৪. এক পাহাড়ের কোলে

হাঁটতে হাঁটতে ওরা নিরাপদ এলাকায় পৌঁছল। এক পাহাড়ের কোলে আঠারজন কমাণ্ডো ওদর জন্য অপেক্ষা করছিল।

তিনজনের মধ্যে বয়সী লোকটি সেগনামা মারইউস। সে এসেছে মেয়েদের মুক্ত করতে এবং সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করতে। সাগর থেকে পাহাড়ের ভেতর দিকে চলে গেছে এক সংকীর্ণ চ্যানেল। পাড়ে নেমে ওখানে নৌকা লুকিয়ে রেখেছিল ওরা।

ওরা কায়রো যাবে, কিন্তু কোন বাহন নেই। ক্যাম্পের ঘোড়া চুরি করাও সহজ নয়। সুর্য ওঠার এখনও অনেক দেরী, ওরা হাঁটা ধরল। পথে কোন সওয়ারী পাওয়া যায় কিনা দেখতে হবে। বন্দীদের পথেই ধরতে হবে, তা না হলে কায়রো গিয়ে ওদের মুক্ত করা কঠিন হবে।

মৃত্যু হাতে নিয়েই ওরা অভিযানে এসেছে। সফল হলে পুরস্কার পাবে। তা দিয়ে জীবন ভর বসে বসে খেতে পারবে। তিরিশ বছর মেয়াদের জেল খাটছিল মেগনামা মারইউস। ডাকাতির আসামী। আরো একটা কেস ছিল খুনের। ওটার রায় বেরোলে তার ফাঁসি হয়ে যেতো।

তার সাথের দু’জনের শাস্তি ছিল চব্বিশ বছরে। কারাগারের নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য ওরা মৃত্যু কামনা করত। এদের শাস্তি মওকুফ করে এ অভিযানে পাঠানো হয়েছে।

এক পাদ্রীর হাতে শপথ করেছে ওরা। পাদ্রী বলেছেন, যত মুসলমান হত্যা করবে, ঈশ্বর তার দশগুণ পাপ মোচন করবেন। সালাহউদ্দীনকে হত্যা করলে ক্ষমা করা হবে সারা জীবনের পাপ। পরকালে পবিত্র যীশুর সাথে একসঙ্গে স্বর্গে থাকবে।

জেল থেকে মুক্তি আর স্বর্গপ্রাপ্তি ও পুরস্কারের লোভে ওরা এসেছে এ দলে। ওদের ভেতর ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা।

জীবন বাজি রেখে এগিয়ে যাচ্ছিল ওরা। হয়ত আইয়ুবীকে হত্যা করবে, নয়তো জীবন বিলিয়ে দেবে। বাকী আঠারজন পরাজিত বাহিনীর সেনা সদস্য। ওদের হৃদয়ে জ্বলছিল প্রতিশোধের আগুন। প্রজ্বলিত আবেগ নিয়ে ওরা এগিয়ে যাচ্ছিল কায়রোর দিকে।

দ্বিপ্রহর। সুলতান আইয়ুবীর হেডকোয়ার্টারের সামনে এসে থামল এক ঘোড়সওয়ার। ঘোড়ার গা ঘামে জবজবে। ক্লান্তিতে আরোহীর মুখে কথা সরছেনা। নেমে পড়ল আরোহী। কেঁপে উঠল ঘোড়ার শরীর। মাটিতে পড়ে মরে গেল ঘোড়াটা, টানা দেড় দিন একনাগাড়ে দৌড়িয়েছে। এর মধ্যে পেটে দানাপানি পড়েনি, বিশ্রামও জুটেনি কপালে।

সুলতান আইয়ুবীর রক্ষীরা সওয়ারকে ঘিরে ধরল। পানি পান করাল। কথা বলার উপযুক্ত হতেই বলল, ‘কোন সালার অথবা কমাণ্ডারের সাথে দেখা করব।’

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী নিজে বেরিয়ে এলেন। আগন্তুক দাঁড়িয়ে সালাম করে বলর, ‘আমি একটা দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছি।’

সুলতান তাকে ভেতরে নিয়ে বললেন, ‘এবার বল।’

‘বন্দী মেয়েরা পালিয়ে গেছে। আমােদরও সবাই নিহত। আমি আহত, তবে কোনরকমে আমি বেঁচে গেছি। ওদের পুরুষ বন্দীদের আমরা হত্যা করেছি। আক্রমণকারী কে জানিনা। আমরা ছিলাম মশালের আলোয়। আক্রমণকারী অন্ধকার থেকে তীর ছুড়েছে।’

সুলতান একজন কমাণ্ডার এবং গোয়েন্দা অফিসারকে ডেকে আনালেন। বললেন, ‘ও কি বলছে শোন।’

সিপাইটি ঘটনা শোনাল। বলল, ‘বন্দী মেয়ের সাথে কমাণ্ডারের সম্পর্কের কথা।’

আইয়ুবী বললেন, ‘তার মানে মিসরেও তাদের কমাণ্ডো বাহিনী রয়েছে।’

‘হতে পারে।’ আলী বললেন, ‘আবার মরু ডাকাত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এমন সুন্দরী যুবতীতো ওদের জন্য মহা মূল্যবান।’

‘ওর কথা মন দিয়ে শোননি তুমি। বন্দীরা লাশের অস্ত্র তুলে এনে আক্রমণ করেছিল ঘুমন্ত প্রহরীদের। আমাদের যে দু’জন প্রহরী এটা দেখেছেন তারা তীর মেরে ওদের হত্যা করার পরপরই আক্রান্ত হয়েছে আমাদের প্রহরীরা। এতে মনে হয় কমাণ্ডো বাহিনী ওদের অনুসরণ করছিল।’

মহামান্য সুলতান, এ মুহূর্তে ওদের ধাওয়া করার জন্য বিশটি ঘোড়া এবং এই সৈনিককে প্রয়োজন। আক্রমণ কে করেছে পরে দেখা যাবে।’ বলল এক কমাণ্ডার।

‘আমার একজন সহকারীকে সাথে পাঠাব।’ আলী বললেন, ‘একে খাবার দাও। খাওয়ার পর ও বিশ্রাম করবে। প্রয়োজনে বিশের অধিক ঘোড়া নিতে পার।’

আগন্তুক বলল, ‘আমি যেখান থেকে ঘোড়া নিয়েছি ওখানে ঘোড়াটা বাঁধা ছিল, কিন্তু কোন লোক ছিল না। সম্ভবতঃ ওরাই আক্রমণকারী। ওখানে আমি আটটি ঘোড়া দেখেছি। নিশ্চয়ই ওরা আটজন ছিল।’

‘কমাণ্ডো বাহিনীতে বেশী লোক থাকেনা। ইনশাআল্লা আমরা ওদের গ্রেফতার করতে পারব।’ কমাণ্ডার বলল।

‘মনে রেখো ওরা কমাণ্ডো বাহিনী।’ সুলতান বললেন, ‘মেয়েগুলো গোয়েন্দা। ওদের একজন সৈন্য অথবা একটা মেয়েকে ধরতে পারলে মনে করবে দু’শ শত্রু সৈন্য পাকড়াও করেছ। এক নারী কারো তেমন ক্ষতি করতে পারেনা। কিন্তু এক গুপ্তচর মেয়ে একটা দেশ এবং জাতি ধ্বংস করে দিতে পারে। ওরা অত্যন্ত বিপজ্জনক। একবার মিসরে ঢুকে গেলে গোটা সেনাবাহিনী অকর্মণ্য হয়ে পড়বে।

সুলতান আরো বললেন, ‘একজন পুরুষ বা মেয়ে গোয়েন্দাকে ধরার জন্য আমি একশত সিপাই কোরবানী দিতে প্রস্তুত। কমাণ্ডোরা ধরা না পড়লে কিছু যায় আসে না। কিন্তু যে কোন মূল্যেই হোক মেয়েগুলোকে গ্রেপ্তার করতে হবে। জীবিত ধরতে না পারলে তীর মেরে শেষ কর দিও।’

এক ঘন্টা পর বিশজন দুঃসাহসী সৈনিক রওয়ানা হল। পথ দেখাচ্ছিল পালিয়ে আসা প্রহরী। কমাণ্ডার আলী বিন সুফিয়ানের সহকারী জাহেদীন। বিশজনের একজন ছিল ফখরুল মিসরী। আলী জানতো না ওরা মুবি এবং বালিয়ানকেই ধাওয়া করতে যাচ্ছে।

কাফেলার একুশতম ব্যক্তি কমাণ্ডার যাচ্ছেন মেয়েদের পাকড়াও করতে। ওদিকে খৃস্টান কাফেলার একুশতম ব্যক্তিও কমাণ্ডার। তার উদ্দেশ্য মেয়েদেরকে মুক্ত করা। এরা যাচ্ছিল পায়ে হেঁটে। যাদের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে তারা, তাদের কারো জানা ছিল না, দু’দলের কে কোথায় আছে।

এখনো সূর্য ডুবেনি। অনেকদূর এগিয়ে এসেছে খৃস্টান কাফেলা। সামনে চড়াই। উপরে উঠল ওরা। দূরে প্রশস্ত মাঠ, মাঠ পেরিয়ে মরুদ্যান। খেজুর গাছ ছাড়াও বিভিন্ন বৃক্ষে ঘেরা। অনেকগুলো উট দেখা যাচ্ছে। ওদের পিঠ থেকে মাল নামানো হচ্ছে। ঘোড়া রয়েছে বার-চৌদ্দটি।

পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা। যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। এখন ওদের ঘোড়ার ভীষণ প্রয়োজন।

কমাণ্ডার কাফেলা থামাল। বলল, ‘আমরা ক্রুশে হাত রেখে সত্যিকার শপথ নিয়েছিলাম। দেখলে তো ক্রুশের মহিমা। ঈশ্বর আকাশ থেকে এ সওয়ার পাঠিয়েছেন। ঈশ্বরপুত্র তোমাদের সাহায্যের জন্য নেমে এসেছেন আকাশ থেকে।

ক্লান্তির চিহ্ন মুছে গেল ওদের চেহারা থেকে। এখনো চিন্তা করছে না এগুলো হাত করবে কিভাবে?

