। ক্লাস শুরু হবার আগে ইস্কুল প্রাঙ্গণে কিণ্ডারগার্টেনের বাচ্চাগুলো রোজই একদফা হুটোপাটি করে ছেকে ধরে অর্চনাকে। গল্পের বায়না করে। অর্চনার মুখে আর সে গাম্ভীর্য দেখা যায় না তখন। আদর করে কারো গাল টিপে দেয়, কারো রিবন ঠিক করে দেয়, কারো বা ঘামে-ধুলোয় জবজবে মুখ নিজের রুমালে করে মুছে দিতে দিতে বলে, খুব দুষ্টুমি করা হয়েছে বুঝি, উঁ–?

সেই সময় শোভা ধরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে কিছু না কিছু বলবেনই তিনি। বলবেন, বাচ্চাগুলোর সঙ্গে আপনাকে দেখলে মনে হয় যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে ওরা।… আরো জোরালো ঠাট্টাও করেছেন, বলেছেন, আপনি নিজেই একটা কিণ্ডারগার্টেন খুলে বসুন, অনেক বেশী লাভ হবে। কি ছাই চাকরি করছেন!

বিব্রতমুখে অর্চনা পাশ কাটায়, ব্যবধানের আবরণ মুখে নেমে আসে। L

এর উপর মালীর ছেলেমেয়ে দুটোর সঙ্গে সেই সম্প্রতি দেখে প্রথমে তো চক্ষুস্থির সকলের। তার পর ফিসফিস, কানাকানি। মীরাদি প্রভাদিকে ঠেলেন, প্রভাদি মীরাদিকে। রোগ সম্বন্ধে প্রতিভাদির কানে কানে রোগনির্ণয় করেন শোভাদি। এমন কি সহকারী হেডমিসট্রেস স্মৃতি করও হালকা বিস্ময় জ্ঞাপন করেন হেডমিসট্রেস মালতী রায়ের কাছে।

কিন্তু শিক্ষয়িত্রীদের মধ্যেও একজনের কিছু কাছাকাছি এসে গেছে অর্চনা। ড্রইং টিচার কল্যাণীদির। সেটা তার নিজের চেষ্টায় নয়, কল্যাণীদির স্বভাবে। নিজেই হুড়মুড়িয়ে তার বাড়ি এসেছেন যখন তখন, বাচ্চাদের অত আদর দেওয়া নিয়ে মন-খোলা ঠাট্টা করেছেন, আবার নিজের বাড়িতেও জোর করেই ধরে নিয়ে গেছেন ওকে। অর্চনার ভাল লাগত, এর পর নিজেই যেত তার বাড়ি, জোর করতে হত না। অনেক সময় অবাক হয়ে ভেবেছে, কাকার সঙ্গে ভাইয়ের সঙ্গে কেন নিজের বাড়িতে থাকেন না কল্যাণীদি। সুন্দরী না হলেও কুৎসিত নন, কেন বিয়েই বা করেননি…। তাঁর ছোট্ট বাড়িটা যেন ছোটখাটো চিড়িয়াখানা একটা। খাঁচায় খাঁচায় কাকাতুয়া, টিয়া, ময়না, বুলবুল হীরামন–একগাদা রঙবেরঙের খরগোশ, হাঁস, পায়রার ঝাঁক, রঙচঙা জারের মাছ–কত কি! এদের সামলাতে গিয়ে কল্যাণীদি স্কুলেও লেট হন এক-একদিন।

প্রথম প্রথম অবাক হয়ে অর্চনা তাঁর পশুপাখির সেবাযত্ন দেখত। ভালও লাগত। কিন্তু এখানে আসায়ও ছেদ পড়েছে শিগগিরই। এলেই আর একজনকে দেখত। কল্যাণীদির ভাইকে। বিকালের দিকে দিদির কাছে একবার অন্তত আসেই নিখিলেশ। আড়াল থেকে ভাইয়ের উদ্দেশে দিদির ছদ্ম অনুশাসন আর বিদ্রূপও কানে আসত। কিন্তু অর্চনার কাছে তাঁর মুখে ভাইয়ের প্রশংসা যেন ধরে না। ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে দুচোখ তাঁর সজল হতেও দেখা গেছে।

ফেরার সময় কল্যাণীদি ভাইকে বলতেন ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। প্রথম প্রথম অর্চনা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি, নিখিলের গাড়িতেই ফিরেছে। তার পর কিছু একটা অজুহাতে এড়িয়ে গেছে। কখনো বলেছে পরে যাবে, কখনো বলেছে হেঁটে যাবে। কল্যাণীদি বুঝেছেন, বুঝেই আর সে-রকম ব্যবস্থা করেননি। তবু আসা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে অর্চনা, কখনো-সখনো কল্যাণীদি একেবারে স্কুল থেকে ধরে নিয়ে এলে আসে।

কল্যাণীদি বলতে ছাড়েননি, কি ব্যাপার বলো দেখি তোমার, এ ভাবে থাকো কেন?

আর কেউ হলে অর্চনা জবাব না দিয়ে শুধু চেয়েই থাকত। এখানে একটু হেসে বলেছিল, আমিও যদি আপনাকে ফিরে এ কথাই জিজ্ঞাসা করি?

কল্যাণীদি অবাক হতে চেষ্টা করেছিলেন প্রথম, ও মা, আমার আবার কি দেখলে?…তার পর হেসেই জবাব দিয়েছেন, আমার কথা ছেড়ে দাও, সাধের কাজল পরতে গিয়ে চক্ষু হল কানা–তোমার কি?

