৩. কমাণ্ডার উঠে দাঁড়াল

কমাণ্ডার কি ভেবে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। মুবির হাত ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করে বলল, ‘খোদার শপথ তোমার জন্য আমি সিংহাসন ত্যাগ করি এই যদি হয় তোমার ইচ্ছে, এই রইল তরবারী! এখন থেকে তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা।’

কমাণ্ডার খাপ সহ তার তরবারী রেখে দিল মুবির পায়ের কাছে। ‘এখন আমি আইয়ুবীর সৈনিক নই, কমাণ্ডারও নই।’

মুবি হাত ধরে টেনে ওকে পাশে বসাল। নিজেও ঘনিষ্ট হয়ে বলল তার পাশে। বলল, ‘তুমি যদি সত্যি আমাকে চাও তোমার জন্য আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করবো। তবে আমাকে পেতে হলে তোমাকে একটা শর্ত পালন করতে হবে, যে পাষণ্ড পশু আমার ওপর আজ এ বর্বর আচরণ করেছে, তার প্রতিশোধ নিতে হবে তোমাকে।’

‘খোদার কসম, সুলতান আমার হাত থেকে কিছুতেই রক্ষা পাবে না। একে আমি খুন করবো।’

মুবি ব্যবসায়ীদের দিকে তাকাল। ক্রিস্টোফার বলল, ‘এক আইয়ুবী মরলে বা বাঁচলে কিছু যায় আসে না। যে আসবে সেও এমন হবে। আজ হোক, কাল হোক মিসরীরা ওদের দাসই হবে। তুমি বরং নাজির কাছে যাও। মুবি থাকবে তোমার সংগে। তোমরা দু’জন সালাহউদ্দীনের আসল রূপ তার কাছে প্রকাশ করে তার সাহায্য চাইতে পার। এ ছাড়া এর বদলা নেয়ার কোন রাস্তা দেখি না আমি।’

নাজি এবং তার সংগীদের যে গোপনে হত্যা করা হয়েছিল এ কথা জানতো না এরা। মুবি চাচ্ছিল দ্রুত নাজির কাছে পৌঁছতে, কিন্তু এক যুবতীর পক্ষে একা মিসর পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব ছিল না। অপ্রত্যাশিত ভাবে ফখরুলকে পাওয়ায় তার বরং সুবিধাই হল। ওরা সিদ্ধান্ত নিল, মিসর যাওয়ার পথে ওকেই ব্যবহার করা হবে।

খৃষ্টান গোয়েন্দা দলে প্রধান রবিন রয়েছে আহতদের তাঁবুতে। ব্যবসায়ীরাও সিদ্ধান্ত নিল এখানেই থাকবে। আইয়ুবীকে ছোঁড়া তীর একবার ফসকে গেছে, আবার চেষ্টা করবে ওরা।

মুবির রূপের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে ফখরুল। হাশিশ তাকে বিবেকশূন্য করে দিয়েছে। ফখরুল আর নিজের তাঁবুতে ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

মুবিকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ার জন্য তাকে পরামর্শ দিল ক্রিস্টোফার। ব্যবসায়ীরা একটা উট দিল তাকে। উটের সাথে দেয়া হল পানির মশক ও প্রয়োজনীয় খাবার। হাশিশ মেশানো খাবারের থলিটা ধরিয়ে দিল মুবির হাতে। ফখরুল পরল ঢাউস জুব্বা ও ব্যবসায়ীদের মত টুপি। উটের পিঠে চাপল মুবি ও কমাণ্ডার।

উট চলতে শুরু করেছে, আশপাশের কোন খেয়াল নেই কমাণ্ডারের। সমস্ত অতীত তার হারিয়ে গেছে। হৃদয়ের কার্নিশে এখন শুধু ঝুলে আছে বিশ্বের সেরা এক সুন্দরীর ছবি। সুলতানকে বাদ দিয়ে যে রূপসী তাকে পছন্দ করেছে। কি সৌভাগ্য তার, মুবিকে বাহুবেষ্টন করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল ও।

‘খৃস্টান কমাণ্ডার আর তোমাদের সুলতানের মত পশুর আচরণতো করবে না?’ কপট কটাক্ষ হেনে বলল মুবি।

‘মুবি, আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি সে কথা কি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে।’

‘না ফখরুল, এ তো আমি রহস্য করে বলেছি। তোমার ভালবাসার ওপর আমার আস্থা না থাকলে কি তোমার সাথে এভাবে একাকী বেরিয়ে পড়তাম? এ দেহ-মন আমি তোমাকেই সঁপেছি। এখন থেকে আমি শুধুই তোমার। আমাকে নিয়ে তোমার যা ইচ্ছে করতে পার। তবে আইয়ুবীর পশুত্ব ভুলতে পারছি না বলেই ওভাবে বলেছি তোমায়। ধৈর্যহীনদের আমি ঘৃণা করি, যেমন ঘৃণা করি তোমাদের সুলতানকে।’

‘তার মানে তুমি আমাকে ধৈর্যহীন বলতে চাইছো? দেখ মুবি, তুমি চাইলে আমি উট থেকে নেমে যাব।’ মুবিকে বাহুবন্ধন থেকে ছেড়ে দিল ফখরুল।

‘ছি! কি বলছো তুমি? তোমাকে আমার ভাল লেগেছে বলেই তো তোমার জন্য আমার ধর্ম পর্যন্ত ত্যাগ করেছি। ইচ্ছে করলে আমি ব্যবসায়ীদের কাছেও তো থাকতে পারতাম।’

মুবির আগেবপূর্ণ কথায় আরো দুর্বল হয়ে পড়ল কমাণ্ডার। গল্পে গল্পে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে ওরা।

সাধারণভাবে চললে ওদের পাঁচদিনের পথ অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু ফখরুল এক পালিয়ে আসা সৈনিক। মুবিও পালিয়ে এসেছে মুসলিম তাঁবু থেকে। তাই সাধারণ পথ ছেড়ে দুর্গম পথে এগিয়ে চলল ওরা।

গভীর হয়ে এল রাত। ঘুমে ভারী হয়ে এল মুবির চোখ। ফখরুলের বুকে মাথা রেখে ও ঘুমিয়ে পড়ল। আকাশের অগণিত তারার রাথে জেগে রইল এক পলাতক সৈনিক। উট এগিয়ে চলছে মিসরের দিকে।

সবেমাত্র ফজরের নামাজ শেষ করেছেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী, প্রহরী তাঁবুতে প্রবেশ করে জানাল, ‘আলী বিন সুফিয়ান এসেছেন।’

তাঁবু থেকে দ্রুত বেরিয়ে এলেন সালাহউদ্দীন। আলীর সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও দিকের কি খবর?’

‘এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক। তবে ওদের উৎকণ্ঠা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের গোয়েন্দারা বলেছে, নেতৃত্ব দেয়ার মত কোন কমাণ্ডার এগিয়ে এলে ওরা বিদ্রোহ করবে।’

কথা বলতে বলতে দু’জন তাঁবুতে প্রবেশ করলেন। ‘নাজি এবং তার সংগীদের আমরা শেষ করেছি, কিন্তু সুদানীদের ভেতর মিসরীয়দের বিরুদ্ধে যে বিষ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, তার প্রভাব এখনও কমেনি। সেনাপতির অন্তর্ধান তাদের উৎকণ্ঠার বড় কারণ। আমাদের গোয়েন্দারা প্রচার করেছে যে, নাজি যুদ্ধের ময়দানে। আমার মনে হয় ওরা একথা বিশ্বাস করছে না।’

‘ওরা বিদ্রোহ করলে আমাদের ওখানকার ফৌজ কি অভিজ্ঞ পঞ্চাশ হাজার ফৌজের মোকাবিলা করতে পারবে?’

‘আমি তার ব্যবস্থা করে এসেছি। সব জানিয়ে দু’জন ঘোড়সওয়ার পাঠিয়ে দিয়েছি নুরুদ্দীন জংগীর কাছে। বিদ্রোহ দমন করার জন্য কিছু সাহায্য পাঠাতে অনুরোধ করেছি তাকে।’

‘ওদিক থেকে সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা কম। গত পরশু দূত মারফত জেনেছি, জংগী সম্রাট ফ্রাংকুর এলাকা আক্রমণ করেছেন। খৃস্টানদের বিশাল এক বাহিনী মিসরের দিকে আসছিল। আক্রান্ত হয়ে পিছনে সরে গেছে ওরা। জংগী কিছু এলাকাও দখল করেছেন। কিন্তু একটা সংবাদে আমি দারুণ উদ্বিগ্ন।’

‘ওরা আবার হামলা করেছে?’

‘ওদের আক্রমণে আমি ভীত নই। আমার উদ্বেগের কারণ হল, শত্রুকে যারা বাঁধা দেবে তারা মদের পিয়ালায় আকণ্ঠ ডুবে আছে। ইসলামের রক্ষকরা হারেমে বন্দী। যুবতী নারীর মোহনীয় চুল ওদের পায়ে শৃংখল পরিয়ে রেখেছে।

হায়, আমার চাচা শেরে কোহ আজ যদি বেঁচে থাকতেন! তিনিই আমাকে যুদ্ধের ময়দানে এনেছিলেন। সামান্য সৈন্য নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন শত্রুর ওপর। কিন্তু মুসলিম নামধারী বেঈমানের দল শত্রুর সাথে মিশে গিয়েছিল। তার সামনে তৈরী করেছিল দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর। তবু চাচা সাহস হারাননি। তুমিতো তার সব ইতিহাস জান।’

‘আমার সব কিছু মনে আছে সুলতান। সে সব যুদ্ধ এবং রক্তঝরার পর আশা করেছিলাম মিসর এবার সোজা পথে আসবে। কিন্তু এক গাদ্দারের মৃত্যু হলে এগিয়ে আসে অন্য গাদ্দার। আসলে গাদ্দার দুর্বল খেলাফতের সৃষ্টি, ফাতেমী খেলাফত হারেমের বিলাসে হারিয়ে না গেলে খৃস্টানদের সাথে আপনার যুদ্ধ এখানে নয়, ইউরোপে হত। আমাদের বন্ধুরাই আমাদেরকে বাইরে যেতে দিচ্ছে না। শাসক যখন ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে প্রজারা তখন সিংহাসের স্বপ্ন দেখে, সাহায্য চায় শত্রুর কাছে। ক্ষমতার লোভে তাদের স্ত্রী কন্যার ইজ্জত আব্রুর কথাও ভুলিয়ে দেয়।’

‘এদের আমি ভীষণ ভয় করি আলী। ইসলাম নিশ্চিহ্ন হলে এসব নামধারী মুসলমানের হাতেই হবে। আমাদের ইতিহাস এখন বিশ্বাসঘাতকের ইতিহাস, ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। আমার মন বলছে, এমন এক সময় আসবে যখন মানুষ নামে থাকবে মুসলমান, কিন্তু চিন্তা করবে শত্রুর মস্তিষ্ক দিয়ে। মসজিদের চেয়ে পতিতালয় বেশী থাকবে, অথবা ওদের ঘরগুলোই হয়ে উঠবে একেকটা পতিতালয়।

অমুসলিমরা মুসলমানকে সে পথেই নিয়ে এসেছে। মিসরে দেখা যাচ্ছে ঝড়ের পূর্বভাস। তোমার সংস্থাকে আরও শক্তিশালী কর, শত্রুর এলাকায় গিয়ে কমাণ্ডা হামলা এবং সংবাদ সংগ্রহের জন্য সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং বুদ্ধিমান যুবকদের বাছাই কর। গুপ্তচর বৃত্তির ময়দানে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হও আলী।’

‘আপনি দোয়া করুন, নতুন করে যে সব যুকব ভর্তি হচ্ছে তাদের মধ্যে আমি প্রাণের স্পন্দন দেখতে পাচ্ছি। তাদের নিষ্ঠা ও আগ্রহ আমাকে আশাবাদী করে তুলছে। এখানকার খবর কি?’