শ’খানেক উট সেনাবাহিনীর জন্য রেশন নিয়ে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে শত্রুর ভয় নেই, এজন্য পাহারা তেমন জোরালো নয়। দশজন ঘোড়সওয়ার পাঠানো হয়েছে। উট চালকরা নিরস্ত্র।

ডাকাতরা ছোটখাট কাফেলা লুট করলেও সামরিক কনভয় আক্রমণ করেনা কখনো। আগেও এভাবে সামরিক ঘাঁটির জন্য রসদ পাঠানো হয়েছে। নির্ভয়ে চলছে রসদবাহী কাফেলা। মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছে।

খৃস্টান কমাণ্ডার অভিযাত্রীদের নিয়ে গেল পাহাড়ের আড়ালে। বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত ওরা। আবেগ এবং সাহসেরও অভাব নেই। গভীর রাতে দু’জন গিয়ে দেখে এল। ঘুমিয়ে আছে রসদবাহী কাফেলা। সশস্ত্র মাত্র দশজন।

ভের হওয়ার সামান্য আগে রওনা দিল ওরা। সাবধানে এগিয়ে গেল। ঘুমন্ত দশজন প্রহরীকে হত্যা করল। কোচম্যানরা বুঝতেই পারলনা কি হচ্ছে। চিৎকার দিল কেউ, সে চিৎকার থেমে গেল তরবারীর আঘাতে।

ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য খৃস্টানরাও চিৎকার করতে লাগল। জেগে উঠল সব কোচওয়ান। শুরু হল হত্যাযজ্ঞ। কমাণ্ডার গলা চড়িয়ে বলল, ‘এগুলো মুসলিম বাহিনীর রেশন। নিশ্চিহ্ন করে দাও। মেরে ফেল উটগুলি। উটচালকদের হত্যা কর।’

খৃষ্টানরা নির্বিচারে তরবারী চালাতে লাগল। বারোটা ঘোড়া দখল করল কমাণ্ডার। ভোরের আলো ফুটল। উট এবং মানুষের লাশে ভরে গেছে মাঠ। কেউ কেউ তড়পাচ্ছে এখনো। পালিয়ে গেছে কেউ। প্রতিরোধ করার মত কেউ নেই।

ঘোড়া নিয়ে সরে পড়ল খৃস্টান অভিযাত্রীরা। ওদের বাহনের প্রয়োজন মিটেছে। এখন ওরা ছুটে চলছে পরবর্তী শিকারের উদ্দেশ্যে।

বালিয়ানের সমগ্র সত্ত্বায় জড়িয়ে আছে মুবি। মদ বিকল করে রেখেছে স্নায়ুগুলো। এখন তার কাছে সাত সাতটা রূপসী যুবতী। ভুলে গেছে বিপদের কথা।

মুবি বার বার বলছে, ‘কোথাও বিশ্রাম নেয়া ঠিক নয়। তাড়াতাড়ি সাগর তীরে পৌঁছার চেষ্টা কর। আমাদের পেছনে শত্রু ধেয়ে আসছে।’

কিন্তু কে শোনে কার কথা। নিঃশঙ্কুচিত্ত মহারাজা সে। হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে মুবির কথা।

মেয়েদের মুক্ত করার পরের রাতে এক জায়গায় বিশ্রাম করছিল ওরা। বালিয়ান মুবিকে বলল, ‘তোমরা সাত যুবতী। আমরা সাতজন পুরুষ। দেখেছো আমার বন্ধুরা কত বিশ্বাসী। আজ ওদের পুরষ্কার দিব। আজ আমার ছয় বন্ধুর সাথে থাকবে তোমার ছয় বান্ধবী। তুমি থাকবে আমার সাথে। আজ আমরা আনন্দ করব।’

‘অসম্ভব!’ ক্রোধকম্পিত কণ্ঠে বলল মুবি, ‘আমরা বাজারের মেয়ে নই। ওরা তোমার কোনা বাদী নয় যে, যা ইচ্ছে তা করবে। বাধ্য হয়ে আমি তোমাকে দেহ দিয়েছি। এরা কারো ভোগর সামগ্রী হবে না।’

‘আনন্দ তুমি একাই লুটবে তা তো হয়না সুন্দরী। তোমার বান্ধবীদেরও কিছু ভাগ দাও।’ বালিয়ানের কণ্ঠে তরল রসিকতা।

‘বালিয়ান, তুমি ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ।’ রাগে ফেটে পড়ছে মুবি।

‘তোমরা কতটুকু ভদ্র তা জানা আছে আমার। আমাদের জন্য তো মরা দেহের উপঢৌকন নিয়ে এসেছ। এরা কতজনের শয্যা-সংগী হয়েছে তার হিসেব দিতে পারো? তোমরা কেউ মেরী নও, এ কথা কে না জানে।’

‘কর্তব্য পালন করতে গিয়ে আমরা দেহের উপঢৌকন পেশ করেছি, ভোগের সামগ্রী হওয়ার জন্য পুরুষদের সংগ দেইনি। আমাদের জাতি, ধর্ম আমাদের ওপর এক গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেছে। সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমরা দেহ, যৌবন, রূপলাবণ্য এবং সতীত্বকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করি। আমরা দেহ দিয়েছি আমাদের ওপর অর্পিত কর্তব্য ও দায়িত্বের অংশ হিসেবে, ভোগের জন্য নয়। এখন তুমি যা বলছ তা ভোগ বিলাস ছাড়া কিছুই নয়। যেদিন আমরা ভোগ বিলাসে জড়িয়ে পড়ব সেদিন থেকে শুরু হবে খৃস্টানদের পতন। ক্রুশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

‘মুবি, আমার বন্ধুরা জীবন পণ করে ক্রুশের জন্য লড়ছে। ওদের উজ্জীবিত করা তোমাদের দায়িত্ব।’

‘ট্রেনিং দেয়ার সময় আমাদের বলা হয়েছে, এক মুসলিম নেতাকে করায়ত্ত করার জন্য দশ জনের শয্যাসংগী হওয়া শুধু বৈধ নয় বরং পুণ্যের কাজ। মুসলমান ধর্মীয় গুরুকে দেহ দান করাকে আমরা সেরা পূণ্য মনে করি।’

‘তাহলে তুমি খৃস্টানদের স্বার্থে আমাকে ব্যবহার করছ?’

‘কেন, এখনো সন্দেহ আছে?’

‘কিন্তু আমি তো খৃস্টান নই।’

‘তা নও। কিন্তু খৃস্টানদের সাথে তোমাদের বন্ধুত্বকে কি অস্বীকার করবে? বলতো খৃস্টানদের সাথে তোমাদের এ বন্ধুত্ব কেন?’

‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য, খৃস্টানদের রক্ষার জন্য নয়। আমি মুসলমান কিন্তু প্রথমে একজন সুদানী।’

‘আর আমি সর্বপ্রথম একজন খৃস্টান। এর পর যে দেশের জন্ম নিয়েছি সে দেশের সন্তান।’

বালিয়ানের হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে মুবি বলল, ‘শোন, ইসলাম কোন ধর্ম নয়, এজন্য তুমি দেশকে প্রাধান্য দিচ্ছ। আমার সাথে চল সাগরের ওপারে। দেখবে আমাদের মহান ধর্ম। তখন নিজের ধর্মকে ভুলে যাবে।

‘যে ধর্ম নিজের মেয়েদের অন্যের শয্যাসংগী হওয়াকে পূণ্যের কাজ মনে করে, সে ধর্মকে শত ধিক।’ আচম্বিত জেগে উঠল বালিয়ানের ঈমানী চেতনা। ‘তুমি নিজের সতীত্ব হারাওনি- আমার ইজ্জত লুণ্ঠন করেছ। আমি নই, তুমিই আমায় ভোগ করেছ।’

‘এক মুসলমানের ঈমান ক্রয় করার জন্য সতীত্ব এমন বড় কিছু নয়। আমি তোমার ইজ্জত লুণ্ঠন করিনি, তোমার ঈমান কিনে নিয়েছি। তোমাকে এ অবস্থায় পথে ছেড়ে যাব না। নিয়ে যাব ঝলমলে আলোর কাছে। তোমার ভবিষ্যত এবং পরকাল হিরার মত উজ্জল হয়ে উঠবে।’