অর্চনার বাধা অনুমান কবে নিখিলেশ দিদিকে বলেছে, তোমার এখানে আসার রুটিনটা আমি না-হয় রাত্রিতেই করে নেব এবার থেকে–ভদ্রমহিলাটিকে বলে দিও।

কল্যাণীদি সত্যিই বলেছেন। হাসতে হাসতেই বলেছিলেন। অর্চনা শুনে মনে মনে দুঃখিত হয়েছে, কিন্তু কিছু বলতে পারেননি।

এর পর নিখিলেশের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ কমই হয়েছে তার। ইস্কুলের গত বার্ষিক উৎসবে নিখিলেশ অবশ্য ওর বাড়িতেই এসেছিল আর নিজেদের বাড়িতে ধরেও নিয়ে গেছে। প্রতি বছর ওই একটা দিন ইস্কুলে আড়ম্বর করে উৎসব হয়, আর রাত্রিতে সব শিক্ষায়ত্রীদের সেক্রেটারির বাড়িতে নেমন্তন্ন থাকে। অর্চনা ইস্কুলের উৎসবে উপস্থিত ছিল কিন্তু বাড়িতে যায়নি। নিখিলেশ গাড়ি নিয়ে একেবারে বাড়িতে হাজির।–আপনার না যাওয়াটা সকলে এত বেশি লক্ষ্য করেছেন যে না এসে পারা গেল না। চলুন–

অর্চনা আপত্তি করতে পারেনি। আপত্তি করতে গেলে পাঁচ কথা বলতে হয়, পাঁচটা, অনুরোধ উপরোধ শুনতে হয়–তাতেই সঙ্কোচ বেশি। তাকে আসতে দেখে বিজ্ঞানের টিচার আর মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী শোভা ধর প্রতিভা গাঙ্গুলীর কানে কানে ফিসফিস করেছেন, এই জন্যেই অপেক্ষা করছিল…।

একটানা দিনযাপনে এই কানাকানি ফিসফিস আর কৌতূহল অনেকটাই থিতিয়ে এসেছিল। ইস্কুলের সেই বার্ষিকী রাত্রির পর কল্যাণীদিও বাড়ি যাওয়া প্রায় বন্ধই হয়েছে, দু-চার দিনের অনুযোগের পর কল্যাণীদিও বলা ছেড়েছেন। মেয়েদের বাড়িতে ও ভাবে প্রশ্রয় দেওয়াটাও সকলেই একরকম সয়ে গেছে– দেড় বছরের ভাই কোলে মালার আগমন প্রায় নৈমিত্তিক। শুধু মালীর ওই ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে বেশি বেশি করতে দেখলই নিজেদের মধ্যে যে দু-চার কথা বলাবলি করতেন সহ-শিক্ষয়িত্রীরা, টাকাটিপ্পনী হয়তো।

এমন একটানা কেটে যেতে পাবত কানে।

কিন্তু কাটল না।

ছোট্ট একটা মর্মন্তুদ ঘটনা থেকে অর্চনা বসুর এই একটানা বিচ্ছিন্নতার বাঁধ ভেঙে সহসা অকরুণ কৌতূহলের এক বন্যা এলো যেন।

আলেয়ার আলো দু-হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরতে গিয়েছিল, মায়ার প্রলোভনে নিজেকে উদঘাটিত করে বসেছে। করে ধরা পড়েছে…।

উপলক্ষ, মালীর ওই কচি ছেলেটার জলে ডোবা। সেই থেকেই সূচনা।

কয়েকটা দিন মূক বেদনায় অর্চনা দিনরাত ছটফট করেছে শুধু। দিনের সেই ছটফটানি ইস্কুলের মেয়েরা কিছুটা টের পেয়েছে। দশ বছরের মালা ক্লাসের ক্লাস-মনিটার। অর্চনাদির ক্লাসে সে পর্যন্ত সহপাঠিনীদের টুঁ-শব্দটি বরদাস্ত করতে পারেনি। নোটবই হাতে নিয়ে মেয়েদের ধমকেছে, এই, একেবারে চুপ সব, নাম টুকবো কিন্তু! অর্চনাদির ক্লাস না এখন? জানিস সেই দিন থেকেই কেমন হয়ে আছেন–

অনুশাসন শেষ হওয়ার আগেই অর্চনা ক্লাসে ঢুকেছে।

কিন্তু রাতের খবর শুধু একজন রাখে। দাশু। দাশুর বয়স হয়েছে, মেজাজটা সব সময় বশে থাকে না। এর দ্বিগুণ ধকল সামলাতেও আপত্তি নেই তার, কিন্তু এই গুমোট আর এত অনিয়ম বরদাস্ত হয় না। গত রাতেও বেশ পষ্টপষ্টি একপশলা হয়ে গেছে এই নিয়ে।

ট্রেতে এক পেয়ালা চা নিয়ে নিঃশব্দ রাগে ঘরে ঢুকে দেখে বই হাতে দিদিমণি খাটে ঠেস দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে বসে আছে। সে চা নিয়ে ঢুকেছে তাও টের পেল না। ছোট টেবিলের দেয়াল-তাকের কাছে ট্রে টেবিলে রাখতেই তাকের ওপর সারি সারি ট্যাবলেটের শিশিগুলোর ওপর চোখ গেল দাশুর। কম করে পাঁচটা, চার-পাঁচ রকমের। এই তিন চার দিনে কোন শিশি থেকে ক’টা ট্যাবলেট কমেছে একবার চোখ বুলিয়ে তাও বলে দিতে পারে। ক্ষুব্ধ রাগে দাশু একে একে সব ক’টা শিশিই চায়ের ট্রেতে নামিয়ে এনেছিল। তার পর সেই ছোট টেবিল সুদ্ধ তুলে এনে বিছানার পাশে ঠক করে রেখেছিল।