বেলাভূমিতে কুড়িয়ে পাওয়া বন্দীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তুমি ওদের সাথে একাবর দেখা করো।

প্রহরীকে ডাকলেন আইয়ুবী। বললেন, ‘আমাদের নাস্তা দাও।’

নাস্তা নিয়ে এল প্রহরী। খেতে খেতে কথা বলছিলেন আইয়ুবী, ‘গতকাল আরো কিছু আহত খৃষ্টান সৈনিককে এখানে আনা হয়েছে। এদের একজনকে আমার সন্দেহ হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে সাধারণ সৈনিক নয়। এছাড়া ঘটনাচক্রে একদল মেয়েকেও এখানে আশ্রয় দিতে হয়েছে। ওদের নিয়ে এসেছে পাঁচজন ব্যবসায়ী। এদের সাথেও একটু দেখা করো।

‘মেয়েরা এখানে কিভাবে এল?’

মেয়েদের ব্যাপারে ব্যবসায়ীরা যা বলেছিল সুলতান আলীকে তা শোনালেন। বললেন, ‘আসলে ওদের আশ্রয় দিয়ে আমার আওতায় নিয়ে এলাম। ওরা গরীব, দীর্ঘদিন জাহাজে ছিল। কিন্তু দেখে তা মনে হয়না। ওদের আলাদা তাঁবুতে রাখা হয়েছে। তুমি নাস্তা সেরে আগে ওদের সাথেই দেখা করো।

এরপর মৃদু হেসে বললেন, ‘কাল উপকূলে হাঁটছিলাম। হঠাৎ কোত্থেকে একটা তীর এসে দু’পায়ের ফাঁকে বালিতে গেঁথে গেল। রক্ষীরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে, কোন তীরন্দাজ পায়নি। ওরা ওই এলাকা থেকে পাঁচজন ব্যবসায়ীকে ধরে নিয়ে এসেছিল। ওরাই মেয়েগুলোকে এখানে রেখে গেছে।’

ওদের চলে যেতে দেয়া হয়েছে শুনে অবাক বিস্ময়ে সুলতানের দিকে তাকিয়ে রইলেন আলী।

‘আপনি তাদের যেতে দিলেন! রক্ষীরা ওদের মালপত্তর তল্লাশী নিয়েছে? সন্দেহ করা যায় এমন কিছু পাওয়া যায়নি ওদের কাছে?’

গভীর মনোযোগ দিয়ে তীরটা দেখলেন আলী। বললেন, ‘এক গোয়েন্দার দৃষ্টি আর সুলতানের দৃষ্টিতে অনেক পার্থক্য। সবার আগে ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করার চেষ্টা করব।’

তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলেন আলী বিন সুফিয়ান। একজন প্রহরী সালাম দিয়ে বলল, ‘আপনার সাথে একজন কমাণ্ডার কথা বলতে চাচ্ছেন।’

‘কি ব্যাপার?’

কমাণ্ডার এগিয়ে এসে বলল, ‘কালকে সাতজন মেয়ের মধ্যে একজন পালিয়ে গেছে। এ ছাড়া কাল রাতের ডিউটি কমাণ্ডার ফখরুল মিসরীকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রহরী বলছে, ডিউটি বদলের সময় তিনি তা চেক করতে বেরিয়ে ছিলেন। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। সুলতানকে এ খবরটি দেয়া জরুরী।’

গভীর ভাবনায় ডুবে গেলেন আলী বিন সুফিয়ান। কমাণ্ডার তার কাছে এসে অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘একটা খৃস্টান মেয়ে চলে যাওয়ার ঘটনা কি খুব গুরত্বপূর্ণ?’

খানিকটা ভেবে নিয়ে আলী বললেন, ‘শোন, সুলতানকে এখন কিছু বলার দরকার নেই। ফখরুল যখন টহল দিতে বেরিয়েছিলেন তখনকার সব প্রহরীদের ডেকে নিয়ে এস। কাল যেসব রক্ষী সুলতানের সাথে সাগর পারে গিয়েছিলেন তাদেরও ডাকবে।’

খবর পেয়ে চারজন প্রহরী এসে হাজির হল। আলী বললেন, ‘কাল যেখানে ব্যবসায়ী এবং মেয়েদের পেয়েছ সেখানে যাও। ব্যবসায়ীরা না গিয়ে থাকলে আমার না আসা পর্যন্ত যেতে দেবে না। না পেলে জলদি ফিরে এস।’

রক্ষীরা চলে গেল। মেয়েদের তাঁবুর কাছে পৌঁছলেন আলী। তাঁবুর বাইরে বসে আছে মেয়েরা। পাশে দাঁড়িয়ে আছে পাহারাদার। আলী মেয়েদের মুখোমুখি হয়ে আরবীতে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা এখানে ছ’জন কেন, আরেকজন কোথায়?’

ওরা পরস্পরের দিকে চাইতে লাগল। আলীর দিকে তাকিয়ে মাথা এপাশ ওপাশ করে বোঝালো তারা আরবী জানেনা।

‘তোমরা সবাই আমার ভাষা বোঝ।’

ওরা হতবাক দৃষ্টিতে আলীর দিকে তাকিয়ে রইল। ওদের সহজ সরল চেহারা দেখে দ্বিধায় পড়লেন গোয়েন্দা প্রধান। এরপর মেয়েদের পেছেনে গিয়ে আরবী ভাষায় বললে, ‘এদের উলংগ করে বারজন কাফ্রী সেপাই ডেকে নিয়ে এস।’

ওরা সবাই এক সঙ্গে পেছনে ফিরল। আতংকিত কণ্ঠে দু’তিনজন একসঙ্গে বলে উঠল, ‘মেয়েদের সাথে তোমরা এমন ব্যবহার করতে পারনা। আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিনি।’

হেসে ফেললেন আলী বিন সুফিয়ান। ‘তোমাদের সাথে খুব ভাল ব্যবহার করব। এক ধমকেই আরবী বলতে শুরু করেছ। এবার ধমক ছাড়াই বল সপ্তম মেয়েটা কোথায়?’

ওরা অজ্ঞতা প্রকাশ করলে আলী বললেন, ‘এ প্রশ্নের জবাব অবশ্যই তোমরা দেবে। একটু আগেও তোমরা বলেছ আরবী জানোনা, এখনতো দিব্বি আরবীতে কথা বলতে পারছ। ঠিক আছে, প্রশ্নের জবাব কি করে পাওয়া যায় আমি দেখছি। সেন্ট্রি, ওদের তাঁবুর ভিতরে নিয়ে যাও।

রাতের প্রহরী এল। ওদের অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন গোয়েন্দা প্রধান। মেয়েদের তাঁবুর প্রহরী বলল, ‘আমাকে দাঁড় করিয়ে তিনি বন্দীদের তাঁবুর দিকে গেলেন। কিছুক্ষণ পর একটা শব্দ শুনলাম, ‘কে তুমি, নেমে এস।’ মনে হল টিলার ওপর একটা ছায়াও দেখেছি। তবে খুবই অস্পষ্ট।

টিলার কাছে গেলেন গোয়েন্দা প্রধান। বালিতে পায়ের ছাপ সুস্পষ্ট। একটা সৈনিক বুটের ছাপ, অন্যটা মেয়েলী জুতো। মেয়েলী জুতার চিহ্ন ধরে আহত বন্দীদের তাঁবু পর্যন্ত চলে এলেন আলী। তাঁবুর পর্দা তুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। শুয়ে আছে পাঁচজন, একজন বসা। আলীকে দেখেই সে শুয়ে কাৎরাতে লাগল। আলী তার কাঁধ খামচে ধরে বাইরে নিয়ে এলেন।

‘রাতে একটা মেয়ে তোমার কাছে এসেছিল কেন?’

রবিন হাবার মত তাকিয়ে রইল। যেন এসব কথা সেকিছুই বুঝতে পারছে না। আলী তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘আমি তোমার ভাষা বুঝি। কিন্তু তোমাকে আমার ভাষাতেই কথা বলতে হবে।’

রবিন তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ‘ওকে এখানে বসিয়ে রাখ।’ প্রহরীকে বলে আবার তাঁবুর ভেতরে ঢুকলেন আলী। বন্দীদের বললেন, ‘কাল রাতে মেয়েটা কতক্ষণ এখানে ছিল? নিজেদের যন্ত্রণার মধ্যে ফেলো না, জলদি জবাব দাও ও কার কাছে এসেছিল?’

সাগরের উত্তাল তরঙ্গের সাথে লড়াই করে ওরা বেঁচে আছে। দেখেছে মৃত্যুর বিভীর্ষিকা। অথচ গোয়েন্দা প্রধানের একা কড়া ধমক খেতেই একজন বলে উঠল, ‘ও এসেছিল রবিনের কাছে। শুয়েছিল কি বসেছিল অন্ধকারে দেখা যায়নি। কি বলেছে তাও শুনিনি। মেয়েটা যে কে তাও জানিনা। রবিনের পদমর্যাদা সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ, আমরা শুধু তার নাম শুনেছি। এখানে আসরা আগমুহূর্ত পর্যন্ত সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল ও। আমরা সাবই সাধারণ সৈনিক। আমাদের ওপর রহম করুন।’

ওদের ওপর করা দৃষ্টি রাখতে বললেন প্রহরীদের। ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছলেন তিনি। রক্ষীরা ওদের তাঁবুর সামনে বসিয়ে রেখেছে। রক্ষীরা বলল, ‘কাল দু’টো উট দেখেছি, আজ একটা নেই।’

গোয়েন্দা প্রধানের জন্য এটা একটা মূল্যবান সংবাদ। ওদের জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু সন্তোষজনক জবাব দিতে পারল না ওরা। উটের পায়ের চিহ্ন পাওয়া গেল। আলী বললেন, ‘তোমরা সাধারণ চুরির অপরাধে অপরাধী নও। তোমরা একটা দেশ এবং একটা জাতির জন্য বিপজ্জনক। ক্ষমা তোমাদের করা যায় না। তোমরা কি ব্যবসায়ী?’

‘হ্যাঁ।’ সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল। ‘আমরা ব্যবসায়ী, আমরা নিরপরাধ।’

সবাই হাতের উল্টো পিঠ দেখাও।’

হাত উল্টে এগিয়ে ধরল ওরা। বাঁ হাতের তর্জনী এবং মধ্যমার মাঝখানটা দেখলেন আলী। একজনের হাতের কব্জি ধরে বললেন, ‘তীর কোথায় লুকিয়ে রেখেছ?’

ওরা না জানার ভান করল। সুলতানের এক দেহরক্ষীকে ডাকলেন আলী। উল্টো করলেন তার হাত। বললেন, ‘এ লোকটি আমাদের তীরন্দাজ। ওর দু আঙ্গুলের ফাঁকে তীরের ঘর্ষণের চিহ্ন রয়েছে। ধনুকে তীর জুড়ে নিক্ষেপের সময় তর্জনী এবং মধ্যমার ফাঁক দিয়ে তীর ছুটে যায়। তীরন্দাজ ছাড়া অন্য কারো এ চিহ্ন থাকেনা। পাঁচজনের মধ্যে কেবল তোমার আঙ্গুলে এই চিহ্ন রয়েছে। এবার বল তীর কোথায়?’

পাঁচজনই নীরব। ওদের একজনকে ধরে রক্ষীকে বললনে, ‘একে ওই গাছের সাথে বেঁধে দাও।’

তারপর অন্য এক রক্ষীকে ডেকে কানে কানে কিছু বললেন। রক্ষী লোকটাকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ল। বিঁধল ডান চোখে। তড়পাতে লাগল লোকটা।

‘ক্রুশের জন্য এভাবে আর কে জীবন দিতে পার? একে দেখ, তড়পাচ্ছে। রক্ত ঝরছে চোখ থেকে। কথা দিচ্ছি, তোমাদের সসম্মানে সাগরের ওপারে পাঠিয়ে দেব। বল দ্বিতীয় উট কে নিয়ে গেছে? কোথায় গেছে?’

‘তোমাদের এক কমাণ্ডার আমাদের একটি উট ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।’

‘সাথে একটি মেয়েও।’ আলীর কণ্ঠে বিদ্রুপ।

শেষতক স্বীকার করল ওরা। শোনাল সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী সম্পর্কে মেয়েটার বলা মিথ্যা কাহিনী। কিন্তু তাঁবু থেকে পালিয়ে আসাটা চেপে গেল।

আলীর ঠোঁটে শ্লেষের হাসি।

‘আশ্চর্য! একজন মাত্র লোক তোমাদের মত পাঁচজন সৈনিকের কাছ থেকে একটা উট এবং একটা মেয়ে ছিনিয়ে নিয়ে গেল?