‘আমি তোমার সে আলোর কাছে যাব না।’

‘দেখো বালিয়ান, পুরুষ যোদ্ধা। ওরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না। তুমি আমার পণ্য গ্রহণ করেছ। আমি তোমার ঈমান সুরার পাত্রে ডুবিয়ে দিয়েছি। তোমার ঈমান ক্রয়ের জন্য আমি দিয়েছি চড়া মুল্য। তোমার বাঁদী হয়ে, রক্ষিতা হয়ে থেকেছি আমি। হয় আমার সতীত্ব ফিরিয়ে দাও, নয় তোমার ঈমান দাও। তুমি এ ক্রয়-বিক্রয় থেকে মুখ ফেরাতে পার না। প্রতারণা করতে পার না এক দুর্বল মেয়ের সাথে।’

‘যে আলো সাগরে ওপারে দেখাতে চাইছ তা এখানেই দেখিয়েছ। আমি দেখতে পাচ্ছি হিরকের মত জ্বলজ্বল করছে আমার ভবিষ্যত।’

মুবি কিছু বলতে যাচ্ছিল, গর্জে উঠল বালিয়ান, ‘খামোশ বদমাশ মেয়ে! সালাহউদ্দীন আইয়ুবী আমার দুশমন হতে পারে কিন্তু আমি রাসূলের দুশমন নই। যে নবীর জন্য আমি সমগ্র মিসর এবং সুদান বিলিয়ে দিতে পারি সে পবিত্র নামের স্বার্থে আমি আইয়ুবীর কাছেও অস্ত্র সমর্পণ করতে প্রস্তুত।’

‘কতবার বলেছি, মদ কম খাও। অত্যাধিক মদপান, রাত জাগা এবং প্রতিদিন আমার সাথে এইসব করে তোমার মাথাটাই বিগড়ে গেছে। আমি যে তোমার স্ত্রী তাও ভুলে গেছো?’

‘আমি এক বেশ্যার স্বামী নই।’

মদের বোতল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল বালিয়ান। বন্ধুদের ডাকতেই ওরা ছুঁটে এল।

‘এ মেয়েরা এখন তোমাদের বন্দী। ওদের কায়রো ফিরিয়ে নিয়ে চল।’

‘কায়রো?’ একজনের হতচকিত প্রশ্ন, ‘আপনি কায়রো ফিরে যেতে চাইছেন?’

‘হ্যাঁ, কায়রো। হতবাক হচ্ছ কেন? এ মরুভূমিতে আর কতকাল ঘুরে মরব? যাও, জলদি ঘোড়া তৈরী কর, আর প্রতিটি ঘোড়ার পিঠে একটি করে মেয়ে বেঁধে দাও।’

বালিয়ানের তাঁবু থেকে আধমাইল দূরে থাকতেই থেমে গেল খৃষ্টান কমাণ্ডার। বিশ্রাম নেয়ার চমৎকার এলাকা। আশপাশে আরো কেউ তাঁবুঁ ফেলেছে কিনা খোঁজ নেয়ার জন্য রাতে তিনজন উষ্ট্রারোহীকে পাঠিয়ে দিল। ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ হয়, উট চলে নিঃশব্দে। তিন আরোহী ছড়িয়ে গেল তিনদিকে।

বালিয়ান যখন মুবির সাথে কথা বলছিল, একটা উট এসে দাঁড়িয়েছিল পেছনে। বালিয়াড়ির আড়ালে। দূর থেকে মশালের আলো দেখে এগিয়ে এসেছিল আরোহী। উটের পিঠে বসে সে মেয়েদের দেখতে পাচ্ছিল। গল্প করছে বালিয়ানের সাথে। দূরে কটা ঘোড়া বাঁধা।

উষ্ট্রারোহী ফিরে এল সংগীদের কাছে। বলল, ‘শিকার তোমাদের পাশেই রয়েছে।’

সময় নষ্ট করল না কমাণ্ডার। হেঁটে রওনা হল। ওরা যখন পৌঁছল বালিয়ান তখন মেয়েদের বেঁধে ফেলার নির্দেশ দিচ্ছে।

সংগীরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তার দিকে। নেতার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তর্ক জুড়ে দিল ওরা। সময় নষ্ট হতে লাগল। বালিয়ান অনেক কষ্টে বোঝাল যে, কায়রো গেলেই ওদের ভাল হবে।

বিস্ফারিত চোখে বালিয়ানে দিকে তাকাচ্ছিল মেয়েরা। ঘোড়ার পিঠে জিন চড়িয়ে ওরা মেয়েদের ধরে ফেলল।

আচমকা আক্রমণ হল। সুলতান আইয়ুবীর ফৌজ ভেবে বালিয়ান চিৎকার দিয়ে বলল, ‘আমরা অস্ত্র সমর্পণ করব। মেয়েদের কায়রো নিয়ে যাব।’

একটা খঞ্জর এসে বুকে বিঁধল তার। নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল বালিয়ান চিরদিনের জন্য। তার সংগীরা এত লোকের মোকাবেলা করতে পারল না। নিহত হল সবাই। মুক্ত হল মেয়েরা। কমাণ্ডারকে চিনতে পেরে খুশীতে উদ্বেলিত হয়ে উঠল মুবি। রাতে কাফেলার চারপাশে দাঁড় করানো হল সশস্ত্র সেন্ট্রি।

সুলতান আইয়ুবীর পাঠানো সওয়াররা এখান থেকে অনেক দূরে। রাতেও পথ চলছিল ওরা। সময় নষ্ট করতে চাইল না কেউ। সাথে পথ প্রদর্শক। পথ ভোলেনি সে।

কাফেলাকে সে আক্রমণের স্থানে নিয়ে গেল। মশাল জ্বেলে দেখাল শৃগাল শকুনের আধ খাওয়া রবিন এবং অন্যদের লাশ।

সওয়ারীদের দেখে শেয়াল পালিয়ে গেল। রক্ষীদের লাশ একত্রিত করে দ্রুত দাফন সারল কমাণ্ডার। এরপর ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন ধরে এগিয়ে চলল। রাতে ট্র্যাক পেতে কষ্ট হচ্ছিল। বাধ্য হয়ে ছাউনি ফেলা হল ওখানে।

খৃস্টানদের সবাই জেগে আছে। ওরা আনন্দিত। ভোরেই বেলাভূমির পথ ধরার সিদ্ধান্ত নিল খৃস্টান কমাণ্ডার। মেগনামা মারইউস বলল, ‘এখনো উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বেঁচে আছে সালাহউদ্দীন।’

কমাণ্ডার বলল, ‘মেয়েদের অনুসরণ করে কায়রো পৌঁছতে পারলে তা সম্ভব হত।’

‘কায়রো অনেক দূর। এজন্য এ পরিকল্পনা বাতিল।’

‘মৃত্যু ছাড়া এ পরিকল্পনা কেউ বাতিল করতে পারবে না।’ মেগনামার ঝাঝালো কণ্ঠ। ‘আমরা ক্রুশ ছুঁয়ে তাকে হত্যা করার জন্য শপথ করেছি। কেউ না গেলে আমি একা যাব। শুধু একটা মেয়ে এবং একজন সংগী প্রয়োজন।’

‘কি করতে হবে সে সিদ্ধান্ত আমি দেব।’কমাণ্ডার বলল, ‘তোমাদের কর্তব্য হল আমার নির্দেশ পালন করা।’

‘আমি কারও হুকুম পালন করতে বাধ্য নই। আমরা সবাই ঈশ্বরের আজ্ঞাবহ।’

কমাণ্ডার তাকে ধমকাতে লাগল। মেগনামা মারইউস তরবারী কোষমুক্ত করে কমাণ্ডারের মাথার ওপর তুলতেই অন্যরা মাঝখানে এসে দাঁড়াল।

‘আমি পাপী, অভিশপ্ত। পাপ এবং অবিচারের মাঝে ধুঁকে ধুঁকে মরছিলাম। তোরা কি জান আমার ত্রিশ বছরের শাস্তি কেন হয়েছিল?

পাঁচ বছর পূর্বে আমর এক যুবতী বোনকে অপহরণ করা হয়েছিল। ষোড়শী। আমি দরীদ্র। পিতা নেই, মা অন্ধ। সন্তানরা অবুঝ শিশু। গতর খেটে জীবিকা নির্বাহ করি। গির্জায় যীশুর মূর্তির কাছে অনেক দিন প্রশ্ন করেছিলাম, কেন আমি গরীব? কোন পাপ তো আমি করেনি! আন্তরিকতার সাথে পরিশ্রম করেও কেন ভূখা থাকি। আমার মা কেন অন্ধ? যীশু কোন জবাব দেননি। বোন অপহরণ হবার পর গির্জায় গিয়েছিলাম। মা মেরিকে প্রশ্ন করেছি, আমার বোনের ওপর তুমি এত ক্রুদ্ধ কেন! ও তো নিষ্পাপ। ওকে রূপ দিয়ে ঈশ্বরই জুলুম করেছেন। যীশুর মত মেরিও কোন জবাব দেয়নি।

একদিন এক আমীরের চাকর বলল, ‘তোমার বোন এক আমীরের ঘরে। আমীরটা বদমাশ। সুন্দরী মেয়েদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। কয়েকদিন আমোদ স্ফুর্তি করে। স্বাদ ফুরিয়ে গেলে গায়েব করে দেয়।

তার উঠাবসা রাজা বাদশার সাথে। মানুষ তাকে সমীহ করে, আইন তার হাতে বন্দী। আমি তার কাছে আমার বোনকে ফেরৎ চাইলাম। গলা ধাক্কা দিয়ে মহল থেকে বের করে দিল আমাকে। আবার গির্জায় গেলাম। যীশু এবং মেরীর মূর্তির সামনে কাঁদলাম। ঈশ্বরকে ডাকলাম। কেউ সাড়া দিল না। আমি গির্জায় একা ছিলাম। পাদ্রী এল, বের করে দিল ঘাড় ধাক্কা দিয়ে। বলল, ‘এখান থেকে মূর্তি চুরি হয়েছে। ভাগ, নইলে পুলিশের হাতে তুলে দেব।’

আমি আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘এটা কি ঈশ্বরের ঘর নয়?’

সে বলল, ‘আমার কাছে না বলে ঈশ্বরের ঘরে আসার সাহস তোকে কে দিয়েছে? পাপের স্খলন চাইলে আমার কাছে আয়। পাপের বর্ণনা দে। আমি ঈশ্বরকে বললে তিনি তোকে ক্ষমা করে দেবেন। তুই সরাসরি ঈশ্বরে সাথে কোন কথা বলতে পারিস না। ভাগ এখান থেকে।’ বন্ধুরা! এরপর খোদার ঘর থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হল।

তার বলার ভংগীতে মরু রাতের নিথর প্রকৃতি বিষন্নতায় ছেয়ে যাচ্ছিল। মেয়েদের চোখ ফেটে বেরিয়ে আসছিল অশ্রু। প্রতিটি যাত্রী মোহাবিষ্টের মত শুনছিল তার বেদনার্ত করুণ বর্ণনা।

ও বলছিল, ‘আমি পাদ্রীকে অবিশ্বাস করলাম। সন্দেহ জাগল যীশু, মরিয়ম এবং অদৃশ্য ঈশ্বরের প্রতি। বাড়ী ফিরে এলাম। আমার অন্ধ মায়ের প্রশ্ন, ‘আমার মেয়ে আসে নি বাবা?’

স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় আমার বোন?’

যীশু মেরীর নির্বাক ছবির মত দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। কিন্তু আমার ভেতর তৈরী হচ্ছিল এক ঝড়। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। সারাদিন ঘুরলাম উদ্দেশ্যহীন ভাবে। সন্ধ্যায় একটা খঞ্জর নিয়ে সাগর পাড় ধরে হাঁটতে লাগলাম। রাতের আঁধারে ছেয়ে গেল প্রকৃতি। অপেক্ষা করলাম। আরো গভীর হল রাত। যে বাড়িতে আমার বোন, সেদিকে চললাম। চলে এলাম মহলের পেছনে। সাধাসিধে মানুষ হলেও একটা বুদ্ধি এল। পেছনের দরজা দিয়ে ভতরে ঢুকে পড়লাম। একটা কক্ষে হৈ-হুল্লোড় চলছিল। সম্ভবত সুরার আসর। আমি অন্য একটি কক্ষে ঢুকলাম। একটা চাকর আমাকে বাঁধা দিল। খঞ্জর তার বুকে ঠেকিয়ে বোনের নাম বলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সে কোথায়?’

সে আমাকে সিঁড়ি দিয়ে উপরে নিয়ে গেল। একটা কক্ষ দেখিয়ে বলল, ‘এখানে।’

আমি দ্রুত রুমে প্রবেশ করলাম। শিকল টানার শব্দে চকিতে পিছনে ফিরে দেখলাম দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কক্ষ শূণ্য। কেউ নেই।

খানিক পর দরজা খুলল। এক সংগে অনেকে ভেতরে ঢুকল। ওদের কাছে তরবারী এবং লাঠি। আমি কক্ষের জিনিসপত্র তছনছ করতে লাগলাম, অনেক ভাঙলাম।

ওরা আমাকে ধরে পিটাতে লাগল। এক সময় আমি অজ্ঞান হয়ে গোলাম। জ্ঞান ফিরতে দেখি আমার হাত পা শক্ত করে বাঁধা। আমার বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগ আনা হল। সাথে রাজার দরবারীর বাড়ীর আসবাবপত্র নষ্ট করা এবং হত্যার উদ্দেশ্যে তিনজকে আহত করা।

কেউ আমার কথা শুনল না। ত্রিশ বছরের শাস্তি দিয়ে কারাগারের জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হল। পাঁচ বছর শেষ হয়েছে। আমি এখন মানুষের মধ্যে নেই। তোমরা ‘কারা নির্যাতন’ দেখনি। দিনে জানোয়ারের মত খাটাতে হয়, রাতে কুকুরের মত গলায় শিকল পরিয়ে এক কক্ষে আটকে রাখা হয়। জানিনা আমার অন্ধ মা বেঁচে আছে কিনা। স্ত্রী সন্তান কোথায় তাও জানা নেই। আমি এক বিপজ্জনক ডাকাত। এ জন্য কাউকে আমার সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি।

সব সময় ভাবতাম ঈশ্বর সত্য না আমি সত্য। শুনেছি খোদা নিষ্পাপদের শাস্তি দেন না। তিনি আমায় কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছেন? কি অপরাধ করেছিল আমার অবোধ শিশুরা?

পাঁচ বছর মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগেছি। কিছুদিন পূর্বে কারাগারে এলেন দু’জন ফৌজি অফিসার। বিশেষ কাজের জন্য লোক খুঁজছেন। আমি রাজা বাদশার ব্যক্তিগত যুদ্ধে নিজকে জড়াতে চাইনি। রাজার প্রতি আমার আকর্ষণ নেই। কিন্তু যখন শুনলাম ক’জন মেয়েকে মুসলমানদের বন্দীখানা থেকে মুক্ত করতে হবে, বোনের কথা মনে পড়ল আমার।

আমাদের বলা হল মুসলামনরা ঘৃণ্য জাতি। সিদ্ধান্ত নিলাম মেয়েদের মুক্ত করব। তাহলে ঈশ্বর যদি সত্য হন আমার বোনকে জালেম খ্রীষ্টানের কব্জা থেকে মুক্তি দিবেন।

ফৌজি অফিসার পুরস্কারের বিনিময়ে একজন মুসলমান রাজাকে হত্যা করার কথা বলল। আমি রাজি হলাম। বলল, ‘টাকার পরিমাণ এমন হতে হবে যাতে আমার পরিবারকে ভাবতে না হয়।’

ওরা কথা দিল। বলল, ‘তুমি সাগরের ওপারে নিহত হলে সরকার তোমার পরিবারের ভরণ পোষণের দায়িত্ব নেবেন।’

এরপর মারইউস দু’জন লোককে দেখিয়ে বলল, ‘এরাও আমার সাথে কারাগারে ছিল। এ দলে শরীক হতে রাজি হল ওরাও। অনেক প্রশ্ন করা হল আমাদের। জবাবে আশ্বস্ত করলাম। বললাম, আপন ধর্ম এবং জাতির সাথে প্রতারণা করব না। আসলে পরিবারের ভরণ পোষণের জন্যই আমার জীবন আমি বিক্রি করে দিয়েছি।

কারাগার থেকে বের করে এক পাদ্রীর কাছে নেয়া হল। তিনি বললনে, ‘একজন মুসলমানকে হত্যা করলে জীবনের সব পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে। মেয়েদেরকে মুক্ত করতে পারলে স্বর্গ নিশ্চিত।’

পাদ্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘খোদা কোথায় থাকেন?’

তার জবাব আমার মনঃপুত হয়নি। ক্রুশে হাত রেখে শপথ নেয়ার পর ছাড়া পেলাম। বাড়ী গেলাম। ওরা আমার পরিবারকে প্রচুর অর্থ সম্পদ দিল। আমি চিন্তামুক্ত হলাম। বন্ধুরা; আমার শপথ পূর্ণ করতে দাও। দেখতে চাই খোদা কোথায় আছেন? একজন মুসলামন বাদশাকে হত্যা করলে কি আমি খোদাকে দেখতে পাব?’

‘তুমি একটা পাগল।’ কমাণ্ডার বলল, ‘এতক্ষণ যা বলেছ তা নিরেট পাগলের প্রলাপ।’

‘ও অনেক মূল্যবান কথা বলেছে।’ একজন বলল, ‘আমি তার সাথে থাকবো।’

‘আমার একটা মেয়ে প্রয়োজন।’ মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বরল মারইউস। ‘ওর জীবন এবং ইজ্জত রক্ষার দায়িত্ব আমার। মেয়ে ছাড়া আইয়ুবী পর্যন্ত পৌঁছা যাবে না। আসার সময় থেকে তার সাথে একা দেখা করার কথা ভাবছি।’

মুবি দাঁড়াল। মারইউসের পাশে গিয়ে বলল, ‘আমি ওর সঙ্গে যাব।’

‘তোমাকে অনেক কষ্টে মুক্ত করেছি।’ কমাণ্ডার বলর, ‘এমন বিপজ্জনক অভিযানে যাবার অনুমতি আমি তোমাকে দেব না।’

‘আমি সতীত্ব হারিয়েছি। এর প্রতিশোধ আমি নেব। আইয়ুবীর শোবার ঘরে ঢোকা আমার জন্য সহজ। মুসলামন যত ক্ষমতাবানই হোক, সুন্দরী নারী দেখলে ওদের মাথা ঘুরে যায়। ও কল্পনাও করতে পারবে না, আমি হব তার জীবনের শেষ নারী।’

অনেক তর্কবিতর্কের পর মারইউস একজন সংগী এবং মুবিকে নিয়ে যাবার জন্য তৈরী হল। সবাই প্রার্থনা করল তাদের সাফল্যের জন্য।

রওয়ানা হল তিনজনের কাফেলা। সাথে দুটো উট। একটাতে মুবি, অন্যটাতে দু’জন পুরুষ।

ওদের কাছে ছিল মিসরের দিরহাম এবং স্বর্ণমূদ্রা। পরণে জুব্বা। মারইউসের দীর্ঘ দাড়ি। অত্যাধিক পরিশ্রমে শরীরের রং কিছুটা কালো। দেখলে ইটালীর লোক মনে হয়না, ইইরোপীয় বলে সান্দেহ করবে যে কেউ। কিন্তু সমস্যা ছিল একটি, আরবী জানত না মারইউস। মুবি এবং দ্বিতীয় ব্যক্তি মিসরে ভাষায় পারদর্শী।

রাতে রওয়ানা হল ওরা। মুবির পরিচিত পথ। ওড়নায় মুখ ঢেকে রেখেছে ও।

ভোরে একটু খোঁজাখুঁজি করতেই পাওয়া গেল ট্র্যাক। ঘোড়ার পায়ের পরিচিত চিহ্ন। অনেকগুলো ঘোড়া গেছে এ পথে।

খৃস্টানদের কাফেলা দ্রুত চলছিল। মাঝ রাত পর্যন্ত থামেনি খৃস্টানরা। সামান্য বিশ্রাম নিয়ে ভোর রাতে আবার যাত্রা শুরু করেছে।

মারইউস ঘোড়া নেয়নি। উট দীর্ঘপথের ক্লান্তি সইতে পারে। না খেয়ে থাকতে পারে অনেকক্ষণ।

ট্র্যাক না পাওয়ায় রাতে পথ চলতে পারেনি মুসলমানরা। দিনের বেলা তই যতদূর সম্ভব দ্রুত ছুটছিল। সূর্য ডোবার এখনও সামান্য বাকী, সামনে দেখা গেল লাশের সারি।

বালিয়ানকে চিনতে পারল আলী বিন সুফিয়ানের সহকারী। পাহাড়ী জন্তু তার সংগীদের লাশের বেশীর ভাগ গোশত খেয়ে ফেললেও তার চেহারা ছিল অক্ষত। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল ওরা। বুঝতে পারছিল না কি হয়েছে। রক্ত বলছে বেশী দিন আগে নিহত হয়নি। বিদ্রোহের দিন মৃত্যু হলে রক্তের দাগ থাকত না।

ট্রাক ধরে আবার এগিয়ে চলল কাফেলা। আধমাইল পর উটের পায়ের চিহ্নও দেখা গেল। সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলল ওরা।

সামনে উঁচুনীচু টিলা। এঁকে বেঁকে চলে গেছে পাহাড়ী পথ। অন্য কোন রাস্তা নেই। এ পথেই গেছে খৃষ্টান কাফেলা।

পাহাড় শ্রেণী পেরিয়ে এল ধাওয়াকারীরা। সামনে বিস্তীর্ণ মাঠ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে বাধ্য হয়ে ওদের থামতে হল।

ভোরেই রওয়ানা হল আবার। খানিক চলার পর সাগরের নির্মল বাতারের স্পর্শ পেল ওরা দেহে। বুঝল, সাগরের কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। কিন্তু খৃস্টানদের দেখা যাচ্ছে না এখনো।

এক জায়গায় দেখা গেল খাবারের উচ্ছিষ্ট পড়ে আছে। রাতে এখানে কেউ বিশ্রাম করেছে।

ট্র্যাক ধরে আবার ঘোড়া ছুটল। সূর্য মাথার ওপর থেকে সামান্য নুয়ে পড়েছে। ঘোড়াগুলোকে বিশ্রাম দেয় হল খানিক। রওয়ানা হল আবার। সাগরের বাতাস জোরালো হচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে কাফেলা। চোখের সামনে ভেসে উঠল সাগর পাড়ের টিলা আর বালিয়াড়ি।

ট্র্যাক দেখে মনে হচ্ছে অনেকগুলো ঘোড়া এগিয়ে গেছে। টিলার প্রায় কাছে এসে পড়েছে ওরা। টিলার ওপর দু’জন লোক। এদিকেই তাকিয়ে আছে। ওদের দেখে দ্রুত বেলাভূমিতে নেমে গেল লোক দু’টি।

ঘোড়ার গতি আরও তীব্র হল। থামতে হল পাহাড়ের কাছে এসে। ওপাশে যাওয়ার কয়েকটি পথ। একজনকে পাঠানো হল পথ দেখার জন্য।

পাহাড়ের ওপর উঠে এর লোকটি। শুয়ে সামনে তাকাল। পেছনের সরে এসে সংগীদের ইশারা করল। ঘোড়া থেকে নেমে উপড়ে উঠে এল সবাই।

কমাণ্ডার সবার সামনে। বেলাভূমির দিকে তাকিয়ে একজনর দেখেই দ্রুত সরে এল সংগীদের কাছে। হুকুম দিল দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার।

ওপাশ থেকে ভেসে আসছিল ঘোড়ার হ্রোষা ধ্বনি। এখানেই সাগর থেকে একটা খাল ভেতরে ঢুকেছে। খৃষ্টানরা লুকিয়ে রাখা নৌকায় উঠছিল। অনেক বড়ো নৌকা। মেয়েরা উঠে পড়েছে। উঠছে বাকীরাও। ঘোড়াগুলো ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

হঠাৎ তীর বৃষ্টি শুরু হল। কমাণ্ডার সকলকে হত্যা না করে জীবন্ত ধরতে চাচ্ছিল। লাফিয়ে যারা নৌকায় চড়তে পেরেছিল তারা দাঁড় টানতে শুরু করল। যারা উঠতে পারল না তারা তীরের আঘাতে নিহত হল।

চওড়া খাল বেয়ে নৌকা চলছে। কমাণ্ডার ওদের ভয় দেখাল, কিন্তু নৌকা থামল না। তীর বৃষ্টি হল একবার, দু’বার, তিনবার। নৌকা লাশে ভরে গেল। ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকা কিনারে এসে ঠেকল। ধরে ফেলল সওয়াররা। কেউ বেঁচে নেই। কারো গায়ে দু’টো তীরও লেগেছে।

নৌকা বেঁধে কাফেলা এগিয়ে চলল ছাউনির দিকে। সাগর পারের সেনা ছাউনি এখান থেকে বেশী দূরে নয়।

মিসরের এক সরাইখানায় অবস্থান করছিল মেগনামা মারইউস। সরাইখানায় দু’টো ভাগ। একভাগ সাধারণ পথচারীদের জন্য। অন্যভাগে থাকেন বড় লোক এবং আমীর ওমরার দল। ব্যবসায়ীরাও এ ভাগেই থাকেন। এখানে মদ এবং নর্তকীর ব্যবস্থা আছে। মারইউস এখানে এসে উঠল।

মুবি এখন তার স্ত্রী। সংগীটি বিশ্বস্ত চাকর। মুবির অনবদ্য রূপ সরাইখানায় মারইউসের মর্যাদা বাড়িয়ে দিল। এমন সুন্দরী স্ত্রী যার ঘরে সে নিশ্চয় অনেক বড়লোক। সরাইখানার লোকেরা তার বিশেষ যত্ন নিতে লাগল।

নিজেকে মুসলমান পরিচয় দিল মুবি। ওদের কাছ থেকে সুলতান আইয়ুবীর অফিস এবং বাড়ীর ঠিকানা জেনে নিল। সুদানীরা পরাজিত এবং সুলতান তাদের ক্ষমা করেছেন এ খবরও পেল সে। আরও শুনল সুদানী কমাণ্ডারদের হারেম এবং যুবতী শূন্য। সুলতান আইয়ুবী তাদের মধ্যে কৃষি জমি বিতরণ করছেন।

মিসরের ভাষা জানে না মারইউস। শাসকদের কাছে পৌঁছার ট্রেনিংও পায়নি সে। মানসিক দিক দিয়ে বিপর্যস্ত। এসেছে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে হত্যা করার বিপজ্জনক মিশন নিয়ে। তার চারপাশে থাকে সশস্ত্র প্রহরা। পাহারার দেয়াল ভেদ করে তার কাছে পৌছা সহজ নয়। কমাণ্ডার তাকে পাগল বলেছেন। বস্তুত সে পাগলই। পৃথিবীর তাবৎ নামী লোকদের হত্যাকারীদের সবাই ছিল আধ পাগল, নয়তো ছিল মানসিকভাবে বিকৃত।

মারইউসও এদেরই একজন। তার কাছে আছে একটা শক্তিশালী অস্ত্র- মুবি। আরবী ভাষা, সভ্যতা সংস্কৃতির ওপর তাকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল। ও জানত মুসলমানদের মনমানসিকতা, অভ্যাস ও চালচলন। গুপ্তচরবৃত্তি এবং অভিনয়ে পারদর্শী মুবি পুরুষ নাচাত চোখের ইশারায়। প্রয়োজনে বিবস্ত দেহ তুলে ধরত পুরুষের কাছে।

সরাইখানার বন্ধ কক্ষে কেটে গেল তিনদিন। ভেতরে তিনজন। মুবি, মারইউস এবং সংগীটি। কেউ জানেনা কি করছে ওরা। দু’টো ঘোড়া এবং কিছু কাপড় কিনেছিল সরাইখানার লোকদের মাধ্যমে। চার দিন পর বেরিয়ে এল মারইউস। সুন্দর করে আঁচড়ানো দাঁড়ি। সুদানীদের মত গাঢ় বাদামী গায়ের রং। পরনে সাধারণ জুব্বা, মাথায় পাগড়ি।

মুবির দেহ কাল বোরকায় ঢাকা। চোখ, কপাল এবং নাক উন্মুক্ত। ঠোঁটের ওপর থেকে ফিনফিনে নেকাব ঝুলানো। তার চোখ ধাঁধানো রূপে চোখ আটকে যায়। সংগীটির নগন্য পোশাক। চাকরদের মত। বাইরে এসে একটা ঘোড়ায় চাপল মারইউস, অন্যটায় মুবি। চাকরের মত তাদের পেছনে চলল সংগীটি।

জংগীর পাঠানো সৈন্যদের সাথে নিয়ে জেরুজালেম আক্রমণ করবে সালাহউদ্দীন, তার আগেই কাজ শেষ করতে চায় ওরা।

অভিযানের পূর্বে সুদানীদের জমি দিয়ে পূনর্বাসন করতে চাইছেন সুলতান। কাজে জড়িয়ে গেলে বিদ্রোহ করার সুযোগ পাবে না ওরা।

সেনাবাহিনীর সংস্কার এবং পূনর্বাসনের কাজ ততোটা সহজ নয়। প্রশাসন এবং ফৌজে সুলতানের বিরোধী লোক ছিল। সুদানীরা আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু গোয়েন্দাদের রিপোর্ট অনুযায়ী এখনও তাদের ভেতরে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে।

প্রশাসন এবং ফোজের কিছু লোক সুদানীদের পরাজয়ের চেয়ে খৃস্টানদের পরাজয়ে কষ্ট পেয়েছে বেশী। ওরা ভেবেছিল সালাহউদ্দীন আইয়ুবী নিহত হবে। সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে যাবে ওদের জন্য।

এরা বিশ্বাসঘাতক জেনেও সুলতান এদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেননি। কখনো প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেননি। ভাল ব্যবহার করেছেন ওদের সাথে। প্রায়ই বলতেন, ‘কাউকে নিজের ঈমান বিক্রি করতে দেখলে বাঁধা দিও। তাকে বলো সে মুসলমান। তার সাথে মুসলমান বন্ধুর মত ব্যবহার করো।’

কিন্তু আলীর গোয়েন্দারা নিয়মিত ওদের তৎপরতার সংবাদ পৌঁছে দিত সুলতানের কাছে।

রসদবাহী কাফেলা লুণ্ঠিত হয়েছে, প্রহরীদের হত্যা করে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে বন্দীদের। এতে বোঝা যায়, সমগ্র মিসরে ওদের কমাণ্ডো বাহিনী ছড়িয়ে আছে। তাদের আশ্রয় দিচ্ছে বিশ্বাসঘাতকরা।

গোয়েন্দা বিভাগকে আরও সম্প্রসারিত এবং শক্তিশালী করার নির্দেশ দিলেন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী।

মুসলিম বিশ্বকে শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন তিনি। অথচ তার বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে ঝড়ো হাওয়ার তাণ্ডব। এজন্য তিনি ছিলেন উদ্বিগ্ন। কি করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন তিনি? মুসলমানের তলোয়ারই স্বজাতির কণ্ঠে ধরা। দিন দিন বিশ্বাসঘাতকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে ছড়ানো ষড়যন্ত্রের জালে ফেঁসে যাচ্ছে ওরা। টাকা এবং নারী সব তছনছ করে দিচ্ছে।

তিনি জানতেন তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এ জন্য কখনও তাকে উৎকণ্ঠিত দেখা যায়নি। তিনি বলতেন, ‘আমার জীবন আল্লাহর হাতে। এ ভূখণ্ডে আমার প্রয়োজন না হলে তিনি তুলে নেবেন।’

এজন্য নিজেকে রক্ষার জন্য তিনি চিন্তিত হননি কখনও। প্রশাসন তাঁর চারপাশে গুপ্তচর ছড়িয়ে রেখেছিল। আলী ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক, আইয়ুবীকে তিনি তার মুর্শিদ মনে করতেন।

একদিন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী অফিসার এবং কমাণ্ডারদের বিভিন্ন কাজের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। হেড কোয়ার্টারের গেটে দু’টো ঘোড়া এসে থামল। আরোহীদের একজন মধ্য বয়সী পুরুষ, অন্যজন যুবতী।

ভেতরে ঢুকতে বাঁধা দিল সেন্ট্রিরা। ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল আরোহী দু’জন। যুবতী এগিয়ে এসে কমাণ্ডারকে বলল, ‘আমার পিতা। সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’

কমাণ্ডার পুরুষ আরোহীকে সুলতানের সাথে দেখা করার কারণ জিজ্ঞেস করল। না শোনার ভান করল সে।

যুবতী বলল, ‘বাবা বধীর। কানেও শোনেন না।’

‘কি জন্য দেখা করতে চাচ্ছেন?’

‘সে কথা আমরা সুলতানকে বলব।’

বাইরে পায়চারী করছিলেন আলী বিন সুফিয়ান। এগিয়ে এলেন তিনি। সালাম দিলেন। জবাব দিল যুবতী।

কমাণ্ডার বলল, ‘এরা সুলতানের সাথে দেখা করতে চাইছেন।’

আলী পুরুষটিকে সাক্ষাতের কারণ জিজ্ঞেস করলনে। যুবতী বলল, ‘আমার পিতা বধির। কানেও শোনেন না।’

‘সুলতান ভীষণ ব্যস্ত। সুলতানের সাথে দেখা না করেও আপনাদের সাক্ষাতের উদ্দেশ্য পুরণ হতে পারে। ছোট খাট অভিযোগগুলো সুলতানের কাছে বলার দরকার কি? এজন্য আলাদা বিভাগ রয়েছে।’

‘এক নির্যাতিতা মুসলিম মেয়ের ফরিয়াদ শোনার সময় কি সুলতানের হবে না? আমার যা বলার তাকেই বলব।’

‘আমাকে বলুন। আমিই আপনাদের ফরিয়াদ সুলতানের কাছে পৌঁছে দেব। প্রয়োজন মনে করলে তিনি আপনাদের ডেকে পাঠাবেন।’

আলী ওদের নিজের কক্ষে নিয়ে গেলেন।

যুবতী বলতে লাগল, ‘উত্তর সীমান্তে আমাদের বাস। বছর দু’য়েক আগে সুদানী ফৌজ সে এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল, অন্য মেয়েদের সাথে আমিও সৈন্যদের দেখার জন্য বেরিয়ে এলাম। এক কমাণ্ডার ঘোড়া ঘুরিয়ে আমার কাছে এল। নাম এবং পরিচয় জানতে চাইল। নাম বললাম। ও আব্বাকে ডেকে আনল। আড়ালে নিয়ে কি যেন জিজ্ঞেস করল। কেউ একজন বলল সে কথা বলতে পারেনা। কমাণ্ডার ফিরে গেল।

সন্ধ্যার পর চারজন সিপাই এসে আমায় জোর করে ধরে নিয়ে গেল। কমাণ্ডারের নাম বালিয়ান। আমি তার হারেমে অন্তরীণ হলাম। ওখানে আরও চারটি মেয়ে ছিল। কামাণ্ডারকে বললাম আমাকে বিয়ে কর। কিন্তু বিয়ে ছাড়াই সে আমায় ভোগ করতে লাগল।

দু’বছর ছিলাম তার কাছে। সুদানীরা বিদ্রোহ করে পরাজিত হল। পালিয়ে গেল বালিয়ান। জানিনা মারা গেছে না বন্দী হয়েছে।

আপনার সৈন্যরা তার বাড়ীতে গিয়ে আমাদের মুক্ত করে দিল। আমি বাড়ী গেলাম। বাবা আমায় বিয়ে দিতে চাইলেন, কিন্তু কেউ আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলনা। বলল, ‘আমি হারেমের বেশ্যা।’

ওখানে আমার থাকাটাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ল। আমরা একটা সরাইখানায় উঠেছি। শুনেছি সুলতান সুদানীদের জমি এবং বাড়ী দিচ্ছেন। বালিয়ানের রক্ষিতা বা স্ত্রী মনে করে তিনি যদি আমাকে কিছু জমি দেন তাহলে ওখান থেকে চলে আসব। তা না হল হয় আত্মহত্যা করব নয়তো হবো বারবনিতা।’

‘সুলতানের সাথে দেখা করা ছাড়াই যদি জমি পেয়ে যান তবে কি তাঁর সাথে সাক্ষাতের প্রয়োজন আছে?’

‘হ্যাঁ, আমার শ্রদ্ধা এবং আবেগ তাকে জানানো দরকার। আমি শুধু তাকে বলব, আপনার দেশে নারীরা পুরুষের ভোগের সামগ্রী। আমীর ওমরা এবং বিত্তশালীদের মধ্যে বিয়ের প্রথা ভেঙে গেছে। মেয়েদের ইজ্জত রক্ষা করুন। ওদের সম্মান ওদের ফিরিয়ে দিন। সুলতানকে একথা বলতে পারলে হয়ত আমি মনে শান্তি পাব।’

পুরুষ সংগীটি নির্বাক বসেছিল।

‘আপনারা অপেক্ষা করুন। মিটিং শেষ হলে আপনাদের ডেকে পাঠাব।’ বেরিয়ে গেলেন আলী।

সরাইখানায় গিয়ে ওদের কক্ষ তল্লাশী নিলেন তিনি। লোকদের জিজ্ঞেস করে জানলেন ওরা স্বামী-স্ত্রী। ওরা কি কি কিনেছে তাও তাকে বলা হল। আলী নিশ্চিত হলেন, এরা খৃস্টানদের গুপ্তচর।

ফিরে এসে চাকরটাকে বন্দী করে জেরা শুরু করলেন। জেরার জবাবে সে বলল, ‘মেয়েটা মুবি। পুরুষ সংগীটির নাম মেগনামা মারইউস।’

আলী ফিরে এলেন মুবিদের কাছে। বললেন, ‘আরেকটু বসুন, আমি সুলতানের অনুমতি নিতে যাচ্ছি।’

সুলতানের কক্ষে আলীর অনেক সময় কাটল। তিনি বিস্তারিত জানালেন সুলতানকে। ফিরে এসে যুবতীকে বললেন, ‘সুলতান অনুমতি দিয়েছেন। আপনার পিতাকে নিয়ে আসুন।

আলী ওদেরকে সুলতানের কক্ষ দেখিয়ে দিলেন।

‘ধন্যবাদ’ বলে ওরা প্রবেশ করল ভেতরে। ঢোকার আগে চারদিক নজর বুলিয়ে বাইরেটা দেখে নিল ভাল করে।

ওরা ভেতরে ঢুকলে সুলতান ওদের বসালেন। হাসিমুখে বললেন, ‘বলুন, আপনাদের জন্য কি করতে পারি।’

কক্ষে সুলতান একা। যুবতীকে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার পিতা কি জন্ম থেকেই বধির?’

সুলতান বসেননি, কক্ষে পায়চারি করতে করতে বললেন, তোমাদের অভিযোগ আমি শুনেছি। আমি তোমাদের ব্যাথায় সমান ভাবে ব্যথিত। তোমাদেরকে জমি এবং বাড়ী দেয়া হবে। শুনলাম তুমি নাকি আরো কিছু বলতে চাইছ।’

‘দীর্ঘজীবী হোন সুলতান! নিশ্চয়ই শুনেছেন কেউ আমাকে বিয়ে করতে চাইছে না। আমাকে বলছে হারেমের বেশ্যা। বাবাকে বলছে মেয়ে বিক্রেতা! জমি এবং বাড়ী তো দেবেন। কিন্তু শূণ্য বাড়ী দিয়ে আমি কি করবো? আমার কি এমন লোকের প্রয়োজন নয়, যে আমার ইজ্জতের হেফাজত করবে?’

একটু থেমে লজ্জাজড়িত কণ্ঠে যুবতী আবার বলল, ‘মহামান্য সুলতান! জানি, আমি আপনার উপযুক্ত নই। এ প্রস্তাব করার দুঃসাহসও আমার নেই যে আপনি আমায় বিয়ে করুন। আমার রূপ যৌবনই আমার শত্রু। এ রূপ নিয়ে কোথাও একাকী জীবন কাটানো আমার জন্য নিরাপদ নয়। আপনার হারেমের বাদী হতে পারলেও আমার জীবনকে ধন্য মনে করতাম।’

মেয়েটি পুরুষ সংগীর কাঁধে একহাত এবং নিজের বুকে এক হাত রেখে সুলতানের দিকে ইশারা করল। পুরুষটি হাত জোড় করে সুলতানের সামনে এগিয়ে এল। সে বোঝাতে চাইছে, ‘সুলতান! আমার এ মেয়েটাকে গ্রহণ করুন।’

‘আমার কোন হারেম নেই। দেশের সব হারেম, পতিতাপল্লী এবং মদপান আমি বন্ধ করে দিয়েছি।’

কথা বলতে বলতে তিনি পকেট থেকে একটা মুদ্রা বের করে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। ‘আমি নারীর ইজ্জতের রক্ষক হতে চাই।’

পায়চারী করতে করতে তিনি ওদের পেছনে চলে এলেন। মুদ্রা হাত থেকে ছেড়ে দিলেন। ঝন করে শব্দ হল। পুরুষটি চমকে পেছনে তাকাল।

সুলতান দ্রুত খাপ থেকে খঞ্জর টেনে পুরুষটির ঘাড়ে ঠেকিয়ে যুবতীকে বললেন, ‘ও আমার ভাষা বোঝে না। ওকে অস্ত্র ফেলে দিতে বল। দেরী হলে তোমার দু’জনই মারা পড়বে।’

ফ্যাকাসে হয়ে গেল যুবতীর চেহারা। বলল, ‘বাবাকে ভয় দেখিয়ে আমায় হাতে নিতে চাইছেন? আমি তো স্বেচ্ছায় নিজকে আপনার কাছে সমর্পণ করতে চাইছি।’

‘যখন তুমি সাগর পারের ছাউনিতে এসেছিলে তখন আরবী জানতে না। এত শীঘ্র এ ভাষা শিখে ফেললে? ওকে অস্ত্র ফেলে দিতে বল।’

যুবতী নিজের ভাষায় পুরুষ সংগীকে অস্ত্র ফেলে দিতে বলল। জুব্বার ভেতর থেকে খঞ্জর বের করে সুলতানের হাতে তুলে দিল লোকটি। ওটা হাতে নিয়ে সুলতান পুরুষটির ঘাড় থেকে খঞ্জর সরিয়ে বললেন, ‘অন্য মেয়েরা কোথায়?’

‘আপনি ভুল করছেন সুলতান।’ কাঁপা কণ্ঠে বলল যুবতী, ‘আমার সাথে আর কোন মেয়ে নেই। আপনি কাদের কথা বলছেন?’

‘আমি অন্ধ নই মেয়ে। একবার যাকে দেখি, কখনও তার চেহারা ভুলি না। যদিও অর্ধেক চেহারা ঢেকে রেখেছ নেকাবে, তবু তোমাকে চিনতে আমার মোটও ভুল হয়নি। যে কাজের জন্য এসেছ তোমরা তুমি তার যোগ্য নও। সরাইখানায় ছিলে স্বামী-স্ত্রী, এখানে পিতা-কন্যা। গোয়েন্দাদের এত আনাড়ি হলে চলে না। তোমাদের চাকরও ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে গেছে।’

মারইউস আইয়ুবীর কথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। সুলতান কি বলছে বুঝার জন্য সে মুবির দিকে তাকিয়ে রইল। সুলতান বললেন, ‘ওকে বল, আমার জীবন খৃস্টানদের ঈশ্বরের হাতে নয়, আমার খোদার হাতে।’

মুবি ইটালীর ভাষায় তাকে সুলতানের কথাটা বুঝিয়ে দিল। জবাবে সে কি বলল সুলতান তা বুঝতে পারলেন না। মুবি বলল, ‘সুলতান! ও বলছে আপনার খোদা কি অন্য কেউ, মুসলমান কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করে?’

সুলতান বললেন, ‘ওকে বল মুসলমানরা এক সত্য খোদাকে বিশ্বাস করে, তিনি সত্যবাদীকে ভালবাসেন। তোমরা আমাকে হত্যা করার জন্য এসেছ এ কথা আমাকে কে বলল? আমার খোদা। তোমাদের খোদা সত্য হলে এতক্ষণে তোমাদের খঞ্জর আমার বুক এফোঁড় ওফোড় করে দিত। আমার খোদা তোমাদের খঞ্জর আমার হাতে তুলে দিয়েছেন।’

একটা তরবারী এবং কিছু জিনিস বের করে সুলতান বললেন, ‘এগুলো তোমাদের, সাগরের ওপার থেকে নিয়ে এসেছ। অথচ তোমারা এখানে আসার পূর্বেই এগুলো আমার হাতে এসে গেছে।’

দোভাষীর কাজ করছিল মেয়েটা। সে সুলতানের কথা মারউইসকে বুঝিয়ে দিল। আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মারইউস। বিস্ময় বিস্ফারিত চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে বলতে লাগল, ‘লোকটাকে সত্য মনে হয়। এসেছি তাকে হত্যা করতে, এখন আমার জীবন তার হাতে। মুবি, তার বুকের ভেতরে এক খোদাকে আমায় দেখাতে বল। আমি তাকে হত্যা করতে এসেছি, এ সংবাদ যে তাকে দিয়েছে সে খোদাকে আমি দেখতে চাই।’

দীর্ঘ আলাপ করার সময় সুলতানের ছিল না। দু’জনকে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তাঁর মনে হল লোকটা পাগল না হলেও মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত। তিনি বন্ধুর মতো কথা বলতে লাগলেন। কি হচ্ছে দেখার জন্য ভেতরে ঢুকলেন আলী। সুলতান মৃদু হেসে বললেন, ‘কোন সমস্যা নেই আলী। খঞ্জর নিয়ে নিয়েছি।’

আলী বেরিয়ে গেল। মারইউস বলল, ‘সুলতান! আমাকে হত্যা করার পূর্বে আপনাকে আমার জীবন কাহিনী শোনাতে চাই।’

অনুমতি পেয়ে সে তার কাহিনী সুলতানকে শোনাল। খৃস্টান কাফেলার সামনে যা বলেছিল হুবহু তাই। যীশু এবং মেরির মূর্তি কথা বলেনি, গির্জায় যেতে পাদ্রীর অনুমতি প্রয়োজন, এতে তার মন ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। সে বলল, ‘মৃত্যুর পূর্বে খোদাকে এক নজর দেখতে চাই সুলতান। আমার ঈশ্বর আমার শিশুদের অনাহারে মেরেছে। আমার মাকে অন্ধ করেছে। একমাত্র যুবতী বোনকে তুলে দিয়েছে মদ্যপ জানোয়াের হাতে। বিনা অপরাধে আমাকে দিয়েছে ত্রিশ বছরের কারাদণ্ড। আমার ফাঁসির জন্য আমার নামে মিথ্যা খুনের দোষ চাপানোর সুযোগ দিয়েছে আমার শত্রুকে। মৃত্যুর মুখোমুখি করে ওখান থেকে বের করে এনেছে আপনাকে হত্যা করার জন্য। সুলতান, এখন আপনার হাতে আমার জীবন। আমাকে সত্য খোদা দেখান। তার কাছে আমার নালিশ জানাবো, ন্যায় বিচার চাইব আমি তার কাছে।’

‘তোমার জীবন আমার হাতে নয়, আমার খোদার হাতে। এতক্ষণে তুমি থাকতে জল্লাদের কাছে। আমি তোমায় সে সত্য খোদাকে দেখাব যিনি তোমাকে মৃত্যুর হাত থেকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন।’

অভিভুত হয়ে সুলতানের কথা শুনছিল মারইউস। তিনি বললনে, ‘আমার খোদাকে গ্রহণ করতে হয় খাঁটি মনে। অন্তর পরিচ্ছন্ন না হলে তিনি তার ফরিয়াদ শোনবেন কেন? তুমি ন্যায়বিচার চাইলে আগে নিজের অন্তর পরিষ্কার কর।’

সুলতান খঞ্জর ছুঁড়ে দিলেন তার দিকে। তার সামনে গিয়ে পেছনে ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মুবি! ওকে বল, আমার জীবন তার হাতে তুলে দিলাম। এ খঞ্জর আমার পিঠে বিদ্ধ করুক।’

খঞ্জর হাতে তুলে নিল মেগনামা মারইউস। গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখল। তাকাল সুলতানের পিঠের দিকে। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর চলে এল সুলতানের সামনে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সুলতানকে। চোখে চোখ রাখল। কেঁপে গেল তার হাত। সত্য খোদাকে দেখছে ও।

হাঁটু গেড়ে সুলতানের পায়ের কাছে খঞ্জর রাখল মারইউস। চুমো খেল সুলতানের হাতে। তার চোখ ফেটে বেরিয়ে এল অশ্রুর বন্যা। মুবির দিকে তাকিে বলল, ‘এই কি খোদা! নাকি খোদাকে এ বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছেন। তার খোদাকে দেখাতে বল।’

সুলতান দুবাহু ধরে তাকে তুললেন, জড়িয়ে ধরলেন বুকের সাথে। নিজের হাতে মুছে দিলেন তার অশ্রু।

মেগনামা মারইউস। এক পথহারা পথিক। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণার বিষ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তার হৃদয়ে। পরিস্থিতি তাকে তার স্বাভাবিক জীবন থেকে সরিয়ে এনে তাকে করে তুলেছিল প্রতিশোধ পরায়ন ও বিকারগ্রস্থ। তার পাগলাটে স্বভাব বা আবেগ বিপজ্জনক অভিযানে নিয়ে এসেছিল তাকে।

সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর চোখে ও নিরপরাধ। কিন্তু ছাড়তেও পারছিলেন না। কারণ তার সাথে আছে ট্রেনিংপ্রাপ্ত বিপজ্জনক ফেরারী গুপ্তচর মুবি। খৃষ্টানদের সংবাদ সুদানীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে সে। উস্কানি দিয়েছে বিদ্রোহের জন্য। ও দেশ এবং জাতির শত্রু। আইন তাকে ক্ষমা করতে পারে না।

তাদের দু’জনকেই আলীর হাতে তুলে দেয়া হল। জবানবন্দিতে অপরাধ স্বীকার করল ওরা। স্বীকার করল রসদবাহী কাফেলা লুণ্ঠন করার কথা। প্রহরীদের হত্যা করে মেয়েদের ছাড়িয়ে নেয়ার কথাও বলল।

জিজ্ঞাসাবাদ চলল তিন দিন। এর মধ্যে মারইউসের চিন্তাধারা অনেকটা পরিচ্ছন্ন হয়েছে। আলাদা আলাদা ভাবে চলছে ওদের জিজ্ঞাসাবাদ। একবার ও জিজ্ঞেস করল, ‘মেয়েটা কোথায়? ওকে মুসলমান করে সুলতান কি তাকে হারেমে অন্তর্ভূক্ত করেছেন?’

‘আজ সন্ধ্যায় এর জবাব পাবে।’

সন্ধ্যায় মারইউসকে এক দেয়াল ঘেরা চত্বরে নিয়ে যাওয়া হল। ওখানে চাদরে ঢাকা দুটো তক্তপোষ। একদিক থেকে চাদর তুলে ফেলা হল। আতংকে বিবর্ণ হয়ে গেল মারইউসের চেহারা। একটা মুবির অন্যটায় তার সংগী। মৃত। ওদের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন। সালাহউদ্দীন আইয়ুবী বললেন, ‘এদের ক্ষমা করা যায় না। মুসলিম মিল্লাতের কত ক্ষতি করেছে তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।’

‘সুলতান, আমায় কেন ক্ষমা করলেন?’

‘কারণ, তুমি এসেছিলে আমাকে হত্যা করতে। ওরা এসেছে আমার জাতিসত্ত্বাকে ধ্বংস করতে। তোমার সংগী বুঝে সুঝে এ দলের সংগী হয়েছে। হত্যা করেছে অনেক লোক। তুমি শুধু আমাকে মেরেই খোদাকে দেখতে চেয়েছ। ফলে তোমায় আমি ক্ষমা করতে পারলেও ওদের ক্ষমা করার সাধ্য আমার নেই।

কিছুদিন পর। মেগনামা মারইউস এখন সাইফুল্লাহ। তাকে সুলতানের দেহরক্ষীদের অন্তর্ভুক্ত করা হল। ইতিহাসে তার নাম না থাকলেও বাহাউদ্দীন শাদ্দাদের ডায়েরীতে সাইফুল্লার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। আরবী ভাষায় লিখিত এ ডায়েরী আজও অক্ষত আছে।

সাইফুল্লাহ সুলতানকে ভালবাসত প্রাণের চেয়ে বেশী। সুলতানের মৃত্যুর পরও সতের বছর বেঁচেছিল সাইফুল্লাহ। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর মৃত্যুর পর সে ছিল সুলতানের কবরের খাদেম।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কবর ছেড়ে সে যায়নি কোথাও। মরার আগে ওসিয়ত করে গিয়েছিল, মৃত্যুর পর যেন সুলতানের কবরের পাশেই তাকে দাফন করা হয়। সে কবরস্তান আজ কালের প্রবাহে হারিয়ে গেছে, কিন্তু হারিয়ে যায়নি সুলতানের জন্য তার ভালবাসার কাহিনী।

* * *