অর্চনার হুঁশ ফিরেছে। চায়ের সঙ্গে ট্রেতে ওষুধের শিশিগুলো দেখে জিজ্ঞাসু নেত্রে দাশুর দিকে তাকাতে সে বলেছে ঘুমোবার ওষুধ খাবে কি জেগে থাকবার ওষুধ খাবে কে জানে–সব ক’টাই এনে দিলাম।

ঈষৎ বিরক্ত মুখে অর্চনা চায়ের পেয়ালা তুলে নিয়েছিল। পরের অভিযোগটা দাশু ঘরের দেয়ালকেই শুনিয়েছে যেন।–সন্ধ্যে থেকে চার পেয়ালা হল, বলো তো চাল ক’টাও চায়েতেই সেদ্ধ করে দিতে পারি।

অর্চনা অন্যদিন হলে হাসত, একটু তোশামোদও করত হয়তো। তার বদলে শুধু বিরক্তই হয়েছে। কিন্তু মেজাজ দাশুরও তেমনি চড়া তখন। তাক থেকে টাইমপীস ঘড়িটা এনে সশব্দে সেটাও টিপয়ের ওপর বসিয়ে দিয়েছিল। রাত তখন দশটার কাছাকাছি।

তুমি যাবে এখান থেকে?

যাব–। বলেই অদূরের টুলটা একেবারে খাটের কাছে টেনে এনে গ্যাঁট হয়ে বসে জবাব দিয়েছে, একেবারেই যাব। কিন্তু এখন তুমি কি করবে জেনে যাই।

ছেলেবেলায় অনেক শাসন করেছে, হম্বি-তম্বি করেছে, এখন আর অতটা সম্ভব নয় বলেই আপসোস যেন।

আঃ, দাশুদা!

দাশুর গলা একটু নেমেছে বটে, কিন্তু ক্ষোভ যায়নি। বলেছে, জীবনভোর তো মেজাজের ওপরেই কাটালে, তার ফলে তো ওই–! ওষুধের শিশিগুলো একসঙ্গে সাপটে হাতে তুলে নিয়েছিল সে।–কালই আমি এগুলো গঙ্গায় দিয়ে আসব।

গঙ্গার বদলে আপাতত সেগুলি তাকের ওপরে রেখেই গজগজ করতে করতে প্রস্থান করেছে। শোনার সঙ্গে সঙ্গে সত্রাসে অর্চনা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চোখ ফিরিয়েছে। চাঁদের আলোয় রাতের গঙ্গা চকচক করছিল।

পরদিন।

অর্চনাকে ইস্কুল থেকে ফিরতে দেখেই দাশু ময়দা মাখতে বসেছিল। খাবে না বলার অবকাশ দিতে রাজী নয় সে। তার দু-হাত জোড়া। বাইরের দরজায় ঠকঠক শব্দ।

অত্যন্ত বিরক্ত হয়েই দাশু উঠে এসে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে দরজার হুড়কো খুলে দিল।

বাইরে দাঁড়িয়ে মালা, কোলে তার দেড় বছরের ফুটফুটে ভাইটা। দেখেই দাশু বেজায় খুশী। এদের দেখে এমন খুশী শিগগির হয়নি বোধহয়।– তোমরা।

আনন্দাতিশয্যে হাত বাড়িয়ে ছেলেটাকে আদর করতে গিয়ে খেয়াল হল, হাতে ময়দা মাখা। উৎফুল্লমুখে অভ্যর্থনা জানাল, এসো এসো–। যেন বহুপ্রতীক্ষিত অথচ অপ্রত্যাশিত কেউ এসেছে। হঠাৎ বাচ্চা ছেলেটার একেবারে মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, এই ক’টা দিন কি কচ্ছিলে চাঁদ। ওদিকে যে–

থেমে গিয়ে মালার উদ্দেশে তাড়াতাড়ি বলল, যাও যাও, ভিতরে যাও—

 ভাইকে নিয়ে মালা ভিতরে ঢুকল। দাশুর মুখে প্রসন্ন হাসি।

ইস্কুল থেকে ফিরে মুখ হাত ধুয়ে অর্চনা চায়ের প্রতীক্ষা করছিল। কিন্তু শুধু চা চাইলে আবার দু-কথা শুনতে হবে বলেই কিছু বলে নি। টেবিলের ওপর বিলিতি মাসিকপত্র উল্টে আছে একটা। মলাটের বিজ্ঞাপনে উজ্জ্বল প্রাণবন্ত এক শিশুর ছবি। অন্যমনস্কর মত অর্চনা চুপচাপ সেটাই দেখছিল। পায়ের শব্দে ফিরে তাকাল।

মালার কোলে ছেলেটাকে দেখে হঠাৎ যেন ভারি খুশী হয়ে উঠল সেও। ক-দিন ধরে অনড় বোঝার মত যে অনুভূতিটা বুকে চেপে আছে, সেটা একেবারে ঝেড়ে ফেলে দিতে চেষ্টা করল। এক ঝলক জীবন্ত আলো দেখে যেন ক’টা দিনের এক দুঃসহ আচ্ছন্নতার ঘোর কাটিয়ে ওঠার তাড়নাই অনুভব করল হঠাৎ।

একগাল হেসে এগিয়ে এসে ছেলেটাকে মালার কাছ থেকে লুফে নিল প্রায়। একবার মাথার কাছে তুলে, দুবার ঝাঁকিয়ে বলে উঠল, ওরে দুষ্টু, তুই এসেছিস।

অর্চনার সাদা চশমাটার ওপর ছেলেটার বরাবরই বড় লোভ। প্রথম সুযোগেই খপ করে সে টেনে ধরল সেটা।

এই দস্যি, ছাড় ছাড়!