তীর ধনুক বের করা হল বালির নীচ থেকে। তড়পাতে তড়পাতে মরে গেল তীর খাওয়া লোকটা।

দশজন অশ্বারোহী ডেকে দ্রুত উটের পায়ের চিহ্ন ধরে এগিয়ে যেতে বললেন গোয়েন্দা প্রধান। ওদের যাবার পনের ঘন্টা পর তাদের পিছু ধাওয়া করে ছুটল আলীর বাহিনী।

খাওয়া এবং বিশ্রাম ছাড়া উট একনাগাড়ে ছ’সাত ঘন্টা চলতে পারে। ধরা পড়ার ভয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল ফখরুল। মরুর জাহাজ উটও তার সহযোগিতা করছিল।

পথে দুজায়গায় উট বসার চিহ্ন পাওয়া গেল। পাশে খেজুরের বীচি, ফলের খোসা। আরো কিছুটা এগিয়ে আলী খাবার রাখার দু’টো থলে কুড়িয়ে পেলেন। একটা খালি, অন্যটাতে তখনও বেশ কিছু খাদ্যদ্রব্য অবশিষ্ট ছিল। খাবারগুলো নাকের কাছে নিতেই পরিচিত একটা গন্ধ নাকে লাগল। আলী বললেন, ‘এ খাবারে হাশিশ মেশানো।’

থলে দু’টো নিয়ে আবার চলতে লাগল কাফেলা। বিচক্ষণ আলী সময় নষ্ট না করে কাফেলাকে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে চললেন।

ফখরুল মিসরী এবং মুবি ধরা পড়লেও কিছু যায় আসে না। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সুদানী সেনাবাহিনীকে নতুন করে প্ররোচিত করার কিছু ছিল না। মুবির প্ররোচনা ছাড়াই আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ঘৃণার বিষ ভরা ছিল ওদের হৃদয়গুলো। এ বিষ ওদের পান করিয়েছিল নাজি। ফাতেমী খেলাফতের সেনাপতিরা ছিল নামে মাত্র জেনারেল। ওরা ছিল অকর্মণ্য ও বিলাসপ্রিয়। আইয়ুবীকে অথর্ব প্রমাণ করতে চাইছিল ওরাও।

মুসলিম শাসকরা খৃস্টান এবং ইহুদী যুবতীর রূপের হারেমে বন্দী। উপদেষ্টাদের বেশীরভাগ ইহুদী বা খৃস্টান। ভোগ আর সুরার অন্ধাকারে হারিয়ে গিয়েছিল ওদের বিবেক।

ওদেরকে হারেমের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করবেন আইয়ুবী, জাগিয়ে তুলবেন জাতির বিবেক, জেগে উঠবে মানবতা, এ অসহ্য। শেরে কোহ-এর শাসন থেকে ওরা বুঝেছিল, সালাহউদ্দীন আইয়ুবী তাদেরকে ধর্মের বন্ধনে আবদ্ধ করবেন। তাই তার সব পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিতে চাচ্ছিল ওরা। এ জন্য সাহায্যের আশায় হাত বাড়াল খৃস্টানদের কাছে। ওরা ময়দান উর্বর করছির খৃস্টান গোয়েন্দাদের জন্য।

নুরুদ্দীন জংগী না হলে সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর ইতিহাস হয়ত অন্যভাবে লেখা হত। বিশ্বের মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যেতনা এতগুলো মুসলিম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব।

আলীর চিঠি পেলেন নুরুদ্দীন জংগী। ঘোড়সওয়ার এবং পদাতিক মিলে দু’হাজার সৈন্য পাঠালেন আইয়ূবীর সাহায্য।

নাজির মৃত্যু সংবাদ পৌঁছে গেল সুদানী সেনা শিবিরে। সুলতান যুদ্ধের ময়দানে, মিসরে রয়েছে অল্প ক’জন সৈন্য, আক্রমণের সুবর্ন সুযোগ। মিসরের সেনা ছাউনিতে হঠাৎ আক্রমণ করা হবে এ সিদ্ধান্ত নিল ওরা।

মিসরে পৌঁছল আলীর ক্ষুদ্র কাফেলা। মুবি এবং ফখরুলকে পাওয়া যায়নি। সুদানী হেড কোয়ার্টারে নিয়োজিত গোয়েন্দাদের ডেকে পাঠালেন তিনি এক গোপন আস্তানায়। ওদের একজন বলল, ‘গতরাতে একটা উট এসেছে। আরোহী একজন পুরুষ ও এক যুবতী।’

‘কোথায় উঠেছে ওরা?’

ওরা কোথায় উঠেছে গোয়েন্দা তার বিশদ বর্ণনা দিল। সুদানীরা মুসলিম ফৌজেরই অংশ, ইচ্ছে করলে আলী যে কারো বাসায় তল্লাশী নিতে পারেন। এতে আগুনে ঘি ঢালা হবে। আরও ক্ষেপে যাবে সুদানী ফৌজ। মুবিকে গ্রেফতার করা তার আসল উদ্দেশ্য নয়, তার উদ্দেশ্য ওদের পরিকল্পনা জানা। নতুন নির্দেশ দিয়ে গোয়েন্দাদের ফেরত পাঠালেন তিনি।

চারদিন পর্যন্ত রাজধানীর বাইরে ঘোরাঘুরি করলেন আলী। পঞ্চম রাতে খোলা আকাশের নীচে বসে আছেন তিনি। বিশ্রাম করছেন আর ফাঁকে ফাঁকে শুনছেন গুপ্তচরদের রিপোর্ট।

এক গোয়েন্দা একটা লোককে ধরে নিয়ে এল। পা কাঁপছিল লোকটির, পড়ে যাচ্ছিল বারবার। গোয়েন্দা বলল, ‘ওর নাম নাকি ফখরুল মিসরী, জড়ানো কণ্ঠে ও শুধু বলছে আমাকে আমার সেনাবাহিনীর কাছে পৌঁছে দাঁও।’

ফখরুল গোয়েন্দা প্রধানের সামনে বসল।

‘একটা মেয়ে নিয়ে যে পালিয়ে এসেছে তুমি কি সেই কমাণ্ডার?’

‘আমিই সুলতানের রক্ষী বাহিনীর সেই পলাতক আসামী। মৃত্যুদণ্ডই আমার প্রাপ্য। তবে আমাকে মারার আগে আমার কথা শোন, নয়ত তোমরা সবাই মরবে।’

আলী বুঝলেন, কমাণ্ডারের এখনও নেশা কাটেনি। তাকে অফিসে নিয়ে গেলেন। পথে পাওয়া খাবারে থলে দেখিয়ে বললেন, ‘এটা কি তোমার? এখান থেকে কে খেয়েছে?’

‘হ্যাঁ, ও আমাকে এ থেকে খাইয়েছে।’

আলী থলে খুললেন। গুড়ের মত একটা টুকরা বেরিয়ে এল। এক ঝটকায় টুকরাটা হাতে তুলে নিল ফখরুল। মুখে দেওয়ার আগেই আলী তার হাত ধরে ফেললেন।

‘দোহাই আপনার, ছেড়ে দিন। এর ভেতর আমার জীবন, আমার আত্মা।’

‘আগে সব কথা খুলে বল। এরপর এর সবই তোমার।’

কমাণ্ডারকে এন্টি ড্রাগ খাওয়ানো হল। কিছুটা প্রকৃতিস্থ হলে গোটা কাহিনী বলল সে।

‘ব্যবসায়ীরা আমাকে কফি পান করাল। মনে হল অন্য পৃথিবীতে পৌঁছে গেছি আমি। মেয়েটা আমাকে ভালবাসার কথা বলল, লোভ দেখাল বিয়ের। আমরা দু’জন উটে সওয়ার হলাম।

পথে ধরা পড়ার ভয়ে বিশ্রাম করেছি কম। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করত। আমার পাশবিক সত্তা জেগে উঠলে বলত, এখন নয়, বিয়ের পর ওসব হবে। উটের সাথে খাদ্যের দুটো ব্যাগ, একটা থেকে ও খেত, আমাকে দিত অন্যটা থেকে। পথে থলে দু’টো কোথাও পড়ে গেল। খোঁজ করার জন্য পীড়াপীড়ি করল ও, আমি রাজি হইনি। বলেছি সময় নষ্ট হলে ধরা পড়ে যাব। খাবারের অভাব হলো, কিন্তু বসতি থেকে দূরে থাকতে চাইত ও।

চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় আমরা এক সুদানী কমাণ্ডারের কাছে পৌঁছলাম। আমার মাথায় অসংখ্য কীটের দংশন। কেন জানিনা, ধীরে ধীরে প্রকৃতিস্থ হলাম। মেয়েটা আমার সামনেই কমাণ্ডারকে সব কথা বলল। প্ররোচিত করতে লাগল বিদ্রোহ করার জন্য। বলল, আলী এবং আইয়ূবীর মাঝে ভুল বুঝাবুঝীর সৃষ্টি করতে হবে। তাদের দীর্ঘ আলোচনায় বিদ্রোহের কথাই প্রাধান্য পেয়েছে। তথোক্ষণে আমি পুরোপুরি সুস্থ।

আবার মাথার যন্ত্রণা, আবার সুস্থ, এভাবে চলতে লাগল। মেয়েটা কমাণ্ডারকে বলল, আইয়ুবী নেই, এখনি বিদ্রোহ করার উপযুক্ত সময়। ও আরও বলল, কিছু দিনের মধ্যেই খৃস্টান সৈন্যরা আবার আক্রমণ করবে। তখন আইয়ুবীকে এখানকার ফৌজও ডেকে নিতে হবে। কমাণ্ডার তার কথায় সম্মত হয়ে বলল, ছ’ সাত দিনের মধ্যেই তারা বিদ্রোহ করবে।

মাঝ রাতে আমাকে অন্য এক কামরায় পাঠিয়ে দেয়া হল। দু’কক্ষের মাঝে ছোট একটি দরজা। দরজাটি ওপাশ থেকে বন্ধ।

কমাণ্ডার এবং মেয়েটা হাসির শব্দ ভেসে আসছিল ও পাশ থেকে। আমার ঘুম আসছিল না। উঠে দরজায় কান লাগিয়ে উৎকর্ণ হয়ে রইলাম। মেয়েটা বলল, ‘ওকে হাশিশ খাইয়ে এদ্দুর এনেছি। একা এতদূর আসা সম্ভব ছিল না বলে পথে ছিলাম ওর প্রেমিকা। পথে হাশিশের পুটলিটা পড়ে গেছে। সকালে এক পুরিয়া না পেলে বিরক্ত করবে।

এরপর বুঝলাম, মদপানের সাথে সাথে ওরা পাপের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। অনেক পরে কমাণ্ডারের কণ্ঠ ভেসে এল, ‘ওর এখন আমাদের প্রয়োজন নেই। জেলে পাঠিয়ে দেব, না হয় মেরে ফেলব।’

‘বরং তাকে মেরেই ফেল।’ মেয়েটার কণ্ঠ, ‘থাকলে ঝামেলা করতে পারে।’

পালানোর চিন্তা করলাম, রাতের শেষ প্রহরে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। ভোরের আলো ফোটার আগেই অনেক দূর চলে এলাম। এবার দু’দিক থেকে ধাওয়াকারীদের ভয়, খৃস্টান বা সুদানীরা পেলে হত্যা করবে, আমাদের ফৌজের কাছেও আমি অপরাধী। তাই দিনে লুকিয়ে থাকতাম কোন পড়োবাড়ীতে। দেহ এবং মস্তিষ্ক দুটোই দুর্বল।

পথ চলতাম রাতে। কখনো ইচ্ছে হতো, ফিরে গিয়ে খৃস্টান মেয়েটাকে হত্যা করি। আবার ভাবতাম, সুলতানের পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইব। কিন্তু কিছুই সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারছিলাম না। এভাবে হাঁটছি, এ লোকটার সাথে দেখা। ও আমাকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছে।

সুদানীরা আক্রমণ করবে এখন এ আর আশংকা নয়, বাস্তব। সুলতানকে সংবাদ দিতে হবে, নষ্ট করার মত সময় নেই। কি করে দ্রুত সুলতানকে সংবাদ দিতে হবে, নষ্ট করার মত সময় নেই। কি করে দ্রুত সুলতানকে খবর দেয়া যায় ভাবতে লাগলেন আলী। একজন অফিসার এসে বলল, ‘সুলতান আপনাকে স্মরণ করেছেন।’

‘সুলতান!’ আলীর অবাক কণ্ঠ, ‘তিনি তো যুদ্ধের ময়দানে! এলেন কখন?’

