১. তাঁবুতে ঢুকল প্রথম রক্ষী

ক্রুসেড-১ || গাজী সালাহউদ্দীনের দুঃসাহসিক অভিযান

 জাদুল আসাদির তাঁবুতে বিশ্রাম নিচ্ছেন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। শিরস্ত্রাণ খোলেননি। তাঁবুর বাইরে সশস্ত্র দেহরক্ষীরা পাহারা দিচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য রক্ষীবাহিনীর কমাণ্ডার একটু অন্যদিকে গেলেন। একজন গার্ড পর্দা ঈষৎ ফাঁক করে উঁকি দিল তাঁবুর ভেতর। দু’চোখ বন্ধ করে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন সুলতান। গার্ড বাইরে দাঁড়ানো চারজন সঙ্গীর দিকে তাকাল। চোখ বন্ধ করে খুলল একবার। সে চারজন দেহরক্ষী অন্যদের সাথে গল্প জুড়ে দিল।

তাঁবুতে ঢুকল প্রথম রক্ষী। খঞ্জর হাতে নিল। বিড়ালের মত নিঃশব্দে এগিয়ে গেল ঘুমন্ত সুলতানের দিকে। খঞ্জর বাগিয়ে ধরে হাত উপরে তুলল। আইয়ুবীর বুক লক্ষ্য করে যখন নেমে আসছিল হাত, ঠিক সে মুহূর্তে পাশ ফিরলেন তিনি। রক্ষীর আঘাত গিয়ে পড়ল সালাহউদ্দীন আইয়ুরীর শিরস্ত্রাণে।

বিদ্যুৎ গতিতে দাঁড়িয়ে গেলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। নিমিষেই ঘটনাটা আঁচ করে নিলেন। নিজের বাছাই করা দেহরক্ষী আক্রমণ করছে দেখেও হতবাক হলেন না।

রক্ষী শিরস্ত্রাণের পাশ কেটে মাটিতে গেঁথে যাওয়া খঞ্জর টেনে তুলছিল। পলকে পূর্ণ শক্তিতে রক্ষীর মুখে ঘুসি মারলেন সালাহউদ্দীন। মট করে হাড় ভাংগার শব্দ হল। বিকট শব্দ করে চিৎ হয়ে পরে গেল রক্ষী।

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী রক্ষীর হাত থেকে ছিটকে পড়া খঞ্জর নিজের হাতে তুলে নিলেন। চিৎকার শুনে বাইরে থেকে ছুটে এল দু’জন রক্ষী।

‘ওকে বেঁধে ফেল।’ নির্দেশ দিলেন সুলতান।

কিন্তু ওরা সুলতানের আদেশ অমান্য করে উল্টো আইয়ুবীকেই আক্রমণ করে বসল। একা খঞ্জর দিয়ে দুই রক্ষীর তলোয়ারের মোকাবেলা করতে লাগলেন আইয়ুবী। তাঁবুর ভেতর শুরু হলো আসম এক লোমহর্ষক লড়াই।

দু’এক মিনিটের মধ্যেই অন্য গার্ডরাও ভেতরে প্রবেশ করল। অবাক বিস্ময়ে কয়েক মুহূর্ত তারা তাকিয়ে রইল আউয়ুবী ও রক্ষীদের অসম লড়াইয়ের দিকে। সম্বিত ফিরে এলে একজন এগিয়ে এসে আঘাত করল রক্ষীদের। দেখাদেখি অন্য রক্ষীরাও ঝাঁপিয়ে পড়ল। এবার রক্ষীরা দুই দল হয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করল। আপন পর পার্থক্য করতে না পেরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী।

সংঘর্ষ থেমে গেল। দু’জন নিহত হল এই সংঘর্ষে। আহত হল কয়েকজন, পালিয়ে গেল একজন। তদন্ত শেষে দেখা গেল দেহরক্ষীদের সাতজন ছিল ঘাতক দলের সদস্য। গুমাস্তিগীন নামে খলিফা সালেহের এক কেল্লাধিপতি আইয়ুবীকে হত্যার জন্য এদের নিয়োগ করেছিল।

সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে হত্যা করার এ ধরনের কয়েকটি প্রচেষ্টা পরপর ব্যর্থ হল। এ হত্যা পরিকল্পনার হোতা ছিল সাইফুদ্দীন। সাইফুদ্দীন ছিল সালাহউদ্দীনের চাচাতো ভাই খলিফা আস সালেহের একজন আমীর। যে সময়ের কথা বলছি, তখন মুসলিম বিশ্বের প্রধান হলেও কার্যত ইসলামী দুনিয়া ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত। বিভিন্ন প্রদেশের গভর্ণরগণ সুলতান উপাধি ধারণ করে বলতে গেলে স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতো। এ ঘনটার পর একদিন ভোরে সাইফুনদ্দীনকে লক্ষ্য করে একটি চিঠি পাঠালেন সালাহউদ্দীন আইয়ুরী। তাতে তিনি লিখলেন,

“খাঁচায় বন্দী পাখীর মাঝে তুমি চিত্তপ্রসাদ খোঁজ, নারী আর মদের মাঝে খোঁজ জীবনের মানে, কিন্তু জাননা সৈনিকের জীবন মানেই এক বিপজ্জনক খেলা।’

চিঠিটি লিখেছিলেন তিনি ১১৭৫ সালের এপ্রিল মাসে। খলিফা সালেহ এবং সাইফুদ্দীন খৃস্টানদের সহযোগিতায় আইয়ুরীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলো। পরাজিত হয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গেল সাইফুদ্দীন। তার তাঁবুতে পাওয়া গেল অগণিত সম্পদ। পাওয়া গেল খাঁচায় বন্ধী রঙবেরঙের পাখী, এক ঝাঁক সুন্দরী তরুণী, নর্তকী, গায়িকা। বিভিন্ন প্রকার বাদ্যযন্ত্র আর পিপা ভর্তি মদ।

সালাহউদ্দীন খাঁচায় দুয়ার খুলে দিলেন, পাখীরা উড়ে গেল উন্মুক্ত আকাশে। নর্তকী, গায়িকা আর তরুণীদের মুক্ত করে দিলেন। চিঠি লিখলেন আমীর সাইফুদ্দীনের কাছে,

‘তোমরা বেঈমানী করে খৃস্টানদের সহযোগিতায় আমাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছ। একবারও কি ভেবেছ, তোমাদের এ ষড়যন্ত্র ইসলামী বিশ্বের মানচিত্র মুছে দিতে পারে? যদি আমাকেই ঈর্ষা কর, যদি আমিই তোমাদের শত্রু হয়ে থাকি, মেরে ফেল আমায়। দু’বার সে চেষ্টাও করেছ। সফল হওনি, আবার না হয় চেষ্টা করে দেখ। এবার সফল হলে হতেও পার।

যদি নিশ্চয়তা দিতে পারো, আমাকে হত্যা করলে ইসলাম আরো গৌরবোজ্জ্বল হবে, তবে আমার মাথা কেটে তোমাদের পায়ের কাছে রেখে দিতে বলব। মনে রোখো, অমুসলিম কখনো মুসলমানের বন্ধু হতে পারেনা। ইতিহাস এর সাক্ষী। ফ্রান্স সম্রাট এবং রিমাণ্ডের মত খৃস্টানকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সহযোগিতা করছ বলে তোমরা ওদের বন্ধু। ওরা সফল হলে ওদের প্রথম শিকার হবে তোমরাই। এরপর পৃথিবীর বুক থেকে ইসলামের নামও মুছে যাবে।

তোমরা যোদ্ধা জাতির সন্তান। সৈন্য হওয়া তোমাদের জাতীয় পেশা। প্রতিটি মুসলমানই আল্লাহর সৈনিক। তার জন্য শর্ত কেবল ঈমান ও সৎ কাজ। খাঁচায় বন্দী পাখীর মাঝে তুমি চিত্তপ্রসাদ খোঁজ, নারী আর মদের মাঝে খোঁজ জীবনের মানে, কিন্তু জাননা সৈনিকের জীবন মানেই এক বিপজ্জনক খেলা। অনুরোধ করি, আমার সাথে সহযোগিতা কর। জিহাদে শরীক হও, না হলে কমপক্ষে বিরোধিতা করো না। আমি তোমাদের কোন শাস্তি দেবনা। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন।’

-সালাহউদ্দীন আইয়ুবী।

এ সব যুদ্ধের ফলে অজস্র যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর হাতে এসেছিল। বন্দীর সংখ্যা ছিল অগণিত। তিনি যুদ্ধলব্ধ সম্পদকে তিন ভাগে ভাগ করলেন। এক ভাগ যুদ্ধবন্দীদের দিয়ে তাদের মুক্ত করে দিলেন। এক ভাগ দিলেন সৈন্য এবং গরীবদের। তৃতীয় ভাগ পাঠিয়ে দিলেন নিজমুল মুলক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেই তিনি শিক্ষা লাভ করেছিলেন। নিজের জন্য এবং জেনারেলদের জন্য কিছুই রাখেননি। বন্দীদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান। কিছু অমুসলিমও ছিল, আইয়ুবীর মহানুভবতায় ওরা তার আনুগত্য গ্রহণ করে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়ে গেল।

ইবনে সাবার ফেদাই গ্রুপ দু’বার সালাহউদ্দীনকে হত্যা করার জন্য আক্রমণ করেছিল। ফেদাইদেরকে ঐতিহাসিকগণ ঘাতক দল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দু’দু’বারই তিনি অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন। তৃতীয় আক্রমণ হল খৃস্টান এবং সাইফুদ্দীনের সম্মিলিত শক্তিকে পরাজিত করার পর। সাইফুদ্দীন পালিয়ে গুপ্তঘাতক দলের সাহায্য কামনা করল।

সালাহউদ্দীনের প্রায় একশো বছর আগে হাসান ইবনে সাবা ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন উপদলের জন্ম দিয়েছিল। নিজেদের পরিচয় দিত মুসলমান হিসেবে। কিছু অলৌকিক কাজ দেখিয়ে মানুষকে অনুসারী বানাতো। সুন্দরী তরুণী, মদ, হিপটোনিজম এবং চাটুকারিতা ছিল ওদের পুঁজি। বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য ছিল বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ঘাতক দল। ওরা মানুষকে হত্যা করত গোপনে।

এরা ছিল সতর্ক, বুদ্ধিদীপ্ত এবং দুঃসাহসী। এরা পোশাক আশাক এবং ভাষা পরিবর্তন করে বড় বড় জেনারেলের দেহরক্ষীর চাকরী নিত। সময় সুযোগ বুঝে এমন ভাবে সারত হত্যার কাজ, নিহত ব্যক্তির হত্যাকারীকে কোনভাবেই খুঁজে পাওয়া যেতনা। ধীরে ধীরে ইবনে সাবার দল ঘাতকদল হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠল। রাজনৈতিক হত্যাকান্ডে ওরা ছিল পারদর্শী, অধিকাংশ ক্ষেত্রে হত্যার কাজে ব্যবহার করত বিষ। সুন্দরী যুবতীরা মদের সাথে এ বিষ মিশিয়ে দিত।

সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে রূপসী নারী দিয়ে বা মদ খাইয়ে হত্যা করা সম্ভব ছিল না। তিনি এ দুটো থেকেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতেন সতর্কভাবে। ফলে আকস্মিক আক্রমণ ছাড়া তাকে হত্যা করার অন্য কোন পথ ছিল না। কিন্তু বিশ্বস্ত ও নিবেদিত প্রাণ দেহরক্ষীদের উপস্থিতিতে তাও ছিল অসম্ভব। সালাহউদ্দীন ভেবেছিলেন পরাজয়ের পর সালেহ এবং সাইফুদ্দীন আর মাথা তুলে দাঁড়াবে না। সম্মিলিত বাহিনীল অহমিকা চুর্ণ হবার পর আইয়ুবীর সাথে টক্কর দেওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে সংশোধন হয়ে যাবে। কিন্তু প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নতুন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল ওরা।

বিজয়ের পর সালাহউদ্দীন আইয়ুবী তার অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখলেন। দখল করলেন গাজাসহ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।

সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী- দুঃসাহসী এক যোদ্ধা, অসাধারণ এক সেনাপতি। ইসলামের শত্রুরা আজো তাকে সম্বোধন করে ‘গ্রেট সালাদীন’ বলে, মুসলমনরা স্মরণ করে জাতীয় বীর হিসাবে।

মুসলিম মিল্লাতের ইতিহাসের পাতায় সোনার হরফে লেখা রয়েছে তার নাম। খৃস্টান জগৎ তার সাহস, বুদ্ধিমত্তা আর রণকৌশলৈর কথা কোনদিন ভুলতে পারবেনা। ইতিহাসের পাতায় ছড়িয়ে আছে তার জয় পরাজয়ের বিস্ময়কর কাহিনী। কিন্তু ক্রুশের ধ্বজাধারীরা মদ আর রূপের মায়াজালে যে ষড়যন্ত্রের বিস্তার ঘটিয়েছিল, নিজেদের সে সব অপকর্মের চমকপ্রদ কাহিনী ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দিতে চেষ্টার কোন ক্রুটি করেনি।

১১৬৯ সালের ২৩ মার্চ। মিসরের গভর্ণর এবং সেনাবাহিনী প্রধান হয়ে এলেন সালাহউদ্দীন। তিনি ছিলেন রাজ পরিবারের সন্তান। অল্প বয়সেই যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মনে করতেন শাসক রাজা নয়, শাসক হলো ইসলামের রক্ষক। বুদ্ধি হওয়ার পর তিনি দেখেছিলেন মুসলিম শাসকদের অনৈক্য। বিলাসপ্রিয় শাসকবর্গ সুন্দরী রমণী আর মদে আকণ্ঠ ডুবেছিল। গাদ্দারী, বিলাসিতা আর অবিশ্বাসের কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছিল মুসলিম মিল্লাতের ভবিষ্যত।

রাষ্ট্রের কর্ণধারদের হারেমের শোভা বর্ধন করছিল ইহুদী আর খৃস্টান যুবতীরা। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব সুন্দরী রমনীদের রূপের আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছিল মানুষের ইসলামী জোশ আর স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বার আবেগ অনুভূতি।

এ সুযোগে খৃস্টান শাসকগণ একের পর এক ছোট ছোট মুসলিম রাজ্যগুলো দখল করে নিচ্ছিল। মুসলিম শাসকবর্গ প্রজার রক্ত শুষে খৃষ্টানদেরকে বাৎসরিক কর প্রদান করত। ওদের সেনা শক্তির ভয়ে সর্বক্ষণ তটস্ত হয়ে থাকত। খৃস্টানরা মুসলমানদেরকে ভোগবিলাসের হারেমে বন্দী রেখে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব দখলের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলছিল।

সালাহউদ্দীন শিক্ষা লাভ করেছিলেন নিজাম-উল-মুলক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে শিক্ষার্থীদেরকে খালেছ ইসলামী আদর্শে গড়ে তোলার ব্যবস্থা ছিল। আর সে জন্যই ঘাতকদলের প্রথম শিকার ছিলেন নিজাম-উল-মুলক। রোমানদের রাজ্যবিস্তারে তিনি ছিলেন বড় বাঁধা। এ বাঁধা দূর করার জন্য তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

সালাহউদ্দীন এখানেই সেনা প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। প্রশাসনিক কাজে তাকে যোগ্য করে গড়ে তুলেছিলেন নুরুদ্দীন জংগী। মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার সকল গুণাবলী এখানেই অর্জন করেছিলেন তিনি। সালাহউদ্দীন আইয়ুবী গোয়েন্দা বৃত্তি, কমাণ্ডো অভিযান এবং গেরিলা অপারেশনকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতেন। তিনি দেখেছিলেন গুপ্তচর বৃত্তিতে খৃস্টান জগৎ অনেক অগ্রসর। মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা আর সাংস্কৃতিক অংগন ছিল ওদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। সালাহউদ্দীন অত্যন্ত ধৈর্য এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে এর মোকাবিলা করেছিলেন।

তিনি মিসরের গভর্ণর ও সেনাবাহিনী প্রধান হয়ে এলে শুরু হল ষড়যন্ত্র। বড় বড় জেনারেলরা এ পদের জন্য ছিল লালায়িত। তারা যখন দেখল তাদের আশায় গুড়ে বালি, তখনা ক্ষুব্ধ জেনারেলগণ ষড়যন্ত্র শুরু করল তার বিরুদ্ধে।

ওদের ধারনায় সালাহউদ্দীন একজন বালকমাত্র। এ পদের যোগ্যতা তার মধ্যে নেই। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে জেনারেলদের সে ধারণা ভেঙে গেল। সালাহউদ্দীন কঠোর নিয়ম শৃংখলা মেনে চলতেন। সৈন্যদের জন্য ভোগবিলাস এবং মদ নিষিদ্ধ করলেন। মনোনিবেশ করলেন ওদের শারীরিক, মানসিক এবং নৈতিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে। ফলে অল্প দিনেই সেনাবাহিনী সুশৃংখল ও সুসংগঠিত হয়ে উঠল। অল্পবয়স্ক অর্বাচীন বালক বলে তাকে যারা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখছিল, টনক নড়ে উঠল তাদের।

সালাহউদ্দীন খৃষ্টান শক্তির মোকাবিলার জন্য একটি শক্তিশালী সেনা বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। মুক্ত ফিলিস্তিনে শ্বাস নেয়ার দুর্গম আকাঙ্খা নিয়ে সেনাবাহিনীকে সে ভাবে গড়ে তুলতে লাগলেন তিনি। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘যে খোদা আমাকে মিসরের গভর্নর করেছেন, অবশ্যই তিনি ফিলিস্তিনও মুক্ত করবেন।’ তার এ ঘোষণার জন্য কেবল খৃস্টানই নয়, খৃস্টানপন্থী মুসলমান আমীর ওমরারাও তার শত্রু হয়ে দাঁড়াল। বাইরের শত্রুর চাইতে ঘরের শত্রুরা হয়ে উঠল তার জন্য অধিকতর বিপজ্জনক।

নতুন গভর্নরের অভ্যর্থনার আয়োজন করা হল। আয়োজন করলেন জেনারেল নাজি। পঞ্চাশ হাজার ফৌজের অধিনায়ক তিনি। অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী ছাড়াও বেসামরিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত। মুচকি হেসে একে একে সকলের সাথে করমর্দন করলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। কণ্ঠে স্নেহ-ভালবাসার উষ্ণ পরশ। কোন কোন অফিসারের ঠোঁটে কুটিল হাসি। দৃষ্টিতে ঘৃণা আর উপহাস। ওদের ধারনা, নুরুদ্দীন জংগীর সাথে সুসম্পর্ক এবং রাজপরিবারের সন্তান বলেই সালাহউদ্দীন গভর্নর হতে পেরেছেন। এক প্রবীণ অফিসার আরেকজনের কানে কানে বলল, ‘এখনো শিশু, আমরা পেলে পুষে নেব।’

অনুষ্ঠানে তাকে শিশুই মনে হচ্ছিল। জেনারেল নাজির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন আইয়ুবী। কপাল কুঞ্চিত হল ঈষৎ। করমর্দনের জন্য হাত প্রসারিত করলেন। নাজি তোষামুদে দরবারীদের মত সালাহউদ্দীনকে কুর্নিশ করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমো খেয়ে বললেন, ‘আপনার জীবন রক্ষার্থে আমার দেহের শেষ রক্তবিন্দুটুকুও বিলিয়ে দেব। আপনি আমাদের কাছে মাননীয় জংগীর আমানত।’

‘ইসলামের চাইতে আমার জীবনের দাম বেশী নয় সম্মানিত জেনারেল।’ আইয়ুবী বললেন, ‘প্রতিটি ফোঁটা রক্ত সংরক্ষণ করে রাখুন। খৃষ্টান ষড়যন্ত্রের ঘনঘটা মুসলিম বিশ্বের আকাশে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।’

জবাবে মৃদু হাসলেন নাজি। যেন তাকে রূপ কথার গল্প শোনানো হচ্ছে। নাজি ছিল ফাতেমী খেলাফতের সিপাহসালার। পঞ্চাশ হাজার ফৌজের অধিনায়ক। সৈন্যদের সবাই ছিল সুদানের অধিবাসী। তার বাহিনী ছিল আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত। বলতে গেলে এরা ছিল নাজির ব্যক্তিগত সৈন্য। নাজি ছিল মুকুটহীন সম্রাট।

তখন মুসলিম দেশগুলোর কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল না। একে অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতো। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করছিল খৃস্টান জগৎ। মিসর এবং আশপাশের শাসকদের জন্য নাজি ছিল এক ত্রাস। তার মস্তিষ্ক ছিল ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রভূমি। ভেড়া দেখলে নেকড়ের যেমন দাঁত বেরিয়ে আসে, সালাহউদ্দীনকে দেখে নাজিরও তেমনি দাঁত বেরিয়ে এসেছিল। আইয়ুবী তার এ ক্রুর হাসির মর্ম না বুঝলেও এটা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, এ শক্তিধর জেনারেলকে তার প্রয়োজন।

‘হুজুর অনেক দূর থেকে এসেছেন। খানিক বিশ্রাম করে নিন।’ নাজি বলল।

‘যে কঠিন দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছে, আমি তার যোগ্য নই। এ দায়িত্বভার আমার বিশ্রাম এবং নিদ্রা কেড়ে নিয়েছে। প্রথমে অফিসে গেলেই কি ভাল হয় না?’

‘হুজুর কি আগে খেয়ে নেবেন?’ বলল একজন অফিসার।

একটু ভেবে ওদের সাথে হাঁটা দিলেন আইয়ুবী। দু’সারিতে দাঁড়িয়ে আছে সশস্ত্র গার্ডবাহিনী। ওদের হাতের অস্ত্র এবং পেশীবহুল বলিষ্ঠ দেহ দেখে তার চেহারায় হেসে উঠল আনন্দের দ্যুতি। দরজার কাছে পৌঁছতেই চেহারায় এ আলো হঠাৎ নিভে গেল। তার বদলে হতাশার আঁধার এসে গ্রাস করল তাকে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে চারজন রূপসী তরুণী। তাদের পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে আছে রেশম কোমল চুল। পরনে পাতলা পোশাক। হাতে ফুলের ঝুড়ি। সালাহউদ্দীনের পথে ওরা ফুল ছুঁড়তে লাগল। সাথে সাথে বেজে উঠল দফ ও রবাবের সুর ঝংকার।

থমকে দাঁড়ালেন আইয়ুবী। ডানে বাঁয়ে নাজি এবং তার সহকারীরা। ভারতীয় রাজরাজড়াদের মত ওরা নুয়ে তাকে সামনে চলার জন্য অনুরোধ করল।

‘সালাহউদ্দীন ফুল মাড়ানোর জন্য আসেনি।’ গমগম করে উঠল আইয়ুবীর কণ্ঠ। ঠোঁটে শ্লেষের হাসি। যে হাসি দেখতে ওরা অভ্যস্ত নয়। ‘হুজুর চাইলে আমরা আকাশের তারা এনে দিতে পারি’ নাজি বলল।

‘আমাকে খুশী করতে হলে একটা জিনিসই আমার পথে ছড়ানো যেতে পারে। খৃস্টানদের লাশ।’ মৃদু হেসে বললেন সালাহউদ্দীন।

ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল অফিসারের।

মুহূর্তে বদলে গেল সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর চেহারা। দু চোক থেকে ঠিকরে বেরোতে লাগল আগুনের হলকা। বললেন, মুসলমানদের জীবন ফুলশয্যা নয়। আপনারা কি জানেন না খৃস্টানরা মুসলিম বিশ্বকে ইঁদুরের মত কেটে টুকরো টুকরো করে চলছে?’