চশমাটা নিয়ে আছড়ে ভাঙলেও অর্চনা অখুশী হত না বোধহয়। ছেলেটাকে বুকের কাছে ধরার সঙ্গে সঙ্গে একটা গুমোট যাতনা হালকা হয়ে হয়ে একেবারে যেন নিঃশেষে মিলিয়ে যাচ্ছে। চশমাটা ওর হাত থেকে ছাড়িয়ে টেবিলের ওপর রেখে দিল। বেজায় খুশী। প্রায় অস্বাভাবিক রকমের খুশী।

আনন্দে দু-হাতে ছেলেটাকে আবার সামনে তুলে ঝাঁকাতে গিয়ে থমকে গেল। কলরব শুনে ময়দা ফেলে হাস্যবদন দাশু একবার উঁকি দেবার লোভ সামলাতে পারেনি। তারই সঙ্গে চোখোচাখি। অর্চনা গম্ভীর হতে চেষ্টা করল, সঙ্গে সঙ্গে দাশুও গম্ভীর মুখে নিজের কাজে ফিরে গেল।

মালা ছবির খোঁজে টেবিলের সেই বিলিতি মাসিকপত্রের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে অর্চনাদির কাণ্ডকারখানা দেখছে আর হাসছে মুখ টিপে। এখন তার আপসোস হচ্ছে খুব, কেন আর দুটো দিন আগে এলো না। ভরসা পায়নি বলেই আসেনি, আজও খুব ভয়ে ভয়েই এসেছিল।

অর্চনা ছেলেটাকে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ল। ঝাঁকাল, আদর করল, তাকের ওপর থেকে বিস্কুট দিল তার হাতে। ভাল বিস্কুট মজুতই থাকে ওর জন্য। তার পর মুখোমুখি ওকে বুকের কাছে এনে বলল, তুই দুষ্টু–

ছেলেটার তাতে আপত্তি, বিস্কুটে কামড় বসিয়ে ভাঙা ভাঙা পাল্টা জবাব দিল, তুমি ডুট্টু–

উঁহু, আমি ভাল।

 তুমি মন্ন—

আর তুই?

 আমি বা-ব্বু–

ভিতরে ভিতরে অর্চনার কি যেন আলোড়ন একটা। সুখের মত আবার ব্যথার মতও। ছেলেটার মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, আর আমি?

ছেলে বিস্কুটে কামড় বসিয়ে জবাব দেবার ফুরসত পেল না।

কিন্তু হঠাৎ হল কি অৰ্চনার? কি যে হল নিজেও জানে না। স্থান কাল ভুল হয়ে গেল। মুখের ভাব বদলাতে লাগল। একটা অব্যক্ত আকুতি বুক ঠেলে ওপরে উঠছে। চোখে মুখে অস্বাভাবিক অগ্ৰহ কিসের। দশ বছরের মেয়েটা ছবি ফেলে হাঁ করে চেয়ে আছে খেয়াল নেই!

আবারও ছেলেটার গালের কাছে, কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল অর্চনা, আমি মা। মা–

বিস্কুট ভুলে শিশুটি এবার ঘাড় ফিরিয়ে ড্যাব ড্যাব করে তাকাল তার দিকে। আর তিমির তৃষ্ণায় তাকে যেন একেবারে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চাইল অর্চনা। ছেলেটা ধড়ফড় করছে হুঁশ নেই। কণ্ঠস্বরে অস্ফুট আকুতি।–মা বল। মা বল! মা বল–

বিভ্রান্ত উত্তেজনার মুখেই সম্বিৎ ফিরল।

লজ্জায় বেদনায় সঙ্কোচে অর্চনা নিস্পন্দ, বিবর্ণ একেবারে। নিভৃতচারী বাসনার এমন মূর্তি এমন করে নিজেও বোধকরি আর দেখেনি কখনো। সেই লজ্জার ব্যথা নিজের কাছেই দুর্বহ, তার ওপর ওই মেয়েটা বিস্ফারিত বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে দেখছে তাকে। দশ বছরের মেয়ে মালা–শুধু দেখছে না, কেমন ভয়ও পেয়েছে।

ছেলেটাকে তাড়াতাড়ি বুকের থেকে নামিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিল। থালায় খাবার নিয়ে দাশু ঘরে ঢুকেছে। ব্যস্তসমস্তভাবে অর্চনা থালাটা তার কাছ থেকে প্রায় কেড়ে নিয়েই মালার সামনে রাখল।–নাও, খেয়ে নাও! আমি আসছি–

দাশুর পাশ কাটিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দাশু অবাক। মেয়েটার খাবার তো সে এনেছিলই!

খেয়েদেয়ে ভাই কোলে করে মালা হৃষ্ট চিত্তেই ঘরে ফিরেছে। কিন্তু অর্চনাদির এমন নতুন কাণ্ডটা মাকে না বলে পারেনি সে। কাণ্ড বলে কাণ্ড, একেবারে তাজ্জব কাণ্ড!