সাথে সাথে সুলতানের সাথে দেখা করলেন তিনি। সুলতান বললেন, ‘সংবাদ পেলাম যুদ্ধের ময়দানে এবং এদিকে ওদের অনেক গুপ্তচর ছড়িয়ে পড়েছে। ওখানে আমার কাজ নেই। এ দিক নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি, তাই চলে এলাম।’

সব ঘটনা খুলে বললেন আলী। ‘সুলতান, আপনি বললে জংগীর ফৌজ আসা পর্যন্ত বিদ্রোহ মুলতবী করার চেষ্টা করে দেখতে পারি। আমাদের সৈন্য কম, ওদের আক্রমণ ঠেকাতে পারব না।’ সুলতান পায়চারি করতে লাগলেন। গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন তিনি। আলী অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন সুলতানে দিকে। কক্ষে নীরবতা।

হঠাৎ পায়চারী থামিয়ে সুলতান বললেন, ‘হ্যাঁ! আলী, এবার তোমার ভাষা ব্যবহার কর। আক্রমণের বিপক্ষে নয়, পক্ষে। ওরা আক্রমণ করবে রাতে, যখন ঘুমিয়ে থাকবে আমাদের ফৌজ।’

আলীর চোখে অবাক বিস্ময়। সুলতান মুখ খুললেন, ‘সব কমাণ্ডারদের ডেকে নিয়ে এস। মনে রেখ আমি এখনো যুদ্ধের ময়দানে। আমি এসেছি কেউ যেন জানতে না পারে।’

তিন রাত পর। গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে সমগ্র কায়রো। একদিন পূর্বে ফৌজকে শহরের বাইরে যেতে দেখা গেছে। বলা হয়েছে সামরিক মহড়ায় অংশ নিতে যাচ্ছে ওরা। নীলনদের পাড়ে বালিয়াড়ি আর টিলা।

টিলা এবং নদীর মাঝখানে ছাউনি ফেলল ওরা। পদাতিক এবং অশ্বারোহী সৈন্য। মাঝরাতে অশ্বক্ষুরের শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠল কায়রোবাসী। শহরের বাইরে যেন রোজ কিয়ামত। ওরা মনে করল সামরিক মহড়া।

শব্দগুলো এগিয়ে আসছে। বাড়ীর ছাদে উঠে এল উৎসুক জনতা। দিগন্তের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। দেখা গেল নীলের শান্ত বুক থেকে উঠে আসছে অগ্নিগোলক। ছাউনি লক্ষ্য করে রাতের বুক চিরে এগিয়ে আসছে তীব্র গতিতে।

শহরময় ছড়িয়ে পড়ল অশ্বক্ষুর ধ্বনি। মানুষ জানল না সুদানী ফৌজের বেশীরভাগ জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ হচ্ছে। সুলতান আইয়ুবীর কৌশল আবারো অভ্রান্ত প্রমাণিত হল। নীল আর পাহাড়ের মাঝের বালিয়াড়িতে তাঁবু ফেলল তার ক্ষুদ্র বাহিনী।

সুদানী ফৌজ দু’ভাগে ভাগ হল। মধ্যরাতে একভাগ মার্চ করল রোম উপসাগরের দিকে। সেখানে পরাজিত হয়েছে খৃস্টান বাহিনী। অন্যভাগ নীলের পাড়ের ছাউনিতে আক্রমণ করল। সুর্যোদয়ের পূবেই রাজধানী দখল করবে ওরা। দ্রুততার সাথে সুদানী বাহিনী সুলতানের ফৌজের ছাউনি দখল করল।

আচম্বিত তাঁবুতে নিক্ষিপ্ত হতে লাগল আগুনের গোলা। নীল থেকেও ছুটে আসছিল অগ্নিগোলক। তাঁবুতে আগুন ধরে গেল। অবাক হয়ে ওরা দেখল, আইয়ুবীর একজন সৈন্যও নেই তাঁবুতে।

রাতের প্রথম প্রহরেই সৈন্যদের সরিয়ে নিয়েছিলেন আইয়ুবী পাহাড়ে এবং নদীতে। ওদের দিলেন বহনযোগ্য কামান মিনজানিক। তাঁবুগুলো ভরে দিলেন তেলে ভেজা খড় এবং শুকনো ঘাস দিয়ে। সুদানী সৈন্যরা তাঁবুর কাছে এল। পাহাড় এবং নদী থেকে নিক্ষীপ্ত তোপের আঘাতে আগুন ধরে গেল শুকনো খড়ে। সুদানী ঘোড়সওয়াররা পদাতিকদের পিষে ফেলতে লাগল। চারদিকে আগুনের লেলিহান শীখা। বেরোতে গিয়ে জীবন্ত পুড়ে মরল অনেক সৈন্য। বেরিয়ে এলে পড়ত মুসলিম বাহিনীর তীরের আওতায়।

সুদানী ফৌজের অন্য দল এগিয়ে যাচ্ছিল রোম উপসাগরের দিকে। তাদের ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন সুলতান আইয়ুবী। পাহাড়ের ফাঁকে লুকিয়েছিল কমাণ্ডো বাহিনী। সুদানী ফৌজের পেছনে থেকে আক্রমণ করত ওরা। সৈন্যরা কিছু বোঝার আগেই পালিয়ে যেত। প্রচুর ক্ষতি স্বীকার করে আবার এগিয়ে চলত সুদানী বাহিনী। আবার পেছন থেকে আচমকা আক্রমণ।

অন্ধকার রাত। এ অন্ধকারে কমাণ্ডোদের ধাওয়া করা অসম্ভব। ভোর পর্যন্ত তিনবার আক্রান্ত হল ওরা। ভয় পেয়ে থেমে গেল ফৌজ। সামনে এগিয়ে যাবার সাহস হারিয়ে ফেলেছে ওরা।

দিনের বেলা কমাণ্ডাররা তাদের বোঝাল। সাহস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল সৈন্যদের। রাতে আবার আক্রমণ হল। অদৃশ্য শত্রুর তীরের আঘাতে মারা পড়ল অসংখ্য সৈন্য। হঠাৎ মাল বোঝাই উটগুলো দিকবিদিক ছুটতে লাগল। মাঝ পথে আগুন জ্বলছে। মাত্র দু’রাতের কমাণ্ডো আক্রমণে সুদানী বাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল। সৈন্যদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে দিল আলীর গোয়েন্দারা। আরব থেকে বিশাল বাহিনী আসার সংবাদে ভয় পেয়ে গেল ওরা। যে যেদিকে পারল পালিয়ে গেল।

নিঃশেষ হয়ে গেল সুদানী বাহিনী।

ওদিকে জংগীর পাঠানো ফৌজ কায়রো এসে পৌঁছল। ইচ্ছে করলে সুলতান আইয়ুবী সুদানীদের নির্বিচারে হত্যা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলেন। সুদানী কমাণ্ডাররা বুঝেছিল তারা অপরাধী, নিঃশেষ হয়ে গেছে ওদের সামরিক শক্তি। ওরা যে অপরাধ করেছে তাতে একমাত্র মৃত্যুদণ্ডই ওদর প্রাপ্য।

কিন্তু সুলতান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। সৈন্যদেরকে সরকারী জমি দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হল। এরপর ঘোষণা করা হল মিসরের সেনাবাহিনীতে ভর্তিচ্ছুদের স্বাগত জানানো হবে।

জংগীর পাঠানো সৈন্য, মিসরের ফৌজ এবং সুদানী বাহিনীর নতুন লোকদের নিয়ে সুলতান আইয়ুবী এক সুশৃখল এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুললেন।

আলী বিন সুফিয়ান তৈরী করলেন দুঃসাহসী কমাণ্ডো এবং গেরিলা বাহিনী।

খৃস্টানরাও অপরূপা সুন্দরী তরুণী এবং গুপ্তচরদেরকে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দিল। দু’পক্ষেরই সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন প্রায়।

সুলতান এসব সুন্দরী তরুনীদের বিষাক্ত ছোবল কিভাবে মোকাবেলা করবেন আর খৃস্টানরাই বা কিভাবে মোকাবেলা করবে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সুশৃঙ্খল বাহিনীর উভয় পক্ষ তা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইল।

কিন্তু এ পায়তারা শেষ হতে বেশী দিন সময় লাগল না। অল্পদিনের মধ্যেই ভয়ংকর সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ল ওরা।

রোমের এক উপশহর। জরুরী সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছেন খৃস্টান নেতৃবৃন্দ। এর মধ্যে রয়েছেন সম্রাট অগাস্টাস, সম্রাট রিমাণ্ড, এলমার্ক, সপ্তম লুইয়ের ভাই রবার্ট।

এদের মধ্যে সবচেয়ে ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছিল এমলার্ককে। খৃস্টানদের সম্মিলিত নৌবাহিনীর প্রধান তিনি। সুলতান সালাহউদ্দীনের হাতে পর্যুদস্ত হয়ে মেজাজ বিগড়ে গেছে তারা। বিজয় দূরে থাক, উপকূলের কাছেও ঘেঁষতে পারেনি সে। যারাই মিসর উপকূলে পা রাখার দুঃসাহস দেখিয়েছে, তারা হয়েছে বন্দী, নয়তো নিহত।

সুলতান আইয়ূবীর গোলন্দাজদের তোপের আঘাতে পুড়ে গেছে জাহাজের পাল এবং মাস্তুল। ভাগ্য ভাল যে সিপাইরা তার জাহাজের আগুন নিভাতে সক্ষম হয়েছিল।

পাল ছেঁড়া জাহাজ ঢেউয়ের দোলায় এগিয়ে গিয়ে পড়ল সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে। অনেক জাহাজ এবং নৌকা ঝড়ে ডুবে গেল। তার জাহাজের মাঝি মাল্লা সাহসিকতার সাথে ঝড়ের মোকাবিলা করল। একদিন পৌঁছল সমুদ্র উপকূলে। তীরে নেমেই মাঝি মাল্লাদের পুরস্কৃত করল এমলার্ক।

খৃস্টান নেতারা তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সম্মেলনের উদ্দেশ্য পরাজয়ের কারণ নিয়ে পর্যালোচনা করা। কেউ কি তাদের সাথে প্রতারণা করেছে? কে সে, নাজি?

তার চিঠি পেয়েই নৌসেনা পাঠানো হয়েছিল। নাজির চিঠি তাদের কাছে নতুন নয়। আগের লেখাগুলোর সাথে এ লেখার হুবুহ মিল আছে।

ওরা আবার চিঠি খুলে বসল। কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে। কায়রো থেকে গোয়েন্দারা কোন সংবাদ দেয়নি। নাজি কোথায় তাও ওরা জানেনা।

রাগে কাঁপছিল এমলার্ক। আইয়ুবীকে হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে নিয়ে আসবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল সে। তার দর্প চুর্ণ হয়ে গেছে। এমলার্ক পরাজিত, ক্লান্ত।

কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলো না ওরা। সম্মেলন পরদিনের জন্য মুলতবী ঘোষণা করা হল।

রাতে মদের আসর চলছে। এক অপরিচিত মুখ ভেতরে এল। শুধু রিমাণ্ড চেনে তাকে। বিশ্বস্ত গোয়েন্দা। আক্রমণের দিন সন্ধ্যায় তাকে মিসরের উপকূলে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। তার চোখের সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে খৃস্টানদের নৌবহর।

রিমাণ্ড গোয়েন্দার সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিল। ভিড় জমে উঠল তার চারপাশে। গোয়েন্দা বলল, ‘আহত হওয়ার ভান করে রবিন আইয়ুবীর ছাউনিতে পৌঁছে গেছে। রবিনের সহযোগী পাঁচজন ছিল। ব্যবসায়ীর পোশাকে। তাদের একজন ক্রিস্টোফার। সে তীর ছুঁড়েছিল আইয়ুবীকে লক্ষ্য করে। লাগেনি।

ধরা পড়েছে পাঁচজনই। সাথে সাতটা মেয়ে। ওরা চমৎকার গল্প ফেঁদেছিল। আইয়ুবী মেয়েগুলোকে রেখে ছেড়ে দিয়েছিল বাকী পাঁচজনকে। কিন্তু এদের গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান এসে সবাইকে গ্রেফতার করল। কথা আদায় করতে গিয়ে অত্যাচার করে মেরে ফেলল একজনকে। অপরাধ স্বীকার করল অন্যরা।

আমি নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়েছিলাম। সুলতান আমাকে আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব দিলেন। শুনেছি সুদানীদের বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে। বড় বড় অফিসারদের গ্রেফতার করা হয়েছে। রবিনসহ এগারজন বন্দী করা হয়েছে। সুবিনা আর তালাশকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ছাউনিতে আইয়ুবীও নেই, নেই আলী বিন সুফিয়ানও। অনেক টাকার বিনিময়ে একটা নৌকা জোগাড় করে আমি পালিয়ে এসেছি।

রবিন এবং অন্যদের উদ্ধার না করলে মারা পড়বে। ছেলেদের না হলেও মেয়েগুলোকে মুক্ত করা জরুরী। ওরা শুধু সুন্দরী ও যুবতীই নয়, মুসলমান আমীর ওমরাদের ফাঁসানোর জন্য ওদেরকে দীর্ঘদিন ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। এরকম সাতটা চৌকস মেয়ে তৈরী করতে অনেক সময় ও কাঠখড় পোড়াতে হবে আমাদের। মুসলমানরা তাদের কি অবস্থা করেছে কল্পনাও করতে পারবেন না।’

‘এ ধরনের সেক্রিফাইস তো আমাদের করতেই হবে।’ সম্রাট অগাস্টাস বললেন, ‘মেয়েদের মেরে ফেলা হবে এ নিশ্চয়তা তোমাকে কে দিল?’