তার গম্ভীর কণ্ঠের ধ্বনি বদলে দিল ঘরের পরিবেশ। প্রতিটি শব্দ থেকে বিস্ফোরিত হচ্ছিল প্রচণ্ড ক্রোধ। ‘আমাদের মেয়েদের উলংগ করে ওদের ইজ্জত পদদলিত করেছি বলেই আজ আমরা ফুল মাড়াতে পারছি। শুনুন, আমার দৃষ্টি আটকে আছে ফিসিস্তিনে। আপনারা কি আমার পথে ফুল বিছিয়ে মিশর থেকে ইসলামকে বিদায় করতে চাইছেন?’

তিনি চারদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বললেন, ‘আমার পথ থেকে ফুল সরিয়ে নাও। এ ফুলে পা পড়লে আমার হৃদয় কাঁটার ঝাঁঝরা হয়ে যাবে। সরিয়ে দাও মেয়েদের। আমি চাইনা ওদের সোনালী চুলে জড়িয়ে গিয়ে আমার তরবারী গতি হারিয়ে ফেলুক।

‘হুজুরের ইজ্জত সম্মান…।’

আমাকে আর কখনো হুজুর বলবে না।’ ঝাঁঝের সাথে বললেন তিনি। মনে হল শব্দের তীব্র আঘাতে ওদের দেহ থেকে মাথা আলাদা করে দেয়া হয়েছে। ‘তোমরা যার কালেমা পড়েছ হুজুরতো তিনি। আমি তাঁর দাসানুদাস মাত্র। সে হুজুরের জন্য আমার জীবন নিঃশেষে বিলিয়ে দিতে চাই। তার পয়গাম আমার বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছি। খৃস্টান জগৎ ওই পয়গাম ছিনিয়ে নিয়ে রোম উপসাগরে ডুবিয়ে দিতে চাইছে। ডুবিয়ে দিতে চাইছে মদের দরিয়ায়। আমি বাদশা হয়ে এখানে আসিনি।’ নাজির চোখের ইশারায় মেয়েরা ফুল কুড়িয়ে দরজা থেকে সরে গেল। দ্রুতপায়ে ভেতরে ঢুকলেন সালাহউদ্দীন। প্রশস্ত কক্ষ। ফুল দিয়ে সাজানো বিশাল টেবিল। টেবিলে নানা রকম সুস্বাদু খাবার।

খাবারে দৃষ্টি বুলিয়ে তিনি তাকালেন সহকারী সালারের দিকে।

‘মিসরের সব মানুষ কি এমন খাবার খেতে পারে?’

‘না হুজুর’। সহকারীর জবাব, ‘গরীবরা তো এসব খাবার স্বপ্নেও দেখেনা।’

‘তোমরা কোন সমাজের লোক? যারা এমন খাবার স্বপ্নেও দেখেনা ওরা কি তোমাদের চেয়ে ভিন্ন জাতি?’

সকলেই নির্বাক।

‘এখানে যত চাকর-বাকর এবং ডিউটিরত সেপাই রয়েছে সবাইকে ডেকে নিয়ে এসো। এ খাবার ওরা খাবে।’

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী একটা রুটির সাথে ক’টুকরা তরকারী তুলে তড়িঘড়ি খাওয়া শেষ করলেন। এরপর নাজিকে সাথে নিয়ে হাঁটা দিলেন গভর্নর হাউসের দিকে।

দু’ঘন্টা পর। গভর্নর হাউস থেকে বেরিয়ে এল নাজি। দ্রুত এগিয়ে গেল ঘোড়ার দিকে। এক লাফে ঘোড়ায় চড়ে দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল।

রাত নেমেছে। নাজি খাস কামরায় কয়েকজন বিশ্বস্ত বন্ধুকে নিয়ে মদের আসর বসিয়েছে। নাজি বলল, ‘যৌবনের তেজ কয়েক দিনের মধ্যেই ঠাণ্ডা করে দেব। কমবখত বলল কি জান? বলল, কাবার প্রভুর শপথ! মুসলিম বিশ্ব থেকে খৃস্টানদের বিতাড়িত করে তবে আমি বিশ্রাম নেব।’

‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবী? হুহ্!’ সহকারী সালারের কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর। ‘ইসলামী রাষ্ট্রের দম ফুরিয়ে গেছে সে এ খবরও জানেনা। এখনতো সুদানীরা দেশ চালাবে।’

অন্য এক কমাণ্ডার প্রশ্ন করল, ‘পঞ্চাশ হাজার ফৌজের সবাই সুদানী একথা তাকে বলেননি। বলেননি যে ওরা আপনার নির্দেশে খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না?’

‘তোমার কি মাথা খারাপ এডরোস? আমি বরং তাকে নিশ্চয়তা দিয়েছি। বলেছি আপনারা ইশারা পেলে আমার সৈন্যরা খৃষ্টানদের ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। কিন্তু…’ থেমে গেল নাজি।

‘কিন্তু কি?’

‘মিসরের লোকদেরকে ফৌজে ভর্তি করার জন্য সে আমাকে নির্দেশ দিয়েছে। কারণ ফৌজ এক এলাকার থাকা নাকি উচিৎ নয়। সে মিসরের লোকদেরকে আমার সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে।’

‘আপনি কি বললেন?’

‘বলেছি আপনার নির্দেশ পালন করা হবে। কিন্তু আমি তা করব না।’

‘তার মনমানসিকতা কেমন বুঝলেন?’

‘একরোখা জেদী।’

‘আপনার বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতার সামনে সে এখনো শিশু। নতুন গভর্নর হয়ে এলো তো! কদিন পরই পদের নেশায় পেয়ে বসবে।’

‘আমি তার এ নেশা দূর করবো না। নেশায় নেশায় তাকে নিঃশেষ করব।’

ওরা অনেকক্ষণ ধরে আইয়ুবীকে নিয়ে কথা বলল। নতুন গভর্নর এই মুকুটহীন সম্রাটের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালে কি পদক্ষেপ নেয় হবে তাও আলোচিত হল।

অন্যদিকে আইয়ুবী তার সহকারীদের বলছিলেন, ‘আমি এখানে রাজা হয়ে আসিনি। কাউকে রাজত্ব করতেও দেবো না।’ তিনি আরো বললেন, ‘আমাদের সামরিক শক্তির প্রয়োজন। এখানকার সেনাবাহিনীর গঠন পদ্ধতি আমার পছন্দ নয়। পঞ্চাশ হাজার ফৌজের সবাই সুদানী। অথচ সব এলাকার লোকেরই সৈন্য হবার অধিকার আছে। এভাবে ওদের জীবনের মানও উন্নত হতে পারে। সব এলাকা থেকে সেনাবাহিনীতে লোক ভর্তি করার জন্য আমি নাজিকে বলে দিয়েছি।

‘নাজি কি আপনার নির্দেশ পালন করবে?’ একজন সহকারী প্রশ্ন করল।

‘কেন, সে কি আমার হুকুম অমান্য করবে নাকি?’

‘করতেও পারে। ফৌজের সর্বময় কর্তা তিনি। তিনি কারো নির্দেশ পালন করেন না, বরং অন্যকে তার নির্দেশ পালনে বাধ্য করেন।’

এ কথায় সালাহউদ্দীন একটু নীরব রইলেন। তবে তার চেহারায় কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। তিনি কি ভাবছেন তা বুঝে উঠার আগেই আলী বিন সুফিয়ানকে রেখে অন্যদের বিদায় জানালেন তিনি।

আলী মধ্য বয়সী এক চৌকস গোয়েন্দা লিডার। কুশলী, সাহসী এবং অসম্ভব বাকপটু। গুপ্তচর বৃত্তির জন্য সে বিশ্বস্তক ও নিবেদিতপ্রাণ কিছু লোককে ট্রেনিং দিয়ে পারদর্শী করে তুলেছে। তাদের নিয়ে গড়ে তুলেছে নিজস্ব গোয়েন্দা দল। আকাশ থেকে তারকা ছিনিয়ে আনতে বললেও যারা পিছপা হবে না। চিন্তা চেতনার দিক থেকে সে ছিল আইয়ুবীর সমমনা। সালাউদ্দীন তাকে বাগদাদ থেকে সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন।

‘শুনলাম তো। চিনতে ভুল না করলে বলব, লোকটি ধুরন্ধর ও বড় ধরনের ক্রিমিনাল। তার ব্যাপারে আগে থেকেও আমি কিছুটা জানি। জনগণের টাকায় লালিত সেনাবাহিনী এখন তার নিজস্ব ফৌজ। তার ষড়যন্ত্রের ফলে প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে। ‘সব এলাকার লোকই সেনাবাহিনীতে ভর্তি করার প্রয়োজন’ আপনার এ সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী এবং সঠিক হয়েছে। আমার তো আশংকা হচ্ছে সুদানী সৈন্যরা প্রয়োজনের সময় আপনার হুকুম অমান্য করে তারই অনুগত্য করবে। বলা যায়না, ফৌজের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি পরিবর্তন করে নাজিকে আপনার অপসারণও করতে হতে পারে।

‘না, নাজির মত প্রভাবশালী ব্যক্তিকে এখনই বিরূপ করতে চাই না। এ মুহূর্তে তাকে অপসারণ করা ঠিক হবে না। নিজেদের রক্ত ঝরানোর জন্য আমি অস্ত্র হাতে নেইনি, আমাদের তরবারী শত্রুর জন্য। আমি আগে ভালবাসা দিয়ে তাকে পরিবর্তন করতে চেষ্টা করব। তুমি বর্তমান সেনাবাহিনী আমাদের কদ্দুর কাজে আসবে তা-ই বোঝার চেষ্টা কর।’

‘আপনার ভালবাসা তাকে শুধরাতে পারবে বলে মনে হয় না’।

সালাহউদ্দীন যা ভেবেছিলেন নাজি ততোটা সহজ ছিল না। ভালবাসা শব্দটি তার অভিধানে ছিল না। তার সব প্রীতি এবং মমতা ছিল ক্ষমতার সাথে। ক্ষমতার প্রশ্নে সে ছিল অত্যন্ত কঠোর। মানুষ হিসাবে ছিল অসম্ভব ধূর্ত। ষড়যন্ত্র ছিল তার হাতিয়ার। কাউকে ফাঁসাতে চাইলে তার সাথে মোমের মত কোমল ব্যবহার করত। আইয়ুবীর সাথে তার ব্যবহার ছিল অনুগত দাসানুদাসের মত। তার সামনে সে কখনো বসত না। আইয়ুবীর প্রতিটি কথায় জি-হুজুরীর ভূমিকা পালন করত।

নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে সে মিসরের সকল অঞ্চল থেকেই সেনা ভর্তি শুরু করে দিয়েছিল। সময় এগিয়ে যাচ্ছে। আইয়ুবীও তাকে একটু একটু পছন্দ করা শুরু করেছেন। নাজি তাকে আশ্বাস দিয়েছিল, সেনাবাহিনী আপনার নির্দেশের অপেক্ষায়। ফৌজের পক্ষ থেকে নতুন গভর্নরকে ‘গার্ড অব অনার’ দেয়ার প্রস্তাবও দিল সে। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে তিনি তার এ আমন্ত্রণ মুলতবী রাখলেন।

রাত নেমেছে। নিজের কক্ষে দু’জন কমাণ্ডার নিয়ে মদ পান করছিল নাজি। মৃদু লয়ে বাজছে সংগীতের সুর মুর্ছনা। তালে তালে নাচছে দু’জন নর্তকী। পায়ে নুপুর নেই। বে আব্রু দেহের ভাঁজে ভাঁজে মাদকতা। প্রহরী ভেতরে এসে নাজির কানে কানে কি যেন বলল।

মদির আবেশে মত্ত নাজির আনন্দে বিঘ্ন ঘটাবার সাহস কারো ছিল না। কিন্তু এ আসর থেকে তাকে কোন সময় তুলে নেয়া যায়’ প্রহরী তা জানত।

উঠে দাঁড়ালেন নাজি। প্রহরী তাকে একটি কক্ষে নিয়ে গেল। সুদানী পোশাক পরে একজন লোক বসে আছে। সাথে এক যুবতী।

নাজিকে দেখে দু’জন উঠে দাঁড়াল। যুবতীর রূপ মাধুর্য দেখে নাজি খানিক হতভম্বের মত তাকিয়ে রইল। সে নারী শিকারী। শুধু ভোগের জন্যই নয়, বড় বড় অফিসারদের ব্লাকমেল অথবা তাদেরকে হাতে রাখার জন্যও সুন্দরী যুবতীদের ব্যবহার করত নাজি। কসাই যেমন পশু দেখলে গোশত পরিমাণ করতে পারে, সেও প্রথম দেখাতেই বুঝত কাকে দিয়ে কোন কাজ করানো যাবে। নারী ব্যবসায়ীরা প্রায়শই তার কাছে মেয়ে নিয়ে আসত।

বিক্রেতা যুবতীর ব্যাপারে বলল, ‘দারুণ স্মার্ট। নাচতে পারে, গাইতে পারে, মুখের মধুতে পাথরও গলিয়ে দিতে পারে।’

নাজি ওর ইন্টারভিউ নিয়ে চমৎকৃত হল। ভাবল, একটু তৈরী করে নিলে যে কোন কাজেই ব্যবহার করা যাবে।

দাম দস্তুর শেষে টাকা নিয়ে চলে গেল লোকটি। নাজি ওকে নিয়ে চলে এল জলসা ঘরে। নাচতে বলল তরুণীকে। দেহের বাড়তি কাপড় ফেলে দিয়ে দু’পাক ঘুরতেই হা হয়ে গেল তিন দর্শক। ফ্যাকাশে হয়ে গেল আগের দু’নর্তকীর চেহারা। নতুন মেয়েটার সামনে ওরা এখন মূল্যহীন বাসি ফুল।

আসর ভেঙে দিল নাজি। নতুন মেয়েটাকে রেখে সকলকে বিদায় করে দিল।

‘নাম কি সুন্দরী?’