দুই এক কথাতেই তার মা তাজ্জব কাণ্ডের মূলসুদ্ধ বুঝে নিলেন। তারপর খপ করে মেয়ের চুলের মুঠি ধরে কয়েক প্রস্থ ঝাঁকানি দিলেন বেশ করে। পাজী মেয়ে, রোজ নাচতে নাচতে তোর ওখানে যাওয়া চাই কেন? ফের যদি ওকে নিয়ে আবার ও-মুখো হতে দেখি মেরে একেবারে হাড় গুঁড়ো করে দেব।

অপরাধ সম্বন্ধে সচেতন নয় বলে মেয়েটা দ্বিগুণ হতভম্ব।

রবিবার সমিতির মধ্যহ্নে-আসরে মালার মা চুপি-চুপি শিক্ষয়িত্রী প্রভা নন্দীর কানে তুললেন কথাটা। ঘটনাটা জানিয়ে অনুযোগ করলেন, কেমন টিচার ভাই আপনাদের, চেহারা-পত্র তো ভাল, টাকাও রোজগার করে–বিয়ে-থা করলেই তো পারে।

প্রভা নন্দী সেই বিকেলেই ছুটেছেন মীরা সান্যালের বাড়ি। এতবড় বিস্ময়ের বোঝা একা বহন করবার নয়, বাসি করতেও মন চায় না। পরদিন টিচার্স-রুমের কানাকানিতে কান পাতলেন সকলেই। এমন কি সহকারী হেডমিসট্রেস স্মৃতি করও। শেষে কাজের অছিলায় উঠে গিয়ে হেডমিসট্রেস মালতী রায়ের ঘরে ঢুকলেন তিনি।

শিক্ষয়িত্রীদের হাবভাবে স্পষ্ট ব্যতিক্রমটা অর্চনার চোখে পড়তে সময় লাগেনি। অর্চনা যেন এতকাল ঠকিয়ে এসেছে তাঁদের। দূরে সরে থেকে একটা আলগা মর্যাদা আদায় করেছে। নতুন করে নতুন চোখে দেখতে শুরু করেছেন তাঁরা ওকে। অনাবৃত কৌতূহলে রহস্যের কিনারা খুঁজেছেন।

শুধু কল্যাণীদি ছাড়া। কিন্তু তাঁর মমতাভরা দুই চোখেও কি এক নির্বাক জিজ্ঞাসা।

অর্চনা হঠাৎ বুঝে ওঠেনি।

 কিন্তু বুঝতে সময়ও লাগেনি।

অস্বস্তির বোঝা একটা অনড় হয়ে বুকে চেপেই ছিল। সেই দিনই বিকেলের দিকে হেডমিসট্রেস ওকে নিজের ঘরে ডেকে দুই একটা অপ্রাসঙ্গিক প্রয়োজনের কথা বলে নিয়ে শেষে খুব মিষ্টি করে বলে দিলেন মেয়েদের একটু বেশি প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে–অতটা করা ঠিক ভাল নয়, অর্চনাকে তিনি স্কুলের গৌরব মনে করেন বলেই কথাটা বললেন–ইত্যাদি।

অর্চনা বুঝেছিল, তার পরের ক্লাসে মালার চোখে চোখ রাখার সঙ্গে সঙ্গে। অন্য মেয়েগুলোর চোখে-মুখেও দুর্বোধ্য বিস্ময় আর কাঁচা কৌতূহল।

অর্চনা না বসু কি নিজের মৃত্যু কামনা করেছে সেদিন?

কিছুই করেনি, কিছুই করতে পারেনি। ক্লাস ছিল আরও একটা, তাও শেষ না করে আসেনি। বাড়ি ফেরার পর দাশু খাবার এনে সামনে ধরেছে তাতেও আপত্তি জানায়নি।

রাত গড়িয়েছে। দাশুও বিদায় নিয়ে গেছে।

ছাই নতুন করে জ্বলবে কত। অর্চনা এক সময় উঠেছে। চুপচাপ চাকরির ইস্তফা-পত্র লেখা শেষ করে টেবিলে চাপা দিয়েছে। তার পরেও বিনিদ্র কাটেনি।

কুঁজোতে জল ছিল, তাকে ওষুধের ট্যাবলেট মজুত ছিল।

সকালে সহজে মাথা তুলতে পারেনি। দাশু ডেকে ডেকে ঘুম ভাঙিয়েছে। চা খেতে খেতে অর্চনা ভাবতে চেষ্টা করল, রাতে ক’টা ট্যাবলেট খেয়েছিল। টেবিলের ওপর ইস্তফা পত্রটা চোখে পড়ল। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তার পর খুব শান্তমুখে সেটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ল।

দুটো দিন কোনরকমে চুপ করে ছিলেন কল্যাণীদি। তার পর ভরসা করে থাকতে পারেননি। কেমন করে যেন বুঝেছিলেন, আর দেরি করলে একেবারে দেরি হয়ে যাবে। হাসি-তামাসায় অতিবড় স্তব্ধতার ধর্মও ভাঙতে পারেন তিনি, কিন্তু এখানে সেই চেষ্টাটাই যেন বিড়ম্বনা বিশেষ। সেদিন ছুটির পর স্কুল-ফটক পেরিয়ে অর্চনার হাত ধরলেন।–ওদিকে নয়, আজ আমার বাড়ি।