রিমাণ্ড বলল, ‘কিন্তু তাই বলে মুসলমানরা ওদের সাথে পশুর মত আচরণ করবে আর আমরা চুপ করে বসে থাকব, তা হয়না। আমি ওদের মুক্ত করার চেষ্টা করব।’

রবার্ট বলল, ‘ভাল ব্যবহার করে মুসলমানরা ওদেরকে আমাদের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করতে পারে। ওদের মুক্ত করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা অর্ধেক সম্পদ এর জন্য ব্যয় করতে প্রস্তুত।’

‘ওরা মেয়ে বলেই এত দামী তা নয়।’ গোয়েন্দাটি বলল, ‘ওরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, তাছাড়া এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজে এমন মেয়ে ক’টাই বা পাওয়া যায়? আপনাদের যুবতী মেয়েরা কি এমনিভাবে শত্রুর হাতে নিজেকে তুলে দিতে পারবে? পারবে কি শত্রুর ভোগের সামগ্রী হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতে? মৃদু হাসির যাদু দিয়ে পারবে বড় বড় দুশমনকে পদানত করতে?’

‘যদি শত্রুরা ওদের পরিচয় জানতে পারে তবে ওদের মৃত্যু অনিবার্য।’

‘হ্যাঁ, প্রচুর টাকার বিনিময়ে আমরা ওদের নিয়েছি। ট্রেনিং দিয়েছি, বিভিন্ন ভাষা শিখিয়েছি। এমন অভিজ্ঞ মেয়েগুলোকে হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না।’

সম্রাট অগাষ্টাস প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা কি মনে কর ওদের বের করে আনা যাবে?’

‘জ্বী। শুধু ক’জন সাহসী লোক প্রয়োজন। হয়ত দু’একদিনের মধ্যে ওরা ওদেরকে কায়রো নিয়ে যাবে। তখন উদ্ধার করতে ঝামেলা হবে। সময় নষ্ট না করলে ক্যাম্পেই ওদের পাব। আমাকে কয়েকজন সাহসী এবং ত্যাগী লোক দিন, আমি ওদেরকে উদ্ধার করে নিয়ে আসব।’ বলল গোয়েন্দা।

‘অবশ্যই মেয়েদেরকে ফিরিয়ে আনতে হবে।’ ক্রোধ কম্পিত কণ্ঠে বলল এমলার্ক। পরাজয়ের অপমান তার চোখে মুখে। কখনো টেবিলে ঘুষী মেরে, কখনো নিজের উরু চাপড়ে কথা বলছিল সে।

‘আমি মেয়েদের ফিরিয়ে আনবো, হত্যা করব আইয়ুবীকে। রূপসী যুবতীদের দিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ছিন্নভিন্ন করে দেব।’

‘এমলার্ক!’ রিমাণ্ড বললেন, ‘আমি তোমার আবেগকে শ্রদ্ধা করি। ট্রেনিংপ্রাপ্ত মেয়েদরও সহজে হাতছাড়া করতে পারি না। তুমি তো জানোই আমাদের মেয়েরা সিরিয়ায় হারেমগুলো জমিয়ে রেখেছে। আমীর ওমরারা এখন ওদের হাতের পুতুল। নারী এবং সুরার গুণে মুসলিম বিশ্ব এখন তিনভাগে বিভক্ত। ঐক্য ভেংগে গেছে ওদের। শুধু দুটো লোক আমাদের জন্য বিপজ্জনক। একজন নুরুদ্দীন জংগী। অন্যজন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। এদের একজন বেঁচে থাকলেও ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা সহজ হবে না। আইয়ুবী সুদানী বিদ্রোহ দমন করেছে, তার মানে লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত। আমরা তার ওপর লক্ষ্য রাখছি।’

‘নিয়মিত যুদ্ধের পরিবর্তে গেরিলা যুদ্ধে তাকে হারাতে হবে। মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করতে হলে ট্রেনিংপ্রাপ্তা মেয়েদেরকে আমাদের প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজন।’

রবার্ট বলল, ‘হ্যাঁ, অভিজ্ঞতা আমাদের তাই বলে। মুসলমানরা নারীদেহের গন্ধ পেলে সব কিছু ভুলে যায়। এ যুদ্ধে ওদের হারাবার সহজ পথ হল ওদর হাতেই ওদেরকে মারতে হবে। বিনোদনের বিভিন্ন পথ উন্মুক্ত করে দাও, ওরা দ্বীন ঈমান ভুলে যাবে। শুধু যুবতী দেহের রূপ ও সৌন্দর্যের বিনিময়ে আরবের অনেক আমীর বাদশা এখন আমাদের হাতের পুতুল।’

মুসলমানদের দুর্বলতাগুলো নিয়ে এদের মধ্যে অনেকক্ষণ কথা হল। সিন্ধান্ত হল, মেয়েদের মুক্ত করা হবে। দুঃসাহসী ক’জন কমাণ্ডো পাঠানো হবে এ অভিযানে।

একটু পর পাঁচজন কমাণ্ডারকে ডেকে আনা হল। ওরা এলে বিস্তারিত পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেয়া হল ওদের।

একজন বলল, ‘আমরা আগে থেকেই দুঃসাহসী কমাণ্ডো ফোর্স তৈরী করে রেখেছি।’

‘কিন্তু এদের বিশ্বস্ত হতে হবে।’ অগাস্টাস বললেস, ‘ওরা কাজ করবে আমাদের দৃষ্টির আড়ালে। কিছু না করেও এসে বলবে অনেক কিছু করেছি।’

‘শুনে আশ্চর্য হবে, ওদের অনককে আমরা কারাগার থেকে সংগ্রহ করেছি। ওরা ছিল চোর, ডাকাত এবং খুনী। কেউ কেউ যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী। স্বতস্ফূর্তভাবেই ওরা আমাদের বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। মেয়েদের উদ্ধার করার জন্য আমি এমন তিনজন লোক দিতে পারব, কুখ্যাত খুনী হিসাবে যাদের ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল।

সকাল পর্যন্ত বিশজনের এক বাহিনী তৈরি করা হল। তাদের একজন মেগনামা মারইউস। সে ছিল রোমের জেলে। ডাক্তাররূপী এক গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান করা হল তাকে।

এদের প্রথম কাজ মেয়েদের মুক্ত করা। রবিন এবং তার সংগীদের মুক্ত করতে না পারলে ঝুঁকি নেয়ার দরকার নেই। দ্বিতীয় কাজ হল সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে হত্যা করা।

প্রয়োজনীয় অস্ত্রসহ সেদিনই তাদেরকে নৌকায় তুলে দেয়া হল।

সুদানীরা ব্যর্থ হয়েছে, দমন করা হয়েছে ওদের সেনা বিদ্রোহ। অনেক অফিসার ওদের নিহত হয়েছে। সুলতান আইয়ূবীর অফিসের সামনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছিল অনেকে। পরাজিত ও বিধ্বস্ত চেহারা। অস্ত্র সমর্পণ করে ওরা আনুগত্য মেনে নিয়েছে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর।

আইয়ুবী নিজের কমাণ্ডারদের বিভিন্ন নির্দেশ দিচ্ছিলেন। সাথে গোয়েন্দা প্রধান। এ বিজয়ে তার ভূমিকা অসামান্য। বলতে গেলে গোয়েন্দা যুদ্ধেই ওদের পরাজিত করা হয়েছে।

হঠাৎ আলীর দিকে তাকালেন সুলতান। বললেন, ‘আলী! ব্যস্তার কারণে সাতটি মেয়ে এবং তার সংগীদের নিয়ে কিছু ভাবতে পারিনি। ওরা ওখনও সাগর পারের ছাউনিতে। যত শীঘ্র সম্ভব ওদের এখানে নিয়ে এস।’

‘এখনি লোক পাঠিয়ে ওদের আনানোর ব্যবস্থা করছি। সুলতান! সম্ভবতঃ সপ্তম মেয়েটার কথা আপনি ভুলে গেছেন। ও এসেছিল সুদানী কমাণ্ডার বালিয়ানের কাছে। বালিয়ান বন্দী হয়নি, নিহত ও আহতদের মধ্যেও নেই। মেয়েটা সম্ভবতঃ বালিয়ানের সাথে পালিয়ে গেছে।’

‘আমার মনে হয় তুমি ঠিকই বলেছ। শোন, এখানে এখন তুমি না হলেও চলবে। বালিয়ান হয়ত রোম উপসাগরের দিকেই পালিয়েছে। খৃস্টান ছাড়া কে আর ওদের আশ্রয় দেবে? যেখানেই পাও, ওকে এনে জেলে পুরে দাও। আর গোয়েন্দাদের একটা দল সাগরের ওপারে পাঠানোের ব্যবস্থা কর।’

‘নিজের দেশেই গোয়েন্দাদের ছড়িয়ে দেয়া বেশী জরুরী।’ নুরুদ্দীন জংগীর পাঠানো সেনা কমাণ্ডার বলল, ‘খৃস্টানদের চাইতে মুসলমান আমীর ওমরারা আমাদের জন্য বেশী ক্ষতিকর। গোয়েন্দাদেরকে ওদের হারেমে ঢুকিয়ে দিতে পারলে অনেক ষড়যন্ত্রই প্রকাশ হয়ে পড়বে। সুলতান জংগী সব সময় উৎকন্ঠার মধ্যে থাকেন, বাইরের হামলা ঠেকাবেন, না ঘরের শত্রু প্রতিরোধ করবেন।’

কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন সুলতান আইয়ুবী। বললেন, ‘যাদের হাতে অস্ত্র আছে তারা যদি বিশ্বস্ত এবং দৃঢ় ঈমানের অধিকারী হয় তবে ভেতরের ষড়যন্ত্র এবং বাইরের আক্রমণ আমাদের কিছুই করতে পারবে না। একটা কথা মনে রেখো, মুসলিম বিশ্বের কোন সীমানা নেই। যখনি ইসলামকে সীমার সংকীর্ণতায় আবদ্ধ করা হয়েছে তখনি বিপর্যয় এসেছে। দৃষ্টিকে প্রসারিত করে তোমার দৃষ্টি নিয়ে যাও রোম উপরাগরের উপারে, দেখবে বিশাল জলরাশিও তোমার পথ রুখতে পারবে না। ঘরের যে আগুনকে ভয় পাচ্ছ তা এক ফুঁতে নিভে যাবে, সেখানে জ্বলবে দ্বীন এবং ঈমানের আলো।’

‘আমরা বেঈমানদের মোকাবেলা করার কথা বলছি সুলতান! আমরা নিরাশ হইনি।’ বলল কমাণ্ডার।

‘বন্ধুরা, তোমরা দুটো শব্দ থেকে দূরে থেকো ‘নৈরাশ্য’ এবং ‘মানসিক বিলাস’। মানুষ প্রথমে নিরাশ হয়, এরপর মানসিক বিলাসিতার মধ্যে দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়ায়।