‘আমার নাম জুলি’।

‘তোমাকে যে দিয়ে গেল সে বলেছে, তুমি নাকি পাথর গলাতে পার। আমি তোমার সে যোগ্যতা যাচাই করতে চাই। ‘

‘কে সে পাথর?’

‘মিসরের নতুন গভর্নর। যিনি একই সাথে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কও।’

‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবী?’

‘হ্যাঁ, যদি তাকে বশে আনতে পার তবে তার ওজন সমান সোনা তোমার পুরস্কার।’

‘তিনি কি মদ পান করেন?’

‘না, মুসলমান শূকরকে যেমন ঘৃণা করে, সে মদ, নারী, নাচ, গান এবং ভোগবিলাশকে তেমনি ঘৃণা করে।’

‘শুনেছি আপনার কাছে এমন সব যুবতী রয়েছে যাদের দেহের যাদু নীল নদের স্রোতকেও রুদ্ধ করে দিতে পারে। ওরা কি ব্যর্থ?’

‘এখনো পরীক্ষা করে দেখিনি। আমার বিশ্বাস তুমি এ কাজ করতে পারবে। সালাহউদ্দীনের বিশ্বাস এবং চরিত্র সম্পর্কে আমি তোমাকে বিস্তারিত বলবো।’

‘তাকে কি বিষ খাওয়াতে হবে?’

‘এখন নয়। তার সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। আমি চাই সে তোমার মত রূপসীর আঁচলে বাঁধা পড়ুক। এরপর তাকে আমার পাশে বসিয়ে মদ খাওয়াব। মারতে চাইলে তোমার প্রয়োজন নেই, ঘাতক দলকে দিয়ে সহজেই তা করানো যায়।’

‘তার মানে আপনি দুশমনি নয় বন্ধুত্ব চাইছেন?’

জুকির বুদ্ধিমত্তায় নাজি কতক্ষণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

‘হ্যাঁ জুকি।’

ওর রেশম কোমল চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল নাজি, ‘আমি তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই। এমন বন্ধুত্ব, যেন সে আমার কথায় উঠে এবং বসে। এর পর কি করতে হবে তা আমি জানি।’ থামল নাজি।

একটু ভেবে নিয়ে আবার বলল, ‘একটা কথা তোমাকে বলা প্রয়োজন। সালাহউদ্দীনের হাতেও একটা চাল আছে। তোমার রূপ যৌবনের ওপর তার চাল বিজয়ী হলে তুমি বাঁচতে পারবে না। সালাহউদ্দীনও তোমায় বাঁচাতে পারবে না। তোমার জীবন আমার হাতে। এ জন্যই তোমার সাথে এত খোলামেলা কথা বলছি। নইলে আমার মত জেনারেল তোমার মত এক গনিকার সাথে এভাবে আলাপ করত না।’

‘অনাগত ভবিষ্যত বলে দেবে কে ধোঁকা দেয়। এবার বলুন তার কাছে আমি পৌঁছব কিভাবে?’

‘আমি তার সম্মানে এক সংবর্ধনার আয়োজন করতে যাচ্ছি। রাতে তার শয়ন কক্ষে তোমায় ঢুকিয়ে দেব।’

‘ঠিক আছে, এর পরের কাজ হবে আমার।’

সে রাতের পর আরও ক’টা রাত চলে গেছে। প্রশাসনিক কাজ এবং নতুন সৈন্য ভর্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আইয়ুবী নাজির নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারেননি। এর মধ্যেই নাজি সম্পর্কে আলী বিন সুফিয়ানের আরো রিপোর্ট পাওয়া গেল। আলীর সে রিপোর্ট পেয়ে সালাহউদ্দীন চিন্তিত হয়ে উঠলেন।

‘আলী! এর অর্থ হল সে খৃষ্টানদের চাইতেও বিপদজনক।’

‘লোকটা মিসরের পোশাকের ভেতর লুকিয়ে থাকা বিষাক্ত সাপ। প্রশাসনের অনেক বড় বড় লোক তার হাতে। সেনাবাহিনীও আমাদের নয় বরং অন্যের অনুগত। এ ব্যপারে কি করা যায় কিছু ভেবেছেন?’

‘শুধু ভাবিনি, কাজও শুরু করে দিয়েছি। সুদানী সৈন্যদেরকে নতুন সৈন্যদের সাথে একীভূত করে দেব। এখন এরা না হবে সুদানের, না মিসরের। এপর নাজিকে সোজা পথে নিয়ে আসা যাবে।’

‘আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, সে খৃষ্টানদের সাথে নিজের ভবিষ্যত জুড়ে দিয়েছে। মুসলিম বিশ্বকে এক কেন্দ্রের আওতায় এনে আপনি মুসলিমদের শক্তি বৃদ্ধি করতে চাইছেন। কিন্তু নাজি আপনার ও ইচ্ছেকে পাগলামী মনে করে।’

‘তুমি কি করছ?’

‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তার চারপাশে আমি গুপ্তচরের প্রাচীর তৈরী করে দিয়েছি। মনে করুণ সে এখন গোয়েন্দাদের দুর্গে বন্দী। আমি সব বিষয়েই আপনাকে অবহিত করব।’

আলীর ওপর ছিল সালাহউদ্দীনের পূর্ণ আস্থা। তাই তার গোপন তৎপরতা সম্পর্কে কিছুই তাকে জিজ্ঞেস করলেন না।

‘শুনলাম নাজি আপনাকে সংবর্ধনা দিতে চাইছে। যেতে চাইলে আমি যখন বলব তখন যাবেন।’

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী কতক্ষণ ঘরময় পায়চারী করলেন। হঠাৎ কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল ব্যথাভরা ‘আহ’ শব্দ। দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। তাকালেন আলী বিন সুফিয়ানের দিকে।

‘আলী, জীবন মৃত্যু তো আল্লাহর হাতে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে বেঁচে থাকার চাইতে জন্মের সাথে সাথেই কি মরে যাওয়া ভাল নয়? কখনো ভাবি, যাদের মাঝে জাতীয় চেতনাবোধ নেই, নেই কোন মহৎ ভাবনা সম্ভবতঃ পৃথিবীতে তারাই সুখী। ওরা নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকে, মরেও যায় তেমনি।

‘না, সম্মানিত আমীর! ওরা সবচেয়ে বেশী হতভাগা।’

‘হ্যাঁ আলী। আমি যখন ওদেরকে ভাগ্যবান মনে করি কে যেন আমার কানের কাছে এসে তোমার কথাটাই উচ্চারণ করে যায়। মনে রেখো আলী, ইতিহাসের বর্তমান ধারা পরিবর্তন করতে না পারলে মুসলিম বিশ্ব হারিয়ে যাবে উপত্যকা আর মরুভূমির সীমাহীন বিস্তারে। খেলাফত এখন তিন ভাগে বিভক্ত। আমীর ওমরার দল স্বেচ্ছাচারী, খৃস্টান ষড়যন্ত্রের আঁধারে হারিয়ে যাচ্ছে ওরা। আমার আশংকা হচ্ছে, মুসলমানরা বেঁচে থাকলেও থাকবে খৃষ্টানদের গোলামীর শৃংখলিত। শুধু বেঁচে থেকেই সন্তুষ্ট থাকবে ওরা। জাতিসত্ত্বা বলে কিছুই থাকবে না, যেন সে শুধু এক মৃতের কফিন। দেখছো না, অর্ধশতাব্দীর মধ্যেই আমাদের মানচিত্র কতো সংকীর্ণ হয়ে এসেছে!’

মাথা নুইয়ে আবার তিনি পায়চারী করতে লাগলেন। কুঞ্চিত কপালে চিন্তার ভাজ। এক সময় মাথা সোজা করে দাঁড়িয়ে গমগম কণ্ঠে বললেন, ‘আলী, নিজের ভেতর থেকে ধ্বংস শুরু হলে তা রোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের খেলাফত এবং আমীরগণ বর্তমান অবস্থায় থাকলে খৃষ্টানদের আক্রমণ করার প্রয়োজনই পড়বে না। যে আগুন আমাদের ঈমান, আমাদের কর্ম আর জাতিসত্ত্বাকে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে খৃস্টানরা তাতে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে মাত্র। ওদের ষড়যন্ত্র আমাদেরকে একে অন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে বাধ্য করছে। হয়তো আমার ইচ্ছে অপূর্ণই থেকে যাবে। আমি পরাজিত হতে পারি, তবুও জাতির কাছে আমি কিছু কথা রখে যেতে চাই। আমি চিৎকার করে বলতে চাই, অমুসলিমকে কখনো বিশ্বাস করো না। যুদ্ধ করতে করতে জীবন দেবে, তবু দুশমনের পাতা ফাঁদে পা দেবে না।’

‘মনে হচ্ছে আপনি হতাশ হয়ে গেছেন?’