আজ থাক—

 কাল তো তুমি আরো একটু দূরে সরবে। আজই এসো, কথা ছিল—

 তার দিকে চেয়ে অর্চনা অপেক্ষা করল একটু। তার পর চুপচাপ সঙ্গে চলল।

যদি আবারও আপত্তি করত বা দু-কথা জিজ্ঞাসা করত কল্যাণীদি কিছুটা স্বস্তি বোধ করতেন। জোর-জুলুম ঝগড়া ঝাঁটি পর্যন্ত করা চলত। কথা কিছু সত্যিই ছিল কি না তিনিই জানেন। বাড়ি ফিরেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত কোন কথার ধারকাছ দিয়ে গেলেন না। হৈ চৈ করে জলযোগের ব্যবস্থা করলেন, অর্চনাকে সঙ্গে নিয়ে পশু-পাখির তদারক করলেন একপ্রস্থ। কোন্ পাখির জন্য নতুন খাঁচা তৈরি করতে হবে, কোন্ খরগোশটার বজ্জাতি বাড়ছে দিনকে দিন, ময়নাটার খাওয়া কমেছে, ডাকও ছেড়েছে–অসুখ-বিসুখ করবে কিনা কে জানে, কাকাতুয়াটার একটা জোড় খুঁজছেন, পাচ্ছেন না–ফলে বেচারী একেবারে মনমরা হয়ে আছে, ইত্যাদি সমাচার শেষ করে শেষে ঘরে এসে বসলেন।

এর পরেও কল্যাণীদি অৰ্চনার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে একটা কথাও তুললেন না। স্কুলে যা নিয়ে এমন কানাকানি সেই বিসদৃশ ব্যাপারেও তাঁর যেন কৌতূহল নেই। দু-পাঁচ কথার পর হঠাৎ নিজের কথাই জিজ্ঞাসা করলেন। খুব হালকা করে বললেন, আচ্ছা এই যে স্কুলে আঁকিযুকি আর বাড়িতে এই সব নিয়ে দিব্বি কাটিয়ে দিচ্ছি—কেমন আছি বলো তো আমি?

জবাবে অর্চনা তাঁর দিকে চেয়ে শুধু হাসল একটু। কল্যাণীদি এ-কথাটাই বলতে চান, না আর কিছু বলতে চান–হয়তো বলবেনও। তবু কল্যাণীদিকে বরাবরই যেমন ভাল লাগে আজও তেমনি লাগছে–বড় মিষ্টি লাগছে। ক্ষত যদি খোঁজেনও, জ্বালা-জুড়ানো প্রলেপ লাগানোর জন্যেই খোঁজেন।

বেশ আছি, না?…হাসিমুখে নিজেই জবাবটা দিয়ে নিলেন।–সকলেই বলে দিব্বি আছি। ব্যাপার কিছু আছে সকলেই জানে, জেনেও ভাবে বেশ কাব্যের মত কাটিয়ে দিচ্ছি। অথচ আমার দশা ভাবো একবার, সময় পার করে দিয়ে এখন কাকাতুয়ার জোড়া খুঁজে বেড়াচ্ছি।

ছোট মেয়ের মতই খিলখিল করে হেসে উঠলেন কল্যাণীদি, যেন খুব মজার কথা কিছু। তার পর বলে গেলেন, অথচ কত কাণ্ড করে শেষে এই দশা ভাবো–বর্ণে অমিল বলে কাকা আর মা একজনকে বাতিল করে দিলেন, আর অমন বর্ণের মিলটা তাঁদের চোখে পড়ল না সেই রাগে আমি কাকার গার্জেন-গিরিই নাকচ করে দিলাম, আর মা যে নিজের মা নয় সৎ-মা সেটাও তাঁকে বুঝিয়ে আসতে ছাড়লাম না। তার পর ওই এক বর্ণে অন্ধ হয়ে বসে রইলাম, অথচ চোখের ওপর দিয়েই কত বর্ণ চলে গেল তাকিয়ে দেখলামও না একবার। কি লাভ হল বলো তো? কেউ কি বসে থাকল, দিন কি থেমে রইল–নিজেই শুধু নিজেকে নিয়ে বসে রইলাম। বিচ্ছিরি, বিচ্ছিরি–

অৰ্চনার আর ভাল লাগছে না, ফাঁপর ফাঁপর লাগছে। চিকিৎসকের আন্তরিকতা সত্ত্বেও ক্ষতের ওপর ভুল ওষুধ পড়লে যেমন লাগে। কিন্তু কল্যাণীদি নিজের ঝোঁকেই বলে যেতে লাগলেন, অথচ যা হয়েছে সেটা মেনে নিলেই এক রকম না এক রকম করে ঘা শুকাতো–তা না, উজানেই সাঁতার কেটে গেলাম। কেউ পারে?

অর্চনা বলল, এসব কথা থাক কল্যাণীদি—

থাকলে চলবে কেন, কল্যাণীদি মাথা নাড়লেন, দুঃখ যেমনই হোক, জীবন ছাড়া জীবনের ফাঁক ঘোচে না রে ভাই–মেয়েদের তো নয়ই। এই বুড়ো বয়সেও আমার সংসার করতে সাধ যায়, আমার বাপু পষ্ট কথা। আমাকে নিয়ে ওরা তোমার মত অমন হাসাহাসি কানাকানি করলে মুখের ওপর বলে দিতাম। আমি আর পাচ্ছি কাকে বলো–কিন্তু তোমার সামনে কেউ আছে কিনা একবার চোখ তাকিয়ে দেখবে না?