আলী বিন সুফিয়ান বেরিয়ে গেলেন। একজন দ্রুতগামী ঘোড়সওয়ার পাঠিয়ে দিলেন সাগরপারের ছাউনিতে। তাকে বললনে, ‘রবিন এবং মেয়েগুলোকে ঘোড়া বা উটে করে সেনা প্রহরায় রাজধানীতে নিয়ে এসো।’

ওদের পাঠিয়ে দিয়ে দু’জন সেপাই সাথে নিয়ে তিনি নিজে বেরোলেন বলিয়ানের খোঁজে। হেড কোয়ার্টারের বাইরে দাঁড়ানো সুদানী কমাণ্ডাররা বলিয়ান সম্পর্কে কিছু তথ্য দিল। ওরা বলল, ‘বালিয়ানকে যুদ্ধের ময়দানে দেখা যায়নি। উপসাগরের ছাউনিতেও যায়নি সে।’

আলী পৌঁছলেন তার বাড়ীতে। দু’জন বৃদ্ধা চাকরানী ছাড়া কেউ নেই। ওরা বলল, ‘এখানে পাঁচজন যুবতী মেয়ে ছিল। কারো রূপ একটু ম্লান হলেই তাকে সরিয়ে দিত বালীয়ান। নিয়ে আসত তরতাজা উচ্ছল যুবতী। বিদ্রোহের আগে একটা ফিরিঙ্গী মেয়ে এসেছিল। ভীষণ সুন্দরী এবং সতর্ক। আমাদের মালিক ছিল তার হাতের পুতুল। বিদ্রোহের পর সুদানীরা যেদিন আত্মসমর্পন করল সে রাতে তিনি সাতজন ঘোড়সওয়ারসহ মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে যান। উনি চলে যাবার পর হারেমের অন্যান্য মেয়েরা হাতের কাছে যে যা পেয়েছে তাই নিয়ে ভেগেছে।’

আলী ফিরে আসার জন্য ঘুরলেন, এক দ্রুতগামী সওয়ার তার সামনে এসে লাফিয়ে পড়ল ঘোড়া থেকে। সওয়ারের নাম ফখরুল মিসরী।

হাঁফাতে হাঁফাতে সে বলল, ‘আমি আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছি। বালিয়ান এবং সে মেয়েটাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। ওরা কোন দিকে গেছে আমি জানি। ওদের পিছু নিয়েছিলাম আমি। কিন্তু ওদের সাথে সাতজন সশস্ত্র প্রহরী থাকায় আমি ফিরে এসেছি। আমি প্রতিশোধ নিতে চাই। ওদের দু’জনকে নিজের হাতে হত্যা করতে না পারলে আমি শান্তি পাব না। আমি একা, খোদার দিকে চেয়ে আমার সাথে কয়েকজন সিপাই দিন।’

‘ওরা কোথায়?

‘ওরা রোম উপসাগরের দিকে যাচ্ছে। তবে ওরা পথ চলছে খুব সাবধানে। সাধারণতঃ তারা বড় রাস্তা এড়িয়ে পার্শ্ববর্তী সরু রাস্তা মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

ফখরুল মিসরী দ্রুত নুয়ে আলীর পায়ে হাত রেখে অনুনয় করে বলল, ‘আমি ওদের পিছু নেব, হত্যা করব ওদের। দয়া করে আমার সাথে মাত্র চারজন সেপাই দিন।’

আলী তাকে শান্ত করলেন। ‘চারজন নয় বিশ জন সওয়ার দেব। ওরা এত শীঘ্র সাগর পারে পৌঁছতে পারবে না। আমরা ওদের পিছু নিচ্ছি, তুমিও থাকবে আমাদের সাথে।

ওদের খোঁজ পেয়ে আলী এবার নিশ্চিন্ত মনে ওদের পিছু নিলেন।

অনেক পথ অতিক্রম করেছে বালিয়ান এবং মুবি। সাধারণ রাস্তা ছেড়ে এগিয়ে চলেছে ওরা। এসব পথঘাট বালিয়ানের চেনা থাকায় পথ চলতে ওদের কোন অসুবিধা হচ্ছে না।

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন তা জানত না বালিয়ান। ভয়ে পালাচ্ছে সে, মুবির মত সুন্দরী যুবতীকে হাতছাড়া করার ইচ্ছে নেই তার। ওর ধারণা ছিল, মিশর এবং সুদানেই রয়েছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সুন্দরীরা। কিন্তু ইটালীর এ যুবতীর রূপ তাকে অন্ধ করে দিয়েছে। তার জন্য উচ্চপদ, ধর্ম এবং দেশ ছাড়তেও কুণ্ঠিত হয়নি সে।

ও জানত না, মুবি তার কাছ থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। সে যে উদ্দেশ্যে দ্বিগুণ বয়েসী এ লোকের কাছে নিজরের হৃদয়, নিজের ইজ্জত বিকিয়ে দিয়েছে তা বরবাদ হয়ে গেছে।

মুবির মত যুবতীর ভালবাসা পেয়ে বালিয়ান ছিল তৃপ্ত। কিন্তু এখন মুবি তাকে ঘৃণা করছে। একজন নারীর পক্ষে একা পথ চলা সম্ভব নয় বলেই বাধ্য হয়ে তার সাথে যাচ্ছে সে। রবিনকে খুঁজে বের করাই এখন তার প্রধান কাজ। ওকে না পেলে সে ফিরে যাবে সাগরের ওপারে।

অনিচ্ছাসত্বেও তাকে বালিয়ানের ভোগের সামগ্রী হতে হচ্ছে। ও কয়েকবারই বলেছে, ‘বিশ্রাম কম করে তাড়াতাড়ি এগিয়ে চল।’ কিন্তু বালিয়ান একটু ভাল জায়গা পেলেই থেমে যেত।

একরাতে বালিয়ানকে মদ ঢেলে দিচ্ছে মুবি। ইচ্ছে করেই বেশী খাওয়ালো। নেশায় বুঁদ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল বালিয়ান। প্রহরীরাও শুয়ে আছে।

ধীরপায়ে এক প্রহরীর কাছে গেল ও। যুবক বয়স। সাহসী। বালিয়ানের বিশ্বস্ত। আলতো স্পর্শে তাকে জাগাল মুবি। নিয়ে গেল খানিক দূরে। বলল, ‘তুমিতো জান আমি কে? কেন এসেছি।’

যুবক কোন কথা না বলে মাথা নাড়ল।

‘তোমাদের জন্য সাহায্যের আশ্বাস নিয়ে এসেছিলাম। চেয়েছিলাম সালাহউদ্দীনকে সরিয়ে তোমাদেরকে ক্ষমতায় বসাব। কিন্তু তোমাদের এ কমাণ্ডার অপদার্থ। বিদ্রোহের পরিকল্পনা করবে তা নয়, প্রতিরাতে মাতাল হয়ে আামাকে ভোগ করা শুরু করল। আমি হলাম তার হারেমের বন্দিনী।’

সামান্য বিরতি নিয়ে মুবি আবার বলতে শুরু করল, ‘কোন চিন্তা ভাবনা না করেই ফৌজকে দু’ভাগে ভাগ করল ও। আক্রমণ করল বুদ্ধিহীনের মত। যার ফলে তোমাদের এক বিশাল বাহিনী শেষ হয়ে গেল। তোমাদের পরাজয়ের জন্য এ লোকটা সম্পূর্ণরূপে দায়ী। এখনও সে আমাকে ভোগ করে চলছে। আমাকে বলছে দেশে নিয়ে আমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু ওকে আমি ঘৃণা করি।

বিয়ে করতে হলে কাকে করব সে সিদ্ধান্ত আমার। তোমাকে আমি ভালবাসি। তুমি যুবক, সাহসী এবং বুদ্ধিমান। প্রথম দেখার দিন থেকেই তোমাকে আমার ভাল লেগেছে। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। এ বুড়ো হাবড়াটার হাত থেকে আমাকে উদ্ধার কর। তোমাকে আমি সাগরের ওপারে নিয়ে যাব। সেনাবাহিনীর বড় পদ এবং ধন সম্পদ থাকবে তোমার পদতলে। কিন্তু একে শেষ না করলে তা সম্ভব নয়। ও ঘুমিয়ে আছে। ওকে হত্যা করে চল আমরা দু’জনে পালিয়ে যাই।’

সৈনিকটার গলা জড়িয়ে ধরল মুবি। মুবির মাতাল করা রূপ তাকে পাগল করে তুলল। কিছুক্ষণ জড়িয়ে রেখে তাকে ছেড়ে সরে বসল ও। যুবক এগোল তার দিকে। আচমকা একটা বশা এসে বিঁধল যুবকের পিঠে। ‘আঃ!’ শব্দ করে লুটিয়ে পড়ল সে। বর্শা টেনে তুলল একজন। বলল, ‘নেমকহারামের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।’

আতংকিত চিৎকার বেরিয়ে এল মুবির কণ্ঠ থেকে। দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোমরা লোকটাকে মেরে ফেললে!’

পেছন থেকে কেউ তার বাহু খামছে ধরল। ঝাঁকুনি দিয়ে টেনে নিয়ে চলল বালিয়ানের কাছে।

‘আমরা এ ব্যক্তির পালিত বন্ধু। তার সাথেই আমাদের জীবন মরণ। আমাদের কাউকে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপাতে পারবে না। নিমকহারাম তার শাস্তি পেয়েছে।’

‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ ভেবেছ একবারও?’

‘সাগরে ডুবতে যাচ্ছি। তোমার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। বালিয়ান যেখানে যাবে, আমরাও সেখানে যাব।’

বালিয়ান তখনো মাতাল হয়ে পড়ে আছে। ওরা দু’জন শুয়ে পড়ল আবার। পরদিন বালিয়ানকে সব ঘটনা খুলে বলা হল। মুবি বলল, ‘লোকটা আমাকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।’

রক্ষীদের ধন্যবাদ জানাল বালিয়ান। আবার পথ চলতে শুরু করল ওরা। মুবি আবারও দ্রুত চলার জন্য তাগাদা দিতে লাগল। বলল, ‘যতশ্রীঘ্র সম্ভব এগিয়ে যাওয়া উচিৎ।’

বালিয়ান চলল তার নিজস্ব গতিতে। মুবির রূপ যৌবন তাকে বিবেকশূন্য করে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু পরিস্থিতি সম্পর্কেও সে ছিল সজাগ। চারদিক দেখেশুনে সাবধানে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল তার। মুবি বুঝেছে, বালিয়ানের হাত থেকে মুক্ত হওয়া এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। প্রয়োজনে এরা বন্ধুকে হত্যা করতেও কুণ্ঠিত হয় না।

বিদ্রোহ পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সুলতান আইয়ুবী আলী বিন সুফিয়ানকে নিজের কাছে রাখা জরুরী মনে করলেন। এ খবর পেয়ে আলী বিন সুফিয়ান ওদের পিছু নেয়া বাদ দিয়ে ছুটে এলেন আইয়ুবীর কাছে। এসেই তিনি এমন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে, ওদের পিছু নেয়ার আর সুযোগ করে উঠতে পারলেন না।

রবিন ও মেয়েদেরকে পনেরজন সেন্ট্রির পাহারায় কায়রো পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বন্দীরা চলছে উটের পিঠে প্রহরীরা ঘোড়সওয়ার। স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলেছে ওরা। মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছে। নির্ভয়ে চলছে কাফেলা। কোন দিক থেকে শত্রুর আক্রমণের ভয় নেই। কয়েদীরা নিরস্ত্র, সাথে ছ’টা মেয়ে। ওরা পালিয়ে যাবে সে আশঙ্কাও নেই। কিন্তু প্রহরীরা জানেনা এরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দা। মেয়েরাও অবলা নয়, ওদেরও সামরিক প্রশিক্ষণ রয়েছে। ওদের রূপ যৌবন, মাদকতাময় দেহ এবং যে কাউকে প্রেমের ফাঁদে জড়ানোর মত অস্ত্র রয়েছে ওদের কাছে। ওদের কমাণ্ডার মিসরী।

একটা মেয়ে তার দিকে বার বার তাকাচ্ছে। চোখে চোখ পড়লেই হাসছে মিষ্টি করে। হৃদয় গলানো হাসি।

কমাণ্ডারের মনে তোলপাড় শুরু হল। বিশ্রামের সময় খাবার দেয়া হল। মেয়েটা খাবার ছুঁলনা। কমাণ্ডারকে জানানো হল এ কথা। কমাণ্ডার মেয়েটাকে ডেকে না খাওয়ার কারণ জানতে চাইল। মেয়েটা কিছুই বলল না, কেবল মায়াময় চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

কমাণ্ডার বললেন, ‘কি ব্যাপার, তুমি খাচ্ছো না কেন?’