‘না আলী, নিরাশ হইনি, একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। আলী, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কাছে আমাদের নির্দেশ পৌঁছে দাও। সেনা ভর্তি আরো তীব্রতর কর। যুদ্ধে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সবসময় প্রাধান্য দেবে। সৈন্য ভর্তির বাধ্যতামূলক শর্ত হল ইসলামী আমল আখলাক। শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার দিকে বিশেষ নজর দেবে। ওদেরকে স্পেশাল গেরিলা ট্রেনিং দেবে। শত্রুর এলাকায় গিয়ে কাজ করতে হবে ওদের। ওরা হবে সুইসাইড স্কোয়ার্ড। গেরিলাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা কর। ওদের থাকতে হবে উটের মত দীর্ঘসময় ক্ষুঁৎ পিপাসা সহ্য করার শক্তি। দৃষ্টি হবে ঈগলের মত, মরু শিয়ালের মত হবে সতর্ক। চিতাবাঘের মত ওরা ঝাঁপিয়ে পড়বে শত্রুর ওপর। শক্তি সাহস আর বুদ্ধিমত্তায় হবে অনন্য। মদ হাসিস বা এ জাতীয় মাদকাসক্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে ওদের। ওদেরকে মোকাবেলা করতে হবে সেই সব নারীদের। যৌবনের পশরা সাজিয়ে, চোখে মদির নেশা জাগিয়ে যারা আসবে ওদের ছোবল হানতে। এ ব্যাপারগুলো এদের এমন ট্রেনিং দেবে, যেনো নৃত্যরত পরী এলেও ওরা থাকতে পারে বরফশীতল।

ভর্তি আরো তীব্রতর করো আলী। মনে রেখো, আমি আবেগতাড়িত হয়ে কাজ করতে পছন্দ করিনা। সংখ্যায় যত নগন্যই হোক, আমি যোদ্ধা চাই। সেই সব যোদ্ধা, যাদের ভেতরে থাকবে ইসলামী ঐতিহ্য ও চেতনাবোধ। কেন যুদ্ধ করছি এ প্রশ্ন কখনো কারো মনে উদয় হবে না। শুরুথেকেই সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার উদ্দেশ্য কি তা ওদের ভাল করে বুঝিয়ে দাও। এ দুর্দিনে জাতি তাদের কাছে কতটুকু ত্যাগ ও কোরবানী দাবী করে এ কথা প্রত্যেকটি সৈনিকের অন্তরে এমন ভাবে গেঁথে দাও, যাতে এটাকে কেউ কেবল চাকরী মনে না করে।’

নাজি তার ক্ষমতা ও প্রাধান্য টিকিয়ে রাখার স্বার্থে একটি দুঃসাহসিক গোয়েন্দা সংস্থা গড়ে তুলেছিল। ওরা নাজিকে বলল, ‘আলী বিন সুফিয়ান সালাহউদ্দীন আউয়ুবীর বিশেষ উপদেষ্টা এবং গুপ্তচর বৃত্তিতে আরব শ্রেষ্ঠ। আপনার অস্তিত্বের জন্য সে এক মারাত্মক হুমকী স্বরূপ।’

নাজি আলীর পেছনে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা লাগিয়ে রেখেছিল। তাদের রিপোর্টের পর সে আলীকে হত্যা করারও পরিকল্পনা করল। সালাহউদ্দীনকে ফাঁসানোর জন্য জুকিকে তৈরী করেছিল নাজি, কিন্তু সে জানতেও পারেনি, নিজেই সে জুকির ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে। শুধু অসাধারণ রূপের জৌলুষেই নয়- জুকির মধুমাখা কণ্ঠে ছিল যাদুর ছোঁয়া। ওকে নিজের পাশে বসিয়ে কথা বলত নাজি।

এখন আর পুরনো নর্তকীদের ডাক পড়েনা। ঈর্ষার আগুনে পুড়ে মরতে লাগল ওরা। এ ঈর্ষার আগুন ওদের এতটাই ক্ষিপ্ত করলো যে, পুরনো নর্তকী দু’জন জুকীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করল। কিন্তু কার্যত এ ছিল অসম্ভব। ওর কক্ষের সামনে সারাক্ষণ দু’জন প্রহরী দাঁড়িয়ে থাকত। অন্যদিকে অনুমতি ছাড়া নর্তকীরা বাইরে যেতে পারত না। অনেক ভেবেচিন্তে ওরা হারেমের এক চাকরাণীকে হাত করে নিল।

গভর্ণরের পুরনো বডিগার্ড বদলে দিলেন আলী। সেখানে নিয়োগ করলেন দুঃসাহসী এবং আত্মত্যাগী নতুন সৈন্য। ওদের প্রত্যেকেই ছিল একেকজন আদর্শ সৈনিক। নাজি এ পরিবর্তন মেনে নিতে না পারলেও আইয়ুবীর সামনে তা প্রকাশ করল না। সম্বর্ধনায় হাজির হওয়ার জন্য সে আবার আইয়ুবীকে অনুরোধ করল। আইয়ুবী বললেন, ‘কবে আপনার দাওয়াতে যেতে পারব দু’ একদিনের মধ্যেই আপনাকে তা জানাবো।’

নাজি চলে গেলে তিনি এ ব্যপারে আলীর পরামর্শ চাইলেন। আলী বললেন, ‘যে কোন সময় আপনি নাজির নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারেন।’

পরদিন সালাহউদ্দীন নাজিকে জানালেন, তিনি এখন তার দাওয়াত কবুল করতে প্রস্তুত। নাজি তিন দিন সময় নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করার অনুমতি প্রার্থনা করলে আইয়ুবী সানন্দে তাতে সম্মতি দিলেন।

অনুমতি পেয়ে নাজি আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করল। অনুষ্ঠানটি হবে শহর থেকে দূরে। মশাল জ্বেলে আলোর ব্যবস্থা করা হবে। ব্যবস্থা থাকবে নাচগানের। ঘোড়সওয়াররা তাদের নৈপুণ্য দেখাবে। মশালের আলোয় অনুষ্ঠিত হবে কুস্তি, নেজাবাজি এৰং তলোয়ারের খেলা। রাতে ওখানেই সবার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তৈরী করা হয়েছে আলীশান তাঁবু। পুরো অনুষ্ঠানমালা জানানো হল সালাহউদ্দীনকে। তিনি মনযোগ দিয়ে বিস্তারিত কর্মসূচী শুনলেন কিন্তু নাচগান সম্পর্কে কিছুই বললেন না। এতে নাজি উৎফুল্ল হল। মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে ভয়ে ভয়ে বলল, ‘সেনাবাহিনীর বেশীর ভাগ ফৌজ দুর্বল মুসলিম। ওরা কখনো সখনো মদপান করে, তবে অভ্যস্ত নয়। আপনাকে সম্বর্ধনা জানানোর এ আনন্দঘন অনুষ্ঠানে ওরা সামান্য পদ পানের অনুমতি চাইছে।’

‘এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই না। আপনি আমাকে দাওয়াত করেছেন, আমি সে দাওয়াত কবুল করেছি। ওখানে আপনি কি করবেন তা আপনিই ভাল বুঝবেন। আপনি ওদের কমাণ্ডার। ইচ্ছে হয় অনুমতি দেবেন, না হয় দেবেন না, আমি এ ব্যাপারে আপনাকে কোন নির্দেশ দেব না।’

‘মিসরের আমীরের জয় হোক।’ আনন্দে গদগদ হয়ে মোসাহেবী কণ্ঠে বলল নাজি। ‘যে কাজ আপনি অপছন্দ করেন না আমি তার অনুমতি দেয়ার কে? নেহায়েত আপনাকে উপলক্ষ করে ওরা একটু আনন্দ করতে চাইছে, নইলে এ প্রস্তাব আমি কিছুতেই উঠাবার দুঃসাহস করতাম না।’

সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। শুনল সালাহউদ্দীনের কর্মচারীরাও। আইয়ুবী নাচগান এবং মদের অনুষ্ঠানে যাবেন শুনে ওরা হতভম্ব হয়ে গেল। চাইতে লাগল একে অপরের দিকে। কেউ বলল, ‘নাজি মিথ্যে বলে সকলকে চমৎকৃত করতে চাইছে।’ কারো ধারণা, ‘নাজি সালাহউদ্দীনকেও হাত করে নিয়েছে।’

এ সংবাদে সবচেয়ে বেশী খুশী হল নাজির লোকেরা। দায়িত্বগ্রহণ করার পরপরই সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ভোগবিলাস এবং নাচগান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। সেনাবাহিনীর জন্য কঠোর নিয়ম পালন বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এ নিয়ম ভাঙার দুঃসাহস কারো ছিল না।

সালাহউদ্দীন আজ নাচগান এবং মদের অনুমতি দিয়েছেন, কাল নিজেই এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন, এই ভেবে নাজি মহা খুশী।

কেবলমাত্র আলী বিন সুফিয়ান জাতেন এর গূঢ় রহস্য। এছাড়া আর কেউ জানতো না, কেন নাজিকে অনুষ্ঠানে নাচগান আর মদ পরিবেশনের অনুমতি দেয়া হয়েছে।

রাত নেমেছে। থোকা থোকা জোসনা ঝরে পড়ছে মরুর বালুকারাশির ওপর। হাজার হাজার মশালের আলোয় দিনের মত উজ্জ্বল মনে হচ্ছে সমগ্র এলাকা।

প্রশস্ত ময়দানের একপাশে ফৌজ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। বিপরীত দিকে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বসার স্থান। যেন কোন সম্রাটের মসনদ। মসনদের ডানে বায়ে চেয়ার সাজানো। একটু দূরে অতিথিদের তাঁবু। আরেকটু সরে গিয়ে বিশাল এক তাঁবু তৈরী হয়েছে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর অবকাশ যাপনের জন্য।

সূর্য ডোবার পূর্বেই আলী বিন সুফিয়ান ওখানে পৌঁছে তাঁবুর চারপাশে কড়া পাহারা বসালেন। অন্যদিকে নাজি শেষ বারের মত জুকিকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছিল। নজরকাড়া রূপ লাবণ্যে জুকিকে মনে হচ্ছিল স্বর্গের অপ্সরা। তার দেহ থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল হালকা সুবাস। সে সুবাসে পরিবেশ হয়ে উঠছিল অপূর্ব মোহনীয় ও মাদকতাময়। তার নিরাভরণ কাঁধে সোনালী চুলের বাহার। শরীরে পোষাকের স্বচ্ছ প্রলেপ। সে প্রলেপের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছিল এক অনুপম শিল্প সুষমা। সে সুষমায় ছিল মাখন কোমল এক মোমের পুতুলের জীবন্ত সজীবতা। ঠোঁটে তার অনির্বচনীয় মুচকি হাসি।

গভীর চোখে জুকির দিকে খানিক তাকিয়ে রইল নাজি। বলল, ‘তোমার এ মাতাল করা রূপযৌবনও হয়ত তাকে প্রভাবিত করতে পারবে না। তখন চালাবে ভাষার যাদু। এতদিনের ট্রেনিং ভুলে যেয়ো না। দেখো আবার তা বাঁদী না হয়ে যাও। মনে রেখ, তুমি হবে অচিন নগরের সেই ফোটা ফুল, যা ধরতে গেলে ধরা যায় না, আবার সেখান থেকে চোখও ফেরানো যায় না। জুকি, তুমি সেই আলো, যার হাত থেকে কোন পতঙ্গের নিস্তার নেই। তুমি সেই মায়াবিনী, রক্ত মাংসের কোন মানুষের সাধ্য নেই তার আকর্ষণকে উপেক্ষা করে। মনে রেখ, সালাহউদ্দীনও মানুষ। ওকে তুমি তোমার পায়ের কাছে বসতে বাধ্য করবে। ক্লিওপেট্রা তার রূপ যৌবন দিয়ে লৌহমানবকে গলিয়ে মরুর বালির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল। সে তোমার চেয়ে বেশী সুন্দরী ছিল না। আমি তোমায় যা শিখিয়েছি তা ক্লিওপেট্রারই পদ্ধতি। নারীর এ চাল কখনো ব্যর্থ হয় না।’

মৃদু মৃদু হাসছিল জুকি। মনোযোগ দিয়ে শুনছিল নাজির কথা। মিসরের বালুকারাশি খেকে জন্ম নিয়েছিল ক্লিওপেট্রার মত রূপসী নাগিণী। ইতিহাস আরো একবার সে অতীতে ফিরে যাচ্ছিল।

সূর্য ডোবার সাথে সাথে জ্বলে উঠল হাজার হাজার মশাল। দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। দফ বাজিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করা হল। ‘মিসরের আমীর সালাহউদ্দীন জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে মরুর নিস্তরঙ্গ প্রকৃতি মুখরিত হয়ে উঠল। নাজি এগিয়ে এসে বলল, ‘আত্মত্যাগী ও ইসলামের রক্ষক সেনাবাহিনী আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে। খোশ আমদেদ মহান নেতা, ওদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। এই যে সেনাবাহিনী, আপনার ইশারায় যারা জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত।’ তোষামুদে শব্দগুলো নাজির কণ্ঠে প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠল। মসনদে বসলেন সালাহউদ্দীন ভেসে এল অশ্বক্ষুরধ্বনি। আলোর নিশানায় চলে এল ঘোড়াগুলো। দু’দিক থেকে আসছে চারটি করে ঘোড়া। আরোহীরা নিরস্ত্র। ছুটে আসছে মুখোমুখি। যে কোন মুহূর্তে সংঘর্ষ হতে পারে। আরো কাছে এগিয়ে আসতেই সওয়াররা স্যাডলে পা রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। এক হাতে তুলে নিল বলগ। অন্য হাত আড়াআড়িভাবে প্রসারিত করে একে অন্যকে পেরিয়ে গেল। যাবার সময় অপর আরোহীকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করল ওরা। একজন প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য সওয়ারকে জাপটে ধরে ছুটে গেল সামনে। দু’দল হারিয়ে গেল দিগন্তের বিস্তৃত মরুতে। সংঘর্ষের স্থানে মাটিতে ডিগবাজি খাচ্ছিল দু’জন সওয়ার।