অর্চনা এতক্ষণে আভাস পেলো কি বলতে চান কল্যাণীদি। ইস্কুলে ওই সদ্য রটনার ফলে নানা সংশয়ে এদিক থেকে আপনজনের বরং পিছপা হবার কথা। ঈষৎ বিস্ময়ে অর্চনা চুপচাপ চেয়েই রইল তার দিকে।

আসল বক্তব্যে পৌঁছে কল্যাণীদির আর রাখাঢাকা নেই। বললেন জল-ঝড়ের দিনে সেই যেদিন প্রথম দেখলাম, সেই দিনই তোমাকে ভাল লেগেছিল। … আমারই ভাই তো, ভাল দেখলে ছেলেটারও ভাল লাগার চোখ– তার দোষ কি বলো?

অর্চনা চেয়েই আছে। আরো শান্ত, আরো একটু নিষ্প্রাণ।

কল্যাণীদিও লক্ষ্য করছেন আর ভিতরে ভিতরে দমে যাচ্ছেন একটু। তবু, মুখের কথা বার করেছেন যখন শেষ না দেখেই ছাড়বেন না। হাসলেন আবারও, চুপ করে গেলে কেন, কথা তো তোমার আমার মধ্যে হচ্ছে!…একটু থেমে বললেন, নিজের ভাই–কত আর বলা যায়, তোমার দুঃখ ও কোনদিন ছোট করে দেখবে না–ঠিক আমার বাবার স্বভাবটি পেয়েছে। তোমার কথা ভেবে ছোঁড়াটা নিজের অনেক কাজকর্মে ঢিলে দিয়েছে জেনেও এতদিন কিছু বলিনি, আজ আর না বলে পারছি না। নেড়েচেড়ে দেখই না দু-দিন–ভাল লাগতেও তো পারে।

নিজের ভাষাপ্রয়োগের বহরেই হয়তো হেসে উঠলেন। তার পর উৎসুক দুই চোখ ওর মুখের উপর রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, বলো তো পাঠিয়ে দিই তোমার কাছে–পাঠাবো?

নীরব দৃষ্টি-বিনিময়। তার পর হঠাৎই অর্চনা হাসল একটু। বড় নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে কি ভেবে নিল খানিক। তখনো হাসছে একটু একটু। শেষে খুব সহজভাবেই বলল, আচ্ছা পাঠাবেন।

আনন্দে কল্যাণীদি বুঝি জড়িয়েই ধরবেন তাকে। কিন্তু আনন্দের মুখেও থমকেই গেলেন, ভরসা করে ঠিক যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না– সত্যি বলছ?

যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে অর্চনা বলল, হ্যাঁ–। সন্ধ্যে হয়ে গেল, আসি–

সেই রাতেই নিখিলেশ এসেছে! আসবে অর্চনা জানত। দাশুর হাত জোড়া, কড়া নাড়ার শব্দ শুনে ও নিজেই শান্ত মুখে দরজা খুলে দিল। আসুন।

যেন প্রতীক্ষাই করছিল। তবু নিখিলেশ বিব্রত বোধ করেছে একটু। দিদি কেন যে তাকে এক রকম ঠেলেই পাঠালো খুব স্পষ্ট নয়। বলল, অসময়ে বিরক্ত করলাম না তো?

না, বিরক্তি কিসের, আসুন।

ধরে নিয়ে এলো তাকে। নিখিলেশ আবারও বলল, আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে দিদি এমন তাড়া লাগালো যে–

জানি। বসুন–। অর্চনারই কোন দ্বিধা বা জড়তা নেই। এমন দ্বিধাহীন সহজ তাকে কোনদিন দেখা যায়নি। বরং যে এলো তার সঙ্কোচ লক্ষ্য করেই যেন হাসিমুখে বলল, দিদি তাড়া না দিলেও আসতে কোন বাধা নেই, কল্যাণীদির ভাই আপনি, আপনাকেও আপনজন ভাবতে ইচ্ছা করে।

নিখিলেশ অবাক হবে কি খুশী হবে ভেবে পাচ্ছে না।

অর্চনা খাটের একধারে বসল।–চা খাবেন একটু?

অসুবিধে না হয় তো আপত্তি নেই।

অসুবিধে কিসের–। উঠে দাশুকে দু পেয়ালা চায়ের কথা বলে আবার এসে বসল।–দাশুর চায়ের জল আর মেজাজ দুই-ই সবসময়ে চড়ানো থাকে। এখন আপনি আছেন, মেজাজ দেখাতে পারবে না।

নিখিলেশ হেসে বলল, অনেক কাল আছে শুনেছি।

অনেক কাল। তাকে ঘাড়ে চাপিয়ে বাবা আমাকে জব্দ করেছেন।

 আলাপের আর একটা সুতো পেল নিখিলেশ–আপনার বাবাকে খুব দেখার ইচ্ছে, দু-বছরেও হল না।

বেশ তো, একদিন চলুন দেখিয়ে দিচ্ছি, একেবারে সাদা মানুষ–

শোনার সঙ্গে সঙ্গে চকিতে অর্চনার সাদা বেশবাসের দিকে চোখ গেল নিখিলেশের। ইতিমধ্যে দাশু চা নিয়ে হাজির। অর্চনা উঠে এক পেয়ালা তার হাতে দিয়ে অন্য পেয়ালাটা নিজে নিয়ে বসল। দাশু চলে গেল।

চুপচাপ পেয়ালায় দু-চারটে চুমুক দিয়ে নিখিলেশ জিজ্ঞাসা করল, আজ দিদির ওখানে গেছলেন নাকি?

হ্যাঁ… আপনার কথাও শুনলাম—

 আমার কথা?