মেয়েটা কাঁদকে কাঁদতে বলল, ‘আমার খালী মায়ের কথা মনে পড়ে।’

মায়ের কথা শুনে কমাণ্ডারের মনটা কেমন নরম হয়ে গেল। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে খেতে পাঠাল তাকে। যাবার সময় মেয়েটা বলল, ‘কেবল আপনাকে খুশি করার জন্যই আমি এখন খাব, নইলে খাওয়ার প্রতি আমার কোন রুচি নেই।’

‘কিন্তু না খেলে যে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে।’

তীর্যক কটাক্ষ হেনে মেয়েটা বলল, ‘আমি অসুস্থ হলে আপনার কি? আমি কি আপনার ইয়ে…’ বলেই লজ্জায় আরক্তিম হয়ে ওখান থেকে সরে পড়ল। মেয়েটার এই কটাক্ষ গেঁথে রইল ওর মনে।

নিশুতি রাত। সবাই ঘুমিয়ে আছে। আলগোছে উঠল কমাণ্ডার। মেয়েটার কাছে গিয়ে আলতো করে টোকা দিল তার গায়ে। চোখ মেলে ওকে দেখেই হাসল মেয়েটা। ওরা সরে এল নিরিবিলি জায়গায়।

মেয়েটা বলর, ‘আমি এক অসহায় তরুণী। ভাগ্য খারাপ বলে আজ এই করুণ পরিণতি। খৃস্টান সৈন্যরা আমাকে অপহরণ করে নিয়ে তুলেছে জাহাজে। অন্য মেয়েদের সাথে জাহাজেই পরিচয় হয় আমার। তাদেরকেও অপহরণ করা হয়েছে। হঠাৎ জাহাজে আগুন লাগায় আমাদের তুলে দেয়া হল একটা নৌকায়। নৌকা তীরে ভিড়ল। গোয়েন্দা ভেবে আমাদেরকে বন্দী করল সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সৈন্যরা।

কমাণ্ডার জানত না সুলতানকেও এ কল্পকাহিনীই শুনিয়েছে ওরা।

কমাণ্ডারকে শুধু বলা হয়েছে, ‘এরা অত্যন্ত বিপজ্জনক বন্দী। কায়রোর গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ওদের হস্তান্তর করতে হবে।’

কমাণ্ডার তাকে তার অপারগাতর কথা জানিয়ে বলল, ‘এ ব্যাপারে আমি তোমাদের কোন সাহায্য করতে পারছি না।’

মেয়েটা মাত্র তুনীর মাত্র একটা তীর ছুঁড়েছে। এখনো অনেক তীর বাকী। বলল, ‘আমি তোমার কাছে কোন সাহায্য চাইনা। তুমি সাহায্য করতে চাইলেও আমি বাঁধা দেব। জানিনা তোমাকে কেন এত ভাল লাগে। আমার জন্য তুমি কোন বিপদে পড়বে, তা আমি হতে দেবনা। আমার সমব্যাথী কেউ নেই। মেয়েরা আমার আপন কেউ নয়, পুরুষদের চিনিনা। মনে হল তোমার মনটা বড় ভাল এজন্য তোমার কাছে আমার দুঃখের কথা বলে মনটা হালকা করছি।’ যুবতি কমাণ্ডারের আরো কাছে সরে এল।

কাজ হল এতে। যুবতীর কাঁধে হাত রেখে সহানুভূতির সুরে বলল কমাণ্ডার, ‘তোমাদের জন্য আমার কষ্ট হয়। কিন্তু এ অবস্থায় তোমার জন্য আমি কিইবা করতে পারি।

আরেকটা তীর ছুঁড়ল ও। বলল, তোমাদের সুলতানকে আমার এ দুঃখের কাহিনী শুনিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তিনি দয়া করে আমাদের দেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু তিনি আমাকে তার তাঁবুতে ডেকে নিলেন। মদে মাতাল হয়ে সারারাত আমার দেহ নিয়ে খেলা করলেন। ও আস্ত একটা জানোয়ার। মদ খেলে সে আর মানুষ থাকে না। আমার হাড়গোড় সব ভেঙে দিয়েছে।’

কমাণ্ডারের রক্তে আগুন লাগল, জেগে উঠল তার পশু শক্তি। মিসরীয় পৌরুষ নিয়ে সমবেদনার সুরে তার গায়ে, মুখে হাত বুলাতে বুলাতে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘আমাদের বলা হয়েছে আইয়ুবী একজন খাঁটি মুমিন। একজন ফেরেস্তা। মদ এবং নারীকে তিনি ঘৃণা করেন। অথচ….’

মেয়েটা তার দেহের ভার কমাণ্ডারের বুকে ছেড়ে দিতে দিতে বলল, ‘আমাকে তো এখন তার কাছেই নিয়ে যাচ্ছ। বিশ্বাস না হলে রাতে দেখো আমি কোথায় থাকি? আমাকে সুলতান জেলে দেবে না, রাখবে তার নিজস্ব হারেমে। ভয়ে এখনি আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।’

এ ধরনের কথায় সুলতানের ওপর কমাণ্ডারের মন বিষিয়ে উঠছিল। কমাণ্ডার জানতো না, যুবতী গোয়েন্দারা এ হাতিয়ার দিয়েই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে। মেয়েটার প্রেমে হাবুডুব খেতে লাগল সে।

‘যদি তুমি আমাকে এ অপমানকর জীবন থেকে মুক্তি দাও, আমি চির জীবনের জন্য তোমার হয়ে যাব। আমার পিতা বিত্তশালী। আমাকে এ অপমানকর জীবন থেকে উদ্ধার করেছ জানতে পারলে তিনি তোমাকে আনন্দের সাথেই গ্রহণ করবেন। চলো আমরা সাগরের ওপারে পালিয়ে যাই।’

‘কিন্তু…’

‘শোন, কোন কিন্তু নয়। দেশে গিয়ে আমি তোমাকে বিয়ে করব। বাবা তোমায় বাড়ী দেবেন, সম্পদ দেবেন। তুমি নিশ্চিন্তে ব্যবসা করে হেসেখেলে জীবনটা পার করতে পারবে।’

কমাণ্ডার বলল, ‘কিন্তু আমি আমার ধর্মত্যাগ করতে পারব না।’

মেয়েটা কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, ‘আমি আমার ধর্ম ছেড়ে দেব।’

এরপর ওরা বিয়ের পরিকল্পনা করতে লাগল। মেয়েটা বলল, ‘আমি তোমাকে বাধ্য করছিনা, ভাল করে ভেবে দেখো কি করবে। আমি শুধু একটা কথা জানতে চাই, আমি তোমাকে যেমন ভালবাসি, তুমিও তেমনটি বাস কিনা। যদি তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও, তবে কায়রো যেতে দেরী করো। একবার কায়রো গেলে তুমি আমার গন্ধও পাবে না।’

মেয়েটা সফর দীর্ঘায়িত করতে চাইছিল, কারণ পলানোর পরিকল্পনা করছিল রবিন। তিনদিনে সফর শেষ হয়ে গেলে তা সম্ভব নয়। ঘুমন্ত প্রহরীদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের হত্যা না করলে পালানো যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ সময়ের। ওরা নিশ্চিন্ত না হলে ও সুযোগ পাওয়া যাবে না।

এ জন্য মেয়েটাকে কমাণ্ডারের পেছনে লাগিয়েছে ওরা। প্রথম সাক্ষাতেই মেয়েটা সফল। যৌবন পুষ্ট দেহটা কমাণ্ডারকে উজাড় করে দিয়েছে সে। কমাণ্ডার উচ্চপদস্থ কোন অফিসার নয়। এমন সুন্দরী যুবতী সে কখনও দেখেনি। কল্পনা দেবী তার হাতের মুঠোয়। ভুলে গেল সে কর্তব্য এবং ধর্ম।

সকালে কমাণ্ডার ঘোষণা করল, ‘পশুগুলো ক্লান্ত, আজ সফর করব না।’

ঘোষণা শুনে সবাই খুশী। ময়দানের কঠিন নিয়ম কানুনে ওরা হাঁফিয়ে উঠেছিল। কায়রো পৌঁছনোর কোন তাড়া ওদের নেই।

বিশ্রাম আর গল্পগুজবে কেটে গেল দিন। কমাণ্ডারের সময় কাটল মেয়েটার কাছে।

রাত নামল। ঘুমিয়ে পড়ল সবাই। মেয়েটাকে নিয়ে দূরে সরে এল কমাণ্ডার। সুখের অতলে হারিয়ে গেল দু’জনে।

ভোরে কাফেলা রওনা হল। পথ পরিবর্তন করল কমাণ্ডার। বলল, ‘এদিকে যাত্রা বিরতির জন্য সুন্দর জায়গা পাওয়া যাবে। খাওয়ার জন্য পাশের গ্রাম থেকে ডিম এবং মুরগীও আনতে পারবো।

কমাণ্ডার তাদের বিনোদনের সুযোগ দিচ্ছে ভেবে প্রহরীরা ভীষণ খুশী। কিন্তু দু’জন প্রহরী কমাণ্ডারের এসব কাজে খুশী হতে পারেনি। ওরা তাকে বলল, ‘আমরা বিপজ্জনক বন্দীদের নিয়ে যাচ্ছি। ওদের সবাই গুপ্তচর। যতশীঘ্র সম্ভব ওদেরকে সংস্থার হাতে পৌঁছে দেয়া উচিৎ। অকারণে সফর দীর্ঘ করা ঠিক হবে না।’

‘তাড়াতাড়ি পৌঁছব কি দেরীতে পৌঁছব সে দায়িত্ব আমার। এ ব্যাপারে তোমাদের না ভাবলেও চলবে। জবাবদিহী করতে হলে আমি করব।’

ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেল প্রহরী দু’জন। তারপরও দু’জন আড়ালে আবডালে শলাপরামর্শ করতে লাগল।

দুপুর। দূর আকাশে একঝাঁক শুকুন উড়ছে। হয়ত লাশ আছে আশপাশে। এলাকাটা বালিয়াড়ি হলেও ছোট ছোট টিলায় মরুবৃক্ষ আছে।

কাফেলা একটা টিলায় পৌঁছল। চড়াই পেরিয়ে বিস্তীর্ণ মাঠ। মাঠে শুকুনের ভিড়। ওরা তাকিয়ে দেখল প্রান্তর জুড়ে অসংখ্য লাশ। সুলতান আইয়ুবীর কমাণ্ডো বাহিনীর আক্রমণে নিহত সুদানী ফৌজ। সুদানীরা লাশ তুলে নিতে পারেনি, পালিয়ে গেছে জীবন নিয়ে। লাশের পাশে পড়ে আছে অস্ত্র। ঢাল, তলোয়ার, নেযা, বল্লম।

ময়দানের পাশ ঘেঁষে এগিয়ে চলল ওরা। পড়ে থাকা অস্ত্রের দিকে জুলজুল চোখে তাকাল রবিন। কথা বলল সংগীদের সাথে।

ডান দিকে সবুজের সমারোহ। সুপেয় ঝরণা। চোখের ইশারায় কমাণ্ডারকে ডাকল মেয়েটা। এগিয়ে এল মিসরী। মেয়েটা বলল, ‘চমৎকার জায়গা, চলোনা বিশ্রাম করি।’

কাফেলাকে থামতে হুকুম দিল কমাণ্ডার। ঝরণার পাশে থামল ওরা। আরোহীরা নেমে পড়ল উট এবং ঘোড়া থেকে। পশুগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে। রাতে থাকার জন্য তাঁবু খাটানো হল দুই টিলার ফাঁকে সবুজ ঘাসে ভরা প্রশস্ত মাঠে।

মরুভূমিতে নেমে এসেছে অন্ধকার রাত। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু কমাণ্ডারের চোখে ঘুম নেই। কখন মেয়েটার কাছে পৌঁছবে এ ভাবনায় অস্থির সে।

জেগে আছে মেয়েটাও। ‘আজ কমাণ্ডারকে মাতাল করতে হবে’ মনে মনে বলল ও।

নীরব রাতে প্রহরীদের নাক ডাকার শব্দ ভেসে আসছে। মিসরী উঠল। পা টিপে টিপে পৌঁছল মেয়েটার কাছে। টিলা ওপাশে চলে গেল ওরা। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল অন্য টিলায়। গাছের ছায়ায় গাঢ় অন্ধকার। ওরা একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসল।

ছাউনিতে কমাণ্ডার নেই। প্রহরীরা সবাই ঘুমিয়ে আছে। কোন সেন্ট্রি নেই। এ অপূর্ব সুযোগকে কাজে লাগালো রবিন। নিঃশব্দে সংগীদের জাগাল। হামাগুড়ি দিয়ে দূরে সরে গেল একে একে সবাই।

টিলার আড়াল হয়ে দৌড়াতে লাগল ওরা। পৌঁছল লাশের কাছে। তীর ধনুক এবং বর্শা নিয়ে ফিরে এল। ঘুমন্ত প্রহরীদের পাশে এসে দাঁড়াল রবিন। বর্শা তুলল মারার জন্য, অন্য চারজনও তৈরী। ঘুমের মধ্যে একসঙ্গে পাঁচজনকে শেষ করতে পারছে এ আনন্দে উদ্ভাসিত ওদের চেহারা।

নিহতদের চিৎকার সঙ্গীদের কানে পৌঁছার আগেই বাকীদেরও নিরস্ত্র অবস্থায়ই হত্যা করতে হবে। রবিন পেছনের দিকে তাকাল একবার। দেখল একটু দূরে ঘুমিয়ে আছে উট চালক তিনজন। কমাণ্ডারকে নিয়ে মেয়েটা সরে গেছে দূরে।

রবিন একজন সৈনিকের বুক লক্ষ্য করে বর্শা নামিয়ে আনতে শুরু করেছে, হঠাৎ একটা তীর এসে তার বুকে বিঁধে গেল। অন্য একটা তীর লাগল তার সংগীর গায়ে। ওরা কিছু বুঝে উঠার আগেই আরও দুটো তীর ওদের দুই সঙ্গীর বুকে এসে বিঁধল।

এগিয়ে এল তীর নিক্ষেপকারী সৈনিক দু’জন। কমাণ্ডারের সাথে এদেরই কথা কাটাকাটি হয়েছিল দিনের বেলা।

শুয়েছিল ওরাও। বন্দীরা ওদের পাশ দিয়ে যাবার সময় চোখ খুলে গেল একজনের। তাকিয়ে দেখল বন্দীরা পালিয়ে যাচ্ছে। ওরা একটু দূরে যেতেই পাশের জনকে জাগাল সে। ফিসফিস করে বলল, ‘ওরা পালাচ্ছে।’

‘কারা?’

‘বন্দীরা।’

‘কই? কোন দিকে গেছে?’ দ্রুত উঠে বসল সে। প্রথম সৈনিকটি হাত ইশারায় বন্দীদের গমনপথের দিকটা দেখাল ওকে। প্রথম সৈনিকটি উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চল, ওদের পিছু নিতে হবে।’

সাবধানে বন্দীদের অনুসরণ করে এগিয়ে চলল দু’জন। দেখল বন্দীরা অস্ত্র কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে আসছে।

টিলার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল দু’জন। বন্দীরা ঘুমন্ত প্রহরীদেরকে হত্যা করতে উদ্যত হতেই এরা তীর ছুঁড়ল। ওরা পড়ে যেতেই কমাণ্ডারকে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসল সৈনিক দু’জন।

তাদের ডাক চিৎকারে জেগে উঠল মেয়েগুলো। সাথে সাথে প্রহরীরাও। মেয়েগুলো লাশের দিকে তাকাল ভয়-বিস্ফোরিত নয়নে। প্রত্যেকর বুকে একটা করে তীর বিঁধে আছে।

এদের পরিকল্পনা মেয়েরা জানত। হতাশা ফুটে উঠল ওদের চেহারায়। এদিক ওদিক তাকাল ওরা। দেখল মিসরী কমাণ্ডার ও একটা মেয়ে সেখানে নেই।

যখন বন্দীদের বুকে তীর বিঁধেছে ঠিক সে মুহূর্তে পাশের টিলায় একটা খঞ্জর কমাণ্ডারের পিঠে আমূল প্রবেশ করল। টিলার উপর পড়ে রইল তার লাশ।

মেয়েটাকে নিয়ে টিলার ওপর বসেছিল কমাণ্ডার। ওরা জানতোনা তার খানিক দূরে বালিয়ানের তাঁবু। ঘোড়াগুলো একটু দূরে। মুবিকে নিয়ে এদিকে এসেছিল বালিয়ান, রক্ষীদের চোখের আড়ালে। হাতে মদের বোতল, চাদর বিছিয়ে বসল মুবিকে নিয়ে।

রাতের নীরবতা ভেঙে ভেসে এল অস্ফুট শব্দ। চমকে উঠল ওরা। উৎকর্ণ হয়ে রইল। সতর্ক পা ফেলে দু’জনে এগিয়ে গেল শব্দ লক্ষ্য করে। দেখল, গাছের নীচে দু’টো ছায়ার অস্পষ্ট অবয়ব দেখা যাচ্ছে।

মুবি আরও এগিয়ে গিয়ে ওদের কথা শুনতে লাগল। মেয়েটার কথা শুনে সে স্পষ্ট বুঝতে পারল যে, এ তার সঙ্গিনীদের একজন।

কমাণ্ডারের তৎপরতা স্পষ্ট। বদামায়েশী করার জন্য অসহায় মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে।

পিছিয়ে এল সে। বালিয়ানকে বলল, ‘লোকটা মিসরী। আমার সঙ্গীনী একটা মেয়েকে ভোগ করার জন্য নিয়ে এসেছে। একে রক্ষা কর। মিসরী তোমায় শত্রু, মেয়েটা বন্ধু। ও আমারয়ে চেয়ে বেশী সুন্দরী। ওকে এনে তোমার হারেমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি কর।’

বালিয়ান মদ পান করছিল, মুবির কথায় উঠে দাঁড়াল। খাপ থেকে খঞ্জর বের করে শিকারী বেড়ালের মত পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল। কমাণ্ডার কিছু বুঝে উঠার আগেই তার পিঠে আমূল বসিয়ে দিল খঞ্জর। টেনে নিয়ে আবার আঘাত করল।

আকস্মিক এ আক্রমণে ভয় পেয়ে মেয়েটা উঠে দাঁড়াল। ওকে দূর থেকে ডাকল মুবি। ও ছুটে গিয়ে মুবিকে জড়িয়ে ধরল।

‘অন্যরা কোথায়?’ মুবির প্রশ্ন।

সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে বলল মেয়েটা। বলল, ‘ওরা এখন পনেরজন সৈনিকের পাহারায় রয়েছে।’

বালিয়ান দৌড়ে গিয়ে সংগীদের ডেকে নিয়ে এল। সাথে অস্ত্র। কমাণ্ডারকে ডাকতে ডাকতে এদিকে এগুচ্ছিল এক প্রহরী। বালিয়ানের এক সংগী তীর মেরে তাকে হত্যা করল। মেয়েটা ওদের নিয়ে এগিয়ে চলল ক্যাম্পাসের দিকে।

টিলার নীচে আলো জ্বলছে। বালিয়ান টিলার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখল মাটিতে গাঁথা লাঠির মাথায় দুটো মশাল। প্রহরীরা লাশগুলো ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েগুলো জড়ো হয়ে আছে পাশে। তা দেখে মুবি এবং মেয়েটা কাঁদকে লাগল।

বালিয়ান সঙ্গীদের বলল, ‘তীর ছোঁড়।’

একসঙ্গে দু’টো তীর নিক্ষিপ্ত হল। লুটিয়ে পড়ল দু’জন প্রহরী। ওরা তখনও বুঝে উঠতে পারছে না কি ঘটছে, আরো দু’টা তীরে পড়ে গেল আরো দু’জন সৈনিক। একজনের দেহে বিঁধল তিনটে তীর।

উট চালকরা অন্ধাকারে লুকিয়ে পড়ল। মুবি মেয়েদের কাছে ছুটে এল। হঠাৎ ওদের কানে ভেসে এল অশ্বক্ষুরের শব্দ।

‘এখানে আর দেরী করা যাবে না।’ বালিয়ান বলল, ‘ওদের একজন পালিয়ে যাচ্ছে কায়রোর দিকে। এখুনি আমাদের পালানো উচিত।’

প্রহরীদের ঘোড়াগুলো নিয়ে নিজের ক্যাম্পের দিকে চলল বালিয়ান। তার একটা ঘোড়া নেই। আহত মিসরী সিপাইটি এদের ঘোড়া নিয়েই পালিয়েছে। নিজের ঘোড়া পর্যন্ত যেতে পারেনি সে।

চৌদ্দটি ঘোড়ার পিঠে জিন চাপানো হল। মালামাল চাপাল দুটার পিঠে। রওনা হল কাফেলা।

মেয়েরা মুবিকে সব ঘটনা খুলে বলল। কিন্তু রবিনদের মৃত্যুর রহস্য বলতে পারল না। মুবি বলল, ‘আইয়ুবীর ক্যাম্পে রবিনের সাক্ষাৎ যেমন অযাচিত ভাবে পেয়েছিলাম, তোমাদেরও পেলাম তেমনি আকস্মিকভাবে। এতে বলব না, পবিত্র যীশু আমাদের সফল করবেন। যে কাজেই আমরা হাত দিয়েছি, ব্যর্থ হয়েছি। রোম উপসাগরের পাড়ে আমাদের সৈন্যরা পরাজিত হয়েছে। মিসরে পরাজিত হয়েছে আমাদের বন্ধু সুদানী ফৌজ। রবিনের মত লোক নিহত হল। জানিনা কি হবে আমাদের পরিণতি। মনে হয় যীশু আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট।’

‘আমি বেঁচে থাকতে তোমাদের গায়ে কেউ হাত তুলতে পারবে না।’ বালিয়ান বলল, ‘আমার সিংহদের কাজ কি দেখনি?’

রোম উপসাগরের তীরে এসে লাগল একটি নৌকা। নেমে এল তিনজন লোক, পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল মুসলিম সেনা ক্যাম্পের দিকে। কথা বলছে ইটালীর ভাষায়।

ক্যাম্পে পৌঁছল ওরা। ওদের কথা শুনে ইটালীর খৃস্টান বন্দীদের ডেকে আনা হল। ওরা বলল, ‘এরা ইটালী থেকে এসেছে হারিয়ে যাওয়া বোনের খোঁজে। সেনাপতির সাথে দেখা করতে চাইছে।’

ক্যাম্পের অধিনায়ক বাহাউদ্দিন শাদ্দাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হল ওদের।

তিনজনের একজন আধ বয়েসী, দু’জন যুবক। দোভাষী বলল, ‘ওদের যুবতী বোনকে খৃস্টান সৈন্যরা তুলে নিয়ে এসেছে। এরা শুনেছে ওদের বোনেরা এখন আইয়ুবীর ক্যাম্পে আছে। বোনদের খোঁজে সাগর পাড়ি দিয়ে এদ্দুর এসেছে এরা।’

তাদের বলা হল মেয়েরা এসেছে তিনজন নয় সাতজন। সাবাই গুপ্তচর। তিনজনই বলল, ‘আমরা গরীব। গুপ্তচরীর সাথে আমাদের বোনদের কোন সম্পর্ক নেই। সাতজনকে আমরা জানিনা। আমাদের বোনদের খোঁজে আমরা এসেছি।

শাদ্দাদ বললেন, ‘যে সাতজন আমাদের কাছে এসেছে, তার মধ্য থেকে পালিয়ে গেছে একজন। বাকী ছ’জনকে আজই কায়রো পাঠিয়ে দিয়েছি। তোমরা বরং ওখানে যাও। আমাদের সুলতান ভাল মানুষ।’

‘বিশ্বাস করুন, আমাদের বোনেরা গোয়েন্দা নয়। আপনারা যাদের পেয়েছেন তারা গোয়েন্দা হলে ওরা আমাদের বোন নয়। আমাদের হতভাগী বোনেরা তাহলে হয়ত সাগরে ডুবে মরেছে। না হয় খৃস্টানদের কাছেই আছে।’ শাদ্দাদের মনটা ছিল নরম। তিনজন গ্রাম্য লোকের দুঃখে তিনিও ব্যথিত হলেন। খাতির যত্ন করে বিদায় করলেন ওদের। চলে গেল ওরা। কোথায় গেল কেউ জানল না।