এভাবে পরপর আটটি দল তাদের নৈপূণ্য দেখাল। এরপর এল উষ্ট্রারোহী বাহিনী। তাদের খেলা শেষ হতেই শুরু হল নেজাবাজি ও অসি চালনা। ওদের সাহস ও নৈপূণ্যে অভিভূত হলেন সালাউদ্দীন। এমন দুঃসাহসী সৈন্যই তো তার প্রয়োজন। তিনি আলী বিন সুফিয়ানের কানে কানে বললেন, ‘ইসলামি জোশ সৃষ্টি করতে পারলে এ ফৌজ দিয়েই সমস্ত খৃষ্টান শক্তিকে পরাভূত করা যায়।

আলী পূর্বের পরামর্শ পুনরাবৃত্তি করে বলল, ‘নাজিকে সরিয়ে দিন, দেখবেন এদের মধ্যে এমনিতেই ইসলামী জযবা ও আবেগ সৃষ্টি হয়ে যাবে।’

কিন্তু সালাইউদ্দীন আইয়ুবী একজন অভিজ্ঞ জেনারেলকে না সরিয়ে তাকে সংশোধন করতে চাইছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীর অবস্থা দেখার জন্য যোগ দিয়েছিলেন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। নাজি যখন নাচগান এবং মদপানের প্রস্তাব করেছিল, নিরাশ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এরা ভোগবিলাসে কদ্দুর ডুবে আছে তা দেখতে নাচগানের অনুমতি দিয়েছিলেন।

সাহসিকতা, ঘোড়া সওয়ারী, অসি চালনা এবং মল্ল যুদ্ধে সেনা সদস্যরা উতরে গিয়েছিল। কিন্তু খাবার সময় ওরা উচ্ছৃংখল হয়ে পড়ল। বিশাল এলাকা জুড়ে খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল। একপাশে সেনা সদস্যদের জন্য, অন্যপাশ বিশেষ অতিথিদের। হরেক রকম খাবারের মনমাতানো গন্ধে মরুভূমির রাতের বাতাস ম-ম করছিল। সেপাইদের সামনে ছিল মদের মশক। খাওয়া শেষ হতেই ওরা মদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন সালাহউদ্দীন। কি ভাবছেন চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছিল না।

নাজিকে প্রশ্ন করলেন, ‘এদের কিভাবে নির্বাচিত করলেন? এরা কি ফৌজের নিকৃষ্টতম সিপাই?’

‘না, আমীর।’ মিনমিনে কণ্ঠে বলল নাজি, ‘এরা সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠ সৈনিক। যুদ্ধের ময়দানে এদের বীরত্ব দেখলে আপনি হতবাক হয়ে যাবেন। ওরা একটু বাড়াবাড়ি হয়ত করছে, কিন্তু আপনার ইশারায় জীবন দিতে প্রস্তুত। আনন্দে উল্লাস করার জন্য মাঝে মাঝে ওদেরকে মুক্তভাবে ছেড়ে দেই। মৃত্যুর পূর্বে পৃথিবীটাকে খানিক ভোগ করে নিক।’

আইয়ুবী এ যুক্তির কোন জবাব দিলেন না। নাজি অন্য অতিথিদের দিকে ফিরতেই তিনি আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, ‘যা দেখার আমি দেখেছি, এরা মদ আর উচ্ছৃংখলতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তুমি বলেছিলে এদের ভেতর কোন আবেগ নেই, আমি দেখছি কোন কর্মও নেই। এরা যুদ্ধের ময়দান থেকে জীবন নিয়ে পালাবে। লুট করবে পতিত সম্পদ। বিজিত এলাকার মেয়েদের সাথে পশুর মত ব্যবহার করবে।’

‘এর ওষুধ হল, আলী বললেন, ‘আপনি বিভিন্ন এলাকার লোক দিয়ে যে ফৌজ তৈরী করেছেন, এদেরকে ওদের সাথে একীভূত করে দিন। ভাল সিপাইদের সাথে মিশলে এদের স্বভাব ভালও হয়ে যেতে পারে।’

মৃদু হেসে সালাহউদ্দীন বললেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি আমার মনের কথা জানতে পেরেছ। একক্ষণ আমিও তাই চিন্তা ভাবছিলাম। আর কারো কাছে একথা প্রকাশ করো না।’

আলী কিছু বলতে যাচ্ছিল, সামনে কয়েকটি মশাল জ্বলে উঠল, বেজে উঠল সানাই আর সারিন্দার সুমধুর সুর। সমাবেশে নেমে এল অখণ্ড নীরবতা। একদিকে দেখা দিল নর্তকীর দল। পরনে ঝলমলে নাচের পোশাক। আধখোলা দেহ, নগ্ন কাঁধে ছড়ানো চুল।

হু হু করে বয়ে যাচ্ছে মরুভূমির উচ্ছল রাতের বাতাস। সে বাতাসে ওদের চুল উড়ছে, পতাকার মত পতপত ঢেউ খেলছে জরীন পোশাক। মনে হচ্ছে বাতাসে ভর করে উড়ে আসছে এক ঝাঁক সোনালী পায়রা। প্রসারিত দুই বাহু মেলে দেয়া দুই উড়ন্ত ডানা। সেই ডানায় বাঁধা রেশমী রুমাল। সেই রুমালে আঁকা বিচিত্র বর্ণালী রঙ। সেই রঙের ভেতর একেকটি মুখ ফুটে আছে রক্ত পদ্মের মত। কোমল, পেলব। মসৃন উন্মুক্ত বাহুলতায় অপার্থিব জ্যোতির পরাগ। পা নড়ছে না ওদের, কিন্তু বাদ্যের তালে তালে ছন্দোবদ্ধভাবে সামনে এগিয়ে আসছে।

দ্বিতীয়ার চাঁদের মত সালাহউদ্দীনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল যুবতীরা। মাথা নোয়াল কুর্ণিশ করার জন্য। সোনালী চুল পিছলে সামনে চলে এল।

দেখা গেল দূরে দৈত্যের মত এক হাবশী দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসছে। পরনে চিতাবাঘের চামড়ার তৈরী পোশাক। হাতে বিশাল একা ডালা, ডালা ভর্তি অর্ধফোটা ফুল।

তরুণীদের সামনে এসে ওটা নামিয়ে রাখল সে। বেড়ে গেল বাদ্যের আওয়াজ। বন্য মোষের মত গজরাতে গজরাতে আবার ফিরে গেল কাফ্রী।

নড়ে উঠল দ্বিতীয়ার চাঁদ। চাঁদের খোলস ভেঙ্গে বেরিয়ে এল অনিন্দ্য এক চাঁদবদনী। মনে হল ধূসর মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে পূর্ণিমার চাঁদ। যেন এ যুবতী এ গ্রহের কেউ নয়। ঠোঁটে তার মৃদু হাসির ঝিলিক। হাসি তো নয়, যেনো অনবদ্য এক খাপখোলা তলোয়ার।

অবাক বিস্ময়ে মোহগ্রস্থের মত তাকিয়ে রইল দর্শকবৃন্দ। দৃষ্টি তাদের পলকহীন। স্মিত হেসে সালাহউদ্দীনের দিকে তাকালেন আলী বিন সুফিয়ান, আইয়ুবীর ঠোঁটেও মুচকি হাসি।

‘ও এতটা সুন্দরী, ধারণা করিনি।’ আলীর কানে কানে বললেন তিনি।

‘মিসরের আমীরের জয় হোক,’ বলতে বলতে এগিয়ে এল নাজি। ‘ওর নাম জোকি।’ বলল সে, ‘আপনার জন্য ইস্কান্দারিয়া থেকে আনিয়েছি। ও নর্তকী বা দেহপশারিণী নয়। কখনো সখনো শখের বশে নাচে বটে, তবে কোন জলসায় যায়না। ওর পিতা আমার পরিচিত, বড় ব্যবসায়ী। এ মেয়েটা আপনার খুব ভক্ত। আপনাকে ও প্রাণ দিয়ে ভালবাসে না বলে বরং নবীর মত সম্মান করে বলাই ভাল। ঘটনাচক্রে হঠাৎ ওর বাবার সাথে দেখা। একটা কাজে ওদিকে গিয়েছিলাম। মেয়েটা বলল, ‘শুনেছি সালাহউদ্দীন আইয়ুবী মিসরের গভর্নর হয়ে এসেছেন? মেহেরবানী করে আমাকে তার সাথে দেখা করিয়ে দেবেন? তাকে দেয়ার মত আমরা জীবনে আর নাচ ছাড়া কিছুই নেই। মাননীয় গভর্নর, এ মেয়েটাকে আপনার সামনে হাজির করার জন্যই নাচগানের অনুমতি চেয়েছিলাম।’

‘আপনি কি ওকে বলেননি, মেয়েদের অর্ধনগ্ন দেহ বা নাচগান আমি পছন্দ করি না। আপনি যাদের পোশাক পরা বলছেন ওরাতো সবাই উলংগ।’

‘মহামান্য আমীর’, ফ্যসফ্যাসে গলায় বলল নাজি, ‘আপনি নাচ গান পছন্দ করে না একথা আমি ওকে বলেছি। ও বলল, আমার নাচ তিনি পছন্দ করবেন। কারণ, আমার নৃত্যে পাপের আহ্বান নেই। দেহ নয়, আমীরকে আমি শালীনভাবে নৃত্যের শৈল্পিক কলাকৌশল দেখাব। আমি পুরুষ হলে তার নিরাপত্তার জন্য জীবন বিলিয়ে দিতাম।’

‘আপনি কি বলতে চাইছেন?’

‘ওকে কাছে ডেকে একটু ধন্যবাদ জানালে ও খুব খুশী হবে।’

‘আপনি চাইছেন আমি তাকে ডেকে বলি যে, হাজার হাজার মানুষের সামনে তোমার নগ্ন দেহটাকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছ, পুরুষের ঘুমন্ত পশু সত্ত্বাকে উসকে দিতে তোমার জুড়ি নেই, এ জন্য তোমাকে ধন্যবাদ!’

‘ছি! ছি! তা কেন করবেন মাননীয় আমীর। আমি ওকে কথা দিয়েছিলাম, এখানে এলে ওকে আপনার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেব। মেয়েটা অনেক আশা নিয়ে এসেছে। দেখুন ওর নৃত্যে পাপের আহবান নেই, আছে নীরব আত্মসমর্পণ। দেখুন না কেমন করে ও আপনার দিকে তাকিয়ে আছে! ও তার নৃত্যের কলাকৌশল, ভালবাসা, শ্রদ্ধা এবং মাদকতাময় দৃষ্টি দিয়ে আপনার উপাসনা করছে। কয়েক মুহূ্র্তের জন্য ওকে আপনার তাঁবুতে আসার অনুমতি দিন। আগামী দিন যারা হবে ইসলামের রক্ষক, ও হবে সে বীরপ্রসু মায়েদের একজন। নিজের সন্তানদের কাছে গর্ব করে বলতে পারবে যে, আমি সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সাথে একান্তে কথা বলেছি।’

‘ঠিক আছে ওকে আমার তাঁবুতে পাঠিয়ে দেবেন।’

অপূর্ব দেহবল্লরীতে কম্পন তুলে নাচছে জুকি। মদির কটাক্ষ হেনে তাকাচ্ছে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর দিকে। ঠোঁটে মধুমাখা মিষ্টি হাসির ঝিলিক। অন্য মেয়েরা প্রজাপতির মত তিরতির করে উড়ে বেড়াচ্ছে। মশালের ক্ষীণ আলোয় মনে হচ্ছে বরফগলা ঝরনার স্বচ্ছ পানিতে ফুলপরীরা দল বেঁধে সাঁতার কাটছে।

নিশ্চুপ বসে ছিলেন আইয়ুবী। নাজির সৈন্যরা মদে মাতাল। মরুভূমির সেই খোলা প্রান্তরে নিশুতি রাতের প্রকৃতিতে ভেসে বেড়াচ্ছে এক অপার্থিব সুর শিহরণ। ছন্দের তালে তালে বেজে চলছে নুপুরের নিক্কন ধ্বনি।

নিজের সাফল্যে নাজি ভীষণ খুশী। নাচ চলছে, ধীরে ধীরে গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে রাত।

মাঝরাতে তাঁবুতে প্রবেশ করলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। মেঝেতে দামী কার্পেট। দরজায় ঝুলানো রেশমী পর্দা। পালংকে চিতাবাঘের চামড়ার তৈরী আচ্ছাদন। কক্ষে মরু জ্যোস্নার মত ঝাড় বাতির হালকা নীলাভ আলোর ফুলঝুরি, বাতাসে মোহনীয় আতরের সুবাস।

নাজি তাঁবুতে ঢুকে বলল, ‘ওকে কিছু সময়ের জন্য পাঠিয়ে দেব মহামান্য আমীর? আমি প্রতিশ্রুতি ভাঙতে ভয় পাই।’

‘হ্যাঁ, পাঠিয়ে দাও।’

ধূর্ত শিয়ালের মত লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে গেল নাজি। খানিক পর দেহরক্ষীরা দেখল এক নর্তকী সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে আসতেই তরুণীকে চিনতে পারল ওরা, এখনো নাচের ফিনফিনে পোশাক পড়ে আছে। রক্ষীরা ওর পথ আটকে দাঁড়াল। ও বলল, ‘মহামান্য গভর্ণর আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন।’

কমাণ্ডার বলল, ‘যেসব আমীর বাজে মেয়েদের সাথে রাত কাটায় সালাহউদ্দীন আইয়ুবী তাদের মত নয়।’

‘তাকেই জিজ্ঞেস করে দেখ না, না ডাকলে কোন সাহসে আমি এখানে আসব?’

‘কার মাধ্যমে তোমায় ডেকে পাঠিয়েছেন?’

‘সেনাপতি নাজি আমাকে বললেন, গভর্ণর তোমায় ডাকছেন। আপনারা বললে আমি ফিরে যাচ্ছি, কিন্তু এর সব দায় দায়িত্ব আপনাদের।’

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী এক নর্তকীকে শোবার ঘরে ডাকবেন, রক্ষীদের কাছে তা অবিশ্বাস্য মনে হল। তারা জানত, তিনি কেমন প্রকৃতির মানুষ। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, নাচগানের সাথে যারা সম্পর্ক রাখবে তাদের একশত বেত্রাঘাত করা হবে। সমস্যায় পড়ল রক্ষী কমাণ্ডার। তবু ভয়ে ভয়ে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর তাঁবুতে প্রবেশ করে কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘বাইরে এক নর্তকী দাঁড়িয়ে আছে, আপনি নাকি তাকে ডেকেছেন।’

‘হ্যাঁ, ওকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।’

কমাণ্ডার বেরিয়ে গেল। তাঁবুতে প্রবেশ করল জুকি। রক্ষীদের ধারণা ছিল, গভর্ণর তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাঁবু থেকে বের করে দেবেন। আইয়ুবীর বজ্র হুংকার শোনার জন্য ওরা কান পেতে রইল। কিন্তু এমন কিছুই ঘটল না।

রাত এগিয়ে যাচ্ছে। তাঁবুর ভেতর শোনা যাচ্ছে অনুচ্ছ কণ্ঠের আওয়াজ। কমাণ্ডার সীমাহীন উদ্বেগ নিয়ে বাইরে পায়চারী করতে লাগল। এক রক্ষী বলল, ‘বাজে মেয়েদের সাথে সম্পর্ক রাখা নিষেধ শুধু আমাদের জন্য।’

‘হ্যাঁ, অন্যজন বলল, ‘অধীনস্ত আর প্রজাদের জন্যই শুধু আইনের কড়াকড়ি। গভর্ণরকে তো আর বেত মারা যাবে না!’

‘রাজা বাদশাদের কাজই এমন।’ কমাণ্ডাররের কণ্ঠে ঝাঝ। ‘হয়ত তিনি মদও পান করেন, উপরের গাম্ভীর্য কেবল আমাদের প্রভাবিত করার জন্য।’

একটি মাত্র ঘটনায় সালাহউদ্দীন আইয়ুবী সম্পর্কে ওদের এতদিনকার সকল ধারণা নিঃশেষ হয়ে গেল। ওদের চোখের সামনে ভেসে উঠল এক বিলাসপ্রিয় চরিত্রহীন রাজকুমারের ছবি।

নাজির খুশীর অন্ত নেই। সালাহউদ্দীন টোপ গিলেছে। তাকে সন্তুষ্ট করার অস্থিরতায় আজ সে মদ পর্যন্ত স্পর্শ করেনি। হৃদয়ভরা আনন্দ নিয়ে এডরোসসহ তাঁবুতে ঝিমুচ্ছিল সে।

এডরোস বলল, ‘ও অনেক্ষণ হয়ে গেছে। সম্ভবত আমাদের নিক্ষিপ্ত তীর সালাহউদ্দীনের হৃৎপিণ্ডে বিঁধে গেছে।’

‘আমার নিক্ষিপ্ত তীর কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না।’ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল নাজি।

‘তীরের নিশানা ভুল হলে এতোক্ষণে ও ফিরে আসত। তুমি ঠিকই বলছ, জুকী মানুষরূপী এক যাদুকন্যা। নয়তো সালাহউদ্দীনের মত পাথর গলাতে পারত না।’

‘আমি যে ট্রেনিং তাকে দিয়েছি, ঘাতকদল তা কল্পনাও করতে পারবে না। সালাহউদ্দীনকে এখন শুধু মদ খাওয়ানোটা বাকী।’

বাইরে কারো পদশব্দে নাজি তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। তাঁবুর পর্দা তুলে তাকাল বাইরে। না, জুকি নয়, একজন সৈনিক যাচ্ছে। নাজি দৃষ্টি ছুঁড়ল আইয়ুবীর তাঁবুর দিকে। বাইরে রক্ষীরা টহল দিচ্ছে। ফিরে এসে এডরোসকে বলল, ‘এবার আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি আমার জুকি পাথর ভেঙেছে।’

রাতের শেষ প্রহর। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল জুকি। নাজির তাঁবুর দিকে না গিয়ে হাঁটা দিল অন্য দিকে। পথে আপাদমস্তক ঢাকা একজন লোক দাঁড়িয়ে। লোকটি জুকিকে ইশারায় কাছে ডাকল, এগিয়ে গেল জুকি। লোকটি তাকে অন্য এক তাঁবুতে নিয়ে গেল। অনেকক্ষণ পর নাজির তাঁবুর দিকে হাঁটা দিল ও।

নাজির চোখে ঘুম নেই, ও একবার তাঁবুর ভেতরে ঢুকছিল, আবার বেরিয়ে আসছিল অস্থিরভাবে। কখনো হৃদয়ে তোলপাড় করা আনন্দ নিয়ে তাকাচ্ছিল আইয়ুবীর তাঁবুর দিকে। আকাশের উদার বিস্তার থেকে সালাহউদ্দীনকে তার পায়ের কাছে নামিয়ে এনেছে জুকি।

‘এডরোস, রাত তো শেষ হয়ে এলো, এখনো যে ও ফিরল না!’

‘ও আর কখনো ফিরে আসবে না। গভর্ণর তাকে সাথে নিয়ে যাবে। কোন রাজপুত্রও এমন হিরের টুকরো ফেলে দিতে পারে না, এদিকটা ভেবেছ কখনো?’

‘না তো! এদিকটা চিন্তাও করিনি।’

‘গভর্ণর তাকে বিয়েও তো করে নিতে পারেন! তাহলে মেয়েটা আমাদের কোন কাজেই আসবে না।’

‘ও যথেষ্ট সতর্ক।’

তবুও এক নর্তকীকে কদ্দুর বিশ্বাস করা যায়। নিজে অভিজ্ঞ পেশাদার নাচিয়ে। মা-ও বাঈজী ছিল। অবশ্যই সে আমাদের ধোঁকা দিতে পারে।’

গভীর চিন্তায় ডুবে গেল ওরা।

তাঁবুতে ঢুকলো জুকি। হেসে বলল, ‘এবার আমাকে আমার দেহের ওজন পরিমাণ স্বর্ণ দিন। ‘

‘কি হয়েছে আগে বলবে তো!’ নাজির কণ্ঠে অস্থিরতা।

‘আপনি যা চাইছিলেন তাই। আপনাকে কে বলল সালাহউদ্দীন পাথর, খোদার ভয়ে ভীত এক অনড় মুমীন।’ মাটিতে পা ঠুকে বলল জুকি, ‘সে মরুভূমির বালুর চাইতেও বেশী অসহায়, সামান্য বাতাসই তাকে উড়িয়ে নেয়ার জন্য যথেষ্ট।’

‘তোমার রূপের জৌলুস আর কণ্ঠের মধু তাকে উতলা করে দিয়েছে।’ এডরোস বলল, ‘নয়তো হারামিটা একটা দুর্গম পাথুরে পর্বত।’

‘পাথুরে পর্বত ছিল, এখন বালিয়াড়িও নয়।’

‘আমার ব্যাপারে কোন কথা হয়েছে?’ নাজির প্রশ্ন।

‘হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করল নাজি লোকটা কেমন? আমি বলেছি, মিসরে আপনার বিশ্বস্ত এবং অনুগত কেউ থাকলে একমাত্র নাজিই রয়েছে।’

‘আমার সাথে পরিচয় কিভাবে জানতে চায়নি?’

‘চেয়েছে, বলেছি তিনি আমার পিতার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আমাদের বাড়ী গিয়ে আব্বাকে বললেন, আমি সালাহউদ্দীনের নফর। তিনি যদি আমায় সাগরে ঝাঁপ দিতে বলেন, তাও আমি দিব।’

‘বাহাবা, বেশ বলেছ।’

‘আমার কথা শুনে তিনি বললেন, তুমি তো ভদ্রঘরের এক সম্ভ্রমশীলা তরুণী। আমি তাকে বললাম, অন্যের কাছে আমি যাই হই, আপনার কাছে আমি নগন্য এক দাসীমাত্র। আপনার ইশারাই আমার জন্য নির্দেশ।’

‘তারপর?’

‘আমার এ কথায় প্রভাবিত হয়ে তিনি বললেন, তুমি খুব ভাল মেয়ে। আরে অত দূরে কেন, আরেকটু কাছে এসে বসো। আমি খুব লজ্জিতভাবে জড়তা ও দ্বিধার ভাব নিয়ে তার পাশে গিয়ে বসলাম। আগে তিনি পাথর থাকলেও আমার দেহের স্পর্শে বলা যায় মোমের মত গলে গেছেন। বিদায়ের সময় আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে বললেন, জীবনে এই প্রথম পাপ করেছি। আমি বললম, আপনি কোন পাপ করেননি, প্রতারণা বা জোরাজুরিও করেননি। অন্যান্য শাসকদের মত জোর করেও ধরে আনেননি। আমি স্বেচ্ছায় এসেছি, আপনার অনুমতি পেলে আবারও আসব, বারবার আসব।’

নিজের নগ্ন দেহের মত অনেক মিথ্যা অবলীলায় বলে গেল জুকি। আনন্দের আতিশয্যে জুকিকে জড়িয়ে ধরল নাজি। এডরোস দু’জনকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল।

রহস্য ঘেরা মরুরাতের জঠর থেকে জন্ম নিল একটি প্রভাত, তবে অন্য প্রভাতের চেয়ে ভিন্ন। এ ভোরের আলো মরুরাতের আঁধার বুকে এমন এক নিগূঢ় তথ্য লুকিয়ে রাখল, যার মূল্য সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সমান। গতরাতে ঘটে যাওয়া রহস্যের দুটি দিক ছিল। একটি জানত নাজি এবং এডরোস। দ্বিতীয়টি আইয়ুবীর দেহরক্ষীরা। আর দু’টি দিকই জানতেন আলী বিন সুফিয়ান, আইয়ুবী এবং জুকি।

সালাহউদ্দীন এবং তার সঙ্গীদের অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে বিদায় দিয়েছিলেন নাজি। দুই সারিতে দাঁড়িয়ে ছিল সুদানী ফৌজ। ‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবী জিন্দাবাদ’ এর ধ্বনিতে প্রকম্পিত হল আকাশ বাতাস। কিন্তু আইয়ুবী মৃদু হাসি বা হাত নেড়ে এ অভিবাদনের কোন জবাব দিলেন না।

নাজির সাতে হাত মিলিয়ে দ্রুত ঘোড়ায় চেপে বসলেন তিনি। তাকে অনুসরণ করল অন্য সংগীরা। অফিসে গিয়ে আলী এবং একজন সহকারীকে নিয়ে কক্ষের দরজা বন্ধ করে দিলেন তিনি। দিন কাটলালেন রুদ্ধদ্বার কক্ষে।

সুর্য ডুবে গেল। রাতের অন্ধকার গ্রাস করল পৃথিবী। কিন্তু তিনি রুদ্ধদ্বার কক্ষের দরজা খুললেন না। কক্ষে খাবার বা পানি দেয়ারও সুযোগ দিলেন না কাউকে। অনেক রাতে তিনজন কক্ষ থেকে বেরিয়ে নিজ নিজ ঘরের দিকে হাঁটা দিলেন।

আলী বিন সুফিয়ান একা হতেই কমাণ্ডার তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

‘জনাব’ অভিমান ভরা কমাণ্ডারের কণ্ঠ, ‘নির্দেশ পালন করা এবং মুখ বন্ধ রাখা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু আমার সিপাইদের মধ্যে অসন্তুষ্টি আর নৈরাশ্য ছড়িয়ে পড়েছে। আমরাও একই অবস্থা।’

‘কেন, কি হয়েছে?’

‘রক্ষীরা বলছে, সুদানী বাহিনীর জন্য মদ বৈধ হলে আমরা কি অপরাধ করেছি? আমার অনুযোগকে অপরাধ মনে করলে যে কোন শাস্তি মাথাপেতে গ্রহণ করব। গভর্ণকে আমরা একজন সৎ চরিত্রবান এবং খোদাভীরু লোক বলে জানি, হাসিমুখে জীবন বিলিয়ে দিতে পারি তার সামান্য ইশারায়।’

‘কিন্তু গত রাতে তার তাঁবুতে এক নর্তকী প্রবেশ করেছিল, এইতো!’ কমাণ্ডারের মুখের কথা টেনে নিলেন গোয়েন্দা প্রধান। ‘না, তুমি কোন অপরাধ করনি। রাজা করুক আর প্রজা করুক, পাপ সে পাপই। আমি তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি, গভর্ণরের সাথে গোপন সাক্ষাতের মধ্যে পাপের কোন সম্পর্ক ছিল না। তাদের মধ্যে কি কথা হয়েছে এ মুহূর্তে বলা যাবে না। কয়েকটা দিন যাক, সব নিজেরাই বুঝতে পারবে।’

কমাণ্ডারের কাঁধে হাত রেখে তিনি আবার বললেন, ‘আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোন আমের বিন সালেহ, তুমি অভিজ্ঞ সৈনিক। ভাল করেই জান ফৌজ এবং ফৌজি কর্মকর্তাদের এমন কিছু গোপন ব্যাপার থাকে যার গোপনীয়তা রক্ষা করা সকলের কর্তব্য। নর্তকী আইয়ুবীর তাঁবুতে গিয়েছিল তাও এক গোপন ব্যাপার। কাউকে সন্দেহের মধ্যে রেখো না, কারো সামনে ভুলেও প্রকাশ করোনা সে রাতে কি ঘটেছিল।’

আলীর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কমাণ্ডার অবহিত ছিল। সে নিশ্চিত হয়ে গেল। সন্দেহের অবসান ঘটল সেপাইদেরও।

দুপুরের খানা খাচ্ছিলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী, তাকে নাজির আগমনের সংবাদ দেয়া হর। খাওয়া শেষে তিনি তাকে ডেকে পাঠালেন। নাজির চেহারায় শংকা এবং ক্রোধের অভিব্যক্তি। কম্পিত কণ্ঠে সে বলল, ‘মহামান্য আমীর! পঞ্চাশ হাজার সুদানী ফৌজকে সদ্য প্রস্তুতকৃত ফৌজের সাথে একীভূত করার নির্দেশ কি আপনি দিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, অনেক চিন্তা ভাবনার পর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আরো সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মিসরের সেনাবাহিনীতে শতকরা ১০ জন থাকবে সুদানী সৈন্য। আপনাকে হেডকোয়ার্টারে বদলী করা হয়েছে, এখন থেকে আপনি আর সুদানী বাহিনীর প্রধান নন।’

‘মহামান্য আমীর, এ আমার কোন অপরাধের শাস্তি?’

‘সেনাবাহিনীর সামগ্রিক স্বার্থেই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সৈনিক জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণে হেডকোয়ার্টার আপনার সেবা নিতে চাচ্ছে, এ-তো আপনার জন্য খুশির খবর। কেবল একটা বাহিনী নয়, আপনি কি চাননা আপনার অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হোক আমাদের সকল সৈনিক?’

‘আমীর, আমার আশংকা হচ্ছে, সম্ভবতঃ আমার বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র চলছে। আপনার মহান ব্যক্তিত্ব এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে একটু যাচাই বাছাই করবেন। আমার মনে হয় কেন্দ্রে আমার কোন শত্রু রয়েছে।’

‘দেখুন, সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনের ভুল বুঝাবুঝি দূর করার জন্যই এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। অফিসার হোক কি সাধারণ সিপাই, এখন থেকে সকলের জন্য মদ নিষিদ্ধ। কোন অনুষ্ঠানে নাচগান চলবে না।’

‘কিন্তু মাননীয় আমীর! আমিতো হুজুরের অনুমতি নিয়েই সবকিছু করেছিলাম।’

‘আপনি যাদেরকে মুসলিম মিল্লাতের সেনাবাহিনী বলছেন, তাদের আসল চরিত্র দেখার জন্য নাচ গানের অনুমতি আমি দিয়েছিলাম। পঞ্চাশ হাজার সৈনিককে তো চাকুরীচ্যুত করতে পারছি না, এ জন্য মিসরের ফৌজের সাথে একীভূত করে ওদের সংশোধন করতে চাচ্ছি। মনে রাখবেন, আমরা কেউ সুদানী, মিসরী বা সিরীয় নই। আমরা সবাই মুসলমান। আমাদের ধর্ম এক, পতাকাও এক।’

‘আমার অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কি একবারও ভেবেছেন?’

‘দেখুন, এ সিদ্ধান্ত আপনার মনপুত না হলে আপনি সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দিতে পারেন। আপনার ওপর আমি কোন কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না।’

‘মহামান্য আমীর, এ অন্যায়, এ জুলুম!’

‘কোনটা অন্যায় আর জুলুম তা বুঝার সাধ্যি কি আপনার আছে? নিজের অতীত একটু নিজেই তলিয়ে দেখুন গিয়ে, আমার মুখে শোনার প্রয়োজন হবে না।’

‘মহামান্য আমীর, এ সিদ্ধান্ত আরেকবার একটু বিবেচনার জন্য অনুরোধ করছি।’

‘অনেক ভেবেচিন্তেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ফিরে গিয়ে সব কিছু প্রস্তুত করুন। কোনরকম হটকারিতার আশ্রয় নেবেন না। মনে রাখবেন, আমার সহকারীর কাছে সাত দিনের মধ্যে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে হবে।’

নাজি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার মুখ খোলার আগেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী।

জুকি গভর্ণরের তাঁবুতে রাত কাটিয়েছে, নাজির গোপন হারেমেও এ সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল। ও এসেছে এই সেদিন, অথচ নাজি প্রথম দিন থেকেই অন্য সবার চাইতে ওকে বেশী ভালবাসে। এক মুহূর্তের জন্যও অন্য নর্তকীদের কক্ষে তাকে যেতে দেয়া হয়নি। জুকির জন্য ছিল আলাদা কক্ষ। নর্তকীরা প্রতিহিংসার আগুনে পুড়তে লাগল। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে ফাঁসানোর জন্য জুকিকে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে ওরা তা জানত না। ওদের ধারণা, জুকি নাজিকে এককভাবে দখল করে নিয়েছে। নর্তকী দু’জনের প্রতিহিংসা চরমে পৌঁছলে ওরা জুকিকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়।

গভর্ণরের তাঁবুতে জুকির রাত কাটানোর সংবাদে ওরা আরো পাগল হয়ে উঠল। কিভাবে তাকে হত্যা করা যায় ভাবতে গিয়ে ওদের মাথায় দুটি চিন্তা আসে। এক, তাকে বিষ প্রয়োগ করা যায়। দ্বিতীয়তঃ ভারাটে খুনী দিয়েও খুন করানো যায়। কিন্তু বাস্তবে দুটোর একটাও তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ জুকির খাওয়া দাওয়ার সবকিছু ছিল ওদের থেকে আলাদা, অন্যদিকে প্রহরী ছাড়া সে তার রুম থেকে বেরই হতো না।

ওরা হারেমের এক চতুর বাদীকে হাত করল। জুকিকে শেষ করতে পারলে প্রচুর ধন সম্পদ দেয়ার লোভ দেখাল তাকে। চাকরাণীটা ছিল লোভী এবং জঘন্য প্রকৃতির। হেরেমের অসংখ্য অপকর্মের হোতা ছিল সে।

প্রস্তাব শুনে সে বলল, ‘মুনীবের কক্ষে গিয়ে ওকে বিষ খাওয়ানো সম্ভব নয়। সুযোগমত খঞ্জর ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে এ জন্য কিছু সময়ের প্রয়োজন।’

‘কতদিন সময় প্রয়োজন তোমার?’

‘জুকির তৎপরতার ওপর নজর রাখতে হবে। হয়ত শীঘ্রই সুযোগ এসে যাবে।’

‘কিন্তু তারাতারি যদি সুযোগ না আসে?’

‘তাহলে ঘাতক দলের সহযোগীতা নিতে হবে। তবে ওরা এজন্য অনেক টাকা দাবি করবে।’

‘যত টাকা লাগে দেব, তবু আমরা চাই কাজটা তুমি তাড়াতাড়ি শেষ কর।’ বলল নর্তকীরা।

ক্রোধে উন্মুক্ত প্রায় নাজি কামরায় পায়চারী করছিল। জুকি তাকে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করেছে। নাজির রাগ কমেনি।

‘আমাকে তার কাছে যেতে দিন।’ এ নিয়ে চতুর্থবারের মত বলল জুকি, ‘আমি তাকে সোজা পথে নিয়ে আসবো।’

‘কোন লাভ নেই।’ বেটা কমবখত হুকুম দিয়ে ফেলেছে, বাস্তাবয়নও শুরু হয়ে গেছে। আমার আর কিছুই রইল না। তোমার যাদু ওকে ধরেনি। আমার বিরুদ্ধে কারা ষড়যন্ত্র করছে জানি। ওরা আমার উন্নতি সইতে পারছে না। আমিই হতাম গভর্ণর। একজন সাধারণ সেনাপতি হয়েই সব শাসকদের শাসন করেছি আমি। আর এখন আমি একজন সামান্য কমাণ্ডারও নই।

নাজি প্রহরীকে ডেকে বললো, ‘জলদি এডরোসকে আসতে বলো।’

এডরোস এলে দু’জনে নতুন নির্দেশ নামার ব্যাপারে আলাপ করল। এডরোসের কাছে এ খবর নতুন না হলেও সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে এ ব্যাপারে এডরোস কোন পরামর্শ দিতে পারলো না।

নাজি বলল, ‘কি করবো আমি ভেবে রেখেছি।’

‘কি ভেবেছেন?’

‘বিদ্রোহ করব।’