দিদি বললেন, আপনি কাজের মানুষ অথচ আজকাল কাজকর্ম কিছু করেন না, আমিই নাকি উপলক্ষ।

নিখিলেশ যেমন বিব্রত, তেমনি অবাক। এই অর্চনা বসুকেই কি সে এত দিন দেখে আসছে!–দিদি বলেছে এ কথা?

বলেছেন। আপনাকে ভালবাসেন বলেই বলেছেন। কত বড় ভবিষ্যৎ আপনার সামনে, যে-কোন দিদিই বলবেন।–আপনার চা জুড়িয়ে যাচ্ছে।

নিখিলেশ পেয়ালা তুলে নিল। হঠাৎ কণ্ঠস্বরের পরিবর্তনে একটু হকচকিয়েই গেছে সে।

অর্চনা তার পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে খুব সহজ অথচ শান্ত মুখে বলল, আপনাদের এই ইস্কুলে কাজ করছি এটা আমার কাছে কতবড় পাওয়া আমিই জানি। এ আমি হারাতে চাইনে।

নিখিলেশ বিস্মিত।–এ কথা কেন?

জবাবে দুই এক মুহূর্ত চুপ করে রইল অর্চনা, তার পর একটু হেসেই ফিরে বলল, কিছু যদি না মনে করেন, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?

নিখিলেশ নির্বাক জিজ্ঞাসু।

আপনার বয়েস কত?

নিখিলেশ প্রায় বিমূঢ়। অস্ফুট জবাব দিল, বছর ঊনতিরিশ-তিরিশ… ।

অর্চনা মাথা নাড়ল।–আমিও সেই রকমই ভেবেছিলাম। হাসল একটু, আমার ছত্তিরিশ। এম. এ. পড়তে পড়তে মাঝখানে কয়েক বছর পড়া ছেড়ে দিয়েছিলাম।

হতভম্বের মত নিখিলেশ চেয়েই আছে। জীবনে এমন একটা বিস্ময়ের মুহূর্ত আর আসেনি বোধ হয়।

অর্চনা একটু থেমে খুব সাদাসিধে ভাবেই বলে গেল, কল্যাণীদি ঠিক বুঝতে পারেননি, আমি কোন হতাশা নিয়ে বসে নেই– বরং নিজেরই ভুলের খানিকটা প্রায়শ্চিত্ত করছি।…হাসতে চেষ্টা করল আবারও, আপনি বিদ্বান বুদ্ধিমান, আপনাকে আর বেশি কি বলব।

.

রাত বাড়ছে। ঘরের মধ্যে আবছা অন্ধকার। খুব দূরে মাঝপ্রহরের শিয়াল ডেকে উঠল কোথায়। অর্চনা খাটে ঠেস দিয়ে বসে আছে। নিঃশব্দে একটা যাতনার নিষ্পেষণ ভোগ করছে।

উঠে জানালার ধারে এসে দাঁড়াল। সামনে আবছা নিস্তরঙ্গ গঙ্গা। ভিতরের যাতনাটা বাড়ছেই। মালীর ছেলেটা ডুবতে ডুবতেও ডাঙা খুঁজেছে অর্চনার সেই খোঁজার আকুতিও গেছে! সরে দেয়ালের তাকের কাছে এসে দাঁড়াল। ঘুমের ওষুধ। না থাক–।

ওষুধের শিশি রেখে দিয়ে ঘরের ঈজিচেয়ারটা অর্ধেকটা বাইরের বারান্দায় টেনে এনে বসল। বাইরে ঘোলাটে অন্ধকার। আকাশে নিশীথিনীর স্তব্ধ সভায় তারাদের মূক উৎসব।

অর্চনা ভাবছে কিছু। ভাবছে না, কিছু যেন মনে পড়ছে। নতুন করে জন্ম হল ব্যথার, তার অব্যক্ত আর্তস্বর ছড়িয়ে পড়ছে ফেলে আসা জীবনের আনাচে-কানাচে। তারাই ভিড় করে আছে। বেদনার্ত আলোড়ন একটা। চোখের সামনে আবছা ভেসে উঠছে কিছু। দূরে, অনেক দূরে…।

…সারি সারি বিশাল সিঁড়ি আর সিঁড়ি। প্রায় আকাশ-ছোঁয়া।

…তার শেষে ইতিহাসকালের বিরাট এক প্রাসাদের আভাস।

…সেখানে এক অতিবৃদ্ধ মুসলমানের মূর্তি। শণের মত ধপধপে পাকা চুল পাকা দাড়ি বাতাসে উড়ছে…মুখ নেড়ে কিছু বলছে সে।

…সামনে একটা জালি দোলায়…হিজিবিজি কি-সব জড়ানো তাতে…শত সহস্র, হাজার হাজার!

…সেই জালিদেয়ালের সামনে থেকে, সেই অবাক-চোখ মুসলমান বুড়োর কাজ থেকে, সেই প্রাসাদসৌধের ওপর দিয়ে সেই সিঁড়ি ধরে যে মেয়েটা তরতরিয়ে নেমে আসছে–সে ও নিজেই। সিঁড়ি সিঁড়ি সিঁড়ি সিঁড়ি–সিঁড়ি যেন আর ফুরোয় না। কলকাতা কতদূর?

ঈজিচেয়ারেই ধড়ফড়িয়ে সোজা হয়ে বসল অর্চনা।

…ওটা শেষের অঙ্ক। শুরু ছিল। তারও অনেক আগে…

অস্পষ্টতার আবরণ ভেদ করে জনাকীর্ণ কলকাতা শহরের সদর রাস্তায় একটা দোতলা বাস স্পষ্ট হয়ে উঠল হঠাৎ।

শুরু সেইখানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *